Monday, May 13, 2024
Homeবাণী-কথারাণীকাহিনী - মৈত্রেয়ী ব্যানার্জী

রাণীকাহিনী – মৈত্রেয়ী ব্যানার্জী

চারিদিকে জল থৈথৈ। বর্ষার জলে মাটির রাস্তা ডুবে কাদা। তার মধ্যেই নিজের ধুতিটি সামলে, এক হাতে নারায়ণশিলা ধরে এগোচ্ছেন ভ্রূকুটি রাজ্যের পুরোহিত মশাই। নারায়ণের মাথায় সোনার মুকুট, তাতে হিরে বসানো। সদ্য এটি দিয়েছেন রাজা রাগমানিক্য। পুরোহিত উপেন্দ্রর ভুরুদুটিও বাঁকা। বিরক্তিতে। ভরা বর্ষায় নদীর জল, পুকুরের জল সব মাটি গুলিয়ে কাদা করে একসময় নেমে যায় পলি রেখে। আর তারপর পরের বৎসর সেই পলিতে দুগুণ বেশি ফসল ঘরে ওঠে। বন্যার জলে শুধু ক্ষতি হয়না, সুফল ও বয়ে নিয়ে আসে। কিন্তু সেকথা ভ্রূকুটি রাজ্যের কেউ বুঝলে তবে না! তারা সবসময়ই বিরক্ত। সবসময় রেগে থাকে। কাউকে কেউ একটা ভাল কথা বলতে পারেনা। তার অবশ্যি একটা কারণ আছে। ভ্রূকুটি রাজ্য আসলে খুব ধনী রাজ্য। তাদের ফসল হয় বেশি। তাদের জমি আছে অনেক, বিঘার পর বিঘা। যার আদি অন্ত নেই। তাদের সৈন্য সিপাহী অনেক, ঢাল তরোয়াল প্রচুর। হাতিশালে হাতি, ঘোড়াশালে ঘোড়া এমনকি উট ও আছে। রাজপ্রাসাদে ময়ূর ঘুরে বেড়ায়। হরিণ এসে পথ আগলে দাঁড়ায়। তাই এদের ভারি অহংকার। কেউ হাসে না। শুধু ভুরু কুঁচকে থাকে।

মল্লিকা ঠিক এর পাশের রাজ্যের কন্যা। না না, রাজকন্যা নয়। সে পুষ্পমাল্য গড়ে এবং তা রাজার প্রাসাদে দিয়ে আসে সকালের সূর্য তেজ ছড়িয়ে দেবার আগেই। এতেই তাদের মা মেয়ের চলে যায়। হয়ত খুব আরামে নয়, কিন্তু তাতে তাদের মুখের হাসি মলিন হয়না। পাশাপাশি দুটি রাজ্য। এই রাজ্যের নাম সুগন্ধি। প্রচুর ফুল ফোটে এই রাজ্যে। পাশের ভ্রূকুটিতে ফসল ফলে বটে কিন্তু ফুল ফোটে না। রাজা বলেছেন ফুলের দরকার নেই, ওতে রাজস্ব বাড়ে না। তাই কেউ ফুল ফোটায় না। এই রাজ্যে কেউ বিনা কাজে সময় নষ্ট করে না। তাই কাজ করতে করতে হাসি গান সব চাপা পড়ে গেছে। আর সুগন্ধি রাজ্যে যতোটুকু না হলে নয় ততটুকু রোজগার করে ফেললেই সেদিন সন্ধ্যায় আসর বসে ওদের। রাজ্যের ছোট ছোট ছেলে মেয়েরা নাচে, গায়, মুখে রঙ মেখে পালা করে। আর তা দেখে হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ে রাজা রানী মন্ত্রী সবাই। এদের না আছে সেপাই না সান্ত্রী। না ঢাল, তরোয়াল। এখন হয়েছে কি, ওই কাঁচা জলে ডোবা রাস্তাটা দু-রাজ্যের মধ্যে দিয়েই গেছে। ওখানে কোন ভাগ বাঁটোয়ারা হয়নি। বাঁটোয়ারা হয়নি তার আরও কারণ হল, সুগন্ধি রাজ্যের রাজা আনন্দমানিক্য হল ভ্রূকুটি রাজ রাগমানিক্যের আপন খুড়োর পুত্র। মানে খুল্লতাতপুত্র। তখন সব শক্ত শক্ত করে বলতে হত কিনা।

তা হল কি ধুতি তুলতে তুলতে উপেনের পা গেছে হড়কে। আর সে এঁটেলমাটির কাদায় গেল উল্টে! উল্টে তো উল্টে! একেবারে পা দুটি ওপর দিকে মাথা নিচু! আর পাশ দিয়ে নাচতে নাচতে যাচ্ছিল সুগন্ধির মল্লিকা। পড়বি পড় তার চোখের সামনেই ধপাস! মল্লিকা তো তার শাড়ির আঁচলটির খুঁট চিবোতে চিবোতে যাচ্ছিল জলের ওপর দিয়ে ছপ্, ছপ্ করে। উপেনের উল্টে যাওয়া মূর্তি দেখে সে তো খিলখিল করে হাসতে হাসতে আর থামতে পারে না। এদিকে পুরোহিতের হাতের নারায়ণ গেছেন ছিটকে। মেয়েটি পুরোহিতের চেনা। মেয়েটির মা পদ্মও উপেনের চেনা কিনা! তাই একটি বিশেষ ক্রোধ আছে ওদের উপর উপেনের। আসলে পদ্ম অসামান্যা সুন্দরী। আর সুন্দরী কন্যা দেখলেই ধনী রাজ্যের লোকেরা তাদের বিয়ে করতে চায়, এটাই নিয়ম। তাতে গদগদ হয়ে যারা বিয়ে করে ফেলে তাদের ভয় থাকে না, কিন্তু যারা বেঁকে বসে, তাদের আজীবন একটা ভয় থেকেই যায়। এই বুঝি কোন ক্ষতি করে দিল ওই ধনী রাজ্যের লোকে। কিন্তু পদ্ম তাতেও ভয় না পেয়ে বিয়ে করে এক মালাকারকে। আর ভীষণ গোঁসা হয় উপেনের। ভ্রূকুটি রাজ্যে এমন ঘটনা ঘটলে মালাকারকে শূলে চড়ানো হত। কারণ ব্রাহ্মণ কন্যা নীচু জাতে বিবাহের দ্বারা পতিত হয়ে যায়। কিন্তু সুগন্ধির রাজা আনন্দ ওসব মানেন টানেন না। তার রাজ্যে যে যাতে খুশি থাকে তাই করে। কোন বাধা নিষেধ নাই।

সে যাই হোক। মালাকারকে বড় হয়ে মল্লিকা কোনদিন দেখতে পায়নি অবশ্যি। মালাকার কোন দূর দেশে ফুল দিতে গিয়ে আর ফেরেনি। পদ্ম এখন ও অপেক্ষায় থাকে। যাই হোক। হাসতে হাসতে মল্লিকা পুরোহিতের হাত ধরে টেনে সোজা করে দেয়। পুরোহিত তখনও তাকে গালিগালাজ করে যাচ্ছেন। তারপর উঠে নদীতে যায় আবার স্নান করতে। কারণ গোটা গা কাদায় মাখামাখি। আর তার থেকেও মালাকারের ছোঁয়া লেগেছে তার গায়ে। স্নান করে হরিনাম জপ করতে করতে এসে আর কোথাও নারায়ণ খুঁজে পায়না উপেন্দ্র। নারায়ণশিলা না পেলেও খুব দুঃখ ছিলনা, কিন্তু সঙ্গে হিরের মুকুট হারিয়ে খুবই দুঃখ হলো তার। তারপর মনে হলো, তাইতো! তাহলে কি পদ্মর মেয়েটা চুরি করে নিয়ে গেল মুকুট? ভুরুদুটি আরও বেঁকে কুটিল হল। পুরোহিত রাজসভায় পৌঁছে যতটা মিথ্যা সাজানো যায় সাজিয়ে রাজার কাছে পেশ করল। ব্যস। বেজে ওঠে দামামা। চারিদিকে ঝনঝন করে অস্ত্রের ঝনঝনানি। যে সব গরিব প্রজা বাড়িতে শুয়ে বসে ছিল সব জোর করে তুলে এনে জোব্বা পরিয়ে হাতে তলোয়ার ধরিয়ে দেওয়া হল। প্যাঁ প্যাঁ প্যাঁ প্যাঁ। দুম দুম দুম দুম। ভয়ানক আওয়াজ।

পাশের রাজ্যের সবাই চমকে উঠল। হলো কি! একজন খবর আনল “ওগো যুদ্ধু হবে! আমাদের রাজ্য আক্রমণ করতে আসছে রাগিরাজ।”

“কেন কেন? আমরা করিচি কি? যে যুদ্ধু হবে?”

“তা তো জানি নে!”

“ধুস! তাহলে মিছে ভয় দেকিয়োনা বাপু!”

কিন্তু সত্যিই যুদ্ধ হলো। নারায়ণ উদ্ধারের জন্য যুদ্ধ। ওদিকে যতো তরোয়াল, এদিকে বাঁশ, বাখারি, ঢিল। তবু যুদ্ধ হলো। ও রাজ্যের অনেক দাস দাসীর প্রয়োজন ছিল। এ রাজ্যের সব মেয়ে বউদের ধরে নিয়ে গেল ভ্রূকুটিরাজ। পদ্মকে চাইল পুরোহিত। কিন্তু পদ্মর মুখ দেখে রাজা রাগমানিক্য গেলেন গলে জল হয়ে। পদ্মর মুখে অন্যরকম হাসি। মল্লিকাও রয়ে গেল মায়ের সাথে।

বেশ কয়েক বছর পর ভ্রূকুটিরাজ মারা গেলেন। নিজের শয়নকক্ষে। কেউ বলল বিষ প্রয়োগ, কেউ বলল গুপ্ত হত্যা। তার বেশি কিছু কেউ বলল না। শোরগোলও উঠল না। রাজার পারলৌকিক ক্রিয়া কর্ম মিটে যাবার পর রানী পদ্ম হলেন পদ্মাবতী। সারা রাজ্যে ফুল আর ফুল। তবে ফুলের গন্ধ আর আগের মত মিঠে নেই। রানী ঘোষণা করলেন যে আগের সুগন্ধ ফিরিয়ে আনতে পারবে তাকে পুরস্কৃত করা হবে। অনেক মালাকার এল, কিন্তু সে গন্ধ আর ফিরে এলনা। রানীর ভুরু গেল কুঁচকে। বিরক্তি বাড়তে লাগল। পুরোহিত উপেন্দ্র এখন রানীকে দেখলেই ভয়ে কাঁপতে থাকে। কখন গর্দান যায়, এই ভেবে। রানী কিন্তু ওকে মারেন না, শুধু এক অদ্ভুত হাসি হাসেন। সে হাসিতে রোদ নেই, জোছনা নেই, শিশির নেই। আছে শুধু হিম শীতল আতঙ্ক। রানী ইতিমধ্যেই স্বপ্নে দেখতে পেলেন সেই হারিয়ে যাওয়া নারায়ণ রয়েছেন নদীগর্ভে। তাঁকে তুলে আনা হল, ঢাক ঢোল বাজিয়ে আবার দেবতার অভিষেক হল। সবাই রানীর নামে জয়ধ্বনি দিল। তবু সুগন্ধ এল না। এখন এ রাজ্যের সবাই হাসে, কিন্তু সে হাসিতে প্রাণ নেই।

সবাই শুধু রানী পদ্মের জয়গান গায়। পুরোহিতও আসতে যেতে পেন্নাম ঠোকে। বলে “জয় রানীমার জয়”

হঠাৎ রাজ্যে আবার সেই সুগন্ধ ফিরে এল! সেই মালাকার এতদিন পর অন্য দেশের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে ফিরে এসেছে। এসে তো নিজের বাড়ি ঘর কিছুই খুঁজে পায় না।

“ওগো! এখেনে আমার পদ্ম আর একটা ছোট্ট মল্লিকা ফুটে থাকত, তারা কোথায়! বলতে পারো?”

কেউ বলতে পারে না। পারবে কি করে? অনেকেই তো মরে গেছে যুদ্ধুতে। আবার কেউ বা গেছে পালিয়ে। শেষে খুঁজতে খুঁজতে মালাকার এল রাজা আনন্দমানিক্যের প্রাসাদে। প্রাসাদ বিবর্ণ হয়েছে। ফুল গাছ আছে, কিন্তু গন্ধ নেই। রাজার মুখে সেই হাসি নেই! রাজা দিলেন তাকে পদ্মর খোঁজ।

মালাকার এল ভ্রূকুটি রাজ্যে। চারিদিকে ছড়িয়ে গেল সুগন্ধ। সবাই তাকে রানীর কাছে নিয়ে গেল। এতদিন পর আবার পদ্ম দেখল মালাকার ভ্রমরকে। মল্লিকা দেখল তার বাপকে। সে বাপের বুকে গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লে। রানীর ইশারায় তাকে সরিয়ে নিয়ে গেল দাসী। ভ্রমর এনে দিল ফুলের সৌরভ। এবার পুরস্কার দেবার পালা।

“কি চাও?”

“যা চাইবো দেবেন?”

“দেব”

“তাহলে সব ছেড়ে চলো আমরা তিনজন চলে যাই।”

“আর তা হয়না। অন্য কিছু চাও।”

ভ্রমর পদ্ম আর মল্লিকা ছাড়া আর কিছু চায়না। রানী দেখল ভ্রমর বড় একগুঁয়ে। তাই আবার স্বপ্ন দেখতে হলো। এবার দেবতা রানীর কাছে চাইলেন রক্ত, এমন শুদ্ধ মানুষের রক্ত, যে সত্যি হাসে, সত্যি কাঁদে, সত্যি ভালবাসে।

পরদিন থেকে ভ্রমরকে আর কেউ দেখেনি।

Anuprerona
Anupreronahttps://www.anuperona.com
Read your favourite literature free forever on our blogging platform.
RELATED ARTICLES

Most Popular

Recent Comments