Wednesday, August 27, 2025
Homeথ্রিলার গল্পরহস্য গল্পকবর - হুমায়ূন আহমেদ

কবর – হুমায়ূন আহমেদ

ফুলির মা ক্ষীণ গলায় বলল, আফা চাচাজান কি ফিরিজের ভিতরে থাকব?

মনিকা দু’টা রিলাক্সিন খেয়ে শুয়েছিল। ফুলির মা’র কথা শুনে উঠে বসলো। চট করে তার মাথায় রক্ত উঠে গেল। রিলাক্সিন মানুষের নার্ভ ঠাণ্ডা করে, তারটাও করেছিল, ঝিমুনির মত এসে গিয়েছিল-ফুলির মা’র কথায় ঝিমুনি কেটে গেল। এই বোকা কাজের মহিলাটা তাকে বিরক্ত করে মা’রছে। অসহ্য। অসহ্য।

মনিকা তীক্ষ্ণ গলায় বলল, কি বললে?

ফুলির মা প্রশ্নটা দ্বিতীয়বার করার সাহস পেল না। যদিও একজন মৃত মানুষকে ফ্রীজে রেখে দেয়ার ব্যাপারটা তাকে খুব ধাঁধায় ফেলে দিয়েছে। একটা মানুষ গত তিন দিন ধরে ফ্রীজে ঠাণ্ডা হচ্ছে। এটা কেমন বিচার?

ফুলির মা চলে যেতে ধরেছিল। মনিকা তাকে ফিরাল। কঠিন গলায় বলল, যেও না তুমি, দাঁড়াও। একই প্রশ্ন তুমি বার বার করছ কেন? তোমাকে কি আমি বুঝিয়ে বলিনি?

জ্বে বলছেন।

তুমি বুঝতে পারনি?

জ্বে পারছি।

তাহলে কেন বার বার বিরক্ত করছ?

মানুষটা ফিরিজের মইধ্যে থাকব।

মনিকা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বলল, শোন ফুলির মা। ব্যাপারটা সেরকম না। আমার ভাই বোনরা সব দেশের বাইরে। সবাই বাবার ডেড বডি শেষ বারের মত দেখতে চাচ্ছে। সেটাই স্বাভাবিক। সবাই দূরে দূরে থাকে। কেউ আমেরিকা কেউ জাপান। ইচ্ছা করলেই ছুটে আসতে পারে না। অনেক সময় প্লেনের টিকিট পাওয়া যায় না। বুঝতে পারছতো ব্যাপারটা? ওরা যেন শেষ দেখা দেখতে পারে সেই ব্যবস্থাই করা হয়েছে। বাবাকে বারডেমের একটা ঠাণ্ডা ঘরে রাখা হয়েছে। যাতে ডেড বডি নষ্ট না হয়। বুঝতে পারছ?

জ্বি।

সবাই যখন বাবাকে শেষ দেখা দেখে ফেলবে তখন তাঁকে যথারীতি গোর দেয়া হবে। বুঝতে পেরেছ?

জ্বি পারছি।

দাঁড়িয়ে আছ কেন, চলে যাও। নাকি তোমার আরো কিছু বলার আছে? বলার থাকলে বল। কিন্তু এরপর আর বিরক্ত করতে পারবে না।

জ্বে না। কিছু বলার নাই। কিন্তু আফা ফিরিজের মইধ্যে গোর আজাব ক্যামনে হইব।

কি বললে?

মিত্যুর পরে গোর আজাব হয়। মানকের নেকের আয়। আল্লাপাকের দুই ফিরিশতা। ফিরিজের মইধ্যে…..

তুমি আমার সামনে থেকে যাও ফুলির মা। তুমি আমার মাথা ধরিয়ে দিয়েছ। হোয়াট এ নুইসেন্স।

বিরক্তিতে মনিকার ঠোঁট বেঁকে গেল। তার ভাবতেই খারাপ লাগছে এরকম নির্বোধ একজন মহিলার হাতে শেষ সময়ে তার বাবার দেখাশোনার দায়িত্ব ছিল। সে নিশ্চয়ই কিছু বুঝতেই পারে নি। শেষ সময়ে শ্বাস কষ্ট হয়, অক্সিজেন দেয়ার দরকার পড়ে। বুদ্ধিমান একজন মানুষ ছুটাছুটি করে ব্যবস্থা করতো। ফুলির মা নিশ্চয়ই সেই ভয়াবহ সময়ে পান খেতে খেতে গল্প জুড়ে দিয়েছে।

ফুলির মা তুমি এখনো দাঁড়িয়ে আছ কেন? তোমাকে না যেতে বললাম।

আফা আপনের শাড়ি ঠিক করেন, হাঁটুর উপরে উইঠ্যা গেছে।

আমার শাড়ি কোথায় উঠেছে না উঠেছে তা তোমাকে দেখতে হবে না। তুমি তোমার কাজে যাও।

ফুলির মা অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে বলল, মরা বাড়িত তিন দিন কাজ কাম করা নিষেধগো আফা। তিন দিন, তিন রাইত চুলা জ্বলে না।

টেলিফোন বাজছে। মনিকা টেলিফোন ধরার জন্যে প্রায় ছুটে গেল। আমেরিকায় কল বুক করা হয়েছে। লাইন অসম্ভব বিজি। কিছুতেই লাইন পাওয়া যাচ্ছে না।

হ্যালো হ্যালো।

কে মনিকা আপু?

হা। টিকিট পেয়েছিস?

পেয়েছি তবে কনফার্মড না। এয়ারপোর্টে বসে থাকতে হবে।

সবাই আসছিস?

পাগল হয়েছ। পাপ্পু গেছে সামা’র ক্যাম্পে, পাপ্পুর বাবা একুশ তারিখ যাবে বেলজিয়াম। ওর কনফারেন্স।

বেলজিয়ামের কোথায় যাবে?

লীয়েগে না–কি যেন নাম। ও আচ্ছা তুমিও তো বেলজিয়াম গিয়েছিলে জায়গাটা কেমন আপা?

সুন্দর। খুব সুন্দর। শহর থেকে বের হলে চোখ জুড়িয়ে যায়।

পাপ্পুর বাবার সঙ্গে আমারো যাবার কথা ছিল…. এর মধ্যে এই খবর।….

টেলিফোন লাইনে কি একটা গন্ডগোল হচ্ছে, কটু করে একটা শব্দ হল। লাইন কেটে গেল।

মনিকা বিরক্ত মুখে রিসিভার নামিয়ে রাখার সময় দেখল, ফুলির মা এখনো দাঁড়িয়ে আছে। টেলিফোনে কি কথাবার্তা হচ্ছে হা করে শুনছে। মনিকা আঁঝালো গলায় বলল, তোমাকে না বললাম চলে যেতে।

কই যামু?

যেখানে ইচ্ছা সেখানে যাও। সব সময় গা ঘেঁসে থাকবে না।

জ্বি আইচ্ছা। আফা আপনের শাড়ি হাঁটুর উপরে উইট্টা রইছে।

একবারতো বললাম, আমার শাড়ি নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না। জ্বি

আইচ্ছা।

আমার জন্যে চা বানিয়ে আন। দুধ চিনি কিছুই দেবে না, আমি দিয়ে নেব।

মরা বাড়িত চূলা জ্বালা নিষেধ আছে আফা। তিনদিন চুলা বন থাকব।

তুমি এক্ষুনি গিয়ে চুলা জ্বালাবে। চা করবে। আজে বাজে কথা বলবে না, মোটেও তর্ক করবে না। আজে বাজে কথা এবং তর্ক দু’টাই আমি অপছন্দ করি।

জ্বি আইচ্ছা।

কথা বলে বলে তুমি আমার মাথা ধরিয়ে দিয়েছ। এখনো দাঁড়িয়ে আছ কেন।

শাড়িটা ঠিক করেন আফা।

মনিকা শাড়ি ঠিক করল। তার মাথার যন্ত্রণাটা বাড়ছে। টেনশান ঘটিত যন্ত্রণা। সব তাকে একা করতে হচ্ছে।

এমন কেউ নেই যাকে দায়িত্ব দিয়ে নিশ্চিন্ত হওয়া যায়। তার ধারণা এই কয়েক বছরে বাংলাদেশের মানুষদের স্বভাবে ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে। সবাই দায়িত্ব নেয়ার ব্যাপারে খুবই আগ্রহী। দায়িত্ব নেয়া পর্যন্তই। একবার দায়িত্ব নিয়ে নেবার পর আর কোন খোঁজ পাওয়া যাবে না।

বারডেমে ডেডবডি রাখার দায়িত্ব নুরুদ্দিন নামের এক লোক (মনিকার দূর সম্পর্কের মামা) নিয়েছিল। খুব আগ্রহের সঙ্গে নিয়েছিল। বারডেমের ডিরেক্টর সাহেব -কি তার খুব ক্লোজ ফ্রেন্ড। একসঙ্গে উঠা-বসা। টেলিফোন করা মাত্র ব্যবস্থা হবে।

মনিকা বলেছিল, জায়গা থাকলে তবেই না ব্যবস্থা হবে। শুনেছি মাত্র তিনটা ডেডবডি রাখার ব্যবস্থা ওদের আছে। তিনটাই যদি অকুপায়েড থাকে?

অকুপায়েড থাকলেও ব্যবস্থা হবে। দরকার হলে অন্য ডেডবডি ফেলে দিয়ে ব্যবস্থা হবে। এই ব্যাপারটা তুমি আমার উপর ছেড়ে দাও তো।

মনিকা ছেড়ে দিয়েছিল। নুরুদ্দীন সাহেব সকাল নটার সময় দায়িত্ব নিয়ে হাসিমুখে চলে গেলেন। যাবার সময় বলে গেলেন তিনি এক ঘন্টার মধ্যে ব্যবস্থা করছেন। এই যে তিনি গেলেন–গেলেনই। আর ফিরলেন না। শেষ পর্যন্ত মনিকার নিজেরই যেতে হল।

এই অবস্থায় মিনিটে মিনিটে মাথা ধরবে নাতো কি? প্রতিটি কাজ তাকে নিজেকে দেখতে হচ্ছে। আত্মীয় স্বজনদের টেলিফোন করা। প্লেনে আসবে তাদের আনার জন্যে এয়ারপোর্টে গাড়ি পাঠানো। কে কোথায় থাকবে সেই ব্যবস্থা করা। বিছানা, বালিশ, মশারী….

আফা আপনের চা।

দুধ চিনি দিয়ে নিয়ে এসেছ?

জি।

তোমাকে না বলেছিলাম দুধ চিনি ছাড়া চা আনতে। তুমি কি ইচ্ছা করেই আমাকে বিরক্ত করছ?

ফুলির মা হাই তুলল। মনিকার কথাকে সে তেমন গুরুত্ব দিচ্ছে না। মনিকা চায়ে চুমুক দিল। আশ্চর্যের ব্যাপার চা খারাপ হয়নি। দুধ চিনি সবই পরিমাণ মত হয়েছে।

আফা, টেলিফোনে কার সাথে কথা কইতেছিলেন?

তা দিয়ে তোমার দরকার আছে?

আফনের ছোড ভইন?

হা আমার ছোট বোন মৃন্ময়ী। ও সিয়াটলে থাকে।

ছোড আফা কি আইতাছে?

হ্যাঁ, আসছে। ভাল কথা, ও যে এসে থাকবে–কোথায় থাকবে? ব্যবস্থা আছে। কোন?

ফুলির মা দাঁত বের করে হাসল।

মনিকা তীক্ষ্ণ গলায় বলল, হাসছ কেন?

সব ব্যবস্তা আছে আফা। খালুজান সব ব্যবস্তা রাখছে। আফনের জইন্যে আলাদা ঘর, মেজো আফার জইন্যে আলাদা ঘর, ছোড আফার ঘর, ভাইজানের ঘর। আফা ভাইজান আসতাছে না?

তোমার এত খবরের দরকার নেই। তুমি ঘর গুছিয়ে ঝাড়পোছ করে রাখ।

ভাইজান কি খবর পাইছে আফা?

কেন শুধু শুধু বিরক্ত করছ ফুলির মা। সামনে থেকে যাও।

ফুলির মা গেল না। দাঁড়িয়ে রইল। কারণ টেলিফোন বাজছে। টেলিফোনে কেউ যখন কথা বলে ফুলির মা’র শুনতে ভাল লাগে। টেলিফোন করেছে মৃন্ময়ী। তার গলার স্বরে স্পষ্ট বিরক্তি—

আপা, বাংলাদেশের টেলিফোনের একি অবস্থা। এই যে লাইন কেটে গেল তারপর থেকে সমানে চেষ্টা করে যাচ্ছি। একটা সামান্য টেলিফোনের জন্যে যদি এত সময় নষ্ট হয় তাহলে দেশ চলবে কি ভাবে।

দেশ চলছে না, এক পায়ের উপর দাঁড়িয়ে আছে।

আমার তাই ধারণা।

দেশে আয়, এলে দেখবি দি কান্ট্রি ইজ গোয়িং টু দ্যা ড্রেইন।

মনিকা আপু, ভাইয়া কি খবর পেয়েছে?

ও খবর পেয়েছে সবার আগে। ওর কাছ থেকে আমি জানলাম।

ভাইয়া আসছে?

হ্যাঁ আসছে। আগামীকাল সকালে এসে পৌঁছাবে।

ভাইয়া একা আসছে?

তার স্ত্রীও আসবে।

তাহলেতো খুব ভাল হয়। ভাইয়ার বিদেশী বউ এখনো দেখিনি। অবশ্যি টেলিফোনে অনেকবার কথা হয়েছে। কেমন যেন হাস্কি ভয়েস।

ঠিকই বলেছিস–থমথমে গলা। এখন অবশ্যি মেয়েদের হাস্কি ভয়েসই সবার পছন্দ।

আপা ভাইয়ার পারিবারিক জটিলতার কথা কি সব শুনেছিলাম, তুমি কিছু জান?

জানি।

বলতো শুনি।

মনিকা মাউথপিস হাত দিয়ে চেপে কাটা গলায় বলল, ফুলির মা। তুমি শুধু শুধু দাঁড়িয়ে আছ কেন? যাও বললাম সামনে থেকে।

কার সাথে কথা কন আফা?

কার সঙ্গে কথা বলি তা জেনে তোমার কি হবে?

এম্নে জিগাইছিলাম।

যাও বললাম। যাও।

ফুলির মা নিতান্ত অনিচ্ছায় রান্নাঘরের দিকে রওনা হল। মনিকা মাউথপিস থেকে হাত সরিয়ে বলল, হ্যালো হ্যালো।

মৃন্ময়ী বলল, কার সঙ্গে কথা বলছিলি–আপা?

ফুলির মা।

ফুলির মাটা কে?

আর বলিস না–শি ইজ এ পেস্ট। শেষ সময়ে বাবার দেখাশোনা করেছে। বুদ্ধির বংশটা নেই, সারাক্ষণ কথা বলে। ওর কথাবার্তা থেকে মনে হয় বাবা তাকে যথেষ্ঠ লাই দিয়েছেন। লাই না পেলে এত কথা বলার সাহস হত না। এমনভাবে সে ঘুরে বেড়াচ্ছে। যেন এ বাড়ির সেই মালিক।

বয়স কত আপা?

কে জানে বয়স কত। আমিতো আর বয়স জিজ্ঞেস করিনি। পঁয়ত্রিশ ছয়ত্রিশ হবে। বেশীও হতে পারে। বয়স জিজ্ঞেস করছিস কেন?

এম্নি জিজ্ঞেস করলাম। আপা ঢাকায় এখন টেম্পারেচর কত?

জানি না কত। তবে বেশ গরম। শেষ রাতের দিকে একটু অবশ্যি ঠান্ডা পড়ে তবে ফ্যান ছেড়ে রাখতে হয়।

আপা মেয়েটার স্বাস্থ্য কেমন?

কার স্বাস্থ্য কেমন?

ফুলির মা।

মনিকা বিস্মিত গলায় বলল, তার স্বাস্থ্য কেমন এটা জানতে চাচ্ছিস কেন?

মৃন্ময়ী অস্বস্তির সঙ্গে বলল, শেষ বয়সের বুড়োদের মধ্যে নানান ধরনের পারভারসান দেখা দেয়। এই জন্যেই জিজ্ঞেস করা।

কি আজে বাজে কথা বলছিস?

সরি আপা। হঠাৎ মুখ ফসকে বলে ফেলেছি। তবে অসুস্থ অবস্থায় দেখা শোনার জন্যে কাজের মেয়ে না রেখে বাবা অনায়াসে একজন নার্স রাখতে পারতো। এমনতো না যে বাবার টাকার অভাব।

চব্বিশ ঘন্টার জন্যে নার্স হয়ত পাওয়া যায় না।

পাওয়া যায় না কেন? টাকা দিলে সবই পাওয়া যায়।

রান্নাবান্নার জন্যেতো লোক দরকার। রান্নাবান্নাতো আর নার্স করে দেবে না।

তাও ঠিক। আপা মেয়েটা কত দিন ধরে আছে?

জিজ্ঞেস করিনি।

টেলিফোনে কট কট কট শব্দ হতে লাগল। মৃন্ময়ীর গলা খুবই অস্পষ্টভাবে পাওয়া যাচ্ছে। মনিকা রিসিভার নামিয়ে স্তব্ধ হয়ে বসে রইল। মৃন্ময়ীর কথাগুলি সে মন থেকে কিছুতেই তাড়াতে পারছে না।

ফুলির মা, ফুলির মা?

ফুলির মা দরজার ওপাশ থেকে বলল, জ্বি। সে যায়নি, দরজার পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল। মনিকা ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে রইল। এই মহিলার স্বাস্থ্য ভাল, বয়স কত হবে, চল্লিশ না-কি তারচেও কম? পুরুষ্টু ঠোঁট। বেঁটে। পান খেয়ে ঠোঁট লাল করে রেখেছে। পুরুষরা পুরুষ্টু ঠোঁট পছন্দ করে। ছিঃ এইসব সে কি ভাবছে?

ফুলির মা।

জ্বী।

আচ্ছা ঠিক আছে তুমি সামনে থেকে যাও।

কি বলতে চাইছেন বলেন।

না-কিছু বলব না, তুমি সামনে থেকে যাও।

ফুলির মা গেল না। সামনে দাঁড়িয়ে রইল। মনিকা তীক্ষ্ণ গলায় বলল, যাচ্ছ না কেন?

ফুলির মা বলল, খালি যাও যাও করেন ক্যান আফা? আফনের আব্বার ছিল উল্টা স্বভাব, এক মিনিটের জন্যে সামনে না থাকলে অস্থির হইয়া পড়ত। রোগ শোকে মাইনষের মাথা যায় আউলাইয়া।

ফুলির মা, তুমি সামনে থেকে যাও।

অনিচ্ছায় ফুলির মা ঘর থেকে বের হল। মনিকা সঙ্গে সঙ্গে ডাকল, ফুলির মা শুনে যাও। তুমি বরং এক কাজ কর। তুমি দেশের বাড়িতে চলে যাও। তোমার মেয়ে ফুলির কাছে যাও।

ফুলির কাছে যাব ক্যামনে? সেতো বাইচ্যা নাই।

তাহলে অন্য কোথাও যাও। তোমাকে আমরা রাখব না।

আমি কি করলাম?

তুমি কিছুই করনি–তারপরেও রাখব না। তুমি চলে যাও। শেষ সময়ে বাবার দেখাশোনা করেছ। তার জন্যে অসংখ্য ধন্যবাদ।

দোষ ঘাট কি কিছু করছি আফা?

না, দোষ কিছু করনি। কিন্তু তোমাকে আমার পছন্দ হচ্ছে না।

আফনের পিতা আমায় বড়ই পছন্দ করতেন।

যিনি পছন্দ করতেন, তিনিতো নেই বুঝতে পারছ?

জ্বি।

তোমাকে টাকা পয়সা হিসাব করে দিচ্ছি–তুমি চলে যাও।

ফুলির মা বারান্দায় চলে এল। তার মনটা খারাপ লাগছে। বাড়ি ছেড়ে যেতে হচ্ছে সে জন্যে খারাপ লাগছে না, চিরকাল এক বাড়িতে তাদের মত মানুষ থাকে না। কলমি শাকের মত তাদের জায়গা বদল করতে হয়। তবে তার খুব শখ ছিল সবাইকে চোখের দেখা দেখা। বুড়ো মানুষটার কাছে এদের কথা এত শুনেছে। একটা সুযোগ পাওয়া গেছে দেখার।

বুড়ো মানুষটার শেষকালে কথা বলার রোগে পেয়ে গিয়েছিল। সারাক্ষণ কথা বলত। একটা গল্প শেষ করে আবার সেই গল্প শুরু করত। মনেই থাকত না, এই গল্প সে একটু আগেই বলেছে। বুড়ো হবার কত যন্ত্রণা।

সে ঘুমাতো বুড়ো মানুষটার ঘরে মেঝেতে বিছানা পেতে। ঘুম হত না। মিনিটে মিনিটে ডাকলে কি ঘুম হয়। একেবারে শেষের দিকে লোকটার মনে মৃত্যুভয় ঢুকে গেল। বিছানায় একা ঘুমুতে পারে না। ছেলেমানুষের মত কাঁদে আর বলে, ও ফুলির মা ভয় লাগছে। ও ফুলির মা, ভয় লাগছে।

ভয় কাটানোর জন্যে ফুলির মা শেষ সময়ে বুড়ো মানুষটার বিছানায় উঠে এসেছিল। তার হাত ধরে বসে থাকতো। একটু পর পর বলতো, আমি আছি কোন ভয় নাই। আরাম কইরা ঘুমান।

এইসব কথা মেয়েগুলিকে বলা যাবে না। মেয়েগুলি মনে কষ্ট পাবে। কি দরকার কষ্ট দিয়ে?

ফুলির মা সন্ধ্যার দিকে বাড়ি ছেড়ে নিজের গ্রামের দিকে রওনা হল। তার চেহারা সুখি সুখি। দু’টা পান মুখে দেয়ায় ঠোঁট লাল। কিন্তু তার মনটা বিষণ্ণ। যে লোকটা একা ঘুমুতে ভয় পেত আজ সে একা একা ঠান্ডা একটা ফ্রীজে পড়ে আছে। গোর আজাব শুরু হয়েছে কিনা কে জানে? মানকের নেকের কি এসেছে?

প্রশ্নের জবাব বুড়ো মানুষটা দিতে পারবেতো?

বিছানায় পাশাপাশি শুয়ে মানকের নেকেরের প্রশ্ন এবং উত্তর সম্পর্কে ফুলির মা বুড়ো মানুষটাকে অনেকবারই বলেছে। জীবিত অবস্থায় শেখা বিদ্যা কি মৃত্যুর পর কাজে আসে? কে জানে? জগৎ বড়ই রহস্যময়।

Anuprerona
Anupreronahttps://www.anuperona.com
Read your favourite literature free forever on our blogging platform.
RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here


Most Popular

Recent Comments