Monday, June 2, 2025
Homeকিশোর গল্পছোটদের গল্পরুঁরুঁর গল্প - হুমায়ূন আহমেদ

রুঁরুঁর গল্প – হুমায়ূন আহমেদ

রুঁরুঁর গল্প – হুমায়ূন আহমেদ

রাত প্রায় একটা বাজে। আমি বসে আছি গৌরীপুর রেল স্টেশনে চিটাগাং মেইল ধরব। ট্রেন আসবে রাত তিনটায়। অপেক্ষা করা ছাড়া বর্তমানে আমার আর কিছু করণীয় নেই। শীতের রাত। ময়মনসিংহ অঞ্চলের বিখ্যাত শীত পড়েছে। গাড়ো পাহাড় থেকে উড়ে আসছে কনকনে হাওয়া। স্যুয়েটারটার উপর কোট, তার উপর একটা চাদর চাপিয়েও ঠক ঠক করে কাঁপছি।

গৌরীপুর রেল স্টেশনের ওয়েটিং রুমে আপাতত স্থান পেয়েছি তবে কতক্ষণ এখানে থাকতে পারব বুঝতে পারছি না। স্টেশনের ভবঘুরে সম্প্রদায়ের বিশাল অংশ এখানে স্থান নিয়েছে। ঝগড়া-ঝাটি হচ্ছে। আমার চোখের সামনে ছোটখাট একটা মারামারিও হয়ে গেল এক ভদ্রলােক তার মেয়ের বিয়ের জন্যে খাসি কিনেছেন। তিনি যাবেন মােহনগঞ্জ। চারটি প্রমাণ-সাইজের খাসি নিয়ে তিনিও আমার মতই ওয়েটিং রুমে অপেক্ষা করছেন ! খাসি চারটির স্বভাব বিচিত্র।

এরা চুপচাপ থাকে, কিন্তু কিছুক্ষণ পরপর চারজনই একত্রে ব্যাকুল স্বরে ডাকাডাকি শুরু করে। তাদের ডাকাডাকিতে ভয় পেয়ে ছোট ছোট বাঁচ্চারা কাঁদতে শুরু করে। যখন বিশৃংখলা চরমে উঠে তখন খাসিরা চুপ করে যায়।

এমন অবস্থায় মেজাজ ঠিক রাখা খুব মুশকিল। আমি প্রাণপণে চেষ্টা করছি। মেজাজ ঠিক রাখতে চেয়ারে পা তুলে বসে বই পড়ার চেষ্টা করছি। এই সময় আমাকে চমকে দিয়ে এক ভদ্রলােক বললেন, “স্যার চা খাবেন?”

ভদ্রলােক আমার পরিচিত নন। পরিচিত হলেও অবশ্যি চেনা যেত না। তিনি পরে আছেন মাংকি ক্যাপ। টুপির ফুটোর ভেতর দিয়ে শুধু চোখ বের হয়ে আছে। রোগা-পাতলা মানুষ। বেশ লম্বা। শীতের কারণেই বােধ হয় খানিকটা বেঁকে গেছেন। ভদ্রলােক আবার বললেন, “স্যার চা খাবেন ?”
আমি বললাম, “জ্বি না।”
“আমি আপনার মতই চিটাগাং মেইল ধরব।”
“ও আচ্ছা।”
” শীত কি রকম পড়েছে দেখেছেন? সাইবেরিয়াতেও এত শীত পড়ে না।”

আমি হাসির মত ভঙ্গি করে আবার বই পড়ায় মন দিলাম। এ জাতীয় উটকো লােককে বেশি প্রশ্রয় দিতে নেই। প্রশ্রয় পেলেই এরা কথা বলে বলে জীবন দুর্বিসহ করে তুলবে। চা খাব না বলার পরও ভদ্রলােক হাল ছাড়লেন না। খানিকটা ঝুঁকে এসে বললেন, “শীতের মধ্যে চা খেলে শরীরটা চাঙ্গা হয়।”
“আমার প্রয়ােজন নেই।”

ভদ্রলােক চলে গেলেন। আমি আবার বই-এ মন দেবার চেষ্টা করলাম।শীত মনে হচ্ছে আরাে বেড়েছে। চাদর ভেদ করে ঠাণ্ডা বাতাস ঢুকছে।
খাসি চারটা আবারাে এক সঙ্গে চেঁচাতে শুরু করেছে। আমি বই পড়ছি, কিন্তু কি পড়ছি নিজেই বুঝতে পারছি না।
“স্যার চা নিন।”
আমি তাকিয়ে দেখি, ভদ্রলােক পিরিচ দিয়ে ঢাকা চায়ের কাপ এগিয়ে ধরে আছেন। আমার নিষেধ শুনেননি।
“শীত কমবে – চুমুক দিন।”
আমি কথা বাড়ালাম না।চায়ের কাপ নিলাম।
‘পান খাওয়ার অভ্যাস আছে ?”
“জ্বী না।”
” পান নিয়ে এসেছি। চা খাবার পর জর্দা দিয়ে একটা পান খান, দেখবেন শীত কমে গেছে। পান খেলে মুখ নড়ে তো – এক্সারসাইজ হয় – এতে শীত কমে।”

আমাকে পানও নিতে হল।ভদ্র- লােক আমার পাশের টেবিলে উঠে বসলেন। লক্ষণ ভাল না। তিনি নিশ্চয়ই দীর্ঘ গল্পের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। আমি আবারও বই খুলে বসলাম। এমন ভাব করলাম যেন এই মুহূর্তে বই পড়াটা আমার খুব জরুরী।
“স্যার, আমার নাম মনসুর। আমিও আপনার সঙ্গে চিটাগং মেইল ধরব, তবে আমি যাচ্ছি দোহাজারী ।”
“ও আচ্ছা।”
“দোহাজারীতে একটা পুরানো বাড়ি আছে। প্রায় দু’শ বছর আগের হিন্দুবাড়ি। ঐ বাড়িতে ভূত থাকে বলে জনশ্রুতি। সেই জন্যেই যাচ্ছি।”
আমি বই থকে মুখ না তুলেই বললাম, ভূত দেখতে যাচ্ছেন?

বলেই মনে হল বিরাট ভুল করেছি। ভদ্রলােককে বকবক করার সুযোগ দিয়েছি। এখন তিনি দীর্ঘ সময় নিয়ে ব্যাখ্যা করবেন কেন তিনি দোহাজারী যাচ্ছেন।
“কথাটা স্যার আপনি নেহায়েত ভুল বলেননি – আমি ভূতের সন্ধানেই যাচ্ছি।”
“বাংলাদেশে যেখানে যত পুরানাে বাড়ি আছে সেখানেই যাচ্ছি। ভূত-প্রেতরা সাধারণত লােকালয়ের বাইরে পুরনো বাড়িঘর পছন্দ করে। ওদের খুঁজে বের করার জন্যে ঐসব জায়গাই ভাল।
শহরে তারা যে একেবারে থাকে না, তা না। মাঝে-মধ্যে শহরেও আসে। তবে অল্প সময়ের জন্যে। গাড়ি-ঘােড়ার যে ভিড় – মানুষই থাকতে পারে না তাে তারা থাকবে কী করে? “
“আপনি ভূত নিয়ে গবেষণা করছেন?”
“জ্বি না। তবে ওদের বিষয়ে অনেক কিছু জানি।”
“ও আচ্ছা।”
“ভূত নিয়ে একটা গ্রন্থ রচনার ইচ্ছা আছে। দেখি পারি কি না। একবার একটা আর্টিকেল লিখে পত্রিকায় পাঠিয়েছিলাম! ওরা ছাপেনি। আজকাল সব কিছুতেই ধরাধরি। লেখা ছাপার মধ্যেও ধরাধরি। পরিচিত লেখকের অগা—মগা-বগা লেখা বড় বড় হেডিং দিয়ে ছাপবে। আমার মত অপরিচিত লেখকের লেখা যত ভালই হােক, ছাপবে না। ঠিক বলিনি স্যার?”
“জ্বী।”
“অথচ আমার লেখাটা ছিল গবেষণাধর্মী, শিরােনাম ছিল – ‘শিশু ভূতের খাদ্য।’ লেখার কপি সঙ্গে আছে। পড়বেন?”
” জি না। আমি একটা বই পড়ছি। বইটা শেষ করা দরকার।”
‘আমার লেখাটা খুব ছােট তিন পৃষ্ঠার, পড়তে সময় লাগবে না।
“পড়তে চাচ্ছি না।”
“না চাইলে পড়তে হবে না। খুব খাটাখাটনি করে লিখেছিলাম … শিশু ভূতের খাদ্যের উপর এরকম লেখা দ্বিতীয়টি লেখা হয়নি বলে আমার ধারণা। অথচ এই লেখা ছাপল না। সম্পাদকের সঙ্গে দেখা করে- ছিলাম। উনি ব্যক্তিগতভাবে লেখাটার প্রশংসা করলেন। অবশ্য বললেন – শিশু ভুতের খাদ্যের উপর লেখা তাদের পত্রিকার উপযােগী নয়। ভূতদের কোন পত্রিকা থাকলে তারা লেখে নেবে।উনি বললেন, ভূতদের কোন পত্রিকায় লেখাটা পাঠিয়ে দিতে।”

আমি মনে মনে সম্পাদকের বুদ্ধির প্রশংসা করলাম। সেই সঙ্গে ক্ষীণ সন্দেহ হতে লাগল, আমার সামনে বসে থাকা এই মানুষটার মাথায় সম্ভবত কোন সমস্যা আছে। সুস্থ মাথার লােক ভূত শিশুর খাদ্য নিয়ে প্রবন্ধ বানাতে পারে না।
মনসুর নামের এই ভদ্রলােক বেশিক্ষণ কথা না বলে থাকতে পারে না বলে মনে হচ্ছে। নড়াচড়া শুরু করেছেন। এই নড়াচড়া কথা শুরু করার প্রস্তুতি। আমি হাতে বইয়ের দিকে আরাে ঝুঁকে এলাম।
‘স্যারের কি একটা মিনিট সময় হবে? জাস্ট ওয়ান মিনিট।”
আমি বই থেকে মুখ তুললাম। মনসুর সাহেব হাসিমুখে বললেন, “আপনার সন্ধানে কি কোন পুরোনাে বাড়ি আছে, যেখানে ভূতের আস্তানা?”
“অনুগ্রহ করে আমার কার্ডটা রাখুন। এখানে আমার ঠিকানা আছে। টেলিফোন নাম্বারও আছে – তবে আমার নিজের টেলিফোন না। পাশের বাসার টেলিফোন। মাঝে মাঝে ওদের খুব নরম গলায় অনুরােধ করলে ওরা আমাকে ডেকে দেয়।”

আমি যন্ত্রণা এড়াবার জন্যেই কোন কথা না বলে টেলিফোন কার্ড পকেটে রেখে দিলাম। মনসুর সাহেব আনন্দিত ভঙ্গিতে বললেন – “পুরানো ধরণের কোন ভূতের বাড়ির সন্ধান পেলে আমাকে দু’ কলম লিখে দেবেন। আমি চিরকৃতজ্ঞ
থাকব।”
“জি আচ্ছা।”
“স্যার, আপনি আমাকে পাগল ভাবছেন না তো?”
“না।”
“থ্যাংক ইউ। অনেকেই ভাবে। আমার নিজের আত্মীয়- স্বজনরাই ভাবে আপনাকে দোষ দিয়ে কি হবে! আমার বড় বােন আমাকে এক পাগলের ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন। পিজির প্রফেসর। তিনি আমাকে খুব ভালমত পরীক্ষা করে বলেছেন যে, আমি পাগল না।”
“ও আচ্ছা ।”
“শুধু যে মুখে বলেছেন তা না – লিখিতভাবে দিয়েছেন। আমার সঙ্গে আছে দেখতে চাইলে দেখাতে পারি।”
“জ্বি না, দেখতে চাচ্ছি না।”

মনসুর দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, “আমাকে পাগল ভাবলে লােকজনদের দোষও দেয়া যায় না। কোন সুস্থ মাথার লােক তাে আর ভূতের বাড়ি খুঁজে বেড়াবে না _ঠিক বলেছি না স্যার?”
“ঠিকই বলছেন। মনসুর সাহেব, ভাই শুনুন, যদি কিছু মনে না করেন আমার বইটা শেষ করা দরকার। খুবই জরুরী।”
” জরুরী হলে তাে বই শেষ করতেই হবে। স্যার বই শেষ করুন – আসলে আমি পড়েছি এমন বিপদে যে, বিপদের কথা কাউকে না বলে থাকতে পারি না। এমন বিপদ যে সবাইকে বলাও যায় না। সবাই এইসব জিনিস বুঝতে পারবে না।

আপনার মত দু’-একজন বুঝবে। যখন এ রকম কাউকে পাই তখন বিপদের কথাটা বলার চেষ্টা করি। আমি জানি, যাকে বলতে চাই তিনি বিবক্ত হন। তারপরেও বলি। এই যেমন আপনি বিরক্ত হচ্ছেন। বই পড়ার কথা বলে আমার হাত থেকে বাচতে চাচ্ছেন। আসলে তাে আপনি বই পড়ছেন না। তখন থেকেই একটা পাতা চোখের সামনে মেলে ধরে আছেন। যখনই আপনাকে কিছু বলতে যাচ্ছি ততবারই আপনি বলছেন – খুব জরুরী, বইটা শেষ করতে হবে।
আমি হাতের বই বন্ধ করে বললাম, “আপনার বিপদটা কি বলুন – আমি শুনছি।”
“আমার কথায় রাগ করেননি তাে?”
“না, রাগ করিনি – বলুন কি বলবেন।”
” আমি বরং আরেক কাপ চা নিয়ে আসি। চা খেতে খেতে শুনুন।”
“চা আনতে হবে না – আপনি বলুন।”
মনসুর সাহেব গলা নামিয়ে বললেন – “একটা ভূতের বাচ্চাকে নিয়ে আমি। বড়ই বিব্রত আছি।”
“ভূতের বাচ্চা?”
“জি, ভূতের বাচ্চা। সান অব এ ঘােস্ট। তিন-চার বছর বয়স। নিতান্তই শিশু।”
“ও আচ্ছা।”
“সে তার বাবা-মার সঙ্গে ঢাকা শহরে বেড়াতে এসেছিল। সারাদিন ঘুরেছে। মীরপুর চিড়িয়াখানায় গিয়েছে। শিশুপার্কে গিয়েছে … নিউ এয়ারপাের্ট গিয়ে প্লেন কি ভাবে উঠে নামে এইসব দেখেছে, তারপর এসেছে গুলিস্তানে …”
“কেন?”
“দেখার জন্যে, আর কিছু না। যাই হােক, গুলিস্তানে এসে পৌঁছার পরই মারামারি শুরু হয়ে গেল। রিকশা শ্রমিক ইউনিয়ন বনাম ট্রাক ড্রাইভার এসােসিয়েশন — বিরাট মারামারি। ককটেল ফাটাফাটি, রিকশা ভাঙা, ট্রাকের কাঁচ ভাঙা – যাকে বলে লংকাকাণ্ড – এই দেখে ভূতের বাবা ভয়ে দিল এক দিকে দৌড়। তার মা দিল আর এক দিকে দৌড় আর বাচ্চাটা লাফ দিয়ে আমার গলা জড়িয়ে ধরে ঝুলতে লাগলো।”
“আপনি কী করে বুঝতে পারলেন যে, একটা ভূতের বাচ্চা আপনার গলা জড়িয়ে ধরে আছে ?”
“শুরুতে কিছু বুঝতে পারিনি। আমার তখন মাথার ঘায়ে কুত্তা-পাগল অবস্থা। পুলিশ টিয়ার গ্যাস ছাড়তে শুরু করেছে। চোখে অন্ধকার দেখছি। আমি দৌড়তে দৌড়তে বাসায় এলাম – বাসায় আসার পর মনে হল বানরের মত কিছু একটা আমার গলা জড়িয়ে ধরে ঝুলছে। জিনিসটাকে ছাড়িয়ে দিতেই সেটা ধুপ করে
মেঝেতে পড়ে গিয়ে উ উ করে কান্না শুরু করল। এখন বিবেচনা করুন আমার মনের অবস্থা। একটা কিছু আমার গলা থেকে খসে পড়েছে আমি তার মেঝেতে পড়ার শব্দ শুনছি, কান্নার শব্দ শুনছি অথচ জিনিসটাকে দেখতে পাচ্ছি না।”
“আপনি কিছু দেখছেন না ?”
মনসুর সাহেব হাসিমুখে বললেন, “দেখব কি করে? ভূত তো আর চোখে দেখা যায় না !”
“কতদিন আগের কথা?”
“প্রায় ন’ মাস।”
“নয় মাস ধরে এটা আপনার সঙ্গে আছে?”
‘জ্বী। ফেলে তো দিতে পারি না। অবােধ শিশু – বাবা-মা’কে হারিয়ে নিতান্তই অসহায়। কোথায় তাদের খুঁজে পাওয়া যাবে সেটা জানে না। কি ভাবে তাদের সঙ্গে যোগাযােগ করা যাবে তাও জানে না।”
“কথা বলতে পারে ?”
“অল্পবিস্তর পারে। সব কথা শিখে নাই। নিতান্তই শিশু, বুঝতেই পারছেন। মানুষের বাচ্চারা তিন বছরে সব কথা বলতে পারে। ভূতের বাচ্চারা পারে না। ওদের গ্রোথ কম।”

আমি হা করে ভদ্রলােকের দিকে তাকিয়ে আছি। তিনি এখন স্বাভাবিক ভঙ্গিতে কথা বলে যাচ্ছেন যে, মাঝে মাঝে আমার মনে হচ্ছে বােধহয় এ রকম কিছু সত্যি সত্যি ঘটছে। ভদ্রলােক হয়ত আসলেই ভূত-শিশু লালন-পালন করছেন।
‘বুঝলেন ভাই সাহেব – মানুষের শিশু পালন করাই কত জটিল, আর এ হচ্ছে ভূত-শিশু। চোখে দেখা যায় না। বাবা-মা হারা শিশু। আমি ছাড়া দেখার কেউ নেই।
রাতে ঘুমুতে যেতাম ওকে সঙ্গে করে।আমার গলা জড়িয়ে ধরে ঘুমাতাে। আমার ঠাণ্ডা লাগতাে। ভূতদের শরীর আবার খুব ঠাণ্ডা। শীতের দিনে দুটা কম্বল গায়ে দিয়ে ঘুমুচ্ছি ভূত-শিশুর কারণে কম্বলের ভেতরটা হিমশীতল।ঠাণ্ডা লেগে নিওমােনিয়ার মত হয়ে গেল। তাই বলে তাে আর রুরুকে ফেলে দিতে পারি না ।’
“ওর নাম কি রুরু ?”
“হ্যা রুরু। ওর মা নাম রেখেছে।”
” রুরুকে খাওয়াতেন কি?”
“এই তাে আপনি আসল পয়েন্ট ধরে ফেলেছেন – প্রধান সমস্যা হচ্ছে এদের খাওয়া। মানুষের কোন খাবারই এরা খায় না। প্রথম দিকে তাে বুঝতেই পারি নি কি খেতে দেব। হেন জিনিস নেই তাকে খেতে দেইনি। টুথ-পেস্ট দিয়েছি, সাবান দিয়েছি, জুতার কালি দিয়েছি,মােমবাতি দিয়েছি, আফটার শেভ লােশন দিয়েছি। যাই দেই হা করে মুখে নেয়, তারপর থু করে ফেলে দেয়।”
“তারপর কি করলেন?”
“কি আর করবো ! রুরুকে একদিন কোলে বসিয়ে আদর-টাদর করে বললাম -বাবা, তুই নিজেই দয়া করে বল তােরা কি খাস। না খেয়ে খেয়ে তুই তাে বাপধন মরে যাবি | তখন সে বলল, ভূতরা আলাে খায়।”
“আলাে খায় ?”
“জ্বি, আলাে। চাদের আলাে, মােমবাতির আলাে – এইসব খায়।”
“এটা জানার পর নিশ্চয়ই রুরুকে খাওয়ানাের প্রবলেম সহজ হয়ে গেল?
“জিনা। প্রবলেমের তখন শুরু। ভূতরা আলাে খায় ঠিকই কিন্তু সব ধরনের আলো খেতে পারে না। বিদ্যুৎ চমকের সময় যে আলাে হয় সেই আলাে কোন ভুত খেতে পারে না। সেই আলাে খাওয়া মানে ভূতের মৃত্যু।”
“বলেন কি!”
“তা ছাড়া একজন বয়স্ক ভূত যে আলাে খেতে পারে একটি শিশু ভূত সেই আলো খেতে পারে না। খেলে বদহজম হয় – পেট খারাপ করে।”
“তাই নাকি?”
“জ্বি, একশ পাওয়ারের একটা বাল্বের আলাে তিন বছর বয়সী ভূতকে খাওয়ালে তার পেট নেমে যাবে।”

আমি খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে ইতস্তত ভঙ্গিতে বললাম, “একটা প্রশ্ন করি, কিছু মনে করবেন না – আমরা ভাত-মাছ খেয়ে বাথরুমে যাই – বাথরুম করি। ভূতরা যে আলাে খায়, ওদের বাথরুম করতে হয় না ।”
‘অবশ্যই হয় । ওরা আলাে খায়, বের হয়ে আসে অন্ধকার ।”
“সেটা মন্দ না।”
“রুরুকে মানুষ করতে গিয়ে অনেক কিছু শিখেছি। এবং বললে বিশ্বাস করবেন না, পশ্চিম দিকে ফিরে কানে ধরেছি ভূতের বাচ্চা আর মানুষ করব না। যথেষ্ট হয়েছে। ওরা তাে আর আমাদের মত না। ওদের নিয়মকানুনই অন্য।”
“তাই নাকি?”
“অদ্ভুত অদ্ভুত সব নিয়ম,শুনলে আপনি হয়ত ভাববেন পাগলের প্রলাপ …যেমন ধরুন ওরা যদি খুব আনন্দিত হয় তাহলে কামড়ায়।”
“তাই বুঝি ?”
“এই দেখুন না কামড়ে কামড়ে আমার হাতের দশা কি করেছে।”
ভদ্রলোকে শার্টের আস্তিন তুলে আমাকে দেখালেন সত্যি সত্যি দাগ দেখা যাচ্ছে। ভদ্রলােক গম্ভীর গলায় বললেন –”ভূতরা সাইজে বড়-ছােট হতে পারে,
এটা জানেন আশা করি?”
“জ্বী না, জানি না।”
“এরা অনেকটা রবারের মত, ইচ্ছা করলে মার্বেলের মত ছােট হতে পারে। রুরু করতাে কি, প্রায়ই ছােট হয়ে আমার নাকের ফুটায় কিংবা কানের ফুটায় বসে থাকতাে।”
“এত দেখি ভাল যন্ত্রণা!”
“যন্ত্রণা মানে জীবন অতিষ্ঠ। তবে ভাই, খুব মায়াকাড়া জানােয়ার। অল্পদিনেই এদের উপর মায়া পড়ে যায়। এক দণ্ড এদের চোখের আড়াল করতে ইচ্ছা করে না। রুরুকে তার বাবা-মা’র কাছে ফিরিয়ে দিতে হবে, এটা যখন মনে হয় তখন চোখে পানি এসে যায়।”
“ওকে তাহলে বাবা-মা’র কাছে দিয়ে দেবার পরিকল্পনা করেছেন?”
“ফিরিয়ে দিতে হবে না? কি বলেন আপনি ! পরের বাচ্চা কত দিন রাখব?”
“ওর বাপ-মা’কেই তাহলে খুঁজে বেড়াচ্ছেন?”

“ঠিক ধরেছেন। রুরুকে নিয়ে ভূতদের আস্তানায় যাচ্ছি। যদি কোন সন্ধান পাওয়া যায়। হাটহাজারিতে একটা দু’শ বছরের পুরানাে ভাঙা বাড়ি আছে। ভূতদের আখড়া। যাচ্ছি ঐদিকে যদি কোন খোজ তারা দিতে পারে। ভূতে ভূতে এক ধরনের যােগাযােগ তাে আছে। আছে না?”
“থাকারই কথা।”
‘আমি অন্যভাবেও চেষ্টা করেছি লাভ হয়নি। যেমন ধরুন থানায় ডায়েরী করাতে গেলাম। ভূতের বাচ্চা পেয়েছি, থানায় জিডি এন্ট্রি থাকা ভাল। ধানমণ্ডি থানার ওসি এমন ভাবে তাকালেন যেন আমি সরাসরি পাগলাগারদ থেকে ছাড়া পেয়ে তার কাছে এসেছি। পুলিশের লােকদের ব্রেইন যে কম থাকে সেটা ঐদিনই বুঝলাম। আশ্চর্য, এরা আমার কথা ভালমত শুনলই না।”
‘আমি পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিতে গিয়েছি, সেখানেও এই অবস্থা – বিজ্ঞাপন ছাপবে না। আরে, আমি আমার নিজের পয়সায় বিজ্ঞাপন দিচ্ছি, তুমি না ছাপার
কে? ঠিক বলছি না স্যার ?”
“ঠিকই বলছেন।”
“শেষে উপয়ান্তার না দেখে দশ হাজার হ্যান্ডবিল ছাপিয়ে গুলিস্তান, ফার্মগেট, মীরপুর এক নম্বর এবং সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালে বিলি করিয়েছি।”
“কি লেখা ছিল হ্যান্ডবিলে ?”
“কপি আছে। দেখুন না।”
ভদ্রলােক তার চামড়ার স্যুটকেস খুলে হ্যান্ডবিল বের করলেন – নিউজপ্রিন্ট কাগজে ছাপা বড় বড় হরফের হ্যান্ডবিল –
.
🔴 জরুরী বিজ্ঞপ্তি 🔴
.
রুরু নামে তিন বছর বয়েসী একটি ভূতের ছানা পাওয়া গিয়েছে। ছানাটি তার বাবা-মা’র নাম বলতে পারে না। তারা কোথায় থাকেন তাও বলতে পারে না। সে তার একটি বােনের নাম জানে– রিরি। উপযুক্ত প্রমাণ দিয়ে রুরির আইনানুগ অভিভাবককে ভূত শিশুটি সংগ্রহ করার জন্যে অনুরােধ জানাচ্ছি।
[ পোস্ট বক্স ১০৩
ঢাকা জিপিও ]

“বাড়ির ঠিকানা না দিয়ে পােস্ট বক্সের নাম্বার দিয়ে দিয়েছি। বাড়ির ঠিকানা দিলে আলতু-ফালতু লােক বিরক্ত করবে। কি দরকার?”
আমি বললাম, “আপনি তাহলে ভূত-শিশু নিয়ে অনেক কষ্ট করেছেন?”
“তা করেছি। তবে এইসব কষ্ট কোন কষ্ট না আসল কষ্ট হল – মানুষ যখন ভুল বুঝে তখন। যখন ভাবে, আমার ব্রেইন ডিফেক্ট হয়ে গেছে তখন মনটা খারাপ হয়ে যায়।”
“আপনার ব্রেইন ডিফেক্ট হয়েছে এরকম তাহলে কেউ কেউ ভাবছে ?”
“সবাই ভাবছে। আমার নিজের বড় বোন একদিন এসে কঠিন গলায় বলল –কই, দেখ তাের ভূত। এখন আপনিই বলুন, স্যার, ভূতের বাচ্চা আমি দেখাব কি করে? এরা তাে অদৃশ্য। সেই কথা বােনকে বুঝিয়ে বললাম। তাতেও কাজ হল না। সে বলে কি – বেশ, তাহলে তুই তাের ভূতকে কথা বলতে বল।আমি কথাটা অন্তত শুনে যাই।”
“শুনিয়েছেন কথা?”
” জ্বী না। রুরু তো অন্যের সামনে কথা বলবে না। অসম্ভব লাজুক।”
“ও আচ্ছা।”
” এই যে এতক্ষণ যে সে আপনার চেয়ারের হাতলে পা ঝুলিয়ে বসে আছে আপনি কি তার মুখ থেকে একটা বাক্য শুনেছেন?”
“জ্বি না।”
ভদ্রলোক বিরক্ত হয়ে বললেন, “সবাই শুধু প্রমাণ চায়। আরে, মুখের কথাটা তো সবচেয়ে বড় প্রমাণ। ঠিক বলছি না?”
“অবশ্যই ঠিক বলছেন।”

আমার ট্রেনের সময় হয়ে এসেছে, ঘণ্টা দিয়ে দিয়েছে। এখন উঠতে হয়। মনসুর সাহেব বললেন – “স্যার তৈরি হােন। এই ফাকে আমি রুরুকে খাইয়ে আনি।”
“সে কি আপনার সঙ্গেই আছে ?”
“জ্বী তাকে আর কোথায় ফেলে যাব ?”
“তাকে কি খাওয়াবেন?”
“চাঁদের আলো। আকাশে চাঁদ উঠেছে। চাঁদের আলােই খানিকটা খাওয়াব। আজ সারা দিনে কিছুই খায়নি। খাওয়া- দাওয়া পুরােপুরি বন্ধ। কি যে যন্ত্রণায় পড়েছি !”
“খাচ্ছে না কেন?”
“এই যে দোহাজারী নিয়ে যাচ্ছি, তার বাবা-মা’কে খুঁজছি, এই জন্যেই খাওয়া-দাওয়া ছেড়ে দিয়েছে। আমার সঙ্গে থাকতে চায়, অন্য কোথাও যেতে চায় না। রুরুকে ফিরিয়ে দিতে আমার নিজেরও ভাল লাগছে না? মায়া পড়ে গেছে না? রুরু চলে গেছে এটা ভাবতেই আমার চোখে পানি আসে।”

বলতে বলতে মনসুর সাহেবের চোখ ভিজে উঠল। তিনি চাদরে চোখ মুছে উঠে দাঁড়ালেন। ধরা গলায় বললেন, “স্যার, আপনি ভূতের বাড়ির কোন সন্ধান পেলে অধমকে জানাবেন –
অন্যের আদরের ধন আমার কাছে পড়ে আছে। আমার একটা দায়িত্ব আছে ? জানি, রুরু চলে গেলে আমার কষ্ট হবে কিন্তু উপায় কি!”

চিটাগাং মেলে উঠে বসেছি। মনসুর সাহেব তার ভূতের বাচ্চাকে চাদের আলাে খাইয়ে আমার পাশে এসে বসেছেন। তাকে এখন বেশ আনন্দিতই মনে হচ্ছে। সম্ভবত ভূতের বাচ্চা চাদের আলাে খেয়েছে।
মনসুর সাহেব বললেন, “জানলার কাচ নামিয়ে দিন স্যার। ট্রেন ছাড়লে ঠাণ্ডা
লাগবে।”
আমি কাঁচ নামাচ্ছি এই সময় ছােট্ট একটা নাটক হল। এক ভদ্রলােক হন্তদন্ত হয়ে ট্রেনের কামরায় ঢুকে পড়লেন। ঢুকেই মনসুরের হাত ধরে টানাটানি।
ভদ্রলােকের পেছনে পেছনে বয়স্ক একজন মহিলাও ঢুকলেন। তিনিও কাঁদতে শুরু
করলেন।

আমি পুরােপুরি হকচকিয়ে গেলাম। যা জানলাম তা হচ্ছে – মনসুর হক গৌরীপুর পোস্ট-মাস্টার সাহেবের ছােটভাই। ঢাকায় থাকতো। মাথা খারাপ হয়ে গেছে। সবাইকে বলে বেড়াচ্ছে তার সঙ্গে ভূতের বাচ্চা আছে। তাকে ঢাকা থেকে এনে গৌরীপুরে তালাবন্ধ অবস্থায় রাখা হয়েছে। তারপরেও মাঝে মাঝে তালা খুলে বের হয়ে পড়ে। আজ যেমন বের হয়েছে।

টানাটানি করে মনসুরকে নামানাে হয়েছে। গার্ড বাতি দেখিয়েছে। ট্রেন চলতে শুরু করেছে। মনসুর সাহেব আমার দিকে তাকিয়ে দুঃখিত ভঙ্গিতে হাসলেন। ক্লান্ত গলায় বললেন – “আমি সত্যি কথাই বলছি। কিন্তু কেউ আমার কথা বিশ্বাস করে না। কেউ না।”
ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে। মনসুরকে দু’দিক থেকে দু’জন ধরে টেনে টেনে নিয়ে যাচ্ছে।

Anuprerona
Anupreronahttps://www.anuperona.com
Read your favourite literature free forever on our blogging platform.
RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here


Most Popular

Recent Comments