নীল অপরাজিতা – ১
তিনি ট্রেন থেকে নামলেন দুপুরবেলা।
দুপুরবেলা বোঝার কোনো উপায় নেই। চারদিক অন্ধকার হয়ে আছে। আকাশ মেঘে মেঘে কালো। বৃষ্টি এখনো নামে নি, তবে যে কোনো মুহূর্তে নামবে বলে মনে হয়। আষাঢ় মাসে বৃষ্টিবাদলার কোনো ঠিক নেই। এই বৃষ্টি, এই রোদ। ময়মনসিংহ থেকে যখন ট্রেন ছাড়ল তখন আকাশ ছিল পরিষ্কার। জানালার ওপাশে ঝকঝকে রোদ। তিন ঘন্টা ট্রেনে কাটিয়ে ময়মনসিংহ থেকে এসেছেন ঠাকরোকোনা নামের স্টেশনে। কত দূর হবে, চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ মাইল! এই অল্প দূরেই আকাশের এমন অবস্থা? না-কি মেঘে মেঘে ময়মনসিংহ শহরও এখন ঢেকে গেছে?
ট্রেন ছেড়ে যাবার পর তাঁর মনে হল, ঠিক স্টেশনে নেমেছেন তো? স্টেশনের নাম পড়েন নি। পাশে বসা এক ভদ্রলোক বললেন, ‘এটাই ঠাকরোকোনা–-নামেন নামেন।’ তিনিই অতি ব্যস্ত হয়ে জানালা দিয়ে সুটকেস, বেতের ঝুড়ি, হ্যান্ডব্যাগ নামিয়ে দিলেন। তাঁর ব্যস্ততার কারণ অবশ্যি সঙ্গে সঙ্গে বোঝা গেল—এখানে ট্রেন এক মিনিটের জন্যে থামে। জিনিসপত্র সব নামানোর আগেই ট্রেন ছেড়ে দিল। দু’টি পানির বোতল ছিল, একটি নামানো হল। অন্যটি রয়ে গেল সিটের নিচে।
‘স্লামালিকুম। আপনি কি শওকত সাহেব?’
তিনি জবাব দিলেন না। অসম্ভব রোগা এবং আষাঢ় মাসের গরমে কালো কোট পরা লোকটির দিকে তাকিয়ে হাসলেন।
‘স্যার, আমার নাম মোফাজ্জল করিম। আমি ময়নাতলা হাই স্কুলের অ্যাসিসটেন্ট হেডমাস্টার।’
মোফাজ্জল করিম সাহেব দুটো হাত বাড়িয়ে দিলেন। মনে হচ্ছে হ্যান্ডশেক জাতীয় প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে যেতে চান। মফস্বলের লোকজন হ্যান্ডশেক করার জন্যে দুটো হাত বাড়ায়। এরা যা করে তাকে পাশ্চাত্যের হ্যান্ডশেক বলা যাবে না। প্রক্রিয়াটির নাম খুব সম্ভব মোসাহাবা। যার দ্বিতীয় অংশে আছে কোলাকুলি। এই মুহূর্তে লোকটিকে জড়িয়ে ধরার কোনোরকম ইচ্ছা তাঁর হচ্ছে না। তিনি এমন ভাব করলেন যেন বাড়িয়ে দেয়া হাত দেখতে পান নি। মোফাজ্জল করিম সাহেব তাতে খানিকটা অস্বস্তি ঠিকই বোধ করবেন। তবে মফস্বলের লোকরা এইসব অস্বস্তি দ্রুত কাটিয়ে উঠতে পারে।
‘করিম সাহেব আপনি ভালো আছেন তো?’
‘জ্বি স্যার ভালো। খুব ভালো। আপনার কোনো তকলিফ হয় নাই তো? আমি একবার ভেবেছিলাম ময়মনসিংহ থেকে আপনাকে নিয়ে আসব। ঘরে লোকজন নাই। আমার স্ত্রী গত হয়েছেন দুই বৎসর আগে ভাদ্র মাসে। সংসার দেখার কেউ নাই। স্যার আপনার মালপত্র সব এইখানে?’
‘জ্বি। তবে একটা পানির বোতল সিটের নিচে রয়ে গেছে।’
‘এ্যাঁ কী সর্বনাশ।’
মোফাজ্জল করিম দ্রুত স্টেশনের দিকে রওনা হলেন। তাঁর ভঙ্গি দেখে মনে হল পানির বোতল না, এক বাক্স হীরে-জহরত সিটের নিচে রয়ে গেছে। শওকত সাহেব দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললেন। পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে এই লোকটা যন্ত্রণা দেবে। প্রচুর কথা বলবে। কারণে-অকারণে এসে সময় নষ্ট করবে। তিনি কুড়ি দিন নিরিবিলিতে থেকে যে কাজটা করতে যাচ্ছেন তা করতে দেবে না। পানির বোতল ট্রেনে রয়ে গেছে শুনে লোকটি স্টেশনের দিকে ছুটে গিয়ে প্রমাণ করল, সে বেআক্কেল ধরনের এবং অতিরিক্ত উৎসাহী। দু’টা জিনিসই খুব বিপজ্জনক।
মোফাজ্জল করিমকে আসতে দেখা যাচ্ছে। শওকত সাহেব আগে লক্ষ করেন নি, এখন লক্ষ করলেন লোকটির বগলে ছাতা। ডান বগলে ছাতা, সেই হিসেবে ডান হাতটা অকেজো থাকার কথা, দেখা যাচ্ছে লোকটার ডান হাত খুবই সক্রিয়। ছাতাটা যেন শরীরেরই অঙ্গ।
‘স্যার ব্যবস্থা করে আসলাম।’
‘কি ব্যবস্থা করে আসলেন?’
‘স্টেশন মাস্টারকে বলেছি—সে টেলিগ্রাফ পাঠিয়ে দিয়েছে বারহাট্টা। বারহাট্টা স্টেশনে আমার ছাত্র আছে। সে বোতল পাঠিয়ে দিবে।’
‘এত ঝামেলার কোনো দরকার ছিল না।’
‘ঝামেলা কিসের স্যার? কোনো ঝামেলা না।’
‘আপনি আমাকে স্যার-স্যার করছেন কেন?’
মোফাজ্জল করিম বিস্মিত গলায় বললেন, ‘স্যার বলব না? আপনি কী বলেন? এত বড় একজন মানুষ আপনি, এত বড় লেখক। অজ পাড়াগাঁয়ে এসেছেন। আমাদের পরম সৌভাগ্য। আমি একবার ভেবেছিলাম স্কুল ছুটি দিয়ে সব ছাত্রদের নিয়ে আসি।’
শওকত সাহেব আঁতকে উঠলেন। কী ভয়াবহ কথা! এই বিপজ্জনক মানুষটিই কি তাঁর কেয়ারটেকার হিসাবে থাকবে? মনে হচ্ছে প্রথম দিনেই জীবন অতিষ্ঠ করে তুলবে।
‘স্যার, স্টেশন মাস্টার সাহেব এককাপ চা খাওয়ার দাওয়াত দিয়েছেন। চলেন যাই।’
‘চা এখন খেতে ইচ্ছা করছে না।
‘একটা চুমুক দিবেন। না হলে মনে কষ্ট পাবে। এরা বিশিষ্ট লোক তো কখনো দেখে না। আপনার নামও শোনে নাই। বই পড়া তো দূরের কথা। দোষ নাই কিছু। অজ পাড়াগাঁ জায়গা। স্যার আসেন। জিনিসপত্র নিয়ে চিন্তা করবেন না। লোক লাগিয়ে দিয়েছি। এরা নৌকায় নিয়ে তুলে ফেলবে।’
‘নৌকায় যেতে হয় না-কি?’
‘জ্বি। বেশি সময় লাগে না। দেড় থেকে দু’ঘন্টা। বাতাস আছে। পাল তুলে দিব—শাঁ শাঁ করে চলে যাব। স্যার চলেন। চা-টা খেয়ে আসি।’
শওকত সাহেব বিরক্ত মুখে রওনা হলেন।
মোটাসোটা থলথলে ধরনের স্টেশন মাস্টার সাহেব বিনয়ে প্রায় গলে পড়ে যাচ্ছেন। তাঁর চোখে দেবদর্শনজনিত আনন্দের আভা। তিনি তাঁর চেয়ার শওকত সাহেবের জন্যে ছেড়ে দিয়ে নিজে একটা টুলে বসেছেন। অন্য একটা টুলে চায়ের কাপ, একটা পিরিচে দুটো নিমকি। অন্য আরেকটা পিরিচে বানানো পান, পানের পাশে একটা সিগারেট এবং ম্যাচ। আয়োজনের অভাব নেই।
কিছু না বললে খারাপ দেখা যায় বলেই শওকত সাহেব বললেন, ‘কি ভালো?’
‘জ্বি স্যার ভালো। একটু দোয়া রাখবেন। জঙ্গলের মধ্যে পড়ে আছি আজ নয় বছর। বদলির জন্যে চেষ্টা কম করি নাই। অনেক ধরাধরি করেছি—লাভ হয় নাই। মফস্বল থেকে চিঠি গেলে এরা স্যার ফেলে দেয়। খাম খুলে পড়েও না।’
প্রসঙ্গ ঘুরাবার জন্য শওকত সাহেব বললেন, ‘স্টেশনঘরের সঙ্গে লাগোয়া বিরাট একটা গাছ দেখলাম। কী গাছ এটা?’
‘এটা স্যার শিরীষ গাছ। গত বৈশাখ মাসে ঐ গাছের ডাল ভেঙে স্টেশনঘরের উপরে পড়ল। ঘর জখম হয়ে গেল। বৃষ্টিবাদলা হলে ঘরে পানি ঢুকে। রিপেয়ার করার জন্য এই পর্যন্ত দু’টা চিঠি লিখেছি—কোনো লাভ নাই। ওদের স্যার মফস্বলের জন্য আলাদা ফাইল আছে। চিঠি গেলেই ঐ ফাইলে রেখে দেয়। খুলেও পড়ে না। স্যার, সিগারেটটা ধরান, আপনার জন্য আনিয়েছি।’
শওকত সাহেব সিগারেট ধরালেন। স্টেশন মাস্টার বললেন, ‘গোল্ড লীফ ছাড়া ভালো কিছু পাওয়া যায় না। বেনসন আনতে পাঠিয়েছিলাম। পায় নাই। মাঝে-মধ্যে পাওয়া যায়। দামী সিগারেট খাওয়ার লোক কোথায়? সবাই হতদরিদ্র।’
শওকত সাহেব দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে ভাবলেন, এই অঞ্চলের সবাই বেশি কথা বলে। যার সঙ্গে দেখা হচ্ছে সেই কথা বলছে। অনবরত কথা বলছে। ভাগ্যিস মোফাজ্জল করিম সাহেব নেই। তিনি নৌকার খোঁজ-খবরে গেছেন। তিনি থাকলে দু’জনের মধ্যে কথা বলার কম্পিটিশন শুরু হয়ে যেত। মোফাজ্জল করিম সাহেব সম্ভবত জিততেন। মাস্টারদের সঙ্গে কথা বলায় কেউ পারে না।
‘স্যার কত দিন থাকবেন এখানে?’
‘ঠিক করি নি। পনেরো-বিশ দিন থাকব।’
‘শুনলাম, নির্জনে একটা লেখা শেষ করার জন্য এসেছেন?
শওকত সাহেব দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললেন। নির্জনতার যে নমুনা শুরু হয়েছে—খুব বেশি ভরসা করতে পারছেন না।
‘স্যার পান খেলেন না?’
‘পান আমি খাই না। থ্যাংক ইউ। আমি বাইরে একটু দাঁড়াই।’
‘বাইরে দাঁড়ায়ে কী দেখবেন স্যার, কিছুই দেখার নাই। শীতকালে তাও একটু হাঁটাহাঁটি করা যায়—বর্ষাকালে অসম্ভব। কাঁচা রাস্তা, হাঁটু পর্যন্ত কাদা। দিন-রাত বৃষ্টি। খাওয়া-খাদ্য কিছু নাই। ইলিশ মাছ এক জিনিস-দুই বছরে চোখে দেখি নাই। তরকারির মধ্যে আছে ডাঁটা, পুঁইশাক আর ঝিঙ্গা। এই তিন জিনিস কত খাওয়া যায় বলেন? পটল এক জিনিস কেউ চোখেও দেখে নাই। অথচ শহর-বন্দরে এই জিনিস খাওয়ার লোক নাই।’
শওকত সাহেব স্টেশনঘর থেকে বের হয়ে এলেন আর তখনি ঝেঁপে বৃষ্টি এল। শিরীষ গাছের ঘন পাতায় বৃষ্টি আটকে যাচ্ছে। কতক্ষণ এ রকম থাকবে কে জানে। শওকত সাহেব মুগ্ধ হয়ে গাছ, বৃষ্টি এবং দূরের মাঠ দেখতে লাগলেন। সামনের অনেকখানি ফাঁকা। দৃষ্টি অনেক দূর পর্যন্ত ছড়িয়ে দেয়া যায়। শহরের সঙ্গে গ্রামের এই রোধহয় তফাৎ। শহরে দৃষ্টি আটকে যায়। গ্রামে আটকায় না।
ছাতা মাথায় মোফাজ্জল করিমকে হন হন করে আসতে দেখা যাচ্ছে। পায়ের জুতা জোড়া খুলে তিনি হাতে নিয়ে নিয়েছেন। প্যান্ট ভাঁজ করে হাঁটু পর্যন্ত তুলে দিয়েছেন। শওকত সাহেব আঁতকে উঠলেন, তাকেও কি এইভাবে যেতে হবে? বৃষ্টির জোর খুব বেড়েছে। শিরীষ গাছের একটিমাত্র ডালে ছ’সাতটা কাক বসে-বসে ভিজছে। অন্য ডালগুলো ফাঁকা। কাকরা কি একটি বিশেষ ডাল বৃষ্টির সময় আশ্রয় হিসেবে ব্যবহার করে? এই ডালটায় নিশ্চয়ই কোনো সুবিধা আছে।
স্টেশন মাস্টার সাহেবও ছাতা হাতে বের হয়েছেন। তিনি নিজেই ছাতা মেলে শওকত সাহেবের মাথার উপর ধরলেন। বিরক্ত মুখে বললেন, ‘এই যে বৃষ্টি শুরু হয়েছে, খুব কম করে হলেও সাতদিন থাকবে।’
শওকত সাহেব বললেন, ‘একটা মজার জিনিস দেখুন তো। এতগুলো ডাল থাকতে কাকরা সবাই একটা ডালে বসে আছে কেন?’
‘পশুপাখির কি স্যার কোনো বুদ্ধিশুদ্ধি আছে? একজন একটা ডালে বসছে। গুষ্টিসুদ্ধ সেই ডালে গিয়ে বসছে। স্যার ভেতরে চলেন। বৃষ্টিতে ভিজতেছেন।’
‘আপনি ছাতাটা আমার হাতে দিয়ে চলে যান। বৃষ্টি দেখতে আমার ভালোই লাগছে।’
‘একদিন-দু’দিন লাগবে স্যার। তারপর দেখবেন যন্ত্রণা। গ্রামদেশে সবচে’ খারাপ সময় হইল বর্ষাকাল।
মোফাজ্জল করিম সাহেব একটা চায়ের দোকানে দাঁড়িয়ে কি যেন কিনলেন, তারপর আবার যেদিক থেকে এসেছিলেন সেদিকে রওনা হলেন। শিরীষ গাছের ঐ ডালটায় আরো কিছু কাক এসে বসেছে। অন্য ডালগুলো এখনো ফাঁকা। যখন ঝড়-বৃষ্টি থাকে না তখন এরা কি করে? অন্য ডালগুলোতে বসে? নাকি কখনো বসে না? প্রচণ্ড শব্দে কাছে কোথাও বজ্রপাত হল। ধক করে বুকে ধাক্কা লাগল। এত বড় শব্দ অথচ কাকদের মধ্যে কোনোরকম চাঞ্চল্য লক্ষ করা গেল না। সম্ভবত তারা শব্দটা কী, কখন হবে, কোথায় হবে জানে বলেই চুপচাপ আছে। আরো দু’টা কাক এসে সেই ডালটাতেই বসল। আশ্চর্য তো!
নৌকা বেশ বড়।
ভেতরে তোশকের বিছানায় রঙিন চাদর। দু’টা বালিশ, একটা কোলবালিশ। মোফাজ্জল করিম বললেন, ‘বিছানা-বালিশ সব বাড়ি থেকে নিয়ে এসেছি। আরাম করতে করতে যাবেন।
শওকত সাহেব বললেন, ‘কোলবালিশ এনেছেন কেন?’
‘ঘরে ছিল। নিয়ে এসেছি।’
তিনি যে শুধু কোলবালিশ এনেছেন তা না, টিফিন ক্যারিয়ারে করে খাবার দাবার নিয়ে এসেছেন। নৌকার চুলায় সেইসব খাবার গরম করা হচ্ছে। দুপুরের খাওয়া শেষ করে নৌকা ছাড়া হবে।
বৃষ্টির তেজ অনেক কমেছে। ঝিরঝির করে বৃষ্টি পড়ছে। তবে বাতাস আছে।
করিম সাহেব বললেন, ‘এই বৎসর মারাত্মক বন্যা হবে। কি বলেন স্যার?’
শওকত সাহেব জবাব দিলেন না। কথা বললেই কথার পিঠে কথা বলতে হবে। ইচ্ছা করছে না। এক ধরনের ক্লান্তিও বোধ করছেন। বিছানায় শুয়ে পড়লে হয়। কোলবালিশ দেখার পর থেকে কোলবালিশ জড়িয়ে শুয়ে পড়তে ইচ্ছে করছে।
‘স্যার, তরকারিতে কেমন ঝাল খান তা তো জানি না। আমি বলেছি ঝাল কম দিতে। খুব বেশি কম হলে কাঁচা মরিচ আছে। আমার নিজের গাছের কাঁচা মরিচ, অসম্ভব ঝাল। সাবধানে কামড় দিবেন?’
শওকত সাহেব কিছুই বললেন না। এক জায়গায় বসে একদিকেই তাকিয়ে আছেন। চোখের সামনের দৃশ্য এখন খানিকটা একঘেয়ে হয়ে গেছে। নৌকার চুলা থেকে ভেজা কাঠের কারণে প্রচুর ধোঁয়া আসছে। চোখ জ্বালা করছে। ধোঁয়া অন্যদিকে সরানোর জন্যে করিম সাহেব তালপাতার একটা পাখা দিয়ে ক্রমাগত হাওয়া করে যাচ্ছেন। এতে কোনো লাভ হচ্ছে না। বরং ধোঁয়া আরো বেশি হচ্ছে।
‘করিম সাহেব।’
‘জ্বি স্যার।’
‘আমি, আপনাকে একটা কথা বলতে চাচ্ছি। যদি কিছু মনে না করেন।’
‘অবশ্যই বলবেন স্যার। অবশ্যই।’
‘আমি মানুষজনের সঙ্গে কথাবার্তা বলতে তেমন আগ্রহ বোধ করি না। ভালো লাগে না। চুপচাপ থাকতে পছন্দ করি।’
‘সেটা আপনাকে বলতে হবে না। আপনাকে দেখেই বুঝেছি। স্টেশন মাস্টার সাহেবকে এই কথা বলছিলাম।’
‘করিম সাহেব, আমি আমার কথাটা শেষ করতে পারি নি—আপনাদের ওখানে আমি যাচ্ছি খুব নিরিবিলিতে কিছু কাজ করতে। শহরের পরিবেশে মন হাঁপিয়ে গেছে। নতুন পরিবেশের কোনো ছাপ লেখায় পড়ে কি-না সেটা দেখতে চাচ্ছি। কাজেই আমি যা চাই তা হচ্ছে—নিরিবিলি।’
‘স্যার আপনাকে কেউ বিরক্ত করবে না। গ্রামের লোকজন যদি আসেও; সন্ধ্যার পর আসবে। এরা আপনার কাছ থেকে দু’একটা মূল্যবান কথা শুনতে চায়।’
‘আমি কোনো মূল্যবান কথা জানি না।’
‘এটা তো স্যার, আপনি বিনয় করে বলছেন।’
‘না, বিনয় করে বলছি না। বিনয় ব্যাপারটা আমার মধ্যে নেই।’
খাবার সময়ও খুব যন্ত্রণা হল। করিম সাহেব প্লেটে ভাত তুলে দিচ্ছেন, তরকারি তুলে দিচ্ছেন। শওকত সাহেব বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘প্লিজ কিছু তুলে দেবেন না। যা দরকার আমি নিজে নেব। কেউ খাবার তুলে দিলে আমার খুব অস্বস্তি লাগে।’
‘আপনি তো স্যার কিছুই নিচ্ছেন না, মুরগির বুকের গোশত একটু দিয়ে দেই।’ তিনি শুধু যে মুরগির বুকের গোশত দিলেন তাই না, এক টুকরা লেবু নিজেই শওকত সাহেবের প্লেটে চিপে দিলেন।
‘কাগজি লেবুটা স্বাস্থ্যের জন্যে ভালো। আমার গাছের কাগজি স্যার।’
‘ভালো।’
‘ছ’টা কাগজি লেবুর গাছ আছে—এর মধ্যে দু’টা গাছ বাঁজা। ফুল ফোটে— ফল হয় না। গাছগুলো কাটায়ে ফেলব ভেবেছিলাম-আমার মেয়ে দেয় না। ও কি বলে জানেন স্যার? ও বলে বাঁজা গাছ বলেই কেটে ফেলবে? কত বাঁজা মেয়েমানুষ আছে। আমরা কী তাদের কেটে ফেলি? আমি ভেবেছিলাম কথা খুবই সত্য। আমার নিজের এক ফুপু ছিলেন বাঁজা। কলমাকান্দায় বিয়ে হয়েছিল। খুব বড় ফ্যামেলি। তারা অনেক চেষ্টাচরিত করেছে। ডাক্তার-কবিরাজ কিছুই বাদ দেয় নাই। তারপর নিয়ে গেল আজমীর শরিফ। সেখান থেকে লাল সুতা বেঁধে নিয়ে আসল। খোদার কি কুদরত—আজমীর শরিফ থেকে ফেরার পর একটা সন্তান হল। আমি চিন্তা করে দেখলাম—আমার লেবু গাছের বেলায়ও তো এটা হতে পারে।’
শওকত সাহেব হাত ধুতে ধুতে বললেন, ‘নিশ্চয়ই হতে পারে। আপনি একটা টবে গাছ দু’টাকে আজমীর শরিফে নিয়ে যান। লাল সুতা বেঁধে আনুন।’
করিম সাহেব কিছু বললেন না, তাকিয়ে রইলেন। সম্ভবত রসিকতাটা তিনি ধরতে পারেন নি।
‘করিম সাহেব।’
‘জ্বি স্যার।’
‘আপনাদের ওখানে পোস্ট অফিস আছে তো?’
‘জ্বি আছে। আমাদের গ্রামে নাই। শিবপুরে আছে। আমরা পোস্টাপিসের জন্যে কয়েকবার দরখাস্ত দিয়েছি। পোস্ট মাস্টার জেনারেলের এক শালার বিবাহ হয়েছে আমাদের গ্রামে, মুনশিবাড়িতে। উনার মারফতে গত বৎসর একটা দরখাস্ত দিয়েছি। উনি আশা দিয়েছেন—হয়ে যাবে।’
‘শিবপুর আপনাদের গ্রাম থেকে কতদূর?’
‘বেশি না, চার থেকে সাড়ে চার মাইল।’
‘আমি আমার স্ত্রীর কাছে একটা চিঠি পাঠাতে চাই—পৌঁছানোর সংবাদ।’
‘কোনো চিন্তা নাই স্যার। চিঠি এবং টেলিগ্রাম দু’টারই ব্যবস্থা করে দেব।’
শওকত সাহেব সুটকেস খুলে চিঠি লেখার কাগজ বের করলেন। বৃষ্টি আবার জোরেশোরে এসেছে। এক হাত দূরের জিনিস দেখা যায় না এমন বৃষ্টি। এর মধ্যেই নৌকা ছাড়া হয়েছে। নৌকার মোট তিনজন মাঝি। একজন হাল ধরে বসে আছে। দু’জন দাঁড় টানছে। বৃষ্টির পানিতে ভেজার জন্যে তাদের মধ্যে কোনো বিকার নেই। যে দু’জন দাঁড় টানছে তাদের দেখে মনে হচ্ছে—দাঁড় টানার কাজে খুব আরাম পাচ্ছে। করিম সাহেব ছাতা মাথায় দিয়ে বাইরে বসে আছেন। শওকত সাহেবের অসুবিধা হবে এই কারণে তিনি ছই-এর ভেতর যেতে রাজি হন নি। শওকত সাহেব সুটকেসের উপর কাগজ রেখে পেন্সিলে দ্রুত লিখে যাচ্ছেন। তাঁর লেখা কাঁচা তবে গোটা-গোটা—দেখতে ভালো লাগে।
কল্যাণীয়া,
হাতের লেখা কি চিনতে পারছ?
নৌকায় বসে লেখা—কাজেই অক্ষরগুলো এমন চ্যাপ্টা দেখাচ্ছে।
ঠাকরোকোনা স্টেশনে ঠিকমতোই পৌঁছেছি। মোফাজ্জল করিম সাহেব উপস্থিত ছিলেন। নাম শুনে মনে হয়েছিল ভদ্রলোকের দাড়ি থাকবে, মাথায় টুপি থাকবে এবং মাপে লম্বা, ন্যাপথলিনের গন্ধ মাখা কোট থাকবে গায়ে। কোটের অংশ শুধু মিলেছে। ভদ্রলোক সারাক্ষণ কথা বলেন। অনায়াসে তাঁকে কথা-সাগর উপাধি দেয়া যায়। কথা-বলা লোকজন কাজকর্মে কাঁচা হয়। ভদ্রলোক তা না। তাঁকে সর্বকর্মে অতি উৎসাহী মনে হল। তাঁর অতিরিক্ত রকমের উৎসাহে ঘাবড়ে যাচ্ছি। ভাত খাওয়ার সময় ভদ্রলোক নিজে লেবু চিপে আমার পাতে ছড়িয়ে দিচ্ছিলেন। অবস্থাটা ভাবো।
আসার সময় তোমার মুখ কালো বলে মনে হল। তাড়াহুড়ায় জিজ্ঞেস করা হয় নি। তাছাড়া ভাবলাম বিদায়-মুহূর্তে কোনো কারণে আমার উপর রাগ করে থাকলেও তা প্রকাশ করবে না। ইদানীং কথা চেপে রাখার এক ধরনের প্রবণতা তোমার মধ্যে লক্ষ করছি। একবার অবশ্যি আমাকে বলেছিলে “তোমাকে কিছু বলা আর গাছকে কিছু বলা প্রায় একরকম। গাছকে কিছু বললে গাছ শুনতে না পেলেও গাছের ডালে বসে থাকা পাখিরা শুনতে পায়। তোমাকে বললে কেউ শুনতে পায় না।” এই কথাগুলো তুমি ঠাট্টা করে বলেছ; না মনের বিশ্বাস থেকে বলেছ আমি জানি না। মন থেকে বললেও আমার প্রতিবাদ করার কিছু নেই। আমি নিজেও বুঝতে পারছি আজকাল তোমার কথা মন দিয়ে শুনছি না। আমাকে বলার মতো কথাও কি তোমার খুব বেশি আছে? সংসার, ছেলেমেয়ে নিয়ে তুমি ব্যস্ত হয়ে পড়েছ। রাত দশটা পর্যন্ত বাচ্চাদের পড়িয়ে, খাইয়ে-দাইয়ে, ঘুম পাড়িয়ে তুমি যখন ক্লান্ত—পরিশ্রান্ত তখন আমি বসছি লেখা নিয়ে।
সময় কোথায়? খুব সূক্ষ্ম হলেও সংসার নামক সমুদ্রে দু’টি দ্বীপ তৈরি হয়েছে। একটিতে আমি, অন্যটিতে ছেলেমেয়ে নিয়ে তুমি। তাই নয় কি?
স্বেচ্ছানির্বাসনে কিছুদিন কাটাতে এসেছি। পরিকল্পনা মতো লেখালেখি করব, তার ফাঁকে অবসরের সময়টা আমাদের জীবন নিয়ে চিন্তা-ভাবনাও করব। জীবনের একঘেয়েমিতে আমি খানিকটা ক্লান্ত। নতুন পরিবেশ সেই ক্লান্তি দূর করবে; না আরো বাড়িয়ে দেবে কে জানে! ভালো লাগবে বলে মনে হচ্ছে না। সারাজীবন শহরে থেকেছি। শহরের সুবিধা ও অসুবিধায় এত অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি যে, নতুন পরিবেশে খাপ খাওয়ানো কষ্টকর হবে বলে মনে হয়। কষ্ট করার একটা বয়স আছে। সেই বয়স পার হয়ে এসেছি। তাছাড়া এখনি হোমসিক বোধ করছি। আসার সময় স্বাতীর জ্বর দেখে এসেছিলাম। ভেবেছিলাম ঘর থেকে বেরুবার আগে তার কপালে চুমু খেয়ে আসব। ড্রাইভার নিচে এত ঘনঘন হর্ন বাজাতে লাগল যে, সব ভুলে নিচে নেমে এলাম। বেচারির জ্বরতপ্ত কপালে চুমু খাওয়া হল না। আমার হয়ে ওকে আদর করে দিও। আমার থাকার জায়গা কী করা হয়েছে এখনো জানি না। মোফাজ্জল করিম সাহেবকে কিছু জিজ্ঞেস করি নি। জিজ্ঞেস করলেই তিনি লং প্লেইং রেকর্ড চালু করবেন। তা শুনতে ইচ্ছা করছে না।
আস্তানায় পৌঁছেই আস্তানা সম্পর্কে তোমাকে জানাব। জায়গাটা পছন্দ হলে তোমাকে লিখব।
সবাইকে নিয়ে চলে আসবে। তবে জায়গা পছন্দ হবে বলে মনে হচ্ছে না।
অনেক অনেক দিন পর তোমাকে দীর্ঘ চিঠি লিখলাম।
ভালো থাক এবং সুখে থাক।
নীল অপরাজিতা – ২
থাকার জায়গা আহামরি ধরনের হবে এ জাতীয় ধারণা শওকত সাহেবের ছিল না। অজ পাড়াগাঁয়ে রাজপ্রাসাদ থাকার কোনোই কারণ নেই। তবে বজলুর রহমান যিনি এই জায়গার খোঁজ তাঁকে দিয়েছেন, তিনি বার তিনেক উচ্ছ্বসিত গলায় বলেছেন, ‘আপনি মুগ্ধ হয়ে যাবেন। এত সুন্দর বাড়ি যে কল্পনাও করতে পারবেন না।’
শওকত সাহেব হাসতে হাসতে বললেন, ‘তাজমহল ধরনের বাড়ি?’
‘তাজমহল তো বাড়ি না। তাজমহল হচ্ছে কবরখানা। মমতাজ মহলের কবর। আপনাকে যে বাড়িতে পাঠাচ্ছি সেটা গৌরীপুর মহারাজার বর্ষা-মন্দির।’
‘বর্ষা-মন্দির মানে?’
‘শীতের সময় কাটানোর জন্যে মহারাজার একটা বাড়ি ছিল। সেটার নাম শীত—মন্দির। তেমনি বর্ষাকাল কাটানোর জন্যে একটা বাড়ি ছিল, তার নাম বর্ষা-মন্দির। দোতলা বাড়ি। বৃষ্টির শব্দ যাতে শোনা যায় সে জন্যে বাড়ির ছাদ টিনের। বৃষ্টি দেখার জন্যে বিরাট টানা বারান্দা। উত্তরেও বারান্দা, দক্ষিণেও বারান্দা। উত্তরের বারান্দায় দাঁড়ালে গারো পাহাড় দেখা যায়। দক্ষিণের বারান্দায় দাঁড়ালে দেখবেন—সোহাগী নদী।’
‘কি নদী?’
‘সোহাগী নদী। বর্ষাকালে যাবেন, নদী থাকবে কানায় কানায় ভরা। বৃষ্টির ফোঁটা নদীতে পড়লে কী যে সুন্দর দেখা যায়, তা ঐ বাড়ির বারান্দায় না দাঁড়ালে বুঝবেন না। বাড়িটার চারদিকে কদমের গাছ। বর্ষাকালে কদম ফুলে গাছ ছেয়ে যায়—সে এক দেখার মতো দৃশ্য। বাংলাদেশের কোথাও একসঙ্গে এতগুলো কদমের গাছ দেখবেন না।’
শওকত সাহেব খুব একটা উৎসাহবোধ করলেন না। বজলুর রহমানের কোনো কথায় উৎসাহী হয়ে ওঠা ঠিক না। ভদ্রলোক মাথা খারাপ ধরনের। নিজেকে মহাকবি হিসেবে পরিচয় দেন। শোনা যায় সতের বছর বয়সে ‘বঙ্গ-বন্দনা’ নামে মহাকাব্য লেখা শুরু করেছিলেন। শেষ করেছেন চল্লিশ বছর বয়সে। এখন কারেকশান চলছে। দশ বছর হয়ে গেল, কারেকশান শেষ হয় নি।
মহাকবি বজলুর রহমান—”অদ্ভুত, অসাধারণ, পাগল হয়ে যাবার মতো” বিশেষণ ছাড়া কথা বলতে পারেন না।
একবার গুলশানের এক বাড়িতে বাগান বিলাস গাছ দেখে খুব উত্তেজিত হয়ে ফিরলেন। চোখ বড় বড় করে বললেন, ‘এই জিনিস না দেখলে জীবন বৃথা। ইন্দ্রপুরীর বাগান বিলাসও এর সামনে দাঁড়াতে পারবে না। লাল রঙের যে ক’টা শেড আছে তার প্রতিটি ঐ গাছের পাতায় আছে। বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকা যায় না। তাকিয়ে থাকলে বুকে ব্যথা করে। অ্যাবসুলিউট বিউটি সহ্য করা মানুষের পক্ষে খুবই কঠিন। বুঝলেন ভাই সাহেব, গাছটার সামনে দাঁড়িয়ে মনে হল, পাগল হয়ে যাব।’
‘পাগল তো আছেনই। নতুন করে কি আর হবেন?
‘ঠাট্টা না ভাই। সত্যি বলছি। একদিন আমার সঙ্গে চলুন। আপনার দেখা উচিত।’ শওকত সাহেব মহাকবিকে সঙ্গে নিয়ে একদিন গেলেন। বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘আপনি কি নিশ্চিত এই সেই বিখ্যাত ইন্দ্রপুরীর গাছ?’ মহাকবি মাথা চুলকে বললেন, ‘জ্বি, এইটাই সেই বাগান—বিলাস। তবে আজ অবশ্যি সেদিনের মতো লাগছে না। ব্যাপারটা কী বুঝতে পারছি না।’ Something is definitely wrong.
শওকত সাহেব ধরেই নিয়েছেন বর্ষা-মন্দির বাগান-বিলাসের মতোই হবে। বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে তিনিও মহাকবির মতো বলতে বাধ্য হবেন—Something is definitely wrong. তবে সোহাগী নামের নদী তাকে খানিকটা আকর্ষণ করল। শুধু নামটির কারণে এই নদী একবার দেখে আসা যায়।
মহাকবি বললেন, ‘আপনি গরিবের কথাটা রাখুন। কয়েকটা দিন ঐ বাড়িতে থেকে আসুন। স্বর্গবাসের অভিজ্ঞতা হবে। আপনার লেখা অন্য একটা ডাইমেনশন পেয়ে যাবে। বাড়ি সম্পর্কে যা বলেছি তার ষোল আনা যদি না পান নিজের হাতে আমার কান দু’টা কেটে নেড়ি কুত্তা দিয়ে খাইয়ে দেবেন। আমি কিছুই বলব না।’
‘যদি যাই, খাওয়া-দাওয়া কোথায় করব? বাবুর্চি সঙ্গে নিয়ে যেতে হবে?’
‘কিছুই নিয়ে যেতে হবে না। ময়নাতলা স্কুলের অ্যাসিসটেন্ট হেডমাস্টার সাহেবকে আমি একটা চিঠি দিয়ে দেব। খুবই মাই ডিয়ার লোক। যা করার সেই করবে। এবং যে ক’দিন থাকবেন আপনাকে মাথায় করে রাখবে।’
তিনি ময়নাতলায় মহাকবির ব্যবস্থা মতোই এসেছেন।
মহাকবি তাঁকে ট্রেনে তুলে দিতেও এসেছিলেন। ময়নাতলা জায়গাটার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কথা বলতে গিয়ে আরেকবার উচ্ছ্বসিত হলেন। তবে ট্রেন ছাড়বার আগ মুহূর্তে লজ্জিত গলায় বললেন, ‘ভাই আপনাকে একটা রং ইনফরমেশন দিয়েছি। নদীটার নাম সোহাগী না। আসলে নদীটার কোনো নাম নেই। সবাই বলে “ছোট গাঙ”। সোহাগী নামটা আমার দেয়া।’
শওকত সাহেব হেসে ফেলে বললেন, ‘কদমের বনও নিশ্চয়ই নেই? আপনার কল্পনা।’
মহাকবি উত্তেজিত গলায় বললেন, ‘আছে। অবশ্যই আছে। নদীর নাম ছাড়া বাকি সব যেমন বলেছি তেমন। যদি এক বিন্দু মিথ্যা হয়, আমার কান দু’টা কেটে কুত্তা দিয়ে খাইয়ে দেবেন। আমি বাকি জীবন ভ্যান গগের মতো কান মাফলার দিয়ে বেঁধে ঘুরে বেড়াব। অনেস্ট। নদীর নামের ব্যাপারে আপনার সঙ্গে মিথ্যা কথা বলেছি-ক্ষমা প্রার্থনা করছি। নাম তো বড় না, জিনিসটাই বড়। অসাধারণ নদী, একবার সামনে দাঁড়ালে পাগল হয়ে যেতে ইচ্ছা করে।’
বাড়ির সামনে শওকত সাহেব বিমর্ষ মুখে দাঁড়িয়ে আছেন। পাগল হয়ে যাবার মতো কিছুই দেখছেন না। অতি পুরাতন জরাজীর্ণ দোতলা ভবন। ছাদ ধসে গেছে কিংবা ভেঙে পড়েছে বলে পরবর্তী সময়ে টিন দেয়া হয়েছে। টানা বারান্দা ঠিকই আছে—তবে রেলিং জায়গায় জায়গায় ভেঙে পড়েছে। বারান্দায় হাঁটাহাঁটি করা বিপজ্জনক হতে পারে। বর্ষাকাল, বৃষ্টির পানিতে বারান্দা পিচ্ছিল হয়ে আছে।
শওকত সাহেব বললেন, ‘এটাই কি বর্ষা-মন্দির?’
করিম সাহেব অবাক হয়ে বললেন, ‘আপনার কথা কিছু বুঝলাম না স্যার। বর্ষা—মন্দির বলছেন কেন?’
‘বাড়িটা কি গৌরীপুরের মহারাজার?’
‘জ্বি না। আমার দাদাজান সেই আমলে লাখপতি হয়ে বাড়ি বানিয়েছিলেন, তারপর অপঘাতে মারা গেলেন। অবস্থা পড়ে গেল। এই বাড়িটা ছাড়া—এখন আমাদের আর কিছুই নাই। বাড়িটাও হয়েছে বাসের অযোগ্য। আমি নিচের তিনটা ঘরে থাকি। উপরটা তালাবন্ধ থাকে। আপনার জন্যে উপরের একটা ঘর ঠিকঠাক করে রেখেছি।’
‘বাড়ির চারদিকে কি এক সময় কদম গাছ ছিল?’
‘জ্বি না। একটা কদম গাছ বাড়ির সামনে ছিল। তিন বছর আগে গাছের উপর বজ্রপাত হল। চলুন স্যার আপনার ঘরটা দেখিয়ে দেই।’
‘চলুন।’
‘সিঁড়িতে সাবধানে পা ফেলবেন। মাঝে মধ্যে ভাঙা আছে।’
‘বাথরুম আছে তো।’
‘জ্বি আছে। বাথরুম আছে, আপনার ঘরের সাথেই আছে।’
‘খাবার পানি কোথেকে আনেন? নদীর পানি?’
‘জ্বি না। টিউবওয়েল আছে। বজলুর রহমান সাহেব চিঠিতে জানিয়েছেন-আপনাকে পানি ফুটিয়ে দিতে। পানি ফুটিয়ে বোতলে ভরে রেখেছি।’
‘ভালো করেছেন।’
‘স্যার আপনি কি গোসল করবেন? গোসলের পানি গরম করে দেব?’
‘পানি গরম করতে হবে না। ঠাণ্ডা পানিতেই গোসল করব।’
‘খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা স্যার আমার এখানে করেছি। দরিদ্র অবস্থায় যা পারি—সামান্য আয়োজন।’
মোফাজ্জল করিম সাহেব, কিছু মনে করবেন না আপনাকে একটা কথা বলি, আপনি একজন বাবুর্চির ব্যবস্থা করুন। যে আমার জন্যে রান্না করবে। আমি টাকা দিয়ে দেব।’
‘তা কী করে হয়?’
‘তাই হতে হবে। আমি তো বজলুর রহমান সাহেবকে বলেছিলাম আপনাকে এইভাবে চিঠি দিতে। চিঠি দেন নি…’
‘জ্বি না, এইসব কিছু তো লিখেন নাই।’
‘উনি আমাকে বলেছেন, বাবুর্চির ব্যবস্থা হয়েছে, আমি তাই মনে করে এসেছি। নয়ত আসতাম না।’
‘আপনি একজন অতি বিশিষ্ট ব্যক্তি। আপনার সামান্য সেবা করার সুযোগ পাওয়া তো স্যার ভাগ্যের কথা…’
‘ভাই আপনাকে যা করতে বলছি করুন।’
রাতে মোফাজ্জল করিম সাহেব শওকত সাহেবকে খাবার জন্যে ডাকতে এলেন। নিচু গলায় বললেন, ‘বাবুর্চির ব্যবস্থা স্যার কাল-পরশুর মধ্যে করে ফেলব। অজ পাড়াগাঁ জায়গা। বাবুর্চিতো পাওয়া যাবে না। একটা মেয়েটেয়ে জোগাড় করতে হবে। আজ গরিবখানায় সামান্য আয়োজন করেছি।’
শওকত সাহেব বললেন, ‘আপনি একটা কাজ করুন, খাবারটা এখানে পাঠিয়ে দিন।’
‘কিছু বিশিষ্ট লোককে দাওয়াত করেছিলাম স্যার। হেডমাস্টার সাহেব, ময়নাতলা থানার ওসি সাহেবও এসেছেন। ময়নাতলা থানার ওসি সাহেব বিশিষ্ট ভদ্রলোক। সাহিত্য অনুরাগী।’
‘আমি এখন আর নিচে নামব না। আপনি কিছু মনে করবেন না।’
‘স্যার উনারা আগ্রহ নিয়ে এসেছিলেন।’
‘অন্য কোনো একসময় তাঁদের সঙ্গে কথা বলব।’
মোফাজ্জল করিম সাহেব খুবই অপ্রস্তুত মুখ করে নিচে নেমে গেলেন। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই উঠে এলেন। শওকত সাহেব বললেন, ‘কী ব্যাপার?’
‘স্যার আপনার বোতলটা এসে পৌঁছেছে। এই যে স্যার বোতল।’
‘টেবিলের উপর রেখে দিন।’
‘আপনার খাবার কি স্যার নিয়ে আসব?’
‘অতিথিরা চলে যাক। তারপর আনবেন। আমি বেশ রাত করে খাই। যদি সম্ভব হয় এক কাপ চা পাঠাবেন।’
‘জ্বি আচ্ছা।’
‘চিনি বেশি করে দিতে বলবেন। আমি চিনি বেশি খাই।’
‘জ্বি আচ্ছা।’
মজার ব্যাপার হচ্ছে প্রথম দর্শনে বাড়িটা যত খারাপ লেগেছিল এখন তা লাগছে না। ভালো লাগছে। শুধু ভালো না। বেশ ভালো লাগছে। তিনি বসে আছেন বারান্দায়। বারান্দায় এই অংশে রেলিং আছে বলে বসে থাকতে কোনো রকম অস্বস্তি বোধ করছেন না। তাঁর সামনে গোল টেবিল। টেবিলের উপর কুরুশ কাঁটার টেবিল ক্লথ। টেবিলের ঠিক মাঝখানে ফুলদানিতে চাঁপা ফুল। মিষ্টি গন্ধ আসছে সেখান থেকে। বৃষ্টি থেমে আকাশ পরিষ্কার হওয়ায় অসংখ্য তারা ফুটেছে। ঢাকার আকাশে তিনি কোনোদিন এত তারা দেখেন নি। আকাশের তারার চেয়েও তাঁকে মুগ্ধ করেছে জোনাকি পোকা। মনে হচ্ছে হাজার হাজার জোনাকি ঝাঁক বেঁধে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যাচ্ছে। দৃশ্যটা এত সুন্দর যে মহাকবি বজলুর রহমানের মতো চেঁচিয়ে বলতে ইচ্ছা করে—পাগল হয়ে যাব।
চাঁদ উঠেছে। চাঁদের আলোয় দূরের নদী দেখা যাচ্ছে অস্পষ্টভাবে। চাঁদের আলো ঘোলাটে নয়, পরিষ্কার। এই আলোয় কেমন যেন জল জল ভাব আছে।
সবচে’ যা তাঁকে বিস্মিত করল তা হচ্ছে—নীরবতা। কোনোরকম শব্দ নেই। ঘরে একটা তক্ষক আছে। তক্ষকটা মাঝে মাঝে ডাকছে। শব্দ বলতে এই। তিনি ভেবেছিলেন, যেহেতু বর্ষাকাল—চারদিকে অসংখ্য ব্যাঙ ডাকবে। তা ডাকছে না। এই অঞ্চলে কি ব্যাঙ নেই?
মোফাজ্জল করিম সাহেব হাতে কেরোসিনের টেবিল ল্যাম্প নিয়ে উঠে এসেছেন। ল্যাম্পটা বেশ বড়। কাচের চিমনি ঝকঝকে পরিষ্কার। প্রচুর আলো আসছে।
‘স্যার, ওসি সাহেব আপনার জন্য টেবিল ল্যাম্পটা পাঠিয়েছেন। আপনি নিশ্চয়ই রাতে লেখালেখি করবেন। হারিকেনের আলো কম। টেবিল ল্যাম্প আপনার ঘরে দিয়ে আসি?’
‘জ্বি দিয়ে আসুন।’
‘আপনার চা একবার বানিয়েছিল তিতা হয়ে গেছে। আবার বানাচ্ছে।’
‘ঠিক আছে। কোনো তাড়া নেই। আচ্ছা করিম সাহেব আপনাদের এদিকে ব্যাঙ ডাকে না?’
‘ডাকে তো। ডাকবে না কেন? ব্যাঙের ডাকে ঘুমাতে পারি না এই অবস্থা।’
‘আমি কিন্তু এখন পর্যন্ত শুনি নি।’
‘তাই না-কি। বলেন কী?’
শওকত সাহেব হেসে বললেন, ‘ব্যাঙ না ডাকার জন্যে আপনাকে খুব লজ্জিত বলে মনে হচ্ছে।’
মোফাজ্জল করিম কি বলবেন ভেবে পেলেন না। ব্যাঙ না ডাকায় তার আসলেই খারাপ লাগছে। শহর থেকে এসেছেন—লেখক মানুষ। ব্যাঙের ডাক, ঝিঁঝির ডাক এইসব শুনতে চান।
‘স্যার, একটা হারিকেন কি বাইরে দিয়ে যাব? অন্ধকারে বসে আছেন।’
‘অসুবিধা নেই, অন্ধকার দেখতেই বসেছি। আলো নিয়ে এলে তো আর অন্ধকার দেখা যাবে না। তাই না?’
‘অবশ্যই স্যার। অবশ্যই। আলো থাকলে অন্ধকার কী করে দেখা যাবে?’
.
পুষ্প বলল, ‘বাবা, এখন কি উনাকে খাবার দিয়ে আসবে? এগারোটা বাজতে পাঁচ মিনিট বাকি। খাবার গরম করব?’
মোফাজ্জল করিম বিছানায় শুয়ে ছিলেন। সারাদিনের ক্লান্তিতে তাঁর তন্দ্রার মতো এসে গিয়েছে। মেয়ের কথায় উঠে বসলেন।
‘খাবার গরম করব বাবা?’
‘করে ফেল।’
‘তোমার কি শরীর খারাপ করেছে?’
‘না।’
‘মন খারাপ না-কি বাবা?’
করিম সাহেব বিস্মিত হয়ে বললেন, ‘মন খারাপ হবে কেন?’
‘ঐ যে ভদ্রলোক আমাদের সঙ্গে খেতে এলেন না। তুমি এত আগ্রহ করে সবাইকে দাওয়াত-টাওয়াত করলে।’
‘লেখক মানুষ, তাঁদের মন-টন অন্য রকম।’
‘লেখক হলেই বুঝি অভদ্র হতে হবে?’
‘এই ধরনের মানুষরা ভদ্রতার ধার ধারেন না। তাঁদের যা ইচ্ছা করেন। কে কী ভাবল এইসব নিয়ে মাথা ঘামান না। এইসব নিয়ে মাথা ঘামাই আমরা—সাধারণ মানুষরা।’
পুষ্প কেরোসিনের চুলায় খাবার গরম করছে। করিম সাহেব মেয়ের পাশে এসে বসেছেন। মেয়েটা অনেক কষ্ট করেছে। সারাদিন একা একা রান্নাবান্না করেছে। গায়ে জ্বর ছিল, জ্বর নিয়েই করতে হয়েছে। অন্য সময় মতির মা সাহায্য করে। গত তিন দিন ধরে মতির মা-ও আসছে না।
‘পুষ্প তোর গায়ে কি জ্বর আছে?’
‘না।’
‘দেখি হাতটা দেখি।’
পুষ্প হাত বাড়িয়ে দিল। করিম সাহেব লক্ষ করলেন—হাত তপ্ত।
‘না বললি কেন? জ্বর আছে তো।’
‘আগুনের কাছে বসে আছি এই জন্যে গা গরম। বাবা, ভদ্রলোক কি খুব রাগী?’
‘আরে দূর। রাগী হবে কেন? কথা কম বলেন। কেউ কথা বেশি বললেও বিরক্ত হন।’
তাহলে তো তোমার উপর খুব বিরক্ত হয়েছেন। তুমি যা কথা বল।’
‘আমি বেশি কথা বলি?’
‘হুঁ। বল। মন ভালো থাকলে অনর্গল কথা বল। এতক্ষণ কথা না বলে চুপচাপ শুয়ে ছিলে তাই ভাবলাম তোমার মন বোধহয় খারাপ।’
‘আমার মন মোটেই খারাপ না। খুবই ভালো। এতবড় একজন মানুষ আমাদের সঙ্গে আছেন—ভাবতেই কেমন লাগে। গত সপ্তাহে ক্লাস সিক্সের রেপিড রিডারে উনার যে গল্পটা আছে সেটা ছাত্রদের বুঝিয়ে দিলাম।’
‘কোন গল্পটা?’
‘মতিনের সংসার।’
‘গল্পটা বেশি ভালো না।’
‘কি বলিস তুই ভালো না! অসাধারণ গল্প।’
‘আমার কাছে অসাধারণ মনে হয় নি। বাবা, সব কিছু গরম হয়ে গেছে। তুমি ইউনুসকে বল, উপরে নিয়ে যাক।
‘ইউনুস নিয়ে যাবে কি? আমি নিয়ে যাব। এতবড় একজন মানুষের খাবার আমি স্কুলের দপ্তরিকে দিয়ে পাঠাব? কী ভাবিস তুই আমাকে?’
পুষ্প ক্ষীণ স্বরে বলল, ‘বাবা আমি কি তোমার সঙ্গে আসব?’
‘আয়। আসবি না কেন? পরিচয় করিয়ে দিব।’
‘উনি আবার রাগ করবেন না তো?’
‘রাগ করবেন কেন? রাগ, ঘৃণা এইসব হচ্ছে আমাদের সাধারণ মানুষের ব্যাপার। উনারা তো সাধারণ মানুষ না। এই যে সন্ধ্যাবেলায় এসে বারান্দায় বসেছেন—এখনো গিয়ে দেখবি সেই একইভাবে বসে আছেন।’
‘মনে হয় খুব অলস ধরনের মানুষ।’
‘অলস ধরনের মানুষ এইভাবে বসে থাকে না। শুয়ে ঘুমায়।’
‘বাবা, আমি কি এই কাপড়টা পরে যাব না বদলাব?’
‘বদলে ভালো শাড়ি পর। হাত-মুখটা ধুয়ে নে।
‘উনি আবার ভাববেন না তো যে উনার সঙ্গে দেখা করার জন্যে শাড়ি বদলে সেজেগুজে গেছি।’
‘কিছুই ভাববেন না। এই ধরনের মানুষ—কে কি পরল, না পরল, কে সাজল, কে সাজল না এইসব নিয়ে মোটেও মাথা ঘামান না। তাঁদের অনেক বড় ব্যাপার নিয়ে চিন্তা করতে হয়। ছোট ব্যাপার নিয়ে চিন্তা করার সময়ই তাঁদের নেই।’
‘কিন্তু বাবা উনি তো ঔপন্যাসিক। ঔপন্যাসিকরা নিশ্চয়ই এইসব ব্যাপার খুব খুঁটিয়ে দেখেন। না দেখলে লিখবেন কি করে?’
‘সেটাও একটা কথা। তাহলে থাক, কাপড় পাল্টানোর দরকার নেই।’
‘না বাবা কাপড় পাল্টেই যাই। আমাকে দশ মিনিট সময় দাও বাবা, গোসল করে ফেলি।’
‘জ্বর গায়ে গোসল করবি?’
‘রান্না-বান্না করেছি। গা কুটকুট করছে।’
‘আবার তো সব ঠাণ্ডা হবে।’
‘আবার গরম করব। বাবা, আরেকটা কথা, আমি কি উনাকে পা ছুঁয়ে সালাম করব?’
‘নিশ্চয়ই করবে।’
শওকত সাহেব বারান্দা ছেড়ে ঘরে ঢুকেছেন।
সুটকেস খুলে দেখছেন রেনু জিনিসপত্র কী দিয়ে দিয়েছে। একগাদা বই থাকবে বলাই বাহুল্য। ঢাকায় বই পড়ার সময় তেমন হয় না। বাইরে এলে বই পড়ে প্রচুর সময় কাটান। রেনু তার নিজের পছন্দের বই একগাদা দিয়ে দেয়। তার মধ্যে মজার মজার কিছু বই থাকে। যেমন এবারের বইগুলোর মধ্যে একটা হল—অষ্টাঙ্গ সংগ্রহ। গ্ৰন্থ পরিচয়ে লেখা—আয়ুর্বেদ শাস্ত্রের মূল তত্ত্ব বিষয়ক গ্রন্থ। এই বই দেয়ার মানে কি? রেনু কি তাঁকে আয়ুর্বেদে পন্ডিত বানাতে চায়?
তিনি কয়েক পাতা ওল্টালেন। বিচিত্র সব কথাবার্তা বইটিতে লেখা—
“পান খাওয়ার নিয়ম : পূর্বাহ্ণে সুপারি অধিক দিয়া, মধ্যাহ্নে খয়ের অধিক দিয়া ও রাত্রে চুন অধিক দিয়া পান খাইতে হয়। পানের অগ্রভাগ, মূলভাগ ও মধ্যভাগ বাদ দিয়া পান খাইতে হয়। পানের মূলভাগ খাইলে ব্যাধি, মধ্যভাগে আয়ুক্ষয় এবং অগ্রভাগ খাইলে পাপ হয়। পানের প্রথম পিক বিষতুল্য, দ্বিতীয় পিক দুর্জর, তৃতীয় পিক সুধাতুল্য—উহা খাওয়া উচিত।”
‘স্যার আসব?’
শওকত সাহেব তাকিয়ে দেখেন করিম সাহেব তাঁর মেয়েকে নিয়ে উপস্থিত হয়েছেন। দু’জনের হাতে দু’টি ট্রে। রাতের খাবার। পেছনে-পেছনে আরেকজন আসছে। তার হাতে পানির জগ, গ্লাস, চিলম্চি।
করিম সাহেব বললেন, ‘স্যার আমার মেয়ে পুষ্প। আমার একটাই মেয়ে। ময়মনসিংহে থাকে। হোস্টেলে থেকে পড়ে। এইবার আই. এ. দেবে। পরীক্ষার ছুটি দিয়েছে। ও ভেবেছিল হোস্টেলে থেকে পড়াশোনা করবে। আমি বললাম, মা চলে আয়। একা একা থাকি। সে চলে এসেছে। চলে আসায় খুবই ক্ষতি হয়েছে। ঘর-সংসার সবই এখন তার দেখতে হয়। এখন ভাবছি হোস্টেলে দিয়ে আসব।’
পুষ্প মেঝেতে ট্রে রেখে এগিয়ে এসে পা ছুঁয়ে সালাম করল। শওকত সাহেব খানিকটা বিব্রতবোধ করলেন। কদমবুসি করলে মাথায় হাত দিয়ে আশীর্বাদের কিছু কথা বলার নিয়ম আছে। তিনি কখনো তা পারেন না।
পুষ্প বলল, ‘স্যার আপনার শরীর কেমন?’
মেয়েও বাবার মতোই তাঁকে স্যার ডাকছে। প্রশ্ন করেছে বোকার মতো। তিনি যদি এখন—’শরীর ভালো’ না বলে বলেন—’শরীর খুবই খারাপ’ তাহলেই মেয়েটি হকচকিয়ে যাবে। পরের কথাটা কি বলবে ভেবে পাবে না।
তিনি তাকিয়ে আছেন পুষ্পের দিকে।
মেয়েটিকে অস্বাভাবিক রকমের স্নিগ্ধ লাগছে। স্নান করার পরপর ক্ষণস্থায়ী যে স্নিগ্ধতা চোখে-মুখে ছড়িয়ে থাকে সেই স্নিগ্ধতা। মেয়েটি কি এখানে আসার আগে স্নান করেছে? সম্ভবত করেছে। চুল আর্দ্র ভাব। মেয়েটির গায়ের রং অতিরিক্ত ফর্সা। শুধুমাত্র ফর্সা রঙের কারণে এই মেয়েটির ভালো বিয়ে হবে। মেয়েটার মুখ গোলাকার। মুখটা একটু লম্বাটে হলে ভালো হত। একে কি রূপবতী বলা যাবে? হ্যাঁ যাবে। মেয়েটি রূপবতী তবে আকর্ষণীয়া নয়। রূপবতীদের দিকে তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে কিন্তু কাছে যেতে ইচ্ছে করে না। যারা আকর্ষণীয়া তারা নিজেদের দিকে প্রবলভাবে আকর্ষণ করে।
মোফাজ্জল করিম সাহেব বললেন, ‘ওর নাম স্যার আসলে পুষ্প না। ওর ভালো নাম নাজনীন। আমরা ডাকতাম নাজু। একদিন ওর বড় মামা এসে বললেন, ‘নাজু—ফাজু আবার কি রকম নাম। এত সুন্দর মেয়ে—এর নাম হল পুষ্প। সেই থেকে পুষ্প নাম।’
শওকত সাহেব কেন জানি বিরক্তিবোধ করছেন। পিতা এবং কন্যা আগ্রহ নিয়ে তার সামনে বসে আছে। এরা তাঁর কাছ থেকে মুগ্ধ ও বিস্মিত হবার মতো কিছু শুনতে চায়। এমন কিছু যা অন্য দশজন শুনাবে না, তিনিই বলবেন। এক ধরনের অভিনয় করতে হবে। অন্যদের থেকে আলাদা হবার অভিনয়। আশেপাশের মানুষদের চমৎকৃত করতে হবে। পৃথিবীর সব বড় মানুষরাই গ্রহের মতো। তাদের আশেপাশে যারা আসবে তাদেরই উপগ্রহ হয়ে গ্রহের চারপাশে পাক খেতে হবে। কোনো মানে হয় না।
মেয়েটা এসেছে। আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছে তাঁর দিকে। তাঁকে কিছু একটা বলতে হবে। ইন্টারেস্টিং কিছু। কিছুই মাথায় আসছে না। তিনি একধরনের যন্ত্রণাবোধ করছেন।
তিনি থেমে থেমে বললেন, ‘পুষ্প খুব ভালো নাম। তবে পুষ্প না হয়ে কোনো বিশেষ ফুলের নামে নাম হলে আরো ভালো হত। অনেক আজেবাজে ধরনের ফুলও কিন্তু আছে। যেমন ধুতরা ফুল। বিষাক্ত ফুল। আবার কুমড়া ফুলও ফুল, সেই ফুল আমরা বড়া বানিয়ে খাই।’
পুষ্প তাকিয়ে আছে। একপলকের জন্যেও চোখ সরাচ্ছে না। মেয়েটির চোখে এক ধরনের কাঠিন্য আছে। সতেরো আঠারো বছরের মেয়ের চোখে এ জাতীয় কাঠিন্য তো থাকার কথা না। এদের চোখ হবে হ্রদের জলের মতো। স্বচ্ছ, গভীর এবং আনন্দময়। করিম সাহেব বললেন, ‘স্যার হাতটা ধুয়ে ফেলেন। রাত তো অনেক হয়েছে। আপনার নিশ্চয় ক্ষিধে লেগেছে।’
শওকত সাহেব বললেন, ‘আপনি কিছু মনে করবেন না। আমি রাতে খাব না।’
‘সে কি!’
‘শরীর ভালো লাগছে না।’
‘ভালো না লাগলেও চারটা খাওয়া দরকার। রাতে না খেলে শরীরের এক ছটাক রক্ত চলে যায়।’
‘রক্ত চলে গেলেও কিছু করার নেই। আমার যা ভালো লাগে না আমি কখনোই তা করি না।’
‘কিছুই খাবেন না স্যার?’
‘না।’
পুষ্প মৃদুস্বরে বলল, ‘একগ্লাস দুধ দিয়ে যাই?’
‘না—দুধ আমি এমনিতেই খাই না। রাতে যদি ক্ষিধে লাগে আমার সঙ্গে বিস্কিট আছে। ঐ খেয়ে পানি খেয়ে নেব। আমার সম্পর্কে আর কিছুই চিন্তা করতে হবে না।
করিম সাহেব বললেন, ‘খাবারটা ঢাকা দিয়ে রেখে যাব?’
‘না। ভাত-তরকারি পাশে নিয়ে ঘুমুতে ভালো লাগবে না।’
করিম সাহেব মেয়ের দিকে তাকালেন। বেচারী মুখ কালো করে ফেলেছে। আহা কত আগ্রহ নিয়ে সে রান্না-বান্না করেছে। নিচে ফিরে গিয়ে নিশ্চয়ই কাঁদবে।
করিম সাহেব বললেন, ‘আর কিছু না খান। এক টুকরা ভাজা মাছ কি খাবেন? ডুবা তেলে ভাজা।’
‘ডুবা তেলেই ভাজা হোক আর ভাসা তেলেই ভাজা হোক, আমি খাব না। আমার একেবারেই ইচ্ছে করছে না।’
পিতা এবং কন্যা বের হয়ে গেল।
দু’জন অসম্ভব মন খারাপ করেছে। ঘর থেকে বেরুবার আগে পুষ্প একপলকের জন্যে পূর্ণদৃষ্টিতে তাকাল শওকত সাহেবের দিকে। এবারের চোখের দৃষ্টি আগের মতো নয়। সম্পূর্ণ অন্য রকম। চোখের মণিতে হ্রদের জলে আকাশের ছায়া—যে আকাশে মেঘের পরে মেঘ জমেছে।
.
শোবার ঘরটা শওকত সাহেবের খুব পছন্দ হয়েছে। হলঘরের মতো বিরাট ঘর। দু’পাশেই জানালা। জানালা দুটিও বিশাল। একসঙ্গে অনেকখানি আকাশ দেখা যায়। কালো রঙের প্রাচীন খাট। খাটে বিছানো চাদর থেকে ন্যাপথলিনের গন্ধ আসছে। খাটের পাশের টেবিলে কেরোসিনের টেবিল ল্যাম্প জ্বলছে। টেবিল ল্যাম্পের এই আলোতেও এক ধরনের রহস্য আছে। বাতাসের সঙ্গে আলো কাঁপছে। সেই সঙ্গে কাঁপছে দেয়ালের ছায়া। মশা নেই বলেই বোধহয় মশারি নেই। কতদিন পর তিনি মশারি ছাড়া ঘুমুচ্ছেন। নিজেকে কেমন যেন মুক্ত মানুষ বলে মনে হচ্ছে।
অষ্টাঙ্গ সংগ্রহ তাঁর হাতে। ঘুমুবার আগে আরো কয়েকটা পাতা ওল্টানো যাক। বইটিতে ঘুমুবার নিয়মকানুনও দেয়া আছে।
আটবার শ্বাস নিতে যেই সময় লাগে সেই সময় পর্যন্ত চিৎ হইয়া তাহার দ্বিগুণ সময় ডান পার্শ্বে, তাহার চারগুণ সময় বাম পার্শ্বে শয়ন করিয়া তারপর যেইভাবে শুইয়া আরাম পাওয়া যায় সেইভাবে শুইতে হয়। নাভির বাম দিকে অগ্নি অবস্থান করে। সুতরাং বাম পার্শ্বে শয়ন করা উচিত….
তিনি ঠিক বই-এর মতো নিয়মে শোবার চেষ্টা করলেন। যদিও খুব ভালোমতোই জানেন—যেভাবেই শোয়া হোক রাত কাটবে নির্ঘুম। এখন পর্যন্ত নতুন জায়গায় প্রথম রাতে তিনি কখনো ঘুমুতে পারেন নি। নির্ঘুম রাত কাটাতে তাঁর খারাপ লাগে না। বরং বলা চলে ভালো লাগে। ভাববার সময় পাওয়া যায়। আজকাল কোনো কিছুর জন্যেই সময় বের করা যায় না। একান্ত ভাববার জন্যে যে সময় সব মানুষের দরকার সেই সময় কি আমরা দিতে পারি? কর্মক্লান্তি দিনের শেষে লম্বা ঘুম, আবার ব্যস্ত দিনের শুরু।
জেগে থাকার এক ধরনের গোপন ইচ্ছা ছিল বলেই বোধহয় অল্প সময়ের ভেতর ঘুমে তাঁর চোখ জড়িয়ে এল। ঘুমিয়ে তিনি বিচিত্র একটি স্বপ্ন দেখলেন।
এই ঘরেই খাটে তিনি শুয়ে আছেন। তাঁর মন কি কারণে অসম্ভব খারাপ। বুকের ভেতর একধরনের কষ্ট হচ্ছে। এমন সময় দরজা খুলে গেল। হারিকেন হাতে ঢুকলো পুষ্প। পুষ্পকে কেমন বউ-বউ দেখাচ্ছে। তিনি খানিকটা হকচকিয়ে গেছেন। এই গভীর রাতে মেয়েটি তাঁর ঘরে কেন? পুষ্প হারিকেন টেবিলের উপর রাখতে রাখতে বলল, ‘তুমি এখনো ঘুমাও নি।’
তিনি অসম্ভব চমকে উঠলেন। মেয়েটি তাঁকে তুমি-তুমি করে বলছে কেন?
পুষ্প খুব সহজ ভঙ্গিতে খাটে পা ঝুলিয়ে বসল। অভিমানী গলায় বলল, ‘আচ্ছা শোন, তুমি এত ভুল কথা বল কেন?’
তিনি মনের বিস্ময় চাপা দিয়ে বললেন, ‘ভুল কথা কি বললাম?’
‘ধুতরা ফুল বুঝি বিষাক্ত? মোটেই বিষাক্ত নয়। ধুতরার ফল বিষাক্ত—বুঝলেন জনাব?’
‘বুঝলেন জনাব’ বলে পুষ্প খুব হাসছে। খুব পা নাড়াচ্ছে। কে? এই মেয়েটা কে? হচ্ছে কি এসব?
তাঁর ঘুম ভেঙে গেল। সবে ভোর হয়েছে। গাছে-গাছে অসংখ্য পাখি ডাকছে।
নীল অপরাজিতা – ৩
মোফাজ্জল করিম সাহেব ফজর ওয়াক্তে ঘুম থেকে ওঠেন।
হাত-মুখ ধোয়ার আগেই চুলা ধরিয়ে ভাতের হাঁড়ি চাপিয়ে দেন। ওজু করে নামাজ শেষ করতে করতে চাল ফুটে যায়। মাড় গেলে আগুন-গরম ভাতে তিন চামুচ ঘি ঢেলে খাওয়া শুরু করেন। খাওয়া শেষ হতে হতে সূর্য উঠে যায়। তিনি রওনা হয়ে যান স্কুলে। স্কুল তাঁর বাড়ি থেকে আড়াই মাইল। বর্ষাকালে নৌকায় অনেক ঘুরপথে যেতে হয়। দু’থেকে আড়াই ঘন্টার মতো লাগে। স্কুলে পৌঁছতে হয় আটটার আগে। যারা এবার এসএসসি দিচ্ছে তাদের স্পেশাল কোচিং হয় আটটা থেকে দশটা। তাঁর উপর দায়িত্ব হল অঙ্ক এবং ইংরেজির। আগে শুধু অঙ্ক করাতেন। নলিনীবাবু দেখতেন ইংরেজি। নলিনীবাবুর হাঁপানির টান খুব বেড়ে যাওয়ায় কিছুদিন ধরে আসছেন না। করিম সাহেবের উপর ডাবল দায়িত্ব পড়ে গেছে। খুব চাপ যাচ্ছে। স্কুল থেকে ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা। সন্ধ্যায় বাসায় ওসি সাহেবের এক শালা পড়তে আসে। মহা মূর্খ। এক মাস টেন্স পড়াবার পর জিজ্ঞেস করলেন, আমি বাড়ি যাই ইংরেজি কি? সে পাঁচ মিনিটি চিন্তা করে বলল I am home going. তিনি প্রচন্ড থাবড়া দিলেন। সে আগের চেয়েও গম্ভীর গলায় বলল, I home going. তাঁর ইচ্ছা করছিল শক্ত আছাড় দেন। একে বলে পন্ডশ্রম।
আজ করিম সাহেব ঘুম থেকে উঠে দেখেন পুষ্প তার আগেই উঠে বসে আছে। কেরোসিনের চুলায় চাল ফুটছে। তিনি খুশি গলায় বললেন, ‘তুই এত সকাল-সকাল উঠলি যে! রাতে ঘুম ভালো হয় নাই?’
‘হয়েছে।’
‘সকালে উঠে ভালো করেছিস মা। সুন্দর করে কয়েকটা পরোটা বানিয়ে ফেল। উনি রাতে না খেয়ে ঘুমিয়েছেন। ক্ষিধে নিয়ে ঘুম ভাঙবে। গোশত-পরোটা দিবি। আর একটা ডিম ভেজে দিস।’
‘তুমি থাকবে না বাবা?’
‘না। একদিন কামাই হয়ে গেছে। অঙ্ক হল প্রাকটিসের ব্যাপার। পরপর দুই দিন কামাই দিলে সব ভুলে যাবে। সব গরু-গাধার দল।’
‘একা-একা উনার কাছে নাশতা নিয়ে যাব বাবা?’
‘হুঁ।’
‘আমার কেন জানি ভয়-ভয় করে। কি গম্ভীর। কাল রাতে একটা কথাও বললেন না। আমি জানি আজও বলবেন না। নাশতাও খাবেন না। তাছাড়া আমার পরোটাও ভালো হয় না বাবা।’
‘তুই একটু ভুল করছিস মা। এইসব মানুষ খাওয়া-খাদ্য নিয়ে মোটেই মাথা ঘামায় না। তুই পোলাও-কোর্মা দিলে যেভাবে খাবেন, ডাল-ভাত দিলেও একইভাবে খাবেন। কিছুক্ষণ পর তুই যদি জিজ্ঞেস করিস, কি দিয়ে খেলেন? বলতে পারবে না। হাঁ করে তাকিয়ে থাকবে।
পুষ্প হেসে ফেলল।
করিম সাহেব বললেন, ‘হাসছিস কেন?’
‘তুমি যেভাবে কথা বলছ তাতে মনে হয়—এই রকম মানুষ তুমি কত দেখেছ। আসলে এই প্রথম দেখছ।’
‘দেখতে হয় না মা। আন্দাজ করা যায়।’
‘ভদ্রলোককে তোমার কি খুব পছন্দ হয়েছে?’
‘পছন্দ হবে না, কী বলিস তুই। নিজে যা ভালো মনে করেন তাই করেন। কাল রাতের কথা চিন্তা কর—অন্য কেউ হলে কি করত? শরীর যত খারাপই হোক দু’মুঠ ভাত খেত। আমাদের খুশি করার জন্য করত। উনি তা করলেন না। কে খুশি হল কে হল না তা নিয়ে মাথাব্যথা নেই।’
পুষ্প হাসতে হাসতে বলল, ‘উনি যদি খারাপ কিছু করেন, তুমি তারও একটা ভালো ব্যাখ্যা বের করবে।’
‘তা তো করবই। কারণ খারাপ কিছু করার ক্ষমতাই এঁদের নেই। সৃষ্টিশীল মানুষ হচ্ছে ঈশ্বরের মতো। ঈশ্বর যেমন মন্দ কিছু করতে পারেন না, এঁরাও পারেন না।’
‘উনাকে দেবতা ডাকলে কেমন হয় বাবা?’
‘ডাকতে পারিস কোনো অসুবিধা নেই, তবে মনে-মনে ডাকাই ভালো। রেগে যেতে পারেন। এই জাতীয় মানুষদের রাগ বেশি থাকে।
‘বাবা, নামাজ শেষ করে আস। তোমার ভাত হয়ে গেছে। শুকনো মরিচ ভেজে দেব?’
‘দে।’
ভাত খেতে খেতে তিনি পুষ্পকে একগাদা উপদেশ দিয়ে গেলেন—বার-বার খোঁজ নিয়ে আসবি উনার ঘুম ভাঙল কি না। ঘুম ভাঙতেই চা দিবি, তারপর বলবি আমার কথা।’
‘তোমার কথা কি বলব?’
‘ঐ যে স্কুলে গেলাম, সন্ধ্যার পর ফিরব। উনি দুপুরে কি খেতে চান জিজ্ঞেস করবি। মতির মার খোঁজ নিবি। আমি জেলেপাড়ায় বলে যাব ওরা মাছ দিয়ে যাবে।
‘বাবা উনি যদি বলেন, তোমাদের এখানে খাব না; বাবুর্চির ব্যবস্থা করতে বলেছিলাম—সেই ব্যবস্থা করে দাও!’
‘তাহলে বলবি, বাবা এসে ব্যবস্থা করবেন। বুঝিয়ে-সুঝিয়ে শান্ত করবি।’
‘বুঝিয়ে-সুঝিয়ে কীভাবে শান্ত করব? উনি তো ছেলেমানুষ না।’
‘এই ধরনের মানুষ স্বভাব-চরিত্রে ছেলেমানুষ থাকে।’
‘কোত্থেকে যে তুমি এইসব ধারণা পেয়েছ কে জানে!
‘উনি তো ঘরে আছেনই। আমার কথা অক্ষরে-অক্ষরে মিলিয়ে নে।’
‘আচ্ছা মিলিয়ে নেব।’
‘আর শোন্ মা, উনি যদি ঘুরতে-টুরতে যেতে চান—নিয়ে যাবি।’
‘কাদার মধ্যে কোথায় ঘুরবেন?’
‘কাদা-পানি এইসব নিয়ে এঁদের কোনো মাথাব্যথা নেই। আমরা সাধারণ মানুষরা এইসব নিয়ে মাথা ঘামাই। এই বুঝি পায়ে কাদা লেগে গেল, এই বুঝি হাত নোংরা হল। যাঁদের মন পরিষ্কার তাঁরা শরীরের নোংরা নিয়ে মাথা ঘামান না। মন যাদের নোংরা, শরীর পরিষ্কারের জন্যে তাদের চেষ্টার শেষ নাই।’
‘আমি তো এই দলে পড়ে যাচ্ছি বাবা। নোংরা আমি সহ্যই করতে পারি না। আমার মন কি নোংরা?’
করিম সাহেব থতমত খেয়ে গেলেন। হাত ধুতে ধুতে বললেন, এইটা একটা কথার কথা বললাম। আমি রওনা হয়ে যাচ্ছিগো মা। মতির মাকে খবর দিতে ভুলবি না।
.
পিরিচ দিয়ে ঢাকা চায়ের কাপ হাতে দরজার ওপাশে পুষ্প বেশ কিছুক্ষণ হল দাঁড়িয়ে আছে। কেন জানি তার অসম্ভব ভয় করছে। সে প্রায় অস্পষ্ট গলায় বলল, ‘আপনার চা। ভেতরে আসব?’
শওকত সাহেব কিছু বললেন না। নিজে উঠে দরজা খুলে দিলেন। পুষ্প ঢুকল। তিনি বললেন, ‘কেমন আছ পুষ্প?’ তাঁর গলার স্বর এত আন্তরিক যে পুষ্প হকচকিয়ে গেল। শওকত সাহেব চায়ের কাপ হাতে নিতে-নিতে বললেন, ‘কাল রাতে আমি তোমাকে একটা ভুল কথা বলেছিলাম। আমি বলেছিলাম ধুতরা ফুল বিষাক্ত। এটা ভুল। ধুতরা ফুল বিষাক্ত না। সাদা এবং নীল মেশানো ফুল। খুব সুন্দর। ধুতরার ফল বিষাক্ত। ফুল নয়।’
পুষ্প নিচু গলায় বলল, “আমি জানি।’
‘জান তাহলে রাতে বললে না কেন?
পুষ্প আগের চেয়েও মৃদু গলায় বলল, ‘বলেছি। মনে-মনে বলেছি।’
‘মনে মনে বলেছ মানে?’
পুষ্প খুব নিচু করে বলল, ‘কেউ যখন ভুল কথা বলে তখন আমি মনে-মনে বলি, কথাটা ভুল। মুখে কিছু বলি না।’
‘কাউকেই বল না?’
‘খুব যারা প্রিয় তাদের বলি।’
‘এ রকম খুব প্রিয় মানুষ তোমার ক’জন আছে?’
পুষ্প জবাব দিল না। তিনি আবার বললেন, ‘প্রশ্নটার জবাব দাও। মনে-মনে বলতে হয় না; সরাসরি বলা যায় এমন প্রিয় মানুষ তোমার ক’জন আছে?’
‘নেই।’
‘তোমার বাবা। তিনি তো আছেন।’
পুষ্প চুপ করে রইল। তিনি শান্ত গলায় বললেন, ‘বাবা কি তোমার খুব প্রিয় নন?’
‘হ্যাঁ প্রিয়, খুবই প্রিয়।’
‘তবু ঠিক সে রকম প্রিয় নয়—তাই—কি?’
‘স্যার আমি আপনার জন্যে নাশতা নিয়ে আসি। রাতে খান নি, আপনার নিশ্চয়ই খুব ক্ষিধে পেয়েছে।’
‘এত ব্যস্ত হবার কিছু নেই। তুমি বস তো। তোমার সঙ্গে খানিকক্ষণ গল্প করি। দাঁড়িয়ে আছ কেন? বস। আরাম করে বস।
পুষ্প তবু দাঁড়িয়েই রইল। সে এখনো চোখ তুলে তাকাচ্ছে না। তিনি মেয়েটাকে ভয় পাইয়ে দিয়েছেন। এমন কিছু কি তিনি বলেছেন যাতে সে এতটা ভয় পেয়েছে। তিনি আবারো বললেন-’পুষ্প বস।
পুষ্প বসল।
তার বসা দেখে তিনি চমকে উঠলেন। স্বপ্নে পুষ্প ঠিক এইভাবেই বসেছিল! এমন ভঙ্গিতেই মুখ ফিরিয়ে রেখেছিল!
মেয়েটার ভয় ভাঙিয়ে দেয়া দরকার। মজার কিছু কথা বলে তাকে জানিয়ে দেয়া দরকার যে, তিনি ভয়াবহ কোনো মানুষ না। এই মেয়ে একবারও হাসে নি। হাসলে তাকে কেমন দেখায়?
‘পুষ্প’
‘জ্বি।’
‘গত রাতে তোমাদের বাড়ির বারান্দায় বসে একটা ব্যাপার নিয়ে ভাবছিলাম। ব্যাপারটা তোমাকে বলি। গত রাতে বারান্দায় বসে-বসে আমি কত বিচিত্র শব্দ শুনলাম কিন্তু ব্যাঙ ডাকতে শুনলাম না। খুবই অবাক হলাম। তারপর ভেবে—ভেবে এর একটা কারণও বের করলাম। কারণটা সত্যি কি-না তুমি বল তো। দেখি তোমার কেমন বুদ্ধি।’
পুষ্প খুব আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছে। মেয়েটাকে আজ এত সুন্দর লাগছে কেন? অসহ্য সুন্দর। এক রাতে সে নিশ্চয়ই বদলে যায় নি। তাহলে কি তাঁর দেখার চোখ বদলে গেছে। স্বপ্নটার কারণে—এটা হচ্ছে নাতো?
তিনি পুষ্পের চোখে চোখ রেখে বললেন, ‘কাল পূর্ণিমা ছিল বলে আমার ধারণা। ফকা ফকা জ্যোৎস্না। ব্যাঙ ডাকে ডাঙায় উঠে। চাঁদের আলোয় তাদের দেখা যায়। ব্যাঙগুলো ডাকছিল না, কারণ তারা ভাবছিল ডাকলেই, শব্দ শুনে শেয়ালের পাল এসে উপস্থিত হবে। চাঁদের আলোয় তারা বুঝে ফেলবে কোথায় ব্যাঙরা আছে। শেয়াল এসে এদের কপাকপ খাবে। এই ভয়ে ব্যাঙের দল চুপ করে ছিল। তোমার কি ধারণা আমার যুক্তি ঠিক আছে?
পুষ্প কথা বলল না। তাকিয়ে রইল।
তিনি বললেন, ‘আমার যুক্তি ঠিক নেই?’
‘মনে হয় ঠিক।’
‘মোটেই ঠিক নেই। আমি তোমাকে ভুল যুক্তি দিয়েছি। শেয়াল দেখে ব্যাঙরা ভয় পাবে কেন? লাফ দিয়ে পানিতে নেমে যাবে।’
পুষ্প বলল, ‘তাহলে তারা ডাকছিল না কেন?’
‘আকাশে মেঘ হলে কিংবা মেঘ হবার সম্ভাবনা থাকলেই ব্যাঙ ডাকে। চাঁদের আলো থাকা মানে—মেঘ নেই। কাজেই ওরা চুপ করে ছিল। বুঝতে পারছ?’
‘জ্বি পারছি।’
পুষ্প এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। সে খুব অবাক হয়েছে।
তিনি বললেন, ‘তোমার বাবা কোথায়?’
‘উনি স্কুলে গেছেন। সন্ধ্যার পর ফিরবেন।’
‘আচ্ছা পুষ্প তোমাদের এই জায়গায় দেখার মতো কি আছে?’
‘কিছুই নেই।’
‘একেবারে কিছু নেই তা কি হয়। কিছু নিশ্চয়ই আছে।’
‘নদীর ঐ পাড়ে পুরানো মঠ আছে।’
‘মঠ কি জিনিস?’
‘আমি নিজেও জানি না—বজলুর রহমান চাচা দেখে এসে বলেছিলেন—এই জিনিস পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে থাকলে তারা এটাকে পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্য বানিয়ে ফেলত। জিনিসটা বাংলাদেশের মতো গরিব দেশে আছে বলে কেউ খবরও রাখে না।’
মেয়েটার ভয় সম্ভবত কেটে গেছে, সহজভাবেই কথা বলছে।
শওকত সাহেব বললেন, ‘বজলুর রহমানের কথার উপর কোনোরকম গুরুত্ব দেয়া ঠিক না পুষ্প।’
পুষ্প বলল, ‘তা আমি জানি। কিন্তু উনি এত ভালোমানুষ যে, কথা শুনলেই বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে।’
‘ভালো মানুষ কী করে বুঝলে?’
পুষ্প জবাব দিল না। কিন্তু তার মুখে এই প্রথম হাসি দেখা গেল। মেয়েটা খুব সুন্দর করে হাসে।
‘শোন পুষ্প, উনি ভালোমানুষ কি না তা কিন্তু তুমি জান না। উনার আচার—ব্যবহার কাণ্ডকারখানা তোমার পছন্দ হয়েছে—তাই তাঁকে ভালোমানুষ ভাবছ।
‘উনি কি ভালোমানুষ না?’
খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে শওকত সাহেব বললেন, ‘যেসব সৎগুণ থাকলে আমরা মানুষকে ভালোমানুষ বলি তা তাঁর নেই। তবে তাঁর চরিত্রে কিছু মজার ব্যাপার আছে। যে কারণে আমিও তাঁকে পছন্দ করি। তাঁর বিস্মিত এবং মুগ্ধ হবার ক্ষমতা অসাধারণ। এইটিই তাঁর একমাত্র গুণ।’
পুষ্প উঠে দাঁড়াল।
‘আপনার নাশতা নিয়ে আসি।’
‘এক মিনিট দাঁড়াও। আমার ধারণা তুমি মনে-মনে বলেছ—’আপনার কথাটা ভুল’ তাই না?’
‘জ্বি—আমি বলেছি।’
‘আচ্ছা যাও নাশতা নিয়ে আস।’
পুষ্প থেমে-থেমে বলল, আমি কি আপনার সঙ্গে যাব? মঠ দেখানোর জন্যে?
‘না। কাউকে সঙ্গে নিয়ে ঘুরতে আমার ভালো লাগে না।’
‘আপনি তো জানেন না কোথায়।’
‘খুঁজে বের করে নেব। তাছাড়া মঠ দেখতেই হবে এমন তো কোনো কথা নেই। আমি কিছু দেখার জন্যে আসি নি। যাও নাশতা নিয়ে এসো।’
.
নাশতা খেয়ে তিনি খাতা খুলে বসলেন। বেরুতে ইচ্ছা করছে না। জানালার পাশেই টেবিল। দৃষ্টি বাইরে চলে যাচ্ছে। কী সুন্দর আকাশ। আকাশে আবার মেঘ জমতে শুরু করেছে। বর্ষা দেখার জন্যে আসলে গ্রামেই আসা উচিত। জানালার পাশে, বিরাট একটা আতা গাছ। তিনি গাছগাছালি বিশেষ চেনেন না। কিন্তু আতা গাছ চেনেন। ছেলেবেলায় যে বাড়িতে ছিলেন, সে বাড়িতে দু’টি আতা গাছ ছিল।
তিনি অনেকক্ষণ আতা গাছের দিকে তাকিয়ে রইলেন। ছেলেবেলার বন্ধুকে যেন অনেকদিন পর দেখলেন। আতা গাছের ডালে কাকের বাসা। সেই বাসায় কাকের ছানা দেখা যাচ্ছে। তা তো হওয়ার কথা না। আষাঢ় মাস ঝড়-বৃষ্টির মাস। পাখিদের এই সময় বাচ্চা ফুটানোর কথা না। প্রকৃতি এই ভুল করবে না। তিনি কি চোখে ভুল দেখছেন?
কে বলেছিল কথাটা—কোনো লেখকের লেখার টেবিল জানালার পাশে থাকা উচিত না। জানালার পাশে টেবিল থাকলে তারা কখনো লিখতে পারেন না।
আসলেই বোধহয় তাই। লেখকের লেখা উচিত চার দেয়ালের ভেতরে আবদ্ধ থেকে। তখনি তাঁরা মনের জানালা খুলে দিতে পারেন।
তিনি প্রথম লাইনটি লিখলেন।
তিনি তাঁর পাণ্ডুলিপি অসংখ্যবার কাটবেন—কিন্তু প্রথম লাইনটি বদলাবেন না।
প্রথম লাইনটি হচ্ছে—”পাখি হিসেবে কাক বেশ অদ্ভুত।”
লাইনটি তাঁর পছন্দ হচ্ছে না। পছন্দ না হলেও উপায় নেই। এই পাণ্ডুলিপির প্রথম লাইনটি—গ্রহণ করা ছাড়া গতি নেই।
কি লিখবেন সব ঠিক করা আছে। ঘটনা সাজানো আছে। এই লেখায় কি বলতে চান তাও তিনি জানেন। দিনের পর দিন এই লেখাটি নিয়ে তিনি ভেবেছেন। চরিত্রগুলো এখন আর চরিত্র নেই—রক্তমাংসের জীবন্ত মানুষ। বলতে গেলে গত ছ’মাসে এই চরিত্রগুলোর কারো না কারো সঙ্গে তাঁর রোজই দেখা হয়েছে।
শুরুতে লেখার গতি মন্থর ছিল, কিছুক্ষণের ভেতর গতি বেড়ে গেল। অতি দ্রুত কলম চলতে লাগল। এক বৈঠকে যে করেই হোক পঁচিশ পৃষ্ঠার মতো লিখে ফেলতে হবে। চরিত্রগুলোকে বেঁধে ফেলতে হবে। যেন এরা কিছুতেই বেরিয়ে যেতে না পারে।
বিকেল পাঁচটায় লেখার টেবিল থেকে উঠলেন। বৃষ্টি এখনো নামে নি। আকাশ অন্ধকার হয়ে আছে। তিনি অত্যন্ত ক্ষুধার্ত এবং ক্লান্ত বোধ করছেন। দুপুরে কিছু খান নি।
পুষ্প ঠিক দু’টার সময় খাবার নিয়ে এসেছিল। তিনি রূঢ় গলায় বলেছেন, ‘আমি লিখতে বসেছি। খবরদার আমাকে বিরক্ত করবে না।’
পুষ্প কাঁদো-কাঁদো গলায় বলল, ‘আপনি দুপুরে খাবেন না?’
‘লেখার টেবিল ছেড়ে উঠলেই খাব। তোমাকে আসতে হবে না। আমি তোমাকে ডেকে আনব। কিন্তু তুমি আর আসবে না। লেখার সময় বিরক্ত করলে আমি খুব রাগ করি।’
পুষ্প আর বিরক্ত করে নি। কিন্তু বেশ কয়েকবার এসে উঁকি দিয়ে গিয়েছে। একজনকে অভুক্ত রেখে সে নিজেও খাবার নিয়ে বসতে পারে নি।
শওকত সাহেব লেখা কাগজগুলো সুটকেসে ঢুকিয়ে ফেললেন। তিনি এখন হাঁটতে বের হবেন। বৃষ্টির পানি এসে লেখাগুলো আবার নষ্ট না হয়।
এই অবেলায় ভাত খেতে বসার কোনো মানে হয় না। রেনু চার পাঁচটা টিনের কৌটা দিয়ে দিয়েছে। একটায় পনির, দু’টা কৌটায় বিস্কিট, একটিতে কাজু বাদাম। রাত জেগে লেখার সময় তাঁর ক্ষিধে পায়। ক্ষিধের রসদ। পনিরগুলো টুকরো করে কাটা। দু’স্লাইস পনির এবং কয়েকটা কাজু বাদাম মুখে দেয়ামাত্র ক্ষিধে কমে গেল। তিনি ঘর থেকে বের হয়ে এলেন। তার মিনিট দশেকের ভেতর আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামল। শোঁ-শোঁ শব্দে বাতাস বইতে লাগল। পুষ্প ছুটে এল দোতলায়। ঘর তালাবন্ধ। মানুষটা গেল কোথায়? সত্যি-সত্যি ঝড় হচ্ছে।
.
আষাঢ় মাসে এমন ঝড় কি হওয়ার কথা?
কালবৈশাখী হবে বৈশাখে। আশ্বিন মাসে আশ্বিনা ঝড়। আষাঢ় মাসে প্রবল বৃষ্টিপাত ছাড়া তো কিছু হবার কথা না। শওকত সাহেব খানিকটা দিশাহারা হলেন। ঝড়ের প্রথম ঝাপ্টার সময় তিনি একটা পুকুরপাড়ে। আশেপাশে কোনো জনমানব নেই। খুঁটিতে বাঁধা একটা গরু তারস্বরে চিৎকার করছে। পুকুরপাড়ে পাকা কালীমন্দির। সেই মন্দিরের দরজা তালাবন্ধ। উত্তর দিকে ধানখেত। কী ধান এগুলো? আউস ধান নিশ্চয় মন্দিরের পাশ দিয়ে কাঁচা রাস্তা গিয়েছে নদীর দিকে। ঝড়ের সময় রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা কি ঠিক হবে? মাথার উপর গাছের ডাল ভেঙে পড়তে পারে। খোলা মাঠে থাকাই তো সবচে’ ভালো। আউশের খেতে নেমে পড়বেন?
বৃষ্টি নেমেছে মুষঝারে। বৃষ্টির পানি কনকনে ঠাণ্ডা। সুচের মতো গায়ে বিঁধছে। তিনি ভিজে পুরোপুরি জবজবে হয়ে গেছেন। চশমার কাচ বৃষ্টির পানিতে অস্পষ্ট হয়ে আছে। এখন চশমা থাকা না-থাকার মধ্যে কোনো বেশ কম নেই। তিনি চশমা খুলে হাতে নিয়ে নিয়েছেন। এখন একজন অন্ধের সঙ্গে তাঁর কোনো তফাৎ নেই।
ঝড়ের আরেকটা প্রবল ঝাপ্টা এল। বাতাসের কী প্রচণ্ড শক্তি! তাঁকে প্রায় উড়িয়ে নিয়ে যায়।
‘হুই হুই হুই…’
তিনি এদিক-ওদিক তাকাচ্ছেন। কেউ কি ডাকছে তাঁকে? শিস দেয়ার মতো তীক্ষ্ণ শব্দ হচ্ছে বাতাসের। এই শব্দ ছাপিয়ে মানুষের গলা ভেসে আসার কথা না। ‘হুই হুই, ভদ্রলোক! হুই!’
হ্যাঁ তাকেই ডাকছে। গামছা পরা একজন কে এগিয়ে আসছে। অতি দ্রুত আসছে।
‘আপনে কোন্ দেশি বেকুব? ঝড়ের সময় নাইরকেল গাছের নিচে?’
তাই তো! তিনি এতক্ষণ কয়েকটা নারিকেল গাছের নিচেই দাঁড়িয়ে আছেন।
তিনি সরে এলেন। বেশিদূর সরতে পারলেন না—বাতাস তাঁকে ধানখেতে নিয়ে ফেলল। হাতের মুঠিতে ধরা চশমা মট করে ভেঙে গেল। হাত জ্বালা করছে। কেটেছে নিশ্চয়ই। কতটা কেটেছে কে জানে।
নারকেল গাছের নিচ থেকে যে তাকে সরতে বলল, দেখা গেল সে-ই খুটিতে বাঁধা গরুটির মালিক। গরু ছেড়ে দিয়ে সেও পলকের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেল। শওকত সাহেব কাদা-পানিতে মাখা হয়ে বৃষ্টি এবং ঝড় কমার জন্যে অপেক্ষা করতে লাগলেন। ঝড় পুরোপুরি থামার জন্যে তাঁকে আধঘন্টার মতো অপেক্ষা করতে হল। এই আধঘন্টায় ময়নাতলা গ্রামের উপর ছোটখাট তাণ্ডব ঘটে গেল। বেশ কিছু কাঁচা বাড়ি ধসে গেল। কয়েকটা বাড়ির টিনের চাল উড়ে গেল। ময়নাতলা হাই স্কুলের প্রাইমারি সেকশানের কোনো চিহ্নই রইল না।
শওকত সাহেব বাড়ির দিকে রওনা হয়েছেন। চশমা নেই বলে কিছুই দেখতে পাচ্ছেন না। চশমা থাকলেও খুব যে লাভ হত তা না। ঘন অন্ধকার। আকাশ এখনো মেঘে মেঘে ঢাকা। ঘনঘন বিজলি চমকাচ্ছে। যে ব্যাঙের ডাক শোনা যাচ্ছে না বলে অনেক গবেষণা করেছেন—সেই ব্যাঙের ডাক এখন চারদিক থেকেই শোনা যাচ্ছে। সেই ডাকের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ঝিঁঝির ডাক
হারিকেন হাতে কে যেন আসছে। শওকত সাহেব অপেক্ষা করতে লাগলেন। লোকটি কাছে এসে অবাক হয়ে বলল, ‘আপনে কেডা?’
‘আমার নাম শওকত।’
‘কোন বাড়ির?’
‘মোফাজ্জল করিম সাহেবের বাড়িতে থাকি।’
‘আপনে তো যাইতেছেন উল্টা পথে। এই পথ গেছে সোহাগী নদীর ঘাটলায়।’
‘কী নদী বললেন?’
‘সোহাগী।’
‘নদীর নাম ছোট গাঙ না?’
‘আমরা মুখের কথায় বলি ছোট গাঙ। ভালো নাম সোহাগী।’
‘শুনে খুশি হলাম। আপনি কি আমাকে মোফাজ্জল করিম সাহেবের বাড়িতে নিয়ে যাবেন? চশমা ভেঙে যাওয়ায় কিছুই দেখছি না।
‘দেখনের কিছু নাই—আপনে ডাইনের রাস্তা ধইরা নাক বরাবর যান।’
শওকত সাহেব নাক বরাবর রওনা হলেন। জোনাকি পোকাগুলো আজ নেই। থাকলে খানিকটা আলো কি আর ওদের কাছ থেকে পাওয়া যেত না? ঝড় সম্ভবত বেচারিদের উড়িয়ে নিয়ে গেছে।
পুষ্প কখন থেকে হারিকেন হাতে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। ভয়ে তার আত্মা শুকিয়ে গেছে। এত বড় একটা ঝড় সে খালি বাড়িতে পার করেছে। বিকট শব্দে আতা গাছের একটা ডাল ভেঙেছে। সে ভেবেছিল পুরো বাড়িটাই বুঝি ভেঙে পড়ে গেছে। তার চেয়েও বড় ভয় এই ঝড়ে বিদেশি মানুষটা কোথায় ঘুরছে। কোনো বিপদ-আপদ হয় নি তো? বাবাই বা কোথায়? নৌকায় থাকলে নির্ঘাৎ নৌকা ডুবে গেছে।
পুষ্পের গলা ছেড়ে কাঁদতে ইচ্ছা করছে। তাদের বাড়ি গ্রামের এক প্রান্তে। আশেপাশে কোনো বাড়ি ঘর নেই যে সে ছুটে গিয়ে বলবে—’আমার বড় বিপদ। আমাকে একটু সাহায্য করুন।’
শওকত সাহেব নিঃশব্দে উপস্থিত হলেন। পুষ্প হারিকেন উচিয়ে ধরল। তিনি লজ্জিত ও বিব্রত গলায় বললেন, ‘ঝড়ের মধ্যে পড়ে গিয়েছিলাম। চশমা-টশমা ভেঙে একাকার করেছি।’
পুষ্প কিছুই বলল না।
‘চিনতে পারছ তো আমাকে? কাদা মেখে ভূত হয়ে আছি। তোমাদের বাড়িতে ডেটল জাতীয় কিছু আছে? হাত কেটে ফেলেছি।’
পুষ্প হারিকেন উঁচু করে ধরেই আছে। কিছু বলছে না। মনে হচ্ছে সে একটা ঘোরের মধ্যে আছে।
‘তুমি বোধহয় খুব দুশ্চিন্তা করছিলে। এমন ঝড় শুরু হবে কল্পনাও করি নি। তবে মজার ব্যাপার কি জান-–I enjoyed it. শুধু না—I enjoyed it thoroughly. করিম সাহেব কোথায়? উনি ফেরেন নি?’
‘না।’
‘তুমি পুরো ঝড়ের সময়টা একা ছিলে?’
‘জ্বি। আপনি কুয়াতলায় আসুন। কাদা ধুয়ে তুলুন। আমি সাবান এনে দিচ্ছি। হাত কতটা কেটেছে?’
‘বেশি না।’
‘দেখি।’
তিনি হাত মেলে ধরলেন। অনেকখানিই কেটেছে। রক্তে মাখামাখি হয়ে আছে। ‘কুয়াতলা কোন দিকে? আমি এখন প্রায় কিছুই দেখতে পাচ্ছি না। হারিকেনটা ভালোমতো ধর।’
পুষ্প বলল, ‘চশমা ছাড়া এখন আপনার চলবে কি করে?’
‘সুটকেসে আমার আরেকটা চশমা আছে।’
.
শওকত সাহেব মাথায় প্রায় তিন বালতি পানি ঢেলে ফেললেন। পুষ্প বলল, ‘আর পানি দেবেন না, ঠাণ্ডা বাধিয়ে বসবেন।’
তিনি হাসিমুখে বললেন, ‘পানিটা গরম, গায়ে ঢালতে খুব আরাম লাগছে। বৃষ্টির পানি কি যে ঠাণ্ডা ছিল কল্পনাও করতে পারবে না। মনে হচ্ছিল শীতে জমে যাচ্ছি। শোন পুষ্প তোমাকে এখানে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে না—তুমি খুব কড়া করে এক কাপ চা বানাও।’
পুষ্প নড়ল না। সে তোয়ালে হাতে দাঁড়িয়ে আছে। পুষ্প আবার বলল, ‘আর পানি ঢালবেন না। আপনি নির্ঘাৎ অসুখ বাধাবেন।’
‘আমার কিচ্ছু হবে না। আমি হচ্ছি ওয়াটার প্রুফ। যখন ক্লাস টেনে পড়ি তখন একবার বন্ধুদের সঙ্গে বাজি ধরে পৌষ মাসের শীতে পুকুরের পানিতে সারারাত গলা ডুবিয়ে বসে ছিলাম। যদি অসুখ না বাধাই তাহলে একশ’ টাকা পাব; এই ছিল বাজি। বাজিতে জিতে একশ’ টাকা পেলাম এবং “ওয়াটার প্রুফ” টাইটেল পেলাম। এদিকে আমার বন্ধুরা যারা সারারাত পুকুরপাড়ে বসে ছিল—তাদের প্রত্যেকের ঠাণ্ডা লেগে গেল। একজন তো নিউমোনিয়ায় মর-মর হল।
যে পুষ্প এতক্ষণ গম্ভীর হয়ে ছিল সে খিলখিল করে হেসে উঠল।
তিনি বললেন, ‘তুমি দেখি হাসতেও পার! আমি ভেবেছিলাম তুমি হাসতে পার না।’
পুষ্প বলল, ‘আপনি কি সত্যিই ওয়াটার প্রুফ টাইটেল পেয়েছিলেন?’
সত্যি পেয়েছিলাম। একটা রাবার স্ট্যাম্প বানিয়েছিলাম যেখানে লেখা
Md. Shawkat
W.P.
W.P. মানে ওয়াটার প্রুফ। বুঝলে পুষ্প, কেন জানি খুব আনন্দ লাগছে। কারণটা ধরতে পারছি না।
পুষ্প বলল, ‘আমি বলব কারণটা কি?’
‘বল তো।’
‘ঝড়ের সময় আপনি খুব ভয় পেয়েছিলেন। ভেবেছিলেন মারা যাচ্ছেন। যখন দেখলেন মারা যান নি এবং ঝড় শেষ হয়েছে তখন আনন্দে মন ভরে গেল।’
‘যুক্তি তো তুমি ভালোই দিয়েছ। ভেরি গুড। আই লাইক ইট। তোমার বুদ্ধি তো ভালোই।’
‘আপনি কি ধরেই নিয়েছিলেন বুদ্ধি খারাপ হবে?’
‘খারাপ হবে ধরি নি। এভারেজ বুদ্ধি ধরেছিলাম। ভালোও না, খারাপও না।’
‘আপনি কি নিজেকে খুব বুদ্ধিমান মনে করেন?
‘হ্যাঁ করি। তুমি কর না?’
‘হ্যাঁ আমিও করি।’
.
‘ওয়াটার প্রুফ’ টাইটেল রাখা তাঁর সম্ভব হল না। গোসল শেষ করে গা মুছতে গিয়ে মনে হল জ্বর আসছে। হাত-পা কেমন জানি করছে। মাথা ভার ভার হয়ে গেছে। পুরোপুরি নিশ্চিত হবার জন্যে নিজের ঘরে ঢুকে সিগারেট ধরালেন। সিগারেট বিস্বাদ লাগল। তিনি বিছানায় শুয়ে পড়লেন। গায়ে চাদর টেনে দিলেন। চাদরে শীত মানছে না। পুষ্পকে বলতে হবে কম্বল-টম্বল দিয়ে যেতে।
কম্বলের কথা মনে আসতেই-–দু’লাইনের কবিতাও মনে এসে গেল।
“ভঞ্জের পিসি তাই সন্তোষ পান
কুঞ্জকে করেছেন কম্বল দান।”
এখন এই কবিতা মাথার ভেতর ক্রমাগত ঘুরপাক খেতে থাকবে। কিছুতেই মাথা থেকে তাড়ানো যাবে না।
ভঞ্জের পিসি তাই সন্তোষ পান
কুঞ্জকে করেছেন কম্বল দান।
স্বাতীকে এই কবিতা তিনি শোনাতেন। অতি দ্রুত আবৃত্তি করতেন। স্বাতী কিছু না বুঝেই হাততালি দিত এবং খিলখিল করে হাসত। হামাগুড়ি দিয়ে তাঁর কাছে এগিয়ে আসত। একবার স্বাতী খাটে বসে আছে—তিনি ঘরে ঢুকে দ্রুত কবিতা পড়লেন। স্বাতী হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে আসতে গিয়ে খাট থেকে পড়ে অজ্ঞান হয়ে গেল।
রেনু ছুটে এসে মেয়েকে কোলে তুলে নিয়ে চিৎকার করে উঠল—’কি হয়েছে? আমার মেয়ের কি হয়েছে?’
রেনুর সেই হাহাকার এখনো বুকে বিঁধে আছে। কবিতার সঙ্গে সঙ্গে সেই হাহাকারও মনে আসে।
ভঞ্জের পিসি তাই সন্তোষ পান
কুঞ্জকে করেছেন কম্বল দান।
এ কি যন্ত্রণা! লাইন দু’টি আরো গভীরভাবে মাথায় বসে যাচ্ছে। এক সময় মাথা থেকে ছড়িয়ে পড়বে শরীরে। শরীরের রক্ত-কণিকাগুলোও তাল মিলিয়ে আবৃত্তি করতে থাকবে।
.
পুষ্প চা নিয়ে ঢুকেছে।
তিনি পুষ্পের দিকে তাকালেন। পুষ্প চায়ের কাপ টেবিলে রেখে তাঁর দিকে এগিয়ে আসছে। মেয়েটি কি এখনো তাকে ভয় পায়? হ্যাঁ নিশ্চয়ই পায়। সহজ স্বাভাবিক সম্পর্ক এখন আর তাঁর কারো সঙ্গেই নেই। By pains men come to greater pains. বড় হবার জন্যে মানুষকে নানা ধরনের কষ্ট করতে হয়। তারপর দেখা যায় তার জন্যে আরো বড় কষ্ট অপেক্ষা করছে।
‘পুষ্প তুমি আমাকে একটা কম্বল দিতে পার?’
পুষ্প হ্যাঁ-না কিছুই বলল না। খুবই স্বাভাবিক ভঙ্গিতে কপালে হাত রাখল। না—মেয়েটা তাকে খুব বেশি ভয় এখন পায় না। ভয় পেলে এত সহজে কপালে হাত রাখতে পারত না।
‘পুষ্প।’
‘জ্বি।’
‘কবিতা শুনবে?’
পুষ্প চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইল। কিছুই বলল না।
তিনি নিচু গলায় বললেন—
‘ভঞ্জের পিসি তাই সন্তোষ পান
কুঞ্জকে করেছেন কম্বল দান।’
পুষ্প কপাল থেকে হাত সরিয়ে, আবার কপালে অন্য হাত রাখল। গা মনে হল পুড়ে যাচ্ছে। সে কি করবে বুঝতে পারছে না। বাবা এখনো ফিরে নি—ময়নাতলা স্কুলের দপ্তরি ইউনুসকে দিয়ে চিঠি লিখে পাঠিয়েছেন—আমার ফিরিতে কিঞ্চিৎ বিলম্ব হইবে। ঝড়ে স্কুলগৃহের বিপুল ক্ষতি হইয়াছে। হেডমাস্টার সাহেবের অফিসকক্ষের কাগজপত্র বিনষ্ট হইয়াছে। একটা ব্যবস্থা না করিয়া আসিতে পারিতেছি না। এদিকে হেডমাস্টার সাহেব প্রাতঃকালে নেত্রকোনা গিয়াছেন, এখনো ফিরেন নাই।
শওকত সাহেব চোখ খুলে আবার বন্ধ করে ফেললেন। আলো চোখে লাগছে। ‘পুষ্প।’
‘জ্বি।’
‘কুঞ্জ কে জান?’
‘জ্বি না।’
‘জীর্ণ দেউল এক, এক কোণে তারি;
অন্ধ নিয়াছে বাসা কুঞ্জ বিহারী।’
‘আমি আপনার জন্য একটা লেপ নিয়ে আসি।’
‘বাতি নিভিয়ে দিয়ে যাও পুষ্প। বাতি চোখে লাগছে। আমার মনে হয় তুমি আমার কবিতা শুনে ভয় পাচ্ছ। ভাবছ আমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে। সে রকম কিছু হয় নি। জ্বর আসার মুহূর্তে কি করে জানি এই কবিতাটা মাথার ভেতর ঢুকে গেছে—কিছুতেই তাড়াতে পারছি না। তোমার এ রকম হয় না?
‘হয়।’
পুষ্প নিচে নেমে এল। ইউনুসকে পাঠাল, ভবেশবাবুকে খবর দিয়ে আনতে। তিনি হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা করেন। চিকিৎসক হিসেবে তাঁর কোনোরকম খ্যাতি নেই। নিজেই বলেন, ওষুধপত্র যা ছিল সব শেষ। আবার ঢাকায় গিয়ে আনতে হবে। এখন আছে এক প্যাকেট চিনির গুঁড়া। ভগবানের নাম নিয়ে ঐ দিয়ে দি। ভগবানের অসীম লীলা। এতেই রোগ আরোগ্য হয়।
.
ভবেশবাবু তৎক্ষণাৎ এলেন।
রোগীর কপালে হাত দিয়ে বললেন, ‘হোমিওপ্যাথির কর্ম-না। জল চিকিৎসা। মা জননী, প্রচুর জল দিয়ে শরীর ঠাণ্ডা করা লাগব। জলের ব্যবস্থা করেন। শীতল জল।
শওকত সাহেব টকটকে লাল চোখে তাকালেন। সব কেমন এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। কি একটা জরুরি কথা বলা দরকার। কথাটা মনে পড়ছে না। তবে কবিতার দু’চরণ এখন আর মাথায় ঘুরঘুর করছে না।
ভবেশবাবু, মাথায় পানি ঢালতে শুরু করলেন।
ঘুমে শওকত সাহেবের চোখ জড়িয়ে আসছে। এখন আরামবোধ করছেন। পাশ ফিরে ঘুমুতে ইচ্ছা করছে। পাশ ফেরা যাবে না। পাশ ফিরলে কানে পানি ঢুকবে।
ভবেশবাবু বললেন, ‘একটু কি আরাম লাগছে স্যার?’
‘লাগছে।’
‘হরে হরে, কৃষ্ণ কৃষ্ণ—জল চিকিৎসার উপর চিকিৎসা নাই। জল হইল আপনার সর্বরোগগ্রাসিনী। জলে যেসব প্রাণী বাস করে তাদের এই কারণে কোনো রোগ-বালাই হয় না। নীরোগ জীবনযাপন করে।’
শওকত সাহেব বললেন, ‘আপনি জানলেন কিভাবে? এরা অসুস্থ হলে তো আপনাকে খবর দেবে না। ইচ্ছা থাকলেও এদের ক্ষমতা নেই।’
‘স্যার আপনি একেবারেই কথা বলবেন না। চুপ করে থাকেন।’
‘শরীরটা ভালো বোধ হচ্ছে—এই জন্যে কথা বলছি—জ্বর মনে হচ্ছে কমেছে, ভবেশবাবু আপনার কাছে থার্মোমিটার আছে?’
‘আজ্ঞে না। আমি হোমিওপ্যাথি করি। থার্মোটিমার এলোপ্যাথ ডাক্তারদের যন্ত্র। আমি নীতিগতভাবে ব্যবহার করি না।’
‘জ্বর বুঝেন কীভাবে?’
‘গায়ে হাত দিয়ে বুঝি।’
‘গায়ে হাত দিয়ে আমার জ্বর আপনার কত মনে হয়েছিল?’
‘এক শ’ চারের উপরে ছিল। এখন এক শ’ দুই।’
শওকত সাহেব পুষ্পের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আমার ঐ হ্যান্ড ব্যাগ খুলে দেখ প্লাস্টিকের একটা বক্স আছে। ওষুধপত্র এবং থার্মোমিটার থাকার কথা।’
থার্মোমিটার পাওয়া গেল। দেখা গেল জ্বর সত্যি-সত্যি এক শ’ দুই। শওকত সাহেব বললেন, ‘ভবেশবাবু আপনি ভালো চিকিৎসক।’
‘এই কথাটা স্যার আপনি কাগজে লিখে দিয়ে নাম সই করে যাবেন। সার্টিফিকেটের মতো সাথে রাখব।’
পুষ্প বলল, ‘আরো পানি ঢালবেন চাচা?’
ভবেশবাবু বললেন, ‘অবশ্যই—পানি জ্বর ধুইয়া নিয়ে যাইতেছে। সেই সঙ্গে রোগের যে বিষ ছিল—সেই বিষ।’
‘ভবেশবাবু।’
‘আজ্ঞে স্যার।’
‘আপনাদের এখানে যে নদী আছে তার নাম কি?’
‘নদীর নাম সোহাগী।’
‘আমিতো জানতাম—ছোটগাঙ।’
‘আগে তাই ছিল—বজলুর রহমান বলে এক পাগল কিসিমের লোক নাম বদলায়ে দিল।’
‘কীভাবে বদলালো?’
‘মজার ইতিহাস। সভা মিছিল করে একটা হুলস্থুল করেছেন। রোজ সকালে উঠে নদীর ধার দিয়ে দৌড়াতেন আর চিৎকার করতেন—সোহাগী, সোহাগী, সোহাগী। স্কুলে ছাত্রদের গিয়ে বলেছেন—তোমরা এই নাম চারদিকে ছড়ায়ে দিবে। তারপর আপনের গান বাঁধলেন সোহাগী নাম দিয়ে।’
‘গানের লাইন মনে আছে?’
‘আজ্ঞে প্রথম কয়েকটা চরণ আছে।’
‘বলুন তো দেখি।’
‘ও নদী তোর কানে আমি চুপে বলিলাম—
সোহাগী তোর নামরে নদী, সোহাগী তোর নাম।’
‘এখন সবাই কি নদীটাকে এই নামেই ডাকে?’
‘জ্বি, ডাকে। সবাই ডাকে।
শওকত সাহেব ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বললেন—‘আসলে সবাই বোধহয় মনে মনে চাচ্ছিল—এই নদীর সুন্দর একটা নাম হোক। যেই মুহূর্তে নাম পাওয়া গেল—সবাই সঙ্গে সঙ্গে গ্রহণ করল।’
ভবেশবাবু বললেন, ‘আর জল ঢালতে হবে না বলে মনে হয়। জ্বর আরো কমেছে। এখন জ্বর হচ্ছে এক শ’ এক। পুষ্প মা, থামোমিটারটা নিয়ে দেখ তো ঠিক বললাম কিনা।’
শওকত সাহেব বললেন, ‘দেখতে হবে না। আপনার কথা বিশ্বাস করলাম।’
‘আজ্ঞে না। পরীক্ষা হয়ে যাক।’
‘পরীক্ষা করা হল। জ্বর ঠিকই এক শ’ এক।’
‘রোগীকে এখন ঘুমাইতে হবে। পুষ্প মা, রোগীকে একা কইরা দাও। কেউ থাকলেই রোগী কথা বলবো। ঘুম হবে না।’
তারা বের হয়ে আসার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই শওকত সাহেব ঘুমিয়ে পড়লেন। ঘুম ভাঙল রাত এগারোটার দিকে। চোখ মেলেই দেখলেন-বিছানার পাশে পুষ্প বসে আছে। একটু দূরে চেয়ারে পা তুলে মোফাজ্জল করিম সাহেব বসে আছেন। তাঁর মুখ ভয়ে পাংশুবৰ্ণ।
মোফাজ্জল করিম সাহেব বললেন, ‘স্যার আপনার শরীর এখন কেমন?’
‘ভালো। শরীর ভালো। আমি আপনােেদর দারুণ উদ্বেগে রেখেছি—দয়া করে ক্ষমা করবেন।’
‘কিছু খাবেন স্যার? খাওয়ার রুচি হয়েছে?’
‘না। তবে একেবারে খালি পেটে থাকা বোধহয় ঠিক হবে না। একগ্লাস দুধ খেতে পারি।’
.
এশার নামাজ শেষ করে করিম সাহেব খেতে বসলেন।
পুষ্পও বসল তাঁর সঙ্গে। করিম সাহেব বললেন, ‘তোর উপর দিয়ে আজ খুব ঝামেলা গেছে।’ পুষ্প কিছু বলল না।
‘ভবেশবাবুকে বুদ্ধি করে খবর দিয়ে খুব ভালো কাজ করেছিস মা। ভবেশবাবু চিকিৎসা কিছু জানেন না। কিন্তু এরা প্রাচীন মানুষ; অনেক টোটকা ফোটকা জানেন। সময়মতো পানি না ঢাললে অবস্থা হয়ত আরো খারাপ হত। তুই তো কিছু খাচ্ছিস না মা!’
‘আমার খেতে ভালো লাগছে না।’
‘তোর আবার জ্বর আসে নি তো। দেখি বাঁ হাতটা আমার কপালে ছোঁয়া তো।’
‘জ্বর নেই বাবা।’
‘না থাকুক, ছোঁয়াতে বলেছি ছোঁয়া।’
পুষ্প বাবার কপালে হাত রাখল। করিম সাহেব বললেন, ‘হাত তো সোহাগী নদীর পানির মতো ঠাণ্ডা।’
‘বলেছিলাম তো, জ্বর নাই।’
‘হুঁ। তাই দেখছি। এদিকে আরেক কাণ্ড হয়েছে—উনার আসার খবর দিকে-দিকে রটে গিয়েছে। কলমাকান্দার সার্কেল অফিসার চিঠি দিয়ে লোক পাঠালেন—উনাকে নিয়ে তাঁর বাসায় যেন এককাপ চা খেতে যাই। আমি বলেছি ঠিক আছে।’
‘নিজ থেকে ঠিক আছে বললে কি জন্যে—উনি তো যাবে না তুমি জানোই।’
‘যেতেও পারে। এরা ঘনঘন মত বদলায়—কাল সকালেই হয়ত বলবেন, করিম সাহেব এক জায়গায় বসে থাকতে তো আর ভালো লাগছে না। চলুন একটু ঘুরাফেরা করি।’
‘কোনোদিনও এই কথা বলবেন না। মাঝখানে তুমি অপমান হবে।’
‘আমাদের স্কুলের সেক্রেটারির বাসায়ও গিয়েছিলাম—বললাম উনার কথা। মহামূর্খ নামও শোনে নাই। যাইহোক বললাম তরফদার সাহেব একটি সংবর্ধনা স্কুলের তরফ থেকে তো দেয়া লাগে। উনি বলেন সংবর্ধনা দিয়ে কি হবে? মন্ত্রী-টন্ত্রী হলে সাহায্য পাওয়ার ব্যাপার ছিল। মূর্খের কথাবার্তা আর কি। যাইহোক শেষকালে রাজি হয়েছেন। তিন শ’ টাকা সংস্থান করেছেন। একটা হাতে লেখা মানপত্র দেয়া হবে। স্কুলের সব টিচাররা মিলে উনাকে নিয়ে চা-টা খাবেন। এককাপ চা, সিঙাড়া, মিষ্টি আর ধর একটা করে কলা।’
‘তোমাদের স্কুলের অর্ধেকটা উড়িয়ে নিয়ে গেছে ঝড়ে আর তোমরা উনার সংবর্ধনায় পয়সা খরচ করবে?’
‘স্কুল উড়িয়ে নিয়ে গেছে; আবার হবে—উনাকে পাব কোথায়?’
খাওয়া শেষ করে করিম সাহেব কুয়াতলায় হাত ধুতে গেলেন। পেছনে-পেছনে পুষ্পও এলো। চাঁদ উঠেছে। চাঁদের আলোয় আবছা করে সব দেখা যাচ্ছে। পুষ্প থালাবাসন ধুচ্ছে। করিম সাহেব একটু দূরে বসে সিগারেট টানতে টানতে মেয়েকে দেখছেন। তাঁর বড় মায়া লাগছে। মেয়েটা কষ্টে পড়ে গেছে। একা কত কি দেখতে হচ্ছে। মতির মাকে কাল যেভাবেই হোক জোগাড় করতে হবে।
‘পুষ্প।’
‘জ্বি বাবা।’
‘কয়েকজন গ্রাম্য গাথককে খবর দেয়া দরকার। সন্ধ্যাবেলা একদিন এইখানে আসর করলে, উনি খুব পছন্দ করবেন।’
‘উনাকে না জিজ্ঞেস করে কিছুই কোরো না বাবা!’
‘জিজ্ঞেস করেই করব। আমাদের কত বড় সৌভাগ্য চিন্তা করে দেখ তো মা—উনার মতো মানুষ এই বাড়িতে আছেন। আমার তো বিশ্বাসই হয় না। ওসি সাহেবকে বলেছি একটা বড় বজরা নৌকা যদি দু’একদিনের জন্যে জোগাড় করতে পারেন।’
‘উনাকে পেলে কোথায়?’
‘স্কুলঘর ঝড়ে উড়ে গেছে শুনে দেখতে গেছেন। তখন বললাম। ওসি সাহেব উনার বিশেষ ভক্ত, লেখা পড়েছেন।’
কুয়াতলা থেকে দোতলার ঘর দেখা যায়। শওকত সাহেবের ঘরের বাতি নেভানো। সেই ঘরের দিকে পিতা এবং কন্যা অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইল।
নীল অপরাজিতা – ৪
শওকত সাহেব বারান্দায় বসে ছিলেন।
আজো তাঁর খুব ভোরে ঘুম ভেঙেছে। ঘুম ভেঙেছে পাখির ডাকে। পাখির দল যে ভোরবেলা এত হৈচৈ করে তিনি আগে কল্পনাও করেন নি। কবিরা পাখির ডাক নিয়ে এত মাতামাতি কেন করেন তিনি বুঝতে পারছেন না। তাঁর কাছে যন্ত্রণার মতো মনে হচ্ছে। তবে রাত কেটে ভোর হবার দৃশ্য অসাধারণ। শুধুমাত্র এই দৃশ্য দেখার জন্যে রোজ ভোরবেলায় ওঠা যেতে পারে।
পুষ্প চা নিয়ে ঢুকল।
শওকত সাহেব বললেন, ‘তুমি কি রোজই এত ভোরে ওঠ, না আমার জন্যে উঠতে হচ্ছে?’
পুষ্প এই কথার জবাব দিল না, হাসল। মেয়েটি বুদ্ধিমতী হাসি দিয়ে বুঝিয়ে দিল—সে রোজ এত ভোরে ওঠে না। মেয়েটি তার বাবার বকবকানির স্বভাব পায় নি —এও এক দিক দিয়ে রক্ষা। দু’জনের কথা শুনতে হলে সর্বনাশ হয়ে যেত।
‘তোমার বাবা কি আছেন না স্কুলে চলে গেছেন?
‘স্কুলে গেছেন। আজ সকাল-সকাল ফিরবেন। হাফস্কুল।’
‘বস পুষ্প, চা খেতে খেতে তোমার সঙ্গে গল্প করি।’
বারান্দায় বসার কোনো জায়গা নেই। একটি মাত্র চেয়ার। সেখানে তিনি বসে আছেন।
শওকত সাহেব বললেন, ‘টেবিলটায় বস। আর টেবিলে যদি বসতে অসুবিধা হয় তাহলে ভেতর থেকে চেয়ার নিয়ে এসো।’ পুষ্প টেবিলেই বসল। তবে টেবিলটা একটু দূরে সরিয়ে নিল।
‘এখন বল তুমি কেমন আছ?’
‘ভালো।’
দেখে খুব ভালো মনে হচ্ছে না। রাতে ঘুম হয় নি তাই না?’
পুষ্প হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ল। এই মানুষটার দৃষ্টি তীক্ষ্ণ। পুষ্প বলল, ‘রাতে ঘুম হয় নি কি করে বুঝলেন?’
‘চোখের দিকে তাকিয়ে বুঝলাম। রাতে ঘুম না হলে চোখের নিচ একটু কালচে হয়ে যায়। তোমার হয়েছে। তবে তুমি যদি এত ফর্সা না হতে তাহলে ধরতে পারতাম না। চা খুব ভালো হয়েছে।’
‘আরেক কাপ দেই?’
‘না। ভালো হয়েছে বলেই দ্বিতীয় কাপ খাব না। হয়ত দ্বিতীয়টা এত ভালো হবে না। সেই মন্দ চা খেয়ে প্রথম কাপের আনন্দ মাটি হবে। আচ্ছা এখন বল, তুমি আমার কোনো লেখা পড়েছ?’
‘একটা পড়েছি।’
‘একটা? মোটে একটা?’
‘জ্বি। আপনি আসবেন যখন কথা হল তখন বাবা নেত্রকোনা থেকে আপনার একটা বই কিনে আনলেন।
‘কোন বইটা কিনলেন?’
বাবা দোকানদারকে বললেন, উনার সবচে’ কমদামী বই যেটা সেটাই দেন। দোকানদার একটা চটি বই দিয়ে দিল—’প্রথম দিবস, দ্বিতীয় রজনী।’
‘কমদামী বই হলেও এটা আমার ভালো লেখার মধ্যে একটা। এই বই নিয়ে সুন্দর একটা গল্প আছে—দাঁড়াও তোমাকে বলি। বৈশাখ মাসের এক তারিখে বই বের হবার কথা। প্রকাশকের দোকানে সকাল থেকে বসে আছি। তখন তো আর আমার এত বই ছিল না—ঐটি হচ্ছে দ্বিতীয় বই। বই বেরুবে—আমার আগ্রহ সীমাহীন। বাইন্ডারের বই দেয়ার কথা; সে আসছে না। দুপুরবেলা প্রকাশক বললেন, আপনি বাসায় চলে যান। বই বের হলে আপনাকে বাসায় দিয়ে আসব। আমি রাজি হলাম না। এসেছি যখন বই নিয়েই যাব। বিকেল পর্যন্ত বসে রইলাম, বাইন্ডারের দেখা নেই। প্রকাশক বললেন, আপনি এক কাজ করুন, বাইন্ডারের ঠিকানা দিয়ে দিচ্ছি—গিয়ে দেখুন কি ব্যাপার।’
বাইন্ডারকে আওলাদ হোসেন লেনে ধরলাম। সে সবেমাত্র লেই লাগাচ্ছে। আমার খুব মেজাজ খারাপ হল। বাইন্ডার বলল, ‘কিছুক্ষণ বসেন একটা কাঁচা বই দিয়ে দেই।’
সেই কিছুক্ষণ মানে চার ঘন্টা। বাসায় ফিরলাম রাত ন’টার পর। বাসায় এসে দেখি—রেনুকে হাসপাতালে নিয়ে গেছে। তার তখন ন’মাস চলছে। ডেলিভারি ডেটের এখনো অনেক দেরি। ব্যথা উঠে গেছে আগেই। ছুটে গেলাম হাসপাতালে। স্বাতীর জন্ম হয়ে গেছে। সন্ধ্যায় তাকে মার পাশে শুইয়ে রাখা হয়েছে। আমার লজ্জার সীমা রইল না। আমার প্রথম বাচ্চা অথচ আমি পাশে নেই। আমার লজ্জা এবং দুঃখ রেনু ঠিকই বুঝল। আমার লজ্জা ঢাকার জন্যে বলল, ‘কই দেখি তোমার বই। বাহ কী সুন্দর! বলেই শুধুমাত্র আমাকে খুশি করার জন্যে এই অবস্থায় বইটি পড়তে শুরু করল। আমার চোখে পানি এসে গেল।’
পুষ্প বলল, ‘আপনি এত সুন্দর করে গল্পটা বললেন যে আমার চোখেই পানি এসে গেছে।’
‘রেনু অনেক বড় ভুল করে। নানান ভাবে আমাকে কষ্ট দেয় কিন্তু ঐ রাতের ঘটনার কথা মনে হলেই ওর সব অপরাধ আমি ক্ষমা করে দেই।’
‘যে মেয়ে ঐ রাতে এমন কান্ড করতে পারেন তিনি ভুল করতে পারেন না।’
‘তাও অবশ্যি ঠিক। এখন তুমি বল, বইটা তোমার কেমন লাগল?’
পুষ্প চুপ করে রইল।
শওকত সাহেব বিস্মিত হয়ে বললেন, ‘বইটা কি তোমার ভালো লাগে নি?’
‘জ্বি না।’
‘ভালো না লাগার তো কথা না। তুমি কি পড়েছ ভালো মতো?’
‘জি।’
‘কেন ভালো লাগল না বলতে পারবে?’
‘পারব।’
‘তাহলে বল তো শুনি।’
‘আপনি কি আমার কথায় রাগ করছেন?
‘না রাগ করছি না। আমার লেখার বিপক্ষে কঠিন-কঠিন কথা আমি সবসময় শুনি। সাহিত্যের অধ্যাপকরা বলেন, পণ্ডিত ব্যক্তিরা বলেন, বিদগ্ধজনেরা বলেন। তোমার মতো অল্প বয়স্ক মেয়ে বলবে তা ঠিক ভাবি নি। বিশেষ করে যে আমার একটি মাত্র বই পড়েছে। এখন তুমি আমাকে বল, কেন ভালো লাগল না।’
পুষ্প নিচু গলায় বলল, ‘বইটার মূল বিষয়টাই ভুল।’
‘মূল বিষয়ই ভুল? কী বলছ তুমি?’
‘ঐটি একটি প্রেমের উপন্যাস। উপন্যাসের মূল বিষয় হল ভালবাসলে ভালবাসা ফেরত দিতে হয়—আপনার বই-এর চরিত্ররা তাই করেছে। কিন্তু এমন তো কখনো হয় না। মনে করুন একটা কালো কুদর্শন মেয়ে প্রচণ্ড আবেগ নিয়ে একটি রূপবান ছেলেকে ভালবাসল। সেই ছেলে কি তার ভালবাসা ফেরত দেবে? কখনো না। আপনি লিখেছেন মানুষ হচ্ছে আয়নার মতো। ভালবাসার আলো সেই আয়নায় পড়লে তা ফিরে আসবে। মানুষ আয়নার মতো না। আমার চেয়ে আপনি তা অনেক ভালো করে জানেন। একটা ভুল কথা লিখেছেন—কিন্তু এমন সুন্দর করে লিখেছেন যে, পড়লে সত্যি মনে হয়। মন অসম্ভব ভালো হয়ে যায়।’
‘মন ভালো হওয়াটাকে তুমি তুচ্ছ করছ কেন?
‘ভুল কথা বলে মন ভালো করলে সেটাকে তুচ্ছ করা কি উচিত না?’
‘পুষ্প আমি আরেক কাপ চা খাব।’
পুষ্প উঠে গেল। শওকত সাহেব চুপচাপ বসে রইলেন।
.
পুষ্প চা নিয়ে ফিরে এল।
তিনি বললেন, ‘থ্যাংক ইউ।’ বলেই হাসলেন। হাসির অর্থ—তুমি যা বলেছ শুনলাম। আমি রাগ করি নি। কিন্তু তিনি যে রাগ করেছেন তা ঢাকতে পারছেন না।
‘স্যার আমি কি আপনার নাশতা নিয়ে আসব?’
‘নিয়ে আস।’
মেয়েটিকে প্রচণ্ড ধমক দিতে ইচ্ছে হচ্ছে। বলতে ইচ্ছে করছে—’শোন বোকা মেয়ে, আমি এই পৃথিবীটাকে যেমন দেখি, যেমন ভাবি তেমন করেই লিখি। সত্যিকার পৃথিবীটা কেমন তা নিয়ে আমার কোনো মাথাব্যথা নেই। সত্যিকার ছবি হচ্ছে ফটোগ্রাফি। সাহিত্য ফটোগ্রাফি নয়, তৈলচিত্র। সেই তৈলচিত্রে আমি কিছু রং বেশি ব্যবহার করেছি। মানুষকে যেভাবে দেখতে ভালবাসি আমি সেইভাবে আঁকি। যদিও জানি মানুষ সে রকম নয়। আমি নিজেও তেমন নই। কিন্তু আমার সে রকম হতে ইচ্ছে করে। কাজেই আমি ধরে নিয়েছি অন্যদেরও তাই হতে ইচ্ছে করে। আমি মানুষের ইচ্ছের ছবি এঁকেছি।’
এইসব কথার কিছুই বলা হল না। তিনি নিঃশব্দে নাশতা খেলেন। নাশতা শেষ করে লেখার টেবিলে গিয়ে বসলেন। পুষ্প পেছনে-পেছনে এল।
‘কিছু বলবে পুষ্প?’
পুষ্প নরম গলায় বলল, ‘আপনি আমার কথায় এতটা মন খারাপ করবেন আমি ভাবি নি। আমি অতি সামান্য মেয়ে, আমার কথার কি গুরুত্ব আছে? ‘
‘আমার সহজে মন খারাপ হয় না। কঠিন আঘাতও আমি সহজভাবে গ্রহণ করতে পারি। কিন্তু এই বইটির ব্যাপারে আমার এক ধরনের স্পর্শকাতরতা আছে। লেখক হিসেবে আমার আত্মবিশ্বাস নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। প্রথম বইটি প্রকাশিত হবার পর তিন বছর একটি লাইন লিখতে পারি নি। তারপর এই বইটি লিখলাম। লেখার পর মনে হল নিজের স্বপ্ন অন্যদের মাঝে ছড়িয়ে দেয়ার ক্ষমতা আমার আছে। হোক না স্বপ্নটা মিথ্যা।’
‘আপনি নিজে যদি এটা বিশ্বাস করেন তাহলে আমার উপর এত রাগ করলেন কেন?’
‘তোমার উপর রাগ করেছি কারণ তুমি আমাকে যা বলেছ তাও কিন্তু আমি বিশ্বাস করি।’
‘তা কেমন করে হয়?’
‘হয়। একই সঙ্গে আমরা ভালবাসি, আবার যাকে ভালবাসি তাকে ঘৃণাও করি। তুমি সম্ভবত এখনো কারো প্রেমে পড় নি। প্রেমে পড়লে বুঝতে পারতে।’
‘আপনি কি এখন লিখবেন?
‘হ্যাঁ।’
‘লেখার সময় আমি যদি পাশে বসে থাকি আপনি কি রাগ করবেন?’
‘আমি চাই না লেখার সময় কেউ আমার আশেপাশে থাক। লিখতে লিখতে প্রায়ই আমার চোখে পানি আসে। এই দৃশ্য অন্যের কাছে হাস্যকর মনে হবার কথা।
‘তাহলে আমি যাই।’
‘আচ্ছা যাও-ভালো কথা, তোমাকে আমার পছন্দ হয়েছে Young lady, you are smart. এখন যাও, আমি লেখা শুরু করি।’
‘আজও কি দুপুরে খাবেন না?’
‘খাব। এখানে খাবার আনতে হবে না। ঠিক দু’টার সময় আমি তোমাদের ঘরে আসব।’
‘বিকেলে কি আমার সঙ্গে মঠটা দেখতে যাবেন?’
‘যাব।’
‘সত্যি যাবেন?’
‘হ্যাঁ, সত্যি যাব।’
.
মঠ ব্যাপারটা আসলে ইটের বিশাল স্তূপ।
বোঝা যাচ্ছে এক সময় অনেক উঁচু ছিল, এখন ভেঙে একাকার হয়ে আছে। চল্লিশ পঞ্চাশ ফুটের মতো উঁচু। উপরে উঠার সিঁড়ি আছে। মোফাজ্জল করিম সাহেবও সঙ্গে আছেন। তিনিই সবচে’ অবাক হলেন, এইটা কি ব্যাপার? জিনিসটা কী?’
শওকত সাহেব বললেন, ‘আপনি কখনো আসেন নি?’
‘আসবো না কেন? এই রাস্তায় কত আনাগোনা করেছি। জঙ্গলের ভেতর কখনো ঢুকি নাই। অবশ্য শুনেছি মঠের কথা।’
পুষ্প বলল, ‘বাবা সিঁড়ি দিয়ে উঠলে কেমন হয়?
‘করিম সাহেব আঁতকে উঠলেন, ‘পাগল হয়েছিস? এটা সাপের আড্ডাখানা। তার উপর বর্ষাকাল। কাছেপিঠেই বেশিক্ষণ থাকা উচিত না।’
শওকত সাহেব বললেন, ‘জিনিসটা কী কেউ কি বলতে পারে? দেখতে অনেকটা বাতিঘরের মতো! এই জায়গায় বাতিঘর থাকবে কেন? বৌদ্ধদের কিছু না তো?’
করিম সাহেব বললেন, ‘না। এই অঞ্চলে কোনো বৌদ্ধ নাই।’
‘এরকম স্তূপ কি একটাই, না আরো আছে?’
‘জানি না তো!’
‘খোঁজ নেয়া যায়?’
‘অবশ্যই খোঁজ নেয়া যায়। স্কুলে একটা নোটিশ দিয়ে দিলেই হবে। দূর দূর থেকে ছেলেরা পড়তে আসে।’
‘তাহলে একটা নোটিশ দিয়ে দেবেন তো? আমি খুবই অবাক হচ্ছি। জঙ্গলের ভেতর এমন বিশাল ব্যাপার দেখব আশা করি নি বলেই বোধহয় অবাক হচ্ছি।’
‘শীতকালে একবার আসবেন স্যার। আমি সব পরিষ্কার-টরিষ্কার করে রাখব। শীতকালে জায়গাটা এমনিতেও খুব সুন্দর হয়। সোহাগী নদীর দুই ধারে কাশফুল ফোটে। আহ্ দেখার মতো। চলেন স্যার, আজ ফেরা যাক। কাদায় মাখামাখি হয়ে গেছেন।
‘চলুন।’
‘আপনার জন্যে স্যার একটা ভালো খবর আছে।’
‘বলুন শুনি।’
‘ওসি সাহেবকে বলেছিলাম একটা বজরার ব্যবস্থা করতে। উনি খুবই করিতকর্মা লোক। ব্যবস্থা করে ফেলেছেন। সন্ধ্যার মধ্যে বজরা ঘাটে চলে আসবে।’
শওকত সাহেব অবাক হয়ে বললেন, ‘বজরা দিয়ে আমি কি করব?’
‘বজরায় বসে লেখালেখি করবেন। ঘুরবেন।’
‘আমি তো ভাই রবীন্দ্রনাথ না। আমি যেখানে আছি ভালো আছি।’
‘সেটা তো স্যার রইলই। বজরাও রইল।’
আগে আগে যাচ্ছেন করিম সাহেব, তাঁর পেছনে শওকত সাহেব। পুষ্প এবং নৌকার মাঝি সবার পেছনে। পুষ্প নৌকার মাঝির সঙ্গে গল্প করতে করতে আসছে। চুল দু’বেণি করায় তাকে খুকী-খুকী লাগছে। আজ সে সুন্দর একটা শাড়ি পরেছিল। কাদায় শাড়ির অনেকখানিই নষ্ট। কাদার দাগ উঠবে বলে মনে হয় না। শওকত সাহেব লক্ষ করলেন, পুষ্প মাঝির সঙ্গে ময়মনসিংহের স্থানীয় ভাষায় টেনে টেনে কথা বলছে। মাঝির মতো করেই বলছে। করিম সাহেব যদিও তা করছেন না। ভাষার ব্যাপারে তিনি যে খুব সাবধান তা বোঝা যাচ্ছে।
করিম সাহেব বললেন, ‘স্যার কি গোমাংস খান?’
‘খাব না কেন?’
‘অনেকে খায় না। এই জন্যে জিজ্ঞেস করছি। আমি লোক পাঠিয়েছি।’
‘কোথায় লোক পাঠিয়েছেন?’
‘এখানে তো স্যার গোমাংস পাওয়া যায় না। আশেপাশে মাংসের দোকান নাই। হাটবারে গরু জবেহ হয়। আজ সেঁজুতখালির হাট। ঐখানে লোক পাঠিয়েছি।’
‘ও আচ্ছা।’
‘সেঁজুতাখালির হাটে আজেবাজে গরু জবেহ করে। বাছা-বাছা গরু জবেহ হয় হলদিয়া হাটে। সোমবার হাট আছে। আমি নিজেই যাব। তবে সেঁজুতখালির হাটে মাঝে—মধ্যে ভালো গোশত পাওয়া যায়—এখন দেখি আপনার ভাগ্য।’
‘গোশত কেমন তা দিয়ে আমার ভাগ্য বিচার করবেন?’
‘ছিঃ ছিঃ স্যার এটা কি বললেন? আমি একটা কথার কথা বলেছি।
বাড়ি ফিরতে-ফিরতে সন্ধ্যা মিলিয়ে গেল। উঠানে জলচৌকি পেতে কে একজন বসে আছে। বারান্দায় একটা বেতের ঝুড়ি এবং একটা সুটকেস। যে বসে আছে তার বয়স বাইশ তেইশ। বেঁটে-খাট একজন যুবক। বেশ স্বাস্থ্যবান। মনে হচ্ছে সম্প্রতি গোঁফ রেখেছে। গোঁফের পেছনে অনেক যত্ন এবং সাধনা আছে তা বোঝা যাচ্ছে।
‘তাকে দেখেই পুষ্প দূর থেকে চেঁচিয়ে উঠল’ ওমা বাবু ভাই! বাবু ভাই তুমি কোত্থেকে?’
শওকত সাহেব লক্ষ করলেন, বাবু ভাই নামধারী যুবক এই উচ্ছ্বাসের প্রতি বিন্দুমাত্র গুরুত্ব দেখাল না। যেন সে ধরেই নিয়েছে তাকে দেখামাত্র এমন রূপবতী একটি মেয়ে আনন্দে চেঁচিয়ে উঠবে।
করিম সাহেব বললেন, ‘ও আমার দূর সম্পর্কের ভাগ্নে হয়। পুষ্পের সঙ্গে তার খুব ভাব।’
শওকত সাহেব বললেন, ‘ও আচ্ছা।’
তিনি দোতলায় উঠে এলেন। রেনুকে আরেকটা চিঠি লেখা দরকার। প্রথম চিঠিটিও পাঠানো হয় নি। আশ্চর্য ব্যাপার এখানে এসে পা দেয়ার পর রেনুর কথা তাঁর মনে হয় নি। স্বাতীর কথাও না। যেন ঐ জীবন তিনি পিছনে ফেলে এসেছেন। সেখানে ফিরে যাবার আর প্রয়োজন নেই।
তিনি জানালার পাশে দাঁড়িয়ে আছেন। এখান থেকে কুয়াতলাটা দেখা যাচ্ছে। পুষ্প কুয়াতলায় দাঁড়িয়ে—ঐ ছেলেটির কি যেন নাম—বাবু। হ্যাঁ বাবু, বালতি বালতি পানি তুলে পুষ্পের পায়ে ঢালছে। কিছু বোধহয় বলছেও—কারণ পুষ্প কিছুক্ষণ পরপর খিলখিল করে হেসে উঠছে। আশ্চর্য, এত আনন্দিত হয়েছে মেয়েটা? তিনি কি কখনো কাউকে এত আনন্দিত করতে পেরেছেন?
শওকত সাহেবের মনে পড়ল কাদা পায়েই তিনি তাঁর ঘরে ঢুকেছেন। সারা ঘর কাদায় মাখামাখি। তিনি ঘর ছেড়ে বাথরুমে ঢুকলেন। দীর্ঘ সময় নিয়ে গা ধুলেন। কাজটা বোধহয় ঠিক হল না। আবার জ্বর না এলে হয়।
গোসল শেষ করে ঘরে ঢুকে দেখেন ময়নাতলা স্কুলের দপ্তরি ইউনুস মিয়া ঘরে কেরোসিন ল্যাম্প জ্বালাচ্ছে।
‘ইউনুস মিয়া!’
‘জ্বি স্যার।’
‘কাদা পায়ে ঘরে ঢুকে ঘরের অবস্থা কি করেছি দেখ। একটু পরিষ্কার করে দিবে?’
‘দিতাছি স্যার।’
‘নিচে গিয়ে পুষ্পকে বলবে এককাপ চা দিতে?’
‘জ্বি স্যার, বলতাছি।’
‘তোমার কি মনে হয়—আজ রাতে বৃষ্টি হবে?’
‘এইটা স্যার ক্যামনে বলব? আল্লাহতালার ইচ্ছার উপরে সব নির্ভর।’
‘তা ঠিক।’
শওকত সাহেব লেখার টেবিলে বসলেন। রেনুকে চিঠি লিখতে হবে। ভাগ্যিস চশমার কাচে ডান হাত কাটে নি। ডান হাত কাটলে কিছুই লিখতে পারতেন না। বাঁ হাতে যন্ত্রণা হচ্ছে। সারাদিন এই যন্ত্রণা টের পান নি কেন?
কল্যাণীয়াসু,
রেনু, প্রথম চিঠি (যা নৌকায় লেখা) তোমাকে পাঠাতে পারি নি। এর মধ্যে দ্বিতীয় চিঠি লেখা হল। দুটোই এক সঙ্গে পাঠাচ্ছি। এখানে কেমন আছি তা বলে লাভ নেই। ভালো আছি। মহাকবি বজলুর রহমান যেমন বলেছেন—বাড়ি তেমন নয় তাতে বুঝতেই পারছ। তবু খারাপ না। মোফাজ্জল করিম সাহেব যত্নের চূড়ান্ত করছেন। আলাদা বাবুর্চির ব্যবস্থা করা যায় নি। শুরুতে বেশ কয়েকবার বলেছি—অজ পাড়াগাঁয় তা বোধহয় সম্ভবও নয়।
এখানকার বর্ষা খুব enjoy করছি। এর মধ্যে ঝড়ের মধ্যে পড়েছিলাম। অনেকদিন পর ছেলেবেলার মতো বৃষ্টিতে ভিজলাম। সেই রাতে একটু জ্বরের মতো হয়েছিল। তুমি এই খবরে আঁতকে উঠবে না। এমন জ্বর—যা থার্মোমিটারেও মাপা যায় না।
এখন তোমার বিরুদ্ধে একটি গুরুতর অভিযোগ—তুমি অষ্টাঙ্গ সংগ্রহ বলে একটি বই সুটকেসে ঢুকিয়ে দিয়েছ। আমার যতদূর ধারণা এইসব বই সাধু সন্ন্যাসীদের জন্যে। তুমি কি ভাবছ আমি সন্ন্যাসী হবার জন্যে এখানে এসেছি? অষ্টাঙ্গ সংগ্রহ থেকে কিছু অংশ তুলে দিচ্ছি। পড়লেই বুঝবে কি জিনিস পাঠিয়েছ—
যে ব্যক্তি সপ্তর্ষি মণ্ডলের সীমান্তে অরুন্ধতী নক্ষত্র দেখিতে পায় না সেই ব্যক্তি এক বছর পর মৃত্যুবরণ করে।
ভক্তি, সদাচার, স্মৃতি, দানশীলতা, বুদ্ধি ও বল এই ছয়টি গুণ যাহার নষ্ট হয় তাহার মৃত্যু ছয় মাসের মধ্যে ঘটে।
বই পড়ার পর অরুন্ধতী নক্ষত্র দেখার চেষ্টা করে বিফল হয়েছি—কাজেই ভয়ে ভয়ে আছি। ছয়টি সদ্গুণের মধ্যে মাত্র দু’টি-বুদ্ধি ও স্মৃতি এখনো আছে। এই দু’টি চলে গেলে কি যে হবে কে জানে।
এতক্ষণ রসিকতা করলেও মৃত্যু নিয়ে আমি কিন্তু প্রায়ই ভাবি। এতদিন যা লিখেছি তার কিছু কি টিকে থাকবে? স্বাতীর ছেলেমেয়েরা কি পড়তে পারবে, না তার আগেই সব শেষ? স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ বলেছেন—
“আমার কীর্তিরে আমি করি না বিশ্বাস।
জানি, কাল সিন্ধু তারে
নিয়ত তরঙ্গাঘাতে
দিনে দিনে দিবে লুপ্ত করি।”
সেখানে আমি কে?
আজ এই পর্যন্ত।
পুনশ্চঃ আমার স্মৃতিশক্তি যে এখনো আছে—কবিতার চারটি চরণ লিখে তা প্রমাণ করলাম। কাজেই আরো কিছু দিন টিকে থাকব। কি সর্বনাশ, আসল খবর দিতে ভুলে গিয়েছি। লেখা খুব ভালো এগুচ্ছে—পঁয়ত্রিশ পৃষ্ঠা লিখে ফেলেছি।
‘স্যার আপনের চা।’
চা নিয়ে এসেছে ইউনুস মিয়া। শওকত সাহেবের মন খারাপ হয়ে গেল। তিনি কি মনে-মনে আশা করেছিলেন পুষ্প আসবে?
‘ইউনুস মিয়া
‘জ্বে।’
‘পুষ্প কি করছে?’
‘গল্প করতেছেন।’
‘কার সঙ্গে?’
‘ঐ যে আসছেন বাবু ভাই।’
‘সে কি প্রায়ই আসে?’
‘জ্বে আসেন।’
‘পুষ্প গল্প করলে রান্নাবান্না কে করছে?’
‘মতির মা চইল্যা আসছে।’
‘আচ্ছা ঠিক আছে, তুমি যাও।’
তিনি রেনুর কাছে লেখা চিঠিটি আবার পড়লেন এবং অবাক হয়ে লক্ষ করলেন চিঠির কোথাও পুষ্পের কথা নেই। রেনু এই চিঠি পড়ে বুঝতেও পারবে না এ বাড়িতে পুষ্প নামের রূপবতী একটি মেয়ে আছে। তিনি এই কাজটি কেন করলেন? ইচ্ছাকৃতভাবে করেন নি। অবচেতন মন তাঁকে বাধা দিয়েছে।
‘স্যার আসব?’
শওকত সাহেব দেখলেন দরজার কাছে বাবু দাঁড়িয়ে। পান খেয়ে ঠোঁট লাল করে এসেছে।
‘আপনার সাথে পরিচয় করবার জন্য আসলাম। আপনাদের মতো মানুষের দেখা পাওয়া আর হাতে আসমানের চাঁন পাওয়া এক কথা।’
‘আমাকে তুমি চেন?’
‘জ্বি না—পুষ্প আমারে বলেছে।’
তাকে ভেতরে আসার কথা বলতে হল না। সে নিজ থেকেই ঘরে ঢুকে পালঙ্কে পা তুলে বসল। তার মধ্যে অপরিচিত একজন মানুষের সঙ্গে কথা বলার প্রাথমিক সংকোচটুকুও পুরোপুরি অনুপস্থিত।
‘তুমি কি পড়াশোনা কর? ‘
‘জ্বি। বি. এ. দিছিলাম—রেফার্ড হয়ে গেল। অবশ্য আই. এ. এক চান্সে পাস করেছি।’
‘এসএসসি এক চান্সে পার নি?’
‘জ্বি না। এসএসসি এক চান্সে পাস করা খুবই কঠিন ব্যাপার। জুয়েল ছেলেমেয়েরা পারে।’
‘তুমি নিজেকে জুয়েল মনে কর না?’
‘আরে না। কি যে স্যার আপনে বলেন।’
‘পাস করার পর কি করবে; চাকরি-বাকরি?’
‘চাকরি-বাকরি আমারে কে দিবে? তারপরেও ধরেন যদি ভুল করে কেউ দেয় তা হইলেও তো সাড়ে সর্বনাশ।’
‘সাড়ে সর্বনাশ কেন?
‘লেখাপড়া কিছুই জানি না। আই. এ-তে তাও কিছু পড়েছিলাম। বি. এ-তে কিছুই পড়ি নাই। নকলের উপর পাস করেছি। এইবার বাইরে থাইক্যা খুব স্ট্যান্ডার্ড নকল আসছে।’
‘তারপরেও রেফার্ড পেয়ে গেলে?’
না পাইয়া উপায় কি বলেন—ঐ দিন হঠাৎ ম্যাজিস্ট্রেট আইসা উপস্থিত। সাপ্লাই বন্ধ। এই এক পেপারে আমার সর্বনাশ হইছে। অন্যগুলোয় ফিফটি ওয়ান পার্সেন্ট নম্বর আছে।’
‘নম্বর তো খুব ভালো পেয়েছ।’
‘আপনারে কি বললাম স্যার—খুব স্ট্যান্ডার্ড নকল ছিল এই বৎসর। ভেরি হাই স্ট্যান্ডার্ড।’
‘পাস করে কি করবে তা কিন্তু এখনো বল নি—’
‘আমাদের মতো ছেলেদের ব্যবসা ছাড়া গতি কি বলেন। বাবার একটা ফার্মেসি আছে নেত্রকোনা সদরে—আল মদিনা ড্রাগ স্টোর। ঐটা দেখাশোনা করব। আপনে স্যার আমার জন্য দোয়া রাখবেন। আপনি জ্ঞানী মানুষ। পুষ্প যেসব কথা আপনার সম্বন্ধে বলল, শুনে চোখে পানি এসে গেল।’
শওকত সাহেব চুপ করে বসে রইলেন। পুষ্প তাঁর সম্পর্কে এমন কী বলতে পারে যে, বাবু নামের এই ছেলের চোখে পানি এসে যায়!
‘পুষ্প কি বলেছে আমার সম্পর্কে?
‘ঐ যে স্যার ঝড়ের মধ্যে পড়লেন—তারপর ব্রেইন ডিফেক্ট হয়ে গেল–খালি উল্টা-পাল্টা কবিতা। স্যার এখন তাহলে যাই। স্লামালিকুম।’
তিনি সালামের উত্তর দিলেন না। উত্তর দেবার মতো অবস্থা তাঁর ছিল না। তিনি পুরোপুরি হতভম্ব।
নীল অপরাজিতা – ৫
গত দু’দিন ধরে শওকত সাহেব বজরায় বাস করছেন।
প্রথম রাতে বেশ অস্বস্তি লেগেছে। বজরার দুলুনি ঠিক সহ্য হয় নি। বজরা দুলছিল না কিন্তু তাঁর কাছে মনে হচ্ছিল খুব সূক্ষ্মভাবে দুলছে। নদীর জলস্রোতের শব্দও মনে হল মাথায় চাপ ফেলছে। দ্বিতীয় দিনে সব অস্বস্তি দূর হয়ে গেল। মনে হল রাত্রি যাপনের এরচে’ ভালো কিছু থাকতে পারে না।
বজরাটা চমৎকার। বসার ঘর, শোবার ঘর। খুব সুন্দর বাথরুম। ভেতরের চেয়ে বাইরের ব্যবস্থা আরো ভালো। ছাদের উপর আরামকেদারা। আরামকেদারার পাশে টেবিল। আরামকেদারায় শুয়ে পা দু’টিও যাতে খানিকটা উঁচুতে রাখা যায় তার জন্যে ছোট্ট টুল যার নাম ‘পা-টুল।’
করিম সাহেব আনন্দে উচ্ছ্বসিত হয়ে বললেন, ‘স্যার ব্যবস্থা কেমন?’
‘ব্যবস্থা ভালো।’
‘স্যার পছন্দ হয়েছে তো?’
‘হয়েছে।’
‘তাহলে স্যার ওসি সাহেবকে ধন্যবাদ দিয়ে একটা চিঠি দিয়ে দিবেন। উনি খুব খুশি হবেন। লোক ভালো।’
‘আমি চিঠি দিয়ে দেব।’
‘উনি জিজ্ঞেস করছিলেন, উনার বাসায় চায়ের দাওয়াত দিলে আপনি কবুল করবেন কিনা। উনার খুব শখ।’
‘হ্যাঁ যাব। চা খেয়ে আসব।’
‘আরেকটা কথা স্যার, ময়নাতলা স্কুলে একদিন যাওয়া লাগে।’
‘ঐখানে কি ব্যাপার?’
‘কিছুই না। টিচারদের সাথে চা-পানি খাবেন। ছাত্রদের দুই একটা কথা বলবেন।’
‘সেটা কবে?’
‘এই সোমবারে। মহাপুরুষদের কথা শুধু শুনলেই হয় না। চোখে দেখতেও হয়। এতে পুণ্য যেমন হয়— তেমনি….’
শওকত সাহেব কথা শেষ করতে দিলেন না, বললেন, ‘আমি যাব। আমাকে দেখলে যদি আপনার ছাত্রদের পুণ্য হয় তাহলে হোক কিছুটা পুণ্য।’
.
ওসি সাহেবের বাসায় চায়ের দাওয়াত রাতের খাবারে রূপান্তরিত হল। পোলাও—কোর্মার সমারোহ। প্রকাণ্ড কাতলা মাছের মাথা বিশাল একটা থালায় সাজিয়ে শওকত সাহেবের সামনে ধরা হল। ওসি সাহেব হাত কচলাতে কচলাতে বললেন, ‘স্যার আপনার জন্য মাছটা মোহনগঞ্জ থেকে আনা হয়েছে।’
শওকত সাহেব বললেন, ‘মাছের মাথা তো আমি খাই না। কখনো না।’
‘না খেলেও এর উপর হাতটা রেখে একটু তাকিয়ে থাকুন।’
‘কেন।’
‘ছবি তুলব স্যার।’
তিনি তাই করলেন। তিন দিক থেকে তিনবার ছবি তোলা হল। শুধু মাছের মাথার সঙ্গে ছবি না, ওসি সাহেবের সঙ্গে ছবি, তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে ছবি, ওসি সাহেবের ছেলের সঙ্গে ছবি এবং শেষ পর্যায়ে ওসি সাহেবের শালাকে পাশে নিয়ে ছবি।
ছবি তোলার পর্ব শেষ হবার পর ওসি সাহেবের স্ত্রী একটি দীর্ঘ কবিতা পড়লেন। তাঁকে উদ্দেশ করেই নাকি কবিতাটি লেখা হয়েছে। যদিও শওকত সাহেব সেই দীর্ঘ কবিতায় তাঁর অংশ কি আছে কিছুই বুঝলেন না।
মোফাজ্জল করিম সাহেব উচ্ছ্বসিত হয়ে বললেন—’অসাধারণ, অসাধারণ!’
কবিতাটি বড় ফ্রেমে বাঁধানো। চারদিকে লতা-ফুল-পাতা আঁকা।
নিমন্ত্রণ রক্ষা করার জন্যে পুষ্পও গিয়েছিল।
ফেরার পথে সে শওকত সাহেবের পাশে পাশে হাঁটতে লাগল। পুষ্পের সঙ্গে এখন প্রায় দেখাই হচ্ছে না। করিম সাহেব খবর দিয়েছেন—পড়াশোনা নিয়ে খুব ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। সারাক্ষণ পড়ে আর বাকি সময়টা বাবুর সাথে দুষ্টামি-ফাজলামি করে।
শওকত সাহেবের ধারণা তা নয়। মেয়েটি যে কোনো কারণেই হোক তাঁকে এড়িয়ে চলছে। তিনি এমন কিছু কি করেছেন যাতে তাঁকে এড়িয়ে চলা উচিত? তিনি মনে করতে পারলেন না। এখন অবশ্যি বেশ সহজভাবে তাঁর পাশে-পাশে হাঁটছে। বাবু সঙ্গে নেই। বাবু থাকলে সে নিশ্চয়ই বাবুর সঙ্গে আগে আগে হাঁটত এবং খানিকক্ষণ পর পর খিল-খিল করে হাসত।
বাবু নামের ছেলেটির সঙ্গে এই মেয়েটির এত ঘনিষ্ঠতা কী করে হয় তা তিনি ভেবে পাচ্ছেন না। এই ছেলের আশেপাশে কিছুক্ষণ থাকলেই তো রাগে গা জ্বলে যাবার কথা। এক দুপুরবেলায় ঐ ছেলে তাঁর ঘরে উপস্থিত—হাতে একটা দড়ি।
‘স্যার কি ঘুমুচ্ছেন না-কি?’
‘না।’
‘দড়ির একটা ম্যাজিক দেখবেন?’
‘না। ম্যাজিক দেখতে ইচ্ছে করছে না।’
‘খুব ইন্টারেস্টিং ম্যাজিক স্যার—দড়িটা কেটে তিন টুকরা করব; তারপর জোড়া লাগায়ে দিব।’
তিনি হাল ছেড়ে তাকিয়ে রইলেন। এই ছেলে তাঁকে ম্যাজিক না দেখিয়ে যাবে না।
‘নেন স্যার দড়িটা মেপে দেখেন।’
‘মাপতে হবে না, তুমি যা দেখাবে দেখাও।’
‘উঁহুঁ মাপেন। শেষে বলবেন অন্য দড়ি।’
তাঁকে দড়ি মাপতে হল।
বাবু বলল, ‘এখন বিস্মিল্লাহ বলে দড়িটা কাটেন।’
‘কাটাকাটি যা করার তুমিই কর।’
‘উহুঁ আপনাকেই কাটতে হবে।’
তিনি দড়ি কেটে তিন টুকরা করলেন। বাবু রুমাল দিয়ে কাটা টুকরাগুলো ঢেকে দিল এবং এক সময় আস্ত দড়ি বের করে আনল।
‘কেমন স্যার, আশ্চৰ্য না?’
‘হ্যাঁ আশ্চর্য।’
‘আসেন, আপনাকে শিখিয়ে দেই কি করে করা লাগে।’
‘আমি শিখতে চাচ্ছি না।’
‘শিখে রাখেন। অন্যদের দেখাবেন। যে দেখবে সেই মজা পাবে।’
তাঁকে দড়ি কাটার ম্যাজিক শিখতে হল।
এমন ছেলের সঙ্গলাভের জন্য পুষ্প এত ব্যাকুল হবে কেন? পুষ্পকে কি তিনি এই কথাটা জিজ্ঞেস করবেন?
পুষ্প তাঁর পাশাপাশি হাঁটছে। করিম সাহেব, ওসি সাহেবের সঙ্গে গল্প করতে—করতে এগুচ্ছেন। তাঁরা অনেক সামনে। ইচ্ছা করলে জিজ্ঞেস করা যায়। ইচ্ছা করছে আবার করছেও না।
পুষ্প বলল, ‘আজকের নিমন্ত্রণটা আপনার কেমন লাগল?’
তিনি বললেন, ‘ভালো।’
পুষ্প বলল, ‘আমি সারাক্ষণ আপনাকে লক্ষ করছিলাম। আপনি অসম্ভব বিরক্ত হচ্ছিলেন অথচ হাসিমুখে বসেছিলেন। আপনি তো অভিনয়ও খুব ভালো জানেন।’
‘ঠিকই ধরেছ।’
‘এরকম কষ্ট কি আপনাকে প্রায়ই করতে হয়?’
‘হ্যাঁ হয়।’
‘ওরা কিন্তু যা করেছে আপনাকে ভালবেসেই করেছে।’
‘তাও জানি।’
‘আপনি কি আমার উপর রাগ করে আছেন?’
‘না। রাগ করে থাকব কেন? রাগ করে থাকার মতো তুমি কি কিছু করেছ?’ পুষ্প তাঁকে বিস্মিত করে দিয়ে বলল, ‘হ্যাঁ করেছি।’
‘কি করেছ?’
‘আপনার কাছ থেকে দূরে-দূরে থাকছি।’
‘তুমি দূরে-দূরে থাকলেই আমি রাগ করব, এমন অদ্ভুত ধারণা তোমার কেন হল বল তো? আমি একা থাকতেই পছন্দ করি। তোমাদের বাড়ি ছেড়ে বজরায় এসে উঠলাম কি জন্যে? যাতে একা থাকা যায়। বজরার মাঝি দু’জনকেও বিদায় করে দিয়েছি। রাতে অবশ্যি খানিকটা ভয় ভয় লাগে।
‘আপনার লেখা কেমন হচ্ছে?’
‘ভালো হচ্ছে, খুব ভালো। এখানে বসে লেখার একটা প্রভাবও লক্ষ করছি— লেখার ধরন একটু মনে হল পাল্টেছে। প্রকৃতির কথা স্বতঃস্ফূর্তভাবে চলে আসছে।’
পুষ্প বলল, ‘সারাক্ষণ আপনার মাথায় লেখা ঘুরে তাই না? লেখা ছাড়া আপনি আর কিছু ভাবতে পারেন না।’
তিনি হেসে ফেলে বললেন, ‘কবিতা শুনতে চাও?’
‘কবিতা?’
‘হ্যাঁ কবিতা। আমি আবৃত্তি ভালো করতে পারি না। আমার উচ্চারণ খারাপ। ‘র’ ‘ড়’-এ গণ্ডগোল করে ফেলি। ‘দ’ এবং ‘ধ’-তেও সমস্যা আছে। তবে প্রচুর কবিতা আমার মুখস্থ। রেনুর সঙ্গে বাজি রেখে একবার সারারাত কবিতা মুখস্থ বলে গেছি। বল কোন কবিতা শুনবে।’
‘যা বলব তাই মুখস্থ বলতে পারবেন?’
‘অবশ্যই পারব।’
‘আচ্ছা আষাঢ় মাস নিয়ে একটা বলুন।’
‘খুব সহজ বিষয় ধরলে। বর্ষা হচ্ছে রবীন্দ্রনাথের প্রিয় ঋতু। বর্ষা নিয়ে তাঁর অসংখ্য কবিতা আছে—’
তিনি নিচু গলায় শুরু করলেন—
আষাঢ় হতেছে শেষ, মিশায়ে মল্লার দেশ
রচি “ভরা বাদরের” সুর।
খুলিয়া প্রথম পাতা গীত গোবিন্দের গাঁথা
গাহি “মেঘে অম্বর মেদুর।”
স্তব্ধ রাত্রি দ্বিপ্রহরে ঝুপ ঝুপ বৃষ্টি পড়ে
শুয়ে শুয়ে সুখ অনিদ্রায়
“রজনী শাঙন ঘন ঘন দেয়া গরজন”
সেই গান মনে পড়ে যায়।
শওকত সাহেব হঠাৎ কবিতা আবৃত্তি থামিয়ে দিলেন। তিনি এ কি করছেন! মেয়েটিকে অভিভূত করার চেষ্টা করছেন! সেই চেষ্টাও ছেলেমানুষি ধরনের চেষ্টা। কোনো মানে হয় না। এর কোনো মানে হয় না।
পুষ্প বলল, ‘হঠাৎ থেমে গেলেন কেন?’
‘ইচ্ছা হচ্ছে না। আকাশে মেঘ নেই, বর্ষার কবিতা এই কারণেই ভালো লাগছে না।’
তিনি সিগারেট ধরিয়ে হনহন করে এগিয়ে গেলেন।
পুষ্প পেছনে পড়ে গেল।
.
পরদিন গেলেন ময়নাতলা স্কুলে।
জরাজীর্ণ স্কুল। দেখেই কান্না পায়। তিনি স্কুলে ঢোকামাত্র একদল রোগাভোগা ছেলে মিলিটারিদের মতো প্যারেড করতে-করতে এল। তাদের একজন দলপতি আছে। সে এসে স্যালুট করে হ্যান্ডশেকের জন্যে হাত বাড়িয়ে দিল। খুবই বিব্রতকর অবস্থা।
সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে মানপত্র পাঠ করলেন স্কুলের বাংলার শিক্ষক তারিনীবাবু। হে মান্যবর, হে জগতের আলো, হে বিদগ্ধ মহাজ্ঞানী, হে বাংলার হৃদয়, হে দেশমাতৃকার কৃতী সন্তান …চলতেই লাগল। চেয়ারে বসে দীর্ঘ সময় এই জিনিস শোনা কোনো সুস্থ মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। কিন্তু তিনি গলায় জুঁই ফুলের মালা নিয়ে চুপচাপ শুনছেন। অনুষ্ঠানে এক ছেলে কবিতা আবৃত্তি করল। রিনরিনে গলায় বলল, ‘লিচু চোর। লিখেছেন বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম।’ কিছুদূর আবৃত্তি করেই সে
গণ্ডগোল করে ফেলল। আবার শুরু করল গণ্ডগোল-আগের জায়গায় এসে আবারো
গণ্ডগোল। তারিনীবাবু ছেলেকে হাত ইশারায় ডাকলেন। সে কাছে এগিয়ে আসতেই, প্রচণ্ড চড় কষিয়ে বললেন—গাধা। যা পেছনে কানে ধরে বসে থাক।
শওকত সাহেব খুবই মন খারাপ করে লক্ষ করলেন ছেলেটি সত্যি-সত্যি সবার পেছনে কানে ধরে চুপচাপ বসে আছে। তিনি এই স্কুলে আসার কারণে বাচ্চা একটি ছেলে লজ্জিত ও অপমানিত হল।
অনুষ্ঠান শেষে হেডমাস্টার সাহেব ঘোষণা করলেন—’মহান অতিথির এই স্কুলে পদার্পণ উপলক্ষে আগামী বুধবার স্কুল বন্ধ থাকবে।’
নীল অপরাজিতা – ৬
আজ লিখতে খুব ভালো লাগছে।
কলম চলছে দ্রুত গতিতে। আকাশ মেঘলা। অল্প-অল্প বাতাস দিচ্ছে। সেই বাতাসে বজরা দুলছে। এই দুলুনির সঙ্গে কোথায় যেন লেখার খানিকটা মিল আছে। ঘুঘু ডাকছে। ঘুঘু নামের এই বিচিত্র পাখি সকালে বা সন্ধ্যায় কেন ‘ডাকে না? যেছে—বেছে ক্লান্ত দুপুরে ডেকে দুপুরগুলোকে কেমন অন্য রকম করে দেয়।
প্রকাণ্ড এক ছাতিম গাছের গুঁড়ির সঙ্গে নৌকা বাঁধা। বজরার জানালা থেকে ছাতিম গাছের ডালপালা এবং তাঁর ফাঁক দিয়ে দূরের আকাশ দেখা যায়। শওকত সাহেব লেখা থামিয়ে ছাতিম গাছটার দিকে তাকিয়ে রইলেন। তাঁর হঠাৎ মনে হল—বৃক্ষরাজি সবসময় আকাশ স্পর্শ করতে চায়। তারা সারাক্ষণ তাকিয়ে থাকে আকাশের দিকে। মানুষ চায় মাটি এবং জলের কাছাকাছি থাকতে। তিনি খুব কম মানুষকেই আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখেছেন—।
‘স্যার আপনের খাওয়া।’
বাবু টিফিন ক্যারিয়ার হাতে উঠে এসেছে।
তিনি আকাশের কাছ থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলেন। বাবু হাঁটুর উপর লুঙ্গি তুলে কালো গেঞ্জি গায়ে চলে এসেছে। কি কুৎসিত ছবি।
‘আজ স্যার গোমাংস। বৃষ্টিবাদলার দিন তো; খাইয়া আরাম পাইবেন। ধুম বৃষ্টি হইব, আসমানের অবস্থা দেখেন।’
‘তুমি টিফিন ক্যারিয়ার রেখে যাও। আমি খেয়ে নেব।
‘উপস্থিত থাইকা আপনেরে খাওয়াইতে বলছে।’
‘কে বলেছে। পুষ্প?’
‘পুষ্প ছাড়া আর কে? শেষ বাটির মধ্যে দৈ-মিষ্টি আছে।’
‘তুমি খেয়েছ?’
‘জ্বি না আপনের খাওয়া শেষ হইলে পুষ্প আর আমি খাইতে বসব।’
আজ তিন দিন হল পুষ্পের সঙ্গে তাঁর দেখা নেই। তার পক্ষে কাদা ভেঙে বজরায় আসা অবশ্যি কষ্টকর, তবু ইচ্ছে করলে সে কি আর আসতে পারত না? অবশ্যই পারত।
‘স্যার কি ‘মঠ’ দেখতে গেছিলেন?’
‘হ্যাঁ।’
‘আমি গতকাল পুষ্পেরে নিয়া গেলাম। ঢুকলাম ভেতরে। পুষ্প না করতেছিল— সাপখোপ থাকতে পারে। আমি বললাম, ভয়ের কিছু নাই। আমি সাপের বাবা সর্পরাজ। হা-হা-হা।’
‘কি দেখলে?’
‘আরে দূর দূর—কিছু না–শেয়ালের গু ছাড়া কিছু নাই।’
শওকত সাহেব দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে খেতে বসলেন। যত তাড়াতাড়ি খাওয়া শেষ করা যাবে তত তাড়াতাড়ি এই আপদ বিদেয় হবে।
‘স্যার আইজ কয় পৃষ্ঠা লেখলেন?’
‘লিখছি কয়েক পৃষ্ঠা।’
‘লেখা শেষ?’
‘না। কিছুটা বাকি আছে।’
‘এত লেখালেখি করেন—আঙুল ব্যথা করে না?’
তিনি চুপ করে রইলেন। কথাবার্তা চালানোর কোনো অর্থ হয় না।
‘আমি স্যার পরীক্ষার হলে তিন ঘন্টা লেখি তারপরে আঙুলের যন্ত্রণায় অস্থির হই। আঙুল যদি দাঁতের মতো বাঁধানোর ব্যবস্থা থাকত তা হইলে লেখকরা সব আঙুল বাঁধিয়ে ফেলত। কেউ রূপা দিয়া, কেউ সোনা দিয়া। ঠিক বললাম না স্যার?’
‘হ্যাঁ ঠিক।’
‘আপনে কি দিয়া বাঁধাইতেন? সোনা না, রূপা?’
‘বাবু।’
‘জ্বি।’
‘খাওয়ার সময় কথা বলতে আমার ভালো লাগে না।’
‘জানতাম না স্যার।’
‘কথা শুনতেও ভালো লাগে না।’
‘আর কথা বলব না স্যার। কি লেখলেন একটু পইড়া দেখি।’
‘না। লেখা শেষ না হওয়া পর্যন্ত আমি কাউকে পড়তে দেই না।’
বাবু দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বলল, ‘পড়লেও কিছু বুঝব না। স্যার আপনি—লালুভুলু পড়েছেন? একটা হিট বই—চোখের পানি রাখা মুশকিল। আমি যতবার পড়ি ততবার কাঁদি।’
শওকত সাহেব খাওয়া বন্ধ করে উঠে পড়লেন।
‘খাওয়া হয়ে গেল?’
‘কিছুই তো খান নাই। গো-মাংস ভালো লাগে না স্যার?’
‘লাগে। আজ খেতে ইচ্ছা করছে না। তুমি এখন টিফিন ক্যারিয়ার নিয়ে যাও।’
‘জ্বি আচ্ছা।’
শওকত সাহেব খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, ‘তুমি পুষ্পকে একবার এখানে আসতে বল তো।’
‘কখন আসতে বলব, এখন?’
‘এক সময় এলেই হবে।’
‘সন্ধ্যার সময় আমি সাথে করে নিয়ে আসব। কোনো অসুবিধা নাই।’
‘থাক সন্ধ্যায় আসার দরকার নাই। আমার কাজ বাকি আছে।’
বাবু বজরা থেকে নেমে আবার উঠে এল।
‘আসল কথা বলতে ভুলে গেছি। আপনার চিঠি আসছে। এই যে নেন।’ একটিমাত্র চিঠি। তাও রেনু লিখে নি। লিখেছে স্বাতী।
বাবা,
অনেকদিন তোমাকে দেখি না।
তুমি কবে আসবে?
তুমি কি আমার সঙ্গে রাগ করেছ? মা বলেছে—পৃথিবীর সবার সঙ্গেই তোমার রাগ। আচ্ছা বাবা পৃথিবী বানান কি ঠিক হয়েছে?
মাকে জিজ্ঞেস করলাম পৃথিবী বানান। মা বলল, ‘তোমার যা ইচ্ছা লেখ।’
আমি কিছু জানি না। বাবা তোমার বই লেখা শেষ হয়েছে? আমার একটা দাঁত পড়েছে। আমি রেখে দিয়েছি—তুমি এলে দেখাব। মার কাছে লেখা তোমার চিঠি আমি লুকিয়ে পড়েছি।
ইতি
তোমার আদরের মেয়ে, স্বাতী।
চিঠিতে কিছুই নেই অথচ শওকত সাহেবের চোখে পানি এসে গেল। তিনি তৎক্ষণাৎ চিঠির জবাব লিখতে বসলেন। আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে স্বাতীকে কিছু লিখলেন না। লিখলেন রেনুকে।
রেনু,
স্বাতীর চিঠি পেয়েছি। খামের উপর তোমার হাতের লেখা ঠিকানা দেখে ভাবলাম তোমার চিঠি। চিঠি লিখছ না কেন বল তো? এক সময় তুমি তোমার রাগ এবং অভিমানের কারণগুলো আমাকে বলতে। দীর্ঘদিন সেইসব বলা বন্ধ করেছ। কোথায় যেন সুর কেটে গেছে। না-কি সুর কখনোই ছিল না, আমরা ভেবে নিয়েছি সুর আছে! একটা সময় ছিল—আমার অর্থবিত্ত ছিল না, খ্যাতি ছিল না, ক্ষমতা ছিল না, লেখার একটা কলম ছিল। আর ছিলে তুমি। তখন প্রায়ই ভাবতাম কোনটি আমার প্রিয়—কলমটা না তুমি?
আজো আমি ঠিক তেমনি করেই ভাবি কিন্তু তুমি বোধহয় তা বিশ্বাস কর না। তুমি অনেক দূরে সরে গেছ। আমি সেদিন যেখানে ছিলাম আজো সেখানে আছি।
ভালবাসা কি সেই সম্পর্কে আমার একটি থিওরি আছে। কাউকে কখনো বলি নি—তেমাকে বলি। আমার ধারণা প্রকৃতি প্রথমে একটি চমৎকার ‘নকশা’ তৈরি করে। অপূর্ব একটি ডিজাইন। যা জটিল এবং ভয়াবহ রকমের সুন্দর। তারপর সেই ডিজাইনটি কাঁচি দিয়ে কেটে দু’ভাগ করে। এক ভাগ দেয় একটি পুরুষকে, অন্য ভাগ একটি তরুণীকে। পুরুষটি তখন ব্যাকুল হয়ে ডিজাইনের বাকি অংশ খুঁজে বেড়ায়। মেয়েটিও তাই করে। কেউ যখন তার ডিজাইনের কাছাকাছি কিছু দেখে তখন প্রেমে পড়ে যায়। তারপর দেখা যায় ডিজাইনটি ভুল। তখন ভয়াবহ হতাশা। আমার মনে হয় প্রকৃতির এটা একটা মজার খেলা। মাঝে-মাঝে প্রকৃতি কি করে জান? মূল ডিজাইনের দুই অংশকে কাছাকাছি এনে মজা দেখে, আবার সরিয়ে নিয়ে যায়। প্রকৃতি চায় না এরা একত্র হোক। দু’জনে মিলে মূল ডিজাইনটি তৈরি করুক। প্রকৃতির না চাওয়ার কারণ আছে—মূল ডিজাইন তৈরি হওয়া মানে অ্যাবসলিউট বিউটির মুখোমুখি হওয়া। প্রকৃতি মানুষকে তা দিতে রাজি নয়। প্রকৃতির ধারণা মানুষ এখনো তার জন্যে তৈরি হয় নি।
তোমাকে এত সব বলার অর্থ একটিই—আমি সবসময় ভেবেছি তোমার কাছে ডিজাইনের যে অর্ধাংশ আছে তার বাকিটা আমার কাছে …
এই পর্যন্ত লিখে শওকত সাহেবের মনে হল তিনি মিথ্যা কথা লিখছেন। রেনুর কাছে মূল ডিজাইনের অর্ধাংশ নেই। রেনুর কাছে তিনি কখনো মিথ্যা বলেন নি—আজ কেন বলবেন?
‘স্যার, ও স্যার।’
শওকত সাহেব বের হয়ে এলেন। বাবু ছাতিম গাছের নিচে দাঁড়িয়ে আছে। তার হাতে কুকুরের বাচ্চার মতো একটা কি যেন দেখা যাচ্ছে। বাচ্চাটি কুঁইকুঁই করছে।
‘কি চাও তুমি?
‘এটা স্যার শেয়ালের বাচ্চা। আমি একটা শেয়ালের বাচ্চা ধরে ফেলেছি। আচ্ছা স্যার শেয়ালের বাচ্চাকে কি কুকুরের মতো ট্রেনিং দেওয়া যায়?’
শওকত সাহেব তীব্র ও তীক্ষ্ণ গলায় বললেন, ‘আর কখনো তুমি আমার আশেপাশে আসবে না। কখনো না।’
বাবু অবাক হয়ে বলল, ‘রাগ করতেছেন কেন স্যার?’
তিনি ক্ষিপ্তের মতো চেঁচালেন, ‘যাও তুমি, যাও বলছি!’
‘এমন করতেছেন কেন? আপনের কি হইছে?’
হৈচৈ শুনে লোক জমে গেল। শওকত সাহেব বজরার ভেতরে ঢুকে গেলেন। সারা বিকাল বিছানায় শুয়ে রইলেন। সন্ধ্যার আগে-আগে করিম সাহেব এলেন চা নিয়ে। হাসিমুখে বললেন, ‘দারুণ খবর পাওয়া গেছে স্যার। মঠ একটা না। আরো দু’টা আছে। দেখতে একই রকম, তবে সাইজে ছোট।’
শওকত সাহেব বললেন, ‘করিম সাহেব আপনি এখন যান। আমার শরীরটা ভালো লাগছে না।’
‘কি হয়েছে, জ্বরজ্বারি না-কি?’
‘জ্বি না।’
‘ভবেশবাবুকে খবর দিব?’
‘কাউকে খবর দিতে হবে না।’
‘মঠে কবে যাবেন বললে ব্যবস্থা করে ফেলি।’
‘করিম সাহেব, আমি চুপচাপ খানিকক্ষণ শুয়ে থাকব।’
‘চা খাবেন না?’
‘না। আমি রাতেও কিছু খাব না। খাবার পাঠাবেন না।’
করিম সাহেব চিন্তিত মুখে ফিরে গেলেন।
সন্ধ্যা মিলিয়ে গেল। বজরার মাঝি এল বাতি জ্বালাতে। তিনি তাকে ফিরিয়ে দিলেন। অন্ধকারে বজরার ছাদে বসে রইলেন। চারদিকে ঝিঁঝি ডাকছে। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। আজো কি সেদিনের মতো ঝড় হবে?
রাতে খাবার নিয়ে এল পুষ্প। সে একা আসে নি, বাবুকে নিয়ে এসেছে। বাবুর হাতে হারিকেন।
পুষ্প বজরায় উঠে বাবুকে বিদেয় করে দিল। সহজ স্বাভাবিক ভঙ্গিতে শওকত সাহেবকে বলল, ‘আপনার খাবার এনেছি।’
তিনি চুপ করে রইলেন।
পুষ্প বলল, ‘খাওয়া শেষ করে আপনি আমার সঙ্গে যাবেন। আজ রাতে বাসায় থাকবেন। আজো ঐ দিনের মতো ঝড় হবে। দিনের অবস্থা ভালো না।’
‘আমার ক্ষিধে নেই পুষ্প।’
‘আপনি কী রাগ করেছেন?’
‘রাগ করি নি। কি নিয়ে রাগ করব আমি?’
‘বাবু ভাই বলছিল, আপনি নাকি তাকে খুব বকা দিয়েছেন। সে আপনার রাগ দেখে হতভম্ব হয়ে গেছে। তার ধারণা ছিল আপনি ফেরেশতার মতো মানুষ।’
‘তোমার কি ধারণা?
‘আপনি খাওয়া শুরু করুন তারপর বলব।’
শওকত সাহেব খেতে বসলেন। পুষ্প ঠিক তার সামনে বসেছে। তার মুখ হাসি-হাসি। যেন কোনো একটা ব্যাপারে সে খুব মজা পাচ্ছে।
শওকত সাহেব বললেন, ‘খাওয়া শুরু করেছি এখন বল আমার সম্পর্কে তোমার কী ধারণা?’
‘আজ বলব না। আপনি যেদিন চলে যাবেন সেদিন বলব। তাছাড়া আমার মনে হয় আপনাকে বলার দরকার নেই। আমার মনে কি আছে তা আপনি ভালোই জানেন।’
পুষ্প এত নিশ্চিন্ত হয়ে কথাগুলো বলল যে তিনি চমকে উঠলেন। সেই চমক পুষ্পের চোখ এড়াল না।
‘বাবু ছেলেটিকে তোমার কি খুব পছন্দ?
‘হ্যাঁ পছন্দ।’
‘কতটুক পছন্দ?’
‘আপনি যতটুক ভাবছেন তার চেয়ে অনেক কম।’
‘কেন পছন্দ বল তো?’
‘ওর মধ্যে কোনো ভান নেই। লুকোছাপা নেই। যা তার মনে আসে সে তাই বলে। যা তার ভালো লাগে—করে। আমরা কেউ তা পারি না। আপনার যা ইচ্ছা করে আপনি কি তা করতে পারবেন?’
‘কেন পারবো না?’
‘না আপনি পারবেন না। আপনার সেই সাহস নেই, সেই ক্ষমতা নেই। এই যে আমি আপনার এত কাছে বসে আছি—আপনার যদি ইচ্ছেও করে আপনি আমার হাত ধরতে পারবেন না।’
‘পুষ্প।’
‘আমি তোমাকে একটা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করি—তুমি সত্যি জবাব দেবে?’
পুষ্প বলল, ‘আমি কখনো, কোনোদিনও আপনার সঙ্গে মিথ্যা কথা বলব না। আমি প্রতিজ্ঞা করেছি।’
‘কখন প্রতিজ্ঞা করলে?’
‘যেদিন আপনাকে প্রথম দেখলাম সেই দিন। যেদিন পা ছুঁয়ে সালাম করলাম।’
‘ভালবাসা সম্পর্কে আমার একটি থিওরি আছে; তুমি কি শুনতে চাও?’
‘না আমি কিছুই শুনতে চাই না। আপনি কী প্রশ্ন করতে চাইছিলেন করুন।’
‘আমার সবসময় মনে হয়েছে বাবু ছেলেটিকে তুমি খবর দিয়ে এনেছ। তুমি আমার সঙ্গে এক ধরনের খেলা খেলতে চেয়েছ। তার জন্যে বাবুকে তোমার প্রয়োজন ছিল। আমার কথা কি ঠিক?’
‘হ্যাঁ ঠিক। আপনি আমাকে অবহেলা করছিলেন—আমার সহ্য হচ্ছিল না। আপনি জানতে চেয়েছেন তাই বললাম। জানতে না চাইলে কোনোদিনও বলতাম না।’
বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছে। করিম সাহেব ছাতা হাতে, মেয়েকে নিতে এসেছেন। তিনি শওকত সাহেবকে বললেন, ‘স্যার আপনিও চলুন। বৃষ্টির মধ্যে একা-একা থাকবেন।’
শওকত সাহেব শীতল গলায় বললেন, ‘আপনারা যান। আমার অসুবিধা হবে না। আমার একা থাকতে ইচ্ছে করছে।’
.
রাত ন’টার দিকে বৃষ্টি নামল।
তুমুল বর্ষণ। শওকত সাহেব বজরার ছাদে আরামকেদারায় এসে গা এলিয়ে দিলেন। তাঁর বৃষ্টিতে ভিজতে ইচ্ছা করছে। তীব্র ইচ্ছা। মানুষ তার জীবনের অধিকাংশ সাধই পূর্ণ করতে পারে না, কিছু ছোটখাট সাধ পূর্ণ করতে পারে।
বর্ষণ চলল সারা রাত। কখনো একটু কমে আসে—কখনো বাড়ে। বাতাসে বজরা দুলতে থাকে। তাঁর বড় ভালো লাগে।
শেষ রাতের দিকে জ্বরের ঘোরে তিনি আচ্ছন্ন হয়ে পড়লেন। তাঁর মনে হল রেনু যেন এসে দাঁড়িয়েছে তাঁর পাশে। রেনু অবাক হয়ে বলছে—’কি হয়েছে তোমার, তুমি বৃষ্টিতে ভিজছ কেন?’
তিনি হাসিমুখে বললেন, ‘বৃষ্টিতে ভিজলেও আমার কিচ্ছু হবে না রেনু। আমি হচ্ছি ওয়াটার প্রুফ। যখন ক্লাস টেনে পড়ি তখন W.P. টাইটেল পেয়েছিলাম তোমার মনে নেই?’
রেনু বলল, ‘তুমি কি কোনো কারণে আমার উপর রাগ করেছ?’
‘না। কারো উপর আমার কোনো রাগ নেই। তোমার উপর একেবারেই নেই।’
‘কেন নেই বল তো?’
‘আমাদের ছোট মেয়েটি অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে গেল, সেই সময়ের কথা কি তোমার মনে নেই রেনু? বেচারী দিনের পর দিন অসহ্য যন্ত্রণায় কি কষ্ট করল। আমি তাকে একদিনও দেখতে যাই নি—কারণ ওর রোগ-যন্ত্রণা দেখা এবং দেখে সহ্য করার ক্ষমতা আমার ছিল না। ও তোমার কোলে মাথা রেখে ছটফট করছে, আমি ঘরে বসে লিখছি। ও মারা যাবার সময়ও বার বার বলছিল—’বাবা কোথায়, বাবা?’
‘থাক ওসব কথা।’
‘না না থাকবে কেন, তুমি শোন—মেয়ে মারা যাবার পরেও তুমি কিন্তু আমার উপর রাগ কর নি। তুমি আমাকে সান্ত্বনা দেয়ার জন্যে ছুটে এসেছিলে–সেই তোমার উপর আমি কী করে রাগ করি?’
বৃষ্টির তোড় বাড়ছে। বজরা খুব দুলছে। শওকত সাহেবের মনে হল তিনি রেনুকে আর দেখতে পারছেন না। নদীর তীরে পুষ্পকে দেখতে পাচ্ছেন। পুষ্প ব্যাকুল হয়ে বলছে—’আপনি খুব ভালো করে আমাকে দেখে বলুন তো আপনি যে ডিজাইনের অর্ধেক অংশের কথা বলছিলেন—সেই অর্ধেক কি আমার কাছে? দু’টি ডিজাইন একটু মিলিয়ে দেখবেন? তাড়াতাড়ি করতে হবে; আমাদের হাতে সময় বেশি নেই।
কাছেই কোথাও বজ্রপাত হল। বজ্রপাতের শব্দে সাধারণত পাখিরা চেঁচামেচি করে না। এইবার কেন জানি খুব চেঁচামেচি করছে।
(সমাপ্ত)