Friday, March 29, 2024
Homeরম্য গল্পবোকাভূ - হুমায়ূন আহমেদ

বোকাভূ – হুমায়ূন আহমেদ

তোমাদের আজ একটা ভূতের গল্প বলি?

ভয় নেই-যে ভূতের গল্প বলব সে হলো বোকা-টাইপ ভূত। বেজায় বোকা। তার নাম হলো ‘বোকাভূ’। তার বয়স বেশি না। মাত্র সাত। মানুষ হয়ে জন্মালে সে ক্লাস টু-তে পড়ত।

বোকাভূ কেমন বোকা এখন বলি। ভূত বাচ্চাদের প্রধান কাজ হচ্ছে মারামারি খামচাখামচি করা। এ ওকে কামড়ে ধরবে, কিল-ঘুসি মারবে, কাদায় চুবাবে। বোকাভূ এইসব কিছুই করে না। সব ভূত বাচ্চারা যখন মারামারি করে সে তখন একটু দূরে উদাস হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। বোকাভূর বাবা তখন খুব রাগ করেন। থমথমে গলায় বলেন, বোকাভূ, তোর হয়েছেটা কী? সবাই মারামারি করছে, তুই করছিস না কেন?

বোকাভূ উদাস গলায় বলে, মারামারি করতে আমার ভালো লাগে না।

‘কী সর্বনাশ, তুই কি সারাজীবন শান্ত শিষ্ট হয়ে থাকবি?’

‘হু’।

‘লক্ষীসোনা পুটপুট, ভুটভুট তুই লাঠিটা নিয়ে যা–ঠাস করে একটা ভূতের বাচ্চার মাথায় বাড়ি দিয়ে আয়। দেখবি কত মজা পাবি।

‘উহুঁ। কাউকে ব্যথা দিলে আমার খুব খারাপ লাগে।’

‘যত দিন যাচ্ছে তুইতো ততই বোকা হচ্ছিসরে বাবা।’

‘হ্যাঁ হচ্ছি।’

‘বোকা হতে হতে শেষটায় হাবা হয়ে যাবি। তখন তোকে আর কেউ বোকাভূ ডাকবে না। ডাকবে–হাবাভূ। ভূতদের নাম হাবাভূ হলে খুব লজ্জার হয়। বাবা তোর চিকিৎসা হওয়া দরকার। চল তোকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাই।’

‘আমার কোথাও যেতে ইচ্ছা করছে না বাবা। আমার শুধু চাঁদের দিকে তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছা করছে।’

বোকাভূর বাবা কাঁদো কাঁদো হয়ে গেলেন। বোকাভূ তাঁর খুব আদরের সন্তান। আজ তার একি অবস্থা। তিনি ছেলেকে ভূত ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলেন।

ভূত ডাক্তার খুবই ভয়ংকর। কটমট করে তাকান, হুম হাম শব্দ করেন, কথা বলেন পদ্যে। তিনি বোকাভূর গলা দু’হাতে চেপে ধরে বিকট হুংকার দিয়ে বললেন–

নাম বল ধাম বল
রোগের বিবরণ বল।
সর্দি কাশি, না কি জ্বর।
কোন ব্যাধি করিয়াছে ভর?

বোকাভূর বাবা বললেন, জনাব, এইসব কিছু না। এর শরীর খুব ভালো। ও শুধু বোকা। আপনি দয়া করে ওর বোকা-ব্যাধি সারিয়ে দিন।

ডাক্তার হুংকার দিয়ে বললেন–

কী রকম বোকা?
অল্প, বেজায় না মধ্যম
বোকামিটা প্রবল না কম?

বোকাভূর বাবা বললেন, বোকামি খুবই প্রবল। বোকাভূ ভূত বাচ্চাদের মতো মারামারি কামড়াকামড়ি কিছুই করে না। সবাই যখন মারামারি করে সে তখন উদাস হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।

ভূত ডাক্তার চিন্তিত মুখে বললেন–

কী ভয়ংকর!
বোকামিতো ঢুকেছে তার অন্তরের ভেতর।

‘জনাব, এইখানেই শেষ না। বোকাভূ যখন দেখে কেউ ব্যথা পাচ্ছে বা কষ্ট পাচ্ছে তখন–তার আনন্দে হেসে ফেলা উচিত। সে কিন্তু হাসে না। তার নাকি খুব কষ্ট হয়। তার নাকি চোখে পানি এসে যায়।’

ভূত ডাক্তার গম্ভীরভাবে মাথা দুলাতে দুলাতে বললেন–

কী ভয়ংকর!
বোকামিতো ঢুকেছে তার অন্তরের ভেতর।

এইখানেই শেষ না ডাক্তার সাহেব। ভয়ংকর কথাটাই এখনো আপনাকে বলা হয়নি। বলতে লজ্জা লাগছে। না বলেও পারছি না। আপনি চিকিৎসক মানুষ, আপনার কাছে কিছু গোপন করা উচিত না। বোকাভূ স্কুলে পড়াশোনা করতে চায়।

ভূত ডাক্তার বোকাভূর বাবার কথায় এতই অবাক হলেন যে পদ্য বলতে ভুলে গেলেন। চোখ কপালে তুলে শুধু বললেন–’সেকি!’

‘সে শুধু ভালো ভালো কাজ করতে চায়। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকতে চায়। দিনে একবার ময়লা কাদায় গোসল করবে তাও করতে চায় না।’

কী ভয়ংকর!
পরিষ্কার ঢুকেছে তার অন্তরের ভেতর।

‘সে পরিষ্কার টলটলা পানিতে গোসল করতে চায়। পরিষ্কার জামা-কাপড় পরতে চায়।

ভূত ডাক্তার দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে বললেন–

মহা সর্বনাশ!
বোকাভূকে বোকামিতে করিয়াছে গ্রাস।

বোকাভূর বাবা কাঁদো কাঁদো গলায় বললেন–‘আপনি আমার বাচ্চাটাকে ভালো করে দিন ডাক্তার সাহেব। ওকে সুস্থ করে দিন। আমি আপনার পায়ে পড়ি।’ বলেই তিনি ডাক্তারের পায়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেলেন।

ডাক্তার সাহেব অনেক চিন্তা ভাবনা করে বললেন—’তোমার ছেলের যে রোগ হয়েছে তার নাম মানুষ-রোগ। মানুষের স্বভাব তার মধ্যে চলে এসেছে।’

বোকাভূর বাবা হতাশ গলায় বললেন, ‘এখন উপায়?’

ডাক্তার সাহেব বললেন, ‘উপায় একটা আছে। তোমার ছেলেকে মানুষের ছেলেমেয়েদের সঙ্গে মিশতে দিতে হবে। মানুষদের স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিতে হবে। সে মানুষের ছেলেমেয়েদের সঙ্গে হেসে খেলে বড় হবে।’

‘তাতে লাভ কী?’

‘মানুষ সঙ্গে থেকে থেকে সে একদিন বিরক্ত হয়ে আবার ভূতদের মতো হতে চাইবে। এই এর একমাত্র চিকিৎসা। আর চিকিৎসা নেই।’

বোকাভূর বাবা কী আর করেন–একদিন ছেলেকে নতুন শার্ট-প্যান্ট কিনে দিলেন।

স্কুলব্যাগ কিনে দিলেন। পানির বোতল কিনে দিলেন। তারপর ভর্তি করিয়ে দিলেন মানুষদের স্কুলে।

বোকাভূ সারাদিন মানুষের বাচ্চাদের সঙ্গে থাকে। স্কুলে পড়ে। মানুষের বাচ্চাদের সঙ্গে খেলে। শুধু রাতে নিজেদের বাসায় ফিরে আসে। নিজেদের বাসা মানে বাঁশগাছ। রাতটা বাঁশগাছে পা ঝুলিয়ে বসে কাটিয়ে দেয়। সকালবেলা মহাউৎসাহে মানুষদের স্কুলে রওনা হয়। কে জানে সে হয়ত তোমাদের স্কুলেই পড়ে! তোমরা তাকে চেন না বলে মনে করছ সে তোমাদের মতোই একজন। তার সঙ্গে তোমরা হাসছ, খেলছ, গল্প করছ। সে দেখতে কেমন বলব? না থাক বলব না। বললে তোমরা তাকে চিনে ফেলবে।

Anuprerona
Anupreronahttps://www.anuperona.com
Read your favourite literature free forever on our blogging platform.
RELATED ARTICLES

Most Popular

Recent Comments