Monday, August 18, 2025
Homeথ্রিলার গল্পভৌতিক গল্পভূত নেই? - হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

ভূত নেই? – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

আমি তোমাদের আগে বলেছি, এখনও বলছি, ভূত আর ভগবান নিয়ে তর্কের আজও শেষ হয়নি। যতদিন মানুষের মনে অনুসন্ধিৎসা থাকবে, ততদিন এ বিতর্কের শেষও হবে না।

এ বিষয়ে পৃথিবীর বিদ্বান এবং সাধারণ লোক দুটো মত পোষণ করেন। কেউ বলেন, বিজ্ঞান ভূতের অস্তিত্ব মানে না, কিন্তু বিজ্ঞান কি শেষ কথা? আমাদের সব প্রশ্নের উত্তর বিজ্ঞান দিতে পারে? আবার কেউ বলেন, ভূত নিশ্চয় আছে।

এমন ঘটনা তোমাদের মধ্যে অনেকেই শুনেছ, কিংবা দেখেছ, খ্যাতনামা ডাক্তাররা যে মুমূর্ষু রোগীকে দিনের-পর-দিন চিকিৎসা করেও সারাতে পারে না, এক সামান্য ফকির রোগীর গায়ে হাত বুলিয়ে, কিংবা তার মাথায় একটা রুদ্রাক্ষ ছুঁইয়ে তাকে সম্পূর্ণ নিরাময় করে তুলেছে।

এতে বোঝা যায়, আমাদের লৌকিক জগতের বাইরে আর একটা জগৎ আছে, যেটা ঠিক বিজ্ঞানের নিয়মে চলে না।

তোমরা পরজন্ম সম্বন্ধে অনেক কথা শুনেছ।

সংবাদপত্রেও নিশ্চয় পড়েছ, জাতিস্মর নিয়ে কত আলোচনা হচ্ছে।

সুদূর রাজস্থানে মরুর মধ্য দিয়ে উটের পিঠে চেপে বাপের সঙ্গে ছোটো সাত বছরের ছেলে চলেছে।

হঠাৎ একটা গ্রামের কাছে একটা কুটিরের দিকে হাত দেখিয়ে ছেলে বাপকে বলল—

‘ওই দ্যাখো বাবা, ওই আমার বাড়ি। ওখানে আমার আত্মীয়স্বজন সবাই আছে।’

বাপ প্রথমে কড়া ধমক দিল ছেলেকে, কিন্তু তাকে নিরস্ত করা গেল না। তার মুখে এক কথা—

‘ওখানে আমার বুড়ো বাপ রয়েছে, বউ চন্দ্রা রয়েছে, ছোটো ভাই এক ভোর বেলা পিছন থেকে ধাক্কা দিয়ে আমাকে কুয়োর মধ্যে ফেলে দেয়। তুমি চলোই-না ওখানে।’

কৌতূহলের বশবর্তী হয়ে বাপ সেই কুটিরের সামনে গেল।

দাওয়ার ওপর এক বৃদ্ধ হাঁপাচ্ছে। একটি বউ জল তুলছে কুয়ো থেকে।

ছেলেটি উট থেকে নেমে হনহন করে বৃদ্ধের সামনে গিয়ে দাঁড়াল।

‘বাবা, আমি কেশোপ্রসাদ। তোমার বড়ো ছেলে।’

দু-চোখের ওপর কোঁচকানো মাংসের স্তর নেমেছে। দৃষ্টিশক্তি ক্ষীণ।

বৃদ্ধ ঝুঁকে পড়ে দেখে বলল, ‘দিল্লাগি করতে এসেছ! আমার ছেলে আজ আট বছর মারা গেছে। ভোর বেলা কূয়ো থেকে জল তুলতে গিয়ে পা পিছলে পড়ে গিয়েছিল কুয়োর মধ্যে।’
ছেলেটি বলল, ‘না, পা পিছলে যায়নি। মাধোপ্রসাদ তাকে ঠেলে দিয়েছিল। তার মতলব ছিল আমি না থাকলে বজরার খেত, বাড়িঘর সবই সে পাবে।’

যে বউটি জল তুলছিল, সে ছেলেটির কথায় আকৃষ্ট হয়ে কাছে এসে দাঁড়াল।

তার দিকে চোখ পড়তেই ছেলেটি চেঁচিয়ে উঠল, ‘আরে চন্দ্রা, আমি কেশোপ্রসাদ, তোমার মরদ।’

চন্দ্রার বয়স বছর ত্রিশের কম নয়। সে সাত বছরের স্বামীকে দেখে হেসে ফেলল। চোখের কোণে একটু জলও দেখা গেল।

বলল, ‘পাগল কোথাকার!’

ছেলেটির বর্তমান বাপ একটু পিছনে দাঁড়িয়ে ছিল। এবার সে এগিয়ে এসে বলল, ‘কী ঝামেলা করছিস? দেরি হয়ে যাচ্ছে, চল।’

ছেলেটি যাবার কোনো লক্ষণই দেখাল না। দাওয়ার ওপর বসে পড়ে বলতে লাগল—

কোন ঘরে সে শুত, সে ঘরে কী আসবাব আছে, বজরার খেতের পরিমাণ কত, বাপের দু-বার সাংঘাতিক অসুখ করেছিল, বিকানির থেকে সেই-ই হাকিম নিয়ে এসেছিল।

আরও অনেক কথা সে বলল।

সে কোন গাঁয়ে বিয়ে করেছিল। চন্দ্রার বাপের নাম কী। এমনকী বিয়ে করে বউকে নিয়ে যখন ফিরছিল, তখন মাঝপথে তুমুল বালির ঝড় উঠেছিল। সে আর চন্দ্রা সারা দেহ আবৃত করে উটের পেটের নীচে আশ্রয় নিয়ে নিজেদের বাঁচিয়েছিল।

চন্দ্রা আর চন্দ্রার শ্বশুর তো অবাক!

সাত বছরের ছেলে এত সব কথা জানল কী করে?

এবার ছেলেটি জিজ্ঞাসা করল, ‘মাধোপ্রসাদ তো আর নেই?’

‘না, তাকে খেতের মধ্যে সাপে কামড়েছে। তুই যাবার এক বছরের মধ্যেই।’

ছেলেটি যাবার মুখেই বাধা।

চন্দ্রা তাকে জড়িয়ে ধরে ভেউ ভেউ করে কান্না।

সে তাকে ছেড়ে দেবে না।

ছেলেটি বলল, ‘আমার নবজন্ম হয়েছে। নতুন আমির ওপর তোমাদের কোনো দাবি নেই। আমার বাবা আছে, মা আছে, দাদারা আছে। সে সংসারে ফিরে যেতেই হবে। এই নিয়ম।’

ছেলেটি বাপের সঙ্গে আবার উটের পিঠে চাপল।

তবে মাঝে মাঝে সে পুরানো সংসারেও আসত।

এই ছেলেটি জাতিস্মর।

আগের জন্মের কথা তার সব মনে আছে।

বিজ্ঞান এর কী ব্যাখ্যা দেবে?

খবর পেয়ে বিখ্যাত এক গবেষক ছেলেটির কাছে গিয়েছিলেন। তাকে নানাভাবে পরীক্ষা করেছিলেন।

শেষে এই সিদ্ধান্তে এসেছিলেন যে, এর মধ্যে কোনো কারচুপি নেই। ছেলেটির সত্যিই আগের জন্মের সব কথা মনে আছে।

এইরকম জাতিস্মরের কাহিনি ইদানীং অনেক শোনা যায়।

শুধু ভারতবর্ষে নয়, পৃথিবীর অন্যান্য দেশেও।

ঠিক এমনিভাবে ভূতের কাহিনিও সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে আছে।

আজ তোমাদের এমনই এক ভূতের কাহিনি শোনাচ্ছি।

এ কাহিনির সঙ্গে আমি কিছুটা জড়িত, কাজেই এটা যে নির্ভেজাল সত্যি কাহিনি এ বিষয়ে তোমাদের কাছে আমি হলফ করে বলতে পারি।

আমার একজন খুব নিকট আত্মীয়া, নাম আরতি বন্দ্যোপাধ্যায় এম. এ. বি. এড কিন্তু ওকালতি করে না। বেসরকারি অফিসের আইন বিভাগের উচ্চপদস্থ অফিসার।

থাকত পাইকপাড়ায়। এক বান্ধবীর সঙ্গে একটি ফ্ল্যাট নিয়ে।

বান্ধবীটি এক স্কুলের শিক্ষিকা।

জীবন দু-জনের বেশ ভালোই কাটছিল। ছুটির দিন সিনেমা, কিংবা আরও অনেক বান্ধবী মিলে বনভোজন অথবা গড়ের মাঠে প্রদর্শনী দেখতে যাওয়া।

হঠাৎ আরতির বিয়ে ঠিক হল।

পাত্রও উচ্চশিক্ষিত। এক যন্ত্রপাতির কারখানার আধা মালিক।

আরতি আমার কাছে এসে দাঁড়াল।

‘আপনি তো অনেক কিছুর সন্ধান রাখেন। আমাকে একটা বাড়ি খুঁজে দিন।’

জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কি, কিনবে?’

‘না, না, ভাড়া নেব। খুব বড়ো দরকার নেই। দু-জনের থাকবার মতন। একটু যেন ভালো এলাকায় হয়, আর দক্ষিণ কলকাতায় দেখবেন, কারণ ওর কারখানাটা কালীঘাটে।’

আমি নিজে থাকি বালিগঞ্জে। একেবারে লেকের কাছে।

পরদিন থেকেই বাড়ি খোঁজা শুরু করে দিলাম। শুধু নিজে নয়, গোটা দুয়েক দালালকেও লাগিয়ে দিলাম।

অনেক বাড়ির সন্ধান এল। কিছু নিজে, কিছু আরতিকে সঙ্গে নিয়ে বাড়ি দেখতে লাগলাম।

আরতি ভারি খুঁতখুঁতে মেয়ে। কোনো বাড়িই তার পছন্দ হল না। কোনো-না-কোনো কারণে সব নাকচ করে দিল।

তিন মাস ঘোরাঘুরির পর কালীঘাট অঞ্চলে এক বাড়ির সন্ধান মিলল।

পার্কের সামনে প্রায় নতুন বাড়ি। সদ্য রং করা হয়েছে। খান তিনেক কামরা। বারান্দা, বাথরুম, আবার ওরই মধ্যে এক ফালি উঠানও আছে।

সেই অনুপাতে ভাড়াও খুব বেশি নয়। দু-শো কুড়ি।

বাড়ির মালিক পাশের বাড়িতেই থাকেন।

এ বাড়ি আরতির পছন্দ হয়ে গেল।

শুধু আরতির নয়, আরতির স্বামী আশিসেরও।

আর দেরি না-করে সেদিনই দু-মাসের ভাড়া আগাম দেওয়া হল।

মাস খানেক পর আরতির বাসায় বেড়াতে গিয়ে খুব ভালো লাগল।

নতুন আসবাবপত্র দিয়ে চমৎকার সাজিয়েছে।

উঠানের পাশে সারি সারি টব।

দেশি ফুল বেল, জুঁই যেমন আছে, তেমনি বিদেশি ফুল ডালিয়া, পাপি, হলিহকও রয়েছে।

এমন বাসা খুঁজে দেবার জন্য আরতি আশিস দু-জনেই আমাকে বার বার ধন্যবাদ দিল।

এরপর অনেক দিন আর আরতির সঙ্গে দেখা হয়নি।

অফিসের কাজে দিল্লি যেতে হয়েছিল, সেখানে মাস তিনেক কাটিয়ে কানপুর। সেখানেও এক মাসের ওপর লেগে গেল।

কলকাতা ফিরলাম প্রায় পাঁচ মাস পর।

এক ছুটির দিনে বন্ধুবান্ধব নিয়ে গল্প করছি, আরতি এসে ঢুকল।

প্রথম নজরেই মনে হল, তার চেহারা একটু যেন ম্লান।

আরতি ভিতরে চলে গেল।

বন্ধুরা বিদায় হতে আমিও ভিতরে গেলাম।

দেখলাম, আরতি চুপচাপ সোফার ওপর বসে আছে।

আমাকে দেখে বলল, ‘আপনার সঙ্গে কথা আছে।’

‘কী বলো? শরীর খারাপ নাকি? চেহারাটা কেমন দেখাচ্ছে।’

আরতি মুখ তুলে বলল, ‘রাত্রে একেবারে ঘুম হচ্ছে না।’

‘সে কী? ডাক্তার দেখাও, নইলে শক্ত অসুখে পড়ে যাবে।’

‘ডাক্তার কিছু করতে পারবে না।’

‘তার মানে?’

‘মানে, বাড়িটা ভালো নয়।’

‘সে কী, স্যাঁতসেঁতে বা অন্ধকার এমন তো নয়। রোদ বাতাস প্রচুর।’

‘সে সব কিছু নয়, অন্য ভয় আছে।’

‘আমি ঠিক বুঝতে পারছি না।’

আরতি কিছুক্ষণ কী ভাবল, তারপর আস্তে আস্তে বলল, ‘ও বাড়িতে আমরা দু-জন ছাড়াও অন্য একজন আছে।’

‘অন্য একজন আছে?’

‘হ্যাঁ, তাকে মাঝে মাঝে গভীর রাতে দেখা যায়।’

অন্য লোক হলে কথাটা হেসে উড়িয়ে দিত। শুনতেই চাইত না।

কিন্তু আমি মৃত্যুর পরে আত্মার অস্তিত্বে বিশ্বাসী। আমার স্থির ধারণা, যারা অতৃপ্ত কামনা-বাসনা নিয়ে এ পৃথিবী ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়, তারা আবার ফিরে আসে। কখনো বায়বীয় মূর্তি, কখনো মানুষের রূপ ধরে ফেলা-যাওয়া সংসারের মাঝখানে ঘুরে বেড়ায়।

‘কী ব্যাপার খুলে বলোতো।’

‘বলছি।’

আরতি কোলের উপর রাখা ভ্যানটি ব্যাগটা পাশে নামিয়ে রাখল। সহজ হয়ে বসে বলতে লাগল—

মাস দুয়েক আগে হঠাৎ খুটখাট শব্দে ঘুম ভেঙে গেল। মনে হল বাইরের ঘরে যেন কার পায়ের আওয়াজ।

আশিস পাশেই শুয়েছিল। তার ঘুমের বহর তো জানোই। বুকের ওপর দিয়ে এক ব্যাটালিয়ন সৈন্য চলে গেলেও তার ঘুম ভাঙবে না।

কাজেই তাকে ডাকার চেষ্টা না-করে নিজেই উঠে পড়লাম।

ভীতু এ বদনাম কেউ দিতে পারবে না। বরং সবাই জানে আমি রীতিমতো সাহসী।

প্রথমে জানলা দিয়ে দেখলাম। কিছু দেখা গেল না। কিন্তু খুটখাট শব্দ ঠিক চলতে লাগল। মনে হল, খড়ম পায়ে কে যেন পায়চারি করছে!

অথচ কোনো লোককে দেখা গেল না।

রাতে মাংস রান্না হয়েছিল। হাড়ের টুকরো রান্নাঘরে প্লেটের ওপর পড়েছিল। খুব সম্ভবত ইঁদুর সেই হাড়ের টুকরো বাইরের ঘরে নিয়ে এসেছে।

কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে আবার বিছানায় এসে শুয়ে পড়লাম।

তখনই ঘুম এল না। একবার ঘুম ভেঙে গেলে চট করে ঘুম আমার আসে না। এপাশ-ওপাশ করতে লাগলাম। পাশের লোকটি অকাতরে নিদ্রা যাচ্ছে। নাক দিয়ে বিচিত্র ধ্বনি বের হচ্ছে।

ঘরে হালকা সবুজ রঙের একটা বাতি জ্বলছিল। অন্ধকারে আমি ঘুমাতে পারি না। এ আমার ছেলেবেলার অভ্যাস। হঠাৎ দেখলাম দীর্ঘ একটা ছায়া আলোকে আড়াল করে এ ঘর থেকে অন্য ঘরে চলে গেল।

চমকে উঠে বসলাম।

আশিসকে ডেকে বললাম, ‘এই ওঠো ওঠো, ঘরের মধ্যে কে ঢুকেছে!’

আশ্চর্য মানুষ! চোখ খুলল না। পাশ ফিরতে ফিরতে বলল, ‘ফ্লিট দিয়ে দাও।’

ছায়াটা সরে সরে বাইরের দেয়ালের সঙ্গে মিশে গেল। আর দেখা গেল না।

আমি তখন বিছানার ওপর উঠে বসেছি। মনকে বোঝালাম, এ শুধু চোখের ভুল। তা না হলে, ছায়া দেখা গেল, অথচ মানুষটাকে দেখা গেল না, তা কি হতে পারে?

ভূতের কথা ভাবতেও পারিনি, কারণ ভূত আছে এমন অদ্ভুত কথা আমি কোনোদিনই বিশ্বাস করি না।’

আমি খুব মনোযোগ দিয়ে আরতির কথা শুনছিলাম।

এবার বললাম, ‘তারপর?’

‘তার পর দিন সব স্বাভাবিক। কোনো গোলমাল নেই। সে রাত্রে ভয় পেয়েছিলাম ভেবেই হাসি পেত। একেবারে ছেলেমানুষি কাণ্ড!

আশিস কারখানার কাজে দিন চারেকের জন্য জামসেদপুরে গিয়েছিল। বাড়িতে আমি একলা।

মাঝরাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল।

এবারে একেবারে স্পষ্ট দেখলাম।

দীর্ঘ একহারা চেহারা। খালি গা। কাঁধের ওপর ধবধবে সাদা উপবীত। কোঁচাটা ভাঁজ করে সামনে গোঁজা। মাথায় পাকা চুল। দুটি চোখ জবাফুলের মতন লাল। গালে খোঁচা খোঁচা দাড়ির মধ্যে দিয়ে উঁচু চোয়াল দেখা যাচ্ছে।

লোকটির ঊর্ধ্ব দৃষ্টি। হাতে শক্ত একটা দড়ি। ওপর দিকে কী যেন খুঁজছে!

সেই মুহূর্তে শরীরের সব রক্ত জমে হিম শীর্ত হয়ে গেল! দু-হাতে বুকটা চেপে ধরেও দ্রুত স্পন্দন কমাতে পারলাম না। মনে হল, তখনই হার্টফেল করবে।

বিকৃতকণ্ঠে বললাম, ‘কে, কে ওখানে?’

লোকটি ওপর থেকে দৃষ্টি নামিয়ে আমার দিকে দেখল।

জ্বলন্ত দৃষ্টি— পলকহীন!

সারা গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল!

তখনই মনে হল লোকটা এ জগতের কেউ নয়। অশরীরী আত্মা। আস্তে আস্তে লোকটা পাশের ঘরে ঢুকে গেল।

আমি খাট থেকে নামলাম, কিন্তু তার পিছনে যাবার সাহস হল না।’

এই কথাগুলো বলবার সময়ে দেখলাম আরতির মুখ-চোখ ফ্যাকাশে হয়ে গেছে।

আমি বললাম, ‘এরকম যখন ব্যাপার, তখন না হয় ও বাড়ি ছেড়ে দাও। অন্য কোথাও বাড়ি খুঁজি।’

আরতি উত্তর দিল, ‘তাতেই তো মুশকিল! আপনি বোধ হয় লক্ষ করেননি, বাড়ির দেয়াল ভেঙে চুরে আমি দুটো ঘর বানিয়েছি। বাইরেটা চুনকাম করেছি, ভিতরে রং দিয়েছি, গ্যাস বসাবার জন্য রান্নাঘরেও অনেক বদল করেছি। অবশ্য এসব বাড়িওয়ালার মত নিয়েই করেছি। ভাড়া থেকে মাসে মাসে কিছু করে টাকা কেটে রাখছি। সে টাকা শোধ হতে বছর দুয়েক লাগবে। তার আগে বাড়ি ছেড়ে দিলে আমার অনেক টাকা লোকসান হয়ে যাবে।’

একটু ভেবে আমি বললাম, ‘ঠিক আছে, আমি একবার তোমার বাড়িওয়ালার সঙ্গে দেখা করব। তিনি কী বলেন, শুনি।’

দিন দুয়েকের মধ্যেই বাড়িওয়ালার কাছে গিয়ে হাজির হলাম।

ঘোরতর কৃষ্ণবর্ণ, বিপুলকায়। কলকাতায় কিছু বাড়ি আছে, কাঠের ব্যাবসা।

একটা ইজিচেয়ারে বসেছিল। আমাকে দেখে ওঠবার চেষ্টা করল, পারল না।

‘কী খবর? আমার কাছে হঠাৎ?’

আরতির কাছে শোনা সব কিছু বললাম। শেষকালে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘ঠিক করে বলুন তো? ও বাড়িটার কোনো দোষ আছে?’

‘দোষ মানে?’

‘মানে, কেউ ওবাড়িতে অপঘাতে মারা গিয়েছিল? আগের কোনো ভাড়াটে?’

বাড়িওয়ালা মাথা নাড়ল, ‘না মশাই, এর আগে মাত্র দু-ঘর ভাড়াটে ছিল। অপঘাত তো দূরের কথা, এমনই মৃত্যু কারও হয়নি। তা ছাড়া এই বিজ্ঞানের যুগে মানুষ যখন পায়চারি করার জন্য চাঁদে যাচ্ছে, তখন কি সব ভূত-প্রেতের কাহিনি আমদানি করছেন?’

তর্ক করলাম না। অনেক বিষয় আছে তর্ক করে বোঝানো যায় না। স্থূল উদাহরণ দেওয়া সেখানে সম্ভব নয়।

চলে এলাম।

তারপর মাস দুয়েক আরতির কোনো খবর নেই।

আমিও নিশ্চিন্ত। যাক, অপদেবতার উপদ্রব আর নেই। সব শান্ত।

কিন্তু আমার ধারণা ভুল প্রমাণ করে একদিন সকালে আশিস এল।

কোটরগত চোখ, বিবর্ণ মুখ, ঘোলাটে দৃষ্টি।

বললাম, ‘কি হে শরীর খারাপ নাকি? আরতি কেমন আছে?’

আমার কথার উত্তর না-দিয়ে আশিস অস্পষ্ট গলায় বলল, ‘একটু জল দিন।’

জল শুধু খেল না, মুখ-চোখে দিল। তারপর বলল, ‘আরতিকে টালিগঞ্জে তার দিদির বাড়ি দিয়ে এসেছি। কালীঘাটের বাড়িতে আর আমাদের থাকা চলবে না!’

‘কেন, কী হল?’

‘আরতির কাছে তো আপনি কিছু কিছু শুনেছেন। আমি কিন্তু এ পর্যন্ত কিছু দেখিনি। কোনো শব্দও শুনিনি। সেইজন্য এতদিন আমি আরতিকে ঠাট্টা করতাম। তা ছাড়া ভূত, আত্মা এসবে আমার কোনোদিনই কোনো বিশ্বাস নেই।

কাল একটা কাজে হাওড়ায় আটকে পড়েছিলাম। বাস বন্ধ। ট্যাক্সিও পাই না। কিছুটা হেঁটে তারপর ট্রামে বাড়ি পৌঁছোতে প্রায় বারোটা হয়ে গিয়েছিল।

আরতি খুব চিন্তিত হয়ে পড়েছিল।

যাক, আরতিকে খাবার সাজাতে বলে আমি হাত-মুখ ধোবার জন্য বাথরুমে ঢুকে পড়লাম।

নীচু হয়ে বেসিনে মুখ ধুয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াতেই মাথায় ঠক করে কী-একটা লাগল। বাথরুমে আবার কে কী রাখল!

একটু কমজোর বাতি। কিন্তু সেই বাতিতেই দেখতে কোনো অসুবিধা হল না।

ঠান্ডা একটা বরফের স্রোত আমার মেরুদণ্ড বেয়ে নেমে গেল!

বাথরুমটা অ্যাসবেস্টসের ছাউনি দেওয়া। আগে টালির ছাদ ছিল, আমরাই খরচ করে অ্যাসবেসটস দিয়ে নিয়েছিলাম। ওপরে দুটো কাঠের কড়ি।

একটা কড়িতে দেহটা ঝুলছে!

গলায় দড়ির ফাঁস। মাথাটা একদিকে কাত হয়ে পড়েছে। দুটো চোখ আধবোজা। জিভটা অনেকখানি বের হয়ে গেছে। বোধ হয় জিভের ওপর দাঁতের চাপ পড়েছিল, তাই জিভ কেটে রক্তের ফোঁটা ঝরে পড়েছে। কিছুটা দেহের ওপর, কিছুটা মেঝেতে। পরনে আধময়লা, ধুতি, কাঁধে পৈতে।

মাথা উঁচু করার সময় ঝুলন্ত দেহের একটা পা আমার মাথায় ঠেকে গিয়েছিল।

আমি সবকিছু ভুলে ”আরতি” বলে চেঁচিয়ে উঠেছিলাম।

আরতি আমার অপেক্ষায় খাবার টেবিলে বসেছিল। আমার চিৎকারে ছুটে এসে বাথরুমের দরজার কাছে দাঁড়িয়েছিল। প্রথমে সে সঠিক কিছু বুঝতে পারেনি। তারপর ওপর দিকে চোখ যেতেই ”ও মাগো বলে” মেঝের ওপর ছিটকে পড়ে অজ্ঞান।

আরতির মুখে জলের ঝাপটা দিয়ে কোনোরকমে জ্ঞান ফিরিয়ে আনলাম। তারপর বাকি রাতটা দু-জনে বাইরের ঘরে বসে কাটালাম।

ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে প্রথমে ট্রামে উঠে আরতিকে নিয়ে যখন তার দিদির বাড়ি এলাম, তখন জ্বরে আরতির গা পুড়ে যাচ্ছে। দুটো চোখ করমচার মতন লাল।’

আমি চুপ করে সব শুনলাম।

আশিসের কথা শেষ হতে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘আরতি এখন কেমন আছে?’

‘খুব ভালো নয়। বিকারের ঘোরে মাঝে মাঝে চেঁচিয়ে উঠছে, ”ওই লোকটা, ওই লোকটাই তো ঘুরে বেড়াচ্ছিল দড়ি হাতে। আমি এখানে থাকব না। আমাকে অন্য কোথাও নিয়ে চলো”।’

অবশ্য আরতির জন্য খুব চিন্তা নেই। ভয়টা কেটে গেলেই ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু সবকিছু নিজের চোখে দেখবার দারুণ ইচ্ছা হল।

এমন তো নয়, একসময় দরজা খোলা পেয়ে বাইরের কোনো লোক বাড়ির মধ্যে ঢুকে পড়ে আত্মহত্যা করেছে? সে হয়তো আত্মহত্যা করবার নির্জন একটা জায়গা খুঁজছিল।

তাই আশিসকে বললাম, ‘চলো একবার নিজের চোখে দেখে আসি। তা ছাড়া, তোমরা ব্যাপারটাকে ভৌতিক ভাবছ, তা তো নাও হতে পারে। পুলিশে খবর দেওয়াও তোমাদের একটা কর্তব্য। তারা এসে মৃতদেহের ভার নেবে।’

আশিস আমার সঙ্গে চলল।

তালা খুলে ভিতরে ঢুকলাম।

বাথরুমের মধ্যে গিয়ে অবাক হয়ে গেলাম। কোথাও কিছু নেই, সব পরিষ্কার।

আশিসকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কই হে? কোথায় তোমার ঝুলন্ত দেহ? রক্তের একটি ফোঁটাও তো কোথাও দেখছি না।’

আশিস রীতিমতো অপ্রস্তুত।

‘সব চোখের ভুল, বুঝলে?’

আশিস মাথা নাড়ল।

‘কিন্তু দু-জনেই ভুল দেখলাম?’

‘ওরকম হয়। একজনের ভয়, আর একজনের মধ্যে সঞ্চারিত হয়ে তাকেও এক ধরনের কাল্পনিক দৃশ্য দেখায়। তুমিই দেখ-না, কাল রাতে তুমি যদি সত্যিই ওরকম একটা দৃশ্য দেখে থাক, তাহলে আজ কোথাও কিছু নেই, তা কি হতে পারে? এইখানটাই তো দেখেছিলে?’

মুখ তুলে ওপরের দিকে দেখেই আমি থেমে গেলাম।

‘কী আশ্চর্য, এটা তো আগে দেখিনি!’

কড়ির সঙ্গে একটা মোটা দড়ি বাঁধা। দড়িটা ফাঁসের আকারে ঝুলছে!

অস্বীকার করব না, আমার হাত-পা বেশ ঠান্ডা হয়ে গেল। বুকের দাপাদাপির জেরে ভয় হল, স্পন্দন থেমে না-যায়।

এ দড়ির ফাঁস তো প্রথম বার দেখিনি! আরও অবাক কাণ্ড, দড়ির ফাঁসটা অল্প অল্প দুলছে, অথচ কোথাও বাতাস নেই। বাইরে বাতাস থাকলেও বাথরুমে বাতাস ঢোকবার কোনো সুযোগ নেই।

আশিসের সঙ্গে বেরিয়ে এলাম।

এটা যে ভৌতিক ব্যাপার নয়, কোনো মানুষের কারসাজি তা হওয়াও অসম্ভব নয়। কোনো যুক্তিতর্ক বিস্তার করেও সমাধান করতে পারলাম না।

আরতিরা আর ও বাড়িতে ফিরে যায়নি। ভবানীপুরে একটা বাড়ি ঠিক করে উঠে গিয়েছিল। আর্থিক লোকসান সত্ত্বেও।

এ ঘটনার প্রায় মাস তিনেক পর এক বিকেলে কালীঘাট পার্ক দিয়ে যাচ্ছি, হঠাৎ আরতির বাড়িওয়ালার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। একটা বেঞ্চে বসে আছে।

আমি তার পাশে বসে পড়ে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘মশাই, সত্যি কথা বলুন তো, বাড়িটার কী রহস্য? আমার আত্মীয়াটি তো থাকতে পারল না, পালাল।’

প্রথমে কিছুতেই বলবে না। অবশেষে আমার পীড়াপীড়িতে বলল—

‘এক বুড়ো ভদ্রলোক ওই বাড়িতে আত্মহত্যা করেছিল। তা প্রায় বছর দশেক আগে। পেটে শূলবেদনা ছিল। বাড়ির সবাই নিমন্ত্রণ খেতে বাইরে গিয়েছিল, তখন বাথরুমে বুড়ো গলায় দড়ি দেয়। তারপর থেকে যে ভাড়াটে আসে, তারাই ভয় পায়। বেশিদিন থাকতে পারে না।’

আমি বললাম, ‘গলায় পিণ্ডদানের ব্যবস্থা করেননি কেন?’

‘করার চেষ্টা করেছি মশাই, অনেক বার করেছি। প্রত্যেক বার এক-একটা বিপদ! বুড়োর আত্মীয়রা গয়া গিয়েছিল পিণ্ড দিতে, তিনদিন ধরে দারুণ ঝড়বৃষ্টি। ধর্মশালা থেকে বের হতেই পারল না।

আমি নিজে একবার গিয়েছিলাম। ট্রেন থেকে স্টেশনে নামতে গিয়ে পা পিছলে পড়ে একমাস হাসপাতালে শয্যাগত।

পুরোহিত দিয়ে শান্তিস্বস্ত্যয়নের আয়োজন করার চেষ্টা করেছিলাম। সেখানেও বিপত্তি।

পুরোহিত আসনে বসবার সঙ্গে সঙ্গে ছাদ ভেঙে একটা চাঙড় তার মাথায় পড়ল। পুরোহিত জ্ঞান হারিয়ে মেঝের ওপর লুটিয়ে পড়ল।

ব্যস, তারপর থেকে আর কোনো পুরোহিতই আসতে রাজি হল না। কী করি বলুন তো?’

এর উত্তর আমার জানা ছিল না। কাজেই সেদিন বাড়িওয়ালার প্রশ্নের কোনো উত্তর দিতে পারিনি।

একটা কথা শুধু মনে হয়েছে, পৃথিবীর সব অবিশ্বাসী মানুষদের জড় করে চিৎকার করে বলি, যাঁরা মনে করেন, মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই সবকিছু শেষ হয়ে যায়, প্রেতযোনি বলে কিছু নেই, তাঁরা কালীঘাট অঞ্চলের এই বাড়িটায় রাত কাটিয়ে যান। বাড়িটা এখনও খালি।

ঠিকানা আমার কাছ থেকে সংগ্রহ করে নিয়ে যাবেন। অবশ্য আমি, ভালো-মন্দ হয়ে গেলে কোনোকিছুর জন্য দায়ী থাকব না। এই মর্মে আমাকে একটা লিখিত চুক্তিপত্র দিতে হবে।

Anuprerona
Anupreronahttps://www.anuperona.com
Read your favourite literature free forever on our blogging platform.
RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here


Most Popular

Recent Comments