Saturday, October 4, 2025
Homeবাণী ও কথাসুখ - নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

সুখ – নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

মাছ ধরতে চান? ওভাবে হবে না।

আমি চমকে উঠলুম। আমার ধারণা ছিল বিকেলের এই নির্জন মাঠে, এই ছোটো নদীটার ধারে যেখানে এক টুকরো পাথরের ওপর বসে আমি শান্ত স্বচ্ছ জলের ভেতরে বঁড়শি ফেলেছি, তার আধ মাইলের ভেতরে কোনো জনপ্রাণী নেই। না, ভুল বলা হল। দু-একটি গোরু চরতে দেখেছিলুম এদিক-ওদিক, আশপাশের ক-টা ঝোপঝাড় থেকে এক-আধটা শেয়ালও বেরিয়ে আসা অসম্ভব নয়, কিন্তু…

তাকিয়ে দেখলুম পিছনে একটি মানুষ দাঁড়িয়ে। ত্রিশ থেকে পঁয়ত্রিশের মধ্যে বয়েস, একটু বেশিমাত্রায় লম্বা বলে শরীরের ওপর দিকটায় অল্প একটু ভাঁজ পড়েছে। গায়ে আধময়লা হাফ শার্ট, পরনে ধুতি, পায়ে ধুলোমাখা রবারের জুতো। কালো ফ্রেমের চশমার ওপর পশ্চিমের রোদ পড়ে মনে হচ্ছিল চোখ দুটি জ্বলছে আগুনের গোলার মতো।

ভদ্রলোক আবার বললেন, নতুন লোক নিশ্চয়? নাহলে এ নদীতে ছিপ ফেলবার পন্ডশ্রম কেউ করে না। কিছু পেলেন?

বললুম, একটা ছোটো বেলে মাছ।

ব্যাস ব্যাস, যথেষ্ট পেয়েছেন। আজকের মতো খুশি হয়ে বাড়ি চলে যান। আর সত্যিই যদি দুটো-চারটে মাছ ধরতে চান, তাহলে রোমে এসে রোমান হতে হবে। অর্থাৎ গামছা পরুন, পলো নিয়ে জলে নামুন, ঘণ্টা তিনেক পরিশ্রম করুন, তারপর দেখবেন অন্তত পোয়াটাক চুনো মাছ জোগাড় হয়েছে।

বলে হেসে উঠলেন।

ভদ্রলোক কিছু লেখাপড়া জানেন বলে মনে হল। আর ঠিক এই পরিবেশে তাঁর আবির্ভাবটা কেমন অসঙ্গত বোধ হয় আমার কাছে। উত্তরবাংলার এই গ্রামটিতে কয়েকটা ছুটির দিন আমি কাটাতে এসেছি এক সপ্তাহ আগে। যে-আত্মীয়টির কাছে এসেছি তিনি সম্পর্কে আমার কাকা; তাঁর পরিচিত এবং বন্ধুবান্ধব অর্থাৎ যে দু-চারটি মোটামুটি শিক্ষিত মানুষ এখানে আছেন, তাঁদের সঙ্গেও আলাপ হয়ে গেছে আগেই। দুজন পোস্ট অফিসের কেরানি, জন কয়েক স্কুলটিচার, একজন ডাক্তার আর তাঁর কম্পাউণ্ডার, জন তিনেক ব্যবসায়ী। এঁদের বাইরে আর কেউ রোমে এসে রোমান হওয়ার প্রবাদ শোনাতে পারেন সেকথা আমার জানা ছিল না। আর বিকেলের এই নির্জন মাঠে যেখানে আধ মাইলের ভেতরে কোনো জনপ্রাণী আছে বলে আমার মনে হয়নি, যেখানে হাওয়ায় বেনাবন সরসর করছিল, যেখানে ওপারের জঙ্গল থেকে মধ্যে মধ্যে ভেসে আসছিল লেবুঘাস আর বনতুলসীর গন্ধ, যেখানে আমার ঠিক পায়ের নীচেই মিহি বালির ওপর খানিকটা নীলচে জল প্রায় নিথর হয়ে ছিল আর কয়েকটা ভাঙা ঝিনুকের রুপালি খোলায় লাল রোদের টুকরো মুক্তো হয়ে জ্বলছিল, সেখানে এই লোকটি যেন হঠাৎ ফুটে উঠল; যেন একটু আগে সে কোথাও ছিল না, একটু পরে এই রোদ মুছে গেলে সে-ও নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে।

আমি ছিপ গুটিয়ে আস্তে আস্তে দাঁড়িয়ে পড়লুম। জলের কোল ছেড়ে উঠে এলুম পাহাড়ের ওপর। সেই চার ইঞ্চি বেলে মাছটা পাথরের ধারেই পড়ে রইল।

নদীর ধারের একটি মাত্র গাছ—একটা শিমুলের গুঁড়িতে হেলান দিয়ে বিড়ি ধরাচ্ছিলেন ভদ্রলোক।

চললেন?

বললুম, হ্যাঁ। ভেবে দেখলুম আপনার প্রস্তাবটাই ভালো। কাল গামছা আর পলো এনেই চেষ্টা করে দেখব।

ভদ্রলোক একটু হাসলেন। বললেন, বাইরের লোক না?

এক সপ্তাহ হল এসেছি।

কোথায় উঠেছেন?

পরিচয় দিলুম। তারপর বললুম, আমার ধারণা ছিল এখানকার সকলের সঙ্গেই আমার মোটামুটি চেনা হয়ে গেছে। কারণ বিকেলে ডাক আসবার সময় সবাই এক বার পোস্ট অফিসে যান। কিন্তু আপনার সঙ্গে কখনো আমার দেখা হয়নি।

বিড়িতে টান দিয়ে ভদ্রলোক বললেন, তার কারণ আমার কখনো চিঠি আসে না–কখনো আসবে না।

শেষ কথাটায় আর এক বার চমকালুম আমি। চিঠি কখনো আসেনি এটা অসম্ভব না হতে পারে, কিন্তু চিঠি কখনো আসবে না—এইটেই কানে অত্যন্ত বেসুরো ঠেকল। আর বিকেলের সেই পড়ন্ত রোদে আরও এক বার তাঁর চশমার কাচ দুটোকে আগ্নেয় বলে মনে হল আমার।

অনুভব করলুম, এখানে আসবার পরে যাদের সঙ্গে আমার আলাপ হয়েছে—এই মানুষটি। তাদের চেয়ে অন্তত খানিকটা আলাদা।

বললুম, আপনিও বোধ হয় ঠিক এখানকার লোক নন।

এখনও এখানকার লোক হতে পেরেছি কি না জানি না। কিন্তু আট বছর আছি এখানে। মাসের হিসেব ধরলে আরও কিছু বেশি।

কী করেন?

চাষবাস। মডেল ফার্মিং।

মডেল ফার্মিং! ভদ্রলোকের মুখের দিকে চেয়ে রইলুম। সব যেন রূপকথার মতো শোনাচ্ছে। এই নগণ্য ছোটো গঞ্জটির আশপাশে মডেল ফার্মিং-এর মতো একটা ব্যাপার কিছু আছে একথা তো কেউ আমাকে বলেনি।

ভদ্রলোক বললেন, বিশ্বাস হচ্ছে না-না? একদিন নিয়ে যাব আপনাকে। আছেন তো এখন?

আর দিন চারেক থাকব।

আচ্ছা, দেখা হবে তাহলে। নমস্কার।

বলে ভদ্রলোক পাড় থেকে নদীর দিকে নেমে গেলেন। জুতো খুলে হাতে নিলেন, কাপড় তুললেন হাঁটু পর্যন্ত, তারপর প্রায় মজা নদীটার তিরতিরে জলটুকু ছপ ছপ করে পার হয়ে একটা বুনো জন্তুর মতো ওপারের বনতুলসী আর লেবুঘাসের বনের মধ্যে কোথায় যেন হারিয়ে গেলেন।

একটা অদ্ভুত অস্বস্তিতে আরও কিছুক্ষণ আমি দাঁড়িয়ে রইলুম সেখানে। যেন স্বপ্ন দেখলুম, যেন একটা অলৌকিক ঘটনা ঘটে গেল চোখের সামনে। এই নির্জন মাঠ, বাতাসে বেনাবনের শব্দ, লেবুঘাস আর বনতুলসীর গন্ধ, আর কালো-হয়ে-আসা রোদের রং সমস্ত জিনিসটাকে অদ্ভুত প্রেতপ্রত্যয়ে পৌঁছে দিতে পারত, যদি-না আমি দেখতুম তখনও নদীর জলটা অনেকখানি ধরে ঘোলা হয়ে আছে, যদি-না আমার চোখে পড়ত শিমুল গাছের তলায় একটা আধপোড়া বিড়ি থেকে সুতোর মতো ধোঁয়া উঠছে তখনও।

কাকা কনফার্মড ব্যাচেলর, একটি পোস্টাল পিয়োনকে নিয়েই তাঁর সংসারযাত্রা। সে-ই রান্নাবান্না করে। রাত্রে খেতে বসে আমি নদীর ধারের সেই অদ্ভুত লোকটার কথা কাকাকে বললুম।

কাকা বললেন, বুঝেছি, পাগলা চৌধুরি।

পাগলা চৌধুরি মানে? পাগল?

না, পাগল বলে তো মনে হয় না। একটু অদ্ভুত ধরনের এই যা।

অদ্ভুত কেন?

তা ছাড়া কী আর। লেখাপড়া জানে মনে হয়, ভদ্রলোক, অথচ কারুর সঙ্গে বিশেষ মেশেটেশে না। যা-কিছু খাতির গ্রামের চাষাভুসোর সঙ্গে। আমি তো এই দু-বছর আছি এখানে, হাটে কয়েক বার দেখা হয়েছে, আর সামান্যই আলাপ।

নিজের সেই মডেল ফার্মিং নিয়েই থাকেন বুঝি?

মডেল ফার্মিং! কাকা ভ্রুকুটি করলেন, সেসব তো কিছু শুনিনি। সামান্য কিছু জমিজমা আছে, চাষবাস করে; তা ছাড়া গ্রামের লোককে জড়িবুটি দেয়, টোটকা চিকিৎসা করে—এই তো জানি।

টোটকা চিকিৎসা?

হুঁ, এইসব করেই চালায়। এখানকার ভদ্রলোকদের সঙ্গে মেলামেশায় একেবারে আনসসাশ্যাল। শুনেছি প্রথম যখন এদিকে এসেছিল, তখন পুলিশে সন্দেহ করেছিল অ্যাবসকার, কিছু খোঁজখবরও নিয়েছিল। শেষে দেখেছে ওই এক ধরনের খেয়ালখ্যাপা লোক—ঘাঁটাঘাঁটি করে কোনো লাভ নেই।

কোথায় থাকেন?

গঞ্জের বাইরে, গাঁয়ের ভেতর। ঠিক কোথায় তা বলতে পারব না।

কৌতূহল মিটল আপাতত। পৃথিবীর অসংখ্য মানুষ নিজের খেয়ালখুশিতে দিন কাটিয়ে চলে। আমার কাছে যা নিছক পাগলামো, আর একজন তার ভেতর নিজের মতো করে যুক্তির শৃঙ্খলা খুঁজে পায়। অতএব ও নিয়ে মাথা-ঘামানো সম্পূর্ণ নিরর্থক। কিন্তু তবুও রাতে অনেকক্ষণ পর্যন্ত আমার ঘুম এল না। জানালার বাইরে দূরের এক সার কালো গাছপালার উপর তামাটে রঙের বিবর্ণ চাঁদটার ডুবে-যাওয়া দেখতে দেখতে আর বাদুড়ের ডানার আওয়াজ শুনতে শুনতে দুটো জিনিস আমাকে বার বার পীড়ন করতে লাগল। সেই পড়ন্ত রোদের আলোয় আগুনের মতো জ্বলতে থাকা চশমার কাচ আমার চিঠি কখনো আসবে না। আর, আর সেই আসন্ন সন্ধ্যায় অমনভাবে নদীটা পার হয়ে বনতুলসী আর লেবুঘাসের জঙ্গলে কোথায় মিলিয়ে গেল লোকটা?

পরের দিনটা নিজের এলোমেলো কাজ নিয়ে কাটল। সারা সকাল বসে বসে অনেকগুলো চিঠি লিখলুম। কাকার ছোটো রেডিয়োটা গোলমাল করছিল, সেটা খুলে ঘণ্টা দুই হাতুড়ে চিকিৎসা চালালুম, কাজ-চালানোর মতো দাঁড়িয়ে গেল। দুপুরে বাঁধানো পুরোনো মাসিক পত্রিকা জোগাড় করে একটা ধারাবাহিক নিটোল প্রেমের উপন্যাস পড়ে ফেললুম শেষ কিস্তিটা পর্যন্ত। বিকেলে চা খাওয়ার সময় মনে পড়ল মাইল পাঁচেক দূরে একটা চমৎকার পুরোনো মন্দির আছে, সেটা নাকি দেখবার মতো। চা শেষ করে কাকার সাইকেলটা নিয়ে সেই মন্দিরটার উদ্দেশেই বেরিয়ে পড়লুম।

কাকা বললেন, দেরি করিসনি, রাস্তাটা খারাপ।

না না, সন্ধ্যার মধ্যেই ফিরে আসব।

ঘড়িতে দেখলুম সাড়ে চারটে। যেতে-আসতে মাইল দশেক রাস্তা, সাইকেলে কতক্ষণই-বা লাগবে? মন্দিরের জন্যে আধ ঘণ্টা সময় ধরে রাখা যেতে পারে। সাড়ে ছ-টার মধ্যে ফিরে আসব। তা ছাড়া পৌনে সাতটা-সাতটার আগে তো ভালো করে অন্ধকারই হয় না আজকাল। ভাবনার কিছুই ছিল না।

কাঁচামাটির পথ, গোরুর গাড়ি চলে, তবু সাইকেলের পক্ষে এমন-কিছু দুরূহ দুর্গম নয়। মাঠের ভেতর দিয়ে আম-জাম-বাবলাবনের পাশ কাটিয়ে, গোটা দুই গ্রাম ছাড়িয়ে আর খুবসম্ভব সেই নদীটারই একটা লোহার সাঁকো পার হয়ে যখন মন্দিরে পৌঁছোলুম তখন আকাশে কালকের মতোই রাঙা বিকেল। কিন্তু আজ আর আমার পাগলা চৌধুরিকে মনে পড়ল না। মন্দিরটাই আমাকে মুগ্ধ করল। লাল পোড়া ইটে বিষ্ণুপুরী ধরনে তৈরি, প্রত্যেকটি ইটে কারুকার্য। এখন ফাটল ধরেছে এখানে-ওখানে, নবরত্ন চুড়োর ক-টাই ভেঙে পড়েছে, তবু দিঘির উঁচু পাড়ের উপর যেন রাজার মহিমায় দাঁড়িয়ে আছে এখনও। ভেতরে কালো কষ্টিপাথরে-গড়া অষ্টভুজা কালীমূর্তি। তাঁর গায়ে বহুদিনের জমাট সিঁদুরের প্রলেপ চাপধরা রক্তের মতো দেখাচ্ছে। মন্দিরের চাইতেও মূর্তিটা অনেক বেশি পুরোনো বলে মনে হল।

ঘাটের সিঁড়িগুলো ভেঙে ঘাসবনের মধ্যে লুকিয়েছে, দিঘিটা মজে এসেছে আধাআধি, শ্যাওলা-পানা-পদ্মপাতায় ঢাকা মেঘরত্ন জলের ওপর পদ্মের কালো শুকনো ডাঁটা সারি সারি ফণাহীন কেউটের মতো দাঁড়িয়ে। মন্দিরের সামনে বসে দিঘির দিকে তাকিয়ে অনেকক্ষণ চুপ করে বসে রইলুম আমি। আর শুনতে পেলুম হাওয়ায় হাওয়ায় দিঘির চারধারে বেল, আমলকী, রুদ্রাক্ষ আর হরীতকীর বন থেকে যেন দমচাপা দীর্ঘশ্বাস উঠছে।

যখন খেয়াল হল, তখন ফিকে নীল রেশমি শাড়ির মতো হালকা সন্ধ্যার গায়ে তারা জরি বুনছে, জোনাকির বুটি ফুটছে বেল-আমলকী-রুদ্রাক্ষের ছায়ায়। অনেক দেরি হয়ে গেল যে। ব্যস্ত হয়ে আমি উঠে দাঁড়ালুম, সাইকেলটা নিয়ে নেমে এলুম উঁচু ডাঙাটা থেকে, তারপর বাড়ির দিকে চলতে শুরু করে দিলুম।

আম-জাম-বাবলা গাছের ওপর দিয়ে তামাটে রঙের চাঁদটা আলো ছড়াচ্ছে। মেটেপথে চলেছি সাইকেল নিয়ে। কেন জানি না ওই মন্দিরটাই আমার মনকে আচ্ছন্ন করে দিল। চমক ভাঙল বিশ্রী একটা হোঁচট খেয়ে। কড়াং কট করে আওয়াজ কানে এল। অর্থাৎ চেন ছিড়ল সাইকেলের।

সামনে এখনও প্রায় দেড় মাইল পথ। আর যেখানটায় চেন ছিড়ল সে-জায়গাটাও একটু বেয়াড়া। কতকগুলি বড়ো বড়ো গাছ যেন সেখানে হুমড়ি খেয়ে পড়েছে রাস্তার উপর। চাঁদ দেখা যায় না, ছাড়া ছাড়া অন্ধকারের টুকরো থমথম করছে। সাইকেলের আলোর শেষ সীমানা দিয়ে বাঘের বাচ্চার মতো বাদামি রঙের কী-একটা দৌড়ে গেল। আতঙ্কের ধাক্কা লাগল এক বার, পরক্ষণেই বুঝতে পারলুম ওটা একটা অতিকায় ভাম বেড়াল।

কয়েক মিনিট স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে নিজেকে সামলে নিচ্ছি, হঠাৎ কানে এল, কী হল সাইকেলের?

আরও এক বার দারুণভাবে চমকালুম আমি। পথের ধারের অন্ধকার ছায়া ফুড়ে একটা কুঁজো মতন লোক এগিয়ে আসছে। লোকটার হাতে ছোটো একটা টর্চের আলো ঝলকে না উঠলে আমি হয়তো চিৎকার করে উঠতুম।

আমার মুখে টর্চ ফেলে লোকটা বললে, আরে, আপনি যে!

তখন চিনতে পারলুম। সেই পাগলা চৌধুরি।

জিজ্ঞেস করলুম, আপনি এখানে?

বুকের ভেতরটা ঢিপ ঢিপ করছিল তখনও, গলার আওয়াজ যে আমার কেঁপে উঠল, নিজেই টের পেলুম সেটা।

একটু কাজ ছিল। কিন্তু আপনি কোথায় গিয়েছিলেন?

কপালিনীর মন্দির দেখতে।

সেটা বুঝেছি। নতুন লোক, তাই জানেন না। দিনের বেলা ছাড়া এসব দিকে না আসাই ভালো।

চোর-ডাকাত? অপদেবতা?

না মশাই, সেসব নয়; অন্য ব্যাপার। নিন এগিয়ে চলুন এখন। সাইকেল তো দেখছি বেকার হয়ে গেছে, টানতে টানতেই যেতে হবে। চলুন।

ভদ্রলোক সঙ্গে থাকায় মনে ভরসা এসেছিল। চলতে চলতে জিজ্ঞেস করলুম, পথে কী আছে বলছিলেন?

সাপ মশাই, সাপ। বিরাট বিরাট গোখরো। পাকা গমের মতো গায়ের রং। পশ্চিমে গহুমা বলে খ্যাত, এদিকে বলে গোমা সাপ। কামড়ালে আর দেখতে হবে না। খুব পুরোনো আমলের জায়গা কিনা, নবাবি ইটের পাঁজা আর ভাঙা মন্দির-মসজিদের তো অভাব নেই আশপাশে। নিশ্চিন্তে বংশবৃদ্ধি করছে। বলেই ভদ্রলোক আমার হাত ধরে টানলেন। একটু দাঁড়ান।

কী হল?

শুকনো পাতার খড়খড়ানি পাচ্ছেন না? ওঁদেরই কেউ যাচ্ছেন একটু দূর দিয়ে। সাপের চলা ছাড়া ওরকম আওয়াজ হয় না। দাঁড়িয়ে যান, এগোতে দিন মহাপ্রভুকে। সাইজে বেশ বড়োই হবেন, নিদেনপক্ষে হাত পাঁচেক মনে হচ্ছে।

আর বলবার দরকার ছিল না। এমনিতেই আমার রক্ত হিম হয়ে এসেছিল।

কতক্ষণ পরে সাপটা চলে গেল জানি না। ভদ্রলোক আমার হাতে আবার একটা চাপ দিলে সভয়ে নড়ে উঠলুম আমি।

নিন, চলুন এবার। লাইন ক্লিয়ার।

চলতে লাগলুম, কিন্তু কীভাবে সে কেবল আমিই জানি। অন্ধকার গাছগুলোর ভূতুড়ে জগৎটা পেরিয়ে যখন তামাটে চাঁদের আলোর আবার মেঠোপথে এসে পড়লুম, তখনও সমানে পা কাঁপছে। চৌধুরির টর্চ মধ্যে মধ্যে জ্বলছে-নিবছে, কিন্তু আমার ক্রমাগত মনে হচ্ছিল—যেসব ছোটো ছোটো অন্ধকারের টুকরোগুলোতে টর্চের আলো পড়ছে না, সাক্ষাৎ মৃত্যু কুন্ডলী পাকিয়ে অপেক্ষা করছে তাদের ভেতর। আমি পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় বিদ্যুতের মতো বিষাক্ত ফণা তুলবে তারা।

আরও আধ মাইল পথ নিঃশব্দে কাটল। আমার গলা অদ্ভুতভাবে শুকিয়ে গিয়েছিল, আমি কথা কইতে পারছিলুম না। চৌধুরি কী ভাবছিলেন জানি না। তামাটে চাঁদের পিঙ্গল আলোয় তাঁর একটা লম্বা ছায়া পড়েছিল পথের উপর। কেমন যেন মনে হচ্ছিল ও-ছায়াটা চৌধুরি নয়, তাঁর আগে আগে একটা ছায়ামূর্তি তাঁকে পথ দেখিয়ে এগিয়ে নিয়ে চলেছে।

হঠাৎ চৌধুরি বললেন, নিন, ওই আপনার পোস্ট অফিসের আলো দেখা যাচ্ছে, গঞ্জের কাছে এসে পড়েছি আমরা। নির্ভয়ে চলে যান এবার।

আপনি?

আমি বাঁ-দিকে যাব। ওই যে ওখানটায় একটা মিটমিটে আলো দেখছেন, ওই আমার আস্তানা। একটু হেসে বললেন, মডেল ফার্ম। আসুন-না বেড়াতে বেড়াতে কাল সকালের দিকে। চিনতে অসুবিধে হবে না, একটা ডোবা দেখতে পাবেন, তার ধারে তিনটে তাল গাছ। আসবেন কাল?

বললুম, আসব।

তাহলে এই টর্চটা রাখুন সঙ্গে, কাল সকালেই সঙ্গে করে আনবেন।

বললুম, টর্চের দরকার নেই, এমনিই যেতে পারব এখন। আর তা ছাড়া আমার চাইতে বেশি পথ যেতে হবে আপনাকে, ওটা আপনারই দরকার।

আমার না হলেও চলে। অভ্যেস হয়ে গেছে।

কেন জানি না ফস করে জিজ্ঞেস করে বসলুম, একটা কথা বলব? রাগ করবেন না?

রাগ করব কেন? বলুন।

আপনি সব জেনেশুনেও এই সন্ধে বেলা ওই সাপের জাঙালে গিয়ে ঢুকেছিলেন?

দরকার মশাই, দরকার। পিয়োর অ্যাণ্ড সিম্পল নেসেসিটি। চৌধুরি হাসলেন, কয়েকটা সাপের খোলস আনতে গিয়েছিলুম।

সাপের খোলস! পা থেকে মাথা পর্যন্ত আমার ঝাঁকুনি লাগল।

হ্যাঁ, হ্যাঁ। আজ কী তিথি জানেন? জানেন না? যা-ই হোক, এই তিথিতে সাপের খোলস কুড়িয়ে আনতে পারলে তা দিয়ে বাতের একটা অব্যর্থ ওষুধ নাকি তৈরি করা যায়। সেইটে পরীক্ষা করব বলেই খোলস খুঁজতে গিয়েছিলুম। একেবারে হতাশ হতে হয়নি, দুটো পেয়েছি। দেখবেন?

এতক্ষণে আমার মনে পড়ল, কাকার কাছে শুনেছি যে চৌধুরি জড়িবুটির ব্যাবসা করেন। আরও খেয়াল হল, চৌধুরির বাঁ-হাতে ছোটো একটা চটের থলি আছে বটে।

চৌধুরি থলিতে হাত ঢোকাবার উপক্রম করতেই আমি প্রায় আর্তনাদ করে উঠলুম।

না না, সাপের খোলস আমি দেখতে চাই না।

হা-হা করে মাঠ কাঁপিয়ে হেসে উঠলেন ভদ্রলোক। বললেন, যতই বিষধর সাপ হোক মশাই, তার খোলসে বিষ থাকে না। আচ্ছা, চললুম এখন; কাল সকালে তাহলে আসছেন আমার ওখানে, নেমন্তন্ন রইল।

বলে আর দাঁড়ালেন না, বাঁ-দিকের রাস্তা ধরে লম্বা লম্বা পায়ে এগিয়ে চললেন। আর আমার মনে হল তাঁর পাশে পাশে যেটা চলেছে ওটা তাঁর ছায়া নয়, আর একটা ছায়ামূর্তি সহযাত্রী বন্ধুর মতো তাঁর কাঁধে হাত দিয়ে এগিয়ে চলেছে।

নদীর ধারের সেই অদ্ভুত বিকাল, সন্ধ্যার অন্ধকারে সাপের জাঙাল আর ঘুরে-ফিরে সেই একটা লোক! সব মিলে একটা রহস্যময় তীব্র আকর্ষণ অনুভব করতে লাগলুম। একজন বিদেশি মানুষ, যথেষ্ট শিক্ষিত বলে মনে হয়, আট বছর ধরে উত্তরবাংলার এই নগণ্য পাড়াগাঁয়ে একটা আশ্চর্য জীবনযাপন করছে। আরও বিচিত্র এই যে, এখানকার কেউ আজ পর্যন্ত তাকে ভালো করে চেনে না। পলাতক আসামি নয়, তা হলে পুলিশের চোখ এড়াতে পারত না। পাগলা বলে একটা বদনাম আছে, কিন্তু যেখানে যেভাবেই দেখা যোক লোকটিকে অন্তত পাগল বলে আমার মনে হয়নি।

রহস্যের আকর্ষণে পরদিন যখন চৌধুরির মডেল ফার্মে গিয়ে পৌঁছেলুম, তখন বেলা গোটা আটেক হবে। চৌধুরি ডোবার ধারে সেই তিনটে তাল গাছের নীচে দাঁড়িয়ে আমারই জন্যে অপেক্ষা করছিলেন মনে হল। বড়ো বড়ো পা ফেলে এগিয়ে এলেন।

আসুন আসুন।

প্রথম দৃষ্টিতেই বুঝতে পারলুম কাকার কথাই ঠিক। এ আর যা-ই হোক, মডেল ফার্মিংয়ের সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নেই। টিনের ছোটো একটি বাড়ি, বিঘে কয়েক জমিতে সামান্য কিছু তরিতরকারি চোখে পড়ল। গুটি ছয়েক হাঁস চরছিল ডোবায়, কয়েকটা মুরগিকেও এদিক ওদিক ছোটাছুটি করতে দেখলুম।

যে-ঘরটায় ঢুকলুম সেইটেই বোধ হয় বসবার ঘর। একটা তক্তপোশের উপর মলিন ছেড়া মাদুর। মেটে দেওয়ালের দুটো কুলুঙ্গিতে কতকগুলি শিশি-বোতল-কৌটো, কিছু শেকড় বাকড়। বুঝতে পারলুম, মডেল ফার্মিংয়ে চৌধুরির অন্নসংস্থান হয় না— এইগুলোতেই তাঁর আসল জীবিকা।

বসুন, চা বলে আসি।

বললুম, চা আমি খেয়ে এসেছি, ব্যস্ত হবেন না।

আহা, খেয়ে তো আসবেনই, সে কি আর আমি জানিনে? কিন্তু আমার ফার্মের টাটকা মুরগির ডিমের অমলেট আর নিজের গোরুর দুধের মালাই চা—তার স্বাদ একটু আলাদা মনে হবে আপনার। বসুন বসুন।

ভেতরের দিকে চলে গেলেন চৌধুরি, আমি সেই তক্তপোশটায় বসে রইলুম। মেটেঘরের সোঁদা গন্ধের সঙ্গে সেই ওষুধপত্রগুলোর আঘ্রাণ যেন একটু একটু করে কুয়াশার মতো আমার মস্তিষ্কের ভেতরে ঘন হতে লাগল। বাইরে থেকে হাঁসের ডাক শুনতে পাচ্ছিলুম, খোলা দরজা দিয়ে প্রকান্ড একটা নীল ভ্রমর এসে ঘরের ভেতরে এক বার ঘুরপাক খেয়ে গেল।

চৌধুরি ফিরে এলেন, বসলেন তক্তপোশের আর এক কোনায়। বললেন, আমার মডেল ফার্ম দেখে খুব নিরাশ হয়েছেন, না?

কী জবাব দেব বুঝতে পারলুম না। একে আদৌ ফার্ম বলে কি না আমার জানা নেই, আর এইটেই মডেল হিসেবে মেনে নেওয়া উচিত কি না তাও আমার মনে সংশয় তুলল।

চৌধুরি হাসলেন, ইচ্ছে একটা সত্যিই ছিল সুকুমারবাবু। কিন্তু এই আট বছরে…

বাধা দিয়ে আশ্চর্য হয়ে বললুম, আমার নাম আপনি জানেন?

কলকাতার একজন প্রফেসার এসেছেন আমাদের পাড়াগাঁয়ে, নাম কে না জানে বলুন? আমার নামও নিশ্চয় শুনেছেন আপনি?

হাসিটা আবার ফুটে উঠল ভদ্রলোকের মুখে, পাগলা চৌধুরি, তাই না?

কুষ্ঠিত হয়ে জবাব দিলুম, তা-ই শুনেছি।

কিন্তু পাগলা আমার নাম নয়, ডাকনামও নয়। এখানকার লোকেই ওটা দিয়েছে আমাকে। আপনি নিশ্চয় চক্ষুলজ্জার খাতিরে আমাকে পাগলাবাবু বলে ডাকতে পারবেন না, আর বার বার চৌধুরিমশাই বলতেও বেয়াড়া লাগবে। আমার একটা জবরদস্ত পোশাকি নাম আছে— তুহিনাংশু দত্তচৌধুরি। সংক্ষেপে তুহিন বলতে পারেন।

তুহিনাংশু দত্তচৌধুরি! এই মুহূর্তে ঘরের মেটে দেওয়াল আর ওষুধপত্রের গন্ধে কুয়াশা জমে-ওঠা আমার মস্তিষ্কের ভেতরে বিদ্যুৎ বয়ে গেল। এই নাম একটু অসাধারণ, এ নাম এক বার কানে এলে সহজে ভোলা যায় না। তৎক্ষণাৎ আমার মনে পড়ল—

সেই কবিতার বইটি। সবসুদ্ধ পঞ্চাশ পৃষ্ঠার বেশি নয়। গাঢ় হলুদ রঙের মলাটে লাল টকটকে অক্ষরে লেখা খাঁচায় সকাল। কতগুলি তীক্ষ্ণধার আধুনিক কবিতা। বিখ্যাত সমালোচকের লেখা উচ্ছসিত মুখবন্ধ।

পড়ে মুগ্ধ হয়েছিলুম। আর শুধু বইটিই নয়, কিছু কিছু সাময়িক পত্রিকায় এই উজ্জ্বল প্রতিভার আবির্ভাব জানিয়েছিল সেদিন। ভিড়ের মাঝখানে মিশে যায়নি, নিজের পরিচয়েই মাথা তুলে দাঁড়িয়েছিল। তারপর হঠাৎ কবে হারিয়ে গেলেন তুহিনাংশু দত্তচৌধুরি। তাঁর আরও কিছু অনুরাগী পাঠকের সঙ্গে আমিও তাঁর কবিতার খোঁজ করেছিলুম দু-এক বছর পর। তারপরে যেমন হয়, খাঁচায় সকাল-এর কবিকে আমি ভুলে গিয়েছিলুম।

কিন্তু মনে পড়ল। প্রায় দশ বছরের ওপার থেকে মনে পড়ল আবার। সেই গাঢ় হলদে মলাটের উপর টকটকে লাল অক্ষরগুলো স্পষ্ট জ্বলে উঠল চোখের সামনে।

রুদ্ধস্বরে বললুম, কবি তুহিনাংশু দত্তচৌধুরি?

ঠিক দেখলুম কি না জানি না, পাগলা চৌধুরির মুখ সাদা হয়ে গেল এক বারের জন্যে। তারপরেই হেসে উঠলেন।

কী আশ্চর্য! সেসব ছেলেমানুষির কথা এখনও কারও মনে আছে নাকি? আমি তো কবে ভুলে গেছি।

ভুলে গেছেন? অথচ এত ভালো কবিতা লিখতেন আপনি!

ভালো কবিতা নয় মশাই, হাত থাকলেই বাঙালির ছেলে কবিতা লেখে, আমিও লিখতুম। তখন সবে কলেজ থেকে বেরিয়েছি, একটা ভদ্র রকমের চাকরিও জুটিয়েছিলুম। একজনের পাল্লায় পড়ে একটা কবিতার বইও ছেপে ফেলা গেল। তারপরেই দেখলুম এসব প্রলাপ বকবার কোনো মানেই হয় না, ভাবলুম একটা বড়ো কাজ কিছু করা যাক—সামথিং কনস্ট্রাকটিভ। একটা মডেল ফার্ম করলে কেমন হয়? ছুটিতে দার্জিলিং চলেছি, এই রেলস্টেশনটায় এসে হঠাৎ ট্রেন থেমে গেল—লাইনে গোলমাল হয়েছে কোথাও। কী মনে হল নেমে পড়লুম এখানে, চলে গেলুম গাঁয়ের ভেতরে। সেইদিনেই কয়েক বিঘে জমি বায়না করে ফেললুম অসম্ভব সস্তায়। সেই থেকে আছি এখানে, কবিতা লেখার চাইতে অনেক বড়ো কাজের খোঁজ পেয়েছি। এদিকের লোকে টোটকায় বিশ্বাস করে, আমিও কিছু আলোচনা করেছি ও নিয়ে। নেহাত ফেলনা জিনিস নয় মশাই। মডেল ফার্মিং-এ তেমন জুত করতে পারিনি, তবুও সব মিলিয়ে বেশ আছি। কী হবে মশাই বানানো কবিতা দিয়ে? কী মানে হয় তার?

এক নিশ্বাসে বলে গেলেন তুহিনাংশু। কিন্তু সম্পূর্ণ বিশ্বাস করতে পারলুম না আমি, কেমন মনে হল অনেক কথার ভিড়ে কয়েকটা ছোটো ছোটো কথা লুকিয়ে রইল। এমন অনেকগুলি প্রশ্ন রইল, যার জবাব তুহিনাংশু কোনোদিন দেবেন না।

আমার স্মৃতির মধ্যে কয়েকটা কবিতার লাইন জ্বলে উঠল হঠাৎ। আশ্চর্য ভালো লেগেছিল সেদিন। অন্যমনস্কর মতো আমি আবৃত্তি করলুম:

মণিকা, তোমার বাঘিনি-প্রেমের
আদিম অন্ধ রাতে
নোনা সাগরের ক্ষুব্ধ নিশান
তোলে সুন্দরবন
আমি ছুটে চলি হিংস্র কিরাত
খর বল্লম হাতে
সাপের মণিতে বিষাক্ত-নীল
আলোর সঞ্চরণ—

থামুন!

না, চিৎকার করলেন না তুহিনাংশু, প্রায় নিশব্দেই উচ্চারণ করলেন। কিন্তু তাঁর চোখে, তাঁর ঠোঁটে, তাঁর সমস্ত শরীরে যেন আর্তনাদ ফুটে উঠল একটা—যেন ঘর ফাটিয়ে একটা নীরব হাহাকার জেগে উঠল তাঁর। আতঙ্কে থেমে গেলুম আমি।

তুহিনাংশু আরও কিছু হয়তো বলতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু একটি মেয়ে এসে ঘরে ঢুকল। কালো, কদাকার, গায়ে ময়লা একটি শাড়ি-জড়ানো। একটি সেমিজ-ব্লাউজ পর্যন্ত নেই। কপাল পর্যন্ত ঘোমটা টানা, হাতে অমলেট আর জলের গ্লাস।

তুহিনাংশু বললেন, আমার স্ত্রী।

আমি বললুম, নমস্কার।

ভদ্রমহিলা ফিরেও তাকালেন না আমার দিকে। তক্তপোশের উপর আমার পাশেই প্লেট আর গ্লাস নামিয়ে রাখলেন। এক হাতে মাথার ঘোমটা আরও খানিকটা টেনে দিলেন, তারপর আবার যে-পথে এসেছিলেন সেই দিকেই অদৃশ্য হয়ে গেলেন।

তুহিনাংশু বললেন, কিছু মনে করবেন না মশাই। আমার স্ত্রী বোবা আর কালা, কানে শুনতে পায় না। চোখেও যে খুব ভালো দেখে তা নয়।

চকিত হয়ে বললুম, তাই নাকি?

সেই কালো ফ্রেমের চশমার ভেতর দিয়ে তুহিনাংশুর চোখ দুটো অস্বাভাবিক তীক্ষ্ণতায় জ্বলতে লাগল, এই তো ভালো মশাই—যাকে বলে আদর্শ স্ত্রী। লেখাপড়া জানে না, গরিবের মেয়ে, কানে শোনে না, কথা বলতে পারে না। আমি বিয়ে করেছি বলে চিরকৃতার্থ হয়ে আছে, কী করি না-করি কোনোদিন তা নিয়ে প্রশ্ন তোলে না। এর চাইতে সুখ কিছু আছে বলতে পারেন আপনি? যাক গে, ওটা খেয়ে ফেলুন আগে, ঠাণ্ডা হলে আর ভালো লাগবে না।

কথা খুঁজে না-পেয়ে আমি অমলেটটাতেই মন দিলুম। স্বাদ পাচ্ছি না, একটা অজানা অস্বস্তি মনটাকে যেন চেপে ধরেছে এসে। মেটে দেওয়াল আর ওষুধ-বিষুধের সেই গন্ধের কুয়াশা আবার যেন ঘন হয়ে আসছে আমার মস্তিষ্কের ভেতরে। আমি এক হারিয়ে-যাওয়া কবি আর এই পাগলা চৌধুরির মধ্যে একটা যোগসূত্র খুঁজে ফিরছি কোথাও। খুঁজছি সেই নির্জন বিকালের আলোয় বনতুলসী আর লেবুঘাসের গন্ধভরা নদীর ধারে, খুঁজছি কপালিনীর মন্দির থেকে আসবার সময় সেই থমথমে অন্ধকারভরা সাপের জাঙালের মাঝখানে।

সেই মহিলা দুটো ময়লা পেয়ালায় করে প্রায় সাদা রঙের চা নিয়ে এলেন। তাঁকে সম্ভাষণ করবার পন্ডশ্রম আমি আর করলুম না। শুধু দুখানি কালো কালো শীর্ণ হাতের ওপর আমার

চোখ পড়ল, যেখানে চারগাছা নীল কাচের চুড়ি ছাড়া আর কোনো আভরণই নেই।

যাই বলুন মশাই, আমি সুখী। তুহিনাংশু যেন স্বগতোক্তি করতে লাগলেন, কবিতা— কলকাতা! কোনো মানে হয় না মশাই। তার চাইতে এই ভালো, অনেক ভালো। ভাবতে পারেন আট বছরের মধ্যে আমার নামে কোনো চিঠি আসেনি, আমি খবরের কাগজ দেখিনি? টোটকা দর্পণ আর ভেষজ-রহস্য ছাড়া কোনো বই পড়িনি? সুখ! সুখের অর্থ যে কী, কেউ বলতে পারে? বেশ আছি আমি, কারও কাছে এতটুকু নালিশ নেই আমার।

কোনো নালিশ নেই? খাঁচায় সকাল কবিতার আরও কয়েকটা পঙক্তি আমার মনে এল :

এক মুঠো আগুন দাও তোমার হৃদয় থেকে
হে লোহিতাক্ষ—হে জবাকুসুমসংকাশ, হে হিরণ্যপাণি!
খাঁচার এই লোহার শলাকাগুলো পুড়ে যাক
গলে যাক—চিরতরে হোক নিশ্চিহ্ন–

চা ঠাণ্ডা হয়ে গেল যে মশাই!

হ্যাঁ, খাচ্ছি।

মালাই চা-ই বটে। চায়ের স্বাদ-গন্ধ পর্যন্ত কিছুই পাওয়া গেল না তাতে। সন্দেহ নেই তুহিনাংশু দত্তচৌধুরি সত্যিকারের সুখের সন্ধান পেয়েছেন এখানে, জীবন থেকে শহরকে চিরদিনের মতোই মুছে দিয়েছেন। নইলে এ চা বরদাস্ত করা অসম্ভব হত।

পকেট থেকে বিড়ি বের করে তুহিনাংশু জিজ্ঞেস করলেন, চলে?

না, মাপ করবেন।

ওঃ, আপনার বুঝি সিগারেট? আমাদের পাড়াগাঁ মশাই, বিড়ি নইলে ঠিক জুত হয় না। আচ্ছা, চলুন এবার আমার ফার্ম একটু দেখিয়ে আনি আপনাকে। অবশ্য দেখবার মতো কিছুই নেই, সামান্য কিছু তরিতরকারি কেবল আছে। বরং শীতকাল এলে…

বলতে বলতে আমরা বেরিয়ে এলুম ঘর থেকে। মাথার ওপর নীল উজ্জ্বল আকাশ, দিগন্তে পাহাড়ের রেখা। শস্যহীন মাঠ পড়ে আছে যতদূর চোখ যায়। সেই নদীটার এক ফালি জল দেখতে পেলুম। এখান থেকেও সেই শিমুল গাছটা দেখা গেল যেখানে আমি মাছ ধরতে গিয়েছিলুম, আর যেখানে প্রথম হঠাৎ যেন বিকালের আলোর ভেতর থেকে ফুটে উঠেছিলেন চৌধুরি।

আমি ওঁর মুখের দিকে চাইলুম। রগের কাছে দু-তিনটে চুল চকচক করছে রোদে, চোখের কোলে কালির রেখা। আজ দিনের বেলায় এই রোদের ভেতরে আমার মনে হল, বয়েসের তুলনায় ভদ্রলোক যেন অনেক বেশি বুড়িয়ে গেছেন।

সামনে একটা প্রকান্ড গ্রানাইট পাথরের চাঙড় পড়ে ছিল। হঠাৎ সেই দিকে এগিয়ে গেলেন তুহিনাংশু।

এই পাথরটা দেখছেন?

দেখছি।

কী মনে হয় আপনার?

কী আবার মনে হবে?

খুব-একটা বিসদৃশ ব্যাপার বলে বোধ হয় না? কোথাও কিছু নেই, হঠাৎ যেন রাস্তাজুড়ে একটা অর্থহীন বাধা। বলতে বলতে একটা উগ্র বন্য আলো তাঁর দু-চোখে ঝলকে উঠল। জানেন, এই আট বছর ধরে এটাকে রোজ আমি ঠেলে সরাতে চেষ্টা করি, অথচ একটুও নড়ে না।

আমি বললুম, কী আশ্চর্য, খামোখা ওটাকে সরাবার জন্যে কেন পন্ডশ্রম করবেন? আর অত বড়ো একটা পাথরকে মাটি থেকে নড়ানো কি কোনো মানুষের পক্ষেই সম্ভব?

কী সম্ভব তাহলে বলতে পারেন? চৌধুরির স্বরে হঠাৎ যেন একরাশ আগুন ঝরে পড়ল, চিরকাল কি এমনি করে একটা পাথরের তলায় সব চাপা পড়ে থাকবে? কবিতা হারিয়ে যাবে? মণিকা হারিয়ে যাবে? যেখানেই যাব এই পাথরের হাত থেকে আমি মুক্তি পাব না? আপনি বিশ্বাস করুন, এইবারে এটা সরবেই, তার সময় এসেছে।

বলতে বলতেই চৌধুরি পাথরটার দিকে এগিয়ে গেলেন। প্রাণপণে ঠেলতে লাগলেন সেটাকে। লোকটা সত্যিই পাগল কি না বুঝতে চেষ্টা করছি, তৎক্ষণাৎ একটা তীব্র চিৎকার আমার কানে এল।

অমন জান্তব, অমন বুকফাটা চিৎকার জীবনে আমি কখনো শুনিনি। বিদ্যুদবেগে ফিরে তাকালুম। বাইরে এসে দাঁড়িয়েছে তুহিনাংশুর সেই কালো কুৎসিত বোবা কালা স্ত্রী। মাথার ঘোমটা খসে পড়েছে, চোখের তারা দুটো বিস্ফারিত, একরাশ রুক্ষ চুল উড়ছে ডাকিনীর মতো। তার মুখের চেহারা কল্পনা করা যায় না, যেন মৃত্যু-বিভীষিকা দেখতে পাচ্ছে সামনে।

আঁ-গাঁ-গাঁ-গাঁ। আবার একটা জৈব আর্তনাদ বেরুল তার গলা দিয়ে।

তখন তুহিনাংশু সোজা হয়ে আমার দিকে মুখ ফেরালেন। পাথর ঠেলবার পরিশ্রমে বুকটা তখনও যেন ঢেউয়ের মতো ওঠা-পড়া করছে ভদ্রলোকের। ঝড়ের মতো নিশ্বাস ফেলতে ফেলতে হেসে বললেন, ভয় পায় মশাই—পাথরটা ঠেলতে গেলেই ভয় পায়। কিন্তু এটা বুঝতে পারে না যে, ওটা না-সরিয়ে দেওয়া পর্যন্ত আমি মুক্তি পাব না।

চৌধুরির মুখের দিকে তাকিয়ে আমার পা দুটো মাটির মধ্যে গেঁথে গেল।

অনেকগুলো কথার উত্তর একসঙ্গে স্পষ্ট হয়ে গেছে তখন। আত্মহত্যা করব না—এই প্রতিজ্ঞা করে তিলে তিলে আত্মহত্যার সাধনা কি এমনিভাবেই করতে হয়? এই বোবা-কালা কুরূপা স্ত্রী, এই জীবন, অকারণে বিকালের নদী পার হয়ে সন্ধ্যার বনতুলসী আর লেবুঘাসের জঙ্গলে হারিয়ে যাওয়ার চেষ্টা, তার অন্ধকারের ভেতরে সাপের খোলস খোঁজার কী অর্থ থাকতে পারে আর? খাঁচার শলা তো নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়নি, তিরের ফলা হয়ে পাখির বুকে বিঁধেছে।

আমি তুহিনাংশু দত্তচৌধুরির আত্মহত্যা দেখতে পাচ্ছি। পাথর ঠেলার পরিশ্রমে তখনও ঝড়ের মতো শ্বাস পড়ছে তাঁর, আর আর ঠোঁটের দু-পাশ দিয়ে দুটো সরু রক্তের ধারা রোদের আলোয় জ্বলে উঠেছে।

চৌধুরির স্ত্রী পাগলের মতো ছুটে এল তাঁর দিকে। কিন্তু আমি দেখলুম তাঁর পাশে সেই ছায়াটা স্থির দাঁড়িয়ে আছে—সেই প্রেতলোকের সহচর, যে শেষ মুহূর্তের আগে তাঁর সঙ্গ ছাড়বে না।

Anuprerona
Anupreronahttps://www.anuperona.com
Read your favourite literature free forever on our blogging platform.
RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here


Most Popular

Recent Comments