Sunday, August 17, 2025
Homeকিশোর গল্পযে কারণে ঘোর বর্ষা দেখতে নেই - ধ্রুব নীল

যে কারণে ঘোর বর্ষা দেখতে নেই – ধ্রুব নীল

যে কারণে ঘোর বর্ষা দেখতে নেই – ধ্রুব নীল

বর্ষা খুব বেশি হলে তাকে ঘোর বর্ষা বলে। এর কারণ, অধিক বর্ষায় একধরনের ঘোর লাগে। তবে সত্য কথাটা হলো, এই ঘোর সবার লাগে না। আমার লাগার কথা ছিল কি না জানি না, তবে ১৯৯০ সালের ওই ঘটনায় আমি একবার ভীষণ এক বর্ষা-ঘোরে পড়ে গিয়েছিলাম। মাসটা ছিল আষাঢ়।

দুলার হাটে আমি আগে কখনো যাইনি। আমার এক বন্ধু আরিফের বাড়ি ওই গ্রামে। আরিফ আমাদের এলাকায় থাকত তার বাবার চাকরির কারণে। ছুটি পেলে বাড়ি যেত। দুর্গম পাহাড়-পর্বত বা সমুদ্র নয়, অচেনা ছিমছাম গ্রামই আমাকে বেশি টানত। তাই নতুন গ্রাম দেখার লোভে আরিফের সঙ্গে যেতে একবার রাজি হয়ে যাই। বাড়িতে ম্যানেজ করতে কষ্ট হলেও আমার জেদের কাছে হার মানে সবাই। যে সময়ের কথা বলছি, তখন মোবাইল-টেলিফোন ছিল না। ছিল শুধু ফিল্মের ক্যামেরা। আমি তখন কলেজে। আমার একটা ক্যামেরা ছিল। ওটা ছিল যাবতীয় অ্যাডভেঞ্চারের একমাত্র সঙ্গী। পকেটে অবশ্য একটা নোটবুক আর কলম রাখার বাতিকও ছিল। দুলার হাটের সবচেয়ে ভেতরে অজপাড়াগাঁ, যাকে বলে সেখানেই ছিল আরিফদের গ্রাম। গ্রামের নামটা ঠিক মনে পড়ছে না। সম্ভবত চানমোহন বা এ রকম একটা কিছু হবে। ধরি নামটা চানমোহনই।

চানমোহনে পৌঁছার পর থেকেই ঝিরিঝিরি বৃষ্টি। উপকূলীয় গ্রাম। নিম্নচাপ আর সতর্ক সংকেতের মাস। বৃষ্টি তো হবেই। আরিফের বাড়ির লোকজন, বিশেষ করে রেজু চাচা আমাকে বারবার সতর্ক করে দিতে লাগলেন আমি যেন ভুলেও বৃষ্টি-বাদলার সময় নদীর কাছে না যাই। তাঁর ধারণা, নদীর কাছে গেলেই আমি সাঁতার কাটতে চাইব এবং ডুবে যাব। নদী বলতে ওটা সমুদ্রেরই অংশ। বড় বড় ঢেউ। তবে সত্যি বলতে কী, ঢেউ বাবদ আগ্রহ ছিল না। আমি এসেছিলাম গ্রামের বর্ষা উপভোগ করতে। অপেক্ষায় ছিলাম কখন নামবে সেই ঘোর বর্ষা।

এসেছি দুদিন হলো। এই দুদিনে ছাতা হাতে গ্রামটা চষে বেড়িয়েছি। ছোটখাটো গ্রাম। সুপারিগাছ, নারকেলগাছ আর বনজুঁইয়ের ঝোপগুলো মুখস্থ হয়ে গেল। সীমানার ওপারে শূন্য সৈকত। আরেক পাশে চিকন জঙ্গলে ছাওয়া রাস্তা চলে গেছে হাটের দিকে। বর্ষা না আসতেই ঘোরে পড়ে গেলাম। গ্রামটার একটা আলাদা গন্ধও পেতে শুরু করেছি। কেমন যেন মেটে মেটে গন্ধ। বাড়িতে চিঠি পাঠিয়ে দিয়েছি, ফিরতে দেরি হবে।

আমার কাঙ্ক্ষিত ঘোর বর্ষা এল দুদিন পরেই। এর মাঝে গল্প হওয়ার মতো কোনো ঘটনা ঘটেনি। তাই ওসব বাদ রাখলাম। তার আগে বলে রাখি, গ্রামে আমার এক অন্য রকম কিশোরের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল। বয়স নয়-দশ হবে। ছেলেটার চোখ বড় বড়। কথা বলে না। আমি আগ বাড়িয়ে টুকটাক কথাবার্তা বলেছিলাম। কারণ তাকে দেখে আমার মনে হয়েছিল সে এ গ্রহের বাসিন্দা নয়। নির্ঘাত এলিয়েন। চুপচাপ মাঠে দাঁড়িয়ে আকাশ দেখে। বিড় বিড় করে। আমি প্রথম দেখেই উচ্ছ্বসিত হয়ে মনে মনে ভাবি, আরে! আমার মতো! ছেলেটার নামও জানি না। তবে এ গল্পে সে একটা গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র। মূল গল্পে আসা যাক।

আমি আরিফদের বাড়ির উঠোনে। দূরে টুকটাক বজ্রপাত হচ্ছিল। পরে সেটাও থেমে গেছে। শুরু হলো ভারী বৃষ্টি। সামনের কিছুই দেখা যায় না এমন বৃষ্টি। আমি স্ট্যাচুর মতো দাঁড়িয়ে রইলাম। বৃষ্টি দেখে মনে হলো কয়েকটা পরতের মতো পড়ছে। পাতলা চাদরের মতো। একটা সময় আমি কিছুই দেখতে পাচ্ছিলাম না। একটা সাদা ঝিরঝির ছবি কেবল। মনে হলো বৃষ্টিটা বুঝি আমায় গিলে খেয়ে ফেলছে। ভয় ভয় লাগল। আরিফদের বাড়ি কোন দিকে, ঠাওর হলো না। পা বাড়ালাম। চোখে বৃষ্টির ছাট বাড়ি খাচ্ছে। আমি অন্ধের মতো এগোচ্ছি। হাঁটতে হাঁটতে বুঝলাম ভুল পথে চলে এসেছি। ভাসা-ভাসা দু-একটা গাছ দেখতে পাচ্ছি। তবে গাছগুলো অপরিচিত। উঠোন পেরিয়ে একটা-দুটো বাড়ির পর একটা সুপারিগাছের রাস্তা থাকার কথা। সেখানে একটা খালের মতো। তার দুই পাশে আবার বেতের ঝোপ। আশ্চর্য! এ গাছ তো দেখিনি আগে। ধীরে ধীরে আরও দৃশ্য পরিষ্কার হতে লাগল। জাঁকিয়ে বসল ভয়টা। আমি কোথায়! এ তো চানমোহন না! যে পথ ধরে হেঁটে এসেছি, সেটাও অচেনা। পাশে এটা কার বাড়ি?

আমার হাতের ছাতাটাই কেবল আমার চেনা। বাকি সবই অচেনা। একজন মানুষের দেখা পেলে হয় এখন। ওই তো। কে যেন মাথায় কলাপাতা ধরে দৌড়ে আসছেন। এক মধ্যবয়সী কৃষক। আগলে দাঁড়ালাম তাঁর পথ।

আমি কোথায়! এ গ্রামের নাম কী!

ও মিয়া ভাই, আষাইঢ়া গেরামে আপনে নতুন?

কী বললেন! এ কেমন নাম।

ও বুঝছি, আপনে নতুন।

দাঁড়ান দাঁড়ান। আমার কথা শেষ হয়নি। আরিফদের বাড়িটা কোন দিকে। আমি চানমোহনে যাব।

চানমোহন! এইডা আবার কেমুন নাম! হেহে।

এটা কোথায়? আজ কত তারিখ? আমি কোথায়?

আপনে আষাইঢ়া গেরামে আছেন। আমি গেলাম। দেরি হইয়া যাইতেছে। সময় বেশি নাই হাতে।

আপনার এত তাড়া কিসের?

মিয়া ভাই, আপনে আটকা পড়ছেন। তয় ডরাইয়েন না। গেরামে আসছেন। ঘুরেন-ফিরেন। গেরস্থ বাড়িত গিয়া জিরান। এরপর সময় হইলে যাইবেন।

লোকটা আর দাঁড়াল না। হনহন করে চলে গেল। আমি যতটা অবাক হয়েছিলাম, ততটাই রয়ে গেলাম। মনের তাগিদে ফের হাঁটতে শুরু করে দিলাম। হাঁটতে হাঁটতে যাকে বলে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে গেলাম। চানমোহনের চেয়েও মনে হলো সুন্দর এ গ্রাম। কোথাও একবিন্দু কৃত্রিমতা চোখে পড়ল না। মাটির গন্ধ এখানে আরও কড়া। বৃষ্টিতে আলের ওপর দু-একটা কই আর টাকি মাছ লাফাতে দেখলাম। হাতের ছাতাটাই এখন বেমানান।

ঝিরঝির বৃষ্টিটা থামতেই ঝলমলিয়ে উঠল রোদ। ছাতা বন্ধ করে বসে পড়লাম একটা গাছের নিচে। টেনশন কাজ করছে, তবে সেটা আমাকে ভাবাচ্ছে না। হয়তো গ্রামটা একেবারে আমার স্বপ্নের গ্রামের মতো বলেই। নাকি আমি স্বপ্ন দেখছি! নাহ্, সে সুযোগ নেই। পথ ভুলই হয়েছে।

এর মাঝে খিদে পেয়েছিল। গাছ থেকে পেয়ারা পেড়ে খেয়েছি। কেউ কিছু বলেনি। সবজি খেতে দু-একজন গৃহিণী আর শিশু-কিশোরকে চোখে পড়ল। তারা কেউ আমার ডাকে সাড়া দেয়নি, কথাও বলেনি। অবাক হয়ে দেখল খানিকক্ষণ, তারপর আবার যার যার কাজে মন দিল।

আরে! ওই তো! ওই ছেলেটা! যাকে আমি এলিয়েন ভেবেছিলাম। এই, এদিকে আসো!

ও বাই, আপনেও আসছেন?

মানে কী! আমিও এসেছি মানে।

আষাইঢ়া গেরামে আপনেও আসছেন? আমিও এই গেরামে থাকি।

ঘটনা কী বলো তো?

হে হে হে।

হাসছ কেন? আজব তো! দাঁড়াও তোমার একটা ছবি তুলি।

পকেটেই ছিল ক্যামেরা। কিন্তু ছবি তোলার আগেই ছেলেটা দৌড়ে চলে গেল। আমি তাকে কয়েকবার ডাকাডাকি করে ক্ষান্ত দিলাম। ভাবলাম, অনেক হলো। এবার কারও বাড়িতে গিয়ে উঠতে হবে। জিজ্ঞেস করতে হবে সব।

প্রথমে একটা বাড়ির উঠোনে ঢুকতেই আমাকে ঘিরে ধরল একদল শিশু। আশপাশের বাড়ির ছেলেমেয়ে এরা। বাড়ির ভেতর থেকে এক প্রবীণ ও এক নারী বেরিয়ে এলেন। আমাকে বসার জন্য একটা পুরোনো ভাঙাচোরা চেয়ারও দিলেন। যেন আমার অপেক্ষাতেই ছিলেন তাঁরা।

ইয়ে মানে। আমি আরিফদের বাসা…।

আসমা, এরে গুড় আর মুড়ি দে।

এক কিশোরীর দিকে তাকিয়ে বললেন গৃহিণী। কিশোরী দৌড়ে ভেতরে গেল গুড়-মুড়ির ব্যবস্থা করতে। প্রবীণ লোকটার গায়ে চকচকে শার্ট। মাফলার ঠিক করে আমার সামনে এসে দাঁড়াল। হালকা কাশি দিল। যেন ভয়াবহ কিছু বলতে চায়।

শোনো বাবা। তুমি এই গেরামে নতুন। তবে তোমারে দেইখা মনে হয় তুমি ভয় পাও নাই।

এই গ্রামে যারা নতুন আসে, তারা সবাই ভয় পায়?

হ, এইটা একটা আষাইঢ়া গেরাম।

এই আষাঢ়ে গ্রাম জিনিসটা কী?

লোকটা চুপ করে রইল। সম্ভবত একটা ভালো সংজ্ঞা সাজাচ্ছে।

এই গ্রাম শুধু আষাঢ় মাসে থাকে।

লোকটা বেশ গুছিয়ে শুদ্ধ ভাষায় কথা বলছে। হতে পারে এই একই কথা তিনি হয়তো আরও অনেককেই শুনিয়েছেন। তাই এমন শোনাচ্ছে।

তুমি ছোট মানুষ। আর তোমার সাহসও মেলা। তোমারে আমরার পছন্দ হয়েছে।

এমন সময় গুড়-মুড়ি হাজির। কোনো রকম খিদে চাপা দিতে হবে। তাই আর না করলাম না। দুদ্দাড় গিলতে শুরু করলাম আর লোকটার কথা শোনার চেষ্টা করলাম।

আরিফদের বাসা কোথায় বলতে পারবেন? তার চাচার নাম রেজু।

সবাই চুপ। দু-একজনের ফিসফিস কানে এলেও আমার নিজের মুড়ি চাবানোর শব্দে সেটা বুঝতে পারলাম না। এরপর যখন আমার মুড়ি আর গুড় খাওয়া শেষ হলো, তখন হুট করে আমার খেয়াল হলো ছাতাটা আমার সঙ্গে নেই। সম্ভবত রোদ ওঠার পর কোনো গাছতলাতেই রেখে এসেছি। আমি উঠে দাঁড়ালাম।

জি আপনাদের ধন্যবাদ। আমি যাই।

ঠিক আছে যাও।

দুপুরে খাইতে আইসো। মৃদুস্বরে বললেন ওই গৃহিণী। আমার খুব ইচ্ছে হলো দুপুরে এই বাড়িতে এসে ডাঁটাশাক দিয়ে ছোট মাছের চচ্চড়ি খেয়ে যেতে। কিন্তু আগে আমাকে চানমোহন খুঁজে বের করতে হবে।

পথে কারও সঙ্গে বিশেষ কথা হলো না। তবে এক বুড়ো কৃষক মাথায় শাকের আঁটি নিয়ে আমার সামনে দাঁড়িয়ে একগাল হাসলেন।

তুমি কুন গ্রামের ছাওয়াল?

আমি চানমোহনের ছাওয়াল। আপনি?

আষাইঢ়া গেরামে ঘুরতাছো? ভালো কইরা দেখো।

কী গ্রাম বললেন? এটা কোথায়? কোন জেলায়?

আমি এমন ভাব করলাম যেন নামটা আমি প্রথম শুনেছি। কিন্তু তাতে কাজ হলো না। লোকটা হাসিমুখেই আবার চলে গেলেন।

রাত হওয়া পর্যন্ত আমি একনাগাড়ে হেঁটেছি। দুপুরে আর খাওয়া হয়নি কারও বাড়িতে। এতক্ষণ হেঁটে আমি নিশ্চিত হয়েছি যে আমি সত্যিই চানমোহনে নেই এবং এ গ্রামটা একটা গোলকধাঁধার মতো। এক দিক দিয়ে সোজা হাঁটতে হাঁটতে আবার সেদিকেই এসে হাজির হচ্ছি। গ্রামটার শেষেই আবার গ্রামটার শুরু। অসহায় বোধ করতে লাগলাম। অবচেতন মন খুঁজতে লাগল সেই বালককে। কিন্তু তার আর দেখা মিলল না। শেষে উপায় না দেখে আবার সেই বাড়িতে গিয়ে হাজির হলাম। কিছু বলতে হলো না। ওরা মনে হয় আমার অপেক্ষাতেই ছিল।

যারা আষাঢ়ে গ্রামে আসে, তারা আপনাদের বাড়িতেই আসে?

ওরা সম্ভবত আমার প্রশ্নটা বুঝতে পারেনি। তাই উত্তর পেলাম না। আমি খেতে শুরু করলাম। এত স্বাদের ভাত আর তরকারি আমি জীবনেও খাইনি। আষাঢ়ে গ্রামটা আসলেই মন্দ না।

‘আমরা এই গেরামে আছি ধরো বাপ-দাদার আমল থেইকা। আমরা কেউ কোথাও যাই নাই।’

গৃহিণী বললেন, ‘তুমি থাইকা যাও।’ খেতে খেতে বললাম, ‘তাই তো মনে হচ্ছে। যাওয়ার রাস্তা তো পাচ্ছি না।’

দুজনে চুপ। আমাদের সঙ্গে দুটো মেয়েশিশুও খাচ্ছিল। তারা নিজেরা নিজেরা কী নিয়ে যেন হাসছে। একজন আমার ক্যামেরার দিকে তাকাচ্ছে বারবার। হাত ধুয়েই তাই দেরি না করে ওর একটা ছবি তুলে ফেললাম এবং কথা দিলাম ছবিটা ওয়াশ করে তাকে একটা কপি দেব।

আমার ঘুমানোর ব্যবস্থা করা হলো। সামনের ঘরের একটা চৌকি। তাতে শীতলপাটি পাতা। একটা ধোয়া কাঁথাও পেলাম। আরামে চোখ বুজে আসতে চাইল একবার। আবার দুশ্চিন্তায় কেটে যেতে লাগল ঘুম। এমন সময় জানালা দিয়ে উঁকি দিল মস্ত একটা চাঁদ। যাক, আষাঢ়ে গ্রামে তাহলে চাঁদও আছে।

এরপর কয়েকটা দিন যথারীতি কোনো গল্প ঘটল না। ঘটনাগুলো রুটিনমাফিক। এর মধ্যে শুধু দুবার ওই রহস্য বালকের দেখা পেয়েছি। সে মহা উৎসাহে নিজের মতো খেলায় মত্ত ছিল। আমার কথার জবাবই দেয়নি। চানমোহনের কথা বললেই দৌড়ে পালায়। যেন নামটা শুনতেই চায় না ও। আমার টেনশন, দুশ্চিন্তা এসবের কথা আর নাই-বা বললাম। শুধু ভয় হতে লাগল আষাঢ়ে গ্রামের বাকিদের মতো না আবার আমিও সব মানিয়ে নিতে শুরু করি।

আমার আপাতত ঠিকানা হয়ে গেল সুরুজ আলির ঘর। যার বাড়িতে আমি প্রথম চিড়া-মুড়ি খেয়েছিলাম। তাঁর স্ত্রী রাবেয়া খাতুনকে আমি চাচি ডাকা শুরু করে দিলাম। তাঁদের ছোট দুই কন্যা আমাকে ভাই বানিয়ে ফেলল। আমার মনে হতে লাগল আমি আসলেই এ গ্রামেরই বাসিন্দা এবং এটাই আমার পরিবার। চানমোহনকে মনে হতে লাগল একটা কাল্পনিক গ্রাম।

আষাঢ়ে গ্রামের নিয়মকানুন অদ্ভুত। গ্রামের সীমানা সবাই এড়িয়ে চলে। কেন এড়িয়ে চলে, সেটা আমি প্রথম দিনেই টের পেয়েছি। সে কথা অবশ্য কাউকে বলিনি। আরেকটা নিয়ম হলো ঝড়-বৃষ্টিতে কেউ ঘর ছেড়ে বের হয় না। কারণটা আমি আঁচ করতে পেরেছিলাম কিছুটা। তবে সত্যি বলতে কী আমারও মনে হলো, ঝড়-বৃষ্টিতে আষাঢ়ে গ্রামে বের না হওয়াই ভালো। এই তো বেশ আছি আমি। কচুশাক, লালশাকের ঝোল, পুকুরে মাছ ধরা, গাছ লাগানো, সবজি গাছের তলার আগাছা পরিষ্কার, লাউগাছের গোড়ায় শুকনো গোবর দেওয়া—এসব তো আমারই কাজ। আমার মনেই পড়ল না, আমি স্কুলে ঠিক কী পড়েছি বা আদৌ আমি স্কুলে যেতাম কি না।

সম্ভবত দশ কি পনেরো দিনের মাথায় আমি সত্যিই বিশ্বাস করতে শুরু করলাম, আমার একটা অসুখ হয়েছিল। আমি উল্টোপাল্টা আচরণ করেছি এবং আমার বাবা সুরুজ আলি ও মা রাবেয়াকে আমি নাকি কিছুদিন চাচা-চাচি ডেকেছি। এ নিয়ে সবাই হাসাহাসিও করেছে।

শুধু একটা চাবি ছিল, যে চাবিটা আমাকে জানিয়ে দেয়, কোথাও না কোথাও একটা তালা আছে। যেটা আমাকে খুলতে হবে। চাবিটা হলো সেই বালক। যার বয়স নয় কি দশ। ছেলেটার মুখে হাসি লেগেই থাকে। আমাকে দেখলে তার হাসির ধরন বদলে যায়। একবার ঠিক করলাম ছেলেটাকে যে করেই হোক পাকড়াও করতে হবে। জানতে হবে রহস্যটা কী।

সন্ধ্যায় গল্প বলার আসর হবে, এমন ঘোষণা দিতেই ফাঁদে পা দিল ছেলেটা। ছোটদের আগেই জানিয়ে রেখেছিলাম, ছেলেটা যেন পালাতে না পারে। ফাঁদে আটকা পড়েছে বুঝতে পেরে মিইয়ে গেল ছেলেটা। মিনমিন করে বলল, আপনে চইলা যান। আপনে চইলা যান। আমি বললাম, ধুর ব্যাটা। আমি যামু না। তুই আমারে ক, তুই এমুন করস ক্যান।

আমি যামু না। আপনে যান।

আমি কই যামু।

চানমোহনে যান।

নামটা শুনেই কেমন যেন লাগল। খুব পরিচিত একটা নাম। পরিচিত সুপারিগাছের সারি, তালগাছ আর বনজুঁই। বনজুঁই অবশ্য এ গ্রামেও আছে। গন্ধ খুব ঝাঁজালো হয়। চানমোহন নামটা শুনলে ঠিক সে রকমই একটা ঝাঁজালো গন্ধ নাকে ঠেকে। সেই গন্ধ অনেকক্ষণ নাকেই লেগে থাকে। ছেলেটা এবার আর দৌড়ে পালাল না। চুপচাপ কেটে পড়ল। আমি এটা-সেটা ভাবতে ভাবতে খাওয়া শেষে শুয়ে পড়লাম।

জানালা দিয়ে আসা চাঁদটা বারবার মেঘের আড়ালে ঢেকে যাচ্ছে। আশপাশে গুঞ্জন। তুফান আইতাছে, আষাইঢ়ড়া তুফান আইতাছে।

আমি শিহরণ বোধ করলাম। এই প্রথম এই গ্রামে ঝড় দেখব। তাও এমন পূর্ণিমার রাতে। অবশ্য চাঁদটা এখন কমই ধরা দিচ্ছে।

শুরু হলো ঝমঝম বৃষ্টি। যেমনটা সবাই বলছিল ওই রকম তুফান না হলেও বৃষ্টির সঙ্গে বাতাস আছে বেশ। আমি কাঁথামুড়ি দিয়ে শুয়ে আছি। জানালা বন্ধ করা দরকার। বৃষ্টির ছাট পায়ের দিকটা ভিজিয়ে দিচ্ছে। জানালা খানিকটা ফাঁকাই রাখলাম। কাঁথা সরিয়ে উঠে দাঁড়ালাম। ফাঁক দিয়ে চোখ রাখলাম। বাতাসে পানির ছিটায় চোখ খোলা রাখা দায়। এর মাঝে একবার শুধু বাড়ির পেছনের পুকুরে চাঁদের আলোর ঝিলিক দেখতে পেলাম। এরপর বাড়তে লাগল বৃষ্টির দাপট। পুরো গ্রাম ঘুমিয়ে পড়েছে বোধ হয়। আমি গুটি পায়ে উঠে দাঁড়ালাম। গোটা বৃষ্টিকে মনে হলো একটা প্রাণী। আমাকে ডাকছে ঝমঝমিয়ে। দরজার আড়ালে রাখা লম্বা কালো মজবুত গড়নের ছাতাটা তুলে নিলাম। দরজা খুলে নামলাম উঠোনে। একেই বুঝি বলে ঘোর বর্ষা। পানির সঙ্গে পানির আঘাতে দেখা দিচ্ছে ধোঁয়াশা। ধীরে ধীরে হারিয়ে গেল পুকুরটা, পুকুরপাড়ের বেতগাছ, হোগলা পাতা, বাসক। সবার শেষে বঁইচিগাছটাও ভুতুড়ে অবয়বের মতো ধীরে ধীরে নাই হয়ে গেল।

বৃষ্টি কতক্ষণ ধরে চলেছে, জানি না। থামতেই ভোরের আলো ফুটে উঠল আকাশে। জানালা দিয়ে দেখলাম আমাদের সরকারি কোয়ার্টারের ৪ নম্বর বিল্ডিংয়ের হাফেজ আংকেল জোর কদমে মসজিদের দিকে যাচ্ছেন। তার মানে ফজরের আজান হয়েছে একটু আগে। বৃষ্টিতে চারপাশ দারুণ সতেজ। এমন শুদ্ধ বাতাস আর হয় না। গেটের তালা খুলে বের হয়ে এলাম। সরকারি আবাসিক এলাকা হওয়ায় চারপাশ বেশ ছিমছাম। গাছপালা থাকলেও বনজঙ্গল কিংবা কাদামাটির সোঁদা গন্ধ নেই। পুকুরপাড়ে একটা বনজুঁইগাছ বেড়ে উঠেছে নিজে নিজে। গাছটাকে আমার খুব আপন মনে হয়। ওটার দিকে তাকিয়ে আমার মনে হলো, ঠিক এ গাছটাই আমি আগে কোথাও কোনো একসময় দেখেছি। আরিফ নামের কোনো এক বন্ধুর গ্রামে বা অন্য কোনো গ্রামে সম্ভবত। কিন্তু এ নামে তো আমার কোনো বন্ধু নেই। কে জানে! ঘোর বর্ষার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে আমরা তো কত গল্পই বানিয়ে ফেলি।

Anuprerona
Anupreronahttps://www.anuperona.com
Read your favourite literature free forever on our blogging platform.
RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here


Most Popular

Recent Comments