ছোট গল্প: ‘রং বদল’

ছোট গল্প: 'রং বদল'

বিয়ের দুইমাস পরই আমার ডিভোর্স হয়ে গেল!
কারণটা একদম ঠুনকো ও ভাবতে পারেন আবার অনেক কঠিনও।

বাবা মায়ের একমাত্র মেয়ে আমি। যথেষ্ট বেশিই আদরে বড়ো হয়েছি। আমার মনে হয় না আমার বাবা মা আমার কোন চাওয়া অপূর্ণ রেখেছেন। এমনকি শেষ চাওয়া হিসেবে পছন্দের ছেলের সাথেই বিয়েটাও করে নিলাম। ছোট থেকেই আবার বাবা-মায়ের কাছে আমার চাওয়ার গুরুত্ব সব সময়ই ছিল আকাশছোঁয়া।

বাবা কলেজের টিচার হওয়ায় আমাকে সব সময়ই সঠিক শিক্ষা দিয়েই বড়ো করেছেন। আর কোন ভাইবোন না থাকায় তাদের সবটুকু আদর, ভালোবাসা যে আমি একাই পেয়েছি এটা তো বলার অপেক্ষা রাখে না।

ভার্সিটিতে পড়াকালীন ই প্রেম হল রিয়ানের সাথে। সবকিছুই খুব সুন্দর চলছিল। কখনোই আমাদের ভালোবাসায় বড় কোন সমস্যা আসেনি। দেখতে দেখতেই আমাদের ভার্সিটি জীবন শেষ হল। রিয়ানের ব্যবসা পছন্দ থাকায় ও নিজের বাবার ব্যবসা সামলাতে শুরু করল আর ভাল ছাত্রী থাকায় আমারও জলদিই জব হয়ে গেল।

অবশ্য জব হওয়ার আগেই আমার আর রিয়ানের বিয়ে ঠিকঠাক হয়ে গেছিল। ওদিকে একমাত্র মেয়ে হওয়ায় বাবা আমার বিয়েতে কোন কিছুরই কমতি রাখলেন না৷ একদম রাজকন্যা বিদায় যাকে বলে সেভাবেই আমি শ্বশুরবাড়ি গেলাম৷

খুব খারাপ লেগেছিল বিয়ের দিন বাবা মা’কে ছেড়ে আসার সময়। একে তো আমার তারা আর তাদের আমি ছাড়া কেউ নেই দেখার মতো তার উপর দুজনেরই বয়স হয়েছে। বাবার চাকরিটা নেই, বয়স হয়েছে অনেক। পরিবারটা বলতে গেলে বাবার মাসিক পেনশনের টাকায়ই চলে যাচ্ছিল। আবার তাদের প্রায় সময়ই এই সেই অসুখ লেগেই থাকে। দেখার মতো কেউ নেই বললেই চলে। অবশ্য বাবা মা’কে বলেছিলাম, যে তাদের কাছেই একটা বাসা নিয়ে থাকব তবে সেটা কবে হবে জানি তো আর না৷

সবই খুব সুন্দর ভাবে চলছিল। নতুন বিয়ে, পছন্দের মানুষকে সারাজীবনের জন্য পাওয়া, স্বপ্নের মতোই লাগছিল সব।

সকালে পরিবারের সবার সাথে কাটিয়ে সারাদিন অফিস করে ক্লান্ত শরীরে এসে প্রিয় মানুষটার বুকে একটু আগলে পরে সারাদিনের সব কষ্ট ভুলে যেতাম।

সবই সুন্দর চললেও বিপত্তি বাঁধল আমার বেতন পাওয়ার কিছুদিন পর। রাতে খেতে বসে শ্বাশুরি হঠাৎই জিজ্ঞেস করে বসলেন,
– বেতন পেয়েছো?
– জি আম্মা, পেয়েছি।
– কত বেতন পাও?
কথাটা শুনে কেমন খোঁচার মতো লাগল, তাও বললাম,
– এইতো আম্মা, ত্রিশ হাজার।
– তোমার শ্বশুরের ব্যবসার কথা তো জানোই, তাইনা?
– জি আম্মা….
– এই এলাকায় এত বড় ব্যবসায়ী আর কে আছে বল? আবার রিয়ানও সেটার হাল ধরেছে৷ আমাদের এত টাকা খাবে কে বল? তুমি এইসব চাকরানীগীরি বাদ দিয়ে সংসারে মন দাও, মেয়ে মানুষ, বিয়ের পর সংসারই সব।

কথাটা শুনে কেমন যেন খচ করে উঠল তাই বললাম,
– কিন্তু আম্মা আপনি তো নিজেও বিয়ের পর প্রায় পনেরো বছর জব করেছিলেন আমি যতটুকু শুনেছি। আর আমি জবটা করছি মূলত আমার বাবা মা’য়ের জন্য। তারা ছাড়া আমার আর আমি ছাড়া তাদের কেউ নেই।
– তোমায় ভুলে গেলে চলবে না, যে তুমি এখন এই বাড়ির বউ। আমরা যা বলব তোমাকে সেটা শুনতে হবে। আর তোমার জব করা টাকা যদি খরচ করতেই হয় তো এই সংসারে করবা, কারণ এখন এই সংসারটাই তোমার। তাই হয় জব বাদ দিয়ে সংসার করবা না হয় সব টাকা এই সংসারে খরচ করবা৷

– এসব কেমন কথা আম্মা! আপনি খুব ভাল করেই জানেন আমার বাবা মায়ের আমি ছাড়া আর কোন ছেলেমেয়ে নেই। আমার বাবা আমাকে বড়ো করতে যথেষ্ট খরচ করেছেন এই জীবনে। বাবার জব নেই। পেনশনের সামান্য টাকায় সংসারটা চলে। আর এখন তাদের দুইজনেরই বয়স হয়েছে। এমন না যে কোন ছেলে আছে যে তাদের দেখবে। আর আমি মেয়ে না হয়ে ছেলে হলে তো তাদেরই দেখতাম তাই না? আপনার ছেলে ও তো আপনাদের দেখে তাই নয় কি?
– চুপ কর! মুখের উপর তর্ক করা পছন্দ না আমার!

রাগ করেই সেদিন খাবার টেবিল থেকে উঠে এলাম। আশ্চর্য! এত ভদ্র পরিবার অথচ এই তার নমুনা? রিয়ানকে ঘরে খুব সুন্দর করে সবটা বুঝালাম। আমার বাবা মা’কে দেখবে কে? ও কি পারত আমার জায়গায় হলে ফেলে দিতে?

তবে আমি মানুষ চিনতে পারলাম! মানুষ কিভাবে মনুষ্যত্বহীন আচরণ করে তাও দেখলাম। কত সুন্দর ভাবে পল্টি নিল সব!

এসবের পর রিয়ানের কোন কথা ছিল না। ওর মায়ের কথাই না-কি ওর কথা। তাদের কোন ভাবেই এসব বুঝাতে পারলাম না। বিষয়টা আমার বাবা মায়ের কানে গেল। বাবা এসে শ্বাশুড়িকে বুঝিয়ে বললেন, যে ওর কিছুই আমাদের লাগবে না৷ আমরা ওকে মানুষ করেছি, বিয়ে দিয়েছি, শেষ।

আসলেই শেষ? এভাবে সব শেষ হয়?

শেষ হল, তবে আমার সংসার। তাও দুই মাসের মাথায়ই! ছয় বছরের ভালোবাসা, এত সুন্দর বুঝাপড়া সবই শেষ হল। সাথে কিছু নিম্নমনের জানোয়ার দেখলাম নিজ চোখে।
আমার বাবা মা অনেক বুঝিয়াছিলেন যে, তাদের নিয়ে আমাকে ভাবতে হবে না। আমার বিয়ে হয়েছে, সেই সংসারই আমার সব।

তবে আমারও তো তাদের উপর একটা দায়িত্ব আছে না-কি?

এটা আমি কেমনে ভুলি? তারা আমাকে এত ভালোবাসা দিয়ে বড় করেছেন আর আমি তাদের ফেলে দেব ? আমি ছেলে হলে কি করতাম?

সত্যি বলতে হাসিমুখেই আমি ডিভোর্স পেপারে সাইন করে রিয়ানের মুখের উপর কাগজটা ছুঁড়ে দিয়ে চলে এলাম। আসার সময় ওর মা’কে বললাম,

এই ছেলে না হয়ে যদি আপনার একটা মেয়ে হতো আর তার সাথে এমনটা হলে খুব ভাল হতো।

বাবার কোলে মাথা দিয়ে শুয়ে আছি। আমার খারাপ না লাগলেও মা আমার পাশে বসে কাঁদছেন। তার কথা, আমার আর সংসার হবে না!

এদিকে মুচকি হাসছি আমি। বেশ হয়েছে। একজন সন্তান হিসেবে আমি অনায়াসে এখন আমার বাবা মায়ের দেখাশোনা করতে পারব।

— আসিফ আহমেদ

You May Also Like

About the Author: Anuprerona

Read your favourite literature free forever on our blogging platform.