Saturday, April 20, 2024
Homeকিশোর গল্পরাজার অসুখ - সুকুমার রায়

রাজার অসুখ – সুকুমার রায়

'রাজার অসুখ' সুকুমার রায়

এক ছিল রাজা। রাজার ভারি অসুখ। ডাক্তার বদ্যি হাকিম কবিরাজ সব দলে দলে আসে আর দলে দলে ফিরে যায়। অসুখটা যে কী তা কেউ বলতে পারে না, অসুখ সারাতেও পারে না।

সারাবে কী করে? অসুখ তো আর সত্যিকারের নয়। রাজা মশাই কেবলই বলেন, ‘ভারি অসুখ’, কিন্তু কোথায় যে অসুখ তা আর কেউ খুঁজে পায় না। কত রকমের কত ওষুধ রাজা মশাই খেয়ে দেখলেন, কিছুতেই কিছু হল না। মাথায় বরফ দেওয়া হল, পেটে সেঁক দেওয়া হ’ল পায়ে জোঁক লাগান হ’ল, মাদুলি বাধা হ’ল, কিন্তু অসুখের কোন কিনারাই হ’ল না।

তখন রাজামশাই গেলেন ক্ষেপে। তিনি বললেন, “দূর করে দাও এই অপদার্থগুলোকে, আর ওদের পুঁথিপত্র যা আছে সব কিছু কেড়ে নিয়ে জ্বালিয়ে দাও।” এমনি করে চিকিৎসকেরা বিদায় হলেন। ভয়ে আর কেউ রাজার বাড়ির দিকেও যায় না। তখন সকলের ভাবনা হ’ল, তাই তো, শেষটায় কী রাজা মশাই বিনা চিকিৎসায় মারা যাবেন?

এমন সময় কোথা থেকে এক সন্ন্যাসী এসে বলল, “অসুখ সারাবার উপায় আমি জানি, কিন্তু সে ভারি শক্ত। তোমরা কী সব করতে পারবে?” মন্ত্রী, কোটাল, সেনাপতি, পাত্রমিত্র সবাই বলল— “কেন পারব না? খুব পারব। জান্‌ দিতে হয় জান্‌ দেব!” তখন সন্ন্যাসী বলল, “প্রথমে এমন এক লোক খুঁজে আন যার মনে কোন ভাবনা নেই, যার মুখে হাসি লেগেই আছে, যে সব সময়ে, সব অবস্থাতেই খুশি থাকে।” সবাই বলল, “তারপর?” সন্ন্যাসী বলল, “তারপর সেই লোকের গায়ের জামা যদি রাজা মশাই একটা দিন পরে থাকেন, আর সেই লোকের তোষকে যদি এক রাত্রি ঘুমিয়ে থাকেন, তাহলেই সব অসুখ সেরে উঠবে।” সবাই শুনে বলল, “এ তো চমৎকার কথা!”

তাড়াতাড়ি রাজা মশাইয়ের কাছে খবর গেল। তিনি শুনে বললেন, “আরে, এই সহজ উপায়টা থাকতে এতদিন সবাই মিলে করছিল কী? এইটা কারো মাথায় আসেনি? যাও, এখনি খোঁজ করে সেই হাসি-ওয়ালা লোকটার জামা আর তোষক নিয়ে এস—।”

চারিদিকে লোক ছুটল, রাজ্যময় ‘খোঁজ-খোঁজ’ রব পড়ে গেল, কিন্তু সে লোকের আর সন্ধান পাওয়া যায় না। যে যায় সেই ফিরে আসে আর বলে, “যার দুঃখ নেই, ভাবনা নেই, সর্বদাই হাসিমুখ, সর্বদাই খুশি মেজাজ, কই, তেমন লোকের তো দেখা পাওয়া গেল না!” সবার মুখে এই একই কথা। তখন মন্ত্রীমশাই রেগে বললেন, “এদের দিয়ে কী কোন কাজ হয়? এ মূর্খেরা খুঁজতেই জানে না।” এই বলে তিনি নিজেই বেরোলেন সে অজানা লোকের খোঁজ করতে।

বাজারের কাছে মস্ত এক দালানের সামনে তিনি দেখলেন, মেলা লোক জমে গিয়েছে আর এক বুড়ো শেঠজি হাসিমুখে তাদের চাল, ডাল, পয়সা আর কাপড় দান করছে। মন্ত্রী ভাবলেন বাঃ এই লোকটাকে তো বেশ হাসি-খুশি দেখাচ্ছে, ওর তো অনেক টাকা পয়সাও আছে দেখছি। তাহলে আর ওর দুঃখই বা কিসের, ভাবনাই বা কিসের? ওরই একটা জামা আর তোষক চেয়ে নেওয়া যাক।

মন্ত্রীমশাই এর রকম ভাবছেন, ঠিক সেই সময়ে একটা ভিখারী করেছে কি, ভিক্ষা নিয়ে শেঠজিকে সেলাম না করেই চলে যাচ্ছে। আর শেঠজির রাগ দেখে কে! তিনি ভিখারীকে গাল দিয়ে, জুতো মেরে, তার ভিক্ষা কেড়ে তাকে তাড়িয়ে দিলেন। ব্যাপার দেখে মন্ত্রীমশাই মাথা নেড়ে সেখান থেকে সরে পড়লেন।

তারপর নদীর ধারে এক জায়গায় তিনি দেখলেন একটা লোক ভারি মজার ভঙ্গি করে নানারকম হাসির গান করছে আর তাই শুনে চারদিকের লোকেরা হো হো করে হাসছে। মানুষ যে এত রকম হাসির ভঙ্গি করতে পারে তা মন্ত্রীমশায়ের জানা ছিল না। তিনি লোকটার গান শুনে আর তামাসা দেখে একেবারে হেসে অস্থির হয়ে উঠলেন আর ভাবলেন, এমন আমুদে লোকটা থাকতে কিনা আমার লোকগুলো সব হতাশ হয়ে ফিরে যায়! তিনি পাশের একটি লোককে জিজ্ঞাসা করলেন্‌; “এই লোকটা কে হে?” সে বলল, “ও হচ্ছে গোব্‌রা মাতাল। এখন দেখছেন কেমন খোস মেজাজে আছে, কিন্তু সন্ধ্যা হলেই ওর মাতলামি, চেঁচামেচি আর উৎপাত শুরু হয়। ওর ভয়ে পাড়ার লোক তিষ্ঠোতে পারে না।” শুনে মন্ত্রীমশাই গম্ভীর হয়ে আবার চললেন সেই লোকটির সন্ধানে।

সারাদিন খুঁজে খুঁজে মন্ত্রীমশাই সন্ধ্যার সময় বাড়ি ফিরলেন, কিন্তু সে লোকের সন্ধান কোথাও মিলল না। এমনি করে দিনের পর দিন তিনি খোঁজ করেন আর দিনের পর দিন হতাশ হয়ে বাড়ি ফেরেন। তাঁর উৎসাহ প্রায় ফুরিয়ে এসেছে, এমন সময়ে হঠাৎ এক গাছতলায় তিনি একটা পাগলা গোছের বুড়ো লোকের দেখা পেলেন।

লোকটার মাথাভরা চুল, মুখভরা দাড়ি, সমস্ত শরীর যেন শুকিয়ে দড়ি হয়ে গিয়েছে। সে একা একা বসে বসে আপন মনে কেবলই হাসছে, কেবলই হাসছে। মন্ত্রী বললেন, “তুমি এত হাসছ কেন?” সে বলল, “হাসব না? পৃথিবী বন্‌বন্‌ করে ঘুরছে, গাছের পাতা সরে সরে যাচ্ছে, মাঠে মাঠে ঘাস গজাচ্ছে, রোদ উঠছে, বৃষ্টি পড়ছে, পাখিরা গাছে এসে বসছে, আবার উড়ে যাচ্ছে। এসব চোখের সামনে দেখছি আর হাসি পাচ্ছে।”

মন্ত্রী বললেন, “তা না হয় বুঝলাম, কিন্তু শুধু বসে বসে হাসলে তো আর মানুষের দিন চলে না। তোমার কী আর কোন কাজকর্ম নেই?”

ফকির বলল, “তা কেন থাকবে না? সকাল বেলায় নদীতে যাই, সেখানে স্নান-টান সেরে, লোকজনের যাওয়া-আসা কথাবার্তা এই সব তামাসা দেখে, আবার গাছতলায় এসে বসি। তারপর, যেদিন খাওয়া জোটে খাই, যেদিন জোটে না খাই না। যখন বেড়াতে ইচ্ছা হয় বেড়াই, যখন ঘুম পায় তখন ঘুমাই। কোনও ভাবনা চিন্তা, হট্টগোল কিছুই নেই, ভারি মজা!”

মন্ত্রী খানিক মাথা চুলকিয়ে বললেন, “যেদিন খাওয়া পাও না সেদিন কি কর?”

ফকির বলল, “সেদিন তো কোন ল্যাঠাই নেই! চুপচাপ পড়ে থাকি আর এই সব তামাসা দেখি। বরং যেদিন খাওয়া হয়, সেদিনই হাঙ্গামা বেশি। ভাত মাখরে, গ্রাস তোলরে, মুখের মধ্যে ঢোকাওরে, চিবোওরে, গেলোরে, —তারপর জল খাওরে, আঁচাওরে, হাত মুখ মোছরে! কত রকম কাণ্ড!”

মন্ত্রী দেখলেন, এতদিনে ঠিক মতন লোক পাওয়া গিয়েছে। তিনি বললেন, “তোমার গায়ের এক-আধখানা জামা দিতে পার? তার জন্য তুমি যত ইচ্ছা দাম নাও, আমরা দিতে প্রস্তুত আছি।” শুনে লোকটা হো হো করে হাসতে লাগল, বলল, “আমার আবার জামা। এই সেদিন একটা লোক একটা শাল দিয়েছিল, তাও তো ছাই ভিখারীকে দিয়ে ফেললাম। জামা-টামার ধারই ধারি না কোনদিন।”

মন্ত্রী বললেন, “তাহলে তো মহা মুশকিল! যদি বা একটা লোক পাওয়া গেল, তারও আবার জামা নেই। আচ্ছা, তোমার বিছানার তোষকখানা দিতে পার? কত দাম চাও বল, আমরা টাকা ঢেলে দিচ্ছি।” এবারে ফকির হাসতে হাসতে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। তার হাসি আর থামেই না। অনেকক্ষণ হেসে তারপর সে বলল, “চল্লিশ বছর বিছানাই চোখে দেখলাম না, তার আবার তোষক আর গদি!”

মন্ত্রীমশাই বড় বড় চোখ করে বললেন, “জামাও গায়ে দাও না, লেপ-কম্বল-বিছানাও সঙ্গে রাখ না, তোমার কি অসুখও করে না ছাই?”

ফকির বলল, “অসুখ আবার কি? অসুখ-টসুখ ওসব আমি বিশ্বাস করি না। যারা কেবল অসুখ-অসুখ ভাবে, তাদেরই খালি অসুখ করে।” এই বলে ফকির আবার গাছে হেলান দিয়ে ঠ্যাং মেলে খুব হাসতে লাগল।

মন্ত্রীমশাই হতাশ হয়ে বাড়ি ফিরলেন। রাজার কাছে খবর গেল। রাজা মন্ত্রীকে ডেকে পাঠালেন, তার কাছে সব কথা শুনলেন, শুনে মন্ত্রীমশাইকে বিদায় দিলেন।

আবার সবাই ভাবতে বসল, এখন উপায় কী হবে? চিকিৎসাও হল না, অনেক কষ্টে যা একটা উপায় পাওয়া গেল, সেটাও গেল ফস্‌কে! সবাই বসে বসে এ ওর মুখ চায় দীর্ঘশ্বাস ফেলে, আর বলে— “নাঃ, আর তো বাঁচাবার উপায় দেখছি না।” ওদিকে রাজামশাই ভাবতে বসেছেন, “আমি থাকি রাজার হালে, ভাল ভাল জিনিস খাই, কোন কিছুর অভাব নেই, লোকেরা সব সময়ে তোয়াজ করছেই— আমার হল অসুখ! আর ঐ হতভাগা ফকির, যার চাল-চুলো কিচ্ছু নেই, জামা নেই, কম্বল নেই, গাছতলায় পড়ে থাকে, যা পায় তাই খায়— সে কিনা বলে অসুখ-টসুখ কিছু মানেই না! সে ফকির হয়ে অসুখ উড়িয়ে দিতে পারল, আর আমি রাজা হয়ে পারব না?”

তার পরদিনই রাজা ঘুম থেকে উঠে পাত্র মিত্র সবাইকে ডেকে বললেন, “যা হতভাগা মূখ্যুগুলো সব, সভায় বসগে যা! তোরা কেউ কিছু করতে পারলি না, এখন এই দেখ আমার অসুখ আমি নিজেই সারিয়ে দিয়েছি। আজ থেকে আবার সভায় গিয়ে বসব। আর যে টুঁ শব্দটি করবে তার মাথা উড়িয়ে দেব।”

Anuprerona
Anupreronahttps://www.anuperona.com
Read your favourite literature free forever on our blogging platform.
RELATED ARTICLES

Most Popular

Recent Comments