Saturday, April 20, 2024
Homeগোয়েন্দা গল্পঅম্বর সেন অন্তর্ধান রহস্য - সত্যজিৎ রায়

অম্বর সেন অন্তর্ধান রহস্য – সত্যজিৎ রায়

অম্বর সেন অন্তর্ধান রহস্য - সত্যজিৎ রায়

গ্রেট স্কলার, নাম মৃত্যুঞ্জয় সোম

আপনি তো আমার লেখা শুধরে দেন, বললেন লালমোহনবাবু, সেটা আর এবার থেকে দরকার হবে না।

ফেলুদা তার প্রিয় সোফাটায় পা ছড়িয়ে বসে রুবিকস কিউবের একটা পিরামিড সংস্করণ নিয়ে নাড়াচাড়া করছিল; সে মুখ না তুলেই বলল, বটে?

নো স্যার। আমার পাড়ায় এক ভদ্রলোক এয়োচেন, কাল পার্কে দেখা হল। এক বেঞ্চিতে বসে কথা বললুম। প্রায় আধা ঘণ্টা। গ্রেট স্কলার। নাম মৃত্যুঞ্জয় সোম।

স্কলার?

স্কলার। বোধহয় হার্বার্ট ইউনিভার্সিটির ডবল এম এ, বা ওই ধরনের কিছু।

উফফ! ফেলুদা এবার মুখ না তুলে পারল না। হার্বার্ট নয় মশাই, হার্ভার্ড, হাভার্ড!

তাই হবে। হাভার্ড।

হাভার্ড সেটা বুঝলেন কী করে? নাকিসুরে মার্কিন মাক ইংরেজি বলেন ভদ্রলোক? ইংরিজিটা একটু বেশি বলেন। নাকিসুর কিনা লক্ষ করিনি। তবে বিদ্বান লোক। থাকেন। বহরমপুর। একটা বই লিখছেন, তাই নিয়ে রিসার্চ করবেন বলে ক’দিনের জন্য কলকাতায় এসেছেন। চেহারাতে বেশ একটা ইয়ে আছে। ফ্রেঞ্চ-কািট দাড়ি, চোখে সোনার বাই-ফোকাল, জামাকাপড়ও ধোপদূরস্ত। আমার হভূরাসে হাহাকার টা পড়তে দিয়েছিলুন। চৌত্ৰিশটা মিসটেক দেখিয়ে দিলেন। তবে বললেন ভেরি এনজয়েবল।

তা হলে আর কী। আপনার পেট্রল খরচ অনেক কমে যাবে এবার থেকে। আর গড়পার-বালিগঞ্জ ঠ্যাঙাতে হবে না।

তবে ব্যাপারটা হচ্ছে কী—

ব্যাপারটা কী হচ্ছে সেটা আর জানা গেল না, কেন না ঠিক এই সময় এসে পড়লেন ফেলুদার মক্কেল অম্বর সেন। নটায় অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছিল। ঘড়ির কাঁটায় কাঁটায় আমাদের কলিং বেল বেজে উঠল।

অম্বর সেনের বয়স মনে হয়। পঁয়তাল্লিশ থেকে পঞ্চাশের মধ্যে, ফরসা রং, দাড়িগোঁফ কামানো, চোখে পুরু ফ্রেমের চশমা, গায়ে পাঞ্জাবি আর ধুতির উপর একটা পুরনো জামেওয়ার শাল। কাশ্মীরি শাল যে কতরকম হয় সেটা সেদিন ফেলুদার সঙ্গে মিউজিয়ামে গিয়ে দেখে এসেছি।

অম্বর সেন ফেলুদার মুখোমুখি চেয়ারে বসে বললেন, আপনিও ব্যস্ত মানুষ, আমিও ব্যস্ত। কাজেই সময় নষ্ট না করে সোজা কাজের কথায় চলে যাওয়াই ভাল। আগে এই জিনিসটা দেখুন।

পাঞ্জাবির পকেট থেকে একটা কাগজ বের করে ভদ্রলোক ফেলুদার দিকে এগিয়ে দিলেন। খাতা থেকে ছেঁড়া একটা পাতা, সেটাকে দল করে পাকানো হয়েছিল, তারপর আবার হাত বুলিয়ে মসৃণ করার চেষ্টা করা হয়েছে।

কাগজটাতে গোটা অক্ষরে লাল কালি দিয়ে লেখা—আমার সর্বনাশের শাস্তি ভোগ করার জন্য প্ৰস্তুত হও। আর সাতদিন মেয়াদ। পালিয়ে পথ পাবে না।

কাগজটা নেড়েচেড়ে দেখে ফেলুদা প্রশ্ন করল, কীভাবে পেলেন এটা?

আমার বাড়িতে একতলায় আমার কাজের ঘর, বললেন ভদ্রলোক, রাত্তিরে এসে জানালা দিয়ে ছুড়ে ডেস্কের উপর ফেলে দিয়ে গেছে। সকালে আমার চাকর লক্ষ্মণ এটা পেয়ে আমার কাছে নিয়ে আসে।

আপনার ঘর কি রাস্তার উপর?

না। ঘরের বাইরে বাগান, তারপর কম্পাউন্ড ওয়াল, তারপর রাস্তা। তবে দেয়াল টপকানো যায়।

সর্বনাশের কথা যে বলছে সেটা কী?

অম্বর সেন মাথা নাড়লেন।

দেখুন মিস্টার মিত্তির, আমি নিৰ্বাঞ্ছাঁট মানুষ। আমার পেশা হল ব্যবসা, তবে আসল কাজ আমার ভাইই করে। আমার পাঁচ রকম অন্য শাখ আছে, সেই সব নিয়ে থাকি। সজ্ঞানে কারুর কখনও কোনও সর্বনাশ করেছি বলে তো মনে পড়ে না। অন্তত এমন সর্বনাশ। নিশ্চয়ই নয় যেটা এই হুমকি-চিঠিকে জাস্টিফাই করতে পারে। ব্যাপারটা আমার কাছে সম্পূৰ্ণ অর্থহীন বলে মনে হচ্ছে।

ফেলুদা ভুরু কুঁচকে একটুক্ষণ ভেবে বলল, অবিশ্যি এটা এক ধরনের রসিকতাও হতে পারে—যাকে বলে প্র্যাকটিক্যাল জোক। আপনার পাড়ায় কাছাকাছির মধ্যে মস্তান ছেলেদের আস্তানা আছে?

আমরা থাকি পাম এভিনিউতে, বললেন অম্বর সেন। পুব দিকে কিছু দূরে একটা বস্তি আছে, সেখানে এই ধরনের ছেলে থাকা কিছুই আশ্চর্য নয়।

পুজোর চাঁদার জন্য হামলা করে না?

তা করে, কিন্তু চাঁদা তো আমরা নিয়মিত দিই।

শ্ৰীনাথ চা এনেছে, তাই কাজের কথা কিছুক্ষণের জন্য বন্ধ হল। লালমোহনবাবু দুবার বিড়বিড় করে রিভেঞ্জ কথাটা বললেন। ফেলুদা সেই সুযোগে আমাদের দুজনের সঙ্গে ভদ্রলোকের আলাপ করিয়ে দিল।

আপনিই বিখ্যাত লালমোহন গাঙ্গুলী?

হেঁ হেঁ।

ভদ্রলোক বেশ তৃপ্তি সহকারে চায়ে চুমুক দিয়ে ফেলুদার দিকে ফিরে বললেন, আসলে আপনার বিষয় আমি আপনার কাহিনীগুলো থেকেই জেনেছি। তাই মনে হল আপনার কাছেই আসি।

পুলিশে খবর দেননি? জিজ্ঞেস করল ফেলুদা।

আমার ভাই অবিশ্যি পুলিশের কথাই বলেছিল, কিন্তু আমি আবার এ সব ব্যাপারে একটু আন-অর্থডক্স। প্রচলিত নিয়মগুলো চট্ট করে মানতে মন চায় না। আর সত্যি বলতে কী, এখনও বোধহয় অতটা বিচলিত হবার কারণ ঘটেনি। আপনার কাছে এলাম, তার একটা কারণ আপনাকে দেখারও একটা ইচ্ছে ছিল। আমাদের পরিবারের মোটামুটি সকলেই আপনাকে চেনে।

পরিবারে আর কে কে আছেন?

আমার ভাই অম্বুজ আছে। সে বিয়ে করেছে, আমি করিনি। অম্বুজের স্ত্রী আছে, একটি মেয়ে আছে বছর দশোকের-ছেলে দুটি বড়, তারা বাইরে থাকে।–তা ছাড়া আমার বিধবা মা আছেন, আর আছে আমাদেরই এক দূর সম্পর্কের আত্মীয়। সে আমাদেরই বাড়িতে মানুষ। ফ্যামিলি মেমবার বলতে এই, তার বাইরে তিনজন চাকর, একটি ঠিকে ঝি, রান্নার লোক, মালী, দারোয়ান আর ড্রাইভার। আমরা থাকি ফাইভ বাই ওয়ান পাম এভিনিউতে। বাবা ছিলেন নামকরা হার্ট স্পেশালিস্ট অনাথ সেন।

ফেলুদা একটু কিন্তু-কিন্তু ভাব করছে দেখে ভদ্রলোক বললেন, আপনাকে আমি শুধু ব্যাপারটা জানিয়ে গেলাম। হতে পারে এটা একটা প্রাকটিক্যাল জোক ছাড়া আর কিছুই না; তবে কী জানেন, এ ধরনের রসিকতার টারগেট বিখ্যাত ব্যক্তিদের মাঝে মাঝে হতে হয় ঠিকই, কিন্তু আমি তো আর তেমন কেউ-কেটা নই, তাই…

ফেলুদা বললে, বুঝতেই পারছেন, এ হুমকি যদি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন হয় তা হলে আমার পক্ষে কিছু করা সম্ভব নয়। যাই হাক-আপাতত এই চিঠিটা আমি রাখতে পারি তো?

নিশ্চয়ই। ওটা তো আপনাকে দেবার জন্যেই আনা।

এমন একটা হুমকি-চিঠি নিয়ে অম্বর সেনের ফেলুদার কাছে আসাটা একটু বাড়াবাড়ি বলেই মনে হচ্ছিল, পরদিন সকালে পাম এভিনিউ থেকে যে ফোনটা এল, তাতে সমস্ত ব্যাপারটা একটা অন্য চেহারা নিল।

বসবার ঘর থেকে ফেলুদার ঘরে কলটা ট্রানসফার করে দিয়ে কান লাগিয়ে যা শুনলাম তা হল এই–

কে, মিস্টার মিত্তির?

অজ্ঞে হ্যাঁ!

আমার নাম অম্বুজ সেন। কাল আমার দাদা বোধহয় আপনার ওখানে গেসলেন একটা হুমকি-চিঠির ব্যাপারে?

হ্যাঁ হ্যাঁ।

ওয়েল, হি ইজ মিসিং।

মানে?

দাদাকে পাওয়া যাচ্ছে না।

পাওয়া যাচ্ছে না?

না! দাদা রোজ ভোরে গাড়িতে করে বেরোন; গঙ্গার ধারে গাড়ি দাঁড় করিয়ে তারপর মাইল দুয়েক হাঁটেন! আজও গেসলেন, কিন্তু আজ আর ফেরেননি।

সে কী!

ড্রাইভার গাড়ি নিয়ে ফিরে এসেছে এক ঘণ্টা ওয়েট করার পর। ও তন্ন-তন্ন করে খুঁজেও দাদার দেখা পায়নি।

পুলিশে জানাননি?

সেখানে একটা গোলমাল আছে মিঃ মিত্তির। আমার মার বয়স আশি, শরীরও ভাল নেই। ওঁকে দাদার ব্যাপারটা নিয়ে এখনও কিছুই জানাইনি। পুলিশ এলেই কিন্তু ব্যাপারটা আর চাপা থাকবে না। তখন ওঁকে সামলানো মুশকিল হবে। কাজেই আমাদের ইচ্ছা কেসটা আপনিই হ্যান্ডল করুন। আপনার উপর আমাদের পুরো ভরসা আছে। অবশ্য আপনার উপযুক্ত পারিশ্রমিক আমরা দেব।

আমি তা হলে একবার আপনাদের ওখানে আসছি। অসুবিধা হবে না তো?

মোটেই না! আপনি এখনই চলে আসুন। আমাদের বাড়ির নম্বরটা জানেন তো?

ফাইভ বাই ওয়ান পাম এভিনিউ তো?

হ্যাঁ হ্যাঁ।

সাহেবি ধাঁচের গাড়িবারান্দাওয়ালা দোতলা ছড়ানো বাড়ি

সাহেবি ধাঁচের গাড়িবারান্দাওয়ালা দোতলা ছড়ানো বাড়ি, সামনে একটা ছোট বাগান, পিছনেও সবুজ দেখে মনে হল বোধহয় টেনিস কোর্ট জাতীয় কিছু আছে। গেটের গায়ে শ্বেতপাথরের ফলকে অম্বরবাবুর বাবার নাম, নামের পরে অনেকগুলো ইংরিজি অক্ষর, কমা, ফুলস্টপ। সব শেষে ব্র্যাকেটের মধ্যে এডিন কথাটা দেখে বুঝলাম ভদ্রলোককে স্কটল্যান্ড যেতে হয়েছিল ডাক্তারি পড়তে।

যিনি আমাদের ট্যাক্সির শব্দ পেয়ে বেরিয়ে এলেন তাঁর সঙ্গে আম্বরবাবুর আদল আছে ঠিকই, কিন্তু ইনি বেঁটে, মোটা আর কালো। অর্থাৎ মুখের মিল বাদ দিলে ইনি অম্বরবাবুর ঠিক উলটা।

আমাদের দেখে ভদ্রলোকের মুখে হাসি ফুটে উঠলেও, দুশ্চিন্তার ফলে সেটা সঙ্গে সঙ্গেই মিলিয়ে গেল।

আসুন ভিতরে।

শ্বেতপাথরের মেঝেওয়ালা ল্যান্ডিং পেরিয়ে বৈঠকখানায় গিয়ে ঢুকলাম। এখানেও মাৰ্বল, তার উপর কাৰ্পেট, আর তার উপর দামি দামি ফারনিচার। যে সোফায় বসলাম, সেটার গদি এত নরম যে, আমার ভারেই প্ৰায় ছ। ইঞ্চি বসে গেল!

রুনা, এসো।

একটি ফ্রক-পরা মেয়ে এসে দরজায় দাঁড়িয়ে অবাক চোখে চেয়ে আছে ফেলুদার দিকে। অম্বুজবাবু ডাকতেই সে গুটি গুটি ঘরের ভিতরে এগিয়ে এল।

ইনি কে জান? জিজ্ঞেস করলেন অম্বুজবাবু!

ফেলুদা, চাপা গলায় উত্তর এল।

আর ইনি?

তোপ্‌সে।

বাঃ, তুমি তো আমাদের দুজনকেই চেনো দেখছি, বলল ফেলুদা।

জটায়ু কোথায়? জিজ্ঞেস করল মেয়েটি। বোঝা গেল সে এই তৃতীয় ব্যক্তিটিকে না দেখে কিছুটা হতাশ হয়েছে।

তিনি তো আসেননি, বলল ফেলুদা। তবে তাঁকে এক’দিন নিশ্চয়ই নিয়ে আসব।

তোপ্‌সে এত মিথ্যে কথা বলে কেন?

এই রে!—আমার সম্বন্ধে হঠাৎ এমন বদনাম কেন?

মিথ্যে মানে? ফেলুদা জিজ্ঞেস করল।

একটা বইয়ে লিখেছে ফেলুদা ওর মাসতুতো ভাই, আরেকটায় লিখেছে জ্যাঠতুতো ভাই। মিথ্যেই তো।

ফেলুদাই আমাকে বাঁচিয়ে দিল। বলল, ওহো–প্রথমে মাসতুতো ভাই লিখেছিল বটে, তখন ও গপপের মতো বানিয়ে লিখতে চেষ্টা করছিল। আমি ধমক দিতে তারপর সত্যি কথাটা লিখতে শুরু করল। আসলে জ্যাঠতুতো ভাইটাই ঠিক।

আপনার সব অ্যাডভেঞ্চার ওর পড়া, বললেন অম্বুজ সেন।

জেঠুকে খুঁজে বার করে দিতে পারবে তুমি? ফেলুদার দিকে সটান তাকিয়ে প্রশ্ন করল রুনা।

চেষ্টা করতে হবে। বলল ফেলুদা; তুমি যদি কোনও কু জোগাড় করে দিতে পারো তা হলে তো কথাই নেই!

ক্লু?

ক্লু জানি তো?

জানি।

আছে তোমার কাছে কোনও ক্লু, যাতে আমরা চট করে বের করে দিতে পারি তোমার জেঠুকে?

ক্লু তো তুমি বার করবে। তুমি তো ডিটেকটিভ।

ঠিক বলেছ। খুব চালাক মেয়ে তুমি। কী নাম তোমার? একটা নাম তো জানি, অন্যটা কী?

ভাল নাম ঝর্না।

ফেলুদা অম্বুজবাবুর দিকে ফিরল।

দেখুন, আপনাদের দিক থেকে কতকগুলো ব্যাপারে সাহায্য না পেলে কিন্তু আমার পক্ষে এগোনো মুশকিল হবে।

কী সাহায্য বলুন।

প্রথমত, আপনাদের সকলের সঙ্গে কথাবার্তা বলতে হবে। আপনার দাদার সঙ্গে আমার মাত্র কয়েক মিনিটের আলাপ। তাঁকে আমার আরেকটু ভাল করে চিনতে হবে। তাঁর কাজের ঘরটাও একবার দেখা দরকার। এমনকী, দরকার হলে তাঁর জিনিসপত্র একটু ঘেঁটে দেখতে হতে পারে। আশা করি আপত্তি হবে না।

মোটেই না, বললেন অম্বুজবাবু।

আর আপনার দাদা যেখানে মর্নিং ওয়াকে যেতেন, সেই জায়গাটাও একবার দেখে আসা দরকার।

কোনওই অসুবিধে নেই। আমাদের ড্রাইভার বিলাস আপনাদের গাড়ি করে নিয়ে গিয়ে সব দেখিয়ে আনবে।

ফেলুদা সোফা ছেড়ে উঠে পায়চারি আরম্ভ করেছে। তিনটে বড় বড় বুককেস বোঝাই বই, সেইদিকে তার দৃষ্টি।

এ সব বই কার?

সবই দাদার।

নানান বিষয়ে ইস্টারেস্ট আছে দেখছি।

অজ্ঞে হ্যাঁ।

এমনকী গোয়েন্দাগিরি সম্বন্ধেও তো বই আছে।

হ্যাঁ। এক সময় ওটা নিয়েও পড়াশুনা করেছেন।

বিজ্ঞান, ইতিহাস, রান্নার বই, মুদ্রা সংগ্ৰহ, থিয়েটার…

থিয়েটারটা দাদার নেশা বলতে পারেন। আমাদের মাঠে পুজোর সময় স্টেজ বেঁধে নাটক হয়। দাদাই নির্দেশক; ফ্যামিলির সকলেই রংটং মেখে নেমে পড়ে। এমনকী ইনিও। রুশনার দিকে দেখিয়ে দিলেন অম্বুজবাবু। রুনা এখনও সেইভাবেই হাঁ করে চেয়ে আছে ফেলুদার দিকে।

এবারে অম্বরবাবুর কাজের ঘরটা একটু দেখতে পারি?

আসুন আমার সঙ্গে।

অম্বুজবাবু উঠে পড়লেন সোফা থেকে।

বৈঠকখানার পাশে একটা প্যাসেজ, সেইটা পেরিয়ে পিছনের মাঠের দিকের একটা ঘরে গিয়ে ঢুকলাম আমরা।

পুব দিকের জানালা দিয়ে রোদ এসে ঘরটাকে আলো করে দিয়েছে। একটা বড় ডেস্ক, তার সামনে একটা রিভলভিং চেয়ার, উলটা দিকে আরও দুটো চেয়ার। জানালার ধারে একটা আরাম-কেদারা। এ ছাড়া টেবিলের পিছন দিকে রয়েছে একটা শেলফ, একটা ক্যাবিনেট আর একটা গোদারেজের আলমারি। তার পাশের দেয়ালে একটা ফোলডিং ব্র্যাকেট থেকে হ্যাঁঙ্গারে ঝুলছে একটা ছাই রঙের কোট।

ডেসকের উপরটা দেখলে মনে হয় অম্বরবাবু বেশ গোছানো লোক ছিলেন। কাগজপত্ৰ টেলিফোন পেনহালডার পিনকুশন পেপার-ওয়েট চিঠির র‍্যাক, সব পরিপাটি করে সাজানো। একটা ডেট-ক্যালেন্ডার রয়েছে, তার তারিখটা তিনদিন আগের। ব্যাপারটা আমারও খটকা লেগেছিল, ফেলুদা সেটার দিকে অম্বুজবাবুর দৃষ্টি আকর্ষণ করায় ভদ্রলোক বললেন, দাদাকে কয়েক’দিন থেকেই অন্যমনস্ক দেখছিলাম। সচরাচর দাদার এরকম ভুল হয় না কিন্তু।

ফেলুদা খুঁতখুঁতে মানুষ, সে নিজেই শনিবার দোসরাটা বদলে মঙ্গলবার পাঁচই করে দিল।

দেরাজ খুলে দেখতে পারি কি? ফেলুদা জিজ্ঞেস করল।

দেখুন না।

তিনটে দেরাজই পরপর খুলে তার ভিতরের জিনিসপত্র হাতড়ে দেখল ফেলুদা। ওপরের দেরাজ থেকে পাওয়া এক টুকরো কাগজ সম্বন্ধে মনে হল তার একটু কৌতুহল হয়েছে, কারণ সেটা সে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখছে।

হিমালয়ান অপটিক্যালস থেকে চশমা করাতেন বুঝি আপনার দাদা?

হ্যাঁ।

একটা ক্যাশমেমো দেখছি। তারিখটা সাতদিন আগের। নতুন চশমা করিয়েছিলেন বুঝি?

কই, না তো! বলে উঠল। রুনা। সে-ও আমাদের পিছন পিছন এসেছে।

তুমি কী করে জানলে, রুনা? জিজ্ঞেস করল ফেলুদা।

আমাকে তো দেখায়নি জেঠু!

অম্বুজবাবু একটু হেসে বললেন, দাদা যে কখন কী করছেন তার খবর আমরা সব সময়ে পেতাম না।

আমরা অম্বরবাবুর স্টাডি থেকে বেরিয়ে এলাম।

আপনাদের এক আত্মীয় এখানে থাকেন বোধ হয়, প্যাসেজে বেরিয়ে এসে বলল ফেলুদা, আপনাদের এখানেই মানুষ হয়েছেন?

কে, সমরেশ? হাঁ, থাকে বইকী।

ফেলুদার অনুরোধে সমরেশকে ডেকে পাঠানো হল। বছর পয়ত্রিশ বয়স, মুখে বসন্তের দাগ, চোখে পুরু চশমা। একটু যেন আড়ষ্টভাব নিয়ে ভদ্রলোক এসে দাঁড়ালেন আমাদের দিকে হাত দশেক দূরে।

বসুন, বলল ফেলুদা।

বেশ কিছুটা দূরে একটা চেয়ারে বসলেন সমরেশবাবু।

আপনার পদবিটা কী?

মল্লিক।

কদ্দিন আছেন। এ-বাড়িতে?

বছর পঁচিশ।

কী করেন?

একটা ফিল্ম ডিসট্রিবিউশন আপিসে কাজ করি।

কোথায়?

ধরমতলায়।

কী নাম কোম্পানির?

কোহিনুর পিকচার্স।

কদ্দিন আছেন। ওখানে?

সাত বাচ্ছর।

তার আগে কী করতে?

এই বাড়ির কাজকর্ম।

হাত দুটোকে ভাঁজ করে হাঁটুর মধ্যে চেপে রেখেছেন ভদ্রলোক-যাকে বলে জবুথবু ভাব।

আপনি অম্বরবাবুর অন্তর্ধনের ব্যাপারে কোনও আলোকপাত করতে পারেন?

সমরেশবাবু চুপ। ফেলুদা বলল, তিনি একটা হুমকি-চিঠি পেয়েছিলেন জানেন?

জানি।

আপনার ঘর কি এ-বাড়ির একতলাতে?

হ্যাঁ।

অম্বরবাবুর কাছে বাইরের লোকজন দেখা করতে আসত?

তা আসত, মাঝে-মাঝে।

সম্প্রতি এমন কোনও লোককে আসতে দেখেছেন, যাকে আগে দেখেননি?

সেটা লক্ষ করিনি। তবে,–

তবে কী?

এই পাড়ায় কিছু ছেলেকে দেখেছি, যাদের আগে দেখিনি।

কোথায়?

মোড়ের মাথায়।

কী করত তারা?

মনে হত এই বাড়ির দিকে চোখ রাখছে।

বয়স কীরকম তাদের?

বিশ থেকে পাঁচিশের মধ্যে বলে মনে হয়।

কজন ছেলে?

চারজন।

ফেলুদা একটুক্ষণ চুপ করে কী যেন ভাবল। তারপর বলল, ঠিক আছে। আপনি আসতে পারেন।

এইসব কথা থেকে ফেলুদা কোনও কু পেল। কিনা জানি না। যেটাতে মনে হয়। সত্যি করে কাজ হল, সেটা হল অম্বুজবাবুর স্ত্রীর সঙ্গে কথাবার্তায়।

রীতিমতো সুন্দরী মহিলা, তার উপর যাকে বলে ব্রাইট। বয়স চল্লিশের উপর হলেও দেখে বোঝার জো নেই। দোতলার একটা ছোট বৈঠকখানায় বসে কথা হল।

ফেলুদা প্রথমেই ক্ষমা চেয়ে নিল ভদ্রমহিলাকে বিব্রত করার জন্য। তাতে কী হয়েছে, বললেন মিসেস অম্বুজ সেন, গোয়েন্দাকে যে এভাবে জেরা করতে হয় সে তো ফেলুদার গল্প পড়েই জেনেছি। খুব ভাল লাগে পড়তে গোয়েন্দার কাহিনী।

তা হলে তো ভালই হল, বলল ফেলুদা। আমার প্রধান মুশকিলটা কোথায় হচ্ছে বলি। অম্বরবাবু একটা হুমকি-চিঠি পেয়েছিলেন জানেন বোধহয়।

তা জানি বইকী।

দেখেছেন সে চিঠি?

তাও দেখেছি।

আমি অম্বরবাবুকে জিজ্ঞেস করেছিলাম। তাঁর জীবনে এমন কোনও ঘটনা ঘটেছিল কি না যার ফলে অন্য কোনও মানুষের সর্বনাশ হতে পারে। উনি বলেছিলেন তেমন কোনও ঘটনা তাঁর জানা নেই। অবিশ্যি আমার বলা উচিত ছিল যে, রিসেন্ট ঘটনা হবার দরকার নেই, অতীতের ঘটনা হলেও চলবে, কেন না প্রতিহিংসার ভাবটা মানুষ অনেক সময়ে অনেক দিন পুষে রাখে। আমি এখন আপনাকে জিজ্ঞেস করতে চাই, আপনি কি এমন কোনও ঘটনার কথা জানেন? দশ-বিশ বছর আগের হলেও চলবে।

ভদ্রমহিলা একটুক্ষণ চিন্তিতভাবে চুপ করে থেকে বললেন, তা হলে আপনাকে বলি। আপনি দেখুন। এমনি ঘটনার কথাই বলছেন কি না। এটা আমার কাল রাত্তিরে হঠাৎ মনে পড়ে। আমার স্বামীকেও এখনও বলিনি।

কী ঘটনা বলুন তো।

একটা অ্যাক্সিডেন্টের ব্যাপার।

অ্যাক্সিডেন্ট?

অনেক’দিন আগে। তখনও রুনা হয়নি; বোধহয় তার পরের বছরই হল। আমার ভাসুর তখন নিজেই গাড়ি চালাতেন। আমার শ্বশুরের গাড়ি। অস্টিন। উনি শ্যামবাজারের দিকে একজন লোককে চাপা দেন। সে-লোক মারা যায়।

আমরা দুজনেই চুপ। ঘরে থমথমে ভাব। অম্বুজবাবু পাশেই ছিলেন, চাপা গলায় বললেন, আশ্চর্য, এটা আমার মনেই ছিল না।

আর কী মনে পড়ছে? ফেলুদা দুজনকেই প্রশ্নটা করল।

নিম্ন-মধ্যবিত্ত ফ্যামিলি, বললেন অম্বুজবাবু, ক্লার্ক ছিলেন ভদ্রলোক।

নাম মনে পড়ছে?

উঁহু।

স্ত্রী ছিল, আর তিনটি ছেলেমেয়ে, বললেন মিসেস সেন। ছেলেটির বয়স তেরো-চোদ্দো। মেয়ে দুটি আরও ছোট। পাঁচ হাজার টাকা তুলে দেন বিধবার হাতে।

কে, অম্বরবাবু?

হ্যাঁ।

সেই থেকেই দাদা ড্রাইভিং বন্ধ করে দেন, বললেন অম্বুজবাবু।এখন মনে পড়ছে।

হুঁ… ফেলুদা গম্ভীর। তার মানে এখন সে-ছেলের বয়স বছর পাঁচিশ। পরিবারটির যে সর্বনাশ হবে এই ঘটনার ফলে, এটা মোটেই অস্বাভাবিক নয়। পাঁচ হাজার টাকা আর কদ্দিন চলে?

এর বেশি আর কিছু মনে পড়ছে না, জানেন, বললেন মিসেস সেন।

আমারও না, বললেন অম্বুজবাবু।

অম্বরবাবু কি ডায়রি রাখতেন? ফেলুদা জিজ্ঞেস করল।

কই, সে রকম তো শুনিনি এখনও, বললেন অম্বুজবাবু।

ফেলুদা উঠে পড়ল।

অনেক ধন্যবাদ, মিসেস সেন। আপনি অন্ধকারে একটা আলো দেখিয়েছেন আমাদের, তার জন্য আমি বিশেষ কৃতজ্ঞ।

আমরা কিন্তু মনেপ্ৰাণে চাইছি যে, আপনি ব্যাপারটার একটা সুরাহা করেন।

কথাটা যে ভদ্রমহিলা খুব আন্তরিকতার সঙ্গে বললেন তাতে কোনও সন্দেহ নেই।

অম্বরবাবুর অসুস্থ মা

অম্বরবাবুর অসুস্থ মাকে বিরক্ত করার কোনও মানে হয় না, তাই আমরা আপাতত পাম এভিনিউ-এর পাট শেষ করে সেনেদের অ্যামবাসডরে চলে গেলাম গঙ্গার ধারে। গে রেস্টোরান্টের সামনে গাড়ি দাঁড় করিয়ে ড্রাইভার বিলাসবাবু বললেন, এইখান থেকে স্যার হাঁটতে আরম্ভ করে সোজা দক্ষিণ দিকে গিয়ে ঠিক এক ঘণ্টা বাদে আবার ফিরে আসতেন। একেবারে ঘড়ির কাঁটায় কাঁটায়।

আপনি গাড়িতেই বসে থাকতেন?

আজ্ঞে হ্যাঁ।

কদ্দিন ড্রাইভারি করছেন সেন-বাড়িতে?

নাইন ইয়ারস।

তার মানে অ্যাক্সিডেন্টের ব্যাপারটা আপনি জানেন না?

অ্যাক্সিডেন্ট?

অম্বরবাবু বছর বারো আগে একবার একটি লোককে গাড়ি চাপা দিয়ে মারেন।

সেন সাহেব?

কেন, আপনার বিশ্বাস হচ্ছে না?

উনি যে কোনওদিন নিজে ড্রাইভ করেছেন সেইটেই জানতুম না।

ওই ঘটনার পরেই ড্রাইভিং ছেড়ে দেন।

তা হবে। ড্রাইভারের তো দোষ দেওয়া যায় না। সব সময়! রাস্তার লোকে যেভাবে চলাফেরা করে, আরও বেশি লোক মরে না কেন সেইটেই তো ভাবি। ড্রাইভারের আর কী দোষ?

অম্বরবাবু যেদিন আর ফিরলেন না, সেদিনের ঘটনাটা একটু বলবেন?

সেদিন উনি আসছেন না দেখে আমি হেস্টিংস পর্যন্ত গিয়ে তল্লাশ করেছিলাম। পথে লোক ধরে ধরে জিজ্ঞেস পর্যন্ত করছি। গাড়ি থামিয়ে থামিয়ে রাস্তায় নেমে খুঁজেছি যদি কোথাও পড়ে-টড়ে গিয়ে থাকেন। হার্টটা তেমন মজবুত ছিল না তো।

লোকজন কেমন ছিল রাস্তায়?

সিকালে এদিকটা লোক মন্দ থাকে না। সব হাঁটতে আসে। তবে নিউ হাওড়া ব্রিজের সাইডটায় লোক থাকে না বললেই চলে। স্যার তো। ওদিকেই যেতেন। ফস করে যদি গাড়িতে কটা জোয়ান লোক এসে কোলপাঁজা করে তুলে নিয়ে যায়, কেউ টেরও পাবে না।

আমরা গাড়িতে করেই দশ মাইল স্পিডে চালিয়ে হেস্টিংস পর্যন্ত ঘুরে এলাম, কিন্তু সন্দেহজনক কিছুই দেখতে পেলাম না।

এরপর দুদিন পাম এভিনিউ থেকে কোনও খবর নেই। বিষ্যদবার বিকেলে লালমোহনবাবু এসেই বললেন, ঘটনা এগোল? অম্বর সেন উধাও শুনে ভদ্রলোকের চোখ কপালে উঠে গেল। বললেন, আপনার একটি কেসও গেজে যেতে দেখলুম না। ধন্যি আপনার লাক!

আপনার গ্রেট স্কলার প্রতিবেশী মৃত্যুঞ্জয় সোমের কী খবর?

দূর দূর! স্কলার না মুণ্ডু!

সে কী মশাই, এর মধ্যে আবার কী হল? সেদিন তা সুপারলেটিভ ছাড়া কথাই বলছিলেন की।

আর বলবেন না মশাই।

কেন, কী হল?

বলতেও লজ্জা করে।

আমার কাছে আবার লজ্জা কী? বলে ফেলুন।

ব্যাপারটা কী জানি না, কিন্তু সেটা যে লালমোহনবাবু চেপে যেতে চাইছেন সেটা বুঝতেই পারছি। এদিকে ফেলুদাও ছাড়বার পাত্র নয়। শেষটায় পীড়াপীড়িতে ভদ্রলোক বলেই ফেললেন।

আরো মশাই, ভাবতে পারেন, ভদ্রলোক প্রদোষ মিত্তিরের নাম শোনেননি। আপনার বন্ধু বলে পরিচয় দিতে গিয়ে একেবারে ভেড়া বনে গেলুম! বলে কিনা-হুইজ প্রদোষ মিত্ৰ?

তাতে আর কী হল, এত বড় স্কলার, হার্বার্টের ডবল এম এ, আমিও তো তাঁর নাম শুনিনি।

কথাটা বোধহয় লালমোহনবাবুকে কিছুটা আশ্বস্ত করল। বললেন, তা যা বলেছেন। এত বড় দুনিয়ায় কটা মানুষকে আর কাটা মানুষ চেনে! আর ভদ্রলোক বোধহয় বেশির ভাগ সময় বিদেশে কাটিয়েছেন। কাজেই এক্সকিউজ করে দেওয়া যায়-কী বলেন?

আমাদের কথার মাঝখানেই পাম এভিনিউ থেকে ফোন এল। অম্বুজ সেন। একটা বেনামি চিঠি এসেছে ভদ্রলোকের নামে। টেলিফোনে সেটা পড়ে শোনালেন ভদ্রলোক।

আগামীকাল শুক্রবার সন্ধ্যা সাড়ে ছাঁটায় ১০০ টাকার নোটে ২০০০০ টাকা ব্যাগে পুরে প্রিনসেপঘাটের দক্ষিণ-পূর্ব কোণের থামের ধারে রেখে যাবেন। অম্বর সেনকে অক্ষত অবস্থায় ফিরে পাবার এই একমাত্র উপায়। পুলিশ বা গোয়েন্দার সাহায্য নিলে ফল হবে মারাত্মক।

ফেলুদা ফোনে বলল, এখনই কোনও সিদ্ধান্ত নেবার দরকার নেই, মিঃ সেন। আরও চব্বিশ ঘণ্টা সময় আছে। এর মধ্যে আমার কয়েকটা কাজ আছে। আপনাদের দিক থেকে কী করণীয় সেটা আমি কাল দুপুর দুটাের মধ্যে আপনাদের বাড়ি গিয়ে বলে আসব। তবে হ্যাঁ, টাকার ব্যবস্থােটা করে রাখবেন। ওটা খুবই জরুরি।

কিন্তু গোয়েন্দার ব্যাপারে শাসিয়ে রেখেছে যে মশাই, ফেলুদা ফোন রাখার পর লালমোহনবাবু বললেন।

ফেলুদা উত্তরে শুধু বলল, জানি।

রকেটের বেগে ঘটনা এগিয়ে চলেছে। এই টাকাটা না দিয়ে উপায় কী আছে সেটা আমিও ভেবে পেলাম না।

লালমোহনবাবু, কাল আপনার গাড়িটা একটু পাওয়া যাবে কি? প্রায় পাঁচ মিনিট চুপ করে থেকে অবশেষে প্রশ্ন করল ফেলুদা।

এনি টাইম, বললেন জটায়ু। কখন চাই বলুন।

সকলে একবার বেরোিব। সাড়ে নটা নাগাত পেলেই চলবে। ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যে আমার কাজ হয়ে যাবে। তারপর বিকেল পাঁচটা নাগােত আপনি যদি গাড়িটা নিয়ে চলে আসেন তো খুব ভাল হয়।

ভেরি গুড।

এরপর ফেলুদা আর কোনও কথাই বলল না।

পরদিন লালমোহনবাবুর গাড়িতে করে ফেলুদা বেরোল। একই বেরোল, কাজেই কোথায় গেল কী করল জানার উপায় নেই। বারোটা নাগাত ফিরে আসার পর দেখলাম তার মুখের ভাব বদলে গেছে।

কী ঠিক করলে ফেলুদা৷ ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলাম।

টাকাটা দিতেই হবে, বলল ফেলুদা। তবে গোয়েন্দা সম্পর্কে হুমকিটা মানা চলবে না।

মানে? তুমি নিজেও থাকবে সেখানে?

ফেলুমিত্তির অত সহজে ঘাবড়াবার লোক নয় রে তোপ্‌সে।

আমার আমরা? আমরা কোথায় থাকব?

তোরাও থাকিবি কাছাকাছির মধ্যে, কারণ হেলপ দরকার হতে পারে।

আমি তো শুনে থা।

দুপুরে খেয়ে দেয়ে আমরা গেলাম পাম এভিনিউ।

অম্বুজবাবু স্বভাবতই বাড়িতে ছিলেন, ফেলুদাকে দেখেই ব্যস্ত হয়ে উঠলেন।

কাল রাত্তিরে চোখের পাতা এক করতে পারিনি মশাই! দেখতে দেখতে কী যে হয়ে গেল! ফেলুদা গম্ভীরভাবে বলল, টাকাটা আপনাদের খসবেই, মিঃ সেন। অম্বরবাবুকে ফিরে পাবার আর কোনও রাস্তা নেই।

তুমি ধরতে পারনি এখনও? রুনা হঠাৎ ঘরের দরজা থেকে চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করে উঠল।

অনেকটা ধরে ফেলেছি, রুনা, বলল ফেলুদা।খুব চেষ্টা করছি। যাতে বাকিটা আজ বিকেলের মধ্যেই ধরতে পারি।

ব্যাস, ঠিক আছে।

রুনাকে ভীষণ নিশ্চিন্ত বলে মনে হল। ফেলুদা ব্যর্থ হবে এটা যেন তার কাছে ভয়ানক একটা দুঃখের ব্যাপার।

তা হলে কী করা উচিত বলে মনে হয়? জিজ্ঞেস করলেন অম্বুজবাবু।

টাকার ব্যবস্থা হয়েছে?

সেটা করে ফেলেছি। বাড়িতে তো অত ক্যাশ থাকে না, তাই আজ সকালেই সমরেশকে দিয়ে ব্যাঙ্ক থেকে আনিয়ে নিয়েছি।

সেই টাকা, এবং যে ব্যাগে করে সেটা দেওয়া হবে—এই দুটো জিনিস আমি একবার দেখতে চাই!

টাকা এবং ব্যাগ এসে গেল। এত টাকা। এর আগে একসঙ্গে দেখেছি কি? মনে তো পড়ে না।

ফেলুদার সামনেই কুড়িটা করে একশো টাকার নোট রাবার ব্যান্ড দিয়ে গোছ করে দশ ভাগে ব্যাগের মধ্যে পুরে দেওয়া হল। তার ফলে ব্যাগের চেহারা হয়ে গেল কচ্ছপের পিঠের মতো।

ভেরি গুড, বলল ফেলুদা। তা হলে আমরা বেরিয়ে পড়ছি পৌনে ছটা নাগাত।

অম্বুজবাবু চমকে উঠলেন।

সে কী, আপনি যাবেন?

অপরাধীকে ধরার চেষ্টা আমাকে করতেই হবে, মিঃ সেন। আপনি টাকা রেখে আসবেন, আর সে লোক দিব্যি এসে সেটা তুলে নিয়ে চলে যাবে, এ তো হতে দেওয়া যায় না। অম্বরবাবুকে ফেরত পাওয়াটাই বড় কথা সেটা জানি, কিন্তু সেই সঙ্গে এই গুণ্ডাদেরও সাজা হওয়া উচিত নয় কি? না হলে তো তারা এই ধরনের কুকীর্তি করেই চলবে। তবে আপনি চিন্তা করবেন না। সাবধানতা অবলম্বন না করে আমি কখনও কিছু করি না।

তা হলে—

আমি বলছি, আপনি মন দিয়ে শুনুন। আপনি আপনার গাড়িতে করে যাবেন টাকা নিয়ে। নিউ হাওড়া ব্রিজের দিকটা দিয়ে আসবেন। ওদিকটা মোটামুটি নিরিবিলি। গাড়ি প্রিনসেপঘাট থেকে অন্তত দুশো গজ আগে দাঁড় করিয়ে আপনার ড্রাইভারকে বলবেন টাকাটা যথাস্থানে রেখে আসতে। আমি কাছাকাছির মধ্যেই থাকব। কাজটা ঠিকমতো হচ্ছে কিনা সেটা আমি দেখতে পাব। আমরা মিট করব ঘটনার পর। গে রেস্টোরান্টের সামনে। আপনি টাকা রেখে সোজা ওখানে চলে আসবেন। আমিও তাই করব। অপরাধীকে যদি ধরতে পারি তা হলে তিনিও আমার সঙ্গেই থাকবেন, বলাই বাহুল্য।

অম্বুজবাবুকে মনে হল যিনি তিনি বেশ নার্ভাস বোধ করছেন। সেটা অস্বাভাবিক নয়। টাকার অঙ্কটা তো কম নয়। আর গুণ্ডারা কী করবে না-করবে। কে জানে?

বিকেলে সাড়ে চারটের সময় লালমোহনবাবু এলে পর ফেলুদার প্রথম কথা হল, মশাই, এমন অভিনব কেস আর আমি কোনওদিন পাইনি।

অবিশ্যি আমাকে জিজ্ঞেস করলে পরে আমি এখনও বলতে পারব না। এর বিশেষত্বটা কোথায়।

তা হলে আমরা কী করছি? জিজ্ঞেস করলেন লালমোহনবাবু।

শুনে নিন। মন দিয়ে, বলল ফেলুদা।তুইও শোন, তোপ্‌সে। সাড়ে পাঁচটার সময় আপনার গাড়ি নিয়ে আপনি আর তোপ্‌সে চলে যাচ্ছেন গে রেস্টোরান্টে। সেখানে আপনাদের অভিরুচি অনুযায়ী পানাহার সেরে ঠিক সোয়া ছাঁটায় রেস্টোরন্ট থেকে বেরিয়ে সটান চলে যাবেন দক্ষিণে প্রিনসেপঘাট লক্ষ্য করে। গাড়ি রেখে যাবেন রেস্টোরান্টের সামনে। থামওয়ালা ঘাটটার কাছে পৌঁছনোর কিছু আগেই দেখবেন ডানদিকে একটা গম্বুজওয়ালা বসার ঘর রয়েছে। দুজনে সেখানে ঢুকে বেঞ্চিতে বসে পড়বেন। ভাবটা এমন হওয়া চাই যেন সান্ধ্যভ্রমণ আর বায়ুসেবন ছাড়া আপনাদের আর কোনও উদ্দেশ্য নেই। ঘাটের দিকে আড়দৃষ্টি রাখবেন, তবে যেন মনে না। হয় যে, ওটাই আপনাদের লক্ষ্য। তারপর সাড়ে ছাঁটার দশ মিনিট পর ওখান থেকে উঠে পড়ে নিজের গাড়িতে ফিরে আসবেন। আমিও সেখানেই আপনাদের মিট করব।

ফেব্রুয়ারি মাস শেষ হতে চলল

ফেব্রুয়ারি মাস শেষ হতে চলল, কিন্তু এখনও দিব্যি ঠাণ্ডা। তবে শীতকালের মতো দিন। আর অত ছোট নেই, ছটা পর্যন্ত বেশ আলো থাকে। আমি আর লালমোহনবাবু কফি আর মুরগির কাটলেট খেয়ে ঠিক সোয়া ছাঁটায় রেস্টোরান্ট থেকে বেরিয়ে রওনা দিলাম প্রিনসেপঘাটের দিকে।

পথে লালমোহনবাবু মাঝে-মাঝে বুক ভরে নিশ্বাস নিয়ে আঃ উঃ শব্দ করে সান্ধ্যভ্রমণের অভিনয় করছেন, সেটা যে খুব কনভিনসিং হচ্ছে তা নয়। কিন্তু ক্ৰমেই আশপাশের লোকজন এত কমে আসছে, ফুচকাওয়ালা আর ভেলপুরিওয়ালার দল এত পিছিয়ে পড়ছে যে, এখন উনি যা খুশি করলেও আপত্তির কিছু নেই।

দশ মিনিট লাগল আমাদের গম্বুজওয়ালা বসার জায়গাটায় পৌঁছতে। বেঞ্চ দখল করার পর এদিক ওদিক চেয়ে লালমোহনবাবু চাপা গলায় প্রশ্ন করলেন, তোমার দাদাকে দেখতে পাচ্ছ কি, তপেশ?

দাদা কেন, কোনও মানুষকেই দেখতে পাচ্ছি না ঘাটের নীকের মাঝিদের ছাড়া। কোনখানে লুকিয়ে রয়েছে ফেলুদা কে জানে। ঘাটের দেড়শো বছরের পুরনো থামগুলো মাথা উচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, তাদের মধ্যে ফাঁকগুলো ক্রমেই অন্ধকারে হয়ে আসছে। ওখানে গিয়ে কেউ টাকার ব্যাগ রাখলে, বা সে ব্যাগ নিতে এলে, কেউ দেখতেও পাবে না।

ওই যে! লালমোহনবাবু আমার হাত খামচে ধরেছেন।

হ্যাঁ—ঠিকই দেখেছেন ভদ্রলোক।

একজন সাদা প্যান্ট আর কালো কোট পরা লোক হাতে একটা ব্যাগ নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে প্রিনসেপঘাটের দিকে। অম্বরবাবুদের ড্রাইভার। বিলাসবাবু।

বিলাসবাবু এবার থামগুলোর ফাঁক দিয়ে ভিতরে ঢুকে অন্ধকারে মিলিয়ে গেলেন।

মিনিটখানেক পরেই তাঁকে আবার দেখা গেল। এবার হাত খালি। বড়রাস্তায় পড়ে ডাইনে মোড় ঘুরে গাছের আড়াল হয়ে গেলেন ভদ্রলোক।

সাড়ে ছটা বেজে গেছে। আলো আরও পড়ে এসেছে। এখন সামনের সারির থামগুলো ছাড়া আর কোনওটাই দেখা যাচ্ছে না। একবার মনে হল অন্ধকারের মধ্যে কে যেন নড়াল; কিন্তু সেটা চোখের ভুল হতে পারে।

এবার দেখলাম সেনদের গাড়ি আমাদের সামনে দিয়ে রেস্টোরান্টের দিকে চলে গেল। তারপর তিনজন জিনস-পরা ছেলে, আর তাদের পিছনে ঢোলা প্যান্টপরা হাতে লাঠিওয়ালা এক বৃদ্ধ ফিরিঙ্গিও সেই দিকেই চলে গেল।

আমরাও উঠে পড়লাম।

আবার ঠিক দশ মিনিটই লাগল আমাদের গাড়িতে পৌঁছাতে।

কিন্তু ফেলুদা কই?

এবার গাড়ির ভিতরে চোখ গেল।

নস্যিরঙের আলোয়ান জড়ানা এবং লুঙ্গি পরা এক বুড়ো বসে আছে ড্রাইভার হরিপদবাবুর পাশে। থুতনিতে খোঁচা-খোঁচা দাড়ি, কিন্তু গোঁফ নেই।

স্যালাম কর্তা! লালমোহনবাবুর দিকে চেয়ে বলল লোকটা।

এ আর বলতে হবে না। ওই মুসলমান মাঝি ফেলুদা ছাড়া আর কেউ না। এদিকে অম্বুজবাবুও এসে পড়েছেন রাস্তার ওদিক থেকে। তাঁর কাছে ফেলুদার নিজের পরিচয় দিতেই হল। নীকো থেকে ঘাটটা সবচেয়ে ভাল দেখা যায়, তাই ওখানেই ওত পাতার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম।

কিন্তু কী হল সেইটে বলুন, মিঃ মিত্তির।

ফেলুদা গম্ভীর।

ভেরি সরি, মিঃ সেন।

মানে?

আমি ঘাটে ওঠার আগেই সে লোক টাকা নিয়ে হাওয়া।

বলেন কী! টাকা নেই? লোকটাকেও ধরা গেল না?

বলছি তো—আমি অত্যন্ত দুঃখিত।

অম্বুজবাবু কিছুক্ষণ ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলেন ফেলুদার দিকে। কথাটা যেন ভদ্রলোকের বিশ্বাসই হচ্ছে না। সত্যি বলতে কী, আমারও কেমন যেন মাথা বিমঝিম করছিল। ফেলুদাকে এভাবে হার মানতে এর আগে দেখিনি কখনও।

আপনাদের পুলিশের সাহায্যই নিতে হবে, মিঃ সেন, বলল ফেলুদা। আপনি বাড়ি চলে যান। এবার তো অম্বরবাবুর ফিরে আসা উচিত। আমরা একবার বাড়িতে টু মেরে আপনার ওখানেই আসছি। এই বেশে তো আর পাম এভিনিউ-এর বৈঠকখানায় ঢোকা যাবে না।

বাড়ি যাওয়ার একমাত্র কারণ ফেলুদার একটু ফিটফট হয়ে নেওয়া। তা ছাড়া হাতেও রং লেগেছিল–জিজ্ঞেস করতে বলল। আলকাতরা—সেটাও ধুয়ে নেওয়া দরকার। আলকাতরাটাও মেক-আপের অংশ কিনা জিজ্ঞেস করাতে কোনও উত্তর দিল না ফেলুদা।

আমরা যখন পাম এভিনিউ রওনা হলাম, তখন প্রায় সাড়ে সাতটা বাজে। পথে লালমোহনবাবু একবার বলেছিলেন, আপনার অমন ব্রিলিয়ান্ট মেক-আপটা মাঠে মারা যাবে। ভাবিনি মশাই— কিন্তু তাতে ফেলুদা কোনও মন্তব্য করেনি।

পাম এভিনিউ পৌঁছানোর সঙ্গে-সঙ্গেই রুনার গলায় উচ্ছসিত চিৎকার শোনা গেল, জেঠু এসে গেছে!

অম্বরবাবু ফিরেছেন আমরা আসার মিনিট দশেক আগে। আমরা বৈঠকখানায় গিয়ে ঢুকতেই ভদ্রলোক সোফা ছেড়ে উঠে হাত বাড়িয়ে ফেলুদার হাত দুটো ধরে ঝাঁকিয়ে দিলেন। ভাই ভাইয়ের বউ, ভাইঝি, সমরেশবাবু, বিলাসবাবু, সকলেই ঘরে রয়েছেন।

কোথায় আটক করে রেখেছিল আপনাকে? একগাল হেসে প্রশ্ন করলেন লালমোহনবাবু।

ওঃ–সে। আর বলবেন না—

ফেলুদা হাত তুলে বাধা দিল ভদ্রলোককে।

উনি তো বলবেনই না, আর আপনিও বলবেন না, মিঃ সেন। কারণ বললেই একরাশ কল্পনার আশ্রয় নিতে হবে। মিথ্যে শব্দটা ব্যবহার করলাম না, কারণ সেটা ভাল শোনায় না।

হুররে হুররে হুররে! চেঁচিয়ে উঠল। রুনা। ফেলুদা ধরে ফেলেছে, ফেলুদা ধরে ফেলেছে!

এবার ফেলুদা একটা চারমিনার ধরিয়ে নিয়ে বলল, আপনারা যে একটা বিরাট ফন্দি ঐটেছিলেন সেটা ধরে ফেলেছি, কিন্তু সেটার কারণটা এখনও ঠিক ধরতে পারছি না।

কারণ বলছি মিঃ মিত্তির, হেসে বললেন অম্বর সেন। কারণ আমার ওই খুদে ভাইঝিটি। সে আপনাকে বলতে গেলে একরকম পুজোই করে। তার ধারণা। আপনি ভুলভ্রাস্তির উর্ধে। তাই ওকে আমি সেদিন বললাম যে, তোর ফেলুদাকে আমি জব্দ করতে পারি। ব্যস-ওই একটি উক্তি থেকেই সমস্ত ফন্দিটির উৎপত্তি। এতে আমাদের সকলেরই ভূমিকা আছে।

অর্থাৎ এও আপনাদের একটা ফ্যামিলি নাটক?

ঠিক তাই। সবাইকে সব কিছু আমিই শিখিয়ে পড়িয়ে দিয়েছিলাম। আপনি কী জিজ্ঞেস করলে কী উত্তর দেবে, সব লিখে মুখস্থ করিয়ে দিয়েছিলাম—এমনকী ড্রাইভার ও চাকরকে পর্যন্ত। প্রধান নারীচরিত্র অবশ্য বউমা, যাঁকে দিয়ে মনগড়া অ্যাকসিডেন্টের কথাটা বালানো হয়েছিল। আমি নিজে ভাবিনি যে, আপনি ব্যাপারটা ধরে ফেলবেনী-ইন ফ্যাক্ট, এই নিয়ে আমার ভাইয়ের সঙ্গে একশো টাকা বাজিও ধরেছিলাম। এ ব্যাপারে রুনার উৎকণ্ঠই ছিল সবচেয়ে বেশি। কারণ তার হিরো যদি ফেল করত, তা হলে তার দুঃখের সীমা থাকত না। এই ঝুকিটা অবশ্য আমাকে নিতেই হয়েছিল, কিন্তু এখন সে নিশ্চিন্তু। এবার বলুন তো আপনার সিসটেমটা কী। কীসে আপনার প্রথম সন্দেহ হল মিঃ মিত্তির?

ফেলুদা বলল, প্রথমত এবং প্রধানত, দুটো ভুকু, দুটোই আপনার কাজের ঘরে পাওয়া। এক হল হিমালয়ান অপটিক্যালসের ক্যাশ মেমো। আমি সেখানে খোঁজ নিয়ে জেনেছি যে, আপনি দিন সাতেক আগে একটি সোনালি ফ্রেমের নতুন চশমা করিয়েছেন। অথচ আপনার বাড়িতে সেটা সম্বন্ধে কেউ জানে না, বা কেউ সেটা আপনাকে পরতে দেখেনি। প্রশ্ন হল, এই চশমার দরকার পড়ছে কেন। এবং ঠিক এই সময় দরকার কেন।

দুই হল—আপনার ডেট ক্যালেন্ডারে তিন দিনের পুরনো তারিখ। আপনার চাকর যখন তারিখ বদল করে না, তখন সেটা নিশ্চয় আপনিই করেন। তা হলে বদল হয়নি কেন?

তখনই মনে হল যে, আপনাকে যদি কিডন্যাপড় হবার ভান করে গা ঢাকা দিতে হয়, তা হলে হয়তো একটা ড়েরা স্থির করে দুদিন আগে গিয়েই সেখানে থাকা অভ্যাস করতে হবে। নতুন জায়গা ধাতস্থ হতে সময় লাগে বইকী!! আর তাই যদি হয়, তা হলে সাবধানতা অবলম্বন করার জন্য আপনাকে হয়তো একটি ছদ্মবেশ ও একটি নতুন নাম নিতে হবে। সেই ক্ষেত্রে একটি নতুন চশমা নেওয়াও মোটেই অস্বাভাবিক নয়।

ধরে ফেলেছে, ফেলুদা সব ধরে ফেলেছে। আবার চেঁচিয়ে উঠল রুনা।

এর মধ্যে লালমোহনবাবু যে হঠাৎ কেন খাঁচায়-বন্ধ সিংহের মতো পায়চারি করতে আরম্ভ করেছেন তা বুঝতে পারলাম না। ভদ্রলোক যাতে কোনও বাড়াবাড়ি না করে ফেলেন। তাই ওঁকে সামলাতে যাব, এমন সময় উনি হঠাৎ দুহাত তুলে চেঁচিয়ে উঠলেন–

ইউরেকা!

চিনেছেন ভদ্রলোককে? ফেলুদা প্রশ্ন করল।

চিনব না? মৃত্যুঞ্জয় সোম!

অম্বরবাবু হা হা করে হেসে উঠলেন।

আপনার সঙ্গে সেদিন পর্কে দেখা হওয়াটা সম্পূর্ণ অ্যাকসিডেন্ট, মশাই। আসলে গড়পারেই আমার এক বন্ধুর বাড়িতে গিয়ে ছিলাম সাতদিন। আপনি যখন এগিয়ে এসে জটায়ু-টটায়ু বলে নিজের পরিচয় দিলেন, তখন ভাবলাম— বা রে, এ তো বেশ মজা! যাকে জব্দ করতে যাচ্ছি তারই সাকরেদের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল! তা হলে এঁকে নিয়ে একটু রগড় করতে পারলে কেমন হয়? তারপর অবিশ্যি মিত্তির মশাইয়ের বাড়িতেও আপনার সঙ্গে দেখা হয়েছিল আমার আসল চেহারায়, কিন্তু আপনি চিনতে পারেননি।

কিন্তু তা হলে ব্যাপারটা কী দাঁড়াচ্ছে? বলল ফেলুদা, নাটকের তো এখানেই শেষ নয়, অম্বরবাবু। এখনও তো ড্রপসিন ফেল চলবে না।

ঘরের আবহাওয়া মুহূর্তে বদলে গেল, কারণ ফেলুদা কথাটা বলেছে গম্ভীর থমথমে ভাবে।

হোয়্যার ইজ দ্য মানি? প্রশ্ন করল ফেলুদা।

অম্বর সেন ফেলুদার দিকে তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে চেয়ে বললেন, মিঃ মিত্তির, আপনি আমাকেও কিন্তু একজন শখের গায়েন্দা বলতে পারেন। আমি যদি বলি যে, টাকাটা আপনিই নিয়ে আমাদের সঙ্গে একটু রগড় করছেন, তা হলে কি খুব ভুল বলা হবে? অপরাধী যখন নেই, কিডন্যাপার নেই, তখন টাকাটা সরে কোথায় যাবে মিঃ মিত্তির?

ফেলুদা মাথা নেড়ে বলল, মিঃ সেন অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে জানাচ্ছি যে, আপনার শখের গোয়েন্দাগিরি এক্ষেত্রে খাটল না। প্রিনসেপঘাটের কাছে আজ। সন্ধ্যায় আমি ছাড়াও আরেকজন ছদ্মবেশী ছিলেন।

বলেন কী! বললেন অম্বর সেন, আপনি তাকে দেখেছেন?

দেখেছি, কিন্তু চিনিনি।

কিন্তু আপনি তখনই তাকে ধরলেন না কেন?

তখন ধরাটা আপনাদের পক্ষে যথেষ্ট নাটকীয়া হত না। আপনারা নাটক পছন্দ করেন তো? আমার মনে হয় আপনাদের সামনে ধরাটা আরও নাটকীয় হবে। আমার সন্দেহ তিনি এখানেই আছেন। এ সন্দেহ ঠিক কি না সেটা আমি একবার পরখ করে দেখতে চাই।

ঘরে যাকে বলে পিন-পড়া নিস্তব্ধতা। রুনার দিকে আড়াচোখে চেয়ে দেখলাম। সেও ফ্যাকাসে মেরে গেছে।

বিলাসবাবু, আপনার জুতোর তলাটা একবার দেখুন তো, বলে উঠল ফেলুদা।

বিলাসবাবু ঘরের দরজার মুখে দাঁড়িয়ে ছিলেন, বললেন, দেখব আর কী স্যার, জুতোর তলায় তো আলকাতরা লেগে রয়েছে। ব্যাগ রেখে ফেরবার সময় তো রাস্তায় পা আটকে যাচ্ছিল।

ওই আলকাতরা আমিই ছড়িয়ে রেখেছিলাম থামটার চারপাশে, বলল ফেলুদা, কারণ একজনের সম্বন্ধে আমার মনে একটা সন্দেহের কারণ ঘটেছিল। আপনারা সকলেই বানিয়ে বানিয়ে কথা বলেছিলেন। কিন্তু ইনি যে মিথ্যেটা বলেছিলেন সেটা একটু অন্যরকম। ইনি বলেছিলেন…ও কী, আপনি যাচ্ছেন কোথায়?

কিন্তু পালাবার পথ নেই। দরজা আগলে দাঁড়িয়ে আছেন বিলাসবাবু। এক ঝটিকায় যাকে বগলদাবা করে ফেলেছেন ভদ্রলোক, তিনি হচ্ছেন সমরেশ মল্লিক।

এবার আপনার স্যান্ডেলের তলাটা এঁদের দেখিয়ে দিন তো, বলল ফেলুদা।বিলাসবাবু একটু হেলপ করলে ব্যাপারটা সহজে হয়ে যায়।

বিলাসবাবু নিচু হয়ে সমরেশবাবুর পা থেকে স্যান্ডেলটা একটানে খুলে নিয়ে তার তলাটা সকলকে দেখিয়ে দিলেন। উনিই যে গিয়েছিলেন প্রিনসেপঘাটের থামের পাশে, তাতে আর কোনও সন্দেহ রইল না।

আপনার কোহিনুর কোম্পানি তো দুবছর হল লাটে উঠেছে সমরেশবাবু, বলল ফেলুদা, তা সত্ত্বেও আপনি সেখানে চাকরি করছিলেন। কী করে সেটা এদের একটু বুঝিয়ে বলবেন? আর যদি চাকরি না-ই করে থাকেন, তবে এই দুবছর কীভাবে রোজগার করেছেন সেটা বলবেন?

সমরেশবাবু নিরুত্তর। বিলাসবাবু এখনও তাঁকে জাপটে ধরে আছেন; মনে হয় পুলিশ আসার আগে পর্যন্ত সেইভাবেই ধরে থাকবেন।

অবিশ্যি এই ব্যক্তির খালস খুলে ফেলার জন্য আপনাদের আমাকেই ধন্যবাদ দিতে হবে, বলল ফেলুদা! আপনারা তো আর বিশ হাজার টাকা রাখতেন না থামের পাশে! নেহাত আমি যখন বললাম শাসনি কেয়ার করি না, আমি নিজে থাকব। সেখানে, তখন আপনাদের বাধ্য হয়েই রাখতে হল, আর সেই টাকা হাত করার সুযোগ নিলেন সমরেশবাবু। যাকগে, এখন তো জানলেন টাকা কোথায় আছে। এবার সেটা আদায় করার রাস্তা আপনারা দেখুন। উনি যদি সেটাকা অন্যত্ৰ পাচার করে থাকেন, তা হলে পুলিশ তো আছেই, তারা এসব আদায়ের অনেক রাস্তা জানে। আমার কাজ এখানেই শেষ।

ফেলুদার সঙ্গে সঙ্গে আমরা দুজনও উঠে পড়েছিলাম, কিন্তু ওঠা। আর হল না। মিসেস সেন বাধা দিলেন।

শেষ বলছেন কী? এত সহজে শেষ হবে কী করে? আপনাকে ঝুড়ি ঝুড়ি মিথ্যে কথাগুলো বললাম, তার বুঝি প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে না? আজ রাত্তিরে আপনাদের খেতে হবে। আমাদের বাড়িতে।

আর ওই বিশ হাজারের অন্তত খানিকটা তো আপনার প্রাপ্য, বললেন অম্বর সেন, সেটা না নিয়ে যাবেন কী করে?

আর তোমরা তিনজনে একসঙ্গে এসেছি বুললেন শ্ৰীমতী রুনা, আমার অটোগ্রাফে সই দেবে না বুঝি?

এন্ডস ওয়েল দ্যাট অলস্‌ ওয়েল, বললেন লালমোহনবাবু।

(সমাপ্ত)

Anuprerona
Anupreronahttps://www.anuperona.com
Read your favourite literature free forever on our blogging platform.
RELATED ARTICLES

Most Popular

Recent Comments