Thursday, August 21, 2025
Homeথ্রিলার গল্পরহস্য গল্পগেছোবাবার বৃত্তান্ত - সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ

গেছোবাবার বৃত্তান্ত – সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ

ঝিলের ধারে বসে ছোটমামা মুগ্ধচোখে চাঁদ দেখতে-দেখতে বলছিলেন,–আচ্ছা পুঁটু, সত্যি করে বল তো, ওই চাঁদে আমেরিকানরা হেঁটেছে, বিশ্বাস হয়? অসম্ভব পুঁটু, অসম্ভব। কবি লিখেছেন, এমন চাঁদের আলোয় মরি যদি সেও ভালো সে-মরণ স্বৰ্গসমান…।

ঠিক এই সময়ই বাঁ-দিকে কোথাও আবছা খসখস-মচমচ শব্দ শুনতে পেলাম। ভাঙা শিবমন্দির খুঁড়ে মস্ত বটগাছ। হাওয়া-বাতাস বন্ধ। সন্দেহজনক শব্দটা সেই গাছের ভেতর থেকে ভেসে এল।

গা ছমছম করতে থাকল। সেইদিকে তাকিয়ে রইলাম। ছোটমামাকে ইদানীং পদ্যে পেয়েছে। চাঁদ, ফুল, পাখি প্রজাপতি নিয়ে শখানেক পদ্য লিখে ফেলেছেন। কিন্তু নিছক লিখেও যেন ওঁর তৃপ্তি নেই, জিনিসগুলো অর্থাৎ ফুল, পাখি, প্রজাপতি, নেড়ে-ঘেঁটে দেখতে বেজায় তৎপর। এদিনই সকালে একটা প্রজাপতির পেছনে যেভাবে ছুটোছুটি করছিলেন! যাই হোক, তাতেও আমার আপত্তি ছিল না। কিন্তু আমাকে নিয়ে টানাটানিতেই আমি অস্থির। নিরিবিলি শুনশান ঝিলের ধরে ভাঙা মন্দির নিয়ে কত ভুতুড়ে গল্প চালু আছে। দিনদুপুরেই সেদিকটাতে পারতপক্ষে কেউ পা বাড়ায় না। এখন তো সন্ধ্যা গড়িয়ে গেছে। জ্যোৎস্নায় চারদিকে যেন একশো ভূত। তার ওপর হঠাৎ বটগাছটটা থেকে ওইসব শব্দ।

ভয়ে-ভয়ে বললুম,–ছোটমামা, এবার বাড়ি ফেরা যাক।

ছোটমামা চাঁদের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করছিলেন। একটু রেগে গিয়ে বললেন,-দিলি তো পদ্যটা নষ্ট করে। বেশ একটা লাইন এসেছিল!

তখনই ধুপ করে শব্দ হল এবং চমকে উঠে দেখলুম, বটতলার চকরা-বকরা আলোছায়ায় কালো কী একটা পড়ল। তারপর সেটা চার পায়ে হেঁটে কঁকা জায়গায় গেল, সেখানে ঝলমলে জ্যোৎস্না। হনুমানই হবে তাহলে।

কিন্তু হঠাৎ প্রাণীটা দু-পায়ে সিধে হল এবং সোজা আমাদের দিকে হেঁটে এল। ছোটমামাকে আঁকড়ে ধরেছিলুম সঙ্গে-সঙ্গে। ছোটমামা পুঁটে-বলে হাঁক ছেড়েই চুপ করে গেলেন। এবার তিনিও প্রাণীটিকে দেখতে পেয়েছিলেন।

প্রাণীটি আমাদের অবাক করে বলে উঠল, কী রে? ভয় পেয়েছিস নাকি? পাসনে। আমি সেই গেছোবাবা।

মানুষের গলায় কথা শুনে ছোটমামার সাহস ফিরে তো এলই, পদ্যের লাইনে বাধা পড়ায় ভেতর-ভেতর খাপ্পা হয়েও ছিলেন। তেড়েমেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। বললেন,–গেছোবাবা মানে?

গেছোবাবা খি-খি করে হেসে বলল,–সে কী রে? আমার কথা শুনিসনি? আমি গেছোবাবা, গাছে-গাছে থাকি। গাছেই আমার বসবাস। তবে তোরা আজকালকার ছেলে, আমায় চিনবিই বা কী করে? চিনত তোদের ঠাকুরদা, তাদের ঠাকুরদা, তস্য তস্য ঠাকুরদা! ওরে বয়েসটা তো কম হল না। সেই যেবার লর্ড ক্লাইভ পলাশির যুদ্ধ জিতে তোদের এই টাউনে ঢুকল…

ওয়েট! ওয়েট!–ছোটমামা থামিয়ে দিলেন।–পলাশির যুদ্ধ? মানে…সেভেনটিন ফিফটি সেভেন! তার মানে তুমি বলতে চাও, তোমার বয়স…পুঁটে, হিসাব কর তো।

গেছোবাবা বলল, খামোকা ছেলেটাকে আঁক কষিয়ে হবেটা কী? তোরা এই যে আমার দর্শন পেলি, সেই তোদের বাপের ভাগ্যি। গড় কর এক্ষুনি! গড় কর!

ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গড় করতে যাচ্ছি, ছোটমামা আমার চুল খামচে ধরে আটকালেন। বললেন,–ওয়েট, ওয়েট। যাচাই করে নিই। ওহে গেছোবাবা, তুমি এতকাল বেঁচে আছো বলতে চাও? ফ্রম এইটিনথ সেঞ্চুরি। অমৃত খেয়েছিলে নাকি?

ছোটমামার বাঁকা হাসি শুনে গেছোবাবা বলল,–খেলেও খেয়েছি, না খেলেও না খেয়েছি।

ছোটমামা চার্জ করলেন, হেঁয়ালি ছাড়। কে তুমি? নাম কী?

নাম একটা ছিল বটে! ভুলে গেছি। –গেছোবাবা মাথা চুলকে বলল, গাছে বসত করতে গিয়ে গেছোবাবা নাম পেয়েছিলুম। তখনকার লোকে খুব ভক্তিশ্রদ্ধা করত। যে গাছে থাকতুম, তার তলায় খাবার রেখে যেত। আজকাল কী যে হয়েছে। লোকে আমাকে ভুলেই গেছে রে! বড় দুঃখ হয়।

লতাপাতা খাই। কখনও ফলমাকড়টা খাই। এই বলে গেছোবাবা পাশের একটা ঝোঁপ থেকে লতা-পাতা ছিঁড়ে চিবোতে শুরু করল। চিবোতে-চিবোতে বলল,–এগুলো একটু তিতকুটে। তবে মোটের ওপর মন্দ না। তোরাও খা না! খেয়ে দ্যাখ!

ছোটমামা কয়েক পা এগিয়ে গেলেন! বুঝলুম, গেছোবাবা সত্যিসত্যি পাতা খাচ্ছে কি না দেখতে গেলেন। আমি অবাক হয়ে সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলুম। ছোটমামা বললেন, কী অদ্ভুত! তুমি যে দেখছি সত্যিই পাতা খাচ্ছ। ওহে গেছোবাবা, এগুলো খেয়ে তোমার বদহজম হয় না?

হলে হয়, না হলেও না হয়–গেছোবাবা ঢেকুর তুলে বলল। তা অত কথায় কাজ কী তোদের? বড় ভাগ্যে দর্শন পেলি। এবার গড় করে চলে যা। নইলে অমঙ্গল হবে।

ছোটমামা ফের চার্জ করলেন, কী অমঙ্গল হবে, শুনি?

গেছোবাবা বলল,–পুলিশ ধরবে। জানিস তো? বাঘে ছুঁলে আঠারো ঘা। আর পুলিশে ছুঁলে আঠারো দুগুণে ছত্রিশ। নে, গড় কর। গড় কর!

গেছোবাবা নিজের পা দেখতে থাকল লম্বা হাতে। চেহারাও লম্বা। জ্যোৎস্নায় ওকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। সন্ন্যাসীদের মতো ঝাকড়-মাকড় চুলদাড়ি, খালি গা, পরনে কৌপিন। ছোটমামা একটু দোনোমনো করে বললেন,–খামোকা পুলিশে আমাদের ধরবে কেন? আমরা চোর না ডাকাত?

গেছোবাবা হিঁ-হিঁ শব্দ করে ভুতুড়ে হাসল। পাঁচুকে জিগ্যেস করিস সেসব কথা। পাঁচুকে দর্শন দিয়েছিলুম। ব্যাটাচ্ছেলে আমাকে গড় করেনি। তারপর আর কী! ছমাস ঘানি টানতে হয়েছিল জেলে। এক মাস পাথর ভেঙে-ভেঙে হাত দুখানায় কড়া পড়ে সে এক অবস্থা! গড় কর, গড় কর!

কথাগুলো শুনতে-শুনতে কী এক ভয়ে ঝটপট গড় করে ফেললুম। ছোটমামা একটু তফাতে, বাধা দেওয়ার সুযোগ পেলেন না। গেছোবাবা আশীর্বাদ করলেন হাত তুলে,-জিতা রহো বেটা! আর ছোটমামার কী হল, জেদ ধরে দাঁড়িয়ে রইলেন।

গেছেবাবা যেন রাগ করেই আগের মতো চার পা হল এবং ঠিক হনুমানের মতো দৌড়তে-দৌড়তে বটগাছের দিকে নিপাত্তা হয়ে গেল।

এবার ছোটমামা আরও অবাক হয়ে বললেন, কী অদ্ভুত! মানুষ না হনুমান? তারপর আমার দিকে তেড়ে এলেন, তুই ওই হনুমানটাকে গড় করলি। রামায়ণের হনুমানজি হলে কথা ছিল। তুই কী রে পুঁটু?

এই সময় পেছনে দিক থেকে টর্চের আলো এসে পড়ল আমাদের ওপর। তারপর মাটি কাঁপিয়ে ধুপধাপ শব্দ করে কেউ এগিয়ে আসতে-আসতে গম্ভীর গলায় বলে উঠল, কারা ওখানে? কী হচ্ছে রাতবিরেতে, আঁ?

ছোটমামা সঙ্গে সঙ্গে কেঁচো হয়ে গেলেন, বললেন, বড়বাবু নাকি? নমস্কার, নমস্কার!

থানার দারোগা বন্ধুবাবুর এমন অতর্কিত আবির্ভাবে আমার বুকের ভেতরটা ধড়াস করে উঠছিল। গেছোবাবার কথাটা তাহলে হাতেনাতে ফলতে চলেছে। লোকে বলাবলি করে, এমন ডাকসাইটে পুঁদে পুলিশ অফিসার নাকি কেউ কখনও দ্যাখেনি। চোর-ডাকাত তল্লাট ছেড়ে গা-ঢাকা দিয়েছে। আমাদের ছোট্ট শহরে আজকাল প্রচুর শান্তি।

বঙ্কুবাবু প্রকাণ্ড মানুষ। টর্চ নিভিয়ে বললেন, হুম! আপনারা এখানে কী করছেন?

ছোটমামা কাচুমাচু হেসে বললেন, চঁদ দেখছিলুম সার! দেখুন না কেমন সুন্দর চাঁদ-ফুল-মুন। এমন নিরিবিলি জায়গায় চাঁদ দেখতে আমার খুব ভালো লাগে। তাই…

বঙ্কুবাবু থামিয়ে দিয়ে বললেন,–সঁদ! চাঁদের কী দেখার আছে? আঁ? নিরেট পাথর। বাতাস নেই। প্রাণ নেই। যেন শ্মশান! চালাকি ছাড়ুন!

ছোটমামা বলে উঠলেন, আমি যে কবি, সার! পোয়েট!

পদ্য লেখেন? বন্ধু দারোগা অট্টহাসি হাসলেন, যেন ভূমিকম্প হতে থাকল। পদ্য লিখেই বাঙালি জাতটা উচ্ছন্নে গেছে। কখনও পদ্য লিখবেন না। আর একটু আধটু যদিবা লেখেন, দ-াদ নয়। চাঁদে আছেটা কী মশাই? বলে আমার ওপর টর্চের আলো ফেললেন। –এটি কে?

–আমার ভাগ্নে সার! পুঁটু।

–একেও লাইন ধরিয়েছেন দেখছি! অ্যাই থোকা, কোন ক্লাসে পড়ো?

ঢোক গিলে বললুম, ক্লাস এইট।

পড়াশোনা নেই? –বঙ্কুবাবু ধমক দিলেন। কতগুলো পদ্য লিখেছ অঙ্কের খাতায়? আমার ভাগ্নে পুঁচকে অঙ্কের খাতায় পদ্য লিখেছিল। তাকে কী করেছিলাম জানো?

ভয় পেয়ে বললুম,–আমি পদ্য লিখিনে। ছোটমামা বললেন, বেড়াতে যাচ্ছি, তাই সঙ্গে এলুম। এসেই গেছোবাবাকে দেখে

ছোটমামার চিমটি খেয়ে থেমে গিয়েছিলুম। বঙ্কুবাবু বললেন, কী বললে, কী বললে? গেছোবাবা না কী যেন?

আমি বলছি স্যার। ছোটমামা বললেন, একটা অদ্ভুত লোক সার। একটু আগে একটা লোক-জাস্ট একটা হনুমান সার!

–গাছেই নাকি থাকে। সেভেনটিন ফিফটি সেভেন–

এরপর কীভাবে এবং কী ঘটল গুছিয়ে বলতে পারব না। বন্ধুবাবু হুইসল বাজিয়ে দিলেন। আর ধুপধাপ শব্দে একদঙ্গল কনস্টেবল এসে পড়ল কোত্থেকে। বঙ্কুবাবু

ছোটমামাকে দেখিয়ে বললেন,-পাকড়ো ইসকো!

–খোকাবাবুকে নেহি। ঔর মরাধারি! তুম খোকাবুকো ঘর পঁহুচা দো!

.

বাবা আমার মুখে তার শ্যালকের খবর পেয়েই থানায় দৌড়েছিলেন। আমাকে ঘিরে ভিড় ঘরের ভেতর। মা, পিসিমা, দিদি, ঠাকুমা এবং শেষে ঠাকুরদা ও পিসেমশাইও চারদিক থেকে প্রশ্নের পর প্রশ্নে আমাকে জেরবার করছিলেন। ছোটমামাকে কেন পুলিশে ধরল? চাঁদ দেখা কি বেআইনি? গেছোবাবার দর্শনও কি বেআইনি?

গেছোবাবার কথা বলতেই ঠাকুমা চমকে উঠে সবাইকে থামিয়ে দিলেন। কপালে ঠেকান জোড়হাত, চোখ বন্ধ, ঠোঁট কঁপছিল। ফোঁস করে শ্বাস ছেড়ে ঠাকুরদার দিকে তাকালেন। ঠাকুরদা আরও গম্ভীর হয়ে গেলেন। ঠাকুমা আমাকে কাছে যেতে বললেন, আমি জানতুম! ঠিক জানতুম, বাবা ঝিলের ধারে শিবতলা তল্লাটেই আছেন। কেউ আমাকে পাত্তা দিত না।

পিসেমশাই বললেন,–এ গেছোবাবা ব্যাপারটা ঠিক মাথায় আসছে না। এটার সায়েন্টিফিক এক্সপ্লানেশন–

পিসিমা চোখ কটমট করে বললেন, তুমি তো নাস্তিক। তোমার মাথায় অনেক কিছুই-আসে না। সায়েন্টিফিক এক্সপ্লানেশন–সবখানেই সায়েন্স খাটে না। ও মা, বলো না!

উনি ঠাকুমার দিকে তাকালে ঠাকুমা ফোকলা দাঁতে একটু করুণ হাসলেন। –তখন তোদের জন্মই হয়নি। ঝিলের ওদিকটায় সে কী জঙ্গল! দিনদুপুরে বাঘ বেরোত। সেই সময়কার কথা তো, প্রথমে দর্শন পেয়েছিল রামু-ধোপার বাবা রঘু। ঝিলে কাপড় কাঁচতে যেত সে। দিনমানে ঘাসের ওপর কাপড়গুলো শুকোতে দিত। শিবতলার ছায়ায় গিয়ে বসে থাকত। তারপর…।

দিদি বিরক্ত হয়ে বলল, আগে আসল কথাটা বলো!

রঘুই প্রথম দর্শন পায়। ঠাকুমা ভক্তিতে গদগদ হয়ে বললেন, ধুপ করে গাছ থেকে পড়লেন। রঘুকে বললেন, কী চাস বল? রঘুটা ছিল বড় বোকা। বলল। কী, টাউনের সব কাপড় যেন কাঁচতে পাই।

ঘর জুড়ে হাসি ফুটল। পিসিমা বললেন,–তাই বলল রঘু? কী বুদ্ধি!

ঠাকুমা বললেন,–তবে বাবার মাহাত্ম্য রে! রঘু যে কাপড়ই কাঁচত, তাই একেবারে ঝকমকে হয়ে উঠত। শেষে সোড়া না সাবান না, শুধু জলে চুবোলেই ময়লা কাপড় সাফ। এদিকে গেছোবাবার খবর রটে গেছে। টাউনসুদ্ধ লোক ঝিলের জঙ্গলে যায়। শিবতলায় যায়। কেউ দর্শন পায়। কেউ পায় না। বাবা থাকেন গাছে। গাছেই স্তবটব করেন। বলে ঠাকুরদার দিকে ঘুরলেন, বলো না, কীভাবে দর্শন পেয়ে ছিল?

ঠাকুরদা গম্ভীরমুখে বললে,–আমার ছিল শিকারের নেশা। সেবার ঝিলের জঙ্গলে একটা বাঘ বড় বেশি উপদ্রব করছিল। বন্দুক নিয়ে বাঘটা মারতে গেছি, হঠাৎ একটা গাছ থেকে কেউ আমার নাম ধরে ডাকল। চমকে উঠে দেখি, গাছের ডালে এক সাধুবাবা। বললেন, খবরদার বাঘ মারবিনে। বাঘটা আমার এক চেলা। তারপর কথাটা বলেই এক গাছ থেকে আর-এক গাছে, ঠিক যেন–

দিদি বলে উঠল, টারজানের মতো! টারজানের মতো!

ঠাকুরদা তাঁর গল্পে বাধা পড়ায় খাপ্পা হয়ে ধমক দিতে যাচ্ছেন, এমনসময় বাবা তার ছোটশ্যালককে নিয়ে ঘরে ঢুকলেন। বাবার মুখে হাসি। ছোটমামার তুষোমুখ।

বাবা বললেন,–বঙ্কুবাবুর কাণ্ড! আর ইনিও এমন বুন্ধু যে নিজের পরিচয়ও দেননি! –ছোটমামার দিকে বাঁকা দৃষ্টিতে তাকালেন বাবা, বলবি তো আমার সঙ্গে কী সম্পর্ক?

–বঙ্কুদারোগা আমার চেনা লোক।

পিসেমশাই বললেন, কিন্তু ওকে হঠাৎ অ্যারেস্ট করল কেন?

বাবা হাসতে হাসতে বললেন,–পাঁচু-চোরের ব্যাপার আর কী?

ঘরসুদ্ধ সব্বাই অবাক হয়ে একগলায় প্রশ্ন করলেন, তার মানে? তার মানে?

কী আশ্চর্য! বাবা একটু রেগে গেলেন, কমাস আগে পাঁচু আমাদের রান্নাঘরে চুরি করতে ঢুকেছিল। হাতেনাতে ধরা পড়েছিল। ভুলে গেলে? –ঘরসুন্ধু হাসলেন। সব্বাই। সেই পাঁচু! ভাত-চোর পাঁচু!

সেই পাঁচু। বাবা বললেন, বঙ্কুবাবুর হাতে খবর আছে, ফেরারি আসামী পাঁচু নাকি ঝিলের ওদিকে গাছে লুকিয়ে আছে। গাছে ডেরা বেঁধেছে। দৈবাৎ কেউ দেখে ফেললে বলে, আমি সেই গেছোবাবা।

মা ফোঁস করে উঠলেন,–তা নান্টুর সঙ্গে তার কী সম্পর্ক?

বাবা ছোটমামার দিকে তাকিয়ে এবার মুচকি হাসলেন, বঙ্কুবাবু ভেবেছিলেন, নান্টু পাঁচুর কাছে হয়তো চোরাইমাল কিনে ঝিলের ধারে ঘাপটি পেতে ছিল।

ছোটমামা রাগ করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। খুব হাসাহাসি চলতে থাকল। একফাঁকে আমিও ঘর থেকে বেরিয়ে এলুম। তারপর বাগানের দিকে ঘরটাতে গিয়ে দেখি, ছোটমামা তুষোমুখে বসে আছেন। এই ঘরটাতে ছোটমামা আর আমি থাকি। বললুম,–ছোটমামা। পুলিশ আপনাকে মারেনি তো?

ছোটমামা ভেংচি কাটার ভঙ্গিতে বললেন,–অত সোজা? আমার গায়ে হাত তুললে কী হতো জানিস?

–কী হতো ছোটমামা?

ছোটমামা ভরাট গলায় বললেন, আমি কবি। কবির গায়ে পুলিশ হাত তুললে কী হতো, তুই-ই ভাব। বাহাত্তর লক্ষ ঊনত্রিশ হাজার কবি হইহই মিছিল করে এসে… এত সোজা?

কথাটা মনে ধরল। বললুম-আচ্ছা, ছোটমামা, গেছোবাবা কি সত্যিই পাঁচু চোর?

হ্যাঁ, ছোটমামা বাঁকা হাসলেন। তুই তো হাদারাম। তাই একটা চোরের পায়ে গড় করলি। আমি ঠিকই টের পেয়েছিলুম বলে গড় করিনি।

কথাটা বিশ্বাস হয়নি। তা ছাড়া গেছোবাবা বলেছিল, তাকে গড় না করলে পুলিশ ধরে। ছোটমামাকে তার একটু পরেই পুলিশে ধরল। কিন্তু ছোটমামার এখন যা মুড, সে কথা বলা যাবে না। এও বলা যাবে না যে, গেছোবাবা যদি সত্যিই পাঁচু-চোর হয়, তাহলে গাছের পাতা কচমচিয়ে খায় কী করে? তার চেয়ে বড় কথা, গেছোবাবা নিজেই বলছিল, পাঁচু তাকে গড় করেনি বলে তাকে জেলে ঘানি টানতে আর পাথর ভাঙতে হয়েছিল। তাছাড়া একজন হিঁচকে চোর পলাশির যুদ্ধ আর লর্ড ক্লাইভের কথা জানবে কী করে? চোরেরা কি ইতিহাস-বই পড়তে পারে? বড় চোর হলেও কথা ছিল, পাঁচু তো নেহাত ছিঁচকে চোর। উঁহু, তাও না–স্রেফ ভাত-চোর।…

ছোটমামার এ রাতে মন খারাপ। দিদি কতবার খেতে ডাকতে এল। বললেন, খিদে নেই। শেষে মা এলেন। সাধাসাধি করার পর ছোটমামা বললেন,–পরে খাব খন! মা রাগ করে বললেন,–রাত দশটা বাজে। আর কতক্ষণ হেঁসেল পাহারা দেব?

তখন ছোটমামা বললেন, ঠিক আছে। টেবিলে রেখে যাও। সময়মতো খাব।

বাড়ির কাজের লোক ভুতো ছোটমামার রাতের খাবার নিয়ে এল। টেবিলে ঢাকা দিয়ে সে চলে যাচ্ছে, ছোটমামা ডাকলেন, ভুতো শোনো।

ভুতে বিনীতভাবে বলল,–মন খারাপ করতে নেই দাদাবাবু। নতুন দারোগাবাবু লোকটা ওইরকমই। যাকে-তাকে চোর বলে ধরে হাজতে ঢোকাচ্ছেন। পাঁচু কি কম দুঃখে–বলেই সে থেমে গেল। ছোটমামা গলা চেপে বললেন,-পাঁচুকে তুমি চেনো?

খুব চিনি-ভুতো ফিক করে হাসল। এ টাউনে ওকে কে না চেনে?

–পাঁচু গাছে চড়তে পারে?

–হুঁ।

–হনুমানের মতো চার পায়ে দৌড়তে পারে?

–হুঁ।

ছোটমামা ভেংচি কাটলেন, হুঁ! খালি হুঁ! তুমি দেখেছ কখনও?

ভুতো গেছোবাবার ভঙ্গিতে বলল, আজ্ঞে, দেখলেও দেখেছি, না দেখলেও না দেখেছি।

এইতেই ভীষণ চটে গিয়ে ছোটমামা বললেন, তুমিও দেখছি গেছোবাবার এক চেলা!

ভূতো তক্ষুনি কপালে দুহাত জোড় করে ঠেকিয়ে বলল, রাতবিরেতে ও নাম মনে আনবেন না দাদাবাবু! আবার ঝামেলায় পড়বেন।

খুব হয়েছে যাও! ছোটমামা গম্ভীরমুখে বসে পা দোলাতে থাকলেন।

আমার ঘুম পাচ্ছিল। শুয়ে পড়ব ভাবছি, হঠাৎ ছোটমামা আস্তে ডাকলেন, পুঁটে! দেখি, ছোটমামা মিটিমিটি হাসছেন।

ফিসফিস করে বললেন,–চল, বেড়িয়ে পড়া যাক। গেছোবাবা ধরা কাঁদ পাতব, বুঝলি? সেজন্যই চালাকি করে আমার খাবারটা এ-ঘরে আনিয়ে রাখলুম। ওঠ, দেরি করা ঠিক নয়।

এমন একটা রোমাঞ্চকর অ্যাডভেঞ্চারের লোভ সামলানো কঠিন। চুপিচুপি দুজনে বাগানের দিকের খিড়কির দরজা খুলে বেরিয়ে পড়লুম। ছোটমামার হাতে তার খাবার থালা। ঝিলের কাছাকাছি গিয়ে বললে,–ফঁদটা বুঝতে পারছিস তো? না পারিস তো কথা নেই। চুপচাপ দেখবি, কী করি!

জ্যোৎস্নাটা এখন আরও ঝলমলে। ঝিলের ধার শিবতলার পর নবাবি আমলের ঘরবাড়ির ধ্বংসস্তূপ আর ঘন জঙ্গল। গা-ছমছম করছিল। এখানে খানিকটা খোলা ঘাসজমিতে পৌঁছে ছোটমামা দাঁড়ালেন। একটু কাশলেন। তারপর ডাকলেন, গেছোবাবা, আছো নাকি? ও গেছোবাবা!

কিন্তু কোনও সাড়া এল না। ছোটমামা একটু গলা চড়িয়ে বললেন, গেছোবাবা! তখন গড় করিনি তোমায়। তাই সত্যিই পুলিশে ধরেছিল। এবার দর্শন দাও, গড় করি। ও গেছোবাবা তোমার জন্য খাবারদাবার এনেছি! কাম ডাউন গেছোবাবা, কাম ডাউন!

এতক্ষণে গাছপালার ভেতর গাঢ় ছায়ায় ধুপ করে শব্দ হল। তারপর সত্যিই গেছোবাবা চায়পেয়ে প্রাণীর মতো বেরোল। খোলা জায়গায় দু-পেয়ে হয়ে প্রথমে অদ্ভুত হিহি হাসি হাসল। তারপর বলল, খাবার এনেছিস? দে, দে খাই। পরে গড় করিস। ওঃ কতকাল পরে মানুষের খাবার খাচ্ছি রে!

বলেই ছোটমামার হাত থেকে থালাটা কেড়ে নিয়ে খুব শব্দ করে খেতে লাগল। ছোটমামা বললেন,–এবার গড় করি?

–তা করলেও করতে পারিস, না করলেও না পারিস।

ছোটমামা গড় করে বললেন–আচ্ছা গেছোবাবা, তুমিই কি পাঁচু?

–তা বললেও বলতে পারিস, না বললেও পারিস।

–তুমি গাছে বসত করলে কেন পাঁচু-সরি গেছোবাবা?

বন্ধুদারোগার ভয়ে।–গেছোবাবা ফোঁস করে নাকঝাড়ল খেতে-খেতে, পেটের বড় জ্বালা রে, বুঝলি তো?

–বুঝলাম। কিন্তু চুরিচামারি না করে কারও বাড়ি কাজকর্ম করলেই তো–

গেছোবাবা হঠাৎ ফুঁপিয়ে উঠল, কাজ দিলে তো করব? একবার পেটের দায়ে একটা বদনাম রটে গেলেই কেলেঙ্কারি না? তার ওপর জেল খাটলে তো কথাই নেই।

আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি। গেছোবাবা থালা চেটেপুটে শেষ করে চার পা হল। ঝিলের ধারে চলে গেল। ছোটমামা আর আমিও তার পিছু পিছু দৌড়ে গেলুম। জল খেয়ে থালা রগড়ে ধুয়ে ঢেকুর তুলে গেছোবাবা বলল,-বেঁচেবতে থাক বাবারা! এই নে তোর থালা, বাড়ি চলে যা। নইলে নতুন দারোগাবাবুর পাল্লায় পড়ে ঝামেলা হবে।

ছোটমামা বললেন,–যাচ্ছি। কিন্তু তুমি তো মানুষ পাঁচু, সরি গেছোবাবা! তুমি এমন হনুমানের মতো দৌড়তে আর গাছে-গাছে বেড়াতে পারে কী করে?

–অভ্যেস রে, অভ্যেস। সার্কাস দেখিসনি? তাছাড়া কথায় বলে, ঠেলায় না পড়লে বেড়াল গাছে চড়ে না। আমি তো মানুষ।

–বুঝলুম। কিন্তু গাছের পাতা খাও কেন?

সেও অভ্যেস। টাউনে ঢুকতে না পেলে কী করব? গাছে-গাছে ঘুরি, গাছের পাতা খাই। বলে গেছোবাবা হাই তুলে উঠে দাঁড়াল। বাবারা তাদের মনে বড় দয়া বাবারা। তোদের ভালো হবে। আমি যাই, বড় ঘুম পাচ্ছে। আহা! কতকাল মানুষের খাবার খাইনি রে! খাওয়ামাত্র ঢুলুনি চেপেছে।

বলে ফের একটা প্রকাণ্ড হাই তুলে গেছোবাবা চার পা হল। জ্যোস্না পেরিয়ে গাঢ় ছায়ায় সে অদৃশ্য হয়ে গেছে ছোটমামা ফোঁস করে শ্বাস ছেড়ে বললেন, কী বুঝলি?

বললুম, কিছু না।

তুই একটা হাঁদারাম! আয় বাড়ি ফিরি।–বলে ছোটমামা হন্তদন্ত হয়ে হাঁটতে থাকলেন। বাড়ির কাছাকাছি গিয়ে কেন যেন ধরা গলায় ফের বললেন,-বড় হ। তখন সব বুঝবি। তবে বুঝলি পটু, বন্ধুবাবু তখন হয়তো ঠিকই বলছিলেন। চঁদ টাদ বোগাস! কী আছে চাদে? নিরেট পাথর। প্রাণ নেই। বাতাস নেই। শ্মশান।

ঘাড় ঘুড়িয়ে চাঁদটার দিকে একবার তাকালুম। অবিকল গেছোবাবার ভঙ্গিতে বলতে ইচ্ছে করছিল, তা হলেও হতে পারে, না হলেও না হতে পারে…

Anuprerona
Anupreronahttps://www.anuperona.com
Read your favourite literature free forever on our blogging platform.
RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here


Most Popular

Recent Comments