Thursday, August 21, 2025
Homeবাণী ও কথাপথ, হে পথ - নাসরীন জাহান

পথ, হে পথ – নাসরীন জাহান

আমার যদি আলাদা একটি গোপন ঘর থাকতো এই স্বপ্নটি আমি প্রায়ই দেখি। বিছানায় ল্যাপটে থাকা সবুজ চাদর পাল্টানোর সময়, অথবা ছাতলা পড়া ঘটর ঘটর ফ্যানের দিকে চেয়ে যখন শুয়ে থাকি, সেই ঘরটির কথা গম্ভীরভাবে মনে হয়। আমি যে ঘরটিতে থাকি, সেই ঘরটিও খুব ছিমছাম, গোছানো। যদিও মাঝে মাঝে একসেট ভালো সোফা, একটি ফ্রিজ, রঙিন টি.ভি. বিশেষ করে একটি টেলিফোন এসবের অভাব অনুভব করি। মনে হয় ফোন থাকলে মহেন্দ্র, ইরফান অথবা আবদুল্লাহর সাথে গল্প করে অনেক একঘেয়ে সময়কে মুখ করে তোলা যেতো। বুও এসবের অভাব সত্ত্বেও আমি আমার ছোেট রুম দুটোকে যথেষ্ট ভালোবাসি। বারান্দাটিকে ভালোবাসি, যেখানে দাঁড়িয়ে আমার অনেক নিঃসঙ্গ সময় অতিবাহিত হয়। আমার একটাই অসুবিধে একটি জিনিস একভাবে দেখতে খুব হাঁপিয়ে উঠি। তাই আমি আমার ঘরে যা-ই আসবাব আছে তাকেই অদলবদল করে মাঝে মাঝে অন্যরকম করার চেষ্টায় নানাভাবে সাজাই। খাট, ড্রেসিং টেবিল আয়না….এই যথাস্থান থেকে সরিয়ে ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় রাখলে ভেতরে এক আশ্চর্য অনাবিলতা অনু করি। তো কথা হচ্ছিলো ঘর নিয়ে। এতো যে মাঝে মাঝে টানা হ্যাচড়া তাতেও কিন্তু আমি কম হাঁপিয়ে উঠি না। কিন্তু জিনিসগুলো এক জায়গায় বেশিদিন স্থির থাকলে আমার যতটুকু শাস কষ্ট হয়, তার চেয়ে ওগুলোকে স্থানাস্ত্র করার কষ্ট যথেষ্ট কম। মনে হয় মাঝে মাঝেই আমি এক নতুন স্থানে সময় কাটাচ্ছি।

২.

এখন গভীর রাত।

দেড় বছরের শিশুর মতো টলমল হাঁটছে মইন। অনেক জরুরি ব্যাপার মনে থাকার কথা ছিলো আজ। মনে থাকেনি। সারাদিন শুধু একটি কথাই মনে থেকেছে তার অনেকগুলো জরুরি কাজ সারতে হবে। আর কিছু মনে থাকেনি। যা তোক পাঁচ পেগ গেলার পর যে কোন জরুরি ব্যাপারকেই ফানুস বানিয়ে উড়িয়ে দেয়া যায়, এমন একটা ভাবনা ওকে ফুরফুরে করে দেয়। যেন, যে পাঁচ পেগ, কিংবা দুই পেগ, কিংবা এক পেগ-যা-ই পান করে, যে পান করে তাকে কোন জরুরি অবস্থার মধ্যে ফেলে দেয়াটাই অন্যায়। তার কাছে যে কোন কৈফিয়ত চাওয়া অন্যায়। সে ঘরে। ফিরলে ঘরের মানুষের কুঞ্চিত হওয়া অন্যায়…..। অন্তত বিয়ের আগে মইন যখন দিনরাত বাংলা মদ, আর মেথরপট্টির মধ্যে থাকতো, তাই মনে হতো তার। আজও মনে হচ্ছে। অন্তত মইন তেমন অন্যায় বরদাস্ত করবে না। তাই সে বেশ দূরে মেইন রোডে রিকশা ছেড়ে দিয়ে রাজার মতো হাঁটতে শুরু করেছে।

ঝাঁ ঝাঁ দুপুরে রাক্ষুসী সূর্য মাথায় নিয়ে, অফিস থেকে রুটিন মতোই বাড়ি ফিরছিলো। সূর্যের গনগনে আঁচে ঝিমঝিম করছিলো মাথা। শহরের ওপর আছড়ে পড়া উজ্জ্বল আলো যখন কখনো নীল, কখনো সবুজ কখনো বেগুনি, হলুদ, বেগুনি নীল, কমলা….বিভিন্ন আকৃতি নিয়ে ঘোর লাগিয়ে দিচ্ছিলো চোখে, তখনই সেই ভিবজিওরের মাঝখান থেকে চিৎকার করে উঠেছিলো একটি মার্সিডিজ গাড়ি-হেই মইন-হেই

নিজের নামটা টং করে মস্তিষ্কের মধ্যে ধাক্কা খায়। ঘোর লাগা চোখে মইন উত্তপ্ত শহরের চলমান যন্ত্রগুলোর ওপর দৃষ্টি বোলায়। সাত রঙের মাঝখানে একটি মার্সিডিজ। হাত নাড়ছে পুতুল। এক গাদা রিকশা, গাড়ি, রাস্তার পাশে স্তুপাকার দুর্গন্ধযুক্ত ময়লা, কাঁচা মাংসের গাড়িসহ কসাইয়ের গাড়ি, একঝাক কুঁজো বিকলাঙ্গ ভিক্ষুকের মাঝখানে পুতুল স্বপ্নের মতো হাত নাড়ছে। রিকশা থেকে লাফিয়ে নামে মইন।

ক্লাসমেট ছিলো, মইন একতরফা দুর্বল ছিলো, বহুদিন পর দেখা। ওর শীতল গাড়িতে বসে, সেন্টের ভুর ভুর গন্ধে মইন নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। এরপর লে হালুয়া! দুপুরে হোটেলে রুটি-মাংস, বিকেলটা অনেকদিন পর ক্রিসেন্ট লেকে, সন্ধ্যার পর ওর নির্জন ফ্ল্যাটে, এক পেগ, দুই পেগ, তিন পেগ-। মইনের পা গর্তের মধ্যে হড়কে পড়ে।

৩.

আমি ঘর নিয়ে ভাবছিলাম। গলির মোড়ে একটি লোক রিকশা থেকে নামছে। আমি গলা বাড়িয়ে দেই, মইন এসে গেছে তাহলে। অন্ধকার পথ দিয়ে হেঁটে আসছে মানুষটি। নিমগাছ আর ঘিঞ্জি বাড়িগুলি রাস্তাটিকে আড়াল করে রেখেছে। ফাঁকে দেখা যাচ্ছে ছায়া মন মানুষটিকে। জানালা থেকে সরে আসি, না, মইন অত লম্বা নয়। নিজেকে শিথিল বিছানায় শুয়ে আমি পুনরায় ভাবনার ভেতর নিমজ্জিত হই। আমার ভাবনা আবারও ঘরকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হতে থাকে। আমার এই ঘরকেই আমি ভালোবাসা সত্ত্বেও আমি আরেকটি নির্জন ঘরের স্বপ্ন দেখি।

যে ঘরে কোন আসবাবই নেই। সেই শূণ্য নির্জন ঘরে থাকবে শুধু থোকা থোকা বাতাস। আমি ভীষণ বিচিত্র মনের মেয়ে। বেশিক্ষণ এক বিষয় আমাকে ক্লান্ত করে তোলে। মুশকিল হয় মইনকে নিয়ে। সেতো আর আসবাব নয়, যখন তখন নিজের মতো করে সাজিয়ে নিলাম। রীতিমতো শিক্ষিত একজন রক্ত মাংসে গড়া মানুষ, যে দিব্যি আমাকে বাঁ ঠ্যাং দেখিয়ে খুঁটিনাটি আমার অনেক অপছন্দের কাজ নাকের ডগায় সেরে ফেলে। বিয়ের পর এতটা বছর কেটে যাওয়ার পরও প্রথম দিন তাকে যেমন দেখেছিলাম এ থেকে ওর খুব একটা পরিবর্তন হয়নি। মাঝে মাঝে দাঁড়ি রাখতে বলে, মিলিটারী ছাঁটের চুল ঝাকড়া করে রেখে অথবা এক দুটো লাল শার্ট, ঠোঙ্গা প্যান্ট বানাতে বলে…. ওর একটু পরিবর্তিত রূপ দেখার তীব্র ইচ্ছে হয়েছে আমার। কিন্তু ওই যে রক্ত মাংসে গড়া মানুষ, হাত আছে, পা আছে, মুখ আছে অনুভূতি আছে। বাধা দিতে জানে, পাশ কাটিয়ে চলে যেতে জানে, মোট কথা সে নিজের অনুভত্বকেই সর্বাগ্রে মূল্য দিতে জানে।

মইনের কারণেই আসলে ধীরে ধীরে আমার ভেল্প আলাদা ঘরের স্বপ্ন আসন গেড়ে বসেছে। দুটোর সময় অফিস থেকে ফিরে সে ঘরের মধ্যে শেকড় ছড়ানো গাছ হয়ে। যায়। পই পই করে বলে দেখেছি, বাইরে থেকে একটু ঘুরে আসো, ফ্রেশ লাগবে, যাবে না।

যাবে না, ভালো কথা, কিন্তু সময় কাটানোর জন্য অথবা ড্রেসিং টেবিল হাতড়ে পুরোনো টাই ক্লিপ খোঁজাখুঁজি করা কেন? নির্দিষ্ট ম্যাগাজিনের খোঁজে তোষক উল্টে পাল্টে একাকার করা কেন? ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ার ছাড়া, তোষকের নিচ ছাড়া আমি আমার এই ছোট্ট দুই রুমের কোথায় আমার গোপন জিনিসগুলো রাখি? ওগুলোর একটি কণাও যদি মইনের চোখে পড়ে আমি কি ওর ক্রোধকে কম চিনি? প্রথমেই তার বিশ্রী ভয়াবহরূপ প্রদর্শন করার পর খুব ঠাণ্ডা অথচ স্পষ্ট গলায় বলে উঠবে না—এর পরে আর আমাদের এক সাথে থাকা চলে না!

যাতে ও এই ঘরের সমস্ত আসবাব পত্রের মতোই নিরাপদ শান্তটি হয়ে থাকে, সেই জন্যেই আমার একটি আলাদা ঘর দরকার। সেই শূণ্য ঘরে থাকবে একটিই মাত্র চেষ্টঅবড্রয়ার, যেখানে আমি আমার পুরোনো প্রেমিকদের দেয়া চিঠি, ডাইরী, চমৎকার ভাষায় প্রেজেন্ট করা বই, ওদের সাথে ভোলা আমার কিছু ছবি, এখনকার লেখা প্রাণপনে লুকিয়ে রাখা ডাইরীটি সব সযত্নে রাখতে পারি। এই জিনিসগুলিই আমি আমার এক ব্যাচেলার বান্ধবীর কাছে রেখেছি, যদিও সে বলেছিলো, এগুলো পুড়িয়ে ফেলতে, সংসারের জন্য এইসব বিষয় অত্যন্ত বিপদজনক! কিন্তু আশ্চর্য স্মৃতিকাতর মেয়ে আমি কিছুতেই এসব বিষয় ধ্বংস করার কথা ভাবতে পারি না। সেদিন মইনের ছেলেবেলার বন্ধু মহেন্দ্র একটি বড় এ্যালবাম প্রেজেন্ট করেছে। আমাকে। এত চমৎকার সেটা, দেখেই ভালোলাগায় উছলে উঠেছিলাম। কিন্তু খুলেই কি বিব্রতকর অবস্থা! একদম কোণায় লেখা পরকীয়া প্রেমে পাপ নেই। কৈশোর। পেরোবার পর থেকে এখন পর্যন্ত আমি আমার প্রেমিকদের প্রতি খুব শ্রদ্ধাশীল, সে যদি রাস্তার পায়ে দাঁড়িয়ে থাকা উদাস ভিখিরিটিও হয় আমার কাছে তার প্রেমই বড়। কেননা সেই প্রেম আমাকে কেন্দ্র করে। আমি সবচাইতে আমাকেই যে ভালোবাসি।

আমি কলেজে পড়বার সময় থেকেই হেমিংওয়ে, শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় এসব লেখকের পাঠক হিসেবে ক্লাসমেটদের অমিতাভ, মিঠুন চক্রবর্তীর আড্ডা থেকে নিজেকে আলাদা ভাবতাম। যখন কোন স্ত্রী অন্যের হাত ধরে পালিয়ে গেছে শুনে সমস্ত পাড়ায় ছিঃ ছিঃ চলছে তখন আমি এ থেকে খুঁজে খুঁজে বের করতাম এর পক্ষের কোন যুক্তি। এক সময় স্থির হতাম এই ভেবে—যদি হাসব্যান্ডের সাথে আন্ডারস্ট্যান্ডিং না-ই হবে, তবে আর সমস্ত জীবন ধরে তার সংসার টেনে লাভ কী? গেছে, ভালোই করেছে। যাহোক, কথা হচ্ছিলো এ্যালবাম নিয়ে। এ্যালবামের কোণার লেখাঁটি বিব্রতকর হলেও মইনের ভয়ে কেটে ফেলতে এক কষ্ট হলো আমার, মনে হলো, আমার কোন ব্যক্তিস্বত্ত্বা নেই। আমার নিজস্ব কোন জিনিস থাকতে নেই। এইসব বিষয় থেকেই সেই হাওয়া ঘর আমাকে আঁকড়ে ধরেছে। সেই ঘরে শুধু একটিই চেস্টঅবড্রয়ার থাকবে এবং তার শুধু একটিই চাবি থাকবে…..।

৪.

ফোমের শয্যায় গোলাপি শাড়ির পুতুল আলতো ভঙ্গিতে শুয়েছিলো। পুতুলকে ওই অবস্থায় দেখে মুহূর্তেই নিজের ঘরের মলিন, দরিদ্র ছাতলা পড়া ঘরে কথা মনে পড়ে গিয়েছিলো মইনের। নিজের ঘরে এতদিন কড়কড়ে সুতির শাড়ি পরিহিতা খুকিকে বেশ টিপটপ লাগতো। গোলাপি শয্যার গোলাপি পুতুলকে দেখে মনে হয় কী শিশু ছিলাম এতদিন! এতদিন কি সে শুধু খুকীর রক্তমাংস স্পর্শ করার বদলে একদলা ফোম ঘেটেছে? তার সহপাঠিনী পুতুল দশ বছর আগের চেয়েও স্বপ্নময়। বিছানায় গা এলিয়ে ঝকঝকে গ্লাসে রঙিন তরল ঢেলে একটু একটু খাচ্ছে আর অদ্ভুত চোখে মইনকে দেখছে তোমাকে দেখে বেশ হেপী মনে হয় মইন, আগের চেয়ে অনেক সুন্দর হয়েছে তুমি—গুল মারতেও শিখে গেছে দেখছি, প্রিন্টের সোফায় মইনের শরীর এলিয়ে পড়ে, ভূঁড়িটা বেড়ে গেছে চোখে পড়ছে না?

আগে তো টিং টিঙে কলাগাছটি ছিলে, ওই ভূড়িটায় তোমাকে মানাচ্ছে বেশ।

ভূঁড়িতে মানাচ্ছে। মইন কি হাসবে? কি আজব পুতুল! ওর শরীর থেকে কামিনী ফুলের গন্ধ আসছে। মইনের ঘোর লাগতে থাকে ওর সমস্ত শরীর কি নূপুর দিয়ে মোড়ানো? একটু নড়লেই অমন ঝুনঝুন শব্দ হচ্ছে যে! ঘাড়ের কাছে পড়ে থাকা ছোট্ট চুল ঝাঁকায় সে, মনে আছে, আমি যখন প্রথম গাড়ি থেকে নেমেছিলাম তুমি হ্যাংলার মতো বার্সিটির গেটে?

মনে আছে, সব….সব। একদিন কাতুকুতু দেয়ার ছলে তোমার বুকে….।

স্টপ! স্টপ! জোর প্রতিবাদে থামিয়ে দেয় ঠিকই, কিন্তু হাসির দমকে পুতুলের গোলাপি শাড়ি, গোলাপি ঠোঁট, গোলাপি ব্লাউজ, গোলাপি মাংস…সমস্ত গোলাপি থর থর করে কেঁপে ওঠে।

ছাদের দিকে তাকায় মইন, ঝাড়বাতি নয়, মহানাগরিক সূর্যকিরণ পুতুলের ঝলমলে গোলাপিতে আছড়ে পড়েছে। অনেকদিন প্র জিপেগ গিলেই এক মহাচত্রের মধ্যে পড়ে যায় সে। পুতুল হঠাৎ দাঁড়ায়, জানো, অনেক বড় হয়েও আমি বাবার সাথে লুকোচুরি খেলেছি, বাবা লুকিয়ে থাকতো আমি খুঁজে বের করতাম, অথবা আমি লুকিয়ে….। দাঁড়াতে গিয়ে পুতুল টাল সামলে পড়ে যেতে নেয়। সোফা থেকে মইনও দাঁড়ায়—আজ খেলবে? আচ্ছা তুমি লুকোও, আমি খুঁজে ব্বে করি।

বিচিত্র ভঙ্গিতে ভূমণ্ডলের চারপাশে তর্জনী ঘুরিয়ে চেঁচিয়ে ওঠে পুতুল। তুমি খেলবে! ওহ গড! ফেনটাসটিক! কি যে একটা হোপলেসকে বিয়ে করেছিলাম। যাক শালা! চুকিয়ে বুকিয়ে ফেলেছি…..এই এই আমি লুকোচ্ছি, তুমি চোখ বোঁজো।

মইন চোখ বুজতেই রংচঙে আলোর শাঁসালো অন্ধকার ওর চোখ বিদ্ধ করে।

কুউউ…. কোকিলের মোন ডেকে ওঠে পুতুল।

সন্তর্পণে চোখ মেলে সমস্ত ঘরে দপদপ পা ফেলে মইন হাঁটে। খাটের পেছনে পুতুলের গোলাপি শাড়ি দেখা যাচ্ছে! কি শিশু মেয়েটা! ভাবতে ভাবতে খপ করে সে ওকে ধরতে যায়। হি হি করে দৌড় দিয়ে গিয়ে পুতুল হুমড়ি খেয়ে পড়ে।

মইন দেখে লাল আলো, নীল আলো, হলুদ আলো…ঝাঁপিয়ে পড়ে ওর ওপর, পেয়েছি, পেয়েছি বলে। কি আশ্চর্য ভিবজিওর। পুতুল ক্রমশ অপ্সরা, ক্রমশ পৃথিবীর প্রথম নারী, যে পোশাককে অশ্লীল করে তোলে…..।

একটা গর্তের মধ্যে পা হড়কে পড়ে যায় মইন। চারপাশে তাকিয়ে কাপড় ঝেড়ে দাঁড়ায়। কিছুটা চোট লেগেছে পায়ে। মুশকিল হলো! দরজা খুলে খুকি হা হা। করে উঠবে না তো! একেবারে বিনা নোটিশে দুপুর থেকে হাওয়া সে।

হায় মইন! তুমি গিলে এসেছে! কোথায়….কার সাথে? নাহ এই মুহূর্তে খুকীকে ভাবতে ভালো লাগছে না।

৫.

চারপাসে শুধু চোখ দেখি। কি যে বিচিত্র সেসব চোখের আকৃতি। যেমন,

(ক) কাঙাল চোখ বাথরুমে, শাওয়ারের নিচে ডুবে যখন উদোম স্নানে ব্যস্ত থাকি, তখন চারপাশের দেয়ালে অনেকগুলো চোখকে কাঙালের মতো চেয়ে থাকতে দেখি। যাদের অনেকেই আমার পুরনো প্রেমিক অথবা একতরফা ভালোবেসেছে। আমাকে। তাদের প্রতি আমার সহানুভূতি ছিলো কিন্তু প্রশ্রয় ছিলো না।

(খ) কঠিন চোখ— মহেন্দ্র অথবা ইরফান অথবা আবদুল্লাহ ওদের একজন, ধরলাম মহেন্দ্ৰই, সোফায় বসে আমার সাথে বিভিন্ন আলাপে ব্যস্ত নানা এটা ঠিক না খুকি, রিকশা ভাড়ার ভয়ে তোমরা হলিডেগুলোতেও অন্তত কোথাও তেমন বেড়াতে যাওনা, এরকম একঘেয়ে জীবনে কেউ বাঁচতে পারে? তুমি রীতিমতো অনার্স গ্র্যাজুয়েট মেয়ে, শশুর শাশুড়ী চায় না বলেই চাকুরি করবে না, মাটি কামড়ে পড়ে থাকবে, মইন এটা খুব অন্যায় করছে….তারপর ক্রমে ক্রমে নিজের হতাশার অতলান্তে তলিয়ে যেতে যেতে, তোমাকেই বা কী বলবো খুকি, জীবনের এতগুলো বছর চলে গেলো, কোন চাকুরিতে স্থির হতে পারলাম না, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে আমিই পলিটিক্সের শিরা হয়ে যাই। ভেরেন্ডা বাজানো ছাড়া আমার দ্বারা আর কিছুই হবে ….কিছুই হবে না….এরকম একটা হতাশ পরিস্থিতি সৃষ্টি করে আমার হাতটিকে টেনে নেয় নিজের কম্পিত হাতের মুঠোয়, একমাত্র তোমরা এখানে এলে তোমার এখানে এলে…বলতে বলতে মহেন্দ্র যখন আমার নির্জন বাড়িটিতে আরও কিছুটা এগোতে চায়, তখনই মইনের দুটি কঠিন চোখ দরজা ফাঁক করে আমার দিকে চেয়ে থাকে। আমি এত্ত ভঙ্গিতে সরে যাইছি, ছি, ও আমাকে একদিনের জন্যও ফাঁকি দেয় না, অথচ আমি…।

(গ) নিষ্পাপ চোখ-—এই চোখ দুটোই আমাকে বেশি বিপন্ন করে তোলে। সেই চোখ আমার পরম আকাঙ্খিত শিশুটির। কি অদ্ভুত মায়াময় চাউনি। স্তন মুখে নিয়ে, ক্রন্দনরত অবস্থায়..কত বিচিত্র ভাবেইনা সেই চোখ আমাকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়। জানালা গলিয়ে যখন ইউক্যালিপ্টাস গাছে বাতাস শরীরে আছড়ে পড়ে, তখনই বুকের কাছে সেই চোখ নড়ে চড়ে ওঠে। ড্রয়িং রুমে হয়তো মইন পত্রিকার প্রতিটি অক্ষর খুঁটে খুঁটে পড়ছে। আমি উনুনে হালুয়া চড়িয়েছি: তিন নম্বর ছোট প্লেটটি শূন্য চোখে আমার দিকে তাকাতেই জল আসে আমার চোখে। এরকম ছোট ছোট অনেক জিনিস কিনেছি আশ্চর্য এক শূন্য অনুভব থেকে।

৬.

সকাল বেলা অফিসে যাওয়ার সময় মইনকে বগুলো জরুরি কাজের কথাই জরুরি ভাবে মনে করিয়ে দিয়েছিলো খুকি। সারা রাস্তা দাদখানি চাল, মুশুরের ডাল, চিনিপাতা দই….করতে করতে অফিসে যেতেই তালগোল পাকিয়ে গেলো। গতকালই মাত্র অতসীকে সে বলেছে ‘নীল শাড়ি আমার খুব ফেভারিট’, ধবধবে অতসী আজই নীলাম্বরী হয়ে ফর্শা আঙ্গুলের ফাঁকে কলমটিকে চেপে ধরে উবু হয়ে কি সব লিখছে। শুধু অতসী দেখবে বলেই বাসায় গেঁয়ো ভূত হয়ে থাকা মইন ফিটফাট হয়ে অফিসে আসে। নীল শাড়ির অতসীর, ফর্শা আঙ্গুলের চাপের কলমটি যদি আমিই হতাম, যদি…..তখনই দাদখানি চাল, ডাল হয়ে গেলো, চিনিপাতা দই, কই হয়ে গেলো, মুশুরের ডাল, চাল হয়ে গেলো।

তারপর ঝা ঝা রোদে বহুদিন পর সবুজাভ, হলুদাভ, নীল, গোলাপি মার্সিডিজের আহ্বান। খুকির সাথে বিয়ের পর আজকের দিনটাই একটু বেশি বেহিসাবী খরচ হয়ে গেলো। এতটা পাতালে, অতলান্তে, গভীরতায়—মইন ঘুমের মধ্যে কখনও অমন স্বপ্ন দেখেনি। যে খুকির শরীরে হাত রাখলে প্রতিদিনই তার মনে হয়েছে-সৃষ্টিকর্তা এ-কি আজব বিষয় সৃষ্টি করলেন, হাজার ব্যবহারেও যার ক্ষয় হয় না, সেই খুকির মাংসও আজ ফোমে পরিণত হয়েছে। মইন স্বপ্নের এক একটি স্তর অতিক্রম করেছে আর উপলব্ধি করেছে, জীবনে আজই প্রথম সে সত্যিকার পুরুষ হয়েছে। আজই প্রথম সে কৈশোর পেরিয়ে যৌবনে পদার্পণ করেছে।

নিদিন যাবত ওদের ফ্ল্যাটে পানি নেই। দুটোর সময় ঘরে ফিরলে খুকির-অসহ্য হয়ে উঠেছে জীন, আচ্ছা রান্না, থালাবাসন ধোয়া না হয় এক চিমটি জলে সারলাম। কিন্তু স্নান? একটু যাও নাগো, নিচের কলে—এই সবের পরে সন্ধ্যায় মইন মাসুদ রানা থেকে মুখ তুলতো। তারপর লুঙ্গিটাকে হাঁটুর ওপর উঠিয়ে থলথলে উঁড়ি নাড়তে নাড়তে দু’বালতি জল নিয়ে সিঁড়িতে উঠতে উঠতে আচমকা ভাবতো— অতসী যদি এই অবস্থায় আমাকে দেখে?

উফ কি সোভার লাগে আপনাকে বলতে বলতে কি মাথা নোয়াতে পারতো?

ঘরে ঢোকার পর হাঁটুর ওপর লুঙ্গি-পরে শার্টটাও ছুঁড়ে ফেলে সোফায় গা এলাতে এলাতে খুকির বিরক্তিকর চেহারার দিকে চেয়ে কখনও কি তার মনে হয়েছে খুকি ওর প্রেমিকা, স্ত্রী? ওর সামনেও অতটা অকৃত্রিম হওয়া ঠিক না, যতটুকু সে নিজের সামনে একা হতে পারে? কখনই মনে হয়নি। কেননা খুকিকে সব সময়ই ওর মা অথবা বড় আপা গোত্নে গার্জিয়ান মনে হয়েছে। মাঝে মাঝে মনে হয়েছে শিশু। গার্জিয়ান বা শিশুর সামনে অত ফর্মাল থাকার দরকারটা কী?

হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ অত্যন্ত জরুরিভাবে সকালে পড়া নিউজটা মনে পড়ে। আজ বৃহস্পতিবার চন্দ্রগ্রহণ। সন্ধ্যা ৭টা ৪৩ মিনিটের কয়েক মুহূর্ত পর ৫ ঘণ্টা স্থায়ী চন্দ্রগ্রহণ শুরু হইবে। চন্দ্র বা সূর্যগ্রহণের সময় আহার হইতে বিরত থাকার রেওয়াজ আবহমানকাল ধরিয়া চলিয়া আসিতেছে।

আবহমানকালকে অস্বীকার করার মতো অত শক্তি ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও মইন সঞ্চয় করতে পারেনি। সূর্যকে যেমন কপালে হারে ছাউনী দিয়ে দেখতে হয়, চাঁদকে দেখার জন্যও তেমনই মইনের অবচেতন হাত কপালে উঠে যায়। আকাশের মাঝখানে থ্যা, উচ্ছিষ্ট, ধর্ষিতা চাদ। কতক্ষণ আগে কি ধকলটাই না গেছে বেচারির ওপর দিয়ে। ভীষণ নির্জন চারপাশ। চাঁদ আজ ছুটি নিয়েছে, পড়ন্ত রাত্রে রাস্তার বা বড় অসহায় করে তুলেছে রাতকে। হাঁটতে হাঁটতে বাঁয়ের গলিতে ঢুকতেই আবার চন্দ্রগ্রহণের কথা মনে পড়ে। পিরিয়ড শুরু হওয়ার ডেট থেকে আরও পনেরো দিন পেরিয়ে গেছে খুকির। মাঝে মাঝেই এমন যায়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কিছুটা বিরতির পর পিরিয়ড শুরু হলে অঝোর হয়ে কেঁদেছে খুকি। কিন্তু এবারের ব্যাপারটা একটু ভিন্ন। ইলিশ মাছ খুব প্রিয় খুকির। সেটা খেতে গিয়ে গতকাল দুপুরে উগড়ে দিয়েছিলো সে। ফলে পাটিতে বসে দুজন দুজনের দিকে প্রশ্নবোধক চোখে তাকিয়েছিলো। নিরুত্তাপ গলায় খুকি ঘরের দেয়ালকেই বকেছিলো, মইনের দিক থেকে চোখ ঘুরিয়ে, আমি অত তাড়াতাড়ি আর খুশি হচ্ছি না। তরল গলায় মইন বলেছিলো, এবার মিস গেলে পিটিয়ে তক্তা বানিয়ে ফেলবো না! খুকি বিস্মিত চোখে ওর দিকে তাকাতেই সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠেছিলো–আরে তোমাকে না, তোমাকে না, ঋতুস্রাবকে।

চন্দ্রগ্রহণের সময় খুকি যদি আহার গ্রহণ করে থাকে? কিছুটা বিচলিত মইন রাস্তার ওপর ছড়িয়ে থাকা গন্ধযুক্ত উচ্ছিষ্টের ওপর দিয়ে দপ দপ পা ফেলে হাঁটে। ঢেকুর তুলে ভ্রু কুঁচকায়, খুকিটার তো জীবনেও ও চন্দ্রগ্রহণ টহন মনে থাকার কথা না। সারাদিন সে ফার্ণিচার এদিক সেদিন করবে, না ওসব দিকে খেয়াল দেবে। আশ্চর্য মেয়ে ও। গম্ভীরভাবে চিন্ত করে দেখে মইন, স্ব উপকরণ থাকা সত্ত্বেও শুধু ওর স্ত্রী হওয়ার কারণে রহস্যময়ী হয়ে উঠতে পারলো না। আচ্ছা চিজ বটে একখানা!

৭.

আমার নাম ভাবনা হলে বেশ হতো। আমি সারাদিন ভাবি। ঘুম থেকে ওঠে প্রায় প্রতিদিনই পত্রিকায় মৃত্যু সংবাদ খুঁটে খুঁটে পড়ি। যে বাসার মানুষের মৃত্যু হয়েছে, আমার সারাদিনের ভাবনায় তারা প্রত্যেকেই জীবন্ত হয়ে ওঠে। তাদের জায়গায় আমি নিজেকে স্থাপন করি। ভাবি, মইন ঘর থেকে বেরিয়ে যদি আর না ফেরে? এক সময় এই ভাবনাও আমাকে রোমাঞ্চিত করে। তাহলে সারাজীবন একজনের সাথে একঘেয়ে জীবন যাপনের যন্ত্রণা থেকে মুক্তি! কেউ কোন দোষ দেবে না, উল্টো সহানুভূতি! কিছুক্ষণ পরই অস্তিত্ব সংকটে শিউরে উঠি, এসব কি ভাবছি আমি? কারও সাথে কোন সাধারণ কথা হলে অতি ব্যস্ততায়ও সেই কথোপকথন আমার কানে বারবার বাজতে থাকে। এইতো সেদিন কে যেন বললো— চাকরিটা ছেড়েই দেবো ভাবছি। চাকরি ছিলো না, সে এক ভালো ছিলাম। কিন্তু চার বছর স্যান্ডেলের তলা খুইয়ে যা-ও একটা গতি হলো, মা বাবা, ভাইবোন সারাদিন এটা চাই, ওটা চাই। তিন পয়সার একটা চাকরি আমাকে রাজহাঁস বানিয়ে ফেলেছে, সংসারে একশোটা ফুটো রাজহাঁস ডিম দাও….. ডিম দাও…..

কে যে কথাগুলো বলেছে, কোথায় বলেছে ভোর থেকে রাত পর্যন্ত তন্ন তন্ন করে ভেবেও হদিস পাইনি। চাকরি যারা করে, সম্ভাব্য সবার কথাই ভেবেছি। খুঁজে পাইনি। প্রতিবেশীর সাথে, টিভি প্রোগ্রাম, শাড়ি কেনা, কাজের মানুষ রাখার ঝকমারি, ইত্যাদি আড্ডা দেয়ার সময় কাপড়ে সুই ঢোকানোর সময়, বাথরুম ঝাট দিতে দিতে, চা পাতার খালি কৌটো বাড়তে বাড়তে বারবার সেই কথাগুলো কানের কাছে চক্কর খেয়েছে। আমার এই এক মহাজ্বালা! সেদিন এক বিয়ের আসরে ঘর্মাক্ত মইন বললো— কি বিশ্রী রোদ উঠেছে। বাসায় আসার প্র এই কথাটিই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে হাজারবার ভেবেছিল কি বিশ্রী রোদ উঠেছে।

সেই ভানায় বিশ্রী শব্দটা আমার ভেত্র এমনভাবে গেঁথে যায়, আগে যেটা নিয়ে শুধু ভাবতামই, বলতাম না। তাই মাঝে মাঝে বিশ্রী শব্দকে মাঝে রেখে বলতে শুরু করলাম। যেমন, মইন যখন এক ঠ্যাং সোফায় তুলে আঙ্গুল ঢুকিয়ে একমনে নাক পরিষ্কার করতে থাকে। টেলিভিশনে হয়তো তখন একটা সুন্দর শাদাকালো অনুষ্ঠান চলছে। আমি হকচকিয়ে বলে উঠি কি বিশ্রী অবস্থা! বিয়ের আগেই আসলে ভালো ছিলো। মইনের ওপর সমস্ত খারাপ লাগা ঝেড়ে দিই। মইনের নাকে আঙ্গুল বহাল থাকে, আধবোজা চোখ মেলে জিজ্ঞেস করে টিভি প্রোগ্রামের সাতে বিয়ের আগের অবস্থার সম্পর্ক কি? অথবা ওর খুঁড়ি প্রশ্রয় পেয়ে পেয়ে ক্রমেই বিশাল হচ্ছে, কারেন্ট চলে গেলে যখন হাতপাখা দিয়ে বাতাস করে আমি ভৎর্সনা করি, পই পই করে বলি খাওয়াটা কমাও, নয়তো এক্সারসাইজ করো। তা করবে না। দিনদিন ডোম্বলদাস হয়ে দেখি কারও জ্ঞান হচ্ছে না।

যা হোক, কথা হচ্ছিলো ভাবনা নিয়ে। কত কিছু যে ভাবি আমি! রাতের স্বপ্নকে নিয়ে ভাবি, জানালায় নির্জন চোখ রেখে ঘুমন্ত শহরকে নিয়ে আমি ভাবি, কোনদিনই এক টুকরো জমি কেনা হবে না, ভাবি। একঘেয়ে একটি জীবনকে আজীবন টেনে নিয়ে যেতে হবে, ভাবি। ইরফান, মহেন্দ্র অথবা আবদুন্নাহ তিনজনের একজন আমার কর হলে কেমন হতো, ভাবি।

ভাবনার সবচেয়ে দুঃসহ, জঘন্য, আনন্দদায়ক, মৌলিক প্রয়োগ আমি আমার শরীরে ঘটাচ্ছি। খুব আশ্চর্যজনক ভাবে বিয়ের একমাস পর থেকেই আমি একটি নিরুত্তাপ শীতল মানুষ। তখন মইন ছিলো ঝড়ের মতো। অত শীতলতার পাশাপাশি সে-ই বা কেন স্বাভাবিক ভালো মানুষটি থাকবে? প্রথম কদিন ভালোমানুষী করলেও শেষে খেপে উঠতে থাকলো। তখন আমার দাদিকে ব্যাপারটা খুলে বললাম। পুরুষদের সম্পর্কে ওয়াকিবহাল দাদি এক ভীতিকর সংবাদ দিলেন আমাকে। বেশিদিন যদি আমি মইনকে এমন শীতলতা দেখাই তবে মইন অন্য নারীতে আসক্ত হবে। ঈর্ষাষিত হয়ে উঠি এবং চিন্তিত হয়ে পড়ি আমি। আমার সেই নাজুক মুহূর্তে ভানা আমাকে বিচিত্রভাবে সহায়তা করে।

আমি উপলব্ধি করি, যখন থেকে মইন আমার কাছে নিতাই শাদামাটা একজন মানুষ হয়ে গেছে, তখন থেকেই তাকে কেন্দ্র করে আমার শরীরের রঙ্গগুলি উবে যাচ্ছে। এই চিজ একবার গেলে আর কি ফেরে? তো অসুখের কারণ তো সনাক্ত করা গেলো। চিকিৎসা? প্রথমেই ভাবি, বাতি নিভিয়ে আমি মইনকে অন্য একটি পুরুষ হিসেবে গ্রহণ করবো। কিন্তু ওই যে বিবেক সংস্কার যেটা আমাকে কিছুদূর সামনে এগোতে দিয়ে টান দিয়ে পেছনে নিয়ে যায়। তার তাড়নাই আমাকে বলে দিলো, এতে করে মইনের সাথে প্রতারণা করা হবে। অন্তত যতদিন দুজন একসাথে আছি, কিছু দায়বদ্ধতা তো আছে। এছাড়াও ধর্ম? আমার পাপ হবে না?

কি করা যায়! ভাবতে ভাবতে একসময় আমি এক নতুন খেলা আবিষ্কার করে ফেলি। সেদিন রাতেই মইনকে বলি, এখন থেকে দুজন অন্ধকারে ঘুমোবো। কোন আলো থাকবে না, একদম কুচকুচে অন্ধকারে। আলো থাকা না থাকায় মইনের কিছু যায় আসে না। আমার প্রতিটি ভজ, রহস্য বই তার চেনা। আমি কি টের পাই না কি অবলীলায় সে আমার সব কিছু ছোঁয়?

শুরু হলো প্রক্রিয়ার বাস্তবায়ন। একরাতে সমস্ত ঘরে ঘোর অন্ধকার। জানলা গলিয়ে এক চিলতে আলো আসছে কি আসছে না। আমি মইনকে বলি—আজ একটু সময়ে নেবো।

নাও রাজকন্যে নাও। আমি চোখ বুজে ভাবতে শুরু করি, আমি খুকি নই, অন্য একটি সুন্দরী রমণী। খুকি ওর বাবার বাড়িতে বেড়াতে গেছে। তখন খুকিরই এক আত্মীয়া বেড়াতে এসেছে খুকির বাসায় তখন মইন একা। সুন্দরী আত্মীয়া রাত কাটাতে চাইলো। মইন তাকে সানন্দে থাকতে বললো। শেষ রাত। সুন্দরী তখন ঘুমোচ্ছে। মইন ওর রুম ছেড়ে সুন্দরীর রুমে চলে এলো। মইনের বিল সুন্দরী তখন কেবলই অস্ফুট কণ্ঠে নানা করছে।

তো এই ভাবনার পর মুহূর্তেই আমি খুকির খোলস ছেড়ে সেই সুন্দরীটির ভেতরে চলে যাই। বিস্ময়ে স্তম্ভিত হয়ে অনুভব করি, আমি জেগে উঠছি। থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে আমার সমস্ত শীতলতা রূপ নিচ্ছে এক গনগনে আগুনে, যা আমি হারাতে বসেছিলাম।

মইনের তারপর কি আনন্দ। উফ, কি ফ্রাস্টেটেড হয়ে পড়েছিলাম তোমাকে নিয়ে। এদ্দিন কি তবে ইচ্ছে করেই অমন শীতল থেকেছো? হেই খুকি! অন্ধকারে তখন অমন না না করছিলে কেন?

এভাবেই শুরু? সারাদিনের অন্য ভাবনার মধ্যে দিয়েও আমি স্থির করে রাখতাম, আজ আমি কোন রমণী হবো। আমার ঘরটি কোন ঘর হবে।

অন্যদিন তেমনই ঘর অন্ধকার। শরীরে পাউডার ছড়িয়ে ভাবি, আমি একটি বিদেশী রমণী। অফিসের সোর্সে মইন লজ্ঞ এসেছে। তো বিদেশিনী তাকে তার রুমে রাত কাটানোর জন্য সাদর আহ্বান জানাচ্ছে। খুকির কথা ভেবে ইতস্তত করছে মইন। কিন্তু বিদেশিনীর আকর্ষণীয় শরীর, ভঙ্গির কাছে এক সময় মইনের দ্বিধা টেকে না। খুকী জানলে কি যে কষ্ট পাবে, আমার নিচে ফোমের শয্যা। অন্ধকার ঘরে দামি আসবাব। খুকি জানলে কি যে কষ্ট পাবে, ভাবতে ভাবতে দোদুল্যমান মইন সেই আকর্ষণীয় গন্ধের মধ্যে ডুবে যাচ্ছে। সবুজ আলো নেই, একবিন্দু আলো নেই, গভীর গভীর অন্ধকারে খুকির খোলস ছেড়ে বিদেশিনীটি হয়ে আমি জেগে উঠি….জেগে উঠি। আমাকে কেন্দ্র করে মইনের ক্রোধ, দুশ্চিন্তার, অপূর্ণতার অবসান হয়।

কিন্তু কখনো বিদেশিনী, কখনো বারবণিতা, কখনো প্রতিবেশিনী, সুন্দরী আত্মীয়া, সমুদ্রের কাছের ডাক বাংলাতে পরিচয় হওয়া পরিচিত-আট বছর যাবত অতসব ভূমিকায় অভিনয় করতে করতে আমার একঘেয়ে শরীর, একঘেয়ে মন, কষ্টার্জিত ভাবনা, ক্রমেই নেতিয়ে পড়ছে, ক্লান্ত হয়ে পড়ছে, শীতল হয়ে পড়ছে।

কিন্তু বাঁচতে হবে বলেই একসময় সেই গভীর অন্ধকার থেকে বেরিয়ে আমি সূর্যালোকে মাথা সোজা রেখে দাঁড়াই। ভাবনার আরেকটি সুন্দর এবং রোমাঞ্চকর অধ্যায় আমাকে টেনে বাইরে আনে। সেই অধ্যায়টি আমার একজন স্বপ্নের পুরুষকে কেন্দ্র করে। যার পূর্ণাঙ্গ একটা রূপ সম্পর্কে আমি বর্ণনা দিতে পারি, কিন্তু যাকে আমি এই জীবনে দেখিনি। এই একটি মানুষকেই যতটুকু সম্ভব দ্বিধাহীন ভালোবাসি আমি। জল স্থল অন্তরীক্ষে আমার স্বপ্নের টেলিফোন বেজে ওঠে ক্রিং ক্রিং। সে ভরাট কণ্ঠে আমাকে ডাকতে থাকে…খুকি….খুকি।

অবিন্যস্ত কাপড়ে দৌড়ে যাই। রিসিভারে পৌরুষদীপ্ত আবেগঘন কণ্ঠ আছড়ে পড়ে—কোথায় ছিলিরে খুকি? ফোন ধরতে দেরি হলো? আমি চুপ।

এত ব্যস্ত থাকি! কাজ শেষে আচমকা মনে হয় তোকে। আচ্ছন্ন হয়ে পড়ি তখন।–আমি চুপ।

তোকে শিশু মনে হয় আমার, কখনো কুমারী, মাঝে মাঝে থুথুড়ে বুড়ি। বিশ্বাস কর, তুই বুড়ি হয়ে গেলে তোর সমস্ত চামড়া যখন ঝুলে পড়বে, কুটি কুটি হাঁটবি তুই, তখনো, তখনো, তোকে ভালোবাসবো, এর চেয়ে বেশি বাসবো। আমি চুপ।

আমাকে কবে ডাকবি? তুই-তো জানিস তুই না ডাকলেও আমি যাবো, ছিঁড়ে কুঁড়ে একাকার করবে তোকে। মইন এসে দেখবে তোর সমস্ত চামড়ায়, ভঁজে ভাঁজে হিংস্র আক্রমণ, পাগলের মতো হাতড়ে দেখবে ভেতর থেকে মনটাকে কে যেন খুলে নিয়ে গেছে। আমি চুপ। আমি চুপ! সেই অদৃশ্য পুরুষ আমার সমস্ত অস্তিত্বে তার দীর্ঘ ছায়া ফেলে গভীর কণ্ঠে বলে—আকাশে যাবি? সমুদ্রে যাবি খুকি?

যাবো। যাবো। রিসিভার রেখে দিই। অদ্ভুত ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ি।

৮.

হাঁটতে হাঁটতে মইনের খেয়াল হয়, সে কেবলই হাঁটছে। এত হেঁটেছে এতক্ষণ, অনেকক্ষণ আগেই তো তার বাড়ি পৌঁছে যাওয়ার কথা, কিন্তু আবছা অন্ধকার গলি, রাস্তার ময়লা, দুপাশের ছোট বড় ঘর বাড়ির চারপাশ দিয়ে কেবলই সে চক্কর খাচ্ছে। তবে কি সে রাজপথ থেকে সোজা গলিতে না ঢুকে পেছন দিয়ে পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে আসা জটিল গলিটায় ঢুকে গিয়েছিলো?

যাক বাবা! ভালোই হয়েছে সোজা গলিতে তো রোজই ঢুকি। আজ না হয় জটিল পথেই ঘুরলাম–ভাবতে ভাবতে শিস দিয়ে ওঠে মইন।

গতকাল রাতে অদ্ভুত স্বপ্ন দেখেছিলো সে। সারাদিন পর এখনই স্বপ্নটির কথা মনে পড়ে তার। ভোরেও একবার হয়েছিলো। স্বপ্নটি ছিলো এমন–দরজায় টুকটুক শব্দ হচ্ছে। দরজা খুলেই বিস্ময়ে মুখ হাঁ হয়ে উঠলো। এলোমেলো ক্লান্ত পায়ে যে পুরুষটি তার ঘরে এসে ঢুকলেন, তিনি তার বাবা। মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। সমস্ত কপালে ঘিনঘিনে ঘাম। শরীরে আঁশটে গন্ধ। তিনি থলেটা মাটিতে নামিয়ে রেখে কষ্ট করে শ্বাস টানতে থাকেন। লোকটিকে গতকালই সে বিছানায় লেপটে থাকা অবস্থায় দেখে এসেছিলো। মইনের কাঁধে সারা শরীর ভর করে দাঁড়াতে পারছিলেন না। থরথর কম্পনের সাথে বিছানায় পতিত হয়েছিলেন। অনড় ডান পা, ডান হাতকে সজোরে নিজের আয়ত্ত্বে আনার আপ্রাণ চেষ্টার পর হতাশায় শক্ত সামর্থ মানুষটির চোখে জল এসে গিয়েছিলো।

এখন তাকে শিশুর মতো টলমনে ভঙ্গিতে ঘরে ঢুকতে দেখে বোবা হয়ে গেলো সে।

গতকাল কুমিল্লায় বাবাকে দেখতে গিয়ে তার মিনমিনে কণ্ঠস্বর মার উদ্দেশ্যে ছুড়ে দিয়েছিলো সে, একবার ফিজিওথেরাপী করে দেখলে হতো।

বাবার শরীর বিছানায় আড়াআড়ি শোয়ানো। তার একটি পা-কে সজোরে নেড়ে চেড়ে এক্সারসাইজ করাতে করাতে ভগ্ন কণ্ঠে মা বলেছিলো, ওরা তো দিনে ষাট টাকা করে নেয়।

পালিয়ে এসেছিলো মইন।

স্বপ্নেও বাবাকে হেঁটে আসতে দেখে তার আগের দিন কুমিল্লায় যাওয়া, ফিজিওথেরাপী, পালিয়ে আসা সব মনে পড়ে গিয়েছিলো।

ঘুম থেকে উঠে দেখেছিলো অর্ধ বিবস্ত্র খুকি ঘুমিয়ে আছে। উত্তপ্ত দেয়াল ধরে অতি সন্তর্পণে অগ্রসরমান টিকটিকি বার বার তার অসহায় লেজ ওপর দিকে উঠাচ্ছে। জানালা দিয়ে থুথু ফেলতে গিয়ে নিচে পুড়ে যেতে থাকা ফলশা গাছের দিকে চেয়ে একবারই মাত্র স্বপ্নের কথা মনে হয়েছিলো। সারাদিনের ঘোরের পর এখন আরেকবার।

আমি কি? নিজেকে মইন প্রশ্ন করে হা হা করে হেসে ওঠে, আমি হলাম বুদ বুদ…রঙ ধনু…আর কি? আর কি?

৯.

আবদুল্লাহর সাথে খুব মজার সম্পর্ক আমার। পত্রিকা অফিসের রিপোর্টার সে। যদি জিজ্ঞেস করি, কেমন আছো হে? আস্তিন গুটিয়ে মাথা ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বলবে—স্বামীর ব্যাভিচারের দরুণ স্ত্রী তাহাকে ক্ষুব্ধ হইয়া এসিড ছুঁড়িলে সে যেমন থাকে—তেমন।

আমার ভাবনার খবর সে জানে। পত্রিকার খবর নিয়ে বেশি ভাবি, সেটাও জানে। ফলে প্রায়ই তার সাথে আমার কথা হয় এমন—

আমি জানো, আজকের পেপারে পড়লাম, নয় মাসের গর্ভবতী এক পাগলিনীকে একদল ছেলে জোরপূর্বক….।

আবদুল্লাহ্ আহা! তুমি যদি সেই পাগলিনীটি হইতে?

আমি না ঠাট্টা নয়, কি যে হচ্ছে চারপাশে। আরেকটা নিউজ পড়ে তো সেদিন স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলাম! অভাব সহ্য করতে না পেরে এক বাবা তার চার সন্তানকে বিষ খাইয়ে।

আবদুল্লাহ–আহা থামো! থামো। আমি যাহা জানি তাহা ইহার চাইতেও অধিক পৈশাচিক। এক বৃদ্ধ পিতাকে খুঁটির সাথে বাঁধিয়া তাহার সামনে রোজ রাতে একদল ছেলে তার বাবা মেয়েকে।

আমি–থাক্ থাক্। ভাল লাগে না।

আশ্চর্য! কি করে এই সব প্রসঙ্গের পর আবদুল্লাহ্ ঘোর লাগা চোখে তাকায়? বলে খুকি, তোমার অনুভব, সচেতনতা খুব সুন্দর, এই জন্যই, এই জন্যই আমি…?

ছিটকে ঘরে আসি আমি। পৃথিবীটা আমার কাছে বীভৎস হয়ে ওঠে।

আজ চন্দ্রগ্রহণ গেলো। জানালা দিয়ে চেয়ে চেয়ে দেখেছি একটি ছায়া একটি চাঁদকে গ্রাস করছে। গ্রাস করছে মনে হতেই আমার শরীরের রোম দাঁড়িয়ে যায়। আজ রাতে যখন অন্ধকারে মইন আমাকে খুঁজতে থাকবে, বিয়ের প্রথম দিকের সংস্কার, বিবেকবোধের পাছায় লাথি দিয়ে কি মহেন্দ্রকে আমন্ত্রণ জানাবো? তুমি আমাকে গ্রাস করো। গ্রাস করো! আট বছর ধরে মইনকে অনেক বিচিত্র স্বাদের নারী উপহার দিয়েছি। বড় ক্লান্তি লাগে। বিচ্ছিরি লাগে। অবসন্ন লাগে। আমার ফের শীতল হয়ে উঠতে থাকা শরীরে মইন যদি আবার ক্রুদ্ধ হয়? বিরক্তি প্রদর্শন করে?

এক সময় অন্য নারীর কাছে….?

কোনই প্রয়োজন নেই জটিলতার। তারচেয়ে এই ভালো, এবার আমি নেবো। আমার কল্পনার সার্বিক সুন্দর পুরুষকে, কখনো মহেন্দ্রকে, কখনো ইরফানকে, বিদেশী পুরুষকে, টেলিভিশন ঠিক করতে আসা মেকানিককে, রাস্তায় একবার দেখা কোন লোককে। এভাবে আরও আটটি বছর কাটিয়ে দেবো। তারপর? আরও আট বছর পর? আমার ঘুম পাচ্ছে। মইন কোথায় গেলো?

কি সব ভাবছি আমি! উঠে দাঁড়াই। ঘড়ি দেখি। চোখ গোল হয়ে আসে। ঘটর ঘটর ফ্যান অফ করে উদগ্রীব চোখ রাস্তার দিকে পাঠিয়ে দেই। সম্ভবত আমার গর্ভে জ্বণ এসেছে। গতকাল বাথরুমে উগড়ে গিয়েছিলাম। মইন তুমি ফিরে এসো…..আরও আট বছর তুমি না চাওয়া সত্ত্বেও তোমাকে বিচিত্র স্বাদের নারী দেবো, তুমি ফিরে এসো। আমি নিজেকে তোমার হাতে খুলে দেবো না, তোমাকেও নেবো না, ফিরে এসো। তুমি শুধু আর্থিক কষ্টে ভুগো, সে জন্য আমিও। কি করার আছে তোমার? সবাই কী কল্পনার মানুষের মতো সার্বিকভাবে সম্পন্ন হয়? আমি একশোবার জানি, নিশ্চিত জানি, অনন্তকাল নারী বলতে তুমি আমাকেই বুঝে। বিট্রে করলে আমিই করি, গোপনে। প্রকাশ্যে কি সম্ভব? মইন, আমরা দুজনেই দ্বিধা এবং বিবেকের কাছে অসহায়। আমি জানি আমাকে স্পর্শ করলেই তুমি জেগে উঠো না। তোমার স্পর্শে আমিও না। তবুও অন্য কোন স্পর্শে আমি জেগে উঠি, প্রকাশ্যে আমরা কেউই তা মেনে নিতে পারি না। সহ্য করতে পারি না। এ জন্য আমরা দুজনই সমান অসহায়।

ঘুম আসে আমার দু’চোখ জুড়ে। আমি আর কিছু ভাবতে পারছি না।

১০.

বেশ কিছুক্ষণ পর মইন বুঝতে পারে, তাকে কানাওয়ালায় ধরেছে। ছেঁড়া ধনুকের মতো লাফিয়ে ওঠে সে। কানাওয়ালার ভাবনাটা মাথায় আসতেই স্পষ্ট করে তাকায় চারপাশে। এতক্ষণ কি সে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে পথ চলেছে? খালি পেটে পাঁচ পেগ পড়ায় নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছে? প্রশ্নই আসে না। বিয়ের আগে বহ্বার মেথর পট্টিতে, পিকনিকে গিয়ে খাঁটি বাংলা গিলেছে। দু’বস্ত্র বিভিন্ন কারণে ভালো মানুষটি হয়ে গেছে বলেই পাঁচপেগে দিশেহারা হবে মইন। ছোঃ।

আরে এ কি! মাথা উঠায় মইন, দু’দুটো কাক এক সাথে মরে তারের সাথে ঝুলছে। কি রোমান্টিক মৃত্যু কিন্তু বাসা থেকে অফিসে যাওয়ার পথে, কখনো তো এই রাস্তায় কাক ঝুলতে দেখেনি। এটা তবে কোন পথ? কোন কোন দিন সন্ধ্যায় বাবা দেরি করে ফিরলে মার ক্রুদ্ধ অথবা চিন্তিত মুখের দিকে তাকিয়ে বলতেন, উফ বাবা! কি বিপদেই না পড়েছিলাম। আমাকে কানাওয়ালায় ধরেছিলো। তখন মনে হতো এটা বাবার নিছক একটা অজুহাত। দেরি করে ঘরে ফেরার চতুর একটা অজুহাত।

দুহাতে চোখের পিচুটি ঘষে, সোজা মাথা উঁদ বরাবর খাড়া করে রাজহাঁসের মতো গলা বাড়িয়ে পুনরায় চারপাশে তাকায়। আরে এ কি! রাস্তার পাশেই ছোট্ট একটি মাঠের মতো! মাঠের ওপর সুরকীর স্তূপ, সুরকীর ওপর একটি বিড়াল শুয়ে আছে, অথবা ঘুমোচ্ছ। বাসায় যাওয়ার পথে কখনও তো এক চিলতে খালি জমিনও চোখে পড়েনি তার।

ঘামতে থাকে মইন। মনে পড়ে, একদিন তুমুল বৃষ্টি। কি কড়কড়ে বাজ! এরমধ্যে নিস্তব্ধ রাস্তায় নেমে দেখেছিলো—ক্ষীণ শরীরে, ভিজে জবজবে কাপড় পরা একটি মানুষ রাস্তায় পড়ে আছে। অফিসের সামনেই। মইন ছিলো সেদিন অফিসের শেষ ব্যক্তি। লোকটির চারপাশে কিছু পয়সা ছড়ানো ছিটানো। কাছে ঝুঁকে মইন দেখেছিলো লোকটির পকেটে একটি ভেজা খাম। আলতো হাতে খুলে ভেজা অস্পষ্ট লেখায় চোখ বুলিয়েছিলো, বাবা, অনেকদিন হয় দেশের বাড়ি আসো না। অফিসের কি অতই ব্যস্ততা যার জন্য….।

মইন লোকটি ভিক্ষুক নয় জেনেই পালিয়ে এসেছিলো। নিচ্ছিদ্র ঘুমে অচেতন হয়তো খুকি। ঘুমিয়ে গেলে খুকি মৃতা নারী। রাতের পথে আর কতক্ষণ ঘুরবে সে? ওইতো ডানের রাস্তা, ওটাই তো…… ভাবতে ভাবতে মাথাটা ঈষৎ ঝুঁকিয়ে সামনের দিকে ঝাঁপ দেয় সে। চাঁদের নিজের কাহিল অবস্থা। সে কি পথ দেখাবে? রাস্তার টিমটিমে আলোর ওপর ভরসা করে ডানে ঘুরতেই পায়ের নিচে বিদ্যুৎ খেলে যায়। একটি বিশাল পাথর ছাতলা পড়া দেয়ালের পাশে। বাসা থেকে বেরোনোর সময় অমন বিশালতা চোখে পড়েনি তার। অর্ধেক পোস্টারে ঢাকা ছাতলা পড়া দেয়ালও। তবে কি বামের রাস্তা? কি সব আজব গলি। কালীর মতো লকলকে শুকনো জিভ বের করে রেখেছে। বিপন্ন পা রাস্তার মাঝখানে ছেড়ে দিয়ে ছেলেবেলার রাজকুমারের মতো মইন বলে ওঠে, পথ, পথ, আমায় বাড়ি নিয়ে চলো।

পথ তাকে নিয়ে চলে। শীরে বাষ্প বেরোনো শরীরকে উত্তুঙ্গ হাওয়ায় সমর্পণ করে ভাবে, কি লাভ বাড়ির খোঁজ করে–খুকি তাকে কতবার ঠেলেছে ঘর থেকে বেরোনোর জন্য। ঘরে থেকে থেকে সে হাঁপিয়ে তুলেছিলো খুকিকে। আজ সেই সে বোলো। অনেকদিন পর বেরোলো। অন্য রকম বেরোলো। আর কি সে কখনো ঘরে ফিরতে পারবে? পুতুলের লাল নীলের পরে খুকি কি আর কখনো তার সামনে সেই আগের আকর্ষণ নিয়ে দাঁড়াতে পারবে? খুকি ঠেলার আগে সেই কি এরপর ঘর থেকে বেরিয়ে পড়বে না? পথের আনন্দ তো মইনের জানা হয়ে গেছে আজ।

মইনের বুক ঠেলে দীর্ঘশ্বাস ওঠে। ঝিমঝিম করছে মাথা। রাস্তার মাঝখানে একটি মুরগি মরে পড়ে আছে। আহ্! আজ শুধু মড়া দেখছি। কি দরকার এমন অভাবের দিনে মুরগিগুলোর মরে যাওয়ার—ভেবে দক্ষিণ গলিতে পা রাখতেই—না, অড় প্রাসাদ আমাদের গলিতে নেই।

আবার হাঁটে। ক্ষিধেয় পা টলছে। এ কোন মহাজীবন তাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে? কোথায় নিয়ে যাচ্ছে? একটি খালি জায়গার ওপর দীর্ঘ বাড়ি হচ্ছে। কোমর অব্দি তৈরি হওয়া অর্ধনির্মিত বাড়িটির দিকে তাকিয়ে ঘাবড়ে যায় মইন। না, তাদের এলাকায় এমন কোন বাড়িও চোখে পড়েনি তার কিশোরবেলা থেকেই সব রাস্তা ঘাট, সিনেমা হল, অলিগলি, হাসপাতাল চেনে ফেলার পর থেকে খুব হারিয়ে যাওয়ার শখ ছিলো মইনের। কখনই কোন অবস্থাতেই সে ইচ্ছে থাকলেও হারিয়ে যেতে পারবে না—এই ভাবনাটাই চিরকাল তাকে ক্লান্ত করে তুলেছে। অনেকটা ক্ষিধে, কিছুটা ভয়, হতাশা ক্লান্তির পাশাপাশি তাই আজ অনেক আনন্দও হচ্ছে তার।

পত্রিকায় খুকি যদি বিজ্ঞাপন দিতে। মইন তুমি যেখানেই যে অবস্থায় আছে, শীগগির ….। ওইতো সোজা রাস্তা। বেশ চেনা লাগছে। তবে কি হনহন হাঁটে মইন। দ্রুত হাঁটলে পথটা শীঘ্রই হরিয়ে যাওয়ার তীব্র সম্ভাবনা আছে এদিকে আবার এবড় নারকেল গাছ কি করে এলোয় কি আজব পরিস্থিতি! কোন প্রেন্সিী তাকে অদৃশ্য দড়ি দিয়ে ঘুরাচ্ছে না তো? কিছুটা ভীত মইন দ্রুত পকেটে হাত দেয়, সিগ্রেটের খোঁজে। সিগ্রেটের কোন নেশা নেই তার। অতসী সিগ্রেট পছন্দ করে। ওর সামনে, অনেকের সামনে শো করে টানে। নেশা যেহেতু নেই, সেহেতু পকেট শূন্য। কে যেন বলেছিলোসকালে খালি পেটে সিগারেট ধরাইলেই বউয়ের খ্যাচ খ্যাচানী শুরু হয়ে যায়। আরে মাতারী তুই কি বুঝবি। খালি পেটে সিগারেট না খাইলে আমার পায়খানাই হয় না।

মনে পড়ে, অফিসের কলিগ রবীন্দ্র বাবু বলেছিলো। ধুৎ! এই প্যাঁচপ্যাঁচ অসহ্য লাগছে। শরীরটা এমন ভারি হয়ে উঠলে কেন? মইন পরখ করে দেখতে চায়, প্রেতলোক থেকে সে বেরিয়ে আসতে পেরেছে কীনা। তবে কী স্বপ্ন বই? অতসীর নীল শাড়ি, গোলাপির জ্বলন্ত চিতা, অপ্সরীর কোল থেকে লাফিয়ে পড়েই এই অন্ধ গলির প্যাচের মধ্যে চক্কর খাওয়া?

মনে পড়ে, বৃষ্টিতে লোকটাকে পড়ে থাকা অবস্থায় দেখেও মইন পালিয়ে এসেছে—এই গল্প শুনে দয়াবতী খুকি বিস্মিত চোখে তাকিয়ে ছিলো ওর দিকে। সেই চোখে কিঞ্চিৎ ঘৃণাও ছিলো। কুঁসে ওঠে মইন, ঘরে বসে বসে এক একটা পুরুষকে রূপকথার বীর রাজকুমার ভাবতে তো কষ্ট হয় না। আরে গৃহনারী, তুমি কি করে বুঝবে বিংশ শতাব্দীতে একটি অর্ধমৃত লোককে টানাটানি করা কি ঝক্কির? থানায় গিয়ে ইচ্ছে করেই নিজের হাত দুটো বাড়িয়ে দেয়া নয়? জীবনকে তুমি কতটুকু দেখেছো?

ভাবতে ভাবতে মইন ডবল মার্চের ভঙ্গিতে পুনরায় বায়ে ঘুরতেই উজ্জ্বল হয়ে ওঠে মুখ। হ্যাঁ এটাইতো সেই চারতলা বিল্ডিং। যার একটি ঘরে খুকিকে নিয়ে সে বাস করে। ক্লান্ত ভাব কেটে গিয়ে ভেতরটা ফুরফুরে হয়ে উঠতেই লে শালা! এটা তো দেখছি অতসীদের বাসা। অতসী আর তার বাসার চেহারার বেশ মিল আছে। একদিন অতসীকে বলেছিলো কথাটা। আমার বাসার সামনে তো ‘আশ্রয়’ নামের কোন নেমপ্লেট ছিলো না? অতসীদের বাসায়ও ছিলো কি? অবিকল স্টাচু মইন মহা ফাপড়ে পড়ে রাজহাঁসের মতো গলা বাড়িয়ে বাড়িটিকে খুঁটে খুঁটে দেখে। না, এটা

তো তার নিজের বাড়িই। চারতলার দড়িতে ওইতো খুকির শায়া ঝুলছে।

শায়াটাতো অতসীরও হতে পারে। ওইতো অসীদের বিল্ডিংয়ের সামনের পদ্ম ফুলের কারুকাজ।

কিন্তু, ‘আশ্রয়’ নেমপ্লেট? তুমি কে হে বাপু? তুমি তো দু’বাড়ির কোথাও ছিলে, কোত্থেকে উড়ে এসে জুড়ে বসেছে, নামটাতো খাসা হে। আমি তো এখন তোমাকেই চাইছি।

কিন্তু, কোত্থেকে এসেছো তুমি? মহা মুশকিল তো! সদ্য আমদানি হয়েছে? তাই হবে। হে হে ঠিক ধরেছি। আমাকে ঘোরে ফেলার মতলব?

ঘুম আসছে। পা দুটো মটমট শব্দে পড়তে চাইছে। এত রাতে যা-ও বাড়িটা খুঁজে পাওয়া গেলো, …ওইতো তিনতলার টবসহ ফুলের ঝাড়! মকবুল গিন্নির ছোট বেলার শখ! কিন্তু সামনের লম্বা ন্যাড়া নারকেল গাছটা দেখিয়েই তো অতসী বলেছিলো, আমাদের পাড়ায় এসে ন্যাড়া নারকেল গাছ বাড়ি কোনটি জিজ্ঞেস করলেই লোকে দেখিয়ে দেয়।

কি মুশকিল! কি মুশকিল!

পেটের ক্ষুধা এমন লেলিহান হয়ে উঠছে! বৈচিত্রপ্রিয় খুকি তত আট বছরের মধ্যে আমি এই একবারই এত রাত করায় শাসন করার বদলে উল্লসিত হবে, উল্লাসে যাবো?

অতসী কী জেগে আছে? নীল শাড়ি পড়া আর মধ্য রাতে প্রতীক্ষায় জেগে থাকা এক কথা?

তবে?

শরীরের ভুস ভুস গন্ধ নিজের নাকেই প্রকট লাগছে। ক্লান্তি, জ্বালা জ্বালা চোখ, থুবড়ে পড়তে চাওয়া পা দুটোকে সজোরে টান করে।

মইন ঘোরে পড়া মানুষের মতো তর্জনী নাড়ায়….তুমি যেই হও বাড়ি, খুকিই হও আর অতসীই হও, কি বলতে চাইছে তা আর বাড়ির কাছে মইনের খোলাখুলি বিশ্লেষণ করা হয়ে ওঠে না, নির্জন রাতে চাপা অথচ তীব্র স্বরে যে-ই হও, যে-ই হও। বলতে বলতে কম্পিত গলা বাড়িয়ে বাড়িটিকে খুঁটে খুঁটে দেখে। ভাবে, এখন সিদ্ধান্ত নেবো আমি।

আমি কোথায় যাবো।

Anuprerona
Anupreronahttps://www.anuperona.com
Read your favourite literature free forever on our blogging platform.
RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here


Most Popular

Recent Comments