Friday, May 3, 2024
Homeবাণী-কথাঅনুবাদ গল্পনিরুদ্দেশ ট্রেন - আর্থার কোনান ডয়েল

নিরুদ্দেশ ট্রেন – আর্থার কোনান ডয়েল

আর্থার কোনান ডয়েল Arthur Conan Doyle Biography

ফ্রান্সের মাসাই শহরের জেল থেকে ফাঁসির আসামি হারবাট দ্য লেরনক-এর সম্প্রতি একটি স্বীকারোক্তি পাওয়া গেছে। আট বছর আগের এক চাঞ্চল্যকর ও আগাগোড়া রহস্য মোড়া অপরাধের একটা যুক্তিগ্রাহ্য ব্যাখ্যা এই স্বীকারোক্তি থেকে দাঁড় করানো যায়। পুলিশ ও প্রশাসন এই অপরাধের সমাধান করতে না পারায় ব্যাপারটা প্রায় ধামাচাপাই ছিল এতদিন।

আগে বলি, ঘটনাটি কী। মোটামুটি তিনটি সূত্রের ভিত্তিতে ঘটনাটির একটা বিবরণ তৈরি করা যায় লিভারপুল শহরের ওই সময়ের খবরের কাগজ, রেল কোম্পানির নথিপত্র এবং ইঞ্জিন ড্রাইভার জন স্লেটার-এর মৃত্যুতদন্ত সম্পর্কিত পুলিশ-আদালতের কাগজপত্র।

তারিখ : ৩রা জুন, ১৮৯০। স্থান : লিভারপুলের ওয়েস্ট কোস্ট সেন্ট্রাল স্টেশন। সঁসিয়ে লুই কারাতাল নামের এক ব্যক্তি স্টেশনমাস্টার জেমস ব্ল্যান্ডের সঙ্গে দেখা করতে চাইলেন।

কারাতাল লোকটি মাঝবয়সি ও ছোটখাটো চেহারার। তার গায়ের রং একটু চাপা। একটু ঝুঁকে চলেন। তার একটি সঙ্গী ছিল, তার আকৃতি বিশাল। কিন্তু সেই সঙ্গীটির বশংবদ হাবভাবে বোঝা যাচ্ছিল সে কারাতালের আজ্ঞাধীন। সঙ্গীর চেহারা দেখে মনে হচ্ছিল সে স্পেন বা দক্ষিণ আমেরিকার লোক। তার কবজির সঙ্গে স্ট্র্যাপ দিয়ে বাঁধা একটা চামড়ার ব্রিফকেস অনেকের নজরে পড়েছিল।

কারাল স্টেশনমাস্টারের অফিসে ঢুকলেন আর তার সঙ্গী বাইরে অপেক্ষা করতে লাগল। কারাল স্টেশনমাস্টার মিঃ ব্ল্যান্ডকে জানালেন যে তিনি আজ দুপুরেই আমেরিকা থেকে এসেছেন লিভারপুলে। আজই আবার বিশেষ দরকারে তাকে প্যারিসে যেতে হবে। প্যারিস যেতে গেলে আগে লিভারপুল থেকে লন্ডনে পৌঁছতে হবে। কিন্তু লন্ডন এক্সপ্রেস ইতিমধ্যেই লিভারপুল থেকে রওনা হয়ে গেছে। তাই তার একটা স্পেশাল ট্রেন দরকার, খরচা যতই হোক না কেন। মিঃ ব্ল্যান্ড পাঁচ মিনিটের মধ্যেই স্পেশাল ট্রেনের ব্যবস্থা করে দিলেন। তবে ট্রেনটি ছাড়বে পঁয়তাল্লিশ মিনিট পরে। লাইন ক্লিয়ার করার জন্য এই সময়টুকু লাগবে। একটা বেশ শক্তিশালী ইঞ্জিন, দুটো বগি আর গার্ডের কামরা–এই হল ট্রেন। প্রথম বগিটি খালিই থাকবে–ঝাঁকুনি কম করার জন্য এই বগিটি দেওয়া হয়েছে। দ্বিতীয় বগিতে আছে চারটে কামরা। এর মধ্যে ইঞ্জিনের দিকে প্রথম কামরাটিতে থাকবেন যাত্রী দুজন। বাকি তিনটি কামরা খালি থাকবে। ইঞ্জিন ড্রাইভার জন স্লেটার। গার্ড জেমস ম্যাকফারসন–রেল কোম্পানির পুরোনো কর্মচারী। ইঞ্জিনে কয়লা দেওয়ার লোকটি অবশ্য নতুন চাকুরে, নাম উইলিয়ম স্মিথ।

কথাবার্তা হয়ে যাওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে রেল কোম্পানির টাকাকড়ি মিটিয়ে দিলেন সঁসিয়ে কারাতাল। যদিও ট্রেন ছাড়তে তখনও আধঘণ্টার বেশি দেরি আছে, কারাতাল ও তার সঙ্গী ট্রেনে বসার জন্য অধের্য হয়ে পড়লেন। অগত্যা তাদের ট্রেনে বসিয়ে দেওয়া হল।

ইতিমধ্যে স্টেশন মাস্টারের অফিসে একটা ঘটনা ঘটল।

তখনকার দিনে বড় শহরে স্পেশাল ট্রেনের চাহিদা থাকা স্বাভাবিক ব্যাপার ছিল। কিন্তু মঁসিয়ে কারাতাল মিঃ ব্ল্যান্ডের অফিস থেকে বেরনোর প্রায় সঙ্গে-সঙ্গেই মিঃ হোরেস মূর নামের এক ভদ্রলোক স্টেশন মাস্টারকে জানালেন যে, লন্ডনে অসুস্থ স্ত্রীর কাছে তাড়াতাড়ি পৌঁছনোর জন্য তারও একটি স্পেশাল ট্রেন চাই। কিন্তু মিঃ ব্ল্যান্ডের কাছে অতিরিক্ত ট্রেন না থাকায় তিনি মিঃ মূরকে বললেন মঁসিয়ে কারাতালের ট্রেনে যেতে। তাতে দুজনেরই খরচা কম হবে। খালি কামরা তো আছেই।

এই প্রস্তাব সময়োপযোগী ও কম খরচসাপেক্ষ হওয়া সত্ত্বেও মঁসিয়ে কারাতাল কিন্তু প্রস্তাবটি সরাসরি নাকচ করে দিলেন। তিনি স্পষ্ট জানিয়ে দিলেন যে অন্য কারোর সঙ্গে ট্রেন ভাগাভাগি করার ব্যাপারে তিনি বিন্দুমাত্র উৎসাহী নন। কারাতালের এই ব্যবহারে ব্যথিত হয়ে মিঃ মূর অগত্যা সন্ধে ছটার প্যাসেঞ্জার ট্রেনে যাওয়াই ঠিক করলেন।

ঠিক সাড়ে চারটের সময় কারাতাল ও তার সঙ্গীকে নিয়ে স্পেশাল ট্রেন লিভারপুল স্টেশন ছাড়ল। আগে লাইন ক্লিয়ার করাই আছে, সুতরাং ট্রেন সোজা গিয়ে সন্ধে ছটা নাগাদ প্রথমে থামবে ম্যানচেস্টার স্টেশনে। কিন্তু সওয়া ছটার সময় ম্যানচেস্টার স্টেশন থেকে লিভারপুলে টেলিগ্রাফ এল ও স্পেশাল ট্রেন এখনও ওখানে পৌঁছোয়নি। অথচ খোঁজ নিয়ে জানা গেল যে, ট্রেনটি চারটে বাহান্নয়, ঠিক সময়ে সেন্ট হেলেন্স স্টেশন পেরিয়ে গেছল। সন্ধে সাতটায় আবার ম্যানচেস্টার থেকে টেলিগ্রাফ এল? পরের ট্রেন ম্যানচেস্টার পৌঁছে গেছে এবং সেই স্পেশাল ট্রেনটির দ্যাখা পাওয়া যায়নি।

এই বিচিত্র ও অভাবনীয় ঘটনায় রেল কর্তৃপক্ষ অবাক হয়ে গেলেন। ট্রেনটি কোনও দুর্ঘটনায় পড়েনি তো? কিন্তু সে ক্ষেত্রে পরের ট্রেনটি তা দেখতে পেত। ছোটখাটো কোনও সারাইয়ের জন্য ড্রাইভার কি ট্রেনটিকে কোনও সাইড লাইনে নিয়ে গেল? পরিস্থিতি বোঝার জন্য তখন সেন্ট হেলেনস এবং ম্যানচেস্টার স্টেশনের মধ্যের সব স্টেশনে টেলিগ্রাফ পাঠানো হল। উত্তরগুলো এল এইরকম :

স্টেশনের নাম — স্পেশাল ট্রেন কখন গেছে

কলিন্‌স গ্রিন – ৫.০০

আর্লসটাউন – ৫.০৫

নিউটন – ৫.১০

কেনিয়ন জংশন – ৫.২০

বার্টন মস – ট্রেন এখানে আসেনি।

–আমার তিরিশ বছরের চাকরিতে এরকম কাণ্ড দেখিনি। বললেন হতভম্ব মিঃ ব্ল্যান্ড।

–কেনিয়ন জংশন ও বার্টন মস স্টেশনের মাঝখানে নিশ্চয়ই কিছু গণ্ডগোল হয়েছে। বললেন ট্র্যাফিক ম্যানেজার মিঃ হুড।

–আমার যতদূর মনে পড়ে, ওই অঞ্চলে কোনও সাইডিং নেই। তাহলে কি ট্রেনটি লাইনচ্যুত হয়েছে?

–তাহলে সেটা পরের ট্রেনের নজরে অবশ্যই পড়ত।

যাই হোক, ম্যানচেস্টার ও কেনিয়ন জংশনে আরও খবরের জন্য টেলিগ্রাফ পাঠিয়ে দিন। আর ওদের বলে দিন কেনিয়ন জংশন ও বার্টন মস-এর মধ্যে লাইনটা ভালোভাবে পরীক্ষা করে দেখতে।

ম্যানচেস্টার থেকে উত্তর এল : ট্রেনের এখনও কোনও খবর নেই। কোনও দুর্ঘটনা হয়নি। লাইন পরিষ্কার ও স্বাভাবিক।

কেনিয়ন জংশনের উত্তর : ট্রেনের কোনও চিহ্ন নেই। পুরো লাইন পরীক্ষা করা হয়েছে। কোনও দুর্ঘটনা হয়নি। লাইন পরিষ্কার। ট্রেন এখানে ঠিক সময়ে পৌঁছেছিল, তারপরে কী হয়েছে, কিছু বোঝা যাচ্ছে না।

উত্তেজিত মিঃ ব্ল্যান্ড বললেন,–আমরা কি উন্মাদ হয়ে গেলাম? ফটফটে দিনের আলোয় একটা ট্রেন হাওয়ায় মিশে গেল? ইঞ্জিন, দুটো বগি, গার্ডের কামরা, পাঁচটা মানুষ–সব অদৃশ্য হয়ে গেল? একঘণ্টার মধ্যে কোনও খবর না পেলে আমি নিজে ইনস্পেকটর কলিন্‌স-কে নিয়ে তদন্ত করতে যাব।

এর খানিকক্ষণ পরে আর-একটা টেলিগ্রাফ এল কেনিয়ন জংশন থেকে : রেললাইনের পাশে নীচে ঝোঁপের মধ্যে ইঞ্জিন ড্রাইভার জন স্লেটারের মৃতদেহ পাওয়া গেছে। জায়গাটা স্টেশন থেকে সওয়া দু-মাইল দূরে। যতদূর মনে হয় ইঞ্জিন থেকে পড়ে নীচে গড়িয়ে গিয়ে মাথায় আঘাত পেয়ে মারা গেছে। কিন্তু আশেপাশে কোথাও ট্রেনটির কোনও চিহ্ন নেই।

সেই সময় ফ্রান্সের কিছু রাজনৈতিক ঘটনা নিয়ে ইংল্যান্ডের খবরের কাগজগুলিতে এত লেখালেখি হচ্ছিল যে ট্রেন হারিয়ে যাওয়ার ঘটনাটি সেরকম কোনও গুরুত্ব পেল না। কিছু কাগজের অভিমত, পুরো ঘটনাটি একটা নতুন ধরনের ধাপ্পা। অবশ্য শেষে জন স্লেটারের মৃত্যু সংবাদে লোকে ঘটনাটির সত্যতা সম্বন্ধে খানিকটা নিশ্চিন্ত হল।

যাই হোক, ঘটনার দিন সন্ধেবেলায় মিঃ ব্ল্যান্ড ইনস্পেকটর কলিনস্‌কে নিয়ে কেনিয়ন জংশনে তদন্তে গেলেন। পরের দিন যখন তাদের তদন্ত শেষ হল, তখনও ট্রেনের তো কোনও হদিস পাওয়াই গেল না, ঘটনার কোনও যুক্তিগ্রাহ্য ব্যাখ্যাও মিলল না। তবে ইনস্পেকটর কলিন্স-এর রিপোর্ট থেকে কিছু সম্ভাবনার ইঙ্গিত পাওয়া যায়। পুলিশ রেকর্ড থেকে সংগ্রহ করা সেই রিপোর্টের সারমর্ম এইরকম?

এই দুটো স্টেশনের মাঝখানে অনেকগুলো লোহার কারখানা ও কোলিয়ারি আছে কিছু চালু, কিছু বন্ধ হয়ে গেছে। এই কারখানা ও কোলিয়ারিগুলোর মালপত্র ট্রলিতে করে নিয়ে যাওয়ার জন্য কমপক্ষে বারোটা ন্যারোগেজ লাইন আছে যেগুলো মেন লাইনের সঙ্গে যুক্ত। যেহেতু স্পেশাল ট্রেনটি ব্রডগেজের, এই ছোট লাইনগুলোকে তদন্তের আওতা থেকে বাদ দেওয়া যায়। কিন্তু এগুলো ছাড়াও সাতটা বড় লাইন আছে, যেগুলো মেন লাইনের সঙ্গে গিয়ে মিশেছে। এর মধ্যে চারটে লাইনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কোলিয়ারিগুলো আপাতত পরিত্যক্ত। বাকি তিনটে লাইনের মধ্যে প্রথমটা মাত্র সিকি মাইল লম্বা এবং এর আশেপাশে স্পেশাল ট্রেনটির দেখা যায়নি। দ্বিতীয় লাইনটি সিঙ্গল লাইন এবং ঘটনার দিন (৩রা জুন) ষোলোটা মালভরতি বগি পুরো লাইনটাকে আটকে রেখেছিল। তৃতীয় লাইনটি ডবল লাইন এবং এই লাইনে সারাদিন ধরে প্রচুর খনিজ পদার্থ নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু ৩রা জুন কয়েকশো লোক খনিশ্রমিক ও রেলওয়ে কর্মী-এই সওয়া দু-মাইল লম্বা রেলপথের আশেপাশে কাজ করছিল এবং স্পেশাল ট্রেনটি এই লাইনে এলে সেটি অবশ্যই তাদের নজরে পড়ত। তা ছাড়া ইঞ্জিন ড্রাইভারের লাশ এই লাইনের কাছাকাছি পাওয়া যায়নি। সুতরাং, এই অঞ্চলটা পেরোনোর পরেই ট্রেনটি নিখোঁজ হয়।

আর ইঞ্জিন ড্রাইভার জন স্লেটারের সম্বন্ধে এইটুকুই বলতে পারি যে, ট্রেন থেকে পড়ে গিয়েই তার মৃত্যু হয়, যদিও কেন বা কীভাবে সে পড়ে গেল কিংবা তারপর ইঞ্জিনটার কী হল, এ সম্বন্ধে কোনও সূত্র পাওয়া যাচ্ছে না।

এরপর পুলিশের অপদার্থতা নিয়ে কাগজে লেখালেখি হতে ইনস্পেকটর কলিক্স এই তদন্তের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নিলেন।

পুলিশ ও রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ এরপর মাসখানেক চেষ্টা করেও এই রহস্যের কোনও সমাধান করতে পারলেন না। পুরস্কার ঘোষণা, অপরাধীকে ক্ষমা করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি ইত্যাদি পদক্ষেপও ব্যর্থ হল।

ইংল্যান্ডের এক জনবহুল অঞ্চলে প্রকাশ্য দিবালোকে যাত্রীসমেত একটা ট্রেন ভোজবাজির মতো অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার এই ঘটনাকে কেউ বললেন আধিদৈবিক, কেউ বা বললেন আধিভৌতিক। কারাতাল বা তার সঙ্গী হয়তো রক্তমাংসের মানুষই নন।

খবরের কাগজে চিঠিপত্র কলমে কয়েকজন পাঠক সমাধানের কিছু সূত্র পাঠিয়েছিলেন। এর মধ্যে একজন ছিলেন তর্কশাস্ত্রে পণ্ডিত। তিনি লিখলেন : একটি-একটি করে সমস্ত সম্ভাবনা খতিয়ে দেখে এবং একে-একে সেগুলি বাদ দিয়ে শেষে যে সম্ভাবনাটি পড়ে থাকবে, তা যতই অসম্ভব লাগুক না কেন, সেটিই সত্যি। কলিয়ারির ওই তিনটে রেল লাইনে তদন্ত চালানো হোক। নিশ্চয়ই ওখানে খনিশ্রমিকদের কোনও গুপ্ত সংগঠন আছে। তারাই যাত্রীসমেত ট্রেনটিকে হাপিস করে দিয়েছে। ওই খনিশ্রমিকদের জিজ্ঞাসাবাদ করা দরকার।

আর-একজন লিখলেন যে, ট্রেনটি নিশ্চয়ই লাইনচ্যুত হয়ে রেললাইনের পাশের খালে পড়ে গেছে। এই যুক্তি অবশ্য সরাসরি নাকচ হয়ে গেল কেন না ট্রেনটি সম্পূর্ণভাবে ডুবে যাওয়ার মতো গভীর কোনও খাল আশেপাশে নেই।

অন্য একজনের মতে, কারাতালের সঙ্গীর ব্রিফকেসে এমন শক্তিশালী ও অভিনব বিস্ফোরক পদার্থ ছিল যে, পুরো ট্রেনটিই বিস্ফোরণে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। এই যুক্তিও ধোপে টিকল না, কেন না সেই বিস্ফোরণ সত্ত্বেও রেললাইন তাহলে কী করে অক্ষত রইল।

যাই হোক, সবাই যখন এই রহস্য সমাধানের আশা ছেড়ে দিয়েছে, তখন একটা নতুন ঘটনা ঘটল।

ব্যাপারটা আর কিছুই নয়। একটা চিঠি। যেটা সেই নিরুদ্দেশ ট্রেনের গার্ড ম্যাকফারসন ৫ জুলাইতে তার স্ত্রীকে লিখেছিলেন। চিঠিটা নিউইয়র্ক থেকে পোস্ট করা এবং তার স্ত্রী সেটা পান ১৪ জুলাই। চিঠির সঙ্গে ছিল একশো ডলার। চিঠিটা এইরকম :

তোমাকে আর তোমার বোন লিজিকে ছেড়ে এসে আমার কষ্ট হচ্ছে। যা টাকা পাঠালাম তাতে জাহাজের টিকিট কিনে তোমরা আমেরিকায় চলে এস। এখানে এসে জনস্টন হাউসে ওঠো। আমি তোমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে নেব। তোমাদের আসার প্রতীক্ষায় রইলাম।

ম্যাকফারসনের নির্দেশমতো তার স্ত্রী ও শ্যালিকা নিউ ইয়র্কে গিয়ে জনস্টন হাউসে তিন সপ্তাহ ছিলেন। কিন্তু ম্যাকফারসন তাদের সঙ্গে যোগাযোগ না করায় অগত্যা তারা ইংল্যান্ডে ফিরে এলেন। মনে হয়, খবরের কাগজ পড়ে ম্যাকফারসন ধারণা করেছিলেন যে তাঁকে ধরার জন্য পুলিশ তার স্ত্রী ও শ্যালিকাকে টোপ হিসেবে ব্যবহার করছে।

গত আট বছর ধরে রহস্য এই পর্যায়ই থেমে ছিল। একটা ট্রেনের হারিয়ে যাওয়ার মতো অবিশ্বাস্য ও অভূতপূর্ব ঘটনার কোনও ব্যাখ্যা পাওয়া গেল না। অবশ্য এটুকু জানা গেছল যে, মঁসিয়ে কারাতাল মধ্য আমেরিকার লোক এবং আর্থিকভাবে সম্পন্ন ও রাজনৈতিক ব্যাপারে প্রভাবশালী। তার বিশালদেহী সঙ্গীর নাম এডুয়ার্ডো গোমেজ এবং সে গুন্ডাপ্রকৃতির ও বদমেজাজের মানুষ। ক্ষীণতনু কারাতালের রক্ষী হিসেবেই সে এসেছিল। কারাতাল প্যারিসে কেন যেতে চাইছিলেন, তারও কোনও কারণ প্যারিসে খোঁজখবর করে পাওয়া গেল না।

.

১৮৯৮ সালে ফাঁসির আসামি হারবার্ট দ্য লেরনক-এর স্বীকারোক্তি প্রকাশ পাওয়া পর্যন্ত সমস্ত ঘটনাটা বলা হল। এবার ঘটনার বাকিটুকু হারবার্টের স্বীকারোক্তির ভাষাতেই শোনা যাক:

বড়াই করে বলার মতো অনেক কিছুই জীবনে করেছি। তবে সেসব আমি সাধারণত প্রকাশ করি না। কারাতাল সম্পর্কিত ঘটনাটা বলতে বাধ্য হচ্ছি, যাতে আমার শাস্তি লাঘব হয়। আপাতত ঘটনার সঙ্গে প্যারিসের রুই-কাতলারা যারা জড়িয়ে ছিলেন তাঁদের নাম বলব না, তবে শাস্তি লাঘব না হলে সেসবও ফাঁস করে দেব। এখন বলি কীরকম সুনির্দিষ্ট ছক অনুযায়ী বুদ্ধি খাঁটিয়ে আমি পুরো কাজটা করেছিলাম।

১৮৯০ সালে প্যারিসের আদালতে একটা বিখ্যাত মামলা চলছিল। রাজনীতি এবং আর্থিক দুর্নীতি সংক্রান্ত এই মামলায় ফ্রান্সের অনেক বিখ্যাত লোকই জড়িত ছিলেন। মঁসিয়ে কারাতাল প্যারিসে আসছিলেন এঁদের বিরুদ্ধে প্রমাণ নিয়ে। তিনি প্যারিসে এলেই এই মামলার ইতি হত এবং তথাকথিত সেই বিখ্যাত ব্যক্তিদের আসল রূপ জনসমক্ষে প্রকাশ পেত। সুতরাং ঠিক করা হল যে, কারাতালের প্যারিসে আসা যেভাবেই হোক আটকাতে হবে।

কয়েকজন লোক নিয়ে তৈরি একটা ছোট সংগঠনকে ভার দেওয়া হল পুরো ব্যাপারটা সামলানোর। প্রভূত অর্থ ও ক্ষমতার অধিকারী এই সংগঠনের দরকার ছিল এমন একজন লোকের যে একাধারে বুদ্ধিমান, সাহসী, দৃঢ়চেতা ও সমস্তরকম পরিবেশের মোকাবিলা করতে সক্ষম–অর্থাৎ লাখে এক। তারা আমাকেই, এই কাজের জন্য নির্বাচন করেছিল। নিজের ঢাক পেটাচ্ছি না, তবে এটুকু বলতে পারি তাদের লোক নির্বাচনে কোনও খুঁত ছিল না।

প্রথমেই বিশ্বাসী একটা লোককে মধ্য আমেরিকায় সঁসিয়ে কারাতালের কাছে পাঠিয়ে দিলাম, যাতে তিনি আমার লোকের সঙ্গেই যাত্রা করেন। কিন্তু দুভার্গ্য! আমার লোকটা পৌঁছোনার আগেই কারাতাল রওনা হয়ে গেছেন। কিন্তু আমার কাছে বিকল্পের অভাব ছিল না–একটা উপায় ব্যর্থ হলে অন্য উপায়ের ব্যবস্থা ছিল। ভেবে দেখুন, পুরো কাজটা কী কঠিন! কারাতালকে খুন করা এমন কিছু একটা কাজ নয়। তাকে সরাতে হবে, তার সঙ্গের নথিপত্র ইত্যাদি নষ্ট করতে হবে এবং তাঁর কোনও সঙ্গী থাকলে তাকেও ছেড়ে দেওয়া যাবে না।

আমার কাছে খবর ছিল যে লিভারপুল থেকে লন্ডন পোঁছনোর পরে কারাতালের সঙ্গে অনেক রক্ষী থাকবে। সুতরাং আমার যা করণীয় তা উনি লন্ডন পৌঁছনোর আগেই করতে হবে। ছরকম প্ল্যান বানিয়েছিলাম। একটা ব্যর্থ হলে অন্যটা কাজে লাগাতে হবে।

টাকায় সবকিছু হয়। প্রথমেই ইংল্যান্ডের রেলওয়ের ওপর এক বিশেষজ্ঞকে জোগাড় করে ফেললাম। এঁর মাধ্যমে রেলওয়ের কিছু অভিজ্ঞ কর্মচারীকেও আমার দলে টেনে নিলাম। পুরো প্ল্যানটা ওই বিশেষজ্ঞের তৈরি, আমি খালি খুঁটিনাটিগুলোর দিকে লক্ষ রেখেছিলাম। জেমস ম্যাকফারসনকে হাতে রাখলাম, কেন না কারাতাল যদি স্পেশাল ট্রেনের ব্যবস্থা করেন, জেমস-এর তাতে গার্ড হওয়ার সম্ভাবনা ছিল ষোলোআনা। ফায়ারম্যান স্মিথকে দলে নেওয়া হল। খালি ইঞ্জিন ড্রাইভার স্লেটারকে বাগানো গেল না–লোকটা একটু গোঁয়ার টাইপের। আমাদের মোটামুটি ধারণা ছিল যে কারাতাল স্পেশাল ট্রেনেই লিভারপুল থেকে লন্ডন যাবেন এবং সেখান থেকে প্যারিস। হাতে সময় কম থাকায় স্পেশাল ট্রেন নেওয়া ছাড়া তাঁর কোনও উপায় ছিল না। তার জাহাজ লিভারপুল পৌঁছনোর আগেই আমার প্ল্যান তৈরি হয়ে গেছল। শুনলে মজা পাবেন, জাহাজটাকে যে পাইলট বোট বন্দরে নিয়ে এসেছিল, তাতেও আমার লোক ছিল।

কারাতালকে দেখেই আমরা বুঝেছিলাম যে তিনি বিপদের আশঙ্কা করছেন এবং খুবই সতর্ক। তার রক্ষী গোমেজ লোকটা বিপজ্জনক ধরনের, দরকার হলে ও পিস্তল চালাতে পিছপা হবে না। নথিপত্রের বাক্সটাও তার হাতে। হয়তো সে কারাতালের প্যারিসে আসার কারণ সম্বন্ধেও অবহিত। সুতরাং গোমেজকে ছেড়ে শুধু কারাতালকে সরানো হবে নিতান্তই পণ্ডশ্রম। তাই দুজনের পরিণতি একই হতে হবে, এবং স্পেশাল ট্রেনে সেই পরিণতি ঘটানো বিশেষ সুবিধাজনক। ট্রেনের তিনজন কর্মচারীর মধ্যে দুজন আমাদের হাতের মুঠোয়, কেন না তাদের আরামদায়ক ভবিষ্যতের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম।

আমার একজন সঙ্গীকে লিভারপুলে রেখে আমি নিজে কেনিয়নের এক সরাইখানায় ওর ইঙ্গিতের অপেক্ষায় রইলাম। যেই কারাল স্পেশাল ট্রেনের ব্যবস্থা করলেন আমার সঙ্গী তখনই হোরেস মূর নাম নিয়ে ওই ট্রেনেই তাদের সঙ্গে যাওয়ার চেষ্টা করল। এই প্ল্যান লেগে গেলে আমার সঙ্গী ওদের দুজনকেই ট্রেনে হত্যা করে সঙ্গের কাগজপত্রগুলো নষ্ট করে দিতে পারত। কিন্তু কারাতালের অনমনীয় মনোভাবের জন্য এই প্ল্যান কাজে লাগল না। আমার সঙ্গী তখন স্টেশন থেকে বেরিয়ে গিয়ে তারপর আর-একটা গেট দিয়ে আবার স্টেশনে এসে ওই স্পেশাল ট্রেনেই গার্ড ম্যাকফারসন-এর কামরায় ঢুকে পড়ল।

এবার বলি, আমি এদিকে কী করছিলাম। সব প্ল্যানই ছকা, শুধু ফিনিশিং টাচ দেওয়ার কাজ আমার। রেলের যে সাইডিংটা আমরা ব্যবহার করব বলে ঠিক করেছিলাম, সেটা মেনলাইন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছল। খানিকটা লাইন পেতে সেটা জোড়া লাগানো হল। ফিশপ্লেট, বোল্ট, জোড়া লাগানোর পয়েন্ট ইত্যাদি দিয়ে আমাদের কেনা রেলের কিছু দক্ষ কর্মী কাজটা সহজেই নিখুঁতভাবে করে দিল। সুতরাং স্পেশালটা যখন হঠাৎ সামান্য ঝাঁকুনি খেয়ে মেনলাইন থেকে সাইডিং-এ চলে গেল, তখন কারাতাল ও গোমেজ কিছু বুঝতে পারলেন না।

প্ল্যানমাফিক ফায়ারম্যান স্মিথের কাজ ছিল ক্লোরোফর্ম দিয়ে ইঞ্জিন ড্রাইভার স্লেটারকে অচেতন করে দেওয়া, যাতে যাত্রী দুজনের সঙ্গে সে-ও অনন্তলোকে যাত্রা করে। কিন্তু এই ছোট্ট কাজটা করতে গিয়ে স্মিথ এমন তালগোল পাকিয়ে ফেলল যে স্লেটারের সঙ্গে তার ধস্তাধস্তি হল এবং ফলত স্লেটার ট্রেন থেকে ছিটকে পড়ে গিয়ে ঘাড় ভেঙে মারা গেল।

আমার নিখুঁত প্ল্যানে এই একটিমাত্র ত্রুটি হয়েছিল এবং আমি মুক্তকণ্ঠে স্বীকার করছি যে আমার সুবিখ্যাত অপরাধ জীবনে এটি একটি কলঙ্ক হিসেবে চিহ্নিত থাকবে। পরে অবশ্য আরও একটা গণ্ডগোল হয়েছিল। ট্রেনের গার্ড হতভাগা ম্যাকফারসন আমেরিকায় পৌঁছে ওর স্ত্রীকে যে একটা চিঠি লিখেছিল, সেটাও আমার পুরো প্ল্যানের মধ্যে আরেকটা খুঁত। অবশ্য তার জন্যে আমি দায়ী ছিলাম না।

হ্যাঁ, আবার ট্রেনের কথায় ফিরে আসি। এই ছোট্ট দু-কিলোমিটার লম্বা সাইড লাইনটা একটা অধুনা পরিত্যক্ত কয়লাখনিতে গিয়ে শেষ হয়েছিল। আপনারা জানতে চাইবেন, এই সাইডলাইন দিয়ে যাওয়ার সময় ট্রেনটা কারোর নজরে পড়েছিল কি না। আসলে এই রাস্তাটুকু ছিল অনেকটা সুড়ঙ্গের মতো–দু-দিকেই উঁচু জমি। ওই জমির ওপর গিয়ে না দাঁড়ালে ট্রেনটা কারোর চোখে পড়ার কথা নয়। একজনেরই সেটা চোখে পড়েছিল–সেটা এই অধমের চোখে। উঁচু জায়গায় দাঁড়িয়ে কী দেখেছিলাম সেটা বলি।

আমার আর-একজন সঙ্গী চারজন সশস্ত্র লোককে নিয়ে লাইনের জোড় দেওয়া জায়গায় অপেক্ষা করছিল। মরচে ধরা লাইনে কোনও কারণে ট্রেনটা যদি আটকে যায়, যাত্রীদের উপযুক্ত ব্যবস্থা করার জন্য তাদের নির্দেশ দেওয়া ছিল। কিন্তু ট্রেনটা সুচারুভাবে সাইডলাইনে যেতেই আমার এই সঙ্গীর কাজ শেষ হল। তখন আমি দুজন সশস্ত্র লোককে নিয়ে নাটকের বাকি অংশটুকুর প্রতীক্ষা করতে লাগলাম।

ট্রেনটা সাইডলাইন দিয়ে বেশ কিছুটা যাওয়ার পরেই ফায়ারম্যান স্মিথ গাড়ির গতি কমিয়ে দিল। এবং সঙ্গে সঙ্গেই আবার গতি বাড়িয়ে দিয়ে স্মিথ, গার্ড ম্যাকফারসন আর আমার ইংরেজ সঙ্গী (ছদ্মনাম হোরেস মুর) তিনজনেই লাফ দিয়ে ট্রেনের বাইরে নেমে এল। গাড়ির গতি কমতেই যাত্রী দুজন একটু অবাক হয়েছিল। কিন্তু গতি আবার বাড়তে তারা দুজন জানলা দিয়ে বাইরের দিকে তাকাল।

ওদের হতভম্ব অবস্থা দেখে আমার বেশ মজা লাগছিল। ভাবুন ব্যাপারটা–ট্রেনের বিলাসবহুল কোচে বসে আপনি হঠাৎ দেখলেন ট্রেনটা লাল-হলুদ রঙের মরচে পড়া একটা অব্যবহৃত লাইনের ওপর দিয়ে চলেছে। ওরা দুজনেই ততক্ষণে হয়তো বুঝতে পেরে গেছে যে পরের বড় স্টেশন ম্যানচেস্টারের বদলে ওরা পরলোকের দিকে এগিয়ে চলেছে।

চালকবিহীন ট্রেন তখন দুলতে-দুলতে ঝাঁকুনি খেতে খেতে দুরন্ত গতিতে এগিয়ে চলেছে। মরচে ধরা লাইনের সংস্পর্শে এসে চাকা থেকে বিকট আওয়াজ হচ্ছে। আমি ওদের দুজনের মুখ স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম। কারাতালের ঠোঁট নড়ছে–হয়তো ঈশ্বরের নাম নিচ্ছে। আর গোমেজকে দেখে মনে হচ্ছিল যেন একটা ষাঁড়কে কসাইখানায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। হঠাৎ গোমেজ আমাদের দেখতে পেয়ে পাগলের মতো হাত নাড়তে লাগল। তার পরেই কবজির স্ত্রাপটা ছিঁড়ে হাতের ব্রিফকেসটা আমাদের দিকে ছুঁড়ে দিল। ভাবখানা এই-নথিপত্রগুলো সব নাও, কিন্তু আমাদের প্রাণে মেরো না। কিন্তু কোনও কাজে আমি দুনম্বরি করি না। তা ছাড়া, ট্রেন তখন ওদের কেন, আমাদেরও নিয়ন্ত্রণের বাইরে।

একটু পরেই ট্রেনটা যখন খনির অন্ধকার গহ্বরের কাছে এসে পড়ল, তখন গোমেজের চেঁচামেচি বন্ধ হল। খনির নীচে যাওয়ার ও কয়লা ওপরে তোলার যে সটান সুড়ঙ্গ আছে সেই অবধি আমরা লাইন পেতে রেখেছিলাম। ওদের দুজনের মুখ দেখতে পাচ্ছিলাম। খনির অতল গহ্বরের আন্দাজ পেয়ে দুজনেই তখন বাকরুদ্ধ ও স্থাণু।

এত দ্রুতগতিতে চলা একটি ট্রেন কীভাবে গর্তে তলিয়ে যায় সেটা দেখার জন্য আমি একটু কৌতূহলীই ছিলাম।

প্রথমে ট্রেনটি খনির সুড়ঙ্গের উলটোদিকের দেওয়ালে গিয়ে প্রচণ্ড জোরে ধাক্কা মারল। ইঞ্জিন, বগি দুটো, গার্ডের কামরা সব তালগোল পাকিয়ে এক হয়ে গেল। তারপর সেই পুরো জিনিসটা এক মুহূর্তের জন্যে গর্তের মুখের ওপর ঝুলে রইল। পরক্ষণেই লোহা, জ্বলন্ত কয়লা, পিতলের ফিটিংস, চাকা, কামরার কাঠের বেঞ্চি, গদি সবগুলো একসঙ্গে জট পাকিয়ে খনির অতল গহ্বরে চলে গেল। বিভিন্ন পদার্থের এই সমষ্টি খনিগহ্বরের দেওয়ালে ধাক্কা খেতে-খেতে নীচে যাওয়ার সময় তার যে আওয়াজ–স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছিলাম। তারপরে দামামার নির্ঘোষের মতো একটা আওয়াজ শোনা গেল। বুঝলাম সবকিছু নীচে পৌঁছে গেছে। বয়লারটা মনে হয় ফেটে গেছল কারণ বিস্ফোরণের একটা শব্দ কানে এল।

একটু পরেই অন্ধকার গহ্বর থেকে বাষ্প ও কালো ধোঁয়া বেরিয়ে আমাদের ঢেকে ফেলল। ধীরে ধীরে সেই গলগল করে বেরোনো ধোঁয়া সরু সুতোর মতো হয়ে গেল। বাইরে তখন গ্রীষ্মের ঝলমলে বিকেল। খানিকক্ষণ পরে খনিটা আগের মতোই নিস্তব্ধ হয়ে গেল।

এরপর আমাদের একটাই কাজ বাকি রইলকৃতকর্মের কোনও চিহ্ন না রাখা। রেলকর্মীদের সেই ছোট্ট দলটি লাইন সংযোগের জায়গায় পাতা লাইন ও অন্যান্য যন্ত্রাংশ চটপট সরিয়ে ফেলল। সবকিছু আবার আগের মতো হয়ে গেল। খনির ভেতরে ঢোকানো লাইনের অংশটুকু ও ট্রেনের ধ্বংসবশেষের কিছু টুকরো যেগুলো খনির মুখের কাছে ছিল, সেসব আমরা খনির গর্তে নিক্ষেপ করলাম। তারপর কোনওরকম তাড়াহুড়ো না করে আমরা বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়লাম–আমি প্যারিসে, আমার এক সঙ্গী ম্যানচেস্টারে, ম্যাকফারসন জাহাজে করে আমেরিকায়। সে সময়ের খবরের কাগজ দেখলেই আপনারা বুঝবেন কত কুশলতায় আমরা এই কাজ করেছিলাম ও বিশ্বশ্রেষ্ঠ ডিটেকটিভদের বোকা বানিয়েছিলাম।

আপনাদের নিশ্চয়ই মনে আছে, গোমেজ ব্রিফকেসটা আমাদের দিকে ছুঁড়ে দিয়েছিল। আমি বলাবাহুল্য, সেটা আমার নিয়োগকর্তাদের ফেরত দিয়েছিলাম। হ্যাঁ, তবে স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে দু-একটা কাগজ আমি নিজের কাছে রেখে দিয়েছি। ওইসব কাগজ প্রকাশ করে দেওয়ার আমার কোনও ইচ্ছে নেই। তবে সেই বিশেষ ব্যক্তিরা যদি আমার মুক্তির ব্যবস্থা না করেন, তা হলে কাগজগুলোর ব্যাপারে আমায় নতুন করে ভাবতে হবে। বিশ্বাস করুন, একা-একা মৃত্যুদণ্ড পেতে আমার একদম ভালো লাগে না।

মঁসিয়ে অমুক, জেনারেল তমুক–আমার কথা আপনারা শুনছেন তো? না শুনলে কিন্তু অমুক, তমুকের জায়গায় আসল নামগুলো বলে দেব।

পুনশ্চ :

আমার স্বীকারোক্তিতে একটা কথা বাদ গেছে। সেটা ওই ম্যাকফারসনের কথা। বোকার মতো ও স্ত্রীকে চিঠি লিখে ফেলেছিল। এইরকম লোককে বিশ্বাস করা কঠিন। ভবিষ্যতে যে-কোনও সময়ে ও স্ত্রীকে এই পুরো ঘটনাটা বলে দিতে পারত। তাই ও যাতে ওর স্ত্রীকে কোনওদিন আর দেখতে না পায় সেই ব্যবস্থাটাও করে দিয়েছিলাম। মাঝে-মাঝে মনে হয় ওর স্ত্রীকে চিঠি লিখে জানাই যে, তিনি চাইলে আবার বিয়ে করতে পারেন।

Anuprerona
Anupreronahttps://www.anuperona.com
Read your favourite literature free forever on our blogging platform.
RELATED ARTICLES

Most Popular

Recent Comments