Read free bangla books online

নিধিরাম – হিমু চন্দ্র শীল

নিধিরাম - হিমু চন্দ্র শীল

রাত তখন দুটো বেজে সাতচল্লিশ মিনিট। নিস্তব্ধ সবকিছু। কুয়াশায় কিচ্ছু দেখা যাচ্ছে না। তবু ভরা পূর্ণিমার আলো কুয়াশার চাদর ভেদ করে ঠিকরে পড়ছে গ্রামের চারপাশে।

দীর্ঘদিন ধরে পেটের পীড়ায় ভুগতে থাকা ছায়া রাণী যখনই ঘরের বাইরে বের হলেন, আচমকা শ্মশান পাড়ের বাঁশঝাড়ে কিছু একটা নড়াচড়া দেখে থমকে গেলেন। মুখ দিয়ে একটি শব্দও বের হলো না। ভোরে কয়েকজনের ডাকাডাকি শুনে ছায়া রাণী সম্বিত ফিরে পেলেন।

জেগে উঠে দেখলেন তিনি ঘরের দরজার সামনে পড়ে আছেন। চারপাশে মানুষ তাকে ঘিরে আছে। কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে ছায়া রাণী তার সঙ্গে ঘটে যাওয়া গতকাল রাতের কাহিনি বর্ণনা করলেন সবাইকে। কেউ বিশ্বাস করলো, কেউ করলো না।

তবে পাড়ায় সবার কাছে শ্রদ্ধার পাত্র হয়ে উঠা নিধিরাম ঠিকই বিশ্বাস করলেন। সবাই তাকে ডাকে ‘নিধিরাম বাবা’, বয়স পঞ্চাশ ছুঁই ছুঁই। বাড়ি কোথায় কেউ জানে না। মাত্র পনেরো-বিশদিন হলো তিনি হুট করে একদিন সন্ধ্যায় এসে গ্রামটিতে আশ্রয় নিয়েছেন।

সবার সম্মতিতে সিদ্ধান্ত হলো ননী গোপাল প্রথমে নিধিরামের পানি পড়া খেয়ে পরীক্ষা করে দেখবেন আদৌ তা কাজ করে কিনা! বিশ টাকা প্রণামী দিয়ে সেদিন সবার সামনে ননী গোপাল এক গ্লাস পানি পড়া খেয়ে নিলেন।
নিধিরামের কথায় মানুষের মনে বিশ্বাস জাগলো। পাড়ার মধ্যে ভূত নেমেছে কথাটা এমুখ ওমুখ করে ছড়িয়ে পড়লো সবখানে। মধ্যরাতে যখন পাড়ার সবাই ঘুমে আচ্ছন্ন থাকে তখনই ভূতের লীলাখেলা শুরু হয়। এমনিতে পাড়াটার মাঝখানে ছয়টা শ্মশান। যে বাড়ির গৃহকর্ত্রী প্রথম ভূতের সাক্ষাৎ পেয়েছিল সে বাড়িটি ছিল একেবারে শ্মশানের সামনে। তাই ভয়মিশ্রিত আতঙ্ক সবার মনে গেঁড়ে বসেছে।

আজ এ বাড়ি তো কাল ওই বাড়ি, এভাবে করতে করতে পুরো পাড়ার কোনো না কোনো বাড়ির সদস্য ওই ভূতের দেখা পেয়েছে। ভূতের দেখা পেলেও, ভূতটা এখনও কারো খুব একটা ক্ষতি করেনি। তবে ভূতকে দেখে ছায়া রাণীর পর বেশ কয়েকজন মূর্ছা গিয়েছিল। ভূতের ভয়ে তটস্থ পাড়াবাসী।

ননী গোপাল পাড়ার কয়েকজনকে নিয়ে সভায় বসলেন চিন্তিত মনে। ভূত থেকে পরিত্রাণ পেতে বিভিন্নজন বিভিন্ন পরামর্শ দিতে লাগলেন। নিধিরামও সম্মানিত ব্যক্তি হিসেবে যোগ দিয়েছেন সেখানে। সবার কথা শেষ হওয়ার পর নিধিরাম মাঝখানে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, আপনাদের যদি কারো আপত্তি না থাকে তাহলে ওই ভূত আমিই তাড়াতে পারবো।

কথাটি শুনে সবাই একটু হকচকিয়ে গেলো। ননী গোপাল, নিধিরামকে বিষয়টা পরিষ্কার করে বলার জন্য বললেন। নিধিরাম আমতা আমতা করে বলতে লাগলেন, এর আগেও আমি বিভিন্ন জায়গায় এমন ভূত তাড়িয়েছি। তবে ভূত তাড়ানোর আগে আপনারা সবাই আমার কাছ থেকে এক গ্লাস করে পানি পড়া খাবেন।

নিধিরামকে পাড়ার সবাই শ্রদ্ধা করে। তাই তার কথায় কেউ আপত্তি করলো না। ননী গোপাল বললেন, নিধিরাম বাবা! এ তো ভালো কথা। আপনার দেওয়া পানি পড়া খেয়ে যদি ভূত দূর হয়ে যায় তাহলে তো সেটাই করা উচিত।

নিধিরাম বললেন, বিশ্বাস না হয় তো প্রথমে কেউ একজন আমাকে পরখ করে দেখতে পারেন। তবে প্রতি গ্লাস পানি পড়ার জন্য বিশ টাকা করে প্রণামী দিতে হবে। কারণ প্রণামী ছাড়া সেই পানি খেয়ে ফল খুব একটা পাওয়া যাবে না।

সবার সম্মতিতে সিদ্ধান্ত হলো ননী গোপাল প্রথমে নিধিরামের পানি পড়া খেয়ে পরীক্ষা করে দেখবেন আদৌ তা কাজ করে কিনা! বিশ টাকা প্রণামী দিয়ে সেদিন সবার সামনে ননী গোপাল এক গ্লাস পানি পড়া খেয়ে নিলেন। তারপর থেকে ননী গোপাল আর কোনোদিন ভূতের দেখা পাননি। গ্রামের শিশু থেকে বৃদ্ধ সবাই ভক্তি সহকারে সেই পানি পড়া খেতে শুরু করলো। সত্যি সত্যি যারা নিধিরামের পানি পড়া খেয়েছে তারা আর কোনোদিন ভূত দেখেনি।

ননী গোপাল গ্রাম্য ডাক্তার হরিপদকে নিয়ে হাজির হলেন নান্টু চরণের বাড়িতে। হরিপদ সবাইকে পরীক্ষা করে বললেন, ভয়ের কিছু নেই।

একদিন বিকেলে পাড়ার ধনাঢ্য ব্যক্তি বলে পরিচিত নান্টু চরণ পরিবারের সদস্যদের নিয়ে আসলেন নিধিরামের কাছে। নান্টু চরণের পরিবারের দুই সন্তান থাকে মধ্যপ্রাচ্যে। সেখানে টাকাপয়সা রোজগার করে গ্রামে অনেককিছু করেছেন তার সন্তানরা। বাড়ির একমাত্র পুরুষ সদস্য হিসেবে নান্টু চরণ সবকিছু দেখভাল করেন।

নান্টু চরণ সবকিছু হিসাব করে চলেন। এলাকার অনেকে মনে করে নান্টু চরণের বাড়িতে একটা গোপন কক্ষ আছে যেখানে অনেক টাকা পয়সা আর স্বর্ণের অলঙ্কার রাখা আছে। বেশ কয়েকবার চোর চুরি করতে গিয়েও নান্টু চরণের কারণে সফল হয়নি। নান্টু চরণকে দেখে নিধিরাম খুব খুশি হলো। কারণ বেশ কয়েকবার নান্টু চরণের বাড়ি থেকে নিধিরামের জন্য খাবার এসেছিল। সেই খাবারের স্বাদ তার মুখে এখনো লেগে আছে। তাছাড়া রাতে ঘুমানোর সময় নিধিরাম যে কম্বলটা গায়ে দেন তাও নান্টু চরণ দান করেছেন।

নান্টু চরণ নিধিরামকে প্রণাম করে প্রণামী দিয়ে এক এক করে বাড়ির সবাইকে খাওয়ালেন পানি পড়া। তারপর শান্ত মনে ফিরে গেলেন বাড়িতে। পরদিন সকাল গড়িয়ে দুপুর হলো। নান্টু চরণের বাড়ি থেকে কোনো সাড়া শব্দ আসছে না দেখে পাড়ার মানুষজন একটু অবাক হলো। নান্টু চরণের অতসী মামী গিয়ে দেখলেন ঘরের দরজা খোলা। নান্টু চরণ আর বাড়ির নারীরা অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে। ঘরের সব জিনিসপত্র এদিক সেদিক ছড়ানো ছিটানো। জোরে একটা চিৎকার দিয়ে অতসী মামী লোক জড়ো করে ফেললেন।

ননী গোপাল গ্রাম্য ডাক্তার হরিপদকে নিয়ে হাজির হলেন নান্টু চরণের বাড়িতে। হরিপদ সবাইকে পরীক্ষা করে বললেন, ভয়ের কিছু নেই। মনে হয় তারা এখনো জীবিত আছে। হয়তো কোনো খাবারের সঙ্গে কেউ কিছু মিশিয়ে দিয়ে তাদের এ অবস্থা করেছে।

সবাই ধরাধরি করে নান্টু চরণের পরিবারের সব সদস্যকে ভ্যানে তুললো, নিয়ে গেলো পাশের কমিউনিটি ক্লিনিকে। পাড়ায় একটা হুলস্থুল কাণ্ড হয়ে গেলো। এমন কাজ কে করতে পারে তা ভেবেচিন্তে সবাই আতঙ্কিত হয়ে পড়ল। কিন্তু এরই মধ্যে শোনা গেল নিধিরামকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। পাড়ার ছোটরা খেলতে গিয়ে নিধিরামের গায়ের গেরুয়া রঙের কাপড়, সঙ্গে একটা পরচুলা মন্দিরের পেছনের পুকুর থেকে আবিষ্কার করেছে।

সুস্থ হয়ে বাড়িতে ফিরে নান্টু চরণ দেখলেন তার পুত্রদের এতদিনের কষ্টের সঞ্চিত সবকিছু শেষ। গোপন কুঠুরি ভেঙ্গে চুরমার। নান্টু চরণের পরিবারের আর বুঝতে বাকি রইল না এসব কিছুর পেছনে কাজ করেছে নিধিরামের পানি পড়ার ভেলকিবাজি।

বছর দুয়েক পর ননী গোপাল এক গ্রামে বেড়াতে গিয়ে দেখলেন দেখতে হুবহু নিধিরামের মতো এক ব্যক্তিকে গাছের সঙ্গে বেঁধে আচ্ছামত পিটাচ্ছে লোকজন। ননী গোপাল একটু খোঁজ নিয়ে জানতে পারলেন লোকটি ‘সাধু বাবা’ সেজে ছদ্মবেশে এলাকার মানুষকে বোকা বানাচ্ছিল। কৌতূহলী ননী গোপাল লোকটিকে একটু পরখ করে দেখতেই তার মুখ থেকে খুব ধীরে বেরিয়ে এলো, ‘হতচ্ছাড়া নিধিরাম’।

Facebook Comment

You May Also Like

x