অমৃতা – বাণী বসু

অমৃতা - বাণী বসু

ঠিক বেরোতে যাচ্ছে, আজকে ফার্স্ট আওয়ারেই ক্লাস আছে, এমন সময়ে ফোনটা বাজল, শ্বশুর ফোনটা ধরেছিলেন, চেঁচিয়ে বললেন—আবার তোমার বন্ধু, অমৃতা।

‘আবার’টা উনি কেন বললেন অমৃতা বুঝতে পারল না। আজকে তো তার কোনও বন্ধু এর আগে ফোন করেনি! এ বাড়িতে এখন সবচেয়ে বেশি ফোন অবশ্য তারই আসে। খুব স্বাভাবিক। কলেজ ইউনিভার্সিটি ধরলে অনেক বন্ধু তার। সকলেই যে এক পর্যায়ের তা নয়। খুব ঘনিষ্ঠ, খানিকটা ঘনিষ্ঠ, পড়াশোনার সূত্রে বন্ধু, গানবাজনার সূত্রে বন্ধু … এইরকম অনেক শ্রেণী-বিভাগ আছে। তারা ফোন করে, করবেই। অমৃতা বেশিক্ষণ কথা না বলে বুঝিয়ে দেয় আগে যেমন ফোনটাকে একটা গল্প করার মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করত তারা, এখন আর তা চলবে না, চলে না, কিন্তু প্রাণ ধরে কিছুতেই কথাটা সোজাসুজি বলে দিতে পারে না সে কাউকে।

শ্বশুরমশাই অদূরে বসে কাগজ পড়ছেন। রিটায়ার্ড মানুষ। সারাদিন ধরে শুধু খবরের কাগজই পড়েন, উল্টে পাল্টে, পাল্টে উল্টে। দুপুরবেলা হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছিলেন, সন্ধেবেলায় অমৃতা চা নিয়ে যেতে হন্তদন্ত হয়ে বললেন—‘কাগজটা, কাগজটা অমৃতা! কাগজটা কোথায় গেল?’ আচ্ছা, অমৃতা তো দশটার সময়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেছে, ঢুকছে এই পাঁচটায়। সে কী করে জানবে কাগজটা কোথায়! উনি কখনও খাবার টেবিলে পড়েছেন, কখনও বসার ঘরে পড়েছেন, কখনও শোবার ঘরে। অমৃতা সব জায়গায় তন্নতন্ন করে খুঁজতে থাকে, আর উনি বলতে থাকেন—‘পার্সপেকটিভটা পড়া হয়নি, কড়চাটাও বাদ পড়ে গেছে, এ হে হে, আজ সেন্টারস্প্রেডে সুনন্দ সান্যালের লেখাটার কন্‌ক্লুশন হল। দুটো মিলিয়ে না পড়লে …’ যেন কাগজগুলো এইটুকু বাড়ি থেকে একেবারে ছুঁ-মন্তরে উড়ে গেছে।

কাগজটা শেষে বাথরুম থেকে পাওয়া যায়। রাজা-উজিররা বাথরুমে বই পড়তেন, বা রইস নেতা ব্যক্তিরা এখনও পড়ে থাকেন এমন কথা অবশ্য শোনা যায়। কিন্তু তার শ্বশুরমশাই অনুকূল গোস্বামী যদি তাদের চার বাই আট সরু লম্বা টয়লেটে কমোডের পেছনে সিসটার্নে কাগজটা রেখে আসেন, তাহলে ধরে নিতে হয় তিনিও বাথরুমে কাগজ পড়ে থাকেন। হোক সে জায়গাটা অপরিসর। পড়াশোনার ব্যবস্থা সেখানে না-ই থাক।

কাগজটা নিতে সে সময়ে কেমন একটু গা ঘিন ঘিন করে অমৃতার। অপরিষ্কার কিছু নয়। তাকে নিজেকেই চানের আগে দুটো বাথরুম ধুতে হয়। কিন্তু একটু পুরনো হতেই কমোড, সিসটার্ন, বেসিন সব কিছুতেই একটা বিবর্ণ ভাব এসে গেছে। মানুষের মল-মূত্রের কথাই কেন কে জানে তার মনে পড়ে যায় বারবার। তার বাবার যখন পা ভেঙেছিল, বাবাকে সে বেডপ্যান দিয়েছে, সামান্য একটু ঘেন্না কি আর করেনি? কিন্তু তাকে ছাপিয়ে ছিল বাবার জন্য দুশ্চিন্তা, যত্ন এবং সেবা করার আগ্রহ, ঠিক সেই ভাবটা শ্বশুরবাড়ির টয়লেট এবং শ্বশুর-শাশুড়ির মলমূত্র সম্পর্কে তার নেই, এটা বুঝতে পেরে একটু লজ্জাবোধ সে করে, কিন্তু ওই পর্যন্তই, ঘেন্নাটাকে আটকাতে পারে না। তবে, সেটা সে বুঝতে দেয় না। ঘেন্নাটাকে জয় করার চেষ্টাও করে যাচ্ছে অনলস। বাথরুম পরিষ্কার করার সময়ে, চান করে রাঁধতে রাঁধতে সেখান থেকে কাগজ আনবার সময়েও। —কে ফোন করল এখন?

—হা লো—

—অমৃতা, আমি রে! আজ তোর ছুটি কটায়? —শম্পার গলা পৃথিবীর যে কোনও প্রান্তে শুনলে চিনতে পারবে সে।

—সওয়া চারটে—শ্বশুরের দিকে আড়চোখে চেয়ে সে বলে।

—ইস্‌স্‌, দশটা থেকে চারটে, ইউনিভার্সিটিতে পড়ছিস না ফ্যাক্টরিতে দিনমজুরি করছিস রে!

—ওই কাছাকাছিই হল৷

—এত কাঠ-কাঠ করে কথা বলছিস কেন রে? হাতের কাছেই কেউ আছেন বুঝি?

—হুঁ।

—আমাকে আড়াইটে নাগাদ একটু সময় দিতে পারবি?

—আবার হুঁ!

—ঠিক আছে, ছাড়ছি—রিসিভারটা রেখে দিল অমৃতা।

তার আসলে আড়াইটেতে ছুটিই আজ। শম্পাকে সময় দিতে কোনও অসুবিধে নেই। কিন্তু এখানে সে ছুটির সময়টা জানায় না। এইটুকু, সারাদিনে এইটুকু সময় সে চুরি করে।

—বাবা আসছি—চটির স্ট্র্যাপে পা গলাতে গলাতে সে বলে। শ্বশুরমশাই ওরই মধ্যে একবার খাবার টেবিলের দিকে তাকিয়ে নেন। তিনটে বড় বড় ক্যাসেরোলে ওঁর আর শাশুড়ির দুপুরবেলার খাবার-দাবার গুছিয়ে রেখেছে অমৃতা। টেবিলের ওপর টেবল ক্লথ, তার ওপরে ম্যাট পাতা, সেখানে কাচের প্লেট উপুড় করে রাখা, একটা করে কাচের বাটি। দুটো হাতা ও চামচও পাশে রেখে দিয়েছে সে।

দশটার ক্লাসটা বোধহয় গেল। এগারোটারটা করতেই হবে, জে. বি.-র ক্লাস না করলে, এত কম সময় পড়াশোনা করে, অর্থাৎ এত ফাঁকি দিয়ে এম. এ.-টা টপকাতে পারবে না সে। অথচ, টপকানো দরকার, ভীষণ দরকার।

ঠিক পুকুরের ধারে নিমগাছটায় ফুল এসেছে। সাদা সাদা গুঁড়ির মতন। একটা মৃদু গন্ধ পেয়ে মুখ তুলেছিল। দেখতে পেল। এখন যদি যাদবপুর-হাওড়া মিনিটা ধরতে পারে তাহলে ভাল হয়। সোজা এসপ্লানেড চলে যাবে, সেখান থেকে কলেজ স্ট্রিট। নইলে গড়িয়াহাট পর্যন্ত অটো, তারপর চেঞ্জ করতে হবে। এখন আর নিমফুল-টুলে মন দিলে তার চলবে না। রাস্তা দিয়ে যে মানুষগুলো চলাফেরা করছে, খুব মড মেয়ে, মিনিস্কার্ট, কিংবা মডেলিশ চেহারার যুবক, শক্ত সমর্থ প্রৌঢ় বা টিপ ধেবড়ে যাওয়া প্রৌঢ়া, এই সমস্ত দেখতে, সব কিছুর দিকে মন দিতে তার ভীষণ ভাল লাগে। মনে মনে গল্প ফাঁদে। ওই প্রৌঢ়া যাঁর সিঁদুর টিপ ধেবড়ে গেছে? উনি সিঁদুর-টিপ পরেছেন কেন? আজকাল তো সব্‌বাই পেছনে আঠা লাগানো বিন্দি পরে। উনি পরেছেন সিঁদুর-টিপ। অথচ স্পষ্টই দেখা যাচ্ছে উনি অফিস যাচ্ছেন, ডালহাউসির টিকিট কাটলেন। অর্থাৎ বেশ আধুনিক। বেশিদিন একভাবে পরলে বিন্দির পেছনে চামড়ায় একটা দাগ হয়ে যায়। উনি বোধহয় এই দাগটাকে ভয় পান। আর তা নয় তো সিঁদুর-টিপ না পরলে বিবাহিতত্ব, সতীত্ব এ সব জাহির করা যাবে না মনে করেন। অনেকেই আজকাল কপাল থেকে সিঁদুর টানেন। এরকম মহিলা এখনও কত আছেন, প্রগতিশীলরা জানেনও না। কিংবা, এই সবচেয়ে সহজ সমাধানটাই তার মনে আসেনি। উনি হয়তো ভিতু মানুষ, কুসংস্কারও আছে, কিন্তু ওঁর একজন শাশুড়ি আছেন, শাশুড়ি ভিতু হোন বা না হোন আরও কুসংস্কারে ভর্তি। সেই সেকেলে শাশুড়িই ওঁকে সিঁদুর-টিপ পরতে বাধ্য করেছেন। ইস্‌স্, এখনও শাশুড়ির সর্দারি! কত বয়স হবে ভদ্রমহিলার! পঞ্চাশের এদিক ওদিক, ওঁর শাশুড়ি হয়তো ঠিক বাহাত্তর। বাহাত্তুরে। এম. এ.-টা পাশ, তারপর চাকরি, ব্যাস, তারপর তার শাশুড়ির খবরদারি থেকে সে মুক্তি খুঁজবে।

আর ওই যে মডেল চেহারার যুবক। শার্টের ওপরের বোতাম খোলা রেখেছে। ভেতরে ওর বক্ষকেশ দেখা যাচ্ছে। এই যুবকটি ভেবেছে যেহেতু তার প্রকৃতিদত্ত গড়নটা আছে, এবং ব্যায়াম-ট্যায়াম করে সে তাকে আরও সংগঠিত করে তুলেছে, সেহেতু সে তার শার্টের প্রথম অথবা দ্বিতীয় বোতাম খোলা রেখে বক্ষকেশের পৌরুষ যথাযথ দেখাতে পারলেই মেয়েরা সব একেবারে তার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়বে। ঠিক তার বর অরি, পুরো নাম অরিসূদন, যেমন ভাবে। তবু তো অরির এ যুবকটির মতো মুখশ্রী নেই। দেহখানা ভাল হলেও এমন সুসংগঠিতও নয় মোটেই। অরি ভাবে, পৃথিবীর যেখানে যত মেয়ে আছে, ওকে দেখলেই কাত হয়ে যাবে।

মিনিস্কার্ট পরা মেয়েটাকে অসহ্য লাগে অমৃতার। ও কী ভেবেছে কী। অতখানি পা বার করে রাখলে ওকে খুব সুন্দর লাগবে? সুন্দরও নয়, সেক্সি। এই এক হয়েছে আজকাল। সেদিন দোকানে গিয়েছিল। নিউমার্কেটে। বাচ্চাদের পোশাকের দোকানে দাঁড়িয়ে ও আর মিলি, ওর রমণী চ্যাটার্জি পাড়ার বন্ধু, এখন যাদবপুর পাড়ার বউ, মিলির ভাইঝির জন্মদিনে দেবার জন্য একটা ফ্রক দেখছিল। পাশের ভদ্রমহিলা বললেন—দেখি দেখি। এরকম আর আছে?

দোকানি আর একটা ওরকম বার করে দিলে নিজের বছর চারেকের মেয়ের গায়ে ফেলে, অদ্ভূত একটা মুখভঙ্গি করে মহিলা বললেন—ওহ, ইটস নট সেক্সি এনাফ।

মিলির এত রাগ হয়ে গেল যে ফ্রক ওরা আর কিনলই না। খেলনার দোকানে গিয়ে একটা পেল্লাই টেডি-বেয়ার কিনে ফেলল। টেডিটা আবার মিলির এত পছন্দ যে ও বলছে ওটা প্রাণ ধরে কাউকে সে দিতে পারবে কি না সন্দেহ। আজকাল এখানেই চমৎকার চমৎকার সফ্‌ট টয় তৈরি হচ্ছে।

মেয়েটা ছোট স্টেপ কেটেছে চুলে। ওপরের টপটা ওর ঢিলে। কিন্তু স্কার্টটা হাঁটুর ওপর। সবাই তাকাচ্ছে। এই গড়িয়াহাট পাড়াতেও। সবচেয়ে আধুনিক পাড়া বলে যার নাম। চাউনিতে ঠিক যে কোনও লোভ আছে তা নয়। যেটা আছে তাকে বলে ডিসগাস্ট, ছেলেগুলো বোধহয় মনে-মনে মজা পাচ্ছে। মুখে কিছু জানতে দিচ্ছে না। শি ডাজ্‌ন্‌ট নো শি হ্যাজ মেড হারসেল্‌ফ এ পিস অফ এগজিবিট। আচ্ছা ওর কি মা নেই? যিনি ওকে বলে দেবেন, এটা কলকাতা, কলকাতা এখনও লস এঞ্জেলেস নয়, এবং কলকাতার অফিস-টাইমের রাস্তা, ডিসকোথেকও নয়, চ্যানেল ফাইভও নয়। ওর মা নিশ্চয়ই তার শাশুড়ির মতো, যিনি তাঁর দুই বাচ্চার মা মেয়ের বেলায় একেবারে অন্ধ। মেয়ে যখন পিঠ-খোলা, হল্টার ছাঁট ব্লাউজ পরে ঘোরে কিছুই বলেন না, কিন্তু তার বেলায় সালোয়ার-কামিজ পরাও বন্ধ করে দিয়েছেন।

কী সুন্দর সালোয়ার-কামিজগুলো সে করিয়েছিল বিয়ের আগে। কালো জর্জেটের ওপর মেটে লাল কারুকাজেরটা পরেই তো সে অরিসূদনের সঙ্গে আলাদা সাক্ষাৎকারে গিয়েছিল বালিগঞ্জ কোয়ালিটিতে। শ্বশুর-শাশুড়ি যেদিন দেখতে আসেন সেদিন ঘটনাচক্রেই একটা নীল টাঙ্গাইল পরে ছিল। ওরা তো জানত না ওঁরা আসবেন। অতর্কিতে এসে তাকে প্রসাধন-বিনা দেখতে চেয়েছিলেন নাকি। ইস্‌স্ সেদিন যদি সে একটা স্কার্ট পরে থাকত। তখন নাকি ওঁদের ওকে খুব পছন্দ হয়েছিল। এখন আর পছন্দ হয় না বোধহয়।

ইস্‌স্‌—যাই-ই দেখুক, যাই-ই ভাবুক, যত দূরেই যাক—সেই শ্বশুর-শাশুড়ি-ননদ-বর প্রসঙ্গ এসে পড়েছে তার মনে। কত ছোট্ট হয়ে গেছে তার পৃথিবীটা, কত ছোট হয়ে গেছে তার জীবন, মনও কী!

বাসটা খুব স্পিডে এসেছে। এমন স্পিডে আসছিল এক এক সময়ে যে ভয় করছিল, বাসটা আবার না খবর হয়ে যায়। সেইসঙ্গে তার সহযাত্রীরা এবং সে-ও। আজকাল এরকম আকছার ঘটছে। স্টপে এসে থামতে, কী শান্তি। কী মুক্তি। পুরনো আকাঙক্ষাগুলো ফিরে আসতে থাকে হুড় হুড় করে। সেই পরিচিত, চিরপরিচিত কলেজ স্কোয়ার, সেন্টিনারি বিল্ডিং, বিধ্বস্ত দর্শন আশুতোষ বিল্ডিং এক ঝলক, অমৃতা ছুটতে লাগল, মাত্র পাঁচ মিনিট দেরি হয়েছে, জে. বি. নিশ্চয়ই ঢুকতে দেবেন। দৌড়তে দৌড়তে, সত্যিকার গলদ্‌ঘর্ম অবস্থায় ক্লাসে ঢুকল সে।

—আসতে পারি, ম্যায়াম?

—এসে তো পড়েইছ, আর অনুমতির দরকার কী!

ক্লাসসুদ্ধ সবাই হেসে উঠল। যাক্ বাবা, মজার ওপর দিয়ে গেছে। জে. বি. মোটেই সবদিনে এরকম মুড-এ থাকেন না। এ নিয়ে ক্লাসে প্রায়ই বন্ধুদের সঙ্গে আলোচনা হয়।

—দ্যাখ, এ. আর. রাগী মানুষ এটা আমরা জেনে গেছি। চোখ সব সময়ে রাগে গোল গোল হয়ে থাকে। পি. এম আবার বড্ড হাসি-খুশি, হাসকুটে বললেই হয়। একটা কোনও মজার উপলক্ষ পেলে সেটাকে আর ছাড়তে চান না। তখন চুলোয় যাক মঙ্গলকাব্য, ক্লাসে খালি হাসির হর্‌রা ওঠে, কিন্তু জে. বি. যে কখন কী রঙে থাকবেন সেটা কেউ বলতে পারবে না। এমন কেন রে উনি? এই ঝড় এই বাঁশি। এই আগুন এই জল! বুঝি না বাবা।

অমৃতা কিন্তু আজকাল ব্যাপারটা বোঝে। এগুলো প্রোফেসর জে. বি.-র পেছনে যে সংসারী জে. বি. আছেন, তাঁর সেই বিশেষ দিনের অভিজ্ঞতার উপচোনি, যাকে বলে লেফ্‌ট-ওভার। যেদিন সকালে কিছুর জন্য কিছু না বরের সঙ্গে ঝগড়া হয়ে যায়, কি শাশুড়ি কি শ্বশুরের সঙ্গে একচোট সেদিন জে.বি. বিরক্ত হয়ে থাকেন। ভীষণ দায়িত্বশীল টিচার তাই লেকচারের ওপর সে সবের বিশেষ প্রভাব পড়ে না, কিন্তু লেকচারের বাইরে যেটুকু অবকাশ, সেখানে পড়ে। এগুলো যে জে. বি. তাকে ডেকে বলেছেন তা নয়। কিন্তু সে জানে। নিশ্চিত জানে।

এ কথা অমৃতা যদি বন্ধুদের, মানে সহপাঠীদের বলে ওরা রৈ রৈ করে উঠবে একেবারে।

—প্রবলেম সবাইকার আছে অমৃতা, তার মানে এই নয় যে বাড়ির ঝালটা তুমি ক্লাসে ঝাড়বে।

‘প্রবলেম সবাইকার আছে’ এটা একটা কথার কথা হয়ে গেছে আজকাল। কেউ বুঝে বলে না, অনুভব করে বলে না। কী অভিজ্ঞতা আছে ওদের? কতটুকু? বাস্তবের কী জানে ওরা?

শর্মিষ্ঠার প্রবলেম কী? না ওর মা-বাবা চান ও দারুণ রেজাল্ট করে, রিসার্চ-টিসার্চ করে একটা অধ্যাপিকা-টিকা হোক, মা-বাবার এই চাওয়ার সঙ্গে শর্মিষ্ঠার চাওয়া একদম মেলে না। শর্মিষ্ঠা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছে স্রেফ আড্ডা দেবার জন্য। অধ্যাপিকা হয়ে সারাজীবন পড়াশোনা করা আর পড়ানো?—ওরে বাবা। তার চেয়ে কলেজ স্কোয়ারে ঝাঁপ দিয়ে সুইসাইড করাও ভাল–ও বলে থাকে।

কিন্তু স্বাভাবিক বুদ্ধি আর স্মৃতিশক্তি প্রখর বলে ও বরাবর ভাল রেজাল্টটাও করে যাচ্ছে। ও এই ব্যাপারটা নাকি বাবা-মাকে বোঝাতে পারে না।

তিলকের কী প্রবলেম? না এত বড় ক্লাসে মাত্র নটি ছেলের অন্যতম ও। ওর বন্ধুরা যখন ডাক্তারি, এঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে, ফিজিক্স, কেমিস্ট্রি, ম্যাথমেটিকস এই সব পড়ছে, তখন ওকে বাংলার মতো একটা রদ্দি সাবজেক্ট পড়তে হচ্ছে। রদ্দি কেন রে? তুই জে. বি.-র ক্লাস, এ. কে. বি.-র ক্লাস, এ. আর.-এর ক্লাস উপভোগ করিস না? ভাল লাগে না তোর রবীন্দ্রনাথ খুঁটিয়ে পড়তে? ভাল লাগে না আধুনিক কবিতা বুঝে নেবার সুযোগ?—হ্যাঁ, লাগে, ভালই এনজয় করে, কিন্তু কোনও প্রসপেক্ট তো নেই! ভবিষ্যতে কী হবে এই ভাবনায়, আর সংখ্যাগরিষ্ঠ মেয়ে-ক্লাসে পড়তে বাধ্য হবার কমপ্লেক্সেই ছেলেটা মুখ শুকিয়ে থেকে থেকে নিজের মনের ওপর অহেতুক চাপ বাড়াচ্ছে।

অনিন্দিতার প্রবলেম তো আর এক। ওর দিদিকে ওর চেয়ে দেখতে অনেক সুন্দর, তাই লেখাপড়ায় তাকে ওর ছাড়িয়ে যেতেই হবে। বোঝো? এটা একটা প্রবলেম হল? দিদিটা তো তোরই, না কী!

অমৃতার একেক সময় মনে হয় নিজের দিনরাতগুলো সে ওদের ধার দেয়। ওই অনিন্দিতাকে, ওই তিলককে, শর্মিষ্ঠাকে, রণিতাকে, চঞ্চলকে। ধার দেয় অন্তত একটা সপ্তাহের জন্য। তখন হয়তো বাস্তব সত্যি সত্যি কী, সে ধারণা ওদের হবে।

আপাতত কল্লোল যুগ এবং অচিন্ত্য সেনগুপ্ত এবং জগদীশ গুপ্ত। অমৃতা ক্লাসে মন দেয়।

বেল বাজল, ক্লাস শেষ হচ্ছে। জয়িতাদি অর্থাৎ জে. বি. হঠাৎ বললেন—অমৃতা ব্যানার্জি।—হ্যাঁ— সে উঠে দাঁড়াল, বাধ্য বিনীত মেয়ের মতো।

—আজ তিনটের সময়ে আমার সঙ্গে দেখা কোরো একবার। সেন্ট্রাল লাইব্রেরিতে থাকব।

সর্বনাশ! আবার দেখা-টেখা করতে বলেন কেন রে বাবা! বন্ধুরা বলতে লাগল—তোর ব্যাপারই আলাদা অমৃতা, তুই জয়িতাদির চোখে পড়ে গেছিস। এখন রোটেশন-এ উনিই হেড অফ দা ডিপার্টমেন্ট। তোর ফার্স্টক্লাস বাঁধা …

বিরক্ত অমৃতা যতই ওদের মন্তব্যগুলো ঝেড়ে ফেলতে চেষ্টা করে, ততই ফেউয়ের মতো পেছনে লেগে থাকে ওরা।

তিলক বলল—অধমের দিকে একটু কৃপাবৰ্ষণ করিস রে অমৃতা, একেই তো স্কুলমাস্টারি ছাড়া আর কিছু জুটবে বলে মনে হচ্ছে না।

অমৃতা রেগে-মেগে বলল—স্কুলমাস্টারি তোর মতো ছেলেদের না জোটাই উচিত। তাগড়া স্বাস্থ্য কর দিকি, রিকশ কি অটো চালাবি এখন, বেশ পুরুষালি কাজ। অন্তত নাকে কাঁদবার সময়টা পাবি না।

অমৃতার বাবা স্কুল-টিচার। স্কুল-টিচিং নিয়ে এসব কথা বললে ওর গায়ে লাগে। তিলকের মতো বা অনিন্দিতার মতো ও কমপ্লেক্সে ভোগে না। উচিত জবাব দেয়।

আজকে অর্থাৎ দুটো অ্যাপো। আড়াইটের সময়ে শম্পা, শম্পাকে সাধারণত ক্যানটিনেই দেখা করতে বলে ও। তো তারপর ছুটতে হবে সেন্ট্রাল লাইব্রেরিতে। খুঁজে বার করতে হবে জয়িতাদিকে। কেন ডেকেছেন কে জানে বাবা! বুকটা গুরগুর করছে। শম্পা আবার কথা শুরু করলে থামতে জানে না। কোথাও কমা, ফুল স্টপ নেই ওর। কথার সূত্রে কথা, তার সূত্রে আরও কথা, আর কাউকে কিছু বলতেই দেবে না ও। অর্থাৎ ফার্স্ট থিং ওকে আজ বলতে হবে,—শম্পা আমার সময় নেই, তিনটের সময়ে জয়িতাদি ডেকেছেন। মাস্টারমশাই, বুঝিস তো?

চৈত্র শেষ হলেও দিনটা বেশ ফুরফুরে আজ। হাওয়া-টাওয়া দিচ্ছে। দুটোয় ছুটি হতে ওরা সবাই কফিহাউজ যাচ্ছে, তুমুল আড্ডা হবে সেখানে, যে যার পকেট থেকে ব্যাগ থেকে টাকা-পয়সা বার করবে। মোগলাই আসবে, পকোড়া আসবে, কফি তো আছেই। ইংরেজির তিশান ছেলেটা আসলে আরও জমবে। তিশান হচ্ছে একটি সবজান্তা হামবড়া ছেলে। ভীষণ আঁতেল-আঁতেল ভাব করে। তো আঁতেলমিটাও তো কোথাও না কোথাও ফলাতে হবে। তিশান খুব সম্ভব এই তাদের গ্রুপটাকে সে জন্য বেছে নিয়েছে। তিশানের আসল নাম নিশান। ও হচ্ছে আর্ট বিষয়ে অথরিটি। সব জানে। প্রি-র‍্যাফেলাইট, ইমপ্রেশনিস্ট, পোস্ট-ইমপ্রেশনিজম, সুররিয়্যালিজম, ডাডাইজম স-ব। তা ও “তিশান-তিশান’ করত, অমৃতাই একদিন জিজ্ঞেস করে তিশান কে রে? কোন দেশের? কবেকার? তখনই বোঝা যায় ওরা যাকে টিশিয়ান বলে জানে তাঁর নামের আসল উচ্চারণ নাকি তিশান। ওরা যাকে জিয়োতো বলে, তাঁর নামটা উচ্চারিত হবে জত্তো৷ র‍্যাফায়েল নয়, র‍্যাফেইল। ওদের মুখে ‘গয়া’ শুনে তো নিশান বাঁকা হেসে মুখে একটার পর একটা মৌরি ফেলতেই লাগল, ফেলতেই লাগল, শেষে বলল—শুধু গয়া বলছিস কেন? ‘গয়াগঙ্গাপ্রভাসাদি কাশী কাঞ্চী মথুরা’ সবগুলো বল। গয়া নাকি উচ্চারণ নয়। ওটা হবে ‘গোইয়া’। তো সেই সূত্রেই শর্মিষ্ঠা ওর নাম দেয় তিশান। সেই তিশান আসলে আড্ডাটা ভাল জমে ওঠে। পারস্পরিক ঠাট্টায়, কথার পরে কথার খেলায়, তিশান তাদের যে জ্ঞান দান করে সেগুলোও নেহাত ফ্যালনা নয় : ভার্জিনিয়া উল্‌ফ নাকি একটা করে উপন্যাস লিখতেন আর পাগল হয়ে যেতেন, লরেন্স নাকি ভেগেছিলেন তাঁর নিজের মাস্টারমশাইয়ের স্ত্রীকে নিয়ে, শুধু অসকার ওয়াইল্ড নয়, ফরস্টার সাহেবও ছিলেন সমকামী, শেলির প্রথম বউ নাকি শেলির অবহেলায় বারনারী হয়ে গিয়েছিলেন … এইসব কেচ্ছা কেলেঙ্কারি কি পাগলামি না থাকলে না কি কোনওরকমের শিল্পীই হওয়া যায় না। সে যাক, আজ হয়তো তিশানের সঙ্গে ওদের খুব জমবে, কিছুটা সময় তরলভাবে কাটতে পারত, কিন্তু অমৃতার তা কপালে নেই। শম্পা তার স্কুলের সময়কার বন্ধু। চিরকালই দুজনে যত ঝগড়া, তত ভাব। শম্পার ধারণা, অমৃতা হল যাকে বলে ‘লাকি’। সেই জন্যেই বরাবর অমৃতার রেজাল্ট শম্পার চেয়ে ভাল, সেইজন্যেই অমৃতার মা-বাবা দুজনেই জীবিত, এবং সেইজন্যেই অমৃতার এত অল্পবয়সে অত ভাল বিয়ে হয়েছে। শম্পা চিরকালের ‘আনলাকি’। বিধাতাপুরুষ আঁতুড় ঘরেই তার কপালে ঢ্যাঁড়া দিয়ে রেখেছেন তাই তার অল্পবয়সে বাবা মারা যান, তাই তার মামারা তাকে দেখে না, মাকে চাকরি করতে এবং ভীষণ ভুগতে হয়, তাই-ই শম্পা কালো, তাকে দেখতে ভাল না, অমৃতার চেয়ে অনেক বেশি বুদ্ধিমতী হওয়া সত্ত্বেও তাই-ই তার রেজাল্ট অমৃতার চেয়ে খারাপ, ইত্যাদি ইত্যাদি ইত্যাদি।

ভাল করে ভেবে দেখতে গেলে সম্পর্কটা ঈর্ষার। ইচ্ছে করলে অমৃতাও শম্পাকে হিংসা করতে পারত ঠিক যে যে কারণে শম্পা তাকে হিংসে করছে সেই সেই কারণেই। শম্পার মা চাকরি করেন বলে অমৃতার মায়ের থেকে তিনি অনেক বাস্তববোধসম্পন্ন, কাণ্ডজ্ঞান তাঁর অনেক বেশি, স্বাধীন ইচ্ছার মানুষ। শম্পা কালো বলেই তার চেহারার শ্রীটুকু চট করে চোখে পড়ে না, না হলে হয়তো অমৃতার মতোই অল্প বয়সে বিয়ে হয়ে যেত। অমৃতার যেমন ভাষাজ্ঞান, সাহিত্য-জ্ঞান ভাল, শম্পার যে তেমন অঙ্কের মাথা অনেক ভাল, যে কারণে সে বি.এসসি করেই কম্‌পুটার ট্রেনিং নিয়ে মোটামুটি ভাল একটা চাকরি করতে পারছে। সেও তার ইচ্ছেমতো স্বাধীনভাবে জীবনের সিদ্ধান্তগুলো নিতে পারবে। শম্পা জানে না অমৃতার তুলনায় সে কত বেশি ভাগ্যবতী। একমাত্র দুর্ভাগ্য তার বাবার অল্পবয়সে মারা যাওয়াটা। সেটা মানতেই হয়। কিন্তু, অমৃতা জানে এসব কথা সে শম্পাকে বোঝাতে পারবে না। কখনও না।

ওই তো আশুতোষ বিল্ডিং-এর গেট দিয়ে শম্পা হন্তদন্ত হয়ে ঢুকছে। একটা হালকা রঙের ছাপা সালোয়ার কামিজ আর একটা পরিষ্কার বিনুনিতে শম্পাকে কত হালকা কত সুশ্রী, নির্ভার, স্বাধীন সুন্দর দেখাচ্ছে তা যদি ও জানত!

—অমৃতা, বাঃ এই তো তুই পাংচুয়ালি এসে গেছিস। চল কফিহাউজে যাই।

—না রে আমাকে আজকে প্রোফেসর বাগচি সেন্ট্রাল লাইব্রেরিতে তিনটের সময়ে যেতে ডেকেছেন। তোর কী বলবার আছে তুই তাড়াতাড়ি বল বরং। আমরা একটু ওইদিকে দ্বারভাঙার সিঁড়িতে বসি চল।

—এত তাড়া করলে হয়? এভাবে কিছু বলা যায়? অমি, তুই আমার কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছিস, প্রতিদিন …

এ নালিশও শম্পার বহুদিনের। প্রতিবাদ করে লাভ নেই। অমৃতা বলল—কী করব বল, প্রোফেসর ডেকেছেন, না করতে তো আর পারি না। তুই বল না। আমি শুনছি। শুধু একটু ছোট করে বল। তোর নিশ্চয়ই কোনও জরুরি কথা আছে।

—জরুরি, বলে জরুরি। শম্পা মুরুব্বির মতো হাত আর কান নেড়ে বলে। কানে খুব বড় সাইজের রিং পরেছে ও। ওর মুখের পক্ষে অনেক বড়। কিন্তু রিংগুলো ওর মাথা নাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দুলতেই অদ্ভূত ভাল লাগে ওকে। ওর চোখের দিকে তাকিয়ে অমৃতা মনে মনে গেয়ে ওঠে ‘কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি।’ গানটা যে কবে গলা থেকে মনে চলে গেছে ও টের পায়নি। এখন যেন আর গানের দিন নেই।

—তোকে একটা কথা বলিনি অমৃতা, প্লিজ কিছু মনে করিস না, আমার ইমিডিয়েট বস, অর্থাৎ প্রোজেক্ট ডিরেক্টর বেশ কিছুদিন ধরে খুব মানে বেশ ইনট্‌রেস্ট দেখাচ্ছে আমার ওপর। তোর কী মনে হয়?

—আমার কী মনে হবে? সিচুয়েশন তোর, মনে হওয়াটাও তোর।

শম্পার চোখে অভিমান ঘনিয়ে আসে তক্ষুনি।

—কথাটা তোকে বলিনি, কারণ আমি খুব শিওর ছিলাম না। রাগ করছিস কেন?

—আরে! রাগ করিনি। কিন্তু আমি যে ভদ্রলোককে দেখলুম না, তোর সঙ্গে তাঁর ইনটার-অ্যাকশন দেখলুম না, কী করে আমার কিছু মনে হবে, বল!

—তোর সঙ্গে শিগগির একদিন আলাপ করিয়ে দেব, বুঝলি? খালি একটাই ভয় করে। তোর সঙ্গে আলাপ হলে হয়তো আর আমার দিকে ফিরেও চাইবে না।

অমৃতা উঠে দাঁড়াল, বলল—বাজে কথায় নষ্ট করবার মতো সময় আমার নেই রে শম্পা। তোর কথা যদি হয়ে গিয়ে থাকে তো এবার আমায় ছেড়ে দে।

তার হাত ধরে টানল শম্পা—কথা শেষ হয়নি, আসল কথাটা বলাই হয়নি। শোন প্লিজ। আমরা। মানে আমি আর ও, সৌমিত্র দাস, দু-চারটে সিনেমা একসঙ্গে দেখেছি, ওয়ালডর্ফে খেয়েছি কয়েকবার, এখন একটা উইক-এন্ড ও দিঘায় যেতে চাইছে আমাকে নিয়ে।

অমৃতা চমকে উঠল।

—ছেলেটা, মানে লোকটা কিন্তু ভীষণ ভাল। কোনওদিন একবার হাতটাও ধরেনি। ও বলছে আমাকে বিয়ে করতে চায়, কিন্তু ফাইন্যাল বোঝাপড়ার জন্যে অন্য কোথাও যাওয়া দরকার। মা মত দিয়ে দিয়েছে। তুই কী বলিস!

অমৃতার চোখদুটোয় ক্রোধের জ্বালা। সে বলল—এটা যে অত্যন্ত অসম্মানজনক প্রস্তাব সেটা বোঝবার জন্যে তোর আমার কাছে আসতে হবে? শম্পা তুই দিনকে দিন অবোধ শিশু হয়ে যাচ্ছিস, না কী বল তো!

—শোন, আমি জানতুম তুই রাগ করবি। প্রস্তাবটা ওইরকম শোনাচ্ছে বটে, কিন্তু সৌমিত্রকে দেখলে, জানলে তুই কথাটা বলবার আগে দুবার ভাবতিস। হি ইজ সো অনেস্ট অ্যান্ড অনারেব্‌ল। অফিসে ওর খুব নামডাক।

—সে যেমনই হোক, এটা যে ‘তোর’ পক্ষে অসম্মানজনক একটা প্রস্তাব, তাতে আমার কোনও সন্দেহ নেই। তুই ‘না’ করে দিবি শম্পা।

—কিন্তু, কিন্তু তা হলে ও যদি বিয়ের প্রোপোজ্যালটা ফিরিয়ে নেয়?

—নিলে নেবে। শম্পা তোর বছর বাইশ বয়স হবে। এখনই কি তুই এমন অরক্ষণীয়া হয়ে গেলি যে তোকে বিয়ের জন্য একটা লোকের সঙ্গে উইক-এন্ড কাটাতে হবে?

—তোর বিয়ে হয়ে গেছে। তুই সেফ অ্যান্ড সিকিওর, তুই আমার কথাটা বুঝবি না ঠিক। কে আমার বিয়ে দেবে বল? বিনা যৌতুকে আমার মতন একটা কালো মেয়েকে কে-ই বা বিয়ে করবে?

—তুই পাগল হয়ে গেছিস শম্পা। তোর কথা শুনে আমার ছি ছি করতে ইচ্ছে করছে।

—তা তো করবেই। অমৃতা, তোর বিয়েতে মাসিমা মেসোমশাই কত ডাউরি দিয়েছিলেন, কী কী আইটেম আমি কিন্তু সব জানি।

রাগে জ্ঞান হারাল অমৃতা।

—তা তুই কি তা হলে ডাউরি নেই বলেই, সেই ছেলেটাকে বিয়ের আগে দুটো রাত উপহার দিতে চাইছিস?

—আর একটাও কথা তোর সঙ্গে আমি বলব না, শম্পা বলল।—তোদের ক্লাসকে আমার খুব জানা হয়ে গেছে। আরও জানা হয়ে গেল। তোরা সেই যাকে বলে না ‘নিজের বেলায় আঁটিসুঁটি, পরের বেলায় দাঁতকপাটি’ সেই। যা তুই ভাল মেয়ে তোর প্রোফেসরের কাছে নোটস নিগে যা। শুধু যাবার আগে একটা কথা শুনে যাস, যে সৌমিত্র দাসকে না দেখেই চূড়ান্ত একটা অপমানকর মত দিয়ে দিলি সে মানে হি ইজ এ পার্ফেক্ট জেন্টলম্যান, তোর বরের মতো এগজিকিউটিভ এঞ্জিনিয়ার না হতে পারে, কিন্তু ওর লাইনে ও-ও বহু দূর পর্যন্ত উঠবে, উঠবে, উঠবে।

শম্পা রাগে গরগর করতে করতে উড়ুনিটা উড়িয়ে, কানের রিং দুলিয়ে চলে গেল।

একটা অনেক কষ্টে তৈরি করা শান্ত দুপুর ভেঙে খান খান হয়ে গেল। যাঃ। সে-ই একমাত্র জানে কত সাবধানে, নিজের সমস্ত শক্তি কতখানি প্রয়োগ করে তবে এইরকম একটা শান্ত দুপুরে পৌঁছনো যায়। এখনও চারিদিকে স্তব্ধতার তরঙ্গ। আড্ডা-পিয়াসীরা ক্যান্টিনে কিংবা কফিহাউজে, পড়ুয়ারা ক্লাসে। একজন বৃদ্ধমতো মানুষ তার দিকে এগিয়ে আসছেন। —মা, অফিসটা কোথায় বলতে পারো?

—অফিস তো একটা না! আপনি কী কাজে এসেছেন বলুন।

—এই একটা রিভিউয়ের অ্যাপিল জমা দেওয়া হয়েছিল, ছেলের বি.এ. পরীক্ষার।

ঠিক উইন্ডোটাতে ওঁকে নিয়ে গেল অমৃতা। ফেরবার সময়ে আবার সেই অনর্থক চিন্তা তাকে খোঁচাতে লাগল। এই ভদ্রলোকের ছেলে বি.এ. পরীক্ষা দিয়েছে? এঁর তো নাতির বি.এ. দেবার কথা। অদ্ভূত তো, ভদ্রলোকের শেষ বয়সের ছেলে বোধহয়, হঠাৎ হওয়া, তখনও কি নিরোধ-টিরোধ বেরোয়নি? আবার দেখো মজা, ছেলে নিজে আসেনি, বাবাকে পাঠিয়েছে। নাতিপ্ৰতিম ছেলের প্রতি হয়তো ভদ্রলোকের ভীষণ মায়া। আদর দিয়ে মাথাটি খেয়েছেন একেবারে। এ ছেলের কিচ্ছু হবে না। কিচ্ছু হবে না।

সে-ও তো বাবা-মা-র একমাত্র সন্তান। খুবই আদরের। কিন্তু জীবনকে মুখোমুখি একটা লড়াই দেবার চেষ্টা তো সে করেই যাচ্ছে, করেই যাচ্ছে নিরন্তর। অনেক দিন থেকেই অসুস্থ। অনেক কিছুই নিজের হাতে করে নিতে অভ্যস্ত সে৷ নিজের ইউনিফর্ম বরাবর নিজে কেচে পরেছে। পি.টি.-র জন্য কেডস-এ চক লাগানো, নিজের টিফিনটা গুছিয়ে নেওয়া, বাবাকে সময়মতো চা বা অন্য কোনও স্বাস্থ্য-পানীয় দিয়ে আসা, লোক না আসলে বাসন-টাসন মেজে নেওয়া। কোনওদিন এসব কাউকে বলতে যায়নি সে। কোনও নালিশও ছিল না—কে জানে তার ভাগ্যবিধাতা এইভাবেই তাকে প্রস্তুত করে নিচ্ছিলেন কি না।

এই সময়ে সেন্টিনারি বিল্ডিং-এর দিকে যেতে দেখল সে জয়িতা ম্যাডামকে। উনিও তাকে দেখতে পেয়েছেন। দাঁড়িয়ে গেছেন। তাড়াতাড়ি এগিয়ে যায় সে—আমি আসছি ম্যাডাম। উনি বললেন—ঠিক আছে লাইব্রেরিতে আর আসতে হবে না। আমার তোমাকে একটা ছোট্ট কথা বলার ছিল। সেটা বলেই ছেড়ে দেব। বলছিলাম—রোজ অত লেট করো কেন? থাকো কোথায়?

—যাদবপুর। মানে যাদবপুরের কাছে।

—দূর, মানছি। কিন্তু দূরত্বটা যখন জানাই হয়ে গেছে তখন তো সময় হাতে নিয়েই বেরোতে পারো।

—না, ম্যাডাম, আসলে …

—অন্য কিছু না। তোমরা ভাল ছাত্রীরা, ভাল মেয়েরা এইভাবে নষ্ট হয়ে যাও এটা আমার ভাল লাগে না। অমৃতা, দুটো যদি না পেরে ওঠো, তা হলে একটাই চুজ করে নাও। স্বামীসঙ্গ বা লেখাপড়া। দুটো একসঙ্গে হয় না।

জয়িতাদি লিফ্‌টে উঠে চলে গেলেন। অমৃতা সেখানেই পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে রইল।

ক্রোধ, নিজের ওপর, ম্যাডামের ওপর, তারপর নিদারুণ দুঃখ, নিজের জন্য, বাবার জন্য, মায়ের জন্য, তার পরে আবার ক্রোধ, নিজের ওপর, সম্পূর্ণ নিজের ওপর, একটা কথাও স্বপক্ষে বলতে পারল না বলে। ওই যে ছোট করে চুল ছাঁটা, ঈষৎ চৌকো মুখের আধা-ফর্সা, ভীষণ ব্যক্তিত্বঅলা মহিলা, যিনি এখন সম্ভবত তাদের ডিপার্টমেন্টে সবচেয়ে সমর্থ, সবচেয়ে আন্তরিক শিক্ষক, আসেন নিজস্ব একটা সাদা মারুতি এইট হানড্রেড নিজে চালিয়ে, উনি কী জানেন, কতটা জানেন, তার মতো একটি প্রায়ই-লেট ছাত্রীর জীবন সম্পর্কে? কী বোঝেন? যদি না-ই জানেন এবং না-ই বোঝেন তো কড়া-কড়া মন্তব্য করেন কেন? যেন উনি দেখতে পাচ্ছেন কীভাবে অমৃতা স্বামীর অফিস যাবার সময়ে দীর্ঘক্ষণ তার কণ্ঠলগ্ন হয়ে সময় কাটিয়ে দিচ্ছে। কিংবা স্বামীর আহ্বানে তার অফিস যাবার আগেই একবার …। সিঁথির মধ্যে সরু সিঁদুরের রেখা দেখেই উনি সব বুঝে নিলেন? বাঃ।

উনি কেমন করে জানবেন তার বিয়ের পর শ্বশুরবাড়ির একটি কাজের লোক ছাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। অন্য লোকটিরও আসার কোনও ঠিক নেই। আসবে না এই ভয়ে সাত সক্কালেই তাকে তিনখানা ঘর আর খাবার-জায়গাটা ঝাঁট দিয়ে রাখতে হয়। শ্বশুর রিটায়ার্ড, কোনখানটা ঝাড়া ভাল হল না, কোন জায়গাটা ঝাঁট পড়ল না এসব ঘুরে ঘুরে দেখার জন্য সে সময়ে তিনি হাজির থাকেন। শাশুড়ি স্কুলে চাকরি করেন। ভোর সাড়ে ছটায় আরম্ভ। তার আগে উঠে তাঁকে চা-জলখাবার তৈরি করে দেওয়া তার কর্তব্য। তার পরে শ্বশুর। তার স্বামী আর সে তাড়াতাড়ি বেরোতে হবে বলে চা আর বিস্কুট ছাড়া আর কিছু খায় না সকালে। তার পরেই তাড়াতাড়ি চান সেরে তাকে দুটো গ্যাস জ্বালিয়ে সংসারের রান্না শেষ করে, ঠিক নটায় স্বামীকে খেতে দিতে হয়। তিন-চারখানা ক্যাসেরোলে বাকি দুজনের খাবার ঠিক করে রাখতে হয়, এতসব করে, রান্নাঘর ঝকঝকে করে মুছে অনেক সময়ে তার নিজের খাবার সময়ই থাকে না, কোনক্রমে কয়েক দলা ভাত গলার ভেতর পাঠিয়ে সে যেমন আছে তেমন বেরিয়ে আসে। সকালে চান করেই সে কলেজে যাবার কাপড় পরে নেয়। এপ্রন তো তাকে কেউ কিনে দেবে না, তাই একটা তোয়ালে ব্লাউজের দুপাশে কাঁধের কাছে পিন দিয়ে আটকিয়ে কোমরে গুঁজে একটার পর একটা কাজ সারতে থাকে সে। স্বামীসঙ্গই বটে!

বিকেলে বাড়ি ফিরবে। ছটা পর্যন্ত চায়ের জন্য অপেক্ষা করবেন ওঁরা। তবু নিজেরা করে নেবেন না। ছটা বেজে গেলে, করবেন, শুধু নিজেদের জন্য। তাকে তার নিজেরটা করে নিতে হবে। লোক না এসে থাকলে বাসন মাজো, ঘর মোছো। তারপর আবার বসে যাও রাতের রুটি তরকারি বানাতে। ফ্রিজ খুললেই তার শাশুড়ি বলেন—বউমা কী নিলে?—ওঁর ভয় যদি অমৃতা ফ্রিজ থেকে দুধ বা কোনও ফলটল নিয়ে খেয়ে ফেলে! অথচ তার শাশুড়ি একজন স্কুল-টিচার! স্কুল টিচার!

সওয়া তিনটে বেজেছে এখন। কিছুটা সময় হাতে আছে এখনও। সাড়ে চারটেয় ক্লাস ছুটি কবুল করা আছে তার। হঠাৎ সে টের পেল খিদেয় তার বত্রিশ নাড়ি পাক খাচ্ছে। আজ কাজ সারতে সারতে দেরি, তারপর শম্পার ফোন আসায় তার বরাদ্দ লপ্‌সিটা খেতে বেমালুম ভুলে গেছে সে। ভুলে গেছে জয়িতাদির ক্লাস করবার আগ্রহে, তাড়ায়। যে জয়িতাদি, সে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে বলে ক’ মিনিট আগেই রায় দিয়ে গেলেন।

হঠাৎ তার মায়ের কাছে যাবার একটা তীব্র ইচ্ছে হল। কিন্তু তার নিজের মা এখন অনেক দূর, সল্টলেক করুণাময়ী, সে হঠাৎ হন্তদন্ত হয়ে উপস্থিত হলে মায়ের আবার না হার্ট-অ্যাটাক হয়। অথচ ভেতরে তীব্র তীক্ষ্ণ একটা মা মা ডাক! সে গড়িয়াহাটের মোড়ে স্বপ্নাচ্ছন্নের মতো নেমে গেল, ডোভার লেনে তার ছোটবেলার বন্ধু সম্পদের বাড়ি। সম্পদ ছিল তার অভিন্নহৃদয় বন্ধু, এখন আই.আই.টি. কানপুর। হঠাৎ সে দেখল সে সম্পদের মায়ের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। মাঝখানের রাস্তাটা সে কীভাবে এসেছে, কীভাবে পার হয়েছে, কিছুই মনে নেই তার।

—তুই? অমৃতা? আজকে কোন দিকে সূর্য উঠল রে! মাসি অবাক হাসিতে মুখ ঝলমলিয়ে বললেন।

উত্তরে অমৃতা বলল—মাসি, আমাকে কিছু খেতে দেবে?


রোদে পিঠ দিয়ে বসে থাকতে তার ভীষণ ভাল লাগে। চৈত্রেও, ফাল্গুনেও, এমনকি বৈশাখেও। প্রথম আলো ফোটবার সময়ে। মা বলে তার শরীরে ক্যালসিয়াম কম আছে তাই। পেছনে একটা কীসের যেন কাদের যেন কারখানা আছে। সেখানে একটা চিমনি আছে। চিমনি দিয়ে লকলকে আগুন আর কালো ধোঁয়া ঠিক কখন বেরিয়ে আসবে, কখন বেরিয়ে আসে সে জানে না। খুব সম্ভব রাতে, যখন সে ঘুমোয়, একটা অতীন্দ্রিয় আঘ্রাণ তার স্বপ্ন জুড়ে, ঘুম জুড়ে থাকে, কিংবা হয়তো দুপুরে যখন সে বাড়ি থাকে না। সন্ধেবেলায় জানলা খুললে একটা উৎকট পোড়া-পোড়া গন্ধ সে পায়। সত্বর বন্ধ করে দেয় জানলার কপাট। কিন্তু এটুকু অসুবিধে সে সহ্য করে নিতে রাজি, যদি প্রতিদিন ভোরবেলায় স্রেফ জানলার জাফরির মধ্য দিয়েই ভোরের কমলালেবুকে একটু একটু করে কাঁসার জামবাটি হয়ে উঠতে দেখার অমূল্য সুযোগ সে পায়, এবং যদি কারখানার মালিকরা যত করোগেটের চালি, যত কুশ্রী ভাবেই তুলুক না কেন, দোলনচাঁপা গাছটা তার সতেজ পত্রসম্ভারের সবুজ নিয়ে একইভাবে দাঁড়িয়ে থাকে! মৃদুল গন্ধের ওই ফুল আর গাঢ় সবুজ পাতার ওই গাছ যেদিন ওরা আরেকটা টিনের চালি কি আর একটা চিমনি বসাবার জন্যে কেটে ফেলবে, উঃ ভাবতেও গা শিউরোয়, মন ছমছম করে, তা সে যাই হোক সেই দিন থেকে সে পুবের জানলা বন্ধ করে দেবে, অন্য কোনও জানলার আশ্রয়ে চলে যাবার কথা ভাববে। ভাবলেই যে সঙ্গে সঙ্গে আশ্রয় মিলে যাবে তার কোনও স্থিরতা নেই, এটুকু বাস্তববোধ তার আছে। খানিকটা অপেক্ষা করার ধৈর্যও তার মধ্যে দুর্লভ নয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ওই দোলনচাঁপা, ওই কমলালেবুর আকাশে ওঠা, এই মিঠে রোদে পিঠ পাতা—এগুলো তার চাই-ই।

পিওন, শোনো, না না রানার, রানার!

রানারের জন্যে আমি কান পেতে আছি। কারণ তোমার চিঠি ওইরকম গতানুগতিতে আসবে না। হোক দেরি, কিন্তু রানার চাই। তার থলির ভেতর থেকে সাবধানে বার করবে, আমাকে শুধু আমাকেই দেবে আর কাউকে না, এমনকি চিঠি-বাক্সকেও না, তারপর? তারপরই ভেবেছ চিঠিটা আমি তাড়াতাড়ি খামের মুখ ছিঁড়ে পড়ব? ভুল ভেবেছ। চিঠিটাকে আমি অনেকক্ষণ ওম দেব, পাখিমায়েরা যেমন ডিমে তা দেয়! কত কাজ আমার করার থাকে। টেবিল গুছোনো, বই গুছোনো, বুদ্ধদেবের মূর্তি পালিশ করা, ডোকরার যে মূর্তিটা কিছুতেই চকচকে হবে না সেটাকে নিয়েও রোজ আমার পড়ে থাকতে হবেই। তারপর বাপি ডাকবে, বাপিকে খেতে দেবার সময়ে আমাকে উপস্থিত থাকতে হয়। আমার ভাল লাগে, ভাল লাগে রানারের চিঠিতে তা দিতে দিতে এই বসে থাকা। আমার বাপি খুব সকাল সকাল বেরিয়ে যায়। বেচারি! আমাকে আর মাকে সুখে রাখবার জন্যে বাপির কী কষ্ট! কী চেষ্টা! আমি তো বলি দিদির বিয়ে হয়ে গেছে। আর কেন তুমি এত কষ্ট করো।

—এ হল সিন্দবাদের বুড়োর জোয়াল, বুঝলি তো? একবার কাঁধে নিলে আর নামানো যায় না। তা ছাড়া তুইও তো আছিস। তোকে পার, উঁহু সুখী করতে হবে না?— বাপি বলে।

এইখানটায় আমি আমার লুকোনো হাসিটা হাসি৷ এ কী রকমের হাসি জানো? ঠোঁটদুটো ছড়ায় না। অন্তত বাইরে নয়। ভেতরে, মুখের গভীরে হাসি। কেন তা তুমি নিশ্চয় জানেো। দিদির বিয়েতে বাবাকে অনেক অ-নে-ক দিতে হয়েছে। সব ওরা মুখ ফুটে চায়নি। কিন্তু অন্য কোনওভাবে, হাবেভাবে, বডি-ল্যাঙ্গোয়েজে চেয়েছে। বাপি তো দিদিকে দিতই। গয়নায় রানি করে দিত একেবারে। কিন্তু তুমিই বলো, ওদের বাড়িতে কি টিভি নেই? সি.ডি. প্লেয়ার নেই? ওয়াশিং মেশিন, পি.সি. হয়তো না-ও থাকতে পারে। কিন্তু এ কেমন কথা যে একজন ম্যানেজমেন্টের মাস্টার্স ডিগ্রি-করা, পঁচিশ-তিরিশ হাজার মাইনে পাওয়া লোক মানে ছেলে এসব শ্বশুরবাড়ি থেকে নেবে? পার্থদা অবশ্য চায়নি। কিন্তু বাবা যখন পার্থদার বাবার বডি-ল্যাঙ্গোয়েজ বুঝে এসব দিল, আপত্তি করেনি তো! আমি যদি পার্থদা হতাম, তা হলে শুধু লজ্জা নয়, রাগ পেত আমার। তক্ষুনি সব ফিরিয়ে দিতাম।

ধুস কী সব লিখছি, এক্কেবারে ধুত্তোর ছাই। এসব কি তোমার আমার কথা না কি? আমার মুখের ভেতরের হাসিটা বিশ্লেষণ করতে গিয়ে এসব বলতে হল আসলে।

ফোন বাজছে। আসছি এবার। নিশ্চয় আমার ফোন।

—হ্যালো।

—হ্যাঁ দোলা, আমিই তো বলছি।

—হ্যাঁ, কয়েকদিন অমৃতা আসছে না। বোধহয় তিন দিন। না, আমরা কিছু ভাবিনি তো! সরি মাসি, সত্যি খোঁজ নেওয়া উচিত ছিল। তুমি সাত দিন খোঁজ পাওনি? ও ফোন করছে না? তুমিও পাচ্ছ না? ওদের ফোন খারাপ?

—অ্যাঁ? তোমার গলা শুনেই রং নাম্বার বলে রেখে দিচ্ছে? আর ইউ সিওর ওটা অমৃতাদেরই ফোন? ওর শ্বশুরের গলা? তুমি ঠি-ক চেনো? আচ্ছা, আমি দেখছি। কিন্তু তুমি, তোমরা একবার যাচ্ছ না কেন? আবার তোমার বেডরেস্ট? যাঃ।

মাসির হৃদয় কেন এত ঠুনকো, কিছুই তো বয়স নয়, তার মায়ের থেকে বেশ কিছু ছোটই হবেন। আশ্চর্য! ওই ভয়েই অমৃতাটার সাত তাড়াতাড়ি বিয়ে দিয়ে দিলেন। তারা বন্ধুরা খুব খেপিয়েছিল অমৃতাকে সে সময়ে। অমৃতা বলেছিল—‘আমাকে কেন? আমার বাবা-মা-কে খেপাগে যা। আমার পেছনে লাগলে ভাল হবে না।’

তা বেশ তো, তারা না হয় গিয়ে অমৃতার বাবা মা-কেই খেপাল। সে এক্তিয়ার তাদের আছে। ‘আচ্ছা মেসোমশাই, গৌরীদান করলেই তো পারতেন। এত ভাবনা যখন অমৃতাকে নিয়ে!’

মেসোমশাই পরীক্ষার খাতাগুলো সরিয়ে রেখে বললেন—‘গৌরীদান? তা-ই বটে। তোমাদের মাসিমাকে বোঝাও। তাঁর ধারণা তিনি যে কোনওদিন পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে পারেন। তখন মেয়েটাকে দেখবার তাঁর কেউ-ই থাকবে না। আ’য়্যাম নট রেস্পনসিব্‌ল এনাফ।’

বলতে বলতে মেসোমশাই যে সত্যি-সত্যিই খুব গম্ভীর হয়ে যাচ্ছিলেন এটা ওরা বুঝতে পেরেছিল। অমৃতার মা কিন্তু সত্যিই খুব অসুস্থ। হাই ব্লাড প্রেশার থেকে হার্ট খারাপ, এর ওপর যখন ব্লাড সুগার হল, উনি আর অপেক্ষা করতে রাজি হলেন না। মেয়ের বিয়ের জন্যে পাগলিনীপ্রায় হয়ে উঠলেন। তা সত্ত্বেও তারা মাসিমাকেও খেপিয়েছিল।

কিন্তু অমৃতা? অমৃতাই বা রাজি হয়ে গেল কেন? ও যদি সেভাবে আপত্তি করত তা হলে জোর-জবরদস্তি করে তো আর ওঁরা বিয়েটা দিতে পারতেন না। আসল কথা, অমৃতাও বোধহয় ভয় পেয়েছিল। কিংবা এ-ও হতে পারে অরিসূদনকে দেখে ও তার প্রেমে পড়ে গিয়েছিল।

এরকম হয়, হয়েই থাকে, সে জানে। অমৃতার বাবা-মা-র যেমন প্রেমের বিয়ে। অমৃতার মা দেখতে কী সুন্দরী! কী সুন্দরী! সাধারণ গ্র্যাজুয়েট। কিন্তু ওঁদের সময়ে ওই রূপের জোরেই তো ওঁর অ-নে-ক ভাল বিয়ে হতে পারত। কিন্তু ওই যে প্রেম! প্রেমে পড়লেন। অমৃতার বাবা তখন এম.এ.-র ব্রাইট স্টুডেন্ট, মাসিকে পড়াতেন। মেসোমশাইয়ের আগেকার ছবি সে দেখেছে। সাধারণ ভাল-ছেলে ভাল-ছেলে ভাবটা। অত রূপসী মাসি যে কী করে …। না, এভাবে বাবা মা-দের সম্পর্কে ভাবাটা ঠিক না। বরং নিজের উদাহরণটাই তার ভাবা দরকার। গেল পার্থদাদের ক্লাবের স্টিমার পার্টিতে, সরু সিঁড়িটা দিয়ে আপার ডেকে উঠছে, সিঁড়ির ওপরে যেন নিজের নিয়তিকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল। প্রথম, একেবারে প্রথম দর্শনে এমনটা হতে পারে সে কোনওদিন ভাবেনি। সারাটা স্টিমার-পার্টি ছলচাতুরি করে ও-ও যেমন তার কাছাকাছি আসবার চেষ্টা করেছে, তেমনি সে-ও করেছে। নির্লজ্জের মতো। এক টেবিলে খেতে বসেছে খুঁজে খুঁজে। এক একটা টেবিলে চারজনের করে জায়গা। ওরা দুজন ছাড়া ছিলেন দুজন বয়স্ক ভদ্রলোক। তাঁদের নিয়ে ঠারে-ঠোরে কী ঠাট্টা ওদের। কেটারারকে বলে যখন এক্সট্রা মাছটা ও তার পাতে দেওয়াল, তখন সেই মাছের টুকরোটা রাগের ভান করে সে কি ওর মুখে গুঁজে দেয়নি! পাতেই তো তুলে দিতে পারত! ওভাবে মুখে গুঁজতে গিয়ে তার ডান হাতের সব আঙুলগুলোর আগা যে ওর মুখের মধ্যে চলে গেল সে শিহরনের কথা জীবনেও ভুলবে না কি সে? ও-ও হয়তো ভুলবে না। হুল্লোড়বাজ, চঞ্চল, অস্থির, খেয়ালি, তবুও ও-ও ভুলবে না। সে স্থির জানে। আর এই ভাল লাগা, এই শিহরন, এই ফিরে ফিরে তাকিয়ে দেখার ইচ্ছে, ফিরে ফিরে সামান্য ঘটনাগুলো ভাবার ইচ্ছে, এ একজনের সঙ্গেই হয়। সেই একজন যত দিন না আসে, তত দিন অনেককে ভাল লাগে, অনেকের দিকে একটু একটু ঝোঁকে মন, কিন্তু সে যখন আসে সিঁড়ির মাথায় ওইরকম বিজলি-চুম্বকের মতো তখন বোঝা যায় আরগুলো সব মিথ্যে, হাস্যকর রকমের ছেলেমানুষি। এইটা সত্য। এইটা অমোঘ।

অমিতকে দেখে তার যা হয়েছিল, অরিসূদনকে দেখে অমৃতার যদি তার কণাও হয়ে থাকে, তা হলেই বোঝা যাবে, কেন উনিশ বছর মাত্র বয়সে, ফাইন্যাল পরীক্ষা ঘাড়ের ওপর, মা শয্যায়-শোওয়া, অমৃতা হঠাৎ বিয়েতে রাজি হয়ে গেল। নইলে অমৃতার মতো অত লেখাপড়ামুখি মেয়ে, অত সিরিয়াস, তারপরে অমন মা-অন্ত প্রাণ, মাকে প্রাণ দিয়ে আগলে রাখত যে, বাবা-মার অমন বুকের ধন যাকে বলে সে কেন …

মাসি বেপথু হাতে ফোনটা নামিয়ে রাখছেন, বুঝতে পারল দোলা। অনায়াসে। এখন মানুষের মনের অনেক কথা, শরীরের অনেক ভাবের কথা সে চট করে বুঝতে পারে। প্রেম তাকে এই শক্তি দিয়েছে। একদিক দিয়ে ভাবতে গেলে এটা অমিতেরই দেওয়া। অমিতাভ। অমিতের জন্য সারা শরীরে একটা সজলতা নিয়ে, আর সীমা মাসি অর্থাৎ অমৃতার মায়ের জন্য একবুক করুণা নিয়ে, আর অমৃতার জন্য একমাথা ভাবনা নিয়ে সে অমৃতার ফোনটা ঘোরাল। রিং হচ্ছে, রিং হয়ে যাচ্ছে ওদিকে। ফল্‌স রিং না কি?

—হ্যাল্লো—একটি বয়স্ক নারীকণ্ঠ জবাব দেয়।

—অমৃতা আছে?

—কে বলছেন?

—আমি দোলা, মাসিমা, অমৃতার বন্ধু। দিন তিনেক কি চারেক হল ওর য়ুনিভার্সিটি কামাই হল, তাই …

—ধরো, ডাকছি।

বেশ কিছুক্ষণ পরে অমৃতার গলা ভেসে এল—দোলা?

—হ্যাঁ আমি, তুই তিন দিন আসছিস না কেন?

উত্তরে অমৃতা বলল—জয়িতাদি খোঁজ করছিলেন? ও।

দোলা বলল—তোর শরীর-টরীর খারাপ না কি?

অমৃতা বলল—তোর আবার জ্বর হয়েছে? কতদিন বলেছি ঠাণ্ডা লাগাস না!

দোলা বলল—ব্যাপারখানা কী বল তো। মাসি ভীষণ ব্যস্ত হয়ে ফোন করেছিলেন। তোদের ফোন পাচ্ছেন না। পেলেও রং নাম্বার বলে কে নামিয়ে রাখছে!

—হ্যাঁ ঠিক আছে। রাখছি—

ফোনের মধ্যে একটা চাপা রাগত গলার ‘এবার রাখো’ শুনতে পেয়েছিল দোলা। সেটা নারী-কণ্ঠ কি পুরুষ-কণ্ঠ সেটা বুঝতে পারেনি।

অমৃতার সমস্ত কথাবার্তাই অসংলগ্ন। তার ওপর ওই ‘এবার রাখো’। দোলা কেমন উদ্‌ভ্রান্ত বোধ করল। কী হচ্ছে? কী হচ্ছে এ সব?

মা জিজ্ঞেস করল—অমন করে খাচ্ছিস কেন দোলা? তেতো দিয়ে ডাল মাখলি যে!

—ওঃ ভুল হয়ে গেছে, বুঝতে পারিনি মা,।

—বুঝতে পারিসনি ওটা নিম-বেগুন? মাথায় কী ঘুরছে বল তো! ঠিক করে খা। ও ভাতটা সরিয়ে রাখ। আরেকটা মাছ ভাজা দেব?

দোলা বলল—এই তো, ঠিক আছে। খেয়ে নিচ্ছি। উঃ আরেকটা মাছ? বলে একটাই খেতে পারছি না।

মা নিজেও দোলার সঙ্গে খেতে বসেছে। বাবা সাত সক্কালে বেরিয়ে যায়। দোলা য়ুনিভার্সিটি যেতে আর মা মায়ের শখের নার্সারি স্কুলে যেতে একই সঙ্গে বসে। তবে দোলার কোনও কোনওদিন দেরিতে ক্লাস থাকে। সেদিনগুলোতে মা খেয়ে বেরিয়ে যায়। দোলা নিজের মতো বেরোয়। নিজের মতো খেয়ে। ওদের বাড়ির কাজের লোক অর্থাৎ অণিমাও কাজ করে, সকাল দশটার মধ্যে সব রান্না-বান্না সেরে গুছিয়ে, নিজে খেয়ে সে-ও চলে যায়, কোনও গেঞ্জি কারখানায় তৈরি গেঞ্জির সুতো কাটতে। আবার সন্ধে সাতটায় আসবে।

দোলাদের বাড়িটা এমন জায়গায় যে কোনও বাসের টার্মিনাস থেকে ওঠার উপায়ই নেই। এক যদি হাওড়া চলে যেতে চাও! ও অবশ্য পাতাল রেলে করে যায়। অটোয় করে কালীঘাট স্টেশনে উঠে ও সেন্ট্রালে নামে, কলুটোলাটা হেঁটে পার হতে হয়, পেছনের দরজা দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢোকে ও।

—খিড়কির দরজা দিয়ে কারা আসে জানিস?—নিলয়, ওদের ক্লাসের সবচেয়ে বিচ্ছুটা বলেছিল একদিন।

—কে?—দোলা ওর ফিচেল হাসি থেকেও কিছু আন্দাজ করতে পারেনি।

—জমাদার।

—আমি জমাদার? আমি জমাদার?—চড় তুলে তাড়া করলে তো নিলয় পালাবেই। পালিয়ে কিন্তু বেশি দূর যাবে না পাজিটা। একটু দূরে দাঁড়িয়ে বলবে—কেন? জমাদার খারাপ? স্ক্যাভেঞ্জার, সংসারের যাবতীয় আবর্জনা, জাল-জঞ্জাল যে পরিষ্কার করে আমাদের জন্য তাকে খারাপ বলছিস? দাঁড়া, জ্যোতিবাবুদের বলে দেব।

তখন অমৃতাই বলে—তুই কিচ্ছু জানিস না নিলয়, খিড়কি দরজা দিয়ে আরও অনেকে আসে, আসে ফুচকাওলা, আসে পাঙ্খা বরফ। দোলাটা তো নির্ঘাৎ ফুচকাওলা। ওর কাছে ফুচকাগুলো যা মচমচে না, আ-হ।

আবার অমৃতা। অমৃতার কথাতেই মাথাটা এখন ভর্তি হয়ে আছে। দোতলার সিঁড়ি দিয়ে উঠে ক্লাসে ঢোকবার মুখে স্বভাবতই অনেকের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। শর্মিষ্ঠা, তানাজি, নিলয়, অনিন্দিতা, লাবণি, তিলক—এক দঙ্গল একেবারে।

কাকে বলবে? নিজের দুশ্চিন্তার কথাটা? শর্মিষ্ঠাকে সে আদৌ নির্ভরযোগ্য মনে করে না, অনিন্দিতাটা অতিশয় তরল প্রকৃতির। লাবণিকে বলা যেত। কিন্তু সময় চাই। এখন ভিড়ের মধ্যে থেকে ওকে ডাকলেই সবগুলো শেয়াল একসঙ্গে খ্যাঁক খ্যাঁক করে উঠবে।

—কী কথা তাহার সাথে? তার সাথে? অ্যাঁ? আমরা বুঝি কেউ নই। কিছু নই!

তিলক পাশে বসেছিল বলে তিলককেই বলে ফেলল কথাটা দোলা।

—তিলক শোন, অমৃতার নির্ঘাৎ কোনও প্রবলেম হয়েছে।

—তিন চারদিন আসেনি। হ্যাঁ কোষ্ঠকাঠিন্য তো অন্ততপক্ষে বটেই!

—অসভ্যতা করিস না। ওর শ্বশুরবাড়িতে কাউকে ফোন ধরতে দিচ্ছে না। ওর মাকেও কথা বলতে দিচ্ছে না। আমি অনেক কষ্টে কনট্যাক্ট করেছি, উল্টো পাল্টা বকল।

—সর্বনাশ! তিলক বলল,—মাথাটা গেছে। যত বলি, অত পড়িসনি অমৃতা, অত পড়িসনি। আজ বলছি না কি?

—তুই কি কখনও সীরিয়াস হবি না?

—ইন্টারভিউয়ের চিঠি এলে নির্ঘাৎ হব।

—শোন তিলক, ওর শ্বশুরবাড়ির লোকেরা কারুর সঙ্গে ওকে কথা বলতে দিচ্ছে না, ব্যাপারটা খুব ফিশি লাগছে।

তিলক বলল—দেবে তো না-ই। শ্বশুর-টশুর টের পেয়েছে আমার মতো একটা লাল টুকটুকে ছেলের সঙ্গে ও পড়ে। সন্দেহ, স্বাভাবিক! তোর শ্বশুর-শাশুড়ি হলেও এগজ্যাক্টলি এমনিই করত।

দোলা কিছু না বলে তিলকের থেকে যতটা সম্ভব দূরে সরে বসল। এক্ষুনি এ. আর. অর্থাৎ অশেষ রায়ের ক্লাস শুরু হবে। এসেই আগে উনি ডিসিপ্লিন সম্পর্কে একটি বক্তৃতা দেবেন। ছেলেরা বলে উনি অশেষ না আরও কিছু, উনি হলেন শেষন। নিজেও শেষ হবেন, আমাদের সবাইকেও পণ্ডিত বানাতে না পেরে শেষ করে দেবেন।

অমৃতার সঙ্গে দোলার বেশিদিনের বন্ধুত্ব নয়। বি.এ. ক্লাসেই। যাতায়াতের রুট এক হলে এইরকম বন্ধুত্ব কারও কারও সঙ্গে হয়ে যায়। তখন অমৃতারা থাকত রমণী চ্যাটার্জি স্ট্রিটে, দোলারা থাকত হিন্দুস্থান রোডে। এত কাছে থাকত অথচ কলেজে পড়তে যাবার আগে ওদের ভাব ছিল না। দোলার খুব ভাল লাগত অমৃতাকে রাস্তাঘাটে দেখে। হয়তো একটা শাড়ির দোকানে ঢুকল, কিংবা রাস্তা পার হচ্ছে। অনেক সময়েই ওর সঙ্গে ওর মাকেও দেখেছে। পোর্সিলেনের মতো রং মাসির। চোখ-মুখ-নাক খুব সুন্দর, বোঝাই যায় এক সময়ে খুব সুন্দরী ছিলেন, তবু ওঁকে ছেড়ে অমৃতার দিকেই চলে যেত চোখ। সুশ্রী তো বটেই, কিন্তু ভারী মিষ্টি। পুতুলের মতো মিষ্টি নয় কিন্তু। ওর চোখের চাওয়ায়, ঠোঁটের হাসিতে মিষ্টত্বের সঙ্গে একটা ব্যক্তিত্ব ছিল, যে ব্যক্তিত্বটা অত সুন্দর হওয়া সত্ত্বেও ওর মায়ের ছিল না। অমৃতাকে হয়তো ওই ব্যক্তিত্বের জন্যই দূরের মানুষ দূরের মানুষ লাগত। হয়তো বা একটু উন্নাসিক। অন্তত দোলা তো কোনওদিনই যেচে ভাব করতে যায়নি।

আশ্চর্য! দুজনে যখন একসঙ্গে এক কলেজের ক্লাসে মুখোমুখি হয়ে গেল, তখন অমৃতাই জিজ্ঞেস করেছিল—তুমি গড়িয়াহাটের আশেপাশে কোথাও থাকে না?

—তুমিও তো কাছাকাছিই, আমি তোমাকে দূর থেকে দেখেছি।

অমৃতাটা খুব ফাজিল ছিল, বলেছিল—আমি কিন্তু তোমাকে খুব কাছ থেকে দেখেছি, বন্ধুদের নিয়ে ফুচকা খেয়েই যাচ্ছ, খেয়েই যাচ্ছ, ঝালমুড়ি খেয়েই যাচ্ছ, আইসক্রিম খেতে খেতে বেরোচ্ছ, রোল কিনে গলির দিকে গেলে। তোমার রোজ কত টাকার ফুচকা লাগে?

দোলা হেসে ফেলে বলেছিল—আজ প্রথম দিন বলে কিন্তু কিছু মনে করছি না। পরে ফুচকা তুলে কথা বললে আড়ি হয়ে যাবে।

অমৃতার সঙ্গে ভাব হওয়ায় দোলার এত ভাল লেগেছিল। যেন কোনও দূর গ্রহের সঙ্গে নিজের কক্ষপথে দেখা হয়ে যাওয়া। গ্রহ কিংবা নক্ষত্র। তার পর মেলামেশা করতে করতে সেই গ্রহত্ব নক্ষত্রত্ব কেমন আস্তে আস্তে ক্ষয়ে যায়। কেন অমৃতার ওইরকম ব্যক্তিত্ব, অনেক টাকা বা অনেক বুদ্ধি থেকে নয়, মা চিররুগ্‌ণ বলে, মায়ের মা হয়ে থাকতে হয় বলে, এ সব দোলা ধীরে ধীরে বুঝেছে। আসলে ফার্স্ট ইমপ্রেশনটা বা ওপর-ওপর দেখাটা কিছু না। একটা মানুষের সামান্য একটু ভেতরে ঢুকলেই বোঝা যায়, সে কে, সে কী এবং কেন। অমৃতা দোলাকে কোনওদিন লক্ষ করেছে বলে দোলার মনে হয়নি, অথচ দেখো, ও দোলার সম্পর্কে দোলার চেয়ে বেশি জানত। জানত দোলা খুব আদুরে, জানত দোলা অনেক বন্ধুর সঙ্গে ঘোরাফেরা, হইচই করতে ভালোবাসে। কিন্তু দোলার মধ্যে যে একটা ভাবুক দোলা, কাঙাল দোলা বসে আছে, অমৃতার বন্ধুত্বের জন্য কাঙাল, তা সে কোনও দিনও বোঝেনি।

বন্ধুত্ব এমন একটা জিনিস যার মধ্যে আবার অন্যান্য আবেগ অনুভূতির কিছু কিছু মাত্রাও থেকে যায়। কখনও থাকে করুণা, কখনও থাকে শ্রদ্ধা, কিন্তু প্রায় সব সময়েই থাকে আস্থা, নির্ভরতা। এটা যদি না থাকে, তাহলে বুঝতে হবে সেটা বন্ধুত্ব নয়, খালি সঙ্গীত্ব। কিছুক্ষণের সঙ্গ দেওয়া নেওয়া।

অমৃতার সঙ্গে দোলার যে বন্ধুত্ব তার মধ্যে দোলার মনোভাবে খানিকটা শ্রদ্ধা সন্ত্রম আছেই। অমৃতা দোলার মতে দোলার চেয়ে সুন্দর, লেখাপড়ায় ভাল, কেমন একটা ধৈর্য একটা রোখ আছে তার জীবনযাপনে। তারও চেয়ে বেশি যেটা আছে সেটা হল ব্যক্তিত্ব। এটা হয়তো ওই রোখ, ওই ধৈর্য থেকেই আসে। আরেকটা কথা, অমৃতা নিজের কথা একদম বলে না। বলার অভ্যাসই নেই। তবে অন্যের কথা শোনে মন দিয়ে। অন্যের সমস্যার সমাধান করতে ওর কোনও আলস্য নেই। দোলা ওদিকে বক্তিয়ার, কোনও কথা পেটে রাখতে পারে না, যদি কারও ওপর রাগ বা অভিমান হয়, যেমন বন্ধুদের মধ্যে হয়েই থাকে, তাহলে দুদিন বড় জোর অপেক্ষা করবে তারপর নিজেই ওপর-পড়া হয়ে বলবে—এই জানিস আমার না তোর ওপর ভী-ষণ রাগ হয়েছে। কেন রাগ, কখন থেকে রাগ, রাগের মাত্রা কতটা এ সব নিয়েও সে রীতিমতো একটা বক্তৃতা দেবে, তারপরে বলবে—কী, এত কথা বললাম, আমার কাছে ক্ষমা চাইলি না? চা, ক্ষমা চা, সরি বল।

দোলা এমনই।

শেষনের ক্লাস হয়ে গেল, প্রধানমন্ত্রী অর্থাৎ পি.এম.-এর ক্লাস হয়ে গেল। তারপর একটা ক্লাস বিরাম। কাকে বলবে দোলা? তিলকের তো ওই ধরনের ফিচেল-ফাজিল প্রতিক্রিয়া।

লাবণির পেছনে পেছনে হাঁটতে লাগল সে। —এই লাবণি, লাবণি, একটু দাঁড়া। প্লিজ।

—কেন রে? আমি কমনরুমে যাচ্ছি, অনেকক্ষণ থেকে টয়লেট পেয়েছে।

—তা চল। কিন্তু রাস্তার দিকের বারান্দাটায় আমি দাঁড়িয়ে আছি, টয়লেট সেরে আসিস একবার। ভী-ষণ দরকার আছে।

লাবণি আসতে যতটা পারে খুলে বলল কথাগুলো দোলা।

লাবণি বলল—দ্যাখ শ্বশুরবাড়ি-টাড়ির অনেক কমপ্লিকেশন থাকে, চাপা গলায় ‘এবার রাখো’টা তুই ঠিক শুনেছিস?

—সেটা তো ঠিক শুনেছিই, কিন্তু তার চেয়েও বেশি মিস্টিরিয়াস হল অমৃতার কথাবার্তা।

—কথাবার্তা মোটেই মিস্টিরিয়াস নয়, লাবণি বলল, বোঝাই যাচ্ছে সামনে এমন কেউ দাঁড়িয়ে আছে যার সামনে ও মুখ খুলতে পারছে না।

—কিন্তু মাসিকে ওই রং নাম্বার বলে ফোন নামিয়ে রাখা!

—মাসি ঠিক নাম্বার ঘুরিয়েছিলেন কি না দ্যাখ। ও রকম অনেক সময়ে নার্ভাস হয়ে গেলে হয়। আর অমৃতার মা তো নার্ভাস থার্টি।

—তা হলে তুই বলছিস ভাবনার কিছু নেই?

—না, তা কিন্তু বলিনি। আচ্ছা ওর শ্বশুরবাড়ির লোকেরা কেমন কিছু জানিস?

—টিপিক্যাল বাঙাল। বউ আসতেই রান্নাঘরে ঢুকিয়ে দিয়েছে।

—এই খবর্দার বাঙাল বলবি না। আমি বাঙাল তা জানিস?

—তোদের নিয়মকানুন তা হলে তুই-ই ভাল বলতে পারবি। যে বউ য়ুনিভার্সিটিতে পড়ে, তাকে দিয়ে সকালে বিকেলে সব রান্না করানো এটা আমাদের ঘটিদের মধ্যে স্বাভাবিক নয়। চলে না।

লাবণি বলল—আমার তো দুই মাসতুতো বউদি আছে। খোদ শ্যামবাজারের। দুজনেই বেরোয়। রান্নার লোক আছে, তবে বউদিরাও ছোটখাটো ব্যাপারে যেমন চা-ফা করা বা লোক এলে ভাল কিছু এ সব করে। তাই বলে পুরো রান্না…

—তোরা মডার্ন। তা ছাড়া কোনকালে পিওর বাঙাল ছিলি রে? ওর শ্বশুরবাড়ি বোঝাই যাচ্ছে সেকেলে। দোলা বলল।

—তা ওঁরা কি চান না ও পড়াশোনা করুক!

—সেটা ভাই আমি জানি না। অমৃতা কোনওদিন বলেনি। যাবি?

লাবণি বলল—সেটা কি ঠিক হবে? চিনি না জানি না…

দোলা বলল—আহা, অমৃতা কেন যাচ্ছে না সে খবর নিতে যেতে পারি না! চল লাবণি প্লিজ।

পরের ক্লাসটা ওরা আর করল না। যদিও জয়িতা বাগচির ক্লাস। পাতাল রেল ধরল দুজনে, কালীঘাট স্টেশনে নেমে একটা যাদবপুরগামী বাস পেয়ে গেল। লাবণি এখনও বলে যাচ্ছে—লোকেদের শ্বশুরবাড়ি। যাই বলিস, আমার যেতে কেমন-কেমন লাগছে।

ধৈর্য রাখতে পারে না দোলা, ঝাঁঝিয়ে ওঠে—ঠিক আছে, যা, তুই নেমে যা।

—নেমে গিয়ে করবটা কী? বাড়ি কতদূর বল তো!

—তাড়াতাড়ি নেমে গেলে তাড়াতাড়ি পৌঁছতে পারবি।

লাবণি গোমড়ামুখে বলল—অকওয়ার্ড সিচুয়েশন আসলে আমার খুব বাজে লাগে। তাই বলছিলাম। অমৃতার জন্যে দুশ্চিন্তা আমারও কিছু কম হচ্ছে না।

তবে সব সমস্যারই সমাধান হয়ে গেল। ওরা ঠিকানা খুঁজে খুঁজে গিয়ে দেখল 4/1/A, সেন্ট্রাল পার্কের এক নম্বর ফ্ল্যাটে তালা মারা। কোল্যাপসিব্‌লটা এমন করে বন্ধ, এমন করে তাতে সাত লিভারের বড়সড় একটা তালা লাগানো যেন কোনওদিন কেউ ওখানে ছিল না। ও বাড়ি বহুদিন খালি পড়ে আছে, বিক্রি হয়ে যাবে এবার।

অমৃতাদেরটা একতলার ফ্ল্যাট, দোতলায় ওঠবার সিঁড়িটা পাশ দিয়ে চলে গেছে।

লাবণি হঠাৎ বলল—চল না, দোতলার ফ্ল্যাট-ট্যাটে জিজ্ঞেস করি।

দোলার ভীষণ দুর্ভাবনা হচ্ছিল, সে বলল—হঠাৎ এত স্মার্ট হয়ে গেলি যে!

উত্তর দিল না লাবণি—দোতলায় উঠতে থাকল। বাড়িটা ছোট। তিন তলায় তিনটে ফ্ল্যাট।

দোতলার ফ্ল্যাটে গিয়ে বেল টিপল ওরা। এক ভদ্রমহিলা বেরিয়ে এলেন।

—কে আপনারা?

—আমরা নীচের ফ্ল্যাটের অমৃতা মানে ওঁদের বাড়ির বউয়ের বন্ধু। ওর কাছে এসেছিলাম, দেখছি তালা মারা। আপনারা যদি কেউ কিছু জানেন।

—তালা মারা? সকালেও তো ভদ্রলোককে বাজার বেরোতে দেখেছি। তবে, কিছু মনে করো না ভাই, তোমাদের তুমিই বলছি, ওঁরা যেন কেমন। কারও সঙ্গে মেশেন না। বউটিকেও মিশতে দ্যান না। প্রতিবেশীর সঙ্গে তো প্রতিবেশীর স্বার্থের খাতিরেই একটু মেলামেশা করতে হয়। ওঁরা সেটুকুও করেন না। এসো না ভেতরে, বসো।

দোলা লাবণির দিকে তাকাল। লাবণি দোলার দিকে। এক পা এক পা করে এগোল, সোফার দিকে তাকিয়ে ভদ্রমহিলা বললেন–বসো, বসো না। তোমরা মেয়েটির বন্ধু! মেয়েটিকে কিন্তু ভাল বলেই মনে হয়। একদিন আমি বেরোচ্ছি, ও-ও বেরোচ্ছে। বলল—বউদি, আপনাকে তো বেরোতে দেখি না!

—আমি বললাম—আজ একটু ব্যাঙ্কে যাবার আছে ভাই। এই পর্যন্ত বলেছি, দরজার ভেতর থেকে ওর শ্বশুরই বোধহয় ডাকলেন, অমৃতা অমৃতা, একটা কথা শুনে যাও। অবভিয়াস আমার সঙ্গে কথা বলতে দেবেন না।

—আশ্চর্য তো! দোলা বলল।

লাবণি বলল—উনি কথা বলতে না দেবার কে? উনি না বললেন আর অমৃতাও শুনে গেল? এত ভিতু মেয়ে তো আমাদের বন্ধু নয়? কেন, আপনাদের সঙ্গে ওঁদের কি কিছু নিয়ে কোনও মনোমালিন্য…

—আরে আলাপ হবে সম্পর্ক হবে তবে তো মনোমালিন্য। আচ্ছা, আমাদের না হয় ওঁরা পছন্দ করেন না, কিন্তু তিনতলা? তিনতলার ফ্ল্যাটের সঙ্গেও ওঁদের কোনও সম্পর্ক নেই। আশপাশের কারও সঙ্গে আছে বলেও জানি না। বউটি, মানে তোমাদের বন্ধু কিন্তু ভাল। দেখো, হয় তো সবাই মিলে কোথাও বেরিয়েছে, তাই তালা। সবাই-ই তো কোল্যাপসিব্‌ল টেনে তালা দিয়েই বেরোয়।

ভদ্রমহিলাকে ধন্যবাদ জানিয়ে ওরা বেরিয়ে এল। একতলায় নেমে লাবণি আবার জানলা-টানলা দিয়ে একটু উঁকি মারার চেষ্টা করল, জানলাগুলো ভেতর থেকে বন্ধ। খুব স্পষ্ট যে ভেতরে কেউ নেই।

রাস্তাটা পেরিয়ে একটা পুকুরের ধার পর্যন্ত ওরা এসেছে। একটি ছেলে হঠাৎ উর্ধ্বশ্বাসে ছুটতে ছুটতে ওদের সামনে এসে দাঁড়াল। বছর পনেরো ষোলো হবে বোধহয়, সবে গোঁফ গজিয়েছে। একটা টি শার্ট আর পায়জামা পরা।

ছেলেটা অমনি উর্ধ্বশ্বাসে বলে গেল—অমৃতা বউদির খুব শরীর খারাপ, কোনও হাসপাতাল-টাতালে নিয়ে গেছে। যখন নিয়ে গেল খুব সম্ভব অজ্ঞান মতো ছিল, একটা শাদা অ্যামবাসাডর। অরিদার অফিসের গাড়ি। কিন্তু ব্যাপারটা ভাল নয়।

বুকের ভেতর ধড়াস ধড়াস করছে, দোলা বলল—কী হয়েছে অমৃতার? দিন তিনেক য়ুনিভার্সিটি যায়নি। কিন্তু আজ সকালে আমার সঙ্গে কথা বলল, তখনও তো কোনও শরীর খারাপের কথা বলেনি! তুমি কে?

—আমি সীজার, ওদেরই তিনতলায় থাকি। হেয়ার স্কুলে পড়ি তো, একসঙ্গে যাতায়াত করি। সেই থেকে ভাব হয়ে গেছে খুব। আমি জানি বউদির শরীর খারাপ। কোনও মেয়েলি ব্যাপার, তাই আমাকে বলতে পারেনি।

ছেলেটি একটু লাল হয়ে মুখ নিচু করল। তারপর বলে উঠল—আপনারা প্লিজ ওর বাবা-মাকে খবর দিন।

বিমূঢ়ের মতো খানিকটা হেঁটে লাবণি ডাকল—এই সীজার, সীজার, শোনো-ও।

অনেকটা রাস্তা চলে গিয়েছিল ও, রাস্তার কোনও চলতি লোক ওদের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে ও আবার ছুটে এল। লাবণি বলল—তোমার, মানে তোমাদের ফোন নম্বরটা দাও।

—ফোর টু-ফাইভ টু থ্রি সেভেন ওয়ান।

—তোমাকে ডাকলে বাড়ির সবাই ডেকে দেবেন তো?

—হ্যাঁ, আপনি…

—আমার নাম লাবণি দে, থাকি গোয়াবাগানে। ফোন নম্বরটা মনে রাখা খুব সোজা। ট্রিপ্‌ল্‌ ফাইভ-ওয়ান টু ফোর থ্রি। কোনও খবর থাকলে আমাকে জানিও। একটু নজর রাখবে বাড়িটার দিকে।

—সে তো রাখবই—দোলার দিকে ফিরল ছেলেটি, আপনারটাও দিয়ে দিন।

—দোলা রায়, ফোন ফোর সিক্স ফোর নাইন ওয়ান নাইন ওয়ান।

—আপনি তো তাহলে কাছেই থাকেন! ঠিকানাটা বলবেন?

দোলা ঠিকানা বলল।

সীজার বলল, ঠিক আছে। আমি এদিকে কোনও কিছু হলে জানাব।

—কোনও কিছু হলে মানে?

—কেন? আপনারা কাগজ পড়েন না? বধূ হত্যা টত্যা…

—তুমি বলছ কি? —দোলা শিউরে উঠে বলল, তার চোখ বড় বড় হয়ে গেছে।

লাবণি বলল—এ কথা তোমার কী করে, কেন মনে হল সীজার?

—কী জানি! মনে হল! বউদির এত সুন্দর চেহারা ছিল, কী রোগা হয়ে গেছে, ওকে দিয়ে বাড়ির সমস্ত কাজ করায়। আমি জানি। খেতে দেয় না।

—কী করে জানলে? ও তোমাকে বলেছে?

—কিছুই বলেনি। একদিন আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম—বউদি, ডায়েটিং করছ না কি? বিউটি-কম্পিটিশনে নাম দেবে? তাইতে ও হেসে বলল—অনেকে ডায়েটিং করে, অনেককে কপাল করায় বুঝলি? তখন কথাটা সিরিয়াসলি নিইনি। এখন মনে হয়েছে। এই ক’দিনই মনে হচ্ছিল।


অমৃতার কথাটা সর্বক্ষণ মাথায় ঘুরছে—‘তোর ডাউরি নেই বলেই কি বিয়ের আগে দুটো রাত উপহার দিতে চাইছিস?’ সৌমিত্র দাস যখন প্রস্তাবটা দিল, দিল এইভাবে—চলো শম্পা একটু বেড়িয়ে আসা যাক।

শম্পা তো বেড়াতে পেলে আর কিছু চায় না। বলল—কোথায়?

—দ্যাখো ডায়মন্ডহারবার পুরনো হয়ে গেছে। আরেকটু দূর। ধরো দিঘা। পুরো রাস্তাটা গাড়িতেই যাব। এখনও খড়্গপুর টু দিঘা, বা এখানকার যে বাসগুলো স্ট্রেইট দিঘা যায়, সেগুলো তেমন ভাল হয়নি। খড়্গপুর টু দিঘাগুলো তো লজঝড়। আমার মারুতি জেন শাঁ শাঁ করে চলে যাবে। এ. সি.। তুমি বাইরের ধুলো, পলিউশন, গরম কিচ্ছু টের পাবে না। ঠিক দুদিন আগেই সৌমিত্র বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছে। শম্পা কিছু বলেনি, মনে মনে বলেছে—ইস্ সত্যি?

মুখে সে বলেছে—কেন?

—কেন মানে?

—বিয়ে করতে চাইছেন কেন?

—চাইছি কেন? আশ্চর্য! তুমি এতদিনেও বুঝতে পারোনি, আমি তোমায় বিয়ে করতে চাইছি! আজকে শুধু মুখ ফুটে বললাম এই পর্যন্ত।

শম্পার গলা ধরে গেছিল, সে বলেছিল—কী আছে আমার? কেনই বা আমাকে…

—তোমার এই কমপ্লেক্সগুলো আমার ভাল লাগে না শম্পা। সত্যি বলছি তোমার এই পার্টটাই সবচেয়ে ডিপ্রেসিং। তুমি একটা অ্যাট্রাকটিভ ইয়াং উওম্যান, পার্ফেক্টলি এডুকেটেড, ডুয়িং এ গুড জব, তোমার ভেতরে আজকালকার মেয়েদের তুলনায় কিছু বস্তু আছে। কেন তোমার এই সব কমপ্লেক্স আমি জানি না। তুমি কি বুঝতে পারো না আমাদের ললিত শা, অভিনাশ চোপরা—এরা তোমার সঙ্গে আলাপটা এগোতে খুবই ইচ্ছুক, খালি আমি তোমার প্রতি দুর্বল জানে বলেই এগোতে পারে না!

—ও তো পুরুষদের একটা মেয়ে দেখলেই র‍্যাগিং করার টেনডেনসি থাকে—

—নাঃ শম্পা, তোমাকে নিয়ে পারা যাবে না, আসলে তোমার বাবা অল্প বয়সে মারা গিয়েই, তোমার একটা পার্মানেন্ট সেন্স অফ ইনসিকিওরিটি এসে গেছে।

—বোঝেন যদি তো বলেন কেন?

সেদিন ওরা ব্লু-ফক্সে গিয়েছিল। ওয়লডর্ফ নয়।

মৃদু আলোর মধ্যে ওদের কথাবার্তা খুব জমেছিল।

যে লোকটা তাকে এত বোঝে, তার এত গুণের কথা খেয়াল করেছে, তার একমাত্র দোষের কথাও সরবে বলে তাকে সাবধান করে দিচ্ছে, তার প্রস্তাবটা কুপ্রস্তাব বলে মানতে মন রাজি হয় না।

মা, তার মা, নানা বিপদে-আতঙ্কে দিশেহারা বেচারি মা তার জীবনের অর্ধেক ব্যাপারই বোঝে না। বাবার মৃত্যুতে বাবার জন্য চাকরি একটা পেয়েছে, কিন্তু তা তো আর বাবার চাকরি নয়! মা পেয়েছে মায়ের বিদ্যে-বুদ্ধিমতো একটা কেরানির চাকরি। নেহাৎ টাটাদের কনসার্ন, ভাল পয়সাকড়ি দেয় বলে তাদের চলে যায়। ডাফ স্ট্রিটের বাড়িটাও আছে। যৌথ পরিবারের বাড়ি। তার বাবাই ভাগ করে পাঁচিল-টাঁচিল তুলে গিয়েছিলেন—তাই। তা নয় তো, ও পারে তার জ্যাঠতুতো জ্যাঠামশাইয়ের পরিবার তাদের কী অবস্থা করত তা একমাত্র ভগবানই জানেন। এখনও যথেষ্ট নাক গলায়। সৌমিত্রকে সে একদিনও বাড়িতে আনেনি। মায়ের সঙ্গেও আলাপ হয়েছে বাইরে, সুতানুটি উৎসবে গান-টান শুনতে গিয়ে। মা তো এক কথায় মুগ্ধ। অত সুন্দর পুরুষালি চেহারা, অত ভাল চাকরি করে? সেই ছেলেকে তিনি যে কোনও মূল্যে জামাই পেতে চান।

সৌমিত্রর প্রস্তাবটা শম্পা খুব হেলায়-ফেলায় রেখেছিল মায়ের কাছে। মা জানো, দিঘাতে একটা কাজ আছে আমাদের কম্প্যানির। সৌমিত্র বলছে আমাকেও ওর সঙ্গে যেতে।

—মানে তুই ওকে হেল্প করবি? না কি?

—তাই দাঁড়ায় ব্যাপারটা।

—আর কে যাবে?

—আবার কে? আমি আর ও।

চমকে উঠল মা।

—তুই আর ও? অফিসে কথা হবে না এ নিয়ে?

—সমাজ অনেক এগিয়ে গেছে মা। দিনকাল বদলে গেছে টের পাও না?

—তা ছাড়া ও তো তোকে বিয়ে করবে কথা-ই দিয়েছে। তবু-তবু শম্পি ওখানে গিয়ে কিন্তু কাছাকাছি ঘরে থেকো না। আর সাবধানে থেকো। বিয়ের আগেই যদি ও স্বামীর মতো ব্যবহার করতে চায়, তুমি কিন্তু রাজি হয়ো না।

—আচ্ছা মা, আমার বুদ্ধি-বৃত্তি, আমার আত্মসংযমের ওপর এতটা আস্থা তোমার এল কী করে?—শম্পা মনে মনে ভাবে। এ কি আস্থা? না দায়িত্ব ভাগ করে নেওয়া, কিংবা দায়িত্ব একেবারে ছেড়ে দেওয়া! তাই, তাই-ই সে অমৃতার কাছে গিয়েছিল। অমৃতা এককথায় না করে দিল, বিষ উগরে দিল। সে বিষ কি তাকে, তার বিশ্বাসকেও আক্রমণ করেনি?

—কী? আমরা যাচ্ছি তো এই উইক-এন্ড-এ।—আবারও ব্লু ফক্স।

—এ সপ্তাহে যদি না যাই, তো কী হয়? শম্পা সৌমিত্রর চোখ এড়ায়।

—কী হয় মানে? আর আমার সময় হবে না কি? তুমি কি জানো না উইক-এন্ড-এও দস্তিদার আমার ওপর কী কাজ চাপিয়ে রাখে? আর তারপর তো আমাদের বিয়ের দিন এসেই যাবে। এই বৈশাখেই।

—আপনি তো আপনার বাড়ির কারও সঙ্গে পরিচয় করালেন না? আপনি স্থির করলেই স্থির হয়ে যাবে?

—ওহ, ইয়েস, হু এলস ইজ দেয়ার এনিওয়ে? দিদি জামাইবাবু থাকেন বম্বেতে, একটা বোন আছে সে জার্মানিতে, জার্মান বিয়ে করেছে। এগুলো তো তোমায় আমি বলেছি, বলিনি?

—না, দিদির কথা বলেছেন। আবছাভাবে বম্বের কথাও। তবে ছোট বোনের কথা, তার জার্মান সাহেবকে বিয়ে করার কথা বলেননি। তা আপনাদের পরিবারে সাহেব-জামাই থাকার জন্যই কি আপনারা এত পারমিসিভ?

প্রথমটা হাঁ হয়ে গেল সৌমিত্র। তারপর বলল—বাহ্‌ বাহ্‌ এই তো মাটির পুতুলের মুখে খই ফুটছে। গড নোজ কোনও ভেন্ট্রিলোকিস্ট মিষ্টি পুতুলটাকে নিজের কথা বলবার জন্য ব্যবহার করছে কি না!

—ঠিক আছে। তাই—শম্পার চোখ এবার জল চকচক—ভেন্ট্রিলোকিস্ট-ই ব্যবহার করছে, তাই বলে আপনিও ব্যবহার করবেন?

—কী বলছ শম্পা? কী বলছ তুমি জানো।

—হতে পারি আমি মাটির পুতুল, তো সেই মাটির পুতুলটাকে ভেঙে দেবেন না সৌমিত্রদা।

চোখ থেকে জল এবার উপচোচ্ছে। শম্পা উঠে দাঁড়াল। সামনে টেবিলের ওপর পড়ে রয়েছে স্মোক্‌ড হিলসা, বাটার নান। চিকেন দো পিঁয়াজা।

—আরে আরে শম্পা, চললে কোথায়? ডোন্ট ক্রিয়েট আ সিন প্লিজ।

—পরে যাতে এর চেয়েও বেশি সিন ক্রিয়েট করতে না হয় তাই, আমি কোয়ায়েটলি চলে যাচ্ছি। আপনি বসুন।

—এই এত খাবার আমি একা খাব?

—খেতেই তো পারেন। ছেলেরা তো একটু বেশিই খায়। কয়েক পেগ হুইস্কি নিয়ে নিলেই পেরে যাবেন। আর নেহাৎ না পারেন আর কাউকে ডেকে নিন না, কোনও কাচের কি পোর্সিলেনের পুতুলকে, কোনও বার্বি ডলকে যে আপনার সঙ্গে দিঘা যেতে রাজি হবে!

ক্রুদ্ধ হতভম্ব সৌমিত্রকে একা বসিয়ে রেখে বেরিয়ে এল শম্পা। ভেতরে এক বুক কান্না। তাদের মায়ের মেয়ের ভীষণ বিয়ের শখ। বিয়ে হলে একটা পুরুষ হবে তাদের সংসারে। সে মাকে এনে রাখবে নিজের কাছে তার বর যদি মায়ের বাড়ি থাকতে না-ও চায়। কিংবা মায়ের কাছাকাছি থাকবে। একটা সমর্থ পুরুষের যে কী ভীষণ দরকার জীবনে, তা তার বাইশ বছরের জীবনে হাড়ে হাড়ে বোঝে শম্পা। সে জানে না, সে ঠিক করল কি না। সৌমিত্রর হয়তো কোনও অসৎ উদ্দেশ্যই ছিল না। সে হয়তো এখনই তাকে বউ ভাবতে শুরু করেছে। কিংবা হয়তো সে তার সঙ্গে সম্মানজনক আচরণ করত। ওরা সত্যিই একটু হাই-সোসাইটির মানুষ। তারা যেমন বিয়ের আগে অদূরে ভাই কি মেসোমশাইকে বসিয়ে রেখে, মুখোমুখি বোঝাপড়া করে, ওদের সমাজে হয়তো সেটাই হয় এই রকম উইক-এন্ড ট্যুরে গিয়ে। আজকে সে তার আপাদমস্তক মধ্যবিত্ততাই প্রমাণ করে দিল সৌমিত্র দাসের কাছে।

পার্ক স্ট্রিট রাস্তাটা পার হওয়া খুব শক্ত। বিশেষত শম্পার চোখ ঝাপসা, মন বোধবুদ্ধি সবই কুয়াশাচ্ছন্ন হয়ে আছে। রাস্তার আলোকস্তম্ভ, যেখানে হলুদ, সবুজ, লাল সংকেত জ্বলে নেভে সে সেটা ভাল করে দেখতে পাচ্ছে না। দেখতে পেলেও বুঝতে পারছে না যেন পুরোপুরি।

‘ব্লাডি বাস্টার্ড, ডার্টি হোর’—সে জেব্রা দিয়ে পার হচ্ছিল না, মোটামুটি ফাঁকা রাস্তা দেখে পার হতে যাচ্ছিল। প্রায় চলে যাচ্ছিল একটা ফিয়েট য়ুনোর চাকার তলায়। গাড়ির বনেটের ঠাণ্ডা কঠিন স্পর্শ ঠিক মৃত্যুর স্পর্শের মতো তার কোমর ও ব্লাউজের মাঝখানের খোলা অংশে লেগে রয়েছে। কিন্তু মৃত্যুর চেয়েও ভয়ঙ্কর স্পর্শের কিছু শব্দ তার শরীর হিম করে দিল। গাড়িটা তাকে পাশ কাটিয়ে নিজেকে মুক্ত করে নিয়ে একেবারে শাঁৎ করে চলে গেল। মুখে পাইপ এক মধ্যবয়সী মনে হল। না কি মধ্যবয়সী নয়? খুব বয়স্ক না কি? বিপরীত দিকের পেভমেন্টে সে এলই বা কেন? তাকে তো যেতে হবে উত্তরে, পার্ক স্ট্রিটটুকু সিঙ্গারের শোরুম আর এশিয়াটিক সোসাইটির পাশ দিয়ে হেঁটে হেঁটে চৌরঙ্গি রোডে পড়া। তারপর ট্রাম গুমটির দিকে যাওয়া, এই তো তার পথ। কেন সে রাস্তা পার হতে গেল। ‘ব্লাডি বাস্টার্ড’টা না হয় পথ-চলতি মুখের কথা সাধারণ গালাগালি হয়ে দাঁড়িয়েছে, কিন্তু ‘ডার্টি হোর?’ তাকে একটা নোংরা পণ্য মেয়ের মতো মনে হচ্ছে লোকের? আজকাল? সাধারণত সে সালোয়ার কামিজই পরে, আজ পরেছে মায়ের একটা লাল রঙের সিল্ক। ঘন গাঢ় রক্তের মতো রংটা, এটা পরে তাকে খুব ভাল দেখায়। সবাই বলে। সৌমিত্রও আজ বলেছিল। একটা মোটা বিনুনি এখনও তার মাথার পেছনে, সৌমিত্রর খুব ইচ্ছে সে স্টেপ কাটে। কিন্তু অতগুলো চুল! একবার স্টেপ কাটলে আর কিচ্ছু করার থাকবে না। তাই সে প্রাণ ধরে কাটতে পারছে না চুলটা। মাথার পেছনে হাত দিল সে, হেয়ার পিন দিয়ে কতকগুলো লাল গোলাপ আটকানো। পার্ক স্ট্রিটের মোড়েই ফুলগুলো গছাল একটা অল্পবয়সী ছেলে। সৌমিত্র কিনল। নিজে অবশ্য পরিয়ে দেয়নি। হাত স্টিয়ারিং-এ। বলল—পরে নাও শম্পা প্লিজ। এই ফুলগুলোই কি ওই গালাগালের কারণ! তার ঠোঁটে কড়া লাল লিপস্টিক। গরম পড়ছে বলে সে অন্য কোনও প্রসাধন করে না। চোখে ম্যাসকারা লাগায়নি। খালি হালকা বাদামি একটা আই শ্যাডো ব্যবহার করেছে আর আইব্রো পেনসিল দিয়ে চোখের ওপর পাতায় পলক ঘেঁষে একটা সরু লাইন। বোঝাই যায় না কিন্তু চোখে একটা শ্ৰী আসে। এতেই তাকে ‘ডার্টি হোর’-এর মতো দেখাল? সৌমিত্ররও তা হলে ওই জাতীয় কিছু লাগে নিশ্চয়ই। একটা সস্তা মেয়ে যাকে উইক এন্ডে এ. সি. গাড়ি করে দিঘা নিয়ে গিয়ে কিছু ফুর্তি করা যাবে? ছি, ছি, বিয়ের আগ্রহে, একটা নোঙরের আগ্রহে সে এমন চোরাবালির ওপর এসে দাঁড়িয়েছে?

একটা ভাঙাচোরা পুতুল। হ্যাঁ, একটা মাটির পুতুল চোখের জলে যার অর্ধেকটা গলে গেছে, আর ক্রোধের আগুনে যার বাকিটা জ্বলে গেছে। এই হল শম্পা, বাড়ির রাস্তা পার হয়ে সে কারবালা ট্যাঙ্ক লেনের দিকে চলে যেতে থাকল। আসলে তার বাড়ি সে পেরিয়ে গেছে সে খেয়ালই তার হয়নি। নিজের রাস্তা সে চিনতে পারছে না।

—এই শম্পাদি কোথায় যাচ্ছিস রে? —শম্পা সাড়া দিচ্ছিল না। কিন্তু দ্বিতীয়বার—এই শম্পাদি’ শুনে তাকে ফিরে তাকাতেই হয়।

বাবুল। প্রতিবেশী এই ছেলেটি একেবারে এক নম্বরের ভাল ছাত্র। এবার জয়েন্টে সেকেন্ড এসেছে। যাদবপুরে বোধহয় কম্পিউটার এঞ্জিনিয়ারিং কি ইলেকট্রনিক্স এরকম কিছু পড়ছে। বাবুলের ফর্সা নিষ্পাপ চশমা পরা মুখটার দিকে তাকিয়ে শম্পা যেন একটু একটু করে তার চেনা পৃথিবীতে ফিরে এল। ওই তো বাবুলদের বাড়ি, গায়ে গায়ে লাগা সুপ্রিয়াদের বাড়ি। সে তার বাড়ি পেছনে ফেলে এসেছে।

—কোথায় যাচ্ছিস?

—কোথাও না।

—তার মানে! আমি তো ভাবলুম তুই আমাদের বাড়িতেই আসছিস, দিদি এসেছে খবর পেয়েছিস।

—না, আমি মিণ্টির কাছে যাচ্ছি না। কোথাও যাচ্ছি না। বাড়িও যাচ্ছি না।

বাবুল ওর পাশে পাশে হাঁটতে হাঁটতে বলল—তুই কি কেঁদেছিস না কি রে, গালময় জলের দাগ। তোর পাউডার ধেবড়ে গেছে।

—পাউডার আমি মাখি না।

—মেয়েরা পাউডার মাখে না! এটা তুই আমাকে খাওয়াতে পারবি না।

—ঠিক আছে, আমায় বিরক্ত করিস না।

—আরে মাসিমা বকেছেন তো হয়েছে কী? এমন বকলেন যে তুই লাল শাড়ি পরে একেবারে সুইসাইড করতে চললি! কোন সাইটটা বাছলি৷ হেদো তো পেছনে ফেলে এসেছিস? দেশবন্ধুর পুকুরই এখন নিয়ারেস্ট। তা মাইল দুয়েক তো হবেই! হ্যাঁ রে পুকুরটা এখনও আছে তো!

শম্পা বলল—আমাকে বিরক্ত করিস না।

—ও বুঝেছি। ট্রাম লাইনে মাথা দিবি। জীবনানন্দকে চাপা দেবার পর থেকে ট্রাম-কোম্পানি খুব সাবধান হয়ে গেছে রে! একে তো লালবাতি জ্বলতে চলেছে তার ওপর যদি আরও কলঙ্ক বাড়ে …

শম্পা ফিরে দাঁড়াল। —ঠিক বলেছিস।

—কী ঠিক বললুম!

—ওই যে সুইসাইডের কথাটা!

—সত্যি তুমি সুইসাইড করতে যাচ্ছিলে?

—যাচ্ছিলাম না, কিন্তু তুই সাজেস্ট করতে এখন মনে হচ্ছে দ্যাট ইজ আ বেস্ট ওয়ে।

—একটা সাজেশন যখন নিলে শম্পাদি, তখন আরেকটাও নাও।

—মানে?

—আমি বলছিলুম তুমি সুপ্রিয়াদির সঙ্গে ঘণ্টাদুয়েক আড্ডা মেরে এসো। চমৎকার একটা সুইসাইডের অভিজ্ঞতা হয়ে যাবে।

শম্পার মুখে একটা ফিকে হাসি দেখা দিয়েই মিলিয়ে গেল। কারবালা ট্যাঙ্ক লেনের সুপ্রিয়া চাটুজ্জে একটি বিখ্যাত বিশ্বনিন্দুক এবং ঝগড়ুটে। ওর মতে একজন যদি হয় ডাফ লেনের ছাগল তো অন্য আরেকজন বেথুন রো-এর, আরশুলো। বাবুলকে দেখলেই বলে—কী রে, যাদবপুর তো হয়ে গেল? এখনও মাস্টারগুলোকে তেল মারছিস? অবশ্য বাবুলকেই একমাত্র কথাটা সামনে বলে, অন্যদের ক্ষেত্রে বলে পেছনে। কে পাকা কুমড়ো কিন্তু কচি শশাটি হবার সাধ হয়েছে, কে আবার কার্বাইড দিয়ে পাকানো আম, কে বা কাকিনী, এই রকম। সুপ্রিয়াদির গুণমুগ্ধ একটা ছোট দল যে পাড়ায় নেই, তা নয়। কিন্তু বেশিরভাগই ওর এই স্বভাবে বিরক্ত। বাবুল যেমন শম্পাও তেমন ওকে এড়িয়ে যায়। সামনে পড়ে গেলে হয়তো বলবে—কী রে, মায়ার ছোটপিসির মতো ডুবে ডুবে জল খাচ্ছিস না কি? দেখতে পাই না কেন আজকাল? এর পরই মায়ার ছোটপিসির গল্পটা সবিস্তারে বলবার জন্যে ছটফট করবে সুপ্রিয়াদি। তখন তার হাত থেকে ছাড়া পাওয়াই এক দুষ্কর ব্যাপার। প্রতিভার তোড় এসেছে তো!

বাবুলই বলে—কবিরা যেমন প্রেরণার তোড়ের মাথায় যা আসছে তা লিখে ফেলতে না পারলে খেপে যায়, সুপ্রিয়াদিও তেমন নিন্দের তোড় এলে আর সামলাতে পারে না। কাপড়ে-চোপড়ে হয়ে যায়, বুঝলি?

শম্পা এখন বলল—ভাল বলেছিস। সেই অর্জুনের আত্মঘাতী হবার জেদ চাপল আর কৃষ্ণ অমনি তাকে বুঝিয়ে দিলেন, বেশ খানিকটা আত্মপ্রশংসা করে নাও, তা হলেই আত্মহত্যার কাজ হয়ে যাবে!

বাবুল বলল—এটাও আমার অরিজিন্যাল রাখতে দিলি না? তোরা মহাভারত-টারত এত পড়ে রাখিস কেন রে? নাঃ এবার ল্যাটিন অ্যামেরিকান পড়তে হবে। নইলে আর তোদের কাছে পাত্তা পাচ্ছি না।

বাবুল পাশে পাশে হাঁটছে। যথেষ্ট ব্রিলিয়ান্ট ছেলে, আবার সবার সঙ্গে মেলামেশাও করে খুব। চমৎকার হালকা কথাবার্তা বলতে পারে। হঠাৎ শম্পার মনে হল—এই যে নিষ্পাপ, হাসিখুশি বাবুল এ-ও তো ভাল পড়াশোনা করছে, সেই সুবাদে ভাল চাকরি-বাকরিও পাবে, তখন ওরও কিছু সাবর্ডিনেট মেয়ে থাকবে, আর একটা এ.সি. গাড়ি, আর ওয়ালেটে অনেক পয়সা, আর একটা মাত্র উইক-এন্ড ছাড়া ছুটিও থাকবে না। সারাক্ষণ কাজে যোতা। তা, ও-ও কি একটি পছন্দের সাবর্ডিনেট মেয়েকে ওর সঙ্গে উইক-এন্ড-এ দিঘা যেতে বলবে? তো সেই মেয়েটি হয়তো শম্পার মতো ডাফ স্ট্রিটের পুরনো বাড়ির বাপ-মরা লড়াই-করা মায়ের লড়াই করা বিস্তর কমপ্লেক্সঅলা মেয়ে নয়, সে হয়তো ‘দেবাঞ্জলি’ কি ‘আকাশ প্রদীপ’ জাতীয় ফ্ল্যাটে থাকে, অনেক আধুনিক, অনেক মডার্ন। দিঘার হোটেলের ডাব্‌ল বেড এ.সি. রুমে বাবুল কন্ডোম বার করলে হয়তো সে মেয়েটি অবাক তো হবেই না, নিশ্চিন্ত হবে, কারণ তার ব্যাগেরটা আর বার করতে হল না। তারপর হয়তো চমৎকার বোঝাপড়ার মধ্যে দিয়ে দুজনে দুদিকে চলে যাবে, বাবুলের অন্য কোনও উইক-এন্ড অন্য কোনও মেয়ের সঙ্গে যুগলে বেড়াতে যাবার পথে হিংস্র ফণা তুলে, কিংবা দুচোখ ভর্তি গরম জল নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে না।

আড়চোখে সে বাবুলের দিকে চাইল। চশমাটা ঠেলে নাকের ওপর ওঠাচ্ছে বাবুল। একটা মোটা-কালো ফ্রেমের চশমা পরেছে। তাতেও তার মুখের ছেলেমানুষি যায়নি। কিন্তু ভী-ষণ সেয়ানা ছেলে। শুধু পড়াশোনাতেই নয়।

—বাবুল, একটা কথা জিজ্ঞেস করব?

—কর না। আবার অনুমতির কী আছে? ওই সুইসাইড সম্পর্কিত নয়তো, যদি আমাকে কয়েক ফাইল সিডেটিভ জোগাড় করে দিতে বলিস, সেটা পারব না কিন্তু।

—বাজে বকিস না। তোরা, মানে তুই মেয়েদের সম্পর্কে কী ভাবিস? বলবি? আমি তোর দিদির মতো!

—তোরা, মানে তুই’টাতে আমার খুব আপত্তি আছে শম্পাদি। আমি হলাম একটা আলাদা ব্যক্তি, আমি আমার মতো ভাবি, ওরা মানে আমার পেছনে যদি পুরো আমাদের জেনারেশনের ছেলেগুলোকে দাঁড় করিয়ে দিস তা হলে আমাকে ভেবে ঠিক করতে হবে, মানে একটু বিশ্লেষণ করে নিতে হবে এই আর কি। আমার দ্বিতীয় আপত্তি হল ‘দিদির মতো’ কথাটায়। মতো টতো কেন? তুই তো আমার একরকম দিদিই হলি, মিন্টির মতো নিজের দিদি নয়, কিন্তু পাড়াতুতো দিদি তো!

—আচ্ছা ঠিক আছে, আমি তোর পাড়াতুতো দিদি। কিন্তু তুই মেয়েদের সম্পর্কে তোর নিজস্ব ধারণার কথাও বল, আবার একটু জেনারালাইজও কর, প্লিজ।

বাবুল বলল—এইরকম হাঁটতে হাঁটতে? যদি গাড়ি চাপা পড়ি? কিংবা সুপ্রিয়াদি এসে পড়ে? জানলায় চোখ রেখে দেখছে হয়তো এখন।

—তা হলে কীভাবে বলতে চাস?

—একটু ‘গজব’-এ খাওয়া না রে শম্পাদি। হেভি চাকরি করিস তো!

—তুইও তো হেভি স্কলারশিপ পাস?

—আমি? স্কলারশিপ? জানিস না ফ্যামিলির উপার্জন পাঁচ-টাচের বেশি হলে স্কলারশিপটা দেয় না। ওই কুমিরছানার মতো দেখিয়ে ড্রয়ারে ঢুকিয়ে একটা সার্টিফিকেট দেয়।

—তাই বুঝি? জানতুম না তো!

—কত কিছুই জানিস না এ পৃথিবীতে। বিপুলা এ পৃথিবীর কতটুকু জানিস বল, অথচ চাকরিতে ঢুকে অব্দি কেমন একটা সবজান্তা, সবজান্তা ভাব করিস। তবে ন্যাশন্যাল ট্যালেন্টেও আমি একটা স্কলারশিপ পাই। তোকে বাজে কথা বলব কেন? তা, সেটা তো বই-টই কিনতেই চলে যায়।

—কী খাবি?

—রেশমি কাবাব চিকেনের। আর আইসক্রিম। তোর রেস্তয় কুলোবে তো? দুজনেই খাব কিন্তু।

সত্যি খিদে পেয়েছে। দা-রুণ! শম্পা নিজের ব্যাগের ভেতরটায় উঁকি দিয়ে বলল—হ্যাঁ হয়ে যাবে। দাঁড়া মায়ের জন্যও একটা প্যাকেট করে দিতে বলি।

অর্ডার দেওয়া হয়ে গেলে, বাবুল বলল—এবার বল তোর হবু বর সৌচিত্র না সৌমিত্র, পদবি জানি না, তোকে এমন কী বলেছে যে তুই কেঁদে মুখের মেকাপ ধুয়ে ফেললি?

এত অবাক শম্পা জীবনে কখনও হয়নি।

সে বলল—সৌমিত্রর কথা তুই কী করে জানলি?

—সবাই জানে পাড়ায়। পাড়ার জামাই আসছে, সব হাত ধুয়ে বসে আছে, কখন পাতে পোলাও পড়বে।

—সর্বনাশ! আলাপ, একটু বেশি আলাপ হলেই বিয়ে? এই তোর তোদের মেয়ে সম্পর্কে ধারণা?

—তোরা তো ঝুলে পড়তে পারলেই বেঁচে যাস। যে প্রথম অ্যাপ্লিক্যান্ট তারই সঙ্গে।

—সেটা উচিত নয় বলছিস?

—অবশ্যই নয়, প্রেমে হাবুডুবু খাস তো আলাদা কথা, তখন আর তোদের হ্রস্ব-দীর্ঘ জ্ঞান থাকে না। কিন্তু আদারওয়াইজ একটু বাজিয়ে নেওয়া তো দরকারই।

—তুই, তুই কী ভাবে বাজিয়ে নিবি?

—আমি? আমার কথা উঠছে কেন? —বাবুল চোখ গোল গোল করে বলল।

—কেন, তুইও তো একদিন বিয়ে করবি?

—আমার কথা তো হচ্ছিল না, হচ্ছিল মেয়েদের কথা।

—বেশ। মেয়েদের কথাই বল। কী ভাবিস তোরা মেয়েদের?

—ছিঁচকাদুনে, রাগী, হিংসুটে, তিলকে তাল করা, তালকে তিল করা, কুচুটে …

—ঠিক আছে, ঠিক আছে আর বলতে হবে না—শম্পা বলল। তার মুখে রাগ নেই। কিন্তু আঘাতের চিহ্ন স্পষ্ট পড়া যায়।

—আরে শোনই না, তারপরে মেয়েরা সেলফলেস, স্যাক্রিফাইসিং, অ্যাডজাস্টিং, অসম্ভব টলারেন্স, একটু রক্ষণশীল। খুব নির্ভরযোগ্য।

—ঠিক আছে, ঠিক আছে, বুঝেছি … প্রথমে গায়ে জ্বালা ধরিয়ে তারপরে তেল মারছিস। তুই যা বললি মানুষ সব মানুষই মোটামুটি এইরকম ভালমন্দের মিশ্রণ …

—এগজ্যাক্টলি। মেয়েরা আলাদা কিছু নয়। ঠিক ছেলেদেরই মতো। ধরন-ধারণগুলো একটু আলাদা, বুঝলি? নইলে এ-ও যেমন সময়ে কুচুটে, ও-ও তেমন সময়ে ক্লিকবাজ। আর এক্সপ্লয়েট করতে পেলে দুজনেই ছাড়বে না। যেমন দ্যাবা, তেমন দেবী। সুপ্রিয়াদি সুবিমলদাকে ভালমানুষ পেয়ে এক্সপ্লয়েট করছে, আবার আমার সমীরকাকু কাকিমাকে দুর্বল পেয়ে এক্সপ্লয়েট করছে। তবে ছেলেরা ছিচকাঁদুনে নয়।

—ছিঁচরাগুনে তা হলে …

—যা বলিস। আর একটা মস্ত ডিফারেন্স হল তোরা যেমন কাউকে পাকড়াও করতে পারলেই ঝুলে পড়তে চাস, ছেলেরা তেমন পাকড়িত হলেও পকৌড়ি হয়ে যেতে চায়।

—মানে?

—মানে ফুটে যেতে চায় আর কি! খাও, দাও, বেড়াও, এক্ষুনি আবার বিয়ে কী? অমনি তো বউয়ের দাঁত কনকন, পেট কনকন শুরু হবে। কে অত ঝামেলা পোয়ায়? বুঝলি না? তোদের চলনটা সেন্ট্রিপিট্যাল, আমাদেরটা সেন্ট্রিফুগ্যাল। কেন্দ্রা—ভিগ, আর কেন্দ্রা—তিগ বুঝলি তো?


আকাশ। আকাশ কি এমন শাদা হয়? হয়। নীল আকাশ সাদাটে হয়ে আছে, কিংবা সাদা মেঘে-মেঘে সাদা হয়ে গেছে এমনটা দেখা যায়। কিন্তু এমন ধোবার বাড়ির পাটভাঙা থান কাপড়ের মতো শাদা? চারদিকে একটা এমনই শাদা আকাশ। শাদা আকাশের কোলে শুয়ে একটা শাদা প্রেতের মতো মানুষ। চারদিকে ভেসে বেড়াচ্ছে আরও কিছু শাদা প্রেত। শাদা শাদা বাসনকোসনে শাদা শাদা জিনিস রান্না করছে প্রেতেরা। নাঃ সে প্রেতেদের রান্নাঘর আর দেখতে পারে না। একটা শাদা ভেলায় সে হাত রাখে, অমনি তার পুরো শরীরটাই ভেলাটার ওপর আড় হয়ে পড়ে। কেউ তাকে ভেলায় তুলে নিতে চাইছে, কিন্তু তার সাধ্যে কুলোচ্ছে না। একটা গলে-যাওয়া ভ্যানিলা আইসক্রিমের কাঠির মতো সে ক্রমাগত সেই শাদা আকাশে না কি শাদা সমুদ্রে পিছলে পিছলে যেতে থাকে। ক্ষীণ কতকগুলো কণ্ঠ অনেক দূর থেকে ভেসে আসে।

হঠাৎ টলমল করতে থাকে শাদা সিলিংঅলা একটা ঘর। সবুজ পর্দা। শাদা শাড়ি টান টান করে পরা—ক্যাপ মাথায় কড়কড়ে একজন নার্স। তার হাতটা ধরে-থাকা, এপ্রন-পরা এক দোহারা চেহারার ভদ্রলোক। চশমা-পরা, সোনালি ফ্রেমের।

—সিস্টার, আপনি একটু যান তো। আমি পেশেন্টের সঙ্গে একটু কথা বলতে চাই। সামনে থেকে শাদা ছায়া সরে যায়।

—আপনার নাম কী? মনে করতে পারছেন?

—অম্ … রি … তা গোস্‌।

—থাক ঠিক আছে।

—আপনার স্বামীর নাম কী?

কোনও উত্তর এল না।

—আপনার স্বামীর নাম কী?

এবারও কোনও উত্তর নেই।

—আপনি কীভাবে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলেন ঠিকঠাক বলুন তো!

—যাইনি।

—অজ্ঞান হয়ে যাননি? তা হলে …

—করে।

—করা হয়েছিল?

পেশেন্ট সামান্য একটু মুখ হাঁ করে, ডাক্তার ফিডিং-কাপ থেকে জল ঢেলে দেন মুখে।

—কত দিন পিরিয়ড বন্ধ হয়েছে আপনার?

—চা চা …

—চার মাস? কাউকে বলেননি?

—শুনুন, আমি বলছি আপনি শুনে যান। চোখদুটো খুলুন। হ্যাঁ সুদ্ধু শুনে যান— আপনার চার মাসের প্রেগন্যান্সি। আপনাকে ক্লোরোফর্ম দিয়ে অজ্ঞান করে এই নার্সিং হোমে আনা হয়েছে। ওঁরা মানে আপনার স্বামী, শ্বশুর, শাশুড়ি ক্লেইম করছেন, আপনি থেকে থেকেই অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছেন। এই প্রেগন্যান্সি সুতরাং টার্মিনেট করে দিতে হবে। আপনারও কি তাই মত!

—জা-নি না।

—সত্যি, মাঝে মাঝে অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছিলেন?

—না।

—শুনুন, এখন ব্যাপারটা রিস্কি হয়ে যাচ্ছে। আর শুধু শুধু প্রথম সন্তান নষ্টই বা করবেন কেন? উনি আপনার লিগ্যাল স্বামী তো?

—বি … য়ে … হয়।

—বেশ, তা হলে বাচ্চা নষ্ট করার কোনও কারণ দেখতে পাচ্ছি না। আলট্রা সনো করে দেখে নিয়েছি, বাচ্চা পার্ফেক্ট। এখন শুধু শুধু সম্পূর্ণ বিনা কারণে ভ্রূণ হত্যায় মানুষ হিসেবে ডাক্তার হিসেবে আমার এথিক্‌স-এ বাধছে। আপনারও কি নষ্ট করাই মত!

—ওর বা চ্‌ চা।

—শুধু ও কেন? কী আশ্চর্য! আপনারও তো৷ আপনারও তো ইচ্ছে-অনিচ্ছে আছে। অধিকার আছে।

—ওর বা চ্‌ চা—না।

—অন্য কারও বাচ্চা?

—না, চাই না।

—ও, ওই স্বামীর বাচ্চা আপনি চান না?

পেশেন্ট আবার একটু মুখ হাঁ করে, ডাক্তার জল দেন।

—শুনুন, বুঝতে পাচ্ছি, স্বামীর ওপর আপনার আস্থা নেই। কিন্তু ওই ভ্রূণটির অর্ধেকটা আপনার। মোটেই ও পুরোপুরি আপনার স্বামীর নয়। আপনি ঘুমোন। আজকের দিনটা ঘুমোন। একটু পরেই আপনার শ্বশুরবাড়ির লোকেরা আপনাকে দেখতে আসবে। তখনও চোখ বুজিয়ে, অজ্ঞান থাকবার ভান করবেন। আপনি আরেকটু সুস্থ হলেই আপনার সঙ্গে আবার কথা বলব।

নার্সটি ঘরে এলেন। ডাক্তার তার সঙ্গে নিম্ন স্বরে কিছুক্ষণ কথা বললেন, তারপর চলে গেলেন। নার্স স্যালাইন লাগাবার আয়োজন করতে হাতটা টেনে নিতে চাইল সে। লাগল। সিস্টার এসে তাড়াতাড়ি হাত ধরলেন—স্যালাইন চলবে। হাত ঝাঁকাবেন না। শরীরের যা অবস্থা করেছেন! চুপ করে থাকুন।

কতক্ষণ পরে, তার খেয়াল নেই, সে কিছু কণ্ঠস্বর শুনতে পেল।

অরিসূদনের গলা—কেমন আছে এখন?

সিস্টার—ভাল না। স্যালাইন চলছে, দেখছেন না?

অরিসূদন—জ্ঞান ফেরেনি?

—একবার ফিরেছিল, আবার … তবে এটা ঠিক অজ্ঞান অবস্থা নয়, শরীরটা খুব দুর্বল তো, তাই আবার একটা আচ্ছন্ন অবস্থা এসেছে। আপনারা যথেষ্ট যত্ন নেননি, যাই বলুন। ফার্স্ট প্রেগন্যান্সি।

—স্ত্রীকে কীভাবে যত্ন করতে হবে সে বিষয়ে আপনার মতামত আমি শুনতে চাই না।

—প্লিজ ডোন্ট মাইন্ড, আমি ট্রেইন্ড নার্স, আমার মতামত জানাবার অধিকার আছে।

ডাক্তারের গলা। বাইরে থেকে ভেতরে এলেন বোধহয়।—হ্যাঁ সব ঠিকই আছে মিঃ গোস্বামী। কিন্তু জেনারেল হেল্‌থের অবস্থা ভাল না। একটু সুস্থ হয়ে উঠুন তার পরে।

অরি—শুনুন, পেশেন্ট আমরা বাড়ি নিয়ে যেতে চাই।

—সে কী? ডাক্তার হিসেবে আমি সেটা অ্যালাও করতে পারি না।

—আমরা বন্ড সই করে নিয়ে যাব।

—পেশেন্টের পার্টি যদি পাগল হয়, আমরা তো আর পাগলামো করতে পারি না। আই’ল আস্ক ইউ টু গো আউট নাউ, মিঃ গোস্বামী। দ্য পেশেন্ট ইজ ভেরি মাচ ইন ডেঞ্জার, শী মাস্ট বি লেফ্‌ট ইন পিস।


সকাল সাতটা। কোল্যাপসিব্‌ল-এ গোঁজা খবরের কাগজ টেনে নিল তিলক। ওর বাবা বললেন—আমাকে আগে দে। বাবা চা-এ চুমুক দিচ্ছিলেন। তিলক বলল—কাল পাকিস্তান-সাউথ আফ্রিকার ম্যাচটা কী হল দেখেই দিচ্ছি। লোডশেডিং-এ তো দেখতে দিলে না।

বাবা বললেন—তোর কি এখনও আশা পাকিস্তান ১৩৫-এর কম করবে ; আর ইন্ডিয়ার মরা চান্স আবার জিইয়ে উঠবে? আমি বলে দিচ্ছি দেখে নে পাকিস্তান সাউথ আফ্রিকাকে হারিয়েছে। তিলক বলল—শচীন-সৌরভ একা কী করবে বলো! বোলার নেই একটা। ম্যাচ-উইনিং বোলার দরকার।

বাবা বললেন—আমি তো অনেক দিন ধরেই বলছি— ম্যান অফ দ্য ম্যাচ নয়, মেন অফ দ্য ম্যাচ করা উচিত। একটা ব্যাটসম্যান আর একটা বোলার। বোলাররা তো পায়ই না। এভাবেই মোটিভেশন নষ্ট হয়ে যায়। তার ওপর যেমনই খেলুক, টাকাটা বাঁধা। শচীনই তো একবার পারফর্ম্যান্স বেজড পেমেন্টের কথা বলেছিল। করুক না সেটা। দেখবে হই-হই করে ম্যাচ জিতে আসছে।

তিলক বলল—যেটা জানো না, সেটা নিয়ে কথা বোলো না বাবা। আ ম্যাচ ইজ আ ম্যাচ। খেলবার সময়ে অত মনে থাকে না কি টাকা পাচ্ছি কি পাচ্ছি না!

—বেশ মনে থাকে, ইনজামাম অতগুলো ছয় হাঁকড়াল কেন তা হলে তাক করে করে? সুপার সিক্স?

—ভেদডুশ মার্কা বোলিং হলে সিক্সার হাঁকড়াবে না তো কী! বলতে বলতে তিলক হঠাৎ স্তব্ধ হয়ে যায়।

বাংলা কাগজের প্রথম পাতার তলায় অমৃতার ছবি। হ্যাঁ, অমৃতা-ই তো! নামী নার্সিংহোম থেকে রোগিণী নিখোঁজ। অফিসঘর ভাঙচুর, ডাক্তার প্রহৃত। হেডলাইন থেকে বিশদে যায় সে—গতকাল সকাল সাড়ে দশটায় অমৃতা গোস্বামী নামে একটি বছর বাইশের রোগিণীকে ‘উজ্জীবন’ নার্সিংহোমে ভর্তি করা হয়। মেয়েটি বারবার মূৰ্ছিত হয়ে পড়ছিল। রাত পর্যন্ত সে আচ্ছন্ন ছিল, তিন নং কেবিনের নার্স মায়াবতী সরকার জানিয়েছেন। সকালবেলায় দেখা যায় তার শয্যা শূন্য। মেয়েটি ঘোরের মধ্যে কোথাও চলে গেছে কি না—এ নিয়ে জল্পনা-কল্পনা শুরু হয়, খোঁজও শুরু হয়, কিন্তু তিনতলা এই নার্সিংহোম তন্ন তন্ন করে খুঁজেও তাকে পাওয়া যায়নি। অতঃপর ভিজিটিং আওয়ারে রোগিণীর স্বামী ও শ্বশুর এ কথা জানতে পারলে, স্বামী অরিসূদন গোস্বামী ডাক্তারের চশমা কেড়ে নিয়ে তাঁকে মারধর করেন, বাইরে জনতা জমে। রোগিণী হারিয়ে গেছে এই অভিযোগে জনতা উত্তাল হয়ে ওঠে, ওই নার্সিংহোমের এনকোয়ারি কাউন্টার চেয়ার বসবার সোফা তছনছ করে দেয়। পুলিশ আসায় ঘণ্টা দুই পরে অবস্থা নিয়ন্ত্রণে আসে। এখন প্রশ্ন, সরকারি হাসপাতাল থেকে না হয় কুকুরে গরিব মানুষের বাচ্চা মুখে করে নিয়ে যেতে পারে, গরিব মানুষ তো মানুষ বলেই গণ্য নয়। কিন্তু নামী নার্সিংহোমের মধ্যেও যদি এই জাতীয় কুকুরের নিঃশব্দ পদসঞ্চার আরম্ভ হয়ে যায়, এবং শিশুর জায়গায় সে কুকুর যদি যুবতী হরণ করতে থাকে তা হলে তো সত্যিকার দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়ায়!

—কী হল? তুলু?

—বাবা দেখো।

—কী পাকিস্তান জিতেছে।

—উঃ ও সব নয়, আমাদের বন্ধু, য়ুনিভার্সিটিতে একসঙ্গে পড়ি আমরা—অমৃতা গোস্বামী।

—কী হল? সিনেমায় নেমেছে?

—উঃ না, দেখো না খবরটা।

বাবার হাতে কাগজটা তুলে দিয়ে মুখোমুখি সোফাটায় ধপাস করে বসে পড়ে তিলক। হঠাৎ সব বন্ধু-বান্ধবের অস্পষ্ট ছায়ার মধ্যে থেকে ত্রিমাত্রিক ছবির মতো ভেসে ওঠে অমৃতার চেহারাটা। অমৃতা, একটু গম্ভীর, কিন্তু রসকষহীন মোটেই নয়, সেই অমৃতা যাকে কথায় কথায় ওরা খেপাত, জে.বি.-র ফেভারিট অমৃতা গোস্বামী। বিবাহিত মেয়ে বলে গোড়ায় গোড়ায় ওর দিকে বেশি ঘেঁষেনি তারা। কিন্তু দূরত্ব খুব শিগগিরই ঘুচে যায়। কত আড্ডা মেরেছে কফিহাউজে। ওর অবশ্য সব সময়ে একটা তাড়া থাকত, চারটের পর আর বসতে চাইত না। খুব দায়িত্বশীল মেয়ে। কী করল এই ডাক্তার? অযত্নে মেরে ফেলেছে, তারপর বডি কোথাও পাচার করে দিয়েছে? কেন? এতেও তো মার খেল। অযত্নে মরে গেলেও মার খেত। কী-ই বা এমন হল অমৃতার? হঠাৎ? এই গত সপ্তাহটায় বোধহয় ক’দিন আসেনি। তার আগে পর্যন্ত তো এসেছে, সমস্ত ক্লাস করেছে, নোট নিয়েছে, ক্যান্টিনে খেয়েছে। এক প্লেট মাংস নিয়ে পাঁউরুটি দিয়ে খাচ্ছিল। অনেকটা ঝোল নিয়েছিল। ওর পাশে ছিল দোলা, যাকে ওরা আদুরি কিংবা ‘দোল দোল দোলুনি/ রাঙা মাথায় চিরুনি’ বলে খেপায়। দোলা বোধহয় একটা ফিশফ্রাই নিয়েছিল। তিলক বলল—‘তোদের বেশ পয়সাকড়ি রয়েছে মনে হচ্ছে, এ অধমের দিকে একটু তাকা …

দোলা তাকে বলল—আজকে অমৃতা খেয়ে আসতে পারেনি, তা জানিস, ওর ভীষণ খিদে পেয়েছে, ও বাসভাড়া ছাড়া পয়সা পর্যন্ত আনেনি। অমৃতার দিকে চেয়ে বলল—একটু চেক করে নিবি তো পার্সটা। আশ্চর্য! তারপর আবার তিলককে বলল, আমি ওকে খাওয়াচ্ছি। কিন্তু তিলক, তুই তো আর শ্বশুরবাড়িতে নেই যে শ্বশুরবাড়ির ডিউটি সেরে খেয়ে আসবার সময় পাসনি। আর তোদের তো শ্বশুরবাড়ি হলে তোরা রাজা লোক, তোদেরই সবাই খাওয়াবে আমরা হাঁ করে দেখব …

অমৃতা মন দিয়ে হাড় থেকে মাংস ছাড়াচ্ছিল দাঁত দিয়ে, ‘শ্বশুরবাড়ির ডিউটি’ বলতে সে শুধু একবার দোলাকে বকেছিল— ‘আঃ দোলা!’ আর একটিও কথা না।

দোলার সাতকাহন শুনে তিলক বলেছিল—খাওয়াবি তো একটা ফিশফ্রাই কি একটা এগরোল। অত বক্তিমে কীসের রে? যাঃ তোকে খাওয়াতে হবে না। তিলক মজুমদারের পকেটেও পয়সা থাকে।

সেই অমৃতা, শেষ! শেষই তো! শেষ ছাড়া কী? কী আর হতে পারে!

ফোনটা ঝনঝন করে বেজে উঠল। তড়াক করে লাফিয়ে উঠে ধরল তিলক—আমি নিশান বলছি। আজ সকালের কাগজটা…।

—হ্যাঁ এইমাত্র দেখলাম। দেখে মাথায় হাত দিয়ে বসে আছি।

—হাইলি সাসপিশাস৷ বুঝলি? সামথিং ইজ ভেরি মাচ রং সামহোয়্যার।

—সে তো বটেই।

—সেই বন্দনা মুখুজ্জের কেসটা দেখলি না, আজও সলভ্‌ড হল না। একটা র‍্যাকেট আছে নিশ্চয়ই এর পেছনে।

নিশান ফোন রাখতেই দোলার নম্বরটা টিপল তিলক। দোলারই সবচেয়ে বন্ধু ছিল অমৃতা। দোলা হয়তো কিছু বলতে পারবে।

—দোলা আছে? আমি তিলক বলছি।

—এ মা! আমার গলাটা তুই চিনতে পারলি না? আসলে কাল থেকে ঠাণ্ডা লেগে…

—বাজে কথা রাখ। আজকের কাগজ দেখেছিস? বাংলা কাগজ আনন্দবাজার…

—আমাদের বাড়ি তো আনন্দবাজার শুধু শনি রবিবার নেওয়া হয় রে! কেন পরীক্ষাটা এগিয়ে এল, না কী?

—অমৃতার সম্পর্কে খবর বেরিয়েছে কাগজে।

—কী—ই—ই—ই? দোলার ‘কী’টা বহু বহুদূর পর্যন্ত ছড়িয়ে গেল, উপরন্তু তীক্ষ্ণ আঘাত করল তিলকের কানের পর্দায়।

—হ্যাঁ, ‘উজ্জীবন’ নার্সিংহোম থেকে নিখোঁজ। রাত্তিরবেলাও আচ্ছন্ন ছিল। ভোরবেলা দেখা যাচ্ছে নেই।

—বলিস কী রে? কালকে আমরা ওর বাড়ি গিয়েছিলাম। কেউ ছিল না।

—কে কে গিয়েছিলি?

—আমি আর লাবণি। পাড়ার একটা ছেলে, নামটা ভুলে যাচ্ছি, বলল ওকে প্রায় অজ্ঞান অবস্থায় সাদা অ্যাম্বাসাডার-এ করে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ওর বরের অফিসের গাড়ি।

—তা হলে তো সব মিলে যাচ্ছে। ডাক্তারটা একটা কেলো করেছে চিকিৎসা নিয়ে…তারপর…

—শোন তিলক, ওই ছেলেটা বলছিল, ওপরের ফ্ল্যাটের ওরাও বলছিল—ওরা লোক ভাল না। ছেলেটা আমাদের ওর বাপের বাড়িতে খবর দিতে বলেছিল।

—দিয়েছিলি?

—না। ওর মায়ের হার্টের অবস্থা জানিস তো? ভেবেছিলাম আজকে য়ুনিভার্সিটি যাব না। ওদের বাড়ি গিয়ে আবার খোঁজ নেব। খবরটা ওঁদের দিইনি।

—ভাল করেছিস। এখন খোঁজ নিয়ে কী করবি? তার তো বডি গাপ্‌ হয়ে গেছে।

—কী আজেবাজে বলছিস। —দোলা ককিয়ে উঠল—না, কক্ষনো না। ঠিক খুঁজে পাওয়া যাবে।

ফোনটা নামিয়ে রেখে দোলা হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল। মা ছুটে এল, বাপি ছুটে এল। সব শুনল।

বাপি বলল—ও বাড়িতে তুমি আর যেও না দোলা। খুব ফিশি ব্যাপার মনে হচ্ছে।

মা বলল—যাবে না মানে? তুমিও তো অমৃতাকে চেনো। অমৃতার অত বিপদ। দোলা ওর বন্ধু। অমনি যাবে না বলে দিলে? ওকে এসকেপিস্ট হতে শেখাচ্ছ? স্বার্থপর হতে শেখাচ্ছ?

বাপি বলল—তারপর দোলা যাক আর অমৃতার শ্বশুরবাড়ির লোকেরা ওর পেছনে গুণ্ডা লেলিয়ে দিক। তা হলে তোমার পরার্থকাতরতার লেস্‌নগুলো ঠিক-ঠিক কাজে লাগবে তো?

দোলার হাউ হাউ কান্না তখন ফোঁপানিতে এসে দাঁড়িয়েছে। সে উঠে দাঁড়িয়ে বাপিকে জড়িয়ে ধরে বলল—আমার ভীষণ ভয় করছে বাপি। অমৃতাকে ওরা ভাল করে খেতে দিত না। সংসারের সমস্ত কাজ করাত। ওর পাড়ার একটা ছেলে ছুটতে ছুটতে আমাদের বলে গেল ওর মা-বাবাকে খবর দিন। বধূ-হত্যার কথা কি আপনারা শোনেননি? আমি মাসির হার্ট খারাপ বলে কিছু বলিনি। এখন কাগজে এই খবর দেখে ওঁর কী হবে? কিছু করো বাপি, কিছু করো, কিছু একটা…

মা সব শুনে বলল—ব্যাপারটা তো আরও গোলমেলে হয়ে গেল। নার্সিংহোম থেকে উধাও শুনে ওরাই তো এসে ডাক্তারকে ঠেঙিয়েছে। তো ডাক্তারের সঙ্গে কি কোনও যোগসাজস না কী? লোক-দেখানো মারধর?

বাপি বলল—এ সব কেসে ফট করে একটা জাজমেন্ট দেওয়া খুব শক্ত। পুলিশ ঠিক খুঁজে বার করবে সত্য কী। এও বলি—অমৃতার বাবা মা দেখেশুনে একমাত্র মেয়ের ওইরকম বিয়ে দিলেন?

মা বলল—বাইরে থেকে দেখতে শুনতে তো খারাপ না। দোলা তো দেখেছে ওর বরকে? কী করে রে?

—সি.ই.এস.সি-র এগজিকিউটিভ এঞ্জিনিয়ার। বেশ ভাল চেহারা। তবে আমার একটু রাফ লেগেছিল মা। ছবিতে বেশ। সামনে কেমন রাফ।

—তবে? মা বাবার এক ছেলে, ভাল চাকরি করে, চেহারা স্বাস্থ্য ভাল, নিজেদের ফ্ল্যাট রয়েছে। সাধারণ মানুষ আর কী চায়?

—বাইরে নয়, ভেতরে দেখতে হয়। আশেপাশে খোঁজ নিতে হয়।—সব্যসাচী বললেন।

—আশপাশের লোক কি চট করে খারাপ কিছু বলবে? প্রথমত আজকাল এক ফ্ল্যাটের লোক আরেক ফ্ল্যাটের কিছু জানে না, তারপর খারাপ-টারাপ লোকে চট করে বলতেও চায় না। বলবে ভাঙচি দিয়েছে।

—আমার মেয়ের বিয়ের সময়ে কিন্তু আমি সব দিকে খোঁজ নিয়ে তবে এগোব, শার্ট উল্টো করে তার সেলাই দেখার মতো, যাকে বলে ইনসাইড আউট।—সংকল্পে ঠোঁটে ঠোঁট বসে গেল সব্যসাচীর।

বাবা মায়ের কথা শুনে দোলার বুকের মধ্যে ঢিপ্‌ ঢিপ্‌ ঢিপ্‌ শুরু হয়ে গেল। আজ অবধি মাকে লুকিয়ে তো কিছু করেনি! এই প্রথম। এর সঙ্গে মিশেছে অমৃতার নিরুদ্দেশের খবর।

শম্পাও দেখেছিল খবরটা। সকালবেলা কাগজ খুলেই অমৃতার ছবি। সে একেবারে হতবাক হয়ে গিয়েছিল।

—মা, মা, ও মা!

—কী রে! অমন করে ডাকছিস কেন? পিঠে মশা কামড়াল?

—মা, শিগগিরি।

মা আঁচলে হাত মুছতে মুছতে ছুটে এলে সে শুধু কাগজটা মার হাতে ধরিয়ে দিতে পারল।

নিবেদিতা, শম্পার মা দু-চার লাইন পড়েই কাগজটা হাত থেকে ফেলে দিলেন। মানে, হাত থেকে পড়ে গেল কাগজটা।

—এ কী খবর? এ কি সত্যি?

শম্পা ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়েছিল। আলগা গলায় বলল, এই তো গত সপ্তাহেই য়ুনিভার্সিটি লনে ওর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলুম। ও আমাকে কত উপদেশ দিল।…শম্পার চোখ উপচোতে থাকল, ধরা গলায় সে বলল—আমি কত ঝগড়া করলুম।

—কী তবে হয়েছিল মেয়েটার? কিছু বলেছিল?

—উঁহু।

শম্পা আর কথা বলতে পারছিল না। সে তার ঈর্ষার সবটাই উজাড় করে দিয়ে এসেছিল। কী যে বিশ্রী একটা তুলনামতো করেছিল অমৃতার পতিগর্বে আঘাত দিতে!

—অদ্ভূত অদ্ভূত অসুখ হয় একেক সময়ে। অজ্ঞান-টজ্ঞান হয়ে যাওয়া…নার্ভের কিছু। কিন্তু গেল কোথায়?

শম্পা বোবা গলায় বলল—মা, ‘উজ্জীবন’ নার্সিংহোম কোনটা বুঝেছ?

—কোনটা?

—প্রথমে যেটার নাম ছিল ‘জীবন’। বাবা যেখানে…মা কতদিন আগেকার কথা। তবু আমার স্পষ্ট মনে আছে ওই নার্সিংহোমটার পেছনে একটা বড় পুকুর ছিল…

—হ্যাঁ, তাই তো! বাঁধানো ঘাট, চারদিকে গাছপালা, নীলরতন সরকারের কম্পাউন্ডে যেমন আছে… অত বড় নয়।

—মা যদি ও ঘোরের মধ্যে চলতে চলতে…

নিবেদিতা মেয়ের মুখের ওপর হাত চাপা দিলেন। অমৃতার ভাগ্যকে তিনিও চিরকাল ঈর্ষা করে এসেছেন। কার ভাগ্যকেই বা করেননি। শম্পাদের ক্লাসে যত জন পড়ত—নূপুর, শর্মিলা, চন্দ্রা, মনীষা…যতজন মেয়ের বাবা বেঁচেছিলেন, যত জন মেয়ে শম্পার থেকে ভাল রেজাল্ট করত। তাঁর মনে হত, সব্বাই বিশেষ সুবিধে পাচ্ছে, আর তাঁর মেয়ে পিতৃহীন বলে, কালো বলে সব্বাই ওর ওপর অবিচার করছে। অমৃতা সেই ছোট্ট থেকেই খুব কর্মঠ, স্বাধীন ধরনের মেয়ে ছিল। বলত—‘মাসি, আমরা তো আছি, আমরা সবাই শম্পাকে দেখব। কথা রাখত অমৃতা। নিজের খাতাপত্র, নোটস সব নির্দ্বিধায় ভাগ করে নিত শম্পার সঙ্গে। ওর বাবা টিচার ছিলেন সায়েন্সের। তাঁর কাছে কত পড়েছে শম্পা। অথচ আজ এই পিতৃহীন মেয়েটাই পাশ করে ভাল চাকরি করছে। তার ভাল বিয়ে হতে যাচ্ছে। অমৃতা কোথায় হারিয়ে গেল। তিনি মনে মনে বললেন—হে ভগবান, ক্ষমা করো, ক্ষমা করো, রক্ষা করো, রক্ষা করো, রক্ষা করো শম্পাকে, রক্ষা করো অমৃতাকে। আরও যত মেয়ে তাঁর মেয়ের মতো, যে যেখানে বিপদে পড়েছে সবাইকে রক্ষা করো।

কাজকর্ম শেষ করে অল্প একটু ভাত আলু ভাতে দিয়ে খেয়ে ওঁরা বেরিয়ে পড়লেন সল্টলেকের উদ্দেশে। যখন ওরা ব্রাহ্ম বালিকায় পড়ত, তখন অমৃতারা থাকত মানিকতলায়, তারপর গেল দক্ষিণে রমণী চ্যাটার্জি স্ট্রিট। মেয়ের বিয়ে দিয়ে তবে ওঁরা একটা আস্তানা নিজেদের মতো করতে পেরেছেন সল্টলেক পূর্বাচলে। সে বাড়িতে কখনও যাবার দরকার পড়েনি তাঁদের। সম্পর্কটা অমৃতার সঙ্গেই আছে। মাসি মেশোর সঙ্গে নেই।

ঠিকানা খুঁজে খুঁজে মা-মেয়ে যখন পূর্বাচলের বাড়িতে পৌঁছলেন তখন একতলা ছোট বাড়িটার মাথায় গন গন করছে রোদ। ছোট্ট একটু বাগান, সেখানে সামান্য কিছু ফুলের গাছ। দু-চারটে জবা। কিছু জিনিয়া। ফুল নেই কোথাও, শুধু গাছগুলোই সার। সাবধানে বেল বাজালেন নিবেদিতা। খুব আস্তে। সামান্য একটু পরে দরজা খুলে দিলেন বিশ্বজিৎবাবু, অমৃতার বাবা।

বোঝাই যাচ্ছে স্কুল কামাই করেছেন। গালে না-কামানো দাড়ি। পায়জামাটার চেহারা দেখে মনে হচ্ছে, বাসিটাই পরে আছেন।

—ও শম্পা, এসো। আসুন আপনি।

সীমা কই?

—ও ঘরে।

সীমা শুয়েছিলেন। ওদের দেখে উঠে বসলেন। বিস্রস্ত জামাকাপড়। চোখ মুখ বসে গেছে।

—দিদি কিছু খবর পেলেন?

—না ভাই।

—কী হয়েছিল?

—কিচ্ছু জানি না। কোনও খবরই ওঁরা আমাদের দেননি। মেয়ের শরীর খারাপ হয়েছিল বলেও কিছু শুনিনি। তবে..

—তবে কী?

—ওর একটু অনিয়মিত হচ্ছিল। আমাকে জিজ্ঞেস করছিল।

—তা হলে তো কনসীভ করেছিল!

—তাও ঠিক জানি না, ভাই। অন্য কোনও লক্ষণ তো ছিল না। খালি বলত খুব খিদে পাচ্ছে, খুব খিদে পায় মা।

চোখদুটো জলে ভরে এল সীমার।

—আমরা সল্টলেকে এসে থেকে তো বেশি আসতেও পারত না। আমাদের যাওয়া তো আরও অসম্ভব। কেন যে রমণী চ্যাটার্জি থেকে চলে এলাম। মেয়েটাকে বোধহয় হাত-পা বেঁধে জলেই ফেলে দিয়েছি।

—কেন? এ কথা বলছেন কেন? ছোট্ট ফ্যামিলি! জামাই অত গুণের!

কোনও কথা বললেন না সীমা। মুখ নিচু করে শুধু নিজের আঙুলগুলোর দিকে তাকিয়ে রইলেন। ফোঁটা ফোঁটা জল পড়ে আঙুলগুলো ভিজতে লাগল। নিবেদিতার মনে হল কী অপূর্ব সুন্দরী এই ভদ্রমহিলা। কিন্তু কোনওদিন সুখের মুখ দেখলেন না। স্বামী দিবারাত্র কোচিং করেন। উনি দিবারাত্র শুয়ে বসে থাকেন। সকাল সন্ধে নিয়ম করে একটু হাঁটেন, হার্টের ব্যারাম। কোনওদিন ভাল থাকেন, বেশির ভাগ দিনই ভাল থাকেন না। সে ভাবে দেখতে গেলে ওর মেয়েও শম্পার থেকে খুব একটা সুখের ছোটবেলা পায়নি। ক্লাস টু থ্রি-এর মেয়েকে যদি নিজের ইউনিফর্ম ইস্ত্রি করে পরে আসতে হয়। ফাইভ সিক্সের মেয়ে দুধ জ্বাল দেওয়া, একটু ভাতে ভাত রান্না করাও শিখে নিয়েছিল। তাঁর পিতৃহীন মেয়েকেও অতটা করতে হয়নি।

ওঁর স্বাস্থ্য ফিরিয়ে দিতে না পারো, অন্তত মেয়েকে ফিরিয়ে দাও। হে ঈশ্বর, ওঁর মেয়েকে ফিরিয়ে দাও।

শম্পা বলল—আমি তোমার কাছে কয়েক দিন এসে থাকব মাসি?

—কী করবি থেকে? তোর তো অফিসও আছে…

—ছুটি নেব।

—তোর মায়ের অসুবিধে হবে।

—না না আমার কোনও অসুবিধে হবে না।

নিজের শোক-দুঃখ নিয়ে একলা একলা থাকতেই স্বস্তি। অন্য কেউ এসব সময়ে থাকলে বড় অসুবিধে হয়, মন খুলে কাঁদা যায় না, স্বামীর সঙ্গে এই ঝগড়া-কথা কাটাকাটি আবার দুজনের একত্র শোকবিহ্বলতা এ সবই কেমন আটকে যায়। যতই হোক পরের মেয়ে, অতিথি, তার দিকেও একটু না একটু নজর দিতেই হয়। অথচ সে সামর্থ্য নেই, না মানসিক, না শারীরিক। তিনি অসহায়ের মতো একবার নিবেদিতা আর একবার শম্পার দিকে তাকান।

—দরকার নেই রে! উনি আছেন। হয়ে যায় আমাদের, চলে যায়।

—ঠিক আছে। দরকার হলেই কিন্তু ডাকবে। কোনও সংকোচ করবে না। ওর শ্বশুরবাড়ি থেকে যোগাযোগ করেছিল?

—হ্যাঁ। আজ সকালেই। জামাই বলল ডাক্তারটা কিছু গণ্ডগোল করেছে। নার্সদের অসতর্কতায় কখন ও উঠেছে, বাইরে চলে গেছে কেউ খেয়াল করেনি। একটা নামী নার্সিংহোম, এত অসাবধান! ওরা যথাসাধ্য চেষ্টা চালাচ্ছে। এই বলল, আর কী বলবে?

—নার্সিংহোমের বিরুদ্ধে কেস করা উচিত।

—তা হয়তো করবে।

শম্পা বিকেলের চা করল। খাওয়াল সবাইকে। তারপর ওরা চলে গেল। মা-মেয়ে। বিশ্বজিৎ আর সীমাও হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। একটা অনভ্যস্ত গোপনতা বয়ে বেড়াতে হচ্ছে ওঁদের। আজ খুব ভোরবেলায় অমৃতার ফোন এসেছিল—মা, আমি বেঁচে আছি। ভাল আছি, কোথায় আছি এখন বলব না। তবে যথাসময়ে জানতে পারবে। ভাবনা কোরো না। কাউকে বোলো না।


আসলে তার মনের মধ্যে একটা কঠিন সংকল্প জন্ম নিচ্ছে। সেই সঙ্গে আত্মধিক্কার। কেন সে বুঝতে পারেনি। কেন? কেন? কেন? শাশুড়ি যখন সেই গোড়ার দিনেই বলে দিলেন, আমাদের নিয়ম—শোবার ঘর বউ ঝাঁট দেবে, রান্না আমরা লোকের হাতের খাই না। এত দিন আমি একা করতাম, এখন তুমি আমি করব।

ওর ভাল না লাগলেও খুব খারাপ লাগেনি। ঠিক আছে, বাড়িতেও তো ছোট্ট থেকে রান্না করছে, ইদানীং একটি লোক রাখা হয়েছে। তাই সে পার্ট ওয়ান-এ ভাল অনার্সটা পেল। গীতবীথি থেকে থার্ড ইয়ারের গানের পরীক্ষাটাও ভালভাবে পাশ করে গেল। ওর খাওয়া-দাওয়ার ওপর যখন খারাপ নজর দিতে লাগলেন শ্বশুর ও শাশুড়ি উভয়েই, সবচেয়ে ছোট্ট মাছটা তার পাতে, সবাইকার ডিম রয়েছে, তারটা কুলোল না, তখন সে বুঝতে পেরেছিল, ইনি শিক্ষিত স্কুল-টিচার হতে পারেন, কিন্তু ইনি সেই সাবেক অন্ধ শাশুড়ি-যুগে পড়ে আছেন। জোর করে চেয়ে নিতে বা এদিকে স্বামীর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে তার রুচিতে বাধত। এই রকমই দিনের পর দিন কাটে। স্বামী তাকে যা সামান্য হাতখরচ দেয়, তাই দিয়ে বাইরে সে ক্ষুন্নিবৃত্তি করে, শাশুড়ি তার ঘরে পর্দা দিতে দিলেন না। ছেলে বাড়ি আসবার সঙ্গে সঙ্গে তাকে তিনি অধিকার করে নিতেন। দুজনের কথাবার্তা বেড়ানো এসব এই তিন বছরে এমন পর্যায়ে এখনও যায়নি যে সে বলতে পারবে তার স্বামী অরিসূদন লোকটা কেমন।

চিনতে পারল যখন তার গর্ভে সন্তান আসার কথাটা সে তাকে বলল। অরি একেবারে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল।—এরই মধ্যে বাচ্চা কী? তোমার পরীক্ষা আছে না? সংসারই বা চলবে কী করে?

—সংসার কী করে চলবে ভাবলে তো কোনওদিনই আমাদের বাচ্চা হওয়া চলে না। আর পরীক্ষা, ও আমি ঠিক চালিয়ে নেব।

বাড়িতে ঘোষণা হয়ে গেল কথাটা। তার পর শাশুড়ি শ্বশুর স্বামী সবাই মিলে তাকে ছি ছি করতে লাগলেন, যেন সে একটা অবৈধ সন্তান ধারণ করেছে। এরপর আর যা বলল তাতে তার আক্কেল গুড়ুম।

অরি বলল—সে যা হবার হয়েছে। টার্মিনেট করে দিলেই হবে।

—মানে?

—মানে জানো না! চলো খালাস হয়ে আসবে। একটা বেলার ব্যাপার। দিন তিনেক বিশ্রাম নিয়ে আবার নর্ম্যাল লাইফ।

—না। সে দৃঢ় কণ্ঠে জানিয়েছিল—বিয়ের তিন বছর পরে প্রথম সন্তান। কোন অপরাধে তাকে খুন করব। আমি পারব না।—এই নিয়ে রোজ জোরাজুরি কথা কাটাকাটি চলতেই লাগল, চলতেই লাগল। অবশেষে এল সেইদিন যেদিন অরি বেলা বাড়তেই অফিস যাবার জন্য তৈরি হচ্ছে না দেখে সে অবাক হয়ে কাছে গিয়ে কপালে হাত দিয়ে ছিল—জ্বর-টর হল না কি?

বিদ্যুৎ গতিতে তার মুখ চেপে বিছানায় শুইয়ে দিয়েছিল অরি। নাকে চেপে ধরেছিল, একটা রুমাল। তাতে মিষ্টি কেমন একটা অবাক করা গন্ধ। সে বুঝতে পারছিল তাকে চ্যাংদোলা করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। ব্যস আর কিছু মনে নেই।

গভীর রাত হবে তখন। তার সামনে কড়কড়ে পোশাক-পরা একজন সিস্টার; তাঁকে দেখতে দেখতে সে যেন অনেকদিনের ঘুম ভেঙে জেগে উঠল। তার গায়ের ওপর সাদা চাদর টানা। সবুজ পর্দাটা দুলছে। সে তা হলে বাড়িতে নেই। অবশ্য তার বাড়িই বা কোথায়? সেন্ট্রাল পার্কের বাড়িটাও তার বাড়ি না, সল্টলেক পূর্বাচলের বাড়িটাও তার বাড়ি নয়। তার বাড়ি ছিল রমণী চ্যাটার্জি স্ট্রিট। সেই মিষ্টির দোকান, একদিকে পাহারার মতো সেই সরকারি ফ্ল্যাট, তাদের বাড়ির মধ্যে এক চিলতে লম্বা উঠোনটায় সার দিয়ে দিয়ে কত গাছ! এমনকি সুপুরি গাছও! টগর ঝোপে অজস্র টগর ফুটত সাদা তারার মতো। আর ছিল একটা মুসান্ডা। আর কী ছিল? নয়নতারা তো ছিলই, তুলসী ছিল, তুলসীর পাতা তুলে না ধুয়েই সে কচকচিয়ে খেত বলে মা কত বকেছে! তার আগেও তার বাড়ি ছিল মানিকতলায়। সেখান থেকে ব্রাহ্ম বালিকা বিদ্যালয়ে যেতে তার ঠিক দশ মিনিট লাগত। সেই বাড়িটাতেও টবের গাছ ছিল দোতলার হাফ-ছাদে। ছাদ-ভরা ফুল, বিশেষত গ্রীষ্মকালের। বাবা যত্ন করত, তাকেও শিখিয়েছিল। তবে যেহেতু তাকে সংসারের অনেক কাজই করে নিতে হত, গাছেদের ভারটা বাবা কোনদিনই তাকে দেয়নি। সেই বাড়ির যে ঘরে সে থাকত, তার একদিকের মেঝের সিমেন্ট একটু ভাঙা ছিল। ভাঙা জায়গাটার জন্য তার খুব খারাপ লাগত। বন্ধুরা আসবার কথা থাকলেই সে জায়গাটাতে একটা শতরঞ্চি পেতে রাখত। সেই বাড়িগুলো তার। তাদের সঙ্গে তার কত সুখস্মৃতি, কত তুচ্ছ ব্যর্থতা, কত তুচ্ছ সুখ, কত শোকতাপের স্মৃতি জড়িয়ে আছে। মানিকতলার বাড়িতে তার ঠাকুমা মারা গেলেন। ছোট্ট সে তখন। কতদিন পর্যন্ত আশা করে বসেছিল ঠাকুমা আকাশ থেকে নেমে আসবেন, আবার তাকে মালঞ্চমামার গল্প বলবেন, কিংবা সেই একঠেঙে পেত্নী আর থালুমালুর গল্প। রমণী চ্যাটার্জি থেকেই তার বিয়ে হল। মা-বাবার নিত্য কথা কাটাকাটি। বাবা কিছুতেই বিয়ে দিতে রাজি নয়, মায়ের করুণ মিনতি। বাবা রেগে যেত, কেন তুমি শুয়ে থাকতেই কি ও সংসার পড়াশোনা সামলাচ্ছে না? ও পড়বে, প্রোফেসর হবে—তার পর আবার বিয়ের ভাবনা কী?

মা বলত—না গো, কুমারী মেয়ে একবার বাড়ির সংসারে জড়িয়ে পড়লে আর বিয়ে করতে পারে না। এ রকম আমি অনেক দেখেছি। আমি চলে গেলে মাতৃহীন মেয়েটার যে কী দুর্গতি… বলতে বলতে মায়ের কণ্ঠরোধ হয়ে যেত। সুন্দর চোখদুটো জলে ভরে উঠত।

বাবা বলত—দুর্গতিটা কি ওর আমিই করব? আমিই নিজের স্বার্থে ওকে বেঁধে রাখব বলছ? বাঃ।

—না, না। তুমি রাখবে না, ও ভীষণ দায়িত্বশীল মেয়ে, ও নিজেই তোমাকে ছেড়ে যেতে পারবে না। মাতৃহীন মেয়ের অনেক সমস্যা..

—আরে বাবা পিতৃহীন তো আর হবে না?

—যদি তা-ও হয়! মানুষের জীবন, কে বলতে পারে?

এই রকম কথা কাটাকাটির মধ্যে অমৃতা একদিন ঢুকে বলেছিল—ঠিক আছে। ঠিক আছে। বাবা কথা বাড়িও না। আমার বিবাহ না উদ্বাহ দিয়েই দাও। রোজ রোজ অশান্তি ভাল লাগে না।

তবে অমৃতার পছন্দ ছিল অধ্যাপক বর। তার বাবা আবার যেহেতু শিক্ষাজগতে আছেন, তার ঘাঁত ঘোঁত জানেন, তাই সে জগতের মানুষদের খুব শ্রদ্ধার চোখে দেখতে পারতেন না। বেশি কথা নয়, সংক্ষেপে বলতেন,—ওঃ লেকচারার, কলেজের? ওদের আমি চিনি।

তিনিই দেখেশুনে ঠিক করলেন এঞ্জিনিয়ার জামাই। মা-বাবা ছাড়া বাড়িতে কেউ নেই। দিদির বিয়ে হয়ে গেছে। শাশুড়ি এখনও চাকরি করছেন। স্কুলের টিচার। নিজেদের নতুন ফ্ল্যাট সেন্ট্রাল পার্কে।

অমৃতার পড়াশোনা নিয়ে কথা বলতে শ্বশুর বলে উঠেছিলেন—অবশ্যই। ও ভাল মেয়ে। পড়াশোনা করবে। চাকরি করবে, সেটাই তো আমরাও চাই।

ব্যস, আর কোনও কথার দরকার হয়নি। লাখ কথা ছেড়ে একটা কথাও বোধহয় হয়নি, এত সহজ সরল ছিল বিয়েটা।

অরিসূদনকে অপছন্দ হবার মতো তো কিছু ছিল না। তবে হ্যাঁ, একটা মানুষকে দেখেই, বা তার সঙ্গে দুটো কথা বলেই যে অনেক সময়ে একটা টান তৈরি হয়, তেমন কিছু হয়নি। অমৃতার তো তেমন আবেগপ্রবণ স্বভাবও না। হয়তো অরিসূদনের ব্যাপারটাও তাই। তার বন্ধু দোলা যেমন সহজে প্রেমে পড়ত, কি ছেলেদের কি নিজের মেয়ে-বন্ধুদের, অমৃতার প্রকৃতিটাই তেমন ছিল না। সে ধৈর্যশীল, সহনশীল, প্রতীক্ষা করতে প্রস্তুত।

অরিসূদন তার পেশায় আকণ্ঠ নিমজ্জিত থাকত। অমৃতাও তার পড়াশোনায় ও সংসার-কর্মে। তার ওপরে শাশুড়ির ছিল ওই রোগ। ছেলেবউকে একা হতে দেবেন না। অরি বলল—চলো, “ফায়ার” এসেছে দেখে আসি। শুনছি খুব ভাল। শাশুড়ির কান এদিকে, বললেন, আমারও একটা টিকিট কাটিস। দেখতে দেখতেই এমন ‘ছি ছি ওয়াক থুঃ’ আরম্ভ করলেন যে তিনজনে হল থেকে বেরিয়ে আসতে পথ পায় না।

কিশোরী আমনকর-এর গান কলামন্দিরে। অমৃতাই বলল—শোনাও না গো। আমার ভীষণ ভাল লাগে আমনকর।

ক্ল্যাসিকাল গান শাশুড়ি ভালবাসেন না।

বেরোবার সময়ে কিন্তু ওঁর এমন পেটের যন্ত্রণা শুরু হল, যে অরিকে ডাক্তারের কাছে ছুটতে হল। দ্বিতীয় পর্বে ওরা পৌঁছল বটে, কিন্তু পেটব্যথাক্রান্ত শাশুড়িকে, সে ডাক্তার ডেকে দেখিয়ে হলেও, ওরা যে গান শুনতে গেছে, সেই রাগ কতদিন যে ভদ্রমহিলা ভুলতে পারলেন না! অরি তখন বলেছিল—এক ছেলের মা হলে, বউ-এর ওপর ভীষণ জেলাসি হয়, বুঝলে?

—জানতেই যখন, তখন বিয়েটা না করলেই পারতে!

—ইস্‌, মা জেলাস হবে বলে আমি বিয়ে করব না? বলতে বলতে রাতের অন্ধকারে জানলা দিয়ে আসা রাস্তার আলোর আবছায়ায় তার দিকে গভীর করে চেয়ে ছিল অরিসূদন। তার হাত চলে গিয়েছিল অমৃতার নাতিপিনদ্ধ বুকে। তারপর যা হয়! কে জানে সেই দিনই সাবধান হতে ভুলে গিয়েছিল কি না অরিসূদন গোস্বামী।

একজন ভদ্রলোক ঢুকছেন। নীল শার্ট কালো প্যান্ট। একটু ভারী চেহারা। লম্বার জন্য ভারী ভাবটা মানিয়ে গেছে। ফর্সাটে ভারী মুখ। একটু চৌকো ধরনের, জে.বি.-র মতো। চোখে সোনালি ফ্রেমের চশমা। কে ইনি? —ও ডাক্তার। গলায় তো স্টেথোস্কোপ ঝুলছেই।

—সিস্টার, পেশেন্টের ঘুম ভেঙেছে?

—হ্যাঁ।

—আপনি একটু কাইন্ডলি বাইরে যান।

—হ্যাঁ,—বেডের পাশে চেয়ার টেনে বসে পড়েন ডাক্তার—আপনি এখন কেমন ফীল করছেন?

—ভাল।

—সম্পূর্ণ সজাগ?

—মনে তো হচ্ছে।

—শুনুন, যখন পূর্ণ সজাগ ছিলেন না, সে সময়ে আপনাকে কয়েকটা কথা জিজ্ঞেস করেছিলাম। কতকগুলো ইনফর্মেশানও দিয়েছিলাম। মনে করতে পারছেন কিছু?

—না। আমার অ্যাবরশন কি হয়ে গেছে?

—কেন? আপনি অ্যাবরশন চেয়েছিলেন?

—না। হয়েই যখন গেছে তখন…

—তা হলে আপনার স্বামী, স্বামীই তো৷

—কে? অরিসূদন গোস্বামী?

—হ্যাঁ

—হ্যাঁ, ওঁর সঙ্গেই আমার বিয়ে হয়েছিল।

—মাফ করবেন, এত অদ্ভূত অদ্ভূত সম্পর্ক নিয়ে এখানে লোকে আসে, তাই কথাটা জিজ্ঞেস করলাম। আচ্ছা, ওঁরা কেন অ্যাবরশন চাইছিলেন?

—আই হ্যাভ নো আইডিয়া।

—তবু?

—ওরা আমার পড়াশোনার ব্যাঘাতের কথা বলেছিলেন। তা ছাড়া সংসারে আমাকে প্রচুর কাজও করতে হয়।

—আই সি। তা আপনি তাতে ওঁদের কী বললেন?

—আমি বলি—পড়াশোনা পরীক্ষা এসব আমি সামলে নেব। সংসারও। তবে সংসারের কাজ থেকে দশ-বারোদিন কি এক মাসের ছুটি দিতে হলে যদি বাচ্চা না হতে হয়, তো ওঁদের পরিবারে বাচ্চা কোনও দিনই আসবে না—এই জাতীয় কিছু।

—তা প্রেগন্যান্সির সময়ে আপনি মাঝে মাঝে অজ্ঞান হয়ে যেতেন?

—অজ্ঞান? আমি জীবনে কখনও অজ্ঞান হইনি ডক্টর। ওই একবার ছাড়া। কী বলব! আপনাকে বলে কী লাভ?

—লাভের কথা পরে ভাববেন। ডাক্তারকে কিছু লুকোবেন না।

—আমার স্বামী আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল, কী যেন দিয়ে আমার নাক-মুখ চেপে ধরল—আর কিছু আমার মনে নেই।

—ওরা অজ্ঞান অবস্থায় এখানে আপনাকে নিয়ে আসেন—বলেন, কনসেপশনের পর আপনার প্রায়ই ফিট হচ্ছে। তাই ওঁরা বউমাকে অ্যাবরশন করাতে নিয়ে এসেছেন। আগে তো বউমা বাঁচুক, তারপর নাতিপুতির কথা ভাবা যাবে।

—শিট!

—কী বললেন?

—কিছু না, বললাম ছিঃ।

—তা ওঁদেরই নাতি, ওঁদের না চাওয়ার কী কারণ থাকতে পারে মিসেস গোস্বামী।

—আমি বুঝতেই পারছি না।

—শুনুন, আমি যতটুকু বুঝেছি ইউ আর ইন সীরিয়াস ডেঞ্জার। আমি বুঝেছিলাম আপনাকে ক্লোরোফর্ম দিয়ে অজ্ঞান করা হয়েছে। তারপরে আপনার সব রকম মেডিক্যাল টেস্ট করাই। অস্বাভাবিক কিছু পাইনি। এদিকে আপনার চার মাস কমপ্লিট হয়ে গেছে। এখন এম.টি.পি করা খু-উব রিস্কি। আপনার প্রাণসংশয় হতে পারে। সুন্দর একটি মেল ভ্রূণ এসেছে আপনার গর্ভে, আমরা অ্যামনিও সেনটেসিস করে দেখে নিয়েছি। কোনও অস্বাভাবিকতা তার নেই। আপনি যদি এঁদের কাছে ফিরে যান, কোনও বাজে ক্লিনিকে অসাধু হাতুড়ের কাছে নিয়ে গিয়ে এরা আপনার গর্ভপাত করাবেই। আপনি তাতে বাঁচবেন না। প্লিজ ডোন্ট গো ব্যাক টু দেম। আপনি আপনার বাপের বাড়ির ঠিকানা বলুন, আমি এক্ষুনি আপনাকে সেখানে পৌঁছে দেবার ব্যবস্থা করছি।

—আমি এভাবে চলে গেলে আপনাদের তো বদনাম হবে, পুলিশ এনকোয়্যারি হবে?

—থ্যাংকিউ ফর স্পেয়ারিং সো মাচ থট ফর আস। আমরা ওগুলো সামলে নেব। আপনি চলে যান। সকাল হলেই হয়তো বন্ড সই করে পেশেন্ট নিয়ে যাবার জন্য জোর করবে। অলরেডি একবার করেছে।

সে শিউরে উঠল।

—ভয় পাবেন না। ঠিকানাটা বলুন।

—শুনুন আমার মায়ের দীর্ঘদিনের হার্টের অসুখ। বাবাকে একা সব সামলাতে হয়। ওঁরা…ওঁরা খুব দুর্বল। ওখানে আমি যাব না।

—তা হলে?

—তা হলে…তা হলে দুটো ঠিকানা আপনাকে বলছি, কেউই আমার আত্মীয় ওখানে কেউ আমাকে খুঁজে পাবে না। সেটা ঠিক হবে তো?

—পুলিশ-কেস হবে। হোক। তখন তো সত্য বেরিয়ে পড়বে, অপরাধের শাস্তি হবে। করুক না কেস।

—তা হলে একটা ঠিকানা বলছি জয়িতা বাগচি, ওয়ান-এ এইট্টি থ্রি, সেক্ট-৩, সল্টলেক সিটি। আর একটা হল ৫/বি ডোভার লেন।

—এগুলো কার ঠিকানা?

—প্রথমটা আমার এক প্রোফেসরের, দ্বিতীয়টা আমার এক বন্ধুর। সে অবশ্য এখন কানপুরে, কিন্তু তার মা আমাকে খুব ভালবাসেন।

—শুনুন মিসেস গোস্বামী…

অবরুদ্ধ ক্রোধ এবার প্রকাশ পেল তার গলায়।

—বারবার মিসেস গোস্বামী বলে আমাকে অপমান করছেন কেন? —আমি অমৃতা

—নিশ্চয়ই, ডাক্তার ঝুঁকে পড়লেন একটু, বললেন হ্যাঁ অবশ্যই, আপনি তো অমৃতাই।


টু-বি’তে চড়ে নামতে হবে গড়িয়াহাটের মোড়ে। তারপর অটো নিয়ে বিজন সেতু পার হয়ে কর্নফিল্ড-এর ঠিক পরেই দোলাদের নতুন বাড়ি। একটুও ভাল লাগে না জায়গাটা দোলার। বাড়ির পেছনে কারখানা, সামনে একটু ডানদিক ঘেঁষে একটা গ্যারাজ। তবে তাদের দোতলা বাড়িটা বেশ জায়গা নিয়ে, অতি আধুনিক মেজাজের ছিমছাম বাড়ি। বাড়িটা সুন্দর। তাছাড়া জায়গাটা খোলা, অনেকদূর পর্যন্ত চোখ চলে যায়। অবশ্য চারদিকে উঁচু-উঁচু ফ্ল্যাটবাড়ি উঠছেই, উঠছেই। কেন যে তারা ডোভার লেনে থাকতে পারল না। হোক না ভাড়াবাড়ি, সম্পদরা কত কাছে ছিল, অমৃতারা…। অমৃতার কথা মনে হতেই মনটা কীরকম তছনছ হয়ে গেল তার। এই অন্তর্ধান, অমৃতার এই কর্পূরের মতো উবে যাওয়া কি শেষ পর্যন্ত মেনে নিতে হবে তাদের? সেই বন্দনা ব্যানার্জি, তারও আগে লাভলি গুপ্তর মতো? টিভি খুললে আজকাল যখন নিরুদ্দেশের বিবরণ দিতে আরম্ভ করেন ঘোষক বা ঘোষিকা, সে আগে আরম্ভ হলেই অন্য চ্যানেলে চলে যেত, আজকাল কিন্তু ওই খবরগুলোর জন্যই বসে থাকে। দীপাঞ্জন চ্যাটার্জি, বয়স ১৭, হাইট : পাঁচ-সাত…হারিয়ে যাবার সময়ে পরনে ছিল খাকি ফুলপ্যান্ট আর লাল চেকশার্ট, সন্ধান দেবার ঠিকানা—ভবানী ভবন। অলকা মাজি—বয়স ২৯ হাইট—পাঁচ এক…গত তেরো জানুয়ারি ১৯৯৮ থেকে নিরুদ্দেশ…। আবদুস সামাদ বয়স বারো…রং কালো…হারিয়ে যাবার সময়ে পরনে ছিল…। যেগুলো মানসিক ভারসাম্যহীন সেগুলো বাদ দিয়ে বাকিগুলো বিশ্লেষণ করতে থাকে সে। এ অভ্যেস নাকি তিলকেরও হয়েছে। তিলকই তাকে ফোন করে জানায়—দোলা শিগগিরই টিভি খোল—অমৃতার খবর দিচ্ছে। ওর বিয়ের ঠিক আগের একটা ফটো দিয়েছে। এ ফটোটা খুব ভাল করে চেনে দোলা। কেমন কাঠ-কাঠ রাগী-রাগী উঠেছে। অমৃতা গোস্বামী—নিরুদ্দেশ ‘উজ্জীবন’ নার্সিংহোম থেকে, ফর্সা রং, উচ্চতা ৫’-৪” রোগা, নিরুদ্দেশ হবার সময়ে পরনে ছিল নার্সিংহোমের গাউন। সম্ভবত সাময়িকভাবে মানসিক ভারসাম্যহীন।

দোলা সঙ্গে সঙ্গে তিলককে ফোন করে—‘সম্ভবত সাময়িকভাবে মানসিক ভারসাম্যহীন’ মানেটা কী রে?

—অমৃতার মাথাটা যদি কাঁধের ওপর ঠিক জায়গায় বসানো না থেকে থাকে তো আমাদের কারও মাথাই নেই—তিলক বলল।

—এটা কী চাল বল তো ওর শ্বশুরবাড়ির?

সীজারকে টেলিফোন করে দোলা—সীজার আছে?

—বলছি

—আমি দোলা রায়, অমৃতার…

—বুঝেছি

—আজ নিরুদ্দেশের খবরটা দেখেছ?

—দু’ দিন ধরে তো দিচ্ছে। প্রমাণ করতে চাইছে ওর মানসিক গোলমাল হয়েছিল। হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে যাওয়ায় নার্সিংহোমে নিয়ে যায়। সেটা এপিলেপ্‌সি হতে পারে। তার পরে হয়তো খানিকটা অ্যামনেসিয়া…এখন তো সব জানাজানি হয়ে গেছে। পাড়ার ছেলেরা মারমুখো। নার্সিংহোমের ডাক্তারকে ধরেছিল পুলিশ। বেল পেয়ে গেছেন শুনেছি। অরিদাকে যে কোনওদিন পাড়ার ছেলেরা ধোলাই দেবে। ওর শাশুড়ি বেরলেই টিটকিরি খান।

—কীরকম?

—আমাদের ছেলেদের মধ্যে একটা এই ধরনের কথাবার্তা হয়, ধরুন

—ধরুন বলো না ধরো…

—আচ্ছা ধরো—এক নম্বর বলল—কে যায়?

—দ্বিতীয় জন জবাব দিল—বউমারির খাল।

—কোথায় যায়?

—নদীনালায়

—কেন যায়

—বউ-মারার সুলুক দিতে

—কেমন সুলুক?

—ধোবার পাটে আছড়ে মারো, পাথর বেঁধে জলে ফেলে দাও

—আর?

—সুযোগ পেলে গলা টিপ্যা ভাসাই-আ দাও।

—কী রি-অ্যাকশন?

—কী বলবে? কিচ্ছু তো বলতে পারে না। মুখ কালো হয়ে যায়। হনহন করে চলে যায়। তবে রি-অ্যাকশন দেখতে হয় পাড়ার অন্য শাশুড়িদের।

—সেটা কীরকম?

—এক মাসিমা একদিন আমায় ডেকে চোখের জল মুছে বললেন— শাশুড়িদের পেছনে লেগেছ বাবা, আমাদের তাহলে ঘরেও খোয়ার, বাইরেও খোয়ার? আমি বললাম—বেশ মাসিমা, জানতে দিন, আমাদের জানতে দিন, কেমন খোয়ার কেন খোয়ার আমরা আপনার হয়েও লড়ব।

—সত্যি জীবনটা কী অসম্ভব রকমের জটিল, তাই না সীজার?

—না দোলাদি, জীবন-টিবন নয়, মানুষ, মানুষই বড্ড গোলমেলে। কোনও দরকার হলেই আমায় ডাকবেন,

—বা রে! কোনও দরকার হলেই তোমায় ডাকব? তোমার অসুবিধে হবে না?

—কোনও অসুবিধে হবে না। অমৃতা-বউদিকে আমরা, মানে আমি খুঁজে বার করবই, আপনাদের কারও অসুবিধে হলে আমি যদি কাজে লাগতে পারি…

দোলা খুব অবাক হয়ে গেল। ছেলেটা আচ্ছা ছেলেমানুষ তো! এখন দিনকাল যা দাঁড়িয়েছে মানুষ খালি ছুটছে। তাদের মতো যারা কেরিয়ার গড়ছে, তাদের তো কথাই নেই। তার মধ্যে হাইস্কুলে পড়া সীজারের মতো একটা ছেলে যদি সব দিদি, সব বউদি, সব শাশুড়িদের আশ্বাস দিতে থাকে যে কারও কোনও অসুবিধে হলেই সে সাহায্য করতে এক পায়ে খাড়া আছে, তবে একটু অবাক লাগে বইকি! ছেলেটা পড়াশোনা সত্যিই করে তো! না স্কুল ড্রপ-আউট? কোনও রাজনৈতিক দলের কেডার-ফেডার নয় তো?

সেদিন য়ুনিভার্সিটিতে গিয়ে একটা ভারী মজার ব্যাপার শুনল দোলা। দোলা কেন সব্বাই। লাবণির বিয়ের ঠিক হয়ে গিয়েছিল, লাবণি বেঁকে বসেছে। ওর মা না কি আজকে আসবেন য়ুনিভার্সিটিতে বন্ধুদের অনুরোধ করতে যেন তারা ওকে বোঝায়।

—কী ব্যাপার রে লাবণি? বন্ধুরা তো সব একখানা গল্পের গন্ধ পেয়ে হামলে পড়ল একেবারে।

লাবণি বলল—আমার ব্যাপার আমি বুঝব, তোদের কী? তোরা কেন নাক গলাচ্ছিস?

—আমরা একটা নেমন্তন্ন পেতে চলেছিলুম, সেটা যে ফস্কে যায়, সেটাই আমাদের নাক গলাবার কারণ, —চঞ্চল বলল।

—পেটপুজো ছাড়া আর কিচ্ছু বুঝিস না, না? কফিহাউজে গিয়েও বলবি খাওয়া, বিয়ের কথা উঠলেও হাত ধুয়ে বসে থাকবি। কেন বাড়িতে খেতে পাস না? আর শিওর হচ্ছিস কী করে তোকে নেমন্তন্ন করবই!

চঞ্চল বলল—করবি না? যদি না করিস কেন করবি না, তা-ও জানি।

—কেন? দোলা জিজ্ঞেস করল।

—কেন আর—বর বা বরযাত্রীরা যদি মনে করে এ মেয়েটার গুচ্ছের বয়ফ্রেন্ড আছে, তাই। নিলয় বলল, লাবণির বর মোটামুটি রক্ষণশীল, একটু গাঁইয়া মতো তো হবেই।

—মানে? লাবণি তো খেপে লাল।

—চটছিস কেন? চটছিস কেন? জেনার‍্যালি তোর মতো মেয়েরা একটু কনজারভেটিভ পছন্দ করে। গাছেরও খাবে, তলারও কুড়োবে।

—এরই বা মানে কী?

—কেন? দ্যাখ কনজারভেটিভ বলে ওরা ডাউরি-টাউরি বাবদ তোর বাবা-মা’র কাছ থেকে গুচ্ছের জিনিস বাগিয়ে নেবে। ধর নানান কিসিমের শাড়ি গয়না, আসবাবপত্র, ফিরিজ, ভি.সি.আর., আরও সব যা-যা আছে। তা শাড়ি গয়নাগুলো তো তোরই মাপসই হবে, তোর বর বা তোর শাশুড়ি তো আর পরবে না। জিনিসপত্রগুলোও তোর সম্পত্তি প্রধানত। গাছের খাওয়া হল তো? এইবারে তুই আধুনিকা ছিল নাকো হেনকাল ছিল না হয়ে যাবি। বুদ্ধিবৃত্তি আছে, লেখাপড়া শিখেছিস বরের নাকে দড়ি দিয়ে একবার উত্তর একবার দক্ষিণ একবার পূর্ব একবার…

তিলক বলল—ধুর, নিলয় এসব ফালতু ইয়ার্কি ছাড় তো। আমাদের মাঝখান থেকে একটা মেয়ে বেমালুম গায়েব হয়ে গেল, এখনও ইয়ার্কি মারছিস? ধ্যুৎ তোদের একটা ইয়েও নেই।

লাবণি এতক্ষণে মুখ খুলল—দ্যাখ, এদেরও একটা বাবা, একটা মা, একটা ছেলে, একটা মেয়ে। ঠিক অমৃতার শ্বশুরবাড়ির মতন। মেয়েটার বিয়ে হয়ে গেছে। আর সবচেয়ে ভয়ের কথা—এই ভদ্রলোকও এঞ্জিনিয়ার আর এর নাম হচ্ছে…নাম হচ্ছে অরিন্দম। ছোট করলে তো অরিই দাঁড়ায়। ওর বাবা-মা যখন এসে অরি এই অরি তাই করতে আরম্ভ করেন না তখন আমার বুক হিম হয়ে আসে।

লাবণির আপত্তির কারণটা হয়তো খুবই হাস্যকর। কিন্তু ওরা কেউ হাসতে তো পারলই না, উড়িয়ে দিতেও পারল না। চঞ্চলসুদ্ধ ওর ভেতরে কী হচ্ছে সেটা বুঝতে পারল। তবু একবার ফাজলামির চেষ্টা করে বলল—এই অরিসূদন না ফরিসূদন অমৃতার অ-ভদ্রলোকটি এমন একটা কাজ করে বসলেন যে সারা পৃথিবীর অরিন্দম, অরিত্ররা আইবুড়ো হয়ে গেল।

কেউই হাসল না।

তিলক আবার জিজ্ঞেস করল—থাকেন কোথায়?

—কোথায়? শুনলে আঁতকে উঠবি। সিঙ্গাপুর! একটা বিদেশ-বিভুঁই, তারপর শুনেছি ইন্টারন্যাশন্যাল জোচ্চোরদের আড্ডা। সেইখানে আমার মতো একটা মেয়েকে হাপিস করে দেওয়া কোনও ব্যাপার? তোরাই বল। আবার ওর বাবা-মা যখন-তখন ওখানে গিয়ে থাকেনও। যদি তিনজনে মিলে… প্লিজ, আমার বাবা-মা এলে তোরা বুঝিয়ে বলিস।

—তুই অমৃতার ঘটনাটা বলেছিস মাসিকে?

—অমৃতার ঘটনা বিশ্বসুদ্ধ লোক জানে।

—তাতে মাসিদের কোনও দুশ্চিন্তা হয়নি?

—উঁহু। বাবা বলছে তুমি এরকম ভীরু দুর্বলচিত্ত মেয়ে আমার জানা ছিল না। আর মা বলছে যার ভাগ্য তার তার। একজনের দুর্ভাগ্য হয়েছে বলে আর পাঁচজনেরও তাই-ই হবে তার কোনও মানে নেই। আর আমরা খুব চেকিং ক্রস চেকিং করে নিয়েছি। কোনও ভয় নেই।

—তা হলে আর ঘাবড়াচ্ছিস কেন? —তিলক বলল।

—ওরে বাবা অরি নামের লোকেরা আমার জন্মশত্রু হয়ে গেছে। মা কালীর দিব্যি আমি কোনও বরকে অরি বলে ডাকতে পারব না।

—ওগো হ্যাঁগো বলে ডাকিস। তোর অত মড হবার দরকারটা কী? —এবারও চঞ্চল।

ওরা কথা বলছিল, ক্যান্টিনে বসে। এখানেই লাবণির মায়ের আসার কথা। এই সময়ে শর্মিষ্ঠা, রঞ্জনা, অয়ন সব হইহই করে ঢুকল, ওরাও লাবণিকে ঘিরে বসে গেল।

শর্মিষ্ঠা বলল—ইস্‌স্‌, আমার একটা এমন দুর্দান্ত সম্বন্ধ আসে না রে! পড়াশোনায় ইস্তফাটা দিয়ে দিই।

রঞ্জনা বলল—যা বলেছিস, পরীক্ষা ভাল্লাগে না আর।

একটি ভদ্রলোক মানে ওদের চেয়ে কিছু বড় একটি বেশ ঝা-চকচকে ছেলে এই সময়ে ক্যান্টিনে ঢুকল। আর সমস্ত ক্যান্টিনকে চমকে দিয়ে লাবণি বন্ধুবান্ধবদের মধ্যে মুখটা ঝট করে নিচু করে লুকিয়ে ফেলল।

কী হল রে?

—ওই যে অরিন্দম ঘোষ।

তিলক তাড়াতাড়ি উঠে এগিয়ে গিয়ে ভদ্রলোককে অভ্যর্থনা করে নিয়ে এল।

—আপনি লাবণি মজুমদারকে খুঁজছেন তো৷

—হ্যাঁ মানে, এখানেই তো আসার কথা বলা হয়েছিল আমায়। কিন্তু…

—লাবণি ইজ দেয়ার। হাইডিং

—হাইডিং? হোয়াই? ফ্রম হোয়াট?

—ফ্রম ইউ।

—ওঃ, খুব অবাক করে দিয়েছি না? কী বন্ধুদের সামনে এমব্যারাসড্‌ না কী?

—আপনি আসুন। এই একটা চেয়ার নিয়ে আয় তো রে। গোপাল এখানে একটা এক্সট্রা চেয়ার দে বাবা। আমাদের জামাইবাবু এসেছেন।—চঞ্চল হাঁকল।

ক্যান্টিনে অন্য যারা বসেছিল সব চকিত হয়ে এদিকে তাকাল। কিন্তু ততক্ষণে হুল্লোড়ের মধ্যে লাবণি এবং অরিন্দম ঘোষ সবাই চাপা পড়ে গেছে।

—আপনারা সব লাবণির বন্ধু। চেয়ারটাতে বসতে বসতে অরিন্দম ঘোষ, সবার দিকে চোখ ঘুরিয়ে এনে বলল।

—হ্যাঁ, এই আমরা সবাই। আরও তিন চার গুণ বাইরে আছে। আমাদের সবাইকেই আপনাকে নেমন্তন্ন করতে হবে। আমরা ন’জন ব্যাটাছেলে আছি, আর সব মেয়েছেলে, আমাদের ন’জনকে স্পেশ্যাল গেস্ট করতে হবে।

—কেন? স্পেশ্যাল কেন?

—বুঝতে পারছেন না? এবারও চঞ্চল—আমরা এই ন’জন আপনার কুড বি রাইভ্যাল। ছেড়ে দিয়েছি।—মাছি তাড়াবার মতো একটা ভঙ্গি করল চঞ্চল।

লাবণি এই সময়ে জিভ ভেঙিয়ে বলল,—শখ কত?

—আপনাদের দয়া-দাক্ষিণ্যের জন্য অশেষ ধন্যবাদ—অরিন্দম ঘোষ হাসতে হাসতে বলল।—কিন্তু শুভ ঘটনাটা আগে ঘটুক। শুনছি লাবণির নাকি প্রচণ্ড অমত। পাঁচ-ছ’ মাস ধরে কেস-স্টাডি চলছে। হঠাৎ লাস্ট মোমেন্টে বেঁকে বসেছে।

নিলয় বলল, আপনার নামটা এফিডেভিট করে পাল্টে ফেলুন।

—কেন বলুন তো!

—আর একটি বোন অন্তত আমদানি করুন।

—আশ্চর্য ব্যাপার। একটা বোন? আমদানি? কোথা থেকে? কেন?

—তাহলে একটা অন্তত তফাত হয় অমৃতার কেসটার সঙ্গে।

—ব্যাপার কী? লাবণি, বুঝিয়ে বলো তো! আমি কিছুই…

—লাবণির বদলে আমি বোঝালে কোনও আপত্তি আছে? —তিলক বলল।

—আছে বইকি? লাবণির মুখ আছে, দু’ পাটি দাঁত, জিভ, গলার স্বর, মাথায় বুদ্ধি অনুভূতি সবই তো আছে, লাবণির মাউথপিস লাগবে কেন?

—লাগবে। দোলা বল তো! একটু ইনট্রোডাকশন দে।

দোলার খুব নার্ভাস লাগছিল। অরিন্দম ঘোষ, খুব স্মার্ট, কিন্তু চালিয়াত টাইপ নয় একেবারেই। খুব সদয় এবং স্বাভাবিক দেখতে।

অরিন্দম বললেন—বলো। দোলা, বাঃ তোমার নামটা খুব নতুন ধরনের তো!

তখন দোলা বলল।

—আশ্চর্য! অরিন্দম ঘোষ বললেন, এই জন্যে? ইসস্ তোমাদের বন্ধু অমৃতা মেয়েটির কী হল তোমরা আর কিচ্ছু জানো না?

—কিচ্ছু না।—অনেকেই বলল একটু আগে পরে।

তিলক বলল, ডাক্তারকে অ্যারেস্ট করা হয়েছিল। কিন্তু পুলিশ ছেড়ে দিয়েছে জামিনে খালাস।

—দাঁড়াও দাঁড়াও এই যে তোমরা মেয়েটির স্বামীকে সন্দেহ করছিলে?

—ডাক্তারের সঙ্গে যোগসাজশ থাকতে পারে—তিলক বলল।

—হয়তো ওকে খুব মেরে অজ্ঞান করে ফেলেছিল, সীজার বলে ওদের পাড়ার একটি ছেলে বলছে, আধা-অজ্ঞান অবস্থায় ওকে গাড়িতে তোলা হয়। তারপর হয়তো পরিচিত ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেছে। মারা যেতে…

দোলা, লাবণি দুজনেই এই সময়টা ককিয়ে উঠল—তিলক প্লি…জ!

অরিন্দম অসন্তুষ্ট গলায় বললেন—এ আবার কী! বিপদের প্রসঙ্গই সহ্য করতে পার না, তো সত্যিকারের বিপদ এলে তোমরা কী করবে? তোমাদের তো কোনও ডিফেন্সই নেই। তিলক প্লিজ কনটিনিউ।

—ও মারা যেতে, বডি পাচার করে এখন রটিয়ে বেড়াচ্ছে ও নিখোঁজ হয়ে গেছে। নিজেই উঠে ঘোরের মাথায় কোথাও চলে গেছে। এখন নিরুদ্দেশে অ্যানাউন্স করছে … এই ভাবে ব্যাপারটা এসটাবলিশ্‌ড হয়ে যাবে বুঝেছেন?

—ওয়েল, তোমার রিজনিং খারাপ না।— কখন যে ভদ্রলোক আপনি ছেড়ে ওদের তুমি বলতে শুরু করেছেন …

—এই নার্সিংহোম আর ওই ডাক্তারের নামটা আমায় দেবে?

—‘উজ্জীবন’, বালিগঞ্জ প্লেসে। আর ডাক্তারের নাম রঞ্জন কার্লেকার।

—আমি আজ উঠছি। লাবণি প্লিজ ডোন্ট মাইন্ড, … অরিন্দম ঘোষ কেমন অন্যমনস্ক ভাবে চেয়ার সরিয়ে উঠে দাঁড়ালেন, যেন কিছু ভাবছেন।

—কোথায় যাচ্ছেন?

তিলক, চঞ্চল দুজনেই অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল।

—ওই ডক্টর কার্লেকরের সঙ্গে একবার …

তিলক বলল—আমি যাব।

দোলা বলল—আমিও।

—আমার একটা ছোট্ট মারুতি আছে বাইরে। তিনজনের বেশি নিতে পারব না। লাবণি তো অফ কোর্স যাবেই। যাচ্ছেই।

উনি চলতে শুরু করলেন, যেন আর কোনও কথা নেই। কথা হয় না। গাড়ির দরজা খুলে বললেন—তিলক তুমি ভাই ফ্রন্ট সিটে বসো। মেয়েরা পেছনে থাক। ও হ্যাঁ, তোমাদের বাড়িতে একটু জানিয়ে দাও—ফিরতে দেরি হতে পারে। মোবাইল ফোনটা ওদের হাতে দিলেন তিনি। তারপর গাড়ি ঘোরালেন।

‘উজ্জীবন’ নার্সিংহোমে ওরা যখন পৌঁছল তখন ভিজিটিং আওয়ার শুরু হতে যাচ্ছে। প্রচুর ভিজিটর ভিড় করেছেন লাউঞ্জে। ওদের দিকে না তাকিয়ে অরিন্দম সোজা চলে গেলেন অর্ধবৃত্তাকার এনকোয়ারি কাউন্টারে।

—ডঃ কার্লেকরের সঙ্গে একটু দেখা করতে পারি?

—সার তো এখন নেই। সাতটার পর ভিজিটিং আওয়ার শেষ হলে আর.এম.ও.-কে নিয়ে রাউন্ড দেবেন।

—তো এখন ওঁকে কোথায় পাব?

—কী করে বলব? খুব সম্ভব উডল্যান্ডস-এ। অপারেশন আছে।

—সাতটার পরে এখানে আসবেনই?

—ওরে বাবা, কাঁটায় কাঁটায়। কী দরকার আপনাদের? কেসটা কী?

তিলকের মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল—কেস জন্ডিস।

—রোগী অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছে? ভীষণ বমি করছে?

—না, সেরকম কিছু নয়।—অরিন্দম তাড়াতাড়ি বললেন।

—সারের সঙ্গে দেখা করতে হলে সাতটা পর্যন্ত …

অরিন্দম বললেন—চলো, আমরা সময়টা কোনও রেস্তোরাঁয় গিয়ে কাটিয়ে দিই। আলোচনাও করা যাবে।

বালিগঞ্জ ধাবায় ভীষণ ভিড়, অরিন্দমের পছন্দ হল না, কোয়ালিটিও তাই। ওরা একটা অল্প নামী দোতলার রেস্তোরাঁয় গিয়ে বসল।

হালকা রং ভেতরটায়। স্বপ্ন-স্বপ্ন আলো জ্বলছে। খাবারের অর্ডার দেবার সময়ে দোলা আর লাবণি হাঁ হাঁ করে উঠল। আমাদের জন্য শুধু চা, বাস।

—সময়টা অনেকখানি। তিন ঘণ্টা এখানে কাটাতে হবে। এইটা প্রথম কথা। দ্বিতীয় কথা খালি পেটে যেমন বেদ বেদান্ত হয় না, তেমনি ইনভেস্টিগেশনও হয় না। কোনও কাজ ভালভাবে করতে গেলে শরীরটা চাঙ্গা রাখতে হয়। মনটাও। মনটা আবার শরীরের ওপর অনেকটা নির্ভরশীল। কী? খুব জ্ঞান দিচ্ছি? না, তিলক?

—তা একটু দিচ্ছেন, কিন্তু আপনি যে অমৃতার খোঁজে এই ডাক্তারকে ধাওয়া করতে পর্যন্ত পিছপা হবেন না, এটা আমরা কেউই বুঝতে পারিনি। অশেষ ধন্যবাদ আপনাকে। আমরা, অন্তত আমি ভীষণ অশান্তিতে ভুগছিলাম। যে মেয়েটা গত মাসেও আমাদের সঙ্গে ক্লাস করেছে, ফুচকা খেয়েছে, সে আজ হারিয়ে গেছে, অথচ আমরা এতগুলো দামড়া ছেলে মেয়ে কিছু করছি না, করতে পারছিনা, এই অবস্থা আমি অন্তত সহ্য করতে পারছিলুম না।

অরিন্দম বললেন—হ্যাঁ, অদ্ভূত কেস! কিন্তু এ ধরনের কেস এ দেশে বেড়েই চলেছে, বেড়েই চলেছে। কোনও প্রতিকার নেই। দ্যাখো তিলক, আমি এখানকারই ছেলে, এখানকারই ইনস্টিটিউশন থেকে পাশ করেছি। আমি এঞ্জিনিয়ারিং-এর ছেলেদের যে অধঃপতন দেখেছি তাতে করে যে কোনও বাবা-মাকে বলতে পারি—এঞ্জিনিয়ার? মেয়ের বিয়ে দেবার আগে দুবার ভাবুন। যে কোনও রেসিডেনশ্যাল কলেজের হস্টেলে যা চলে তার মধ্যে চরমতম ক্রুয়েলটি, ডিবচরি আমি দেখেছি। তোমরা বলবে, আমিই একা ভাল হয়ে এদের মধ্যে থেকে বেরিয়ে এসেছি? হোয়াটস দা প্রফ? আমি জোর দিয়ে বলছি তিলক, লাবণি, দোলা, আ অ্যাম ওয়ান অফ দা ফিউ হু হ্যাভ কাম ব্যাক আনটেইন্টেড।

এখন কী হয় জানি না, আমাদের সময়ে মেয়েদের ওখানে সাঙ্ঘাতিক র‍্যাগিং করা হত। তার ডিটেইল্‌স আমি এই মেয়েদের সামনে বলতে চাই না। ভাল ভাল রেজাল্ট করা ছেলেরা অমানুষের মতো ব্যবহার করে। তাদের ভেতর থেকে নিষ্ঠুরতম, কুৎসিততম সেডিস্ট বেরিয়ে আসে। ওরা জীবনের সবরকম অভিজ্ঞতা ওখানে স্বাধীন থাকার সুযোগে করে নিতে চায়। অন গড, লাবণি আমি ও সবের মধ্যে যাইনি। আমার মা-বাবা দুজনেই প্রোফেসর। একটা অন্য ধরনের ভ্যালুজ-এর মধ্যে আমরা বড় হয়েছি। আমি আর আমার বোন। বোনের যখন এঞ্জিনিয়ার-এর সঙ্গে বিয়ের সম্বন্ধ এল, আমিই ফার্স্ট না করেছিলাম। সবচেয়ে ভাল কী জানো দোলা, নিজেদের পছন্দে, অনেকদিন মেলা মেশা করে বিয়ে করা। এখন লাবণির আপত্তি হতেই পারে। দু-চার দিনের মেলামেশায় কে কাকে বুঝতে পারে? আমি তো বুঝতেই পারিনি লাবণি এত ভিতু, এবং…এবং লাবণির মধ্যে এত ফেলো-ফিলিং আছে।

—আপনি কী ভেবেছিলেন?—দোলা খুব আস্তে প্রশ্ন করল।

খাবার-দাবারগুলো আসতে শুরু করেছে।

অরিন্দম বললেন—এগুলোর সদ্ব্যবহার করো ভাই। তিলক প্লিজ। লাবণি বি প্র্যাকটিক্যাল।

কয়েক গ্রাস খেয়ে তিলক বলল—অরিন্দমদা বললেন না লাবণিকে আপনি কী ভেবেছিলেন?

—তুমি শুনে কী করবে ব্রাদার?

—কিছু না, আমাদেরও তো লাবণি সম্পর্কে একটা অ্যাসেসমেন্ট আছে! মিলিয়ে নিতুম।

—আমি ভেবেছিলাম ও খুব সাহসী, খুব স্মার্ট, যে কোনও সিচুয়েশনে ও মানিয়ে নেবে। ওর সঙ্গে যদি কেউ খারাপ ব্যবহার করে ও তার ঠিক উত্তরটা দেবে। কিন্তু সেই সঙ্গে লাবণি প্লিজ ডোন্ট মাইন্ড, সেলফিস নয়, জাস্ট সেলফ-সেন্টার্ড। দুটোর মধ্যে তফাত আছে বোঝো তো?

—ওটুকু ইংরেজি আমরা বাংলার ছেলেপুলে হলেও জানি।

—ভাষার কথা হচ্ছে না কনসেপ্টটার কথা বলছি। সেলফিশ লোক সব সময়ে নিজের সুবিধেটা দেখবে, কারও সঙ্গে কোনও সম্পদ শেয়ার করতে চাইবে না। একলা খাবে, একলা পরবে, একলা ভোগ করবে। আর সেলফ-সেন্টার্ড লোক নিজের বাইরের পৃথিবীটাকে দেখতেই পায় না। দেখিয়ে দিলে তখন হয় তো তার মনুষ্যত্ব কাজ করে, কিন্তু আদারওয়াইজ সে নিজেকে নিয়েই থাকে। আজকের পৃথিবীর বেশির ভাগ মানুষই সেলফ-সেন্টার্ড, সমাজটাই এখন এই ধাঁচের হয়ে গেছে।—বলে অরিন্দম একটু হাসল—লাবণি, কিছু মনে করলে না তো? লাবণি শুধু মাথা নাড়ল, তার চোখ দুটো ভিজে ভিজে উঠছে যদিও সে একেবারেই আবেগপ্রবণ নয়।

তিলক বলল—ঠিক আছে। আমরা সেলফ-সেন্টার্ড। আপনি বুঝি এ জেনারেশনের নন? কত বড় হবেন আপনি আমাদের চেয়ে?

অরিন্দম হেসে বলল—তিরিশ ক্রস করেছি ভাই। আমি এখনও জানি না, আমি সেলফ-সেন্টার্ড কি না। চেষ্টা করি বুঝতে।

দোলা বলল—আচ্ছা অরিন্দমদা, আপনি পাত্রী দেখতে এসেছিলেন, হঠাৎ আমাদের কাছে অমৃতার কথা শুনে সঙ্গে সঙ্গে ছুটে এলেন কেন? লাবণির কাছে প্রুভ করতে যে আপনি আরেক অরিসূদন নন? মনে করবেন না কিছু। আপনি ফ্র্যাংকলি কথা বলেছেন, তাই আমিও বলতে সাহস পেলাম।

—তুমি যা বললে সেটা আমার সাবকনশাসে থাকতেই পারে, কিন্তু ফার্স্ট রি-অ্যাকশন যেটা হল সেটা হচ্ছে আমি চোখের সামনে দেখতে পেলাম এই দোলা এই লাবণি কী রকম ভ্যানিশ করে যাচ্ছে। পেছনে দু-চারটে ক্রুয়েল মুখ, আমাদের এঞ্জিনিয়ারিং কলেজের থার্ড ইয়ারের ছাত্রদের মতো, যারা আমাদের ব্যাচকে র‍্যাগ করেছিল। আমার মাথার মধ্যেটা কেমন করে উঠল। আই রিজলভ্‌ড্‌ দেন অ্যান্ড দেয়ার টু সি ইট টু দা এন্ড।

—আপনাকে কী ভাবে র‍্যাগ করেছিল?—তিলক জিজ্ঞেস করল।

—দে মেড মি ড্রিঙ্ক মাই ওন ইউরিন, দেন দেয়ার্স।

—বলেন কী? আপনার বমি হল না?

—নাঃ, আমি মোরারজি দেশাইয়ের কথা ভাবতে ভাবতে দু গেলাস খেয়ে ফেললাম।

—তারপর!

—তারপর অনেক আদিরসাত্মক খিস্তি করল। মা-বাবাকে নিয়ে।

লাবণি-দোলা শিউরে উঠল।

দোলা বলল—আপনি সহ্য করলেন, কিছু বললেন না।—সে উত্তেজিত।

অরিন্দম বললেন—আমি কী বললাম জানো? বললাম আরে ইয়ার এ সব তো জানা কথা ঔর কুছ নয়া চিজ হ্যায় তো বাতাও।

—বললেন? এই কথা?

অরিন্দম এবার হেসে ফেললেন, বললেন—এখন ভাবি যে এইরকম বললে হত। তখন রাগে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলাম। অজ্ঞান মানে সত্যি-সত্যি অজ্ঞান। একটা বছর আঠারোর প্যাংলা ছেলে তো! ওভার প্রোটেকটেড।

—তারপর?

—তারপর আবার কী? জ্ঞান ফেরাবার নামে বালতি বালতি জল ঢেলে আমাকে ভিজিয়ে আমার বিছানা ভিজিয়ে ছেড়ে দিল। একজন ইউপির ছেলে ছিল—বলল, ডরপুক কাঁহিকা, ভাগ হিয়াসে।

—ইউরিন খাওয়াটা?

—ওটা সত্যি।

—ইহ্‌হ্‌হ্‌—লাবণি মুখ চোখ বিকৃত করে বলে উঠল।

—কী হল, ডিসিশন নিয়ে ফেললে না কি? লাবণি?

লাবণি বলল—চুপ করুন তো। তখন থেকে বক্‌বক্‌বক্‌। খুব গাবাতে পারেন।

—নিজের ঢাক মাঝে মধ্যে নিজেকেই পেটাতে হয়, বুঝলে ম্যাডাম?

ঘড়ির দিকে চোখ, দোলা বলল—সময় হয়ে এসেছে কিন্তু।

বেয়ারাকে ডেকে তাড়াতাড়ি বিল মিটিয়ে দিলেন অরিন্দমদা। গাড়িতে উঠে তিলক জিজ্ঞেস করল—আমাদের লাইন অফ অ্যাকশন কী সেটা একবার বলুন।

—জাস্ট ফলো মি। নিজেরাই বুঝতে পারবে।

সন্ধের আলো জ্বলে উঠেছে নার্সিংহোমে। এখন কিছু কিছু ফিরতি মানুষের ভিড়। সাতটা বাজতে পাঁচ। এনকোয়ারির ভদ্রমহিলা বললেন—ও আপনারা? যান, সার ঘরে আছেন, দশ মিনিটের মধ্যে রাউন্ডে বেরোবেন। দোতলায় উঠে প্রথম বাঁ দিকের ঘর।

ঘরের সামনে লেখা ডঃ রঞ্জন কার্লেকর এম.বি.বি.এস., ডি.জি.ও., এম.ডি. (ও.এন.জি) এম.আর.সি.ও.জি. (লন্ডন), এফ.আর.সি.ও.জি (এডিনবরা)

পর্দা ঠেলে সোজা ঘরে ঢুকে গেলেন অরিন্দম। সামনে বসা একজনের সঙ্গে কথা বলছিলেন ডাক্তার। অতজনকে একসঙ্গে ঢুকতে দেখে অবাক হয়ে তাকাতে অরিন্দম বললেন—আমরা সবাই অমৃতার বন্ধু। অমৃতা সম্পর্কে জানতে চাই আপনার কাছ থেকে।

চশমাটা খুলে রাখলেন ডাক্তার, চোখের ওপর একবার হাত বুলিয়ে নিয়ে বললেন— মারবেন না কি?

—আমাদের দেখে কি সে রকম মনে হচ্ছে? তিলক বলল। অরিন্দম দোলাকে এগিয়ে দিয়ে বললেন—এ হল দোলা, এ হল লাবণি, এর নাম তিলক, এখন এরা সব্বাই কলকাতা য়ুনিভার্সিটির বাংলা-বিভাগের ছাত্র, মানে অমৃতার সহপাঠী। আমরা ঠিক করেছি, অমৃতাকে আমরা খুঁজে বার করবই। প্রথমেই এসেছি আপনার কাছে। আই হোপ ইউ’ল কোঅপারেট।

সামনে বসা ভদ্রলোককে চোখের ইশারায় চলে যেতে বললেন ডাক্তার। কে জানে, কোনও সিকিওরিটি ম্যানকে ডাকতে পাঠালেন কি না। তারপর বললেন—অমৃতা গোস্বামী নিখোঁজ হয়েছে একমাসের ওপর হয়ে গেছে। তার বন্ধুরা এতদিন কী করছিল?

—আমরা ঠিক কী ভাবে এগোব বুঝতে পারছিলাম না। তিলক বলল।

—আমার যা বলার আমি পুলিসকে বলেছি। এস.ডি.জে.এম আলিপুরকে বলেছি। অমৃতার স্বামী এবং তার লোকজন এখানে ভাঙচুর করে, থানায় এফ.আই.আর. করে ওরা আমাকে থানায় নিয়ে গিয়েছিল। এক রাত হাজতবাস করেছি। তারপর জামিনে খালাস। কেস যখন উঠবে তখন কথা বলব, এখন না। আমার রাউন্ড দেবার সময় হয়ে গেছে। আপনারা এখন আসুন।

ওপাশের একটা দরজা দিয়ে উনি ভেতরে চলে গেলেন। ওরা বোকার মতো কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে বাইরে বেরিয়ে এল।

তিলক বলল—অরিন্দমদা এবার?

—এবার বাড়ি। বাড়ি চলো।

গাড়িতে উঠে স্টিয়ারিং-এ হাত দিয়ে অরিন্দম বললেন—দ্যাট ডক্টর নোজ আ লট। অ্যান্ড হি ইজ বেসিক্যালি নট আ ক্রুয়েলম্যান। দিস ইজ ইমপর্ট্যান্ট। উইদিন আ উইক উই উইল সল্‌ভ দা অমৃতা রিড্‌ল। হোপফুলি।

—এক সপ্তাহ?

—আবার কী?

—এত কনফিডেন্স আপনার? দোলা বলল।

—আমার নয় দোলা, ওই ডাক্তারের, কী যেন নাম? কার্লেকর। হি ইজ অ্যাবসলিউটলি শিওর অফ হিমসেলফ।

—তাতে কী হল? তিলক অবাক হয়ে বলল।

—দেখো তিলক, যারা হার্ডনড ক্রিমিন্যাল তাদের কথা আলাদা। কিন্তু একজন ডাক্তার যদি কোনও ক্রাইম করে ফেলেও থাকেন তিনি তো ক্রিমিন্যালের পর্যায়ে পড়েন না? পড়েন?

—সাধারণত না।

—ওঁদের কথাবার্তা হাবভাব প্রকাশ করে দেয় ভেতরে কোনও গণ্ডগোল আছে কি না। এখন এই ডাক্তারের মুখে তোমরা লক্ষ করেছ কি না জানি না, সামান্য হাসি লেগে ছিল। যাকে বলে দুষ্টু হাসি। খেয়াল করেছিলে?

লাবণি বললে—হ্যাঁ, আপনার মুখে যেমনটা মাঝে মধ্যে লেগে থাকে।

—থ্যাংক ইউ ম্যাডাম, ওই ডক্টর কার্লেকর খুব মজা পাচ্ছিলেন আমাদের দেখে। ইনটারেস্টিং ম্যান। ক্রাইম করে ওরকম মুখের ভাব হয় না।

—হোয়াট ইজ আওয়ার নেকস্ট কোর্স অফ অ্যাকশান? তিলক জিজ্ঞেস করল।

—ভাবতে দাও, একটু ভাবতে দাও।

প্রথমে দোলাকে নিউ বালিগঞ্জে নামিয়ে সোজা উত্তরে গিয়ে লাবণিকে গোয়াবাগানে নামাল অরিন্দম। তারপর তিলককে আমহার্স্ট স্ট্রিটে নামিয়ে উর্ধ্বশ্বাসে ছুটে চলল দক্ষিণের দিকে।

লাবণির মা জিজ্ঞেস করলেন—কোথায় গিয়েছিলি রে?

লাবণি বলল—বেড়াতে।

—অরিন্দমের সঙ্গে?

—হ্যাঁ কিন্তু আরও বন্ধুরা ছিল।

—তা হলে কথাবার্তা কিছুই হল না?

—হলও বটে, হল না-ও বটে।

—কী যে হেঁয়ালি করিস! মত কি তার পুরোনো জায়গায় অনড় আছে? না বদলাল।

—হুঁ।

—কী হুঁ হুঁ করছিস! বদলেছে?

লাবণি মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে বলল—বদলেছে মা।—লোকটা বেশ! ওকে ছাড়া আর কাউকেই বিয়ে করব না—কথা দিচ্ছি। কিন্তু এম.এ. ফাইন্যালটা হয়ে গেলে।

—ওকে ছাড়া আর কাউকেই … বাব্বা, এত?

—কেন তোমার হিংসে হচ্ছে মেয়ে পর হয়ে গেল?

—হিংসে তো বটেই। কিন্তু এ হিংসেও যে কী সুখের, নিজে মা না হলে বুঝতে পারবি না।

—তবে একটা কথা মা। অন্য কোনও নাম ওর বার করতে হবে তোমাদের। অরি বা অরিন্দম বলে আমি ডাকতে পারব না। ওর বাবা মা তো অরি বলেই উল্লেখ করছিলেন। আর কোনও নাম নেই?

—আছে, মা খুব গম্ভীর ভাবে বললেন—ওর দিদিমা ওকে একটা অন্য নামে ডাকেন?

—বাঃ ভাল তো! কী নাম?

মা বললেন—নাড়ু। ডাকবি?

সেদিন রাত্রে লাবণি একটা অদ্ভূত স্বপ্ন দেখল। অনেক জল। অনেক, কিন্তু সমুদ্র নয়। স্থির জল। তার একূল ওকূল দেখা যায় না। সেই জলে একটা মড়া ভেসে যায়। কাছে এলে মনে হয় ওটা অমৃতার শব। একটা ফিকে নীল শাড়ি পরনে। চুলগুলো খুলে গেছে, জলে ছড়িয়ে গেছে। আরও কাছে এলে সেই শবের চোখ দুটি খুলে গেল, লাবণি দেখল চোখ দুটো তার। অমনি আয়ত। অমনি কাজল টানা। বড় বড় পাতা ছাওয়া বাদামি মণিওয়ালা চোখ। ভয় পেয়ে সে চিৎকার করে কার নাম ধরে ডাকল। তারপরই সে চমকে উঠে পাশ ফিরে শুল।

পরদিন সকালে ওর আট বছরের ছোট ভাই অবন, ওর পাশের খাটে শোয়, হাসতে হাসতে বলল, দিদি তোর হল কী? ঘুমের মধ্যে বুড়োদের মতো ‘হরি হরি’ করে ডাকছিলি? কবে থেকে তোর এত হরিভক্তি হল জানি না তো?


—‘আমি যাব না, যাব না, যাব না’—এই প্রতিজ্ঞা শম্পার। নিবেদিতা মাঝে মাঝে তাঁর কাজের ফাঁকে ফাঁকে ভয়ে ভয়ে আড়চোখে তার দিকে চেয়ে দেখছেন। মেয়েটার মুখ চোখ কঠিন। তিনি কিছু বলতে গেলে ধমকে ধমকে কথা বলছে।

—দুধটা খেয়ে নে শম্পি।

—তুমি খাও।

—আমি তো এক্ষুনি অফিস যাব, ভাত খাব…

—আমিও তো

—তুই তো বললি অফিস যাবি না, ছুটি নিচ্ছিস।

—অফিস যাচ্ছি না মানেই বেরোব না, তা তো বলিনি।

—বেরোবি? কোথায়?

—তোমার না জানলেও চলবে।

অনেকক্ষণ সহ্য করেছেন নিবেদিতা। আর পারলেন না। বললেন—তা তো বটেই পাঁচ বছর বয়স থেকে এই বাইশ বছর পর্যন্ত বড় করে তুললুম স্রেফ একা হাতে, নিজের অসুখ-বিসুখ গ্রাহ্য করিনি। একদিকে অফিস চলেছে আর একদিক মেয়ের জামা সেলাই, পড়া দেখিয়ে দেওয়া…

—প্লিজ মা, প্লিজ—শম্পা কেঁদে ফেলল— তুমি অমন করে বলো না। আমার ভীষণ মন খারাপ হয়ে আছে। মন খারাপটাই রাগ হয়ে বেরোচ্ছে।

—মন খারাপ তো হবেই। হওয়ারই কথা। নিবেদিতা বললেন, মন কি আমারই কম খারাপ? কোথায় গেল মেয়েটা?

—মাসি মেসোর কী রকম গা-ছাড়া ভাব দেখলে মা!

—ঠিক বলেছিস! ঠিক বলেছিস। অদ্ভূত একটা চুপচাপ ভাব। যেন নিয়তির কাছে আত্মসমর্পণ করেছেন দুজনেই। নিবেদিতা বললেন, ভগবান না করুন, আমার যদি অমনি হয় তো আমি তো দেয়ালে মাথা ঠুকে রক্তারক্তি কাণ্ড করে ফেলব।

—আসলে মাসি-মেসোর সারা জীবনের দুঃখকষ্ট বোধ হয় এখন সীমা ছাড়িয়ে গেছে মা। আমি যদ্দূর জানি মাসিদের বিয়েটা ওঁদের কারও বাড়িতেই মেনে নেয়নি বলে চিরদিন ওঁরা একা। একা একাই সব সামাল দিতে হয়েছে। অমৃতার ঠাকুমা বোধহয় নাতনি হওয়ার পর ওদের বাড়িতে চলে এসেছিলেন। অমৃতার মামার বাড়িতে কে আছে না আছে, আমি জানিই না। বুঝতে পারি, এঁদের ভীষণ সাফারিং। অত তো স্ট্রাগ্‌ল করে দিন কাটাচ্ছিলেন, তার ওপর হল মাসির ওই রকম দুরারোগ্য অসুখ।

নিবেদিতা রান্নার শেষে এখন রান্নাঘর পরিষ্কার করছেন। তাঁর হাতে একটা ঝাড়ন আস্তে আস্তে তেলচিটে হয়ে উঠছে। শম্পা হঠাৎ দেখল তার মা যেন বড্ড রোগা হয়ে গেছে, যেন বুড়োটে, অথচ মায়ের মাথায় পাকা চুল দেখাই যায় না। কতই বা বয়স হবে মায়ের। চুয়াল্লিশ কি পঁয়তাল্লিশ! সে অমৃতার মা বাবার দুঃখ-দুর্দশার কথা বলছিল, একাকিত্বের কথা বলছিল বটে, কিন্তু তার মায়ের দুঃখ-দুর্দশাও তো কিছু মাত্র কম নয়। তার পাঁচ বছর বয়সে হঠাৎ এনকেফেলাইটিস হয়ে তার বাবা চোদ্দো-পনেরো দিন ভুগে মারা গেলেন। তার মামারা যথেষ্ট অবস্থাপন্ন। বড় জন দিল্লিতে থাকেন। কিন্তু ছোট মামা তো থাকেন এখানেই কোম্পানির ফ্ল্যাটে দেওদার স্ট্রিটে। বাবার কাজকর্ম চুকে গেলে একমাত্র ছোট বোনকে না কি বলেছিলেন—আমার উচিত ছিল তোকে নিয়ে যাওয়া। কিন্তু কম্প্যানির দেওয়া ফ্ল্যাট, আত্মীয়স্বজন অ্যালাও করে না বুঝলি তো!

নিবেদিতা না কি বলেছিলেন— না দাদা, এ বাড়ি আমার শ্বশুরবাড়ি। ওঁর বাড়ি। এখান ছেড়ে আমি কোথাও যেতে চাই না। তা ছাড়া স্কুল এখান থেকে খুব কাছে।

নিবেদিতা তখনও তাঁর স্বামীর অফিস থেকে প্রাপ্য টাকা-পয়সার কিছুই পাননি। ছোট মামা টাকা-পয়সার দরকার আছে কি না আছে একবার জিজ্ঞেস পর্যন্ত করলেন না। আর এদিকে তার জ্যাঠামশাই? তিনি অবশ্য উদার স্বরে বললেন, বউমা ভেবো না, আমাদের যখন জুটছে, তোমাদেরও জুটে যাবে, আলাদা সংসার আর রাখার দরকার কী? তবে আস্তে আস্তে নিবেদিতা তাঁর ভাসুরের রান্নাঘরে ঢুকে যেতে লাগলেন। এই সময়ে যেমন স্বামীর টাকা-পয়সাগুলো পেলেন, তেমন একটা চাকরি দেবার অফারও পাঠাল ওরা। নিবেদিতা হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। তাঁর ভাসুর ও জা অনেক বাধা দেবার চেষ্টা করেছিলেন। শরীর থাকবে না বউমা, কেন তুমি চাকরি করতে যাবে? কিন্তু নিবেদিতা তত দিনে বুঝে গেছেন এ সব কুম্ভীরাশ্রুর মানে। কোনও মতে যদি মাঝের দেওয়ালটা ভেঙে দেওয়া যায়। গোটা বাড়িটাই ওঁদের হয়ে যাবে, উপরন্তু জুটবে একটি বিনা মাইনের রাঁধুনি, একটি ফাই ফরমাশ খাটার মেয়ে।

আশ্চর্য হয়ে শম্পা ভাবে—কেন সব মৃত্যুর গল্প, সব বিধবার গল্পই এ রকম এক রকম! কেন অন্য কিছু হয় না। স্বামী মারা গেলেই বিধবার ভাসুর দেবর জা-রা স্বার্থপর ধান্দাবাজ হয়ে ওঠে কেন? স্বাভাবিক মনুষ্যত্ব তো বলে— আহা, এই বয়সে স্বামী মারা গেল, ওই টুকুনি মেয়ে নিয়ে বেচারি এখন কী করবে? খাওয়া-পরার বা শিক্ষা-দীক্ষার ভাবনা নেই, সে তো আমরাই আছি, ওর নিজেরও কিছু টাকা-পয়সা আছে, কিন্তু—শোক? এই শোক এই একাকিত্ব? এগুলো কাটিয়ে ওঠার কী মন্ত্র ওদের আমরা দিতে পারি?

শম্পাকে মা কোনওদিন সেভাবে সংসারের কাজ করতে দেননি। অসম্ভব কর্মঠ মানুষ নিবেদিতা। এখনও শম্পার ও নিজের ব্লাউজ পেটিকোট সেলাই করেন। সালোয়ার-কামিজ তো করেন হেলায়। আর এই সব করেন দশটা পাঁচটার চাকরি করে। রান্না করে। ঘর পরিষ্কার করা ও বাসন মাজার একটা ঠিকে লোক আছে তাদের। বাস। শম্পা মাঝে মাঝে শখের রান্না করে, ঘরদোরও অবশ্য গোছায়, বিছানা ঝাড়ে, কিন্তু কোনওটাই দায়িত্ব নিয়ে নয়। সে যদি একদিন তাড়াহুড়োয় বিছানা ঝাড়তে ভুলে যায়, মা কিছুই বলবে না। নিজে ঝেড়ে দেবে।

সে হঠাৎ মার হাত থেকে ঝাড়নটা কেড়ে নিয়ে বলল—কী এত পরিষ্কার করছ মা! দাও বাকিটা আমি করে দিচ্ছি।

নিবেদিতার একটু হাঁপানি আছে। তিনি বললেন—তুই পারবি? আমি তাহলে খোলা হাওয়ায় গিয়ে একটু নিশ্বাস নিয়ে বাঁচি। শোন গ্যাসটা ভাল করে মুছবি। ওভন দুটোয় আর এই তলার লোহার পাইপটায় একটু কেরোসিন ঘষে দিবি। তলায় সবুজ বোতলটায় কেরোসিন আছে। ওভন মোছার আর ধাপিটা মোছার ঝাড়ন আলাদা। একটু সাবান নিয়ে নিস। নইলে উঠবে না। সবশেষে একটু ফিনাইল দিবি। পারবি তো এত সব?

—এত করার দরকার কী মা?

—এত? ওভনগুলোয় মরচে ধরে জং ধরে গেলে পাল্টাতে হবে। ধাপিটা যদি ছেড়ে দিস এমন তেলচিটে হয়ে যাবে যে সে আর কহতব্য নয়। ফিনাইল দিলে পোকা-মাকড় আরশুলার হাত থেকে কিছুটা রেহাই। থাক তুই পারবি না। আমায় দে।

—না, না, পারব। জাস্ট জিজ্ঞেস করেছিলাম।

মা রান্নাঘর ছেড়ে বাইরে চলে গেলে, ঝাড়ন দিয়ে শম্পা তার নিজের যাবতীয় দুঃখ, সন্দেহ, অপমান সব প্রবল বেগে ঝাড়তে থাকল। দুঃখ মুছতে মুছতে কেমন একটা চকচকে আকার ধারণ করে, আর দুঃখ থাকে না শুধু, যেন ট্রাজেডি হয়ে যায়— ট্রাজেডি অফ শম্পা সেন, হু ট্রাস্টেড। না শুধু শম্পা কেন, ট্রাজেডি অফ নিবেদিতা সেন হু লস্ট হার হাজব্যান্‌ড অ্যাট দা এজ অফ থার্টি ওয়ান। মুছতে মুছতে তার সন্দেহ এক অমোঘ সত্য রূপে, বিশ্বাসঘাতকতা রূপে দেখা দেয়, তার অপমান হয়ে যায় আত্মসম্মান। শুধু আত্মসম্মান বললে যেন সবটা বলা হয় না, হয়ে ওঠে আত্মমর্যাদা। এতক্ষণ যে তার প্রবল মন খারাপ করছিল তার মধ্যে তো শুধু অমৃতাই ছিল না, সে নিজেও ছিল।

মা বেরিয়ে যাবার পরে, শম্পা আর একবার গা ধুয়ে নিয়ে ভাল করে সাজল। গরম পড়ে গেছে। একটা হালকা, নতুন ছাপা শাড়ি বাছল সে। ঠোঁটে একটু মেরুন ধাঁচের লিপস্টিক, চোখে হালকা করে আই-ব্রো পেনসিল। বেণীটা ঝুলতে থাকল, কপালে একটা মেরুন রঙের ছোট্ট টিপ পরে সে ছাতা আর মেরুন ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। রয়েজ কমপিউটার ফার্মে কাজ করতে করতেই আরও বেশ কয়েকটার সঙ্গে যোগাযোগ হয়ে গেছে। মনে হয় কোনও একটাতে হয়েই যাবে।

প্রথম সে ঢুকল ‘উইল পাওয়ার’-এ—মিঃ মিশ্র আছেন? একটু দেখা করব।

—আপনার নাম?

—শম্পা সেন, ফ্রম ‘রয়েজ’। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ডাক পড়ল।

—আরে মিস সেন—কী ব্যাপার? ‘রয়েজ’-এর জন্য কী করতে পারি, বলো।

—‘রয়েজ’ নয়, আমার জন্য করতে হবে।

—তোমার জন্য? তুমি ওখানে নেই?

—আছি এখনও। কিন্তু থাকবার ইচ্ছে নেই৷ প্লিজ কীপ ইট সিক্রেট।

—তা না হয় রাখলাম। কিন্তু তুমি ঠিক কী চাইছ?

—বেটার ওয়ার্কিং অ্যাটমসফিয়ার, অ্যান্ড ন্যাচার‍্যালি বেটার পে৷ অ্যানালিস্ট হিসেবে আমার তিন বছরের এক্সপিরিয়েন্স হয়ে গেল। আমি কি একটা প্রমোশন আশা করতে পারি না?

—ওয়েল, অফ কোর্স, কিন্তু তুমি আবার যদি হুট করে ‘উইল পাওয়ার’ও ছেড়ে দাও?

—তেমন কোনও কারণ ঘটলে তো ছেড়ে দেবই। আপনাদের নিজেদের স্বার্থেই তেমন কিছু ঘটাবেন না।

—তোমার ফ্র্যাংকনেস আমাকে মুগ্ধ করেছে মিস সেন। আমাকে দু’দিন সময় দেবে? আমি আমাদের পোজিশনটা একটু রিভিউ করে নিতে চাই।

—সময় দিতে পারব না মিঃ মিশ্র। আপনার যা রিভিউ করার এক্ষুনি করে নিন। ফ্র্যাংকলি স্পিকিং আমি এক্ষুনি আরও কয়েকটা অর্গ্যানাইজেশনে যাব। একটা না একটায় পেয়ে যাব ঠিক।

—আচ্ছা! এত তাড়া?

—এতই তাড়া।

—ঠিক আছে। তোমাকে রেখে নিচ্ছি। কিন্তু প্রজেক্ট নিয়ে বাইরে যেতে হতে পারে।

—মোস্ট ওয়েলকাম। শুধু থাকার বন্দোবস্তের সময়ে যদি মনে রাখেন আমি মেয়ে তাহলেই আর কোনও অসুবিধে থাকবে না।

তিন দিন পরে ‘রয়েজ’-এ পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে দিয়ে ‘উইলপাওয়ার’-এ যোগ দিল শম্পা। এ তিনদিন অফিস গেল না। অন্য কোথাও বেরোল না। খালি অমৃতার কথা ভাবল। অমৃতাই তাকে বলেছিল—প্রস্তাবটা তোর পক্ষে অসম্মানজনক এটা বুঝতে তোর আমার কাছে আসতে হবে শম্পা?

অমৃতা এমনিতেই যাকে বলে প্রাজ্ঞ। তার ওপরে বিবাহিত। বিয়ে মানুষকে অন্য অভিজ্ঞতা দেয়। অনেক পরিণত করে দেয় তাকে। কিন্তু সেই অমৃতা যে না-কি তাকে একটা মহাসর্বনাশ থেকে বাঁচিয়ে দিয়ে গেল, সে নিজেকে বাঁচাতে পারল না, কেন? কেন? কী এমন সে পরিস্থিতি যা অমৃতার বুদ্ধি এবং প্রজ্ঞার বাইরে, যা তাকে এমনভাবে পরাজিত করতে পারে? কী সেটা? কী? কী? কী?

মাকে সে জানাল না পর্যন্ত যে সে চাকরি বদল করেছে। মায়ের প্রশ্নের মুখোমুখি এখনই সে হতে চাইছে না। কেন না মায়েরও তার কাছ থেকে কিছু তিরস্কার প্রাপ্য রয়েছে। সৌমিত্রর প্রস্তাবটায় মা না করেনি। অবশ্য, বেড়াতে যাওয়ার কথা সে মাকে বলেনি, কাজের কথা বলেছিল, কিন্তু একমাত্র সৌমিত্রর সঙ্গেই সে যাচ্ছে সে কথা তো গোপন করেনি! মা কী করে তাকে ছাড়তে চাইল! মা নিজে তো বিবাহিত। মা জানে না দিঘায় নির্জন মুহূর্ত আসতে পারে? মা জানে না সৌমিত্র আগেই তাকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে রেখেছে? মা জানে না এরকম পরিস্থিতিতে একজন মেয়ের কাছে একজন পুরুষ কী হয়ে উঠতে পারে?

আসলে লোভ! অস্বীকার করে লাভ নেই তার মা যে কোনও মূল্যে এই বিয়েটা চেয়েছিল। মায়ের মতো রক্ষণশীল আবহাওয়ায় বড় হওয়া, বাস করা একজন মহিলা। মেয়ের বিয়ে হবে, এই লোভে তিনি মেয়েকে বাঘের মুখে ছেড়ে দিতে দ্বিধা করলেন না। কী করে সে আর মায়ের ওপর আস্থা রাখবে? অমৃতা, অমৃতাই তাকে বাঁচার মন্ত্র দিয়ে গেছে। নিজে মরে। না, না, অমৃতা, তুই কখনও মরতে পারিস না, অমৃতা তুই অমৃতা। তুই কখনও অতি নশ্বর মানুষদের ভাগ্য স্বীকার করে নিস না। আমি শম্পা, তোর ছোটবেলার বন্ধু, কত ঈর্ষা করেছি তোকে, কত জ্বালিয়েছি অভিমান করে করে, কিন্তু আমি তোকে ভালবাসি, আমি তোকে শ্রদ্ধাও করি, পূর্ণ আস্থা আছে আমার তোর শক্তি, তোর বুদ্ধির ওপরে। অমৃতা তুই কোনও জ্যোতির্বৃত্ত থেকে বেরিয়ে এসে একবার দেখিয়ে দে। সংসারে ভালমানুষদের, ভাল মেয়েদের ক্ষতি হয় না, কেউ করতে পারে না।

গরম চোখের জল টপ টপ করে পড়ে শম্পার চিবুক, গলা, ওপর বুক সব ভিজিয়ে দিতে লাগল। কী এখন করবে সে? অমৃতার জন্য কিছুই করতে পারবে না? কিছু না?

হঠাৎ একটা সংকল্প জাগল তার। সে টেলিফোন ডাইরেক্টরির পাতা খুলে কয়েকটা ফোন নম্বর টুকল।

—হ্যাললো, যাদবপুর থানা? ও. সি.র সঙ্গে একটু কথা বলব।

—বলছি।

—আপনাদের অঞ্চলে ৪/১এ সেন্ট্রাল পার্কে অমৃতা গোস্বামী…।

—আপনি কে বলছেন?

—ওর বন্ধু!

—নাম?

—নামে দরকার নেই। আমার বন্ধুকে ওর শ্বশুরবাড়ির লোকেরা এবং ‘উজ্জীবন’ নার্সিংহোমের ডাক্তার মিলে কিছু করেছে।

—কিছু করেছে মানে কী?

—মানে খুন করেছে কি না জানি না। আপনাদের জানবার কথা, আপনারা ইনভেস্টিগেট করুন।

সে ফোন নামিয়ে রাখল। তারপর করল বালিগঞ্জ থানায়। ওঁরা বললেন ওটা কড়েয়ার কেস।

—হ্যাললো কড়েয়া থানা।

—ইয়েস

—ও.সি-র সঙ্গে একটু কথা বলব…।

—ধরুন…।

—একটু পরে ভীষণ গম্ভীর বাজের মতো গলায় প্রশ্ন এল— কে বলছেন? আমি কড়েয়া থানার ও.সি.।

—আপনাদের এলাকায় ‘উজ্জীবন’ নার্সিংহোম থেকে।

—দাঁড়ান দাঁড়ান, আপনি কে?

—আমি অমৃতার বন্ধু। সে নিখোঁজ হয়েছে। এখনও খোঁজ দিতে পারছেন না কেন? ‘উজ্জীবন’-এর পেছনের পুকুরটা দেখেছেন?

—মেয়েটি পুকুরে আত্মহত্যা করেছে এ ধারণা আপনার হল কেন?

—আত্মহত্যা নয়। কখনও নয়, হয় হত্যা করে ওকে ওখানে ফেলে দেওয়া হয়েছে, আর নয় তো অ্যাকসিডেন্ট। রাতে হয়ত ওর ফোন এসেছিল ভাল বুঝতে পারেনি—নেমে আধা-আচ্ছন্ন অবস্থায় পুকুরে।

—ফর ইয়োর ইনফর্মেশন পুকুরটা চারপাশ থেকে জাল দিয়ে ঘেরা। আপনার নাম?

—শম্পা সেন।

—আবাস?

—কুড়ির-এ ডাফ স্ট্রিট—বলবে না বলবে না করেও শম্পা কী রকম বোকা আনাড়ির মতো বলে ফেলল।

—আপনার সন্দেহের কোনও কারণ? কাকে সন্দেহ করছেন? বাড়িকে? না ডাক্তারকে?

—জানি না। শুধু এইটুকু জানি পুরুষরা ভয়ানক। স্বামীই হোক, জ্যাঠামশাই-ই হোক।

—আর ও.সি-ই হোক। বাজের মতো গলাটা ওপার থেকে গমগম করে উঠল।

হঠাৎ ওরই মধ্যে শম্পার মনটা কেমন ভাল হয়ে গেল। এই কড়েয়া থানার ও.সি. ভদ্রলোক, বাজের মতো গলা, কিন্তু তার সঙ্গে একটু অপ্রত্যাশিত রসিকতা করলেন। এমন একটা সময়ে যখন একটি নিরুদ্দিষ্ট পেশেন্টের কেস ঝুলছে। তাহলে কি উনি অমৃতা সম্পর্কে আশাজনক কোনও খবর শুনেছেন? অবশ্য, সে ভাবে দেখতে গেলে খুন, জখম, রাহাজানি, দুর্ঘটনা, নিরুদ্দেশ সবই এঁদের কাছে জলভাত। এই সব ঘটনা, এই সব ভয়ঙ্কর দৃশ্য, সংশ্লিষ্ট আত্মীয়স্বজনের কান্নাকাটি বিলাপ সবই এঁদের প্রতি মুহূর্তে দেখতে শুনতে হয়। তবু, তবু, কেমন একজন নির্ভরযোগ্য; মানুষ-মানুষ মানুষ বলে মনে হল বজ্র-কণ্ঠকে। এবং পরের ফোনটা যখন এল সে সেটা এই মেজাজেই ধরল।

—আমি সৌমিত্র বলছি। ফোনটা রেখে দিল সে। আবার বাজল। তক্ষুনি।

—আমি সৌমিত্র বলছি। কী করেছি আমি?

কোনও কথা বলতে পারল না সে।

—‘রয়েজ’ ছেড়ে দিলে!

সে নীরব।

—‘উইলপাওয়ার’ জয়েন করছ?

সে নীরব।

—তুমি কী করে জানলে ‘উইলপাওয়ার’-এ সৌমিত্র দাসের মতো খারাপ কোনও লোক নেই।

আস্তে খুব আস্তে সে বলল—জানি না।

—তবে?

—ধরেই নিয়েছি।

—কী ধরে নিয়েছ! ওখানেও সৌমিত্র দাস আছে?

—হ্যাঁ।

—তবে?

—ট্যাক্‌ল করতে পারব এবার।

—কী ভাবে?

—সর্বতোভাবে অ্যাভয়েড করে।

—ভাল।

ও পাশে ফোন রেখে দেবার শব্দ হল।

যে মন কড়েয়া থানার ও.সি. ভাল করে দিয়েছিলেন, সে মন সৌমিত্র দাস আবার খারাপ করে দিয়ে গেল।

—তুমি শম্পা না? অমৃতার বন্ধু?

—তুমি দোলা, য়ুনিভার্সিটিতে…।

অপ্রত্যাশিতভাবে ওদের দেখা হয়ে গেল পার্ক স্ট্রিট রাসেল স্ট্রিটের মোড়ে। শম্পা একা। দোলার সঙ্গে অবশ্য একটি অতি রূপবান যুবক। দোলা বলল— শুধু য়ুনিভার্সিটি কেন? আমি তো কলেজ থেকেই ওর সঙ্গে আছি। তোমার সঙ্গেও। তুমি সায়েন্সে ছিলে বলে বেশি দেখা হত না। অনেকদিন পর তোমায় দেখছি।

—আমি তো চাকরি করি।

—কোথায়?

—আগে ‘রয়েজ কমপিউটার’-এ ছিলাম রফি আমেদ কিদোয়াই স্ট্রিটে। এখন এই রাসেল স্ট্রিটে ‘উইলপাওয়ার’-এ এসেছি। তুমি?

তখন সবে গোধূলি ফুরোচ্ছে। শম্পা বাড়ি ফিরছে। সব দিন সে এত তাড়াতাড়ি ফিরতে পারে না অবশ্য। আজ দোলা, দোলাদের সঙ্গে দেখা হবে বলেই বোধ হয়…

শাঁ শাঁ করে গাড়িগুলো বেরিয়ে যাচ্ছে। আলো জ্বলে উঠছে রাস্তার। দোলা বলল—আইসক্রিম পার্লারে যাচ্ছিলাম। এ আমার বন্ধু অমিত।

—রে নয় তো? শম্পা হেসে জিজ্ঞেস করল।

—রে হতে হলে আবার অমিট্‌-ও হতে হয়। অমিত ছেলেটি বলল। রে আপাতত একজনই এ দেশে—সত্যজিৎ রে। স্ট্রেইট ফ্রম দা সান।

—আপনি অভিনয় করেন? —শম্পার আসলে মনে হল ছেলেটির এমন ফিগার, এমন চেহারা, মুখ চোখ, তার ওপর সত্যজিৎ রে-র কথা বলছে, ও হয়তো!…।

হেসে উঠল ছেলেটি, বলল— প্রতিদিনকার লাইফে যেটুকু অভিনয় বাধ্যতামূলকভাবে করতেই হয় তার বাইরে আর কোনও অভিনয় আমি করি না।

সন্ধেটা ঝপ করে নেমে গেল। দোলা বলল চলো না শম্পা, তুমি তো বাড়িই ফিরছ, আমাদের সঙ্গে চলো না প্লিজ।

—টু ইজ কম্প্যানি, থ্রি ইজ ক্রাউড— শম্পা ভেতরে ভেতরে একটু কুঁকড়ে গিয়ে বলল।

অমিত বলল— টু ইজ কনভার্সেশন। থ্রি ইজ ডিসকাশন। প্লেজেন্ট, থ্রিলিং। চলুন। একটু মুখ ঠাণ্ডা করে আসা যাক। যা গরম!

শম্পা আর একটু গাইগুঁই করেছিল, কিন্তু দোলা কিছুতেই ছাড়বে না।

প্রথম সন্ধের এই পার্ক স্ট্রিট শম্পার ভীষণ পরিচিত, ভীষণ প্রিয়। তারা এদিকটায় এলে রাসেল স্ট্রিটেই নিজের গাড়ি পার্ক করত সৌমিত্র। বার্গেন কাউন্টার থেকে রিডাকশন সেল-এ তোয়ালে, বেড শীট কিনত শম্পা। ওই দিকে ব্লু ফক্স, আরও এগিয়ে ওয়ালডর্ফ। এগুলো তাদের নিজস্ব জায়গা। যেন মার্কা মারা আছে।

দোলার কোনও বয়ফ্রেন্ড আছে জানত না সে। থাকতেই পারে। কতদিন পরে দেখা হল তাদের। দোলা আগে খুব দোহারা গোলগাল মাখন মাখন ধরনের মেয়ে ছিল, দেখলেই বোঝা যেত, বড়লোকের আদুরি। গালগুলো শীতকালে লাল হয়ে যেত একটু ফেটে। কাঁধ পর্যন্ত সোজা চুল। দোলার বন্ধুদের একটা খেলাই ছিল দোলার ভুঁড়িতে কাতুকুতু দেওয়া।

এখন কি দোলা একটু লম্বা হয়েছে? আঠারো উনিশের পর মেয়েরা আর লম্বা হয়? সেই গোলগাল ভাবটা ওর আছেই এখনও। কিন্তু এখন আর কেউ ওর ভুঁড়িতে কাতুকুতু দেবে না। মোছা মোছা ভুরু, ছোট চোখ, ঠোঁট দুটো মিলিয়ে একটা গোল মতো কমলার কোয়ার মতো। তাইতেই লাবণ্য ফেটে পড়ছে ওর। লাইল্যাক রঙের একটা সালোয়ার কামিজ পরেছে, অদ্ভূত অ্যাট্রাকটিভ দেখাচ্ছে। শম্পা যেতে যেতে একবার পাশের দোকানের কাছে নিজের ছায়াটা দেখে নিল। লম্বা, কালো, পোড়খাওয়া, সাজগোজ করা একটা মেয়ে। দোলা যেন একটা আকাশের মতো। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন, তার কোনও রঙ লাগে না। আর শম্পা একটা বাজ পড়া গাছ। গাছটাতে আদিবাসীরা গোবর মাটি আর সিঁদুর লেপে গেছে। আর দোলার সঙ্গের ছেলেটি? যেমনি লম্বা তেমনি অদ্ভূত সুন্দর একটা শ্যামের ওপর লালচে রঙ ধরা ত্বকের জৌলুষ। মুখ চোখ কেমন, তাকিয়ে তাকিয়ে তো আর দেখা যায় না। কিন্তু তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে।

হঠাৎ শম্পা বলল— মা ভাববে দোলা, আমি বরং চলেই যাই।

দোলা হঠাৎ ওর হাতটা ধরে ফেলল, কানের কাছে মুখ এনে বলল—প্লিজ ডোন্ট টেল এনিবডি।

অমিত বলল— কী হল? —সে একটু এগিয়ে গিয়েছিল।

দোলা বলল— দ্যাখো না শম্পা আসতে চাইছে না।

—তার মানে একজন অ্যাট্রাকটিভ লেডির সঙ্গ থেকে আমি বঞ্চিত হচ্ছি?

শম্পা বলল—মনে পড়ে গেল বাড়িতে একটু তাড়াতাড়ি ফেরার আছে। প্লিজ কিছু মনে করবেন না।

—আপনাকে দেখে কিন্তু এত গরমেও ঠিক বাড়ি ফিরতি মনে হচ্ছে না। মনে হচ্ছে এইমাত্র বিউটি পার্লার থেকে বেরোলেন কোনও বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে…।

শম্পা লজ্জা সামলে বলল—কম্পুটার-এর কাজ তো। সারাক্ষণ এ.সি-র মধ্যে থাকি। আচ্ছা আসছি। ভাগ্যে থাকলে আবার দেখা হবে।

ফিরতে ফিরতে শম্পা ভাবল— কোন বুদ্ধিতে সে ওদের সঙ্গে যাবার উদ্যোগ করছিল? কে না জানে প্রেমিক-প্রেমিকারা একা থাকতে চায়?

মুখের কথা কখনও মনের কথা হয় না কি? দোলা মুখে বলছে এসো এসো, মনে মনে বলছে যাও যাও। তারও এমন দিন ছিল। সে আর সৌমিত্র অবশ্য ঠিক রোম্যান্টিক প্রেমিক-প্রেমিকা ছিল না। সৌমিত্র একটু প্র্যাকটিক্যাল গাদ্যিক ধরনের মানুষ। শম্পার ভেতরে রোমান্টিকতা কি আর ছিল না? কিন্তু সেই রোম্যান্টিকতার চাহিদা মেটেনি বলে তার কোনও নালিশ ছিল না। শক্তিশালী, প্র্যাকটিক্যাল পুরুষ। তারা হয় নির্ভরযোগ্য, দায়িত্বশীল, মিষ্টি মিষ্টি কথার ঝুড়ি নয়, হিম্যান। হঠাৎ সে চমকে উঠল—কী ভাবছে সে? সৌমিত্র দাস নির্ভরযোগ্য? দায়িত্বশীল? এই তার ধারণা তার চেহারা, কথা-বার্তা থেকে? না শুধু তাই নয়, অফিসের মধ্যে তার কাজ কর্ম থেকেও। কে জানত সেই দায়িত্বশীল মানুষটার মুখ থেকে এমন একটা উড়নচণ্ডে অশালীন প্রস্তাব আসবে?

এখন সমস্ত বাসে ট্রামে প্রচণ্ড ভিড়। শম্পা হাঁটতে লাগল। হাঁটতে লাগল। ট্রাম গুমটিতে গিয়ে দাঁড়াবে, লাইন দেবে। তারপর নিজের পালা এলে চড়তে পাবে ট্রামে, যদি না কেউ কনুইয়ের গুঁতো দিয়ে এগিয়ে যায়। তার চেয়ে পাতাল রেলে যাওয়া ভাল। শোভাবাজার স্টপে নামতে হবে সম্ভবত। বেশ খানিকটা ফিরতে হবে তারপর। কিন্তু যাওয়াটা হবে খুব তাড়াতাড়ি। পাঁচ মিনিট, দশ মিনিট বড় জোর।

পাতালে নেমে ট্রেনে বসতে পেয়ে গেল শম্পা। হঠাৎ তার মনে হল—ভালবাসা জিনিসটা ঠিক কী? এই যে বাবা মা স্থির করে দিচ্ছেন ছেলে মেয়েরা বিয়ে করছে যেমন অমৃতা করেছিল—তার মধ্যে দেখাই তো যাচ্ছে ভালবাসা ছিল না, একটা পরের বাড়ির মেয়ে তার বাবা-মা নিজের কত অভ্যাস, কত ভালবাসার জিনিস ছেড়ে অন্যের বাড়ি আসছে, তাকে তো সাদর অভ্যর্থনা করতে হবে, ভালবাসা, স্নেহ, আশ্রয় দিয়ে নিশ্চিন্ত করতে হবে, অথচ প্রথমেই লোকে চোখ বাঁকিয়ে জিজ্ঞেস করবে—বউ কেমন হল? মানিয়ে নিচ্ছে তো? আরে বাবা তোমাদেরই তো তার সঙ্গে মানাতে হবে! তার যা কিছু অভ্যাস সে একদিনে পাল্টে ফেলতে পারবে কেন? আর পাল্টাবেই বা কেন? তার জ্যাঠতুতো দাদার বউ এল, জেঠিমা দু-দিন পরই মুখ বেঁকিয়ে বললেন—সকালে বাসিমুখে চা না খেলে তার মাথা ধরে, কোষ্ঠ পরিষ্কার হয় না। আচ্ছা, সে বেচারি কী করবে? এই অভ্যেসটা সে গত দশ কি পনেরো কি তারও বেশি বছর হয়তো করেছে। তামাক তো আর খায় না! বেড-টি অনেকেই খায়। এখন শাশুড়ি অসন্তুষ্ট হচ্ছেন বলে তাকে যদি এক্ষুনি অভ্যেসটা পাল্টাতে বলা হয় সে কি পারবে? এটা অন্যায় নয়? এরা একবাড়ি লোক, নিজেদের পরিবেশ নিজেদের লোকজন নিজেদের অভ্যেসের মধ্যে বাস করবে, আর সে সব ছেড়ে এসে বেমালুম এদের মতো হয়ে যাবে? সাধে কি আর তখনকার মেয়েরা শ্বশুরবাড়ি যেতে মড়াকান্না কাঁদত? এখনও কাঁদে। যাদের একটু বয়স বেশি, পঁচিশ-ছাব্বিশ তারা তবু একটা লড়াই দিতে পারে, তার চেয়ে ছোটরা স্রেফ হতবুদ্ধি হয়ে যায়। অসুখী হয়, অশান্তিতে জ্বলে। অমৃতাটার কী হয়েছিল কে জানে? বড্ড চাপা মেয়ে, তেমন কিছু বলত না। কিন্তু আজকে এই দোলার মুখে যে আভা সে দেখেছে, অমৃতার মুখে কোনওদিন তা দেখেনি। অর্থাৎ বিনা ভালবাসায় এক ছাদের নীচে সহবাস কতকগুলি সহানুভূতিহীন মানুষের সঙ্গে, একটি পুরুষের সঙ্গে সহবাস বিশেষ অর্থে। সে এমন শিউরে উঠল, যে পাশের যাত্রিনী তার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে নড়েচড়ে বসলেন।

সৌমিত্রর সঙ্গে তার যেটা ঘটেছিল, সেটাও কিন্তু ভালবাসা নয়। একটা ব্যবস্থা। অ্যারেঞ্জমেন্ট। এই যে এতদিন তাদের দেখা হল না তার জন্য সে বা সৌমিত্র কেউই কি বিন্দুমাত্র বিচলিত? বিচলিত সে অপমানে, সৌমিত্রও নিশ্চয় অপমানিত বোধ করেছে, সে দিনের ফোনালাপে। সে তো বুঝিয়েই দিয়েছে সৌমিত্র দাসকে সে কতটা খারাপ ভাবে। তাদের পরস্পরকে না হলেও চলবে। একটা পারস্পরিক বন্দোবস্ত হতে যাচ্ছিল, হল না। ভাগ্যিস, অমৃতা তাকে সাবধান করেছিল! অথচ বাইরে থেকে লোকে তো এটাকে ভাব ভালবাসাই বলবে? বিয়েটা হলে সকলেই বলত, ওরা নিজেরা দেখেশুনে করেছে, প্রেমের বিয়ে। প্রেম জিনিসটা কী তা সে বুঝতেই পারছে না। কারও জন্যে তার কোনও টান নেই। অমৃতার স্বামী-ভাগ্যকে ঈর্ষা করে তার খুব শিক্ষা হয়েছে, তার পর থেকেই সে চারপাশের মানুষগুলোকে আরও ভাল করে বুঝতে শুরু করেছে। যেমন সে বুঝতে পেরেছে দোলা ওই অমিত ছেলেটির দারুণ প্রেমে পড়েছে। অর্থাৎ মোহাচ্ছন্ন হয়েছে। তা নয়তো দোলার মতো ধনী বাবা মায়ের আদরের মেয়ে তাঁদের লুকিয়ে ছেলেটির সঙ্গে বেড়াতে আসতে পারে? চুম্বকের মতো একটা টান আছে ওই ছেলেটির। সামলানো যায় না। সে নিজেও যে সে টান অনুভব করেনি তা নয়। যেই ছেলেটি তার দিকে চাইল, তার সমস্ত শরীর যেন শিউরে উঠল। একেই বোধহয় তাহলে সেক্স অ্যাপীল বলে। ছেলেটির চেহারা চিন্তা করলেই রক্তের মধ্যেটা কেমন রিমঝিম রিমঝিম করতে থাকে। রূপান্ধ। রূপের মোহ। সুন্দরী অভিনেত্রীদের যেমন প্রেমে পড়ে ছেলেরা। হ্রস্ব-দীর্ঘ তাল থাকে না। ধনসম্পত্তি তার পায়ে বিলিয়ে দিয়ে দেউলে হয়ে যায়!

কিন্তু অমিত ছেলেটি কী রকম? তার ধরন ধারণ আগে হলে সে বলত স্মার্ট। এখন মনে হল ওপর চালাক। বেশ চালাক-চালাক কথা বলবে, মেয়েদের কমপ্লিমেন্ট দেবে, ফ্লার্ট করবে। তার মন বলল এ রকম ছেলে নিরাপদ নয়, কিন্তু প্রেম তো! নিরাপদ খুঁজতে গেলে যদি প্রেমের বিরল অনুভূতি ফসকে যায়। তা হলেই বা জীবনে কী লাভ! খালি ভাল খেয়ে পরে, কর্তব্য করে বেঁচে থাকা? যেমন তার মা বেঁচে আছে এখন? অমৃতার বাবা-মা তো ভালবেসে বিয়ে করেছিলেন। দু পক্ষের বাধা অগ্রাহ্য করে। তা হলে তাঁদের রক্তে এই রিমঝিম লেগেছিল? কয়েক বছরের জন্যও তো লেগেছিল! সারা জীবন দুঃখ-ধান্দা করতে করতে সে-প্রেমের কতটুকু টিকে আছে, এখন? বিশেষত মেয়ের এই ট্রাজেডি ঘটার পরে? কে জানে? ওরা হয়তো পরস্পরের প্রতি এতই অনুরক্ত যে মেয়ের বিয়েটা একটু দেখেশুনে দিতেও গাফিলতি করলেন। বোকামি? না অবহেলা?

শম্পার মনে হল সে কেন বিয়ে করতে চেয়েছিল? আশ্রয়ের জন্য, নিরাপত্তার জন্য। আর কিছুর জন্য না। ভাল যদি বাসতেই হয় তো সে একমাত্র মাকে ভালবাসবে। সারা পৃথিবীতে আর কাউকে না। কাউকে না। যেখানে নিরাপত্তা নিশ্চিত সেখানে হয়তো বিয়ে করবে, কিন্তু মাকে চাই। মাকে ছেড়ে সে কোনও আশ্রয় আর খুঁজবে না, খুঁজবে না, খুঁজবে না।

ডাফ স্ট্রিটের বাড়িটা তাদের শক্তপোক্ত, পুরোনো। কিন্তু কেমন একটা মহিমা আছে, পুরনো কিন্তু ভাল জিনিসের যেমন মহিমা থাকে। সিঁড়ি তিনটে ভেঙে, বেল-এ হাত রাখল সে। মা এসে খুলে দিল। আর কে-ই বা দেবে? এ সময়ে তো কোনও লোকজন থাকে না।

মা বলল—আয় শম্পি, দেরি করলি যে?

—কেন? আজ অন্য দিনের চেয়ে তাড়াতাড়িই তো ফিরেছি মা।

দালান পার হয়ে বাইরের ঘরে ঢুকল সে। ঢুকেই স্থাণু হয়ে গেল। সৌমিত্র বসে আছে।

মা একটি কথাতেও তাকে জানতে দেয়নি। বাইরে ওর জেন ডিলুক্সটাও কই দাঁড়িয়ে নেই।

মা বলল—চা খাবি তো করি?

শম্পা কোনও কথা বলতে পারল না। মা একবার তাদের দিকে তাকিয়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল।

সৌমিত্র উঠে দাঁড়াল। ওর রং কালো। সামান্য একটু ভুঁড়ি হয়েছে। মুখটা খুব পুরুষালি, পরিষ্কার কামানো, কিন্তু ঠোঁট দুটো খুব নরম। খানিকটা মেয়েলি। খুব লম্বাও নয়। শম্পা ওর কাঁধ ছাড়িয়ে যায়।

সে বলল—আস্তে আস্তে, খুব নিচু গলায়—আমি বুঝতে পারিনি। আমাকে এবারের মতো মাফ করে দাও শম্পা, দেবে?

আর এই কথা শোনার সঙ্গে সঙ্গে শম্পার রক্তের মধ্যে শুরু হয়ে গেল রিমঝিম রিমঝিম রিমঝিম। কীসের টানে যে সে সৌমিত্রর দিকে এগিয়ে গেল স্বপ্নাচ্ছন্নের মতো সে জানে না। তার চোখ দিয়ে জল ঝরছে।

সৌমিত্র খুব ভয়ে ভয়ে আলতো করে তাকে ধরল, খুব দামি মুক্তো ধরার মতো রুমাল দিয়ে মুছিয়ে দিতে লাগল চোখের জল। খুব আস্তে বলল—এ ক’দিন কী ঝড় যে বয়ে গেছে আমার ওপর দিয়ে তা আমিই জানি। শম্পা, প্লিজ ডোন্ট মিসআন্ডারস্ট্যান্ড মি, এভার। হয়তো নিজেকে ঠিক বোঝাতে পারি না, বাট আই অলওয়েজ মীন ওয়েল।

শম্পার ভেতরে অনেক কথারা ভিড় করে আসছিল। সৌমিত্র, সৌমিত্র, তুমি কেন বিয়ের আগে দিঘা বেড়াতে যাবার প্রস্তাব দিলে? এটা তো আমেরিকা-ইয়োরোপ নয়, এখানকার একজন মেয়ে কী ভাবতে পারে এ কথা শুনলে? আমি ভুল বুঝেছি ঠিক আছে। কিন্তু তুমি কী বুঝেছিলে? আমাকে কী বুঝে, কী ভেবে তুমি …. তুমিও তো কিছু ইয়াংকি নও। তোমারও তো কিছু কিছু ইনহিবিশন থাকার কথা, সামাজিক, ব্যক্তিক। এ তো শুধু আমার ভুল বোঝা নয় সৌমিত্র, সমস্ত সমাজ, সমাজের সমস্ত মানুষ ভুল বুঝত। একবার যদি ভুল করে—লোভে পড়ে দিঘা চলে যেতুম, ফেরবার পর আমি আর এই শম্পা থাকতুম না, সারা পৃথিবীর মূল্যায়নে আমি একটা আলাদা শম্পা হয়ে যেতুম, হয়তো বা তোমার চোখেও … হয়তো কেন নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই…।

কিন্তু এত সব কথার একটাও বলতে পারল না সে৷ চোখ দিয়ে একটার পর একটা ফোঁটা গড়াতে লাগল। পেছনের ফোঁটাটা সামনের ফোঁটার সঙ্গে মিশে একটা অবাধ অনর্গল অশ্রুধারা তৈরি করতে লাগল।

শুধু যখন চূড়ান্ত বিচলিত সৌমিত্র ভয়ে ভয়ে বলল, শম্পা, এত কাঁদছ কেন? তোমাকে হার্ট করে আমি ভীষণ অনুতপ্ত, প্লিজ শম্পা … তখন সে কোনওমতে অশ্রুবিকৃত কণ্ঠে বলতে পারল—‘এরকম আর কখনও কোরো না। কখনও না।’


ডঃ রঞ্জন কার্লেকরের সঙ্গে অরিন্দম ঘোষের কথা হচ্ছিল। এখন ভোর ছটা। এই সময়টায় কার্লেকর কর্মমুক্ত থাকেন, হঠাৎ কোনও কঠিন ডেলিভারি কেস না এলে। এই সময়টায় তিনি তাঁর ছোট্ট বাগানে কাজ করেন। খুরপি দিয়ে গাছের গোড়ার মাটি কুপিয়ে দেওয়া, সার টার দেওয়া, জল দেওয়া এগুলো সব তিনি নিজেই করেন। একজন মালি আছে, সে দু সপ্তাহ পরপর এসে ঘাস ঘেঁটে দিয়ে, অন্য কিছু করবার থাকলে করে দিয়ে যায়। কিন্তু সেটা পাক্ষিক ব্যবস্থা। দৈনিকেরটা তিনি নিজেই করেন, যদি কোনও দিন পেশার কারণে করতে না পারেন তাঁর অস্বস্তি হয়। গাছগুলোও তাদের অভ্যস্ত পরিচর্যা না পেয়ে বোধহয় মনমরা থাকে। কিন্তু আর কারও থেকে কিছু আশা করে না।

কার্লেকরের স্ত্রী রম্ভা কার্লেকর নটার আগে ঘুম থেকে ওঠেন না। উঠে হাই-টাই তুলে আড়মোড়া-টোড়া ভেঙে তিনি বেড-টি খান। তারপর সংসারের কাজে লাগেন। রম্ভা ছিলেন রঞ্জনের ক্লাস ফেলো। তুমুল প্রেম করে দুজনের বিয়ে হয়েছে। রম্ভা উত্তর প্রদেশীয়, কিন্তু এমন ভাবে রঞ্জনের পরিবারের সঙ্গে মিশে গিয়েছিলেন যে কোনও তফাত বোঝা যেত না। রঞ্জনের পদবি কার্লেকর হলেও এঁরা আর মারাঠি নেই। বাপ-ঠাকুর্দা—তাঁর ঠাকুর্দা এই রকম বহু পুরুষ বাংলায় বাস করা মানুষদের মতো তাঁরাও বাঙালি হয়ে গিয়েছিলেন। রম্ভাকে কিন্তু প্রেমিকের পরিবারের বাঙালিয়ানা শিখতে হয়েছিল। রঞ্জনের কেরিয়ার ডিগ্রির অর্থে যখন তুঙ্গে, অর্থাৎ ইংল্যান্ডে এম.আর.সি.ও.জি করছেন তখন অন্য কোনও তরুণীর সঙ্গে রঞ্জন জড়িয়ে পড়ছেন বুঝে রম্ভা নিজের প্র্যাকটিস জলাঞ্জলি দিয়ে, লন্ডন পাড়ি দিয়েছিলেন। হয়তো তিনি যতটা উতলা হয়েছিলেন, ততটা কিছু হয়নি। কিন্তু সেই থেকে রঞ্জনকে চোখের আড়াল না করা তাঁর অভ্যাস হয়ে গেছে। প্র্যাকটিস করেন না। উপভোগ করেন জীবন এমনি অলসভাবে, ছেলেটি দুন স্কুলে পড়ে, মেয়েটি দার্জিলিং লোরেটোয়। রঞ্জন বহুবার বলেছেন তাঁর নার্সিংহোমে যোগ দিতে, কিন্তু রম্ভা ওসব দিকে আর যাননি। সুন্দরী রোগিণী দেখলেই তাঁর বুক কাঁপত। এখন একটা বিউটি পার্লার করেছেন। পার্লারের সঙ্গে আস্তে আস্তে যোগ করে চলেছেন হেলথ ক্লাব, কসমেটিক সার্জারি ইউনিট, কিন্তু দুপুরবেলা অর্থাৎ বারোটা থেকে চারটে কি বড় জোর পাঁচটার পর তিনি আবার বাড়িতে। সল্টলেকের এই বাড়ির অঙ্গসজ্জা তিনি কয়েকমাস পরপরই পাল্টে দেন। কেউ যদি গৃহসজ্জা নিয়ে তাঁর কাছে পরামর্শ নিতে আসে তাও তিনি সানন্দে দিয়ে থাকেন, সাহায্য করেন। কিন্তু সে অর্থে তিনি কোনও পেশার সঙ্গে জড়িয়ে পড়েননি। তাঁর মন সব সময়ে সতর্ক হয়ে থাকে রঞ্জনকে নিয়ে। তার যত্ন হচ্ছে কিনা, সে ঠিক সময়ে খাওয়া-দাওয়া-ব্যায়াম করছে কিনা, তার পোশাক-আশাক, তার গাড়ি, তার শোফার, তার নার্সিংহোমের স্টাফ, রাত্তিরে নিতান্ত দরকার না পড়লে তার বেরোনো বা না বেরোনো—এই সবেরই তিনি খোঁজ রাখেন। এক হিসেবে তিনিই রঞ্জনের জগতের মালকিন। রঞ্জন তাঁকে জানতে না দিয়ে তাঁর কিছু মনস্তাত্ত্বিক চিকিৎসা করিয়েছেন। ছেলে-মেয়েকে দূর স্কুলে পাঠাবারও তিনি পক্ষপাতী ছিলেন না। কিন্তু রম্ভাকে তাঁর বেছে নেওয়া জীবন যাত্রা ও সিদ্ধান্ত থেকে একচুল নড়ানো যায়নি।

ভোরবেলার বাগান। খুব সুন্দর ভোরালো হাওয়া দেয়। হাওয়ার মধ্যে মিশে থাকে স্বাস্থ্যের গন্ধ, গাছপালার এবং মানুষের। এ দিকটাও তো একটু খোলামেলা, অনেক নিয়মিত পদচর্চাকারী এই সময়ে তাঁর বাগানের পাশ দিয়ে চলে যান। হয় যাচ্ছেন, নয় ফিরছেন। তাঁদের সকাল আরও অনেক আগে হয়। কিন্তু ডঃ কার্লেকর বহু চেষ্টা করেও এর আগে বাগানে নামতে পারেন না। তাঁর অনেক রাত পর্যন্ত কাজে যায়, অনেক দিনই রাতে নার্সিংহোম থেকে কল আসে, নার্সিংহোমের কাজ সেরে এসে তিনি দেখেন উৎকণ্ঠিত রম্ভা ঘরবার করছে। রোগীর জন্যে, স্ত্রীর জন্যে এই ডবল উৎকণ্ঠায় তাঁকে সিডেটিভ খেতে হয়। এর আগে তিনি উঠতে পারেন না। তবে এই সময়টুকু তিনি একেবারে পরিপূর্ণ উপভোগ করেন। মনটাকে করে দেন সম্পূর্ণ চিন্তাশূন্য। চোখ থাকে গাছের মূলে, হাতে থাকে আদিম লোহার স্পর্শ আর চিরকালীন মাটির ছোঁয়া। শরীরের ত্বকে লাগে অলৌকিক ভোরের হাওয়া।

—ডঃ কার্লেকর!

প্রথমে শুনতে পেলেন না উনি। এত নিবিষ্ট ছিলেন।

—ডঃ কার্লেকর!

এবার তিনি মুখ তুলে আর একটি মুখ দেখলেন। বাগানের জাফরি কাটা গেটের ওধারে। বেশ চমৎকার চেহারার একটি যুবক। মানে, এমন চেহারার যে তাকে সমীহ না করে পারা যায় না। সে যুবকটি ডেকে সাড়া পেতেই অভ্যস্ত।

—হ্যাঁ বলুন।—কোনও রোগিণীর বিবরণ আশঙ্কা করেছিলেন তিনি। এ সময়ে তিনি কোনমতেই কোথাও যান না বলে হয়তো ছেলেটি প্রিয়জনের জন্য তাঁর কাছে ছুটে এসেছে।

কিন্তু তাঁর আশঙ্কা ও অনিচ্ছার কথা প্রকাশ করার আগেই ছেলেটি নমস্কার করে বলল—আমি অরিন্দম ঘোষ, সিঙ্গাপুর থেকে আসছি।

আশ্চর্য! ছেলেটি এমন করে বলল যেন সিঙ্গাপুরটা এই কয়েক ব্লক দূরে।

রঞ্জন কার্লেকর ততক্ষণে গেট খুলে দিয়েছেন। ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে ছেলেটিও বলেছে … অশেষ ধন্যবাদ।

—আমার বিয়ের ব্যাপারে আপনাকে একটু সাহায্য করতে হবে ডক্টর।

এমন কথা কার্লেকর কখনও শোনেননি। বিয়ের পরের ব্যাপারে তাঁর কাছে সাহায্যের জন্য অবশ্য লোককে আসতেই হয়, কিন্তু তিনি ঘটকালি তো কখনও করেননি!

—ঠিক এক সপ্তাহ পরে ফিরে যেতে হবে আমাকে। এর মধ্যে অন্তত রেজিস্ট্রেশনটা করে নিতে চাইছি। কিন্তু আমার হবু-পত্নী আমাকে বিয়ে করতে রাজি হচ্ছেন না, যদি আপনি আমাকে সাহায্য না করেন।

হতভম্ব হয়ে ছেলেটির দিকে চেয়ে রইলেন ডঃ কার্লেকর।

—মেয়েটির বন্ধু ওই অমৃতা নামের মেয়েটি, সে নিখোঁজ হয়েছে। যতদিন তার খোঁজ না পাওয়া যাচ্ছে …

—সে ক্ষেত্রে আপনাকে অপেক্ষা করতে হবে—এতক্ষণে ডাক্তার বলতে পারলেন।

—আর একটা কমপ্লিকেশনও আছে। অমৃতার স্বামীর নাম অরিসূদন, আমার নাম অরিন্দম, দুটোই অরি দিয়ে শুরু। সেইজন্য অরি নামের কলঙ্ক ঘোচাতে না পারলে মেয়েটি আমায় বিয়ে করতে চাইছে না।

—তা হলে বোধহয় আপনার এ বিয়েটা হচ্ছে না—বলেই ডঃ কার্লেকর আচমকা চুপ করে গেলেন।

অরিন্দম ঘোষ খুব আন্তরিক চোখে চেয়ে বলল—ওই লোকটাই কালপ্রিট, নয়? আমরা ঠিকই বুঝেছি।

—আমি আপনার সঙ্গে আর কথা বলব না।

—কিন্তু কেন ডঃ কার্লেকর? আমি তো পুলিশের কাছ থেকে খুব রিলায়েব্‌ল সোর্স থেকে জেনে এসেছি যে আপনি অমৃতার হোয়্যারঅ্যাবাউটস সম্পর্কে সঠিক সংবাদ ওদের দিয়েছেন। অমৃতা লিখিতভাবে তার স্বেচ্ছায় চলে যাবার কথা তাদের জানিয়েছে। মাঝখানের মিষ্ট্রিটাই খালি সল্‌ভ করতে পারছি না। কেনই বা অমৃতা নার্সিংহোমে গেল, আর অরিসূদন যদি নিজেই কোনও অপরাধ করে থাকে তাহলে কেন আপনাকে মারধর করল, আপনার অফিস ভাঙচুর করল! এফ. আই. আর. করল!

—হাতের শিকার ফসকে গেলে রাগে মারধর করতে পারে না?—ডঃ কার্লেকর ঠোঁটে ঠোঁট চেপে বললেন।

—শিকার? অরিসূদন অমৃতাকে খুন করতে চেয়েছিল?

—ষোলো সপ্তাহের প্রেগন্যান্সির পর একটা চূড়ান্ত অ্যানিমিক মেয়েকে এম. টি. পি. করতে আনলে তাকে খুন করার মতলব ছাড়া আর কী বলা যায়?

চোখ বড় বড় করে অরিন্দম বলল—আই সি, আই সি। একটু পরে বলল—তা হলে আপনিই ওকে নিরাপদ জায়গায় নিয়ে গিয়ে রেখেছেন।

—আমি কাউকে রাখিনি। নিরাপদ জায়গার চয়েসটা পেশেন্টের। আমি শুধু সাহায্য করেছি।

—কোথায় গেছে একটু যদি বলেন।

—কী করে জানব আপনি তার বন্ধু না শত্রু? কী করে জানব আপনি আর এক অরিসূদন নন!

—বাঃ সেদিন অতজন ওর বন্ধুর সঙ্গে আপনার কাছে গেলাম।

—বন্ধুদের হয়তো বুঝিয়েছেন আপনিও বন্ধু, আসলে …

—আমি তো সিঙ্গাপুরে থাকি। জাস্ট বিয়ে পাকা করতে এসে এই ঝামেলায় পড়ে গেছি। আমি এসবের বিন্দুবিসর্গও জানি না। অমৃতাকে চিনিই না।

—আপনি তো অদ্ভূত লোক!

—সেটা অবশ্য ঠিক, অরিন্দম বলল—কোনও জিনিসের শেষ না দেখে আমি ছাড়ি না। তা ছাড়া লাবণির যদি সত্যি অরি নামে ঘেন্না এসে যায়, সত্যিই যদি তার অমৃতার নিরুদ্দেশের কিনারা না হলে বিয়ে করতে ভয় হয় বা অনিচ্ছা হয়, সেটা তো স্বাভাবিক মানবিক রি-অ্যাক্‌শন! আই অ্যাপ্রিশিয়েট হার কনসার্ন। মেয়েটা যে মানুষ সেটা প্রমাণ করেছে আমার কাছে … আজকাল এইগুলো কিন্তু মানুষের মধ্যে দেখা যায় না বড় একটা।

—দেখুন যত কথাই আপনি বলুন, পেশেন্টের ঠিকানা আমি আপনাকে বলছি না। ওরা কেস করেছে, পেশেন্টকে আমি অসাবধানে মেরে ফেলে ভয়ে কোথাও পাচার করে দিয়েছি। ঠিক সময়ে কোর্টে হাজির করে সব ফাঁস করে দেব। পেশেন্টের ঠিকানা যতই লোক জানাজানি হয়ে যাবে, ওরা ঠিক খবর পাবে, পিছিয়ে যাবে।

—সেক্ষেত্রে আপনি কেস করবেন, অমৃতা কেস করবে। আমরা আপনাকে সাহায্য করব।

—আপনি কীভাবে সাহায্য করবেন, আপনি তো সিঙ্গাপুরে …

—সে ব্যবস্থা হয়ে যাবে। এখানেও ওদের ব্রাঞ্চ আছে। তেমন হলে চাকরি ছেড়ে দেব। তাই বলে অরিসূদন গোস্বামীকে ছাড়ব না। সে আমার নামে কালি ছিটিয়েছে। শুনুন ডক্টর, আমাকে ওরা কেউ চেনে না, ফলো-টলো করবে না। আমি অমৃতার কাছে যাব, প্লিজ ঠিকানাটা বলুন, আর ওকে আমার পরিচয় দিয়ে একটা ফোন করে দিন।

১০
ভোর থেকে সকাল হচ্ছে। আলোটা অস্ফুট, আচ্ছন্ন ছিল, এখন স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।

শিবানী দত্তর কাজের মেয়ে দরজা থেকে চেঁচিয়ে বলল—মা, একজন ভদ্রলোক আপনার সঙ্গে দেখা করতে চাইছেন।

—বলে দে আমার ফিনাইল লাগবে না,—একটা কণ্ঠ ভেসে এল।

—জ্যাম আছে? জ্যাম—মেয়েটি বলল।

—জ্যামও লাগবে না—আবার তীক্ষ্ণ কণ্ঠ ভেসে এল।

—আপনাদের বাড়িতে বুঝি বসবার ঘর নেই? — ভদ্রলোক বললেন।

—কেন থাকবে না? অচেনা অজানা লোককে … বলতে বলতে মেয়েটি থেমে গেল। শিবানী সবে চান করে একটা কালো নকশা পাড় শাড়ি পরেছেন। তাঁর কাঁচাপাকা ভিজে চুল গিঁট দিয়ে পিঠে ফেলা। হাতে একটা ঝোলানো পাত্র।

—তাড়াতাড়ি দুধটা নিয়ে আয় কমলি৷ পাত্রটা নিয়ে কমলি বেরিয়ে গেলে, তিনি অরিন্দমের দিকে চেয়ে বললেন—এত সকালে? আপনাকে তো ঠিক?

—কেন? ডঃ কার্লেকর ফোন করেননি?

—ও, এক্ষুনি আসবেন আমি ভাবিনি। আপনাকে দোতলায় আসতে হবে।

দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে শিবানী উঠোন পেরিয়ে ঘরের পাশের সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে বললেন, আসুন, একটা অভিজ্ঞতা বটে!

—কার?

—ওর তো বটেই। আমারও, আমাদেরও। শুনুন, ও কিন্তু একটা ভীষণ ট্রমার মধ্যে দিয়ে গেছে। শরীরটাও খুব খারাপ। আপনাকে সাবধানে কথা বলতে হবে।

অমৃতা যে কেন ডঃ কার্লেকরকে জয়িতাদির নাম ঠিকানা বলেছিল সে জানে না। এইরকম চূড়ান্ত সময়গুলোতে বোধহয় মানুষের আস্থা, বিশ্বাস, ভালবাসা, এইসবের পরীক্ষা হয়ে যায়। কিন্তু সল্টলেকের দিকে খানিকটা এগোতেই তার মনে হল—এ সে কী করছে। ক্লাসের বাইরে জয়িতাদির সঙ্গে তার কী সম্বন্ধ। এইরকম বিপন্ন অবস্থায় তাঁর কাছে গেলে তো তাঁকে বিব্রত করা ছাড়া আর কিছুই হবে না। তখন সে ডক্টর কার্লেকরকে সম্পদদের বাড়িতে ডোভার লেনে নিয়ে যেতে বলে।

ডঃ কার্লেকর বলেছিলেন—মন ঠিক করো অমৃতা। ইনি নির্ভরযোগ্য তো! অমৃতার মনে পড়ল তারা রমণী চ্যাটার্জিতে আসার পর কেমন করে দুধের বুথে শিবানী মাসির সঙ্গে তার আলাপ হয়ে যায়। বিধবা, একটি ছেলে নিয়ে একা থাকেন। তারপর সম্পদের সঙ্গে কী ভাব! দুজনকে আলাদা করা যেত না। সম্পদের মা হয়তো অমৃতা সম্পর্কে কোনও আশাও মনে পোষণ করে থাকতেন। কিন্তু সম্পদ কানপুরে চলে যাওয়ার পরই যোগাযোগটা কমে যেতে থাকে। একদিন সম্পদের কাছ থেকে একটা চিঠি পেল অমৃতা।

প্রিয় অমৃতা,

দারুণ আছি। এনজয়িং লাইফ। খুব চনমনে একটা জীবন। তোরা সেই ম্যাদামারা ইউনিভার্সিটিগুলোতে পড়ে এই দারুণ ক্যামপাস লাইফটা মিস করলি। আমাদের এখানে মেয়েরাও পড়ে জানিস নিশ্চয়। একটা সাউথ ইন্ডিয়ান মেয়ে নাম তটিনী আয়েঙ্গার, খুব আমার পেছনে ঘুরছে। কী করি বল তো! ঝুলে পড়ব? সাউথ ইন্ডিয়ান মানে কিন্তু সেই রাজীব গান্ধীর খুনী ধানু মেয়েটার মতো মনে করিসনি। তটিনী রীতিমতো চার্মিং। আমি ওর অ্যাটেনশন উপভোগ করি। কিন্তু এখনও প্রেম-প্রেম ভাব হয়নি। অন গড। পরামর্শ দিস।

ইতি সম্পদ।

সম্পদের সম্পর্কে ওভাবে কোনওদিনই ভাবেনি অমৃতা। কিন্তু শিবানী মাসির আশার কথা সে বুঝতে পারত। যৌবনে বিধবা, একটিমাত্র ছেলে, এমন পূত্রবধূ চান যাকে চেনেন, জানেন। সহজেই ভালবাসার বিনিময় করতে পারবেন। কিন্তু সম্পদ তো প্রথমত তার একবয়সী বলেই তাকে ভাইয়ের মতো দেখতে অভ্যস্ত ছিল সে, তারওপর এই চিঠিই বলে দিল সম্পদেরও তার প্রতি সেরকম কোনও মনোভাব নেই। তবু শিবানী মাসির সঙ্গে তার যোগাযোগ ছিন্ন হয়নি। মাসি ভীষণ শক্ত মানুষ। মনের জোর সাঙ্ঘাতিক। সেইজন্যে ভীষণ খিদের মুখে সে যেন ঘুমের মধ্যে হাঁটতে হাঁটতে শিবানীমাসির কাছে পৌঁছে গেছিল।

কথায় কথায় মাসিও তার অনেক কথা জেনে গিয়েছিলেন। মা শুনলে হয়তো ভয়ে কেঁদে কেটে অজ্ঞান হয়ে যেতেন, মাসির এক চোখে আগুন আর এক চোখে জল৷ মাসি বলেছিলেন—অমি, তুই তো এরকম বোকা ভালমানুষ কোনওদিন ছিলি না! গোড়ার থেকে প্রতিবাদ করিসনি কেন, তোর বরকে বলবি তো, পড়াশোনা চালিয়ে এত কাজ আমি করতে পারছি না, বলবি তো তোর খাওয়া-দাওয়াও ঠিক মতো হচ্ছে না!

—মাসি পারিনি, আমার একটা আত্মসম্মানবোধ আছে, হয়তো এটাই ইগো। আমি এটাকে একটা চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছিলাম। আর গোড়ার থেকেই ওঁরা এমন বলতেন—ঘটির মেয়ে, দেখো এক ঘটি জল গড়িয়ে খায় কি না।

—এখনও বাঙাল-ঘটি! পঞ্চাশ বছর পরেও? তা তোর বরকে তোর খাওয়া-দাওয়ার অসুবিধের কথা বলেছিলি?

—মাসি, তুমি পারতে?

—আমাদের জেনারেশন আর তোদের জেনারেশন?

—এটা তোমাদের ভুল ধারণা। খাওয়া-দাওয়া বিষয়ে বেশিরভাগ মেয়েই এখনও লাজুক।

—লাজুক না কি অভিমানী?

—যা বলো। সকালে যাই হোক, রাত্রে তো একই সঙ্গে খেতে বসি। সবাইকার পাতে যা থাকে, আমার পাতে তার অনেকগুলোই থাকে না। ও দেখতে পায় না?

—আচ্ছা, তুই এখন ভাল করে খা। অনেক পুরুষই এগুলো জানে না। ওদের মাথায় আসে না।

—তা হলে আমরা যে অত যত্ন করে ওদের খাবার বেড়ে দিই, পছন্দসই রাঁধবার চেষ্টা করি এগুলো … অল দিজ আর টেক্‌ন ফর গ্রান্টেড?

—ঠিক ওই কথাই আমি বলতে চাইছিলাম। টেক্‌ন ফর গ্রান্টেড, বউ কি খেল না খেল নজর করলে পুরুষের পৌরুষ চলে যেত।

—যে-ত। এখনও কি যায়?

—অভ্যেস যে মা। বহু বহু যুগের অভ্যেস, মাথার মধ্যে বাসা বেঁধে আছে।

—আমি মানতে পারছি না মাসি।

—বেশ তো মানতে না পেরে কী-ই বা করবি। কী করতে পেরেছিস বল? কর না কিছু? বাঁচি তো তা হলে।

মাসি থাকেন একদম একা। ডোভার লেনের ওপর দোতলা বাড়ি। নীচে দুটো ঘর আর রান্নাঘর। ওপরেও তিনটে। একটু বারান্দা। পেছনের দিকে। আর ছাদ। মাসির কাছে সে নিরাপদ আশ্রয় পাবেই। ডঃ কার্লেকরকে নিয়ে সেই শেষ রাতে যখন সে মাসির দরজার সামনে দাঁড়িয়ে সমস্ত ব্যাপারটার আকস্মিকতায়, রহস্যে ভয়ে ঠকঠক করে কাঁপছিল, ‘মাসি!’ সে গলা চিরে ডেকেছিল। ‘কে রে?’ উনি বললেন, ‘অমি?—ওমা তুই এখন? কোনও বিপদ-আপদ? উনি কে? জামাই না কি?’

—আমি ডাক্তার। একটু ভেতরে ঢুকতে দিন, আমার হাতে বেশি সময় নেই।’

সব খুলে বলে, নিরাপত্তা আর গোপনতার ব্যবস্থা ষোলো আনা করে উনি চলে গেলে প্রথম ফোনটা সে মা-বাবাকেই করেছিল। বলেই দিয়েছিল যেতে পারবে না, বেশিবার ফোন করতেও পারবে না। ওঁরা যেন না ভাবেন।

অবশ্য অনেক পরে দ্বিতীয় ফোনটা অনেক ভাবনা-চিন্তার পর করে ডঃ জয়িতা বাগচিকে।

—কে বললে? অমৃতা? তুমি না নিরুদ্দেশ হয়ে গিয়েছিলে?

সব শুনে বললেন—ইস্‌ লোকটাকে মারতে পারলে না, টেনে একটা চড়? হ্যাঁ, অবশ্যই সাহায্য করব। পরীক্ষা তুমি দেবেই। এ বছরেই। হ্যাঁ সিক বেড-এ হলেও।

আত্মগত সে বলে—ব্যস এইটুকুই চাই জয়তীদি। আবার কী? আর কিছু আপনাকে করতে হবে না।

একমাত্র উঁচু পাঁচিল দেওয়া ছাদটাতে বেড়াতে পারে অমৃতা। দূরদর্শনে নিরুদ্দিষ্ট বলে তার ছবি দেখানো হয়েছে। এ পাড়ার অনেকে তাকে চেনেও। শিবানীর সঙ্গে তারাও আলোচনা করে মাঝে মাঝে। অনেক রকম শুনি বটে, কাগজেও পড়ি। কিন্তু সাক্ষাৎ আমাদের পাড়ার মেয়ে। ছোট্ট থেকে যাকে দেখছি তার এমন হতে পারে? ডাক্তারটাই বোধহয়…

তখন রুক্ষস্বরে শিবানী বলেন—তোমরা কোনও কিছু তলিয়ে ভাববার চেষ্টা করো না কেন বলো তো? ডাক্তারের স্বার্থ কী?

—ওর শ্বশুরবাড়িরই বা কী স্বার্থ?

—আমি জানি না। কিন্তু বধূহত্যা-টত্যা কি শোননি? সেগুলো তো শ্বশুরবাড়িই করে? স্বামী, দেওর, শাশুড়ি, শ্বশুর…

—হত্যাই যদি করবে তো নামী নার্সিংহোমে নিয়ে গেল কেন?

—দেখো পুলিশে কী বলে?

ছাদে বেড়িয়ে বেড়িয়ে সে থার্ড পেপার মুখস্থ করছিল। নিজেরই লেখা, তবু মুখস্থ করতে হয়।

এখন তার শরীরে বেশ ভালমতো গর্ভলক্ষণ দেখা দিয়েছে। কিন্তু তার ফর্সা রঙে এখন লালচে আভা। শরীর একটু ভারী হয়েছে। হনহন করে হাঁটতে তার একটু অসুবিধে হয়। কিন্তু অন্যসব দিক দিয়েই শরীর সুস্থ। অন্যদের যা-যা হয় বলে সে শুনেছে তার কিছুই তার হয় না। বমি নয়, ব্যথা নয়, খাদ্যে অরুচি নয়। খালি অড়হর বা মটর ডালের গন্ধটা সে সহ্য করতে পারে না। আর কোকিল ডাকলেই সে কানে আঙুল দেয়। অর্থাৎ একটি শব্দ, একটি গন্ধ। বাকি পৃথিবীর রূপরস তার ওপর অত্যাচার করে না মোটেই।

শিবানীমাসি ছাদেই উঠে এলেন অরিন্দম ঘোষকে নিয়ে। সে থতমত খেয়ে গেল।

পাঁচ মাসের গর্ভিণী লম্বা দোহারা মেয়েটির দিকে তাকিয়ে অরিন্দমের বাক্‌রোধ হয়ে গেল। এ মেয়ের চোখমুখ চলাফেরা সবই নির্ভুলভাবে জানিয়ে দিচ্ছে এ একজন ব্যক্তি, নরম, মধুর। কিন্তু প্রয়োজনে রুক্ষ হতে পারে। সে শুনেছিল গর্ভসঞ্চারে মেয়েরা সুন্দর হয়। বিশ্বাস করেনি, কেন না দেখেনি কখনও। তার থেকে সাত বছরের ছোট বোন যখন মায়ের গর্ভে তখন পেট উঁচু, চোখ বসা মাকে দেখে তার কেমন গা ঘিন-ঘিন করত। নিজের কাছেই নিজে লজ্জা পেত অবশ্য। গর্ভ, অবাঞ্ছিত গর্ভ তার ওপরে, এ মেয়েটিকে কী যে শ্ৰী কী যে মহিমা দিয়েছে! এ যেন সেই ইম্যাকুলেট কনসেপশনের মেরি। ত্বক কী মসৃণ, চুল যেন ঝলমল করছে। মুখেচোখে একটা নরম আলো, খুব মনোযোগে এমনটা হয়। ওকে দেখে মনে হচ্ছে, যে কাজটা এখন করছে, পড়া, সেটা ছাড়া আর সমস্ত কিছু, গোটা বিশ্বটাই ও ভুলে গেছে। ট্রমা? ও বোধহয় ওর অনতিঅতীত জীবন এবং জীবনসংশয়ের কথা সম্পূর্ণ ভুলে গেছে।

—নমস্কার, আমি আপনার বন্ধুদের পক্ষ থেকে আপনাকে দেখতে এসেছি। ডঃ কার্লেকর অনুমতি দিয়েছেন।

—বন্ধু? কে বন্ধু? অমৃতা অবাক হয়ে বলল…

—ওরা মানে দোলা, তিলক, নিলয়, লাবণি—এরা সবাই আপনাকে খুব খোঁজাখুঁজি করছে। ভী-ষণ মনখারাপ ওদের, ভয়ও।

—ও! অমৃতার চোখ দুটো অন্যমনস্ক হয়ে গেল। একটু পরে বলল—আপনি কে? গোয়েন্দা? সত্যান্বেষী?

—এগজ্যাক্টলি। ওই শেষেরটা যেটা বললেন।

—ওরা কি আপনাকে অ্যাপয়েন্ট করেছে?

—অনেকটা তাই। মানে আমি নিজেও আগ্রহী। আপনি যদি বন্ধুদের বা মা-বাবাকে কোনও চিঠি দিতে চান, আমি পৌঁছে দেব।

—আমার মা-বাবাকে আপনি চেনেন?

—চিনে নিতে হয় একজন সত্যান্বেষীকে।

—ওঁদের কাছ থেকেই কি আমার ঠিকানা পেলেন?

—না, না। ওঁরা আপনার বিনা অনুমতিতে ঠিকানা দেবেনই না। কিন্তু ওঁদের বডি ল্যাঙ্গুয়েজ আমাকে জানিয়ে দেয় আপনি বেঁচে আছেন, ভাল আছেন। ডঃ কার্লেকরই আপনার ঠিকানা দিয়েছেন।

—তা এখন? এখন আপনি কী করবেন? ওদের সব বলে দেবেন?

—নাঃ, সেটা করা যাবে না। ডাক্তারের বারণ আছে, আমি শুধু ওদের একটু নিশ্চিন্ত করে দেব। কেসটির জন্য অপেক্ষা করতে বলে দেব। আর…

—আর?

—আর সিঙ্গাপুরে ফিরে যাব।

—রিপোর্ট করবেন?

—কাকে?

—আপনার বস্‌কে?

—হ্যাঁ সে তো করতেই হবে, কিন্তু অমৃতা গোস্বামীর নিরুদ্দেশের বিষয়ে না। আমার কোনও ডিটেক্টিভ এজেন্সি নেই। আমি তো একটা এঞ্জিনিয়ার। সিঙ্গাপুরে কাজ করি। ছুটিতে এসেছিলাম। একটু সত্যান্বেষণ করে গেলাম।

—আপনার নাম?

—নাম জেনে আপনার কী লাভ? ঘোষ আমি ঘোষ একজন।

বলতে বলতে অরিন্দম তাড়াতাড়ি পেছন ফিরল। যেন পালাতে পারলে বাঁচে।

১১
আকাশের রং যে এমন মন-কেমনিয়া হতে পারে, বাতাসের স্পর্শ যে এমন শিহরন-জাগানিয়া হতে পারে, গাছের পাতাদের নড়ায়-চড়ায় যে এমন আসঙ্গ কামনা ভেতর থেকে উঠে আসতে পারে, খাদ্যের স্বাদ যে এতটা চমৎকার হতে পারে, সারা দিনরাত যে এমন প্রতীক্ষাময় হতে পারে, পৃথিবীর সব মানুষ যে অমন মোছা-মোছা জলরঙের ছবি হয়ে যেতে পারে, মা-বাবা যে অমন অচেনা অন্যলোক হয়ে যেতে পারে, দোলা কোনওদিন কল্পনাও করেনি।

সে চুপিচুপি একটা সোয়েটার বুনছে। আসলে দুটো বুনছে। একটা প্রকৃত বোনা, আর একটা ক্যামোফ্লাজ। দেখাচ্ছে বাপির জন্য বুনছে একটা রাস্ট কালারের পুলোভার, কিন্তু আসলে বুনছে দুটো। যাতে কেউ বুঝতে না পারে। সবার সামনেই নিশ্চিন্ত মনে একটাতে জোড়াসাপ বুনতে থাকে সে। মায়ের অবশ্য নজর খুব। ‘কী রে? কালকে আর্ম-পিট অবধি এসে গিয়েছিলি না? আবার ভুল করেছিস বুঝি?’

—হ্যাঁ মা, দোলা নির্বিচারে মিথ্যা বলে। আর্ম-পিট অবধি যেটা হয়ে গেছে সেটা ওর, এটা বাপির। এখন বর্ষা পড়ে না গেলেও মাঝেমধ্যেই বৃষ্টি হচ্ছে। কিন্তু সোয়েটার দুটো সে শুরু করেছে ঘোর গ্রীষ্মে। যখন পশম হাতে করলেই মনে হয় একবার বরফজলে হাতটা ডুবিয়ে আসি। এখন অবশ্য বৃষ্টি নামছে। ‘আমি তখন ছিলেম মগন গহন ঘুমের ঘোরে যখন বৃষ্টি নামল।’ তার সারা দেহ জুড়ে বৃষ্টি। কামনার স্বেদ-এর সঙ্গে গ্রীষ্মের ঘাম, বর্ষার রাঙা জল বাইরে থেকে তফাত করা যায় না। কিন্তু এ সেই কামনার স্বেদ, কামনার রোমাঞ্চ যার কথা জয়দেবরা বলে গিয়েছিলেন। পদকর্তারা বলে গিয়েছিলেন। এ-কি মানুষের জন্য? না দেবতার জন্য? বোঝা দায়। দোলা আগে জানত না দেবতা হয়, বিশ্বাসই করত না। কিন্তু এখন জানে, হয়, একটা মানুষের দেবতা। সব মানুষের অবশ্য হয় না। হাতে-গোনা যে কয়েকজনের হয় তাদের মধ্যে দোলন একজন। কখনও সে মেট্রোর সিঁড়ি ভেঙে নেমে আসে, কখনও নন্দন চত্বরে ফোয়ারার পাশ থেকে ঈষৎ সিক্ত অবস্থায় বেরিয়ে আসে। কখনও বা সিনেমা হলের অন্ধকারের অন্তরালে গাঢ় আকার নেয়, কখনও ভিক্টোরিয়া কি মিউজিয়ামের থামের আড়ালে একটা অদ্ভূত অভ্যন্তরীণ নেশা লাগানো স্বাদ-গন্ধঅলা চুম্বন হয়ে নেমে আসে। দোলার অন্তর্বাস ভিজে যায়। এই ভেজায় কী অস্বস্তি। কিন্তু কী অপার্থিব আনন্দ!

দোলার চেহারার মধ্যে আগে একটা বালিকা-বালিকা ভাব ছিল। এমন বালিকা, বড়রা দেখলেই যাঁদের গালে টুস্কি মেরে বলে কী রে কোন ক্লাস হল? কিন্তু আসলে বলতে চায় কী রে কত বড় হলি? কিন্তু সেই বালিকা-ভাবটা মুছে না গেলেও দোলার মধ্যে এমন একটা তরুণীত্ব, সময়ে সময়ে যুবতীত্ব এসে গেছে, যে অনেক মানুষের কামনার ধন। কী যে একটা অধরা লাবণি তার অঙ্গে অঙ্গে বয়ে যায়। মেয়েবন্ধুরা বলে—যত দিন যাচ্ছে কী সুন্দর যে হচ্ছিস দোলা! কী মাখিস রে?

—কী আবার মাখব? চিরকাল যা মাখি। মনে মনে অবশ্য সে জানে মেখেছে, সে প্রেম মেখেছে।

ছেলেবন্ধুদের অনেকে বলে—দোলা তোকে কি ফ্যানটাসটিক লাগছে রে, কোথায় লাগে প্রীতি জিনটা, কোথায় লাগে আমিশা পটেল-ফটেল, রানি মুখার্জি-টুখার্জি!

ছবি তোলো, ভাল অ্যাঙ্গল থেকে, যত্ন করে কমপোজ করে— এ লাবণ্যের ছবি কিন্তু উঠবে না। এ এক অলৌকিক অশরীরী লাবণ্য। তিশান তো একদিন বলেই ফেলল— কিরে দোলা আমার সঙ্গে একদিন ডেট করবি নাকি? আইসক্রিমের বেশি কিছু খাওয়াতে পারব না কিন্তু।

দোলা বলল—দুটো আইসক্রিম তুই একাই খেগে যা, একটা আমার কথা ভেবে ভেবে খাবি।

দোলার দিদি ঝুলন বলে—মা, দোলার সেই বয়সটা এসেছে, যে বয়সে বিয়ে দিতে হয়।

মা বলে—সাত বুড়ির এক বুড়ি হয়েছিস তুই।

লজ্জা পেয়ে ঝুলন বলে—সত্যি মা, খেয়াল কোরো।

—কেন, এত সুন্দর সময়টা ও যদি মা-বাবার আশ্রয়ে থেকে জীবনটা সত্যিকার উপভোগ করে তাতে তোর আপত্তি কেন? কীরে দোল বল কিছু?

দোলা লজ্জা পেয়ে বলে—তাই তো!

ঝুলন বলে—আমাদের হাতে খুব ভাল একটা পাত্র আছে মা, যেমন দেখতে ভাল, তেমনই ভাল ছেলে, নেহাৎ অল্পবয়স তাই হয়তো পার্থর মতো অতটা এস্টাবলিশড না। কিন্তু হবে, আস্তে আস্তে হবে।

দোলার বুকের ভেতরটা ধড়াস ধড়াস করতে থাকে—এই বুঝি, এই বুঝি—তার নামটা করল দিদি।

—কেমন ছেলে, শুনি?

—সুপ্রতিম রায়চৌধুরী ওদের কলিগ, জুনিয়র এগজিকিউটিভ হয়ে যোগ দিয়েছে। আমার তো ভীষণ পছন্দ।

দোলা বলে ওঠে, তোর পছন্দ যদি তো তুইই বিয়ে করগে যা না। ভীষণ রাগ হয়ে যায় তার। অমন একটা জ্বলজ্বলে মানুষ রিলিফ ম্যাপের মতো বহুলোকের চ্যাপ্টা পশ্চাৎপটে উঁচু-উঁচু হয়ে রয়েছে, অথচ ওদের চোখে পড়ে না? সে অবশ্য এখনও জানে না পার্থদার সঙ্গে ওর সম্পর্কটা ঠিক কী! পার্থদার ও দূরসম্পর্কের তুতো ভাইয়ের কাজিন না কী। ঠিক আছে তা না-ই হল, তাহলে পার্থদাদের অফিসের ডিনার-পার্টিতে এসেছিল কেন? এত কথা জিজ্ঞেস করেছে ওকে, এ কথাটা কখনও জিজ্ঞেস করেনি। ‘পার্থদা আপনার কে হন?’ এরকম একটা প্রশ্ন করে জবাব শুনেছিল ‘ও পার্থদার কেউ বুঝি হতেই হবে? নইলে আমার সঙ্গে মিশবে না?’ দোলাকে অপ্রস্তুত দেখে অবশ্য সঙ্গে সঙ্গে সম্পর্কটা ব্যাখ্যাও করে দিয়েছিল। পার্থদার অফিসের একজনের সঙ্গে ওর সম্পর্ক। খুড়তুত শালা। বাব্বাঃ এইসব খুড়তুতো জ্যাঠতুতো পিসতুতো মাসতুতো বড্ড গুলিয়ে যায় দোলার। ওর ভাবখানা হল : আমি অমিতাভ। আমার নামের আগে-পিছে কিছু নেই। অতীত অবশ্যই আছে, কিন্তু তাকে তো ফেলে এসেছি! ভবিষ্যৎ? যখন আসবে, তখন আসবে। এখন, এই মুহূর্তটুকুকে এই মুহূর্তেই উপভোগ করে ফেলো, রোমন্থন করবার জন্য যেন ফেলে রেখে দিও না। দিলে শেষ পর্যন্ত পস্তাবে।

—অমিত, তোমার বাবা-মা মানে ফ্যামিলির কথা একদম বলো না—সে অনুযোগ করে।

অমিতের জবাব আসে সঙ্গে সঙ্গে—তাহলে আমার বাবা-মা মানে ফ্যামিলির সঙ্গেই তোমার ডেট করতে হয়! করবে? বলো! আমি সরে যাই।

—আহা! কী কথার কী উত্তর। বন্ধুদের বাবা-মা’দের বিষয়ে বুঝি জানতে ইচ্ছে হয় না! আমার বাপি-মা-দিদিকে আমি ভীষণ ভালবাসি। আমার যত বন্ধু আছে, সবাইকার বাবা-মা’কে আমি চিনি, ওঁরাও আমাকে ভীষণ ভালবাসেন…

—আচ্ছা দোলা, তোমাদের মেয়েদের এই ভীষ্‌ষণ ভালবাসাটা খুব খুব সস্তা, না? খু-উ-ব ইজি!

আহত হয় দোলা, অভিমানে মুখ ফিরিয়ে নেয় সে।

—ডোন্ট বি হার্ট প্লিজ! বি প্র্যাক্টিক্যাল। বন্ধুদের সঙ্গে তোমার বন্ধুত্ব কেন? একসঙ্গে পড়েছ বলে৷ আজ থেকে দশ বছর পরে কে কোথায় থাকবে তার কিন্তু কোনও ঠিক নেই। হয়তো শপিং করতে গিয়ে একজন পিসিমা মতো মহিলাকে দেখে বলবে…আরে! লাবণি না? কী মুটিয়েছিস রে! কিংবা তোমার হট ফেভারিট নিলয় চন্দরকে তোমার দিকে এগিয়ে আসতে দেখে তুমি বিরক্ত হয়ে পেভমেন্ট বদলই করে ফেলবে, কেননা দাড়ি-না-কামানো উড়োখুড়ো চুল এই লোকটাকে তুমি আদৌ চেনো না।

—কেন? কেন? নিলয় কেন অমন হবে? বেশ তো!

—আরে বাংলায় এম.এ পাস করে আজকালকার দিনে একটা ছেলের চাকরি জোটানো কী অসম্ভব তা জানো? কী করবে ও? টুইশানি। সারাটা জীবন ট্যুইশানি করে কাটিয়ে দেবে। তা ওর দাড়ি কামানো থাকবে না তো কার থাকবে না?

—এ ধরনের অ্যাসাম্পশন কিন্তু খুব বাজে যাই বল। হার্টলেস।

—আরে বাবা, হার্ট-ফার্টের ব্যাপারই এ নয়। প্লেইন অ্যান্ড সিম্পল ট্রুথ।

—আর লাবণি? লাবণি কেন পিসিমা হয়ে যাবে? তুমি ওকে দেখেছ?

—জানতে হলে দেখতে হয় না। দেখতে হয় না, জি.কে অ্যাবাউট লাইফ মেন অ্যান্ড উইমেন দিয়েই হয়ে যায়। জি.কে অর্থাৎ জেনার্‌ল নলেজ বলে নাইনটি নাইন পার্সেন্ট মেয়ের বিয়ের দু-এক বছর পরেই বাচ্চা হয়, তার পরেই জমে মেটারনিটি ফ্যাট, পেটে, কাঁধে, বিশেষ করে আরও আরও প্রত্যঙ্গে, মুখচোখ অতি পরিশ্রমে-দুশ্চিন্তায় কালি-কালি হয়ে যায়। প্রেগন্যান্সির সময়ে চুল উঠে টিকটিকির ল্যাজ হয়, নয় টাক পড়ে যায়। তো তারপরেও একটা মেয়েকে পিসি-মাসি দেখানোটা এত কী আশ্চর্যের হল?

—মোটেই না, মোটেই এরকম আজকাল হয় না, সবার হয় না, এখন সবাই বিউটি-কনশাস, ফিগার-কনশাস। তা ছাড়া, আলাদা করে লাবণির কথাই যদি বলতে হয় তো ও তো সিঙ্গাপুর যাচ্ছে বিয়ের পর।

—সিঙ্গাপুরে তাহলে লোকের বাচ্চা-কাচ্চা হয় না, বলছ! ওখানে তো ওকে আরও খাটতে হবে। আরও কালি পড়বে চোখে। সিঙ্গাপুর তো শিশু, খোদ আমেরিকার নিউ ইয়র্ক, ওয়াশিংটন ডি.সি-তে তো আর যাওনি। ওফ্ফ্ কিছু মোটা দেখেছি বাবা ওখানে। অত মোটা মহিলা আর তুমি কোত্থাও পাবে না।

—নিউ ইয়র্কে? ওয়াশিংটনে? অবিশ্বাসের গলায় দোলা বলে—যাঃ। কী ভাঁওতা তুমি কাকে দিচ্ছ বলো তো? যাদের দেশে জিম আর এরোবিক্স আর হেলথ ক্লাবের ছড়াছড়ি, মিস ইউনিভার্স প্রতিযোগিতা হয় যাদের দেশে…

—মিস ফ্যাটিয়েস্ট প্রতিযোগিতাটাও ওরা করলে পারে, প্রতোক বছর ওরাই ক্রাউনটা পাবে।

ব্যাস, অমিতের বাবা-মা, তার ভাই-বোন আছে কিনা, থাকলে তারা কী রকম, কে কী করে, অমিতের ব্যক্তিগত জীবন এ সমস্ত প্রসঙ্গই এই ধরনের তরল হাসাহাসি, তর্কাতর্কিতে চাপা পড়ে যায়। তারপর থাকে কোনও রেস্তোরাঁর মৃদু আলো, কোনও সিনেমাহলের অন্ধকার। সাধারণত হল অন্ধকার হয়ে যাবার পরই ওরা ঢোকে। অন্ধকারে দুটো হাত লতার মতো পরস্পরকে জড়িয়ে থাকে, একটা বড় হাত, ছোট হাতকে চাপ দেয়, ছোট হাতের পাতা বড় হাতের পাতাকে চিমটি কাটে ; অন্ধকারে অদ্ভূত অদৃষ্ট অশব্দ কায়দায় চুম্বন-বিনিময় হয়, হাতে হাত, পায়ে পা, গায়ে গা, সেই উদ্‌ভ্রান্ত শরীরী অভিজ্ঞতার সময়ে কিছু মনে হওয়া সম্ভবই নয়। বাইরে বেরিয়েও আসে ওরা শো ভাঙবার বেশ আগে, জনস্রোতে যদি চেনা কারও সঙ্গে দেখা হয়ে যায়! কী ছিল? কী ছিল ছবিটা? যাঃ কেউ জানে না। দোলার চোখে লজ্জা জড়িয়ে থাকে, ওর চোখে গাঢ়, গাঢ় প্রেম। অন্যদিকে যেন চোখ সরাতেই পারছে না। তারপর দোলা এক বাসে উঠে যাবে, সজল শরীর, তার পিঠ দিয়ে উরু দিয়ে আকাঙক্ষার লাভা-ঢল নামবে, কিন্তু কিছু করার নেই। এরপর রাত হয়ে যাবে। তার বাস চোখের আড়াল হলে ও কোথায় যাবে? ওর শরীর কেমন করবে? ওর মন কেমন করবে? দোলা জানে না, জানে না, জানে না। শুধু জানে সে এই জন-জঙ্গলে একা, একেবারে একা, তাকে কেউ অশোভন ধাক্কা দিলে এ সময়টা সে কিছু বুঝতে পারে না। তার হাত-ব্যাগটা ছিনিয়ে নিতে কিংবা কেটে পয়সাকড়ি নিয়ে নিতে এ সময়টায় পকেটমার, ছিনতাইবাজদের কোনওই অসুবিধে হবে না। রাস্তা দিয়ে, বিশেষত গড়িয়াহাটের কাছাকাছি সব সময়ে পুজোর ভিড়, দোলার মনে হবে রাস্তাগুলো কেন এত ফাঁকা, চারদিকে কেন এত অন্ধকার, অথচ লোডশেডিং হয়নি, রাস্তায় প্রচুর আলো, বিজ্ঞাপনের বড় বড় ল্যুমিনাস রঙের সাইনবোর্ড, বিজলির কত রকম কেরামতি, অন্ধকার একটা ফাঁকা কানা গলি দিয়ে দোলা হাঁটবে, অবশ্যই বুকের আলোয় পথ চিনে চিনে, যে চাঁদ আকাশে ওঠেনি, যে আকাশ শহরের সমস্ত দূষিত বাষ্প নিয়ে, বিজলি আলোর দাবড়ানিতে শাদা, একদম ময়লাটে শাদা হয়ে আছে, সেই আকাশকে আকাশ-নীল রঙে চুবিয়ে তারপর তাতে একটি স্নিগ্ধ দ্বাদশীর চাঁদ এঁকে দিলে তবে দোলার বুকের ভেতরটা তৈরি হবে। সেই চাঁদের চাঁদনিতে পথ দেখে দেখে সে কর্নফিল্ড রোড থেকে এক স্টপ এগিয়ে যাবে। একটা মস্ত খেলার মাঠ, কে জানে কতদিন থাকবে, একটা মস্ত পুকুর, কে জানে কতদিন থাকবে, তাদের যে-কোনও একটার পাশ দিয়ে দোলা বাড়ির ঘনিষ্ঠ রাস্তাটি ধরবে। যে কেউ এখন দোলাকে দেখলে বলে দিতে পারবে এ হল একটা প্রেমে-পড়া মেয়ে, প্রেমে হাবুডুবু খাওয়া মেয়ে। অথচ তার বাবা-মা বোঝেন না, তার বন্ধুরা বোঝে না—কেননা সে তো বলেনি কাউকে! ঘুণাক্ষরেও বলেনি। তারা সবাই, বাবা-মা এবং বন্ধুরা সব্বাই মনে করে দোলাটা একটা আদুরি, দোল দোল দুলুনি, সে নিজের দায়িত্বে নিজেকে নিয়ে কিছু করতে পারে না, কখনও করেনি। তার চেয়েও বড় কথা, দোলার নিষ্পাপ মুখকে দোলার অকপট কথাবার্তাকে তারা সবাই বিশ্বাস করে। বাবা, মা, দিদি, পার্থদা, নিলয়, শর্মিষ্ঠা, লাবণি, চঞ্চল..সবাই, সব্বাই।

এই যে গোপনতা এ-ও কিন্তু দোলার পক্ষে সত্যিই স্বাভাবিক নয়। কেন সব কিছু গোপন করছে দোলা? আরও কত ছোটবেলায় ওর বাবার বন্ধু যখন ওর সবে কুঁড়ি-ধরা বুক চটকে চটকে আদর করেছিলেন তখন সে কথা সে মাকে বলে দিয়েছিল। হিস্ট্রির একটা ঝাঁকড়াচুলো মাকড়ামুখো ছেলে কী যেন নাম, তার সঙ্গে জমাবার চেষ্টা করেছিল প্রাণপণ সেটাও সে নিলয়, অমৃতা, লাবণি সব্বাইকে বলে দিয়েছিল। এমন যদি দাঁড় করানো যায় যুক্তিটা যে এদের দিকে তার নিজের বিন্দুমাত্র আকর্ষণ ছিল না তাই বলে দিতে তার বাধেনি, তাহলেও কিন্তু ভুল হবে। বাবার বন্ধু সেই পরিমলকাকুকে সে খুব ভালবাসত। তাহলে? তাহলে এই একটা সোয়েটার বোনবার ছলে দুটো সোয়েটার বোনা, লাইব্রেরি যাবার ছল করে সিনেমা যাওয়া, কেন? কেন য়ুনিভার্সিটিতে যাবার কথা বলে সারাদিন ওর সঙ্গে ঘোরা জলে ভিজে, রোদে পুড়ে, টই টই টই টই? সে তো বলতেই পারত—বাপি জানো, পার্থদাদের স্টিমার-পার্টিতে একজনের সঙ্গে আলাপ হল, অমিতাভ সেন। খুব মজাদার ছেলে, জানো বাপি? একদিন বাড়িতে ডাকব? এটাই তার পক্ষে ষোলো আনা স্বাভাবিক হত। বাপি নির্ঘাত বলত—তাই নাকি রে! আমার হবু ছোট সান-ইন-ল’ মনে হচ্ছে? ডাক, ডাক, ডাক। মা শুনলেই বলত গাছে কাঁটাল গোঁফে তেল। তোমার ওই স্বভাব আর গেল না। ঝুলনের সময়েও এগজ্যাক্টলি এমনি করেছিলে। বাড়িতে ছেলেবন্ধু আনলেই হবু সান-ইন-ল’ মনে হচ্ছে? আচ্ছা লোক যা হোক।

এরপর অমিতাভ বাড়িতে আসত। বাপি-মা অবাক, মুগ্ধ হয়ে যেতেন। দুই বাড়ির মধ্যে কথা বলাবলি, খেতে ডাকাডাকি শুরু হয়ে যেত। বাপি-মা’র লাইসেন্স নিয়ে পরিষ্কার বিবেকে দোলা লজ্জা-লজ্জা হাসিমুখে ওকে মিট করতে বেরত, ও পৌঁছে দিত। বন্ধুরা বলত—ওঃ দোলা, ফ্যানটাসটিক, কেউ হয়তো বলত—এৎ তূ দোলা?

কেন? কেন? কেন এমন ঘটাল না সে? তবে কি নিষিদ্ধ প্রেমের মতো গোপন প্রেমেও একটা আলাদা উত্তেজনা থাকে? মা-বাবাকে ঠকানোর, মিথ্যে কথা বলারও কি একটা আলাদা রোমাঞ্চ থাকে? আর বন্ধুদের?

সেদিন লাবণি যখন বলল—অমৃতাটার কী হল বল তো!

নিলয় বলল—ঘাবড়াচ্ছিস কেন? অরিন্দমদা তো বলছে ও ভাল আছে, সেফ আছে।

লাবণি মুখভঙ্গি করে বলল—আচ্ছা দোলা তুই-ই বল অরিন্দম ঘোষ কি পেশাদার টিকটিকি? শার্লক হোমস? না ফেলুদা? না ভাদুড়িমশাই? নিলয়টা এমন করছে যেন…

দোলার মনে হল—কে? কার কথা বলছে ওরা? কে অমৃতা? কে অরিন্দম ঘোষ? এদের কথা তো সে জানত না?

লাবণি বলল—বল না, তোর তো চিরকাল ও বেস্ট ফ্রেন্ড। তোর ওপিনিয়নের তো একটা আলাদা মূল্য আছে, তুই নিশ্চিন্ত হতে পারছিস?

হঠাৎ যেন বহু যুগের ওপার থেকে আষাঢ় আসার মতো অমৃতা তার মনে এল। ধোঁয়া ধোঁয়া। আবছা আবছা। কুয়াশার মধ্যে যেমন দেখা যায় বা ধুনো-গুগগুলের ধোঁয়ার মধ্যে দিয়ে যেমন চেনা যায়! অমৃতা। অমৃতা, তাই তো! তার এক সময়ের হার্ট-থ্রব অমৃতা চক্রবর্তী-গোস্বামী হঠাৎ হারিয়ে গিয়েছিল বটে। সে ভীষণ উদ্বিগ্ন ছিল। লাবণিকে নিয়ে…। অরিন্দম ঘোষ তো লাবণির হবু? তার যেমন ও? না, না, লাবণির হবু আর তার হবুতে এক সমুদ্র তফাত, এক সমুদ্র তফাত তাদের সম্পর্কের সুর-লয়-তালেও।

কিন্তু অমৃতার কথা, তার নিরুদ্দিষ্ট হবার কথা সে একেবারে ভুলে গিয়েছিল? কী আশ্চর্য! কী ভীষণ লজ্জাজনক! বুকের মধ্যে একটা চিনচিনে ব্যথা, গলার কাছে একটা পিণ্ড অনুভব করে সে। বলে— অরিন্দমদা কী বলছেন?

নিলয় বলল—উনি বলছেন ও সেফ অ্যান্ড সিকিওর।

লাবণি বলল—বাট দ্যাট ইজ জাস্ট আ হাঞ্চ!

নিলয় বলল—না রে লাবণি, আমার মনে হয় উনি ডেফিনিট কিছু জানেন।

—তাহলে বলছেন না কেন সেটা?—দোলা বলল।

—সেটাই তো! রহস্য করছে কেন? লাবণি বিরক্ত সুরে বলল।

সেদিন বাড়ি ফিরতে ফিরতে দোলার মনে হল—ইস্‌স সে কী স্বার্থপর! যে অমৃতাকে সে চোখে হারাত, যে নিরুদ্দেশ হয়ে গেলে সে ভয়ে, রাগে, ক্ষোভে অস্থির হয়ে গিয়েছিল, অরিন্দমদার সঙ্গে সেই নার্সিংহোম যাত্রা! এ সমস্তর ওপর একটা পর্দা পড়ে গিয়েছিল যেন। আজ নিজের কাছে স্বীকার করতেই হয় অরিন্দম ঘোষ যে বলছেন অমৃতা ঠিক আছে, ভাল আছে, কোনও প্রমাণ ছাড়াই এটা মেনে নিতে পেরে সে বেঁচে গেছে। অমিতাভ এখন তার মন থেকে সব কিছু, সব্বাইকে হঠিয়ে দিয়েছে। তার মগজে জায়গা নেই, হৃদয়ে জায়গা নেই। কাউকে কিছু বলবার তাগিদ নেই ; আপনাতে সে আপনি মগ্ন, আপনি সম্পূর্ণ। একটা সুখ আর অলৌকিক আনন্দের বলয়ের মধ্যে এখন তার ঘোরাফেরা। কাউকে সে-সুখের কথা, আনন্দের কথা বলে সুখ ভাগ করে নেবার প্রশ্নই ওঠে না।

১২
ক’দিন ধরে শ্রাবণ অঝোরে ঝরছে। আকাশের মুখ দিনরাত দুপুর বিকেল সন্ধে-সকাল নীলগাইয়ের মত নীলচে কালো। ‘নীল নবঘনে আষাঢ় গগনে তিল ঠাঁই আর নাহিরে’—গলা ছেড়ে গান গাইতে গাইতে ডক্টর কার্লেকর ছাই-ছাই রঙের টি-শার্টের তলায় নীলচে কালো রঙের প্যান্ট পরছিলেন বোধহয় আকাশের সঙ্গে রং মিলিয়ে। রম্ভা ঘরে ঢুকেই অবাক হয়ে গেলেন।

—কোথায় বেরচ্ছ? এখন? এই আনআর্থলি ওয়েদারে?

—তোমাদের বেবিরা তো ওয়েদার চার্ট-ফার্ট মানে না অপ্সরী!

মন খুব ভাল থাকলে রঞ্জন রম্ভাকে অপ্সরী বলে ডেকে থাকেন। আদরের ডাকে কান না দিয়ে রম্ভা বললেন—এত তাড়াতাড়ি তো তুমি নার্সিংহোমে যাও না? এখনও এগারোটা বাজেনি।

—এগারোটা না বাজলেও বারোটা বেজে যেতে পারে ডার্লিং। পায়ে মোকাসিন গলাতে গলাতে রঞ্জন বললেন।

—এই পোশাকে তুমি নার্সিংহোমে যাবে? রম্ভার অবাক হওয়া এখনও ফুরোয়নি।

—তা এই শ্রাবণধারাপাতে কি তুমি আমায় সুটেড বুটেড হয়ে যেতে বলো?

—তোমাকে কখনও ক্যাজুয়াল পরে নার্সিংহোমে যেতে দেখিনি।

—খেয়াল করোনি ডার্লিং। গেছি গেছি, এমন বর্ষায় গেছি।

—গাড়িটা তো বারান্দার তলাতেই দাঁড়াবে। ড্রেস করতে তোমার আপত্তি কী?

—সেটা এখানে। ‘উজ্জীবন’-এ বারান্দার তলা নেই। সেখানে আর পাঁচজন গাড়িহীনের মতোই আমাকে ছাতা মাথায় ঢুকতে হবে।

—কী জানি বাবা! রম্ভার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বলছে রঞ্জন নার্সিংহোমে যাচ্ছে না। তা না-ই যাক। অন্য কোথাও কোনও এমার্জেন্সি কল থাকতেই পারে। ডক্টর কার্লেকরের সব কেসই তো উজ্জীবনে আসে না! কিন্তু বলল না কেন সে কথা! রঞ্জন সাধারণত কোথায় যাচ্ছে, কেন যাচ্ছে, আনুমানিক কত ঘন্টা লাগতে পারে, কেস জটিল কি না এ সবই রম্ভাকে বলে থাকে। প্রথমত স্ত্রী একজন ডাক্তার, তারই মতো স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ বলে। দ্বিতীয়ত স্ত্রী সন্দেহপ্রবণ বলে।

রম্ভাকে একবার গম্ভীর পরক্ষণেই বিষণ্ণ হয়ে যেতে দেখে রঞ্জন বললেন—আরে, এর ওপর তো একটা এপ্রন চাপিয়ে নেব। তলায় ফর্ম্যাল শার্ট আছে না ক্যাজুয়্যাল আছে তখন কে দেখছে?

অনেক কথাই এর উত্তরে রম্ভার বলার ছিল। বলার ছিল নার্সিংহোমের স্টাফ যাতে সবসময়ে শতকরা শতভাগ পেশাদার চেহারায় থাকে, তাই ডক্টর কার্লেকরও নিজেকে তাদের আদর্শ হিসেবে গড়েছেন। এটাই নাকি তাঁর ‘ইমেজ’। সেই ‘ইমেজ’আজকে হঠাৎ ভাঙার কী দরকার পড়ল? কিন্তু এসব বলে রম্ভা কথা বাড়ালেন না। এই যে ঈষৎ বিষণ্ণ, সামান্য অবহেলিত, অবহেলিত বলেই সূক্ষ্মভাবে আহত তাঁর নিজের ‘ইমেজ’ এটাকে এই মেজাজটাকেও তিনি উপভোগ করেন। রঞ্জন বেরিয়ে গেলে, তার গাড়ি যতদূর দেখা যায় তিনি বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখবেন। এখন বৃষ্টি সোজা ছাটে পড়ছে, তবুও বারান্দায় রেলিং ঘেঁষে দাঁড়ালে তিনি ভিজে যেতে পারেন। সেই সামান্য ভেজা কামিজটা তিনি বদলাবেন না। বর্ষাকালে এমনিতেই তিনি একটু অ্যালার্জিতে ভোগেন। ভিজলে তো আর কথাই নেই। সন্ধে নাগাদ জ্বরটা এসে যেতে পারে। তখন তিনি কপালে একটু বাম ঘষে নীল আলো জ্বেলে বিছানায় শুয়ে থাকবেন। চেম্বারে বসবার আগে রঞ্জন আর তিনি একসঙ্গে বসে একটু কফি খান। কফি খাওয়ার একটা সুন্দর জায়গাও আছে তাঁদের। খাবার ঘরের একদিকে দুটো কোণা জুড়ে এত বড় জানলা যে মনে হয় জানলা নেই, কাচের ওপারেই বাগান, বাগানের ওপারে শান্ত পথঘাট। এই কোণটাতে তাঁদের স্মোকড গ্লাসের কফি-টেব্‌ল পাতা। সেদিকে যেতে গিয়ে যখন রম্ভাকে দেখতে পাবে না, রঞ্জন ওপরে আসবেই। বেডরুমে।

—কী ব্যাপার? নীচে নামোনি এখনও?

—তুমি রেডি? চান করেছ?

—শিওর! ওডি কলোনের গন্ধটা পাচ্ছ না!

—নাঃ!, নাক বন্ধ।

—আবার সর্দি হল না কি? —রঞ্জনের গলায় থাকবে উৎকণ্ঠা।

—সর্দি হয় তো হয়েছে। চলো।—বলে রম্ভা মন্থর ভঙ্গিতে উঠবেন। নীল-এর ওপর ধূসর ছাপের সেই শিফনটা পরনে। রঞ্জন কাছে এসে গালে গাল রাখবে। রেখেই চমকে উঠবে।

—এ কী? তোমার তো বেশ গা গরম।

—ও, তাই মাথাটা ব্যথা করছিল।

—করছিল, এখন?

—কমে গেছে।

—থাক তা হলে নীচে গিয়ে কাজ নেই। এখানেই আনতে বলে দিই। বাজার টিপবেন রঞ্জন। কালীচরণ, ওঁদের বেয়ারা কফি পট সুদ্ধু ট্রলিটা বেডের পাশে রেখে যাবে।

কফিতে একটু করে চুমুক দেবেন আর রম্ভার জ্বর-লালচে মুখের দিকে চিন্তান্বিত দৃষ্টিতে তাকাবেন রঞ্জন। কফিটা যখন দেড় কাপ মতো শেষ তখন রঞ্জন ঝুঁকে পড়বেন, রম্ভার বুকের ওপর। —ডার্লিং …

—আঃ, কী করছ? ছোঁয়াচ লাগবে।

—দূরে থাকলেও লাগতে পারে যখন তখন কাছেই থাকি। রঞ্জনের গলার স্বর এখন বদলে যাবে। গাঢ়, গভীর। সেই অনেকদিন আগেকার, বিবাহপূর্ব রঞ্জন, মেডিক্যাল কলেজের থার্ড ইয়ারের রঞ্জন আর রম্ভা।

সামান্য জ্বর গায়ে অসময়ের সেই গাঢ় সঙ্গমের জন্যে আজ অপেক্ষা করবেন রম্ভা। সারাদিন ধরে তার প্রস্তুতি চলবে, প্রস্তুতি এবং প্রতীক্ষা। এইরকম অসময়ে না হলে তো রঞ্জনের আর সময়ই হয় না।

১৩
‘উজ্জীবন’-এর দরজায় দাঁড়াল ধূসর রঙের মারুতি এসটিমটা। ছাতা হাতে রহমান শোফার নেমে দাঁড়িয়ে গাড়ির দরজা খুলল। নেমে গেট অবধি পৌঁছে হঠাৎ রহমানের হাত থেকে ছাতাটা কেমন কেড়ে নিলেন ডক্টর কার্লেকর। —‘রহমান, ছাতাটা একটু রাখছি। বুঝলে?’

—ঠিক আছে সাব।

—গুড মর্নিং

— গুড মর্নিং

—গুড মর্নিং

নিজের ঘরে ঢুকে গেলেন রঞ্জন। বেল বাজালেন। এনকোয়্যারি থেকে রিসেপশনিস্ট মেয়েটি উঠে এল।

—তুমি কেন? রজ্জাক কী করছে? আশ্চর্য তো? রজ্জাককে বলবে—আই ডোন্ট ওয়ান্ট হিম টু রিপীট দিস। যাই হোক সিসটার মাধুরীকে ডেকে দিও।

—সেন না দাশ?

—সরি, সেন।

মাধুরী সেন বেশ বয়স্কা। চল্লিশের বেশ ওপরে। কিন্তু দারুণ কর্মঠ, পটু এবং দায়িত্ববোধসম্পন্ন। দুই মাধুরীই। কিন্তু দাশ-এর বয়স চব্বিশ-পঁচিশ, দেখতে-শুনতেও একটা আলগা চটক আছে। রম্ভা চান না মাধুরী দাশ রঞ্জনের কাছাকাছি আসে। মাধুরী দাশও খুবই নিপুণ। তবু, নিজের জীবনের এই জটিলতার কথা মনে রেখেই রঞ্জন মাধুরী সেনকে তাঁর কাজকর্মগুলো করতে দিতে পছন্দ করেন।

মাধুরী সেন আসতে রঞ্জন নিচু গলায় বললেন—আমি যাচ্ছি, রাউন্ডে আসতে একটু দেরি হতে পারে। আমার চেম্বারের বাইরে নট টু বি ডিসটার্বড-টা লাগিয়ে দিন। কোনও কারণেই যেন কেউ আমাকে বিরক্ত না করে। আশা করছি ঘণ্টাখানেকের মধ্যে এসে যাব। পেছনের দরজায় একটা ট্যাক্সি ডাকিয়ে রাখুন। আপনিই। এলে আমাকে ডাকবেন। ছাতাটা নিয়ে যান।

কতকগুলো আলট্রাসনোগ্রাফির রিপোর্টের ওপর ঝুঁকে পড়লেন কার্লেকর।

একটু পরেই হলুদ-কালো ট্যাকসিটা ছুটে চলল ডোভার লেনের দিকে।

খসখস খসখস করে খবরের কাগজের ওপর মুখস্থ উত্তর লিখে যাচ্ছে অমৃতা। স্পেশ্যাল পেপার … শর্ট নোট সব—বিজয় গুপ্ত কেতকা দাস রামেশ্বর ভট্টাচার্য দ্বিজ মাধব …। এগুলো স-ব সে আগে মুখস্থ করেছে, মুখেও বলে নিয়েছে। কিন্তু তার বাবা তাকে এই কায়দাটা শিখিয়ে দিয়েছেন। যতই বলে নাও, লেখবার সময়ে ঠি-ক ভুলে যাবে। সেইজন্যে লেখার অভ্যাস দরকার। বাবারা নাকি ছোটবেলায় এ সব কাজ বালি-কাগজে করতেন। সেগুলো অনেক কমদামি। এখন সে সব পাওয়া যায় না, কাগজ জিনিসটাই দুর্মূল্য হয়ে গেছে। একটা রুলটানা বা না-টানা লম্বা ফুলস্ক্যাপ সাইজের খাতা আট থেকে ন টাকার মধ্যে আসা-যাওয়া করে। অত পয়সা অমৃতা কী করে খরচ করবে? সে পুরোনো খবরের কাগজের ওপর শাঁই শাঁই করে লিখে যায়। মাসি মাঝে মাঝে বলেন—কী রে, খবরের কাগজের ওপর লিখছিস বুঝতে পারবি?

অমৃতা একটু হাসে। বুঝতে পারবার তত দরকার নেই। দরকার হল গড়গড় করে এই লিখে যাওয়াটা।

একটা নোট লেখা শেষ করে সে ফিরে মাসির দিকে তাকায়—তোমরা কেমন করে পরীক্ষার প্রিপেয়ারেশন করতে মাসি?

—আমি তো বার বার করে পড়তাম। ঘুরে ফিরে পড়তাম।

—নিজে উত্তরগুলো লিখতে না?

—কিছু লিখতাম, আর কিছু স্রেফ বই পড়ে চলে যেতাম।

—হত তাতে?

—ওই যা হত তা হত। বি.এ পাস কোর্সের পড়া তো, তা-ও জানতাম যে দেখাশোনা চলছে, পছন্দ হলেই বিয়ে হয়ে যাবে।

বিয়ের প্রসঙ্গে অমৃতার চোয়াল সামান্য কঠিন হয়ে যায়। লক্ষ পড়বার মতো নয়। চোয়ালের এই কঠিনতাও অমৃতার ভেতরের। সে জিজ্ঞেস করে—তোমার কী সাবজেক্ট ছিল মাসি?

—দূর, অত কি মনে আছে? ওই ফিলসফি, হিসট্রি, স্যানসক্রিট বোধহয়।

—পড়তে তোমার ভাল লাগত না?

—নাঃ।

—কী ভাল লাগত তাহলে?

—এই গপ্পো করা, নিন্দেমন্দ পরচর্চা, সিনেমা যাওয়া, আমাদের সময়ে তো প্রচুর সিনেমা-হল, প্রচুর সিনেমা, প্রতি সপ্তাহে একটা করে দেখতাম।

—যাঃ।

—মাসির ওপর অশ্রদ্ধা হচ্ছে না কি রে?

অমৃতার মুখ নরম, নরম, আরও নরম হয়ে গেল। সে বলল—

—অশ্রদ্ধা? কী যে বলো!

—তবে উনি যখন চলে গেলেন তখন আমার বয়স ঠিক পঁয়ত্রিশ। উনিশে বিয়ে হয়েছিল, ঠিক ষোলো বছর। সেই সময়টা …সম্পদ তখন এগারো বছরের। বারোয় পা দিয়েছে। ওকে দেখাশোনাটা খুব বড় কাজ ছিল। তবু, তবু মনে হত কেন আর একটু ভাল করে পড়াশোনাটা করিনি! টাকা-পয়সার অভাব তত বুঝিনি। খুব ভাল ইনসিওরেন্স ছিল, অফিস থেকেও পাওনা ছাড়া অতিরিক্ত অনেক দিয়েছিল, তা ছাড়া এই বাড়ি ছিল, মহানির্বাণ রোডের বাড়িটা ব্যাঙ্ককে ভাড়া দেওয়া, কিন্তু তা নয়, কেমন শূন্য-শূন্য লাগত। মনে হত আমার নিজের ভেতরটায় কিছু নেই, কিছু জন্মায়নি।

—তাহলে আবার শুরু করলে না কেন?

—অভ্যেসটাই তখন চলে গিয়েছিল, বুঝলি অমি? কতকগুলো সাপ্তাহিক পত্রিকা, মেয়েদের পত্রিকা আর কখনও সখনও এক আধটা বাংলা নভেল ছাড়া কিছ্‌ছু পড়িনি এই ষোলো বছর। বয়সটাও তখন মনে হত অনেক। কেঁচে-গণ্ডুষ করতে লজ্জাও ছিল, আবার ওই যে বলছি অনভ্যাস। মনের মধ্যে গভীরতাই বলিস আর মনোযোগই বলিস—কণামাত্র ছিল না।

অমৃতা বলল—ধ্যাঃ। তোমার গভীরতা নেই? মনোযোগ নেই? বিশ্বাস করতে বলো?

বললেন—মগজ, মস্তিষ্কের কথা বলছি রে। মাথা দিয়ে কোনও কঠিন জিনিস সল্‌ভ করতে পারার ক্ষমতাটা চলে গিয়েছিল।

—চলে যায়নি মাসি। হয়তো ঘুমিয়ে গিয়েছিল। জাগাবার চেষ্টা করলেই জাগত। তা ছাড়া, তোমার কোনও মোটিভেশন ছিল না। টাকা-পয়সার যেহেতু অভাব ছিল না। তাই নতুন করে কিছু করার উৎসাহ বা প্রেরণা পাওনি।

—ঠিক বলেছিস। কত বুঝিস তোরা আজকালকার মেয়েরা।

—এমা, তোমাকে এভাবে বলা আমার উচিত হয়নি।

—দেখো কাণ্ড, আমি কি তাই বলেছি? সত্যিই আমার মনে হয়, তোরা কত কত এগিয়ে গেছিস। কত কী জানিস। কত ভুল করিস না। কত ভুল শুধরে নিতে পিছপা হস না।

—আমরা একটা নতুন প্রজন্ম মাসি, এটা আমাদের কোনও বাহাদুরি নয়। সায়েন্স, টেকনলজি, মাস-মিডিয়া এই সব কথা আমাদের শিখিয়েছে। ভাবনা উসকে দিয়েছে। তোমাদের সময়ের থেকে আমাদের সময় আর একটু এগিয়ে গেছে।

—ভেতরে ভেতরে কিন্তু রয়ে গেছে সেই পশুবৃত্তি, সেই লোভ, সেই হিংসা … একটু থেমে অমৃতা আবার বলল।

শিবানী বললেন—না, তুই পড়, আমি তোকে বড্ড বকাচ্ছি। অমৃতা হাসল। পড়া জিনিসটাও তো যান্ত্রিকভাবে হয় না। তার মধ্যে অন্য মানুষের উষ্ণতা, অন্য মানুষের যুক্তি, বুদ্ধি, জীবনবোধ এসব না মিশলে আর যারই হোক, তার পড়া হয় না।

শর্মিষ্ঠা তো বেশিরভাগ সময়েই সর্বোচ্চ নম্বর পায়। কিন্তু ওকে একটা আলোচনার মধ্যেও আজ পর্যন্ত টেনে আনতে পারল না কেউ। রবীন্দ্রনাথ-কাদম্বরী রহস্যের মতো মুখরোচক মনোরোচক বিষয়ে পর্যন্ত না।

নিলয় প্রশ্নটা করেছিল। শর্মিষ্ঠা বলল—‘কবিমানসী’ তো পড়েছিস?

—তা পড়েছি উল্টেপাল্টে।

—তা হলে? তা হলে জিজ্ঞেস করছিস কেন?

—হায় কপাল! ওটা তো জগদীশ ভট্টাচার্যের দেখা-বোঝা, তুই কী বুঝিস, তোর কিছু মনে হয় না?

—না। আমি ওঁদের দেখিওনি। শুনিওনি।

—তাই বলে বুঝবিও না?—অমৃতা অনুযোগ করে।

—বুঝতে হলে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে কথা বলতে হয়, কাদম্বরী দেবীর সঙ্গে কথা বলতে হয়, প্ল্যানচেটে বসবি? তাতেও হবে না, টিকটিকি লাগাতে হবে।

—কী আশ্চর্য! রবীন্দ্রনাথের লেখাগুলো তো রয়ে&#