Read Free Bangla Books Online



বুলগেরিয়ার রূপকথা: হিংসুটে হলে কী হয়

বুলগেরিয়ার রূপকথা: হিংসুটে হলে কী হয়

গ্রামের এক চাষিকে নিয়ে গল্প। বেচারা ভীষণ গরিব। দিন আনে দিন খায়। কোনোমতে টেনেটুনে সংসার চলে। অভাব লেগেই থাকে সারা বছর। সম্বল বলতে মাত্র ছোট্ট এক টুকরা জমি। এতে যে শাকসবজি ফলে, তা বেচে দিন গুজরান করা কঠিন। আয়রোজগারের অন্য কোনো উপায়ও নেই। সুতরাং ভীষণ দুঃখকষ্টের মধ্যে কাটে তার ও পরিবারের সবার জীবন।

চাষি লোকটি গরিব হলে কী, তার স্বভাব বিশেষ সুবিধার নয়। সে দারুণ হিংসুটে লোক। পড়শি অন্য কোনো লোকের সৌভাগ্য দেখলে সে কষ্ট পায়। মনের ভেতরে অনেক জ্বালাযন্ত্রণা হয়। সেটা আবার মুখ ফুটে বলেও ফেলে। আশপাশের মানুষেরা এটা বেশ ভালো করেই জানে। তারা চাষি লোকটাকে পছন্দ করে না। একদমই না। ওকে এড়িয়ে চলে সব সময়। দেখলেই মুখ ফিরিয়ে নেয়। শুধুই কি পাড়াপড়শি? না। কোনো আত্মীয়স্বজনের সঙ্গেও তার সামান্যতম বনিবনা নেই। সে একজন একঘরে মানুষ।

এভাবেই দিনকাল কাটছিল। চাষি লোকটার বয়স হয়েছে। শরীরে জোর নেই আগের মতো। যথেষ্ট খাটাখাটনি করতে পারে না তাই। চাষবাসের কাজ বেশ কঠিন। টানা মেহনত না করতে পারলে ভালো ফসল আশা করা যায় না। জমি চাষ করার জন্য গরু লাগে। এই চাষির তা নেই। গরু কিনতে হলে অনেক টাকা দরকার। সেই টাকা কে দেবে?

জমিতে সেচ দিতে হয় অনেক সময়। আশপাশে কোনো কুয়ো বা পুকুর নেই। পানি পাওয়া যাবে কোত্থেকে? অতএব বৃষ্টিই একমাত্র ভরসা। সময়মতো বৃষ্টি না হলে? কম্ম কাবার। চাষির তখন মাথায় হাত। ফসল না পেলে দুঃখকষ্টের সীমা শেষ থাকে না। দুবেলা দুমুঠো খাবারই জোটে না। হায় রে পোড়া কপাল!

অদ্ভুত একটা ঘটনা ঘটে গেল একদিন। তখন সন্ধ্যা হয় হয়। জমিতে কাজ সেরে বাড়িতে ফিরছিল চাষি। মহা ক্লান্ত। সারা দিন অনেক ধকল গেছে। এখন বাড়ি ফিরে বিশ্রাম নেওয়ার পালা। পথে দেখা হলো একজন বুড়ো মানুষের সঙ্গে। তার মুখভরা সাদা দাড়ি। সুন্দর চেহারা। দেখলে মনে একরকম ভক্তি জেগে ওঠে। এই তল্লাটে আগে কোনো দিন একে দেখা যায়নি। মিষ্টি হেসে শান্ত মানুষটি চাষিকে ডেকে বলেন,

‘এত মন খারাপ কেন তোমার? কিছু মনে না করলে আমাকে খুলে বলো। খুব ক্লান্ত হয়ে পড়েছ দেখছি। আহা রে বাছা। তোমাকে দেখে ভীষণ মায়া হচ্ছে আমার।’

চাষি জবাব দেয়, ‘আমার অভাব–অনটন ও কষ্টের কথা আপনাকে কী আর বলব! আমার দুর্ভাগ্যের অন্ত নেই। সেসব তেতো কথা শোনার মতো লোক এই দুনিয়ায় কেউ নেই। কোনো শান্তি–স্বস্তি নেই আমার জীবনে। সুখ তো দূরের কথা! পোড়া কপাল আমার।’

বুড়ো লোকটি দরদভরা কণ্ঠে বলেন, ‘আমি মন দিয়ে শুনব। তুমি বলো। তোমার কথা শোনার জন্যই আমি এখানে এসেছি। আমাকে বিশ্বাস করে তুমি সব কথা নিশ্চিন্তে বলতে পারো।’

বুড়ো চাষি দীর্ঘশ্বাস ফেলে। কাঁদো কাঁদো হয়ে বলে, ‘আমি যে কত গরিব, আপনি চিন্তাও করতে পারবেন না। কীভাবে বলি সেই সব কথা! লজ্জারও ব্যাপার। আমার যদি একটা গরু থাকত, জমিতে হালচাষ করে ভালো ফসল ফলানো যেত। যদি সেচের ব্যবস্থা থাকত, তাহলে আরও ভালো হতো।’

আগন্তুক মানুষটি বলেন, ‘আচ্ছা ধরো, একটা গরু তুমি এখনই পেয়ে গেলে। তারপর? কী করবে তুমি তারপর?’

চাষি এ কথা বিশ্বাসই করতে চায় না। বলে, ‘আসলেই যদি কোনোভাবে একটা গরু পেয়ে যাই? ওহ, তাহলে কোনো দুশ্চিন্তা আর থাকবে না। আমার মতো সুখী মানুষ তখন এই দুনিয়ায় আর কে? আমার খুশির কোনো সীমা থাকবে না তখন। সেটা কি আর কোনোকালে হবে? এমন আনন্দ এমন শান্তি কি আর এই জীবনে পাব? সেটা নিশ্চয়ই সম্ভব না। এমন কিছু আশা করাও ভীষণ বোকামি।’

সৌম্যকান্তি বুড়ো মানুষটি কী করেন এই কথা শুনে। চোখ বুজে কী সব মন্ত্র আওড়ালেন। তক্ষুনি একটা তরতাজা সবল গরু এসে হাজির হয়ে গেল ওখানে। এ কি ম্যাজিক নাকি? এমন অদ্ভুতুড়ে কাণ্ডকারখানা দেখে চাষি হতবাক। তার মুখে কথা সরে না। এমনই তাজ্জব সে হয়েছে।

বুড়ো মানুষটি হাসতে হাসতে বলেন, ‘এই নাও তোমার গরু। এটা নিয়ে বাড়ি চলে যাও। তোমার কষ্টের দিন শেষ হোক। আজ থেকেই হোক। এই আশীর্বাদ করছি তোমাকে।’

চাষি তো হতভম্ব। নিজের চোখকে সে বিশ্বাস করতে পারছে না। শূন্য থেকে এই গরু কেমন করে কীভাবে এখানে চলে এল!

বুড়ো মানুষটি চাষির মাথায় পরম স্নেহে, মমতায় হাত বুলিয়ে দেন। নরম কণ্ঠে বলেন, ‘এক কাজ করো তো বাপু। গরু নিয়ে বাড়ি ফিরে যাও। গিয়ে তোমার প্রতিবেশীকে আমার কাছে পাঠিয়ে দিয়ো। আমি তার জন্য এখানে অপেক্ষা করব।’

চাষি এমনধারা অদ্ভুত কোনো কথা শুনবে, মোটেও আশা করেনি। বিনয়ের সঙ্গে বলে, ‘আমাকে আপনি গরু উপহার দিলেন। আমি কৃতজ্ঞ। কিন্তু আমার প্রতিবেশীকে আবার কেন? তার সঙ্গে আপনার কী দরকার? একটু কি বলা যায় সেটা?’

আগন্তুক এমন কিছু শুনবেন বলে যেন তৈরি হয়েই ছিলেন। চাষিকে বলেন, ‘নিশ্চয়ই বলা যায়। তাকে আমি দুটো গরু উপহার দেব।’

চাষি তার স্বভাবমতো চটে যায়। স্বভাব কি কখনো বদলায় নাকি? আগন্তুকের কথা শুনে যেন তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠে। ফোঁস করে বলে সে, ‘আপনি জানেন না, আমার পড়শির সবকিছুই আছে। কোনো কিছুর কমতি নেই তার। আপনি তাকে দুটো গরু দিতে যাবেন কেন? সেটা তো তেলা মাথায় তেল দেওয়া হবে। কোনোমতেই উচিত হবে না সেটা। আপনার মতলব তো সুবিধার না। যান, আমি আপনার গরু নেব না। এই গরু এক্ষুনি ফিরিয়ে নিন।’

বুড়ো মানুষটি কী আর করেন। ব্যথিত হয়ে বলেন, ‘আচ্ছা বেশ। তাই হবে। তোমার সমস্যা কি জানো? গরিবি নয়। হিংসা। এই হিংসাই তোমার সর্বনাশ করল। এমন একটা দামি গরু তুমি নিজের দোষে হারালে। তোমার ভাগ্য তো কিছুতেই বদলাবে না। কোনো দিনও না।’

বুড়ো মানুষটি গরু নিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেলেন। আর চাষি? মনমরা হয়ে ধপাস করে মাটিতে বসে পড়ল। মাথা কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে তার। নিজের বোকামি ও গা জ্বালানো হিংসার জন্য এমন বড় ও সুন্দর একটা সুযোগ তার হাতছাড়া হয়ে গেল।

লেখা: হাসান হাফিজ

Facebook Comment

You May Also Like