
পঁয়তাল্লিশ নম্বর শ্যামবাজার স্ট্রিটের বাড়ির বয়স এ বাড়ির মুড়োয় লেখা আছে, যার থেকে হদিশ পাওয়া যায় বাড়িখানার পত্তন এ শতকে নয়। একশ পুরো না হলেও পঁচাশির কাছাকাছি বয়স গেছে। মা গঙ্গা খুব কাছ দিয়ে বয়ে যাওয়ায় তাঁর জলো হাওয়ায় এবং বঙ্গোপসাগর দক্ষিণে একশ পাঁচ কিলোমিটারের মধ্যে হওয়ায় সাগরের নোনা হাওয়ায়ও বটে কলকাতার বাড়ি ইংল্যান্ডের ঐতিহ্য-সমৃদ্ধ ম্যানর হাউজের মতো দীর্ঘদিন টেঁকে না। তবু বিলিতি কোম্পানির পয়লা নম্বরের জিনিস—মাৰ্বল, থাম, খিলেন, টালি, আসল বর্মা-টিকের জানলা, দরজা, বরগা এবং চুন-বালির বিশ ইঞ্চির গাঁথনি এই সব বাড়ির প্রাচীনত্বকে এখনও সাড়ম্বরে রক্ষা করে চলেছে। সযত্নে পালিশ করা এর প্রাচীনত্ব যার আরেক নাম আভিজাত্য, আরেক নাম প্রশ্নহীন অতীতমুখিতা, আরেক নাম? সংস্কার এবং তা কু-উপসর্গযুক্ত।
মার্বলের সাদা-কালো ছক-কাটা চল্লিশ ফুট লম্বা দালান। এ মুড়ো থেকে ও মুড়ো হাঁটলে তবে কালো পাথরের সিঁড়ি। আবার দালান, একতলার। অমনি চল্লিশ ফুট লম্বা। অমনি সাদা-কালো ছক। তার মাঝামাঝি অবধি হেঁটে গেলে তবে খাবার ঘরের দরজা। এই সমস্তটা হাঁটতে দুপুর দুটো অর্থাৎ ঠিক দ্বিপ্রহরে, ক্লান্ত দুর্বল শরীরটা তার থরথর করে কাঁপতে থাকে। সৈন্য-ব্যারাকের মতো বাড়ির গড়ন। দক্ষিণ চেপে সারি সারি ঘর, দোতলারগুলো তো বটেই, একতলার ঘরগুলোও কলকাতার বিখ্যাত দখিনা পবন সময়মতো পেয়ে থাকে। উত্তরে দালান। লাল নীল সুবজ হলুদ কাঁচ দিয়ে তার মাথায় কারুকার্য। তিন পাট করা জানলার শার্সিতেও তাই। সূর্য উত্তরায়ণে গেলে মার্বলের মেঝের ওপর চার রঙের হোরিখেলা হয়ে থাকে। পূবমুখী বাড়ি। ছাদে উঠলে সূর্যোদয় দেখা যায়। সামনের অনেক দূর পর্যন্ত প্রায় সমান মাপের দোতলা বাড়ি নিয়েই পল্লী। দূরে, ঠিক দুটি তালগাছের মধ্য দিয়ে সূর্যদেব যখন উঠে আসেন তখন শ্যাওলা-ছ্যাতলা-পড়া, টবের ফুল গাছঅলা, এ মুড়ো ও মুড়ো টানা তার বা নারকেল-দড়িতে কাপড়-শুকনো বৃদ্ধ ছাদগুলোও আলোয় আলো হয়ে যায়। কিন্তু জবাকুসুমসঙ্কাশ তরুণ তপনের কাছে তাদের আলোয় আলোকময় হয়ে ওঠবার প্রার্থনা যে জাগেই এমন কথা বলা যায় না। কারণ সেই সব অলৌকিক প্রত্যূষে পাড়ার প্রান্তে টিউব-ওয়েলের ঘটাং ঘটাং একবার চড়ায় ওঠে আবার খাদে নামে, বাসন মাজার ঝনঝন শব্দ, ঝাঁটার শপাং শপাং এবং নিদ্রোত্থিত গৃহিণীদের কর্কশ নির্দেশাদি ভোরবেলার বাতাবরণে এমন একটা দুটো বিবাদী স্বর চড়িয়ে রাখে যে বৈদিক উদাত্ত-অনুদাত্ত-স্বরিতই হোক আর রাবীন্দ্রিক সুরই হোক, বিষণ্ণ মুখে পশ্চাদপসরণ করতে পথ পায় না।
বাড়ির পশ্চিমে খোলা আধকাঁচা উঠোনে চাকরবাকরদের টালি-ছাওয়া পাকা ঘর। মস্ত মস্ত চৌবাচ্চা-অলা কলঘর এবং অযত্নের বাগান। কোথায়, কবে, কোন পাখি ঠোঁটে করে আধ-খাওয়া ফল ফেলে গিয়েছিল। কাঁচা উঠোনের মাটি ফাটিয়ে সেখানে বঙ্কিম ঠামের এক চিরসবুজ, চিরফলন্ত পেয়ারা গাছ। পাশে জোড়া নিম। সে-ও পাখ-পাখালিরই মালিগিরিতে। নিমের ছায়া ভালো, বলে সবাই। এই তিনে মিলে পশ্চিম দিক এমন ছায়া করে রাখে যে দুপুর বারোটার পর সূর্য হেললে শেষ বেলার রোদ আর এ বাড়ি পায় না। পেতে হলে ছাদে উঠতে হবে। দালানে এখন লম্বা ছায়া পড়ে গেছে। উত্তরের শনশনে হাওয়া ঢুকছে লাল-নীল কাচ শার্শির এক আধটা ভোলা পাল্লার ফাঁক দিয়ে। পায়ের তলায় হিমের ছুঁচ। গায়ের কালো পশমি চাদরটা ভেদ করে হাড় হিম করে দিচ্ছে উত্তুরে হাওয়া।
বাড়ির আর সব ঘরে শান্তিনিকেতনী পর্দা ঝুললেও খাবার ঘরের দরজা ফাঁকা। ঢুকতে, বেরোতে এঁটো-কাঁটা লাগবে। বাড়ির ছেলেরা, কর্তারা বাসি-টাসি মানার ধার ধারে না। ওসব পবিত্রতা খালি মেয়ে-মহলের জন্যে। শাশুড়ি বলেন মেয়েছেলের চরিত্তিরেই বাড়ির চরিত্তির। ব্যাটাছেলের দস্তখত আর মেয়েছেলের সহবত। ব্যাটাছেলের এক এক আঁচড় সইয়ে এক এক থলি টাকা উঠে আসবে। আর মেয়েছেলের শীল-শাল, হায়া-লজ্জা, আচার-বিচারেই বাড়ির মান-ইজ্জত। লোকজনের অভ্যেস বড় খারাপ তার ওপর, নোংরা কি ভিজে হাতটা ঝপ করে হয়ত পর্দায় মুছে ফেলল। চোদ্দবার অমন নোংরা হবে দিনে। তার চেয়ে দরজা ন্যাড়া থাক। সেই ন্যাড়া দরজা-পথে দেখা যায় ডান দিক ঘেঁসে খাবার টেবিল পড়েছে, যা এ বাড়ির বড় ছেলে বিদেশ থেকে ফিরে চালু করেছিল অনেক আপত্তি, অনেক মন কষাকষির পর। পাশে ফ্রিজ। তারও বয়স বেশি নয় এবং তাকে চালু করতেও সেই একই মানুষ ও একই রকম মন কষাকষি। সব এঁটো-কাঁটা সকড়ি হয়ে যাবে। প্রথম প্রথম ফল দুধ দই মিষ্টি ছাড়া কিছু থাকত না। এখন সবই থাকে। খালি সকড়ি আর আ-সকড়ির তাক আলাদা। এখন না হলে চলে না। গ্রীষ্মের দিনে শরবত, ঠাণ্ডা জল—পাঁচটা মানুষকে ঠাণ্ডা খাইয়ে কেরামতি দেখাবার জিনিসও বটে। এ জিনিস কিছু সবার ঘরে নেই। বাঁ দিকের কোণে কালো কম্বলের আসন। সামনে পরিষ্কার করে মোছা মেঝের ওপর সাদা পাথরের থালা। কাশীধামের জিনিস। পাশে গেলাস, বাটি, সবই একদম সাদা, শ্বেতশুভ্র পাথরের। পবিত্র নিষ্কলঙ্ক।
থালার ওপর ছোট ডেকচি থেকে আতপান্ন বেড়ে হঠাৎ ডুকরে উঠলেন মাঝবয়সী গিন্নি-বান্নি মানুষটি। চুলগুলি চার ভাগের এক ভাগ সাদা। চওড়া সিঁথিতে চওড়া সিঁদুর। চওড়া লাল নকশি পাড় শাড়ি। তিন থাক দাঁত দেওয়া। এই রকমের রাঙা পাড় শাড়ি ছাড়া উনি পরতে চান না। দু হাত ভর্তি ঝমঝমে চুড়ি লোহা রুলি শাঁখা। কান্নাটি তার চেয়েও ঝমঝমে। কণ্ঠের জোরেও বটে, শোকের জোরেও বটে: ‘কোথায় গেলি রে খোকা! একবার দেখে যা বাছার আমার কষ্টটা দেখে যা একবার। দুধের বাছাকে কেমন করে এ জিনিস ধরে দিই রে!’
বসেছিলেন আরও দুজন। একজন খুড়শাশুড়ি। তিনি চট করে চোখে আঁচল চাপা দিলেন। দ্বিতীয় জন বড় ননদ। তিনি চোখ মুছতে মুছতে উঠে দাঁড়ালেন। এসরাজের আর্তনাদ-মলিন আবহসঙ্গীতসহ এ এমনই এক গা-ছমছমে দৃশ্য যে কোনও এয়োতিই একে বেশিক্ষণ সহ্য করতে পারে না। খাবার জন্য সবে যে ঘরে পা বাড়িয়েছিল, এতক্ষণ দালান হাঁটার ক্লান্তি তার পায়ে, এতক্ষণ পাথরের ঠাণ্ডায় পা পেতে রাখার কালশিটে তার দু পায়ের আঙুলে। শরীরের ভেতরটা দুর্বলতায় এবং আকস্মিক উত্তেজনায় কাঁপছে। হঠাৎ সে বলে উঠল—‘যা দিলে আপনারও কষ্ট হয় না, আমিও খেতে পারি এমন জিনিস দিলেই তো পারেন মা। রোজ রোজ এ নিয়ে এত কান্নাকাটির দরকার কি? আর এ আমি সত্যিই খেয়ে উঠতে পারছি না, পারছি না…।’ শেষের শব্দগুলো বিকৃত রুদ্ধ কান্নায়।
ঘরের মধ্যে যেন অকস্মাৎ বজ্রপাত হল।
বড় ননদ চলে যাবেন বলে ফিরে দাঁড়িয়েছিলেন। সেই অবস্থাতেই একটু ন যযৌ হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে যুগপৎ শাশুড়ি ও বউ-এর মুখ দুটো দেখে নিলেন। তারপর হঠাৎ একটু বেগেই বেরিয়ে গেলেন।
শাশুড়ি সেই যে উদ্যত কান্না গিলে মুখখানাকে নিচু করে ফেলেছেন আর তোলেননি। খুড়শাশুড়ির চোখের জল শুকিয়ে মুখটা কিরকম বিহ্বল হয়ে রয়েছে। যেন তাঁকে কেউ থাবড়া মেরেছে হঠাৎ। আলু-কাঁচকলার হবিষ্যান্ন আজ আর কিছুতেই বন্দনার গলা দিয়ে নামল না। ক্রোধে-ক্ষোভে-লজ্জায় গলার মধ্যে পিণ্ড, পাকিয়ে গেল।
ঊনিশশ’ পঞ্চান্ন সাল সবে আরম্ভ হয়েছে। জানুয়ারির শেষ। শীত খুব জানান দিচ্ছে। এখনও, স্বাধীনতার সাত আট বছর পরেও বুঝি কমলালেবু, আপেল, প্লাম কেকের সাহেবি ডালির প্রত্যাশায় আছে। এ বাড়িতে এই শীতের অর্থ এবার অন্যরকম। এ শীত মৃত্যুর, ক্ষতির, বিষাদের, যে বিষাদের কূল এখনও দূরে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। আজ তিন চার মাস হতে চলল অভিমন্যু ভট্টাচার্য এ বাড়ির বড় ছেলে, বন্দনার স্বামী, চার বছরের অভিরূপের বাবা। যোগীন্দর অ্যান্ড যোগীন্দরের চীফ ডিজাইনার হঠাৎ ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাক হয়ে মারা গেছেন। মারা যাবার বয়স তো হয়ইনি, চল্লিশ ছুঁই-ছুঁই মানুষটিকে কোনক্রমেই ত্রিশের বেশি বলে বোঝা যেত না। এক সময়ে নামী স্পোর্টসম্যানও ছিলেন। ফার্স্ট-ডিভিশন ফুটবলার। বাঁ হাঁটুর মালাইচাকি ঘুরে যাওয়ায় খেলা বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু যোগব্যায়াম, মূলারের ফ্রি-হ্যান্ড এক্সারসাইজ চার্ট এবং ঘড়ি ধরে অনুসরণ করে শরীর-স্বাস্থ্য রেখেছিলেন সোজা, মজবুত, ঘাতসহ, তরুণ। মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত কিছুই বুঝতে পারেননি। কোনও অসুখ-বিসুখের বালাই-ই ছিল না শরীরে। ট্যুরে গিয়েছিলেন মধ্যপ্রদেশ। রাশিয়ার কোল্যাবরেশনে নতুন স্টীল প্লান্ট বসেছে। ট্রেন থেকে নেমে বাড়ি পৌঁছলেন ভর সন্ধেবেলা। মা বাবাকে আসতে যেতে প্রণাম করার রেওয়াজ। বাবার পায়ের ওপর নত হয়েই চট করে উঠে দাঁড়ালেন। বাবা বললেন—‘কি হল রে?’
—‘না কিছু না। আমি চান সেরে আসছি বাবা।’
রূপ চৌকাঠ থেকেই বাবার কোলে ওঠার বায়না নিয়েছিল। সে প্রচণ্ড বাবা-ভক্ত। তার হাতটা ধরে অভিমন্যু বললেন—‘কোলে উঠলে কিন্তু সেই মজার জিনিসটা দোবো না রূপু।’ বাবার হাত ধরে মজার জিনিস পাবার আশায় লাফাতে লাফাতে দোতলায় উঠল ছোট্ট অভিরূপ। ঘরে ঢুকেই বন্দনাকে বললেন—‘বুকে ক’দিন ধরেই একটা চিনচিনে ব্যথা হচ্ছে বুঝলে! কাজের ভিড়ে মন দেবার সময় পাইনি। একটা কার্বো-ভেজ থার্টি বার করো তো বাক্স থেকে!’ বন্দনা ওষুধের বাক্সটা নামিয়েছে তাক থেকে, শুনছে হাসতে হাসতে বলছেন—‘বুকের বাঁ দিক ব্যথা, তার মানে হার্ট, তার মানে ফেল, তার মানে চললুম এ যাত্রায়, বুঝলে কিছু?’
বন্দনা বলল—‘কি হচ্ছেটা কি? সব তাতেই হাসি-ঠাট্টা। যা-তা খেয়েছো বুঝি?’
—‘বাঃ, অফিস পাঠিয়েছে নিজের স্বার্থ দেখতে। খাতিরের খাওয়া চারবেলা, খাবো না?’
—‘খেয়েছে তো ওই সব রিচ রান্না আর …’
—‘ওঃ বন্দনা, তুমি এমন করছো যেন খেয়ে সাঙ্ঘাতিক একটা পাপ করে ফেলেছি। আরে বাবা, খাওয়ার জন্যেই তো জীবন! তবে তুমি রাগ করো না, আমি শুধু বুড়ি ছুঁয়েছি।‘
—‘অর্থাৎ?’
—‘তুমি যেমন কনে-বউ হয়ে ষোড়শ ব্যঞ্জনের বুড়ি ছুঁয়েছিলে ঠিক তেমনি।’
—‘সত্যি?’
—‘সত্যি। আসলে তো চালিয়েছি মাছ-পোড়া, মাংস-পোড়া আর কাঁচা সবজি দিয়ে। তবু যে কেন এই বায়ুপুরাণ!’
বন্দনা বলল—‘এখনও ব্যথা কমছে না? দাঁড়াও আমি এখুনি ডাঃ সেনগুপ্তকে ফোন করে দিচ্ছি।’
—‘আরে দাঁড়াও, দাঁড়াও’ খপ্ করে বন্দনার হাতটা ধরে ফেললেন অভিমন্যু।
—‘কথায় কথায় অত ডাক্তার-বদ্যি কিসের, অ্যাঁ? কার্বো-ভেজে কমছে না দেখলে তবে ঠিক করব এটা বায়ুপুরাণ নয়, হৃৎ-পুরাণ। তখন খাবো একটা স্পাইজেলিয়া সিক্স, নাম শুনেছো জীবনে? তারপর ক্রেটিগাস মাদার গরম জলে কয়েক ফোঁটা ফেলে …।’
বলতে বলতেই অভিমন্যু বাথরুমের দিকে এগিয়েছিলেন। ধবধবে টার্কিশ তোয়ালে এক হাতে, সবুজ বর্ডার দেওয়া, অন্য হাতে পাটভাঙা পায়জামা-পাঞ্জাবি। এ বাড়ির সবাই গামছা ব্যবহার করে, অভিমন্যু ছাড়া। পায়জামার অভ্যাসও অভিমন্যুর একার। বাকি সবাই ধুতি, কিম্বা লুঙ্গি। এসব খানিকটা বিদেশে গড়ে ওঠা অভ্যাসও বটে, খানিকটা বন্দনার ইচ্ছের জোরেও বটে। অভিমন্যুর চোখের তলায় সামান্য কালি, ঘুমোতে না পারার, সর্বক্ষণ ঘিনঘিনে ব্যথা লেগে থাকার। পরিষ্কার কামানো মুখে একটু এই এতটুকু সবুজ শ্যাওলার ছোপ। মুখে নির্ভেজাল সরল, বিজয়ীর হাসি। দৃশ্যটা চোখ বুজলেই চোখের সামনে ভাসে।
বাথরুম বন্ধ করবার পরই হঠাৎ সেই অব্যক্ত যন্ত্রণাময় চিৎকার—‘বন্দনা-আ-আ।’
সুটকেস থেকে জামাকাপড় বার করছিল বন্দনা। খাটের গায়ে একে একে সাজিয়ে রাখছে। ব্যবহৃত রুমাল, গেঞ্জি, আন্ডারওয়্যার সব বালতিতে। শার্ট তোয়ালে, পায়জামা, পাঞ্জাবি ধোবার বাক্সে ফেলবে বলে জড়ো করছে। সেই চিৎকার যেন বুকের মধ্যে দমাস করে একটা শেল ফাটালো।
—‘বন্দনা-আ-আ-আ।’
বাথরুমের দরজাটা কোনমতে খুলে দিয়ে মেঝের ওপর শুয়ে পড়েছিলেন। চোখ দুটো ক্রমেই বড় হয়ে উঠছে। সে কি যন্ত্রণায়? ভয়ে না বিস্ময়ে?
—‘কলি কলি, শিগগিরই সেনগুপ্তকাকাকে ফোন কর’ —বলতে বলতে বন্দনা মাথাটা কোলে তুলে নিয়েছে, তার ঘোমটা খসে পড়েছে, চুল এলানো, কাঁধের ওপর এখনও অভিমন্যুর একটা শার্ট, ধোবাকে দেবে না নিজে কাচবে, বিচার করছিল বলে কাঁধের ওপর তুলে রাখা, পড়ি-মরি করে চতুর্দিক থেকে ছুটে আসছে ননদ কলি, মিলি, কাকিমা, শাশুড়ি। ছেলেরা বাড়িতে কেউ নেই। শ্বশুরমশাই ভাগ্যিস আজকাল রোজ কোর্টে যান না। তাঁর খড়মের দ্রুত আওয়াজ—‘ওকে আগে একটু কোরামিন দাও, কোরামিন দাও, দশ পনের ফোঁটা। নেই? তোমাদের বাড়িতে কি কিছু থাকে না? কলি, ফোনটা করেছো? সে কি? হাত কাঁপছে, দাও, আমায় দাও, সামান্য একটা কাজও কি মেয়েদের দিয়ে হবে না?—হ্যালো, সেনগুপ্ত, সেনগুপ্ত আমি কাশীনাথ। ‘কাশী, ছেলের বোধহয় স্ট্রোক হচ্ছে, করোনারি, শিগগিরই এসো, দেরি নয়।’
ডাক্তার এসে মৃত্যু-যন্ত্রণার অন্তিম পর্ব দেখলেন। অক্সিজেন-সিলিন্ডারটা পৌঁছলো প্রয়োজনের ঠিক পঁয়ত্রিশ মিনিট পরে। ততক্ষণে সব শেষ।
তিন মাস কাবার হয়ে চার মাসে পড়ল সময়। আকস্মিক এই মৃত্যুর সীমাহীন আতঙ্ক ও বীভৎসতা এখনও পর্যন্ত বন্দনাকে বোবা করে রেখেছে। প্রস্তরীভূত। জড়বৎ। শুধু মাঝে মাঝে অগ্ন্যুৎপাত হয়। ঘুমের ঘোরে সে বিছানার চাদর মুঠো করে আঁকড়ে আপ্রাণ চিৎকার করে ওঠে। স্বামীর সেই অমানুষিক যন্ত্রণায় বিকৃত মুখের ছবি, সেই ভয়বিস্ফারিত কেমন যেন অবাক হয়ে যাওয়া শেষ অভিব্যক্তি ঘুমের মধ্যে থেকে থেকে হানা দেয়। শুধু একবার রুদ্ধ কণ্ঠে বলতে পেরেছিল—‘আমি কি মরে যাচ্ছি বন্দনা? আমি কি সত্যি-সত্যি মরে যাচ্ছি?’
মৃত্যুর জন্য কোনও প্রস্তুতি ছিল না ভদ্রলোকের। কর্মব্যস্ত, পরিপূর্ণ জীবনযাপনে মগ্ন আনন্দমুখর জীবনটার মাঝখানে থেকে মানুষটাকে যেন কেউ নির্মম হাতে ছিঁড়ে নিল।
শুধু স্বামী বলে নয়, অসামান্য প্রিয়জন বলেই নয়, বন্দনা যেন কোনও সম্পূর্ণ তৃতীয়-ব্যক্তির চোখ দিয়ে ঘটনাটাকে দেখতে পায়, এবং দেখে তৃতীয় ব্যক্তি হয়েও যন্ত্রণায় আছাড়ি-পিছাড়ি করতে থাকে। লম্বা-চওড়া, সুঠাম স্বাস্থ্যবান মানুষটা। সব সময়ে হুল্লোড়ে, হাসিতে, আড্ডায় সবাইকে মাতিয়ে রাখত। আত্মীয়মহলে তো বটেই, অফিসে-ফ্যাকটরিতে পর্যন্ত কি জনপ্রিয় ছিল সব কিছু হেসে উড়িয়ে দেবার এই ক্ষমতায়। ওয়ার্কার-মহলের মুখভার, ম্যানেজমেন্ট আগে খুঁজবে ভটচায্যি সাহেবকে। পার্সোনেল-এর দায় তাঁর নয়, জনসংযোগের দায়ও তাঁর নয়, তবু এসব ব্যাপারে কোনও গুরুতর সমস্যা হলে ভট্চায্যির ক্যারিশমার ওপর সবাইকার প্রথম আস্থা। পরিপূর্ণ জীবনের প্রতিমূর্তি যেন। আহা! যখন সব শেষে শুয়েছিল। মুখটা কালো, কার প্রতি যেন দুরন্ত অভিমানে চোখ দুটো ঈষৎ বিস্ফারিত হয়ে আছে। বন্দনা, আমি কি সত্যি সত্যি মরে যাচ্ছি? সে দৃশ্য দেখে বুকফাটা আর্তনাদ করে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল বন্দনা। শুধু বেঁচে থাকার আহ্লাদেই যে অষ্টপ্রহর আটখানা হয়ে থাকত, সেই মানুষটির অকালমৃত্যুর কাছে তার ব্যক্তিগত শোকও যেন নগণ্য।
ভয়ঙ্কর কিছু একটা করতে ইচ্ছে যায়। দৌড়ে গিয়ে চিতায় উঠে পড়া, কিম্বা ছাদের ওপর থেকে লাফ খাওয়া, কিম্বা গঙ্গায় ঝাঁপ, কেরোসিন গায়ে ঢেলে লকলকে আগুনের বেড়ে…। বীভৎস কিছু একটা। তুলসীচন্দন দিয়ে চোখের পাতা দুটি আস্তে বুজিয়ে দিচ্ছেন শাশুড়ি। ছেলের মাথাটি কোলের ওপর আড় হয়ে পড়েছে। সেই শিশুকালের মতো, সন্ধের ঝোঁকে যখন শেলেট-পেনসিল হাতে জাদুর চোখে ঘুম আসত। সারা মুখটা মায়ের চোখের জলে ভেজা। মেজ ছেলে শান্তিপুরের নতুন ধুতি আনছে। ছোট ছেলে কুঁচনো চাদর। পাড়া-প্রতিবেশীদের সঙ্গে ছেলেদের বন্ধু-বান্ধবরা ফুল, অগুরু, খই, ফুটো পয়সা। মৃদু গলায় মাসতুত ভাইটি ডাকল ‘বল হরি।’ ‘হরিবোল’ গলা বসে গেছে ভাইদের, তাবৎ শ্মশানযাত্রীর। হরিনাম নয়, পুরুষ কণ্ঠের দুর্লভ কান্না। এক দিক দিয়ে ছেলেকে বার করা হচ্ছে, যে মাত্র ঘণ্টাকয় আগে সুটকেস হাতে এই গেট দিয়েই ঢুকেছিল। আরেক দিক দিয়ে অজ্ঞান অচৈতন্য বউটির দেহ কেউ মাথার দিকে, কেউ পায়ের দিকে, কেউ কোমরের কাছে ধরে পৌঁছে দিয়ে যাচ্ছে সাদা, ঠাণ্ডা, খালি ঘরে। ছেলের জন্য ডাকা ডাক্তারের বিদ্যা বউয়ের চিকিৎসায় কাজে লাগছে এবার।
শ্রাদ্ধ? শেষ কাজ। সে তো করতেই হয়। গুরুজনের চোখের ওপর দিয়ে কনীয়ানের প্রেতকার্য। শ্রাদ্ধের দিন বাড়ির যেখানে যত ঠাকুর দেবতার ছবি ছিল সব আছড়ে ভাঙছিল বন্দনা। কোথা থেকে তার শরীরে এত জোর, এত ক্রোধ এল সে জানে না। ময়না ডালের কীর্তন দিয়েছেন কর্তা। সবাই সেইখানে। মাথুর পালায় ভাবাবেশে ঘন ঘন মূর্ছা হচ্ছে মূল গায়েনের, হুঙ্কার দিয়ে চলছে দোহারকি। সেরেস্তা-ঘরে শ্রাদ্ধ-কর্ম। বৈঠকখানায় একদিকে শান্তিপর্ব, আরেকদিকে গীতা পাঠ। পাল্লা দিয়ে চড়ছে, নামছে পণ্ডিতদের গলার স্বর। কাকার কোলে-বসে সদ্য চার বছর অতিক্রান্ত অভিরূপ শ্রাদ্ধ ঘরে। রোগিণীর কাছে তখন কেউ ছিল না। হঠাৎ আছড়ে পিছড়ে কাচ-ভাঙার শব্দে সব এক এক করে ছুটে এসেছিল। কৃষ্ণ, কালী, অন্নপূর্ণা, গুরুদেব যা যা পেয়েছে আছড়ে-আছড়ে ভাঙছে বউ। মুখ দিয়ে গাঁজলা উঠছে। হাত-ভর্তি রক্ত। বাড়িতে ওর হাতের কাছে সত্যি এতো ঠাকুরের ছবিও তো ছিল। ঠাকুরের ছবি ঘরে রাখলে, ঘর নিরাময় হয়, সুখে-শ্রীতে উছলে পড়ে সংসার এই বিশ্বাস। ইনজেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছিল দিনের পর দিন। সেই অসহায় নিদ্রার মধ্যে দিয়েই পাড়া ভেঙে ব্রাহ্মণ ভোজন হল। বাড়ির বড় ছেলে, রাজার মতো ছেলে গেছে, কেউ যেন বাদ না যায়। সে যা-যা খেতে ভালোবাসত তা সবাই খাক। বিশ্বাত্মা পরিতৃপ্ত হোক। তারপর এঁরা সব মাছ-হাত, মাছ-মুখ করলেন সাতাশ বছরের অচৈতন্য উন্মাদিনী শাঁখা ভেঙে, লোহা খুলে, হা-হা সিঁথি, শুকনো-মুখ, সাদা-কাপড়ে পরিত্যক্ত ভিখারিণীর শবের মতো পড়ে রইল একধারে। এই বিয়োগান্ত সামাজিক নাটকের আসল নায়ক যে এই নায়িকা এই রুক্ষকেশী, ধূম্রলোচনা, ধূমাবতী এ কথা কুশীলবদের কারও খেয়াল রইল না।
দিনের পর দিন। সকাল থেকে রাত, রাত থেকে সকাল নিত্যকর্ম হল ঘুম। ঘুম, ঘুম আর ঘুম। যাতে কোনও ছিদ্রপথে শোক ঢুকে না পড়ে তার চূড়ান্ত ডাক্তারি ব্যবস্থা। শরীর রক্ষার জন্য এক ঘুম থেকে জেগে উঠে আরেক ঘুমে চলে যাবার হাইফেন-সময়ে সামান্য কিছু খেয়ে নেওয়া, স্নায়ুতন্ত্র ভয়ঙ্কর বিচলিত থাকায় সেই খাবারও প্রায়শই বমি করে ফেলা। অতঃপর দুর্বল ঘুরন্ত মাথা, টলমলে দেহটাকে টেনে এনে আবার শয্যায় ফেলে দেওয়া। সবাই ভেবেছিল এ জীবনটাও বরবাদই হয়ে গেল বুঝি। বাড়ির প্রথম শিশুটির বুঝি সম্পূর্ণ অনাথ হতে আর দেরি নেই। শুধু বুড়ো ডাক্তার সেনগুপ্ত মাথা নেড়ে নিঃশ্বাস ফেলে বলেছিলেন: ‘ভরা যৌবনের জীবন, তার ওপর স্ত্রী-শরীর, এতো আদরের শরীর, যত্নের স্বাস্থ্য, ও কি সহজে যায় মা!’
একদা একদিন এইরকম ওষুধ-ঘুম থেকে সহসা জেগে উঠে বন্দনা বুঝতে পারছিল না সে কোথায়। তার চোখের সামনে তখন একটা ফিকে নীল পট। তাতে লম্বা কালোকালো ডোরা আর মাঝে একটা ছোট্ট কালো বল। কিছুই মাথায় নিচ্ছিল না। মাঠ তো সবুজ হয়! নীল মাঠ? ডোরাগুলো কি? ওই বল কোন খেলার? কোন খেলুড়ির? কখন সে খেলা শুরু হবে? দুর্বল মস্তিষ্কে এই সব অস্ফুট প্রশ্ন ঘোরাফেরা করছিল। তারপর একটা খয়েরি চিল, যাকে বন্দনার চোখে কালোই দেখাল, হঠাৎ বাচ্চা ঘোড়ার মতো তীব্র হ্রেষাধ্বনি করে ঝপ করে ঝাঁপিয়ে পড়ল একটা কালো ফুটকির ওপরে, বন্দনা সহসা বুঝতে পারল এটা চিল, ওটা পায়রা, দলছুট বেচারা পায়রা, নীল বিস্তারটা মাঠের নয়, আকাশের। ডোরার মতো দেখতে ওগুলো গরাদ। সংসার কারাগৃহের লৌহগরাদও বটে আবার পঁয়তাল্লিশ নম্বর শ্যামবাজার স্ট্রিটের দোতলার ঘরের দক্ষিণের জানলার গরাদও বটে।
এই সময়ে ছোট কালো বলটা নড়েচড়ে উঠল। খোঁচা খোঁচা চুলে ভরা একটা ছোট্ট শিশু মাথা। ওর বাবা নেই। মা থেকেও নেই। বিশাল সংসারে ছোট্ট পাঁচ বছরের রূপ একা। এখনও সেই ঘর সেই-ই আছে। কিন্তু হায়, আশ্রয় নেই আর। রূপ সেই প্রচণ্ড প্রতারণার দিকে মহানির্বেদে পেছন ফিরে কিসের প্রত্যাশায় আকাশমুখে দাঁড়িয়ে রয়েছে সে জানে না। ভীষণ রোগা। কাঁধের হাড় দুটো উঁচু হয়ে আছে। কচি মাথাটা কুচকুচে কালো কদমছাঁট চুলে ছাওয়া। বন্দনার ঠিক পায়ের কাছে খোলা জানলাটা। তার ফ্রেমে আটকে আছে আকাশ। স্তূপের পর স্তূপ মেঘপাহাড়। একটা স্তূপের ওপারে সূর্য। আলোর ছটা বিকীর্ণ হয়ে পড়েছে সারা আকাশ জুড়ে। পাহাড়-পর্বতের মাথা জাগানো সেই আকাশ-সমুদ্রে সাঁতার কাটছে একলা স্বভাবের চিল, ঘুরপাক খাচ্ছে তীব্র শিসের শব্দের সঙ্গে সঙ্গে দলবদ্ধ পায়রা।
এই ছবিটা বোধহয় বন্দনার চিরকাল মনে থাকবে। উদার আকাশের পটে পিং পং বলের মতো একটি শিশুমস্তক। একদিকে বিরাট আর একদিকে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র। কী অনন্ত, অবাধ! কী সীমাবদ্ধ, ভঙ্গুর, কী শক্তিহীন!
বুকের মধ্যে যেন বাঘে আঁচড়াচ্ছে। বন্দনা খাট থেকে তাড়াতাড়ি নামতে গিয়ে হোঁচট খেলো, বুঝতে পারল তাড়াতাড়ি চলাফেরা করার শক্তি তার নেই। আস্তে আস্তে পা টিপে-টিপে এগিয়ে গিয়ে পেছন থেকে ছেলেকে বুকের মধ্যে টেনে নিল। রূপ প্রথমে বুঝতে পারেনি কে। মা প্রাণপণে তার চোখ টিপে ধরে আছে।—‘কে?’ আঃ ছাড়ো না! কে? ছোট্ট অভিরূপ চিলের গলায় চেঁচায়। কেমন বিরক্ত, খ্যাপাটে সুর।
—‘ভাল্লাগছে না বলছি, ছাড়ো! ছাড়ো না!’
বন্দনা ওর চিবুকটা ধরে আস্তে আস্তে সামনে ঘোরায়। মাতৃস্পর্শ ভুলে গেছে ছেলেটা। আসলে মাতৃস্পর্শ-মাতৃগন্ধ তো কোনও অলৌকিক ব্যাপার নয়, চুড়ির রিনিঝিনি, বিশেষ পাউডার বা মাথার তেলের গন্ধ সমস্ত মিলিয়ে মাতৃ-আবহ। বন্দনাকে দেখে অবাক হয়ে তাকাল, তারপর তার ছোট্ট দুটো তুলতুলে ঠোঁটে হঠাৎ জোয়ার এল। বন্দনা দেখছে ঠোঁট ফুলে ফুলে উঠছে, চোখের কূল ভরে ভরে উঠছে। ছেলের মুখ বুকের মধ্যে গুঁজে নিয়ে বন্দনা মনে মনে বলল—‘ঈশ্বর যদি না-ই থাকেন, রূপু তোর আমি আছি। বিশ্বজননী যদি তাঁর কর্তব্য ভুলে যান, তোর এই শক্তিহীন মা একাই সংগ্রাম করবে।’ রূপ ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। তার মায়ের মনে হল ও যেন শুধু অভিরূপই নয়, অভিমন্যুও। নির্মম বিশ্বপ্রকৃতির হিংস্র হাতের মুঠোয় অসহায় মানুষ। বলছে—‘আমাকে কেড়ে নিও না। পৃথিবী বড় সুন্দর। আমাকে আর একটু বাঁচতে দাও।’ দাঁতে দাঁত চেপে বন্দনা বলে—‘আমাকে শেষ না করে তোকে কেউ আর নিতে পারবে না। একবার হেরেছি তাই বলে কি বারবার হারব?’
অধ্যায় ২
—‘মা!’ দেশ থেকে-আসা রাশীকৃত তেঁতুল কুটে কুটে জড়ো করছিলেন দুই জায়। কিছু হবে ছড়া-তেঁতুল, কিছু হবে তেঁতুলের কাই-আচার। তাছাড়াও অম্বলে, রান্নায়, বাসন-মাজার…সারা বছরের ব্যবস্থা। ডাক শুনে চমকে মুখ তুলে তাকালেন।—‘ওকি বউমা, তুমি! কি দরকার? ডাকলে না কেন? নিচে নামলে কি করে? কি সর্বনাশ, যদি পড়ে যেতে।’ শশব্যস্তে উঠে দাঁড়ালেন শাশুড়ি। আঁচল খসে পড়ল চাবিশুদ্ধ ঝনাৎ করে।
—‘পড়ে যাব কেন? রূপু বলছে খিদে পেয়েছে।’ কেমন শূন্য চোখে তাকাল বন্দনা,—‘এখন ও কি খায়?’
সব ভুলে গেছে ও। ছেলে কখন খায়, কি খায় কিচ্ছু মনে নেই। দুজনে চোখ চাওয়া-চাওয়ি করলেন, শেষে কাকিমা বললেন,—‘এই তো মা, এক্ষুনি চান করেই ভাত খাবে। এখন তো আর কিছু খায় না। বায়নাদেরে হয়েছে তো খুব। দাঁড়াও আমি দেখছি।’ কাকিমা বঁটি কাত করে রাখলেন।
বন্দনা তাড়াতাড়ি বলে উঠল—‘না, না, বায়না করেনি, খিদে পেয়েছে ওর। আমি চান করিয়ে দিচ্ছি কাকিমা। তার আগে খাওয়ার মতো কিছু নেই?’
কাকিমা তাকালেন বড় জায়ের দিকে, চিন্তিত মুখ। শাশুড়ি বললেন—‘আচ্ছা একটা কমলালেবু দিচ্ছি, এইটে খেতে বল ততক্ষণ। অন্য কিছু খেলে খিদে নষ্ট হয়ে যাবে।’
লেবুটা হাতে করে সিঁড়ির দিকে এগোল বন্দনা। সে যেন নতুন করে হাঁটতে শিখছে। তার ননদ কলি নেমে আসছে দোতলা থেকে। তরতর করে। দুদিকে দুবেণী। কাঁধে ব্যাগ, কলেজ যাচ্ছে নিশ্চয়ই। সসম্ভ্রমে সরে দাঁড়াল—‘বউমণি, তুমি যে নিচে নেমেছ? কখন উঠলে? কখনই বা নামলে? খোকামণি কোথায়?
বন্দনা লেবুটা তুলে ধরে কৈফিয়তের সুরে বলল—‘এই যে, খোকার জন্যে লেবু নিয়ে যাচ্ছি। ওর খিদে পেয়েছে।’ কিরকম যেন বাচ্চা, ভীতু বালিকার মতো কথাগুলো। অসংলগ্ন।
কলি বলল—‘এস বউমণি, আমি তোমায় ওপরে পৌঁছে দিই।’
—‘তোমার কলেজের দেরি হয়ে যাবে না?’ রেলিং ধরে ধরে আস্তে আস্তে উঠতে উঠতে বন্দনা বলল—‘আমি ঠিক উঠতে পারব।’
কলি একবার ওপরে তাকাল, একবার নিচে। আর দেরি করলে সত্যিই ফার্স্ট পিরিয়ডটা মিস হয়ে যাবে। লেকচারের মাঝখানে ক্লাসে ঢোকা একদম পছন্দ করেন না এ কে বি। সে দু তিনটে সিঁড়ি টপকে এক লাফে নিচে নামল, আবার পেছন ফিরে তাকাল—‘বউমণি ধরে ধরে যাও। মাথা ঘুরে গেলে মুশকিল হবে। আমি আসছি তাহলে।’
বউমণিকে দেখলেই আজকাল কেন কে জানে বড়দার বিয়ের দৃশ্যগুলো মনে পড়ে যায়। বাসি বিয়ের দিন সন্ধেবেলায় রান্নাঘর থই-থই করছে অন্ন-ব্যঞ্জনে। বিশাল একটা রুপোর থালায় সব কিছু-কিছু উঠেছে, রুপোর বড় মেজ, সেজ, রাঙা, ফুল, ছোট বাটিতে হরেক ব্যঞ্জন। বড় রুই মাছের মুড়ো ল্যাজা। বাটি থেকে উঁচিয়ে রয়েছে। পায়েসের সুগন্ধে রান্নাঘর ম’ম। রান্নাঘরে বামুন ঠাকুর, মা, কাকিমা। চাঁদের আলো রঙের শাড়ি, লাল ব্লাউজ, এক গা গয়না পরে নতমুখে বউমণি এসে দাঁড়াল। মা বললেন—‘দ্যাখো বউমা, চোখ চেয়ে দ্যাখো ভালো করে, এই সব তোমার। তোমার রসুইঘর। তোমার অন্ন। তোমার ব্যঞ্জন। তোমার কল্যাণে এইরকম রোজ রোজ হবার সামর্থ্য হোক আমার খোকার।’ কাকিমা হেসে বললেন—‘মনে মনে “উইশ’’ করো।’ মা ঝঙ্কার দিয়ে বলে উঠল—‘উইশ-ফুইশ আবার কি রে ছোট গিন্নি? একটি বর আমরা ওকে দিয়েছি, আর দুটি বর ও দেব্তাদের কাছ থেকে আমাদের জন্যে মেঙে নিক।’
—‘তা ও পারবে, যা লক্ষ্মীমন্ত বউ তোমার,’ কাকিমা বন্দনার থুতনিতে আদর করে বলেছিলেন। পেছনে কখন বড়দা এসে দাঁড়িয়েছে। বরেরা তো বাসিবিয়ের দিনেই বউয়ের পেছনে সবচেয়ে বেশি ঘুরঘুর করে! তা বড়দা বলল—‘আর বর চেয়ে আমাকে ফ্যাসাদে ফেলে কাজ নেই। এই সমস্ত রান্না যদি রোজ হয় তাহলে ফার্স্ট থিং তো মা আর কাকিমাকে সারাক্ষণ হেঁশেলেই কাটাতে হবে, আর এই সব খেয়ে কলিটার এইসান পেট ছাড়বে…’
কলি প্রচণ্ড প্রতিবাদ করে উঠেছিল—‘আহা, খালি আমারই, না? আর সবার বুঝি সোনায় গড়া পেট?’
বড়দি বলল—‘তুই আর সরু গলায় চেঁচাসনি। একেই তো সানাইয়ের প্যাঁপোঁয় কাজ-কর্ম করা দায় হয়ে উঠেছে। কেউ কারও কথা শুনতে পাচ্ছি না। এই দাদা, তুই এখন এখানে ঘুরঘুর করছিস কেন রে? কালরাত্রির দিন বউয়ের মুখ দেখলে কি হয় জানিস?’
—‘কি হয় বল না রে খুকি! তুই একটা অথরিটি লোক। আমাদের একটু শেখা-টেখা!’
—‘খবর্দার ঠাট্টা করবি না। কি হয় মুখে উচ্চারণ করতে নেই, তা জানিস? যা যা ভাগ এখান থেকে, ভাগ বলছি।’
কাকিমা এই সময়ে বললেন—‘না, না, জন্মের ভাত-কাপড়টা ওকে দিয়ে দিইয়ে দাও, নিয়ে-টিয়ে বন্দনা বউ একেবারে ঘরে যাক।’
ফুলকাটা পেতলের ট্রেতে করে সুতরাং কাপড় এল, সেটা দু আঙুলে তুলে দাদা বলল—‘জন্মের ভাত কাপড়? বাব্বাঃ বাঁচা গেল। এই নাও বাবা, জন্মের মতো দিয়ে দিলাম। এরপর একদম ফ্রি।’
বউমণি মুখ নিচু করে মিটিমিটি হাসছে। বড়দি ঝঙ্কার দিয়ে উঠল—‘ফিচলেমি হচ্ছে, না? এটা সিম্বলিক তা জানিস। সারা জীবন যত অন্ন বস্ত্র লাগে সবই দিতে হবে। এক্সট্রাও অনেক দিতে হবে। জন্মদিন, বিবাহবার্ষিকী, আরও নানান খানান আছে, সে সব এখনই ফাঁস করছি না। কি বল, বন্দনা?’
দাদা ভালোমানুষের মতো মুখ করে বলেছিল—‘যাক তোদের সিম্বলে যখন শাড়ি দিয়েছিস, শাড়ির ওপর দিয়েই যাবে শুধু, তারপরই ফ্রি।’—‘কিসের অত ফিরি ফিরি করছিস রে মুখপোড়া?’ পিসিমা এসে পড়েছেন। পিসিমা এসে না দাঁড়ালে যজ্ঞিবাড়ি ঠিক জমে না। বললেন—‘তুই আর ফ্রি নেই। আষ্টে-পৃষ্ঠে বাঁধা-ছাঁদা হয়ে গেছিস, বুঝলি?’
কলি রাস্তা পার হয়ে বাস স্টপে এসে দাঁড়াল। অনেক দিন সে ভালো করে বউমণিকে দেখেনি। নিজের ঘরে শুয়ে বসে থাকে, বাইরে বেরোয় না, বউমণির এই অসুখ, এই বিষাদকে কলি ভয় পায়। খোকামণি তার কাছে একবার, খুড়তুত বোন মিলির কাছে একবার খায়, মায়ের কাছে ঘুমিয়ে পড়ে, কাকাদের ছায়ায় ছায়ায় ঘোরে। ওকে স্কুলে দেবার কথা হচ্ছে। কিছুটা সময়ও অন্তত সমবয়সী বাচ্চাদের সঙ্গে মিশে ভুলে থাকবে। কিন্তু বাড়িশুদ্ধ সবাই যেন আস্তে আস্তে ভুলে যাচ্ছে বউমণি বলে একটা জ্বলজ্যান্ত মানুষ এখানে আছে। সে কি ছিল, আর কি হয়েছে! আজ সিঁড়ি দিয়ে তাকে টলতে টলতে উঠতে দেখাটা কলির কাছে একটা মস্ত ধাক্কা। ও যে এমন হয়ে গেছে, এত রোগা শ্রীহীন, একটা রঙচটা কাঁচকড়ার পুতুলের মতো তা কলি আগে খেয়াল করেনি।
কনডাকটর বলল—‘টিকিট দিদি টিকিট।’
নামবার সময় হয়ে এসেছে, কলি তাড়াতাড়ি ব্যাগ খুলে পয়সা বার করে দিল। একদম অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিল।
‘কলি, তুমি শাড়ি পরতে ভালোবাস?’ নতুন বউদি সামনে একগাদা সিল্কের শাড়ি মেলে বলছে। চোদ্দ বছরের কলি সবে শাড়ি ধরেছে, বাইরে শাড়ি, বাড়িতে ফ্রক, এখনও সামলাতে পারে না, কিন্তু শাড়ি তার প্রাণ, ঘাড় নেড়ে বলছে—হ্যাঁ-অ্যাঁ-অ্যাঁ।
—‘এইগুলোর থেকে যেটা ইচ্ছে বেছে নাও।’
সবচেয়ে সুন্দরটা, লাল-নীল-হলুদ ফুল ফুল ঝকঝকে জমকালোটা কলি বেছে নিচ্ছে। মেজদা বসে বসে বউদির সঙ্গে গল্প করছিল। নতুন বউয়ের সঙ্গে গল্প করতে সবারই ভালো লাগে। সে বউ যদি আবার এমনি শিক্ষিত, এমনি হাসি-খুশি, রসিক, এমনি মিষ্টি হয়। মেজদা বলল—‘এ হে হে হে, কলি, টিকেয় আগুন হয়ে যাবে যে রে শেষটায়।’ বউমণি বলে উঠল—‘এ কি কথা মেজদা! কলি তো একদমই কালো না। তাছাড়াও চাপা রঙে লাল খুব সুন্দর খোলো।’
কলি মুখ গোঁজ করে বসে আছে। নেবে না ওই শাড়ি, কিছুতেই না। মেজদা বললে—‘পাচ্ছিস নিয়েই নে। সেই কবে তোর বর দেবে তার জন্যে হত্যে দিয়ে বসে থাকাটা কি ঠিক?’
—‘কেন দাদারা বুঝি দিতে পারে না?’ বউমণির চোখে ছদ্ম তিরস্কার।
—‘আরে সেই কথাই তো বলছি।’
—‘আরে সেই কথাই তো বলছি। আমার কাছে লবডঙ্কা। আমার বউ এলেও আগে থেকে বলে দেবো, এ বাড়ির বড়বউ একটা শাড়িছত্রের গোলমেলে প্রিসিডেন্ট ক্রিয়েট করে গেছেন, তুমি যেন সেইমতো চলো না, নৈব নৈব চ।’ মেজদা হাসতে হাসতে বলছে কিন্তু কলির গায়ে যেন হুল ফুটছে। সে কি ভিখারি? চাইতে এসেছে? বউমণি ভালোবেসে দিচ্ছে তাই। সে-ও বউমণিকে দেবে। বউমণি রেগে গেছে—‘মেয়েদের ব্যাপারে কেন নাক গলাতে আসেন বলুন তো? আপনি এখন যান। আমরা দুজনে এখন সব গুছিয়ে তুলব। হয় যান, নয় বসে বসে দেখুন। একটাও কমেন্ট নয়। আর আপনার বউ আপনার হাতে পড়বার আগে আমাদের হাতে পড়বে, তখনই তাকে যা শেখাবার শিখিয়ে দেবো। কি বল কলি?’
চার দাদার কোলের বোন। বড়দার পরে অবশ্য বড়দি। একেবারে পিঠোপিঠি। কিন্তু কলির প্রায় শৈশব অবস্থায় বড়দির বিয়ে হয়ে গেছে। চার দাদার যত আদর, যত ঠাট্টা-ফাজলামি সব কলিকে নিয়ে। এমন পেছনে লাগত যে কাঁদিয়ে ছেড়ে দিত। মেজদাকে বার করে দিয়ে বউমণি দরজায় খিল তুলে দিল, বলল—‘নাও, এবার নাও।’
—‘নেওয়ার কি আছে বউমণি, থাক না তোমার আলমারিতে। যখন দরকার হবে তখন পরব,’ কলির অভিমান এখনও যায়নি।
—‘সে তো পরবেই। আলমারির সব শাড়িই যখন দরকার হবে পরবে। একটা তোমার নিজস্ব করে নাও। নাও কলি, লক্ষ্মীটি, না হলে আমি ভীষণ দুঃখ পাব।’
—‘তাহলে তুমি বেছে দাও। আমি তো বুঝতে পারি না। কোনটা আমাকে মানাবে দেখে দাও।’
‘ঠিক? আমিই বেছে দিই তাহলে?’ বউমণি শাড়ির স্তূপের মধ্যে থেকে সেই লাল-হলুদ-নীল ফুল ফুল মিষ্টি শাড়িটাই তুলল। বলল—‘এইটাই সবচেয়ে মানাবে তোকে কলি। এমন চকচকে আয়নার মতো রং, পরে একেবারে লাল হয়ে উঠবি।’
তারপর খুড়তুত বোন মিলি এল। মিলি শাড়ি পছন্দ করল। তিনজনে মিলে বউমণির ঢাউস দুটো আলমারি গোছানো হল।
সেই কাশ্মীরি সিল্ক পরে বড়দার মৃত্যুর পরও বন্ধুর বিয়েতে গেছে কলি। সবাই বলেছে, ‘কি সুন্দর, কি অপূর্ব দেখাচ্ছে তোকে, কোথাকার সিল্ক রে? কোথা থেকে কিনেছিস? ও কি তোর চোখে জল কেন রে কলি? দাদা দিয়েছিলেন, না? বড়দা!’ কলি মাথা নাড়ছে। ফোঁটা ফোঁটা জল পড়ে মেক-আপ নষ্ট হচ্ছে, অস্ফুট গলায় বলছে—‘বউদি, আমার বউমণি দিয়েছিল রে।’
বন্ধুরা মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে। দাদার স্মৃতি হলে কান্নার মানে বোঝা যায়, বউদি তো আর মরে যায়নি রে বাবা! চন্দনা বলে—‘নে, নে, বর দেখবি চল। মোছ চোখের জল। ইস কাজল বাঁচিয়ে। বর যা হয়েছে না? দেখে আমিই এইসান একসাইটেড হয়ে গেছি যে আমারই টপ করে বিয়ে করে ফেলতে ইচ্ছে হচ্ছে।’
কলির ভালো লাগে না। বউমণি মরে যায়নি। কিন্তু এভাবে বেঁচে থাকারও তো কোনও মানে হয় না। শুষ্ক প্রেতিনীর মত, একাম্বরা, রুক্ষ চুল, হাঁটতে পারছে না, হাঁপাচ্ছে, ওষুধ খেয়ে খেয়ে চোখের দৃষ্টি ঘোলাটে। সেই উজ্জ্বল, হাসিখুশি, নিতান্ত সরল, আমুদে বউমণি যে তাদের সবাইকে বিশেষ করে তাদের দুই বোনকে এতো ভালোবাসত!শনিবার ম্যাটিনি শো-এ সিনেমা যাওয়া মানেই সে, মিলি আর বউমণি, লুকিয়ে লুকিয়ে রেস্টুরেন্টে খাওয়া, ‘শ্রী’তে যাবার নাম করে এক এক দিন মেট্রো, কি লাইটহাউজে চলে যাওয়া, তারপর ট্যাক্সি করে হুশ, শ্রী সিনেমার কাছে এসেই তিনজনে মুখ চাওয়া-চাওয়ি। বউমণি বলবে—‘এখানেই ছেড়ে দিই। কি বল?’
ট্যাকসিটা চলে গেলে রাস্তার ওপর তিনজনের কি ধুম হাসি।
—‘এই শ্রী-তে কি হচ্ছে ভালো করে দেখে রাখ। এই মিলি তুই ঠিক উল্টো-পাল্টা করবি।’
—‘আমি না, আমি না, দিদি, কলি।’
বাড়ি ঢুকতেই চায়ের গন্ধ। সাড়া পেয়ে কাকিমা বলছেন—‘বাঃ খুব তাড়াতাড়ি এসে গেছ তো বন্দনা বউ! যা রে কাপড় বদলে আয় সব, চা হয়ে গেছে।’
তিনজনে মিলে দুদ্দাড় ওপরে, মাঝে বউমণির ঘর। বড়দা আসতে এখনও দেরি আছে। ঢুকে তিনজনে বিছানায় গড়িয়ে পড়ছে হাসতে হাসতে বন্দনা বলছে—‘ট্যাকসির কথাটা জানলে কাকিমা কি বলবেন?’
কলি বলছে—‘তিন মেয়েতে মিলে একলা একলা নীরাতে ঢুকে খেয়ে আসার কথাটা?’ আবার হাসি।
—‘ইটালিয়ান ক্যাসার্টটা কি দুর্দান্ত, না?’
—‘সাঙ্ঘাতিক। বউমণি ওই পাতলা বিস্কুট তো আমি ডেকোরেশন বলে ফেলেই দিচ্ছিলুম।’
—ওকে ওয়েফার বলে। ডেকোরেশন তো বটেই। কিন্তু সব ডেকোরেশনই শেষ পর্যন্ত পেট্টায় নমো করবার। কেকেও তো চেরি থাকে, আইসিং থাকে, সেগুলো ভেঙে ভেঙে খাস না?’
—‘আইসিং কি গো?’
—ওই যে রে সাদা সাদা নকশাগুলো।
—‘হ্যাঁ খাই তো। আমাদের দোলের মঠের বিলিতি সংস্করণ বলো?’
—বউমণি, আবার কবে বেরোবো।’
খোকামণিকে বেড়িয়ে নিয়ে বাড়ি ফিরছে রতন। ভালোমানুষের মত মুখ করে বন্দনা বলছে—‘কোথায় রে? শ্রী না চিত্রা?’ যেন কিছু বুঝতে পারছে না দুই ননদের ইচ্ছে-অনিচ্ছে।
—‘না, না,’ মিলিটা অধৈর্য হয়ে উঠেছে—‘না, না বউমণি, এসপ্লানেড, এসপ্লানেড। মেট্রো, নিউ এম্পায়ার, লাইটহাউজ, গ্লোব।’
—‘বাস রে বাস। কি লম্বা লিস্টি দিচ্ছিস!’
—‘ইঃ রে আমার! ইংরেজি ছবি বুঝতে পারিস?’ কলি বলছে।
—‘সব কথা বোঝবার দরকার হয় নাকি? তুই বুঝেছিস? কি অপূর্ব ছবিটা বলতো আঃ ‘গন উইথ দা উইন্ড,’ ওঃ বউমণি রেট বাটলারকে যদি হাতের কাছে। পেতুম!’
—‘কি করতিস?’ বউমণি হাসছে।
—‘উঃ কি যে করতুম!’ হাত মুখ সব মিলিয়ে মিলি একটা অদ্ভুত ভঙ্গি করে।
—‘তুই কলি?’
—‘স্কার্লেটটার মতো বোকামি অন্তত করতুম না!’
আবার তিনজনের হু হু হাসি।
—‘বউমণি তোমাকেও বলতে হবে। ওসব চলবে না।’
—‘এই খবর্দার, বন্দনার চোখে-মুখে চাপা হাসি, ‘আমার রেট বাটলার এসে গেছে।’
হাসতে হাসতে দরজার খিল খোলা হচ্ছে, বড়দার মাথার চুল এলোমেলো, ভারি ব্যাগটাকে টেবিলে রাখতে রাখতে বলছে—‘এতো হাসি কিসের, অ্যাঁ? অ্যাত্তো হাসি? এই মিলিয়া, কলিয়া, আমার বিরুদ্ধে কি ষড়যন্ত্র করছিস রে তোরা!’
বেশি দিনের কথা নয়, মাত্রই বছরখানেক। অথচ মনে হয়, কতদিন, কতদূর, কোন গতজন্মে কিংবা স্বপ্নে এসব ঘটেছিল বোধহয়। এখন কলি মায়ের কাছ থেকে আগাম অনুমতি নিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে এসপ্লানেড পাড়ায় যায়, মাঝে মাঝে। কিন্তু তেমন জমে না। বন্ধুদের হই-হুল্লোড়ের মাঝখানেও হঠাৎ-হঠাৎ স্তব্ধ হয়ে যায়। বউমণির শাড়ির গন্ধ, চুলের গন্ধ, মোড়ের দোকান থেকে তবক দেওয়া পান কিনে তিনজনে খাওয়া আর হাসা। তিন ননদ-ভাজে। তিন অসম বয়সী বন্ধু মিলে। ‘গন উইথ দা উইন্ড’, ‘গ্যাস লাইট’, ‘জোয়ান অফ আর্ক …।’
—‘এই কলি, কলি তোর রোল কল করছেন।’
—‘হানড্রেড অ্যান্ড ফাইভ। কলিকা ভট্টাচার্য,’ স্যারের চোখ সোজা কলির মুখের ওপর। মুখ চেনেন, নামও জানেন। বসে রয়েছে ক্লাসে, অথচ জবাব দিচ্ছে না। এম. এ ক্লাসে ক’টাই বা মেয়ে, সবাইকার বায়ো-ডাটা স্যারেদের নখদর্পণে। স্যারের মুখে বিরক্তি, বিদ্রূপ। —‘হ্যাললো শকুন্তলা, আর য়ু থিংকিং অফ ইয়োর দুষ্মন্ত?’ ক্লাসশুদ্ধ ছেলে-মেয়ে অসভ্যের মতো হাসছে। হো-হো করে। কলির মুখ লজ্জায় নিচু। লজ্জায়, অপমানে। চোখ ফেটে জল বেরিয়ে আসতে চাইছে। সে আর কোনদিন এ. কে. বির ক্লাস করবে না। কোনদিন না। তখন বুঝবেন একঘর ছেলের মাঝখানে এরকম নিষ্ঠুর নির্লজ্জ ঠাট্টা করবার ফল কি। সবাই হাসছে কলি বুঝতে পারছে। একমাত্র তার মুখোমুখি বেঞ্চে ছেলেটি নির্বিকার। মুখ সামান্য বিরক্তিতে কুঁচকে আছে। পরিমল। অনুরাধা পাশ থেকে কনুইয়ের গুঁতো দিচ্ছে। —‘এই কলি, এই, দ্যাখ পরিমল রেগে গেছে। তোর হয়ে। অন ইয়োর বিহাফ। য়ু শুড বি গ্রেটফুল। হি, হি।’ অনুরাধা ইংলিশ মিডিয়াম থেকে এসেছে, কথায় কথায় ইংরেজি বলে, ছেলেদের সঙ্গে মেশেও খানিকটা, নানারকম খবরাখবর সংগ্রহ করে আনে। কারুর কোনও ভাবান্তর ওর চোখ এড়ায় না।
ক্লাস শেষ হতে সে কলিকে ঠেলতে ঠেলতে পরিমলের পাশ দিয়ে বার করে।
—পরিমল বলছে—‘আমি দুঃখিত। ক্ষমা চাইছি।’
কলির মুখ লাল। কিছু বুঝতেও পারছে না, বলতেও না।
অনুরাধা হাসছে—‘কিসের ক্ষমা? কেন ক্ষমা?’
—‘এ. কে. বির হয়ে। ওঁর রুচিবিরুদ্ধ উক্তির জন্যে। আই অ্যাম অ্যাশেমড অফ হিম।’ কলি পালাতে পারলে বাঁচে। পরিমলের সামনে থেকে। অনুরাধার পাশ থেকে।
পরিমল ধুতি শার্ট পরা, চোখে কালো ফ্রেমের চশমা। খুব গম্ভীর। হাসলে দাঁত দেখা যায় না। খুব দায়িত্বশীল, ভদ্র এবং পরিচ্ছন্ন। সিগারেট টানে না। মাঝে মাঝে খুব গভীর দৃষ্টিতে কলির দিকে চেয়ে থাকে। এটা অনুরাধার আবিষ্কার। প্রথমে অনুরাধা ভেবেছিল, সে-ই এই জরিপের লক্ষ্য। তাই একদিন অন্য বেঞ্চে বসল। সেদিনই ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে গেল। পরিমল মুখুজ্জের নিরীক্ষণের বিষয় স্মার্ট, চোখে-মুখে কথা বলা, তুখোড় মেয়ে অনুরাধা নয়, শ্যামলা, লাজুক, মুখচোরা কলিকা ভট্টাচার্য। অনুরাধা বলে—‘ডাক্তারি পড়তে পড়তে ছেড়ে দিয়েছে। এসে এখন আর্টস-ক্লাসে জুটেছে রে কলি, তুই কি মাটিয়া কলেজের সামনে দিয়ে রোজ যাতায়াত করতিস না কি?’
অধ্যায় ৩
পঁয়তাল্লিশ নম্বরের বাথরুমে শাড়ি নিয়ে ঢোকার চল নেই। হয় ভিজে কাপড়ে আসতে হবে। নয়তো শুদ্ধু কাপড়ে অর্থাৎ একখানা মটকার কাপড় আছে, তাই পরে। এই মটকার কাপড় না-কাচা, ময়লা এবং অনেকজনের পরা হলেও সবসময়ে পবিত্র। কেন তার যুক্তি খুঁজতে যাওয়া বৃথা। ভিজে-কাপড়ে বেরোতে বন্দনার বরাবর লজ্জা করে। ব্যাটাছেলে কারুর সামনে পড়ে গেলে তো কথাই নেই। মেয়েদের বিশেষত গুরুজনদের সামনে পড়লেও বিশ্রী অস্বস্তি হয়। একখানা মটকার কাপড়, ব্লাউজ নয়, পেটিকোট নয়, শুদ্দু কাপড় সারা গায়ে ব্যান্ডেজের মতো জড়িয়ে দোতলার কোণের বাথরুম থেকে দালানের মাঝবরাবর নিজের ঘরে আসত সে। স্নানের সময়টাও নিজের ইচ্ছে এবং সুবিধে মতো হলে চলবে না। সকালে উঠে বাসিমুখ ধোয়ার পরই চান-টান করে নেওয়া এ বাড়ির নিয়ম। চান সেরেই বাইরে বেরিয়ে দেখতে হবে ব্রাশ মুখে, গামছা কাঁধে মেজদা কি ছোড়দা দাঁড়িয়ে। কি যে অপ্রস্তুত অবস্থা। ওর জড়োসড়ো ভাব দেখে একদিন অভিমন্যু বলেছিল—‘একটা বিদ্রোহের স্লোগান ছেড়ে দেবো নাকি ভট্চায্যি বাড়িতে?’
—‘কিরকম স্লোগান?’
—‘কলঘরেতে বউমেয়েদের জামাকাপড় নিয়ে যেতে দিতে হবে দিতে হবে।’
—‘সর্বনাশ। তাহলে রান্নাঘর খাবার ঘরে ঢোকা একদম বন্ধ হয়ে যাবে যে! অচ্ছুৎ হয়ে যাব!’
—‘তবে? পুরুষমানুষদের কলঘর আলাদা করতে হবে করতে হবে।’
—‘করতে হবে, করতে হবে করে না চেঁচিয়ে নিজেই করে দাও না।’
সেই দক্ষিণ দিকে নিচ থেকে পিলার তুলে দ্বিতীয় স্নানঘর তোলবার তোড়জোড় হল। বন্দনার ঘরের ঠিক পাশে খানিকটা ফাঁকা দালান আছে। তারপর কলিদের পড়ার ঘর। এইটুকুর সঙ্গে বাইরে থেকে খানিকটা যোগ করে বেশ বড়—বাথটব, বেসিন, কমোড, শাওয়ার-অলা টালিবসানো, এক আধুনিক বাথরুম। হঠাৎ, আধখানা পিলার তোলার পর শ্বশুরমশাই সেটা বন্ধ করে দিলেন। ঘরের লাগোয়া বাথরুম অস্বাস্থ্যকর। অরুচিকর, অশুচি। পিলারগুলো এখনও বেকার পড়ে রয়েছে। লোহার শিকগুলো জড়িয়ে মাকড়সার জাল। কলঘর থেকে মটকার সেই কাপড় জড়িয়েও এখন আসা যায় না। সেটার চওড়া লাল পাড়। বন্দনা ভিজে কাপড় গায়ে জড়িয়ে বুকের ওপর আড়াআড়ি তোয়ালে ফেলে কাঁপতে কাঁপতে ঘরে ঢুকে তাড়াতাড়ি আলনার দিকে গেল। একি? আলনার ওপর এই টুকটুকে লাল শাড়িটা কে রাখল? লাল জমি। তাতে ঢালা সোনালি জরির পাড়। সোনার পাতের মতো চকচক করছে। ভেতরে ছোট ছোট বুটি। এই শাড়ি অভিমন্যু শেষ বিবাহবার্ষিকীতে উপহার দিয়েছিল। মাত্র সেইদিনই পরা হয়েছিল। পরে পার্ক স্ট্রিটের রেস্তোঁরায় দুজনে খেতে যাওয়া হয়েছিল। ফেরবার সময়ে ফ্লুরি থেকে ছেলে এবং বোনেদের জন্যে একগাদা চকোলেট, পেস্ট্রি। পাটভাঙা শাড়িটা ইস্ত্রি করে ভোলাও হয়নি। অনেক সময়ে একবার পরা শাড়ি বন্দনা খাটে তোষকের তলায় রেখে দেয়। এটা হয়ত সেই নিয়মেই তোষকের তলায় থেকে গিয়েছিল। শয্যার ওপর থেকে একটা মানুষ কর্পূরের মতো উবে গেছে। আরেকটা মানুষ আপাদমস্তক ভিতর-বাহির পাল্টে গেছে। অথচ জড় বস্তু বলেই দুটি মানুষের জীবনের সঙ্গে পাটে পাটে জড়ানো ওই শাড়ি একইরকম রয়ে গেছে! এখনও ওতে তাদের স্পর্শ, তাদের গন্ধ মাখানো। শাড়িটা নাকের কাছে ধরে বন্দনা যেন অভিমন্যুর আফটার-শেভ লোশনের গন্ধ পেল। একমুহূর্ত। একমুহূর্তের জন্য অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিল বন্দনা। কিন্তু ঠাণ্ডাটা সর্বাঙ্গে ফুটছে। বসন্তের হাওয়া। কেমন গা শিরশির করে। কোথায় গেল ওর পরবার কাপড়টা? কোথাও কোনও চিহ্ন নেই। রূপের ছোট ছোট সার্ট প্যান্ট পাজামা গুছোনো রয়েছে। আলনার পেছনে পড়ে গেল না কি? না তো! পেছন ফিরে নিচু হতে খাটের তলায় কোণে দলা পাকানো কি যেন একটা দেখা গেল। খাটের তলা থেকে দোমড়ানো মোচড়ানো কালোপাড় শাড়িটা বেরোল। কি ভাবে ওখানে গেল ভাববার সময় নেই। ঝেড়ে-ঝুড়ে এটাকেই পরতে হবে। একটা কাচা হয়েছে। দুটো ধোপার বাড়ি গেছে। এই একটাই মাত্র আছে এখন। কারও খেয়াল হয়নি চারটের বেশি এই শাড়ি বন্দনার দরকার হতে পারে। কে খেয়াল করবে? খেয়াল করার লোক তো চলে গেছে। হঠাৎ শিউরে উঠল বন্দনা। খেয়াল করার লোকটি থাকলে তাকে এ জিনিস পরতে হত না। দুটো আলমারি ভর্তি থাকে-থাকে শাড়ি সাজানো রয়েছে। তার কতো পরাই হয়নি। কি যে উল্টোপাল্টা চিন্তা! কালো-পাড় শাড়িটা চার ভাঁজ করে বিছানার ওপর রেখে হাত দিয়ে সমান করতে লাগল বন্দনা। বিশ্রী কুঁচকে গেছে। জায়গায় জায়গায় ময়লা। এমন সময়ে কোথা থেকে চিলের মতো চেঁচাতে চেঁচাতে ছুটে এসে শাড়িটার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল রূপ। কান্নায়, রাগে মুখখানা লালচে-কালো। অনেকক্ষণ থেকে কেঁদে কেঁদে চোখ রগড়াচ্ছে বোধহয়, মুখময় সেই রগড়ানির কাদা।
—‘এই কাপড়টা বিচ্ছিরি, নোংরা, এই কাপড়টা বাঁদর, শালা, ননসেন্স, ড্যাম, ড্যামিট, ইডিয়ট’—কাপড়টাকে ঘুসি মারছে আর পাগলের মতো ছড়া কাটছে রূপ। তার পাঁচ বছরের জীবনে যেখান থেকে যত গালাগাল শিখেছে। বাড়িতে পাড়ায় যেখান থেকে যত কটু-কাটব্য সংগ্রহ করতে পেরেছে সব এখন তার মুখ দিয়ে গরম ফোয়ারার মতো বেরিয়ে আসছে। তার অস্থির দাপাদাপির মধ্যে থেকে শুধু এইটুকু বার করতে পারল বন্দনা যে এই কাপড়টা নাকি মদনার মায়ের, এটা ওর মায়ের নয়। ওর মা টকটকে লাল, কিংবা সবুজ সবুজ, কিংবা পিংক পিংক শাড়ি পরবে খালি, নইলে ও খাবে না দাবে না, স্কুল যাবে না। দেশবন্ধুর পার্কের পুকুরে যেখানে গত বছর ছোটির দাদা নাইতে গিয়ে ডুবে গিয়েছিল সেইখানে গিয়ে ডুবে যাবে। কী ভয়ঙ্কর!
ছেলের চিৎকারে, কান্নায় তখন ঘরের দরজায় সারা বাড়ির লোক জড়ো হয়ে গেছে। শাশুড়ি হাউ-হাউ করে কাঁদছেন। চোখের জলে সব ঝাপসা, বন্দনা ভালো করে দেখতে পাচ্ছে না মুখগুলো। শ্বশুর, খুড়শ্বশুর, ছোট দেওর, কলি, কাকিমা সবাই আছে। সবার মুখে উদ্বেগ, আতঙ্ক। দুঃসহ শোক আবার ছায়া ফেলেছে তার। হাতড়ে হাতড়ে আলমারি খুলল সে, অন্ধের মতো হাতড়ে হাতড়েই একটা হালকা নীল জমির শাড়ি বার করল। হলুদ পাড়। ছেলের দিকে চেয়ে ফিসফিস করে বলল—‘এইটে পরি সোনা! এটা যে আমার খুব ভালো লাগে, জানো না? লাল টুকটুকেটা যে তোমার বউ-এর জন্যে রেখে দিয়েছি।’
আবার ঝাঁপিয়ে পড়ল রূপ—‘বউকে আমি খুন করে ফেলব।’
এতটুকু বাচ্চার শরীরে যে কোথা থেকে এতো জোর এল, এত জেদ! দাঁত দিয়ে সে সারাক্ষণ ‘মদনার মার শাড়ি’টাকে কুটি-কুটি করে কাটতে লাগল। অনেক করে বুঝিয়ে সুজিয়ে, বউ যে কত লক্ষ্মী, কত বেচারা, লাল শাড়িটার জন্যে সে যে কতদিন ধরে হা পিত্যেশ করে করে আছে, না পেলে অভিমানে সে যে কি করে ফেলতে পারে—এত রকম বলে কয়ে বন্দনা যখন ফিকে নীল শাড়ির আঁচল গায়ে জড়িয়ে উঠে দাঁড়াল, তখন বেলা গড়িয়ে গেছে।
ছেলেকে শিশুকালের মতো চাপড়ে চাপড়ে ঘুম পাড়িয়ে রেখে সে বাইরে এল। কোথাও কারো সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। বাড়িটা অস্বাভাবিক স্তব্ধ। এতগুলো জ্যান্ত মানুষ বুকের মধ্যে ধরেও যেন কবরখানা। অনেক দূরের কোনও ঘর থেকে খালি পাখা চলার ঝিকঝিক আওয়াজ আসছে। বন্দনার মনে হল সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। সে একাই শুধু জেগে। অনেক বেলা। রোদ হেলে গেছে। খাওয়া-দাওয়ার পাট চুকে গেছে। কিংবা ও পাট আজকে বন্ধ। রূপের পাশে এসে নির্জীবের মতো শুয়ে পড়ল বন্দনা। শীত-শীত করছে। গায়ে একটা চাদর টেনে দিল। বিকেলের দিকে ছেলেকে ডাকতে গিয়ে গায়ে হাত দিতেই হাতটা ছ্যাঁক করে উঠল। প্রচণ্ড জ্বর। হু হু করে উঠছে। থার্মোমিটার বগলে দিতে দেখতে দেখতে চার ছাড়িয়ে গেল।
চা দিতে কলি ঢুকেছে, বলল—‘থার্মোমিটার কেন গো বউমণি?’
—‘রূপের অনেক জ্বর রে কলি, ডাক্তারবাবুকে একটু ডাকতে বলবি?’
বন্দনার মনে হল তার নিজেরও জ্বর। কেমন বমি-বমি পাচ্ছে। গা শির শির করছে। সারা সকালবেলাটা ভিজে কাপড় গায়ে কেটে গেছে। একে ঋতুবদলের সময়। তার ওপর এই তো শরীর! হওয়া কিছু বিচিত্র নয়।
এই সময়েই রূপ বেঁকতে শুরু করল। হাত পা ঠকঠক করে কাঁপছে। মুখে ফেনা, গোঁ গোঁ আওয়াজ। তারস্বরে চিৎকার করতে করতে কলি ছুটে চলে গেল। শাশুড়ি দৌড়ে এলেন। ‘বউমা, মুখে চামচে ধরো, ছোট গিন্নি শিগগিরই আঁশবটি নিয়ে এসো, আঁশবটি ঠেকাও গায়ে। কলি জল নিয়ে আয়। জল নিয়ে আয়।’
বন্দনা ছেলের মাথাটা কোলে নিয়ে কাঠের মতো বসে।
কাকিমা বললেন—‘বেশ করে ব্রহ্মতালুতে বরফজল ঢাললা বন্দনা। জ্বরটা মাথায় চড়ে গেছে। তড়কা। ভয় খেয়ো না মা।’
ডাক্তারবাবু এসে সব বিবরণ শুনে অনেকক্ষণ চুপচাপ বসে রইলেন। হাতে কলম, প্রেসক্রিপশন লেখার প্যাড। ভালো করে বুক-পিঠ দেখে শুনে বললেন—‘কোথাও কিছু গণ্ডগোল নেই। শক থেকে জ্বর এসেছে মনে হয়। ওষুধ আমি দিচ্ছি। জ্বর কমে যাবে। কিন্তু ছেলেকে যদি মানুষ করতে চাও, সুস্থ সবল ভাবে বাঁচতে দিতে চাও মা তো ও আঘাত পায় এমন কিছু করো না। সেনসিটিভ ছেলে, এই বয়সে বাপকে হারালো। সব সময়ে তার কোলে, পিঠে, দেখেছি তো! তার সেই ছেলে একবারও বাপের নাম মুখে আনে না, ওর এতবড় শোকটা তোমরা বুঝলে না? এই বেশে তোমাকে ওর অচেনা লাগে, ও ভয় পায়। ফিলিং অফ ইনসিকিওরিটি।’
ছেলে তখন জ্বরের ধমকে কেঁপে কেঁপে উঠছে। মাথার কাছে ঠাকুমা বসে, পায়ের কাছে দাদু। তাঁদের দিকে ফিরে বয়স্ক ডাক্তার বললেন—‘কাশীদা, এখনও পর্যন্ত এটা তড়কাই মনে হচ্ছে। কিন্তু এর থেকে শক্ত ব্যামো, মৃগী-টৃগি দাঁড়িয়ে যাওয়া আশ্চর্য নয়। আর তাহলে এ ছেলের জ্যান্ত মড়া হয়ে থাকা কেউ আটকাতে পারবে না। বউদি, আর কোনদিন বন্দনা-বউমাকে সাদা কাপড় পরতে দেবেন না। বুঝলেন?’ ওদিক থেকে কোনও সাড়া এল না। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে থেকে ডাক্তারবাবু ব্যাগ তুলে নিয়ে চলে গেলেন।
কিন্তু কেউ অনুমতি দিক আর না দিক, বন্দনা আর কোনদিন সেই কালোপাড় সাদা শাড়ি গায়ে তোলেনি। হাতে যেমন চুড়ি পরত, গলায় সরু সোনার চেন। কানে মুক্তো, আঙুলে হীরের আংটি যা দিয়ে অভিমন্যু সর্বপ্রথম তার হাত ছুঁয়েছিল। রূপ তার পছন্দের লাল শাড়িটা মাকে পরাতে পারেনি বটে, কিন্তু তার ড্রয়িংখাতা ভর্তি মোম রং আর প্যাস্টেলে শুধু একটাই ছবি। চারদিকে খাড়া খাড়া সবুজ ঘাস। তার ওপর দিয়ে দোলনা। বিন্দুর মতো সব ছেলেমেয়ে চারদিকে ঘুরে বেড়াচ্ছে। শুধু দুজনকে এদের মধ্যে স্পষ্ট চেনা যায়। ছোট্ট ছেলে তার মায়ের হাত ধরে বেড়াচ্ছে। ছেলেটির মাথায় গোল্লা-পাকানো পাকানো চুল, পাশে তার মা, কাঁধের পাশে মস্ত খোঁপা দেখা যাচ্ছে, তাতে ফুল গোঁজা। পরনে লাল শাড়ি। তলায় ছবির নাম—‘মা এবং নূপ।’
অধ্যায় ৪
খুড়তুত ননদ মিলি এসে বসল। ওরা বড় একটা এ ঘরে আসে না আজকাল। কলি এম. এ পড়ছে, সময় কম। মিলিরও এবার বি এস-সি ফাইনাল ইয়ার। কেমিস্ট্রিতে বড্ড মুখস্থ করতে হয়। সারাদিনই দুলে দুলে পড়া মুখস্থ করছে মিলি। তাছাড়া ওদের আগ্রহবিন্দু এখন পঁয়তাল্লিশ নং শ্যামবাজার স্ট্রীটের দোতলার ঘর ছেড়ে অন্যত্র সরে গেছে। সে ঘরে সেই নতুন নতুন গন্ধওয়ালা হাসি-খুশি হইহল্লার মানুষগুলি আর থাকে না। জাদুকরের ফুসমন্তরে তারা উধাও হয়ে গেছে। সিন্ডারেলার রাজকুমারী বেশ যেমন রাত বারোটা বাজার সঙ্গে সঙ্গে গিয়েছিল! বন্দনার জুড়িগাড়ি এখন লাউয়ের খোল, কোচম্যান জোড়া টিকটিকি, সাত ঘোড়া সাতটি নেংটি ইঁদুর। সুন্দরী রাজকুমারীর জায়গায় ধুলোকালিমাখা ঘুঁটেকুড়ুনি। যদি আবার একটা বিয়ে লাগে বাড়িতে, তখন ওদের আগ্রহ শ্যামবাজার স্ট্রীটের বাড়িকে ঘিরে কিছুদিনের জন্য ফিরে আসবে। কোনও একজন চাঁদের আলো রঙের খড়মড়ে নতুন শাড়ি, ঝকঝকে সোনার গয়না লালহলুদ সুতো বাঁধা হাতওয়ালা শ্রীময়ী মুখ তাদের সবসময়ে টানবে। আপাতত টানের মানুষগুলি রুনু, নমিতা, সুচরিতা, সর্বাণী, এ. কে. বি, এস. এম, প্রদীপ, সুপ্রকাশ, পরিমল ইত্যাদি ইত্যাদি। এদের খবর পঁয়তাল্লিশ নম্বর রাখে না। মিলির আবার আরেক পাগলামি আছে। সে ক্রিকেট-পাগল। অ্যালবাম জুড়ে ক্রিকেটারদের ছবি—পলি উমরিগর, লালা অমরনাথ, হাজারে, মুস্তাক আলি, ফাদকার, মানকড়, নীল হার্ভে, কাউড্রে, লেন হাটন এবং পলি উমরিগর। পলি পলি করে মিলি পাগল। তার অটোগ্রাফ অভিযান, ক্রিকেট কমেন্টারি শোনা, ফটো কাটিং, কাগজের ছবি আটকানো এবং সেই বৈভব ভালো করে দেখতে দেখতেই অবসর সময় কেটে যায়।
সকালের প্রথম দিকটা রূপকে নিয়ে দেখতে দেখতে কেটে যায় বন্দনার। সে স্কুলে চলে যাবে পৌনে দশটা নাগাদ। ফার্স্ট ট্রিপের বাস। ফিরতে ফিরতে সাড়ে তিনটে। এই সময়টুকু বন্দনা একা। সমস্ত বিশ্ব তার সমাজ-সংসার নিয়ে একটা বিশাল স্রোতোস্বান সমুদ্র, মাঝখানে অনন্ত নির্জনতার মধ্যে একটি মৌনী জলটুঙ্গি ঘরে প্রেতিনী এক। যার কোনও ভবিষ্যৎ নেই। বর্তমানও নিভু-নিভু, আছে শুধু অতীত। সে প্রেতিনী ছাড়া কি? ঘরখানা তার লম্বায়, চওড়ায় বিরাট। সেই ঘরের কোণে কোণে ইচ্ছে করলে ছড়িয়ে যাওয়া যায়, নিজেকে তুলে দেওয়া যায় পনের ফুট উঁচু সিলিং-এ। বড় বড় জানলা আছে। তার বাইরে তাকালেই বাড়ির মাথায় মাথায় খোলা আকাশ দেখা যায়। বারো মাস তাতে একটা দুটো ঘুড়ি ওড়ে। একমুঠো আকাশ নয়, বেশ উদার আকাশই। ছাদে ছাদে কাপড় শুকোচ্ছে, কোনও কোনও ছাদে বাহারি বাগান। কিন্তু বন্দনা এভাবে নিজেকে ছড়াতে পারে না। প্রত্যকটি ছাদের দিকে তাকালে তার মনে হয় কৌতূহলী চোখে কেউ চেয়ে আছে। অপবিত্র কৌতূহল। আকাশটা এত নির্বিকার, নির্বিকল্প যে বন্দনা সেখানে কোনও উত্তর কোনও ভাষা খুঁজে পায় না, সেখান থেকে চোখ ফিরিয়ে নিলে ঘরের চতুর্দিকে কালো কালো ছায়া। বন্দনা ভাবে রোদ থেকে চোখ ফেরানোর জন্যে এমন হচ্ছে। কিন্তু বারবার চোখ কচলালেও, অনেকক্ষণ সময় কেটে গেলেও একই রকম ছায়া কোণে কোণে ওৎ পেতে থাকে। ফিকে নীল, রঙ-জ্বলা হলুদ চৌকোনা নিজের কোলের দিকে তাকিয়ে বন্দনা স্তব্ধ হয়ে বসে থাকে। ওই ছায়ারা হয় সরে যাক, নয় তাকে একেবারে গ্রাস করে নিক।
আজকে মিলি আসতে ছায়াগুলো তড়িঘড়ি সরে গেল। মিলির চান করা চাপ-চাপ কোঁকড়া চুল পিঠের ওপর ছড়ানো। ক্যান্থারাইডিন হেয়ার-অয়েলের উগ্র গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে ঘরে। চান করে গায়ে পাউডার দিয়েছে। ঘাড়ে গলায় সাদা ছোপ। ছাপা শাড়ির আঁচল খাঁটের প্রান্ত বেয়ে মেঝেয় লুটোচ্ছে।
—‘আজ বুঝি তোর সকাল-সকাল ছুটি হল?’
—‘না গো বউমণি আজ বন্ধুর গাড়িতে লিফট পেয়েছি।’
‘তুমি কি করছিলে?’
—‘কিছু না।’
—‘কিচ্ছু না?’
—‘না রে।’
—‘বউমণি আমাকে একটা কার্ডিগ্যান বুনে দেবে? ডিজাইনটা তোমায় এনে দেবো। রুইতন শেপের জালি, ধারে ধারে গিঁট গিঁট মতন, তুমি নিশ্চয় দেখেছ। নতুন উঠেছে গো, খুব সুন্দর। দেবে বুনে?’
—‘দেবো। কিন্তু অনেক দেরি হবে।’
—‘তাতে কি? এ বছর তো শীত হয়েই গেল। পরের বছর পরব।’
—‘আমি যদি ভুল করে ফেলি?’
—‘যাঃ।’
বউমণি কত সোয়েটার অবলীলায় বুনেছে ছ বছর ধরে, তার আবার ভুল? মিলি বিশ্বাস করতেই পারে না।
তারপর চুপি চুপি গলায় বলল—‘একটা কথা বলব বউমণি, কিছু মনে করবে না?’ বন্দনা বলল—‘বল না কি বলবি!’
—‘জ্যাঠাইমা আর মা বলছিল খোকামণি যখন স্কুলে চলে যায় তখন তো তুমি শাড়ি খুলে ফেললে পারো। আর ডাক্তার-জ্যাঠা কি তোমায় এতো গয়নাও পরতে বলেছিলেন?’
কথা শুনে বন্দনা মিলির মুখের দিকে বোকার মতো চেয়ে রইল। বুঝতে দেরি হল। কি বলছে রে বাবা! খোকামণি মানে ছেলে স্কুলে গেলে সে শাড়ি খুলে ফেলতে পারে? মানে? শাড়ি খুলে কি পরবে? সালোয়ার-টালোয়ার? নাকি সায়া-ব্লাউজই তার পক্ষে যথেষ্ট! ডাক্তার-জ্যাঠা? গয়না? আস্তে আস্তে বুঝতে পারল। নিজের শাড়িটার দিকে তাকিয়ে দেখল রঙ ফিকে হয়ে আসা তুঁতে রঙের টাঙাইল একটা। এগুলোর রঙ থাকে না। ফিকে হতে হতে দুপুরের আকাশের মতো একটা ঘষা-ঘষা নীল হয়ে এসেছে। ভেতরের শাদা বুটিগুলো মিলে-মিশে গেছে। একটু ছাই-ছাই রঙ ধরেছে শাদা পাড়ে আর বুটিগুলোয় কষে পরা হয়েছিল শাড়িটা। ধোপার বাড়িও গেছে। তাই এই দশা। এই রঙিন শাড়ি রূপ স্কুলে চলে গেলে তাকে খুলে ফেলতে বলছে মিলি। খুলে বোধহয় সেই কালো পাড় শাদা শাড়ি পরতে হবে। মিলি অবশ্য বলছে না। মিলিটা বোকা, সরল। তাকে দিয়ে তার মা-জেঠিমা বলাচ্ছেন। নিজেদের বলতে কিন্তু-কিন্তু লেগেছে। কিছুদিন ধরেই ওর কেমন মনে হত সামনে থেকে যেন সবাই সরে সরে যাচ্ছে। সে তো চট করে ঘর থেকে বেরোয় না। তবু ছেলেকে খাওয়াবার সময়ে, স্কুলে পাঠাবার সময়ে তাকে তো যেতেই হয়। সে সময়টা বাড়িতে মোটামুটি সবাই থাকে, দেওররা ছাড়া। অথচ বন্দনার দৃষ্টি পরিধির মধ্যে যেন কেউ থাকে না। শাশুড়ি রান্নাঘরের মধ্যে, কাকিমা যেন মনে হয় খাবার ঘরের কপাটের আড়ালে সরে গেলেন, খুড়শ্বশুর ছেলের হাত ধরে রাস্তায় নামেন, স্কুল বাসে তুলে দেবেন, কিন্তু শ্বশুরমশাইকে দেখতে পাওয়া যায় না। ‘মা’ বলে তিনি যেন অনেকদিন ডাকেননি। সবাই যেন অস্বাভাবিক গম্ভীর। এ সবের তাহলে একটা মানে আছে? এবং সে মানে এই রঙ-চটা তুঁতে নীল শাড়ি?
ওর হতভম্ব ভাব দেখে ততক্ষণে ছোট ননদ ‘আসছি একটু’ বলে পগার পার।
একটা ঝাপসা ছবি স্পষ্ট হয়ে ওঠবার মতো বন্দনা হঠাৎ তার পারিপার্শ্বিক সজাগ চোখে দেখতে পেল। এতক্ষণ সে চুপচাপ খাটে বসেছিল। উঠে দাঁড়াতে উল্টো দিকের আলমারির লম্বা আয়নায় তার পুরো দৈর্ঘ্যের ছায়া পড়ল। বন্দনার মনে হল সে ভূত দেখছে। ডিগডিগে রোগা, বিবর্ণ, কণ্ঠার হাড় উঁচু। সেই গর্তে বোধহয় এক পো তেল ধরে যাবে। চোখের তলায় ঘন কালি, হাতে কয়েকগাছি চুড়ি ঢলঢল করছে, একটি অসুস্থ, আধপেটা খাওয়া, অপরিণত দেহ, অপুষ্টিতে ভোগা বালিকামূর্তি আয়নার ভেতর থেকে তার দিকে ভীতু চোখে চেয়ে রইল। বন্দনার যেন হঠাৎ খেয়াল হল, সে আর ননদ-দেওরদের সবার সঙ্গে টেবিলে বসে খায় না। কোনও কোনও দিন ছুটির সকালে বা রাতে নির্দিষ্ট খাবার সময়ে নিচ থেকে দেওরদের দরাজ গলার তর্কাতর্কি ভেসে আসে। ননদদের সরু গলার হাসি। শ্বশুরমশাইয়ের গলা-খাঁকারি। সবাই একসঙ্গে খেতে বসেছে। তার বেশ কিছুক্ষণ পর, এক কিম্বা দেড়ঘণ্টা বাদে, মিলি কিম্বা কলি এসে বলে যায়—‘বউমণি তোমার হয়ে গেছে, মা খেতে ডাকছে।’ নিচে গিয়ে দেখে খাবার ঘরের এক কোণে কম্বলের আসন পাতা। একটি পাথরের গ্লাসে জল, সাদা পাথরের থালায় দলা পাকানো আতপচালের ভাত। বেশির ভাগ দিনই কয়েক রকম আনাজসেদ্ধ, ডালসেদ্ধ আর ঘি থাকে। কোনও কোনও দিন সেদ্ধর বদলে কোনও তরকারি। অম্বল। রাত্রে লুচি, পরোটা। কিন্তু খাদ্যটা ভালো হলেও দিনের পর দিন খেতে খেতে প্রচণ্ড অম্বল হয়, মুখ সব সময়ে টকে থাকে। রুটি খেলেও সহ্য হয় না। আমাশা হয়ে যায়। বেশির ভাগ দিনই রাত্রে খায় না বন্দনা। শাশুড়ি দুধ নিয়ে সাধাসাধি করলে দুধটুকু কোনমতে গলাধঃকরণ করে নিয়ে শুয়ে পড়ে। রাত্রে পেটের মধ্যে কেমন একটা অচেনা অনুভূতিতে ঘুম ভেঙে যায়। সর্বক্ষণ গা-বমি-বমি করতে থাকে। দুঃখ, বিষাদ, দারুণ মানসিক অবসাদের সঙ্গে শারীরিক কষ্টগুলো এতদিন এমন নিঃশেষে মিশে ছিল যে আলাদা করে তাদের শারীরিক বলে বুঝত না বন্দনা। আজ এক চমকে বুঝতে পারল এ সমস্তই দিনের পর দিন অর্ধাহার, অনাহার এবং অনভ্যস্ত আহারের ফল। তার খাওয়া-দাওয়া নিয়ে অবশ্য এঁদের দুঃখের শেষ নেই। দুধ-ছানা-ফল ইত্যাদি নিয়ে শাশুড়ি সাধাসাধিও করেন। বলেন—‘শরীর টিঁকবে কেন? নিজের দিকে না তাকাও, ছেলেটির দিকে তো তাকাতে হবে বউমা!’ কিন্তু সে সাধ্য-সাধনাতে কোনও জোর থাকে না। তিনি সাধাসাধি করবেন এ-ও যেমন স্বাভাবিক, সে সাধাসাধিতে ফল হবে না সে-ও যেন ঠিক তেমনি স্বাভাবিক। অনেক সময়ে কাকিমা বলেন—‘দিদি, ওর গলা দিয়ে খাবার নামে না গো আর! তুমি আমি বলে করব কি?’ চোখে আঁচল চাপা দেন কাকিমা। কিন্তু সাতাশ বছরের পরিপূর্ণ যৌবনের জঠরাগ্নি সে তো বাধা মানে না। গভীর রাতে সকলে যখন নিশ্চিন্তে ঘুমোয় তখন সেই বাড়বানল তাকে জাগিয়ে রাখে। কষ্টে চোখ দিয়ে ঝরঝর করে গরম জল পড়ে। খাটের বাজুতে মাথা রেখে অবসন্নের মতো পড়ে থাকে বন্দনা, মনে করে এটা ওর শোকেরই প্রতিক্রিয়া। অবসন্ন হয়ে একটা ঘোর লাগে, ঠিক ঘুম নয়, সেই ঘোরের মধ্যে বন্দনা স্বপ্ন দেখে ঝমঝম করে বৃষ্টি পড়ছে। জানলা বন্ধ করতে গিয়ে দেখে ওমা এ তো বৃষ্টি নয়! জল নয়! শিলের মতো কি যেন পড়ছে! ওমা শিল তো নয় মাছ! খণ্ড খণ্ড মাছ ওলট পালট খেতে খেতে ভীষণ বেগে বন্দনার জানলায়, জানলার সিলে, বন্ধ শার্শিতে, বন্ধ চেতনায় এসে আছড়ে পড়ছে। কী হীন কি দীন এই নিষিদ্ধ স্বপ্ন! বন্দনা মাঝরাত্তিরে পশ্চিমের বাথরুমে যায়। বমি করে আসে। ওঠে শুধু জল। টক জল।
আসলে বন্দনা কোনদিন মাছ ছাড়া খেতে পারত না। অত্যধিক মৎস্য-প্রীতির জন্যে বাবা-কাকা আদর করে বেড়াল বলে ডাকতেন। মাতৃহীন কন্যা, মাছ খেতে ভালোবাসে, বাবা মাছ খাইয়ে কৃতার্থ হয়ে যেতেন। রুই, কাতলা, ইলিশের সময়ে ইলিশ, তপসের সময়ে তপসে। চিংড়ি, পার্শে, কই, মৌরলা। বন্দনার শ্বশুরবাড়িতে আর এক কাঠি বাড়া। নিরামিষ রান্নার রেওয়াজই নেই। পোস্তচচ্চড়ি এঁরা পেঁয়াজ ছাড়া খেতে জানেন না, ডালে রসুন ফোড়ন, আলুবেগুনের তরকারিতে কুচো চিংড়ি, চচ্চড়িতে মাছের মুড়ো, এ পড়বেই। খুব সম্ভব সেই জন্যই এখন তার জন্য বেশির ভাগ দিন ভাতে-ভাত-এর আয়োজন হয়। এখন মাছের হেঁশেল আলাদা হয়ে গেছে। অত রকম রান্না সেরে এঁরা আর নিরামিষ রান্না করে উঠতে পারেন না। বোধহয় ভালো জানেনও না। অথচ এদিকে ভীষণ গোঁড়া।
অভিমানে বন্দনার চোখে জল এল। এতদিন ধারণা ছিল শ্বশুর-শাশুড়ি তাকে নিজের মেয়ের মতো ভালোবাসেন। বিয়ের পর মাতৃহীন কন্যা বলে বন্দনার বাবা যখন অত্যধিক কাতর হয়ে পড়েছিলেন, শাশুড়ি বলেছিলেন—‘ভাবছেন কেন বেইমশাই। ও আমার মেয়ে হল। বউ নয়। মেয়ে। বউমা বলে ডাকতে ভালোবাসি তাই ডাকি। নইলে আমার কলি, কলিও যা বন্দনাও তা।’
সত্যিই, কোনদিন বন্দনার মনে হয়নি, শ্বশুরবাড়িতে সে কিছু খারাপ আছে। আগে সংসারের নানান কাজ, বিশেষত তদারকি করতে হত, এখানে চা-টা পর্যন্ত মুখে ধরা হয়, ছাড়া-কাপড়টা পর্যন্ত লোকে কেচে দেয়। একটু কড়া শাসন, বাইরে বেরোনোর ব্যাপারে একটু সংযম, নিয়ম মেনে চলতেই হয়। কিন্তু বন্দনার কোনদিন তা নিয়ে কোনও নালিশ ছিল না। তার এতবড় দুঃখের ওপর সেই শ্বশুর-শাশুড়ি কি করে অমন নিষ্ঠুরতা করতে পারলেন? শাশুড়ি হয়ত অশিক্ষিত বলে পুরনো সংস্কার আঁকড়ে আছেন, কিন্তু শ্বশুরমশাই? তিনি যে তাকে কত মা মা করে ডাকেন, কত আপনজনের মতো ব্যবহার করেন তিনিও তো বলতে পারতেন!
দশ-এগার বছর বয়সে মা চলে গেছেন। স্ত্রীলোকহীন সংসারে বাবা-কাকার তত্ত্বাবধানে পড়াশোনা, গানবাজনা নিয়ে মেতে থেকেছে, বৈধব্যের নিয়মকানুন, মেয়েলি আচার-বিচারের কিছুই সে জানে না। এসব নিয়ে কোনদিন চিন্তা করারও দরকার হয়নি। দু বেণী ঝুলিয়ে কলেজ গেছে হালকা মনে, বাড়ি ফিরে স্কিপিং রোপ, সেতার, রেডিও, সিনেমা, গল্পের বই। সংসারের আর পাঁচটা সাধারণ দৃশ্যের মতো দেখেছে থানপরা শূন্যসিঁথি বিধবাদের। আভরণহীন, শূন্যদৃষ্টি, মুখে হয় বিষাদ নয় কেমন একটা কাঠিন্য। কিন্তু প্রিয়জন বিয়োগের সন্তাপ ছাড়াও যে তাঁদের জীবনে আর কোনও দুঃখ থাকতে পারে এবং তা অসহনীয়ও হতে পারে তার বেণীদোলানো মাথায় সে চিন্তা কখনও আসেনি। আজ নিজে সেই থানকাপড়ের দলে ভর্তি হয়ে সেই দীর্ঘ, কঠিন, নিঃশব্দ মিছিলের অন্তর্বর্তিনী হয়ে বড় মর্মান্তিকভাবে বোধোদয় হল।
হঠাৎ বিদ্যুচ্চমকের মতো তার মনে হল আচ্ছা তার শাশুড়ি, খুড়শাশুড়ি এঁরাও তো তার সঙ্গে খান না। ওঁরা তাহলে সবই খান। আচ্ছা, তার স্বামী-বিয়োগের শোক যেমন প্রচণ্ড, শাশুড়ির পুত্রশোকও কি তেমনি প্রচণ্ড নয়, তাহলে? স্বামীহারা স্ত্রীর রসনা যদি খাদ্যের প্রতি সম্পূর্ণ উদাসীন হয়ে যাবে বলে লোকে প্রত্যাশা করে, পুত্রহীনা মায়ের ক্ষেত্রেও তো তাই-ই হবার কথা। অর শুধু মা-ই বা কেন? বাবা? বাবা কি ছেলেকে কম ভালোবাসেন? অভিমন্যুর বাবা খোকা-অন্ত প্রাণ ছিলেন। খোকার সঙ্গে পরামর্শ ছাড়া কোনও কাজ করতেন না। ছেলেও ছিল ভীষণ পিতৃ-মাতৃ-ভক্ত। বাবা বারণ করলেন বাথরুম ওঠা বন্ধ হয়ে গেল। আগে কেন কথাটা বলেননি, পিলার অর্ধেক উঠে যাবার পর কেন বললেন এসব প্রশ্নই আর তার মনে এল না। কোনও খেদও না। অথচ একটা বিলাস- বাথরুমের কি শখই ছিল! আচ্ছা, বিপত্নীকের দুঃখই বা কম কিসে? আজ যদি অভিমন্যু থাকত, বন্দনা চলে যেত, অভিমন্যুর কি এরকম বুকের শিরছেঁড়া যন্ত্রণা হত না? তার জন্যে কি নিরামিষ হেঁশেল হোত? এমনি আলাদা আয়োজন? আলাদা প্রয়োজন? এতদিনে বন্দনা বুঝতে পারল হিন্দু নারীর জীবনে বৈধব্যকেই কেন সবচেয়ে বড় অভিসম্পাত মনে করা হয়, আর কেনই বা গুরুজনরা বিবাহিত মেয়েদের ‘জন্ম-এয়োস্ত্রী হও’ বলে অমন গুরুভঙ্গিতে আশীর্বাদ করে থাকেন! প্রিয়জন বিয়োগের দুঃখের চেয়েও বোধহয় শেষ পর্যন্ত বড় হয়ে ওঠে সারা জীবন বঞ্চনার এই নিষ্ঠুর শাস্তি। আয়নার দিকে চেয়ে বন্দনার মনে হল গত শতাব্দীর কঙ্কাবতী কন্যার সঙ্গে আজকের বন্দনা ভট্চায্যির মৌলিক কোনও পার্থক্যই নেই। যতদিন কঙ্কাবতীর দশার মধ্যে মোটা দাগের নিষ্ঠুরতাগুলো চোখে পড়ত ততদিন করুণাসাগর তার দিকে ধাবিত হয়েছে। আজকের এই যন্ত্রণা নীরব এবং গোপন।
এরপরই খাবার ঘরে সেই বিস্ফোরণ—‘এ আমি আর খেতে পারছি না, পারছি না।’
অধ্যায় ৫
কলি আর মিলি, কলিকা আর মল্লিকা দুইজাঠতুতো, খুড়তুত বোন। দুজনের অবস্থার এবং চরিত্রের একটা আপাত-মিল থাকলেও, আসলে কিন্তু সূক্ষ্ম কতকগুলো তফাত আছে। মল্লিকা মাত্রই এক সন্তান, দাদা ছেড়ে তার আর কোনও বোনও নেই সহোদর। তার আবদার পূর্ণ হবে না এমন হতে পারে না। বাড়ির নিয়ম মেনে মিলি যা খুশি চাইতে পারে, যা খুশি করতে পারে। কোনও বাধা নেই। টেস্ট ক্রিকেটের সীজন-টিকিট, গ্র্যান্ড-এ গিয়ে বিদেশী খেলোয়াড়দের অটোগ্রাফ নিয়ে আসা, ক্রিকেট-পাগলদের সঙ্গে পত্র-মিতালি। এমনকি বাবাকে সঙ্গে নিয়ে পলি উমরিগরের সঙ্গে পার্ক স্ট্রিটের রেস্তোরাঁয় কফি খাওয়া এবং তাঁর স্বাক্ষরিত ফটোগ্রাফ জোগাড় করা, এ সমস্তই মিলি তার ইচ্ছেমত করে থাকে। বাবা মা তাকে কিছুতে বাধা দেন না, চাঁদটা নেহাত পেড়ে দেওয়া যায় না, তাই। তবে জ্যাঠাইমার প্রবল প্রতাপ এবং জ্যাঠামশাইয়ের ব্যক্তিত্বের কাছে তার বাবা-মাকে খানিকটা নমনীয় হয়ে থাকতেই হয়। প্লেয়ারদের বাড়িতে ডেকে ভাই-ফোঁটা দেবার ইচ্ছেটা যেমন তার পূর্ণ হয়নি। পত্র-মিতালির চিঠিগুলোও সব জ্যাঠামশাইয়ের হাত-ফেরত হয়ে আসে। জ্যাঠাইমা মায়ের কথাবার্তায়, মতামতে সায় দিয়ে সাউখুরি করাও মিলির একটা তোষামুদে অভ্যাস। এ ভাবে সে জ্যাঠাইমার নেকনজরে থাকবার চেষ্টা করে, নিজের অজান্তেই। যেহেতু মা- বাবার তাকে অদেয় কিছু নেই, তাই তারও যে অন্যদের কিছু দেয় আছে, এখনও পর্যন্ত মিলি সে কথাটা শেখেনি। পরে কি হবে বলা যায় না। তবে তার চেয়ে দু বছরের বড় দিদি কলির তার ওপর বেশ প্রভাব আছে।
কলিও কম আদরের নয়। বড়দি কণিকার বিয়ে হয়ে গেছে বহুকাল, বড়দি থাকেও দূরে, মাদ্রাজে। আসা-যাওয়া খুব কম। চার ভাইয়ের কোলে এক বোন। সেজভাই আবার নিজের মতে ক্রিশ্চান বিয়ে করার অপরাধে বাড়ি থেকে বহিষ্কৃত। তার এবং তার পরিবারের সঙ্গে এ বাড়ির কোনও সম্পর্কই নেই। তার ওপর বড়দা মারা গেছেন হঠাৎ। সবচেয়ে ছোট কলি। তার বাবা মা বলেন বাড়িতে মেয়ে না থাকলে মানায় না। ওরা দুই বোন থাকায় বাড়ির শ্রীবৃদ্ধি হয়েছে। দুদিকে দুটো বেণী ঝুলিয়ে, ধনেখালি ডুরে শাড়ির আঁচল কোমরে জড়িয়ে কপালে কুমকুমের টিপ দিয়ে দুই বোন বাবা-মা-কাকা-কাকী-দাদাদের চোখের সামনে ঘুরে বেড়ায় দুটো গাঁদা ফুলের তোড়ার মতো। কিন্তু কলির জীবনে শোকের কীট প্রবেশ করেছে। মিলির মতো নির্ভেজাল হাসি-খুশিতে ডগোমগো হয়ে থাকা আর যেন তার আসে না। এক একটা অভিজ্ঞতা তার কিশোরী জীবনে প্রবেশ করে আর তাকে একটু একটু করে বদলে দিয়ে যায়। মিলির থেকে মাত্র দু বছরের বড় হলেও খেলার খবর, সিনেমার পাতা আর অনুরোধের আসরের কাল সে যেন কবেই কাটিয়ে এসেছে। কলির জীবনের প্রথম দুঃখ তার সেজদার বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়া। সেজদা লেখাপড়া মন দিয়ে করত না, গান-বাজনা করত, হোটেলে যারা গান-টান গায় তাদের সঙ্গে মিশত। পিয়ানো অ্যাকর্ডিয়ন বাজাত দারুণ সুন্দর। একদম শ্যামবাজারের বাড়ির মতো নয়। কলির জীবনে বৈচিত্র্যের স্বাদ এই সেজদাই এনে দিত। খুব ভাব ছিল তাই। সেজদা মজাদার খাবার জিনিস নিয়ে আসত। বীফ কাবাব, হ্যাম স্যান্ডউইচ। ছাদে গিয়ে দুজনে খেতো। মিলিকে ডাকত না। মিলি একটু লাগানে ভাঙানে স্বভাবের আছে। পেট-আলগা। মায়ের সঙ্গে রোজ রাত্রে শুয়ে শুয়ে ওর গল্প হয়। কোন ছেলে ওর দিকে চেয়ে শিস দিয়েছিল, কবে কে বাসে গা ঘেঁসে বিশ্রীভাবে দাঁড়িয়েছিল—এসব লজ্জার কথাও অনায়াসে মাকে বলে দিতে পারে। বীফ কাবাব, হ্যাম স্যান্ডউইচের কথা ওর পেটে থাকবে না। সেজদা বেচারি নিপাট ভালোমানুষ এক অঙ্কের দিদিমণিকে বিয়ে করল চুপিচুপি। মীরা ইসাবেলা মণ্ডল। প্রথম কলিকেই জানিয়েছিল, কলির সঙ্গেই আলাপ করিয়ে দিয়েছিল একদিন সিনেমা দেখাতে গিয়ে। কে বলবে ক্রিশ্চান। রঙ ময়লা, মিষ্টি মুখ, ঠিক যেন কলির এক দিদি। এতগুলো দাদা আর ওই আহ্লাদি বোন না থেকে এরকম একটা দিদি যদি থাকত তো কাজ দিত। বোনের আদুরেপনা আর বোকামি, দাদাদের খুনসুটি একেক সময় অসহ্য মনে হয় তার। কলি বলেছিল—‘বল না সেজদা, বাড়িতে বলেই দ্যাখ না।’
সেজদা উদাস হয়ে বলেছিল—‘নাথিং ডুয়িং। হোটেলঅলা ওল্ড ম্যান জানতে পারলে, এখুনি আমাকে খড়ম পেটা করে তাড়াবে।’
—‘মা? মা নিশ্চয় বাবাকে বোঝাবে!’
—‘মা? ওরেব্বাবা! সুন্দরবনের রয়্যাল বেঙ্গল টাইগ্রেস। মোর ফেরোসাস দ্যান বস্। তার অমতে বাড়িতে বউ আসবে, আবার ক্রিশ্চান, আবার ছোট জাত! তুই কি পাগল হয়েছিস কলি? একটু গুছিয়ে নিই, একটা বড় হোটেলে কাজ পাবার কথা হচ্ছে। তখন জানিয়ে কেটে পড়ব। তুই মাঝে মাঝে চলে যাবি। ঠিকানাটা তোকে জানিয়ে যাব।’
ঠিকানা জানিয়ে যাওয়া কিন্তু সেজদার আদৌ হয়নি। বেচারি এক রাত্তিরে খবরটা জানিয়েছিল, খাওয়া-দাওয়ার পর, বাবার সেরেস্তায় গিয়ে, বজ্রাহত কাশীনাথ ভট্টাচার্য তাকে সেই মুহূর্তে বাড়ি থেকে বার করে দেন। তখন কলিরা ঘুমিয়ে পড়েছে। সকালবেলা উঠে আর সেজদাকে দেখেনি। নাম উচ্চারণ করলে পর্যন্ত রক্তচক্ষু দেখতে হয়। এখনও।
কলি অপেক্ষা করত, সেজদা হয়ত কলেজে দেখা করতে আসবে। বলে যাবে ঠিকানাটা। কেমন আছে খবরাখবর দেবে, নেবে। কিন্তু সেজদা যেন উবে গেল। কলেজ থেকে ফিরতে ফিরতে কলির মনে পড়ত সেজদার কথাগুলো—‘ইন এনি কেস, দ্যাখ আমায় চলে যেতে হবে। দাদা এঞ্জিনিয়ার। স্টার-পাওয়া ছেলে। মেজদাটাও ঘষটে ঘষটে কস্ট অ্যাকাউন্ট্যান্ট হয়ে যাবে। ভেবলু কিছু না হোক একটা উচ্চশ্রেণীর কেরানিগিরি তো হাঁকড়াবেই! কিম্বা হয়ত বাবার জুনিয়র হয়ে কোর্টে বেরোবে। আমি দ্যাখ আই এস সিটাতে ঠেকে গেলুম। তার ওপর ব্যাঞ্জো, পিয়ানো, অ্যাকর্ডিয়ন এগুলো এমন টানে আমায় আর অন্য কিছু করতেই ইচ্ছে যায় না। হোটেলের অ্যাকর্ডিয়ন-বাদককে তোদের ভট্চায্যি বাড়ি টিঁকতে দেবে?’
কলির সুমসৃণ সহজ সরল জীবনে এই প্রথম ধাক্কা। গোড়ায় গোড়ায় লুকিয়ে কাঁদত। মিলিটা ন্যাকা, একদিন গিয়ে কাকিমাকে বলে দিল।
—‘জানো মা, দিদি সেজদার জন্যে কাঁদে।’
—‘এই চুপ চুপ। বড় গিন্নি জানতে পারলে কি বট্ঠাকুর টের পেলে আর রক্ষা থাকবে না।’
কলি তখন মিলিকে বলেছিল—‘তুই কি আমার হাসি-কান্নার ওপরও ট্যাক্স বসাবি? এক্সাইজ অফিসার না কি রে তুই?’
মিলি বলেছিল—‘তা নয়। কিন্তু ভেবে দ্যাখ সেজদাও তো আমাদের কথা, আমাদের বংশমর্যাদার কথা ভাবেনি। কোন্ কেরেস্তান রাক্ষুসীকে বিয়ে করে বসে রইল!’
—‘কার কথা রিপিট করছিস রে? মার? কেরেস্তান-রাক্ষুসীটা তো তোর ডিকশনারির না?’
মিলি হেসে ফেলেছিল—‘মা-জ্যাঠাইমা বলাবলি করছিল তো!’
অত দুঃখেও কলির হাসি আসে—‘তুই-ও অমনি অবিকল তুলে নিলি গলায়? পারিসও বাবা।’
তারপরই তাড়াতাড়ি বড়দার বিয়ে হয়ে গেল। বউমণি এল ঘর আলো করে। সে কি রোশনাই! তিনদিন ধরে কি ধুমধামের যজ্ঞি! সারাক্ষণই সবার মুখ চলছে। তপসে মাছের ফ্রাই হচ্ছে, ছোট চুবড়ির এক চুবড়ি নীলকণ্ঠ ঠাকুর ভাইবোনেদের সামনে ধরে দিয়ে গেল, —‘চেখে দ্যাখো তো দাদাদিদিরা নীলকণ্ঠ বামুনের নাম থাকবে কি না!’ রসে টইটম্বুর ভাসছে লালচে কালো পানতুয়া, প্রথম রসটুকু ঢুকতেই গরম গরম আগে কলি-মিলি। মায়েরা সব সময়েই বলে থাকেন—‘পরের বাড়ি চলে যাবে দুদিন পরেই, ওদের আদর-খাতির আলাদা।’ কিন্তু কলি জানে এই সমস্ত আদরের পেছনে একটা ভয়াল ভ্রূকুটি রয়েছে। সে জানে না সচেতনে, কিন্তু তার অন্তরাত্মা জানে এ বাড়ির সন্তান বাবা-মার দ্বারা পরিত্যক্ত হয়ে কোথায় কোথায় চলে যেতে পারে, কেউ খোঁজ রাখার পর্যন্ত দরকার মনে করবে না। বউমণির বিয়ের আসরে সব্বাই জিজ্ঞেস করছে ‘টুবলু কোথায় গেল? টুবলুকে দেখছি না তো?’
—‘চাকরির ইনটারভিউ দিতে গেছে।’
—‘কোথায়?’
—‘বম্বের দিকে।’
সেই চাকরির ইনটারভ্যু সেজদার এখনও চলছে।
তাই মিলি যখন অপরাধীর মতো মুখ করে বলল—‘দিদি একটা কথা শুনবি?’ কলি বলল—‘কি কথা? ছাদে যেতে হবে? ওদের কোনও গোপন কথা থাকলেই ওরা ছাদে যায়। বাড়ির বড়রা কেউ নেহাত দরকার না পড়লে ছাদে যায় না। ছাদে ওদের সমস্ত গোপন কথা নিরাপদ। কলির মনে হল মিলি নিশ্চয়ই সেজদাকে দেখেছে।
ছাদের চিলেকুঠরিতে ঠাকুরঘর। কয়েক ধাপ সিঁড়ি উঠে তারপর। সেই সিঁড়ির ওপর বসে ওরা গল্প করে। শীতের দুপুরে-সকালে পড়া তৈরি করে।
মিলি বলল—‘রাগ করবি না?’
—‘না, কেন? কি করেছিস?’
কলি নিজের এমন কোনও সাম্প্রতিক অন্যায় ভেবে পেল না, যা নিয়ে মিলি নালিশ করলে সে বকুনি খেতে পারে।
মিলি বলল—‘আমি বউমণিকে একটা কথা বলে ফেলেছি, বউমণি বোধহয় খুব কষ্ট পেয়েছে।’
—‘কি বলেছিস?’ কলি উদ্বিগ্ন হয়ে বলল।
—‘আমি বলিনি রে দিদি। আসলে মা, জ্যাঠাইমা সব সময়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে তো।’
—‘কি আলোচনা?’
—‘এই বউমণি রঙিন শাড়ি পরে, গয়না পরে, বিশেষ করে কানের গয়না বিধবাদের পরতে নেই, সংসারের অকল্যাণ হয়।’
—‘তুই এই সব বললি গিয়ে বউমণিকে?’
মিলি ঢোক গিলল—‘না, এতো কথা বলিনি।’
—‘বড়দের পেছন পেছন পাকামি করে ঘোরবার তোর দরকার কি রে মিলি? সমস্ত কথাগুলো গিলবি, কোথায় কতটুকু বলতে হয়, তোকে কি মানায় না মানায় কিচ্ছু বুঝবি না, ছি ছি! ডাক্তার-জ্যাঠা সেদিন কি বলে গিয়েছিলেন খেয়াল আছে? বউমণি ওরকম বিশ্রী সাজলে খোকামণি মরে যেতে পারে, তা জানিস?’
—‘সেটাই বলছিলুম, জ্যাঠাইমা বলছিল খোকামণি স্কুলে চলে গেলে তো বউমা ওসব গয়না-টয়না খুলে রাখলে পারে। একেই তো সংসারের ওপর দিয়ে একটা ঝড় বয়ে গেল, আবার যদি…’
—‘বললি? তুই একথা বললি? মিলি তুই শুধু বোকা নয়। কি অদ্বিতীয় নিষ্ঠুর তা যদি জানতিস। তুই দুদিন পরে বি এস সি দিয়ে গ্র্যাজুয়েট হতে যাচ্ছিস, তোর একটা সাধারণ বুদ্ধি পর্যন্ত নেই? ছি ছি!’
বেশি ছিছিক্কার মিলি আবার সইতে পারে না। ফোঁস করে উঠল —‘লোকে নিন্দে করলে? আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী সবাইকে নিয়েই তো ঘর করতে হয় আমাদের।’
—‘মা-কাকিমা সেকেলে লোক। তারা নিজেদের মধ্যে যে-সব আলোচনা করে সেই কথাগুলো তোর বউমণির কাছে গিয়ে না লাগালে ঘুম হচ্ছিল না? ভাব তো মিলি তোর যদি, আমার যদি এমনি হত!’
মিলির হাতে সোনার মকরমুখো বালা, গলায় মটরদানা, কানে তারের কাজ করা মাকড়ি, জ্যোতিষী দেখিয়ে মা তিনখানা আংটি পরিয়ে দিয়েছেন—মুক্তো, চুনী আর গোমেদ। মিলি হঠাৎ কেঁদে ফেলল। বলল—‘আমি খুব খারাপ করেছি না রে দিদি? বউমণি সত্যি কি হয়ে গেছে! আমার কথায় কেমন ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল, চোখ দুটো যেন পাগলের মতো, আমি সইতে পারিনি, পালিয়ে এসেছি। সেদিন থেকে সুযোগ খুঁজছি, কখন তোকে বলব।’
মিলি এতো কাঁদতে লাগল যে কলি নিজের চোখের জল মুছে, ওকে সান্ত্বনা দিতে বাধ্য হল। বলল—‘মিলি শোন, যা করে ফেলেছিস, ফেলেছিস। আর কক্ষনো এ ধরনের কথা বউমণির কানে তুলবি না। চল, একদিন আমরা বউমণিকে নিয়ে সিনেমা যাই।’ ‘বলবি?’
মিলি ভয়ে ভয়ে বলল—‘আমি বলতে পারব না দিদি বউমণি বোধহয় আর কোনদিন আমার সঙ্গে কথা বলবে না।’
কলি সান্ত্বনা দিয়ে বলল—‘বউমণি ওরকম মানুষই নয়। ক’টা দিন যাক। আমিই বলব এখন।’
মিলি বলল—‘আগে জ্যাঠাইমাকে জিজ্ঞেস করে নিস।’
অন্যমনস্ক গলায় কলি বলল—‘তা অবশ্য।’ আগে বউদিকে না জিজ্ঞেস করে আগে মাকে জিজ্ঞেস করার কথায় তার মন কেন যেন সায় দিল না। অনুমতি চাওয়ার ব্যাপারটা আগেও ছিল, কিন্তু এখন যেন তার গুরুত্ব আরও বেড়ে গেছে। এটা অনুভব করতে ভালো লাগল না।
দুজনে অনেকক্ষণ ধরে হাত ধরাধরি করে ঠাকুরঘরের সিঁড়ির ধাপে বসে রইল। চুপচাপ। বসন্তের হাওয়া দিচ্ছে হু হু করে। কোথা থেকে নাম-না-জানা ফুলের গন্ধ আসছে। মন কেমন করে। কার জন্যে যেন ভীষণ মন কেমন করে। সে কি বিতাড়িত সেজদা? সে কি অকালমৃত বড়দা সে কি বিধবা শ্রীহীন বউমণি? নাকি অন্য কেউ? কলি বুঝতে পারে না। বুকটা এতো টনটন করতে থাকে যে মনে হয় গলার মধ্যে দিয়ে উপছে বেরিয়ে আসবে। কাদের বাড়ি আবার রেডিও খুলে দিয়েছে। গান হচ্ছে—‘আমি যে গান গেয়েছিলেম, জীর্ণ পাতা ঝরার বেলায়, মনে রেখো।’ ক’টা দিনই বা জীবনের কেটেছে। কলির বয়স কুড়ি। মিলির আঠার বছর তিন-চার মাস। কারুরই অতীত এখনও ভালো করে তৈরি হয়নি। তবু সেই অপরিণত অতীতের দুঃখে, নাকি আসন্ন ভবিষ্যতের আশঙ্কায় দুজনে হাতে হাত জড়াজড়ি করে বসে থাকে। মিলির ভাবটা যেন সব মুশকিলের আসান তার দিদি করে দেবে। এই মুহূর্তে তার মা-বাবার ওপরও ভরসা নেই। তাঁরা অন্য জগতের অন্য ধাতুর লোক। জীবনের সব পথ মা বাবার হাত ধরে হাঁটা যায় না। জীবনের এই ধাপে বরং তার দু বছরের বড় দিদি তার ভাষা বুঝবে, তার ভুলের ক্ষমা জুটিয়ে দেবে।
অধ্যায় ৬
জুন মাসের দুপুরবেলা। গরমের ছুটির পর সবে স্কুল খুলেছে। রূপ স্কুলে চলে গেছে। বন্দনা তার ঘরের কাজ সারছে। জানলা-দরজায় ধুলো পড়ে, রোজ না ঝাড়লে গরাদে হাত দেওয়া যায় না। আসবাবপত্রের ওপরেও এখন পাতলা ধুলোর সর। রূপের টেবিল এলোমেলো হয়ে থাকে। রঙের প্যালেট, জলের মধ্যে রঙগোলা, তুলি ডোবানো। বই, খাতাপত্তর যেগুলো সেদিনের রুটিন অনুযায়ী নিয়ে গেছে, গেছে। কিন্তু বাকি সব উল্টোপাল্টা। এই সময়ে সব কিছু গুছিয়ে ঝেড়ে-ঝুড়ে ঝকঝকে করে তোলবার কাজটা পরিপাটি করে করবে এই সংকল্প তার।
ঘরের দরজায় টোকা পড়ল। খোলাই আছে। মোটা পর্দার আড়াল। ননদেরা পর্দা ঠেলে ঢুকে আসে, শাশুড়িরাও তাই। তাহলে হয়ত ছোট দেওর। কেন? দরজার কাছে গিয়ে বন্দনা দেখল শ্বশুরমশাই। খুব অন্যমনস্ক ছিল নিশ্চয়ই নয়ত খড়মের শব্দ শুনতে পেত, খোলা দালানের পথে অনেক দূর থেকেই।
‘আসুন বাবা, ভেতরে আসুন’— মাথার কাপড় টেনে বন্দনা বলল। কাশীনাথবাবু বললেন—‘যোগীন্দর অ্যান্ড যোগীন্দর প্রভিডেন্ট ফান্ড-এর কাগজপত্রগুলো সব পাঠিয়েছে। এবার টাকাকড়িগুলো সব পাওয়া যাবে। খোকা তোমাকে আর তোমার মাকে জয়েন্ট নমিনি করেছে দেখছি। দুজনেরই ফিফটি-ফিফটি শেয়ার। টাকাটা আনতে তোমাকেই যেতে হবে মা, খোকার কিছু বকেয়া পাওনাও আছে। আমি নিজে তোমাকে সঙ্গে নিয়ে যাব। কাল সুবিধে হবে?’
—‘ক’দিন পরে গেলে হয় না?’ বন্দনা থতমত খেয়ে বলল। সে এতদিন বাইরে বেরোয়নি, মানুষজনের মুখ না দেখে কাটিয়েছে যে হঠাৎ বাইরে বেরোবার প্রস্তাবে সে সন্ত্রস্ত হয়ে ওঠে। আরও সঙ্কোচ অভিমন্যুর অফিসে যেতে। অফিসের বার্ষিক উৎসবে রানীর মতন সেজেগুজে গেছে। গান, নাটক, স্পোর্টস হত সব শ্রেণীর কর্মচারীদের স্ত্রী ছেলেমেয়েদের জন্য। কত পার্টিতে অভিমন্যুর সমপর্যায়ের এবং আরও উচ্চপদস্থ অফিসারদের সঙ্গে আলাপ করেছে। তার নরম অথচ সপ্রতিভ ব্যক্তিত্বের জন্য বিশেষ জনপ্রিয় ছিল সে অভিমন্যুদের অফিসের এই সব নানাবিধ উৎসবে অনুষ্ঠানে। সেখানে এই অনাথিনী, ভিখারিনীর বেশে স্বামীর পাওনা টাকার ভিক্ষা হাত পেতে নেবার জন্য যেতে হবে ভেবে শিউরোচ্ছিল সে। খবরটাও একদম হঠাৎ। প্রস্তুতি ছাড়া, নিজেকে খানিকটা গুছিয়ে না নিয়ে সে পারবে না, পারবেই না।
কাশীনাথবাবু গম্ভীর গলায় বললেন—‘দেরি না করাই ভালো। এমনিতেই অনেক দেরি হয়ে গেল। অমনি একেবারে ব্যাঙ্কের কাজটাও সেরে আসব।’
বন্দনা চেয়ে আছে দেখে একটু ইতস্তত করে থেমে থেমে বললেন—‘মোট পঞ্চাশ হাজারের মতো টাকা, আমি বলছিলাম কি সবটাই একসঙ্গে আমার অ্যাকাউন্টে জমা দিয়ে রাখি। কি বলো?’
বন্দনা হঠাৎ আতঙ্কে স্থির হয়ে গেল। ইনি বলছেন কি? আজ এক বছরেরও বেশি সময় হল একটা পয়সারও মুখ দেখেনি সে। কিছুদিন আগে এল আই সি’র দরুন হাজার তিরিশেক টাকা পাওয়া গিয়েছিল। অভিমন্যু লাইফ ইনসিওর করাতে চাইত না। কেমন একটা বিরাগ ছিল ওর ব্যাপারটার ওপর। বলত—‘কমপালসারি সেভিং-এর আমার দরকারটা কি? আমি কি অসংযমী, না বদখেয়ালি? তাছাড়া আমি চিরকাল বেঁচে থাকব। শুধু শুধু কতকগুলো টাকা প্রিমিয়াম গুনতে আমার বয়ে গেছে।’ এক এজেন্ট বন্ধু অনেক বলে কয়ে, অনেক কাঁদুনি গেয়ে ওইটুকু করিয়েছিল। রূপ তার নমিনি ছিল। সে নাবালক বলে তার অভিভাবক হিসেবে ঠাকুর্দাদা সে টাকা তুলেছেন, বন্দনাকে তার বিলি-ব্যবস্থার কথা কিছু জিজ্ঞেস করেননি। অভিমন্যুর সব সঞ্চয় তার বাবার সঙ্গে জয়েন্ট অ্যাকাউন্টে থাকত। সেসবের খবরও সে কিছু রাখে না। স্বামীর মৃত্যুর পর থেকে একটি পয়সারও মুখ দেখেনি। অবশ্য তার দরকারই বা কি? কিন্তু স্বামী সব সময়ে তার হাতে কিছু টাকা রাখত। বলত—‘নিজেকে পরাধীন-টিন ভেবো না যেন, এটা তোমার একদম নিজস্ব। নিজের ইচ্ছেমতো খরচ করবে।’ মাসের শেষে হিসেব দিতে গেলে অভিমন্যু নানা উপায়ে মুখ বন্ধ করে দিত। সেই টাকা দিয়ে বন্দনা ননদদের সিনেমা দেখিয়েছে, রেস্তোরাঁয় খাইয়েছে, দেওরদের প্রতি শীতে নতুন নতুন সোয়েটার বুনে দিয়েছে। শাশুড়িদের স্কার্ফ; ননদদের কার্ডিগ্যান। স্বামীকে পুল-ওভার, স্লিপ-ওভার, হাতওয়ালা কার্ডিগ্যান, ছোট হাতা টি শার্ট। জন্মদিনে উপহার দিয়েছে সবাইকে। ইচ্ছে করলে তার থেকেও সঞ্চয় করতে পারত, করেনি, দুহাতে বিলিয়ে দিয়েছে। দেওয়াতে তার বরাবরই ভীষণ আনন্দ। আর বাপের বাড়ির তো কথাই নেই। বাবা-কাকা তো সংসার-খরচের টাকা সব তার হাতেই রাখতেন। অল্পবয়স থেকেই পয়সা-কড়ির মাসিক হিসেব করে চলা তার অভ্যাস। শূন্য হাতে কেমন অসহায় লাগে।
উত্তর দেবার সময়ে বন্দনা নিজের গলার স্বর নিজেই চিনতে পারল না। —‘না, বাবা।’
কাশীনাথবাবু প্রতিক্রিয়া একটু দেরিতে এল। কেমন খসখসে স্বর, গলাটা যেন হঠাৎই বসে গেছে। কেটে কেটে বললেন—‘কি না! আমার অ্যাকাউন্টে টাকা রাখবে না? বেশ, তুমি যদি মনে করো তোমার আলাদা অ্যাকাউন্ট দরকার, তো তাই হবে।’
ফেরবার সময়ে তাঁর খড়মের শব্দ বন্দনার কানে বাজতে লাগল। সিঁড়ি দিয়ে তিনি নেমে যেতেই মনটা ব্যাখ্যার অতীত গ্লানিতে ভরে গেল। যেন সারা শরীরে তার কাদা লেগে গেছে। কেন যে নিজেকে এতো ক্লিন্ন লাগল সে ভেবে পেল না। টাকাকড়ির বিষয়ে কোনদিন ভাবতে হয়নি, কোনও মতামত দিতে হয়নি। অভিমন্যু কোনদিন তার সঙ্গে আলোচনা করেনি তার টাকা নিয়ে সে কি করবে। একটা সাজানো যৌথ পরিবারের চৌখুপি কাটা ছকে সে যেন একটা ঘুঁটির মতো এসে বসে গিয়েছিল। তার জন্য কোনও নিয়ম বদলাবার দরকার হয়নি, কোনও ব্যবস্থার পরিবর্তন হয়নি, বাড়িতে ন’জন সদস্যের জায়গায় দশজন হয়েছিল এই পর্যন্ত। বন্দনা কোথাও এতটুকু ভার হয়নি। সকলকে সে তারা যেমন তেমনিভাবেই মেনে নিয়েছিল। অভিমন্যু শুধু তার জন্য কিছু মাসিক হাত-খরচ বরাদ্দ করেছিল। কথায় কথায় বাবার সঙ্গে তার জয়েন্ট অ্যাকাউন্টের কথা সে জানতে পেরেছিল। বাবার মৃত্যুর পর তাঁর সবচেয়ে কৃতী সবচেয়ে বিশ্বাসভাজন ছেলে সংসারের দেখাশোনা করবে, তাই এই ব্যবস্থা। অন্যরকম কিছু যে হতে পারে সে সম্ভাবনার কথা কি কেউ দুঃস্বপ্নেও ভাবতে পেরেছিল। প্রভিডেন্ট ফান্ড, এল আই সি’র নমিনি সে কাকে করল, কাকে অভিভাবক রাখল রূপের, এত সব সংবাদ বন্দনার সম্পূর্ণ অজ্ঞাত। ছ বছরের বিবাহিত জীবনে তাদের সম্পর্কটা ছিল হাসি আনন্দ আহ্লাদের, বিশেষ করে অভিমন্যু তার থেকে এগার বছরের বড় হওয়ায়, বন্দনার নির্ভরশীলতা ও সমর্পণ ছিল একেবারে প্রশ্নহীন।
সেই স্বামী দু ঘণ্টার মধ্যে তাকে ঝেড়ে ফেলে দিয়ে চলে গেল এখন সে তার রেখে-যাওয়া টাকাকড়ির বিষয়ে কথা বলছে, নিজস্ব মতামত দিচ্ছে, সিদ্ধান্ত নিচ্ছে—এই পরিস্থিতিটা বন্দনার সমস্ত অস্তিত্বকে যেন টেনে কাদা-মাটির মধ্যে ফেলে দিল। সে বাতাসে বিচরণ করত, এখন পচা ডোবায় পড়ে কোনমতে কাদা ঠেলে ওঠবার চেষ্টা করছে। অনুভূতিটা এইরকম। শ্বশুরমশাই স্পষ্টই ক্ষুণ্ণ হয়েছেন। সে যেন সূক্ষ্মভাবে বয়স্ক মানুষটিকে অপমান করল। অভিমন্যুর অবর্তমানে সে তার বাবার ওপর নির্ভর করতে পারছে না, যদিও অভিমন্যু তার টাকা-পয়সাঘটিত ব্যবস্থাদির মধ্যে দিয়ে নিজের বাবার ওপর তার নির্ভরতা তার বিশ্বাস বারবার প্রকাশ করে গেছে। অভিমন্যু পেরেছিল, বন্দনা পারছে না। এই খবরটা আজকের ছোট্ট সংলাপটুকুর মধ্যে দিয়ে ফাঁস হয়ে গেল। যা গোপন থাকলে ভালো হত, তা চাউর হয়ে গেল। সমস্ত ব্যাপারটার স্থূলতা, নগ্নতা বন্দনাকে লজ্জায় আপাদমস্তক এমনি মলিন করতে থাকল যে শ্বশুরমশাইনেমে যাওয়ার কিছুক্ষণ পরে সে দরজাটা নিঃশব্দে বন্ধ করে দিয়ে রূপের চেয়ারে বসে টেবিলে মাথা রেখে কেঁদে ফেলল। কাঁদল কতদিন পর! এত কান্না কেঁদেছে যে মনে হয়েছিল চোখের জল বুঝি সব ফুরিয়ে গেছে। শরীরটাকে নিংড়োলেও আর জল বেরোবে না। কিন্তু চোখের জল কতরকমের হয়, সবই তো শুধু শোকের নয়! সেই বহুবিধ চোখের জলের সঙ্গে তার পরিচয় করাবে বলেই তার জীবন যেন ভূমিকা হিসেবে জুন মাসের এই রোদ- ঝনঝনে সকালবেলাটাকে বেছে নিয়েছে।
ড্রয়ার থেকে চিঠি লেখার প্যাড বার করল বন্দনা। এ তার গায়ে হলুদের তত্ত্বের গোলাপি ফুলছাপ লেটার প্যাড। ব্যবহার করার দরকার হয়নি। তাদের জীবনে বিরহ বিশেষ ছিল না। বন্দনার এমন কোনও অন্তরঙ্গ সখীও ছিল না যাকে গোলাপি লেটার প্যাডে চিঠি দেওয়া যায়। কিন্তু এই ছাড়া আপাতত কিছু নেই। এতেই লিখতে হবে। তারপর খামের জন্য শাশুড়ির কাছে যেতে হবে। তিনি বলবেন—‘কাকে চিঠি লিখলে বউমা?’ এমনিই জিজ্ঞেস করবেন। অতিসাধারণ মেয়েলি কৌতূহল। তবু ভালো লাগে না।
বন্দনা অনিচ্ছার সঙ্গে বলবে—‘কাকাকে।’
—‘বে-ই মশায়ের চিঠি আজকালের মধ্যে এসেছে বুঝি? কই দেখিনি তো? উনি তো বলেননি?’
যেন কাকা সম্প্রতি চিঠি দিয়ে না থাকলে বন্দনা একটা অতিরিক্ত চিঠি তাঁকে দিতে পারে না।
কাকাকে চিঠি দিয়ে অবশ্য খুব যে একটা লাভ আছে, তা-ও নয়। প্রথম মুশকিল চিঠি কাকার কাছে পৌঁছবে কি না। কখন যে কোথায় থাকেন? বছর দেড়েক হল সরকারি চাকরি থেকে আগেভাগে অবসর নিয়ে নিয়েছেন। দাদা অর্থাৎ বন্দনার বাবা মারা যাবার পর থেকেই উড়ু-উড়ু করছিলেন। রিটায়ার করার পর যেন পাখা গজালো। হিমালয়ের নেশা চিরদিনই ছিল। এখন আর কাকাকে বাড়িতে পাওয়া যায় না। অভিমন্যুর মৃত্যু সংবাদও তাঁর কাছে পৌঁছেছিল অনেক দেরিতে। খবর পেয়েও আসেননি। শুধু শ্বশুরমশাইকে একটা চিঠি দিয়ে জানিয়েছিলেন বুড়ির সামনে গিয়ে দাঁড়ানোর মতো মনের জোর তাঁর নেই। কাশীনাথবাবু স্বয়ংই বুড়ির দ্বিতীয় পিতা। এই অকল্পনীয় বিপর্যয়ে তিনিই যেন বুড়িমাকে কোলে তুলে নেন।
নানান জায়গা থেকে এখন কাকার চিঠি আসে, হরিদ্বার, কাঠগুদাম, আলমোড়া, রিলকোট, মিলাম। তাতে কোনও সান্ত্বনার ভাষা থাকে না, কোনও ব্যক্তিগত কথাই না। খালি হিমালয় আর হিমালয়। বন্দনা ড্রয়ার থেকে কাকার শেষ চিঠিটা বার করে খুলল। উত্তর দেওয়া হয়নি এ চিঠির। বেশির ভাগেরই জবাব বন্দনা দেয় না। কিন্তু সে জবাব দিক না দিক, কাকার চিঠি নিয়মিত এসে যায়। কাকা লিখেছেন:
বুড়িমা,
এমন একটি আকাশের তলায় দাঁড়াইয়া আছি, যেখানে সভ্যতার ধোঁয়া-কালি পৌঁছয় না। আকাশই যে আদিমাতা, আকাশই যে সেই বহুকথিত ফার্স্ট প্রিন্সিপল, তাহা বুড়িমা এইস্থানে দাঁড়াইয়া তোমার ঠিকই উপলব্ধি হইবে। সমুদ্রপৃষ্ঠ হইতে এগারহাজার ফুট উচ্চে আছি। বাতাস একটু পাতলা। ধীরে ধীরে অভ্যাস হইয়া যাইবে। কোথাও তৃণাদি গুল্ম অবধি লক্ষিত হইতেছে না। কিন্তু সামান্য দূরে (যদিও প্রকৃতপক্ষে বহু দূর) অপরূপা কাঞ্চনজঙ্ঘা একদিকে এবং মহিমময় এভারেস্ট আরেক দিকে মাথা তুলিয়া দাঁড়াইয়া আছে। দেখিতে দেখিতে কুয়াশার আড়ালে চলিয়া যাইতেছে, আবার সূর্য কিরণে হাসিয়া উঠিতেছে। কাঠের নির্জন, আক্ষরিক অর্থে জনহীন বাংলোয় কাচের মধ্য হইতে এই অলৌকিক দৃশ্য দেখিতেছি, এ যে কি অতীন্দ্রিয়ানুভূতি সৃষ্টি করে, আমি সামান্য মানুষ ভাষায় প্রকাশ করিতে পারি এ ক্ষমতা নাই। যেন স্বর্গের দ্বার আমার সম্মুখে উন্মুক্ত। এই তুষার, এই পর্বতপৃষ্ঠ ওই দূর-দৃষ্ট শৃঙ্গগুলি ইহারাই স্বর্গের পথের প্রথম সোপান ইহাতে সন্দেহ নাই। শুধু সৌন্দর্য ও নির্মলতার কারণে নয়। এই পীঠের উপর পা রাখিয়া দেখিতেছি পৃথিবীতে ক্রোধ নাই, লোভ নাই, মাৎসর্য নাই, শোক দুঃখ কিছু নাই, শুধু অখণ্ড শান্তি ও আনন্দ, আনন্দধারা বহিছে ভুবনে। এই আনন্দ বাহিরে, এই আনন্দ অন্তরে, ইহা জীবন এবং অভিজ্ঞতা-নিরপেক্ষ। দাঙ্গা হাঙ্গামা করিয়া যে নিষ্ঠুর ব্যক্তিগুলি সাম্প্রতিক কালে অগণিত মানুষ খুন করিয়াছে, তাহাদেরও যদি সূর্যোদয়ের সময়ে সুবর্ণ জ্যোৎস্নাময় কাঞ্চনজঙ্ঘা ও এভারেস্ট গিরিশৃঙ্গ দেখানো যাইত তাহারাও ইহা উপলব্ধি করিত। মা আমি কবিত্ব করিতেছি না, দর্শনতত্ত্বও লিখিতে বসি নাই। কবি অথবা ঋষি করিয়া ঈশ্বর আমাকে পাঠান নাই। কিন্তু আমার নিশ্চিত বিশ্বাস মানব-জন্ম দুঃখের জন্য, বিষাদের জন্য, হত্যা-হানাহানি-ঈর্ষা-বিদ্বেষ-জড়ত্বের জন্য সৃষ্টি হয় নাই। অনন্ত সৌন্দর্য প্রত্যক্ষ করিব বলিয়া অনন্তমাধুর্য আস্বাদন করিব বলিয়া, অনন্ত আনন্দ হইব বলিয়া মনুষ্য হইয়াছি। শুধু আমি নহে, পৃথিবীতে যতেক পৃথক দেহযন্ত্রে এক আমি-স্রোত প্রবাহিত হইতেছে, সেই প্রত্যেক স্বতন্ত্র দেহাশ্রিত ‘আমি’ আনন্দ লাভ করিবে। করিবেই। মনুষ্যের শেষ পুরস্কার ইহাই।’
আশীর্বাদক কাকা।
সান্ত্বনা নেই। তবু বারবার উল্টেপাল্টে চিঠিটা পড়ল বন্দনা। কাকার হাত ধরে দেশবন্ধু পার্কে গান্ধীজীর বক্তৃতা শুনতে যাওয়া। চিড়িয়াখানায় হাতির শুঁড়ে পয়সা দেওয়া, জিরাফ দেখা, কমলালেবুর খোসা ছাড়াতে ছাড়াতে এসপ্লানেড পর্যন্ত এসে পড়া শীতের রবিবারের সকালে। খুব কড়া সিগারেট খেতেন কাকা, ডান হাতের আঙুলগুলো নিকোটিনে হলুদ হয়ে থাকত। বন্দনা যখন ছোট্ট ছিল ওর ধারণা ছিল কাকা মাত্রেরই আঙুলের ডগা ওরকম তামাটে হলুদ হয়ে থাকে। কাকাত্বের এটা একটা অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। মা যখন অল্প বয়সে মারা গেলেন তখনই কাকা ঠিক করে ফেলেছিলেন সংসার করবেন না। বাবা বহুবার চেষ্টা করেছেন। কাকার সেই এক কথা—‘যা দুরন্ত মেয়ে দাদা, তোমার একার কর্ম নয়। এ মেয়েকে মানুষ করতে হলে আমায় হাল ধরতে হবে।’ বাবার কাছে রাত, কাকার কাছে দিন। লেখাপড়া গান বাজনা সবই কাকার উৎসাহে। নয়তো বাবা মায়ের মৃত্যুর পর ভীষণ মনমরা হয়ে গিয়েছিলেন। সেই কাকার অপরাজিত চিরকুমার স্নেহময় ব্যক্তিত্বটি যেন চিঠিগুলোর মধ্যে থেকে বন্দনার হাত ধরবার জন্য উঠে আসে। সে ড্রয়ার হাঁটকায় কাকার আরও চিঠির জন্য। সাদা বণ্ড পেপারে সারি সারি পিঁপড়ের শ্রেণীর মতো লেখা। একটা লাইনও একটু বেঁকে যায় না। শুদ্ধ ভাষার বাঁধুনি কোথাও আলগা নেই। অক্ষরগুলো সামান্য কুঁকড়োনো। সই করবেন সব সময়ে এক লাইনে ‘আশীর্বাদক কাকা।’ ‘বুড়িমা,
কালামুনি গিরিপথের অভিমুখে চলিয়াছি। এ জায়গাটি সমুদ্রপৃষ্ঠ হইতে সাত হাজার একানব্বুই ফুটের মতো উঁচু। সবুজে সবুজ। দুটি ছোট ছোট ঝর্ণাধারা। এই উপত্যকার ‘প্রাণ ভরিয়ে তৃষা হরিয়ে’ আরও আরও প্রাণের আশ্বাস লইয়া বহিতেছে। চারিদিকে যেদিকেই চাহি রক্তবর্ণ রডোডেনড্রন গুচ্ছ। এপ্রিল হইতে জুলাই অবধি ইহারা ক্রমাগত ফুটিতে থাকিবে। শীতের বরফ গলিবার সঙ্গে সঙ্গে পাথরের খাঁজে মাথা চাড়া দেয় সবুজ তৃণগুচ্ছ। সরলসুন্দর মানবশিশুর সহিত ইহাদের আমি তফাত করিতে পারি না। ভেড়া এবং ছাগলেরা তখন নির্ভয়ে চরিবে। তাহাদের পাহারা দিবে বড় বড় পাহাড়ি কুকুর। হঠাৎ-হঠাৎ যেন মনে হয় সেই অতীত যুগে ফিরিয়া গিয়াছি যখন মানুষ পশুপালক ছিল, কৃষিকাজ শেখে নাই। গৃহপালিত পশুর দল লইয়া দেশ হইতে দেশান্তরে সবুজের সন্ধানে ঘুরিয়া বেড়াইত। সঞ্চয় করিত না। প্রকৃতির দাক্ষিণ্যের উপর নির্ভর করিত। এবং পশুর সহিত গায়ে গা লাগাইয়া বসবাস করিত। জটিলতাহীন সে জীবন তো ভালোই ছিল! উচ্চ হিমালয়ের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গ্রামের অধিবাসীরা এখনও আদিমানবের জীবনযাপন করে। মাতৌলি, মাপা, বরফু—সঙ্গীতময় নামগুলি গ্রামের। নভেম্বর হইতে প্রায় মে মাস পর্যন্ত ইহারা নিম্ন হিমালয়ে অস্থায়ী বাসস্থান প্রস্তুত করিয়া বাস করে, গ্রীষ্মে পথ তুষার মুক্ত হইলেই ঢালু পাহাড়ের বিস্তীর্ণ তৃণাঞ্চল বা বুগিয়াল বাহিয়া ইহারা বকরি চরাইতে চরাইতে চলিবে, ক্রমাগত উপরে উঠিয়া যাইবে। সবুজ ঘাস এবং গোলাপি ফুলের দেশে। ইহারা এ অঞ্চলের অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য পথপ্রদর্শক। আমার কোনও গিরিশৃঙ্গ জয় করিবার স্বপ্ন নাই। দূর হইতে দেখিয়াছি ত্রিশূলীর মুকুট হইতে দিব্য স্বর্ণ ঝরিয়া পড়িতেছে। গায়ে গা লাগাইয়া পরম মিত্রের মতো দণ্ডায়মান হরদেওল। ওই গিরিশিরায় জমাট ঝুলন্ত তুষার দ্বিপ্রহরে প্রলয়ঙ্কর নির্ঘোষে ভাঙিয়া পড়িত। কুয়াশায় চতুর্দিক ঢাকিয়া যাইত, চলিতে থাকিত ঝড়ো বাতাস। পৃথিবীর আদিম চরিত্র যদি দেখিয়া লইতে চাও, তাহা হইলে এখানে আসিতে পারো। আমি বকরিওয়ালাদের সহিত পুরা এক পক্ষকাল বুগিয়ালে তাহাদের জীবন যাপন করিলাম।…’
বন্দনা অনেকক্ষণ ধরে কাকার সঙ্গ করে। কাকার হাত ধরে বেড়াতে যায়। কুয়াশায় ঢাকা ঘুম, অর্ধেক মেঘাবৃত অর্ধেক সোনার বরণ কাঞ্চনজঙ্ঘার সামনে আটচল্লিশ সালের এপ্রিলের সকালে দাঁড়িয়ে থাকে, একপাশে বাবা, একপাশে কাকা।
দু এক মাস আগে কাকা একটা সংক্ষিপ্ত চিঠিতে লিখেছিলেন—বন্দনা কি তাঁর সঙ্গে অমরনাথ যাবে? তবে রূপকে নিয়ে যাওয়া যাবে না। যদি বন্দনা রাজি থাকে তিনি তাহলে ব্যবস্থা করতে আরম্ভ করবেন। চিঠিটা এসেছিল কনখল হরিদ্বার থেকে। অনেক চিঠিই ওখান থেকে আসে। কে জানে ওখানে স্থায়ী আস্তানা করেছেন কি না। নিজের কথা তো কিছুই লেখেন না। কিন্তু বন্দনার রূপকে ছেড়ে যাবার কোনও প্রশ্নই ওঠে না, সে এখন স্কুলে যাবার আগে পর্যন্ত মায়ের আঁচল আঁকড়ে থাকে। স্কুলবাস যতক্ষণ না মোড় পেরিয়ে বাঁক নিচ্ছে, ততক্ষণ বারান্দায় দাঁড়ানো মায়ের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে। বাড়ি ফিরে আর কোন দিকে চাইবে না, যেন জাদুকরের নিষেধ আছে, খুড়শ্বশুর ডাক দ্যান—‘দাদাভাই, দাদাভাই, এদিকে একবার শুনে যাও।’ আর দাদাভাই! সে ততক্ষণে উর্ধ্বশ্বাসে তার মায়ের খোঁজে ছুটেছে। ঘরে ঢুকে মা তার গোটাগুটি আছে কি না দেখে তবে শান্তি।
প্রথমেই জিজ্ঞেস করবে—‘বারান্দায় দাঁড়াওনি কেন, আগে বলো!’
—‘ঠিক বুঝতে পারিনি রে, তোর বাস কি কাঁটায় কাঁটায় এক সময়ে আসে?’ কিম্বা বন্দনা হয়ত বলে—‘ঘুম এসে গিয়েছিল রূপু।’
আর যায় কোথায়! সঙ্গে সঙ্গে অর্ডার হয়—‘এবার থেকে তুমিও দুপুরবেলা আমার মতো টাস্ক করবে।’
—‘বেশ তো, তুই আমাকে দিয়ে যাস টাস্ক্।’ অমনি রূপের ভারি হাসি পেয়ে যায়।
—‘চালাকি, না? আমি টাস্ক দেবো আবার তুমি সেগুলো পটাপট সেরে রেখে আবার মজা করে ঘুমিয়ে পড়বে, না? সে হবে না।’
রূপের কথাবার্তা থেকেই পরিকল্পনাটা বন্দনার মাথায় এল। শ্বশুরমশাইকে একদিন বলল —‘বাবা, আমি মনে করছি পড়াশোনা করব। পরীক্ষা দেবো আবার।’
—‘তুমি তো গ্র্যাজুয়েট হয়েই গেছ আবার কিসের পড়াশোনা?’
—‘কেন, স্পেশ্যাল অনার্স পড়তে দিচ্ছে আজকাল, তাছাড়াও এম এ তেই তো ভর্তি হতে পারি।’
—‘ভেবে দেখি, তোমার মাকে জিজ্ঞেস করে দেখি।’ কাশীনাথবাবু বললেন।
মায়ের মত হল না। প্রথমে বললেন—‘ওই তো তোমার শরীরের অবস্থা! কি করে তুমি ট্রাম-বাস করবে?’ তারপর ছেলের দোহাই দিলেন।
—‘ছেলের অযত্ন হবে, দেখেছ তো তোমাকে ছেড়ে একদণ্ডও থাকতে পারে না।’
বন্দনা বলল—‘আমি কি আর সব ক্লাস করব। যে সময়টা রূপ স্কুলে থাকে, সেই সময়টাই খালি যাব।’
তখন উনি বললেন—‘খোকা পছন্দ করত না।’ এ কথাটার কোনও প্রমাণ নেই। কিন্তু এরপর আর কথা চলে না।
সে তাহলে কি করবে? সংসারের কাজ-কর্ম তাকে দিয়ে হয় না। রান্নাঘর পুরোপুরি শাশুড়িদের দখলে। সেখানে আর কারুর প্রবেশাধিকার নেই। ননদেরা নিজেদের ঘর গুছোয়। দাদাদের ঘর গুছিয়ে দেবার লোক আছে। নিজের ঘরটুকু গুছিয়ে, রূপের পড়াশোনা দেখেও তার হাতে অঢেল সময়। বাড়িতে জমা রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, মধুসূদন, বঙ্কিম, বিবেকানন্দ গ্রন্থাবলী তার বারবার করে পড়া হয়ে গেল। পড়তে আর ভালোও লাগে না। মনের স্থৈর্য, মনোযোগ বলে কিছু নেই, হাতে পায়ে কাজ করতে পারলে হয়ত সে মুক্তি পেত। সে কয়েকবার এগিয়েছেও। কিন্তু শাশুড়িরা হাঁ-হাঁ করে ওঠেন। ‘ও কি? ওকি? তুমি চা করছ কেন? তোমাকে করতে হবে কেন। আমরা এতগুলো মানুষ থাকতে? যাও গে যাও ঘরে যাও। খোকনকে দেখো গে যাও।’ এমনিতেই পশ্চিমবঙ্গীয় বাড়িতে বউয়েদের আদর খুব। কাজকর্ম শাশুড়িরা, কিম্বা লোকজনেই করে। গোড়ায় গোড়ায় তার শাশুড়ি তাকে চুল বেঁধে মাথায় সিঁদুর দিয়ে তবে ছাড়তেন। নাপতিনী আসত নিয়মিত, আলতা পরাতে। কিন্তু সামান্য চা-করা, খাবার দেওয়া এ কাজগুলোও করতে না দিলে সারা দিন ঠুঁটো জগন্নাথ হয়ে তার সময় কাটবে কি করে? ছাদে ঠাকুর ঘর, দুবেলা ঠাকুরকে ফুল ফল দেওয়ার অধিকারটাও এঁরা তার কেড়ে নিয়েছেন। সেই কবে শোকের মাথায় ঠাকুরের ছবি ভেঙেছিল! দিনের পরে দিন যায়। রূপ স্কুলে চলে গেলে হাতের সামান্য কাজ সারবার পর মনে হয় সময় থাবা গেড়ে তার মুখের দিকে হাঁ করে চেয়ে বসে আছে। তার কি বীভৎস চেহারা। ঘরের ওয়ালক্লকটার টিকটিকোনি শুনতে শুনতে মাথা খারাপ হয়ে যাবার জোগাড় হয়। ঘড়িটা প্রতি মিনিটে, প্রতি সেকেন্ডে কিছু না-কিছু অপ্রীতিকর, হতাশাজনক খবর তাকে শোনায়। বন্দনা শোনে: ‘কেউ নেই, নেই কেউ, নেই নেই নেই। একা তুমি, একা একা, একা থাকো, কেউ আসবে না আর, এই ভাবে দিন যাবে, ভেবে ভেবে, দেখো দিন, যাবে কি না, তুমি নেই, সে-ও নেই। নেই, নেই, নেই নেই…। কোয়ার্টারের ঘণ্টা বাজে কিরকির করতে করতে, ঢং ঢং শব্দে ঘড়িটা বলে ‘তুমি অনাথা, ‘তুমি বিধবা’, ‘তুমি শেষ।’
এইভাবে দিন যায়। দিন কাটে। যেন মনে হয় কাটে না। কাটবে না। কিছুতেই কাটবে না আর। তবু কেটে যায়। একই রকমের রাতের পরে একই রকমের দিন, কোনও প্রাতেই তার সূর্য-ওঠা সফল হয় না। একা ঘরে অসহায়, নিরুপায় কষ্টে তার মাথার চুল দু হাতে ছিঁড়তে ইচ্ছে করে।
অধ্যায় ৭
এ কে বি বলেছিলেন গ্রীষ্মের ছুটিতে নিয়ম করে সপ্তাহে একদিন ওঁর বাড়ি যেতে। শ্রীলাকে আর ওকে। অনুরাধারা বলল—‘দারুণ লাকি তুই কলি, এ কে বি যেসব নোট্স্ দেবেন, সাজেশান দেবেন সেগুলো কিন্তু আমাদের সঙ্গে শেয়ার করে নিতে হবে।’
কলি হাসিমুখে বলল—‘দাঁড়া আগে যাই! গ্রীষ্মের ছুটিতে বেরোতে হলে বাবার অনুমতি নিতে হবে। সে এক মহা ফ্যাচাং।’
কথাটা শুনে বাবা চশমার ফাঁক দিয়ে চেয়ে দেখলেন, বললেন—‘বয়স কত?’
কলি থতমত খেয়ে বলল—‘কুড়ি বছর পেরিয়ে গেছে, প্রায় একুশ-হতে চলল।’
—‘কুড়ি বছরের ছোকরা তোমাদের পড়ায়?’ বাবা ভুরু কুঁচকে বললেন—‘কতবার ডবল পোমোশন পেয়েছে? দ্বিতীয় স্যার হরিনাথ নাকি?’
তখন কলি বুঝল, বাবা এ কে বির বয়সের কথা জিজ্ঞেস করছেন। বলল—‘ও, মানে পঞ্চাশ, টঞ্চাশ হবে। আমি কি করে বলব?’
—‘বিবাহিত?’
—‘হ্যাঁ।’ কলি এবার খুব অপমানিত বোধ করছে।
—‘ছেলেপিলে কটি?’
—‘জানি না, ওঁর মেয়ে আমাদের সঙ্গে পড়ে।’
—‘অ, তা যাবে যাও। তবে অত দিগ্গজ হয়ে কি হবে?’
আর শোনবার দরকার ছিল না। কলি জামা-কাপড় বদলাতে ছুট্টে চলে গেল।
বৈঠকখানা রোডে থাকেন এ কে বি। দোতলায় উঠে একটা মস্ত ঘর। আপাদমস্তক বইয়ে ঠাসা। শ্রীলা যথারীতি আসেনি। মাস্টারমশাইরা ভালো ছাত্রী বলে তাকে সাহায্য করতে চাইলে কি হবে, শ্রীলার ওসব ভালো লাগে না, বলে—‘ধুৎ, এই কাঠফাটা গরমে আমি রাস্তায় বেরোই আর কি? তার চেয়ে পাখার তলায় একটা জমজমাট গল্পের বই নিয়ে শুলে আখেরে কাজ দেবে।’
শ্ৰীলা নেই দেখে এ কে বি একটু নিরাশ হলেন। বললেন—‘কন্যাটি বড়ই ফাঁকিবাজ। ঠিক আমার কন্যাটির মতোই। সামান্য একটু গাইড্যান্স পেলেই ফার্স্ট ক্লাসটা হয়ে যেত।’ কলির বুকের মধ্যে চমকে ওঠে—পরিমল ঢুকছে। এ কে বি বললেন ‘এসো, এসো।’ স্যারের মেয়ে অরুন্ধতীও এসে বসল অবশ্য।
এ কে বি বললেন—‘দেখ বৎস এবং বৎসাগণ আমার তিন রকম আলাদা আলাদা স্ট্যান্ডার্ডের নোটস আছে। ছাত্র-ছাত্রীর ধারণ ক্ষমতা বুঝে আমি তা দিয়ে থাকি। উপস্থিত আসরে অরুন্ধতী যেমন বি গ্রেডের নোটস পাবার অধিকারী। কিন্তু আমার নিজস্ব কন্যা বলে তাকে কিঞ্চিৎ কডা জিনিস গলাধঃকরণ করতেই হবে।
অরুন্ধতী ঠোঁট গোল করে বলল—‘কে চেয়েছে তোমার এ গ্রেডের নোটস। আমাকে বি গ্রেডই দাও না।’
—‘না, না, না, না।’ এ কে বি মাথা নাড়লেন—‘অত সহজে তুমি পার পাবে না বৎসে। তোমাকে এই ভারি এবং কড়া জিনিসই গ্রহণ করতে হবে। ইহাই তোমার নিয়তি।’
পরিমল হাসছিল, বলল—‘স্যার, তফাতটা কি দেখতে পারি?’
এ কে বি তার কথায় কান না দিয়ে বললেন—‘সি গ্রেড সর্বসাধারণের জন্য, বি গ্রেড, ভাষাজ্ঞান আছে অথচ কনসেপশন নেই এমত ছাত্রকুলের জন্য, এবং বলা বাহুল্য এ গ্রেড—উচ্চাকাঙ্ক্ষী, পরিশ্রমী ও বুদ্ধিমান ছাত্রদের জন্য। কিন্তু একটা কথা, এই নোট্স বন্ধুদের মধ্যে বিতরণের জন্য নয়।’
কলির মনে পড়ল অনুরাধার দাবির কথা। এ কে বি তখনও বলছেন—‘কেন, সেকথা আমি আগেই বলেছি, সবাইকার হজমশক্তি এক রকমের নয়। সুতরাং বৎসগণ, সাবধান।’
পরিমলের হাতে একগোছা টাইপকরা কাগজ তুলে দিয়ে এ কে বি চলে গেলেন। পরিমল বলে যাবে, অন্যরা লিখবে, কলিকে কার্বন কপি করতে হচ্ছে। কার্বন কপিটা পরিমল পাবে।
বিকেল তিনটে সাড়ে তিনটে নাগাদ স্যার এসে তলায় দাগ দেওয়া জায়গাগুলো ব্যাখ্যা করে দিলেন। কলি এবং পরিমলকে দুটি বই দিলেন, সেদিনের মতো অধিবেশন শেষ হল।
বই ব্যাগে পুরে দুরুদুরু বুকে কলি উঠে দাঁড়াল। এবার অরুন্ধতী বাড়ির ভেতরে চলে যাবে, স্যার সিঁড়ির মুখ পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে চলে যাবেন। রাস্তায় বেরোবে সে একা পরিমলের সঙ্গে। এরকম পরিস্থিতিতে ভট্টাচার্য- বাড়ির মেয়েরা বোধহয় কোনদিন পড়েনি। রাস্তায় বেরিয়ে সে মুখ নিচু করে নিজের বাড়ির দিকে হাঁটা দিল। পেছন থেকে পরিমল ডাকল—‘শুনুন।’
কলি দাঁড়িয়ে পড়ল, তেমনি পেছন ফিরে। পরিমল বলল—‘আমার ভাগের নোটসগুলো তো দিলেন না!’
—‘ওঃ, ভীষণ ভুল হয়ে গেছে!’ কলি লাল হয়ে গেছে। তাড়াতাড়ি ব্যাগ থেকে সে কার্বন কপিটা বার করল।
—‘আপনি আচ্ছা স্বার্থপর তো!’ পরিমলের গলায় হাসি, —‘অতক্ষণ গোটা নোটটা ডিকটেট করলাম, পুরস্কার স্বরূপও অরিজিন্যালটা পেতে পারি না?’
কলি থতমত খেয়ে গেছে, তাড়াতাড়ি তার হাতের লেখা কপিটা বার করল, আবার। সেটা নিয়ে পরিমল বলল—‘যাক, আপনার হাতের লেখাটা আমার পাওয়া হয়ে গেল। এমনি চাইলে তো আর দিতেন না!’
কলি বলল—‘আমার হাতের লেখা? হাতের লেখা কি হবে? কি করবেন?’ ভীষণ উদ্বিগ্ন তার গলার স্বর, হৃৎকম্প হচ্ছে বোঝাই যাচ্ছে।
—‘যাক গলার স্বরটা ভালো করে শোনা গেল। এই সুবাদে।’ পরিমল বলল ‘হাতের লেখা নিয়ে আর কি করব। হাতের লেখা তো আর খাবার জিনিস নয়! থাকবে আমার ফাইলে, ভালো লাগবে আমার।’
কলি চট করে মুখ তুলে তাকাল, অনুরাধাদের ঠাট্টা-তামাসার কথা মনে পড়ল, তারপর পর পর বাবার মুখ আর সেজদার মুখ। সে হঠাৎ শরীরে তীব্র মোচড় দিয়ে উল্টো দিকে ঘুরল, দৌড়নো সম্ভব নয়। সম্ভব হলে সে দৌড়েই সেখান থেকে চম্পট দিত।
সিংদরজা পেরোলেই বাঁ দিকে বৈঠকখানা, ডানদিকে বাবার সেরেস্তা ঘর। বাবা আজকাল কোর্টে বেরোনো কমিয়ে দিয়েছেন। কলি শুনতে পেল বৈঠকখানায় বাবার বন্ধু হরিহরকাকুর গলা।—‘কি হে কাশীনাথ, আজ তোমার চালে তেমন ফোঁস নেই কেন? বলি পরশুদিনের শোধ নেবে না?’
কাশীনাথ বললেন—‘আমি কি তোমার মতন ক্যাছাখোলা নাকি? দস্তুরমত সংসারী মানুষ। বিষয়-চিন্তা আছে, ছেলেপুলেদের ভবিষ্যৎ চিন্তা আছে।’
কলি আর দাঁড়াল না। তাড়াতাড়ি প্যাসেজ পেরিয়ে উঠোনের দিকে পা চালাল।
বাবার কানে চটির শব্দ ঠিক পৌঁছেছে। চেঁচিয়ে বললেন—‘কে এলি? কলি? এতো দেরি?’
—‘হ্যাঁ বাবা,’ কলির জবাব দূর থেকে এল। এখন বাবার সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলার সাহস নেই তার। এখনও মুখ লাল, বুকে গুরগুর শব্দ, চোখ ছলছল করছে। বাবার বন্ধু-বান্ধবের সামনে উকিলি জেরার মুখোমুখি হওয়া এখনই সম্ভব নয়।
দাবার নেশার চেয়ে আড্ডার ঝোঁকই কাশীনাথবাবুর বেশি। রবিবারের আড্ডা জোর আড্ডা। অন্যান্য দিন বিকেলের দিকে দু একজন উঁকি দ্যান। যদি যথেষ্ট বন্ধুসমাগম হয় তো দাবার ছক পড়ে। এবং ফাঁকে ফাঁকে গল্পগাছা করতে করতে হঠাৎ বিনা আড়ম্বরে একজন কারুর কিস্তি মাৎ হয়ে যায়।
কাশীনাথবাবুর গলায় গলায় বন্ধু তারাপদবাবু এক টিপ নস্য নিয়ে বললেন—‘একটা জিনিস খুব অন্যায় করছ হে কাশী।’
—‘কি অন্যায় আবার করলুম হে!’
—‘মেজছেলের বিয়েটা দাও! যদ্দুর জানি তোমার বড় মেয়ের কোলে চারটি পর পর ছেলে। বড়র পরই মেজ, তার বয়স তো গড়াচ্ছে!’
—‘বড় মেয়ে আমার খোকার পরে’—কাশীনাথবাবু বললেন—‘মেজর সঙ্গে বড়র বছর ছয়েকের তফাত।’
তারাপদবাবু বললেন—‘তা হলেও তোমার মেজছেলের বিয়ের বয়স হয়েছে স্বীকার করবে তো! এভাবে চললে ছেলে যে তোমার বিবাগী হয়ে যাবে! একজনকে একভাবে হারালে আরেকজনকে যে অন্যভাবে…না, না কাশীনাথ শোক পুষে রাখাটা ঠিক নয়। ওতে সংসারের স্বাস্থ্যহানি হয়। দেখো, যে গেছে সে তো আচ্ছা করে বুকে দুরমুশ পিটেই গেছে। কিন্তু তুমি-আমি যদি সেইটি নিয়েই বাকি জীবন মনমরা হয়ে বসে থাকি তো জীবনের ধর্মকে উপেক্ষা করা হয় হে, জীবন তখন তোমার ওপরে শোধ নেবে। আমার কেসটা থেকেই শিক্ষা নাও না! কোলের ছেলেটি গেল। গিন্নি এমন শোকার্ত হয়ে পড়লেন যে আর বিছানা থেকে উঠতে পারেন না। পাগল-পাগল ভাব। অগত্যা রাণু আমার বড় মেয়ে সংসারের হাল ধরল। বাকি ভাইবোনগুলিকে পড়ানো, শোনানো, আমাদের যত্ন-আত্তি, রুগীর সেবা, মেয়েটার হাড় কালি হয়ে গেল ভায়া। সদাসর্বদা মুখ শুকনো, অল্পবয়সেই যেন সাত গিন্নির এক গিন্নি এমনি চেহারা, এমনি কথাবার্তা। কি বলব কাশী, মেয়েটার বিয়ে দিতে পারলুম না। যেই দেখে বলে এ যে আদ্যিকালের বদ্যিবুড়ি, বয়স লুকুচ্ছেন! মেজ-সেজর বিয়ে হয়ে গেল। ছেলেটার পর্যন্ত দেখেশুনে লাগিয়ে দিলুম। এখন সেই বউয়ে আর তার বড় ননদে বাড়িতে ধুন্ধুমার লেগে আছে। কাক-চিল বসতে পায় না এমনি গলার জোর। গিন্নি ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকেন, মাঝে মাঝে বলেন—কি গো এর একটা বিহিত করো, আমি যে আর পারি না। আমি বলি— বিহিত এর হবে না গিন্নি। এ তো তোমারই কীর্তি। একজনের শোক আঁকড়ে রইলে, আরেকটা সন্তান যে জ্যান্ত মরে গেল খেয়াল করলে না। জীবন এইভাবে শোধ নেয় ভায়া। ছাড়ান ছুড়িন নেই।’
কাশীনাথবাবু নিঃশ্বাস ফেলে বললেন—‘কথাটা ঠিকই বলেছ। আমার যে কতদিকে কত জ্বালা। ভাবছিলুম আর ক’টা দিন যাক। বড় বউমা বড্ড মনমরা হয়ে থাকেন, তাঁর চোখের ওপর দিয়ে…’
—‘থাকবে না, মনমরা থাকবে না।’ অচিন্ত্যবাবু বললেন,—‘বাড়িতে একটা উৎসব লেগে গেলে দেখবে ঠিক মেঘ কেটে যাবে।’
—‘তা যাবে কি না জানি না ভায়া। তবে কথা আরও একটা আছে। আমার ছোট মেয়ে ডাগর হয়ে উঠল। খুব পা হয়েছে। এখানে যাচ্ছে, সেখানে যাচ্ছে, —‘বাবা আসি,’ ‘বাবা যাই?’ বললেই কি হয় রে ভাই। আমার অবস্থায়, আমার বয়সে ভাবতে হয় কোথায় যাচ্ছে। কেন যাচ্ছে। ওর বিয়েটা এবার দেওয়া দরকার।’
তারাপদবাবু বললেন—‘ভালো তো! পাঁজি পুঁথি দেখে দুজনের মাথাই একদিনে মুড়িয়ে দাও। এক লক্ষ্মী যাবে তো আরেক লক্ষ্মী আসবে।’ গলা খাটো করে তারাপদবাবু বললেন—‘তা ছাড়াও, তোমার মেয়ের বিয়ের খরচাপাতি উঠবে কি করে যদি ছেলেরটা আগে না দাও।’
—‘সেটা একটা কথা বটে। খোকাটা দুম করে চলে গিয়ে আমাকে বসিয়ে দিয়ে গেছে। অমন সা-জোয়ান রোজগেরে সন্তান। দেখো দিকিনি এই বৃদ্ধ বয়সে কোথায় আরাম করব পায়ের ওপর পা তুলে, তা না ছেলের বউ, তার ছেলে সব দায়িত্ব আমার ঘাড়ে।’ কাশীনাথবাবুর গলা ভারি হয়ে এল।
বন্ধুদের সঙ্গে এই কথাবার্তার জের টেনেই পরদিন দুপুরে গিন্নির কাছে কথাটা পাড়লেন কাশীনাথ।
—‘একবছর তো কবেই পার হয়ে গেছে, এবার মেজর বিয়েটা না দিলে কর্তব্য অবহেলা করা হয়।’
গৃহিণী বললেন—‘এ কথা তো একশবার। তার উপর গাবলুর বোম্বাইয়ে ট্রান্সফার হবার কথা হচ্ছে। সঙ্গে বউ না দিলে তো আতান্তরে পড়বে! কিন্তু আমার দুটো কথা বলবার আছে।’
—‘বলো না কি বলবে!’
—‘এক নম্বর তুমি আগে পাত্রীর করকোষ্ঠী দেখাবে। ওসব জাল, ভুয়ো, বিয়ের জন্যে আগে থেকে তৈরি করানো ঠিকুজি নয়। জন্মসময় চেয়ে নিয়ে আমাদের নিজেদের লোক দিয়ে আমরা করিয়ে নেবো।’
—‘কেন বলো তো! খোকার বেলা তো তুমি এতো ঠিকুজি-ঠিকুজি করোনি?’ গৃহিণী ডিবে থেকে পানের বোঁটায় করে একটু চুন জিভের ডগায় ছুঁইয়ে বললেন—‘সেটাই তো কথা! ঠিকুজি দেখিনি, ভুল করেছি, ও ভুলের চারা নেই। তা নয়ত কোথাও কিছু নেই অমন জ্বলজ্যান্ত ছেলেটা দুম করে চলে যায়! সেদিন কথায় কথায় বউমার হাতখানা সোজা করে ধরেছিলুম, পষ্ট বৈধব্য রেখা! ওসব মেয়েছেলের কপালে হয় গো, কপালে হয়।’
—‘তুমি আবার এসব দেখতে জানলে কবে?’
—‘আরে বাবা, জানতে হয়! মায়ের প্রাণ, ও তুমি বুঝবে না। খোকা গিয়ে থেকে আমি ওর ঠিকুজি নিয়ে গুরুদেবের কাছে ছোটাছুটি করছি। খোকার আশি-একাশি পর্যন্ত পরিষ্কার আয়ু। অপঘাত নেই, আঘাত নেই, কিচ্ছু নেই। গুরুদেবের কাছ থেকেই রেখা-টেখা দেখতে চিনতে শিখছি। আমার বিদ্যেতে ওইটুকু ধরা পড়ল। তারপর জানি না। বউটারই কি কম খোয়ার হল ভাগ্যের হাতে। আহা এই বয়সে…’ গৃহিণী উদাস হয়ে গেলেন। একটু পরে বললেন—‘এবার আগে ঠিকুজি, পরে কথাবার্তা। রূপ গুণ ওসব কিছু নয়, স-ব সংসারে মানিয়ে যায়। বড়র তো রূপ মন্দ ছিল না, সে ধুয়ে কি এখন জল খাচ্ছি। আর নগদ দান সামগ্রী নিয়ে তুমি অমন কচলাকচলি করবে নাকো। কোষ্ঠী যেখানে মিলবে, সেখানেই বিয়ে হবে, এই আমার শেষ কথা।’
—‘নগদ না নিলে তোমার ঘরখরচাই উঠবে কোত্থেকে আর মেয়েটা যে গড়গড়িয়ে এম এ পাশ করতে চলেছে তার বিয়েরই বা কি করবে?’
—‘নেবে না তা তো বলিনি। বলেছি কচলাকচলি চলবে না। তারা যা দিতে পারবে তাই নিতে হবে। আর মেয়ের বিয়ে আমি ছেলের দানসামগ্রী, বরপণ দিয়ে দেবো এমন হা-ঘরে আমাকে পাওনি বাপু। তোমাদের ভট্চায্যিদের সে রীত হতে পারে, আদতে চাল-কলার বামুন তো! আমরা মুখুটি। আচায্যি বংশ।’
—কাশীনাথবাবু বললেন—‘এই শুরু হল। তুমি থামাবে এই আমরা আর তোমরার পাঁচালি?’
গিন্নি বললেন—‘তুমি না হয় যা রোজগার করছ সংসারে ঢালছ। ইনসিওরের প্রিমিয়াম দিচ্ছ, কিন্তু আমার সোনার চাঁদ ছেলে? সে তো কিছু কম রোজগার করেনি। আহা সে তো সবটাই তোমার হাতে তুলে দিয়ে গেছে সেই থেকে খরচা করবে।’
কাশীনাথ গম্ভীর গলায় বললেন—‘বউমা তো তাঁর টাকা আলাদা অ্যাকাউন্ট করেছেন। সে পাসবইও তাঁর কাছে। তোমার অংশেরটুকু আমার কাছে আছে এই পর্যন্ত। তা দিয়ে আজকালকার দিনে একটা মেয়ের বিয়ে হয় না।’
গৃহিণী মেঝেতে মাদুর পেতে আধশোয়া হয়ে ছিলেন, উঠে বসলেন —‘বউমার আলাদা ব্যাঙ্ক? বলো কি গো? আগে বলোনি তো?’
কাশীনাথ বললেন—‘এসব গুহ্য কথা। মেয়েমানুষের কানে তোলা মূর্খামি। কথা উঠল তাই বললুম।’
গৃহিণী বললেন—‘দাদার টাকা যদি বোনের বিয়েতে লাগে তো সে তো খুব ভালো কথা, সে আমি বউমাকে বলে ঠিক বার করে নেবোখন। তুমি ছেলের পাত্রী আর মেয়ের পাত্র এক সঙ্গেই দেখ। বউমা কলিকে খুব ভালোবাসে।’
—‘দেখ কদ্দুর কি করতে পারো। আমার তো মনে হয় না বউমা দেবেন। চাইতে গিয়ে ছোট না হতে হয়।’
অধ্যায় ৮
কলির বিয়ে লাগল শ্রাবণ মাসেই। আষাঢ় মাসে বিয়ে হলে কন্যা ধনধান্য ভোগসুখরহিতা হয়, গৃহিণী কোট ধরেছিলেন আষাঢ়ে কোনমতেই বিয়ে চলবে না। শ্রাবণে কন্যা মৃতবৎসা হয় বলেও আপত্তির কারণ ছিল, কিন্তু সবাইকার আগ্রহের আতিশয্য দেখে ঠাকুরমশাই একটা নির্দোষ সর্বশুভংকর লগ্ন বার করেছেন ঠিক খুঁজে। কলির এম এ পরীক্ষা নভেম্বর মাসে। সে রাজি নয় একদম। ভীষণ কান্নাকাটি করছে। এ. কে. বি বলেছেন ভালো করে পড়াশোনা করলে হাই-সেকেন্ড ক্লাস তার বাঁধা। বিয়ের হুজুগে পড়াশোনা ডকে উঠলে সে নিজের মুখ, এ. কে. বি’র মুখ রাখতে পারবে না। তাছাড়াও অন্য একটা কথা আছে। কলি জোর করে নিজের হৃদয় থেকে একটি ভদ্র সুশ্রী মুখের আগ্রহদৃষ্টিকে নির্বাসিত করতে চায়। পারে না। ছাদে পায়চারি করতে করতে, পড়া মুখস্থ করতে করতে হৃদয় উদ্বেল হয়ে ওঠে। পরিমল তাদের স্বজাতি। ঘটক-টটকের মাধ্যমে অনায়াসে ঘটানো যেত জিনিসটা। একটু সময় দিলেই তৈরি হয়ে নিতে পারত ও। কিন্তু এর বেশি কলির সাহস নেই। বিয়ের কথায় তার মুখ বুক শুকিয়ে গেছে। ঢোঁক গিলতে কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু একমাত্র পরীক্ষার দোহাই ছাড়া অন্য কোনও ওজর-আপত্তির কথা কাক-পক্ষীতেও টের পায়নি। মিলি সর্বক্ষণ আঠার মতো লেগে আছে, সে-ও না। খালি বলছে—‘এতো কাঁদছিস কেন? তুই একটা বোকার রাজা। কত শাড়ি পাবি, গয়না পাবি, কত্ত রকম উপহার, কনে সেজে তোকে যা দেখাবে না! তার ওপর বর পাবি। হি, হিঃ আমায় যদি কেউ বিয়ে দিত এক্ষুনি রাজি হয়ে যেতুম। বি এস সি’র রেজাল্টটা বেরোবার আগে হলেই ভালো হত।’ কানের কাছে বকবকবক। কলি বলে—‘তুই চুপ করবি মিলি?’
আত্মীয়স্বজনরাও এক এক করে এসে পড়ছেন। বড় মাসি এসে থাকবেন, পিসিমাও। কাকিমার বউদি, কলিরা রাঙা কাকিমা বলে, তিনি খুব কাজের, যজ্ঞিবাড়ি হলেই তাঁর ডাক পড়ে। তিনিও এসে গেছেন। সবাই মিলে দিবারাত্র আদিরসাত্মক ঠাট্টা করে কলির কান ঝালাপালা করে দিচ্ছেন।
নেমন্তন্ন করতে এ. কে. বি’র বাড়ি গিয়েছিল কলি, স্যার কার্ডটা হাতে নিয়ে বললেন—‘আনন্দিত হলাম, বলতে পারছি না, কলিকা, আশীর্বাদ করছি যদিও।’
—‘কেন স্যার? পরীক্ষা আমি দোবই। সেইরকম কনডিশন করিয়ে নিয়েছি, ভালো রেজাল্টও করবই। আপনি দেখবেন।’
—‘তা আমি জানি। তোমার ওপর সে ভরসা আমার আছে। আমার নিরানন্দ অন্য কারণে।’
কলি মুখ নিচু করল।
এ.কে.বি.বললেন—‘পরিমল মুখার্জি অতো ব্রাইট ছেলে, ও তো ফার্স্ট ক্লাস পাবেই। তারপর হয়ত কমপিটিটিভ পরীক্ষা দিয়ে অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিসে চলে যাবে। পাত্র হিসেবে তো খারাপ ছিল না, তবু সাহস করতে পারলে না? এতো ব্যক্তিত্বহীন, অব্যবস্থিতচিত্ত তোমরা! তবে ওকে আশা দেওয়াই বা কেন?’
কলির দু চোখ ভরে এসেছে। গুমগুম করে মাদল বাজছে বুকের মধ্যে। ধরা গলায় সে বলেছিল—‘আমি কোনদিন কোনও আশা দিইনি স্যার কাউকে, আপনি জিজ্ঞেস করে দেখবেন!’ বলে একরকম ছুট্টে বাইরে চলে এসেছিল।
মা এখন আস্তে আস্তে একটার পর একটা গয়না দিয়ে তাকে সাজাচ্ছে। কলি মেয়ে হয়েও, বিবাহের পাত্রী হয়েও তার কি গয়না হল, শাড়ি হল খোঁজ নেয়নি। মা দু’হাতে পাঁচ গাছা করে চুড়ি পরালেন, তার মুখে কঙ্কন। গলায় সরু পাটি হার। হঠাৎ কলি চমকে বলল—‘মা এরকম বেঁকি চুড়ি, পাটি হার বউমণির ছিল না?’
মা আস্তে বললেন—‘বউমারই তো! তোকে দিয়েছে। ওর আর এসব কোন কাজে লাগবে? আর যা আছে খোকামণির জন্যে যথেষ্ট।’
কলি বলল—‘মা, বউমণি কোথায়? কই সে আমাকে তো বলেনি। এসব গয়না আমাকে দিচ্ছে? বউমণি নিজে হাতে না দিলে এসব আমি পরব না।’ কলির গলায় কান্না উঠে আসছে।
—‘এখানে স্ত্রী-আচার শুরু হচ্ছে। গায়ে-হলুদ দেওয়া হবে। বউমার এখানে আসতে নেই, কলি অসভ্যতা করো না।’
কলি বলল—‘একটু দাঁড়াও, আমি জিজ্ঞেস করে আসছি।’
আজ অনেকদিন পর রূপ স্বেচ্ছায় মায়ের আঁচল ছাড়া হয়েছে। বিয়ে-বাড়িতে অনেক মজা, তার ওপর সমবয়সী বন্ধুবান্ধব। দুড়দাড় করে সিঁড়ি দিয়ে ওঠা আর নামা, হঠাৎ চিৎকার করে এ ওকে ভড়কে দেওয়া এই সব হচ্ছে তার উৎসব। বন্দনার তাই আজ বিশেষ কাজ নেই। সকালের দিকে রাশীকৃত পান সেজেছে। এখন একদিকে নান্দীমুখের আয়োজন হচ্ছে। আরেকদিকে এয়োরা সব গায়ে হলুদের আয়োজন করছেন। ছাদনাতলা হচ্ছে নিচের উঠোনে, বন্দনা সেই দৃশ্য থেকে যতদূর পারে সরে নিজের ঘরের দক্ষিণের জানলায় দাঁড়িয়ে আছে। গরাদ ধরে। ঝমঝম খসখস শব্দে পেছন ফিরে তাকাতেই নতুন হলুদ ডুরে পরা কলি তাকে জড়িয়ে ধরল। অদূরে বড়দি। কলি বলল—‘বউমণি, আমাকে এই সব তোমার গয়না পরানো হচ্ছে দেখ। এসব আমি কেন নেব? মোটেই নেব না।’
বন্দনা বলল—‘নিবি না কেন কলি? এসব আমি তোকেই দিয়েছি তো!’
—‘দিলে আশীর্বাদ করে তুমিই পরিয়ে দিও। আর এতেই বা কেন? এতো তুমি আমাকে দেবে কেন? একটা কিছু দাও। যা হোক একটা কিছু।’
বন্দনা মৃদুস্বরে বলল—‘কলি, একটা গয়নায় তো মেয়ের বিয়ে হয় না রে! গা সাজিয়ে দিতে হয়। তোর দাদা থাকলে যা করতেন, আমি সেটা আমার সাধ্যমতো করেছি। কেন কষ্ট পাচ্ছিস, এই সব আমি তোকে দিয়েছি। মুক্তোর সেট দিয়ে আশীর্বাদ করব।’
—‘আবার মুক্তোর সেট? বউমণি তুমি কি পাগল হলে?’
বন্দনার চোখ ছলছল করছে, বলল—‘গয়নার সার্থকতা কিসে বল? কেউ তাকে পরলে তবে তো? তুই পরলে, আমার ভালো লাগবে, বিশ্বাস কর।’
—‘তাহলে তুমি একবার ওখানে এসো!’
—‘যাব’, একটু ইতস্তত করে বন্দনা বলল, ‘যাব, একটু পরে। তুই যা। আমার হাঁতের ক’টা কাজ আছে। সেরে যাব।’
কলি নিচে চলে গেল। বড়দি বলল—‘দেখলি তো?’
মা বলল—‘দেখলে তো? আমি কি মিছে কথা বলছি, না তোমার বউমণির আঁচল থেকে চাবি খুলে নিয়ে তার আলমারি থেকে গয়না চুরি করেছি? লেখাপড়া শিখলে মেয়েছেলের মতিভ্রম ছাড়া আর কিছু হয় না।’ মার গলায় ভীষণ রাগ।
গায়ে হলুদ হয়ে গেলে হুলুধ্বনির মধ্যে দিয়ে কলি চার কলাগাছের মধ্যিখানে শিলের ওপর দাঁড়াল। তার চোখ দিয়ে ঝরঝর করে জল পড়ছে। একটা খুরিও সে ভাঙতে পারল না। তার হয়ে বড়দি, বড়মাসি, বড়মাসির বউ, পাশের বাড়ির মাসিমা এঁরা ভেঙে দিলেন। কে কোথায় বলল—‘খোকার বিয়ের পর বাড়িতে এই প্রথম কাজ। কোথায় বন্দনা বউ এয়ো হয়ে দাঁড়াবে, ছিরি হাতে করে ছাদনা তলায় ঘুরবে, তা নয়…।’
বড়দি বলল—‘এই কলি, এখন থেকেই এতো কাঁদতে শুরু করলি, বিয়ের সময়ে মুখ যে ভিমরুলের চাকের মতো হয়ে যাবে রে!’
কাকিমা বললেন—‘চার দাদার এক বোন। তুই তো কোন জন্মেই চলে গেছিস। দিদির কোল-পোঁছা। কত আদর। যা চেয়েছে মুখের কথা খসতে না খসতে হাজির। কাঁদবে না! দিদির কোলের ওই তো ঘর আলো করে ছিল রে!’
কলির চোখ দিয়ে অঝোরে জল পড়ছে। একমাত্র কলি ছাড়া কেউ জানে না, বাড়ি-ছাড়ার, মা-বাবার কোল-ছাড়ার কান্না এ নয়। তাকে কাঁদাচ্ছে স্মৃতিতে ওতপ্রোত হয়ে মিশে থাকা একটি বিষণ্ণ তরুণ মুখ, প্রৌঢ় মাস্টারমশাইয়ের র্ভৎসনা, তীব্র এক মৃত্যুদৃশ্য যা সে এখনও ভুলতে পারেনি, এবং নিরাভরণ একটি একদা-শ্ৰীমতী-এখন শ্রীহীন নারীমুখ। কলির বাস্তবিক মনে হচ্ছে বউমণির হাত থেকে, গলা থেকে জোর করে করে গয়নাগুলো উপড়িয়ে নিয়ে তাকে পরানো হল। তারপর একটা অদৃশ্য নারী-কণ্ঠ চেঁচিয়ে বলল—‘যা যা এবার এখান থেকে দূর হয়ে যা শতেকখোয়ারি, হতভাগী!’ নির্জন, নিরানন্দ, তমসাবৃত পথ দিয়ে বউমণি শূন্যহাতে একলা একলা চলে যাচ্ছে। কলির এমন শক্তি নেই, এমন সাহস নেই যে তার জন্য কিছু করে।
কলির উপলব্ধি ঠিকই। শাশুড়ি বন্দনার কাছে প্রথমে টাকাই চেয়েছিলেন। বন্দনা ভয়ানক বিপাকে পড়ে গিয়েছিল। ফিক্স্ড্ ডিপপাজিটের ওই পঁচিশ হাজার টাকাই তার একমাত্র ভরসা। ব্যবহার হয়তো করে না, কিন্তু আছে যে এটাই তার আত্মবিশ্বাসের একমাত্র কারণ। খানিকটা ভেবে নিয়ে সে বলেছিল—‘টাকা তো তেমন কিছু নয় মা, আমি বরং আমার গয়না কিছু দেবো।’ সোনার গয়না দেবার কথা সে আদৌ ভাবেনি। কারণ সোনাও যে টাকা পয়সার মতোই মূল্যবান এটুকু জ্ঞান তার এতদিনে হয়েছে। সে তার মুক্তো-চুনীর জড়োয়া সেটটা বার করে দিয়েছিল।
শাশুড়ি তখনই বলেছিলেন ‘এ তো পোশাকি, তোলা গয়না বউমা। এ দিয়ে তুমি না হয় ওকে আশীর্বাদ করো। টাকাটা পেলে সোনার গয়নাগুলো গড়াতুম। পঁচিশ ভরি মোট লাগবে। আমার মফ চেনটা থেকে সাতভরি বেরোবে, টাকা না দেবে বাকিটুকু না হয় তুমিই দাও। যেমন আছে তেমনি দিয়ে দেবো, বানিটা আর লাগবে না। খোকা থাকলে তো সে-ই ব্যবস্থা করত। দিয়ে-থুয়েও তোমার ছেলের বউয়ের জন্য যথেষ্ট থাকবে।’
গয়নার প্রয়োজন যে শুধু ছেলের বউয়ের জন্য নয়, সেগুলো তার মূল্যবান সম্পত্তি, অনিশ্চিত জীবনের পাথেয়, অসুখ-বিসুখ, ছেলের উচ্চশিক্ষা নানা কারণেই দরকার হতে পারে এ কথা বন্দনা শাশুড়িকে মুখ ফুটে কিছুতেই বলতে পারল না। বাবার দেওয়া চুড়ি, হার, কানবালা, এঁদের দেওয়া কঙ্কন, সবই তাকে বার করে দিতে হল।
মনটা সেইদিন থেকে এতো খারাপ, এতো তেতো হয়ে আছে যে বন্দনা ভয় পেয়ে যাচ্ছে—কলির যেন আবার কোনও অমঙ্গল না হয়। কলিকে সে খুবই পছন্দ করে। ভালোও বাসে। ভালোমনে দিতে পারছে না, মাঝ রাত অবধি ওই গয়নার জন্য তাকে কাঁদতে হয়েছে। সেই চোখের জলে ভেজা গয়না পরে কলি শ্বশুরবাড়ি যাবে। বন্দনা মনে মনে বারবার কলির মঙ্গলকামনা করে।
অধ্যায় ৯
বেলা গড়াচ্ছে। বিয়েবাড়ি সেজে উঠছে। বেজে উঠছে। ফুলের গন্ধ, সানাইয়ের আওয়াজ যে এমন অশান্তিকর হতে পারে বন্দনা যেন আগে বোঝেনি। কত সাজসজ্জা, শুধু মানুষ নয়, ঘর, দোর, দালান, ছাদ, উঠোন সব সেজে উঠেছে, নতুন রঙের গন্ধ চারিদিকে। কত অলঙ্কার, প্রসাধনের গন্ধ, রোশনাই। কোথাও নিজেকে লুকোবার এতটুকু ঠাঁই নেই। ছোট্ট ছোট্ট ধুতি পাঞ্জাবি পরিয়ে ছেলেকে পাঠিয়ে দিয়ে বন্দনা শুকনো মুখে তাড়াতাড়ি একটু ট্যালকম পাউডার ঘষে। গরদের কালোপেড়ে শাড়ি শাশুড়ি রেখে গেছেন। আজকের দিনে বহু আত্মীয়-কুটুম, বন্ধু-বান্ধব আসবে, রঙিন কাপড় পরা চলবে না। শাড়িটা পরে বন্দনা আর আয়নার দিকে ফিরে তাকাল না। কোনক্রমে একটা হাত খোঁপা করে নিয়ে ঘরের বাইরে পা বাড়াল। কেউ না বলে বড় বউ শুভদিনে গোমড়া মুখে নিজের ঘরে বসে সংসারের অকল্যাণ করছে। মহিলামহলের দিকে পা বাড়াতে সে যেন মরমে মরে যায়।
কলি ধরেছিল বউমণি তাকে সাজাবে। কাকিমা বলেছিলেন—‘বেশ তো, তাতে দোষ কিছু নেই।’ কলির মার কিন্তু মত হয়নি। তিনি নিজের ভাইয়ের বউকে কাজটা দিয়েছেন। বউটি খুব পয়া। আসতে না আসতে ভাইয়ের শেয়ার মার্কেটের পয়সা ফুলে উঠতে শুরু করেছে। ভাইয়ের ছেলের পদোন্নতি হয়েছে। দুটি নিখুঁত শিশুর জননীও হয়েছে বউটি। মেয়ের বিয়ের কোনও ব্যাপারে বিধবার ছোঁয়া থাকা তাঁর পছন্দ নয়। শুধু অপছন্দই নয়। আতঙ্ককর। গয়নাগুলো অবশ্য তার ছোঁয়া লাগাই, এবং সেই পরেই সালঙ্কারা কন্যা সম্প্রদান হবে। তবে তাতে কিছু এসে যায় না। অলঙ্কার, বিশেষত সোনা শুদ্ধ জিনিস। ওতে দোষ নেই।
বড়মাসিমা ক’দিন ধরেই আছেন। সন্ধেবেলায় তাঁর মেয়ে বউ এসেছে। দুজনেই পয়সা-অলা ঘরের বউ। কলির মেসোর জমিদারির পয়সা। আর তার মাসতুত দিদির শ্বশুরবাড়ি তিনপুরুষে সরকারি আমলা। তাদের ঠাট-বাটই আলাদা। মাসিমার পুত্রবধূ চন্দ্রার চড়া মেক-আপ। থিয়েটারের অভিনেত্রীর মতো, জমকালো। টিকলি থেকে চন্দ্রহার অবধি সবই পরেছে বউটি। ব্রোকেড শাড়ি। একটু মোটাসোটা সুন্দরী। চোখের কাজলে, ঠোঁটের লিপস্টিকে, গালের রুজে চন্দ্রা বিয়েবাড়ি জমজমাট করে রেখেছে। তার ননদ অর্থাৎ বড় মাসিমার মেয়ের দুটি ছেলে মেয়ে হয়ে গেছে। কিন্তু এখনও বেশ আঁটসাঁট। তার বিয়ে হয়েছে আলিপুরের দিকে। নামকরা ফ্যাশন-দুরস্ত পরিবার। পুরো কালো রঙের সাজগোজ তার। কালো পাথরের গয়না, কালোর ওপর সোনালি বুটির জরিদার রেশমি শাড়ি, কালো মিনের চুড়ি, লম্বা সীতাহার। মিনেকরা কাজ। চন্দ্রা আর এই মাসতুত ননদ কাজল দুদিক থেকে বন্দনাকে ঘিরে ধরল।
কাজল বলল—‘দ্যাখ বন্দনা, আমি তোর থেকে সাত বছরের বড়। আমি দু ছেলের মা হয়ে এমন চুটিয়ে সাজতে পেরেছি, আর তুই আমার চোখের সামনে এমনি পাগলির মতো ঘুরবি? তোর কি মার খাবার ইচ্ছে হয়েছে?
চন্দ্রা কোনও মন্তব্য করল না, খালি তার অজস্র গয়নার কিছু কিছু উল্টে-পাল্টে ঠিকঠাক করতে লাগল। হারের খামিগুলো বারে বারে উল্টে যায়। গয়নার ঝুল্লিগুলোও বড্ড শাড়ির জরিতে আটকে আটকে যায়। এইভাবে প্রত্যেক বিয়েবাড়িতে কিছু কিছু ঝুল্লি হারায়। আবার স্যাকরাকে ডাকো, আবার তাকে সারাও। কাজলদি কি বলতে চাইছে সে বুঝতে পারছে না। কি করবে বন্দনা? কি করতে পারে? সে বন্দনার উত্তরের জন্য অপেক্ষা করতে লাগল। বন্দনার সম্পর্কে তার তীব্র কৌতূহল। ক মাস আড়াআড়ি বিয়ে হয়েছিল দুজনের। চন্দ্রার আগে। বন্দনার বিয়েতে চন্দ্রা নতুন বউ। ঠিক এইরকম সাজের চূড়ান্ত করে গিয়েছিল। মাথায় সোনার মুকুট, পায়ে নূপুর। কিন্তু সে বরাবরই একটু মোটা, আলগা ধরনের। বন্দনা ছিমছাম। সিংহাসনের ওপর সোজা বসে থাকা নরম-ঢলঢলে মুখের জা’টিকে দেখে সেবার বেশ হিংসে হয় চন্দ্রার। সেই প্রথম ঈর্ষার অনুভূতি কোনদিন যায়নি। অভিমন্যুর মৃত্যুর খবরে সকলকারই মাথায় বজ্রাঘাত হয়েছিল। চন্দ্রারও খুব খারাপ লাগে। কিন্তু নিয়মভঙ্গের দিন সে লালপাড়, সোনালি জরির বুটি মাইসোর সিল্ক পরে খেতে এসেছিল, এক-গা সোনার গয়না, চওড়া সিঁদুর, লিপস্টিক, গায়ে সুগন্ধ। কাজল এল শ্বশুরবাড়ি থেকে। কালো কাজের সাদা ঢাকাই পরনে। চন্দ্রাকে দেখে তিরস্কারের সুরে বলল ‘কি করেছিস রে চন্দ্রা? আজকের দিনে কেউ এমনি সাজে?’ চন্দ্রার রাগ হয়ে গিয়েছিল, বলেছিল—‘আহা, সবাই তো সেজেছে, আজ এয়োস্ত্রীদের বিশেষ দিন, মা-ই তো বলছিল, নয়তো আমি আর জানছি কোত্থেকে? আমার সিঁদুরের ওপর মা-ই তো আরেক দফা সিঁদুর চড়িয়ে দিল। জানি না বাবা।’
কাজল আহত গলায় বলেছিল—‘মার আর বুদ্ধিশুদ্ধি কোনদিন হবে না।’
চন্দ্রা বাঁকা হেসে বলেছিল—‘তা দিদিভাই, তুমি কিন্তু আমার থেকে কিছু কম সাজোনি। লাল হয়ত পরোনি। সিঁদুরটাও তোমার হেয়ার-স্টাইল না কি বলে, তার চোটে একটু ঢাকা পড়ে গেছে, কিন্তু তোমার শাড়িটা আমারটার চেয়ে অনেক দামী। এটাই সেবার জামাইবাবু পূর্ব-পাকিস্তান থেকে বুনিয়ে আনলেন না? তোমার কানে হীরে, আঙুলে হীরে, লকেটেও হীরে। সবই আসল কমল হীরে। ওসবের দাম কত হতে পারে আমিও ব্যবসাদারের ঘরের মেয়ে ভাই। আমার জানা। তোমাদের মতো ভান-ভড়ং-এর মধ্যে আমি নেই। শ্রাদ্ধবাড়িই হোক আর যা-ই হোক, পাঁচটা মানুষ অসবে তো! ভদ্রলোকের সামনে বেরুবার মতো পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হতে হবে তো অন্তত।’
কাজল গম্ভীর হয়ে বলেছিল—‘বন্দনাকে দেখতে যাওয়াটা আমাদের প্রথম কর্তব্য। আমি তো আবার আগের দুদিন আসতেই পারিনি। কিন্তু তোকে নিয়ে ওর কাছে যেতে আমার লজ্জা হচ্ছে।’
চন্দ্রা বলল—‘নাই বা নিয়ে গেলে!’
কাজল একাই চলে গেল রাগ করে। যেতে যেতে দালানের গোল আয়নার সামনে চট করে একবার দাঁড়িয়ে নিজের প্রতিবিম্বটা দেখে নিল। নাঃ, অত্যধিক উগ্র, অশোভন কিছু নেই। চন্দ্রা যা-ই বলুক। সবই সংযত, শোভন, অভিজাত। কিন্তু বন্দনার ঘরে কাজলের জন্য বেশ খানিকটা ধাক্কা অপেক্ষা করে ছিল।
আলনার ওপর একটা আধময়লা ঢাকা চাপা দেওয়া। আলমারি, ড্রেসিং-টেবিলের কাচ মলিন। জলচৌকির ওপর পর পর সুটকেস তার ওপর কেউ একটা ধোপার বাড়ির পাটভাঙা চাদর চাপা দিয়ে গেছে, কারণ তার ওপরেই অভিমন্যু আর বন্দনার যুগল ছবি। বিয়ের। তাতে মালা দেওয়া। সন্দেহ নেই, দুজনেই মৃত। টেবিলের ওপর পাতলা ধুলো। জোড়া খাট, তার একদম ওধারে, দেয়ালের ধার ঘেঁষে অবিশ্বাস্যরকমের শীর্ণ একটি শরীর। চুলগুলো বালিশের এপাশ-ওপাশ ছড়িয়ে পড়েছে পাগলিনীর মতো। চোখ বুজোনো। গাল বসে গেছে। রঙ পাণ্ডুর। ঠোঁট দুটো শুকিয়ে উঠেছে। গায়ের ওপর একটা গরম কালো চাদর বুক পর্যন্ত টানা। বন্দনা ওষুধ খেয়ে ঘুমোচ্ছে। এ কে? এ কি? কাজলের স্বামী ফরেন সার্ভিসে আছেন, স্বামীর সঙ্গে তাকে বহু জায়গায় ঘুরতে হয়। এসেছে মাত্র গতকাল। অভিমন্যুদার মৃত্যু সংবাদ পেয়ে একবারও আসতে পারেনি দেখা করতে। তার মনে হল জানা না থাকলে সে বন্দনাকে চিনতে পারত না। এখনও খুব কষ্টে চিনছে। নিজের গায়ে ফরাসী সেন্টের গন্ধ যেন তার দু গালে চড় মারছে। কাজলের মনে হল এই অনুষ্ঠানের মতো, এই অনুষ্ঠানে তার, চন্দ্রার এবং অন্য অনেকের উপস্থিতির মতো হৃদয়হীন, অশ্লীল ব্যাপার আর কিছু হতে পারে না। ভয় হল বন্দনার যদি হঠাৎ ঘুম ভেঙে যায়! সে যদি দেখতে পেয়ে যায় তাকে, তার এই সযত্ন সংযত নিয়মভঙ্গের সাজখানাকে? তাড়াতাড়ি পালাতে গিয়ে কার সঙ্গে যেন ধাক্কা খেল। ফিরে দেখে চন্দ্রা। ফিসফিস করে চন্দ্রা বলল—‘ও সারাক্ষণ ওষুধ খেয়ে ঘুমোয় দিদিভাই, আধপাগল মতো হয়ে গেছে। ও আমাদের দেখতে পাবে না। দেখবার চোখই নেই। বুঝতে পারবে না কিছু। ওর চোখে আমার লালও যা তোমার কালোও তা।’
চন্দ্রার চোখ ছলছল করছে। দুজনে পা টিপে-টিপে বাইরে বেরিয়ে এল। কাজল রুমাল টানতে ভুলে গেছে, কোমর থেকে, শাড়ির আঁচলে চোখ মুছছে।
আজ কাজলের অনুযোগের জবাবে বন্দনা কি বলে শোনবার জন্য চন্দ্রার উদগ্র কৌতূহল। আজ তো বন্দনা রোগিণীও না, পাগলিনীও না। হঠাৎ শুধু চন্দ্রাদের জাত থেকে অন্য এক জাতে চলে গেছে। ধনী-দরিদ্রে যেমন দুস্তর পার্থক্য, নীল রক্তে আর লাল রক্তে যেমন, সধবা আর বিধবার মাঝখানেও সেইরকম এক দুর্লঙ্ঘ্য ব্যবধান। কি বলে ওই জাতের মানুষ?
বন্দনা শুধু বলল—‘কাপড়টা মা দিয়েছেন। কলির বিয়েতে এটাই আমি বাড়ি থেকে পেয়েছি।’
মিলি সামনে দিয়ে যাচ্ছিল। ভীষণ সেজেগুজে। চন্দ্রা বলল—‘বন্দনা, মিলির গায়ে ওটা তোমার ফুলশয্যের বেনারসীটা না?’ বন্দনা মাথা নাড়ল হ্যাঁ।
নিঃশ্বাস ফেলে কাজল বলল—‘চল বন্দনা, কনের ঘরে যাই।’
হঠাৎ সন্ত্রস্ত হয়ে বন্দনা বলল—‘আমি? না থাক। আমার যাওয়া চলবে তো!’
—‘সে আবার কি? যাওয়া চলবে না কেন?’
—‘কি জানি, কাজলদি সব নিয়ম তো আমার জানা নেই!’
কাজল বলল—‘কোনও নিয়ম নেই। তুই আয় তো। সকলকার সঙ্গে দেখা করবি তো!’
বন্দনা বিপন্ন মুখে বলল—‘আমি বরং নিচে যাই একবার। মা বলেছিলেন নিরামিষ ঘরে রান্না-বান্না, খাওয়ানো একটু দেখতে। সময়মতো না গেলে রাগ করবেন।’ বলে বন্দনা আর অপেক্ষা করল না। সিঁড়ির দিকে চলে গেল।
চন্দ্রার হৃদয়ে সমবেদনা। দুঃখ। সবই ঠিকঠাক আছে। তা সত্ত্বেও, সব ছাপিয়ে তার বুকের ভেতরটায় কিরকম একটা হালকা ভাব। আর কোনদিন কোনও আত্মীয় সমাবেশে তার মাসতুত জা বন্দনা তার প্রতিদ্বন্দিনী হয়ে উঠবে না। আগে আগে যত বিয়ে, অন্নপ্রাশন, সাধের নেমন্তন্নে দুজনে গেছে। সবার মুখে এক কথা। ফিস ফিস করে অবশ্য। ‘বড়মাসিমার বউটিও সুন্দরী, কিন্তু যাই বলো আর তা-ই বলো মেজমাসিমার বউটির যেন আলাদা একটা শ্ৰী আছে চোখে মুখে গড়নে।’ দেওররা, ভাসুররাও বন্দনা এলেই বেশি মনোযোগী হয়ে উঠত। ধারা পাল্টে যেত সবার। একটা যেন অতিরিক্ত সম্ভ্রম। তার নিজের স্বামী-ই তো বলত ‘বন্দনা ফ্যানটাসটিক’। এই সব কথাবার্তা চন্দ্রার কানে বিষ ঢালত, সে কোনদিন হাসিমুখে এই সব প্রসঙ্গে যোগ দিতে পারত না। স্বামীকে বলত ‘তোমার বুঝি অভিমন্যুদার ভাগ্যের জন্য হিংসে হয়!’ তার স্বামী বলত ‘অভিমন্যু? ওঃ ও তো লগন-চাঁদা ছেলে। হিংসে করে আর কি করব!’ ‘তা দেখে শুনে বন্দনার মতো বউ আনলেই তো পারতে!’ স্বামী হতভম্ব হয়ে বলত ‘যা ব্বাবা। আচ্ছা তো তোমরা মেয়েরা। কোথা থেকে কোথায় সড়াত করে চলে গেলে?’ এই সব অপ্রীতিকর প্রসঙ্গের আর পুনরাবৃত্তি হবে না।
কাজলের মনের ভাবটাও হল বড় বিচিত্র। বন্দনা যেন এক কথায় তাকে বুঝিয়ে দিল সে আর কাজলদের, চন্দ্রাদের কেউ নয়, সে অন্য জায়গায় বদলি হয়ে গেছে। ক্রমশ আরও যাবে। কাজেই চন্দ্রাদের সাজগোজ, কাজলদের অতি সযত্ন অতি সাবধান প্রসাধন, অলঙ্কার-নির্বাচন এসব আর বন্দনাকে স্পর্শ করে না। বন্দনার কিছু মনে করার প্রশ্ন নেই। কুকুর যদি মাংস খায়, গরু কি তাতে কিছু মনে করে? ওরা নিশ্চিন্তে সাজতে পারে। কাজল মাসিমার বড় ঘরে যেখানে কনে সেজে কলি বসে আছে, আর তার পাশে মিলি উপহার নিচ্ছে সেখানে চলে গেল। পেছন পেছন চন্দ্রা। কাজল অনেকক্ষণ চুপ করে দেখল, তারপর মনের মেঘ কাটাতে বলল—‘কলিকে ভারি মিষ্টি দেখাচ্ছে, না? এই রকম একটু বিষণ্ণ ভাবটা কনের মুখে খুব সুন্দর মানিয়ে যায়, দেখেছিস, চন্দ্রা? বেশি স্মার্ট, বেশি হাসি, অঙ্গভঙ্গি ভালো লাগে না।’
চন্দ্রা বলল—‘যা বলেছ। আজকালকার কনেগুলোকে দেখলে তো কনে বলে বোঝাই যায় না। তবে কলিকে যত ভালোই দেখাক আজকের দিনের শ্রেষ্ঠ সুন্দরীর প্রাইজ যদি কাউকে দিতেই হয় তো সে তোমাকে, তোমাকে, তোমাকে।’
কাজল বলল—‘দু ছেলে মেয়ের মা, বড়টা সিনিয়র কেমব্রিজ দিতে চলল, আমার আবার সাজগোজ, আমার আবার রূপ!’
চন্দ্রা বলল—‘বারবার দু ছেলে মেয়ের মা, দু ছেলে মেয়ের মা করো না তো! ওদের পেটে ধরা ছাড়া আর কিছু তোমাকে কোনদিন করতে হয়েছে?’
কাজলের কাঁধে দু হাত দিয়ে একটু বেঁকে দাঁড়িয়ে চন্দ্রা আবদেরে গলায় বলল—‘বলো না গো কি করে এমন ফিগার রাখলে? আমি রোজ রোজ বেঢপ হয়ে যাচ্ছি!’
এই সময়ে কলির চোখ পড়ল ওদের দিকে। ইশারায় ডেকে বলল—‘বউমণিকে দেখেছ।’
—‘বউমণি কে? ও, বন্দনা? দেখলাম তো!’
—‘ওকে এখানে একটু আসতে বলো না!’
—‘বলেছিলাম, এল না রে, নিচে চলে গেছে। কাজ আছে।’
কলির চোখ ছাপিয়ে আবার জল এল। বড় মাসিমা ঢুকে বললেন ‘চোখের কাজল ধেবড়ে গেলে কেমন করে শুভদৃষ্টি করবি মা? এই চন্দ্রা বউ, কাজলা ওকে কাঁদাচ্ছিস কেন রে?’
শাশুড়িকে আসতে দেখে চন্দ্রা ঘর থেকে টুক করে সরে গেল। মা কাজলকে বললেন—‘কাজলা, এক খিলি পান এনে দে তো কলিকে। গলাটাও শুকোবে না, ঠোঁট দুটিও টুকটুকে রসালো হয়ে থাকবে। সারা দিনের উপোস, আহা মুখখানা শুকিয়ে উঠেছে গো!’
অধ্যায় ১০
এ বছর বৃষ্টি হয়নি তেমন। আষাঢ়ে বৃষ্টি হয়েছে নিয়মরক্ষা। শ্রাবণের বৃষ্টি গ্রামের দিকে যত ঝরেছে, শহরে তত ঝরেনি। এক এক দিন মেঘের পরে মেঘ জমে। ঘন শ্রাবণ মেঘ। মাটির ওপর মেঘের ছায়া। তারপর হঠাৎ হু-হু করে হাওয়া দেয়। কিছুক্ষণ পরেই আকাশ ফর্সা। যেন কলির বিয়েতে অসুবিধে হবে বলেই শ্রাবণের গোড়ায় ঝিরঝিরে মতো নামমাত্র হয়ে বৃষ্টি থেমে গেল। আজ সকাল থেকেই মেঘের গুরু গুরু ডাক, কালি-ঢালা আকাশ, তারপর মুষলধার। স্কুলবাস থেকে নেমেই হাঁটু জল। নাতিকে কোলে করে নামালেন দাদু। সে জলে নামবার জন্য ছটফট করছে। দোরগোড়া থেকে ঠাকুমা ধমকাচ্ছেন। বারান্দায় উৎকণ্ঠিত মা আধঘোমটা দিয়ে দেখছে। একটা মস্ত ছাতা দরজার সামনে এসে থামল। ওপরে ছাতা, তলায় জল। মাঝখানে ঢোলা প্যান্ট পরা কোমর, আর তার ওপর ফুলে ওঠা শার্টের অংশ। নাতি-দাদুর দিক থেকে এই দৃশ্যের দিকে চোখ পড়ে গেল। আর কিছু দেখতে হল না। বুকের মধ্যে গুরগুর শুরু হয়েছে। এক দৌড়ে বন্দনা ঘরের মধ্যে চলে গেল। কাকা। দীর্ঘ চার বছরেরও পর।
ক্রমশ ক্রমশ প্যান্ট-গোটানো, ভেরিকোজ-ভেন-অলা শক্ত শক্ত মজবুত কাঠের গুঁড়ির মতো পা দু-খানা দৃশ্য হল। ঠাকুমা মাথায় ঘোমটা টেনে বললেন—‘অ মা, বে-ই মশাই!’ সামান্য লজ্জা পেয়ে ভেতরে যেতে যেতে বললেন—‘আসুন, আসুন। দেখুন দিকি নাতি আমাকে টেনে একেবারে রাস্তায় বার করে ফেলেছে।’
কথা শুনে দাদু পেছন ফিরে তাকালেন—‘আরে আরে সোমনাথবাবু? পথ ভুলে?’ কাশীনাথবাবুর মুখে উল্লাস, বিস্ময়!
—‘দেখ দাদাভাই আজ কে এল!’
বন্দনা ছুটেছে বাথরুমে। চোখ মুখ ভেসে যাচ্ছে। বুকের মধ্যে একটা বিস্ফোরণের মতো কিছু। তার অশ্রু কি শোকের, না আনন্দের, না অভিমানের? বন্দনা জানে না। সে শুধু দেখছে অনেক দিনের খরার পর বৃষ্টি নামছে। ততক্ষণে ছেলে বাইরে থেকে ডাকাডাকি করছে—‘ও মা। দেখ না আমি কেমন ভিজেছি।’ শাশুড়ি ডাকাডাকি করছেন, ‘অ বউমা, দেখে যাও কে এসেছেন, তোমার আবার অসময়ে বাথরুম কেন গো?’
চোখ মুখ ধুয়ে বহু কষ্টে আত্মসংবরণ করে বেরিয়ে এল বন্দনা, একতলায় বৈঠকখানা ঘরে যখন পৌঁছল তখন চোখে জল নেই, কিন্তু চোখ ফোলা, লালচে, বুকের সামনের কাপড় ভিজে।
কাকার গলার স্বর গমগম করছে। কোথা থেকে এলেন। কিভাবে হঠাৎ ঠিক করলেন, টিকিট পেতে কি কষ্ট! বন্দনা ঢুকে প্রণাম করতে আর্তনাদ করে উঠলেন—‘এ কি চেহারা করেছিস রে বুড়ি?’
বন্দনা প্রাণপণে নিজেকে সামলায়, ঠোঁট কামড়ে মেঝের দিকে চেয়ে আছে। শাশুড়ি বসেছিলেন, নীরস কণ্ঠে বললেন—‘আর কি চেহারাই বা আশা করেন বে-ই মশাই। সব সাধ-আহ্লাদ তো ঘুচেই গেল এই বয়সে। খায় না, দায় না।’
কাকা মাথা নেড়ে বললেন—‘সে কি? এটা তো ঠিক নয়! এ হতে দেওয়া একেবারেই ঠিক নয়।’
কাশীনাথবাবু বললেন—‘কি ঠিক নয় সোমনাথবাবু?’
—‘এইভাবে জীবনটাকে অপচয় হতে দেওয়া কি ঠিক?’ সখেদে বললেন সোমনাথ। কাশীনাথবাবু বললেন—‘জীবন তো তার সঙ্গে সঙ্গেই শেষ হয়ে গেছে। আর জীবন!’ নিঃশ্বাস পড়ল তাঁর।
কাকা বললেন—‘এ কি কথা বলছেন? বিধাতার দান জীবন! অমূল্য জীবন, সে কি নষ্ট হতে দেওয়া ঠিক?’
শাশুড়ি বললেন—‘বউমা, কাকাকে ঘরে নিয়ে যাও মা। শুকনো কাপড় চোপড় দাও। একেবারে কাক-ভেজা ভিজেছেন।’
বন্দনার পেছন পেছন ওপরে উঠলেন কাকা। মুখে কথা নেই। ঘরের মধ্যে রূপ রঙ-তুলি নিয়ে মেঝেতে বসে গেছে। তাকে দেখে কাকার মুখে হাসি ফুটল। খপ করে কোলে তুলে বললেন—‘আমি কে বলো তো?’
রূপ বলল—‘আঃ ছাড়ো না, জানি না!’
—‘আগে বলো আমি কে, তবে ছাড়ব।’
এঁকে বেঁকে মানুষটির খপ্পর থেকে বেরিয়ে আসাবার চেষ্টা করতে করতে রূপ বলল—‘তোমার নাম আমি জানি। বে-ই মশাই। বিচ্ছিরি নাম। এরম নাম আবার হয় নাকি?’
কাকা হাসতে হাসতে বললেন ‘ঠিক বলেছ নাতিবাবু। নামটা বিচ্ছিরি, বুড়ি আমি তোর কে হই ওকে বলে দে তো!’
বন্দনা শুকনো গলায় বলল—‘সত্যিই কি তুমি আমার কেউ হও? কেউ নয় তুমি আমার।’
—‘যাক, এতক্ষণে তোর গলার আওয়াজ পেলুম’। কাকা একইরকম হাসি-হাসি মুখে বললেন ‘যাক একটা ধুতি-টুতি কিছু দিবি তো? যতই ঠাণ্ডা অভ্যাস থাক, তোদের এই সমতলের বৃষ্টি গায়ে লাগলেই যত বুড়োটে রোগ চেপে ধরবে।’
বন্দনা বলল—‘তুমি তাহলে পাকাপাকি ভাবেই পাহাড়ি হয়ে গেলে?’
—‘পাকাপাকি আমি কিছুই হচ্ছি না, তা যদি বলিস। কাঁচাকাঁচি বললে না হয় মেনে নিতে পারি।’
বন্দনা আলমারি খুলে অভিমন্যুর ধুতি-পাঞ্জাবি-গেঞ্জি বার করে দিল। কাকাকে বাথরুমে নিয়ে গেল।
সোমনাথবাবু স্টেশনে নেমে সেখানে লাগেজ রেখে আগে বুড়ির বাড়ি এসেছেন। এতদিনে এই একবারই মাত্র মনে হয়েছে বড় অন্যায় হয়ে গেছে। বুড়িকে দেখে আসা উচিত ছিল। আসলে সোমনাথবাবুর মনোভাব বড় বিচিত্র। বুড়িকে কোলে-কাঁখে করে মানুষ করেছেন, তার বিয়ে দিয়েছেন উপযুক্ত পাত্র দেখে। তারপর দাদা মারা গেলেন, দাদা ছিলেন তাঁর জীবনের একমাত্র অবলম্বন। তাঁরও বালকবয়সে বাবা মা মৃত। মস্ত বড় একান্নবর্তী পরিবারে এই দাদাই তাঁকে পক্ষীমাতার মতো সব ঝড়-ঝঞ্ঝা আড়াল করে মানুষ করেছেন। সংসার করেছেন, বেশি বয়সে। বউদি মারা গেলে মনে হয়েছিল দ্বিতীয়বার মাতৃহীন হলেন। দাদা বা দাদার মেয়ের চেয়ে তাঁর নিজের কষ্ট কিছুমাত্র কম হয়নি। বিয়ে তো করলেনই না। মনের মধ্যে নিজের অজ্ঞাতেই কিরকম একটা বৈরাগ্য তৈরি হয়ে গেল। ক্রমশই যেন গিঁট খুলছে। দাদা চলে যেতে শূন্য বাড়িতে মনে হয়েছিল জীবনরজ্জুর সব গ্রন্থিগুলো খুলতে খুলতে জীবন- ব্যাপারটা এবার খুব সোজা সরল দাঁড়িয়ে গেল। আর কোথাও আটকে থাকবার দরকার নেই। মেয়ে ভালো ঘরে-বরে পড়েছে। তার কোনও অভাব-অভিযোগ নেই। সে এতই ব্যস্ত যে কাকার কাছে আর দু-দিন কাটিয়ে যাবারও সময় পায় না। ভালোই তো! যে যার নিজের মতো করে সুখী হোক। সুখে থাকলেই হলো। সুখটাই বড় কথা। ব্যস। তাহলে তো কোনও দায় নেই। পরিণত যৌবনে কেদার বেড়াতে গিয়ে হিমালয়ের প্রেমে পড়ে গিয়েছিলেন সোমনাথবাবু। মাঝে মাঝেই ট্রেকিং-এ যেতেন। এবার যেন পাকাপাকিভাবেই পায়ে স্পাইক দেওয়া শু, হাতে লাঠি আর পিঠে রুকস্যাক উঠল। উলিকটের গেঞ্জির ওপর গরম কাপড়ের শার্ট, তার ওপর সোয়েটার, কোট, কম্বল চাপিয়ে সোমনাথবাবু চলেছেন এ পাহাড় থেকে ও পাহাড়ে। কেদার-বদরি হল তো গঙ্গোত্রী-গোমুখ, সেটা হল তো যমুনোত্রী, সেটা শেষ হলে অমরনাথ, রূপকুণ্ড, সন্দকফু, ফালুট। আবার নেপাল হয়ে এভারেস্টের পাদমূলে। যতটা যাওয়া যায় একটার পর একটা। সারা বছর অফিস করেন, তারপর মাসখানেকের ছুটি নিয়ে বেরিয়ে পড়েন। চাকরিটা বড্ডই বাধাস্বরূপ মনে হওয়াতে একটু সকাল-সকাল অবসর নিয়ে নিলেন। ব্যাস তারপর থেকে বাধাবন্ধনহীন হিমালয়যাত্রী। আলমোড়ায় বসে খবর পেলেন অভিমন্যুর মৃত্যুর। পিঠের কাছে তখন গোটা হিমালয়ান রেঞ্জ, চৌখাম্বা, নীলকণ্ঠ, ত্রিশূল কোলে কোলে রোদ এসে পড়েছে। অপূর্ব শোভা। কুয়াশা কেটে ক্রমশ ঝকঝক করছে সব। সবই যেন মানুষের কামনা-বাসনা, আনন্দ-বিষাদের ঊর্ধ্বে। মনে হল, না না অভিমন্যু মোটেই হারায়নি, আছে এই পৃথিবীতেই, এই বায়ুমণ্ডলে, শরীরের বাধা মুক্ত হয়ে সে পরমানন্দে ভ্রমণ করছে। সে-ও বুঝি এবার তাঁর মতো পরিব্রাজক-ভূমিকা বেছে নিল। সব মানুষই শেষ পর্যন্ত তাই নেয়। বুড়ির কিছুদিন খুব কষ্ট হবে। কিন্তু আসল ব্যাপারটা বুঝতে পারলে আর কষ্ট নেই। কিছুদিন, মাত্র কিছুদিন মেয়েটা অপেক্ষা করুক। জীবনের সত্য-রূপ বুঝতে মাত্র ক’টা দিন আর। নানান জায়গায় ঘুরতে ঘুরতে কনখল হয়ে কাশীতে পৌঁছলেন সোমনাথবাবু। কাশীতে থাকাকালীন, দশাশ্বমেধ ঘাটে তাঁর একদিন একটি অদ্ভুত অভিজ্ঞতা হয়।
লাক্সার রোডের ধর্মশালা থেকে রোজই দশাশ্বমেধ ঘাটের দিকে আসতেন তিনি। একদিন ঘাটের সিঁড়ি দিয়ে নামছেন, দেখলেন সাদা থান পরা এক অশীতিপর বৃদ্ধা গঙ্গাস্নান করে জড়-পুঁটলি হয়ে বহু কষ্টে উঠে আসছেন। উঠতে উঠতে হঠাৎ বসে পড়লেন, সোমনাথবাবু তাড়াতাড়ি তাঁকে সাহায্য করতে এগিয়ে গিয়ে দেখেন তাঁর শ্বাসকষ্ট শুরু হয়েছে। ঘাটের সিঁড়ির ওপর সোমনাথবাবুর কোলে মাথা রেখে, সোমনাথবাবুর হাতের গঙ্গাজল মুখে নিয়ে বৃদ্ধা মারা গেলেন। মৃত্যুর আগে মনে হল বিড়বিড় করে কি বলছেন।
—‘কিছু বলবেন, মা?’ সোমনাথবাবু তাঁর মুখের কাছে কান নিয়ে গেলেন। ‘কিছু চাই?’
—‘নারায়ণ, নারায়ণ,’ অতি কষ্টে বললেন বৃদ্ধা।
—‘বলুন, কি ইচ্ছে আপনার!’
—অজ্ঞাত পরিচয় প্রৌঢ়ের দিকে তাকিয়ে বৃদ্ধা বললেন, ‘বিশ্বনাথ, পরজন্মে যেন আর বিধবা করো না।’
সোমনাথবাবু একটা ধাক্কা খেলেন। মানুষের কত রকমের আশা, আকাঙ্ক্ষা, প্রার্থনার বস্তু আছে জীবনে। রূপং দেহি, ধনং দেহি, যশো দেহি, দেহি মে। অথচ আশি বছর অতিক্রান্ত এই বৃদ্ধার মুখ দিয়ে এতো অকিঞ্চিৎকর প্রার্থনা উচ্চারিত হল! আর কিছু চাওয়ার কথা মনে পড়ল না? ঐশ্বর্য, বুদ্ধি, যশ, জ্ঞান, বৈরাগ্য, ঈশ্বর-প্রেম কিছু না। শুদ্ধ নির্বৈধব্য?
মুখ তুলতে নানা বয়সের আরও কয়েকটি মুখ দেখতে পেলেন সোমনাথ। বেশির ভাগই শীর্ণ। নানা অভিজ্ঞতার রেখা আঁকা, হাতে গঙ্গাজলের ঘটি, গায়ে নামাবলী, সব মুখেই যেন এক মুখ।
হঠাৎ সোমনাথবাবু সোজা হয়ে বসলেন—মৃত বৃদ্ধাকে অনেকক্ষণ থেকে চেনা-চেনা লাগছিল। কেন তিনি বুঝতে পেরেছেন। তাঁর মুখে যেন বুড়ির আদল।
ভিড়ের মধ্যে থেকে একজন বললেন—‘দিদিমা মুক্তি পেলেন। আহা বোধহয় গত পঞ্চাশ বছর ধরে মানুষটা একা একা এই কাশীতে পড়েছিল গা! কী দুঃখুটাই পেয়েছে।’
আর এক জন কপালে জোড় হাত ঠেকিয়ে বললেন—‘গঙ্গার কোলের ওপর গেলেন। মাসিমার ডাক নিশ্চয়ই শুনবেন বাবা, পরের বারে দেখ। যাবে ভাগ্যিমানি জাজ্বল্য এয়োতি হয়ে পাকা মাথায় সিঁদুর পরে। বিশ্বনাথ, বিশ্বনাথ!’
ব্রাহ্মণ সন্তান, শেষ সময়ে মুখে জল দিয়েছেন, অপরিচিতা বৃদ্ধার মুখাগ্নি সোমনাথবাবুই করলেন। সারা দিনের পর স্নানটান সেরে ধর্মশালার টানা বারান্দায় বসলেন। পাহাড় থেকে সমতলে নামলে কিছুদিনের জন্য শরীরটা বেজুত হয়ে থাকে। হরিদ্বারে মাত্র একদিন কাটিয়ে কাশীতে এসেছেন। কেমন একটা অবসাদ। আগে এমন হলে মনে হত, সমতলের হাওয়া তাঁর সহ্য হচ্ছে না, আরও উঁচুতে থাকা দরকার। চলে যাওয়া দরকার, আবার। আজ মনে হল—না। গ্রন্থিমোচন হয়নি। হয়নি বলেই এই অবসাদ। জীবনের পাকে যে গিঁট পড়েছে, তিনি তাকে খোলবার বিন্দুমাত্র চেষ্টা না করে চলে গেছেন, যতক্ষণ না খুলছেন যতক্ষণ না ফিরছেন, হিমালয় বৈরাগ্য, আনন্দ সব মায়া। সব মিথ্যা। তিনি একেবারেই মূর্খের স্বর্গে বাস করছিলেন। বুড়িমাকে এক্ষুনি একবার দেখে আসা দরকার।
কাশীনাথবাবু এবং তাঁর স্ত্রী কিছুতেই সোমনাথবাবুকে যেতে দেবেন না।
কাশীনাথ এবং তাঁর ভাই বন্দনার খুড়শ্বশুর দুজনেই বললেন—‘লাগেজটা আপনি স্টেশনে রেখে এলেন কেন, বুঝিয়ে বলুন আগে।’
—‘আরে প্রায় বছরখানেক পরে বাড়ি ফিরছি। বাড়ি তো একটা জঞ্জালের আণ্ডিল হয়ে আছে কি না। তাই ভাবলুম ওদিকে গিয়ে কাজ নেই। দেরি হয়ে যাবে, আগে বুড়িকে দেখে…’
—‘তা বেশ তো, হাতের সুটকেস, বেডিংটা নিয়ে আসতে কি হয়েছিল? বুড়ির বাড়িতে কি আপনার উঠতে নেই?’
বেয়ান হেসে বললেন—‘তা সুটকেসের জিনিসও বুড়ির বাড়ি আছে, আর শয্যের অভাবও ভগবানের ইচ্ছেয় এখনও হয়নি। তোমরা ওঁকে সুটকেস-বেডিং-এর জন্যে অত হয়রান করছ কেন?’
সোমনাথবাবু উকিলি জেরার মুখে খুবই অপ্রস্তুতে পড়ে গেলেন। কিছুতেই তিনি মুখ ফুটে বলতে পারছেন না, কুটুমবাড়িতে ও রকম না বলে-কয়ে হুট করে ওঠা যায় না। অন্তত তিনি পারেন না।
বেয়ান বললেন—‘বেশ তো, যা করেছেন করেছেন। এখন মেয়ের বাড়ি দু-দিন জিরিয়ে তবে জঞ্জালের আণ্ডিলে যাওয়া হবেখন।’
বন্দনা চা দিয়ে গেল কুটুমদের জন্য তুলে রাখা, দামী বোন চায়নার কাপে। সঙ্গে মুড়ি, বেগুনি, ফুলুরি। ইলিশমাছ ভাজা। বেলা চারটে প্রায় বেজে গেছে। সোমনাথবাবু তাঁর নিয়ম ভঙ্গ করে ভাতে কিছুতেই আর বসবেন না। শেষ বেলায় গড়িয়ে নেবার অভ্যাসও সোমনাথবাবুর নেই।
বেয়াই-বেয়ানদের সঙ্গে গল্পগাছা সেরে বন্দনার আয়ত্তের মধ্যে আসতে সোমনাথের সন্ধে প্রায় উতরে গেল।
বন্দনা বলল—‘কাশীতে আমার মতো দেখতে কাকে দেখলে তাইতে হঠাৎ মনে পড়ে গেল বুড়ি বলে একটা মানুষ আছে, নইলে কাশীর পর কোথায় যেতে?’
কাশীর দৃশ্যটা মনে পড়ে সোমনাথের মুখের ওপর ছায়া নেমে এসেছে। কার মুখে কখন তিনি বন্দনার আদল দেখেছিলেন সে সব খুঁটিনাটি তিনি বলেননি। মনে করতেও চান না আর। তবু তো মন থেকে মোছা যায় না কিছুতেই! অশীতিপর এক মৃত্যুপথযাত্রিণীর মুখে এক যুবতীর মুখের আদল কেউ দেখে? তবু তো দেখেছিলেন! মুখের গাম্ভীর্যটাকে মুহূর্তের মধ্যে মুছে ফেলে সোমনাথ বললেন—‘কোথায় আর যেতুম রে বুড়ি। তোর কাছে যে আমার কান বাঁধা। তবে হ্যাঁ, তোকে নিয়ে যেতে ইচ্ছে হয়েছিল খুব। জানি পুঁচকেটাকে নিয়ে পারবি না, তাই উচ্চবাচ্য করিনি। কিন্তু তোর যে খুব অসুখ গেছে। বিছানায় শুয়ে কাটিয়েছিস মাসের পর মাস—এ সব কথা তো আমি জানতুম না মা!’
বন্দনার চোখে জল এসে যায়! কাকা বলছেন কি! তিনি কি সত্যিই এ পৃথিবীর নন? নির্মম, সর্বত্যাগী সন্ন্যাসী হয়ে গেছেন? এমন করছেন, এমন ভাবে কথা বলছেন যেন বন্দনার কিছুই হয়নি, কোনও পরিবর্তনই হয়নি তার জীবনে, মাসের পর মাস বিছানায় শুয়ে থাকার কোনও কারণ যেন তার ঘটেনি। একবারও অভিমন্যুর নাম মুখে আনলেন না। যেন তিনি জানেন না যে সে নেই। ধরেই নিয়েছেন আপাতত সে কোথাও গেছে, সময় হলেই এসে পড়বে। কিম্বা অভিমন্যু ভট্টাচার্য বলে বন্দনার জীবনে, কাকার জীবনে কেউ কখনও ছিল না। তার শোক দুঃখ ক্ষতির কোনও গুরুত্বই তিনি দিলেন না। নিজের কথাতেই ভরপুর। অমরনাথের পথে কোথায় কবে পিছলে বরফের ফাটলে পড়ে যাচ্ছিলেন। মানস সরোবরে সন্ন্যাসীরা কি রকম অবলীলাক্রমে চান করে অথচ জলে হাত দিলে মনে হয় হাত খসে গেল। এভারেস্টের পথে শেরপারা তাঁকে ইয়েতির পায়ের ছাপ দেখিয়েছিল। এমনভাবে বলছেন যে এক একটা সময়ে রূপের সঙ্গে সঙ্গে বন্দনাকেও হেসে ফেলতে হচ্ছে।
—‘বুঝলে নাতিবাবু, আমি চলেছি আর কুয়াশা চলেছে। আমি যদি চলি তিন পা তো কুয়াশাটা চলে ছয় পা। শেরপা ব্যাটাও চলেছে, কিন্তু চলছে কি না বুঝতে পারছি না তো। এমন ঘন কুয়াশা যে মনে হচ্ছে সামনে একটা খাড়া সাদা দেয়াল, নিশ্চয়ই মাথা ঠুকে যাবে। এমন সময়ে সেই বিচ্ছিরি কুয়াশার মধ্যে থেকে ভেসে এল এক অদ্ভুত ডাক। কোনও মানুষ কিম্বা পশুর গলারও অমন আওয়াজ কেউ কখনো শোনেনি হলপ করে বলতে পারি। জানিস, আগের দিনই আবার শেরপাটা ইয়েতির টাটকা পায়ের ছাপ দেখিয়েছে। এক হাত লম্বা, তিনটে মর্তমান কলার মতন আঙুল। আমি তো ভাবলুম এই আমার হয়ে গেল। আলভারেজের শেষ হয়েছিল বুনিপের হাতে, আর সোমনাথ বাঁড়ুজ্জেকে শেষ করবে ইয়েতি। ইয়েতিই আমার নিয়তি। প্রাণপণে কুয়াশার সাদা দেয়াল ফুঁড়ে যেদিক থেকে ডাকটা আসছিল তার উল্টো দিকে দৌড় লাগিয়েছি। আর কোথায় যায়! সোজা ইয়েতির খাসখপ্পরে। বিচ্ছিরি-গন্ধঅলা বুক। একেবারে প্রাণপণে জড়িয়ে ধরেছে। তারপর শুনলুম ইয়েতিটা ভাঙা ভাঙা হিন্দি বলছে—‘এ সাব। আপ কঁহা দৌড়কে দৌড়কে যাতা, পহলে বোলা না হুঁয়াপর খাদ হ্যায়। হুঁয়া মৎ যানা!’
ধড়ে প্রাণ এল, শেরপা দ্রিমিং। বললুম—‘দ্রিমিং, ইয়েতির ডাক শুনতে পেয়েছ?’
দ্রিমিং বললে—‘ইয়েতিকা আওয়াজ! হায় রাম, আপ কিধরসে সুনা। কহানী সুনকর আপকো দিমাগ বিলকুল খারাপ হো গয়া। ডরো মৎ সাব।’
আমি বললুম—‘এই তো দু মিনিট আগে একটা গোঙানির মতো আওয়াজ। শুনতে পাওনি?’
দ্রিমিং বললে—‘হায় রাম, সাব উও তো হম খাঁসতা থা—বোঝো নাতিবাবু কোথায় ইয়েতির হাসি আর কোথায় দ্রিমিং-এর কাশি।’
রূপ খুব মজা পায়। হেসে লুটিয়ে পড়ে। বন্দনাও হাসতে থাকে, বলে—‘তুমি পারোও বাবা, সেই একরকম রয়ে গেলে। কোত্থেকে গল্পগুলো বানাচ্ছো বলো তো!’
কাকা বলেন—‘তোর মার কথা শুনেছিস? আচ্ছা, এর মধ্যে গপ্প বানাবার আছেটা কি? তবু যদি বলতুম সত্যি ইয়েতি দেখেছি। হিমালয়ে কত মজা, কত রোমাঞ্চ তা তো আর জানিস না। গল্পের চেয়েও অনেক গুণ আশ্চর্য।’
রূপ এখন আস্তে আস্তে দাদুর কোলে উঠে বসেছে। বিরক্তি নেই। আবদার নেই। দুধ খেয়ে নিল দাদুর কোলে বসেই। বন্দনা বলল—‘কতক্ষণ তুই দাদুর কোলে বসে থাকবি রূপু, পা ব্যথা করবে যে!’
কাকা বললেন—‘আরে এখনই দেখছিস কি? এ তো সবে কোলে চড়িয়েছি, এরপর কাঁধে চড়াব, বলো দাদা? তারপর?’
—‘তাপ্পর হিমালয়!’ রূপ হাততালি দিয়ে বলে উঠল।
—‘ওই দ্যাখ বুড়ি, এরই মধ্যে ওকে নেশা ধরিয়ে দিয়েছি। দিয়েছি তো?’
রাত্রে সোমনাথবাবু জিদ ধরলেন বুড়ির সঙ্গে খাবেন। মেজ দেওর আজকাল বোম্বাইতে বদলি হয়েছে। কলির বিয়েতেও সে আসতে পারেনি। ছোট দেওর আর মিলি আগে খেয়ে নিয়েছে। এবার বাড়ির কর্তাদের পালা। আজকাল খাওয়ার টেবিলে বসবার লোক কমে যাওয়ায় কর্তারা ছেলেমেয়েদের সঙ্গেই বসেন। কিন্তু আজ বড় বেয়াই এসেছেন। তিনজনে একত্রে বসবেন। সেইমতোই টেবিল সাজানো হয়েছিল। সোমনাথবাবুর জিদ শুনে দুই গিন্নিই আপত্তি করে উঠলেন। গাঁই গুঁই। অসুবিধে আছে। তাছাড়া, বউমার অভ্যাস নেই, ও লজ্জা পাবে। সোমনাথবাবু হেসে বললেন—‘বুড়ি আমার সঙ্গে খেতে লজ্জা পাবে, এ একটা নতুন কথা শোনালেন বটে, বেয়ান। মা অল্প বয়সে চলে গেল। বুড়ির স্কুলে যাবার সময়ে আমাকেই বউদির মতো গরস পাকিয়ে পাকিয়ে খাইয়ে দিতে শিখতে হয়েছিল। প্রথম-প্রথম এমন থাবা ভরে দিতুম যে ওর সাজ নষ্ট হয়ে যেত। জানেন তো। তবু আমি না খাওয়ালে ওর স্কুলে যাওয়াই হত না। আপনাদের বাড়ির বউমা হতে পারে, কিন্তু আমার যে মেয়েও বটে, মা-ও বটে।’
খাবার টেবিল ডান দিকে। শাশুড়িরা দুজনে মিলে সারাটা সন্ধে ধরে অনেকরকম রান্না করেছেন। রুপোর থালায় সাদা বলের মতো লুচি। লালচে মাছের কালিয়া, পোলাও, দই-ইলিশ, মাংস, ভাপা দই, চাটনি। বাঁ দিকে দেয়াল ঘেঁষে বন্দনার কম্বলের আসন পড়েছে। সামনে পাথরের সেট। ফল, মিষ্টি, গ্লাসে দুধ।
সোমনাথবাবু ঘরে ঢুকেই বললেন—‘ওকি ওটা কি বুড়ির জায়গা? নিচে কেন?’
দুই শাশুড়ি মুখ চাওয়া-চাওয়ি করলেন। খুড়িমা ঢোঁক গিলে বললেন—‘কাষ্ঠাসনে দোষ নেই অবশ্য। তবু মাছ-মাংস ছিষ্টি আঁশ, ছোঁয়া ন্যাপা।’
কাশীনাথবাবু কাষ্ঠ হেসে বললেন—‘বেয়াইমশাই সত্যি-সত্যিই কাশী থেকে এলেন তো? আমার কিন্তু মনে হচ্ছে খোদ বিলেত থেকে এসেছেন।’
সোমনাথবাবু সে কথা ভালো করে শুনলেনও না, বললেন—‘এত্তো সব দিয়েছেন আমাদের। বুড়ি-মার যে কিচ্ছু নেই!’
খুড়শাশুড়ি বললেন—‘সকালে একবার ময়দা খেয়েছে, রাত্তিরে আবার খেলে ওর অম্বল হয় কি না!’
—‘তো ভাত দিলেন না কেন? এতো বড় রাতটা ওর কাটবে কি করে? ওই শশা, কলা আর খরমুজা যে পেটের মধ্যে তলিয়ে যাবে? বুঝেছি, ওইজন্যেই ওরকম পেত্নীর মতো চেহারা হয়েছে।’
শাশুড়ি ছেলে ভোলাবার মতো করে একটু কর্তৃত্বভরা কণ্ঠে বললেন—‘নিন নিন আরম্ভ করুন বেইমশাই। মেয়েদের খাওয়ার দিকে নজর দিতে নেই। মেয়েমানুষের গতর লোহার গতর, দুটো খুদ খুঁটে খেলেও গতর ফেটে পড়ে। আজ যে আবার একাদশী!’
সোমনাথবাবু বুঝতে-পারা গলায় স্বস্তির নিঃশ্বাসফেলে বললেন—‘তাই বলুন, আজ আপনাদের সব একাদশী। তাই ফল মূল মিষ্টি। সকড়ি জিনিস খাবেন না কেউ।’
কাশীনাথবাবু তীব্রকণ্ঠে বলে উঠলেন—‘আপনি বলছেন কি সোমনাথবাবু! চাঁদ থেকে এসেছেন না কি? আপনার কথার অর্থ জানেন? আপনার বেয়ানরা এয়োস্ত্রী মানুষ, ওঁরা একাদশী করবেন? ছি ছি ছি!’
সোমনাথ ধরা গলায় বললেন—‘শুধু আমার ওই একফোঁটা মা-টাই তাহলে এইভাবে নিশিপালন করতে পারবে, বলছেন? দাদা চাঁদ থেকেও আসিনি, বিলেত থেকেও আসিনি। কিন্তু এ আমি বাস্তবিকই বুঝতে পারলুম না। শিক্ষিত বাড়ি আপনাদের! আমাকে মাপ করবেন। এ সব আর আমার গলা দিয়ে নামবে না।’
ক্ষিপ্ত কণ্ঠে চিৎকার করে উঠলেন কাশীনাথবাবু—‘এ তো আপনি আমাদের অপমান করছেন? কুটুম্ব হয়ে বাড়ি বয়ে এসে অপমান। আপনার মেয়ে আমার বাড়িতে বসে অনাচার করছে, তা জানেন? ব্রাহ্মণের ঘরের বিধবা হয়ে পেড়ে শাড়ি, গহনা পরে বিবি সেজে বেড়াচ্ছে, তবু স্নেহের বশে কিচ্ছু বলিনি।’
উত্তপ্ত আবহাওয়ায় কথার পিঠে কঠিন কথা আপনা থেকেই বেরিয়ে আসে। শাশুড়ি যোগ করলেন—‘অলুক্ষুণে বউ। সংসারের অলক্ষণ? আমার অমন ইন্দ্রের মতো ছেলেটাকে পেটে পুরেছে। তারও পর অনাচার? এই তো চারদিকে এতো বাড়ি আছে। এতো সংসার আছে। কোথায় এমন বিয়ের ছ-সাত বছর যেতে-না-যেতে এমন ইন্দ্রপাত হয়। আর কোথায়ই বা সোমত্ত বিধবা মেয়েমানুষ হাতে চুড়ি ঝমঝমিয়ে, রঙিন শাড়ি দলমলিয়ে বেড়াচ্ছে? আমরা দুই জা তো সদাসর্বদা ভয়ে ভয়ে থাকি। কোত্থেকে কি সব্বোনাশ হয়ে যায়।’
ক্রোধ-কম্পিত দুই প্রৌঢ়-প্রৌঢ়ার মুখ দিয়ে আজ অনেকদিন পর জমা রাগ, ক্ষোভ, দ্বেষ সব গলগল করে বেরিয়ে এল। তাঁদের দিকে শান্ত চোখে চেয়ে, ততোধিক শান্ত গলায় সোমনাথ বললেন—‘আজই বরঞ্চ আমি বুড়িমাকে নিয়ে যাই। ওকে রেডি হতে বলুন।’
দরজার পিঠে ঠেস দিয়ে কাঠ হয়ে দাঁড়িয়েছিল বন্দনা। শাশুড়ির শেষ কথাগুলো কানে ঢুকতে তার হঠাৎ কি রকম তীব্র গা-বমি করে উঠল। টলতে টলতে সে কোনমতে ওপরে গিয়ে ছেলের পাশে শুয়ে পড়ল। ক্লান্ত, কালিমাখা চোখে আর জল নেই। জল আসে না। রাগও নেই। সহসাই যেন তার বোধশক্তি চলে গেছে।
কিছুক্ষণ পরে এসে কাকা যখন মাথায় হাত রেখে, কোমল গলায় বললেন—‘বুড়ি, রাগ করেছিস?’ সে উত্তর দিতে পারল না।
কাকা পাশে বসে পড়লেন। বললেন—‘এদিকে ফের বুড়ি, আমার দিকে তাকা! আমার সঙ্গে যাবি না?’
সে একটু কেঁপে উঠল। ক্ষীণ স্বরে বলল—‘আমি বড় দুর্বহ। তুমি কি বইতে পারবে?’
সোমনাথবাবু বললেন—‘বুড়ি, আমি তোকে বইব না তুই আমাকে বইবি, সে-সব পরে ঠিক হবে রে। আগে তো তুই এই আবহাওয়া থেকে বার হ।’
কাশীনাথবাবুর গলা খাঁকারির আওয়াজ পাওয়া গেল বাইরে।
—‘বেয়াইমশাই!’
—‘বলুন দাদা’। সোমনাথবাবু বাইরে বেরিয়ে দাঁড়ালেন।
—‘রাগের মাথায় কি বলতে কি বলেছি, দোষ ধরবেন না। হাত জোড় করছি। আপনি না খেলে এরকমভাবে চলে গেলে গেরস্থের অকল্যাণ হয়, মাথা ঠাণ্ডা করে এবার চলুন।’
সোমনাথবাবু বললেন—‘মাথা গরম তো আমি করিনি দাদা! আপনি আমার বড় দাদার মতন। আপনার ওপর কি আমার রাগ করা সাজে? তাছাড়াও, এই মুমূর্ষু মেয়েটাকে আর ঘুমন্ত বাচ্চাটাকে এতরাতে পথে বার করা বোধহয় ঠিকও হবে না। বৃষ্টিও পড়ছে বেশ। আমরা কাল সকালেই যাব এখন।’
—‘দু চার দিনের জন্যে বউমা আপনার কাছে কাটিয়ে আসবেন এ আর বেশি কথা কি? কিন্তু এইভাবে যদি নিয়ে যান মনে রাখবেন বরাবরের জন্যেই নিয়ে যেতে হবে। খোরপোষের জন্যেও আমি কিছু দিতে পারব না। খোকা তার সব টাকা তার মাকে উইল করে দিয়ে গেছে। সে আমার বড় ছেলে। অনেক যত্ন করে, খরচ করে তাকে আমি মানুষ করেছি। অত খরচ অন্য কোনও সন্তানের জন্য আর করতে পারিনি। তাদের একরকম বঞ্চিতই করেছি বড়র জন্যে। তার সঞ্চয়ের ওপর আমার ন্যায্য দাবি আছে। বউমা এখানে থাকলে কোনও অসুবিধে নেই। কিন্তু এখান থেকে তাঁকে নিয়ে গেলে স্বপ্নেও আশা করবেন না যে তাঁর খোর-পোষের জন্য আমার কাছ থেকে কিছু আদায় করতে পারবেন।’
সোমনাথবাবু মৃদু স্বরে বললেন—‘আপনি নিশ্চিন্তে থাকুন দাদা। অভিমন্যু যদি তার স্ত্রীর ব্যবস্থা করে গিয়ে না থাকে আমার কোনও খরচ দাবি করবার প্রশ্ন উঠছে না। আমি আমার নিজের সাধ্য অনুযায়ী ওদের দেখাশোনা করব। কতদূর কি করতে পারব জানি না, কিন্তু এমন তিল তিল করে মরতে ওকে দেব না। এটা নিশ্চিত।’
ক্রুদ্ধ কণ্ঠে জবাব এল —‘বেশ।’ রাগত খড়মের আওয়াজ দালানের শেষ প্রান্ত পর্যন্ত বাজতে লাগল।
পরদিন বেলা নটা নাগাদ বন্দনা রূপের হাত ধরে কাকার সঙ্গে ট্যাকসিতে গিয়ে উঠল। সঙ্গে দুটি ট্রাঙ্ক, একটি সুটকেস, একটি হোল্ডল। শ্বশুরবাড়ির দেওয়া গয়না বিশেষ ছিল না। কঙ্কনজোড়াই সবচেয়ে ভালো, সেগুলো কলিকে দিয়েছে। হার, আংটি, কানের ফুল কিছু একটা প্যাকেটে করে কাশীনাথবাবুর টেবিলে নামিয়ে রাখলেন সোমনাথবাবু। বললেন—‘ছেলেতে যা ইনভেস্ট করেছিলেন, সবই লস গেল। আমার বুড়ি-মা যতটুকু পারছে ফিরিয়ে দিচ্ছে।’
ক্ষিপ্তের মতো গয়নার ঠোঙাটা মেঝেতে ছুঁড়ে ফেললেন কাশীনাথবাবু। সোমনাথ বললেন—‘আসি। অভিরূপকে আমার যথাসাধ্য মানুষ করার চেষ্টা করব। আপনি ভাববেন না।’
তীব্রস্বরে কাশীনাথ বললেন—‘নাতিকে ফিরিয়ে আনবার জন্যে দরকার হলে আমি কোর্টঘর করব। এখন যাচ্ছেন যান।’
সোমনাথ ক্রমশই বিরূপ হয়ে উঠছিলেন। জিভ কেটে বললেন—‘নিজে আইনজীবী হয়ে এটা কি বললেন দাদা। কোর্টে গেলে অবধারিতভাবে বেরিয়ে পড়বে অভিমন্যুর লাইফ-ইনসিওরেন্সের টাকা, প্রভিডেন্ট ফান্ড, বুড়ির গয়না… সবই আপনারা…’
খ্যাঁশখেঁশে গলায় কাশীনাথবাবু বললেন—‘যান, যান, আর কথা বাড়াবেন না। অলক্ষণ যত শিগগিরই দূর হয়ে যায় ততই ভালো।’
বন্দনা গাড়ির মধ্যে বসে শিউরে উঠে কানে আঙুল দিল। আসার সময়ে সে শাশুড়িদের প্রণাম করে আসতে পারেনি। তাঁদের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। শ্বশুরমশাই পা ফিরিয়ে নিয়েছিলেন, খুড়শ্বশুর বাজার করার ছুতোয় বেরিয়ে গেছেন, তাঁরও সঙ্গে দেখা হয়নি। শুধু খুড়তুত ছোট ননদ মিলি ঘটনা-পরম্পরার আকস্মিকতায় হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল। বন্দনা দোতলা থেকে একতলায় নামছে, সিঁড়ির মুখে মিলি কাঁদতে কাঁদতে তার আঁচল চেপে ধরেছিল।—‘বউমণি তুমি যেও না, তুমি আর খোকামণি চলে গেলে আমি কি করে থাকব। কে আমার বোনা দেখিয়ে দেবে!’ বন্দনা ফিসফিস করে বলেছিল—‘কলেজ-ফেরত যাস না আমার কাছে, ঠিকানা তো জানিস!’
শ্রাবণের আকাশ সজল, গম্ভীর কিন্তু ক্ষান্তবর্ষণ। এতটুকু হাওয়া নেই। পথের পাশে পাশে অ্যাসফাল্টের যেখানে একটু ফাটল পেয়েছে গজিয়ে উঠেছে ঘাস, ঘাসফুল। গাছগুলোর পাতা চিকন সবুজ, বৃষ্টির জলে নেয়ে ধুয়ে পরিষ্কার হয়ে উঠেছে। সেদিকে তাকালেই সানাইয়ে পূরবীর আলাপ শুনতে পাওয়া যায়। লাল বেনারসী, দুহাতে শাঁখা, বালা, হাতভর্তি সোনার চুড়ি। পথে যে এখনও জল জমে আছে। কালকের বৃষ্টির বাসি জল। তার মধ্যে অনেকদিন আগেকার কোন বধূর ছায়া পড়েছে। মাথায় মৃতমায়ের সোনার সিঁথিপাটি, দুধে-আলতা ভরা পাথরের থালা, আলপনা, হাতের মধ্যে ছটফটে মাছ। উৎসুক মুখগুলো ওড়না ফাঁক করে দেখছে, খুড়শাশুড়ি বললেন—‘ঘর-আলো-করা বউ হয়েছে দিদি। বরণ আরম্ভ করো, দুধ তো উথলে গেল বলে।’ হাসি-ভরা গলার আওয়াজ। দুধে-আলতায় পা ডুবিয়ে পা দু-টি গোলাপি। ভট্চায্যি বাড়ির প্রথম বউ, কৃতী ছেলের জন্যে অনেক খুঁজে পেতে সংগ্রহ করে আনা রূপসী বধূর বধূবরণ হচ্ছে।
অধ্যায় ১১
অষ্টমঙ্গলায় বাড়ি ফিরে কলি শুনল বউমণি কাকার কাছে গেছে। খোকা নেই, বউমণি নেই। বাড়িটা কিরকম খালি-খালি লাগছে। শ্রীহীন। এ ক’দিনের মধ্যেই শ্বশুরবাড়িতে বেশ মানিয়ে নিয়েছে কলি। খুব আমুদে বাড়ি। তাদের বাড়ির মতো গুমোরও নেই। গুমোটও নেই। চার ভাইয়ের পরিবার। সে বড় বউ। শাশুড়ি-শ্বশুর কেউ নেই। আছেন এক অবিবাহিত জাঠশ্বশুর। তিনি দিলদার লোক। ভাইপোদের সঙ্গে একত্রে বসে আড্ডা দ্যান। নিজেদের বাড়িতে মাথার ওপর সব সময়ে একটা চাপ টের পেতো। এটা বলতে নেই, সেটা করতে নেই। ওটা করতেই হবে। এ বাড়িতে ও সবের বালাই-ই নেই।
বিয়ের প্রথম তিনদিন কাটতেই জাঠশ্বশুর সবাইকে সামনে রেখে বললেন—‘দ্যাখো বাপু। আমরা পাঁচটি ছোকরা শাসনের অভাবে একেবারে বখে যাচ্ছি। দু-দিন পর আর কেউ আমাদের বাড়ি পদার্পণ করবে না। কাজে কাজেই আমাদের ইহকাল-পরকালের ভার নেবার জন্যে তোমাকে কষ্ট করে আনা। তুমি নতুন বউটি হয়ে থাকলে আমাদের একদম চলবে না।’
সবচেয়ে ছোট ছোকরাটি চোদ্দ বছরের, টেবিল চাপড়ে বলল—‘হিয়ার, হিয়ার। জেঠু আমরা কি বউদিকে শাসনকার্যে সহায়তা করতে পারি?’
—‘তুই আবার কি সহায়তা করবি রে ব্যাটা।’
—‘বউদি, সবচেয়ে বড় ছোকরাটি নানারকমের নেশা করেন, সিগারেট খান এনতার, সিগারেট লুকোলে সিগার, সিগার লুকোলে নস্যি, নস্যি লোপাট করে দিলে, দোকান থেকে জর্দা পান খেয়ে আসেন, এঁর কিঞ্চিৎ লাঠৌষধির দরকার হয়ে পড়েছে। দ্যাখো তুমি তোমার শাসনদণ্ড ব্যবহার করবে কি না!’
কলি ভীষণ অপ্রস্তুত। কিন্তু জেঠু একটুও টসকালেন না। বললেন—‘আরে বউমা, তোমাকে এখন অনেক কাজ করতে হবে। তুমিও মা একটা নেশা না হলে এতে পেরে উঠবে না, জর্দা পান ধরো, মুস্কিপাতি জর্দা। একটু একটু করে ডোজটা বাড়াবে।’ সবাই হই-হই করে উঠতে জেঠু হাসতে হাসতে চলে গেলেন, মুখ ফিরিয়ে বলে গেলেন—‘আর আমার পেছনে লাগবি তোরা? সর্ষেতে ভূত ধরিয়ে দোব।’ কলির বর সঞ্জয়ও খুব রসিক মানুষ। ফাজিলই বলা চলে। কাউকে দু-মিনিটগম্ভীর থাকতে দেয় না। বাসি-বিয়ের দিন কলি গম্ভীর হয়ে ছিল, মন খারাপ স্বভাবতই। সঞ্জয় তার পরের ভাইকে বললে বিজু, এই বিজু চট করে পান্তুয়া নিয়ে আয় তো ক’টা। ভাই সঙ্গে সঙ্গে আদেশ পালন করল। সঞ্জয় পান্তুয়াগুলো কলির মুখের পাশে ধরে, ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখে, আর মাথা নেড়ে ‘উঁহু’ বলে রেখে দেয়। ঘরশুদ্ধ লোক হাসছে। জিজ্ঞেস করছে, ‘কি হল?’ ‘কি দেখছিস রে সঞ্জয়?’ ‘কি করবি রে দাদা?’ সঞ্জয় বলল, ‘দেখছি কোনটা বেশি গোল, নতুন বউমার চোখ, না ভানু ঠাকুরের পান্তুয়া।’ কলি হেসে ফেলতেই তার মুখের মধ্যে একটা পান্তুয়া গুঁজে দেওয়া হল। পেছন থেকে কে একজন হাত দুটো ধরে রেখেছে। কলিকে পান্তুয়া গলাধঃকরণ করতেই হল। সঞ্জয় বলল, ‘দেয়ার য়ু আর। আমাদের বাড়িতে কাউকে মুখ গোমড়া করে থাকতে দেওয়া হয় না। মুখ গোমড়া করলেই পান্তুয়া খেতে হয়।’
এতো তাড়াতাড়ি, নতুন জামাইয়ের সঙ্গে আলাপ-সালাপ না করেই বউমণি কাকার কাছে চলে গেছে শুনে কলির একটু অভিমান হল। বাড়িতে আর সবাই তো বুড়োবুড়ি। মিলি, ছোড়দা আর বউমণি। মেজদা তো কর্মস্থল থেকে ছুটিই পেল না। বউমণির ঘরেই কলিদের থাকবার ব্যবস্থা হয়েছে। কলির মনে হল ঘরটা দরকার হবে বলেই কি বউমণি চলে গেল? কেন আর কি ঘর ছিল না? এতো বড় বাড়ি তাদের!
মিলিটাকে একা পাওয়াই যাচ্ছে না। জামাইবাবুর সঙ্গে আঠার মতো সেঁটে আছে। জামাইবাবুটিও তেমনি। কথায় কথায় ছ্যাবলামির ফোয়ারা। একবার সামনে দিয়ে যেতে-যেতে শুনতে পেল মিলিকে অফার দেওয়া হচ্ছে—‘আরে বাবা, আমার একলারই তো বিয়ে হয়ে গেছে? আমার তো আরও তিনটে ভাই রয়েছে। যাকে ইচ্ছে তুমি গলায় মালা দাও। ব্যাস দিদির কাছেও থাকতে পাবে, জামাইবাবু মানে সঞ্জয়দার কাছেও থাকতে পাবে।’
সঞ্জয়ের পরের ভাই বিজু এবার মিলির সঙ্গেই বি এস সি দিয়েছে। তার পরের জন সবে মেডিক্যাল কলেজে ঢুকেছে, ছোট জন তো ক্লাস নাইনে পড়ে। যদিও এঁচড়ে পক্ব।
মিলি বলছে— ‘ইঃ, আপনার সব তো-পুঁচকে পুঁচকে ভাই! তাদের বিয়ে করতে হবে আমায়? কেন, আমায় বিয়ে পাগলা ঠাউরেছেন না কি?’
—‘না, না, সে কথা না, আমাকে তোমার খুব পছন্দ হয়েছে কি না, তাই বলছিলুম। আমার প্রোটোটাইপ কিন্তু আর ভূভারতে খুঁজে পাবে না।’
কলি ঘরে ঢুকে বলল—‘এই মিলি। গাছে জল দিয়েছিস?’
—‘এমা একদম ভুলে গেছি।’ মিলি উঠে পড়ল। ছাদের গাছগুলো দুই বোনেরই সমান প্রিয়।
কলি বলল—‘দ্যাখ, মনে হচ্ছে কতদিন তোতে-আমাতে গাছে জল দিইনি। এ ক’দিন দিয়েছিলি তো?’
—‘হ্যাঁ’ মিলি বলল, ‘ওতে আমার ভুল হয় না। তোর ফুলশয্যের দিন তত্ত্ব সাজাতে সাজাতে হাত ভেরে গেছিল, তা-ও দিয়েছি ঠিক।’
কলি বলল—‘হ্যাঁ রে, আমাদের পড়ার ঘরটাতে কিম্বা ছোড়দা-মেজদার ঘরটাতে বুঝি থাকবার ব্যবস্থা করা যেত না!’
—‘কার থাকা?’
—‘এই আমাদের!’
—‘যাঃ। ও ঘরে আবার নতুন জামাইকে থাকতে দেওয়া যায় না কি? তক্তাপোশ গায়ে ফুটবে না?’
—‘তো তাই বুঝি বউমণি কাকার কাছে চলে গেল? বউমণি শেষ কবে বাপের বাড়ি গেছে ভুলেই গেছি। এমনি যাক, যাক। এই কারণে যেতে হলে আমার খুব খারাপ লাগবে।’
—‘তোকে বলেছে!’ মিলি ঠোঁট উল্টোল, ‘কে তোকে বললে নতুন জামাই থাকবে বলে বউমণি বাপের বাড়ি গেছে। তাই জন্যে না আরও কিছু! জ্যাঠামশাই তো বউমণিকে তাড়িয়ে দিয়েছে।’
—‘তাড়িয়ে দিয়েছে মানে?’ কলি ভীষণ অবাক হয়ে বলল।
—‘বউমণিকে, বউমণির কাকাকে। কাকা এসেছিলেন। রাত্তিরে খেতে বসে সেকি ঝগড়া! যদি শুনতিস। আমি শুয়ে পড়েছিলুম। উঠে বসে ঠকঠক করে কাঁপছি। বউমণির শরীর খারাপ হয়ে গেছে, ভালো করে খাওয়া-দাওয়া করে না এই নিয়ে কি বলেছিলেন, বাস আর যায় কোথায়!’
—‘বউমণির শরীর খারাপ হয়ে গেছে, খায় না এতো সত্যি কথা!’
—‘জানি না বাবা, সব খেপে লাল। জেঠিমা বললে অলক্ষণ, জ্যাঠামশাই বললে যত তাড়াতাড়ি যায় তত ভালো।’
—‘বলিস কি রে? কলির চোখ বড় বড় হয়ে উঠেছে, নিঃশ্বাস ঘন, ‘তুই কিছু বললি না?’
মিলি অবাক হয়ে তাকিয়ে বলল—‘আমি? আমি কি বলব?’
মাত্র সাতদিন বিয়ে হয়েই কলি যেন অনেক বড়, অনেক পরিণত, আত্মবিশ্বাসে ভরপুর হয়ে উঠেছে। বলল—‘তুই না হয় চিরকালের খুকুমণি। ছোড়দা? ছোড়দা কোথায় ছিল?’
—‘ছোড়দা? তবেই হয়েছে? আমি যদি খুকুমণি হই তবে ছোড়দাটা কি রে? নবজাত শিশু? গোলমাল শুনে নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে এসে বলল—‘এই মিলি মিলি, এতো গোলমাল কিসের রে?’ আমি বললুম—‘কি জানি বউমণিকে নিয়ে কি সব হচ্ছে।’ ছোড়দাটা কি বলল জানিস? বলল —‘বুড়োগুলো জ্বালালে। আমি ছাদে যাচ্ছি। গোলমাল থেমে গেলে, কোস্ট ক্লিয়ার দেখলে সাইরেন বাজাবি, আমি নেমে আসব।’ পরদিন বউমণি যখন ন’টা নাগাদ চলে যাচ্ছে, তার আগেই ছোড়দা না-খেয়ে-টেয়ে অফিসে তাড়া আছে বলে পগার পার।’
—‘এ বাড়ির কেউ মানুষ হল না। বড়দাই একমাত্র ছিল, যাকে ভক্তি শ্রদ্ধা করা যায়।’
—‘আর সব মেনিমুখো, না রে?’ মিলি উৎসাহের সঙ্গে বলল।
কলির মনের মধ্যে ব্যথা আর রাগ প্রতিযোগিতা করে বাড়ছে। সে মিলির কথার জবাব দিল না। তরতর করে নেমে এল। মিলি ব্যস্ত হয়ে পেছন পেছন নামতে নামতে বলল—‘এই দিদি। কাউকে বলিসনি আমি বলেছি, প্লীজ, মা আমাকে মেরে ফেলবে।’
কলি একেবারেই দাঁড়াল না। নিচে নেমে এসে রান্নাঘরে মাকে পেয়ে গেল। জামাই খাবে, মা ঘি-ভাত চাপিয়েছে, ডেকচির ঢাকনির ওপর জ্বলন্ত কয়লা সাজাচ্ছে। কাকিমাকে দেখতে পাওয়া গেল না। কলি বিনা ভূমিকায় বলল—‘মা এসব কি শুনছি?’
—‘কি শুনছিস?’
—‘বউমণিকে নাকি তোমরা তাড়িয়ে দিয়েছ?’
—‘কে বললে?’ আঁচলের চাবির গোছা সশব্দে কাঁধে ফেলে ঘুরে দাঁড়ালেন কলির মা।
—‘যেই বলুক, কথাটা তো সত্যি!’
—‘আমরা তাড়িয়েছি। না সে নিজে তেজ করে গেছে! মটমটে তেজ! কোথায় ছিল অত তেজ। অত আদিখ্যেতার কাকা! মরণকালে তো একবার দেখতেও আসেনি। এল, চ্যাটাং চ্যাটাং বাক্যি শোনাল, বাস অমনি তিনি ধিন ধিন করে নেচে উঠলেন। ভাঙবে, ওই তেজ ভেঙে সে আবার ফিরে আসবে। দাদাভাইটার জন্যে আমার’… গলা ধরে এল শেষের দিকে।
কলি কঠোর গলায় বলল—‘মা সেজদাকে তোমরা তাড়িয়ে দিয়েছিলে সে কি ফিরেছে? বউমণিকেও তাড়ালে? সে-ও ফিরবে না। খোকাও ফিরবে না। তোমাদের এই মহাপবিত্র বাড়িতে শেষ পর্যন্ত তোমরা চার বুড়োবুড়ি ছাড়া কেউই থাকবে না। খোকামণিকে তোমরা ফিরিয়ে আনার চেষ্টাও করো না। এই আবহাওয়ায় সে মরে যাবে।’
কলির মায়ের কানে তার র্ভৎসনার প্রথম অংশটা লেগে ছিল।
তিনি বললেন—‘সেজদার কথা উঠল কিসে?’
—‘কিসে আর? নিজের ছেলেকে তাড়াচ্ছ, বউকে তাড়াচ্ছ, যে তোমাদের তালে তাল মেলাতে একটু এদিক ওদিক করছে তাকেই তাড়াচ্ছ!’
—‘তালে তাল মেলালে ক্ষেতিটা কি শুনি? আমরা তো বয়সেও বড়, দেখলুম না জীবনে কম। আমাদের কথা শুনলে মন্দটা কি হয়? তোর কিছু মন্দ হয়েছে?’
—‘হয়নি। হতে কতক্ষণ! সংস্কারই যদি মানো তো এটুকু তো মানবে আমার বিয়ের সাতদিনের মধ্যে বাড়ির বউ, একমাত্র বাচ্চা এ বাড়ি থেকে বিদায় নিতে বাধ্য হয়েছে! এতে আমার ভালো হবে মনে করো?’
কাকিমা এসে দাঁড়িয়েছেন। সংসারের গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে কলি তার মায়ের সঙ্গে রাগারাগি করছে। এটা সম্পূর্ণ নতুন। কিন্তু যতটা নতুন, কাকিমার চোখে ততটা লাগল না। মাথায় একমাথা সিঁদুর পরে, হাতে শাঁখা, সোনাবাঁধানো লোহা, একগা গয়না, কলি যেন ক’দিনেই অনেক বড় হয়ে গেছে। অনেক অধিকার অর্জন করে ফেলেছে। কাকিমা আস্তে আস্তে বললেন—‘কথাটা কিন্তু কলি ঠিকই বলেছে দিদি।’
কলির মা বললেন—‘সে যদি তেজ করে চলে যায়, তার কাকার উশকুনিতে তো আমি কি করব?’
—‘সে তো তেজ করে যায়নি দিদি। তা যদি বলো, তেজ সে বেচারী কোনদিনই দেখায়নি। বটঠাকুর এমন করে বললেন যে তারপর আর বেয়াইয়ের ওকে এখানে রাখা চলে না, মানুষের একটা মান-অপমানও তো আছে। আর যাই বলো দিদি! বউটা কি রোগা হয়ে গেছে! বাড়ি থেকে এক কাপড়ে বেরিয়ে গেল। আমার ভালো লাগেনিকো।’
কাকিমা চোখে আঁচল দিলেন।
কলির মা বললেন—‘কর্তার যা গোঁ! কথায় কথায় মানের কণা খসে যায়। যত গালাগাল তো উনিই করলেন। ছি, ছি, একশ-বার ছি!’
কলি বলল—‘বুঝছো যদি তো বউমণিকে ফিরিয়ে আনবার ব্যবস্থা করো মা। তোমরা নিজেরা যাও। গিয়ে বলো।’
—‘ওরে বাবা। সে কথা কর্তাকে কে বলবে? হুলো বেড়ালের গলায় ঘন্টা বাঁধা! সে আমার দ্বারা হবে না।’
কলি বলল—‘ঠিক আছে। তোমরা না বলো তো আমি বলব। ইয়ার্কি নাকি? বাবা কি চিরকাল যা ইচ্ছে তাই করবেন না কি? বউমণির এটা নিজের বাড়ি না? কাকিমা তুমিই বা কি? কাকাও তো ছিলেন? কেউ একটা কথা বলতে পারলে না?’
কাকিমা বললেন—‘চিরকাল চোখ নিচু করে, মুখ নিচু করে থেকেছি মা। বটঠাকুরকে দেব্তার মতো মান্যি করেছি, দিদিকেও। দিদি সে কথা জানে। মুখের ওপর কথা বলবার অভ্যাস নেই মা, থাকলে কি আর এতো বড় অন্যায়টা চোখের ওপর দিয়ে হতে পারত!’
শ্বশুরবাড়ি ফিরে যাবার আগের মুহূর্তে বাবার সঙ্গে কলির তীব্র বচসা হয়ে গেল। কলি শুধু বউমণিকে ফিরিয়ে আনবার কথাই বলেনি। সেজদাদের খোঁজখবর করার কথাও বলেছিল। বিবাহিত না হলে বাবা বোধহয় তাকে তুলে আছাড় দিতেন। ধমক দিলেন প্রচণ্ড। কলি বলল—‘আমি উচিত কথা বলবোই। তোমার নিজের যাওয়া উচিত বউমণিকে ফিরিয়ে আনতে।’
উচিত কথা মেয়ে তাঁকে শেখাচ্ছে বলে কাশীনাথবাবু এমন চিৎকার করলেন যে নতুন জামাই ছুটে এল। বাড়ি ফিরতে ফিরতে বলল—‘বাপরে এমন জাঁদরেল বাড়ির জাঁহাবেজে মেয়েকে বিয়ে করেছি আগে বুঝতে পারিনি তো!’
কলির চোখমুখ থমথম করছিল, বলল—‘আস্তে আস্তে বুঝবে।’
অধ্যায় ১২
সোমনাথবাবু বললেন—‘বুড়ি একটাই মুশকিল মা। আমার পেনশন আর ডিভিডেন্ডের টাকায় আমার একারটা রাজার হালে চলে যেত। দাদার জমা টাকাও বেশ কিছু ছিল। কিন্তু আমি যে ছাই ভ্রমণ করে করে তার অনেকটাই খরচ করে ফেলেছি। সে টাকা তো আসলে তোরই। দাদারও সে জ্ঞান হয়নি, আমারও না।’
বন্দনা রাগ করে বলল—‘তা, বাবার টাকাকড়ি, যা নাকি আসলে আমার, সে সব খরচ করে ফেলেছো বলে কি আর আমাকে খাওয়াবে না? নিজের ব্যবস্থা নিজে করে নিতে বলছ, না কি বলো তো!’
এতোটা তরল ভঙ্গিতে কথা বলা অনেক দিন বন্দনার অভ্যাস নেই। কিন্তু নন্দন রোডের এই দোতলা সবুজ রঙের বাড়িটার মধ্যে ঢুকে হঠাৎ তার শরীর মনের ওপর থেকে একটা ঘেরাটোপের মতো বিষণ্ণতার আবরণটা খসে পড়েছে। ছেলেকে বলছে—‘দ্যাখ রূপু, এই উঠোনটা আমার সুইমিংপুল হতো ছোটবেলায়। মুষলধারে বৃষ্টি পড়লে নর্দমাটা বন্ধ করে দিতুম। দাওয়া অবধি জল উঠে যেত, তার ভেতর সাঁতার কাটতুম। কাকাও নামত, জানিস তো?’
রূপ বলল—‘আমিও করব মা, আমিও করব। তখন কিন্তু বারণ করতে পারবে না।’
ছাদের লোহার ঘোরানো সিঁড়ি বেয়ে অন্তত পাঁচ বার ওঠা-নামা করা হয়ে গেল ছেলের। দু-তিনটে ধাপ দৌড়ে ওঠে। আর ফাঁক দিয়ে হাসি-হাসি মুখ বার করে নিচে তাকায়, সেই মুখে বন্দনা তার নিজের ছেলেবেলার মুখখানা অবিকল দেখতে পায়। ছাদের ওপর সে স্কিপিং করত, পাড়ার বন্ধুদের সঙ্গে চু-কিত-কিত খেলত। কিংবা নাম-পাতাপাতি, কিংবা বুড়ি-বাসন্তী। খেলার নাম শুনে রূপ হেসেই অস্থির। দোতলার দালানে এক কোণে দেয়াল-আলমারি, তাতে মায়ের তোলা বাসন থাকত। তার তলায় দু-ফুট মতো ফাঁক। সেই জায়গাটুকুতে ছিল তার পুতুলের সংসার। মা একটা পর্দা করে দিয়েছিল। পর্দাটা দু পাশে সরিয়ে দিলেই তার পুতুলের সংসার বেরিয়ে পড়ত। বেনে পুতুল, মুড়কি পুতুল, কাচের পুতুল, কাচকড়ার পুতুল এবং সবচেয়ে দামী, সবচেয়ে আদরের আলুর পুতুল। তাকে রোজ ফ্রক পাল্টে, দুধ খাইয়ে তবে তার নিজের খাওয়া-দাওয়া আরম্ভ হত। সে কথা বলতে কাকা বললেন, ‘তোর সেই আলুর পুতুল কিন্তু আলমারিতে এখনও তোলা আছে বুড়ি। তুই তাকে শেষ যে ফ্রকটা পরিয়েছিলি, সেটা পরে। এখন যদি ছেলেকে দিতে চাস তো দিতে পারিস!’
রূপ বলল—‘ধ্যাৎ। আমি কি মেয়ে যে পুতুল নিয়ে খেলব! মেয়েগুলো বোকা তাই আলু-পটলের পুতুল নিয়ে খেলে।’
বন্দনা হেসে ফেলল—‘আলু-পটলের আলু নয় রে, প্লাস্টিকেরই পুতুল, আমাদের ছোটতে তাকে আলুর পুতুল কেন বলতো জানি না।’
সোমনাথবাবু খাতা-কলমে কিসব অঙ্ক কষে বললেন—‘তিনজনের চলে যাবে ঠিকই। কিন্তু একটু কষ্ট করতে হবে। একটু হিসেব করে চলতে হবে—এই আর কি!’
বন্দনা বলল—‘বারে, হিসেব করে চলা বুঝি আমার অভ্যেস নেই? আমার বিয়ের আগেকার কথা ভাবো তো! কে করত হিসেব?’
সোমনাথ বললেন—‘আমাতে আর তোতে। ঠিকই। কিন্তু সে তো হিসেবে চলত না রে, বেহিসেবে চলত। যা ইচ্ছে, যা দরকার, দাও খরচ করে দাও। নেহাৎ খরচা করার নানান উপায় আমাদের খুড়ো-ভাইঝির জানা ছিল না তাই। কিন্তু তোর ছেলে তো বড়মানুষের ছেলে, আজকালকার ছেলেও বটে।’
—‘ওকে মাথায় চড়িয়ে আর আমার সর্বনাশ করো না’, —বন্দনা বলল আমাদের যেমনি আয়, আমরা তেমনিই চলব। ওকে অযথা আদর, প্রশ্রয় একদম নয়। আর তুমি অত ভাবছোই বা কেন? আমার হাজার পঁচিশেক টাকা ফিক্সড আছে।’
সোমনাথ বললেন—‘ওতে তুই হাত দিসনি। ওটা থাকুক। পরে কত খরচ আছে।’
—‘লোকজন রেখ না। কাজকর্ম আমি একাই করে নেব।’ বন্দনা পরামর্শ দিল।
—‘তুই কি পারবি? যা ভূতের মতো চেহারা হয়েছে।’
—‘না কাকা, আমাকেও কিন্তু অযথা আদর দেবে না। কাজ করতে পেলে আমি বেঁচে যাব। তিনটে মানুষের তো কাজ!’
অবশেষে, অনেক বাগবিতণ্ডার পর ঠিক হল বাসন মাজা এবং ঘর-পরিষ্কারের জন্য একজন লোক থাকবে। কিন্তু বাকি সব, অর্থাৎ রান্না এবং তার আনুষঙ্গিক ও কাপড়-কাচা বন্দনা নিজেই করবে।
কার্যকালে অবশ্য দেখা গেল, কাজের লোকটির চেয়ে অনেক বেশি কাজের সোমনাথবাবু নিজে। নিজের গুলো তো বটেই, রূপের জামাকাপড়, বিছানার চাদর, বালিশের ওয়াড় ইত্যাদি খুব নিপুণভাবে কেচে ফেলে তিনি চোরের মতো কলঘর থেকে বেরোচ্ছেন এবং বন্দনার হাতে ধরা পড়ে যাচ্ছেন। বন্দনা ঝঙ্কার দিচ্ছে—‘আচ্ছা কাকা, তুমি কি বলো তো? বিছানার চাদর কি কেউ রোজ রোজ কাচে? কালই তো আছড়ে আছড়ে কাচলে।’
সোমনাথবাবু অপরাধীর মতো মুখ করে বলছেন—‘আজকে তোদেরটা কেচে দিলুম।’
—‘বাঃ। তাহলে আমি কাচব কি? রূপুর গুলোও তো তুমিই কেচে দিলে।’
—‘আরে, কত কাচার আছে, ধর, তোর ওই বালিশের ওয়াড় গুলো, তার ঢাকা…।’
এবার বন্দনা হেসে ফেলে। কাকা করুণ চোখে তার দিকে চেয়ে বলেন—‘তুই আগে বেঁচে ওঠ মা, তারপরে করতে চাইলে অনেক কাজ পাবি।’
ভোরবেলা চা করে তিনি বন্দনাকে ডাকেন। ততক্ষণে তাঁর আনাজপাতি কাটাও সারা। বঁটি দিয়ে পারেন না, টেবিলের ওপর ছুরি দিয়ে সব ফালা-ফালা করে কেটে রেখেছেন।
প্রথম যেদিন ভোরবেলায় চা খেতে ডাকলেন কাকা, তখন পাখিরা সবে তাদের আধো-আধো বুলি কপচানো সেরে ব্যস্ততার সুর ধরতে আরম্ভ করেছে। জানলা দিয়ে সরু ফিতের মতো আবছা আলো এসে পড়েছে, একটু পরেই সেটা রোদ হয়ে উঠবে। —‘বুড়ি বুড়ি, চা হয়ে গেছে রে, ওঠ।’ যেন বহুযুগের ওপার থেকে ভেসে আসে এই ডাক।
ঘরের বাইরের দালানেই খাবার ব্যবস্থা। আগে রান্নাঘর, খাবার ঘর, বৈঠকখানা সব নিচে ছিল। সোমনাথবাবু সে সব ব্যবস্থা ওপরে তুলে এনেছেন। ইচ্ছে আছে, নিচেটা ভাড়া দিয়ে দেবেন। বড় চৌকো দালান, তারই একধারে পার্টিশন করে নিয়ে রান্নার ব্যবস্থা। অন্য দিকটাতে টেবিল পাতা; সেই সাবেকি গোল টেবিল, যাতে একসময়ে বন্দনা তার বাবা-কাকার সঙ্গে খেতে বসত।
বন্দনা বিছানা ছাড়তে-ছাড়তে বলল—‘ওকি! আমায় ডাকলে না! এত ভোরে চা-ই বা কেন?’
—‘ভুলে গেছিস? ভুলে মেরে দিয়েছিস সব? আমরা তিনজনে এমনি ভোরে চা খেতুম না বুঝি? শিগ্গিরি আয়। জুড়িয়ে যাবে।’ কাকা নিজের পুরনো র্যাপার ভাঁজ করে চায়ের পট ঢেকে রাখেন।
—‘দাঁড়াও আগে দাঁত মাজি, কাপড় ছাড়ি।’
—‘এ হে হে হে, তুই যে দেখছি সাত গিন্নির এক গিন্নি বড়াইবুড়ি হয়ে উঠেছিস! এ যে বাসি মুখে বাসি কাপড়ে খাবারই চা রে!’
—‘না বাবা, আমার অভ্যেস নেই।’
—‘শোন বুড়ি, মুখটা ধুয়ে আয়। কাপড়-টাপড় ছাড়তে যাসনি। আগে চা, তারপর অন্য সব। চা জুড়িয়ে যাবার মতো প্যাথেটিক ব্যাপার আর হয় না।’
অগত্যা বন্দনা বেডটির অভ্যাস ঝালিয়ে নেয়। প্রথম প্রথম শ্বশুর বাড়িতে খুব অসুবিধে হত। সকালে জলখাবারের সময়ে দুধ খেতে হত। বাবাকে শাশুড়ি জিজ্ঞেস করে নিয়েছিলেন—‘বেয়াই মশাই, আপনার মেয়ের খাওয়া-দাওয়ার অভ্যেস কি?’
বাবা কিছুই বলতে চান না।—‘যা দেবেন তাই খাবে, ওর কোনও ন্যাটা নেই।’
—‘তবু!’
তখনই বাবা বলেছিলেন—‘মেয়েটি আমার বেড়াল। মাছ আর দুধ ছাড়া চলে না। বাস আর কিছু চাই না।’ সকালে এক কাপ দুধ খাওয়া। কিন্তু ভোরবেলা উঠে যে তার আগেই একবার চা খাওয়া হয়ে যেত, সেটা আর বাবা ভেঙে বলেননি। বললেও অবশ্য বিশেষ কাজ হত না। কারণ এ বাড়িতে, সকালবেলায় শুদ্ধ হয়ে স্নান-টান করে তবে খাবার নিয়ম।
ভোরবেলা ঘুম ভেঙে প্রাণটা চা-চা করত। অভিমন্যু অঘোরে ঘুমোচ্ছ। তাদের বাড়িতে প্রতিষ্ঠিত ঠাকুর রয়েছেন। ঠাকুমা এই সেদিন পর্যন্ত বেঁচে ছিলেন। তাঁর বেঁধে দেওয়া নিয়ম পালন করেই তারা বড় হয়েছে। বিদেশে বেড়াতে গিয়ে ভোরবেলা বেয়ারা চা নিয়ে ডাকাডাকি করলে অভিমন্যু ভীষণ বিরক্ত হত—‘এঃ, দিলে ঘুমটা মাটি করে।’ বন্দনা কিন্তু ভাবত বাড়িতে না হোক ঘরের মধ্যে যদি চালু করা যায় জিনিসটা। কিন্তু মানিয়ে নেওয়ার অভ্যাস আবার সব অভ্যাসের ওপরে যায়! কবে ভোরের গলা-শুকোনো বন্ধ হয়ে গেছে। বাসি কাপড় না ছেড়ে, স্নান না করে কিছু খাবার চিন্তাও অশুচি মনে হতে আরম্ভ করেছে, সে নিজেই জানে না। সে স্নান করে আসার পর অভিমন্যু বিছানা ছাড়বে, বিশেষত ছুটির দিনে, তখন কত রকম আহ্লাদিপনা, ঢং করবে গায়ে পড়ে। বন্দনা তাড়াতাড়ি দূরে সরে গিয়ে বলত—‘ইস্ দিলে তো ছুঁয়ে! যাই, বদলে আসি কাপড়টা!’
—‘কাছাখোলা বাড়ির মেয়ে। তোমার আবার কবে থেকে এতো ছুঁৎমার্গ হল গো!’
—‘হয়েছে, হানতি পারোনি।’ বন্দনা উত্তর দিত।
এখন আবার সেই অভ্যাসকে জোর করে পাল্টে ফেলা। কাকা তাকে তার কুমারী-জীবনের ছন্দে নিয়ে আসবেনই। নইলে নিজের জীবনটার ছন্দও বোধহয় মেলে না। বেসুরো, বেতালা হয়ে যায়।
রান্নাঘরে গিয়ে বন্দনা দেখল, টেবিল-ময় কুচি-কুচি আলু। কুচি-কুচি লাউ; ফালা-ফালা পেঁয়াজ।
—‘একি! ও কাকা! এগুলো কি হবে গো?’
কাকা মাথা চুলকে বলেন—‘কেনরে আলু রাঁধবি, পেঁয়াজ রাধবি, লাউ রাঁধবি। মাছ সব কাটিয়ে কুটিয়ে এনেছি।’
বন্দনা বলল—‘আলু যে রাঁধব সে তো হাড়ে-হাড়ে টের পাচ্ছি, লাউও রাঁধব। কিন্তু কি রাঁধব? তোমার প্ল্যানটা কি?’
—‘প্ল্যান আবার কি? রান্নাও আবার একটা কাজ। তারও আবার প্ল্যান? দেনা সব কিছু নুন চিনি আদা হলুদ দিয়ে চড়িয়ে, দেখবি দিব্যি একটা যা-হোক কিছু হয়ে যাবে।’ সোমনাথবাবু একটু কাঁচুমাচু হয়ে বলেন।
বন্দনা বলল—‘তোমাকে আর আমায় এতো সাহায্য করতে হবে না। আর কত কেটেছো বলো তো! আমরা মানুষ আড়াইটে সে খেয়াল আছে? নাকি আমি রাক্ষসী-টসী হয়ে এসেছি বলে তোমার ধারণা।’
রূপ তার আগের স্কুলেই যাচ্ছে। প্রচণ্ড খরচ স্কুলের, স্কুল বাসও আছে। সোমনাথবাবু তার জন্যে আলাদা খেলার ঘর করে দিয়েছেন। সে ওই ঘরে সমবয়সী ছেলে-মেয়ে জুটিয়ে বিজলি-চালিত এরোপ্লেন, কাঠের দোতলা বাঘ-আঁকা বাস, রবারের সেপাই-বাহিনী। ব্যাগাটেলি ইত্যাদি নিয়ে মহা-আনন্দে সময় কাটায়। বিকেলবেলা মাঠে যায় হাতে ক্রিকেট ব্যাট, ক্যাম্বিসের বল, উইকেট নিয়ে। ও বাড়িতে নজরদারি ছিল খুব বেশি, বাড়িতে অন্য কোনও বাচ্চা সহসা ঢুকতে পেত না। রূপ ছিল সঙ্গীহীন। পার্কে গেলেও মন খুলে খেলাধুলো করার বা সমবয়সীদের সঙ্গে মেলামেশা করবার সুযোগ পেত না। এখানে শুধু বন্ধুবান্ধবই নয়। খেলার মাঠে তাকে ছেড়ে দিয়ে সোমনাথবাবু কাছাকাছি বেঞ্চে বসে থাকেন। অনেক সময়ে ঘুরে বেড়ান। রূপের সেই প্রচণ্ড মা-মা বাতিক কমতে আরম্ভ করেছে। সকালবেলা তাড়াতাড়ি চান-টান সেরে মাকে গম্ভীর চালে বলে—‘দেখো আবার বেশি দেরি করিয়ে দিও না, যা হয়েছে তাই দিয়ে দাও।’ তারপর কাকার হাত ধরে বড় রাস্তায় স্কুলবাস ধরতে যায়। কিছুতেই সোমনাথবাবুকে সে দাদু বলবে না। দাদু তো শ্যামবাজারে থাকে। ছোড়দাদুও তো শ্যামবাজারে থাকে। এটা কাকা। মায়েরও কাকা, ছেলেরও কাকা। বন্দনা বলেছিল—‘কেন শ্যামবাজারের বাড়িতে তোর কাকা নেই বুঝি? আমার কাকাকে কেন কাকা বলবি রে?’
রূপ মায়ের অজ্ঞতায় অবাক হয়ে যায়—‘সে তো কাকু! মেজকাকু, ছোটকাকু! কাকা কোথায়?’
—‘ঠিক আছে বাবা, যা প্রাণ চায় বল। তুই খুশি থাকলেই হল।’
প্রথমটা ভাবা গিয়েছিল, দাদু-দিদার জন্য রূপ খুবই কান্নাকাটি করবে। কিন্তু দেখা গেল বাচ্চারা খুব স্বার্থপর। নিজের খেলাধুলো, খাওয়া-দাওয়া, বন্ধুবান্ধব এবং মায়ের কোলটি ঠিক থাকলে আর বাদ বাকি সব কিছুই তারা চট করে ভুলে যেতে পারে। এক দাদু স্কুল বাসে তুলে দিতে, নামিয়ে আনতে যেতেন। এখন যাচ্ছেন আরেক জন। রূপের তাতে কিছু এসে যায় না। স্কুল থেকে ফিরে জলখাবার খেতে-খেতে সে মহাউৎসাহে বন্ধু আর টিচারদের গল্প করে। ক্লাসে কিরকম ডিগডিগে রোগা আর হোঁৎকা মোটা দুটো ছেলে আছে। অরিন্দম রোজ-রোজ জোক বলে। সঞ্জয় দত্ত খুব খারাপ ছেলে, রোজ পয়সা চায়। রাজা হাজরা আর অর্ণব শেঠ কিরকম ফাইট করে। তার পরই সে মাঠে যাবার জন্যে হামলাতে থাকে। মাঠ থেকে ফিরে ছেলে ঢুলতে থাকবে। অল্প একটু পড়ান সোমনাথবাবু। স্কুলটা ভালো। হোম-টাস্ক দেয় না। বেশির ভাগ পড়াই স্কুলে হয়ে যায়। পড়তে-পড়তে গল্প শুনতে-শুনতে ঢুল এসে যায়। দুধ খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে রূপ।
একটা পুরো সংসারের কর্তৃত্ব। অভ্যাস ছিল না কোনদিনই। প্রথম প্রথম বাধো-বাধো ঠেকত। তারপর নেশা ধরে গেল। শ্যামবাজারের বাড়িতে আজ্ঞাপালন ছাড়া আর কোনও সাংসারিক কর্তব্য পালনের বালাই ছিল না। কোনও-কোনও দিন শখের পোশাকি রান্না শাশুড়িরা রাঁধতে বলতেন। শ্বশুরদের খাওয়ার সময় মাথায় ঘোমটা দিয়ে বসে থাকতে হত। কিন্তু, নিজের ইচ্ছেমতো, বুদ্ধিমতো চলবার সুযোগ তার কোনদিনই হয়নি। এখন বন্দনা রান্নার বই কেনে কাকাকে ফরমাশ করে। নানারকম পদ রাঁধতে-রাঁধতে, কাকা আর ছেলের উৎসাহে আর উচ্ছ্বাসে সে রীতিমত দক্ষ রাঁধুনি হয়ে উঠেছে। দুপুরবেলা বাসনওয়ালী যাচ্ছে, তাকে ডেকে ছেঁড়া জামাকাপড় দিয়ে একটা সসপ্যান, কি একটা কেটলি কেনা হল তো সে মহা জয়ের আনন্দ। অবসর সময়ে বসে-বসে মায়ের পুরনো সেলাই-কলটা টেনে নিয়ে সেলাইও সে মন্দ করে না। বালিশের ঢাকা, পেটিকোট, পায়জামা, পর্দা, সুটকেসের ঢাকা—কি নয়? টেবলক্লথ তৈরি করে কোনকালে স্কুলে শেখা কার্পেটের স্টিচ দিয়ে। কত কতদিন সে রাস্তায় বেরোয়নি। এখনও বেরোবার দরকার হয় না। বাজার হাট সব কাকাই করেন। কিন্তু মাসে একদিন অন্তত কাকা তাদের নিয়ে বেরোবেনই। যেখানে হোক। কলকাতায় এবং তার আশপাশে যে এতো যাবার জায়গা আছে, দেখবার জিনিস আছে তা-ই তো বন্দনার জানা ছিল না। কলকাতার লোকেরা কলকাতা দেখে সবচেয়ে কম। ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের ভেতরে অতবড় মিউজিয়ামটা সে কোনদিন দেখেনি। সেন্ট পল্স ক্যাথিড্রালের ভেতরে কোনদিন ঢোকেনি। গান্ধীঘাট বা ব্যান্ডেল চার্চ জায়গাগুলো কী সুন্দর। দমদম এয়ারপোর্টে গিয়ে শুধু প্লেন ওঠা-নামা দেখতে-দেখতেই রূপের মতন তারও মনে ছেলেমানুষি উৎসাহ আসে। ইন্টারন্যাশন্যাল লাইনের প্লেন নামবে তো? রূপের সঙ্গে-সঙ্গে বন্দনাও জিজ্ঞেস করতে থাকে। সেই বিশাল প্লেন ডানা মুড়ে খুব কাছে দাঁড়ায়। অ্যালিট্যালিয়া লুফথানজা রূপ পড়ে। সিঁড়ি লাগে গিয়ে। যাত্রীরা সব আত্মীয়স্বজনদের টাটা করে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে যায়। সুন্দরী এয়ার হোস্টেস, সুদর্শন ইউনিফর্ম পরা ক্রুরা সব চলে যায়। প্লেনের দরজা বন্ধ হয়ে যায়, সিঁড়ি ফিরে আসে। তারপর বিরাট দেহ নিয়ে বাঁক ফিরে একসময় উড়ে চলে যায় প্লেন। বন্দনার বুকের ভেতর হু-হু করে। বুক যেন ফেটে যাচ্ছে শতখান হয়ে। চোখ ফাটে না। মুখে ভাষা ফোটে না। শুকনো আমসির মতো মুখ দেখে, কাকা বলেন—‘বড্ড গরম, চ’ আজ ট্যাক্সি করে বাড়ি ফেরা যাক।’ রূপ উৎসাহিত হয়ে বলে—‘আবার কবে আসব কাকা!’ বন্দনার মুখের দিকে তাকিয়ে কাকা বলেন—‘চল্ তো এখন শিগ্গির শিগ্গির।’ রাক্ষসীর প্রাণ যেমন কৌটোর ভোমরাতে, কাকার প্রাণ যেন তেমন বন্দনার সুখ-দুঃখের সঙ্গে প্রাণের অধিক টানে বাঁধা হয়ে গেছে। এতটুকু চোখ ছলছল, মুখের ছায়া তাঁকে বুঝি যম-যন্ত্রণা দেয়। ট্যাক্সিতে বসে চোখ বুজোয় বন্দনা। হাজার চেষ্টা সত্ত্বেও বৃষ্টি বাধা মানে না। ঝরে পড়ে শাড়িতে, কোলের ওপর, পাশে বসা ছেলের গায়ের ওপর। রূপ বলে—‘কাকা, আমার বাবা কি অমনি প্লেনে করেই চলে গেছে? আর কোনদিন আসবে না? যারা চলে গেল ওরা আসবে না? আসে না কেন? বলো না, বলো না, কাকা!’
আজ কতদিন পরে রূপের মুখে বাবার নাম। বন্দনা বাইরে মুখ ফেরায়। রূপ তখন কাকার হাতে ছোট্ট ছোট্ট হাতে, ছোট্ট ছোট্ট কিল মারছে—‘ওদের আমি মারব, মারব, মারব।’
কাকা বলেন,—‘ওদের মারিস। আমাকে মারছিস কেন রে পাগলা?’ তিনি হাসবার চেষ্টা করেন, এই প্রথম কিছুতেই হাসি ফোটে না।
অধ্যায় ১৩
চেহারাটি শান্ত, গভীর অথচ মধুর। যেন অনেক অভিজ্ঞতা পরিপাক করে তবে এই মাধুর্যে পৌঁছতে পেরেছে। পরিপাটি বেশবাস, বেশকে ছাড়িয়ে মানুষটিকেই চোখে পড়ে আগে। কথাবার্তা মৃদু, দৃঢ়, মার্জিত, অথচ সপ্রতিভ। স্কুল-বোর্ডের প্রত্যেকের পছন্দ হয়ে গেল। সরকারি অনুদান এঁরা নেন না। ট্রাস্টের টাকাতেই স্কুল চলে। বহু ধনী লোকের দান রয়েছে। সব সরকারি নিয়মকানুন মেনে চলবার দরকার হয় না তাই। এঁরা মনে করেন শিক্ষয়িত্রীদের সবচেয়ে বড় গুণপনা তাঁদের চরিত্র, এবং সেই চরিত্রকে বাইরে রূপ দেবার উপযুক্ত ব্যক্তিত্ব। চরিত্র বলতে অবশ্য এঁরা মোটের ওপর আভিজাত্য, ভদ্রতা, নৈতিক পবিত্রতা এই সবই বোঝেন। পোশাকে, কথাবার্তায়, হাব-ভাবে এই জাতীয় চরিত্র প্রকাশ পেলেই এঁরা খুশি। চরিত্র বলতে যদি খুব বেশি আত্মস্বাতন্ত্র্য, নিজের সিদ্ধান্তে অটল থাকবার ক্ষমতা, এই সব বোঝায় তাহলে এঁরা হয়ত একটু অসোয়াস্তি বোধ করবেন। আপাতত প্রার্থিনীর চেহারাটি পলকা, কিন্তু বোঝাই যাচ্ছে স্বভাবটি হালকা নয়। সুতরাং বন্দনার চাকরি প্রায় এককথায় হয়ে গেল।
মিসেস খাসনবিশ সেক্রেটারি। বললেন—‘শী নীড্স ইট ভেরি মাচ, বাট ডাজন্ট মেক এ শো অফ দ্যাট।’ অতুল মুখার্জি চেয়ারম্যান, বললেন—‘একজ্যাক্টলি। এটা আমার মতে ভদ্রমহিলার সবচেয়ে বড় কোয়ালিফিকেশন। আর তাছাড়াও, মেয়েদের প্রোভাইড করবার জন্যেই তো একদিন এ স্কুলের পত্তন হয়েছিল। এই ধরনের মেয়েদের। এডুকেশন দিয়ে ছেড়ে দিলেই তো হবে না, প্রয়োজনে তার অ্যাপ্লিকেশনের ভদ্র ক্ষেত্রও তো দিতে হবে।’
—‘বছরখানেক যাক, বি. এডটা আমরাই করিয়ে নেবো’, আরেকজন সদস্য বললেন।
সংসারের অর্ধেক কাজ করে দ্যান সোমনাথবাবু। তাঁর অবসর রয়েছে, স্বাস্থ্য ভালো, উৎসাহ প্রচুর। বন্দনা আর রূপকে পেয়ে তিনি যেন নতুন জীবন পেয়েছেন। এমন উদ্যমের সঙ্গে নাতির জুতো পালিশ করেন, কেড্সে রঙ লাগান, যে কোনদিন তিনি এগার হাজার থেকে ষোল হাজার ফিটের মধ্যে ট্রেকিং করে বেড়াতেন, কিংবা চার হাজার ফিটের তলায় নামলে অস্বস্তি বোধ করতেন এ কথা কেউ বললেও বিশ্বাস করবে না। ভীষণ সংসারী এক দাদু-মানুষ। বন্দনার হাতের কাজ অভ্যেস হয়ে যেতে বছরখানেকের বেশি লাগল না। এখন কাজগুলো যান্ত্রিকভাবে হয়ে যায়, সুতরাং মন তার নিজের কাজ আরম্ভ করে দেয়, কি করি, কি করি করে অস্থির তো করে দেয়ই তারপর সোমনাথবাবু দেখেন, স্টোভে ভাত চাপিয়ে বন্দনা গালে হাত দিয়ে বসে আছে। আনাজ কুটতে- কুটতে আগে কাকাকে যে কারণে বকত এখন নিজেই তাই করছে। অর্থাৎ কুটছে তো কুটছেই।
সোমনাথ বললেন—‘বুড়ি, তুই এম এ-তে ভর্তি হয়ে যা।’
বন্দনা বলল—‘তার চেয়ে আমি একটা চাকরি করি না, কাকা। টাকাকড়িও কিছুটা সুবিধে হয়।’
—‘তোর যা ইচ্ছে, যেমন ইচ্ছে, যাতে তুই ভালো থাকিস তাই কর।’
বাড়ি থেকে স্কুল সামান্য দূরত্ব। হেঁটেই চলে আসতে পারে বন্দনা। পথটুকু যেন মুক্তির আপন পথ। সুখী হবার জন্য পথে বার হওয়া যে তার এতো জরুরি ছিল, সে আগে কখনও বোঝেনি। ঘরের মধ্যে যেন অনেকগুলো আয়না ফিট করা থাকে। প্রত্যেকটি দেয়াল থেকে একটি করে আত্মমুখ চেয়ে থাকে, যেদিকে তাকাও খালি আমি, আমি, আমি। সেই আমির ভাবনা, আমির দুঃখ, আমির দুশ্চিন্তা, মন-খারাপ, আশা-আকাঙ্ক্ষা, দিবাস্বপ্ন দিয়ে ক্রমে ক্রমে বাড়িটার কোণগুলো পর্যন্ত ভর্তি হয়ে যায়। দমবন্ধ হয়ে আসে। কাঁধে নতুন চামড়ার ব্যাগ, পরনে ফিকে সবুজ চিকনের কাজ করা শাড়ি, বন্দনা চলেছে, দুধার দিয়ে বয়ে চলেছে জনস্রোত। বহমান বলে প্রতি মুহূর্তে যেন নতুন হয়ে উঠছে। ব্যস্ত সমস্ত, কর্মস্থলে চলেছে, স্টপে স্টপে অফিসযাত্রী মানুষের উত্তেজিত অপেক্ষা। তারই মধ্যে অপেক্ষাকৃত মন্থরগতিতে প্লাস্টিকের ঝুড়ি হাতে দুলিয়ে বাজার করতে চলেছে কোনও সুখী গৃহিণী। বাচ্চা ছেলে বা মেয়ের হাত ধরে রাস্তা পার হচ্ছে কোনও মা। বাচ্চাকে স্কুলে পৌঁছে টুকিটাকি কেনাকাটা সেরে বাড়ি ফিরবে। গাঁজা পার্কে এই কর্মব্যস্ত সকালেও বেশ কিছু লোক এসে গেছে। এরা কি বেকার? না অবসরপ্রাপ্ত? কি সূত্রে এদের এখন এ-পার্কে আসা, এ হেন অসময়ে, তা বোঝা সম্ভব নয়। কোন কোনদিন রিকশায় উঠে পড়ে বন্দনা। এমনিতে তার বেরোনোর সময়ের হেরফের হয় না। কিন্তু এক-এক দিন রূপ স্কুলে চলে যাবার পর কাকা বাড়ি ফিরে খুব গাঁই-গুঁই করতে থাকেন।
—‘তুই চাকরিটা নিলি, আর এখন দ্যাখ আমাকে একা-একা খেতে হবে।’
বন্দনা অপরাধী-অপরাধী মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে দেখলে, কাকা ভীষণ ব্যস্ত হয়ে বলেন, ‘যাঃ, তোর দেরি করিয়ে দিলুম। শিগ্গিরি বেরিয়ে পড়। আমার একা খেতে কোনই অসুবিধে হবে না।’
সামান্য মনখারাপ নিয়ে একটু দেরি করে বাড়ি থেকে বেরোয় বন্দনা। হাঁটতে ভালো লাগে না, ফুটপাতে খুব ভিড় মনে হয়। যদিও সসম্ভ্রমে জায়গা ছেড়ে দিতে থাকে যুবকরা। মানুষ। মানুষ দেখতে-দেখতে আস্তে-আস্তে তার চিত্ত ভরে যায়। হাসি-খুশি, রাগী-রাগী, বিরক্ত, তৃপ্ত দেখতে, অসুখী খিটখিটে দেখতে, ব্যস্ত, ঢিলেঢালা, কত রকমের মানুষ। মানুষের মুখশ্রী এ ক’দিনেই ভীষণভাবে ভালোবেসে ফেলেছে বন্দনা। তার বুকের মধ্যে কে যেন সদাসর্বদা গুনগুন করতে থাকে—আমি তোমাদের সবার একজন। তোমাদের মধ্যে তোমাদেরই মতো কাজ করব, ঘুরব, ফিরব, দোহাই তোমাদের আমাকে আলাদা করে রেখ না। ঘর সে যত পবিত্র, যত পরিচ্ছন্ন, যত সজ্জিতই হোক না কেন, তার চেয়ে এই ছায়াচ্ছন্ন বীথিকাপথ, কিংবা ঢং-ঢং ঘণ্টিবাজাননা ট্রামলাইন পাতা, তীব্রগতিতে ভারি দোতলা বাস চলা, বহু মানুষের অবিরাম চলাফেরায় অক্লান্ত রাজপথ অনেক, অনেক গুণে ভালো। অথচ অফ পিরিয়ডে সহকর্মিণীদের সঙ্গে গল্প করতে-করতে একেক সময়ে বন্দনার কাকার জন্যে ভীষণ মন কেমন করে ওঠে। সে সমস্ত রান্না সেরে, রান্নাঘর পরিষ্কার করে, টেবিলের ওপর কাকার খাবার বাটিতে-বাটিতে বেড়ে থালা চাপা দিয়ে রেখে আসে। কাকা রূপকে স্কুলবাসে তুলে দিয়ে গড়িমসি করে ব্যায়াম করেন, তেল মাখেন, চান করেন, গীতা পড়েন, যে অধ্যায় বন্দনাকে পড়াবেন মনে করেন সেটা দাগ দিয়ে দিয়ে ভালো করে পড়ে রাখেন। তারপর ঠাণ্ডা খাবার খেয়ে সব নামিয়ে দেন। স্টোভে একটু গরম করে নেওয়া কিছুই না, বন্দনা যখন বাড়ি থাকত তখন সোমনাথবাবু আগ বাড়িয়েই কাজটা করতেন, বলতেন—‘সারা সকাল রেঁধেছিস আর উনুনের ধারে যাসনি।’ কিন্তু এখন যেহেতু তাঁকে একা খেতে হয়, সেহেতু গরম করার হাঙ্গামায় তিনি আর যেতে চান না। বন্দনা বকাবকি করলে হাসেন, বলেন—‘যে মানুষের ভোজনং যত্রতত্র শয়নং হট্টমন্দিরে, একটু গরম-ঠাণ্ডায় তার কি এসে যায় বল তো?’
বাসনমাজার লোক এলে দরজা খুলে দেওয়া, রূপ ফিরলে তাকে মোড়ের মাথা থেকে নিয়ে আসা, খেতে দেওয়া, সমস্ত সামলান কাকা। বন্দনা যখন ফেরে, তখন পরিষ্কার তকতকে বাড়িতে শেষ বেলার আলো, ছেলের ঘুমন্ত মুখে সেই আলো ছড়িয়ে থাকে। পাশে আর্মচেয়ারের হাতল থেকে পা দুটো নামিয়ে নিয়ে কাকা বলেন—‘তুই এখানে একটু শো বুড়ি। আমি চা-টা করি।’
বন্দনা বলে—‘আচ্ছা, তুমি কি বলো তো? সারা দুপুর তো একবার ওপর একবার নিচ করেছো। একটু ঘুমিয়ে ছিলে তো?’
—‘ঘুমোবো কি রে? পাগল হলি নাকি? জীবনের আর ক ঘণ্টা মোটে বাকি বল দিকিনি? ঘুমিয়ে সে সময় কেউ নষ্ট করে? শোন, লুচির ময়দা মেখে রেখেছি, আলু কুটে জলে ভিজিয়ে রেখেছি, চল তোকে গরম-গরম ভেজে দিই।’
—‘আচ্ছা কাকা, তোমাকে আমি সত্যি ভীষণ বকবো। কে তোমাকে বলেছে লুচির ময়দা মাখতে। তুমি খাবে?’
—‘আরে আমি তো খেয়েছি তখন প্রায় দুটো। এখন কি আর খেতে পারি? চা ছাড়া কিচ্ছু না।’
—‘তাহলে রূপু খাবে?’
—‘উঁহুঃ, ওকে কিচ্ছু দিসনি। পেট পুরে ভাত খেয়েছে, মাংসটা গরম করে দিলুম। ব্যাটা গপাগপ এক থালা খেয়ে নিল। এখন পাঁচ ঘণ্টার মধ্যে আর কিচ্ছু দোব না।’
—‘তাহলে কার জন্যে লুচিটা হবে?’
—‘কেন বুড়ি, তুই কি মানুষ না? তুই কি সকাল নটায় সামান্য দুটো খেয়ে সারা দুপুর গলাবাজি করে, এই চারটের সময় এক মাইল পথ হেঁটে বাড়ি ফিরলি না? তোদের খেতে নেই, খিদে পেতে নেই, না? তোদের জন্যে আলাদা করে কিছু করে দেওয়াটা এতই হাস্যকর? আচ্ছা তৈরি হয়েছিস। গরুর জাত নাকি? সকালে যা খেয়েছিলি, চাট্টি গলার কাছে রেখে দিয়েছিস? জাবর কাটবি। এখন?’
কাকার রাগ দেখে বন্দনা অবাক। বলে—‘কি আশ্চর্য, তুমি এতো রাগ করছ কেন? খাবার তো কত রকম জিনিসই আছে। খাব না কেন? লুচিটা হাঙ্গামা নয়?’
—‘খাবার অনেক জিনিস আছে? তোর ভাঁড়ারের খবর আমি রাখি না। কি আছে শুনি? পাঁউরুটি? পাঁউরুটি চিবোতে ভালোবাসিস তুই? সত্যি করে বল।’
—‘ন্না।’
—‘মুড়ি? মুড়ি চিবোতে ভালো লাগবে সারাদিনের পর?’
—‘খেলেও হয়। অসুবিধে কি! চায়ের সঙ্গে একবাটি মুড়ি নিয়ে নিতুম।’
—‘মুড়ি মাখবার কি রেখেছিস? চানাচুর? বাদাম ভাজা? নারকোল?’
—‘উহুঃ।’
—‘তাহলে কি ভাবে খাবি? শুকনো মুড়ি একগাল আর এক চুমুক করে চা!’
—‘ঠিক ধরেছে। আমার খুব ভালো লাগে।’
—‘ভালো লাগাচ্ছি তোকে। আমি এখনও বেঁচে আছি; বুঝলি? তোকে তো আর করতে হচ্ছে না। আমি সারাদিন শুয়ে বসে আছি; আমি তোকে ভেজে খাওয়াব। লুচিগুলো সব হয়ত গোল হবে না। কোনটা কোনটা আফ্রিকার ম্যাপের মতো, অস্ট্রেলিয়ার ম্যাপের মতো হয়ে যাবে।’ বলতে বলতে কাকা হেসে ফেলেন।
অগত্যা বন্দনা রান্নাঘরে গিয়ে লুচি বেলে দেবে। কাকার কি গোঁ; সেই লুচি ভেজে, আলু ছেঁচকি করে তাকে খাইয়ে তবে ছাড়বেন।
সত্যি কথা, চাকরিটা নিয়ে বন্দনা বেঁচে গেছে। মেয়েদের পড়ানোটা বন্দনার কাছে যত না পড়ানো, তার চেয়ে বেশি পড়া। ওদের ছেলেমানুষি কথাবার্তা, আগ্রহ, কৌতুক, সব মিলিয়ে তরুণ জীবন্ত মনগুলোকে সারা ক্লাস পড়ানোর নাম করে ও শুধু উপভোগ করে। সেভন থেকে এইট, এইট-এ থেকে এইট-বি। তার এই খুশিটা স্টাফরুমের সবার কাছে বেশ প্রকাশ হয়ে পড়ে। তৃপ্তিদি একদিন বললেন—‘আরে ওই দুষ্টুর শিরোমণি এইট-বির ক্লাস করে তোর এতো খুশি কিসের? অ্যাঁ?’ চিন্তাদি বললেন—‘প্রথম প্রথম তো। দু দিন যেতে দাও না, তারপরই ঝাঁকের কই ঝাঁকে মিশবে।’ কিন্তু বন্দনা জানে সে ক্লান্ত হবে না। আসলে আর্থিক স্বাধীনতার ব্যাপার নয়। কাকার কাছে আসবার পর থেকে টাকাকড়ির ব্যাপারে তার আর নিজেকে পরনির্ভরশীল মনে হয় না। কিন্তু মানসিক নির্ভরতা? সেটা থেকেই গেছে। এখন তার একটা নিজস্ব জীবন হয়েছে যেটা কাকা-নির্ভর নয়, রূপ-নির্ভরও নয়। এতে যে তার চারপাশের গণ্ডিটা কিভাবে দূরে হটতে-হটতে মিলিয়ে গেছে এবং মিলিয়ে গিয়ে কি পরিমাণে তাকে বাঁচিয়ে দিয়েছে তা একমাত্র সে-ই জানে। কিন্তু কাকা? কাকার জীবনের গণ্ডিটাকে সে কেটে ছেঁটে ছোট করে দিল না তো? তাদের জন্যই তিনি ভ্রমণের নেশা ছাড়লেন। অমন পর্যটক মানুষটা হাতা-খুন্তি বেড়ি-ঝাঁটা- বালতি ধরলেন, তাঁর কর্তব্যবোধে তিনি করছেন, কিন্তু তাঁকে সঙ্গ দিয়ে, তাঁর যত্ন করে, ক্ষতিপূরণ করে দেওয়াটা কি তার উচিত ছিল না? কাকাকে সে একটা আনন্দহীন খাটুনির জীবনের চক্রে বেঁধে দিল না তো!
যেদিন এরকম মনে হয় সেদিন বন্দনা ভীষণ অন্যমনস্ক হয়ে যায়। ক্লাসে যেতে দেরি করে, কখন ছুটি হবে সে-জন্য উন্মুখ হয়ে বসে থাকে। ফেরবার সময়ে তার প্রিয় জ্যাকারান্ডা কি করবী গাছের ফুলের থোকার দিকে তাকায় না। ধূলিমলিন যে রাস্তা হাঁটতে সে রোজ রোজ বেঁচে থাকার আনন্দস্বাদ পায় আজ তা পায় না, কোনক্রমে ব্যস্ত হয়ে বাড়ি ফিরে দরজার কড়াটা এমনভাবে নাড়ে যেন ভয় পাছে কেউ দরজা না খোলে। কাকা এসে দরজা খুলে দিয়ে এক মুখ হাসেন। সেই প্রিয় প্রৌঢ় মুখখানাকে দেখে তবে শান্তি। বন্দনার সে সময়ে ইচ্ছে করে ছোটবেলার মতো কাকাকে জড়িয়ে ধরে গালে খুব কষে হামি খায়। কিন্তু সে অভ্যেস চলে গেছে। এখন জিনিসটা পাগলামি বা ন্যাকামি বলে মনে হবে। বিশেষ করে তাদের দু-জনের স্বভাবই খুব সংযত, উচ্ছ্বাসহীন বলে। সে খুব করুণ কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে—‘কাকা তুমি ভালো আছো তো? ভালো ছিলে?’ —বলতে বলতে চোখ ছলছল করতে থাকে।
সোমনাথবাবু বলেন—‘হঠাৎ—? ভালো থাকব না কেন? ও কি কাঁদছিস নাকি?’
—‘তোমার জন্যে আজ সারাদিন মন কেমন করছিল স্কুলে।’
—‘আচ্ছা পাগল মেয়ে তো। আমি কি তোদের ফেলে কোথাও গেছি?’
বন্দনা মনে মনে বলে—‘তুমি যাওনি কাকা, বরং ফিরে এসেছ, মুক্তজীবন থেকে স্বেচ্ছায় এসে জোয়াল কাঁধে তুলে নিয়েছ, তুমি মহানুভব। আসলে আমিই চলে গেছি। তোমায় ফেলে চলে গেছি।’
সারা সন্ধে কাজকর্ম করতে-করতে ঘুরে-ঘুরে বন্দনা কাকার কাছে চলে আসে। বাচ্চা মেয়ের মতো। রূপ খেলার মাঠ থেকে ফিরে একটু মাকে চায়, রাত্রে কোনদিন মার কাছে, কোনদিন কাকার কাছে শোয়। বন্দনা ছেলের সঙ্গে গল্প করে। কিন্তু মন পড়ে থাকে কাকার কোলের কাছটিতে। প্রাণপণে সে খালি বোঝবার চেষ্টা করে কাকার প্রাপ্তির ঝুলিতে কিছু কম হয়ে যাচ্ছে কি না।
অধ্যায় ১৪
আস্তে আস্তে গ্রীষ্ম। প্রচণ্ড আগুনের ফোয়ারা। চোখ ঝলসে যাচ্ছে। পিচ গলছে। গাছগুলো শুষছে। তা-ও কিরকম একটা অসহ্য সূর্যের এই তাপ। এই তাপ যেন বেঁচে থাকার আসল অনুভূতি তীব্রভাবে এনে দিচ্ছে। জামা-কাপড় ভেদ করে, চামড়া ভেদ করে, পেশীর স্তর, তন্তু সব ভেদ করে যেন হাড়ের কাঠামো পর্যন্ত গিয়ে পৌঁছচ্ছে এই তেজ। তবে সে সঞ্জীবিত সোনালি, সবুজ হবে। গমের দানার মতো আস্তে আস্তে পরিপুষ্ট, পরিপূর্ণ। স্টাফরুমে এখান থেকে ওখান থেকে রব ওঠে। গলদঘর্ম শান্তিদি বলেন—‘উঃ কি গরম রে বাবা আর পারছি না।’ ঊষাদি বলেন—‘ঘামে শরীরের রক্তগুলো সব এবার জল হয়ে যাবে।’ নমিতাদি জলে লেবু নিংড়ে পান করতে-করতে বলেন—‘লেবুর জল। অনেকবার বলেছি এর রেমিডি হল লেবুর জল। কথা তো শুনবে না। সল্টগুলো বেরিয়ে যাচ্ছে, সেগুলো তো আবার শরীরকে ফিরিয়ে দিতে হবে?’
বন্দনা বলে—‘মুখ চোখ একবার ভালো করে ধুয়ে আসুন না ঊষাদি!’
—‘ওরে বাবা, সাম্প্রতিককালে জলে হাত দিয়ে দেখেছ। ফুটছে! টগবগ করে ফুটছে। নীরুকে আজ আর চা করতে কেটলি হীটারে চাপাতে হবে না।’
ক্লাস এইটের ক্লাস-টীচার বন্দনা। মেয়েগুলো তাকে বড় ভালোবাসে। ওদের ভালোবাসা যেমন হয়, আবেগপ্রবণ, বীরপূজামিশ্রিত। ঊর্মি বলে একটি মেয়ে প্রায়ই ফুল নিয়ে আসে, আজ মেয়েটি ওকে একগুচ্ছ সোনার বরণ চাঁপা উপহার দিল। বন্দনা আদর করে ওর গাল টিপে দিল, মেয়েটিকে ক্লাসের অন্যান্য মেয়েদের চেয়েও ছেলেমানুষ মনে হয়। বলল—‘কোথা থেকে নিয়ে এসেছ ফুল?’
—‘আমাদের বাগানে ফোটে দিদি!’ খুশিতে রাঙা হয়ে ঊর্মি জবাব দিল।
—বেশ, খুব ভালো। কিন্তু সেদিন যে পদ্ম এনেছিলে! সে-ও কি তোমাদের বাগানে ফোটে!’
—‘না দিদি’—ঊর্মিমালার মুখ লাল হয়ে গেছে, ‘ঠাকুমা পুজোর জন্য আনিয়েছিলেন দিদি। আমি বলতে…আমি চাইতে…আমি যখন বললুম আপনাকে…’
—‘আচ্ছা, আচ্ছা, ঠিক আছে। কিনে-টিনে আনতে যেও না যেন।’
ছাড়া পেয়ে মেয়েটি ছুটতে-ছুটতে চলে গেল। খুব লজ্জা পেয়েছে। চাঁপার স্তবকের মধ্যে মুখ ডুবিয়ে বন্দনা মুগ্ধ চিত্তে ভাবল—সত্যিই চম্পা সূর্যের সৌরভ। সূর্যের স্বরূপ-সম্পদ। সূর্য পিতৃসম। প্রাচীন মিশরীয়দের মতো সূর্যের জন্য ভক্তি ও কৃতজ্ঞতা টলটল করতে থাকে তার মনে। তুমি ছিলে বলেই তো এই ভূগোলক, এই বায়ুস্তর, এই অম্লজান, উদযান, এই শ্যামশষ্প ভরা ধরিত্রী যার তুলনা নক্ষত্রলোকের কোথাও নেই এবং এই জীবন, যা দ্বিতীয়বার আর মানুষ পাবে কি না সে জানে না। একবার, মাত্র একবারই হয়ত এই দুর্লভ উপভোগে ভরা জীবন।
বিকেলে বাড়ি ফেরবার সময়ে ঝড়ের মতো বাতাস বয়। এ তো বাণিজ্যবায়ু নয়। তবু, মনের মধ্যে গুনগুন করতে থাকে ‘মাইটি ট্রেড উইন্ডস্ ব্লোয়িং, মাইটি ট্রেড উইন্ডস’ …‘গভীর হাওয়ার রাত ছিল কাল।’ গাছগুলো পাতা সমেত পাগলের মতো দুলতে থাকে। ঝুরঝুর করে পথের ওপর ঝরে পড়ে ফুলের পাপড়ি, পরাগ। বেণী ওড়ে। আঁচল লুটোপুটি। সমস্ত শরীরটা বেলুনের মতো, না পাখির মতো উড়ে যেতে চায় যেখানে ছোট-ছোট সাবানের ফেনার মতো মেঘ উড়ে চলেছে, আকাশের দিকে তাকিয়ে বন্দনা দেখে কবি ঠিকই বলেছিলেন জীবনের দুর্দান্ত নীল মত্ততা। তারও হৃদয় বুঝি পৃথিবীর বোঁটা ছিঁড়ে উড়ে যাচ্ছে। নীল হাওয়ার সমুদ্রে স্ফীত মাতাল বেলুনের মতো। স্বাতী তারার কোল ঘেঁষে শাদা বকের মতো উড়ছে, উড়ে যাচ্ছে।
অধ্যায় ১৫
স্কুল থেকে ফিরে খেলতে যাবার জন্যে ছটফটানি শুরু হয়েছে রূপের। আজকাল খাওয়া শেষ করে আর শোয় না, যদি ঘুমিয়ে পড়ে। বিকেল বয়ে যায়। সারাদিন রপটাচ্ছে। পরিশ্রম হচ্ছে খুব। কিন্তু সোমনাথ বলেন, ‘ও হল বালক, নতুন বড় হচ্ছে, প্রতি দিন, প্রতি মুহূর্তে ওর শক্তি বাড়ছে, ওর শক্তিসামর্থ্যের পরিমাপ আমার মতো বুড়োরা করতে পারবে না। ওর শরীর যখন পারছে, তখন ও বিশ্রাম না নিয়েই খেলতে যাক, খেলুক। না পারলে তখন দেখা যাবে।’ ইতিমধ্যে ওকে দুবেলা দুধ খাওয়ানো হচ্ছে, প্রতিদিন একটি করে মুরগীর ডিম, সপ্তাহে তিন দিন মাংস এবং যথেষ্ট ফল খাওয়ানো হচ্ছে। তার মা চাকরি নেওয়ার পর খাওয়ার মান আরও উন্নত হয়েছে। জামা প্যান্ট পাল্টে, পায়ে ধবধবে কেডস হাতে ব্যাট নিয়ে, দাদুর হাতে উইকেটগুলো ধরিয়ে দিয়ে রূপ খুব বড় সড় মানুষের মতো পায়চারি করছে। মা বাড়ি না ফিরলে সে খেলতে যেতে পারছে না। ভারি উৎকণ্ঠিত। দালানে দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়েই ব্যাটটাকে শূন্যে হাঁকড়াচ্ছে রূপ—‘দেখলে কাকা, হাতটা কি রকম সট করে উঠে গেল। আমি হবো স্ট্রোক প্লেয়ার। ঠুকে ঠুকে কিষেণের মতো খেলা আমার পোসাবে না। কি বলো?’
সোমনাথ বললেন—‘ঠিক। একেবারে ঠিক।’
—‘আচ্ছা কাকা স্ট্রোক-প্লেয়ার কি বোলার হতে পারে না?’
—‘কেন পারবে না রে?’
—‘তাই ভাবছিলুম কাকা। আমার ডান হাতটা কিরকম ঘোরে না, বল করবার সময় বাঁ-হাতি বোলার। সেদিন সঞ্জুর ক্যাচখানা ধরলুম, দেখেছিলে? মাটিতে ডিগবাজি খেয়ে, একেবারে বাঁ-হাতের আঙুল দিয়ে…’ উৎসাহের চোটে ডিগবাজিটা শানের মেঝের ওপর খেয়েই দেখিয়ে দিল রূপ। তারপর ধুলো ঝেড়ে বলল—‘হাতে স্পিন কি? রাইটহ্যান্ড ব্যাটসম্যান, ন্যাটা স্পিনার, খারাপ, কাকা?’
—‘দারুণ ভালো রে, জব্বর!’
চারদিক চেয়ে ভারিক্কি চালে আবার বলে রূপ—‘মা এখনও কেন এল না বলো তো। বড্ড ভয় হয় কাকা। চারদিকে যা অ্যাকসিডেন্ট! মায়ের আবার কিছু হলো টলো না তো?’
সোমনাথ হাসতে-হাসতে তার পিঠ চাপড়ে বলেন—‘দূর পাগলা উদীয়মান ক্রিকেটারদের মায়েদের কিস্যু হয় না।’
বন্দনার আজকে বাড়ি ফিরতে সত্যিই খুব দেরি হচ্ছে। ছুটির পর সে স্কুল থেকে বেরিয়ে বাড়িমুখো না হয়ে উল্টো দিকে চলে গিয়েছিল। ভিক্টোরিয়ার দিকে। চওড়া রাস্তা দিয়ে দ্রুতগামী গাড়িদের পাশাপাশি সে হেঁটে যাচ্ছিল রেসকোর্সের দিকে। অনেকটা হেঁটে তবে মন বশে এল। পিকনিকের আয়োজন হচ্ছে স্কুলে। ডায়মন্ড হারবারের দিকে যাওয়া হবে, নিজেদের স্কুল-বাস নিয়ে। কি কি রান্না হবে তার একটা তালিকা তৈরি হচ্ছিল। প্রতিমাদি বলে বলে যাচ্ছিলেন, নতুন আসা একটি মেয়ে নাম নন্দা, লিখে নিচ্ছিল। ‘চার কিলো মাংস, পাঁচ কিলো মাছ’…বলতে- বলতে প্রতিমাদি হঠাৎ থেমে বললেন—‘দুজনের মতো নিরামিষের ব্যবস্থা রাখতে হবে নন্দা, ফ্রায়েড রাইসটা নিরামিষ রাখো, কাজু কিসমিস কড়াইশুঁটি দিয়ে হোক মিষ্টি-মিষ্টি, কড়াইশুঁটির কচুরি, আলুর দম, ভেজিটেবল চপ, চাটনিটা কমন।’ বন্দনা কিছুতেই মুখ ফুটে বলতে পারল না সে সবই খায়, তার জন্যে আলাদা ব্যবস্থা করবার দরকার নেই। কথাটা না বলতে পেরে ভেতরে-ভেতরে কী গভীর লজ্জা! এঁরাও তো জিজ্ঞেস করতে পারতেন। ধরেই নিলেন কেন যে তার খাওয়া নিরামিষ হবে? তাহলে বললে প্রতিক্রিয়া কি হত। ঘৃণা? বিস্ময়? বিদ্রূপ? টিটকিরি? নিজের কাছে লজ্জিত হলেও এদের কাছে যেন তার মানটা বেঁচে গেল। কিন্তু অস্বস্তিতে স্টাফরুমে বসতে পারল না সে। উঠে বাইরের বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াল। হঠাৎ কানে এল নন্দার গলা, আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করছে—‘কেন প্রতিমাদি, বন্দনাদি নিরামিষ খাবেন কেন? উনিও কি প্রিন্সিপ্যালের মতো সৎসঙ্গী?’
নীলিমাদি অনুচ্চস্বরে বললেন—‘জানো না বুঝি? ও তো উইডো। সাজ-পোশাক দেখলে বোঝা যায় না অবশ্য। অনেকেই এ ভুল করে।’
মা বাড়ি ফিরতে রূপ মুরুব্বির মতো বলল—‘তোমার জন্যে আমরা আটকে ছিলুম। রোজ রোজ কিন্তু এতো দেরি করো না। অন্ধকার হয়ে গেলে কি আর বলের সুতো দেখতে পাব?’ ব্যাট কাঁধে বীরপুরুষ বেরিয়ে গেল। বন্দনা দরজা বন্ধ করে দিয়ে ওপরে উঠল। কোত্থেকে যে আজ এত ক্লান্তি এল! টেবিলের ওপর কাকা ফ্লাসকে চা রেখে দিয়েছেন, পাশে কিছু ঢাকা প্লেট, কিছু খাবার-দাবার আছে। বন্দনা ফ্লাস্ক থেকে চা ঢেলে ঢেলে অনেকক্ষণ ধরে খেল। আর কিছু মুখে দিতে ইচ্ছে করছে না। প্লেটের ঢাকা খুলে দেখল—কবিরাজি কাটলেট, স্যালাড। মাঝে মাঝে শখ করে দোকান থেকে আনান কাকা। খেতে ইচ্ছে করছে না, কিন্তু পড়ে থাকলে কাকাকে অনেক কৈফিয়ত দিতে হবে। সে কাটলেটটাকে টুকরো-টুকরো করে জানলা দিয়ে নিচে ফেলে দিল, কয়েকটা কুকুর ছুটে এসে টুকরোগুলো নিয়ে মহা কাড়াকাড়ি চেঁচামেচি শুরু করে দিয়েছে দেখে আস্তে-আস্তে জানলা থেকে সরে এল। যাক নিশ্চিন্ত।
অনেক রাতে কোথা থেকে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্নার আওয়াজে উঠে বসলেন সোমনাথ। তাঁর ঘুম খুব সজাগ। পাশের বাড়ির কার্নিশে পায়রারা রাতে পা বদলায়, তার খসখস আওয়াজে তাঁর ঘুম ভেঙে যায়। প্রথমটা উঠলেন না। কোথা থেকে আসছে কান্নাটা? সরু একটা বারান্দা আছে রাস্তার দিকে, পরপর তিনটে ঘর তার কোলে। মনে হচ্ছে, বন্দনার ঘরের সংলগ্ন সেই বারান্দার অংশ থেকেই আসছে আওয়াজটা। আজ রূপ মায়ের কাছে শুয়েছে। পাছে তার ঘুম ভেঙে যায় তাই বারান্দায় উঠে গিয়ে কাঁদছে বন্দনা।
শ্বশুরবাড়িতে যেভাবে ছিল তাতে তিল তিল করে মরে যাচ্ছিল মেয়ে। সেখান থেকে তাকে নিজের কাছে নিয়ে এসে একটা সুস্থ স্বাভাবিক পরিবেশের মধ্যে রেখে তার শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য তিনি খুব সম্ভব ফেরাতে পেরেছেন। কয়েক বছর আগেকার বন্দনার সঙ্গে আজকের বন্দনার আকৃতিতে কোনও মিল নেই। এখন তার বয়স যেন কমে গেছে, দেখলে মনে হয় নবীনা কুমারী মেয়ে। বিবাহিত জীবনেও সে এতো সুন্দর ছিল না বোধহয়। সোমনাথ নিজে থেকে চিরকৌমার্য বেছে নিয়েছেন। কৌমার্যের মধ্যে তিনি একটা অতিরিক্ত সৌন্দর্য দেখতে পান। বিবাহিত রমণীর রূপ যেন সকালের আকাশের মতো, খোলামেলা। তার মধ্যে কোনও রহস্য থাকে না। বন্দনা এখন নিজের মতো একটা জীবন পেয়েছে। নিজের সঙ্গে অনবরত বোঝাপড়ার মধ্যে দিয়ে সে নিজেকে চিনতে পারছে। স্বনির্ভরতা এবং দায়হীনতা এ দুটো জিনিসের স্বাদ আলাদা। বন্দনা নিজস্ব জীবনবৃত্ত পেয়ে স্ব-নির্ভর এবং একই সঙ্গে তার কাকা মাথার ওপরে থাকায় অনেকটা দায়হীন। এখন সে সুস্থ, স্বাভাবিকও। কিন্তু এ আশা সোমনাথের নেই যে মেয়ে অভিমন্যুর অভাবের দুঃখ, তার অকালমৃত্যুর বেদনা কোনদিন ভুলতে পারবে। ভুলুক—তা তিনি চানও না। এ ব্যথাও যে জীবনের এক দুরূহ দান। যে পায় সেই জানে, এর মূল্য কত! জীবনের কত তুচ্ছতা, জীর্ণতা ঝরে ঝরে যায়, মূল্যবোধ, দৃষ্টিভঙ্গি বদলে যায়। মানুষ ভেঙে ভেঙে আবার নতুন হয়ে গড়ে ওঠে গভীর রাতে মৃত প্রিয়জনের জন্য এই সন্তপ্ত কান্না এ বড় নিভৃত, গোপন কান্না, কে জানে কত ফাল্গুনী রাতের বকুলগন্ধ মেশা সুখস্মৃতি মথিত হচ্ছে ওই কান্নায়, সেসব রাতের পুনরাবৃত্তি এ জীবনে আর কখনও হবে না। তারও জন্য এ ব্যাকুল কান্না। গুরুজনদের দেখবারও নয়, শোনবারও নয়। বুক দিয়ে আগলে রাখতে পারেন মেয়েকে, কিন্তু এই স্মৃতির আগ্রাসী কবলের কাছে তিনি ব্যর্থ। সন্তর্পণে পাশ ফিরে শোন সোমনাথ। কাঁদুক। একটু কেঁদে নিক। মাঝে মাঝে এমনি হালকা হয়ে না নিলে গুরুভার বুকে বেঁধে মেয়ে পথ চলবে কি করে? কিন্তু গুমরে গুমরে কান্না চলতেই থাকে, চলতেই থাকে। যেন বুক নিংড়ে যাচ্ছে বেদনায়, দুঃসহ কষ্টে। অনেকক্ষণ শুনে। শুনে আর থাকতে পারলেন না সোমনাথ। ধীরে ধীরে পাশে গিয়ে দাঁড়ালেন। অঘ্রান মাসের কৃষ্ণপক্ষ। চাঁদ নেই। কিন্তু অসংখ্য তারার আলো। বাড়িগুলো সে আলোয় ভুতুড়ে দেখাচ্ছে। বন্দনার ছায়ামূর্তিও যেন ভৌতিক। সান্ত্বনা জানাবার ভাষা নেই। শুধু আলতো করে মাথায় হাতটা রাখলেন সোমনাথ। কান্না স্বভাবতই বেড়ে গেল। বেশ কিছুক্ষণ পর সোমনাথ আস্তে আস্তে বললেন, ‘কি হয়েছে বুড়ি? এমনি করে কাঁদছিস কেন? আমায় বলবি না?’ গুমরে গুমরে বন্দনা বলল—‘আমি তাকে ভুলে গেছি কাকা। তার জন্যে আমি আর শোক করি না। সেই দুঃসহ কষ্ট আমায় আজকাল ছেড়ে গেছে। আমি কি রকমের সতী সাধ্বী স্ত্রী বলো! খাচ্ছি-দাচ্ছি, দিব্যি সাজপোশাক করছি, বেঁচে আছি মহা আনন্দে। প্রতিদিন কিভাবে উপভোগ করছি জীবনটাকে তোমায় বলে বোঝাতে পারব না। কিন্তু সে যে অকালে অত কষ্ট পেয়ে মর্মান্তিকভাবে চলে গেল, তাকে আমি মন থেকে একেবারে মুছে ফেলে দিয়েছি। তুমিই বলো কাকা আমি কি এক নিষ্ঠুর, নির্দয়, পাপিষ্ঠা নই? আমি কি নারী নামের যোগ্য? দেশের পুরাণে লোককথায় মৃত স্বামীর পেছন পেছন স্ত্রীর যমালয়ে গিয়ে স্বামীকে ফিরিয়ে আনার তপস্যার কথা লেখা আছে, যে দেশের একটি মেয়ে একদিন লর্ড বেন্টিংকের সামনে নিজের আঙুল মোমবাতির শিখায় পুড়তে দিয়ে দেখিয়ে অবাক করে দিয়েছিল যে আগুনে পুড়ে মরা তার কাছে কিছুই নয়, আমিও তো সেই দেশেরই মেয়ে….’
সোমনাথবাবু এতক্ষণ চুপচাপ শুনছিলেন এইবার আর থাকতে পারলেন না, বললেন, ‘থাম বন্দনা, চুপ কর। তুই স্কুলে-কলেজে পড়া শিক্ষিত মেয়ে হয়ে এ দেশের সবচেয়ে কলঙ্কজনক লজ্জাকর কুসংস্কারের বীভৎস নজির তুলে কিসের সাফাই গাইতে চাইছিস? ছি, ছি। আমি তোকে কিছুই শেখাতে পারিনি। কিচ্ছু দিতে পারিনি। আর আমাকেই বা শেখাতে হবে কেন, তুই নিজেই বা নিজের শক্তিতে শিখবি না কেন?’
কাকাকে এত ক্ষুব্ধ বন্দনা কোনদিন দেখেনি। তিনি তার দিকে তাকিয়ে নেই। তাঁকে ভেদ করে পেছনে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছেন। যেন বন্দনা তাঁর সামনে থেকে মুছে গেছে।
কাকা বলছেন, ‘যে সাবিত্রী বেহুলার গল্পের তুই উল্লেখ করলি, সে তো মানুষের সবচেয়ে বড় আকাঙক্ষা অমৃতত্ব লাভের প্রতীক কাহিনী বলেই আমি জানি। বিশুদ্ধ জ্ঞান, বিশুদ্ধ প্রেম দিয়ে অমৃতত্ব লাভ। এত পড়েছিস এটুকু বুঝিসনি? দেখতে পাই তুই রোজ অভিমন্যুর ছবিতে ফুল দিস, ঠাকুরের ছবির পাশাপাশি তার ছবি রেখে দিয়েছিস। ধূপধুনো দিয়ে পুজো করিস। তোর সেন্টিমেন্টে লাগবে বলে কিছু বলতে পারিনি। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে বাধা দেওয়া উচিত ছিল। এমনি করেই কুসংস্কারের চোরাবালিতে তোরা ডুবিস।’
বন্দনা ব্যথিত গলায় বলল, ‘ফুল দিতেও বারণ করছ?’
‘ফুল দিতে বারণ করিনি বুড়ি, আনুষ্ঠানিক পুজো করতে বারণ করছি। ভালোবাসা মনের ধর্ম। তাকে যে মুহূর্তে অনুষ্ঠানের মধ্যে ফেলবি, সেই মুহূর্ত থেকে সে মরতে আরম্ভ করবে। স্তূপীকৃত হয়ে থাকবে শুধু শুকনো ফুল বেলপাতার জঞ্জাল। মন্দিরে মন্দিরে একটু ঘুরলেই তো এ তথ্য বুঝতে বাকি থাকে না।’
‘আকাশের দিকে চেয়ে দ্যাখ শুদু এক মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির অন্তর্গত কিছু গ্রহতারা দেখতে পাচ্ছিস। তাই-ই এতো যে হিসেব হয় না। তোর আমার দৃষ্টির বাইরে। ধারণাশক্তির বাইরে অবাধ অগাধ মহাশূন্য পড়ে আছে, অণুর পরে অণু জমে জমে সৃষ্টি হল জল, মাটি, প্রাণী। এই সব, এই এত আয়োজন কি বৃথা মনে করিস? বিজ্ঞানের কথা না হয় ছেড়েই দিলুম।’
‘আমি তো মনে করি অভিমন্যু এক অর্থে পুণ্যাত্মা মানুষ ছিল। মাত্র আটত্রিশ বছরের অভিজ্ঞতা তার প্রয়োজন হয়েছিল এ যাত্রায়। তুই কি মনে করিস তোর পুজো নিতে এখনও সে পৃথিবীর আবহমণ্ডলের মধ্যে গতিহীন প্রেত হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে! জানিস না মানুষের মধ্যে অঙ্গুষ্ঠ পরিমাণ যে আলোকবর্তিকা জ্বলছে, অভিজ্ঞতার সারটুকু নিয়ে তাকে বিশুদ্ধ দীপ্তি হতে হবে বলেই তার বারবার পৃথিবীতে আসা? অভিমন্যুর যে অভিজ্ঞতাটুকুর প্রয়োজন তোকে দিয়ে ছিল, তা নিশ্চিত পূর্ণ হয়ে গেছে, দেহাতীত আত্মা কাউকে মনে রাখে না, সতীত্ব সাধ্বীত্ব ইত্যাদি বাঁধা বুলি কপচে তুই যে জিনিসের ছায়ামাত্র প্রকাশ করতে চাইছিস সেই ভালোবাসা মনে রাখার প্রয়োজনও আর তার নেই।
বন্দনা আর কাঁদছিল না, অবাক হয়ে কাকার উত্তেজিত মুখের দিকে চেয়েছিল, বলল, ‘বাঃ, যে মুহূর্তে একটা মানুষ চলে গেল, অমনি তাকে ভুলে যাব? তাকে আর মনে রাখার দরকার নেই? পুরনো কাপড়ের মতো ধোবার বাক্সে ফেলে দিয়ে নতুন কাপড়ের পাট ভাঙব? এই তোমার তত্ত্ব কাকা? এ যে বড় হৃদয়হীন দর্শন, তোমার বিজ্ঞান, তোমার আধ্যাত্মিক তত্ত্ব মাথা দিয়ে বুঝলাম, কিন্তু হৃদয় কি তা মানে?’
—‘ভুলে যাওয়া উচিত তা তো বলিনি; প্রিয়জনের সঙ্গে আমাদের যে সম্পর্ক তার মধ্যে একটা চিটচিটে আসক্তির দিক আছে, সেটা ত্যাগ করার কথা বলছি। সেটা বাদ দিলে যে ভালো