Thursday, August 21, 2025
Homeথ্রিলার গল্পরহস্য গল্পহাত - সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়

হাত – সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়

হু-হু করে রাস্তা ছুটে চলেছে জানালার দুপাশ দিয়ে। বেশ লাগছে। ছুটির কলকাতা। পথে তেমন। ভিড় নেই। ফাঁকা ফাঁকা। গাড়ি-ঘোড়াও কম। ট্যাক্সির বাঁ-ধারের জানলা ঘেঁষে বসেছি। বেশ জাঁকিয়ে। আরাম করে। পুরো গাড়িটাই আমার দখলে। আজ আর শাটলের হাঙ্গামা নেই। চলেছি উত্তর থেকে দক্ষিণে।

আমার বাঁ-হাতের কনুই জানলায় ফেলে রেখেছি আলতো করে। অলস ডান হাত পড়ে আছে মসণ আসনে। আমি দেখছি। হাঁ করে দেখছি—শহর কলকাতা। বড় বাড়ি। ছোট বাড়ি। দোকানপাট। বেমানান গাছ। আলো ঝলমলে দোকান। আসছে আর ছুটে চলে যাচ্ছে পেছনে। কে যেন টেনে নিচ্ছে ভালো করে দেখার আগেই।

ডান হাতের চেটো আসনের ওপর চলে বেড়াচ্ছে। মসৃণতা উপভোগ করছে। খুবই অন্যমনস্ক। আঙুলে কী যেন ঠেকল। আঙুলে আঙুল। আর একটা হাতের সরু সরু আঙুল। একটা, দুটো, মধ্যমা, অনামিকায় একটা পাথর বসানো আংটিও রয়েছে। বাইরে তাকিয়ে আছি। প্রথমে অতটা খেয়াল করিনি। যেই মনে হল গাড়িতে আমি একা, আর একটা হাত এল কোথা থেকে, সঙ্গে সঙ্গে ফিরে তাকালুম। কোথাও কিছু নেই! আমার হাতটাই পড়ে আছে, মসৃণ চকচকে আসনে। ডান পাশের দোকানপাটের আলো ভাঁড়ের চা ছুড়ে মারার মতো মাঝে মাঝে এসে পড়ছে, আবার। গড়িয়ে চলে যাচ্ছে। কোথাও কিছু নেই! বেশ ভালো করে বার কতক দেখে নিলুম। তারপর। ভাবলুম, আমি কী বোকা। শুধু একটা হাত আসবে কোথা থেকে। মানুষ ছাড়া হাত হয়! মানুষহীন হাত কেউ স্পর্শ করেছেকেউ দেখেছে কোনওদিন? কতরকম মনের ভুল হয়।

গাড়ি চলেছে। চালক খুব মন দিয়ে চালাচ্ছে। দেখতে পাচ্ছি, তার বাঁ-পাশের চোখের অংশ চিকচিক করছে বহুমূল্য মণির মতো। ধারালো মুখ। বেশ খাড়া নাক। প্রশ্ন করতে সাহস হল না। কী ভাববে! পাগল ভাবাও বিচিত্র নয়। কিছুক্ষণের মধ্যেই ভুলে গেলুম। চারপাশে টগবগে শহর। চুম্বকের মতো মন টেনে নিল।

অন্যমনস্ক হাত সরাতেই আবার কী ঠেকল। সরু সরু আঙুল। পালিশ করানখ। একটা, দুটো, মধ্যমা, অনামিকা। অনামিকায় পাথর বসানো আংটি। আবার সেই একই ব্যাপার। আঙুল নিয়ে অন্যমনস্ক কিছুক্ষণ খেলা করার পর চমকে উঠেছি। হাত। আর একটা হাত। সঙ্গে সঙ্গে ফিরে। তাকালুম। কিছুই নেই। আমার হাতটাই শুধু পড়ে আছে। একটু সরে গেছে দূরে। ওপাশে এগিয়ে গেছে বেশ কিছুটা। সাহসী শিশুর মতো বেড়াতে বেড়াতে অন্যের এলাকায় গিয়ে ঢুকেছে।

বেশ ভয় পেয়ে গেলুম এইবার। স্টিয়ারিং-এ শক্ত হয়ে বসে থাকা মানুষটিকে সন্দেহ হল সবার আগে। ওই রকম কাঠ হয়ে বসে আছে কেন! বাঁ-পাশে একটু বেশি ঘুরে। আধখানা চোখ জ্বলজ্বল করছে। কোনও কথা নেই মুখে। বলার মতো কত কী বিষয় রয়েছে। গত কয়েকদিনে শহর। জীবনের কড়াইতে বহু বিষয় ভাজা হয়েছে, গরম তেলে ভাজার মতো। নির্বাচনের ডাল ফুলুরি। প্রার্থিত প্রার্থীর শোচনীয় পরাজয়। নেতারা অনেক বেগুনি ভেজেছেন। ক্রিকেটের ভেজিটেবল কাটলেট। মুখরোচক এত কিছু থাকতে ভদ্রলোক মুখ খুললেন না কেন? খুবই সন্দেহজনক। বেঁচে আছেন তো? অনেক সময় গাড়ি চালাতে চালাতে হৃদরোগের আক্রমণ হয়। খবরে। পড়েছিলুম। একবার এক ইঞ্জিন ড্রাইভারের এই রকম হয়েছিল। বন জঙ্গল, নদী, প্রান্তর পেরিয়ে ট্রেন ছুটেছে। বাঙ্কে বাঙ্কে যাত্রীরা অঘোর ঘুমে দুলছে। কেউ জানতেই পারল না, সামনের ইঞ্জিনে ড্রাইভার মৃত।

লোকটি বেঁচে আছে কি না দেখার জন্যে বললুম, ‘আলোটা একবার জ্বালবেন?’

কেন, কী বৃত্তান্ত, কোনও প্রশ্ন না করেই পেছন দিকে হাত ঘুরিয়ে আলোটা জ্বেলে দিল। পাশটা ভালো করে একবার দেখে নিলাম। পরিষ্কার। সুন্দর। কিছু নেই। একটা কাগজের টুকরোও পড়ে নেই। আমি সুইচ টিপে আলোটা নিভিয়ে দিলুম। নির্বিকার চালক স্টিয়ারিং ধরে বসে আছে। কোনও প্রশ্ন নেই। এমন উদাসী মানুষ কদাচিৎ চোখে পড়ে। একবার মনে হল প্রশ্ন করি, গাড়িতে আর কেউ কি আছে? সাহস হল না। হয়তো হেসে উঠবে। বলবে, কী মশাই, খুব টেনেছেন। কিংবা ধমক দেবে, ন্যাকামি হচ্ছে?

ডান হাতটাকে কোলে তুলে নিলুম। নিজের হাত নিজের এলাকাতেই থাক। পাশের ফাঁকা। অঞ্চলটিকে আর বিশ্বাস নেই। বেশ অস্বস্তি হচ্ছে। হয়তো কেউ বসে আছে। আমি দেখতে পাচ্ছি। না। গা ছমছম করে উঠল। ব্যাপারটাকে মনের ভুল বলে উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।

ড্রাইভারকে জিগ্যেস করলুম, ‘হ্যাঁ মশাই, আপনার গাড়িতে কি কিছু আছে?’

‘কী আবার থাকবে?’ সংক্ষিপ্ত উত্তর।

‘কখনও কিছু ঘটেছে এই গাড়িতে?’

‘কী আবার ঘটবে?’ সেই একই ধরনের উত্তর।

আর কিছু জিগ্যেস করার সাহস হল না। এখন তাড়াতাড়ি নেমে পড়তে পারলে বাঁচি, কিন্তু আশ্চর্যের কথা, ভয় করলেও আমি সেই শরীরহীন অদৃশ্য হাতের প্রেমে পড়ে গেছি। স্পর্শে বুঝেছি, অবশ্যই কোনও সুন্দরীর সুন্দর হাত। লম্বা, সরু সরু মসৃণ আঙুল। বাদামের মতো। তেলা নখ। আংটিটা নিশ্চয় হিরের। রক্তমুখী নীলাও হতে পারে! সোনার ওপর জ্বলজ্বল করছে।

পাশে ফিরে তাকালুম। যদি দেখতে পাই সেই অদৃশ্য রমণীকে। এমন যার হাত সে কী শাড়ি পরবে? পিঙ্ক রঙের সিল্কের শাড়ি? ওই রং আমার ভীষণ প্রিয়। আর মুখ কেমন হবে? খুব। ধারালো। ছোট কপাল। একেবারে নিভাঁজ। আলো পড়লে চকচক করবে। সেই ছোট্ট কপাল ঘিরে থাকবে কুচকুচে কালো চুলের তটরেখা। রেশমের মতো কোমল। ঘাড়ের কাছে দুলবে তুলতুলে একটা খোঁপা। কানে চিকচিক করবে দুল। টিকোলো নাকে একটা হিরের নাকছাবি। আমি নিজে পরিয়ে দোব। পিঠটা হবে চওড়া। সরু হয়ে নেমে গেছে কোমরের দিকে। পিঙ্ক-রঙের ব্লাউজ ছুঁড়ে বেরুবে তপ্ত কাঞ্চন বর্ণ। দু-সার সুন্দর দাঁত, হাসলেই চকচক করে উঠবে। গোল। নিটোল হাতে দু-গাছা, মাত্র দু-গাছা রুলি কাটা সোনার চুড়ি। এ হাতে দু-গাছা, ও হাতে দু-গাছা। হাত নাড়লেই ঠিন ঠিন শব্দ। নীলার আংটি ছাড়াও আর একটা আংটি আমি পরাব বাঁ-হাতের মধ্যমায়। জোড়া সাপ। সাপের চারটে চোখে বসানো থাকবে ছোট ছোট চুনী, পোখরাজ আর পান্না। ঠিক এইরকম একটা আংটি ছিল আমার মায়ের আঙুলে। সে আংটি আর নেই। মা যখন মৃত্যুশয্যায় তখন আর কিছু বেচার নেই দেখে বাবা বেচে দিয়েছিলেন। আমার বড়বোন আশা বারণ করেছিল। মায়ের একটা স্মৃতি অন্তত থাক। বাবা উপায় থাকলে হয়তো রেখে দিতেন। তখন অবশ্য বলেছিলেন, ‘তোরা এখনই স্মৃতি নিয়ে ব্যস্ত হচ্ছিস কেন? মানুষটা আগে বাঁচুক। বেঁচে উঠুক, তারপর নতুন স্মৃতি তৈরি করা যাবে।’ মানুষের কত আশা! ভাবলে হাসি পায়।

ড্রাইভার হঠাৎ জিগ্যেস করলে, ‘যাবেন কোথায়? লেক তো এসে গেছে।’

‘আসুক না। আপনি চালিয়ে যান। মিটার তো আছে।’

‘কোনদিকে যাব বলুন?’

‘টালিগঞ্জের দিকে চলুন।’

‘কোথায় যেতে চান আপনি?

‘চলুন না। এত ব্যস্ত হচ্ছেন কেন?

‘আমি বেশি রাত পর্যন্ত গাড়ি চালাই না। আমাকে আবার ফিরতে হবে। গাড়ি গ্যারেজ করতে হবে। দিনকাল ভালো নয়।’

‘আপনার এই গাড়িটার দাম কত?’

‘কেন? কিনবেন নাকি?’

‘না এমনি জিগ্যেস করছি।’

‘অ এমনি!’

ভদ্রলোক দাম বললেন না। যতই হোক গাড়ির মালিক, তার আলাদা অহংকার তো হবেই। অনেক পয়সা থাকলে গাড়িটা কিনে নিলুম। এ সাধারণ গাড়ি নয়। এর একটা অতীত আছে। একটা ইতিহাস আছে। সে ইতিহাস হয়তো কাঠখোট্টা মালিকও জানে না।

এবার চারপাশ অন্ধকার। বাড়ি তেমন নেই। গাছপালাই বেশি। শীত শীত কুয়াশা কুয়াশা ভাব। গাছের পাতায় পাতায় হিসহিস করে বাতাসের শব্দ হচ্ছে। আসনে হাতটা আবার আলতো করে ফেলে রেখেছি। এবার আমি লোভী হয়ে উঠেছি। মনে মনে আমি সেই হাতটিকে খুঁজছি। এবার সেই স্পর্শ পেলে আমি আঙুলে আঙুলেই কথা বলব। আমার হৃদয়টাকে আমার আঙুলের মাথায় এনে বসাব।

লোভ আর আকাঙ্ক্ষা এসে গেছে। পেতে চাইছি, তাই বোধহয় পাওয়া হল না। অজানা অদৃশ্য জগৎ থেকে রহস্যের আঁচল ফাঁক করে সে হাত আর এল না। ভীষণ মন খারাপ হয়ে গেল। এতক্ষণ বেঁচে থাকার যেন একটা অর্থ খুঁজে পেয়েছিলুম। দেহ আর মস্তিষ্কের সমস্ত মৃত কোষ বেঁচে উঠেছিল। শতকরা একশো ভাগ জীবিত হয়ে উঠেছিল। চারপাশের অন্ধকার থেকে ঝাঁক ঝাঁক বাদুড়ের মতো বিষণ্ণতা উড়ে আসছে।

‘গাড়ি ঘোরান।’

‘কোথায় ঘোরাব?’

‘আমি তো গাড়িয়াহাট যাব। আগেই বলেছি।’

‘এই তো বললেন টালিগঞ্জ যাব।’

‘ভুল বলেছি। এখন আমি গড়িয়াহাট যাব।’

গাড়ি রাস্তার বাঁ-দিক ঘেঁষে দাঁড়িয়ে পড়ল।

সুইচ টিপে মিটারের আলো জ্বেলে ভদ্রলোক বাঁ-দিকে ঝুঁকে পড়লেন। তারপর সোজা হয়ে মনে মনে কী হিসেব করে বললেন, ‘দিন না, বিয়াল্লিশ টাকা দিন। ফর্টি টুঁ রুপিজ।’

‘কী হল আপনি যাবেন না!’

‘না, আপনি এখানে নেমে যান! অন্য গাড়ি ধরে নিন।’ সংক্ষিপ্ত রূঢ় জবাব।

‘আপনার গাড়ির নম্বর কত? দয়া করে বলবেন।’

‘কেন পুলিশে যাবেন? বলে দিচ্ছি ডরু বি টি থ্রি জিরো থ্রি ফাইভ।’

একটা পঞ্চাশ টাকার নোট এগিয়ে দিতে দিতে বললুম, ‘আপনি অসন্তুষ্ট হলেন? আমি থানা পুলিশের জন্যে জিগ্যেস করিনি। আপনার গাড়িটা খুব পবিত্র। এর ভেতর একটা জিনিস আছে, আপনি নিজেও হয়তো জানেন না।’

‘অ, তাই নাকি?’

আটটা টাকা আমাকে ফেরত দিতে দিতে ভদ্রলোক রসকষহীন গলায় বললেন, ‘একেবারে অনুভূতিশূন্য মানুষ।’ কথা না বাড়িয়ে দরজা খুলে পথে নেমে পড়লুম। আজ আর কারুর সঙ্গে ঝগড়াঝাঁটি নয়। এমনিই আমি ভীষণ রগচটা মানুষ। আজ কিন্তু আমার স্বভাব একেবারে পালটে গেছে। খুব হালকা লাগছে। ভেতরে যেন শান্তির অসীম উৎস খুলে গেছে! সব যেন সিনেমা। আমি এক চিরকালের নায়ক। বাতাসে ভেসে ভেসে উড়ে চলেছি। আমার চুল উড়ছে। সাদা পোশাক উড়ছে! চারপাশ থেকে ভেসে আসছে অর্গান আর পিয়ানোর সুর। সুন্দরী রমণীদের খিলখিল, কাচ-ভাঙা হাসির শব্দ। এত বছর বেঁচে আছি, পৃথিবীকে এত সুন্দর কোনও দিন মনে হয়নি।

কোথায় চলেছি আমি! আবার সেই লেকের কাছেই এসে পড়েছি। রাত ক্রমশ গভীর হচ্ছে। মাথার ওপর জ্বলজ্বল করছে এক আকাশ তারা। সার সার গাছ বসে গেছে বিরাটের নিস্তব্ধ। ধ্যানে। অচেনা, অদ্ভুত পরিবেশে আমার একটুও ভয় করছে না। কেবলই মনে হচ্ছে একটা হাত আমাকে ইশারায় ডাকছে। এগিয়ে এসো, এগিয়ে এসো। যত এগোবে ততই শান্তি, তত আনন্দ। এই পৃথিবীতেই সেই জায়গা আছে। সেই একান্ত নিভৃত স্থান। মাতৃগর্ভে যেমন শিশু থাকে। তেমনই সেই স্থান আছে পৃথিবীর নিভৃত একান্তে। চলে এসো! চলে এসো! আমার হাতে হাত রাখো! আমি তোমাকে নিয়ে যাব!

আমি তো সেইরকম একটা জায়গাতেই যেতে চাই। ওই হাতেই হাত রাখতে চাই। যে হাত তৈরি হয়েছে আমার মায়ের হাত, আমার প্রেয়সীর হাত, আমার রক্ষাকর্তীর হাত একসঙ্গে মিলিয়ে মিশিয়ে ছাঁচে ঢালাই করে।

পেছন দিক থেকে একটা গাড়ি আসছে হেডলাইট জ্বেলে। ট্যাক্সি। হাত তুলতেই থেমে পড়ল। দরজা খুলে উঠে বসলুম। মিটার ফ্ল্যাগ নেমে পড়ল মৃদু সুর তুলে। পেছনের সুখী অন্ধকারে ধীরে ধীরে ডুবে গেলুম। আলো পড়তে চালকের মুখ দেখতে পেলুম। হাসি পেয়ে গেল। আগের গাড়ি। সেই এক ড্রাইভার। আমাকে চিনতে পারেনি।

আপন মনেই বললুম, ‘ডব্লু বি টি থ্রি জিরো থ্রি ফাইভ।’

ভদ্রলোক ঘাড় ঘুরিয়ে বললেন, ‘জানি, আপনি। আপনার জন্যেই ফিরে এলুম। হেডলাইট অন করে। ওদের হাতে আপনাকে ছেড়ে দিতে ইচ্ছে হল না।’

‘কাদের হাতে?’

‘নিশাচরদের হাতে। এইসব এলাকা আর আগের মতো নেই।’

‘কিছু হত না। আর-এক হাতে আমার হাত রেখেছি।’

‘জানি কোন হাতের কথা বলছেন। সে হাতে হাত রাখতে হলে নিজের হাত আগে পবিত্র করতে হয়।’

‘তার মানে?

‘বুঝে নিন।’

পিকাডেলি রেস্তোরাঁর সামনে নেমে পড়লুম গাড়ি থেকে। ভাড়া দিতে গেলুম। ভদ্রলোক নিলেন না।

সামনের জানলার পাশে দাঁড়িয়ে জিগ্যেস করলুম, ‘সবই কি মনের ভুল?’

‘জানি না। আমি কিছু জানি না। জানার কথাও নয়।’

গাড়ি ছেড়ে দিল। যতক্ষণ দেখা যায়, ততক্ষণ তাকিয়ে রইলুম পেছনের ছোট্ট লাল আলোটার দিকে। যত দূরে যাচ্ছে তত ছোট হচ্ছে। সাপের ছুঁচোলো চোখ হয়ে অন্ধকারে হারিয়ে গেল।

চওড়া পিচের রাস্তা নির্জন রাত পেয়ে দৌড়োচ্ছে যেন।

আমার হাত?

মাথার ওপর মার্কারি ভেপার ল্যাম্প জ্বলছে। সেই আলোয় প্রথমে নিজের ডান হাত মেলে ধরলুম। আঙুলগুলো ছড়িয়ে দিলুম মাছের পুচ্ছের মতো। কালচে, কর্কশ একটা হাত। আঙুলের মাথাগুলো ভোঁতা ভোঁতা। নখের আকৃতি সুন্দর বাদামের মতো নয়। আধখাওয়া চাঁদের মতো। কোণগুলো দাবা দাবা। অমসৃণ, চিড়খাওয়া চামড়া। এই আমার হাত। এ তো বনমানুষের হাত। এই হাত আশাকে বাড়ি থেকে তাড়িয়েছে। এই হাত অসুস্থ বেকার ছোট ভাইকে সামান্য কিছু টাকা দিয়ে যৌথ সম্পত্তির অংশ নিজের নামে লিখিয়ে নিয়েছে। এই হাত আর একটি হাতকে কথা দিয়েও নিজের হাতে তুলে নেয়নি। এই হাত আরও অনেক হাতকে নিজের ব্যবসার স্বার্থে কলুষিত করেছে। কী করেনি এ হাত? এ তো ভোগের হাত। পাপের হাত। বাঁ-হাতটাও মেলে ধরলুম আলোয়। একই চেহারা। দুটি যমজ ভাই। ভেপার ল্যাম্পের আলোয় ডানা-মেলা বাদুড়ের মতো থমকে আছে। আমারই বুকের সামনে। নিজের হাতদুটোকে নিজেই চিনতুম না এত দিন! আশ্চর্য!

Anuprerona
Anupreronahttps://www.anuperona.com
Read your favourite literature free forever on our blogging platform.
RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here


Most Popular

Recent Comments