Friday, April 26, 2024
Homeথ্রিলার গল্পরহস্য গল্পআমিই মিসির আলি - হুমায়ূন আহমেদ

আমিই মিসির আলি – হুমায়ূন আহমেদ

আমিই মিসির আলি - হুমায়ূন আহমেদ

আমিই মিসির আলি | হুমায়ূন আহমেদ || Amie Misir Ali by Humayun Ahmed

আপনিই মিসির আলি?

হ্যাঁ।

মেয়েটা এমনভাবে তাকাল যেন সে নিজের চোখকে ঠিক বিশ্বাস করতে পারছে না, আবার অবিশ্বাসও করতে পারছে না। বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলা থেকে নিজেকে সামলে নিয়ে নরম গলায় বলল, আমি ভীষণ জরুরি একটা চিঠি নিয়ে এসেছি। চিঠিটা এই মুহূর্তে আপনাকে না দিয়ে একটু পরে দেই? নিজেকে সামলে নেই। আমি মনে মনে আপনার চেহারা যেমন হবে ভেবেছিলাম, অবিকল সে রকম হয়েছে।

মিসির আলি মেয়েটির দিকে তাকালেন। সরল ধরনের মুখ। যে মুখ অল্পতেই বিস্মিত হয়। বারান্দায় চড়ুই বসলে অবাক হয়ে বলে, ও মাগো কী অদ্ভুত একটা চড়ুই! মেয়েটার সুন্দর চেহারা। মাথার চুল লালচে এবং কোঁকড়ানো না হলে আরো সুন্দর লাগত। বয়স কত হবে-পঁচিশ ছাব্বিশ। নাকি আরো কম? কপালে টিপ দিয়েছে, টিপটা ঠিক মাঝখানে হয় নি। বঁটা দিকে সরে আছে। মেয়েরা সাধারণত টিপ দেওয়ার ব্যাপারে খুব সাবধানী হয়। টিপ এক পাশে হলে কপালে সতীন জোটে-তাই বাড়তি সাবধানতা। এই মেয়েটা হয়তো তেমন সাবধানী নয়, কিংবা এই গ্ৰাম্য কুসংস্কারটা জানে না। মেয়েটা চোখে কাজল দিয়েছে। গায়ের রঙ অতিরিক্ত সাদা বলেই চোখের কাজলটা ফুটে বের হয়েছে। শ্যামলা মেয়েদের চোখেই কাজল মানায়, ফৰ্মা মেয়েদের মানায় না। তার পরেও এই মেয়েটিকে কেন জানি মানিয়ে গেছে।

সে পরেছে সবুজ রঙের শাড়ি। এখনকার মেয়েরা কি সবুজ রঙটা বেশি পরছে? প্রায়ই তিনি সবুজ রঙের শাড়ি পরা তরুণীদের দেখেন।…আগে শহরের মেয়েরা সবুজ শাড়ি এত পর্যন্ত না। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মেয়েদের রঙের পছন্দ কি বদলাচ্ছে? রঙ নিয়ে কোনো গবেষণা কি হয়েছে? র্যানডম স্যাম্পলিং করা যেতে পারে। প্রতিদিন পঞ্চাশটা করে মেয়ের শাড়ির রঙ দেখা হবে। একেক দিন একেক জায়গায়। আজ নিউমার্কেটে, কাল গুলিস্তানে, পরশু। ধানমণ্ডি। পরীক্ষাটা একমাস ধরে করা হবে। তারপর করা হবে। গসিয়ান কার্ড।

মিসির আলি ভুরু কুঁচকালেন। পরীক্ষাটা যতটা সহজ মনে হচ্ছে তত সহজ হবে। না। স্ট্যাটিসটিক্যাল মডেল দাঁড় করানো কঠিন হবে। মূল গ্রুপের ভেতর থাকবে সাব গ্রুপ। বিবাহিত মেয়ে, অবিবাহিত মেয়ে। উনিশ বছরের কম বয়সী মেয়ে, উনিশ বছরের চেয়ে বেশি বয়সের মেয়ে, ডিভোর্সড মেয়ে, বিধবা মেয়ে।

মেয়েটি অবাক হয়ে বলল, মনে হচ্ছে কোনো একটা বিষয় নিয়ে আপনি খুব দুশ্চিন্তা করছেন? কী নিয়ে দুশ্চিন্তা করছেন?

মিসির আলি বললেন, দুশ্চিন্তা করছি না তো।

আপনি অবশ্যই দুশ্চিন্তা করছেন। দুশ্চিন্তা না করলেও চিন্তা করছেন। কেউ যখন গভীর কিছু নিয়ে চিন্তা করে-তখন বোঝা যায়।

তুমি বুঝতে পার?

হ্যাঁ পারি। ও আচ্ছা, আমি তো পরিচয়ই দেই নি। আপনি বসতে বলার আগেই বসে পড়েছি। আমার ডাক নাম লিলি! ভালো নামটা আপনাকে বলব না। ভালো নামটা খুবই পুরোনো টাইপ। দাদি নানিদের সময়কার নাম। এখন বলতে লজ্জা লাগছে।

মিসির আলি বললেন, পুরোনো জিনিস তো আবার ফিরে আসছে। পুরোনো প্যাটার্নের গয়নাকে এখন খুব আধুনিক ভাবা হচ্ছে।

যত আধুনিকই ভাবা হোক, আমার ভালো নামটাকে কেউ কখনো আধুনিক ভাববে না। আচ্ছা আপনাকে বলে ফেলি, আপনি কিন্তু হাসতে পারবেন না।

আমি হাসব না। আমি খুব সহজে হাসতে পারি না।

আমার ভালো নাম হল মারহাবা খাতুন। নামটার একটা ইতিহাস আছে। ইতিহাসটা আরেকদিন বলব। ইতিহাসটা শুনলে এখন নামটা আপনার কাছে যতটা খারাপ লাগছে– তাত খারাপ লাগবে না। তখন মনে হবে এই নামও চলতে পারে।

এখনো যে নামটা আমার কাছে খুব খারাপ লাগছে তা না।

আপনার খারাপ লাগছে তো বটেই। আপনি ভদ্রতা করে বলছেন খারাপ না। আপনাকে দেখেই মনে হচ্ছে মানুষ হিসেবে আপনি অত্যন্ত ভদ্র। কাউকে মনে আঘাত দিয়ে আপনি কথা বলতে পারেন না।

কীভাবে বুঝলে?

এই যে আমি বকবক করে যাচ্ছি, আপনি মনে মনে খুবই বিরক্ত হচ্ছেন। কিন্তু কিছুতেই সেটা প্রকাশ করছেন না। আপনি নিজেকে ব্যস্ত রাখার জন্যে অন্য কিছু ভাবছেন। আচ্ছা সত্যি করে বলুন তো, আপনি কি আমার বকবকানিতে বিরক্ত হচ্ছেন না?

মিসির আলি জবাব না দিয়ে চুপ করে রইলেন। তিনি যথেষ্ট বিরক্ত হচ্ছেন।

একটা বয়স পর্যন্ত হয়তো মেয়েদের অকারণ অর্থহীন কথা শুনতে ভালো লাগে, তারপর আর লাগে না। এই মেয়েটি অকারণে কথা বলেই যাচ্ছে। মেয়েটার মনে গোপন কোনো টেনশন কি আছে? টেনশনের সময় ছেলেরা কম কথা বলে, মেয়েরা বলে বেশি। একটা ভালো দিক হচ্ছে মেয়েটার গলার স্বর অস্বাভাবিক মিষ্টি। কথা শুনতে ভালো লাগে। এর গলার স্বর একঘেয়ে হলে এতক্ষণে মাথা ধরে যেত।

বেলা বারোটার মতো বাজে। মিসির আলিকে নিউমার্কেট যেতে হবে। একটা কেরোসিনের চুলা সেই সঙ্গে আরো কিছু টুকিটাকি জিনিস কিনবেন। সমুদ্রতীরে নিরিবিলিতে কিছুদিন থাকার একটা সুযোগ পাওয়া গেছে। তাঁর এক ছাত্র বিনোদ চক্রবর্তী টেকনাফে কী একটা এনজিওতে কাজ করে। সে দিন পনের সমুদ্রের পাড়ে থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছে। জায়গাটার নাম কাদাডাঙ্গা। এমন একটা জায়গা যার আশেপাশের দুতিন মাইলের ভেতর কোনো লোকালয় নেই। সামনে সমুদ্র, পেছনে জঙ্গল। দিনরাত সমুদ্র দেখা, নিজে রান্না করে খাওয়া। ভাবতেই অন্য রকম লাগছে। সমুদ্র দর্শন উপলক্ষে কিছু জিনিসপত্র কেনা দরকার। আজই তা শুরু করার কথা। মেয়েটির জন্যে সম্ভব হচ্ছে না। কারো মুখের উপর বলা যায় না, তুমি চলে যাও, আমার জরুরি কাজ আছে। মিসির আলির কাজটা তেমন জরুরিও না। কেরোসিনের চুলা বিকেলেও কেনা যায়। সন্ধ্যার পরেও কেনা যায়।

আপনাকে কি আমি চাচা ডাকতে পারি?

মিসির আলি ছোট্ট নিশ্বাস ফেলে বললেন, ডাকতে পার।

যেহেতু ইউনিভার্সিটিতে মাষ্টারি করেছেন, সবাই বোধ হয় আপনাকে স্যার ডাকে। সবাই ডাকে না, তবে অনেকেই ডাকে।

লিলি ঝুঁকে এসে বলল, আমি অনেকের মতো হতে চাই না। আমি অনেকের চেয়ে আলাদা থাকতে চাই। আমি এখন থেকে আপনাকে চাচা ডাকব।

আচ্ছা।

না চাচা ডাকব না, চাচাজী ডাকব। চাচাজী ডাকের মধ্যে আন্তরিকতা আছে। চাচা ডাকের মধ্যে নেই। তাই না?

হুঁ।

লিলি ঝুঁকে এসে বলল, জী লাগালেই যে আন্তরিক হয়ে যায় তা কিন্তু না। যেমন ধরুন, বাবাজী, বাবাজী শুনতে ফাজলামির মতো লাগে না?

লিলি মুখ টিপে টিপে হাসছে। মেয়েটাকে এখন খুবই সুন্দর লাগছে। মনে হচ্ছে বেতের চেয়ারে একটা পরী বসে আছে। হঠাৎ মেয়েটাকে এত সুন্দর লাগছে কেন মিসির আলি বুঝতে পারলেন না। মানুষের চেহারাও কি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদলায়? বদলাতে পারে। দিনের একেক সময় তার মুখে একেক রকম আলো পড়ে। সেই আলোর কারণেই চেহারা বদলায়। এনসেল আড়ামের একটা ফটোগ্রাফির বইতে পড়েছিলেন–তিনটা স্পট লাইট দিয়ে যে কোনো মানুষের চেহারা নিয়ে খেলা করা যায়।

চাচাজী পান মসলা খাবেন?

না।

একটু খেয়ে দেখুন খুব ভালো। আমি নিজে বানিয়েছি। আমার নিজের ফর্মুলা। আমি এই ফর্মুলার নাম দিয়েছি-লিলিস পান পাউডার। কারণ আমার জিনিসটা পাউডারের মতো। মুখে দিয়ে কুটুর কুটুর করে চাবাতে হয় না। বুড়ো মানুষ যাদের দীতের অবস্থা ভালো না।–তাদের জন্যে খুব সুবিধা। চাবাতে হবে না।

লিলি পান পাউডারের কৌটা বাড়িয়ে দিল। হাতের মুঠোর ভেতর রাখা যায় এমন কৌটা। দেখতে খুবই সুন্দর। কৌটার গায়ে ময়ূরের পালকের ডিজাইন। মনে হয় ছোট্ট একটা ময়ূর হাতের মুঠোয় শুয়ে আছে।

মিসির আলি বললেন, তোমার কৌটাটা খুব সুন্দর।

আপনার পছন্দ হয়েছে?

হ্যাঁ পছন্দ হয়েছে।

কৌটাটা আমি আপনাকে দিয়ে দিতাম, কিন্তু দেওয়া ঠিক হবে না। আপনার কাছে এই কৌটি দেখলে সবাই হিসাহসি করবে।

কেন বল তো?

কারণ কৌষ্টাটা মেয়েদের। মেয়েরা এই ধরনের কৌটায় পিল রাখে। কোন ধরনের পিল বুঝতে পারছেন তো? বাৰ্থ কনট্রোল পিল।

ও আচ্ছা।

আপনি কি আমার কথায় লজ্জা পেয়েছেন? প্লিজ লজ্জা পাবেন না; আমার স্বভাব হচ্ছে—মুখে যা আসে বলে ফেলি। চিন্তাভাবনা করে কিছু বলি না। আপনি নিশ্চয়ই আমার মতো না। আমার মনে হয় আপনি আপনার প্রতিটি কথা খুব চিন্তাভাবনা করে বলেন। ছাঁকনি দিয়ে কথাগুলি ছাঁকেন।

মিসির আলি ঘড়িত দিকে তাকিয়ে বললেন, লিলি তুমি তোমার জরুরি চিঠিটা আমাকে দিয়ে দাও। আমার আজ একটু বের হতে হবে। আমার কিছু কেনাকাটা আছে।

কেরোসিনের চুলা কিনবেন?

মিসির আলি খুবই চমকালেন, কিন্তু মুখের ভাবে কিছুই প্রকাশ করলেন না। তিনি কেরোসিনের চুলা ঠিকই কিনবেন, কিন্তু এই তথ্য মেয়েটির জানার কথা না। টেবিলের উপর কোনো কাগজের টুকরাও নেই, যেখানে কেরোসিনের চুলা লেখা। থটি রিডিং জাতীয় কিছু? সেই সম্ভাবনাও ক্ষীণ। ইএসপির কথা খুব শোনা যায়। বাস্তবে দেখা যায় না?

মিসির আলি মনের বিস্ময় চেপে রেখে বললেন, হ্যাঁ একটা কেরোসিনের চুলা কিনব।

আমি যে বলে দিতে পারলাম। এতে অবাক হন নি?

প্ৰথমে অবাক হয়েছিলাম। এখন অবাক হচ্ছি না।

এখন অবাক হচ্ছেন না কেন? আমি কীভাবে কেরোসিনের চুলার ব্যাপারটা বলে ফেলেছি তা ধরে ফেলেছেন–এই জন্যে অবাক হচ্ছেন না?

হ্যাঁ।

আচ্ছা বলুন, আমি কীভাবে বলতে পারলাম কেরোসিনের চুলা?

আমি লক্ষ করেছি। তুমি কথা বলার সময় যতটা না। আমার চোখের দিকে তাকাও তারচেয়ে বেশি তাকাও আমার ঠোটের দিকে। কথা বলার সময় ঠোঁটের দিকে তোকানোর প্রয়োজন পড়ে না, কারণ শব্দটা আমরা কানে শুনতে পাই। তুমি ঠোঁটের দিকে তাকাচ্ছ তার মানে তুমি লিপ রিডিং জোন। আমি নিশ্চয়ই তোমার সঙ্গে কথা বলার সময় বিড়বিড় করে কেরোসিনের চুলা বলেছি। তুমি ঠোঁট নাড়া দেখে বুঝে ফেলেছি।

লিলি হাসতে হাসতে বলল, আপনাকে আমি দশে সাড়ে নয় দিলাম। আসলেই আপনার বুদ্ধি আছে।

তোমার কি ধারণা হয়েছিল বুদ্ধি নেই?

আপনাকে তো আমি খুব ভালোমতো জানি না। যা জানি বইপত্র পড়ে জানি। বইপত্রে সব সময় বাড়িয়ে বাড়িয়ে লেখা হয়। তাছাড়া চাচাজী আপনি কিছু মনে করবেন না। আপনার চেহারায় হালকা বোকা ভাব আছে। আপনি নিজে তো নিজেকে আয়নায় দেখেন। ঠিক বলছি না চাচাজী?

হ্যাঁ ঠিক বলছ।

আমি বুঝতে পারছি আমাকে বিদায় করতে পারলে আপনি খুশি হন। আমি আর মাত্ৰ বারো মিনিট থাকব। তারপর চলে যাব।

হিসাব করে বারো মিনিট কেন?

লিলি হাসিমুখে বলল, একটা বাজার ঠিক দশ মিনিট পরে আপনাকে আমি চিঠিটা দেব। এই চিঠি আগেও দেওয়া যাবে না, পরেও দেওয়া যাবে না। একটা বাজার ঠিক দশ মিনিট পরেই দিতে হবে। কারণটা হচ্ছে আজ মে মাসের ছয় তারিখ। এই তারিখে সূৰ্য ঠিক মাথার উপর আসবে একটা বেজে দশ মিনিটে। যিনি চিঠিটা আমার কাছে দিয়েছেন, তিনি এইসব বিষয় খুব ভালো জানেন। সূৰ্য মাথার উপর আসার ব্যাপারটা আমি তার কাছ থেকে জেনেছি।

চিঠিটা কে দিয়েছে তোমার হাজবেন্ড?

জী।

তার শখ কি আকাশের তারা দেখা? যারা আকাশের তারা দেখে এইসব ব্যাপার তারাই খুব ভালো জানে।

হ্যাঁ তিনি আকাশের তারা দেখেন। তাঁর তিন-চারটা টেলিস্কোপ আছে। আচ্ছা চাচাজী বইপত্রে পড়ি আপনার অবজারভেশন ক্ষমতা অস্বাভাবিক। দেখি তো কেমন? আমাকে দেখে আমার হাজবেন্ড সম্পর্কে বলুন। বলা কি সম্ভব?

না সম্ভব না।

কিছু নিশ্চয়ই বলা সম্ভব। এই যে আমি বললাম–তিনি আকাশের তারা দেখেন। এই বাক্যটায় আমি সম্মানসূচক তিনি ব্যবহার করেছি। এখান থেকেই তো আপনি বলতে পারবেন যে, আমার স্বামীর বয়স বেশি। সমবয়সী হলে বলতাম, ও আকাশের তারা দেখে।

মিসির আলি নড়েচড়ে বসলেন। এই মেয়েটির সহজ সরল চোখের ভেতরে তীক্ষ্ণ চোখ লুকিয়ে আছে। এই চোখকে অগ্রাহ্য করা ঠিক না।

কেরোসিনের চুলা কিনতে চাচ্ছেন কেন?

আমি কয়েক দিনের জন্যে বাইরে যাব। নিজে রান্নাবান্না করে খেতে হবে। তার প্ৰস্তুতি।

শুধু কেরোসিনের চুলা কিনলে হবে না। এর সঙ্গে আরো অনেক কিছু কিনতে হবে। কী কী কিনতে হবে আসুন তার একটা লিস্ট করে ফেলি। এতে দ্রুত সময় কেটে যাবে।

লিলি তার হ্যান্ডব্যাগ খুলে কাগজ কলম বের করুল। মিসির আলিকে অবাক করে দিয়েই টেবিলে ঝুঁকে দ্রুত লিখে ফেলল–

১. কেরোসিনের চুলা
২. চুলার ফিতা
৩. কেরোসিন
৪. ছুরি
৫. কাঠের বোর্ড (মাছ গোশত কাটার জন্যে)
৬. কেতলি
৭. সসপ্যান
৮. দুটি হাঁড়ি (ভাতের এবং তরকারির)
৯. চায়ের কাপ
১০. চামচ
১১. কনডেন্সড মিল্ক
১২. চা
১৩. কফি

মেয়েটা এমনভাবে লিখছে যেন মিসির আলি চেয়ারে বসে পড়তে পারেন। মেয়েটার এই ভঙ্গিটা ভালো লাগছে। কাজের ভঙ্গি। কাজটা সে হেলাফেলার সঙ্গে করছে। না, গুরুত্বের সঙ্গে করছে।

আপনি এক যাচ্ছেন?

হ্যাঁ।

আমারও মাঝে মাঝে খুব ইচ্ছা করে একা কোথাও গিয়ে থাকতে। রবিনসন ক্রুশোর মতো একা কোনো দ্বীপে বাস করা। কী করব না করব কেউ দেখবে না। আমার মনে হয়। আমি একা এক সারা জীবন কাটাতে পারব। আচ্ছা চাচাজী আপনি কি পারবেন?

বুঝতে পারছি না। আমি কখনো ভেবে দেখি নি।

কোনো পুরুষ মানুষের পক্ষে এক একা সারা জীবন কাটানো সম্ভব না। পুরুষদের নানান ধরনের চাহিদা আছে। ভদ্র চাহিদা, অভদ্র চাহিদা। ওদের চাহিদার শেষ নেই।

মেয়েরা কি তার থেকে মুক্ত?

মেয়েরাও তার থেকে মুক্ত না। তবে মেয়েরা ব্যক্তিগত চাহিদার কাছে কখনো পরাজিত হয় না। পুরুষরা হয়।

লিলি লেখা বন্ধ করে সোজা হয়ে বসতে বসতে বলল, সব মিলিয়ে আটত্রিশটা আইটেম লিখেছি। এই আটত্রিশটা আইটেম সঙ্গে নিয়ে গেলে আপনি একা একা থাকতে পারবেন। এর মধ্যে অষুধও আছে। চট করে অসুখবিসুখ হলে ডাক্তারখানা পাবেন না।

থ্যাংক য়্যু। আমি কাল আবার আসব। এর মধ্যে যদি আরো নতুন কোনো আইটেমের নাম মনে আসে আপনাকে বলব।

আচ্ছা।

লিলি ছোট্ট নিশ্বাস ফেলে বলল, এখন একটা বেজে দশ মিনিট। এই নিন চিঠি। দয়া করে ঝুড়িতে ফেলে দেবেন না। পড়বেন। তবে আমার সামনে পড়বেন না। আমি চলে যাবার পর পড়বেন।

অবশ্যই পড়ব।

আমি বাজার করতে খুব পছন্দ করি। আপনি যদি রাজি হন তাহলে কাল যখন আসব তখন আপনাকে নিয়ে কেরোসিনের চুলাটুলা কিনে দেব। আপনি যে দামে কিনবেন, আমি তার অর্ধেক দামে কিনে দেব। আর কিছু আইটেম আছে যা দোকানে গেলে মনে পড়বে। কাগজ কলম নিয়ে বসলে মনে পড়বে না। এই তো এখন একটা জরুরি। আইটেম মনে পড়ল, ন্যাকড়া।

ন্যাকড়া?

হ্যাঁ ন্যাকড়া। ন্যাকড়াকে মোটেই তুচ্ছ মনে করবেন না। চুলা থেকে গরম চায়ের কেতলি নামাবেন কীভাবে? হাতের কাছে ন্যাকড়া না থাকলে হয়তো গায়ের শার্টের একটা অংশ দিয়ে নামাতে যাবেন-তারপর এ্যাকসিডেন্ট। সারা গা গেল পুড়ে। ভালো কথা অষুধের লিষ্টে আমি বার্নল লিখে দিয়েছি। নিতে কিন্তু ভুলবেন না।

আচ্ছা ভুলব না।

চাচাজী বাজার করার সময় আমাকে কি আপনি সঙ্গে নেবেন?

তুমি কাল আসি তখন দেখা যাবে। আমার সমস্যা কি জান? আমি আমার নিজের কাজগুলি নিজেই করতে ভালবাসি। কেউ আমাকে কোনো ব্যাপারে সাহায্য করছে এটা ভাবতেই আমার কাছে খারাপ লাগে।

এই জন্যেই কি বিয়ে করেন নি?

বিয়ে না করার পেছনে এটা কারণ হিসেবে কাজ করে নি। বউকে দিয়ে কাজ করাব-এই ভেবে তো আর কেউ বিয়ে করে না।

কাল আমি ঠিক এগারটার সময় আসব।

আচ্ছা।

আমার যেতে ইচ্ছা করছে না। আরো কিছুক্ষণ আপনার সঙ্গে গল্প করতে ইচ্ছা করছে। বসব?

না। আমি একনাগাড়ে কারো সঙ্গেই পঞ্চাশ মিনিটের বেশি গল্প করতে পারি না। দীর্ঘদিন মাষ্টারি করেছি। তো। মাষ্টারদের ক্লাসগুলি হয় পঞ্চাশ মিনিটের। যে সব শিক্ষক দীর্ঘদিন অধ্যাপনা করেছেন তারা কখনো পঞ্চাশ মিনিটের বেশি কোনো সিটিং দিতে পারেন না।

আমার নাম কি আপনার মনে আছে?

মনে আছে। ডাক নাম লিলি। ভালো নাম মারহাবা খাতুন।

আমার ভালো নাম আসলে মারহাবা খাতুন না। মাহাবা বেগম। আমি মার পরে একটা র বসিয়ে মাহাবাকে মারহাবা করেছি।

মাহাবা তো বেশ আধুনিক নাম। তুমি কেন বললে খুব পুরোনো ধরনের নাম?

মিথ্যা করে বললাম। ছোট্ট একটা পরীক্ষা করলাম। মিথ্যা কথা বললে আপনি ধরতে পারেন কি না সেই পরীক্ষা। আমি আপনাকে নিয়ে লেখা একটা বইয়ে পড়েছি কেউ মিথ্যা কথা বললে আপনি সঙ্গে সঙ্গে ধরে ফেলেন। আসলে আপনি পারেন না।

তুমি নাম নিয়ে মিথ্যা বলতে পার এটা মাথায় আসে নি। কাজেই আমি সেইভাবে তোমাকে লক্ষ করি নি।

মেয়েদের সম্পর্কে আপনি আসলে খুব কম জানেন। নিজের নাম নিয়ে মিথ্যা কথা বলতে মেয়েরা খুব পছন্দ করে।

তাই নাকি?

হ্যাঁ। ধরুন কোনো মেয়ে টেলিফোন ধরেছে। অপরিচিত একজন পুরুষ জিজ্ঞেস করুন, আপনি কে বলছেন? মেয়েটা তখন নিজের নাম না বলে ফট করে তার বান্ধবীর নাম বলে দেবে। আচ্ছা। আমি যাই, আপনি তো আবার পঞ্চাশ মিনিটের বেশি কথা বলেন না। আমি যে বাড়তি কিছুক্ষণ কথা বললাম-কেন বললাম জানেন? পঞ্চাশ মিনিট পুরো করার জন্যে বললাম। আমি আপনার কাছে এসেছি। সাড়ে বারোটায়। এখন বাজছে একটা বিশ। পঞ্চাশ মিনিট হয়েছে?

হ্যাঁ হয়েছে।

আপনি আমাকে দ্রুত বিদায় করতে চাচ্ছিলেন। আমি চলেই যেতাম। কিন্তু পঞ্চাশ মিনিটের কথা বলে আপনি নিজেই নিজের ফাঁদে আটকে গেলেন। খুব বুদ্ধিমান মানুষদের এটা একটা সমস্যা। নিজেদের তৈরি করা ছোট ছোট ফাঁদে তারা নিজেরা ধরা পড়ে। চাচাজী যাই?

আচ্ছা যাও।

মিসির আলি মেয়েটিকে বাড়ির গোট পর্যন্ত এগিয়ে দিলেন। এই কাজটা তিনি সচরাচর করেন না।

লিলি গেট পার হয়ে থমকে দাড়িয়ে পড়ল। লজ্জিত গলায় বলল, চাচাজী আমি খুব দুঃখিত।

মিসির আলি বললেন, কেন বল তো?

আমি বুঝতে পারছিলাম। আপনি আমার উপর খুব বিরক্ত হচ্ছেন, তারপরেও আমি চলে যাই নি; বরং আপনি যেন আরো বিরক্ত হন। সেই চেষ্টা করেছি। আসলে আপনার সামনে থেকে চলে যেতে ইচ্ছা করছিল না।

মিসির আলি বললেন, আমি যতটা বিরক্ত হয়েছি বলে তুমি ভাবছ, তত বিরক্ত কিন্তু আমি হই নি। বরং তোমাকে আমার ইন্টারেষ্টিং একটি মেয়ে বলে মনে হয়েছে।

তাহলে চলুন আবার ঘরে ফিরে যাই। কিছুক্ষণ গল্প করি। বলতে বলতে লিলি হেসে ফেলল। মিসির আলিও হাসলেন। লিলি বলল, আপনাকে ভয় দেখাবার জন্যে বললাম, আপনি কি ভেবেছিলেন আমি আরো ঘণ্টাদুই আপনার সঙ্গে বকবক করব? আপনার মাইগ্রেনের ব্যথা তুলে তারপর বিদেয় নেব?

লিলি হাসছে। এই মেয়েটার হাসি একটু অন্যরকম। সে যখন হাসে তার চোখে পানি জমে। এই হাসির একটা নোমও আছে–অশ্রু হাসি।

জনাব মিসির আলি

জনাব মিসির আলি

শ্রদ্ধাষ্পদেষু,

আমার স্ত্রী লিলি নিশ্চয়ই অনেক নাটকীয়তা করে এই চিঠি আপনার হাতে দিয়েছে। সে এমন এক মেয়ে যে কোনো রকম নাটকীয়তা ছাড়া কিছু করতে পারে না। খুব সহজ কথাও সে সহজে বলবে না। দুতিন জায়গায় প্যাঁচ দিয়ে বলবে। সহজ কথাটাকেই তখন মনে হবে ভয়ঙ্কর জটিল। আপনি খুব বড় সাইকিয়াট্রিস্ট, আপনার কাছে হয়তো এর ব্যাখ্যা আছে, আমার কাছে কোনো ব্যাখ্যা নেই।

যাই হোক মূল প্রসঙ্গে আসি। আমি এবং আমার স্ত্রী আমরা দু জনই আপনার মহাভক্ত। আপনার বিষয়ে প্রকাশিত প্রতিটি গ্রন্থ আমার স্ত্রী কয়েকবার করে পড়েছে, এবং আমাকেও পড়তে বাধ্য করেছে। আমি আপনার সঙ্গে নিরিবিলিতে কিছু কথা বলার জন্যে অত্যন্ত আগ্রহ্যাঁ। সবচেয়ে ভালো হত। আমি যদি লিলির সঙ্গে ঢাকায় চলে আসতে পারতাম। তা সম্ভব হচ্ছে না, কারণ আমি বন্দি জীবনযাপন করছি। গতি সাত বছর ধরেই আমি হুইল চেয়ারে আছি। রোড এ্যাকসিডেন্টে সম্পাইনাল কর্ড জখম হয়েছিল। আপনি তো জানেন স্পাইনাল কর্ডের জীবকোষ কখনো রিজেনারেট করে না। আমাকে আমার ভাগ্য মেনে নিতে হয়েছে। চাকার জীবনে অভ্যস্ত হবার চেষ্টা করছি। অভ্যস্ত হওয়া সম্ভব হচ্ছে না। কখনো হবে তাও মনে হয় না। নিজেকে এখন আর আমার মানুষ বলে মনে হয় না। মনে হয় আমি একটা দুচাকার রিকশা।

আপনাকে ভুলিয়েভালিয়ে এখানে আনার একটি পরিকল্পনা আমি এবং আমার স্ত্রী দুজনে মিলে করেছি। জানি না। আপনাকে কনভিক্ষস করতে পারব কি না। চেষ্টা করে দেখা যাক। আমার এখানে আসার জন্যে তিনটি টোপ আমি ফেলছি। কেন জানি আমার মনে হচ্ছে প্ৰথম দুটি টোপ কাজ না করলেও শেষটি করবে। টোপ দিয়ে মাছের মতো মানুষও ধরা যায়।

টোপ নাম্বার এক

আমাদের বসতবাড়িটা মেঘনার পাড়ে। উঁচু পঁচিল দিয়ে ঘেরা দোতলা পাকা দালান। দোতলায় প্রশস্ত টানা বারান্দা। বারান্দা থেকে মেঘনা দেখা যায়। না দেখা গেলেই ভালো হত। কারণ এই মেঘনা জমি গ্রাস করতে করতে দ্রুত এগিয়ে আসছে। যে কোনো সময় (হয়তো এ বছরই)। আমাদের এই অতি চমৎকার বাগানবাড়িটা গ্ৰাস করবে। আমাদের বাড়িটা চমৎকার। বাড়ির সামনের বাগান চমৎকার! আমি নিশ্চিত একবার আপনি এসে উপস্থিত হলে অবাক বিশ্বয়ে বলবেন-বাকি জীবনটা এখানে কাটিয়ে দিতে পারলে কী ভালোই না হত! আমাদের বাড়ির পেছনে কিছু অদ্ভুত গাছ বাড়ির আদি মালিক বাবু অশ্বিনী রায় (আমার দাদাজান এই বাড়ি পরে তার কাছ থেকে কিনে নিয়েছিলেন।) লাগিয়েছিলেন। গাছগুলির নাম এখানে কেউ জানে না। এর মধ্যে একটা গাছের গা থেকে নীল বর্ণের কষ বের হয়। দু বছর পরপর মরিচের ফুলের মতো নীল রঙের ফুল ফোটে। আমার স্ত্রী এই গাছটির নাম দিয়েছে–নীল মরিচ গাছ! আমার এখানে যে-ই আসে সে-ই এই গাছটার একটা নাম দেয়। আপনিও হয়তো একটা নাম দেবেন।

টোপ নাম্বার দুই

আপনার বিষয়ে একটা বইয়ে পড়েছি আপনার সারা জীবনের শখের বস্তু হল ভালো একটা টেলিস্কোপ। যে টেলিস্কোপে আপনি বৃহস্পতির চাঁদ দেখতে পারবেন, শনির বলয় দেখতে পারবেন। আপনার অবগতির জন্যে জানাচ্ছি, টেলিস্কোপ চোখে দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকা বর্তমানে আমার একমাত্র শখ। বৃহস্পতি গ্রহের চাঁদ দেখা বা শনির বলয় দেখার চেয়েও বিস্ময়কর দৃশ্য এড্রোমিডা নক্ষত্রপুঞ্জ দেখা। নক্ষত্রপুঞ্জের স্পাইর্যালে শত শত নক্ষত্র ঝলমল করছে। এই দৃশ্য একবার দেখলে সারা জীবনের জন্যে আকাশের গায়ে আটকে থাকতে হবে। আমি সর্বশেষ যে টেলিস্কোপটি এনেছি তার সঙ্গে ট্ৰেকার যুক্ত। পৃথিবীর ঘূর্ণনের সঙ্গে টেলিস্কোপও ঘুরবে, কাজেই আকাশে যে কাণ্ডুটিকে ফোকাস করা হয়েছে সেই বস্তু কখনো দৃষ্টির আড়াল হবে না। আপনি যদি আসেন। দুজনে মিলে আকাশের তারা দেখব। দুজনে মিলে দেখব। কারণ লিলির তারা দেখার বিষয়ে কোনো আগ্রহ নেই। আমি ঠিক করে রেখেছি। আমার চারটা টেলিস্কোপের একটা আমি আপনাকে উপহার দেব। চারটা টেলিস্কোপই আমার অত্যন্ত প্রিয়। সেখান থেকে আপনাকে একটা উপহার হিসেবে দিতে আমার কষ্ট যে হবে না তা না। কষ্ট হবে। তবে আপনি এই টেলিস্কোপ চোখে লাগিয়ে গাঢ় আনন্দ পাবেন এটা ভেবেই সেই কষ্ট দূর করব।

টোপ নাম্বার তিন

এইটিই শেষ টোপ। আমি নিশ্চিত এই টোপে আপনি কাবু হবেন। ইএসপি ক্ষমতাসম্পন্ন মানুষ সম্পর্কে আপনার প্রবল কৌতূহল। সালমা নামের একটি ১৪/১৫ বছরের মেয়ে আমাদের সন্ধানে আছে। গ্রামেরই মেয়ে।

মেয়েটি অতীন্দ্ৰিয় ক্ষমতাসম্পন্ন। আমি নানাভাবে পরীক্ষা করেছি। এবং নিশ্চিত হয়েছি। একটি পরীক্ষা হল বিখ্যাত জেনার টেস্ট। তার ক্ষমতা কোন পর্যায়ের সেটা এখন আর ব্যাখ্যা করলাম। না। কিছুটা রহস্য রেখে দিলাম।

টোপ নাম্বার চার

যদিও তিনটা টোপ ব্যবহার করার কথা ছিল, তারপরেও আমি চতুৰ্থ টোপটি ব্যবহার করছি। অনেকের ব্যাপারে এই টোপ কাজ করলেও আপনার ব্যাপারে করবে বলে মনে হচ্ছে না। এটা হল। লিলির রান্না। রান্নার উপর নোবেল পুরস্কার দেবার ব্যাপার থাকলে প্রতি বছরই সে একটা করে নোবেল পুরস্কার পেত। সামান্য আলু ভাজাও যে অমৃতসম খাদ্য হতে পারে লিলির আলু ভাজা না খেলে বুঝতে পারবেন না।

টোপ নাম্বার পাঁচ

ক্ষমা প্রার্থনাপূর্বক আরো একটি টোপ। এটি আপনাকে কাবু করে ফেলবে বলে আমার ধারণা। আমার ব্যক্তিগত লাইব্রেরির কথা বলছি। বইয়ের মোট সংখ্যা আঠার হাজারের বেশি। আপনার পছন্দের বিষয়ে (সাইকোলজি, বিহেভিয়ারেল সায়েন্স) প্রচুর বই আছে। শুধু একটি নাম উল্লেখ করছি Asmond-এর The Other Mind.

মিসির আলি সাহেব, কয়েকটা দিনের জন্যে আপনি কি আসতে পারেন না? আমার শরীর পঙ্গু, কিন্তু মনটা পঙ্গু না। আপনি নিজে একজন সতেজ মনের মানুষ। আপনার সঙ্গে মানসিক যোগাযোগের জন্যে গভীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছি।

বিনীত
এস. সুলতান হক

পুনশ্চ : আকাশ দেখার জন্যে এই সময়টা খুব ভালো। কুয়াশা থাকে না। এবং চারদিন পরই অমাবস্যা। আকাশ ভর্তি হয়ে যাবে তারায়। শুক্লপক্ষ তারা দেখার জন্যে ভালো না। চাঁদের আলোয় তারাদের ঔজ্জ্বল্য কমে যায়। কাজেই এখনি সময়।

মিসির আলি যে কোনো চিঠি তিনবার পড়েন। চিঠির ভেতরে কিছু কথা থাকে যা একবার পড়ে ধরা যায় না। দ্বিতীয় কিংবা তৃতীয়বারে ধরা পড়ে। এটিও তিনবার পড়লেন। সুন্দর চিঠি। সুন্দর হাতের লেখা। প্রতিটি অক্ষর স্পষ্ট। কাটাকুটি যে নেই তা না। তবে কাটা অংশগুলি হোয়াইট ইঙ্ক দিয়ে মুছে দেওয়া। ভদ্রলোকের বাগানবাড়িতে যেতে ইচ্ছা করছে। কিন্তু সম্ভব না। মিসির আলি তাঁর ছাত্রকে কুরিয়ারে চিঠি দিয়েছেন! সে সব কাজ ফেলে টেকনাফে এসে বসে থাকবে। তিনি না পৌঁছলে খুব অস্থির বোধ করবে। দুশ্চিন্তা করবে। তিনি কাউকে অকারণ দুশ্চিন্তায় ফেলতে চান না।

লিলিকে দেখে

লিলিকে দেখে মিসির আলি চিনতে পারলেন না। চিনতে পারার কথাও না-দরজা ধরে যে দাঁড়িয়ে আছে সে আগের দিনের লিলি না, অন্য কেউ। মাথার চুল নীল রঙের স্কার্ফ দিয়ে ঢাকা। চোখে কালো চশমা। ঠোঁটে গাঢ় লাল লিপস্টিক। জাপানি কিমানের মতো একটা পোশাক পরেছে। তার রঙ দেখে চোখ ধাধিয়ে যায়। উঁচুহিলের জুতা পরেছে। বলে তাকে দেখাচ্ছেও অনেক লম্বা।

চাচাজী আমাকে চিনতে পারছেন না, আমি লিলি। মাহাবা বেগম।

মিসির আলি বিড়বিড় করে বললেন, ও আচ্ছা আচ্ছা।

সত্যি করে বলুন তো আমাকে চিনতে পেরেছিলেন?

না চিনতে পারি নি।

মানুষের চেহারা মনে রাখা কত কঠিন দেখলেন?

দেখলাম।

আমি কী করেছি। জানেন? লম্বা করে লিপস্টিক দিয়ে ঠোঁট লম্বা করেছি। মানুষকে চেনা যায় ঠোঁট দিয়ে আর চোখ দিয়ে। যে দুটা জিনিস দিয়ে চেনা যায়, সে দুটা জিনিস আমি বদলে দিয়েছি! চশমা দিয়ে চোখ ঢেকেছি। আর ঠোঁট বদলে দিয়েছি।

মিসির আলি বললেন, লিলি বোস! তোমাকে সুন্দর লাগছে।

সুন্দর দেখাবার জন্যে আমি সাজ করি নি। নিজেকে বদলে দেবার জন্যে করেছি। ভালো কথা চাচাজী, আপনি কি কেরোসিনের চুলা এইসব কিনে ফেলেছেন?

না কেনা হয় নি।

লিলি স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বলল, বাঁচলাম। কারণ আমি সব কিনে ফেলেছি। এমন অনেক কিছু কিনেছি যা লিষ্টে ছিল না, যেমন হারিকেন, টর্চ, ব্যাটারি। হাফ কেজি সুতলি কিনেছি।

সুতলি কেন?

এখন আপনার কাছে মনে হচ্ছে সুতলি কী জন্যে? কিন্তু একা থাকতে গিয়ে দেখুন সুতলি কত কাজে লাগবে। মশারি খাটাবার জন্যে লাগবে। ভেজা জামা কাপড় শুকুতে দেবেন–তার জন্যে দড়ি টানাতে হবে। আরো অনেক কিছুর জন্যে লাগবে। শলার ঝাড়ুও কিনেছি।

কত টাকা খরচ হযেছে?

আপনার বাজেটের চেয়ে কম লেগেছে।

তুমি তো জানি না। আমার বাজেট কত?

বাজেট যতই হোক, তারচেয়ে কম। কারণ বাংলাদেশে আমার চেয়ে দরদরি আর কেউ করতে পারে না। চাচাজী শুনুন। এই যে বাজারটাজার করে ফেলেছি তার জন্যে রাগ করেন নি তো?

না।

প্লিজ রাগ করবেন না। আরেকটা কথা জিনিসগুলির দাম দেবারও চেষ্টা করবেন। না। কোনো লাভ হবে না। কারণ কিছুতেই দাম দিতে পারবেন না। আমার হাজবেন্ডের চিঠিটা পড়েছেন?

হ্যাঁ।

আপনি টোপ গেলেন নি। তাই না? আপনি নিশ্চয় সমুদ্র ফেলে তারা দেখতে যাচ্ছেন না? সমুদ্র হাত দিয়ে ছোয়া যায়। আকাশের তারা যত সুন্দরই হোক হাত দিয়ে ছোয়া

তারা দেখার ইচ্ছা থাকলেও যেতে পারছি না। আমার এক ছাত্রের সঙ্গে সবকিছু ঠিক করা। সে আবার আমাকে অতিরিক্ত রকমের শ্রদ্ধাভক্তি করে। সে টেকনাফে এসে বসে থাকবে।

লিলি হাসিমুখে বলল, আপনাকে টেকনাফে না দেখলে তার মাথা খারাপের মতো হয়ে যাবে। সে ভাববে আমাদের স্যার তোলা টাইপ মানুষ, না জানি তার কী হয়েছে!

ঠিক বলেছ লিলি।

আমার কোনো ইএসপি ক্ষমতা নেই, কিন্তু আমি জানতাম। আপনি আমাদের এখানে আসবেন না। আমি আমার হাজবেন্ডকে সেটা বলেছি। সে বিশ্বাস করে নি। তার ধারণা সে এমন গুছিয়ে চিঠিটা লিখেছে যে চিঠি পড়েই আপনি হোণ্ড অল বেঁধে রওনা দিয়ে দেবেন। উত্তর দক্ষিণে তাকবেন না।

মিসির আলি বললেন, চিঠিটা খুবই গুছিয়ে লেখা।

লিলি বলল, আপনার জন্যে চিঠিটা গুছিয়ে লেখা না। আবেগ আছে এমন সব মানুষদের জন্যে চিঠিটা গুছিয়ে লেখা। আপনি তাদের দলে পড়েন না।

তোমার ধারণা আমার আবেগ নেই?

আছে তবে তা সাধারণ মানুষের আবেগ না। অন্য ধরনের আবেগ। আপনাকে যদি লেখা হত-আমি মহাবিপদে পড়েছি। মারা যাচ্ছি। একমাত্র আপনি আমাকে মৃত্যুর হাত থেকে বাচাতে পারেন। তাহলে আপনি চলে যেতেন। কিন্তু সেটা তো আর লেখা যাবে না। কারণ ও মারা যাচ্ছে না!

মিসির আলি বললেন, লিলি তুমি এক কাজ করা! তোমাদের ঠিকানাটা লিখে রেখে যাও। সমুদ্র দেখা শেষ হলে তোমাদের ওখানে চলে যাব।

আপনি একা একা খুঁজে বের করতে পারবেন না। যাওয়াও খুব ঝামেলা, ট্রেন, বাস-রিকশা-হাঁটা।

একটু ঝামেলা না হয় করলাম।

লিলি হেসে ফেলে বলল, থাক দরকার নেই। চাচাজী শুনুন আমি কিন্তু আজও পঞ্চাশ মিনিট থাকব। আমাকে আগেভাগে বিদায় করে দিতে চাইলেও আমি যাব না। তবে আজ যে গতদিনের মতো শুধু বকবক করব তা না। আপনাকে কফি বানিয়ে খাওয়াব। আমি কফি নিয়ে এসেছি। আপনি কফি পছন্দ করেন তো?

করি।

মিসির আলি দেখলেন লিলি তার কাঁধে ঝোলানো পাটের ব্যাগ থেকে কফির কৌট, মগ, চায়ের চামচ এবং ফ্লাঙ্ক বের করছে। বোঝা যাচ্ছে কফি বানানো হবে। মেয়েটা কফির সব সরঞ্জাম সঙ্গে নিয়ে এসেছে। গরম পানিও এনেছে। ফ্লাস্কে নিশ্চয়ই গরম পানি।

লিলি বলল, মেশিন ছাড়া এক্সপ্রেসো কফি বানানো যায় না, কিন্তু আমি বানাতে পারি। আপনাকে শিখিয়ে দিচ্ছি। আপনি প্রতিটি স্ট্রেপ খুব ভালোভাবে লক্ষ করুন। এই দেখুন কী করছি-এক চামচের চেয়ে সামান্য বেশি নিলাম কফি। চিনি নিলাম তিন চামচ। এখন চিনি আর কফি মিক্স করছি। চামচ দিয়ে ঘষে ঘষে মেশানো। এই মেশানোর কাজটা অনেকক্ষণ করতে হবে। যত ভালোমতো মেশাবেন কফি তত ভালো হবে।

এত যন্ত্রণা?

ফন্ত্রণ ভাবলে যন্ত্রণা। আমি কখনো যন্ত্রণা ভাবি না। যে লেখক লেখাকে যন্ত্রণা মনে করেন। তিনি কখনো লেখক হতে পারেন না। ঠিক তেমনি যে রাধুনি রান্নাকে যন্ত্রণা মনে করেন। তিনি রাঁধুনি হতে পারেন না। চাচাজী আপনার কাছে কি আলু আছে?

না।

থাকলে ভালো হত। আমি আপনাকে আলু ভাজা কী করে করতে হয় শিখিয়ে দিতাম। যেসব রান্না খুব সহজ মনে হয়। সেসব রান্না আসলে খুব কঠিন। আমার মতে পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন রান্না হল চা বানানো, আর দ্বিতীয় কঠিন রান্না হল আলু ভাজা।

লিলি চিনির সঙ্গে কফি মিশিয়েই যাচ্ছে। ক্লান্তিহীন আঙুল নাড়াচাড়া করছে। তার মুখ উজ্জ্বল। যেন কোনো বিশেষ কারণে সে আনন্দিত। আনন্দ চেপে রাখতে পারছে না। মিসির আলি ভুরু কুঁচকালেন। সেই বিশেষ কারণটা কী? তিনি তাদের বাগানবাড়িতে যাচ্ছেন না এটাই কি বিশেষ কারণ?

লিলি বলল, চাচাজী আপনি কি লক্ষ করছেন কফির কাপ থেকে এখন চমৎকার কফির গন্ধ আসতে শুরু করেছে?

হ্যাঁ লক্ষ করছি।

তার মানে হল এখন আমরা তৈরি পানি ঢালার জন্যে। এখন আমি ওয়ান থার্ড কাপ পানি ঢেলে, চামচ নেড়ে নেড়ে ফেনা করব। ফেনায় যখন কাপ ভর্তি হয়ে যাবে তখন বাকি পানিটা ঢালব।

তৈরি হয়ে যাবে এক্সপ্রেসো কফি?

হ্যাঁ। আগে তো আর কফি বানানোর মেশিন ছিল না। এইভাবেই কফি বানানো হত। এখন আর কেউ কষ্ট করতে চায় না। ফন্ট করে মেশিন কিনে ফেলে।

মিসির আলি সিগারেট ধরাতে ধরাতে বললেন, লিলি তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে তুমি খুব আনন্দিত। তোমার মধ্যে একটা দুশ্চিন্তা ছিল। দুশ্চিন্তা হঠাৎ কেটে গেছে।

লিলি বলল, কফি বানাচ্ছি। তো এই জন্যেই আমাকে আনন্দিত মনে হচ্ছে। যে কোনো রান্নাবান্নার সময় আমি খুব আনন্দে থাকি।

মিসির আলি বললেন, ব্যাপারটা তা না! যেই মুহুর্তে আমি বললাম-আমি তোমাদের বাগানবাড়িতে যেতে পারছি না, সেই মুহুর্তেই তোমার চোখ-মুখ উজ্জ্বল হয়ে গেল। কারণ ব্যাখ্যা করে তো।

আমি আমার হাজবোন্ডের সঙ্গে বাজি রেখেছিলাম যে আপনি যাবেন না। আপনি না। যাওয়াতে আমি বাজি জিতেছি, তো এই জন্যেই হয়তো আমার চোখেমুখে আনন্দ চলে এসেছে। পৃথিবীর সমস্ত স্ত্রীদের একটা চেষ্টা থাকে কোনো না কোনোভাবে তাদের স্বামীদের হারিয়ে দেওয়া। যেহেতু আপনি বিয়ে করেন নি-আপনি এই ব্যাপারটা জানেন না।

লিলির কফি বানানো শেষ হয়েছে। ফেনো-ওঠা কফির কাপ মিসির আলির সামনে রাখতে রাখতে সে বলল, চাচাজী চুমুক দিয়ে দেখুন। মিষ্টি একটু বেশি লাগবে। উপায়। নেই, এক্সপ্রেসো কফি কড়া মিষ্টি না হলে ভালো লাগে না।

মিসির আলি কফির কাপ হাতে নিতে নিতে বললেন, লিলি আমি সিদ্ধান্ত পাল্টেছি! তোমাদের বাগানবাড়িতে যাব। শেষ পর্যন্ত তুমি তোমার স্বামীর কাছে বাজিতে হারলে।

লিলি বলল, কফিতে চুমুক দিন। এত কষ্ট করে বানালাম আর আপনি কাপ হাতে নিয়ে বসে আছেন?

মিসির আলি কফিতে চুমুক দিয়ে বললেন, এখন যদি আমরা রওনা দেই। কতক্ষণে পৌঁছব?

পৌঁছতে পৌঁছতে রাত নটা দশটা বেজে যাবে।

তাতে কোনো সমস্যা নেই তো?

জি না সমস্যা নেই।

তাহলে চল কফি শেষ করে রওনা দিয়ে দেই।

কফি খেতে কেমন হয়েছে আপনি কিন্তু এখনো বলেন নি।

মিসির আলি নিচু গলায় বললেন, এত ভালো কফি আমি আমার জীবনে খেয়েছি বলে মনে পড়ে না।

লিলি ক্লান্ত গলায় বলল, থ্যাংক য়্যু।

সে তার মাথার নীল স্কার্ফ খুলে বিশেষ কায়দায় মাথা ঝাকি দিয়েছে। তার চুল ছড়িয়ে পড়েছে চারদিকে। চেহারা আবার প্যান্টে গেছে।

মিসির আলির মনে হল মেয়েটা কখন কী করবে। সব আগে থেকে ঠিক করা। সে যে একটানে মাথা থেকে স্কার্ফ খুলে মাথা ঝাকাবে এটাও সে আগে থেকেই ঠিক করে এসেছে।

গা ছমছম করছে

মিসির আলি হঠাৎ লক্ষ্য করলেন তার গা ছমছম করছে। যেন অশুভ কিছু তার জন্যে অপেক্ষা করছে। ভয়ঙ্কর কিছু। লৌকিক কিছু না, অলৌকিক কিছু। অনেককাল আগে তার একবার এ রকম অনুভূতি হয়েছিল। শ্যামগঞ্জ রেলস্টেশনে অপেক্ষা করছেন। গভীর রাত। তিনি এগারো সিন্ধুর এক্সপ্রেসে ভৈরব যাবেন। ট্রেন আসবে ভোররাতে। পৌষ মাসের মাঝামাঝি। প্রচণ্ড শীত। ওয়েটিং রুমে বসে সময় কাটানোর জন্যে ঢুকতে যাবেন হঠাৎ তার পা জমে গেল। বুক ধকধক করতে লাগল। মনে হল ওয়েটিং রুমে অশুভ কিছু আছে। ভয়ঙ্কর কিছু। যে ভয়ঙ্করের কোনো ব্যাখ্যা নেই। তার উচিত কিছুতেই ওয়েটিং রুমে না ঢোকা। একবার ঢুকলে আর বের হতে পারবেন না।

কৌতূহল সব সময় ভয়কে অতিক্রম করে। তাঁর বেলাতেও তাই হল। তিনি কৌতূহলী হয়েই উঁকি দিলেন। ওয়েটিং রুমের ইজ চেয়ারে একজন বৃদ্ধ হলুদ কম্বল গায়ে দিয়ে শুয়ে আছে। বৃদ্ধের হাতে জ্বলন্ত সিগারেট। বৃদ্ধ চোখ বন্ধ করে সিগারেট টানছে। মিসির আলি ঘরে ঢুকলেন। বৃদ্ধ চোখ মেলল না, তবে তার ঠোঁটের কোনায় সামান্য হাসি দেখা গেল। শরীর জমিয়ে দেওয়া তীব্র ভয় মিসির আলিকে আবারো আচ্ছান্ন করল। তিনি প্ৰায় ছিটকে বের হয়ে এলেন। বাকি রাতটা কাটালেন প্ল্যাটফরমে পায়চারি করে। এগার সিন্ধুর এক্সপ্রেস ভোর চারটা চল্লিশে প্ল্যাটফরমে ইন করল। মিসির আলি ট্রেনে ওঠার আগে আরেকবার ওয়েটিং রুমে উঁকি দিলেন। বৃদ্ধ যাত্রী ঠিক আগের জায়গাতেই আছে। মাথা নিচু এবং চোখ বন্ধ করে আগের মতোই সিগারেট টানছে। ঠোটের কোনায় আগের মতোই অস্পষ্ট হাসি।

মিসির আলি তার জীবনের এই ভয় পাওয়া ঘটনাকে নানা ভাবে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছেন। সবচেয়ে কাছাকাছি ব্যাখ্যা যেটা দাঁড় করিয়েছিলেন সেটা হল কিশোর বয়সে তিনি নিশ্চয়ই নির্জন স্টেশনের ওয়েটিং রুমের কোনো ভূতের গল্প পড়ে ভয় পেয়েছিলেন। ভয়টা এতই তীব্র ছিল যে, মস্তিষ্কের নিউরোন সেই স্মৃতি মূল্যবান কোনো স্মৃতি মনে করে যত্ন করে মেমোরি-সেলে ঢুকিয়ে রেখেছে। নষ্ট হতে দেয় নি। অনেককাল পরে আরেকটি নির্জন স্টেশন দেখামাত্র মস্তিষ্ক মনে করল এ রকম একটা স্মৃতি তো আছে। স্মৃতিটা বের করে বর্তমানের সঙ্গে মিলিয়ে দেখা যাক। যেহেতু অনেকদিনের স্মৃতি, বের করতে গিয়ে সমস্যা হল। স্মৃতির কিছু অংশ নষ্ট হয়ে গেল। কিছু অন্য রকম হয়ে গেল। মস্তিষ্ক শুধু যে স্মৃতি বের করে আনল তা না, স্মৃতির মনে জড়িত ভয়ঙ্কর ভীতিও বের করে আনল। এ রকম কাণ্ডকারখানা মস্তিষ্ক মাঝে মাঝে করে। এর যেমন মন্দ দিক আছে, ভালো দিকও আছে। মস্তিষ্কের ভেতর হঠাৎ নিউরোনের প্রবল ঝড় সৃষ্টি হয়। এতে ক্ষতিকারক স্মৃতি উড়ে চলে যায়। স্মৃতি জমা করে রাখা মেমরি-সেল খালি হয়।

আজ যে ভয়টা পাচ্ছেন তার পেছনের কারণটা কী? তিনি দাঁড়িয়ে আছেন। পাচিলঘেরা প্ৰকাণ্ড একটা বাড়ির গেটের কাছে। অন্ধকারে পঁচিল-ঘেরা বাড়িটাকে জেলখানার মতো লাগছে। তিনি দাঁড়িয়ে আছেন একা। এতক্ষণ লিলি তার সঙ্গে ছিল। অনেকক্ষণ ডাকাডাকি করে সে দারোয়ান শ্রেণীর কাউকে দিয়ে গেট খুলিয়েছে।

তাও পুরো গেট না। গেটের অংশ যার ভেতর ছোটখাটো মানুষ হয়তো বা কষ্ট করে ঢুকতে পারে। গেট খুলতেই লিলি তাঁর দিকে ফিরে বলল, স্যার আপনি দাঁড়ান। পঁচিছয় মিনিট লাগবে! আমি কুকুর বেঁধে আসি। আমাদের তিনটা কুকুর আছে। খুবই উগ্র স্বভাব, অপরিচিত কাউকে দেখলে কী করবে কে জানে? আমাকেই একবার কামড়ে দিয়েছিল।

মিসির আলি তারপর থেকে দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি ঘড়ি দেখেন নি। কিন্তু তাঁর কাছে মনে হচ্ছে পাঁচ-ছ মিনিটের অনেক বেশি সময় পার হয়েছে। কোনো সাড়া শব্দ পাওয়া যাচ্ছে না। বিশাল বাড়ি কিন্তু পুরোপুরি নিঃশব্দ। তিনটা ভয়ঙ্কর কুকুর অথচ তারা একবারও শব্দ করবে না এটা কেমন কথা? তাছাড়া বাড়ি অন্ধকারে ড়ুবে আছে। বিশাল এই বাড়ির একটি ঘরেও বাতি জ্বলবে না, এটাইবা কেমন কথা! এমন তো না যে, এই বাড়িতে মানুষজন থাকে না। রাত তো বেশি হয় নি। খুব বেশি হলে দশটা। যে দারোয়ান গেট খুলেছে তার হাতে কি একটা টর্চ থাকবে না?

এমন গাঢ় অন্ধকার মিসির আলি অনেকদিন দেখেন নি। নক্ষত্রের আলো পর্যন্ত নেই। আকাশ মেঘে ঢাকা। প্ৰবল অন্ধকারে জোনাকি বের হয়। জোনাকিও নেই। অনেকদিন তিনি জোনাকি দেখেন নি। জোনাকি দেখতে পেলে ভালো লগত।

নদীর আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। স্রোতের শব্দ। হঠাৎ করেই কি নদী সাড়াশব্দ শুরু করলঃ এতক্ষণ এই নদী ছিল কোথায়? বকুল ফুলের গন্ধ আসছে। এটা কি বকুল ফুলের সময়? শহরবাসী হয়ে ছোটখাটো ব্যাপারগুলি ভুলতে বসেছেন। গন্ধটা হয়তো বকুল ফুলের না। অন্য কোনো বুনো ফুলের। জায়গাটা বন তো বটেই। আশপাশে লোকালয় 6न्छे!

ঘড়ঘড় শব্দ হল। মিসির আলির চোখ হঠাৎ ধাঁধিয়ে গেল। গেট খুলেছে। গেটের ওপাশে জাহাজি লণ্ঠন হাতে লিলি দাঁড়িয়ে আছে। তার পাশে দারোয়ান। দারোয়ানের হাতে লম্বা টর্চ। পাঁচ ব্যাটারির টর্চ নিশ্চয়ই। এই টর্চে আলো ফেলে দেখতে ইচ্ছা করছে—আলো কেমন হয়।

লিলি বলল, স্যার আসুন। ওর শরীরটা খারাপ বলে বাতি নিভিয়ে শুয়ে পড়েছে। আর আমি খুঁজে পাচ্ছি না হারিকেন। বরকতকে দেখুন এত লম্বা টর্চ নিয়ে ঘুরছে। টর্চে নেই ব্যাটারি। ব্যাটারি ছাড়া টর্চ হাতে নিয়ে ঘোরার দরকারটা কী স্যার আপনিই বলুন। আপনাকে ব্যাগ হাতে নিতে হবে না। বরকত নেবে।

মিসির আলি বললেন, তোমার কুকুর কি বাধা হয়েছে?

হ্যাঁ বাধা হয়েছে। সকালে কুকুরগুলির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেব তখন আর আপনাকে কিছু বলবে না। আপনার থাকার ব্যবস্থা করেছি। দোতলার সবচেয়ে দক্ষিণের ঘরে। ঘরটা তেমন ভালো না, তবে খুব বড় ঘর। এই ঘরের খাটটা সুন্দর। অন্য ঘরগুলিতে এত সুন্দর রেলিং দেওয়া খাট নেই।

লণ্ঠনের আলোয় বাড়িঘর কিছু দেখা যাচ্ছে না। লণ্ঠন তার চারপাশ আলো করছে। দূরে আলো ফেলতে পারছে না। লণ্ঠন এবং টর্চের এই হল তফাত-লণ্ঠন নিজেকে আলোকিত করে। নিজেকে দেখায়। টর্চ অন্যকে আলোকিত করে।

সিঁড়িটা সাবধানে উঠবেন স্যার। শ্যাওলা জমে কেমন পিছলা হয়ে গেছে। রেলিং ধরে উঠুন। আপনার নিশ্চয়ই খুব ক্ষিধে লেগেছে। ক্ষিধে লেগেছে না স্যার?

হুঁ লেগেছে।

আপনি হাত-মুখ ধুয়ে একটু বিশ্রাম করুন। আমি খাবার রেডি করে ফেলব। এর মধ্যে কোনো কিছুর দরকার হলে দোতলার বারান্দায় রেলিং ধরে দাঁড়াবেন। মাথা নিচু করে বরকত বরকত করে ডাক দেবেন। আমাদের একটাই কাজের লোক বরকত। একের ভেতর চার। সে-ই দারোয়ান, সে-ই কেয়ারটেকার, সে-ই মালি, সে-ই কুকুর-পালক। ভাত খাবার আগে চা-কফি কিছু খাবেন?

খেতে পারি।

আমি এক্ষুনি বরকতকে দিয়ে পাঠিয়ে দিচ্ছি।

তোমার হাজবেণ্ডের সঙ্গে কি রাতে দেখা হবে?

অবশ্যই হবে।

অসুস্থ বলছিলে।

অসুস্থ হোক যাই হোক গেস্টের সঙ্গে দেখা করবে না?

মিসির আলির ঘর পছন্দ হল। পুরোনো বাড়ির একটা সুন্দর ব্যাপার হল–ঘরগুলি প্রকাণ্ড। ছোটখাটো ফুটবল খেলার মাঠ। কড়ি বর্গার ছাদ অনেক উঁচুতে। ছাদ থেকে লম্বা লম্বা লোহার রড নেমে এসেছে। রড়ের মাথায় ফ্যান। এক শোবার ঘরেই চারটা ফ্যান। ইলেক্ট্রিসিটি ছাড়া এই ফ্যান চলার কথা না। কাজেই ধরে নেওয়া যেতে পারে এদের জেনারেটর আছে। ফ্যানগুলি পুরোনো আমলের ডিসি ফ্যান না। আধুনিক কালের ফ্যান। ফ্যানের পাখায় জমে থাকা ময়লা থেকে বোঝা যায় যে ফ্যানগুলি ব্যবহার করা হয়।

ঘরে শোবার খাট দুটা। চারপাশে রেলিং দেওয়া প্ৰকাণ্ড খাটটা ঘরের মাঝামাঝি রাখা। এই খাটে ওঠার জন্যে দুই ধাপ সিঁড়ি আছে। জানালার পাশে খাটের সাইজেরই একটা টেবিল। বিশাল টেবিলের সঙ্গে বেমানান ছোট একটা চেয়ার চেয়ার টেবিলের উলটোদিকে দুটা আলমিরা। কাঠের আলমিরা তালাবন্ধ। চারটা সোফার চেয়ার। চেয়ারে সবুজ মখমলের গদি। চেয়ারের পাশে পুরোনো ডিজাইনের দুটা আলনা। তারপরেও মনে হচ্ছে ঘরটা ফাঁকা। দুটা খাটেই বিছানা করা হয়েছে। কিছুক্ষণ আগেই করা হয়েছে বলে মনে হচ্ছে। একটায় বিছানো হয়েছে। ধবধবে সাদা চাঁদ র। সাদা বালিশের ওয়ার। রেলিং দেওয়া খাটে সবকিছুই রঙিন। তবে দুটো খাটেই কোলবালিশ আছে। মিসির আলি বাথরুমে উঁকি দিলেন। বাথরুমও প্রায় শোবার ঘরের মতোই বড়। খুবই আধুনিক বাথরুম। এই বাথরুম অবশ্যই পরে বানানো হয়েছে। যে সময়ের বাড়ি সে সময়ে টাইলস নামক বস্তু বাজারে আসে নি।

বাথরুমটা শুধু যে ঝকঝকি করছে তা না, বড় বড় হোটেলের মতো করে গোছানো। বেসিনের উপর সাবান, টুথপেষ্ট এবং একটা মোড়ক-না-খোলা টুথব্রাশ। তোয়ালে রাখার জায়গায় তোয়ালে ঝুলছে। ময়লা নয়-মনে হচ্ছে এইমাত্র ধোপাখানা থেকে নিয়ে আসা।

মিসির আলি বেসিনের কালে পানি আশা করেন নি। দোতলায় পানি আসতে হলে ছাদে পানির ট্যাংক থাকতে হবে। সেই ট্যাংকে পানি তোলার ব্যবস্থা থাকতে হবে। ট্যাপ খুলতেই পানি পাওয়া গেল। অনেকদিন অব্যবহারের পর হঠাৎ কল খুললে লাল পানি বের হয়–সে রকম পানি না। পরিষ্কার পানি। মিসির আলি মুখে পানি ছিটালেন।

সিঁড়িতে থপথপ শব্দ করতে করতে কেউ-একজন আসছে। বাড়ির মালিক নিশ্চয় নিন। তিনি হুইল চেয়ারে থাকেন। তাহলে কে আসছে–দারোয়ান? একেকটা সিঁড়ি ভাঙতে এত সময় নিচ্ছে কেন? নিশ্চয়ই ভারী কিছু নিয়ে আসছে। সেই ভারী বস্তুটা কী হতে পারে? চেয়ার-টেবিল কাঁধে করে আনবে না। তাঁর ঘরে চেয়ার-টেবিল আছে। বালতিতে করে গরম পানি কি আনিছে? রাতের বেলার অতিথিদের গরম পানি দেওয়ার রেওয়াজ আছে। অতিথি গরম পানিতে গোসল করবেন, কিংবা হাত-মুখ ধোবেন। তাঁর প্রতি যে বিশেষ যত্ন নেওয়া হচ্ছে তাতে সেটা প্ৰকাশ পাবে।

না বালতি নিয়ে কেউ আসছে না। বালতি হলে মাঝে মাঝে সিঁড়িতে নামিয়ে রাখত। তার শব্দ পাওয়া যেত। সেই শব্দ পাওয়া যাচ্ছে না। মিসির আলি ঘর থেকে বের হয়ে বারাণদায় চলে এলেন।

দারোয়ান বরকত আসছে। তার কোমরে মাটির কলসি। কলসির মুখ দিয়ে ধোঁয়া বের হচ্ছে, তার মানে কলসিতে করে গরম পানিই আনা হচ্ছে। মিসির আলি স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেন। যাক লজিক শেষ পর্যন্ত কাজ করেছে। সিদ্ধান্তে আসার পরই টেনশন বোধ করা শুরু করছেন। লজিকের যে সিঁড়িগুলি গাথা হয়েছে সেই সিড়িগুলি কি ঠিক আছে? সিঁড়ি বেয়ে ওঠা যাবে তো?

মিসির আলি জানেন এই সবই হচ্ছে বয়সের লক্ষণ। বয়স মানুষের সবচেয়ে বড় ক্ষতি যা করে-তা হল আস্থা কমিয়ে দেয়। যা-ই করা হয় মনে হয় ঠিকমতো বুঝি করা হল না। ভুল থেকে গেল।

স্যার গরম জল।

বুঝতে পারছি।

সিনান করলে করেন।

গোসল করব না।

বড় সাব সিনান করতে বলেছেন।

তোমার বড় সাহেব বললে তো হবে না। আমার গোসল করতে ইচ্ছে করছে না।

আর কিছু লাগবে?

না আর কিছু লাগবে না। ভালো কথা-তুমি গরম পানি না বলে গরম জল বলছ কেন? তোমাদের এদিকে কি পানিকে জল বলা হয়? এটা কি হিন্দুপ্রধান অঞ্চল?

বরকত জবাব দিল না। সরু চোখে তাকিয়ে রইল। মিসির আলি বললেন, আচ্ছা! ঠিক আছে তুমি যাও।

যাও বলার পরেও সে যাচ্ছে না। আগের মতোই সরু চোখে তাকিয়ে আছে। বলশালী একজন মানুষ। বয়স কত হবে ত্রিশ কিংবা পঁয়ত্রিশ। বেশিও হতে পারে। চুলে পাক ধরেছে। মানুষটার বুদ্ধি কেমন? চট করে মানুষের বুদ্ধি বের করার কোনো উপায় এখনো বের করা যায় নি। সাইকোলজিস্ট্ররা নানান ধরনের পরীক্ষা অবিশ্যি বের করেছেন। কোনো পরীক্ষাই মিসির আলির কাছে গ্রহণযোগ্য মনে হয় না। আসলে বুদ্ধি পরীক্ষার ব্যবস্থা না থেকে থাকা উচিত ছিল বোকামি পরীক্ষার ব্যবস্থা। প্রথম শ্রেণীর বোকাদের জন্যে এক রকম পরীক্ষা। দ্বিতীয় শ্রেণীর বোকাদের জন্যে আরেক রকম পরীক্ষা।

বরকত চলে যাচ্ছে। যেতে যেতেও দুবার ফিরে তাকাল। সিঁড়ির কাছে অন্ধকার। কাজেই তার চোখের দৃষ্টিতে কী আছে বোঝা যাচ্ছে না। কিছু একটা নিশ্চয়ই আছে। নয়তো এতিবার করে তাকাত না।

মিসির আলি নিজের ঘরে ঢুকলেন। ঘরটা নিজের মতো করে সাজিয়ে নেওয়া দরকার। নিজের গায়ের গন্ধ ঘরময় ছড়িয়ে দিতে হবে। গন্ধ যত ছড়াবে ঘর হবে তত আপন। নিম্নশ্রেণীর পশুরা তাই করে। নিজের গায়ের গন্ধ দিয়ে সীমানা ঠিক করে দেয়। অদৃশ্য সাইনবোর্ড গন্ধ দিয়ে বলে-এই আমার সীমানা। এর ভেতর আর কেউ আসবে না। যদি তুলে চলেও আস, বেশিক্ষণ থাকবে না। থাকলে সমূহ বিপদ।

মিসির আলি সুটকেস খুলে বই বের করলেন। চারটা বইয়ের মধ্যে একটা হল ক্লোজ-আপ ম্যাজিকের বই। দড়িকাটার খেলা, পিংপং বল অদৃশ্য করে দেবার খেলার মতো ছোট ছোট ম্যাজিকের কৌশল দেওয়া আছে। পড়তে ভালো লাগে। তিনি বইগুলি টেবিলে সাজিয়ে রাখলেন। এত বড় টেবিলে চারটা মাত্র বই দেখতে হাস্যকর লাগছে। মিসির আলি ঠিক করে রাখলেন-এ বাড়ির লাইব্রেরি থেকে বেশ কিছু বই এনে টেবিল ভর্তি করে রাখবেন। চোখের সামনে প্রচুর বই থাকলে ভালো লাগে।

আবারো সিঁড়িতে থপথপ শব্দ হচ্ছে। বরকত কি আবারো ভারী কিছু নিয়ে উঠছে? ব্যাপারটা কী? এবার সে কী আনিছে? মিসির আলি দ্রুত বারান্দায় চলে এলেন। বরকত ভারী কিছু তুলছে না। তার হাতে ছোট্ট তেলের শিশির মতো শিশি। অথচ এমনভাবে সে উঠছে যেন তার উঠতে কষ্ট হচ্ছে। মাঝে মাঝে সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে সে বিশ্রামও করে নিচ্ছে বলে মনে হয়। এমন স্বাস্থ্যবান একজন মানুষের সিঁড়ি ভাঙতে কোনো কষ্ট হবার কথা না। অথচ তার যে কষ্ট হচ্ছে এটা পরিষ্কার। হার্টের কোনো অসুখ কি আছে? কিংবা আর্থরাইটিস? ওঠার সময় হাঁটুতে ব্যথা করে?

বরকত মিসির আলির সামনে এসে বলল, ওষুধ নিয়া আসছি।

মিসির আলি বিস্মিত হয়ে বললেন, কীসের অষুধ?

সাপের অষুধ। আপনের ঘরের চারদিকে দিয়া দিব।

ঘরের চারদিকে সাপের অষুধ দেবে মানে কী? দোতলায় সাপ আসবে কীভাবে?

বরকত প্রশ্নের জবাব দিল না। ঘরে ঢুকে গেল। মিসির আলি বারান্দায় দাঁড়িয়েই তীব্ৰ কাৰ্বালক এসিডের গন্ধ পেলেন। তাঁর গন্ধ বিষয়ক সমস্যা আছে। কিছু কিছু গন্ধ মনে হয় তাঁর স্নায়ুতে সরাসরি আক্রমণ করে। চট করে মাথা ধরে যায়। কার্বলিক এসিডেও তাই হয়েছে। মিসির আলি ছোট্ট নিশ্বাস ফেলে ভাবলেন, শুধু সাপ না, আমি নিজেও আর এই ঘরে ঢুকতে পারব না। এই গন্ধ নিয়ে বাস করার চাইতে ঘরে দুতিনটা সাপ নিয়ে বাস করা অনেক সহজ। মশারি ভালোমতো খুঁজে দিয়ে রাখলে সাপ ঢুকতে পারবে না। সাপকে খাটে উঠতে হলে খাটের পা বেয়ে উঠতে হবে। সাপের জন্যে এই প্রক্রিয়া খুবই কষ্টকর হবার কথা। সাপ শুধু শুধু এত কষ্ট করবে না।

বরকত নেমে যাচ্ছে। শিশিটা নিশ্চয়ই ঘরে কোথাও রেখে এসেছে। বোতল থেকে গন্ধ বের হচ্ছে! আচ্ছা বোতলাটা সে কোথায় রেখেছে? খাটের নিচে রেখেছে নিশ্চয়ই। মশার কয়েল জ্বালিয়ে আমরা বেশির ভাগ সময় জ্বলন্ত কয়েলটা খাটের নিচে রেখে দেই।

সিঁড়ি দিয়ে নামতে বরকতের তেমন কষ্ট হচ্ছে বলে মনে হলো না। বেশ দ্রুতই নামছে। বরকতের আর্থরাইটিস নেই, এটা নিশ্চিত।

সিঁড়ির শেষ মাথায় ছোট একটা শব্দ হল। জায়গাটা গাঢ় অন্ধকার। তারপরেও মিসির আলির মনে হল কে যেন সেখানে বসে আছে। তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে তাকে দেখছে। মিসির আলির মনে হল তার হাতে একটা টর্চ থাকলে ভালো হত। টর্চের আলো ফেলে। দেখা যেত কে ঘাপটি মেরে বসে আছে। তিনি সিঁড়ি বেয়ে দুধাপ নামলেন। উঁচু গলায় বললেন, কে? কে ওখানে?

কেউ জবাব দিল না। মিসির আলি আরো কয়েকটা সিঁড়ি টপকালেন। আর তখনি শান্ত গভীর পুরুষ গলায় কেউ একজন বলল, স্যার রেলিং ধরে ধরে নামুন। খুব খেয়াল রাখবেন যতবার ওঠানামা করবেন। রেলিং ধরে ধরে করবেন। আমার নাম সুলতান। ওয়েলকাম টু মাই ধ্বংসস্তুপ। ধ্বংসস্তুপের ইংরেজিটা মনে পড়ছে না বলে বাংলা বললাম। স্যার কেমন আছেন?

হুইল চেয়ারে বসে যে মানুষটি হাত বাড়িয়েছে মিসির আলি কয়েক মুহূর্তের জন্যে তার উপর থেকে চোখ ফেরাতে পারলেন না। কাছাকাছি আসায় মানুষটাকে এখন দেখা যাচ্ছে। কেউ একজন একতলার দরজাও মনে হয় খুলেছে। আলো এসে পড়েছে মানুষটার মুখে। অত্যন্ত সুপুরুষ একজন মানুষ। অতিথিকে স্বাগতম বলার জন্যে যিনি বিশেষভাবে পোশাক পরেছেন। ইস্ত্রি করা ধবধবে সাদা প্যান্টের সঙ্গে, হালকা নীল ফুল হাফ শার্ট। পোশাকটায় স্কুল-ড্রেস স্কুল-ড্রেস ভাব আছে। কিন্তু এই মানুষটাকে খুব মানিয়েছে। ভদ্রলোক চশমা পরেন, নাকের কাছে চশমার দাগ আছে, কিন্তু এখন চোখে চশমা নেই। তাঁর বড় বড় ভাসা ভাসা চোখ, বুদ্ধিতে ঝিকমিক করছে। বয়স পঞ্চাশের বেশি। মাথা ভর্তি কাঁচা-পাকা চুল। কাঁচা-পাকা চুলের যে আশ্চর্য সৌন্দৰ্য আছে, তা এই মানুষটার চুলের দিকে তাকালে পরিষ্কার বোঝা যায়।

স্যার আপনি আমার প্রশ্নের জবাব দেন নি। আপনি কেমন আছেন?

আমি ভালো আছি।

ঘরটা পছন্দ হয়েছে?

কার্বলিক এসিড দেওয়ার আগ পর্যন্ত পছন্দ ছিল। আমার কিছু গন্ধবিষয়ক সমস্যা বোঝা যায়।

আপনি এসেছেন। আমি অসম্ভব খুশি হয়েছি। খুশির প্রকাশটা অবিশ্যি করতে পারছি না। আপনি তীক্ষ্ণ বুদ্ধির মানুষ, আপনি নিশ্চয়ই আমার খুশি ধরতে পারছেন।

মিসির আলি কিছু বললেন না। মানুষটা যে খুশি হয়েছে, তা বোঝা যাচ্ছে। আনন্দিত মানুষের ভেতর অস্থিরতা থাকে। ব্যথিত মানুষ চুপচাপ হয়ে যায়। এই মানুষটা অস্থির। হুইল চেয়ার নিয়ে এদিক-ওদিক করছে।

আমি আপনাকে খাবার ঘরে নিয়ে যাবার জন্যে অনেকক্ষণ থেকে সিঁড়ির গোড়ায় বসে আছি। আপনি বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিলেন, আমি নিচ থেকে আপনাকে লক্ষ করছিলাম। আমার মনে হচ্ছিল কোনো একটা বিষয় নিয়ে আপনি দুশ্চিন্তা করছিলেন। দুশ্চিন্তার বিষয়টা ধরার চেষ্টা করছিলাম।

দুশ্চিন্তা করছিলাম না। আপনার স্ত্রী লিলি কোথায়?

ও রান্না শেষ করে ঘুমুতে চলে গেছে। ভুল বললাম, সে চলে যায় নি। আমি তাকে জোর করে পাঠিয়েছি। ওর কিছু মানসিক সমস্যা আছে। সমস্যাগুলি হঠাৎ হঠাৎ দেখা দেয়। আপনাকে নানান কৌশল করে এখানে আনার অনেকগুলি কারণের মধ্যে একটা কারণ হল লিলির ব্যাপারটি নিয়ে আপনার সঙ্গে আলাপ করা।

ও আচ্ছা।

স্যার আসুন। খেতে আসুন। খাবার ঘরটা একতলায়। একতলায় থাকায় রক্ষা। আমি যেতে পারছি। দোতলায় হলে যেতে পারতাম না।

মিসির আলি ভেবেছিলেন বিশাল একটা খাবার ঘর দেখবেন। তা দেখলেন না। ছোট ঘর। খাবার টেবিলটাও ছোট। টেবিলের পাশে একটা মাত্র চেয়ার। মনে হচ্ছে একজনের জন্যেই খাবার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এই ঘরের প্রধান আকর্ষণ মোমদানি। রূপার তৈরি মোমদানিতে এক সঙ্গে একুশটা মোম জুলছে। ঘর আলো হয়ে আছে। মোমদানিটা খাবার টেবিলে রাখা।

মিসির আলি চেয়ারে বসতে বসতে বললেন, আপনি খাবেন না?

জি না। সন্ধ্যার পর আমি কিছু খাই না। আগে পানি, চা-কফি খেতাম। এখন তাও না। সূর্য ড়ুবল মানে আমার খাওয়ার পর্ব শেষ।

মিসির আলি একবার ভাবলেন জিজ্ঞেস করেন–সূৰ্য ডোবার পর কেন খান না? শেষ পর্যন্ত প্রশ্নটা করলেন না। সূৰ্য ডোবার পর খাদ্য গ্ৰহণ না করার পেছনে অদ্রলোকের নিশ্চয়ই কিছু যুক্তি আছে। সেইসব যুক্তি তিনি যদি অন্যদের জানাতে চান-প্রশ্ন না করলেও জানাবেন।

সূৰ্য ডোবার পর আমি খাওয়া বন্ধ করে দিয়েছি কেন জানেন?

না জানি না।

সরি, আমি আপনাকে খুবই বোকার মতো প্রশ্নটা করলাম। সন্ধ্যার পর আমি কেন কোনো খাদ্য গ্ৰহণ করি না সেটা তো আপনার জানার কথা না। তবে আপনার লজিকেল ডিডাকসানের যে ক্ষমতা আপনি নিশ্চয়ই বের করে ফেলেছেন?

আমি কিছু বের করি নি।

স্যার আপনি খাওয়া শুরু করুন। সব টেবিলে দেওয়া আছে। আপনি খেতে থাকুন। আমি গল্পটা বলি। এক রাতে খেতে বসেছিঃ হঠাৎ মনে হল-পৃথিবীর পশুপাখি কীটপতঙ্গ কোনো কিছুই রাতে খাদ্য গ্ৰহণ করে না। জীব জগতের নিয়মই হল রাতে খাদ্য গ্ৰহণ না করা। এমনকি উদ্ভিদও সূর্যের আলো নিয়ে খাদ্য তৈরি করে দিনে, রাতে না। আর আমরা মানুষরা জীব জগতের সমস্ত নিয়ম ভঙ্গ করে রাতে খাদ্য গ্রহণ করছি। এটা তো ঠিক হচ্ছে না। তারপর থেকে সূর্য ডোবার পর ফুড ইনট্রেক পুরোপুরি বন্ধ করে দিলাম। প্রথম কিছুদিন কষ্ট হয়েছে। এখন আর হচ্ছে না। এখন ভালো আছি। শরীর খুবই ফিট। যার সঙ্গেই দেখা হয় তাকেই গল্প বলার ছলে বলতে চেষ্টা করি–সূৰ্য ডোবার পর খাদ্য গ্রহণ করা ঠিক না। মিসির আলি প্লেটে ভাত নিতে নিতে বললেন, জীব জগতের কেউই রাতে খাবার খায় না?

বাদুড় আর পেঁচা খায়। এরা নিশাচর-এদেরটা হিসেবে ধরছি না। আমি যে বকবক করছি আপনি বিরক্ত হচ্ছেন না তো?

বিরক্ত হচ্ছি না।

প্রথম দফাতে অনেক বিরক্ত করে ফেলেছি। আর করব না। আপনি খাওয়াদাওয়া শেষ করে বিশ্ৰাম করুন। আমি বইয়ে পড়েছি আপনি একা খেতে পছন্দ করেন। সবকিছু দেওয়া আছে। আপনি খান। আমি পাশের ঘরেই থাকব। কোনো দরকার হলে ছাকবেন।

মিসির আলি বিব্রত গলায় বললেন, আমার একা খাওয়াটা কোনো নিয়মের কারণে না। একা থাকি বলেই এক খাই।

একা খেয়ে আপনার অভ্যাস হয়ে গেছে। হঠাৎ করে এই অভ্যাস ভাঙানো ঠিক হবে না। আপনি খাওয়া শেষ করুন—তখন শুভরাত্রি জানানোর জন্য আসব। আপনাকে খুব স্পেশাল ডেজার্টও খাওয়াব।

খাবার আয়োজন বেশি না। আলু ভাজা, মুগের ডাল, করলা ভাজি, বেগুন ভাজি, সজনের ঝোল, পটেলের ঝোল এবং ডাল। সবই নিরামিষ! একটা বাটিতে ঘি, অন্য একটা বাটিতে তেঁতুলের আচার। মিসির আলি অত্যন্ত তৃপ্তি করে খেলেন। লিলি মেয়েটির রান্নার হাত যে অসাধারণ-এ বিষয়ে কোনো সন্দেহই নেই। এত অল্প সময়ে এতগুলি পদ সামনে দেওয়া সহজ ব্যাপার না। মেয়েটার অসুস্থতার ব্যাপারটি এখনো মিসির আলির কাছে পরিষ্কার হয় নি। তাঁর কাছে মনে হচ্ছে মেয়েটাকে যে কোনো কারণেই হোক তার সামনে আসতে দেওয়া হচ্ছে না, কিংবা সে নিজেই আসছে না। এই মুহুর্তে ব্যাপারটা নিয়ে ভাবতে ইচ্ছা করছে না।

মিসির আলি খাওয়া শেষ করার সঙ্গে সঙ্গেই সুলতান ঢুকল। তার হাতে কাচের মুখ খোলা বিয়াম এবং একটা চামচ। সে কি আড়াল থেকে মিসির আলির খাওয়া দেখছিল? তা না হলে খাওয়া শেষ হওয়া মাত্র তার উপস্থিত হওয়াটা সম্ভব না।

স্যার আপনার ডেজার্ট। অনেক রকম ডেজার্ট খেয়েছেন, এটাও খেয়ে দেখুন। আপনাকে মেপে মেপে দু চামচ দেব। দু চামচের বেশি খাওয়া ঠিক হবে না। তবে আপনার যদি আরো খেতে ইচ্ছে করে, তাহলে খাবেন! সাধারণত দু চামচের বেশি। খেতে ইচ্ছা করে মা।

সোনালি রঙের ঘন তরল পদার্থ। হারিকেনের আলোয় ঝিকঝিক করে জুলছে। সুলতান বলল, তর্জনীতে মাখিয়ে মাখিয়ে মুখে দিল। এইভাবেই খাওয়ার নিয়ম।

মিসির আলি বললেন, জিনিসটা কি মধু?

জি মধু।

বিশেষ কোনো মধু? অবশ্যই বিশেষ মধু। চাকভঙা মধু এই বাক্যটা নিশ্চয়ই শুনেছেন। এটা হল চাকভঙা মধু। সুন্দরবনের মধুয়ালীরা মার্চ-এপ্রিল মাসে এই মধু সংগ্রহ করে। এই সময় খলিসা ফুল ফুটে। মৌমাছিরা খলসা ফুল থেকে মধু জমা করে। কেওড়া ফুলের মধুও আছে। সেটাও খারাপ না। তবে খলসা ফুলের মতো ভালো মধু পৃথিবীর আর কোথাও আছে বলে আমি মনে করি না।

মিসির আলি আঙুলে মধু মাখিয়ে মুখে দিলেন। তিনি বিশেষ কোনো পার্থক্য অনুভব করতে পারলেন না। ঘন মিষ্টি সিরাপে হালকা ফুলের গন্ধ।

অন্য মধুর সঙ্গে পার্থক্য বুঝতে পারছেন?

না। মধু আমি খাই না। যারা নিয়মিত খায় তারা হয়তো পার্থক্যটা ধরতে পারবে। আমি পারব না।

আপনিও পারবেন। আমার কাছে এই মুহুর্তে আট রকমের মধু আছে। অস্ট্রেলিয়ান মধু, কানাডার মধু, আয়ারল্যান্ডের মধু এবং পাঁচ রকমের সুন্দরবনের মধু। সব আপনাকে খাওয়াব। আপনি নিজেই পার্থক্য ধরতে পারবেন। আপনি যখন এ বাড়ি থেকে বিদায় নেবেন তখন আপনি মোটামুটিভাবে একজন মধু বিশেষজ্ঞ।

মিসির আলি মধু শেষ করে উঠে দাঁড়ালেন।

সুলতান বলল, যান শুয়ে পড়ুন। সকালবেলা নাশতা খেতে খেতে আগামী কয়েক দিনের প্রোগ্রাম সেট করে ফেলব।

আচ্ছা।

পান খাবার অভ্যাস আছে?

না।

কাঁচা সুপারি দিয়ে একটা পান খেয়ে দেখুন। কাঁচা সুপারিতে এলকালয়েড আছে। এই এলকালয়েড স্নায়ুর উপর কাজ করে। শরীরে হালকা ঝিমঝিম ভাব নিয়ে আসে। ইন্টারেস্ট্রিং সেনসেশন।

মিসির আলি কাঁচা সুপারির একটা পান মুখে দিলেন!। সুলতান বলল, আপনার ঘর পান্টে দিয়েছি। কার্বলিক এসিডের গন্ধ আপনার কাছে বিরক্তিকর এটা জানতাম না। এই ঘরটায় কাৰ্বলিক এসিড দেওয়া হয় নি।

দোতলায় সাপ কি সত্যি আছে?

থাকার কোনোই কারণ নেই। তবে সাপ দেখা গেছে। আমি নিজেই দেখেছি। আমি সাপ চিনি না। যেটাকে দেখেছি তার ফণা আছে। কাজেই বিষ থাকার কথা।

বলেন কী?

আপনার খাটটা ঠিক ঘরের মাঝখানে দিতে বলেছি। খাটের নিচে জ্বলন্ত হারিকেন থাকবে। সাপ কাৰ্বলিক এসিডের চেয়েও বেশি ভয় পায় আলো। মশা নেই, তবু মশারি খাটিয়ে ঘুমাবেন। বাথরুমে যাবার প্রয়োজন হলে ভালোমতো মেঝে দেখে তারপর নামবেন। আপনার কি ভয় লাগছে?

সামান্য লাগছে। সাপ আমার পছন্দের প্রাণী না।

আমার নিজেরও না। আমি এই পৃথিবীতে একটা জিনিসই ভয় পাই। তার নাম সাপ। মানুষ নানান রকম দুঃস্বপ্ন দেখে, আমি একটা দুঃস্বপ্নই দেখি-আমি সাপের সঙ্গে শুয়ে আছি। বেশ স্বাভাবিকভাবেই শুয়ে আছি। স্বপ্নটা দেখার সময় ভয় লাগে না। স্বপ্নটা যখন ভেঙে যায় তখন প্রচণ্ড ভয় লাগে। গা ঘিন ঘন করতে থাকে। বারবার গোসল করি, তারপরেও মনে হয় সাপের স্পৰ্শ শরীরে লেগে আছে। আপনার সঙ্গে এই বিষয়টা নিয়ে পরে কথা বলব।

আচ্ছা।

আমি দোতলা পর্যন্ত আপনাকে এগিয়ে দিতে পারছি না। ইচ্ছা থাকলেও সম্ভব না। হুইল চেয়ার দোতলায় ওঠাবার কোনো ব্যবস্থা নেই। বরকত আপনাকে নতুন ঘর দেখিয়ে দেবে।

এত বড় বাড়িতে আপনারা তিন জন মাত্র মানুষ!

আমরা ছয় জন ছিলাম! এখন তিন জন। জানি করে এসেছেন। আপনি ক্লান্ত। শুয়ে পড়ুন। কাল আপনার সঙ্গে কথা হবে। আমার উচিত ছিল ঘর পর্যন্ত আপনাকে এগিয়ে দেওয়া, সেটা সম্ভব না। বরকত এগিয়ে দেবে।

কোনো অসুবিধা নেই।

বরকতের অনিদ্রা রোগ আছে। সে কুকুরগুলির সঙ্গে সারারাত জেগে থাকে। আপনার যদি কোনো কিছুর প্রয়োজন হয়-সিঁড়ির কাছে এসে ওকে ডাকলেই হবে।

থ্যাংক য়্যু।

নতুন জায়গায় ঘুম যদি না আসে তার জন্যে আপনার ঘরে ফ্রিজিয়াম জাতীয় কিছু ট্যাবলেট দিতে বলেছি। লিলি নিশ্চয়ই দিয়েছে। রাত জেগে যদি বই পড়তে চান তার ব্যবস্থাও করেছি। The other Mind বইটাও আপনার বিছানার কাছে আছে। বইটা কি পড়েছেন?

না।

পাঁচ জন সিরিয়াল কিলারের মানসিকতা ব্যাখ্যা করে বইটা লেখা হয়েছে। আমি নিজে খুবই আগ্রহ করে বইটা পড়েছি। আপনার অনেক বেশি ভালো লাগবে বলে আমার ধারণা।

বরকত এক গাদা জিনিসপত্র সঙ্গে নিয়েছে। ফ্লাস্ক আছে, চায়ের কাপ আছে, পানির বোতল আছে। মিসির আলির চোখ ঘুমে জড়িয়ে আসছে। ফ্লাস্ক ভর্তি চা থাকলেও তিনি যে ব্রাত জাগিবেন এবং চা খাবেন তা মনে হচ্ছে না। বরকত পাশে পাশে হাঁটছে। মনে হচ্ছে তার হাঁটতে খুবই কষ্ট হচ্ছে।

নতুন যে ঘরে মিসির আলিকে থাকতে দেয়া হয়েছে সে ঘরটাও প্রায় আগেরটার মতোই বড়। তবে আসবাবপত্র নেই। ঘরের মাঝখানে কালো রঙের খাট। খাটের পাশেই ছোট্ট টেবিল। টেবিলে হারিকেন আছে, একটা কেরোসিনের টেবিল ল্যাম্প আছে, দেয়াশলাই এবং মোমবাতিও রাখা আছে। ঘুমের অষ্ণুধ রাখা হয়েছে, এক ধরনের নয়–বেশ কয়েক ধরনের। The Other Mind বইটি রাখা হয়েছে বিছানায় বালিশের উপর।

শোবার আগে বই পড়া মিসির আলির অনেক দিনের অভ্যাস। পড়ার বই তিনি সঙ্গে এনেছেন। বাইরে বেড়াতে গেলে হালকা ধরনের বইপত্র পড়তেই ভালো লাগে। সাইকোলজির কঠিন বই না। কিন্তু এ বাড়ির কর্তা যে কোনো কারণেই হোক চাচ্ছে যেন তিনি The other Mind বইটি পড়েন। আজ পড়া যাবে না, কারণ ঘুমে চোখ বন্ধ হয়ে छान्छ।

মিসির আলি দরজার ছিটিকিনি লাগাতে গেলেন। জং ধরে ছিটিকিনি আটকে গেছে। অনেক চেষ্টা করেও ছিটিকিনি লাগাতে পারলেন না। লাভের মধ্যে লাভ এই হল যে ঘুম কেটে গেল। মিসির আলি ডায়েরি বের করলেন-কয়েক পৃষ্ঠা লিখবেন। এতে মস্তিষ্ক ক্লান্ত হবে। তারপর বই নিয়ে বসবেন। সাইকোলজির কঠিন বই না, জেরোম কে জেরোমের এক নায়ে তিনজন।

টেবিলে যদিও দুটা বাতি তারপরেও এই আলো লেখার জন্যে যথেষ্ট মনে হচ্ছে না। মিসির আলি লিখে আরাম পাচ্ছেন না। এক সময় তার মনে হল শুধু যে আলোর অভাবেই তিনি লিখে আরাম পাচ্ছেন না, তা না। যে বিষয় নিয়ে লিখছেন সেই বিষয়টি লিখতেও ভালো লাগছে না। মনের ভেতরে এক ধরনের চাপ সৃষ্টি হচ্ছে।

এখন রাত একটা কুড়ি। আমার অনেকদিনের অভ্যাস ঘুমুতে যাবার আগে হয়। কিছুক্ষণ লিখি, নয় বই পড়ি। লাল মলাটের এই ডায়েরিটা আমি কিনেছিলাম নির্জন সমুদ্রবাসের অভিজ্ঞতা লেখার জন্যে। সমুদ্রবাস এই মুহুর্তে করতে না পারলেও নির্জনবাস ঠিকই করছি। যাদের বাড়িতে আমি আছি তারা আমাকে খুবই আন্তরিকতার সঙ্গে গ্রহণ করেছে কিন্তু আমি কেন যেন ঠিক স্বস্তি পাচ্ছি না। আমার শুধুই মনে হচ্ছে— কোথাও একটা সমস্যা আছে। আমি সমস্যা ধরতে পারছি না। সমস্যার নিয়ম হল–সমস্যাটা যদি এমন হয় যে খুবই স্পষ্ট তাহলে সেই সমস্যা ধরা যায় না। ধরতে সময় লাগে।

এরা খুব আগ্রহ করে আমাকে এই বাড়িতে এনেছে। আগ্রহের পেছনের কারণটা কী? আমাকে আকাশের তারা দেখানোর জন্যে কিংবা ভালো ভালো খাবার রান্না করে খাওয়াবার জন্যে নিশ্চয়ই আনে নি। আমি অতি বিখ্যাত কোনো ব্যক্তি না যে এ বাড়িতে কিছুদিন থেকে গেলে এদের সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধি পাবে। এরা বলতে পারবেআমাদের সঙ্গে মিসির আলি কিছুদিন ছিলেন। তিনি আমাদের অতি বন্ধু মানুষ। প্রায়ই আসেন। আগামী সামারে আবার আসবেন। এই দেখুন। মিসির আলির সঙ্গে আমাদের ছবি।

সুলতান বা তার স্ত্রী আমার কাছ থেকে ঠিক কী চাচ্ছে তা এখনো ধরতে পারছি না। বলে আমার অস্বস্তিটা কাটছে না। তারা কোনো বিপদে আছে বলে আমার মনে হয় না। বিপদে থাকলে প্রথম রাতেই বিপদের কথা জানতে পারতাম। এদের আচার-আচরণে সামান্য অস্বাভাবিকতা আছে এটা থাকবেই। একটা বিশাল পঁচিল ঘেরা বাড়িতে দিনের পর দিন যদি তিনটি মানুষ বাস করে তাহলে তাদের চরিত্রে পরিবেশের প্রভাব প্রবলভাবে পড়বে। পরিবারের প্রধান মানুষটি হুইল চেয়ারে জীবন যাপন করছেন। এর প্রভাবও বাকিদের উপর পড়বে। আফ্রিকার আদিবাসি এক জনগোষ্ঠীর উপর একবার একটি সমীক্ষা চালানো হয়েছিল। দেখা গেল এরা সবাই খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটে। কারণ অনুসন্ধান করে পাওয়া গেল। এদের দলপতি বা পায়ে ব্যথা পেয়েছিল। ব্যথার কারণে সারাজীবন তাকে খুঁড়িয়ে হাঁটতে হয়েছে। তাই সংক্রমিত হয়েছে পুরো দলের উপর।

আমি এ বাড়ির তিন সদস্যকে আলাদা আলাদাভাবে দেখার চেষ্টা করছি, আবার দলবদ্ধভাবেও দেখার চেষ্টা করছি। সুলতানকে আমার মনে হয়েছে আত্মবিশ্বাসী একজন মানুষ। আমি যা করছি ঠিক করছি, আমি যা ভাবছি ঠিক ভাবছি গোত্রের একজন। একই ব্যাপার লিলির মধ্যে এবং বরকতের মধ্যেও দেখলাম। দীর্ঘদিন কিছু মানুষ যদি একটি গণ্ডিতে বাস করে তাহলে একটা পর্যায়ে তারা তাদের ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য হারিয়ে ফেলতে শুরু করে। এদের ক্ষেত্রেও কি তাই হতে যাচ্ছে?

সুলতানের আট ধরনের মধু এবং মধুনিয়ে তার বাড়াবাড়ি উচ্ছাসের কারণটা ধরতে পারছি না। যারা মধ্যপান করেন এবং ভালো মদের ব্যাপারে যাদের আগ্রহ আছে তাদের মধ্যে এই উচ্ছাস দেখা যায়। নানান ধরনের মাদ সংগ্ৰহ করতে এবং অতিথিদের তা দেখাতে এরা পছন্দ করেন। সুলতানের মধুর ব্যাপারটা শুরুতে আমি সে রকম কিছুই ভেবেছিলাম। পরে লক্ষ করলাম ব্যাপারটা সে রকম না। আমি নিশ্চিত যে সুলতান মধু খায় না। কারণ সে যখন আমাকে মধু দিচ্ছিল তখন তার নাক এবং ভুরু সামান্য কুঞ্চিত হল। যে তঁটকি কখনো খায় না। তার সামনে এক বাটি শুটকির ঝোল দিলে সে এই ভঙ্গিতেই নাক কুঁচকাবে। আমি একবার ভেবেছিলাম তাকে সরাসরি জিজ্ঞেস করি সে মধু খায় কি না। শেষ পর্যন্ত জিজ্ঞেস করি নি। আমি যে চোখ খোলা রেখে সব দেখছি তা ঠিক এই মুহূর্তে এদের জানতে দিতে চাচ্ছি না। বরকত নামের দারোয়ানের একটা বিষয় আমার চোখে লাগছে। আমি লক্ষ করেছি। সিঁড়ি বেয়ে উঠতে তার খুবই কষ্ট হয়। দেখে মনে হয় কষ্টটা শারীরিক। আমার ধারণা তা না। আমার ধারণা কষ্টটা মানসিক। দোতলার কোনো ভয়ঙ্কর স্মৃতি কি তার মাথায় আছে? যে কারণে দোতলায় ওঠার ব্যাপারে তার অনাগ্ৰহ আছে?

অস্বাভাবিক না। মেয়ে মাত্রই নিজেকে রহস্যময়ী হিসেবে উপস্থিত করতে চায়। মেয়েটি বুদ্ধিমতী। সে নানানভাবে আমার বুদ্ধির হিসেব নিতে চাচ্ছে। দাঁড়িপাল্লায় বুদ্ধি মাপতে চাচ্ছে। তার ভাবভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে আমার বুদ্ধির ব্যাপারটা তার কাছে জরুরি। কেন জরুরি? সে কি আমার বুদ্ধি ব্যবহার করতে চায়? কোথায় ব্যবহার করবে…

এই পর্যন্ত লিখে মিসির আলি হাই তুললেন। তার ঘুম পাচ্ছে। এখন ঘুমানো যায়।

বিস্ময়কর ঘটনা

মিসির আলি বিড়বিড় করে বললেন, This is a dream. Nothing but a dream. যে বিস্ময়কর ঘটনা এই মুহুর্তে তাঁর চোখের সামনে ঘটছে সেটা স্বপ্ন ছাড়া আর কিছুই হতে পারে না। স্বপ্নে বিস্ময়কর ঘটনা খুব স্বাভাবিকভাবে ঘটে। এখানেও তাই ঘটছে। তিনি পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছেন তাঁর মশারির ছাদে একটা সাপ কুণ্ডলি পাকিয়ে শুয়ে আছে। কুণ্ডলি ভেঙে সাপটা মাথা বের করল। এই তো এখন মশারি বেয়ে নিচে নামছে। সাপের গায়ে লম্বা লম্বা দাগ থাকে-এর গায়ে ফুটি ফুটি। অনেকটা চিত্র হরিণের মতো।

তিনি আবারো বিড়বিড় করে বললেন, This is a dream. Nothing but a dream. স্বপ্লের নানান স্তর আছে। তিনি নিশ্চয়ই গভীর কোনো স্তরের স্বপ্ন দেখছেন। এ ধরনের স্বপ্ন চট করে ভাঙে না। মানুষের মস্তিষ্ক স্বপ্নটা পুরোপুরি দেখানোর ব্যবস্থা করে। তার বেলাতেও এই ব্যাপারটিই হচ্ছে। স্বপ্নটা প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত তাকে দেখতে হবে। তাঁর মস্তিষ্ক দেখাবে। তিনি না চাইলেও দেখাবে।

যদি ঘটনাটা স্বপ্ন হয়ে থাকে তাহলে তার চুপচাপ শুয়ে সাপটার দিকে তাকিয়ে থাকা ছাড়া কিছু করার নেই। চোখ বন্ধ করলেও সাপটা চলে যাবে না। তাঁর চোখ বন্ধ না করার সঙ্গে স্বপ্নের কোনো সম্পর্ক নেই। আর যদি স্বপ্ন না হয়ে থাকে তাহলে অনেক কিছুই করার আছে। শুয়ে না থেকে তার উঠে বসা দরকার। হাততালি দেওয়া দরকার। সাপ শব্দ পছন্দ করে না। যেকোনো ধরনের কম্পন তার কাছে বিরক্তিকর। খাটটা দোলানো যেতে পারে। বালিশের নিচে সিগারেট আছে। সিগারেট ধরানো যেতে পারে। সিগারেটের ধোয়াও নিশ্চয়ই সাপটা পছন্দ করবে না।

মিসির আলি উঠে বসার সিদ্ধান্ত নিলেন কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও বসতে পারলেন না। এর দুটা কারণ হতে পারে। স্বপ্নে নিজের ইচ্ছায় কিছু করা যায় না। তিনি উঠে বসার চেষ্টা করছেন। কিন্তু পারছেন না। কাজেই এটা স্বপ্ন। আর স্বপ্ন না হয়ে ঘটনাটা যদি সত্যি হয় তাহলে তিনি উঠে বসতে পারছেন না, কারণ তিনি প্রচণ্ড ভয় পেয়েছেন। তয়ে স্নায়ুতে স্থবিরতা চলে এসেছে। মস্তিষ্ক উঠে বসার সিগন্যালটা ঠিকমতো দিতে পারছে না। যে সব রাসায়নিক বস্তু নিউরনের বিদ্যুৎপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করে তাদের ভেতরের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে গেছে। তিনি বালিশের নিচে হাত দিয়ে সিগারেট নিলেন। সিগারেট ধরালেন। তামাকের গন্ধ পাওয়া গেল। তাহলে কি এটা স্বপ্ন না, সত্যিঃ স্বপ্ন হল সিনেমার পর্দায় ছবি দেখার মতো–ছবি দেখা যাবে, শব্দ শোনা যাবে। তবে কোনো গন্ধ পাওয়া যাবে না। স্বপ্ন গন্ধ এবং বর্ণহীন।

তিনি গন্ধ পাচ্ছেন এবং রঙও দেখছেন। সাপের গায়ের হলুদ ফুটি স্পষ্ট দেখেছেন। এই তো এখন তার হাতে বেনসন এন্ড হেজেস-এর সোনালি প্যাকেট। গাঢ় লাল রঙের উপর লেখা Special filter.

তবে এখানেও কথা আছে, গভীর স্তরের স্বপ্নে বর্ণ গন্ধ সবই থাকে। আচ্ছা এমন কি হতে পারে তিনি যা দেখছেন তা স্বপ্ন না, বাস্তব ঘটনা। তাকে তো আগেই কলা হয়েছে এই বাড়ির দোতলায় সাপ আছে। যদি সাপ থেকেই থাকে তাহলে ঘরে সাপ আসতেই পারে। কারণ এই ঘরটায় কার্বলিক এসিড দেওয়া হয় নি।

ধরে নেওয়া যায় একটা সাপ ঘরে ঢুকেছে। আলো সমস্ত প্ৰাণীকুলকে কৌতূহলী করে, সাপটিকেও করেছে। সে এগিয়ে এসেছে খাটের নিচে রাখা হারিকেনের দিকে। এখানে এসে সে শুনতে পেল নিশ্বাস ফেলার শব্দ। খাট থেকে শব্দটা আসছে। সাপট আবারো কৌতূহলী হল। সে দেখতে গেল ব্যাপারটা কী? কীসের শব্দ? শব্দটা কোত্থেকে আসছে? দেখতে গিয়ে সে চলে গেল মশারির ছাদে। তার কৌতূহল মিটেছে বলে সে এখন চলে যাচ্ছে। কিংবা তার কৌতূহল মেটে নি। সে চলে যাচ্ছে কারণ সে বুঝতে পারছে কৌতূহল মেটার কোনো সম্ভাবনা নেই।

মিসির আলি বিছানায় উঠে বসলেন। বালিশের কাছে হাত বাড়ালেন। টর্চ লাইটটা আছে। তিনি টর্চের আলো ফেললেন। সাপটা দেখা যাচ্ছে না। খাট বেয়ে নিশ্চয়ই নেমে গেছে। তিনি কয়েকবার কাশলেন। টর্চ লাইটে টোকা দিলেন!। বসে বসেই খাট নাড়ালেন। তিনি এখন বিছানা থেকে নামবেন। তাকে একটা কাজ করতে হবে। ছোটখাটো একটা পরীক্ষা। তাকে যেতে হবে বড় টেবিলটার কাছে। টেবিলের উপর ডায়েরি আছে। ডায়েরির পাতায় কিছু একটা লেখে নাম সই করতে হবে।

এই মুহুর্তে যা ঘটছে তা স্বপ্ন না। সত্যি তা প্রমাণ হবে ডায়েরির লেখা থেকে। সকালে ঘুম ভেঙে যদি দেখেন ডায়েরিতে কিছু লেখা নেই তাহলে বুঝতে হবে পুরো ব্যাপারটা স্বপ্ন। আর যদি দেখেন লেখা আছে তাহলে বুঝতে হবে যা দেখেছেন সবই সত্যি। মিসির আলি খুব সাবধানে বিছানা থেকে নামলেন। সাপটাকে প্রথমবার দেখে যে ভয় পেয়েছিলেন, সেই ভয়টা এখন আর লাগছে না। তবে গা ছমছম করছে।

মেঝেতে কোথাও সাপটিকে দেখা গেল না। মিসির আলি টেবিলের কাছে গেলেন। ডায়েরিতে লিখলেন -আজ সাত তারিখ। আমি আমার মশারির উপর একটা সাপ দেখেছি। লিখে নাম সই করলেন। ডায়োরি উন্টে এমনভাবে টেবিলে রাখলেন যেন সকালে ঘুম ভাঙতেই চোখে পড়ে ডায়েরিটা উল্টানো। কিছুক্ষণ বারান্দায় দাঁড়াবেন। ঘরের ভেতর দমবন্ধ লাগছে।

তিনি দরজায় ছিটিকিনি না দিয়েই শুয়েছিলেন। পুরোনো আমলের বাড়ি ছিটিকিনি জং ধরে আটকে গিয়েছিল। যেহেতু ছিটিকিনি লাগানো নেই, আংটা ধরে টানলেই দরজা খুলে যাবার কথা। কিন্তু আশ্চর্য দরজা খুলতে পারলেন না। প্রাণপণে টেনেও দরজা নাড়ানো গেল না। মনে হচ্ছে দরজা বাইরে থেকে বন্ধ। তিনি বেশ কয়েকবার চেষ্টা করলেন। কোনো লাভ হল না। মিসির আলি খাটে এসে উঠলেন। হইচই চিৎকার করার কোনোই মানে হয় না। পুরো ব্যাপারটা স্বপ্ন হবার সম্ভাবনা অনেক বেশি। কাজেই তার যা করণীয় তা হল বিছানায় চলে যাওয়া। ঘুমিয়ে পড়া এবং ঘুম ভাঙার জন্যে অপেক্ষা করা।

মিসির আলি বিছানায় শুয়ে পড়লেন। শীত শীত লাগছে। পায়ের কাছে রাখা চাঁদ র বুক পর্যন্ত টেনে দিলেন। একটা হাত রাখলেন কোলবালিশের উপর। তিনি চোখ বন্ধ করে আছেন। মাথার ভেতরে সমুদ্র গর্জনের মতো শব্দ হচ্ছে। এ রকম শব্দ কেন হচ্ছে কে জানে? প্রচণ্ড ভয় পাবার পরে কি মানুষের শারীরবৃত্তীয় কর্মকাণ্ড খানিকটা এলোমেলো হয়ে যায়?

তাঁর ঘুম ভাঙল অনেক বেলায়। ঘর ভর্তি আলো। পাখপাখালি চারদিকে কিচকিচ করছে। খাটের পাশে লিলি দাঁড়িয়ে আছে। তার হাতে চায়ের কাপ। আজ মেয়েটিকে দেখে মনে হচ্ছে তার বয়স কিছুতেই সতের আঠার বছরের বেশি হবে না। লিলি হাসিমুখে বলল, চাচাজী আপনি দরজার ছিটিকিনি না লাগিয়েই ঘুমিয়েছেন? মিসির আলি উঠে বসতে বসতে বললেন, ছিটিকিনি লাগাতে পারি নি। লিলি বলল, আমি তো আর সেটা জানি না। এর আগেও দুবার এসে বন্ধ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থেকে চলে গেছি। এইবার কী মনে করে দরজা ধাক্কা দিলাম। ধাক্কা দিতেই দরজা খুলে গেল। চাচাজী রাতে ঘুম কেমন হয়েছে?

ভালো।

নিন চা নিন। আমি বইয়ে পড়েছি আপনি বাসিমুখে দিনের প্রথম চা খান। নাশতা তৈরি আছে! হাত মুখ ধুয়ে নিচে নামলেই নাশতা দিয়ে দেব।

তোমার শরীর এখন ভালো?

শরীর খুব ভালো। কাল রাতেও ভালো ছিল। ওর সঙ্গে রাগারণি করে বিছানায় শুয়ে পড়েছিলাম। ও আপনাকে কী বলেছে? আমার মাথা খারাপ? আমার চিকিৎসা দরকার?

এই ধরনেরই কিছু।

লিলি হাসতে হাসতে বলল, ওর কোনো দোষ নেই। রাগারগির এক পর্যায়ে আমি মাথা খারাপের অভিনয় করেছি। ও আমার অভিনয় ধরতে পারে না। চাচাজী আমার চা কেমন হয়েছে?

ভালো হয়েছে।

কাল রাতের খাবারটা কেমন ছিল?

ভালো ছিল। আমি খুব তৃপ্তি করে খেয়েছি।

আজ। আপনাকে কই মাছের পাতুড়ি খাওয়াব। পুঁই শাকের পাতা আনতে পাঠিয়েছি। পাওয়া গেলে হয়। এমন জংলা জায়গায় বাস করি। আশপাশের দুতিন মাইলের মধ্যে হাটবাজার নেই।

মিসির আলি কাপে চুমুক দিতে দিতে বললেন, লিলি একটা কাজ কর তো–টেবিলের উপর দেখ আমার ডায়েরিটা উল্টো করে রাখা আছে। পাতাটা খুলে দেখা কী লেখা।

লিলি টেবিলের কাছে গেল। ডায়েরি উলটো করে রাখা নেই। বইগুলির উপর রাখা। লিলি বলল, চাচাজী টেবিলের উপর কোনো ডায়েরি উল্টো করে রাখা নেই।

লাল মলাটের বইটি ডায়েরি। সাত তারিখ বের করে দেখ তো কিছু লেখা আছে কি না।

লিলি অবাক হয়ে বলল, কিছু লেখা নেই। কী লেখা থাকবে?

মিসির আলি হালকা গলায় বললেন, রেখে দাও। কিছু লেখা থাকবে না। তোমার স্বামীর ঘুম কি ভেঙেছে?

ওর ঘুম একটার আগে ভাঙবে না। সারা রাত জেগে তারা দেখেছে। আপনাকে কী কী দেখাবে সব ঠিকঠাক করেছে। আজ। আপনাকে কী দেখানো হবে জানেন?

না।

শনির বলয়। এইসব দেখে কী হয় কে জানে! আমার খুবই ফালতু লাগে। চাচাজী আমি নিচে যাচ্ছি। হাতমুখ ধুয়ে আপনি নেমে আসুন। আজ আপনি নাশতা থাবোন চুলার পাশে বসে। গরম গরম লুচি ভেজে পাতে তুলে দেব।

তোমার লুচিগুলিও কি স্পেশাল?

অবশ্যই। অর্ধেক ময়দা আর অর্ধেক সুজিদানা মিশিয়ে কাই তৈরি করা হয়। দশ বারো ঘণ্টা এই কাই ভেজা ন্যাকড়ায় জড়িয়ে রেখে দিতে হয়। লুচির কাই আমি কাল রাতেই তৈরি করে রেখেছি।

ভালো।

শুধু ভালো বললে হবে না। আপনি চলে যাবার আগে আমাকে একটা সার্টিফিকেট দিয়ে যাবেন। রান্নার সার্টিফিকেট। সেই সার্টিফিকেট আমি বাঁধিয়ে রাখব।

অবশ্যই দিয়ে যাব। তুমি চাইলে এখনি দিয়ে দিতে পারি।

ওমা এখন কেন দেবেন? আমি তো এখনো আপনার জন্যে রান্নাই করি নি। চাচাজী যাই।

লিলি চলে যাবার পর মিসির আলি টেবিলের কাছে গেলেন। ডায়েরি হাতে নিলেন। সেখানে স্বপ্নের কথা লেখা নেই। তাহলে ব্যাপারটা কি দাঁড়ালা? গত রাতে যা দেখেছেন সবই স্বপ্ন? গাঢ় স্বপ্ন?

মিসির আঁলি হাত মুখ ধুয়ে নিচে নামলেন। লুচি বেগুনভাজা খেলেন। চা খেলেন। লিলি বলল, চাচাজী আপনি ঘুরে ফিরে বাড়ি দেখুন। বাগান দেখুন। লাইব্রেরি ঘর খুলে রেখেছি। লাইব্রেরির বইপত্র দেখতে পারেন।

তোমার কুকুরগুলি কি বাঁধা আছে?

হ্যাঁ কুকুর বাঁধা। বরকতকে পুঁই পাতার খোঁজে পাঠিয়েছি। বড় বড় পুঁই পাতা ছাড়া পাতুড়ি হয় না। বরকত এলেই কুকুরগুলির সঙ্গে আপনার পরিচয় করিয়ে দেব। তখন আপনার কুকুরভীতি থাকবে না।

নীল ফুল ফোটে ঐ গাছটা কোথায়?

পেছনের বাগানে। বিশাল গাছ আপনি দেখলেই চিনতে পারবেন। গাছের গুঁড়িটা বাঁধানো। পেছনের বাগানে একটা ভাঙা মন্দির আছে। মন্দিরে ঢুকবেন না। সাপের আড্ডা।

কী মন্দির?

কালী মন্দির। হিন্দু বাড়ি ছিল। বাড়ির মালিক অশ্বিনী রায় শাক্ত মতের মানুষ ছিলেন। স্বপ্নে দেখে তিনি কালী প্রতিষ্ঠা করেন। খুবই ইস্টারেস্টিং গল্প। আমি ভাসা ভাসা জানি। সুলতানকে জিজ্ঞেস করলেই আপনাকে বলবে।

আচ্ছা তাঁকে জিজ্ঞেস করব।

লিলি বলল, আমি ঐ দিনের মতো এক্সপ্রেসো কফি বানিয়ে আপনার জন্যে নিয়ে আসছি। ঠিক আছে চাচাজী?

ঠিক আছে।

মিসির আলি বাড়ি দেখতে বের হলেন। রাতে বাড়িটা যত প্ৰকাণ্ড মনে হয়েছিল। দিনের আলোয় মনে হচ্ছে তার চেয়েও প্ৰকাণ্ড। তবে প্ৰকাণ্ড হলেও ধ্বংসস্তুপ। বাড়িটা যেন অপেক্ষা করছে কখন হুমড়ি খেয়ে পড়বে। বাড়িটার দিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকা যায় না! ভয় ভয় করে। মনে হয় বাড়িটাও কৌতূহলী চোখে তাঁকে দেখছে। চিন্তাভাবনা করছে। চিন্তা ভাবনা শেষ হলেই বাড়ি গম্ভীর গলায় ডাকবে, এই যে ভদ্রলোক আপনার সঙ্গে কিছু কথা আছে, দয়া করে শুনে যান।

মিসির আলি বাড়ির পেছনে চলে গেলেন। তিনি বৃক্ষপ্রেমিক না। গাছপালা নিয়ে ষ্ঠার বাড়াবাড়ি কৌতূহল নেই, কিন্তু নীল মরিচ ফুল গাছটা দেখতে ইচ্ছা হচ্ছে।

বাড়ির পেছনের জায়গাটা আশ্চর্যরকমভাবে পরিষ্কার। ঝোপঝাড় নেই, বড় বড় ঘাস নেই, গাছের নিচে শুকনো পাতা পড়ে নেই। মনে হচ্ছে এই কিছুক্ষণ আগে ঝাট দেওয়া হয়েছে। নীল মরিচ ফুল গাছটা দূর থেকে দেখা যাচ্ছে। এমন কিছু বিস্ময়কর গাছ বলে মনে হচ্ছে না। তবে মরিচ ফুল গাছের পাশেই চেষ্ট্ৰী গাছ ফুলে ফুলে ছেয়ে আছে। পাতাশূন্য গাছ সাদা ফুলে ঢেকে আছে। মিসির আলি বিস্মিত গলায় বললেন, বাহ সুন্দর তো!

চেরী গাছের পাতা শীতকালে ঝরে যায়। এখন শীত না, তারপরেও গাছে একটা পাতা নেই কেন? জন্মভূমি ছেড়ে অন্যদেশে এসে গাছের জিনে কি কোনো পরিবর্তন হয়েছে? নাকি এটা চেরী গাছ না, অন্য কোনো গাছ। তিনি নাম জানেন না।

ভাঙা মন্দিরটা দেখা যাচ্ছে। মন্দিরের অংশটা ঝোপঝাড়ে ঢাকা। বড় বড় কয়েকটা আম গাছ জায়গাটা অন্ধকার করে রেখেছে। উইয়ের টিবির মতো কিছু উঁচু মাটি দেখা গেল। মন্দিরের ঠিক সামনে সারি করে লাগানো জবা গাছ। জবা গাছ। এত বড় হতে মিসির আলি দেখেন নি। গাছগুলি আম কঁঠালের গাছের মতোই প্ৰকাণ্ড। একটা গাছেই শুধু ফুল ফুটেছে। কালচে লাল রঙের ফুল! দেখতে ভালো লাগে না। জবা ফুল ছাড়া কালী পূজা হয় না। পূজার ফুলের জন্যই কি এই গাছগুলি লাগানো? এত প্রাচীন গাছ? মিসির আলি মন্দিরের দিকে এগিয়ে গেলেন।

মন্দিরের গায়ে শ্বেত পাথরের ফলকে কী সব লেখা। পড়তে ইচ্ছা করছে।

বাবু অশ্বিনী কুমার রায়
কর্তৃক
অদ্য শনিবার বঙ্গাব্দ ১২০৮ গৌর কালীমূর্তি অধিষ্ঠিত হইল।

মিসির আলি নামফলকের দিকে তাকিয়ে আছেন। গৌর কালীমূর্তি ব্যাপারটা বোঝা যাচ্ছে না। কালী কৃষ্ণবর্ণ, গৌরবর্ণ না।

চাচাজী আপনার কফি। আপনাকে বলা হয়েছে মন্দিরের কাছে না। আসতে আর আপনি সোজাসুজি মন্দিরে চলে এসেছেন। আপনি দেখি একেবারে বাচ্চাদের মতো। যেটা করতে না করা সেটাই করেন।

মিসির আলি কফির মগ হাতে নিতে নিতে বললেন, গৌর কালী ব্যাপারটা কী?

গৌর কালী হল যে কালীর গায়ের রঙ গৌর। ধবধবে সাদা। বাবু অশ্বিনী রায় স্বপ্নে দেখেছিলেন মা কালী তাকে বলছেন-তুই আমাকে প্রতিষ্ঠা কর। তবে গায়ের রঙ কালো করিস না বাবা। গৌর বর্ণ করবি। অশ্বিনী কুমার রায় বললেন, ঠিক আছে মা করব। দেবী তখন বললেন, আমি তোর এখানে থাকব নগ্ন অবস্থায়। আমার গায়ে যেন কোনো কাপড় না থাকে। অশ্বিনী কুমার রায় বললেন, সেটা কি ঠিক হবে মা? কত ভক্তরা তোমাকে দেখতে আসবে! দেবী বললেন, কেউ আমাকে দেখতে আসবে না। তোকে যা করতে বললাম তুই কর।

মিসির আলি বললেন, অশ্বিনী কুমার নগ্ন গৌরবর্ণের কালী প্রতিষ্ঠা করলেন?

লিলি বলল, হ্যাঁ।

মন্দিরে কি মূর্তি আছে?

না। অশ্বিনী কুমার রায় নিজেই মূর্তিটা মেঘনায় ফেলে দিয়েছিলেন।

কেন?

গল্পটা আমি পুরোপুরি জানি না। ভাসা ভাসা জানি। দূরবীনওয়ালা, অর্থাৎ সুলতান সাহেব ভালোমতো ও আপনাকে গুছিয়ে বলবে।

আগে থেকে অগোছালোভাবে শুনি। অগোছালো গল্প শুনতেই আমার বেশি ভালো লাগে।

ঘটনাটা হল এ রকম–যেদিন দেবী প্রতিষ্ঠিত হল সেই রাতেই অশ্বিনী বাবুকে দেবী স্বপ্নে দেখা দিয়ে বললেন, এই বোকা ছেলে! নরবলি ছাড়া শক্তির প্রতিষ্ঠা হয়? তুই এক কাজ করা, আগামী অমাবস্যার নরবলি দে। অশ্বিনী বাবু বললেন, এইটা পারব না। মা। আমি মহাপাতক হব। দেবী বললেন, পাপ-পুণ্যের তুই বুঝিস কী? তোকে যা করতে বললাম কর। নয়তো মহাবিপদে পড়বি। অশ্বিনী বাবু স্বপ্নের মধ্যেই কাঁদতে কাঁদতে বললেন, এই কাজটা পারব না মা। নরবলি ছাড়া তুমি যা করতে বলবে তাই করব। দেবী তখন বললেন, তুই যখন পারবি না। তখন আমার ব্যবস্থা আমিই করব। তখন তোর দুঃখের সীমা থাকবে না। অশ্বিনী বাবুর ঘুম ভেঙে গেল। দুশ্চিন্তায় তিনি অস্থির হয়ে গেলেন। খুবই কান্নাকাটি শুরু করলেন। আগামী অমাবস্যার না জানি কী হয়!

কিছু হয়েছিল?

হ্যাঁ হয়েছিল। অশ্বিনী বাবুর বড় মেয়েকে মন্দিরের ভেতর পাওয়া গেল। বড় মেয়ের নাম শ্বেতা। বয়স আঠার উনিশ। বিয়ের কথা চলছিল। সকালে মন্দিরে ঢুকে অশ্বিনী বাবু দেখেন, মেয়ের মাথা একদিকে ধড় আরেক দিকে। দেবীর খাড়ায় চাপ চাপ রক্ত।

কী সৰ্বনাশ!

অশ্বিনী বাবুর মাথা খারাপের মতো হয়ে গেল। তিনি সেই রাতেই দেবীমূর্তি মেঘনা নদীর মাঝখানে ফেলে দিয়ে এলেন।

উনার কি একটাই মেয়ে ছিল?

ওনার চার মেয়ে ছিল। দুমাসের মাথায় দ্বিতীয় মেয়েটিরও একই অবস্থা হল। মন্দিরের ভেতর তাকে পাওয়া গেল মাথা একদিকে ধড় আরেক দিকে। অশ্বিনী বাবু বাড়িঘর বিক্রি করে বাকি দুই মেয়ে আর স্ত্রীকে নিয়ে প্রথমে গেলেন ডিব্ৰুগরে, সেখান থেকে শিলিগুড়িতে। শিলিগুড়িতে তাঁর তৃতীয় মেয়েটির একই অবস্থা হল। তখন তাঁর স্ত্রী সীতাদেবী মামলা করলেন স্বামীর বিরুদ্ধে। সীতাদেবী বললেন, হত্যার ঘটনাগুলি তার স্বামী ঘটাচ্ছেন। দোষ দিচ্ছেন মা কালীর। ছোট মেয়েটাও বাবার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিল।

মামলার রায় কী হয়েছিল?

ওনার ফাঁসি হয়েছিল।

তুমি এতসব জানলে কী করে?

এই মামলা নিয়ে অনেক লেখালেখি হয়েছে। আমাদের দূরবীনওয়ালা সেইসব লেখা সবই যোগাড় করেছিল। আপনি চাইলে আপনাকে খুঁজে বের করে দেবে। আপনি কি চান?

না চাই না।

লিলি বলল, আমাকে দেখে কি বুঝতে পারছেন যে আমার মনটা খুব খারাপ?

না বুঝতে পারছি না।

আমার মনটা খুবই খারাপ কারণ পুঁই পাতা পাওয়া যায় নি। বড় বড় পুঁই পাতা দিয়ে পেঁচিয়ে পাতুড়ি করতে হয়। কলাপাতা দিয়েও হয়। তবে ভালো হয় না।

মিসির আলি হেসে ফেলে বললেন, মন খারাপের কারণটা তো মনে হয় খুবই গুরুতর।

আপনার কাছে গুরুতর মনে না হতে পারে আমার কাছে গুরুতর। ও যেমন তারা দেখে, আমি করি রান্না। কোনো রাতে যদি আকাশ মেঘে ঢেকে যায় ওর প্রচণ্ড মেজাজ খারাপ হয়। ঠিক সে রকম আমি যখন রান্নার জিনিসপত্র পাই না, আমার মেজাজ খারাপ হয়। এটা কি দোষের?

না দোষের না। এত সুন্দর বাগান তুমি এখানে বেড়াতে আস না?

লিলি বলল, কখনো না। নেংটিা দেবীর আশপাশে আমি থাকব? পাগল হয়েছেন? তাছাড়া গাছপালা আমার ভালোও লাগে না। চাচাজী শুনুন আমি চলে যাচ্ছি। খবরদার আপনি কিন্তু মন্দিরের ভেতর ঢুকবেন না।

আচ্ছা ঢুকব না। তোমার স্বামীর ঘুম ভেঙেছে?

হুঁ ভেঙেছে।

তার নাশতা খাওয়া শেষ?

সে নাশতা খাবে না। দুপুরে ভাত খেয়ে আবার ঘুমিয়ে পড়বে। ঘুম না এলে ঘুমের অষুধ খেয়ে ঘুমাবে।

কেন?

রাত জাগবে। আজ সে আপনাকে নিয়ে তারা দেখবে।

আজ কি অমাবস্যা?

আগামীকাল অমাবস্যা।

মিসির আলি বললেন, কদিন ধরেই যেমন মেঘলা যাচ্ছে–অমাবস্যার রাতে যদি আকাশে মেঘ থাকে তাহলে তো সমস্যা।

লিলি নিচুগলায় বলল, আপনার আর কী সমস্যা। সমস্যা আমার। আকাশে মেঘ দেখলে ও প্রচণ্ড রেগে যায়। হইচই করে। অমাবস্যা হল বৃষ্টির সময়। অন্যদিন বৃষ্টি না হলেও অমাবস্যার বৃষ্টি হবেই। চাঁদের আকর্ষণ বিকর্ষণের কিছু ব্যাপার নিশ্চয়ই আছে। আমি জানি না। আপনি নিশ্চয়ই জানেন।

আমি জানি না।

কফির মগটা দিন আমি নিয়ে চলে যাই। দুপুরের রান্না হলে খবর দেব চলে আসবেন। এখন নিজের মনে ঘুরে বেড়ান। শুধু দয়া করে মন্দিরে ঢুকবেন না।

মিসির আলি নীল মরিচ গাছের নিচে বসলেন। কালো সিমেন্টে বাঁধানো বেদি, বসার জন্যে সুন্দর। সঙ্গে বই নিয়ে এলে পড়া যেত। দোতলায় উঠে বই আনতে ইচ্ছা করছে না। আচ্ছা গতরাতের ঘটনাটা নিয়ে কি কিছু ভাববেন! না থাক এখনো সময় হয় নি। মন্দিরের ভেতরটা একবার উঁকি দিয়ে দেখতে ইচ্ছা করছে। মেয়েটা যদিও নিষেধ করেছে। নিষেধ আগ্রাহ্য করার একটা প্রবণতা হয়তো মানুষের ডিএনএর ভেতরই আছে। মানুষকে যেটাই নিষেধ করা হয়েছে সেটাই সে করেছে। ব্যাপারটা শুরু করেছিলেন আদি মানব আদম। তাঁকে কোনো ব্যাপারে নিষেধ করা হয় নি, শুধু বলা হয়েছিল-গন্ধম ফলটা খেও না। আদম প্রথম যে কাজটা করলেন সেটা হল গন্ধম ফল।

এডমন্ড হিলারির মার ছিল উচ্চতা ভীতি। তিনি তাঁর পুত্রকে বললেন, তুমি আর যা-ই কর বাড়ির ছাদে উঠবে না। সেই হিলারি এভাররেষ্টের চূড়ায় উঠে বসে থাকলেন।

মিসির আলি মন্দিরের দিকে রওনা হলেন। ভেতরে ঢোকার দরকার নেই-তিনি শুধু উঁকি দিয়ে চলে আসবেন। পরিত্যক্ত মন্দিরে সাপ থাকা স্বাভাবিক, তবে কাল রাতের ঘটনার পর দিনের সাপ তত ভয়ঙ্কর হবে বলে মনে হয় না।

মন্দিরে ঢোকার দরজাটা কাঠের। দরজায় হুক আছে। তালা লাগানোর ব্যবস্থাও আছে। কিন্তু দরজায় তালা নেই। মিসির আলি ধাক্কা দিতেই দরজা খুলল। মেঝে শ্বেত পাথরের, ঝকঝক করছে। মনে হচ্ছে এই মাত্র কেউ এসে সাবান পানি দিয়ে ধুইয়ে গেছে। তার চেয়েও বিস্ময়কর ঘিটনা হল মন্দিরে আছে। গৌর কালীর নগ্ন মূর্তি।

এখানেই বিস্ময়কর সমাপ্তি না। এর চেয়েও বিস্ময়কর ব্যাপার হল মূর্তিটি দেখতে অবিকল লিলির মতো! যেন কোনো ভাস্কর এসে লিলিকে দেখে পাথর কেটে কেটে মূর্তি বানিয়েছে। কাকতালীয়ভাবে একটা মানুষের চেহারার সঙ্গে পুরোনো মূর্তির চেহারা মিলে যাবে এটা বিশ্বাসযোগ্য না। এটা খুবই অবিশ্বাস্য একটা ঘটনা।

মিসির আলি মন্দির থেকে বের হলেন। চেরী গাছটার নিচে বরকত দাঁড়িয়ে আছে। তার হাতে শলার ঝাড়ু, বাগান কুঁট দিয়ে এসেছে। তবে সে এই মুহুর্তে বাগান ঝাট দিচ্ছে না, একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মিসির আলির দিকে। সেই দৃষ্টিতে কৌতূহল, বিস্ময়, আনন্দ কোনো কিছুই নেই। সে তাকিয়ে আছে মাছের মতো ভাবলেশহীন চোখে।

মিসির আলি মন্দির থেকে বের হয়ে মন্দিরের পেছনের দিকে হাঁটতে শুরু করলেন। বরকত চোখের দৃষ্টিতে এখনো তাঁকে অনুসরণ করছে। তাঁর দৃষ্টির আড়ালে যাবার জন্যেই মন্দিরের পেছনে চলে যাওয়া দরকার।

মন্দিরের পেছনটা সম্পূর্ণ অন্যরকম। একটা কুয়া আছে। কুয়ার পাড় পাথর দিয়ে বাঁধানো। কুয়ার উপরে তারের জাফরি। সেখানে বাগান বিলাস গাছ। গাছ ভর্তি ফুল। অন্ধকার কুয়া, ফুলের কারণে আলো হয়ে আছে। নদীর কাছের বাড়িতে কখনো কুয়া থাকে না। এই কুয়াটাই প্রমাণ করে দিচ্ছে একসময় নদী অনেক দূরে ছিল। মিসির আলি কুয়ার পাড়ে উঠলেন। পানি আছে কি না দেখতে হবে। পাথর নিয়ে ফেলতে হবে।

মিসির আলি কুয়াতে পাথর ফেলতে পারলেন না। তার আগেই তাঁকে চমকে উঠতে হল, কারণ ঝাঁটা হাতে বরকত এসে দাঁড়িয়েছে। মিসির আলি বললেন, কিছু বলবে?

বরকত জবাব দিল না। চোখও নামিয়ে নিল না।

মিসির আলি বললেন, বাগান বঁট দিতে এসেছ?

বরকত বলল, না।

মিসির আলি বললেন, তোমার কুকুরগুলির সঙ্গে এখনো পরিচয় হয় নি। চল যাই কুকুরগুলির সঙ্গে পরিচিত হয়ে আসি।

বরকত বলল, আপনেরে ডাকে।

কে ডাকে?

বরকত এই প্রশ্নের জবাব না দিয়ে বাড়ির দিকে আঙুল উঁচিয়ে দেখাল। মিসির আলি বললেন, কে ডাকছে? লিলি?

বরকত জবাব দিল না। আঙুল উঁচিয়ে রাখল। মিসির আলি আঙুল লক্ষ করে এগুলেন। বরকত এখনো হত নামাচ্ছে না। তাঁর চিহ্ন আঁকা সাইনবোর্ডের মতো হাত স্থির করে রেখেছে। তাকে দেখাচ্ছে কাকতাডুয়ার মতো।

হাতের আঙুল লক্ষ করে মিসির আলি উপস্থিত হলেন লাইব্রেরি ঘরে। বিরাট ঘর। সাধারণত লাইব্রেরি ঘরের চারদিকেই বই থাকে। এই ঘরের একদিকের দেওয়ালে বই রাখা। কোনো আলমিরা নেই। সব বই র্যাকে রাখা। র্যাকের উচ্চতা এমন যে হুইল চেয়ারে বসেই হাত বাড়িয়ে বই নেওয়া যায়।

লাইব্রেরি ঘরের ঠিক মাঝখানে হুইল চেয়ারে সুলতান বসে আছে। সুলতানের সামনে টি টেবিলের মতো ছোট্ট টেবিল। সুলতানের উল্টোদিকে আরেকটা হুইল চেয়ার।

সুলতান হাসি মুখে বলল, স্যার কেমন আছেন? মিসির আলি বললেন, ভালো।

আপনার বসার জন্যে একটা হুইল চেয়ার রেখে দিয়েছি।

তাই তো দেখছি।

সুলতান গলার স্বর গম্ভীর করে মাথা সামনের দিকে খানিকটা কুঁকিয়ে বলল, সাধারণ চেয়ার না রেখে আপনার জন্যে হুইল চেয়ার কেন রেখেছি বলতে পারবেন?

না, বলতে পারব না।

আপনি কি বিস্মিত হচ্ছেন?

সামান্য হচ্ছি।

স্যার বিস্মিত হবার কিছু নেই। আমি ব্যাখ্যা করলেই বুঝবেন আপনার জন্যে হুইল চেয়ারের ব্যবস্থা করাটা খুবই যুক্তিযুক্ত। আপনি চেয়ারটায় আরাম করে বসুন, আমি ব্যাখ্যা করছি।

মিসির আলি বসলেন। সুলতান বলল, চেয়ারের কনট্রোলগুলি দেখে নিন। পায়ের এখন আর আপনার কোনো ব্যবহার নেই। চেয়ার ঘোরানো, সামনে পেছনে যাওয়া, সবই এখন থেকে করবেন হাতে। কাজটা এক হাতেও করতে পারেন তবে দুটা হাত ব্যবহার করলে পরিশ্রম কম হবে।

মিসির আলি বললেন, আমার তো আর এই চেয়ারে বসে অভ্যস্ত হবার দরকার নেই। আমি বসলাম আমার মতো। আপনি হুইল চেয়ারের রহস্যটা ব্যাখ্যা করুন।

সুলতান বলল, স্যার লিলি আপনাকে চাচাজী ডাকে। সেই সূত্রে আপনি অবশ্যই আমাকে তুমি করে বলবেন।

আচ্ছা বলব।

এখন বলি কেন আপনার জন্যে হুইল চেয়ারের ব্যবস্থা করলাম। আমি আকাশের বিশেষ বিশেষ দিকে টেলিস্কোপ ফিট করি। তারপর আসে ফোকাসের ব্যাপারটা। টেলিস্কোপ স্ট্যান্ডে বসিয়ে এই কাজটা আমাকে করতে হয় হুইল চেয়ারে বসে। একবার টেলিস্কোপ সেট করা হয়ে গেলে সেখানে আর হাত দেওয়া যাবে না। সেটিং বদলানো যাবে না। স্যার বুঝতে পারছেন?

পারছি।

হুইল চেয়ারে বসে আমি টেলিস্কোপ সেট করলাম। তারপর হুইল চেয়ার নিয়ে সরে গেলাম-আপনি আরেকটা হুইল চেয়ার নিয়ে টেলিস্কোপের কাছে চলে এলেন। আপনাকে কষ্ট করতে হল না। আপনাকে আর দাঁড়িয়ে, হাঁটু গেড়ে কিংবা কুঁজো হয়ে টেলিস্কোপে চোখ রাখতে হবে না। হুইল চেয়ারের লজিকটা কি এখন আপনার কাছে পরিষ্কার হয়েছে?

মিসির আলি হাসিমুখে বললেন, হ্যাঁ পরিষ্কার হয়েছে। খুবই যুক্তিযুক্ত ব্যাখ্যা। ব্যাখ্যাটা চট করে মাথায় আসে না বলে শুরুতে হুইল চেয়ার দেখে একটা ধাক্কার মতো খেয়েছিলাম।

সুলতান হাসতে হাসতে বলল, আজ যেমন মন্দিরে ঢুকে আপনি একটা ধাক্কার মতো খেলেন। মন্দিরে ঢুকে দেখলেন গৌর কালীর মূর্তি দেখতে অবিকল লিলির মতো। এরও কিন্তু অত্যন্ত সরল ব্যাখ্যা আছে।

কী ব্যাখ্যা?

গৌর কালীর মূর্তি বাবু অশ্বিনী কুমার অনেক আগেই নদীতে ফেলে দিয়েছিলেন। এই মূর্তিই পরে আমি বানিয়েছি। হুইল চেয়ারে বসে জীবন কাটে না। নানান ধরনের কাজে নিজেকে ব্যস্ত রাখতে গিয়ে মাইকেল এঞ্জেলো হবার হাস্যকর চেষ্টা। ছেনি হাতুড়ি নিয়ে পাথর কাটাকাটি।

মূর্তিটা সুন্দর হয়েছে।

মোটেও সুন্দর হয় নি। মুখের আদালটা শুধু এসেছে। আর কিছু আসে নি। নগ্ন মূর্তি বলে আপনি লজ্জায় ভালোমতো তাকান নি। ভালোমতো তাকালে ত্রুটিগুলি ধরতে পারতেন। মূর্তির একটা হাত বড়, একটা ছোট। পায়ের প্রোপরাশন ঠিক হয় নি। হাঁটু যেখানে থাকার কথা তারচেয়ে উঁচুতে হয়েছে। আপনি এখন যদি দেখেন তাহলে ত্রুটিগুলি চোখে পড়বে। মূর্তিটা নগ্ন কেন বানিয়েছি সেই ব্যাখ্যা শুনতে চান? তারও ব্যাখ্যা আছে।

না। এর ব্যাখ্যা আমার কাছে আছে। গৌর কালীর মূর্তিটা ছিল নগ্ন। তুমি মন্দিরে গৌর কালী প্ৰতিষ্ঠা করতে চেয়েছ। অতীত ফিরিয়ে আনার চেষ্টা। ইংরেজিতে সহজভাবে বলা যায় An attempt to recreate the past.

ব্যাপারটা তাই বাবু অশ্বিনী রায়ের ঘটনাটা আমাকে খুবই আলোড়িত করে। আমার মূর্তি বানানোতেও তার একটা ছায়া পড়েছে।

মিসির আলি বললেন, তোমার কি মাঝে মাঝে নিজেকে বাবু অশ্বিনী কুমার মনে হয়?

সুলতানকে দেখে মনে হল মিসির আলির এই কথায় সে একটা ধাক্কার মতো খেয়েছে। নিজেকে সামলাতে তার সময় লাগছে। তার ভুরু কুঁচকে আছে। চোখের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ। সে পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করতে করতে বলল, এই কথাটা কেন বললেন স্যার?

এমনি বললাম, মন্দিরে মূর্তি প্রতিষ্ঠা থেকে এটা মনে হল। কোনো মানুষকে খুব বেশি পছন্দ হয়ে গেলে জীবনযাত্রায় সেই মানুষটার ছায়া পড়ে।

সুলতান কঠিন গলায় বলল, অশ্বিনী কুমার একজন সিরিয়াল কিলার। সে ঠাণ্ডী মাথায় একের পর এক মানুষ খুন করেছে। খুনগুলি করেছে অতি প্রিয়জনদের। নিজের কন্যা। তাকে আমার পছন্দ হবে কেন?

মানুষের পছন্দ অপছন্দের ব্যাপারটা অত্যন্ত বিচিত্র। মানুষ সুন্দর যেমন পছন্দ করে, অসুন্দরও করে।

সবাই করে না। কেউ কেউ হয়তো করে।

সুন্দরের পূজাও সবাই করে না। কেউ কেউ করে।

সুলতান অসহিষ্ণু গলায় বলল, আপনি কি বলতে চাচ্ছেন পরিষ্কার করে বলুন।

মিসির আলি শান্ত গলায় বললেন, আমার ধারণা অশ্বিনী বাবুর ব্যাপারটা তোমার মাথায় ঢুকে গেছে। তুমি তার মতো করে জীবন যাপন করতে চাচ্ছি। তুমি আকাশের তারা দেখ কারণ অশ্বিনী বাবু দেখতেন।

সুলতান কঠিন গলায় বলল, আপনাকে কে বলল অশ্বিনী বাবু তারা দেখতেন?

মিসির আলি সহজ গলায় বললেন, আমাকে কেউ বলে নি। আমি অনুমান করছি। এই অনুমানের পেছনে ভিত্তি আছে। তোমার সঙ্গে গল্প করার ফাঁকে ফাঁকে আমি লাইব্রেরিতে সাজানো বইগুলির উপর চোখ বুলিয়েছি। চামড়ায় বাঁধানো, সোনার জলে নাম লেখা বেশ কিছু পুরোনো বই দেখলাম। আকাশের তারা নিয়ে লেখা দুটা বই চোখে পড়েছে। একটার নাম তারা পরিচিতি, আরেকটার নাম-আকাশ পৰ্যবেক্ষণ। একটা ইংরেজি বই আছে western Hemisphere Stars, এখন তুমি বল এই বইগুলি কি অশ্বিনী বাবুর?

হ্যাঁ।

উনি কি আকাশ দেখতেন?

হ্যাঁ দেখতেন। তাঁর একটা দূরবীন ছিল। ম্যাক এলেষ্টার কোম্পানির চোঙ দূরবীন। উনি তারা দেখতেন বলেই কি তুমি এখন তারা দেখছ?

সুলতান কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে নিচু গলায় বলল, না ব্যাপারটা সে রকম না। আকাশের বিষয়ে আমার কৌতূহল ছোটবেলা থেকেই ছিল। তবে অশ্বিনী বাবুর লেখা ডায়েরি পড়ে আমি টেলিস্কোপ কিনতে আগ্রহী হই এটা ঠিক। তিনি আকাশ দেখতেন এবং কী দেখলেন তা খুব গুছিয়ে লিখে রাখতেন। পড়তে ভালো লাগে। তার মানে এই না যে আমি তাঁর জীবনযাত্রা অনুসরণ করছি। আপনি নিশ্চয়ই বলবেন না–মন্দিরে মূর্তি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে, এখন আমি মানুষ বলি দেয়া শুরু করব?

মিসির আলি বললেন, অশ্বিনী বাবুর লেখা ডায়েরিটা কি আমি পড়তে পারি?

অবশ্যই পড়তে পারেন। আপনি কিন্তু স্যার আমার প্রশ্নের জবাব দেন নি।

প্রশ্নটা যেন কী?

প্রশ্নটা হল—আপনার কি ধারণা আমিও মানুষ বলি দিচ্ছি? গ্ৰাম থেকে মানুষ ধরে এনে গোপনে বলি দিয়ে মন্দিরের পেছনের কুয়ায় ফেলে দিচ্ছি? আমাকে কি অসুস্থ মানুষ বলে মনে হচ্ছে?

মিসির আলি সিগারেট ধরাতে ধরাতে বললেন, ছোটখাটো অসুখগুলি চট করে ধরা যায়। কিন্তু ভয়ঙ্কর অসুখগুলি মানুষের মস্তিষ্কের গভীরে বাস করে। এদের চট করে ধরা যায় না। যেমন অশ্বিনী বাবুর কথাই ধরা যাক–তীর ভয়ঙ্কর অসুখ ধরতে অনেক সময় লেগেছিল। অশ্বিনী বাবুর সবচেয়ে কাছের মানুষ তাঁর স্ত্রী পর্যন্ত ধরতে পারেন নি। তিনটি মেয়ের মৃত্যুর পর ধরতে পারলেন।

সুলতান হতভম্ব গলায় বলল, স্যার আপনি তো দেখি সত্যি সত্যি আমাকে অশ্বিনী বাবুর দিলে ফেলে দিয়েছেন। ঠিক করে বলুন তো আপনি আমার সম্পর্কে কী ভাবছেন?

এখন পর্যন্ত আমি কিছুই ভাবছি না। তবে আমার অবচেতন মন নিশ্চয়ই ভাবছে। অবচেতন মনের কর্মকাণ্ড খুব অদ্ভুত। অবচেতন মনকে মাঝে মাঝে আমার কাছে আত্মভোলা শিশুর মতো মনে হয়। যে শিশু নিজের মনে খেলছে। জিগ স পাজলের খেলা। একটা টুকরার সঙ্গে আরেকটা টুকরা জোড়া দিয়ে ছবি বানাচ্ছে। ছবি ভেঙে ফেলছে। আবার বানাচ্ছে। মাঝে মাঝে অদ্ভুত কোনো ছবি তৈরি হয়ে গেলে অবাক বিস্ময়ে কিছুক্ষণ ছবির দিকে তাকিয়ে আবার সেই ছবিও নষ্ট করে ফেলছে।

সুলতান শান্ত গলায় বলল, স্যার শুনুন, আমার কোনো হচবি দাঁড় করাতে হলে সরাসরি আমাকে জিজ্ঞেস করলেই হবে। আমি জবাব দেব। অনুমানের উপর কিছু দাড় করানোর প্রয়োজন নেই।

মিসির আলি বললেন, অবচেতন মন কাউকে জিজ্ঞেস করে কাজ করে না। জিজ্ঞাসাবাদের বিষয়টি চেতন মনের, অবচেতন মনের না। তবে চেতন মন থেকে সে যে তথ্য নেয় না, তা না। তথ্য নেয়। যেটা তার পছন্দ তাই নেয়, সব তথ্য নেয় না।

সুলতান ছোট্ট নিশ্বাস ফেলে বলল, স্যার আমার নিজের ধারণা এই বাড়িটা আপনার উপর প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে। জেলখানার মতো উঁচু পঁচিলে ঘেরা বিরাট বাড়ি। গেট সব সময় তালাবন্ধ। তিনটা কুকুর বাড়ি পাহারা দিচ্ছে। আপনার ধারণা হয়েছে আপনি বন্দি হয়ে গেছেন। যেই মুহুর্তে মানুষ নিজেকে বন্দি ভাবে সেই মুহূর্ত থেকে তার চিন্তার ধারা বদলে যায়। আমি যখন মুক্ত মানুষ ছিলাম তখন একভাবে চিন্তা করতাম। যেই মুহুর্তে হুইল চেয়ারে বন্দি হয়েছি সেই মুহুর্ত থেকে অন্যভাবে চিন্তা করা শুরু করেছি। আপনার বেলাতেও তাই হচ্ছে। আপনি আমাকে সহজভাবে গ্রহণ করতেই পারছেন না। আপনি ধরেই নিয়েছেন। আমি হচ্ছি হুইল চেয়ারে বসা অশ্বিনী বাবু।

মিসির আলি কিছু বললেন না। সুলতান বলল, আপনি খেতে যান। আপনার খাবার দেয়া হয়েছে।

তুমি খাবে না?

না। আমার মেজাজ খুবই খারাপ। আপনার কারণে মেজাজ খারাপ না। আকাশ মেঘে ঢাকা, তারা দেখা যাবে না। এই জন্যে মেজাজ খারাপ। মেজাজ খারাপ নিয়ে আমি খেতে পারি না। আপনি খেতে যান, আমি অশ্বিনী বাবুর ডায়েরিটা খুঁজে বের করি। তাঁর অনেক খাতাপত্রের সঙ্গে ডায়েরিটা আছে। খুঁজে বের করতে সময় লাগবে।

পুঁই পাতা পাওয়া যায় নি কথাটা সত্যি না। পাতা পাওয়া গেছে। সেই পাতায় কৈ মাছের পাতুড়ি রান্না হয়েছে। লিলি মিসির আলির পাতে মাছ তুলে দিয়ে হাসতে হাসতে বলল-দেখলেন কেমন বোকা বানালাম!

আয়োজন প্রচুর। মাছই আছে তিন রকমের। চিংড়ি মাছ, মলা মাছ আর কৈ মাছ। নানান ধরনের ভর্তা, ভাজি। কুচকুচে কালো রঙের একটা ভর্তা দেখা গেল। আরেকটার বর্ণ গাঢ় লাল। পাশাপাশি দুটা বাটিতে লাল এবং কালো ভর্তা রাখা হয়েছে যার থেকে ধারণা করা যায় যে শুধু রান্না না, খাবার সাজানোর একটা ব্যাপারও মেয়েটার মধ্যে আছে। লিলি বলল, চাচাজী এই দেখুন কালো রঙের এই বস্তু হল কালিজিরা ভর্তা। কৈ মাছের পাতুড়ি আপনার পাতে তুলে দিয়েছি বলেই এটা দিয়ে খাওয়া শুরু করবেন না। কালিজিরা দিয়ে কয়েক নলা ভাত খেলে মুখে রুচি চলে আসবে। তখন যাই খাবেন, তাই ভালো লাগবে।

মিসির আলি বললেন, আমার রুচির কোনো সমস্যা নেই। তারপরেও তুমি যেভাবে খেতে বলবে আমি সেইভাবেই খাব। লাল রঙের বস্তুটা কী?

মরিচ ভর্তা। শুকনো মরিচের ভর্তা।

আমি কাল খেতে পারি না।

এই মরিচ ভতাঁর বিশেষত্ব হচ্ছে ঝাল নেই বললেই হয়। বিশেষ প্রক্রিয়ায় শুকনো মরিচ থেকে ঝাল দূর করা হয়েছে। বিশেষ প্রক্রিয়াটা শুনতে চান?

শুনে আমার কোনো লাভ নেই, তবু বল।

শুকনো মরিচ লেবু পানিতে ড়ুবিয়ে রাখলে মরিচের ঝাল চলে যায়। ভিনিগারে ড়ুবিয়ে রাখলেও হয়। আমি ঝাল দূর করেছি লেবু পানিতে ড়ুবিয়ে।

বিচিত্র ধরনের রান্নাবান্না তুমি কি কারো কাছ থেকে শিখেছি? না নিজে মাথা খাটিয়ে বের করেছ?

বেশির ভাগ রান্নাই আমি আমার নানির কাছ থেকে শিখেছি। নানি আমাকে রান্না শিখিয়েছেন, তার চেয়েও বড় কথা রান্নার মন্ত্র শিখিয়েছেন। আমি প্রায় কুড়িটার মতো রান্নার মন্ত্র জানি।

মিসির আলি বিস্মিত হয়ে বললেন, রান্নার কি মন্ত্র আছে নাকি?

লিলি সহজ ভঙ্গিতে বলল, হ্যাঁ মন্ত্র আছে। এই মন্ত্র কাউকে শেখানো নিষেধ। মন্ত্র শেখালে তার পাওয়ার চলে যায়। কিন্তু আপনি চাইলে আপনাকে শেখাব।

আমি রান্না শিখতে চাচ্ছি না। কিন্তু মন্ত্রটা শিখব।

মন্ত্রটা সত্যি শিখতে চান?

শিখতে চাই না, শুধু শুনতে চাই। যেকোনো একটা মন্ত্র বললেই হবে।

লিলি বলল, একেক রান্নার একেক মন্ত্র। ছোট মাছ রান্নার মন্ত্রটা বলি। ছোট মাছের সঙ্গে তেল মশলা মাখাতে হয়। চুলায় হাঁড়ি দিয়ে আগুন দিতে হয়। হাঁড়ি পুরোপুরি গরম হবার পর তেল-মশলা মাখা মাছটা হাঁড়িতে দিয়ে মন্ত্রটা পড়তে হয়। দশবার। তারপর পানি দিতে হয়। পানি এমনভাবে দিতে হয় যেন মাছের উপর দু আঙুল পানি থাকে। এই মন্ত্রের দাম দশ-দুই মন্ত্র। পানি ফুটতে শুরু করলেই রান্না শেষ। আরেকবার মন্ত্রটা পড়ে ফুঁ দিয়ে হাঁড়ির মুখ বন্ধ করে হাঁড়ি নামিয়ে ফেলতে হবে। তরকারি বাটিতে ঢালার আগে আর ঢাকনা নামানো যাবে না।

এখন মন্ত্রটা বল। লিলি বলল, মন্ত্রটা অনেক লম্বা। শুরুটা এরকম–

উত্তরে হিমালয় পৰ্বত
দক্ষিণে সাগর
নদীতে সপ্ত ডিঙ্গায়
চাঁদ সদাগর।
আমি চুলার ধারে
ধোঁয়া বেশুমার
অগ্নিবিনা রন্ধন হবে
প্রতিজ্ঞা আমার।
অগ্নি আমার ভাই
জল আমার বোন
আমি কন্যা চম্পাবতী
শোন মন্ত্র শোন।
আশ্বিনে আশ্বিনা বৃষ্টি
কার্তিকে হিম
শরীরে দিয়াছি বন্ধন
আলিফ লাম মিম।

মিসির আলি মন্ত্র শুনে হাসলেন। লিলি বলল, চাচাজী হাসবেন না। এই মন্ত্র পড়ে। একবার ছোট মাছ রান্না করে দেখুন। দশবার মন্ত্র পড়ার পর দু আঙুল পানি। আর কিছু লগবে না।

মিসির আলি বললেন, লিলি আমার ধারণা মন্ত্রটা হল-টাইমিং। সেই সময় তো গ্রামেগঞ্জে ঘড়ি ছিল না। রান্নার মতো তুচ্ছ বিষয়ে ঘড়ির ব্যবহারের প্রশ্নই আসে না। আমার ধারণা তখন মন্ত্র পড়ে সময়ের হিসাব রাখা হত। তুমি যে মন্ত্রটা বললে এই মন্ত্র দশবার বলতে যত সময় লাগে অতটা সময় তেল-মশলা মাখানো মাছ গরম চুলায় রাখলেই হবে। তুমি এক কাজ কর। ঘড়ি দেখে দশবার মন্ত্র পড়তে কত সময় লাগে সেটা বের কর। তারপর মন্ত্র ছাড়া সময় দেখে রান্না কর। দেখবে রান্না ঠিকই হয়েছে।

লিলি বলল, আপনার আসলেই অনেক বুদ্ধি। মন্ত্র যে কিছুই না, সময়ের হিসাব এটা আমিও টের পেয়েছি। কিন্তু আমার অনেক সময় লেগেছে। আপনি সঙ্গে সঙ্গে ধরে ফেলেছেন। আপনি কি যেকোনো সমস্যার সমাধান সঙ্গে সঙ্গে করে ফেলেন? এই ক্ষমতা কি সত্যি আপনার আছে?

মিসির আলি কিছু বললেন না। তিনি লক্ষ করলেন লিলি তীক্ষ্ণ চোখে তাকে দেখছে। সে কি কিছু বলার চেষ্টা করছে? প্রশ্নের ভেতরেও লুকানো প্রশ্ন থাকে। মেয়েটির এই প্রশ্নের ভেতর লুকানো কোনো প্রশ্ন কি আছে?

লিলি বলল, মিষ্টি জাতীয় কিছু রান্না করিনি। আপনি কি মধুখাবেন? মধু এনে দেব? ঐ দিন খলসা ফুলের মধু খেয়েছেন, আজ কেওড়া ফুলের মধু খান।

না।

লিলি হঠাৎ গম্ভীর হয়ে বলল, আপনি কি আমাকে কিছু জিজ্ঞেস করতে চান? জিজ্ঞেস করতে চাইলে করতে পারেন।

মিসির আলি বললেন, সুলতান চিঠিতে একটা মেয়ের কথা বলেছিল ঐ মেয়েটি সত্যি আছে? সালমা নাম, পনের ষোল বছর বয়স। অতীন্দ্ৰিয় ক্ষমতাসম্পন্ন মেয়ে।

লিলি সহজ গলায় বলল, থাকবে না কেন আছে। দূরবীনওয়ালাকে বললেই সে আপনাকে দেখাবে।

মিসির আলি বললেন, মেয়েটা থাকে কোথায়?

লিলি বলল, মেয়েটা কোথায় থাকে তা দিয়ে কী করবেন? মেয়েটার সত্যি কোনো ক্ষমতা আছে কিনা এটা জানা জরুরি। তাই না?

মেয়েটার সত্যি কি ক্ষমতা আছে?

মেয়েটার শুধু যে ক্ষমতা আছে তা না, ভয়াবহ ক্ষমতা আছে।

তুমি নিজে দেখেছ?

হ্যাঁ। আপনি তাকে দেখে খুবই অবাক হবেন! প্রথমে আপনার বিশ্বাস হবে না। ভাববেন ঠাট্টা করা হচ্ছে।

মিসির আলি বললেন, তুমিই কি সেই মেয়ে?

লিলি হ্যাঁ-সূচক মাথা নেড়ে খিলখিল করে হেসে ফেলল এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই হাসি থামিয়ে গম্ভীর হয়ে বলল, চাচাজী শুনুন মধু আপনাকে খেতেই হবে। ইচ্ছা না করলেও খেতে হবে। দূরবীনওয়ালা যদি শোনে আপনাকে মধু দেওয়া হয় নি তাহলে খুব রাগ করবে। আমাকে বলা হয়েছে আজ যেন কেওড়া ফুলের মধু দেওয়া হয়।

মধু না খেলে সুলতান রাগ করবে?

রাগের চেয়েও যেটা করবে তা হল মেজাজ খারাপ।

মিসির আলি বললেন, নিয়ে এস তোমার মধু।

লিলি বলল, সুন্দরবনের বানররা মধু কীভাবে খায় এই গল্প কি আপনি জানেন?

না জানি না!

আপনি আঙুলে মধু মাখিয়ে খেতে শুরু করুন। আমি গল্পটা করি। ছোট বাচ্চাদের যেমন গল্প বলে বলে খাবার খাওয়াতে হয় আপনাকেও সে রকম গল্প বলে বলে মধু খাওয়াক।

ঠিক আছে, শুরু কর তোমার গল্প।

কোনো বানরের যখন মধু খেতে ইচ্ছা করে সে তখন নদীর পাড়ে চলে যায়। সারা গায়ে কাদা মাখে। তারপর রোদে বসে এই কাদা শুকায়। আবার যায় কাদায়। আবারো কাদায় হুটোপুটি করে গায়ে কাদা মাখে। আবারো রোদে শুকায়। এই প্রক্রিয়াটি কয়েকবার করার পর বানরের গায়ে শক্ত কাদার একটা স্তর পড়ে যায়। তখন সে মহানন্দে চাক ভেঙে মধু খায়। মৌমাছিরা কাদার স্তরের জন্যে তার গায়ে হুল ফুটাতে পারে না। বুলেট প্রাফ জ্যাকেটের মতো মৌমাছি ধ্রুফ কর্দম জামা। চাচাজী ঘটনাটা কি আপনার কাছে ইন্টারেস্টিং লাগছে?

হ্যাঁ ইন্টারেস্টিং তো বটেই।

সুন্দরবনের মধু নিয়ে আমি এর চেয়েও এক শ গুণ ইন্টারেস্ট্রিং একটা গল্প জানি। সেটা আজ বলব না। অন্য একদিন বলব।

সন্ধ্যা থেকেই বৃষ্টি

সন্ধ্যা থেকেই বৃষ্টি শুরু হয়েছে। বৃষ্টি যে মুষলধারে পড়ছে তা না, তবে বাতাস প্রবল বেগে বইছে। বাড়ির চারদিকে প্রচুর গাছপালা বলে ঝড়ের মতো শব্দ হচ্ছে। এমন ঝড়বৃষ্টির রাতে আকাশ দেখার প্রশ্নই আসে না। মিসির আলি দোতলায় তাঁর ঘরে আধশোয়া হয়ে আছেন। কিছুক্ষণ আগেই রাতের খাবারের পর্ব শেষ করে এসেছেন। বিছানা থেকে আর নামতে হবে না। এটা ভেবেই শান্তি শান্তি লাগছে। ঝড়বৃষ্টি শুরু হবার সঙ্গে সঙ্গেই আবহাওয়া শীতল হয়েছে। ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা লাগছে। যতই সময় যাচ্ছে ততই ঠাণ্ডা বাড়ছে। মিসির আলি তার গায়ে পাতলা চাঁদ র দিয়েছেন। কোলবালিশ আড়াআড়ি রেখে তার উপর পা তুলে দিয়েছেন। মোটামুটি আরামদায়ক অবস্থান। তাঁর মাথার কাছে টেবিলের উপর একটা হারিকেন এবং কেরোসিনের টেবিল ল্যাম্প। তাতেও ঘরে তেমন আলো হচ্ছে না। মিসির আলির হাতে অশ্বিনী কুমার বাবুর হাতে লেখা ডায়েরি। লেখা খুব স্পষ্ট নয় এবং যথেষ্ট পরিমাণে প্যাচানো। এই আলোয় পড়তে কষ্ট হচ্ছে তারপরেও স্বস্তির কারণ আছে–হঠাৎ ইলেকট্রিসিটি চলে গিয়ে ঘর অন্ধকার হবে না। ঢাকা শহরে ঝড়বৃষ্টি মানেই টেনশন-এই বুঝি ইলেকট্রসিটি চলে গেল!

বরকত এসে টেবিলে চায়ের ফ্লাস্ক এবং কাপ রেখে গেছে। দরজার ছিটিকিনি ঠিক করে দিয়ে গেছে। মিসির আলি বরকতের সঙ্গে টুকটাক আলাপ চালাবার চেষ্টা করেছিলেন। লাভ হয় নি। মিসির আলির ধারণা কোনো এক বিচিত্র কারণে বরকত তাকে পছন্দ করছে না।

ভালো দুৰ্যোগ শুরু হয়েছে। মিসির আলি গাছের ডাল ভাঙার শব্দ শুনলেন। ঝড়বৃষ্টির সময় গাছের পাখিরা কোনো ডাকাডাকি করে না। তারা একেবারেই চুপ হয়ে যায়। অথচ তাদেরই সবচেয়ে বেশি ডাকাডাকি করার কথা। কুকুররা মনে হয় প্রাকৃতিক দুৰ্যোগ পছন্দ করে না। মাঝে মাঝেই তাদের ক্রুদ্ধ গর্জন শোনা যাচ্ছে। তারা কেউ আলাদা আলাদা ডাকছে না, যখন ডাকছে তিনজন এক সঙ্গেই ডাকছে।

মিসির আলি খুব মন দিয়েই ডায়েরি পড়ার চেষ্টা করছেন। শুধু কুকুররা যখন ডেকে উঠছে তখন মনোসংযোগ কেটে যাচ্ছে। কেন জানি কুকুরের ডাকটা শুনতে ভালো লাগছে না।

অশ্বিনী কুমারের ডায়েরিটি ঠিক ডায়েরির আকারে লেখা না। অনেক অপ্রয়োজনীয় জিনিস লেখা আছে। কিছু কিছু লেখাতে দিনক্ষণ স্থানকাল উল্লেখ করা। বেশির ভাগ লেখাতেই তারিখ নেই। বাজারের হিসাব আছে। চিঠির খসড়া আছে। আয়ুৰ্বেদ অষুধের বর্ণনা আছে। ডায়েরির শুরুই হয়েছে আয়ুৰ্বেদ অষুধের বর্ণনায়।

গাত্রবর্ণ উজ্জ্বল এবং গৌর করিবার অব্যৰ্থ উপায়।
পুন্নাগের কচি ফল দিয়া ক্বাথ প্রস্তুত করিতে হইবে। উক্ত ক্বাথ জ্বাল দিয়া ভাসমান তৈল পাওয়া যাইবে। উক্ত তৈল সর্বাঙ্গে মাখিতে হয়। পুন্নাগের আরেক নাম রাজচম্পক।

রামায়ণ মহাকাব্যে পুন্নাগের সুন্দর বর্ণনা আছে। রাবণ সীতাকে হরণ করিবার পরের অংশে আছে, রাম ভ্রাতা লক্ষণকে নিয়া বিষন্ন মনে হাঁটিতেছিলেন। হঠাৎ চোখে পড়িল পুন্নাগ পুষ্পের মেলা–

তিল্লকাশোক পুন্নাগ বকুলোদ্দাল কামিনীম্
রম্যোপবন সম্বাধীং পদ্মসম্পীড়িতো কাম।।

নোট : আমি পুন্নাগ তৈল প্ৰস্তৃত করিবার চেষ্টা করিয়াছি। ক্বাথ জ্বাল দিলে তৈল প্ৰস্তুত হয় না। নিশ্চয়ই অন্য কোনো প্রক্রিয়া আছে।

বৈদ্যদের নথিতে গাত্ৰবৰ্ণ ঔজ্জ্বল্যের নিমিত্ত রক্তচন্দন, অনন্তমূল এবং মঞ্জিষ্ঠার উল্লেখ আছে। তবে পুন্নাগের সমকক্ষ কেহ নাই। ইহা বারংবার বলা হইয়াছে।

পুন্নাগ প্রসঙ্গে আরো কোনো কৌতুহলোদ্দীপক তথ্য পাইলে লিপিবদ্ধ করা হইবে।

এই পর্যন্ত লেখার পর দুটি পাতা খালি। কিছুই লেখা নেই। তৃতীয় পাতায় দিনক্ষণ দিয়ে তারা দর্শনের বর্ণনা।

অদ্য ৫ই জ্যৈষ্ঠ, ইংরেজি ২০শে মে মধ্যরজনী।

বিভূতিবাবুর হিসাব অনুযায়ী অদ্য রজনী দশ ঘটিকায় সারমেয় যুগল মধ্যগগনে অবস্থান করিবে ; সারমেয় যুগল দর্শনের সমস্ত ব্যবস্থা সুসম্পন্ন করিয়াছি। কন্যাদের মাতাকে এই অপূর্ব দৃশ্য দেখিবার জন্যে বলিয়াছিলাম। তিনি শিরঃপীড়ায় আক্রান্ত বলিয়া অপারগতা প্ৰদৰ্শন করিলেন। কিঞ্চিৎ ব্যথিত হইয়াছি। জগতের কোনো মনোমুগ্ধকর দৃশ্য একা উপভোগ করা যায় না।

আকাশ পরিষ্কার আছে। সন্ধ্যাকালে মেঘ ছিল—এখন মেঘ দূরীভূত হইয়াছে। ঈশ্বরের অসীম কৃপা।

বিভূতিবাবুর পত্রানুযায়ী সারমেয় যুগলের একটির গলায় এই মণ্ডলের সর্বাপেক্ষা উজ্জ্বল তারকাটি অবস্থিত। এই তারকাটির প্রভা তৃতীয় মাত্রার। তারকাটির নাম চার্লসের হৃদয়। সম্রাট প্রথম চার্লসের স্মৃতির উদ্দেশে এই নামকরণ।

সারমেয় যুগলের উল্লেখ বেদে আছে। ইহাদের বলা হইয়াছে যমের দুয়ারের প্রহরী। এই মণ্ডলের দুইটি উজ্জ্বল তারকার একটির ভারতীয় নাম জ্যেষ্ঠ কালকত্বজ্ঞ আরেকটির নাম কনিষ্ঠ কালকন্দ্র। জ্যেষ্ঠ কলকজ্ঞ একটি বিষম তারা এবং অত্যন্ত সৌন্দর্যমণ্ডিত। যে চারটি তারা দিয়া কন্যার হীরক নামক বিখ্যাত চিত্রটি গঠিত জ্যেষ্ঠ কলকজ্ঞ তার একটি।

আজ সারমেয় যুগল দেখিবার সৌভাগ্য যেন হয় তার জন্যে ভগবানের কাছে প্রার্থনা করিয়াছি।

মিসির আলি দ্রুত পাতা উল্টালেন। ডায়েরিতে বিচিত্র সব বিষয়ে লেখা আছে। জ্যামিতিক চিহ্ন আছে। তার ব্যাখ্যা আছে। জায়গায় জায়গায় টকা-টিপ্লনি আছে।

যেমন জ্ঞান সম্পর্কে বলা হয়েছে—

জ্ঞান

জ্ঞান দুই প্রকার। পবিত্র জ্ঞান এবং অপবিত্র জ্ঞান। অপবিত্র জ্ঞান ঈশ্বর কর্তৃক অনুমোদিত। আদি মানব আদমের পতন হইয়াছিল ঈশ্বর কর্তৃক অনুমোদিত জ্ঞান আহরণের জন্যে। অনুমোদিত জ্ঞান অতীব রহস্যময় জ্ঞান। যদিও পরিত্যাগ লাভের জন্যে এই জ্ঞানের প্রয়োজন নাই।

পুন্নাগ ফুলের কথা কয়েক পাতা পরেই আবার পাওয়া গেল।

পুন্নাগ

সৌরভ্যং ভুবন এয়েহপি বিদিতং পুষ্পেষু লোকোত্তরং
কীৰ্ত্তিঃ কিঞ্চ দিগঙ্গনাঙ্গনগতা কিন্ত্বতদেকংশৃনু।
সর্বান্যেবা গুণানি যানিগিরতি পুন্নাগে তে সুন্দরান্‌
উজঝণ্ডি খলু কোটরেষু গরল জ্বালানদ্বিজিহ্বালী।

অর্থ : হে পুন্নাগ, তোমার সুগন্ধ ত্রিভুবন খ্যাত। তোমার যশ ও খ্যাতি দিগাঙ্গনারা নিজ অঙ্গনে ছাড়াইয়া রাখে। তবু তোমার একটি অখ্যাতি। তোমার শরীরের কোটরে বাস করে বিষধর সর্প।

নোট: পুন্নাগ বৃক্ষের কোটরে বিষধর সর্প বাস করে এই তথ্য জানা ছিল না। হায় এই বিপুল বসুধার কত অল্পই না। আমি জানি!

দরজায় খটখটি শব্দ হচ্ছে। বই নামিয়ে মিসির আলি বললেন, কে?

চাচাজী আমি লিলি। আপনার কিছু লাগবে?

না। আমার কিছু লাগবে না।

আপনার ঘরের ছিটিকিনি বরকতকে ঠিক করতে বলেছিলাম। বরকত কি ঠিক GKER?

ইয়া ঠিক করেছে।

ছিটিকিনি লাগিয়েছেন?

না।

ছিটিকিনি লাগিয়ে ঘুমুবেন। ভুলবেন না যেন। কুকুরগুলি মাঝে মাঝে সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় ওঠে। এই জন্যে বলছি। হঠাৎ ঘুম ভেঙে যদি দেখেন আপনার মাথার কাছে এলশেশিয়ান তাহলে ভয়েই হার্টফেল করবেন।

অবশ্যই ছিটিকিনি লাগিয়ে ঘুমাব। তুমি বাইরে দাঁড়িয়ে কথা বলছি কেন? ভেতরে এস।

আপনি আসতে বলছেন না, এই জন্যে আসতে পারছি না। আমি আপনার জন্যে পান নিয়ে এসেছি।

এস ভেতরে এস।

লিলি পানের বাটা হাতে ঘরে ঢুকল। হাসিমুখে বলল, আমাকে আপনার কাছে পাঠিয়েছে দূরবীনওয়ালা। আমার দায়িত্ব হল আপনাকে জাগিয়ে রাখা।

কেন কল তো?

দূরবীনওয়ালার ধারণা হয়েছে কিছুক্ষণ বৃষ্টি হবার পর আকাশ পরিষ্কার হয়ে যাবে, তখন তারা দেখা যাবে। বৃষ্টির পর আকাশ নাকি ঝকঝকে হয়ে যায়। তখনই তারা দেখার আসল মজা।

ও আচ্ছা।

আপনি একবার ঘুমিয়ে পড়লে তো আর আপনাকে জাগানো ঠিক হবে না। তাই আপনাকে জাগিয়ে রাখার চেষ্টা। এখন বলুন কী করলে আপনি জেগে থাকবেন?

জেগে থাকা আমার জন্যে কোনো সমস্যা না। আমি অনেক রাত জাগি। তুমি আমাকে জেগে থাকতে বলেছি। আমি জেগে থাকব।

অশ্বিনী বাবুর ডায়েরি পড়ছেন?

হুঁ।

মরা মানুষের ডায়েরি পড়ে লাভ কী বলুন তো? মানুষটা তো মরেই গেছে। এরচেয়ে জীবিত মানুষের ডায়েরি পড়া ভালো। আপনি এত আগ্রহ করে পুরোনো ডায়েরি পড়েন জানলে আমি ডায়েরি লেখার অভ্যাস করতাম। চাচাজী নিন পান খান।

মিসির আলি পান হাতে নিলেন। লিলি চেয়ার টেনে খাটের পাশে বসেছে। তাকে ক্লান্ত লাগছে। পরপর দুবার হাই তুলল। মিসির আলি বললেন, তোমার ঘুম পাচ্ছে তুমি ঘুমিয়ে পড়। সুলতানকে বলে রেখো বৃষ্টি কমলে যেন আমাকে খবর দেয়। আমি জেগে থাকব।

আমার সঙ্গে গল্প করতে আপনার ভালো লাগছে না। তাই না? আপনার মন পড়ে আছে অশ্বিনী বাবুর লেখাতে। ঠিক বলছি না চাচাজী?

মিসির আলি বললেন, ডায়েরিটা পড়ে শেষ করতে ইচ্ছা হচ্ছে এটা ঠিক। তার মানে এই না যে তোমার সঙ্গে কথা বলতে ভালো লাগছে না। তুমি খুব গুছিয়ে কথা বল।

লিলি বলল, অশ্বিনী বাবুর ডায়েরি পড়ে কী তথ্য বের করলেন বলুন শুনি।

মাত্র তো পড়া শুরু করেছি।

যা পড়েছেন সেখান থেকে এখনো ইন্টারেস্টিং কিছু বের করতে পারেন নি?

পুন্নাগ ফুলের কথা লেখা আছে। খুব আগ্রহ করে লেখা। এই ফুল বেটে গায়ে মাখলে গায়ের রঙ উজ্জ্বল হয় বলে তিনি লিখেছেন। এর থেকে ধারণা করা যায় যে গায়ের রঙ নিয়ে তিনি খুব চিন্তিত ছিলেন। আমার ধারণা তাঁর মেয়েগুলির গায়ের রঙ ছিল কালো। তিনি মন্দিরে কালী মূর্তি প্রতিষ্ঠা করেন যে কালী হল গৌর কালী অর্থাৎ সেই কালীর গায়ের রঙও সাদা। তার মানে গায়ের রঙের প্রতি অশ্বিনী বাবুর মনে অবসেসন তৈরি হয়েছিল।

লিলি মুগ্ধ গলায় বলল, বাহ। আপনি তো চট করে একটা ব্যাপার ধরে ফেলেছেন!

মিসির আলি বললেন, আমি একটা হাইপোথিসিস দাড় করিয়েছি। হাইপোথিসিসটা সত্যি কি না তার এখনো প্রমাণ হয় নি।

লিলি একটু ঝুঁকে এসে গলা নামিয়ে বলল, আচ্ছা চাচাজী মাঝে মাঝে কিছু বাড়ি যে অভিশপ্ত হয়ে যায় এটা কি আপনি জানেন?

মিসির আলি সোজা হয়ে বসতে বসতে বললেন, অভিশপ্ত বাড়ি বলে কিছু নেই। বাড়ি হল বাড়ি, ইট পাথরের একটা স্ট্রাকচার। এর বেশি কিছু না।

লিলি বলল, চাচাজী আমার কথা শুনুন, এমন অনেক বাড়ি আছে যেখানে বিশেষ কিছু ঘটনা বার বার ঘটতে থাকে। একটা চক্রের মতো ব্যাপার। চক্র ঘুরতে থাকে। এই বাড়িটাও সে রকম একটা বাড়ি।

তার মানে?

এই বাড়িটাও একটা চক্রের মধ্যে পড়ে গেছে। আপনি এমন বুদ্ধিমান একজন মানুষ… আপনার চোখে চক্রটা পড়ছে না কেন?

মিসির আলি বললেন, চক্র বলে কিছু নেই লিলি।

লিলি চাপা গলায় বলল, চক্র অবশ্যই আছে। অশ্বিনী বাবু তাঁর বাড়িতে গৌর কালী মূর্তি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সুলতানও কি তাই করে নিঃ মন্দিরে সে কি একটি মূর্তি রাখে নিঃ চাচাজী আমার ভালো লাগছে না। আমি যাচ্ছি। আপনি ঘুমিয়ে পড়ুন। আজ রাতে বৃষ্টি থামবে না। সারারাত বৃষ্টি হবে। কালও বৃষ্টি হবে। বিছানা থেকে নেমে ছিটিকিনি লাগান। শেষে দেখা যাবে ছিটিকিনি না লাগিয়েই আপনি ঘুমিয়ে পড়েছেন। এ বাড়িতে কখনো ছিটিকিনি না লাগিয়ে ঘুমুবেন না। কখনো না।

মিসির আলি বিছানা থেকে নামলেন, দরজার ছিটিকিনি লাগালেন। বিছানায় এসে বসলেন। অশ্বিনী বাবুর ডায়েরি এখন আর তাঁর পড়তে ইচ্ছা করছে না। বৃষ্টির বেগ আরো বাড়ছে। গাছের পাতায় শো শো শব্দ হচ্ছে। মিসির আলি চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছেন। তাঁর খুবই অস্থির লাগছে। চক্রের ব্যাপারটা মাথা থেকে দূর করতে পারছেন না। বিশ্বব্ৰহ্মাণ্ডে চক্ৰ তো আছেই। পৃথিবী ঘুরছে সূর্যের চারদিকে। প্রতিবারই একই জায়গায় ঘুরে ঘুরে আসছে। ঘুরছে গ্যালাক্সি। অতি ক্ষুদ্র যে ইলেকট্রন সেও ঘুরপাক খাচ্ছে নিউক্লিয়াসের চারদিকে। পদার্থের সর্বশেষ অবস্থা ল্যাপটনস-এর ভর নেই, চার্জ নেই–অস্তিত্বই নেই, শুধু আছে ঘূর্ণন। স্পিন। জনের পর মৃত্যু-জীবন চক্র। বিগ ব্যাং-এ মহাবিশ্ব তৈরি হল। মহাবিশ্ব ছড়িয়ে পড়ছে। কোনো এক সময় আবার তা সংকুচিত হতে শুরু করবে। আবার এক বিন্দুতে মিলিত হবে। আবার বিগ ব্যাং—আবারো মহাবিশ্ব ছড়াবে–The expanding Universe …

মিসির আলি কখন ঘুমিয়ে পড়লেন নিজেই জানেন না।

তার ঘুম ভাঙল নিশ্বাসের শব্দে। কে যেন তাঁর গায়ে গরম নিশ্বাস ফেলছে! খুবই অস্বাভাবিক ব্যাপার। ঘরের দরজা বন্ধ। বাইরের কারো ঢ়োকার কোনো পথ নেই। মিসির আলি চোখ মেললেন-হারিকেনের আলোয় স্পষ্ট দেখলেন বিশাল একটা কুকুর। কুকুরটার মুখ তাঁর মাথার কাছে, তার গরম নিশ্বাস চোখেমুখে এসে লাগছে। পশুদের চোখ অন্ধকারে সবুজ দেখায়। এর চোখও সবুজ। এ তাকিয়ে আছে একদৃষ্টিতে। মিসির আলি চোখ বন্ধ করে ফেললেন। ব্যাপারটা স্বপ্ন তো বটেই। অত্যন্ত জটিল স্বপ্ন যা মস্তিষ্কের অতল গহবর থেকে উঠে এসেছে।

কুকুরটা চাপা শব্দ করছে। এই শব্দও স্বপ্নের অংশ। কুকুরটা এখন খাট থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। এই তো এখন ফিরে আসছে। আবার যাচ্ছে। এখন সে খাটের চারদিকে পাক খেতে শুরু করেছে। কুকুরটা ঘুরছে চক্রাকারে। আবারো সেই চক্র চলে এল। চক্রের হাত থেকে মানুষের মুক্তি নেই। মিসির আলি চোখ মেললেন। অতি সাবধানে মাথা ঘুরিয়ে তাকালেন দরজার দিকে। দরজা খোলা। খোলা দরজা দিয়ে ঠাণ্ডা বাতাস আসছে। বৃষ্টি থেমে গেছে। বাতাসও হচ্ছে না।

দরজা খুলল কীভাবে? বাইরে থেকে দরজা খোলার কোনো ব্যবস্থা কি আছে? এটা নিয়ে চিন্তা করার কোনো অর্থ আছে? কোনোই অর্থ নেই। স্বপ্নে বন্ধ দরজা, খোলা দরজা বলে কিছু নেই। স্বপ্নের লজিক খুঁজতে যাওয়া অর্থহীন। রাত কত হয়েছে? টেবিলের উপর হাতঘড়িটা রাখা আছে। ঘড়ি দেখতে হলে তাঁকে উঠে বসতে হবে। তাতে শব্দ হবে। কুকুরের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হবে। এই কাজটা এখন কিছুতেই করা যাবে না। ভয়ঙ্কর এলশেশিয়ান কুকুর। তার মনে কোনো রকম সন্দেহ উপস্থিত হলেই সে ঝাপ দিয়ে পড়বে। মিসির আলির হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে এল। খুব পানির তৃষ্ণ হচ্ছে। তৃষ্ণায় বুকের ছাতি ফেটে যাচ্ছে।

এই তৃষ্ণবোধ মিথ্যা। কারণ পুরো ব্যাপারটাই মিথ্যা। তিনি স্বপ্ন দেখছেন। এর বেশি কিছু না। কুকুরটা যদি তার উপর ঝাঁপ দিয়েও পড়ে তাতে তাঁর কিছু হবে না। বরং লাভ হবে—দুঃস্বপ্ন ভেঙে যাবে। তিনি মিথ্যামিথ্যি জাগবেন না। সত্যিকার অর্থেই জাগবেন। তখনো যদি তৃষ্ণা থাকে তাহলে পানি খাবেন। তৃষ্ণা না থাকলে চা খাবেন। চা খাবার পর একটা সিগারেট।

মিসির আলি খুব সাবধানে বিছানায় উঠে বসলেন। কুকুরটা হাঁটা বন্ধ করে স্থির হয়ে গেল। সে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। তার লেজ নড়ছে। এর মানে কি এই যে সে বাঁপ দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে? মিসির আলি এখন মনেপ্ৰাণে চাচ্ছেন কুকুরটা তার উপর ঝাপ দিয়ে পড়ুক। স্বপ্ন ভেঙে যাক। কুকুর ঝাপ দিচ্ছে না। সে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আচ্ছা অশ্বিনী বাবুর কি কুকুর ছিল? জিজ্ঞেস করে জানতে হবে।

দরজায় শব্দ হল। টিকটক করে মোর্সকোডের মতো শব্দ করছে। যেন কেউ কোনো সংকেত দিচ্ছে। মিসির আলি দরজার দিকে তাকালেন। খোলা দরজার ওপাশে কাউকে দেখা যাচ্ছে না। তবে কেউ যে আছে তা বোঝা যাচ্ছে। যে আছে তাকে মিসির আলি চেনেন না। কিন্তু কুকুরটা চেনে। সে দরজার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। কুকুরটা সিঁড়ি বেয়ে নামছে। তার নেমে যাবার শব্দ পাওয়া যাচ্ছে।

মিসির আলি দ্রুত বিছানা থেকে নামলেন। দরজা বন্ধ করে ছিটিকিনি টেনে দিলেন। টেবিলের কাছে এসে ঘড়ি দেখলেন। রাত তিনটা পঁচিশ। তিনি পরপর দুঃগ্লাস পানি খেলেন। তারপরেও তৃষ্ণ কমছে না। তিনি খুব যে নিশ্চিন্ত বোধ করছেন তাও না। স্বপ্নে যে কোনো সময় যে কোনো কিছু ঘটতে পারে। স্বপ্ন ফিজিক্সের সূত্র মেনে চলে না। হয়তো এক্ষুনি দেখা যাবে কুকুরটা বন্ধ দরজা ভেদ করে চলে এসেছে। সে একা আসে নি, সঙ্গী দুজনকেও নিয়ে এসেছে। মানুষের মতো কথা বলাও শুরু করতে পারে। না তা করবে না। স্বপ্ন ফিজিক্সের সূত্র না মানলেও সাধারণ কিছু নিয়ম মানে। আট ন বছরের বাচ্চা যদি কুকুর স্বপ্ন দেখে তাহলে সেই কুকুর তার সঙ্গে কথা বললেও বলতে পারে। মিসির আলি যে কুকুর দেখবেন সে কুকুর কথা বলবে না।

তিনি কী করবেন বুঝতে পারছেন না। বিছানায় উঠে আবার ঘুমিয়ে পড়ার ব্যবস্থা করবেন? নাকি হাটহাঁট করবেন? মিসির আলি জানালার কাছে চলে গেলেন। যদি কুকুরটাকে দেখা যায়। চেরী গাছের নিচে কেউ কি আছে? হ্যাঁ আছে তো বটেই। ঐ তো হুইল চেয়ারটা দেখা যাচ্ছে। হুইল চেয়ারের পেছনে আছে। বরকত। রাত তিনটা পঁচিশ মিনিটে ওরা দুজন কী করছে? তারা দেখার প্রস্তুতি?

হঠাৎ মিসির আলির বুকে একটা ধাক্কার মতো লাগল। তিনি অবাক হয়ে দেখলেন হুইল চেয়ারে বসা মানুষটা উঠে দাঁড়িয়েছে। এই তো হাঁটতে শুরু করেছে। মন্দিরের দিকে কি যাচ্ছে? হ্যাঁ ঐ দিকে যাচ্ছে। এখন সিগারেট ধরিয়েছে! আবার ফিরে আসছে। হাতের জ্বলন্ত সিগারেট এখন ফেলে দিল। এই মানুষটা যে সুলতান তাতে কি কোনো সন্দেহ আছে? না কোনো সন্দেহ নেই। মানুষটা আবার হাঁটতে শুরু করেছে। মিসির আলি তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে আছেন। না মানুষটা মন্দিরের দিকে যাচ্ছে না। সে মন্দিরের পেছনে যাচ্ছে। মন্দিরের পেছনে আছে কুয়া। এখান থেকে কুয়া দেখা সম্ভব না। কিন্তু স্বপ্নে সম্ভব। মিসির আলি কুয়া দেখার জন্যে অপেক্ষা করছেন। কুয়া দেখা গেল না। মানুষটা চোখের আড়াল না হওয়া পর্যন্ত মিসির আলি তাকিয়ে রইলেন।

মিসির আলির মাথায় সমুদ্ৰ গৰ্জনের মতো শব্দ হচ্ছে। সমুদ্রের ঢেউ আছড়ে পড়ার শব্দ। মনে হচ্ছে কাছেই কোথাও সমুদ্র আছে। বড় বড় ঢেউ উঠছে। ঢেউয়ের মাথায় সমুদ্র ফেনা। মাথা এলোমেলো লাগছে। কেউ কি ভরাট গলায় কবিতা আবৃত্তি করছে?

I let myself in at the kitchen door.
It is you, she said, I cant get up. Forgive me.
Not answering your knock. I can no more
Let people in than I can keep them out.

এটা কার কবিতা? মিসির আলি কিছুতেই মনে করতেন পারলেন না। ঘুমে তাঁর চোখ বন্ধ হয়ে আসছে। তিনি বিছানায় শুয়ে পড়লেন। মাথার ভেতর কবিতাটা ভাঙা রেকর্ডের গানের মতো বেজে যাচ্ছে–

I let myself in at the kitchen door.
It is you, she said, I cant get up. Forgive me.

আমাকে ক্ষমা কর, আমি উঠতে পারছি না। আমাকে ক্ষমা কর, আমি উঠতে পারছি না। I can’t get up. Forgive me.

সূর্য ওঠার আগে

সূর্য ওঠার আগেই মিসির আলির ঘুম ভাঙল। অন্ধকার মাত্র কাটতে শুরু করেছে। টেবিলে রাখা হারিকেন নিভে গেছে। টেবিল ল্যাম্প দপদপ করছে। যেকোনো মুহূর্তেই নিভবে। মনে হচ্ছে হিসাব করে তেল দেওয়া। সূর্যের আলো ফুটবে আর এরা নিভে যাবে। মিসির আলি প্রথমেই তাকালেন দরজার দিকে-ছিটিকিনি লাগানো আছে, দরজা বন্ধ। তিনি বিছানায় উঠে বসে মেঝের দিকে তাকালেন–মেঝে ঝকঝক করছে। ঝড়বৃষ্টির রাতে কোনো কুকুর উঠে এলে মেঝেতে তার পায়ের দাগ থাকত। মেঝেতে কোনো দাগ নেই। গত রাতে মোটামুটি ভয়াবহ একটা স্বপ্ন দেখেছিলেন এই বিষয়ে কোনো সন্দেহ থাকার কারণ নেই, তবু সন্দেহটা যাচ্ছে না।

তিনি বিছানা থেকে নামলেন। দরজা খুলে বারান্দায় এসে দাঁড়ালেন। সকালের প্রথম আলোয় নদী দেখা যাচ্ছে। আশ্চর্যের ব্যাপার হল নদীটি পাচিল ঘেরা বাড়ির সঙ্গে যাচ্ছে না। মনে হচ্ছে ওই বাড়িটার সঙ্গে নদীর কোনো যোগ নেই। নদী দেখতে ভালো লাগছে না।

ভেতরের উঠোনে একটা জলচৌকির উপর বরকত দাঁড়িয়ে আছে। তার হাতে পেতলের বদনা। সে মিসির আলিকে দেখতে পায় নি। মিসির আলি ডাকলেন, এই বরকত। বরকত ভয়াবহভাবে চমকে উঠল। হাত থেকে বদনা জলচৌকিতে পড়ে ঝন ঝন শব্দ হল। এতটা চমকানোর কোনো কারণ নেই। মিসির আলি বললেন, কী করছ?

নামাজের অজু করি। ফজরের নামাজ।

মিসির আলি বিস্মিত হলেন। এত দীর্ঘ বাক্য বরকত তার সঙ্গে এর আগে ব্যবহার করে নি।

তোমার কুকুর কি বাধা আছে?

জি বান্দা। আসেন নিচে আসেন।

মিসির আলি নিচে নেমে এলেন। বরকত বলল, চা খাইবেন?

মিসির আলি বললেন, গরম চা খেতে পারলে ভালো হত।

নামাজ শেষ কইরা চা দিতাছি।

তোমার কুকুরগুলি কোথায় একটু দেখি।

বরকত আঙুল উঁচিয়ে পেয়ারা গাছের সঙ্গে বাধা কুকুরগুলি দেখাল। গলা নামিয়ে বলল, কাছে যান। শ‍ইলে হাত দেন। আপনেরে কিছু বলব না।

কিছু বলবে না কেন?

বরকত চাপা গলায় বলল, একটা ঘটনা ঘটাইছি। আপনের জুতা আর কাপড় শুকাইয়া দিছি! অখন এরা আপনের শইল্যের গন্ধ চিনে।

মিসির আলি বললেন, কাজটা তুমি নিজ থেকে করে নি। কেউ তোমাকে করতে বলেছে। কে বলেছে?

বরকত জবাব দিল না। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। মিসির আলির মনে হল বরকত তার আগের অবস্থায় ফিরে গেছে। এখন আর কথা বলবে না। কিছু জিজ্ঞেস করলে অদ্ভুত ভঙ্গিতে তাকিয়ে থাকবে।

মিসির আলি বললেন, গেট খুলে দাও নদীর পাড়ে বেড়াতে যাব। এত কাছে নদী, অথচ নদীই দেখা হয় নি।

বরকত বলল, গেইট খুলন যাইব না। বড় সাবের নিষেধ আছে।

নিষেধ?

জি নিষেধ। আমি খুলতে চাইলেও খুলতে পারব না। চাবি থাকে বড় সাবের কাছে।

চাবি সব সময় বড় সাহেবের কাছে থাকে?

বরকত শীতল গলায় বলল, সব সময় চাবি উনার কাছে থাকে না। যখন আপনের মতো কেউ বেড়াইতে আসে তখন চাবি উনার কাছে থাকে।

মিসির আলি বললেন, যাতে অতিথিরা পালিয়ে যেতে না পারে সেই জন্যে?

কী জন্যে সেইটা আমি জানি না বড় সাহেব জানে।

আচ্ছা ঠিক আছে তুমি নামাজ পড়তে যাও। তোমার নামাজের দেরি হয়ে যাচ্ছে। শেষে নামাজ কাজ হবে।

বরকত গম্ভীর মুখে বলল, ফজরের নামাজ দুপুর পর্যন্ত কাজা হয় না। এর একটা ইতিহাস আছে। ইতিহাসটা শুনবেন?

বল শুনি।

নবীয়ে করিম একবার দেরি কইরা ঘুম থাইকা উঠছিলেন। নবীয়ে করিমের জন্যে আমরা মাফ পাইছি।

এটা জানতাম না।

ভদ্ৰলোকরা সব বিষয় জানে, ধৰ্মকৰ্ম বিষয়ে জানে না। এইটা একটা আফসোস। আফসোস তো বটেই। বরকত তোমার সঙ্গে কথা বলে ভালো লাগল। আমি বাগানের দিকে যাচ্ছি তুমি নামাজ শেষ করে চা নিয়ে এসো। দুৰ্বকাপ চা আনবে। আমার জন্যে এক কাপ তোমার জন্যে এক কাপ। আমরা চা খেতে খেতে গল্প করব। ভালো কথা আমি যখন তোমাকে ডাকলাম তুমি এত ভয় পেলে কেন? ভয়ে হাত থেকে একেবারে বদনা পড়ে গেল।

বরকত জবাব দিল না, তার ঠোঁটের কোনায় অস্পষ্ট হাসির রেখা দেখা গেল। মিসির আলি হাঁটতে শুরু করলেন, চেৱী গাছের নিচে এসে দাঁড়ালেন। তাঁর দৃষ্টি মাটির দিকে। হুইল চেয়ারের কোনো দাগ কি মাটিতে আছে? থাকার কোনোই কারণ নেই। কাল রাতে যা দেখেছেন তার পুরোটাই স্বপ্ন। এই সত্য সন্দেহাতীতভাবে সত্য। তারপরেও দেখা। মানুষের মন এমন যে একবার কোনো বিষয়ে সন্দেহ উপস্থিত হলে সেই সন্দেহ আর যেতেই চায় না। কাপড়ে ময়লা লেগে যাবার মতো। যত ভালো করেই ধোয়া হোক অস্পষ্ট দাগ থেকেই যায়। সেই দাগ বারবার ধুতে ইচ্ছা করে।

হুইল চেয়ারের পায়ের রেখা ভেজা মাটিতে আছে। মিসির আলির ভুরু কুঞ্চিত হল। স্বপ্নের একটি অংশ কি সত্যি? মানুষ যেমন মিথ্যা কথা বলার সময় মিথ্যার সঙ্গে কিছু সত্য মিশিয়ে দেয়, স্বপ্নেও কি সে রকম কিছু ঘটেঃ মস্তিষ্ক স্বপ্নের সঙ্গে সামান্য বাস্তব মিশায়। মিসির আলি হুইল চেয়ারের দাগ ধরে এগুতে লাগলেন। তাঁকে বেশিদূর যেতে হল না, তার আগেই থমকে দাঁড়াতে হল। লাইব্রেরি ঘরের বারান্দা থেকে সুলতান বলল, স্যার কী করছেন? সুলতানের গলায় চাপা কৌতূহল।

মিসির আলি বললেন, কিছু করছি না। হাঁটছি, প্রাতঃভ্রমণ বলতে পার।

আমার কাছে মনে হচ্ছে মাটিতে কী যেন খুঁজতে খুঁজতে এগুচ্ছেন। কী খুঁজছেন? হইল চেয়ারের পায়ের দাগ?

মিসির আলি বললেন, হ্যাঁ। তুমি কাল রাতে হুইল চেয়ার নিয়ে বাগানে ঘুরেছ। কোথায় কোথায় গিয়েছিলে তাই দেখছিলাম।

এই অনুসন্ধানের আপনার বিশেষ কোনো কারণ আছে কি?

না তেমন কোনো কারণ নেই।

শেষ রাতের দিকে বৃষ্টি থামল। আকাশ পরিষ্কার হল। আমি বাগানে ঘুরছিলাম, এবং আকাশ দেখছিলাম।

সুলতান হুইল চেয়ার নিয়ে লাইব্রেরি ঘরের বারান্দা থেকে নিচে নামতে শুরু করল। হুইল চেয়ারে বারান্দা থেকে বাগানে নামার জন্যে ব্যবস্থা করা আছে। তার পরেও তাকে নামতে হচ্ছে সাবধানে। সুলতান সহজ গলায় বলল, পঙ্গু মানুষেরও মাঝে মাঝে ঘুরে বেড়াতে ইচ্ছা করে। বাগানে যেতে ইচ্ছা করে। শীতের সময় বাগানে ঘুরে বেড়ানো সহজ। বর্ষার সময় বেশ কঠিন। কাদায় চাকা ড়েবে যায়। তখন পেছন থেকে কাউকে ঠেলতে হয়। স্যার আপনার রাতের ঘুম ভালো হয়েছিল?

হ্যাঁ ভালো হয়েছে।

বেশ ভালো, নাকি মোটামুটি ভালো?

বেশ ভালো ।

আপনি কি আর্লি রাইজার?

না। আজ কীভাবে কীভাবে যেন ঘুম ভেঙে গেছে। আমার কপালে সূর্যোদয় দৃশ্য নেই। শুধুই সূর্যাস্তের দৃশ্য।

সুলতান হালকা গলায় বলল, আমার কপালে সূর্যোদয় দৃশ্য প্রচুর পরিমাণে আছে। আমি রাতে ঘুমাই না। সকালে সূৰ্য দেখে ঘুমাতে যাই। আমার কপালে সূর্যাস্ত নেই।

মিসির আলি বললেন, আমি তোমাকে ঘুম থেকে বঞ্চিত করছি, যাও শুয়ে পড়।

সুলতান বলল, না, আজ আমি আপনার সঙ্গে গল্প করব। চলুন নীল মরিচ ফুল গাছটার কাছে। যাই। আপনি বেদিতে বসবেন! আমি বসব হুইল চেয়ারে। আমাদের আই লেভেল ঠিক থাকবে।

মিসির আলি বললেন, বরকতকে চা নিয়ে আসতে বলেছিলাম। তুমি চা খাবে?

খেতে পারি।

চায়ে চিনি কতটুক খাও?

কেন জানতে চান বলুন তো?

বিশেষ কোনো কারণ নেই। এমনি জিজ্ঞেস করলাম ।

দুচাম।

আমার ধারণা ছিল তুমি চায়ে চিনি খাও না।

এ রকম ধারণা হবার কারণ কী?

মধু খাও না তো তাই ভাবলাম মিষ্টি জাতীয় কিছুই খাও না।

সুলতান শীতল গলায় বলল, মধু খাই না আপনাকে কে বলল?

মিসির আলি হাসিমুখে বললেন, কেউ বলে নি। আমার ধারণা তুমি খাও না। অন্যদের আগ্রহ করে খাওয়াও । আমার ধারণাটা কি ঠিক?

হ্যাঁ আপনার ধারণা ঠিক। আমি মধু খাই না। এই ধারণা আপনার কেন হল এটা বুঝতে পারছি না। ব্যাখ্যা করবেন?

আমার সিক্সথ সেন্স এ রকম বলছিল।

সুলতান কঠিন গলায় বলল, সিক্সথ সেন্স বলে কিছু নেই। এটা আপনি যেমন জানেন, আমিও জানি। আমি মধু খাই না এটা কেন বললেন?

সুলতান তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। সে বড় বড় নিশ্বাস নিচ্ছে। তার হাতের মুঠি বন্ধ। প্রতিটি লক্ষণ বলে দিচ্ছে সে রেগে গেছে। রাগ সামলাতে পারছে না। মিসির আলি সুলতানের রাগটাকে তেমন গুরুত্ব দিলেন বলে মনে হল না। যেন তিনি ধরেই নিয়েছেন সুলতান রাগবে। মিসির আলি গাছের বেদিতে পা তুলে বসলেন। স্বাভাবিক গলায় বললেন, সুলতান তোমার কাছে কি সিগারেট আছে? দিনের প্রথম চা-টা সিগারেট দিয়ে খেতে হয়। আমি আমার প্যাকেট তুলে উপরে রেখে এসেছি। সিগারেট হাতে নিয়ে বসে থাকি। এর মধ্যে চা চলে আসবে। সিগারেট হাতে বসে থাকার মধ্যেও আনন্দ আছে। যারা ধূমপান করে না তারা সুস্বাস্থের আনন্দ পায়, সিগারেট হাতে বসে থাকার আনন্দটা পায় না।

বরকত চা নিয়ে এসেছে। দুজনের জন্যেই চা এনেছে। সুন্দর কাপে করে মিসির আলির জন্যে চা আর তার নিজের জন্যে গ্লাস ভর্তি চা। মিসির আলি বললেন, বরকত তুমি কাপটা তোমার বড় সাহেবকে দাও। আর আমি তোমার গ্লাসে করে চা খাব। গ্লাস ভর্তি চা খাওয়ায় আলাদা আনন্দ আছে। কাপের চা বাইরে থেকে দেখা যায় না। গ্লাসের চা দেখা যায়।

সুলতান সিগারেটের প্যাকেট বের করতে করতে বলল, আমি মধু খাই না। এই ধারণার পেছনে আপনার ব্যাখ্যাটা এখন শুনি। আমি ব্যাখ্যাটা শোনার জন্যে অপেক্ষা করছি।

আমার ব্যাখ্যা খুবই সহজ। তুমি আমাকে মধু দেবার সময় নাক-মুখ কুঁচকে ফেলেছিলো। রিফ্লেক্স একশান। সেখান থেকেই বুঝলাম তুমি মধু খাও না। খেলেও যে মধুটা আমাকে খেতে দিয়েছ সেটা খাও না।

তাহলে শুধু শুধু সিক্সথ সেন্সের কথা কেন বললেন?

আমি একটা ছোট্ট পরীক্ষা করলাম। আমি দেখলাম সিক্সথ সেন্সের কথা শুনে তুমি চমকে গেলে, খানিকটা রেগেও গেলে। চমকাও কি না এটাই ছিল আমার পরীক্ষা। বরকত দেখি চা ভালো বানায়।

সুলতান তাকিয়ে আছে। মনে হচ্ছে সে অপেক্ষা করছে মিসির আলি কী বলেন তা শোনার জন্যে। মিসির আলি সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে বললেন, তুমি যখন বললে সুন্দরবনে নানান ধরনের ফুলের মধু পাওয়া যায়—খলিসা ফুলের মধু, কেওড়া ফুলের মধু, গড়ান ফুলের মধু, তখন হঠাৎ করে আমার মনে হল-অনেক বিষাক্ত ফুলও তো প্রকৃতিতে আছে। যেমন ধৃতরা ফুল। এমন কি হতে পারে না যে কিছু মৌমাছি ধুতরা ফুল থেকে মধু নেয়। সেই সব ফুলে ধুতরার ভয়ঙ্কর বিষ মিশবে। সেই বিষ হল a very powerful haducinating drug যা মানুষের চিন্তায় কাজ করে। চেতনাকে পাল্টে দেয়। রিয়েলিটির ভুল ব্যাখ্যা করে। সুন্দরবন হল একটা ট্রপিক্যাল ফরেস্ট। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বন। সেখানে ধুতরা ফুল থাকারই কথা। তুমি বল থাকবে না?

হ্যাঁ থাকবে। এবং আছে। সুন্দরবনের ভেতর মাঝে মাঝে হঠাৎ কিছু ফাঁকা জায়গা পাওয়া যায়। সেখানে প্রচুর ধুতরা ফুল ফোটে।

সেই ফুল থেকে মৌমাছিরা মধু সংগ্রহ করে?

সব মৌমাছি করে না। বিশেষ এক ধরনের মৌমাছি করে। এদের মৌমাছিও বলে না। বলে মৌ পোকা।

মিসির আলি বললেন, যেকোনোভাবেই হোক বিশেষ ধরনের এই মধু তোমার সংগ্রহে আছে। তার খানিকটা তুমি আমাকে দুদফায় খাইয়েছ যে কারণে আমি ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্ন দেখেছি। দুঃস্বপ্নের সঙ্গে বাস্তব মিশে ছিল। প্রথম রাতে সাপ নিয়ে কথা হল-আমি স্বপ্নে দেখলাম সাপ। দ্বিতীয় রাতে কুকুর নিয়ে কথা হল। লিলি আমাকে বলল দরজার ছিটিকিনি বন্ধ করে ঘুমুতে-মাঝে মাঝে কুকুর দোতলায় উঠে আসে। সেই রাতে আমি স্বপ্ন দেখলাম কুকুর। কুকুরটা ঘরে ঢুকে আমার বিছানার চারদিকে ঘুরপাক খাচ্ছিল।

সুলতান বলল, আপনার ডিডাকটিভ লজিক যে ভালো, আমি জানতাম। এতটা ভালো বুঝতে পারি নি। I am impressed.

মিসির আলি চায়ের গ্লাস নামিয়ে রাখতে রাখতে বললেন, এখন তুমি কি আমাকে বলবে, কেন আমাকে এখানে এনেছি? তারা দেখানোর জন্যে নিশ্চয়ই আন নি। চিঠিতে তুমি টোপ ফেলার কথা বলেছ। সেটা কথার কথা ছিল না। আসলেই টোপ ফেলে এনেছি। কেন এনেছ? খোলাখুলি বলতে অসুবিধা আছে?

না অসুবিধা নেই। আপনার সঙ্গে অনেক লুকোচুরি খেলা হয়েছে। আর খেলার প্রয়োজন দেখছি না।

তাহলে তোমার উদ্দেশ্যটা বলে ফেল। তুমি কিছু মনে কোরো না-আমার এখানে থাকতে ভালো লাগছে না। আমি আজ চলে যাব। দুপুরের পর রওনা হতে চাই।

সুলতান বলল, আজ অমাবস্যা। আকাশে মেঘ নেই। আমি নিশ্চিত যে আজ রাতে আকাশ পরিষ্কার থাকবে। আপনাকে আজ রাতে একটা স্পাইরাল গ্যালাক্সি দেখাব। দেখার পর মনে হবে আপনার মানব জীবন ধন্য।

আমার গ্যালাক্সি দেখার শখ এখন নেই। আমি চলে যেতে চাচ্ছি। আকাশ দেখতে ইচ্ছা করছে না।

সুলতান শীতল গলায় বলল, স্যার শুনুন। আপনার ব্যক্তিগত ইচ্ছা-অনিচ্ছার কথা ভুলে যান। আমি আপনাকে এখান থেকে বের হতে দেব না।

মিসির আলি অবাক হয়ে বললেন, বের হতে দেবে না?

সুলতান বলল, না। এবং তার জন্যে কোনো সমস্যাও হবে না। কেউ জানবেও না আপনি কোথায় আছেন। আপনার পরিচিতজনারা জানে আপনার স্বভাব হচ্ছে মাঝে মধ্যে বাইরে কোথাও চলে যাওয়া। সবাই ভাববে। এবারো তাই হয়েছে। আপনার এক ছাত্র আপনার জন্য টেকনাফে অপেক্ষা করছে। সে যখন দেখবে আপনি এসে পৌঁছান নি তখন সে খানিকটা খোঁজ করবে। সবাই জানবে টেকনাফ যাবার পথে আপনি হারিয়ে গেছেন। কিছুদিন পর মানুষ আপনাকে ভুলে যাবে। মানুষ বিস্মৃতিপরায়ণ জীব।

আমাকে এখানে আটকে রেখে তোমার লাভ কী?

লাভ আছে। সাইকোলজি বিশেষ করে প্যারাসাইকোলজির উপর আপনার দখল অসাধারণ। আপনি আমার উপর গবেষণা করবেন। আমার মাথার ভেতর উঁকি দিয়ে দেখবেন সেখানে কী আছে। কেন আমি এ রকম?

তুমি কী রকম?

আপনার অনুমান শক্তি তো ভালো, আপনি অনুমান করুন। আপনাকে সামান্য সাহায্য করছি। আমার তুলনায় অশ্বিনী কুমার রায় একজন মহাপুরুষ। হা হা হা।

মিসির আলি তাকিয়ে আছেন। সুলতানও তাঁর দিকে তাকিয়ে আছে। সে এখন আর হাসছে না। কিন্তু হাসিটা শরীরের ভেতর আছে। কারণ তার শরীর কাঁপছে। মনের ছায়া চোখে নাকি পড়ে। চোখ হচ্ছে মনের জানালা। মিসির আলির মনে হল না-সুলতানের চোখে মনের কোনো ছায়া পড়েছে। শান্ত স্থির চোখ। যে চোখ বুদ্ধিতে ঝকমক করছে।

সুলতান বলল, স্যার আপনার কি ভয় লাগছে?

মিসির আলি বললেন, না।

সুলতান বলল, ভয় লাগছে না কেন?

বুঝতে পারছি না কেন।

সুলতান বলল, আপনি যে ভয় পাচ্ছেন না সেটা আপনাকে দেখে বোঝা যাচ্ছে। ভয় পাবেন না জানলে আগেই আপনাকে বলতাম। যাই হোক আপনার উচিত আমাকে ধন্যবাদ দেওয়া।

কেন বল তো?

সুলতান সিগারেট ধরাতে ধরাতে বলল, আপনাকে জীবনের শ্রেষ্ঠতম গবেষণার সুযোগটা আমি করে দিচ্ছি। একজন অতি ভয়ঙ্কর মানুষকে আপনি খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ পাচ্ছেন। যে আপনার গবেষণায় আপনাকে সাহায্য করবে। আপনিও আমাকে কিছুটা সাহায্য করবেন।

আমি কী সাহায্য করব?

আমাকে সঙ্গ দেবেন। আপনার সঙ্গে বিজ্ঞান, সাহিত্য, শিল্পকলা নিয়ে আলাপ করব। আকাশের তারা দেখব। তাছাড়া আমি নিজেও ছোটখাটো কিছু পরীক্ষা করছি। মানসিক পরীক্ষা। এই পরীক্ষাতেও আপনি সাহায্য করবেন। মনোজগতের যে পড়াশোনা আপনার আছে আমার তা নেই। পরীক্ষাটা ঠিকমতো হচ্ছে কি না। আপনি দেখে দেবেন।

কী পরীক্ষা?

সালমা নামের একটা মেয়ের কথা আপনাকে চিঠিতে লিখেছিলাম। তাকে নিয়েই পরীক্ষা। আমি মোটামুটি নিশ্চিত যে, সব মানুষের ভেতরই অতীন্দ্ৰিয় ক্ষমতা আছে। মানুষের মনে ভয়ঙ্কর চাপ দিয়ে সেই ক্ষমতা বের করে আনা যায়। আমি সালমার উপর এই চাপটাই দিচ্ছি!

মেয়েটা কোথায়?

মেয়েটা এ বাড়িতেই আছে। রাতে আপনার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেব।

লিলি বলছিল সালমা বলে আলাদা কেউ নেই। লিলিই সালমা।

লিলির সব কথা গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করার কিছু নেই। আমি এখন ঘুমুতে যাব। আপনার কিছু জিজ্ঞেস করার থাকলে জিজ্ঞেস করুন।

না, হুইল চেয়ারের আমার কোনোই প্রয়োজন নেই। আমি শারীরিকভাবে সুস্থ একজন মানুষ। ইচ্ছা করেই হইল চেয়ারে সময় কাটাই যাতে বাইরের লোকজন জানে।

এ বড়িতে পঙ্গু একজন মানুষ থাকে। পঙ্গু বলেই সে শহর ছেড়ে নির্জন বাস করে। এই কাজটা না করলে কথা উঠত সম্পূর্ণ সুস্থ একজন মানুষ দিনের পর দিন এই নির্জনে স্বেচ্ছাবন্দি হয়ে আছে কেন? অবিশ্যি হুইল চেয়ারের একটা ভালো ব্যবহারও আছে। টেলিস্কোপ ফিট করে তারা দেখার সময় এটা খুব কাজে লাগে।

তুমি যে আমাকে এখানে আটকে রাখার জন্যে এনেছ তা কি এ বাড়ির লোকজন জানে?

জানবে না কেন? জানে। লিলি জানে, বরকত জানে। আপনার মতো অনেকেই এ বাড়িতে আসে। কেউ ফিরে যায় না। বুঝতেই পারছেন এ বাড়ি থেকে কাউকে জীবিত ফেরত পাঠানো আমার জন্যে সম্ভব না। কোনো ভয়ঙ্কর মানুষ যদি তার কর্মকাণ্ড চালিয়ে যেতে চায় তাহলে অবশ্যই তাকে সাবধানী হতে হবে। সিরিয়াল কিলারদের কথাই ধরুন–সব সিরিয়াল কিলারই চিতাবাঘের চেয়েও সাবধানী। তাকে একের পর এক মানুষ মারতে হবে। সাবধানী না হলে এই কাজটা সে করতে পারবে না। স্যার আমি ঠিক বলছি?

হ্যাঁ ঠিক বলছ।

থ্যাঙ্ক যু। আমি সালমা মেয়েটিকে নিয়ে গবেষণাধর্ম যে কাজটা করেছি তা লেখার চেষ্টা করেছি। আমি পাঠিয়ে দেব। পড়ে দেখুন। লেখাটা গবেষণাধর্মী হয় নি। সায়েন্টিফিক পেপার কী করে লিখতে হয় জানি না। এই দায়িত্বটা আপনার। আমরা এই জঙ্গলে বসে একের পর এক রিসার্চ পেপার বিদেশী জার্নালে পাঠাব। মূল অথর আপনি আমি কো-অথর।

সুলতান হাসল। সেই হাসি যা চট করে মুখ থেকে মুছে যায়। কিন্তু শরীরে থেকে যায়। বেশ কিছুক্ষণ শরীর দুলতে থাকে। এই প্রথম মিসির আলির শরীর গুলিয়ে উঠল। তার কাছে মনে হল ঘেন্নাকর কিছু তার সামনে বসে আছে।

সুলতান বলল, স্যার এখন আপনি আমাকে সামান্য ভয় পাচ্ছেন। আপনার চোখমুখ শুকিয়ে গেছে। কোস্পেনি হিসেবে আমি খারাপ হব না। আমি শিক্ষিত একজন মানুষ। অংকশাস্ত্রের মতো একটা জটিল বিষয়ে আপার পিএইচ. ডি. ডিগ্নি আছে। আপনি যদি অংকের ছাত্র হতেন তাহলে আমাকে চেনার সামান্য সম্ভাবনা ছিল–আমার পিএইচ. ডি.র কাজ খুব ভালো হয়েছিল। গ্রুপ থিওরির সব বইতেই সুলতান ফাংশন বলে একটা ফাংশানের উল্লেখ আছে। আমার নামে তার নাম। যৌবনে এই দিকে কিছু মেধা ব্যয় করেছিলাম। পরে এইসব অর্থহীন মনে হয়েছে। স্যার আমি কী বলছি আপনি কি শুনছেন?

হ্যাঁ শুনছি,

এখন আমার কাছে মনে হচ্ছে আসল রহস্য পদার্থবিদ্যা বা অংকে না-আসল রহস্য মানুষের মনে। আকাশ যেমন অন্তহীন, মানুষের মনও তাই। পৃথিবীর বেশির ভাগ অংকবিদ আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে ভালবাসতেন। আমিও ভালবাসি। আকাশের দিকে তাকালে জাগতিক সব কিছু তুচ্ছ মনে হয়। we are so insignificant. আমাদের জন্ম-মৃত্যু সবই অর্থহীন!

মিসির আলি বললেন, তুমি কি মানুষ খুন করেছ?

সুলতান জবাব দিল না।

মিসির আলি বসে স্তব্ধ হয়ে আছেন। সুলতান হুইল চেয়ার ঘুরিয়ে চলে যাচ্ছে। পেয়ারা গাছের নিচে বরকতকে দেখা যাচ্ছে সে কুকুরকে গোসল দিচ্ছে।

রোদ উঠেছে। আবহাওয়া অত্যন্ত মনোরম। চেরী গাছ থেকে একটা দুটা করে ফুল পড়ছে। ফুলগুলি গাছে যত সুন্দর দেখাচ্ছে—হাতে নেওয়ার পর তত সুন্দর লাগছে না। কিছু সৌন্দৰ্য দূর থেকে দেখতে হয়, কাছ থেকে দেখতে হয় না।

আমার নাম সুলতান

আমার নাম সুলতান।

সাধারণত গরিব ঘরের ছেলেমেয়েদের এ জাতীয় নাম থাকে। সুলতান, সম্রাট, বাদশাহ্। বাবা মা ভাবেন বড় হয়ে ছেলে রাজা বাদশাহ্ হবে। আমি কোনো গরিব ঘরের সন্তান ছিলাম না। বিত্তশালী পরিবোরর সন্তান ছিলাম। আমার বাবা মারি সন্তানদের নামকরণের মতো তুচ্ছ বিষয়ে কোনো আগ্রহ ছিল না। আমরা অনেকগুলি ভাই-বোন ছিলাম। মা প্রতিবছর একটি করে সন্তান প্রসব করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন। জ্ঞান হবার পর থেকেই মাকে বিছানায় শোয়া পেয়েছি। নিজের সন্তানদের দিকে ভাকানোর মতো অবস্থা তাঁর ছিল না। তাঁর মন এবং শরীর দুইই নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। শেষের দিকে তিনি মৃত্যুর জন্যে অপেক্ষা শুরু করলেন।

আমরা থাকতাম পুরোনো ঢাকার একটা বাড়িতে। সেই বাড়িটিও বিশাল। সেই বাড়িও উঁচু পঁচিলে ঘেরা। আমাদের পড়াশোনার জন্যে ঢাকায় এনে রাখা হয়েছিল। কিন্তু সেই দিকে কারো নজর ছিল বলে মনে হয় না। বাবা ব্যস্ত তার ব্যবসা নিয়ে। আজ ঢাকা, কাল নারায়ণগঞ্জ, পরশু খুলনা এই অবস্থা। মা বিছানায়। বাড়ি ভর্তি কাজের লোক। এরা পান খেয়ে ব্যস্ত ভঙ্গিতে ঘোরাফেরা ছাড়া কিছু করে না। সন্ধ্যার পর দুজন প্রাইভেটটিউটর আসেন। তাঁরা চা পানি খান। বেত নিয়ে হান্বিতাম্বি করেন। সপ্তাহে তিন দিন আসেন। একজন মওলানা। তাঁর বিরাট দাড়ি, চোখে সুরমা। তিনি আমাদের কোরান শরীফ পাঠ করা শেখান। বিরাট বিশৃঙ্খলার ভেতরে আমরা বড় হচ্ছি। তবে বিশৃঙ্খলারও নিজস্ব ছন্দ আছে। কোথাও ছন্দ পতন হচ্ছে না। একদিন হল–আমার বড় বোন মারা গেল, ভালো মানুষ-সারাদিন কাজকর্ম করেছে। মওলানা সাহেবের কাছে সিপারা পড়েছে। রাতে এশার নামাজ পড়ে ঘুমুতে গিয়েছে, সেই ঘুম আর ভাঙল না।

বাবা তখন চিটাগাং-এ। তিনি খবর পেয়ে কাজকর্ম ফেলে চলে এলেন। তাঁকে কন্যা শোকে অধীর বলে মনে হল না, তিনি শুধু বারান্দার এ মাথা থেকে ও মাথা পর্যন্ত হাঁটতে লাগলেন। আর বারবার বলতে লাগলেন-সমস্যাটা কী? ঘটনাটা কী?

বড় বোনের মৃত্যুর পেছনে কোনো সমস্যা বা ঘটনা হয়তো ছিল, আমি নিতান্তই শিশু বলে বুঝতে পারি নি। আমার বড় বোনের নাম মীরু। তার তখন আঠার উনিশ বছর। সমস্যারই সময়। আমার ধারণ ভালো কোনো সমস্যাই ছিল।

বড় বোনের মৃত্যুর ঠিক ছমাসের মাথায় মারা গেল আমার মেজো ভাই। তার নাম ইজাজত। স্কুল থেকে ফেরার পথে রিকশার ধাক্কা খেয়ে নর্দমায় পড়ে গিয়ে মাথায় ব্যথা পেল। বাসায় এসে কয়েকবার বমি করে চোখ উন্টে দিল। বাবা শোকে যে অভিভূত হলেন তা না, চোখ-মুখ কুঁচকে বললেন, সমস্যাটা কী? ট্রাকের নিচে পড়ে মারা যায় এটা ঠিক আছে। কিন্তু রিকশার নিচে পড়ে মৃত্যু এটা কেমন কথা? আর কিছু না অভিশাপ লেগে গেছে। মহাঅভিশাপ লেগে গেছে। এই বাড়িতে থাকা আর ঠিক হবে না।

সেই বছরের শেষ দিকে আমার সবচেয়ে ছোট বোনটি মারা গেল। তার মৃত্যু স্বাভাবিকভাবেই হয়েছিল বলা চলে। ডিপথেরিয়ায় মৃত্যু। ছোটবোনের মৃত্যুর পর বাবা সবাইকে নিয়ে গ্রামের বাড়িতে চলে আসেন। ঠিক হল ঢাকায় নতুন কোনো বড় বাড়ি ঠিক না হওয়া পর্যন্ত আমরা গ্রামে থাকব। অভিশাপ লাগা বাড়িতে ফিরে যাব না। গ্রামের বাড়িতে আমাদের লেখাপড়া দেখিয়ে দেবার জন্যে সাৰ্বক্ষণিক একজন শিক্ষক রাখা হল তার নাম ইদারিশ। মুহম্মদ ইদারিশ মাস্টার। বাবা তাঁকে ডেকে বিশেষ নির্দেশ দিয়ে দিলেন–শিশুদের শাসনে রাখতে হবে। কঠিন শাসন। পড়াশোনা না করলে, বেয়াদবি করলে মেরে তক্তা বানিয়ে দেবে। কোনো অসুবিধা নেই। শিশুদের দুইটাই অষুধ। একটা কৃমির অষুধ, আরেকটা মার।

মুহম্মদ ইদারিশ অত্যন্ত উৎসাহে তাঁর কর্মকাণ্ড শুরু করলেন। প্রতিদিনই তিনি নির্যাতনের নানান কৌশল বের করতে লাগলেন। দুই হাতে ইট নিয়ে সূর্যের দিকে তাকিয়ে থাকা দিয়ে শুরুটা করলেন। হাতের ইট তাঁর পায়ে ফেলে দিয়ে তাঁকে প্রায় খোঁড়া করে ফেলার চেষ্টা করেছিলাম বলেই হয়তো আমার শাস্তির ব্যাপারে তিনি বিশেষ যত্নবান হলেন। এমন সব শাস্তি যা অনেক চিন্তা-ভাবনা, গবেষণা করে বের করতে হয়। চট করে মাথায় আসে না।

আমাকে তিনি এক বিকালে বিশেষ এক ধরনের শাস্তি দেবার জন্যে মন্দিরে নিয়ে ঢুকলেন। গা থেকে শার্ট খুলে খালি গা করলেন। দড়ি দিয়ে দুই হাত পেছনমোড়া করে বাঁধলেন। তারপর দুটা প্ৰকাণ্ড বড় মাকড়সা সুতা দিয়ে বেঁধে আমার গলায় মালার মতো পরিয়ে দিয়ে মন্দিরের দরজা বন্ধ করে চলে গেলেন।

আমার মাকড়সা ভীতি আছে। এই নিরীহ প্রাণী মানুষের কোনোই ক্ষতি করে না। কিন্তু যারা একে ভয় পায় তাদের কাছে এরা রাজ্যের বিভীষিকা নিয়ে উপস্থিত হয়। যে কারণে মাকড়সা ভীতির আলাদা নাম পর্যন্ত আছে।

প্রথম কিছুক্ষণ আমার মনে হল আমি বোধহয় এক্ষুনি মারা যাব। সুতা দিয়ে বাধা মাকড়সা দুটা সারা গায়ে কিলবিল করছে। গলা বেয়ে মুখের দিকে উঠতে চেষ্টা করছে। আমি চিৎকার করার চেষ্টা করছি, গলা দিয়ে সামান্যতম শব্দও বের হচ্ছে না। আমার ইচ্ছা করছিল ছুটে গিয়ে দরজায় আছড়ে পড়ি। সেটা সম্ভব হচ্ছিল না, কারণ আমার হাত-পা জমে গিয়েছিল। ঘর অন্ধকার। আমি চোখে কিছুই দেখছি না, কিন্তু অদ্ভুত কারণে মাকসড়া দুটাকে দেখতে পাচ্ছি। মনে হচ্ছে তাদের গা থেকে হালকা সবুজ আলো বের হচ্ছে। এই সময় অদ্ভুত একটা ঘটনা ঘটল-চোখের সামনে দেখলাম একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার মুখ হাসি হাসি-যুবতী মেয়ে। তার গায়ে কোনো কাপড় নেই, তার জন্যে কোনো লজ্জাও নেই। তার মাথা ভর্তি লম্বা লম্বা চুল। সেই চুল মুখের উপর পড়ে আছে বলে মুখ পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে না। মেয়েটা বলল, মাকড়সা তো সামান্য পোকা। তুই ভয়ে দেখি মরে যাচ্ছিস?

আমি বললাম, আপনি মাকড়সা দুটা ফেলে দিন। আপনার পায়ে পড়ি।

নারীমূর্তি বলল, পায়ে পড়ে লাভ হবে না। আমি মাকড়সা হাত দিয়ে ছোব না। স্নান করে এসেছি। হাত নোংরা হবে। তুই মাকড়সার দিকে না তাকিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে কথা বল। তাহলে ভয় কমবে।

আমি বললাম, আপনি কে?

নারীমূর্তি চাপা গলায় বলল, আমি গৌর কালী। কী আশ্চর্য তুই তো দেখি মাকড়সার ভয়ে মরেই যাচ্ছিস! পেচ্ছাব করে মন্দিরও অপবিত্র করে ফেলেছিস। তুই কেমন ছেলে বল দেখি। মাকড়সার ভয়ে কেউ পেচ্ছাব করে? ছিঃ!

আমি বললাম, আপনি একটা কাঠি দিয়ে মাকড়সা দুটা ফেলে দিন।

নারীমূর্তি চাপা হাসি হাসতে হাসতে বলল-পাগলের মতো কথা বলবি না। আমি এখন কাঠি পাব কোথায়? কাঠি খুঁজতে হলে মন্দিরের বাইরে যেতে হবে। কুয়ার পাড়ে তোর মাস্টার বসে আছে। আমি নেংটো হয়ে তার সামনে যাব নাকি? তোকে একটা বুদ্ধি দেই শোন–এই মাস্টার তোকে আরো অনেক যন্ত্রণা দেবে। যন্ত্রণা দেবার আগেই ব্যবস্থা করে ফেল।

কী ব্যবস্থা?

মাস্টারকে প্রায়ই দেখি কুয়ার ওপর বসে থাকে। আচমকা ধাক্কা দিয়ে ব্যাটাকে কুয়ার ভেতর ফেলে দিবি। পারবি না?

না।

না পারার কী আছে? এক ধাক্কায় সব সমস্যার সমাধান। খুবই গহিন কুয়া। নিচে বিষাক্ত গ্যাস। একবার পড়লে আর দেখতে হবে না। কাজটা যে তুই করেছিস সেটাও কেউ বুঝবে না। ভাববে নিজে নিজে পড়ে গেছে। আমার অবিশ্যি ধারণা কেউ কোনোদিন জানবেও না যে এইখানে একজন মানুষ পড়ে আছে।

মন্দিরের ভেতরের স্মৃতি। এরপর আমার কিছু মনে নেই। হয়তো আমি অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলাম। এই ঘটনার তৃতীয় দিনের দিন আমি মুহম্মদ ইদরিশ মাস্টারকে ধাক্কা দিয়ে কুয়ায় ফেলে দেই। কুয়াটা খুব গভীর তো বটেই, ধাক্কা দেওয়ার অনেক পরে ঝপাং শব্দটা কানে আসে। ও আল্লাগো ও আল্লাগো শব্দটি দুবার শোনা যায়। তারপর সব নিস্তব্ধ। আমি খুব স্বাভাবিকভাবে কুয়ার পড়ে কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁট করি। তারপর ঘরে চলে আসি।

মাস্টার সাহেব বাড়িতে নেই এটা নিয়ে বাড়ির কাউকেই উদ্বিগ্ন হতে দেখা গেল না-কারণ তখন আমার মায়ের শরীর খুবই খারাপ। শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। এখন মারা যান তখন মারা যান অবস্থা। মওলানা ডাকা হয়েছে। মওলানা তওবা করিয়েছেন। খবর পেয়ে বাবা চলে এসেছেন ঢাকা থেকে। মা সেই যাত্রা রক্ষা পেয়ে যান। বাবা উৎফুল্ল মনে ঢাকায় ফিরে যান। যাবার আগে আরেকজন নতুন মাস্টার ঠিক করে যান। মুহম্মদ ইন্দরিশের বিষয়ে তিনি সিদ্ধান্ত নেন যে সে ভালো কোনো সুযোগ পেয়ে চাকরি ছেড়ে ঢাকায় চলে গেছে। নিমকহারাম টিমকহারাম বলে তাকে অনেক গালাগালিও করেন।

মার শরীর আরেকটু ভালো হলে আমরা আবার ঢাকা শহরে চলে আসি। মুহম্মদ ইন্দরিশ কুয়ার ভেতরে থেকে যায়। তার বিষয়ে কেউ কিছুই জানে না। আমি নিজেও ব্যাপারটা ভুলে যাই। একবার শুধু রাতে মন্দিরে দেখা নারীমূর্তিকে স্বপ্নে দেখি। স্বপ্নটা এ রকম-আমি মন্দিরের বারান্দায় বসে পেয়ারা খাচ্ছি। নারীমূর্তি এসে আমার সামনে দাঁড়াল। পরিচিত ভঙ্গিতে হাসতে হাসতে বলল, এই বাঁদর! আমাকে চিনতে পারছিস না? আমি বললাম চিনতে পারছি।

অন্যদিকে তাকিয়ে কথা বলছিস কেন? নাকি আমার গায়ে কাপড় নেই বলে। তাকাতে লজ্জা লাগছে?

আমি বললাম, লজ্জা লাগছে।

চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বল তাহলে লজ্জা লাগবে না। এখন বল দেখি ইদারিশ মাস্টারের উচিত শিক্ষা হয়েছে না?

আমি বললাম, হয়েছে।

দেখলি কেউ কিছু বুঝতে পারে নি।

হুঁ।

মানুষের শরীর পচে গেলে খুবই দুৰ্গন্ধ হয়। কুয়াটা তো অনেক গভীর। এই জন্যে পচা গন্ধ নিচে জমে আছে উপরে আসতে পারছে না। বুঝতে পারছিন্স?

হুঁ।

আমি তোকে একটা বিষয়ে সাবধান করতে এসেছি।

কোন বিষয়ে?

তুই কুয়ার ধারে একা একা যাবি না।

গেলে কী হবে?

ইদরিশ মাস্টার তোকে ডাকবে। তুই বাচ্চা মানুষ তো। ডাক শুনে ভয়টয় পেতে পারিস।

আচ্ছা কুয়ার ধারে যাব না।

কখনো কোনোদিনও কুয়ার ভেতরে কী আছে। উঁকি দিয়ে দেখতে যাবি না। দেখতে গেলেই মহাবিপদ।

আচ্ছা দেখতে যাব না।

ইদারিশ মাস্টারের প্রসঙ্গ এইখানেই শেষ। অনেক বছর পর ইদারিশ মাস্টারর প্রসঙ্গটা আমার আবার মনে আসে। তখন আমি বিলেতে পড়াশোনা করছি। কোনো এক। উইক এন্ডে হঠাৎ একটা বই হাতে এল-বইটার নাম The crystad door, বইটার লেখক কিংস কলেজের একজন বিখ্যাত সাইকিয়াট্রিস্ট-James Hauler, তিনি এই বইটিতে বললেন-মানুষের মনের কিছু দরজা আছে যা সহজে খোলে না। মানুষ যদি কোনো কারণে ভয়ঙ্কর কোনো চাপের মুখোমুখি হয় তখনি দরজা খুলে যায়। তিনি এই দরজার নাম দিয়েছেন crystal door.

জেমস হাউলার বলছেন–এই স্ফটিক দরজার সন্ধান বেশির ভাগ মানুষ সমগ্র জীবনে কখনো পায় না। কারণ বেশির ভাগ মানুষকে তীব্র ভয়াবহ মানসিক চাপের মুখোমুখি হতে হয় না। জেমস হাউলার মনে করেন মানুষের কাছে দুধরনের বাস্তব আছে। একটি দৃশ্যমান জগতের বাস্তবতা, আরেকটি অদৃশ্য জগতের বাস্তবতা। স্বপ্ন হচ্ছে সে রকম একটি অদৃশ্য জগত এবং সেই জগতও দৃশ্যমান জগতের মতোই বাস্তব। স্ফটিক দরজা বা crystal door হল অদৃশ্য বাস্তবতার জগতে যাবার একমাত্র দরজা। এই সাইকিয়াট্রিষ্ট মনে করেন যে কৃত্রিম উপায়ে মানুষের মনে চাপ সৃষ্টি করে অদৃশ্য দরজা খোলা যেতে পারে। তিনি একটি কৃত্রিম উপায় বেরও করেছেন। তার উপর গবেষণা করছেন।

মনের উপর কৃত্রিম চাপ সৃষ্টির জন্যে তিনি উৎসাহী ভলেন্টিয়ারকে একটি সাত ফুট বাই সাত ফুট এয়ার টাইট ধাতব বাক্সে ঢুকিয়ে তালাবদ্ধ করে দেন। বাক্সের ভেতরটা ভয়ংকর অন্ধকার। বাইরের কোনো শব্দও সেখানে যাবার কোনো উপায় নেই। পরীক্ষাটা কী, কেমন ভাবে হবে তার কিছুই ভলেন্টিয়ারকে জানানো হয় না। সে কোনো রকম মানসিক প্ৰস্তৃতি ছাড়াই বাক্সের ভেতর ঢোকে। তারপর হঠাৎ লক্ষ করে বাক্সের ভেতর পানি জমতে শুরু করছে। আস্তে আস্তে পানি বাড়তে থাকে। ভলেন্টিয়ার বাক্সের ভেতর দাঁড়ায়। ডাকাডাকি করতে শুরু করে। বাক্সের ডালায় ধাক্কা দিতে থাকে। কোনো উত্তর পায় না। এদিকে পানি বাড়তে বাড়তে তার গলা পর্যন্ত চলে আসে। সে প্ৰাণে বাঁচার জন্যে পায়ের আঙুলে ভর করে উঠে দাঁড়ায়। পানি বাড়তেই থাকে। পানি নাক পর্যন্ত যাবার পর পরীক্ষাটা বন্ধ হয়। তীব্র ভয়ে ভলেন্টিয়ার দিশাহারা হয়ে যায়। পরীক্ষায় দেখা গেছে শতকরা ত্রিশভাগ। ভলেন্টিয়ার পরীক্ষার শেষ পর্যায়ে হঠাৎ নিজেকে বাক্সের বাইরে অ্যালো ঝলমল একটা জগতে দেখতে পায়। যে জগতের আলো পৃথিবীর আলোর মতো না। সেই আলোর বর্ণ সোনালি। সেই জগতের বৃক্ষরাজি বৃক্ষরাজির মতো না। সেই জগত অদ্ভূত অবাস্তব এক জগত। যেখানে অস্পষ্ট কিন্তু মধুর সঙ্গীত শোনা যায়। শতকরা দশভাগ। ভলেন্টিয়ার নিজেদের আবিষ্কার করেন। অন্ধকারে ধূম্রময় এক জগতে। সেই জগত আতঙ্ক এবং কোলাহলের জগত। বাকি ষাট ভাগ কিছুই দেখে না। তারা আতঙ্কময় এক অভিজ্ঞতা নিয়ে বাক্স থেকে বের হয়ে আসে।

আমি জেমস সাহেবের বইটি পড়ে মোটামুটি নিশ্চিত হয়ে যাই যে শৈশবে মুহম্মদ ইদারিশ মাষ্টার না জেনেই এ ধরনের একটি পরীক্ষা আমার উপর করেছিল। ভয়াবহ মানসিক চাপ সৃষ্টি করে স্ফটিক দরজা খোলার ব্যবস্থা করেছিল। আমি আমার পাঠ্য বিষয় গণিতশাস্ত্রের চেয়ে প্যারাসাইকোলজির বিষয়ে বেশি আগ্রহ বোধ করতে থাকি। এ ধরনের বইপত্র যেখানে যা পাই পড়ে ফেলার চেষ্টা করি। এটা করতে গিয়ে অনেক ভালো বই যেমন পড়েছি।–অনেক মন্দ বইও পড়েছি। ভালো বই পড়ার উদাহরণ হিসেবে বলি-মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের মানসিক জগত নিয়ে লেখা পেরিনের অসাধারণ বই Death call. পেরিন দেখিয়েছেন মৃত্যুর দিন এগিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত মানুষদের মানসিক রূপান্তর একই ধারায় হয়। মৃত্যুর খুব কাছাকাছি চলে আসার পর হঠাৎ মনে হয় মানুষগুলি আর এ জগতে বাস করছে না। তারা অন্য কোনো জগতের বাসিন্দা হয়ে গেছে। যে জগতটির সঙ্গে পৃথিবীর জগতের কোনােই মিল নেই। তাদের সেই জগতটি সত্য বলে মনে হয়।

পেরিনের লেখা আরেকটি বইও আমাকে আলোড়িত করেছিল। এই বইটি ক্যানসারে আক্রান্ত রুগীদের নিয়ে লেখা ; রুগীরা জানেন তাদের মারণ ব্যাধিতে ধরেছে। বাঁচার কোনো আশা নেই। তারপরেও মনের গভীর গোপনে বেঁচে থাকার আশা পোষণ করেন। তাঁরা ভাবেন একটা কিছু অলৌকিক ব্যাপার তাদের জীবনে ঘটবে। ঈশ্বর প্রার্থনা শুনবেন, তাদের আরোগ্য করবেন। ক্যানসারের কোনো অষুধ বের হয়ে যাবে। সেই অষুধে রোগমুক্তি ঘটবে। আশায় আশায় বাঁচতে থাকেন। এক সময় হঠাৎ করেই বুঝতে পারেন-কোনো আশা নেই। নিশ্চিত মৃত্যু সামনেই অপেক্ষা করছে। তখন তাঁরা অন্য রকম হয়ে যান। আত্মা তাদের ত্যাগ করে। আশা ত্যাগ করার পরও দু-এক দিন তারা বাঁচোন। সেই বঁচা ভয়াবহ বাচা। মানুষটা বেঁচে আছে, কথা বলছে, খাচ্ছে ঘুমুচ্ছে কিন্তু মানুষটার আত্মা নেই।

আমার মায়ের বেলায় ঠিক একই ব্যাপার ঘটেছিল। আত্মা তাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিল। সে এক ভয়াবহ ব্যাপার!

বিলেতে পড়াশোনার সময়ই আমি মনে মনে ঠিক করে ফেলি সুযোগ এবং সুবিধামতো আমি প্যারাসাইকোলজির উপর কিছু কাজ করব। সেই সুযোগের জন্যে আমাকে দীর্ঘদিন অপেক্ষা করতে হয়।

মিসির আলি খাতার উপর থেকে চোখ তুললেন। সুলতান এসে পাশে দাঁড়িয়েছে। সে এসেছে নিঃশব্দে। মিসির আলি সুলতানের ঘরে ঢোকার শব্দ পান নি। সে যখন পাশে এসে দাঁড়িয়েছে তখনই বুঝতে পেরেছেন।

সুলতান খাটে বসতে বসতে বলল, সন্ধ্যাবেলা পড়াশোনার জন্যে ভালো না। মিসির আলি কিছু বললেন না। সুলতান বলল, আপনি গভীর মনোযোগ দিয়ে আমার লেখা পড়ছেন দেখে ভালো লাগল। ঘটনাগুলি আমি মোটামুটি ভালোই গুছিয়ে লিখেছি।

মিসির আলি বললেন, আমি যখন কিছু পড়ি মন দিয়েই পড়ি। তুমি গুছিয়ে না। লিখলেও আমি মন দিয়েই পড়তাম।

সুলতান বলল, এইখানে আপনার সঙ্গে আমার কিছু মিল আছে। আমি যখন যা করি মন দিয়েই করি। যখন আকাশের তারা দেখি, খুব মন দিয়ে দেখি। যখন মনে করি কারো উপর মানসিক চাপ সৃষ্টি করব তখন সেই কাজটাও খুব মন দিয়ে করি।

ভালো।

সুলতান বলল, ভালোমন্দ বিবেচনা করে আমি কিছু করি না। আমাকে যা করতে হবে সেটা আমি করি। যাই হোক এটা নিয়ে পরে আপনার সঙ্গে কথা হবে। আপনি একটা কাজ করুন। পুরো খাতাটা এখন পড়ার দরকার নেই। ধীরে সুস্থে পড়বেন। আমার ধারণা। আপনি পড়ার অনেক সময় পাবেন। এখন শুধু সালমার অংশটা পড়ুন। এই মেয়েটি হচ্ছে আমার বর্তমান গবেষণা সাবজেক্ট। মেয়েটার সঙ্গে আপনার পরিচয় করিয়ে দেব। তার বিষয়ে আগে জানা থাকা ভালো।

মিসির আলি খাতা বন্ধ করতে করতে বললেন, তোমাদের ঐ কুয়াতে কি শুধু মুহম্মদ ইদারিশ মাস্টারই আছে? নাকি আরো অনেকে আছে?

সুলতান হাসি মুখে তাকিয়ে রইল-জবাব দিল না। তার মুখ দেখে মনে হচ্ছে সে খুব মজার কোনো কথা শুনল।

মিসির আলি বললেন, তোমার স্ত্রী কোথায়? লিলি?

সুলতান হাই তুলতে তুলতে বলল, ও অসুস্থ।

মিসির আলি বললেন, তোমার পরীক্ষা নিরীক্ষায় লিলি সাহায্য করে না?

সুলতান বলল, ওর সাহায্যের তেমন প্রয়োজন পড়ে না! ও ভলেন্টিয়ার যোগাড় করে আনে। আপনাকে যেমন আনল। অবিশ্যি আপনাকে ভলেন্টিয়ার বলা ঠিক হচ্ছে না। বিপজ্জনক কাজে ভলেন্টিয়ার পাওয়া যায় না-জোর করে বানাতে হয়। আপনি অকারণে কথা বলে সময় নষ্ট করছেন। সালমার বিষয়ে কী লিখেছি তাড়াতাড়ি পড়ে ফেলুন। এক শ ছয় পৃষ্ঠায় পাবেন। আমি বরকতকে দিয়ে হারিকেন পাঠিয়ে দিচ্ছি। ভালো কথা চা খাবেন? আপনাকে আজ মনে হয়। বৈকালিক চা দেওয়া হয় নি। লিলি অসুস্থ হওয়ায় একটু সমস্যা হয়েছে। খাবারদাবারের ব্যবস্থাট খানিকটা এলোমেলো হয়েছে।

সুলতান উঠে দাঁড়াল। মিসির আলি হারিকেনের জন্যে অপেক্ষা করতে লাগলেন। সালমার বিষয়ে কী লেখা আছে মন দিয়ে পড়তে হবে। মিসির আলি খাতা খুললেন। এক শ ছয় পৃষ্ঠা বের করলেন। এখনো ঘরে কিছু আলো আছে, পড়া শুরু করা যেতে পারে। এর মধ্যে নিশ্চয়ই হারিকেন চলে আসবে।

স্যাম্পল নাম্বার ৭
নাম : সালমা
বয়স : পনের থেকে ষোল
পড়াশোনা : নবম শ্রেণীর ছাত্রী
বুদ্ধি : ভালো। বেশ ভালো।

জীব হিসেবে মানুষকে যতটা ভঙ্গুর মনে করা হয় সে তত ভঙ্গুর না। মানুষের মানসিক ভারসাম্য নষ্ট করা কঠিন কাজ। মস্তিষ্কের ডিফেন্স ম্যাকানিজম প্রক্রিয়া অত্যন্ত প্রবল। মানসিক চাপ প্রতিরোধে সে তার সমগ্র শক্তি নিয়োগ করে। আমি অত্যন্ত বিস্ময়ের সঙ্গে মানুষের এই ক্ষমতা অনেকবার প্রত্যক্ষ করেছি। সালমার বিষয়েও একই ব্যাপার ঘটেছে। তার উপর সৃষ্টি করা মানসিক চাপ সে নিজস্ব ডিফেন্স ম্যাকানিজমের মাধ্যমে প্রতিহত করছে! আমি প্রতিদিনের পর্যবেক্ষণ লিখে যাচ্ছি।

১৮.৪.৮০

সালমাকে প্রথম সংগ্রহ করা হল। সংগ্ৰহ পদ্ধতি অবান্তর বলে উল্লেখ করছি না। বাবা-মা-ভাই-বোন ছেড়ে হঠাৎ এই নতুন জায়গায় উপস্থিত হয়ে সে প্রথমে খুবই ঘাবড়ে গেল। আমি অতি দ্রুত তাঁর ভয় দূর করলাম। তাকে বলা হল আমি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তার বাবা মাকে খুঁজে বের করে তাকে তাদের কাছে পাঠাব। মেয়েটি মিশুক প্রকৃতির। প্রাথমিক শঙ্কা ও ভয় সে দ্রুত কাটিয়ে উঠল। রাতে অনেকক্ষণ তার সঙ্গে গল্প করলাম। পড়াশোনার খোঁজ নিলাম। সে জানাল যে তার ভীতির বিষয় একটাই তা হল অংক। তার ধারণা সে এস.এস.সি.-তে সব বিষয়ে পাস করলেও অংকে ফেল করবে। আমি তার অংক ভীতি কাটানোর জন্যে অংক নিয়ে কিছুক্ষণ গল্প করলাম। নয় সংখ্যাটির অদ্ভুত গুণ ব্যাখ্যা করলাম। যেমন ৯ এমন একটা সংখ্যা যাকে যে কোনো সংখ্যা দিয়ে গুণ করলে এবং গুণফলের সাথে সংখ্যাগুলিকে যোগ করলে আবার ৯ হয়।

৯X৬=৫৪; ৫+৪=৯
৯X১৬=১৪৪; ১+৪+৪=৯

সালমা এতে খুবই মজা পেল। নিজেই ব্যাপারটা পরীক্ষা করল। এবং জানতে চাইল-৯-এর বেলায় এরকম কেন হচ্ছে? বোঝা যাচ্ছে মেয়েটির বুদ্ধি ভালো। অল্প বুদ্ধির মেয়ে অংকের এই ব্যাপারটা ধরতে পারত না।

১৯.৪.৮০

আজ সালমার উপর প্রথম মানসিক চাপ সৃষ্টি করা হল। আমি তার কাছে জানতে চাইলাম। সে কুমারী কি না। প্রথম কিছুক্ষণ প্রশ্নটা সে ধরতেই পারল না। তাকে কুমারী বলতে কী বোঝাচ্ছে তা ব্যাখ্যা করার পর সে হতভম্ব হয়ে গেল। সে কল্পনাও করে নি এ ধরনের কোনো প্রশ্ন আমি তাকে করতে পারি। সে কান্নাকাটি শুরু করে দিল। আমি কঠিন ধমক দিয়ে তার কান্না থামিয়ে খুবই শান্ত গলায় বললাম যে তাকে এখানে আনা হয়েছে গৌর কালীর মন্দিরে দেবীর উদ্দেশে বলি দেওয়ার জন্যে। বলিদানের জন্যে কুমারী মেয়ে প্রয়োজন বলেই জিজ্ঞেস করা হচ্ছে।

তাকে দেবীমূর্তি দেখিয়েও আনলাম। সে জানতে চাইল কবে বলি দেওয়া হবে। আমি বললাম অমাবস্যায়। মেয়েটি সারারাত অচেতনের মতো পড়ে রইল। তার শরীরের উত্তাপ বাড়ল। রাতে ভুল বকতে থাকল।

২০.৪.৮০

সকালবেলা মেয়েটা আমার সঙ্গে খুবই স্বাভাবিক ব্যবহার করল এবং ভীত গলায় বলল-গত রাতে সে ভয়ঙ্কর একটা দুঃস্বপ্ন দেখেছে। দুঃস্বপ্নে একজন কেউ তাকে এসে বলেছে যে তাকে মা কালীর কাছে বলি দেওয়া হবে। মেয়েটা কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, চাচা এমন একটা ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্ন কেন দেখলাম?

মেয়েটির নিজস্ব ডিফেন্স ম্যাকানিজম কাজ করতে শুরু করেছে। তার মস্তিষ্ক তাকে নিশ্চিতভাবে বুঝিয়েছে কাল রাতের ঘটনাটা দুঃস্বপ্ন ছাড়া কিছুই না।

দুঃস্বপ্ন দেখে ভয় পাওয়া যেতে পারে, তবে দুঃস্বপ্ন কেটে গেলে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। তার সময়টা স্বপ্ন এবং জাগরণী—এই দুইয়ের ভেতর ভাগ করে নিল। যখনই সে ভয় পাচ্ছে তখনি ভাবছে এটা স্বপ্ন, কিছুক্ষণের মধ্যে স্বপ্ন কেটে যাবে এবং সব স্বাভাবিক হয়ে যাবে।

২১.৪.৮০

আজ সালমাকে রাতে থাকতে দেওয়া হল মন্দিরে। মন্দিরে সামান্য আলোর ব্যবস্থা রাখা হল। গাঢ় অন্ধকারে মানুষ ভয় পায় না। ভয় পাবার জন্যে আলো-আঁধার প্রয়োজন। কুকুর তিনটা মন্দিরের চারপাশে যেন ঘুরপাক খায় সেই ব্যবস্থা করা হল। মন্দিরের মূল দরজা খোলা। আমার দেখার ইচ্ছা মেয়েটি কী করে। সে তেমন কিছু করল না। সারারাত মূর্তির গা ঘেঁষে বসে রইল। মাঝে মাঝে দেখছি তার ঠোঁট নড়ছে। সে হয়তো কথা বলছে মূর্তির সঙ্গে। আমার ধারণা মূর্তিটাকে সে ভয়ঙ্কর হিসেবে না নিয়ে বন্ধু হিসেবে নিয়েছে। কারণ মূর্তিটা দেখতে লিলির মতো। সালমা লিলিকে চেনে! মূর্তির গা ঘেঁষে বসে থাকার এই একটিই যুক্তি। তাকে অবিশ্যি অমাবস্যা কবে তা জানানো হয়েছে। অমাবস্যার মধ্যরাতে ঘটনা ঘটানো হবে তাও বলা হয়েছে। জেমস হাউলারের বিখ্যাত পরীক্ষার মতো পরীক্ষা। তার পরীক্ষার বাক্সে পানি জমতে শুরু করেছে। আমার পরীক্ষায় অমাবস্যা এগিয়ে আসছে। হা হা হা।

মিসির আলি খাতা বন্ধ করলেন। তাঁর মাথায় সূক্ষ্ম যন্ত্রণা হচ্ছে। তিনি স্পষ্ট বুঝতে পারছেন সালমা নামের মেয়েটি আজ রাতেই মহাবিপদে পড়তে যাচ্ছে। সুলতান তার বিখ্যাত পরীক্ষা সালমাকে নিয়ে করছে না। সে পরীক্ষাটি করছে মিসির আলি নামের একজনকে নিয়ে যাকে সে মানসিকভাবে নিজের কাছাকাছি ভাবছে। মিসির আলি মোটামুটি নিশ্চিত যে সুলতান মধ্যরাতে এই হত্যাকাণ্ডটি ঘটাবে তাকে ভয় দেখানোর জন্যে। বাচ্চা একটি মেয়ের মানসিক পরিবর্তন নিয়ে তার কোনো মাথাব্যথা নেই। সালমা মেয়েটি তার সাবজেক্ট না। তার সাবজেক্ট মিসির আলি। মেয়েটির মৃত্যুতে তার কিছু যায় আসে না। তার আগ্রহ কৌতূহল মিসির আলিকে নিয়ে। যে কারণে সালমা মেয়েটিকে যোগাড় করার পরই মিসির আলি নামের মানুষটাকে এখানে আনার জন্যে ব্যবস্থা করেছে। সুলতানের মতো মানুষেরা একটা পৰ্যায়ে বুদ্ধির খেলা খেলতে চায়। আমিই শ্ৰেষ্ঠ এটা প্রমাণ করার জন্যে ব্যস্ত হয়ে ওঠে। এটা তাদের একটা খেলা। শিশুদের সঙ্গে সিরিয়াল কিলারদের কোথায় যেন সামান্য মিল আছে। শিশুদের কাছে যেমন সবই খেলা এদের কাছেও তাই।

সালমা মেয়েটিকে রক্ষা করার কোনো উপায় কি আছে? খুব ঠাণ্ডা মাথায় ভাবতে হবে এবং অতি দ্রুত ভাবতে হবে। হাতে সময় খুব বেশি নেই। সুলতানের সঙ্গে প্রত্যক্ষ যুদ্ধে তিনি নামতে পারছেন না। মানসিক যুদ্ধ অবশ্যই করা যাবে কিন্তু তার জন্যে প্রয়োজনীয় অস্ত্ৰ কি তার কাছে আছে?

সুলতানের বিষয় অংক। কাজেই যুক্তি ব্যাপারটা তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ হবার কথা। যুক্তির ক্ষমতার প্রতি তার আস্থা অবশ্যই থাকবে। সুলতানের মানসিক দুর্গে তাকে পৌঁছতে হবে যুক্তির সিঁড়িতে পা রেখে। এমন যুক্তি যা সুলতানকে গ্রহণ করতে হবে। তিনি কি পারবেন? মিসির আলি চোখ বন্ধ করে আছেন। নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করছেন। পারছেন না। তিনি অনুভব করলেন তাঁর শরীর কাঁপছে। এটা ভালো লক্ষণ না। এটা বয়সের লক্ষণ। জরার লক্ষণ।

‘দিধ্বং নো অত জরসে নিনেষজ্‌
জরা মৃত্যুবে পরি নো দদাত্যথ
পক্কেন সহ সংভবেম’

আমার ভাগ্য আমাকে নিয়ে যাবে জরায়, জরা নিয়ে যাবে সেই মৃত্যুতে যা আমাকে অসীমের সঙ্গে যুক্ত করবে।

মিসির আলির ঘুম পাচ্ছে। তিনি বিছানায় লম্বা হয়ে শুয়ে পড়লেন। তার শীত লাগছে। শীতে গায়ে কাঁটা দিচ্ছে। তিনি গায়ের উপর চাঁদ র টেনে দিলেন। তিনি কিছুক্ষণ ঘুমূবেন। মধ্যরাতের আগেই সুলতান নিশ্চয়ই তীকে ডেকে নিয়ে যাবে। হয়তো তখনি সালমার সঙ্গে দেখা হবে। হত্যাকাণ্ডটা যে খুব সহজ হবে তাও মনে হয় না। সুলতানের মতো মানুষেরা ড্রামা পছন্দ করে। হয়তো মেয়েটাকে স্নান করানো হবে। নতুন কাপড় পরানো হবে। গলায় দেওয়া হবে জবা ফুলের মালা। এই ফুল প্রাচীন ভারতের অনেক নারীরক্তের সাক্ষী। ঘুমের মধ্যে মিসির আলি বিড়বিড় করে বললেন, সালমা মাগো, ভয় পেও না। আমি আছি তোমার পাশে। আমি সাধারণ কেউ না মা, আমি মিসির আলি।

সুলতান মরিচ ফুল গাছের বেদিতে বসে আছে। তার সামনে হারিকেন। হারিকেনের আলোয় সুলতানের মুখ দেখা যাচ্ছে। আনন্দময় মানুষের মুখ। সে হাত দিয়ে মাথার চুল টানছে। কিন্তু তাতে কোনো অস্থিরতা প্রকাশ পাচ্ছে না। সুলতানের সামনে দুটা পিরিচে ঢাকা কফির মগ। মিসির আলি এসে বেদিতে বসলেন!। সুলতান কফির মগ মিসির আলির হাতে এগিয়ে দিতে দিতে বলল, আমি এর মধ্যে দুবার খোঁজ নিয়েছিলাম! দেখলাম। আপনি ঘুমাচ্ছেন। স্যার আপনার ঘুম কি ভালো হয়েছে?

হ্যাঁ ভালো হয়েছে।

সুলতান হাসিমুখে বলল, এমন পরিস্থিতিতে কেউ ঘুমুতে পারে আমার ধারণা ছিল না।

মিসির আলি বললেন, পরিস্থিতি কি খুব খারাপ?

খারাপ তো বটেই, আজ অমাবস্যা না? আমি সালমা মেয়েটার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছি। ও আসলে আমার পরীক্ষায় কোনো কাজে আসছে না। তাকে তো আর ফেরতও পাঠাতে পারি না। এই রিস্ক আমার পক্ষে নেওয়া সম্ভব না। কাজেই অন্য ব্যবস্থা নিতে হচ্ছে। কফি খেতে কেমন হয়েছে?

ভালো হয়েছে।

সালমা মেয়েটির সঙ্গে কি কথা বলবেন?

না।

না কেন?

মিসির আলি জবাব দিলেন না। কফির মাগে চুমুক দিতে লাগলেন। একবার তাকালেন মরিচ ফুল গাছটার দিকে। গাছ ভর্তি জোনার্কি। জুলছে, নিভছে। এত সুন্দর লাগছে দেখতে যে তিনি চোখ ফেরাতে পারছেন না।

স্যার কী দেখছেন?

জোনাকি। অনেকদিন পর জোনাকি দেখলাম। অপূর্ব দৃশ্য! মনে হচ্ছে আকাশের সব তারা গাছে নেমে এসেছে।

সুলতান সিগারেট ধরাতে ধরাতে বলল, আপনি জোনাকি দেখে অভিভূত হচ্ছেন, মেয়েটিকে রক্ষা কীভাবে করা যায়। এই বিষয়ে ভাবছেন না?

ভাবছি। কোনো কিছুর দিকে তাকিয়ে থেকে অন্য কিছু ভাবা সহজ।

ভেবে কিছু পেয়েছেন?

হ্যাঁ।

কী পেয়েছেন? আচ্ছা আমিই বলি আপনি কী পেয়েছেন–আপনি ঠিক করেছেন যুক্তি দিয়ে আমার সিদ্ধান্ত বদলাবেন। আপনার বুলিতে যেসব ধারালো যুক্তি আছে তার সব একের পর এক করবেন। সক্রেটিসের বিখ্যাত যুক্তিটা দিতে পারেন। সক্রেটিস বলেছেন, কোনো মানুষই জেনেশুনে মন্দ কাজ করে না।

মিসির আলি সহজ গলায় বললেন, এইসব যুক্তি তোমার বেলায় খাটবে না। তোমাকে যা করতে হবে তা হল—তোমার মনের ভেতরে, চেতনার গভীরে যে ভয় বাস করছে তাকে বের করে আনা।

সুলতান শীতল গলায় বলল, আমার ভেতরে ভয় বাস করছে? কীসের ভয়?

মিসির আলি বললেন, কুয়ার ভয়। গৌর কালীমূর্তি এসে স্বপ্নে তোমাকে বলে গেল কখনো যেন কুয়ার পাশে না যাও। কুয়াতে ভয়ঙ্কর কিছু তোমার জন্যে অপেক্ষা করছে। গৌর কালী বলে তো কিছু নেই। তোমার অবচেতন মন গৌর কালীকে সৃষ্টি করেছিল। সেই অবচেতন মনই ভয়টাকেও সৃষ্টি করেছে। সেই ভয় বাস করছে কুয়ার ভেতরে। আমি যুক্তি দিয়ে কথা বলছি তুমি কি যুক্তিগুলি বুঝতে পারছ?

পারছি।

কুয়ার পাশে যেই মুহুর্তে তুমি দাঁড়াবে প্রবল ভয় তোমাকে সম্পূর্ণ গ্ৰাস করবে। অবচেতন মন তোমাকে ভয়ঙ্কর কিছু দেখাবে। কী দেখবে আমি জানি—হয়তো দেখবে কুয়ার গা বেয়ে ইদারিশ মাস্টার উঠে আসছে। তাকে দেখাচ্ছে একটা কুৎসিত মাকড়সার মতো। কিংবা এর চেয়েও ভয়ঙ্কর কিছু দেখাবে।

সুলতান হাতের সিগারেট ফেলে দিয়ে শান্ত গলায় বলল, আপনি যা বলছেন ঠিক আছে। আমি সেটা জানি। জানি বলেই কখনো কুয়ার পাশে যাই না। কারো পক্ষেই আমাকে কুয়ার পাশে নিয়ে যাওয়া সম্ভব না।

তোমার কাছে চলে আসবে। তুমি বসে আছ বেদিতে, তুমি দেখবে কুয়া ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে তোমার দিকে।

সুলতান তীক্ষ্ণ গলায় বলল, তার মানে?

মিসির আলি বললেন, তুমি আকাশের তারা দেখ—এই ব্যাপারটি তুমি সবচেয়ে ভালো বুঝবে। আকাশের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলে মনে হয় না আকাশের তারা নিচে নেমে আসছে। অনেকটা সে রকম। দৃষ্টি বিভ্রম। কুয়া থাকবে কুয়ার জায়গায় অথচ তোমার মনে হবে কুয়া জীবন্ত প্রাণীর মতো এগিয়ে আসছে।

সুলতান চাপা গলায় বলল, আপনি আমার সঙ্গে একটা ট্রিকস করার চেষ্টা করছেন। মিসির আলি বললেন, হ্যাঁ করছি। তোমার মনের গভীরে ঘাপটি মেরে বসে থাকা ভয়টাকে বের করে এনেছি। ভয়ে তোমার চেতনা যখন অসাড় হয়ে এসেছে তখন বলেছি কুয়া এগিয়ে আসছে। তোমার অবচেতন মন তা গ্ৰহণ করেছে। একে সাইকোলজির ভাষায় বলে induced hallucination. তোমার চোখ মুখ দেখে বুঝতে পারছি তুমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছ কুয়া তোমার দিকে এগিয়ে আসছে। তোমার মনও আমাকে খানিকটা সাহায্য করেছে। এই কুয়াটার প্রতি তোমার তীব্র আকর্ষণ। তুমি সব সময় তার কাছে যেতে চেয়েছ। কিছুক্ষণের ভেতর কুয়াটাকে তুমি তোমার সামনে এসে দাঁড়াতে দেখবে। তোমার ইচ্ছা করবে না, তারপরেও তুমি উঁকি দেবে—এবং যে ভয় তুমি পাবে সেই ভয়ের জন্ম এই পৃথিবীতে নয়। অন্য কোনো জগতে।

সুলতান চিৎকার করে উঠল, স্টপ, প্লিজ স্টপ। স্টপ ইট প্লিজ।

সুলতান বিকৃত গলায় চেচাচ্ছে। তার মুখ দিয়ে ফেনা বের হতে শুরু করেছে। ছুটে এসেছে লিলি। কিছুদূর এসেই সে থমকে দাঁড়িয়ে গেল। সুলতান চিৎকার করেই যাচ্ছে। সে থরথর করে কাঁপছে। সে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মরিচ ফুলের গাছের বেদির দিকে। ভয়ঙ্কর কিছু সে অবশ্যই দেখতে পাচ্ছে।

মিসির আলি শান্ত ভঙ্গিতে সিগারেট ধরালেন। এগিয়ে গেলেন মন্দিরের দিকে। সালমা মেয়েটি নিশ্চয়ই মন্দিরে আছে। বেচারি হয়তো ভয়েই মরে যাচ্ছে! তাঁর ভয়টা কাটানো দরকার।

সালমা মূর্তির আড়ালে গুটিসুটি মেরে বসে ছিল। মিসির আলিকে দেখে সে চোখ বড় বড় করে তাকাল। মিসির আলি কোমল গলায় বললেন, কেমন আছ গো মা? মেয়েটা জবাব দিল না। তার চোখ ভর্তি হয়ে গেল পানিতে।

মিসির আলি বললেন, আমার ছোট্ট মায়ের চোখে পানি কেন? কাছে এস চোখ মুছিয়ে দেই। এস জোনাকি পোকা দেখি। আমি আমার জীবনে এক সঙ্গে এত জোনাকি দেখি নি।

(সমাপ্ত)

Anuprerona
Anupreronahttps://www.anuperona.com
Read your favourite literature free forever on our blogging platform.
RELATED ARTICLES

Most Popular

Recent Comments