Saturday, October 4, 2025
Homeরম্য গল্পহাসির গল্পনেশাড়ু অ্যান্ড কোং - নবনীতা দেবসেন

নেশাড়ু অ্যান্ড কোং – নবনীতা দেবসেন

নেশাড়ু অ্যান্ড কোং – নবনীতা দেবসেন

আমাদের উত্তেজনার শেষ নেই। এবারে দোল অন্যরকম হবে। এবারে দোলে সত্যি সত্যি ভাঙের শরবত তৈরি করা হবে বাড়িতে। সেই অনেক, অনেক বছর আগে একবার পুজোর সময়ে সত্যনারায়ণ পার্কে গিয়েছিলুম মারোয়াড়ি দোকানের বাদাম পেস্তা দেওয়া ভাঙের শরবত খেতে। আমার বড় মেয়ে পিকো, স্বাতী (গঙ্গোপাধ্যয়), দীপংকর চক্রবর্তী, রঞ্জন মিত্র আর আমি। পিকো তখন ইস্কুলে। বুদ্ধি করে নিজে গাড়ি চালাইনি, পাছে ভাং-টাং খেয়ে ফিরে আসতে না পারি? স্বাতী-সুনীলের পুরোনো ভোজপুরী ড্রাইভার মহেন্দ্রকে নেওয়া হল, তার প্রধান কারণ, সে-ই শুধু নিশ্চিত জানে কোন দোকানে মিলবে। দীপংকর দোকানিকে অন্তরালে নিয়ে গিয়ে বলে দিল, চার গেলাস ভাং সমেত রেগুলার, আর দুই গ্লাস ভাং ছাড়া বাদাম-পেস্তার শরবত, বাচ্চা আর ড্রাইভারের জন্য। কিন্তু কাউকেই কথাটা বলা চলবে না।

যথাকালে বড় বড় গ্লাস ভর্তি অপরূপ স্বর্গীয় স্বাদ-গন্ধের শরবত এল। মনে হল চুমুক দিয়ে গ্লাসভর্তি গলে যাওয়া গোলাপ-গন্ধী কুলফি মালাই খাচ্ছি বুঝি। আরে? কই কিছুই হচ্ছে না তো? একটু উন্নত মানের সঘন প্যারামাউন্টের শরবত। এতগুলো টাকা গোল্লায় গেল গো!

তারপরে বোঝা গেল বাড়ি গিয়ে। কেউ অদৃশ্য জলের মধ্যে পা দিয়ে ফেলার ভয়ে শাড়ি তুলে লক্ষ্য দিচ্ছি, কেউ নিজের পেটে ড্রাম বাজিয়ে মার্চ করছে, কেউ পুরুত হয়ে ওম শান্তিঃ ওম শান্তিঃ করছে। সে এক অপরূপ কাণ্ড। পিকোই কেবল বুক ফুলিয়ে দেখছ, আমার কিছু হয়নি বলে সব্বাইকে সামলাচ্ছে।

সেই যে আমাদের বাড়িতে বিজয়ার দিনে মা সিদ্ধির শরবত তৈরি করতেন, তার চেয়ে আর একটু ঘন। এটুকুই। সে শরবতও ছোটদের আর বড়দের দুরকম হত, বড়দেরটায় সিদ্ধি এক চিমটি বেশি, বাচ্চাদের সিদ্ধির পরিমাণ নামমাত্র।

কোনোদিন কারুর মধ্যে নেশার চিহ্ন দেখিনি। শুধু একবার কালীপুজোর সময়ে দীপংকর, আর রঞ্জন সিদ্ধি বেটে শরবত বানিয়েছিল। আমার মা-কে দেওয়া হচ্ছিল না, কিন্তু মা খোঁজ করলেন,–কই দেখি, কী বানিয়েছিস? শুধু তলানিটুকু বাকি ছিল। মাকে সেটাই দেওয়া হল। ভয়ে কাঁটা হয়ে। ওতেই নাকি চরম নেশা হয়। মায়ের কিন্তু কিছুই নেশা হয়নি তাতে। একমুখ হেসে বিজয়গর্বে বললেন,–এত কড়া কড়া ওষুধ খাই, আমাকে কোনো নেশা কাবু করতে পারবে না। ওষুধের বিষের জোর একদম সাপের বিষের মতন! হুঁ হুঁ বাবা!

কিন্তু দীপংকর আর সমীরের নেশা হল। ওরা তো মায়ের মতো কড়া কড়া ওষুধ খায় না! সমীর ছিল আমার পাতানো ছেলে, রাঢ় বাংলার এক গ্রামে তাদের বাস। সমীরের কথা আপনারা জানেন, সেই যে ভক্তিমান ছেলেটিকে কুম্ভমেলায় পেয়ে ছেলে পাতিয়ে নিয়েছিলুম। রঞ্জনের বেদম ঘুম পেল, আর কিছু নয়। আমারও ঘুম ঘুম পাচ্ছিল। পিকো-টুম্পাকে সিদ্ধি দেওয়া হয়নি, বলাও হয়নি কিছু। ওদেরই সিদ্ধি খেয়েছি ভেবে উত্তেজনায় ঘুম ছুটে গেল। নানান পাগলামি করতে লাগল। যেমন, কালী সাজা, সমীরের আর দীপংকরের মত্ততার দুটি উদাহরণ দিচ্ছি।

প্রথমে দীপংকর। আমরা স্থির করেছিলুম মায়ের ঘরে নো এন্ট্রি বোর্ড লাগিয়ে দেব। কিন্তু দীপংকর কথা শোনার ছেলে? তদুপরি সিদ্ধির দ্বারা শক্তিমান। সে গান গাইতে গাইতে এবং নাচতে নাচতে মাসিমার ঘরেই প্রবেশ করল, আআয় আআয় হআঁস, চই চই চই..মাসিমা বললেন, বা, বা, বেশ সুন্দর কিন্তু অন্য একটা গান গাইলে হতো না? দীপংকর তক্ষুনি মহা উৎসাহে রাজি। সে চিৎকার করে যাত্রাপালার গান ধরল, নাটকীয় ভাবে হাত-পা নেড়ে।… ওকে ছুঁস নে পাগোল! ও যে বিষের বড়ি ইইই– মা বললেন, ঠিক আছে ঠিক আছে, বাবা, তুমি একটু বিশ্রাম নাও।

ইতিমধ্যে মজা বুঝে পিকো টুম্পা একটা বজ্জাতি শুরু করেছে। আমার দুটো জাপানি মুখোশ ছিল, একটি লাল-কালো, একটি সাদা। সাদা মুখোশ পরে টুম্পা সমীরের সামনে গিয়ে মাটিতে চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ল। পিকো লাল কালোটা মুখে পরে হাতে পিঠ চুলকোনোর আঙুলওলা মোষের শিং-এর ডান্ডাটা খাঁড়ার মতন মাথার ওপরে তুলে টুম্পার বুকে আলগোছে এক পা তুলে দাঁড়াল। এ সবই ঘটছে মায়ের সামনে, মায়ের ঘরে। সমীর মায়ের খাটের পাশে হাঁটু গেড়ে বসে হাত জোড় করে বলছিল–আমাকে ভকতি দাও, শকতি দাও মা গো,–এবারে টান শুয়ে পড়ল পিকো-টুম্পার যুগ্ম প্রজেক্ট, জ্যান্ত, ফ্ৰকপরা, মুখোশ পরা। কালীমূর্তির সামনে। আর আকুল হয়ে বলতে লাগল, আমাকে ক্ষমা করে দে মা, আমার সব ব্যাড ইভিলগুলোকে তুই দয়া করে গুড ইভিল করে দে মা। আর ওইরকম করব না মা! আমরা হেসে গড়াচ্ছি। পিকো-টুম্পা গম্ভীর। ওরা যেই হেসে মুখোশ খুলে ফেলল, ঘোর কাটল সমীরের। সবাই অট্ট হাসছি, সেই হাসিতে সমীরও যোগ দিল। মা ওদের খুব বকুনি দিলেন। হাসতে হাসতে সমীর কিন্তু কিছুই বলল না।

কিছুদিন আগে, দোল উপলক্ষে সিদ্ধি খাওয়া হবে স্থির হল। মা আর মাথার ওপরে নেই। পিকো-টুম্পা দূরে যে যার সংসারে। দীপংকরটা চলে গিয়েছে জন্মের মতো। সমীর তার গ্রামে। রঞ্জন চাকরি করে অনেক দূরের পাহাড়ি শহরে। আপাতত এ-বাড়িতে আছি শুধু কানাই ঝর্না নীলু অমিত, বাবুসোনা, আমি আর শ্রাবস্তী। আর আছে, ছোট ছোট চারপেয়ে ছেলে-মেয়েরা, ভুতুম, কেলটুশ, আর তাদের দিদি তুরতুরিয়া। শ্রাবস্তী বলেছে অফিসের বন্ধুদের কাছ থেকে একটু ভাং চেয়ে আনবে। তার পরে শরবত বানানো হবে। বাড়ি শুষ্টু সবাই উত্তেজিত, দোলে ভাঙের শরবত হবে।

দোল এসে পড়ল বলে। শ্রাবস্তী অফিস থেকে ভাং এনে দেখাল, পাকা তেঁতুলের ডেলার মতো দেখতে। মিষ্টি মিষ্টি গন্ধ। সে শিখেও এসেছে কেমন করে এটা দিয়ে শরবত বানাতে হয়। অবিশ্যি এমন না, যে ও না জানলে কেউ বানাতে পারবে না। কানাই জানে বাঁকুড়া স্টাইলের সিদ্ধির শরবত। আর নিলু জানে ওদের ক্যাম্পের স্টাইলের সিদ্ধির শরবত। কানাই বলল, ওদের গ্রামের ভাঙের শরবতটায় ওরা ক্ষীর মালাই গুলে দেয়। নীলু বলল, ওদের ক্যাম্পের সিদ্ধির শরবতটায় বাদাম পেস্তা বেটে দেয়। শুধু ঝর্না বলল সে কোনোদিন খায়নি, ভাঙের শরবত বানাতেও জানে না, খেতেও চায় না। দুউর দুর। জ্যাত্তো নেশার জিনিস।

আমরা নিশ্চিন্ত। একটা না একটা বানানো হবেই হবে। চয়েস অনেক।

আফিম নয় তো রে? আফিসের ডেলাও কিন্তু এমনি দেখতে হয়।

আরে দূর, কেউ ফ্রি-তে আফিম দেবে? আর, মাগো, তোমার-আমার কাছে আফিমও যা ভাংও তাই।

ওর কাছেই রইল ভাং-এর ডেলা। এমনই কপাল, একটু জমিয়ে সবাই মিলে ভাং খাব কী, ঠিক দোলের আগের দিন কেশ ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়ল। খালি মাথা ঘুরে ঘুরে ঠশঠশ করে মৃগী রুগিদের মতো মুখ ঠুকে মেঝেতে লুটিয়ে পড়ছে। থ্যাবা হয়ে, চার পা এলিয়ে আহা, ঠিক যেন সদ্যোজাত বাছুর। যন্ত্রণার চোখ বুজে আসছে। মাঝে মাঝে মনে হচ্ছে অজ্ঞান হয়ে পড়ছে। এ কী রে বাবা? কুকুরদের আবার মৃগী হয় নাকি? শুনিনি তো কখনো? মুখে অবিশ্যি গাজলা উঠছে না। আমরা গিয়ে বুকে হাত দিয়ে দেখছি হার্ট চালু কিনা। পশুপ্রাণীর ডাক্তারবাবুকে পাওয়া গেল না, বাইরে গেছেন। কেল্টশের জন্যে আমরা ভেবে অস্থির। ইতিমধ্যে শ্রাবস্তী তার ট্রাউজার্সের পকেট থেকে ভাঙের ডেলাটা আনতে গেল, কানাইকে দিয়ে দেবে। সে ওটা দিয়ে যা পারে করুক। বাঁকুড়া হোক, কিংবা ক্যাম্প, এসে যায় না। যা হয় একটা কিছু হলেই হল। তরিবত করে সিদ্ধির শরবত খাওয়ার ভাবনা এখন চুলোয় গেছে, কেশের জন্য সবাই উদবিগ্ন।

একটু পরেই শ্রাবস্তী এসে খুব উত্তেজিত গলায় বলল, আমার প্যান্টের পকেট থেকে ভাং-এর গোল্লাটা কে নিল? প্যান্টটা মাটিতে পড়ে আছে, পকেটে ভাঙের ডেলাটা নেই। কে নিয়েছ, বল শীগগির! কেশ ওর পিছু পিছু একটুখানি এসেই ফের চার পা ছেতরে পড়ে গেল। আরও কিছুক্ষণ খোঁজ করার পরে আমাদের একটা সম্ভাবনা মাথায় এল। আচ্ছা, গন্ধে গন্ধে লোভী কেন্টুশ গিয়ে প্যান্টের পকেট থেকে ভাং-এর ডেলাটা খেয়ে ফেলেনি তো? নিশ্চয়ই তারই ফলে এত মাতলামি করছে? কী কাণ্ড!

যাক, তাহলে আর ভয়ের কিছু নেই, শুধু একটু তেঁতুল গোলা? কী লেবুর জল? নাঃ, কেশ টক ভালোবাসে না। কোনোটাই খাওয়ানো যাবে না। কী করা?

আহা, একটু দুধ খাওয়ালে হয় না?

কিন্তু কেন্টুশ কিছুতেই খেতে এল না। চলতে গলে পড়ে যেতে থাকল, আর সেখানেই শুয়ে ফুরফুর করে নাক ডাকিয়ে ঘুমোতে থাকল। তার খিদেই পেল না।

থাকুক অমনি করে, আস্তে আস্তে ধাতস্থ হয়ে যাবে। বিষ তো নয়।

দুদিন ধরে ওর ঘোর কাটেনি, কুকুরছাড়া তো? পরিণত বয়স্ক কুকুর হয়তো আর একটু দ্রুত সেরে উঠত। আস্তে আস্তে সুস্থ হয়ে উঠল কেশ, আমাদের চা খাবার সময়ে আবার বিস্কুট চাইতে লাগল হেংলু হয়ে। আঃ, আমাদের হৃৎপিণ্ডের গতি সহজ হল।

আর কোনোদিন কারুর প্যান্টের পকেট থেকে গন্ধে গন্ধে কিছু চুরি করে খায়নি কেশ। কেশের কেলোর কীর্তির সেখানেই ইতি হল।

এখন সে অতি সাবধানি ভদ্দরলোক। সাধ্যসাধনা করে কিছু না দিলে খায় না। বিস্কুট দিলেও তিন বার শুঁকে পরীক্ষা করে তারপরে ভেবেচিন্তে মুখে নেয়। একবার ভুল করে কেশও বড় হয়ে গেল?

শারদীয়া কলকাতা পুরশ্রী ১৪২৪

Anuprerona
Anupreronahttps://www.anuperona.com
Read your favourite literature free forever on our blogging platform.
RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here


Most Popular

Recent Comments