Saturday, April 20, 2024
Homeরম্য গল্পঘূর্ণি - নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

ঘূর্ণি – নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

অথ নিমন্ত্রণ ভোজন - নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

অনেক দূরের গ্রাম থেকে বিয়ে করে এনেছিল কালাচাঁদ। বউ যমুনা তখনও কিছু জানত না।

বাবরি চুল ষন্ডা মানুষটাকে দেখে তার ভালোই লেগেছিল। মস্ত ছাতি, মোষের মতো চওড়া কাঁধ। গায়ের কুচকুচে কালো রং রোদ পড়লে যেন উজলে উজলে ওঠে। আর কী অসম্ভব শক্তি তার শরীরে। একটা হ্যাঁচকা টান দিয়ে তিনমনি ধানের বস্তাটাকে কতদূরে ছিটকে দিলে!

এমন জোয়ান, অথচ মুখোনা ঠিক বারো বছরের ছেলের মতো শান্ত আর কোমল। হাসলে ভারি লাজুক মনে হয়। যমুনা খুশি হয়েছিল। সরল মানুষটি প্রাণভরে তাকে ভালোবাসবে, আপদ-বিপদের দিন এলে লোহার মতো চওড়া বুকের ভেতরে ছোট্ট একটা পাখির মতো লুকিয়ে রাখবে—বলবে, আমি আছি, ভাবনা কী!

আসবার দিন ঝরঝর করে কেঁদে ফেলেছিল বুড়ো বাপ।

তোর মা নেই যমুনা, এইটুকু বয়েস থেকে তোকে বড়ো করে তুলেছিলুম। আজ তুই দূরদেশে চলে যাচ্ছিস, বছরে এক বারও তোকে দেখতে পাব না। কী নিয়ে আমি বাঁচব বল দিকি?

যমুনা কিছু বলতে পারেনি। চোখের জলে গলার স্বর থমকে গিয়েছিল।

কালাচাঁদ বলেছিল, তুমি ভেবো না মোড়ল। দু-চার মাস বাদ এক বার করে তোমার মেয়েকে আমি দেখিয়ে নিয়ে যাব।

কথা দাও।

কথা দিচ্ছি।

বুড়ো মোড়ল আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল কিন্তু সময় পেল না। নোঙর আগেই তুলে ফেলেছিল কালাচাঁদ, এবার একটা খোঁচ দিলে লগিতে। পদ্মার স্রোতে ছোট্ট একটা দুলুনি খেয়ে নৌকা ছুটল তিরের মতো। পড়ে রইল ভাঙনের মুখে হেলে-পড়া মন্দিরটা। দেখতে দেখতে মিলিয়ে এল গ্রামের চিহ্ন, কখন ছাড়িয়ে গেল শ্মশানটা। নৌকা চলল।

কালাচাঁদ বইঠা ধরে বসেছিল। যমুনার দিকে তাকিয়ে নরম গলায় জিজ্ঞেস করলে, ভয় করছে তোমার?

লালশাড়ির ঘোমটাটা আস্তে আস্তে মুখ থেকে সরিয়ে দিলে যমুনা। ভিজে ভিজে পাতার তলা থেকে দুটো ডাগর চোখ মেলে ধরল স্বামীর দিকে। বললে, না।

বাপের জন্যে মনখারাপ করছে?

যমুনা জবাব দিলে না। আবার দু-ফোঁটা জল গড়িয়ে এল চোখ থেকে।

কালাচাঁদ এক বারের জন্যে বইঠাটা তুলে ধরল। তারপর বললে, মনখারাপ করবারই কথা। তুমি ভেবো না, যখনই তোমার ইচ্ছে হবে নিয়ে আসব বাপের বাড়িতে। কেমন?

কৃতজ্ঞতায় যমুনা ঘাড় নাড়ল, আচ্ছা।

পদ্মার ভরা স্রোতে নৌকা চলল। যমুনা তাকিয়ে রইল জলের দিকে। গহীন অথৈ পদ্মা। এপারের গাছপালাগুলো দেখা যায়, ওপারটা একেবারে ঝাপসা। মাঝখানে জল আর জল। উঃ, কত জল আছে এই নদীতে।

হঠাৎ যমুনা জিজ্ঞেস করল, তুমি বুঝি পদ্মায় খুব নৌকা বাও?

কালাচাঁদ হা-হা করে হেসে উঠল। হাসিটা যেন কেমন বেয়াড়া আর নতুন রকমের শোনাল যমুনার কানে। চমকে চোখ তুলল যমুনা।

পদ্মার জলেই তো বাস করি বলতে গেলে। অমাবস্যার ঘুটঘুটে আঁধারে পাড়ি জমাই। ঝড়-তুফান পেরিয়ে চলে আসি।

যমুনা শিউরে উঠল মনে মনে।

ভয় লাগে না তোমার?

কালাচাঁদ শব্দ করে হাসল না বটে, কিন্তু হাসি এবার ঝরে পড়ল গলা দিয়ে।

পদ্মার ধারে যে ঘর বাঁধে, পদ্মাকে ভয় করলে তার চলে?

কিন্তু এ যে রাক্ষুসি নদী!

কালাচাঁদ বললে, উঁহুঁ, মা। মা কালী। ঝড় উঠলে, রাত কালির মতো কালো হয়ে গেলে খাঁড়া নিয়ে নাচতে শুরু করে। সে-নাচ দেখলে আর ভয় হয় না বউ, সঙ্গে সঙ্গে নেচে উঠতে ইচ্ছে করে। তোমাকেও সে-নাচ দেখাব বউ, কোনোদিন ভুলতে পারবে না।

আমার দেখে দরকার নেই। যমুনা কেঁপে উঠল।

কালাচাঁদ একটু চুপ করে রইল, বইঠা বাওয়া বন্ধ করে স্নেহভরা চোখ মেলে চেয়ে রইল যমুনার দিকে। ছেলেমানুষ, এখনও কিছু জানে না। কিন্তু আস্তে আস্তে সব সয়ে যাবে ওর। রাত্রের পদ্মাকে চিনবে, রাত্রের পদ্মায় যা ঘটে তা-ও ওর কাছে তখন আর ভয়ংকর ঠেকবে না। ঠিক কথা, মা-র সেই কালীমূর্তি এক বার যে দেখেছে, তার চোখ সে-রূপে একেবারে ডুবে গেছে। যমুনারও তাই হবে।

কিন্তু এখনই নয়। এই দিনের আলোয় পদ্মা আর এক রকম। এ মা-র আর এক চেহারা। কোলে তুলে নেয়, আদর করে, ঠাণ্ডা হাওয়ার আঙুল বুলিয়ে দেয় গায়ে। এই পদ্মার মাঝিরা সারি গায়, ধানের নৌকা গঞ্জে এসে ভেড়ে, বাচ্চারা মোচার খোলা ভাসায়, দামাল ছেলে ঝাঁপাই ঝোড়ে, বউ-ঝিরা কলসি ভরে নিয়ে যায়, জেলের জালে রুপোলি ইলিশ ঝিলমিল করে। এই পদ্মা ফসল দেয়, বাঁকে বাঁকে খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে। তুফানের রাতের কথা এখন থাক।

কালাচাঁদের চোখ আর মন পদ্মার ওপর দিয়ে ছড়িয়ে গেল। সাদা ঘোলাজল তো নয়, যেন মায়ের দুধ! মাটি সেই দুধ টেনে নিচ্ছে শিশুর মতো, পুষ্ট হয়ে উঠছে ধানের চারা, আম-জাম নারকেল-সুপুরি রসে-শাঁসে ভরে উঠেছে। যমুনার ভীরু মুখের ওপর দৃষ্টি ফিরিয়ে এনে একটু চেয়ে রইল কালাচাঁদ, গুনগুন করল বার কয়েক, তারপর গান ধরল গলা ছেড়ে :

পদ্মা মোদের মা জননী রে,
পদ্মা মোদের প্রাণ,
তার সোনার জলে মোদের খেতে
ভরে সোনার ধান রে
ভরে সোনার ধান–

মুগ্ধ আনন্দে চোখের তারা দুটো বড়ো হয়ে উঠল যমুনার। এমন ষন্ডা জোয়ান মানুষটা, এত বড়ো বুকের ছাতি, এমন লোহার মতো হাতের গুল, তার গলায় এই গান! আর এত মিষ্টি তার গলা! পদ্মার বুকের ওপর দিয়ে দরাজ গলার এই গান যেন দূরদূরান্তে ভেসে যেতে লাগল।

যমুনার মুখের দিকে আড়চোখের দৃষ্টি রেখে কালাচাঁদ গেয়ে চলল :

রঙ্গিলা নাও স্রোতে বাইয়া
বন্ধু আসে ভিনদেশিয়া
আর আপন ভুলে রূপবতী
ভাসায় কলসখান–

যমুনার চোখে আর পলক পড়ে না। এই রূপবতী কে? সে-ই? আর এই কি সেই ভিনদেশিয়া বন্ধু, যে এমন করে তাকে রঙিলা নায়ে তুলে নিয়ে ভেসে চলেছে?

যমুনা স্বপ্ন দেখছিল, কিন্তু স্বপ্নটা ভেঙে গেল আচমকা।

নৌকার সঙ্গে সঙ্গে ওটা কী চলেছে? শ্যাওলা-ধরা কাঠের গুড়ি? না, তা তো নয়! পিঠের ওপরে কাঁটার মতো উঁচু উঁচু হয়ে আছে, চারটে ছোটো ছোটো কদাকার পা জল টানছে, সরু সুচালো মুখ, আর জলের একটু ওপরে দুটো হিংস্র পলকহীন চোখ যেন একভাবে চেয়ে আছে তার দিকে!

কুমির! কুমির! ভীত বিকৃত গলায় চেঁচিয়ে উঠল যমুনা।

সঙ্গে সঙ্গে জলের দিকে চোখ গেল কালাচাঁদের, আচমকা থেমে গেল গানটা! হিংস্র কর্কশ গলায় বললে, শা-লা। তারপর বইঠাটা বাগিয়ে ঢপাস করে একটা প্রচন্ড ঘা বসাল কুমিরটার পিঠের উপর।

ল্যাজের একটা বিরাট ঝাপটা দিয়ে, একরাশ জল ছলকে দিয়ে কুমির ডুবে গেল। যমুনা তখনও কাঠের পুতুলের মতো শক্ত হয়ে আছে। কালাচাঁদ হেসে বললে, ভয় নেই—ভয় নেই। আমরা আছি নৌকার উপর, ও-শালা আমাদের কী করবে। আর জলের তলায় হলেই বা কী করত? কালাচাঁদ দুলেকে চেনে না, গলা টিপে মেরে ফেলতুম ওকে।

কুমিরের চাইতে আরও নিষ্ঠুর—আরও বীভৎস দেখাল কালাচাঁদের চোখ। যমুনা ভরসা পেল না, আরও শক্ত হয়ে ঠায় বসে রইল, বুকের ভিতরটা তার হিম হয়ে গেছে। কিছুই জানত না যমুনা, তবু এই মুহূর্তে কেমন করে যেন টের পেল–কালাচাঁদকে সে যা ভেবেছিল, কালাচাঁদ ঠিক তা নয়।

২.

চাষির ছেলে, অথচ চাষবাস করে না। জমিজমা বলতেও কিছু নেই। অল্পস্বল্প ঘরামির কাজ জনমজুর খাটা। তবু টিনের নতুন দো-চালা ঘর, গোয়ালে তিন-তিনটে গোরু। ত্রি-সংসারে কোথাও কেউ নেই।

এই হল কালাচাঁদের সংসার।

তখনও কিছু টের পায়নি যমুনা। পেল সেদিন, যেদিন অনেক রাতে কোত্থেকে একপেট মদ খেয়ে ফিরল কালাচাঁদ। ভাত আর মাছের ঝোল রান্না করে যমুনা ঝিমুচ্ছিল দাওয়ায় বসে বসে। পেয়ারা গাছের পাশে হলদে রঙের এক টুকরো চাঁদ ঝুলে পড়ছিল, থেকে থেকে ডাহুক ডাকছিল ঝোপের ভেতর। যমুনা ঝিমুচ্ছিল আর আলগা আলগা স্বপ্নের মধ্য দিয়ে টুকরো টুকরো মেঘের মতো ভেসে যাচ্ছিল ছাড়া ছাড়া কতগুলো ছবি। মাকে উঠোনে নামানো হয়েছে, একমাথা রুখো চুল ছড়িয়ে পড়েছে চারদিকে। ছোট্ট যমুনা কাঁদছে লুটোপুটি খেয়ে, পাশের বাড়ির মানিকের মা কী যেন বোঝাতে চাইছে তাকে। বাবা একটা নারকেল গাছে হেলান দিয়ে কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে। তারপরে বৃষ্টি পড়ছে, অনেক-অনেক বৃষ্টি। উঠানে ব্যাং লাফাচ্ছে–একটা-দুটো-তিনটে-চারটে। বাবা হাট থেকে আসছে, বেলা ডুবে যাচ্ছে, যমুনা দাঁড়িয়ে আছে দোরগোড়ায়। বাবা এসে যমুনাকে দু-হাত বাড়িয়ে বুকে টেনে নিলে, বললে, কী সুন্দর শাড়ি কিনে এনেছি তোর জন্যে। বিক্রমপুরের তাঁতের শাড়ি, ময়ূরকণ্ঠী রং…

কড়-কড়াং! যেন বাজ পড়ল কোথাও। চমকে উঠে বসল যমুনা। সদর দরজাটা আছড়ে ফেলে বাড়িতে ঢুকল কালাচাঁদ, টলতে টলতে এগিয়ে এল।

মদ খাও নাকি তুমি? যমুনা চেঁচিয়ে উঠল।

কারও বাপের পয়সায় খাই নাকি? রূঢ় কর্কশ জবাব এল একটা।

ছি, ছি!

চুপ কর হারামজাদি। গলাটাকে সপ্তমে চড়িয়ে কালাচাঁদ জানোয়ারের মতো গর্জন করে। উঠল, চেঁচাবি তো গলা টিপে মেরে ফেলব!

নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারল না যমুনা, নিজের কানকেও নয়। লণ্ঠনের একমুঠো আলো গিয়ে পড়েছে কালাচাঁদের মুখে। সেই কালাচাঁদ, কিন্তু এক মাস ধরে যমুনা যার ঘর করেছে এ সে নয়। সমস্ত চেহারার আদলটাই বদলে গেছে তার। এখনই একটা লোহার মতো থাবা বাড়িয়ে সে যমুনার গলা টিপে ধরতে পারে।

যমুনা পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।

আস্তে আস্তে স্বামীকে চিনল যমুনা। কালাচাঁদের আসলে পেশা ডাকাতি। রাতের অন্ধকারে পদ্মার বুকে সে ডাকাতি করে বেড়ায়।

প্রথম জানবার পর তিন রাত সে ঘুমোতে পারেনি। চোখের জলে ঘরের দাওয়া ভিজিয়ে ফেলেছে, ছুটে পালিয়ে যেতে চেয়েছে বাপের কাছে। কিন্তু কালাচাঁদের চোখের দিকে তাকিয়ে সে সাহসও পায়নি। কোথায় যাবে, কোনখানে পালাবে? কালাচাঁদের হাত থেকে তার পরিত্রাণ নেই কোথাও।

কেঁদেছে, নিজের মাথা খুঁড়েছে মাটিতে, তারপর ভাগ্যের সঙ্গে মানিয়ে নিয়েছে। দেখেছে সন্ধ্যার অন্ধকারে ছায়ামূর্তির মতো একদল মানুষ এসে জড়ো হয় তাদের বাড়ির দাওয়ায়, ফিসফিস করে কথা বলে, মদ খায়, গাঁজা খায়, তারপর একসঙ্গে কোথায় বেরিয়ে চলে যায়। অসম্ভব ভয়ে সারারাত জেগে জেগে দুঃস্বপ্ন দেখে যমুনা। ভোর হওয়ার আগে ফেরে কালাচাঁদ, টাকা এনে ঢালে মেজের ওপর, আনে রক্তমাখা গয়না। দাঁতে দাঁত চেপে যমুনাকে বলে, একটা টু শব্দ যদি করবি কারও কাছে, তাহলে গলা কেটে পদ্মায় ফেলে দেব—মনে থাকে যেন।

যমুনা বালিশ কামড়ে উপুড় হয়ে পড়ে থাকে, নিশ্বাস পর্যন্ত বন্ধ হয়ে আসে তার। তারপর একটা ছোটো শাবল দিয়ে ঘরের কোনায় গর্ত করে টাকা-গয়নাগুলো পুঁতে রাখে কালাচাঁদ। বিড়ি ধরিয়ে যমুনার পাশটিতে এসে শোয়। আতঙ্কে শরীর সিঁটিয়ে ওঠে যমুনার, স্বামীর গা থেকে যেন মানুষের রক্তের আঁশটে গন্ধ পায় সে!

কালাচাঁদের মনটা নরম হয় এতক্ষণে, হাত বাড়িয়ে যমুনাকে টেনে নিয়ে আদর করতে থাকে। যমুনার মনে হয় একটা বাঘ যেন মেরে ফেলবার আগে খেলা করছে শিকারটাকে নিয়ে। চোখের পাতা চেপে ধরে সে শক্ত হয়ে থাকে।

চোখ মেলে চা বউ, চোখ মেলে চা। তোর জন্যই তো এসব করি। একছড়া সুন্দর হার পেয়েছি, পরিয়ে দেব তোকে।

প্রায় নিঃশব্দ গলায় যমুনা বলে, হার আমি চাই না, তোমার পায়ে পড়ি, এই মানুষ মারার কাজ তুমি ছেড়ে দাও। তারপর ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে আরম্ভ করে।

বিরক্ত হয়ে কালাচাঁদ বিড়বিড় করে, দুত্তোর, মেয়েমানুষের নিকুচি করেছে।

যমুনাকে ছেড়ে দিয়ে কাত হয়ে শোয়। ভাবে, বিয়ে না করেই বেশ ছিল। দলের শাকরেদ রাখালের সেই বিধবা বোনটাই ছিল তার সত্যিকারের যোগ্য। যমুনার মতো একটা ভিজে কাঁথা নয়, তেতে থাকত আগুনের মতো। তেমনি ছিল সোনা আর পয়সার খাঁই। কালাচাঁদের সড়কিতে নিজের হাতে শান দিয়ে বলত, একসঙ্গে তিনটেকে ফুড়তে পারবে এমনি করে ধার দিয়ে দিলুম।

তিন দিনের জ্বরে মরে গেল। নইলে কি আর যমুনাকে বিয়ে করে আনত সে? রাখালের বোনটার কথা ভাবতে ভাবতে কালাচাঁদের ক্লান্ত শরীর ঘুমে জড়িয়ে আসে, নাক ডাকতে শুরু করে। আর আস্তে আস্তে বিছানা ছেড়ে বেরিয়ে যায় যমুনা—আকাশে সকালের আলো ফুটেছে।

তবু চেষ্টা করেছে যমুনা। দিনের আলোয় কালাচাঁদের মনটা ভালো থাকলে, তার মুখোনাকে বারো বছরের ছেলের মতো শান্ত আর কোমল দেখালে—সেই সময়।

আচ্ছা, তোমার পরকালের ভয় নেই?

দুত্তোর পরকাল! ওসব বুঝি না!

খুন কর কেন?

সহজে করি না তো? চিনে না-ফেললে কিংবা বাধা না-দিলে হাত ছোঁয়াই না কারুর গায়ে।

মানুষ মারতে কষ্ট হয় না?

কই মাছ কুটতে কষ্ট হয় তোর? হাঁস কাটতে?

এক হল?

কালাচাঁদ হাসে, তফাত কিছু নেই। লাল রক্ত বেরোয়, ছটফট করে, তারপর সব ঠাণ্ডা।

যমুনা চুপ করে থাকে কিছুক্ষণ। আবার বলে, পরকালের ভয় না-ই করলে, পুলিশকে ভয় হয় না? ধরতে পারলে যে নিয়ে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দেবে।

এই ভয়টা কালাচাঁদেরও নেই তা নয়। পুলিশের নজর তার ওপর আছেই। যমুনাকে বিয়ে করে আনবার আগে দু-তিন বার দারোগা এসে এটা-ওটা জিজ্ঞেস করে গেছে তাকে। কিন্তু এত সাবধান তার দলটা, এমন হিসেব করে কাজ করে যে আজ পর্যন্ত কাঁটার আঁচড়টি লাগেনি তার গায়ে। তবু মধ্যে মধ্যে বুক ধুকপুক করে। জলপুলিশের লঞ্চ ইদানীং একটু বেশি যাওয়া-আসা করছে এই তল্লাট দিয়ে। ভয় করে বই কী কালাচাঁদের।

আর ভয় করে বলেই সেটাকে আরও বেশি করে উড়িয়ে দিতে চায়। হা-হা করে হাসে এবারে।

ওঃ, পুলিশ। পুলিশ ঢের দেখেছি।

বেশ, পুলিশও নয় কিছু করতে পারবে না। কিন্তু টাকা তো কম জমল না। কেন আর এসব করে বেড়াও তুমি? যা আছে তাই দিয়ে জমিজমা কেনো, বলদ আনো, চাষবাস করো।

বলিস কী! সড়কি ফেলে লাঙল নেব! জোয়ানের কাজ ছেড়ে চাষা হয়ে যাব।

কোনো লজ্জা নেই। চাষেই তো লক্ষ্মী। দোহাই তোমার—অনেক তো করলে, এবার ছেড়ে দাও এসব।

দাঁড়া দাঁড়া। আর দু-চারটে ভালো খেপ মেরে নিই, তারপর…

না না, এখুনি। আজ থেকেই ছেড়ে দাও। যমুনা পা জড়িয়ে ধরে, ছেড়ে দাও এসব।

আবার রাখালের বোনটাকে মনে পড়ে, বুকের ভেতরটা যেন জ্বালা করতে থাকে কালাচাঁদের। উঠে দাঁড়িয়ে বলে, দেখব, দেখব ভেবে।

ভাবে কালাচাঁদ। পুলিশের ভয়, ফাঁসির দড়ি। ছেড়েছুড়ে দিলেও মন্দ হয় না। কিন্তু তার বদলে চাষা? লাঙল চেপে ধরে দুপুরের রোদে হাল দেওয়া, জল-কাদার ভেতর ধান রোয়া, সকাল থেকে নুয়ে নুয়ে পিঠ কুঁজো করে ফসল কাটা। পারবে কালাচাঁদ? তার মেজাজে কুলোবে?

তা ছাড়া রাত? ডাকিনীর মতো কালো হয়ে আসে। পদ্মা তার ঝোড়ো চুল মেলে দিয়ে ডাক দেয়। অথই গহীন জলের ওপর খাঁড়া নাচতে থাকে। সঙ্গীরা আসে, ফিসফিস করে খবর দিয়ে যায় পাট বিক্রি করে ফিরছে নামকরা মহাজন, নৌকাটা ধরতে পারলে…

বুকে ঢেউ দোলে, খাঁড়া নাচিয়ে পদ্মা ডাক দেয়। মাথার ভেতর মদের নেশা আগুনের চাকা হয়ে ঘুরতে থাকে। কালাচাঁদ আর থাকতে পারে না। খিদেয় ছটফটিয়ে ওঠা বাঘ হরিণের গন্ধ পায়।

তারপর নদী।

ছিপের দাঁড় তালে তালে পড়তে থাকে, জল কেটে সোঁ সোঁ করে এগিয়ে চলে। বারো চোদ্দো জোড়া চোখ অন্ধকারে জোনাকির মতো জ্বলে, একটা মিটমিটে আলো দুলতে থাকে–পাটবেচা মহাজনের নৌকাটা আসছে। মাঝপদ্মা, নিথর রাত—পদ্মার জলে খড় ঝলকায়। তখন কোথায় যমুনা, কোথায় কে?

দাওয়ার খুঁটি ধরে বসে আছে যমুনা। জল গড়াচ্ছে চোখ দিয়ে।

সকালে দৃশ্যটা দেখেই বিরক্ত হয় কালাচাঁদ।

এই সাতসকালেই কাঁদতে বসলি কেন?

যমুনা চুপ করে রইল।

তবে তুই কাঁদ বসে বসে, আমি চললুম কালাচাঁদ পা বাড়াবার উদ্যোগ করল।

একটু দাঁড়াও। যমুনা চোখের জল মুছল, কথা শুনবে একটা?

আবার ওইসব বলবি তো? কালাচাঁদের মুখে মেঘ ঘনিয়ে এল, তুই যা শুরু করেছিস, এরপর বাড়ি ছেড়ে পালাতে হবে আমাকে। নইলে গিয়ে ধরা দিতে হবে পুলিশের হাতে।

যমুনা চোখ দুটো মেলে ধরল কালাচাঁদের দিকে। কাঁপা গলায় বললে, আমার কথা নাহয়–ই ভাবলে। আমার পেটে যে আসছে তার কথা এক বার ভাবো। তোমার যদি একটা-কিছু হয় তাহলে…

যমুনাকে শেষ করতে দিলে না কালাচাঁদ। সঙ্গে সঙ্গে বসে পড়ল বউয়ের পাশে, দু-হাতে জড়িয়ে ধরল কোমরটা।

তোর ছেলে হবে বউ? সত্যি, ছেলে হবে তোর?

আনন্দে আদরে যমুনাকে ভরে দিলে এক মুহূর্তে। বদলে গেছে কালাচাঁদ—আবার সেই মানুষটা, বিয়ের আগে যার মস্ত জোয়ান শরীরটার ওপর ছেলেমানুষের মতো একখানা মুখ দেখে ভারি ভালো লেগেছিল যমুনার।

অনেকক্ষণ পরে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বললে, ডাকাতের ছেলে ডাকাত হবে—এই কি তুমি চাও?

কালাচাঁদ চুপ করে রইল একটু। তারপর ধীরে ধীরে বললে, না, এবার থেকে ভালো হয়ে যাব, সব ছেড়ে দেব–দেখে নিস তুই।

৩.

ছেলেই হল। গোলগাল, হৃষ্টপুষ্ট। কোলে তুলতে কাঁকাল বেঁকে আসে যমুনার। বড়ো হলে বাপের মতো হয়ে উঠবে, এখুনি ফুঠে বেরুচ্ছে তার লক্ষণ।

কিন্তু কেবল জোয়ানই হবে বাপের মতো? ভাবতে গিয়ে চোখে অন্ধকার নামে।

কথা রাখতে চেষ্টা করেছিল কালাচাঁদ। প্রায় এক বছর সে যেন নতুন হয়ে গিয়েছিল। ঘরে পোঁতা টাকাকড়ি যা আছে আছেই, তবুও আবার মন দিয়ে ঘরামির কাজ শুরু করেছিল এখানে-ওখানে। জনমজুরির খোঁজে আসা-যাওয়া করেছিল দূর দূর গ্রামে। যমুনাকে নিয়ে গিয়েছিল বাপের বাড়ি, বুড়োকে দেখিয়ে এসেছিল নাতির মুখ।

বুড়ো কেঁদে অস্থির হয়ে গিয়েছিল।

তবু ভাগ্যিস এতদিনে মনে পড়ল বাপটাকে।

কী করব বাবা, অনেক দূরের পথ যে।

না-এলি, না-এলি। তোরা সুখে থাকলেই আমার সুখ। হ্যাঁ রে, তোকে তো কালাচাঁদ কোনো কষ্ট দেয় না? ভাত-কাপড়ের দুঃখু পাসনে তো?

এক বারের জন্যে মুখ শুকিয়ে গিয়েছিল যমুনার। না, ভাত-কাপড়ের কষ্ট নেই। কষ্ট যে তার কোথায়, সেকথা মুখফুটে কোনোদিন বলতে পারবে না যমুনা, শুধু ভেতরে ভেতরে পুড়ে খাক হয়ে যাবে তুষের আগুনে।

না বাবা, কোনো কষ্ট নেই।

বলে যমুনা ভেবেছিল— সত্যিই তো। এই সাত-আট মাসের ভেতরে কালাচাঁদ এক বারও রাত্রে বেরোয়নি পদ্মার বুকে হানা দিতে, রক্তমাখা পাপের ধন নিয়ে আসতে। ছেলের ভবিষ্যৎ ভেবে বদলে গেছে সে। জমি কেনবার কথা ভাবছে, বলদও মনের মতো খুঁজছে হাটে হাটে। না, যমুনার কোনো দুঃখ নেই।

ফিরে আসবার সময় তেমনি করেই বুড়ো বাপ এসে দাঁড়িয়েছিল ঘাটে। আর পদ্মার স্রোতে তেমনি তিরের মতো ভেসে গিয়েছিল নৌকা। এবার আর কালাচাঁদ কথা বলেনি, গান গায়নি, নিঃশব্দে বইঠা টানতে টানতে তাকিয়ে ছিল জলের দিকে।

কী ভাবছ? যমুনা জিজ্ঞেস করেছিল।

উঁ?

কী ভাবছ চুপ করে?

ক্লান্তভাবে হেসেছিল কালাচাঁদ। বলেছিল, ভাবছি তোর কথাই সত্যি হল তাহলে। এরপর থেকে একেবারে চাষাই হয়ে যাব। রাতের পদ্মা যখন কালো আঁধারে ডাক পাঠাবে, তখন সে-ডাক আমি আর শুনতে পাব না, একপেট পানতা ভাত খেয়ে ভোঁস ভোঁস করে ঘুমোব কেবল।

আবার ওই কথা? ফের যদি ওসব বলবে, তাহলে ছেলে বুকে করে আমি সোজা গাঙের মধ্যে ঝাঁপ দিয়ে পড়ব এই বলে দিচ্ছি তোমাকে।

কালাচাঁদ আর কথা বলেনি। চুপ করে বইঠা টেনেছে বসে বসে।

হ্যাঁ, চেষ্টা সে করেছিল। মদ ছেড়ে তাড়ি ধরেছিল, তাও হপ্তায় এক-আধ দিনের বেশি নয়। সন্ধ্যার অন্ধকারে যারা ছায়ামূর্তির মতো আসা-যাওয়া শুরু করেছিল, টিটকিরি দিত তারা।

কী হল তোর? বউয়ের আঁচল ছেড়ে যে নড়তে চাসনে?

আর ভালো লাগে না এসব। আমাকে আর ডাকিনি। পাপ কাজের ভেতরে আমি আর নেই। ছেলের আখেরটা তো দেখতে হবে।

আরে ছেলের আখেরের কথাই তো হচ্ছে। একটু বড় হলেই সঙ্গে নিবি। নিজের হাতে শিখিয়ে পড়িয়ে নিবি এখন থেকে। তবে-না বাপের নাম রাখতে পারবে।

না। ওসব করব না আমি।

পাগলামো করিসনি কালাচাঁদ। একজন ধমকে দেয়, ওই বউ-ই তোর মাথা খেয়েছে। দে ওটাকে তাড়িয়ে। তুই সঙ্গে না বেরুলে আমরা জোর পাই না—কানা হয়ে যাই। বউটাকে দে বাপের বাড়ি পাঠিয়ে।

কালাচাঁদ চুপ করে থাকে। তার মুখের চেহারা দেখে বোঝা যায়, কথাটা তার পছন্দ হয়নি।

একজন টিপ্পনী কেটে বলে, তাহলে একদিন রাতে মুখে কাপড় বেঁধে দিই বউটাকে লোপাট করে। তারপর…

হঠাৎ কালাচাঁদ বেসুরো গলায় গর্জন করে ওঠে। দপ দপ করে জ্বলে ওঠে চোখ, মুখের চেহারা হয়ে ওঠে হিংস্র জানোয়ারের মতো। কালাচাঁদ বলে, খবরদার-খুন করে ফেলে দেব এসব বললে। মুখ সামাল!

আহা-হা! ঠাট্টাও বুঝতে পারিসনে?

না, ওসব ঠাট্টা আমার ভালো লাগে না।

দলের লোকেরা নিরাশ হয়ে চলে যায়। কিন্তু কালাচাঁদ খুশি হতে পারে না। মনের ভেতর সমানে জ্বলে যেতে থাকে। ওদের কথাগুলো বাজতে থাকে কানে।

যমুনা এসে বলে, অনেক রাত হল যে। খাবে না?

না।

কী হল?

কালাচাঁদ ধমক দিয়ে বলে, বিরক্ত করিসনি আমাকে। তোর ইচ্ছে হয়, একপেট গিলে পড়ে থাক গে।

নিজের ওপর রাগ হয় কালাচাঁদের, অকারণ বিদ্বেষে মনটা ভরে ওঠে। ঘরামি-জনমজুর চাষি! রাত্রের পদ্ম আর তাকে কোনোদিন ডাক পাঠাবে না। সে তার জীবন থেকে সরে গেছে চিরকালের মতো। এখন ভালোমানুষ হবে কালাচাঁদ, পরের ঘর ছেয়ে দেবে, বেড়া বাঁধবে, ফসল কাটবে।

অসহ্য মনে হয়।

সব ওই যমুনার জন্যে। যদি রাখালের বোনটা অমন করে না মরে যেত, যদি সে বিয়ে করে না আসত, যদি ছেলেটা না হত কীসের ভয় ছিল কালাচাঁদের, কাকেই-বা পরোয়া করত সে? যেমন চলছিল, তেমনিই চলত। পুলিশের হাতে ধরা পড়ে ফাঁসিতে ঝুলতে হলেই-বা কী আসত-যেত তার! জোয়ান চিরকাল জোয়ানের মতোই মরে।

কিন্তু…

মাথাটা দু-হাতে টিপে ধরে বসে থাকে কালাচাঁদ। কিছু ভালো লাগে না। বিশ্রী অশ্লীল ভাষায় পৃথিবীসুদ্ধ লোককে তার গালাগাল দিতে ইচ্ছে করে।

যমুনা আবার এসে জিজ্ঞেস করে, খেয়ে নিলে হত না?

দূর হয়ে যা সামনে থেকে। উঠে ছিটকে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায় কালাচাঁদ।

আরও এক মাস যায়, দু-মাস যায়, জমি কিনব কিনব করেও কেনা হয় না। হাটে হাটে ঘুরেও বলদ পছন্দ হয় না কিছুতেই। আর রাত জেগে জেগে শোনে দূরে পদ্মার ঢেউ ভাঙার শব্দ। ভাবে অন্ধকারে নিশ্চিন্ত টাকার থলে নিয়ে পদ্মায় পাড়ি দিচ্ছে পাটবেচা মহাজন, ভারী ভারী গয়নাপরা মেয়েদের নিয়ে নৌকা চলেছে দূরের শহরে। কালাচাঁদের মাথার ভেতর তুফান ছুটতে থাকে।

ছেলেটাকে বুকে নিয়ে যমুনা ঘুমিয়ে পড়লে এক-একদিন এসে দাঁড়ায় পদ্মার ধারে। কালো উজ্জ্বল জল যেন হাতছানি দিয়ে তাকে ডাক পাঠায়। মানুষ শিকার করার স্মৃতিগুলো সব ভেসে ওঠে চোখের সামনে। থাকতে পারে না কালাচাঁদ, একটা ডিঙি খুলে নিয়ে ভাসিয়ে দেয় অন্ধকার নদীতে, ঘণ্টা খানেক পাগলের মতো বইঠা টেনে মনের অসহ্য অস্থিরতাটাকে খানিক শান্ত করতে চেষ্টা করে।

কিন্তু আর পারল না শেষপর্যন্ত।

সেই ছায়ামূর্তিরা এল, অনেকক্ষণ ধরে আলাপ করল ফিসফিসে গলায়। তারপর… কালাচাঁদ বললে, বউ যাচ্ছি!

কালাচাঁদের মুখের দিকে তাকিয়েই বুঝতে পেরেছিল যমুনা। ভয়ে পিছিয়ে গেল দু-পা। কোথায় যাবে?

শিকারে।

আবার? তুমি যে আমায় কথা দিয়েছ।

কথা দিয়েছি! কদর্যভাবে মুখ ভ্যাংচাল কালাচাঁদ, তুই আমায় ভেড়য়া বানিয়েছিস, সকলের কাছে ইজ্জত নষ্ট করেছিস। আমি আর এভাবে থাকতে পারব না, পাগল হয়ে যাব।

যাবার জন্যে পা বাড়াল কালাচাঁদ। যমুনা দু-হাতে পা জড়িয়ে ধরল তার।

আমার কথা না-শোনো না-ই শুনলে। কিন্তু ছেলেটা…

কালাচাঁদের সমস্ত চেহারাটাকে বুনো মোষের মতো দেখাল। হিংস্র গলায় বললে, পা ছাড়, ছেড়ে দে বলছি।

দোহাই তোমার, ছেলেটার কথাও একটি বার…

ছেলে নিয়ে পদ্মায় ডুবে মর তুই। তোরও শান্তি, আমিও বেঁচে যাই। পা ছাড় হারামজাদি।

ধৈর্যের শেষ সীমায় এসে লাথি মারল কালাচাঁদ। যমুনা ছিটকে পড়ল তিন হাত দূরে। এক বারের জন্য অনুতাপ এল মনে। এক বার ভাবল…

কিন্তু ভাবলেই জট পাকায়। এতদিন ধরে যত ভেবেছে ততই যমুনার জালে সে জড়িয়ে গেছে, টের পেয়েছে ধীরে ধীরে তার শক্তি শুকিয়ে আসছে, সাহস থমকে দাঁড়াচ্ছে। কালাচাঁদ আর অপেক্ষা করল না, পদ্মা তখন তার নাড়ি ধরে টান দিয়েছে।

নৌকাতে ছিল চক্রবর্তী। মেয়ের বিয়ের জন্যে গয়না কিনে নিয়ে ফিরছিল।

কাঁপতে কাঁপতে বেরিয়ে এল, ছাইয়ের মতো তার মুখ।

দোহাই বাবা, গরিব ব্রাহ্মণকে ছেড়ে দাও, ব্রহ্মস্ব হরণ কোরো না।

জবাব দিলে রাখাল। চক্রবর্তীর গলার ওপর রামদা বাগিয়ে ধরে বললে, চুপ কর বুড়ো শয়তান কোথাকার। যা আছে বের করে দে এখুনি। নইলে এক কোপে মাথা উড়িয়ে দেব।

তেমনি থরথর কাঁপতে কাঁপতে হাঁটু ভেঙে বসে বড়ল চক্রবর্তী। ভাঙা ঘ্যাসঘেসে গলায় বললে, বাবাসকল, দয়া করে… চুপ। কী আছে দে এখুনি!

চক্রবর্তী বেঁচে যেত, অনর্থক একটা বুড়ো মানুষকে খুন করে হাত নোংরা করবার ইচ্ছে ছিল না। কিন্তু নৌকার লণ্ঠনের মিটমিটে আলোয় কালাচাঁদের মুখের দিকে তার চোখ পড়ল। দুগ্রহ।

চক্রবর্তী যেন সমুদ্রে ভাসতে ভাসতে কুটো কুড়িয়ে পেল।

তুমি বাবা কালাচাঁদ না? রায়নগরে চাটুজ্জেদের রান্নাঘর ছেয়ে দিয়েছিলে না গত বছর? বলতে বলতে আশায় জ্বলে উঠল চক্রবর্তীর মুখ। আমি সে-বাড়িতে ছিলুম, তারা আমার কুটুম। বসে বসে তামাক খেতুম আর তোমার সঙ্গে কত গল্প…

কথাটা আর শেষ হল না। রাখালের হাতের রামদা নেচে উঠল বিদ্যুতের মতো। চক্রবর্তীর মনে হল ঘাড়ের ওপর খুব জোরে কে একটা ধাক্কা দিয়েছে। তারপরেই মাথাটা ছিটকে পড়ল পাটাতনের ওপর। চোখ দুটো তখনও জ্বলজ্বল করছে, ঠোঁট দুটো বাকি কথাটা শেষ করতে চাইছে তখনও। কবন্ধটা কয়েক সেকেণ্ড স্থির হয়ে বসে রইল। আট-দশটা শিরা থেকে ফোয়ারার মতো ছিটকে উঠল রক্ত, তারপর উবুড় হয়ে পড়ে গেল শরীরটা।

শা-লা! চিনে ফেলেছিস। রাখালের চোখ দুটো অদ্ভুত দেখাচ্ছে, মনে হল এখন সে রক্ত খেতে পারে।

একটা মাঝি নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, তাকে ধরা গেল না। আর-একটা বল্লমের মুখে এফোঁড়-ওফোঁড় হয়ে গেল।

এ খুন এই প্রথম নয়, এমন আরও অনেক বারই ঘটেছে কালাচাঁদের। নিজের হাতেই যে কতগুলোকে শেষ করেছে সেকথা আঙুল গুনেও বলতে পারে না। তবু হঠাৎ রক্ত দেখে মাথাটার ভেতর কেমন পাক খেয়ে গেল তার। চোখ বুজে বসে পড়ল পাটাতনের ওপর।

ঝিম ভাঙল কার যেন ঝাঁকুনিতে।

কী হল তোর? এই কালাচাঁদ, এই…

কিছুই হয়নি, চোখ খুলে উঠে পড়ল কালাচাঁদ। চক্রবর্তীর রক্তে সারা গা তার মাখামাখি।

শেষরাতে যখন স্নান করে বাড়ি ফিরল, রক্তের গন্ধটা তখনও যেন জড়িয়ে আছে শরীরে, কেমন গুলিয়ে উঠছে শরীর।

চক্রবর্তীকে খুন না করে উপায় ছিল না, চিনে নিয়েছিল। তবু–তবু–

শালা!

নিজের উদ্দেশেই গালাগাল করলে কালাচাঁদ। এই অধঃপাত হয়েছে যমুনার জন্যেই।সে-ই তাকে এমনভাবে সব কাজের বার করে দিয়েছে। মানুষের রক্ত দেখে আজ তার মাথা ঘুরে গেল—ছি ছি! এরপরে আর তার মুখ-দেখানোর জো রইল না। বাড়ির দরজায় পা দিয়ে কালাচাঁদ ভাবল, আজ বউটা একটা কথাও বলতে এলে একচোট বোঝাপড়া হয়ে যাবে তার সঙ্গে।

কিন্তু কিছুই করবার দরকার হয় না কালাচাঁদের।

ভাঙা চাঁদের আলো পড়েছে বারান্দায়। সেইখানেই মুখথুবড়ে শুয়ে আছে যমুনা।

এই ওঠ, ওঠ। ওঠ-না হারামজাদি! দরজা খোলা রেখে এইভাবে পড়ে পড়ে ঘুমোচ্ছিস!

যমুনার সাড়া এল না। কালাচাঁদের পায়ের গুতোয় সমস্ত শরীরটা একবার নড়ে উঠল কেবল। আর তখনি একটা তীব্র দুর্গন্ধ এসে লাগল নাকে-মুখে, চাঁদের বিবর্ণ আলোয় দেখল খানিকটা তরল জিনিস লেপটে আছে যমুনার সর্বাঙ্গে, সারা বারান্দায়।

ঘরের বারান্দায় মিটমিট করছে লণ্ঠন। পলতেটা বাড়িয়ে দিল কালাচাঁদ, তারপর সেটা নিয়ে যমুনার মুখের ওপর এক বার ঝুঁকে পড়েই দু-হাত পিছিয়ে গেল সঙ্গে সঙ্গে।

দুটো সাদা পর্দা নেমে এসেছে যমুনার খোলা চোখে—যেন মরা পাখির চোখ। ঠোঁটের দু পাশে গলায় বুকে বমি চিকচিক করছে এখনও।

কলেরা।

কখন বার কয়েক ভেদবমি করে এই বারান্দার ওপরেই মুখথুবড়ে মরেছে যমুনা। কালাচাঁদকে ছুটি দিয়ে গেছে চিরকালের মতো। আর কাঁদবে না, বাধা দেবে না, বারণ করবে না কোনোদিন।

চক্রবর্তীর রক্ত দেখে যেমন হয়েছিল, তেমনি আর এক বার মাথাটা ঘুরে গেল কালাচাঁদের। একদিনে দু-বার। অন্ধের মতো বসে পড়ল সেই দুর্গন্ধ ময়লাগুলোর ওপর। ঘরের ভেতর ককিয়ে ককিয়ে কেঁদে উঠল ছেলেটা, শুকনো কাতর গলায়। ওর খিদে পেয়েছে, মায়ের দুধ চায় এখন।

৪.

ক্রমশই দূর আকাশের একেবারে শেষ সীমায় বন্দরের আলোগুলো অস্পষ্ট হয়ে মিলিয়ে এল। মিঠাইয়ের দোকানে যে বড়ো পেট্রোম্যাক্স ল্যাম্পটা জ্বলছিল, সেটা পর্যন্ত একটা তারা হয়ে গেল কেবল। তারপরেই নীরেট অন্ধকার আর অতল গহীন পদ্মা ছাড়া ডাইনে-বাঁয়ে সামনে পেছনে দেখবার মতো কিছুই রইল না।

উজানের মুখে শিরশিরিয়ে খানিক বাতাস দিচ্ছিল, তবু স্রোতের একরোখা টানে নৌকা এগিয়ে চলল সামনের দিকেই। পদ্মার ওপর কোনাকুনি পাড়ি জমালে লক্ষ্মীপুরের বাজার, সেখান থেকে কুমারহাটির খাল বেয়ে আরও ঘণ্টা খানেকের পথ। ভোরের আলো ফুটতে-না-ফুটতেই বাড়ি পৌঁছে যাব—মথুরানাথ ঘোষাল ভাবল।

বিশাল পদ্মা, মাথার ওপর তারা-জ্বলা বিরাট আকাশ। মাঝখানে অন্ধকারের কালো পর্দা এই দুটোকে যেন একসঙ্গে জুড়ে দিয়েছে। ওপরের তারারা স্থির, নীচে পদ্মার জলে লক্ষ লক্ষ তারা নেচে উঠছে একসঙ্গে, ঠিকরে পড়ছে, ছিটকে যাচ্ছে। স্রোতের মুখে ভেসে-যাওয়া পচা কচুরিপানার গন্ধ ভেসে বেড়াচ্ছে। এক-একটা কচুরির ঝাঁক পাশ দিয়ে ভেসে যাচ্ছে পচা মড়ার মতো। দাঁড় টানা আর ফেলার আওয়াজ উঠছে তালে তালে। তরতর করে এগিয়ে চলেছে নৌকা। অন্ধকারে যাদের চোখ ভামবেড়ালের মতো তীক্ষ্ণ আর উজ্জ্বল হয়ে যায়, সেই মাঝিরাও কপালে হাত রেখে একাগ্রভাবে তাকিয়ে। এপার-ওপারের একটা গাছপালার আভাস পাচ্ছে না। এ বছর বান ডেকেছে অস্বাভাবিক, খ্যাপা পদ্মা মাত্রা ছাড়িয়ে নিজেকে এলিয়ে দিয়েছে।

অনেকটা আন্দাজ, অনেকখানি অভ্যাস আর রক্তের সংস্কারের ওপর ভরসা রেখে মাঝিরা পাড়ি জমিয়েছে। এক বার ওপারের ডাঙা ধরতে পারলে লক্ষ্মীপুরের বাজার খুঁজে নিতে আর কষ্ট হবে না। তবু মনের ভেতর অনিশ্চিত অবস্থা একটা আছেই। আর সেইটে কাটাবার জন্যে একজন গান ধরেছে :

কোন দেশেতে গেলা বন্ধু
পাথার দিয়া পাড়ি,
আমার সাথে দিয়া গেলা
জীবন-ভরা আড়ি রে–

যে দুজন দাঁড় টানছিল, তাদের একজন মাঝপথে থামিয়ে দিলে গানটাকে।

একটু সামাল ভাই, খেয়াল থাকে যেন। বড় পাকটা অনেক নৌকা গিলেছে এবার।

হালের মাঝিই গান ধরেছিল। সে বললে, ভয় নেই—ভয় নেই, টেনে যা। সে আরও ঢের দক্ষিণে, অনেক নীচুতে।

ভয় নেই, ভরসাও নেই।

আমার হাল ঠিক আছে। হালের মাঝি অভয় দিলে, নিজেদের কাজ করে যা তোরা।

মথুরানাথ ঘোষাল ছইয়ের বাইরে বসে হুঁকো টানছিল। এই রাতে এমন দুরন্ত পদ্মায় পাড়ি দেওয়ার ইচ্ছে তার বিশেষ ছিল তা নয়। কিন্তু বন্দরে দু-তিন দিন আটকে পড়তে হল। ওদিকে কাল থেকে ভাগীদারেরা গোলায় ধান তুলতে থাকবে। সামনাসামনি দাঁড়িয়ে নজর না রাখলে ঠিক বোকা বুঝিয়ে যাবে বউ-ছেলেকে। তাই আজ রাতে না ফিরলেই তার নয়।

কিন্তু মাঝখানে ভাবনায় বাধা পড়ল মথুরার।

অন্ধকারে তাকাতে তাকাতে তার চোখের দৃষ্টি এতক্ষণে অনেকটা স্পষ্ট আর স্বচ্ছ হয়ে গিয়েছিল। তা ছাড়া তারাজ্বলা আকাশের ছায়া পদ্মার ঘোলা জলের ওপর পড়ে একটা চঞ্চল আলোর দীপ্তি যেন নেচে উঠছিল, ছুটন্ত স্রোতের ওপর কাঁপছিল। সেই আলোয় একটা কীসের ওপর যেন মথুরার চোখ পড়ল।

একখানা নৌকা আসছে না এদিকপানে?

পেছন ফিরে যারা দাঁড় টানছিল, তারা দেখতে পায়নি। কিন্তু হালের মাঝির ভামবেড়ালের মতো জ্বলন্ত সজাগ চোখ ঠিকই লক্ষ করেছিল। মনের ভেতর ছায়া ঘনাচ্ছিল তার।

ঠিকই বলেছেন কর্তা। বড়ো একটা জেলেডিঙির মতো এগিয়ে আসছে তরতরিয়ে। কিন্তু

আলো নেই কেন? এই রাত্তিরে যেভাবে পাড়ি মেরে এগিয়ে আসছে…

মাঝপথেই সে থেমে গেল। আর সঙ্গে সঙ্গেই আতঙ্কে গলা বুক শুকিয়ে উঠল মথুরার।

হ্যাঁ রে, এ তল্লাটে তো কোনো ভয়ডর ছিল না।

একেবারে যে নেই তাই-বা কী করে বলি কর্তা? দিন বারো আগেই মাইল সাতেক উজানে একটা বড়োরকম ডাকাতি হয়ে গেছে!

জলপুলিশ কী করে?

ঘুরে তো বেড়ায়। কিন্তু এত বড়ো গাং। তারপর কে কোনদিক দিয়ে কোন খাল বেয়ে সুট করে সরে পড়ে, তার কি ঠিকঠিকানা আছে! শয়তানের সঙ্গে কে পেরে উঠবে বাবু?

বলিস কী! মথুরার জিভটা কে যেন ভেতর থেকে টানতে লাগল। রাত্রির এই ঠাণ্ডা ভিজে হাওয়াতে সারা গা দিয়ে যেন আগুনের হলকা বেরিয়ে এল। ভাঙা গলায় বললে, হাঁকডাক করব?

দাঁড়ের মাঝিরা দাঁড় বন্ধ করে ঝুঁকে বসল সামনের দিকে। নীরস গলায় একজন বললে, এত রাত্তিরে মাঝগাঙে চেঁচিয়ে গলা ফাটালেও কেউ সাড়া দেবে না কর্তা। এ বড়ো বিষম ঠাঁই। ধারেকাছে দু-একখানা এক-মাল্লাই থাকলেও এখন তারা কিছুতেই কাছে ভিড়বে না।

হালের লোকটি নড়েচড়ে বসল। পদ্মায় মাঝি, রক্ত গরম হয়ে উঠেছে। সে বললে, লগি বাগিয়ে ধর মকবুল। যদি ডাকাতই হয় একটা মোকাবেলা করে ছাড়ব।

মকবুল সংক্ষেপে শান্ত গলায় বললে, খেপেছ ইয়াকুবচাচা!

সত্যি কথা। কী স্বার্থ আছে তাদের? সামান্য দু-একটি ময়লা জামাকাপড়, এক-আধটা তেলচিটে বালিশ, হুকো আর আগুনের মালসা, রান্নার মাটির হাঁড়ি আর কলাইকরা বাসন, সঙ্গে দু-চার ছ-গন্ডা পয়সা বা এক-আধটা টাকা। এর লোভে কেউ আর ডাকাতি করতে আসবে না, মজুরিই পোষাবে না তার। অনর্থক পরের জন্যে মারামারি করতে গিয়ে তারা নিজেদের মরণকে ডেকে আনবে কেন?

এর মধ্যেই অন্ধকারে নৌকাটা অনেকখানি এগিয়ে এসেছে। বারো-চৌদ্দোটি কালো কালো মাথা। বারো-চৌদ্দোটি হাতের দাঁড়ে জলের ওপর দিয়ে ছুটে আসছে বাইচের নৌকার মতো। ছিপ-নৌকা। এত রাত্রে এই সময় কোন বাইচ খেলায় তারা বেরিয়ে পড়েছে সেটা বুঝতে কারও আর এক মিনিটও সময় লাগল না। মথুরা ঘোষাল গেঞ্জির তলায় কাঁপা আঙুল ঢুকিয়ে পৈতে খুঁজতে লাগল, কিন্তু সময় বুঝে পৈতের সন্ধান পাওয়া গেল না।

ছিপ-নৌকা প্রায় ঘাড়ের ওপর এসে পড়েছে। ইয়াকুব অনর্থক জেনেও হাঁক ছাড়ল, এই নাও সামলে, আপন ডাইন…

আপন ডাইনে নৌকা সামলাবার কোনো গরজ দেখা গেল না তাদের। তার বদলে বেশ মোলায়েম গলায় কে যেন জানতে চাইল, নৌকা কোথায় যাবে হে?

কুমারহাটি।

কুমারহাটি? বেশ বেশ। তা একটু তামাক খাওয়াও-না মিয়াভাই, গলা শুকিয়ে গেছে।

দু-চোখ বুজে বসে রইল মথুরা ঘোষাল, কানের মধ্যে তার ঝিঝি ডাকছে। সব নিয়মমাফিক চলছে, এমনিভাবেই ওরা এসে আলাপ জমায়।

মকবুল গলা চড়িয়ে বললে, না, তামাক আমাদের নেই।

ও-নৌকা থেকে হাসির আওয়াজ এল। মিষ্টি খিলখিল হাসি।

আছে শেখের পো, আছে! কেন আর মিছে কথা বাড়াচ্ছ বলো দেখি! ভালো মানুষের মতো হুঁকোটা বাড়িয়ে দাও, এক ছিলিম টেনে নিয়ে চলে যাই।

মকবুল বোধ হয় একটা অসম্ভব আশায় হুঁকোই খুঁজতে যাচ্ছিল, কিন্তু তার আগেই খটখটাং করে ছিপ এসে নৌকার গায়ে ভিড়ে গেল। টলমল করে দুলে উঠল নৌকা।

ইয়াকুব চেঁচিয়ে উঠল, গায়ে এসে পড়লে যে, তফাত যাও তফাত যাও!

থামো হে সুমুন্দি, আস্তে। ভালো কথায় কান দেওয়ার পাত্তর তো নও, তাই বাঁকা আঙুলেই ঘি ওঠাতে হবে। আচ্ছা, তামাক তোমাদের আর দিতে হবে না, আমরাই খুঁজে নিচ্ছি।

কথাটা বলেই তারা আর সময় দিলে না। চোখের পলকে তিন-চার জন লোক প্রায় একসঙ্গেই এই নৌকার ঝাঁপ দিয়ে পড়ল। একদিকে কাত হয়ে নৌকাটা সোজা হয়ে উঠতে না-উঠতেই দেখা গেল একখানা বিরাট রামদার উজ্জ্বল চেহারা তিন-চারখানা সড়কির ক্ষুধার্ত ফলক। অন্ধকার পদ্মার অতল থেকে একদল প্রেত এসে যেন তাদের সামনে দাঁড়াল।

রামদা যার হাতে ছিল, কালভৈরবের মতো তার চেহারা। মাথার বিরাট বাবরি নাচিয়ে রামদাখানাকে বার কয়েক শূন্যে ভেঁজে নিয়ে সে মথুরাকে বললে, তাড়াতাড়ি বের করে দাও সব। একটু শোরগোল তুলেছ কী ধড় থেকে মাথা তফাত করে দেব!

মথুরা অস্পষ্টভাবে কী-একটা হাউমাউ করে বলবার চেষ্টা করছিল। কিন্তু সেই মুহূর্তেই বুঝতে পারলে, ঠিক তার হৃৎপিন্ডের ওপরটিতে বুকের চামড়ায় পিনের মতো খোঁচার একটুখানি মৃদুযন্ত্রণা। সড়কির একটা ধারালো ফলা অত্যন্ত পরিষ্কার অর্থ নিয়ে জায়গাটি স্পর্শ করে আছে।

চুপ। নইলে এখুনি এফোঁড়-ওফোঁড় করে ফেলব।

মথুরা যেমন ছিল তেমনি বসে রইল। একটা নিশ্বাস পর্যন্ত শব্দ করে ফেলবার মতো সাহস তার নেই।

লুট শুরু হয়ে গেল। বাক্স-বিছানা থেকে শুরু করে জার্মান সিলভারের পান খাওয়ার ছোটো কৌটোটি পর্যন্ত বাদ পড়ল না। স্পর্শ করল না কেবল মাঝিদের ছেঁড়াখোঁড়া বিছানা, গোটা দুই লোহার কড়াই আর তিন-চারখানা কলাই-করা এনামেলের থালা।

সমস্ত চেষ্টা-ভাবনা ছেড়ে দিয়ে মাঝিরা গলুইয়ের উপর নিশ্ৰুপ হয়ে বসে ছিল। যেন নিতান্তই দর্শকের দল, যেন কিছুই তাদের করবার নেই। হঠাৎ যেন মকবুলের জ্ঞান ফিরে এল। চমকে জিজ্ঞেস করল, এমন করে নৌকা ছুটেছে কেন ইয়াকুব চাচা? জলের এমন টান কেন?

টান!

সঙ্গে সঙ্গে খেয়াল হল সকলের। সত্যিই তো! দুরন্ত একটা স্রোতের টানে দুখানা নৌকাই যেন ঝড়ের পালে ছুটে চলেছে। এ স্বাভাবিক টান নয়, পদ্মার স্রোতের চাইতে অনেক প্রখর, অনেক দুরন্ত এর শক্তি।

মুহূর্তের মধ্যে বদলে গেল সব। শিকার আর শিকারি দু-দলের মধ্যেই একসঙ্গে হাহাকার উঠল একটা। রামদা হাতে করে যে এতক্ষণ সকলকে শাসাচ্ছিল, তৎক্ষণাৎ তার হাতখানা ঝুলে পড়ল দুর্বলভাবে। ভয়-জড়ানো গলায় সে বলল, বড়ো পাকের টান!

বড়ো পাকের টান! পদ্মার এই অঞ্চলে সে-পাকের খ্যাতি কে না জানে! চুম্বক যেমন অনিবার্য আকর্ষণে লোহাকে টেনে আনে, তেমনি এই বড়ো পাকের টানও বহুদূর থেকে নৌকা বা যা-কিছু পায় সকলের অজ্ঞাতে বুভুক্ষু জলচক্রের ভেতর সেগুলিকে গ্রাস করতে নিয়ে আসে। সাপের চোখের মতো তার আকর্ষণ-প্রভাব। হুশিয়ার মাঝিরা দূর থেকে সে প্রভাব অনুভব করে প্রাণ বাঁচায়। যারা পারে না, সেই অনিবার্য নিষ্ঠুর আকর্ষণে মোহমুগ্ধের মতো ছুটে আসে। বিশাল ঘূর্ণি প্রচন্ড কয়েকটি আবর্তে বার কয়েক তাদের ঘুরিয়ে সোঁ করে অতলগর্ভে তলিয়ে নেয়, জলের উপর কোনোখানে এতটুকু চিহ্ন রেখে যায় না। তারপর হয়তো তিন মাইল দূরের বাঁকের মুখে কয়েকটা দেহ বা একখানা উবুড়-করা নৌকা ভেসে ওঠে। এ নিয়তির টান, এর হাত থেকে পরিত্রাণ নেই। এই পাকের টানে এক বার পড়লে কোনো মাঝির সাধ্য নেই যে নৌকা কিংবা প্রাণ বাঁচিয়ে আসতে পারে।

ডাকাতির উত্তেজনায় হোক কিংবা অসাবধানেই হোক—কোন অশুভক্ষণে যে নৌকা পাকের টানের মধ্যে এসে পড়েছে কেউ তা বুঝতে পারেনি। যখন পারল তখন আর সময় ছিল না। নৌকার গায়ে ঘা দিয়ে দিয়ে পদ্মার জল বাজতে লাগল খানিকটা ক্রুর কুৎসিত হাসির মতো।

লুটের মাল যেমন ছিল তেমনিই পড়ে রইল। সড়কি, বল্লম, রামদা ফেলে দিয়ে দু-দলই দাঁড় টানতে লাগল পাগলের মতো। ছিঁড়ে যেতে লাগল হাতের পেশি, ফেটে যেতে লাগল। হৃৎপিন্ড। কিন্তু প্রকৃতির এই অসম্ভব শক্তির কাছে মানুষের সমস্ত চেষ্টা হার মানল। এক-পা এগিয়ে তিন-পা পিছিয়ে এল নৌকা। উজানের বাতাসটুকুও পড়ে গেছে, পালের কাছ থেকে কোনো সাহায্যের আশা নেই।

নৌকা আর বাঁচবে না।

এবার ঝুপঝাপ করে জলে ঝাঁপিয়ে পড়ল সবাই। নৌকার যা হওয়ার হোক, কোনোমতে বাহুবলে যদি আত্মরক্ষা করা যায়, যদি চড়া কিংবা অন্য কিছুর আকস্মিক আশ্রয় জুটে যায়। নৌকা দুখানা উল্কার গতিতে ছুটে চলে গেল সেই অনিবার্য মৃত্যুচক্রের দিকেই।

৫.

জলে ঝাঁপিয়ে পড়ল বটে, কিন্তু স্রোতের টানে কে যে কোন দিকে বুদবুদের মতো নিশ্চিহ্ন হল তার আর সন্ধানই মিলল না। সে-আকর্ষণে মথুরা ঘোষালও কুটোর মতো ঘূর্ণির রাক্ষসগর্ভের দিকে ভেসে চলল। আগেই প্রায় মরে গিয়েছিল সে, এখন আচ্ছন্ন চেতনার ভেতর তার মনে হতে লাগল পেছন থেকে মরণের দূতেরা লক্ষ লক্ষ ঠাণ্ডা হাতে তাকে পাতালের অন্ধকারে ঠেলে নিয়ে চলেছে, একবিন্দু করুণা নেই তাদের। জলের গর্জন ক্রমশ একটা ক্রুদ্ধ জন্তুর আক্রোশধ্বনির মতো বেড়ে উঠছে, পাকটা আর কত দূরে?

সেই সময় হটাৎ জলের ভেতরে কীসে পা আটকাল মথুরার। কী যেন একটা জিনিস স্থির হয়ে আছে এই ভয়ংকর স্রোতের ভেতরেও। দু-হাতে সেটাকে প্রাণপণে আঁকড়ে ধরল মথুরা, টের পেল পাড়-ভেঙেপড়া একটা নারকেল গাছের আশ্রয় পেয়েছে সে। পাড় কবে ভেঙেছে, পদ্মাতীরের সীমানা কত দূর সরিয়ে দিয়েছে ঠিক নেই, তবু অল্প গভীর এখানকার জলে ঘূর্ণির প্রবল টানকে উপেক্ষা করেও মাত্র মাথাটুকু জাগিয়ে এখনও দাঁড়িয়ে আছে নারকেল গাছটা।

পিঠের ওপর দিয়ে একটানা স্রোত। আশ্রয় পেয়েও অস্বস্তি বোধ করছিল মথুরা। নিশ্চিত মরণের ভেতর বাঁচার এতটুকু আশা মনকে চাঙ্গা করে তুলল অনেকখানি। শরীর ক্রমশ অচল হয়ে আসছে, গায়ে যে প্রচুর শক্তি অবশিষ্ট আছে তাও নয়। আর একটু দুর্বল হয়ে পড়লে নিঃসন্দেহে আত্মসমর্পণ করতে হবে নদীর করুণার সামনে।

অবশিষ্ট শক্তিটুকু কোনোমতে গুছিয়ে নিয়ে মথুরা বহুকষ্টে নারকেল গাছটার আগায় এসে পৌঁছুল। জল থেকে মাথাটা হাত তিনেক মাত্র উপরে। কিন্তু মাথা বলতে কিছুই এখন আর অবশিষ্ট নেই। কালক্রমে শুকিয়ে শুকিয়ে তারা পদ্মার জলে ঝরে পড়েছে। শুধু দু-একটা শুকনো ডাঁটা ন্যাড়া মাথার ওপর কাঁটার মুকুটের মতো দাঁড়িয়ে আছে।

নক্ষত্র-ছাওয়া আকাশে এতক্ষণ কেবল অন্ধকারের উৎসব চলছিল। কিন্তু এতক্ষণে সেটা ফিকে হয়ে এল। ভাঙা ভাঙা হয়ে টুকরো মেঘের ওপার থেকে চাঁদ উঠল এতক্ষণে। খন্ড চাঁদ, নিষ্প্রভ আলো, তবু সেই ম্লান করুণ আলোয় পদ্মার এই নিশীথ রূপটাকে আরও রহস্যময়, আরও ভয়ংকর মনে হতে লাগল। নারকেল গাছটা থরথর করে উঠছে স্রোতের বেগে, দীর্ঘকাল এই টান সয়ে জলের ভেতর ডুবে থেকে তার দাঁড়াবার শক্তিও কমে আসছে। ক্রমশ তিল তিল করে ক্ষয় হচ্ছে তার তলার মাটি, যেকোনো সময়ে উপড়ে নিয়ে যেতে পারে। কিন্তু এত কথা ভাববার সময় মথুরার ছিল না। শেষ অবলম্বনটুকু দু-হাতে জড়িয়ে ধরে সে অজ্ঞানের মতো পড়ে রইল। তার চারদিকে মুখের শিকার ছেড়ে যাওয়া কালনাগিনি আক্রোশে গর্জে চলল।

বোধ হয় পাঁচ মিনিটও নয়, হঠাৎ সে টের পেল নারকেল গাছটায় জোরালো ঝাঁকুনি লেগেছে একটা। চমকে তাকিয়ে দেখল স্রোতে ভাসতে ভাসতে এসে আর একটি মানুষও তারই মতো এই গাছটাকে আঁকড়ে ধরেছে। লোকটার সারা শরীর জলের মধ্যে, ঝাঁকড়া চুলওয়ালা মাথা আর দুখানি হাত মাত্র ভেসে আছে জলের ওপর।

এক বারের জন্য শিউরে উঠে পরক্ষণেই হাসি ফুটে উঠল মথুরার মুখে। একেই বলে বিধাতার ঠাট্টা। রামদা মাথার ওপর ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে এই লোকটাই-না এতক্ষণ শাসাচ্ছিল তাদের। এতক্ষণ জলে ভিজলেও তাকে চিনতে কষ্ট হয় না। তার ঝাঁকরা বাবরি আর বুনো মোষের মতো শরীরটা এক বার দেখলে আর ভোলবার নয়। কয়েক মিনিটের মধ্যেই লোকটার এত পরাক্রম চুপসে এতটুকু হয়ে গেছে। ইচ্ছের বিরুদ্ধেও মথুরা শব্দ করে হেসে উঠল।

লোকটা চমকাল-দারুণভাবে চমকাল। যেন মাথার ওপর কালো পদ্মার প্রেতাত্মার হাসি শুনেছে সে। আতঙ্কে বিষণ্ণ চোখ মেলে তাকিয়ে দেখল, চাঁদের আলোয় চিনতেও পারল মথুরাকে।

ওঃ, তুমি!

সমস্ত ভয় আর ভাবনার একেবারে শেষ ধাপে পৌঁছেছে মথুরা। এখন আর ঘাবড়াবার মতো কিছু নেই। লোকটার দশা দেখে ভারি কৌতুক বোধ হল তার।

ঠাট্টা করে মথুরা বললে, তোমাদেরই দয়ায় এখানে আসতে হল বাবা। কিন্তু যাত্রাটা দেখছি তোমাদেরও শুভ হয়নি।

নাঃ! একটু চুপ করে থেকে লোকটা বড়ো রকমের নিশ্বাস ফেলল। পদ্মার হাওয়ায় আর কলধ্বনিতে নিশ্বাসের আওয়াজটা মথুরা শুনতে পেল না। লোকটা আবার বললে, ছ-মাস আগেও জেল খেটে বেরিয়েছি, দু-বছর, কিন্তু এমন বিপদে আর কখনো পড়িনি।

মথুরা চুপ করে রইল।

লোকটা বলে চলল, কাল পূর্ণ হয়েছিল আর কী। ধর্মের ঢাক হাওয়ায় বাজে কিনা? বউটা বলত, এত পাপ ধর্মে সইবে না, এমন কাজ কোরোনি। আমি তার কথা শুনিনি। মরণ তাকে টেনে নিলে। দু-তিন বছর ভালো হয়ে থাকলুম, তারপর আবার মানুষ মারার জন্যে পদ্মা ডাক পাঠাল। মায়ের কাছে অনেক বলি দিয়েছি, এবার আমাকেই বলি নেবে।

আশ্চর্য! কান্নায় ভরা লোকটার গলা। একটা নিষ্ঠুর ভয়ংকর ডাকাত কোথাও নেই— নিতান্তই সাধারণ মানুষ। মরণের সামনে দাঁড়িয়ে বুকের ভেতর থেকে তার হাহাকার উঠছে।

মথুরা শুনতে লাগল।

ছেলেটাকে মানুষ করতে চেয়েছিলুম চাষি গেরস্থর মতো লাঙল ঠেলে, মাটি কুপিয়ে। বউয়ের শেষ মিনতি। পারলুম না। কিছুদিন পরেই আবার ওরা আমায় টানতে লাগল। বললে, চল কালাচাঁদ চল। আবার ধরিয়ে দিলে ডাকাতির নেশা। ছেলের কথা ভাবলুম না, বউয়ের শেষ কথা ভুলে গেলুম। কিন্তু এবার দারোগা দল-কে-দল ধরে নিয়ে গেল। তিন বছর ফাটক খেটে এলুম।

তারপরেও আবার বেরিয়েছিলে ডাকাতি করতে?

ও যে রক্তের টান বাবু, ওখানেও যে সর্বনাশা বড়ো পাকের টান। নদীর ওপর কালো হয়ে রাত নামলে, পদ্মার জল খাঁড়া দুলিয়ে ডাক পাঠালে, হু-হু করে হাওয়ার তুফান বইলে তখন যে আর কিছুতেই ঘরে থাকা যায় না। অনেক চেষ্টা করেছি, দড়ি দিয়ে নিজেকে বেঁধে রেখেছি, তারপর নিজেই দড়ি কেটে পালিয়ে গেছি। এতদিনে সব মিটল। শুধু ছেলেটাকে যদি…

কালাচাঁদ থামল। পদ্মা গর্জন করে চলল একটানা। ঘুমের ঘোরে কোন দূরের বাসা থেকে ভুলে বেরিয়ে এসে একটা গাংচিল কেঁদে চলে গেল।

জল থেকে ওপরে উঠে যাওয়ার চেষ্টা করল কালাচাঁদ, কিন্তু বসবার জায়গা কোথাও নেই। বৃষ্টিবাদলায় শ্যাওলা পড়ে পড়ে গাছটা পেছল হয়ে আছে, বার বার হাত ফসকে যেতে চায়। আবার ভালো জায়গাটি মথুরা দখল করে বসে আছে, এক বার হতাশভাবে কালাচাঁদ সেদিকে তাকিয়ে দেখল। তার পা দুখানা তখনও জলের ভেতর, বড়ো পাকের টান হিংস্রভাবে সে-দুখানাকে যেন শরীর থেকে ছিঁড়ে নিতে চাইছে। হাতের মুঠা একটু আলগা হলেই সঙ্গে সঙ্গে টেনে নেবে নিজের ঘুরন্ত রাক্ষসগর্ভের মাঝখানে।

কালাচাঁদ আবার বললে, তোমার বাড়ি তো কুমারহাটি না?

হুঁ।

আমার হল মাদারঘাটা। একই দেশের মানুষ তাহলে।

সে তো বটেই। একটু খোঁচা দেওয়ার লোভটা সামলাতে পারল না, না হলে আর সর্বনাশ করতে আসবে কেন আমার?

জ্যোৎস্না আর একটু উজ্জ্বল হলে দেখা যেত কালাচাঁদের কালো মুখ লজ্জায় আরও কালো হয়ে উঠেছে।

আর লজ্জা দিয়ো না ও-কথা বলে, শাস্তি তো আমার শুরু হয়েছে। নামটা কী?

মথুরা নাম জানাল।

ঘোষাল? ব্রাহ্মণ? কালাচাঁদ জিভ কাটল, ব্রহ্মস্ব লুট করতে গিয়েছিলুম! হবেই তো, হবেই তো। নিজে নিজেই এক বার মাথা নাড়ল, এমনিই হয়।

আর কখনো ব্রহ্মস্ব লুট করনি বোধ হয়?

না জেনে ক-বার করেছি বলতে পারিনে, কিন্তু জানিতে এক বার। কালাচাঁদ থামল। চক্রবর্তীর কবন্ধ থেকে একরাশ রক্ত যেন ফিনকি দিয়ে চোখে-মুখে ছিটকে পড়ল তার। একটু চুপ করে থেকেই বললে, দন্ড হাতে হাতেই পেয়েছিলুম। ঘরে ফিরে দেখি বউটা মরে কাঠ হয়ে আছে। কলেরা।

আবার চুপ। পদ্মার গর্জন, ঘূর্ণির একটা ক্রুদ্ধ আহ্বান। কালো আকাশ আর কালো জল, দুয়ের মাঝখানে খানিকটা কাকজ্যোৎস্না জ্বলছে কুয়াশার একটা পর্দার মতো। পাখার শব্দ বাজিয়ে উড়ে চলেছে গোটা কয়েক বাদুড়, মরা জ্যোৎস্নায় তাদের ছায়া ওদের ওপর দিয়ে ভেসে গেল। নীচে জলের অবিশ্রান্ত গতি, সময়ের সঙ্গে নিরবচ্ছিন্ন কলরোল ছুটেছে দ্বৈতসংগীতে। কাল যেমন করে সব ভেঙে এগিয়ে যায়, ঠিক সেই একই নিয়মে ছুটেছে কীর্তিনাশা পদ্মা। দুই কূলে তার ভাঙনের ডমরু বাজছে।

মানুষের দেহ-মন দুই-ই আশ্চর্য! সব অবস্থার সঙ্গেই যেমন করে হোক মানিয়ে নিতে পারে। তাই এর মধ্যেও মথুরার চেতনা অসাড় হয়ে আসছিল। চট করে ঘোর ভেঙে গেল। সত্যি সত্যিই ঝিমুচ্ছে নাকি সে! এক বার হাত খুলে পড়ে গেলেই আর দেখতে হবে না, একটা টানেই পদ্মা একেবারে পনেরো-ষোলো হাত দূরে নিয়ে চলে যাবে। তখন আর ফিরে আসা মানুষ কেন–দৈত্যের পক্ষেও সম্ভব নয়।

চোখ মেলে মথুরা চেয়ে দেখল। তেমনি জলের ভিতর বারো আনা শরীরটাকে ডুবিয়ে প্রাণপণে গাছটাকে আঁকড়ে আছে কালাচাঁদ। চাঁদ আরও খানিকটা উঠে এসেছে, প্রায় মাথার ওপর। সেই আলোয় মথুরা আরও স্পষ্ট করে দেখতে পেল তাকে। ক্লান্তি, যন্ত্রণা আর ভয় সমস্ত মুখের ওপর থমকে আছে তার বেঁচে থেকেও যেন নরকবাস করছে।

কেমন আছ হে কালাচাঁদ?

ভালো নেই ঠাকুরমশাই। ক্লিষ্ট গলায় জবাব এল, জলে পড়বার আগেই পাঁজরাতে একটা চোট পেয়েছিলাম। ভিজে ভিজে আর জোর পাচ্ছিনে গায়ে। বেশিক্ষণ যে ধরে থাকতে পারব, সে-ভরসা আর নেই।

ওপরে উঠতে পারবে? ওপরে দুজনের জায়গা হওয়ার কথা নয়, কিন্তু এই চরম বিপদে পরমশত্রুকে মথুরা ডাক না দিয়ে থাকতে পারল না। লোকটার জন্যে এখন তার কষ্ট হচ্ছে।

কিন্তু কালাচাঁদের মনও বদলে গেছে এখন।

না ঠাকুরমশাই, দুজনের জায়গা হবে না ওখানে। তা ছাড়া শরীরেও এমন বল নেই যে। এতটুকু উঠে আসতে পারি। হাত-পা আমার অসাড় হয়ে যাচ্ছে।

তাহলে?

আর উপায় নেই ঠাকুর, মরণ আমার ঘনিয়ে এসেছে। তার আগে…

বার-বার-বারাং–

একটা ভয়ংকর শব্দ চারদিক কাঁপিয়ে জেগে উঠল, কোথায় যেন তোলপাড় হয়ে উঠল জল। পদ্মা ভাঙছে, ভেঙে চলেছে— মানুষের নীড়, পৃথিবীর মাটি। কোথায় যেন মস্ত একটা ভাঙন নামল কাছাকাছিই।

দুজনেই কান পেতে কিছুক্ষণ ধরে শুনল শব্দটা। আবার পাড়ি ভাঙল। হয়তো কারও ঘর গেল, কারও জমি গেল, কারও সর্বস্ব হারিয়ে গেল ওর সঙ্গে।

কিছুক্ষণ পরে আবার নিশ্বাস ফেলল কালাচাঁদ।

তুমি আমার দেশের মানুষ ঠাকুরমশাই, মরণের আগে তোমার চরণে নিবেদন আছে একটা।

মথুরার কষ্ট হল।

মরবে কেন হে? অনেকক্ষণ তো কাটালে। আর ঘণ্টা তিনেকের বেশি রাত্তির নেই। এর মধ্যে যদি কোনো জাহাজ এসে পড়ে তো ভালোই, নইলে দিনের বেলা যে করে হোক উপায় একটা হবেই। ভগবান আছেন।

আমার জন্যে নেই। কালাচাঁদ হাসতে চেষ্টা করল, তা ছাড়া তিন ঘণ্টা আর পারছিনে ঠাকুরমশাই, আমার হয়ে এসেছে। আমার ন-দশ বছরের একটা ছেলে আছে সংসারে, সে পড়ে আছে রতনগঞ্জে তার এক পিসির বাড়িতে। তুমি সেই পিসিকে এই গেজেটা দিয়ে, খান কয়েক মোহর আছে এতে। এ নিয়ে যেন আমার ছেলের নামে জমি কিনে রাখে। বড়ো হলে যেন আমার ছেলে চাষি হয়ে নিজের রোজগারের ফসল খেতে পারে। তা ছাড়া আরও বোলো, উত্তরের পোঁতায় দু-ঘটি…

হাত নামিয়ে গেজেটা তুলে নিলে মথুরা।

উত্তরের পোঁতায় দু-ঘটি…

কিন্তু আর বলতে পারল না কালাচাঁদ। এক হাতে গেজেটা বাড়িয়ে দিতে গিয়ে দুর্বল বাঁ হাতখানা কালাচাঁদের পিছলে গেল নারকেল গাছের গা থেকে। তারপরেই ছলাৎ করে শব্দ হল—যেন বড় একটা রুই মাছ উলাস দিয়ে উঠল জলের ওপর।

তাকিয়ে রইল মথুরা ঘোষাল। দেখল পদ্মার সেই দুরন্ত ঘূর্ণির টানে কালাচাঁদের ঝাঁকড়া মাথাটা ডুবতে ডুবতে ভেসে উঠল এক বার।

যমুনা ঠিকই বলেছিল ঠাকুরমশাই। মাথাটা ডুবে আবার ভেসে উঠল। মা নয়, রাক্ষুসি; রক্ত খায়।

সেই শেষ কথা। জলে বুদবুদ মিলিয়ে গেল। আর যাওয়ার আগে সমস্ত বিশ্বাস এমন একজনের হাতে দিয়ে গেল—একটু আগে চোখ বুজে যাকে সে খুন করতে পারত।

সকালের আলো জাগল। জেগে উঠল পদ্মা, যে মা, যে খিদের ফসল দেয়, পিপাসার জল দেয়। যে-পদ্মায় রঙিলা নাও ভাসিয়ে ভিনদেশিয়া বন্ধু দেশে ফিরে আসে। যে-পদ্মার জলে কালাচাঁদের ছেলে ডিঙি বেয়ে ধান বেচতে যাবে লক্ষীপুরার বাজারে।

একটা চলতি স্টিমার এসে নারকেল গাছের মাথা থেকে যখন অজ্ঞান অচৈতন্য মথুরা ঘোষালকে উদ্ধার করল, তখন তার হাতের মুঠোয় গেজেটা বজ্রশক্তিতে ধরা।

Anuprerona
Anupreronahttps://www.anuperona.com
Read your favourite literature free forever on our blogging platform.
RELATED ARTICLES

Most Popular

Recent Comments