Monday, August 18, 2025
Homeথ্রিলার গল্পকুনাল - আলী ইমাম

কুনাল – আলী ইমাম

প্রথম যেন মনে হলো অনেক দূর কেউ বুঝি আগুনের তীর ছুড়ে মারছে। আস্তে আস্তে চোখ খুলল কুনাল। আর তক্ষুনি যেন শরীরটা দারুণ ব্যথায় চিনচিন করে উঠল। পানির ছপাৎ ছপাৎ শব্দ উঠছে শুধু। চারদিকে অথৈ পানি। তার উপর একটা ভাঙা কাঠের টুকরোর ওপর অবসন্নের মতো পড়ে আছে কুনাল। চর কাজলের জেলেপাড়ার সেই দুরন্ত ছেলেটা। বুকের কাছটা কেটে গিয়েছিল মাদার গাছের কাটায়। পানির তোড়ে ভেসে যাবার সময় আকুল হয়ে কুনাল ওটাকেই ধরার চেষ্টা করেছিল। সেই কাটা জায়গায় লোনা পানির ঝাপটা লেগে জ্বলছে। জ্বলছে কুনালের সারাটা বুক, চোখ। কোত্থেকে যে কি হয়ে গেল।

এতক্ষণ সংজ্ঞাহীনের মতো পড়েছিল। চোখের সামনে ধু ধু করছে পানি। মাঝ সমুদ্রে এসে পড়ছে নাকি সে। হঠাৎ পায়ের কাছটায় কেমন সুড়সুড়ি লাগতেই মাথাটা ঘুরিয়ে দেখল। একটা পাতিহাঁস তার পায়ের কাছে মাথা ঘষছে। কে জানে। কোথেকে ভেসে এসেছে এটা। কেমন অসহায়ের মতো দেখাচ্ছে হাঁসটাকে তখন।

তিলিবুড়িকে বাঁচাতে পারেনি সে। চোখে কম দেখে বুড়ি। কত বয়স হয়েছে। তিলিবুড়ির তা কেউ জানে না। কোথায় যেন থাকে। মাঝে মাঝে হঠাৎ করে এসে হাজির হয় জেলেপাড়াতে। তার সঙ্গে থাকে সেই কুচকুচে কালো কুকুরটা।। কুকুরটার গলায় আবার একটি ঘণ্টি বাঁধা। তার শব্দ ওঠে টুং টাং টুং টাং! বুড়িকে দেখলে জেলেপাড়ার লোকগুলোর মুখ কেমন শুকিয়ে আসে। তিলিবুড়ি নাকি ডাইনি। ও যেখানে যায় সেখানেই একটা সর্বনেশে কাণ্ড ঘটে।

কুনালের মনে আছে এক শীতের রাতে জেলেপাড়ার সবাই শুনলো একটা মৃদু শব্দ। টুং টাং। আর সেই সঙ্গে তিলিবুড়ির গা জমানো শীতল হাসি। ও হাসি শুনলে বুকের ভেতরটা অবধি কেমন ঠাণ্ডা হয়ে যায়।

সবাই দেখল মাধাই জেলের ঝুপড়িতে দাউদাউ করে কীভাবে যেন আগুন লেগেছে। আকাশটা লাল হয়ে উঠেছে। সবাই ছুটোছুটি করছে। কুনাল ভয় পেয়ে বেরিয়ে এসেছিল। মাধাই জেলের বউটা চিৎকার করে বলছে, ওই অলক্ষুণে বুড়িটা এসেছে যে। সর্বনেশে মানুষখেকো ডাইনিটা এসেছে যে, আগুন লাগবে না ক্যানে? তোরা বল আগুন ক্যানে লাগবে না?

কুনাল ম্লান আলোতে দেখছিল তিলিবুড়ির চোখ টলটল করছে। যেন তক্ষুনি ঝরঝর করে কেঁদে ফেলবে। বুড়িটা কাঁপা কাঁপা গলায় বলছিল, ও বাবা মাধাই, আমি এমনি এসেছিলাম। আমাকে একটা কাপড় দিবি? ঠাণ্ডা লাগে খুব। চুপ কর বুড়ি। তুই যেখানটায় যাস, সেখানেই একটা সর্বনাশ ঘটে।

শীতের হি হি বাতাসে তিলিবুড়ি কাঁপছে। জেলেপাড়ার নারকেল গাছের পাতাগুলোর ভেতর তখন কেমন শব্দ উঠছে।

তোকে আজ মেরেই ফেলব, বলে মাধাই জেলে পাগলের মতো একটা বৈঠা নিয়ে মারতে গেল তিলিবুড়িকে। মাটিতে গড়াগড়ি দিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বুড়ি বলছে, আমাকে আর মারিস না বাপ। আমার ব্যথা লাগে রে। আর মারিস না রে।

জেলেপাড়ার সবাই গোল হয়ে দেখছে মাধাই জেলে তিলিবুড়িটাকে বেদম মারছে। কুনালের মনে হলো, সবার চোখই খুশিতে যেন চকচক করে উঠছে। কুচকুচে কালো কুকুরটা একপাশে দাঁড়িয়ে হাঁপাচ্ছে। মাঝে মাঝে তার ঘণ্টির শব্দ উঠছে টুং টাং টুং টাং।।

সে রাতেও এসেছিল তিলিবুড়ি। গরকির রাতে। সারাদিন জোলো বাতাস বইছে। জেলেপাড়ার সবার মুখই কেমন থমথমে। সমুদ্র যেন কেমন ক্ষেপে উঠছে। আকাশের ভাবগতিক তেমন সুবিধার নয়। সমুদ্রে কেউ মাছ ধরতে যায়নি। যারা গিয়েছিল, তারাও তাড়াতাড়ি করে ফিরে এসেছে।

জেলেপাড়ার ঝুপড়িগুলো তুমুল বাতাসে কাঁপছে। ঠিক সে সময়ে সবাই শুনল টুং টাং টুং শব্দ। সবার মুখই সে শব্দ শুনে আতঙ্কে শুকিয়ে গেল। অলক্ষুণে তিলিবুড়ি আসছে। না জানি কি সর্বনাশ ঘটে আজ রাতে। মন্তু জেলে হঠাৎ লাফিয়ে পড়ল।

দাঁড়া, আগে বুড়িটার গলা টিপে মেরে আসি।

বলে বাইরে যেতেই অন্ধকারের ভেতর থেকে কুচকুচে কালো কুকুরটা হিংস্রভাবে এসে লাফিয়ে পড়ল তার উপর। মন্তু জেলে চাপা রাগে ফুঁসতে ফুসতে গিয়ে ঢুকল ঝুপড়িটার ভেতর। আর জোরে গালাগালি করতে লাগল তিলিবুড়িকে।

কুনাল ঝুপড়ির ফাঁক দিয়ে দেখে বুড়িটা কেমন কেঁপে কেঁপে হাসছে। আস্তে আস্তে বাতাসের বেগ বাড়তে লাগল। একসময় সমুদ্র থেকে উঠে এলো সেই বিশাল দত্যিটা। নিমিষেই সবকিছুকে তছনছ করে ভাসিয়ে নিল। কুনাল পানির তোড়ে ভেসে যাবার সময় দেখেছে তিলিবুড়ি পাগলের মতো তাকে আঁকড়ে ধরতে চাইছে। কুনালের মনে হলো বুড়িটা কি অসহায়। হঠাৎ একটা টিনের ধারালো টুকরো তীরবেগে এসে বুড়িটার গলার কাছটা প্রায় কেটে দিল। কুনাল ভেসে যেতে যেতেই দেখল তিলিবুড়ি ভয়ঙ্কর চিৎকার করে ডুবে যাচ্ছে। পানিটা পলাশ ফুলের মতো লাল হয়ে উঠছে।

চিলচিলে রোদটা শরীরে জ্বালা ধরাচ্ছে। কুনালের মাথাটা ঝিমঝিম করছে। যেন অনন্তকাল ধরে ভেসে যাচ্ছে সে এমনি করে। এমনি ঢেউতে দুলতে দুলতে চোখ ঠিকমতো খোলাও যাচ্ছে না। কেমন ঘোলাটে দেখাচ্ছে সবকিছু। লোনা পানির ঝাপটা লেগে চোখটা বুঝি নষ্টই হয়ে গেল। পাতিহাঁসটা কেমন চুপচাপ বসে আছে পায়ের কাছে। ওটাকে যদি এখন রেঁধে খাওয়া যেত। পাতিহাঁসের মাংশ খুব চমৎকার লাগে তার কাছে। খিদেতে যেন পেটের ভেতরটা জ্বলে যাচ্ছে।

দূরে ওটা কি ভেসে যাচ্ছে? লাশ! কুনাল আবছা চোখেই দেখতে পায় বুড়ো ফাদারের লাশটা ভেসে যাচ্ছে। কেমন ফুলে উঠেছে ফাদারের শরীরটা। গলার কাছের মাংশটুকু কারা যেন খুবলে তুলে নিয়ে গেছে।

কানের কাছে তার রিনরিন করে বেজে উঠল ফাদারের স্নেহমাখা মিষ্টি গলা, কেমন আছ? শান্তিতে আছ?

সবুজ ঘাস ভর্তি মাঠ। টকটকে শাপলা ভরা একটা পুকুর। উত্তর দক্ষিণের এলোমেলো বাতাসে নিমফুলের ঝিরঝিরে একটা গন্ধ ভেসে আসে। কুনালের কাছে সে গন্ধটা চমৎকার লাগে।

সকালবেলায় বাতাসে নিমফুলের গন্ধ। বাতাস জানালাতে শব্দ করছে। সামনের আবছা অন্ধকারের ভেতর থেকে ফাদারের স্নেহময় শব্দ ভেসে আসছে। মাথাটা দপদপ করে উঠল কুনালের। এখন চোখের সামনে দিয়ে ভেসে যাচ্ছে সেই ফাদারের লাশ। কুনালের চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করছে, ফাদার, ও ফাদার, তুমি কেমন আছ? তুমি কি শান্তিতে আছ?

শিরাগুলো যেন ছিড়ে যেতে চাইছে। পাগল হয়ে যাবে নাকি সে? পাতিহাঁসটাকে হঠাৎ রেগে একটা লাথি দিল। সেটা কেমন করুণ কণ্ঠে ডেকে পাখা ঝাপটে পড়ে গেল। কুনালের দিকে এগিয়ে আসতে চাইছে পাতিহাঁসটা। কুনালের কান্না পাচ্ছে। ভীষণভাবে।

কোথাও বুঝি কেউ বেঁচে নেই। সমস্ত পৃথিবীটাই বুঝি বিরাণ হয়ে গেছে। জনমানব শূন্য হয়ে গেছে। শুধু সে আর ওই হাঁসটা যেন বেঁচে আছে। কুনাল অবসন্ন শরীরটাকে কোনোমতে ঘুরিয়ে কাঁপা কাঁপা হাত বাড়িয়ে দিল পাতিহাঁসটির দিকে। অস্পষ্ট গলায় শুধু বলল, আয়।

আর তক্ষুণি কাঠের টুকরোটা সরে গেল কুনালের নিচ থেকে। অথৈ পানিতে আস্তে আস্তে তলিয়ে যেতে লাগল চর কাজলের কুনাল নামের ছেলেটা। তলিয়ে যাবার আগে শুধু দেখল, সমস্ত আকাশটা উজ্জ্বল আলোর বন্যায় ভরে আছে। তার মাঝ দিয়ে অনেকগুলো দূরের পাখি উড়ে যাচ্ছে। তাদের ডানায় রোদ লেগে ঝকঝক করছে। একবার মাথাটা উঁচু করতে চাইল কুনাল । পারল না।

Anuprerona
Anupreronahttps://www.anuperona.com
Read your favourite literature free forever on our blogging platform.
RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here


Most Popular

Recent Comments