Wednesday, May 8, 2024
Homeবাণী-কথাআঁতেল বাবা মার পুত্র কন্যা - হুমায়ূন আহমেদ

আঁতেল বাবা মার পুত্র কন্যা – হুমায়ূন আহমেদ

হুমায়ূন আহমেদ

কিছু কিছু জিনিসের প্রতি আমার এলার্জি আছে। আঁতেল বাবা মার পুত্র কন্যারা হচ্ছে সেই সব জিনিসের একটি। আঁতেল সহ্য করা যায় কিন্তু তাদের অফ-স্প্রীং অসহনীয়। এই সব অফ-স্ত্রীং জ্ঞানী জ্ঞানী আবহাওয়ায় থেকে কেমন যেন ভ্যাবদা মেরে যায়। বুদ্ধি শুদ্ধি নতুন লাইনে চলে। সেই লাইন ভয়াবহ লাইন।

উদাহরণ দেই। উদাহরণটা একটু স্থূল ধরণের। সূক্ষ রুচির পাঠকরা দয়া করে ক্ষমা করে দেবেন। এক সন্ধ্যায় জনৈক প্রথম সারির আঁতলের বাসায় কিছুক্ষণ ছিলাম। এই কিছুক্ষণেই তিনি তার জ্ঞান বুদ্ধি ও বিশ্লেষণ দিয়ে আমাকে অভিভূত করে ফেললেন। আমি প্রথম জানলাম যে জীবনানন্দ দাশের সব বিখ্যাত কবিতাই ইংরেজী কবিতা থেকে নেয়া। বিভুতিভূষণের সাহিত্য কোন সাহিত্যই নয় এক ধরনের রূপকথা, ইত্যাদি। আলোচনা যখন মায়াকোভস্কিতে চলে এসেছে তখন রঙ্গমঞ্চে আঁতেলের পুত্রের আবির্ভাব ঘটল।

পুত্রের বয়স পাঁচ ছ। সম্পূর্ণ দিগম্বর। মুখ ভর্তি হাসি। আমি তার দিকে তাকিয়ে বললাম, কি খবর খোকা? খোকা সঙ্গে সঙ্গে বলল, হাইগা আইলাম।

আতেঁল ভদ্রলোক স্তম্ভিত। তিনি পুত্রের দিকে তাকিয়ে বললেন–অরূপ, যাও ভেতরে যাও।

অরূপ বলল, আমি হাইগা আইলাম।

ভেতরে যাও বলছি।

অরূপ আবার সেই ভয়াবহ বাক্যটি উচ্চারণ করল।

আঁতেল রাগে প্রায় কাঁপতে লাগলেন। তাঁর মুখে কথা জড়িয়ে যেতে লাগল। আমি বললাম, বাদ দিন ছেলেমানুষ। মায়াকোভস্কি সম্পর্কে কি যেন বলছিলেন?

ভদ্রলোক কর্কশ গলায় তার কাজের মেয়েটিকে ডাকতে লাগলেন। সেই মেয়ে এসে অরূপকে ধরে ভেতরে নিয়ে যাবার পর ভদ্রলোক খানিকটা শান্ত হলেন এবং কপালের ঘাম মুছে বললেন, শিশুদের সাইকোলজি খুব অদ্ভুত, কি বলেন?

তাতো বটেই।

শিশুরা কোন কাজ করতে পারে না। কাজেই বাথরুম করাটাকে তারা মনে করে বিরাট একটা কাজ। তারা মনে করে এই কাজের খবর সবাইকে জানিয়ে দেয়া উচিত। সে তখন তাই করে। অনেকটা মুরগীর ডিম পাড়ার মত।

আমি বললাম–চমৎকার বলেছেন। কারেক্ট।

ভদ্রলোক বললেন, আপনি ডঃ মেয়ারের লেখা শিশু সাইকোলজির অসাধারণ বই রাইজ অব দি রিজনিং সম্ভবত পড়েননি। সেখানে ডঃ মেয়ার দেখিয়েছেন–

ভদ্রলোক কথা শেষ করবার আগেই অরূপ আবার ঢুকল। এবার তার পরনে প্যান্ট। টুকটুকে লাল রঙের একটা শার্ট।

ভদ্রলোক ছেলেকে দেখেই অত্যন্ত গম্ভীর হয়ে গেলেন। খড়খড়ে গলায় বললেন, এখানে কি চাই?

অরূপ বলল, হাগা নিয়া আসলাম।

বলেই প্যান্টের পকেটে হাত দিল। সম্ভবত প্যান্টের পকেটে করেই সে তার কর্মকাণ্ড নিয়ে এসেছে। আমাদের তা দেখিয়ে অবাক করে দিতে চায়। অরূপ তা করার সুযোগ পেল না। তার আগেই কাজের মেয়েটি এসে হেঁ মেরে তাকে নিয়ে গোল।

আঁতেল ভদ্রলোক কাষ্ঠ হাসি হেসে বললেন, চাইল্ড সাইকোলজির চমৎকার নমুনা দেখলেন। অরূপের ধারণা হয়েছিল প্রথম বার তার কথা আমরা বিশ্বাস করিনি। কাজেই শুধুমাত্র আমাদের বিশ্বাস করানোর জন্য নোংরা কাজটা সে বাধ্য হয়ে করেছে। হাতে নাতে সে প্রমাণ করে দিতে চাচ্ছে। তাই না?

অবশ্যই।

এই জিনিসটা যদি গ্রোণআপদের মধ্যে থাকতো তা হলে পৃথিবীর চেহারাটাই পাল্টে যেত, তাই না?

জ্বি, তাতো বটেই।

আমরা যেন কি নিয়ে আলাপ করছিলাম?

মায়াকোভস্কি।

হ্যাঁ মায়াকোভস্কি। আপনি কি জানেন–

এতক্ষণ প্রথম সারির আঁতেলের পুত্রের গল্প বললাম। এখন শুনুনু দ্বিতীয় সারির মহিলা আঁতেলের পুত্রের গল্প।

এই মহিলা সব সময় চেষ্টা করেন পুত্রের প্রতিভা যেন নানা দিকে বিকশিত হয়। ছেলে যেন নিজেই নতুন ধরনের খেলা ভেবে ভেবে বের করে এবং খেলে। একদিন সোশ্যাল ওয়ার্ক সেরে মহিলা বাসায় ফিরে জিজ্ঞেস করলেন, খোকন আজ কি খেলা খেললে?

আজ নতুন একটা খেলা খেলেছি মা।

বই চমৎকার। খেলাটার নাম কি? কি ভাবে খেললে?

খেলাটার নাম ডাক পিওন।

বাহ খুব ভাল–ডাক পিওন। তা কিভাবে খেললে?

তোমার ট্রাঙ্ক খুলে চিঠিগুলি প্রথম বের করেছি।

মা আঁৎকে উঠে বললেন, কোন চিঠি?

ঐযে নীল চিঠিগুলি। লাল ফিতা দিয়ে যেগুলি বাঁধা। তারপর ঐ চিঠিগুলি আশেপাশের সব বাড়িতে একটা করে দিয়ে এসেছি। এইটাই ডাক পিয়ন খেলা।

আঁতেল নয় এ একম একটা সাধারণ পরিবারের ন বছর বয়েসী একটি মেয়ের কথা দিয়ে এবারের গল্প শেষ করি।

বাড়িতে মেহমান এসেছেন। বসার ঘরে বসে সবাই গল্প গুজব করছেন। হঠাৎ ন বছর বয়েসী মেয়েটি বলল, কাল রাতে বাবা মা কি করেছে আমি সব দেখেছি। এখন আমি বলে দেব।

মেয়েটির বাবা-মা দুজনই আতঙ্কে নীল হয়ে গেলেন। মেয়েটির মা কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন–যাও লক্ষী, তোমার ঘরে গিয়ে ল্যাগো দিয়ে খেল।

উঁহু, আমি বলবই। প্রথমেই মা খুব রেগে গেল তারপর বাবা যা করে মাও তাই করে আর হাসে।

অতিথিরা বিপদ টের পেয়ে বললেন–এই গল্পটা আরেকদিন শুনব, কেমন?

উঁহু, আমি আজই বলব। প্রথম বাবা করল কি হাতে পানি নিয়ে মার মুখে পানি ছিটিয়ে দিল। মা খুব রেগে গেল। তারপর সেও বাবার মুখে ছিটিয়ে দিল। তারপর দুজনই হাসে আর মুখে পানি ছিটায়। আমি পর্দার আড়াল থেকে সব দেখেছি।

Anuprerona
Anupreronahttps://www.anuperona.com
Read your favourite literature free forever on our blogging platform.
RELATED ARTICLES

Most Popular

Recent Comments