Thursday, August 28, 2025
Homeরম্য গল্পদৈত্য ও নাপিত - মজার গল্প

দৈত্য ও নাপিত – মজার গল্প

এক গায়ে ছিল এক জন্ম-কুঁড়ে নাপিত। সে ছিল অকর্মার ধাড়ী। কোন কাজে তার মন বসত না। তার কাজ ছিল একটাই। নিজের পুরনো আয়নাখানা আর দু’চারখানা দাতপড়া কাঁকই (চিরুনি) দিয়ে নিত্যক্ষণ নিজের মুখসৌন্দর্য ও চুলের বাহার দেখে পরম সন্তোষ লাভ করা। বাড়িতে তার একমাত্র বুড়া বিধবা মা। তারা গরিব মানুষ, সংসার চলে না। পৈত্রিক পেশায় মন লাগালে সংসারের দুঃখ দূর হয়। কিন্তু ছেলে কাজকর্মের ধারেকাছেও নেই। মা হতাশ হয়, দুঃখ করে। অন্য ভাল ছেলেদের নজির দেখায়। কিন্তু কে শোনে কার কথা!

ছেলে তার স্বভাব থেকে একচুলও নড়ে না। অনেক ভেবেচিন্তে মা ছেলের বিয়ে দেয়। আশা, এতে ছেলের সংসারের মন ফিরবে। কিন্তু কিসের কি! বউ সংসার নাপিতের মন পায় না। সে ব্যস্ত থাকে তার পুরনো অভ্যাস নিয়ে। তাতেই তার দুনিয়ার আনন্দ, নিদারুণ পুলক। খেউরি করার (চুল কাটার) যন্ত্রপাতিতে জং ধরে। একটা জমিতে ধান হয়েছে সেগুলো সে কেটে ঘরে তুলবে তাতেও তার প্রবল অনিচ্ছা। তো, নাপিতের মা অবশেষে ত্যক্তবিরক্ত হয়ে ছেলেকে ঝটাপেটা করে একদিন।

এই বার নাপিতের মনে লাগে। সে ঘর ছেড়ে বেরোয়। একটা কিছু করে অনেক টাকাকড়ি ধনরত্ন কামাতে না পারলে সে আর বাড়িমুখো হবে না।

বাড়ি থেকে বেরিয়ে নাপিত গ্রাম-গঞ্জ-লোকালয় ছাড়িয়ে, নদী, পাহাড়-পর্বত ডিঙ্গিয়ে এক গহীন অরণ্যের কাছে এসে পড়ে। সেখান থেকে শোনে দুদ্দাড় শব্দ। কৌতূহলবশত সাহস করে ঢুকে পড়ে বনে! দেখে এক দৈত্য উদ্দাম নাচে মত্ত।

দৈত্যরা কাউকে পেলে ঘাড় মটকে দিতে পারে, তাই ভয় হয় প্রথমে নাপিতের। পরে সে ভাবে, আমার তো হারাবার কিছু নেই। এমনিতেও না খেয়ে মৃত্যু আর অমনিতে দৈত্যের ঘাড় মটকানিতে মৃত্যু। পরেরটাতেই কষ্ট কম। তাই একটু খেলিয়ে দেখার জন্য সেও নাচতে থাকে।

কিন্তু পরে সাহস করে দৈত্যকে জিগায়ঃ এত যে নাচ! পুলকটা (আনন্দটা) কিসের?

দৈত্য বনজঙ্গল কাপিয়ে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে। তোমার এই প্রশ্ন শোনার জন্যই তো নাচ থামিয়ে কাজ শুরু করিনি। দুনিয়ার বুদ্ধ, বুঝতে পারনি কেন নাচি? তোমাকে খাব, সেই আনন্দেই নাচছি। তা তুমি উল্লুকটা নাচছ কেন?

নাপিত : সে বড়ই এক মহৎ কারণে গো, দৈত্যমশাই! আমার কতদিনের স্বপ্ন আর পরিশ্রমের অবসান ঘটতে যাচ্ছে—নাচব না?

দৈত্য : হেয়ালি রাখ! আমার পেটে যাওয়ার আগে তোর নাচের রহস্য ভেদ কর!

নাপিত : আমাদের রাজকুমার গুরুতর অসুস্থ। রাজবদ্যিরা নিদান নির্দেশ করেছেন এক শ’ একটা দৈত্যের কলজের রক্ত যোগাড় করে আনতে পারলেই তার রোগমুক্তির ওষুধ তৈরি করা যায়। রাজকর্মচারীরা ঢোল সোহরত করে ঘোষণা দিয়েছে—“যে এক শ’ একটা দৈত্য ধরে দিতে পারবে তাকে অর্ধেক রাজত্ব আর রাজকন্যা দেয়া হবে।” কত পাহাড়পর্বত, বনজঙ্গল আর পোড়োবাড়িতে হানা দিয়ে এক শ’ দৈত্যকে বাক্সবন্দী করতে পেরেছি। তোমাকে কব্জায় পেয়ে এক’শ এক শিকার পূর্ণ হল। তুমি এখন আমার পকেটে বন্দী।

এই কথা বলে পকেট থেকে পুরনো আয়নাটা বের করে দৈত্যের মুখের সামনে ধরে। দৈত্য দেখে হায়, হায়—এ যে তারই মুখ!

ভয় পেয়ে দৈত্য বলে : আমাকে মুক্ত করে দাও ভাই। তোমাদের রাজা তোমাকে দেবে অর্ধেক রাজত্ব আর রাজকন্যা। আমি তোমাকে দেব সাতরাজার ধন। তা দিয়ে তুমি পেতে পার সাত রাজকন্যা।
নাপিত বলে : তুমি এত ধন কোথায় পাবে? আর পেলেই আমি তা কেমন করে বাড়িতে নিয়ে যাব?

দৈত্য : সে কোন চিন্তার ব্যাপারই না। আমাদের অনেক শক্তি। তোমার পেছনের বটগাছের নিচেই আছে সব সম্পদ। আর তা তোমার বাড়িতে পৌছে দেবার দায়িত্বও আমার।

দৈত্য মাটি উথাল পাতাল করে সাত ঘড়া ভরতি হিরাজহরত আর সোনাদানা বের করে নাপিতকে সুদ্ধ পৌছে দেয় তার বাড়িতে। নাপিত মহাখুশি! তবে সে দৈত্যকে সহজে ছাড়ে না। বলে : আমার ক্ষেতের ধান কেটে তা বাড়িতে এনে দাও।

দৈত্য নিরুপায় হয়ে তাই করে। দৈত্যকে ধান কাটতে দেখে অন্য এক দৈত্য বলে, এ কি করছ? তুমি কি দৈত্যকুলের কুলাঙ্গার নাকি? এক ফেরেববাজের পাল্লায় পড়ে দৈত্যকুলের সম্মান খোয়াবে?

দৈত্য বলে : ভাইরে মহাবিটকেলের পাল্লায় পড়েছি। সহজে এর হাত থেকে পরিত্রাণের উপায় দেখি না।

আগন্তুক দৈত্য বলে : “কি যে ছাইভস্ম বল! মানুষ আর দৈত্য কি এক হল? মানুষ দৈত্যকে কামলা খাটাচ্ছে এ কথা কেউ শুনেছে কখনও। তাও আবার লোকটা সামান্য এক নাপিত। তুমি ওই পাজিটার বাড়িখানা আমাকে দেখিয়ে দাও, আমি ওকে আচ্ছা করে শায়েস্তা করি।”

নতুন দৈত্যেব কথা শুনে দৈত্য আশ্বস্ত হতে পারে না। তার ডর (ভয়) লাগে। তাই দূর থেকে নব্য জেল্লাদার আর উৎসবমুখর নাপিতবাড়ি দেখিয়ে দিয়ে এসে দৈত্য ধান কাটতে থাকে। নাপিতবাড়িতে ভোজের আয়োজন হচ্ছে। তাতে এক বিপত্তিও ঘটেছে। মাছ রান্না করে থরে থরে সাজিয়ে রাখা হয়েছিল। ভাঙা জানালা দিয়ে এক হুলো এসে সে মাছের তরকারির একটা অংশ নিয়ে ভো দৌড়ে পালিয়েছে। নাপিতবউ তাই ধারাল বটি নিয়ে ভাঙ্গা জানালার পাশে ঘাপটি মেরে দাড়িয়ে আছে। ছোচা বেড়াল আবার আসবে। তখন ওর দফারফা করতে হবে। এর মধ্যে বেড়াল আসেনি। চুপিসারে এসেছে নতুন দৈত্য। আর ভাঙা জানালা গলিয়ে জটাচুল ভর্তি মাথাটা ঢুকিয়েছে ঘরে। ওদিকে ওৎ পেতে থাকা নাপিতবউ বঁটি দিয়ে বসিয়েছে এক কোপ। আর তাতে দৈত্যের নাক কেটে থেকে গেছে নাপিতের ঘরে। আর্তচিৎকার দিয়ে যন্ত্রণায় কোকাতে কোঁকাতে দৈত্য পগার পাড়। কোন লজ্জায় আর মুখ দেখাবে দৈত্যকে। দৈত্য সব দেখে আরও ভয় পায়। সব ধান ঘরে তুলে দিয়েও দৈত্য ভাবে নাপিত যদি তাকে না ছাড়ে! সে হাত জোড় করে মুক্তি চায়।

নাপিত এবার আয়নার উল্টা পিঠ দেখিয়ে বলেঃ এই দেখ, তোমার ছবি আর আটক নাই। কিছুই দেখা যাচ্ছে না। তোমার মুক্তি ঘটেছে। এবার যাও।

দৈত্য নাতিপকে সালাম জানিয়ে বিদায় হয়।

Anuprerona
Anupreronahttps://www.anuperona.com
Read your favourite literature free forever on our blogging platform.
RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here


Most Popular

Recent Comments