Sunday, September 14, 2025
Homeবাণী ও কথাঅনুবাদ গল্পপ্রতিশোধ - আর্থার কোনান ডয়েল

প্রতিশোধ – আর্থার কোনান ডয়েল

আচ্ছা, বার্গার, তুমি কেন আমাকে বিশ্বাস করে সবকিছু খুলে বলছ না?

কথা হচ্ছিল দুই বন্ধুর মধ্যে–একজনের নাম কেনেডি, অন্যজন বার্গার। শীতের সন্ধ্যায় রোম শহরে কেনেডির বসার ঘরে। বাইরে আলোয় ঝলমলে আধুনিক রোম। জনবহুল রাস্তা, গাড়িঘোড়া চলছে, হোটেল-রেস্তোরাঁয় আলোর বাহার। কিন্তু কেনেডির ঘরে প্রাচীন রোমের বিভিন্ন স্মৃতিচিহ্নের সমারোহ। কেনেডির আসল বাড়ি ব্রিটেনে–পেশায় ও নেশায় পুরাতত্ত্ববিদ। ঘরের একটি দেওয়ালে ঝুলছে প্রাচীন রোমের একটি দেওয়ালচিত্রের অংশবিশেষ। এদিক-ওদিকে রাখা পুরোনো আমলের কিছু আবক্ষ মূর্তি– রোমান সেনেটর ও যোদ্ধাদের। ঘরের সেন্টার টেবিলের ওপর পুরোনো রোমের জন-স্নানাগারের একটা ছোট সংস্করণ রাখা আছে। এ ছাড়া ঘরের বিভিন্ন জায়গায় ছড়ানো পুরোনো রোমের টুকিটাকি স্মৃতিচিহ্ন–শিলালিপির টুকরো, গয়না, বাসনপত্র ইত্যাদি। সবই প্রত্নতাত্ত্বিক খননকার্যের সময়ে উদ্ধার করা। এমনকী সিলিং-এ ঝোলানো একটা অতি প্রাচীন ফুলদানি। প্রতিটি জিনিসই প্রামাণ্য এবং দুর্লভ। অর্থ দিয়ে এগুলির দাম নিরুপণ করা যায় না।

কেনেডির বয়স ত্রিশের সামান্য বেশি, কিন্তু এই অল্পবয়সেই পুরোনো রোমের ওপর পুরাতাত্ত্বিক গবেষণায় তার নাম সারা ইউরোপে ছড়িয়ে পড়েছে। ধনী পরিবারের সন্তান হিসেবে আর্থিক স্বচ্ছলতার জন্য কেনেডি মাঝে-মাঝে একটু আধটু পয়সা উড়িয়ে ফুর্তি করলেও তার বুদ্ধি এত তীক্ষ্ণ এবং প্রত্নতত্ত্বের প্রতি ভালোবাসা এত তীব্র যে, সে দীর্ঘসময় নিবিষ্টচিত্তে গবেষণার কাজে ব্যস্ত থাকে। কেনেডি বেশ সুপুরুষ কপাল চওড়া, নাকটি তীক্ষ্ণ। মুখে যুগপৎ দৃঢ়তা ও দুর্বলতার ছাপ।

কেনেডির বন্ধু জুলিয়স বার্গার কিন্তু সম্পূর্ণ অন্য ধরনের মানুষ। বার্গারের বাবা জার্মান, মা ইটালিয়ান। জার্মানির শারীরিক শক্তি ও কঠোরতার সঙ্গে ইটালির কমনীয়তা এই বৈপরীত্যের সমাবেশ বার্গারের ব্যক্তিত্বে। তার চেহারায় প্রথমেই চোখে পড়ে তার নীল চোখ, বিশাল কপাল ও সোনালি চুল। সেই সঙ্গে নজরে পড়ে তার রোদে জ্বলা গায়ের রং। সব মিলিয়ে বাগারকে দেখলে পুরোনো রোমের আবক্ষ মূর্তিগুলির মুখাবয়ব মনে পড়ে যায়। বার্গারের সরল হাসি আর স্বচ্ছ দৃষ্টি অবশ্যই ওর বংশপরিচয়ের ইঙ্গিতবাহী। বয়স ও খ্যাতিতে বার্গার কেনেডির সমকক্ষ, কিন্তু লক্ষণীয় কৃপা না পাওয়ায় তাকে অনেক কষ্ট করে ওপরে উঠতে হয়েছে। বারো বছর আগে জার্মানির বনবিশ্ববিদ্যালয়ের সামান্য একটা বৃত্তি নিয়ে ও বোমে এসেছিল। তারপর এত বছর ধরে অনেক কৃচ্ছসাধন করে ধীরে ধীরে পুরাতত্ত্বে খ্যাতিলাভ করে ও আজ বার্লিন আকাঁদেমির একজন সদস্য। কিন্তু পুরাতত্ত্বের বাইরে অন্য সমস্ত ব্যাপারে, বিশেষ সামাজিক আদবকায়দায়, বার্গার ধনী কেনেডির থেকে অনেক নীচে। নিজের পড়াশোনার বিষয়ে কথা বলতে গেলে ওর মুখমণ্ডল উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে, কিন্তু বাকি সব ব্যাপারেই বার্গার চুপচাপ ও মুখচোরা গোছের।

চারিত্রিক বৈপরীত্য সত্ত্বেও গত কয়েক বছরে এদের দুজনের মধ্যে বন্ধুত্ব ক্রমশ গাঢ় হয়েছে। দুজনেই পরস্পরের পেশাগত দক্ষতার ব্যাপারে শ্রদ্ধাশীল। বার্গারের সহজ সরল ব্যবহারে মুগ্ধ হত কেনেডি। আবার কেনেডির প্রাণপ্রাচুর্য, উচ্ছলতা ও রোমের হাই-সোসাইটিতে ওর অবাধ বিচরণ বার্গারের ভালো লাগত। আপাতত একটা কারণে দুজনের সম্পর্কের ওপর একটু কালো ছায়া দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। তার কারণ একটা গুজবকেনেডি নাকি একটি মেয়ের সঙ্গে অত্যন্ত নিষ্ঠুর ও হৃদয়হীন ব্যবহার করেছে। রোমের অনেকেই খানিকটা কৌতূহলবশত এবং খানিকটা ঈর্ষার জন্য এই ঘটনাটি নিয়ে কানাঘুষো করছিল।

–আচ্ছা বার্গার। তুমি কেন আমাকে বিশ্বাস করে সবকিছু খুলে বলছ না? বার্গারের শান্ত মুখের দিকে চোখ রেখে ও মেঝের কার্পেটের দিকে আঙুল দেখিয়ে কেনেডি আবার একই কথা বলল। কার্পেটের একধারে একটা লম্বামত বেতের ঝুড়ি রয়েছে। তাতে নানা জিনিস। যেমন টালির টুকরো, শিলালিপির ভগ্নাবশেষ, মরচে-ধরা পুরোনো গয়না, ছেঁড়া প্রাচীন কাগজ ইত্যাদি। জিনিসগুলি দেখলে প্রথমেই মনে হবে এগুলি কোনও ডাস্টবিন থেকে কুড়িয়ে আনা। কিন্তু পুরাতাত্ত্বিকের চোখে এগুলি অতি দুর্লভ মহার্ঘ বস্তু। জিনিসগুলি কেনেডির ঘরে এনেছে বার্গার।

লোভে চকচক করছিল কেনেডির চোখ। ও আবার বলল,–তোমার এই অমূল্য রত্নভাণ্ডারে আমি ভাগ বসাচ্ছি না। কিন্তু তোমার এই আবিষ্কার একেবারে প্রথম সারির। পুরো ইউরোপে সাড়া পড়ে যাবে। কিন্তু কোথায় পেলে এসব আমায় বলবে না?

একটা চুরুট ধরিয়ে বার্গার বলল,–এখানে যা দেখছ, তা কিছুই নয়। আমার আবিষ্কৃত জায়গায় বারো জন পুরাতাত্ত্বিক এই ধরনের জিনিসের মধ্যে অনায়াসে সারা জীবন কাটিয়ে দিতে পারে।

কেনেডি কপাল কুঁচকে গোঁফে হাত বুলোত বুলোতে বলল,বার্গার, তুমি না বললেও আমি বুঝতে পেরে গেছি। তুমি নিশ্চয়ই ভূগর্ভে কোনও একটা বড় কবরখানা আবিষ্কার করেছ। এত ধরনের পুরোনো জিনিস কবরখানা ছাড়া আর কোথায় পাওয়া যাবে?

–ঠিকই বলেছ। আমি ভূগর্ভে একটা নতুন কবরখানার খোঁজ পেয়েছি।

–কোথায়?

–সেটা কী করে বলি কেনেডি? এটুকু বলতে পারি আমি না দেখিয়ে দিলে জায়গাটা কারও পক্ষে খুঁজে পাওয়া সম্ভব নয়। এই কবরখানাটা ছিল অভিজাত সম্প্রদায়ের লোকের জন্য। সুতরাং এখানে যে ধরনের ভগ্নাবশেষ ও স্মৃতিচিহ্ন ছড়িয়ে আছে তা অন্য কোথাও পাওয়া যাবে না। আমি প্রথমে এটার ওপর গবেষণা করে একটা পেপার লিখব, তারপরে তোমার মতো প্রতিদ্বন্দ্বীর কাছে সমস্ত কিছু খুলে বলব।

পুরাতত্ত্বের প্রতি কেনেডির ভালোবাসা অসীম। এই নতুন আবিষ্কারের ব্যাপারে জানার জন্য সে প্রায় অধৈর্য হয়ে বার্গারকে বলল,-বার্গার, আমি তোমায় শপথ করে বলছি, তোমার অনুমতি ছাড়া এ বিষয়ে আমি কোনও পেপার লিখব না। অতএব তুমি নির্দ্বিধায় আমাকে তোমার আবিষ্কারের ব্যাপারটা খুলে বলতে পারো। নাহলে কিন্তু আমি নিজে চেষ্টা করে জায়গাটা খুঁজে বের করব। আর এই ব্যাপারে তোমার আগেই আমার গবেষণাপত্র প্রকাশ করব।

চুরুটে টান দিয়ে হালকা হেসে বার্গার বলল,–দ্যাখো ভাই, তুমি কিন্তু তোমার কোনও কথাই আমাকে কখনও খুলে বলল না। আজ পর্যন্ত তোমার একান্ত গোপনীয় কিছু আমায় খুলে বলেছ কি?

–তুমি কি বলতে চাইছ ঠিক বুঝতে পারছি না। তবে তোমার যে-কোনও প্রশ্নের উত্তর দিতে আমি রাজি আছি।

সোফায় ভালো করে হেলান দিয়ে চুরুটের ধোঁয়া ছেড়ে বার্গার বলল,-বেশ। এবার বলো, মেরি সন্ডারসনের সঙ্গে তোমার কী সম্পর্ক ছিল।

প্রচণ্ড রেগে গিয়ে কেনেডি চেঁচিয়ে উঠল,–এটা কী ধরনের প্রশ্ন? তুমি কি আমার সঙ্গে ঠাট্টা করছ?

বার্গার স্বাভাবিকভাবে বলল,–না বন্ধু, এটা ঠাট্টা নয়। আমি তমাকে চিনি আর ওই মেরি নামের মেয়েটিকেও দেখেছি। তাই তোমার মুখ থেকে জানতে চাই, তোমাদের দুজনের মধ্যে ঠিক কী হয়েছিল।

–আমি তোমাকে একটি কথাও বলব না।

–তা হলে তো ব্যাপারটা মিটেই গেল। রাত দশটা বাজল, এবার চলি।

কেনেডি ব্যাকুলভাবে বলে উঠল,–না, না বার্গার, একটু অপেক্ষা করো। এখনই যেও না। যে ব্যাপারটা নিয়ে জানতে চাইছ, সেটাতো বেশ পুরোনো হয়ে গেছে। এখন সে সম্বন্ধে কিছু জানতে চাওয়া প্রায় পাগলামির পর্যায়ে পড়ে।

বার্গার উঠে দাঁড়িয়ে তার বেতের ঝুড়িটা হাতে নিয়ে বলল,–ঘটনাটা শুধু তোমার ব্যক্তিগত ব্যাপার বলে উড়িয়ে দেওয়া যায় না, এ নিয়ে পুরো রোমে অনেক আলোচনা হয়েছিল। যা হোক, শুভরাত্রি।

প্রায় দরজার কাছ থেকে বার্গারের হাত ধরে ওকে ভেতরে এনে কেনেডি বলল,–বলো, কী জানতে চাও?

একটা চুরুট ধরিয়ে আবার বসে পড়ে বার্গার জিগ্যেস করল,-মেরি সন্ডারসনের শেষ পর্যন্ত কী হয়েছিল?

–ও তো দেশে নিজের বাড়িতে ফিরে গেছে। ইংল্যান্ডে।

–কিন্তু ব্যাপারটা বেশ অদ্ভুত না? তোমার সঙ্গে বেশ কিছুকাল মেরির বন্ধুত্ব ছিল। তা হলে ও হঠাৎ এমন করে চলে গেল কেন? আর তোমার সঙ্গে যদি ওর বন্ধুত্ব না হয়ে থাকে, তা হলে ওকে আর তোমাকে জড়িয়ে এত গুজব কেন?

কেনেডি ফায়ারপ্লেসের দিকে তাকিয়ে খানিকটা অন্যমনস্কভাবে বলল, হয়তো তুমি ঠিকই বলছ। মেরিকে আমি বেশ পছন্দই করতাম। কিন্তু এখন বুঝি, ব্যাপারটা তার বেশি কিছুই নয়। আসলে ওর সঙ্গে বন্ধুত্বটা করেছিলাম খানিকটা অ্যাডভেঞ্চার-এর নেশায়। মেরি তো একজন অভিজাত ঘরের মহিলার সঙ্গিনী ছিল। ওর সঙ্গে নাকি একজনের বিয়েও ঠিক হয়ে গেছল। এতসব বাধা সত্ত্বেও ওর সঙ্গে যোগাযোগ করা আর বন্ধুত্ব পাতানো একটা অ্যাডভেঞ্চার হিসেবে দেখেছিলাম।

–কিন্তু মেয়েটির হবু স্বামীর কী হল?

–কে জানে কী হয়েছে। লোকটা নিশ্চয়ই আমার তুলনায় অত্যন্ত সাধারণ মানের ছিল।

–আর একটা প্রশ্ন। এত তাড়াতাড়ি তুমি কীভাবে মেয়েটিকে বিদায় করলে?

–আমাদের ব্যাপারটা জানাজানি হওয়ার পর মেয়েটি আর রোমে থাকতে চাইল না। এদিকে আমার পক্ষে রোম। ছাড়া অসম্ভব। তা ছাড়া, ওর বাবাও খুব রাগারাগি করছিলেন। তাই আমি ধীরে ধীরে নিজেকে এই সম্পর্কের থেকে সরিয়ে নিলাম। আর আমার কিছু বলার নেই।

-ভাই কেনেডি, আমি পুরো ব্যাপারটা অবশ্যই গোপন রাখব। তবে একটা কথা বলি। তোমার আর আমার জীবনের দৃষ্টিভঙ্গি সম্পূর্ণ আলাদা। এবার বলো, আমার আবিষ্কার করা জায়গায় কবে যেতে চাও?…চলো না, আজ রাতেই যাওয়া যাক। একটু শীত হলেও আজকের রাতটা ভারী সুন্দর।

জায়গাটা কত দূরে?

–বেশি দূরে নয়। হেঁটে গেলেই ভালো। এত রাতে গাড়ি ভাড়া করলে গাড়িওয়ালা সন্দেহ করবে। আমি বরং আমার বাড়ি থেকে মোমবাতি, দেশলাই ও আর কয়েকটা দরকারি জিনিস নিয়ে শহরের বড় গেটটার কাছে ঠিক রাত বারোটার সময় তোমার জন্য অপেক্ষা করব।

–ঠিক আছে। আমিও পৌঁছে যাব।

শহরের ঘড়িঘর-এ যখন রাত বারোটার ঘণ্টা বাজছে, ঠিক তখনই হাতে একটা লণ্ঠন ঝুলিয়ে ওভারকোট পরা বার্গার নির্দিষ্ট স্থানে এসে হাজির হল। একটু দূরেই অপেক্ষারত কেনেডি এগিয়ে এল বার্গারের কাছে।

রাতের হাওয়া বেশ ঠান্ডা। শরীর গরম রাখতে দুজনেই পাথুরে রাস্তার ওপর দিয়ে দ্রুত চলতে লাগল। রাস্তায় দু একজন বিক্ষিপ্ত পথচারী ছাড়া আর জনমানুষের চিহ্ন নেই। রাস্তার দুধারে কবরখানা ও অনেক স্মৃতিসৌধ। বেশ খানিকটা গিয়ে সেন্ট ক্যালিস্টাসের সমাধির কাছে বার্গার থামল।

বার্গার বলল,–দাঁড়াও। এর খুব কাছেই আমার আবিষ্কৃত সমাধি। এই যে এদিকে এসো। এই সরু রাস্তাটা দিয়ে যেতে হবে। তুমি আমার পেছনে এসো।

কাঠের তৈরি একটা ফাঁকা গোয়ালঘরের কাছে গিয়ে বার্গার পকেট থেকে চাবি বের করল।

কেনেডি বলল,–একী! তোমার ভূগর্ভের ভাণ্ডার এই বাড়ির মধ্যে না কি?

–হ্যাঁ, এটাই রাস্তা। এই ঘরটির জন্য লোকে ভাবতেই পারবে না যে এর নীচে কী আছে। এমনকী এই বাড়ির মালিকও জানে না যে তার বাড়ির নীচে আছে পুরাতত্ত্বিক রত্ন ভাণ্ডার। এই বাড়িটা আমি ভাড়া নিয়েছি। ভেতরে এসে দরজাটা বন্ধ করে দাও।

যদিও বাড়িটা জনহীন, বার্গার তবুও লণ্ঠনের বেশির ভাগটাই ওভারকোট দিয়ে ঢেকে রাখল, যাতে বাইরে থেকেও কেউ তাদের উপস্থিতি টের না পায়। ঘরে এক কোণে কাঠের মেঝেটা ঢিলে ছিল। দুজনে মিলে সেখান থেকে কয়েকটা তক্তা তুলে দেওয়ালের গায়ে দাঁড় করিয়ে রাখল। মেঝের ফোকরটা থেকে নীচে পাথরের সিঁড়ি নেমে গেছে। বার্গার আগে হাতে আলো নিয়ে নামল–পেছনে কেনেডি। নীচে নেমে মনে হল এটা যেন বুনো খরগোশের গর্ত–অর্থাৎ অজস্র অলিগলিতে ভরা। একবার রাস্তা হারিয়ে ফেললে সঠিক রাস্তা খুঁজে বাইরে বেরিয়ে আসা অসম্ভব বললেই হয়।

কেনেডি বলল, তুমি কী করে এই গোলকধাঁধায় চলাফেরা করো?

–প্রথমদিকে আমিও দু-একবার প্রায় ফেঁসে গেছলাম। এখন গলি-খুঁজির প্ল্যান একটু আধটু বুঝতে পারি। তা সত্ত্বেও এখনও বেশি ভেতরে যেতে গেলে সুতোর গোলা সঙ্গে নিয়ে সুতো ছাড়তে-ছাড়তে যাই।

প্রায় বিশ ফুট নীচে একটা চৌকো মতো জায়গায় ওরা দুজনে দাঁড়িয়ে। লণ্ঠনের কঁপা আলোয় হলদেটে ফাটা দেওয়াল চোখে পড়ছে। আর এই চৌকোনা জায়গাতে চারদিক থেকে বেরিয়েছে অজস্র সুড়ঙ্গের মতো গলি গলির মুখগুলো ঘুটঘুঁটে অন্ধকার।

বার্গার কেনেডিকে বলল,–তুমি কিন্তু আমার সঙ্গে-সঙ্গে এসো। অন্য কোনওদিকে যাওয়ার চেষ্টা কোরো না। তোমাকে সোজা নিয়ে যাচ্ছি দুর্লভ জিনিসের জায়গাটায়।

মাঝে-মাঝেই এক-একটা গলি দুভাগে বিভক্ত হয়ে যাচ্ছে। বার্গার নির্দ্বিধায় এগিয়ে চলল। মনে হয় যাওয়ার পথে ও কোনও গোপন চিহ্ন রেখে দিয়েছে। চতুর্দিকে দেওয়ালের ধারে-ধারে মমি-তে পরিণত মৃতদেহ থাকে-থাকে রাখা। আধো-আলো আধো-আঁধারে কঙ্কালসার মমিগুলো দেখে গা ছমছম করছিল কেনেডির। কিন্তু তবুও ও উৎসুকভাবে দেখছিল মৃতদেহগুলির চারপাশে ছড়িয়ে রাখা শিলালিপি, বাসনপত্র, গয়না ও অন্য টুকিটাকি জিনিস। কেনেডি বুঝতে পারছিল যে ভূগর্ভের আবিষ্কৃত সমাধিগুলির মধ্যে এই সমাধিটি অতি প্রাচীন এবং পুরোনো রোমে আদি খ্রিস্টানদের একটা উল্লেখযোগ্য কবরখানা।

হঠাৎ কেনেডি জিগ্যেস করল,–আচ্ছা, লণ্ঠনের আলো নিভে গেলে কী হবে?

–আমার কাছে মোমবাতি আর দেশলাই আছে। তোমার কাছে দেশলাই আছে কি?

কেনেডি উত্তর দিল,–না। তুমি বরং আমায় কটা দেশলাই দাও।

–না, তার কোনও দরকার নেই। আমাদের দুজনের ছাড়াছাড়ি হওয়ার কোনও সম্ভাবনাই নেই।

–আচ্ছা, বার্গার, আর কত দূরে যেতে হবে? প্রায় সিকি মাইল তো হাঁটা হয়ে গেল।

–সিকি মাইলেরও বেশি। আসলে এই বিস্তীর্ণ সমাধিক্ষেত্রের কোথায় যে শেষ, তা আমিও জানি না। দাঁড়াও, আমার সুতোর গোলাটা বের করি। বাকি পথটায় হাঁটা আরও কঠিন।

সুতোর একপ্রান্ত একটা পাথরের কোণায় বেঁধে সুতোর গোলাটা বুক পকেটে নিয়ে বার্গার চলতে লাগল। কেনেডি বুঝতে পারছিল যে গলিগুলো এখন গোলকধাঁধার মতো জটিল হয়ে উঠেছে। খানিকক্ষণ পরে ওরা একটা বড় গোলাকার হলঘরে পৌঁছে গেল। ঘরের মাঝখানে চৌকো এক বেদির ওপর একটা শ্বেতপাথরের ফলক রাখা।

লণ্ঠনের আলোয় ফলকটা দেখতে পেয়ে আনন্দে আত্মহারা হয়ে কেনেডি বলল,–এ তো দারুণ জিনিস! খ্রিস্টানদের বানানো প্রথম বেদি হয়তো এটাই। নিশ্চয়ই এই ঘরটাকে চার্চ হিসেবে ব্যবহার করা হত।

বার্গার বলল,–ঠিক বলেছ। এই ঘরের দেওয়ালের ফাঁকে-ফাঁকে যে দেহগুলো মমি করে রাখা আছে, সেগুলো সবই সেই সময়ের বিশপ ও পোপদের। তুমি অন্তত একটা দেহ কাছে গিয়ে দেখে এসো।

কেনেডি দেওয়ালের দিকে গিয়ে একটা মৃতদেহের মাথার দিকে তাকিয়ে বলল,–আমার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, তোমার এই আবিষ্কার সত্যিই অভূতপূর্ব। লণ্ঠনটা একটু কাছে নিয়ে এসো–আমি এগুলো সব দেখতে চাই।

ততক্ষণে বার্গার একটু দূরে সরে গেছে এবং হলঘরের অন্যদিকে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। হঠাৎ ও কেনেডিকে বলল, এইখান থেকে বাইরে বেরোেনোর সিঁড়ি অবধি যাওয়ার পথে কতগুলো ভুল রাস্তা আছে জানেন? দুহাজারের ওপর। প্রাচীন খ্রিস্টান সম্প্রদায় এইরকম গোলকধাঁধা বানিয়ে নিজেদের সমাধিক্ষেত্র রক্ষা করত। সঙ্গে আলো থাকলেও এখান থেকে বেরোনো কঠিন। আর অন্ধকার হলে তো কথাই নেই।

–হ্যাঁ, আমারও তাই মনে হয়।

–আর এই অন্ধকার ভয়াবহ। একবার এই অন্ধকারের অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের চেষ্টা করেছিলাম। আজ আবার একবার চেষ্টা করি।

এই বলেই বার্গার লণ্ঠনের দিকে ঝুঁকল আর পর মুহূর্তেই সবকিছু নিচ্ছিদ্র অন্ধকারে ঢেকে গেল। যেন একটা অদৃশ্য হাত কেনেডির দুচোখ চেপে ধরে আছে। এই অন্ধকারের যেন একটা শরীরী সত্তা আছে যা কেনেডিকে পিষে ফেলতে চাইছে। এই অন্ধকার যেন একটা নিরেট দেওয়াল, যার কাছে যেতে শরীর ভয়ে কেঁপে ওঠে।

–অনেক হয়েছে বার্গার। এবার আলোটা জ্বালো।

বার্গার তখন হাসতে আরম্ভ করল ও সেই হাসির গা ছমছমে প্রতিধ্বনি ঘরের চারদিক থেকে শোনা যেতে লাগল। বার্গার বলল, কী হল কেনেডি, ঘাবড়ে গেলে না কি?

–আর দেরি কোরো না–এবার আলোটা জ্বালাও। কেনেডির গলায় ব্যাকুলতা।

–জানো কেনেডি, তোমার কথা শুনে বুঝতেই পারছি, যে তুমি কোনখানে দাঁড়িয়ে। তুমি কি বুঝতে পারছ আমি কোথায়।

–না। মনে হচ্ছে তুমি আমার চারদিকেই দাঁড়িয়ে আছ।

–এই সুতোটা আমার হাতে না থাকলে বুঝতেই পারতাম না যে কোন রাস্তা ধরব।

–তাড়াতাড়ি আলোটা জ্বালাও। শেষ করে এই তামাশা।

–কেনেডি, তুমি দুটো জিনিস খুব পছন্দ করো। এক হচ্ছে অ্যাডভেঞ্চার আর দুনম্বর হল যে-কোনও বাধা অতিক্রম করা। এই গোলকধাঁধা থেকে বেরোনো হবে আসল অ্যাডভেঞ্চার। আর বাধাগুলো হচ্ছে, এই অন্ধকার আর দুহাজার ভুল রাস্তা। ঠিক জায়গায় পৌঁছোতে একটু অসুবিধে হবে অবশ্যই। কিন্তু তোমার হাতে এখন প্রচুর সময়–তাড়াহুড়ো করার কোনও দরকার নেই। মাঝে-মাঝে যখন বিশ্রামের জন্য একটু থামবে তখন একটু মেরি সান্ডারসনের কথা ভেব। আর এটাও ভেবে দেখো, তুমি ওর সঙ্গে যথাযথ ব্যবহার করেছিলে কি না।

–শয়তান! তুমি কী বোঝাতে চাইছ? বিকৃত গলায় চিৎকার করে কেনেডি সেই ঘরে ছোট-ছোট বৃত্তাকারে ঘুরতে লাগল আর যেন সেই ঘন অন্ধকারকে দুহাত দিয়ে ধরতে চাইল।

একটু দূর থেকে বিদ্রুপের সুরে কথা ভেসে এল, বিদায় কেনেডি। তুমি এখন নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ যে তুমি মেরির প্রতি অন্যায় করেছ। খালি একটা ছোট ব্যাপার তোমাকে বলা হয়নি। মেরির বিয়ের সম্বন্ধ হয়েছিল একটা গরিব, সামাজিক আদবকায়দা না-জানা লোকের সঙ্গে আর সেই লোকটার নাম জুলিয়াস বার্গার।

জামাকাপড়ের একটা খসখসে আওয়াজ শোনা গেল। আর শোনা গেল পাথরের ওপর আস্তে-আস্তে মিলিয়ে যাওয়া পায়ের আওয়াজ। তারপরেই ভূগর্ভের সেই পুরোনো চার্চে নেমে এল এক নিচ্ছিদ্র নিস্তব্ধতা। জলে ডুবে গেলে মানুষকে যেমন জল ঘিরে ধরে, সেই নিস্তব্ধতাও কেনেডিকে চারদিক দিয়ে ঘিরে ধরল।

দুমাস পরে ইউরোপের খবরের কাগজে নিম্নলিখিত সংবাদটি বেরিয়েছিল:

রোমে সদ্য আবিষ্কৃত ভূগর্ভের একটি সমাধিক্ষেত্রকে পুরাতত্ত্বের জগতে একটা আবিষ্কার বলা যেতে পারে। জার্মানির তরুণ পুরাতত্ত্ববিদ জুলিয়াস বার্গার এই সমাধিক্ষেত্রটি আবিষ্কার করেন। প্রাচীন খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের বিভিন্ন স্মৃতিচিহ্নে ভরা এই সমাধিক্ষেত্র পুরাতত্ত্বের ইতিহাসে নিঃসন্দেহে একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন। যদিও এই আবিষ্কারের ওপর গবেষণাপত্রটি বার্গারের লেখা, তবে মনে হয় আর এক কম ভাগ্যবান পুরাতাত্ত্বিক এই জায়গাটি বার্গারের আগেই আবিষ্কার করেছিলেন। মাস দুই আগে তরুণ ব্রিটিশ পুরাতাত্ত্বিক কেনেডি হঠাৎ নিখোঁজ হয়ে যান। অনেকে ভেবেছিলেন, একটি মেয়েকে জড়িয়ে একটা কলঙ্কজনক ব্যাপারে তাঁর নাম এসে যাওয়ায় তিনি রোম ছেড়ে চলে গেছেন। এখন বোঝা যাচ্ছে পুরাতত্ত্বের প্রতি ভালোবাসাই তাঁকে বিপদের মুখে ঠেলে দিয়েছিল। কেনেডির মৃতদেহ সম্প্রতি ওই সমাধিক্ষেত্রেই পাওয়া গেছে। মৃতদেহের পা আর জুতোর অবস্থা দেখে মনে হয়, কেনেডি দিনের পর দিন ওই ভূগর্ভের গোলোকধাঁধাঁয় পথ হারিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছিলেন। এমনকী মোমবাতি বা দেশলাই পর্যন্ত সঙ্গে না নিয়ে ওই ভূগর্ভে ঢুকে তিনি চরম নির্বুদ্ধিতার পরিচয় দিয়েছেন। ব্যাপারটা আরও বেদনাদায়ক এই কারণে যে কেনেডি ছিলেন ডাঃ জুলিয়াস বার্গারের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। কেনেডিকে হারানোর বেদনা ডাঃ বার্গারের আবিষ্কারের আনন্দকে অনেকটাই ম্লান করে দিয়েছে।

Anuprerona
Anupreronahttps://www.anuperona.com
Read your favourite literature free forever on our blogging platform.
RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here


Most Popular

Recent Comments