Tuesday, March 19, 2024
Homeথ্রিলার গল্পভৌতিক গল্পরঙ্কিণী দেবীর খড়্গ - বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়

রঙ্কিণী দেবীর খড়্গ – বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়

রঙ্কিণী দেবীর অসি - বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়

জীবনে অনেক জিনিস ঘটে, যাহার কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণ খুঁজিয়া পাওয়া যায় না তাহাকে আমরা অতিপ্রাকৃত বলিয়া অভিহিত করি। জানি না, হয়তো খুঁজিতে জানিলে তাহাদের সহজ ও সম্পূর্ণ স্বাভাবিক কারণ বাহির করা যায়। মানুষের বিচার, বুদ্ধি ও অভিজ্ঞতালব্ধ কারণগুলি ছাড়া অন্য কারণ হয়তো তাহাদের থাকিতে পারে। ইহা লইয়া তর্ক উঠাইব না, শুধু এইটুকু বলিব, সেরূপ কারণ যদিও থাকে‚ আমাদের মতো সাধারণ মানুষের দ্বারা তাহার আবিষ্কার হওয়া সম্ভব নয় বলিয়াই তাহাদিগকে অতিপ্রাকৃত বলা হয়।

আমার জীবনে একবার এইরূপ একটি ঘটনা ঘটিয়াছিল, যাহার যুক্তিযুক্ত কারণ তখন বা আজ কোনদিনই খুঁজিয়া পাই নাই। পাঠকদের কাছে তাই সেটি বর্ণনা করিয়াই আমি খালাস। তাঁহারা যদি সে রহস্যের কোনো স্বাভাবিক সমাধান নির্দেশ করিতে পারেন, যথেষ্ট আনন্দ লাভ করিব।
ঘটনাটা এইবার বলি।

কয়েক বছর আগেকার কথা। মানভূম জেলার চেরো নামক গ্রামের মাইনর স্কুলে তখন মাস্টারি করি।
প্রসঙ্গক্রমে বলিয়া রাখি, চেরো গ্রামের প্রাকৃতিক দৃশ্য এমনতর যে‚ এখানে কিছুদিন বসবাস করিলে বাংলাদেশের একঘেয়ে সমতলভূমির কোনো পল্লী আর চোখে ভালো লাগে না। একটি অনুচ্চ পাহাড়ের ঢাল, সানুদেশ জুড়িয়া লম্বালম্বি ভাবে সারা গ্রামের বাড়ীগুলি অবস্থিত। সর্বশেষ সারির বাড়ীগুলির খিড়কি দরজা খুলিলেই দেখা যায় পাহাড়ের উপরকার শাল, মহুয়া, কুরচি, বিল্ববৃক্ষের পাতলা জঙ্গল, একটা সুবৃহৎ বটগাছ ও তাহার তলায় বাঁধানো বেদী, ছোট–বড় শিলাখণ্ড ও ভেলা-কাঁটার ঝোপ।

আমি যখন প্রথম ও-গ্রামে গেলাম তখন একদিন পাহাড়ের মাথায় বেড়াইতে উঠিয়া এক জায়গায় শালবনের মধ্যে একটি পাথরের ভাঙা মন্দির দেখিতে পাইলাম।

সঙ্গে ছিল আমার দুটি উপরের ক্লাসের ছাত্র‚ তাহারা মানভূমবাসী বাঙালী। একটা কথা‚ চেরো গ্রামে বেশির ভাগ অধিবাসী মাদ্রাজী, যদিও তাহারা বেশ বাংলা বলিতে পারে, অনেকে বাংলা আচার-ব্যবহারও অবলম্বন করিয়াছে। কি করিয়া মানভূম জেলার মাঝখানে এতগুলি মাদ্রাজী অধিবাসী আসিয়া বসবাস করিল, তাহার ইতিহাস আমি বলিতে পারি না।

মন্দিরটি কালো পাথরের এবং একটু, অদ্ভুত গঠনের। অনেকটা যেন চাঁচড়া রাজবাড়ীর দশমহাবিদ্যার মন্দিরের মতো ধরনটা। এ অঞ্চলে এরূপ গঠনের মন্দির আমার চোখে পড়ে নাই‚ তা ছাড়া মন্দিরটি সম্পূর্ণ পরিত্যক্ত ও বিগ্রহশূন্য। দক্ষিণের দেওয়ালে পাথরের চাঁই কিয়দংশ ধসিয়া পড়িয়াছে, দরজা নাই, শুধু, আছে পাথরের চৌকাঠ। মন্দিরের মধ্যে ও চারিপাশে বনতুলসীর ঘন জঙ্গল। সান্ধ্য আকাশের পটভূমিতে সেই পাথরের বিগ্রহহীন ভাঙা মন্দির আমার মনে কেমন এক অনুভূতির সঞ্চার করিল। আশ্চর্যের বিষয়, অনুভূতিটা ভয়ের। ভাঙা মন্দির দেখিয়া মনে ভয় কেন হইল একথা তারপর বাড়ী ফিরিয়া অবাক হইয়া ভাবিয়াছি। তবুও অগ্রসর হইয়া যাইতেছিলাম ভালো করিয়া দেখিতে, একজন ছাত্র বাধা দিয়া বলিল, ‘যাবেন না স্যার ওদিকে…’
‘কেন?’
‘জায়গাটা ভালো না। সাপের ভয় আছে সন্ধেবেলা। তা ছাড়া লোকে বলে অনেক রকম ভয়ভীত আছে‚ মানে অমঙ্গলের ভয়। কেউ ওদিকে যায় না।’
‘ওটা কি মন্দির?’
‘ওটা রঙ্কিণী দেবীর মন্দির, স্যার। কিন্তু আমাদের গাঁয়ের বুড়ো লোকেরাও কোনো দিন ওখানে পুজো হ’তে দেখে নি‚ মূর্তিও নেই বহুকাল। ওইরকম জঙ্গল হয়ে পড়ে আছে আমাদের বাপ-ঠাকুরদার আমলেরও আগে থেকে। চলন স্যার নামি।’
ছেলে দুটো যেন একটু বেশি তাড়াতাড়ি করিতে লাগিল নামিবার জন্য। রঙ্কিণী দেবী বা তাহার মন্দির সম্বন্ধে দু-একজন বৃদ্ধ লোককে ইহার পর প্রশ্নও করিয়াছিলাম‚ কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় লক্ষ্য করিয়াছি, তাহারা কথাটা এড়াইয়া যাইতে চায় যেন, আমার মনে হইয়াছে রঙ্কিণী দেবী সংক্রান্ত কথাবার্তা বলিতেও তাহারা ভয় পায়।
আমিও আর সে বিষয়ে কাহাকেও কিছু জিজ্ঞাসা করা ছাড়িয়া দিলাম। বছর খানেক কাটিয়া গেল।

স্কুলে ছেলে কম, কাজকর্ম খুব হাল্কা, অবসর সময়ে এ-গ্রামে ও-গ্রামে বেড়াইয়া এ অঞ্চলের প্রাচীন পট, পুঁথি, ঘট ইত্যাদি সংগ্রহ করিতে লাগিলাম। এ বাতিক আমার অনেকদিন হইতেই আছে। নতুন জায়গায় আসিয়া বাতিকটা বাড়িয়া গেল।
চেরো গ্রাম হইতে মাইল পাঁচ-ছয় দূরে জয়চণ্ডী পাহাড়। এখানে খাঁড়া উঁচু, একটা অদ্ভুত গঠনের পাহাড়ের মাথায় জয়চণ্ডী ঠাকুরের মন্দির আছে। পৌষ মাসে বড় মেলা বসে। বি-এন-তার লাইনের একটা ছোট স্টেশনও আছে এখানে।

এই পাহাড়ের কাছে একটি ক্ষুদ্র বস্তিতে কয়েক ঘর মানভূমপ্রবাসী উড়িয়া ব্রাহ্মণের বাস। ইহাদের মধ্যে চন্দ্রমোহন পাণ্ডা নামে একজন বৃদ্ধ ব্রাহ্মণের সঙ্গে আমার খুব আলাপ হইয়া গেল‚ তিনি বাঁকা বাঁকা মানভূমের বাংলায় আমার সঙ্গে অনেক রকমের গল্প করিতেন। পট, পুঁথি, ঘট সংগ্রহের অবকাশে আমি জয়চণ্ডীতলা গ্রামে চন্দ্রমোহন পাণ্ডার নিকট বসিয়া তাঁহার মুখে এদেশের কথা শুনিতাম। চন্দ্র পাণ্ডা আবার স্থানীয় ডাকঘরের পোস্টমাস্টারও। এদেশে প্রচলিত কত রকম আজগুবি ধরনের সাপের, ভুতের, ডাকাতের ও বাঘের (বিশেষ করিয়া বাঘের‚ কারণ বাঘের উপদ্রব এখানে খুব বেশী) গল্প যে বৃদ্ধ চন্দ্র পাণ্ডার মুখে শুনিয়াছি এবং এই সব গল্প শুনিবার লোভে কত আষাঢ়ের ঘন বর্ষার দিনে বৃদ্ধ পোস্টমাস্টারের বাড়িতে গিয়া যে হানা দিয়াছি, তাহার হিসাব দিতে পারিব না।

মানভূমের এই সব অরণ্য সভ্যজগতের কেন্দ্র হইতে দূরে অবস্থিত, এখানকার জীবনযাত্রাও একটু স্বতন্ত্র ধরনের। যতই অদ্ভুত ধরনের গল্প হউক, জয়চণ্ডী পাহাড়ের ছায়ায় শালবনবেষ্টিত ক্ষুদ্র গ্রামে বসিয়া বৃদ্ধ চন্দ্র পাণ্ডার বাঁকা বাঁকা মানভূমের বাংলায় সেগুলি শুনিবার সময় মনে হইত এদেশে এরূপ ঘটিবে ইহা আর বিচিত্র কি? কলিকাতা বালিগঞ্জের কথা তো ইহা নয়।
কথায় কথায় চন্দ্র পাণ্ডা একদিন বলিলেন, ‘চেরো পাহাড়ে রঙ্কিণী দেবীর মন্দির দেখেছেন?’
আমি একটু আশ্চর্য হইয়া বৃদ্ধের মুখেরর দিকে চাহিলাম। রঙ্কিণী দেবী সম্বন্ধে এ পর্যন্ত আমি আর কোনো কথা কাহারও মুখে শুনি নাই‚ সেদিন সন্ধ্যায় আমার ছাত্রটির নিকট যাহা কিছু শুনিয়াছিলাম, তাহা ছাড়া।
বলিলাম, ‘মন্দির দেখেছি, কিন্তু রঙ্কিণী দেবীর কথা জানবার জন্যে যাকেই জিগ্যেস করেচি সে-ই চুপ করে গিয়েচে কিংবা অন্য কথা পেড়েছে‚ এর কারণ কিছু বলবেন?’
চন্দ্র পাণ্ডা বলিলেন, ‘রঙ্কিণী দেবীর নামে সবাই ভয় খায়।‘
‘কেন বলুন তো?’
‘মানভূম জেলায় আগে অসভ্য বুনো জাত বাস করতো। তাদেরই দেবতা উনি। ইদানীং হিন্দুরা এসে যখন বাস করলে, উনি হিন্দুদের ঠাকুর হয়ে গেলেন। তখন তাদের মধ্যে কেউ মন্দির করে দিলে। কিন্তু রঙ্কিণী দেবী হিন্দু দেব-দেবীর মতো নয়, অসভ্য বন্য জাতির ঠাকুর। আগে ওই মন্দিরে নরবলি হ’ত। ষাট বছর আগেও রঙ্কিণী মন্দিরে নরবলি হয়েছে। অনেকে বিশ্বাস করে রঙ্কিণী দেবী অসন্তুষ্ট হলে রক্ষা নেই‚ অপমৃত্যু আর অমঙ্গল আসবে তাহলে। এরকম অনেকবার হয়েছে নাকি। একটা প্রবাদ আছে এ অঞ্চলে, দেশে মড়ক হবার আগে রঙ্কিণী দেবীর হাতের খাঁড়া রক্তমাখা দেখা যেত। আমি যখন প্রথমে এদেশে আসি, সে আজ চল্লিশ বছর আগে কথা‚ তখন প্রাচীন লোকদের মুখে একথা শুনেছিলাম।’
‘রঙ্কিণী দেবীর বিগ্রহ দেখেছিলেন মন্দিরে?’

‘না, আমি এসে পর্যন্ত ওই ভাঙা মন্দিরই দেখচি। এখান থেকে কারা বিগ্রহটি নিয়ে যায়, অন্য কোন দেশে। রঙ্কিণী দেবীর এসব কথা আমি শুনতাম ওই মন্দিরের সেবাইত বংশের এক বৃদ্ধের মুখে। তাঁর বাড়ী ছিল ওই চেরো গ্রামেই। আমি প্রথম যখন এদেশে আসি‚ তখন তাঁর বাড়ী অনেকবার গিয়েচি। দেবীর খাঁড়া রক্তমাখা হওয়ার কথাও তাঁর মুখে শুনি। এখন তাঁদের বংশে আর কেউ নেই। তার পর চেরো গ্রামেও আর বহুদিন যাই নি। বয়েস হয়েছে, বড় বেশি কোথাও বেরই না।’
‘বিগ্রহ মূর্তি কী?’
‘শুনেছিলাম কালীমূর্তি। আগে নাকি হাতে সত্যিকার নরমুণ্ড থাকতো অসভ্যদের অমলে। কত নরবলি হয়েছে তার লেখা-জোখা নেই। এখনও মন্দিরের পেছনে জঙ্গলের মধ্যে একটা ঢিপি আছে‚ খুঁড়লে নরমুণ্ড পাওয়া যায়।’
সাধে এদেশের লোক ভয় পায়! শুনিয়া সন্ধ্যার পরে জয়চণ্ডীতলা হইতে ফিরিবার পথে আমারই গা ছমছম করিতে লাগিল।

আরও বছর দুই সুখে-দুঃখে কাটিল। জায়গাটা আমার এত ভালো লাগিয়াছিল যে হয়তো সেখানে আরও অনেকদিন থাকিয়া যাইতাম। কিন্তু স্কুল লইয়াই বাঙালীদের সঙ্গে মাদ্রাজীদের বিবাদ বাধিল। মাদ্রাজীরা স্কুলের জন্য বেশি টাকাকড়ি দিত, তাহারা দাবী করিতে লাগিল কমিটিতে তাহাদের লোক বেশি থাকিবে। ইংরাজির মাস্টার একজন মাদ্রাজী রাখিতেই হইবে, ইত্যাদি। আমি ইংরাজি পড়াইতাম‚ মাঝে হইতে আমার চাকুরি রাখা দায় হইয়া উঠিল। এই সময়ে আমাদের দেশে একটি হাই স্কুল হইয়াছিল, পূর্বে একবার তাহারা আমাকে লইয়া যাইতে চাহিয়াছিল, ম্যালেরিয়ার ভয়ে যাইতে চাহি নাই। এখন বেগতিক বুঝিয়া দেশে চিঠি লিখিলাম। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এসব কারণে চেরো গ্রামের মাস্টারি আমায় ছাড়তে হয় নাই। কিসের জন্য ছাড়িয়া দিলাম পরে সে কথা বলিব।

এই সময় একদিন চন্দ্র পাণ্ডা চেরো গ্রামে কি কার্য উপলক্ষে আসিলেন। আমি তাঁহাকে অনুরোধ করিলাম আমার বাসায় একটু চা খাইতে হইবে। তাহার গরুর গাড়ী সমেত তাঁহাকে গ্রেপ্তার করিয়া বাসাবাড়ীতে আনিলাম।
বৃদ্ধ ইতিপূর্বে কখনও আমার বাসায় আসেন নাই। বাড়ীতে ঢুকিয়াই চারিদিকে চাহিয়া বিস্ময়ের সরে বলিলেন, ‘এই বাড়ীতে থাকেন আপনি?’
বলিলাম, ‘আজ্ঞে হ্যাঁ, ছোট্ট গাঁ, বাড়ী তো পাওয়া যায় না‚ আগে স্কুলের একটা ঘরে থাকতাম। বছর খানেক হ’ল স্কুলের সেক্রেটারি রঘুনাথন, এটা ঠিক করে দিয়েছেন।

পুরানো আমলের পাথরের গাঁথুনির বাড়ী। বেশ বড় বড় তিনটি কামরা, একদিকে একটা সরু যাতায়াতের বারান্দা। জবরদস্ত গড়ন, যেন খিলজিদের আমলের দুর্গ কি জেলখানা। হাজার ভূমিকম্পেও এ বাড়ীর একটা, চুন বালি খসাইতে পারিবে না। বৃদ্ধ বসিয়া আবার বাড়ীটার চারিদিকে চাহিয়া দেখিতে লাগলেন। ভাবিলাম বাড়ীটার গড়ন তাঁহার ভালো লাগিয়াছে। বলিলাম, ‘সেকালের গড়ন, খুব টনকো‚ আগাগোড়া পাথরের।’
চন্দ্র পাণ্ডা বলিলেন, ‘না, সেজন্য নয়। আমি এই বাড়ীতে প্রায় ত্রিশ বছর আগে যথেষ্ট যাতায়াত করতাম। এই বাড়ীই হ’ল রঙ্কিণী দেবীর সেবাইত বংশের। ওদের বংশে এখন আর কেউ নেই। আপনি যে এ বাড়ীতে আছেন তা জানতাম না। তা বেশ বেশ। অনেকদিন পরে বাড়ীটাতে ঢুকলাম কিনা, আমার বড় অদ্ভুত লাগছে। তখন বয়েস ছিল ত্রিশ, আর এখন হল প্রায় ষাট।’
তারপর অন্যান্য কথা আসিয়া পড়িল। ঢা পান করিয়া বৃদ্ধ গরুর গাড়ীতে গিয়া উঠিলেন।

আরও বছর খানেক কাটিয়াছে। দেশের স্কুলে চাকুরির আশ্বাস পাইলেও আমি এখনও যাই নাই, কারণ এখানকার বাঙালী-মাদ্রাজী সমস্যা একরূপ মিটিয়া আসিয়াছে, আপাতত আমার চাকুরিটা বজায় রহিল বলিয়াই তো মনে হয়।
চৈত্র মাসের শেষ।
পাঁচ-ছয় ক্রোশ দূরবর্তী এক গ্রামে আমারই এক ছাত্রের বাড়ীতে অন্নপূর্ণা পূজার নিমন্ত্রণ রক্ষা করিতে গিয়াছিলাম। মধ্যে রবিবার পড়াতে শনিবার গরুর গাড়ী করিয়া রওনা হই, রবিবার ও সোমবার থাকিয়া মঙ্গলবার দুপুরের দিকে বাসায় আসিয়া পৌঁছিলাম।

বলা আবশ্যক বাসায় আমি একাই থাকি। স্কুলের চাকর রাখহরি আমার রাঁধে। এ কয়দিন স্কুলের ছুটি ছিল, রাখহরিকে আমি সঙ্গে করিয়া লইয়া গিয়াছিলাম। বাহিরের দরজার তালা খুলিয়াই রাখহরি বলিয়া উঠিল, ‘এঃ, বাবু, এ কিসের রক্ত! দেখুন…’
প্রায় চমকিয়া উঠিলাম।
তাই বটে! বাহিরের দরজায় চৌকাঠের ঠিক ভিতর দিক হইতেই রক্তের ধারা উঠান বাহিয়া যেন চলিয়াছে। একটানা ধারা নয়, ফোঁটা ফোঁটা রক্তের একটা অবিচ্ছিন্ন সারি। একেবারে টাটকা রক্ত‚ এইমাত্র সদ্য যেন কাহারও মুণ্ড কাটিয়া লইয়া যাওয়া হইয়াছে।

আমি তো অবাক। কিসের রক্তের ধারা এ! কোথা হইতেই বা আসিল, আজ দু’দিন তো বাসা বন্ধ ছিল। বাড়ীর ভিতরের উঠানে রক্তের দাগ আসে কোথা হইতে? তাহার উপর সদ্য তাজা রক্ত!
অবশ্য কুকুর, বিড়াল ও ইঁদুরের কথা মনে পড়িল। এক্ষেত্রে পড়াই স্বাভাবিক। চাকরকে বলিলাম, ‘দেখ তো রে, রক্তটা কোন দিকে যাচ্ছে‚ এ সেই বড় হুলো বেড়ালটার কাজ…’

রক্তের ধারাটা গিয়াছে দেখা গেল সিঁড়ির নিচের চোরকুঠরির দিকে। ছোট্ট ঘর, ভীষণ অন্ধকার এবং যত রাজ্যের ভাঙাচোরা পুরনো মালে ভর্তি বলিয়া আমি কোনোদিন চোরকুঠরি খুলি নাই। চোরকুঠরির দরজা পার হইয়া বন্ধ ঘরের মধ্যে রক্তের ধারাটার গতি দেখিয়া ব্যাপার কিছু বুঝিতে পারিলাম না। কতকাল ধরিয়া ঘরটা বাহির হইতে তালা বন্ধ, যদি বিড়ালের ব্যাপারই হয়, বিড়াল ঢুকিতেও তো ছিদ্রপথ দরকার হয়।
চোরকুঠরির তালা লোহার শিকের চাড় দিয়া খোলা হইল। আলো জ্বালিয়া দেখা গেল ঘরটায় পুরনো, ভাঙা, তোবড়ানো টিনের বাক্স, পুরানো ছেঁড়া গদি, খাটের পায়া, মরিচাধরা সড়কি, ভাঙা টিন, শাবল প্রভৃতি ঠাসা বোঝাই। ঘরের মেঝেতে সোজা রক্তের দাগ এক কোণের দিকে গিয়াছে রাখহরি খুঁজিতে খুঁজিতে হঠাৎ চিৎকার করিয়া বলিয়া উঠিল, ‘এ কি বাবু! এতে কি করে এমনধারা রক্ত লাগল…’
তারপর সে কি একটা জিনিস হাতে তুলিয়া ধরিয়া বলিল, ‘দেখুন কাণ্ডটা বাবু…’

জিনিসটাকে হাতে লইয়া সে বাহিরে আসিতে তাহার হাতের দিকে চাহিয়া আমি চমকিয়া উঠিলাম।

একখানা মরিচারা হাতলবিহীন ভাঙা খাঁড়া বা রাম দা‚ আগার দিকটা চওড়া ও বাঁকানো বড় চওড়া ফলাটা তাজা রক্তে টকটকে রাঙা! একটু আধটু রক্ত নয়, ফলাতে আগাগোড়া রক্ত মাখানো, মনে হয় যেন খাঁড়াখানা হইতে এখনি টপটপ করিয়া রক্ত ঝরিয়া পড়িবে।

সেই মুহূর্তে এক সঙ্গে আমার অনেক কথা মনে হইল। দুই বৎসর পূর্বে চন্দ্র পাণ্ডার মুখে শোনা সেই গল্প। রঙ্কিণী দেবীর সেবাইত বংশের ভদ্রাসন বাড়ী এটা। পুরানো জিনিসের গুদাম এই চোরকুঠরিতে রঙ্কিণী দেবীর হাতের খাঁড়াখানা তাহারাই রাখিয়াছিল হয়তো‚ মড়কের আগে বিগ্রহের খাঁড়া রক্তমাখা হওয়ার প্রবাদ।
আমার মাথা ঘুরিয়া উঠিল।

মড়ক কোথায় ভাবিতে পারিতাম যদি সময় পাইতাম সন্দেহ করিবার। কিন্তু তাহা পাই নাই। পরদিন সন্ধ্যার সময় চেরো গ্রামে প্রথম কলেরা রোগীর খবর পাওয়া গেল। তিনদিনের মধ্যে রোগ ছড়াইয়া মড়ক দেখা দিল। প্রথমে চেরো, তারপর পাশের গ্রাম কাজরা, ক্রমে জয়চণ্ডীতলা পর্যন্ত মড়ক বিস্তৃত হইল। লোক মরিয়া ধুলধাবাড় হইতে লাগিল। চেরো গ্রামের মাদ্রাজী বংশ প্রায় কাবার হইবার যোগাড় হইল।
মড়কের জন্য স্কুল বন্ধ হইয়া গেল। আমি দেশে পলাইয়া আসিলাম। তারপর আর কখনো চেরোতে যাই নাই। গ্রীষ্মের বন্ধের পরেই দেশের স্কুলের চাকুরিটা পাইয়াছিলাম।

সেই হইতে রঙ্কিণী দেবীকে মনে মনে ভক্তি করি। তিনি অমঙ্গলের পূর্বাভাস দিয়া সকলকে সতর্ক করিয়া দেন মাত্র। মূর্খ জনসাধারণ তাঁহাকে অমঙ্গলের কারণ ভাবিয়া ভুল বোঝে।

Anuprerona
Anupreronahttps://www.anuperona.com
Read your favourite literature free forever on our blogging platform.
RELATED ARTICLES

Most Popular

Recent Comments