ভূমিকা
ছোটো থেকে সবসময় চাইতাম, সবাই আমাকে ভালোবাসুক, কেউ অপছন্দ না করুক; অনেক অনেক মানুষ আমাকে ভালোবাসুক। কিন্তু জানতাম না, কীভাবে ভালোবাসা পেতে হয়!
.
তখন সবেমাত্র এসএসসি দিয়েছি।
স্কুলের একটা ছোট ঘটনাকে ঘিরে মানসিক ট্রমায় ছিলাম। তখন হঠাৎ জানতে পারি সোশ্যাল মিডিয়ায় গল্প-উপন্যাস লেখা যায়। ফেসবুকে লেখা যায় শুনে অতিরিক্ত ভাবনা থেকে বাঁচার জন্য সময় কাটাতে একটা ছোট গল্প লিখি। সেখানে পরিচিত কয়জন ভালো মন্তব্য করে, উৎসাহিত করে। অনুপ্রাণিত হয়ে একটা ত্রিশ পর্বের থ্রিলার গল্প লিখি। গল্পটি লিখতে গিয়ে মানসিক চাপ থেকে মুক্ত হই। চরিত্রদের নিয়ে ভেবেই কূল পাই না, আবার অন্যকিছু ভাবব কখন?
তখন ফেসবুকে রোমান্টিক গল্প লেখার ট্রেন্ড ছিল। আমিও ট্রেন্ডে ভেসে দুটি রোমান্টিক গল্প লিখি।
লিখতে গিয়ে নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার করি।
ভাবি, আর ট্রেন্ড নয়! এইবার নিজের মতো লিখব। সেই ভাবনা থেকেই সৃষ্ট ‘পদ্মজা।’
পদ্মজা লিখতে গিয়ে প্রচুর সাড়া পেতে থাকি। প্রতিদিন সন্ধ্যায় নতুন পর্ব পোস্ট করতেই পাঠকদের হই-হুল্লোর লেগে যেত। আমার প্রাইভেট গ্রুপে (Elma’s manuscript’s) প্রতিদিন চলত পাঠকদের আগাম ধারণার পোস্ট।
তারপর কী হবে? সেটা নিয়ে তাদের মধ্যে হতো প্রচুর আলোচনা। একদিন পৰ্ব না দিলে কমেন্টবক্স, ইনবক্স, গ্রুপ ভেসে যেত পাঠকদের অনুরোধ এবং হুমকিতে।
তখন আমি ছিলাম ষোড়শী কিশোরী, কলেজে ভর্তি হয়েছি কিন্তু করোনা থাকায় কলেজে যেতে হতো না। তাই সারাক্ষণ পদ্মজা ও পাঠকদের নিয়ে মেতে থাকতাম।
আমার কাছে সোনালি দিন মানে পদ্মজা লেখার মুহূর্তগুলো। আমি বারবার বহুবার সেই দিনগুলোতে ফিরে যেতে চাইব।
পদ্মজায় আমি কী লিখেছি, কতটা ভালো অথবা খারাপ লিখেছি তা জানি না। শুধু জানি, এই উপন্যাস আমাকে বিশাল পাঠকসমাজ উপহার দিয়েছে। আমার ছোটোবেলার সেই কাঙ্ক্ষিত ‘অনেক মানুষের ভালোবাসা’ অর্জন করতে সাহায্য করেছে। যখন বাস্তব জীবনের বেড়াজালে পড়ে শ্বাস নিতে কষ্ট হয় আমি এই পাঠক সমাবেশে নিঃশ্বাস নিতে আসি।
আমি ব্যাকরণ জানি না,
আমি সাহিত্যের সব গণ্ডি চিনি না,
বুঝি না কীভাবে টিকে থাকতে হয়,
শুধু উপলব্ধি করি, মাঝেমধ্যে আমার মাথার ভেতর অনেক চরিত্র, কাহিনি কিলবিল করে। সেই অসহ্যরকম যন্ত্রণা থেকে বাঁচতে আমি তাদের নিয়ে লিখতে শুরু করি। মন যেভাবে চায় সেভাবে লিখি। কোনো নিয়ম মানি না।
নিয়ম-নীতিবিহীন একটি লেখাকে বইরূপে পাবার জন্য পাঠকদের প্রতিদিনকার আবদার আমাকে প্রতিনিয়ত বিস্মিত করেছে। পদ্মজা লেখার সময় ঘুণাক্ষরেও ভাবিনি, কখনো পদ্মজা বই হবে। এরকম একটা ভাবনা অসম্ভবের মতো ছিল। আজ পদ্মজার বইরূপে আসার একমাত্র কারণ পাঠকরা। পদ্মজা উপন্যাসের জন্ম আমার জন্য হলেও পদ্মজা বইয়ের জন্ম পাঠকদের জন্য। তাদের আবদারে, তাদের অনুরোধে পদ্মজা বইয়ে পরিণত হয়েছে।
যারা বইটি সংগ্রহ করবে বেশির ভাগই এরই মধ্যে সোশ্যাল মিডিয়ায় উপন্যাসটি পড়ে ফেলেছে। শুধু ভালোলাগা থেকে বইটি সংগ্রহ করতে আগ্রহী! তাদের প্রতি আমার এক আকাশ ভালোবাসা এবং ভালোবাসা দেয়ার জন্য কৃতজ্ঞতা।
ইলমা বেহরোজ
উপশহর, সিলেট
পদ্মজা – ১
দরদর করে ঘামছে ফাহিমা। ক্লান্তিতে শরীর ভেঙে পড়ার উপক্রম। কপালের বিন্দু বিন্দু ঘাম হাতের তালু দিয়ে মুছে শীর্ণ পায়ে হেঁটে একটা চেয়ার টেনে বসতেই তার হাত থেকে লাঠি পড়ে মেঝেতে মৃদু শব্দ তুলল। লাঠি তোলার আগ্রহ কিংবা শক্তি কোনোটাই পেল না সে, চেয়ারে ভার ছেড়ে দিয়ে চোখ বুজল।
ফাহিমার অত্যন্ত দক্ষ হাত, শক্তিশালী বাহু। পুরুষের মতো উচ্চতা তার। জিজ্ঞাসাবাদের দায়িত্ব পালনে সে শতভাগ সফল। আসামির মুখ থেকে কথা বের করতে যেকোনো কিছু করতে বদ্ধপরিকর সে। বড় বড় রাঘব বোয়ালরাও তার সামনে টিকতে পারে না। অপরাধীরা তার হাত থেকে বাঁচার জন্য ভেতরের সব কথা উগড়ে দেয়নি এমন ঘটনা কখনো ঘটেনি। অথচ আজ পাঁচদিন দিন যাবৎ এক অল্প বয়সী মেয়ে তার হেফাজতে থাকা সত্ত্বেও মুখ দিয়ে টু শব্দটিও করেনি। শারীরিক, মানসিক-কোনো নির্যাতন বাকি রাখা হয়নি তবুও তার আর্তনাদ কেউ শুনতে পায়নি! যেন একটা পাথরকে লাগাতার পেটানো হচ্ছে, যার জীবন নেই, ব্যথা নেই; একটি জড়বস্তু মাত্র! এই পাথরের রক্ত ঝরে, কিন্তু জবান খোলে না।
ফাহিমা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে চাপা আক্রোশ নিয়ে মেয়েটিকে শাসাল, ‘শেষবারের মতো বলছি, মুখ খোল।’
মেয়েটি তার থেকে দুই হাত দূরে চেয়ারে বাঁধা অবস্থায় ঝিমুচ্ছে। এক মিনিট… দুই মিনিট করে দশ মিনিট পার হয়ে গেল কিন্তু মেয়েটির থেকে কোনো জবাব এলো না। ফাহিমা হতাশাবোধ করছে। চারপাশে থমথমে নীরবতা, মেয়েটি কি নিঃশ্বাসও নেয় না?
নীরবতা ভেঙে যায় বুটের ঠকঠক শব্দে। উপস্থিত হয় ইন্সপেক্টর তুষার। তাকে দেখেই ফাহিমা উঠে দাঁড়ায়, স্যালুট করে।
তুষার পেশাদারী কণ্ঠে প্রশ্ন করে, ‘কী অবস্থা?’
ফাহিমা নিজের ব্যর্থতা প্রকাশ করার সঙ্গে চারদিনের বর্ণনা দেয় পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে। তুষার বহুদর্শী চোখে মেয়েটিকে দেখল তার চারপাশে ঘুরতে ঘুরতে ফাহিমাকে বলল, ‘আপনি আসুন।’
রিমান্ডে আসামিকে বিভিন্ন নির্যাতনের মাধ্যমে জিজ্ঞাসাবাদ করার ব্যাপারটা ফাহিমার কাছে ভীষণ উপভোগ্য। কিন্তু এই প্রথম সে কোনো দায়িত্ব থেকে পালাতে চাচ্ছে। ফাহিমা হাঁফ ছেড়ে বেরিয়ে যায়।
তুষার একটি চেয়ার টেনে মেয়েটির সম্মুখ বরাবর বসে। ঠান্ডা গলায় বলে, ‘আজই আমাদের প্রথম দেখা।’
সামনের মানুষটা যেভাবে ছিল সেভাবেই রইল। কিছু বলল না, তাকালও না।
তুষার বলল, ‘মা-বাবাকে মনে পড়ে?’
মা-বাবা শব্দ দুটি যেন নিস্তব্ধ তীড়ে সমুদ্রের ঢেউ নিয়ে আসে। মেয়েটি নড়ে উঠে, চোখ তুলে তাকায়। তার অপূর্ব গায়ের রং, ঘোলাটে চোখ। কাটা ঠোঁট থেকে রক্ত ঝরছে। চোখের চারপাশে গাঢ় কালো দাগ। এ নতুন নয়, মুখের এমন দশা রিমান্ডে আসা সব আসামিরই হয়।
তুষার মুখের প্রকাশভঙ্গী আগের অবস্থানে রেখে পুনরায় প্রশ্ন করল, ‘মা-বাবাকে মনে পড়ে?’
মেয়েটি বাধ্যের মতো মাথা নাড়ায়। মনে পড়ে। তুষার কিছুটা ঝুঁকে এলো।
মেয়েটির দৃষ্টিজুড়ে নীলচে যন্ত্রণা। তুষার তার হাতের বাঁধন খুলে দিয়ে নির্বিকার ভঙ্গিতে প্রশ্ন ছুঁড়ল, ‘নাম কী?’
মেয়েটির নাম সহ খুঁটিনাটি সবই জানে তুষার, তবুও জিজ্ঞাসা করল। তার মনে হচ্ছে, অপর পক্ষ থেকে উত্তর আসবে।
তার ধারণাকে সত্য প্রমাণ করতে ভারাক্রান্ত কণ্ঠে মেয়েটি নিজের নাম উচ্চারণ করল, ‘পদ্ম…আমি…আমি পদ্মজা।’
পদ্মজা চৈতন্য হারিয়ে হেলে পড়ে তুষারের ওপর। তুষার দ্রুত তাকে বাহুডোরে আটকে ফেলল। উঁচু কণ্ঠে ফাহিমাকে ডাকল, ‘ফাহিমা, দ্রুত আসুন।’
.
১৯৮৯ সাল।
সকাল সকাল রশিদ ঘটকের আগমনে হেমলতা বিরক্ত হোন। তিনি বহুবার পইপই করে বলেছেন, ‘পদ্মর বিয়ে আমি এখনি দেব না। পদ্মকে অনেক পড়াব।’
তবুও রশিদউদ্দিন প্রতি সপ্তাহে নতুন নতুন প্রস্তাব নিয়ে আসে। হেমলতার কথা হচ্ছে, মেয়ের বয়স আর কতই হলো? মাত্র ষোল। শামসুল আলমের মেয়ের বিয়ে হয়েছে চব্বিশ বছর বয়সে। পদ্মর বিয়েও তখনি হবে, ওর পছন্দমতো।
হেমলতা রশিদকে দেখেও না দেখার ভান ধরে মুরগির খোয়াড়ের দরজা খুলে দিলেন। রশিদ এক দলা থুথু উঠানে ফেলে হেমলতার উদ্দেশ্যে বলল, ‘বুঝছ পদ্মর মা, এইবার যে পাত্র আনছি এক্কেরে খাঁটি হীরা।’
হেমলতা বিরক্ত ভরা কণ্ঠে জবাব দিলেন, ‘আমি কি আমার মেয়ের জন্য আপনার কাছে পাত্র চেয়েছি? তবুও বার বার কেন এসে বিরক্ত করেন?
রশিদউদ্দিন হার মানার লোক নয়, সে হেমলতাকে বুঝানোর চেষ্টা করল, যুবতী মাইয়া ঘরে রাহন ভালা না। কখন কী হইয়া যাইব টের পাইবা না।’
‘মেয়েটা তো আমার। আমাকেই বুঝতে দেন?’ রশিদউদ্দিনের উপস্থিতি যে তিনি নিতে পারছেন না তা স্পষ্ট। তবুও রশিদ নির্লজ্জের মতো নানা কথায় তাকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করল কিন্তু সুবিধা করতে পারল না। ব্যর্থ থমথমে মুখ নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল।
প্রতিদিন কোনো না কোনো পাত্রপক্ষ এসে হাতে টাকা গুঁজে দিয়ে বলবে, ‘মোর্শেদের বড় ছেড়িডারে চাই।’
সব পাত্র যদি এই এক মেয়েকেই চায় তাহলে তার কী করার? তাকেও তো টাকাপয়সা কামাতে হবে!
রশিদ গজগজ করতে করতে আওড়ায়, ‘গেরামে কি আর ছেড়ি নাই? একটা ছেড়িরেই ক্যান সবার চোক্ষে পড়তে হইব?’ কথা শেষ করেই সে এ দলা থুতু ফেলল সড়কে।
রোদ উঠতে না উঠতেই মেঘে মেঘে ছেয়ে গেছে আকাশ, কিছুক্ষণের মধ্যে বৃষ্টি হবে। বছরের এই সময়ে এভাবেই রোদ-বৃষ্টির খেলা চলে। বর্ষায় একদম স্কুলে যেতে ইচ্ছে করে না পূর্ণার। শুধু মারের ভয়ে যেতে হয়। সে মুখ কালো করে স্কুলের জামা পরে পদ্মজাকে ডাকল, ‘আপা? এই আপা? স্কুলে যাবা না? আপারে।’
পদ্মজা পিটপিট করে চোখ খুলে কোনোমতে বলল, ‘না। যাব না।’ পর পরই চোখ বুজে তলিয়ে গেল গভীর ঘুমে। পূর্ণা নিরাশ হয়ে হেমলতার ঘরে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘আম্মা, আপা কি স্কুলে যাইব না?’
হেমলতা বিছানা ঝাড়ছিলেন। হাত থামিয়ে পূর্ণার দিকে কড়াচোখে তাকিয়ে বললেন, ‘যাইব কি? যাবে বলবি। বল, যাবে।’
পূর্ণা মাথা নত করে বলল, ‘যাবে।’
হেমলতা বললেন, ‘তোদের পড়াশোনা করাচ্ছি আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলার জন্য নয়। বইয়ের ভাষায় কথা বলবি।’ পূর্ণা মাথা নত করে রেখেছে। তা দেখে হেমলতা সন্তুষ্ট হোন। তার মেয়েগুলো মায়ের খুবই অনুগত।
তিনি পুনরায় বিছানা ঝাড়তে ঝাড়তে বললেন, পদ্মর শরীর ভালো না। সারারাত পেটে ব্যাথায় কেঁদেছে। থাকুক, আজ ঘুমাক।’
পূর্ণার সদ্য পা দেয়া কিশোরী মন চট করে বুঝে যায় পদ্মজা কীসের ব্যাথায় কেঁদেছে। সে গতকাল রাতে নানাবাড়ি ছিল বলে জানত না। ভোরেই চলে এসেছে। নানাবাড়ি কাছে, হেঁটে যেতে পাঁচ মিনিটও লাগে না।
পূর্ণাকে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে হেমলতা বললেন, ‘তুই যা। মাথা নিচু করে যাবি মাথা নিচু করে আসবি। কোনো অভিযোগ যেন না শুনি।’
‘আচ্ছা আম্মা।’
পূর্ণা ঘরে এসে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে থাকে। সবাই বলে তার চুল নাকি খুব সুন্দর। কিন্তু সে নিজেকে পুরোটাই সুন্দর মনে করে। গায়ের রং কালো হতে পারে তবে সে কখনোই সেজন্য নিজেকে অসুন্দরভাবে না। পূর্ণার ইদানীং খুব সাজতে ইচ্ছে করে। কিন্তু হেমলতা সাজগোজ পছন্দ করেন না। তাই সে সতর্ক দৃষ্টিতে মায়ের উপস্থিতি একবার দেখে নিলো। আশপাশে নেই! পূর্ণা দ্রুত গত মাসে মেলা থেকে আনা লাল লিপস্টিক গাঢ় করে ঠোঁটে মাখল। এখন হেমলতা দেখার আগে এক ছুটে বেরিয়ে যাবে।
ঘড়ির কাঁটায় সকাল দশটা বাজল। এখনো পদ্মজা ওঠেনি। হেমলতা শব্দহীন পায়ে মেয়েদের ঘরে প্রবেশ করেন। বিশাল বড় বিছানায় পদ্মজা দুই হাত ভাঁজ করে ঘুমাচ্ছে। জানালার পর্দা ভেদ করে আসা আলতো পেলব রোদ্দুরের স্পর্শে পদ্মজার মসৃণ পাতলা ঠোঁট, ফরসা ত্বক চিকচিক করছে। হেমলতা বিসমিল্লাহ বলে দ্রুত পদ্মজার গায়ে তিনবার ফুঁ দিলেন। গুরুজনরা বলে, মায়ের নজর ভালো না। এতে সন্তানের ক্ষতি হয়। তাই সঙ্গে সঙ্গে নজর কাটাতে বিসমিল্লাহ বলে ফুঁ দিয়ে দিলেন
হেমলতার মায়া লাগছে পদ্মজার ঘুম ভাঙাতে।
তবুও আদুরে গলায় ডাকলেন, ‘পদ্ম। এই পদ্ম।’
পদ্মজা চোখ খুলে মাকে দেখে হুড়মুড়িয়ে উঠে বসে। যেদিন ঘুম থেকে উঠতে দেরি হয় সেদিনই তাকে হেমলতা ডেকে তুলেন। পদ্মজা অপরাধী কণ্ঠে প্রশ্ন করল, ‘বেশি দেরি হয়ে গেছে আম্মা?’
হেমলতা হেসে বললেন, ‘না, মুখ ধুয়ে খেতে আয়।’
পদ্মজা দ্রুত কলপাড়ে গিয়ে দাঁত মেজে মুখ ধুয়ে নিল। হেমলতা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন। তার বাবা ছিল হাই স্কুলের শিক্ষক। তাই তার মধ্যে নিয়ম-নীতির প্রভাব বেশি। মেয়েদের শক্তপোক্ত নিয়মে বড় করছেন। নিয়মের মধ্যে সবকিছু হওয়া চাই।
পদ্মজা রান্নাঘরে ঢুকে দেখে স্টিলের প্লেটে খাবার সাজানো। হেমলতা রান্নাঘরে ঢুকতেই পদ্মজা দ্রুত ওড়না দিয়ে মাথা ঢেকে নিল।
এটি হেমলতার দেওয়া আরেকটি আদেশ, খাওয়ার সময় মাথা ঢেকে খেতে হবে। পদ্মজা খেতে বসতেই হেমলতা মেয়েকে সরল কণ্ঠে বললেন, মুখ ধুতে গিয়ে চুল ভিজিয়ে এসেছিস। খেয়ে রোদে বসে চুলটা শুকিয়ে নিস।’
‘আচ্ছা আম্মা।’ পরক্ষণেই বলল, ‘আম্মা, পূর্ণা, প্রেমা আসেনি?’
‘পূর্ণা স্কুলে। প্রেমা দুপুরে আসবে।’
‘আর আব্বা…আব্বা কবে আসবেন?’ মিনমিন করে বলল পদ্মজা।
এই প্রশ্নে হেমলতা থমকে দাঁড়ালেন। শুকনো গলায় জবাব দিলেন, ‘খাওয়ার সময় কথা বলতে নেই।
পদ্মজার চোখ দুটি জ্বলতে শুরু করে। তার জীবনে জন্মদাতা আছে কিন্তু জন্মদাতার আদর নেই। সে জানে না তার দোষটা কোথায়? কেন নিজের বাবা বাকি বোনদের আদর করলেও তাকে করে না? কথা অবধিও বলেন না। পদ্মজা বহুবার হেমলতাকে জিজ্ঞাসা করেছিল, ‘আমি কি তোমাদের সত্যিকারের মেয়ে আম্মা? নাকি সন্তান হয় না বলে কি দত্তক এনেছিলে? আব্বা কেন আমাকে এত অবহেলা করে? ও আম্মা…আম্মা বলো না?’
হেমলতা নিশ্চুপ থেকে অনেকক্ষণ পর জবাব দেন, ‘তুই আমার গর্ভের সন্তান। আর তোর বাবারই মেয়ে। এখন যা, পড়তে বস। অনেক পড়তে হবে তোর।’
ব্যাস এইটুকুই! যতবার প্রশ্ন করেছে একই উত্তর পেয়েছে। কখনো কোনো শব্দের নড়চড় হয়নি।
‘এত কী ভাবছিস? তাড়াতাড়ি খেয়ে উঠ।’
হেমলতার কথায় পদ্মজার ভাবনার সুতো ছিঁড়ে গেল। সে দ্রুত খাওয়া শেষ করে। হঠাৎ তার মনে পড়ে, আজ বড়ই আচার বানানোর কথা ছিল।
সন্ধ্যার পরপরই বিদ্যুৎ চলে যায়। কয়েক মাস হলো গ্রামে বিদ্যুৎ এসেছে। আট গ্রাম মিলিয়ে অলন্দপুর। তাদের গ্রামের নাম আটপাড়া। প্রতিদিন নিয়ম করে সন্ধ্যারাত থেকে তিন ঘণ্টা অন্ধকারে তলিয়ে থাকে গ্রাম। সারাদিন তো বিদ্যুৎ এর নামগন্ধও থাকে না। তাহলে বিদ্যুৎ দিয়ে লাভটা কী হলো? পদ্মজা, পূর্ণা, প্রেমা তিন বোন একসঙ্গে পড়তে বসে। হঠাৎ বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন হতেই মোড়ল বাড়ি অন্ধকারে তলিয়ে যায়। নয় বছরের প্রেমা খামচে ধরে পদ্মজার ওড়না। পদ্মজা মৃদু স্বরে ডাকল, ‘আম্মা…আম্মা।’
হেমলতা ভেতরের ঘর থেকে বললেন, ‘টর্চ নিয়ে যা।’
হেমলতার ডাকে পদ্মজা উঠে দাঁড়ায়। প্রেমা অন্ধকার খুব ভয় পায়। বড় বোনের ওড়না ছেড়ে পূর্ণার হাত চেপে ধরে। টর্চ নিয়ে ঘরে ঢোকার মুহূর্তে পদ্মজা গেইট খোলার আওয়াজ পায়। উঁকি দিয়ে দেখে হানিফ এসেছে। লোকটা সম্পর্কে তার সৎ মামা। হানিফকে দেখেই সে দৌড়ে ঘরে ঢুকে পড়ে।
হানিফ চেঁচিয়ে বলে, ‘বুবু, বাড়ি আন্ধার ক্যান! বাত্তি-টাত্তি জ্বালাও।’
‘হানিফ নাকি?’ হেমলতা হারিকেন হাতে বারান্দায় এসে দাঁড়ান। হানিফ দাঁত বের করে হাসল। বলল, ‘হ, আমি।’
‘আয়, ভেতরে আয়।’
হানিফ বারান্দা পেরিয়ে বড় ঘরে ঢুকে বলল, ‘তোমার ছেড়িগুলা কই?’
‘ঘরেই আছে, পড়াশোনা করে।’
‘এই আন্ধারেও পড়ে!’ অবাক হয়ে বলল হানিফ।
হেমলতা কিছু বললেন না। হানিফ এই বাড়িতে আসলে কোনো কারণ ছাড়াই অস্বস্তি হয় তার
তিনি প্রসঙ্গ এড়াতে বললেন, ‘ওদের খাওয়ার সময় হয়েছে। তুইও খেয়ে নে।
‘এইহানেই খামু? না তোমার সরাইখানাত যাইতে হইব?’
তার উচ্চারিত শেষ বাক্যে রসিকতা ছিল। গ্রামে থেকেও হেমলতা খাবারের জন্য আলাদা ঘর রেখেছে সেটা হানিফের কাছে রসিকতাই বটে!
হেমলতার স্বাভাবিক সুরে বললেন, ‘খেতে চাইলে খেতে আয়।’
পদ্মজা কিছুতেই রাতের খাবার খেতে আসল না। কেমন জড়োসড়ো হয়ে আছে। মনে হচ্ছে, হানিফকে ভয় পাচ্ছে বা কোনো কারণে অবহেলা করছে। হানিফ ছয় বছর সৌদিতে ছিল। তিন মাস হলো দেশে ফিরেছে। তিন মাসে যতবার হানিফ এই বাড়িতে পা রেখেছে ততবারই পদ্মজা অজুহাত দিয়ে দূরে দূরে থেকেছে। হেমলতার বিচক্ষণ, সন্দেহবাতিক মস্তিষ্ক মুহূর্তে ভেবে নিল অনেক কিছু। আজই এই লুকোচুরির ফয়সালা করবেন তিনি। হানিফ পদ্মজাকে দেখার জন্য অনেক ছলচাতুরী করেও সুযোগ পেল না। বিদ্যুৎ আসার ঘণ্টাখানেক পর হানিফ চলে যায়। পূর্ণা, প্রেমা ঘরে ঢুকতেই পদ্মজা ঝাঁপিয়ে পড়ে তাদের ওপর। রুদ্ধশ্বাস কণ্ঠে বলে, ‘কতবার না করেছি? লোকটার পাশে বেশিক্ষণ না থাকতে? তোরা কেনো শুনিস না আমার কথা?’
পূর্ণা, প্রেমা বিস্ময়ে হতবিহ্বল। পদ্মজা কখনো কিছু নিয়ে এভাবে নিষেধ করে না। তাহলে এখন কেন এমন করছে? হেমলতা রুমে ঢুকতেই পদ্মজা চুপসে গেল।
‘পদ্ম আমার ঘরে আয়।’
মায়ের এমন কাঠকাঠ আদেশ শুনে পদ্মজার কলিজা শুকিয়ে একটুখানি হয়ে যায়। পূর্ণা-প্রেমা নিজেদের মধ্যে চাওয়াচাওয়ি করে। পদ্মজা ধুকধুকানি হৃদস্পন্দর নিয়ে হেমলতার ঘরের দিকে গেল।
হেমলতা মেয়ের দিকে সরু চোখে তাকিয়ে আছেন। পদ্মজা পায়ের আঙুল খিঁচে দাঁড়িয়ে আছে! সুন্দরীরা ভীতু আর বোকা হয় তার দৃষ্টান্ত প্ৰমাণ পদ্মজা। তাকে ছাড়া পদ্মজা কীভাবে চলবে?
পদ্মজার সঙ্গে উঁচুকণ্ঠে কথা বলতে হেমলতার খুব মায়া হয়। কিন্তু আজ বলতেই হবে। আবেগ লুকিয়ে তিনি বজ্রকণ্ঠে প্রশ্ন করলেন, ‘কী লুকোচ্ছিস আমার থেকে? হানিফ কী করেছে?’
পদ্মজা ফোঁপাতে থাকে। হেমলতা সেকেন্ড কয়েক সময় নিয়ে নিজেকে সামলে নিলেন। কণ্ঠ নরম করে বললেন, ‘হানিফ ধড়িবাজ লোক! সৎ ভাই বলে বলছি না। আমি জানি সে কতটা খারাপ। তার ব্যাপারে যেকোনো কথা আমি বিশ্বাস করব। তুই আমাকে বল কী লুকোচ্ছিস? কী করেছে হানিফ?’
মায়ের আদুরে কণ্ঠ শুনে পদ্মজা বাঁধ ভাঙা নদীর মতো হু হু করে কেঁদে উঠল। লুটিয়ে পড়ল মায়ের পায়ে।
২
বাড়িটি মোড়ল বাড়ি নামে পরিচিত। পদ্মজার দাদার নাম ছিল মিয়াফর মোড়ল। তিনি গ্রামের একজন সফল ব্যবসায়ী ছিলেন। চার পুত্রের জন্মের পর তাদের জন্য ছয় কাঠা জমির ওপর টিনের বিশাল বড় বাড়ি বানিয়েছিলেন। টগবগে দুই পুত্র ষোলো বছর আগে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে নিহত হয়। ছোট ছেলে আট বছর বয়সে কলেরা রোগে মারা যায়। বাকি থাকে বড় ছেলে মোর্শেদ মোড়ল। বর্তমানে এই বাড়ির উত্তরাধিকার মোর্শেদ। যদিও তিনি সবসময় বাড়িতে থাকেন না, বাউন্ডুলে জীবন তার। স্ত্রী-সন্তানের অধীনেই এখন মোড়ল বাড়ি, তারাই বাড়িটির রক্ষণাবেক্ষণ করে। পুরো বাড়ির চারপাশ জুড়ে গাছগাছালি। বাড়ির পিছনে টলটলে জলের স্রোতস্বিনী। অন্ধকার গাঢ় হতেই পরিবেশ নিশুতি রাতের রূপ ধারণ করে।
রাতের এই নির্জন প্রান্তর ঝিঁঝিঁ পোকার ডাকে ছেয়ে গেছে। ঝিঁঝিঁ পোকার সঙ্গে পদ্মজার ভাঙা কান্না মিলেমিশে ভৌতিক পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। মনে হচ্ছে কোনো আত্মা তার ইহজীবনের না পাওয়া কোনো বস্তুর শোকে এমন মরা সুর ধরেছে। হেমলতা পদ্মজাকে টেনে পাশে বসালেন। পদ্মজা ডান হাতের উল্টো পাশ দিয়ে চোখের জল মুছে হেমলতাকে বলতে শুরু করল, ‘মামা সৌদিতে যাওয়ার আগের দিন ওই বাড়িতে খালামণি, ভাই, আফা সবাই এসেছিল। সেদিন ঢাকা থেকে যাত্রাপালার লোকও এসেছিল তাই…’
হেমলতা শিকারি পাখির মতো চেয়ে আছে। পদ্মজা কান্নার দমকে কথা বলতে পারছে না। হাত-পা কাঁপছে, তাকে ভীত দেখাচ্ছে। হেমলতা মেয়ের হাত চেপে ধরেন উৎসাহ দিতে ঠিক তখনই উঠোনে ধপ করে একটা আওয়াজ হয়। পদ্মজা কেঁপে উঠল। পূর্ণা, প্রেমা কথা শোনার জন্য দরজায় কান পেতে রেখেছিল। হুট করে কিছু পতনের আওয়াজ হওয়াতে দুজন ভয় পেয়ে দরজা ঠেলে হুড়মুড়িয়ে ঘরে ঢুকে পড়ে। হেমলতা গোপন বৈঠক ভেঙে দ্রুত পায়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ান। উঠানে বিদ্যুৎ নেই। পিছনে তিন মেয়ে এসে দাঁড়িয়েছে। হেমলতা গলা উঁচিয়ে খেঁকিয়ে উঠলেন, ‘কে? কে ওখানে?
ভাঙা গলায় কেউ খুব কষ্টে উচ্চারণ করল, ‘আমি।’
চির পরিচিত কণ্ঠটি চিনতে বিড়ম্বনা হলো না তার। তিনি দ্রুত পায়ে উঠানে ছুটে যান। গেইটের পাশে নিথরের মতো পড়ে আছে মোর্শেদ মোড়ল। তার গায়ে শীতের চাদর। হাঁপড়ের মতো উঠা-নামা করছে বুক যেন দম ফুরিয়ে যাচ্ছে। হেমলতা চোখেমুখে ছড়িয়ে পড়ে উদ্বেগ। তিনি দুই হাতে মোর্শেদকে আঁকড়ে ধরেন। পদ্মজা, পূর্ণা, দৌড়ে এলো সাহায্য করতে। মোর্শেদের এমফাইসিমা রোগ আছে। এই রোগে অল্প চলাফেরাতেই শ্বাসটানের উপক্রম হয় এবং দম ফুরিয়ে যায়। শ্বাস নেবার সময় গলার শিরা ভরে যায়। তিন মা-মেয়ে মোর্শেদকে ধরে ঘরে নিয়ে যায়।
মোর্শেদ হুট করে বাড়ি ছাড়ে, হুট করেই বাড়ি ফেরে। কখনো কাকডাকা ভোরে, কখনো নিশুতি রাতে, কখনো কাঠফাটা রোদে তার মনে পড়ে নিজ আলয়ের কথা; ফিরে আসে ক্ষিপ্ত ঘোড়ার মতো।
মোর্শেদের এমফাইসিমা রোগটা ধরা পড়ে সাত বছর আগে। তার অ্যাজমা ছিল আবার ধূমপানেও আসক্ত। ফলে ফুসফুসের এই রোগটি খুব দ্রুত আক্রমণ করে বসে।
মোর্শেদ খানিকটা সুস্থ হয়ে রাত একটার দিকে ঘুমিয়ে পড়েন। পূৰ্ণা, প্রেমা ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়েছে। পদ্মজা বারান্দার ঘরে ঝিম মেরে বসে আছে। তার চোখের দৃষ্টি জানালার বাইরে। জ্যোৎস্না গলে গলে পড়ছে! কি সুন্দর দৃশ্য! সেই দৃশ্যের দিকে অপলক নয়নে চেয়ে থেকে পদ্মজা ভাবছে, আম্মা এখনো আসছে না কেন?
সে আজ সব বলতে চায়, হৃদয়ের ক্ষত বয়ে বেড়ানো যাচ্ছে না।
কিছুক্ষণের মধ্যে দরজার পাশে এসে দাঁড়ান হেমলতা। হাতে থাকা হারিকেনের তীব্র আলোয় পদ্মজা গুটিয়ে যায়।
হেমলতা হারিকেনের আগুন নিভিয়ে পদ্মজার পাশে গিয়ে বসেন। পদ্মজা সবকিছু বলার জন্য তৈরি ছিল তবুও অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছে।
পদ্মজা তখন চতুর্থ শ্রেণির ছাত্রী। বয়স আর কত হবে, নয় কী দশ। খুব কম বয়সেই তাকে স্কুলে পাঠানো শুরু করেছিলেন হেমলতা। হানিফের সৌদি চলে যাবার উপলক্ষ্যে রবিবারের এক সকালে নানাবাড়িতে সবার দাওয়াত পড়ে। স্কুল মাঠেও সেদিন নাচ-গান অনুষ্ঠিত হচ্ছিল। দুপুরের দিকে বাড়ির সবাই সেখানে চলে যায়। বাড়িতে রয়ে যায় শুধু পদ্মজা, পদ্মজার বৃদ্ধ নানা, আর হানিফ। পদ্মজা ঘুমে ছিল তাই বাকিদের সঙ্গে যেতে পারেনি যখন ঘুম ভাঙল আবিষ্কার করল বাড়িতে কেউ নেই। সেদিন মোর্শেদ হঠাৎ করে অসুস্থ হওয়াতে হেমলতা বাপের বাড়িতে ছিলেন না।
বাড়ি থেকে বের হওয়ার উপক্রম হতেই কানে আসে হানিফের ডাক, ‘পদ্ম নাকি?’
পদ্মজা মিষ্টি করে হেসে মাথা নাড়ায়। হানিফের লোলুপ দৃষ্টি তখন পদ্মজার সারা শরীর ঘুরে বেড়াচ্ছে। ওইটুকু মেয়ের ফরসা চামড়া বিকৃত মস্তিষ্কের হানিফকে বড্ড টানে! উপেক্ষা করতে পারে না।
মিষ্টি সুরে হানিফ বলল, ‘আয়, আমার ঘরে আয়।’
সহজ সরল শিশুসুলভ পদ্মজা মামার ডাকে সাড়া দেয়। সে শুনেছে, মামা-ভাগনে যেখানে আপদ নেই সেখানে। অথচ, সেদিন সে মামাকেই ঘোর বিপদ হিসেবে জানল।
পদ্মজা রুমে ঢুকতেই হানিফ চট করে দরজা বন্ধ করে দিল। তার অদ্ভুত চাহনি আর দরজা লাগানোর গতি দেখে পদ্মজার মন কেমন করে ওঠে। হানিফ কুৎসিত অঙ্গভঙ্গি করতে থাকে। পদ্মজার দেখতে খুব খারাপ লাগছে, গা ঝিমঝিম করছে, ভয় হচ্ছে!
হানিফ বিছানায় বসে পদ্মজাকে কাছে ডাকে, ‘এদিকে আয় তোর লগে গল্প করি।’
পদ্মজা কাছে যেতে সংকোচ বোধ করছে। হানিফ পদ্মজার ডান হাতে ধরে টেনে কোলে বসায়। পদ্মজার বাহুতে গভীরভাবে স্পর্শ করে বলে, ‘তুই জানোস তুই যে সবার থাইকা বেশি সুন্দর?’
হানিফের প্রশ্ন পদ্মজার কানে ঢুকেনি। সে মোচড়াতে থাকে কোল থেকে নামার জন্য। আপত্তিকর স্পর্শগুলো পদ্মজাকে খারাপ অনুভূতি দিচ্ছে। তার কান্না পাচ্ছে, মাথা ভনভন করছে। হানিফ গলার জোর বাড়িয়ে মিষ্টি করে বলল, ‘মোছড়াস ক্যান রে ছেড়ি। শান্তিমত বইয়া থাক। মামা মেলা থাইকা সাজনের জিনিষ কিইন্যা দিমু।’
হানিফ দুই হাতে শক্ত করে ধরে রেখেছে পদ্মজাকে। পদ্মজা কিছুতেই কোল থেকে নামতে পারছে না। সে কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল, ‘মামা আমি চলে যাব।’
‘কই যাবি? মামার ধারে থাক।’ বলল হানিফ।
হানিফের শক্তপোক্ত হাতের স্পর্শগুলো শুধু অস্বস্তি দিচ্ছে না, স্পর্শকাতর জায়গাগুলো ব্যাথায় বিষিয়ে তুলছে। পদ্মজা কান্না আটকে রাখতে পারল না, হঠাৎ কেঁদে ওঠল। বলল, ‘ব্যাথা পাচ্ছি মামা। বাড়ি যাব আমি।’
হানিফ হাতের বাঁধন নরম করে আদুরে গলায় বলল, ‘আচ্ছা আর ব্যাথা দিতাম না। কান্দিস না।’
বাঁধন হালকা হতেই পদ্মজা কোল থেকে নেমে পড়ে। হানিফকে তার আজরাইলের মতো লাগছে। মায়ের কাছে সে আজরাইলের অনেক গল্প শুনেছে। আজরাইল যখন জান নিতে আসবে তখন শরীরে খুব কষ্ট অনুভব হবে। এই মুহূর্তে যেন ঠিক তেমনই অনুভূতি হলো। তাহলে তার হানিফ মামাই আজরাইল? পদ্মজা দরজার দিকে তাকায়, অনেক উঁচুতে ছিটকিনি উচ্চতা কম হওয়াতে সে দরজা খুলতে পারবে না। তাই হানিফকে ভীতকণ্ঠে অনুরোধ করল, ‘মামা দরজা খুলে দাও।’
ধমকে উঠল হানিফ, ‘ক্যান? আমি তোরে যাইতে কইছি?’ তার কর্কশ কণ্ঠের ধমকে পদ্মজা ভয়ে কেঁপে ওঠল। তার চোখে নহর বইছে। হানিফ পদ্মজাকে জোর করে কোলে তুলে নেয়। পদ্মজা কাঁদছে। বার বার বলছে, ‘মামা আমি বাড়ি যাব।’
হানিফের তাতে বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ নেই। বাড়িতে কেউ নেই। বৃদ্ধ সৎ বাবা বধির, কানে শুনে না। পদ্মজা হানিফকে কিল, ঘুষি দিতে থাকে। ভয়ে জোরে জোরে কান্না শুরু করেছে। এভাবে কাঁদলে পাশের বাড়ির যে কেউ চলে আসবে। হানিফের রক্ত টগবগ করছে উত্তেজনায়। সে দ্রুত ওড়না দিয়ে পদ্মজার হাত, পা, মুখ বেঁধে ফেলল। পদ্মজার দুই চোখের পানি হানিফের হৃদয়কে ছুঁতে পারছে না। সে ভীষণ আনন্দ পাচ্ছে। পৈশাচিক উল্লাসে ভেসে যাচ্ছে। হানিফ সিগারেট জ্বালায়। খুব আনন্দ হলে তার সিগারেট টানতে ইচ্ছে হয়। সিগারেট টানতে গিয়ে মাথায় এলো নৃশংস বাসনা। তাৎক্ষণিক নাক, মুখ দিয়ে ধোঁয়া উড়িয়ে সিগারেটটি দুই আঙুলের মাঝে রেখে পদ্মজার বাম পায়ের তালুতে জ্বলন্ত সিগারেটটি চেপে ধরল।
স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে পদ্মজা হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে। হেমলতা দুই হাতে শক্ত করে মেয়েকে বুকের সঙ্গে জড়িয়ে ধরেন। পদ্মজা কাঁদতে কাঁদতে বলল, ‘আম্মা, তখন আমার খুব কষ্ট হচ্ছিল। আমার দমটা বেরিয়ে যাচ্ছিল। আমি তোমাকে খুব ডেকেছি আম্মা। তুমি আসোনি।’
পদ্মজার কথাগুলো হেমলতার বুকে ঝড় তুলে দিয়েছে। লণ্ডভণ্ড হয়ে যাচ্ছে শরীরের প্রতিটি শিরা-উপশিরা। এ যেন ১৯৭১ সালের পাকিস্তানিদের নৃশংসতা। নিজের চোখে তিনি দেখেছেন পাকিস্তানিদের নিষ্ঠুরতা। হানিফ আর তার দেখা অত্যাচারী পাকিস্তানিদের মধ্যে কোনো তফাৎ নেই হেমলতা নির্বাক, বাকরুদ্ধ। শুধু অনুভব হচ্ছে তার বুকে পড়ে আদরের পদ্মজা হাউমাউ করে কাঁদছে। হেমলতার সর্বাঙ্গ জ্বলছে। হানিফকে ক্ষত- বিক্ষত করে দিতে হাত নিশপিশ করছে। সেদিন একটুর জন্য পদ্মজা ধর্ষিতা হয়নি। পোড়া স্থানের যন্ত্রণা আর মানসিক চাপ সহ্য করতে না পেরে চৈতন্য হারায়। তখনই বাড়িতে সবাই ফিরে আসে।
বাকিটুকু আর পদ্মজাকে বলতে হয়নি, হেমলতা জানেন। পদ্মজার গা কাঁপিয়ে জ্বর এসেছিল সেদিন। একুশ দিন বিছানায় ছিল। ততদিনে হানিফ দেশ ছেড়ে চলে যায়। পদ্মজা ভয়ে, লজ্জায় ঘটনাটি কাউকে বলেনি। পায়ের পোড়া দাগ দেখে যখন হেমলতা প্রশ্ন করেছিলেন, ‘পা এমনভাবে পুড়ল কী করে?’
পদ্মজা সহজভাবে জবাব দিয়েছিল, ‘চুলার কাছে গিয়েছিলাম। লাকড়ির আগায় পা লেগে পুড়ে গেছে।’
কথাটা পদ্মজা সাজিয়েই রেখেছিল। সঙ্গে অনেক যুক্তি। তাই মিথ্যে বলতে একটুও কাঁপেনি। পুরো ঘটনাটা পদ্মজার বুকে দগদগে ক্ষত হয়ে রয়ে যায়। এই ছয় বছরে লুকিয়ে কতবার কেঁদেছে সে। মনে হলেই চুপ করে কোথাও বসে থাকে। হেমলতা মেয়ের নিশ্চুপতা দেখে মাথা ঘামাননি কখনো। পদ্মজা ছোট থেকেই চুপচাপ ছিল। কিন্তু আজ হেমলতার খুব আফসোস হচ্ছে। নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছে। তিনি ভেবেছিলেন, তার তিনটা মেয়েই তার কাছে খোলা বইয়ের মতো। চাইলেই পড়া যায়। পদ্মজাকে বাড়ির পিছনের নদীর বুক দিয়ে তরতর করে বয়ে যাওয়া স্বচ্ছ টলটলে পানির মতো মনে হতো। যার জীবনে অস্বচ্ছ বলতে কিছু নেই। সবই সাদামাটা, সহজ সরল। অথচ পদ্মজার জীবনেই কত বড় দাগ জ্বলজ্বল করে জ্বলছে! কতবড় ঘটনা লুকিয়ে ছিল! মেয়েরা কথা লুকিয়ে রাখার সীমাহীন ক্ষমতা নিয়ে জন্মায়। কথাটি নিজের মেয়েদের ক্ষেত্রে মাথায় আসেনি।
অনেকক্ষণ মায়ের বুকে থাকার পর পদ্মজা শান্ত হয়। তখন হেমলতা ধীর কণ্ঠে বললেন, ‘পা টা দেখি।’
পদ্মজা বাঁ পা বিছানায় তুলল। হেমলতা পদ্মজার পা কোলে নিয়ে পোড়া দাগটা দেখলেন মনোযোগ দিয়ে। বুকের ধুকপুকানি বেড়ে যায়, রক্ত টগবগ করে ওঠে। রন্ধ্রে রন্ধ্রে শুরু হয় প্রতিশোধের স্লোগান। তিনি হঠাৎ বলে উঠলেন, ‘এই পোড়া দাগ হানিফের রক্ত দিয়ে মুছব।’
কথাটি কত সহজ করে বলেছেন হেমলতা। কিন্তু পদ্মজার হৃদয় কাঁপিয়ে তুলল। কী যেন ছিল কথাটিতে! তাকে তাকিয়ে থাকতে দেখে হেমলতা বলেন, ‘এখন যা ঘুমিয়ে পড়। কাল স্কুল আছে।’
পদ্মজাকে ঘরে পাঠিয়ে রান্নাঘর থেকে রামদা, ছুরি হাতে নিয়ে উঠানে গিয়ে বসেন হেমলতা। উঠানের এক পাশে একটা বড় পাথর আছে। তিনি সেখানে গিয়ে পাথরটির পাশে বসে ছুরিটি পাথরে ঘষতে থাকলেন। ঘষতে ঘষতে পাথর গরম হয়ে আগুনের স্ফুলিঙ্গ দেখা দেয়। ধার হয়ে গেছে। পদ্মজা ঘর থেকে লুকিয়ে দেখছে। অজানা আশঙ্কায় তার বুক কাঁপছে। হেমলতা বারান্দা পেরিয়ে ঘরে ঢুকতে যাবে তখন পদ্মজা উৎকণ্ঠিত গলায় ডাকল, ‘আম্মা!’
পদ্মজা কিছু বলার পূর্বেই হেমলতা বললেন, ‘আন্নার চাচার বড় মেয়ে বহুবছর আগে নিখোঁজ হয়েছে শুনেছিস তো? সেই মেয়ের ধর্ষক হানিফ ধর্ষণের পর মেয়েটাকে পুঁতে ফেলেছে। অলন্দপুরের এই একটা মানুষই এতটা বর্বর। আমি তখন ঢাকা পড়তাম। বাড়ি এসে ঘটনাটি শুনি। আম্মার অনুরোধ আর কান্নায় আমি সেদিন মুখ খুলিনি। এত বড় পাপ চেপে যাই। সেই শাস্তি আমি ধীরে ধীরে পাচ্ছিলাম। আজ পুরোপুরি পেয়ে গেলাম। আমার পাপের শাস্তি শেষ হয়েছে।’
হেমলতার মুখ দিয়ে যেন আগুনের স্ফুলিঙ্গ বের হচ্ছে! তিনি কথা শেষ করে জায়গা ত্যাগ করলেন। পদ্মজার মস্তিষ্ক শূন্য হয়ে পড়ে।
৩
‘এই আপা, স্কুলে যাবা না?’
‘যাব।’
‘তাড়াতাড়ি করো।’
তাড়া দিয়ে পূর্ণা বাড়ির ভেতর চলে গেল। পদ্মজা বাড়ির পেছনের নদীর ঘাটে উদাসীন হয়ে বসে আছে। এ নদীর নাম—মাদিনী। জলে কানায় কানায় ভরে উঠেছে মাদিনী। জলের একটানা স্রোত বয়ে যায় সাগরের দিকে। উজান থেকে ভেসে আসছে ঘন সবুজ কচুরিপানা। পদ্মজার এই দৃশ্য দেখতে বেশ লাগছে, নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে আছে মাদিনীর স্বচ্ছ জলের দিকে। একটা লঞ্চ জল কেটে এগিয়ে যাচ্ছে মাদিনীর বুকের ওপর দিয়ে। লঞ্চ দেখে এক মাস আগেকার ঘটনা মনে পড়ে গেল তার।
সেই রাতে হেমলতা ছুরি ধার দিয়ে নিজ ঘরে চলে যান। পদ্মজা অজানা আশঙ্কায় সেদিন ঘুমোতে পারেনি। চুপচাপ অন্ধকার ঘরে শুয়ে থাকে। শেষরাতে চোখ লেগে আসে। ভোর হতেই হিমেলের চিৎকারে ঘুম ভেঙে যায়। হিমেল তার ছোটো মামা, প্রতিবন্ধী। এক পা বাঁকিয়ে হাঁটে। খুব সরল মনের মানুষ। বয়স বাইশ হলেও, এখনো শিশুদের মতো আচরণ করে; কথায় কথায় খুব কাঁদে।
পদ্মজা ওড়না গায়ে জড়িয়ে দৌড়ে বের হয়। পদ্মজাকে দেখে উত্তেজিত হয়ে পড়ে হিমেল, ‘এই পদ্ম, আপা কই? আপা…আপা।’
পদ্মজা উৎকণ্ঠা নিয়ে প্রশ্ন করল, ‘কী হয়েছে মামা? এমন করছ কেন?’ পদ্মজার প্রশ্ন উপেক্ষা করে হিমেল হেমলতাকে ডাকছে, ‘আপা, এই আপা।’
হেমলতা বাড়ির পেছন থেকে ব্যস্ত পায়ে হেঁটে এলেন। ‘কী হয়েছে?’
হেমলতাকে দেখে হাউমাউ করে কেঁদে উঠল হিমেল।
‘আপা, ভাইজান খুন হইছে। রাইতে কে জানি মাইরা ফেলছেরে আপা…’
হিমেল কাঁদতে কাঁদতে হাঁটু ভেঙে বসে পড়ল। পদ্মজা তাৎক্ষণিক সন্দিহান চোখে মায়ের দিকে তাকাল। হেমলতাকে দেখে মনে হচ্ছে, তিনি চমকে গিয়েছেন। অথচ, তার চমকানোর কথা ছিল না। নাকি হিমেলের সামনে অভিনয় করলেন?
হেমলতা দ্রুত পায়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে বললেন, ‘পূৰ্ণা- প্রেমাকে ওদিক যেতে দিস না, পদ্ম। আমি আসছি।’
হেমলতার পিছু পিছু খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হেঁটে যায় হিমেল।
পদ্মজা রাতেই ভেবেছিল, এমন ঘটনা ঘটতে পারে। সে তার মাকে সবচেয়ে ভালো জানে। তবুও এখন ভয় পাচ্ছে। পুলিশ কি এসেছে? মাকে ধরে নিয়ে যাবে না তো? ভাবতে গিয়ে ধক করে উঠল পদ্মজার বুক। গ্রামের কাছেই শহর, থানা। পুলিশ নিশ্চয় চলে এসেছে। পদ্ম ধপ করে বসে পড়ল মাটিতে। সে ঘামছে, নাক-মুখ-গলা ঘেমে একাকার হয়ে যাচ্ছে।
খুনের কথা শুনে ভীষণ ভয় পেয়েছে পূর্ণা। আতঙ্কে দম বন্ধ হওয়ার উপক্রম। সে পদ্মজার পাশে এসে হাত চেপে ধরে। পদ্মজা মৃদু কাঁপছে। চোখে ভাসছে, হেমলতাকে পুলিশ শিকল দিয়ে বেঁধে নিয়ে যাচ্ছে। তার খুব কান্না পাচ্ছে। সময় নষ্ট না করে তড়িঘড়ি করে মাথায় ওড়নার আঁচল টেনে নিয়ে পূর্ণার উদ্দেশ্যে বলল, ‘প্রেমাকে দেখে রাখিস।’
বাড়ি ভরতি মানুষ। মানুষ আসছে ঠেলেঠুলে। হেমলতা হানিফের লাশের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। ঠিক সেই মুহূর্তে ফরসা রঙের দুজন মহিলা ঝাঁপিয়ে পড়ল তার ওপর। আকস্মিক আক্রমণে অপ্রস্তুত হয়ে পড়েন হেমলতা। খেয়াল করে দেখেন, মহিলা দুজন তার মা আর বোন। তারা হাউমাউ করে কাঁদছে। কিন্তু হেমলতার তো কান্না পাচ্ছে না! ব্যাপারটা লোকচক্ষু ঠেকছে? একটু কী কান্নার অভিনয় করা উচিত? হানিফের মৃতদেহ দেখে মনে হচ্ছে কেউ ইচ্ছেমতো কুপিয়েছে। হেমলতার দেখে শান্তি লাগছে! এমন শান্তি অনেকদিন পাওয়া হয়নি। পদ্মজাও সেখানে উপস্থিত হয়। হেমলতার নজরে পড়ে। ভীতু চোখে মায়ের চোখের দিকে তাকাল পদ্মজা। হেমলতা ভ্রু কুঞ্চিত করে আবার স্বাভাবিক করে নিলেন। পদ্মজা চোখ ঘুরিয়ে দেখছে পুলিশ এসেছে কি না! চারিদিকে এত মানুষ। পদ্মজাকে এদিক-ওদিক উঁকি দিতে দেখে হেমলতা মেয়ের দিকে তেড়ে যান। চোখ রাঙিয়ে পদ্মজার মাথা ঢেকে দিলেন ওড়না দিয়ে। পদ্মজা দ্রুত ওড়নার আঁচল মুখে চেপে ধরে গোয়ালঘরে ঢুকে পড়ে। তার মা চায় না সে কখনো এত মানুষের সামনে থাকুক।
হেমলতা ঘাড় ঘুরিয়ে দেখেন, পদ্মজা গোয়ালঘর থেকে উঁকি দিয়ে বাইরের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করছে।
কিছুক্ষণের মধ্যে পুলিশের দল আসে। সবাইকে জিজ্ঞাসাবাদ করে হানিফের লাশ নিয়ে যায়। লোকমুখে শোনা যায়, হানিফ খুন হয়েছে শেষ রাতে। সকালে লঞ্চ ঘাটে লাশ ভেসে ওঠে!
হেমলতাকে পুলিশ নিয়ে যায়নি বলে পদ্মজা স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়ে। মানুষের ভিড়ও কমে গেছে। হেমলতার মা কাঁদতে কাঁদতে ক্লান্ত হয়ে উঠোনের এক কোণে বসে আছেন। পদ্মজা গুটিপায়ে গোয়ালঘর থেকে বেরিয়ে আসে। পদ্মজার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসেন হেমলতা। সেই হাসি দৃষ্টিগোচর হয় হেমলতার মা মনজুরার। তিনি কিছু একটা ভেবে নিয়ে হেমলতার কাছে এসে কিড়মিড় করে বললে, ‘তুই খুন করছস?’
সঙ্গে সঙ্গে হেমলতা জবাব দিলেন, ‘তোমার এমন মনে হচ্ছে কেন?’
হেমলতার কণ্ঠ স্বাভাবিক। পদ্মজা এই প্রশ্ন শুনে ভয় পেয়ে গেছে।
যদি নানু পুলিশকে বলে দেয়? পুলিশ তো তার মাকে নিয়ে যাবে!
‘কাইল রাইতে তুই আইছিলি হানিফের ঘরে। আমি দেহি নাই?’ রাগে কাঁপছেন মনজুরা।
‘হুম এসেছি।’ হেমলতার নির্বিকার স্বীকারোক্তি।
‘কেন মারলি আমার ছেড়ারে? তোর কী ক্ষতি করছে?’
‘আসছি বলেই আমি খুন করেছি?’
‘এত রাইতে তুই তার কাছে আর কী দরকারে আইবি?’
‘আমি তাকে মারতেই যাব কেন?’
মনজুরা আহত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন হেমলতার দিকে। হেমলতার চোখ মুখ শক্ত। নিস্তব্ধতা কাটিয়ে মনজুরা চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘পুলিশের কাছে যামু আমি।’
পদ্মজা কেঁদে উঠল। অস্পষ্ট কণ্ঠে বলল, ‘নানু, এমন করো না।’ হেমলতা নিচু স্বরে কঠিন করে বললেন, ‘আমার মেয়েদের থেকে আমাকে দূরে সরানোর চেষ্টা করো না, আম্মা। ফল খুব খারাপ হবে।’
পদ্মজার মনে হলো মনজুরা ভয় পেয়ে গেছেন। তার চোখেমুখে ছড়িয়ে পড়েছে শঙ্কা। তিনি সবসময়ই হেমলতাকে ভয় পেয়ে চুপসে থাকেন। পদ্মজা বুঝে উঠতে পারে না, নানু কেন ভয় পায় মাকে? মায়ের অতীতে কী ঘটেছে? কেন তিনি এমন কাঠখোট্টা? ছেলের খুনিকে কোনো মা ছেড়ে দেয়? নানু কেন ছাড়লেন? মেয়ে বলে? নাকি অন্য কারণ আছে? কোনো উত্তর নেই। এসব ভাবলে ভীষণ মাথা ব্যথা হয়। অন্য আট-দশটা পরিবারের মতো তারা নয় কেন? নাকি গোপনে সব পরিবারেই এমন জটিলতা আছে?
প্রশ্ন হাজারটা!!
উত্তর কোথায়?
সেদিন রাতে খাওয়ার সময় হেমলতা নিম্নস্বরে পদ্মজাকে ডাকেন, ‘পদ্ম?’
‘জি, আম্মা।’
‘আমি হানিফকে খুন করিনি। কারা করেছে তাও জানি না।
কথাটি শুনে পদ্মজা অবাক হয়। তার মা মিথ্যে বলে না। তাহলে কারা খুন করল? পদ্মজা প্রশ্ন করল, তাহলে শেষ রাতে মামার কাছে কেন গিয়েছিলে আম্মা?’
হেমলতা জবাব না দিয়ে খাওয়া ছেড়ে উঠে গেলেন।
পদ্মজার ভাবনার সুতো কাটল কারো পায়ের আওয়াজ শুনে। ঘাড় ঘুরিয়ে মোর্শেদকে দেখতে পেল। মোর্শেদ পদ্মজাকে ঘাটে বসে থাকতে দেখে বিরক্তিতে কপাল কুঁচকে ফেললেন, ‘এই ছেড়ি, যা এন থাইকা।’
জন্মদাতার এমন দূর দূর ব্যবহারে পদ্মজার কান্না পায়। নিঃশব্দে এক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ে, তা আড়াল করে ব্যস্ত পায়ে বাড়ির ভেতর চলে যায় সে।
কয়েক মাস পর পদ্মজার মেট্রিক পরীক্ষা। নিয়মিত স্কুলে যেতে হয়। তিন বোন বই নিয়ে সড়কে ওঠে। পদ্মজার কোমর অবধি ওড়না দিয়ে ঢাকা। পূর্ণা একনাগাড়ে বকবক করে যাচ্ছে। স্কুলে যাওয়া অবধি কথা বন্ধ হবে না, মাঝে মাঝে জোরে জোরে হাসছেও! মেয়েটার হাসির রোগ আছে বোধহয়। একবার হাসি শুরু করলে আর থামে না। পদ্মজা বার বার বলেছে, ‘আম্মা
রাস্তায় কথা বলতে আর হাসতে মানা করছে। চুপ কর
তবুও পূর্ণা হাসছে। বাড়ির বাইরে এসে সে মুক্ত পাখির মতো আচরণ করে। তাকে দেখে মনে হয়, খাঁচা থেকে মুক্ত হয়েছে।
‘পদ্ম…ওই, পদ্ম। খাড়া।’
পদ্মজা ক্ষেতের দিকে তাকাল। ক্ষেতের আইল ভেঙে দৌড়ে আসছে লাবণ্য। একই সঙ্গে পড়ে দুজন। কাছে এসে হাঁপাতে লাগল লাবণ্য। শান্ত হওয়ার পর চারজন মিলে স্কুলের উদ্দেশ্যে হাঁটা শুরু করে।
‘বাংলা পড়া শিখে এসেছিস বলল পদ্মজা?’
তার প্রশ্ন অগ্রাহ্য করে লাবণ্য বলল, ‘আরে ছেড়ি, বাড়িত শুদ্ধ ভাষায় কথা কইলে বাইরেও কইতে হইব নাকি?’
‘আমি আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলতে পারি না।’
লাবণ্য অসন্তোষ প্রকাশ করল। সে অলন্দপুরের মাতব্বর বাড়ির মেয়ে। তাদের বাড়ির সবাই শিক্ষিত। তবুও তারা আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলে, পরিবারের দুই-তিন জন সদস্য ছাড়া। আর পদ্মজার চৌদ্দ গুষ্ঠি মূর্খ, দুই- তিন জন ছাড়া…তবুও এমন ভাব করে! আঞ্চলিক ভাষা নাকি পারে না!
‘সত্যি আমি পারি না। ছোটো থেকে আম্মা শুদ্ধ ভাষা শিখিয়েছেন। উনিও এই ভাষাতেই কথা বলেন। তাই শুদ্ধ ভাষায় কথা বলতেই আরাম পাই।’
‘পূর্ণা তো পারে।’
‘আমার চেষ্টা করতে ইচ্ছে হয় না।’
‘আইচ্ছা বাদ দে। শুন, কাইল আমরার বাড়িত নায়ক-নায়িকারা আইব।’
পূর্ণা বিগলিত হয়ে প্রশ্ন করল, ‘কেন আসবে? কোন নায়ক?
‘শুটিং করতে। ছবির শুটিং।’
পদ্মজা এসবে কোনো আগ্রহ পাচ্ছে না। পূর্ণা খুব আগ্রহবোধ করছে। সপ্তাহে একদিন সুমিদের বাড়িতে গিয়ে সাদাকালো টিভিতে ছায়াছবি দেখে, তাই অভিনয় শিল্পীদের প্রতি তার আগ্রহ আকাশছোঁয়া। পূর্ণা গদগদ হয়ে প্রশ্ন ছুঁড়ল, ‘কোন নায়ক নায়িকা? বলো না লাবণ্য আপা!’
‘দাঁড়া! মনে করি।’
পূর্ণা কৌতূহল নিয়ে তাকিয়ে আছে। লাবণ্য চোখ বুজে মনে করার চেষ্টা করল। এরপর মনে হতেই বলল, ‘লিখন শাহ আর চিত্রা দেবী।’
‘তুমি আমার ছবির নায়ক-নায়িকা?’
‘হ।’
স্কুলের যাওয়ার পুরোটা পথ লাবণ্য আর পূর্ণা ছায়াছবি নিয়ে আলোচনা করল। মূল বক্তব্যে ছিল সুদর্শন অভিনেতা—লিখন শাহ।
৪
দিনটিকে বড়ো অলক্ষুণে মনে হচ্ছে পদ্মজার। সকালে উঠে দেখে লাল মুরগিটার একটা বাচ্চা নেই। নিশ্চয় শিয়ালের কারবার! রাতে মুরগির খোপের দরজা লাগানো হয়নি। আর এখন চোখে পড়ল, দেয়াল ঘড়িটার কাঁটা ঘুরছে না। ঘড়িটা রাজধানী থেকে হানি খালামণি দিয়েছিলেন। গ্রামে খুব কম লোকই হাতঘড়ি পরে। দেয়াল ঘড়ি হাতেগোনা দুই-তিনজনের বাড়িতে আছে। পদ্মজা সূর্যের দিকে চেয়ে সময়ের আন্দাজ করার চেষ্টা করল। পূর্ণা-প্রেমা দুপুরের খাবার খেয়েই ঘুমিয়ে পড়েছে। আর আম্মা…পদ্মজা পাশের ঘরে উঁকি দিয়ে দেখে হেমলতা মনোযোগ সহকারে সেলাই মেশিনে কাপড় সেলাই করছেন। আটপাড়ায় একমাত্র তিনিই সেলাই কাজ করেন। প্রতিটি ঘরের কারো না কারো পরনে তার সেলাই করা জামা আছে।
‘লুকিয়ে দেখছিস কেন? ঘরে আয়, হঠাৎ বললেন হেমলতা। পদ্মজা লজ্জা পেয়ে বলল, ‘না, আম্মা। কাজ আছে।’
হেমলতা জগ বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, ‘পানি ভরে নিয়ে আয়।’
জগ হাতে নিয়ে পদ্মজা বলল, ‘ছদকা কোন মুরগিটা দেব?’
হেমলতা গতকাল স্বপ্নে দেখেছেন, বাড়িতে আগুন লেগেছে। তাই ছদকা দিবেন বলে মনস্থির করেছেন। দুঃস্বপ্ন দেখলেই তিনি ভীষণ অস্থির হয়ে পড়েন, গরিব-দুঃখীদের ছদকা দেয়ার পরই স্বস্তি পান। তার পূর্ণাঙ্গ বিশ্বাস, গরিব-মিসকিনদের দান করলে তাদের দোয়ায় বিপদ কেটে যায়।
‘সাদা মোরগটা। মুন্না এসেছে?’
‘না। প্রতিদিন বিকেলবেলা পানি নিতে আসে। একটু পরই আসবে।’ হেমলতা আর কথা বাড়ালেন না। পদ্মজা কলপাড় থেকে পানি নিয়ে আসে। আছরের আজানের সঙ্গে সঙ্গে মোড়ল বাড়ির কল থেকে পানি নিতে আসে মুন্না। গ্রামে সচ্ছল পরিবার নেই বললেই চলে। হাতেগোনা যে কয়টা পরিবারে সচ্ছলতা বিদ্যমান শুধু তাদের বাড়িতেই টিউবওয়েল আছে। পুরো আটপাড়াতে টিউবওয়েল মাত্র পাঁচটা। পদ্মজাদের টিউবওয়েল থেকে পানি নিতে প্রতিদিন অনেকেই আসে। তার মধ্যে একজন মুন্না; বয়স বেশি নয়, মাত্র দশ। মা হারা ছেলেটির পঙ্গু বাবা সদরে বসে ভিক্ষা করে। মুন্নাকে দেখে রাখার বা যত্ন করার কেউ নেই। এখানে-ওখানে ঘুরে বেড়ায়, কারো মায়া হলে একবেলা নিয়ে দুমুঠো খেতে দেয়।
পদ্মজা মোরগ নিয়ে কলপাড়ে এসে দেখে—মুন্না নেই। একটু সামনে হেঁটে যেতেই ঘাটে দেখতে পেল ছেলেটিকে। ডাকল, ‘এই, মুন্না।’
মুন্না ফিরে তাকাল, পদ্মজার হাতে সাদা মোরগ দেখে খুশিতে জ্বলজ্বল করে ওঠে তার চোখ-মুখ। পদ্মজা না বললেও সে বুঝে গেল—আজ ছদকা পাবে। দাঁত কেলিয়ে হেসে দ্রুত পায়ে এগিয়ে এরো মুন্না।
‘হাসছিস কেন? এই নে মোরগ। তোর আব্বাকে নিয়ে খাবি।
মুন্না খুশিতে গদগদ হয়ে মোরগটিকে দুই হাতে জড়িয়ে ধরল। কী সুন্দর মুন্নার হাসি! তার খুশিতে পদ্মজাও খুশি হলো। বলল, ‘খুব খুশি?’
‘হ’
‘আমাদের জন্য দোয়া করবি।’
‘করবাম, আপা।’
‘আচার খাবি?’
‘হ, খাইবাম।’ কোনো খাবারে ছেলেটার ‘না’ নেই। সে সব খায়।
পদ্মজা আবার হাসল। খাওয়ার কথা শুনলেই পেটুক মুন্নার চোখ চকচক করে ওঠে। আচার নিয়ে আসে পদ্মজা, মুন্নার সঙ্গে ঘাটের সিঁড়িতে বসে আরাম করে দুজন আচার খায়। মুন্না একটু একটু করে খেতে খেতে বলল, ‘আপা, তুমি খুব ভালা।’
‘তাই?’
‘হ। বড়ো হইয়া আমি তোমারে বিয়া করবাম।’
পদ্মজা বিষম খেল। দ্রুত এদিক-ওদিক তাকিয়ে দেখল, কেউ শুনল নাকি। বিয়ে তার কাছে খুব লজ্জাজনক শব্দ। শব্দটি শুনলেই লজ্জায় লাল হয়ে যায় সে, অন্তর কাঁপে। ফিসফিসিয়ে মুন্নাকে জিজ্ঞাসা করে, ‘বিয়ের কথা কোথায় শিখলি?’
‘আব্বা কইছে।’
‘আর বলবি না এসব। যা, বাড়িতে যা।’
পদ্মজা তড়িঘড়ি করে বাড়ির ভেতর চলে যায়।
রান্নাঘরে ঢুকে দেখে, হেমলতা রাতের রান্নার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। সন্ধ্যার পর বিদ্যুৎ থাকে না। হারিকেন জ্বালিয়ে রান্না করতে হয়। প্রতিদিন ঘরে একটা, আবার রান্নাঘরে আরেককটা হারিকেন জ্বালানো অনেক খরচের ব্যাপার। তাই বিকেলে রাতের রান্না সেড়ে ফেলেন তিনি।
পদ্মজা উৎসাহ নিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘আম্মা, আমি রাঁধি?’
লাগবে না। সাহায্য কর শুধু।
পদ্মজা চোখ ঘুরিয়ে খুঁজতে লাগল, কী কাজ করা যায়! কিন্তু এমন কিছু পেল না যেটা করা যায়, কোনো সাহায্যের প্রয়োজনই তো নেই-ই! হেমলতা বললেন, ‘লাউ নিয়ে আয়।’
‘লাহাড়ি ঘর থেকে?’
‘লাহাড়ি ঘরে নেই। ছিঁড়ে নিয়ে আয়।’
পদ্মজা এমনভাবে ছুটে যায় যেন মায়ের আদেশ নয়, চাঁদ পেয়েছে!
লাউ, বরবটি, ঢেঁড়স, কাঁকরোল, করলা, চিচিঙ্গা, পটল, ঝিঙাসহ নানা ধরনের সবজির মেলা বাড়ির চারপাশে। পদ্মজা সাবধানে ঘাসের ওপর দিয়ে লাউ গাছের দিকে এগোয়। বর্ষাকাল হওয়াতে জোঁকের উপদ্রব বেড়েছে। অবশ্য জোঁকের ভয় তার নেই।
পদ্মজার গমনপথের দিকে ঝিম মেরে কতক্ষণ চেয়ে রইলেন হেমলতা। মেয়েটাকে দেখলে মাঝেমধ্যে মন বিষণ্নতায় ভরে ওঠে, বুকের ভেতর কীসের যেন অস্থিরতা অনুভব হয়; যুক্তিহীন কিছু চিন্তা ঘুরে বেড়ায় মস্তিষ্ক জুড়ে। পদ্মজার চুল দেখলে মনে হয়, এই সুন্দর ঘন কালো রেশমি চুল পদ্মজার একেকটা কাল রাত। পদ্মজার ছিমছাম গড়নের দুধে-আলতা দেহের অবয়ব দেখলে মন বলে—এই দেহ পদ্মজার যন্ত্রণা। পদ্মজার ওষ্ঠদ্বয়ের নিম্নে স্থির হয়ে থাকা কালো সূক্ষ্ম তিল দেখলে যেন পদ্মজার এক জীবনের কান্নার কারণ। হেমলতা পদ্মজার রূপের বাহার নিতে পারেন না। কেন কৃষ্ণকলির ঘরে ভুবন মোহিনী রূপসীর জন্ম হলো? জন্ম-মৃত্যু-বিয়ে…এই তিনের ওপর কারো হাত থাকে না। যদি থাকত, হেমলতা মোর্শেদকে বিয়ে করতেন না…কিংবা পদ্মজার মতো রূপসীর জন্মও দিতেন না। ভুলেও আল্লাহর কাছে রূপসী মেয়ে চাইতেন না। হেমলতার বুক চিরে ভারি দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে।
আজ শুক্রবার। স্কুল নেই। ফজরের নামাজ আদায় করে তিন বোন পড়তে বসেছে। প্রেমা নামাজ পড়তে চায় না, ঘুমাতে চায়। হেমলতার মারের ভয়ে পড়ে। সে ঝিমুচ্ছে আর পড়ছে। তা দেখে পদ্মজা আর পূর্ণা ঠোঁট টিপে হাসছে। হেমলতা বিরক্ত হোন। প্রেমার তো পড়া হচ্ছেই না…সেই সঙ্গে পদ্মজা আর পূর্ণার মনোযোগ নষ্ট হচ্ছে। তিনি কর্কশ কণ্ঠে ধমকে উঠলেন, ‘প্রেমা, ঘুমাচ্ছিস কেন? ঠিক হয়ে পড়।’
আচম্বিত ধমকে চমকে উঠল প্রেমা, তাড়াতাড়ি পড়া শুরু করল চোখ খুলে। হেমলতা কিছুক্ষণ প্রেমাকে পর্যবেক্ষণ করে স্বাভাবিক গলায় বললেন, ‘পড়তে হবে না। ঘরে গিয়ে ঘুমা।’
প্রেমা একটু অবাক হয়। পরমুহূর্তেই খুশি হয়ে ছুটে যায় ঘরে। পূর্ণা মুখ ভার করে ফেলল। তারও তো পড়তে ইচ্ছে করছে না। কিন্তু মা কখনো তাকে ছাড় দেন না। হয়তো ছোটোবেলা ছাড় দিতেন, মনে নেই। সে আবার সব কিছু খুব দ্রুতই ভুলে যায়। ব্রেন ভালো প্রেমার, যা পড়ে মনে থাকে। পদ্মজার অবশ্য সবকিছুই স্বাভাবিক…
…শুধু রূপ বাদে।
.
সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গে হাতে ঝাকি জাল আর বড়শি নিয়ে মোর্শেদ বাড়িতে ঢুকলেন, কাঁধে পাটের ব্যাগ ঝুলানো। ভোরে মাছ ধরতে গিয়েছিলেন। তিনি বাড়ি ফিরলে পূর্ণা ও প্রেমা সবচেয়ে বেশি খুশি হয়। মাছ খেতে পারে অনেক! অর্থসংকটের জন্য হেমলতা খুব কম মাছ কেনেন। মোর্শেদ যতদিন বাড়িতে থাকেন, ততদিন মাছের অভাব হয় না। মোর্শেদ কিছু বলার আগেই পূর্ণা
ও প্রেমা গামলা নিয়ে ছুটে আসে উঠানে। তিনি কাঁধের ব্যাগ উলটে ধরলেন গামলার ওপর। পুঁটি, ট্যাংড়া, পাবদা, চিংড়ি মাছের ছড়াছড়ি লেগে যায়।
হেমলতা মনে মনে ভারি খুশি হোন। পদ্মজা লতা দিয়ে চিংড়ি খেতে খুব পছন্দ করে। আর প্রেমা-পূর্ণা পছন্দ করে পাবদা মাছের ভুনা। আড়াল থেকে পদ্মজা দেখছে, তার ঠোঁটেও হাসি। মেয়েগুলো খুব খুশি হয়েছে মাছ দেখে। মোর্শেদ বাড়ি থেকে বের হতেই লতা আনতে বাড়ির পেছনে ছুটে যাবে পদ্মজা।
প্রেমার মাথায় হাত বুলিয়ে হেমলতাকে উদ্দেশ্য করে মোর্শেদ বললেন, হুনো লতা। আমার আম্মারারে পাবদা ভুনা কইরা দিবা। সবজি-টবজি দিয়া রানবা না।’
‘আব্বা, আপনি বাড়িতে থাকবেন? তাইলে তো প্রতিদিনই মাছ খেতে পারি,’ বলল পূর্ণা।
মোর্শেদ আড়চোখে আড়ালে লুকিয়ে থাকা পদ্মজাকে একবার দেখে তীক্ষ্ণ চোখে হেমলতার দিকে তাকিয়ে পূর্ণাকে জবাব দিলেন, ‘কোনো রহম অশান্তি না হইলে তো থাকবামই।’
গামছা নিয়ে কলপাড়ে চলে যান তিনি। জন্মদাতার ইঙ্গিত বুঝতে পেরে পদ্মজার মুখটা ছোটো হয়ে যায়। প্রতিবার বাড়ি ছাড়ার আগে মোর্শেদ পদ্মজাকে কটুকথা শোনান। তখন হেমলতা রেগে গিয়ে জবাব দিলে তর্কা- তর্কি করে তিনি বাড়ি ছাড়েন।
‘মোর্শেদ নাকি? বাড়ি ফিরলা কোনদিন?’
মোর্শেদ গোসল সেরে সকালের মিষ্টি রোদ পোহাচ্ছিলেন। ঘাড় ঘুরিয়ে রশিদ ঘটককে দেখে হেসে বললেন, ‘আরে, মিয়া চাচা। আহেন, আহেন। পূর্ণারে চেয়ার আইননা দে। খবর কী?’
পূর্ণা চেয়ার নিয়ে আসে। রশিদ এক দলা থুতু উঠানে ফেলে চেয়ারে বসল আরাম করে। প্রেমাকে উঠানে খেলতে দেখে খসখসে গলায় ফরমায়েশ দিল, ‘এই মাইয়া, যা পানি লইয়া আয়। অনেকক্ষণ ধইরা দমডা আটকাইয়া আছে।’
প্রেমা রান্নাঘর থেকে পানি এনে দেয়। রশিদ পানি খেয়ে মোর্শেদকে বলল, ‘খবর তো ভালাই। তো বাবা ছেড়িডারে কী বিয়া দিবা না?’
‘দুই বছর যাক। পড়তাছে যহন মেট্রিকটা পাশ করুক। কী কন?’
‘মেজোডা না। বড়োড়া। তোমার বউ তো মরিচের লাহান। কোনোবায় ও রাজি অয় না। তুমি বোঝাও। পাত্র খাঁড়ি হীরা। বাপ-দাদার জমিদারি আছে।’
মোর্শেদ আড়চোখে হেমলতা এবং পদ্মজার উপস্থিতি পর্যবেক্ষণ করলেন— নেই ওরা। তিনি জানেন পদ্মজার উপর কোনোরকম জোরজবরদস্তি তিনি করতে পারবেন না। হেমলতা তা হতে দেবে না। এসব তো আর বাইরের মানুষের সামনে বলা যায় না। মোর্শেদ রশিদ ঘটককে নরম গলায় বললেন, ‘থাকুক না, পড়ুক। মায়ে যহন চায় ছেড়ি পড়ুক তাইলে পড়ুক।’
রশিদ নিরাশ হয়ে তাকিয়ে রইল। ভেবেছিল, মোর্শেদ হয়তো রাজি হবে। রশিদ এতদিন মেয়ের শ্বশুর বাড়িতে ছিল। এরপর বড়ো অসুখে পড়ে। তাই মোর্শেদ বাড়ি ফিরেছে শুনেও আসতে পারেনি। আজ একটু আরামবোধ হতেই ছুটে এসেছে অনেক আশা নিয়ে। কিন্তু মোর্শেদের জবানবন্দিতে সে আশাহত হলো। কটমটে গলায় বলল, ‘যুবতী ঘরে রাহন ভালা না। যহন বংশে কালি পড়ব তহন বুঝবা। হুনো মোর্শেদ, এই বয়সি মাইয়াদের স্বভাব চরিত্র বেশিদিন ভালা থাহে না। পাপ কাম এদের চারপাশে ঘুরঘুর কর। বেলা থাকতে জামাই ধরাইয়া দেওন লাগে। বুঝছ? তোমার বউরে বোঝাও।’
পাত্রের অনেক প্রশংসা করল রশিদ; জমিজমা, বাড়িঘর—সবকিছুর বাড়াবাড়ি রকমের বর্ণনা দিল। রশিদ ঘটক যেতেই মোর্শেদ হেমলতার পাশে গিয়ে বসেন, পদ্মজার বিয়ের কথা তুলেন ইনিয়েবিনিয়ে। হেমলতা সাফ নাকচ করে জানিয়ে দিলেন—কিছুতেই এখন মেয়ের বিয়ে দিবেন না। আর মোর্শেদকে পদ্মজার ব্যাপারে নাক গলাতেও মানা করে দেন। শেষ কথাটা বেশ কঠিন করেই বললেন, ‘আগে বাপ হও। পরে বাপের কাজ করতে এসো।’
মোর্শেদের তিরিক্ষি মেজাজ। রান্নাঘর ছেড়ে বেরিয়ে যান তিনি। রগে রগে তার রাগ টগবগ করছে। পদ্মজাকে বারান্দায় দেখে তিনি ঝাঁঝালো কণ্ঠে বললেন, ‘ছেড়ি যহন রূপ দিয়া নটি হইব, তহন আমার ঠ্যাংও পাইবা না। এই ছেড়ি মজা বুঝাইব।’
কথাটি শুনে পদ্মজার চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ে। হেমলতা রান্নাঘর থেকে বের হয়ে আসেন মোর্শেদকে কিছু কঠিন কথা শোনাতে। পদ্মজা তখন দৌড়ে আসে। হেমলতার হাতে ধরে রান্নাঘরের ভেতরে নিয়ে যায়। মোর্শেদ যতক্ষণ বাড়িতে থাকে, তারও ততক্ষণ খুব ভালো লাগে। পূর্ণা-প্রেমা কত খুশি হয়। বাড়িটা পরিপূর্ণ লাগে। সে চায় না বাবা ঝগড়া করে রাগ নিয়ে বাড়ি ছেড়ে চলে যাক। হেমলতা রাগে এক ঝটকায় মেয়ের হাত সরিয়ে দেন। তার সহ্য হয় না মোর্শেদকে। মানুষের কথা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হওয়া বদমেজাজি একজন মানুষ মোর্শেদ। ভালোটা কখনো বোঝে না, মানুষের কথায় নাচে। সারাক্ষণ একটা বাক্যই যেন জপ করে, ‘লোকে কী বলবে?’
.
মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে। মাথার ওপর বৃষ্টি নিয়ে মোর্শেদ বাড়ি ফেরেন। মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছে তিনি খুব খুশি। হেমলতাকে ডেকে বললেন, ‘এক মাসের লাইগগা ঘরটা ছাইড়া লাহাড়ি ঘরে উইঠঠা পড়ো।’
হেমলতা কিছু বললেন না। তার প্রশ্নবোধক চাহনি দেখে মোর্শেদ বললেন, ‘শুটিং করার লাইগগা মাতব্বর বাড়িত যারা আইছে হেরার নাকি শুটিংয়ের জন্যি আমার বাড়ি পছন্দ হইছে। বিরাট অংকের টেকা দিব কইছে। আমিও কথা দিয়া আইছি।’
হেমলতা রেগে যেতে গিয়েও পারলেন না। সত্যি, টাকা খুব দরকার। পদ্মজার সামনে মেট্রিক পরীক্ষা। কত খরচ! কলেজে পড়াতে ঢাকা পাঠাতে হবে। পদ্মজা যখন ছোটো ছিল তখনো একবার এই বাড়িতে শুটিং হয়েছিল। তিনি কিছুক্ষণ ভেবে বললেন, ‘টাকার কথা আমার সঙ্গে আলোচনা করতে বলো। নয়তো জায়গা হবে না।’
‘আরে..বলামনে। এখন সব গুছাও। ওরা কালই আইব।’
পূর্ণা আড়াল থেকে সবটা শুনেছে। সাত দিন হয়েছে লিখন শাহ আর চিত্রা দেবী অলন্দপুরে এসেছে। অথচ, সে দেখতে পারল না! হেমলতা যেতে অনুমতি দেননি। পূর্ণা নামাজের পর দোয়ায় খুব অনুনয় করে আল্লাহকে বলেছে, যেন লিখন শাহ আর চিত্রা দেবীকে স্বচক্ষে দেখতে পারে। আর এখন শুনছে তাদের বাড়িতেই নাকি আসছে ওরা! পূর্ণার মনে হচ্ছে খুশিতে সে মারা যাবে! বুকের ভেতর দম আটকে আসছে…
…পানি লাগবে…পানি।
.
‘এই, মগা আমাকে এক কাপ চা দাও তো।’
মগা ঝড়ের গতিতে চা নিয়ে আসে। চিত্রার পাশের চেয়ারটা টেনে তাতে বসল লিখন। এরপর মগাকে বলল, ‘দারুণ চা করো তো তুমি! ‘
কাঁচুমাচু হয়ে হাসল মগা। ভাবে বোঝা গেল, প্রশংসা শুনে ভীষণ লজ্জা পেয়েছে। এদিকে মগার ভাবভঙ্গি দেখে হেসে উঠল চিত্রা। চিত্রার হাসির সেই দৃশ্য মুগ্ধ হয়ে দেখছে মগা। মাতব্বর বাড়ির কামলা সে, চিত্রনায়ক লিখন শাহ এবং চিত্র নায়িকা চিত্রা দেবীর সেবা করার দায়িত্ব তাকে দেয়া হয়েছে। চিত্রার সুন্দর মুখশ্রীর সামনে সবসময় থাকতে পারবে ভেবে মগা ভীষণ খুশি। চিত্রা বলল, ‘তোমার ভাইয়ের নামটা যেন কী?’
চার ফুট উচ্চতার মগা উৎসাহ নিয়ে জবাব দিল, ‘মদন।’
চিত্রার হাসি পায়। অনেক কষ্টে চেপে রাখল।
মগা-মদন…এসবও কারো নাম হয়?
শুটিংয়ের মাঝে হুট করে আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামে। তাই আপাতত শুটিং স্থগিত আছে। বারান্দায় বসে বৃষ্টি দেখছে সবাই, প্রত্যেকের হাতে রং চা। ডিরেক্টর আবুল জাহেদের খিচুড়ির স্বাদ অতুলনীয়। তিনি আজ খিচুড়ি রান্না করছেন, বৃষ্টি দেখেই ঢুকে পড়েছেন রান্নাঘরে।
চিত্রা লাহাড়ি ঘরের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আচ্ছা, এই বাড়ির দুইটা মেয়ে কোথায়? আসার পর একবার এসেছিল। এরপর তো আর এলো না।
মগা বলল, ‘ওই যে লাহাড়ি ঘর। ওইডাত আছে।’
‘লাহাড়ি ঘর…সেটা কী?’
মগার বদলে লিখন জবাব দিল, ‘যে ঘরের অর্ধেক জুড়ে ধান রাখা হয়, আর অর্ধেক জায়গায় চৌকি থাকে কামলাদের জন্য—ওই ঘরকে এখানে লাহাড়ি ঘর বলে। বোঝা গেছে?
চিত্রা চমৎকার করে হাসল, ‘বোঝা গেছে। এই মগা, বৃষ্টি কমলে লাহাড়ি ঘরে যাব। ঠিক আছে?’
চিত্রার ‘এই মগা’ ডাক যেন মুহূর্তে মগার জগৎ-সংসারকে স্বর্গ করে তোলে। সে বাধ্যের মতো মাথা নাড়িয়ে বলল, ‘আইচ্ছা, আপা।’
চিত্রা লিখনের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তুমি যাবা? ওই তো সামনেই আলসেমি করো না।’
মগা হইহই করে উঠল, ‘না না, বেঠা লইয়া যাওন যাইত না। বাড়ির মালিকের মানা আছে।
মগার না করার তীব্রতা দেখে ভীষণ অবাক হলো সবাই। চিত্রা প্রশ্ন করল, ‘মানা কেন?’
‘বাড়ির বড়ো ছেড়িডারে তো আপনেরা দেহেন নাই। আগুন সুন্দরী। এই লিখন ভাইয়ের লাহান বিলাই চোখা। ছেড়িডারে স্কুল ছাড়া আর কোনোহানো যাইতে দেয় না। বাড়ি দিবার আগে কইয়া রাখছে—লাহাড়ি ঘরে বেঠামানুষ না যাইতে। এই ছেড়ি লইয়া বহুত্তা কিচ্ছা আছে।’
চিত্রা বেশ কৌতূহল বোধ করল। লিখন তীক্ষ্ণ ঘোলা চোখে লাহাড়ি ঘরের দিকে তাকাল। দেড় দিন হলো এখানে এসেছে। উঠানের শেষ মাথায় থাকা লাহাড়ি ঘরটা একবারো মনোযোগ দিয়ে দেখা হয়নি।
সামনের দরজাটা বন্ধ। দুটো ছোটো মেয়ে এসেছিল ঘরটার ডান পাশ দিয়ে। ঘরটার ডানে-বাঁয়ে-পেছনে গাছপালা। বাড়িটা পুরনো হলেও দারুণ।
তবে এই মুহূর্তে তার অন্যকিছুর প্রতি তীব্র কৌতূহল কাজ করছে।
পদ্মজা – ৫
মধ্যখানে চাদর টানিয়ে দুই ভাগ করা হয়েছে লাহাড়ি ঘরকে। একপাশের চৌকিতে হেমলতা এবং মোর্শেদ থাকেন। অন্যপাশেরটা পদ্মজা, পূর্ণা ও প্রেমার দখলে। লাহাড়ি ঘরের পেছনের দরজাটি আপাতত প্রধান দরজা হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
ঘরের পেছনে অসংখ্য কচু গাছ ছিল। হেমলতা মোর্শেদকে নিয়ে সব কচু কেটে জায়গা খালি করে সেখানে তৈরি করেছেন মাটির চুলা। বড়ো সড়কে ওঠার জন্য ঝোপঝাড় কেটে সরু করে পথ করা হয়েছে। এতে অবশ্য মোর্শেদের মত ছিল না। সড়কে ওঠার একটা পথ থাকতে আরেকটা পথ তৈরি করার বিপক্ষে তিনি। হেমলতা দুই মেয়েকে নিয়ে সব ঝোপঝাড় সাফ করেছেন। শুটিং দলে অনেক পুরুষ। পদ্মজাকে ভুলেও তাদের সামনে দিয়ে আসা-যাওয়া করতে দেওয়া যাবে না। হেমলতার মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে, পদ্মজার মুখ পুড়িয়ে দিতে। পরক্ষণেই নিজের ওপর ঘৃণা হয়। একজন মায়ের মনে কী করে নিজের মেয়েকে নিয়ে এমন ভাবনা আসতে পারে? পদ্মজার হাতে সূচ ফুটলে তার মনে হয় নিজের শরীরে আঘাত লেগেছে। কেন এত টান পদ্মজার প্রতি? ভেতরে ভেতরে এই প্রশ্নের উত্তর তিনি জানেন। শুধু প্রকাশ পায় না, না জানার ভান ধরে থাকেন।
থাকতে হয় তাকে।
‘আম্মা, আজ আমি রাঁধি?’
পদ্মজার প্রতিদিনকার প্রশ্ন! হেমলতা রাঁধতে দেবেন না জানা সত্ত্বেও পদ্মজা প্রতিদিন অনুরোধ করে। হেমলতা বিপদ-আপদ ছাড়া পদ্মজাকে রান্নাঘরে পাঠান না। সোনার শরীরে পাতিলের কালি লাগুক চান না তিনি। হেমলতা হাসেন, পদ্মজা মুগ্ধ হয়ে দেখে। হেমলতার বয়স ছয়ত্রিশ। শ্যামলা চেহারা, দাঁতগুলো ধবধবে সাদা; চোখের মণি অন্যদের তুলনার বড়ো এবং কালো, চোখ দুটিকে পদ্মজার গভীর পুকুর মনে হয়। ছিমছাম গড়ন। পূৰ্ণা যেনো মায়েরই কিশোরী শরীর। তবে তারা তিন বোনই মায়ের মতো চিকন আর লম্বা হয়েছে।
হেমলতা সম্মতি দিয়ে বললেন, ‘আজ তুই রাঁধবি।’
পদ্মজা ভাবেনি অনুমতি পাবে। সে আদুরে উল্লাসে প্রশ্ন করল, সত্যি আম্মা?’
‘সত্যি। আছরের আজান সেই কবে পড়েছে! দ্রুত যা।’
পদ্মজা রান্নার প্রস্তুতি নিচ্ছে। পূর্ণা-প্রেমা হিজল গাছের নিচে পাটি বিছিয়ে লুডু খেলছে। প্রেমা বার বার বাটপারি করায় এ নিয়ে কিছুকক্ষণ পর পর তর্কও হচ্ছে তাদের মাঝে।
সকালে বৃষ্টি হয়েছিল। রান্না করতে গিয়ে পদ্মজা ভেজা মাটির সোঁদা গন্ধ পেল। মাটির ঘ্রাণ তাকে খুব টানে।
মোর্শেদ বাড়ি ফিরে পদ্মজাকে রাঁধতে দেখে কপাল কুঁচকে ফেলেন। ঘরে ঢুকে হেমলতাকে মেজাজ দেখিয়ে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন, ‘এই ছেড়ি রান্ধে ক্যান?’
হেমলতা নির্লিপ্তভাবে জবাব দেন, ‘আমি বলেছি।’
‘কতদিন কইছি—এই ছেড়ির হাতের রান্ধন আমারে না খাওয়াইতে?’
মোর্শেদের কঠিন স্বর পদ্মজার কানে আসে। মায়ের অনুমতি পাওয়ার খুশিটুকু মুহূর্তে ফাটা বেলুনের মতো চুপসে যায়। সে জানে এখন ঝগড়া শুরু হবে। তার আম্মা, আব্বার অনুচিত কথাবার্তা মাটিতে পড়তে দেন না। তার আগেই জবাব ছুঁড়ে দেন।
‘খেতে ইচ্ছে না হলে খাবা না।’
রাইতবেলা না খাইয়া থাকবাম আমি?’
‘খাবার রেখেও যদি না খেতে চাও সেটা তোমার সমস্যা। আমি বা আমার মেয়ে কেউই না করিনি।’
মোর্শেদ কিছু নোংরা কথা শোনাতে প্রস্তুত হোন। হেমলতা সেলাই মেশিন রেখে উঠে দাঁড়ান। তিনি বুঝে গিয়েছেন মোর্শেদ কী বলবেন। আঙুল তুলে শাসিয়ে মোর্শেদকে বললেন, ‘একটা নোংরা কথা উচ্চারণ করলে আমি আজ তোমাকে ছাড় দেব না। পদ্ম তোমার মেয়ে। আল্লাহ সইবে না। নিজের মেয়ে সম্পর্কে এত নোংরা কথা কোনো বাবা বলে না।’
মোর্শেদ নোংরা কথাগুলো হজম করে নিলেন। তবে কিড়মিড় করে বললেন, ‘পদ্ম আমার ছেড়ি না।’
‘পদ্ম তোমার মেয়ে। আর একটা কথাও না। বাড়িতে অনেক মানুষ। নিজের বিকৃত রূপ লুকিয়ে রাখ।’
মোর্শেদ দমে যান। চৌকিতে বসে বড়ো করে নিশ্বাস ছাড়েন। চোখের দৃষ্টি অস্থির। পদ্মজার জন্মের পর থেকেই হেমলতার রূপ পালটে গেছে। কিছুতেই এই নারীর সঙ্গে পারা যায় না। অথচ, একসময় হেমলতাকে কত মেরেছেন! হেমলতার পিঠে, উরুতে, ঘাড়ে এখনো মারের দাগ আছে। সময় কোন যাদুবলে হেমলতাকে পালটে দিল, জানা নেই মোর্শেদের।
.
রাতের একটা শুট করে সবাই বিশ্রাম নিচ্ছিল। চিত্রা তখন কথায় কথায় জানাল, ‘মগা যে মেয়েটার কথা বলেছিল, তাকে দেখতে লাহাড়ি ঘরে গিয়েছিলাম।’
চিত্রার কথায় লিখন আগ্রহ পেল না। মেয়েটা কখনো কোনো মেয়ের প্রশংসা করে না। খুঁত খুঁজে বের করে সেটা নিয়ে আলোচনা করতে তার ভীষণ আগ্রহ। নিজেকে সে খুঁতহীন সেরা সুন্দরী মনে করে। ‘মেয়েটার নাম পদ্মজা। মগা, পুরো নামটা যেন কী?’
চিত্রা ওর সঙ্গে কথা বললে, মগা খুব লজ্জা পায়। এখনো পেল। লাজুক ভঙ্গিতে জবাব দিল, ‘উম্মে পদ্মজা।’
‘হ্যাঁ, উম্মে পদ্মজা।’
চিত্রার পাশ থেকে সেলিনা পারভীন প্রশ্ন করলেন, ‘কী নিয়ে আলাপ হচ্ছে?’
সেলিনা পারভীন চলমান চলচ্চিত্রে চিত্রার মায়ের অভিনয় করছেন। চিত্রা বলল, ‘এই বাড়ির মালিক যিনি, উনার বড়ো মেয়ের কথা বলছি। এমন সুন্দর মুখ আমি দুটি দেখিনি। মেয়েটার মুখ দেখলেই বুকের ভেতর নিকষিত, বিশুদ্ধ ভালো লাগার জন্ম হবে। ভগবান এত শ্রী দিয়েছেন মেয়েটাকে!
হতবাক হয়ে গেল লিখনসহ উপস্থিত প্রত্যেকে। চিত্রার মুখে অন্য নারীর প্রশংসা! অবিশ্বাস্য! সবাইকে অবাক হয়ে তাকাতে দেখে বিব্রতবোধ করল চিত্রা। গলার জোর বাড়িয়ে বলল, ‘সত্যি বলছি! সন্ন্যাসী ছাড়া কোনো পুরুষ এই মেয়েকে উপেক্ষা করতে পারবে না।’
পদ্মজাকে নিয়ে বেশ খানিকক্ষণ আলোচনা চলল তাদের মাঝে। আগ্রহ বেশি দেখাল লিখন। কিন্তু যখন শুনল পদ্মজার ষোলো বছর, তখন দমে গেল। ছোটো মেয়ে! হয়তো এমন বয়সি বেশিরভাগ মেয়েরা স্বামীর ঘরে থাকে, তবুও লিখনের পদ্মজাকে খুব ছোটো মনে হচ্ছে। তার একটা বোন আছে, ষোলো বছরের। এখনো দুই বেণি করে স্কুলে যায়, কত ছোটো দেখতে! নিজের ক্ষণ-সময়ের অভিলাষের কথা ভেবে আনমনে হেসে উঠল লিখন। চিত্রা তখনো পদ্মজার রূপের প্রশংসা করছিল।
.
হিজল গাছের নিচে দাঁড়িয়ে আছে পদ্মজা। রাতের জোনাকি পোকা চারিদিকে। পদ্মজা প্রায় রাতে মুগ্ধ হয়ে দেখে জোনাকি পোকাদের। মনে হয় দল বেঁধে হারিকেন নিয়ে নাচছে তারা! তবে এই মুহূর্তে রাতের সৌন্দর্যটুকু পদ্মজার মনে দাগ কাটতে পারছে না। ঠোঁট কামড়ে কাঁদছে সে, খুব জ্বলছে চোখ দুটো। রান্না খারাপ হওয়ার অজুহাতে থালা ভরতি ভাত-তরকারি তার মুখে ছুঁড়ে দিয়েছেন মোর্শেদ। চোখে ঝোল পড়েছে, তা নিয়ে হেমলতার সে কী রাগ! মোর্শেদ অবশ্য চুপ ছিলেন। তিনি তো রাগ মিটিয়েই ফেলেছেন। আর তর্ক করে কী হবে?
পেছনে এসে হেমলতা দাঁড়ালেন। ডাকলেন, ‘পদ্ম?’
পদ্মজা তাকাল।
হেমলতা ভেজা কণ্ঠে প্রশ্ন করলেন, ‘খুব জ্বলছে?’
পদ্মজা জবাব দিতে পারল না। ঠোঁট ভেঙে কেঁদে উঠল। মা ছাড়া পৃথিবীতে আর কেউ নেই তার। মা বাদে আর কারো আদরও পাওয়া হয়নি। সবাই তার দোষ খোঁজে। হেমলতার বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেরোল। পদ্মজা ছিঁচকাঁদুনে। ছোটো থেকে বাবার অনাদর আর অপমানে বিদ্ধ হয়ে কেঁদে চলেছে তবুও চোখের জল ফুরোয় না, মন শক্ত হয় না। এমন হলে তো চলবে না!
পদ্মজার কান্নার বেগ বাড়ল। হেমলতা সদ্য কাটা বড়ো গাছটির গুঁড়িতে বসে, চুপ করে পদ্মজার ফোঁপানো শুনছেন। একটিবারের জন্যও কান্না থামানোর চেষ্টা করলেন না। যখন চাঁদ মাথার উপরে চলে এলো তখন ক্লান্ত হয়ে পদ্মজা নিজেই থেমে গেল। শান্ত হয়ে বসল মায়ের পাশে। হেমলতা উদাস গলায় বললেন, ‘এভাবে চলবে না পদ্ম।
পদ্মজা মায়ের দিকে তাকাল। হেমলতা বললেন, ‘শোন পদ্ম, কেউ আঘাত করলে কাঁদতে নেই। কারণ মানুষ আঘাত করে কাঁদানোর জন্যই। যখন উদ্দেশ্য সফল হয়ে যায় তখন তারা শান্তি পায়। যে তোকে আঘাত করল তাকে কেন তুই শান্তি দিবি? শক্ত থাকবি। বুঝিয়ে দিবি তুই এত দুর্বল না। যাকে তাকে পাত্তা দিস না। হাজার কষ্টেও কাঁদবি না। কান্না সাময়িক সময়ের জন্য মন হালকা করে। পুরোপুরি নয়। যে তোকে আঘাত করবে তাকে তুই তোর চাল-চলন দিয়ে ছিন্নভিন্ন করে দিবি। তখন তার মুখটা দেখে তোর যে শান্তিটা হবে সেটা কান্না করার পর হবে না। এই শান্তি স্থায়ী!’
হেমলতার কথা পদ্মজার ওপর প্রভাব ফেলল না। সে করুণ স্বরে বলল, ‘কিন্তু আব্বার ব্যবহার আমার সহ্য হয় না আম্মা। আমার সঙ্গে কেন এমন করে আব্বা?
‘তাকে কখনো সামনাসামনি আব্বা ডাকার সুযোগ পেয়েছিস? পাসনি! তবুও কেন আব্বা-আব্বা করিস? তুইও তাকে পাত্তা দিবি না।’
‘তুমি খুব কঠিন আম্মা।’
‘তোকেও হতে হবে।’
‘আব্বা কেন এমন করে, আম্মা? আমি কি আব্বার মেয়ে না? আব্বা কেন বার বার বলেন, আমি তার মেয়ে না।’
এহেন প্রশ্নে হেমলতা চোখ সরিয়ে নিলেন। পদ্মজা জানে এই জবাব সে পাবে না। সে দাঁতে দাঁত চেপে কান্না আটকানোর চেষ্টা করল।
হেমলতা পরম স্নেহে একহাত পদ্মজার মাথায় রেখে বললেন, ‘কাঁদিস না আর। মায়ের রং না হয় পাসনি। মায়ের মতো শক্ত হওয়ার তো চেষ্টা করতেই পারিস।’
পদ্মজা নির্লজ্জ হয়ে আবার প্রশ্ন করল, ‘আম্মা, আমি কি আব্বার মেয়ে না? বলো না আম্মা।’
পদ্মজার চোখ বেয়ে জল পড়ছে। মায়া হচ্ছে হেমলতার, বুক ভারি হয়ে আসছে। তিনি আবেগ লুকিয়ে কণ্ঠ কঠিন করার চেষ্টা করলেন, ‘মার খাবি, পদ্ম। কতবার বলব, তুই আমার আর তোর আব্বার মেয়ে!’
‘কী নাম আমার আব্বার?’
কী শান্ত কণ্ঠ পদ্মজার! হেমলতা চমকালেন, তবে তা প্রকাশ করলেন না। মেয়েদের সামনে তিনি কখনো দুর্বল হতে চান না। পদ্মজার দিকে ঝুঁকে কণ্ঠ খাদে নামিয়ে বললেন, ‘তোর আব্বার নাম, মোর্শেদ মোড়ল।’
পদ্মজা হতাশ হয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। মার ওপর বিরক্তি জন্মাছে, খুব কঠিন করে বলতে ইচ্ছে হচ্ছে, যাও এখান থেকে। আমার কাছে আর আসবে না। কখনো না।’
কিন্তু এমন ব্যবহার কখনো করতে পারবে না সে…কক্ষনো না। রাতের বাতাসে ভেসে আসছে হাসনাহেনা ফুলের ঘ্রাণ, আকাশে থালার মতো চাঁদ; ঝিরিঝিরি মোলায়েম বাতাস চারিদিকে। পদ্মজার চোখের জল শুকিয়ে যায়। হেমলতা ঝিম মেরে বসে আছেন। মা-মেয়ে পাশাপাশি বসে থেকেও যেন কত দূরে! নিজেদের মতো ভেবে যাচ্ছে এটা-সেটা নিয়ে। হঠাৎ নিস্তব্ধতা কাটিয়ে একটা অসহায় কণ্ঠ ভেসে এলো: ‘মায়েরা তাদের জীবনের গোপন গল্প সন্তানদের বলতে পারে নারে পদ্ম।’
পদ্মজা তাকাল। হেমলতা ছলছল চোখে তাকিয়ে আছেন। পদ্মজার বুকের ভেতরটা হু হু করে ওঠে। এই মানুষটাকে এত নরম রূপে মানায় না।
মাকে আশ্বস্ত করে পদ্মজা বলল, ‘আমি আর কখনো জানতে চাইব না আম্মা।’
শুটিং দলের একজনও বাড়িতে নেই। সবাই স্কুল মাঠে গেছে। কয়দিন ধরে নদীর ঘাটে যেতে না পেরে তৃষ্ণার্থ হয়ে উঠেছে পদ্মজা। এই সুযোগ হাতছাড়া করা যায় না। হেমলতার অনুমতি নিয়ে সে ঘাটে চলে যায়, সিঁড়িতে বসে আয়েশ করে। কয়েক মুহূর্ত পর শুনতে পায়, গান বাজছে কোথাও। পদ্মজা গানের সুর অনুসরণ করে নিচের দিকে নামে। ঘাটের বাঁ- পাশে বাঁধা নৌকায় একজন পুরুষ বসে আছে, হাতে রেডিয়ো। গানের উৎস তাহলে এখানেই। পদ্মজা বিব্রতবোধ করে। দ্রুত উলটো দিকে ঘুরে ব্যস্ত পায়ে চলে আসে লাহাড়ি ঘরে। তাকে এত দ্রুত ফিরতে দেখে হেমলতা প্ৰশ্ন করলেন, ‘কেউ ছিল?’
পদ্মজা ওপর-নিচে মাথা নাড়াল। হেমলতা চিন্তিত স্বরে প্রশ্ন ছুঁড়লেন, ‘কিছু বলেছে? দেখতে কেমন?’
‘না, আম্মা, কিছু বলেনি। আমাকে দেখেনি। মাথার চুল ঝাঁকড়া। মুখ খেয়াল করিনি।’
পূর্ণা অংক করছিল। পদ্মজার মুখে আগন্তুকের বর্ণনা শুনে হই হই করে উঠল, ‘এইটাই তো লিখন শাহ, নায়ক।’
হেমলতা আড়চোখে মেয়ের দিকে তাকান। নায়ক-নায়িকাদের প্রতি পূর্ণার যে তীব্র আগ্রহ, তা ভালো লাগে না তার। পূর্ণা মায়ের চাহনি দেখে দমে যায়।
সারাক্ষণ শুটিং দলের আশপাশে ঘুরঘুর করে মেয়েটা। হেমলতা বিরক্ত হয়ে তাকে কড়া নিষেধ দিয়েছেন, আর যেন না যায়; যদি যায়…মার একটাও মাটিতে পড়বে না। পূর্ণা ভয় পেয়েছে। কিন্তু লিখন শাহ আর চিত্রা দেবী জুটিটা এত ভালো লাগে তার যে শুটিং না দেখলে দম বন্ধ হয়ে আসে। তাই সে চুপিসারে টিনে একটা ছিদ্র করেছে। হেমলতা সেলাই মেশিন রেখেছেন লাহাড়ি ঘরের পেছনের বারান্দায়, সারাক্ষণ সেখানেই থাকেন। সেই সময় পূর্ণা ছিদ্র দিয়ে উঁকি দিয়ে শুটিং দেখে।
পূর্ণার এই আচরণ দেখতে দেখতে একদিন পদ্মজারও আগ্রহ জন্মাল। সাত-পাঁচ ভেবে একদিন উঁকি দিয়ে বসল সে-ও।
ঝাঁকড়া চুলের মানুষটি একজন অতি সুন্দরী মেয়েকে কোলে তুলে নিয়েছে। মানুষটির দৃষ্টি মোহময়। বাড়ি জুড়ে গানের সুরধ্বনি। কেউ কেউ ক্যামেরা ধরে রেখেছে। গানের শুটিং চলছে বোধহয়! অদ্ভুত ঠেকছে পদ্মজার, লজ্জা পেয়ে চোখ সরিয়ে নিলো সে।
৬
রাতে ঝড় উঠেছিল। লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে বহু গাছপালা। লাহাড়ি ঘরের পেছনে তৈরি পথ বন্ধ হয়ে গেছে গাছের ভাঙা ডালপালা পড়ে। মোর্শেদ রাতে বাড়ি ফেরেননি। হেমলতার একার পক্ষে সম্ভব নয় ডালপালা সরানো। তাই পদ্মজা আর পূর্ণা স্কুল থেকে ফিরছিল বাড়ির সামনের পথ দিয়ে। উঠোনে শুটিং দলের সবাই উপস্থিত। পদ্মজার মাথা নত, ঘোমটা টানা লম্বা করে। এত মানুষের সামনে দিয়ে যেতে তার হাঁটু কাঁপছে। আজ যেন পথ শেষই হচ্ছে না। উপস্থিত অনেকের নজরে চলে এলো পদ্মজা। মিলন নামে একজন পূর্ণাকে ডাকল, ‘এই পূৰ্ণা!’
পূর্ণা দাঁড়াল, সঙ্গে পদ্মজা; যদিও মেয়েটা শুটিং দলটির দিকে তাকাচ্ছে না। মিলন পদ্মজার দিকে চোখ স্থির রেখে পূর্ণাকে প্রশ্ন করল, ‘পাশের মেয়েটা কে? প্রথম দেখছি।’
‘আমার বড়ো আপা।’
‘আপন?’
মিলন আশ্চর্য হয়ে বলল। দশ দিন হলো তারা এখানে এসেছে, কখনো পূর্ণা-প্রেমা ছাড়া কোনো মেয়েকে চোখে পড়েনি, কণ্ঠও শোনা যায়নি। তাই বড়ো বোন বলাতে সে খুব অবাক হলো। পূর্ণা হেসে বলল, ‘হুম। আপন। ‘
মিলন বিড়বিড় করে বলল, ‘চেহারায় তো মিল নেই।’
‘সবাই বলে।’
‘আচ্ছা, যাও।’
দুই বোন লাহাড়ি ঘরে চলে যায়, হাঁফ ছেড়ে বাঁচে পদ্মজা। ভেতরটা এত কাঁপছিল! সে অনেক মানুষের পা দেখেছে, তবে চোখ তুলে তাদের মুখ দেখার সাহস হয়নি। কিন্তু হ্যাঁ…ইচ্ছে হয়েছিল বটে! সিনেমায় যারা অভিনয় করে, তারা দেখতে কেমন? সাধারণ মানুষের মতোই?
নাকি অন্যরকম?
.
বিকেলে হাজেরা নামক এক মহিলা আসে মোড়ল বাড়িতে, সে সবুর মিয়ার স্ত্রী। সবুর দিনরাত গাঁজা খেয়ে পড়ে থাকে, বউ-বাচ্চাদের খোঁজ রাখে না। হাজেরা এর-ওর বাড়ি গিয়ে এটা-ওটা চেয়ে নেয়, খায় দুই বাচ্চাকে সঙ্গে নিয়ে। পদ্মজার খুব মায়া হয় হাজেরার জন্য। মহিলা আসতেই হেমলতা পদ্মজাকে প্রশ্ন করলেন, ‘গাছে কয়টা লাউ আছে?’
‘নয়টা, আম্মা।’
‘পূর্ণা কোথায়? ওরে বল দুইটা লাউ হাজেরাকে দিয়ে দিতে। কাঁচামরিচও দিতে বলবি।’
পদ্মজার নীরবতা দেখে হেমলতা বুঝতে পারেন পূর্ণা বাড়িতে নেই। ‘পূর্ণা কী টিভি দেখতে গেছে?’
পদ্মজাকে দ্বিধাগ্রস্ত হতে দেখা গেল। বিব্রতভাবে বলল, ‘আম্মা, আমাকে ব…বলে গেছে।’
‘তুই ওর অভিভাবক? একটু শরীরটা খারাপ লাগছিল বলে শুয়েছিলাম। ওমনি সুযোগ লুফে নিয়েছে!
‘আম্মা, আমার দোষ। পূর্ণাকে কিছু বোলো না।
পদ্মজার ভেজা কণ্ঠ হেমলতার রাগ উড়িয়ে দিল। তিনি অন্য দিকে মুখ করে শুয়ে বললেন, ‘হাজেরাকে নিয়ে যা। ঘোমটা টেনে যাবি। বেগুন বেশি থাকলে কয়টা দিয়ে দিস।’
পদ্মজার মন ভরে গেল। তার মা এত বেশি উদার! কখনো কাউকে ফিরিয়ে দেন না। সামর্থ্যের মধ্যে আরো বেশি কিছু দেওয়ার মতো থাকলে, তিনি কখনো কার্পণ্য করেন না। তবে হাজেরার স্বভাব অভাবে নষ্ট হয়ে গেছে, চুরি করার প্রবণতা আছে তার মাঝে। তাই পদ্মজাকে সঙ্গে যেতে বলেছেন।
উঠোনের এক কোণে, লাহাড়ি ঘরের ডান পাশে লাউয়ের মাচা। নয়টা লাউ ঝুলছে তাতে। চোখের সামনে শুধু তরতাজা, টাটকা সবুজ পাতা। পদ্মজা বাড়ির দিকে তাকাল না। একটা লাউ হাজেরার হাতে দিয়ে বলল, ‘কী দিয়ে রান্না হবে?’
‘জানি না গো পদ্ম। গিয়া দেহি মাছ মিলানো যায়নি।’
‘তোমার ছোটো ছেলের ঠান্ডা কমেছে?’
পদ্মজা কাঁচামরিচ ছিঁড়ে হাজেরার আঁচল ভরে দিল। হাজেরা গুঞ্জন করে কাঁদছে আর বলছে, ‘ছেড়াডা সারাদিন মাডিত পইড়া থাহে একলা একলা। রাইত হইলে জ্বরে কাঁপে। দম ফালাইতে পারে না।’
‘ডাক্তার দেখাচ্ছ না কেন?’
‘টেহা লাগব না? কই পামু?’
‘তুমি মাতব্বর বাড়িতে যাও। শুনছি, উনারা খুব দান-খয়রাত করেন।’
হাজেরা বাধ্যের মতো মাথা নাড়াল। বেগুন গাছ বাড়ির পেছনে। সাবধানে বাড়ির পেছনে গেল পদ্মজা। সে মনে মনে ভাবছে—হাজেরার ছেলে সুস্থই আছে। সকালেই দেখেছে ছেলেটাকে, দিব্যি খেলাধুলা করছিল। দেখে যে কেউ বলবে: সুস্থ। হাজেরা মিথ্যা বলছে।
মানুষের খুব অভাব পড়লে বুঝি এমনই হয়?
‘এতো সবজি আছে! টমেটো নেই? পাওয়া যাবে?
পরিষ্কার সহজ গলায় বলা পুরুষালী কণ্ঠটা পদ্মজাকে মৃদু কাঁপিয়ে তুলল। ঘুরে তাকাল সে, ব্রিত বোধ করল লিখনকে দেখে। কারো সামনে নিজের অস্বস্তি প্রকাশ করা উচিত না—কথাটি হেমলতা বলেছেন। পদ্মজা হাসার চেষ্টা করে জবাব দিল, ‘এই বর্ষাকালে টমেটো কোথায় পাবেন?
‘বর্ষাকালে টমেটো চাষ হয় না?’
‘টমেটো শীতকালীন ফসল।’
‘গ্রীষ্ম-বর্ষাতেও তো পাওয়া যায়।’
পদ্মজা অস্বস্তি লুকিয়ে রাখতে পারছে না। স্কুলের শিক্ষক আর খুব আপন মানুষগুলো ছাড়া কোনো পর-পুরুষের সঙ্গে তার কখনো কথা হয়নি। লিখনের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে জবান বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। সে চুপচাপ বেগুন বুঝিয়ে দিল হাজেরাকে। লিখন বলল, ‘আমি তো গতবার বর্ষাকালেও টমেটোর সালাদ তৈরি করেছি!’
‘হয়তো টমেটোর জাত আলাদা ছিল। আমাদের এখানে সাধারণত শীতকালেই টমেটো হয়।’
দ্রুত জবাব দিয়ে লাহাড়ি ঘরে ফিরল পদ্মজা। মনে হচ্ছে পর-পুরুষের সঙ্গে কথা বলে ঘোর পাপ করে ফেলেছে, পাপ মোচন করতে হবে। ঘরে ঢুকে ঢকঢক করে দুই গ্লাস পানি খেল। হেমলতা ঘুমাচ্ছেন। নয়তো পদ্মজার মুখ দেখে নির্ঘাত বুঝে যেতেন, কিছু একটা ঘটেছে। পদ্মজা ভক্তি নিয়ে আল্লাহ তায়ালার প্রতি শুকরিয়া আদায় করল।
.
হেমলতা সালোয়ার-কামিজ সেলাই করছিলেন। তখন বারান্দার সামনে একজন পুরুষ লোক এসে দাঁড়াল। শাড়ির আঁচল মাথায় টেনে নিলেন হেমলতা, জিজ্ঞাসু দৃষ্টি নিয়ে তাকালেন লোকটা দিকে। লোকটি হেসে বলল, ‘আমি শুটিং দলের মিলন।’
হেমলতা জোরপূর্বক হাসার চেষ্টা করলেন। আড়চোখে তাকালেন ঘরের দরজার দিকে। পদ্মজা ঘুমাচ্ছে, দরজাটা লাগানো দরকার। তিনি সোজা প্রশ্নে চলে যান, ‘কোনো দরকার?’
‘না, এমনি দেখতে আসলাম। কতদিন হলো আপনাদের বাড়িতে উঠলাম। এদিকটায় আসা হয়নি।’
হেমলতা পেঁচিয়ে কথা বলা পছন্দ করেন না। সরাসরি বলে উঠলেন, ‘এদিকে আসা নিষেধ। আপনাদের বলা হয়নি?’
মিলনের জ্বলজ্বল করা চোখেমুখে ছায়া নেমে আসে, অপমানিত বোধ করল সে। আমতা আমতা করে বলল, ‘ইয়ে…আচ্ছা, আসছি।’
মিলন স্থান ত্যাগ করল। তবে যাওয়ার পূর্বে তার তীক্ষ্ণ চোখের দৃষ্টি হেমলতার নজর এড়াতে পারল না। হেমলতা চোখ বুজে জীবনের হিসেব কষেন, নরম দৃষ্টিতে তাকান ঘুমন্ত পদ্মজার দিকে। তিনি নিশ্চিত, এই লোক পদ্মজাকেই দেখতে এসেছিল।
এখন পূর্ণার চেয়ে পদ্মজার বেশি আগ্রহ শুটিং দেখার। টিনের ছিদ্র আরো দুটো করেছে। লিখন শাহকে দেখলে তার ঠান্ডা, কোমল অনুভূতি হয়। এই অনুভূতির নাম সে জানে না। শুটিংয়ে লিখন শাহ কত ভালোবাসেন চিত্রা দেবীকে, পদ্মজার দেখতে খুব ভালো লাগে।
পূর্ণা তেলের বোতল নিয়ে বলল, ‘আপা, তেল দিয়ে দাও না।’
‘সোনা বোন, একটু দাঁড়া।’
পদ্মজা ছিদ্র দিয়ে লিখন শাহর হাসি, কথা বলার ভঙ্গী দেখছে। লজ্জাও পাচ্ছে। সময়টাকে থামিয়ে দিতে ইচ্ছে হচ্ছে তার।
‘এই আপা। পরেও তো দেখতে পারবে। দিয়ে দাও না।’
‘আরেকটু। শুটিং শুরু হচ্ছে। একটু…’
পূর্ণার রাগ হয় খুব। কিন্তু সে আপাকে কিছু বলবে না। তার সব ইচ্ছের সঙ্গী, সব গোপন কথার স্বাক্ষী তার আপা। আপাকে খুব ভালোবাসে সে। মাঝে মাঝে মনে হয়…সেই ভালোবাসাটুকু যেন মায়ের প্রতি ভালোবাসার চাইতেও বেশি…কিংবা হয়তো না। পদ্মজা মিটিমিটি হাসছে। পূর্ণা তেল রেখে ছিদ্র দিয়ে উঁকি দিল।
নাহ! তার এখন ভালো লাগছে না এসব দেখতে। চোখ সরিয়ে নিলো সে।
‘কী রে পদ্ম? কী দেখছিস?’
হেমলতার কণ্ঠ শুনে চমকে উঠল পদ্মজা। আরক্ত হয়ে উঠল তার গাল। ডাকাতি করতে গিয়ে বাড়ির মালিকের কাছে ধরা পড়লে যেমন অনুভূতি হয়, তেমন অনুভূতি হচ্ছে তার। উহু, এই অনুভূতি আরও বেশি ভয়ংকর! হেমলতার দৃষ্টি গেল টিনের ছিদ্রের দিকে। সঙ্গে সঙ্গে পদ্মজা অনুভব করল, তঁর পায়ের নিচের মাটি কাঁপছে। পূর্ণা ভয়ার্ত চোখে একবার মাকে একবার বোনকে দেখছে।
ছিদ্রের গুরু তো সে! মারও সে খাবে।
৭
হেমলতা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দুই মেয়েকে দেখছেন। টিনের গায়ে তৈরি ছিদ্র তিনটের দিকে চোখ রেখে প্রশ্ন করলেন, ‘শুটিং দেখছিলি?’
পদ্মজা বাধ্যের মতো মাথা ঝাঁকায়। হেমলতা চোখ দুটি হঠাৎ শীতল হয়ে এলো।
তিনি চৌকিতে বসে প্রশ্ন ছুঁড়লেন, ‘ছিদ্রের বুদ্ধি পূর্ণার?
প্রশ্নটা শুনে পূর্ণার গলা শুকিয়ে যায়। এক ফোঁটা পানি দরকার, নয়তো দম বেরিয়ে যাবে। পদ্মজা চকিতে চোখ তুলে তাকাল। অসহায় কণ্ঠে বলল, ‘আম্মা, আর হবে না। পূর্ণাকে কিছু বলো না। ওর দোষ নেই। আমি…’
হেমলতা পদ্মজাকে কথা শেষ করতে দিলেন না। প্রেমাকে ডেকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘প্রেমা, তোর আব্বা কোথায়?’
‘উঠানে আম্মা।’
‘গিয়ে বল, আমি ডাকছি।’
প্রেমা একছুটে গিয়ে আবার একছুটে ফিরে এলো। হেমলতা বারান্দা পেরিয়ে চুলার কাছে গিয়ে বসেন। তখন মোর্শেদ এসে জানতে চাইলেন, ‘কী হইছে? ডাক ক্যারে?’
‘মেয়েদের চৌকির পাশে একটা জানালা করে দাও। মুরগির খোপের কাছে কাঠ আছে।’
‘কেন?’
‘আমি চেয়েছি তাই, না পারলে না করো; অন্য কাউকে ডাকব।’
‘ত্যাড়া কথা কওন ছাড়ো।’
‘তোমার সঙ্গে ভালো করে কথা বলতে ভালো লাগে না।’
‘লাগব ক্যারে? তোমার তো আমারে পছন্দ না। তোমার পছন্দ বিলাই চোখা ব্যাটা ছ্যাড়ারে।’
‘অহেতুক কথা বোলো না। মাসের পর মাস কোথায় থাকো, তা আমার অজানা নয়। রোগে ধরলেই লতার কথা মনে পড়ে।’
মোর্শেদ মিনিটখানেক রাগ নিয়ে তাকিয়ে রইলেন।
.
মোর্শেদ ঘণ্টাখানেক সময় নিয়ে দুই ফুট উচ্চতার একটি জানালা তৈরি করে দিলেন। পদ্মজা-পূর্ণা হতবাক, সেই সঙ্গে খুশিও। হেমলতা জানালায় ছোটো পর্দা টানিয়ে দিলেন। রুম থেকে বাইরের দৃশ্য দেখা যায়, কিন্তু জানালার ওপাশে কে আছে তা বাহির থেকে বোঝা যায় না।
সন্ধ্যায় শুটিং শুরু হলো। পদ্মজা-পূর্ণা-প্রেমা চৌকিতে বসল চিড়া নিয়ে তাদের চোখেমুখে খুশির ঝিলিক। হেমলতা মৃদু হাসলেন। বড়ো মেয়ে দুটো কখনো মুখ ফুটে শখ-আহ্লাদের কথা বলে না। না বলা সত্ত্বেও অনেকবার তিনি দুই বোনের ইচ্ছে পূরণ করেছেন। আর কিছু ইচ্ছে বুঝতে পারলেও পূরণের সামর্থ্য হয়নি তার। যতটুকু পারেন ততটুকুই করেন।
হেমলতা ঘরের বাইরে যেতেই পূর্ণা বলল, ‘আমাদের মায়ের মতো সেরা মা আর কেউ না। তাই না আপা?’
‘মায়ের মতো কেউ হয় না। সবার কাছে সবার মা সেরা। আমাদের মা আমাদের কাছে সেরা। লাবণ্যর মা লাবণ্যর কাছে সেরা। মনির মা মনির কাছে সেরা।’
‘ওরা বলেছে?’
‘দূর বোকা! এসব বলতে হয় না।’
‘না, আমাদের আম্মাই সবচেয়ে ভালো মা। এমন মা আর একটাও নেই।’
হেমলতার কর্ণকুহরে প্রতিটি কথা আসে। পূর্ণা সবার অনুভূতি অনুভব করতে জানে না। পদ্মজা জানে।
পদ্মজা হেসে বলল, ‘আমাদের আম্মা সত্যি সেরা। আলাদা।’
পূর্ণা জানালার বাইরে চোখ রেখে প্রশ্ন করল, ‘আপা, চিত্রা দিদিকে কেমন লাগে?’
পদ্মজা চিত্রার দিকে তাকাল। ছাইরঙা শাড়ি পরা, হাতে কালো রঙের ঘড়ি। ফুলহাতা ব্লাউজ; শালীন, তবে সর্বাঙ্গে আধুনিকতার ছোঁয়া। নাকে সাদা পাথরের নাকফুল, লম্বা চুল বেণি করে রেখেছে; মুখে খুব মায়া। স্নিগ্ধ একটা মুখ, যেন শরতের শুভ্র এক টুকরো মেঘ। পদ্মজা বলল, ‘আমার দেখা দ্বিতীয় সুন্দর মেয়েমানুষ চিত্ৰা দিদি।’
পূর্ণা আগ্রহ নিয়ে জানতে চাইল, ‘প্রথম কে?’
পদ্মজা কণ্ঠ খাদে নামিয়ে মোহময় কণ্ঠে বলল, ‘আমাদের আম্মা।’
সঙ্গে সঙ্গে হেমলতার বুক শীতল, কোমল অনুভূতিতে ছেয়ে গেল। পদ্মজা এত সুন্দর করে ‘আমাদের আম্মা’ বলেছে! হেমলতা প্রথম…এই প্রথম শুনলেন, তিনি সুন্দর! ভূবন মোহিনী রূপসীর মুখে শুনলেন। এই আনন্দ কোথায় রাখবেন? কেন ছেলেমানুষি অনুভূতিতে তলিয়ে যাচ্ছেন তিনি! প্ৰেমা অবাক স্বরে বলল, ‘আম্মা তো কালো। চিত্রা দিদির চেয়ে সুন্দর কীভাবে?’
‘এভাবে বলছিস কেন প্রেমা? তুই ফরসা হয়ে গেছিস বলে কালোকে ভালো মনে হয় না?’ পূর্ণা গমগম করে উঠল। বোনের কথা শুনে ভয় পেল প্ৰেমা।
পদ্মজা বলল, ‘বকছিস কেন? প্রেমা কত ছোটো। ও কী সুন্দরের গভীরতা বুঝে? ও খালি চোখে কালো-সাদার তফাৎ দেখে।’
‘সুন্দরের গভীরতা তো আমিও বুঝি না।’
পূর্ণার কণ্ঠ ভারী নিষ্পাপ শোনাল। পদ্মজা এদিক-ওদিক তাকিয়ে দেখে নিলো হেমলতার উপস্থিতি। এরপর বলল, ‘আম্মার রং কালো। কিন্তু সৌন্দর্যের কমতি নেই। আম্মাকে কখনো এক মনে দেখিস, বুঝবি। আমাদের আম্মার চোখ দুটি গভীর, বড়ো-বড়ো; পাতলা, মসৃণ ঠোঁট আম্মার ঘন চুলের খোঁপায় এক আকাশ কালো মেঘ। আম্মার শাড়ির কুঁচির ভাজে আভিজাত্য লুকানো। আম্মা যখন তীক্ষ্ণ চোখে আমাদের দিকে তাকান, তখন মনে হয়: প্রকাণ্ড কোনো রাজ্যের রানি তার পূর্বপুরুষের ক্ষমতা প্রকাশ করছেন তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিয়ে। এতকিছু থাকা সত্ত্বেও কি আম্মা আমাদের দেখা প্রথম সুন্দর মানুষ হতে পারেন না?’
পদ্মজার প্রতিটি কথা পূর্ণার ওপর ভীষণ ভাবে প্রভাব ফেলে। ওদিকে প্রেমা চোখ পিটপিট করে কিছু ভাবছে।
পূর্ণা উচ্ছ্বাস নিয়ে বলল, ‘কাল থেকে আমি আম্মাকে মন দিয়ে দেখব।’
‘আমিও,’ প্রেমাও পূর্ণার দলে যোগ দিল।
আবেগের সাইক্লোনে দুই ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল হেমলতার চোখ বেয়ে, কিছুতেই আটকে রাখতে পারলেন না। এই কালো রঙের জন্য ছোটো থেকে সমাজের তুচ্ছতাচ্ছিল্য পেয়ে এসেছেন! লুকিয়ে কত কেঁদেছেন। কত করে চেয়েছেন, কেউ তাকে সুন্দর বলুক। কিন্তু সেই কপাল কখনো হয়নি। আর আজ, এই বয়সে এসে শুনলেন—তিনি কুৎসিত নন। তার মাঝেও সৌন্দর্য আছে! জন্মদাত্রী মা গায়ের কালো রঙের জন্য গরম চামচ দিয়ে ঘাড়ে পোড়া দাগ বসিয়ে দিয়েছিলেন। আর আজ গর্ভের সন্তান সেই অনুচিত কাজের জবাব দিল! আল্লাহর সৃষ্টি কেউ অসুন্দর নয়। সবার মধ্যেই সৌন্দর্য আছে…
…যা ধরা পড়ে শুধুমাত্র সুন্দর একজোড়া চোখে…পদ্মজার সুন্দর চোখে!
.
নিশুতি রাত। চারিদিকে ঝিঁঝিপোকার ডাক। হুট করে হেমলতার ঘুম ভেঙে গেল। ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় ইঙ্গিতে জানান দিচ্ছে ষড়যন্ত্রের। লাহাড়ি ঘরের ডান পাশে দুইজোড়া পায়ের আওয়াজ। হেমলতার বুক কেঁপে উঠল। দ্রুত উঠে বসলেন তিনি, দুই চৌকির মাঝের পর্দা সরিয়ে দেখে নিলেন পদ্মজার অবস্থান। পদ্মজাকে ঘুমাতে দেখে স্বস্তি পেলেন, ছাড়লেন আটকে যাওয়া নিশ্বাস। পায়ের আওয়াজ খুব কাছে শোনা যাচ্ছে। হেমলতা ডান পাশে তাকালেন। গাঢ় অন্ধকার ছাড়া কিছু দেখা যাচ্ছে না। তবুও তিনি তাকিয়ে আছেন। দৃষ্টি দেখে মনে হচ্ছে, টিনের ওপাশে থাকা অদৃশ্য গোপন শত্রুকে তিনি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছেন।
‘কে ওখানে?’
হেমলতার ঝাঁঝালো কণ্ঠে পায়ের আওয়াজ থেমে গেল। কয়েক সেকেন্ড পর ছুটে পালাল দুইজোড়া পা।
৮
ভোর, বাইরে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি পড়ছে। সেই সঙ্গে সুন্দর ঠান্ডা একটা হাওয়া বইছে। বৃষ্টি পড়ার কারণে আকাশ মেঘলা, চারপাশটা একটু অন্ধকারাচ্ছন্ন। হালকা আলোতেই মেঝেতে শীতল পাটি বিছিয়ে তিন বোন পড়ছে। ঝমঝম করে বৃষ্টি হয়েছে রাতভর, বর্ষা-স্নানে প্রকৃতি স্নিগ্ধ। এমন সকালে কেউ কেউ ঘুমাতে চায়, আর কেউ-বা বই পড়তে পছন্দ করে…অথবা পছন্দের অন্য যেকোনো কাজ করে। পূর্ণার ঘুমাতে ইচ্ছে করছে, পড়া একদমই সহ্য হচ্ছে না। পদ্মজাকে বলল, ‘আর কতক্ষণ? ঘুমাতে চাই আপা।’
পদ্মজা নিচু গলায় বলল, ‘এইটুকু শেষ করে ঘুমিয়ে পড়িস।’
‘আম্মা তো আরো পড়তে বলল।’
‘কিছু হবে না। এই যে…’ আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বলল, ‘এইটুকু পড় ভালো করে, তাহলেই আম্মা ছুটি দিবে।’
পূর্ণা মনের বিরুদ্ধে গিয়েই পড়া শেষ করল। হেমলতা প্রথমে ছুটি দিতে না চাইলেও পদ্মজার অনুরোধে ছেড়ে দিলেন। ছুটি পেয়ে দৌড়ে গিয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিল পূর্ণা, সঙ্গে সঙ্গে তলিয়ে গেল গভীর ঘুমে।
কিছুক্ষণ পর বৃষ্টি থেমে রোদ উঠল। স্কুলের জন্য তৈরি হয়ে পূর্ণাকে অনেক ডাকল পদ্মজা, সাড়া পেল না। এদিকে স্কুলে যাওয়ার সময় হয়েছে। হেমলতা বাইরে থেকে উঁকি দিয়ে প্রশ্ন করলেন, ‘পূর্ণা ঘুমে?’
‘জি, আম্মা।’
‘সে জানে না স্কুল আছে? তবুও কোন আক্কেলে ঘুমাল?’
মায়ের রাগের ফলাফল ভেবে পদ্মজা শঙ্কিত। আজ পূর্ণা নির্ঘাত মার খাবে। সে হেমলতাকে আশ্বস্ত করে বলল, ‘তুমি যাও আম্মা। পূর্ণা কিছুক্ষণের মধ্যে তৈরি হয়ে যাবে।’
হেমলতা জানেন, পূর্ণা এত সহজে ঘুম থেকে উঠবে না। প্রায়ই এমন হয়। যতই আদর করে ডাকা হোক না কেন, বৃষ্টিমাখা সকালে তার ঘুম ভাঙানো যুদ্ধের সমান। বাঁশের কঞ্চিকে পূর্ণা ভীষণ ভয় পায়, অথচ কঞ্চির বাড়ি না খাওয়া অবধি ঘুম তাকে কিছুতেই ছাড়ে না! এ যেন ভূত তাড়ানো। হেমলতা বাঁশের কঞ্চি আনতে বাঁশ বাগানের দিকে চলে যান। এদিকে পদ্মজা ডেকেই যাচ্ছে, ‘পূর্ণা? ওঠ। মারটা খাওয়ার আগে ওঠ। এই পূর্ণা। পূর্ণা রে…পূর্ণা, উঠ।’
পূর্ণা পিটপিট করে চোখ খুলে আবার ঘুমিয়ে যাচ্ছে। প্রেমা এই ব্যাপারটা খুব উপভোগ করে। একটা মানুষ এত ডাকাডাকির পরও কী করে ঘুমিয়ে থাকতে পারে? সে নিষ্কম্প স্থির চোখে তাকিয়ে আছে বড়ো দুই বোনের দিকে। হেমলতা হাতে বাঁশের কঞ্চি নিয়ে ঘরে ঢুকলেন। তা দেখে পদ্মজা পূর্ণাকে জোরে চিমটি কাটে, কিন্তু মুখে বিরক্তিকর আওয়াজ তুলে আবার ঘুমে তলিয়ে যায় পূর্ণা।
তুই সর পদ্ম। ও মারের যোগ্য। পিটিয়ে ওর ঘুম ছুটাতে হবে, হেমলতার রাগান্বিত স্বর।
পদ্মজা মায়ের কথার ওপর কিছু বলার সাহস পেল না, দূরে গিয়ে দাঁড়াল। হেমলতা পূর্ণার পায়ের গোড়ালিতে কঞ্চি দিয়ে বাড়ি দিতেই একটা আওয়াজ হলো প্যাঁচ করে। ভয়ে চোখ বুজে ফেলল পদ্মজা। ইস! পায়ের চামড়া ছিঁড়ে গেছে বোধহয়। ঘুমন্ত পূর্ণার মস্তিষ্ক জানান দেয়, আম্মা এসেছেন এবং তিনি আঘাত করছেন। সে চোখ খোলার আগেই দ্রুত উঠে বসল। চোখ খুলতে খুলতে যদি দেরি হয়ে যায়! বোকাসোকা মুখ করে মায়ের দিকে তাকাল পরিস্থিতি বুঝতে। পদ্মজা ঠোঁট টিপে হাসছে, প্রেমা জোরে হেসে উঠল। হেমলতা কড়া চোখে তাকাতেই থেমে গেল দুই বোনের হাসি। পূর্ণা ভীতু কণ্ঠে বলল, ‘আর হবে না আম্মা।’
‘সে তো প্রতিদিনই বলিস।’
‘আজই শেষ। আম্মা…আম্মা মেরো না।’ সে লাফিয়ে উঠে চৌকির কোণে গিয়ে বসে।
এমন সময় ঘন মেঘে আকাশ ছেয়ে গেল, শোনা গেল বজ্রপাতের আওয়াজ। মনে মনে পূর্ণা-প্রেমা খুশি হলো। আজ আর স্কুলে যেতে হবে না। বাড়ি থেকে দুই ক্রোশ দূরে স্কুল। আম্মা নিশ্চয় যেতে না করবেন। পূৰ্ণা খুশি লুকিয়ে প্রশ্ন করল, ‘মেঘ আসবে মনে হয়। যাব স্কুলে?’
‘মেঘ তোর কী সমস্যা করল? এখনি যাবি স্কুলে। তৈরি হ।
হেমলতা চলে যেতেই পূর্ণা ভ্রুকুঞ্চন করে থম মেরে বসে রইল।
পদ্মজা তাড়া দেয়, ‘বসে আছিস কেন? জলদি কর। নয়তো আবার মার খাবি।’
পূর্ণা তীব্র বিরক্তি নিয়ে স্কুলের জন্য প্রস্তুত হয়।
বর্ষাকাল চলছে। রাতে বিরতিহীনভাবে বৃষ্টি হওয়ায়, কাদা জমেছে রাস্তায়। পথ চলা কষ্টকর।
তিন বোন হাতে জুতা নিয়ে পা টিপে হাঁটছে। তাদের মনে কাজ করছে পিছলে পড়ে বই খাতা নষ্ট হওয়ার ভয়। অর্ধেক পথ যেতে না যেতেই আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামল। পথের পাশ থেকে বড়ো তিনটে কচু পাতা ছিঁড়ল পদ্মজা। পূর্ণা-প্রেমার হাতে দুটো দিয়ে নিজের মাথায় ধরল তৃতীয়টি, তবে তাতে লাভ হলো না। মাথা না ভিজলেও, শরীর ও বই-খাতা ভিজে একাকার হয়ে গেল।
পূর্ণা বিরক্তি প্রকাশ করল, ‘ধ্যাত! ভিজে স্কুলে গিয়ে লাভ কী আপা? দেখো, হাঁটু অবধি পায়জামা কাদা আর বৃষ্টির পানি দিয়ে নষ্ট হয়ে গেছে।’
পদ্মজা চিন্তিত ভঙ্গিতে বলল, ‘বুঝতে পারছি না কী করব! স্কুলে যাব? নাকি বাড়ি ফিরব।’
‘আপা, বাড়ি যাই।’ বলল প্রেমা।
পদ্মজা একটু ভাবল। এরপর দুই বোনকে বলল, ‘ভিজে তো কতবারই গেলাম। আজও যাই। সমস্যা কী?’
অগত্যা স্কুলেই যেতে হলো। পদ্মজা সম্মতি না দিলে বাড়িতে গিয়েও উঠতে পারবে না তারা। স্কুল ছুটির আগেও বৃষ্টি পুরোপুরি থামেনি। তখন গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি পড়ছিল। বৃষ্টিতে ভিজে ভিজেই বাড়ি ফেরার পথ ধরল দুই বোন। প্রেমার এক ঘণ্টা আগে ছুটি হয়েছে। পদ্মজা নিচু কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করল, ‘স্কুলে আব্বা এসেছিলেন?’
‘হুম। প্রেমাকে নিয়ে গেছে।’
‘তোর সঙ্গেও তো দেখা হলো।’
পদ্মজার গলাটা করুণ শোনায়। পূর্ণার মন খারাপ হয়। আব্বা কেন তার এত ভালো আপাকে ভালোবাসে না?
বৃষ্টির পানি ও মাটি মিশে কাদায় একাকার হয়ে গেছে পুরো পথ। কাদামাটিতে হাঁটার মতো ভোগান্তি আর নেই। পূর্ণা যেভাবে হেলেদুলে হাঁটছে তাতে পদ্মজার ভয় হচ্ছে, পড়ে না যায়। সে বোনকে ডেকে বলল, ‘পূর্ণা, সাবধানে হাঁট। পড়ে যাবি।’
তার সাবধানী বাণী শেষ হতেই ধপাস করে কাদামাটিতে পড়ে গেল পূর্ণা। আঁতকে উঠে পদ্মজা। পূর্ণার পা নিমিষে ব্যথায় টনটন করে ওঠে। পদ্মজা দুই হাতে আঁকড়ে তোলার চেষ্টা করে। পূর্ণা কিছুতেই ওঠাতে পারছে না। পা যেন ব্যথায় অবশ হয়ে গেল।
কাঁদো কাঁদো হয়ে পদ্মজাকে বলল, ‘আপা, পা ভেঙে গেল মনে হয়। ইস…এত ব্যথা করছে!’
‘মচকেছে বোধহয়। ঠিক হয়ে যাবে। ওঠার চেষ্টা কর। আমার গলা ধরে ওঠ।
গ্রামের পথ, গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি হচ্ছে বলে পথে কেউ নেই। গৃহস্থরা ভাতঘুম দিয়েছে। সামনের বিলে থইথই জল, তার পাশে খেত; ডানে-বাঁয়ে কাদামাটির পথ, পেছনে ঝোপঝাড়। পদ্মজা সাহায্য করার মতো আশপাশে কাউকে দেখতে পেল না। এদিকে পা সোজা করার শক্তি পাচ্ছে না পূৰ্ণা, প্রচণ্ড ব্যথা! ঠোঁট কামড়ে কাঁদছে সে। পদ্মজা না পারছে পূর্ণাকে তুলতে, আর না পারছে পূর্ণার কান্না সহ্য করতে। সে মনে মনে আল্লাহর কাছে সাহায্য প্রার্থনা করে, ‘আল্লাহ, কিছু করো। সাহায্য করো।’ একটু পর পূর্ণাকে বলল, ‘বোন আমার, একটু চেষ্টা কর উঠতে।’
পদ্মজার উৎসাহে পূর্ণা পায়ের পাতা মাটিতে ফেলল। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে ব্যথার বিজলি চমকে ওঠল তার পুরো শরীরে। ‘ও মা! আপা রে, পারছি না। আমার পা শেষ। মরে যাব আমি।’
‘এসব বলিস না। পায়ের ব্যথায় কেউ মরে!’
অল্পক্ষণের মাঝেই আহত পা ফুলে দুই ইঞ্চি উঁচু হয়ে গেছে! তা দেখে আতঙ্কে চোখ-মুখ নীল হয়ে গেল পদ্মজার, কান্না পাচ্ছে তার। পদ্মজা আলতো করে চাপ দিতেই পায়ের ব্যথায় চেঁচিয়ে উঠল পূর্ণা।
‘একটু সাবধানে হাঁটলে কী হতো? ইশ, এখন কী কষ্টটা হচ্ছে।’ পদ্মজার চোখ জলে ভরে উঠেছে।
‘আপা…আপা, ব্যথায় মরে যাচ্ছি।’
পদ্মজা খুব কাছে পায়ের শব্দ পেল। চকিতে চোখ তুলে তাকাল সে খেতের দিকে; পরমুহূর্তে হাসি ফুটে উঠল ঠোঁটে। সে উচ্ছ্বাসে চেঁচিয়ে উঠল, ‘পূর্ণা রে, আম্মা আসছে!’
হেমলতাকে দেখে পূর্ণা কলিজায় পানি প্রায়, মাকে দেখেই যেন ব্যথা অনেকটা কমে গেছে। হেমলতা ছুটে আসেন। পূর্ণার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, ‘কিছু হয়নি। এসব সামান্য ব্যাপার।
এরপর পদ্মজাকে বললেন, ‘তুই বইগুলো নে।’
হেমলতা এদিকে সেলাই করা কাপড় দিতে এসেছিলেন। যার কাপড় ছিল, সে অসুস্থ। তাই যেতে পারছিল না। বাড়িতেও কোনো কাজে মন টিকছিল না। তাই ছাতা নিয়ে বেরিয়ে পড়েন। ঘরে চুপচাপ বসে থাকার চেয়ে একটা মানুষকে সাহায্য করা ভালো। ফেরার পথে তিনি দূর থেকে দুটো বিপর্যস্ত মেয়েকে দেখতে পেলেন। একটা মেয়ে পথে বসে আছে, আরেকটা মেয়ে তাকে তোলার চেষ্টা করছে। মেয়ে দুটিকে চিনতে পেরে বুক কেঁপে ওঠে তার। পথ দিয়ে আসলে দেরি হবে বলে তিনি খেতের ভেতর দিয়েই ছুটে এসেছেন।
পূর্ণা ব্যথায় যেন নিশ্বাস নেয়ার শক্তি পাচ্ছে না। একটা ভ্যান পাওয়া গেলে খুব উপকার হতো। আশ্চর্যভাবে দুই মিনিটের মাথায় দেখা মিলল ভ্যানের! ভ্যানে চিত্রা, লিখনসহ আরো দুজন, তারা মাতব্বর বাড়িতে গিয়েছিল। আরেকটু এগোতেই পদ্মজা আর তার মা-বোনকে দেখতে পেল চিত্রা, উদ্বিগ্ন কণ্ঠে ভ্যানচালককে বলল, ‘চাচা, ভ্যান থামান।’
চিত্রার দৃষ্টি অনুসরণ করে লিখনের নজরে ব্যাপারটা আসতেই সে তাড়াহুড়ো করে ভ্যান থেকে নেমে আসে, চিত্রাও বসে নেই। চোখে-মুখে ভয় নিয়ে জানতে চাইল, ‘কী হয়েছে? পূর্ণার কী হয়েছে?
পদ্মজা বলল, ‘কাদায় পড়ে পা মচকে গেছে।’
হেমলতা, চিত্রা, পদ্মজা এবং পূর্ণাকে ভ্যানে তুলে দিয়ে লিখনসহ বাকি দুজন সহকর্মী ভ্যান ছেড়ে দিল। তারা মোড়ল বাড়িতে হেঁটেই ফিরবে।
.
অনেকটা কমেছে পা ব্যথা, দুটি বালিশের ওপর রাখা হয়েছে পা। ব্রেস নেই বলে ব্রেসের মতো কাপড় বেঁধে দিয়েছেন হেমলতা। যে ব্যথা পেয়েছে, তাতে কয়দিন স্বাভাবিক ভাবে হাঁটতেও পারবে না। হেমলতা মেয়েকে খাইয়ে দিতে দিতে বললেন, ‘এবার খুশি? স্কুলে যেতে হবে না। কাজ করতে হবে না। সকালে উঠে পড়তে বসতে হবে না।
পূর্ণা রাজ্যের দুঃখ নিয়ে বলল, ‘সবই ঠিক আছে। কিন্তু এখন টিভি দেখতে যাব কীভাবে?’
সাড়া না পেয়ে পূর্ণা বুঝতে পারল, সে মুখ ফসকে ভুল জায়গায় ভুল কথা বলে ফেলেছে। বিব্রত হয়ে উঠল ও, ঢোক গিলল। এরপর কাঁচুমাচু হয়ে মিইয়ে যাওয়া গলায় বলল, ‘মোটেও খুশি হইনি।’
পূর্ণার অগোচরে হেমলতা ঠোঁট চেপে হাসেন। আড়াল থেকে তা দেখে পদ্মজাও হাসল।
তখন দিনের শেষভাগ। সূর্য মামা আকাশ গাঢ় লাল আভায় রাঙিয়ে বিদায় নিতে চলেছেন। আকাশের সঙ্গে মিশে রয়েছে ঘন মেঘ, সেই মেঘের ফাঁক দিয়ে উঁকি দিচ্ছে দিনান্তের শেষ আলো। ঠিক তখন মগা এসে জানাল, মুন্নার বাপ খুন হয়েছে। কথাটি শোনার সঙ্গে সঙ্গে উপস্থিত সবার মাথায় যেন আছড়ে পড়ল বজ্র। পঙ্গু, ভিক্ষুক অসহায় মানুষটাকে আবার কে মারল? এমন মানুষের শত্রু থাকে? তাও আবার এমনই যে একেবারে মেরে ফেলল! হেমলতা শ্বাসরুদ্ধকর কণ্ঠে প্রশ্ন করলেন, ‘কখনকার ঘটনা?’
মগা জানাল, দুপুরের কথা। দুপুর দুটো কি তিনটায় গ্রামবাসী জানতে পারে ঘটনাটি। আস্তে আস্তে সব গ্রামে খবর যাচ্ছে। লাশ নোয়াপাড়ার ধানখেতে পাওয়া গেছে। সবাই মিলে মুন্নার বাপকে দেখতে যায়। বাড়িতে রয়ে যায় শুধু পদ্মজা, প্রেমা ও পূর্ণা।
পুলিশ লাশ নিয়ে যাওয়ার পর সবাই মুন্নাকে নিয়ে বিপাকে পড়ে। আত্মীয় বলতে তার কেউ নেই। দুঃসম্পর্কের যারা আছে তারা মুন্নার দায়িত্ব নিতে চাইল না। মাতব্বর মুন্নার ভার নিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু মুন্না জানাল, সে থাকলে পদ্মজাদের বাড়িতে থাকবে। হেমলতা মাতব্বরের অনুমতি নিয়ে সানন্দে মুন্নাকে নিজের বাড়িতে নিয়ে আসেন। এখন থেকে মুন্না এই বাড়ির ছেলে। পদ্মজা-পূর্ণা খুব খুশি হয়। খুশি হলো না শুধু প্রেমা। মুন্না ও প্রেমা সমবয়সি। প্রেমা ভাবছে, তার আদর এখন ভাগাভাগি হয়ে যাবে।
হেমলতা ব্যাপারটা বুঝতে পেরে পদ্মজাকে বললেন, ‘প্রেমার বোধহয় মুন্নাকে পছন্দ হচ্ছে না। দুজনের মধ্যে সখ্যতা করে দিস, যাতে একজন আরেকজনকে আপন চোখে দেখে।’
পদ্মজা আশ্বস্ত করে বলল, ‘কয়দিন গেলেই মিশবে
মুন্না বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। হেমলতা তাকে ঘরে এনেই গরম গরম ভাত খাইয়ে দিয়েছিলেন। খেয়েই ছেলেটা ঘুমিয়ে পড়ে। রাত তো কম হলো না! মা-বোনের বৈঠক দেখে পূর্ণা বলল, ‘আম্মা, মুন্নার নতুন নাম রাখা উচিত।’
‘কেন?’
‘এখন থেকে মুন্না আমাদের ভাই। আমাদের নাম প দিয়ে। তাইলে ওর নাম-ও প দিয়ে হবে। তাই না আপা?’
হেমলতা হেসে বললেন, ‘তুই নাম রাখ তাহলে।’
‘রেখেছি তো। প্রান্ত মোড়ল।’
‘মুন্নাকে আগে ওর নতুন নাম সম্পর্কে জানা, যদি রাজি হয় তখন সবাই এই নামে ডাকব। ওরও তো পছন্দ আছে।’
‘রাজি হবে না মানে? পিটিয়ে রাজি করাব
মেয়ের কথায় হেমলতা হাসলেন। পূর্ণা বলল, শ্বশুরবাড়ি থেকে গিয়ে আনার মতো একটা ভাই হলো আমাদের। আপাকে যখন বিয়ে দেব, আমি আর প্রান্ত গিয়ে আপাকে নিয়ে আসব তাই না আম্মা?’
অসুস্থ হলে খুব কথা বলে পূর্ণা। মুখ বন্ধ রাখতেই পারে না। অনেক বছর আগের ঘটনা, বা কয়েক বছর পর কী হবে তা নিয়ে অনবরত কথা বলতে থাকে।
.
গহিন অন্ধকার। আজ বোধহয় অমাবস্যা। হেমলতা কালো চাদরের আবরণে ঘাপটি মেরে বারান্দায় বসে আছেন। হাতের কাছে ছুরি, লাঠি। গত তিন দিন ধরে ঘরের পাশে পায়ের আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। তখন ঘরে মোর্শেদ ছিলেন, আর যাই হোক—পুরুষ তো, তাই সাহসও ছিল বুকে। আজ মোর্শেদ নেই। মুন্নাকে দত্তক নিয়ে বাড়িতে আনায় তিনি ঝগড়া করে বাড়ি ছেড়েছেন। কবে ফিরবেন ঠিক নেই! আজ কিছুতেই ঘুমানো যাবে না। হাতেনাতে সন্দেহকারীকে ধরে এই বিপদ থেকে মুক্ত হতে হবে। কিন্তু অনেকক্ষণ হলো কেউ আসছে না। চোখ বুজে আসছে হেমলতার। সারাদিন অনেক খাটুনি গেল।
কাদামাটিতে ছপছপ শব্দ তুলে কেউ আসছে। হেমলতা সতর্ক হয়ে ওঠেন, শক্ত করে ধরলেন লাঠি-ছুরি। পায়ের শব্দটা কাছে আসতেই তিনি বেরিয়ে আসেন। অন্ধকারে মুখ পরিষ্কার নয়। আন্দাজে ছুঁড়ে মারেন হাতের লাঠি। লাঠিটা বেশ ভালোভাবেই পড়ল সামনে থাকা ছায়াটির ওপর, হতভাগা আর্তনাদ করে বসে পড়ল মাটিতে; ততক্ষণে পেছনের ছায়াটি দৌড়ে পালাল! প্রথমজনও পালানোর চেষ্টা করল, হেমলতার জন্য পেরে উঠল না। তিনি আরেকটা লাঠি দিয়ে আবার আঘাত করে বসেন, তার দৃষ্টি থেকে যেন আগুন স্ফুরিত হচ্ছে।
আহত ব্যক্তির আর্তচিৎকার শুনে বাড়ির ভেতর থেকে ছুটে আসে সবাই। টর্চের আলোতে চারদিক আলোকিত হয়ে ওঠে। হেমলতা স্বাভাবিক ভঙ্গি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি যেন জানতেন এই ছায়াটিরই আসার কথা ছিল। আজই শুটিং দলকে বাড়ি থেকে বের করবেন। তবেই শান্তি! হই- হুল্লোড় শুনে পদ্মজা, প্রেমা, মুন্না বেরিয়ে আসে। পূর্ণা ঘরেই রইল।
চোখের সামনে ডিরেক্টর আবুল জাহেদকে দেখে চমকে গেল পদ্মজা!
আর ঠিক তখনই কোত্থেকে যেন আগমন ঘটল মোর্শেদের!
৯
আবুল জাহেদকে আহত অবস্থায় দেখে সবাই চমকে গেল। তার কপাল বেয়ে রক্ত ঝরছে।
ফার্স্ট এইড বক্স আনতে একজন দৌড়ে যায় বাড়ির ভেতর। লিখন কিছু সময়ের জন্য থমকাল। আবুল জাহেদের ক্ষতটা ব্যান্ডেজ করার পর তাকে একটা চেয়ারে বসতে দেয়া হয়। হেমলতা একহাতে লাঠিতে ভর দিয়ে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছেন।
লিখন বিস্ময় নিয়ে প্রশ্ন করল, ‘কী হয়েছিল? আপনি উনাকে আঘাত করেছেন কেন?’
হেমলতা স্বাভাবিক কণ্ঠে বললেন, ‘এই অসভ্য লোক আজ চারদিন ধরে মাঝরাতে এখানে ঘুরঘুর করে। তার উদ্দেশ্য খারাপ।’
লিখন চোখের কোণ দিয়ে পদ্মজাকে দেখে আবুল জাহেদকে প্রশ্ন করল, ‘উনি যা বলছেন, সত্যি?’
আবুল জাহেদ গমগম করে উঠল, ‘এখানে আমি আজই প্রথম এসেছি। ঘুম আসছিল না তাই হাঁটতে হাঁটতে চলে এসেছি। বলা নেই, কওয়া নেই হুট করেই উনি আক্রমণ করে বসলেন। কী ব্যথা!’ কপালে হাত রাখল সে।
হেমলতা প্রতিবাদ করলেন দৃঢ় স্বরে, ভুলেও মিথ্যে বলবেন না।’
আবুল জাহেদ কিছুতেই তার উদ্দেশ্য স্বীকার করল না। তর্কে-তর্কে ভোরের আলো ফুটল। হেমলতা কঠিন করে জানিয়ে দিয়েছেন, আজই এই বাড়ি ছাড়তে হবে। হেমলতার সিদ্ধান্ত শুনে দলটির মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। তীরে এসে নৌকা ডুববে নাকি! সিনেমার শেষ অংশটুকু এখনো বাকি। শর্ত অনুযায়ী আরো দশদিন সময় আছে। দলের একজন বয়স্ক অভিনেতা এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করলে হেমলতা জবাব দিলেন, ‘আমার তিনটা মেয়ের নিরাপত্তা দিতে পারবেন? একটা পুরুষ মানুষ রাতের আঁধারে যুবতী মেয়েদের ঘরের পাশ দিয়ে ঘুরঘুর কেন করবে? কীসের ভিত্তিতে?’
কাউকে কথা বলার সুযোগ না দিয়ে সবাইকে এড়িয়ে লাহাড়ি ঘরে চলে গেলেন হেমলতা। এদের সঙ্গে তর্ক করে শুধু সময়ই নষ্ট হবে। আবুল জাহেদের ধূর্ত চাহনি তার নজরে এসেছে বারংবার। প্রথম রাতে পায়ের আওয়াজ শুনে চিনতে পারেননি। পরদিন সন্দেহ তালিকায় থাকা চার-পাঁচ জনকে অনুসরণ করে তিনি নিশ্চিত হোন: রাতে কে লাহাড়ি ঘরের পাশে হেঁটেছিল। ঘরের ডান পাশে পলিথিন কাগজ দিয়ে ঢাকা তুষের স্তূপ রাখা আছে। অসাবধানতায় আবুল জাহেদের কাদা-মাখা জুতা তুষের স্তূপে পড়ে যায়, তাই তুষ লেগে যায় জুতায়। হেমলতা বাড়ির বারান্দায় সেই জুতাজোড়া দেখতে পান। তুষ বাড়ির আর কোথাও নেই, তাই ব্যস্ত হয়ে তুষের স্তূপের কাছে এসে দেখেন; একজোড়া জুতার ছাপ! সেই জুতা যখন আবুল জাহেদ পরল তখন তিনি পুরোপুরিভাবে নিশ্চিত হলেন, শেয়ালটা আসলে কে!
শুটিং দলটার মধ্যে একটা হাহাকার লেগে গেছে। বেশ কিছুকক্ষণ তারা নিজেদের মধ্যে আলোচনা চলল। হেমলতাকে কিছু বলে লাভ নেই, তা প্রত্যেকে বুঝে গেছে; তাই সবাই মোর্শেদকে ধরল। বিনিময়ে তারা আরো টাকা দিতে রাজি আছে। হেমলতার ধমকের ভারে তখন চুপ হয়ে গেলেও, টাকার কথা শুনে মোর্শেদের চোখ দুটি জ্বলজ্বল করে ওঠে। ঘরে এসে হেমলতার সঙ্গে ধুন্ধুমার ঝগড়া লাগিয়ে দেন। হেমলতা প্রথমে কিছুতেই রাজি হোননি। তবে শেষ অবধি নিজের সিদ্ধান্তে অনড় থাকতে পারলেন না। দলের কিছু ভালো মানুষের অনুরোধ ফেলতে বেশ অস্বস্তিবোধ করছিলেন। দশদিনের বদলে পাঁচ দিনের সময় দিলেন। যতক্ষণ এরা বাড়ি না ছাড়বে তিনি শান্তি পাবেন না। তবে একটা স্বস্তির নিশ্বাসও ফেললেন।
ভাগ্যিস কোনো ঘটনা ঘটার আগে ব্যাপারটা সামলানো গেছে।
বেশ গরম পড়েছে আজ। পদ্মজা পাটিতে বসে মনোযোগ দিয়ে মুন্নাকে শেখাচ্ছে; কাকে কী ডাকতে হবে।
‘আমায় ডাকবি বড়ো আপা। পূর্ণাকে ছোটো আপা। আর প্রেমা তো তোর সমান। তাই প্রেমা ডাকবি। দুজন মিলেমিশে থাকবি। বুঝেছিস?’
‘হ, বুঝছি।’
‘আম্মাকে তুইও আম্মা ডাকবি। আমাদের আম্মা-আব্বা এখন থেকে তোরও আম্মা-আব্বা, বুঝেছিস?
মুন্না বিজ্ঞ স্বরে বলল, ‘হ, বুঝছি।’
হেমলতা রান্না রেখে উঠে আসেন। মুন্নাকে বললেন, ‘শুদ্ধ ভাষায় কথা বলবি। তোর পদ্ম আপা যেভাবে বলে।’
মুন্নার সরল স্বীকারোক্তি, ‘কইয়ামনে।’
পদ্মজা বলল, কইয়ামনে না। বল, আচ্ছা বলব।’
মুন্না বাধ্য ছেলের মতো হেসে বলল, ‘আচ্ছা, বলব।’
হেমলতা হেসে চলে যান। পূর্ণা রুম থেকে মুন্নাকে ডাকল, ‘মুন্না রে?’
‘হ, ছুডু আপা।’
পদ্মজা মুন্নার গালে আলতো করে থাপ্পড় দিয়ে বলল, বল—জি, ছোটো আপা।’
মুন্না পদ্মজার মতো করেই বলল, ‘জি ছোটো আপা।’
পদ্মজা হাসল। পূর্ণা বলল, ‘তোর নাম পালটাতে হবে। আমি তোর নতুন নাম রেখেছি।
‘কেরে? নাম পালডাইতাম কেরে?’ পদ্মজা কিছু বলার আগে মুন্না প্ৰশ্ন করল, ‘আইচ্ছা এই কথাডা কেমনে কইতাম?’
পদ্মজা হেসে কপাল চাপড়ায়, এই ছেলে তো আঞ্চলিক ভাষায় বুঁদ হয়ে আছে। পূর্ণা বলল, ‘তুই এখন আমাদের ভাই। আমাদের নামের সঙ্গে মিলিয়ে তোর নাম রাখা উচিত। উচিত না?’
মুন্না দাঁত কেলিয়ে হেসে সায় দিল, ‘হ।’
‘এজন্যই তোর নাম পালটাতে হবে। আজ থেকে তোর নাম প্রান্ত মোড়ল। সবাইকে বলবি এটা। মনে থাকবে?’
‘হ, মনে রাহাম।’
‘বল, আচ্ছা মনে রাখব।’
‘আচ্ছা, মনে রাখব।’
দুপুর গড়াতেই হাজেরা এলো। সঙ্গে নিয়ে এসেছে বানোয়াট গল্প আর বিলাপ। ইশারা-ইঙ্গিতে সে লাউ চাইছে। মোর্শেদ গতকাল সব লাউ বাজারে তুলেছেন, গাছে আর একটা ছিল। এদিকে ঘরে চিংড়ি মাছ আছে, প্ৰান্ত লাউ দিয়ে চিংড়ি খাওয়ার ইচ্ছে প্রকাশ করেছে বলে হেমলতা ছেলের ইচ্ছে পূরণ করতে হাসিমুখে শেষ লাউটা ছিঁড়ে এনে ঘরে রেখেছেন। এখন আবার হাজেরারও লাউ চাই! কেউ কিছু চাইলে হাতে থাকা সত্ত্বেও হেমলতা ফিরিয়ে দেননি। আজও দিলেন না। তিনি হাজেরাকে হাসিমুখে লাউ দিয়ে দিলেন। হাজেরা সন্তুষ্টি প্রকাশ করে চলে গেল। পদ্মজা মায়ের দিকে অসহায় চোখে তাকাল। প্রান্ত এই বাড়িতে এসে প্রথম যা চাইল, তাই পেল না। মনের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে না তো! হেমলতা পদ্মজার দৃষ্টি বুঝেও কিছু বললেন না। প্রান্তকে ডেকে কোলে বসালেন। ছেলেটাকে দেখতে বেশ লাগছে। দুপুরে তিনি গোসল করিয়েছেন। মনে হচ্ছিল, কোনো ময়লার স্তূপ পরিষ্কার করা হচ্ছে। জন্মদাতার মৃত্যু প্রান্তের উপর বিন্দুমাত্র প্রভাব ফেলল না। এজন্য কেউই অবাক হয়নি। বাপ-ছেলের শুধু রাতেই একসঙ্গে থাকা হতো। অনেক রাত প্রান্ত একা থেকেছে। এইটুকু ছেলে কত রাত ভয় নিয়ে কাটিয়েছে! হেমলতা আদুরে কণ্ঠে বললেন, ‘একটা গল্প শোনাই। শুনবি?’
‘হুনাও।’
পদ্মজা প্রান্তের ভাষার ভুল ধরিয়ে দিল, ‘হুনাও না। বল, শোনাও, আম্মা।’
প্রান্ত মাথা কাত করে হেমলতাকে বলল, ‘শোনাও, আম্মা।’
আম্মা ডাকটা শুনে হেমলতা বুক বিশুদ্ধ ভালোলাগায় ছেয়ে গেল। তিনি কণ্ঠে ভালোবাসা ঢেলে বললেন, ‘আমাদের একদিন মরতে হবে জানিস তো?’
‘হ।’
‘জান্নাত-জাহান্নামের কথা কখনো কেউ বলেছে?’
প্রান্ত মাথা দুই পাশে নাড়াল, কেউ শোনায়নি। হেমলতা এমনটাই সন্দেহ করেছিলেন। প্রান্ত এ সম্পর্কে জানে না। তিনি ধৈর্য নিয়ে সুন্দর করে জান্নাত-জাহান্নামের বর্ণনা দিলেন। জান্নাতের বর্ণনা শুনে প্রান্তের চোখ দুটি জ্বলজ্বল করে উঠল। প্রশ্ন করল হাজারটা। হেমলতাকে জানাল, সে জান্নাতে যেতে চায়; জাহান্নামে যেতে চায় না। হেমলতা বললেন, ‘আচ্ছা, এখন গল্পটা বলি। মন দিয়ে শুনবি।’
প্রান্ত মাথা কাত করে হ্যাঁ সূচক সম্মতি দিল। হেমলতা বলতে শুরু করলেন, ‘একজন মহিলা একা থাকত বাড়িতে। না, দুটি ছেলেমেয়ে থাকত তার সঙ্গে, খুব ছোটো ছোটো; খুব অভাব তাদের। ছোটো একটা জায়গায় মাটির ঘর। ঘরের সামনে শখ করে একটা লাউ-চারা লাগায়। লাউ গাছ বড়ো হয়, পাতা হয় অনেক। এই লাউ পাতা দিয়ে দিন চলে তাদের। কখনো সিদ্ধ করে খায়। নুন-মরিচ পেলে শাক রেঁধে খায়। তো একদিন একজন ভিক্ষুক এলো। ভিক্ষুকটি খায় না দুই দিন ধরে। লাউ গাছে পাতা দেখে তার ভীষণ খেতে ইচ্ছে করে। লাউ গাছের মালিককে ভিক্ষুক বলে, লাউ পাতা দিতে, রেঁধে খাবে। খুব অনুনয় করে বলে। মহিলাটির মায়া হয়। ভিক্ষুক মহিলাকে কথা শোনাতে শোনাতে কয়েকটা লাউ পাতা ছিঁড়ে দেয়। তার কয়দিন পর লাউ গাছের মালিক মারা গেল। গ্রামবাসীসহ মসজিদের ইমাম মিলে দাফন করে তাকে। বুঝতে পেরেছিস প্রান্ত?’
‘হ।’
প্রান্ত মনোযোগ দিয়ে শুনছে, মনোযোগী শ্রোতা সে। হেমলতা বাকিটা শুরু করলেন, ‘গ্রামের ইমাম একদিন স্বপ্ন দেখেন, যে মহিলাটিকে তিনি দাফন করেছেন তার চারপাশে আগুন দাউদাউ করে জ্বলছে। কিন্তু তার গায়ে আঁচ অবধি লাগছে না। মহিলাটিকে ঘিরে রেখেছে লাউ পাতা! তাই আগুন কাছে ঘেঁষতে পারছে না। ওই যে সে এক ভিক্ষুককে নিজের একবেলা খাবারের লাউ পাতা দান করেছিল? সেই লাউ পাতা এখন তাকে কবরের শাস্তি থেকে বাঁচাচ্ছে। জাহান্নাম থেকে বাঁচতে আমাদের অনেক ইবাদত করা উচিত। তার মধ্যে একটি হলো দান। সামর্থ্য অনুযায়ী দান করা উচিত। কাউকে ফিরিয়ে দেয়া উচিত না। বোঝা গেছে?’
‘হ, বুঝছি। আমিও অনেক দান করাম।’
‘হুম। করবি। অনেক বড়ো হবি জীবনে। আর অনেক দান-খয়রাত করবি। আচ্ছা, প্রান্ত এখন যদি কোনো অভাবী এসে বলে, তোর লাউটা দিতে। তুই কী করবি?’
প্রান্ত গম্ভীর হয়ে ভেবে বলল, ‘দিয়া দিয়াম।’
‘একটু আগে একজন মহিলা এসেছিল, দেখেছিস?’
‘হ, দেখছি।’
‘সে খুব গরিব। বাড়িতে ছোটো ছোটো বাচ্চা আছে। এসে বলল, লাউ দিতে। তাই তোর লাউটা দিয়েছি। এজন্য কী এখন তোর মন খারাপ হবে?’
‘লাউড়া তো তুমি দিছো। তাইলে তোমারে আগুন থাইকা বাঁচাইব লাউডা?’
‘লাউটা আমি দিলেও, তোর জন্য ছিল। তুই এখন খুশি মনে মেনে নিলে লাউটা তোকে আগুন থেকে বাঁচাবে।’
হেমলতার কথায় প্রান্তর চোখেমুখে দীপ্তি ছড়ায়। পরপরই মুখ গম্ভীর করে প্রশ্ন করল, ‘একটা লাউ কেমনে বাঁচাইব আমারে?’
প্রান্তর নিষ্পাপ কণ্ঠে প্রশ্নটা শুনে হেমলতা-পদ্মজা-পূর্ণা হেসে উঠল পদ্মজা বলল, ‘কয়টা পাতা অনেকগুলো হয়ে মহিলাটাকে বাঁচিয়েছিল। তেমন একটা লাউ অনেকগুলো হয়ে তোকে বাঁচাবে।’
প্রান্ত একটার পর একটা প্রশ্ন করেই যাচ্ছে। হেমলতা হেসে হেসে তার উত্তর দিচ্ছেন। পদ্মজার হুট করেই প্রান্তের থেকে চোখ সরে হেমলতার ওপর পড়ে।
মা হাসলে সন্তানদের বুকে যে আনন্দের ঢেউ উঠে তা কী মায়েরা জানেন? পদ্মজার আদর্শ তার মা। সে তার মায়ের মতো হতে চায়। হুবহু মায়ের মতো!
পাঁচদিন শেষ। শুটিং দলের মধ্যে খুব ব্যস্ততা। সবকিছু গোছানো হচ্ছে। তাড়াহুড়ো করে পাঁচ দিনে শেষ করা হয়েছে শুট। লিখন উঠানে চেয়ার নিয়ে বসে আছে। চিত্রা এসে তার পাশে বসল, কাশির মতো শব্দ করল লিখনের মনোযোগ পেতে। তাকাল লিখন, ম্লানমুখে প্রশ্ন করল, ‘সব গোছানো শেষ?’
হুম, শেষ। তুমি তো কিছুই গুছাওনি!’
‘বিকেলে রওনা দেব। আমার আর কী আছে গোছানোর? দুপুরেই শেষ করে ফেলব।’
‘মন খারাপ?’
লিখন কিছু বলল না, তাকাল লাহাড়ি ঘরের দিকে; দৃষ্টিতে শূন্যতা, কিছু ফেলে যাওয়ার বেদনা। বুকের বাঁ পাশে চিনচিন করা ব্যথাটা আর সহ্য হচ্ছে না। চিত্রা হাতঘড়ি পরতে পরতে বলল, ‘ছোটো বোনের সমান বলে ঠোঁট বাঁকিয়ে ছিলে। এখন তার প্রেমেই পড়লে।’
লিখন কিছু বলল না, তবে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল একটা। চিত্রা বলল, ‘পদ্মজা কিন্তু অনেক বড়োই। শুনেছি, আগামী মাসে ওর সতেরো হবে। এই গ্রামে সতেরো বছর বয়সি অবিবাহিত মেয়ে হাতেগোনা কয়টা। পদ্মজার নব্বই ভাগ সহপাঠী বিবাহিত। তাছাড়া খুব কম মেয়েই স্কুলে পড়ে।’
চিত্রার কথা অগ্রাহ্য করে লিখন বলল, ‘তোমার বিয়েটা কবে হচ্ছে?’
‘ভগবান চাইলে বছরের শেষ দিকে।’
কিছুক্ষণের মধ্যে সবাই ঢাকা রওনা দেবে। হেমলতা-মোর্শেদ বিদায় দিতে এসেছেন। দলটার তিন-চার জনের চরিত্রে সমস্যা থাকলেও, বাকিরা খুব ভালো। তারা হেমলতার সঙ্গে মিশে গিয়েছিল। নিজের বাড়ি মনে করে থেকেছে, বাড়ির দেখাশোনা করেছে। লিখন হেমলতার আড়ালে একটি সাহসিকতার কাজ করে ফেলল। ব্যস্ত পায়ে চলে গেল লাহাড়ি ঘরের দিকে
বারান্দায় বসেছিল পদ্মজা। লিখনকে দেখে ভয়ে কেঁপে উঠল তার বুক। পদ্মজাকে কিছু বলতে দিল না লিখন। সে দ্রুত বারান্দায় উঠে পদ্মজার হাতে একটা চিঠি গুঁজে দিয়ে জায়গা ত্যাগ করল।
প্রবলভাবে কাঁপছে পদ্মজা। এমনকি পূর্ণাও চৌকি থেকে ব্যাপারটা খেয়াল করে হতভম্ব। খোঁড়ার মতো ধীর পায়ে হেঁটে এলো সে। ততক্ষণে পদ্মজার সারা শরীর বেয়ে ঘাম ছুটছে, হিতাহিত জ্ঞান শূন্য হয়ে গেছে। হাত থেকে পড়ে গেল চিঠি, সেই চিঠিটি দ্রুত কুড়িয়ে নিলো পূর্ণা।
পদ্মজার মনে হচ্ছে—এখনই সে মাথা ঘুরে পড়ে যাবে! হেমলতা এসে দেখেন পদ্মজা হাঁটুতে থুতনি ঠেকিয়ে বসে আছে। কেমন দেখাচ্ছে যেন। তিনি উৎকণ্ঠা নিয়ে প্রশ্ন করলেন, ‘পদ্ম? শরীর খারাপ?
মায়ের কণ্ঠ শুনে পদ্মজা ভয় পেল। বাতাসে অস্বস্তি, নিশ্বাসে অস্বস্তি; চোখ দুটি স্থির রাখা যাচ্ছে না, নিশ্বাস এলোমেলো। পূর্ণা পরিস্থিতি সামলাতে বলল, ‘আম্মা, আপার মাথাব্যথা।’
‘হুট করে এমন মাথাব্যথা উঠল কেন? পদ্ম রে, খুব ব্যথা?’
পদ্মজা অসহায় চোখে পূর্ণার দিকে তাকাল। আকস্মিক ঘটনায় সে ভেঙে পড়েছে। ডান হাত কাঁপছে অনবরত। হেমলতা চোখ ঘুরিয়ে দুই মেয়েকে দেখলেন। এদের হাবভাব হঠাৎ সন্দেহজনক লাগছে। তিনি কঠিন স্বরে প্রশ্ন করলেন, ‘কী লুকোচ্ছিস দুজন? কেউ এসেছিল?’
মায়ের প্রশ্নে পদ্মজার চেয়ে পূর্ণা বেশি ভয় পেল। হাতের চিঠিটা আরো শক্ত করে চেপে ধরল সে।
কী লেখা আছে না পড়ে এই চিঠি হাতছাড়া করবে না সে।
পদ্মজা – ১০
হেমলতার ধারাল দৃষ্টি তিরের ফলার মতো পদ্মজার গায়ে বিঁধছে। সে কাঁপা স্বরে জানিয়ে দিল, ‘শুটিং দলের একজন এসেছিল।’
হেমলতার ঠোঁট দুটো ফুলে উঠল প্রচণ্ড আক্রোশে। পদ্মজা সবাইকে চেনে না। তাই তিনি পূর্ণাকে প্রশ্ন করলেন, ‘পূর্ণা, কে এসেছিল?’
পূর্ণা দুই সেকেন্ড ভাবল। এরপর নতমুখে বলল, ‘কালো দেখতে যে… মিলন।’
পদ্মজা আড়চোখে পূর্ণার দিকে তাকাল। তার ভয় হচ্ছে: মা যদি এখন বলে, মিলন তো তার সামনেই ছিল…তাহলে কী হবে? পূর্ণা মিথ্যে বলল কেন! সত্য বললেই পারত। হেমলতা বিশ্বাস করেছেন নাকি করেননি সেটা দৃষ্টি দেখে বোঝা গেল না। পূর্ণা মাথা নত করে দাঁড়িয়ে রইল অপরাধীর মতো। হেমলতা বারান্দা অবধি এসে আবার ঘুরে তাকালেন। মনটা খচখচ করছে। মনে হচ্ছে, ঘাপলা আছে। নাকি তার সন্দেহবাতিক মনের ভুল ভাবনা? কে জানে!
.
রাতে পদ্মজা খেতে চাইল না। বিকেলের ঘটে যাওয়া ঘটনা তাকে ঘোরে রেখেছে। চিঠিটা পড়তে বিন্দুমাত্র ইচ্ছে হচ্ছে না। তবুও কেমন-কেমন একটা অনুভূতি হচ্ছে। অচেনা, অজানা অনুভূতি। পদ্মজার হাব-ভাব হেমলতার বিচক্ষণ দৃষ্টি এড়াতে পারল না, তিনি ঠিকই খেয়াল করেছেন। কিন্তু মেয়েরা স্বয়ং আল্লাহ ছাড়া অন্য সবার থেকে কথা লুকোনোর ক্ষমতা নিয়ে যে জন্মায় তা তো অস্বীকার করা যায় না। যেমন তিনি এই ক্ষমতা ভালো করেই রপ্ত করতে পেরেছেন। পদ্মজাকে জোর করে খাইয়ে দিলেন। কোনো প্রশ্ন করলেন না।
রাতের মধ্যভাগে মোর্শেদ হেমলতাকে জড়িয়ে ধরতে চাইলে হেমলতা এক ঝটকায় সরিয়ে দেন। চাপা স্বরে ক্রোধ নিয়ে বললেন, ‘তোমার বাসন্তীর কী হয়েছে? সে কী তোমাকে ত্যাগ করেছে? সেদিন ফিরে এলে কেন?’
মোর্শেদ চমকালেন, অপ্রস্তুত হয়ে গেলেন যেন। হেমলতা বাসন্তীকে চিনল কী করে? এই নাম তার গোপন অধ্যায়। অবশ্য হেমলতার মতো মহিলা না জানলেই বোধহয় বেমানান লাগত। মোর্শেদ বিব্রত কণ্ঠে বললেন, ‘হে আমারে কী ত্যাগ করব। আমি হেরে ছাইড়া দিছি।’
হেমলতা বাঁকা হাসলেন। অন্ধকারে তা নজরে এলো না মোর্শেদের।
‘বিশ বছরের সংসার এমন আচমকা ভেঙে গেল যে!’
হেমলতার কণ্ঠে ঠাট্টা স্পষ্ট, তবে চাপা দীর্ঘশ্বাস রয়ে গেল গোপনে। মোর্শেদের শরীরের পশম দাঁড়িয়ে পড়ে। এ খবরও হেমলতা জানে? এতকিছু…কীভাবে? হেমলতার চোখের কোণে জল চিকচিক করে উঠেছে, তিনি চাদর গায়ে দিয়ে চলে গেলেন বারান্দায়। রাতে বেশ ঠান্ডা পড়ে মোর্শেদের কোনো কৈফিয়ত তিনি শুনতে চান না। তাই বারান্দার ঘরে এসে বসলেন।
কতদিন পর রাতের আঁধারে বারান্দার ঘরে এসেছেন! বিয়ের এক বছর পরই জানতে পেরেছিলেন, মোর্শেদ তাকে বিয়ে করার ছয় মাস আগে বাসন্তী নামে এক অপরূপ সুন্দরী মেয়েকে বিয়ে করেছেন। স্বামীর ঘর ছাড়া আর পথ ছিল না বলে এত বড়ো সত্য হজম করে নিয়েছিলেন।
বাসন্তীর মা বারনারী। আর একজন বারনারীর মেয়েকে সমাজ কিছুতেই মানবে না। মোর্শেদের বাবা মিয়াফর মোড়ল টাকার বিনিময়ে দেহ বিলিয়ে দেওয়া একজন বারনারীর মেয়েকে ছেলের বউ হিসেবে মানতে আপত্তি করেন। ততদিনে মোর্শেদ বিয়ে করে ফেলেছে, যদিও সে খবর মিয়াফর মোড়ল পাননি। তিনি মোর্শেদের মন ফেরাতে শিক্ষিত এবং ঠান্ডা স্বভাবের হেমলতাকে বেছে নিলেন। কুরবান হলো হেমলতার! তখন কলেজে ওঠার সাত মাস চলছিল! এরপর পড়াটাও আর এগোল না। জীবনের মোড় করুণ- রূপে পালটে গেল।
.
পরদিন সকাল সকাল স্কুলে রওনা হলো দুই বোন। পূর্ণা পথে চিঠিটা পড়ার পরিকল্পনা করেছিল। পদ্মজা হতে দিল না। সেয়ানা দুইটা মেয়ের হাতে কেউ চিঠি দেখে ফেললে? ইজ্জত যাবে। পদ্মজার প্রতি বিরক্তবোধ করছে পূর্ণা। চিঠিটা তার কাছে। পথে নতুন করে পরিকল্পনা করল সে, ক্লাসে বইয়ের চিপায় রেখে চিঠি পড়বে। কিন্তু তাও হলো না। পর পর দুই দিন কেটে গেল। সুযোগ পেলেও পড়তে দিতে চাইত না পদ্মজা, সারাক্ষণ যেন হাতে জান নিয়ে থাকে। এই বুঝি মা এলো! দুই দিন পর পূর্ণা মোক্ষম সুযোগ পেল। প্রান্ত ও প্রেমাকে নিয়ে হেমলতা বাপের বাড়ি গিয়েছেন। যদিও কয়েক মিনিটের পথ, দ্রুতই ফিরবেন।
চিঠি পড়ায় পদ্মজার চেয়ে পূর্ণার আগ্রহ বেশি। সে চিঠি খোলার অপেক্ষায় ছিল। আজ খুলতে গিয়ে মনে হলো, যার চিঠি তার খোলা উচিত এবং আগে তারই পড়া উচিত। তাই পদ্মজার দিকে বাড়িয়ে দিল চিঠিটা I
পদ্মজা চিঠি খুলতে দেরি করছিল বলে পূর্ণা তাড়া দিল, ‘এই আপা, খোলো না। লজ্জা পাচ্ছো কেন? জিনিসটা চিঠি, কারো গায়ের কাপড় না।’
পদ্মজা বিস্মিত নয়নে তাকাল, যেন পূর্ণা কাউকে খুন করার কথা বলেছে। বলল, ‘কীসব বলছিস পূর্ণা?’
আচ্ছা, মাফ চাই। আর বলব না।’
পদ্মজা ভাঁজ করা সাদা কাগজটা মেলে ধরল চোখের সামনে। প্রথমেই বড়ো করে লেখা ‘প্রিয় পদ্ম ফুল’।
পূর্ণা পাশে এসে বসল। চিঠিতে দুজনের পূর্ণ মনোযোগ:
প্রিয় পদ্ম ফুল,
আমি কীভাবে শুরু করব বুঝতে পারছি না, অনুগ্রহ করে এই চিঠিটি একবার পড়ো। জানো পদ্ম, হঠাৎ করে নিজেকে চিনতে পারছি না। আমার হৃদয়-মস্তিষ্ক যেন অন্য কেউ নিয়ন্ত্রণ করছে। আজ চলে যাব ভাবতেই বুকের ভেতর তোলপাড় হয়ে যাচ্ছে। তার কারণ—তুমি। যেদিন তোমাকে প্রথম দেখি, থমকে গিয়েছিল আমার নিশ্বাস ও কণ্ঠনালী। এতটুকুও মিথ্যে বলিনি। সেদিন শুটিংয়ে সংলাপ বলতে গিয়ে ভুল করেছি বারংবার। না চাইতেও বার বার চোখ ছুটে যাচ্ছিল লাহাড়ি ঘরের দিকে। বুকে থাকা হৃদপিণ্ডটায় শিরশিরে অনুভূতি শুরু হয় সেই প্রথম দেখা থেকেই। তোমাকে দ্বিতীয় বার দেখার আশায় প্রতিটা ক্ষণ গুণেছি। দ্বিতীয় বার দেখা পাই যখন বেগুন নিতে আসো। সেদিন কথা বলার লোভ সামলাতে পারিনি। টমেটোর অজুহাতে শ্রবণ করি পদ্ম ফুলের কণ্ঠ। মনে হচ্ছিল, এমন রিনরিনে গলার স্বর এই ইহজীবনে আর কখনো শুনিনি। রাতের ঘুম আড়ি করে বসে। তোমায় প্রতিনিয়ত দেখার একমাত্র পন্থা তোমার স্কুল। সবার অগোচরে কতবার তোমার পিছু নিয়েছি। তুমি বোকা, ধরতে পারোনি একবারও। সুন্দরীরা বোকা হয় আবার প্রমাণ হলো। এই, বোকা বলেছি বলে রাগ কোরো না যেন।
এরই মধ্যে জানতে পারি, তোমার মায়ের ইচ্ছে তুমি অনেক পড়বে। তোমার জন্য অনেক উঁচু বংশ থেকে বিয়ের প্রস্তাব এসেছে। তাও তিনি ফিরিয়ে দিয়েছেন। সেখানে আমি অতি সামান্য, অযোগ্য পাত্র। তবুও সাহস করে তোমার বাবার কাছে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছি। পদ্ম ফুলটাকে যে আমার চাই। তিনি রাজি হয়নি। সিনেমায় অভিনয় করা নায়কের সঙ্গে আত্মীয়তা নাকি করবেন না। এটাও বললেন, তোমার অনেক পড়া বাকি। তোমার মা কিছুতেই রাজি হবেন না। আহত মনে দু-পা পিছিয়ে আসি। ভেবেছি, তোমার কলেজ পড়া শেষ হলে পরিবার সঙ্গে করে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসব। তোমার মা সম্পর্কে যা জেনেছি- বুঝেছি, তাতে এতটুকু বিশ্বাস আছে, তিনি অভিনেতা বলে আমাকে এড়াবেন না। তিনি বিচক্ষণ মানুষ।
সময় নেই আর। যা এতদিন বলতে চেয়েছি কিন্তু সুযোগ পাইনি আজ বলতে চাই—আমি তোমায় ভালোবাসি পদ্ম ফুল। আমার ভালোবাসা বর্ণনা করার জন্য শব্দগুলো কম হতে পারে তবুও আমি বলছি, যদি আমি আকাশ হই তুমি সেই সূর্যের রশ্মি, যে রশ্মি থেকে নতুন করে আলোকিত হয়েছি আমি।
ইতি
লিখন শাহ্
পদ্মজার মিশ্র অনুভূতি হচ্ছে। পূর্ণা হাসছে। ভ্রু উঁচিয়ে পদ্মজাকে বলল, ‘আপা রে, লিখন ভাইয়ার সঙ্গে তোমাকে যা মানাবে! কী সুন্দর করে লিখেছে।’
পদ্মজা লজ্জায় চোখ তুলতে পারছে না। পূর্ণা বলল, ‘আল্লাহ! একদম বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে দিয়েছে! আপা, তুমি কিন্তু বিয়ে করলে লিখন ভাইয়াকেই করবে।’
‘আর কিছু বলিস না।’ পদ্মজা মিনমিনে গলায় বলল।
পূর্ণা শুনল না। সে অনবরত কথা বলে যাচ্ছে, ‘আমার ভাবতেই কী যে খুশি লাগছে আপা। নায়ক লিখন শাহ আমার বোনের প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে! একদিন বিয়ে হবে।’
‘চুপ কর না।’
‘এই আপা, লিখন ভাইয়াকে ফেরত চিঠি দিবে না?’
পদ্মজা চোখ বড়ো করে তাকাল। অবাক স্বরে বলল, ‘কীভাবে? ঠিকানা কোথায় পাব? আর আম্মা জানলে? না, না।’
পূর্ণা আর কিছু বলতে পারল না। হেমলতার উপস্তিতি টের পেয়ে চুপ হয়ে গেল। পদ্মজা দ্রুত চিঠিটা ভাঁজ করে বালিশের তলায় রাখল…
…বুক ধুকপুক করছে।
১১
মাঘ মাস চলছে। কেটে গেছে চার মাস। শুষ্ক চেহারা আর হিমশীতল মন নিয়ে পদ্মজা বসে আছে নদীর ঘাটে, গুনে গুনে তিন নম্বর সিঁড়িতে। নাকের ডগায় মেট্রিক পরীক্ষা, দিনরাত পড়তে হচ্ছে। সে নিয়ম করে প্রতিদিন ভোরে পড়া শেষ করে ঘাটে এসে বসে, নিজের অনুভূতিদের সঙ্গে বোঝাপড়া করার জন্য। কখনো উদাস হয়ে আবার কখনো লাজুক মুখশ্রী নিয়ে ভাবে কারো কথা। সেই যে চিঠি দিয়ে হারাল, আর সাক্ষাৎ মিলল না তার। কখনো কি মিলবে? তিনি কি আসবেন? এক চিঠি প্রতিদিন নিয়ম করে পড়ে পদ্মজা। ধীরে ধীরে অনুভব করে তার মধ্যে আছে অন্য আরেক সত্তা…যে সত্তা প্রতিটি মেয়ের অন্তঃসালের গভীরে জেঁকে বসে থাকে ভালোবাসার অনুভূতি নিয়ে। পূর্ণা শীতের চাদর মুড়ি দিয়ে পদ্মজাকে খুঁজছে। দুই দিন আগে তার অষ্টম শ্রেণির চূড়ান্ত পরীক্ষা শেষ হয়েছে। হিমেল হাওয়ার হাড় কাঁপানো শীতে থেমে থেমে কাঁপছে সে।
পদ্মজাকে ঘাটে বসে থাকতে দেখে পেছন থেকে ডাকল, ‘আপা?’
পদ্মজা তাকাল। বলল, ‘কী?’ পরপরই উৎকণ্ঠা নিয়ে বলল, ‘আম্মা আবার অসুস্থ হয়ে পড়েছে?’
পূর্ণা পদ্মজার পাশ ঘেঁষে বলল, ‘না, আম্মার কিছু হয়নি।’
পদ্মজা হাঁফ ছেড়ে বলল, ‘আম্মা সারাদিন সেলাই কাজ করে। একদিকে তাকিয়ে থাকে, এক জায়গায় বসে থাকে। এজন্যই শরীরে এত অশান্তি। দুর্বল হয়ে পড়েছে। আব্বাকে বলিস, আম্মারে নিয়ে সদরে যেতে। আমার কথা তো শুনবে না।
‘আচ্ছা।’
দুজন নদীর ওপারে তাকাল। অতিথি পাখির মেলা সেখানে। রোমাঞ্চকর আকর্ষণ। এত পাখি দেখে মন ভরে গেল। পাখিদের কলকাকলিতে এলাকা মুখরিত। এপার থেকেও শোনা যাচ্ছে। কোত্থেকে দৌড়ে আসে প্রান্ত। সে চার মাসে শুদ্ধ ভাষা রপ্ত করে নিয়েছে ভালোভাবে। এসেই বলল, ‘আপারা, কী করো?’
পূর্ণা বলল, ‘পাখি দেখি। আয়, তুইও দেখ।’
প্রান্ত দূরে চোখ রাখল। সকালের ঘন কুয়াশার ধবল চাদরে ঢাকা নদীর ওপার। পাখিদের ভালো করে চোখে ভাসছে না। শীতের দাপটে প্রকৃতি নীরব। তাই পাখির কলকাকলি শোনা যাচ্ছে দারুণভাবে। প্রান্ত বলল, ‘বড়ো আপা, একটা ধরে আনি?’
‘একদম না। পাখি ধরা ভালো না। অতিথি পাখিদের তো ভুলেও ধরা উচিত না। ওরা আমাদের দেশে অতিথি হয়ে এসেছে।’
প্রান্ত চুপসে গেল। ঠোঁট উলটে বলল, ‘আচ্ছা।’
‘তোরা এইহানে কী করস?’
মোর্শেদের কণ্ঠস্বর শুনে তিনজন ঘুরে তাকাল। প্রান্ত হাসিমুখে ছুটে এসে বলল, ‘আব্বা, আমি আজ তোমার সঙ্গে মাছ ধরতে যাব।’
মোর্শেদ প্রান্তকে কোলে তুলে নিয়ে বললেন, ‘তোর মায় আমার লগে কাইজ্জা করব।’
‘আম্মাকে আমি বলব।’
‘আইচ্ছা যা, তুই রাজি করাইতে পারলে লইয়া যামু।’
মোর্শেদ গত দুই মাস ধরে প্রান্তকে চোখে চোখে রাখছেন। ছেলে নেই বলেই হয়তো! প্রতিটা বাবা-মায়েরই একটি ছেলের আশা থাকে।
হেমলতা পর পর তিনটা মেয়ে জন্ম দিলেন। এ নিয়ে মোর্শেদ কখনো অভিযোগ করেননি। তবে মনে মনে খুব করে একটা ছেলে চাইতেন। প্রান্তকে যখন প্রথম আনা হলো, ভিক্ষুকের ছেলে বলে তার খুব রাগ হয়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রান্তকে চোখের সামনে ঝাঁপাতে-লাফাতে দেখে ছেলের জন্য রাখা মনের শূন্যস্থানটা নাড়া দিয়ে ওঠে। মোর্শেদ দুই হাত বাড়িয়ে দেন অনাথ ছেলেটির দিকে। এখন দেখে আর বোঝার উপায় নেই, মোর্শেদ আর প্রান্তের মধ্যে রক্তের কোনো সম্পর্ক নেই। মোর্শেদ কাঠখোট্টা গলায় দুই মেয়েকে বললেন, ‘সদরে যাইয়াম। তোদের দুজনের লাইগা চাদর আনতাম না সুইডার?’
কথাটি শুনে পদ্মজা দারুণভাবে চমকাল। অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু পেলে মানুষ কিছুক্ষণের জন্য স্তব্ধ হয়ে যায়। পদ্মজার অবস্থাও তাই হলো। খুশি প্রকাশ করার মতো পথ খুঁজে পাচ্ছে না, স্নায়ু কোষ থমকে গেছে। শীতের তাণ্ডবে প্রকৃতি বিবর্ণ, অথচ তার মনে হচ্ছে, বসন্তকাল চলছে। ঢোক গিলে ঝটপট উত্তর দিল, ‘আব্বা, তোমার যা পছন্দ তাই এনো।’
খুশিতে পদ্মজার গলা কাঁপছে। মোর্শেদ অনুভব করলেন সেই কাঁপা গলা। গত সপ্তাহের ঘটনা, মধ্যরাতে রমিজের মেয়ে এক ছেলের সঙ্গে ধরা পড়ে। অলন্দপুরে সে কী তুলকালাম তাণ্ডব! ছেলেটিকে ন্যাড়া করে জুতার মালা পরিয়ে পুরো অলন্দপুর ঘুরানো হয়েছে। আর মেয়ের পরিবারকে মাতব্বর সমাজ থেকে বিচ্যুত করেছেন। পদ্মজা অপূর্ব সুন্দর হওয়া সত্ত্বেও আজও কোনো চারিত্রিক দোষ কেউ দিতে পারেনি। মেয়েটার দ্বারা কোনো অনৈতিক কাজ হয়নি। তার ঘরে যেন সত্যি একটা পদ্মফুলের বাস! ইদানীং মোর্শেদ পদ্মজাকে নিয়ে দোটানায় ভোগেন। খারাপ ব্যবহারটা আগের মতো আসে না। তিনি দ্রুত জায়গা ছেড়ে চলে যান।
সকাল সকাল কলস ভরে খেজুরের মিষ্টি রস নিয়ে এলেন মোর্শেদ প্রেমা খেজুরের রস দেখেই বলল, ‘আম্মা, পায়েস খাব।
হেমলতা সমর্থন করলেন, ‘আচ্ছা, খাবি।’
সূর্য অনেক দেরিতে উঠল। প্রকৃতির ওপর সূর্যের নির্মল আলো ছড়িয়ে পড়েছে। আলোতে তেজ নেই। চার ভাই-বোন কাঁচা খেজুরের রস নিয়ে উঠানে বসল পাটি বিছিয়ে। খেজুরের কাঁচা রস রোদে বসে খাওয়াটাই যেন একটা আলাদা স্বাদ, আলাদা আনন্দের। পায়েসের জন্য তো নারিকেল দরকার তাই মোর্শেদ নারিকেল গাছে উঠেছেন।
আচমকা পদ্মজা প্রশ্ন করল, ‘আজ কী সোমবার?’
পূর্ণা কথা বলার পূর্বে হেমলতা বারান্দা থেকে বললেন, ‘আজ তো সোমবারই। কেন?’
পদ্মজা খেজুরের বাটি রেখে ছুটে যায় বারান্দায়।
‘আজ স্কুলে যাওয়ার কথা ছিল আম্মা। ঝুমা ম্যাডাম বলেছিলেন, গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে। সবাইকে যেতে বলেছেন।’
‘আমায় বলে রাখতি। সামনে পরীক্ষা। গুরুত্বপূর্ণ দেখে পড়া দিবে বোধহয়, এজন্যই ডেকেছে। তাড়াতাড়ি যা। এই পূর্ণা, তুইও যা।’
দুই বোন তাড়াহুড়ো করে বাড়ি থেকে দ্রুত বের হয়। সূর্য উঠলেও কনকনে শীতটা রয়ে গেছে। দুজনের গায়ে মোর্শেদের আনা নতুন সোয়েটার। পদ্মজা যখন মোর্শেদের হাত থেকে সোয়েটার পেল তখন আর আবেগ লুকিয়ে রাখতে পারেনি। মোর্শেদের সামনেই হাউমাউ কেঁদে দিল! তার কান্না মোর্শেদের হৃদয় স্পর্শ করে। কিন্তু মোর্শেদ নিজের অহংবোধের তাড়নায় দুর্বলতা প্রকাশ করেন না, পরিস্থিতি থেকে বাঁচতে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান, ফেরেন অনেক রাতে। পূর্ণা হাঁটার মাঝে বলল, ‘আব্বার পছন্দ ভালো তাই না আপা?’
‘কীসের পছন্দ?’
‘সোয়েটারগুলো কী সুন্দর।’
ধান
পদ্মজা হাসতেই সামনের দাঁতগুলো ঝিলিক দিল। হাতের ডান পাশে ধানখেত। ধান গাছের ডগায় থাকা বিন্দু বিন্দু জমে থাকা শিশির রোদের আলোয় ঝিকমিক করছে। অনেকে হাতে কাঁচি নিয়ে প্রস্তুতি নিচ্ছে ধ কাটার। বাতাসে নতুন ধানের গন্ধ। হঠাৎ পূর্ণা চেঁচিয়ে উঠল, ‘আপারে, লিখন ভাই।’
পদ্মজার নিশ্বাস এলোমেলো হয়ে পড়ে। মুহূর্তে বুকের মাঝে তাণ্ডব শুরু হয়। পূর্ণার দৃষ্টি অনুসরণ করে পেছনে তাকাল সে। লিখন ব্যস্ত পায়ে এদিকেই আসছে। তার পাশে চার ফুট উচ্চতার মগা।
পদ্মজা অজানা আশঙ্কায় চোখ ফিরিয়ে নিলো। রুদ্ধশ্বাসে পূর্ণাকে বলল, ‘এখানে আর এক মুহূর্তও না।
কথা শেষ করেই সে স্কুলের দিকে হাঁটা শুরু করে। পূর্ণা অবাক হয়। কিন্তু, এ নিয়ে রা করল না। লিখন পেছন পেছন আসছে। পদ্মজার বুক কাঁপছে বিরতিহীন ভাবে। তার চাহনি বিক্ষিপ্ত, হৃদয় অশান্ত।
১২
বট গাছের সামনে চিন্তিত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে লিখন। শীতের শুষ্কতায় বটগাছের অধিকাংশ পাতা ঝরে পড়েছে। লিখনের কাছে শীতকাল খুবই অপছন্দের ঋতু। শীত চরম শুষ্কতার রূপ নিয়ে প্রকৃতির ওপর জেঁকে বসে থাকে যা সহ্য হয় না লিখনের। ঠান্ডা লেগেই থাকে। ছোটো থেকে কয়েকবার নিউমোনিয়ায় ভুগেছে। সে মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে রুক্ষতা, তিক্ততা ও বিষাদের প্রতিমূর্তি শীতকাল।
লিখন এক হাতের তালু দিয়ে আরেক হাতের তালু ঘষে উত্তপ্ততা সৃষ্টি করে। ভীষণ ঠান্ডা লাগছে। তখন পদ্মজা এত দ্রুত হাঁটছিল যে মনে হচ্ছিল, সে পালাতে চাইছে। লিখন আর এগোয়নি। পালাতে দিল পদ্মজাকে। মগা বলেছে, পদ্মজার লোকসমাজের ভয় খুব। তাই লিখন এই নির্জন মাঠের পাশে বটগাছের নিচে দাঁড়িয়ে আছে। পদ্মজা এ পথ দিয়েই বাড়ি ফিরবে। তখন যদি একটু কথা বলা যায়।
পদ্মজা জড়োসড়ো হয়ে হাঁটছে। ভয়ে ঠোঁট শুকিয়ে কাঠ। বার বার জিহবা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিচ্ছে।
পদ্মজা মিনমিনে গলায় পূর্ণাকে ডাকল, ‘পূর্ণা রে…’
পূর্ণা তাকাল। পদ্মজা এদিক-ওদিক তাকিয়ে বলল, ‘আমার ভয় হচ্ছে। উনি মাঝপথে দাঁড়িয়ে নেই তো?’
পূর্ণা চরম বিরক্তি নিয়ে বলল, ‘থাকলে কী হয়েছে? খেয়ে ফেলবে?’
পদ্মজা আর কথা বলল না। পূর্ণার সঙ্গে কথা বলে লাভ নেই। তখন লিখন শাহকে পাত্তা না দেয়ার জন্য পূর্ণার খুব রাগ হয়েছে। পদ্মজা বরাবরই মাথা নিচু করে হাঁটে। তাই লিখন শাহকে দেখতে পেল না। পূর্ণা দূর থেকে দেখতে পায়। কিন্তু এইবার আর পদ্মজাকে আগে থেকে বলল না। সে উত্তেজিত হয়ে ভাবছে, লিখন শাহ্ যখন আপার সামনে এসে দাঁড়াবে কী যে হবে!
.
লিখন-পদ্মজার দূরত্ব মাত্র কয়েক হাত…তখন পদ্মজা আবিষ্কার করল লিখনের উপস্থিতি। সে দ্রুত ওড়নার ঘোমটা চোখ অবধি টেনে নিলো। ভয়ে- লজ্জায় তার সর্বাঙ্গে কাঁপন ধরে গেছে। লিখনের পাশ কাটার সময় পুরুষালি কণ্ঠটি ডেকে উঠল, ‘পদ্ম।’
পদ্মজা দাঁড়াতে চায়নি। তবুও কেন যেন দাঁড়িয়ে গেল। লিখন দুয়েক পা এগিয়ে আসে। পূর্ণা ঠোঁট টিপে সেই দৃশ্য গিলছে। লিখন উসখুস করতে শুরু করে, কথা গুলিয়ে ফেলেছে। পদ্মজা লিখনকে পেছনে ফেলে সামনে এগিয়ে যায়। লিখন হতভম্ব হয়ে অবাক চোখে শুধু চেয়ে রইল।
পূর্ণা বলল, ‘আমাকে বলুন, আমি বলে দেব।’
লিখন পকেট থেকে একটা চিঠি বের করে অনুরোধ স্বরে বলল, দয়া করে, তোমার বোনকে দিয়ো। আমি কাল বিকেলে ঢাকা চলে যাব।’
পূর্ণা হাসিমুখে চিঠিটি হাতে নিয়ে বলল, ‘আপা আপনার আগের চিঠিটা প্রতিদিন পড়ে।’
কথাটি শুনে লিখনের ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠে। পূর্ণা চিঠি নিয়ে দৌড়ে ছুটে যায় পদ্মজার দিকে। লিখন আর পিছু নিলো না। পূর্ণা আসতেই পদ্মজা ধমকে উঠল, ‘কী কথা বলছিলি এত? কেউ দেখলে কী হতো? তুই আম্মার কথা কেন ভাবছিস না?’
পদ্মজার কাঁদো-কাঁদো স্বরে পূর্ণা চুপসে গেল। সত্যি কী সে বেশি করে ফেলল? পূর্ণা আশপাশে তাকিয়ে দেখে, কেউ আছে নাকি। সত্যি কেউ দেখে থাকলে কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে। পূর্ণা চোখ নামিয়ে চুপচাপ হেঁটে বাড়ি চলে আসে। হঠাৎ সৃষ্টি আতঙ্কের কারণে চিঠির কথা আর পদ্মজাকে বলা হয়ে উঠে না।
.
গোধূলি বিকেল। হেমলতা পদ্মজাকে ফরমায়েশ দেন, ‘পদ্ম, কয়টা টমেটো নিয়ে আয়।
‘আচ্ছা, আম্মা।’
পদ্মজা লাহাড়ি ঘরের ডান দিকে যায়। দুমাস আগে মোর্শেদ এদিকের সব ঝোপজঙ্গল সাফ করে টমেটোর ছোটোখাটো খেত করেছেন। লাল টকটকে টমেটো। হেমলতা রান্নার ফাঁকে বারান্দার দিকে উঁকি দিলেন। মোর্শেদ আর প্রান্ত কিছু নিয়ে বৈঠক করছেন।
হেমলতা ফোঁস করে নিশ্বাস ছাড়লেন। বাসন্তী নামক মানুষটিকে কী কারণে ত্যাগ করলেন মোর্শেদ? জানতে ইচ্ছে করলেও হেমলতা এই বিষয়ে কোনো প্রশ্ন করলেন না। তবু এতটুকু বুঝেছেন মোর্শেদের বাইরের ঘোর কেটে গেছে, যার ফলস্বরূপ সংসারে তার মন পড়েছে। হেমলতাকে খুব সমীহ করে চলেন। তবে হেমলতা জানেন, মোর্শেদ পদ্মজাকে নিজের মেয়ে হিসেবে এখনো মেনে নেননি। তা নিয়ে মাঝেমধ্যেই খোঁচা দেন। এত অবিশ্বাস মানুষটার!
পদ্মজা সাবধানে খেতের মধ্যখানে গেল। টমেটো ছিঁড়তে গিয়ে মনে পড়ে গেল তার লিখনের কথা। মনে মনে ভাবল, কেন এসেছেন উনি? কী-ই বা বলতে চেয়েছিলেন?
জানার জন্য ব্যকুল হয়ে হয়ে ওঠে পদ্মজার মনটা 1
‘আপা, একটা কথা বলি?’
পদ্মজা চমকে পেছনে তাকাল, হঠাৎ পূর্ণার আগমনে ভয় পেয়েছে। বুকে ফুঁ দিয়ে বলল, ‘বল।’
রাগ করবে না তো?’
পদ্মজা চোখ ছোটো ছোটো করে তাকাল। বলল, ‘করব না।’
পূর্ণা লিখনের দেয়া চিঠিটি দেখিয়ে বলল, ‘লিখন ভাইয়ার চিঠি।’
পদ্মজা ছোঁ মেরে চিঠিটি নিলো। তার এহেন ব্যবহারে পূর্ণা অবাক হলো বটে, সেই সঙ্গে মনে মনে খুশি হলো বোনের আকুলতা দেখে। পদ্মজা দ্রুত চিঠির ভাঁজ খুলল। পূর্ণা বাড়ির দিকে তাকিয়ে দেখছে, কেউ আসছে নাকি পদ্মজা পড়া শুরু করল।
প্রিয় পদ্ম ফুল,
চার মাস কেটে গেল। চার মাসে একটুও অবসর মেলেনি। কিন্তু মনে ছিল এক আকাশ ছটফটানি। তোমার মনের কথা তো জানাই হলো না। তোমাদের অলন্দপুরের প্রায় প্রতিটি বাড়ির ছেলের স্বপ্ন তোমাকে ঘরে তোলার। তাই সারাক্ষণ ভয়ে ছিলাম। আমার অনুপস্থিতিতে কেউ তুলে নেয়নি তো! তিন দিনের সময় নিয়ে চলে এসেছি। শুধু একবার দেখতে আর জানতে, তুমি কি আমার জন্য অপেক্ষা করবে? মেট্রিক পরীক্ষা অবধি অপেক্ষা করলেই হবে। এরপর আমি মা আর বাবাকে নিয়ে তোমার মায়ের কাছে আসব। উনার কাছে অনুরোধ করব, তোমার পড়া শেষ হলে যেন আমার সঙ্গেই বিয়ে দেন। উনি কথা দিলে অনেকটা নিশ্চিন্ত হতে পারব। এখন অনিশ্চয়তায় ভুগছি। আমি গুছিয়ে লিখতে পারছি না আজ। কয়েকটা চিঠি লিখেছি। একটাও মনমতো হয়নি। অনুগ্রহ করে তুমি মানিয়ে নিয়ো। ভুলত্রুটি মার্জনা কোরো।
ইতি
লিখন শাহ্
বাড়ির সবাই ঘুমে। পদ্মজা চুপিচুপি উঠে বসে পড়ার টেবিলে। রাত অনেক, গাছের পাতায় নিশ্চয় শিশির বিন্দু জমছে। এরপর ভোররাতে টিনের চালে শিশিরকণা বড়ো বড়ো ফোঁটায় বৃষ্টির মতো ঝরবে। গাঁ হিম করা ঠান্ডা, তা উপেক্ষা করে পদ্মজা হাতে কলম তুলে নিলো। সাদা কাগজে লিখল, অপেক্ষা করব। এরপর কাগজটা ভাঁজ করে বালিশের তলায় রেখে শুয়ে পড়ল।
ফজরের নামাজ আদায় করে চার ভাইবোন পড়তে বসে। পড়ায় মন টিকছে না পদ্মজার। বই আনার ছুতোয় পদ্মজা ঘরের ভেতর চলে গেল। রাতের লেখা কাগজটা ছিঁড়ে কুটিকুটি করে ফেলে দিল জানালার বাইরে। এরপর আবার নতুন করে লিখল: আমার আম্মা যা চান তাই হবে।
পড়াশেষে অভ্যাসবশত ঘাটে যায় পদ্মজা। হাতের মুঠোয় তিনটে চিঠি—দুটো লিখনের, একটা তার লেখা। পূর্ণাও পাশে। প্রেমা- প্ৰান্ত বাড়িজুড়ে ছুটাছুটি করছে। সামনের কোনোকিছু ঠিকমতো দেখা যাচ্ছে না। সবকিছুই অস্পষ্ট। কুয়াশার স্তর এত ঘন যে, দেখে মনে হচ্ছে সামনে কুয়াশার পাহাড় দাঁড়িয়ে আছে। সেই পাহাড় ভেদ করে একটা নৌকা এসে ঘাটে ভেরে। নৌকায় লিখন আর মগা। আকস্মিক ঘটনায় পিলে চমকে উঠল পদ্মজার। পালানোর মতো শক্তিটুকু পেল না।
লিখন মায়াভরা কণ্ঠে পদ্মজার উদ্দেশ্যে বলল, ‘আমি বাধ্য হয়ে এসেছি। আজ বিকেলে চলে যাব। মগা বলল, প্রতিদিন সকালে নাকি তুমি ঘাটে বসো। তাই এসেছি।’
পদ্মজা মনে মনে দোয়া ইউনুস পড়ছে। ভয়ে বুক দুরুদুরু করছে। মা দেখে ফেললে কী হবে? বা অন্য কেউ? একটু সাহস জড়ো হতেই নিজের লেখা চিঠি সিঁড়িতে রেখে পদ্মজা ছুটে চলে গেল বাড়ির ভেতর। পূর্ণা বড়ো বড়ো চোখে শুধু দেখল। লিখন নৌকা থেকে নেমে চিঠিটা হাতে তুলে নেয়। ভাঁজ খুলে একটা লাইন পেল শুধু। বিষাদের ছায়া নেমে আসে লিখনের মুখে।
পূর্ণার কৌতূহল হলো চিঠিতে কী আছে জানার জন্য। তবে তা প্রকাশ বল না। শুধু বলল, ‘আপা আপনার কথা প্রতিদিন ভাবে।’
.
১৯৯৬ সাল। পদ্মজা থেমে থেমে কাঁপছে। মুখ লুকিয়ে রেখেছে হাঁটুর ওপর। তুষার কালো চাদর টেনে দিল তার গায়ে। পদ্মজা চোখ তুলে তাকাল। বিষাদভরা কণ্ঠে বলল, ‘সেদিন আমার লেখা প্রথম চিঠিটা কুটিকুটি কেন করেছি জানি না। ইচ্ছে হয়েছিল তাই করেছি। তবে জানেন, আমি একদম ঠিক করেছিলাম। সেদিন যদি আমি কথা দিয়ে দিতাম। আমার কথা ভঙ্গ হতো।’
পদ্মজা হাসল। তুষার একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল পদ্মজার দিকে।
বলল, ‘লিখনের সঙ্গে আর দেখা হয়নি?’
পদ্মজা হাতের কাটা জায়গায় ফুঁ দিয়ে বলল, ‘হয়েছিল।’
‘তাহলে কথা ভঙ্গ হতো কেন বললেন?’
তুষারের দিকে তাকাল পদ্মজা, এরপর হাঁটুতে মুখ লুকালো। এক মিনিট, দুই মিনিট, তিন মিনিট করে…কেটে গেল দশ মিনিট। পদ্মজার সাড়া নেই। তুষার ডাকল, ‘পদ্মজা? শুনতে পাচ্ছেন?’
‘পাচ্ছি।’
‘আপনার কী কষ্ট হচ্ছে?’
‘হচ্ছে।’
‘মুখ তুলে তাকান।’
পদ্মজা ছলছল চোখে তাকাল। তুষার উদ্বিগ্ন হয়ে বলল, ‘কোনো সমস্যা হচ্ছে?’
তুষারের প্রশ্ন অগ্রাহ্য করে পদ্মজা ভেজা কণ্ঠে বলল, ‘আমার আম্মা আমার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা কেন করল?’
তুষার ভেতরে ভেতরে চমকাল। হেমলতা নামে মানুষটার সম্পর্কে যা জানে এবং জানল, তাতে তার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা শব্দটা যায় না পরপরই নিজেকে সামলে নিলো।
ভালো মানুষের খারাপ রূপ—এমন কেইস শত শত আছে।
তুষার সাবধানে প্রশ্ন করল, ‘কী করেছেন তিনি?’
পদ্মজা উত্তর দিল না। মেঝেতে শুয়ে চোখ বুজল। তুষার গোপনে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। পদ্মজা এখন আর কিছু বলবে না, সে ক্লান্ত; অতীত হাতড়াতে গিয়ে মনের অসুস্থতা বেড়ে গেছে। তুষার তাকাল মেয়েটার মুখের দিকে। আঁচল সরে গেছে তার বুকের ওপর থেকে, চাদরের অংশ পড়ে আছে মেঝেতে। তুষার চাদরটা টেনে দিতে গিয়ে আবিষ্কার করল, পদ্মজার গলায় কালো-খয়েরি মিশ্রণে কয়টা দাগ। কেউ শক্ত হাতে চেপে ধরেছিল গলা! হুংকার ছাড়ল সে, ‘ফাহিমা?’
ফাহিমা কাছেই ছিল, তাই ছুটে এলো। তুষার বলল, আপনি আসামির গলা টিপে ধরেছেন?’
ফাহিমা চট করে বলল, ‘না, স্যার। প্রথম থেকেই গলায় দাগগুলো দেখছি। প্রশ্নও করেছি। মেয়েটা উত্তর দিল না।’
কপাল ভাঁজ করে ফেলল তুষার। হাজারটা প্রশ্ন মাথায় ভনভন করছে, মস্তিষ্ক শূন্য প্রায়। পদ্মজা যতটুকু বলেছে, তার পরের সাত বছরের কাহিনি জানা পর্যন্ত শান্তি মিলবে না। মাথা কাজ না করলে তুষার সিগারেট টানে। তাই সে বেরিয়ে গেল।
১৩
বাড়ির গিন্নির মতো কোমরে ওড়নার আঁচল গুঁজে রান্নাবান্না করছে পদ্মজা। হেমলতার কোমরে ব্যথা। তিনি রান্না করতে চাইলেও পদ্মজা রাঁধতে দিল না। মোর্শেদও বললেন, ‘বেদনা লইয়া রান্ধা লাগব না। তোমার মাইয়া যহন রানতে পারে তে হেই রান্ধক।’
শেষ অবধি হেমলতা হার মানলেন। পদ্মজা মাটির চুলায় মুরগি গোশত রান্না করছে। খড়ি বা লাকড়ি হিসেবে আছে বাঁশের মুড়ো। আগুনের শিখার রং নীলচে। শীতের মাঝে রান্নার করার শান্তি আলাদা। মুরগি গোশত রান্না হওয়ার কারণ—আজ এতিম-মিসকিন খাওয়ানো হবে। হেমলতা বলেন, সামর্থ্য থাকলে মাসে একবার হলেও এতিম-মিসকিনদের খাওয়ানো উচিত, নয়তো ঘরে রহমত থাকে না। রান্না শেষ করে পদ্মজা হেমলতার কাছে এলো। বলল, ‘আম্মা রান্না শেষ।’
হেমলতা দৌর্বল্যমাখা কণ্ঠে বললেন, ‘তোর আব্বারে গিয়ে বল—আলী, মুমিন, আর ময়নাকে নিয়ে আসতে।’
পদ্মজা কিছু না বলে মাথা নিচু করে ফেলল। মোর্শেদের সঙ্গে আগবাড়িয়ে কথা বলতে তার ভয় হয়। অনেকদিন বাজে ব্যবহার করেন না। হুট করে যদি করে ফেলেন তো খুব কষ্ট হবে। হেমলতা মৃদু হাসলেন। বললেন, ‘কিছু বলবে না। যা তুই।’
পদ্মজা ধীর কণ্ঠে বলল, ‘সত্যি যাব?’
হেমলতা সামনে-পেছনে মাথা ঝাকিয়ে ইঙ্গিত করলেন যেতে। পদ্মজা মোর্শেদকে উঠানেই পেল, চেয়ারে বসে রোদ পোহাচ্ছেন। পদ্মজা গুটিগুটি পায়ে হেঁটে গেল। আব্বা ডাকতে গিয়ে গলা ধরে আসছে তার। ঢোক গিলে ডাকল, ‘আব্বা?’
মোর্শেদ ঘাড় ঘুরাতেই পদ্মজার মনে হলো বুকে কিছু ধপাস করে পড়ল। পদ্মজা দৃষ্টি অস্থির রেখে মিনমিনে গলায় বলল, ‘আম্মা বলেছে আলীদের নিয়ে আসতে।’
‘রান্ধন শেষ?’
‘জি, আব্বা।’
মোর্শেদ গলায় গামছা বেঁধে বেরিয়ে যান। পদ্মজা মোর্শেদের যাওয়ার পানে তাকিয়ে থাকল বেশ কিছুক্ষণ। অনুভূতিগুলো থমকে গেছে, ঝাপসা হয়ে আসছে পদ্মজার চোখ দুটো। অল্পতেই তার কান্না চলে আসে। সে তাড়াতাড়ি ডান হাতের উলটো পাশ দিয়ে চোখের জল মুছল। গাছ থেকে পাখির কিচিরমিচির শব্দ আসছে। পদ্মজা সেদিকে তাকাল। তখনি হেমলতা ডাকলেন, ‘পদ্ম।’
পদ্মজা ছুটে যায়, ‘কিছু লাগবে আম্মা?’
‘না। পূর্ণারা কোথায় গেল?
‘ঘাটে।’
‘কী করে?’
‘মাছ ধরে।’
‘বড়শি দিয়ে?’
‘জালি দিয়ে।’
‘এত বড়ো মেয়ে নদীতে নেমে জাল দিয়ে মাছ ধরে!’ কী মনে করে যেন আবার মেনে নিলেন, ‘আচ্ছা, থাক। তুই আয়। বস আমার পাশে।’
পদ্মজা হেমলতার পায়ের কাছে বসে পায়ে হাত দিল টিপে দেওয়ার জন্য। হেমলতা পা সরিয়ে নিতে নিতে বললেন, ‘লাগবে না।’ শাড়ির আঁচল দিয়ে পদ্মজার কপালের ঘাম মুছে দিয়ে বললেন, ‘কোমরের ব্যথাটা কমেছে চিন্তা করিস না। তোর আব্বা কিছু বলেছে?’
‘না, আম্মা। আচ্ছা আম্মা, আব্বা এত পালটাল কীভাবে?’ পদ্মজা নিজের আগ্রহ দমে রাখতে পারল না।
হেমলতা মৃদু হাসলেন। উদাস হয়ে টিনের দেয়ালে তাকিয়ে বললেন, ‘শুনেছিলাম তোর বাপ ভালো মানুষ। কিন্তু বিয়ের পর তার ভালোমানুষি ভুলেও দেখিনি। কারণ, তার কানে-মগজে মন্ত্র দেয়ার মানুষ ছিল। অন্যের নিয়ন্ত্রণে ছিল। এখন আর কেউ নিয়ন্ত্রণ করে না তাই পালটাচ্ছে। তোর বাপের ব্যক্তিত্ব নেই। নিজস্ব স্বকীয়তা নাই। অন্যের কথায় নাচে ভালো।’
শেষ কথাটা হেমলতা হেসে বললেন। পদ্মজা কিছু বলল না। হেমলতা শুয়ে পড়লেন। আজ সারাদিন বিশ্রাম নিবেন। আগামীকাল অনেক কাজ। অনেকগুলো কাপড় জমেছে।
‘রূপ ক্ষণিকের, গুণ চিরস্থায়ী। এটা আব্বা শেষ বয়েসে এসে বুঝেছে।’
পদ্মজার শীতল কণ্ঠ এবং কথার তিরে হেমলতা ভীষণভাবে বিস্মিত হলেন। তিনি সেকেন্ড কয়েক কথা বলতে পারলেন না। পদ্মজা চলে যাওয়ার জন্য উঠতেই, হেমলতা অবিশ্বাস্য স্বরে প্রশ্ন ছুঁড়লেন, ‘এই খবর তুই কোথায় পেলি?’
পদ্মজা ঘাড় ঘুরিয়ে বলল, ‘আমি তো তোমারই মেয়ে, আম্মা। তোমার এত বড়ো দুঃখ আমি জানব না?’
পদ্মজা চলে গেল। পেছনে রেখে গেল হেমলতার অবিশ্বাস্য চাহনি।
.
বিকেলবেলা হেমলতা ঘর থেকে বের হলেন। শরীরে কিছুটা আরাম এসেছে। পূর্ণা বরই ভর্তা করছে, পাশে প্রেমা। পদ্মজাকে দেখা গেল না। নিশ্চয়ই ঘাটে বসে আছে। প্রান্তও তো নেই।
তিনি পূর্ণাকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘প্রান্ত কোথায়?’
পূর্ণা কয়েক সেকেন্ড ভাবল কী উত্তর দিবে। এরপর ভয়ার্ত কণ্ঠে বলল, ‘জানি না, আম্মা।’
‘জানিস না কী?’ তিনি এবার প্রেমাকে ধরলেন, ‘প্রান্ত কোথায় রে প্রেমা?’ প্রেমা সহজ স্বরে বলল, ‘আমরা সবাই ঘাটে ছিলাম। প্রান্ত উঠানে ছিল। এরপর এসে দেখি নেই।’
হেমলতা গলা উঁচিয়ে বললেন, ‘কোন মুখে বলছিস জানি না? একসঙ্গে নিয়ে থাকতে পারিস না। একা ছাড়িস কেন? কোথায় গেছে ছেলেটা।’
হেমলতার ধমক ঘাট অবধি পৌঁছে যায়। পদ্মজা বাড়ির পেছন থেকে ছুটে এসে প্রশ্ন করে, ‘কী হয়েছে আম্মা?’
‘প্রান্ত বাড়ি নেই সেটা আমাকে কেউ বলল না! দেখ দুটোকে, বসে বসে বরই ভর্তা গিলছে। দিন দিন অবাধ্য হচ্ছে মেয়েগুলো।’
পূর্ণা ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে। প্রেমা হেমলতার ধমকে ভয় পাচ্ছে, কিন্তু অতটা না। হেমলতার মন কু গাইছে।
তিনি নিজ ঘরে যেতে যেতে পদ্মজাকে বললেন, ‘বের হচ্ছি আমি। সাবধানে থাকবি।
তখন দুজন লোক প্রান্তকে নিয়ে বাড়িতে ঢুকল। প্রান্তর কপাল বেয়ে রক্ত ঝরছে। পদ্মজা উদগ্রীব হয়ে হেমলতাকে ডাকল, ‘আম্মা।’ এরপর দৌড়ে গেল উঠানে। প্রান্ত কাঁদছে। হেমলতা ব্যস্ত পায়ে বেরিয়ে আসেন। প্রান্তকে আহত অবস্থায় দেখে ভড়কে যান। বুকটা হাহাকার করে উঠে তার। ছুটে গিয়ে প্রান্তকে দুই হাতে জড়িয়ে ধরে লোক দুটিকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আমার ছেলের কী হয়েছে?’
একজন লোক বলল, ‘পলাশ মিয়ার ছেড়ার লগে মাইর লাগছিল। হেই ছেড়ায় পাথথর দিয়া ইডা মারছে কপালে আর ফাইট্টা গেছে।’
মোর্শেদ লাহাড়ি ঘরের সামনে গাছ কাটছিলেন। চেঁচামেচি শুনে চলে আসেন। প্রান্তকে এমতাবস্থায় দেখে লোক দুটিকে তেজ নিয়ে বললেন, ‘কোন কুত্তার বাচ্চায় আমার ছেড়ারে মারছে? কোন বান্দির ছেড়ার এত বড়ো সাহস?’
মোর্শেদ উত্তরের অপেক্ষা করলেন না। প্রান্তকে নিয়ে ছুটে চলে যান বাজারে। হেমলতা রয়ে গেলেন বাড়িতে। বাজারে আজ হাট বসেছে। মোর্শেদ হেমলতাকে নিষেধ করেছেন সঙ্গে যেতে। বাড়িতে থেকে হেমলতা হাঁসফাঁস করছেন। প্রান্ত একা বড়ো হয়েছে। কতবার কতরকম আঘাত পেয়েছে, দেখার কেউ ছিল না; সবসময় মিনমিনিয়ে কেঁদেছে। এমন বাচ্চা ছেলের এত বড়ো আঘাত পেয়ে চেঁচিয়ে কাঁদার কথা। কষ্ট তো আর কম পায়নি! দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করেছে। হেমলতার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। পদ্মজা ঘরে লুকিয়ে কাঁদছে। পূর্ণা-প্রেমা বাড়ির বাইরে বার বার উঁকি দিয়ে দেখছে, তাদের আব্বা প্রান্তকে নিয়ে ফিরল কি না!
.
দেখতে দেখতে চলে এসেছে মেট্রিক পরীক্ষা। কেন্দ্র শহরে, যেতে লাগে ছয় ঘণ্টা। বাড়িতে থেকে পরীক্ষা দেয়া সম্ভব না। এদিকে কেন্দ্রের পাশেই মোর্শেদের মামা বাড়ি; মামা নেই, তবে মামাতো ভাইয়েরা আছে। কথাবার্তা বলে সেখানেই দেড় মাসের জন্য হেমলতা আর পদ্মজা উঠল। মোর্শেদ বাকি দুই মেয়ে আর প্রান্তকে নিয়ে বাড়িতে রয়ে গেছেন। হেমলতা পদ্মজাকে নিয়ে আসার পূর্বে নিজে এসে দেখে গেছেন, পরিবেশ কেমন। মোর্শেদের দুই মামাতো ভাইয়ের মধ্যে একজন রাজধানীতে থাকে। আরেকজনের বয়স হয়েছে অনেক। ছেলে-মেয়েদের বিয়ে দিয়ে বউ নিয়ে একাই থাকেন। ছেলেরা শহরে চাকরি করে। পদ্মজার জন্য উপযুক্ত স্থান। তাই আর অমত করলেন না।
মোর্শেদের যে ভাইটি বাড়িতে আছেন তার নাম—আকবর হোসেন। বয়স ষাটের বেশি হবে। তবে আকবর হোসেনের স্ত্রী জয়নবের বয়স খুব কম, হেমলতার বয়সি। হেমলতা আকবর হোসেনকে ভাইজান বলে সম্বোধন করেন। দালান বাড়ি, বেশিরভাগ সময় বিদ্যুৎ থাকে। ফলে পদ্মজা মন দিয়ে পড়তে পারছে। পরীক্ষাও ভালো করে দিচ্ছে।
হেমলতা অবশ্য আকবর হোসেনকে চোখে চোখে রেখেছেন। শীতল প্রকৃতির লোক, তবে বিশ্বাসী। রাতের খাবার আকবর হোসেনের সঙ্গেই খেতে হয়। হেমলতা দেড় মাসের খাওয়ার খরচ নিয়ে এসেছেন। আকবর হোসেন কিছুতেই আলাদা রাঁধতে দিচ্ছেন না। এভাবে অন্যের বোঝা হয়ে থাকতে হেমলতার আত্মসম্মানে লাগে। তিনি কথায় কথায় জানতে পারলেন, আকবর হোসেন এবং জয়নবের নকশিকাঁথা খুব পছন্দ। তাই তিনি কিছুদিন যাবৎ নকশিকাঁথা সেলাই করছেন। যতক্ষণ পদ্মজা পরীক্ষা দেয়, ততক্ষণ হেমলতা কেন্দ্রের বাইরে কোথাও বসে বা দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করেন।
অনেক রাত অবধি পদ্মজা পড়ে, আজ অনেকক্ষণ ধরে কী যেন ভাবছে। হেমলতা ব্যাপারটা খেয়াল করে পদ্মজার পাশে বসে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কী ভাবছিস?’
পদ্মজা এক নজর হেমলতাকে দেখে চোখ ফিরিয়ে নিলো। হেমলতা তাকিয়ে রইলেন জানার জন্য। পদ্মজা দ্বিধা নিয়ে বলল, ‘রাগ করবে না তো?’
হেমলতা পদ্মজাকে পরখ করে নিলেন। বললেন, ‘কী জানতে চাস?’
পদ্মজা এদিক-ওদিক চোখ বুলায়। কীভাবে শুরু করবে বুঝে উঠতে পারছে না। দুই মিনিট পর নীরবতা ভেঙে বলল, ‘দুপুর থেকে আমার খুব জানতে ইচ্ছে হচ্ছে, হানিফ মামাকে কে মারল? তোমার সঙ্গে মামার কী কথা হয়েছিল? হানিফ মামাকে… মানে তুমি তো অন্য কারণে গিয়েছিলে কিন্তু ফিরে এলে। খুনও হলো। আমি সবসময় এটা ভাবি। কখনো উত্তর পাই না। মনে মনে অনেক যুক্তি সাজাই। কিন্তু যুক্তিগুলো মিলে না। সব যুক্তিই খাপছাড়া, এলোমেলো।’
‘কাল পরীক্ষা। আর আজ এসব ভেবে সময় নষ্ট করছিস!’
হেমলতার কণ্ঠ স্বাভাবিক। তবুও পদ্মজা ভয় পেয়ে গেল। তবে কিঞ্চিৎ আশা মনে ভীষণভাবে উঁকি দিচ্ছে।
১৪
কিছুটা দূরেই রেলস্টেশন। সেখান থেকে হুইসেলের শব্দ ভেসে আসছে। গভীর রাতের ট্রেন ছুটে যাচ্ছে নিজ গন্তব্যের দিকে। কাছে কোথাও নেড়ি কুকুরের দল ঘেউঘেউ করছে। হেমলতা জানালাগুলো বন্ধ করে দিলেন যাতে কুকুরের ডাকাডাকির আওয়াজে পদ্মজার পড়াশোনায় সমস্যা না হয়।
পদ্মজা ইংরেজি বইয়ের দিকে চোখ রেখে মিনমিনে স্বরে বলল, ‘পরীক্ষা তো পরশু।
হেমলতা খোলা চুল মুঠোয় নিয়ে হাত খোঁপা করে বললেন, ‘কাল আর পরশুর মাঝে তো খুব একটা পার্থক্য নেই।’
পদ্মজা কিছু বলল না। বইয়ের দিকে তাকিয়ে এমন ভান ধরল যেন পড়ায় তার ভীষণ একাগ্ৰতা।
হেমলতা চোখ ছোটো ছোটো করে পদ্মজাকে দেখছেন। মেয়েটা পড়ায় মনোযোগ দেয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করছে, কিন্তু সফল হতে পারছে না। বার বার নিচের ঠোঁট কামড়াচ্ছে। তিনি হঠাৎই বললেন, ‘ছাদে যাবি?’
এহেন প্রস্তাবে পদ্মজা বিস্মিত হলো, নাকের পাটা হয়ে গেল লাল। যদিও এই কথাই নাক লাল কেন হলো, তা জানা নেই। সে হাঁ করে তাকিয়ে রইল মায়ের দিকে। হেমলতা আবার বললেন, ‘যাবি?’
পদ্মজা প্রফুল্লচিত্তে বলল, ‘যাব…যাব আম্মা।’
আকবর হোসেনের বাড়িটির নাম সিংহাসনকুঞ্জ। এই অদ্ভুত নামের হেতু ছাদে উঠলেই জানা যায়। মা-মেয়ে সিঁড়ি বেয়ে ছাদের দিকে উঠছে। তাদের পায়ের শব্দ মোহময় ছন্দ তুলে হারিয়ে যাচ্ছে গহিন অন্ধকারে। ছাদের ঠিক মধ্যিখানে দাঁড়িয়ে আছে বিশাল সিংহাসন। তা দেখে পদ্মজার চক্ষু চড়কগাছ!
বিষ্ময় নিয়ে প্রশ্ন করল, ‘আম্মা! এই সিংহাসন কার?’
হেমলতা পদ্মজার মুখের ভাব দেখে বেশ আনন্দ পাচ্ছেন। তিনি নিজেও দুইদিন আগে সিংহাসনটি দেখে খুব অবাক হয়ে আকবর হোসেনের কাছে একই ভাবে করেছিলেন প্রশ্নটা। তাই আকবর হোসেনের উত্তর পুনরাবৃত্তি করলেন, ‘তোর আকবর কাকার বাবা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা সাহিত্যের অধ্যাপক ছিলেন। উনার ইচ্ছে ছিল নিজের বাড়ির ছাদে একটা সিংহাসন তৈরি করার। শেষ বয়সে এসে নিজের মনের ইচ্ছে পূরণ করেছেন। দিনরাত নাকি রাজকীয় ভঙ্গীতে সিংহাসনে বসে থাকতেন। মৃত্যুও হয় এই সিংহাসনে, ঘুমানো অবস্থায়।’
পদ্মজা হাঁ করে কিছুক্ষণ স্থির হয়ে রইল। তারপর খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগল সিংহাসনটি—ময়ূর সিংহাসন! ইট-সিমেন্টের তৈরি আসনটি যেন পেখম মেলে দাঁড়িয়ে আছে। অনেক বড়ো, দৈর্ঘ্যে পাঁচ ফুট বা আরো বেশি হবে। পদ্মজা প্রশ্ন করল, ‘আম্মা, এটা মোঘল সম্রাট শাহজাহানের সিংহাসনের মতো না?’
হেমলতা বললেন, ‘অনেকটাই তেমন। সম্রাট শাহজাহানের সিংহাসনের মতো করে বানানোর স্বপ্নই বোধহয় তিনি দেখতেন। অর্থের জন্য পারেননি।’ পদ্মজা ভিন্ন প্রসঙ্গে চলে গেল। অনুরোধ করে বলল, ‘আম্মা তুমি সিংহাসনে বসো।’
‘আমাকে মানাবে না। তুই বস, তোকে রাজরানি লাগবে।’
‘তুমি আগে বসো। আম্মা একটু বসো…একটু?’
পদ্মজার অনুরোধে হেমলতা সিংহাসনে বসলেন। পদ্মজাকে ডেকে
বললেন, ‘তুইও আয়, পাশে বস।’
পদ্মজা এলো না। দূর থেকে বলল, ‘মাঝে বসো আম্মা।’
‘কী শুরু করেছিস!’
‘বসো না।’
হেমলতা কপাল কুঁচকে সিংহাসনের মাঝে বসেন। পদ্মজার ঠোঁটে হাসি ফুটে আবার হারিয়ে গেল। বলল, ‘আরেকটু বাকি।’
‘কী বাকি?’
বাঁ-পায়ের উপর ডান পা তুলে রানিদের মতো বসো।’
হেমলতা বিরক্তি নিয়ে উঠে পড়েন। পদ্মজাকে বললেন, ‘পাগলের প্রলাপ শুরু করেছিস!’
পদ্মজা নাছোড়বান্দা হয়ে দৃঢ়ভাবে বলল, ‘আম্মা, বসো। নয়তো আমি কাঁদব।’
পদ্মজার ছেলেমানুষি দেখে হেমলতা হাসবেন না রাগবেন—ঠাওর করতে পারলেন না।
রাতের সৌন্দর্য আর তার মায়াবী রূপকে, প্রতিটি মানুষের ভেতরের আহ্লাদ-ইচ্ছে-কষ্টকে ঠেলেঠুলে বের করে আনার ক্ষমতা বোধহয় আল্লাহ নিজ হাতে দিয়েছেন। তাই হেমলতা তার নিজের শক্ত খোলসে ফিরতে পারলেন না। পদ্মজার পাগলামোর সুরে সুর মিলিয়ে তিনি সিংহাসনে রাজকীয় ভঙ্গীতে বসলেন। পদ্মজার কেমন অদ্ভুত একটা অনুভূতি হয়, বুকের ভেতর ঝিরিঝিরি কাঁপন। এই তো তার কল্পনার রাজ্যের রাজরানি—হেমলতা…এবং তার কন্যা সে পদ্মজা। চোখের মণিকোঠায় ভেসে উঠল একটি অসাধারণ দৃশ্য। হেমলতার সর্বাঙ্গে হীরামণি-মুক্তার অলংকার। অসম্ভব সুন্দর শ্যামবর্ণের এই সাহসী নারীকে দেখতে কতশত দেশ থেকে মানুষ ভিড় জমিয়েছে। আর সে হেমলতার পাশে বসে আছে। চারিদিকে ঢাকঢোল পিটানো হচ্ছে। হাতিশাল থেকে হাতির হুংকার আসছে। তারাও যেন খুশি এমন রানি পেয়ে।
‘তোর পাগলামি শেষ হয়েছে?
পদ্মজা জবাব না দিয়ে হেমলতার পাশে এসে বসল। কোলে মাথা রেখে গুটিসুটি মেরে শুয়ে আক্ষেপের স্বরে বলল, ‘আম্মা, তুমি রানি আর আমি রাজকন্যা কেন হলাম না? সবাই আমাদের ভালোবাসত। সম্মান করত। মুগ্ধ হয়ে দেখত।
হেমলতার বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। সমাজ কেন তার প্রতিকূলে থাকল? কেন পদ্মজা ছোটো থেকে সমাজের অন্য কারো মেয়ের সঙ্গে মেশার অধিকার পেল না? তিনি বললেন, ‘জন্ম যেভাবেই হোক। জীবনে সফলতা না এনে মৃত্যুতে ঢলে পড়া ব্যক্তির ব্যর্থতা। তুই এমন জায়গায় যাওয়ার চেষ্টা কর যাতে মানুষ সম্মান করে। সম্মান করতে বাধ্য হয়। চোখ তুলে তাকাতেও যেন ভয় করে। যারা দূরছাই করেছে তাদের যেন বিবেকে বাঁধে।’
‘পারব আমি?’
‘কেনো পারবি না? পুরো জীবন তো দুঃখে-অবহেলায় যায় না।’
‘তোমার জীবনের অনেকগুলো বছর দুঃখ আর অবহেলাতেই তো গেছে। কিছুই পাওনি।’
হেমলতা তাৎক্ষণিক পালটা জবাব দিতে পারলেন না। তিনি দুঃখকষ্ট- অবহেলা-অপমান আর একাকীত্ব ছাড়া জীবনে কী পেয়েছেন? উত্তরটাও চট করে পেয়ে গেলেন।
পদ্মজাকে বললেন, ‘তিনটে মেয়ে পেয়েছি। আমার মেয়েরা আমার সফলতা। আমার অহংকার। প্রেমা তো ছোটো। তোরা দুইজন নিজেদের মতো থাকিস, পড়িস; কোনো দুর্নাম নাই। যখন মানুষ বলে—এই যে, এরা হচ্ছে হেমলতার মেয়ে…তখন আমার অনেক কিছু পাওয়া হয়ে যায়। গর্বে বুকটা ভরে উঠে।’
পদ্মজা আশ্বস্ত করে বলল, ‘কখনো ভুল কাজ করব না। তোমার সম্মান আমাদের জন্য একটুও নষ্ট হতে দেব না।’
হেমলতা পদ্মজার ডান হাত নিয়ে তার উলটোপাশে চুমু দিয়ে বললেন, ‘আমি জানি পদ্ম। আমার মেয়েরা কখনো আমার অসম্মান হতে দিবে না।’
নিস্তব্ধতা ভেঙে ভেঙে মাঝে মাঝে পাতার ফাঁকে ফাঁকে পাখ-পাখালির ডানা নাড়ার শব্দ ভেসে আসছে। পদ্মজা চোখ তুলে আকাশের দিকে তাকাল। আকাশে একটা চাঁদ, অগণিত তারা। আকাশকে তারায় পরিপূর্ণ একটি কালো গালিচার মতো লাগছে। হেমলতা বিভ্রম নিয়ে বললেন, ‘গায়ের কালো রংয়ের দোষে সমাজের সঙ্গে আমার সখ্যতা কখনো হয়ে উঠেনি। প্রকৃতির মতিগতি অবস্থা দেখে দেখে আমার সময় কাটত। আব্বা শিক্ষক ছিলেন বলে কালো হয়েও পড়াশোনা করার সুযোগ পেয়েছিলাম। অবশ্য আব্বার সামর্থ্যও ছিল। আমাদের সব ভাই-বোনকে পড়িয়েছেন। আম্মা আমাকে পড়ানোতে বেশি আগ্রহ দেখিয়েছিলেন। রং কালো, কেউ বিয়ে করবে না। একটু পড়ালেখা থাকলে হয়তো করবে সেই আশায়। যখন আমি তোর বয়সি ছিলাম, তখন বড়ো আপার মেয়ে হয়। মেয়েটার গায়ের রং কালো। শ্বশুর বাড়িতে তুলকালাম কাণ্ড। বংশের সবাই ফরসা। বাচ্চা কেন কালো হলো। আপাকে বের করে দিল! বাড়ি ফিরল আপা, সমাজের কত কটুক্তি হজম করেছে! তখন আমি নামাজের দোয়ায় আকুতি করে চাইতাম একটা সুন্দর মেয়ের। আমার বিয়ে হলে মেয়েটা যেন পরির মতো সুন্দর হয়, আমার মতো অবহেলার পাত্রী যেন না হয়; বড়ো আপার মতো কালো মেয়ে নিয়ে শ্বশুর বাড়ি থেকে বিতাড়িত হতে যেন না হয়। তুই যখন পেটে তখন নফল নামাজ-রোজা বাড়িয়ে দেই। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ বাদে সময় পেলেই সেজদায় লুটিয়ে আল্লাহকে একই কথা বলতাম। আমার পরির মতো মেয়ে চাই। দোয়াও কবুল হয়ে গেল। তোর যেদিন জন্ম হয়, সবাই অবাক হয়ে শুধু তাকিয়েই ছিল। আমি তো খুশিতে কেঁদেই দিয়েছিলাম। এত সুন্দর বাচ্চা এই গ্রামে কেন, পুরো দেশেও বোধহয় ছিল না। চোখের পাপড়ি যেন ভ্রুতে এসে ঠেকছিল। ঠোঁট এত লাল ছিল যেন ঠোঁট বেয়ে রক্ত ঝরছে। সদ্য জন্মানো শিশুর মাথা ভরতি ঘন কালো রেশমি চুল। অলন্দপুরের সবার কাছে ছড়িয়ে পড়ে এই কথা। দল বেঁধে দেখতে আসে। এক সপ্তাহ বেশ তোড়জোড় চলে। কী খুশি ছিলাম আমি! সারাক্ষণ তোকে চুমো খেতাম। রাতেও ঘুমাতে ইচ্ছে করত না। মনে হতো, এই বুঝি আমার পরির মতো মেয়ে চুরি হয়ে গেল! তোর আব্বা সারাক্ষণ খুশিতে বাকবাকম করত। বাইরে থেকে এসে গোসল ছাড়া কোলে নিত না। যখন কোলে নিত বার বার আমাকে বলত, ‘ও লতা। ছেড়িড়া মানুষ না শিমুল তুলা।’
হেমলতা থামলেন। তার চোখের তারায় জল ছলছল করছে। পদ্মজা আগ্রহ নিয়ে শুনছিল। সে বলল, তারপর?
‘কেউ বা কারা রটিয়ে দিল তুই তোর বাপের মেয়ে না। যুক্তি দাঁড় করাল: বাপ-মা কালো মেয়ে এত সুন্দর হয় কী করে? গ্রামের প্রায় সব মানুষ অশিক্ষিত, কুসংস্কারে বিশ্বাসী। তাই বিবেচনা ছাড়াই বিশ্বাস করে নিলো।’
হেমলতা থামলেন। পদ্মজার মনে হতে থাকে, হেমলতা কিছু একটা লুকিয়েছেন। শুধু গ্রামের মানুষ বললেই এত বড়ো দাগ লেগে যায় না। অন্য কোনো কারণ আছে, যা যুক্তি হিসেবে শক্ত ছিল। হেমলতা দম নিয়ে বললেন, ‘আমায় একা করে দিয়ে তোর বাপ সরে গেল। সমাজ সরে গেল। আঁতুড়ঘরে তোকে নিয়ে একা পড়ে রইলাম। তোকে দেখলেই মনে হতো, আল্লাহ কোনো মূল্যবান সম্পদ আমাকে দেখে রাখতে দিয়েছেন। তোকে দেখে রাখা আর বড়ো করাটাই জীবনের লক্ষ্য মনে হতে থাকে। নিজেকে শক্ত করে আমি অন্য-আমি হয়ে যাই, খোলসটা পালটে যেতে থাকে; রাত জেগে স্বপ্ন সাজাই। তোর সঙ্গে ফুল কুড়ানোর স্বপ্ন দেখে ফুল গাছ লাগাই। যখন তোর চার বছর হয় বাড়ি ভরে যায় ফুলগাছে। ছোটো শাড়ি পরিয়ে প্রতিদিন মা-মেয়ে মিলে ফুল তুলে মালা গাঁথতাম। নিশুতি রাতে পাকা ছাদে জোছনা পোহানোর স্বপ্ন ছিল। আজ পূরণ হলো। আর দুইটা ইচ্ছে বাকি, সাগর জলে মা-মেয়ে পা ডুবিয়ে পুরো একটা বিকেল কাটাব। আর, শেষ বয়সে নাতি-নাতনিদের নিয়ে তাদের মায়ের জীবনী বলব।’
পদ্মজা দুই হাতে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে হেমলতার কোমর। তিনি টের পান পদ্মজা ফোপাচ্ছে।
উৎকণ্ঠা নিয়ে বললেন, ‘পদ্ম… কাঁদছিস কেন?
পদ্মজা বাচ্চাদের মতো কাঁদতে থাকল। কাঁদতে কাঁদতে বলল, ‘আমাকে কখনো একা থাকতে দিয়ো না আম্মা। আমি তোমাকে ছাড়া থাকতে পারব না। তোমার মতো কেউ হয় না।’
‘এজন্য কাঁদতে হয়? আমি সবসময় তোর সঙ্গে আছি। কান্না থামা। কী মেয়ে হয়েছে দেখো! কেমন করে কাঁদছে। পদ্ম, চুপ…আর না…মারব এবার…পদ্ম।’
পদ্মজা থামল। কিন্তু ভেতরের ছটফটানি পীড়া দিচ্ছে। কেন এমন হচ্ছে জানে না, কিন্তু হচ্ছে; কান্না পাচ্ছে। ভয় হচ্ছে আকাশ ভরা রাতের দিকে তাকিয়ে। একটু আগেই সুন্দর লাগছিল এই আকাশ। আচমকা ভয়ংকর মনে হচ্ছে। মায়ের কোল ছাড়তে ইচ্ছে হচ্ছে না। মনে হচ্ছে, চারিদিকে অশরীরীদের ভিড়। তাদের কোলাহলে মস্তিষ্ক ফেটে যাচ্ছে। পদ্মজা মায়ের কোলে মুখ লুকাল। মেয়েকে অনেকক্ষণ কথা বলতে না দেখে হেমলতা বললেন, ‘পদ্ম, ঘুমিয়ে পড়েছিস?’
‘না আম্মা।’
হেমলতা একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, ‘সেদিন মাঝ রাত্রিরে ছুরি নিয়ে বের হয়েছিলাম। হানিফের ঘরটা আব্বা-আম্মার ঘর থেকে দূরে হওয়াতে সুবিধা ছিল। ঘরের পাশে গিয়ে দেখি, মদনও ঘরে। আমার পক্ষে দুজন পুরুষকে সামলানো সম্ভব না। তাই মদনের চলে যাবার অপেক্ষা করতে থাকি। এরপর আরেকজন লোক আসে। একটু দূরে সরে যাই, গোয়ালঘরের পেছনে। মিনিট কয়েক পর উঁকি দিয়ে দেখি দরজা লাগানো, সাড়াশব্দ নেই। সাবধানে দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকে দেখি হানিফ নেই। তখন হয়তো আম্মা দেখেছে। তাই ভাবছে আমি খুন করেছি।’
‘নানু কেন এমন ভাবল? হানিফ মামা তো তোমারই ভাই।’
হেমলতা তাৎক্ষণিক জবাব দিলেন না। সময় নিয়ে একটা গোপন সত্যি বললেন, ‘আমি তোর নানুর ভাইকে খুন করেছি। তাই তিনি আমাকে ঘৃণা করেন, ভয় পান; সন্দেহ করেন।’
হেমলতার কণ্ঠ স্বাভাবিক। পদ্মজা চমকে উঠে বসল। মুখখানা হাঁ অবস্থায় স্থির হয়ে গেল তার, দৃষ্টি গেল থমকে। পদ্মজা যাতে নিজেকে সামলে নিতে পারে সেই সময়টুকু দিতে হেমলতা দূরের আকাশে চোখ রাখেন। পদ্মজা নিজেকে ধাতস্থ করে নিয়ে বলল, ‘তিনি কি হানিফ মামার মতো ছিলেন?’
হেমলতা সম্মতিসূচক মাথা নাড়ালেন। সিঁড়িতে কারো পায়ের আওয়াজ শোনা যাচ্ছে।
হেমলতা সাবধান হয়ে পদ্মজাকে আড়াল করে দাঁড়ান। সেকেন্ড কয়েক পর একটা ছেলের দেখা মিলল, অচেনা মুখ। হেমলতা আগে কখনো দেখেননি। ছেলেটিও তাদের দেখে ভড়কে গেল।
পদ্মজা – ১৫
ভোর বেলার সূর্য উদয়ের সময় চার পাশে ছড়িয়ে পড়ল মৃদু সূর্যালোক। ট্রেনের জানালা দিয়ে সূর্যের আগুনরঙা আলো পদ্মজার মুখশ্রী ছুঁয়ে যাচ্ছে। ফজরের নামাজ পড়ে ট্রেনে উঠেছে তারা। গন্তব্য অলন্দপুর। পদ্মজার মেট্রিক শেষ হলো আজ তিন দিন। হেমলতার কাঁধে মাথা রেখে চোখ বুজল পদ্মজা। পুরো দেড় মাস পর পূর্ণা-প্রেমা-প্রান্তর দেখা পাবে। খুশিতে আত্মহারা সে।
মাঝে একটু জিরিয়ে ফের চলছে ট্রেন। হেমলতা জানালার বাইরে তাকিয়ে আকাশ দেখছেন। কারণে-অকারণে তিনি এখন আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকেন। শুষ্ক চক্ষুদ্বয় যখন-তখন সজল হয়ে উঠে। কিছুতেই বারণ মানে না, নীল আকাশের বুকে যেন সেদিন রাতের স্মৃতি আকার নিয়ে ভেসে উঠল। ছেলেটার বয়স তেইশ-চব্বিশ বছর হবে। অবাক চোখে তাকিয়ে ছিল। দেখতে-শুনতে বেশ ভালো। হেমলতা পদ্মজাকে আড়াল করে কঠিন স্বরে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘কে তুমি?’
ছেলেটি হেমলতার কথার ধরনে বিব্রতবোধ করল।
ইতস্তত করে বলল, ‘মুহিব, মুহিব হোসেন।’
হেমলতার টনক নড়ল। তিনি সাবধানে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘বারেক হোসেন তোমার বাবা?’
মুহিব ভদ্রভাবে বলল, ‘জি।’
হেমলতা কী যেন বলতে চেয়েছিলেন, পারলেন না। তার আগেই মুহিব অপরাধী স্বরে বলল, ‘বিরক্ত করার জন্য দুঃখিত। আমি আসছি।’ এরপরই হন্তদন্ত হয়ে চলে গেল। সেদিন আর রাত জাগা হলো না। ছাদ থেকে নেমে গেল মা-মেয়ে। গোপন বৈঠকে একবার বাধা পড়লে আলোচনা চালিয়ে যেতে আর মন সায় দেয় না। অনুভূতিগুলো ভোঁতা হয়ে যায়।
পরদিন জানা গেল—মুহিব তার পিতার সঙ্গে রাগ করে ঢাকা ছেড়ে চাচার বাড়ি উঠেছে। এখনকার ছেলে-মেয়েদের ক্ষমতা খুব। তারা খুব সহজ কারণে মা-বাবার সঙ্গে রাগ করে দূরে সরে যেতে পারে। হেমলতা অবজ্ঞায় কপাল কুঞ্চিত করতে সঙ্কোচবোধ করলেন না। পরে অবশ্য বুঝেছেন, মুহিব খুবই ভালো ছেলে। নম্র, ভদ্র, জ্ঞানী। মেধাবী ছাত্র, বিএ পড়ছে। সবচেয়ে ভালো গুণ হলো, মুহিবের নজর সৎ। হেমলতা চোখের দৃষ্টি চিনতে ভুল করেন না। ঠিক সতেরো দিন পর বারেক হোসেন ছেলেকে নিতে আসেন। যেদিন আসেন পরদিন রাতেই হেমলতার কাছে বিয়ের প্রস্তাব পাঠান। মুহিবের বউ হিসেবে পদ্মজাকে নিতে চান। হেমলতা অবাক হোন। মুহিব মনে মনে পদ্মজার প্রতি দুর্বল, অথচ তিনি একটুও বুঝতে পারেননি!
নিঃসন্দেহে মুহিব পাত্র হিসেবে উপযুক্ত। মুহিবের বড়ো দুই ভাই—মুমিন ও রাজীব। দুজনই চাকরিজীবী। মুমিন বিয়ে করে বউকে ডাক্তারি পড়াচ্ছে। বউয়ের পড়াশোনার সমর্থনে আছে পুরো পরিবার। বোঝা যাচ্ছে, পরিবারের প্রতিটি মানুষের মস্তিষ্ক, ভাবনা উচ্চ মানের। বারেক হোসেন বিয়ের প্রস্তাবের সঙ্গে এটিও বলেছেন, ‘আমার মেয়ে নেই। ছেলের বউরাই আমার মেয়ে। আপনার মেয়ের যতটুকু ইচ্ছে পড়বে। কোনো বাধা নেই।’
হেমলতা প্রস্তাব ফিরিয়ে দিলেন না। তিনি আনন্দ সাথে জবাব দিলেন, ‘পদ্মজা আইএ শেষ করুক। এরপরই না হয়।’
বারেক হোসেন হেসে বললেন, ‘তাহলে এটাই কথা রইল।’
স্মৃতির পর্দা থেকে চোখ সরিয়ে নিলেন হেমলতা। গোপনে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। গলাটা কাঁপছে। ঠোঁট শুকিয়ে কাঠ। ব্যাগ থেকে বোতল বের করে পানি পান করলেন।
.
অলন্দপুর।
প্রেমা-প্রান্ত বাড়ির বাইরে সড়কে পায়চারি করছে। পূর্ণা গেটের আড়াল থেকে বার বার উঁকি দিয়ে দেখছে দূরের পথ। হেমলতা ও পদ্মজাকে আনতে মোর্শেদ যে সেই কখন গঞ্জে গেলেন, এখনো আসছেন না! পুরো দেড় মাস পর মা-বোনের সাক্ষাৎ পাবে তারা। হৃদপিণ্ড দ্রুতগতিতে চলছে। মিনিট পাঁচেক পর কাঁচা সড়কের মোড়ে মোর্শেদের পাশে কালো বোরখা পরা দুজন মানুষকে দেখা যায়। পূর্ণা লাজলজ্জা ভুলে আগে আগে ছুটতে থাকে। পেছনে প্রান্ত এবং প্রেমা। দৌড়ে গিয়ে মা-বোনকে একসঙ্গে জড়িয়ে ধরে প্রবল কণ্ঠে কেঁদে উঠল পূর্ণা। হেমলতা পূর্ণাকে ধমক দিতে গিয়েও থেমে গেলেন। মাঝে মাঝে একটু বাড়াবাড়ি করা দোষের নয়। পদ্মজার চোখ বেয়েও টপটপ করে জল পড়ছে। প্রায় প্রতিটা রাত সে ভাই-বোনদের কথা মনে করেছে। বিশেষ করে পূর্ণাকে মনে পড়েছে বেশি। মনে হচ্ছে, কত শত বছর পর দেখা হলো! পদ্মজাকে জাপটে ধরে ফুঁপিয়ে কাঁদছে পূর্ণা। প্রতিটি দিন সে বাড়ির আনাচে-কানাচে পদ্মজার শূন্যতা অনুভব করেছে। পূর্ণা অশ্রুসিক্ত চোখ মেলে বোনের দিকে তাকাল। এরপর আবার জড়িয়ে ধরে বলল, ‘আপা, আমার এত আনন্দ হচ্ছে! আগে কখনো এমন হয়নি।
পদ্মজার কোমল হৃদয়, পূর্ণার ভালোবাসা দেখে বিমোহিত হয়ে উঠল সে স্নেহমাখা কণ্ঠে বলল, ‘আমার সোনা বোন। আর কাঁদিস না।’
পূর্ণা দ্রুত চোখের জল মুছে প্রফুল্লচিত্তে বলল, ‘আপা, আমি তোমার পছন্দের চিংড়ি মাছ দিয়ে লতা রেঁধেছি।’
পদ্মজা অবাক চোখে তাকাল। এদিকে এক বোনের প্রতি আরেক বোনের নিঃস্বার্থ ভালোবাসা দেখে হেমলতা প্রশান্তিদায়ক সুখ অনুভব করছেন। আনন্দে বাকহারা হয়ে পূর্ণার দুই গালে চুমো দিল পদ্মজা। মোর্শেদ দৃশ্যটি মুগ্ধ হয়ে দেখছিলেন, মানুষজনকে আসতে দেখে তাড়া দিলেন, ‘দেহো মাইয়াডির কারবার। মানুষ আইতাছে। আর হেরা রাস্তায় কান্দাকাটি লাগাইছে। হাঁট, সবাই হাঁট।’
বাড়ি ফিরে হাতমুখ ধুয়ে সবাই খেতে বসে। খাওয়া-দাওয়া শেষ করে চার ভাই-বোন আশ্রয় নিলো ঘাটে। এই ঘাট হচ্ছে তাদের বৈঠকখানা। দেড় মাসে কী কী হলো, না হলো সব পূর্ণা বলছে। প্রেমা পূর্ণার নামে বিচার দিল। প্রান্ত প্রেমার নামে বিচার দিল। প্রান্ত কেন বিচার দিল তা নিয়ে আবার বাকবিতণ্ডা লাগিয়ে দিল প্রেমা। সে কী কাণ্ড! তুমুল ঝগড়ায় লিপ্ত হয় দুজন। এক পর্যায়ে ক্লান্ত হয়ে বিচার নিয়ে ছোটো দুজন গেল হেমলতার কাছে।
তখন পদ্মজা শুষ্ককণ্ঠে পূর্ণাকে বলল, জানিস পূর্ণা, আম্মা আমার বিয়ে ঠিক করেছে।’
পূর্ণা ভীষণ চমকাল। চমকিত কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করল, ‘কবে? কার সঙ্গে?’
‘যে বাড়িতে ছিলাম ওই বাড়ির ছেলের সঙ্গে। বিএ পড়ছে। আমার আইএ শেষ হলে বিয়ের তারিখ পড়বে।’
‘আপা আমার বিশ্বাস হচ্ছে না। আম্মার না ইচ্ছে তোমাকে অনেক পড়াবে। তোমার চাকরি হবে।’
পদ্মজা চুপ থাকল ক্ষণকাল। তারপর বলল, ‘আম্মার কী যেন হয়েছে। পালটে গেছেন।’
‘কী রকম?’
‘আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকেন। বেশিরভাগ কথা এড়িয়ে যান। আমার ভবিষ্যত নিয়ে আগের মতো আগ্রহ দেখান না। আমি কথা তুললে এড়িয়ে যান। গল্প করেন না। আম্মা আগের মতো নেই পূর্ণা।’ কথাগুলো বলতে গিয়ে পদ্মজার গলা কিঞ্চিৎ কাঁপল।
‘কী বলছ!’
‘সত্যি।’
‘কিছু হয়েছে ওখানে?
‘না। আমি যতটুকু জানি তেমন কিছুই হয়নি।’
পূর্ণা সীমাহীন আশ্চর্য হয়ে চিন্তায় ডুবে গেল। পদ্মজা শূন্যে তাকিয়ে রইল। লিখন শাহ নামে মানুষটার কথা মনে পড়ছে। তিনি যখন শুনবেন এই খবর, সহ্য করতে পারবেন? সত্যি ভালোবেসে থাকলে সহ্য করতে কষ্ট হবে নিশ্চয়ই। পূর্ণা দ্বিধাভরে প্রশ্ন করল, ‘আপা, লিখন ভাইয়ের কী হবে?’
পদ্মজা ক্লান্ত ভঙ্গিতে তাকাল। বলল, ‘আমি তাকে বলেই দিয়েছি, আম্মা যা বলবেন তাই হবে।’
পূর্ণার মনজুড়ে নেমে আসে বিষাদের ছায়া। তার আপার মতো সুন্দরীকে শুধুমাত্র লিখন শাহর পাশেই মানায়। লিখন শাহ আর পদ্মজাকে নিয়ে কত স্বপ্ন দেখল সে।
সব স্বপ্নে গুড়ো-বালি!
পূর্ণা কাতর কণ্ঠে বলল, ‘লিখন ভাইয়ের সঙ্গে তোমার বিয়ে না হলে আমি কষ্ট পাব খুব।’
‘আমি তো আম্মার কথার বাইরে যেতে পারব না।’
পূর্ণা গলার স্বর খাদে এনে বলল, ‘যদি লিখন ভাই রাজি করাতে পারে?’ পদ্মজা অবিশ্বাস্য দৃষ্টি নিয়ে তাকাল। সেই দৃষ্টি যেন ইঙ্গিত দিচ্ছে, হওয়ার নয়! পূর্ণা কপাল কুঁচকে ফেলল। বিরক্তিতে বলে উঠল, ‘ধ্যাত! ভালো লাগছে না।’
.
বাতাসটা গরম ঠেকছে, ক্রমশ বেড়ে চলেছে মাথাব্যথা। এত এত গাছগাছালি চারিদিকে, তবুও এতটুকুও শীতলতা নেই। হেমলতা আলমারির কাপড় গুছিয়ে বিছানার দিকে তাকালেন। মোর্শেদ এই রোদ ফাটা দুপুরে কখন থেকে ঝিম মেরে বিছানায় বসে আছেন। মুখখানা বিমর্ষ, চিন্তিত 1 হেমলতা প্রশ্ন ছুঁড়লেন, ‘কী হয়েছে?’
মোর্শেদ তাকিয়ে আবার চোখ সরিয়ে নিলেন। হেমলতা তাকিয়ে রইলেন জবাবের আশায়। ক্ষণকাল সময় নিয়ে মোর্শেদ বললেন, ‘বাসন্তী এই বাড়িত থাকবার জন্য আইতে চায়।’
হেমলতার চোখ দুটি ক্রোধে জ্বলে উঠে আবার নিভে গেল।
তিনি নির্বিকার কণ্ঠে বললেন, ‘তোমার ইচ্ছে হলে নিয়ে এসো। বাড়ি তো তোমার।’
মোর্শেদ চকিতে তাকালেন। তিনি ভেবেছিলেন হেমলতা রাগারাগি করবে। মোর্শেদের চোখের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ রূপ নিলো। কিড়মিড় করে হেমলতাকে বললেন, ‘আমি তারে চাই না।’
হেমলতা ঠাট্টা করে হাসলেন। বললেন, ‘বিশ বছর সংসার করে এখন তাকে চাও না! আমি হলে মামলা ঠুকতাম।’
মোর্শেদ আহত মন নিয়ে তাকিয়ে রইলেন অনেকক্ষণ। তার চোখ দুটিতে অসহায়ত্ব স্পষ্ট। হেমলতা নিজের আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করে সেখান থেকে সরে পড়েন। মোর্শেদ তখন কপট রাগ নিয়ে নিজে নিজে আওড়ান, ‘বাসন্তী আমারে ডর দেহায়! মা*ডারে খুন করতে পারলে জীবনে শান্তি পাইতাম।’
হেমলতা দরজার ওপাশ থেকে ঘাড় ঘুরিয়ে মোর্শেদকে পরখ করছেন। রাগে ছটফট করছেন মোর্শেদ। বাসন্তীর প্রতি তার এত রাগ কেন?
হেমলতা পুনরায় ঘরে এসে বললেন, ‘ভালোবাসার মানুষকে এভাবে গালি দিয়ে ভালোবাসা শব্দটির সম্মান খুইয়ে দিয়ো না।’
‘আমি তারে কোনোকালেও ভালোবাসি নাই। বাসলে তোমারে বাসছি।’ হেমলতা ভীষণ অবাক হয়ে তাকালেন। চোখের তারায় জ্বলজ্বল করে কিছু একটা যেন ছুটতে শুরু করে।
ভোঁতা অনুভূতিগুলো মুহূর্তে নাড়াচাড়া দিয়ে উঠে। মোর্শেদ অপ্রস্তুত হয়ে পড়েন। তিনি বিছানা থেকে নেমে গটগট পায়ে বেরিয়ে যান। হেমলতা মোর্শেদের যাওয়ার পানে তাকিয়ে থাকেন ঝাপসা চোখে।
মানুষটার থেকে এই একটি শব্দ শোনার জন্য একসময় কত পাগলামি করেছেন, কত কেঁদেছেন। আকুতি-মিনতি করেছেন। মোর্শেদের মুখে ভালোবাসার সত্য স্বীকারোক্তি শুনে হেমলতার ভীষণ আনন্দ হচ্ছে। বয়সটা কম হলে আজ তিনি অনেক পাগলামি করতেন, অনেক!
.
পূর্ণার গা কাঁপানো জ্বর। তাই পূর্ণাকে নানাবাড়ি রেখেই পদ্মজা বাড়ি ফিরল সঙ্গে এলো হিমেল-প্রান্ত-প্রেমা। তিন ভাইবোন মিলে বাড়িজুড়ে ছোটাছুটি করে লাউ, শিম, লতা, পুঁইশাক বন্দোবস্ত করল। বাজার থেকে মাছ নিয়ে এলো হিমেল। বাড়িতে শুঁটকি ছিল। আজ হেমলতা আর মোর্শেদ ফিরবেন। তাই এত আয়োজন। দুই দিন আগে তারা ঢাকার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছে। হেমলতার বড়ো বোন হানির মেজো মেয়ের বিয়ের কথাবার্তা চলছে। হানি বলেছেন, হেমলতা না গেলে তিনি বিয়ের তারিখ ঠিক করবেন না। তাই বাধ্য হয়ে হেমলতা গেছেন। তবে পদ্মজার শুরু থেকে খটকা লাগছে। তার মা তাকে রেখে পাশের এলাকায় যেতেও আপত্তি করেন। আর আজ দুই দিন ধরে তিনি মাইলের পর মাইল দূরে পদ্মজাকে ছাড়া রয়েছেন! অবশ্য এসব এখন ভাবার সময় নয়। পদ্মজা যত্ন করে কয়েক পদের রান্নার প্রস্তুতি নিলো। সকাল থেকে সূর্যের দেখা নেই। পরিবেশ ঠান্ডা, স্তব্ধ। এ যেন ঝড়ের পূর্বাভাস। প্রান্ত-প্রেমা উঠান জুড়ে মারবেল খেলছে। হিমেল শুধু দেখছে, মাঝে মাঝে প্রবল কণ্ঠে হেসে হাত তালি দিচ্ছে। রান্না শেষ হলো বিকেলে প্রেমা, প্রান্ত ও হিমেলকে খাবার বেড়ে দেয় পদ্মজা।
খাওয়াদাওয়া শেষ হলে বলল, ‘মামা, তুমি আর প্রান্ত গিয়ে পূর্ণাকে নিয়ে আসো। সন্ধ্যা হয়ে যাবে একটু পর। আম্মা-আব্বাও চলে আসবে।’
হিমেল-প্রান্ত বের হতেই পেছন পেছন ছুটে গেল প্রেমা। পদ্মজা একা হয়ে গেল। রান্নাঘর গুছিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়াল।
কালো মেঘে ছেয়ে গেছে আকাশ, বাতাস বইছে প্রবলবেগে। বাতাসের দাপটে পদ্মজার চুল ও ওড়না উড়ছে। পরিবেশ অন্ধকার হচ্ছে ধীরে ধীরে। তার মনটা কু গাইতে লাগল। সে এক হাত দিয়ে অন্য হাতের তালু চুলকাতে চুলকাতে গেটের দিকে বারংবার তাকিয়ে দেখছে, কেউ এলো কি না! যতক্ষণ কেউ না আসবে শান্তি মিলবে না। বিকট শব্দ তুলে কাছে কোথাও বজ্রপাত পড়ল। ভয়ে পদ্মজার আত্মা শুকিয়ে যায়। চারিদিক কেমন গাঢ় অন্ধকারে তলিয়ে যাচ্ছে! ঘোমটা টেনে বাড়ি থেকে বের হওয়ার সিদ্ধান্ত নিতেই আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামে। বিকট বজ্রপাত, দমকা হাওয়া সঙ্গে বড়ো বড়ো ফোঁটার বৃষ্টি, যেন প্রলয়ঙ্কারী ঝড় বইছে। লাহাড়ি ঘরের মাথার ওপরে থাকা তাল গাছগুলো অবাধ্য বাতাসের তেজে একবার ডানে আরেকবার বাঁয়ের দিকে ঝুঁকে পড়ছে। পদ্মজার গায়ের পশম দাঁড়িয়ে গেল আতঙ্কে, ছুটে গেল নিজের ঘরে। বিছানার উপর কাঁচুমাচু হয়ে বসে অপেক্ষা করতে লাগল। টিনের চালে ধুমধাম শব্দ হচ্ছে। পদ্মজা অনবরত প্রার্থনা করে যাচ্ছে, যেন বৃষ্টি কমে যায়।
কিন্তু বৃষ্টির বেগ কমার বদলে উলটো বাড়ল! এতসব শব্দ ভেদ করে আরেকটি শব্দ এসে থেমে গেল পদ্মজার কানের কাছে, সদর ঘরে কিছু একটা পড়েছে। ভয় পদ্মজাকে আরো বেশি করে গ্রাস করে ফেলল।
পরক্ষণেই খুশিতে সে আওড়াল, ‘আম্মা এসেছে?’
বিছানা থেকে নেমে হন্তদন্ত হয়ে সদর ঘরে যায় পদ্মজা। ঘরটা অন্ধকারে তলিয়ে আছে। জানালা দিয়ে আসা ঈষৎ আলোয় দেখল একজন পুরুষের অবয়ব। সঙ্গে সঙ্গে তার সর্বাঙ্গ অসাড় হয়ে পড়ল। জায়গায় স্তব্ধ হয়ে গেল দুটো পা।
পদ্মজা কাঁপা কণ্ঠে বলল, ‘কে আপনি? খালি বাড়িতে কেন ঢুকেছেন? কোনো জবাব এলো না। পদ্মজা অনুরোধ করে ভেজা কণ্ঠে বলল, ‘বলুন না, কে আপনি?’
একটি ম্যাচের কাঠি জ্বলে উঠল। সেই আলোয় দুটি গভীর কালো চোখ বিভ্রম নিয়ে তাকিয়ে রইল পদ্মজার দিকে।
শীতল-স্পষ্ট কণ্ঠে চোখের মালিক বলল, ‘আমির হাওলাদার।’
পুরুষালী কণ্ঠটি শুনে আরো ভড়কে গেল পদ্মজা। রগে-রগে, বরফের মতো ঠান্ডা আর সূক্ষ্ম কিছু একটা দৌড়ে বেড়াচ্ছে। এক হাত দরজায় রেখে, পদ্মজা আকুতি করে বলল, ‘আপনি চলে যান। কেন এসেছেন?’
উত্তরের আশায় না থেকে পদ্মজা দৌড়ে নিজের ঘরে চলে গেল, ভেতরে ঢুকেই লাগিয়ে দিল দরজা। তার মস্তিষ্ক জমে গেছে, কাজ করছে না। লোকটা যদি সম্মানে আঘাত করে বা গ্রামের মানুষ যদি দেখে ফেলে খালি বাড়িতে অচেনা পুরুষের সঙ্গে…কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে। সে আর ভাবতে পারছে না।
করাঘাত শুনে পদ্মজা ঘরের সব আসবাবপত্র ঠেলেঠুলে দরজার কাছে নিয়ে এলো। শরীর কাঁপছে, মাটিতে বসে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল সে। দুই হাত মাথায় রেখে আর্তনাদ করে ডাকল, ‘আম্মা, কোথায় তুমি? আমি খুব একা, আম্মা। আম্মা…।’
১৬
টিনের চালে ঝুম ঝুম শব্দ। বৃষ্টির এই ছন্দ অন্যবেলা বেশ লাগলেও এই মুহূর্তে ভয়ংকর ঠেকছে পদ্মজার কাছে। একেকটা বজ্রপাত আরো বেশি ভয়ানক করে তুলেছে পরিবেশ। সে কাঁচুমাচু হয়ে ফোঁপাচ্ছে।
বৃষ্টির শব্দ একটু কমলে কিছু কথা ভেসে আসে বাতাসে, ‘আপনি ভয় পাচ্ছেন কেন? আমাকে ভয় পাবেন না। বিপদে পড়ে এই বাড়িতে উঠেছি। বিশ্বাস করুন।’
পদ্মজা কান্না থামিয়ে কান খাড়া করে শোনার চেষ্টা করল। দরজার ওপাশ থেকে আমির নামের মানুষটি বলছে, ‘দরজা খুলুন। বিশ্বাস করুন আমাকে। আমি আপনার কোনো ক্ষতি করতে আসেনি। ভয় পাবেন না।’
পদ্মজা একটু নড়েচড়ে বসল। আমির আবার বলল, ‘শুনছেন?’
ঢোক গিলে কথা বলার চেষ্টা করল পদ্মজা। কী অদ্ভুত, কথা আসছে না! খ্যাঁক করে গলা পরিষ্কার করতে চাইল সে। বলল, ‘আ…আমি দরজা খুলব না।’
ক্ষণকাল কোনো উত্তর এলো না, শুধু বৃষ্টির ধ্বনি শোনা গেল। একসময় পুরুষালি কণ্ঠটি বলল, ‘আচ্ছা, খুলতে হবে না। দয়া করে আপনি শুধু ভয় পাবেন না।’
‘আপনি চলে যান।’
বৃষ্টিটুকু থামতে দিন। হঠাৎ বৃষ্টির জন্যই তো আপনার বাড়িতে ওঠা। আমার বৃষ্টিতে সমস্যা হয়।’
আমিরের মুখে স্পষ্ট শুদ্ধ ভাষা শুনে পদ্মজা অনুমান করে নিলো, লোকটি শিক্ষিত। কথাবার্তা শুনে ভালো মানুষ মনে হচ্ছে, তবুও সাবধানের মার নেই। সে দরজা খুলল না, বিছানায় গিয়ে বসল; আগের থেকে ভয় কিছুটা কমেছে।
আমিরের কণ্ঠ শোনা গেল, ‘শুনছেন?’
পদ্মজা জবাব দিল, ‘বলুন।’
‘আপনার নাম কী? ডাকনাম বলুন।’
‘পদ্মজা।’
‘সুন্দর নাম। আমার নাম জিজ্ঞাসা করবেন না?’
‘জানি।’
আমির অবাক হওয়ার ভান ধরে প্রশ্ন করল, ‘কীভাবে? আমাকে চিনেন?’
‘না, কিছুক্ষণ আগেই নাম বললেন।’
‘তখন তো ভয়ে কাঁপছিলেন, নামও শুনেছেন!
আমিরের কণ্ঠে রসিকতা। পদ্মজা মৃদু হাসল, কেন হাসল জানে না। আমির পুনরায় বলল, ‘শুনছেন?’
‘শুনছি।’
‘আপনি কি এরকমই ভীতু?’
‘সাহসিকতা প্রমাণ করানোর জন্য এখন বের হতে বলবেন, তাই তো?’
ওপাশ থেকে গগন কাঁপানো হাসির শব্দ ভেসে আসে। আমির হাসতে হাসতে বলল, ‘বেশ কথা জানেন তো।’
চলমান প্রসঙ্গ এড়িয়ে পদ্মজা বলল, বৃষ্টি কমলেই কিন্তু চলে যাবেন!’
‘তাড়াতে হবে না। বৃষ্টি কমলে নিজে থেকেই চলে যাব।’
কষ্ট নিবেন না। খালি বাড়ি তো, তাই বলছি।’
‘বাকিরা কোথায়? এটা মোর্শেদ কাকার বাড়ি না?’
‘জি।’
‘উনার ধানের মিল তো এখন আমার আব্বার দখলে। ছুটিয়ে নিবেন কবে?’
পদ্মজা অবাক হয়ে দরজার দিকে তাকাল। বিস্ময় নিয়ে বলল, ‘আপনি মাতব্বর কাকার ছেলে?’
‘অবাক হলেন মনে হচ্ছে?’
‘মাতব্বর কাকার ছেলের নাম তো বাবু!’
আমির হেসে বলল, ‘আমার ডাকনাম বাবু। এই নামে আম্মা আর আব্বা ডাকে। ভালো নাম আমির।’
পদ্মজা আর কথা দীর্ঘ করল না। বজ্রপাত থেমেছে, বৃষ্টি রয়ে গেছে। আমির জিজ্ঞাসা করল, ‘বাকিরা কোথায়?’
‘আম্মা-আব্বা ঢাকা। আজ ফেরার কথা ছিল। আর আমার দুই বোন আর ভাই নানাবাড়ি। বোধহয় বৃষ্টির জন্য আসতে পারছে না।’
‘এখনো আমাকে ভয় পাচ্ছেন?’
‘একটু, একটু।’
‘এটা ভালো। অচেনা মানুষকে একেবারেই বিশ্বাস করতে নেই।
.
বাসন্তী ভ্যান থেকে নেমে সামনে এগোলেন। মোর্শেদের বাড়িটা তিনি চেনেন না। তাই কোনদিকে যেতে হবে বুঝে উঠতে পারছেন না। এদিকে আকাশের অবস্থা ভালো না। রাস্তাঘাটেও মানুষ নেই। ঝড়ো হাওয়া বইছে। আরো কিছুটা পথ হাঁটার পর আচমকা ঝড় শুরু হলো। তিনি দৌড়ে একটা বাড়িতে উঠে পড়েন। রমিজ আলি বারান্দায় বসে হুঁকা টানছিল। সিল্কের শাড়ি পরনে, পেট উন্মুক্ত, লম্বা চুলের বেণুনীতে ধবধবে সাদা বাসন্তীকে দেখে সে অবাক হয়ে এগিয়ে এলো। বিস্ময়ের সঙ্গে প্রশ্ন করল, ‘কেডা আপনে? কারে চান?’
বাসন্তী কেঁপে উঠলেন। ঘাড় ঘুরিয়ে রমিজকে দেখে লম্বা করে হেসে বললেন, ‘হুট কইরা মেঘখান আইয়া পড়ল তো।’
‘তো আপনে কার বাড়িত যাইতেন?’
‘মোর্ছেদের বাড়ি।’
রমিজ আলি বিরক্তি নিয়ে সরে গেল। ঘরের ভেতর থেকে চেয়ার এনে দিয়ে বলল, ‘মোর্শেইদদার কী লাগেন আপনে?’
বাসন্তী চিন্তায় পড়ে যান। গ্রামের মানুষ তো জানে না তার আর মোর্শেদের সম্পর্ক কী! এখন জানানোটা কতটা যুক্তিসংগত হবে? সেকেন্ড কয়েক ভাবার পর যুক্তি মিলল। গ্রামবাসীকে বলা উচিত। নয়তো নিজের অধিকার তিনি কখনো পাবেন না। একমাত্র গ্রামবাসীরাই পারবে তার জায়গাটা শক্ত করে দিতে। বাসন্তী রমিজ আলির চোখের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আমি তার বউ লাগি। পরথম বউ। তার লগে আমার বিছ বছরের ছম্পর্ক।’
রমিজ আলির চক্ষুদ্বয় যেন কোটর থেকে বেরিয়ে আসতে চাইল। মোর্শেদের বউ! বারকয়েক চোখ পিটপিট করল সে, ‘কী বললেন? কার বউ?’
‘মোর্ছেদ, মোর্ছেদের বউ।’
মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি পাওয়ার মতো আনন্দ হতে থাকে রমিজের। সে প্রবল উৎসাহ নিয়ে বলল, ‘হের পরের বউয়ে জানে?’
‘না।’
‘থাহেন কই আপনে?’
‘রাধাপুর।’
‘লুকাইয়া রাখছিল বিয়া কইরা?’
‘হ। এখন মোৰ্ছেদ আমারে তালাক দিতে চায়। আমার সঙ্গে ছংছার করতে চায় না। তাই আমি আমার অধিকার নেয়ার জন্য আইছি। আমি তার বাড়িতে থাকবার চাই। আপনেরা আমারে ছাহায্য করেন। গ্রামবাছী ছাড়া মোর্ছেদ আমারে জায়গা দিব না।’
রমিজ আলি প্রবল বৃষ্টি, আর বজ্রপাতকে হটিয়ে বাহাদুরের মতো বলে উঠল, ‘আপনের জায়গা করে দেওন আমরার কাম। আপনি চিন্তা কইরেন না। মেঘডা কমতে দেন। এরপর খালি দেহেন কী হয়!’
বাসন্তীর চোখ-মুখ জ্বলজ্বল করে উঠল। অবশেষে একটা ভরসা পাওয়া গেল। রমিজ আলির প্রতিশোধের নেশা পেয়েছে। মোর্শেদ তাকে কত কটু কথা বলেছে, অবজ্ঞা করেছে, অপমান করেছে। এইবার তার পালা। প্রতিটি অপমান ফিরিয়ে দেয়ার শপথ করেছে সে অনেক আগেই। বাসন্তীকে ভরসা দিয়ে সে বলল, ‘আপনি বইয়া থাহেন। আমি আরো কয়জনরে লইয়া আইতাছি।’
রমিজ আলি খুশিতে গদগদ হয়ে বেরিয়ে গেল লোকবল আনতে। ছইদ, রজব, মালেক, কামরুলকে নিয়ে ফিরে এলো। সবার হাতে হাতে ছাতা। কামরুল আটপাড়া এলাকার মেম্বার। গ্রামে কোনো অনাচার হলে তা দেখার দায়িত্ব তার। তাই তিনি মাথার উপর বজ্রপাত, ঝড় নিয়েই ছুটে এসেছেন।
.
পদ্মজা উসখুস করছে। টয়লেটে যাওয়া প্রয়োজন। প্রস্রাবের বেগ ক্রমাগত বাড়ছে। এভাবে আর কতক্ষণ থাকা যায়। সাহসও পাচ্ছে না বের হওয়ার। ঘরে পায়চারি করল কিছুক্ষণ। চোখ বন্ধ করে জোরে শ্বাস নিলো। এরপর কাঁচি কোমরে গুঁজে আয়তুল কুরসি পড়ে বুকে ফুঁ দিয়েই দরজা খুলল। আচমকা দরজা খোলার আওয়াজ শুনে আমির চমকে তাকাল। আকাশ থেকে কালো মেঘের ভাব কেটে গেছে অনেকটা। সন্ধ্যার আজান পড়ছে। সালোয়ার, কামিজ পরা পদ্মজাকে দেখে মুহূর্তে হৃদস্পন্দন থমকে গেল তার। পদ্মজা ওড়না টেনে নিলো নাক অবধি। কাঁপা পায়ে আমিরের পাশ কেটে গেল। আমিরের চোখ স্থির। নিশ্বাস এলোমেলো। ঠোঁট শুকিয়ে কাঠ। পদ্মজা যখন ফিরছিল ঘরে, আমির ডাকল, ‘পদ্মজা?’
পদ্মজা দাঁড়াল। মানুষটা খারাপ হলে এতক্ষণে আক্রমণ করত। যেহেতু করেনি, মানুষটার উদ্দেশ্য খারাপ না। তাই দাঁড়াল, তবে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল না।
আমিরের গায়ে স্যান্ডো গেঞ্জি। শার্ট ভিজে যাওয়াতে বারান্দার দড়িতে রেখেছে, যাতে বাতাসে শুকিয়ে যায়। যেন রূপকথার জগতে হারিয়ে গেছে এমনভাবে আমির বলল, ‘অলন্দপুরে এমন রূপবতী আছে—জানা ছিল না।’
পদ্মজা লজ্জা পাওয়ার পাশাপাশি বিব্রতবোধ করল। বৃষ্টি প্রায় কমে এসেছে। তাই সে বলল, ‘আপনি এবার আসুন। কেউ দেখলে খারাপ ভাববে।’
‘যেতে তো ইচ্ছে করছে না।’
লোকটা বলে কী! এতক্ষণ বলল বৃষ্টি কমলেই চলে যাবে। এখন বলছে, যাবে না। পদ্মজা ঘুরে তাকাল। চোখের দৃষ্টিতে আকুতি ফুটিয়ে বলল, ‘দয়া করে চলে যান।’
আমির কিঞ্চিৎ হাঁ হয়ে তাকিয়ে রইল। না চাইতেও আমির পদ্মজার নজরে পড়ে। শ্যামবর্ণের একজন পুরুষ, থুতনির মাঝে কাটা দাগ। সঙ্গে সঙ্গে চোখ সরিয়ে নিলো পদ্মজা। কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল, ‘বৃষ্টি কমে গেছে। আম্মা-আব্বা চলে আসবে। চলে যান।’
আমির অপলক নয়নে তাকিয়ে আছে। তার নিস্তব্ধতা পদ্মজাকে বিরক্ত করে তুলল। এত ঘাড়ত্যাড়া, দুই কথার মানুষ কীভাবে হয়? উঠানে পায়ের শব্দ! কয়েক জোড়া পায়ের শব্দ। বারান্দা থেকে দুজন তাকাল। গ্রামের এতজনকে দেখে পদ্মজার নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে, দৌড়ে ঘরে ঢুকে পড়ল সে। রমিজ আলি চেঁচিয়ে ডাকল, ‘কইরে মোর্শেইদদা? আকাম কইরা এখন লুকায়া আছস ক্যান? বাইর হ। তোর আকাম ধইরা লইয়া আইছি।’
আমির বারান্দা পেরিয়ে বেরিয়ে আসে।
গম্ভীরমুখে বলল, ‘উনারা বাড়িতে নেই।’
উৎসুক জনতা আমিরকে দেখে অবাক হয়। কামরুল বললেন, ‘আরে আমির। শহর থেকে আইলা কবে?’
‘এই তো চার দিন হলো। আছেন কেমন?’
‘এই তো আছি। তা এইহানে কী করো?’
আমির উত্তর দেয়ার আগে রমিজ আলি প্রশ্ন করলেন, ‘বাড়িত কেউ নাই?’
আমির বেশ সহজ-সরল গলায় বলল, ‘আছে। পদ্মজা আছে।’
উপস্থিতি পাঁচ-ছয়জন তীক্ষ্ণ চোখে তাকাল। সবার দৃষ্টি দেখে আমির বুঝল, সে কত বড়ো ভুল করে ফেলেছে। তাহলে পদ্মজা এটারই ভয় পাচ্ছিল? আমির দড়ি থেকে শার্ট নিয়ে দ্রুত পরল। এরপর কৈফিয়ত দেয়ার স্বরে বলল, ‘আপনারা যা ভাবছেন তা নয়। বাড়ি ফিরছিলাম। বৃষ্টি নামে তাই এই বাড়িতে উঠে পড়ি। বাড়িতে কেউ নাই জানলে…’
আমির কথা শেষ করতে পারল না। রমিজ আলি চেঁচিয়ে আশপাশে বাড়ির সব মানুষদের ডাকা শুরু করল। মাতব্বর তাকে কম অপদস্ত করেনি সমাজ থেকে কোণঠাসা করেছে। মোর্শেদ পথেঘাটে কটু কথা শুনিয়েছে। আজ সেই যন্ত্রণা কমানোর দিন। আমির ভড়কে গেল।
কামরুল আঙুল শাসিয়ে কঠিন স্বরে বললেন, ‘তোমার কাছে এইডা আশা করি নাই। তোমার আব্বারে ডাকাইতাছি। উনি যা করার করবেন।’
আমির বিরক্তি নিয়ে বলল, ‘আরে আজব! কী শুরু করেছেন আপনারা?’
ছইদ আমিরের কাছাকাছি বয়সের। ব্যক্তিগত শত্রুতা আছে তাদের মধ্যে। ছইদ হুংকার ছেড়ে বলল, ‘চুপ থাক তুই! তোর বাপে মাতব্বর বইলা তোরে ডরাই আমরা? আকাম করবি আর ছাইড়া দিমু?’
রাগে-অপমানে আমিরের চোখ লাল বর্ণ ধারণ করে। রেগে গেলে চোখের রং পালটে যায় তার। কালো মুখশ্রীর সঙ্গে লাল চোখ ভয়ংকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। ছইদ ভেতরে ভেতরে ভয় পেল। আমিরের হাতে কম মার সে খায়নি। তবে আজ সুযোগ পেয়েছে। পুরো গ্রামবাসী এক দলে। সে কিছুতেই ছাড়বে না। ঢোক গিলে বলল, ‘চোখ উলডাইয়া লাভ নাই। কুকামের উসুল না তুলে যাইতাছি না।’
আমির রাগে শক্ত হাতে থাপ্পড় বসাল ছইদের কানে। মুহূর্তে ছইদের মাথা ভনভন করে উঠে। ততক্ষণে রমিজের উসকানিতে মানুষ জমে গেছে। সবার হাতে হাতে টর্চ, হারিকেন। রাতের আঁধার নেমে এসেছে। আমির আবারও ছইদকে মারতে গেলে কয়জন এসে তাকে জাপটে ধরল। কামরুল একজন মহিলাকে আদেশের স্বরে বললেন, ‘শিউলির আম্মা, কয়জনরে লইয়া মাইয়াডারে বার কইরা আনো। লুকাইছে নটি। গ্রামডা নটিদের ভিড়ে ধ্বংস হইয়া যাইতাছে।’
পদ্মজা মাটিতে নতজানু হয়ে বসে কাঁপছে, তীব্র কাঁপুনি পা থেকে মাথার চুল অবধি। বাইরের প্রতিটি কথা তার কানে এসেছে। চারপাশ যেন ভনভন করছে।
শিউলির আম্মা পদ্মজার ঘরে আসে। দরজা খোলা ছিল। টর্চ ধরে দেখল পদ্মজা মাটিতে বসে কাঁপছে। পদ্মজাকে খুব পছন্দ করে সে। তাই পদ্মজার মাথায় হাত রেখে বলল, ‘কেন এমন কাম করছস?’
পদ্মজা ঝাপসা চোখ মেলে তাকাল। শিউলির আম্মা পাশের বাড়ির। পদ্মজার সঙ্গে ভালো সম্পর্ক। পদ্মজা শিউলির মাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠল। বলল, ‘ভাবি আমি কোনো খারাপ কাজ করিনি। সবাই ভুল বুঝছে।’
রীনা নামে একজন মহিলা পদ্মজাকে জোর করে টেনে দাঁড় করাল। হেমলতার অনেক বাহাদুরি এই মেয়ে নিয়ে, অনেক অহংকার। সেই অহংকার আজ ভালো করে ভাঙবে। সে মনে মনে পৈশাচিক আনন্দে মেতে উঠেছে।
ঘৃণা ভরা কণ্ঠে পদ্মজাকে বলল, ‘ধরা পড়লে সবাই এমনডাই কয়। আয় তুই।’
পদ্মজা আকুতি করে বলল, ‘বিশ্বাস করুন আমি খারাপ কিছু করিনি আম্মা এসব শুনলে মরে যাবে। আপনারা এমন করবেন না।’
কারো কানে পৌঁছাল না পদ্মজার আর্তনাদ, আকুতি। সবাই গ্রামের সবচেয়ে সুন্দর মনের, সুন্দর পরিবারের সদস্যগুলোকে ধ্বংস করায় মেতে উঠল। পদ্মজাকে টেনেহিঁচড়ে বের করে আনে বাহিরে। কখনো ঘোমটা ছাড়া কোনো পুরুষের সামনে না যাওয়া মেয়েটার বুকের ওড়না পড়ে রইল ঘরে। তিন-চার জন মহিলা শক্ত করে পদ্মজার বাহু চেপে ধরে রাখে। সবাইকে উপেক্ষা করে পদ্মজা ঘৃণাভরা চোখে তাকাল আমিরের দিকে। আমির চেষ্টা করছে নিজেকে ছাড়ানোর, কিছুতেই পারছে না।
পূর্ণা বাড়িতে ঢুকে দেখে কোলাহল। সে ভয় পেয়ে গেল। জ্বরের তোড়ে কাঁপছে পূর্ণা। একটু এগিয়ে দেখল, পদ্মজার বিধ্বস্ত অবস্থা। মুহূর্তে তার জ্বর উবে গেল। দৌড়ে এসে পদ্মজাকে জড়িয়ে ধরে চেঁচিয়ে উঠল, ‘আমার আপাকে এভাবে ধরেছেন কেন? আপা…এই আপা? কাঁদছ কেন?’
পদ্মজা কেঁদে বলল, ‘পূর্ণা, আম্মা মরে যাবে এসব দেখলে। আমি কিছু করিনি পূর্ণা।’
পূর্ণা কিছু বুঝে উঠতে পারছে না। শুধু অনুভব করছে তার বুক পুড়ছে। পুরো শরীর ব্যথায় বিষিয়ে যাচ্ছে। সে রীনাকে বলল, ‘খালা আপনি আমার বোনকে এভাবে ধরেছেন কেন? ছাড়েন।’ ধমকে উঠল পূৰ্ণা।
রীনা কর্কশ কণ্ঠে বলল, ‘তোর বইনের গতরে রস বাইড়া গেছিল। এজন্য খালি বাড়িত ব্যাঠা ছেড়া ডাইকা আইনা রস কমাইছে।’
নোংরা কথাটি শুনে পূর্ণার গা রি রি করে উঠল! তেজ নিয়ে বলল,
‘খারাপ কথা বলবেন না। আমার আপা এমন না।
পাশ থেকে একজন মহিলা পূর্ণার উদ্দেশ্যে বলল, ‘তোর মা যেমন হের মাইডাও এমন অইছে। নিজেও এমন কিচ্ছা করল। মাইয়াও করল।’
পদ্মজা চমকে তাকাল।
মহিলা বলে যাচ্ছে, ‘বুঝলা তোমরা সবাই…মায় এক বেশ্যা, মাইয়ারে বানাইছে আরেক বেশ্যা।’
পদ্মজা আচমকা রেগে গেল খুব। আক্রোশে তার শরীর কাঁপতে থাকল। রীনা সহ দুজন মহিলাকে ঠেলে সরিয়ে রাগে চেঁচিয়ে উঠল, ‘আমার মা নিয়ে কিছু বললে আমি খুন করব। মেরে ফেলব একদম। জিভ ছিঁড়ে ফেলব।’
পদ্মজার এহেন রূপে সবাই থতমত খেয়ে যায়। তার লম্বা চুলগুলো খোঁপা থেকে মুক্ত হয়ে পিঠময় ছড়িয়ে পড়েছে। চোখের মণি অন্যরকম হওয়াতে মনে হচ্ছে, কোনো প্রেতাত্মা রাগে ফোঁস ফোঁস করছে। গ্রামের কিছু মহিলা আবার বিশ্বাস করে, পদ্মজা কোনো পরির মেয়ে। তাই এত সুন্দর। এই মুহূর্তে তারা ভাবছে, পদ্মজার ভেতর কেউ ঢুকেছে। তাই সামনে এগোল না। রীনা একাই এগিয়ে এলো। পদ্মজার চুলের মুঠি ধরে বিশি গালিগালাজ করতে শুরু করল। কামরুলকে বলল, ‘কামরুল ভাই, এই বান্দিরে বাঁন্ধা লাগব।’
পূর্ণা-প্রেমা পদ্মজাকে ছাড়াতে গেলে ছইদসহ আরো তিন চারজন এগিয়ে আসে। অন্ধকারে ভিড়ের মাঝে বাজেভাবে নিগৃহীত হলো পদ্মজা-পূর্ণা- প্রেমা। কয়টা কালো হাত নিজেদের তৃপ্তি মিটিয়ে নিলো খুব সহজে। তিন বোনের কান্না, তাদের আর্তনাদ কারো হৃদয় ছুঁতে পারল না।
হেমলতার অনুপস্থিতিতে তার আদরের তিন কন্যার জীবন্ত কবর হচ্ছিল, বাধা দেয়ার কেউ ছিল না।
১৭
নৌকা ছাড়ার পূর্বে আকাশের কালো মেঘের ঘনঘটা চোখে পড়ল। তার কিছুক্ষণ পর হঠাৎই নেমে এলো ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি। খোলা নৌকা হওয়াতে চোখের পলকে কাকভেজা হয়ে গেল যাত্রী পাঁচজন। ভিজলেন না হেমলতা, মোর্শেদ ছাতা ধরে রেখেছেন। বজ্রপাতের সঙ্গে সঙ্গে হেমলতার আত্মা দুলে উঠছে, খচখচ করছে মনটা। তিনি জলের দিকে স্থির চোখে তাকিয়ে রইলেন। জলে বৃষ্টির ফোঁটা পড়ার সঙ্গেই বলের মতো একদলা পানি লাফিয়ে উঠছে। তারপর ছোট্ট ছাতার মতো আকৃতি নিয়ে চারপাশে প্রসারিত হয়ে হাওরে মিলিয়ে যাচ্ছে। দেখতে সুন্দর! কিন্তু সেই সৌন্দর্য মনে ধরছে না। অজানা আশঙ্কায় তিক্ত অনুভূতি হচ্ছে। মোর্শেদ গলা খাকারি দিয়ে হেমলতার দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করে বললেন, ‘কিছু খাইবা?’
হেমলতা নিরুত্তর। মোর্শেদ শুষ্ক হাসি হেসে বললেন, ‘আর কিছুক্ষণ। আইয়াই পড়ছি।’
হেমলতা কিছু বললেন না। নিরুত্তরে রইলেন। বৃষ্টির স্পর্শ নিয়ে আসা হাওরের হিমেল বাতাসের ছোঁয়া লাগছে চোখেমুখে। হাওরের ঘোর লাগা বৃষ্টি দেখতে দেখতে চোখে এসে ভর করে ঘুম। হেমলতা নিকাব খুলে চোখেমুখে পানি দিয়ে ঘুম কাটান। এরপর ক্লান্ত চোখ দুটি মেলে তাকান মোর্শেদের দিকে। মোর্শেদের হাতে হাত রেখে বললেন, ‘আমার এত খারাপ লাগছে কেন? বুক পোড়া কষ্ট হচ্ছে।’
মোর্শেদ হেমলতার কণ্ঠ শুনে সহসা উত্তর দিতে পারলেন না। চিত্ত ব্যথায় ভরে উঠল। কিছু সময় অতিবাহিত হওয়ার পর আশ্বস্ত করে বললেন, ‘আইয়া পড়ছি তো। ওই যে বাজারের ঘাট দেহা যাইতাছে।’
হেমলতা মোর্শেদের হাত ছেড়ে দূরে তাকালেন। অলন্দপুরের বাজারটা ছোটো পিঁপড়ার মতো দেখাচ্ছে। নৌকাটা বার বার দুলছে। ঝড় বইছে চারিদিকে, মনেও তো বইছে। তিনি নিজেকে শান্ত করতে চোখ বুজে বার কয়েক প্রাণভরে নিশ্বাস নিলেন। ব্যথাতুর মন আর্তনাদ করে শুধু জানতে চাইছে, আমার মেয়েগুলো কেমন আছে? কী করছে?
রীনা চুল এত শক্ত করে ধরেছে যে পদ্মজার সারা শরীর ব্যথায় বিষিয়ে উঠছে, আকুতি করেও ছাড়া পাচ্ছে না। পূর্ণা-প্রেমা খামচে ধরে রেখেছে পদ্মজাকে। কিছুতেই তারা বোনকে ছাড়বে না।
আমির ক্রোধে উন্মত্তপ্রায় হয়ে চিৎকার করে উঠল, ‘কামরুল চাচা এটা ঠিক হচ্ছে না! মেয়েগুলোর অভিশাপে পুড়ে যাবেন।’
আমিরের কথায় ক্ষণকালের জন্য কামরুল হতবুদ্ধি হয়ে গেলেন। রমিজ আলী কামরুলের নরম, নিঃশব্দ, ভয়ার্ত মুখের দিকে চেয়ে ভেতরে ভেতরে উদ্বিগ্ন হলেও তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে বললেন, ‘বেশ্যাদের শাপে কেউ পুড়ে না।’
জলিল প্রেমাকে সরিয়ে নিয়েছে। দূর থেকে প্রেমার কান্না শোনা যাচ্ছে। বড়ো আপা, বড়ো আপা করে গলা ফাটিয়ে কাঁদছে। ছইদ অনেক টেনেও পূর্ণাকে সরাতে পারল না, তাই অন্ধকারের সুযোগ নিয়ে পূর্ণার বুকে নোংরা হাতের দাগ বসিয়ে দিতে দ্বিধা করল না। পূর্ণা এমন ঘটনার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিল না। কোনো মেয়েই এমন নিচু ঘটনার সাক্ষী হতে চায় না। অকস্মাৎ এই ঘটনা কাটিয়ে ওঠার পূর্বেই একটা শক্ত হাত পায়জামার ফিতা টেনে ধরল। পূর্ণার পায়ের তলার মাটি সরে গেল। ভয়ে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে উঠল, ‘আপা…আপা।’
পূর্ণার আর্তনাদ পদ্মজার মস্তিষ্ক প্রখর করে তুলে। পদ্মজা মুখ তুলে পূর্ণার দিকে তাকাল। তার চেয়ে এক হাত দূরে পূর্ণা। পদ্মজার আঙুল শক্ত করে ধরে রেখেছে সে। কাছে আসতে পারছে না ছইদের জন্য। পূর্ণার কান্না দেখে পদ্মজা আতঙ্কে নীল হয়ে গেল। চারিদিকে কোলাহল। সবাই গালি দিচ্ছে মা- বাপ তুলে। কেউ বলছে না, মেয়েটা ভালো, এরকম করতেই পারে না। পূর্ণা চেঁচিয়ে যাচ্ছে। কেঁদে মাকে ডাকছে। পদ্মজা এক দৃষ্টে মানুষগুলোর দিকে তাকিয়ে রইল।
মানুষ এত নিষ্ঠুর হয়?
পূর্ণার হাত ছইদ আলগা করতেই সে ছুটে এসে জড়িয়ে ধরল পদ্মজাকে। তার পুরো শরীর কাঁপছে। হৃৎপিণ্ড এত জোরে চলছে যে অনুভব করা যাচ্ছে। পূর্ণা কাঁদতে কাঁদতে বলল, ‘আপা…আপা…কেন মেয়ে হলাম, আপা? এত কষ্ট হচ্ছে, আপা। আপা…’
পদ্মজার দুচোখ বেয়ে টুপ করে দুই ফোঁটা জল পড়ে। এক হাতে শক্ত করে পূর্ণাকে বুকের সঙ্গে চেপে ধরে।
রমিজের উসকানিতে কামরুল গলা উঁচিয়ে বললেন, ‘নটিরে বান ছইদ।’
পূর্ণার কানে কথাটা আসতেই সে আরো জোরে পদ্মজাকে জড়িয়ে ধরল। ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে থাকা পদ্মজা হঠাৎ শান্ত হয়ে ঠান্ডা স্বরে বলল, ‘পূৰ্ণা, ছেড়ে দে আমায়।’
রীনা পদ্মজাকে চুলে ধরে টেনে নিয়ে যেতে চাইলেও পদ্মজা জায়গা থেকে এক চুলও নড়ল না। ঠায় দাঁড়িয়ে রইল। পূর্ণাকে ফিসফিসিয়ে বলল, ‘বেঁচে থাকলে সব উসুল হবে। ছেড়ে দে।’
পদ্মজার কণ্ঠে মায়ের ছায়া ছিল! পূর্ণা সঙ্গে সঙ্গে শান্ত হয়ে গেল। চোখ তুলে পদ্মজার দিকে তাকাল। পদ্মজার গাল বেয়ে রক্ত ঝরছে। ছইদ পূর্ণাকে নিতে আসলে একটি দুঃসাহসিক কাজ করে বসল সে, লাথি বসিয়ে দিল ছইদের অণ্ডকোষ বরাবর। ছইদ মাগো বলে কুকিয়ে উঠে। জলিলসহ উপস্থিত তিনজন তেড়ে আসে পদ্মজার দিকে, পূর্ণাকে ধাক্কা দিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দূরে। অশ্রাব্য গালি দিতে দিতে কেউ পদ্মজাকে থাপ্পড় দিল, কেউ বা দিল লাথি। নির্মম দৃশ্যটি দেখে দুই তিনজন গ্রামবাসীর মনে মায়া উদয় হয়। তারা ছুটে আসে পদ্মজাকে বাঁচাতে। প্রান্ত ভয়ে চুপসে গিয়েছিল। পদ্মজাকে কাদায় ফেলে মারতে দেখে দৌড়ে আসে, জলিলের হাতে শরীরের সব শক্তি দিয়ে কামড় দেয়। জলিল প্রান্তের কান বরাবর থাপ্পড় বসাতেই প্রান্তের মাথা ভনভন করে উঠল। পরিস্থিতি বিগড়ে যেতে দেখে কামরুল হতবুদ্ধি হয়ে পড়েন। মনে মনে বেশ ভয় পান। কেশে গলা পরিষ্কার করে, দুই হাত তুলে চেঁচিয়ে বললেন, ‘তোমরা থামো, এইডা কি করতাছ? থামো কইতাছি। সবাই সইরা আসো। থামো…!’
সবকিছু থেমে গেল। পদ্মজা কাঁচুমাচু হয়ে পড়ে রইল কাদায়। নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। নাভির নিচে একটা লাথি পড়েছে বেশ জোরে। চোখ বুজে রেখেছে। দুই হাত বুকের উপর। লম্বা-চুল কাদায় মেখে ছড়িয়ে আছে আশপাশে। যন্ত্রণায় যেন পাঁজরগুলো মড়মড় করে ভেঙে যাচ্ছে। জ্বরের তোপে জ্ঞান হারিয়েছে পূর্ণা। হেমলতার মা মনজুরা বাড়িতে ঢুকে পদ্মজাকে এভাবে পড়ে থাকতে দেখে আঁতকে উঠলেন। দৌড়ে এসে পদ্মজাকে তুলতে চাইলে কামরুল হুংকার ছাড়লেন, ‘এই ছেড়িরে ধরন যাইব না। যান এন থাইকা।’
মনজুরা পদ্মজার কামিজ ঠিক করে দিয়ে দুজন লোককে নিয়ে পূর্ণাকে তুলে ঘরে নিয়ে গেলেন। মনজুরার বুক কাঁপছে হেমলতার ভয়ে। হেমলতা বার বার বলেছিল দুই দিন তার মেয়েদের চোখের আড়াল না করতে! আর তিনি একা বাড়িতে ছেড়ে দিয়েছেন! ইচ্ছে হচ্ছে এক ছুটে কোথাও পালিয়ে যেতে। হিমেল নাক টেনে টেনে কাঁদছে। জপ করছে হেমলতার নাম। মনজুরা রেগে ধমকালেন, ‘আহ! থাম তো।’
.
বাপের বাড়িতে কাউকে না পেয়ে হেমলতা চিন্তায় পড়ে যান।
মোর্শেদ হেমলতার দুশ্চিন্তা বুঝতে পেরে বললেন, ‘বাড়িত গিয়া বইয়া রইছে মনে হয়। আও বাড়িত যাই।’
হেমলতা মিনমিনে গলায় বললেন, ‘তাই হবে।
দুজন হেঁটে বাড়ির রাস্তায় উঠে। তখন পাশ কেটে একজন মহিলা হেঁটে যায়। কিছুটা হাঁটার পর মোর্শেদের খটকা লাগল। তিনি ঘাড় ঘুরিয়ে তাকান। মহিলাটি অনেক দূর চলে গিয়েছে। মহিলার অবয়ব দেখে মোর্শেদের বাসন্তীর কথা মনে পড়ে যায়। মনে মনে আওড়ান, বাসন্তী আইছে?’ পরপরই নিজের মনকে বুঝ দিলেন, ‘না, না হে আইব কেমনে। আর আইলেও যাইব গা ক্যান?’
তিনি আর মাথা ঘামালেন না। হেমলতার বুক দুরুদুরু করছে। ঠান্ডা বাতাস বইছে। তবুও তিনি অজানা আশঙ্কায় ঘামছেন।
তারা বাড়ির কাছাকাছি এসে মাতব্বরকে দেখতে পেল। মাতব্বরের সঙ্গে আরো দুজন ব্যক্তি। বাড়ির সামনে মানুষের ভিড়ও দেখা যাচ্ছে। হেমলতার হৃৎপিণ্ড থমকে গেল। মেরুদণ্ড বেয়ে বরফের ন্যায় ঠান্ডা কিছু একটা ছুটে গেল। তিনি নিশ্বাস আটকে রেখে ছুটতে থাকেন। পিচ্ছিল পথে পিছলা খেয়ে পড়ে যেতে গিয়েও নিজেকে সামলে নেন। হেমলতার দৌড় দেখে মোর্শেদ পিছু নেন, অবাক হয়ে প্রশ্ন করেন, ‘তুমি দৌড়তাছ ক্যান?’
হেমলতা প্রশ্নটি শুনলেন না। নিকাব বাতাসের দমকে উড়ে পড়ল দূরে। তিনি ভিড় ঠেলে বাড়িতে ঢুকলেন। সঙ্গে সঙ্গে কোলাহল বেড়ে গেল। এত ভিড়ের মাঝে একটা মেয়েকে কাদায় পড়ে থাকতে দেখে তিনি অবাক হলেন। অন্ধকারে মেয়েটিকে চিনতে বেশ অসুবিধা হচ্ছে।
তিনি আঙুল তুলে বিড়বিড় করলেন, ‘কে?’
হেমলতার প্রশ্ন কারো কান অবধি গেল না। কোত্থেকে একটি আলো এসে পড়ল পদ্মজার ওপর। সঙ্গে সঙ্গে হেমলতার চক্ষুদ্বয়ের সামনে পদ্মজার কাদা-রক্তে মাখা মুখটা ভেসে উঠল
হেমলতা গগন কাঁপিয়ে আর্ত চিৎকার করে উঠলেন, ‘পদ্ম…আমার পদ্ম।
পদ্মজার বুক ধড়াস করে উঠল! অস্তিত্ব কেঁপে উঠল। আম্মা এসেছে! তার পৃথিবী! তার শক্তি! পদ্মজা দুর্বল দুই হাতে ভর রেখে উঠে বসার চেষ্টা করল। পারল না। ভাঙা গলার জোর দিয়ে শুধু ডাকল, ‘আম্মা…আম্মা।’
হেমলতার পৃথিবী থমকে গিয়েছে। বিধ্বস্ত, পর্দাহীন, কাদা, রক্তমাখা পদ্মজাকে দেখে বিশ্বাস হচ্ছে না এটা তার মেয়ে। তিনি দ্রুত নিজের বোরখা খুলে পদ্মজাকে ঢেকে বুকের সঙ্গে জড়িয়ে ধরলেন। অসহনীয় যন্ত্রণায় যেন কলিজা বেরিয়ে আসছে তার। তার সোনার কন্যার এ কী রূপ! কে করল? কাঁপা কণ্ঠে শুধু বললেন, ‘পদ্ম…আমার পদ্ম। ‘
হেমলতার বুকে মাথা রেখে পদ্মজা হাউমাউ করে কেঁদে উঠল, ‘আম্মা…আম্মা।’
হেমলতা পদ্মজাকে আরো জোরে চেপে ধরলেন বুকের সঙ্গে। দৃষ্টি অস্থির। বুক হাপড়ের মতো ওঠানামা করছে।
মোর্শেদ বাড়িতে ঢুকে উঁচু গলায় বললেন, ‘এইহানে এত মানুষ ক্যান? মাতব্বর মিয়া আপনে এইনে ক্যান? কী অইছে?’
প্রান্ত-প্রেমা দৌড়ে এসে মোর্শেদকে জড়িয়ে ধরল। দুজন ভয়ে কাঁদছে, কান্নার শব্দ হচ্ছে না। মোর্শেদ বিস্ময়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ়। মাতব্বর মজিদ গম্ভীর কণ্ঠে কামরুলকে প্রশ্ন করলেন, ‘মেয়েটার এই অবস্থা কারা করেছে? এটা কি নিয়মের মধ্যে পড়ে?’
কামরুল মাথা নিচু করে রেখেছেন। মিনমিনে গলায় বললেন, —আমি ছেড়িডারে মারতে কই নাই। জলিল, ছইদ আর মজনুর ছেড়ায় নিজ ইচ্ছায় মারছে।’
‘আপনি আটকালেন না?
‘আটকাইছি বইললাই মাইয়াডা বাঁইচা আছে। আর এমন নটিদের বাঁচার অধিকার নাই।’
‘থামেন মিয়া! কার কী শাস্তি হবে সেটা আমার দায়িত্ব। আপনার না। ছইদ, জলিল আর মজনুর ছেলেকে তো দেখা যাচ্ছে না। আগামীকাল তাদের আমি মাঠে দেখতে চাই।’
কামরুল মাথা নিচু করে রাখলেন। মজিদ হাওলাদার ভারি সৎ এবং নিষ্ঠাবান মানুষ। গ্রামের মানুষদের দুই হাতে আগলে রেখেছেন। পুরো অলন্দপুরের মানুষ মজিদকে ফেরেশতা-সমতুল্য ভাবে। পঁচিশ বছর ধরে অলন্দপুর সামলাচ্ছেন তিনি।
গুড়িগুড়ি বৃষ্টি পড়ছে। গাঢ় থেকে গাঢ়তর হচ্ছে অন্ধকার। হেমলতা কিছুতেই হিসেব মিলাতে পারছেন না। অনেক বছর আগের ঘটনা আর এই ঘটনা হুবহু একরকম কী করে হলো? তিনি নিজের ভেতর একটা হিংস্র পশুর উপস্থিতি অনুভব করছেন। কামরুলের মুখ থেকে শোনা তিনটা নাম মস্তিষ্কে নাড়া দিচ্ছে প্রচণ্ডভাবে!
ছইদ, জলিল আর মজনুর ছেলে!
মজিদ সবাইকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘আগামীকাল সবাই স্কুল মাঠে চলে আসবেন। মিয়া মোর্শেদ, মেয়ে নিয়ে আলো ফুটতেই চলে আসবেন। এই বাড়ি পাহারায় থাকবে মদন আর আলী। আমার ছেলেকে আমি নিয়ে যাচ্ছি। ঠিক সময়ে সেও উপস্থিত থাকবে।’
১৮
ভিড় কমতেই কানে তালা লাগানোর মতো প্রচণ্ড শব্দে কাছে কোথাও বজ্রপাত হলো। হেমলতা একা পদ্মজাকে তুলতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন মোর্শেদ এগিয়ে এসে দুই হাতে পাঁজকোলা করে তুলে নিলেন পদ্মজাকে। সেই সময় বিজলি চমকায়, সেই আলোয় পদ্মজার মুখটা দেখে মোর্শেদের বুক কেমন করে উঠল! কষ্টে চুরমার হয়ে গেল হৃদয়খানা। জন্মের দিন পদ্মজাকে কোলে নেয়ার পর যে অনুভূতি হয়েছিল ঠিক সেরকম একটা অনুভূতি হচ্ছে…এর নামই বোধহয় পিতৃত্ব!
প্রচণ্ড ঝোড়ো বাতাস বইছে। তারা ঘরে ঢুকতেই ভারি বর্ষণ শুরু হলো। মুহূর্তে দেখা দিল তাণ্ডবরূপি ঘূর্ণিঝড়; সেই তাণ্ডব ছুঁতে পারল না মোড়ল বাড়ির মানুষদের মন। ঝড়ের তাণ্ডবের চেয়েও বড়ো তাণ্ডবের সঙ্গে যুদ্ধ করে চলেছে তারা। হেমলতা গরম পানি করে পদ্মজাকে গোসল করালেন, পালটে দিলেন জামাকাপড়। পদ্মজা ঠোঁট কামড়ে নীরবে শুধু কেঁদে গেল, অশ্রু আটকে রাখতে পারছে না কিছুতেই। ইচ্ছে হচ্ছে বাড়ির পেছনের আম গাছটার সঙ্গে ফাঁস লেগে মরে যেতে। হেমলতা পদ্মজার চুল মুছে কপালে চুমু দিলেন। তার চোখ থেকে পদ্মজার নাকে এক ফোঁটা জল পড়ল। পদ্মজা চোখ তুলে তাকাল মায়ের দিকে।
‘আম্মা আসছে? আম্মা কোথায়? আম্মা আসেনি?’
পাশের ঘর থেকে পূর্ণার চিৎকার শোনা যাচ্ছে। সেকেন্ড কয়েকের মধ্যে ছুটে এলো সে, হেমলতাকে দেখেই ঝাঁপিয়ে পড়ল বুকের ওপর। হাউমাউ করে কেঁদে উঠল। পূর্ণার শরীরকে আগ্নেয়গিরি মনে হচ্ছে। এত উত্তাপ! জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে। পূর্ণার কান্না দেখে পদ্মজাও ডুকরে কেঁদে উঠল। হেমলতা স্তব্ধ হয়ে দুই মেয়ের কান্না শুনছেন। কাউকেই সামলানোর চেষ্টা করছেন না।
এদিকে মনজুরা জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন দরজার সামনে।
টিনের চালে ভারি বর্ষণের শব্দ হচ্ছে, জগৎ-সংসার একাকার হয়ে যাচ্ছে সেই শব্দে।
মাঝরাত। বাতাসের বেগ প্রচণ্ড। হেমলতা কালো রংয়ের শাড়ি পরে, একটা ব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়ে বাড়ির বাইরে পা বাড়ান। মনজুরা বারান্দার ঘর থেকে উঁচু কণ্ঠে বললেন, ‘রাম-দা ব্যাগে ক্যান ঢুকাইছস? আর কোন কেলাঙ্কারি বাকি?’
হেমলতা বিদ্যুৎবেগে ফিরে দাঁড়ালেন মনজুরার মুখে দিকে এক লহমার জন্য, পরক্ষণেই নিঃশব্দে বর্ষণ মাথায় নিয়ে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন। সঙ্গে সঙ্গে আঁতকে উঠলেন মনজুরা, ছুটে গেলেন পদ্মজার ঘরে। পদ্মজা চুপচাপ শুয়ে আছে। মৃদু ফোঁপানোর আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। পূর্ণা ঘুমাচ্ছে। তিনি ঘর ছেড়ে দ্রুত বারান্দা-ঘরে এলেন। বড্ড অস্থির লাগছে। জীবনে প্রথমবার সৃষ্টিকর্তার কাছে হেমলতার জীবন ভিক্ষা চেয়ে সেজদায় লুটিয়ে পড়লেন! মেয়েটার যাতে কিছু না হয়।
ফজরের আজান শোনা যাচ্ছে। বৃষ্টি থেমে গেছে। ধরণী শান্ত যেন কিছুই হয়নি। পদ্মজা ঘর থেকে বেরিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়াল। গেটের শব্দ পেয়ে উৎসুক হয়ে তাকাল। বিধ্বস্ত অবস্থায় হেমলতা ঢোকেন বাড়ির ভেতর। মনজুরা কখন যে পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন, পদ্মজা টের পায়নি। হেমলতা বাড়িতে ঢুকে কাঁধের ব্যাগটা মুরগির খোঁপে সামনে ছুঁড়ে ফেলেন। অন্ধকারের কারণে তার মুখ স্পষ্ট নয়। হেমলতা বাড়ির পেছনের দিকে চলে গেলেন। পদ্মজার অনুভূতিশূন্য, বিভীষিকাময় সন্ধ্যার স্মৃতি আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে রেখেছে তাকে। সে ধীর পায়ে উঠানে এসে দাঁড়াল। পেছন পেছন গেলেন মনজুরা। পায়ের শব্দে চমকে তাকাল পদ্মজা, দেখতে পেল নানিকে। ধীর কণ্ঠে প্রশ্ন করল, ‘নানু, আম্মা কোথায় গিয়েছিল?’
মনজুরা ক্ষণকাল নীরব থেকে বললেন, ‘জানি না।’
মনজুরার কণ্ঠে ভয়। পদ্মজা নিজের দুর্বল শরীর ঠেলে নিয়ে এলো বাড়ির পেছনে। দেখতে পেল, হেমলতা নদীতে নেমে গোসল করছেন। তিনি এক মুহূর্তে কয়েকটা ডুব দিলেন।
পদ্মজার মাথায় এবার দুশ্চিন্তা ভর করতে শুরু করে। ব্যস্ত পায়ে ঘাটের কাছে এসে সে ক্ষীণ স্বরে ডাকল, ‘আম্মা।’
হেমলতা ঘুরে তাকালেন। ঝড় শেষে আকাশ সাদা, অন্ধকার কাটার পথে। পদ্মজা বলল, ‘অসময়ে কেন গোসল করছ? ঠান্ডা লাগবে।’
হেমলতা গোসল শেষ করে উঠে এলেন ওপরে। পদ্মজাও আর কিছু বলল না। হেমলতা উঠানে এসে মনজুরাকে আদেশের সুরে বললেন, ‘পূর্ণাকে নিয়ে আসো আম্মা।’
পদ্মজা অবাক হয়ে শুধু দেখছে। পূর্ণা ধীর পায়ে হেঁটে আসে। তার জ্বর অনেকটা কমেছে। মনজুরা দূরে দাঁড়িয়ে রইলেন। হেমলতা মৃদু হেসে পূর্ণাকে বললেন, ‘পদ্মজার পাশে এসে দাঁড়া।’
পূর্ণা হতবুদ্ধি হয়ে পড়ল। সে বাধ্যের মতো এসে দাঁড়াল পদ্মজার পাশে। হেমলতা মুরগির খোঁপের পাশ থেকে কালো ব্যাগটা হাতে তুলে নিলেন, ভেতর থেকে বের করলেন একটা রাম-দা আর একটা কৌটা। পূৰ্ণা রাম-দা দেখে চমকে উঠল, চোখাচোখি হলো দুই বোনের।
রক্তেমাখা রাম-দা দুই মেয়ের পায়ের সামনে রাখলেন হেমলতা, শীতল কিন্তু তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বললেন, ‘মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব। তাই পৃথিবীতে সেরা মানুষগুলোরই বাঁচার অধিকার আছে। মানুষরূপী পশুদের না। যখন যেখানে কোনো মেয়েকে অসম্মান হতে দেখবি এক কোপ দিয়ে অমানুষটার আত্মা দেহ থেকে আলাদা করে দিবি। যে তোকে অসম্মান করেছে সে দোষী, তুই না। তার শাস্তি পাওয়া উচিত, তোর না। তাই আত্মহত্যার কথা কখনো ভাববি না। দোষীর আত্মা হত্যা করা উচিত। আর আমি মনে করি, এতে পাপ নেই। বরং পাপীকে বিনাশ না করা পাপ। আর আমার মেয়েরা যেন সেই পাপ কখনো না করে। সেই…’
‘মেয়েদের এসব কী কইতাছস তুই? মাথা খারাপ হইয়া গেছে তোর?’ মনজুরা হইহই করে উঠলেন।
হেমলতা ঢোক গিলে মনজুরার কথা হজম করে নিলেন। আবার মেয়েদের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আমি কখনো ছেলে চাইনি। মেয়ে চেয়েছি। প্রতিবাদী, দুঃসাহসি মেয়ে চেয়েছি। আল্লাহ আমাকে তিনটা মেয়ে দিয়েছেন। এখন সেই মেয়েরা যদি এইটুকুতে দুর্বল হয়ে পড়ে, তাহলে কীভাবে হবে? ঠিক আগের মতোই মাথা উঁচু করে বাঁচবি। যতদিন আমি আছি কেউ তোদের অসম্মান করে টিকতে পারবে না। আমি না হয় যতদিন বেঁচে থাকি তাদের শাস্তি দেব, পৃথিবী থেকে মুছে দেব; কিন্তু যখন থাকব না? তখন…তখন কী তারা বেঁচে থাকবে? বেঁচে থাকতে দেয়া ঠিক হবে? অন্য কোনো মেয়ের সঙ্গে নোংরামো করবে না, তার নিশ্চয়তা আছে? নেই। এখন থেকে নিজেদের শক্ত কর। মেয়েদের সাহস মেয়েদেরই হতে হয়। নিজেকে রক্ষা করার দায়িত্ব নিজের। গত রাতের স্মৃতি দুঃস্বপ্ন ভেবে ভুলে যেতে বলব না, মনে রাখ। প্রতিটি মানুষের ভেতর লুকানো হিংস্র শক্তি আছে। সবাই প্রকাশ করতে জানে না। চিনতে পারে না নিজেকে। গত রাতের ঘটনাটি মনে রেখে নিজের ভেতর লুকানো হিংস্র শক্তিটাকে জাগিয়ে হাতের মুঠোয় রাখ। যাতে সঠিক সময়ে হাতের মুঠো খুলে মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াতে পারিস। আঘাতে, আঘাতে চুরমার করে দিতে পারিস পাপের জগত।’
এইটুকু বলে হেমলতা ক্লান্ত হয়ে দপ করে বসে পড়লেন। পদ্মজা ‘আম্মা’ বলে হেমলতাকে ধরতে চাইলে, হাত উঠিয়ে বললেন, ‘দাঁড়িয়ে থাক।’ সময় নিয়ে প্রাণ ভরে দম নিলেন তিনি, এরপর কৌটাটা খুলে ঠান্ডা তরল কিছু ঢেলে দিলেন দুই মেয়ের পায়ে। পূর্ণা কেঁপে উঠে দূরে সরে গেল। পদ্মজা আতঙ্ক নিয়ে প্রশ্ন করল, ‘কার রক্ত?’
রক্তের কথা শুনে ঘৃণা আর ভয়ে পূর্ণার সর্বাঙ্গ রি রি করে উঠল। তার মনে হচ্ছে পায়ে পোকা কিলবিল করছে। টাটকা তাজা লাল রক্ত! বমি গলায় এসে আটকে গেছে। হেমলতা জবাব দিলেন না, শুধু মৃদু হাসলেন। পূৰ্ণা এই ভয়ংকর দৃশ্য সহ্য করতে না পেরে জ্ঞান হারাল। দুই হাতে বোনকে জাপটে ধরল পদ্মজা। কী আশ্চর্য, এই ভয়ংকর ঘটনা তাকে একটুও বিচলিত করল না! হেমলতার গায়ে ভেজা শাড়ি। তাই তিনি পূর্ণাকে ধরলেন না। মনজুরাকে বললেন, ‘পূর্ণারে ঘরে নিয়ে যাও আম্মা।’
মনজুরা কঠোর চোখে চেয়ে আছেন হেমলতার দিকে। হেমলতা আবারো হাসলেন। ভেজা কণ্ঠে মনজুরাকে বললেন, ‘কালো বলে অবহেলা না করে বুকে আগলে রাখলে আমার জীবনটা, আমার মেয়েদের জীবনটা অন্যরকম হতে পারত আম্মা।’
হেমলতার কথায় মনজুরার সারামুখ বিষণ্ণতা ছেয়ে গেল। তিনি হেমলতার দিকে তাকিয়ে থাকতে পারলেন না, অপরাধবোধে মাথা নুইয়ে ফেললেন। পূর্ণাকে ধরে নিয়ে গেলেন ঘরে। হেমলতা সেখানেই পড়ে রইলেন। আকাশের দিকে তাকিয়ে জোরে জোরে নিশ্বাস ফেললেন। আলো ফুটেছে পুরোপুরি। পাখির কিচিরমিচির শোনা যাচ্ছে। তিনি পানি দিয়ে উঠানের রক্ত মুছে দিলেন চিরতরে। রাম-দা ধুয়ে লুকিয়ে রাখলেন লাহাড়ি ঘরে। শাড়ি পালটে উঠানে পা রাখতেই মগাকে দেখতে পেলেন। খবর এনেছে সে, বিচার বসবে দুপুরে। রাতের ঘূর্ণিঝড়ে গ্রামের বেশিরভাগ ঘরবাড়ি উড়ে গেছে, ফসল ও পশুপাখিসহ বিভিন্ন ক্ষতি হয়েছে। অনেক মানুষ আহত হয়েছে! এই খবর শুনে হেমলতার চোখ সজল হয়ে উঠল 1 প্রকৃতির দিকে তাকিয়ে তিনি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলেন। প্রকৃতি কখনো কাউকে ছাড়ে না! গ্রামবাসী অন্যায় দেখেও নিস্তব্ধ থেকেছিল। এ বুঝি তারই শাস্তি!
.
মাথার ওপর সূর্য, তাপদাহও প্রচণ্ড। পূর্ণা, পদ্মজা ও হেমলতা কালো বোরখার আবরণে নিজেদের ঢেকে নিয়ে যাত্রা শুরু করেছে অলন্দপুরের মাধ্যমিক স্কুলের উদ্দেশ্যে। খা খা রোদ্দুর, তপ্ত বাতাসের আগুনের হলকা। সবুজ পাতা নেতিয়ে পড়ার দৃশ্য পড়ছে চোখে। মোর্শেদ বাকিদের নিয়ে আসছে। রীনাদের বাড়ির পাশ দিয়ে যাওয়ার পথে করুণ কান্নার স্বর ভেসে আসে। পদ্মজা চোখ তুলে তাকিয়ে দেখল, রীনার বাড়ির ছাদ উড়ে গেছে, গাছপালা ভেঙে পড়ে আছে উঠানে। হেমলতা পদ্মজাকে টেনে নিয়ে এগিয়ে যান।
বটের ছায়ায় আশ্রয় নিচ্ছিল এক রাখাল ছেলে। সে হেমলতার মুখ দেখে বুঝে যায়, পেছনের দুটি মেয়ে পদ্মজা আর পূর্ণা।
রাখাল ছেলেটি ছুটে এসে পদ্মজাকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘পদ্ম আপা, তুমি ডরাইও না। তোমার কিচ্ছু হইব না।’
চারদিকে নিঝুম, নিস্তব্ধ, ঝিমধরা প্রকৃতি। ঘামে দরদর তৃষ্ণার্ত রাখাল হাঁপিয়ে কথা বলছে। স্কুলে যাওয়ার পথে, মাঝে মাঝেই এই পনেরো বছর রাখালের সঙ্গে দেখা হতো পদ্মজার। পদ্মজার জন্য পাগল সে। বড়ো বোনের মতো মান্য করে। পদ্মজা
মৃদু হাসল। তবে মুখের ওপর পাতলা পর্দা আছে বলে, রাখালের চোখে তা পড়ল না। রাখালকে পেছনে ফেলে তিন মা-মেয়ে এগিয়ে চলল।
স্কুল মাঠে অনেক মানুষ জমেছে। রাতের ঘূর্ণিঝড়ের জন্য অলন্দপুরের বেশি অর্ধেক মানুষ আসেনি। তবুও উপস্থিত জনতার সংখ্যা শ-পাঁচেক তো হবেই! ঘটনা ঘটেছে আটপাড়ায়, আর তা ছড়িয়ে পড়েছে সব পাড়ায়! যথাসময়ে বিচার কার্য শুরু হলো। পদ্মজা এবং আমির দুজন দুই দিকে দাঁড়িয়ে আছে।
আমির একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে পদ্মজার দিকে, তার দুচোখ ভরতি মুগ্ধতা।
মাতব্বর ঠান্ডা গলায় প্রশ্ন করলেন, ‘পদ্মজা-আমিরকে একসঙ্গে কারা কারা দেখেছেন?’
রমিজ আলী, কামরুল, মালেক হাত তুললেন। মজিদ মাতব্বর বললেন, ‘কী দেখেছেন? ব্যাখ্যা করুন।
রমিজ আগে আগে উঁচু কণ্ঠে বললেন, ‘আমি দেখছি ঝড়ের সন্ধ্যায় আপনের পোলারে পদ্মজার ঘর থেকে বাইর হইতে। বাড়িত আর কেউ আছিল না।’
আমির রেগে গিয়ে কিছু বলতে চাইলে মজিদ মাতব্বর হাতের ইশারায় আটকে দিলেন। আমির বাপের বাধ্য সন্তান, তাই থেমে গেল।
মজিদ মাতব্বর বললেন, ‘আপনি আমিরকে পদ্মজার ঘর থেকেই বের হতে দেখেছেন?’
রমিজ আলী দৃষ্টি অস্থির রেখে আমতা আমতা শুরু করলেন। দম নিয়ে বললেন, ‘তারে বারান্দা থাইকা বাইর হইতে দেখছি।’
মজিদ মাতব্বর মুহূর্তখানেক নীরব থেকে বললেন, ‘তাহলে কোন আন্দাজে আপনি বলছেন, তারা নিষিদ্ধ কাজে লিপ্ত ছিল?’
কথাটি শুনে পদ্মজার সর্বাঙ্গ রি রি করে উঠল, চোখ বুজে ফেলল সে। রমিজ আলী থমকে গিয়ে পরপরই হুংকার দিয়ে ওঠে, ‘একটা অচেনা ছেড়া খালি বাড়িত কোনো ছেড়ির কাছে কেন যাইব? আপনার নিজের ছেড়া বলে তার দোষ ঢাকতে পারেন না। আমার ছেড়ির বেলা কিন্তু ছাড়েন নাই।’
মাতব্বর রেগে গেলেন, যুক্তি দিয়ে কথা বলুন। আপনার মেয়েকে হাতেনাতে ধরা হয়েছিল। তার গায়ে কাপড় ছিল না। তারা একসঙ্গে একই ঘরের একই বিছানায় ধরা পড়েছে। আমির আর পদ্মজার বেলা সেটা হয়নি।’
মজিদ মাতব্বরের ক্ষমতা এবং কথার দাপটের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে কষ্ট হচ্ছে রমিজ আলীর। কামরুল চুপসে গিয়েছেন। সামনে নির্বাচন। মজিদ মাতব্বরকে খেপানো মানে নিজের কপালে দুঃখ বয়ে আনা।
ভিড়ের মাঝ থেকে কেউ একজন বলল, ‘তাহলে আপনার ছেলে একটা মেয়ের কাছে খালি বাড়িতে গেল কেন?’
মজিদ মাতব্বর উঁকি দিয়ে প্রশ্নদাতাকে খুঁজে বের করলেন। তারই প্রতিপক্ষ হারুন রশীদ! মজিদ মাতব্বর আমিরের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন, ‘তুমি মোড়ল বাড়িতে কেন গিয়েছিলে?’
আমির সহজ গলায় বলল, ‘বাড়ি ফিরছিলাম হঠাৎ ঝড় শুরু হলো সামনে মোর্শেদ কাকার বাড়ি ছিল। মোর্শেদ কাকা বাড়ি নেই আমার জানা ছিল না। জানলে বৃষ্টিতে ভিজতাম তবুও ওই বাড়ি যেতাম না। এই গ্রামের অনেকেই জানে আমার শ্বাসকষ্ট আছে। বাড়ির সবাই জানে বৃষ্টিতে ভিজলে ঠান্ডা লেগে যায়, শ্বাসকষ্ট হয়। তাছাড়া পদ্মজাকে এর আগে কখনো দেখিনি আমি। কেউ কী কখনো পদ্মজার সঙ্গে আমাকে দেখেছে?’ আমির জনতার উদ্দেশ্যে বলল, ‘বলেন, কেউ দেখেছেন? আমাদের আগে কখনো দেখাই হয়নি তাহলে সম্পর্ক কী করে হবে?’
হারুন রশীদ বললেন, ‘যখন দেখলা ছেড়িড়া বাড়িত একলা তখন বাইর হইয়া গেলা না ক্যান?’
আমির সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিল, ‘আমার মাথায় আসেনি এমন কিছু হতে পারে। আর…’
আমির পদ্মজার দিকে তাকাল। পদ্মজা সঙ্গে সঙ্গে চোখ সরিয়ে নিলো। আমির বলল, ‘আর…পদ্মজার মতো রূপসী আর একটাও নেই এটা সবাই স্বীকার করতে বাধ্য। আমি প্রথম দেখে অভিভূত হয়ে পড়ি। তাই মস্তিষ্কে একবারো কোনো বিপদের আশঙ্কা আসেনি। এমন নোংরা কিছু হতে পারে ঘুণাক্ষরেও ভাবিনি।’
মজিদ মাতব্বর ছেলের দুর্বলতা বুঝতে পেরে অসন্তুষ্ট হলেন। তবুও স্বাভাবিক থেকেই বললেন, ‘গ্রামবাসী কোনো প্রমাণ ছাড়াই লাফিয়েছে। মেয়েটাকে অপদস্থ করেছে। প্রমাণ ছাড়া কারো বিরুদ্ধে নোংরা অপবাদ দেয়া অপরাধ।’ তিনি কামরুলের দিকে তাকিয়ে তাকে লক্ষ্য করে বললেন, ‘ছইদ, মজনুর ছেলে আরেকটা কে জানি? কোথায় তারা?’
কামরুল ধীরভাবে বললেন, ‘খুঁজে পাই নাই। মনে হয় ভয়ে কোনহানে লুকাইছে।’
রমিজ আলী হঠাৎ গমগম করে উঠলেন, ‘এইডা আমি মানি না। পদ্মজা- আমিররে আপনে ছাইড়া দিতে পারেন না। আপনের ক্ষমতা বেশি দেইখা আপনে এমনে নিজের ছেড়ারে ঢাইকা রাখতে পারেন না। আপনি বেইমানি করতাছেন।’
আমির রেগেমেগে রমিজ আলীকে ধরতে এলে, মজিদ গর্জন করে উঠলেন, ‘আমির!’
আমির কিড়মিড় করে রাগ হজম করার চেষ্টা করল। হারুন অতিশয় ধূর্ত লোক। তিনি রসিকতা করে বললেন, ‘সত্য হউক আর মিথ্যাই। বদনাম তো বদনামই।’
মজিদ সবার প্রশ্ন কথা উপেক্ষা করে উপস্থিত গ্রামবাসীর উদ্দেশ্যে বললেন, ‘আপনাদের আমার বিচারের প্রতি বিশ্বাস আছে?’
সবাই আওয়াজ করে বলল, ‘আছে।’
মজিদ মাতব্বর তৃপ্তির সঙ্গে হাসলেন। ক্ষণকাল নীরব থেকে উঠে দাঁড়ালেন। গলার স্বর উঁচু করে বললেন, ‘মোর্শেদের মেয়েদের সঙ্গে খারাপ হয়েছে। পদ্মজার নামে অনেক প্রশংসা শুনেছি। সে খুবই ভালো মেয়ে। আর আমার ছেলেকেও সবাই চিনেন, সে কেমন। যারা যারা দোষ করেছে তাদের খুঁজে বের করে শাস্তি দেয়া হবে। পদ্মজা আর আমির নামে যে পাপের অভিযোগ করা হয়েছে তার যুক্তিগত প্রমাণ নেই। আর প্রমাণ ছাড়া আমি কখনো কাউকে শাস্তি দেইনি। আজও দেব না। তবে আমি আজ সবার সামনে মোর্শেদ আর তার স্ত্রীর কাছে একটা প্রস্তাব রাখব।’
হেমলতা, মোর্শেদ সহ উপস্থিত সবাই কৌতূহল নিয়ে তাকাল। মজিদ মাতব্বর এক নজর আমিরকে দেখে বললেন, ‘পদ্মজাকে আমিরের বউ করে নিয়ে যেতে চাই।’
চারিদিকে কোলাহল বেড়ে গেল। সব কোলাহল সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে স্বপ্নাবিষ্টের মতো শুধু মজিদ মাতব্বরের প্রস্তাবটি পদ্মজার কানে বাজতে থাকল। জীবনের কোন মোড়ে এসে দাঁড়িয়েছে সে?
১৯
সূর্যের প্রখর তাপে সমস্ত প্রকৃতি যেন নির্জীব হয়ে ওঠেছে। উপস্থিত সবার মধ্যে চাপা উত্তেজনা কাজ করছে। রমিজ আলি আর হারুন রশীদ নামক ধূর্ত মানুষগুলোর চোখ ছানাবড়া। মজিদ মাতব্বর ধীর শান্ত কণ্ঠে বললেন, ‘আপনারা চাইলে সময় নিতে পারেন। আজ এখানে…’
হেমলতা কথার মাঝে আটকে দিয়ে বললেন, ‘আপনি বিয়ের তারিখ ঠিক করুন।’
মজিদ মাতব্বরের প্রস্তাবের চেয়ে এই প্রস্তাবে হেমলতার রাজি হওয়াটা যেন কোলাহল মুহূর্তে দ্বিগুণ বাড়িয়ে দিল। পদ্মজা হতবাক, বিস্ময়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ়! মোর্শেদ চোখ বড়ো করে হেমলতার দিকে দৃষ্টিপাত করলেন। আশপাশ থেকে ফিসফিসানি ভেসে আসছে। মজিদ মাতব্বর মৃদু হাসলেন। আনন্দের সঙ্গে সবাইকে নিমন্ত্রণ করলেন, ‘আগামী শুক্রবার আমার ছেলের সঙ্গে মোর্শেদের বড়ো মেয়ের বিবাহ। আপনাদের সবার নিমন্ত্রণ রইল।’ কথা শেষ করে হেমলতার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন, ‘দিন তারিখ ঠিক আছে?’
হেমলতা সম্মতি জানালেন। মোর্শেদ অবাকের চরম পর্যায়ে, কোনো কথা আসছে না মুখে। পদ্মজা ঢোক গিলে ব্যাপারটা হজম করে নিলো মুহিবের সঙ্গে যখন তার বিয়ের আলোচনা হলো তখন সে ভারি অবাক হয়েছিল। লিখন শাহ নামে একটা মানুষকে মনে পড়েছিল। এখন তেমন কিছুই হচ্ছে না, অনুভূতিগুলো ভোঁতা। যা হওয়ার হবে। সেসব নিয়ে ভেবে লাভ নেই।
বিচার সভা ভেঙে গেল। মজিদ মাতব্বর আলাদা করে মোর্শেদের সঙ্গে কথা বললেন। তিনি আগামীকাল নিজ স্ত্রী এবং বাড়ির অন্যান্য বউদের নিয়ে পদ্মজাকে দেখতে আসবেন। মোর্শেদ, হেমলতা সমস্বরে অনুমতি দিলেন বাড়ি ফেরার পথে অনেকের কটু কথা কানে আসে। পদ্মজা আর আমির দুজনেরই চরিত্র খারাপ। এজন্যই বিয়ে হচ্ছে। মাতব্বর ক্ষমতাবান বলে পুরো ব্যাপারটা ঘুরিয়ে নিয়েছে। কিন্তু তলে তলে তো নিজেরা জানে তাদের ছেলেমেয়ে কেমন। তাই তাড়াতাড়ি করে বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। কেউ একজন খুব বিশ্রীভাবে পদ্মজাকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘কে জানে, মনে কয় তো ছেড়ি পেট বাঁধাইছে। রাইতে বাপ-মারে দিয়া পায়ে ধরাইয়া বিয়া ঠিক করছে।’
পদ্মজার মন তিক্ত হয়ে ওঠে, হাঁটতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। এত নোংরা মন্তব্য সহ্য করা খুব কঠিন। মিথ্যে অপবাদ চারিদিকে। বোরখার আড়ালে পদ্মজার চোখ দুটি ছলছল করছে। খুব কাঁদতে ইচ্ছে হচ্ছে।
হেমলতা পদ্মজার একহাত শক্ত করে চেপে ধরলেন। মানুষদের ছায়া ছেড়ে খেতের রাস্তা দিয়ে যাওয়ার পথে বললেন, ‘জীবন খুব ছোটো। এই ছোটো জীবনে অনেক ঘটনা ঘটে। যে ভালো তার সঙ্গে যে শুধুই ভালোই হবে তা কিন্তু ঠিক না, উচিতও না। ভালো খারাপে মিলিয়েই জীবন। তাই বলে সেই খারাপকে পাত্তা দিয়ে সময় নষ্ট করতে হবে—তার কোনো মানে নেই। খারাপটাকে পাশে রেখে ভালো মুহূর্ত তৈরি করার চেষ্টা করবি। ভালোটা ভাববি। শুধুমাত্র কয়জনের কথায় কী আসে যায়? পুরো গ্রামবাসী জানে, তুই কেমন। পুরো অলন্দপুরের যত মানুষ আজ এসেছে তাদের মধ্যে বেশিরভাগ মানুষই মনে মনে তোর গুণগান গেয়েছে। তারা মনে মনে বিশ্বাস করে তুই নির্দোষ। কিন্তু চুপ ছিল। যারা খারাপের দলে তারা সংখ্যায় কম বলে কোলাহল করে নিজেদের দাপট দেখাতে চেয়েছিল। সবার অগোচরে বোঝাতে চেয়েছিল, আমরা অনেকজন। কিন্তু পারেনি। কোলাহল কোনো কিছুর সমাধান নয়। এখন যারা নিন্দা করল তারা নিজেদের নিচু মনের পরিচয় দিয়েছে, সেই সঙ্গে আমলনামায় পাপের সংখ্যা বাড়িয়েছে। তাদের শাস্তি পৃথিবী এবং আখিরাত—দুটোতেই হবে। একদিন এদের শাস্তি হবেই এই কথাটা ভেবে খুশি হ। সব ভুলে যা, বাকি জীবন পড়ে রয়েছে। তা নিয়ে ভাব। চোখের জল অতি আপনজন এবং আল্লাহর জন্য ফেলা উচিত। এদের মতো অমানুষদের জন্য না।’
পদ্মজা হুহু করে কেঁদে উঠল। আচমকা হেমলতাকে মাঝপথে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে, কান্নামাখা কণ্ঠে বলল, ‘তুমি জাদুকর আম্মা। তুমি জাদু জানো।’
হেমলতা পদ্মজার পিঠে হাত বুলিয়ে দিলেন। মোর্শেদ পদ্মজাকে কান্না থামাতে বলতে চাইলে হেমলতা ইশারায় চুপ করিয়ে দেন। পাশেই বিস্তীর্ণ ক্ষেত। গ্রীষ্মের দুপুরের রূপ স্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে। মোর্শেদের কপাল বেয়ে ঝরঝর করে ঘাম ঝরছে। তার দৃষ্টি থমকে আছে হেমলতার দিকে। একটা অপ্রিয় সত্য সম্ভাবনার কথা মনে হতেই চোখ দুটি ছলছল করে উঠল। তিনি দ্রুত চোখ সরিয়ে বড়ো করে নিশ্বাস ফেলেন। জীবনের লীলাখেলায় তিনি নিঃস্ব। পদ্মজার কান্না থামার লক্ষণ নেই। হেমলতা ছদ্ম গাম্ভীর্যের সহিত বললেন, ‘এত কাঁদলে কিন্তু মারব।’
.
আকাশ জুড়ে তারার মেলা। জানালা গলে চাঁদের আলো পদ্মজার মুখশ্রী ছুঁয়ে দিচ্ছে। বারান্দার ঘরে উপুড় হয়ে শুয়ে আছে সে, বুকটা কেমন কেমন করছে; কাঁপছে অনবরত। হেমলতার উপস্থিতি টের পেয়ে দ্রুত উঠে বসল। হেমলতা পদ্মজার দিকে মুহূর্তকাল তাকিয়ে রইলেন।
‘ঘুম আসছে না?’ জানতে চাইলেন তিনি।
পদ্মজা মাথা দুই পাশে নাড়াল। হেমলতা আর কিছু বললেন না। নীরবতা কাটিয়ে বলল, ‘মেজো আপার বিয়ের তারিখ পড়েছে?’
হেমলতা পদ্মজার দিকে তাকিয়ে আবার চোখ সরিয়ে নিলেন। বিছানার ওপর বসে ইশারায় পদ্মজাকে কোলে শুতে বললেন। পদ্মজা শুয়ে পড়ল। মায়ের কোলটা তার এখন ভীষণ দরকার ছিল। হেমলতা পদ্মজার প্রশ্ন এড়িয়ে অন্য কথা তুললেন।
বললেন, ‘জানি না কোনো মা তার মেয়ের সঙ্গে নিজের বিয়ের গল্প করেছে কি না। কিন্তু আমি আমার বিয়ের গল্প তোকে বলতে চাই। শুনবি?’
পদ্মজা সায় দিল। হেমলতা পদ্মজাকে বিয়ের ব্যাপারে আগ্রহী করে তোলার জন্য নিজের অতীতে নিয়ে যান, ‘সেদিন রাতে আব্বা এসে বলল, তিনদিন পর আমার বিয়ে। আমি খুব অবাক হয়েছিলাম। কষ্ট হয়েছিল। আমি আরো পড়তে চেয়েছিলাম। এরপর শুনলাম—যার সঙ্গে আমার বিয়ে হচ্ছে তার পড়াশোনা নেই, জ্ঞানও যথেষ্ট কম; রাগচটা লোক। এসব তথ্য জেনে রাগ কিংবা মন খারাপ কিছুই হয়নি। ভয় হয়েছিল—না জানি কেমন হবে সংসার!
‘বিয়ের দিন ঘনিয়ে এলো। তোর আব্বাকে তখনো আমি দেখিনি। বিয়ের দিন আয়নায় প্রথম দেখি। কালো একটা মুখ। চোখ দুটি গভীর। কখনো না দেখা মানুষটাকে, প্রথম দেখেই মনে হয় আমার সবচেয়ে আপন একজন মানুষ। সব ভয় কেটে গেল। বিদায়ের সময় সবাই বলেছিল দুজনকে খুব মানিয়েছে, রাজযোটক। একজন হিন্দু দিদি বলেছিলেন, সাক্ষাৎ রাম- সীতা। আটপাড়ায় যদি একজন ছয় ফুট লম্বার মানুষ থাকে তবে সেটা তোদের আব্বা ছিল। বিয়ের পর জানতে পারি, তোর আব্বাকে বিয়ে করার জন্য অনেক মেয়েই পাগল ছিল। নিজেকে খুব সৌভাগ্যবতী মনে হতো। অশিক্ষিত ভেবে নাক কুঁচকেছিলাম। সেই আমি তোর আব্বার জন্য দিনকে রাত, রাতকে দিন মানতে রাজি ছিলাম। তোর আব্বার প্রতি এতটাই ভালোবাসা সৃষ্টি হয়েছিল, যদি ছুরি নিয়ে রক্তের আবদার করত আমি আমার বুক পেতে দিতাম।’
পদ্মজা মাঝপথে আটকে দিয়ে বলল, ‘তাও তো আব্বা তোমাকে ভালোবাসেনি।’
হেমলতার হাসি উজ্জ্বল মুখটা সঙ্গে সঙ্গে নিভে গেল। অপ্রতিভ হয়ে উঠলেন। তিনি এলোমেলো দৃষ্টিতে দূরের দিকে চেয়ে বললেন, ‘তাকে বিয়ে করতে বাধ্য করা হয়েছিল।’
পদ্মজা চুপ করে রইল। হেমলতাও নিশ্চুপ। দরজার পাশে মোর্শেদ বসে বসে বিড়ি ফুঁকছিলেন। হেমলতার প্রতিটি কথা বুড়ো হয়ে যাওয়া মনটাকে দুমড়ে-মুচড়ে দেয়। তিনি বিড়ি নিয়ে বেরিয়ে যান চৌরাস্তার উদ্দেশ্যে। চৌরাস্তার পাশে একটা বড়ো ব্রিজ আছে, ওখানে দখিনা হাওয়ার তীব্রতা খুব। সেখানেই এসে দাঁড়ান। ফেলে আসা জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপ চোখ খুঁজে মনে করার চেষ্টা করেন।
বেশ কিছুক্ষণ পর পদ্মজা বলল, ‘আম্মা, প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, আর প্রশ্ন করব না। তবুও…’
‘বলব একদিন।’
পদ্মজা নিশ্চুপ হয়ে গেল। একমুহূর্ত স্থির থেকে হেমলতা বললেন, ‘পূর্ণা খুব কান্নাকাটি করে দেখলাম। মেয়েটা এত দুর্বল কী করে হলো?’
পদ্মজা হেমলতার এক হাত মুঠোয় নিয়ে আশ্বস্ত করল, ‘আমি আছি আম্মা। সামলে নেব।’
‘ঘরে যা। রাত হয়েছে অনেক।’
পদ্মজা উঠে বসল। ওড়নাটা ভালো করে টেনে নিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য পা বাড়ায়। হেমলতা বিছানার শেষ প্রান্ত থেকে বালিশ টেনে নিতে গিয়ে বালিশের তলায় ভাঁজ করা দুটি চিঠি দেখতে পেলেন। তিনি হাত বাড়িয়ে চিঠি দুটো নিয়ে পদ্মজার উদ্দেশ্যে বললেন, ‘পদ্মজা, এগুলো কী?’
পদ্মজা ফিরে তাকাল। হেমলতার হাতে লিখনের চিঠি দুটি দেখে সর্বাঙ্গে বৈদ্যুতিক কিছু একটা ছড়িয়ে পড়ে শরীর কাঁপিয়ে দিল। মাটি যেন টেনে ধরল দুই পা। হেমলতা প্রথম চিঠিটির ভাঁজ খুলে প্রথম লাইন পড়ে বেশ অবাক হোন, পদ্মজার দিকে একবার চকিতে তাকান। এরপর এক নিশ্বাসে দুটো চিঠি পড়ে শেষ করলেন।
পড়া শেষে থম মেরে বসে রইলেন অনেকক্ষণ। ভয়ে পদ্মজার দুই চোখ জ্বলছে। মাথা নত করে দাঁড়িয়ে আছে সে। হেমলতা ধীর পায়ে হেঁটে পদ্মজার কাছে এসে দাঁড়ান। দুই ভ্রু প্রসারিত করে, শান্ত অথচ ধারাল কণ্ঠে বললেন, ‘এসব কবে হয়েছে? আমাকে জানাসনি কেন?
পদ্মজা বলল, ‘যখন উনারা শুটিং করতে আসেন।’ ওর মনে হচ্ছে এখুনি অজ্ঞান হয়ে যাবে। কিন্তু কিছুই হচ্ছে না। মনে মনে প্রার্থনা করছে, যাতে অজ্ঞান হয়ে পড়ে যায়। তাহলে এই লজ্জা থেকে বেঁচে যাবে।
হেমলতা পদ্মজাকে পরখ করলেন, পদ্মজা অস্বাভাবিকভাবে কাঁপছে; বার বার কামড়ে ধরছে নিচের ঠোঁট।
পদ্মজা হেমলতাকে চুপ থাকতে দেখে বলল, ‘তুমি যা বলবে তাই হবে আম্মা। আমার ওপর রাগ কোরো না।’
পদ্মজা – ২০
আজ যেন শুধু মোড়ল বাড়ির মাথার ওপরেই সূর্য উঠেছে। সকাল থেকে আত্মীয় আপ্যায়নের প্রস্তুতির তোড়জোড় চলছে। সবাই ঘেমে একাকার। বাড়ির প্রতিটি মানুষ ব্যস্ত। মোর্শেদ হিমেল ও প্রান্তকে নিয়ে বাজার করে ফিরেছেন সূর্য ওঠার মাথায়। লাহাড়ি ঘরের পাশে বড়ো উনুন করা হয়েছে। সাধারণ চালের পরিবর্তে সুগন্ধি, সিদ্ধ চালের ভাত রান্না করা হয়েছে; সেই সঙ্গে রাজহাঁস আর দেশি মুরগি। বাড়িজুড়ে রমরমা ব্যাপার। একদিন আগের ঘটনা ধামাচাপা পড়েছে পঁচানব্বই ভাগ। ছোটো ছোটো দরিদ্র ছেলেমেয়েরা খাবারের ঘ্রাণ পেয়ে ছুটে এসেছে মোড়ল বাড়ি। সবার মধ্যেই নতুন উত্তেজনা, নতুন অনুভূতি। শুধু পূর্ণা এখনো সেদিনের ঘটনা থেকে বেরোতে পারছে না, চিত হয়ে শুয়ে আছে ঘরে। মনজুরা আর শিউলির মাকে কাজে সাহায্য করছিল পদ্মজা। হেমলতা ধমকে ঘরে পাঠিয়ে দেন। পদ্মজা ঘামে ভেজা কপাল মুছতে মুছতে ঘরে প্রবেশ করে। পূর্ণার দুচোখ জলে নদী যেন! পদ্মজা বিছানার ওপর পা তুলে বসে। বোনের উপস্থিতি টের পেয়ে, হাতের উলটো পাশ দিয়ে চোখের জল মুছল পূর্ণা।
পদ্মজা কণ্ঠ খাঁদে নামিয়ে বলল, ‘চোখের জল কী শেষ হয় না?’
পূর্ণা নিরুত্তর। পদ্মজা অভিজ্ঞ স্বরে বলল, ‘দেখ পূর্ণা, এসব মনে রাখলে তোরই ক্ষতি। দেখছিস না, আমি অল্প সময়ের ব্যবধানে সব ভুলে হবু শ্বশুরবাড়ির মানুষদের জন্য রান্নাবান্না করছি। তুইও ভুলে যা। তোর বন্ধুরা আসছে। তুই নাকি তাদের ধমকে দিয়েছিস? এটা কিন্তু ঠিক না। ‘
পূর্ণা পদ্মজার দিকে তাকাল। দৃষ্টি ভীষণ শীতল। পদ্মজাকে বলল, ‘সত্যি ভুলতে পেরেছ আপা?’
পদ্মজা সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিল, ‘ভুলিনি। কিন্তু সহ্য করতে পেরেছি। তোর মতো চোখের জল অপাত্রে ঢালছি না।’
পূর্ণা উঠে বসে, একটা বালিশ বুকে জড়িয়ে ধরে দায়সারাভাবে বলল, ‘তুমি অনেক শক্ত আপা। আমি খুব দুর্বল, ভুলতে পারছি না।’
পদ্মজা আর কথা বাড়াল না। পূর্ণার গাঁ ঘেঁষে বসে ফিসফিসিয়ে বলল, ‘গতকাল রাতে কী হয়েছে জানিস?’
‘কী হয়েছে?’
পদ্মজা চারিদিকে চোখ বুলিয়ে বলল, ‘তোর নায়ক ভাইয়ের চিঠি আম্মার হাতে পড়েছে।’
পূর্ণা আঁতকে উঠে বলল, ‘সে-কী! কখন? কীভাবে?’
‘আর বলিস না! সেদিন তুই নানাবাড়ি ছিলি। তখন চিঠি দুইটা বের করেছিলাম। বারান্দার ঘরে বালিশের নিচে রেখে দিই। আর মনে নেই 1 এরপরেই অঘটন ঘটে। এরপর দিন বিচার বসল। চিঠির কথা ভুলেই গেলাম। বারান্দার ঘরে ছিলাম রাতে তবুও মনে পড়েনি। আর আম্মা পেয়ে গেল।’
উত্তেজনা-ভয়ে পূর্ণার গলা শুকিয়ে গেছে। প্রশ্ন করল, ‘আম্মা কী বলছে?’
পদ্মজা ঠোঁট দুটি উলটে কী যেন ভাবে। এরপর ব্যথিত স্বরে বলল, ‘তেমন কিছুই না। এজন্যই আরো ভয় হচ্ছে।’
‘কিছুই না?’
‘কখন হলো এসব—জিজ্ঞাসা করেছে। আমি বললাম, তুমি যা বলবে তাই হবে। এরপর আম্মা অনেকক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে ছিল।’
‘তারপর?’
‘বলল, ঘুমা গিয়ে। শেষ।’
দুই বোন একসঙ্গে চিন্তায় পড়ে গেল। কপাল ভাঁজ করে কিছু ভাবতে শুরু করে। পূর্ণা বলল, ‘আম্মা তোমার মুখ দেখে বুঝে গেছে তুমি লিখন ভাইকে ভালোবাস না।’
পদ্মজা অন্যমনস্ক হয়ে বলল, ‘মনে হয়।
পূর্ণা খুব বিরক্তি নিয়ে বলল, ‘লিখন ভাই এত সুন্দর, তোমাকে এত ভালোবাসে তবুও কেন ভালোবাসোনি আপা? লিখন ভাইয়ের চিঠি তো ঠিকই সময় করে করে পড়তে। বিয়ে করতে কী সমস্যা?’
‘আম্মা দিলে তো করবই। সমস্যা নেই।’
‘তোমার এই ন্যাকার কথা আমার ভালো লাগে না আপা।’
পূর্ণার রেগে কথা বলা দেখে পদ্মজা হেসে ফেলল।
পদ্মজা পূর্ণার এক হাত মুঠোয় নিয়ে বলল, ‘গতকাল রাতে আম্মা আব্বাকে কতটা ভালোবাসে আমাকে বলেছে। প্রথম দেখেই নাকি আপন- আপন লেগেছিল। আব্বার জন্য আম্মা দিনকে রাত, রাতকে দিন মানতেও রাজি ছিলো। এতটা ভালোবাসত! আমার তেমন কোনো অনুভূতি হয়নি তোর নায়ক ভাইয়ের জন্য। প্রথম প্রথম কোনো পুরুষের চিঠি পেয়েছিলাম, সবকিছু নতুন ছিল। তাই একটা ঘোরে গিয়ে নতুন অনুভূতির সাক্ষাৎ পাচ্ছিলাম। আম্মার ভালোবাসার কথা শোনার পর থেকে মনে হচ্ছে আমি উনাকে ভালোবাসিনি। সবটা মোহ ছিল। দূরে যেতেই উবে গেছে। তবে উনি খুব অসাধারণ একজন মানুষ। আম্মা উনার হাতে আমাকে তুলে দিলে কোনো ভুল হবে না। কিন্তু এটা এখন কল্পনাতীত। পরিস্থিতি পালটে গেছে। আমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে।’
পদ্মজার এত কথা উপেক্ষা করে পূর্ণা কটমট করে বলল, ‘তোমার কী কালাচাঁদরে দেখলে আপন আপন লাগে?’
পদ্মজা চোখ ছোটো ছোটো করে জিজ্ঞাসা করল, ‘কালাচাঁদ কে?
পূর্ণা মিনমিনিয়ে বলল, ‘তোমার হবু জামাই,’ তারপরই গলা উঁচিয়ে বলল, ‘আমিও কালা। কিন্তু আপা, তোমার জন্য লিখন ভাইয়ের মতো সুন্দর জামাই দরকার।’
পদ্মজা এক হাতে কপাল চাপড়ে বলল, ‘এখনও লিখন ভাই! যা তোর সঙ্গে তোর নায়কের বিয়ে দিয়ে দেব। এখন আয়, ঘর থেকে বের হ। মুক্তা, সোনামণি, রোজিনা এসেছে। তোর সঙ্গে কথা বলবে। আয় বলছি…আয়।’
পূর্ণাকে টেনে নিয়ে বন্ধুদের মাঝে বসিয়ে দিল পদ্মজা। ঘরে এসে আয়নায় নিজেকে দেখে থমকে দাঁড়াল, ছুঁয়ে দেখল গালের দাগটা। সে কী সত্যি নির্মম, নিষ্ঠুর মুহূর্তটি সহ্য করে নিয়েছে? না, করেনি। বুকের ভেতরটা খুব জ্বলে। এই অপমান মেনে নিতে গিয়ে প্রতিটি মুহূর্তে মরে যাচ্ছে সে। কিন্তু আম্মা বা পূর্ণাকে সেটা বুঝতে দেয়া যাবে না। পদ্মজা দ্রুত চোখের জল মুছে একা হাসার চেষ্টা করল।
সূর্য মামার রাগ কমেছে। তাই মোড়ল বাড়ির মাথার ওপর থেকে সরে দূরে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। সদর ঘর ভরতি মানুষ। হাওলাদার বাড়ির মহিলারা এসেছে। যদিও তাদের আরো আগে আসার কথা ছিল। নানা কারণে তারিখ পিছিয়ে দিতে হয়েছে। হাওলাদার বাড়ির বউদের গ্রামবাসী শেষবার তাদের বিয়েতেই দেখেছে। আবার দেখার সুযোগ হওয়াতে দল বেঁধে মানুষ এসেছে। লোকমুখে শোনা যায়, হাওলাদার বাড়ির মেয়ে-বউদের সারা অঙ্গে সোনার অলংকার ঝলমল করে। মগা-মদনসহ আরো দুজন ভৃত্য মোড়ল বাড়ির গেটে দাঁড়িয়ে বাড়ি পাহারা দিচ্ছে। পদ্মজাকে শাড়ি পরাচ্ছেন হেমলতা। পদ্মজা এর আগে কখনো শাড়ি পরেনি। পূর্ণা-প্রেমা ছোটো হয়েও পরেছে। পদ্মজার কখনো ইচ্ছে করেনি। তাই সে হেমলতাকে বলল, ‘প্রথম শাড়ি তুমি পরাবে।’
শাড়ি পরানো শেষে, চোখে কাজল এঁকে দেন হেমলতা। ঠোঁটে লিপিস্টিক দিতে গিয়েও দিলেন না। মাথার মাঝ বরাবর সিঁথি করে চুল খোঁপা করতেই, পূর্ণা ছুটে আসে। হাতে শিউলি ফুলের মালা।
হেমলতা মৃদু ধমকের স্বরে বললেন, ‘এতক্ষণ লাগল!’
হেমলতার কথা বোধহয় পূর্ণার কানে গেল না।
পূর্ণা চাপা উত্তেজনা নিয়ে
তা আপাকে কী সুন্দর লাগছে!’
পদ্মজা লজ্জা পেল, চোখে-মুখে ছড়িয়ে পড়ল লাল আভা। হেমলতা পদ্মজার খোঁপায় ফুলের মালা লাগিয়ে দিয়ে বললেন, ‘শুধু রূপে চারিদিক আলোকিত করলে হবে না, গুণেও তেমন হতে হবে।’
পদ্মজা বাধ্যের মতো মাথা নাড়াল। তখন হুড়মুড়িয়ে সেখানে উপস্থিত হয় লাবণ্য। দৌড়ে এসে পদ্মজাকে জাপটে ধরে। এক নিশ্বাসে বলে উঠে, ‘আল্লাহ, পদ্ম তুই আমার ভাবি হবি। আমার বিশ্বাসই হইতাছে না। মনে হইতাছে স্বপ্ন দেখতাছি। ইয়া…মাবুদ, শাড়িতে তোরে পরি লাগতাছে। তোর রূপ দেখে বাড়ির সবাই অজ্ঞান হয়ে যাবে দেহিস।’
পদ্মজা কী বলবে ভেবে পেল না, শুধু হাসল। হেমলতা পদ্মজার মাথার ঘোমটা টেনে দিয়ে লাবণ্যকে বললেন, ‘তোমার সইকে নিয়ে যাও।’
পদ্মজা হেমলতার হাতে হাত রেখে অনুরোধ করে বলল, ‘আম্মা, তুমিও এসো।’
হেমলতা হেসে পদ্মজার মাথায় এক হাত রেখে বললেন, ‘কয়দিন পর থেকে এরাই তোর আপন। মা পাশে থাকবে না।’
পদ্মজার চোখ দুটি সজল হয়ে ওঠে। ছলছল চোখ নিয়ে সে তাকিয়ে রইল মায়ের দিকে। পদ্মজাকে নতুন বউ রূপে দেখে হেমলতার বুকে ঝড় বইছে। মেয়েটা কয়দিন পর আলাদা হয়ে যাবে। দুই মাস আগে হলে তিনি সাত রাজার ধনের বিনিময়েও মেয়ের বিয়ে দিতেন না। তিনি নিজের আবেগ নিয়ন্ত্রণ করে বললেন, ‘আমি আসছি। লাবণ্য যাও তো নিয়ে যাও। পূর্ণা তুইও যা।’
লাবণ্য পদ্মজাকে নিয়ে যায়। পদ্মজার বুক ধড়ফড় করছে। মায়ের যেন কী হয়েছে! সে পেছন ফিরে তাকাল। সঙ্গে সঙ্গে হেমলতা অন্য দিকে ঘুরে দাঁড়ালেন। চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ে, তিনি দ্রুত তা মুছে ফেললেন।
সদর ঘর কোলাহলময় ছিল। পদ্মজা ঢুকতেই সব চুপ হয়ে গেল। লাবণ্য পদ্মজাকে ছেড়ে ভারী আনন্দ নিয়ে বলল, ‘আম্মা, কাকিম্মা, ভাবি, আপারা—এই যে পদ্মজা। আমার নতুন ভাবি।’
পদ্মজা চোখ তুলে তাকাল। অলংকারে জ্বলজ্বল করা পাঁচ জন নারীকে দেখে যেন চোখ ঝলসে গেল। সবাই তার দিকে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে। পদ্মজা চোখ নামিয়ে ফেলল। তখন কোত্থেকে আবির্ভাব হলো আমিরের সদর দরজার মুখে দাঁড়িয়ে ছিল পদ্মজা, হবু বউকে দেখে থমকে গেল সে। পদ্মজার পরনে খয়েরি রংয়ের জামদানি শাড়ি। শাড়িতে কোনো মেয়েকে এত সুন্দর মনে হতে পারে এর আগে কখনো অনুভব করেনি আমির। আমিরের লজ্জা খুব কম। সে উপস্থিত গুরুজনদের উপেক্ষা করে পদ্মজাকে বলল, ‘মাশাআল্লাহ। দিনের বেলা চাঁদ উঠে গেছে।’
লজ্জায় পদ্মজার রগে রগে কাঁপন ধরে। এত লজ্জাহীন মানুষ কী করে হয়! আমিরের মা ফরিনা ধমকের স্বরে বললেন, ‘বাবু, এইনে বয় আইসসা।’
আমির পদ্মজার ওপর দৃষ্টি স্থির রেখে মায়ের পাশে গিয়ে বসল। হেমলতা সদর ঘরে প্রবেশ করতেই আমির ধড়ফড়িয়ে উঠল। ছুটে এসে হেমলতার পা ছুঁয়ে সালাম করল। হবু শাশুড়ির প্রতি আমিরের এত দরদ দেখে ফরিনা খুব বিরক্ত হলেন। পাশ থেকে ফরিনার জা আমিনা ফিসফিসিয়ে বললেন, ‘মেয়ের রূপ আগুনের হলকা। বাবু এইবার হাত ছাড়া হইলো বলে।’
আমিনার মন্ত্র ফরিনার মগজ ধোলাই করতে পারল না। পদ্মজার রূপে তিনি মুগ্ধ। আমির কালো বলে তিনি ছোটো থেকেই আমিরকে বলতেন, ‘বাবু, তোর জন্যি চান্দের লাহান বউ আনাম।’
সেই কথা রক্ষার পথে। তিনি শুধু পছন্দ করছেন না শাশুড়ির প্রতি আমিরের এত দরদ! কী দরকার ঝাঁপিয়ে পড়ে পায়ে ধরে সালাম করার? আমির হেমলতাকে ভক্তির সঙ্গে প্রশ্ন করল, ‘ভালো আছেন?’
হেমলতা মিষ্টি করে হেসে বললেন, ‘ভালো আছি। যাও গিয়ে বসো।’
আমির বাধ্যের মতো মায়ের পাশে গিয়ে বসল। মজিদ মাতব্বর, মোর্শেদের সঙ্গে বাইরে আলোচনা করছেন। আর কোনো পুরুষ আসেনি বাড়িতে। তারা বিয়ের আয়োজনে ব্যস্ত। মুহূর্তে পদ্মজার সারা অঙ্গ সোনার অলংকারে পূর্ণ হয়ে উঠল। রূপ বেড়ে গেল লক্ষ গুণ, যার কোনো সীমা নেই। যার সঙ্গেই পদ্মজা কথা বলেছে, সেই এগিয়ে এসে বালা নয়তো হার পরিয়ে দিচ্ছে।
কী অবাক কাণ্ড!
সবাই আড্ডা দিচ্ছে। তবে চুপ করে বসে আছে পদ্মজা। কেউ প্রশ্ন করলে জবাব দিচ্ছে। লাবণ্য একজনকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘রানি আপা, বাড়ির পেছনে যাইবা?’
রানি খুশিতে গদগদ হয়ে বলল, ‘যাব।’
তার খুশির কারণ লাবণ্য কিছুটা ধরতে পেরেছে। রানির একজন প্ৰেমিক আছে। তাই শুধু সুযোগ খোঁজে দেখা করার। যেখানেই দাওয়াত পড়ে সেখানেই তার প্রেমিক উপস্থিত হয়। লাবণ্য সবার কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে পদ্মজা-পূর্ণা, রানিকে নিয়ে বাড়ির পেছনে যায়। রানি বাড়ির পেছনে এসেই ছুটে যায় ঘাটের দিকে, সেই মুহূর্তেই একটা নৌকা এসে ভেরে সেখানে। নৌকায় কে ছিল দেখা যাচ্ছে না। রানি নৌকায় উঠে পড়ে। শোনা যায়, কারো সঙ্গে সে বিরতিহীন ভাবে কথা বলছে। পূর্ণা লাবণ্যকে প্রশ্ন করল, ‘লাবণ্য আপা, রানি আপা কার সঙ্গে কথা বলে?’
‘আবদুল ভাইয়ের সঙ্গে।’
‘কোন আবদুল?’
‘যার কথা ভাবছিস।’ কথা শেষ করে লাবণ্য চোখ টিপল। পূর্ণা অবাক হয়ে বলল, ‘মাস্টারের সঙ্গে!’
লাবণ্য হাসে। রানি এগিয়ে আসে। লাবণ্য বলল, ‘কথা শেষ?’
‘হ, চইলা গেছে।’
রানি পদ্মজার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘মাশাআল্লাহ, তুমি এত সুন্দর। আমার কোলে নিয়া আদর করতে মন চাইতাছে।
পদ্মজা মুচকি হেসে বলল, ‘আপনি খুব শুকনো। আমাকে কোলে নিতে পারবেন না।’
‘শুকনা হইতে পারি। শক্তি আছে।’
রানির কথা বলার ঢংয়ে সবাই হেসে উঠল। পূর্ণা পেছনে ফিরে দেখে আমির আসছে। সে তাৎক্ষণিক পদ্মজার কানে কানে বলল, ‘আপা তোমার কালাচাঁদ আসছে।’
পদ্মজা পূর্ণাকে চোখ রাঙিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল, ‘কীসব কথা! উনার বোনরা আছে।’
আমির সেখানে এসেই বোনদের আদেশ করল, ‘লাবণ্য-রানি যা এখান থেকে।’
আমিরের আদেশ শুনে রানি-লাবণ্য খুব বিরক্ত হলো। রানি কাঁদোকাঁদো হয়ে বলল, ‘দাভাই, থাকি না।’
আমির চোখ রাঙিয়ে ধমকের স্বরে বলল, ‘যেতে বলছি যা।’
লাবণ্য বিরক্তিতে, ইস বলে পদ্মজাকে বলল, ‘আয় অন্যখানে যাই।’
‘পদ্মজা থাকুক। তোরা যা।’
আমিরের কথা শুনে বেশি চমকাল পদ্মজা। লাবণ্য ফোঁসফোঁস করতে করতে বলল, ‘কেন? কেন?’
পদ্মজা-পূর্ণা অন্যদিকে ফিরে আছে। আমির দৃষ্টি কঠোর করতেই লাবণ্য-রানি চলে যায়। পূর্ণা চলে যেতে চাইলে পদ্মজা পূর্ণার হাত চেপে ধরে। পূর্ণা পদ্মজার হাত ছাড়িয়ে, ধীরকণ্ঠে বলল, ‘একা থেকে তোমার কালাচাঁদের ভালোবাসা খাও।’
‘ছি।’
পূর্ণা ছুটে চলে গেল। আমির পদ্মজার পাশে এসে দাঁড়াতেই পদ্মজা বলল, ‘বিয়ের আগে গুরুজনদের না জানিয়ে এভাবে একা কথা বলা ঠিক নয়।’
‘কী হবে?’
পদ্মজা কিছুক্ষণ নীরব থেকে বলল, ‘কলঙ্ক লাগবে।’
‘আর কী বাকি আছে?’
‘পরিমাণ না বাড়ানোই ভালো।’
পদ্মজার কথা বলতে একটুও গলা কাঁপেনি। বাড়ির ভেতর চলে আসার জন্য পা বাড়াতেই আমির পদ্মজার এক হাত থাবা দিয়ে ধরে আবার ছেড়ে দিল। পদ্মজা ছিটকে সরে গেল দূরে।
আমির বলল, ‘তুমি সত্যি একটা পদ্ম ফুল, পদ্মবতী। এজন্যই লিখন শাহর মতো সুদর্শন যুবক তোমার প্রেমে পড়েছে।’
দেখা হওয়ার পর এই প্রথম পদ্মজা চোখ তুলে তাকাল। পরপরই চোখের দৃষ্টি সরিয়ে ছুটে বাড়ির ভেতর চলে গেল। আমির অনেকক্ষণ সেখানে দাঁড়িয়ে ছিল।
দেখতে দেখতে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসে। এবার আত্মীয় বিদায়ের পালা। যাওয়ার পূর্বে লাবণ্য একটা কাগজ পদ্মজার হাতে গুঁজে দিয়ে বলল, ‘দাভাই দিছে।’
ঘুমাবার আগে পদ্মজা কাঁপা হাতে কাগজটির ভাঁজটি খুলল। কাগজটিতে যত্ন করে লেখা—
সারা অঙ্গ কলঙ্কে ঝলসে যাক
তুই বন্ধু শুধু আমার থাক।
২১
বাড়ির সব কাজ শেষ করে ক্লান্ত পায়ে হেঁটে ঘরে ঢুকলেন হেমলতা। মোর্শেদ সবেমাত্র শুয়েছেন। হেমলতা বিছানার এক পাশে কাত হয়ে শুয়ে চোখ বন্ধ করলেন।
মোর্শেদ হেমলতার দিকে ফিরে ধীরকণ্ঠে বললেন, ‘ধানের মিলটা পাইয়া যাইতাছি।’ গলা দুর্বল হলেও খুশিতে চোখ চকচক করছে।
হেমলতা মৃদু হেসে বললেন, ‘মাতব্বর কী যৌতুক দিচ্ছেন?’
মোর্শেদ হেসে বললেন, ‘সে কইতে পারো। সে আমারে কী কইছে জানো?’
‘কী?’
‘কইল, শুনো মোর্শেদ…আইচ্ছা আগে হুনো আমি কিন্তু শহুরে ভাষায় কইতে পারুম না। আমি আমার গেরামের ভাষায় কইতাছি।’
মোর্শেদের কথা বলার ভঙ্গি দেখে হেমলতা আওয়াজ করে হাসলেন। বললেন, ‘যেভাবে ইচ্ছে বলো।’
মোর্শেদ খ্যাক করে গলা পরিষ্কার করে বললেন, ‘কইল, হুনো মোর্শেদ, তোমার এই মোড়ল বাড়ি হইতাছে একটা বিল। যে বিলে একটাই পদ্ম ফুল আছে। এই পদ্ম ফুলডার জন্যই এই বিলটা এত সুন্দর। আর আমি সেই পদ্ম ফুলডারে তুইললা নিয়া যাইতাছি। এই বিলে পদ্ম ফুলডার চেয়ে দামি সুন্দর আর কিছু নাই। তাই আমার আর কিছু লাগব না। বিনিময়ে আমি এই খালি বিলডারে ধানের মিল দিয়ে দিলাম। বুঝলা লতা? মাতব্বর মানুষটা সাক্ষাৎ ফেরেশতা। মন দয়ার সাগর।’
হেমলতা ছোটো করে বললেন, ‘হুম।’
পরমুহূর্তেই বললেন, ‘একটা প্রশ্ন করার ছিল।’
মোর্শেদ ভ্রু উঁচিয়ে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকান। হেমলতা উঠে বসে বললেন, ‘লিখনকে মনে আছে? সে কি তোমাকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিল?’
মোর্শেদ লেশমাত্র অবাক হলেন না। দায়সারাভাবে বললেন, ‘এতদিনে জানলা? আমি মনে করছি কবেই জাইন্যা ফালাইছ।’
‘আমি তো আর সবজান্তা নই। আমাকে বলোনি কেন?’
‘বইললা কী হইত? ছেড়ি বিয়া দিতা? আর ছেড়াড়া নায়ক। কত ছেড়ির লগে ঘষাঘষি করে। ছেড়িগুলাও নষ্টা। নষ্টাদের সঙ্গে চলে এই ছেড়ায়।’
মুখ খারাপ করো না। ছেলেটার মধ্যে আমি তেমন কিছু দেখিনি। তুমি আমাকে জানাতে পারতে। নিশ্চিন্তে ছেলেটা সুপাত্র। বর্তমান পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকলে, সে মা-বাবা নিয়ে আসলে আমি ফিরিয়ে দিতাম না। থাক…এসব কথা। এখন বলেও লাভ নেই। পদ্মজার মন স্থির আছে। পরিস্থিতি আর ভাগ্য সেখানে নিয়ে যাচ্ছে সেখানেই গা ভাসিয়ে চলুক। ঘুমাও এখন। ভোরে উঠে গোলাপ ভাইয়ের বাড়িতে যেয়ো। কত কাজ বাকি! বাড়ির বড়ো মেয়ের বিয়ে কী সামান্য কথা!
হেমলতা কথা বলতে বলতে অন্যদিকে ঘুরে শুয়ে পড়েন, ঘুমিয়েও পড়লেন কিছুক্ষণের মাঝে।
.
সকাল থেকে পূর্ণার দেখা নেই। তাকে খুঁজতে খুঁজতে ঘাটে চলে গেল পদ্মজা। পূর্ণা সিঁড়িঘাটে বসে উদাস হয়ে কিছু ভাবছে। পদ্মজা পা টিপে হেঁটে এলো। পূর্ণা তখনো বোনের উপস্থিতি টের পায়নি। পদ্মজা পাশে বসে, তাও পূর্ণা টের পেল না। পদ্মজা ধাক্কা দিতেই, পূর্ণা চমকে তাকাল।
বুকে ফুঁ দিয়ে বলল, ‘ভয় পেয়েছি আপা।’
‘উদাস হয়ে কী ভাবছিস?’
‘কিছু না।’
‘আবার ওইসব ভাবছিস! কতবার না করলে শুনবি বল তো?’
পূর্ণা নতজানু হয়ে রইল। ক্ষণকাল পার হওয়ার পর ভেজা কণ্ঠে বলল, ‘নিজের ইচ্ছায় মনে করে কষ্ট পেতে আমার ইচ্ছে করে না। কিন্তু মনে পড়ে যায়।’
‘চেষ্টা তো করবি। আর ভুলতে হবে এমন তো কোনো কথা নেই 1 অমানুষগুলোও তাদের শাস্তি পেয়েছে। একটু নিজেকে ভালো রাখার চেষ্টা কর।’
পূর্ণা চোখের জল মুছে আগ্রহ নিয়ে বলল, ‘আম্মা তিনজনকে কী করে মারল আপা? আমাদের আম্মা খুনি?’
পূর্ণার মুখ চেপে ধরল পদ্মজা। চারপাশে চোখ বুলিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল, ‘আর কখনো এটা বলবি না।’
‘কিন্তু আমি জানতে চাই, কী করে আম্মা খুন করল?’
‘জানি না।’
‘আম্মাকে জিজ্ঞাসা করবে?’
পদ্মজা ভাবল। এরপর বলল, ‘করব। তবে আজ না অন্য একদিন।’
‘বিয়ে করে তো চলেই যাবে।’
পদ্মজা অভিমানী চোখে তাকাল পূর্ণার দিকে। বলল, ‘আর কী আসব না? ফিরে যাত্রা আছে। আবার কয়দিন পর পর এমনিতেও আসব।’
‘তাহলে কালাচাঁদের সঙ্গে বিয়েটা সত্যিই হচ্ছে?’
‘তুই কী মিথ্যে ভাবছিস?’
পূর্ণা বিরক্তিতে কপাল কুঁচকে ফেলল। বলল, ‘লিখন ভাইয়ের জন্য কষ্ট হচ্ছে।’
লিখন নামটা শুনে পদ্মজা অপ্রতিভ হয়ে উঠল। নিজেকে অপরাধী অপরাধী মনে হচ্ছে। এই অনুভূতির কোনো মানে নেই, সে কোনো অপরাধ করেনি…তবুও ভাবলেই কী যেন হয় ভেতরে!
পদ্মজা প্রসঙ্গ পালটাতে বলল, উনাকে…মানে মাতব্বরের ছেলেকে পছন্দ না তাই কালা বলিস, ঠিক আছে বুঝলাম। কিন্তু চাঁদ কেন বলিস বুঝলাম না!’
পূর্ণা আড়চোখে পদ্মজার দিকে তাকাল। যান্ত্রিক স্বরে জানাল, ‘পাতিলের তলার মতো কালা হয়ে আমার চাঁদের মতো সুন্দর বোনকে বিয়ে করবে বলেই কালাচাঁদ ডাকি। নয়তো কালা পাতিল ডাকতাম। আবার দরদ দেখিয়ে বলো না, উনি তো এত কালা না, শ্যামলা।’ কথা শেষ করে পূর্ণা ঠোঁট বাঁকাল।
পদ্মজা শব্দ করে হাসতে শুরু করল। কিছুতেই তার হাসি থামছে না। পূর্ণা পদ্মজার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থেকে বলল, ‘তুমি খুব কঠিন আপা। খুব ধৈর্য তোমার, ঠিক আম্মার মতো।’
পদ্মজা হাসি থামিয়ে পূর্ণার দিকে তাকাল। সময়টা শুধু দুই বোনের পদ্মজা স্নেহার্দ্র কণ্ঠে শুধাল, ‘আর তুই ঠিক আম্মার বাহ্যিক রূপের জোড়া পৰ্ব।’
প্রান্ত-প্রেমা হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসে নদীর ঘাটে। পদ্মজার উদ্দেশ্যে বলল, ‘বড়ো আপা, দুলাভাই আসছে।’
আমির আসার সংবাদ পেয়েই খিড়কি দিয়ে পদ্মজা নিজের ঘরে চলে গেল। এই লোকটা এত বেহায়া আর নির্লজ্জ! গতকাল নাকি সকাল-বিকাল বাড়ির সামনে ঘুর ঘুর করেছে। আজ একেবারে বাড়িতে! বিয়ের তো আর মাত্র তিন দিন বাকি। এতটুকু সময় নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারল না?
পদ্মজা কপাল চাপড়ে বিড়বিড় করে, ‘এ কার সঙ্গে বিয়ে হচ্ছে আল্লাহ!’ উঠানে হেমলতা ছিলেন। আমির বাড়ির ভেতর ঢুকেই হেমলতার পা ছুঁয়ে সালাম করল। নতজানু হয়ে আন্তরিকতার সঙ্গে বলল, ‘কেমন আছেন আম্মা?’
হেমলতার চক্ষু চড়কগাছ! আমিরের সঙ্গে মগা এসেছে। মগার হাতে মাছের ব্যাগ, মাথায় ঝুড়ি। তাতে মশলাপাতি সঙ্গে শাকসবজি। বিয়ের আগে এত বাজার আবার আম্মা ডাকা হচ্ছে! অপ্রত্যাশিত ব্যাপার স্যাপার! হেমলতা ঢোক গিলে ব্যাপারটা হজম করে নিলেন। ধীরেসুস্থে বললেন, ‘ভালো আছি। তুমি কেমন আছো? বাড়ির সবাই ভালো আছে?’
‘জি, জি। সবাই ভালো।’
আমির মগাকে ইশারা করতেই মগা বারান্দায় মাছের ব্যাগ, মাথার ঝুড়ি রেখে দিল।
হেমলতা ঠোঁটে হাসি ধরে রেখে বললেন, ‘এতসব বিয়ের আগে আনার কী দরকার ছিল? পাগল ছেলে।’
আমির হেসে নতজানু অবস্থায় ইতস্ততভাবে বলল, ‘এমনি।’
‘যাও, ঘরে গিয়ে বসো।’
‘আম্মা…’
হেমলতা চলে যেতে গিয়েও দাঁড়িয়ে পড়লেন। আমির দ্রুত বলল, ‘আম্মা, ক্ষমা করবেন। সন্ধ্যার আগে বাড়ি ফিরতে হবে।’
হেমলতা বুঝতে পারছেন না, ছেলেটা কী চাচ্ছে! তিনি আগ্রহান্বিত হয়ে জানতে চাইলেন, ‘কোনো দরকার ছিল?’
‘আ…আসলে আম্মা। পদ্মজার সঙ্গে একটু কথা ছিল।’
আমির উসখুস করছে। হাত-পা নাড়াচ্ছে এদিক-ওদিক, কিন্তু চোখ মাটিতে স্থির। হেমলতা আমিরকে ভালো করে পরখ করে নিয়ে বললেন, ‘আচ্ছা যাও, পদ্মজা ঘরে আছে নয়তো ঘাটে।’
অনুমতি পেয়ে ব্যস্ত পায়ে হেঁটে ঘরের দিকে চলে গেল আমির। হেমলতা তার যাওয়ার পানে চেয়ে থেকে ভাবছেন, ‘ছেলেটার সঙ্গে এখনও চোখাচোখি হয়নি। সবসময় মাথা নত করে রাখে। কিন্তু কথাবার্তায় তো মনে হচ্ছে, এই ছেলে মোটেও লাজুক নয়, তিনি কিছুক্ষণ ভ্রু কুঁচকে রাখলেন। পরে ভাবলেন: হয়তো গুরুজনদের সামনে মাথা নিচু করে রাখা ছোটোবেলার স্বভাব। ভালো অভ্যাস!
হেমলতা মুচকি হেসে লাহাড়ি ঘরের দিকে এগিয়ে যান।
পদ্মজার ঘরের শেষ প্রান্তে একটি বারান্দা আছে। বারান্দা পেরোলেই বাড়ির পেছনের দরজা। আমির আসছে শুনে ঘর আর বারান্দার মাঝ বরাবর দরজায় পর্দা টানিয়ে দিল পদ্মজা। আমির হন্তদন্ত হয়ে ঘরের দিকে, পর্দার অন্যপাশে দাঁড়াল। পদ্মজা দাঁড়াল বারান্দার দিকে। পর্দার কাপড় পাতলা ও মসৃণ। তাই পদ্মজার অবয়ব স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে আমির। তিরতির করে বাতাস বইছে। সেই বাতাসে পদ্মজার কপালে ছড়িয়ে থাকা চুলগুলো অবাধ্য হয়ে উড়ছে।
আমির ডাকল, ‘পদ্মজা?’
‘হু?’ পদ্মজা লজ্জায় কথা বলতে পারছে না।
‘কেমন আছো?’
‘ভালো। আপনি?’
‘ভালো।’
বেশ কিছুক্ষণ নীরবতা। পদ্মজা বলল, ‘কী বলবেন বলুন।’
সঙ্গে সঙ্গে আমির বলল, ‘মায়াভরা চোখগুলো দেখার সৌভাগ্য কী হবে?’ আমিরের কণ্ঠে আকুতি! তৃষ্ণা! পদ্মজার পীড়া লাগছে। বেহায়া মানুষ বড়োই বিপজ্জনক। সে পালানোর জন্য পা বাড়াতেই আমির হই হই করে উঠল, কসম লাগে পালাবে না।’
পদ্মজা মাথার ওড়না টেনে নিয়ে বলল, ‘প্রয়োজনীয় কথা থাকলে বলে চলে যান।’
‘তাড়িয়ে দিচ্ছো?’
‘ছি, না।’
‘তোমায় না দেখলে আজ আর প্রাণে বাঁচব না। রাতেই ইন্না লিল্লাহ…’
‘রসিকতা করবেন না। কাউকে না দেখে কেউ মরে না।’
‘পদ্মবতীর রূপ যে পুরুষ একবার দেখেছে সে যদি বার বার না দেখার আগ্রহ দেখায় তাহলে সে কোনো জাতেরই পুরুষ না। একবার দেখা দাও। কসম লাগে…’
‘বার বার কসম দিয়ে ঠিক করছেন না।’
‘আচ্ছা, কসম আর কসম দেব না। একবার দেখা দাও।’
পদ্মজার দুই ঠোঁট হাঁ হয়ে গেল। কী বলে মানুষটা! কসম করেই বলছে আর কসম দিবে না। আমির ধৈর্যহারা হয়ে বলল, ‘পদ্মবতী অনুরোধ রাখো…’
‘এভাবে বলবেন না। নিজেকে ছোটো লাগে।’
‘পর্দা সরাব?’
পদ্মজা ঘামছে। বাতাসে অস্বস্তি, নিশ্বাসে অস্বস্তি। তবুও সায় দিল 1 আমির পর্দা সরিয়ে খুব কাছ থেকে পদ্মজাকে দেখতে পেল। কালো রঙের সালোয়ার কামিজ পরেছে। সিঁথির মাঝ অবধি ঘোমটা টেনে রাখা।
পদ্মজা চোখ তুলে তাকাতেই আমির বলল, ‘জীবন ধন্য।’
আমিরের কথা বলার ভঙ্গি দেখে পদ্মজা হাসি সামলাতে পারল না। অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে হাসল। আমির বলল, ‘এ মুখ প্রতিদিন ভোরে দেখব। আর প্রতিদিনই জীবন ধন্য হবে। এমন কপাল কয়জনের হয়!
পদ্মজা কিছু বলল না। আমির আবেগে আপ্লুত হয়ে বলল, আমার ইচ্ছে হচ্ছে তোমার হাতে খুন হয়ে যাই।’
পদ্মজা চমকে উঠল। বিস্মিত কণ্ঠে বলল, ‘আপনি পাগল।’
আমির কণ্ঠ খাদে নামিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল, ‘তোমার উপস্থিতি আমার নিশ্বাসের তীব্রতা কতটা বাড়িয়ে দিয়েছে টের পাচ্ছো?’
পদ্মজা দূরে সরে গেল। মনে মনে বলল, ‘আল্লাহ আমি পাগল হয়ে যাব। এ কার পাল্লায় পড়লাম। জ্ঞানবুদ্ধি, লাজলজ্জা কিছু নেই।’
অথচ মুখে বলল, ‘পেয়েছি। এবার আসি।
আমিরকে কিছু বলতে না দিয়ে পদ্মজা বারান্দা ছাড়ল।
বাড়ির পেছনে মগাকে পেয়ে তার পথ আটকে বলল, ‘মগা ভাই।’
মগা সবগুলো দাঁত বের করে হাসল। বলল, ‘জে, ভাবিজান।’
মগার মুখে ভাবি ডাক শুনে পদ্মজা বিরক্ত হলেও প্রকাশ করল না। বিরক্তি লুকিয়ে বলল, ‘লিখন শাহর কথা আপনি উনাকে বলেছেন?’
‘উনিটা কে?’
‘আপনার আমির ভাই।
‘জে, ভাবিজান।’
মগার অকপট স্বীকারোক্তি! পদ্মজা এ নিয়ে আর কথা বাড়াল না। মগাকে পাশ কেটে চলে গেল। মগা দৌড়ে এসে পদ্মজার পথ রোধ করে দাঁড়ায়, ফিসফিসিয়ে গোপন তথ্য দিল: আগামী দুই দিনের মধ্যে লিখন শাহ আসছে। তার বাবা-মাকে নিয়ে। খবরটা মগা গত সপ্তাহ পেয়েছে।
সংবাদটি পেয়ে পদ্মজার পায়ের নিচ থেকে যেন মাটি সরে গেল। ঢোক গিলে নিজেকে আশ্বস্ত করল: আমি তো কথা দেইনি বিয়ে করার। কখনো চিঠিও দিইনি। লিখন শাহ নিরাশ হলে এটা তার দোষ নয়, লিখন শাহর ভাগ্য। তবুও পদ্মজার খারাপ লাগছে। অপরাধী মনে হচ্ছে নিজেকে।
জীবনে আবার কি নতুন কিছু ঘটতে চলেছে? বুক ধড়ফড় করছে।
ঘাটের সিঁড়িতে ঝিম মেরে বসে রইল পদ্মজা।
২৩
মোড়ল বাড়ির আনাচে-কানাচে আত্মীয়স্বজনদের উচ্চরব। পদ্মজা বিছানার এক কোণে চুপটি করে বসে আছে। ঘরে দুষ্টু রমণী আছে কয়েকজন নিজেদের মধ্যে রসিকতা করছে, উচ্চস্বরে হাসছে। অথচ এরাই বিপদের সময় পাশে ছিল না। ভীষণ গরম পড়েছে। পদ্মজার পরনে সুতার কাজ করা সুতি শাড়ি। গরমে শুধু ঘামছে না, বমিও পাচ্ছে। প্রেমা পদ্মজার পাশে বসে ছিল।
প্রেমাকে ফিসফিসিয়ে বলল পদ্মজা, ‘এই বনু? আম্মাকে গিয়ে বলবি লেবুর শরবত দিতে?’
প্রেমা মাথা নাড়িয়ে চলে গেল শরবত আনতে। হেমলতা রান্নাঘরে ছিলেন। প্রেমা লেবুর শরবতের কথা বললে তিনি বললেন, ‘তুই যা আমি নিয়ে যাচ্ছি।’
লেবু গাছ থেকে সবেমাত্র ছিঁড়ে আনা পাকা লেবুর শরবত বানিয়ে পদ্মজার ঘরের দিকে গেলেন তিনি। গিয়ে দেখেন, পদ্মজা বিছানার এক পাশে গুটিসুটি মেরে বসে আছে। ছটফট করছে।
ঘরভরতি অনেক মানুষ। তিনি সবার উদ্দেশ্যে বললেন, ‘সবাই অন্য ঘরে যাও। পদ্মজাকে একা ছাড়ো।’
হেমলতার এমন আদেশে অনেকের রাগ হলেও চুপচাপ বেরিয়ে গেল। তিনি দরজা বন্ধ করে শরবতের গ্লাস পদ্মজার হাতে তুলে দিয়ে বললেন, ‘সবসময় মুখ বন্ধ রাখা ভালো না। যারা বিপদে পাশে থাকে না, তাদের জন্য বিন্দুমাত্র অসুবিধার মুখোমুখি হবি না। গরমে তো শেষ হয়ে যাচ্ছিস। জানালার পাশটাও অন্যরা ভরাট করে রেখেছিল। ভালো করেই সরতে বলতি।’
পদ্মজা মায়ের কথার জবাব না দিয়ে এক নিশ্বাসে লেবুর শরবত শেষ করল। এবার একটু আরাম লাগছে। আলনার কাপড়গুলো অগোছালো। সকালেই তো ঠিক ছিল। নিশ্চয় মেয়েগুলোর কাজ। হেমলতা আলনার কাপড় ঠিক করতে করতে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কী নিয়ে এত চিন্তা করছিস?’
পদ্মজা কিছু না বলে বিছানায় আঙুল দিয়ে আঁকিবুকি করতে থাকল। পদ্মজার অস্বাভাবিকতা দেখে হেমলতা চিন্তায় পড়ে যান, ‘বলবি তো?’ পদ্মজা বিচলিত হয়ে বলল, ‘আম্মা উনি বোধহয় আজ আসবেন।’
‘উনি? উনি কে? আমির?’
না আম্মা। লিখন শাহ যে, উনি।’
হেমলতা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, ‘কপালে যা আছে তাই তো হবে। ভাবিস না। আমি আছি, সব সামলে নেব। লিখনকে আমি বুঝাব।’
হেমলতার কথা শেষ হতেই পদ্মজা ভেজা কণ্ঠে বলল, উনি খুব কষ্ট পাবেন আম্মা।’
হেমলতা অবাক হয়ে তাকালেন পদ্মজার দিকে। পদ্মজা এত ব্যাকুল কেন হচ্ছে? তিনি কী পদ্মজার অনুভূতি চিনতে ভুল করেছেন? নাকি শুধুমাত্র কারো মন ভাঙবে ভেবে পদ্মজার এত ব্যাকুলতা? হেমলতা দোটানায় পড়ে গেলেন। পদ্মজার জীবনে এ কেমন টানাপোড়নের আবির্ভাব হলো! এই মুহূর্তে পদ্মজাকে বুঝতে তিনি হিমশিম খাচ্ছেন। ওদিকে হানি ডাকছে। হেমলতার বড়ো বোন হানি, গতকাল ঢাকা থেকে ছেলেমেয়ে নিয়ে গ্রামে এসেছে। হেমলতা দরজার দিকে পা বাড়ানোর আগে বলে গেলেন, আমার নোংরা অতীত আজ তোকে শুনাব। বাকি সিদ্ধান্ত তোর। যা চাইবি তাই হবে। মনে রাখিস, যা চাইবি তাই পাবি।’
পদ্মজা কিছু বলার পূর্বেই হেমলতা চলে গেলেন। পদ্মজার বুকের ভেতর অপ্রতিরোধ্য তুফান শুরু হয়। মায়ের অতীত জানার জন্য কত অপেক্ষা করেছে সে। আজ যখন সেই সুযোগ এলো…তার ভয় হচ্ছে খুব। কেন হচ্ছে জানে না; কিন্তু হচ্ছে। হাত-পায়ের রগে রগে শিরশিরে অনুভূতি ছড়িয়ে যাচ্ছে।
.
ভ্যানগাড়িতে চড়ে অলন্দপুরের আটপাড়ায় ঢুকল লিখন শাহ। সঙ্গে বাবা-মা এবং বোন। বাবা শব্দর আলী, মা ফাতিমা বেগম এবং বোন লিলি।
শব্দর আলী চশমার গ্লাস দিয়ে গ্রামের খেত দেখছেন আর বার বার বলছেন, ‘এই তো আমার দেশ। এই তো আমার বাংলাদেশ।’
ফাতিমা ভীষণ বিরক্ত ভ্যানে চড়ে। উনার ইচ্ছে ছিল কোনো মন্ত্রীর মেয়েকে ঘরের বউ করে আনবেন। অথচ পুত্রের নাকি পাত্রী পছন্দ হয়েছে গ্রামে। লিখনের জেদের কাছে হেরে গ্রামে আসতেই হলো।
লিখনের পরনে ছাইরঙা শার্ট। চোখে সানগ্লাস। উত্তেজনায় রীতিমতো তার হাত-পা কাঁপছে। এমন একটা দিন নেই, যেদিন পদ্মজার কথা ভেবে শুরু হয়নি। এমন একটা রাত নেই, যে রাতে পদ্মজাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখা হয়নি। সময়ের ব্যবধানে পদ্মজাকে খুব বেশি ভালোবেসে ফেলেছে সে। প্রায়ই স্বপ্নে দেখে, পদ্মজা গৃহবধূর মতো তার ঘরে কোমরে আঁচল গুঁজে কাজ করছে।
কখনো বা অপরূপ সুন্দরী পদ্মজাকে ঘুমের ঘোরে ঠিক বিছানার পাশেই দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে। কল্পনার পদ্মজাকে নিয়ে সে সংসার পেতেছে। এবার হয়তো সত্যিই সেই সংসার হতে চলেছে। লিখন আনমনে হেসে উঠল। মনে
পড়ে যায় পদ্মজাকে প্রথম দেখার কথা। সঙ্গে সঙ্গে বুকের মধ্যে অদ্ভুত ঝড় শুরু হয়। কী মায়াবী, কী স্নিগ্ধ একটা মুখ! তার চেয়েও সুন্দর পদ্মজার ভয় পাওয়া, লজ্জায় পালানোর চেষ্টা করা, পরপুরুষের ভয়ে আতঙ্কে থাকা। লিখন আওয়াজ করে হেসে উঠল। ফাতিমা আর শব্দর অবাক হয়ে ছেলের দিকে তাকালেন। লিলির এসবে খেয়াল নেই। সে আকাশের দিকে তাকিয়ে কী যেন ভাবছে। লিখন মা-বাবাকে এভাবে থাকাতে দেখে খুক খুক করে কাশল। বলল, ‘সুন্দর না গ্রামটা? বুঝছো আব্বু, এই গ্রামটা এত সুন্দর যে আগামী বছর আবার আরেকটা সিনেমার জন্য এখানে আসতে হবে।’
শব্দর আলী প্রবল আনন্দের সঙ্গে বললেন, ‘সে ঠিক বলেছিস। মন জুড়িয়ে যাচ্ছে দেখে। চারিদিকে গাছপালা-নদী, পথঘাটও খুব সুন্দর, সাজানো। এখানে একটা বাড়ি বানালে কেমন হয়?’
লিখন গোপনে দীর্ঘশ্বাস লুকাল। তার বাবা যখন যেখানে যান, তখন সেখানেই বাড়ি বানানোর স্বপ্ন দেখেন। কখনোই বানানো হয় না। ফাতিমা বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘তা আমরা উঠছি কার বাড়ি? তোর পছন্দ করা মেয়ের বাড়ি নাকি অন্য কোথাও?’
মায়ের চোখেমুখে বিরক্তি দেখে লিখনের হাসি পেল। বলল, ‘তোমাকে রাগলে এত ভালো লাগে আম্মু।’
ফাতিমা আড়চোখে ছেলের দিকে তাকান। প্রশংসা শুনতে তিনি বেশ পছন্দ করেন। লিখনের মুখে প্রশংসা শুনে একটু নিভলেন, ‘হয়েছে, আর কতক্ষণ?’
‘পাঁচ মিনিট। অলন্দপুরের মাতব্বর বড়ো মনের মানুষ। আমাকে নিজের সন্তানের দৃষ্টিতে দেখেন। যতদিন ছিলাম প্রতিদিন খোঁজ নিয়েছেন। নিজের একজন লোককে আমার সহায়ক হিসেবেও দিয়েছিলেন! উনার বাড়িতেই উঠব।’
লিলি চোখ-মুখ বিকৃত করে বলল, ‘অন্যের বাড়িতে উঠব! উফ।’
‘মারব ধরে। অন্যের বাড়ি তোর কাছে, আমার কাছে না। মজিদ চাচার বউ ফরিনা চাচি এত ভালো রাঁধেন! আমাকে নিজের হাতে বেশ কয়েকবার খাইয়ে দিয়েছেন। উনার একটাই ছেলে। ঢাকায় ব্যাবসা সামলাচ্ছে। তার সঙ্গে অবশ্য সাক্ষাৎ হয়নি। কিন্তু ফরিনা চাচি সারাক্ষণ ছেলে-ছেলে করতেন। আমাকে পেয়ে ছেলের সব ভালোবাসা ঢেলে দিয়েছিলেন। তাই ওই বাড়ি আমার কাছে আপন না লাগুক, পরও লাগে না। আর বিশাল বাড়ি। উনারা বিব্রত হবেন না। তিন-চার দিনেরই তো ব্যাপার।’
লিখনের এত বড়ো বক্তব্যের পার লিলি আর কিছু বলার মতো পেল না।
হাওলাদার বাড়ির সামনে এসে ভ্যান থামল। বাড়ির চারপাশ সাজানো দেখে বেশ অবাক হলো লিখন। লিলি চারপাশ দেখতে দেখতে বলল, ‘দাদাভাই, তুমি যে বিয়ে করতে এসেছো—এই খবর উনারা বোধহয় পেয়েছেন। তাই আগে থেকেই এত আয়োজন।’
লিখন লিলির মাথায় গাঁট্টা মেরে বলল, ‘বাড়িতে দুটো মেয়ে আছে। তাদের কারো বিয়ে হবে হয়তো। চল।’
ইটের বড়ো প্রাচীর চারদিকে। মাঝে বড়ো গেট। প্রাচীরের উচ্চতা ১৫ ফুট, আর গেটের বারো। পাশেই দুজন দাঁড়িয়ে ছিল, তারা লিখনকে চিনে। তাই বাড়ির ভেতর ঢুকতে দিল।
গেট পার হলেই খোলা জায়গা, প্রচুর গাছপালা। বেশ অনেকগুলো সুপারি গাছ এবং তালগাছ। সবকিছু সুন্দর! দুই মিনিট হাঁটার পর রং করা টিনের একটা বড়ো ঘর। তার সামনে সিঁড়ি। সিঁড়ির দুই পাশে সিমেন্টের তৈরি বসার বেঞ্চি। এই ঘরটাকে গ্রামে আলগ ঘর বলা হয়, কেউ কেউ আলগা ঘর বলে থাকে। অতিথিরা এসে বিশ্রাম নেয়, রাত্রিযাপন করে। ভেতরে ইট সিমেন্টের তৈরি দুতালা অন্দরমহল। আলগ ঘরের বারান্দায় বসে ছিলেন মজিদ মাতব্বর, ফরিনা ও রিদওয়ান। লিখনকে দূর থেকে দেখতে পেয়ে উনারা অবাক হোন, সেই সঙ্গে খুশিও। শহরের চারজন মানুষ হেঁটে আসছে। সর্বাঙ্গে আধুনিকতার ছোঁয়া। দেখতেও ভালো লাগে। লিখন বারান্দায় পা রাখতেই মজিদ মাতব্বর হেসে বললেন, ‘আজকের দিনটা সত্যি খুব সুন্দর।’
লিখন হেসে ফরিনা এবং মজিদ মাতব্বরকে সালাম করে বলল, ‘এই হচ্ছেন আমার বাবা-মা আর বোন। আর আম্মু-আব্বু…উনি হচ্ছেন মজিদ চাচা। আর ইনি ফরিনা চাচি। আর ওই যে বড়ো বড়ো গোঁফদাড়ি, উনি হচ্ছেন রিদওয়ান ভাইয়া। এই বাড়িরই আরেক ছেলে।’
মজিদ মাতব্বর একজনকে ডেকে বললেন চেয়ার দিয়ে যেতে আর অন্দরমহলে খবর পাঠাতে মেহমান এসেছে। তাৎক্ষণিক চেয়ার ও ঠান্ডা শরবত চলে এলো। পরিচিয় পর্ব শেষ হতেই লিখন প্রশ্ন করল, ‘বাড়িতে কোনো অনুষ্ঠান চলছে নাকি?’
‘সে চলছে। আমার ছেলেটার বিয়ে। একমাত্র ছেলে।’
লিখন হাসল। চোখ পড়ে আলগ ঘরের ডান পাশে। কয়েকটা মেয়ে উঁকি দিয়ে তাকে দেখছে। লিখন আনমনে হেসে উঠল। কোনো মেয়ে যখন তাকে দেখে খুব তৃপ্তিদায়ক অনুভূতি হয়। নায়ক কী এমনি এমনি হওয়া! শব্দর আলী জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তাই নাকি? তাহলে তো ঠিক সময়েই এসেছি। আমরাও আমাদের একমাত্র ছেলের বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এই গ্রামে এসেছি।’
মজিদ মাতব্বর আগ্রহ নিয়ে জানতে চাইলেন, ‘মেয়ে কে? কার মেয়ে? আমাকে বলুন। এখনি বিয়ে করতে চাইলে এখনি হবে।’
শব্দর আলী লিখনকে প্রশ্ন করলেন, ‘মেয়ের পরিচয় বল।’
লিখন কথা বলার পূর্বেই ফরিনা গেটের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে উঠলেন, ‘এই তো আমার ছেড়ায় আইয়া পড়ছে। আমির এইহানে আয়। দেইখা যা কারা আইছে।’
ফরিনার দৃষ্টি অনুসরণ করে সবাই পেছনে তাকাল। আমির চুল ঠিক করতে করতে এগিয়ে আসছে। হাঁটার গতিতে বোঝা যাচ্ছে, বেশ চঞ্চল একটা ছেলে। আমির ঘেমে একাকার। কয়েক ফুটের দূরত্ব থাকা অবস্থায় লিখনকে দেখেই সে চিনে ফেলল। মগার কাছে লিখনের বর্ণনা শুনেছে। এছাড়া লিখন একজন নামকরা অভিনেতা। তার অভিনীত ছায়াছবি সে দেখেছে। হাঁটার গতি কমিয়ে দিল আমির। কাছে এলে লিখন উঠে দাঁড়াল। হেসে আমিরের সঙ্গে করমর্দন করে বলল, ‘আমি লিখন শাহ।’
আমির বলল, ‘আমির হাওলাদার। বসুন আপনি।’
লিখন পূর্বের চেয়ারে বসে। আমির তার থেকে একটু দূরত্ব রেখে দূরে বসল। মজিদ মাতব্বর আমিরকে লক্ষ্য করে বললেন, ‘কোথায় থাকিস সারাদিন? বলেছিলাম না, লিখন শাহ এসেছিল? এই যে ইনি।’
আমির শুষ্কমুখে বলল, ‘চিনি আমি। উনার অনেক কাজ আমার দেখা।’
শব্দর আলী, ফাতিমা, লিলি, লিখন সবাই একসঙ্গে মৃদু হাসল। কেউ চেনে বললে আনন্দ হবারই কথা। রিদওয়ান আমিরকে বলল, ‘লিখনও বিয়ে করতে এসেছে।’
আমির কিছু বলল না। ফরিনা জানতে চাইলেন, ‘পাত্রী কে? কইলা না তো?’
লিখন বুক ভরা ভালোবাসা নিয়ে বলল, ‘পদ্মজা। মোড়ল বাড়ির বড়ো মেয়ে।’
লিখনের কথা শুনে মুহূর্তে হাওলাদার বাড়ির সব মানুষের মুখ কালো হয়ে গেল। থেমে গেল আলগ ঘরের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েগুলির কোলাহল; চারিদিক স্তব্ধ, শান্ত। লিখন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়। কী হলো সবার! লিখন মা-বাবার সঙ্গে দৃষ্টি বিনিময় করল। মজিদ মাতব্বর শান্ত কণ্ঠে প্রশ্ন করলেন, ‘তার সঙ্গে তোমার বিয়ে হওয়ার কথা ছিল?’
মজিদ মাতব্বরের কথা বলার ধরন পালটে যাওয়াতে লিখন আহত হয়, ‘না। আজ প্রস্তাব নিয়ে যাব।’
মজিদ দৃঢ়তার সঙ্গে বললেন, ‘পরশু আমির-পদ্মজার বিয়ে।’
লিখন চকিতে চোখ তুলে তাকাল। বুক পোড়ার মতো অসহনীয় যন্ত্রণা কামড়ে ধরে তার সর্বাঙ্গে। হাড়ে হাড়ে বরফের ন্যায় ঠান্ডা কিছু ছুটতে শুরু করে দিয়েছে…
…যেন এখুনি সব রগ ছিঁড়ে রক্ত বেরিয়ে আসবে।
২৪
ফাতিমা কাতর চোখে লিখনের দিকে তাকালেন। চোখে চোখ পড়তেই লিখন হাসার চেষ্টা করল। তার দৃষ্টি এলোমেলো। কী বলবে খুঁজে পাচ্ছে না। আমির চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। ‘আব্বা আসছি,’ বলে জায়গা ত্যাগ করল। শব্দর আলী হতভম্ব হয়ে গেছেন।
তিনি মজিদ মাতব্বরকে প্রশ্ন করলেন, ‘মজা করছেন?’
মজিদ মাতব্বর শব্দর আলীর চোখে চোখ রেখে জবাব দিলেন, ‘প্রথম পরিচয়ে মজা করার মতো মানুষ আমি না ভাইসাহেব।’
লিলি এক হাত লিখনের পিঠের ওপর রেখে ডাকল, ‘ভাইয়া।
লিখন লিলির হাতটা মুঠোয় নিয়ে ঢোক গিলল। বলল, ‘বিয়ে হবে না তো কী? বলেছি যখন দেখাবোই।’
‘ভাইয়া তোর চোখে জল,’ লিলির গলা ভেঙে আসছে।
লিখন দ্রুত হাতের উলটোপাশ দিয়ে চোখের জল মুছল। পরিবেশ থম মেরে গেছে। কেউ কিছু বলার মতো খুঁজে পাচ্ছে না। লিলি অবাক চোখে তাকিয়ে আছে তার ভাইয়ের দিকে। পদ্মজা নামের মেয়েটাকে নিয়ে কত গল্প শুনেছে সে। মেয়েটা তার বয়সি শুনে লিলি খুব হেসেছিল। তার ভাইয়া এত ছোটো মেয়ের প্রেমে পড়েছে! দিনগুলো কত যে সুন্দর ছিল! মেট্রিক পরীক্ষার সময় বার বার খোঁজ নিয়েছে কবে শেষ হবে পরীক্ষা। যেদিন শেষ হলো সেদিন থেকেই শুটিং শুরু হলো। কথা ছিল এক সপ্তাহ পর থেকে শুরু হবে। কিছু জরুরি কারণে আগে শুরু হয়ে গেল। তাই আসতে কয়েকদিন দেরি হয়েছে।
মজিদ মাতব্বর স্তব্ধতা কাটিয়ে বললেন, ‘বিয়েটা একটা দুর্ঘটনার জন্য খুব দ্রুত ঠিক হয়েছে।’
লিখন উৎসুক হয়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘কী দুর্ঘটনা?’
ফরিনা সন্দিহান গলায় বললেন, ‘তার আগে তুমি কও তো, পদ্মজার লগে কী তোমার প্রেম-ট্ৰেম আছিল?’
লিখন ফরিনার প্রশ্নে বিব্রতবোধ করল। ধীরকণ্ঠে জবাব দিল, ‘না। শুধু আমার পক্ষ থেকেই।’
লিখনের উত্তরে ফরিনা সন্তুষ্ট হলেন। শব্দর আলী কী দুর্ঘটনা ঘটেছিল জানতে চাইলেন। মজিদ মাতব্বর সময় নিয়ে ধীরে ধীরে সব বললেন। সব শুনে লিখন আশার আলো দেখতে পায়। ভাবে, এরকম একটা ঘটনা ঘটেছে বলে অন্য কেউ বিয়ে করবে না—এমনটা ভেবেই হয়তো পদ্মজার বিয়ে দিয়ে দেওয়া হচ্ছে। সে যদি এখনি পদ্মজাকে বিয়ে করতে রাজি থাকে, তাহলে তাকে ফিরিয়ে না-ও দেওয়া হতে পারে। আর পদ্মজা কী বিন্দুমাত্র ভালোবাসে না তাকে? বাসে, নিশ্চয় বাসে। লিখন নিজেকে নিজে সান্ত্বনা দেয়।
শব্দর আলী আফসোস নিয়ে বললেন, ‘কী আর করার! পরিস্থিতি এখন হাতের বাইরে।’
‘আপনারা কিন্তু বিয়ে শেষ করে তবেই যাবেন,’ বললেন মজিদ মাতব্বর।
ফাতিমা মতামত জানালেন দৃঢ়ভাবে, ‘না, না আজই চলে যাব। এই গ্রামে আর এক মুহূর্ত না। ‘
শব্দর আলী মৃদু করে ধমকালেন, ‘কী বলছ? কিছুক্ষণ পর সন্ধ্যা। এখন ট্রেন পাবে কোথায়? কাল ভোরে নাহয় চলে যাব।’
রিদওয়ান অনুরোধ করে বলল, ‘বিয়েটা শেষ হওয়া অবধি থেকে যান। দেখুন, মেহমান হয়ে এসেই অপ্রত্যাশিত খবর শুনলেন। এজন্য খারাপ লাগছে। কিন্তু কিছু তো করার নেই। মেয়েটা জলে ভাসবে বিয়েটা না হলে।
লিখন সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ করে বলল, ‘পদ্মজাকে ফেলনা ভাবছেন কেন? কেউ অপবাদ দিলেই কী সে পঁচে যায়?’
রিদওয়ান কিছু বলতে গেলে মজিদ মাতব্বর কড়া চোখে তাকিয়ে থামতে ইশারা করেন। কাজের মেয়েকে ডেকে বললেন, ‘উনাদের ঘরে নিয়ে যাও। আর আপনারা না করবেন না। আমি আপনাদের অবস্থা বুঝতে পারছি। বিয়ে অবধি না থাকুন, রাতটা থেকে যান।’
বাধ্য হয়ে ফাতিমা থাকতে রাজি হলেন। তিনি রাগে ফোঁসফোঁস করছেন। সব রাগ হাওলাদার বাড়ির ওপর। মনে মনে এই বাড়ির বিনাশ চাইছেন তিনি। মেয়েটাকে তুলে নিয়ে যেতে ইচ্ছে হচ্ছে। লিখন তার চোখের মণি। নয়তো কী গ্রামের মেয়ে নিতে আসতেন! আর সেই ছেলের মন এভাবে ভাঙল! ঘরে ঢুকেই বিছানায় চোখের চশমা ছুঁড়ে ফেলেন। কটমট করে শব্দর আলীকে বললেন, ‘তোমার না এক বন্ধু আছে মেজর? তাকে কল করে বলো মেয়েটাকে তুলে এনে লিখনের সঙ্গে বিয়ে দিতে। আমার ছেলেকে হারতে দেখতে পারব না।’
‘আহ! চুপ করো তো। সব জায়গায় ক্ষমতা চলে না। পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করো।
‘কীসের পরিস্থিতি? তুমি জানো, তোমার ছেলের ব্যক্তিগত ডায়রিতে আগে শুধু আমার নাম ছিল। সেখানে এখন বেশি পদ্মজা নামটা লেখা। কতটা পাগল এই মেয়ের জন্য। এখন মেয়েটাকে ছেড়ে শহরে চলে গেলে,
চলে গেলে, ছেলের দেবদাস রূপ দেখতে হবে। আর আমি তা পারব না।’
শব্দর আলী পায়ের মোজা খুলতে খুলতে অসন্তুষ্টি নিয়ে বললেন, ‘তোমার যা ইচ্ছে করো। আমি পারব না। ক্লান্ত আমি। শান্তি দাও।’
ফাতিমা কড়া কিছু কথা বলতে গিয়েও থেমে গেলেন। লিলি ঘরে ঢুকেছে। লিখন আসেনি। আমেনা লিলিকে বললেন, ‘লিখন কোথায়?’
‘কী জানি! ভাইয়া ব্যাগটা আমার হাতে দিয়ে বেরিয়ে গেল।’
.
রোদের কঠিন রূপ শীতল হয়ে এসেছে। মৃদু বাতাস বইছে। তবুও লিখন ঘামছে। পদ্মজার বাড়ির দিকে যাচ্ছে সে। আতঙ্কে তার ঠোঁট শুকিয়ে কাঠ। মাথায় শুধু কয়টা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে, ‘আমি কী পাগলামি করছি? এত আয়োজন ভেঙে ওর বাবা-মা কী আমার হাতে তুলে দিবে পদ্মজাকে? পদ্মজা আমাকে দেখলে কী কাঁদবে? ও কী আমাকে একটুও ভালোবাসেনি? মায়া নিশ্চয় জমেছে?’
লিখন আকাশের দিকে তাকিয়ে মনে মনে আল্লাহর কাছে অনুরোধ করে, ‘আল্লাহ, সব যেন ভালো হয়
পূর্ণা বারান্দায় চেয়ার নিয়ে বসে আছে। বয়স্ক কিছু মহিলা বাড়ির পেছনে গীত গাইছে। সঙ্গে তাল মিলিয়ে নাচছে দুই বুড়িসহ ছোটো ছোটো ছেলেমেয়েরা। পুরো বাড়ি সাজানো হচ্ছে রঙিন কাগজ দিয়ে। উঠানের এক কোণে একটি লাল বড়ো গরু বাঁধা, বিয়ে উপলক্ষে জবাই করা হবে। চারিদিকের এত আনন্দ পূর্ণার মন ছুঁতে পারছে না। প্রথমত, সে স মানসিকভাবে বিপর্যস্ত! কিছুতেই স্থির হতে পারছে না। দ্বিতীয়ত, পদ্মজার জন্য লিখন শাহ ছাড়া অন্য কাউকে তার পছন্দ হচ্ছে না। সব মিলিয়ে সে উদাসীন। চোখ ছোটো করে বাচ্চাদের খেলা দেখছে। হুট করে চোখের তারায় ভেসে উঠে লিখন শাহ। পূর্ণা দ্রুত চোখ কচলে আবার তাকাল। সত্যি তাই! খুশিতে আত্মহারা হয়ে পড়ল সে, হন্তদন্ত হয়ে ছুটে গেল পদ্মজার ঘরে। পদ্মজার কানে কানে গিয়ে বলল, ‘লিখন ভাই এসেছে। তুমি কিন্তু পালিয়ে যাবে আপা। এই বিয়ে কিছুতেই করবে না।’
কথা শেষ করে খুশিতে আবার ছুটে গেল বারান্দায়। এমন দিনে লিখনের উপস্থিতি পদ্মজাকে অপ্রস্তুত করে তুলল। গলা শুকিয়ে দম বন্ধ হওয়ার উপক্রম।
লিখন বাড়িতে ঢুকে হয়ে সব দেখে। কত আয়োজন! কত মানুষ! তার স্বপ্নের রানি পদ্মজার বিয়ে। কিন্তু তার সঙ্গে না! ভাবতেই লিখনের বুক ছ্যাঁত করে উঠল। মেয়েরা খুব আগ্রহ নিয়ে সুদর্শন লিখনকে দেখছে। লিখন পূর্ণাকে বারান্দায় দেখে এগিয়ে এসে প্রশ্ন করল, ‘কেমন আছো-পূর্ণা?’
পূর্ণা খুশিতে উচ্চকণ্ঠে জবাব দেয়, ভালো, খুব ভালো। ভাইয়া আপনি…’
পূর্ণা থেমে গেল। অনেকে তার উচ্চ গলার স্বর শুনে তাকিয়ে আছে, তাই চুপসে গেল। আস্তে আস্তে বলল, ‘এত দেরিতে আসলেন কেন? আপার তো বিয়ে। আপনি আপাকে নিয়ে পালিয়ে যান।’
পূর্ণার এমন কথায় লিখন হাসল। আদুরে কণ্ঠে জানতে চাইল, ‘আন্টি কোথায়?’
পূর্ণা ঝটপট করে বলল, ‘আপনি আসুন ঘরে। আমি আম্মাকে নিয়ে আসছি।’
লিখনকে সদর ঘরে বসিয়ে পূর্ণা ছুটে গেল রান্নাঘরে। হেমলতা রান্না করছিলেন। পাশে অনেকে আছে। পূর্ণা ইশারায় বাইরে আসতে বললে, হেমলতা তাই করলেন। পূর্ণা ফিসফিসিয়ে জানাল, ‘লিখন ভাই এসেছে।’
‘কোথায়? বসতে দিয়েছিস?’
‘হ্যাঁ, দিয়েছি। তুমি আসো।’
হেমলতা ব্যস্ত পায়ে হেঁটে সদর ঘরে যান। এসে দেখেন দুজন বয়স্ক মহিলা অনবরত লিখনকে প্রশ্ন করে যাচ্ছে: সে কোত্থেকে এসেছে? এই বাড়ির কী হয়? পদ্মজার মতো চোখ কেন? পদ্মজার আসল বাপের ছেলে নাকি। এমন আরো যুক্তিহীন কথাবার্তা। হেমলতা সবাইকে উপেক্ষা করে লিখনকে বললেন, ‘লিখন, তুমি আমার ঘরে এসো।’
লিখন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। হেমলতার পিছু পিছু চলে গেল, তা অনেকের নজরেই পড়ল। একজন আরেকজনের সঙ্গে আলোচনা করতে থাকল লিখন শাহকে নিয়ে। সবাই ভেবে নিয়েছে—পদ্মজা যার সন্তান, এই ছেলেও তার সন্তান। এজন্যই সবার মাঝ থেকে তুলে নিয়েছে হেমলতা, নয়তো কথায় কথায় ধরা পড়ে যাবে।
লিখনকে মোড়ায় বসতে দিলেন হেমলতা। লিখন কীভাবে কী শুরু করবে বুঝে উঠতে পারছে না। হেমলতা শুরু করলেন, ‘আমি জানি তুমি কী বলবে। তোমার দুটো চিঠি আমি পড়েছি।’
লিখন লজ্জা পেল। তবে স্বাভাবিক হয়ে গেল পরক্ষণেই। হেমলতা বললেন, ‘দেখো লিখন পরিস্থিতি আর হাতে নেই। অন্য সময় হলে আমি পদ্মজাকে তোমার হাতে তুলে দিতাম। তুমি নম্র-ভদ্র বুদ্ধিমান ছেলে। কমতি নেই কিছুতেই। কিন্তু এখন তা সম্ভব নয়। তবুও পদ্মজা তোমাকে নিজের মুখে যদি চায়, আমি তাৎক্ষণিক তাকে তোমার হাতে তুলে দেব। কিন্তু সে চাইবে না। কারণ, সে তোমাকে ভালোবাসে না। আমার কথাগুলো শুনে কষ্ট পেয়ো না। আমি সরাসরি কথা বলি। পদ্মজার দৃষ্টি, অনুভূতি আমার চেনা। সে তোমাকে ভালোবাসেনি কখনো। শুধু তোমার মন ভাঙবে ভেবে মায়া হচ্ছে, কষ্ট পাচ্ছে। তুমি বাড়ি ফিরে যাও। কষ্ট হবে ভেবেই বলছি, ফিরে যাও।’
লিখন কয়েক সেকেন্ড চুপ রইল। তার চোখের দৃষ্টি রাখা মাটিতে। তারপর বলল, ‘আন্টি মেয়ের ভালোবাসা দেখছেন, অন্যের সন্তানেরটা দেখবেন না?’
‘অন্যের অনেক সন্তানই আমার মেয়েকে ভালোবাসে। সবার কথা ভাবা কী সম্ভব?’
হেমলতার কথায় ভীষণ আহত হয় লিখন। তার মনে হচ্ছে সে কঠিন পাথরের সঙ্গে কথা বলছে। দুই চোখ জ্বলছে ভীষণ। এখনি কান্নারা ঠেলেঠুলে বেরিয়ে আসবে। ছেলে হয়ে কাঁদা ভীষণ লজ্জার ব্যাপার। লিখন নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করল। হেমলতা কঠিন স্বরে বললেন, ‘তুমি পদ্মজার রূপের প্রেমে পড়েছো।’
লিখন সঙ্গে সঙ্গে চোখ তুলে তাকাল। বলল, ‘আন্টি ক্ষমা করবেন কিছু কথা বলি। পৃথিবীতে যে কয়টা সফল প্রেমের গল্প আছে তার মধ্যে নিরানব্বই ভাগ সৌন্দর্যের টানেই শুরু হয়। এরপর আস্তে আস্তে ভালোবাসা গভীর হয়। মানুষটাকে নিয়ে ভাবতে গিয়ে, স্বপ্ন দেখতে গিয়ে ভালোবাসাটা আকাশ ছুঁয়ে ফেলে। সময়ের ব্যবধানে সে মানুষটা শিরা-উপশিরায় বিরাজ করতে শুরু করে। তখন তার অন্যান্য গুণ চোখে ভাসে। ভালোবাসা আরো বাড়ে। কারো কারো তো দোষও ভালো লেগে যায়। অবস্থা এরকম হয় যে, রূপ নষ্ট হয়ে গেলেও মানুষটাকে আমার চাই। এজন্যই বুড়ো বয়সেও কুঁচকে যাওয়া মানুষটাকেও ভালোবাসতে ইচ্ছে করে। অথচ শুরুটা হয় সৌন্দর্য দিয়ে। আন্টি, আমি পদ্মজার রূপে মুগ্ধ হয়ে ছিলাম এটা সত্যি। কিন্তু গত কয়েক মাসে সারাক্ষণ পদ্মজাকে ভাবতে গিয়ে আমি সত্যি সত্যি পদ্মজাকে ভালোবেসে ফেলেছি। পদ্মজার রূপ আগুনে ঝলসে গেলেও এমন করেই বাসব। প্লিজ আন্টি, কথাগুলো শুটিংয়ের ডায়লগ ভেবে উড়িয়ে দিবেন না। বাস্তব জীবনে মুখস্থ ডায়লগ আমি আওড়াই না।’
লিখনের কণ্ঠ গম্ভীর, অথচ চোখে জল ছলছল করছে। হেমলতা স্তব্ধ হয়ে যান। এখন কী জবাব দিবেন? ভালোবাসার বিরুদ্ধে কোন শক্তি কাজে আসে? আদৌ কি ভালোবাসার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা যায়? তিনি সময় নিয়ে বললেন, ‘আমার পদ্মজা তোমার কাছে খুব ভালো থাকত লিখন। কিন্তু সমাজের কিছু সীমা আছে, যার মুখোমুখি আমি হয়েছি। জেনেশুনে আমার মেয়েকে সেসবের মুখোমুখি কী করে হতে দেই?’
লিখন হাতজোড় করে বলল, ‘প্লিজ আন্টি! ‘
হেমলতা একদৃষ্টে লিখনের দিকে তাকিয়ে আছেন। তিনি সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছেন। এমন তো কখনো হয় না। পদ্মজার জন্মের পর সিদ্ধান্তহীনতায় কখনো ভোগেননি। যেকোনো একটা পথ বেছে নিয়েছেন, আর তাতেই পদ্মজার মঙ্গল হয়েছে। এবার কেন এমন হচ্ছে? কেন তিনি নিজের অবস্থান থেকে সরে যাচ্ছেন? পদ্মজার জীবন নিয়ে যেন ভেসে আছেন মাঝ নদীতে। চারদিকে স্রোত; মাঝি নেই, বৈঠা নেই। আমির না লিখন? কার কাছে ভালো থাকবে পদ্মজা? হেমলতার শরীর ভীষণ খারাপ লাগছে। তিনি দুর্বল কণ্ঠে বললেন, ‘এত বোঝো যখন, তখন নিজেকেও সামলাতে পারবে। বাড়ি ফিরে যাও।’
‘আন্টি, আমার বেঁচে থাকতে কষ্ট হবে।’
‘পদ্মজার সঙ্গে যা হয়েছে তবুও সে বেঁচে আছে। আর তুমি এইটুকু মানিয়ে নিতে পারবে না?
লিখন আর কথা খুঁজে পেল না। আহত মন নিয়ে উঠে দাঁড়াল। চলে যেতে ঘুরতেই হেমলতা দাঁড়াতে বললেন। ভীষণ ক্লান্ত লাগছে, তবুও হেঁটে লিখনের সামনে এসে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘নিজেকে শক্ত রেখো। তোমার এখনও অনেক পথ যাওয়া বাকি। কারো জন্য কারো জীবন থেমে থাকে না! ভাগ্যে যা থাকে, তাই হয়। সব যেহেতু আয়োজন হয়ে গেছে, তাই আর ভেবে লাভ নেই। তবে কবুল বলার আগেও যদি পদ্মজা বলে, তার তোমাকেই চাই…আমি সব ভেঙেচুরে পদ্মজাকে নিয়ে তোমার বাড়ি ছুটে যাব। আমি আমার মেয়েটাকে ভীষণ ভালোবাসি, বাবা। এই মেয়েটার সুখের জন্য আমি স্বার্থপর হয়েছি। অন্যের সন্তানের কষ্ট চোখে ভেসেও ভাসছে না। আমাকে ক্ষমা করে দিয়ো।’
হেমলতার চোখে জলের ভিড়। লিখন ভীষণ অবাক হয়ে দেখতে থাকল এই কঠিন মানুষটাকে। হেমলতা নিজের দুর্বলতা, নিজের কান্না কেন দেখালেন লিখনকে? জবাব খুঁজে পেল না লিখন। শুধু এইটুকু বুঝতে পারল যে হেমলতার কাছে জীবন মানেই পদ্মজা।
লিখন ভাঙা গলায় ‘আসি’ বলে চলে যায়। হেমলতা সব কাজ ভুলে গুটিসুটি মেরে বিছানায় শুয়ে পড়েন। চোখ বেয়ে দুই ফোঁটা জল বেরিয়ে আসে। মনের শক্তি কমে গেছে। দুর্বল হয়ে পড়েছেন তিনি। নিজের উপর আস্থা কিংবা বিশ্বাস পাচ্ছেন না। সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতাটুকু যেন কোথায় হারিয়ে গিয়েছে।
পদ্মজা – ২৫
বারান্দার গ্রিলে হাত রেখে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে পদ্মজা। তার পরনে শাড়ি রয়ে গেছে। আকাশের বুকে থালার মতো একখান চাঁদ। চাঁদের আলোয় চারদিক ঝিকমিক করছে। চারপাশ থেকে ভেসে আসছে ঝিঁঝিপোকার ডাক।
‘পদ্ম…’
পদ্মজা কেঁপে উঠে পেছনে ফিরে তাকাল। মোর্শেদকে দেখতে পেয়ে হাঁফ ছাড়ল গোপনে। মোর্শেদ বললেন, ‘তোর মায়ে কী আর উডে নাই?’
‘না, আব্বা।’
মোর্শেদ চিন্তিত ভঙ্গিতে কিছু ভাবলেন। বললেন, ‘তুই হজাগ ক্যান? যা ঘরে গিয়া ঘুমা। আমি ঘাটে যাইতাছি।’
‘আচ্ছা, আব্বা।’
মোর্শেদের যাওয়ার পানে পদ্মজা তাকিয়ে রইল। সে ভাবছে…কিন্তু কী ভাবছে তা নিজেই ধরতে পারছে না। কুকুরের ঘেউ ঘেউ শুনে উদাসীনতা কেটে গেল। শাড়ির আঁচল টেনে সাবধানে হেঁটে ঢুকল সদর ঘরে, ওখানে পাটি বিছিয়ে দূর-দূরান্ত থেকে আসা আত্মীয়রা ঘুমাচ্ছে। তাদের ডিঙিয়ে পদ্মজা হেমলতার ঘরে এলো। হেমলতা ঘুমাচ্ছেন বেঘোরে। শুনেছিল, লিখন শাহকে নিয়ে মা নিজ ঘরে এসেছিলেন। এরপর কী হলো কে জানে! সন্ধ্যার পর পূর্ণা জানাল, আম্মা ঘুমাচ্ছে। হেমলতা কখনো সন্ধ্যা সময় ঘুমান না। তাই পদ্মজা ঘোমটা টেনে হেমলতার ঘরে ছুটে আসে। মাকে এত শান্তিতে ঘুমাতে কখনো দেখেনি পদ্মজা। তাই আর ডাকেনি। কেউ ডাকতে আসলে তাড়িয়ে দিয়েছে। ঘুমাচ্ছে যখন, ঘুমাক নাহয়। এখন মধ্য রাত। হেমলতার মুখের সামনে মাটিতে বসে একদৃষ্টে তাকিয়ে মাকে দেখছে পদ্মজা, তার গলা কাঁপছে।
শ্বশুর বাড়ি কীভাবে থাকবে সে! মাকে ছাড়া দুইদিন থাকতে গিয়ে এত বড়ো ঝড় বয়ে গেল। আর এখন কিনা সারাজীবনের জন্য মায়ের ছায়া ছেড়ে দিতে হবে! এই মুখটা না দেখলে তার দিন কাটে না…এই মানুষটার আদুরে শাসন ছাড়া দিন সম্পূর্ণ হয় না। পদ্মজা বিছানায় মাথা ঠুকে ফুঁপিয়ে উঠল। অস্ফুট করে ডাকল, ‘আম্মা।’
সঙ্গে সঙ্গে হেমলতা চোখ খুললেন। পদ্মজা খেয়াল করল না। সে কাঁদতে কাঁদতে চাপা স্বরে বলছে, ‘তোমাকে ছাড়া কীভাবে থাকব আম্মা! বিয়ে করাটা কী খুব দরকার ছিল?’
‘ছিল।’
পদ্মজা চমকে গিয়ে মাথা তুলল। গলার স্বর আগের অবস্থানে রেখে বলল, ‘কেন আম্মা?’
‘সব জানতে নেই, মা।’
পদ্মজা মাথা নত করে নাক টানছে। হেমলতা বললেন, ‘বিয়ে হতেই হবে। বর বদল হলে সমস্যা নেই। তোর কী আর কাউকে পছন্দ?
প্রশ্নটি শুনে পদ্মজা বিব্রত হয়ে গেল। হেমলতাও প্রশ্নটা করতে গিয়ে অস্বস্তি বোধ করছিলেন। পদ্মজা মাথা দুই পাশে নাড়িয়ে জানাল, তার আলাদা করে কাউকে পছন্দ নেই। হেমলতা উঠে বসেন। চুল খোঁপা করতে করতে প্রশ্ন করলেন, ‘রাত কী খুব হয়েছে? কারো সাড়া নেই যে।’
‘মাঝ রাত।’
‘আর তুই জেগে থেকে কাঁদছিস?’ মৃদু ধমকের স্বরে বললেন।
পদ্মজা নিরুত্তর। হেমলতা জানালার বাইরে চেয়ে দেখলেন চাঁদের আলোয় চারিদিক উজ্জ্বল। আজ জ্যোৎস্না রাত। চাঁদের আলো গলে ঘরের মেঝেতে এসে পড়ছে। তিনি বিছানা থেকে নামতে নামতে পদ্মজাকে তাড়া দিয়ে বললেন, ‘শাড়ি পালটে সালোয়ার-কামিজ পরে নে।’
‘কেন আম্মা?’
‘যা বলছি কর।’
পদ্মজা ঘরে গিয়ে শাড়ি পালটে নিলো। উঠানে এসে দেখে হেমলতার হাতে বৈঠা। পদ্মজা অবাক হয়ে প্রশ্ন করল, ‘হাতে বৈঠা কেন?’
‘পূর্ণাকে নেব? নেওয়া উচিত। যা ওকে ডেকে নিয়ে আয়। প্রান্ত-প্ৰেমা যেন টের না পায়।’
পদ্মজা অসহায়ের মতো তাকিয়ে রইল মায়ের দিকে। হেমলতা তাড়া দিলেন, ‘যা তো!’
হন্তদন্ত হয়ে ছুটে গেল পদ্মজা, কয়েক মিনিটের মধ্যে ফিরল পূর্ণাকে নিয়ে; বেচারি ঘুমে ঢুলছে। হেমলতা ঘাটে এসে দেখেন মোর্শেদ নৌকায় বসে বিড়ি ফুঁকছেন
‘নৌকা ছাড়ো।’
মোর্শেদ দুই মেয়ে আর বউকে দেখে হকচকিয়ে গিয়েছেন। তার মধ্যে হেমলতা যেভাবে বললেন, নৌকা ছাড়ো—তা শুনে আরো ভড়কে গেলেন। চোখ বড়ো বড়ো করে প্রশ্ন করলেন, ‘ক্যান? কী অইলো?’
মোর্শেদের প্রশ্নের জবাব না দিয়ে পদ্মজা-পূর্ণাকে নিয়ে হেমলতা নৌকায় উঠে স্থির হয়ে বসলেন। বৈঠা মোর্শেদের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে মিষ্টি করে হেসে বললেন, ‘জ্যোৎস্না রাতের নৌকা ভ্রমণে বের হয়েছি আমরা। তুমি এখন আমাদের মাঝি।’ হেমলতা থামলেন। এরপর আঞ্চলিক ভাষায় বললেন, ‘লও, মাঝি, বৈঠা লও। ছাড়ো তোমার নৌকা। যত সিকি চাইবা তুমি ততই পাইবা।’
একসঙ্গে চারটা দুঃখী মানুষ হেসে উঠে। মোর্শেদ বৈঠা হাতে নিয়ে নৌকা ছাড়লেন। হুট করেই যেন অনুভব হচ্ছে, যুবক কালের রক্ত শরীরে টগবগ করছে।
এই তো তার সংসার, এই তো তার আনন্দ।
.
রাতের নির্মল বাতাস বইছে। মাদিনী নদীর স্বচ্ছ জলে চাঁদের প্রতিচ্ছবি। কচুরিপানারা ভেসে যাচ্ছে। সবকিছু সুন্দর, মুগ্ধকর। পূর্ণার বুকের ভারটা খুব হালকা লাগছে। পদ্মজা প্রাণভরে নিশ্বাস নিলো, রগে রগে যেন বয়ে গেল শান্তি। আল্লাহ তায়ালা যেন প্রকৃতির সৌন্দর্যে যেকোনো দুঃখী মানুষকে সুখী অনুভব করানোর মন্ত্র ঢেলে দিয়েছেন।
‘মোর্শেদ নাকি গো?’ হিন্দুপাড়া থেকে কেউ একজন চেঁচিয়ে ডাকল।
মোর্শেদ এক হাত তুলে জবাব দিলেন, ‘হ দাদা, আমি।’
রাইতের বেলা যাইতাছ কই?’
‘মেয়ে-বউ লইয়া জ্যোৎস্না পোহাইতে বাইর হইছি দাদা।’
‘তোমাদেরই দিন মিয়া।
মোর্শেদ আর কিছু বললেন না, হাসলেন। ওপাশ থেকেও আর কারো কথা শোনা গেল না। নৌকা আটপাড়া ছেড়ে হাওড়ে ঢুকে পড়েছে। সা সা করে বাতাস বইছে। গায়ের কাপড় উড়ছে। হেমলতা দুই মেয়ের মাঝে এসে বসলেন, চাদর নিয়ে এসেছেন। দুই মেয়েকে দুইহাতে জড়িয়ে ধরে ঢেকে দিলেন চাদরে। বাতাসে চাদর উড়ে প্যাতপ্যাত আওয়াজ তুলছে। চাঁদটা একদম মাথার ওপর। তাদের সঙ্গে সঙ্গে ঘুরছে! মোর্শেদ মনের সুখে গান ধরলেন—
লোকে বলে বলেরে
ঘর-বাড়ি ভালা নাই আমার
কী ঘর বানাইমু আমি শূন্যেরও মাঝার।।
ভালা কইরা ঘর বানাইয়া
কয়দিন থাকমু আর
আমি কয়দিন থাকমু আর
আয়না দিয়া চাইয়া দেখি
আয়না দিয়া চাইয়া দেখি
পাকনা চুল আমার।
পাকনা চুল আমার বলতেই পূর্ণা ফিক করে হেসে ফেলল। পদ্মজাকে ফিসফিসিয়ে বলল, আব্বা বোধহয় এখনো জোয়ান থাকতে চায়।’
পদ্মজা হেসে চাপা স্বরে বলল, ‘চুপ থাক। আব্বা কী সুন্দর গায়!’
মোর্শেদ গেয়ে যাচ্ছেন —
এ ভাবিয়া হাসন রাজা
হায়রে, ঘর-দুয়ার না বান্ধে
কোথায় নিয়া রাখব আল্লায়
কোথায় নিয়া রাখব আল্লায়
তাই ভাবিয়া কান্দে।।
লোকে বলে ও বলেরে
ঘর-বাড়ি ভালা নাই আমার।।
জানত যদি হাসন রাজা
হায়রে, বাঁচব কতদিন
বানাইত দালান-কোঠা
করিয়া রঙিন।।
লোকে বলে ও বলেরে
ঘর-বাড়ি ভালা নাই আমার।
মোর্শেদ থামলেন। তিন মা-মেয়ে একসঙ্গে হাতের তালি দিল, সেই আওয়াজে মুখরিত হয়ে উঠল চারপাশ। এত সুন্দর রাত বার বার ফিরে আসুক। মোর্শেদ হাঁ করে তাকিয়ে থাকেন সামনে থাকা তিনটা মানুষের দিকে। তাদের চোখেমুখে খুশি ঝিলিক মারছে। অথচ তিনি জানেন একেকজন কতটা দুঃখী। মোর্শেদ ঢোক গিলে লুকায়িত এক সত্যের কষ্ট পুনরায় লুকিয়ে যান। হেমলতা আর তিনি ছাড়া এই কলিজা ছেঁড়া কষ্ট কেউ জানে না। মোর্শেদ হেসে বললেন, ‘এই অভাগা মাঝিকে কী আপনারা আপনাদের মাঝে জায়গা দেবেন?’
মোর্শেদের কণ্ঠে শুদ্ধ ভাষায় মিষ্টি আবদার শুনে পদ্মজা পুলকিত হয়ে উঠল। আজ সব কিছু কত সুন্দর! পূর্ণা বলল, ‘দেব। এক শর্তে, নৌকা চালানোর বিনিময়ে সিকি যদি না নেন।’
মোর্শেদ মেয়ের রসিকতা শুনে হা হা করে হাসেন। সেই হাসি বার বার প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরে আসে কানে। তিনি বৈঠা রেখে হেমলতার সামনে এসে বসেন। নৌকা নিজের মতো যেদিকে ইচ্ছে ছুটে চলছে।
মোর্শেদ হেমলতাকে বললেন, ‘দুইডা ছেড়িরে খালি তুমি ধইরা রাখবা? ছাড়ো তো এইবার। আয় রে, তোরা আমারে ধারে আইয়া ব।’
পদ্মজা অবাক হয়ে মায়ের দিকে তাকাল। হেমলতা যেতে বললেন। পদ্মজা মোর্শেদের ডান পাশে বসল, আর পূর্ণা বাঁ-পাশে। মোর্শেদ পূর্ণাকে এক হাতে, পদ্মজাকে আরেক হাতে জড়িয়ে ধরে হু হু করে কেঁদে ওঠেন 1 অপরাধী স্বরে বললেন, ‘আমি বাপ হইয়া পারি নাই আমার ছেড়িদের বেইজ্জতির হাত থাইকা রক্ষা করতে। আমারে মাফ কইরা দিস তোরা।’
মোর্শেদ কখনো এত আদর করে পদ্মজাকে জড়িয়ে ধরেননি। এই প্রথম ধরেছেন, আবার কাঁদছেনও! পদ্মজার চোখ দুটি জলে ভরে ওঠে। হেমলতা মোর্শেদের পায়ের কাছে বসলেন। মোর্শেদের হাঁটুতে মাথা রেখে, দুই মেয়ের হাত চেপে ধরলেন। কেটে যায় অনেকগুলো মুহূর্ত। নৌকা হাওড়ের পানির স্রোতে একবার এদিক, তো আরেকবার ওদিক যাচ্ছে। বাতাসে চারজনের চোখের জল শুকিয়ে মিশে গেছে ত্বকের সঙ্গে।
নিস্তব্ধতা ভেঙে পদ্মজা বলল, ‘আজ আমি বুঝলাম জীবনে সুখ বা দুঃখ—কোনোটাই চিরস্থায়ী নয়। দুঃখে মর্মাহত না হয়ে সুখের সময়টা তৈরি করে নিতে হয়। তাহলেই জীবনে সুখকর মুহূর্ত আসে। আবার সুখ সর্বক্ষণ সঙ্গে থাকে না। দুনিয়ার লীলাখেলার শর্তে দুঃখ বার বার ফিরে আসে।’
হেমলতা পদ্মজার দিকে না তাকিয়ে পদ্মজার ডান হাতে পরম মমতায় চুমু খেলেন। চাঁদটা অর্ধেক হয়ে এসেছে। খুব তাড়াতাড়ি আকাশে মিলিয়ে যাবে।
২৬
হাওরে বিশাল জলরাশি। কখনো ঢেউয়ে উথাল-পাতাল, আবার কখনো মৃদু বাতাসে জলের ওপর চাঁদের প্রতিচ্ছবির খেলা। নৌকা বাজারের দিকে যাওয়ার পথ ধরেছে। তাই মোর্শেদ নিস্তব্ধ বৈঠক ভেঙে বৈঠা নিয়ে বসেন, নৌকা নিয়ন্ত্রণে এনে যেতে থাকেন রাধাপুর হাওড়ের দিকে। ওড়নার ঘোমটার আড়ালে কখন খোঁপা খুলে গেছে, পদ্মজা খেয়াল করেনি। হেমলতা দেখেন পদ্মজার চুল হাওড়ের জলে ডুবে আছে। তিনি মৃদু স্বরে পদ্মজাকে বললেন, ‘চুল ভিজে যাচ্ছে পদ্ম।’
পদ্মজা দ্রুত সামলে নিলো। খোঁপা করে ঘোমটা টেনে নিয়ে বলল, কখন খুলে গেছে খেয়াল করিনি।’
অনেকক্ষণ কেউ কোনো কথা বলল না। হেমলতা চাঁদের দিকে তাকিয়ে আছেন একমনে।
পদ্মজা ডাকল, ‘আম্মা?’
হেমলতা অশ্রুভরা চোখে তাকালেন। পদ্মজা কিছু বলার আগে তিনি বললেন, ‘পূর্ণা গল্প শুনবি?’
পূর্ণা গল্প বলতে পাগল, শুনতে খুব ভালোবাসে। খুশিতে বাকবাকুম হয়ে বলল, ‘শুনব।’
‘কষ্টের গল্প কিন্তু।’
‘গল্প হলেই হলো।’
হেমলতা হাসলেন। পদ্মজা নড়েচড়ে বসল। সে আন্দাজ করতে পারছে তার মা কোন গল্প বলবে। হেমলতা দুই হাতে জল নিয়ে মুখ ধুয়ে নিয়ে একবার মোর্শেদের দিকে তাকিয়ে হাসলেন। পেছন ঘুরে বসে প্রশ্ন করলেন ‘মুখ না দেখে গল্প শুনতে ভালো লাগবে?’
পূর্ণা মুখ গোমড়া করে না বলতে যাচ্ছিল। পদ্মজা এক হাতে খপ করে ধরে আটকে দিল। মাকে বলল, ‘যেভাবে ইচ্ছে বলো।’
হেমলতা বড়ো করে দম নিয়ে বলা শুরু করলেন, আব্বার প্রথম স্ত্রী মারা যায় অল্প বয়সে। আব্বা প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক ছিলেন; একজন বুদ্ধিমান, উদার মনের মানুষ। অন্যদিকে আম্মাকে যৌতুকের জন্য মুখে তালাক দিয়ে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছিল তার প্রথম স্বামী। বাপের সংসারে এসে সমাজের তোপে পড়তে হয় আম্মাকে। আব্বার উদার মন ছিল, তাই তিনি অবলা-অসহায় আম্মাকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেন। আমার নানার কাছে বিয়ের প্রস্তাব দেন। নানা সানন্দে রাজি হয়ে যান। রাজি হবেনই না কেন? স্বামীর বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া বিবাহিত নারীকে কে-ই বা বিয়ে করতে চায়? আম্মা-আব্বার বিয়ের বছর দেড়েক হতেই হানি আপার জন্ম হয়। তার দুই বছরের মাথায় আমার আগমন ঘটে।’
কথার মাঝে পদ্মজা পুলকিত হয়ে বলল, ‘সেদিন নিশ্চয় গাছে গাছে ফুল মাঝে ফুটেছে?’
হেমলতা ম্লান হেসে বললেন, ‘শুনেছি আমার গায়ের রং দেখে আম্মা নাক কুঁচকেছিল। আমার বয়স যখন তিন মাস, তখন আম্মার আগের স্বামী আম্মাকে ফিরিয়ে নিতে আসে। আব্বার তখন আর্থিক সমস্যা ছিল। দিনে দুইবেলা খাওয়াতেও হিমশিম খেতেন।
‘তাই বিপদে পাশে থাকা আব্বাকেসহ আমাদের দুই বোনকে ছেড়ে স্বার্থপর মা পালিয়ে যায় তার প্রথম স্বামীর কাছে। আব্বা ছোটো ছোটো দুই মেয়েকে নিয়ে মাঝ নদীতে পড়েন। কিন্তু আল্লাহ সহায় ছিলেন। আব্বার ফুফু সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন, চলে আসেন আমাদের কাছে; আপা আর আমার দায়িত্ব নেন। হুট করেই আব্বার আর্থিক অবস্থা উন্নত হতে থাকে। গৃহস্থিতে রহমত ঝরে পড়ে। পাঁচ বছর পর আম্মা ফিরে আসে। বিধ্বস্ত অবস্থা, ফরসা মুখ মারের চোটে দাগে দাগে বিশ্রি হয়ে গেছে। তবে একা আসেনি, দুই বছরের এক ছেলে নিয়ে ফিরে এসেছে। তখন আমাদের কুঁড়ে ঘরের বদলে বিশাল বাড়ি হয়েছে। আব্বা প্রথম মানেননি। আম্মা আব্বার পায়ে পড়ে কাঁদে, ক্ষমা চায়। আব্বা আবার আগের ভুল করেন। মেনে নেন আম্মাকে। আম্মার ছেলের নাম বিনোধ ছিল, আব্বা নতুন নাম দেন হানিফ। আম্মা আমাকে সহ্য করতে পারত না। কিন্তু আব্বার চোখের মণি ছিলাম। আব্বার আড়ালে আম্মার দ্বারা নির্যাতিত হয়েছি প্রতিদিন। ছয় বছর হতেই স্কুলে ভরতি করে দেন আব্বা। হানি আপা তখন স্কুলে পড়ে। আমি…’
‘থামলে কেন, আম্মা?’ অধৈর্য হয়ে বলল পদ্মজা।
হেমলতা ভ্রুকুটি করে বললেন, ‘আম্মার ব্যাপারে আর বলতে ইচ্ছে হচ্ছে না। সে এখন অনুতপ্ত। আফসোস করে, কাঁদে। বলতে ভালো লাগছে না।’
শীতল বাতাসে সবার শরীর কাঁটা দিচ্ছে। চাঁদটা ছোটো হয়ে গেছে অনেক। মোর্শেদ এক ধ্যানে বৈঠা দিয়ে জল ঠেলে নৌকা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন সামনে। হেমলতা আবার বলতে শুরু করলেন, ‘মেট্রিক দেয়ার পর আম্মা পড়াতে চাচ্ছিল না। আব্বার জন্য ঢাকার কলেজে পড়ার সুযোগ পাই হোটেলে উঠি। আব্বা নিয়মিত টাকা পাঠাতেন। জানিস পদ্ম, কলেজে আমি সবার ছোটো ছিলাম। সবাই হাঁ করে তাকিয়ে থাকত। শাড়ি পরতাম বলে একটু বড়ো লাগত অবশ্য। সবসময় সুতি শাড়ি পরে বেণী বেঁধে রাখতাম। কারো সঙ্গে মিশতাম না। ভীষণ ভীতু ছিলাম। রিমঝিম নামে খ্রিষ্টান এক মেয়ের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়। মেয়েটা এত সুন্দর ছিল দেখতে, ঠিক তোর মতো সুন্দর। চোখের মণি ছিল ঘোলা। তার নাকি শ্যামলা মানুষ ভালো লাগে; তাই নিজে যেচে আমার সঙ্গে বন্ধুত্ব করে। কয়েকদিনের ব্যবধানে আমরা খুব ঘনিষ্ঠ হয়ে পড়ি। ইংলিশে যাকে বলে বেস্ট ফ্রেন্ড। রিমঝিমের সঙ্গে মাঝে মাঝে ওর বড়ো ভাই আসত। নাম ছিল—যিশু
যিশু একদম রিমঝিমের আরেক রূপ। চোখ ধাঁধানো সৌন্দর্য ছিল দুই ভাই-বোনের। যিশু ভাইয়া বলে ডাকতাম তাকে। যিশু ভাইয়া মজা করে বলতেন, ধর্ম এক হলে হেমলতাকেই বিয়ে করতাম। পদ্মজা-পূর্ণা খারাপ লাগছে শুনতে?’
‘না, আম্মা, এক স্বরে বলল দুজন।
পদ্মজা বলল, ‘পরে কী হলো?’
‘তখন অলন্দপুর থেকে রাজধানীতে চিঠি পৌঁছাতে দুই সপ্তাহ লাগত। একদিন কলেজ ছুটির পথে হানি আপার চিঠি পেলাম। পাশে রিমঝিম ছিল যিশু ভাই সবেমাত্র এসেছেন রিমঝিমকে নিয়ে যেতে। চিঠি পড়ে জানতে পারি, আব্বা হাওড়ে গিয়েছিলেন মাছ ধরতে। আব্বার নৌকার চেয়ে কয়েক হাত দূরের নৌকায় সুজন নামে এক ছেলে ছিল। তখন ভারি বর্ষণ হচ্ছিল। বজ্রপাত হচ্ছিল একটার পর একটা। একটা বজ্রপাত সুজনের ওপর পড়ে, সঙ্গে সঙ্গে ছেলেটা ঝলসে যায়। আব্বা ছিটকে পড়েন জলে। দূর থেকে এক দল জেলে ঘটনাটি দেখতে পায়। তারা আব্বাকে তুলে নিয়ে যায় বাড়িতে। এরপর থেকেই আব্বা কানে শুনতে পান না, ঠিক করে হাঁটতে পারেন না; মস্তিষ্ক অচল হয়ে পড়ে। এই খবর শোনার পর হাউমাউ করে কান্না শুরু করি। কখনো একা অলন্দপুর আসিনি, আব্বা গিয়ে আনতেন। খুব অসহায় হয়ে পড়ি, কী করে বাড়ি যাব? যিশু ভাই সব শুনে, আমার কান্না দেখে বললেন, বিকেলের ট্রেনে অলন্দপুর নিয়ে যাবেন। আমি তখনো কাঁদছিলাম। একবার শুধু অলন্দপুর যেতে চাই। আব্বাকে দেখতে চাই। যদিও জানতাম, অনেকদিন হয়ে গেছে এই দুর্ঘটনার।
‘আটপাড়া পৌঁছাতে পৌঁছাতে অনেক রাত হয়ে যায়। বাড়ি এসে দেখি সদর ঘরের দরজায় তালা মারা, কেউ নেই বাড়িতে। মুরগি আর গরু-ছাগল ছাড়া। বারান্দার ঘরে দরজা ছিল না। শুধু একটা চৌকি ছিল। বড্ড ক্লান্ত ছিলাম। চৌকিতে শুয়েই ঘুমিয়ে পড়ি। ঘুম ভাঙে আম্মার চেঁচামেচিতে। যিশু ভাইও নিজের অজান্তে আমার পাশে কখন ঘুমিয়ে পড়েছিল বুঝতে পারেনি। দীর্ঘ যাত্রার কারণে আমার মতোই তিনি ক্লান্ত ছিলেন। আমার জন্মদাত্রী মা গ্রামবাসী ডেকে চেঁচাতে থাকেন, যেন হাতেনাতে চোর ধরেছেন। অবস্থা বেগতিক দেখে ভড়কে যাই। কিছু বলতে পারিনি। যিশু ভাই সবাইকে অনেক বোঝানোর চেষ্টা করে, কেউ বুঝেনি। তখন নিয়ম খুব কঠিন ছিল। যিশু ভাই খ্রিষ্টান শুনে সবাই আরো ক্ষেপে যায়। আব্বার সামনে গ্রামবাসী আমাদের দুজনের মাথা ন্যাড়া করে দিল। কোমর সমান চুল ছিল আমার। মাথা ন্যাড়া করতে গিয়ে মাথার চামড়া ছিঁড়ে ফেলে। রক্ত বের হতে থাকে গলগল করে। আমার করুণ অবস্থা দেখে আম্মার তখন হুঁশ আসে। গ্রামবাসীর হাত থেকে আমাকে বাঁচানোর চেষ্টা করে কিন্তু পারেনি। গায়ের রং কালো, তার ওপর রক্তাক্ত ন্যাড়া মাথা। কী যে বিশ্রি রূপ হয়েছিল!
‘আমি আমার একমাত্র ভরসার আব্বাকে চিৎকার করে ডেকে কেঁদেছিলাম। আব্বা শোনেননি, আমার দিকে শুধু হাঁ করে তাকিয়েছিলেন। কিছু লোক যিশু ভাইকে অনেক মারধর করে। সেদিন রাতেই উনাকে রক্তাক্ত অবস্থায় ছুঁড়ে ফেলে আসে নদীর পাড়ে। গরুর ঘরে গোবরের ওপর বেঁধে রাখে আমাকে। দূরদূরান্তরের মানুষ দেখতে আসে। আমি তখন নিশ্বাসে নিশ্বাসে নিজের মৃত্যু কামনা করেছি। একবার বাঁধনছাড়া হতে পারলে আত্মহত্যা করব বলে পণ করি। হাত বাঁধা ছিল, তাই দাঁত দিয়ে নিজের হাঁটুতে বোকার মতো কামড় দিতে থাকি একটার পর একটা…যাতে মরে যাই। যেই দেখতে আসত সেই বিশ্রি গালি দিয়ে যেত। কেউ কেউ লাথি দিয়েছে। রাধাপুরের হারুন রশীদ আছে না? উনার আব্বা তখন অলন্দপুরের মাতব্বর ছিলেন। উনার গোয়ালঘরেই বন্দি ছিলাম। দুই দিন পর আমাকে ছাড়ে। ছাড়া পেয়েই ইচ্ছে হচ্ছিল, গলায় কলসি বেঁধে ছুটে গিয়ে নদীতে ঝাঁপ দেই। কিন্তু পারিনি। শরীরে একটুও শক্তি ছিল না। দৌড়ে পালাতে গিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ি গোয়ালঘরের বাইরে। ধারাল কিছু একটা ছিল মাটিতে। মাটিতে পড়তেই হাতের বাহু ছিঁড়ে গলগল করে নামে রক্তের ধারা। এই যে আমার বাহুর দাগটা, এটা সেদিনই হয়েছে।’
হেমলতা মেয়েদের দাগটা দেখানোর জন্য ঘুরে তাকান। দেখেন তার দুই মেয়ে মুখে হাত চেপে কাঁদছে।
হেমলতা হাসার চেষ্টা করে বললেন, ‘তোরা মরাকান্না শুরু করেছিস কেন?’
হেমলতার কথা শেষ হতেই ঘূর্ণিঝড়ের মতো দুই মেয়ে ছুটে আসে তার দিকে। নৌকা দুলে ওঠে। হেমলতা চমকে গিয়ে দ্রুত নৌকা ধরে নিজের ভারসাম্য রক্ষা করলেন। চিৎকার করে ওঠেন, ‘আরে…’
কথা শেষ করার পূর্বেই বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে দুই মেয়ে। জড়িয়ে ধরেই আম্মা আম্মা বলে কাঁদতে থাকে। দুই মেয়ে এত শক্ত করে জড়িয়ে ধরেছে যে হেমলতার মনে হচ্ছে এখনি দম বেরিয়ে যাবে। তাদের কান্না থামার কোনো লক্ষণ নেই। হেমলতা দুজনের পিঠে হাত বুলিয়ে সান্ত্বনা দেন। কিছুতেই কিছু হলো না।
তারা কেঁদেই চলেছে।
হেমলতা কঠিন স্বরের ভান করে মোর্শেদের উদ্দেশ্যে বললেন, ‘নৌকা ঘুরাও। এদের আর কিছু বলব না।’
পদ্মজা ঠোঁট কামড়ে কান্না আটকে বলল, ‘আর কাঁদব না। পূর্ণা আর কাঁদিস না। তোমাকে শুধু জড়িয়ে রাখি?’
হেমলতা পদ্মজার মাথায় চুমু দিয়ে বললেন, ‘রাখ।’
পূর্ণা নাক টানছে। হেমলতা বলছেন, ‘আমাদের এক ঘরে করে দেওয়া হলো। বাজারে ভেষজ উপায়ে আব্বার চিকিৎসা চলছিল। সেটাও বন্ধ হয়ে গেল। কেউ পরিবারের মুখও দেখতে চায় না। দেখলেই এটা-ওটা ছুঁড়ে দিত। বলা হয়নি, সেদিন রাতে আব্বা-আম্মা মামার বাড়ি ছিল। ওই বাড়ির পাশে এক ডাক্তার থাকত, আব্বাকে দেখাতে গিয়েছিল। হানি আপার বিয়ে দেয়ার জন্য আম্মা উঠেপড়ে লাগে। তখন হিমেল আম্মার পেটে, সাত মাস চলে। আমার ওপর আম্মার মার প্রতিদিন চলতেই থাকে। আমার জন্য পরিবারের এত ক্ষতি হলো…হানিফ স্কুলে যেতে পারে না…সবাই দূর দূর করে…হানি আপার বিয়ে হয় না…আব্বার চিকিৎসা হয় না… বিপদ-আপদে কেউ পাশে আসে না…ওদিকে হিমেল আসার সময় ঘনিয়ে এসেছে…কোনো দাত্রী আসেনি।
‘আম্মা একা যুদ্ধ করে হিমেলকে জন্ম দেয়। সব মিলিয়ে আমাদের জীবন নরক হয়ে ওঠে। বছর দুয়েকের মধ্যে আব্বা কিছুটা সুস্থ হন আল্লাহর রহমতে, হাঁটাচলা করতে পারেন…আগের মতো সবকিছু না বুঝলেও মোটামুটি বুঝতেন। হানি আপার বিয়ে ঠিক হলো। বনেদি ঘর থেকে প্রস্তাব এসেছিল। শর্ত একটাই—পাঁচ বিঘা জমি দিতে হবে। আমাদের জমি ছিল সাড়ে পাঁচ বিঘা। আম্মা পাঁচ বিঘা জমি দিয়েই হানি আপার বিয়ে দিলেন। সবকিছু স্বাভাবিক হলো। যদিও মাঝে মাঝে অনেকে কথা শুনিয়েছে। একসময় আমার বিয়ের প্রস্তাবও এলো। তোদের আব্বার সঙ্গে আমার বিয়ে হয়। বিয়ের কয়েক মাসের মধ্যে জানতে পারি তোদের আব্বার দ্বিতীয় স্ত্রী আমি।’
শেষ কথাটা হেমলতা মোর্শেদের দিকে তাকিয়ে বললেন। মোর্শেদ চোখের দৃষ্টি নত করে ফেলেন। পূর্ণা খুব অবাক হয়ে তাকাল মোর্শেদের দিকে। হেমলতা পূর্ণাকে নিজের দিকে ফিরিয়ে নিয়ে বললেন, ‘তোর আব্বাকে ভুল বুঝিস না মা। ভালোবাসার ওপর কিছু নেই। সে তার প্রেমিকাকে ভালোবেসে লুকিয়ে বিয়ে করেছিল। কাউকে জানতে দেয়নি আমাকে তার পছন্দ ছিল না। একসময় বিরক্ত হয়ে অনেক মারধোর করে। ভীষণ বদমেজাজি আর জেদি ছিল তোদের আব্বা। জোর করে তোদের দাদা বিয়ে করিয়েছিলেন, তাই রাগ মেটাত আমার উপর। বাদ সেসব কথা। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়। জান বাঁচানোর তাগিদে মানুষ যেদিকে পারে পালাতে থাকে। অলন্দপুরে পাকিস্তানি ক্যাম্প তৈরি হয়। শহর থেকে একটা দল আসে, যারা যুদ্ধ করতে চায় তাদের যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করতে। তোদের আব্বা তার প্রথম স্ত্রীর কাছে বেশি থাকত। আবার তোর দুই চাচা যুদ্ধে চলে যায়। আমি একা ছিলাম খালি বাড়িতে। চারিদিকে অত্যাচার, জুলুম। ইচ্ছে করে দেশের জন্য কিছু করতে। মনে সাহস নিয়ে স্কুলের প্রধান শিক্ষকের সঙ্গে যোগাযোগ করি। তিনি কমান্ডার আবুল কালামের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দেন। প্রধান শিক্ষক গোপনে গ্রামের যুবক-যুবতীদের অনুপ্রেরণা দিতেন যুদ্ধের জন্য। এ খবর একসময় পাকিস্তানিরা পেয়ে গেল। তিনি শহিদ হলেন।
‘ট্রেনিং-এ অংশ নিয়ে হয়ে উঠলাম একজন মুক্তিযোদ্ধা। প্রথম অপারেশনে আমরা সফল হই, উড়িয়ে দিই অলন্দপুরের ক্যাম্প। এরপর চলে যাই আরেক এলাকায়। হাতে রাইফেল নিয়ে পরবর্তী অপারেশনে নামি। তখন ধরা পড়ে যাই পাকিস্তানিদের হাতে। বন্দি করে কারাগারে। স্বচক্ষে দেখি ধর্ষণ, শারিরীক অত্যাচার। কী বর্বরতা তাদের! রড দিয়ে পিটিয়েছে। পিঠের দাগগুলো এখনো আছে। আরো কয়দিন থাকলে হয়তো আমিও ধর্ষিত হতাম। তার আগেই আবুল কালামের বুদ্ধির কাছে হেরে গেল তারা। ফেরার আগে চোখ বন্ধ করে এক নিশ্বাসে দুইজনকে ছুরি দিয়ে হত্যা করে আসি।
‘দেশ স্বাধীন হয়। চারিদিকে স্বাধীনতার উল্লাস। আমি তখন হাসপাতালে, চিকিৎসাধীন। আরো অনেকে ছিল। সেই হাসপাতালেই যিশু ভাইয়েরও চিকিৎসা চলছিল। তিনিও একজন মুক্তিযোদ্ধা। রিমঝিমের সঙ্গে ফের দেখা হলো। এক মাস লাগল সুস্থ হতে। ফেরার সময় সঙ্গে আসে রিমঝিম আর যিশু ভাই। পথে বার বার করে বললাম, তোমাদের মতো দেখতে যেন আমার একটা মেয়ে হয়। অলন্দপুরের বাজারে নামিয়ে দিয়ে ওরা আর আসেনি, ফের যদি গ্রামের লোক দেখে ফেলে। কিন্তু আমার আশঙ্কাই ঠিক হলো। অনেকে যিশু ভাইয়ের সঙ্গে আমাকে দেখে ফেলে। বাড়িতে ফিরে দেখি তোদের আব্বা এসেছে। তিন মাস পর জানতে পারি আমি মা হব। মনে প্রাণে একটা সুন্দর মেয়ে চাইতে থাকি আল্লাহর কাছে। ঘুমালে স্বপ্ন দেখি রিমঝিমকে। আমার মন খুব চাইত রিমঝিমের মতো সুন্দর মেয়ে। ঠিক তাই হলো।
‘কিন্তু রটে গেল বদনাম। অনেকে বলে তারা যিশুর সঙ্গে আমাকে দেখেছে, এতদিন যিশুর কাছে ছিলাম; তারই সন্তান পদ্মজা। সেজন্যই এত সুন্দর। আর এত মিল! তোদের আব্বাও বিশ্বাস করল। আল্লাহ চাইলে সব পারে কেউ বিশ্বাস করল না। কিন্তু জানিস, পদ্ম? তোর জন্মের পর থেকেই আমি অলৌকিকভাবে খুব শক্ত আর কঠিন হয়ে পড়ি। কেউ কিছু বললে সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিয়ে দেই। তোর সম্পর্কে কেউ কিছু বলতে আসলে দা নিয়ে তেড়ে যাই। এ খবর ছড়িয়ে পড়ে সব জায়গায়। তার মধ্যে কমান্ডার আবুল কালাম আসেন অলন্দপুরে। গ্রামের অনেকে যুদ্ধে গিয়েছিল। আমি ছাড়া আর একজন ফিরেছিল, বদর উদ্দিন নাম। বদর উদ্দিন এবং আবুল কালামের কাছ থেকে গ্রামবাসী জানতে পারে আমিও যুদ্ধ করেছি। হেমলতা একজন মুক্তিযোদ্ধা। এ খবর শোনার পর থেকে সবাই মোটামুটি সমীহ করে চলতে থাকে। একটা শক্ত জায়গা দখল করে বাঁচতে থাকি। প্রতিটি ঘটনা আমাকে ভেতরে ভেতরে শক্ত করেছে। তুই জন্মের পর বুঝেছি, আমি অনেক কিছু পারি। একা চলতে পারি।’
কথা শেষ করে হেমলতা হাঁফ ছাড়েন। চাঁদ ডুবে গেছে অনেকক্ষণ আগে। কিছুক্ষণের মধ্যে ফজরের আজান পড়বে। পদ্মজা-পূর্ণা স্তব্ধ।
‘এই দুনিয়ায় বাঁচার দুটি পথ—চুপ থাকো, নয় প্রতিবাদ করো। কিন্তু আমার নিয়ম বলে, সামনে চুপ থেকে আড়ালে আবর্জনাটাকে ছুঁড়ে ফেলে দাও। যাতে এই আবর্জনার প্রভাবে আর কিছু না পঁচে।’
হেমলতার শেষ কথাগুলো পদ্মজার রগে রগে শিহরণ জাগাল। সে দূরে চোখ রেখে কিছু ভাবতে থাকে। মানুষের জীবনে কত গল্প! কত যন্ত্ৰণা! হেমলতা নৌকা ঘোরাতে বললেন। মোর্শেদ তাই করলেন, বাড়ি ফিরতে হবে। আজ পদ্মজার গায়ে হলুদ। নৌকা চলছে ঢেউয়ের তালে তালে। আগের উত্তেজনাটা আর কাজ করছে না। একটা ইঞ্জিন ট্রলারের শব্দ পাওয়া গেল। চারজন চকিতে তাকাল সেদিকে। ট্রলারে একজন লোক, একজন ভেতর থেকে সাদা কাপড়ে মোড়ানো কিছু একটা নিয়ে বেরিয়ে এলো। আবছা আলোয় সাদা কাপড়ে মোড়ানো বস্তুটি দেখে পিলে চমকে উঠল পূর্ণার। মানুষ মরার পর সাদা কাপড়ে যেভাবে মোড়ানো হয়, ঠিক তেমন। এক মুহূর্তে পরেই লোক দুটি মোড়ানো বস্তুটি ছুঁড়ে ফেলে পানিতে।
মোর্শেদ চেঁচিয়ে ওঠেন, ‘কে রে?’
লোক দুটি একবার মোর্শেদের নৌকাটির দিকে দৃষ্টিপাত করে দ্রুত ট্রলারের ভেতর চলে গেল। মোর্শেদ তড়িঘড়ি করে বৈঠা চালিয়েও তাদের ধরতে পারল না। ট্রলারটি চোখের সামনে অদৃশ্য হয়ে গেল। যেখানে সাদা কাপড়ে মোড়ানো বস্তুটি ফেলা হয়েছে, সেখানে মোর্শেদের নৌকাটি পৌঁছাতেই হুট করে হেমলতা ঝাঁপিয়ে পড়েন পানিতে।
পদ্মজা আকস্মিক ঘটনায় চমকে গেল। আতঙ্ক নিয়ে ডাকল, ‘আম্মা!’
হেমলতার দেখা নেই। পদ্মজা নৌকা থেকে ঝাঁপ দিতে যাবে তখনি হেমলতা ভেসে উঠলেন। হাতে সাদা কাপড়ে মোড়ানো বস্তুটি। হেমলতা মুখ তুলে মোর্শেদ ও মেয়েদের উদ্দেশ্যে বললেন, ‘লাশ।’
পূর্ণা লাশ শুনেই কাঁপতে থাকে। অথচ পদ্মজা স্থির, ঠান্ডা।
অন্যদিকে হেমলতা এই শেষ রাত্রিরে নদীর জলে ভেসে আছেন দুই হাতে মৃত মানুষ জড়িয়ে ধরে!
২৭
লাশটি নৌকায় তুলতেই পূর্ণা ভয়ে কুঁকড়ে গিয়ে মোর্শেদের পাশ ঘেঁষে বসল। তার মনে হচ্ছে চারিদিক থেকে প্রেতাত্মারা তাকিয়ে আছে, যে কোনো মুহূর্তে ঝাঁপিয়ে পড়ে ঘাড় মটকে দেবে। ঘাড় মটকানোর কথা ভাবতেই পূর্ণার ঘাড় শিরশির করে উঠল। ‘ভূত, ভূত’ বলে চেঁচিয়ে উঠল সে। হঠাৎ পূর্ণার চিৎকার শুনে মোর্শেদ ভয় পেয়ে যান। এমনিতেই গায়ে কাঁটা দিচ্ছে লাশ দেখে।
তিনি পূর্ণাকে এক হাতে জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘কোনহানে ভূত? ডরাইস না।’
মাথার কাছে বাঁধা দড়িটা খুলে কাপড় সরাতেই একটা মৃত মেয়ের মুখ দেখা গেল। হেমলতা আর পদ্মজা দুজনই ভেতরে ভেতরে চমকে উঠল। হেমলতা এদিক-ওদিক তাকিয়ে মানুষের উপস্থিতি দেখে নিলেন। এরপর কণ্ঠ খাদে নামিয়ে বলেন, ‘চিনি না তো। তুই চিনিস?’
পদ্মজা মাথা নাড়িয়ে জানাল, সে চেনে না। পরপরই মোর্শেদকে ডাকল পদ্মজা, ‘আব্বা, দেখেন তো আপনি চিনেন নাকি?
মোর্শেদ উঠে আসতে চাইলে পূর্ণা ধরে রাখে। মোর্শেদ পূর্ণাকে নিয়েই এগিয়ে আসেন। মৃত মেয়েটার মুখ দেখে বললেন, ‘না, এরে চিনি না।’
হেমলতা চিন্তায় পড়ে যান, শরীরের পশম কাঁটা দিচ্ছে। চারিদিক অন্ধকারে ঢাকা, হীমশীতল বাতাস; আর সামনে সাদা কাপড়ে মোড়ানো এক মেয়ের লাশ।
তিনি ব্যথিত কণ্ঠে বললেন, ‘কোন মায়ের বুক খালি হলো কে জানে!’
পদ্মজা বিড়বিড় করে, ট্রলারের এক জনকে চেনা চেনা লাগছিল আম্মা।
হেমলতা ধৈর্যহারা হয়ে প্রশ্ন করলেন, ‘কে? চিনেছিস? নাম কী? জানিস?’
পদ্মজা ভাবছে। গভীর ভাবনায় ডুবে কিছু ভাবছে। হেমলতার প্রশ্নের জবাবে বলল, ‘নাম জানি না। দাঁড়াও, আমি বলি লোকটা কেমন!
পদ্মজা চোখ খুঁজে ফিরে গেল কিছুক্ষণ আগের মুহূর্তে। চোখ বোজা অবস্থাতেই বলল, ‘আব্বা যখন বলল, কে রে? তখন একটা লোক আমাদের দিকে তাকিয়েছিল। লোকটার চোখগুলো ভীষণ লাল। অনেক মোটা, খুব কালো। মাথার চুল ঝুটি বাঁধা ছিল। এমন একজন লোক আমি স্কুল থেকে ফেরার পথে অনেকবার দেখেছি।’ কথা শেষ করেই পদ্মজা চোখ খুলে খুশিতে গদগদ হয়ে বলল, ‘লোকটার দেখা পেলে আমি ঠিক চিনে ফেলব আম্মা।’
‘চিনে কী হবে? প্রমাণ তো নেই। আর মেয়েটা মারা গেছে নাকি খুন সেটা তো জানি না।’
‘প্রমাণ নেই তা ঠিক। কিন্তু মেয়েটা খুন হয়েছে, আম্মা। এই দেখো, মেয়েটার গলায় ক
দাগ। আর পেটের কাছে দেখো রক্তের দাগ। নদীর পানি পুরোটা রক্ত মুছে দিতে পারেনি।’
হেমলতা অবাক হয়ে পদ্মজার কথামতো খেয়াল করে দেখেন। সত্যি তো! তিনি বিস্ময় নিয়ে বললেন, ‘একটার পর একটা খুন! হানিফের পর প্রান্তর বাপ…এরপর এই মেয়ে। আমি বুঝতে পারছি না, কে বা কারা এমন করছে।’
‘ওই লোকটার দেখা যদি আরেকবার পাই—আমি ঠিক এর রহস্য বের করব,’ বলল পদ্মজা।
মৃত মেয়েটার মুখ কাপড় দিয়ে ঢেকে দিলেন হেমলতা। এরপর দড়ি দিয়ে আগের মতো বেঁধে মোর্শেদকে বললেন, ‘কলাপাড়ার দিকে যাও।’
‘ওখানে কিয়ের কাম?’ বললেন মোর্শেদ।
হেমলতা শান্ত কণ্ঠে বললেন, ‘কলা গাছের ভেলা বানিয়ে লাশ ভাসিয়ে দেব। পানিতে ফেললে কেউ পাবে না। ভাসিয়ে দিলে কেউ না কেউ পাবে। হয়তো মেয়েটার পরিবারও খুঁজে পাবে! আমাদের বাড়িতে এখন লাশ নিয়ে যাওয়া ঠিক হবে না। অনেক মানুষ আছে। সবাই ভয় পাবে। বিয়ের আমেজটা চলে যাবে। তাড়াতাড়ি যাও, কলাপাড়ার দিকে নৌকা ঘুরাও।’
.
সকাল সকাল গায়ে হলুদ সম্পন্ন করার পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু বউ এখনো ঘুমে আচ্ছন্ন। বাড়ি ভরতি মানুষ। কলাগাছের ছাদ বানিয়ে সবাই অপেক্ষা করছে নতুন বউয়ের জন্য। হেমলতা কিছুতেই পদ্মজাকে ডাকতে দিচ্ছেন না। দুপুরের আজান পড়তেই পদ্মজা চোখ খোলে। যখন মনে পড়ল আজ তার গায়ে হলুদ তখন সে ধড়ফড়িয়ে উঠে বসল। সেই কাকডাকা ভোরে বাড়ি ফিরে ঘুমিয়েছিল। তারপর আর কিছু মনে নেই। বালিশের পাশে হলুদ শাড়ি রাখা। পদ্মজা দ্রুত শাড়িটি পরে নিয়ে ডাকল পূর্ণাকে। বাইরের কোলাহল শোনা যাচ্ছে। পদ্মজা দরজা খুলতেই নয় বছর বয়সি একটা মেয়ে চেঁচিয়ে বাইরে খবর দিল, ‘পদ্ম আপার ঘুম ভাঙছে।’
হেমলতা রান্নাঘরের সামনে বসে মুরগি কাটছিলেন।
হানি উঠান থেকে হনহনিয়ে হেঁটে এসে হেমলতাকে শ্লেষাত্মক কণ্ঠে বললেন, ‘এবার তোর চাঁদকে নিয়ে যেতে পারি?’
হেমলতা হেসে অনুমতি দিলেন, ‘যাও।’
হানি, মনজুরাসহ সম্পর্কে ভাবি হয় এমন আরো দুজন পদ্মজাকে নিয়ে ঘর থেকে বের হলো। গান গাওয়ার জন্য ‘গীত গাওনি’ মহিলাদের খুব সমাদর করে আনা হয়েছে।
গ্রামের মহিলারা মিলে গোলাকার হয়ে বসে গানের জলসা তৈরি করেছে। যারা যারা গান গাইতে পারে, তারা চারপাশে ঘুরে ঘুরে গাইছে।
পদ্মজাকে দেখে সবার মনোযোগ তার দিকে চলে গেল। গায়ে হলুদের স্থান বাড়ির পেছনে। মোর্শেদ পথ আটকে গামছা কোমরে বাঁধতে বাঁধতে বললেন, ‘আমার ছেড়িরে আমি লইয়া যামু।’
কথা শেষ করে মোর্শেদ পদ্মজাকে পাঁজকোলা করে তুলে নিলেন। হানি চেঁচিয়ে উঠে বললেন, ‘আরে মিয়া করেন কী! দুলাভাইরা কোলে নেয় তো।’
‘বাপ নিলে বিয়া অশুদ্ধ হইয়া যাইব না।’
পদ্মজা লজ্জায় শাড়ির আঁচল দিয়ে মুখ ঢেকে ফেলল। অজানা অনুভূতিতে তার হাত পা কাঁপছে। উপস্থিত মানুষের উচ্ছ্বাস দ্বিগুণ বেড়ে যায়। প্রেমা-প্রান্ত অন্যান্য শিশুদের নিয়ে খুশিতে লাফাচ্ছে, একজন আরেকজনকে রং মাখিয়ে দিচ্ছে। কলা গাছের ছাদের নিচে খাটের ছোটো চৌকি রাখা। সেখানে পদ্মজাকে দাঁড় করিয়ে দেন মোর্শেদ। সামনে সাতটি বদনা, দশটি কলসি ভরতি পানি। একটি কুলোয় রাখা দূর্বা, ধান, হলুদ বাটা, হলুদ শাড়ি, ব্লাউজ, তোয়ালে ও সাবান।
গীত গাওনিরা নেচে নেচে গীত গাইছে। শোনা যাচ্ছে—
‘কালা বাইগুনের (বেগুনের) ধলা ফুল
রুমালে গাঁথিয়া তুল
কইনা লো তোর দয়াল বাবাজির মায়া তুল।
বরির (বরইয়ের) গাছে কুমড়ার ফুল
রুমালে গাঁথিয়া তুল
কইনা লো তোর দয়া চাচাজির মায়া তুল।’
‘কন্যা ডাক দেও তোর জননী না মাইরে
মাও দিয়া যাওক সোনা মুখে হলদিরে
হলুদা, ডাক দেও তোর জনমদাতা বাপেরে
বাবা দিয়ে যাউক তোর সোনা মুখে হলদিরে।’
গীতের তালে তালে ছেলেমেয়েরা একজন আরেকজনকে জোর করে ধরে হলুদ মাখিয়ে দিচ্ছে। পদ্মজার জন্য রাখা হলুদ অনেকেই নেয়ার জন্য ওঁত পেতে আছে, হানির জন্য পারছে না। হানি পাহারাদার হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। ছেলে অনন্ত এসে হলুদ চাইলে হানি মার দেবেন বলে তাড়িয়ে দিলেন। হেমলতা ভিড় কমিয়ে চারিদিক পর্দা দিয়ে ঘিরে ফেলেন। মানুষে গিজগিজ করছে বাড়ি, অথচ দিন কয়েক আগে এরাই পদ্মজার সম্মান লুটে নিতে দেখেছে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে। এই গ্রামবাসীর প্রতি কোনো সহানুভূতি নেই তার। ছয়-সাত জন মহিলাকে নিয়ে হলুদের গোসল শেষ করলেন। অন্যান্য মহিলাদের না নেয়াতে তর্ক-বিতর্ক শুরু হয়ে গেল! গায়ে হলুদ করতে হয় সবাইকে নিয়ে, সবার সামনে…আনন্দ করতে করতে। হেমলতা কেন শুধুমাত্র ছয়-সাত জন নিয়ে করছেন? তিনি অবশ্য কারো কোনো কথার জবাবই দিলেন না।
গোসল শেষ করে পদ্মজাকে হলুদ মসলিন শাড়ি পরানো হলো। কানের কাছে মনজুরা গুনগুন করে কাঁদছেন। পদ্মজার শুনতে ভালো লাগছে না। বিয়ে হলে নাকি এক সপ্তাহ আগে থেকে কান্নাকাটি শুরু হয়। গায়ে হলুদের দিন আত্মীয়রা কাদায় গড়াগড়ি করে কাঁদে। অথচ পদ্মজা, হেমলতা শান্ত!
পদ্মজাকে গায়ে হলুদের খাবার দেয়া হলো। বিশাল এক থালা; তাতে কয়েক রকমের পিঠা, আস্ত একটি মুরগি, পোলাও, শাকসহ নানা পদ। পদ্মজা খা আগে অন্যরা কেড়ে নিয়ে যাচ্ছে। লোক সমাগম কমতেই হেমলতা আলাদা করে প্লেটে করে ভাত আর মুরগির মাংস নিয়ে আসেন, নিজ হাতে খাইয়ে দেন মেয়েকে।
খাওয়ার মাঝে পদ্মজার মনে পড়ে মনজুরা তখন বলেছিলেন, ‘বিয়ের পর মেয়েরা পর হয়ে যায়। মা-বাবা পর হয়ে যায়। স্বামী আর স্বামীর বাড়িই সব। মা-বাপের সঙ্গে দেখা করতেও তাদের অনুমতি লাগে।’
পদ্মজা হেমলতার দিকে তাকিয়ে ভাত চিবোয়। হেমলতা খেয়াল করে দেখেন, পদ্মজা তার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে আছে। চোখের পলক ফেলছে না। চোখজুড়ে চিকচিক করছে জল।
তিনি শান্ত স্বরে বললেন, ‘খাওয়ার সময় কাঁদতে নেই।’
আকস্মিক পদ্মজা ফোঁপাতে শুরু করল। হেমলতা সান্ত্বনা পর্যন্ত দিলেন না, পরবর্তী লোকমা মুখে তুলে দিলেন। ফোঁপাতে ফোঁপাতে খাবার শেষ করল পদ্মজা। চোখের জলে বুক ভিজে একাকার। হেমলতা মেয়ের সামনে শক্ত থাকলেও, ঘরের বাইরে এসে হাতের উলটো পাশ দিয়ে চোখের জল মুছতে লাগলেন। কী যে যন্ত্রণা হচ্ছে বুকে! কাঁদতে পারলে বোধহয় ভালো হতো। কিন্তু কাঁদার সময় কোথায়? সবার সামনে তো আর কাঁদতে পারেন না। ভিড় কমলে কাঁদবেন, অনেক কাঁদবেন, জীবনে শেষ বারের মতো কাঁদবেন। এরপর আর কখনো কাঁদবেন না …
…কোনোদিনও না।
পদ্মজার দুই হাতে গাছের মেহেদি লাগানো হচ্ছে। উঠানে বড়ো চৌকি পেতে তার চারিদিকে রঙিন পর্দা টাঙানো হয়েছে। কাগজের ফুল মাথার উপর ঝোলানো। চারিদিকে ঘিরে রয়েছে মেয়েরা। সামনের খালি জায়গায় চলছে নাচ।
ঠিক তখনই সেখানে উপস্থিত হলো হাওলাদার পরিবার—লাবণ্য, রানি এবং তাদের আত্মীয়স্বজন; সঙ্গে নিয়ে এসেছে বউয়ের বেনারসি, গহনা। হানি ছুটে এসে সবার আপ্যায়নের ব্যবস্থা করলেন। সবার শেষে বাড়িতে ঢুকল আমির। বিয়ের আগের দিন রাতে বরের আগমন সবাইকে খুব হাসাল। কেউ কেউ বলল, এত সুন্দর বউ দূরে রাখার আর তর সইছে না তাই চলে এসেছে। আমির সেসব পাত্তা দিল না। সোজা হেমলতার কাছে গেল। গিয়ে বলল, ‘আম্মা, পদ্মজার সঙ্গে একটু কথা বলতে চাই।’
আমিরের অকপট অনুরোধ। হেমলতা ভীষণ অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন। এমন ছেলে তিনি দুটো দেখেননি।
আমির আবার বলল, ‘বেশিক্ষণ না, একটু সময় চাইছি।’ আমিরের কণ্ঠ পরিষ্কার। মাথা নিচু। পরিবারের ভালো শিক্ষাই পেয়েছে। তবে লাজলজ্জা একদমই নেই।
হেমলতা মৃদু হেসে বললেন, ‘ঘরে গিয়ে বসো। পদ্ম আসছে।’
আমির হেমলতার পা ছুঁয়ে সালাম করে পদ্মজার ঘরের দিকে চলে গেল। হেমলতা পদ্মজাকে ডেকে নিয়ে এসে বললেন, আমির কথা বলতে চায়। ব্যাপারটা দৃষ্টিকটু, কিন্তু না তো করা যায় না। কোনো বিশেষ দরকার হয়তো।’
পদ্মজা ঘরের সামনে এসে থমকে দাঁড়াল। পেছন ফিরে তাকাতেই হেমলতা ইশারায় যেতে বললেন। পদ্মজা ঘরে ঢুকে ডাগর ডাগর চোখ মেলে আমিরের দিকে তাকাল। আমিরকে খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছে, মনে হচ্ছে কিছু নিয়ে খুব চিন্তিত। আমির পদ্মজাকে দেখেই হাসল। বলল, ‘বসো।’
পদ্মজা বিছানার এক পাশে বসে। অন্য পাশে আমির বসে প্রশ্ন করে, ‘যা প্রশ্ন করি সত্যি বলবে।’
পদ্মজা দৃঢ়কণ্ঠে বলল, ‘আমি মিথ্যে বলি না।’
আমির অসহায়ের মতো বলল, ‘তুমি কি মন থেকে এই বিয়েতে রাজি?’
পদ্মজা চকিতে তাকাল। সঙ্গে সঙ্গেই চোখ নামিয়ে নিয়ে বলল, ‘আম্মা যখন যা করেছেন তাই আমি মন থেকে মেনে নিতে পেরেছি।’
আমির বলল, ‘লিখন শাহ তো তোমাকে পছন্দ করে।’
‘জানি। আর আপনি জানেন সেটাও জানি।’
আমি আমাদের বিয়ে ঠিক হওয়ার পর জেনেছি। তুমি…তুমি মনে কিছু নিয়ো না, বলতে চাইছি, যদি তোমার আমাকে অপছন্দ হয় আর লিখন শাহকে ভালোবেসে থাকো বলতে পারো। আমি বিয়ে ভেঙে দেব।’
পদ্মজা অপমানে লাল হয়ে গেল। থমথমে গলায় বলল, ‘অবিশ্বাস থাকলে বিয়ে না হওয়াই ভালো। আপনি ভেঙে দিতে পারেন।’
আমিরের চোখ কোটর থেকে বেরিয়ে আসতে চাইল। পদ্মজা ধারালো স্বরেও কথা বলতে পারে! আমির ইতস্তত করে বলল, ‘আমার কোনো অবিশ্বাস নেই। তোমার মনে কেউ না থাকলে বিয়ে আমার সঙ্গেই হবে। আর কারোর সঙ্গে হতে দেব না।’
পদ্মজা কিছু বলল না। উঠে যেতে চাইলে আমির অনুনয়ের সঙ্গে বলল, ‘একবার হাত ধরা যাবে?’
‘আজ নয়, আগামীকাল।’ বলার সময় পদ্মজার ঠোঁটে দেখা গেল হাসির রেখা।
আমির সেটা খেয়াল করে মুগ্ধস্বরে বলে উঠল, ‘সুবহানআল্লাহ।’
.
বিয়ের অনুষ্ঠান শুরু হয়েছে অনেকক্ষণ আগে। পদ্মজা বধূ সেজে বসে আছে। দুই পাশে বসে আছে পূর্ণা ও প্রেমা। কাজী বিয়ে পড়াচ্ছেন। অনেকক্ষণ ধরে পদ্মজাকে কবুল বলতে বলছেন। পদ্মজা কিছুতেই বলছে না। সে একমনে হেমলতাকে খুঁজছে। বউ কবুল বলছে না শুনে অনেকে ভিড় জমিয়েছে। হেমলতা সেই ভিড় ভেঙে ঘরে ঢুকলেন। হেমলতাকে দেখে পদ্মজার ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠল, ছলছল চোখ নিয়ে তিনবার কবুল বলল সে। হেমলতার দুই চোখে পানি, ঠোঁটে হাসি। পদ্মজাকে বধূ সাজাবার পর এই প্রথম দেখলেন তিনি। লাল বেনারসিতে পদ্মজার রূপ যেন গলে গলে পড়ছে। পাশের ঘরে কে যেন কাঁদছে! হেমলতা দেখতে গেলেন।
আয়না দেখানো পর্ব শুরু হয়। আয়নায় তাকাতেই আমির চোখ টিপল। পদ্মজা লজ্জা পেয়ে সরিয়ে নিলো দৃষ্টি। আমির সবার চোখের আড়ালে খপ করে ধরে ফেলল পদ্মজার এক হাত। স্বামীর অধিকার নিয়ে ধরা প্রথম স্পর্শে কেঁপে উঠে পদ্মজা। অদ্ভুত এক অনুভূতিতে তলিয়ে যেতে থাকে সে।
আমির ফিসফিস করে বলল, ‘এই যে ধরলাম, মৃত্যুর আগে ছাড়ছি না।’ বিয়ে বাড়ির কোলাহল কমে গেছে। বিদায়ের পালা চলছে। করুণ কান্নার স্বরে চারিদিক হাহাকার করছে। মনজুরা, হানি কেঁদে কুল পাচ্ছে না। মোর্শেদ নদীর ঘাটে বসে গোপনে চোখের জল ফেলছেন। পূর্ণা পদ্মজার গলা জড়িয়ে সেই যে কান্না শুরু করেছে থামছেই না। কাঁদছে প্রেমা ও প্রান্ত। একটা মেয়ের বিয়ের বিদায় পর্ব কতটা কষ্টের তা শুধু সেই মেয়ে আর তার পরিবার জানে। পদ্মজা পূর্ণার মাথায়, পিঠে হাত বুলিয়ে দিয়ে বার বার বলছে, ‘বোন, বোন আমার। মন খারাপ করে থাকবি না কিন্তু। একদম কাঁদবি না। আমি আসব। তুইও যাবি। আমার খুব কষ্ট হবে রে বোন। আর কাঁদিস না। এভাবে কাঁদলে অসুস্থ হয়ে যাবি।
একজন তাড়া দেয়, সন্ধে হয়ে যাবে। তাড়াতাড়ি করুন।’
পদ্মজা আকুল হয়ে কেঁদে ডাকল, ‘আম্মা…আমার আম্মা কোথায়? আম্মা, ও আম্মা।’
হেমলতা লাহাড়ি ঘরের পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন। পদ্মজার ডাকে সাড়া দিতে সামনে এগোতে থাকেন। প্রতি কদমে কদমে বুক ব্যথায় চুরমার হয়ে যাচ্ছে। তবুও হাসার চেষ্টা করছেন। কিন্তু পারছেন না। যে মেয়ের জন্য তিনি নতুন করে জীবনের অর্থ খুঁজে পেয়েছিলেন সেই মেয়ের আজ বিদায়! সারাজীবনের জন্য অন্যের ঘরে চলে যাবে। হেমলতাকে দেখেই পদ্মজা ছুটে এসে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠল। হেমলতা দ্রুত চোখের জল মুছে, পদ্মজাকে আদুরে কণ্ঠে বললেন, ‘এভাবে কাঁদতে নেই মা। বিয়ে তো হবারই কথা ছিল।’
‘আম্মা, তোমাকে ছাড়া কেমন করে থাকব?’
‘সবাইকেই থাকতে হয়। আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যাবে মা।
হেমলতা পদ্মজার চোখেমুখে কপালে চুমু খেয়ে, দুই চোখের জল মুছে দিয়ে বললেন, শ্বশুর বাড়ির সবার সঙ্গে মিলেমিশে থাকবি। নিজের খেয়াল রাখবি।’
পদ্মজা হাউমাউ করে কাঁদছে। হেমলতাকে জোরে চেপে ধরে বলল, ‘আম্মা আমি যাব না। আম্মা যাব না আমি।’
হেমলতা পদ্মজার মুখের দিকে চাইতে পারছেন না। ভাঙা গলায় আমিরকে ডেকে বললেন, ‘বাবা, নিয়ে যাও আমার মেয়েকে। ওর খেয়াল রেখো। ওর আব্বা ঘাটে বসে আছে। ডাকতে হবে না, একা থাকুক। তোমরা পদ্মকে নিয়ে যাও। সন্ধে হয়ে যাচ্ছে।’
আমির নম্রকণ্ঠে বলল, ‘পদ্মজাকে সারাজীবন আগলে রাখব। আপনি চিন্তা করবেন না।
হেমলতা কৃতজ্ঞচিত্তে তাকিয়ে রইলেন শুধু কিছু বলতে পারলেন না। চোখ বেয়ে টুপটুপ করে কয়েক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ে মাটিতে পদ্মজার বেনারসিতে।
আমির পদ্মজাকে পাঁজকোলা করে নেয়। পদ্মজা আকুতিভরা কণ্ঠে হেমলতাকে ডেকে অনুরোধ করে, ‘আম্মা আমাকে ধরো। ওরা নিয়ে যাচ্ছে, আম্মা…’
হেমলতা মুখ ঘুরিয়ে নেন। পূর্ণা দুই হাতে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। পদ্মজাকে পালকিতে বসিয়ে তার গালে দুই হাত রেখে আমির বলল, ‘কেঁদো না আর। একদিন পরই আসব আমরা।’
পদ্মজা দুই হাতে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে উঠে। সব কিছু শূন্য লাগছে। মস্তিষ্ক ফাঁকা হয়ে গেছে। পালকি ছুটে চলছে শ্বশুরবাড়ি।
পূর্ণা হেমলতাকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘আম্মা কেন বিয়ে দিলে আপার? তোমার কি কষ্ট হচ্ছে না?’
হেমলতা হাঁটুভেঙে মাটিতে বসে পড়েন। পূর্ণাকে জড়িয়ে ধরে গগন কাঁপিয়ে চিৎকার করে কেঁদে ওঠেন। উপস্থিত সবার কান্না থেমে যায়। তিনি বলেন, ‘আমি যদি পারতাম তাহলে আমার পদ্মর বিয়ে দিতাম না পূর্ণা। ও যে আমার সাত রাজার ধনের চেয়েও বেশি।’
হানি বরাবরই কাঁদুক স্বভাবের। হেমলতা কখনো কাঁদে না। সেই হেমলতাকে এভাবে কাঁদতে দেখে তিনি নিজেও কান্না লুকিয়ে রাখতে পারলেন না।
হেমলতার মাথা বুকের সঙ্গে জড়িয়ে ধরে ভেজা কণ্ঠে বললেন, ‘এটাই তো নিয়ম। কেঁদে আর কী হবে?’
হেমলতা মুহূর্তে ছোটো বাচ্চা হয়ে গেলেন। হানিকে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন। বললেন, ‘আপা, আপা ওরা আমার মেয়ে নেয়নি। আমার কলিজা ছিঁড়ে নিয়ে যাচ্ছে। আপা, কেন বিয়ে দিতে হলো আমার পদ্মর?’
মনজুরা হেমলতার মাথায় হাত রেখে সান্ত্বনা দেন, ‘দেখিস পদ্ম খুব ভালো থাকবে। ও খুব ভালো মেয়ে।’
হেমলতা হানিকে ছেড়ে মনজুরাকে জড়িয়ে ধরলেন। হাত পা ছুঁড়ে কাঁদতে কাঁদতে বললেন, ‘আম্মা, আম্মা তুমি কখনো আমাকে কিছু দাওনি এইবার আমার এই মরণ কষ্টটা কমিয়ে দাও। আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। আম্মা, আমার পদ্মকে ছাড়া আমি কীভাবে থাকব?
মনজুরার বুক ধুকপুক করছে। জন্মের পর হেমলতা কী কখনো এভাবে কেঁদেছে? মনে পড়ছে না। তিনি পারেননি হেমলতার এই কষ্ট কমাতে। শুধু বুকের সঙ্গে চেপে ধরে রাখলেন। এভাবে যদি ছোটো থেকে আগলে রাখতেন, হেমলতার জীবনটা এত কষ্টের হতো না।
.
পদ্মজা ছটফট করছে। কিছু ভালো লাগছে না। ইচ্ছে হচ্ছে ছুটে যেতে মায়ের কাছে। গলা শুকিয়ে কাঠ। এখুনি মারা যাবে হয়তো। পদ্মজা হঠাৎ চিৎকার করে উঠল, ‘থামো তোমরা, থামো। আল্লাহর দোহাই লাগে থামো।’
পদ্মজার চিৎকার শুনে আমির ভড়কে যায়, বেয়াড়াদের দ্রুত থামতে বলে। পালকি থেমে যায়। পদ্মজা পালকি থেকে মাটিতে পা রেখেই মোড়ল বাড়ির দিকে ছুটতে থাকল। কেউ আটকে রাখতে পারল না। সবাইকে ধাক্কা দিয়ে দূরে ঠেলে ছুটে চলেছে সে মায়ের বুকে। আমির শুধু চেয়ে রইল। সন্ধ্যা নামার পূর্ব মুহূর্তে একটা লাল বেনারসি পরা অপরূপ সুন্দরী মেয়ে ছুটছে। দেখতেও ভালো লাগছে।
২৮
‘আম্মা…’
পদ্মজার কণ্ঠে আম্মা ডাকটি হেমলতার অস্তিত্ব মাড়িয়ে দিয়ে যায়। হেমলতা থমকে গিয়ে ঘুরে তাকান। উঠে দাঁড়ানোর জন্য প্রস্তুত হতেই পদ্মজা ঝাঁপিয়ে পড়ে বুকে। হেমলতা টাল সামলাতে না পেরে আবার মাটিতে বসে পড়েন। পদ্মজা নিরবিচ্ছিন্নভাবে কাঁদতে থাকল। হেমলতা সীমাহীন আশ্চর্য হয়ে কথা বলার শক্তি হারিয়ে ফেলেছেন। নির্বাক, স্তব্ধ থেকে শুধু পদ্মজার কান্না অনুভব করছেন। কান্নার দমকে পদ্মজার শরীর ঝাঁকি দিচ্ছে বারংবার।
পূর্ণা পদ্মজাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘আপা… আর যেয়ো না।’
পদ্মজা অনুরোধ স্বরে হেমলতাকে বলল, ‘আম্মা আমি যাব না।’
হেমলতার দুই চোখ বেয়ে টপটপ করে জল পড়ছে। প্রতি ফোঁটা জল পদ্মজার বুকে সাইক্লোন, টর্নেডোসহ সব ধরনের দুর্যোগ বইয়ে দিচ্ছে। হেমলতা শক্ত করে জড়িয়ে ধরলেন পদ্মজাকে। অশ্রুরুদ্ধ কণ্ঠে বললেন, ‘কোথাও যেতে হবে না তোর।’
হেমলতার এহেন কথা শুনে হানি, মনজুরার মাথায় বাজ পড়ল। সে কী কথা! হেমলতা একবার যখন বলেছে তাহলে সত্যি যেতে দিবে না। তাহলে মেয়ের বিয়ে দেওয়ার কী দরকার ছিল! হানি শক্ত কিছু কথা শোনানোর জন্য প্রস্তুত হয়। তখনই হেমলতা পদ্মজাকে সরিয়ে দেন নিজের কাছ থেকে। চোখে মুখ শক্ত করে কাঠ কাঠ কণ্ঠে বললেন, ‘এটা ঠিক করিসনি পদ্ম! এভাবে চলে আসা মোটেও ভদ্রতা নয়। আবেগকে এত প্রশ্রয় দিতে নেই। বিয়ে দিয়েছি এবার শ্বশুর বাড়ি যেতেই হবে। ওই তো আমির এসেছে।’
হেমলতা হাত ঝেড়ে মাটি থেকে উঠে দাঁড়ান। হঠাৎ মায়ের রূপ পালটে যাওয়াতে পদ্মজা স্তব্ধ হয়ে যায়। হাঁ করে তাকিয়ে আছে। সে ভাবছে, চোখের পলকে আম্মা পালটে গেল কেন? এই তো মাত্রই কাঁদছিল!
.
পদ্মজা নিজের চুলে আঙুল পেঁচাতে পেঁচাতে হাসছে। তুষার রয়ে সয়ে প্রশ্ন করল, ‘হাসছেন কেন?’
পদ্মজা নাটকীয়ভাবে ব্যথিত স্বরে বলল, ‘আপনি কাঁদছেন তাই।’
তুষার দ্রুত চোখের জল মুছল। মৃদু হেসে বলল, ‘কাঁদছি নাকি!’
পদ্মজা হঠাৎ গুনগুনিয়ে কাঁদতে শুরু করল। তুষার জানতে চাইল, ‘আপনি কাঁদছেন কেন?’
মুহূর্তে পদ্মজা দাঁত কেলিয়ে হেসে উঠে। চোখে জল ঠোঁটে হাসি নিয়ে বলল, ‘মনে চাইল তাই। আম্মা বলতেন, যখন যা ইচ্ছে হয় করে ফেলতে। তাতে কারো ক্ষতি বা নিজের কোনো ক্ষতি না হলেই হলো।’
‘আপনার মায়ের খবরটা গতকাল শুনলাম। জানেন সারারাত ঘুমাতে পারিনি।’
‘আপনার মনটা খুব নরম, স্যার। কিন্তু কঠিন ভাব নিয়ে থাকেন, আমার আম্মার মতো।’
‘তারপর কী হলো?’
পদ্মজা চেয়ার ছেড়ে মেঝেতে বসে শিশুসুলভ ভঙ্গিতে বলল, ‘আর তো বলব না।’
তুষার শ্বাসরূদ্ধকর কণ্ঠে প্রশ্ন করল, ‘কেন?’
পদ্মজা ঘাড়ে এক হাত রেখে ক্লান্ত ভঙ্গিতে বলল, ‘এমনি।’
‘হেয়ালি করবেন না, পদ্মজা। আপনি ছাড়া এই রহস্যের কিনারা অসম্ভব। আপনার পুরো গ্রাম আপনার বিপক্ষে। খুনের কারণ ও কেউ বলতে পারছে না। আমরা তদন্ত করেও কুল পাচ্ছি না।’
পদ্মজা চোখ গরম করে তাকাল। কটমট করে বলল, ‘বলব না মানে বলব না।’
তুষার দ্বিগুণ গলা উঁচিয়ে বলল, ‘তাহলে এতটুকু কেন বললেন?’
‘আমার ইচ্ছে হয়েছে তাই।’
‘আপনার ইচ্ছায় সব হবে না।’
‘যা খুশি করে নিতে পারেন।’
পরিস্থিতি বিগড়ে যাচ্ছে। পরিস্থিতি সামলাতে তুষার দুই হাতে মুখ ঢেকে রাগ নিয়ন্ত্রণ করে। এরপর ধীরেসুস্থে বলল, ‘দেখুন যদি সব খুলে না বলেন, তাহলে আমি আপনাকে আইনের হাত থেকে বাঁচাতে পারব না। নির্দোষ প্রমাণ করতে পারব না। আর আমার মন বলছে, আপনি দোষ করতে পারেন না।’
‘সবসময় মন সঠিক কথা বলে না।’
‘তাহলে বলছেন, আপনি নির্দোষ না?’
পদ্মজা চোখ সরিয়ে নিলো। হাসল। কী যন্ত্রণা! কত কষ্ট সেই হাসিতে! চোখ ভরতি জল নিয়ে আবার তাকাল তুষারের দিকে। বলল, ‘আমি খুন করেছি। একই রাতে, একই প্রহরে, একই জায়গায় একসঙ্গে পাঁচ জনকে। আপনার আইন যা শাস্তি দেয়—তা আমি মাথা পেতে নেব।’
তুষার অধৈর্য হয়ে বলল, ‘আপনার ফাঁসির রায় হবে—পদ্মজা। আপনি বুঝতে পারছেন না। আমার আপনাকে বাঁচাতে ইচ্ছে হচ্ছে।’
‘ওপারে যাওয়া আমার জরুরি। আমি সব রায় মেনে নেব।’
‘আমি মানতে পারব না,’ তুষারের অকপট স্বীকারোক্তি। কথাটা মুখ থেকে বের হওয়ার পর তুষার বুঝল সে অচেনা এবং ভয়ংকর অনুভূতি নিয়ে খেলছে। পদ্মজার দিকে চেয়ে অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। পদ্মজা তুষারকে পরখ করে নিয়ে হাসল। শান্ত ভঙ্গিতে বলল, এত ব্যকুল কেন হচ্ছেন? আমার প্রেমে পড়ে যাননি তো?
তুষার থতমত খেয়ে গেল, বেশ অনেকক্ষণ বসে রইল গাঁট হয়ে। ওপর থেকে আদেশ এসেছে—পদ্মজা কেন এতগুলি খুন করেছে, সেই রহস্য উদঘটন করতে। না পারলে চাকরি চলে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
চাকরি চলে যাক সমস্যা নেই, নিজের শান্তির আর আত্মতৃপ্তির জন্য হলেও পদ্মজার পেছনের ছয়টি বছরের গল্প জানতেই হবে। এই কেস হাতে পাওয়ার পর থেকে তার ঘুম হচ্ছে না রাতে। সারাক্ষণ মস্তিষ্ক কিলবিল করে। এত জটিল কেস কখনো ফেস করতে হয়নি। অলন্দপুর পুরোটা ঘেঁটেও কিছু জানা যায়নি। যারা খুন হয়েছে তারা আর পদ্মজা ছাড়া হয়তো কেউ জানেও না। তুষার আবার বলল, ‘আপনার বিরুদ্ধে সব প্রমাণ। আপনার বিরুদ্ধে সবাই সাক্ষী দিচ্ছে। আপনি কী…’
কথার মাঝপথে তুষারকে থামিয়ে দিয়ে পদ্মজা বলল, ‘খুনগুলো তো সত্যি আমি করেছি। তাহলে প্রমাণ আমার বিরুদ্ধেই তো থাকবে।’
তুষারের মন বিরক্তে তেঁতো হয়ে যায়। পদ্মজার সামনে কয়েকবার পায়চারি করে বেরিয়ে গেল সে, সিগারেট ফুঁকে মাথা ঠান্ডা করল। চা নিয়ে এলো ফাহিমা। তুষার শুধাল, ‘মেয়েটাকে তোমার অপরাধী মনে হয়?
‘আমি কিছু ভাবতে পারছি না, স্যার। মেয়েটাকে দেখলে আমার হাত- পা অবশ হয়ে পড়ে। এত মেরেছি কিছুতেই ঢুঁ শব্দটাও করেনি! এরপর থেকে আমি রাতে ভয়ংকর স্বপ্ন দেখি।’
‘পৃথিবীটা রহস্যে ঘেরা, ফাহিমা। একজন নারী পাঁচ জনকে কীভাবে খুন করতে পারে? আবার একসঙ্গে? সেই সাহস কী করে পেল?’
‘সেটা আমিও ভাবছি, স্যার। কীভাবে খুন করেছে সেটা ধারণা করা যাচ্ছে। কিন্তু এত সাহস, ধৈর্য কীভাবে কোনো নারীর থাকতে পারে!
‘নারীরা চাইলে সব পারে কথাটা শুনে এসেছি। এবার স্বচক্ষে দেখছি।’
‘জি, স্যার।’
‘কত আসামি পায়ে পড়ে জীবন ভিক্ষা চেয়েছে। কিছুতেই মন গলেনি। মন কাঁদেনি। এই মেয়েটা জীবন চায় না; তবুও আমার ইচ্ছে হচ্ছে নতুন একটা জীবন পাবার সুযোগ করে দিতে, নির্দোষ প্রমাণ করতে।’
ফাহিমা অবাক হয়ে তাকাল তুষারের দিকে। তুষার কখনও হু, হ্যাঁ-এর বাইরে কিছু বলে না। খুব কঠিন, কাঠখোট্টা একটা মানুষ। অনুভূতি বলতে কিছু নেই। তার মুখে এই ধরনের আবেগী কথাবার্তা শুনে অবাক হচ্ছে ফাহিমা।
‘পরিস্থিতি হাতের বাইরে। পদ্মজার ফাঁসি দেখার জন্য দেশ উতলা হয়ে আছে।
‘কেন এমন হচ্ছে, ফাহিমা?’
‘আজ যদি হেমলতা উপস্থিত থাকতেন গল্পটা অন্যরকম হতো, স্যার।’ তুষার আবার ফিরে এসে পদ্মজার সামনের চেয়ারে বসল। ধীরকণ্ঠে বলল, ‘আজই শেষ দিন। এরপর আর আমাদের সাক্ষাৎ হবে না।’
পদ্মজা চমকে তাকাল। দ্রুত তুষারের পায়ের কাছে বসে বলল, ‘আপনার আম্মা কি আপনাকে বিয়ের জন্য খুব চাপ দেয়?’
‘আপনি কী করে জানলেন?’
‘সেদিন দেখলাম ফোনে কাউকে আম্মা ডেকে রেগে বিয়ে না করার কথা বলছিলেন।’
‘আমি তো অনেক দূরে দাঁড়িয়ে কথা বলছিলাম। আপনার শ্রবণ শক্তি তো প্রখর,’ তুষার বলল। লম্বা নিশ্বাস নিয়ে আবার যোগ করল, ‘কোন কথাটা লুকিয়ে আপনার মা বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন?’
‘আপনি জানলেন কী করে?’
‘কিছু তথ্য পেয়েছি গতকাল। এইটুকুর জন্য বিশ্বাসঘাতক অপবাদ দিতে পারেন না। উনি আপনার ভালোর জন্যই…’
পদ্মজা চুপ থেকে হুট করে ফোঁস করে জ্বলে উঠে বলল, ‘আপনি বুঝবেন না আমার কষ্ট। না পাওয়া দামি সময়টাকে আমি কতবার মনে করে বুক ভাসিয়ে কেঁদেছি—বুঝবেন না আপনি।’
পদ্মজা কাঁদতে কাঁদতে হেসে উঠল। আবার পরক্ষণেই কান্না শুরু করল করুণস্বরে, গা কাঁপিয়ে তোলার মতো কান্না। মনে হয় কোনো অশরীরী কাঁদছে। কী বিশ্রি, ভয়ংকর সেই কান্নার ছন্দ।
তুষারের কান ঝাঁ ঝাঁ করে ওঠে। চিন্তায় মাথার রগ দপদপ করছে। আগামীকাল ভোরে পদ্মজাকে কোর্টে তোলা হবে, রায় হবে। পদ্মজার ফাঁসি চাই বলে রাস্তায় রাস্তায় মিছিল হচ্ছে, রেডিয়োতে চলছে আন্দোলন। কিন্তু তুষারের মন যে কিছুতেই মানতে পারছে না। এমন নিষ্পাপ মনের, অপরূপ সুন্দরীর বিরুদ্ধে পুরো পৃথিবী!
কী আশ্চর্য!
বাঁকা রাস্তা পেরিয়ে পালকি চলছে ধীরে ধীরে। সন্ধ্যার আজান পড়েছে কিছুক্ষণ আগে। দিনের আলো কিছুটা এখনও রয়ে গেছে। দক্ষিণ দিক থেকে ধেয়ে আসছে হাওয়া। শীতল, নির্মল পরিবেশ। পদ্মজার বুক ধুকপুক করছে। নতুন মানুষ নতুন পরিবেশে মানিয়ে নিতে পারবে তো! একবার সে হাওলাদার বাড়ি গিয়েছিল। অন্দরমহল নামে এক বিশাল বাড়ি আছে। সেই বাড়িতে মেয়ে-বউরা থাকে। এখন কী সেও থাকবে? পদ্মজা পর্দার ফাঁকফোকর দিয়ে বাইরে চোখ মেলে তাকাল। আমির হাতে পাগড়ি নিয়ে তার বড়ো ভাইয়ের সঙ্গে আলোচনা করছে। চোখেমুখে উপচে পড়ছে খুশি। পদ্মজা চোখ সরিয়ে নিলো। মায়ের কথা, পূর্ণার কথা খুব মনে পড়ছে।
অন্দরমহলে মেয়েরা অপেক্ষা করছে নতুন বউয়ের জন্য। আমির গেটের সামনেই পালকি থামিয়ে দিয়েছে। জাফর বিরক্তিতে ‘চ’-এর মতো শব্দ করে বলল, ‘এইখানে আবার থামালি কেন?’
আমির পাগড়ি রিদওয়ানের হাতে দিয়ে বলল, ‘আমার বউ আমার কোলে চড়ে অন্দরমহলে যাবে।’
পদ্মজা কথাটা শুনেই কাঁচুমাচু হয়ে চুপসে গেল। আমির পালকির পর্দা সরিয়ে হাত বাড়িয়ে নামতে ইশারা করল। পদ্মজার নাক অবধি টানানো ঘোমটা। আমির সরাতে গিয়েও সরাল না। মুখে বলল, ‘কী হলো? নেমে আসো।’
পদ্মজা লজ্জায় জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়েছে। সে গাঁট হয়ে বসে রইল। আমির হেসে নিজের কপাল চাপড়াল এক হাতে, এরপর নিজেই টেনে নামাল পদ্মজাকে। তখনো পদ্মজার নাক অবধি ঘোমটা। আমির চট করে তাকে পাঁজকোলা করে নেয়। কুঁকড়ে গেল পদ্মজা, ভয়ে দুহাতে জড়িয়ে ধরল আমিরের গলা। আমির যত এগোচ্ছে, সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে তার গায়ের উষ্ণতা পদ্মজার শাড়ি ভেদ করে সর্বাঙ্গে ছড়িয়ে পড়ছে। অচেনা, অজানা অনুভূতিরা যেন জেঁকে বসেছে চারিদিকে।
মরণ প্রেমের সূত্রপাত এখান থেকেই শুরু হয়!
২৯
অন্দরমহলের সদর দরজায় গ্রামের মেয়েদের ভিড় জমেছে, সবাই দেখতে এসেছে নতুন বউকে। আমিরের কোলে পদ্মজাকে দেখে মিটিমিটি হাসছে। ফিসফিসিয়ে একজন আরেকজনকে কিছু বলছে। ফরিনা ধমক দিয়ে কোলাহল থামিয়ে দিলেন। আমির দরজার সামনে উপস্থিত হতেই আনিসা বলল, ‘এইবার বউকে নামান ছোটো ভাই। বড়ো আম্মার পা ছুঁয়ে সালাম করে এরপর ঘরে ঢুকেন।’
আনিসা আমিরের চাচাতো ভাইয়ের বউ, জাফরের স্ত্রী। দেশের বাইরে থাকে। ঢাকার স্বনামধন্য এক ভার্সিটির প্রফেসরের মেয়ে আনিসা। বিয়ের পরপরই স্বামী নিয়ে দূর-দূরান্তে পাড়ি জমিয়েছিল। দুই সপ্তাহ আগে ছুটি কাটাতে শ্বশুরবাড়ি এসেছে। আনিসার কথামতো আমির পদ্মজাকে কোল থেকে নামিয়ে দিল। এরপর দুজন নত হয়ে সালাম করল ফরিনাকে। ফরিনা হেসে ছেলে এবং ছেলের বউকে চুমু খেলেন। আবেগে আপ্লুত হয়ে বললেন, ‘সুখী হ, বাবা। বউয়ের খেদমতে জীবনভর ভালা থাক। আমার কইলাম বছরের মধ্যেই নাতি চাই।’
লাবণ্য ফোড়ন কাটল, ‘পদ্ম আমার লগে শহরে যাইব আম্মা। আমরা একলগে কলেজে পড়াম। নাতি-টাতি পরে পাইবা।’
ফরিনা ক্ষুধার্ত বাঘিনীর মতো তেড়ে এসে লাবণ্যর গালে চড় বসিয়ে দিয়ে উঁচু কণ্ঠে বললেন, ‘আমার কথার পিছে কথা কওনের সাহস দেখাবি না।’
আকস্মিক ঘটনায় সবাই হকচকিয়ে যায়। পদ্মজা অবাক চোখে তাকাল। সামান্য কথার জন্য কোনো মা এত মানুষের সামনে যুবতী মেয়েকে মারে? লাবণ্য লজ্জায়-অপমানে কাঁপতে লাগল, চোখে টলমল জল নিয়ে পালিয়েই গেল একরকম। ফরিনার চোখেমুখে কাঠিন্য ফুটে আছে। পদ্মজা ভয়ে চোখের দৃষ্টি মাটিতে রাখে। ফরিনা পদ্মজার হাতে ধরে ভেতরে নিয়ে যেতে যেতে বললেন, ‘মুখে মুখে কথা কইবা না কুনুদিন। যা কই মাইন্যা চলবা। শ্বশুর বাড়ির সব মানুষ হইতাছে গিয়া দেবতার লাহান। তাগোরে সেবা করলেই জান্নাত পাওন যাইব। নইলে কুনুদিন জান্নাতে পাও দিতে পারবা না। হুনছি তো তুমি হইছো গিয়া অনেক বাধ্য ছেড়ি। কামে-কাজেও হেইডা দেখাইবা। আমার কথা গুলান মনে রাখবা।’
পদ্মজা মাথা নাড়ায়। মুসলমানদের দেবতার সঙ্গে তুলনা করাটা পদ্মজার ভালো লাগেনি। কিছু কথা গলায় এসেও আটকে গেছে। বলার সাহস পাচ্ছে না।
ফরিনা আবার বললেন, ‘হুনো বউ, স্বামীর উপরে কিচ্ছু নাই। স্বামীরেই দুনিয়া ভাববা, মা-বাপ, ভাই-বোন হইছে গিয়া পর। স্বামী আপন। স্বামীর বাইরে কিছু ভাববা না। স্বামী যা কয় তাই মানবা। নিজের হাতে স্বামীর পা ধুইয়া দিবা। স্বামী বইতে কইলে বইবা, উঠতে কইলে উঠবা, হুত্তে কইলে হুইবা। স্বামী যহন কাছে ডাকব না করবা না। আল্লাহ বেজার হইব। ফেরেশতারা অভিশাপ দিব। দুনিয়াত স্বামীর আদরের থাইকা মধুর আর কিছু নাই।’
পদ্মজা অপ্রতিভ হয়ে উঠেছে। লজ্জায়, আড়ষ্টতায় সারা শরীর ঘামছে। আনিসা ফরিনাকে ফিসফিসিয়ে বলল, ‘বড়ো আম্মা, অনেক মানুষ আছে তো। এসব পরেও বলতে পারতেন।’
আনিসার কথা পুরোপুরি উপেক্ষা করলেন ফরিনা। তিনি পদ্মজাকে একটা চেয়ারে বসিয়ে আবারও বলতে শুরু করলেন, ‘খালি স্বামী লইয়াও পইড়া থাহন যাইব না। তোমার শ্বশুর-শাশুড়ি জীবিত আছে। তাগোর সেবা করবা। যহন যা করতে কই, করবা। না পারলে কইবা, শিখাইয়া দিয়াম। হত্তিদিন ভোরে উঠবা। নামাজ পইড়া রান্ধাঘরে যাইবা। তহন বাকিসব ভুইলা রান্ধনে মন দিবা।’
আমির কপালের চামড়া কুঁচকে মায়ের কথা শুনছিল। এবার সে ধৈর্যহারা হয়ে বলল, ‘রান্নাবান্না করার জন্য অনেক মানুষ আছে আম্মা। পদ্মজা রাঁধতে হবে না। আর আমার এত সেবাও লাগবে না। বড্ড ক্লান্ত লাগছে। ভিড় কমাও। আর নিয়মনীতি শেষ করো। এরপর আমার বউ আমার ঘরে ছেড়ে দাও।’
আমিরের কথা শেষ হতেই হাসির রোল পড়ে যায়। পদ্মজা ঠোঁট টিপে হাসি আটকায়। ফরিনা কিছু কঠিন কথা বলতে প্রস্তুত হোন।
আনিসা রসিকতা করে বলল, ‘আজ তো একসঙ্গে থাকা যাবে না। আরো একদিন ধৈর্য ধরুন।’
আমির প্রবল বিস্ময় নিয়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘কেন? বিয়ে তো হয়ে গেছে।’
কেউ আমিরের জবাব দিল না। উলটো সবাই হাসতে থাকল।
‘আইজ কাইলরাত্রিরে হতচ্ছাড়া!’ বলল শাহানা। জাফরের বড়ো বোন। আমিরের বিয়ে উপলক্ষে বাপের বাড়ি এসেছে। সঙ্গে নিয়ে এসেছে পুরো শ্বশুরবাড়ি। আমির শাহানাকে প্রশ্ন করল, ‘কালরাত্রি তো হিন্দুদের নিয়ম। আমি মানি না। আমার বউ আমার ঘরে দিয়ে আসা হোক।’
‘সবসময় ত্যাড়ামি করিস কেন? আমরাও তো নিয়ম মেনেছি,’ বলল জাফর। কণ্ঠে তার গাম্ভীর্য। তাতেও লাভ হলো না। আমির কিছুতেই এই নিয়ম মানবে না। ফরিনা, শাহানা, শিরিন, আনিসা, আমিনাসহ অনেকে আমিরকে মানানোর চেষ্টা করল। কারো কথা আমিরের কর্ণগোচর হলো না। এর মধ্যে রিদওয়ান আমিরের সঙ্গে তাল দিয়ে বলল, ‘কালরাত্রি-টাত্রি বাদ। এসব নিয়ম মেনে লাভটা হবে কী? যার বউ তাকে তার বউ দিয়ে দেও।’
‘তুই চুপ থাক। আগুনে ঘি ঢালবি না,’ বললেন আমিনা।
রিদওয়ান চুপসে গেল। থামলো না শুধু আমির। ফরিনাও জেদ ধরে বসে আছেন। তিনি আমির-পদ্মজাকে আজ কিছুতেই একসঙ্গে থাকতে দিবেন না। যেমন মা তেমন তার ছেলে। মজিদ হাওলাদার অনেকক্ষণ যাবৎ এসব দেখছেন। চেঁচামিচি আর নেয়া যাচ্ছে না। তিনি ওপর থেকে নেমে আসেন। অন্দরমহলটি তিন তলা নিয়ে তৈরি। তৃতীয় তলায় কেউ থাকে না। শুধু ছাদ আছে। ঘর বানানো হয়নি। অসমাপ্ত ইটের পুরনো বাড়ি। চিন্তাভাবনা চলছে তৃতীয় তলাটা থাকার জন্য উপযুক্ত করার। মজিদকে দেখে সবাই থেমে গেল। তিনি পদ্মজার পাশে চেয়ার নিয়ে বসেন। পদ্মজা একটু নড়েচড়ে বসে। মজিদ পদ্মজাকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তুর্কি কী চাও মা? আজ শাশুড়ির সঙ্গে থাকবে? নাকি আমার পাগল ছেলের সঙ্গে? ভেবে বলো। তুমি যা বলবে তাই হবে।
পদ্মজা উসখুস করতে করতে বলল, ‘জি, আম..আম্মার সঙ্গে থাকব।’
ফরিনার ঠোঁটে বিশ্বজয়ের হাসি ফুটে উঠে। তিনি আমিরের দিকে তাকিয়ে ব্যঙ্গ করে হাসেন। পরপরই পদ্মজার উপর ঝাঁপিয়ে পড়েন। চুমুতে চুমুতে পদ্মজা গাল ভরিয়ে দেন।
একবার আড়চোখে আমিরকে দেখল পদ্মজা। আমির তাকিয়েই ছিল। পদ্মজা তাকাতেই আমির চোখ রাঙানি দিয়ে হুমকি দিল। সঙ্গে সঙ্গে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলো পদ্মজা। বিয়ের বাকি সব নিয়ম শুরু হলো, ওপর থেকে নেমে এলেন নুরজাহান। তিনি এই বাড়ির প্রধান কর্ত্রী, মজিদ হাওলাদারের জন্মদাত্রী। তিনি হইহই করে নামলেন, ‘কইরে…কইরে আমার নাত বউডা কই?’ বলতে বলতে ছুটে আসেন তিনি। উপস্থিত সবাই দৃষ্টি ঘুরিয়ে নুরজাহানের দিকে তাকাল। নুরজাহান পদ্মজার সামনে এসে বসলেন। পদ্মজার মুখখানা দুই হাতে ধরে দেখে মুগ্ধ হয়ে বললেন, ‘বাবু দেহি চাঁদ লইয়া আইছে! এই ছেড়ি তোর জন্যি আমার জামাই তো এহন আমার দিকে চাইবোই না।’
নুরজাহান কেন এ কথা বললেন, পদ্মজা ঠাওর করতে পারল না। আমির যখন হেসে বলল, ‘আরে বুড়ি, তুমি তো আমার প্রথম বউ। ভুলি কীভাবে?’ তখন পদ্মজা নুরজাহানের কথার মানে বুঝতে পেরে ঠোঁট চেপে হাসল। নুরজাহান আমিরের থুতনিতে চিমটি দিয়ে ধরে বললেন, ‘আমার চান্দের টুকরা। বউরে আদর কইরো ভাই। বকাঝকা কইরো না। ছেড়িড়া জন্ম ঘর ছাইড়া আইছে। তুমি এখন সব। তুমি যেমনে রাখবা তেমনেই থাকব। স্বামী হাত ছাইড়া দিলে শ্বশুরবাড়ির আর কেউই বউদের আপন হয় না। বুঝছো ভাই?’
আমির নুরজাহানের পা ছুঁয়ে সালাম করে বলল, ‘বুঝছি জান।’
নুরজাহান মন খারাপের নাটক করে বললেন, ‘এইডা ঠিক না ভাই।’
‘কোনটা?’
‘এহন থাইকা জান ডাকবা বউরে। আমি হইলাম দুধভাত।’
আমির একটু জোরেই হাসল। সঙ্গে আরো অনেকে হাসল। পদ্মজা নত হয় নুরজাহানের পা ছুঁয়ে সালাম করার জন্য। নুরজাহান দ্রুত পদ্মজাকে আটকালেন। জড়িয়ে ধরে পিঠে হাত বুলিয়ে আদর করে বললেন, ‘রূপে যেমন গুণেও তেমন থাইকো বইন।’
‘রাইত বাড়তাছে। সব নিয়ম তো শেষ। যাও যের ঘরে যাও। এই তোরা বাড়িত যাইতে পারবি? রাইতের বেলা আইছিলি কেন? বউ তো কাইলও দেহন যাইত। জাফর ছেড়িগুলারে দিয়া আইতে পারবি? মদন কই? মগা কই? কামের বেলা দুইডারে পাওন যায় না,’ কথাগুলো একনাগাড়ে বললেন ফরিনা বেগম। তিনি নুরজাহানের উপস্থিতি যেন উপেক্ষা করতে চাইছেন। মদন ছুটে আসে বাইরে থেকে। মাথা নত করে ফরিনাকে বলল, ‘আইছি, খালাম্মা।’
‘থাহস কই? যা এদের দিয়া আয়। আমরার বাড়িত যহন আইছে এরা এহন আমরার দায়িত্বে। সুন্দর কইরা বাড়িত দিয়া আইবি।’
‘আচ্ছা খালাম্মা। আপারা চলেন!’
মেয়েগুলো সারাক্ষণ হাসছিল। যাওয়ার সময়ও হাসতে হাসতে গেল। মেয়েগুলোর উদ্দেশ্যে রানি ঠোঁট বাঁকাল, তা খেয়াল করে রিদওয়ান রানির মাথায় গাঁট্টা মেরে বলল, ‘সারাক্ষণ মুখ মুরাস কেন? একদিন দেখবি আর মুখ সোজা হচ্ছে না। বিয়েও হবে না।’
‘না হলে নাই। ছেড়িগুলারে দেখছ বড়ো ভাই? কেমনে হে হে কইরা হাসতাছিল।’
‘তাতে তোর কী?’
নুরজাহান পদ্মজাকে বললেন, ‘ই মেলা রাইত হইছে। আইয়ো বনু আমার ঘরে আইয়ো। আইজ আমার লগে থাকবা।’
‘আপনার লগে ক্যান? পদ্মজায় আমার লগে আমার ঘরে থাকব। হেইডাই তো কথা হইছে। পদ্মজায়ও এইডাই চায়।’
‘দেহো বউ তর্ক কইরো না। নাত বউ আমার পছন্দ হইছে। আমি আমার লগে রাখুম।’
‘এই পদ্মজা তুমি কার লগে থাকবা?’ ফরিনা কিঞ্চিৎ রাগান্বিত স্বরে প্রশ্ন করলেন। পদ্মজার অবস্থা দরজার চাপায় পড়ার মতো। এ কোন জগতে এসে পড়ল সে! পদ্মজা গোপনে ঢোক গিলল। নুরজাহান আমিরকে আদেশ করলেন, ‘খাড়ায়া রইছস কেন? বউরে কোলে লইয়া আমার ঘরে দিয়া যা।’
আমির পদ্মজাকে কোলে তুলতে গেলে ফরিনা বললেন, ‘বাবু আমি তোর মা। তোরে জন্ম দিছি আমি। আমার কথাই শেষ কথা। আমার ছেড়ার বউ আমার ঘরে থাকব। আমার কথা অমান্য করলে জান্নাত পাইবি না।’
নুরজাহান পদ্মজাকে উদ্দেশ্যে করে বললেন, ‘দেখছোনি বনু? এমন কইলজা বড়ো বউ কেউ ঘরে রাহে? আমি মানুষ ভালা বইলা এই বউরে বাইর কইরা দেই নাই। সহ্য কইরা কইরা এহন মরার পথে আছি।’
‘তোমাদের কারোর সঙ্গে থাকতে হবে না। আমার বউ আমার ঘরেই চলুক,’ বলল আমির। কণ্ঠে তার খুশির মেলা। সুযোগ বুঝে নিজের জিনিস নিজে বুঝে নিতে চাইছে। ফরিনা তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিয়ে আমিরের দিকে তাকিয়ে নুরজাহানকে বললেন, ‘আপনার ঘরেই লইয়া যান।’
ফরিনার কথা শুনে আমিরের মুখটা ফাটা বেলুনের মতো চুপসে যায়। নুরজাহান বিজয়ের হাসি হেসে বললেন, ‘ভাই, বউরে কোলে লও। লইয়া আও আমার ঘরে।’
পদ্মজা দ্রুত মিনমিনিয়ে বলল, ‘আমি হেঁটে যেতে পারব।’
‘আইচ্ছা তাইলে হাঁটো। ধরো আমার হাত ধরো, নুরজাহান হাত বাড়িয়ে দেন। পদ্মজা নুরজাহানের হাত শক্ত করে ধরে মৃদু করে হাসল। তাদের পিছু নিলো আমির। সে দাদির ঘর অবধি যাবে।
পদ্মজাকে তার মোটেও ছাড়তে ইচ্ছে করছে না।
.
নুরজাহানের ঘরে যাওয়ার পথে পদ্মজা কান্নার সুর শুনতে পেল। কে কাঁদছে? কী করুণ সেই কান্নার স্বর! এদিক-ওদিক দৃষ্টি মেলে তাকাল সে। আরেকটু এগোতেই খুব কাছে জোরে একটা আওয়াজ হলো, কেঁপে উঠে দ্রুত সেদিকে তাকাল পদ্মজা। মাত্র দুই হাত দূরে একটা দরজা। ভেতর থেকে কেউ দরজা ধাক্কাচ্ছে আর কাঁদছে। পদ্মজাকে ভয় পেতে দেখে আমির বলল, ‘ভয় পাচ্ছো?’
পদ্মজা ভয়ে ভরা ব্যথিত কণ্ঠে বলল, ‘কে ওখানে? এভাবে কাঁদছে কেন? দরজাটা খুলে দিন না!
তার কথায় আমির বা নুরজাহান কারো কোনো ভাবান্তর হলো না। পদ্মজাকে নিয়ে পাশ কেটে চলে গেল।
পদ্মজা – ৩০
নুরজাহান শক্ত করে পদ্মজার হাত চেপে ধরে ক্ষীণ স্বরে বললেন, ‘ঘরে আহো, পরে কইতাছি।’
কান্নার শব্দ ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে। নুরজাহান পদ্মজাকে নিয়ে নিজের ঘরে প্রবেশ করলেন। আমির চেয়ার টেনে বসার জন্য প্রস্তুত হতেই নুরজাহান হইহই করে উঠলেন, ‘তুই বইতাছস ক্যান?’
আমির হকচকিয়ে গিয়ে বলল, ‘মানে?’
‘বউয়ের ধারে আর থাহন যাইবো না। আইজ কাইলরাত্রি।’
‘মুসলমানদের কালরাত্রি পালন করতে নেই। গুনাহগার হবেন,’ বলল পদ্মজা। তার মাথা নত। প্রথম দিন এসেই কথা বলা ঠিক হলো নাকি ভাবছে।
মুখের ওপর কথা শুনে নুরজাহান কড়া চোখে তাকালেন। পদ্মজা দেখার আগেই, কয়েকের সেকেন্ড মধ্যে চোখের দৃষ্টি শীতল রূপে নিয়ে এলেন। পদ্মজাকে প্রশ্ন করলেন, ‘গেরামের রেওয়াজ ফালাইয়া দেওন যাইব?’
নুরজাহানের কণ্ঠ স্বাভাবিক। পদ্মজা নির্ভয়ে চোখ তুলে তাকাল। বলল, যা পাপ তা করতে নেই দাদু। জেনেশুনে ভুল রেওয়াজ সারাজীবন টেনে নেওয়া উচিত না। আমার কথা শুনে রাগ করবেন না।’
তুমি কী আইজ জামাইয়ের লগে থাকতে চাইতাছ?’ নুরজাহানের কণ্ঠ গম্ভীর। এমন প্রশ্নে পদ্মজা লজ্জায় আরক্ত হয়ে উঠে। আমতা আমতা করে বলল, ‘ন…ন…না! তে…তেমন কিছু না।’
পদ্মজা আড়চোখে আমিরকে দেখে আবার চোখের দৃষ্টি নত করে ফেলল। আমির নুরজাহানকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘আমি যাচ্ছি বুড়ি।’ এরপর পদ্মজার দিকে তাকিয়ে হাত নেড়ে কোমল কণ্ঠে বিদায় জানাল, ‘আল্লাহ হাফেজ পদ্মবতী।’
পদ্মজা নতজানু অবস্থায় মাথা নাড়াল। আমির বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। পদ্মজা ধীরে ধীরে মাথা উঁচু করে নুরজাহানকে দেখল।
ঢোক গিলে বলল, ‘রাগ করেছেন দাদু?’
নুরজাহান হাসলেন। পদ্মজার এক হাত ধরে বিছানার কাছে নিয়ে বললেন, ‘আমার বইনে তো ঠিক কথাই কইছে। গুসা করতাম কেরে?’
পদ্মজা স্বস্তির নিশ্বাস নিলো। নুরজাহান বললেন, তুমি বও। আমি লতুরে ভাত দেওনের কথা কইয়া আইতাছি।’
‘আমি খেয়েছি দাদু। তখন খাওয়ালেন আম্মা।’
‘ব্যাগডা কই? শাড়িডা খুইলা আরেকটা পরো। সিঁদুর রঙেরডা পরবা।’ বলতে বলতে নুরজাহান ব্যাগ থেকে সিঁদুর রঙের শাড়ি বের করে এগিয়ে দিলে, পদ্মজা হাত বাড়িয়ে শাড়িটা নিলো। জানতে চাইল, ‘কোথায় পালটাব?’
‘খাড়াও দরজা লাগায়া দেই। ঘরেই পাল্ডাও। আমারে শরমাইয়ো না, বইন। তোমার যা আমারও তা।’
পদ্মজা শাড়ি হাতে নিয়ে চারপাশে চোখ বুলিয়ে শাড়ি পালটানোর মতো উপযুক্ত জায়গা খুঁজতে থাকল। পালঙ্কের পেছনে চোখ পড়ায় সেদিকে গিয়ে শাড়ি পালটে নিলো। এরপর নুরজাহানের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল, ‘দাদু তখন কাঁদছিল কে?’
নুরজাহান বিছানায় বসতে বসতে জবাব দিলেন, ‘আমার খলিলের বড়ো ছেড়ার বউ।’
পদ্মজা দুই কদম এগিয়ে আসে।
আগ্রহভরে জানতে চায়, ‘কেন কাঁদছিল? উনাকে কি ঘরে আটকে রাখা হয়েছে?’
‘বও। আমার ধারে বও।’
পদ্মজা নুরজাহানের সামনে ঝুঁকে বসে। নুরজাহান বললেন, ‘তোমার চাচা হউরের (শ্বশুর) বড়ো ছেড়ার বউ রুম্পার গত বৈশাখো আচম্বিক মাথা খারাপ হইয়া যায়। এরে-ওরে মারতে আহে। কেউরে চিনে না। নিজের সোয়ামিরেও না। আলমগীর তো এহন ঢাহাত থাহে। আমির তো গেরামে আইছে অনেকদিন হইলো। আলমগীর শহরে আমিরের কামডা করতাছে। এর লাইগগাই তো আলমগীর বিয়াতে আছিল না। রুম্পা তোমার হউরিরে দা নিয়া মারতে গেছিল।
‘এজন্য আপনারা ঘরে আটকে রাখেন উনাকে? হুট করে কেন এমন হলেন?’ পদ্মজা আঁতকে উঠে জিজ্ঞাসা করল।
নুরজাহান এদিক-ওদিক তাকিয়ে কী যেন দেখলেন! এরপর সতর্কতার সঙ্গে ফিসফিসিয়ে বললেন, ‘বাড়ির পিছে বড়ো জঙলা আছে। দোষী জায়গা। ভুলেও ওইহানে যাইয়ো না। রুম্পা শনিবার ভরদুপুরে গেছিল, এর পরেরদিন জ্বর উডে। আর এমন পাগল হইয়া যায়। এগুলো তেনাদের কাজ! রাতে নাম লওন নাই। তুমি মাশাল্লাহ চান্দের টুকরা। ভুলেও ওইদিকে যাইয়ো না। ক্ষতি হইব।’
নুরজাহানের কথা শুনে পদ্মজার গায়ের পশম দাঁড়িয়ে পড়ে। মনে মনে ভাবে, অবিশ্বাস্য! ভয় পেয়ে কারো মাথা খারাপ হয়ে যায়?
পদ্মজা উৎসুক হয়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘উনাকে ডাক্তার দেখানো হয়েছে?’
‘হ। দেহানি হইছে। শহরে দুইবার লইয়া গেছে। কবিরাজ আইল। কেউই ভালা কইরা দিতে পারে নাই। আইচ্ছা এসব কথা বাদ দেও এহন। এই বাড়িত যহন বউ হইয়া আইছো সবই জানবা। খালি বাইরে কইয়ো না এই খবর। গেরামের কেউ জানে না। রাইত অইছে ঘুমাও।’ নুরজাহান শুতে শুতে বললেন, ‘হুনো জামাইয়ের কাছে কইলাম যাইবা না।’
‘না, না…যাব না।’
‘বুঝলা বইন, তোমার দাদা হউরে বিয়ার প্রত্তম রাইতে লুকাইয়া আমারে তুইলা নিজের ঘরে লইয়া গেছিল। আদর-সোহাগ কইরা ভোর রাইতে পাড়াইয়া দিছিল। আমি ছুডু আছিলাম। তাই ডরে কইলজা শুকায়া গেছিল।’
বলতে বলতে নুরজাহান জোরে হেসে উঠলেন। পদ্মজা মৃদু করে হাসে। নুরজাহান ডান দিকে কাত হয়ে শুয়ে পড়েন। পদ্মজা ধীরে ধীরে এক কোণে কাঁচুমাচু হয়ে শুয়ে পড়ে।
কী অদ্ভুত সব! সাধারণত বিয়ের রাতে নতুন বউরা ঘুমানোর সুযোগ পায় না। জামাইয়ের বাড়ির মানুষেরা সারাক্ষণ ঘেঁষে থাকে। পদ্মজা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। হারিকেনের আগুন নিভু নিভু করে জ্বলছে, নিভে যাবে যেকোনো মুহূর্তে। কেটে গেল অনেকক্ষণ। ঘুম আসছে না। দেহ এক তীব্র অনুভূতিতে ছেয়ে যাচ্ছে। আচমকা পদ্মজা ভ্রু কুঁচকে ফেলে। কান খাড়া করে ভালো করে শোনার চেষ্টা করে। আবার কাঁদছে! রুম্পা মিনমিনিয়ে কাঁদছে। পদ্মজা স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে, সে ধড়ফড়িয়ে উঠে বসে। সঙ্গে সঙ্গে নুরজাহান পদ্মজার দিকে ফেরেন। জানতে চান, ‘ডরাইতাছো?’
‘উনি আবার কাঁদছেন।’
‘সারাবেলাই কান্দে। এইসবে কান দিয়ো না। ঘুমাইয়া পড়ো।’
পদ্মজা উসখুস করতে করতে শুয়ে পড়ল, নিভে গেল হারিকেন। নুরজাহান নাক ডাকছেন, ঘুমিয়ে পড়েছেন। নাক ডাকার তীব্রতা অনেক, যা পদ্মজার বিরক্তি বাড়িয়ে তুলছে। পদ্মজা ঘুমানোর চেষ্টা করল, হাজার ভাবনার ভিড়ে একসময় ঘুমিয়েও পড়ল। শেষ রাতে ঘুমের ঘোরে অনুভব করল, হাঁটুতে কারো হাতের ছোঁয়া। পদ্মজা চটজলদি চোখ খুলে ফেলল। মুখের সামনে কেউ ঝুঁকে রয়েছে। পদ্মজা ধড়ফড়িয়ে উঠে চিৎকার করে উঠল, ‘কে?’
সঙ্গে সঙ্গে পুরুষ অবয়বটি ছুটে বেরিয়ে যায়। পদ্মজার শরীর কাঁপছে, শরীর বেয়ে ছুটছে ঘাম। ভয়ে ঠোঁট শুকিয়ে গেছে।
সে নুরজাহানকে ভয়ার্ত স্বরে ডাকল, ‘দাদু… দাদু।’
নুরজাহান একটু নড়ে আবার ঘুমিয়ে পড়লেন। পদ্মজা আর ডাকল না। সে ঘন ঘন নিশ্বাস নিয়ে নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করল, চোখের দৃষ্টি দরজার বাইরে। দরজা তো লাগানো ছিল। বাইরে থেকে কেউ কীভাবে ঢুকল? নাকি এর মাঝে দাদু টয়লেটে গিয়েছিলেন? পদ্মজার বুক হাঁপড়ের মতো ওঠানামা করছে। সে জিহ্বা দিয়ে শুকনা ঠোঁট ভিজিয়ে নিলো। একটু ভয় ভয় করছে। কে এসেছিল! এভাবে গায়ে হাত দিচ্ছিল কেন?
পদ্মজা চোখ-মুখ খিঁচে ছি বলে আগন্তুকের প্রতি ঘৃণা প্রকাশ করে। বাকি রাতটুকু আর ঘুম হলো না তার। ভয়টা কমেছে। এই জায়গায় পূর্ণা থাকলে হয়তো পুরো বাড়ি চেঁচিয়ে মাথায় তুলে ফেলত। পদ্মজা মনে মনে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করে, এরকম ঘটনা পূর্ণার জীবনে যেন না আসে। একদম গুঁড়িয়ে যাবে। উঠে দাঁড়াতে পারবে না। পূর্ণার কথা মনে পড়তেই পদ্মজার বুকটা হু হু করে উঠল। ভীষণ কান্না পাচ্ছে। অন্যদিন পাশে পূর্ণা থাকে। আজ নেই!
ফজরের আজান পড়তেই নুরজাহান চোখ খুললেন। বিছানা থেকে নেমে দেখেন, পদ্মজা জায়নামাজে দাঁড়িয়েছে মাত্র। তিনি প্রশ্ন করলেন, ‘ওজু করলা কই?’
‘কলপাড়ে।’
‘চিনছো কেমনে?’
পদ্মজা হাসল। বলল, ‘খুঁজে বের করেছি।’
নুরজাহান চোখ-মুখ শক্ত করে বললেন, ‘নতুন বউ রাইতের বেলা একলা ঘুরাঘুরি কইরা কল খোঁজার কী দরকার আছিল? আমারে ডাকতে পারতা।’
পদ্মজার মাথা নত করে অপরাধী স্বরে বলল, ‘ক্ষমা করবেন, দাদু।’
‘কি কাল আইল। আইচ্ছা, পড়ো এহন। নামাজ পড়ো।’
নুরজাহান অসন্তুষ্ট ভাব নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যান।
পদ্মজার দুই চোখ ছলছল করে উঠে। যখন টের পেল এখুনি কেঁদে দিবে, দ্রুত ডান হাতের উলটোপাশ দিয়ে চোখের জল মুছে ফেলল।
.
পদ্মজাকে কাতান শাড়ি পরানো হয়েছে। বউভাতের অনুষ্ঠান চলছে। সে এক বিশাল আয়োজন। বিয়ের চেয়েও বড়ো করে বউভাতের অনুষ্ঠান হচ্ছে। অলন্দপুরের বাইরে থেকেও মানুষ আসছে পদ্মজাকে দেখার জন্য। আটপাড়ার প্রতিটি ঘরের মানুষ তো আছেই। পদ্মজার চারপাশে মানুষ গিজগিজ করছে। রাতে ঘুম হয়নি। পরনে ভারি শাড়ি-গহনা। এত মানুষ চারিদিকে। সব মিলিয়ে পদ্মজার নাজেহাল অবস্থা। মাথা নত করে বসে আছে সে।
‘আপা।’
পূর্ণার কণ্ঠ শুনে মুহূর্তে পদ্মজার ক্লান্তি উড়ে গেল, চোখ তুলে তাকাল চকিতে। পূর্ণা-প্রেমা-প্রান্ত ঝাঁপিয়ে পড়ল পদ্মজার ওপর। পূর্ণা আওয়াজ করে কেঁদে উঠে বলল, ‘রাতে আমার ঘুম হয়নি আপা।
পদ্মজার গলা জ্বলছে। প্রেমা-পূর্ণা-প্রান্তকে দুই হাতে জড়িয়ে ধরে চাপা কণ্ঠে বলল, ‘আমারো ঘুম হয়নি বোন।’
‘আপা, বাড়ি চল।’
পেছন থেকে লাবণ্য বলল, ‘কাইল যাইব। আইজ না। এহন পদ্মজা আমরার বাড়ির ছেড়ি।’
সে পদ্মজার জন্য খাবার নিয়ে এসেছে। পূর্ণা রাগ নিয়ে বলল, ‘আমার বোন আমি নিয়ে যাব।’
‘আমাদের আপা আমরা নিয়ে যেতে এসেছি।’ বলল প্রান্ত।
রানি প্রান্তর কান টেনে ধরে বলল, ‘পেকে গেছিস তাই না?’
‘উ! ছাড়ো, রানি আপা। ব্যথা পাচ্ছি।’
‘ওরেম্মা! তুই শুদ্ধ ভাষাও কইতে পারস?’
রানি অবাক হয়ে জানতে চাইল।
প্রান্ত অভিজ্ঞদের মতো হেসে ইংরেজিতে বলল, ‘ইয়েস।’
যারা যারা প্রান্তকে চিনে সবার চোখ কোটর থেকে বেরিয়ে আসতে চাইল। প্রান্ত ইংরেজি বলেনি, যেন মাত্রই এখানে বজ্রপাত ঘটাল। রানি চোখেমুখে বিস্ময়ভাব রেখে বলল, ‘এইটা মুন্না না অন্য কেউ।
‘আমি মুন্না না আমি প্রান্ত, প্রান্ত মোড়ল।’ প্রান্তের বলার ভঙ্গী দেখে সবাই হেসে উঠল। পদ্মজা হাসতে হাসতে রানিকে বলল, ‘প্রান্ত অনেকগুলো ইংরেজি শব্দ শিখেছে।’
‘বউ মানুষ কেমনে দাঁত বাইর কইরা হাসতাছে দেখছ? বেহায়া বউছেড়া।’ কথাটি দরজার পাশ থেকে কেউ বলল। অন্য কেউ শুনতে না পেলেও পদ্মজা শুনতে পেল। সে সেদিকে তাকাল। অল্পবয়সি দুজন মহিলা এমনভাবে তাকিয়ে আছে যেন পদ্মজাকে চোখ দিয়ে গিলে খাবে। তাদের উদ্দেশ্যে কেবল হাসল পদ্মজা।
পদ্মজার হাসি দেখে থতমত খেয়ে গেল মহিলা দুজন। একে-অন্যেও দিকে চাওয়াচাওয়ি করে, আবার পদ্মজার দিকে তাকাল। পদ্মজা ততক্ষণে চোখ সরিয়ে নিয়েছে।
অতিথি আপ্যায়ন চলছে ধুমধামে। রমিজ আলী, কামরুল, রজব সবাই উপস্থিত হয়েছে। খাওয়া শেষে তারা আড্ডা শুরু করে।
রমিজ বললেন, ‘মনজুর ছেড়া, জলিল, ছইদ এরা কি আইছে?’
কামরুল দাঁতের ফাঁক থেকে যত্ন করে গরু মাংস বের করে উত্তর দিলেন, ‘না আহে নাই। হেদিন ছইদের বাপে আমার কাছে গেছিল।’
‘কেরে গেছিল?’
‘ছইদরে যাতে মাতব্বরের হাত থাইকা বাঁচায়া দেই।’
‘হেরা এহন কই আছে?’
‘আছে কোনহানে। কয়দিন পরপরই তো উধাও হইয়া যায়। এহনের ছেড়াদের দায়-দায়িত্ব নাই বুঝলা। আমার যহন দশ বছর তহন খেতে কাজ করতে যাইতাম।’
কামরুলের কথা উপেক্ষা করে রমিজ অন্য প্রসঙ্গ তুললেন, ‘ক্ষমতা যার বেশি হের সুখ বেশি। আমার মাইয়াডা নির্দোষ আছিল। তবুও কেমনডা করছিল সবাই? আইজ মাতব্বরের ছেড়া বলে কিছুই হইল না। বদলা আমরা বিয়া খাইতে আইছি।’
রমিজের অসহায় মুখখানা দেখে কামরুল, রজব, মালেক হো হো করে হেসে উঠলেন। রমিজের দৃষ্টি অস্থির। পেট ভরে খাওয়ার লোভে এসেছে সে, নয়তো আসার এক ফোঁটাও ইচ্ছে ছিল না।
.
পদ্মজা কিছুতেই খেতে পারছে না। অথচ পেট চোঁ চোঁ করছে ক্ষুধায়। চোখের সামনে এত মানুষ থাকলে কী খাওয়া যায়? পূর্ণা ব্যাপারটা ধরতে পেরে লাবণ্যকে বলল। লাবণ্য সবাইকে বেরিয়ে যেতে বলল বটে, তবে কেউই তার কথা গ্রাহ্য করল না। তাই সে ফরিনা বেগমকে নিয়ে এলো। ফরিনা বেগম সবাইকে বের করে, দরজা ভিজিয়ে দিয়ে যান।
ঘরে শুধু রানি, লাবণ্য, পদ্মজা, প্রেমা, পূর্ণা এবং প্রান্ত। খাওয়ার জন্য প্রস্তুত হলো পদ্মজা।
পূর্ণা উচ্ছ্বাস নিয়ে বলল, ‘আপা আমি খাইয়ে দেই?’
পদ্মজা মায়াময় দৃষ্টি নিয়ে তাকাল। ঠোঁটে ফুটে মিষ্টি হাসি। পূৰ্ণা অনুমতির অপেক্ষা না করে বাড়িয়ে দিল এক লোকমা ভাত। ছলছল করে উঠল পদ্মজার দুই চোখ। পূর্ণা কখনো খাইয়ে দেয়নি। এই প্রথম খাওয়াতে চাইছে। হাঁ করল পদ্মজা। লাবণ্য হেসে বলল, ‘আমার এমন একটা বইন যদি ত
‘আমি তোর বইন না?’ বলল রানি।
লাবণ্য চোখ-মুখ শক্ত করে বলল, ‘জীবনে খাইয়ে দিছস? আবার বইন কইতে আইছস যে।’
‘তুই খাইয়ে দিছস? পূর্ণা তো ছুটু। তুইও তো ছুটু।’
‘আগে পদ্মজা খাওয়াইছে। এরপর পূর্ণা।’
‘আইচ্ছা ভাত লইয়া আয়। খাওয়াই দিমু।’ রানি বলল।
‘এহন পেট ভরা।’
‘হ, এহন তো তোর পেট, নাক, মাথা সবই ভরা থাকব।’
দুই বোনের ঝগড়া দেখে পূর্ণা, পদ্মজা হাসল। কী মিষ্টি দুজন। ঝগড়াতেও ভালোবাসা রয়েছে। লাবণ্যের চেয়ে রানি বেশি সুন্দর। তবে লাবণ্যকে দেখলে বেশি মায়া লাগে। লাবণ্য যে রাগী দেখলেই বোঝা যায়। গতকাল কী রাগটাই না দেখাল! ঘরে ঢুকল আমির। আমিরকে দেখেই পদ্মজা সংকুচিত হয়ে গেল। রানি প্রশ্ন করল, ‘এইহানে কী দাভাই?’
‘পদ্মজাকে নিয়ে যেতে হবে। ওহ খাচ্ছে। আচ্ছা, খাওয়া শেষ হলে নিয়ে যাব।’ বলতে বলতে আমির পদ্মজার সামনে বসল। লাবণ্য জিজ্ঞাসা করল, ‘কই নিয়ে যাবা?’
‘আম্মার ঘরে।’
‘কেন?’
‘আম্মা বলছে নিয়ে যেতে।’
‘আম্মা একটু আগেই দেইখা গেল।’
আমির হকচকিয়ে গেল। আমতা আমতা করে বলল, ‘ওহ তাই নাকি?’ রানি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আমিরকে পরখ করে নিয়ে বলল, ‘দাভাই, মিথ্যে বলছ কেন?’
‘মি…মিথ্যে আমি? অসম্ভব। আম্মা না দাদু বলছে নিয়ে যেতে। এই তোরা যা তো। তোদের বান্ধবিরা আসছে। যা। হুদাই ঘ্যানঘ্যান শুরু করেছিস।’
লাবণ্য কথা বাড়াতে চাচ্ছিল। রানি টেনে নিয়ে যায়। প্রেমা-প্ৰান্তও বেরিয়ে যায়। তারা বাড়ি থেকে পরিকল্পনা করে এসেছে, একসঙ্গে পুরো হাওলাদার বাড়ি ঘুরে দেখবে। পূর্ণা খাইয়ে দিচ্ছে। পদ্মজা আমিরের উপস্থিতিতে বিব্রত হয়ে উঠেছে। খাবার চিবোতে পারছে না। আমির পদ্মজাকে বলল, ‘বড়ো ভাবি বলল রাতে নাকি ঘুমাওনি।
‘না… হ্যাঁ। আসলে ঘুম আসেনি।’
‘ঘুমাবে এখন?’
‘না, না। কী বলছেন? বাড়ি ভরতি মানুষ।’
আমিরের চোখের দিকে তাকিয়ে বলল পদ্মজা। আমিরের পলকহীন দৃষ্টি দেখে চোখ নামিয়ে নিলো।
আমির বলল, ‘আচ্ছা খাও। আমি আসছি।’
‘আপনি কি রাতে দাদুর ঘরে এসেছিলেন?’
আমির চলে যাওয়ার জন্য দাঁড়িয়েছিল। এই কথা শুনে চমকে তাকাল পদ্মজার দিকে ঝুঁকে জানতে চাইল, ‘কেন? কেউ কি তোমার ঘরে এসেছিল?’
আমিরের এমন ছটফটানি দেখে পদ্মজা খুব অবাক হলো। সে অবাক চোখে তাকিয়ে থেকে বলল, ‘হ্যাঁ, এসেছিল। শেষ রাতে।’
‘আচ্ছা,’ বলেই হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে গেল আমির। পদ্মজা পেছনে ডাকল, শুনল না আমির। হুট করে লোকটার পরিবর্তন পদ্মজাকে ভাবাতে লাগল।
৩১
পদ্মজাকে নতুন করে পুনরায় সাজানো হয়েছে। বাসর রাত নিয়েও হাওলাদার বাড়ির হাজারটা রীতি। সেসব পালিত হচ্ছে। পদ্মজা নিয়ম-রীতি পূরণ করছে ঠিকই, তবে মন অন্য জায়গায়। বিকেলে সে দেখেছে, আমির রিদওয়ানের পাঞ্জাবির কলার দুই হাতে ধরে কিছু বলছে। খুব রেগে ছিল। তবে কি রিদওয়ানই এসেছিল রাতে?
‘ও বউ উডো। এহন ঘরে গিয়া খালি দুইজনে মিললা দুই রাকাত নফল নামাজ পইড়া লইবা। আনিসা যাও লইয়া যাও। দিয়া আও ঘরে,’ বললেন ফরিনা। পদ্মজা কল্পনার জগত থেকে বেরিয়ে বাস্তবে ফিরে আসে। খলিল হাওলাদারের দুই মেয়ে শাহানা, শিরিন এবং আনিসা পদ্মজাকে নিয়ে দ্বিতীয় তলায় ওঠে। আমিরের ঘরে ঢুকতে আর কয়েক কদম বাকি। পদ্মজা ঘোমটার আড়াল থেকে চোখ তুলে তাকাল। দরজা গোলাপ ফুল দিয়ে সাজানো, টকটকে লাল গোলাপ; হাওলাদার বাড়ির গোলাপ বাগান অলন্দপুরে খুবই জনপ্রিয়। পদ্মজার শুভ্র, শীতল অনুভূতি হয়। ঘরে ঢুকতেই তাজা গোলাপ ফুলের ঘ্রাণে শরীর-মন অবশ হয়ে আসে।
শুধু বিছানা নয়, পুরো ঘর লাল গোলাপ দিয়ে সাজানো।
শাহানা পদ্মজাকে বিছানায় বসিয়ে দিল। এরপর বলল, ‘ডরাইবা না। রাইতটা উপভোগ করবা। এমন রাইত জীবনে একবারই আহে।’
পদ্মজার লজ্জায় মরিমরি অবস্থা! সারা দেহ থেকে যেন গরম ধোঁয়া বের হচ্ছে। আনিসা সবকিছু ঘুরে ঘুরে দেখছে। একসময় বলল, ‘আমার বাসর রাতটাও হুবুহু এই রকম ছিল। চারিদিকে গোলাপের ঘ্রাণ। ফুলের ঘ্রাণে ভালোবাসা আরো জমে উঠেছিল।’
‘এই বাড়ির বউদেরই কপাল। আমরা এই বাড়ির ছেড়ি হইয়াও জামাইর বাড়িত গিয়া কাগজের ফুলের বাসর পাইছি,’ বলল শিরিন।
আনিসা দেমাগি স্বরে বলল, ‘এসব পেতে যোগ্যতা লাগে। যোগ্যতা ছাড়া ভালো কিছু পাওয়া যায় না। আমি উচ্চশিক্ষিত এবং সুন্দরী ছিলাম। ভালো কিছু পাওয়ার যোগ্য ছিলাম তাই পেয়েছি। আর পদ্মজা যথেষ্ট সুন্দরী, গ্রামে থেকেও পড়ালেখায় খুব ভালো। তাই সেও যোগ্য। তোমাদের না আছে পড়াশোনা না আছে কোনো ভালো গুণ। গায়ের রঙও ময়লা। কাগজের ফুলই তোমাদের জন্য ঠিক ছিল।’
আনিসার কথাগুলো শুনতে পদ্মজার খুব খারাপ লাগে। কোনো মানুষকে এভাবে বলা ঠিক নয়। শিরিন হইহই করে উঠল, ‘এই রূপ বেশিদিন থাকব না ভাবি। এত দেমাগ ভালা না। বিয়ার এতদিন হইছে একটাও বাচ্চা দিতে পারছ? পারো নাই। তাইলে এই গরিমা দিয়া কী হইব? সন্তান ছাড়া নারীর শোভা নাই।’
আনিসা রেগেমেগে ফুঁসে উঠে গলা উঁচু করে বলল, ‘সমস্যা আমার নাকি তোমাদের পেয়ারের ভাইয়ের সেটা খোঁজ নাও আগে। আমি এখনই জাফরকে সব বলছি। এতদিন পর বাড়িতে এসেছি এসব নোংরা কথা সহ্য করতে? অপমান সহ্য করতে? কালই চলে যাব আমি।’
আনিসা রাগে কাঁদতে কাঁদতে বেরিয়ে যায়। পদ্মজা হতবাক। শাহানা শিরিনকে ধাক্কা দিয়ে বলল, ‘এত কিছু কেন কইতে গেলি? জানস না, এই ছেড়ি কেমন? আমি হের বড়ো হইয়াও হেরে কিছু কই না। এহন আরেক ভেজাল হইব।’
‘যা হওয়ার হইয়া যাক। আমরারে কেমনে পায়ে ঠেলতাছিল দেহো নাই? এইডা তো আমরার বাপের বাড়ি। এত কথা কেন হুনতে হইব?’ শিরিনের কণ্ঠ কঠিন। সে আজ এর শেষ দেখেই ছাড়বে।
‘নতুন বউডার সামনে এমনডা না করলেও হইত! ও পদ্ম তুমি বেজার হইয়ো না। এরা সবসময় এমনেই লাইগা থাহে।’
পদ্মজা হাসার চেষ্টা করে। শাহানা দরজার বাইরে তাকিয়ে দেখে আমির আসছে কি না! রাত তো কম হলো না। শাহানা আরো অনেকক্ষণ সময় নিয়ে পদ্মজাকে বুঝাল, কী কী করতে হবে, কীভাবে স্বামীকে আঁচলে বেঁধে রাখতে হয়।
পদ্মজা সব মনোযোগ সহকারে শুনে নিলো।
আমির ঘরে ঢুকতেই শাহানা-শিরিন বেরিয়ে গেল। দরজা লাগিয়ে পালঙ্কের পাশে এসে দাঁড়াল আমির। পদ্মজা পালঙ্ক থেকে নেমে আমিরের পা ছুঁয়ে সালাম করে, আমির দুই হাতে পদ্মজাকে আঁকড়ে ধরে দাঁড় করায়। অনুভব করে—পদ্মজা কাঁপছে; প্রচণ্ড শীতে মানুষ যেভাবে কাঁপে, ঠিক সেভাবে। আমির দ্রুত ছেড়ে দিল তাকে। বলল, ‘পানি খাবে?’
পদ্মজা মাথা নাড়িয়ে জানাল, খাবে। আমির এক গ্লাস পানি এগিয়ে দিল। এক নিশ্বাসে ঢকঢক করে পানি শেষ করল পদ্মজা। সারা শরীর কাঁপছে। শাহানা, শিরিন বের হতেই বুকে হাতুড়ি পেটা শুরু হয়েছে। ঘরে চারটা হারিকেন জ্বালানো। যেদিকে চোখ যায় সেখানেই গোলাপ ফুল। ফুলের ঘ্রাণে চারিদিক মউ মউ করছে। এমন পরিবেশে বিয়ের প্রথম রাতে পরপুরুষকে স্বামী রূপে দেখা কোনো সহজ অনুভূতি নয়। আমির গ্লাস নিতে এগিয়ে আসলে পদ্মজা আঁতকে উঠে এক কদম পিছিয়ে গেল। তা দেখে আমির একটু শব্দ করেই হাসল। ভীতু ভীতু চোখে সেদিকে তাকাল পদ্মজা। আমির বলল, ‘হাতে গ্লাস নিয়ে সারারাত কাটাবে নাকি? দাও আমার কাছে।
গ্লাসটি পদ্মজার হাত থেকে নিয়ে টেবিলের ওপর রেখে এলো আমির। পদ্মজা পালঙ্কের এক কোণে চুপটি করে বসে আছে, অনবরত কাঁপছে তার ডান পা। মনে মনে দোয়া করছে—মাটি যেন ফাঁক হয়ে যায়। আর সে তার ভেতর ঝাঁপ দিয়ে পাতালে হারিয়ে যেতে চায়। নয়তো লজ্জা, আড়ষ্টতায় প্রাণ এখনি গেল বুঝি! আমির দূরত্ব রেখে পদ্মজার সোজাসুজি বসে। পদ্মজার এক পা যে কাঁপছে সেটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। তার দৃষ্টিও অস্থির। বার বার এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে। আমির মজা করে জানতে চাইল, ‘পালানোর পথ খুঁজছো নাকি?’
‘না…না তো,’ বলল পদ্মজা।
‘তাহলে কী খুঁজছ?’
পদ্মজা নিরুত্তর রইল। আমির পদ্মজার আরো কাছে এসে বসে। পদ্মজার এক হাত ছুঁতেই ‘ও মাগো!’ বলে চিৎকার করে ওঠে। আমির পদ্মজার আকস্মিক চিৎকারে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়। ভয়ে ঢোক গিলল পদ্মজা, সময়টা যাচ্ছেই না। সে যদি পারত পালিয়ে যেতে…চারিদিকে ভয়ংকর অনুভূতিদের খেলা! আমির হাঁ করে পদ্মজার দিকে অনেকক্ষণ চেয়ে রইল, এরপর দূরে সরে বসে পদ্মজাকে বলল, ‘আমার সঙ্গে সহজ হওয়ার চেষ্টা করো। আমার দিকে ফিরে বসো। গল্প করি।’
পদ্মজা আমিরের দিকে ফিরে বসল, দৃষ্টি বিছানার চাদরে নিবদ্ধ।
আমির প্রশ্ন করল, ‘আমার সম্পর্কে কতটুকু জানো?’
‘খুব কম,’ মিনমিনিয়ে বলল পদ্মজা।
‘আমি তোমার চেয়ে বারো বছরের বড়ো। জানো?’
‘এখন জানলাম। তবে আপনার আচরণ ছোটোদের মতো।’ পদ্মজা মৃদু হেসে আমিরের চোখের দিকে তাকিয়ে বলল। আমির বলল, ‘আমার চরিত্রের আরো বৈশিষ্ট্য আছে।’
‘বুঝতে পেরেছি। আপনার কথাবার্তা এখন বড়োদের মতো মনে হচ্ছে। ‘ঢাকা আমার ব্যাবসা আছে।’
‘শুনেছি।’
‘আমার সঙ্গে তোমাকেও ঢাকা যেতে হবে।’
‘আচ্ছা।’
‘এই বাড়ির চেয়েও বিশাল বড়ো বাড়িতে আমি একা থাকি। যতক্ষণ বাইরে থাকব তোমাকে একা থাকতে হবে। ভয় পাওয়া যাবে না।’
‘আমি ভয় পাই না।’
‘আমাকে তো ভয় পাচ্ছো।’ আমির হেসে বলল। পদ্মজা নিরুত্তর। ‘কথা বলো।’
‘কী বলব?’
‘আচ্ছা, আসো একটা মজার খেলা খেলি।’
পদ্মজা উৎসুক হয়ে তাকাল। আমির বলল, ‘দুজন দুজনের চোখের দিকে তাকিয়ে থাকব। যার চোখের পলক আগে পড়বে সে হেরে যাবে।’
পদ্মজা খেলতে রাজি। এই খেলাটা সে পূর্ণার সঙ্গেও খেলেছে। পদ্মজা অনেকক্ষণ এক ধ্যানে তাকিয়ে থাকতে পারে। তাই তার আত্মবিশ্বাস আছে, সেই জিতবে। বরাবরই জিতে এসেছে। আমির এক-দুই-তিন বলে খেলা শুরু করে দিল। একজন আরেকজনের দিকে তাকিয়ে রইল একধ্যানে। পদ্মজা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে আমিরকে পরখ করে। আমিরের চুল খাড়া করে উলটো দিকে আছড়ে রাখা, থুতনির নিচে কাটা দাগ। গালে হালকা দাড়ি, শ্যামলা গায়ের রং। ঘন ভ্রু, চোখের পাঁপড়ি। পরনে সাদা পাঞ্জাবি। এত বেশি ভালো লাগছে দেখতে। আমির পদ্মজার রূপে আগে থেকেই দিওয়ানা। তার ওপর এতক্ষণ তাকিয়ে থেকে অনুভূতির দফারফা অবস্থা। সে মুগ্ধ হওয়া কণ্ঠে বলল, ‘পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর নারী আমার বউ। কী ভাগ্য আমার!’
‘আপনিও সুন্দর,’ কথাটা মুখ ফসকে বলে উঠল পদ্মজা। যখন বুঝতে পারল লজ্জায় মাথা নত করে ফেলল। আমির খুশিতে বাকবাকুম হয়ে বলল, ‘তোমার পলক পড়েছে। আমি জিতে গেছি।’
পদ্মজা লজ্জায় নখ খুঁটতে থাকে। আমির নিজের চুলে হাত বুলাতে বুলাতে বলল, ‘আমি জানি আমি কতটা সুন্দর! রংটা একটু কালো হতে পারে। তবে আমি সুন্দর। তোমার মুখে শোনার পর থেকে ধরে নিলাম, পৃথিবীর সেরা সুন্দর পুরুষের নাম আমির হাওলাদার।’
পদ্মজার দুই ঠোঁট নিজেদের শক্তিতে আলগা হয়ে গেল। সে আমিরের দিকে তাকিয়ে ভাবছে, মানুষ এত আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে নিজের প্রশংসা নিজে কীভাবে করতে পারে? আমিরের ভাব দেখে মনে হচ্ছে, সে সত্যিই পৃথিবীর সেরা সুন্দর পুরুষ। পদ্মজা ফিক করে হেসে দিল। আমির তাকাল। বলল, ‘হাসছো কেন?’
পদ্মজা হাসি চেপে বলল, ‘কোথায়? না তো। আপনার আম্মা বলেছিলেন, দুই রাকাত নফল নামাজ আদায় করতে।’
‘আমার আম্মা তোমার আম্মা না?’
‘হুম।’
‘এখন থেকে আপনার আম্মা না শুধু আম্মা বলবে। গয়নাগাটি নিয়েই নামাজ পড়বে? অস্বস্তি হবে না? খোলো এবার।’
পদ্মজা অবাক হয়ে জানতে চাইল, ‘শিরিন আপা বললেন, গয়নাগাটি নাকি স্বামি খুলে দেয়। তাহলে?’
আমির তীক্ষ্ণ চোখে তাকাল। ঠোঁটে বাঁকা হাসি নিয়ে বলল, ‘তাই নাকি? দাও খুলে দেই।’
পদ্মজা দ্রুত দৃষ্টি অন্যদিকে ফিরিয়ে নিয়ে আমতা আমতা করে বলল, ‘এ…এটা বোধহয় নিয়ম না। তাই আপনি জানতেন না। আমি…আমি পারব।’
দুই রাকাত নফল নামাজের সঙ্গে তাহাজ্জুদের নামাজও আদায় করে নিয়েছে দুজন। আমির তাহাজ্জুদ নামাজের নিয়ম জানে না। পদ্মজা হাতে কলমে শিখিয়েছে। আমিরও মন দিয়ে শিখেছে এবং নামাজ পড়েছে। এরপর পদ্মজা জানালার সামনে গিয়ে দাঁড়াল।
জানালার সামনে বিশাল বড়ো জঙ্গল। সে আমিরকে প্রশ্ন করল, ‘এই জঙ্গলে নাকি কী একটা আছে?’
আমির পদ্মজার প্রশ্ন শোনেনি। সে পেছন থেকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে নিজের বধূর দিকে। পদ্মজার গায়ে কোনো অলংকার নেই। খোলা চুল কোমর অবধি এসে থেমেছে। মধ্য রাতের বাতাসে তার চুল মৃদু দুলছে। আমির অনুভূতিকে প্রশ্রয় দিল। পদ্মজার কোমর পেছন থেকে জড়িয়ে ধরল দুই হাতে, পদ্মজার কেঁপে ওঠে বড়ো করে নেয়া নিশ্বাস অনুভব করে গভীরভাবে। পদ্মজার হৃৎপিণ্ড থমকে গেল, শিরশির করে উঠল পায়ের তলার মাটি। তবে, অদ্ভুত বিষয় হলো…শুরুর মতো আমিরের স্পর্শ অস্বস্তি দিচ্ছে না তাকে। বরং ধারাল কোনো অজানা অনুভূতিতে তলিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। আমির পদ্মজার ঘাড়ে থুতনি রেখে বলল, ‘প্রথম যেদিন তোমাকে দেখি সেদিনই মনে মনে পণ করি তোমাকেই বিয়ে করব। তবে ভাবিনি প্রথম দিনই আমার কারণে এতটা অপদস্থ হতে হবে তোমাকে। অনেক চেষ্টা করেছি সব আটকানোর, পারিনি। সেদিনই বাড়ি ফিরে আব্বাকে বলি, আমি বিয়ে করতে চাই পদ্মজাকে। প্রথম প্রথম কেউ রাজি হচ্ছিল না। পরে রাজি হয়ে যায়। মনে হচ্ছে, চোখের পলকে তোমাকে পেয়ে গেছি।’
পদ্মজা নিশ্চুপ। ভাবছে—অবাধ্য, অজানা অনুভূতিদের সঙ্গে যুদ্ধ করবে…নাকি সখ্যতা করবে? আমির পদ্মজাকে ঘুরিয়ে নিজের দিকে ফেরাল। মেয়েটা পাথরের মতো শক্ত হয়ে গেছে। আমির বলল, ‘তোমায় আমি পদ্ম ফুল দিয়ে একদিন সাজাব। নিজের হাতে।
পদ্মজা কিছুই যেন শুনছে না। সে কাঁপছে। আমির বলল, ‘কথা বলো। আল্লাহ, আবার কাঁপছো! আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরো, স্থির হতে পারবে। এই কী হলো?’
পদ্মজা শরীরের ভার ছেড়ে দিয়েছে আমিরের ওপর। আমির দুই হাতে শক্ত করে ধরে রাখে তাকে। সেদিন রাতে জান্নাতের সুবাস এসেছিল ঘরে। পদ্মজা নিজের অস্তিত্বের পুরো অংশ জুড়ে স্বামীরূপে একজন পুরুষকে অনুভব করে। ভালোবাসাটা শুরু হয় সেখান থেকেই। মন মাতানো ছন্দ এবং সুর দিয়ে শুরু হয় জীবনের প্রথম প্রেম…
…প্রথম ভালোবাসা।
৩২
সকাল থেকে বাতাস বইছে। কাছাকাছি কোথাও বৃষ্টি হয়ে গেছে, এমন আমেজ সেই বাতাসে। একটু শীতল চারপাশ। গরু গাড়ি চড়ে পদ্মজা যাচ্ছে বাপের বাড়ি। পাশে আছে আমির এবং লাবণ্য। পদ্মজার পরনে সবুজ শাড়ি, ভারি সুতার কাজ; গা ভরতি গহনা। এসব পরে থাকতে অস্বস্তি হচ্ছে। ফরিনা বেগমের কড়া নিষেধ, কিছুতেই গহনা খোলা যাবে না। আমির পদ্মজার এক হাত শক্ত করে ধরে রেখেছে, ছেড়ে দিলেই যেন হারিয়ে যাবে। আমিরের এহেন পাগলামি পদ্মজাকে বেশ আনন্দ দিচ্ছে।
সে চাপা স্বরে বলল, ‘কোথাও চলে যাচ্ছি না, আস্তে ধরুন।’
আমির নরম স্পর্শে পদ্মজার হাত ধরল। পদ্মজা বলল, ‘মনে আছে তো কী বলেছিলাম?’
‘কী?’
সঙ্গে সঙ্গে পদ্মজা হায় হায় করে উঠল, ‘ও মা! ভুলে গেছেন?’
আমির শূন্যে তাকিয়ে মনে করার চেষ্টা করল। সকালে ঘুম ভাঙার পর দেখে ছিল পদ্মজা নতুন শাড়ি পরে দাঁড়িয়ে আছে। আমির মিষ্টি করে হেসে ডেকেছিল, ‘এদিকে আসো।’
পদ্মজা ছোটো ছোটো করে পা ফেলে আমিরের পাশে দাঁড়াল। আমির খপ করে পদ্মজার হাত ধরে বিছানায় বসিয়ে দিয়ে বলল, ‘কখন উঠেছ?’
‘যেভাবে টান দিলেন। ভয় পেয়েছি তো।’
‘এত ভীতু?’
‘কখনোই না।
‘তা অবশ্য ঠিক।’
‘উঠুন। আম্মা আপনাকে ডেকে নিয়ে যেতে বলেছেন।’
‘কেন? জরুরি দরকার নাকি?’
‘আমি জানি না। উঠুন আপনি।’
‘এই তুমি তো কম লজ্জা পাচ্ছো।’
পদ্মজার মুখ লাল হয়ে উঠে। সে বিছানা থেকে দূরে সরে দাঁড়াল। মাথা নত করে বলল, ‘আপনি লজ্জা দিতে খুব ভালোবাসেন।’
আমির হাসতে হাসতে বিছানা থেকে নামল। বলল, ‘তোমার চেয়ে কম ভালোবাসি। আচ্ছা, তুমি কবে ভালোবাসবে বলো তো?’
পদ্মজা পূর্ণ-দৃষ্টিতে আমিরকে দেখল। আমির আবার হাসল। পদ্মজার দিকে এগিয়ে এসে বলল, ‘যেদিন মনে হবে তুমিও আমাকে ভালোবাসো, বলবে কিন্তু। সেদিনটা আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় হবে।’
পদ্মজা তখনো একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে। আমির হাত নাড়িয়ে পদ্মজার পলক অস্থির করে বলল, ‘কী ভাবছো?’
‘কিছু না।’
‘কিছু বলবে?’
‘আমরা আজ ওই বাড়ি যাব।’
‘এটাই তো নিয়ম।’
‘আপনি একটু বেশরম।’
আমির আড়চোখে তাকাল। পদ্মজা ঠোঁট টিপে হেসে দৃষ্টি অন্যদিকে ঘুরিয়ে নেয়। আমির আমতা আমতা করে বলল, ‘তা..তাতে কী হয়েছে?’
‘কিছু না।’
‘কী বলতে চাও, বলো তো।’
‘বড়োদের সামনে আমাকে নিয়ে এত কথা বলবেন না। মানুষ কানাকানি করে। আপনাকে বেলাজা, বেশরম বলে। শুনতে ভালো লাগে না আমার।’
‘আমার বউ নিয়ে আমি কী করব, আমার ব্যাপার।
‘কিন্তু আমাকে অস্বস্তি দেয়।’ পদ্মজা করুণ স্বরে বলল।
আমির নিভল, ‘আচ্ছা, ঠিক আছে। নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করব।’
সত্যি? আমার আম্মার সামনে ভুলেও পদ্মজা, পদ্মজা করবেন না।’
‘ইশারা দিতেই চলে আসবে। তাহলে ডাকাডাকি করব না।’
পদ্মজা হাসল। আমির ইষৎ হতচকিত। বলল, ‘হাসছো কেন?
‘এমনি। মনে রাখবেন কিন্তু।’
‘তুমিও মনে রাখবে।’
সকালের দৃশ্য থেকে বেরিয়ে আমির বলল, মনে আছে। তোমার অস্বস্তি হয় এমন কিছুই করব না।’
আমিরের কথায় পদ্মজা সন্তুষ্ট হলো। নিজেকে আজ পরিপূর্ণ মনে হচ্ছে। উত্তেজনায় কাঁপছেও। দুই দিন পর মা-বাবা, ভাইবোনকে দেখবে। দুই দিনে কী কিছু পালটেছে? পদ্মজা মনে মনে ভাবছে, আম্মা বোধহয় শুকিয়েছে। আমাকে ছাড়া আম্মা নিশ্চয় ভালো নেই।
পদ্মজার খারাপ লাগা কাজ করতে থাকে। ছটফটানি মুহূর্তে বেড়ে যায়। আমির জানতে চাইল, ‘পদ্মজা, শরীর খারাপ করছে?’
‘না।’
‘অস্বাভাবিক লাগছে।’
‘আম্মাকে অনেকদিন পর দেখব।’
‘অনেকদিন কোথায়? দুই দিন মাত্র।’
‘অনেকদিন মনে হচ্ছে।’
‘এই তো চলে এসেছি। ওইযে দেখো, তোমাদের বাড়ির পথ।’
আমির ইশারা করে দেখাল। আমিরের ইশারা অনুসরণ করে সেদিকে তাকাল পদ্মজা। ওই তো তাদের বাড়ির সামনের পুকুর দেখা যাচ্ছে। আর কিছু সময়, এরপরই সে তার মাকে দেখবে। পদ্মজা অনুভব করে তার নিশ্বাসের গতি বেড়ে গেছে। হৃৎপিণ্ড লাফাচ্ছে। সে আমিরের এক হাত শক্ত করে ধরে বাড়ির দিকে নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে রইল।
হেমলতা নদীর ঘাটে মোর্শেদের সঙ্গে কথা বলছিলেন, সকালে মোর্শেদকে বাজারে পাঠিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু মোর্শেদ কিছু জিনিস ভুলক্রমে আনেননি। তা নিয়েই আলোচনা চলছে। ঠিক আলোচনা নয়। হেমলতা বকছেন আর মোর্শেদ নৌকায় বসে শুনছেন। তিনি কথা বলার সুযোগই পাচ্ছেন না। হেমলতা নিশ্বাস নেয়ার জন্য থামতেই মোর্শেদ বললেন, ‘অহনি যাইতাছি। সব লইয়া হেরপর আইয়াম।’
‘এখন গিয়ে হবেটা কী? হঠাৎ ওরা চলে আসবে।’
‘আমি যাইয়াম আর আইয়াম,’ বলতে বলতে মোর্শেদ নৌকা ভাসিয়ে দূরে চলে যান। হেমলতা ক্লান্তি ভরা দৃষ্টি নিয়ে স্বচ্ছ জলের দিকে তাকিয়ে রইলেন অনেকক্ষণ। আচমকা পূর্ণার চিৎকার ভেসে এলো কানে। তিনি চমকে ঘুরে তাকালেন। আপা আপা বলে চেঁচাচ্ছে পূর্ণা। হেমলতা বিড়বিড় করলেন, ‘পদ্ম এসে গেছে!’
ব্যস্ত পায়ে হেঁটে বাড়ির উঠোনে চলে এলেন তিনি। সঙ্গে সঙ্গে ফুলের মতো সুন্দর মেয়েটি হামলে পড়ে বুকের ওপর। আম্মা, আম্মা বলে জান ছেড়ে দিল। হেমলতার এত বেশি আনন্দ হচ্ছে যে, হাত দুটো তোলার শক্তি পাচ্ছেন না। চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ল। তিনি দুই হাতে শক্ত করে পদ্মজাকে জড়িয়ে ধরলেন। শূন্য বুকটা চোখের পলকে পূর্ণ হয়ে উঠেছে। পদ্মজা নিশ্চয় বুঝে যাবে, দুই রাত তার আম্মা ঘুমায়নি, চোখদ্বয় নিশ্চিন্তে আরাম করতে পারেনি। বুঝতেই হবে পদ্মজাকে। পদ্মজা ঘন ঘন লম্বা করে নিশ্বাস টানছে। স্পষ্ট একটা ঘ্রাণ পাচ্ছে সে, মায়ের শরীরের ঘ্রাণ! পারলে পুরো মাকেই এক নিশ্বাসে নিজের মধ্যে নিয়ে নিত।
হেমলতা পদ্মজার মাথায় আলতো করে ছুঁয়ে দিয়ে বললেন, আর কাঁদিস না। এই তো, আম্মা আছি তো।’
‘তোমাকে খুব মনে পড়েছে, আম্মা।’
‘আমারও মনে পড়েছে,’ হেমলতার চোখের জল ঠোঁট গড়িয়ে গলা অবধি পৌঁছেছে। তিনি অশ্রুমিশ্রিত ঠোঁটে পদ্মজার কপালে চুমু দেন। আমির হেমলতার পা ছুঁয়ে সালাম করতে নেয়। হেমলতা ধরে ফেলেন। আমিরের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন, ‘লাগবে না, বাবা।’
আমির বিনীত কণ্ঠে বলল, ‘ভালো আছেন, আম্মা?’
‘ভালো আছি। তুমি ভালো আছো তো? আমার মেয়েটা কান্নাকাটি করে জ্বালিয়েছে খুব?’
‘ভালো আছি আম্মা। একটু-আধটু তো জ্বালিয়েছেই।’ কথা শেষ করে আমির আড়চোখে পদ্মজার দিকে তাকাল।
ফোঁপাচ্ছে পদ্মজা। হেমলতা অনেকক্ষণ চেষ্টা করে পদ্মজাকে নিয়ন্ত্রণে আনেন। বাড়িতে মনজুরা, হানিসহ হানির শ্বশুরবাড়ির অনেকেই ছিল। তারা আগামীকাল ঢাকা ফিরবে। জামাই স্বাগতমের বিশাল আয়োজন করা হয়েছে। পূর্ণা পদ্মজা ও লাবণ্যকে টেনে নিয়ে গেল ঘরে। হানির স্বামী আমিরকে নিয়ে গল্পের আসর জমালেন। আমির আসার সময় গরুগাড়ি ভরে বাজার করে নিয়ে এসেছে। হেমলতা সেসব গোছাচ্ছেন। তিনি বার বার করে মজিদ মাতব্বরকে বলে দিয়েছিলেন, ফের যাত্রায় বাজার না পাঠাতে। তবুও পাঠিয়েছেন। ফেলে তো দেওয়া যায় না।
.
রাতের খাবার শেষ হয়েছে অনেকক্ষণ। পূর্ণাকে আমির ছোটো আপা বলে ডাকছে, শালির চোখে একদমই দেখছে না। তেমন রসিকতাও করছে না। আমিরের ব্যবহারে পূর্ণা ধীরে ধীরে ওকে বোনজামাই হিসেবে পছন্দ করে নিচ্ছে। না হোক নায়কের মতো সুন্দর, মন তো ভালো। লাবণ্য, আমির আর পূর্ণার সঙ্গে লুডু খেলছে হানির বড়ো ছেলে। পদ্মজা কিছুক্ষণ খেলে উঠে এসেছে। হেমলতা, মোর্শেদ বারান্দার বেঞ্চিতে বসে ছিলেন। পদ্মজা দরজার পাশে এসে দাঁড়াল। মোর্শেদ দেখতে পেয়ে ডাকলেন, ‘কী রে মা? আয়।’ পদ্মজাকে টেনে এনে দুজনের মাঝখানে বসিয়ে দিয়ে প্রশ্ন করলেন, হউরবাড়ির মানুষেরা ভালা তো?’
পদ্মজা নতজানু হয়ে জবাব দিল, ‘সবাই ভালো।
‘একটু আধটু সমস্যা থাকবেই, মানিয়ে নিস। জয় করে নিস। সব কিছুই অর্জন করে নিতে হয়।’ বললেন হেমলতা। পদ্মজা হেমলতার দিকে তাকিয়ে মৃদু করে হাসল। হেমলতা আবার বললেন, ‘তোর শাশুড়ি একটু কঠিন তাই না? চিন্তা করিস না। যা বলে করবি। পছন্দ-অপছন্দ জানবি সেই মতো কাজ করবি। দেখবি, ঠিক মাথায় তুলে রেখেছে।
‘আচ্ছা, আম্মা।’ বলল পদ্মজা।
‘সব শাশুড়ি ভালো হয় না লতা। আমার শাশুড়িরে আজীবন তেল দিলাম। কোনো পরিবর্তন হয়েছে? হয়নি।’ বললেন হানি। তিনি ঘর থেকে সব শুনছিলেন। কথা না বলে পারলেন না।
হেমলতা এক হাতে পদ্মজাকে জড়িয়ে ধরলেন। তারপর হানির উদ্দেশ্যে বললেন, ‘আমার পদ্মর কপাল এত খারাপ নিশ্চয় হবে না।’
‘পদ্মর অবস্থা আমার মতো হয়েছে যদি শুনি, ওরে তুলে নিয়ে যাব আমার কাছে। তুই মিলিয়ে নিস।’
‘আহ! থামো তো আপা। আমির-লাবণ্য শুনবে। কী ভাববে?’
হানি আর কিছু বললেন না। চারজন মানুষ নিশ্চুপে বসে রইল একসময় হেমলতা রান্নাঘরের দিকে চলে গেলেন। রান্নাঘর গুছানো হয়নি। নিজের ঘরের দিকে পা বাড়ালেন মোর্শেদ, সারাদিন অনেক ধকল গেছে। ক্লান্তিতে শরীর ভেঙে আসছে। হানি পদ্মজার পাশে বসে বললেন, ‘শোন মা, শাশুড়িরে বেশি তেল দিতে গিয়ে নিজের জীবন নষ্ট করবি না। তোর মায়ের অনেক জ্ঞান, অভিজ্ঞতা মানি। কিন্তু লতাকে শাশুড়ি নিয়ে সংসার করতে হয়নি তাই সে জানে না। আমি জানি শাশুড়িরা কেমন কালসাপ হয়। এরা সেবা নিবে দিনরাত। বেলাশেষে ভুলে যাবে। নিজের কথা আগে ভাববি। শাশুড়ি ভুল বললে জবাব দিবি সঙ্গে সঙ্গে। নিজের জায়গাটা বুঝে নিবি। পড়াশোনা থামাবি না। পড়বি আর আরামে থাকবি। আমরা বান্দি পাঠাইনি। সাক্ষাৎ পরি পাঠাইছি। শুনছি, আমিরের টাকাপয়সা, জমিজমা অনেক আছে। তাহলে তোর আর চিন্তা কীসের? জামাই হাতে রাখবি। তাহলে পুরো সংসার তোর হাতে থাকবে। আমার কপালে এসব ঠেকেনি। বিয়ের পর থেকে শ্বশুরবাড়ির মানুষের মন রাখতে রাখতে কখন বুড়ি হয়ে গেছি বুঝিনি। বুঝছিস তো?’
পদ্মজা মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানাল। প্রসঙ্গ পালটাতে বলল, ‘মেজো আপা আসেনি কেন? বিয়ে কবে আপার?’
‘ওর তো পরীক্ষা সামনে। পড়াশোনা শেষ করুক। এরপর বিয়ে দেব।’
‘বিয়ে না ঠিক হওয়ার কথা ছিল। হয়নি?’
‘কবে?’ আশ্চর্যান্বিত হয়ে বললেন হানি। পদ্মজা হানির প্রশ্নে অবাক হলো। কৌতূহলী হয়ে জানতে চাইল, ‘আম্মা না কয়দিন আগে তোমাদের বাড়ি গেল। বড়ো আপার বিয়ে ঠিক করতে।’
হানি হাঁ হয়ে চেয়ে রইলেন পদ্মজার দিকে। তিনি কিছুই বুঝছেন না। তার মেয়ের বিয়ে আবার কবে ঠিক হওয়ার কথা ছিল? পদ্মজা বিয়ে করে কী আবোলতাবোল বকছে! তিনি বললেন, ‘কী বলিস?’
হানির সহজ সরল মুখখানার দিকে পদ্মজা একদৃষ্টে চেয়ে রইল। সে ছে: আম্মা রাজধানীতে তাহলে কেন গিয়েছিল? মিথ্যে কেন বলেছে? সেদিন রাজধানীতে গিয়েছিল বলেই এত বড়ো অঘটন ঘটেছিল। না! অঘটন ভাগ্যেই লেখা ছিল। কিন্তু মিথ্যে কেন বলল আম্মা?
৩৩
মাদিনী নদীর বুকে কুন্দ ফুলের মতো জোনাকি ফুটে রয়েছে। পদ্মজা তা এক মনে চেয়ে দেখছে। রাত অনেকটা। আমির ঘুমাচ্ছে। তিন দিনে আমিরের সঙ্গে পূর্ণা-প্রেমার খুব ভাব হয়েছে। সারাক্ষণ আড্ডা, লুডু খেলা। পদ্মজা যত দেখছে তত আমিরের প্রেমে পড়ছে। আমিরের ঘুমন্ত মুখের দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে পদ্মজার মনে পড়ল, আগামীকাল ফিরে যেতে হবে শ্বশুরবাড়ি। মা-বাবা, ভাই-বোন সবাইকে ছেড়ে আবার চলে যেতে হবে—ভাবতেই মনটা খারাপ হয়ে আসে। মন ভালো করতে চলে আসে নদীর ঘাটে। জোনাকিদের কুরুক্ষেত্র দেখতে দেখতে কেটে যায় অনেকক্ষণ। আঁধার ভেদ করে একটা আলোর ছোঁয়া লাগে চারপাশে। এসময় কে এলো? পদ্মজা ঘাড় ঘুরে তাকাল, মাকে দেখে হাসল একগাল। হেমলতা হারিকেন হাতে নিয়ে এগিয়ে আসেন। কিঞ্চিৎ রাগ নিয়ে বললেন, ‘এত রাতে একা ঘাটে এসেছিস কেন? মার খাসনি অনেকদিন। বিয়ে হয়েছে বলে আমি মারব না নাকি?’
হেমলতার ধমকে পদ্মজা মেরুদণ্ড সোজা করে থতমত হয়ে দাঁড়াল। মা শেষ কবে মেরেছেন, পদ্মজা মনে করতে পারছে না। তিনি যেভাবে বললেন মনে হলো, না জানি কত মেরেছেন। তাই পদ্মজাও ভয় পাওয়ার ভান ধরল। বলল, ‘যাচ্ছি ঘরে।’
‘কী জন্য এসেছিলি? ঘুম আসছে না?’ হেমলতার কণ্ঠটা নরম শোনাল।
‘কাল চলে যেতে হবে তাই মন খারাপ হচ্ছিল।’
হেমলতা হারিকেন মাটিতে রাখেন। তারপর দুহাতে পদ্মজাকে বুকে টেনে নেন। বাঁধন ছেঁড়া হলো পদ্মজার কান্নারা। মায়ের বুকে মুখ চেপে পিঠটা বারংবার ফুলে ফুলে উঠতে লাগল। কিছুক্ষণ পার হলো এভাবেই। ‘এত সহজে কাঁদিস কেন? মা-বাবার কাছে সারাজীবন মেয়েরা থাকে না রে মা।’
‘তুমি সঙ্গে চলো।’
‘পাগল মেয়ে! বলে কী! কান্না থেমেছে?’
পদ্মজা দুহাতের উলটো পাশ দিয়ে চোখের জল মুছে বলল, ‘হুঁ।’
আমির তো ঘুমে। তুইও ঘুমিয়ে পর গিয়ে।’
পদ্মজা মাথা নাড়াল। দুই কদম এগিয়ে আবার চটজলদি পিছিয়ে আসে। মাকে জিজ্ঞাসা করে, ‘তুমি ঘুমাবে না আম্মা?’
‘ঘুমাব, চল।’
‘আম্মা?’
হেমলতা হারিকেন হাতে নিয়ে পদ্মজার চোখের দিকে তাকালেন। পদ্মজা বলল, ‘তোমার জীবনের সবটা আমাকে বলেছো। কিছু আড়ালে থাকলে সেটাও বোলো, আম্মা।’
‘কেন মনে হলো, আরো কিছু আছে?’ হেমলতার কণ্ঠটা অন্যরকম শোনাল।
‘মনে হয়নি। এমনি বলে রাখলাম।’
পদ্মজা নতজানু হয়ে নিজের নখ খুঁটছে। হেমলতা স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। কেটে গেল অনেকটা সময়। তিনি ঢোক গিলে গলা ভিজিয়ে বললেন, ‘তাই হবে।
পদ্মজা খুশিতে তাকাল। নিশ্চয় এখন সব বলবে আম্মা। হানি খালামনির বাড়ির কথা বলে সেদিন কোথায় গিয়েছিলেন? এখনই জানা যাবে।
হেমলতা আশায় পানি ঢেলে দিলেন, ‘এখন ঘুমাতে যা। অনেক রাত হয়েছে।’
পদ্মজার চোখমুখের উজ্জ্বলতা নিভে গেল। মা কাঙ্ক্ষিত প্রসঙ্গটি কেন এড়িয়ে যাচ্ছেন? পদ্মজা সরাসরি জিজ্ঞাসা করার অনেক চেষ্টা করেছে, কিন্তু পারছে না। জড়তা ঘিরে রেখেছে তাকে। মা সবসময় নিজ থেকে সব বলেন। নিশ্চয় কোনো কারণে এই বিষয়ে চুপ আছেন। পদ্মজা মনে মনে নিজেকে সান্ত্বনা দিল, ‘একদিন আম্মা বলবে।’
কালো মেঘে ঢাকা আকাশ। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়ছে। লাহাড়ি ঘরের বারান্দায় হাত-পা ছড়িয়ে বসে আছেন হেমলতা। সন্ধ্যার আজান পড়বে। চারপাশে এক মায়াবী ঘনছায়া। মন বিষাদময়। পদ্মজা দুপুরে মোড়ল বাড়ি ছেড়েছে। বিদায় মুহূর্তটা একটুও স্বস্তির ছিল না। মেয়েটা এত কাঁদতে পারে! তবে হেমলতার চোখ শুকনো ছিল। মায়ের চোখ শুকনো দেখে কি পদ্মজা কষ্ট পেয়েছিল? কে জানে! হেমলতা বারান্দা ছেড়ে উঠতে গিয়ে আবিষ্কার করলেন শক্তির অবস্থান শূন্যে। তিনি আবার বসে পড়লেন। হেসে ফেললেন, পদ্মজা ছাড়া এত দুর্বল তিনি! এটা ভাবতে অবশ্য ভালো লাগে। হেমলতা আকাশের দিকে তাকালেন। চোখ দুটি জ্বলছে। জলভরা চোখ নিয়ে আবার হাসলেন। কী যন্ত্রণাময় সেই হাসি! মাটিতে হাতের ভর ফেলে উঠে দাঁড়ান তিনি। এলোমেলো পায়ে লাহাড়ি ঘর ছাড়েন। উঠোনে এসে থমকে দাঁড়ান। বাড়ির গেট খোলা ছিল। পাতলা অন্ধকার ভেদ করে একটি নারী অবয়ব এগিয়ে আসছে বাড়ির দিকে। হেমলতা নারী ছায়াটির স্পষ্ট মুখ দেখার জন্য অধীর আগ্রহে তাকিয়ে থাকেন। গেটের কাছাকাছি আসতেই হেমলতা আন্দাজ করতে পারেন কে এই নারী! তিনি মৃদু হেসে এগিয়ে যান।
‘অনেক দেরি করলেন আসতে।’
বাসন্তী উঠোনে পা রেখে বললেন, ‘আপনি আমাকে চিনেন?’
হেমলতা জবাব না দিয়ে বাসন্তীর ব্যাগ নিতে হাত বাড়ালেন। বাসন্তী ব্যাগ আড়াল করে ফেললেন, তিনি খুব অবাক হচ্ছেন। মনে যত সাহস নিয়ে এসেছিলেন, সব ভেঙে চুরমার হয়ে যাচ্ছে। হেমলতা বললেন, ‘আপনি এই বাড়িতে নির্দ্বিধায় থাকতে পারেন। আমি বা আমার সন্তানদের পক্ষ থেকে আপত্তি নেই।’
‘আ…আপনি আমাকে চিনলেন কীভাবে?’
‘সে যেভাবেই চিনি। জেনে কি লাভ আছে? আপনি প্রথম দিনই একা আসতে পারতেন। লোকজন না নিয়ে।’
বাসন্তীর এবার ভয় করছে। শরীর দিয়ে ঘাম ছুটছে। একটা মানুষ সতিন দেখে এত স্বাভাবিক কী করে হতে পারে? তিনি তো ভেবেছিলেন যুদ্ধ করে স্বামীর বাড়িতে বাঁচতে হবে। বাসন্তীর ধবধবে সাদা চামড়া লাল বর্ণ ধারণ করেছে। হেমলতার কথা, দৃষ্টি এত ধারাল মনে হচ্ছে তার! হেমলতা বাসন্তীকে চুপ দেখে বললেন, ‘আপনি বিব্রত হবেন না। এটা আপনারও সংসার। আসুন।’
হেমলতা আগে আগে এগিয়ে যান। বারান্দা অবধি এসে পেছনে ফিরে দেখেন, বাসন্তী ঠায় দাঁড়িয়ে আছেন। হেমলতা কথা বলার জন্য প্রস্তুত হোন, তখনই একটা পুরুষালি হুংকার ভেসে এলো, ‘তুমি এইহানে আইছো কেন?’
মোর্শেদের কণ্ঠ শুনে বাসন্তী কেঁপে উঠলেন। মোর্শেদকে এড়িয়ে একজন বনেদি লোকের প্রতি ক্ষণিকের জন্য আকৃষ্ট হয়ে পড়েছিলেন বাসন্তী। এরপর থেকেই মোর্শেদ এবং তার সম্পর্কে ফাটল ধরে। মোর্শেদ ত্যাগ করেন তাকে। কিন্তু তিনি এক সময় বুঝতে পারেন, কোনটা ভুল কোনটা সঠিক। সংসারের প্রতি টান অনুভব করে ফিরে আসতে চান। মোর্শেদ জায়গা দিলেন না। ততদিনে মোর্শেদ দ্বিতীয় স্ত্রীর প্রতি ভালোবাসা উপলব্ধি করেন, মোহ ছেড়ে ফিরে আসেন সংসারে হেমলতার কাছে।
‘বাইর হইয়া যাও কইতাছি। বাইর হও আমার বাড়ি থাইকা।’
মোর্শেদ বাসন্তীকে ধাক্কা দিয়ে বেরিয়ে যেতে বললেন। বাসন্তী হুমড়ি খেয়ে পড়তে গিয়েও নিজেকে সামলে নিলেন। চোখ গরম করে মোর্শেদের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘এইটা আমারও ছংছার। আমি যাব না।’
‘বাসন্তী, ভালাই ভালাই কইতাছি যাও এন থাইকা। নইলে তোমার লাশ ফালায়া দিয়াম আমি।’
বাসন্তী কিছু কঠিন কথা শোনাতে গিয়েও শুনালেন না। হেমলতা উঠোনে নেমে আসেন, ‘যখন বিয়ে করেছো তখন হুঁশ ছিল না! এখন সংসার দিতে আপত্তি?’
‘তুমি জানো না লতা, এই মহিলা কত্তডা খারাপ। এই মহিলা লোভী। লোভখোরের বাচ্চা। মাদারির বাচ্চা।’
‘কী সব বলছো? মুখ সামলাও।’
মোর্শেদের কপালের রগ দপদপ করছে। নিশ্বাস ঘন হয়ে এসেছে। বাসন্তীকে পেটাতে হাত নিশপিশ করছে। তবুও হেমলতার কথায় তিনি থামলেন। কিন্তু তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে রইলেন বাসন্তীর দিকে। হেমলতা বললেন, ‘আপনি ঘরে যান। এই ঘর আপনারও। উনার কথা মনে নিবেন না।’
‘আমার ঘরে এই মহিলায় ঢুকলে খারাপি হইয়া যাইব।’
হেমলতা মোর্শেদের চোখের দিকে তাকিয়ে ইশারায় কিছু একটা বললেন। এরপর বাসন্তীকে বললেন, ‘আপনি যান। সদর ঘরের ভেতরের দরজার বাঁদিকে যে ঘরটা সেখানেই যান। দেখিয়ে দিতে হবে?’
বাসন্তী কিছু না বলে গটগট আওয়াজ তুলে বারান্দা পেরিয়ে সদর ঘরে ঢুকে পড়েন। হাত-পা কাঁপছে তার। হেমলতার ব্যবহার স্বাভাবিক হলেও অস্বাভাবিক ঠেকছে। সেদিন বৃষ্টিতে ভিজে ফেরার জন্য জ্বরে বিছানায় পড়ে যান। গত কয়দিন জ্বরে এতই নেতিয়ে গিয়েছিলেন যে, ওঠার শক্তিও ছিল না। শরীরটা একটু চাঙ্গা হতেই আবার চলে এসেছেন। এত সহজে সব পেয়ে যাবেন জানলে জ্বর নিয়েই চলে আসতেন। মোর্শেদ অসহায় চোখে তাকালেন হেমলতার দিকে। বললেন, ‘কেন এমনডা করলা? আমি বাসন্তীর লগে থাকবার চাই না।’
‘ঠান্ডা হও তুমি। তুমি কিছুই জানো না, যেদিন আমরা ঢাকা থেকে ফিরি সেদিন উনি এসেছিলেন। লোকজন নিয়ে এসেছিলেন। এরপরই আমার মেয়েদের জীবনে অন্ধকার নেমে আসে। পরিস্থিতি হাতের নাগালে চলে যাওয়াতে উনি সেদিন ফিরে গিয়েছিলেন। বিয়ের দিন বেয়াই সব বললেন। বেয়াইয়ের কাছে কামরুল মিয়া অভিযোগ করেছিলেন। বেয়াই কামরুল ভাইকে বলেন, ব্যাপারটা এখন ছড়াছড়ি না করতে। এতে উনার সম্মান নষ্ট হবে। যে বাড়িতে ছেলের বিয়ে দিচ্ছেন সেই বাড়ির কর্তার প্রথম বউ আছে, বউ আবার একজন পরনারীর মেয়ে। অধিকার নিতে লোকজন নিয়ে বৈঠক বসাবে—এসব সত্যিই অসম্মানজনক। তিনি আমাকে অনুরোধ করেছেন, ব্যাপারটা যেন নিজেদের মধ্যে মিটিয়ে নেই। আর বাসন্তী আপার তো দোষ নেই। সবচেয়ে বড়ো কথা, আমার সংসারের হাল ধরার জন্য একজন দরকার। খুব দরকার।’ হেমলতার শেষ কথাগুলো করুণ শোনাল। মোর্শেদ বিস্ময়ে তাকিয়ে আছেন। বাসন্তী এত কিছু করেছে তা ভাবতে পারছেন না। মোর্শেদ কণ্ঠ খাদে নামিয়ে বললেন, ‘তারে আমি মানতে পারতাছি না। বুঝায়া শুনায়া বাইর কইরা দেও।’
‘তুমি আমার কথাগুলো শোনো, থাকতে দাও উনাকে। ক্ষমা করে দাও। আমি জানি না সে কী করেছে। যাই করুক, ক্ষমা করে দাও।’
মোর্শেদের মাথায় খুন চেপেছে। তিনি কী করবেন, কী বলবেন ভেবে পাচ্ছেন না। ক্রোধে-আক্রোশে ফুলতে ফুলতে বাড়ির পেছনে চলে যান। নৌকা নিয়ে বের হবেন। রাতে বোধহয় ফিরবেন না আজ। আজান পড়ছে, বৃষ্টির বেগ বেড়েছে। হেমলতা ব্যস্ত পায়ে হেঁটে যান বারান্দায়। গোপনে দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। বুক মুচড়ে একটা কান্না ছিটকে এলো গলায়, সেইসঙ্গে চোখ ছাপিয়ে জল। কোন নারী সতিন মানতে পারে? বাধ্য হয়ে মানতে হচ্ছে, ভাগ্য বাধ্য করছে। নয়তো তিনি এত উদার নন। কখনোই অন্যকে নিজের সংসারের ভাগ দিতেন না। সেই প্রথম থেকে মনে পুষে রেখেছেন, কখনো মোর্শেদের স্ত্রী এই সংসার চাইলে মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দেবেন। যার জন্য তিনি একাকীত্বে ধুঁকেছেন, যার জন্য মোর্শেদের ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন, যার জন্য মোর্শেদের মার খেয়েছেন—তাকে কখনোই এত সহজে সুখ দিতেন না। কখনোই না। হেমলতার শরীরে কাঁটা ফুটছে। তিনি কোনমতে কান্নাটাকে গিলতে চাইলেন। বাসন্তীর গলা কানে এলো, ‘আপনি কাঁদতাছেন?’
হেমলতা চমকে তাকালেন। লজ্জায় চোখের জল মোছার সাহস পেলেন না। চোখে জল নিয়েই হাসলেন। বাসন্তী হতবাক! কী অসাধারণ নারী!
বাসন্তী প্রসঙ্গ পালটে জানতে চাইলেন, ‘ছেলেমেয়েরা কই?’
‘বড়ো মেয়েটার বিয়ে হয়েছে। শ্বশুরবাড়িতে আছে। আজই ফের যাত্রা শেষ করে শ্বশুর বাড়ি গেল। মেজো আর ছোটোটা তাদের নানাবাড়ি গেছে। বড়োটার জন্য কান্নাকাটি করছিল তাই আম্মা নিয়ে গেছে।’
‘ঘরে একটা ছোটু ছেড়া ঘুমাইতাছে। কে ছে?’
‘প্রান্ত। আমারই ছেলে।’
‘চুনছিলাম তিন মেয়ে ছুধু ‘
হেমলতা আর কথা বাড়ালেন না। রান্নাঘরের দিকে যেতে যেতে বললেন, ‘আপনি কলপাড়ে যান। কাপড় পালটে নেন। আমি খাবার বাড়ছি।’
.
পদ্মজা মুখ ভার করে বসে আছে। রাতের খাবারের সময় ফরিনা বেগম কথা শুনিয়েছেন। কঠিন স্বরে বলেছেন, ‘বাপের বাড়ির আহ্লাদ মিটায়া আইছো তো? আর কোনোদিন যাইতে কইবা না। এইডাই তোমার বাপের বাড়ি, স্বামীর বাড়ি। আর তোমার ভাই-বইনদের কইবা সবসময় আনাগোনা না করতে। বাড়ির কাছে বইলা সবসময় আইতে হইব এইডা কথা না। চোক্ষে লাগে।
পদ্মজা বুঝতে পারছে না, তার ভাই বোন তো শুধু বৌভাতের দিন এসেছে। দাওয়াতের আমন্ত্রণ রক্ষার্থে। এজন্য এভাবে কেন বলতে হবে। কান্না পাচ্ছে খুব। আম্মার কথা মনে পড়ছে। পূর্ণা কী করছে? আসতে তো নিষেধ দিয়ে দিল। তাহলে কীভাবে দেখা হবে? আমির ঘরে ঢুকতেই পদ্মজা দ্রুত চোখের জল মুছল। পদ্মজার ফ্যাকাসে মুখ দেখে আমির প্রশ্ন করল, ‘আম্মা কিছু বলছে?’
পদ্মজা দ্রুত বলল, ‘না, না।’
‘তাহলে কাঁদছ কেন?’
‘আম্মার কথা মনে পড়ছে।’
‘যেতে চাও? চলো।’
‘ওমা কী কথা! এত রাতে। আর দুপুরেই না আসলাম।’
‘তাহলে মন খারাপ করো না। আমরা আবার যাব। কয়দিনের মধ্যে।’ বাইরে অনেক হাওয়া বইছে। পদ্মজা জানালা লাগাতে গেল। তখন একটা চিৎকার শুনতে পেল। আমির তা লক্ষ করে বলল, ‘বড়ো ভাবির চিৎকার। রুম্পা ভাবি। পাগলের মতো আচরণ তার। পাগলই বলে সবাই।
পদ্মজা কৌতূহল নিয়ে আমিরের সামনে এসে দাঁড়াল, ‘আপনার মনে হয় কেউ ভয় পেয়ে মানসিক ভারসাম্য হারাতে পারে?’
‘অসম্ভবের কী আছে?’
‘আমার কাছে খটকা লাগছে। উনার সঙ্গে অন্য কিছু হয়েছে?’
‘আমি তো এতটুকুই জানি,’ আমির চিন্তিত হয়ে বলল।
পদ্মজা বলল, ‘উনার সঙ্গে আমার দেখা করিয়ে দিবেন?’
আমির উত্তেজিত হয়ে বলল, ‘ভাবি তোমাকে আঘাত করবে।’
‘বাঁধাই তো থাকে। অনুরোধ করছি।’
পদ্মজাকে হাতজোড় করে অনুরোধ করতে দেখে আমির সায় দিল, ‘আচ্ছা, ভোরে নিয়ে যাব। তখন সবাই ঘুমে থাকে।’
‘আপনাদের এই বাড়িটা খুব রহস্যজনক।’
‘সত্যি নাকি? আমার তেমন কিছু মনে হয় না।’
‘আপনি তো কয়দিনের জন্য গ্রামে আসেন। আর এসব সবাই বুঝে না।’
‘ওরে আমার বুঝদার। তবে জিন আছে শুনেছি। আমার এক ফুফু বাড়ির পেছনের পুকুরে ডুবে মরেছিলেন। এছাড়া চাচিকে মাঝেমধ্যেই জিনে ধরে।’
‘সে কী!’
‘তবে আমি বিশ্বাস করি না এসব। তুমি বিশ্বাস করো?’
‘না। আচ্ছা…’
পদ্মজা কথা শেষ করতে পারল না। আমির পদ্মজাকে টেনে বিছানায় নিয়ে এলো। আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘আর কথা না। ঘুমাও।’
‘আমি ভর্তা হয়ে যাচ্ছি।’
‘এই যে আস্তে ধরলাম।’
‘শুনুন না?’
‘কী?’
‘আমি পড়তে চাই।’
‘পড়বে।’
‘আম্মাকে অসন্তুষ্ট রেখে জোর করে পড়তে মন মানবে না।’
‘আম্মাকে রাজি করাব।’
পদ্মজা খুশিতে গদগদ হয়ে উঠল।
সে ও আমিরকে এক হাতে জড়িয়ে ধরল।
৩৪
আজানের ধ্বনিতে জেগে ওঠে পৃথিবী, জেগে ওঠে পদ্মজা। বিছানা থেকে উঠতে গিয়েও উঠতে পারল না। আমির দুই হাতে জাপটে ধরে রেখেছে তাকে। পদ্মজা আমিরকে মৃদু কণ্ঠে ডাকল, ‘এই যে, শুনছেন?’
আমির সাড়া দিল না। আবার ডাকল পদ্মজা। আমির ঘুমের ঘোরে কিছু একটা বিড়বিড় করে পুনরায় ঘুমে তলিয়ে যায়। এবার পদ্মজা উঁচু স্বরে ডাকল, ‘আরে উঠুন না। ফজরের নামাজ পড়বেন। এই যে…’
আমির পিটপিট করে চোখ খুলে তাকাল। দুই হাতের বাঁধন আগলা করতেই পদ্মজা আমিরকে ঠেলে দ্রুত উঠে বসে। বিছানা থেকে নামতে নামতে বলল, ‘অজু করতে আসুন। আপনি আমাকে কথা দিয়েছিলেন আজ থেকে নামাজ পড়বেন।
পদ্মজা দ্রুত কলপাড়ের দিকে যেতে থাকে। সে সবসময় আলো ফোটার আগে ফজরের নামাজ আদায় করার চেষ্টা করে। কলপাড় থেকে অজু করে এসে দেখে, আমির বালিশ জড়িয়ে ধরে আয়েশ করে ঘুমাচ্ছে। সে মৃদু হেসে কপাল চাপড়ায়। আমিরের পাশে গিয়ে তার চুলে বিলি কেটে দিয়ে কোমল কণ্ঠে বলল, ‘উঠুন না। নামাজ পড়ে আবার ঘুমাবেন। মসজিদে যেতে হবে না, আমার সঙ্গেই পড়ুন। এই যে, শুনছেন? এই যে, বাবু…’
পদ্মজা দ্রুত জিভ কাটল। মুখ ফসকে আমিরের ডাক নাম ধরে ডেকে ফেলল! পদ্মজা সাবধানে পরখ করে দেখল, আমির শুনল কি না! না শোনেনি। পদ্মজা হাঁফ ছেড়ে আরো এক দফা ডাকার পর আমির উঠে বসে। কাঁদো কাঁদো হয়ে অনুরোধ করে, ‘কাল থেকে পড়ব। দয়া করে, আজ ঘুমাতে দাও।’
পদ্মজা তার কথা শুনল না। বরং স্ত্রীর অনুনয়ের কাছে হেরে গেল আমির। সহধর্মিণী যদি এত সুন্দরী হয় তার অনুরোধ কি ফেলা যায়? আমির অনিচ্ছা সত্ত্বেও কলপাড় থেকে অজু করে আসে। পাশাপাশি জায়নামাজে বসে নামাজ আদায় করল দুজন।
নামাজ শেষ হতেই পদ্মজা তাড়া দিয়ে বলল, ‘এবার চলুন।’
আমির টুপি বিছানার ওপর রেখে অবাক হয়ে জানতে চাইল, ‘কোথায়?’
অভিমান হলো পদ্মজার, ‘এমনভাবে বলছেন যেন জানেন না!’
আমিরের সত্যি কিছু মনে পড়ছে না। চোখে এখনো ঘুম ঘুম ভাব। সে শুধু ঘুমাতে চায়। পদ্মজার অভিমানী মুখ দেখে মনে করার চেষ্টা করল। মনে পড়তেই বলল, ‘ওহ! দাঁড়াও, চাবি নিয়ে আসছি।’
আমির ঘরের বাইরে চলে যায়। পদ্মজা প্রবল উত্তেজনা নিয়ে অপেক্ষা করছে। জানালার পাশে দাঁড়াতেই ভোরের স্নিগ্ধ বাতাসে সর্বাঙ্গ চাঙ্গা হয়ে উঠে। বাইরে সবেমাত্র ভোরের আলো ফুটেছে। পদ্মজা মুগ্ধ নয়নে দেখছে বাড়ির পেছনের জঙ্গল। কী সুন্দর সবকিছু! এত এত গাছ। অযত্নে গড়ে ওঠা বন-জঙ্গল বোধহয় একটু বেশি আকর্ষণীয় হয়।
প্রকৃতির রূপ দেখতে দেখতে আচমকা চোখের তারায় দৃশ্যমান হয় রানি। রানির পরনে আকাশি রঙের সালোয়ার-কামিজ। সে জঙ্গলের ভেতরে যাচ্ছে। চোর চুরি করার সময় যেভাবে চারপাশ দেখে দেখে এগোয় ঠিক সেভাবে চারপাশ দেখে দেখে এগোচ্ছে রানি। পদ্মজা নিশ্বাস বন্ধ করে পুরো দৃশ্যটা দেখল। রানি জঙ্গলের ভেতরে চলে যায়।
পেছন থেকে আমির ডাকল, ‘পদ্মবতী?’
হঠাৎ ডাক শুনে পদ্মজা মৃদু কেঁপে উঠল।
আমির কপাল কুঁচকে প্রশ্ন করল, ‘কিছু কী হয়েছে?’
‘না! কী হবে? চলুন আমরা যাই।’ পদ্মজা হাসার চেষ্টা করল।
পদ্মজা যে কিছু একটা এড়িয়ে যাচ্ছে তা বেশ বুঝতে পারছে আমির। তবে প্রশ্ন করল না। রানির কথা তুলতে গিয়েও তুলল না পদ্মজা। সে ভাবছে, ‘আগে রানি আপাকে জিজ্ঞাসা করতে হবে। এখনই উনাকে বলা ঠিক হবে না। কী ভাবেন আবার!’
রুম্পার ঘরের দরজা খুলতেই ক্যাচক্যাচ আওয়াজ হলো। ঘরে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে নাকে দুর্গন্ধ ঠেকে। পদ্মজা প্রথমে জানালা খুলে দিল। পালঙ্কের দিকে তাকিয়ে দেখতে পেল, সেটি শূন্য। আমিরের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালে, আমির ইশারা করল পালঙ্কের নিচে দেখতে। পদ্মজা ঝুঁকে পালঙ্কের নিচে দেখে কেউ একজন নিথরের মতো শুয়ে আছে, যেন মৃত লাশ। জট লাগা চুল দিয়ে মুখ ঢাকা, হাতে-পায়ে বেড়ি।
আমির পদ্মজার পাশে বসে জানাল, ‘উনিই রুম্পা ভাবি।’
পদ্মজা ধীর কণ্ঠে অনুরোধ করে, ‘উনাকে একটু ডাকবেন?’
‘রেগে যায় যদি?’
‘তবুও ডাকুন।’
আমির লম্বা করে নিশ্বাস নিয়ে ডাকল, ‘ভাবি? ভাবি? শুনছেন ভাবি?’
রুম্পা নড়েচড়ে চোখ খুলে। দেখতে পায়, দুই হাত দূরে একটা ছেলে ও মেয়ে বসে আছে। তাদের মুখ স্পষ্ট নয়। আলো তখনো ভালো করে ঘরে ঢোকেনি। রুম্পা শান্ত চোখে চেয়ে রইল অনেকক্ষণ। পদ্মজা হাত বাড়িয়ে বলল, ‘আমার হাতে ধরে বেরিয়ে আসুন।’
রুম্পা বাঁধা দুই হাতে পদ্মজার হাত ধরার চেষ্টা করে, পারল না। পদ্মজা নত হয়ে রুম্পার দুই হাত ধরে টেনে বাইরে নিয়ে এলো। রুম্পা কাছে পৌঁছাতেই দুর্গন্ধে বমি চলে আসে পদ্মজার। গলা অবধি এসে বমি আটকে গেছে। না জানি রূম্পা ভাবি কতদিন গোসল করেনি, দাঁত মাজেনি। এই বাড়ির কেউ কী একটু পরিষ্কার করে রাখতে পারে না? প্রস্রাবের গন্ধও পাওয়া যাচ্ছে। মনে হচ্ছে ঘরেই পায়খানা-প্রস্রাব করে, নয়তো এত বিশ্রী গন্ধ হতো না।
রুম্পা মলিন মুখে চেয়ে আছে পদ্মজার দিকে। শান্ত, স্থির দৃষ্টি। আমি গর্ব করে রুম্পাকে বলল, ‘আমার বউ। বলছিলাম না, সবচেয়ে সুন্দরী মেয়েটা আমার বউ হবে। দেখিয়ে দিলাম তো?’
রুম্পা হাসল। আশ্চর্য মায়া সেই হাসিতে! পদ্মজা মুগ্ধ হয়ে দেখল। ময়লাটে মলিন মুখের হাসি বোধহয় পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর হাসি। অনেকদিন গোসল না করার কারণে চেহারা-হাত-পা ময়লাটে হয়ে গেছে। নখগুলোও বড়ো বড়ো। নখের ভেতর ময়লার স্তূপ। ঠোঁট ফেটে চৌচির। টলমল করা চোখ। দেখে মনে হচ্ছে এক্ষুনি চোখ দিয়ে বর্ষণ বইবে।
রুম্পা পদ্মজাকে শান্ত কণ্ঠে বলল, ‘এ তো ম্যালা সুন্দর ছেড়ি। তোমার নাম কী গো?’
পদ্মজা এক পলক আমিরকে দেখে জবাব দিল, ‘উম্মে পদ্মজা।’
‘ছুডু ভাই, এত সুন্দর ছেড়ি কই পাইলেন? এ…এ যে চান্দের লাকান মুখ।’
রুম্পার আরো কাছে গিয়ে বসে পদ্মজা। দুর্গন্ধটা আর নাকে লাগছে না। মানুষটাকে তার বেশ লাগছে। রুম্পার কুচকুচে কালো, লম্বা চুল। মাটিতে পাঁচ-ছয় ইঞ্চি চুল লুটিয়ে আছে। অনেকদিন না ধোয়ার কারণে জট লেগে আছে, কিন্তু সৌন্দর্যের অস্তিত্ব এখনো বোঝা যায়। সুস্থ অবস্থায় নিশ্চয় অনেক বেশি সুন্দর চুলের অধিকারিণী ছিল।
পদ্মজা শুধাল, ‘আমি আপনাকে তুমি করে বলি?’
রুম্পা দাঁত বের করে হেসে মাথা নাড়াল।
পদ্মজা হেসে বলল, ‘কিছু বলবেন?’
রুম্পা হাসি হাসি মুখে তাকিয়ে থাকে পদ্মজার দিকে। কোনো জবাব দেয় না। সেকেন্ড কয়েক পর রুম্পার চোখের দৃষ্টি এদিক-ওদিক ছুটতে থাকে। হাসি মিলিয়ে মুখে নেমে আসে আঁধার। হঠাৎই যেন চাঁদের মতো ঝকঝক করা মুখ কলঙ্কে লেপটে দিয়েছে কেউ। পদ্মজা অবাক হয়ে রুম্পার পরিবর্তন দেখতে লাগল।
আকস্মিক তাকে আক্রমণ করে বসল রুম্পা, খামচে ধরল পা। আমির লাফিয়ে উঠে রুম্পার হাত থেকে পদ্মজাকে ছাড়ানোর চেষ্টা করল। রুম্পা পা ছেড়ে এবার কামড়ে ধরল পদ্মজার শাড়ি। মুখ দিয়ে ক্ষোভে-আক্রোশে ভাষাহীন শব্দ করতে থাকল।
আমির ধমকে ওঠে, ‘ভাবি ছাড়ো বলছি। পদ্মজা তোমার ক্ষতি করতে আসেনি। ভাবি ছাড়ো।’
পদ্মজা স্তব্ধ হয়ে দেখছে রূম্পাকে। তার চোখেমুখে কোনো ভয়ভীতি নেই। কিছু যেন খুঁজছে রুম্পার মধ্যে। খুঁজে কূলকিনারা পাচ্ছে না। রুম্পা শাড়ি ছেড়ে দিতেই পদ্মজা একটু পিছিয়ে গেল, দরজার ওপর পড়ল চোখ। দেখতে পেল: কেউ সরে গেল যেন। অদ্ভুত কারণে পদ্মজার বুক কাঁপতে থাকে। নুরজাহান নিজ ঘর থেকে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসেন। আমির- পদ্মজাকে দেখে তার চক্ষু চড়কগাছ! তিনি বাজখাঁই কণ্ঠে বললেন, ‘তালা খুলছে কেডায়? বাবু, নতুন বউরে নিয়া এইহানে আইছোস কেন?’
আমির দ্রুত রুম্পার কাছ থেকে সরে আসে। নুরজাহানকে কৈফিয়ত দেয়, ‘ভাবলাম, বাড়ির সবাইকে পদ্মজা দেখেছে। রুম্পা ভাবিকেও দেখুক। ভাবতে পারিনি ভাবি এমন কাজ করবে। ভাবি তো এখন আরো বেশি বিগড়ে গেছে, দাদু।’
‘তুই আমারে কইয়া আইবি না? তোর চিল্লানি হুইননা আমার কইলজাডা উইড়া গেছিল। বউ, তোমারে দুঃখ দিছে এই ছেড়ি?’
পদ্মজা দ্রুত বলল, ‘না, না। কিছু করেনি।’
আমির চেঁচিয়ে উঠল, ‘কী বলছ? কিছু করেনি মানে? হাত দেখি?’
আমির পদ্মজার দুই হাত টেনে নিয়ে দেখে, বাঁ-হাতে নখের জখম।
আমির ব্যথিত স্বরে বলল, ‘ইস! কতটা আঘাত পেয়েছ। ঘরে চলো। দাদু এই নাও চাবি। তালা মেরে দিয়ো।’
আমির পদ্মজাকে টেনে নিয়ে বেরিয়ে যায়। বেরোবার আগ মুহূর্তে পদ্মজা রুম্পার দিকে তাকাল। দেখতে পেল, রুম্পা আড়চোখে তাকে দেখছে। সে চোখে স্নেহ, মমতা! একটু হাসিও লেগে ছিল। পদ্মজার মাথা চক্কর দিয়ে উঠল।
কী হচ্ছে এসব!
ঘরে এসে আমিরকে বলল, ‘উনার যত্ন কেউ নেয় না কেন?’
‘দেখোনি কী রকম করল? এই ভয়েই কেউ যায় না। শুরুতে তোমাকে দেখে যদি রেগে যেত তখনই তোমাকে নিয়ে চলে আসতাম। সবাইকে ভাবি তুই করে বলে। তোমাকে তুমি বলে সম্বোধন করতে দেখে ভেবেছি, বোধহয় তোমাকে পছন্দ হয়েছে। তাই আঘাত করবে না। কিন্তু সেই ধারণা ভুল হলো।
‘আপনি অকারণে চাপ নিচ্ছেন। নখের দাগ বসেছে শুধু।’
‘রক্ত চলে এসেছে।’
‘এইটুকু ব্যাপার না।’
আমির তুলা দিয়ে পদ্মজার হাতের রক্ত মুছে দিয়ে বলল, ‘আর ওইদিকে পা দিবে না।’
‘আম্মার কণ্ঠ শোনা যাচ্ছে।’
‘লাবণ্যকে ঘুম থেকে তুলছে। ও ফজরে উঠতেই চায় না।’ আমির হেসে ফেলল।
‘আমি যাই।’
‘কোথায়?’
‘আম্মা সকাল সকাল রান্নাঘরে যেতে বলেছিলেন।’
‘তুমি রান্না করবে কেন?
‘অনুরোধ করছি এমন করবেন না। আমি আমার বাড়িতেও রান্না করেছি। টুকটাক কাজ করেছি। এখন না গেলে আম্মা রেগে যাবেন। রাগানো ঠিক হবে না।’
‘এসব ভালো লাগে না, পদ্মজা।’
‘আমি আসছি।’
আমিরকে কথা বলার সুযোগ না দিয়ে পদ্মজা ব্যস্ত পায়ে বেরিয়ে যায়। আমির শুধু চেয়ে থেকে দেখল।
পদ্মজা – ৩৫
বাইরে বিকেলের সোনালি রোদ, মন মাতানো বাতাস। লম্বা বারান্দা পেরিয়ে নুরজাহানের ঘরের দিকে যাচ্ছে পদ্মজা। বাতাসের দমকায় সামনের কিছু চুল অবাধ্য হয়ে উড়ছে। এতে সে খুব বিরক্ত বোধ করছে। তার এক হাতে দই অন্য হাতে পিঠা। চুল সরাতেও পারছে না। তখন কোথেকে উড়ে এলো আমির। এক আঙুলে উড়ন্ত চুলগুলো পদ্মজার কানে গুঁজে দিয়ে আবার উড়ে চলে গেল। চমৎকার করে হাসল পদ্মজা। আমিরের চলে যাওয়া দেখে মনে মনে বলল, ‘কী চমৎকার মানুষ আপনি!’
নুরজাহানের ঘরের সামনে এসে দেখে, দরজা ভেজানো। পদ্মজা অনুমতি না নিয়ে দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকেই এক বিস্ময়কর দৃশ্য দেখে তার চোখের আকৃতি গোল গোল হয়ে যায়। পালঙ্কে ভুরি ভুরি সোনার অলংকার জ্বলজ্বল করছে। চোখ ধাঁধানো দৃশ্য! পদ্মজাকে দেখে নুরজাহান অপ্রস্তুত হয়ে পড়েন। তা পদ্মজার দৃষ্টিগোচর হলো। নুরজাহান ক্ষুদ্ধ হয়ে ওঠেন, ‘তুমি এইনে কেরে আইছো? আমি কইছি আইতে?’
নুরজাহানের ধমকে থতমত খেয়ে গেল পদ্মজা। বিচলিত ভঙ্গিতে দইয়ের মগ, পিঠার থালা টেবিলের উপর রেখে বলল, ‘আম্মা বললেন দই, পিঠা দিয়ে যেতে।’
‘তোমার হউরি কইলেই হইব? আমি কইছি? আমারে না কইয়া আমার ঘরে আওন মানা হেইডা তোমার হউরি জানে না?’
‘মাফ করবেন।’ মাথা নত করে বলল পদ্মজা।
‘যাও, বাড়াইয়া যাও।’
পদ্মজা চঞ্চল পায়ে বেরিয়ে গেল। দরজার বাইরে এসে থমকে দাঁড়াল। সে ভাবছে, ছোটো কারণে এত ক্ষুদ্ধ প্রতিক্রিয়া কেন দেখালেন তিনি? মাথায় ঢুকছে না।
পদ্মজা আনমনে হেঁটে নিজের ঘরে চলে আসে। এই বাড়িতে আসার পর থেকে কী কী হয়েছে সব ভাবছে। প্রথম রাতে কেউ একজন তার ঘরে এসেছিল, নোংরা স্পর্শ করেছে। সেটা যে আমির নয় সে শতভাগ নিশ্চিত 1 এরপর ভোরে রানিকে দেখল চোরের মতো বাড়ির পেছনের জঙ্গলে ঢুকতে। রুম্পা ভাবির সঙ্গে দেখা হলো, তিনি শুরুতে স্বাভাবিক ছিলেন। শেষে গিয়ে পাগলামি শুরু করলেন। দরজার ওপাশে কেউ ছিল। পদ্মজা ভ্রুকুটি করে মুখে ‘চ’ কারান্ত শব্দ করল। সব ঝাপসা লাগছে।
ফরিনা বলেছিলেন দই-পিঠা দিয়েই রান্নাঘরে যেতে। পদ্মজা বেমালুম সে কথা ভুলে গিয়েছে। যখন মনে পড়ল কেটে গিয়েছে অনেকটা সময়। সে দ্রুত আঁচল টেনে মাথা ঘুরে ছুটে গেল রান্নাঘরের দিকে। এসে দেখে ফরিনা ও আমিনা মাছ কাটছেন। পদ্মজা পা টিপে টিপে রান্নাঘরে ঢুকে। ভয়ে বুক কাঁপছে। কখন না কঠিন কথা শোনানো শুরু করে দেন।
‘অহন আওনের সময় হইছে তোমার? আছিলা কই?’ বললেন ফরিনা।
‘ঘরে।’ নতজানু হয়ে বলল পদ্মজা।
‘আমির তো বাইরে বাড়াইয়া গেছে অনেকক্ষণ হইল। তুমি ঘরে কী করতাছিলা? স্বামী বাড়িত থাকলে ঘরে থাহন লাগে। নাইলে বউদের খালি রান্ধাঘরে শোভা পায়। এই কথা কী তোমার মায় কয় নাই?’
চুলার থেকে কিছুটা দূরত্বে কয়েকটা বেগুন পড়ে আছে। এখানে আসার পর থেকে সে দেখছে প্রতিদিন বেগুন ভাজা করা হয়। পদ্মজা দা নিয়ে বসে বেগুন হাতে নিতেই ফরিনা বললেন, ‘বেগুন লইছো কেরে?’
‘আজ ভাজবেন না?’
‘জাফর আর হের বউ তো গেলোই গা। এহন কার লাইগা করাম? আর কেউ বেগুন খায় না।’
পদ্মজা বেগুন রেখে কণ্ঠ খাদে নামিয়ে বলল, ‘কী করব?’
ফরিনা চোখ-মুখ কুঁচকে মাছ কাটছেন। যেন পদ্মজার উপস্থিতি তিনি নিতে পারছেন না। অনেকক্ষণ পর কাঠ কাঠ গলায় পদ্মজার প্রশ্নের জবাব দিলেন, ‘ঘরে গিয়া বইয়া থাহো।’
পদ্মজার চোখ দুটি জলে ছলছল করে ওঠে। ঢোক গিলে বলল, ‘আর হবে না।’
‘তোমারে কইছে না এইহান থাইকা যাইতে? যাও না কেরে? যতদিন আমরা আছি তোমরা বউরা রান্ধাঘরের দায়িত্ব লইতে আইবা না।’ আমিনার কণ্ঠে বিদ্রুপ।
পদ্মজা আমিনার কথায় আহত হলো। সে কখন দায়িত্ব নিতে চেয়েছে? আমিনার কথা শুনে ফরিনা চোখ গরম করে বললেন, ‘আমার ছেড়ার বউরে আমি মারাম, কাটাম, বকাম। তোমরা কোনোদিন হের লগে উঁচু গলায় কথা কইবা না। বউ, তুমি ঘরে যাও।’
পদ্মজার সামনে এভাবে অপমানিত হয়ে আমিনা পাথর হয়ে যান। তিনি সেই শুরু থেকে ফরিনাকে ভয় পান। তাই আর টু শব্দ করলেন না। পদ্মজা ফরিনার দিকে অনুসন্ধানী দৃষ্টি নিয়ে তাকাল। মনে হচ্ছে এই মানুষটারও দুই রূপ আছে। এই বাড়ির প্রায় সবাইকে তার মুখোশধারী মনে হচ্ছে। কেউ ভালো, কিন্তু খারাপের অভিনয় করে। আর কেউ আসলে শয়তান, কিন্তু ভালোর অভিনয় করে। কিন্তু কেন? কীসের এত ছলনা!
কে ভালো? আর কে শয়তান?
‘খাড়াইয়া আছো কেন? যাও, ঘরে যাও।’
‘গিয়ে কী করব আম্মা? কোনো সাহায্য লাগলে বলুন না।’ পদ্মজা কাজে সাহায্য করার জন্য রীতিমতো অনুরোধ করছে। কিন্তু ফরিনার এক কথা, ‘তোমারে যাইতে কইছি। যাও তুমি, ঘরে যাও।’
পদ্মজা আর কথা বাড়াল না, ধীর পায়ে জায়গা ত্যাগ করল। এদিক- ওদিক হেঁটে ভাবতে লাগল—কার ঘরে যাবে। লাবণ্যের কথা মনে হতেই এগিয়ে গেল সেদিকে, বিকেলে টিভি দেখে মেয়েটা; নিশ্চয়ই এখনও দেখছে। লাবণ্যের ঘরে ঢুকতেই লিখন শাহর কন্ঠ শ্রবণপথে প্রবেশ করে। পদ্মজা টিভির দিকে তাকাল। লিখন শাহ অভিনীত ছায়াছবি চলছে। পদ্মজা চলে যেতে ঘুরে দাঁড়াল। লাবণ্য ডাকল, ‘ওই ছেমড়ি যাস কই? এইদিকে আয়।’
পদ্মজা লাবণ্যর পাশের পালঙ্কে বসল। লাবণ্য দুই হাতে পদ্মজার গলা জড়িয়ে ধরে বলল, ‘সারাদিন দাভাইয়ের সঙ্গে থাকস কেন? আমার ঘরে একবার উঁকি দিতে পারস না?’
‘তোর দাভাই আমাকে না ছাড়লে আমি কী করব?
‘ঘুসি মেরে সরাইয়া দিবি।’
‘হ্যাঁ, এরপর আমাকে তুলে আছাড় মারবে।’
‘দাভাইকে ডরাস?’
‘একটুও না।’
‘সত্যি?’
‘মিথ্যে বলব কেন?’
‘একদিন রাগ দেখলে এরপর ঠিকই ডরাইবি।’
‘আমি রাগতেই দেব না।’
লাবণ্য হাসল। টিভির দিকে তাকিয়ে বলল, ‘লিখন শাহর মতো মানুষরে ফিরাইয়া দেওনের সাহস খালি তোরই আছে। আমার জীবনেও হইত না।’
পদ্মজা কিছু বলল না। লাবণ্যই বলে যাচ্ছে, ‘এই ছবিটা আমি এহন নিয়া ছয়বার দেখছি। লিখন শাহ তার নায়িকারে অনেক পছন্দ করে। কিন্তু নায়িকা পছন্দ করে অন্য জনরে, তারে বিয়া করে। বিয়ার অনেক বছর পর লিখন শাহর প্রেমে পড়ে নায়িকা। ততদিনে দেরি হয়ে যায়। লিখন শাহ মরে যায়। এই হইলো কাহিনি। আইচ্ছা পদ্মজা, যদি এমন তোর সঙ্গেও হয়?’
পদ্মজা আঁতকে উঠে বলল, ‘যাহ কী বলছিস! বিয়ের আগে ভাবতাম যার সঙ্গে বিয়ে হবে তাকেই ভালোবাসব। কিন্তু এখন আমার তোর ভাইকেই দরকার।’
‘ও বাবা! লাইলি আসছে। যাহ, আমি মজা করছি। আমি কেন চাইব আমার ভাইয়ের বউ অন্যজনরে পছন্দ করুক। লিখন শাহ আমার। শয়নে স্বপনে তার লগে আমি সংসার পাতি।’
পদ্মজা হাসল। লাবণ্যর পিঠ চাপড়ে বলল, ‘আব্বাকে বল, লিখন শাহকে ধরে এনে তোর গলায় ঝুলিয়ে দিবে।’
‘বিয়া এমনেও দিয়া দিব। কয়দিন পর মেট্রিকের ফল। আমি যে ফেল করাম এই খবর আমি তো জানি, পুরা গেরামও জানে।’
‘কিছু হবে না। পাশ করবি। রানি আপা কোথায়?’
‘কী জানি কই বইয়া রইছে। চুপ থাক এহন। টিভি দেখ। দেখ, কেমনে কানতাছে লিখন শাহ। এই জায়গাটা আমি যতবার দেহি আমার কাঁনতে মনে চায়,’ বলতে বলতে লাবণ্য কাঁদতে শুরু করল। ওড়নার আঁচল দিয়ে তার চোখের জল মুছে দিয়ে টিভির দিকে তাকাল পদ্মজা। দৃশ্যে চলছে, লিখন শাহ ঠোঁট কামড়ে কাঁদছে। তার ঘোলা সুন্দর চোখ দুটি আরো ঘোলা হয়ে উঠেছে, ভাংচুর করছে ঘরের জিনিসপত্র। তার মা-বোন-ছোটো ভাই ভয়ে গুটিসুটি মেরে দাঁড়িয়ে আছে। এক টুকরো কাচ ঢুকে পড়ল লিখন শাহর পায়ে, আর্তনাদ করে ফ্লোরে বসে পড়ল সে। তার মা দৌড়ে এসে ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ধরে পাগলামি থামাতে বলল। লিখন শাহ আর্তনাদ করে বলছে, ‘তুলির বিয়ে হয়ে যাচ্ছে আম্মা। আমি কী নিয়ে বাঁচব? কেন তুলি আমাকে ভালোবাসল না? আমি তো সত্যি ভালোবেসে ছিলাম।’
পদ্মজা বাকিটা শুনল না। মনোযোগ সরিয়ে নিলো। তার কানে বাজছে, ‘পদ্মজার বিয়ে হয়ে যাচ্ছে আম্মা। আমি কী নিয়ে বাঁচব? কেন পদ্মজা আমাকে ভালোবাসল না? আমি তো সত্যি ভালোবেসেছিলাম।’
চোখের কোনায় অশ্রু জমল পদ্মজার। সে অশ্রু আড়াল করে লাবণ্যকে বলল, ‘তুই দেখ। আমি যাই।’
লাবণ্যের কানে পদ্মজার কথা ঢুকল না। সে টিভি দেখছে আর ঠোঁট ভেঙে কাঁদছে। পদ্মজা আর কিছু না বলে উঠে যায়। দরজার সামনে আমিরকে দেখতে পেয়ে ধক করে উঠল তার বুক। পরে মনে হলো, সে তো কোনো অপরাধ করেনি। তাহলে এত চমকানোর কী আছে? আমির কাগজে মোড়ানো কিছু একটা এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘ঘরে, রান্নাঘরে কোথাও পেলাম না। মনে হলো লাবণ্যর ঘরেই আছো। টিভি দেখছিলে নাকি?
৩৬
বাসন্তী ঠোঁটে লাল রঙের লিপস্টিক মাখছেন। প্রেমা-প্রান্ত বেশ আগ্রহ নিয়ে দেখছে। তারা দুজন বাসন্তীকে মেনে নিয়েছে। বাসন্তীর কথাবার্তা আর চালচলন আলাদা, যা ছোটো দুটি মনকে আনন্দ দেয়। তারা আগ্রহভরে বাসন্তীর কথা শোনে। লিপস্টিক লাগানো শেষ হলে বাসন্তী প্রেমাকে বললেন, ‘তুমি লাগাইবা? ‘
বাসন্তীর আরো কাছে ঘেঁষে বসল প্রেমা। বাসন্তী প্রেমার ঠোঁটে টকটকে লাল লিপস্টিক গাঢ় করে ঘষে দিয়ে প্রান্তকে বললেন, ‘তুমিও লাগাইবা আব্বা?’
‘জি,’ বলল প্রান্ত। প্রেমাকে লিপস্টিকে সুন্দর লাগছে। তাই তারও ইচ্ছে করছে ঠোঁটে লিপস্টিক দিতে।
বাসন্তী প্রান্তর ঠোঁটে লিপস্টিক দেওয়ার জন্য উঁবু হোন। পূৰ্ণা বেশ অনেকক্ষণ ধরে এসব দেখছে। এই মহিলাকে সে একটুও সহ্য করতে পারে না। মহিলার উপস্থিতি অসহনীয় যন্ত্রণা দেয়। এক তো সৎ মা, বাপের আরেক বউ। তার ওপর এই বয়সেও এত সাজগোজ করে! প্রান্তকে লিপস্টিক দিচ্ছে দেখে তার গা পিত্তি জ্বলে উঠল। ঘর থেকে দপদপ করে পা ফেলে ছুটে আসে। প্রান্তকে টেনেহিঁচড়ে দাঁড় করিয়ে বলল, ‘তোর হিজরা সাজার ইচ্ছে হচ্ছে কেন? কতবার বলেছি এই বজ্জাত মহিলার কাছে না ঘেঁষতে?
পূর্ণাকে বাসন্তী ভয় পান। মেয়েটা খিটখিটে, বদমেজাজি। হেমলতা বলেছেন, সেদিনের দুর্ঘটনার পর থেকে পূর্ণা এমন হয়ে গেছে। হুটহাট রেগে যায়, কথা শোনে না। পদ্মজা যাওয়ার পর থেকে আরো বিগড়ে গেছে। এজন্য তিনি যথাসম্ভব পূর্ণাকে এড়িয়ে চলেন। তবুও এসে আক্রমণ করে বসে। গত দুই সপ্তাহে মেয়েটা তার জীবন অতিষ্ঠ করে তুলেছে। তিনি কাটা কাটা গলায় পূর্ণাকে বললেন, ‘এই ছিক্ষা পাইছ তুমি? গুরুজনদের সঙ্গে এমনে কথা কও!
‘আপনি চুপ থাকেন। খারাপ মহিলা। বুড়া হয়ে গেছে এখনও রং-ঢং করে।’ চোখ-মুখ বিকৃত করে বলে পূর্ণা।
কথা মাটিতে পড়ার আগে তীব্র থাপ্পড়ে মাটিতে উলটে পড়ল সে। চোখের দৃষ্টি গরম করে ফিরে তাকাল, কে মেরেছে দেখার জন্য! দেখল হেমলতাকে! হেমলতা অগ্নি চোখে তাকিয়ে আছেন, চোখের দৃষ্টি দিয়েই পূর্ণাকে পুড়িয়ে ফেলবেন। পূর্ণার চোখ শিথিল হয়ে আসে। সে দৃষ্টি সরিয়ে নেয়। হেমলতা বললেন, ‘নিজেকে সংশোধন কর। এখনও সময় আছে।’
পূর্ণা নতজানু অবস্থায় বলল, ‘আমি এই মহিলাকে সহ্য করতে পারি না আম্মা।’
‘করতে হবে। উনার এই বাড়িতে অধিকার আছে।’
‘আমি খুন করব এই মহিলাকে।’ রাগে তার শরীর কাঁপছে।
পূর্ণার অবস্থা দেখে হেমলতা অসহায়বোধ করছেন। পূর্ণা কেন এমন হলো? তিনি কি এক মেয়ের শূন্যতার শোক কাটাতে গিয়ে আরেক মেয়েকে সময় দিচ্ছেন না? বুঝিয়ে-শুনিয়ে পূর্ণাকে আবার আগের মতো করতে হবে। তিনি কণ্ঠ নরম করে কথা বলার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু এরপর পূর্ণা যা বলল তাতে তিনি আর রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারলেন না। পূর্ণা বাসন্তীকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘বেশ্যার মেয়ে বেশ্যাই হয়। আর বেশ্যার সঙ্গে এক বাড়িতে থাকতে ঘেন্না লাগে আমার।’
এই কথা শুনে রাগে-দুঃখে হেমলতা শরীর কাঁপতে শুরু করে। তিনি ছুটে যান বাঁশ বাগানের দিকে। বাঁশের কঞ্চি নিয়ে ফিরে আসেন। রাগান্বিত হেমলতাকে কঞ্চি হাতে দেখে বাসন্তী দ্রুত পূর্ণাকে আগলে দাঁড়ান। হেমলতাকে অনুরোধ করে বললেন, ‘এত বড়ো ছেড়িডারে মাইরো না। ছোটো মানুছ, বুঝে না।’
‘আপা আপনি সরেন। ও খুব বেড়ে গেছে।’
বাসন্তীর স্পর্শ পূর্ণার ভালো লাগছে না। সে ঠেলে তাকে সরিয়ে দেয়। সঙ্গে সঙ্গে হেমলতা বাঁশের কঞ্চি দিয়ে পূর্ণার পিঠে বাড়ি দিলেন। পূৰ্ণা আর্তনাদ করে শুয়ে পড়ল। হেমলতা আবার মারার জন্য উদ্যত হতেই বাসন্তী পূর্ণাকে আগলে দাঁড়িয়ে অনুরোধ করে বললেন, ‘যুবতি ছেড়িদের এমনে মারতে নাই। আর মাইরো না। আজকে ছাইড়া দাও।’
প্রেমা-প্রান্ত ভয়ে গুটিয়ে গেছে। হেমলতার চোখ দিয়ে টপটপ করে জল পড়ছে। তিনি বাঁশের কঞ্চি ফেলে লাহাড়ি ঘরে চলে গেলেন। বারান্দায় বসে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। মনে মনে মোর্শেদের ওপর ক্ষেপে গেলেন। মোর্শেদ চিৎকার করে বাসন্তীর সম্পর্কে সব বলেছে বলেই তো পূর্ণা জেনেছে। তাই এখন পূর্ণা কারো অতীত নিয়ে আঘাত করার সুযোগ পাচ্ছে। মোড়ল বাড়ির ছোটো সংসারটা কেমন ওলটপালট হয়ে গেছে!
হেমলতা আকাশের দিকে তাকিয়ে হাঁ করে নিশ্বাস নেন। সব কষ্ট, যন্ত্রণা যদি উড়ে যেত! সব যদি আগের মতো হতো। সব কঠিন মানুষেরাই কী জীবনের এক অংশে এসে এমন দুর্বল হয়ে পড়ে? কোনো দিশা খুঁজে পায় না?
.
আমির বিছানায় বসে উপন্যাস পড়ছে। ছয়দিন পর পদ্মজার মেট্রিকের ফলাফল। এরপরই ঢাকার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করবে। যদিও ফরিনা বেগম এই সিদ্ধান্তে রাজি নন। কিন্তু আমির মনে মনে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ, সে পদ্মজাকে রাজধানীতে নিয়েই যাবে। পদ্মজার কথা মনে হতেই আমির বই রেখে গোসলখানার দরজার দিকে তাকাল। তার ঘরের সঙ্গে আগে গোসলখানা ছিল না। পদ্মজার জন্য করা হয়েছে। সে বই রেখে সেদিকে যাওয়ার জন্য পা বাড়াল, তখনি পদ্মজা চিৎকার করে উঠল। আমির দৌড়ে ভেতরে ঢুকল দরজা ঠেলে। পদ্মজা শাড়ি দিয়ে শরীর ঢেকে রেখেছে, কাঁপছে কিছুটা। আমির দ্রুত কাছে এসে বলল, ‘কী হয়েছে?’
‘ওখানে, ওখানে কে যেন ছিল। আ…আমাকে দেখছিল।’
পদ্মজার ইঙ্গিত অনুসরণ করে আমির সেদিকে তাকাল। গোসলখানার ডান দেয়ালের একটা ইট সরানো। সকালে তো সরানো ছিল না! পদ্মজা কাঁদতে থাকল। কাপড় পালটাতে গিয়ে হঠাৎ চোখ পড়ে দেয়ালে। আর তখনই দুটি চোখ দেখতে পায়। সে তাকাতেই সরে গেল চোখ দুটি! পদ্মজার পিলে চমকে ওঠে। আমির পদ্মজার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল, ‘শুকনো কাপড় পরে আসো। কেঁদো না।’
কথা শেষ করেই সে বেরিয়ে যায়। যাওয়ার তাড়া দেখে মনে হলো, অজ্ঞাত আগন্তুক হয়তো আমিরের পরিচিত! সে অবগত মানুষটি সম্পর্কে! পদ্মজা দ্রুত কাপড় পরে আমিরকে খুঁজতে থাকল।
আমির সোজা রিদওয়ানের ঘরের দিকে যায়। রিদওয়ান পানি পান করছিল। আমির গিয়ে রিদওয়ানের বুকের শার্ট খামচে ধরে চিৎকার করে বলল, ‘তোকে সাবধান করেছিলাম। দ্বিতীয় সুযোগ দিয়েছিলাম।’
‘শার্ট ছাড়।’
‘ছাড়ব না। কী করবি? তুই আমার বউয়ের দিকে কু-নজর দিবি আর আমি ছেড়ে দেব?’
‘প্রমাণ আছে তোর কাছে?’
‘কুত্তার বাচ্চা প্রমাণ লাগবে? আমি জানি না?’
‘আমির মুখ সামলা। গালাগালি করবি না। ‘
‘করব। কী করবি তুই?’
‘আবার বলছি, শার্ট ছাড়।’
রিদওয়ানের নাকে-মুখে ঘুসি মেরে বসল আমির। টাল সামলাতে না পেরে পালঙ্কের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ল রিদওয়ান। দুজনের চিৎকার, চেঁচামিচি শুনে বাড়ির সবাই ছুটে এলো রিদওয়ানের ঘরে।
৩৭
পদ্মজা ঘরের চৌকাঠে পা দিয়েছে মাত্র। আমির রিদওয়ানকে টেনে হিঁচড়ে তুলে বলল, ‘তোকে না করেছিলাম। বার বার না করেছি। তবুও শুনলি না।’
রিদওয়ান দুই হাতে আমিরকে ধাক্কা মেরে দূরে ছুঁড়ে ফেলে। আমির আলমারির সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে আরো হিংস্র হয়ে রিদওয়ানের দিকে তেড়ে আসে। নুরজাহান দৌড়ে এসে পথ রোধ করে দাঁড়ান। চিৎকার করে বললেন, ‘কী অইছে তোদের? তোরা এমন করতাছস কেন?’
‘দাদু, সরে যাও। মাদা** বাচ্চারে আমি মেরে ফেলব।’
‘তুই কি ভালা মানুষের বাচ্চা?’ তেজ নিয়ে বলল রিদওয়ান।
আমির নুরজাহানকে ডিঙিয়ে রিদওয়ানকে আঘাত করতে প্রস্তুত হয়।
তখন মজিদ হাওলাদারের কর্কশ কণ্ঠ ভেসে আসে, ‘যে যেখানে আছো, সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকো।’
আমির মজিদ হাওলাদারকে এক নজর দেখে শান্ত হওয়ার চেষ্টা করল। পরেই জ্বলে উঠে বলল, ‘আব্বা আপনি জানেন না ও কী করছে? পদ্মজা গোসল করছিল আর ও লুকিয়ে লুকিয়ে সেটা দেখছিল।’ আমিরের কণ্ঠ থেকে যেন আগুন ঝরছে।
ফরিনা, আমিনা, রানিসহ হাওলাদার বাড়িতে কাজ করা দুজন মহিলা ছি ছি করে উঠল। রিদওয়ান সাবধানে প্রশ্ন করল, ‘তোর কাছে কী প্রমাণ আছে?’
‘প্রমাণ লাগবে? আমি জানি এটা তুই ছিলি। বিয়ের রাতেও তুই পদ্মজার কাছে গেছিলি।’
‘অপবাদ দিবি না।’
‘তুই ভালো করেই জানিস আমি অপবাদ দিচ্ছি না।’
‘তুমি কী করে নিশ্চিত যে, ছেলেটা রিদওয়ানই ছিল? পদ্মজা দেখেছে? নাকি তুমি?’ বললেন মজিদ।
‘কেউ দেখেনি। কিন্তু আমি নিশ্চিত ওই চরিত্রহীনটা রিদু। কারণ, আমার আগে থেকে ও পদ্মজাকে পছন্দ করত।
পদ্মজা বিস্ময়ে তাকাল। কী হচ্ছে, কী সব শুনছে? ফরিনার দুই ঠোঁট হাঁ হয়ে গেল। মুখে হাত দিয়ে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন। আমিনা বললেন, ‘আপা, আমি আগেই কইছিলাম এই ছেড়ি বিনাশিনী। এই ছেড়ির রূপ আগুনের লাকান। এই ছেড়ির জন্য এখন বাড়ির ছেড়াদের ভেজাল হইতাছে।’
আমির আমিনার কথা শুনেও না শোনার ভান করল। মজিদকে বলল, ‘আব্বা, আপনি এর বিচার করবেন? না আমি ওরে মেরে ফেলব? আর আম্মা, এরপরও বলবা পদ্মজাকে এই বাড়িতে রেখে যেতে? আমাকে তো ফিরতেই হবে ঢাকা। মনে রেখো, পদ্মজাকে রেখে আমি কিছুতেই যাব না। আব্বা, তুমিও কথাটা মনে রেখো, আমি তোমার ব্যবসায় আর নেই…যদি পদ্মজা আমার সঙ্গে ঢাকা না যায়।’
‘তুমি যেখাবে যাবা তোমার বউ তো সেখানেই যাবে। বউ রেখে যাবা কেন? আর রিদওয়ান তুমি আমার সঙ্গে আসো। তোমার সঙ্গে আমার বোঝাপড়া আছে।’
মজিদ হাওলাদার ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যান। আমির পদ্মজার হাতে ধরে বলল, ‘কসম, আর কখনো তোমাকে এমন পরিস্থিতিতে পড়তে দেব না।’
খুশিতে পদ্মজার চোখের তারায় অশ্রু জ্বলজ্বল করে উঠে। সে আমিরের এক হাত শক্ত করে ধরে বোঝায়, ‘আমি আপনাকে ভালোবাসি। বিশ্বাস করি।’
.
সন্ধ্যার ঠিক আগমুহূর্ত। এমন সময় হাওলাদার বাড়ির রাতের রান্না করা হয়। মগা এক ব্যাগ মাছ দিয়ে গেছে। লতিফা মাছ কাটছে। লতিফা এই বাড়ির কাজের মেয়ে। সবাই ছোটো করে লুতু ডাকে। ফরিনা ভাত বসিয়েছেন। আর অনবরত বলে চলেছেন, ‘আমি এই বাড়ির বড়ো বান্দি। দাসী আমি। বাবুর বাপ দাসী পুষে রাখছে। দাসী পালে। সারাদিন কাম করি। অন্যরা হাওয়া লাগাইয়া ঘুরে। মরণ হয় না কেন আমার? মরণই আমার একমাত্র শান্তি।’
পদ্মজা গুনগুন করে গান গাচ্ছে আর রান্নাঘরের আশপাশে ঘুরছে। ফরিনার সব কথাই তার কানে আসছে। তার গায়ে লাগছে না। বরং হাসি পাচ্ছে। সে বহুবার রান্নাঘরে গিয়েছে কাজ করার জন্য। ফরিনা তাড়িয়ে দিয়ে বলেছেন, কাজ করতে হবে না। আর এখন বলছেন, কেউ সাহায্য করে না! পদ্মজা পা টিপে টিপে রান্না ঘরে ঢুকে বলল, ‘আম্মা, আমি সাহায্য করি?’
‘এই ছেড়ি তুমি এত বেয়াদব কেরে? কতবার কইছি তোমার সাহায্য করতে হইব না।’
‘না…মানে আপনি বলছিলেন, কেউ সাহায্য করে না।’
‘তোমারে তো বলি নাই। তোমার গায়ে লাগে কেন?’
‘মেঝে ঝাড়ু দিয়ে দেই?’
‘তোমারে কইছি আমি? তুমি যাও এন থাইকা। যাও কইতাছি।’
অগত্যা পদ্মজা বেরিয়ে যায়। বাসায় লাবণ্য নেই, আমির নেই। কার কাছে যাবে? রানি আছে! রানির কথা মনে হতেই পদ্মজা রানির ঘরের দিকে এগোল। যাওয়ার পথে কানে সন্ধ্যার আজান ভেসে আসে। তাই আর সেদিকে এগোল না, ফিরল নিজের ঘরে। নামাজ আদায় করতে হবে।
প্রার্থনা সম্পন্ন করে সুরা ইয়াসিন পড়ল একবার। জানালা লাগাতে গিয়ে দেখতে পেল রানিকে, সেদিনের মতো জঙ্গলের ভেতর ঢুকছে। আর কিছুক্ষণ পরেই চারিদিক রাতের গাঢ় অন্ধকারে তলিয়ে যাবে। এমন সময় রানি আপা কী করতে ওখানে যাচ্ছে? এত সাহসই কী করে হয়? পদ্মজা হুড়মুড়িয়ে ঘর থেকে বের হয়। আজ সে এর শেষ দেখে ছাড়বে। লাবণ্য সবে মাত্র সদর ঘরে ঢুকেছে।
পদ্মজাকে তাড়াহুড়ো করে কোথাও যেতে দেখে বলল, ‘কী রে, কই যাস?’
পদ্মজা চমকে উঠল। বলল, ‘এই তো…এইখানেই। কোথায় ছিলি? আচ্ছা, পরে কথা বলব। আসি এখন।’
লাবণ্য ঠোঁট উলটে পদ্মজার যাওয়ার পানে তাকিয়ে থাকে। মনে মনে ধরে নেয়, পদ্মজা দুই তলা থেকে হয়তো দাভাইকে আসতে দেখেছে তাই এগিয়ে আনতে যাচ্ছে। সে নিজ ঘরের দিকে চলে গেল। পদ্মজা কখনো বাড়ির পেছনের দিকে যায়নি, এই প্রথম। বাড়ির ডান পাশে বিশাল পুকুর। কালো জল। কিন্তু বাড়ির সামনের পুকুরের জল স্বচ্ছ।
দুই মিনিট লাগে শাক-সবজির খেত পার হতে। বাড়ির পেছনে এরকম শাক-সবজির বাগান আছে সে জানত না। এরপর পৌঁছাল জঙ্গলের সামনে। সেখান থেকে অন্দরমহলের দিকে তাকাল। ওই তো তাদের ঘরের জানালা দেখা যাচ্ছে। আরেকটা জানালাও দেখা যাচ্ছে। পদ্মজা কপাল কুঁচকে খেয়াল করল, সেই জানালার গ্রিল ধরে কেউ তাকিয়ে আছে। পদ্মজা ঠাওর করার চেষ্টা করল এটা কার ঘর। মনে হতে বেশি সময় লাগল না—রূম্পা ভাবির! তবে কী তিনিই তাকিয়ে আছেন? পদ্মজা আবার তাকাল। রূম্পা জানালার পর্দা সরিয়ে হাত নাড়াল, মৃদু হেসে পালটা হাত নাড়াল পদ্মজাও। দূর থেকে রুম্পার মুখটা দেখে মনে হচ্ছে, সে কিছু বলতে চায় পদ্মজাকে। তার ভেতর লুকানো আছে কোনো এক রহস্যময় গল্প।
.
‘ভাবি এইনে রাইতের বেলা কী করেন?’
ভূমিকম্পে ভূমি যেভাবে কেঁপে উঠে, পদ্মজা ঠিক সেভাবেই কেঁপে উঠল। তাকিয়ে দেখল মদনকে। সে জঙ্গলের ভেতর থেকে এসেছে। পদ্মজা আমতা আমতা করে বলল, ‘হাঁ…হাঁটতে এসেছিলাম।’
‘এই রাইতের বেলা?’
‘বিকেল থেকেই। এখন ফিরে যাচ্ছিলাম।’
‘চলেন এক সঙ্গে যাই। জায়গাডা ভালা না ভাবি। আপনি হইছেন সুন্দর
মানুষ। জিন, ভূতের আছর পড়ব।’
‘আপনি যান। আমি আসছি।’
‘আর কী করবেন এইহানে?’
পদ্মজা জঙ্গলের দিকে তাকাল। শিরশিরে অনুভূতি হলো একটা! সব জঙ্গল অযত্নে বেড়ে উঠলেও এই জঙ্গল যেন যত্নে বেড়ে ওঠা। সে অন্ধকারে খোঁজার চেষ্টা করল রানিকে। পেল না। এদিকে মদনের সঙ্গে না গেলে সে বাড়িতে যদি বলে দেয়! তাহলে অনেকের প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে। আর একটার পর একটা মিথ্যে বলতে হবে। পদ্মজা মনে মনে পরিকল্পনা করে, মদনের সঙ্গে বাড়ি অবধি গিয়ে আবার চলে আসবে।
৩৮
মদন পদ্মজাকে রেখে কিছুতেই যাচ্ছে না। আবার পদ্মজাও অন্দরমহলের ভেতর ঢুকতে চাইছে না। সে বার বার বলছে, ‘আমি একটু হাঁটব এদিকে। আপনি যান।’
‘রাইতের বেলা একলা থাকবেন! আমার কামই আপনারারে দেইখা রাখা।’
‘এদিকে তো আলো জ্বলছে। উনিও এখন আসবেন। আপনি যান। আর আপনার পা তো কাদায় মাখা। বেশিক্ষণ এভাবে না থেকে ধুয়ে আসুন।’
মদন পায়ের দিকে তাকাল। লুঙ্গি হাঁটু অবধি তুলে বেঁধে রাখা। সে হেসে বলল, ‘আইচ্ছা তাইলে আমি ধুইয়া আইতাছি। বেশিখন (বেশিক্ষণ) লাগব না।’
‘আচ্ছা, আসুন।’
মদন চলে যেতেই পদ্মজা ফোঁস করে নিশ্বাস ফেলল। গলার মাঝে যেন এতক্ষণ কাঁটা বিঁধে ছিল। বাড়ির পেছনে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই দেখলে পেল আমিরকে। আমির আলগ ঘর পেরিয়ে এদিকেই আসছে। পদ্মজা আর ঘুরে দাঁড়াতে পারল না, আলগ ঘরের দিকে চেয়ে রইল। পদ্মজাকে দেখতে পেয়ে লম্বা করে হাসল আমির। বলল, ‘পদ্মবতী কী আমার জন্য অপেক্ষা করছে?’
‘বোধহয় করছি।’
আমির ভ্রুকুটি করে বলল, ‘বোধহয় কেন?’
‘ঘরে একা ভালো লাগছিল না। তাই হাঁটতে বের হয়েছিলাম। আপনি
নামাজ পড়েছেন?’
‘এই যে মাথায় টুপি। মসজিদ থেকে আসলাম।’
পদ্মজা আড়চোখে অন্দরমহলের ডান দিকে তাকাল। ভাবছে, রানি আপা কোথায় গেল? উসখুস করতে থাকল সে।
ঠিক তখনই পদ্মজাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরল আমির। স্বামীর কাজে পদ্মজা হতভম্ব হয়ে দ্রুত এদিক-ওদিক তাকিয়ে দেখল, কেউ আছে নাকি! এরপর আমিরের হাতের বাঁধন ছুটানোর চেষ্টা করতে করতে বলল, ‘ছাড়ুন, কেউ দেখবে।’
‘কেউ দেখবে না। এদিকে কেউ নেই,’ আমিরের কণ্ঠ মোহময়। সে পদ্মজার ঘাড়ে থুতনি রাখল। ওর ঠোঁটের ছোঁয়া লাগাতেই পদ্মজার গা জুড়ে শুরু কাঁপুনি এলো। জোর করে আমিরের হাতের বাঁধন থেকে ছুটে গিয়ে বলল, ‘আপনি ঘরে যান।’
আমির হতাশ ভঙ্গিতে বলল, ‘আচ্ছা চলো।’
‘আপনি যান আমি আসছি।’
‘কেন? তুমি কোথায় যাবে?’
পদ্মজা নিচের ঠোঁট কামড়ে কিছু ভাবল। বলল, ‘আলগ ঘরে যাব। আপনি ঘরে যান। নয়তো আম্মা আমাকে খুঁজবে। আমি কিছুক্ষণের মধ্যে চলে আসব। এরপর সব বলব।’
‘আরে, কী করবে বলবে তো।’
‘আপনি যান না।’
পদ্মজা ঠেলে আমিরকে অন্দরমহলের দিকে পাঠিয়ে দিল। আমির অসহায় মুখ করে জিজ্ঞাসা করল, ‘আমিও থাকি?’
‘আপনি ঘরে গিয়ে বসেন, আমি যাব আর চলে আসব।’
পদ্মজার অনুরোধ ফেলা যাচ্ছে না। আমির না চাইতেও অন্দরমহলে চলে গেল। সেই সুযোগে এক নিশ্বাসে দৌড়ে অন্দরমহলের ডান পাশে চলে এলো পদ্মজা। সঙ্গে সঙ্গে সামনে পড়ল রানি। দুজন দুজনকে হঠাৎ চোখের সামনে দেখে চমকে উঠল, অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল। রানিই আগে কথা বলল, ‘রাইতের বেলা এমনে ছুটতাছো কেন?’
পদ্মজার মাথা থেকে ঘোমটা পড়ে গেছে সেই কখন। দৌড়ে আসাতে চুলের খোঁপাও খুলে গেছে। গাছ-গাছালির বাতাসে তিরতির করে তার চুল উড়ছে। তবুও সে ঘামছে। আমতা আমতা করে বলল, ‘আ…আমি তো হাঁটতে বের হয়েছি। জোনাকি দেখলাম এদিকে। তাই নিতে এসেছি।’
‘ওহ। কই জোনাকি। নাই তো।’
‘একটু আগেই ছিল।’
‘এহন তো নাই। রাইতের বেলা একলা থাকবা কেন? আসো ঘরে যাই।’
‘তুমি কোথায় গিয়েছিলে আপা? সন্ধ্যার আগে তোমার ঘরে গেলাম কিন্তু পেলাম না। এদিক দিয়ে কোথাও ছিলে? কিন্তু এদিকে তো ঝোপঝাড়, জঙ্গল।’
পদ্মজার প্রশ্নে রানির মুখ রক্তিম হয়ে উঠল, কেমন অস্বাভাবিক দেখাল তার চাহনি; হাসল অপ্রস্তুতভাবে। কী বলবে খুঁজছে যে তা স্পষ্ট। পদ্মজা অপেক্ষা করছে, রানি কী বলে শোনার জন্য।
পদ্মজা ডাকল, ‘আপা?’
‘আরে আমি ওষুধ খুঁজতে আসছিলাম।’
‘কী ওষুধ?’
‘তুমি চিনবা না। আসো বাড়িত যাই। মেলা রাইত হইয়া গেছে।’
পদ্মজাকে পিছনে রেখেই রানি চলে যাচ্ছে। এটাকে পালিয়ে যাওয়া বলে। পদ্মজা আর থেকে কী করবে! সেও রানির পিছু পিছু অন্দরমহলে চলে আসে।
ঘরে ঢুকতেই আমির হামলা করে, ‘কাহিনি কী বলো তো।’
‘বিশ্বাস করবেন?’
‘তোমার কথা বিশ্বাস করব না, এ হয়?’
‘রানি আপা প্রায় জঙ্গলের ভেতর যায়। আমি জানালা থেকে দেখি। এমন ভাবে যায় যেন চুরি করতে যাচ্ছে।’
আমির শুনে অবাক হলো। চাপা স্বরে প্রশ্ন করল, ‘সত্যি! প্রায়ই যায়?’
‘আমি সত্যি বলছি।’
আমির চোখেমুখে ছড়িয়ে পড়ে দুশ্চিন্তা, কপালের চামড়া পর্যন্ত কুঁচকে গেছে। গভীর ভাবনায় বিভোর সে। পদ্মজা বলল, ‘আমি আজ অনুসরণ করে জঙ্গল অবধি গিয়েছিলাম। মদন ভাইয়ার জন্য ভেতরে ঢুকতে পারিনি। এরপর আপনি এলেন। পরে আবার যেতে চেয়েছি। কিন্তু ততক্ষণে রানি আপা চলে এসেছে। সরাসরি প্রশ্নও করেছি, কেন জঙ্গলে গিয়েছিল। বলল, ওষুধ আনতে। মানে কোনো ঔষধি পাতা। কিন্তু আমার বিশ্বাস হয়নি। প্রায়ই কেন কেউ ঔষধি পাতা আনতে যাবে? তাও আবার ভোরে আর রাতে।’
পদ্মজা এক দমে কথাগুলো বলল। আমির জবাবে বলল, ‘আব্বাকে বলতে হবে।’
‘আগে আমার কথা শুনুন।’
‘বলো?’
‘এখন কাউকে বলবেন না।’
‘বলা উচিত। ব্যাপারটা জটিল মনে হচ্ছে।’
‘আমরা আগে বের করি, কী হয়েছে…আপা কী করতে যায়? এরপর নিজেরা সমাধান করতে পারলে করব। নয়তো বড়োদের বলব। যদিও আমরা নিশ্চিত না কোনো সমস্যা আছে।’
‘অবশ্যই সমস্যা আছে। তুমি জানো, ওদিকে কোনো মহিলা ভয়ে ভুলেও যায় না। অথচ রানি যায়। বড়ো কোনো কারণ নিশ্চয়ই আছে।’
‘সেটা আমরা দুজন মিলে বের করি?’
‘কীভাবে?’
‘আমার মনে হচ্ছে আবার যাবে, কাল-পরশুর মধ্যে। আমরা পিছুপিছু যাব।’
‘খারাপ বলোনি।’
‘কাউকে বলবেন না এখন, অনুরোধ।’
আমির হাসল। পদ্মজার কোমর পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘বলব না।’
‘আপনি কারণে-অকারণে ছোঁয়ার বাহানা খুঁজেন।’
‘এতে পাপ তো নেই।’
‘খাওয়ার সময় হয়েছে, চলুন। ঠিক সময়ে না গেলে আম্মা রেগে গিয়ে চেঁচামেচি করবেন।’
‘আম্মারা চেঁচামেচি করেই। তোমাকে একটা কথা বলার ছিল।’
‘কী?’
‘তোমাকে খয়েরি রঙে বেশি সুন্দর লাগে।’
‘আমি তো খয়েরি শাড়ি পরিনি।’
‘পুরো কথা বলতে দাও।’
‘আচ্ছা, বলুন।’
আমির পদ্মজার কানের কাছে ঠোঁট নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল, ‘আর কালো রঙে আবেদনময়ী লাগে।’
পদ্মজার কানে-ঘাড়ে আমিরের নিশ্বাস ছিটকে পড়ে। সে ঘুরে আমিরের দিকে তাকাল। আবার চোখ সরিয়ে নিয়ে বলল, ‘কিন্তু আপনি সবসময় আকর্ষণীয়।’
আমির হইহই করে উঠল, ‘সত্যি? কত…কত দিন পর একটু প্রশংসা করলে। ইয়া আল্লাহ!’
পদ্মজা মৃদু আওয়াজ করে হাসল। বলল, ‘প্রশংসা শুনতে খুব ভালোবাসেন?’
‘অবশ্যই। তবে বউয়ের প্রশংসা করতে আরো বেশি ভালোবাসি।’ আমির আরো শক্ত করে পদ্মজার কোমর আঁকড়ে ধরল। আমিরের দুই হাতে ধরে পদ্মজা বলল, ‘আপনি সবসময় এত শক্ত করে ধরেন কেন? গায়ের জোর দেখান?’
‘কেন? ভালো লাগে না?’
‘মোটেও না। আদর করে ধরবেন। ‘
আমির হাতের বাঁধন কোমল করে দিয়ে বলল, ‘লজ্জার ছিটেফোঁটাও গিলে ফেলেছ দেখছি।’
‘বিয়ের এতদিন পরও কোন মানুষটা লজ্জা পায়, তা আমাকে দেখাবেন। আমি অত ভং ধরতে পারব না।’
‘কী ঝাঁঝ কথায়!’
‘এবার ছাড়ুন
‘ইচ্ছে হচ্ছে না।’
‘আবার শক্ত করে ধরেছেন।’
‘যদি দৌড়ে পালাও?’
‘পালিয়ে আর কোথায় যাব?’
আমির পদ্মজাকে নিজের দিকে ফিরিয়ে এক হাতে কোমর চেপে ধরে অন্য হাত গালে রাখল। তখনই হুড়মুড়িয়ে ঘরে ঢুকে পড়ল লতিফা। পদ্মজা, আমির দুজন দুদিকে ছিটকে গেল। আমির ধমকে উঠল, ‘লুতু কতবার বলেছি না বলে ঘরে ঢুকবি না। আমাদের তো নতুন বিয়ে হয়েছে, নাকি?’
পদ্মজা খেয়াল করল আমির কথাগুলো রাগে বলার চেষ্টা করলেও, ঠিক রাগত শোনাল না। হাসি পেল তার। ওদিকে লতিফার মুখের অবস্থা দরজার চিপায় পড়ার মতো। সে আমিরকে ভীষণ ভয় পায়। কাঁচুমাচু হয়ে বলল, ‘খালাম্মা খাইতে যাইতে কইছে।’
৩৯
পদ্মজা ভক্তির সঙ্গে নুরজাহানের পা টিপে দিচ্ছে। তার মূল উদ্দেশ্য রুম্পার ঘরে যাওয়া। সকাল থেকে বারংবার রুম্পার ঘরে ঢোকার চেষ্টা করেছে, পারেনি। মদন কিছুতেই ঢুকতে দেয়নি। তার এক কথা, নুরজাহান না বললে ঢুকতে দিবে না। অগত্যা পদ্মজা নিরাশ হয়ে নুরজাহানের ঘরে এসে পা টেপা শুরু করেছে…যদি একটু পটানো যায়। ঘণ্টাখানেক ধরে সে নুরজাহানের পা টিপছে। হাত টনটন করছে ব্যথায়। নুরজাহান আয়েশ করে ঘুমাচ্ছেন। কখন যে ঘুম ভাঙবে! এভাবে কেটে যায় আরো অনেকটা সময়। নুরজাহান চোখ মেলে তাকান। ঘুমকাতুরে কণ্ঠে পদ্মজাকে বললেন, ‘এহনো আছো?’
পদ্মজা মৃদু হাসল। নুরজাহান বললেন, ‘অনেকক্ষণ হইছে। যাও, এহন ঘরে যাও।’
পদ্মজার চোখে মুখে আঁধার নেমে আসে। পরক্ষণেই মিষ্টি করে হেসে বলল, আপনার ভালো ঘুম হয়েছে?’
‘সে হয়েছে।’
‘দাদু একটা প্রশ্ন করি?
‘করো।’
‘রুম্পা ভাবিকে যেদিন দেখেছিলাম অনেক নোংরা দেখাচ্ছিল। উনাকে পরিষ্কার করে রাখার জন্য একটা মেয়ে দরকার। কিন্তু সবসময় মদন ভাইয়া পাহারা দেন।’
‘ষাঁড়ের লাহান শক্তি ওই ছেড়ির। হের লগে ছেড়িরা পারব না। সবাই ডরায়।
‘তাই বলে এভাবে অপরিষ্কার থাকবে সবসময়!’
‘সবাই ডরায়। কেউ যাইব না সাফ কইরা দিতে। তুমি বেহুদা কথা বলতাছো।’
নুরজাহানের কঠিন কণ্ঠের সামনে পদ্মজার আসল কথাটাই মুখে আসছে না। সে মনে মনে নিজেকে প্রস্তুত করে নিয়ে বলল, ‘আমার মনে হয় আমি পারব। ভাবি আমাকে আঘাত করবে না। আমাকে যাওয়ার অনুমতি দিতেন যদি।’
‘পাগল হইছো ছেড়ি? কেমনে খামচাইয়া ধরছিল মনে নাই? আর কথা কইয়ো না। যাও এন থাইকা।’
পদ্মজা আর কিছু বলার সাহস পেল না। সে ঘর ছেড়ে বারান্দায় এসে দাঁড়াল। দুই তলার বারান্দা থেকে আলগ ঘরের সামনের খালি জায়গা দেখা যাচ্ছে। সেখানে গ্রামের মানুষের ভিড়। মজিদ হাওলাদার তার লোকজন নিয়ে গ্রামের মানুষদের সমস্যা শুনছেন। কাউকে অর্থ দিয়ে সাহায্য করছেন, কাউকে বা ধান দিয়ে। এই ব্যাপারটা প্রায়ই ঘটে। পদ্মজার খুব ভালো লাগে। গর্ব হয়।
.
পূর্ণা ঘাটে বসে আছে। মাদিনী নদীর স্রোতে তার দৃষ্টি স্থির। প্রান্ত-প্রেমা স্কুলে গিয়েছে। সে যায়নি। ইদানীং সে স্কুলে যায় না একদমই। ভালো লাগে না। পদ্মজা যাওয়ার পর থেকে সব থমকে গেছে। পদ্মজার শূন্য জায়গাটা কিছুতেই পূর্ণা মানতে পারছে না। বাড়ির প্রতিটি কোণে সে পদ্মজার স্মৃতি খুঁজে পায়। এই তো এই ঘাটে বসে দুজন কত সময় পার করত, কত গল্প করত; আজ পদ্মজার জায়গা শূন্য। পূর্ণা অনুভব করে, সে তার মায়ের চেয়েও বেশি ভালোবাসে পদ্মজাকে। পদ্মজার প্রতিটি কথা কানে বাজে। এতদিন হয়ে গেল তবুও এই শোক, এই শূন্যতা কাটিয়ে উঠতে পারছে না সে। পূর্ণার চোখ দুটি ছলছল করে উঠে। সে নিচের ঠোঁট কামড়ে দুইবার ডাকল, ‘আপা…আপারে।’
বাসন্তী দূর থেকে পূর্ণাকে দেখতে পেলেন। জুতা খুলে পা টিপে হেঁটে এসে পূর্ণার পাশে বসেন। পূর্ণা এক ঝলক বাসন্তীকে দেখে দ্রুত চোখের জল মুছল। এরপর বলল, ‘আপনি এখানে এসেছেন কেন?’
প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়ে পূর্ণা তীক্ষ্ণ দৃষ্টি মেলে বাসন্তীর দিকে তাকাল। দেখতে পায়, বাসন্তীকে আজ অন্যরকম লাগছে। আরেকটু খেয়াল করে বুঝতে পারল অন্যরকম কেন লাগছে। আজ বাসন্তীর ঠোঁটে লিপস্টিক নেই, কপালে টিপ নেই, চোখে গাঢ় কাজল নেই। থুতনির নিচে সবসময় কালো তিনটা ফোঁটা দিতেন সেটাও নেই। পূর্ণা বাসন্তীর হাতের দিকে তাকাল। হাতেও দুই-তিন ডজন চুড়ি নেই। দুই হাতে শুধু দুটো সোনার চিকন চুড়ি।
পূর্বের প্রশ্নের উত্তরের অপেক্ষা না করে পূর্ণা পালটা প্রশ্ন করল, ‘আপনি আজ সাজেননি কেন?’
‘না ছাজলে কি আমারে ভালা লাগে না?’ বেশ আগ্রহ নিয়ে জানতে চাইলেন বাসন্তী।
পূর্ণা বাসন্তীর চোখেমুখে স্নিগ্ধতা খুঁজে পেল। মহিলা মায়াবী চেহারা পেয়েছে! প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। চকচকে গাল। বয়স চল্লিশের উপর মনেই হয় না। কিন্তু মুখে পূর্ণা কিছু বলল না। সে চোখ সরিয়ে নিলো। বাসন্তী বললেন, ‘আমার সঙ্গে গপ করবা?’
‘আমার ঠেকা পড়েনি।’ পূর্ণার ঝাঁঝাল স্বর।
বাসন্তী পূর্ণার পাশ ঘেঁষে বসেন। পূর্ণা বিরক্তিতে চোখ-মুখ কুঁচকে ফেলল। কিছু কঠিন কথা শোনানোর জন্য প্রস্তুত হলো সবেমাত্র। তখন বাসন্তী বললেন, ‘আম্মা, আমি তোমার আব্বারে ভালোবাছছিলাম ছত্যি। তবুও ছেছ বয়ছে আইছছা একটা ভুল করে ফেলি। ভুল যখন বুঝতে পারি তোমার আব্বারে বলি। কিন্তু তোমার আব্বা মুখ ফিরাইয়া নেয়। আমার তোমার আব্বা ছাড়া আর গতি ছিল না। তাই গ্রামের মানুছ নিয়া আছছিলাম। আমার এই কাজের জন্য তোমাদের এত বড়ো ক্ষতি হবে জানলে এমন করতাম না। যাক গে ছেছব কথা। তোমার আব্বা আমারে আজও মাইনা নেয় নাই। তাতে আমার দুঃখ নাই। তোমার আম্মার মতো একটা ছোটো বইন পাইছি। তোমার দুইডা ভাই-বইনের মতো ছন্তান পাইছি। আমি নিঃছন্তান। আমার কোনো ছন্তান নেই। কখনো হবেও না। ছন্তানের চূন্যতা আমাকে খুঁড়ে খুঁড়ে খায়। তোমাদের বাড়িতে আছার পর থেকে সেই দুঃখ ঘুচে গেছে। প্রান্ত-প্রেমা যখন আমারে বড়ো আম্মা কইয়া ডাকে, আমার খুছিতে কান্দন আইছছা পড়ে। ছুধু ভালো লাগে না তোমার গুমট মুখটা। বিছ্বাস করো আম্মা, তোমার মারে আমি তাড়াতে আছি নাই। ছে হইছে গিয়া হীরার টুকরা। তার মতো মানুছ হয় না। আমি যা চেয়েছি তার চেয়েও বেছি পাইছি। ছেটা তোমার আম্মা দিছে। আমি চাই না আমার জন্য তুমি কছ্ট পাও। আমি তোমারে বলব না আমারে আম্মা ডাকতে। আমি ছুধু চাই তুমি আমারে মাইনা নাও। ভালো থাকো। হাছিখুছি থাকো। আমি তোমার বন্ধু হইতে চাই। তোমরা যেমনে বলবা আমি তেমনেই চলব। এই যে দেখো, তোমার ছাজগোজ পছন্দ না বলে আমি আজ ছাজি নাই। আর কোনোদিনও ছাজব না। আমি কী কম ছুন্দর নাকি যে ছাজতেই হবে!’ শেষ বাক্যটি রসিকতা করে হেসে বললেন তিনি।
বাসন্তীর কথাগুলো পূর্ণার মন ছুঁয়ে যায়। পূর্ণা বরাবরই কোমল মনের। তবুও শক্ত কণ্ঠেই বলল, ‘আমি আপনার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করব না। আপনি আপনার মতো থাকুন প্রেমা-প্রান্তকে নিয়ে। আমি আমার মতো থাকব আমার মাকে নিয়ে। আমার আর কারোর বন্ধুত্বের দরকার নেই। ‘
বাসন্তীর চোখ ছলছল করছে। তবুও তিনি হাসতে কার্পণ্য করলেন না। বললেন, ‘তোমার চুল অনেক চুন্দর আর লম্বা। এখন তো ভরদুপুর। বাইন্ধা রাখো।’
পূর্ণা চুলগুলো হাত খোঁপা করে নিয়ে বলল, ‘আম্মা এখনও ঘুমে?
‘হ।’
‘আম্মার কী যে হয়েছে! কখনো একদমই ঘুমায় না। আর কখনো ঘুম ছেড়ে উঠতেই পারে না।’
‘পদ্মজার জন্য কান্ধে দেখি। ছরীর দুর্বল হয়ে পড়ছে। এজন্য ঘুমায়।’
পূর্ণা উঠে দাঁড়াল। বাসন্তী বললেন, ‘আমি রানছি বলে ছকালে খাইলা না। এখন নিয়া আছি ভাত?’
‘পরে খাব।’ বলে পূর্ণা দ্রুত পায়ে বাড়ির ভেতর চলে গেল।
মায়ের ঘরে এসে দেখল, তিনি গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। চুল ছড়িয়ে আছে বালিশে। কেমন শুকিয়ে গেছেন। এতক্ষণ না খেয়ে থাকলে তো আরো শুকাবেন। ডেকে খেতে বলা উচিত। আপা থাকলে কত যত্ন করত!
পূর্ণা ডাকল, ‘আম্মা…আম্মা।’
হেমলতা সাড়া দিলেন না। পূর্ণা ঝুঁকে হেমলতার গায়ে হাত দিয়ে ডাকল, ‘ও, আম্মা। উঠো এবার। দুপুর হয়ে গেছে। আম্মা…ও আম্মা।’
হেমলতা চোখ খুললেন, চোখের মণি ফ্যাকাসে। তিনি উঠতে চাইলে হুট করে হাত কাঁপতে থাকল।
পূর্ণা উদ্বিগ্ন হয়ে বলল, ‘কী হয়েছে আম্মা?’
হেমলতা কিচ্ছুটি বললেন না। পূর্ণা হেমলতাকে ধরে ওঠাল।
হেমলতা পূর্ণার দিকে চেয়ে থেকে ক্ষীণ স্বরে প্রশ্ন করলেন, ‘কে তুমি?’
৪০
হেমলতার এহেন প্রশ্নে চমকে উঠল পূর্ণা। চাপা স্বরে অবাক হয়ে উচ্চারণ করল, ‘আম্মা!’
সেকেন্ড কয়েক পর তার উপর থেকে হেমলতা চোখ সরিয়ে নিলেন। পূর্ণা বলল, ‘আমাকে চিনতে পারছ না?’
হেমলতা বিছানা থেকে নামতে নামতে বললেন, ‘ঘুমটা হঠাৎ ভেঙে গেল। তাই এমন হয়েছে। সবার খাওয়াদাওয়া হয়েছে?’
পূর্ণা তখনো অবাক চোখে তাকিয়ে আছে। হেমলতা পূর্ণার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কী রে? কিছু জিজ্ঞাসা করেছি না?’
‘হয়েছে। দুপুরের আজান পড়বে।’
‘এতক্ষণ ঘুমিয়েছি! আরো আগে ডাকতে পারলি না?’
‘ঘুমাচ্ছিলে আরাম করে। তাই ডাকিনি।’
‘ফজরের নামাজটা পড়া হলো না। এখন কাজা পড়তে হবে। তুই নামাজ পড়েছিলি তো?’
‘পড়েছি।’
‘খেয়েছিস?’
‘না।’
‘এরকম করে আর কতদিন চলবে? যা খেয়ে নে।’
পূর্ণা বাধ্য মেয়ের মতো হেঁটে চলে গেল রান্নাঘরে। ক্ষুধায় পেট চোঁ চোঁ করছে। কতক্ষণ না খেয়ে রাগ করে থাকা যায়? হেমলতা খোলা চুল হাত খোঁপা করে নিয়ে কলপাড়ের দিকে যান। অজু করে ঘরে ঢোকার সময় দেখেন, পূর্ণা খাচ্ছে। তিনি পূর্ণার উদ্দেশ্যে বললেন, ‘খাওয়া শেষ করে ঘরে আসিস।’
পূর্ণা খেয়েদেয়ে থালা ধুয়ে গুছিয়ে রাখল। রান্নাঘর থেকে বের হয়ে দেখে, চারা গাছ লাগানোর জন্য বাসন্তী উঠানের এক কোণে বসে মাটি খুঁড়ছেন। পূর্ণা দৃষ্টি সরিয়ে হেমলতার ঘরে চলে এলো। এসে দেখে হেমলতা জায়নামাজে অসম্ভব উদ্বিগ্ন হয়ে বসে আছেন।
পূর্ণা মৃদুকণ্ঠে ডাকল, ‘আম্মা?’
হেমলতা চমকে তাকান। পূর্ণা দ্বিতীয়বারের মতো অবাক হয়। চমকানোর কী এমন হলো? হেমলতা দ্রুত নিজের অভিব্যক্তি লুকিয়ে স্বাভাবিক হয়ে জায়নামাজ ভাঁজ করলেন ধীরেসুস্থে। এরপর পূর্ণাকে কাছে এসে বসতে বললেন। পূর্ণা পাশে এসে বসে। হেমলতা ভারি কণ্ঠে বললেন, ‘আপার (বাসন্তী) প্রতি তোর এত রাগ কেন? আম্মাকে বল?’
‘এখন রাগ নেই।’
‘প্রেমা-প্রান্তের মতো মিলেমিশে থাকতে পারবি না? ওরা বড়ো আম্মা ডাকে। তুই শুধু খালাম্মা ডাকবি।’
‘মাত্র উঠলে ঘুম থেকে। আগে খাও। এরপর কথা বলব।’
‘আমি এখনই বলব। কথাগুলো বলব বলব করে বলা হয়নি। দেখ পূৰ্ণা, আপা অন্য পরিবেশে বড়ো হয়েছে, থেকেছে তাই একটু অন্যরকম। তাই বলে মানুষটা তো খারাপ না। আপা সত্যি একটা সংসার চায়। পরিবারের একজন সদস্য ভাবতে দোষ কোথায়? বাকি জীবনটা কাটাক না আমাদের সঙ্গে। আমার কাজকর্মের একজন সঙ্গীও হলো। বয়স তো হচ্ছে, একা সব সামলানো যায়? আপারও বয়স হচ্ছে। কিন্তু দুজনে মিলে তো কাজ করতে পারব। কয়দিন পর তোর বিয়ে হবে, প্রেমার বিয়ে হবে। শ্বশুরবাড়ি চলে যাবি। তখন আমার একজন সঙ্গী থাকল। আর এমন নয় যে, আপার মনে বিষ আছে। আপারও দরকার ভালো সঙ্গ, ভালো পরিবেশ, ভালো সংসার। আমি দেখেছি, আপা কত সুখে আছে এখানে। প্রেমা-প্রান্তর জন্য জান দিয়ে দিতে প্রস্তুত। নিঃসন্তান বলেই হয়তো এত মায়া বাচ্চাদের জন্য। আপা কিন্তু এখন আমাদের ছাড়া অসহায়। তার মা মারা গেছে। বাবা তো নেই। আত্মীয়-স্বজন নেই। এই বয়সে যাবে কোথায়? আমরা একটু মানিয়ে গুছিয়ে নিতে পারি না? সতিন হলেই সে খারাপ হবে, সৎ মা হলেই সে খারাপ হবে এমন কোনো বাণী আছে?’
পূর্ণা বেশ অনেকক্ষণ চুপ রইল। এরপর বলল, কিন্তু উনি অনেক সাজগোজ করেন। যদিও আমাকে কিছুক্ষণ আগে বলেছেন, আর সাজবেন না। তবে উনার কথার ধরন আমার ভালো লাগে না। স কে ছ উচ্চারণ করেন, শুদ্ধ-অশুদ্ধ মিলিয়ে জগাখিচুড়ি বানিয়ে কথা বলেন।’
হেমলতা পূর্ণার কথায় হাসলেন। পূর্ণা ওড়নার আঁচল আঙুলে পেঁচাতে পেঁচাতে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে। হেমলতা পূর্ণার মাথায় হাত রেখে বললেন, ‘তোর আপা যদি প্রান্তকে শুদ্ধ ভাষা রপ্ত করিয়ে দিতে পারে। তুই তোর বাসন্তী খালাকে স উচ্চারণ শিখাতে পারবি না?’
‘উনি শিখবেন?’
‘বললে অবশ্যই শিখবেন।
‘সত্যি?’
‘বলেই দেখ।’
‘এখন যাব?’
‘যা।’
‘যাচ্ছি।’
পূর্ণা ছুটে বেরিয়ে গেল। হেমলতা মৃদু হেসে বারান্দায় বেরিয়ে আসেন। সেলাই মেশিনের সামনে বসেন। অনেকগুলো কাপড় জমেছে। সব শেষ করতে হবে।
.
উঠানে বাসন্তীকে পেল না পূর্ণা। এদিক-ওদিক তাকিয়ে খুঁজতে থাকল। বাসন্তী কলপাড় থেকে হাত পা ধুয়ে বেরিয়ে এসেছেন। পূর্ণা কথা বলতে গিয়ে দেখে জড়তা কাজ করছে। দুই-তিনবার ঢোক গিলে ডাকল, ‘শুনুন?’
বাসন্তী দাঁড়ালেন। পূর্ণাকে দেখে হাসলেন। পূর্ণা এগিয়ে এসে বলল, ‘আপনাকে আমি পড়াব।’
‘কী পড়াইবা?’
‘লাহাড়ি ঘরের বারান্দায় আসেন আগে।’
বাসন্তী কিছু বুঝে উঠতে পারছেন না। তবুও পূর্ণার পিছু পিছু গেলেন। বারান্দার চৌকির উপর পূর্ণা বসল। পূর্ণার সামনে বাসন্তী উৎসুক হয়ে বসলেন। পূর্ণা গম্ভীর কণ্ঠে বলল, ‘আপনাকে আমি দন্ত-স উচ্চারণ শেখাব।’
‘দন্ত-ছ উচ্চারণ তো আমি পারি।’
‘আপনি দন্ত-স না বলে দন্ত-ছ বলেন। শুনতে ভালো লাগে না। বলুন, দন্ত-স।’
বাসন্তী চোখ ছোটো ছোটো করে বললেন, ‘দন্ত-ছ।’
‘হয়নি। বলুন, দন্ত-স।’
‘দন্ত-ছ।’
‘আবারও হয়নি। আচ্ছা বলুন, সংসার।’
‘ছংছার।’
‘স-ং-সা-র।’
‘ছ…সওও-ং-চ…সার।
সংসার উচ্চারণ করতে করতে পূর্ণার মুখের সামনে ঝুঁকে পড়েছেন বাসন্তী। পূর্ণা কপাল কুঁচকে বলল, ‘ওপরে চলে আসছেন কেন? দূরে বসুন। ‘ বাসন্তী দ্রুত সোজা হয়ে বসলেন। পূর্ণা বলল, ‘এবার বলুন, সন্তান।’
‘স…সন্তান।’
‘ফাটাফাটি! হয়ে গেছে। এবার বলুন, আসছে।’
‘আছছে।’
‘আরে, আবার ছ উচ্চারণ করছেন কেন? বলুন, আসছে। আ-স-ছে।’
‘আ-স-ছে।’
‘হয়েছে। এবার বলুন, সাজগোজ।’
‘সাজগোছ।’
.
দুপুরের খাবার খেতে হাওলাদার বাড়ির পুরুষেরা একসঙ্গে বসেছে। আলমগীর, খলিল সবাই আজ উপস্থিত। আমির দুই দিন পর শহরে ফিরবে, তাই চলে এসেছে আলমগীর। অতিরিক্ত গরম পড়েছে। বাড়ির চারপাশে এত গাছপালা তবুও একটু বাতাসের দেখা নেই। আমিনা, লতিফা হাত পাখা দিয়ে বাতাস করছে অনবরত। খাবার পরিবেশন করছে পদ্মজা, ফরিনা আর রিনু। পদ্মজা আমিরের থালায় গোশত দিতেই আমির বলল, ‘তুমি কখন খাবে?’
পদ্মজা চোখ তুলে তাকিয়ে বলল, ‘আম্মার সঙ্গে।’
‘এখন বসো না।’
‘জেদ ধরবেন না। অনুরোধ।’ ফিসফিসিয়ে বলল পদ্মজা।
মাছের তরকারি আনার জন্য রান্না ঘরে গেল সে, বাটিতে করে মাছের ঝোল নিয়ে ফিরে এলো। আমিরের দিকে চোখ পড়তেই আমির চোখ টিপল। ঠোঁট কামড়ে হাসল পদ্মজা। আলমগীরের থালায় মাছের ঝোল দেওয়ার সময় খেয়াল করল, আলমগীর বেশ ফূর্তিতে আছে। বয়স পঁয়ত্রিশ হবে। এসে একবারও রুম্পার কথা জিজ্ঞাসা করল না। বিস্ময়কর! বউয়ের প্রতি বিন্দুমাত্র মায়া-ভালোবাসা যে নেই তা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে।
রানি, লাবণ্য ছুটে এসে বাপ-চাচার মাঝে বসল। খাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে সবাই বিভিন্ন রকম আলোচনা করছে। রানির বিয়ে নিয়ে বেশি কথা হচ্ছে। খুব দ্রুত রানির বিয়ে দিতে চায় তারা। আচমকা রানি গড়গড় করে বমি করতে আরম্ভ করল। বিরক্তিতে চোখ-মুখ কুঁচকে ফেলল সবাই। প্রতিটি খাবারের থালা নষ্ট হয়ে যায়। আমিনা দ্রুত রানিকে ধরে কলপাড়ে নিয়ে যান। লাবণ্য, পদ্মজা, নুরজাহান, ফরিনা ছুটে গেল পিছু পিছু। বাড়ির পুরুষেরা হাত ধুয়ে উঠে পড়ে। মুহূর্তে একটা হইচই লেগে যায়।
রানি বমি করতে করতে ক্লান্ত হয়ে বসে পড়ল কলপাড়েই। আমিনা হায় হুতাশ করে বিলাপ করছেন, ‘আমার ছেড়িড়ার কী হইল? কয়দিন ধইরা খালি বমি করতাছে। জিনের আছড় লাগল নাকি! কতবার কইছি যহন তহন ঘর থাইকা বাইর না হইতে।’
লাবণ্য তথ্য দিল, ‘আপা রাতেও ছটফট করে। ঘুমাতে পারে না।’
আমিনা কেঁদে কূল পাচ্ছেন না। রানির চোখ-মুখ লাল হয়ে গেছে। তিনি রানিকে প্রশ্ন করলেন, ‘আর কী কষ্ট হয় তোর? ও আম্মা কবিরাজ ডাকেন। আমার ছেড়িডার কী হইল?’
রানি ক্ষীণ স্বরে বলল, ‘মাথাডা খালি চক্কর মারে।’
নুরজাহান চোখ দুইটি বড়ো বড়ো করে প্রশ্ন করলেন, ‘এই ছেড়ি তোর শরীর খারাপ শেষ হইছে কবে?’
‘দুই মাস হবে,’ কথাটা বলে রানি চমকে উঠল। সবাই কী ধারণা করছে? সে চোখ তুলে ওপরে তাকাল। সবাই উৎসুক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কেমন করে তাকিয়ে আছে! রানির শরীর কাঁপতে থাকে। আমিনা মেয়েকে দুই হাতে জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘এমন কিছু হয় নাই, আম্মা। আপনি ভুল বুঝতাছেন। আমার ছেড়ি এমন না।’
‘হেইডা কবিরাজ আইলে কওয়া যাইব। এই ছেড়ির জন্য যদি এই বাড়ির কোনো অসম্মান হয় কাইট্টা গাঙে ভাসায়া দিয়াম। মনে রাইখো বউ।’ নুরজাহানের রাগী স্বর। রানির গলা শুকিয়ে কাঠ! হৃৎপিণ্ড দ্রুত গতিতে চলছে। শরীরের ভারসাম্য হারিয়ে ফেলছে। একসময় মাথা ঘুরিয়ে পড়ে গেল আমিনার কাঁধে। আমিনা চিৎকার করে উঠলেন, ‘ও রানি…’
পদ্মজা – ৪০
রানির অবস্থা বেগতিক। খলিল হাওলাদার দরজা বন্ধ করে এলোপাথাড়ি মেরেছেন। কারো কথা শোনেননি। রিদওয়ান বাড়ির কাজের মানুষদের হুমকি দিয়েছে, রানি গর্ভবতী এই খবর বাইরে বের হলে সব কয়টাকে খুন করবে। মগা, মদন, লতিফা, রিনু ভয়ে আধমরা। তারা নিশ্বাস নিতেও ভয় পাচ্ছে। কেউ যদি বাইরে এই খবর বের করে, নিশ্চিত সবাই তাদেরই ভুল বুঝবে। রানি মারের চোটে অজ্ঞান হয়ে গেছে। সারা গায়ে মারের দাগ। ঠোঁট থেকে রক্ত ঝরছে। আমিনা রানিকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে কাঁদছেন। খলিল হাওলাদারকে বার বার পাষাণ বাপ বলে আখ্যায়িত করছেন। পদ্মজা পরিষ্কার কাপড়, পানি এনে ফরিনার হাতে দিল। ফরিনা রানির মুখে পানি ছিটিয়ে দেন। রানি কিছুতেই চোখ খুলছে না। লাবণ্য ফুঁপিয়ে কাঁদছে। রানির সঙ্গে তার সবসময় ঝগড়া হয় ঠিক, তবে ভালোও তো বাসে। দরজার বাইরে থেকে রানির চিৎকার শুনেছে। রানি চিৎকার করে ডাকছিল, ‘আম্মা, দাভাই, লাবণ্য কই তোমরা? আব্বা মাইরা ফেলতাছে। বাঁচাও তোমরা আমারে। লাবণ্য, কই তুই? আম্মা…।’
দরজায় সবাই মিলে অনেক ধাক্কা দিয়েছে, ডেকেছে…খলিল হাওলাদার সাড়া দেননি। এক নিশ্বাসে মেয়েকে এলোপাতাড়ি মেরে গেছেন। রানিকে মাটিতে ফেলে জোরে জোরে লাথি মেরেছেন। রাগের বশে রানির তলপেটে বেশি আঘাত করেছেন। রানি আকাশ কাঁপিয়ে কেঁদেছে। কেউ পারেনি ঘরের ভেতর প্রবেশ করতে। পদ্মজা আমিরের পাঞ্জাবি দুই হাতে খামচে ধরে কান্নামাখা কণ্ঠে বারংবার অনুরোধ করেছে, ‘আল্লাহর দোহাই লাগে আপনি এসব থামান। একটু চেষ্টা করুন।’
আমির অনেক চেষ্টা করেছে দরজা ভেঙে ঘরে প্রবেশ করার জন্য, পারেনি। যখন করাত আনার জন্য প্রস্তুত হয় তখন খলিল হাওলাদার ক্লান্ত হয়ে বেরিয়ে এসেছেন। রানির গলার স্বর থেমে যায়, শোনা যাচ্ছে না। সবাই ভেতরে প্রবেশ করে দেখে, রানি উপুড় হয়ে পড়ে আছে। শরীর রক্তাক্ত। আমিনা ‘রানি’ বলে চিৎকার করে ওঠেন। ছুটে যান রানির কাছে। মগাকে পুনরায় কবিরাজকে নিয়ে আসতে পাঠানো হয়েছে। এত কিছু হয়ে যাচ্ছে, নুরজাহান একবারও নিচে নেমে আসেননি। রানি গর্ভবতী শুনে সেই যে ওপরে গিয়েছেন তো গিয়েছেনই! আর আসার নাম নেই। এত চেঁচামিচি শুনেও কী আসতে ইচ্ছে হয়নি?
এতই কঠিন মন!
কবিরাজ আসার অনেকক্ষণ পর রানি চোখ খুলল। ফরিনা আমিনাকে বললেন, ‘ছেড়ির বিয়া দিতে কইছিলাম। দিলি না। ছেড়ির কথা হুনছিলি তোরা। এহন তো মজা বুঝতেই হইব। বিশ বছরের যুবতী ছেড়ি বাপের ঘরে থাহে? না লাংয়ের ঘরে?’
আমিনা কিছু বলতে পারলেন না। আঁচলে মুখ লুকিয়ে শুধু কাঁদছেন। মজিদ ঘরে প্রবেশ করে ফরিনাকে বললেন, ‘তোমাদের মেয়েকে জিজ্ঞাসা করো, এই আকাম কে করেছে! বেজন্মাটা কে?’
পদ্মজা ধীরপায়ে পালঙ্কের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। তার মাথায় ঘোমটা টানা। ফরিনা রানিকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘বাচ্চার বাপ কেডায়?’
রানি কিছু বলছে না। ঠোঁট কামড়ে কাঁদছে। চোখ বেয়ে জলের ধারা নামছে। ফরিনা তেজ নিয়ে বললেন, ‘কী রে ছেড়ি? এহন কথা আয় না কেন? বাচ্চার বাপের নাম ক? কইবি তো। বিয়া তো দেওন লাগব।’
তবুও রানি চুপ। তার কান্নার বেগ বেড়ে গে ওন লাগব মজিদ হাওলাদার লাবণ্যকে ডাক দিলেন, ‘লাবণ্য?’
লাবণ্য কেঁপে উঠল। মজিদ জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তোর তো জানার কথা। একসঙ্গে থাকিস। কার সঙ্গে রানির সম্পর্ক ছিল?’
লাবণ্য মাথা নত করে দাঁড়িয়ে থাকে। আড়চোখে রানিকে দেখে। রানি অন্য দিকে তাকিয়ে আছে। লাবণ্য বুঝে উঠতে পারছে না, তার কি বলা উচিত? মজিদ ধমকে উঠলেন, ‘লাবণ্য, সত্য বল। কিছু লুকানোর চেষ্টা করবি না। তাহলে তোরও এই দশা হবে।’
লাবণ্য ভয়ের চোটে গড়গড় করে বলতে থাকল, ‘আপার সঙ্গে আবদুল ভাইয়ের প্রেম আছে। দুইজনে প্রায়ই দেখা করে বাড়ির পেছনে। খালের পাড়ে। অনেক বছর হইছে প্রেমের।’
রানির কান্নার শব্দ বেড়ে যায়। ফরিনা ঝাঁঝালো কণ্ঠে রানিকে বললেন, ‘এই ছেড়ি চুপ কর! এহন মেলাইতাছস কেরে? কুকাম করার সময় মনে আছিল না? আমরারে কইতে পারলি না তোর আবদুলরে পছন্দ। আর আবদুলই কেমন ধাঁচের বেড়া মানুষ হইল? প্রস্তাব লইয়া আইতে পারে নাই? তোরে ডাইকা লইয়া কুকাম কইরা বেড়াইছে।’
নিজের বাড়ি বানায়া প্রস্তাব লইয়া আইব কইছিল।’ রানি কাঁদতে কাঁদতে বলল। ফরিনা পালটা বললেন, ‘কয়দিন তর সয় নাই? শরীর গরম হইয়া গেছিল বেশি? খারাপ ছেড়ি কোনহানের।’
আমির ঘরে ঢুকতেই মজিদ গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, ‘আবদুলরে ধরে নিয়ে আয়।
আমির অবাক হয়ে বলল, ‘আবদুল করছে এই কাজ? ও তো এমন না।’
‘মুখ দেখে বোঝা যায়, কে কেমন?’
আমির উত্তরে কিছু বলল না। রানি আহত, দুর্বল শরীর নিয়ে দ্রুত বিছানা থেকে নামে। আমির ঘর থেকে বেরোনোর জন্য পা বাড়িয়েছে মাত্র—রানি আমিরের পায়ে ধরে বসে আকুতি করে বলল, ‘দাভাই, উনারে কিছু কইরো না। উনারে মাইরো না। আমি তোমার পায়ে পড়ি। ও কাকা, আমারে মারো। উনারে মাইরো না।’
‘কী পাগলামি করছিস? পা ছাড়।’ বলল আমির।
‘দাভাই, দোহাই লাগে।’
আমির রানিকে দুই হাতে তুলে দাঁড় করাল। কোমল কণ্ঠে বলল, ‘কিছু করব না। শুধু নিয়ে আসব। বিয়ে পরিয়ে দেব।’
‘সত্যি, দাভাই?’
‘সত্যি।’
হাতের উলটোপাশ দিয়ে চোখের জল মুছল রানি, আমির বেরিয়ে গেল। মজিদ চোখ-মুখ কঠিন অবস্থানে রেখে ঘর ছাড়েন। রানি মাথা ঘুরিয়ে পড়ে যেতে নিলেই পদ্মজা ধরে ফেলে। আমিনা, ফরিনা এগিয়ে আসেন। সবাই মিলে রানিকে ধরে নিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিল। বিয়ে হবে শুনে ভেতরে ভেতরে রানির খুব আনন্দ হচ্ছে। কিছুক্ষণ আগের সব মার, ব্যথা তুচ্ছ মনে হচ্ছে। রানি আবদুলকে এত বেশি ভালোবাসে যে, আবদুলের এক কথায় সে বিয়ের আগে ঘনিষ্ঠ হতে রাজি হয়ে গিয়েছে। যখন যেখানে যেতে বলেছে, তখন সেখানেই গিয়েছে; দ্বিতীয়বার ভাবেনি। অন্ধভাবে ভালোবেসেছে। কতদিনের স্বপ্ন! কত আশা! পূরণ হবে অবশেষে। রানি নিজের অজান্তে হাসে। তৃপ্তির হাসি! কিছু পাওয়ার হাসি!
উপস্থিত আর কেউ খেয়াল না করলেও, সেই হাসি পদ্মজা খেয়াল করল। এই হাসি বেশিক্ষণ থাকল না। বিকেলবেলা আমির দুঃসংবাদ নিয়ে ফিরল। আবদুল খুন হয়েছে গত রাতে! মাদিনী নদীতে লাশ পাওয়া গেছে। আবদুলের বাড়িতে পুলিশের ভিড়! রানির কানে কথাটা আসতেই গগন কাঁপানো চিৎকার দিয়ে লুটিয়ে পড়ল মাটিতে, নিভে গেল জীবনের সুখের আলো…নিভে গেল স্বপ্ন পূরণের ইচ্ছের প্রদীপ।
পদ্মজা এই খবর শুনে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। প্রতিটা মৃতদেহ নদীতেই কেন পাওয়া যায়? এতে কি প্রমাণ পানির সঙ্গে ধুয়ে যায়? আগের খুনগুলোর খুনি কি এই আবদুলের খুনি? পদ্মজা চেয়ার টেনে বসল। মাথা ব্যথা করছে খুব। রগ দপদপ করে কাঁপছে। চোখ বন্ধ করে ভাবল, এই অলন্দপুরে পাপের সাম্রাজ্য কারা তৈরি করেছে? ভাবতে গেলে শরীর কেমন করে! শূন্য হাত নিয়ে ভাবনা থেকে বের হতে হয়। কূল-কিনারা পাওয়া যায় না।
৪২
সূর্যমামার ঘুম ভাঙতে তখনো বাকি তবে পাখিরা ডাকাডাকি করে সবার ঘুম ভাঙানোর কাজ শুরু করে দিয়েছে। পদ্মজা স্বামীর বুকের ওম ছেড়ে অজু করে এলো। এসে দেখে, তার সোহাগের স্বামী এখনো গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন! তাকে ডেকে তুলে দুজন একসঙ্গে ফজরের নামাজ আদায় করে নিলো। নামাজ শেষ করেই ঘুমিয়ে পড়ল আমির। পদ্মজা রান্নাঘরে চলে গেল। ফরিনা বেগম এখনও আসেননি। আজ মেট্রিক পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ পাবে। উত্তেজনায় পদ্মজার ভেতর কাঁপছে। সে পায়চারি করতে করতে লাবণ্যর ঘরের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। দরজা খোলা। পদ্মজা বাইরে থেকে উঁকি দেয়, রানি মেঝেতে বসে উদাস হয়ে কিছু ভাবছে। সেদিনের পর থেকে রাতে ঘুমায় না। নিজের মতো জগৎ করে নিয়েছে। খাবার রেখে যাওয়া হয়, যখন ইচ্ছে হয় খায়। পদ্মজা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে জায়গা ত্যাগ করল। রানি নিজের ঘরে লাবণ্যকে ছাড়া অন্য কাউকে দেখলে খুব রেগে যায়। তাই এই ভোরবেলা তার সামনে না যাওয়াই মঙ্গল। পদ্মজা সদর ঘরে পায়চারি করছে। ফরিনা বেগম তাসবিহ পড়তে পড়তে সদর ঘরে প্রবেশ করলেন। পদ্মজাকে দেখে প্রশ্ন করলেন, ‘উইট্টা পড়ছ! চুলায় আগুন ধরাইছো?’
পদ্মজা অপরাধীর মতো মাথা নত করে ‘না’ উচ্চারণ করল। ফরিনা এ নিয়ে কথা বাড়ালেন না। মৃদু কণ্ঠে আদেশ করলেন, ‘লাবণ্যরে গিয়া ডাইককা তুলো। ছেড়িডা আইজও মানুষ হইল না। ভোরের আলো ফুইটা গেছে। হে এহনও ঘুমায়।’
পদ্মজা বাধ্য বউয়ের মতো বলল, ‘আচ্ছা আম্মা।’
পদ্মজা আবার লাবণ্যর ঘরের সামনে গেল। এবার আর বাইরে থেকে উঁকি দিয়ে চলে যায়নি। ভেতরে ঢুকল। পদ্মজা আওয়াজ করে দরজা খুলে। তাও রানির ভাবান্তর হলো না। সে যেভাবে মেঝেতে বসে জানালার বাইরে তাকিয়ে ছিল, সেভাবেই রয়ে গেল। রানির দিকে দৃষ্টি খেয়াল করে পালঙ্কের পাশে গিয়ে দাঁড়াল পদ্মজা। লাবণ্যকে ডাকল, ‘এই লাবণ্য। লাবণ্য?’
লাবণ্য আড়মোড়া ভেঙে পিটপিট করে তাকিয়ে বলল, ‘উ?’
‘আজ ফলাফল। আর তুই ঘুমাচ্ছিস!’
পদ্মজার কথা বুঝতে লাবণ্যর অনেক সময় লাগল। যখন বুঝতে পারল লাফিয়ে উঠে বসল। বুকে হাত রেখে, হাসফাঁস করতে করতে বলল, ‘কী বললি এটা! দেখ কলিজাডা কেমনে লাফাইতাছে! কী ভয়ানক কথা মনে করায়া দিলি, উফ!’
পদ্মজা হাসল। বলল, ‘কলিজা লাফায় না, বুক ধুকপুক করে।’
ওইটাই…ওইটাই। আমি ফেল করব। রানি আপার মতো মাইর খাব দেখিস। আমার শ্বাস কষ্ট হইতাছে।’ লাবণ্য ভয়ে ঘন ঘন নিশ্বাস নিচ্ছে। রাতে দুশ্চিন্তা করতে করতে ঘুমিয়েছে, ঘুম ভেঙেও সেই আতঙ্ক! এই চিন্তায় রাতে ঘুমাতে ঘুমাতে মাঝরাত হয়ে গেছে। লাবণ্যর ছটফটানি দেখে ভয় পেয়ে গেল পদ্মজাও। সান্ত্বনা দিয়ে বলল, ‘এমন কিছুই হবে না, দেখিস। অকারণে চিন্তা করছিস। সূর্য উঠে যাবে। নামাজ পড় জলদি। আল্লাহর কাছে দোয়া কর।’
লাবণ্য হুড়মুড়িয়ে বিছানা থেকে নেমে কলপাড়ে ছুটে গেল। এইবার হেসে ফেলল পদ্মজা, রানির দিকে চোখ পড়তেই মিলিয়ে গেল হাসি। রানি কাঁদছে। পদ্মজা দুই পা রানির দিকে এগিয়ে আবার পিছিয়ে এলো।
শেষমেষ সাহস জুগিয়ে এগিয়ে এসে মৃদু কণ্ঠে ডাকল, ‘আপা?’
চোখ ভরতি অশ্রু নিয়ে তাকাল রানি। পৃথিবীর সব কষ্টরা বুঝি এক জোট হয়ে রানির চোখে ভিড় জমিয়েছে! রানি পদ্মজাকে অবাক করে দিয়ে অশ্রুরুদ্ধ কণ্ঠে বলল, ‘প্রিয় মানুষ হারানোর কষ্ট
এতডা যন্ত্রণা কেন দেয়, পদ্মজা? তুমি তো অনেক জ্ঞানী। সবাই তোমারে বুদ্ধিমতী কয়। তুমি একটা বুদ্ধি দেও না। এই কষ্টের পাহাড় কমানোর বুদ্ধি। আমারে দেখায়া দিবা শান্তির পথ?’
মানুষের কতটা কষ্ট হলে এভাবে শান্তি খুঁজে? পদ্মজার চোখ টলমটল করে উঠল। সে ঢোক গিলে বলল, ‘পুরনো স্মৃতি মুছে সামনের কথা ভাবো। নামাজ পড়ো, হাদিস পড়ো, কোরআন পড়ো। একদিন ঠিক শান্তি খুঁজে পাবে।’
‘আমার মতো পাপীরে আল্লাহ কবুল করব?’
আল্লাহ তায়ালার মতো দয়াবান, উদার আর কেউ নেই। পাপ মোছার জন্য অনুতপ্ত হয়ে সেজদা দিয়েই দেখো না, আপা। ক্ষমা চেয়ে দেখো। আল্লাহ ঠিক তোমার জীবনে শান্তি ফিরিয়ে আনবেন। সেদিন বুঝবে, আল্লাহ তোমার সেজদা কবুল করেছেন।’
রানি জানালার বাইরে তাকাল। আমগাছের ডালে চোখ রেখে বলল, ‘কেন এমনডা হইল আমার লগে?’
‘ব্যভিচার করেছ, আপা। বিয়ের আগে এভাবে…! আপা, এসব ভেবো না আর। যা হওয়ার হয়েছে।’
‘দুনিয়াত আর চাওনের-পাওনের কিচ্ছু নাই আমার।’
‘এবার আখিরাতের জন্য সম্পদ জমাও।’
রানি অন্যরকম দৃষ্টি নিয়ে তাকাল। পদ্মজা সবসময় মাথায় সোজা সিঁথি করে। এক অংশ সিঁথি দেখা যাচ্ছে। বাকিটুকু শাড়ির আঁচলে ঢাকা। মেয়েটা এত স্নিগ্ধ, এত সুন্দর, এত পবিত্র দেখতে! দেখলেই মন প্রাণ জুড়িয়ে যায়।
পদ্মজা বলল, ‘আখিরাতের সম্পদ ইবাদত, খাঁটি ইবাদত।’
তুমি খুব ভালা, পদ্মজা।’ মৃদু হেসে বলল রানি। তার চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ল জল। পদ্মজা অপ্রস্তুত হয়ে হাসল। বলল, ‘এখন নামাজ পড়তে পারবে? তাহলে পড়ে নাও। মনে শান্তি আসবে।’
‘ওইদিনের পর আর গোসল করি নাই।’
‘আজ করবে কিন্তু।’
‘করব।’
‘আসি?’
‘আসো।’
পদ্মজা বেরিয়ে যায়। দরজার বাইরে পা রাখতেই রানির কান্নার স্বর কানে এলো। থমকে দাঁড়াল পদ্মজা, পেছন ফিরে দেখে নিলো একবার। রানি হাঁটুতে মুখ লুকিয়ে কাঁদছে। পদ্মজা মনে মনে প্রার্থনা করল: আল্লাহ, ক্ষমা করে দাও রানি আপাকে। শান্তির পথে ফিরে আসার রহমত দাও।
.
বাড়ির সবাই মেট্রিক পরীক্ষার ফলাফল জানার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। আমির বের হয়েছে সেই সকাল দশটায়। এখন বাজে দুপুর তিনটা। লাবণ্য মিনিটে মিনিটে গ্লাস ভরে পানি খাচ্ছে। আর বার বার টয়লেটে যাচ্ছে। পদ্মজা ঝিম মেরে বসে আছে। হেমলতা সবসময় পদ্মজাকে বলতেন, মেট্রিকে ফার্স্ট ডিভিশন পেতে হবে। পদ্মজার একবার মনে হচ্ছে সে ফার্স্ট ডিভিশন পাবে, আরেকবার মনে হচ্ছে সেকেন্ড ডিভিশনে চলে যাবে! সে এক হাতের আঙুল দিয়ে অন্য হাতের তালু চুলকাচ্ছে। এই মুহূর্তে খুব মনে পড়ছে মাকে, কতদিন হলো দেখা হয় না। প্রথম প্রথম মায়ের জন্য প্রায় কাঁদত সে। এখন অবশ্য মানিয়ে নিয়েছে।
আছরের আজান পড়ছে। এখনও ফেরেনি আমির। পদ্মজা নামাজ পড়তে চলে গেল। নামাজ পড়ে এসে দাঁড়াল বারান্দায়। এরপর যা দেখল, খুশিতে আত্মহারা হয়ে পড়ল। আমিরের সঙ্গে হেমলতা, পূৰ্ণা এসেছে। দুজনের পরনে কালো বোরখা। তিনজন আলগ ঘর পেরিয়ে অন্দরমহলের দিকে আসছে। মাথার ওপর কড়া রোদ নিয়ে মরুভূমিতে সারাদিন হাঁটার পর পথিক তৃষ্ণার্ত হয়ে পানির দেখা পেলে যেমন আনন্দ হয়, ঠিক তেমন আনন্দ হচ্ছে পদ্মজার। ইচ্ছে হচ্ছে দুই তলা থেকে ঝাঁপ দিয়ে নেমে যেতে। কিন্তু তা তো সম্ভব নয়। পদ্মজা উন্মাদের মতো দৌড়াতে থাকে। সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় উলটে পড়ে যেতে গিয়েও নিজেকে সামলে নিলো, কিন্তু দৌড় থামল না। সদর ঘরের সবাইকে তোয়াক্কা না করে বাড়ির বউ ছুটে বেরিয়ে যায়। হেমলতা কিছু বুঝে ওঠার আগেই তার নয়নের মণি ঝাঁপিয়ে পড়ে বুকের ওপর। পদ্মজার ছোঁয়ায় চারিদিকে যেন বসন্ত শুরু হয়। পূর্ণা পদ্মজাকে দেখেই জড়িয়ে ধরে ফোঁপাতে থাকল। হেমলতার বুকে মাথা রেখে পূর্ণাকে এক হাতে জড়িয়ে ধরে কাঁদো কাঁদো হয়ে পদ্মজা বলল, ‘এতদিনে তোমাদের আমার কথা মনে পড়ল? এভাবে পর করে দিলে, আম্মা? আর পূর্ণা, তুই তো আসতে পারিস। বোনকে মনে পড়ে না?
শাড়ির আঁচল টেনে পদ্মজার মাথার চুল ঢেকে দিলেন হেমলতা। বললেন, ‘মেয়ের শ্বশুরবাড়ি আসা কী এতই সোজা?’
‘তাহলে শ্বশুরবাড়ি পাঠানোর কী দরকার? যদি মা-বাবা সহজে না আসতে পারে!’
‘আপা…আমার তোমাকে খুব মনে পড়ে।’ পূর্ণা বাচ্চাদের মতো কাঁদছে। পদ্মজা পূর্ণার চোখের জল মুছে দিয়ে বলল, ‘আমারও মনে পড়ে।’ হেমলতা পদ্মজার চোখের জল মুছে দিয়ে উচ্ছ্বাস নিয়ে বললেন, ‘সাতশো পঞ্চাশ মার্ক পেয়েছিস। স্টার মার্ক। ফার্স্ট ডিভিশন। এই খুশিতে আর কাঁদিস না।’
পদ্মজার চোখে জল। গাল, ঠোঁট চোখের জলে ভেজা। এমতাবস্থায় সে হাসল। তাকে মায়াবী ভোরের শিশিরের মতো দেখাচ্ছে। হেমলতা অন্দরমহলের সদর দরজার দিকে তাকিয়ে দেখেন, হাওলাদার বাড়ির বাকিরা তাকিয়ে আছে। তিনি পদ্মজাকে সরিয়ে সদর দরজার দিকে এগিয়ে যান। ফরিনা বেগমের মুখ দেখে পদ্মজার ভয় হচ্ছে। উনার মুখ আগে আগে ছোটে। আম্মাকে কিছু বলবেন না তো?
হেমলতা সবাইকে সালাম দিয়ে বললেন, ‘আমির ধরে নিয়ে এলো।’
মজিদ হাওলাদার বিনীত স্বরে বললেন, ‘এই প্রথম আমাদের বাড়িতে এসেছেন। আগে জানলে, গরু জবাই করে রাখতাম।’
হেমলতা হাসলেন, ‘বলেছেন, এই অনেক।’
‘বললেই হবে না। করতে হবে। কয়দিন কিন্তু থেকে যাবেন।’
‘এটা বলবেন না। আজই ফিরতে হবে আমার। কিছুক্ষণ থেকেই চলে যাব।’
‘প্রথম বার আসলেন আর কিছুক্ষণ থেকেই চলে যাবেন?
‘আবার আসব। অনেকদিন থেকে যাব।’
‘আজকের রাতটা থেকে যান।’
‘আম্মা, আজ আমার সঙ্গে থেকে যাও।’ পদ্মজা অনুরোধ করে বলল। হেমলতা হেসে সম্মতি দিলেন। ফরিনা কিছু বলছেন না। ভ্রুকুটি করে দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি হেমলতাকে ভেতরে ভেতরে ভয় পান। কেমন ধারাল চোখের দৃষ্টি, যেন একবার তাকিয়েই ভেতরের সব দেখে ফেলতে পারে। আর চোখমুখের ভাব দেখলে মনে হয়, কোন দেশের রাজরানি! তার উপর আমির দরদ দেখিয়ে শাশুড়ি নিয়ে এসেছে। ফরিনা বিরক্ত হচ্ছেন। হেমলতা ফরিনার দিকে তাকাতেই ফরিনা চোখ সরিয়ে নিলেন। হেমলতা ফরিনাকে প্রশ্ন করলেন, ‘আপা, কথা বলছেন না যে? আমার উপস্থিতি বিরক্ত করেছে খুব?’
হেমলতার কথার ফরিনাসহ উপস্থিত সবাই অস্বস্তিতে পড়ে যায়। ফরিনা হাসার ব্যর্থ চেষ্টা করে বললেন, ‘কী বলছেন, আপা? বিরক্ত হইতাম কেরে? এই পরথম আইছেন। খুশিই হইছি।’
‘তাই বলুন।’
‘দরজায় দাঁড়ায়া গপ আর কতক্ষণ হইব? ঘরে আহেন।’ ফরিনা দ্রুত সটকে পড়েন। সদর ঘরে আগে আগে হেঁটে চলে যান। তিনি হাঁপাচ্ছেন। বিড়বিড় করে বললেন, ‘মহিলা এত্ত চালাক! সত্যি সত্যি সব বুইঝা ফেলে।’
হেমলতা সবার আড়ালে শাড়ির আঁচল মুখে চেপে সেকেন্ড দুয়েক হাসলেন। হেমলতাকে হাসতে দেখে, পদ্মজাও হাসল। সবাই সদর ঘরে এসে বসে। লাবণ্য ও পদ্মজার ফলাফল দেওয়ার উপলক্ষে শিরিন, শাহানাকে দাওয়াত দেওয়া হয়েছিল। তারা এখন হাওলাদার বাড়িতেই আছে। দুই বোন নাস্তা তৈরি করতে রান্নাঘরে গেল। লাবণ্য দরজা বন্ধ করে ঘরে বসে আছে। আমির এখনও লাবণ্যর ফলাফল কাউকে বলেনি। সে সদর ঘর থেকে লাবণ্যকে ডাকল, ‘লাবণ্য? এই লাবণ্য? শুনছিস? এদিকে আয়। আজ তোর খবর আছে।’
আমিরের কথা শুনে লাবণ্যর বুকের ধুকপুকানি থেমে যায়। এখুনি নিশ্বাস বন্ধ হয়ে যাবে অবস্থা। নিশ্চিত ফেল করেছে! লাবণ্য চিত হয়ে শুয়ে অপেক্ষা করতে থাকে, কখন সে মারা যাবে। আমির আবার ডাকল, ‘বেরিয়ে আয় বলছি। নয়তো দরজা ভেঙে ঘরে ঢুকব। তখন কিন্তু গায়ে মার বেশি পড়বে।’
লাবণ্য তড়িঘড়ি করে বিছানা থেকে নামে। গায়ের ওড়না ঠিক করে সদর ঘরে ঢুকতে ঢুকতে নামাজের সব সুরা পড়তে থাকে।
আমির চেয়ার ছেড়ে দাঁড়াতেই লাবণ্য কেঁপে উঠল। কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল ‘আগামী বছর মেট্রিকে পাশ করাম। আল্লাহর কসম কইরা কইতেছি
‘এই বছরই তো পাশ করেছিস! তাহলে আগামী বছর আবার মেট্রিক দিবি কেন?’
লাবণ্য চকিতে তাকাল। তার মুখটা হাঁ হয়ে যায়। লাবণ্যর মুখের ভঙ্গি দেখে সবাই হাসল। লাবণ্য খুশিতে কেঁদে দিল। আমির লাবণ্যকে জড়িয়ে ধরে মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, ‘আরেকটুর জন্য ফেল করিসনি।’
লাবণ্য হাসতে হাসতে কাঁদছে। লাবণ্যর পাগলামি দেখে আমিরও হাসছে। তখন সদর ঘরে প্রবেশ করল রিদওয়ান হাওলাদার। হেমলতা রিদওয়ানের দিকে অনুসন্ধানী দৃষ্টিতে তাকান। হেমলতার চোখে চোখ পড়তেই রিদওয়ান বিব্রত হয়ে উঠল, সরিয়ে নিলো চোখ। একটু পর আড়চোখে তাকিয়ে দেখে,
দেখে, হেমলতা তখনো তীক্ষ্ণ দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে আছেন। রিদওয়ান ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল।
এ যেন সাপুড়ে ও সাপের খেলা!
৪৩
নৈশভোজ শেষ হয়েছে মাত্র। পদ্মজা ও লাবণ্যকে পেয়ে পুলকিত পূর্ণা। আনন্দ বয়ে যাচ্ছে মনে। একটু পর পর উচ্চস্বরে হাসছে। হেমলতা একবার ভাবলেন, মেয়েকে এত জোরে হাসতে নিষেধ করবেন। পরমুহূর্তে কী ভেবে আর করলেন না। তিনি নিজেও বাড়ির বড়োদের সঙ্গে প্রফুল্লচিত্তে কথা বলছেন।
আমির সবার মনোযোগ পাওয়ার জন্য বলল, ‘আমার একটা কথা ছিল।’
সবাই আমিরের দিকে তাকাল। আমির নির্দ্বিধায় বলল, ‘ আমি আগামীকাল ফিরব।’
হেমলতা বললেন, ‘ঢাকায়?’
‘জি। পদ্মজাকে নিয়ে যাব। সঙ্গে লাবণ্যও যাবে। দুজনকে কলেজে ভর্তি করে দেব।’
পূর্ণার পাশ থেকে উঠে আমিরের পাশে দাঁড়াল লাবণ্য। আবদার করে বলল, ‘দাভাই, তুমি কইছিলা পাশ করলে আমারে দেশের বাইরে পড়তে পাঠাইবা।’
‘ছেড়ি মানুষ বাইরে যাইতি কেন? কইলজাডা বড়ো হইয়া গেছে?’ রেগে বললেন ফরিনা।
লাবণ্য মায়ের কথা অগ্রাহ্য করে আমিরকে বলল, ‘কথা রাখতে হইব তোমার।’
আমিরে একবার মজিদকে দেখল। এরপর লাবণ্যকে বলল, ‘সত্যি যেতে চাস?’
‘হ।’
লাবণ্যর মাথায় গাট্টা মারল ‘আমির। বলল, ‘আগে শুদ্ধ ভাষাটা শিখ। এরপর দেশের বাইরে পড়তে যাবি।’
লাবণ্য আহ্লাদিত হয়ে বলল, ‘পদ্মজা শিখায়া দিব। এইডা কোনো ব্যাপার না, দাভাই।’
‘আপাতত ঢাকা চল। শুদ্ধ ভাষায় কথা বলে অভ্যস্ত হ। এরপর সত্যি পাঠাব।’
‘তুই পাগল হইয়া গেছস, বাবু? এই ছেড়িরে একা বাইরে পাড়াইয়া দিবি?’
‘জাফর ভাই আছে, ভাবি আছে। সমস্যা নেই, আম্মা। একটাই তো বোন। নিজের মতো পড়াশোনা করুক।’
ফরিনা বিরক্তিতে কপাল কুঁচকে ফেলেন। মেয়েমানুষ…এখন বিয়ে দেয়ার সময়, কিন্তু সবাই পড়াতে চাচ্ছে। এখন নাকি আবার বিলেতে পাঠাবে! মজিদ কথা বলছেন না। মানে তিনিও আমিরের দলে। তাহলে আর কথা বলে কী হবে? এই সংসারে এমনিতেও তার দাম নেই। নিজের মতোই বকবক করে যান, কেউই তার কথা শোনে না। ফরিনা রাগ করে বললেন, ‘তোদের যা ইচ্ছে কর।’ বলেই চলে যান।
হেমলতা বললেন, ‘কালই চলে যেতে হবে? দুই-তিন দিন পর হলে হবে না?’
আমির নম্র কণ্ঠে বলল, ‘না, আম্মা। আমি আট বছর হলো ঢাকা গিয়েছি। এর মধ্যে এই প্রথম তিন মাসের ওপর গ্রামে থেকেছি। ব্যাবসা ফেলে এসেছি। আমার অনুপস্থিতিতে আলমগীর ভাইয়া সামলাচ্ছে। এখন তো ভাইয়াও চলে এসেছে। আর আমার ব্যাবসা আমারই সামলানো উচিত। যত দ্রুত সম্ভব যেতে চাই। আপত্তি করবেন না।’
হেমলতা পদ্মজার দিকে চেয়ে বললেন, ‘তাহলে আগামীকালই যাচ্ছো?’
‘জি। আব্বা, আম্মাকে তো অনেক আগেই বলেছি। পদ্মজাও জানে। কিন্তু পদ্ম ভাবেনি সত্যি সত্যি যাব। দেখুন, কেমন অবাক চোখে তাকিয়ে আছে। কাল চলে যাব বলেই আজ আপনাকে নিয়ে এসেছি। আজ রাতটা মেয়ের সঙ্গে থাকুন। আবার কবে না কবে দেখা হয়!’
হেমলতা বেশ অনেকক্ষণ নিশ্চুপ রইলেন। তারপর বললেন, ‘তোমার কীসের ব্যাবসা আজও জানলাম না।’
মজিদ অবাক হয়ে বললেন, ‘আত্মীয় হলেন এতদিন এখনও জানেন না মেয়ের জামাই কীসের ব্যাবসা করে! বাবু, এটা তো বলা উচিত ছিল?’
‘আমি তো ভেবেছি জানেন হয়তো। তাই বলিনি। আম্মা, আমাদের এক্সপোর্ট-ইমপোর্টের বিজনেস। মানে মালামাল বিভিন্ন দেশে আমদানি- রপ্তানি করে থাকি। এ কাজে আব্বা, রিদওয়ান, ভাইয়া, চাচা আছে। তাছাড়া, অনুন্নত দেশগুলো থেকে কম দামে পণ্য এনে উন্নত দেশগুলোতে বেশি মূল্যে বিক্রি করি। সব পণ্য গোডাউনে রাখা হয়। আমাদের অফিসও আছে। গোডাউন আর অফিসের সব কাজ আমাকে সামলাতে হয়। বলতে পারেন, আমারই সব ‘
‘অনেক বড়ো ব্যাপার।’ হাসলেন হেমলতা। তিনি জানতেন না আমির এতটা বিত্তশালী। এক্সপোর্ট-ইমপোর্ট বিজনেস কম কথা নয়। এ সম্পর্কে মোটামুটি তিনি জানেন। কলেজ থাকাকালীন অনেক ব্যাবসা সম্পর্কেই জেনেছেন।
পদ্মজাকে জড়িয়ে ধরে বসে আছে পূর্ণা।
পদ্মজা বলল, ‘কথা বলছিস না কেন?’
‘কাল চলে যাবা, আপা?’
‘তাই তো কথা হচ্ছে।’
‘আমার খুব মনে পড়ে তোমাকে।’
‘কাঁদছিস কেন? আসব তো আমি।’
‘সে তো অনেক মাস পর পর।’ পূর্ণার গলা কাঁপছে
পদ্মজা কিছু বলতে পারল না। আমির ও মজিদের সঙ্গে কথা বলছেন হেমলতা। খলিল, আলমগীর নীরব দর্শক হয়ে বসে আছে। বিকেল থেকে রিদওয়ানের দেখা পাওয়া যাচ্ছে না। পদ্মজা হেমলতার উপর চোখ রেখে পূর্ণাকে প্রশ্ন করল, ‘আম্মা খুব শুকিয়েছে। খাওয়াদাওয়া করে না?’
‘না। মাঝে মাঝে সারাদিন পার হয়ে যায় তবুও খায় না।’
‘জোর করে খাওয়াতে পারিস না?’
‘জোর করলে ধমক দেয়। আমাদের কথা শুনে না।’
‘আম্মা ঘাড়ত্যাড়া।’
‘ঠিক বলেছ।’
‘পূর্ণা, উনি কেমন? আম্মার সঙ্গে ঝগড়া করে?
‘উনিটা কে?’
‘আব্বার প্রথম বউ।’
‘তুমি তো দেখতেও যাওনি।’
শ্বশুরবাড়ি থেকে চাইলেই যাওয়া যায় না। বল না, কেমন? আদর করে তোদের?’
‘ভালো খুব। সহজ-সরল। আম্মাকে খুব মানে। প্রেমা-প্রান্তকে অনেক আদর করে। দেখতেও খুব সুন্দর। আগে সাপুড়ের বউদের মতো সাজত। আমার পছন্দ না বলে এখন আর সাজে না।’
‘তুই নাকি খুব খারাপ ব্যবহার করিস?’
‘এখন করি না। তুমি কাকে দিয়ে এত খোঁজ রাখো?’
‘সে তোর জানতে হবে না। তাহলে উনি ভালো তাই তো?’
‘হুম।’
‘তাহলে মিলেমিশে থাকিস।’
‘ঢাকা যাওয়ার আগে দেখে যাও একবার।’
‘বাপের প্রথম বউকে আমার দেখার ইচ্ছে নেই।’ পদ্মজা থমথমে স্বরে বলল।
পূর্ণা বলল, ‘আচ্ছা। আমি আজ তোমার সঙ্গে ঘুমাব।’
‘হু, ঘুমাবি। আম্মার খেয়াল রাখবি। আম্মাকে দেখে মনে হচ্ছে, কোনো বিষয় নিয়ে খুব চিন্তা করে। তুই কথা বলবি, সময় দিবি। আম্মাকে একা ছাড়বি না।’
‘আমি তোমার মতো সব সামলাতে পারি না।’
‘চেষ্টা করবি। আব্বা আর প্রেমা-প্রান্তকে নিয়ে আসতে ভোরে মগা ভাইয়াকে পাঠাব। সবাইকে চোখের দেখা দেখে যাব।’
পূর্ণা পদ্মজাকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। তার ভীষণ কান্না পাচ্ছে। কত দূরে চলে যাবে আপা! পদ্মজা অনুভব করে পূর্ণার ভেতরের আর্তনাদ। সে পূর্ণার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, ‘খুব দ্রুত আসব।’
পদ্মজা মাঝে শুয়েছে। তার দুই পাশে হেমলতা আর পূর্ণা। পূর্ণা শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রেখেছে তাকে। আর পদ্মজা শক্ত করে ধরে রেখেছে মায়ের এক হাত। হেমলতা নীরবতা ভেঙে পদ্মজাকে বললেন, ‘পদ্ম?’
‘হু, আম্মা?’
‘শহরে নিজেকে মানিয়ে নিবি। শক্ত হয়ে থাকবি। আর মনে রাখবি, কেউ কারোর না। সবাই একা। সবসময় নিজের ওপর বিশ্বাস রাখবি, নিজের ওপর আস্থা রাখবি। সৎ পথে থাকবি। কখনো কারো ওপর নির্ভরশীল হবি না। যদি তুই অন্য কারো ওপর নিজের ভালো থাকার দায়িত্ব দিয়ে দিস, কখনো ভালো থাকবি না। নিজের ভালো থাকার দায়িত্ব নিজেরই নিতে হয়। নিজেকে কখনো একা ভাববি না। যেখানেই থাকি আমি, আমার প্রতিটা কথা তোর সঙ্গে মিশে থাকবে। ছায়া হয়ে থাকবে। আল্লাহ সবাইকে কোনো না কোনো উদেশ্যে সৃষ্টি করেছেন। সেই উদ্দেশ্য সফল হলে আর বেঁচে থাকার মানে থাকে না। মৃত্যুতে ঢলে পড়ে। আমার ইদানীং মনে হয়, আমার দায়িত্ব ছিল তোকে জন্ম দেয়া, বড়ো করে তুলে বিয়ে দেয়া। সেই দায়িত্ব কতটুকু রাখতে পেরেছি জানি না। কিন্তু তোর দায়িত্ব অনেক বড়ো কিছু!’
পদ্মজা চাপা স্বরে বলল, ‘কী সেটা?’
‘জানি না।’
‘তুমি এত কী ভাবো, আম্মা? মুখটা এরকম ফ্যাকাসে হয়ে যাচ্ছে কেন? খাওয়াদাওয়া ঠিকমতো করবে। আমি পরেরবার এসে যেন দেখি মোটা হয়েছো।’
হেমলতা হাসলেন। তার সাদা ধবধবে দাঁত ঝিলিক দেয়। তিনি পদ্মজাকে এক হাতে জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘পরেরবার যখন আসবি একদম অন্য রকম দেখবি।’
‘কথা দিচ্ছো?’
‘দিচ্ছি।’
পদ্মজা হাসল। পূর্ণা বলল, ‘আমাকে জড়িয়ে ধরো, আপা।’
পদ্মজা পূর্ণাকে জড়িয়ে ধরে। হেমলতা দুই মেয়েকে একসঙ্গে জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘অনেক রাত হয়েছে, এবার চুপচাপ ঘুমা দুজন। আর কোনো কথা না।’
.
মাঝরাতে হেমলতার ঘুম ভেঙে গেল। তিনি চোখ খুলে কান খাড়া করে শুনতে পেলেন, দরজার বাইরে কেউ হাঁটছে। গা থেকে কাঁথা সরিয়ে ধীরে ধীরে বিছানা থেকে নেমে সাবধানে দরজা খুলে বেরিয়ে পড়লেন। পায়ের শব্দটা যেদিক থেকে আসছে সেদিকে গিয়ে সাদা পাঞ্জাবি পরা একটা পুরুষ অবয়ব দেখতে পান।
তিনি তীক্ষ্ণ স্বরে ডাকলেন, ‘রিদওয়ান?’
রিদওয়ান কেঁপে উঠে পেছনে ফিরল। বড়ো বড়ো হয়ে গেল তার চোখ দুটি। সে যে অপ্রস্তুত হয়ে পড়েছে, দেখেই বোঝা যাচ্ছে।
হেমলতা প্রশ্ন করলেন, ‘এত রাতে এখানে কী করছো?’
‘জ…জি হাঁটছিলাম।’
‘এত রাতে?’
‘প্রায়ই হাঁটি। অন্যদের জিজ্ঞাসা করতে পারেন।’
হেমলতা রিদওয়ানকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত পরখ করে নিয়ে বললেন, ‘কোনোভাবে আমাকে খুন করতে এসেছো কী?’
রিদওয়ান থতমত খেয়ে গেল। বলল, ‘ন…না না! আপনাকে কেন খ…খুন করতে যাব? কী বলছেন!
‘প্রমাণ সরাতে।’ হেমলতার সহজ উক্তি।
রিদওয়ান হঠাৎই অন্যরকম স্বরে কথা বলল, ‘সে তো আমিও একজন প্রমাণ। স্বচক্ষে দেখা জ্বলজ্বলন্ত প্রমাণ। আপনি আমাকেও খুন করে প্রমাণ সরাতে পারেন। যেহেতু দুজনই একই পথের। কাউকে কারোর খুন করার প্রয়োজন নেই। আমি এখানে অন্য কাজে এসেছি।
হেমলতা কঠিন চোখে তাকালেন। পরপরই চোখ শীতল করে নিয়ে বললেন, ‘শুভ রাত্রি।’
রিদওয়ান হেসে হেলে-দুলে হেঁটে চলে গেল। হেমলতা ঘরে ঢোকার জন্য ঘুরে দাঁড়ালেন। কিন্তু কদম ফেলার পূর্বেই পড়ে গেলেন শরীরের ভারসাম্য হারিয়ে। ভাগ্যিস আওয়াজ হয়নি! তিনি হাতে ভর দিয়ে ওঠার চেষ্টা করলেন। বাঁ-হাতের মাংস পেশি শক্ত হয়ে আছে। হাত নাড়াতে কষ্ট হচ্ছে। ভর দিয়ে ওঠা আরো কষ্টদায়ক। তিনি ওভাবেই বসে থাকলেন অনেকক্ষণ।
৪৪
প্রতিদিনের মতো পাখিদের কলতানে পদ্মজার ঘুম ভাঙল। জানালার ফাঁক গলে আসা দিনের আলো বিছানায় লুটোপুটি খাচ্ছে। সে তড়িঘড়ি করে উঠে বসে। অন্যদিন ফজরের আজানের সঙ্গে সঙ্গে উঠে পড়ে। আজ দেরি হয়ে গেল!
‘পূর্ণাকে তুলে নিয়ে যা। একসঙ্গে অজু করে নামাজ পড়তে বস।’
হেমলতার কণ্ঠ শুনে পদ্মজা ঘুরে তাকাল। তিনি কোরআন শরীফ পূর্বের জায়গায় রেখে বললেন, ‘পূর্ণাকে একটু বুঝাস, নামাজ পড়তে চায় না।’
‘আচ্ছা, আম্মা।’
পদ্মজা পূর্ণাকে ডেকে নিয়ে কলপাড়ে যায়। এরপর দুই বোন একসঙ্গে জায়নামাজে দাঁড়াল। নামাজ শেষ করে হেমলতার সামনে এসে দাঁড়াল পদ্মজা। হেমলতা জানালার বাইরে তাকিয়ে আছেন। পদ্মজা হেমলতার চোখ দেখে উৎকণ্ঠিত হয়ে বলল, ‘আম্মা, তোমার চোখ এমন লাল হলো কেন?’
হেমলতা দুই চোখে হাত বুলিয়ে বললেন, ‘রাতে ঘুমাইনি তাই।’
পুনরায় পদ্মজার উৎকণ্ঠা, ‘কেন? কেন ঘুম হয়নি? কেমন দেখাচ্ছে তোমাকে! বিছানায় পড়াটাই শুধু বাকি।’
কিছু চুল পদ্মজার মুখের ওপর চলে এসেছে। হেমলতা তা কানে গুঁজে দিয়ে আদরমাখা কণ্ঠে বললেন, ‘আজ আমার মেয়ে চলে যাবে। তাই আমি সারারাত জেগে আমার আদরের মেয়েকে দেখেছি।
হেমলতার কথা শুনে পদ্মজা আবেগী হয়ে উঠে। হেমলতাকে জড়িয়ে ধরে কান্নামাখা কণ্ঠে বলল, ‘আমার খুব মনে পড়ে তোমাকে। চলো আমার সঙ্গে। একসঙ্গে থাকব। তোমার না ইচ্ছে ছিল, আমাকে নিয়ে শহরে থাকার।
‘পাগল হয়ে গেছিস! মেয়ের জামাইর বাড়িতে কেউ গিয়ে থাকে? দুই- তিন দিন হলে যেমন তেমন।’
হেমলতার শরীরের উষ্ণতা পদ্মজাকে ওম দিচ্ছে। মায়ের উষ্ণতায় কী অদ্ভুত শান্তি! পদ্মজা কান্না করে দিল। হেমলতা পদ্মজার মুখ তুলে বললেন, ‘সকাল সকাল কেউ কাঁদে? বাড়ির বউ তুই, শাশুড়ি কী করছে আগে দেখে আয়, যা।’
পদ্মজা আরো কাঁদতে থাকল। কাঁদতে কাঁদতে যতবার চোখের জল মোছে ততবারই আবার ভিজে যাচ্ছে। বুকটা হাহাকার করছে। মা-বাবা- বোনদের রেখে কত দূরে চলে যাবে সে!
কাঁদতে কাঁদতে বেরিয়ে গেল পদ্মজা। পেছন থেকে শোনা গেল হেমলতা কথা, ‘বাচ্চাদের মতো করছিস কিন্তু।’
পদ্মজা শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখ মুছে নিলো। ঢোক গিলে নিজেকে শক্ত করে চলে গেল রান্নাঘরের দিকে। পদ্মজা ঘর ছাড়তেই হেমলতার চোখ বেয়ে দুই ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ে। তিনি দ্রুত জল মুছে নিলেন। পালঙ্কের দিকে চেয়ে দেখেন, পূর্ণা চিত হয়ে ঘুমাচ্ছে। এ বাবা! এ মেয়ে কখন ঘুমাল? হাসি পেল হেমলতার। তিনি কাঁথা দিয়ে পূর্ণাকে ঢেকে দিলেন।
পদ্মজা রান্নাঘরে ঢুকতেই ফরিনা মুখ ঝামটালেন, ‘আইছো ক্যান? যাও ঘুমাও গিয়া।
‘কখন এত দেরি হয়ে গেল বুঝিনি।’ মিনমিন করে বলল পদ্মজা।
‘বুঝবা কেন? মা আইছে তো। হউরির লগে তো আর মায়ের মতো মিশতে মন চায় না।’
পদ্মজা অবাক হয়ে তাকাল। আবার চোখ নামিয়ে নিয়ে বলল, ‘আমি তো মিশতেই চাই। আপনি সবসময় রেগে থাকেন।’
মুখের উপরে কথা কইবা না। যাও এহন।’
পদ্মজা ঘুরে দাঁড়াল চলে যাওয়ার জন্য। ফরিনা তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে বললেন, ‘কইতেই যাইবাগা নাকি? জোর কইরা তো কাম করা উচিত। এই বুদ্ধিডা নাই?’
পদ্মজা স্তব্ধ হয়ে কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে। প্রতিদিন সে কাজ করার জন্য জোরাজুরি করে, কিন্তু ফরিনা করতে দেন না। এজন্যই সে এক কথায় চলে যাচ্ছিল। আর এখন কী বলছেন! সে ব্যাপারটা হজম করে নিয়ে রান্নাঘরে ঢুকল। ফরিনা গলার স্বর পূর্বের অবস্থানে রেখেই বললেন, ‘হইছে, কাম করতে হইব না। এরপর তোমার মায়ে কইবো দিনরাত কাম করাই তার ছেড়িরে। যাও। বারায়া যাও।’
পদ্মজা হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। লতিফা ঠোঁট চেপে হাসছে। ফরিনার এমন ব্যবহারের সঙ্গে সে অভ্যস্ত।
বেশ অনেকক্ষণ পর পদ্মজা বলল, ‘আম্মা, আমি করবটা কী?’
পদ্মজা মাথা থেকে ঘোমটা সরে গেছে। মুখটা দেখার মতো হয়েছে। ফরিনা পদ্মজার মুখ দেখে হেসে ফেললেন, দ্রুত হাসি লুকিয়েও ফেললেন। এই মেয়েটাকে তিনি অনেক আগেই ভালোবেসে ফেলেছেন। এত শান্ত, এত নম্র-ভদ্র মেয়ে দুটো দেখেননি। হেমলতাকে হিংসে হয়…হেমলতার গর্ভকে হিংসে হয়! পদ্মজার ঢাকা যাওয়া নিয়ে প্রথম প্রথম ঘোর আপত্তি ছিল ফরিনার। কিন্তু এখন নেই। ওপর থেকে যাই বলুন না কেন, তিনি মনে মনে চান পদ্মজা পড়তে যাক। অনেক পড়ুক, অনেক বেশি পড়ুক। এই মেয়ের জন্ম রান্নাঘরে রাঁধার জন্য নয়, রানির আসনে থাকার জন্য। পদ্মজা ফরিনার দুই সেকেন্ডের মৃদু হাসি খেয়াল করেছে। সে সাহস পেল। ফরিনার পাশ ঘেঁষে দাঁড়াল।
ফরিনা চোখ-মুখ কুঁচকে প্রশ্ন করলেন, ‘ঘেঁষতাছো কেন?’
পদ্মজা শিমুল তুলোর ন্যায় নরম স্বরে বলল, ‘আমার খুব মনে পড়বে আপনাকে, আপনার বকাগুলোকে। আপনি খুব ভালো।’
ফরিনা তরকারিতে মশলা দিচ্ছিলেন। পদ্মজার কথা শুনে হাত থেমে যায়। পদ্মজার দিকে তাকান। পদ্মজা বলল, ‘আমি আপনাকে একবার জড়িয়ে ধরব, আম্মা?’
ফরিনা কিছু বলতে পারলেন না। এই মেয়েটা এত ভালো কেন? তিনি পদ্মজার চোখের দিকে তাকাতেই অনুভব করলেন, কয়েক বছরের লুকোনো ক্ষত জ্বলে উঠছে। ক্ষতরা পদ্মজার সামনে উন্মোচন হতে চাইছে। কোনোভাবে কী যন্ত্রণাদায়ক এই ক্ষত সারাতে পারবে পদ্মজা? ভরসা করা যায়? পদ্মজার মায়ামাখা দুটি চোখ দেখে বুকে এমন তোলপাড় শুরু হলো কেন? বত্রিশ বছর আগের সেই কালো রাত্রির কথা কেন মনে পড়ে গেল? যে কালো রাত্রির জন্য আজও এই সংসার, এই বাড়িকে তিনি আপন ভাবতে পারেন না। প্রতিটি মানুষের সঙ্গে বাজে ব্যবহার করেন। সেই যন্ত্রণা কেন বুক খুঁড়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে?
উত্তরের আশায় না থেকে পদ্মজা জড়িয়ে ধরল ফরিনাকে। ফরিনা মৃদু কেঁপে উঠলেন। নিজেকে ধাতস্থ করে নিয়ে পদ্মজার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। পদ্মজা ফরিনার বুকে মাথা রাখতেই টের পেল, ফরিনার বুক ধুকধুক করছে।
.
হাওলাদার বাড়ি থেকে ডানে, দুই মিনিট হাঁটার পর ঝাওড়া নামের একটি খালের দেখা পাওয়া যায়। খালের পাড়ে দাঁড়িয়ে আছে হাওলাদার বাড়ির সবাই। ট্রলার নিয়ে মাঝি অপেক্ষা করছে। ট্রলারটি হাওলাদার বাড়ির। পদ্মজার পরনে কালো বোরকা। লাবণ্য যাবে না। সকাল থেকে তার ডায়রিয়া শুরু হয়েছে। তিন-চার দিন পর আলমগীর ঢাকা নিয়ে যাবে। আজ আমির আর পদ্মজা যাচ্ছে। প্রেমা, প্রান্ত, মোর্শেদ, বাসন্তী সবাই সকালেই এসেছে। সবার সঙ্গে কথা হয়েছে। পূর্ণা হেঁচকি তুলে কাঁদছে। হেমলতা পদ্মজার দুই হাত মুঠোয় নিয়ে চুমু দিয়ে বললেন, ‘ঠিক মতো পড়বি, খাবি। স্বামীর খেয়াল রাখবি। কাঁদবি না কিন্তু। একদম কাঁদবি না।’
তুমি কাঁদছো কেন, আম্মা?’
‘না, না, কাঁদছি না,’ বলেও হেমলতা কেঁদে ফেললেন। পদ্মজার কান্নার বেগ বেড়ে যায়। বোরকা ভিজে একাকার। একদিকে মা অন্যদিকে তিন ভাই-বোন কেঁদেই চলেছে। হেমলতা নিজেকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছেন, পারছেন না। পদ্মজা বলল, ‘আর কেঁদো না, আম্মা। তুমি অসুস্থ।’
হেমলতা কান্না আটকাতে ঢোক গিলেন। বললেন, ‘কাঁদব না। সাবধানে যাবি। দেরি হচ্ছে তো। আমির, নিয়ে যাও আমার মেয়েকে। যা, মা, সাবধানে যাবি। নিয়মিত নামাজ পড়বি।’
পদ্মজা হেমলতার পা ছুঁয়ে সালাম করল। পদ্মজার দেখাদেখি আমিরও করল। বাড়ির সব গুরুজনদের সালাম করে ট্রলারে পা রাখতেই হেমলতার কণ্ঠে উচ্চারিত শব্দমালা ভেসে আসে, ‘আমার প্রতিটা কথা মনে রাখবি। কখনো ভুলবি না। আমার মেয়ে যেন অন্য সবার চেয়ে গুণেও আলাদা হয়। শিক্ষায় কালি যেন না লাগে।’
পদ্মজা ফিরে চেয়ে বলল, ‘ভুলব না, আম্মা। কখনো না। তুমি চোখের জল মোছ। আমাদের আবার দেখা হবে।’
হেমলতা তৃতীয় বারের মতো চোখের জল মুছে হাত নেড়ে বিদায় জানান। ট্রলারের ইঞ্জিন চালু হয়।
মা-মেয়ে একে অপরের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল।
দুজনের চোখ বেয়ে অঝোর ধারায় বর্ষণ হচ্ছে।
.
কাঁদছেন মোর্শেদ। তবে পদ্মজার জন্য কম, হেমলতার জন্য বেশি। হেমলতার দিনগুলো এখন আরো দুর্বিষহ হয়ে উঠবে। কাঁদছেন ফরিনাও। প্রতিদিন বাড়িজুড়ে একটা সুন্দর মুখ, সুন্দর মনের জীবন্ত পুতুল মাথায় ঘোমটা দিয়ে আর হেঁটে বেড়াবে না। আবারও মরে যাবে তার দিনগুলো। হারিয়ে যাবে সাদা-কালোর ভিড়ে।
মাদিনী নদীর ঠান্ডা আর্দ্রতা বাতাসে মিশে ছুঁয়ে দিচ্ছে পদ্মজার মুখ। চোখের জল শুকাতে শুকাতে আবার ভিজে যাচ্ছে। আমির পদ্মজার কোমর এক হাতে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘এবার তো থামো।’
আমিরের আলতো ছোঁয়ায় পদ্মজা আরো আবেগী হয়ে উঠল। আমির বলল, ‘এ তো আরো বেড়ে গেছে! থামো না। আমি আছি তো। আমরা ছয় মাস পর পর আসব। অনেকদিন থেকে যাব।’
‘সত্যি তো? কাজের বাহানা দেখাবেন না?’
‘মোটেও না।’ আমির পদ্মজার চোখের জল মুছে দিল। চোখের পাতায় চুমু খেল। পদ্মজা নুয়ে যায়। বলল, ‘নদীর পাড় থেকে কেউ দেখবে।
‘কেউ দেখবে, কেউ দেখবে, কেউ দেখবে! এই কথাটা ছাড়া আর কোনো কথা পারে আমার বউ?’
পদ্মজা আমিরের দিকে একবার তাকাল। চোখের দৃষ্টি সরিয়ে বলল, ‘আমরা ট্রলার দিয়ে ঢাকা যাব?’
‘সেটা সম্ভব না। কিছুক্ষণ পরই ট্রেনে উঠে যাব। ‘
আমির পদ্মজার গাল ছোঁয়ার জন্য হাত বাড়াতেই, আমিরকে হতবাক করে দিয়ে পদ্মজা ট্রলারের ভেতর ঢুকে গেল।
পদ্মজা – ৪৫
ট্রেনের বগি দিয়ে হেঁটে সামনে এগোচ্ছে আমির। তার এক হাতে লাগেজ অন্য হাতে পদ্মজার হাত। শক্ত করে ধরে রেখেছে যেন ছেড়ে দিলেই হারিয়ে যাবে। পদ্মজার মুখ নিকাবের আড়ালে ঢেকে রাখা। সে এদিক-ওদিক তাকিয়ে আমিরকে প্রশ্ন করল, ‘খালি সিট রেখে আমরা কোথায় যাচ্ছি?’
‘কেবিনে।’
ততক্ষণে দুজন ৭৬ নম্বর কেবিনের সামনে চলে এসেছে। আমির দরজা ঠেলে পদ্মজাকে নিয়ে ঢুকল। চারটা বার্থ। চারজনের কেবিন বোঝাই যাচ্ছে। পদ্মজা বলল, ‘বাকি দুজন কখন আসবে? ট্রেন তো ছেড়ে দিচ্ছে।’
‘চার বার্থই আমাদের।’
পদ্মজা ডান পাশের বার্থে বসতে বসতে বলল, ‘অনেক খরচ করেছেন।’
আমির লাগেজ জায়গা মতো রেখে পদ্মজার পাশে বসল। বলল, ‘নিকাব খোলো এবার। কেউ আসছে না।’
পদ্মজা নিকাব খুলল। ঝমঝম শব্দ তুলে ট্রেন যাত্রা শুরু করেছে। আমির জানালা খুলে দিতেই পদ্মজার চুল তিরতির করে উড়তে থাকল। পদ্মজা দ্রুত দুই হাত মুখের সামনে ধরে, বাতাস থেকে রক্ষা পাওয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করে। আমির বাঁ-পাশের বার্থে বসে হাসল। বলল, ‘হাত সরাও। বউকে একটু দেখি।’
পদ্মজা দুই হাত সরাল। ঠোঁটে বাঁকা হাসি। চোখ ছোটো ছোটো করে তাকিয়ে আছে। চুল অবাধ্য হয়ে উড়ছে। আমির এক হাতের উপর থুতনির ভর দিয়ে বলল, ‘এই হাসির জন্য দুনিয়া এফোঁড়ওফোঁড় করতে রাজি।’
পদ্মজা দাঁত বের করে হাসল, লজ্জায় নামিয়ে নিলো চোখ। আমির পদ্মজার পাশে বসে খোঁপা করে দিল। বলল, ‘এবার বোরকাটাও খুলে ফেল! গরম লাগছে না?’
পদ্মজা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাল। আমির বলল, ‘কেউ আসবে না। পৌঁছাতে বিকেল হবে। নিশ্চিন্তে শুধু বোরকা খুলতে পারো। আর কিছু খুলতে হবে না।’
পদ্মজার কান রি রি করে উঠে। আমিরের উরুতে কিল দিয়ে বলল, ‘ছি, আপনি যা তা!’
আমির উচ্চস্বরে হেসে ওঠে। পদ্মজা ভ্রুকুটি করে বোরকা খুলে জানালার ধারে বসে বলল, ‘আমরা যে বাড়িতে যাচ্ছি সেখানে কে কে থাকে?’
‘একজন দারোয়ান আর একজন বুয়া আছে।
‘উনারা বিশ্বস্ত?’
‘নয়তো রেখে এসেছি?’
পদ্মজা কিছু বলল না। আমির পদ্মজার পাশ ঘেঁষে বসল। পদ্মজার কানের দুলে টোকা দিয়ে জড়িয়ে ধরল কোমর। পদ্মজা মেরুদণ্ড সোজা করে বসে। শীতল একটা অনুভূতি সর্বাঙ্গে ছড়িয়ে পড়ে। চোখ বুজে স্বভাববশত বলে উঠে, ‘কেউ দেখবে!’
আমির ভ্রুকুঞ্চন করে চোখ তুলে তাকাল। পদ্মজা বুঝতে পারে, সে ভুল শব্দ উচ্চারণ করে ফেলেছে। জিহ্বা কামড়ে আড়চোখে আমিরকে দেখে হাসার চেষ্টা করল। আমির বেশ অনেকক্ষণ তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে রইল পদ্মজার দিকে।
এরপর আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে, পদ্মজার ঘাড়ে নাক ডুবিয়ে বলল, ‘দেখুক। যার ইচ্ছে দেখুক।’
.
দরজায় টোকা দিচ্ছে কেউ। শব্দে পদ্মজার ঘুম ছুটে গেল। ধড়ফড়িয়ে উঠে বসল সে। কখন ঘুমিয়ে পড়েছিল, মনে পড়ছে না। আমিরের কোলে তার মাথা ছিল। মানুষটা এতক্ষণ বসে ছিল তাহলে? পদ্মজাকে এভাবে উঠতে দেখে আমির ইশারায় শান্ত হতে বলে। পদ্মজা দ্রুত নিকাব পরে নেয়। আমির গিয়ে দরজা খুলল। ঝালমুড়ি নিয়ে একজন লম্বা লোক দাঁড়িয়ে আছে, নাকটা মুখের তুলনায় একটু বেশি লম্বা। আমির বলল, ‘এভাবে অনুমতি না নিয়ে টোকা দেয়া অভদ্রতা। আমাদের দরকার পরলে আপনাদের এমনিতেই খুঁজে নিতাম। আর এমন করবেন না। আপনার জন্য আমার বউয়ের ঘুম ভেঙে গেছে। নিন টাকা। ঝালমুড়ি দেন।’
লোকটি বেশ আনন্দ নিয়ে ঝালমুড়ি বানিয়ে দিল। বোধহয় আর বিক্রি হয়নি। হতে পারে আমিরই প্রথম খরিদ্দার। লোকটি চলে গেল। আমির কেবিনে ঢুকে দরজা বন্ধ করে পদ্মজাকে বলল, ‘একজন লোক ঝালমুড়ি বিক্রি করতে এসেছিল। এই নাও খাও। এরপর আবার ঘুমাও।’
দুজনে একসঙ্গে ঝালমুড়ি খেতে খেতে সুখ-দুঃখের গল্প শুরু করে। আমির তার শহুরে জীবনের গতিবিধি বলছে: কখন কখন বাসায় থাকে, কীভাবে ব্যবসায় সময় দেয়। পদ্মজা মন দিয়ে শুনছে। একসময় পদ্মজা বলল, ‘একটা কথা জানার ছিল।’
‘কী কথা?’
‘আমার মনে হচ্ছে, আপনাদের বাড়িতে লুকোনো কোনো ব্যাপার আছে। শুধু মনে হচ্ছে না, একদম নিশ্চিত আমি।’
আমির উৎসুক হয়ে ঝুঁকে বসল। আগ্রহভরে জানতে চাইল, ‘কীরকম?’
পদ্মজা আরো এগিয়ে আসে। আকাশে দুপুরের কড়া রোদ। ছলাৎ করে রোদের ঝিলিক জানালায় গলে কেবিনে ঢুকে আবার হারিয়ে যাচ্ছে। বাতাস ভ্যাপসা গরম, মাঝে মাঝে শীতল, ঠান্ডাও। সেসব উপেক্ষা করে পদ্মজা তার ভেতরের সন্দেহগুলো বলতে শুরু করল, ‘আমি নিশ্চিত, রুম্পা ভাবিকে বন্দি করে রাখা হয়েছে। কেন বন্দি করে রাখা হয়েছে সেটা দাদু জানেন। উনি সবসময় রুম্পা ভাবির ঘরের দরজায় নজর রাখেন। আমি অনেকবার ঢুকতে চেয়েছি, পারিনি। বাড়ির পেছনের জঙ্গলে কিছু একটা আছে। সেটা ভূত- জিন জাতীয় কিছু না, অন্যকিছু। এমনটা মনে হওয়ার তেমন কারণ নেই। আমার অকারণেই মনে হয়েছে, জঙ্গলটা আপনাআপনি সৃষ্টি হয়নি আর ভয়ংকরও হয়নি। কেউ বা কারা এই জঙ্গলটিকে যত্ন করে তৈরি করেছে। ভয়ংকর করে সাজিয়েছে। এছাড়া, বাড়ির সবাইকে আমার সন্দেহ হয়। এ ব্যাপারে আপনি কী বলেন?’
আমির একটুও অবাক হলো না, মুখের প্রকাশভঙ্গী পালটাল না। সে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, ‘আমি জানি এসব।’
পদ্মজা আমিরের দুই হাত খামচে ধরে এক নিশ্বাসে বলল, ‘আমাকে বলুন। অনুরোধ লাগে, বলুন। আমি শুনতে চাই। অনেকদিন ধরে নিজের ভেতর পুষে রেখেছি।’
আমির অসহায় দৃষ্টিতে তাকাল। বলল, ‘আমার ধারণাও তোমার ধারণা অবধিই সীমাবদ্ধ। এর বাইরে কিছু জানি না। এই রহস্য খুঁজে বের করার ইচ্ছে হওয়া সত্ত্বেও আমি হজম করেছি। আমার ইচ্ছে মাটিচাপা দিয়েছি।’
আমিরের গলাটা কেমন যেন শোনাল। পদ্মজা কণ্ঠ খাদে নামিয়ে বলল, ‘কেন? কেন দিয়েছেন?’
আমির হাসল। বলল, ‘ধুর! এখন এসব গল্প করার সময়? শুনো, এরপর কী করব…
পদ্মজা কথার মাঝে আটকে দিয়ে সঙ্গে সঙ্গে বলল, ‘কথা ঘোরাবেন না। আমি খেয়াল করেছি হাওলাদার বাড়ির প্রতি আপনি উদাসীন। কোনো ব্যাপার পাত্তা দেন না। সবসময় বাড়ির চেয়ে দূরে দূরে থাকেন। কোনো ঘটনায় নিজেকে জড়ান না। কেন নিজেকে গুটিয়ে রাখেন?’
আমিরের দৃষ্টি অস্থির। সে এক হাতে বার্থ খামচে ধরার চেষ্টা করে ঘন ঘন শ্বাস নেয়। পদ্মজা খুব অবাক হয়! আমিরের এত কষ্ট হচ্ছে কেন?
পদ্মজার উৎকণ্ঠা, ‘কী হলো আপনার? কোথায় কষ্ট হচ্ছে?’
‘না! কিছু হয়নি।’ বলেই আবার অদ্ভুতভাবে ডাকল, ‘পদ্মবতী?’
আমির চট করে পদ্মজার দুই হাত শক্ত করে ধরল। তার চোখ দুটিতে ভয়। পদ্মজা আমিরের চোখের দিকে তাকাল। আমির বলল, ‘আমার তোমাকে অনেক কিছু বলার আছে। অনেকবার বলতে গিয়েও পারিনি। আজ যখন কথা উঠেছে…আচ্ছা পদ্মজা, আমার পরিচয় জেনে আমাকে ছেড়ে যাবে না তো? আমি তোমাকে হারালে একাকীত্বে ধুঁকে ধুঁকে নিঃশেষ হয়ে যাব। আমার জীবনের একমাত্র সুখের আলো তুমি।’
পদ্মজার হৃৎপিণ্ড থমকে গেল। সে পরিস্থিতি বুঝে উঠতে পারছে না। আমির উত্তরের আশায় চাতক পাখির মতো তাকিয়ে আছে। পদ্মজা ধীর কণ্ঠে বলল, ‘লুকোনো সব কথা বলুন আমাকে। আপনি আমার স্বামী। আপনাকে ছেড়ে যাওয়ার কথা কখনো ভাবি না আমি। বিশ্বাস করুন!’
আমির নতজানু হয়ে বলল, ‘আমি আমার আব্বার অবৈধ সন্তান। আমার জন্মদাত্রী জন্ম দিয়েই মারা যায়। দিয়ে যায় অভিশপ্ত জীবন।’
পদ্মজা দুই পা কেঁপে উঠে। মাথা ভনভন করে উঠে। শিরদাঁড়া বেয়ে গড়িয়ে যায় ঠান্ডা স্রোত। আমির ঢোক গিলে আবার বলল, ‘আমার জন্মদাত্রী মারা যাওয়ার পর আব্বা আমাকে নিয়ে আসেন। আমার বর্তমান আম্মা আমাকে দেখে খুব রেগে যায়। কিছুতেই আমাকে মানতে চায়নি। তখন ছেলেমেয়ে ছিল না আম্মার। তাই মাস ঘুরাতেই আমাকে মেনে নিলো। ছেলের মতো আদর শুরু করল। এসব দাদুর মুখে পরে শুনেছি। আব্বা আমাকে তুলে এনে জায়গা দিলেও সন্তানের মতো ভালোবাসেননি কখনো। যখন আমার এগারো বছর আমি আর রিদওয়ান একসঙ্গে জানতে পারি, আমি আব্বার অবৈধ সন্তান। আব্বা আবার রিদওয়ানকে খুব আদর করতেন। রিদওয়ান ছোটো থেকেই আমার সঙ্গে ঝামেলা করত, ঝগড়া করত। যখন এমন একটা নোংরা খবর জানতে পারল, তখন ও আরো হিংস্র হয়ে ওঠে। আমি তখন অনেক শুকনো আর রোগা ছিলাম। রিদওয়ান ছিল স্বাস্থ্যবান, তেজি। আব্বার এমন ছেলেই পছন্দ। কেন পছন্দ জানা নেই। উনিশ থেকে বিশ হলেই রিদওয়ান খুব মারত। আব্বার কাছে বিচার দিলে রিদওয়ান আরো দশটা বানিয়ে বলত। তখন আব্বা আমাকে মারতেন।
‘রিদওয়ান একবার আমাকে জঙ্গলে বেঁধে ফেলে রেখেছিল। দেড় দিন পড়ে ছিলাম। রাতে ভয়ে প্যান্টে প্রস্রাব করে দিয়েছি। মুখ বাঁধা ছিল, তাই এত চিত্কার করেছি তবুও কেউ শুনেনি। ভয়ে বুক কাঁপছিল। মনের ভয়ের কারণে কল্পনায় ভয়ংকর ভূত, দানব দেখছিলাম। বাঁচানোর মতো কেউ ছিল না। আমাদের বাড়িতে কাজ করতেন ফকির মিয়া নামে একজন। দেড় দিনের দিন উনি আমাকে জঙ্গলে বাঁধা অবস্থায় পান। বাড়িতে বৈঠক বসে। রিদওয়ানকে দুটো বেতের বাড়ি দিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়। রিদওয়ান এক তো বলিষ্ঠবান তার উপর আমার দুই বছরের বড়ো। কিছুতেই পেরে উঠতাম না। জানো পদ্মবতী, ও…ও পানিতে আমার মাথা জোর করে চেপে ধরে রেখেছে অনেকবার। ও মানসিকভাবে বিকৃত, পশু। ওর জন্য আমার জীবন জাহান্নাম হয়ে ওঠে। আম্মাকে বললেও আম্মা বাঁচাতে পারতেন না। সবসময় নিশ্চুপ থাকতেন। যখন আমার পনেরো বছর বয়স, তখন এক শীতের রাতে পালানোর চেষ্টা করি; শীতে কাঁপতে কাঁপতে খেতে অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাই। পরেরদিন চোখ খুলে দেখি, আমি হাওলাদার বাড়িতে। আমার সামনে রিদওয়ান, আব্বা, চাচা, আম্মা সবাই। বুঝতে পারি, আমার আর কোনো জায়গা নেই। এখানেই থাকতে হবে। যতই কষ্ট হোক থাকতে হবে। এছাড়া উপায় নেই।’
আমিরের কণ্ঠে স্পষ্ট কান্না। চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ল। পদ্মজা হেঁচকি তুলে কাঁদছে। আমির অশ্রুসজল চোখ মেলে পদ্মজার দিকে তাকাল। হেসে পদ্মজার দুই চোখের জল মুছে দিয়ে বলল, ‘আরে পাগলি! কাঁদছো কেন? এসব তো পুরনো কথা। আমার পড়াশোনাটা আবার চলছিল ভালোই। আমি ভালো ছাত্র ছিলাম। এ দিক দিয়ে বুদ্ধিমান ছিলাম। সবসময় ভালো ফলাফল ছিল। এজন্য কদর একটু হলেও পেতাম। যখন আমার আঠারো বয়স বাড়িতে অস্বাভাবিক কিছু অনুভব করি। রাত করে অদ্ভুত কিছুর শব্দ শুনি। জঙ্গলে আলো দেখতে পাই। চাচাকে প্রায় রাতে জঙ্গলে যেতে দেখি। রিদওয়ান আর চাচা মিলে কিছু একটা নিয়ে সবসময় আলাপ করত। ওদের চোখেমুখে থাকত লুকোচুরি খেলা। আমি একদিন রাতে চাচাকে অনুসরণ করি। প্রায় দশ মিনিট হাঁটার পর চাচা দেখে ফেলে। এই ভুলের জন্য সেদিন কম মার খেতে হয়নি! তবুও বেহায়ার মতো কয়দিন পর আবার অনুসরণ করি। রিদওয়ান পেছনে ছিল দেখিনি।
‘আব্বা সেদিন অনেক মারলেন। দা পর্যন্ত ছুঁড়ে মারেন। এই যে থুতনির দাগটা, এটা সেই দায়ের আঘাত। একসময় আব্বা আমাকে নিয়ে আলোচনায় বসলেন। বললেন, আমাকে পড়ালেখার জন্য শহরে পাঠাবেন কোনো ব্যাবসা করতে চাইলে তারও সুযোগ করে দিবেন। আমি এই বাড়ি আর বাড়ির আশপাশ নিয়ে মাথা না ঘামাই। আমি মেনে নিই। রিদওয়ানের সঙ্গে থাকতে হবে না আর। এর চেয়ে আনন্দের কী আছে?
চলে আসি ঢাকা। শুরু হয় নিজের জায়গা শক্ত করার যুদ্ধ। এখানে এসেও অনেক অপমান সহ্য করতে হয়। তবুও থেমে যাইনি। যুদ্ধ করে চলেছি। আমাকে বাঁচতে হবে। মানুষের মতো বাঁচতে হবে। কারো লাথি খেয়ে না। যখন আমার তেইশ বছর, তখন থেকে আমার কদর বেড়ে যায়। ব্যবসায় মোটামুটি সফল হয়ে যাই। ভাগ্য ভালো ছিল আমার। অতিরিক্ত পরিশ্রম আমাকে নিরাশ করেনি। তখন আব্বা আমার প্রশংসায় পঞ্চমুখ রিদওয়ান আগের মতো হাত তোলার সাহস পায় না। সেই আমি আজ এই জায়গায়। এখন আমার যে অবস্থান, হাওলাদার বাড়ির কারোর সাহস নেই আমার চোখের দিকে তাকানোর। আমি চাইলেই শোধ নিতে পারি। কিন্তু নেব না। তারা থাকুক তাদের মতো। রিদওয়ান ছোটোবেলা যা করেছে, মেনে নিয়েছি। এখন তোমার দিকেও নজর দিয়েছে। ওর নজর আমার বাড়িগাড়ি, অফিস-গোডাউনেও আছে। আমি টের পাই, ও পারলে আমাকে খুন করে ফেলত। কিন্তু পারে না। আমার ক্ষমতার ধারেকাছেও ওর জায়গা নেই। এখন আমার নিজের এক বিশাল রাজত্ব আছে, আছে অহংকার করার মতো অনেক কিছু। হাওলাদার বাড়ির কেউ কেউ মিলে আমাকে নিয়ে কোনো পরিকল্পনা করছে, আমি নিশ্চিত। তাই বাড়িতে আমি থাকতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি না। আম্মা ছাড়া ওই বাড়ির সবার ভালোবাসা মুখোশ মাত্র। আমার দরকার ছিল একজন ভালো মনের সঙ্গিনী। আমি পেয়ে গেছি, আর কিছু দরকার নেই। আমি আমার অর্ধাঙ্গিনীকে তার আসল সংসারে নিয়ে যাচ্ছি। এখন আমার মন শান্ত। কোনো চিন্তা নেই। নিজেকে খুব বেশি সুখী মনে হচ্ছে।’
আমির পদ্মজার হাতে চুমু খেল। পদ্মজা তখনো কাঁদছে। সে আচমকা আমিরকে গভীরভাবে, শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ভেজা কণ্ঠে বলল, ‘আমি কখনো আপনাকে কষ্ট দেব না। কোনোদিন না। কেউ আপনাকে ছুঁতে আসলে আমি তার গর্দান নেব। আমি উন্মাদ হয়ে তাকে ছিঁড়ে কুটিকুটি করব।’
‘এখন আর কারো সেই ক্ষমতা নেই। মিছেমিছি ভয় পাচ্ছো।’
পদ্মজা আরো শক্ত করে তাকে ধরার চেষ্টা করে। আমির পদ্মজার পিঠে হাত বুলিয়ে বলল, ‘এই প্রথম আমার বউয়ের গভীর আলিঙ্গন পেলাম। ভালো লাগছে। ছেড়ো না কিন্তু!’
.
রেল স্টেশনের প্লাটফর্মে হাঁটছে ওরা। আমির পদ্মজার এক হাত ধরে রেখে খুব দ্রুত হাঁটছে। পদ্মজা তাল মেলাতে পারছে না, চেষ্টা করছে যদিও। মোটরগাড়ি নিয়ে একজন কালো চশমা পরা লোক অপেক্ষা করছিল। তার সামনে থামল আমির। লোকটা সালাম দিয়ে গাড়ির দরজা খুলে দিয়ে ব্যাগ জায়গামতো রাখল। আমির আগে উঠতে বলল পদ্মজাকে। পদ্মজা অবাক হলো। এরকম গাড়ির সঙ্গে সরাসরি পরিচয় নেই তার। কিন্তু প্রকাশ করল না। আমিরের কথামতো গাড়িতে উঠে বসল সে, তারপর উঠল আমির গাড়ি চলতে শুরু করে। আমির পদ্মজাকে এক হাতে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘আমাদের নিজস্ব গাড়ি। দুজনে রাত-বিরাতে যখন-তখন ঘুরতে বের হব।’
পদ্মজা কিছু বলল না। সে উপভোগ করছে নতুন জীবন। ঘণ্টাখানেকের মধ্যে গাড়ি একটা বাড়ির সামনে থামল। কালো চশমা পরা লোকটি দ্রুত গাড়ি থেকে নেমে খুলে দিল আমিরের ডান পাশের দরজা। পদ্মজাকে নিয়ে নামল আমির।
বাড়ি দেখে তো পদ্মজা মুগ্ধ! ডুপ্লেক্স বাড়ি। একজন দারোয়ান দৌড়ে এসে সালাম দিল, পরিচিত হলো পদ্মজার সঙ্গে। এরপর এলো একজন মধ্যবয়স্ক নারী। সে বোধহয় বাড়ির কাজের লোক। সবাই একসঙ্গে বাড়ির ভেতর ঢুকল। পদ্মজা তার নতুন বাড়ি মন দিয়ে দেখছে। পূর্ব দিক থেকে সদর দরজা দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করতেই দেখতে পেল বিশাল বৈঠকখানা উত্তর দক্ষিণে লম্বা। দক্ষিণ পাশে বারান্দা তাতে নানা ধরনের ফুল ফুটে আছে টবের মধ্যে, মনে হচ্ছে একটা ছোটোখাটো বাগান। বৈঠকখানার দক্ষিণ পশ্চিম কোনার দিকে বেশ বড়ো শোবার ঘর। পদ্মজা প্রশ্ন করার আগে আমির বলল, ‘না, এটা আমাদের ঘর না।’
উত্তর পশ্চিম কোনার দিকে রান্নাঘর এবং টয়লেট। আর এই দুয়ের মাঝে মানে বৈঠকখানার পশ্চিম দিকের মাঝখানটায় খাওয়ারঘর। বৈঠকখানার মাথার ওপর দিকে তাকালে সেখানে ঝুলতে থাকা সোনালি রঙের ঝাড়বাতি দেখা যায়। বৈঠকখানার উত্তর দিকে একটা সিড়ি সাপের মতো পেঁচিয়ে ওপরে উঠে গেছে। আমির পদ্মজাকে নিয়ে সেদিকে এগোল। সিঁড়ি পেরুনোর পর হাতের বাঁ দিকে অনেক বড়ো একটা শোবার ঘর। দামি দামি জিনিসে সৌন্দর্য আকাশছোঁয়া। দুজন একসঙ্গে শোবার ঘরটিতে প্রবেশ করল। পদ্মজা চোখ ঘুরিয়ে সবকিছু দেখছে। আমির বলল, ‘গোসল করে নাও?’
পদ্মজা বোরকা খুলে কলপাড় খুঁজতে থাকল। আমির গোসলখানার দরজা খুলে দিয়ে বলল, ‘এই যে এদিকে ‘
দুজন একসঙ্গে ফ্রেশ হয়ে ঘর থেকে বের হয়। পদ্মজা দুই তলাটা আরেকটু দেখার জন্য ডানদিকে মোড় নিলো। প্রথমে চোখে পড়ল বড়ো ব্যালকনি। এরপর আরেকটা শোবার ঘর। ব্যালকনিতে লতাপাতার ছোটো ছোটো টব।
বিরাট অট্টালিকায় সুখে কেটে গেল পাঁচ মাস। লাবণ্য দেশ ছেড়েছে দুই মাস হলো। মাস তিনেক হলো বুয়াও কাজ ছেড়ে দিয়েছে। পদ্মজা আর কাজের লোক নিতে দিল না, সে এক হাতেই নাকি সব পারবে। তবুও আমির একটা বারো বছর বয়সি মেয়ে রেখেছে সাহায্যের জন্য। ভোরের নামাজ পরে রান্নাবান্না করে পদ্মজা। এরপর শাড়ি পালটে নেয় কলেজে যাওয়ার জন্য। আমিরকে ব্লেজার, টাই পরতে সাহায্য করে। প্রথম যেদিন আমিরকে ব্লেজার পরতে দেখেছিল সেদিন অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করেছিল, ‘এই পোশাকের নাম কী? আপনাকে খুব বেশি সুন্দর দেখাচ্ছে।’
আমির হেসে জবাব দিয়েছিল, ‘ব্লেজার। বাইরে থেকে আনা।’
এমন অনেক কিছুই পদ্মজার অজানা ছিল। সবকিছু এখন তার চেনাজানা। এই বিলাসবহুল জীবন বেশ ভালো করেই উপভোগ করছে। মানুষটা সারাদিন ব্যস্ত থাকে। তবুও ফাঁকেফাঁকে টেলিফোনে যোগাযোগ করে। পদ্মজাকে নিয়ে গোডাউন দেখিয়েছে, অফিস দেখিয়েছে। সবকিছু সাজানো, গোছানো। গোডাউনে বিভিন্ন ধরনের পণ্য। কত কত রকমের দ্রব্য। পদ্মজা জীবনে ভালোবাসা এবং অর্থ—দুটোই চাওয়ার চেয়েও বেশি পেয়েছে।
সকাল নয়টা বাজে। আমির তাড়াহুড়ো করছে, তার নাকি আজ দরকারি মিটিং আছে। পদ্মজা শাড়ির আঁচল কোমরে গুঁজে দৌড়ে দৌড়ে খাবার পরিবেশন করছে। আমির দুই তলা থেকে নেমেই বলল, ‘আমি গিয়ে গাড়ি পাঠিয়ে দিচ্ছি। কলেজ চলে যেয়ো।’
‘আরে, খেয়ে যাবেন তো।’
‘সময় নেই। আসছি।’
‘খেয়ে যান না।’
‘বলছি তো তাড়া আছে। জোরাজুরি করছো কেন?’
আমির দ্রুত বেরিয়ে যায়। পিছু ডাকতে নেই, তাই পদ্মজা ডাকল না। মনাকে ডেকে বলল, ‘খেয়ে নাও তুমি।’
মনা পদ্মজার সাহায্যকারী। পদ্মজার ছোটোখাটো ফরমায়েশ পালন করে। পদ্মজা বৈঠকখানায় গিয়ে বসল। আজ কলেজে যেতে ইচ্ছা করছে না। ভোরে একটা খারাপ স্বপ্ন দেখেছে। মায়ের কথা মনে পড়ছে খুব। বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে। ঝুম বৃষ্টি, অকারণে বিষণ্নতায় ছেয়ে আছে মন। অকারণেও না বোধহয়! আমির বিরক্ত হয়ে কথা বলেছে, এজন্যই বোধহয় মনের আকাশে বৃষ্টি নেমেছে। পদ্মজা পুরোটা দিন উপন্যাস পড়ে কাটিয়ে দিল। সন্ধ্যার আগ মুহূর্তে কলিং বেল বেজে ওঠে। দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলে দিল পদ্মজা। আমির দাঁড়িয়ে আছে। বাইরে বাতাস হচ্ছে। পদ্মজা বলল, ‘আসুন।’
আমির ভেতরে ঢুকল না। সে ঠায় দাঁড়িয়ে থেকে পদ্মজার দিকে তাকিয়ে আছে। পদ্মজা কপাল কুঁচকাল, ‘কী হলো? আসুন।’
আমির চট করে পদ্মজাকে কোলে তুলে নিলো। পদ্মজা চেঁচিয়ে উঠে বলল, ‘কেউ দেখবে।’
আমির মনাকে ডাকল, ‘মনা? কই রে? দেখে যা।’
‘আপনি ওকে ডাকছেন কেন?’
‘এবার কাউকে দেখাবই।
‘উফফ! ছাড়ুন।’
‘মনা? মনা?’
মনা দুই তলা থেকে নেমে আসে। আমির মনাকে নামতে দেখে বলল, ‘এই দেখ তোর আপাকে কোলে নিয়েছি। দাঁড়া, তোর সামনে একটু আদর করি।’
পদ্মজা শাড়ির আঁচল দিয়ে মুখ ঢেকে চাপাস্বরে বলল, ‘মনা কী ভাববে! আমি আর বলব না, কেউ দেখবে। এবার ছেড়ে দিন।’
আমির পদ্মজাকে নামিয়ে দিল। মনা কাঁচুমাচু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সে কী করবে বুঝতে পারছে না। আমির বলল, ‘যা ঘরে যা।’
মনা এইটা শোনার অপেক্ষায় ছিল। সে দৌড়ে চলে যায়। পদ্মজা হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। আমিরকে গুরুজনদের মতো বলল, ‘আক্কেলজ্ঞান কখন হবে আপনার? বয়স তো কম হলো না।’
অবিকল পদ্মজার কথার ধরণ অনুসরণ করে আমির বলল, ‘আর কতদিন কেউ দেখবে কথাটা মুখে থাকবে? বিয়ের তো কম দিন হলো না।’
‘আপনি…আপনি কালাচাঁদ না কালামহিষ।’
‘এটা পূৰ্ণা বলত না? হেহ, আমি মোটেও কালো না।’
‘তো কী? এই যে দেখুন, দেখুন…আমার হাত আর আপনার হাত।’
পদ্মজা হাত বাড়িয়ে দেখায়। আমির খপ করে পদ্মজার হাত ধরে চুমু খেয়ে বলল, ‘এই হাতও আমার।’
পদ্মজা বলল, ‘ঠেসে ধরা ছাড়া আর কী পারেন আপনি? ছাড়ুন।’
আমির পদ্মজার হাত ছেড়ে দিয়ে হাসতে থাকল।
৪৬
দেখতে দেখতে চলে এসেছে শীতকাল। সকাল বাজে দশটা তবুও কুয়াশার চাদরে চারিদিক ঢাকা। ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে আছে পদ্মজা। মনটা কু গাইছে। অজানা একটা ঝড় বইছে বুকে, স্থির হয়ে কোথাও দাঁড়াতে পারছে না। ঢাকা আসার পর থেকে নিয়মিত পূর্ণার লেখা চিঠি পেত। প্রায় চার মাস হলো বাড়ি থেকে কোনো চিঠি আসছে না। পদ্মজা নয়টা চিঠি পাঠিয়েছে। একটারও উত্তর আসেনি। বাড়ির সবার কথা খুব মনে পড়ছে। ব্যালকনি ছেড়ে ঘরে চলে যায় পদ্মজা। বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই ঘুমের রাজ্যে হারিয়ে যায়। একটা সুন্দর স্বপ্ন দেখে: হাওলাদার বাড়িতে টেলিফোন এনেছে। পূর্ণা হাওলাদার বাড়িতে এসে পদ্মজার সঙ্গে যোগাযোগ করে। পদ্মজা কথা বলতেই ওপাশ থেকে পূর্ণার উল্লাস ভেসে এলো, ‘আপা? আপা আমি তোমার গলার স্বর শুনতে পাচ্ছো। তুমি শুনছো?’
‘শুনছি। কেমন আছিস? আম্মা কেমন আছে? বাড়ির সবাই ভালো আছে?’
‘সবাই ভালো। তুমি কেমন আছো? আমার বিশ্বাস হচ্ছে না তোমার গলা শুনছি!’
‘আচ্ছা, শোন?’
‘বলো আপা।’
‘আশপাশে কেউ আছে?’
‘খালাম্মা আছে।’
‘এই বাড়িতে আর আসবি না। আমি যতদিন না আসব। মনে রাখবি?’
‘কেন? কেন আপা?’
‘মানা করেছি, শুনবি।’
‘আচ্ছা, কিন্তু আমি ভেবেছিলাম এবার প্রতিদিন দুলাভাইয়ের বাড়িতে আসব। আর তোমার সঙ্গে কথা বলব। ধুর!’
‘আবার যখন আসব আমাদের বাড়িতে টেলিফোন নিয়ে আসব। এরপর প্রতিদিন আমাদের কথা হবে। এখন আমার মানা শোন।’
‘টাকা কোথায় পাবে?’
‘সেদিন উনি বলেছেন, নিয়ে আসবেন। আমি মানা করেছিলাম। বললেন, তুমি আনন্দে থাকলেই আমার সুখ। তোমার সুখের জন্যই এখন আমার সব। আর কী বলার?’
‘দুলাভাই খুব ভালো তাই না আপা?’
‘হুম। আম্মার শরীর সত্যি ভালো আছে?’
‘আছে। আগের চেয়ে ভালো।’
‘খেয়াল রাখিস আম্মার।’
‘রাখব।’
বাতাসটা বেড়েছে। পদ্মজার গা কাঁটা দিচ্ছে। আচমকাই ঘুমটা ভেঙে চট করে উঠে বসল সে। হাতের দিকে তাকিয়ে দেখল, টেলিফোন নেই। স্বপ্নে মনে হচ্ছিল সবই বাস্তব! পদ্মজা দেয়াল ঘড়িতে দেখে, এগারোটা বাজে। টেলিফোন পুরো দেশে হাতেগোনা কয়জনের বাসায় আছে। সেখানে গ্রামে টেলিফোনে যোগাযোগ করা যাবে ভাবাও হাস্যকর।
পদ্মজা বিছানা ছেড়ে ড্রয়িংরুমে চলে এলো, কপালে হাত দিয়ে দেখে, গায়ে জ্বর এসেছে। পূর্ণার সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে করছে। সে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। রান্নাঘরে যেতে যেতে ডাকল, ‘মনা?’
হঠাৎ মাথায় এলো, মনা তো বাসায় নেই। দুইদিন আগে বাড়িতে গিয়েছে। খুব একা লাগছে তার। সবকিছুই রান্না করা আছে। আর কী রাঁধবে? এক কাপ চা বানিয়ে খাওয়া যায়। পদ্মজা এক কাপ চা নিয়ে বৈঠকখানার জানালার পাশ ঘেঁষে বসল। গ্রামের সোনালি দিনগুলোর কথা মনে পড়ছে। মোর্শেদ প্রথম যেদিন সোয়েটার কিনে দিয়েছিলেন, সেই দিনটার কথা মনে পড়ছে। সকাল সকাল উঠে খেজুরের রস দিয়ে পিঠা খাওয়া, তিন বোনের একসঙ্গে পড়তে বসা, একসঙ্গে স্কুলে যাওয়া— স্বর্ণময় দিনগুলো কখনো কী আর ফিরবে?
কলিং বেল বেজে উঠল। অসময়ে কলিং বেল শুনে অবাক হলো পদ্মজা। আমির তো এই সময় আসে না। দুই ঘণ্টা আগেই বের হলো। তাহলে কে এসেছে? গায়ে শাল টেনে নিলো সে। এরপর দরজা খুলল। দরজার সামনে আমির দাঁড়িয়ে আছে। পদ্মজা অবাক হয়ে জানতে চাইল, ‘এত দ্রুত?’
‘তৈরি হও, গ্রামে যাব।’
পদ্মজা চোখের পলক ফেলে আবার তাকাল। বলল, ‘গ্রামে মানে অলন্দপুর?’
আমির দরজা লাগিয়ে দিয়ে বলল, ‘হু, দ্রুত যাও। শাড়ি পালটাও।’
পদ্মজার উৎকণ্ঠা, ‘হুট করে যে! কোনো খারাপ খবর?’
আমির হেসে বলল, ‘তেমন কিছুই না। কয়দিন ধরে দেখছি মন খারাপ করে বসে থাকো। তাই হুট করে যাওয়ার কথা ভাবলাম। কলেজে তো শীতের বন্ধ আছেই। আমি এক সপ্তাহর জন্য ম্যানেজারকে সব বুঝিয়ে দিয়েছি। আর আলমগীর ভাইয়া এসেছে। কোনো চিন্তা নেই। এবার দ্রুত যাও। ট্রেন বারোটায়। আজকের শেষ ট্রেন কিন্তু এটাই। আমি তৈরি আছি। শুধু লাগেজে দুই তিনটা শার্ট ঢুকিয়ে নিলেই হবে।’
পদ্মজা আর কিছু বলল না। ছুটে গেল দুই তলায়। তার হৃৎপিণ্ড খুশিতে দামামা বাজাচ্ছে। দশ মিনিটের ব্যবধানে শাড়ি পালটে, লাগেজও গুছিয়ে ফেলল। দুজন বেরিয়ে পড়ে। গন্তব্য অলন্দপুর। দীর্ঘ আট মাস পর জন্মস্থান, জন্মদাত্রী, জন্মদাতা, ভাই-বোন সবাইকে দেখতে পাবে। ভেতরে ভেতরে উত্তেজনা এতটাই কাজ করছে যে, শীতের প্রকোপও টের পাচ্ছে না পদ্মজা।
কেবিনে ঢোকার পর থেকে বার বার এক কথাই বলে চলেছে সে, ‘কতদিন পর যাচ্ছি! আম্মা হুট করে আমাকে দেখে জ্ঞান না হারিয়ে ফেলে! পূর্ণা নিশ্চিত অজ্ঞান হয়ে যাবে।’
আমির হাসল। পদ্মজার এক হাত মুঠোয় নিয়ে বলল, ‘আসো গল্প করি।’
পদ্মজার তাকাল। তার চোখ দুটি হাসছে। চিকমিক করছে। সে প্রশ্ন করল, ‘আলমগীর ভাইয়া আমাদের বাসায় উঠবেন?’
‘না। অফিসেই থাকবে।’
‘রানি আপা ভালো আছে? কিছু বলছে?’
আমির চুল ঠিক করতে করতে ব্যথিত স্বরে বলল, ‘ওর জীবনটা নষ্ট হয়ে গেছে। বাচ্চা নষ্ট করতে দিল না। এরপর মৃত বাচ্চা জন্ম দিল। এখন অবস্থা আরো করুণ। ঘরেই বন্দি।’
‘ইস! খারাপ লাগে ভাবলে। মানুষের কপাল এত খারাপ কী করে হয়! মোড়ল বাড়ির সড়ক দেখা যাচ্ছে। পদ্মজা খুশিতে আত্মহারা। দ্রুত হাঁটছে। সে কখনো বাহারি শাড়ি, বোরকা পরে না। আজ পরেছে। শাড়ি বোরকা দুটোতেই ভারি কাজ, চকচক করা ছোটো-বড়ো পাথর। দেখলে মনে হয় হীরাপান্না চিকচিক করছে। সে তার মাকে দেখাতে চায়, সে কতটা সুখী। কোনো কমতি নেই তার জীবনে। মোড়ল বাড়ির গেট ধাক্কা দিয়ে ভেতরে ঢুকতেই সব আনন্দ, উল্লাস নিভে যায়। পূর্ণা-প্রেমা দাঁড়িয়ে আছে। দুজনকে চেনা যাচ্ছে না। শুকিয়ে কয়লা হয়ে গেছে।
চোখ ঢুকে গেছে গর্তে। গাল ভাঙা। গায়ে শুধু হাড়। মনে হচ্ছে কতদিন অনাহারে কাটিয়েছে। পূর্ণা পদ্মজাকে দেখেই ‘আপা’ বলে কেঁদে উঠল। ছুটে না এসে দপ করে বসে পড়ল মাটিতে। প্রেমা দৌড়ে এসে পদ্মজাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকল। পদ্মজা বাকরুদ্ধ। অজানা আশঙ্কায় গলা শুকিয়ে আসছে। চোখ দুটো মাকে খুঁজছে। পদ্মজা আমিরের দিকে তাকাল। আমিরের চোখ অস্থির। পদ্মজা প্রেমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে আড়চোখে দেখে, পূর্ণা হাউমাউ করে কাঁদছে। কেন আসছে না ছুটে? কীসের এত কষ্ট তার?
পদ্মজা এগিয়ে আসে। পূর্ণাকে টেনে তুলে ক্ষীণ স্বরে বলল, ‘এত শুকিয়েছিস কেন? আম্মা…আম্মা ভালো আছে?’
‘আপা…আপারে।’ বলে পদ্মজাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল পূর্ণা। পদ্মজা ঘরের ভেতর তাকাল। কয়েকজোড়া চোখ তার দিকে তাকিয়ে আছে। অজ্ঞাত ভয়ে গলা দিয়ে কথা আসছে না তার। পূর্ণাকে এক হাতে জড়িয়ে ধরে ঘরের ভেতর ঢুকল। সদর ঘরে চেনা অনেকগুলো মুখ। প্রতিবেশী সবাই। আপন মানুষগুলো কোথায়? পদ্মজা আরো দুই পা এগিয়ে আসে।
উঠান থেকে মনজুরার কণ্ঠ ভেসে আসে, ‘পদ্ম আইছে, পদ্ম…’
সদর ঘরের মধ্যখানে পাটিতে শুয়ে আছেন হেমলতা। গায়ের ওপর কাঁথা। মেরুদণ্ড সোজা করে রাখা। গোলাপজলের ঘ্রাণ চারপাশে। পদ্মজার বুকের হাড়গুলো যেন গুড়োগুড়ো হতে শুরু করল। বুকে এত ব্যথা হচ্ছে! সহ্য করা যাচ্ছে না। সে হেমলতার পাশে বসে নিস্তরঙ্গ গলায় ডাকল, ‘আম্মা? ও আম্মা?’
হেমলতা পিটপিট করে তাকালেন। চোখ দুটি ঘোলা, কোটরে ঢুকে গেছে। গালে মাংস নেই, ভাঙা। তিনি পদ্মজার দিকে তাকিয়ে আবার চোখ সরিয়ে নিলেন। চিনতে পারলেন না। পদ্মজা হেমলতার এক হাত মুঠোয় নিয়ে চুমু দিল। তার চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ে হেমলতার হাতে। তাতেও হেমলতার ভ্রুক্ষেপ নেই। তিনি নিজের মতো ঘরের ছাদে তাকিয়ে আছেন। মনজুরা সদর ঘরে ঢুকেই বিলাপ শুরু করেছেন, পদ্মজা জোরে চেঁচিয়ে উঠল, ‘চুপ করো। কেউ কাঁদবে না। চুপ করো।’
সবার কান্না থেমে যায়। পদ্মজা হেমলতাকে বলল, ‘ও, আম্মা? কথা বলো? আমি…আমি তোমার পদ্মজা। তোমার আদরের পদ্মজা।’
‘আম্মা চারমাস ধরে কাউকে চিনে না, আপা।’ পূর্ণা ডুকরে কেঁদে উঠল। পদ্মজার চোখ পড়ে সদর ঘরের ঈশান কোণে। মোর্শেদ কপালে হাত দিয়ে বসে আছেন। এই মানুষটাকেও চেনা যাচ্ছে না। পিঠের হাড্ডি ভেসে আছে। সবার এ কী হাল! পদ্মজা বাকহীন হয়ে পড়েছে। কিছু বলবে নাকি কাঁদবে? বুকে নাম না জানা নীল যন্ত্রণা হচ্ছে! শরীরের শক্তি কমে আসছে। পদ্মজা দুই হাতে হেমলতার মাথা তুলে ধরল। হেমলতা তাকালেন। নিষ্প্রাণ চাহনী। হেমলতার মাথা বুকের সঙ্গে জড়িয়ে ধরে পদ্মজা। আকুল ভরা কণ্ঠে বলল, ‘একবার কথা বলো, আম্মা? একবার দুই হাতে জড়িয়ে ধরো।’
হেমলতার হাত দুটো নেতিয়ে আছে মাটির ওপর। পূর্ণা খেয়াল করল—হেমলতার হাত দুটি কাঁপছে। চেষ্টা করছেন পদ্মজাকে জড়িয়ে ধরার, কিন্তু পারছেন না। তাহলে কী পদ্মজাকে চিনতে পেরেছেন? পদ্মজা কাঁদতে থাকল। অনেকে অনেক কিছু বলছে। কারো কথা কানে ঢুকছে না। শুধু বুঝতে পারছে, এই পৃথিবীর বুক থেকে তার মা হারিয়ে যাচ্ছে। হারিয়ে যাচ্ছেন হেমলতা। হারিয়ে যাচ্ছে তার কল্পনার রাজ্যের রাজরানি। স্বপ্ন তো সব পূরণ হয়নি! এ তো কথা ছিল না। তবে কেন এমন হচ্ছে? পদ্মজার বুক ছিঁড়ে যাচ্ছে। যন্ত্রণায় বিষিয়ে উঠছে সারা শরীর। কাঁপা ঠোঁটে হেমলতার পুরো মুখে চুমু খেল সে। ভারি করুণ ভাবে বলল, ‘ও আম্মা? কোথায় হারাল তোমার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি, ঝাঁঝালো কণ্ঠ?’
কেটে গেল অনেকটা মুহূর্ত। কাছের মানুষেরা ছাড়া আর কেউ নেই। রা নেই কারো মুখে। হেমলতার মতোই সবাই বাকহীন, স্তব্ধ। কেউ খায়নি বাসন্তী গুপ্ত ব্যথা নিয়ে রেঁধেছেন। প্রেমা-প্রান্ত, আমির ছাড়া কেউ খেল না। পদ্মজাকে অনেক জোরাজুরি করেছে আমির। কিছুতেই খাওয়াতে পারল না। আমিরও আর ঘাঁটল না। পদ্মজা জানতে পারল, দুই মাস ধরে হেমলতা বিছানায় পড়ে আছেন। মাঝে মাঝে এক দুটো কথা বলেন। চারদিন ধরে তাও বলেন না। গতকাল ভোরে মুখ দিয়ে ফেনা বের হয়েছে। এমন অবস্থা হয়েছিল যে সবাই ভেবেছিল আত্মাটা বেরিয়েই যাবে। হাওলাদার বাড়ি থেকে সবাই দেখতে আসে। তখন জানা যায়, আলমগীর ঢাকা যাচ্ছে। মোর্শেদ অনুরোধ করে বলে, পদ্মজা আর আমিরকে খবর দিতে। ওরা যেন দ্রুত চলে আসে। রাতের ট্রেনে সকালে গোডাউনে পৌঁছে আমিরকে সব বলে আলমগীর। আমির সব শুনে আর দেরি করেনি। পদ্মজাকে নিয়ে চলে আসে। পথে কান্নাকাটি করবে তাই আগে কিছুই বলেনি। পদ্মজা এতসব জেনেও কিছু বলল না। মনে অভিমানের পাহাড় তৈরি হয়েছে। কারো কথা শুনতে ইচ্ছে করছে না। সারাক্ষণ চেষ্টা করছে হেমলতার সঙ্গে কথা বলার। হেমলতা কিছুতেই কথা বলছেন না। একটু-আধটু পানি খাচ্ছে, এর বেশি আর কিছুই খাচ্ছেন না। গায়ে মাংস বলতে কিছু নেই। চামড়া ঝুলে গেছে। পদ্মজা হেমলতার পুরো শরীর মুছে দিয়ে কাপড় পালটে দিল। এরপর শোয়া অবস্থায় অজু করাল। ঠোঁট ভেঙে কেঁদে আরো একবার আকুতি করল, ‘একবার কথা বলো, আম্মা। একবার ডাকো পদ্মজা বলে।’
হেমলতা তাকালেন, কিছু বললেন না। তাকিয়েই রইলেন। মাঝরাতে সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়েছে, তখনো পদ্মজা জাগ্রত। ক্লান্ত হয়ে সবার চোখ দুটি লেগে গেলেও তার চোখ দুটির পলকও পড়ছে না। তার মন বলছে, কে যেন চারপাশে ঘুরছে তার মাকে নিয়ে যেতে। ঝিঁঝিপোকার ডাক, শেয়ালের হাঁক ছাপিয়ে সে যেন কারো পায়ের শব্দ শুনতে পাচ্ছে। অবচেতন মন যেন অনুভব করছে আজরাইলের উপস্থিতি। পদ্মজার বুকে ভয় জেঁকে বসে। চোখ ফেটে জল বেরিয়ে আসে। এদিক-ওদিক তাকিয়ে কেঁদে অনুরোধ করে, ‘অনুরোধ করছি, আমার মাকে কষ্ট দিয়ো না।’
মুখে হাত চেপে কান্না আটকানোর প্রচেষ্টায় বার বার ব্যর্থ হতে থাকল পদ্মজা। কাঁদতে কাঁদতে কণ্ঠ নিভে এসেছে। ঠান্ডায় শরীর জমে গেছে। চোখটা লেগেছে মাত্র তখন দপ একটা শব্দ ভেসে এলো। চমকে তাকাল পদ্মজা। হেমলতা হাত দিয়ে মাটি থাপড়াচ্ছেন। শরীর কাঁপছে। পদ্মজার নিশ্বাস থেমে যায়। হেমলতার এক হাত শক্ত করে ধরে কেঁদে উঠে বলল, ‘আম্মা, আম্মা যেয়ো না আমাকে ছেড়ে। ও আম্মা, আম্মা…আমার কষ্ট হচ্ছে আম্মা। তোমার খুব কষ্ট হচ্ছে? আম্মা পায়ে পড়ি আমাকে ছেড়ে যেয়ো না। আম্মা…আম্মা।’
দ্রুত হেমলতাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে পদ্মজা। বাড়ির সবার ঘুম ভেঙে যায়। অনেকগুলো করুণ কান্নার স্বরে হাহাকার করে ওঠে মোড়ল বাড়ি। পদ্মজা কাউকে অনুরোধ করে বলল, ‘নিয়েন না আমার আম্মাকে। কষ্ট দিচ্ছেন কেন এত? আমার আম্মার কষ্ট হচ্ছে। আম্মা, ও আম্মা। আম্মা আমাকে ছেড়ে যেয়ো না।’
পদ্মজা কাঁদতে কাঁদতে সুরা ইয়াসিন পড়া শুরু করল। হেমলতা শেষবারের মতো উচ্চারণ করলেন, ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ।’
শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করে চোখ বুজে ফেললেন। থেমে গেল শরীরের কাঁপাকাঁপি। দেহটা শুধু পড়ে রইল পরিত্যক্ত বস্ত্রের মতো। পদ্মজা দেহটাকে খামচে জড়িয়ে ধরে আম্মা বলে চিৎকার করে উঠল। মানুষ ছুটে আসে আশপাশের সব বাড়ি থেকে। পূর্ণা কাঁদতে কাঁদতে জ্ঞান হারাল। ফজরের আজান পড়ছে। আমির পদ্মজাকে হেমলতার থেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করে, কিন্তু কিছুতেই প্রাণ বিহীন দেহটা পদ্মজা ছাড়তে চাইল না। যেন তার ডাকেই ফিরে আসবেন হেমলতা। কথা বলে উঠবেন, আবার হাঁটবেন। পদ্মজাকে ধমকে বলবেন, ‘চুপ! এত কীসের কান্না? আমার মেয়ে হবে শক্ত আর কঠিন মনের। এত নরম হলে চলবে না।’
তা কী আর হয়?
এটা শুধুই কল্পনা। আত্মা একবার দেহ ছেড়ে দিলে আর ফিরে আসে না। আপন ঠিকানায় ফিরে যায়। হেমলতা নামে মানুষটার আয়ুকাল এতটুকুই ছিল। তিনি উড়াল দিয়েছেন পরকালে, রেখে গেছেন আদরের তিন কন্যাকে। আদরের কন্যাদের ছেড়ে তো কখনো দূরে থাকতে পারতেন না! এবার কীভাবে চলে গেলেন? তিনি নিশ্চয় মৃত্যুর সঙ্গে কঠিন যুদ্ধ করেছেন! থেকে যেতে চেয়েছিলেন আরো কিছুদিন। পেরে ওঠেননি।
ভোরের আলো ফুটতেই পদ্মজা নিজেকে শক্ত করে গোসল করে এসে কোরআন শরীফ নিয়ে বসল। হেমলতা বলতেন, ‘মা-বাবা মারা গেলে কান্নাকাটি না করে লাশের পাশে বসে কোরআন শরীফ পড়া ভালো। এতে করে কবরে আযাব থাকলে কম হয়।’
সে প্রতিটা অক্ষর পড়ছে আর কাঁদছে। জীবনের আকাশের সাতরঙা রংধনু নিভে গেছে। আর কখনো উঠবে না। কোনোদিন না। মোর্শেদ বারবার পাঞ্জাবির হাতা দিয়ে চোখের জল মুছছেন কিন্তু, আবার ভিজে যাচ্ছে। গোসলের পর হেমলতার মুখটা উজ্জ্বল হয়েছে। ঠোঁটের কোণে লেগে আছে হাসি। পদ্মজা হেমলতার মৃতদেহের সামনে এসে দাঁড়াল। সাদা কাপড়ে মোড়ানো লম্বা দেহটা দেখে হাহাকার করে ওঠে বুক। আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আমি জানি, তোমার রুহ আমার পাশেই আছে। এভাবে কথা না ভাঙলেও পারতে, আম্মা। বলেছিলে, কখনো কিছু লুকোবে না! বেহেশতে ভালো থেকো, আম্মা। আমি পূর্ণা-প্রেমা-প্রান্তকে দেখে রাখব। আমি তোমাকে ভীষণ ভালোবাসি, আম্মা।’
হাঁটু ভেঙে খাঁটিয়ার সামনে বসে পড়ে সে। হেমলতার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল, ‘আল্লাহকে বলে খুব দ্রুত আমাকে নিতে এসো কিন্তু।’
আমির, হিমেলসহ আরো দুইজন খাঁটিয়া কাঁধে তুলে নিলো। কালিমা শাহাদাত বলতে বলতে সামনে এগোলো তারা। পূর্ণাকে তিনজন মহিলা ধরে রেখেছে। সে হাত-পা দিয়ে ঝাঁপিয়ে চেষ্টা করছে ছোটার জন্য। তার ইচ্ছে হচ্ছে মৃত দেহটা রাখতে আঁকড়ে ধরে রাখে। পদ্মজা মাটিতে বসে পড়ল। কী একটা বুক ফুঁড়ে বেরিয়ে যাচ্ছে! আম্মা…আম্মা বলে দুই হাতে খামচে ধরে মাটি। মাটিতে মাথা ঠেকিয়ে বিড়বিড় করে বলল, ‘আমার আম্মাকে কষ্ট দিয়ো না মাটি। একটুও কষ্ট দিয়ো না। আমার আম্মাকে যত্নে রেখ। হীরের টুকরো তোমার বুকে ঘুমাতে যাচ্ছে। কষ্ট দিয়ো না…কষ্ট দিয়ো না।’
.
হাড় কাঁপানো শীতে কাঁপছে পদ্মজা। সন্ধে থেকে খুব ঠান্ডা পড়েছে। এক কাপড়ে মাটিতে মা একা আছে ভেবে পদ্মজার অশান্তি হচ্ছিল। তাই কম্বল নিয়ে রাতের বেলা ছুটে এসেছে মায়ের কবরে। সদ্য হওয়া কবরে কাঁচা মাটির ঘ্রাণ। পদ্মজা কম্বল দিয়ে মায়ের কবর ঢেকে দিল। এরপর দুই হাতে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলল, ‘আম্মা…মনে আছে তোমার? যখন আমি ছোটো অনেক, আব্বা আমার গায়ের কম্বল নিয়ে গিয়েছিল। তখন তুমি তোমার শাড়ির আঁচল দিয়ে সারারাত আমাকে জড়িয়ে ধরে রেখেছিলে? মনে আছে? আমাকে কেন সেই সুযোগ দিলে না? কেন বললে না, তুমি মরণ রোগে আক্রান্ত। আমার জীবনে অভিশপ্ত আক্ষেপ কেন দিয়ে গেলে, আম্মা? কেন পেলাম না আমার মাকে সন্তানের মতো আদর করার সুযোগ? কোন দোষে আমার সঙ্গ তুমি নিলে না? মৃত্যুর আগে নিজের মেয়ের সঙ্গে এত বড়ো অনাচার করে গেলে, আম্মা! বিশ্বাসঘাতকতা করলে। আমি তো তোমাকে অন্ধের মতো বিশ্বাস করতাম। কখনো কোনো বিষয়ে জোর করিনি। জোর করে জানতে চাইনি। আমি বিশ্বাস করতাম তুমি সব বলবে আমায়। তুমি নিজে আমাকে বার বার বলেছো, তোমার জীবনের এক বিন্দু অংশ থাকবে না যা আমাকে বলবে না। তবে কেন সেই কথা রাখতে পারলে না? আমার কষ্ট হচ্ছে, আম্মা। তুমি অনুভব করছো? আমি তোমার বুকে শুয়ে অভিযোগ তুলছি, তুমি আমার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছো! আমার কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছো দশ মাস। তুমি পারতে আমাকে বলতে। তুমি পারতে আমাকে বিয়ে না দিয়ে নিজের কাছে রাখতে। তুমি পারতে আমাকে আরো দশ মাস আমার মায়ের সঙ্গ দিতে। আমি এত আক্ষেপ নিয়ে কী করে বাঁচব, আম্মা?’
কয়েকটা শেয়াল দূরে দাঁড়িয়ে আছে। মাঝরাতে কবরে ঝাঁপিয়ে পড়ে কেউ কাঁদতে পারে এমন হয়তো কখনো দেখেনি তারা। পদ্মজা হেমলতার কবরে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে আর অশ্রু বিসর্জন করছে। আত্মহত্যা পাপ না হলে হয়তো এই পথই বেছে নিত সে। মোর্শেদ, আমির টর্চ নিয়ে পদ্মজাকে খুঁজতে খুঁজতে কবরে আসে। হেমলতার কবর দেখে মোর্শেদ দুর্বল হয়ে পড়েন। পদ্মজার সঙ্গে সঙ্গে তিনিও কাঁদতে থাকেন। আমিরের শব্দভাণ্ডারে সান্ত্বনা দেয়ার মতো ভাষা মজুদ নেই। সে সাহস করতে পারল না কথা বলার। কান্না থামিয়ে পদ্মজা সুরা ইয়াসিন পড়তে থাকল। সে চায় না তার মায়ের কবরে বিন্দুমাত্র কষ্ট হোক। সন্তানের আমল নাকি পারে, মৃত মা- বাবার শাস্তি কমাতে। যদি কোনো পাপের শাস্তি হেমলতার আমলনামায় থেকে থাকে, তা যেন মুছে যায় পদ্মজার কণ্ঠের মধুর স্বরে। ধীরে ধীরে পদ্মজার কণ্ঠ কমে আসে। ঠান্ডায় জমে যায়। পালটে যায় চোখের মণির রং। আমির দ্রুত পদ্মজাকে কোলে তুলে নিলো। মোর্শেদকে বুঝিয়ে-শুনিয়ে বাড়িতে নিয়ে আসে। হেমলতা মাটির কবরে পড়ে রইলেন একা। শেয়ালগুলি একসঙ্গে চেঁচিয়ে উঠল। মৃত্যুর মতো সত্য আর নেই।
জন্মালে মৃত্যুর স্বাদ উপভোগ করতেই হবে।
.
হেমলতার ঘরে দরজা বন্ধ করে পদ্মজা আর পূর্ণা বসে আছে। পুরো বিছানা জুড়ে হেমলতার পরনের কাপড়চোপড়। এসবই শেষ স্মৃতি। পূর্ণা দুটো শাড়ি বুকের সঙ্গে জড়িয়ে ধরে থেমে থেমে কাঁদছে। পদ্মজা মাটিতে বসে আছে। উসকোখুসকো চুল। পূর্ণা আর কাঁদতে পারছে না। বুক ফেটে যাচ্ছে তবুও শব্দ বেরোচ্ছে না। পদ্মজা হেমলতার চুড়ি দুটো হাতে নিয়ে বলল, ‘আম্মা বলে এখন কাকে ডাকব? পূর্ণা রে, আমাদের আম্মা কই গেল?’
পূর্ণা বিছানা থেকে নেমে আসে। পদ্মজাকে জড়িয়ে ধরে ভাঙা স্বরে বলল, ‘আল্লাহ কেন এমন করল, আপা? আমাদের প্রতি একটু দয়া হলো না।’
‘এই ঘরটায় আর আসবে না, আম্মা!’
‘আপা, আম্মা আসে না কেন? আপা…আমার শ্বাস নিতে কষ্ট হয়। আমাকে মেরে ফেলো।’
‘কাঁদিস না বোন। আমাদের আবার পরকালে দেখা হবে। এরপর আর মৃত্যু নেই। অনন্তকাল একসঙ্গে থাকব। ঠিক দেখা হবে।’
পালঙ্কের উপর একটা পুরনো খাতা। পদ্মজা হাত বাড়িয়ে নিলো। পূৰ্ণা এই খাতার প্রতিটি অক্ষর আগেই পড়েছে। তাই আর সেদিকে ফিরল না। সে ক্লান্ত দেহ নিয়ে মাটিতে শুয়ে পড়ে। পদ্মজা খাতার পৃষ্ঠা ওল্টায়—
আমার আদরের পদ্মজা,
আজ পনেরো দিন হলো তোর বিয়ের। প্রতিটা রাত আমার নির্ঘুমে কাটে। পুরো বাড়িজুড়ে তোর স্মৃতি। স্মৃতিগুলো আমায় বিষে জর্জরিত করে দেয়। মেয়ে হয়ে জন্মালে বিয়ে করে শ্বশুরবাড়ি যেতেই হয়। তবুও মানতে কষ্ট হচ্ছে আমার মেয়ে সারাজীবনের জন্য অন্যের ঘরে চলে গেছে। বলেছিলাম, আমার জীবনের বিন্দুমাত্র অংশ তোর অজানায় রাখব না। সেই কথা রাখতে আমি লিখতে বসেছি। স্বপ্ন ছিল, তোকে অনেক পড়াব। অনেক…অনেকদিন নিজের কাছে রাখব। কিন্তু মানুষের সব স্বপ্ন কী পূরণ হয়? দীর্ঘ দুই বছর আমার শরীরে বাসা বেঁধে ছিল এক রোগ। প্রাথমিক অবস্থায় ছিল। কিন্তু পাত্তা দেইনি। যখন তোর মেট্রিক পরীক্ষার জন্য আকবর ভাইজানের বাড়িতে গেলাম তখন একজন ভালো ডাক্তারের সঙ্গে আমার দেখা হয়। তিনি আকবর ভাইজানের বন্ধু। দেখা করতে এসেছিলেন। তখন তুই পরীক্ষা কেন্দ্রে ছিলি। উনার নাম আসাদুল জামান। বিলেত ফেরত ডাক্তার। কথায় কথায় আমার সমস্যাগুলোর কথা বলি। তিনি খালি চোখে আমাকে দেখে কিছু প্রশ্ন করলেন। উনার ধারণা, আমি পারকিনসন্স ডিজিস নামক প্রাণঘাতী রোগে আক্রান্ত, যার আশি ভাগ লক্ষণ আমার সঙ্গে মিলে যায়। তিনি দ্রুত আমাকে পরীক্ষা করতে বলেন। এই রোগের চিকিৎসা তো দূরে থাক দেশে এই রোগ পরীক্ষার কেন্দ্রও তেমন নেই। সেদিনটা আমার জীবনের বড়ো ধাক্কা ছিল। আমি দিকদিশা হারিয়ে ফেলি। আমি মারা গেলে আমার তিন মেয়ের কী হবে? কী করে বাঁচবে? ভয়ানক এই রোগ নিয়ে তোর সামনে হাসতে আমার ভীষণ কষ্ট হতো। তবুও হাসতে হতো। মুহিব খুব ভালো ছেলে। তাই তাদের প্রস্তাব ফিরিয়ে দেইনি। আমি মারা যাওয়ার আগে তোর ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে চেয়েছিলাম। বিয়ে ঠিক করে ফিরে আসি গ্রামে। প্রতিটা দিন, প্রতিটা মুহূর্ত অসহনীয় যন্ত্রণায় কাটতে থাকে। আসাদুল জামান ঢাকার এক হাসপাতালের নাম লিখে দিয়েছিলেন। যেখানে এই রোগের পরীক্ষা করা হয়। শতভাগ ভাগ নিশ্চিত হওয়ার জন্য পরীক্ষা করানোটা জরুরি হয়ে পড়ে। তার জন্য কেউ একজনকে দরকার পাশে। তোর আব্বাকে সব বলি। সব শুনে তোর আব্বা হাউমাউ করে বাচ্চাদের মতো কেঁদেছে! মানুষটাকে এত কাঁদতে কখনো দেখিনি! আল্লাহর ওপর ভরসা রেখে চলে যাই ঢাকা। আমি তখন হুঁশে ছিলাম না। মৃত্যু আমার পেছনে ধাওয়া করছিল। তাই মাথায় আসেনি আমি না থাকলে আমার মেয়েদের কোনো ক্ষতি হতে পারে। ঢাকা যাওয়ার পথে আল্লাহর কাছে আকুতি করেছি যাতে পরীক্ষায় কিছু ধরা না পড়ে। বিয়েটা ভেঙে দিতে পারি। আর আমার মেয়েদেরকে নিয়ে আরো কয়টা বছর বাঁচতে পারি। কিন্তু আল্লাহ শুনলেন না। তিনি দয়া করলেন না, মা! জানতে পারলাম, আমার হাতে সময় কম। এ রোগের নিরাময় নেই। যেকোনো বছরে যেকোনো মুহূর্তে মারা যেতে পারি। এই কথা শোনা আমার পক্ষে সহজ ছিল না। ভেঙে গুঁড়িয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু তোদের কথা মনে পড়তেই আবার নিজেকে শক্ত করে নিয়েছি। যতদিন বাঁচব শক্ত হয়ে বাঁচব। তোর জীবন গুছিয়ে দিয়ে যাব। আমি পেরেছি। তোর বিয়ে হয়েছে। ভালো ছেলের সঙ্গে হয়েছে। সুখে আছিস। এই তো শান্তি। আমার ভাবতে কষ্ট হয়, একদিন তোকে, তোদের সবাইকে আমি ভুলে যাব। এখন তো কথা ভুলে যাই। তখন নিজের নাড়ি ছেড়া সন্তানদের মুখও অচেনা হয়ে যাবে। কী নির্মম তাই না মা?
রবিবার।
তুই ঢাকা চলে গিয়েছিস অনেকদিন হলো। আমার মনে হচ্ছে, আমাদের আর দেখা হবে না। আমার শরীরের অবস্থা ভালো না। আজ নাকি প্রান্তকে চিনতে পারিনি। বেশ অনেক্ষণ ওর চেহারাটা আমার অচেনা লেগেছে। কী অদ্ভুত! ভুলে যেয়ে আবার মনে পড়ে। হাত, পা, মাথা, মুখের থুতনি, চোয়াল মাঝে মাঝে খুব কাঁপে। ধীরে ধীরে শরীরের ভারসাম্য একদম নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। লাহাড়ি ঘরে গিয়েছিলাম হুট করে চৌকির উপর থেকে পড়ে গিয়েছি। পূর্ণার সে কী কান্না! মেয়েটা খুব কাঁদতে পারে। একদমই হাঁটতে ইচ্ছে করে না। শক্তি কুলোয় না। তোর কথা খুব মনে পড়ে। মনে সাধ ছিল, বৃদ্ধ হয়ে তোর শরীরে ভর দিয়ে হাঁটব। পেটের চামড়ার ফোসকার মতো কী যেন হয়েছে। চুলকায়, ব্যথা করে। রাতে ঘুম হয় না যন্ত্রণায়। তোর আব্বা আমার অশান্তি দেখে ঘুমাতে পারে না। বাসন্তী আপা সব জানে। মানুষটা অনেক ভালো। ভুল তো সবাই করে। এমন কেউ আছে যে জীবনে ভুল করেনি? বাসন্তী আপার রান্না নাকি অনেক মজার হয়। খুব ভালো ঘ্রাণ হয়। প্রান্ত-প্রেমা সারাক্ষণই বলে। কিন্তু আমি সেই ঘ্রাণ পাই না। ঘ্রাণশক্তিটাও লুপ্ত হয়ে গেছে। কয়দিন ধরে টয়লেটও হচ্ছে না। খাবার গিলতে পারি না। কোন পাপে এমন করুণ দশা হলো আমার? বোধহয়, আর শক্তি পাব না লেখার। সবকিছু ভুলতে আর কতক্ষণ? সব লক্ষণ জেঁকে বসেছে শরীরে। বাকি শুধু দুনিয়াটাকে ভুলে যাওয়া। আজ সারারাত জেগে আরো কিছু কথা লিখতে চাই। সেদিন আমি জলিল আর মজনুর ছেলেকে খুন করেছি। ছইদ তার আগেই খুন হয়ে গিয়েছিল। আটপাড়ার বড়ো বিলের হাওড়ের টিনের ঘরে ওরা তিনজন সবসময় জুয়া খেলে, গাঁজা খায়। সেদিনও গাঁজা খেয়ে পড়েছিল। গিয়ে দেখি ছইদের লাশ এক কোণে পড়ে আছে। দা হাতে দাঁড়িয়ে আছে তোর দেবর রিদওয়ান। ও আমাকে দেখে পালিয়ে যায়। এরকম দৃশ্য দেখে অপ্রস্তুত হয়ে পড়ি তবুও থেমে থাকিনি। ঘুমন্ত জলিল আর মজনুর ছেলেকে বেঁধে—খুনের বর্ণনা লিখতে ইচ্ছে করছে না! শুধু এইটুকু বলব, আমি যখন জলিল আর মজনুর ছেলেকে কোঁপাচ্ছিলাম তখন রিদওয়ান ঘরের এক পাশে লুকিয়ে ছিল। সে সব দেখেছে। আমি বের হতেই সে উলটোদিকে হাঁটা শুরু করে। আজও জানতে পারিনি সে কেন ছইদকে খুন করেছে। তুই ঢাকা চলে গিয়েছিস ভেবে শান্তি লাগছে। রিদওয়ান ভয়ংকর মানুষ। তার খুন করার হাত পাকা। এটা তার প্রথম খুন নয়। সাবধানে থাকবি। আমিরকে সাবধানে রাখবি। তোর শাশুড়িকে বহুবার লুকিয়ে কাঁদতে দেখেছি। উনাকে আপন করে রাখবি।
আর লেখা যাচ্ছে না। হাত কাঁপছে। কেমন ঝাপসা হয়ে আসছে চারিদিক। এই খাতাটা প্রান্তের। লুকিয়ে নিয়ে এসেছি। আমার সব শাড়ির সঙ্গে ট্রাঙ্কের ভেতর যত্নে রাখব। আমার অনুপস্থিতিতে যখন পড়বি, কাঁদবি না একদম। জীবনে বড়ো হবি। আমি না থাকলে মৃত্যুর কামনা করবি না। এটাও এক ধরনের পাপ। আল্লাহর যখন ইচ্ছে হবে তখনই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে। তিনি যে কারণে সৃষ্টি করেছেন তা পূরণ হলেই মৃত্যু ধেয়ে আসবে। শুধু মৃত্যুর কথা স্বরণ রাখবি। কোরআনের পথে চলবি। কোনো পাপে জড়াবি না। অন্যায়কে প্রশ্রয় দিবি না। আমাদের আবার দেখা হবে। আমার মায়ের সঙ্গে আবার দেখা হবে। তুই তো আমার মা, আমার পদ্মজা। আমার সাত রাজার ধন। আমার তিন কন্যা আমার অহংকার। আমার বেহেশত। ভালো থাকবি, খুব ভালো থাকবি। আম্মা কিন্তু সব দেখব। কান্নাকাটি করতে দেখলে ওপারে আমার শান্তি হবে না। তাই কাঁদবি না। আল্লাহ হাফেজ মা, ভালো থাকিস।’
পড়া শেষ হতেই খাতাটা বুকের সঙ্গে জড়িয়ে ধরে হাতপা ছুঁড়ে আম্মা, আম্মা বলে কাঁদতে থাকে পদ্মজা। তার আর্তনাদে চারিদিক স্তব্ধ হয়ে যায়।
৪৭
১৯৯৬ সাল। ঘনকুয়াশার ধবল চাদর সরিয়ে প্রকৃতির ওপর সূর্যের নির্মল আলো ছড়িয়ে পড়েছে। কাচের জানালার পর্দা সরাতেই এক টুকরো মিষ্টি পেলব রোদ্দুর পদ্মজার সুন্দর মুখশ্রীতে হুমড়ি খেয়ে পড়ে। নিচতলা থেকে মনার কণ্ঠস্বর ভেসে এলো, ‘আপামনি।’
মিষ্টি রোদের কোমল ছোঁয়া ত্যাগ করে ঘুরে দাঁড়াল পদ্মজা। আমির আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে লেপের ওম ছেড়ে উঠে বসেই দরজার বাইরে দেখতে পেল পদ্মজাকে। ধনুকের মতো বাঁকা শরীরে সবুজ সুতি শাড়ি মাথায় লম্বা বেনুনি চওড়া পিঠের ওপরে সাপের মতন দুলছে। পাতলা কোমর উন্মুক্ত।
আমির চমৎকার করে হেসে ডাকল, ‘পদ্মবতী।’
পদ্মজা না তাকিয়েই জবাব দিল, ‘অপেক্ষা করুন, আসছি।’
আমির মুখ গুমট করে বলল, ‘ইদানীং আমাকে একদমই পাত্তা দিচ্ছো না তুমি। বুড়ো হয়ে গেছি তো।’
ওপাশ থেকে আর সাড়া এলো না। আমির অলস শরীর টেনে নিয়ে বারান্দায় গেল। পদ্মজা বৈঠকখানায় এসে দেখে, মনা সোফায় পানের কৌটা নিয়ে বসে আছে। তাকে দেখেই দ্রুত উঠে দাঁড়াল। নয় বছরের মনা এখন চৌদ্ধ বছরের ছটফটে কিশোরী। পদ্মজা গম্ভীর স্বরে বলল, ‘পান খাওয়ার অনুমতির জন্য ডেকেছিস?’
মনা নতজানু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সে মাথা নত অবস্থায় রেখেই চোখ উলটে তাকিয়ে পদ্মজাকে দেখল একবার। এরপর চোখ নামিয়ে নিয়ে বলল, ‘অনেকদিন খাই না। আপামণি, একটা খেতে দাও না?’
মনা চাইলে লুকিয়ে খেতে পারত। কিন্তু সে পদ্মজাকে ডেকে অনুমতি চাইছে। পদ্মজা মনে মনে সন্তুষ্ট হলেও প্রকাশ করল না। সোফায় বসে প্রশ্ন করল, ‘পান কে দিয়েছে? সঙ্গে পানের কৌটাও আছে দেখছি!’
‘আব্বা আসছিল।’ ভীতু কণ্ঠে বলল মনা।
‘কখন?’
‘ভোরবেলা।’
‘বাসায় আসেনি কেন?’
‘কাজে যাচ্ছে তাই।’
‘উনি এমনি এমনি কেন পানের কৌটা নিয়ে আসবেন? তুই স্কুল থেকে ফেরার পথে বস্তিতে গিয়েছিলি?’
মনা জবাব দিল না। তার চুপ থাকা প্রমাণ করছে, পদ্মজার ধারণা সত্য। পদ্মজা আর কথা বাড়াল না। বলল, ‘একটা পান খাবি। কৌটাসহ বাকি পান, সুপারি রহমত চাচাকে দিয়ে তোদের বস্তিতে পাঠিয়ে দে।’
পদ্মজা চলে যেতে গিয়ে আবার দাঁড়িয়ে পড়ল। তীক্ষ্ণ কণ্ঠে প্রশ্ন করল, ‘তুই নাকি গণিতে ফেল করেছিস?’
পদ্মজার প্রশ্নে মনা দৃষ্টি চোরের মতো এদিক-ওদিক চোখের দৌড়াতে থাকল। পদ্মজা ধমকে উঠল, ‘বলছিস না কেন? আমি প্রতিদিন রাতে সময় নিয়ে তোকে গণিত বুঝিয়েছি। তবুও ফেল করলি কী করে?’
মনা কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল, ‘পরীক্ষার আগের দিন পড়িনি। পরীক্ষায় গিয়ে সব ঝাপসা ঝাপসা মনে পড়ছিল।’
‘কেন পড়িসনি?’ প্রশ্নটি করে থামল পদ্মজা। পরক্ষণেই বলল, ‘সেদিন আমি অসুস্থ ছিলাম। নিচে একবারও আসতে পারিনি। এই সুযোগে পড়া রেখে টিভি দেখেছিলি তাই তো?’
মনা বাধ্যের মতো মাথা নাড়াল। পদ্মজা হাসবে না কাঁদবে বুঝতে পারছে না। বেহায়ার মতো আবার স্বীকারও করছে, পড়া রেখে টিভি দেখেছে! ঢাকা আসার পরের বছরই মনাকে স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছিল সে। এখন মনা পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে। মাথায় বুদ্ধি বলতে নেই। সারাক্ষণ টিভি, টিভি আর টিভি! এত পড়ানোর পরও কিছু মাথায় রাখতে পারে না। পদ্মজা বিরক্তি নিয়ে জায়গা ছাড়ল।
শোবার ঘরে ঢুকতেই আমির আক্রমণ করে বসে। পদ্মজার কোমরের খোলা অংশে হাত রাখতেই পদ্মজা, ‘ঠান্ডা!’ বলে ছিটকে সরে যায়। আমির হতভম্ব হয়ে গেল। দুই পা এগোতেই তার ব্যক্তিগত প্রাপ্তবয়স্ক নারীটির রিনরিনে কণ্ঠে ধমক বেরিয়ে এলো, ‘একদম এগোবেন না। এই শীতের মধ্যে ভেজা হাতে ছুঁলেন কীভাবে? আপনি আমার কালো সোয়েটারটা দেখেছেন? পাচ্ছি না। শীতে জমে যাচ্ছি একদম।’
আমির কিছু বলল না। সে পদ্মজার দিকে আড়চোখে তাকিয়ে আছে। পদ্মজা এদিক-ওদিক চোখ ঘুরিয়ে তার কালো সোয়েটারটা খুঁজল। হঠাৎ আমিরের দিকে চোখ পড়তেই হেসে বলল, ‘এভাবে সঙের মতো খালি গায়ে দাঁড়িয়ে আছেন কেন?
আমির কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, তখনই বেজে উঠল টেলিফোন। এই সুযোগে পদ্মজা পাশের ঘরে চলে গেল। কালো সোয়েটারটা যে কোথায় হারাল! এটা খুঁজে বের করতেই হবে। এ সোয়েটারটা পরে সে খুব স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। আমির টেলিফোন রেখে পদ্মজাকে ডেকে জানাল, সে বের হবে। জরুরি দরকার। পদ্মজা সোয়েটার খোঁজা রেখে তাড়াতাড়ি করে খাবার পরিবেশন করে। আমির খাওয়াদাওয়া শেষ করে প্রতিদিনের মতো পদ্মজার কপালে চুমু দিয়ে অফিসের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে যায়! পদ্মজা তৈরি হয় রোকেয়া হলে যাওয়ার জন্য। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুবাদে রোকেয়া হলের অনেক মেয়েকেই চিনে। আজ মনার স্কুল নেই। সে একাই বাসায় থাকবে। এক ছোটো বোনের সঙ্গে দেখা করার জন্য হলে যেতে হবে। আমিরের তো কখনোই ছুটি নেই, নিজের ব্যাবসা। যখন তখন কাজ পড়ে যায়।
রোকেয়া হলের চারপাশ সবুজ গাছে আবৃত। পদ্মজা গেটের বাইরে গাড়ি রেখে এসেছে। হিম শীতল বাতাসে চোখজোড়া ঠান্ডায় জ্বলছে। তার পরনে বোরকা, মুখে নিকাব। রোকেয়া হলের ‘ক’ ভবনে এসে জানতে পারল যার খুঁজে সে এসেছে সে নেই। চারিদিক নিরিবিলি। প্রায় সবাই ক্যাম্পাসে। নির্জন পরিবেশে এমন ঠান্ডা বাতাস রোমাঞ্চকর অনুভূতি দেয়। রোকেয়া হলে এ নিয়ে অনেকবার এসেছে সে। পদ্মজা ‘ক’ ভবনের নিচ তলার শেষ মাথার কাছাকাছি গিয়ে ঘুরে দাঁড়াল ফিরে যাওয়ার জন্য। তখন অতি সূক্ষ্ম একটা শব্দ কানে ভেসে এলো। পদ্মজা থমকে দাঁড়াল। দুই পা পিছিয়ে চোখ বুজে শোনার চেষ্টা করল, শব্দটা কীসের! আওয়াজ তীব্র হয়েছে! কাছে কোথাও ধস্তাধস্তি হচ্ছে। পদ্মজার মস্তিষ্ক সচল হয়ে ওঠে। অনুসন্ধানী দৃষ্টি নিয়ে ফিরে তাকাল। একটা মেয়ের চাপা কান্নার শব্দ কর্ণকুহরে পৌঁছাতেই পদ্মজা দ্রুতগামী ঘোড়ার মতো ছুটে এলো শেষ কক্ষের দরজার সামনে। পৌঁছেই দেখতে পেল অর্জুন এবং রাজু একটা মেয়েকে টেনে হিঁচড়ে কক্ষ থেকে বের করতে চাইছে। ক্যাম্পাসের ছাত্রসংগঠনের নেতা এরা। ছয় মাস হলো ছাত্রসংগঠনের নেতৃত্বে এসেছে। আর এখনই ক্ষমতার অপব্যবহার শুরু করেছে!
পদ্মজার উপস্থিতি টের পেয়ে অর্জুন, রাজু ঘুরে তাকাল। মেয়েটা ভয়ে কাঁপছে। পদ্মজাকে দেখে মেয়েটা ছুটে আসতে চাইলে অর্জুন ধরে ফেলে। পদ্মজা বেশ শান্তভাবেই বলল, ‘ক্ষমতার অপব্যবহার করতে নেই। ছেড়ে দাও মেয়েটাকে।’
পদ্মজার কণ্ঠ মেয়েটি চিনতে পেরে অস্ফুটভাবে ডাকল, ‘পদ্ম আপা।’ এরপর বলল, ‘পদ্ম আপা, আমি মিঠি। ওরা আমাকে জোর করে তুলে নিয়ে যাচ্ছে। আমাকে বাঁচাও।’
পদ্মজা ভালো করে খেয়াল করে চিনতে পারল মিঠিকে। অর্জুন মিঠির গালে শরীরের সব শক্তি দিয়ে থাপ্পড় মেরে রাজুকে বলল, ‘এরে ঘাড়ে উঠা। এই আপনি সরেন। মাঝে হাত ঢুকাবেন না। বিরক্ত করা একদম পছন্দ না আমার।’
পদ্মজা বাধা হয়ে দাঁড়াল, দেখো, মা জাতিকে এভাবে অপমান করতে নেই। হাতে ক্ষমতা পেয়েছো সৎভাবে চলো। সবার ভালোবাসা পাবে। এভাবে অন্যের ইজ্জত নষ্ট করছো সেই সঙ্গে নিজেদের পাপী করছো।’
‘এই ফুট এখান থেকে। নীতি কথা শোনাতে আসছে!’ অর্জুন পদ্মজাকে ঠেলে সরিয়ে দিতে চাইল।
পদ্মজা জায়গায় অটল থেকে বলল, ‘ভালোভাবে বলছি, ভেজাল না করে ছেড়ে দাও। নারীকে নারীরূপে থাকতে দাও। শক্ত হতে বাধ্য করো না।’
অর্জুন রাগে দাঁতে দাঁত কামড়ে বলল, ‘আর একটা কথা বললে জামাকাপড় খুলে মাঠে ছেড়ে দেব।’
কথাটা শেষ করে চোখের পলক ফেলতে পারল না। তার আগেই পদ্মজার পাঁচ আঙুলের দাগ বসে যায় অর্জনের ফরসা গালে। অর্জুন রক্তিম চোখে কিড়মিড় করে তাকাল। মিঠিকে ছেড়ে চেপে ধরল পদ্মজার গলা। পদ্মজা সঙ্গে সঙ্গে লাথি বসিয়ে দিল অর্জুনের অণ্ডকোষ বরাবর। কোঁকিয়ে উঠে অণ্ডকোষে দুই হাত রেখে বসে পড়ে অর্জুন। রাজু গালিগালাজ করে পদ্মজার দিকে তেড়ে আসে। পদ্মজা মেঝে থেকে ইট তুলে ছুঁড়ে মারে রাজুর মাথা লক্ষ্য করে। ভয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলল মিঠি।
রাজুর কপাল ফেটে রক্তের ধারা নামছে। অর্জুন আকস্মিক তেড়ে এসে পদ্মজার নিকাব টেনে খুলল; পদ্মজার ঘোলা চোখের ভয়ংকর চাহনি, রক্তজবার মতো ঠোঁটের কাঁপুনি অর্জুনের অন্তর কাঁপিয়ে তুলে। কিন্তু সে থামল না, প্রস্তুত হলো হামলা করতে। পদ্মজা তার কাঁধের ব্যাগ থেকে ছুরি বের করে টান বসাল অর্জুনের গলায়। এই দৃশ্য দেখে মিঠির শরীর কাঁপতে থাকে। অর্জুন চিৎকার করে বসে পড়ে। গলায় হাত দিয়ে দেখে গলাটা তখনো শরীর থেকে আলাদা হয়ে যায়নি! চামড়া ছিঁড়েছে শুধু। তার হৃৎপিণ্ড মাত্রই যেন মৃত্যুর সাক্ষাৎ পেল। পদ্মজার অভিজ্ঞ হাত তার কলিজা শুকিয়ে দিয়েছে। মেঝেতে বসে হাঁপাচ্ছে সে। পদ্মজা ছুরির রক্ত অর্জুনের গেঞ্জিতে মুছে বলল, ‘তোমাদের ভাগ্য ভালো পদ্মজার হাতে পড়েছো। হেমলতার হাতে পড়োনি।
মিঠিকে প্রশ্ন করল, ‘আমার জানামতে তুমি প্রথম বর্ষে আছো। তোমার অন্য ভবনের দ্বিতীয় তলায় থাকার কথা। এখানে আসলে কী করে?
মিঠির ভয় এখনও পুরোপুরি কাটেনি। সে ঠোঁট ভিজিয়ে নিয়ে বলল, ‘আমি গত কয়দিন অসুস্থ ছিলাম। ক্যাম্পাসে যেতে পারিনি। অর্জুন দাদা নাজমাকে দিয়ে আমাকে ডেকেছিল।’
‘অমনি চলে এসেছো? কয়দিন আগে তৃতীয় বর্ষের একটা মেয়ের কী হাল হয়েছে দেখোনি, শুনোনি? এরপরও এদের ডাকে সাড়া দিলে কেন?’
‘না দিয়েও উপায় নাই।’
পদ্মজা আর কথা বাড়াল না। মিঠিকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে কামরা থেকে। নিকাব পরতে পরতে বলল, ‘এসব বেশিদিন সহ্য করা যায় না। মেয়েরা হলে এসে থাকে পড়াশোনার জন্য। এসব নির্যাতনের স্বীকার হওয়ার জন্য নয়! তোমার চেনাজানা যারা এদের নির্যাতনের ভুক্তভোগী তাদের সবার নামের তালিকা আমাকে দিতে পারবে?’
মিঠি জানতে চাইল, ‘কেন?
‘সবাইকে নিয়ে প্রশাসনের কাছে যাব। তাদের নীরবতা আর মেনে নেব না। ক্যাম্পাসে আসার পর থেকে নেতাদের অপকর্ম দেখছি। থামানোর চেষ্টা করেছি। একজন, দুজন থামে আরো দশজন বাড়ে। এইবার আমাদের আন্দোলন করতে হবে।’
মিঠি মিনমিনিয়ে বলল, ‘কেউ ভয়ে আন্দোলন করতে চায় না। শুনেছি, অনেকবার দিন তারিখ ঠিক হয়েছে। এরপর যাদের আসার কথা ছিল তাদের মধ্যে আশি ভাগই আসত না। অনেককেই বাসায় আক্রমণ করা হয়েছে।’
পদ্মজার বুক ফুঁড়ে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। সমাজে মেয়েরা এত দুর্বল! তাদের দেহের লুকায়িত আকর্ষণীয় ছন্দগুলো না থাকলে হয়তো তারাও সাহসী হতো। ছন্দ হারানোর ভয় থাকত না। কাউকে ভয় পেতে হতো না।
পদ্মজা মিঠিকে বলল, ‘তুমি বরং কয়দিন বাড়ি থেকে ঘুরে আসো। এখানে থাকা তোমার জন্য এখন বিপজ্জনক। আমি আগামীকাল গ্রামে যাচ্ছি। আমার আম্মার মৃত্যুবার্ষিকী। ছোটো বোনের মেট্রিক পরীক্ষা দেড় মাস পর। আরেক বোনের বিয়ে দেওয়ার কথা ভাবছি। দেড়-দুই মাসের মতো গ্রামে থাকব। এরপর এসে এই নেতাদের ব্যবস্থা করব। তোমাদের বর্ষের শিখা আছে না? মেয়েটা বেশ সাহসী। ওর মতো আরো কয়টা মেয়ে পাশে থাকলেই হবে। তুমি যাও এখন। দ্রুত বাড়ি ফেরার চেষ্টা করো। যতক্ষণ এখানে আছো একা চলাফেরা কোরো না। শিখাও তো মনে হয় হলেই থাকে?
‘জি।’
‘ওর সঙ্গে থেকো।’
‘কখনো কথা হয়নি।’
‘এখন তো ক্যাম্পাসে বোধহয়। আচ্ছা বিকেলে আমি আবার আসব। ওর সঙ্গে কথা বলব। আমি আসছি এখন।
‘পদ্ম আপা?’
পদ্মজা তাকাল। মিঠি পদ্মজাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলল। ভেজাকণ্ঠে বলল, ‘অনেক ধন্যবাদ তোমাকে। আমি খুব ভয় পেয়েছিলাম।’
‘বাঁচার সংগ্রামে ভীতু হলে চলে না, মিঠি।’
‘ভেবেছিলাম জীবনটা শেষ হয়েই গেল বুঝি।
‘কখনো এমন ভাববে না। বিপদে সামর্থ্য মতো যা পারো করবে। শরীরের শক্তি নিশ্চয় কম নয়। মনের জোরটা কম। সেই জোরটা বাড়াবে। মনের জোর বাড়াতে টাকা লাগে না। কঠিন জীবন সহজ করে তোলার দায়িত্ব নিজেরই নিতে হয়।
মিঠি মাথা তুলে তাকাল। একটু সরে দাঁড়িয়ে চোখের জল মুছে বলল, দ্রুত ফিরবে, পদ্ম আপা। আমরা আমাদের নিরাপত্তার যুদ্ধে নামব।’
পদ্মজা হেসে বলল, ‘ফিরব। দ্রুত ফিরব।’
.
গাড়ি বাড়ির উদ্দেশ্যে ছুটছে। বাড়ির নাম আগে ছিল, আমির ভিলা। বছর ঘুরতেই আমির বাড়ির নাম পালটে দিল—পদ্ম নীড়। পদ্মজা জানালার কাচ তুলে বাইরে তাকাল। রাস্তাঘাটে মানুষজন কম। ঠান্ডা বাতাস। সূর্যের আলোয় একদমই তেজ নেই। যেন থুড়থুড়ে বুড়ো হয়ে গেছে। পদ্মজা আকাশপানে তাকিয়ে তিনটা প্রিয় মুখকে খোঁজে। চোখ দুটি টলমল করে ওঠে। কোথায় আছে তারা? আবার কবে হবে দেখা? পদ্মজা কাচ নামিয়ে দিল। রুমাল দিয়ে চোখের জল মুছে সিটে হেলান দিয়ে চোখ বুজল।
.
নিস্তব্ধ বিকেল ঘন কুয়াশায় ঢেকে আছে অলন্দপুরের আটপাড়া। সেই নিস্তব্ধতা ভেঙে যায় নূপুরধ্বনিতে। পূর্ণার চঞ্চল কাদামাখা দুটি পা দৌড়ে ঢুকে মোড়ল বাড়ি। পায়ের নূপুরজোড়া রিনঝিন রিনঝিন সুর তুলে ছন্দে মেতেছে। পরনে লাল টুকটুকে শাড়ি। আঁচল কোমরে গোঁজা। শাড়ি গোড়ালির অনেক ওপরে পরেছে।
.
বাড়িতে ঢুকেই চেঁচিয়ে ডেকে উঠল, ‘বড়ো আম্মা। ও বড়ো আম্মা।’
বাসন্তী রান্নাঘর ছেড়ে দৌড়ে আসেন। হাতের চুড়িগুলো ঝনঝন করে ওঠে। মুখে বয়সের কিঞ্চিৎ ছাপ পড়েছে। পূর্ণাকে এভাবে হাঁপাতে দেখে প্ৰশ্ন করলেন, ‘বাড়িতে ডাকাত পড়ছে?’
‘আপার চিঠি।’ পূর্ণা হাতের খামটা দেখিয়ে বলল।
আপার চিঠি শুনে পড়া রেখে প্রেমা ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। ওড়না দিয়ে ঘোমটা টানা। ষোড়শী মনে বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই। সবার চেয়ে আলাদা হয়েছে। খুব ভীতু এবং লাজুক সে। পূর্ণা বড়ো বোন হয়ে সারাদিন বনবাদাড়ে ঘুরে বেড়ায়। আর সে ঘরে বসে পড়ে, বাড়ির কাজ করে। স্কুলে যায়। পদ্মজার কথামতো প্রতিদিনের রুটিন অনুসরণ করে। সে বলল, ‘কী বলেছে আপা? চিঠিটা দাও।’
পূর্ণা কপাল কুঁচকে বলল, ‘তোর পড়তে হবে না। বলছে, মাঘ মাসের ১৯ তারিখ আসছে। অনেকদিন থেকে যাবে।’
‘আজ কত তারিখ?’ প্রশ্ন করলেন বাসন্তী।
পূর্ণা কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল, ‘১৯ মাঘ।’
বাসন্তীর চোখ দুটি যেন কোটর থেকে বেরিয়ে আসতে চাইল।
বিস্ফোরিত কণ্ঠে বললেন, ‘আজই! বিকেল তো হয়ে গেছে।’
পূর্ণা অস্থির হয়ে বাসন্তীর কাছে দৌড়ে আসে। দুই হাতে ধরে করুণ স্বরে বলল, ‘তাড়াতাড়ি সালোয়ার কামিজ বের করো। এভাবে দেখলে একদম মেরে ফেলবে আপা।’
বাসন্তী আরোও করুণ স্বরে বললেন, ‘মা, আমি আগে আমার রূপ পালটাই। তুমি তোমারটা খুঁজে নাও।’
কথা শেষ করেই বাসন্তী ঘরের দিকে চলে যান। বুক দুরুদুরু কাঁপছে। পরনে ঝিলমিল, ঝিলমিল করছে টিয়া রঙের শাড়ি। দুই হাতে তিন ডজন চুড়ি। কপালে টিপ, ঠোঁটে লিপস্টিক। এ অবস্থায় পদ্মজা দেখলে কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে। তিনি সাজগোজ পূর্ণার কথায় ছেড়ে দিয়েছিলেন। এরপর পূর্ণার কথাতেই দুজন মিলে আবার শুরু করেছেন। পদ্মজা এক-দুই দিনের জন্য প্রতি শীতে বাড়ি আসে তখন সব রং-বেরঙের জিনিস লুকিয়ে রাখা হয়। পূর্ণা চিঠি প্রেমার হাতে দিয়ে ঘরে গেল। ট্রাঙ্ক খুলে সাদা-কালো রঙের সালোয়ার কামিজ বের করে পরে নিলো দ্রুত। হাতের চুড়ি খুলতে গিয়ে ভেঙে গেল কয়েকটা। অন্যবার দুই-তিন দিন আগে চিঠি আসে। আর আজ যেদিন পদ্মজা আসছে সেদিনই চিঠি আসতে হলো! দশ দিন আগে চিঠি পাঠিয়েছে পদ্মজা। ডাকঘর থেকেই দেরি করেছে। পূর্ণা মনে মনে ডাকঘরের কর্মচারীদের গালি দিয়ে চোদ্দোগুষ্ঠি উদ্ধার করে দিচ্ছে। সে দ্রুত জুতা পরে বারান্দায় এসে প্রেমাকে তাড়া দিল, ‘জলদি পানি নিয়ে আয়।’
প্রেমার বেশ লাগছে। সে মনেপ্রাণে দোয়া করছে, বড়ো আপা এখুনি এসে যাক আর দেখুক ছোটো আপার সাজগোজ। কিন্তু প্রকাশ্যে পূর্ণার আদেশ রক্ষার্থে কলসি নিয়ে কলপাড়ের দিকে গেল সে। পূর্ণা মনে মনে আয়তুল কুরসি পড়ছে! এই বুঝি পদ্মজা এসে গেল! গতবার মার তো খেয়েছেই, তার সঙ্গে পদ্মজা রাগ করে তিন মাস চিঠি লেখেনি। বাতাসের বেগে পাতায় মড়মড় আওয়াজ হচ্ছে। আর পূর্ণার মনে হচ্ছে, এই তো তার রাগী আপা হেঁটে আসছে। নাহ, পানির জন্য অপেক্ষা করা যাবে না। পূর্ণা কলপাড়ে ছুটে যায়। কলসি থেকে পানি নিয়ে পায়ের কাদা, ঠোঁটের লিপস্টিক ধুয়ে ফেলে। কপালের টিপ খুলে লাগিয়ে রাখল কলপাড়ের দেয়ালে। হাতের চুড়ি, গলার হার, কানের বড়ো বড়ো দুল ট্রাঙ্কের ভেতর রেখে এসেছে। পায়ের দিকে আবার চোখ পড়তেই আঁতকে উঠল নূপুরজোড়া হাঁটার সময় অনেক আওয়াজ তোলে। এ রকম নূপুর পরা নাকি ইসলামে নিষেধ। আবার দৌড়ে গেল ঘরে। দৌড়াবার সময় বার বার হুমড়ি খেয়ে পড়তে গিয়েও নিজেকে সামলে নিচ্ছে। নূপুর দুটো খুলে ট্রাঙ্কের ভেতর রেখে ধপ করে মাটিতে বসে লম্বা করে শ্বাস নিলো। বিড়বিড় করে বলল, ‘বাঁচা গেল!’
পরমুহূর্তেই হাঁটুতে থুতনি রেখে মিষ্টি করে হাসল একবার, আজ তার আপা আসবে। তার জীবনের সবচেয়ে দামি এবং ভালোবাসার মানুষটা আসবে। ঈদের আনন্দের চেয়েও বেশি এই আনন্দ।
পূর্ণা মাথায় ঘোমটা টেনে রান্নাঘরে গেল। প্রায় বছরখানেক পর আবার রান্নাঘরে ঢুকেছে সে। বাসন্তী সাদা রঙের শাড়ি পরেছেন। তাড়াহুড়ো করে এটা ওটা রাঁধছেন। পূর্ণা সাহায্য করার জন্য হাত বাড়ালে বাসন্তী বললেন, ‘প্রান্তরে বলো, লাল রঙের দাগ দেয়া রাজহাঁসটা ধরে জবাই করতে।’
পূর্ণা চুলায় লাকড়ি আরেকটা দিয়ে লাহাড়ি ঘরের দিকে এগোয়। প্রান্তকে লাহাড়ি ঘরেই বেশি পাওয়া যায়। প্রেমা বড়ো বোনের জন্য মায়ের ঘরটা গুছাচ্ছে।
৪৮
ইট-পাথরের শহরের সবই কৃত্রিম। কৃত্রিমতা ছেড়ে ছায়ায় ঘেরা মায়ায় ভরা গ্রাম, আঁকা-বাঁকা বয়ে চলা নদীনালা, খাল-বিল, সবুজ শ্যামল মাঠের প্রাকৃতিক রূপ দেখে তৃষ্ণার্ত নয়নের পিপাসা মিটাতে গিয়ে পদ্মজা আবিষ্কার করল, তার চোখে খুশির জল! সবেমাত্র অলন্দপুরের গঞ্জের সামনে ট্রলার পৌঁছেছে। ট্রলারটি হাওলাদার বাড়ির। আলমগীর ও মগা ট্রলার নিয়ে রেলষ্টেশনের ঘাটে অপেক্ষা করছিল। আমির পদ্মজার পাশ ঘেঁষে দাঁড়াতেই পদ্মজা বলল, ‘ইচ্ছে হচ্ছে জলে ঝাঁপ দেই।’
আমির আঁতকে উঠল, ‘কেন?’
পদ্মজা আমিরের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসল। বলল, ‘অল্পতে ভয় পেয়ে যান কেন? বলতে চেয়েছি, অনেকদিন পর চেনা নদীর জল দেখে ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছে হচ্ছে। ডুব দিতে ইচ্ছে হচ্ছে।’
আমির এক হাতে পদ্মজার বাহু চেপে ধরে নিজের সঙ্গে মিশিয়ে বলল, ‘তাই বলো!’
পদ্মজা চোখ তুলে আমিরের দিকে তাকাল। আমিরের গাল ভরতি দাড়ি ঘন হয়েছে। চোখের দৃষ্টি গাঢ়, তীক্ষ্ণ। পঁয়ত্রিশ বছরের পুরুষ! অথচ একটা সন্তান নেই। বাবা ডাক শুনতে পারে না। মানুষটার জন্য দুঃখ হয়। পদ্মজা গোপনে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল।
আজানের ধ্বনি ভেসে আসছে। ট্রলার মোড়ল বাড়ির ঘাটে এসে ভিড়ল। বাড়ির দিকে তাকাতেই প্রথমে চোখে পড়ে রাজহাঁসের ছুটে চলা। ঝাঁক ঝাঁক রাজহাঁস দৌড়ে বাড়ির ভেতর ঢুকছে।
হাঁসের প্যাক প্যাক শব্দে চারিদিক মুখরিত। ট্রলারের শব্দ শুনে পূৰ্ণা- প্রেমা-প্রান্ত ছুটে এলো ঘাটে। প্রথমে এলো পূর্ণা। পদ্মজা প্রথম সিঁড়িতে পা রাখতেই পূর্ণা জান ছেড়ে ডেকে উঠল, ‘আপা।’
পূর্ণাকে এভাবে ছুটে আসতে দেখে পদ্মজা ভয় পেয়ে গেল। সাবধান করতে বলল, ‘আস্তে পূৰ্ণা।
বলতে বলতে সিঁড়িতে পা পিছলে গেল পূর্ণার। পদ্মজা দ্রুত তাকে আঁকড়ে ধরে। এখনই অঘটন ঘটে যেত! পদ্মজা পূর্ণাকে ধমক দিতে প্রস্তুত হয়, তখনই পূর্ণা শক্ত করে জড়িয়ে ধরল পদ্মজাকে। বুকে মাথা রেখে হাঁপাতে হাঁপাতে উচ্চারণ করল, ‘আপা! আমার আপা!’
বুক বিশুদ্ধ ভালোলাগায় ছেয়ে গেল পদ্মজার। মৃদু হেসে পূর্ণাকে কিছু বলার জন্য উদ্যত হতেই প্রেমা-প্রান্ত এসে জড়িয়ে ধরল তাকে। পদ্মজা তিনজনের ভার সামলাতে না পেরে শেষ সিঁড়ি থেকে নদীর জলে পড়েই যাচ্ছিল, ট্রলারের শীর্ষভাগে দাঁড়িয়ে থাকা আমির দুই হাতে দ্রুত পদ্মজাকে আঁকড়ে ধরে তার খুঁটি হলো। পদ্মজা চোখ বন্ধ করে ফেলেছিল। যখন বুঝতে পারল সে পড়েনি, তার ভাইবোনেরাও পড়ে যায়নি—তখন চোখ খুলল। ঘাড় ঘুরিয়ে স্বামীর মুখ দেখে হাসল। আমির পদ্মজাকে সোজা হয়ে দাঁড়াতে সাহায্য করে। পূর্ণা-প্রেমা হেঁচকি তুলে কাঁদছে! খুশিতে কেউ এভাবে কাঁদতে পারে? পদ্মজার ভালো লাগছে। বাসন্তীকে দূরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে পদ্মজা তার ভাই-বোনদের বলল, ‘তোরা কী বাড়িতে ঢুকতে দিবি না?’
পূর্ণা চোখের জল মুছতে মুছতে বলল, ‘চলো।’
পদ্মজা সিঁড়ি ভেঙে বাসন্তীর সামনে এসে দাঁড়াল। সাদা রঙের শাড়ি পরে ছলছল চোখে তাকিয়ে থাকা এই মানুষটার প্রতি পদ্মজার অনেক ঋণ। মোর্শেদ স্ত্রী হারানোর শোকে খাওয়াদাওয়া ছেড়ে দিয়েছিলেন। হেমলতা মারা যাওয়ার ছয় মাসের মাথায় তিনিও পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেন। ফেলে যান দুটি কিশোরী মেয়ে, বউ এবং একমাত্র ছেলেকে। অর্থনৈতিক সমস্যা দেখা দিল, সংসার চলে না। আমির সাহায্য করতে চেয়েছিল। পদ্মজার আত্মসম্মানে লাগে। সে কিছুতেই স্বামীর টাকা বাবার বাড়ির সংসারে ঢালবে না। নিজেরও কাজ করার উপায় ছিল না। এমতাবস্থায় বাসন্তী চাইলে ফেলে চলে যেতে পারতেন। তিনি যাননি। এক পড়ন্ত বিকেলে পদ্মজাকে বললেন, ‘নকশিকাঁথা সেলাই করতে পারি আমি। শখে সেলাই করতাম। দুই তিনজন পয়সা দিয়ে কিনতে চাইত। টাকার দরকার ছিল না, তাই বিক্রি করিনি। তুমি বললে আমি নকশিকাঁথা গঞ্জে বেঁচার চেষ্টা করতাম।’
পদ্মজা সেদিন অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিল। সায় পেয়ে বাসন্তী ছুটে ঘরে যান। একটা নকশিকাঁথা এনে পদ্মজাকে দেখান। অসম্ভব সুন্দর হাতের কাজ! আমির নকশিকাঁথাটি দেখে মুগ্ধ হয়ে যায়। সঙ্গে সঙ্গে বলল, ‘বড়ো ভাইয়া যতবার ঢাকা যাবে নকশিকাঁথা দিয়ে দিবেন। শহরে নকশিকাঁথার অনেক চাহিদা রয়েছে। আপনাদের সমস্যা কিছুটা হলেও ঘুচবে। এক কাজ করলেই তো পারেন আরো দুই-তিনজনকে নিয়ে নকশিকাঁথা বানানো শুরু করেন। তাহলে অনেকগুলি হবে। তাদের পারিশ্রমিক দিয়ে দিবেন। ঢাকা বিক্রির পর দ্বিগুণ টাকা আসবে।’
এ প্রস্তাবে পদ্মজা অমত করল না। সেদিন থেকে বাসন্তী দুই হাতে দিনরাত পরিশ্রম করছেন। পূর্ণাকে মেট্রিক অবধি পড়ালেন। প্রেমা-প্রান্তকে এখনও পড়াচ্ছেন। পূর্ণার যেকোনো আবদার পূরণ করে চলেছেন। বাসন্তীর পা ছুঁয়ে পদ্মজা সালাম করল। বলল, ‘কেমন আছেন আপনি?’
‘ভালো আছি মা। তুমি, জামাইবাবা সবাই ভালো আছোতো?’
‘আলহামদুলিল্লাহ, ভালো আছি। আগের চেয়ে শুকিয়েছেন। ত্বক ময়লা হয়েছে। নিজের যত্ন নেওয়া কি ভুলে গিয়েছেন?’
বাসন্তী চোখ নামিয়ে হাসলেন। এক হাতে নিজের মুখশ্রী ছুঁয়ে বললেন, ‘সেই বয়স কী আর আছে? বিধবা মানুষ! ‘
‘পূর্ণা খুব জ্বালায় তাই না? বাধ্য করে রঙিন শাড়ি পরতে, সাজতে!’ বাসন্তী চমকে তাকালেন। পদ্মজা হাসছে। পূর্ণা মাথায় ব্যাগ নিয়ে পদ্মজার পাশে এসে দাঁড়াল। আহ্লাদী কণ্ঠে অভিযোগ করল, ‘আপা, তুমি নাকি মুচির সঙ্গে আমার বিয়ে দিতে এসেছো?’
পদ্মজা হাসি প্রশস্ত হয়। আমিরকে এক পলক দেখে পূর্ণার দিকে তাকাল। বলল, ‘কে বলেছে? তোর ভাইয়া?’
পূর্ণা আমিরকে ভেংচি কেটে পদ্মজাকে বলল, ‘আর কে বলবে? আপা আমি মুচি বিয়ে করব না। আমার ফরসা, চকচকে জামাই চাই।’
মগা পূর্ণাকে রাগানোর জন্য বলল, ‘মেট্রিক ফেল করা ছেড়িরে ধলা জামাই হাঙ্গা করব না।’
পূর্ণা কিড়মিড় করে উঠে। পদ্মজা পূর্ণার গাল টেনে দিয়ে বলল, আচ্ছা, এসব নিয়ে পরে আলোচনা হবে। চারপাশ অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে। বাড়িতে চল।
দুই হাতে দুই ভাই-বোনকে জড়িয়ে ধরে বাড়ির উঠানে পা রাখে সে। সতেজ হয়ে জামাকাপড় পালটে নেয়। রাজহাঁস ভুনা আর গরম গরম ভাতের ভোজন হয়। সঙ্গে আলমগীর ও মগা ছিল। আলমগীর বাড়ি ফেরার আগে আমির-পদ্মজাকে বলে যায়, ‘আগের স্মৃতি আর কতদিন বুকে রাখবি? দাদু মরার পথে। চাচি আম্মা আত্মগ্লানি আর তোদের না দেখার শোকে শুকিয়ে কঙ্কাল হয়ে গেছে। এবার অন্তত বাড়িতে আসিস। অনুরোধ রইল আমার। পদ্মজা তুমি আমিরকে বোঝোও।’
পদ্মজা আশ্বস্ত করে বলল, ‘এবার বাড়ির সবাইকে গিয়ে দেখে আসব। আপনি নিশ্চিন্তে যান।’
‘অপেক্ষায় থাকব।’
আলমগীর, মগা চলে যেতেই আমির পদ্মজাকে বলল, ‘তুমি গেলে যাও, আমি যাব না।’
‘এবার যাওয়া উচিত। অনেক তো হলো। চার বছর কেটেছে। ওই রাতটা আজীবন বুকে তাজা হয়ে থাকবে। তাই বলে সম্পর্ক ছিন্ন করতে পারি না। ইসলামে সম্পর্ক ছিন্ন করা হারাম।’
‘ওই বাড়িতে গেলে আমার দমবন্ধকর কষ্ট হয়, পদ্মজা।’
‘সে তো আমারও হয়। কিন্তু আম্মার কথা খুব মনে পড়ে। আম্মার তো কোনো দোষ ছিল না। তবুও শাস্তি পাচ্ছেন।’
‘ছিল দোষ।’
‘যে আসল দোষী তার দেখা আজও পেলাম না। যিনি দোষী না তিনি সবার চোখে দোষী।’
‘আম্মা সেদিন কেন ঘুমিয়ে পড়েছিলেন? এটাই আম্মার দোষ।’
‘জোর করে ঘুম আটকে রাখা যায়? আমরা আগামীকাল যাচ্ছি, এটাই শেষ কথা।’
‘পদ্ম…’
আমিরের বাকি কথা শুনল না পদ্মজা। সে দ্রুত হেঁটে হেমলতার ঘরের দিকে এগোল। হেমলতার ঘরের দরজা খুলতেই অদ্ভুত একটা অনুভূতি হয়, বুকের ভেতর বয়ে যায় শিহরণ। ছয় বছর আগের মতোই সব। নেই শুধু আম্মা! পদ্মজা ধীর পায়ে ঘরে ঢুকল। হেমলতার শাড়ি বের করে ঘ্রাণ শুঁকল আলমারি খুলে। বুকের সঙ্গে জড়িয়ে রাখল অনেকক্ষণ। গাল বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে মাটিতে, হাউমাউ করে কান্নাটা অনেকদিন ধরে আসে না। কষ্টগুলো চেপে থাকে বুকের ভেতর। পূর্ণা দরজার ওপাশে দাঁড়িয়ে আছে, দেখছে তার আপাকে। পদ্মজা বার বার নাক টানছে। অজস্র চুমুতে ভরিয়ে দিচ্ছে মায়ের শাড়ি। যেন সে শাড়ি না, তার মাকেই চুমু দিচ্ছে! পূর্ণার মন ব্যথায় ভরে ওঠে। তার কী মায়ের জন্য কষ্ট হচ্ছে, নাকি আপার কান্না দেখে?
জানে না পূর্ণা। শুধু উপলব্ধি করছে, তার কান্না পাচ্ছে।
কান্নার শব্দ শুনে পদ্মজা ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল। পূর্ণাকে কাঁদতে দেখে দ্রুত চোখের জল মুছে হাতের শাড়িটা রেখে দিল আলমারিতে। ডাকল, ‘এদিকে আয়।’
পূর্ণা ফোঁপাতে ফোঁপাতে এগিয়ে আসে। পদ্মজা বিছানায় বসলে, পূর্ণা তার কোলে মাথা রেখে কাঁচুমাচু হয়ে শুয়ে পড়ল। পদ্মজা বলল, ‘বয়স একুশের ঘরে। মনটা তো সেই চৌদ্ধ-পনেরো বছরেই পড়ে আছে।’
পূর্ণা পদ্মজার এক হাত মুঠোয় নিয়ে বলল, ‘আমার খুব কান্না পাচ্ছে।’
‘কাঁদিস না।’
‘ঠেলেঠুলে বেরিয়ে আসছে।’
‘থামানোর চেষ্টা কর।’
‘থামছে না।’
তুই তো আরো কাঁদছিস।’
‘বেড়ে যাচ্ছে তো।’
পদ্মজা ঠাস করে পূর্ণার গালে থাপ্পড় বসিয়ে দিল। সঙ্গে সঙ্গে থেমে গেল পূর্ণার কান্না। সে চোখ বড়ো বড়ো করে তাকাল। পদ্মজা আওয়াজ করে হেসে উঠে। পূর্ণা উঠে হাত ঝাড়তে ঝাড়তে হেসে এমনভাবে, ‘থেমে গেছে বলল যেন বিশ্বজয় করেছে!
আরো বেড়ে গেল পদ্মজার হাসি। মুখে হাত চেপে হাসি আটকানোর চেষ্টা করছে। হাসতে হাসতে চোখের কার্নিশে জল জমে টইটুম্বুর অবস্থা। পূর্ণা কখনোই কান্না নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। থামাতে বললে, আরো বেড়ে যায়। ব্যাপারটা যে কেউ উপভোগ করে।
প্রেমা ঘরে ঢুকে অভিমানী কণ্ঠে শুধাল, ‘আমাকে ছাড়া কী কথা নিয়ে হাসা হচ্ছে?’
পদ্মজা হাসতে হাসতে বলল, ‘পূর্ণা কাঁদছিল। থামাতে পারছিল না।’
প্রেমা হেসে বিছানায় উঠে দুই পা ভাঁজ করে বসে বলল, ‘বড়ো আপা, ছোটো আপা কিন্তু নামাজ পড়ে না।’
পদ্মজা হাসি থামিয়ে পূর্ণার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তুই নামাজ পড়িস না কেন? চিঠিতে তো বলিস অন্য কথা।’
পূর্ণার ইচ্ছে হচ্ছে প্রেমাকে লবণ-মরিচ দিয়ে ক্যাচ ক্যাচ করে কাঁচা আমের মতো কামড়ে খেতে। ভালো সময়টা কীভাবে নষ্ট করে দিল বজ্জাত মেয়েটা! কিন্তু এখন পরিস্থিতি সামলাতে হবে। সে পদ্মজাকে বোঝানোর চেষ্টা করল, ‘আপা, বিশ্বাস করো শুধু এক ওয়াক্ত পড়িনি। আর…আর প্রেমাকে আমি আমার…হ্যাঁ আমার চুড়ি দেইনি বলে…’
৩০২ ॥ পদ্মজা
পদ্মজা কথার মাঝে ধমকে উঠল, ‘মিথ্যে বলবি না। কতবার বলেছি, মিথ্যা কথা ছাড়তে। সত্য স্বীকার কর। কীসের কাজ তোর? পড়ালেখা ছেড়েছিস চার বছর হলো। মেট্রিকটা দ্বিতীয় বার দিলি না। বিয়ে করতে চাস না বলে বিয়ের জন্যও জোর করিনি। তার মূল্য কী এভাবে কথা না শুনে দিবি? এমন না এটা আমার আদেশ। যিনি সৃষ্টি করেছেন উনার আদেশ।’
পূর্ণা মাথা নত করে রেখেছে। প্রত্যুত্তরে বলার মতো কিছু নেই। পদ্মজা বিছানা থেকে নামতে নামতে বলল, ‘তোদের সঙ্গে আমি ঘুমাব না।’
প্রেমা আর্তনাদ করে উঠল, ‘আপা, আমার দোষ কী?
পূর্ণা জলদি করে পদ্মজার কোমর জড়িয়ে ধরে। কিছুতেই বোনকে যেতে দিবে না।
পদ্মজা বলল, ‘ছাড় বলছি।’
পূর্ণা আকুতি করে বলল, ‘যেয়ো না। এখন থেকে প্রতিদিন পড়ব। সত্যি বলছি।’
পদ্মজা নরম হলো, ‘সত্যি তো?’
‘সত্যি।’
পদ্মজা এবারের মতো ছেড়ে দেয়। পূর্ণা আড়চোখে প্রেমাকে দেখল। দৃষ্টি দিয়ে যেন হুমকি দিল: আমারও দিন আসবে! সেদিন তোকে বুঝাব মজা!
গ্রামে এলেই আমির প্রান্তর সঙ্গে ঘুমায়। পদ্মজাকে তার বোনদের সঙ্গে ছেড়ে দেয়। আজও তার ব্যতিক্রম হলো না। দুই বোনকে নিয়ে শুয়ে পড়ে পদ্মজা। কত কত গল্প তাদের! পদ্মজা শুধু শুনছে আর হাসছে। প্রেমার মুখ দিয়ে সহজে কথা আসে না, কিন্তু পদ্মজা এলে কথার ঝুড়ি নিয়ে বসে। পূর্ণা নিজের বিয়ে নিয়ে বেশি কথা বলছে, পরিকল্পনা করছে।
তখন প্রেমা ব্যঙ্গ করে বলল, ‘ছোটো আপার লজ্জার লেশমাত্র নেই।’
পূর্ণা খেপে গিয়ে জবাব দিল, ‘তুই যে প্রান্তকে বলছিলি, শহরে গিয়ে সাহসী পুলিশ বিয়ে করবি। আমি কাউকে বলেছি? বলেছি, তোর লজ্জা নাই?’
গোপন কথা ফাঁস হয়ে যাওয়াতে প্রেমা লজ্জায় জবুথবু হয়ে যায়! তার বড়ো আপার সামনে ছোটো আপা কী বলছে! লজ্জায় কান দিয়ে ধোঁয়া বেরোতে থাকে। পদ্মজা হাসল। প্রেমাকে বলল, লজ্জার কিছু নেই। অভিভাবকদের নিজের পছন্দ জানানো উচিত। তোর বিয়ে পুলিশের সঙ্গেই হবে। আর পূর্ণার বিয়ে হবে পূর্ণার পছন্দমতো।’
পদ্মজার কথায় পূর্ণা ভারি খুশি হলো। সে আবেগে আপ্লুত হয়ে বলল, ‘নায়কের মতো জামাই চাই। একদম লিখন ভাইয়ার মতো। আপা, জানো লিখন ভাইয়া এক সপ্তাহ হলো এখানে শুটিং করতে এসেছে।’
পদ্মজা জানতে চাইল, ‘কার বাড়ি?’
‘সাতগাঁয়ের হান্নান চাচার বাড়ি। বিশাল বড়ো টিনের বাড়ি।’
পদ্মজা চুপ হয়ে গেল। এই মানুষটা শুধুমাত্র তার স্মৃতি। কিন্তু মানুষটার জীবনের পুরোটা জুড়ে সে। এই তো মাস চারেক আগে, পদ্মজা পত্রিকা পড়তে বসেছিল। তৃতীয় পৃষ্ঠায় লিখন শাহর ছবির সঙ্গে ওপরের শিরোনাম দেখে বেশ অবাক হয়। শিরোনামে লেখা ছিল, লিখন শাহর পদ্ম ফুল। পদ্মজা আগ্রহ নিয়ে প্রতিটি লাইন পড়েছিল। সাংবাদিক লিখনকে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘ত্রিশ তো পার হয়েছে। বিয়ে করবেন কবে?’
লিখন তখন জানাল, ‘সে যখন আসবে।’
‘আমরা কী জানতে পারি, কে সে? যদি দ্বিধা না থাকে।’
‘জানাতে আমার বাধা নেই। সে পদ্ম ফুল। আমার সাতাশ বছরের কঠিন মনে তোলপাড় তুলে দিয়েছিল। সেই তোলপাড়ের তাণ্ডব বুকের ভেতর আজও হয়। সেই ফুলের সুবাস নাকে আজও লেগে আছে। শুধু আমি তাকে জয় করতে পারিনি।’
লিখন শাহর সাক্ষাৎকারের কথোপকথন বেশ আলোড়ন তুলে দেশে। এরকম একজন সুদর্শন পুরুষকে কোন নারী অবহেলা করেছে? তা নিয়ে মানুষের কত কল্পনা-জল্পনা, আলোচনা-সমালোচনা। পদ্মজার অস্বস্তিকর অনুভূতি হয়।
পূর্ণা পদ্মজাকে মৃদু ধাক্কা দিয়ে ডাকল, ‘ঘুমিয়ে গেলে, আপা?’
‘না। তারপর বল।’ নিস্তরঙ্গ গলায় বলল পদ্মজা।
ঝিঁঝিপোকার ডাক, শিয়ালের হাঁক ভেসে আসছে কানে। রাত গভীর থেকে গভীরতর হচ্ছে। তবুও কথা শেষ হচ্ছে না পূর্ণা-প্রেমার। পদ্মজাও মানা করছে না। বরং অবাক হচ্ছে, তার বোনেরা কত কথা লুকিয়ে রেখেছে তার জন্য!
কাক ডাকা ভোর। ঘন কুয়াশায় চারপাশ ডুবে আছে। বাতাসের বেগ বেশি। ঠান্ডায় ঠোঁট কাঁপছে। পদ্মজার পরনে দামি, গরম সোয়েটার। ওপরে আবার শালও পরেছে। বাসন্তী সুতি সাদা শাড়ি পরে রান্না করছেন। মাঝে মাঝে কাঁপছেন। পদ্মজা দ্রুত পায়ে রান্না ঘরে ঢুকল। বাসন্তী পদ্মজাকে দেখে হেসে বললেন, ‘কিছু লাগবে?’
পদ্মজা খেয়াল করে দেখল বাসন্তীর মুখটা ফ্যাকাসে। ঠান্ডায় এমন হয়েছে। সে শক্ত করে প্রশ্ন করল, ‘আপনার শীতের কাপড় নেই?’
বাসন্তী হেসে বলল, ‘আছে তো।’
‘তাহলে এভাবে শীতে কাঁপছেন কেন? নামাজ পড়ে ঘুমিয়ে পড়তেন। বয়স হয়েছে তো। যান ঘরে যান।’
‘ভাত বসিয়েছি।’
‘আমি দেখব।’
‘সারারাত তো সজাগ ছিলে, আম্মা। তুমি ঘুমাও। আমি রাতে ঘুমিয়েছি।’
‘তাহলে সোয়েটার পরে আসেন।’
বাসন্তী মাথা নত করে বসে রইলেন। পদ্মজা বেশ অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকে। এরপর নিজের গায়ের শাল বাসন্তীর গায়ে দিয়ে বলল, ‘নিজের জন্যও কিছু কেনা উচিত। পূর্ণা বয়সে বেড়েছে, বুদ্ধিতে না। ও পারে না কিছু সামলাতে। শুধু আবদার করতে পারে। যতদিন বেঁচে আছেন নিজের যত্ন নিন। আমি ঘরে যাচ্ছি।’
পদ্মজা রান্নাঘর ছেড়ে বারান্দার গ্রিলে ধরে বাইরে তাকাল। কুয়াশার জন্য বাড়ির গেটও দেখা যাচ্ছে না। সে ঘুরে দাঁড়াল ঘরে ঢোকার জন্য। তখন মনে হলো, উঠানে কে যেন দাঁড়িয়ে আছে। পদ্মজা আবার ঘুরে তাকাল। দেখতে পেল তার শাশুড়ি ফরিনাকে। তীর্থের কাকের মতো তাকিয়ে আছেন। শুকিয়েছে খুব বেশি। গায়ে লাল-সাদা রঙের মিশ্রণে শাড়ি। ফরিনার চারপাশে উড়ো কুয়াশা। কুয়াশার দেয়াল ভেদ করে যেন তিনিই শুধু আসতে পেরেছেন। পদ্মজা হন্তদন্ত হয়ে বের হলো। কাছে এসে দাঁড়াতেই বুকটা হু হু করে উঠল। ফরিনা পদ্মজাকে দেখেই কাঁদতে শুরু করলেন। পদ্মজা ফরিনার খুব কাছে এসে দাঁড়াল, সালাম করল পা ছুঁয়ে। ফরিনার ঠান্ডা দুই হাত ধরে বলল, ‘এত সকালে কেন আসতে গেলেন? আমরা তো যেতামই।’
‘এত রাগ তোমার?’
‘না, আম্মা। আপনার প্রতি কোনো রাগ নেই আমার। আট মাস আপনি আমার যে যত্ন নিয়েছেন মায়ের অভাববোধ করিনি। মনে হয়েছিল, আমার মা ছিল আমার পাশে।’
‘তাইলে কেরে যাও না আমার কাছে? আমার ছেড়ায় কেন মুখ ফিরায়া নিছে আমার থাইকা?’
‘উনি পাগল। আম্মা, আপনি কেমন আছেন? দেখে বোঝা যাচ্ছে, ভালো নেই। আম্মা বিশ্বাস করুন, আপনার প্রতি আমাদের রাগ নেই। ওই বাড়িটা দেখলে খুব কষ্ট হয়, আম্মা। খুব যন্ত্রণা হয়। এজন্য যাই না। আপনাকে অনেকবার চিঠি লিখেছি, ঢাকা গিয়ে কয়দিন থেকে আসার জন্য। গেলেন না কেন?’
ফরিনা অবাক হয়ে বললেন, ‘আমার কাছে তো কুনু চিডি আহে নাই।’
‘সে কী! আমি তো এই চার বছরে ছয়টি চিঠি লিখেছি। পাঠিয়েছিও।’
‘আমি তো পাই নাই।’
ফরিনা চিন্তিত হয়ে পড়লেন। পদ্মজা বলল, ‘আচ্ছা এ ব্যাপারে কথা বলব উনার সঙ্গে। আমি যখন আম্মার কবর জিয়ারত করতে আসি তখনো তো এসে আমাকে আর উনাকে দেখে যেতে পারেন।’
‘তোমরা বাড়িত যাও না বইলা, আমি ভাবছি আমারে ঘেন্না করো তোমরা তাই সামনে আইতে পারি নাই। আমার জন্য আমার নাতনিডা… ‘
ফরিনা হু হু করে কেঁদে উঠলেন। পদ্মজার চোখ ছলছল করে উঠল। সে ফরিনাকে বলল, ‘আপনার জন্য কিছু হয়নি। আপনি এভাবে ভাববেন না। কান্না থামান।
যতই বলো মা, কান্না থামাবে না। চার বছর ধরে এভাবেই কাঁদছে।’ মজিদের কণ্ঠস্বর শুনে পদ্মজা দ্রুত ঘোমটা টেনে নিলো। মজিদকে সালাম করে বলল, ‘ভালো আছেন, আব্বা?’
‘এই তো আছি কোনোমতে।’
‘আম্মা, আপনি কান্না থামান। আমার খারাপ লাগছে।’
ফরিনা আঁচল দিয়ে চোখের জল মুছে বললেন, ‘আমার বাবু কই?’
‘ভেতরের ঘরে ঘুমাচ্ছে। ডেকে দিচ্ছি।’
‘না, থাকুক। ঘুমাক। ‘
পদ্মজা শ্বশুর, শাশুড়িকে সদর ঘরে নিয়ে আসে। আস্তে আস্তে ঘুম ভাঙে সবার। আমির যত যাই বলুক, মাকে দেখেই নরম হয়ে যায়। জড়িয়ে ধরে বাচ্চাদের মতো কাঁদতে শুরু করে। মজিদ ছেলে আর ছেলের বউকে ছাড়া কিছুতেই বাড়ি যাবেন না। কম হলেও চার-পাঁচ দিন থেকে আসতে হবে। অবশেষে আমির রাজি হলো। প্রেমার সামনে পরীক্ষা তাই প্রেমাকে সঙ্গে নিলো না। বাসন্তী, প্রেমা, প্রান্ত বাড়িতে রয়ে গেল। পদ্মজাদের সঙ্গে গেল পূর্ণা।
.
হাওলাদার বাড়ির গেট পেরিয়ে ভেতরে পা দিতেই পদ্মজার সর্বাঙ্গ অদ্ভুত ভাবে কেঁপে উঠল। সূর্য ওঠেনি, দমকা বাতাস হচ্ছে। সেই বাতাসে শোঁ শোঁ শব্দ হচ্ছে। মাথার ওপর দিয়ে বাজপাখি উড়ে গেল একটা, সেই পাখির ডাক অদ্ভুত হাহাকারের মতো। যেন মনের চেপে রাখা কষ্ট ও ক্ষোভ নিয়ে কেউ আর্তচিৎকার করছে। নাকি এটা নিছকই পদ্মজার ভাবনা? চারদিকে চোখ বুলাতে বুলাতে আলগ ঘর পেরিয়ে অন্দরমহলের সামনে এসে দাঁড়াল সে। চার বছর পূর্বে তো এখানে, এই জায়গাটায় তার আদরের তিন মাসের কন্যা পারিজার রক্তাক্ত লাশ পড়ে ছিল! পদ্মজার বুক কেমন করে উঠল! ভীষণ ব্যথা হচ্ছে!
বুকে হাত রেখে সেখানেই দাঁড়িয়ে পড়ল পদ্মজা। আমির উদ্বিগ্ন হয়ে প্রশ্ন করল, ‘খারাপ লাগছে?’
পদ্মজা স্বাভাবিক হয়ে বলল, ‘না।’ থেমে নিশ্বাস নিলো। বলল, ‘পূর্ণাকে দেখুন, কেমন পাগল।’
আমির সামনে তাকাল। পূর্ণা মাথার উপর ব্যাগ নিয়ে সবার আগে বরই খেয়ে খেয়ে কোমর দুলিয়ে হেঁটে যাচ্ছে! অন্দরমহলের সামনে এবং আলগ ঘরের পেছনে টিউবওয়েল বসানো হয়েছে। হেমন্তকালে ধান কাটা হয়েছে, তখন কৃষকরা আলগ ঘরে থেকেছে। তাদের জন্যই এই টিউবওয়েল বসানো হয়েছিল। টিউবওয়েলের চারপাশে গোল করে সিমেন্ট দিয়ে মেঝেও করা হয়েছে। সব মিলিয়ে একটি কলপাড়ের রূপ নিয়েছে।
পূর্ণা নারিকেল গাছের সামনে এসে থমকে দাঁড়াল। কলপাড়ে এক সুদর্শন যুবক পিঁড়িতে বসে গোসল করছে। পরনে লুঙ্গি। রানি গামছা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কী যেন বলছে। পূর্ণা ব্যাগ রেখে হাঁ করে সেই যুবককে পরখ করে। সুঠাম, সুগঠিত শরীর, মায়াবী, ফরসা স্বাস্থ্যোজ্জ্বল ত্বক। প্রশস্ত বুকে ঘন পশম। চওড়া পিঠ। শক্তপোক্ত দেখতে দুই হাত। ডান হাতে ছোটো কলস নিয়ে মাথায় পানি ঢালছে। সেই জল চুল থেকে কপাল, কপাল থেক ঠোঁট, ঠোঁট থেকে বুক বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে। হঠাৎ চুল ঝাঁকি দিয়ে উঠল, জলের ছিটে ছড়িয়ে পড়ে চারিদিকে। রানি যুবকটিকে বকতে বকতে দূরে সরে দাঁড়াল। যুবকটি আবারও মাথায় পানি ঢেলে চুল ঝাঁকায়। উদ্দেশ্য, রানিকে ভিজিয়ে দেয়া। পূর্ণা মুগ্ধ হয়ে গেল। সে দ্রুত মাটিতে ব্যাগ রেখে ওড়না ঠিক করে, চুলের খোঁপা খুলে দিল। ঠোঁট জুড়ে হাসি ফুটিয়ে কলপাড়ের দিকে হেঁটে গেল। তার চোখের দৃষ্টি দেখলে যে কারো মনে হবে, পূর্ণা অপরিচিত এই যুবকটিকে চোখ দিয়ে পিষে ফেলছে। কলপাড়ের পাশে ভেজা কাদা ছিল। পূর্ণা পা রাখতেই পিছলে পড়ে গেল।
ধপাস শব্দ শুনে যুবকটি লাফিয়ে উঠে ভরাট কণ্ঠে চিৎকার করে উঠল, ‘বোয়াল মাছ! বোয়াল মাছ!
৪৯
ঘটনাটি পদ্মজার চোখে পড়তেই সে দৌড়ে আসে। রানি আকস্মিক ঘটনায় হতভম্ব। সে পূর্ণাকে তুলতে দৌড়ে আসতে গিয়ে শাড়ির সঙ্গে পা প্যাঁচ লাগিয়ে পূর্ণার চেয়ে ঠিক এক হাত দূরে আছাড় খেল! এ যেন ধপাস করে পড়ার প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। যুবকটি হাসবে, নাকি সাহায্য করবে বুঝে উঠতে পারছে না। সেকেন্ড দুয়েক ভেবে মনস্থির করল, হাসা ঠিক হবে না। সাহায্য করা উচিত। কলপাড় থেকে এক পা নামাতেই পদ্মজা চলে এসে পূর্ণাকে তোলার চেষ্টা করতে লাগল। যুবকটি রানিকে সাহায্য করে ওঠার জন্য। পদ্মজা উৎকণ্ঠা নিয়ে পূর্ণাকে প্রশ্ন করে, ‘খুব ব্যথা পেয়েছিস?’
পূর্ণার মুখ ঢেকে আছে রেশমি ঘন চুলে। আড়চোখে একবার যুবকটিকে দেখল। মিনমিনিয়ে বলল, ‘না।’
ফরিনা ছুটে এসে বললেন, ‘এইডা কেমনে হইল? এই ছেড়ি এমনে আইলো কেন? ও ছেড়ি, কোনহানে দুঃখ পাইছো?’
পূর্ণা নরম কণ্ঠে বলল, ‘ব্যথা পাইনি।’
‘পাওনি মানে কী? সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছো না। পদ্মজা, ওকে নিয়ে যাও। কাদা মেখে কী অবস্থা!’ বলল আমির।
পদ্মজা আর আমিরকে দেখে রানি প্রচণ্ড অবাক হয়েছে! খুশিতে তার কাঁদতে ইচ্ছে হচ্ছে।
আমিরের পা ছুঁয়ে সালাম করে বলল, ‘দাভাই? তুমি আইছো! পদ্মজা, এতদিনে আমরারে মনে পড়ছে?’
পদ্মজা মৃদু হেসে বলল, ‘তোমাকে সবসময়ই মনে পড়ে, আপা। আমরা পরে অনেক গল্প করব। পূর্ণাকে নিয়ে এখন ভেতরে যাই।’
পদ্মজা আর ফরিনা পূর্ণাকে ধরে ধরে অন্দরমহলে নিয়ে যায়। পিছু পিছু রানিও গেল। যুবকটি আমিরের সামনে এসে দাঁড়াল। হেসে বলল, ‘আসসালামু আলাইকুম আমির ভাই। চিনতে পারতাছেন?’
আমির যুবকটিকে চেনার চেষ্টা করল। বলল, ‘মৃদুল না?’
‘জি ভাই।’
আমিরের হাসি চওড়া হলো। মৃদুলের সঙ্গে করমর্দন করে বলল, ছোটোবেলায় দেখেছি। কত্ত বড়ো হয়ে গেছিস! চেনাই যাচ্ছে না।’
‘আমার ঠিকই আপনারে মনে আছে।’
‘সেই
মৃদুলের বাহুতে আলতো করে থাপ্পড় দিয়ে আমির বলল, ‘ছোটোবেলা তো তুমি করে বলতি। এখন আপনি আপনি বলছিস কেন?’
মৃদুল এক হাতে ঘাড় ম্যাসাজ করে হাসল। এরপর বলল, ‘ষোলো- সতেরো বছর পর দেখা হইছে তো।’
‘তো কী হয়েছে? তুমি বলে সম্বোধন করবি। গোসল করছিলি নাকি?’
‘জি।’
‘কাপড় পালটে আয়, অনেক আলাপ হবে।’
‘আচ্ছা ভাই।’
নারিকেল গাছের পাশে ব্যাগটি পড়ে থাকতে দেখে, এগিয়ে গিয়ে সেটা নিয়ে অন্দরমহলের দিকে গেল আমির।
.
বৈঠকখানায় বসে আছে পদ্মজা। পূর্ণার কোমরে, পায়ে গরম সরিষা তেল মালিশ করে দিয়ে বিশ্রাম নিতে বলেছে। হুমকি দিয়ে এসেছে, ঘর থেকে বের হলে একটা মারও মাটিতে পড়বে না। পূর্ণার মুখ দেখে মনে হয়েছে, আর বের হওয়ার সাহস করবে না। বেশ জোরেই পড়েছে। পা, কোমর লাল হয়ে গেছে। এই বাড়িটা মৃতপ্রায়। আগে তাও মানুষ আছে বলে মনে হতো। এখন মনেই হয় না এই বাড়িতে কেউ থাকে। নির্জীব, স্তব্ধ। রান্নাঘর থেকে বেশ কিছুক্ষণ পর পর টুংটাং শব্দ আসছে। ফরিনা ও আমিনা তাড়াহুড়ো করে রান্না করছেন। আমির বের হয়েছে। বাড়িতে মাত্রই এলো, আর কীসের কাজে বেরিয়েও পড়ল! স্তব্ধতা ভেঙে একটা ছোটো বাচ্চা দৌড়ে আসে পদ্মজার কাছে। বাচ্চাটার কোমরে, গলায় তাবিজ। তাবিজের সঙ্গে ঝনঝন শব্দ তোলা জাতীয় কিছু গলায় ঝুলানো। পদ্মজা বাচ্চাটিকে কোলে তুলে নিলো। রানি বৈঠকখানায় এসে বাচ্চাটিকে বলল, ‘আলো আম্মা, এদিকে আয়। তোর গায়ে ময়লা। পদ্ম মামির কাপড়ে লাগব।
পদ্মজা আলোর গাল টেনে বলল, ‘কিছু হবে না। থাকুক।’
আলোর গালে চুমু দিল পদ্মজা। আলোর বয়স দুই বছর। রানির মেয়ে হয়েছে শুনেছিল পদ্মজা। কিন্তু দেখতে আসতে পারেনি। এবারই প্রথম দেখা। পদ্মজা বলল, ‘আলো ভাগ্যবতী হবে। দেখতে বাপের মতো হয়েছে।’
বাপের মতো হয়েছে কথাটি শুনে রানির মুখ কালো হয়ে যায়। তার প্রথম বাচ্চা মারা যাওয়ার এক বছরের মাথায় সমাজের নিন্দা থেকে বাঁচাতে খলিল হাওলাদার রানির জন্য পাত্র খুঁজতে থাকলেন। কিন্তু কেউই রানিকে বিয়ে করতে চায়নি। সবাই জেনে গিয়েছিল রানি অবৈধ সন্তান জন্ম দিয়েছে, বাচ্চাটিও মারা গেছে। কোনো পরিবার রানিকে ঘরের বউ করতে চাইছিল না। এদিকে বিয়ে দিতে না পেরে সমাজের তোপে আরো বেশি করে পড়তে হচ্ছিল। খলিল হাওলাদার পিতা হয়ে রানিকে ফাঁস লাগিয়ে মারতে চেয়েছিলেন। তখন মজিদ হাওলাদার মদনকে ধরে আনলেন। মদন, মগার বাবা-মা নেই। দুই ভাই এই বাড়িতেই ছোটো থেকে আছে। এই বাড়ির সেবার কাজে নিযুক্ত। বাধ্য হয়ে মদনের সঙ্গে বাড়ির মেয়ের বিয়ে দেওয়া হয়। মদন কামলা থেকে ঘরজামাই হয়। রানি মন থেকে মদনকে আজও মানতে পারেনি। কখনোও পারবেও না। ঘৃণা হয় তার। মাঝে মাঝে আলোকেও তার সহ্য হয় না। আলোর মুখটা দেখলেই মনে হয়, এই মেয়ে মদনের মেয়ে।
কামলার মেয়ে!
আলো আধোআধো স্বরে বলল, ‘নান্না, নান্না।’
পদ্মজা আদুরে কণ্ঠে বলল, ‘নানুর কাছে যাবে?’
আলো পদ্মজার কোল থেকে নামতে চাইলে পদ্মজা নামিয়ে দিল। আলো দৌড়ে গেল রান্নাঘরে। রানি বলল, ‘আম্মার জন্য পাগল এই ছেড়ি। সারাবেলা আম্মার লগে লেপটায়া থাকে।’
‘তুমি নাকি আলোকে মারধোর করো?’
রানি চমকাল। প্রশ্ন করল, ‘কেলা কইছে?’
‘শুনেছি। আলো একটা নিষ্পাপ পবিত্র ফুল। ওর কী দোষ?’
রানি চুপ করে রইল। পদ্মজা বলল, ‘সব রাগ এইটুকু বাচ্চার ওপর ঝাড়া ঠিক না, আপা।’
‘আমার কষ্টডা বুঝবা না, পদ্মজা।’
‘বুঝি। এতটা অবুঝ না আমি। আলো মদন ভাইয়ার মেয়ে এটা ঠিক কিন্তু তোমারও তো মেয়ে। তোমার গর্ভে ছিল। দশ মাস তোমার রক্ত খেয়েছে।’
‘আমি কী আমার ছেড়িরে ভালোবাসি না? বাসি। মাঝে মাঝে খুব রাগ হয়। জানো পদ্মজা, আবদুল ভাইয়ের কথা মনে হইলে আমার সব অসহ্য লাগে। একলা একলা কাঁনদি। তহন আলো কানলে…আমি ওরে এক দুইডা থাপ্পড় মারি। পরে আফসোস হয় কেন মানলাম ছেড়িডারে। ও তো আমারই অংশ।’
‘নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করো। নিয়তির উপর কারো হাত নেই। অতীত ভুলতে বলব না। কিছু অতীত ভোলা যায় না। কিন্তু চাইলেই পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে বাঁচা যায়। নিজেকে মানিয়ে নাও। আলোর প্রতি যত্নশীল হও। মানুষের মতো মানুষ করো। একটা মেয়েকে নিয়ে সমাজে বাঁচা যুদ্ধের মতো। গোড়া থেকে খেয়াল দাও।’
‘তোমার কথা হুনলে বাঁচার শক্তি পাই, পদ্মজা।’
পদ্মজা হাসল। বৈঠকখানায় আমির প্রবেশ করে। তার পেছনে দেখা যায় মৃদুলকে, ছেলেটাকে দেখে হাসল রানি। পদ্মজাকে দেখিয়ে বলল, ‘এই যে এইডা হইছে, পদ্মজা। তোর ভাবি।’
মৃদুল পদ্মজাকে সালাম করার জন্য ঝুঁকতেই পদ্মজা বলল, ‘না, না। কোনো দরকার নেই। বসুন আপনি।’
মৃদুল বসল। বলল, ‘আপনের কথা কথা অনেক শুনছি। আজ দেখার সৌভাগ্য হইলো।’
আমির পদ্মজাকে বলল, ‘ওর নাম মৃদুল। রানির মামাতো ভাই। ছোটোবেলা আমাদের বাড়িতে কয়দিন পর পর আসত। যখন আট-নয় বছর তখন দূরে চলে যায়। আর দেখা হয়নি। চাইলেই দেখা হতো। কেউ চায়নি। তাই দেখাও হয়নি।
‘কোথায় থাকেন?’ জানতে চাইল পদ্মজা।
‘জি ভাবি, রামপুরা।’
রামপুরার কথা পদ্মজা শুনেছে। তাদের জেলার শহর এলাকার নাম রামপুরা। সবাই চেনে। ছেলেটার চেহারা উজ্জ্বল, চকচকে। হাসিখুশি! আলাপে আলাপে জানতে পারল, মৃদুল পদ্মজার চেয়ে দুই বছরের বড়ো। মেট্রিক ফেল করার পর আর পড়েনি। মিয়া বংশের ছেলে।
কথাবার্তায় শুদ্ধ-অশুদ্ধ দুই রূপই আছে। ভীষণ রসিক মানুষও বটে!
খাওয়া-দাওয়া শেষ হওয়ার পর পদ্মজা দোতলায় গেল, সঙ্গে রয়েছে আমির। নুরজাহান বেশ কয়েক মাস ধরে অসুস্থ। শরীরের জায়গায় জায়গায় ঘা। চামড়া থেকে দুর্গন্ধ বের হয়। সারাক্ষণ যন্ত্রণায় আর্তনাদ করেন নুরজাহানের ঘরে ঢুকতেই নাকে দুর্গন্ধ লাগল, নাকে রুমাল চেপে ধরল পদ্মজা। নুরজাহান বিছানার ওপর শুয়ে আছেন। সময়ের ব্যবধানে একেবারে নেতিয়ে গিয়েছেন তিনি। বয়সটা যেন কয়েক গুণ বেড়েছে, হাড় দেখা যাচ্ছে। লজ্জাস্থান ছাড়া পুরো শরীর উন্মুক্ত। এক পাশে লতিফা দাঁড়িয়ে, আর মাথার কাছে বসে আছেন একজন কবিরাজ। একটা কৌটা থেকে সবুজ তরল কিছু নুরজাহানের ক্ষত স্থানগুলোতে লাগাচ্ছেন। পদ্মজা নুরজাহানের বাঁ-পাশে গিয়ে দাঁড়াল। নাক থেকে রুমাল সরিয়ে মানিয়ে নেয়ার চেষ্টা করল দুর্গন্ধের সঙ্গে। ডাকল, ‘দাদু? দাদু…শুনছেন।’
নুরজাহান ধীরে ধীরে চোখ খুললেন। পদ্মজা প্রশ্ন করল, ‘দাদু, খুব কি কষ্ট হয়? কোথায় বেশি যন্ত্রণা?’
নুরজাহান শুধু তাকিয়ে রইলেন। চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ে। পদ্মজার বুকটা হাহাকার করে উঠল। বয়স্ক মানুষটা কত কষ্ট করছে! লতিফা বলল, ‘দাদু কথা কইতে পারে না। খালি কান্দে’
নুরজাহানের অসহায় চাহনি দেখে পদ্মজার চোখ দুটি ছলছল করে উঠল। সে নুরজাহানের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল, ‘আল্লাহর নাম স্মরণ করেন। ইনশাআল্লাহ সব ঠিক হয়ে যাবে। ধৈর্য ধরুন।’ তারপর লতিফাকে বলল, ‘ভালো করে খেয়াল রেখো।’
আমির বেশ অনেকক্ষণ কথা বলল নুরজাহানের সঙ্গে। নুরজাহান জবাব দিলেন না, শুধু উ-আ করলেন। আমিরের দুই চোখ বেয়ে জল পড়ে। পদ্মজার ভালো লাগে না দেখতে। সে আমিরকে বুঝিয়ে-শুনিয়ে বাইরে নিয়ে আসে। বারান্দা পেরোনোর পথে রুম্পার ঘরের দরজা খোলা দেখতে পায়। যাওয়ার সময় তো বন্ধই ছিল। পদ্মজা ঘরের ভেতর উঁকি দেয়। কেউ নেই। পালঙ্কও নেই।
সে অবাক হয়ে আমিরকে প্রশ্ন করল, ‘রুম্পা ভাবি কোথায়?’
আমিরও এসে উঁকি দিল। শূন্য ঘর। সে অবাক স্বরে বলল, ‘জানি না তো।’
পদ্মজা চিন্তায় পড়ে গেল। হেমলতা মারা যাওয়ার পর গ্রামে আর থাকেনি। শহরে ফিরে যায়। এক মাসের মাথায় জানতে পারল, সে গর্ভবতী। গর্ভাবস্থার প্রথম পাঁচ মাস খুব খারাপ যায়। প্রতি রাতে হেমলতাকে স্বপ্নে দেখত। ছয় মাস পড়তেই ফরিনা গ্রামে নিয়ে আসেন। এ সময় পদ্মজার একজন মানুষ দরকার। কাছের মানুষদের দরকার। তাই আমিরও নিষেধ করেনি। তার মধ্যে আবার মোর্শেদ মারা গেলেন। পদ্মজা আরো ভেঙে পড়ে। কাছের মানুষদের সহযোগিতায় বাচ্চার কথা ভেবে নিজেকে শক্ত রাখার চেষ্টা করে। তখন পদ্মজা অনেকবার চেষ্টা করেছে রুম্পার সঙ্গে দেখা করার। কিন্তু মদন আর নুরজাহানের নজরের বাইরে গিয়ে কিছুতেই সম্ভব হয়নি।
এরপর কোল আলো করে এলো ফুটফুটে কন্যা। পদ্মজা তারপরও চেষ্টা চালিয়ে গেল। সারাক্ষণ রুম্পাকে নজরবন্দি করে রাখার ব্যাপারটা তার খটকা বাড়িয়ে তোলে। একদিন সুযোগ পেল।
সেদিন রাতে নুরজাহান, মদন, আমির, রিদওয়ান, আলমগীর সবাই যাত্রাপালা দেখতে গিয়েছিল। দুই তলায় ছিল শুধু পদ্মজা, তার মেয়ে পারিজা আর ফরিনা। ফরিনার দায়িত্বে পারিজাকে রেখে রুম্পার ঘরে যায় পদ্মজা। রুম্পা তখন অচেতন হয়ে পড়ে ছিল নিজের প্রস্রাব-পায়খানার ওপর। পদ্মজা নাকে আঁচল চেপে ধরে সব পরিষ্কার করে রুম্পার জ্ঞান ফেরায়। জানতে পারে: তিন দিন ধরে রুম্পাকে খাবার দেয়া হচ্ছে না। পদ্মজা খাবার নিয়ে আসে। রুম্পাকে খাইয়ে দেয়।
তবে কথা বলার সুযোগ হওয়ার আগেই ফরিনার চিৎকার ভেসে আসে কানে। ফরিনার কাছে পারিজা! পদ্মজার বুক ধক করে উঠে। ছুটে বেরিয়ে যায় সে, ঘরে এসে দেখে ফরিনা নেই। তার আর্তনাদ ভেসে আসছে কানে। পদ্মজা সেই আর্তনাদের সঙ্গে দুমড়ে-মুচড়ে যাচ্ছে। তড়িঘড়ি করে সিঁড়ি বেয়ে নামতে গিয়ে উলটে পড়ে। তবুও ছুটে যায়। ফরিনার কান্নার চিৎকার অনুসরণ করে অন্দরমহলের বাইরে বেরিয়ে আসে। চাঁদের আলোয় ভেসে উঠে তার তিন মাসের কন্যার রক্তাক্ত দেহ। ফুটফুটে কন্যা! ছোটো ছোটো হাত, পাগুলো নিথর হয়ে পড়ে আছে। সময় থেমে যায়। মনে হতে থাকে, নিশুতি রাতের প্রেতাত্মারা একসঙ্গে, একই স্বরে চিৎকার করে কাঁদছে। পদ্মজার মস্তিষ্ক ফাঁকা হয়ে যায়। কোন পাষাণ মানব তিন মাসের বাচ্চার গলায় ছুরি চালিয়েছে? তার কী হৃদয় নেই? পদ্মজা মেয়ের নাম ধরে ডেকে চিৎকার দিয়ে সেখানেই লুটিয়ে পড়ে।
পুলিশ আসে, তদন্ত হয়। সেদিন ফরিনা দরজা খোলা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। হঠাৎ করে ঘুম ভেঙে যায়। তিনি হাত বাড়িয়ে বুঝতে পারেন পাশে পারিজা নেই। দ্রুত উঠে বসেন। পদ্মজা নিয়ে গেল নাকি? ভাবতে ভাবতে নাতনিকে খুঁজতে থাকেন। বারান্দা থেকে বাইরে চোখ পড়তেই দেখতে পেলেন, একজন মোটা, কালো লম্বা চুলের লোক দৌড়ে পালাচ্ছে। খালি জায়গায় কাঁথায় মোড়ানো কিছু একটা পড়ে আছে। ফরিনা ছুটে বাইরে বেরিয়ে আসেন। নাতনির রক্তাক্ত দেহ দেখে চিৎকার শুরু করেন। পুলিশ কোনো কিনারা খুঁজে পায়নি।
পরের দিনগুলো বিষাক্ত হয়ে উঠে। পদ্মজা মাঝরাতে চিৎকার করে কেঁদে উঠত। খাওয়া-দাওয়া একদমই করত না। মাঝরাতে মেয়ের কবরে ছুটে যেত। আমির পদ্মজাকে নিয়ে হাওলাদার বাড়ি থেকে দূরে সরে আসে। প্রায় এক বছর পদ্মজা মানসিকভাবে বিপর্যন্ত ছিল। তারপর বুকে ব্যথা নিয়েই স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসে। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে, একদিন ফিরবে অলন্দপুর। সেই নিষ্ঠুর খুনিকে খুঁজে বের করে শাস্তি দিবেই। জানতে চাইবে, কীসের দোষে তার তিন মাসের কন্যা বলি হলো? ছোট্ট শিশুটি কী ক্ষতি করেছিল?
কেউ জানুক আর নাই বা জানুক, পদ্মজা জানে হাওলাদার বাড়িতে আসার প্রধান উদ্দেশ্য, পারিজার খুনিকে বের করা। সে শতভাগ নিশ্চিত এই বাড়ির কেউ না কেউ জড়িত এই খুনের সঙ্গে। শুধু বের করার পালা। পুরনো কথা মনে হতেই পদ্মজা দুই চোখ বেয়ে জল গড়াতে থাকল। আমির জল মুছে দিয়ে বলল, ‘বোধহয় তিন তলায় রাখা হয়েছে। ‘
পদ্মজা তিন তলার সিঁড়ির দিকে তাকাল। শুনেছে, তিন তলার কাজ নাকি সম্পূর্ণ হয়েছে। নতুন অনেকগুলো ঘর হয়েছে। তবে আর কথা বাড়াল না। এখন গোসল করতে হবে। আজান পড়বে। আজ রাত থেকেই সে নিশাচর হবে। এক মুহূর্তও নষ্ট না করে সব রহস্যের জাল কাটতে হবে। এটাই তার নিজের সঙ্গে নিজের প্রতিজ্ঞা। আমির ডাকল, ‘কী হলো? কী ভাবো?’
পদ্মজা আমিরের দিকে একবার তাকাল। চাহনি অস্থির করে বলল, ‘কিছু না। ঘরে চলুন।’
‘কিছু তো ভাবছিলে।’
‘এতদিনের জন্য গ্রামে এসেছি। চাকরিটা থাকবে তো?’
‘থাকবে না কেন? রফিক কতটা সম্মান করে আমাকে দেখোনি? আর তোমার যোগ্যতার কী কমতি আছে? যেখানে ইচ্ছে সেখানেই চাকরি হবে।’
পদ্মজা থমকে দাঁড়াল। আমিরের দিকে তাকিয়ে হেসে বলল, ‘আপনি যেখানে ইচ্ছে সেখানে চাকরি করতে দিবেন?’
আমির হেসে ফেলল। বলল, ‘তা অবশ্য দেব না।’
পদ্মজা – ৫০
পড়ন্ত বিকেলের শীতল বাতাসে শরীর কাঁটা দিচ্ছে। পদ্মজা শাল গায়ে জড়িয়ে নিয়ে পা রাখল নিচতলায়, ফরিনার ঘরে। ফরিনা কাঁথা সেলাই করছিলেন। পদ্মজাকে দেখে দুই পা ভাঁজ করে বসে উল্লাস করে বললেন, ‘তুমি আইছো!
পদ্মজা ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বলল, ‘জি, আম্মা। কাঁথা সেলাই করছিলেন নাকি। আমি সাহায্য করি?’
‘না, না তুমি এইসব পারবা না। সুঁই লাগব হাতে।’
‘কিছু হবে না, আম্মা। প্রতিদিনই সেলাই করা হয়।’
ফরিনা অবাক হয়ে জানতে চাইলেন, ‘তুমি কাঁথা সিলাও?’
পদ্মজা হেসে বলল, ‘ওই একটু।’
‘কেরে? আমরা থাকতে তুমি সিলাও কেরে? তোমার সৎ আম্মায় তো নকশিকাঁথা সিলায়। হে থাকতে তোমার সিলাই করা লাগে কেরে?’
পদ্মজা ফরিনার হাত থেকে সুঁই টেনে নিয়ে বলল, ‘আব্বা মারা যাওয়ার পর দুই বছর আমি কেমন অবস্থা ছিলাম জানেনই তো। সে অবস্থায় আমার পক্ষে আমার পরিবারের জন্য কিছু করা সম্ভব ছিল না। তখন উনি পর হয়েও, সৎ মা হয়েও নিজের ঘাড়ে সব দায়িত্ব তুলে নিলেন। কিন্তু যতটুকু করতেন ততটুকুতে পরিবার চলতে গিয়ে হিমশিম খেত। তাই আমিও চেষ্টা করেছি একটু যদি নকশিকাঁথার পরিমাণটা বাড়ানো যায়!’ পদ্মজার ফুলের পাপড়ির মতো ফোলা ফোলা দুটি ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠল, সেই হাসিতে পরমা সুন্দরীর মুখমণ্ডল যেন আলোকিত হয়ে উঠল অল্প আভায়। ফরিনা অবাক হয়ে সেই হাসি দেখলেন।
মন দিয়ে কাঁথায় ফুল তুলছে পদ্মজা। দাঁত দিয়ে সুতা কেটে ফরিনার দিকে তাকাল। পদ্মজার নিখুঁত নাক, নিখুঁত চোখ। ফরিনা একদৃষ্টে তাকিয়ে আছেন। পদ্মজা ডাকল, ‘আম্মা?’
ফরিনার সংবিৎ ফিরতেই প্রশ্ন করলেন, ‘তুমি নাকি শহরে কাম করো?
পদ্মজা হাসল, ‘হু, করা হয়। প্রেমা-প্রান্ত দুইজনই পড়াশোনা করে। পড়ালেখার কত খরচ! আর পূর্ণা তো পড়ালেখার চেয়ে বেশি খরচ করে ফেলে শাড়ি-অলংকার কিনতে গিয়ে। আম্মা নেই। বাধা দিতে কষ্ট হয়। আর উনি নিজের সব সঞ্চয় উজার করে দেন আমার তিন ভাই-বোনকে। টাকা তো থাকে না। তাই চাকরি নিতে হলো। দুই বোনের বিয়ে দিতে হবে না? আমার তো ফরজ কাজ বাকি। তার জন্য টাকা জমাতে হচ্ছে। আর উনার নকশিকাঁথার টাকার সঙ্গে বেতনের কিছুটা অংশ মিলিয়ে পাঠিয়ে দেই। বেশ ভালোই চলছে। উনি আছেন বলেই আমার মাথার উপরের চাপটা কমেছে।’
‘হ, বাসন্তী অনেক ভালা। আমি হের চেয়ে চার বছরের বড়ো। মেলা সম্মান করে আমারে। আচ্ছা, আমির তোমারে বাইরে কাম করতে দিছে?’
এ প্রশ্নে পদ্মজা কপাল চাপড়ে বলল, ‘আর বলবেন না, আম্মা! কী যে যুদ্ধ করতে হয়েছে। শেষমেশ রাজি হয়েছেন। কিন্তু উনার অফিসে নাকি চাকরি করতে হবে। উনার অফিসে চাকরি নিলে উনি আমাকে কোনো কাজ করতে দিতেন? টাকা ঠিকই মাস শেষে হাতে গুঁজে দিতেন। ঘুরে-ফিরে, স্বামীর টাকায় বাপের বাড়ি খায় কথাটা আত্মসম্মানের সঙ্গে লেগে যেত। এ নিয়ে তিনদিন আমাদের ঝগড়া ছিল। আলাদা থেকেছি, কেউ কারো সঙ্গে কথা বলিনি।’
ফরিনা বেশ আগ্রহ পাচ্ছেন। উৎসুক হয়ে জানতে চাইলেন, ‘এরপরে কী হইলো? কাম করতে দিছে কেমনে?’
‘এরপর… তিন দিন পর এসে বলল, চাকরি পেয়েছে একটা। ছয় ঘণ্টা কাজ। হিসাব রক্ষকের পদ। বেতন ভালো। জানেন আম্মা, আমি ভীষণ অবাক হয়েছি! এত কম সময়ের চাকরি, আবার বেতনও তুলনায় বেশি 1 এরপর জানতে পারি উনার পরিচিত একজনের অফিসে চাকরি বন্দোবস্ত করেছেন। উনি চান না আমি বেশি সময় বাইরে থাকি। আবার জেদ ধরেও বসে ছিলাম। এভাবেই সব ঠিক হয়। ইনশাআল্লাহ আম্মা, পূর্ণার বিয়েটা ধুমধামে হয়ে যাবে। প্রেমার তো দেরি আছে। অনেক পড়বে ও।’
ফরিনা পদ্মজার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, ‘আল্লাহ হাজার বছর বাঁচায়া রাখুক।’
‘আম্মা, রুম্পা ভাবি কী তিন তলায়?’
‘হ।’
‘আজ দেখতে যাব ভাবছি। চাবি কার কাছে?’
ফরিনা মুখ গুমট করে বললেন, ‘হেই ঘরে যাওনের দরকার নাই। রিদওয়ান চাবি দিব না। ওরা আর আমারারে দাম দেয় না। যেমনে ইচ্ছা চলে।’
‘দিবে না মানে কী? আপনি গুরুজন আপনাকে দিতে বাধ্য।’
‘চাইছিলাম একবার, যা ইচ্ছা কইয়া দিছে।’ ফরিনার মুখে আঁধার নেমে আসে। তিনি নির্বিকার ভঙ্গিতে বললেন, ‘চাবি চাওনের লাইগগা রিদওয়ান হের আম্মারেও মারছে।’
পদ্মজার চোখ দুটি বড়ো বড়ো হয়ে যায়, ‘সে কী! মায়ের গায়ে হাত তুলেছে?
ফরিনা কাঁথা সেলাই করতে করতে বললেন, ‘নিজের মা আর কই থাইকা! এই ছেড়ার মাথা খারাপ। অমানুষ।
‘বাড়ির অন্যরা কিছু বলেনি?’
‘অন্যরা কারা?’
‘আব্বা, চাচা, বড়ো ভাই কেউ কিছু বলেনি?’
‘বাকিদের কথা জানি না। তোমার শ্বশুর তো নিজেই শকুনের বাচ্চা।’ পদ্মজা চমকে তাকাল। ফরিনাও চকিতে চোখ তুলে তাকালেন। তিনি মুখ ফসকে বলে ফেলেছেন। দুজন দুজনের দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইল। পদ্মজা প্রশ্ন করার আগে ফরিনা বললেন, ‘পূর্ণায় গাছে উঠছে। সকালে আছাড়ড়া খাইল বিকেল অইতেই গাছে উইট্টা গেছে। ছেড়িডারে কয়ডা মাইর দিয়ো।’
পদ্মজা স্পষ্ট বুঝতে পেরেছে তার শাশুড়ি আগের কথাটা ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করছে। সে আগ বাড়িয়ে কথা বলতে পারল না। মৃদু কণ্ঠে বলল, ‘আমি আসি।’
‘যাও।’
পদ্মজা দরজা অবধি এসে ফিরে তাকাল। ফরিনা দ্রুত দৃষ্টি ঘুরিয়ে নিলেন। পদ্মজা ঘর ছাড়তেই তিনি হাঁফ ছেড়ে বাঁচেন। পদ্মজা উদাসীন হয়ে হাঁটছে আর ভাবছে: আম্মা কেন নিজের স্বামীকে শকুনের বাচ্চা বললেন?
পদ্মজা সামলে নিলো নিজেকে। এখন এসব ভাবা যাবে না। রিদওয়ানের কাছ থেকে চাবি নিতে হবে। সে রিদওয়ানের ঘরের সামনে এসে দরজায় শব্দ করতেই ওপাশ থেকে পুরুষালি কণ্ঠ ভেসে আসে, ‘কে?’
পদ্মজা জবাব না দিয়ে আরো জোরে শব্দ করল। রিদওয়ান কপাল কুঁচকে দরজা খুলল। পদ্মজাকে দেখে কপালের ভাঁজ মিলিয়ে যায়। ঠোঁটে ফুটে ওঠে হাসি। মোটা হয়েছে আগের চেয়ে। গালভরতি ঘন দাড়ি। এক- দুটো চুল পেকেছে। সে খুশিতে গদগদ হয়ে বলল, ‘আরে বাপরে, পদ্মজা আমার দুয়ারে এসেছে!’
পদ্মজা সোজাসুজি বলল, ‘রুম্পা ভাবির ঘরের চাবি দিন।
রিদওয়ান দরজা ছেড়ে দাঁড়াল, ‘এতদিন পর এসেছো আবার আমার ঘরের সামনে! ভেতরে আসো, বসো। এরপর কথা বলি।’
‘আমি আপনার সঙ্গে কথা বলতে আসিনি। দয়া করে চাবিটা দিন।’
‘চাবি তো দেব না।’
‘কী সমস্যা?’
রিদওয়ান পদ্মজার কাঁধে হাত রেখে বলল, ‘আরে, ঘরে আসো তো আগে।’
পদ্মজা এক ঝটকায় রিদওয়ানের হাত সরিয়ে দিল। চোখ গরম করে তাকিয়ে বলল, ‘চাবি দিন।’
‘চোখ দিয়ে তো আগুন ঝরছে। কিন্তু আমি তো ভয় পাচ্ছি না। চাবি আমি দেব না।’
‘দেবেন না?’
রিদওয়ান আড়মোড়া ভেঙে আয়েশি ভঙ্গিতে বলল, ‘না।’
পদ্মজা আর কথা বাড়াল না। চলে গেল। রিদওয়ান পিছু ডেকেছে। সে শোনেনি। মগাকে দিয়ে পাথর আনিয়ে সোজা চলে গেল তিন তলায়। মদন একটা ঘরের সামনে চেয়ার নিয়ে বসে ছিল। তাহলে এই ঘরেই রুম্পা আছে। সে দরজার সামনে এসে দাঁড়াতেই মদন বিনয়ের সঙ্গে বলল, ‘কুনু কাম আছিল ভাবি?’
পদ্মজা নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল, ‘তালা ভাঙব। মগা, তালা ভাঙ।’
মদন দুই হাত মেলে দরজার সামনে দাঁড়াল, ‘রিদওয়ান ভাইয়ের কাছে চাবি আছে। তার কাছ থাইকা লইয়া আহেন। তালা ভাইঙেন না।’
‘উনি আমাকে চাবি দেননি। তাই আমি তালা ভাঙব। আপনি সরে দাঁড়ান।’
‘না, ভাবি, এইডা হয় না। আমার ওপরে এই ঘরডার ভার দিছে।’
‘আপনি সরে দাঁড়ান।’ পদ্মজা কথাটা বেশ জোরেই বলল। মদন হাওলাদার বাড়ির বউয়ের সামনে আর দাঁড়িয়ে থাকার সাহস পেল না। দৌড়ে চলে গেল। বাড়ির সবাইকে জানাল, পদ্মজা তালা ভাঙছে।
সঙ্গে সঙ্গে ছুটে এলো খলিল, আলমগীর, আমির, রিদওয়ান, ফরিনা, আমিনা। ততক্ষণে পদ্মজা তালা ভেঙে ফেলেছে। আমির হন্তদন্ত হয়ে এসেই প্রশ্ন করল, ‘তালা ভাঙলে কেন?’
‘আপনার ভাই আমাকে চাবি দেয়নি। আমার রুম্পা ভাবির সঙ্গে দেখা করার ইচ্ছে হচ্ছিল তাই ভেঙেছি।’
‘এইডা অসভ্যতা। তোমারে ভালা ভাবছিলাম। ছেড়ি মানুষের এত তেজ, অবাধ্যতা ভালা না।’
পদ্মজা এক নজর খলিলকে দেখল। এরপর ঢুকে গেল রুম্পার ঘরে। রুম্পা ঘরের মাঝে মেঝেতে উপুড় হয়ে পড়ে আছে। লম্বা চুল এখন ঘাড় অবধি! কে কেটে দিয়েছে? যেন চুল না ময়লা ঝাড়ু। পদ্মজা দৌড়ে রুম্পার পাশে এসে বসে। রুম্পার শাড়ি ঠিক করে দিয়ে ডাকল, ‘ভাবি? ভাবি? শুনছো ভাবি?’
রুম্পার সাড়া নেই। গলায়, হাতে, পায়ে মারের দাগ। ফরিনা তাকে দেখে চমকে গেলেন। রুম্পার এক হাত চেপে ধরে উদ্বিগ্ন হয়ে প্রশ্ন করলেন, ‘ও মা গো, কেলায় মারছে বউডারে? আল্লাহ গো, কেমনে মারছে। রক্ত শুকায়া পাথথর হইয়া গেছে। এর লাইগগা আমরারে রুম্পার কাছে আইতে দেও না তোমরা? বউডা তোমরারে কী করছে? পাগল মানুষ।’ ফরিনা বাড়ির পুরুষদের দিকে ঘৃণার চোখে তাকান। তিনি রূম্পার অবস্থা দেখে কাতর হয়ে উঠেছেন।
আমিনা দূরেই দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি বরাবরই অন্যরকম মানুষ। অহংকারী, হিংসুক। অন্যদের ভালো দেখতে পারে না। রানির জীবনটা এভাবে ধ্বংস হয়ে যাওয়ার পর আরো বেশি খামখেয়ালি হয়ে উঠেছেন।
পদ্মজা আমিরের দিকে তাকিয়ে হুংকার দিয়ে উঠল, ‘আপনি দাঁড়িয়ে আছেন কেন? অন্যরা পাষাণ। আপনি তো পাষাণ না। ভাবিকে বিছানায় তুলে দিন।’
পদ্মজার কথায় আমির রুম্পাকে কোলে তুলে বিছানায় শুইয়ে দিল। আমির আর ফরিনা ছাড়া বাকি সবাই বিরক্তিতে কপাল ভাঁজ করে চলে যায়। তারা অসন্তুষ্ট। খলিল যাওয়ার আগে বিড়বিড় করে পদ্মজাকে অনেক কিছু বললেন। পদ্মজা সেসব কানে নেয়নি। সে শুধু অবাক হচ্ছে। মানুষগুলোর প্রতি ঘৃণা হয়। সে রুম্পার জ্ঞান ফেরানোর চেষ্টা করছে। আমিরকে বলে, কবিরাজ নিয়ে আসতে। আমির চলে যায়। ফরিনার কাছ থেকে পদ্মজা জানতে পারল, তিনি দুই বছর পর রুম্পাকে দেখছেন! কী অবাক কাণ্ড! কখন চুল কাটা হয়েছে জানেন না। পদ্মজা জানতে চাইল, ‘কেন এত ভয় পান বাড়ির পুরুষদের? একটু শক্ত করে কথা বলে ভাবিকে দেখতে আসতে পারলেন না? ভাবির মা বাপের বাড়ি কোথায়? উনারা মেয়ের খোঁজ নেন না?’
‘রুম্পার মা-বাপ নাই। ভাই আছে দুইডা। ভাইগুলা আগেই খোঁজ নিত না। পাগল হুনার পর থাইকা নামও নেয় নাই।’
‘মানুষ এত স্বার্থপর কী করে হয়, আম্মা?’
ফরিনা রুম্পার শাড়ির ময়লা ঝেড়ে দেন। ঘরদোর পরিষ্কার করেন। রুম্পার জ্ঞান ফেরে ঘণ্টাখানেক পর। কিন্তু কথা বলার শক্তিটুকুও নেই তার। সে ড্যাবড্যাব করে পদ্মজার দিকে তাকিয়ে থাকে, যেন পদ্মজার জন্য অপেক্ষায় ছিল। পদ্মজার জন্যই বেঁচে আছে! কিছু বলার চেষ্টা করছে কিন্তু পারছে না। কতদিন ধরে তাকে পানি ছাড়া কিছু দেওয়া হচ্ছে না। ঘরের এক কোণে বালির বস্তা রাখা, ক্ষুধার চোটে কতবার বালি খেয়েছে। পেট খারাপ হয়ে পুরো ঘর নষ্ট করেছে। বমি করতে করতে ক্লান্ত হয়ে গতকাল থেকে সে অজ্ঞান। তবুও কেউ এসে দেখেনি। পদ্মজার চোখের জল আপনাআপনি পড়ছে। রুম্পার কষ্ট তাকে দুমড়েমুচড়ে দিচ্ছে। সে মনে মনে শপথ করে, রুম্পাকে নিয়ে শহরে যাবে। ফরিনা ও পদ্মজা মিলে রুম্পাকে গোসল করাল। নতুন শাড়ি পরিয়ে, গরম গরম ভাত খাওয়াল। চুলে তেল দিয়ে দিল। খাওয়া শেষে রুম্পা বিছানায় নেতিয়ে পড়ে। শরীরের শক্তি আসতে সময় লাগবে। একটু ঘুমালেই পুনরুদ্ধার হবে গায়ের জোরের। পদ্মজা রুম্পার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল, ‘ঘুমাও, ভাবি।’
পদ্মজা টের পেল, রুম্পার দুর্বল দুটি হাত পদ্মজার হাত শক্ত করে ধরতে চাইছে। সে রুম্পার দুই হাত শক্ত করে ধরে বলল, ‘তোমাকে ছেড়ে কোথাও যাব না।
রুম্পার চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ে। পদ্মজা জল মুছে দিল। ফরিনাকে বলল, ‘আম্মা, আমি আমার ঘর থেকে আমার কোরআন শরীফ আর জায়নামাজ নিয়ে আসি। আর উনাকে বলে আসি আপাতত আমি রুম্পা ভাবির সঙ্গে থাকব।’
যাও তুমি। আমি এইহানে আছি।’
পদ্মজা বেরিয়ে গেল। বারান্দা পেরোবার সময় উঠানে চোখে পড়ে। সেখানে পূর্ণা, রানি, বাচ্চাদের নিয়ে গোল্লাছুট খেলছে। পূর্ণার পরনে শাড়ি! মেয়েটা এত দস্যি হলো কী করে? সে চোখ সরিয়ে নিজের ঘরের দিকে গেল। সন্ধ্যার আজান পড়ার বেশি দেরি নেই।
রানি এক দলের নেতা, পূর্ণা অন্য দলের নেতা। দুই দলের নাম শাপলা আর গোলাপ। প্রতি দলে ছয়জন করে। বাচ্চাগুলোর বয়স নয়-দশ।
আলো আলগ ঘরের বারান্দায় চেয়ারে বসে আছে। মৃদুল আলগ ঘর থেকে বেরিয়ে বলল, ‘এই বাচ্চারা আমিও খেলতাম।’
রানি বলল, ‘না, না। তোরে নিতাম না।’
পূর্ণা মৃদুলকে দেখেই অন্যদিকে চাইল। তার ভীষণ লজ্জা করছে মৃদুলের সামনে পড়তে! মৃদুল আরেকটু এগিয়ে এসে বলল, ‘ডরাইতাছোস? ডরানিরই কথা। এই মৃদুলের সঙ্গে কেউ পারে না। আর তুই তো মুটকি। কেমনে পারবি?’
‘আমি তোর চার মাসের বড়ো। সম্মান দিয়া কথা ক। মাঝখান থাইকা সর। খেলতে দে।’
‘ধুর, তোর ছেড়ির এখন খেলার সময়। আর তুই খেলতাছস। সর। এই এই, বোয়াল মাছ। তোমার দলের একটারে বাদ দিয়া আমারে লও। এই মুটকিরে একশোটা গোল্লা না দিলে আমি বাপের ব্যাঠা না।’
পূর্ণা হাঁ করে তাকাল। তাকে বোয়াল মাছ ডাকা হচ্ছে! তার দিকে তাকিয়ে বাচ্চারাও হাসছে! দেখতে চকচকে সুন্দর হয়ে গেছে বলে কী যা ইচ্ছে ডাকার অধিকার বাঘিনী পূর্ণা দিয়ে দিবে? কখনো না। সে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে বলল, ‘আমাকে আপনার কোন দিক দিয়ে বোয়াল মাছ মনে হচ্ছে?’
পূর্ণাকে কথা বলতে দেখে মৃদুল হাসল। রসিকতা করে বলল, ‘আরে কালি বেয়াইন দেখি কথা কইতেও পারে।’
পূর্ণা আহত হলো। এক হাতে নিজের গাল ছুঁয়ে ভাবল, আমি কি কালি ডাকার মতো কালো? বাঘিনী রূপটা মুহূর্তে নিভে গেল। তার চোখ দুটি ছলছল করে ওঠে। যাকে পছন্দ করল সে-ই কালি বলছে। পূর্ণা থম মেরে দাঁড়িয়ে রইল। রানি বলল, ‘মৃদুইলল্যা সর কইতাছি। খেলতে দে।’
‘আমিও খেলাম। এই আন্ডা তুই বাদ। তোর বদলে আমি বেয়াইনের দলের হয়ে খেলাম।’
মৃদুলের এক কথায় ন্যাড়া মাথার ছেলেটি সরে দাঁড়াল। মৃদুল খেলার নির্দিষ্ট জায়গায় গিয়ে দাঁড়াল। পূর্ণাকে বলল, ‘কালি বেয়াইন তুমি আগে যাইবা? নাকি আমি আগে যামু?’
পূর্ণা মিনমিনিয়ে বলল, ‘আমি খেলব না।’
রানি দূর থেকে বলল, ‘দেখছস মৃদুইললা তুই খেলার মাঝে ঢুকছস বইললা পূর্ণা খেলত না। সবসময় কেন খেলা নষ্ট কইরা দেস তুই?’
মৃদুল সেসব কথায় ভ্রুক্ষেপও করল না। সে রসিকতার স্বরেই বলল, ‘আরে বেয়াইনের শক্তি ফুরায়া গেছে। আর খেলতে পারব না। এই আন্ডা তুই আয়। বেয়াইন খেলব না। তুই আইজ হারবিরে আপা।’
রানি আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলল, ‘আমার দলই জিতব।’
‘আগে আগে চাপা মারিস না। আমার মতো দেখায়া দে। এই পেটওয়ালা তুই আগে যা।’
পূর্ণা ব্যথিত মন নিয়ে আলগ ঘর পেরিয়ে অন্দরমহলের দিকে পা রাখে। সে কালো নিজেও জানে! কিন্তু কেউ কালি বললে তার খুব খারাপ লাগে। আল্লাহ কেন তাকে সৌন্দর্য দিলেন না? একটু ফরসা করে দিলে কী হতো? তার আপার মতো কালো রঙে সবাই সৌন্দর্য কেন খুঁজে পায় না? পূৰ্ণা দুই হাত দিয়ে দুই চোখের জল মুছে। অভিমানী মন থেমে থেমে কাঁদছে। এই শাড়ি তো মৃদুলের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্যই পরেছিল। দরকার নেই এই চকচকে পুরুষ।
কেউ তাকে কালি বললে সে ভীষণ রাগ করে! ভীষণ।
৫১
সুনসান নীরবতা চারিদিকে। রাত গভীর থেকে গভীরতর হচ্ছে। রুম্পা বিভোর হয়ে ঘুমাচ্ছে। পদ্মজা তীর্থের কাকের মতো অপেক্ষা করছে, কখন রুম্পা চোখ খুলবে। পদ্মজা বসে আছে নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে। দরজায় কেউ টোকা দিতেই পদ্মজা সাবধান হয়ে গেল। রুম্পার নিরাপত্তা নিয়ে তার মন অস্থির হয়ে আছে। সে গম্ভীরকণ্ঠে জানতে চাইল, ‘কে, কে ওখানে?’
‘আমি।’
আমিরের কণ্ঠ শুনে পদ্মজা ফোঁস করে নিশ্বাস ছাড়ল। খুলে দিল দরজা। আমিরের চুল এলোমেলো। ক্লান্ত দেখাচ্ছে। সে পদ্মজাকে দেখে বলল, ‘ঘুম ভেঙে গেল। তোমাকে মনে পড়ছে।’
‘আমি তো এখন যেতে পারব না।’
‘আমি থাকি তাহলে।’ আমিরের নির্বিকার কণ্ঠ।
পদ্মজা চোখ রাঙিয়ে বলল, ‘শীতের রাতে মেঝেতে থাকবেন? রুম্পা ভাবি বিছানায় ঘুমাচ্ছে। এই ঘরে থাকলে মেঝেতে থাকতে হবে। ঘরে যান।’
‘মেঝেতেই থাকব।’
‘আপনি সবসময় ঘাড়ত্যাড়ামি করেন কেন? আপনাকে তো আমি বলে এসেছি কতটা দরকার রুম্পা ভাবির সঙ্গে থাকা।’
‘গত দিনও বোনদের সঙ্গে ছিলে। আর আজ রুম্পা ভাবির সঙ্গে থাকতে চাইছ!’
‘কয়টা দিনই তো। আজীবন একসঙ্গেই থাকব।’
‘আচ্ছা যাচ্ছি, এখনও ঘুমাওনি কেন?’
পদ্মজা একবার রুম্পাকে দেখে নিয়ে বলল, ‘এই তো ঘুমাব।’
আমির চারপাশ দেখে বলল, ‘সাবধানে থাকবে। রিদওয়ান দোতলায় ঘুরঘুর করছে। ভয় পাবে না। আমি আছি।’
পদ্মজা আমিরের চোখের দিকে তাকাল। বলল, ‘আপনি আমার সঙ্গে থাকতে নয়, দেখতে এসেছেন আমি ঠিক আছি কি না তাই না? একদমই ভয় পাবেন না। আমার কিছু হবে না।’
আমির দুই হাতে পদ্মজার দুই গাল ধরে বলল, ‘আমি তো জানি আমার পদ্মবতী কতটা সাহসী! এজন্যই এই বাড়িতে আসার সাহস করতে পেরেছি।’
‘আহ্লাদ হয়েছে? এবার যান।’
আমির হেসে চলে গেল। পদ্মজা অনেকক্ষণ অন্ধকার বারান্দায় তাকিয়ে রইল। এরপর দরজা বন্ধ করে শুয়ে পড়ল বিছানায়। আমিরকে সে কতটা ভালোবাসে সে নিজেও জানে না! আমিরের প্রতিটি স্পর্শ ও কথার ছন্দে হৃদয় স্পন্দিত হয়। আমিরের পাগলামি, খেয়াল রাখা, দায়িত্ববোধ সবকিছু পদ্মজাকে মুগ্ধ করে। একজন আদর্শ স্বামী বোধহয় একেই বলে। আমিরের কথা ভাবতে ভাবতে কখন যে সে ঘুমিয়ে পড়ল! ভালোবাসার মানুষদের নিয়ে ভাবা সময়টা জাদুর মতো। চোখের পলকে নির্ঘুম রাত কেটে যায় নয়তো নিজের অজান্তে আবেশে ঘুম চলে আসে।
সকালে উঠেই পূর্ণাকে গিয়ে ডেকে তুলল পদ্মজা। এরপর রুম্পার ঘরে এসে নামাজ পড়ল। কোরআন পড়ল। রুম্পার ঘুম আরো কিছুক্ষণ পর ভাঙে। রুম্পাকে ধরে ধরে টয়লেটে নিয়ে গেল পদ্মজা। তারপর গেল রান্নাঘর থেকে খাবার আনতে। ফরিনা মাত্র চুলা থেকে খিচুড়ি নামিয়েছেন।
‘আম্মা, ভাবির জন্য খিচুড়ি নিয়ে যাই?’ বলল পদ্মজা।
ফরিনা হেসে বললেন, ‘এইডা আবার কওন লাগে। লইয়া যাও। তুমি খাইবা কুনসময়?’
‘ভাবিকে খাইয়ে এসে তারপর উনাকে নিয়ে খাব। আম্মা, রাতের মুরগির গোশত আছে না?
‘হ আছে তো। ওই যে ওই পাতিলডায়।’
পদ্মজা গরম গরম খিচুড়ি মুরগি গোশতের ভুনা দিয়ে নিয়ে যায়। ঘরে ঢুকে দেখে রুম্পা মেঝেতে পড়ে আছে। পদ্মজা থালা বিছানার উপর রেখে রুম্পাকে তোলার চেষ্টা করে।
অবাক হয়ে প্রশ্ন করে, ‘ভাবি মেঝেতে পড়লেন কীভাবে?
রুম্পা কিছু বলছে না। সে উদ্ভ্রান্তের মতো ছটফট করছে, এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে; পদ্মজাকে দূরে ঠেলে দেয়ার চেষ্টা করছে। পদ্মজা বিস্মিত। রুম্পা এমন করছে কেন? সে রুম্পাকে প্রশ্ন করেই চলেছে, ‘কেউ এসেছিল ঘরে? কে এসেছিল? ভয় দেখিয়েছে? ভাবি… ভাবি বলুন আমাকে। ভাবি…ধাক্কাচ্ছেন কেন? আমি আপনার জন্য খাবার এনেছি।’
খাবারের কথা শুনে রুম্পা থমকে গেল। পদ্মজার দিকে এক নজর তাকিয়ে বিছানার দিকে তাকাল। ঝাঁপিয়ে পড়ল খাবারের ওপর। গরম খাবার গাপুসগুপুস করে খেতে থাকল। পদ্মজা বিস্ময়ে হতবুদ্ধি হয়ে পড়েছে। এমনভাবে রুম্পা খাচ্ছে যেন আর কোনোদিন খাওয়া হবে না। সুযোগ আসবে না। পদ্মজা পানি এগিয়ে দিল। রুম্পা অল্প সময়ের ব্যবধানে পুরো থালার খিচুড়ি ও এক বাটি গোশত খেল।
খাওয়া শেষে পদ্মজা নমনীয় কণ্ঠে প্রশ্ন করল, ‘ভাবি আমার সঙ্গে একটু কথা বলবে?’
রুম্পা দূরে সরে যায়। দেয়াল ঘেঁষে বসে। মাথা দুইদিকে নাড়িয়ে ইশারা করে জানাল, সে কথা বলবে না। পদ্মজা তবুও আশা ছাড়ল না। সে রুম্পার পাশে গিয়ে বসল। রুম্পার এক হাত মুঠোয় নিয়ে বলল, ‘আমি তোমাকে আমার সঙ্গে ঢাকা নিয়ে যাব। যাবে?’
রুম্পা এক ঝটকায় হাত সরিয়ে নিলো। পদ্মজাকে ধাক্কা মেরে চেঁচিয়ে বলল, ‘বাইর হ আমার ঘর থাইকা। বাইর হ তুই।’
রুম্পার ব্যবহারে পদ্মজা আহত হলো, ‘ভাবি! আমি তোমার ভালো চাই।’
‘বাইর হ কইতাছি। বাইর হ।’
শীতের ঠান্ডা হিম বাতাস জানালা দিয়ে ঢুকছে। শীতের দাপট বেড়েছে। এবারের শীত বোধহয় মানুষ মারার জন্য এসেছে! এত ঠান্ডা! রুম্পার পরনে শাড়ি ছাড়া আর কিছু নেই। ঠান্ডায় তার গায়ে কাঁটা দিচ্ছে পদ্মজা রুম্পার চোখের দিকে দৃষ্টিপাত করল। রুম্পার চোখ বার বার দরজার দিকে যাচ্ছে। পদ্মজা উঠে স্থির হয়ে দাঁড়াল না, ছুটে গেল দরজার কাছে। দরজার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা আগন্তুক ছুটে পালাতে চাইল। তবে তার আগেই পদ্মজা জোরাল কণ্ঠে ডেকে উঠল, ‘লুতু বুবু।’
লতিফা একবার ঘাড় ঘুরিয়ে পদ্মজাকে দেখল। এরপর দ্রুত পায়ে সিঁড়ি ভেঙে নেমে গেল নিচে, তার চোখে ভয়। আচমকা ঝনঝন শব্দ হলো একটা। পদ্মজা চকিতে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল। রুম্পা পাগলামি শুরু করেছে। মুখ দিয়ে অদ্ভুত শব্দ করতে করতে ঘরের জিনিসপত্র ছুঁড়ছে। রুম্পাকে থামানোর চেষ্টা করল পদ্মজা, বোঝাল অনেক করে। কিছুতেই রুম্পা থামল না। উলটো তার ছোড়া স্টিলের গ্লাস এসে পড়ল পদ্মজার কপালে। ‘আহ’ বলে বসে পড়ল পদ্মজা, সঙ্গে সঙ্গে থেমে গেল রুম্পার পাগলামি। ছুটে এসে পদ্মজার আহত স্থানে হাত রাখে, উৎকণ্ঠিত হয়ে বলল, ‘আমি তোমারে ইচ্ছা কইরা দুঃখ দেই নাই বইন। বেশি বেদনা করতাছে?’
আঞ্চলিক ভাষায় চিকন কণ্ঠ! পদ্মজা দুই চোখ মেলে তাকাল। রুম্পা পদ্মজার কপালের ফোলা অংশে ফুঁ দিচ্ছে। ভীষণ অস্থির হয়ে আছে। বোঝাই যাচ্ছে পদ্মজাকে অনেক পছন্দ করে রুম্পা। মুখোশ খুলে বেরিয়ে এসেছে আসল রূপে। সে কঠিন নয়, পাগল নয়। বরং বড্ড নরম, কোমল। পদ্মজা শান্ত স্বরে প্রশ্ন করল, ‘কেন পাগলের অভিনয় করো?’
রুম্পার হাত থেমে গেল। সে ধরা পড়ে গেছে!
.
কুয়াশার স্তর ভেদ করে একটা নৌকা ঢুকল খালে, মাঝি মৃদুল। গতকাল যে ছেলেটাকে আন্ডা ডেকেছিল সেই ছেলেটাও নৌকায় আছে। তার ভালো নাম, জাকির। মৃদুলের সঙ্গে বাচ্চাকাচ্চাদের অনেক খাতির। পূর্ণা খালের ঘাটে বসে ছিল। সে ফজরের নামাজ আদায় করে খিচুরি খেয়ে এখানে চলে এসেছে। মন খারাপের সময় ঘাটে বসে থাকতে তার ভালো লাগে। গতকাল রাতে খাওয়ার সময় মৃদুল কম হলেও বিশ বার তাকে কালি ডেকেছে। অন্ধকারে নাকি দেখাই যায় না। এমন অনেক কথা বলেছে। কালো রঙের মেয়ে হওয়া বোধহয় পাপ! আবার পদ্মজাও রাতে তার সঙ্গে থাকেনি। পুরো রাত সে কেঁদেছে। কেউ কেন তাকে কালি বলবে! আবার তার আপা ও তাকে সময় দিল না। শ্বশুরবাড়ির অন্য বউকে নিয়ে ব্যস্ত। পূর্ণার খুব অভিমান হয়েছে। বয়স বিশ পার হলেও রয়ে গেছে সেই ছোট্ট কিশোরী মেয়েটি। মৃদুল নৌকা থামিয়ে পূর্ণাকে ডাকল, ‘কালি বেয়াইন।’
পূর্ণা তাকাল না। মৃদুল আবার ডাকল, ‘বেয়াইন গো।’
তাও পূর্ণা সাড়া দিল না। মৃদুল জাকিরকে বলল, ‘কী রে ব্যাঠা, বুঝছিস কিছু? এই ছেড়িরে ভূতে ধরল নাকি?’
জাকির দাঁত বের করে শুধু হাসল। মৃদুল জোরে বলল, ‘আরে বেয়াইন কী কানে শুনে না? কাল তো ঠিকই শুনছিল। ঠান্ডা কী কানের ভেতরে ঢুইকা গেছে? ও কালি বেয়াইন। বেয়াইন…’
পূর্ণা হুট করে উঠে দাঁড়াল। আঙুল শাসিয়ে মৃদুলকে বলল, ‘আপনার কী মা-বাপ নাই? থাকলেও শিক্ষা দেয়নি যারে তারে যা ইচ্ছে ডাকা উচিত না? অসভ্যতা অন্য জায়গায় করবেন আমার সামনে না। আমি কালো আমি জানি। আপনাকে কালি বলে সেটা মনে করিয়ে দিতে হবে না। আমি আপনাকে অনুমতি দেইনি আমাকে কালি ডাকতে বা বেয়াইন ডাকতে। আমি আপনার বেয়াইনও না। আমার দুলাভাইয়ের আপন ভাই না আপনি। কোথাকার কে আপনি? এই ফরসা চামড়ার দেমাগ দেখান? আরেকবার আমাকে কালি বললে আমার চেয়ে খারাপ কেউ হবে না।’
কথা শেষ করেই পূর্ণা কুয়াশার আড়ালে হারিয়ে যায়। রেখে যায় অপমানে থমথম করা একটা মুখ। মৃদুল ঘোর থেকে বেরোতে পারছে না। তাকে একটা মেয়ে এভাবে বলেছে? তার মতো সুন্দর ছেলের জন্য গ্রামের সবকটি মেয়ে পাগল। আর এই কালো মেয়েটা তাকে এভাবে অপমান করল! মৃদুল রাগে বৈঠা ছুঁড়ে ফেলল খালে। নৌকা থেকে নামতে গেলে তার এক পায়ে ধাক্কা লেগে নিমিষে দূরে চলে যায় নৌকাটি।
নৌকায় থাকা ছেলেটি চিৎকার করল, ‘মৃদুল ভাই। আমি আইয়াম কেমনে? বৈডাডাও ফালায়া দিছো।’
মৃদুল বিরক্তি নিয়ে ফিরে তাকাল। সত্যিই তো নৌকা অনেক দূরে চলে গেছে! এই ঠান্ডার মধ্যে ছোটো বাচ্চাটা সাঁতরে পাড়ে আসবে কীভাবে!
মৃদুল রাগ এক পাশে রেখে বরফের মতো ঠান্ডা জলে ঝাঁপ দিল।
.
রুম্পা থেমে থেমে কাঁদছে। এদিকে অনবরত প্রশ্ন করে যাচ্ছে পদ্মজা, সে ভীষণ অস্থির। একজোড়া পায়ের শব্দ ভেসে আসতেই রুম্পার কান্না থেমে গেলে। এই পায়ের শব্দগুলো সে চেনে! রুম্পা কাঁপতে থাকল। রুম্পার অবস্থা দেখে পদ্মজার শিরদাঁড়া বেয়ে ঠান্ডা স্রোত গড়িয়ে যায়। রুম্পা পদ্মজার এক হাত ধরে চাপাস্বরে দ্রুত বলল, ‘এহান থাইকা চইলা যাও, বইন। আর আগাইয়ো না। ওরা পিশাচের মতো। ছিঁইড়া খাইয়া ফেলব। ওদের দয়ামায়া নাই। তুমি অনেক ভালা। তোমারে কোনোদিন ভুলতাম না। তুমি এইহানে থাইকো না। তুমি এই বাড়ির কেউয়ের লগে যোগাযোগ রাইখো না।’
‘ওরা কী করেছে? ভাবি, অনুরোধ করছি আমাকে বলুন। ভাবি অনুরোধ করছি।’
রুম্পা সেকেন্ডে সেকেন্ডে ঢোক গিলছে। পায়ের শব্দটা যত কাছে আসছে তার কাঁপুনি তত বাড়ছে। সে ছলছল চোখে পদ্মজার দিকে তাকিয়ে কোনোমতে বলল, ‘পেছনে…উত্তরে…ধ রক্ত।’
পরমুহূর্তেই দরজা ঠেলে রুমে ঢুকে খলিল হাওলাদার। এত জোরে দরজা ধাক্কা দিয়েছেন যে, বিকট শব্দ হয়। হুংকার ছেড়ে পদ্মজাকে বললেন, ‘তুমি এই ঘর থাইকা বাইর হও। অনেক অবাধ্যতা দেখাইছো আর না।’
খলিলের চোখ দুটি দেখে পদ্মজার রক্ত ছলকে উঠে। গাঢ় লাল। সে দুই হাতে রুম্পাকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘আমি রুম্পা ভাবির সঙ্গে থাকব।’
‘থাকবা না তুমি।’
‘কেন জানতে পারি?’
‘একটা পাগলের সঙ্গে কীসের থাকন?’
‘রুম্পা ভাবি পা…’ পদ্মজা কথা শেষ করতে পারল না। বুকে মুখ লুকিয়ে রাখা রুম্পা পিঠে চিমটি দিয়ে ভেজাকণ্ঠে ফিসফিসিয়ে বলল, ‘কইও না। আমি পাগল না কইও না। দোহাই লাগে।’
পদ্মজা থেমে গেল। খলিল বললেন, ‘বাড়ায়া যাও, বউ।’
পদ্মজা নাছোড়বান্দা হয়ে বলল, ‘যাব না আমি। রুম্পা ভাবির সঙ্গে থাকব।’
রুম্পা পদ্মজাকে ধাক্কা মেরে দূরে সরিয়ে দিয়ে পুনরায় পাগলামি শুরু করে। খলিল রুম্পাকে আঘাত করার জন্য উদ্যত হতেই পদ্মজা বাধা হয়ে দাঁড়াল। বলল, ‘নিজের মেয়েকে অমানুষের মারতে পারেন বলে সবার মেয়েকে মারার অধিকার পাবেন না।’
পদ্মজার কথা মাটিতে পড়ার আগে খলিলের শক্ত হাতের থাপ্পড় পদ্মজার গালে পড়ে।
পদ্মজা ব্যথায় ‘মা’ বলে আর্তনাদ করে উঠল।
৫৩
ভোর হয়েছে আর কতক্ষণই হলো! দুই ঘণ্টার মতো। এর মধ্যেই মেঘলা আকাশ বেয়ে অন্ধকার নেমে এসেছে চারিদিকে। পূর্ণা আলগ ঘরের সামনে থাকা বারান্দার চেয়ারে মুখ ভার করে বসে আছে। তার গায়ে সোয়েটার, সোয়েটারের ওপরে তিন তিনটে কাঁথা। তবুও পাতলা ঠোঁট জোড়া ঠান্ডায় কাঁপছে। বসে থাকতে থাকতে একসময় বিরক্ত হয়ে উঠে দাঁড়াল। কোথাও যাওয়ার মতো অবস্থা নেই। তার চেয়ে বরং আপার সঙ্গে আড্ডা দেয়া যাক। চৌকাঠে পা রাখতেই মৃদুলের কণ্ঠস্বর কানে এলো। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল সে। মৃদুল কাঁপতে কাঁপতে হেঁটে আসছে। শরীর ভেজা। রানি আপা, রানি আপা বলে ডাকছে। কিন্তু এখানে তো রানি নেই। মৃদুল বারান্দায় পা রেখেই পূর্ণার মুখটা দেখতে পেল। তার দিকে তাকিয়ে আছে। সঙ্গে সঙ্গে মৃদুলের কপালে ভাঁজ পড়ল। এই মেয়ের জন্যই তো এমন ঘটনা ঘটল। এখন ঠান্ডায় কাঁপতে হচ্ছে। সে দৃষ্টি সরিয়ে দাঁড়াল দূরে। শার্ট খুলে দড়িতে মেলে দিয়ে ডাকল, ‘কইরে রানি আপা। শীতে মইরা যাইতেছি। কাপড় নিয়ে আয়। ভেজা শরীর নিয়া ঘরে কেমনে ঢুকব?’
পূর্ণা কাঠখোট্টা গলায় বলল, ‘রানি আপা এইখানে নেই। অকারণে চেঁচাচ্ছেন।’
মৃদুল পূর্ণার স্বরেই পালটা জবাব দিল, ‘তোমারে কইছি আমার উত্তর দিতে? আমার ইচ্ছে হইলে আমি চেঁচাব। তোমার ভালা না লাগলে কানে ফাত্তর ঢুকায়া রাখো।’
পূর্ণা দাঁতে দাঁত চেপে কিড়মিড় করে তাকিয়ে থাকে। মৃদুল আড়চোখে পূর্ণাকে দেখে চোখের দৃষ্টি সরিয়ে নেয়। বাতাস বেড়েছে। খালি গায়ে কাঁপুনি শুরু হয়। মৃদুলকে এভাবে কাঁপতে দেখে পূর্ণার মায়া হচ্ছে। সে কণ্ঠ খাদে নামিয়ে বলল, ‘আমি আপনার কাপড় নিয়ে আসব?’
মৃদুল চোয়াল শক্ত রেখেই আবারও আড়চোখে তাকাল। কিন্তু উত্তর দিল না। সে সম্পূর্ণভাবে পূর্ণাকে উপেক্ষা করছে। পূর্ণা জবাবের আশায় কয়েক সেকেন্ড দাঁড়িয়ে থাকে, এরপর চলে যায়। পূর্ণা চলে যেতেই মৃদুল শীতের তীব্রতায় মুখ দিয়ে ‘উউউউউউ’ জাতীয় শব্দ করে কাঁপতে থাকল। যতক্ষণ না প্যান্ট শুকাবে ঘরের ভেতর ঢুকতে পারবে না। তার ঘরে যাওয়ার পথে ধান ছড়ানো আছে। এদিক দিয়ে গেলে ধান ভিজে নষ্ট হবে। সহ্য করা ছাড়া আর উপায় নেই। কেউ যদি কাপড় দিয়ে যেত!
আলগ ঘরের পেছনে উত্তর দিকের বারান্দায় গিয়ে মগাকে পেল পূৰ্ণা। মগা ঝিমুচ্ছে। ‘মগা ভাইয়া?’
মগা তাকাল। পূর্ণা বলল, ‘মৃদুল ভাইয়ের ঘর কোনটা?’
মগা আঙুলের ইশারায় দেখিয়ে দিল। পূর্ণা মৃদুলের ঘরে গিয়ে একটা লুঙ্গি আর শার্ট নিয়ে বেরিয়ে আসে। মৃদুল পায়ের শব্দ পেয়ে মুখ দিয়ে উচ্চারণ করা শীতের কাতরতা বন্ধ করে দিল। পূর্ণা মৃদুলের চেয়ে এক হাত দূরে এসে দাঁড়াল। এগিয়ে দিল লুঙ্গি আর শার্ট। মৃদুল ঘুরে তাকাল। আর রাগ দেখানো সম্ভব নয়। রগে রগে ঠান্ডার তীব্রতা ঢুকে গেছে। রক্ত শীতল হয়ে এসেছে। সে পূর্ণার হাত থেকে নিজের কাপড় নিতে নিতে হৃদয় থমকে দেয়ার মতো একটা মায়াবী মুখশ্রী আবিষ্কার করল। টানা টানা চোখ, চোখের পাঁপড়িগুলো এত ঘন যে মনে হচ্ছে কোনো বিশাল বটবৃক্ষ ছায়া ফেলে রেখেছে, পাতলা ফিনফিনে ঠোঁট, ত্বকে তেলতেলে ভাব চকচক করছে। লম্বা এলো চুল বাতাসে উড়ছে। শ্যামবর্ণের মুখ এত আকর্ষণীয় হয়? কিছু সৌন্দর্য বোধহয় এভাবেই খুব কাছে থেকে চিনে নিতে হয়। মৃদুলের দৃষ্টি শীতল হয়ে আসে। সে আগে লুঙ্গি নিলো। পূর্ণা অন্যদিকে ঘুরে দাঁড়াল। বলল, ‘আমি দেখব না। আপনি পালটে ফেলুন।’
মৃদুল মোহময় কোনো টানে আবার ফিরে তাকাল। তবে মুখটা আর দেখতে পেল না। মায়াবী মুখটা অন্যদিকে ফিরে আছে। সে লুঙ্গি পালটে মিনমিনিয়ে বলল, ‘শার্টটা?’
পূর্ণা হেসে শার্ট এগিয়ে দিল। মৃদুলের এলোমেলো দৃষ্টি। হুট করেই বুকে ঝড়ো বাতাস বইছে। কী আশ্চর্য! পূর্ণা গর্বের সঙ্গে বলল, ‘আমাকে কালি বলে কষ্ট দিলেও আমি আপনার কষ্ট দেখতে পারিনি। আমি সবসময় মহৎ।’
অন্যসময় হলে হয়তো মৃদুলও পালটা জবাব দিত। কিন্তু এখন ইচ্ছে হচ্ছে না। মোটেও ইচ্ছে হচ্ছে না। পূর্ণা কিছু না বলে আলগ ঘরে ঢুকে যায়। মৃদুল দ্রুত পায়ে দুই পা এগিয়ে আসে। আবার পিছিয়ে যায়। আজকের দিনটা অন্যরকম লাগছে। আচ্ছা, দিনটা অন্যরকম নাকি অনুভূতি অন্যরকম?
.
নিজেকে ধাতস্থ করার আগেই খলিল পদ্মজাকে ঠেলে ঘর থেকে বের করে দ্রুত দরজায় তালা লাগিয়ে দিলেন। পদ্মজা গালে হাত রেখে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। দুই চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। চোখের জল বিসর্জন হচ্ছে আঘাতের যন্ত্রণায়? নাকি কারো হাতে থাপ্পড় খাওয়ার অপমানে? কে জানে! খলিল কপাল কুঁচকে আরো কী কী যেন বলে চলে গেলেন। পদ্মজা ঠায় সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে। সে আকস্মিক ঘটনাটি হজম করতে পারছে না। দিকদিশা হারিয়ে ফেলেছে।
ঘরের ভেতর থেকে আওয়াজ পেয়ে সংবিৎ ফিরল পদ্মজা, বন্ধ দরজার দিকে একবার তাকাল। এই মুহূর্তে পরিস্থিতি কীভাবে সামলানো উচিত—তার মাথায় আসছে না। একটু দূরে চোখ পড়তেই দেখতে পেল লতিফাকে। পদ্মজাকে তাকাতে দেখেই লতিফা আড়াল হয়ে যায়। পদ্মজা সে জায়গাতেই দাঁড়িয়ে থাকে, তার মধ্যে কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। আকাশ মেঘাচ্ছন্ন। এই তীব্র শীতে আবার বৃষ্টি হবে নাকি! ভাবতে ভাবতেই গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি নামে। পদ্মজার গা কেঁপে উঠল ঠান্ডার তীব্রতায়।
সাই সাই বাতাস বইছে। সুপারি গাছগুলো একবার ডানে দুলে পড়ছে তো আরেকবার বাঁয়ে। আলগ ঘরের পেছনের বারান্দায় গায়ে কাঁথা মুড়িয়ে জুবুথুবু হয়ে বসে আছে মগা। পদ্মজা শাড়ির আঁচল ভালো করে টেনে ধরে শীত থেকে বাঁচতে। আবহাওয়ার অবস্থা ভালো না, তার মধ্যে বৃষ্টি আর বাতাস! সামান্য শাড়ির আঁচলে কী ঠান্ডার তীব্রতা আটকানো যায়!
ইচ্ছেও করছে না ঘরে যেতে। সে এদিক-ওদিক চেয়ে এক কোনায় একটা চেয়ার দেখতে পেল। চেয়ারটা আনার জন্য এগোল সে, আর তখনই নাকে একটা বিশ্রি বোটকা গন্ধ ধাক্কা দিল। সজাগ হয়ে উঠল পদ্মজার স্নায়ু। যত এগোচ্ছে গন্ধটা তীব্র হচ্ছে! সে সাবধানে এক পা এক পা করে ফেলছে। এরইমধ্যে আমিরের চেঁচামেচি কানে আসে। পদ্মজা থমকে যায়। উলটো ঘুরে বাইরে উঁকি দেয়। বাইরে ধস্তাধস্তি শুরু হয়েছে। প্রথমে দৃষ্টি কাড়ে আমিরের রাগী মুখশ্রী।
পদ্মজা সবকিছু ভুলে ছুটে নেমে যায় নিচ তলায়। বাইরে এসে দেখে, আমির তার চাচাকে মারছে! যেভাবে পারে কিল-ঘুসি দিচ্ছে। আমির এতটাই রেগে গিয়েছে যে নিজের আপন চাচাকে মারছে! মজিদ হাওলাদার, রিদওয়ান, আমিনা, রানি, সবাই আটকানোর চেষ্টা করছে। কেউ পারছে না। আমির খলিলকে ছেড়ে রিদওয়ানকে ধাক্কা মেরে কাদায় ফেলে দিল। আমিরের আচরণ উন্মাদের মতো। সে বিশ্রি গালিগালাজ করতে করতে রিদওয়ানের পেটে লাথি বসায়। রিদওয়ান কোঁকিয়ে উঠল। আমিনা আমিরকে কিল-থাপ্পড় মারছেন, তাতেও কাজ হচ্ছে না। এমন তো আমির নয়! পদ্মজা দৌড়ে আসে। আমিরকে চিৎকার করে বলল, ‘কী করছেন আপনি? পাগল হয়ে গেছেন? ছাড়ুন।’
আমির পদ্মজার জবাব দিল না, বরঞ্চ থাবা মেরে ধরল খলিলকে। খলিলের নাক বেয়ে রক্ত ঝরছে। সেই অবস্থায়ই শক্ত মুঠো করে মুখে আরেকটা ঘুসি মারল সে। রানি, আমিনা হাউমাউ করে কাঁদছে। মৃদুল, পূর্ণা, মগা, মদন—প্রত্যেকে দৌড়ে আসে। মৃদুল, পদ্মজা দুই হাতে আমিরকে টেনে সরাতে চায়। কেউই পারল না। আমিরের শরীরে যেন দানবের শক্তি ভর করেছে। সে কিছুতেই ক্লান্ত হচ্ছে না। মৃদুল দুই হাতে জাপটে ধরে আমিরকে দূরে সরিয়ে আনে। আমির হিংস্র বাঘের মতো হাত পা ছুড়তে ছুড়তে বলছে, ‘কুত্তার বাচ্চারা অনেক কিছু করেছিস, করতে দিয়েছি। আমার বউয়ের গায়ে হাত দেস কোন সাহসে? মৃদুল ছাড়। আমি ওদের আজরাইলের মুখ দেখিয়ে ছাড়ব। শুয়োরের বাচ্চা…’
মৃদুলকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে ছুটে গিয়ে রিদওয়ানকে ধরল আমির পদ্মজা হতভম্ব হয়ে পড়েছে! রিদওয়ান গতকাল তার কাঁধে হাত দিয়েছিল, আর আজ খলিল থাপ্পড়ে মেরেছে। এসব কে বলেছে আমিরকে? থাপ্পড়টা লতিফা দেখেছিল। তাহলে কী লতিফা বলেছে?
আমিনা পদ্মজার পায়ে লুটিয়ে পড়েন। পদ্মজা দ্রুত সরে যায়, ‘চাচি কী করছেন!’
আমিনা কাঁদতে কাঁদতে বললেন, ‘থামাও এই কামড়াকামড়ি। আল্লাহর দোহাই লাগে।’
পদ্মজা কী করবে বুঝতে পারছে না। আমির তার কোনো কথাই কানে নিচ্ছে না। এমন রাগ সে আগে কখনো দেখেনি! গুরুজনদের গায়ে হাত তোলার মতো রাগ আমিরের হতে পারে, এটা তার ধারণার বাইরে ছিল! পদ্মজা আমিরের সোয়েটার খামচে ধরে কণ্ঠ কঠিন করে বলল, ‘ছাড়ুন বলছি। ছাড়ুন।’
আমির তাও শুনল না। সে ধাক্কা মেরে পদ্মজাকে সরিয়ে দিল। দুই হাত দূরেই নারিকেল গাছ ছিল। সেখানে পড়লে নিশ্চিত কোনো অঘটন ঘটে যেত, অঘটন ঘটার পূর্বেই দুটো হাত পদ্মজাকে আঁকড়ে ধরে। পদ্মজা কৃতজ্ঞতার নজরে তাকাল। ফরিনাকে দেখতে পেল। ফরিনা এরকম ধস্তাধস্তি দেখেও চুপ করে আছেন, পদ্মজা অবাক হলো! থামানোর চেষ্টা পর্যন্ত করছেন না। পদ্মজা আবার আমিরকে থামানোর চেষ্টা করল, মৃদুল চেষ্টা করল। কিছুতেই কিছু হলো না। আমির খুব বেশি উত্তেজিত হয়ে আছে। মনে হচ্ছে, অনেক বছরের রাগ একসঙ্গে মিটিয়ে নিচ্ছে। পদ্মজা আমিরকে অনুরোধ করে সরে আসতে। সেই অনুরোধ আমিরের কর্ণকুহর অবধি পৌঁছেছে কি না সন্দেহ!
পদ্মজা অসহায় মুখ করে সরে যাবে, তখনই দুটি শক্তপোক্ত হাত আমিরকে টেনে সরিয়ে আনার চেষ্টা করে। সেই হাতে খুব দামি ঘড়ি। হাতের মালিককে দেখার জন্য পদ্মজা চোখ তুলে তাকাল। পরক্ষণেই চমকে উঠল মুখটা দেখে! দীর্ঘ সময় পর আবার সেই মানুষটির সঙ্গে দেখা। যে মানুষটি তার প্রথম ভালোবাসা না হলেও, প্রথম আবেগমাখা অনুভূতি ছিল…লিখন শাহ!
দূরে সরে দাঁড়াল পদ্মজা। মৃদুল, লিখন মিলে আমিরকে চেপে ধরে দূরে নিয়ে যেতে চাইল। আমির ছটফট করছে ছুটতে, তবে পারছে না। তীব্র রাগ নিয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে লিখনকে দেখে তার দৃষ্টি স্থির হলো, তবে থেকে গেল ছটফটানি। লিখন হেসে বলল, ‘এবার থামুন। অনেক শক্তি ফুরিয়েছেন।
আমির কিছু বলতে চাইল বটে, তবে তার আগেই রিদওয়ান ইট দিয়ে আমিরের ঘাড়ে আঘাত করে বসল সবার অগোচরে। আমির আর্তনাদ করে বসে পড়ে। লিখন রিদওয়ানকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে দেয়। পদ্মজা উৎকর্ণ হয়ে দৌড়ে আসে। আমিনা, রানি খলিল এবং রিদওয়ানকে নিয়ে দ্রুত আলগ ঘরে গয়ে দরজা বন্ধ করে দেয়। মজিদ মগাকে বললেন, ‘তাড়াতাড়ি গঞ্জে যা। বিপুল ডাক্তাররে নিয়ে আয়। আমার বাড়িতে এসব কী হচ্ছে!’
ফরিনা তখনো দূরে ঠায় দাঁড়িয়ে আছেন। এই ঘটনা তাকে বিন্দুমাত্র বিচলিত করেনি! বরং এই ঘটনার জন্য তিনি খুশি! কী চলছে তার মনে?
৫৪
ফরিনা তাড়াহুড়ো করে খোশমেজাজে রান্না করছেন। সাহায্য করার মতো পাশে কেউ নেই। একাই দৌড়ে দৌড়ে সব করছেন। হাওলাদার বাড়িতে অতিথি এসে একদিন না থেকে যেতে পারে না, এতে নাকি গৃহস্থ বাড়ির অমঙ্গল হয়। তাই মজিদ লিখনকে থেকে যেতে জোর করেছেন। পদ্মজা নিজের ঘরে স্বামী সেবায় ব্যস্ত। আমিরের ঘাড়ের চামড়া ফুলে গেছে। হাড়ে বিষের মতো যন্ত্রণা। বিপুল ডাক্তার ওষুধপত্র দিয়েছেন। পদ্মজা অশ্রুসজল নয়নে আমিরের মুখের দিকে চেয়ে চুলে বিলি কেটে দিচ্ছে। অনেকক্ষণ স্বামীর যন্ত্রণা দেখেছে। সহ্য করতে হয়েছে। মাত্রই আমির চোখ বুজেছে। সে মনে মনে আল্লাহ তায়ালার কাছে প্রার্থনা করছে, দ্রুত যেন আমিরের ব্যথাটা সেরে যায়। নয়তো তাকে দিয়ে দিক। ঘাড়ের আহত অংশে পদ্মজা আলতো করে ছুঁয়ে দিলো, নীল হয়ে আছে। নীরবে পদ্মজার পাশে এসে দাঁড়াল লতিফা। পদ্মজা কারো উপস্থিতি টের পেয়ে জলদি চোখের জল মুছল। তারপর লতিফাকে দেখে বলল, ‘লুতু বুবু!
লতিফা বলল, ‘খাইবা না? খালাম্মা খাইতে ডাকতাছে।’
পদ্মজা গম্ভীরকণ্ঠে বলল, ‘আম্মা নিজের ছেলেকে কেন দেখতে আসেননি?’
‘খালাম্মায় লিখন ভাইজানের লাইগে রানতাছিল।’
পদ্মজা ক্ষিপ্ত হয়, ‘নিজের ছেলেকে না দেখে উনি কীভাবে অতিথির জন্য ভোজ আয়োজন করছেন? আমি কিছুতেই বুঝতে পারছি না।’
লতিফা নতজানু হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। পদ্মজা অনেকক্ষণ ক্ষিপ্ত নয়নে মেঝেতে চোখ নিবদ্ধ করে রাখল। এরপর আমিরকে এক ঝলক দেখে, লতিফাকে বলল, ‘তুমি যাও, আমি আসছি।’
লতিফা দুই পা এগোতেই পদ্মজা ডেকে উঠল, ‘লুতু বুবু।’
লুতু দাঁড়াল। পদ্মজা বলল, ‘তুমি আমার ওপর নজর রাখছিলে কেন? আর আমাকে জিজ্ঞাসা না করে থাপ্পড়ের কথাই বা কেন উনাকে বলেছো?’
লতিফার কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। সে নত হয়ে, ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। পদ্মজা আরো দুই বার প্রশ্ন করেও কোনো জবাব পেল না। তাই বলল, ‘নিষেধাজ্ঞা আছে নাকি?’
এইবার লতিফা হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়াল। সে কিছু একটা ভাবছে, মুখ তুলে দেখে পদ্মজা তার দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে আছে। অপ্রতিভ হয়ে লতিফা বলল, ‘আমি যাই। নইলে খালাম্মায় চেতব।’
পদ্মজার উত্তরের আশায় না থেকে তড়িঘড়ি করে চলে গেলে লতিফা। পদ্মজা ভ্রুকুটি করে দরজার বাইরে তাকিয়ে রইল। প্রতিটি প্রশ্ন আলাদা আলাদা। অথচ তার মনে হয় সব প্রশ্নের এক উত্তর, একই সুঁতায় গাঁথা এখন সেসব ভাবার সময় না। আমিরের প্রতি যত্নশীল হওয়া দরকার। পদ্মজা আমিরের কপাল ছুঁয়ে তাপমাত্রা অনুমান করে। ভীষণ গরম। জ্বর উঠছে নাকি!
লিখন আর মৃদুলের আড্ডা জমে উঠেছে। জমিয়ে আড্ডা দিচ্ছে দুজন। লিখনের নায়িকা তিন দিন আগে ঘাট থেকে পিছলে নদীতে পড়ে গেছে। সাঁতার জানে না তাই প্রচুর পানি খেয়েছে। সেই সঙ্গে পা মচকে গেছে। কোমরেও ব্যথা পেয়েছে। এই কথা শুনে মৃদুল হাসতে হাসতে চেয়ার থেকে পড়ে যাচ্ছিল। পূর্ণা দূর থেকে কটমট করে মৃদুলের দিকে তাকিয়ে আছে। কত অসভ্য এই লোক! মানুষের আঘাতের কথা শুনে হাসে! তার গা জ্বলে যাচ্ছে মৃদুলের হা হা করে হাসা দেখে। লিখন আরো জানাল, সে এবং তার দল গত তিনদিন নায়িকা ছাড়া দৃশ্যগুলোর শুটিং করেছে। বাকি যা দৃশ্য আছে সবকিছুতে নায়িকার উপস্থিতি থাকতেই হবে। তাই আপাতত শুটিং স্থগিত। আশা করা যাচ্ছে, তিন-চার দিনের মধ্যে নায়িকা সুস্থ হয়ে যাবে। পূর্ণাকে দূরে বসে থাকতে দেখে লিখন ডাকল। খুশিতে গদগদ হয়ে দৌড়ে এলো পূর্ণা, ঘণ্টা দুয়েক আগে একটু কথা হয়েছিল; আর হয়নি। লিখন প্ৰশ্ন করল, ‘ভেতরের অবস্থা কেমন? আমির হাওলাদার আগের চেয়ে কিছুটা ভালো অনুভব করছেন?’
‘ঘুমাচ্ছে দেখে এলাম। আপা আছে পাশে।’
‘তোমার আপা পাশে থাকলে আর কী লাগে!’ লিখনের কণ্ঠটা করুণ
শোনায়। পূর্ণা প্রসঙ্গ পালটে বলল, ‘ভাইয়া, আপনি কিন্তু আমাদের বাড়িতে যাবেন। তখন বললাম, কিছুই বললেন না।’
‘যাব।’
‘প্রান্ত অনেক খুশি হবে।’
‘প্রান্ত যেন কে?’
‘আমার ভাই। ওই যে খুন—’
‘মনে পড়ছে। কী যেন নাম ছিল… মুন্না বা মান্না এরকম কিছু নাম ছিল না?’
‘জি ভাইয়া।’
‘সবাই কত বড়ো হয়ে গেছে। পড়াশোনা আর করোনি কেন?’
পূর্ণা বাঁ হাত চুলকাতে চুলকাতে বলল, ‘মেট্রিক ফেল করায় আর পড়তে ইচ্ছে করেনি।
মৃদুল ভূত দেখার মতো চমকে উঠে বলল, ‘তুমিও মেট্রিক ফেল?’
পূর্ণা আশ্চর্য হয়ে জানতে চাইল, ‘কেন? আরো কেউ আছে এখানে?’
মৃদুল মুচকি হেসে চুল ঠিক করতে করতে চমৎকার করে বলল, ‘আমিও মেট্রিক ফেল।’
মৃদুলের কথা শুনে লিখন সশব্দে হেসে উঠল। পূর্ণা সরু চোখে তাকিয়ে আছে মৃদুলের দিকে। মজা করল নাকি সত্য বলল? লিখন ঠোঁটে হাসি ধরে রেখে বলল, ‘মৃদুল মজা করছো, নাকি সত্যি?’
মৃদুল গুরুতর ভঙ্গিতে বলল, ‘মিথ্যা কইতে যামু কেন? এতে আমার লাভডা কী?’
মৃদুলের ভঙ্গি দেখে লিখন চারপাশ কাঁপিয়ে হাসল। সঙ্গে তাল মিলাল পূর্ণা ও মৃদুল। লিখন আগের চেয়েও সুন্দর হয়েছে। দেখতে কত ভালো দেখাচ্ছে। কী অপূর্ব মুখ। বলিষ্ঠ শরীর। পূর্ণা কেন জানি আজও মনে হচ্ছে, লিখনের পাশেই পদ্মজাকে বেশি মানায়। পরক্ষণেই পূর্ণা নিজেকে শাসাল, ‘চুপ থাক পূর্ণা! আমির ভাইয়ার মতো ভালো মানুষ দুটি নেই। আপার জন্য আমির ভাইয়া সেরা।’
তবুও মন বোঝে না। হয়তো সৌন্দর্যের মিলটার জন্যই লিখন-পদ্মজা দুটি নাম তার ভাবনায় একসঙ্গে জোড়া লেগে যায়। অথচ বিবেক দিয়ে ভাবলে মনে হয় আমিরের জায়গা কেউ নিতে পারবে না। কেউ না। সে অনন্য। তার মতো ভালোবাসতে কেউ পারবে না, লিখনও না।
হাসিখুশি মুহূর্ত উবে যায় খলিলের কর্কশ কণ্ঠে, ‘বেহায়া, বেলাজা ছেড়ি। পর পুরুষের সামনে কেমনে দাঁত মেলায়া হাসতাছে। ঘরে বাপ-মা না থাকলে এমনই হয়। এই ছেড়ি ঘরে যাও।’
লিখন-মৃদুলের সামনে এভাবে কটু কথা শুনে পূর্ণার বুক ফেটে কান্না আসে। সে এক পলক তাদেরকে দেখে আলগ ঘরের ভেতর চলে যায়। এদিকে লিখন, মৃদুলও হতভম্ব। খলিলের মাথায়, হাতে ব্যান্ডেজ। নাকের নিচে চামড়া উঠে গেছে, মাংস দেখা যাচ্ছে। তবুও তেজ কমেনি। তিনি পূর্ণাকে উদ্দেশ্য করে বলছেন, ‘মা ডা মইরা যাওয়ার পর থেকে এই ছেড়ি দস্যি হইয়া গেছে। এত বড়ো ছেড়ি বুড়া হইতাছে। বড়ো বইনে বিয়া দেয় না। কোনদিন কোন কাম ঘটায় আল্লায় জানে। তা, লিখন, দুপুরের খাবার খাইছো?’
লিখনের ইচ্ছে হচ্ছে না এই কুৎসিত ভাবনার লোকটার জবাব দিতে। যেহেতু সে এই বাড়ির অতিথি, তাই মনের কথা শুনতে পারল না। বলল, ‘জি না।’
খলিলকে উপেক্ষা করে আলগ ঘরে চলে গেল মৃদুল। পূর্ণা আলগ ঘরের পেছনের বারান্দায় এসে দাঁড়াল, মৃদুল তার পেছনে। কোমল স্বরে বলল, ‘খালুর কথায় কষ্ট পাইছো?’
পূর্ণা মৃদুলের দিকে না তাকিয়ে জবাব দিল, ‘আপনি কারো কষ্টের কথা ভাবেন দেখে ভালো লাগল।’
‘সবসময় ত্যাড়া কথা কেন কও? আমি যদি আগে জানতাম তোমারে কালি কইলে তোমার এত্ত কষ্ট হয়, তাইলে কইতাম না।’
পূর্ণা তাকাল। পূর্ণার দৃষ্টি দেখে মৃদুলের মন কেমন করে ওঠে। এ দৃষ্টির নাম বোধহয় মন কেমন করা দৃষ্টি’। পূর্ণা নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বলল, মাফ চাইছেন?’
মৃদুলের জোড়া ভ্রু কুঁচকে আসে। দুই পা পিছিয়ে যেয়ে বলল, ‘জীবনেও না।’
.
পদ্মজা ক্ষুধার্ত বাঘিনীর মতো রান্নাঘরে ঢুকে ফরিনাকে বলল, ‘আম্মা, কী হয়েছে আপনার?’
ফরিনা প্রবল বিস্ময়ে জানতে চাইলেন, ‘কেন? কী হইব আমার?’
ফরিনার ব্যবহারে পদ্মজা অবাক। সে কিঞ্চিৎ হাঁ হয়ে তাকিয়ে রইল। ফরিনা নিশ্চিন্ত মনে চুলা থেকে পাতিল নামালেন। তারপর বললেন, ‘ও পদ্মজা, মগারে একটু কইবা লিখন-মৃদুলরে ডাইকা আনতে। লিখন ছেড়াডা কহন আইছে। এহনও খায় নাই।’
পদ্মজা আর ঘাঁটল না ফরিনাকে। সে বুঝে গেছে কোনো জবাব পাবে না। সদর ঘরে পার হতেই সদর দরজায় মৃদুল এবং লিখনের দেখা পেল। পদ্মজা চট করে আঁচল দিয়ে মাথা ঢেকে নিয়ে বলল, ‘আপনারা এখানে এসে বসুন। আম্মা আপনাদেরই খোঁজ করছিলেন।’
কথা শেষ হতেই পদ্মজা সদর ঘর ছেড়ে রান্নাঘরে চলে গেল। আবিষ্ট হয়ে সেদিকে তাকিয়ে রইল লিখন। সেই পুরনো দিনের মতোই তার স্বপ্নের প্রেয়সী এক ছুটে পালিয়ে বেড়ায়। পার্থক্য শুধু—আগে লজ্জায় পালাত, এখন অস্বস্তিতে। লিখন গোপনে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। পদ্মজাকে এক ঝলক দেখার জন্য এই বাড়িতে সে পা দিয়েছে। যাকে মনপ্রাণ উজার করে ভালোবাসে তার স্বামীর বাড়িতে আসা কতটা কষ্টের তা শুধু তার মতো অভাগারাই জানে। মৃদুল লিখনের দৃষ্টি খেয়াল করে কিছু একটা আন্দাজ করে বলল, ‘পদ্মজা ভাবিকে চিনেন?’
‘চিনব না কেন—’
লিখন থেমে গেল। সে নিজের অজান্তেই কী বলে দিচ্ছিল! হেসে বলল, ‘এতসব জেনে কী হবে? আসো গিয়ে বসি। তারপর বলো, কখনো প্রেমে পড়েছো?’
‘না মনে হয়।’ উদাসীন হয়ে বলল মৃদুল।
‘নিশ্চিত হয়ে বলো।’
মৃদুল ভাবল, কোন নারীর প্রতি তার আকর্ষণ বেশি কাজ করেছে। উত্তর পেয়েও গেল। সকালেই সে পূর্ণার মধ্যে অদ্ভুত কিছু পেয়েছে। অজানা অনুভূতি অনুভব করেছে। এটা কী প্রেম? মৃদুল নিশ্চিত নয়। তাই সে বলল, ‘না, পড়ি নাই।’
‘আচ্ছা, সেসব বাদ। বিয়ে করছো কবে সেটা বলো।’
‘উমম, হুট করে একদিন। আমার ইচ্ছা আমি হুট করে একদিন বিয়ে করে আম্মারে চমকে দেব।’
লিখন সশব্দে হাসল। বলল, মানুষের সব চাওয়া পূরণ হয় না। প্রতিটি মানুষের জীবনের কোনো না কোনো পাশে অপূর্ণতা থাকে।’
‘তাহলে বলছেন আমার এই ইচ্ছে পূরণ হইব না?’
‘না তা বলছি না। হুট করে বিয়ে করে ফেলা আর কেমন অসম্ভব কাজ? মেয়ে রাজি থাকলেই হলো। মেয়ে বেঁকে গেলে কিন্তু কিচ্ছা খতম।’
লিখন আবারও সশব্দে হাসল। মৃদুলও অকারণে তাল মিলিয়ে হাসল। সে ভাবছে, একটা মানুষ এত হাসতে পারে কীভাবে? এত সুখী লিখন শাহ?
সে তো আর জানে না দুঃখীরা পাহাড় সমান কষ্ট লুকোয় হাসির আড়ালে।
.
ধীরে ধীরে বাড়ির সবাই বৈঠকখানায় জমা হলো, আমির ছাড়া। রিদওয়ান, খলিল এত শান্ত আচরণ করছে যে মনেই হচ্ছে না সকালে এত বড়ো ঘটনা ঘটে গেছে। বাড়ির মহিলারা দৌড়ে দৌড়ে খাবার পরিবেশন করছে। পদ্মজা খুব অবাক হয়ে প্রতিটি মানুষকে পর্যবেক্ষণ করছে। লিখনও এতে কম অবাক হয়নি। কত শান্ত পরিবেশ! ঝগড়ার পর মান-অভিমান, তর্ক-বিতর্ক থাকে। সেসব কিছুই নেই। পদ্মজা সবার সামনে আলাদা প্লেটে খাবার নিয়ে ফরিনাকে বলল, ‘আম্মা, আমি উনার জন্য খাবার নিয়ে যাচ্ছি। ঘুম ভেঙেছে হয়তো।
পদ্মজা সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠছে। লিখন সেদিকে আড়চোখে তাকিয়ে রইল। পদ্মজার হাঁটার ছন্দ দৃপ্ত ও সাবলীল। মাথায় শাড়ির আঁচলে ঘোমটা টানা। স্বামীর জন্য খাবার নিয়ে যাচ্ছে। এই স্বামীটা কী সে হতে পারত না? এতটাই অযোগ্য ছিল? অযোগ্য নাকি নিয়তির খেলা? কেন ভোলা যায় না এই নারীকে?
লিখনের বোন লিলি আর পদ্মজা একই ক্যাম্পাসের হওয়া সত্ত্বেও লিখন কখনো পদ্মজার সামনে এসে দাঁড়ায়নি, পদ্মজার অস্বস্তি হবে ভেবে। সে পদ্মজার চোখে ভালোবাসা দেখতে চায়, বিব্রতভাব বা অস্বস্তি দেখতে চায় না। এ যে বড়ো যন্ত্রণার। এতদিনেও বুকের ভেতর কীভাবে পুষে আছে এক পাক্ষিক ভালোবাসা? কোনোভাবে কী এই ভালোবাসা পূর্ণতা পাবে! আসবে কী সেই সুদিন? লিখনের শুষ্ক চক্ষু সজল হয়ে ওঠে। সে ভাবতে পারে না, পদ্মজা বিবাহিত! লিখনের ঠিক সামনেই মৃদুল ছিল, লিখনের প্রতিক্রিয়া দেখে অনেক কিছুই বুঝে নিলো। নিশ্চিত হওয়া যাবে পূর্ণাকে জিজ্ঞাসা করলে। খাওয়াদাওয়া শেষ করে পূর্ণার সঙ্গে কথা বলতে হবে। মৃদুল চারিদিকে চোখ বুলিয়ে কাঙ্খিত রমণীকে খোঁজে।
.
পদ্মজা আমিরকে ধরে ধরে বসাল। ঘাড়ে প্রচণ্ড ব্যথা। টিকে থাকাই দায়। রাগে কিড়মিড় করছে এখনো। পদ্মজা তাকে শান্ত করে খাইয়ে দিল। খাওয়া শেষে আমির ম্লান হেসে বলল, ‘লিখনের সঙ্গে কথা হয়েছে?’
পদ্মজা নিষ্কম্প স্থির চোখে তাকাল, ‘উনার সঙ্গে কেন কথা হতে যাবে আমার?’
‘উনি তো তোমার জন্যই এসেছেন।’
‘আপনাকে বলেছে? অন্য দরকারেও আসতে পারে।’
আমির হাসল। বলল, ‘সে আজও তোমাকে পছন্দ করে। আশা করে তুমি তার কাছে যাবে।’
‘অসম্ভব। যা তা বলছেন। আপনি এসব বললে আমার খারাপ লাগে।’
পদ্মজা থামল। আমির মৃদু হাসছে। পদ্মজা আমিরের কোলে মাথা রেখে আদুরে কণ্ঠে বলল, আপনি জানেন না আপনাকে কত ভালোবাসি আমি? আমি আপনাকে ছাড়া এক মুহূর্তও ভাবতে পারি না।’
‘তাহলে বাচ্চার জন্য বিয়ে করতে বলো কেন?’
‘বন্ধ্যা নারীর কত যন্ত্রণা, বুঝবেন না।’
‘আমাদের একটা মেয়ে হয়েছিল।’
‘আর হবে না তাই বলি।’
‘হবে, আল্লাহ চাইলে হবে। তাছাড়া আমার কাছে তো ফুটফুটে একটা বউই আছে। আর কী লাগে?
পদ্মজা আমিরের কোল থেকে মাথা তুলে উঠে বসে। চিরুনি দিয়ে আমিরের চুল আঁচড়ে দিতে দিতে বলল, ‘চুলগুলো বড়ো হয়েছে অনেক। ‘
‘হু, এদিকে আসো।’
আমির পদ্মজাকে এক হাতে টান দিতে গিয়ে ঘাড়ে চাপ খেয়ে ‘আহ’ করে উঠল। পদ্মজা ব্যস্ত হয়ে পড়ল, ‘খুব লেগেছে? আমি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছিলাম। কেন এমন করেন আপনি!
তেজহীন দুপুরের সূর্যটা একটু একটু দেখা যাচ্ছে। কিছুক্ষণ পর আবার ডুবেও যাবে। পূর্ণা লবণ দিয়ে টক বরই খাচ্ছে, দেখে মনে হচ্ছে অমৃত! মৃদুল পূর্ণার পাশে এসে বসতেই পূর্ণা চমকে উঠে। মৃদুলকে দেখে বুকে থুতু দেয়। তারপর বাজখাঁই কণ্ঠে বলল, ‘হুট করে এভাবে কেউ আসে?’
আর কথা কইও না। তোমারে সারা দুনিয়া খুঁজতে খুঁজতে হয়রান হয়ে গেছি। মাত্র মগা কইল তুমি নাকি ছাদে।’
‘কেন? আমাকে খুঁজছেন কেন?’
‘এমনে খ্যাট খ্যাট কইরা কথা কইতাছ কেন? একটু ভালো কথা আহে না মুখে?’
পূর্ণা একটু নড়েচড়ে বসল। হেসে বলল, ‘দুঃখিত। এবার বলুন কী দরকার।’
‘ব্যক্তিগত প্রশ্ন করতাম আর কী!
‘আমার ব্যক্তিগত কোনো তথ্য নেই।’
‘তোমার না, তোমার বড়ো বইনের। পদ্মজা ভাবির।’
পূর্ণা উৎসুক হয়ে তাকাল। মৃদুল উশখুশ করতে করতে বলল, ‘পদ্মজা ভাবি আর লিখন ভাইয়ের মধ্যে কী কোনো সম্পর্ক ছিল?’
পূর্ণা জোরে নিশ্বাস ছাড়ল। তার ভাব দেখে মনে হচ্ছে মৃদুল কোনো ফালতু প্রশ্ন করেছে। নির্বিকার কণ্ঠে বলল, ‘না। তবে লিখন ভাই আপাকে পছন্দ করত। আপার সঙ্গে ভাইয়ার বিয়েটা কীভাবে হয়েছে জানেন?’
‘আমির ভাইয়ের কথা বলছো?’
‘আপার কী আর কোথাও বিয়ে হয়েছে?’
‘সোজা উত্তর দিতে পারো না? তারপর বলো।’
‘ওই ঘটনাটা না হলে হয়তো লিখন ভাইয়ের সঙ্গেই আপার বিয়েটা হতো। কিন্তু হয়নি। এতটুকুই।’
‘লিখন ভাইরে দেখলে মনে হয় তাদের মধ্যে কোনো গভীর সম্পর্ক ছিল। তারপর বিচ্ছেদ হয়ে গেছে। ভাই অনেক ভালোবাসতে পারে।’
‘হু।’ পূর্ণা বরই খাচ্ছে তৃপ্তি করে।
মৃদুল বিরক্তি নিয়ে অনেকক্ষণ পূর্ণার দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর উঠে দাঁড়াল এক পাশে; চোখ ঘুরিয়ে দেখে নিলো চারপাশ। পূর্ণা বাঁকা চোখে মৃদুলকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত পরখ করে নিলো, মৃদুলের উপস্থিতি তার হৃৎস্পন্দন বাড়িয়ে দেয়, বুক হাপড়ের মতো ওঠানামা করে। তবে তা প্রকাশ করার সাহস হয় না। পূর্ণা আরেকটা বরই হাতে নিলো। তখন মৃদুল ডাকল, ‘বেয়াইন।’
পূর্ণা তাকাল। মৃদুল ঝুঁকে ছাদের মেঝেতে কিছু দেখছে। পূর্ণা উৎসুক হয়ে সেদিকে এগিয়ে যায়। মৃদুল আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বলল, ‘রক্ত না?
পূর্ণা মৃদুলের মতো ঝুঁকে ভালো করে খেয়াল করল। তারপর বিস্ফোরিত কণ্ঠে বলল, ‘তাই তো।
‘মানুষের রক্ত না পশুর রক্ত, বুঝতাম কেমনে?’
‘পশুর রক্ত এইখানে আসবে কেন?’
‘মানুষের রক্তই বা কেন আসবে?’
‘তাই তো!’
দুইজন চিন্তিত হয়ে ভাবতে থাকল। পূর্ণা বলল, ‘মনে হয় কোনো পাখি শিকার হয়েছে। আর রক্তাক্ত অবস্থায় এখানে এসে পড়েছে।’
‘তাহলে মরা পাখিডা কই?’
‘ধরুন, আহত হয়েছে কিন্তু মরেনি। এরপর চলে গেছে।’
.
সন্ধ্যারাত, জোনাকিপোকারা ছুটে বেড়াচ্ছে। ঠান্ডা বাতাস। সেই বাতাসে পাতলা শার্ট পরে লিখন দাঁড়িয়ে আছে নারিকেল গাছের নিচে, জোনাকি পোকা দেখছে। মাঝেমধ্যে অন্দরমহলের দিকে তাকিয়ে কাউকে চোখ দুটি খুঁজছে। সেদিন হেমলতা ফিরিয়ে দেয়ার পর, সারা রাত বাড়ি ফেরেনি সে। খেতে বসে ছিল, আকাশ কাঁপিয়ে কেঁদেছে। কেউ শোনেনি। স্বপ্ন ভেঙে যাওয়ার মতো কষ্ট দুটো নেই। স্বপ্নে সাজানো সংসার ভেঙে চুরমার হওয়ার দিন ছিল সেদিন। এক সময় ইচ্ছে হয়েছিল পদ্মজাকে তুলে নিয়ে পালাতে। কিন্তু বিবেক সাড়া দেয়নি। পরদিন সকালে উঠেই মা-বাবাকে নিয়ে ঢাকার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করে। প্রতিটা মুহূর্তে আফসোস হয়, শুরুতে কেন হেমলতার কাছে প্রস্তাব দিতে পারল না!
পরবর্তী কয়েকটা মাস ঘোরের মধ্যে কেটেছে। সিনেমা জগত থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন ছিল। বছরখানেক লেগেছিল জীবনের গতি স্বাভাবিক করতে। কিন্তু মন…মন তো ভেঙে গুঁড়িয়ে গেছে। আজও জোড়া লাগেনি। পদ্মজা কী কখনো জানবে, সে ঢাকায় কতবার পদ্মজার পিছু নিয়েছে? জানবে কী তার ভালোবাসার গভীরতা?
লিখন আনমনে হেসে উঠল। চোখে জল ঠোঁটে হাসি! এ হাসি সুখের নয়, যন্ত্রণার। নিজের প্রতি উপহাস!
পূর্ণা অন্দরমহলে আসেনি। পদ্মজা ভীষণ রেগে আছে। আলগ ঘরের বারান্দায় সারাক্ষণ কী করে এই মেয়ে? এর আগেও যখন পারিজা তার পেটে ছিল, পূর্ণা তখন এই বাড়িতে ছিল অনেকদিন। তখনো মাঝরাত অবধি আলগ ঘরের বারান্দায় বসে থাকত। পদ্মজা গায়ে শাল জড়িয়ে বেরিয়ে আসে অন্দরমহল থেকে। সারাদিন পূর্ণার খোঁজ নেয়া হয়নি। এখন ধরে ঘরে নিয়ে যাবে। নির্জন, থমথমে পরিবেশ।
তখন লিখনের কণ্ঠ ভেসে আসে, ‘পদ্মজা?’
কণ্ঠটি শোনামাত্র ভেতরে ভেতরে কেঁপে উঠে পদ্মজা, অপ্রতিভ হয়ে যায়। একটা মানুষ কেন তাকে এত বছর মনে রাখবে? কেন অনুচিত আশা নিয়ে বসে থাকবে? পদ্মজার রাগ হয়, অস্বস্তি হয়। কষ্টও হয়। প্রার্থনা করে, এই মানুষটার জীবনে কেউ আসুক। এসে তার জীবনটা কানায় কানায় পূর্ণ করে দিক। ভুলিয়ে দিক অতীত। পদ্মজা স্বাভাবিক কণ্ঠে বলল, ‘এভাবে রাতের বেলা ডাকবেন না।’
পদ্মজা লিখনকে উপেক্ষা করে দুই পা এগিয়ে যায়।
‘জীবন থেকে তো সরেই গিয়েছো। আমি তোমাকে বিব্রত করতে চাই না। তাই সুযোগ থাকা সত্ত্বেও সামনে আসিনি। আজ যখন এসেই পড়েছি, কয়েক হাত দূরে থেকেই একটু কথা বললে কী খুব বড়ো দোষ হয়ে যাবে?’
লিখনের করুণ কণ্ঠ শুনে দাঁড়িয়ে পড়ে পদ্মজা। হাসল লিখন, সুরগুলি যেন ফিরে এসে প্রাণে মৃদুগুঞ্জন শুরু করে দিয়েছে। পদ্মজার উপস্থিতি এভাবে কাঁপন ধরাচ্ছে কেন!
আজকের এই সময়টা সুন্দর, ভারী সুন্দর!
পদ্মজা – ৫৫
কোনো সাড়া নেই। পদ্মজা পেছনে ফিরে তাকাল। লিখন একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে। অন্ধকারে তার দিকে চেয়ে কী যে দেখছে! পদ্মজা আবার মুখ ঘুরিয়ে নিলো। কাটা কাটা গলায় বলল, ‘কিছু বলার নেই, আসি আমি।’
‘ভুলে গেছো আমায়? মনে পড়ে না?’ লিখনের কণ্ঠে ব্যাকুলতা।
পদ্মজার তীক্ষ্ণ বাক্যবাণ, ‘না ভুলবার মতো কোনো সম্পর্ক কী আমাদের ছিল? ছিল না। আর এভাবে নির্জনে কথা বলা ঠিক হচ্ছে না। আপনি বুঝদার মানুষ, জ্ঞানী মানুষ। এতটুকু নিশ্চয়ই বুঝবেন।’
লিখন ম্লান হেসে বলল, ‘আচ্ছা, আজ আসো।’
‘একটা অনুরোধ ছিল।’
‘কী?’
পদ্মজা ফের তাকাল। সরাসরি লিখনের চোখের দিকে। সঙ্গে সঙ্গে লিখনের বুক কেঁপে উঠল, সে অপলক চোখে তাকিয়ে রইল। পদ্মজা বলল, ‘নিজেকে এবার গুছিয়ে নিন। মরীচিকার পেছনে অনেক দৌড়েছেন, আর না। এবার নিজের জীবনটা নতুন করে সাজান। আপনার মনের জোর বাড়ান। মানুষ দ্বিতীয় প্রেমেও পড়ে। দ্বিতীয় বার কাউকে ভালোবাসে। মনপ্রাণ উজাড় করে ভালোবাসে। আপনি চেষ্টা করুন। আপনিও পারবেন। কেউ না কেউ আপনার জন্য অবশ্যই আছে।’
‘পদ্ম ফুল।’
পদ্মজা একটু সময়ের জন্য হলেও থমকায়। লিখন বলল, ‘এভাবেই ভালো আছি আমি। তুমিও এভাবেই সারাজীবন ভালো থেকো।’
পদ্মজা কী জবাব দেবে, বুঝে উঠতে পারছে না। এই লিখন শাহ তো এক ধ্যানেই পড়ে আছে। সে আর কথা দীর্ঘ করল না। যে বুঝেও বুঝতে চায় না, তাকে বুঝিয়ে লাভ নেই। সে দুই পা পিছিয়ে গিয়ে বলল, ‘শুভ রাত্রি।’
লিখন পদ্মজার যাওয়ার পানে তাকিয়ে রইল, তার চোখ অশ্রুসজল। তবে বুকে প্রশান্তি। জীবনের খরতাপ দহনে মায়াময় পদ্মজার কণ্ঠ, একটু দেওয়া সময় তার বুকে প্রশান্তির ঢেউ তুলেছে। এই…এইটুকু সময়ের স্মৃতি নিয়েই কয়েকটা রাত আরামে ঘুমানো যাবে। সে বিড়বিড় করল, ‘আমি মানতে পারি না তুমি অন্য কারো। আমি তোমাকে ভালোবাসি।’
শেষের শব্দ তিনটে ঘোর লাগা কণ্ঠে ভেঙে ভেঙে বলল।
.
পূর্ণাকে ঘরে এনে পদ্মজা ধমকে বলল, ‘এই ঠান্ডার মধ্যে সোয়েটার না পরে কীভাবে থাকিস? বাইরে বাতাসও হচ্ছে। আমার কোনো কথাবার্তাই কী শুনবি না?’
পূর্ণা অপরাধী স্বরে বলল, ‘আর হবে না, আপা। আগামীকাল সন্ধ্যার আজানের সঙ্গে সঙ্গে ঘরে চলে আসব।’
‘জি, না। বিকেল থেকেই ঘরে থাকবেন। এমনিতেই এই বাড়ির অবস্থা ভালো না। তুই দুই দিন পর বাড়িতে চলে যাবি।’
‘তুমি যাবে না?’
পদ্মজা আনমনে কিছু ভাবল। বলল, ‘যাব। কয়দিন পর। শোন, রাতে টয়লেটে যেতে ভয় পেলে আমাকে ডাকবি। চেপে রাখবি না।’
‘আচ্ছা।’
পূর্ণা খুক খুক করে কাশতে থাকল। পদ্মজা বিচলিত হয়ে বলল, ‘কাশিও হয়ে গেছে! কত ঠান্ডা বাঁধিয়েছিস। জ্বরও আছে নাকি দেখি।’
পদ্মজা পূর্ণার কপাল ছুঁয়ে তাপমাত্রা অনুমান করে বলল, ‘আছেই তো। তুই কী নিজের যত্ন নেয়া শিখবি না? সারাদিন নতুন শাড়ি পরে, সাজগোজ করে ঘুরে বেড়ালেই নিজের যত্ন নেয়া হয়ে যায়? স্বাস্থ্যের যত্ন নিতে হবে তো।’
পূর্ণা বাধ্য মেয়ের মতো বলল, ‘আচ্ছা নেব।’
‘তা তো সবসময় বলিস। তুই বস, আমি কুসুম গরম পানি নিয়ে আসছি। গড়গড়া কুলি করে এরপর ঘুমাবি।’
‘আপা–’
—তুই চুপ থাক। চুপচাপ লেপের ভেতর শুয়ে থাক। আমি আসছি।’
পদ্মজা ॥ ৩৪৫
পদ্মজা রান্নাঘরে এসে দেখে বালতিতে পানি নেই। বাড়ির সবাই যার যার ঘরে আছে। হয়তো ঘুমিয়েও গেছে। আমির তো সেই কখন ঘুমিয়ে পড়েছে। পদ্মজা ছোটো বালতি হাতে নিয়ে কলপাড়ে আসে। চারিদিক নির্জন, থমথমে। কোনো সাড়াশব্দ নেই। পদ্মজা আশপাশে চোখ ঘুরিয়ে নিলো। ঝাপসা আলোয় পুরো বাড়িটাকে রহস্যময় মনে হচ্ছে। যদিও এই বাড়িতে সবসময়ই রহস্য বিদ্যমান!
পদ্মজা বালতি রেখে কল চাপতে যাবে তখনই কানে একটা ঝনঝন শব্দ আসে। স্টিলের কিছু কাছে কোথাও পড়েছে। পদ্মজা থমকে দাঁড়াল। কান খাড়া করে বুঝতে পারল, শব্দটা রানির ঘর থেকে আসছে। রানি আপার কোনো বিপদ হলো না তো? পদ্মজা ছুটে আসে রানির ঘরের সামনে। কানে ক্রোধ মেশানো চাপা কণ্ঠ ভেসে আসে, ‘তোমার লগে কয়বার হুতছি বইললা ভাইবো না সবসময় হুইতে দিয়াম। মাড়িতে যেভাবে এতদিন ছিলা, আজও থাকবা। বিছানাত ওঠার জন্য গাঁইগুঁই করবা না।’
‘মাডিত অনেক ঠান্ডা লাগে। আমারে এক কোনাত জায়গা দাও।’
‘তুমি মাডিত থাকবা মানে মাড়িত থাকবা। কামলা হইয়া মালিকের ছেড়ির লগে হুইবার সাহস আর করবা না।’
‘আমি বিছানাত ঘুমাইয়াম। তুমি আমার বউ লাগো।’
তুমি মাডিত ঘুমাইবা। আমি তোমারে জামাই মানি না।’
‘দেহো, রানি—’
এরপরই একটা আর্তচিৎকার ভেসে আসে। রানি-মদন তর্ক করছে। নিশ্চয় রানি মদনকে ধাক্কা দিয়েছে। মদন ব্যথা পেয়েছে। পদ্মজা একবার ভাবল, দরজায় কড়া নাড়বে। এরপর ভাবল, স্বামী-স্ত্রীর অনেক কথা সে শুনে ফেলেছে। আর না শোনাই ভালো। যেহেতু তারা কারো সামনে ঝগড়া করে না, রাতে নিজ ঘরে সবার অগোচরে ঝগড়া করছে তাহলে ব্যপারটা ব্যক্তিগত। পদ্মজা সরে আসে। মনটা খুব খারাপ হয়ে গেছে। এই দাম্পত্য সংসারে কী ভালোবাসা, সুখ কখনো আসবে না? মদন তো দেখতে খারাপ না। শুধু এতিম আর এই বাড়ির একজন বাধ্য ভৃত্য। এ ছাড়া তো ভীষণ সহজ-সরল। সবার সঙ্গে হেসেখেলে কথা বলে। ঠোঁটে সবসময় লেগে থাকে হাসি।
লিখন আর মৃদুল একই ঘরে, একই বিছানায় শুয়েছে। লিখনের জন্য আলাদা ঘর ছিল বটে, কিন্তু সে মৃদুলের সঙ্গেই শুয়েছে। ছেলেটাকে খুব ভালো লেগেছে তার। সোজাসুজি কথা বলে। মনে কিছু চেপে রাখতে পারে
৩৪৬ ॥ পদ্মজা
না। এতক্ষণ বকবক করেছে। সবেমাত্র অন্যপাশে ফিরে চোখ বুজেছে। বোধহয় ঘুম পেয়েছে। লিখনের মনটা আনচান করছে। ইচ্ছে হচ্ছে, পদ্মজাকে দেখতে যেতে, একসঙ্গে বসে গল্প করতে। কিন্তু তা তো সম্ভব নয়। এই বাড়িতে আর আসা যাবে না। পদ্মজার সামনে এলেই মন বেপরোয়া হয়ে যায়। কত-শত ইচ্ছে জেগে ওঠে। লিখনের ব্যক্তিত্ব ভীষণ শক্ত। শুধু এই একটা জায়গাতেই সে দুর্বল। এভাবে চলতে পারে না। নিজের জায়গায় নিজেকে শক্ত থাকতে হবে। লিখন জোরে নিশ্বাস ছাড়ল। মৃদুল ফিরে তাকাল। বলল, ‘ভাইয়ের ঘুম পাইতাছে না?’
‘হু। তুমি ঘুমাও।’
মৃদুল মেরুদণ্ড সোজা করে শুয়ে বলল, ‘আপনি—’
‘আপনি না তুমি। একটু আগেই না আমাদের কথা হলো। তুমি আমাকে তুমি বলবে।’
মৃদুল হাসল। বলল, ‘তুমি যে মেয়েটার জন্য অপেক্ষা করছো সে মেয়েটা পদ্মজা ভাবি। তাই না?’
লিখন অপ্রস্তুত হয়ে উঠল। পদ্মজা যে বাড়ির বউ সে বাড়ির আত্মীয়র সঙ্গে এসব নিয়ে কথা বলাটা নিশ্চয় অনুচিত! এতে পদ্মজার অসম্মান হবে। সে তো চায় না পদ্মজা কষ্ট পাক, তাকে নিয়ে কেউ দুই লাইন বেশি ভাবুক। পদ্মজা সবসময় ভালো থাকুক। লিখন জোরপূর্বক হাসল। তারপর বলল, ‘কী বলছো! তেমন কিছুই না। ঘুমাও এখন। আমারও অনেক ঘুম পাচ্ছে।’
লিখন অন্যদিকে ঘুরে শুয়ে পড়ে। মৃদুল হতাশ হয়ে চোখ বুজে।
পদ্মজা অন্ধকারে ধীরে ধীরে হাঁটছে। হাতে কাচের গ্লাস। তাতে কুসুম গরম পানি। সিঁড়িতে পা রাখতেই কারো পায়ের আওয়াজ কানে এলো। পদ্মজা ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে, আলমগীর চোরের মতো চারপাশ দেখে দেখে সদর দরজার দিকে যাচ্ছে। পদ্মজা দ্রুত সিঁড়ি থেকে নেমে চেয়ারের পেছনে লুকিয়ে পড়ল, গ্লাস রেখে দিল এক পাশে। তার স্নায়ু উত্তেজিত হয়ে পড়েছে। চোখ দুটি তীক্ষ্ণ হয়ে আলমগীরকে পরখ করছে। আলমগীরের পরনে পাঞ্জাবি। বাড়িতে ভদ্রলোকের উপস্থিতি টের পাওয়া যায় না। শান্তশিষ্ট, চুপচাপ। মাঝেমধ্যে দেখা যায়…তবে কথা হয় না। প্রশ্ন করলে উত্তর দেয়। নিজ ইচ্ছায় কথা বলে না।
সদর দরজা পেরিয়ে গেল আলমগীর। পদ্মজাও সাবধানে আলমগীরের পিছু নিলো। পায়ের জুতাগুলো হাঁটার তালে মৃদু শব্দ তুলছে। তাই পদ্মজা
পদ্মজা ॥ ৩৪৭
জুতাজোড়া খুলে দরজার পাশে রেখে দিল। আলমগীর অন্দরমহলের ডান দিকে এগোচ্ছে। ঝিঁঝি পোকার ডাক চারিদিকে। দূরে কোথাও শেয়াল ডাকছে। গা ছমছমে পরিবেশ। এদিক-ওদিক কোনো মৃদু শব্দ হতেই পদ্মজা উৎকর্ণ হয়ে উঠছে। কেমন গা কাঁটা দিচ্ছে। এত রাতে দীর্ঘদেহী এই লোক যাচ্ছে কোথায়? হাঁটতে হাঁটতে তারা বাড়ির পেছনে চলে আসে। আলমগীর অন্দরমহলের পেছনে গিয়ে দাঁড়াল। মনে হচ্ছে এটাই তার গন্তব্য। পদ্মজা কলাগাছের পেছনে লুকিয়ে পড়ল। বাতাসে গা কাঁপুনি দিচ্ছে। আলমগীর চারপাশ দেখে নিলো টর্চ জ্বালিয়ে। তারপর মুখ দিয়ে একটা অদ্ভুত আওয়াজ করল। কাউকে ইঙ্গিত দিচ্ছে! পদ্মজার রগে রগে দামামা শুরু হয়।
কী হতে চলেছে? আজ কী দেখবে?
বিরক্ত হয়ে শোয়া থেকে উঠে বসল পূর্ণা। এতক্ষণ হয়ে গেল তার আপা আসছে না কেন? সে জুতা পরে নেমে এলো নিচ তলায়। রান্নাঘরে যাওয়ার পথে পায়ে কাচের গ্লাস লেগে পড়ে গেল। ভয় পেয়ে গেল পূর্ণা। এখানে গ্লাস কে রাখল? খানিকটা পানি লাগল তার পায়ে। মনে হচ্ছে, পানিটা গরম। এই রাতের বেলা গরম পানি এখানে…কীভাবে?
পূর্ণা ভাবল, তার আপার না পানি গরম করার কথা ছিল? কিন্তু গরম করে এখানে কেন রাখবে? তার কাছে নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল তো! পূৰ্ণা রান্নাঘরে এসে দেখে—পদ্মজা নেই। আতঙ্কিত হয়ে পড়ল সে। দরজার পাশে পদ্মজার জুতা দেখে ভয়টা আরো বেড়ে যায়। সে দৌড়ে আমিরের ঘরে গেল। গিয়ে দেখল, আমির ঘুমাচ্ছে। পদ্মজা নেই। পূর্ণা এবার ঘামতে থাকল। সে শুনেছে, এই বাড়িতে ভূত-জিন আছে। এরা মানুষের ক্ষতি করে। বিশেষ করে সুন্দর মানুষদের। তার মানে তার আপার গুরুতর বিপদ! পূর্ণা এক দৌড়ে রান্নাঘরে এসে জ্বালিয়ে নিলো একটা লণ্ঠন। অন্যসময় হলে ভয় কাজ করত। আজ করছে না। সে তার আপাকে জান দিয়ে হলেও বাঁচাবে। সে ভাবছে, কোনো পাজি জিন হয়তো আপার উপর ভর করে পুকুরপাড়ে নিয়ে গেছে।
পূর্ণা ঝটপট বেরিয়ে পড়ে। কাউকে ডাকার বুদ্ধি অবধি মাথায় আসেনি। সে আতঙ্কে হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়েছে। আয়তুল কুরসি পড়তে পড়তে পুকুরপাড়ের পথ ধরে।
.
পদ্মজাকে চমকে দিয়ে তৃতীয় তলার একটা জানালা হাট করে খুলে যায়। সেখান থেকে একটা মোটা দড়ি ছুঁড়ে দেওয়া হয় আলমগীরের উদ্দেশ্যে। পদ্মজার ওষ্ঠদ্বয় আপনা থেকেই আলাদা হয়ে গেল, দুই চোখ বড়ো বড়ো করে তাকিয়ে রইল সেদিকে। আলমগীর সেই দড়ি বেয়ে তৃতীয় তলায় উঠে গেল। দেখে মনে হচ্ছে: এর আগেও বহুবার আলমগীর কাজটা করেছে।
মস্তিষ্ক শূন্য হয়ে গেল পদ্মজার। জানালা দিয়ে আলমগীর কার ঘরে গিয়েছে? তৃতীয় তলায় সে একবার গেছে বলে জানেও না, কোন ঘরে কী আছে। ঠান্ডা, শিরশিরে একটা অনুভূতি হচ্ছে পায়ের গোড়ালিতে। পদ্মজা এক হাত দিয়ে ছুঁতেই বুঝতে পারে জোঁকে ধরেছে। জোঁকে তার খুব ভয়। কিন্তু এখন ভয় করছে না। তার স্নায়ু উত্তেজিত হয়ে আছে অন্যকাজে। সে জোঁক ছাড়িয়ে নিলো।
অনেকক্ষণ পার হয়ে গেলেও আলমগীরের দেখা নেই। দড়ি তো ঝুলছে! আবার কী নামবে? পদ্মজা কোমরে এক হাত রেখে তাকিয়ে রইল। আচমকা মনে পড়ে গেল—তৃতীয় তলায় রুম্পা আছে। ডান দিকের কোনো এক ঘরে। আর আলমগীর ডান দিকের কোনো ঘরের জানালা দিয়েই ঢুকেছে। মানে কী? রুম্পার কাছে গিয়েছে?
পদ্মজা বারংবার শুধু চমকাচ্ছে। আলমগীর দড়ি বেয়ে নামতে শুরু করল। তারপর ইশারায় অন্য কাউকে নামতে বলল। কাঙ্ক্ষিত সেই মুখটি দেখে চমকে গেল পদ্মজার পিলে। রূম্পা! শাড়ির আঁচল কোমরে গুঁজে দড়ি বেয়ে নামছে। বার বার দড়ি থেকে হাত ছুটে যাচ্ছে তার। আলমগীর দুই হাত বাড়িয়ে রেখেছে যাতে রুম্পা পড়ে গেলে ধরতে পারে। পদ্মজার বুক দুরুদুরু করছে, যদি রুম্পা পড়ে যায়! এত ঝুঁকি কেন নিচ্ছে?
রুম্পার পা মাটিতে পড়তেই আলমগীর শক্ত করে রুম্পাকে জড়িয়ে ধরল। পরক্ষণেই ভেসে এলো রুম্পার কান্নার সুর। সঙ্গে সঙ্গে রুম্পার মুখ চেপে ধরে কিছু একটা বলল আলমগীর। টর্চের আলো ফেলে চারপাশ দেখে, রুম্পাকে এক হাতে শক্ত করে ধরে হাঁটা শুরু করল সামনে। তখন কোথেকে উদয় হয় একজন অদ্ভুত লোকের। লোকটা কালো, মোটা, লম্বা চুল। এক হাতে রাম-দা, অন্য হাতে লাঠি। অজানা বিপদের আশঙ্কা পেয়ে ভয় হলো পদ্মজার। পা থেকে কিছুটা দূরে থাকা কয়েকটা পাথরের মধ্যে বড়োসড় দেখে একটা পাথর হাতে নিলো, যেন বিপদে কাজে লাগানো যায়। পরক্ষণেই তর্ক-বিতর্ক শুরু হয়ে গেল আলমগীর আর অজ্ঞাত লোকটির মধ্যে। একসময় তা হাতাহাতিতে রূপ নিলো। রুম্পা ভয়ে জুবুথুবু হয়ে গেছে। অজ্ঞাত লোকটি রুম্পাকে ধরতে চাইছে। কিন্তু আলমগীর তা হতে দিচ্ছে না। পদ্মজার মনে হচ্ছে, এখন তার সামনে যাওয়া উচিত। আল্লাহর নাম নিয়ে সে কলাগাছের পেছন থেকে বেরিয়ে আসে। আলমগীর অজ্ঞাত লোকটির হাত থেকে রাম-দা নিয়ে দূরে ফেলে দিল, পরক্ষণেই দেখতে পেল পদ্মজাকে। চেঁচিয়ে উঠে বলল, ‘বোন, সাহায্য করো।’
অজ্ঞাত লোকটি পদ্মজাকে দেখে আরো বেশি হিংস্র হয়ে উঠল। ছুটে এসে ছোঁ মেরে রুম্পাকে ধরতে চাইল সে। আলমগীর ঝাঁপিয়ে পড়ল অজ্ঞাত লোকটির ঘাড়ে। দুই হাতে ঝাপটে ধরে রেখে রুম্পাকে বলল, ‘তুমি যাও, রুম্পা।
রুম্পা দৌড়ে পদ্মজার কাছে আসে। সে হাঁপড়ের মতো হাঁপাচ্ছে, ঘামছে ভয়ে। আলমগীর অজ্ঞাত লোকটিকে আটকে রাখতে পারছে না। সে অনেক কষ্টে অনুরোধ করে, ‘আমার রুম্পাকে ওরা মেরে ফেলবে। তুমি ওরে খালপাড়ে নিয়ে যাও পদ্ম। আমি আজীবন তোমার গোলাম হয়ে থাকব।’
পদ্মজা দুই হাতে আঁকড়ে ধরে রুম্পাকে। আলমগীরের হাত থেকে পড়ে যাওয়া টর্চের আলো অজ্ঞাত লোকটির মুখে পড়তেই পদ্মজার খুব চেনা মনে হয়। পারিজার খুনির বর্ণনাও ঠিক এমনই—ভাবতেই পদ্মজার রক্ত ছলকে ওঠে।
সেই মুহূর্তে মরার ওপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে আবির্ভাব ঘটে পূর্ণার। সে পুকুরপাড়ে যাচ্ছিল। টর্চের আলো পেয়ে এদিকে ছুটে এসেছে। অজ্ঞাত লোকটি রুম্পার উদ্দেশ্যে হাতের লাঠি ছুঁড়ে মারে। দ্রুত রুম্পাকে নিয়ে সরে যায় পদ্মজা, লাঠি গিয়ে সোজা পড়ে পূর্ণার কাঁধে। আপা বলে আর্তনাদ করে বসে পড়ে সে।
পদ্মজা দিকদিশা হারিয়ে ফেলল। কী করবে সে? মনে হচ্ছে রুম্পাকে কেউ খুন করতে চাইছে, তাই আলমগীর তাকে নিয়ে পালাচ্ছে। আর এই নাম না জানা লোক রুম্পাকে আঘাত করতে চাইছে কেন? পূর্ণাও আঘাত পেয়েছে। কী করবে পদ্মজা? রুম্পাকে নিয়ে খালের দিকে পৌঁছে দিবে? পূর্ণাকে এই ভয়ংকর পরিবেশ থেকে নিরাপদে নিয়ে যাবে?
নাকি পারিজার খুনি হিসেবে সন্দেহ করা লোকটিকে ধরবে?
৫৬
থেকে থেকে দূরে হুতুম প্যাঁচা ডাকছে, ভুতুড়ে শোনাচ্ছে ডাকটা। গা কাঁপুনি দেবার মতো ঠান্ডা। সময়টা যেন থমকে দাঁড়িয়ে চড়ছে দণ্ড শূলে। পদ্মজা ছুটে এলো পূর্ণার কাছে। পূর্ণা উবু হয়ে শুয়ে পড়েছে। কাঁদছে মা, মা করে। পদ্মজা এক হাতে শক্ত করে ধরে রেখেছে রুম্পাকে। আরেক হাতে পূর্ণার কাঁধে ছুঁয়ে দেখল কোথায় আঘাত পেয়েছে। ঠান্ডায় তার ঠোঁট কাঁপছে। কানে ভেসে আসছে দুজন পুরুষের ধস্তাধস্তির দুপদাপ শব্দ। পদ্মজার ঠান্ডা হাতে পূর্ণার আহত স্থানের রক্ত লাগতেই সে আঁতকে উঠল। রুম্পাকে ছেড়ে জড়িয়ে ধরল পূর্ণাকে। পাশে তাকিয়ে দেখল, যে লাঠি দিয়ে আঘাত করা হয়েছে সে লাঠির আগায় কাঁচি বাঁধা। পূর্ণার ঘাড়ের চামড়া ছিঁড়ে গেছে। গলগল করে রক্ত বের হচ্ছে। রক্তে ভেসে যাচ্ছে পূর্ণার পুরো শরীর। আলমগীর অজ্ঞাত লোকটির সঙ্গে পারছে না। সে আকুতি, মিনতি করে পদ্মজাকে বলছে, ‘পদ্মজা, পদ্মজা, বোন সহায় হও।’
টানাপোড়নে পদ্মজার হাত পা কাঁপতে থাকল। সে পূর্ণাকে টেনে তোলার চেষ্টা করল। পূর্ণা কিছুতেই উঠতে পারছে না। যন্ত্রণায় ছিন্নভিন্ন হয়ে যাচ্ছে। পূর্ণার কান্না দেখে পদ্মজার বুক ব্যথায় বিষে যাচ্ছে। এই রাত, রাতের আঁধার এত পাষাণ কেন হলো!
আলমগীরের আর্তনাদ ভেসে এলে, পদ্মজা চমকে ফিরে তাকাল। অজ্ঞাত লোকটি আলমগীরের স্পর্শকাতর স্থানে অস্বাভাবিকভাবে আঘাত করেছে। ফলে সে দুর্বল হয়ে আর্তনাদ করে উবু হয়ে ছটফট করছে। অজ্ঞাত লোকটি দ্রুতগামী ঘোড়ার গতিতে ছুটে এসে রুম্পাকে ধরতে চাইল। পদ্মজা বাধা হয়ে দাঁড়াল। অজ্ঞাত লোকটি কর্কশ কণ্ঠে পদ্মজাকে হুংকার দিল, ‘আমার কাম আমারে করতে দে।’
একটা মানুষের কণ্ঠস্বর এত ভয়ংকর কী করে হয়! এই কণ্ঠস্বর যে কাউকে কাঁপিয়ে তুলবে। পদ্মজা কিঞ্চিৎ চমকালেও থেমে থাকল না। উত্তুরে হাওয়ায় তার চুল এলোমেলো হয়ে উড়ছে। সে অজ্ঞাত লোকটির মতোই হুংকার দিয়ে বলল, ‘নিজের ভালো চান তো আত্মসমর্পণ করুন।’
পদ্মজার কথা শুনে লোকটি ব্যঙ্গ করে হাসল। খুব কাছ থেকে অজ্ঞাত লোকটির মুখ দেখে কপাল কুঁচকে ফেলল পদ্মজা। লোকটির মুখ থেকে বিশ্রি একটা দুর্গন্ধ আসছে। স্বাস্থ্যবান দেহ, গায়ের রং কুচকুচে কালো। সাদা দাঁতকপাটি আর লাল ভয়ংকর চোখ—দুটিই আগে নজর কাড়ছে। পদ্মজা কিছু বুঝে ওঠার পূর্বেই অজ্ঞাত লোকটি পদ্মজাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিল। এরপর লাঠি তুলে নিলো হাতে। রুম্পা ছুটে পালাতে চাইল। কিন্তু পারল না। অজ্ঞাত লোকটি তার গলা চেপে ধরল।
পদ্মজা দৌড়ে এসে অজ্ঞাত লোকটির পিঠে কিল-ঘুসি দিল, তাও কাজ হলো না। পদ্মজার গায়ের শক্তি লোকটিকে এক চুলও নাড়াতে পারেনি। রুম্পা গোঙাচ্ছে। পূর্ণা যন্ত্রণায় কাঁদছে, ভয়ে জুবুথুবু হয়ে আছে। রাত গভীর থেকে গভীরতর হচ্ছে। নিশাচর পাখিরা আজ যেন অদ্ভুত স্বরে ডাকাডাকি করছে। কেমন গা কাঁপিয়ে তোলা ডাক! ঝিঁঝিপোকাদের ডাক বেড়েছে, কান ঝালাপালা হয়ে যাচ্ছে। সেই সঙ্গে বেড়েছে বাতাসের বেগ।
অজ্ঞাত লোকটির হিংস্র থাবা রুম্পাকে গ্রাস করে নিয়েছে। লোকটি পা দিয়ে মাটি থেকে লাঠি তুলল। তারপর লাঠির আগা থেকে কাঁচি নিলো হাতে।
আর কিছু মুহূর্ত, তাহলেই সেই ধারাল কাঁচি রুম্পার গলার রগ কেটে ফেলবে। উড়ে যাবে রুম্পার রুহ। আলমগীর নিজের যন্ত্রণা ভুলে ছুটে আসে তার সহধর্মিণীর প্রাণ বাঁচাতে। তার আগেই ঘটে যায় ভয়ংকর এক দৃশ্য। পদ্মজা অজ্ঞাত লোকটির পড়ে থাকা রাম-দা তুলে তার পিঠেই কোপ বসিয়ে দিল। সঙ্গে সঙ্গে অজ্ঞাত লোকটি লুটিয়ে পড়ল মাটিতে। ফলে রাম-দা ঢুকে গেল আরো গভীরে
জবাইয়ের পর গরু যেভাবে কাতরায়, অজ্ঞাত লোকটি সেভাবে কাতরাতে থাকল। রক্ত ছিটকে পড়ে পদ্মজার শাড়িতে, মুখমণ্ডলে। কাতরাতে থাকা দেহটি ডিঙিয়ে আলমগীর রুম্পার কাছে যায়। তারপর পদ্মজার দিকে তাকাল। পদ্মজার বুক হাঁপড়ের মতো ওঠানামা করছে, চোখে জ্বলছে ধিকিধিকি আগুন। ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়ে যায় দেহটি। নিস্তেজ হয়ে পড়ে পদ্মজাও। সে এলোমেলো পায়ে কয়েক কদম পিছিয়ে যায়। তার শরীর কিঞ্চিৎ কাঁপছে।
এটা সে কী করেছে! এ যে অচিন্তনীয় কাজ!
সব এলোমেলো লাগছে। মাথা ভনভন করে ঘুরছে। গুলিয়ে উঠছে গা।
পূর্ণা এই দৃশ্য দেখে নিজের রক্তক্ষরণ ভুলে যায়, ভয়ে কাঁপতে থাকে। নাভি উলটে বমি বেরিয়ে আসে। আলমগীর তাড়াহুড়ো করে পদ্মজার পাশে এসে দাঁড়াল। পদ্মজার বুকে বইছে অপ্রতিরোধ্য তুফান! সে নিষ্কম্প চোখে তাকিয়ে আছে নিথর দেহটির দিকে। আলমগীর একটা চাবি পদ্মজার হাতে গুঁজে দিয়ে এক নিশ্বাসে বলল, ‘ভয় পেয়ো না। এই বাড়িতে দিন-দুপুরে খুন হলেও তা বাইরের কেউ জানবে না। সকালে উঠে দেখবে এখানে বাবলুর লাশও নেই, রক্তও নেই। কেউ না কেউ সরিয়ে দেবে। সব দুঃস্বপ্ন মনে হবে। দ্রুত ঘরে ফিরে যাও। আমার অনেক কথা বলার আছে। তোমার বাপের বাড়ির ঠিকানায় আমি চিঠি লিখব। আসছি।’
রুম্পা দ্রুত পায়ে হেঁটে এসে পদ্মজাকে জড়িয়ে ধরল। তার বুকটা হাহাকার করছে। পদ্মজার কথা খুব মনে পড়বে। আলমগীর অস্থির হয়ে চারিদিক দেখছে, আতঙ্কে কাঁপছে, এই বুঝি কেউ এসে পড়ল, আর আবার বন্দি করে নিলো রুম্পাকে। এমন অশান্তি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা যায় না। আতঙ্কে যেকোনো মুহূর্তে হৃদস্পন্দন বন্ধ হয়ে যেতে পারে।
পদ্মজাকে কিছু বলতে চেয়েছিল রুম্পা, আলমগীর বলতে দিল না। তার আগেই টেনে নিয়ে দৌড়াতে থাকল। পদ্মজা তাদের যাওয়ার পানে চেয়ে রইল। ঝিঁঝিপোকাদের আলোর ভিড়ে দুজন হারিয়ে যাচ্ছে। তারা বাঁচার আশায় দৌড়াচ্ছে। না হওয়া সংসার পাতার স্বপ পূরণ করতে দৌড়াচ্ছে। দুজন আড়াল হয়ে যেতেই পদ্মজা নিজের মুখ ছুঁয়ে দুই হাত সামনে এনে দেখল, টকটকে লাল রক্ত। সঙ্গে সঙ্গে সে বমি করতে থাকল। তারপরপরই সংবিৎ ফিরল। সে পূর্ণাকে খুঁজতে থাকে। একটু দূরে পূর্ণা ঘাসের ওপর নিস্তেজ হয়ে পড়ে আছে। পদ্মজা দৌড়ে যায়। পূর্ণা পিটপিট করে তাকাল। পূর্ণাকে দুই হাতে জড়িয়ে ধরে দাঁড় করানোর চেষ্টা করে পদ্মজা। একুশ বছর বয়সি একটা মেয়ের শরীর তো কম ভারি নয়। পদ্মজার শক্তিতে কুলোচ্ছে না। সে পূর্ণাকে আকুতি করে বলল, ‘ওঠার চেষ্টা কর বোন।’
পূর্ণার শরীরে ভূমিকম্প বয়ে যাচ্ছে। সে পুরো ভর পদ্মজার উপর দিয়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করল। পদ্মজা শরীরের পুরোটা শক্তি দিয়ে পূর্ণাকে আগলে ধরে সামনে হাঁটা শুরু করে। তার পাজোড়া ঠকঠক করে কাঁপছে। সে জানে না এটা শীতের কাঁপুনি নাকি ভয়ংকর কোনো কিছুর প্রত্যক্ষদর্শী হওয়ার উত্তেজনা। মনে হচ্ছে ভয়ংকর একটা ঝড় হুট করে শুরু হয়ে হুট করে থেমে গেছে। আর রেখে গেছে নিশ্বাস থামিয়ে দেওয়া নিস্তব্ধতা। পদ্মজা ঘামছে, কাঁপছে। ঠোঁট শুকিয়ে কাঠ। মনে হচ্ছে, এই বুঝি মৃত বাবলু উঠে দাঁড়াল। অনেক…অ-নে-ক প্রেতাত্মা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল দুই বোনের ওপর!
জঙ্গলের গাছপালা থেকে প্যাঁচাদের দল তীক্ষ্ণ চোখে দেখছে, সদ্য খুন হওয়া একটা মৃত দেহ পড়ে আছে ঘাসের ওপর। আরেকটু দূরে ছিমছাম গঠনের শাড়ি পরা একটা মেয়ে চুল খোলা রেখে এলোমেলো পায়ে আরেকটা দুর্বল দেহকে ধরে ধরে নিয়ে যাচ্ছে বাড়ির ভেতর! দুজনের গায়ে তাজা লাল রক্ত। এই দৃশ্য রাতের আঁধারের চেয়েও ভয়ংকর! যার স্বাক্ষী হয়ে রইল রাতের আঁধার আর নিশাচর পাখিরা।
.
প্রতিদিনের মতোই ভোরের আলো নিকষকালো রাতকে ঠেলে দূরে সরিয়ে পৃথিবীটাকে আলোকিত করে তুলেছে। পাখিরা কিচিরমিচির করে ডাকছে। নতুন করে শুরু হয়েছে আরেকটা দিন। শুধু পদ্মজার সময়টা থমকে গেছে। সে তার গোসলখানায় বসে আছে। কনকনে ঠান্ডায় গোসল করেছে। এরপর থেকেই উদাসীন হয়ে ভেজাকাপড়ে বসে আছে। অন্য ঘরে ঘুমাচ্ছে পূর্ণা। পদ্মজা রাতে ধীরে-সুস্থে পূর্ণার ক্ষত সামলেছে। বুঝতে দেয়নি, সে মনে মনে কতটা ভেঙে পড়েছে। যখন রাতে তারা দুই বোন দুইতলায় উঠছিল, তখন পেছনে কে যেন ছিল! এত চিৎকার, চেঁচামিচি হয়েছে আর কেউ শোনেনি? অন্দরমহলের রিদওয়ান এবং মজিদের ঘরের মানুষদের তো শোনার কথা ছিল। তাদের ঘর ডান দিকে, আর ডান দিকেই এত বড়ো ঘটনাটি ঘটে গিয়েছে। পূর্ণা জোরে জোরে কেঁদেছে, আলমগীর চেঁচিয়েছে। বাবলু নামের সেই লোকটি খুন হওয়ার সময় আকাশ কাঁপিয়ে চিৎকার করেছিল। দুপদাপ শব্দ তুলে কাতরেছিল। তবুও কেউ আসেনি! কেন? তার কেন মনে হচ্ছে, সবাই শুনেছে…কিন্তু কেউ এগিয়ে আসেনি। পদ্মজার চোখ দুটি ঝাপসা হয়ে আসে। সবকিছু কেমন ওলটপালট লাগছে। কাউকে খুন করার মতো সাহস কী করে হলো? এটা কি ওর মা হেমলতার গুণ? দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল পদ্মজা। চোখ পড়ে আলমগীরের দেয়া চাবিটার দিকে। চাবিটা দেখতে অনেক বড়ো। সে অপলক চোখে চাবিটির দিকে তাকিয়ে রইল।
আমির ঘুম থেকে উঠে পদ্মজাকে দেখতে না পেয়ে গোসলখানায় উঁকি দিয়ে পদ্মজাকে দেখে চমকে ওঠে। পদ্মজার শাড়ি হাঁটু অবধি তোলা। আঁচল বুকে নেই। চুল এলোমেলো। গায়ের রং ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। থেমে থেমে কাঁপছে। সেদিকে পদ্মজার ভ্রুক্ষেপ নেই। আমির হন্তদন্ত হয়ে গোসলখানায় প্রবেশ করে। পদ্মজার দুই বাহু দুই হাতে চেপে ধরে উদ্বিগ্ন হয়ে জানতে চাইল, ‘পদ্মবতী, কী হয়েছে? এ কী অবস্থা তোমার!’
পদ্মজা কিছু বলল না। সে আমিরের চোখের দিকে নিজের দৃষ্টি নিবদ্ধ করে রাখল। আমির দ্বিগুণ বিচলিত হয়ে বলল, ‘এই পদ্ম, তুমি কাঁপছো কেন? কী হয়েছে?’
পদ্মজার ঠোঁট দুটি ভেঙে চোখ ছাপিয়ে জল নেমে আসে। আমির অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। আচমকা আমিরকে জড়িয়ে ধরল পদ্মজা। আমিরের পুরো শরীর মুহূর্তে ঠান্ডা বরফ হয়ে গেল। পদ্মজা বাঁধভাঙা নদীর মতো কাঁদতে থাকল হু হু করে। আমির শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘বলো না, কী হয়েছে? আমার চিন্তা হচ্ছে।’
পদ্মজা আরো শক্ত করে আমিরকে জড়িয়ে ধরল। কাঁদতে কাঁদতে বলল, ‘আমি…আমি খ…খুন করেছি।’
‘কী…কী বলছো! এই, পদ্মজা।’
পদ্মজা আমিরের পিঠ খামচে ধরে বলল, ‘আ…আমি..এটা কীভাবে করেছি!
আমির পদ্মজাকে নিজের সামনাসামনি বসিয়ে বলল, ‘আমার মাথায় কিছু ঢুকছে না। সব বলো আমাকে! কান্না থামাও।’
পদ্মজা মেঝেতে দৃষ্টি রেখে ফোঁপাতে ফোঁপাতে পুরো ঘটনাটা বলল। সে নিজের কাজে নিজে অবাক। আমির পদ্মজাকে শান্ত করার জন্য বুকের সঙ্গে চেপে ধরে বলল, ‘কিছু হয়নি। শান্ত হও। কান্না থামাও।’
পদ্মজার কান্না থামে। সে একটা ঘোরের মধ্যে আছে। তার মাথা কাজ করছে না। মস্তিষ্কে কিছুই নেই। আমির তা বেশ বুঝতে পেরেছে। আলমারি থেকে শাড়ি, ব্লাউজ নিয়ে এসে নিজে পরিয়ে দিলো পদ্মজাকে। পদ্মজার পুরো শরীর যেন শরীর না, বরফ। এতই ঠান্ডা! আমির পদ্মজার চুল মুছে দিয়ে বলল, ‘ঘরে চলো। না, থাক। আমি নিয়ে যাচ্ছি।’
পদ্মজা তরঙ্গহীন স্বরে বলল, ‘তোমার ঘাড়ে টান পড়বে। আমি যেতে পারব।’
আমির পদ্মজাকে ধরে নিয়ে এসে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে গায়ে লেপ জড়িয়ে দিল। বলল, ‘আমি থাকতে তোমার কিছু হবে না। ডান দিকে তো?’
পদ্মজা হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়াল। আমির সোয়েটার পরে বেরিয়ে পড়ে। বেশ কিছুক্ষণের মধ্যে ফিরে এসে বলল, ‘কোথায়? কোথাও তো কিছু পাইনি।’
পদ্মজা বিস্মিত হয়ে দ্রুত উঠে বসল। তারপর চোখ বড়ো বড়ো করে জানতে চাইল, ‘লাশ বা রক্ত কিছুই নেই?’
আমির নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল, ‘না তো। তুমি বোধহয় রাতে দুঃস্বপ্ন দেখেছো।’
পদ্মজা বোকা বনে যায়। অস্থির হয়ে পড়ে। এটা কী করে সম্ভব! এই কাকডাকা ভোরে লাশ থাকবে না কেন! আলমগীরের বলা কথাগুলো মনে পড়তেই পদ্মজা সব বুঝতে পারে। ধীরে ধীরে আবার শুয়ে পড়ল সে, চোখ বুঁজে। তার ঠোঁট দুটি তিরতির করে কাঁপছে!
৫৭
অন্ধকার নেমে এসেছে। সন্ধ্যা তার ঝাঁপি থেকে অন্ধকার নিয়ে এসে ঝপ করে রাত নামিয়ে দিল। বিদ্যুৎও চলে গেল। পদ্মজা হারিকেন জ্বালিয়ে প্রেমার ঘরে এলো। প্রেমা পড়ছিল। পূর্ণা শুয়ে আছে। পদ্মজাকে দেখে প্ৰেমা এগিয়ে এসে হারিকেন নিলো। বলল, ‘আপা সন্ধ্যার নামাজ পড়েনি।’
‘তুই পড়। আমি দেখছি।’
পদ্মজা পূর্ণার শিয়রে বসে কাশি দিল পূর্ণার মনোযোগ পেতে। পূর্ণার সাড়া পাওয়া যায়নি। বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। সেদিনের ঘটনার ছয় দিন কেটে গেছে। পূর্ণার স্বাভাবিক হতে দুইদিন লেগেছিল। এই দুইদিন ঘর থেকে বের হয়নি। কিন্তু কাঁধের ক্ষতটা শীতের কারণে পেকেছে। খুব জ্বালাতন করে। আপা, আপা করে কাঁদে। পদ্মজার ভালো লাগে না সেই কান্না শুনতে। কষ্ট হয়। বুক ভারি হয়ে আসে। সে পূর্ণার গায়ে লেপ জড়িয়ে দিয়ে মাথায় কিছুক্ষণ বিলি কাটল। প্রেমাকে প্রশ্ন করল, ‘প্রান্ত কোথায়?’
‘লাহাড়ি ঘরে।’
‘কী করে ওখানে?’
কী হিবিজিবি বানায়। বিজ্ঞানী হয়ে যাবে দেখো।’
‘মজা করে বলছিস কেন? হিবিজিবি বানাতে বানাতেই একদিন চমকে দেয়ার মতো কিছু বানিয়ে ফেলবে। বিরক্ত করিস না। ওকে ওর মতো সময় কাটাতে দিস।’
‘কে যায় ওরে বিরক্ত করতে? আমি আমার পড়া নিয়েই আছি।’ কথা শেষ করেই প্রেমা পড়ায় মনোযোগ দেয়। পদ্মজা মুচকি হাসল। প্রেমাকে খুব ভালো লাগে তার। মেয়েটা শুধু লাজুক নয় ভীষণ বুদ্ধিমতীও বটে। চাল চলন আকর্ষণ করার মতো।
বাসন্তী এই রাতের বেলা হারিকেন জ্বালিয়ে কাঁথা সেলাই করছেন। পদ্মজা রাগী স্বরে বলার চেষ্টা করল, ‘রাতের বেলা কী করছেন আপনি? বিশ্রাম নিন এখন।’
বাসন্তী পদ্মজার দিকে চেয়ে হাসলেন। বললেন, ‘কিছুক্ষণ আগেই তো সন্ধ্যা হলো।’
‘সারাদিন কাজ করেন। এখনও করবেন? বিকেলে এতসব রান্নাও করলেন। যতদিন গ্রামে আছি আমি এই সেলাই-টেলাই যেন আর না দেখি।’
বাসন্তীকে আর কিছু বলতে না দিয়ে পদ্মজা কাঁথা কেড়ে নিলো। বাসন্তীর কোনো কথা শোনেনি। আলমারির ভেতর কাঁথা, সুতা, সুঁই রেখে বলল, ‘যতদিন আমি আছি এগুলো বের করবেন না। বুঝেছেন?’
‘আমার কী আর কিছু বলার আছে?’
পদ্মজা হেসে ফেলল। সঙ্গে বাসন্তীও। আমিরের আগমন ঘটে তখনি। পরনে বেশ দামি জ্যাকেট। পায়ে বুট। সে বাইরে গিয়েছিল হেমলতার মিলাদের ব্যবস্থা করতে। পদ্মজা এগিয়ে এসে প্রশ্ন করল, ‘সব ঠিক হয়েছে? আর একদিন পরেই কিন্তু — ‘
‘কোনো চিন্তা করো না। সব ঠিক হয়ে গেছে। পেটে ইঁদুর দৌড়াচ্ছে। খেতে দাও।’
বাসন্তী বিছানা থেকে দ্রুত নামলেন, ‘দিতেছি বাবা।’
‘আমি যাচ্ছি তো।’ বলল পদ্মজা।
‘তুমি জামাইকে নিয়ে কলপাড়ে যাও। দেখ, জুতায় কাদা লাগিয়ে আসছে।’
সঙ্গে সঙ্গে পদ্মজা আমিরের পায়ের দিকে তাকাল। আমিরও তাকাল। পদ্মজা আক্ষেপের সুরে বলল, ‘এত কাদা নিয়ে ঘরে ঢুকলেন কেন?’
আমির তাড়াতাড়ি ঘর থেকে বেরিয়ে দরজার সামনে দাঁড়াল। অপরাধী স্বরে বলল, ‘দুঃখিত আমি।’
‘আসুন কলপাড়ে।’
কুয়াশায় চারিদিক ঝাপসা হয়ে আছে। কুয়াশার স্তর এতই ঘন যে পাঁচ- ছয় ফুট দূরের কিছু দেখা যাচ্ছে না। পদ্মজা কল চাপছে,
আমির জুতার কাদা পরিষ্কার করছে। কলের পানি কুসুম গরম। শীতের সময় কল থেকে গরম পানি আসার ব্যাপারটা দারুণ। আমির বলল, ‘পূর্ণা কী ঘুমিয়ে গেছে?
‘হু।’
‘ঘুমাবেই তো। প্রতিদিন সন্ধ্যার আজান পড়তেই ঘুমিয়ে পড়ে। আর ফজরের আজানের আগ থেকে উঠে পকপক শুরু করে। ঘুমাতে পারি না।’
পদ্মজা শব্দ করে হাসল। বলল, ‘ঠিকই তো করে। ফজরে কীসের ঘুম?’
‘বোনের পক্ষই তো নিবে।’
ক্ষণকাল পিনপতন নীরবতা। আমিরের জুতা ধোয়া শেষ। পদ্মজা শুকনো কণ্ঠে বলল, ‘ওই বাড়ির মানুষদের আসতে বলেছেন?’
ওই বাড়ির নাম উঠতেই আমির জ্বলে উঠল। গম্ভীর কণ্ঠে বলল, ‘ওই বাড়ির নাম নিতে নিষেধ করেছি।’
‘তবুও…’
‘না বলিনি। আর বলবও না।’
আমির পায়ে গটগট শব্দ তুলে চলে যায়। পদ্মজা আমিরের যাওয়ার পানে তাকিয়ে থাকল। সে রাতের পর ওই বাড়িতে তারা তিন দিন ছিল। তারপরই আমির চাপ দিতে থাকে, হাওলাদার বাড়ি ছাড়তে। সে সারাক্ষণ আতঙ্কে থাকে। এভাবে আতঙ্ক নিয়ে বাঁচা যায় না। আমির রাতে ঘুমায় না, ছটফট করে। ভয় পায়, এই বুঝি পদ্মজার কিছু হয়ে গেল। পদ্মজা খেয়াল করেছে, আমির রাতে কপালের ওপর হাত রেখে চুপচাপ শুয়ে থাকে। তাছাড়া এইভাবে লাশ অদৃশ্য হয়ে গেল!
পর পর তিন দিন কেটে যায় তবুও কেউ কিছু বলেনি। কারো মধ্যে কোনো পরিবর্তন দেখা যায়নি। ব্যাপারটা ভয়ংকর। পূর্ণার ওখানে থাকা বিপজ্জনক। পদ্মজা বিপদকে ভয় পায় না। কিন্তু পূর্ণার কিছু হলে সে মানতে পারবে না। আবার পূর্ণা একা এই বাড়িতে আসবেও না। তাই বাধ্য হয়ে তিনজন একসঙ্গে চলে এসেছে। তবে পদ্মজা আবার যাবে ওই বাড়িতে। যেতে তাকে হবেই। হাওলাদার বাড়ির প্রতিটি কোনার রহস্য সে নিজের নখদর্পণে আনবেই।
এটা তার শপথ।
অনেক রাত হয়েছে। রাতের খাবারের সময় পূর্ণাকে ডেকে তোলা হয়। একবার ঘুম ভেঙে গেলে পূর্ণা আর ঘুমাতে পারে না। ঘণ্টার পর ঘণ্টা পার হয়ে যায়। প্রেমা এখনও পড়ছে। পূর্ণা বিরক্তি নিয়ে প্রেমার দিকে তাকাল। মনে মনে বলে, এই মেয়ে কী বিশ্ব জয় করে ফেলবে পড়ে? এত তো আপাও পড়েনি।
‘বাত্তিডা নিভিয়ে এসে ঘুমা। অনেক পড়ছস।’ কিড়মিড় করে বলল পূর্ণা।
প্রেমা গুরুজনদের মতো করে বলল, ‘বাত্তিডা না বাতিটা হবে।’
‘আমাকে কিছু শেখাতে আসলে থাপ্পড় দিয়ে দাঁত গাছে তুলে দেব।’
প্রেমার মুখে আঁধার নেমে আসে। সে থমথমে মুখ নিয়ে বই বন্ধ করে ঝিম মেরে বসে থাকে। পূর্ণা সন্তুষ্ট হয়ে বলল, ‘এবার হারিকেনের আগুন নিভা। এরপর শুয়ে পড়।’
প্রেমা হারিকেনের আগুন নিভাতে প্রস্তুত হতেই, পূর্ণা বলল, ‘না, থাক নিভাতে হবে না। ভয় করে। তুই শুয়ে পড়।
প্রেমা বাধ্যের মতো এসে শুয়ে পড়ে লেপের ভেতর। তার ঠান্ডা পাজোড়া পূর্ণার পায়ে লাগতেই, পূর্ণা হইহই করে উঠে, ‘ও মাগো কী ঠান্ডা! দূরে যা।’
প্রেমা রাগী চোখে তাকাল। পূর্ণা ধমক দিয়ে বলল, ‘কী হইছে? এমনে তাকাস কেন? খেয়ে ফেলবি?’
পূর্ণার সঙ্গে কথা বলে নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মারতে ইচ্ছে হচ্ছে না প্রেমার। পূর্ণার কথাবার্তাকে পাত্তা দিলে প্রেমার ঘুম নষ্ট হবে, সকালে উঠে নামাজ পড়াও হবে না, বই পড়াও হবে না, এটা ভেবে প্রেমা পাশ ফিরে শুয়ে পড়ে। কিছুক্ষণের মধ্যে ঘুমিয়েও যায়।
পূর্ণা মাথা তুলে দেখে প্রেমা ঘুমাল নাকি। যখন বুঝল ঘুমিয়ে গেছে, তখন লেপ দিয়ে ভালো করে ঢেকে দিল প্রেমাকে। এরপর জড়িয়ে ধরল। যাতে দ্রুত প্রেমার ঠান্ডা শরীর গরম হয়ে আসে। এই বোনটাকে সে ভীষণ ভালোবাসে। খুব বেশি। শুধু ভালোবাসাটা প্রকাশ করতে পারে না কেন জানি! প্রেমার ঘুম খুব পাতলা। পূর্ণা তাকে জড়িয়ে ধরতেই তার ঘুম ছুটে যায়। ঠোঁটে ফুটে উঠে মুচকি হাসি। প্রায় এরকম হয়। সে ঘুমালে পূর্ণা তার কপালে চুমু দেয়, চুলে বিলি কেটে দেয়। হাত-পায়ের নখ কেটে দেয়। ভালোবাসার অনেক রূপ হয়! এই দুই বোনের ভালোবাসাটা অন্যরকম। লুকিয়ে একজন আরেকজনকে ভালোবাসে। প্রাণের
প্রাণের চেয়েও বেশি ভালোবাসে। দুজনই টের পায়। কিন্ত প্রকাশ্যে সাপে-নেউলে যুদ্ধ চলে!
পূর্ণার কিছুতেই ঘুম আসছে না। হারিকেনের আলো নিভু নিভু। সে উঠে বসে। আবার শুয়ে পড়ে। নিভু নিভু আলোর দিকে চেয়ে মৃদুলের কথা ভাবে। মানুষটার কথা ইদানীং উঠতে বসতে মনে পড়ে তার। কাঁধে আঘাত পাওয়ার পর পূর্ণা দুইদিন ঘর থেকে বের হয়নি। তাই মৃদুল বার বার পূর্ণার ঘরে উঁকি দিত। পদ্মজা সারাক্ষণ থাকত তাই ঢোকার সাহস পায়নি। দুই দিন পর পূর্ণা ছাদে যায়। পিছু পিছু মৃদুলও আসে। পূর্ণার পেছনে দাঁড়িয়ে কাশে। পূর্ণা ফিরে তাকায়। মৃদুলকে দ্বিধাগ্রস্ত দেখায়। পূর্ণা প্রশ্ন করে, ‘কিছু বলবেন?’
মৃদুল বলল, ‘কেমন আছো? হুনলাম, রাইতে রান্নাঘরে নাকি পইড়া গেছিলা।’
‘হু। ভালো আছি।’
‘তোমার কি ধপাস কইরা পইড়া যাওয়ার ব্যামো আছে?’
পূর্ণা কিছু বলেনি। পদ্মজা নিষেধ করেছে, সেদিনের রাতের ব্যাপারে কাউকে কিছু বলা যাবে না। মৃদুল দেখল: পূর্ণা কপাল কুঁচকে, কাঁধে হাত বুলাচ্ছে। সে বিচলিত হয়ে জানতে চাইল, ‘বেদনা করে? দায়ের উপর পড়ছো, কত্তটা কাটছে কে জানে! তার ওপরে শীতের দিন এই ঘা সহজে ভালা হইব না। এইখানে তো বাতাস হইতাছে। ঘরে যাও। ঘা বাড়াইও না।’
‘না। এইখানেই থাকব।’
মৃদুল আর জেদ ধরেনি। পূর্ণা যতক্ষণ ছিল, সে-ও ছিল। পরদিন একটু পর পর পূর্ণার খোঁজ নিয়েছে। পূর্ণা খুব সুন্দর একটা অনুভূতির সাক্ষাৎ পেয়েছিল। শুরুতে মৃদুলকে দেখে শুধুই ভালো লাগলেও, আস্তে আস্তে মৃদুলের বিচরণ শুরু হয়েছে তার পুরো অস্তিত্ব জুড়ে। মৃদুলের কথা বলা, দুষ্টুমি, হাসি সব ভালো লাগে। মনের অনুভূতিগুলো হাঁটি হাঁটি পা পা করে গুরুতর সম্পর্কের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এমনকি মৃদুলও যে তার ব্যপারে আগ্রহী, তা পূর্ণা টের পায়। এই বাড়িতে আসার পরদিন মৃদুল আমিরের সঙ্গে দেখা করার অজুহাতে পূর্ণার সঙ্গে দেখা করতে আসে। সবার অগোচরে বলে যায়, তার সঙ্গে পরের দিন দুপুরে উত্তরের ঘাটে দেখা করতে। পূর্ণা বলেছিল যাবে। কিন্তু সে দুপুরে ঘুমিয়ে পড়েছিল। ঘুম ভাঙে সন্ধ্যায়। তাই আর যাওয়া হয়নি। গতকাল পদ্মজা বের হতেই দিল না।
পূর্ণার মন কেমন কেমন করছে। খুব মনে পড়ছে মৃদুলকে। হারিকেনের আলো নিভে গেল, আর ঠিক তখনই টোকা পড়ল জানালায়। পূর্ণা ভয় পেয়ে গেল। কে যেন তার নাম ধরে ডাকছে। ভূত এলো নাকি! পূর্ণা ধড়ফড়িয়ে বিছানা থেকে নামল। আবারও সেই ডাক ভেসে এলো, কণ্ঠটা পরিচিত পূর্ণা ভ্রুকুঞ্চন করে টিনের দেয়ালে কান পাতে। আবারও ভেসে আসে চেনা স্বর, ‘এই পূর্ণা।’
কণ্ঠটা চেনার সঙ্গে সঙ্গে পূর্ণা জানালা খুলল। দেখা গেল মৃদুলের মুখটা। পূর্ণার বুক ধক করে উঠল। সর্বাঙ্গে একটা উষ্ণ বাতাস ছুঁয়ে যায়। সে ফিসফিসিয়ে বলল, ‘পাশের ঘরে আপা, ভাইয়া। আপনি ঘাটে যান। আমি আসছি।’
‘আচ্ছা।’
মৃদুল চলে গেলে পূর্ণা তাড়াহুড়ো করে সোয়েটার পরে নিলো। শাল দিয়ে ঢাকল মাথাটা। তারপর হারিকেনে নতুন আগুন জ্বালিয়ে, হারিকেন নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। ভালোবাসার কথা বলা হয়নি। কোনো সম্পর্ক নেই দুজনের। তবুও পূর্ণা কোনো এক বশীকরণের জাদুতে ছুটে যাচ্ছে মৃদুলের কাছে। কলপাড় অবধি গিয়ে আবার ছুটে এলো ঘরে। আয়না, কাজল বের করে কাজল দিলো চোখে; তারপর বেরিয়ে পড়ল। ব্যস্ত পায়ে চলে এলো ঘাটে। চারিদিকে জোনাকিপোকা, জ্বলজ্বল করে জ্বলছে; একটু দূরেই দাঁড়িয়ে আছে মৃদুল। পূর্ণার হাঁটার গতি কমে গেল, সে অকারণে লজ্জা পাচ্ছে। এগিয়ে এলো মৃদুল, তার গলায় মাফলার; মাথায় টুপি আর পরনে সোয়েটার। শীতল জলোবাতাসে শীত আরো বেশি জেঁকে ধরছে। পূর্ণা মৃদুলের দিকে না তাকিয়ে, বিনিদ্র আরক্ত চোখে হারিকেনের মৃদু আলোয় নদীর অশান্ত জলরাশির দিকে চেয়ে বলল, ‘কেন ডেকেছেন?’
‘কেমন আছো?’
পুরুষালি ভরাট কণ্ঠটি কাঁপিয়ে তুলল পূর্ণাকে। অন্য কখনও তো এমন হয় না। এখন এরকম হওয়ার কারণ কী। রাতের অন্ধকার এবং নির্জনতা?
পূর্ণা বলল, ‘ক্ষতস্থান পেকেছে। তাই একটু যন্ত্রণা হয়। আপনি কেমন আছেন?’
‘ভালো নেই।’ মৃদুলের কণ্ঠটি করুণ শোনায়।
মৃদুলের দিকে চোখ তুলে তাকাল পূর্ণা, চোখাচোখি হলো দুজনের। হারিকেনের আলোয় পূর্ণার কাজল কালো চোখ দুটি তিরের বেগে ঘায়েল করে মৃদুলকে। পূর্ণা সাবধানে প্রশ্ন করল, ‘কেন?’
‘জানি না।’
‘এত রাতে আসা ঠিক হয়নি।’
‘এত রাইতে আমার ডাকে তুমি কেন সাড়া দিলা?’
‘জানি না।’
দুজনের কেউই কথা খুঁজে পাচ্ছে না। দুজনের কেউই জানে না তারা কেন দেখা করেছে। মৃদুল জানে না সে কেন এত রাতে, তীব্র শীতে এখানে ছুটে এসেছে। পূর্ণা জানে না সে কেন পরপুরুষের ডাকে সাড়া দিল। শুধু এইটুকু জানে, তাদের অশান্ত মন শান্ত হয়েছে। খালি খালি জায়গাটা পূর্ণ হয়েছে। হৃৎস্পন্দন ছন্দ তুলে নৃত্য করছে। পূর্ণার কাঁধের ব্যথা বাড়ছে, তাই বেঁকে গেল তার ভ্রু দুটি। কাঁধে এক হাত রাখল সে। মৃদুল ব্যথিত স্বরে জানতে চাইল, ‘আবার বেদনা করে? দেখি কেমনে কী হইছে।’
মৃদুল দুই পা এগিয়ে আসতেই, পিছিয়ে গেল পূর্ণা। লাজুক ভঙ্গিতে বলল, ‘অবিবাহিত মেয়ের কাঁধ দেখতে চাওয়া অন্যায়।’
‘সে তো দেখা করাও অন্যায়। সব অন্যায় কী মানা যায়?’
‘অনেকে তো মানে।’
‘আমি পারি না।’
‘আপনি অন্যরকম।’
‘ব্যথা কমেছে?’
‘হু, হুট করে ব্যথা বেড়ে যায়। আবার সঙ্গে সঙ্গে কমেও যায়।’
‘পাকলে এরকম হয়।’
‘হু।’
‘ভয় হচ্ছে না?’
পূর্ণা কেমন করে যেন মৃদুলের দিকে তাকাল। মৃদুল থমকে যায়। পূর্ণা বলল, ‘কার ভয়? আপনার?’
‘আমার আর সমাজ—দুইটারই।’
‘আপনাকে ভয় পেলে আসতাম না। আর সমাজের ভয় অনেক আগেই কেটে গেছে।’
উত্তরে বলার মতো কিছু পেল না মৃদুল। ঝিঁঝিপোকারা ডাকছে। আলো দিচ্ছে। কী সুন্দর দেখাচ্ছে। তার মাঝে দুজন প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ ও নারী দাঁড়িয়ে আছে বুকে ভালোবাসার উথালপাতাল ঢেউ নিয়ে। অনেকক্ষণ পর মৃদুল বলল, ‘আমি আসতে চাইনি।’
পূর্ণা আবারও সেই মন কেমন করা দৃষ্টি নিয়ে তাকাল। বলল, ‘তাহলে কেন এসেছেন?’
‘মনে হইতাছে কোনো বশীকরণ তাবিজের জোরে এখানে আইসা পড়ছি।’
পূর্ণা হেসে ফেলল। হারিকেনের মায়াবী আলোয় সে হাসি কী যে ভালো দেখাচ্ছিল। তার প্রশংসা করার মতো যোগ্য শব্দ মৃদুলের ভাষার ভাণ্ডারে মজুদ নেই। সে গাঢ় স্বরে বলল, ‘পিরিতির মায়া বড়ো জ্বালা।’
কপাল ঈষৎ কুঁচকে পূর্ণা প্রশ্ন করল, ‘কার পিরিতের দহনে জ্বলছেন?’
‘তোমারে কইতে হইব?’
‘না।’
‘ঘরে যাও।’
পূর্ণা তার মুখের ধারে হারিকেন ধরে মৃদুলের দিকে চেয়ে বলল, ‘আমি কাজল দিয়েছি।’
পূর্ণা ভেবেছে তার কাজল কালো চোখ মৃদুল দেখেনি। মৃদুল তো শুরুতে দেখেই ঘায়েল হয়েছে। সে হেসে পূর্ণার চোখ, মুখ আবার দেখল। হারিকেনের হলদে আলোয় পূর্ণার তেলতেলে ত্বক চিকচিক করছে। মৃদুল বলল, ‘দেখেছি। ভালো লাগছে।’
মৃদুলের এইটুকু প্রশংসায় পূর্ণার মন নেচে উঠল। সে ঠোঁটে হাসি রেখে বলল, ‘সাবধানে বাড়ি যাবেন।’
৫৮
সুষ্ঠুভাবে হেমলতার মৃত্যুবার্ষিকীর মিলাদ সম্পন্ন হলো। বিকেলে মোড়ল পরিবারের সদস্যরা একসঙ্গে আটপাড়ার মসজিদের সামনে এসে দাঁড়াল। সঙ্গে বৃদ্ধা মনজুরা আর হিমেলও আছে। মসজিদের কবরস্থানে পাশাপাশি শুয়ে আছেন মোর্শেদ, হেমলতা ও পারিজা। কবরের কাছে আসা নিষেধ বলে মেয়েরা দূর থেকে দুই চোখ ভরে তিনটি কবর দেখছে এবং চোখের জল বিসর্জন দিচ্ছে। মৃত্যুর এতগুলি বছর পেরিয়ে গেছে, তবুও কবরের সামনে এসে দাঁড়ালে বুকে এত কষ্ট হয়!
কাছের মানুষের মৃত্যু হচ্ছে ভয়ানক বিষের নাম। এই বিষ যারা পান করেছে তারাই জানে কষ্টের মাত্রা কতটুকু। পূর্ণা ছিঁচকাঁদুনে। সে চোখের জলে স্নান করছে। পদ্মজা ছলছল চোখে তাকিয়ে আছে কবরগুলোর দিকে মা নামক মমতাময়ী মানুষটার ছায়ার অভাববোধ প্রতিটি পদক্ষেপে সহ্য করতে হয়। কত ভালোবাসতেন তিনি। মাথার উপর তার ছায়া ছাড়া নিশ্বাস নেওয়া দায় ছিল। আর আজ এত বছর ধরে পদ্মজা দিব্যি এই মানুষটাকে ছাড়াই বেঁচে আছে। জন্মদাতা পিতা ছোটো থেকে অনেক লাঞ্ছনা-বঞ্চনা করেছেন। কত আকুল হয়ে থাকত পদ্মজা, পিতার ভালোবাসা পেতে। যখন ভালোবাসা পেল, বেশিদিন পৃথিবীতে রইলেন না। মা মরা মেয়েদের রেখে নিজেও পাড়ি জমালেন ওপারে।
তারপর পদ্মজার কোল আলো করে এলো কন্যা পারিজা। পিতা-মাতার মৃত্যুর শোক কিছুটা হলেও লাঘব হয়। কিন্তু এই সুখও বেশিদিন টিকেনি। খুব কম আয়ুকাল নিয়েই জন্মেছিল পারিজা। পদ্মজাকে আঁধারের গহিনে ছুঁড়ে ফেলে এক এক করে চলে যায় সুখতারারা। পদ্মজা বেশিক্ষণ দীর্ঘশ্বাসের ঘূর্ণি বুকের ভেতর চেপে রাখতে পারল না। মুখ এক হাতে চেপে ধরে ডুকরে কেঁদে উঠল সে। বাসন্তী পদ্মজার মাথাটা পরম যত্নে নিজের কাঁধে রাখেন। মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন, ‘কেঁদো না, মা। একদিন দেখা হবে। হাশরের ময়দানে।’
সময় তার নিজের গতিতে চলে, কারো জন্য থেমে থাকে না। কেটে যায় আরো তিনটে দিন। এর মাঝে পূর্ণা মৃদুলের সঙ্গে শুটিং দেখতে গিয়েছে একবার। গ্রামের পথে দুজন হেসেখেলে কথা বলেছে। এতেই কানাঘুষা শুরু হয়েছে। এদিকে আমিরের ভীষণ জ্বর। শুকিয়ে গেছে অনেক। ভেতরে ভেতরে কী যেন ভাবে সারাক্ষণ। খাওয়া-দাওয়াও কমে গেছে। সবসময় চিন্তিত থাকে। বাড়িতে বেশিক্ষণ থাকে না। এদিক-ওদিক ঘুরে বেড়ায়। এখন শুয়ে আছে বারান্দার ঘরে। পদ্মজা কপালে জলপট্টি দিচ্ছে। আমিরের চোখ দুটি বন্ধ। পদ্মজা আদুরে গলায় ডাকল, ‘শুনছেন?’
আমির চোখ বন্ধ রেখেই বলল, ‘হু?’
‘কী এত ভাবেন?’
আমির চোখ খুলে পদ্মজার দিকে তাকাল। তার চোখ দুটি ভয়ংকর লাল। রাতে না ঘুমানোর ফল। সে পদ্মজাকে পালটা প্রশ্ন করল, ‘কী ভাবব?’
‘জানি না। কিছু তো ভাবেনই। চোখ দুটি তার প্রমাণ। আপনি কোনো কিছু নিয়ে কি ভয় পাচ্ছেন?’
আমির বড়ো করে নিশ্বাস ছাড়ল। বলল, ‘তেমন কিছু না।’
‘যেমন কিছুই হউক। বলুন না আমাকে।’
‘আমাদের ঢাকা ফেরা উচিত।’
‘হঠাৎ’
‘জানি না কিছু। আমার প্রায় মাঝরাতে ঘুম ভেঙে যাচ্ছে আজেবাজে স্বপ্ন দেখে। তোমাকে হারাতে পারব না আমি।’
‘আমার কিছু হবে না। আমি কারো কোনো ক্ষতি করিনি যে—’ পদ্মজা থেমে গেল। সে তো একজনকে খুন করেছে! পদ্মজার দৃষ্টি এলোমেলো হয়ে পড়ে। আমির পদ্মজার দিকে চেয়ে বলল, ‘তুমি কী করে কাউকে খুন করতে পারলে! আমি ভাবতেই পারি না। এরপর থেকেই ভয়টা বেড়ে গেছে। আমার খুব চিন্তা হয়। ঘুম হয় না। রাত জেগে পাহারা দেই যাতে কেউ আমার পদ্মবতীকে ছুঁতে না পারে।’
পদ্মজার দুই চোখ জলে ভরে উঠে। বলল, ‘প্রথম তো বিশ্বাস করেননি, এটাই ভালো ছিল। এখন তো বিশ্বাস করে চিন্তায় পড়ে গেছেন। আর অসুস্থ হয়েও পড়েছেন।’
‘আমি ভেবেছিলাম স্বপ্ন দেখেছো। তাই ঘুম থেকে উঠে আবোলতাবোল বলছো। তারপর সুস্থ-স্বাভাবিক ভাবেও যখন বললে, অবিশ্বাস কী করে করি?’
‘এত ভালোবাসতে নেই। আমার কপালে সয় না।’
‘ভালোবাসতে না করছো?’
‘মোটেও না। মাত্রা কমাতে বলছি।’
পাশেই অজয়বাবুর আম বাগান। শোঁ শোঁ করে শীতল হাওয়া বইছে। পাখির ডাকও শোনা যাচ্ছে। পূর্ণা মৃদুলের চেয়ে পাঁচ-ছয় হাত দূরে দাঁড়িয়ে আছে। তার মস্তক নত। ওড়না বেসামাল হয়ে উড়ছে। মগাকে দিয়ে পূর্ণাকে ডেকে এনেছে মৃদুল। আসার পর থেকেই ঝিম মেরে দাঁড়িয়ে আছে পূর্ণা। দাঁত দিয়ে নখ কাটছে। মৃদুল নীরবতা ভেঙে বলল, ‘আমি আগামীকাল বাড়িত যাইতেছি।’
পূর্ণা চকিতে তাকাল। রুদ্ধশ্বাস কণ্ঠে প্রশ্ন করল, ‘কেন?’
মৃদুল মুচকি হেসে বলল, ‘নিজের বাড়িত কেন যায় মানুষ? এইহানে তো বেড়াইতে আইছিলাম।’
‘ওহ।’
পূর্ণা মৃদুলের উপর থেকে দৃষ্টি সরিয়ে অন্যদিকে দৃষ্টিপাত করে গোপনে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। কান্না পাচ্ছে তার। মৃদুল এক ধ্যানে পূর্ণার দিকে চেয়ে থাকল। বলল, ‘অন্যদিকে চাইয়া রইছো কেন? এদিকে চাও।’
পূর্ণা বাধ্যের মতো মৃদুলের কথা শোনে। তার দুইচোখে জল টলমল করছে। পূর্ণার মেঘাচ্ছন্ন দুটি চোখ দেখে মৃদুলের ভীষণ কষ্ট হয়। সে কেমন একটা ঘোর নিয়ে জানতে চাইল, ‘চলে যাব শুইনা কষ্ট হইতাছে?’
পূর্ণা আবারও দৃষ্টি ঘুরিয়ে নিলো। অভিমানী স্বরে বলল, ‘মোটেও না। চলে যান।’
‘দুইদিন পরই আসতাছি।’
পূর্ণার চোখেমুখে হাসির ছটা খেলে যায়। সে ঘাড় ঘুরিয়ে দুই কদম এগিয়ে এসে বলল, ‘সত্যি?’
‘সত্যি। এবার হাত ধরি?’
মৃদুলের বেশরম আবদারে পূর্ণা লজ্জা পেল। সে দুই কদম পিছিয়ে যায়। দুই হাত পেছনে লুকিয়ে ঠোঁটে হাসি রেখে বলল, ‘বাড়ি থেকে আসার পর।’
পূর্ণা দৌড়ে পালায়। মৃদুল পেছনে ডাকল, ‘এই কই যাও?’
চঞ্চল পূর্ণা না থেমে ফিরে তাকাল। তার লম্বা কেশ হাওয়ায় এলোমেলো হয়ে উড়ছে। সে মিষ্টি করে হেসে জবাব দিল, ‘বাড়ি যাই। আপনি সাবধানে যাবেন। জলদি ফিরবেন।’
মৃদুল তার গোলাপি ঠোঁট দাঁত দিয়ে চেপে ধরে হেসে মাথা চুলকাল। কী অপূর্ব দেখাচ্ছে গ্রামের চঞ্চল শ্যামবর্ণের মেয়েটিকে। হাওয়ার তালে মেঠো পথ ধরে ছুটে যাচ্ছে বাড়ির দিকে। চুল আর ওড়না দুটোই হাওয়ার ছন্দে সুর তুলে যেন উড়ছে।
.
সকাল সকাল মগা এসে খবর দিল, রানি মদনের মাথায় আঘাত করেছে। মদন এখন হাসপাতালে ভর্তি। খলিল হাওলাদার রানিকে মেরে আধমরা করে একটা ঘরে বন্দি করে রেখেছেন। এ কথা শুনে পদ্মজা অস্থির হয়ে পড়ে। খলিল হাওলাদার এতই জঘন্য যে পদ্মজার মনে হয় এই মানুষটা নিজের মেয়েকে যেকোনো মুহূর্তে খুন করে ফেলতে পারে। পদ্মজা আমিরকে চাপ দেয় ওই বাড়িতে নিয়ে যেতে। নয়তো সে একাই চলে যাবে। একপ্রকার জোর করেই আমিরকে নিয়ে আসে হাওলাদার বাড়িতে। হাওলাদার বাড়ির পরিবেশ থমথমে, নির্জন। সবসময়ই এমন থাকে। এ আর নতুন কী! অন্দরমহলে ঢুকতেই আমিনা আমিরের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। কাকুতি-মিনতি করে বলল, ‘বাপ, আমার মেয়েরে আমার কাছে আইন্যা দেও। নাইলে ওর কাছে আমারে লইয়া যাও। তোমার দুইডা পায়ে ধরি।’
আমির আমিনাকে মেঝে থেকে তুলে আশ্বাস দেয়, ‘আমি দেখছি। সব ঠিক হয়ে যাবে।’
খলিলের ঘরের দিকে গেল আমির। ফরিনা এসে বিস্তারিত বললেন, রাইতের বেলা মদনের চিল্লানি হুনি। দৌড়ে সবাই আইয়া দেহি মদন পইড়া আছে। মাথা দিয়া কী যে রক্ত বাইর হইতাছে! আর রানির হাতে এত্ত বড়ো একটা ইট। ছেড়িডারে দেইখা মনে হইতাছিল ওর উপরে জিনে আছর করছে। আরেকটু অইলে এতিম ছেড়াডা মইরা যাইত। বাবুর বাপ আর রিদওয়ান মিইল্যা তাড়াতাড়ি হাসপাতাল লইয়া গেছে। আর এইহানে তোমার চাচা শ্বশুরে রানিরে মাইরা ভর্তা কইরা লাইছে। নাক মুখ দিয়া রক্ত ছুটছে। তবুও থামে নাই। আমরা অনেক চেষ্টা করছিলাম বাঁচাইতে, পারি নাই। আলোডা কী যে কান্দা কানছে! এহন ঘুমাইতাছে।’
আমির চাবি নিয়ে আসে। আমিনা সঙ্গে যেতে চাইলে আমির বলল, ‘আমি আর পদ্ম যাচ্ছি। রানিকে নিচে নিয়ে আসি। পদ্ম, আসো।’
পদ্মজা ছুটে গেল আমিরের পিছু পিছু। ঘরের দরজা খুলে ঘরে ঢুকতেই রানি তাকাল। রুম্পা যে ঘরে ছিল সেই ঘরেই তাকে রাখা হয়েছে। রানি কাঁদছিল। দরজা খোলার শব্দ শুনে বিছানায় হেলান দিয়ে বসে আছে চোখমুখের রক্ত শুকিয়ে গেছে। আমির, পদ্মজাকে দেখে রানি দৃষ্টি সরিয়ে নেয়। কাউকে দেখতে ইচ্ছে হচ্ছে না। সে নিজের জীবন নিয়ে সুখী না। পৃথিবীর সব কষ্ট যেন তার বুকে। এসব মারধোর আর গায়ে লাগে না। বাপের কথায় বাড়ির কামলা বিয়ে করল। এটা তার জন্য কতটা অপমানের কেউ বুঝবে না। সে শুধু মানুষ ভেবেই বাড়ির কামলাকে স্বামী মানতে পারেনি। এতটা উদার সে নয়। সে মানে, সে ভালো না। বাপের জোরাজুরিতে নাতনিও দিল। তারপর থেকেই মদন পেয়ে বসে। কারণে- অকারণে তাকে ছুঁতে চায়। মদনের একেকটা ছোঁয়া রানির জন্য কতটা বেদনাদায়ক তাও কেউ জানবে না। গতকাল রাতে মদন জোর-জবরদস্তি করেছিল, তাই রানি নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি। খালি ড্রামের নিচে থাকা ইট নিয়ে চোখ বন্ধ করে মদনের মাথায় আঘাত করে। এতে সে মোটেও অনুতপ্ত নয়।
পদ্মজা রানির মনের অবস্থা একটু হলেও বুঝতে পারছে। মেয়েটা হাসিখুশি থাকার জন্য বাচ্চাদের সঙ্গে কাবাডি, গোল্লাছুট, কানামাছি কত কী খেলে! তবুও সুখী হতে পারে না। পদ্মজা সাবধানে রানির পাশে এসে বসল। বলল, ‘খুব মেরেছে?’
রানি পদ্মজার দিকে তাকিয়ে তীব্র কটাক্ষ করে বলল, ‘তুমি জাইন্যা কী করবা? মলম লাগাইয়া দেওন ছাড়া আর কী করনের আছে?’
আমির কিছু বলতে চাইলেও, পদ্মজা থামিয়ে দিল। সে চমৎকার করে হেসে রানিকে বলল, ‘মলম লাগানোর মানুষই বা কয়জনের ভাগ্যে জোটে, আপা?’
রানির দৃষ্টি শীতল হয়ে এলো। এই মেয়েটার সঙ্গে রাগ দেখানো যায় না। পদ্মজার মাঝে অদ্ভুত কিছু আছে, যা রাগ দমন করতে পারে। রানি বলল, ‘আমি…আমি ভালা নাই, পদ্মজা। আমি একটু আরাম চাই। সুখ চাই। আর কষ্টের বোঝা টানতে পারতাছি না।’
রানির কথার ধরন এলোমেলো। সে অন্য এক জগতে আছে। বন্দি পাখির মতো ছটফট করছে। মুক্তির আশায় ডানা ঝাঁপটাচ্ছে। পদ্মজার খুব মায়া হলো, ভীষণ অসহায় লাগল নিজেকে। ভালোবাসার মানুষ জীবনে এসে আবার হারিয়ে গিয়ে এভাবেই জীবন এলোমেলো করে দেয়। এত যাতনা কেন প্রেমে
যার শূন্যতা আজও শান্তি দিল না রানিকে। প্রতিনিয়ত কুঁড়ে কুঁড়ে খায়। রানির ভেতরটা যে একেবারে শূন্য। সে পিরিতের যন্ত্রণায় আজও কাতর! যদি রানিকে তার উপযুক্ত কোনো ছেলের সঙ্গে বিয়ে দেয়া হতো তবে কী সে তার ভালোবাসাকে ভুলতে পেরে একটু সুখী হতে পারত?
আমির আর পদ্মজা মিলে ধরে ধরে রানিকে নিচ তলায় নিয়ে আসে। সবার এত্ত প্রশ্ন…তবে রানি নিশ্চুপ। কারোর কোনো কথার উত্তর দিল না। সবাই যত্ন আত্তি করল। আমিনা খাইয়ে দেন। পুরো দিন রানি বিছানায় শুয়ে থাকে। আমিনা সারাদিন চেষ্টা করেছেন রানি যাতে কথা বলে। কিন্তু সে পণ করেছে কথা না বলার। অন্যদিকে মদন ভালো আছে। কয়দিন হাসপাতালে ভর্তি থাকতে হবে। সেলাই লেগেছে কয়টা। গঞ্জের হাসপাতালে নেয়া হয়েছিল, এরপর সেখান থেকে শহরে। এ খবর ছড়িয়ে পড়েছে গ্রামে। রানিকে সবাই অনেক খারাপ কথা বলছে, অভিশাপ দিচ্ছে। অনেকে বাড়ি বয়ে এসে কটু কথা বলে গেছে। কেউ নিষেধ করেনি। রানি চুপ করে শুনেছে। বাড়ির অবস্থার কথা ভেবে আমির আর মোড়ল বাড়িতে ফেরার কথা বলেনি।
দিনশেষে রাত আসে। সুন্দর পৃথিবীকে জাপটে ধরে ঘোর অন্ধকার। সেই অন্ধকারে হারিয়ে যায় রানি। সকালে চিঠি পাওয়া যায় তার। তাতে লেখা:
আমার আলোরে দেইখা রাইখো তোমরা।
৫৯
ঘন কুয়াশা বেয়ে শীতের বিকেল নেমেছে ধীরে ধীরে। পদ্মজা আলোকে বুকের সঙ্গে মিশিয়ে দুই তলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। তার চোখের দৃষ্টি বাড়ির গেটের দিকে। বাড়ির সব পুরুষ সকালে বেরিয়েছে রানির খোঁজে। এখনও ফেরেনি। যে নিজের ইচ্ছায় হারিয়ে যায়, তাকে কী আর খুঁজে পাওয়া যায়? তবুও পদ্মজা চাইছে রানিকে যেন অক্ষত অবস্থায় ফিরে পাওয়া যায়। আলো সারাদিন মায়ের জন্য কেঁদেছে। মায়ের আদরের জন্য ছটফট করেছে। আলোর অস্থিরতা দেখে কেঁপেছে পদ্মজার দুই ঠোঁটও, জানপ্রাণ দিয়ে চেষ্টা করেছে মায়ের মতো আদর করার। কিন্তু সে তো আলোর মা নয়, মায়ের গন্ধ তার গায়ে নেই। রানি মা হয়ে কী করে পারল আলোকে ছেড়ে যেতে? পৃথিবীর সব মা একরকম হয় না। সব মা সন্তানের জন্য ত্যাগ করতে জানে না। দুঃখ আপন করে নিতে জানে না। পদ্মজা আলোর কপালে চুমু দিল। মেয়েটা চুপ করে আছে। চারিদিক কুয়াশায় ধোঁয়া ধোঁয়া। দিন ডুবিডুবি। স্তব্ধ হয়ে আছে সময়। একতলা থেকে শোনা যাচ্ছে আমিনার বিলাপ। তিনি এত কাঁদতে পারেন! পদ্মজা ঘুরে দাঁড়াল ঘরে যেতে। তখনই সামনে পড়লেন ফরিনা। পদ্মজা হাসার চেষ্টা করে বলল, আম্মা, আপনি!’
‘আলো ঘুমাইছে?’
‘না, জেগে আছে।’ পদ্মজা আলোর কপালে আবার চুমু দিল।
ফরিনা বললেন, ‘রানিরে কি পাওন যাইব?’
‘জানি না আম্মা।’ পদ্মজার নির্বিকার স্বর।
‘আলমগীর রুম্পারে লইয়া কই গেছে জানো তুমি? ওরা ভালো আছে তো?’
‘আপনাকে সেদিনই বলেছি আম্মা, জানি না আমি।’
ফরিনা আর প্রশ্ন করলেন না। তিনি নারিকেল গাছের দিকে চোখের দৃষ্টি নিবদ্ধ করলেন। পদ্মজা সেকেন্ড কয়েক সময় নিয়ে ফরিনাকে দেখল। ফরিনা আগের মতো ছটফটে নেই। নিশ্চুপ হয়ে গেছেন। আগে মনে হতো তিনি মনে মনে কোনো কঠিন কষ্ট পুঁতে রেখেছেন; কিন্তু এমন কোনো শক্তি আছে যার জন্য তিনি হাসতে পারেন, বেঁচে আছেন। আর এখন দেখে মনে হচ্ছে, সেই শক্তিটা নষ্ট হয়ে গেছে! জীবনের আশার আলো ডুবে গেছে। কথাগুলো ভেবে পদ্মজা চমকে উঠে! সে তো আনমনে নিজের অজান্তে এসব ভেবেছে! কিন্তু সত্যিই কি এমন কিছু হয়েছে? পদ্মজা আগ্রহ নিয়ে প্রশ্ন করল, ‘আম্মা, আপনি আমাকে কিছু বলতে চান?’
ফরিনা তাকান। পদ্মজা তীর্থের কাকের মতো তাকিয়ে রইল ফরিনার দিকে। ফরিনা ঝরঝর করে কেঁদে ফেললেন। হঠাৎ যেন পাহাড়ের শক্ত মাটির দেয়াল ভেঙে ঝরনাধারার বাঁধ ভেঙে গেল। পদ্মজা খুব অবাক হলো। ফরিনা আঁচলে মুখ চেপে ধরলেন। উৎকণ্ঠার সঙ্গে জানতে চাইল পদ্মজা, ‘আম্মা, আম্মা আপনি কাঁদছেন কেন? কী হয়েছে? বলুন আমাকে। কী বলতে চান আপনি?
আচমকা ফরিনার কান্নার শব্দে আলো ভয় পেয়ে যায়। সে জোরে জোরে কাঁদতে থাকে। পদ্মজা আলোকে শান্ত করার চেষ্টা করে। বারান্দায় পায়চারি করে আদুরে কণ্ঠে বলল, ‘মা, কাঁদে না, কাঁদে না। কিছু হয়নি তো। মামি আছি তো।’
আলো জান ছেড়ে কাঁদছে, কান্না থামাচ্ছে না। বেশ অনেক্ষণ পর আলো কান্না থামায়। সঙ্গে সঙ্গে পদ্মজা ফরিনার দিকে এগিয়ে এলো। প্রশ্ন করল, ‘বলুন আম্মা। কী বলতে চান আমাকে?’
‘কিছু না।’ বলেই তড়িঘড়ি করে দোতলা থেকে নেমে যান তিনি। পদ্মজা আশাহত হয়ে অনেকবার ডাকলেও তিনি শোনেননি। পদ্মজা বিরক্তি নিয়ে বাইরে তাকাল। দেখতে পেল মজিদ হাওলাদারকে। তিনি আলগ ঘর পেরিয়ে অন্দরমহলের দিকে আসছেন। হাঁটছেন খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। পায়ে ব্যথা পেয়েছেন নাকি! পদ্মজা নিচ তলায় যেতে উদ্যত হলো। তখনই মাথায় এলোঃ কোনোভাবে কী আব্বাকে দেখে আম্মা ভয় পেলেন? আর উত্তর না দিয়ে চলে গেলেন?
নিশ্চয়ই এমনটা হয়েছে! ঘরের গোপন খবরই দিতে চেয়েছিলেন ফরিনা। কিন্তু ঘরের মানুষ দেখে আর দিতে পারলেন না। আচ্ছা, তিনি এমন হাউমাউ করে কেন কাঁদলেন? পদ্মজার কপালের চামড়া কুঁচকে গেল।
মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াল সে। আলোর পিঠে হাত বুলাতে বুলাতে ভাবতে লাগল পেছনের সব অদ্ভুত ঘটনা নিয়ে। রুম্পা পাগলের অভিনয় করত, তাকে ঘরে বন্দি করে রাখা হয়েছিল অথচ বাড়ির কারও তা নিয়ে মাথাব্যথা ছিল না। রুম্পা দিনের পর দিন না খেয়ে ছিল। পদ্মজা যতটুকু বুঝেছে ফরিনা খুব ভালোবাসেন রুম্পাকে, তাহলে তিনি কেন খাবার নিয়ে যেতেন না? রুম্পার ঘরে লতিফা নজর রাখত। রুম্পা লতিফাকে দেখে ভয় পেয়েছিল। যেদিনই সে জানতে পারে রুম্পা পাগল না, সেদিন রাতেই বাবলু নামের কালো লোকটি রুম্পাকে মারতে চেয়েছিল। এতসব কার নির্দেশে হচ্ছে? কে এই বাড়ির আদেশদাতা? আর আলমগীরই কী করে জানল রুম্পা খুন হতে চলেছে? তারপর একটা খুন হলো, অথচ ভোর হওয়ার আগেই সেই লাশ উধাও হয়ে গেল। কেউ খুনির খোঁজ করল না! রুম্পা বা আলমগীরের কথা রানি আর ফরিনা ছাড়া কেউ জিজ্ঞাসাও করল না! এই বাড়ির মানুষ জীবিত থেকেও মৃত। কী চলছে আড়ালে! আলমগীর তাকে একটা চাবি দিয়েছিল।
চাবিটা কীসের? রুম্পা বলেছিল: পেছনে…উত্তরে…ধ রক্ত। এই কথার মানেই বা কী?
পদ্মজা দ্রুত দুই চোখ বন্ধ করে ফেলল। তার মাথাব্যথা করছে। দপদপ করছে কপালের রগগুলো। রানির নিখোঁজ হওয়ার ব্যাপারটা পুরোপুরি মাথা থেকে বেরিয়ে গেছে। গাঢ় রহস্যের টানে উন্মাদ হয়ে উঠল সে। বাড়িতে খলিল, রিদওয়ান নেই। এই সুযোগে জঙ্গলে তাকে যেতেই হবে।
পরিবেশে অস্পষ্টতা ক্রমে ছড়িয়ে পড়েছে। সন্ধ্যাকে ম্লান আলোয় জড়িয়ে ধরল বিকেল। আজান পড়ছে। পদ্মজা নিচ তলায় এসে আলোকে লতিফার কাছে দিয়ে নিজ ঘরে গিয়ে নামাজ আদায় করে নিলো। তারপর খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিল আলোকে। মজিদ পায়ে ব্যথা পেয়েছেন। তিনি ঘরে শুয়ে আছেন। ফরিনাও ঘরে। বাড়ির বাকি পুরুষরা তখনো ফিরেনি। আমিনা সদর দরজায় বসে আছেন। চুল এলোমেলো। কপালে এক হাত রেখে বাইরে তাকিয়ে রানির অপেক্ষায় প্রহর গুণছেন। মানুষটার অনেক দোষত্রুটি আছে ঠিক। তবে মেয়ের জন্য পাগল! বাড়ির আরেক কাজের মেয়ে রিনু আলোর সঙ্গে শুয়ে আছে। আলো একা ঘরে কীভাবে থাকবে, তাই পদ্মজাই রিনুকে আলোর সঙ্গে থাকতে বলেছে। লতিফা রান্নাঘরে রান্না করছে। সবাই যে যার কাজে ব্যস্ত। মানবতাবোধ থেকেও অন্তত রানির নিখোঁজ হবার শোকে কাতর হওয়া উচিত। কিন্তু পদ্মজা কাতর হতে পারছে না। তাকে চুম্বকের মতো কিছু টানছে উলটোদিক থেকে। পদ্মজা শক্ত করে খোঁপা বাঁধে। শাড়ির আঁচল কোমরে গুঁজে গায়ে জড়িয়ে নেয় শাল। হাতে নেয় টর্চ আর ছুরি। তারপর অন্দরমহলের দ্বিতীয় দরজা দিয়ে বেরিয়ে পড়ে। এক নিশ্বাসে ছুটে আসে জঙ্গলের সামনে। হাঁপাতে থাকে। চোখের সামনে ঘন জঙ্গল। পেছনে কয়েক হাত দূরে অন্দরমহল। হাড় হিম করা ঠান্ডা। পদ্মজার ঠোঁট কাঁপতে থাকে।
এই জায়গায় সে বহুবার এসেছে, কখনোই জঙ্গলের ভেতর পা রাখতে পারেনি। কেউ না কেউ…অথবা কোনো না কোনো ঘটনা তাকে বাগড়া দিয়েছেই। আজ কিছুতেই সে পিছিয়ে যাবে না। তার স্নায়ু উত্তেজিত হয়ে আছে। জঙ্গলের ঘাসে পা রাখতেই একটা অদ্ভুত অনুভূতি হয়। গায়ের লোমকূপ দাঁড়িয়ে পড়ে। আরো কয়েক পা এগোতেই গা হিম করা অদ্ভুত সরসর শব্দ ভেসে আসে।
পদ্মজার একটু ভয় ভয় করছে। গাঢ় অন্ধকারে এমন এক গভীর জঙ্গলে সে একা! শীতের বাতাসে গাছের পাতাগুলো শব্দ তুলছে আর পদ্মজা উৎকর্ণ হয়ে উঠছে। ভয়-ভীতি নিয়েই সে সামনে এগোতে থাকে। চারিদিকে ঘাস, সরু একটা পথ বাদে। হয়তো এই পথ দিয়ে মানুষ চলাচল করে। পদ্মজা সেই পথ ধরে এগোতে থাকে। সে চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে চারপাশ দেখছে। বড়ো বড়ো গাছ দেখে মনে হচ্ছে কোনো অশরীরী দাঁড়িয়ে আছে! পদ্মজা মনে মনে আয়াতুল কুরসি পড়ে বুকে ফুঁ দেয়।
একটা সময় ফুরিয়ে গেল সেই পথ। পদ্মজা টর্চের আলোতে নতুন পথ খুঁজতে থাকে, যেদিকেই তাকায় সেদিকেই বুনো লতাপাতা। যারা এদিকে আসে তারা কী এখানেই থেমে যায়? পদ্মজা ভেবে কুল পায় না। মাথার ওপর ডানা ঝাপটানোর শব্দ শোনা যেতেই ধক করে উঠল পদ্মজার বুক। সে টর্চ ধরল মাথার ওপর। দুটো পাখি উড়ে গেল ঠিক সেই মুহূর্তেই, চোখের সামনে ভেসে উঠল চন্দ্র তারকাহীন ম্লান আকাশ। পদ্মজা লম্বা করে নিশ্বাস নিলো। কী না কী ভেবেছিল! সে সূক্ষ্ম-তীক্ষ্ণ চোখে দেখল চারপাশ। রুম্পা কী বলেছিল মনে পড়তেই সে উত্তরে তাকাল। বেশিদূর দৃষ্টি গেল না। ঝোপঝাড়ে ঢাকা চারপাশ। পদ্মজা মুখে অস্ফুট বিরক্তিকর শব্দ করল।
নিজে নিজে বিড়বিড় করে, ‘কোনদিকে যাব এবার?
ছটফট করার কারণে হাত থেকে ছুরি পড়ে গেল, সামনে ঝুঁকে ছুরি তুলতে গেলে সেই সঙ্গে ঘাস উঠে আসে হাতে। পদ্মজা অবাক হলো। এই বুনো ঘাসের শেকড় কি মাটির নিচে ছিল না? পদ্মজা উত্তর দিকের আরো কতগুলো ঘাস এক হাতে তোলার চেষ্টা করল। সঙ্গে সঙ্গে হাতে উঠে এলো ওগুলো। সত্যি মাটির নিচে শেকড় নেই! কে বা কারা পথের চিহ্ন আড়াল করতে নতুন তাজা ঘাস দিয়ে সাজিয়ে রেখেছে পথ। পথ লুকোতে প্রায়ই এমন করা হয়? তাহলে তো বেশ পরিশ্রম করে! পদ্মজার উত্তেজনা বেড়ে গেল। সে উত্তর দিকের পথ ধরে এগোতে থাকে, থামল প্রায় দশ মিনিটের মতো হাঁটার পর।
এই মুহূর্তে সে চলে এসেছে জঙ্গলের ঠিক মধ্যখানে।
সামনে ঘন ঝোপঝাড়। পরিত্যক্ত ভাব চারিদিকে। ভূতুড়ে পরিবেশ থেকে থেকে পেঁচা ডাকছে কাছে কোথাও। পদ্মজা বিপদ মাথায় নিয়ে ঝোপঝাড় দুই হাতে সরিয়ে অজানা গন্তব্যে হাঁটতে থাকে। কাঁটা লাগে মুখে। চামড়া ছিঁড়ে যায়। পদ্মজা ব্যথায় ‘মা’ বলে আর্তনাদ করে উঠল ব্যথাকে পাত্তা না দিয়ে এগোতে থাকে সে। ঝোপঝাড় ছেড়ে বড়ো বড়ো গাছপালার মাঝে আসতেই পদ্মজার মনে হলো: তার পেছনে কেউ আছে! চট করে ঘুরে দাঁড়াল। কেউ নেই! মনের ভুল ভেবে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে পদ্মজা। আবার মনে হয়, পেছনে কেউ আছে। পদ্মজা থমকে ঘুরে তাকাল। তার মনটা আনচান করছে, কু গাইছে। কেমন যেন ভয়ও করছে। এই গভীর জঙ্গলে সে একা।
কিছুক্ষণ আগে সন্ধ্যা হলো। কিন্তু এখানে মনে হচ্ছে গভীর রাত। কোনো অঘটন ঘটে গেলে কেউ জানবে না। পদ্মজার রগে রগে শিরশিরে অনুভব হয়। ভয়টা বেড়ে গেছে। ভেঙে পড়ছে সে! রাতের অন্ধকার তার শক্তি, সাহসিকতা যেন শুষে নিচ্ছে। পদ্মজা আল্লাহকে স্বরণ করে, স্বরণ করে হেমলতাকে। চোখ বুজে হেমলতার অগ্নিমুখ ভাবে। তিনি যেভাবে তীক্ষ্ণ চোখে তাকাতেন সেভাবে পদ্মজা তাকাল। কান খাড়া করে চারপাশে যত জীব, প্রাণী আছে সবকিছুর উপস্থিতি টের পাওয়ার চেষ্টা করে। কাছে কোথাও অদ্ভুত একটা কিছু ডাকছে। নিশাচর পাখিদের তীক্ষ্ণ ডাকও শোনা যাচ্ছে। ঝিঁঝিপোকারা ডাকছে এক স্বরে। বাতাস বইছে শোঁ শোঁ শব্দে। এ সবকিছুকে ছাড়িয়ে একটা মানুষের গাঢ় নিশ্বাস তীক্ষ্ণভাবে কানে ঠেকল। খুব কাছে, পেছনে কেউ দাঁড়িয়ে আছে! নিশ্বাস নিচ্ছে। পদ্মজার হাত দুটো শক্ত হয়ে যায়। অদ্ভুত এক শক্তিতে কেঁপে উঠে সে। চোখের পলকে দুই পা পিছিয়ে লোকটিকে না দেখেই ছুরি দিয়ে আঘাত করে। লোকটি ‘আহ’ করে উঠে। পদ্মজা চোখ খুলে ভালো করে দেখে, মুখটি অন্ধকারের জন্য অস্পষ্ট তবে কণ্ঠটি পরিচিত মনে হলো। পদ্মজার ছুরির আঘাত লোকটির হাতে লেগেছে। পদ্মজা রাগী কিন্তু কাঁপা স্বরে প্রশ্ন করে, ‘কে আপনি?’
লোকটি ক্ষুধার্ত বাঘের মতো ছুটে এসে চেপে ধরল পদ্মজার গলা। পদ্মজা আকস্মিক ঘটনার জন্য প্রস্তুত ছিল না। লোকটি এত জোরে গলা চেপে ধরেছে যে তার দম বন্ধ হয়ে আসছে। মাথার ওপর আরো কয়েকটি পাখি ডানা ঝাপটে উড়ে গেল। একটা বলিষ্ঠ হাত গাঢ় অন্ধকারে অপরূপ সুন্দরী এক মেয়ের গলা টিপে ধরে রেখেছে। সুন্দরী মেয়েটি ছটফট করছে! লোকটির মুখ অন্ধকারে ঢাকা। ভয়ংকর এক দৃশ্য!
পদ্মজা তার হাতের ছুরিটা শক্ত করে ধরে, লোকটির পেটে ক্যাঁচ করে টান দিল। আর্তনাদ করে সরে গেল আক্রমণকারী, মাটিতে বসে পড়ে হাঁটুগেড়ে। পদ্মজা আবারও আঘাত করার জন্য এগোতেই উঠে দাঁড়াল লোকটি, যেন নতুন উদ্যমে শক্তি পেয়েছে। লোকটা ঝাঁপিয়ে পড়ল পদ্মজার ওপর, নখের আঁচড় হাতে বসিয়ে কেড়ে নেয় ছুরি।
পদ্মজা ছুরি ছাড়া এমন হিংস্র পুরুষের শক্তির সামনে কিছু না। যেভাবেই হোক, এর হাত থেকে বাঁচতে হবে। পদ্মজা টর্চ দিয়ে লোকটির মাথায় বাড়ি মারল, টাল সামলাতে না পেরে পিছিয়ে গেল আক্রমণকারী। পদ্মজা উলটোদিকে দৌড়াতে থাকে, পিছু ধাওয়া করে লোকটা। দুইবার ছুরির আঘাত, একবার মাথায় টর্চের বাড়ি খাওয়ার পরও ব্যাটা মাটিতে লুটিয়ে পড়েনি। নিঃসন্দেহে এই রহস্যের পাক্কা খেলোয়ার সে।
পদ্মজার শাল পড়ে যায় গা থেকে। তার খোঁপা খুলে রাতের মাতাল হাওয়ায় চুল উড়তে থাকে। ঝোপঝাড়ের মাঝে উদ্ভ্রান্তের মতো দৌড়াচ্ছে সে। কানে আসছে বাতাসের শব্দ শোঁ, শোঁ, শোঁ! দুই হাতে শাড়ি ধরে রেখেছে গোড়ালির ওপর, যাতে পা বেঁধে পড়ে না যায়। জুতা ছিঁড়ে পড়ে থাকে জঙ্গলে। কাঁটা কাঁটায় ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় পাজোড়া। রক্ত বের হয় গলগল করে। তবুও সে থামল না।
এত সহজে মরবে না…
…এই রহস্যের গোড়ায় পৌঁছতে হলে তাকে বাঁচতেই হবে।
পদ্মজা – ৬০
রাতের আঁধার কেটে ভোরের আলোর মাধ্যমে শুরু হয়েছে আরেকটি নতুন দিন। পূর্ণা ও মগা মেঠোপথ ধরে হাওলাদার বাড়ি যাচ্ছে। মাথার ওপর আকাশ আলো করা তেজবিহীন সূর্য। পূর্ণার পায়ের গতি চঞ্চল। সে অস্থির হয়ে আছে। পাশেই কৃষকের ফসলি জমি ছেয়ে গেছে সবুজের সমারোহে। ফসলি জমির সবুজ আর ঘাস, গাছ-পালার ডগায় জমে থাকা শিশির বিন্দু সকালের প্রকৃতিতে এক অপরূপ সৌন্দর্য সৃষ্টি করেছে। অথচ সেই সৌন্দর্য পূর্ণাকে ছুঁতে পারছে না। অন্যবেলা হলে সে শিশিরভেজা ঘাসে গা এলিয়ে দিত। কোনো এক অদ্ভুত কারণে ঠান্ডার মধ্যেও তার শিশিরে ভিজতে ভালো লাগে। এখন সেই মন-মানসিকতা নেই। মগা কিছুক্ষণ আগে তাকে খবর দিয়েছে: গতকাল রাতে পদ্মজা আহত অবস্থায় জঙ্গল থেকে ফিরেছে। প্রেমা ঘরে পড়ছিল। বাসন্তী রান্নাঘরে। তাই তারা শুনতে পায়নি। পূর্ণা রোদে বসে সকালের খাবার খাচ্ছিল। খবরটা শোনা মাত্র খাবার রেখে মগাকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে।
কুয়াশা ঢাকা পথে উত্তরে হাওয়ায় কাঁপতে কাঁপতে পূর্ণা হাওলাদার বাড়ি আসে। এক ছুটে পদ্মজার ঘরে যায়। পদ্মজা ঘুমে। শিয়রে ফরিনা বসে আছেন। পূর্ণা করুণস্বরে জানতে চাইল, ‘ও খালাম্মা, আপার কী হয়েছে?’
ফরিনা ইশারায় শান্ত হতে বলে, ধীরেসুস্থে রাতের ঘটনা খুলে বললেন। গতকাল এশার আজানের সময় পদ্মজা কোত্থেকে দৌড়ে সদর ঘরে এসে লুটিয়ে পড়ে। পা থেকে গলগল করে রক্ত বের হচ্ছিল, কাঁটার আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত। শ্বাস নিচ্ছিল ঘন ঘন। গালের চামড়ারও একই অবস্থা। ফরিনা, লতিফা, আমিনা, রিনু পদ্মজাকে দেখে চমকে যায়। আমিনা দূরে দাঁড়িয়ে থাকলেও বাকি তিনজন পদ্মজাকে ধরে ঘরে নিয়ে আসে। পদ্মজা পানি খেতে চায়। পানি খাওয়ার পর বলে যে সে জঙ্গলে গিয়েছিল। জঙ্গলের কথা শুনে উপস্থিত দুজন কাজের মেয়ে ও ফরিনার মুখ পাংশুটে হয়ে যায়। তারা আর প্রশ্ন করেনি। বরং বুঝে গিয়েছিল কী হয়েছে! কাঁটা বের করতে গিয়ে আরো রক্তক্ষরণ হয়েছে। পদ্মজা যন্ত্রণায় ঠোঁট কামড়ে শুয়েছিল, অনবরত চোখের জল ফেলেছে। ব্যান্ডেজ করাটা জরুরি হয়ে যায়। কাটাছেঁড়ার প্রাথমিক চিকিৎসা সম্পর্কে ফরিনার ধারণা নেই। তাই তিনি মজিদ হাওলাদারকে গিয়ে বলেন। এই বাড়িতে প্রায়ই মারামারি, কাটাকাটি চলে। তাই মজিদ হাওলাদারের কাছে ব্যান্ডেজ, স্যাভলনসহ বিভিন্ন জিনিসপাতি রয়েছে। তিনি প্রাথমিক চিকিৎসার জিনিসপাতি নিয়ে আসেন। তারপর পদ্মজার পা ভালো করে পরিষ্কার করিয়ে ব্যান্ডেজ করে দেন।
বোনের পায়ের কাছে বসে হাহাকার করে বলল পূর্ণা, ‘আমার আপা এত কষ্ট পেয়েছে!’ পূর্ণার চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ে। সে ফরিনার কাছে জানতে চায়, ‘ভাইয়া কোথায়?’
তাৎক্ষণিক ফরিনার মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে যায়। তিনি মিনমিনে গলায় বললেন, ‘জানি না।’
পূর্ণা অবাক স্বরে বলল, ‘ভাইয়া জানে না আপার কথা? রাতে দেখেনি?’
‘বাবু তো বাড়িত আহেই নাই। রানিরে যে খুঁজতে গেল আর আইছে না।’
‘রানি আপারে পাওয়া যায়নি?’
‘না।’
‘আচ্ছা।’
পদ্মজা শরীর নাড়াচ্ছে দেখে পূর্ণা কথা থামিয়ে দিল। সে পদ্মজার পেটের কাছে এসে বসল। বলল, ‘আপা।’
পদ্মজা পিটপিট করে চোখ খোলে। জানালা দিয়ে সূর্যের আলো টুপ করে পদ্মজার ঝাঁপিয়ে পড়ল চোখেমুখে। দ্রুত চোখ বুজে ফেলল পদ্মজা। তারপর আবার ধীরে ধীরে চোখ খুলল। পূর্ণাকে দেখে অবাক হয়ে উঠে বসতে চাইলে অনুভব করল পায়ে অনেক ব্যথা। সে পায়ের দিকে চেয়ে আরও অবাক হলো। পায়ে ব্যান্ডেজ এলো কী করে! মনে করার চেষ্টা করল, কী হয়েছে তার সঙ্গে। আপন মনে নিজেকেই বলল, ‘রাতে এক ছুটে অন্দরমহলে চলে আসি। ভুলেও পেছনে ফিরে তাকাইনি। সদর ঘর থেকে আম্মা ঘরে নিয়ে আসেন। আব্বা ব্যান্ডেজ করে দেন। আম্মা খাইয়ে দেন। অনেক রাত হয়। উনি তখনো ফিরেননি। তাই চিন্তা হয়। আম্মাকে জিজ্ঞাসা করলে আম্মা বলছিলেন, চলে আসবে। তারপর কী হয়েছিল মনে নেই। ঘুমিয়ে পড়েছি বোধহয়!’
পদ্মজা ভাবনা থেকে বেরিয়ে সর্বপ্রথমে ফরিনাকে প্রশ্ন করল, ‘উনি ফিরেছেন?
‘না।’
পদ্মজা কী বলবে বুঝতে পারছে না। সে অনেক্ষণ পর বলল, ‘চাচা আর রিদওয়ান ভাই ফিরেছে?’
আইছে তো। তোমার চাচা এহন কই জানি না। রিদওয়ান হের ঘরেই আছে।
‘তাহলে আপনার ছেলে কোথায়?’ পদ্মজা উত্তেজিত হয়ে পড়ে। পূর্ণা পদ্মজার এক হাতে চেপে ধরে অনুরোধ করে, ‘আপা, শান্ত হও। খালাম্মা, রিদওয়ান ভাই আর ছোটো চাচা কিছু বলেনি ভাইয়ার ব্যাপারে? আপনি জিজ্ঞাসা করেননি?’
ফরিনা নির্বিকার স্বরে বললেন, ‘আমি হেরার লগে কথা কই না।’
‘আপনার ছেলের জন্য আপনার চিন্তা হচ্ছে না? রাতে বাড়ি ফেরেনি। আপনি তো মা নাকি?’ পদ্মজার গলা কাঁপছে। তার হৃৎস্পন্দন বেড়ে গেছে আমিরের কিছু হলে সে মাঝসমুদ্রে পড়বে। হেমলতার পর এই একটা মানুষকেই সে অন্ধের মতো বিশ্বাস করে, ভালোবাসে। ফরিনা নিশ্চুপ। তিনি পদ্মজার কথায় পাত্তা দিচ্ছেন না।
ব্যথায় টনটন করে উঠল পদ্মজার পা। শীতের সময় কাটাছেঁড়া খুব যন্ত্রণার, যে যন্ত্রণায় পূর্ণা এখনও ভুগছে। সেদিন কাঁধে আঘাত পেল, আজও শুকায়নি ভালো করে। কিছুর ছোঁয়া লাগলেই ব্যথা করে। পূর্ণা পদ্মজাকে অনুরোধ করে বলল, ‘আপা, এমন করো না। ভাইয়া চলে আসবে। রানি আপাকে খুঁজতে গেছে। এজন্যই আসতে পারেনি।’
‘রানি আপার বাপ-ভাই তো চলে আসছে।’
‘তুমি তো জানোই, তারা কেমন। রানি আপার জন্য মায়া শুধু ভাইয়ার। তাই ভাইয়া রানি আপাকে ছাড়া আসতে পারছে না।’
পূর্ণার কথাগুলো যুক্তিসঙ্গত হলেও, পদ্মজার মন মানছে না। গোলমাল তো আছেই। পদ্মজা পূর্ণাকে এক হাতে সরিয়ে বিছানা থেকে নামার জন্য এক পা মেঝেতে রাখে। সঙ্গে সঙ্গে পুরো শরীরে একটা সূক্ষ্ম তীব্র ব্যথা ছড়িয়ে পড়ে। আর্তনাদ করে আবার শুয়ে পড়ল পদ্মজা। ফরিনা ও পূর্ণা আঁতকে উঠে জোর করে শুইয়ে দিল পদ্মজাকে। কিন্তু পদ্মজা নাছোড়বান্দা, সে তার স্বামীর খবর যতক্ষণ না পাবে শান্ত হবে না। ফরিনা আশ্বস্ত করে বললেন, ‘ওরা বাবুর ক্ষতি করব না। বাবুর কাছে ওদের অনেক কিছু পাওনের আছে। কাগজে-কলমে এই বাড়িডার মালিক বাবু।’
পদ্মজা তীর্যকভাবে তাকাল। বলল, ‘আপনি সব জানেন তাই না?’
পূর্ণা ফোড়ন কাটে, ‘কী জানবে?’
পূর্ণার উত্তর না দিয়ে পদ্মজা ফরিনাকে প্রশ্ন করল, ‘বলুন, আম্মা।’
ফরিনা আড়চোখে দরজার দিকে তাকালেন। ফরিনার দৃষ্টি অনুসরণ করে পদ্মজা-পূর্ণাও তাকাল। কে যেন দাঁড়িয়ে আছে। শাড়ি দেখে মনে হচ্ছে লতিফা। পূর্ণা ডাকতে উদ্যত হয়। পদ্মজা পূর্ণার হাত ধরে ফেলে। ইশারা করে চুপ থাকতে। তারপর ফরিনাকে প্রশ্ন করে, ‘তাহলে আপনি নিশ্চিত ওরা উনার ক্ষতি করবে না?’
‘জানে মারব না।’
এ কথা শুনে পদ্মজা হকচকিয়ে যায়। সে উৎকর্ণ হয়ে বলল, ‘এ কথা কেন বলছেন?’
ফরিনা আবার নিশ্চুপ হয়ে গেলেন। পদ্মজার মাথার রগ রাগে দপদপ করছে। এই বাড়ির মানুষগুলোর মস্তিষ্কের কী চলে তার কোনো কিনারা নেই! এত জটিল! কিছুতেই ধরা যাচ্ছে না। একেকবার একেকজনের একেক রূপ।
.
পদ্মজাকে সারাদিন এটা-ওটা বলে বিছানায় রাখা হলো। ফরিনাও সারাদিন পাশে রইলেন। পদ্মজা সারাক্ষণ উনি, উনি করে গেছে। ফরিনা কোনো জবাবই দিলেন না। দরজার ওপাশেও সারাক্ষণ লতিফা ছিল। পূর্ণা অনেকবার লতিফাকে ধরেছে। তখন লতিফা হেসে বলেছে, ‘পদ্ম আপা কেমন আছে, দেখতে আইছিলাম।’ পূর্ণা কঠিনস্বরে অনেকবার নিষেধ করেছে যাতে আর না আসে। তবুও লতিফা এসেছে। পদ্মজা নিষেধ করার পর, পূর্ণা স্থির হয়। বিকেল হয়ে গেল, তবুও আমিরের দেখা নেই। এদিকে পদ্মজা বিছানায় বসে ইশারায় ফজরের কাজা নামাজ পড়েছে। দুপুরের, আছরের নামাজও বসে বসে ইশারায় করেছে। ফরিনা দুপুরে না করেছিলেন, ‘এত কষ্ট কইরা নামাজের কী দরহার! কইরো না। আল্লাহ মাফ করব এমনিতে।’
পদ্মজা তখন মিষ্টি করে হেসে জবাব দিয়েছিল, যতক্ষণ হুঁশজ্ঞান আছে নামাজ ছাড়ার পথ নেই, আম্মা। আল্লাহ তায়ালা অসুস্থ মানুষকে ইশারায় নামাজ পড়ারও পথ দিয়েছেন। কেন দিয়েছেন? নামাজ বাধ্যতামূলক বলে। ইসলামে নামাজের গুরুত্ব অনেক বেশি।’
ফরিনা এই কথার ওপরে কিছু বলতে পারেননি। পদ্মজা ধর্মকর্ম নিয়ে খুব জানে। পদ্মজার কাছ থেকে তিনি অনেক কিছু শিখেছেন। ধর্মের কথা বলার সময় পদ্মজা অন্য সবকিছু ভুলে যায়। তাই পুরোটা দুপুর তিনি পদ্মজাকে ইসলাম ধর্মের খুঁটিনাটি নিয়ে প্রশ্ন করেই গেছেন। বিকেলবেলা পূর্ণা জানাল, সে আজ এই বাড়িতে থাকবে। পদ্মজা এ কথা শুনে আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। সে জোরাজুরি করে পূর্ণাকে মোড়ল বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়। এই বাড়ি মোটেও সুবিধার না। সে ঝুঁকি নিতে চায় না। পূর্ণা চলে যাওয়ার আগে পদ্মজা কিছু সুরার নাম বলে দেয়। পড়ে ঘুমানোর জন্য একটা দুই লাইনের সুরা শিখিয়ে দেয়। পড়ে ঘুমালে বিপদ হবে না।
পূর্ণা চলে যাওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই আজান পড়ে সন্ধ্যার। পূর্বের নিয়মেই নামাজ পড়ে পদ্মজা। ফরিনা পদ্মজার ঘর ছেড়ে রান্নাঘরে চলে যান। পদ্মজা নামাজ শেষ করে বালিশে হেলান দিয়ে চোখ বুজে। আমিরের জন্য খুব চিন্তা হচ্ছে। দুইদিন কেটে যাচ্ছে আমিরের দেখা নেই। তার মনের অবস্থা করুণ। বার বার দীর্ঘশ্বাস ছাড়ছে। প্রহর গুণছে এই বুঝি মানুষটা চলে এলো। পদ্মবতী, পদ্মবতী বলে একাকার করে দিল ঘর। কিন্তু আসে না।
পদ্মজার বুকের বাঁপাশে চিনচিন ব্যথা বেড়েই চলেছে। গতকাল রাতে আক্রমণ করা লোকটিকে সে তখন চিনতে পারেনি। কিন্তু এখন আন্দাজ করতে পারছে তার পরিচয়। তবে আমিরের শূন্যতা তাকে পোড়াচ্ছে খুব। সে এমন ছটফটানি নিয়ে আর থাকতে পারছে না। আহত পা মাটিতে রেখে ভর দিতেই আবার সেই তীব্র ব্যথা। কিন্তু এর চেয়েও গভীর ব্যথা আমিরের দেখা না পাওয়া। পদ্মজার দুই পায়ের পাতার এক পাশ অক্ষত। সে ওই এক পাশ দ্বারা মাটিতে ভর দিয়ে ধীরে ধীরে এক তলায় যায়। সোজা চলে আসে রিদওয়ানের ঘরে। দরজা একটু খোলা ছিল। পদ্মজা একবার ভাবল কড়া নেড়ে ঘরে ঢুকবে। কী মনে করে আর নাড়ল না, সোজা দরজায় ধাক্কা মারল। রিদওয়ান চমকে ঘুরে তাকাল। পদ্মজাকে দেখে তাড়াতাড়ি শার্ট পরতে উদ্যত হয়। পদ্মজা মুচকি হেসে বলল, শার্ট পরে লাভ নেই। চোখে পড়ে গেছে।’
রিদওয়ান ফিরে দাঁড়াল। লম্বা করে হেসে শার্ট পরল। বোতাম লাগাতে লাগাতে বলল, ‘বুদ্ধিমতী। তো দেখতে এসেছো কেমন আছি? ভালো নেই। ছুরি এবং চুরির মালিক দুজনেরই তেজ বেশি ছিল।’
পদ্মজা তিরষ্কার করে হাসল। দুই কদম এগিয়ে এসে বলল, ‘পাগলের প্রলাপ! আন্দাজ ঠিক হবে ভাবিনি। এবার বলুন উনি কোথায়?’
রিদওয়ান ভ্রু দুটি বাঁকিয়ে বলল, ‘আমির?’
পদ্মজা জবাব দিল না। রিদওয়ান বলল, ‘আমি জানব কী করে তোমার জামাই কোথায়?’
‘জানেন না?’ পদ্মজার কড়া প্রশ্ন।
রিদওয়ান উত্তরে হাসল। একটা ছুরি বের করল সে আলমারি থেকে, শীতল স্বরে প্রশ্ন করল, ‘তোমার ছুরিটার নাম কী? আমির কোন দেশ থেকে এনে দিয়েছে?
ফুটপাত থেকে কেনা। ছুরির ধার থাকলেই চলে। অভিজ্ঞ হতে হয় আক্রমণকারীর হাত। তাই ছুরির নাম না খুঁজে নিজের হাতটাকে অভিজ্ঞ করুন।’ পদ্মজার সূক্ষ্ম অপমান বুঝতে রিদওয়ানের অসুবিধা হলো না। সে আলমারির কপাট লাগিয়ে এগিয়ে এসে বলল, ‘ব্যঙ্গ করছ?’
পদ্মজা তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে রইল রিদওয়ানের দিকে। বলল, ‘কী আছে জঙ্গলে? কী আড়াল করছেন?’
‘তা জেনে তুমি কী করবে?’
‘কোন অপরাধ চলছে?’
‘তোমাকে জানতে হবে না।’
তখনো তো মারতে এসেছিলেন। এখন তো কাছে আছি, আক্ৰমণ করছেন না কেন?’
রিদওয়ান হাসল। পদ্মজার পেছনে গিয়ে ঘাড়ে ফুঁ দিল। সঙ্গে সঙ্গে পদ্মজা দূরে সরে যায়। হুমকি দিয়ে বলল, ‘নোংরামি করার সাহস করবেন না। তখনের আঘাতগুলো ভুলে যাবেন না। আমি আমাকে রক্ষা করতে জানি।’
‘এজন্যই পালিয়ে এসেছিলে?’
‘পদ্মজা ক্ষণকালের জন্য পালিয়েছে। যা-ই থাকুক, আমি খুঁজে বের করবই। আর ধ্বংসও করব এই আমি।’
‘দেখো, পদ্মজা, তুমি আর এসব ঘেঁটো না। সুখে আছো সুখে থাকো। নয়তো পরিণতি খারাপ হবে। ভালো করে বলছি ঢাকা ফিরে যাও। আর এসো না।’
‘ভয় পাচ্ছেন?’
‘কাকে? তোমাকে?’ রিদওয়ান সশব্দে হাসল। রিদওয়ানের হাসি পদ্মজার গায়ে জ্বালা ধরিয়ে দিচ্ছে। রিদওয়ান হাসতে হাসতে বলল, ‘তোমাকে ভয় পাবে রিদওয়ান?’
‘উনি কোথায় সত্যি জানেন না?’
‘না, জানি না।’
‘আমি কিন্তু—’
‘কী করবে? খুন করবে?’ রিদওয়ান কিড়মিড় করে এগিয়ে আসে। পেছন থেকে পদ্মজার দুই হাত মুচড়ে ধরে বলল, ‘ভালো করে বলছি আর গভীরে যেয়ো না। এককালে তোমাকে বিয়ে করার কথা ভেবেছিলাম বলে বলছি, আর গভীরে যেয়ো না। তোমার করুণ দশা আমিও আটকাতে পারব না।’
‘ছাড়ুন আমাকে।’
‘ছাড়ব না।’ রিদওয়ান পদ্মজার কাঁধে ঠোঁট ছোঁয়াতেই পদ্মজার সারা শরীর রি রি করে ওঠে। মাথা দিয়ে পেছনে থাকা রিদওয়ানের মুখে আঘাত করে সে।
রিদওয়ান কিছুটা পিছিয়ে গেল, নাকে ভীষণ ব্যথা পেয়েছে। সে কিড়মিড় করে তাকাল হিংস্র জন্তুর মতো। বলিষ্ট, মোটাসোটা শরীরটাকে হারানো যেকোনো মেয়ের জন্য অসাধ্য। পদ্মজা নিজেকে রক্ষা করার জন্য টেবিল থেকে জগ নিলো হাতে। রিদওয়ান বলল, ‘তুমি বাড়াবাড়ি করছো, পদ্মজা।’
‘উনি যদি জানতে পারেন যে আপনি আমার সঙ্গে এই অসভ্যতা করেছেন, আপনার দেহে প্রাণ থাকবে না।’
রিদওয়ান ফিক করে হেসে দিল, যেন মাত্রই মজার কোনো কথা বলল পদ্মজা। রিদওয়ান হাসি ঠোঁটে রেখে বলল, ‘আগে তো ও নিজেকে বাঁচাক। তারপর আমাকে প্রাণে মারবে নাহয়।’
রিদওয়ানের এই কথাটি যেন বজ্রপাত ঘটাল। চিৎকার করে জানতে চাইল পদ্মজা, ‘কোথায় রেখেছেন উনাকে? কী করেছেন উনার সঙ্গে?’
‘ঘরে যাও, পদ্মজা।’
‘আপনি বলুন, উনি কোথায়?’
‘যাও ঘরে।’
‘বলুন আপনি।’
‘পদ্মজা!’
পদ্মজা জগ ছুঁড়ে মারল রিদওয়ানের দিকে। ঝট করে সরে দাঁড়াল রিদওয়ান। জগ স্টিলের থালাবাসনের ওপর পড়ে বিকট শব্দ হলো। সেই শব্দ শুনে ছুটে আসে ছুটে মজিদ, খলিল।
তবে আসেনি একজন মহিলাও।
পদ্মজা বিছানার ওপর ছুরি দেখে দ্রুত হাতে তুলে নিলো সেটা। সে তার নিজস্ব কৌশল ব্যবহার করে রিদওয়ানকে আঘাত করতে উদ্যত হলো। রিদওয়ান ছুরিসহ পদ্মজার হাত ধরে ফেলে। ফিসফিসিয়ে বলল, ‘তোমার তিন বছরের ছুরি চালানোর অভিজ্ঞতা আর আমার বিশ বছরের পেশা। পেরে উঠবে না।’
পদ্মজার হাত থেকে খলিল ছুরি টেনে নিলো। পদ্মজা যেন হিংস্র বাঘিনী হয়ে উঠেছে। আমিরের শোকে তার মাথা কাজ করছে না। দুই দিন হয়ে গেল আমিরের দেখা নেই। তার ওপর সারা শরীরে ব্যথা। তার নিজেকে উন্মাদ মনে হচ্ছে। রাগে রিদওয়ানের গলা চেপে ধরল সে। রিদওয়ান পদ্মজার হাত থেকে ছোটার চেষ্টা করতে গিয়ে পদ্মজাকে নানাভাবে আঘাত করল বটে, তবে পদ্মজা কিছুতেই ছাড়ছে না। তার শরীরের শক্তি হঠাৎই দ্বিগুণ বেড়ে গেছে। আমির তার জীবনে কতটা মূল্যবান—তা কেউ জানে না। আমিরের জন্য সে সবকিছু করতে পারে। খলিল এক হাতে পদ্মজার চুল মুঠ করে ধরে, অন্য হাতে পদ্মজার গাল চেপে ধরে বলল, ‘বেশ্যার ছেড়ি, আমার ছেড়ারে ছাড়।’
তাও পদ্মজা ছাড়ল না। মজিদ এগিয়ে এসে পদ্মজাকে টেনে সরালেন। পদ্মজার শরীর কাঁপছে। সে চিৎকার করে বলছে, ‘উনার কিছু হলে আমি কাউকে ছাড়ব না। মেরে ফেলব। মেরে ফেলব একদম।’
রিদওয়ান ছাড়া পেয়ে প্রাণভরে নিশ্বাস নিলো। তারপরই তেড়ে এসে থাপ্পড় বসাল পদ্মজার গালে। পদ্মজার গালের ক্ষত থাপ্পড়ের ভার নিতে ব্যর্থ হয়, ছিলে গেল চামড়া। পদ্মজার দুই হাত মজিদ ধরে রেখেছেন। পদ্মজা আম্মা মজিদকে খেয়াল করেনি। সে চেঁচিয়ে ফরিনাকে ডাকল, আম্মা, আপনি কোথায়? আম্মা ওরা আপনার ছেলেকে মেরে ফেলবে। আম্মা…’
ফরিনা এলেন না। খলিল হুংকার ছাড়েন, ‘এই খানকির ছেড়ির গত্রে আগুন বেশি। ছিঁইড়া দে ওরে।’
পদ্মজার কান দিয়ে ধোঁয়া বের হচ্ছে। সে মুখভরতি থুতু ছুঁড়ে দেয় খলিলের মুখের ওপর। তাৎক্ষণিক রিদওয়ান পদ্মজার শাড়ির আঁচল দিয়ে পদ্মজারই গলা পেঁচিয়ে ধরে কিড়মিড় করে বলল, ‘এই মাঘীর ঝি, তোরে অনেক্ষণ ধরে বোঝাচ্ছিলাম। ভালো কথা কান দিয়ে ঢুকে না? মায়ের মতো হইছস? তোর মারেও মেরে দিতাম, যদি নিজে থেকে না মরত।’
পদ্মজার চোখ উলটে যাচ্ছে। মজিদ রিদওয়ানকে বললেন, ‘রিদওয়ান ওরে ছেড়ে দে। মরে যাবে!’
রিদওয়ান তাও ছাড়ছে না। অবশেষে খলিল রিদওয়ানকে জোরে ধাক্কা দিয়ে সরালেন। পদ্মাজার শরীরের সব শক্তি শেষ। সে কাশতে কাশতে মেঝেতে লুটিয়ে পড়ল, চোখ বুজে আসছে। কল্পনায় ভেসে উঠল আমিরের শ্যামবর্ণের মায়াময় মুখ। আর মুখ দিয়ে অস্ফুট স্বরে ডাকল, ‘আম্মা।’
তারপরই হারিয়ে ফেলল জ্ঞান। তিনজন পুরুষের মাঝে লুটিয়ে পড়ে আছে পদ্মজা। বুকে শাড়ি নেই। খয়েরি রঙের ব্লাউজ পরা। গলায় লাল দাগ। মুখে নখের আঁচড়। গালে চেপে ধরার দাগ। চামড়া ছিলে যাওয়ার রক্ত। ফরসা দুই হাত শক্ত করে চেপে ধরার দাগ জ্বলজ্বল করে ভাসছে। চুল কয়টা ছিঁড়ে পড়ে আছে আশপাশে। পায়ের সাদা ব্যান্ডেজ আবার লাল হয়ে উঠেছে। আগুন সুন্দরী পদ্মজার খুঁতহীন রূপে খুঁতের মেলা বসে গেছে! জানালা দিয়ে আসা উত্তরে হাওয়ায় হুঁশহারা পদ্মজার রক্ত ধীরে ধীরে শুকাতে থাকে। কেউ নেই তাকে বুকে আগলে ধরার জন্য।
পদ্মজার অবস্থা দেখে ঘরের দেয়ালগুলোও গুমরে গুমরে কাঁদছে।
৬১
মাথার ওপর সূর্য নিয়ে কলসি কাঁখে আজিদের বাড়িতে ঢুকল পূর্ণা। পাতলা ছিপছিপে গড়ন অথচ কাঁখে পিতলের প্রকাণ্ড কলসি! খালি কলসির ভারেই বাঁকা হয়ে পড়েছে! পানিভরতি কলসি নিয়ে কী করে বাড়ি ফিরবে কে জানে! সকাল থেকে তাদের টিওবওয়েলে সমস্যা। পানি আসছে না। সকালে বাসন্তী আজিদের বাড়ি থেকে পানি নিয়েছেন। এখন আবার আসতে চেয়েছিলেন, পূর্ণা আসতে দিল না। সে নিজে দায়িত্ব নিয়ে এসেছে। বাসন্তী অনেকবার বলেছেন, ‘এইটুকু শরীর নিয়ে পারবি না।’
পূর্ণা অহংকার করে বলেছে, ‘আমি পারি না এমন কিছু নেই। তুমি ঘরে যাও তো।’
আজিদের বাড়ির সামনে পুকুর আছে। সেখানে নতুন ঘাট বাঁধানো হয়েছে। ঘাটে গোসল করছে আজিদের বউ আসমানি। ছয় মাস আগে বিয়ে হলো। আসমানির সঙ্গে পূর্ণার অনেক কথা হয়েছে।
পূর্ণা আসমানিকে না দেখলেও আসমানি পূর্ণাকে দেখে ডাকল, ‘কি গো পূর্ণা! ফেইরাও চাইলা না। ভাবিরে চোক্ষে পড়ে নাই?’
পূর্ণা ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল। অপরাধী কণ্ঠে বলল, ‘খেয়াল করিনি, ভাবি।’
‘পানি নিতে আইছো?’
‘হু, আমাদের টিউবওয়েল—’
‘শুনছি খালাম্মার কাছে। একটু বইসো। আমি ডুব দিয়া আইতাছি।’
‘আচ্ছা, ভাবি।’
পূর্ণা মুখে আচ্ছা বললেও মনে মনে পরিকল্পনা করে পানি নিয়ে অন্য পথ দিয়ে বাড়িতে চলে যাবে। আসমানি একবার কথার ঝুড়ি নিয়ে বসলে, কথা ফুরোয় না। পূর্ণা আড্ডাবাজি খুব পছন্দ করে। কিন্তু এখন তার তাড়া আছে। তাড়াতাড়ি ফেরা চাই। দুপুর হয়ে গেছে। পদ্মজাকে এখনও দেখতে যেতে পারেনি সে। গতকাল বিকেলে যে দেখে এলো, তারপর আর খোঁজ মিলেনি। চিন্তায় সারারাত ঘুম হয়নি পূর্ণার। আজিদের বাড়ির অঙ্গণ শূন্য, ঘরের বাইরে কেউ নেই। পূর্ণা সোজা কলপাড়ে এসে দ্রুত কল চেপে কলসি ভরে নিলো। কিন্তু কলসি কাঁখে তুলতে গিয়ে হলো সমস্যা, কিছুতেই তুলতে পারছে না। আসমানি গামছা দিয়ে চুল মুছতে মুছতে এগিয়ে এলো। ফরসা, সুন্দর একটা মুখ। নতুন বউ-নতুন বউ ছাপটা এখনও মুখে লেগে আছে। আসমানি কাছে এসে হেসে বলল, ‘এত বড়ো কলসি নিবা কেমনে? খালাম্মারে পাঠাইতা।’
‘তুমি একটু সাহায্য করো।’
‘কী কও? আমি লইয়া যামু কলসি?’
‘আমি কি তা বলছি, ভাবি! কাঁখে তুলতে সাহায্য করো।’
আসমানি ঠোঁটে হাসি নিয়ে বলল, ‘ওহ! বাড়ির বউ তো শরম লজ্জার ডরেই বাইর হই না। নয়তো বাড়ি অবধি দিয়া আইতাম।’
‘বাড়ি থেকে বের হতেই লজ্জা, ভাসুরের সঙ্গে শুতে লজ্জা নাই?’
পূর্ণা কটাক্ষ করে বলল, ঠোঁটে তিরস্কারেরা হাসি। আসমানির চোখমুখের রং পালটে গেল, লাল হয়ে গেল ফরসা মুখটা। চোখ ছাপিয়ে নেমে এলো জল। ক্ষণমুহূর্ত পূর্ণার দিকে চেয়ে থাকে সে। তারপর এদিক- ওদিক দেখে পূর্ণার এক হাত চেপে ধরে চাপা স্বরে বলল, ‘কী কইরা জানছো?’
পূর্ণা এক ঝটকায় আসমানির হাত সরিয়ে দিল। বলল, ‘তোমার সঙ্গে দেখা করতে এসে জানালা দিয়ে এই নোংরামি দেখছি। আজিদ ভাই মাটির মানুষ। কত ভালো উনি। উনাকে কেন ঠকাচ্ছো, ভাবি?’
আসমানি স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। তার হাত দুটি অস্বাভাবিকভাবে কাঁপছে। চোখ থেকে জলের ধারা নেমেছে। পূর্ণার দেখে মায়া হয়। সে কণ্ঠ নরম করে বলল, ‘কাউকে বলিনি আমি। বারো-তেরো দিন যখন চেপে রাখতে পেরেছি, সারাজীবন পারব। ভালো হয়ে যাও, ভাবি। আজিদ ভাইকে ঠকিও না। পাপ করো না।’
আসমানি অশ্রুরুদ্ধকর কণ্ঠে বলল, ‘আমারে খারাপ ভাইবো না।’
পূর্ণা কিছু বলল না। খারাপ কাজ করার পরও কী করে খারাপ না ভেবে থাকা যায়! সে আসমানিকে অগ্রাহ্য করে কলসি তোলার চেষ্টা চালাল। আসমানি দ্রুত পায়ে কলপাড় ছাড়ে। পূর্ণা কলসি কাঁখে তুলতে সক্ষম হলো, কিন্তু খুব বেশি ভার। এখনই কোমর মচকে যাবে! পূর্ণা কলপাড় ছাড়তেই সামনে এসে দাঁড়াল আসমানি। চারিদিকে চোখ বুলিয়ে এক নিশ্বাসে বলল, ‘কাউরে কইয়ো না, পূর্ণা। আমারে তোমার ভাই আর ঘরে রাখব না। আমি চাই নাই এমন করতে। শফিক ভাই তো আমগোর থানার পুলিশ মানুষ। আমার ছোডু বইনডা এক মাস ধইরা হারায়া গেছে। অনেক খুঁজছি পাই নাই। পুলিশ দিয়া খোঁজানোর ক্ষেমতা আমার বাপের নাই। শফিক ভাইরে কইছিলাম, তহন উনি কইছে উনার সঙ্গে—’
আসমানি ফোঁপাতে থাকে। চোখ থেকে বৃষ্টির মতো জল পড়ছে, সমুদ্র বয়ে যাবে এক্ষুনি। পূর্ণা খুব অবাক হয়। একটা মানুষ কতটা নিকৃষ্ট হলে এভাবে ছোটো ভাইয়ের বউয়ের বিপদে সাহায্য করার নামে এমন কুৎসিত শর্ত রাখতে পারে? পূর্ণার রাগ হয় খুব। আসমানিকে আশ্বাস দিয়ে পূর্ণা বলল, ‘ভাবি, কেঁদো না। যে মানুষ এমন শর্ত দিতে পারে সে কখনোই কাউকে সাহায্য করতে পারে না। উনি তোমার বোনকে খুঁজবে না। কিন্তু আশা দেখিয়ে ভোগ ঠিকই করবে। আর সুযোগ দিয়ো না। দোয়া করো শুধু তোমার বোন যেন ফিরে আসে।’
আসমানি শাড়ির আঁচল দিয়ে দুই চোখ মুছে বলল, ‘জানো পূর্ণা, আমি আমার বইনরে ছাড়া একটা দিনও থাকতে পারতাম না।’
‘তোমার সঙ্গে তো এক মাসে আরো দুইবার দেখা হয়েছে। কখনো তো বললে না তোমার বোনকে পাওয়া যাচ্ছে না।’
‘আম্মা কইছে, ছেড়ি মানুষ হারায়া গেলেও কেউরে কইতে নাই। মানুষ ভাববো ছেড়া নিয়ে পলাইছে।’
‘আমি আসি আজ। কাল এসে সব শুনব। অনেক কথা বলব।’
আসমানি ঘাড় কাত করে সম্মতি জানাল। পূর্ণা ধীর পায়ে আজিদের বাড়ির উঠোন ছাড়ে। পথে উঠতেই দেখা হয় আজিদের মার সঙ্গে। নাম মালেহা বানু। সঙ্গে পাশের বাড়ির বৃদ্ধা জয়তুনি বেগম রয়েছেন। বৃদ্ধার মাজা বয়সের ভারে ঈষৎ ভেঙে শরীর সামনে ঝুঁকে পড়েছে। পূর্ণাকে দেখে মালেহা বললেন, ‘কি রে ছেড়ি, পানি নিতে আইছিলি?’
‘জি, খালা।’
‘কলসির ভারে দেহি সাপের লাহান বাঁইকা গেছস লো!’ বললেন জয়তুনি বেগম।
পূর্ণার সত্যি খুব কষ্ট হচ্ছে। সে কলসি নামাল। প্রাণ ভরে নিশ্বাস নিলো একটা। মালেহা বললেন, ‘বিয়েশাদি কী করবি না? তোর বইনে না আইছে বিয়া দিব?’
‘দিবে মনে হয়।’
‘তোর লগে হাওলাদার বাড়ির কোন ছেড়ার নাকি ঢলাঢলি চলে?’ বললেন জয়তুনি বেগম। কথা বলার ভঙ্গিটা দৃষ্টিকটু ছিল। পূর্ণার গা জ্বলে উঠে। রেগে যায়। বলল, ‘আপনাকে কে বলেছে?
‘এইসব কিচ্ছা বাতাসে ছড়ে। এমন আর করিছ না, পূর্ণা। গায়ের রঙডা ময়লা, বয়সও বেশি; আবার তো আরেক কিচ্ছাও আছে। কয়েক বছর আগে বেইজ্জতি হইছিলি গ্রামবাসীর হাতে। এহন আবার এমন কিচ্ছা কইরা বেড়াইলে কেউ বিয়া করব না। এহন দেখ তোর বইনে কোনো ল্যাংড়া, লুলা দেইখা বিয়া দিতে পারেনি।’ বললেন মালেহা।
পূর্ণার মাথার আগে মুখ চলে বেশি। সে কিছু কড়া কথা শোনাতে উদ্যত হয়। তার পূর্বেই একটা প্রিয় পুরুষ কণ্ঠ ধেয়ে আসে, ‘পূর্ণারে কে বিয়া করব না করব সেটা তো আপনেরে দেখতে কয় নাই কেউ।’
পূর্ণা না তাকিয়েই চিনে যায় কণ্ঠটির মালিককে। বুকের বাঁ পাঁজর ছ্যাঁত করে উঠল। উপস্থিত তিনজন একসঙ্গে ঘুরে তাকাল। কিছুটা দূরে মৃদুল দাঁড়িয়ে আছে। মাথায় গামছা বাঁধা। পরনে কালো শার্ট আর নীল লুঙি। রোদের আলোয় গায়ের ফরসা রঙ চিকচিক করছে। কী সুন্দর! পূর্ণা হেসে আবার চোখ ঘুরিয়ে নিলো। মৃদুল মালেহাকে উদ্দেশ্য করে আবার বলল, নিজের চরকায় তেল দেন। পূর্ণার গায়ের রঙ ময়লা আর আপনের কি পরিষ্কার? নিজের রঙডা আগে দেখেন।’
‘এই ছেড়া তুমি কই থাইকা আইছো? বাপের নাম কিতা?’ বললেন মালেহা।
‘কেন? পছন্দ হইছে? ছেড়ি আছে? বিয়া দিবেন? ছেড়ির গায়ের রং পরিষ্কার তো?
মালেহা বানু হকচকিয়ে গেলেন। এ কেমন জাতের ছেলে! কেমন ফটফট করে! মৃদুল যেন বিরাট রসিকতা করেছে এমনভাবে হাসল পূর্ণা। মৃদুল কলসি কাঁধে তুলে নিয়ে পূর্ণাকে আদেশের স্বরে বলল, ‘হাসি থামায়া হাঁটো।’
মালেহা বানু ও জয়তুনি বেগমকে অবাক করে মৃদুল, পূর্ণা চলে যায়। কিছুটা দূর এসে পূর্ণা প্রথম মুখ খুলল, ‘কখন এসেছেন?’
‘কিছুক্ষণ আগে। মুখটা শুকনা দেখাইতাছে কেন? ‘আপাকে দেখেছেন আপনি?’
‘না। অন্দরমহলে ঢুকি নাই।’
পূর্ণা চুপ হয়ে যায়। মৃদুল বলল, ‘এত ভার কলসি নিতে পারছো?’
‘কষ্ট হয়েছে।’
‘তো নিতে গেলা কেন?’
পূর্ণা আবার চুপ হয়ে গেল। মৃদুল দাঁড়িয়ে পড়ে। আর এক মিনিট হাঁটলেই মোড়ল বাড়ি। সে পূর্ণার মুখের দিকে চোখ রেখে বলল, ‘খুশি হও নাই?’
‘কী জন্য?’ পূর্ণা অবাক হয়ে জানতে চাইল।
‘এই যে আইয়া পড়ছি।’
পূর্ণা চোখ নামিয়ে ফেলে। মুচকি হাসে। চোখেমুখে লজ্জা ফুটে উঠে। মৃদুলও হাসল। সে যা বোঝার বুঝে গেছে। আশপাশে অনেক গাছপালা। বড়ো একটা গাছের ছায়ায় তারা দাঁড়িয়ে আছে। গ্রামের কেউ দেখে ফেলবে এই ভয় দুজনের কারোর মধ্যে নেই। পূর্ণার পরনের কাপড়খানি ভেজা। কলসি থেকে পানি পড়ে ভিজে গেছে। পেট ও কোমরের একাংশে লেপ্টে আছে কাপড়। মাথায় ঘোমটা নেই। গাছের পাতার ফাঁকফোকর দিয়ে এক ঝলক রোদ পূর্ণার মুখ ঘেঁসে কাঁধ ছুঁয়ে মাটিতে পড়ে। সবকিছু মৃদুলের নজরে বন্দি! সে চমৎকার করে পূর্ণাকে বলল, ‘ঘোমটা দিয়ে পথে হাঁটবা। বুঝছো, ডাগরিনী?’
পূর্ণা ঠোঁটে হাসি রেখেই বাধ্যের মতো হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়াল। তারপর চট করে টেনে নিলো ঘোমটা। মৃদুলের মুখের ডাগরিনী শব্দটা তার মন কাঁপিয়ে তুলেছে। খুশিতে উড়তে ইচ্ছে হচ্ছে। ডাগরিনী বলেছে মানে, তার চোখ দুটি ডাগর ডাগর…যা মৃদুলের ভালো লেগেছে! তার প্রশংসা করেছে!
দুপুরের খাওয়াদাওয়া করে পূর্ণা তৈরি হয় হাওলাদার বাড়ি যাওয়ার জন্য। সঙ্গে তৈরি হয় বাসন্তী, প্রেমা ও প্রান্ত। তখন মগা এলো। পূর্ণার হাতে চিঠি দিয়ে বলল, ‘তোমার বইনে দিছে।’
চিঠি হাতে নিয়ে পূর্ণা মনে মনে ভয় পেল। আপা চিঠি কেন পাঠাবে? অজানা আশঙ্কায় পূর্ণার বুক ধুকপুক করতে থাকে। মগা চলে যায়। চিঠি খুলল পূৰ্ণা—
আদরের বোন,
তুই আমাকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসিস, আমি জানি। আমার সব কথাও মানিস। মাঝে মাঝে ফাঁকিবাজিও করিস তবে এখন আমি তোকে যা করতে বলব একদম অমান্য করবি না। এটা আমার অনুরোধ।
যতদিন না আমি আসছি বা চিঠি লিখছি, একদম এই বাড়িতে আসবি না। কেউ যদি বলে আমি পাঠিয়েছি তোকে আনতে। তাও আসবি না। চোখ-কান খোলা রাখবি। প্রেমাকে দেখে রাখবি। আমি ভালো আছি। পায়ে একটু আরাম পেয়েছি। একদম চিন্তা করবি না। আমি খুব দ্রুত আসব। কেন নিষেধ করেছি আসতে, তা নিয়ে মাথা ঘামাস না। আমি একদিন তোকে সব বলব। এখন আমার কথাটা রাখ। এমুখো হস না। আমি ভালো আছি। আবার ভাবিস না আমি কোনো বিপদে আছি। শুনবি কিন্তু আমার কথা। আমার কথা অমান্য করলে আমার সঙ্গ আর পাবি না, মনে রাখবি। খাওয়াদাওয়া করবি ঠিকমতো। নামাজ পড়বি। ঘরের কাজকর্মে হাত লাগাবি।
ইতি
তোর আপা
লেখাগুলো এলোমেলো, অগোছালো। মনে হচ্ছে তাড়াহুড়ো করে লিখেছে অথবা অনেক কষ্টে লিখেছে একেকটা অক্ষর। কপালে ছড়িয়ে থাকা এক গাছি চুল কানে গুঁজে পূর্ণা আবার চিঠিটা পড়ল। পড়ার পর এতটুকু নিশ্চিত হয়েছে যে তার বোন ভালো নেই।
বড়ো বিপদে আছে সে!
৬২
ঘুম ভাঙতেই হকচকিয়ে গেল পদ্মজা। চোখের সামনে সব কালো। কালো রং ব্যাতীত কিছু নেই। ঘোর অন্ধকার। কিছু দেখা যাচ্ছে না। পদ্মজা চোখ কচলে আবার তাকাল। না, কিছুই বদলায়নি! সবকিছু কালো। বিকেলে সে বৈঠকখানার সোফায় শুয়ে শুয়ে বই পড়ছিল। তারপর নিজের অজান্তে ঘুমিয়ে পড়ে। আর ঘুম ভাঙতেই দেখছে সব অন্ধকার! পদ্মজা অন্ধকারে হাতড়ে বেড়ায় দেয়ালের সুইচ। তখন সিঁড়ি ভেঙে নেমে আসে একটা আলো। আলোয় ভেসে উঠে আমিরের মুখ। পদ্মজা দেয়াল থেকে হাত সরিয়ে সেদিকে তাকিয়ে থাকে। আমির পদ্মজার চেয়ে দুই হাত দূরে এসে দাঁড়াল। তার দৃষ্টি আবেগপ্রবণ। পদ্মজার হৃদস্পন্দন থমকে যায়। কাঁচুমাচু হয়ে প্রশ্ন করল, ‘আপনি সব বাতি নিভিয়েছেন?’
আমির জবাব না দিয়ে হাতে থাকা সুন্দর কাচের হারিকেনটি পাশে রাখল। পদ্মজা কিছু বুঝে ওঠার আগে পদ্মজাকে কোলে তুলে নিলো। পদ্মজা আমতা আমতা করে শুধু বলতে পারল, ‘এ…এ… কি…কী?’
আমির তাদের ঘরে নিয়ে আসে পদ্মজাকে। পদ্মজা ঘর দেখে অবাক হয়। ঘরের চারিদিকে অদ্ভুত সুন্দর কাচের ছোটো হারিকেন। আর মাঝে এক ঝুড়ি পদ্মফুল! সময়টা শরৎকাল। দিনের বেলা শরতের সাদা মেঘ নীল আকাশে পাল তোলে, ছবির মতো ঝকঝকে সুন্দর করে তোলে আকাশটাকে। কমে আসে যখন তখন বৃষ্টির জ্বালাতন। সময় বিল ঝিল ছাপিয়ে শাপলা আর পদ্ম ফোঁটার। এত পদ্ম ফুল দেখে মনে হচ্ছে বড়ো এক বিলের সব পদ্ম ফুল তুলে নিয়ে এসেছে আমির। পদ্মজা প্রশ্ন করার পূর্বে আমির পেছন থেকে দুই হাতে পদ্মজার কোমর জড়িয়ে ধরে বলল, মনে আছে প্রথম রাতে বলেছিলাম একদিন পদ্ম ফুল দিয়ে আমার পদ্মাবতীকে সাজাব! সময়টা নিয়ে এসেছি। দেখো তাকিয়ে।’
পদ্মজা ঝুড়ি ভরতি পদ্ম ফুলগুলোর দিকে তাকাল। তার চোখ দুটি জলে ছলছল করে উঠছে। ঘাড় ঘুরিয়ে আমিরের দিকে চেয়ে আবেগমাখা কণ্ঠে বলল, ‘সে কথাটাও মনে রেখেছেন!’
উত্তরে আমির হেসেছিল। প্রথম রাতের চেয়ে কোনো অংশে কম সুন্দর ছিল না সেই রাত। পদ্মজা সেজেছিল পদ্ম ফুল দিয়ে। স্বামী যত্ন করে সাজিয়েছিল। সময়টাকে আরো সুন্দর করে তুলতে প্রকৃতি দিয়েছিল মৃদু শীতল বাতাস।
জানালা দিয়ে প্রবেশ করা বাতাসের দাপটে পদ্মজার ঘুম ছুটে যায়। সে ধড়ফড়িয়ে উঠে বসে। হাত বাড়িয়ে খোঁজে আমিরকে। নেই, বিছানা খালি! আবার সে পুরনো দিনের আরেকটি সুন্দর মুহূর্ত স্বপ্নে দেখেছে।
জলে ভরে উঠে তার চোখ দুটি। আজ পাঁচ দিন আমির নেই, কোনো এক অজানা জায়গায় বন্দি হয়ে আছে। পদ্মজা এক হাতের উলটোপাশ দিয়ে চোখের জল মুছল। বালিশের ওপর থাকা আমিরের শার্টটায় চুমু খেল একবার, আবার ভিজে উঠল তার চোখ দুটি। সেদিন রিদওয়ান, খলিল, মজিদ দ্বারা আহত হওয়ার পর তাকে ওখান থেকে কে নিয়ে এসেছে, সে জানে না। চোখ খুলে ফরিনাকে দেখেছিল। তিনি ডুকরে কাঁদছেন আর চোখের জল মুছছেন। লতিফাকে জিজ্ঞাসা করে পদ্মজা জানতে পারে, সময়টা দুপুর। সারা শরীরে তখন বিষধর ব্যথা। ওঠার শক্তিটুকু নেই। গলায় ব্যথা একটু বেশি ছিল। প্রথমে তার মাথায় আসে আমিরের কথা। রাতের ঘটনা মনে পড়তেই বুঝে যায়, এভাবে সে এদের সঙ্গে পারবে না। তাকে তার মায়ের মতো শান্ত হতে হবে। সময়-সুযোগ বুঝে কাজ করতে হবে। ফরিনা আদর করে খাইয়ে দিলেন। তিনি পদ্মজার ওপর করা নির্মম অত্যাচার আটকাতে পারেননি বলে বারবার ক্ষমাও চেয়েছেন। তিনি নাকি চেষ্টা করেছিলেন। কীরকম চেষ্টা করেছেন সেটা বলেননি। পদ্মজা জিজ্ঞাসাও করেনি। এরপর পদ্মজা কাঁপা হাতে পূর্ণাকে চিঠি লিখে ফরিনার হাতে দেয়। তিনি মগাকে দিয়ে পাঠিয়ে দেন মোড়ল বাড়ি।
পরের দিনগুলো চুপচাপ কাটিয়ে দেয় পদ্মজা। আমিরের শোকে ভেতরে ভেতরে ঝড় বইলেও সামনে সে নিশ্চুপ থেকেছে। সুস্থ হওয়াটা আসল। নয়তো কাজের কাজ কিছুই হবে না। উলটো নর্দমার কীটগুলোর হাতে মরতে হবে। আমিরের জন্য দোয়ায় দুই হাত তুলে অঝোরে কেঁদেছে, আমির যেন ভালো থাকে। তার কাছে ফিরে আসে। খুব মনে পড়ে মানুষটাকে! হাত-পা ছড়িয়ে কাঁদতে ইচ্ছে করে। পদ্মজা আমিরের শার্ট বুকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে উঠল। দরজার সামনে এসে ফরিনা দাঁড়ান। কেউ একজন দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে খেয়াল হতেই পদ্মজা হাতের উলটোপাশ দিয়ে চোখের জল মুছে তাকাল। ফরিনা ঘরের ভেতরে ঢুকলেন, গায়ে সাদা খয়েরি মিশ্রণের শাল। পদ্মজা আমিরের শার্ট বালিশের ওপর রেখে বলল, ‘আছরের আজান পড়েছে, আম্মা?’
মৃদুল অন্দরমহলের সদর দরজায় দাঁড়িয়ে চেঁচাচ্ছে। তাকে মদন কিছুতেই অন্দরমহলে ঢুকতে দিচ্ছে না। চারদিন ধরে সে চেষ্টা করছে অন্দরমহলে ঢোকার। গত তিন দিন ভুঁড়িওয়ালা একজন লোক অন্দরমহল পাহারা দিচ্ছিল, ভেতরে ঢুকতে দিচ্ছিল না। এখন দিচ্ছে না মদন। মাথায় ব্যান্ডেজ নিয়ে সে মৃদুলের সঙ্গে তর্ক করছে। মৃদুল বলছে, ‘দুলাভাই, ঢুকতে দেন কইতাছি। সমস্যাটা কী ঢুকলে? সেটাই তো বুঝতাছি না।’
‘দেহো মৃদুল মিয়া, এইডা আমার কথা না। মজিদ চাচার কথা। উনি কইছে বাড়ির ভেতরে নতুন কেউরে ঢুকতে না দিতে।’
‘আমি তো আত্মীয়, নাকি? আমার সঙ্গে এমন করা হইতাছে কেন? আগে তো ঠিকই ঢুকতে দিত। এহন দেয় না কেন?’
‘হেইডা তো আমি জানি না।’
‘সরেন কইতাছি। নইলে ওই যে গাছের মোড়াডা ওইডা দিয়ে আবার মাথাডা ফাডায়া দিব। একবার মারছে আপাই, এহন আমি মারাম।’
‘হেইডাই করো, তবুও আমি চাচার কথা অমান্য করতে পারতাম না।’
‘আমার কিন্তু কইলাম রাগ উঠতাছে। মাটির তলায় গাইরালামু।’
‘মিয়া ভাই, তুমি আমারে যা ইচ্ছা কইরালাও। আমি—’
মৃদুলের মাথা বরাবরই চড়া! হুট করে খুন করার মতো রাগ চেপে যায় মাথায়। সে মদনের গলা চেপে ধরতেই মদন কাশতে থাকল। আলো কান্না শুরু করে। আলোর কান্না শুনে খলিল ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। সদর দরজার সামনে এমন দৃশ্য দেখে দৌড়ে ছুটে এলো সে। মৃদুলকে ধাক্কা দিয়ে দূরে সরিয়ে হুংকার ছাড়ল, ‘তোমার এত সাহস কেমনে হইছে? আমার জামাইয়ের গলা চাইপা ধরো!’
মৃদুলের নাক লাল হয়ে গেছে রাগে। সে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করে। রাগী মেজাজ নিয়েই দুই হাত দিয়ে চুল ঠিক করতে করতে বলল, ‘আপনার জামাই আমারে ভেতরে ঢুকতে দেয় না।’
তুমি মেহমান মানুষ, আলগ ঘরে থাকবা। এইহানে কী দরকার?’
‘এই নিয়ম কবে করছেন আপনেরা? আগের বার যখন ছিলাম তহন তো ঠিকই ঢুকতে দিছেন ‘
‘এহন আর ঢুহন যাইব না। এইডা অন্দরমহল। বাড়ির বউ-ছেড়িদের জায়গা।
‘সত্যি কইরা কন তো, বাড়ির ভিতর কী চলে?’
খলিলের মেজাজ বিগড়ে যাচ্ছে। ইচ্ছে হচ্ছে, অসভ্য ছেলেটার কানের নিচে কয়টা দিয়ে দিতে। সে কটাক্ষ করে মৃদুলকে বলল, ‘নিজের বাড়ি রাইখা এইহানে পইড়া রইছো কেন? মাইনষের অন্ন নষ্ট করতাছো। নিজের বাড়িত যাও। ‘
অপমানে মৃদুল বাকহীন হয়ে পড়ে! সে ক্ষণকাল কথা বলতে পারল না। তার আপন ফুফা এমন কথা বলল! ক্ষণমুহূর্ত পর সে জ্বলে উঠে বলল, ‘আপনের বাড়ির উপর থুতু মারি। আমি ব্যাঠা মিয়া বংশের ছেড়া। শত বিঘার মালিক আমি একাই। আপনের অন্নের ঠেকা পড়ে নাই আমার। আমার বাড়িত কামলাই আছে দশ-বারো জন। আমি কাইলই চইলা যাইয়াম বাড়িত।’
মৃদুলের আর এক মুহূর্তও এখানে দাঁড়াতে ইচ্ছে করছে না। সে ঘুরে দাঁড়াল। কাছেই একটা বিরাট পাতিল ছিল। কোনো কাজে হয়তো বের করা হয়েছে। সে পাতিলে জোরে লাথি মেরে হনহন করে চলে যায়। পূর্ণা তার বোনের খবর নিয়ে দিতে বলেছে বলেই সে বার বার অন্দরমহলে ঢোকার চেষ্টা করেছে। নয়তো মৃদুলকে কেউ একবার কোনো ব্যপারে না করলে সে দ্বিতীবারের মতো সেখানে ফিরেও তাকায় না।
.
পদ্মজার কথার জবাব দিলেন না ফরিনা। তিনি পদ্মজার পাশে গিয়ে বসলেন। পেছনে রিনু আসে। হাতে খাবারের প্লেট। তিনবেলা ফরিনাই খাইয়ে দিচ্ছেন। যত্ন নিচ্ছেন। মায়ের চেয়ে কোনো অংশে কম করছেন না। তবুও এই মানুষটা কোন কারণে সেদিন তার চিৎকার শুনেও বাঁচাতে যাননি? ফরিনা প্লেট হাতে নিতেই পদ্মজা বলল, ‘আমি এখন মোটামুটি ভালোই আছি, আম্মা। আমি খেয়ে নিতে পারব। হাঁটতেও তো পারি।’
তার এক কথায় খাবারের প্লেট পদ্মজার হাতে তুলে দিলেন ফরিনা। রিনুকে চলে যেতে বললেন। পদ্মজা চুপচাপ খেয়ে নেয়। তার খেতে ইচ্ছে করে না একদমই। কিন্তু সামনের যুদ্ধটার জন্য তার খেতেই হবে। তাকে সুস্থ থাকতে হবে। সুস্থতা ছাড়া যুদ্ধে সফল হওয়া সম্ভব নয়। যতক্ষণ পদ্মজা খেল ততক্ষণ ফরিনা পাশে বসে থাকলেন। খাওয়া শেষ হওয়ার পর পদ্মজা ফরিনাকে বলল, ‘আব্বাকে খুব ভয় পান আম্মা?’
ফরিনা স্বাভাবিকভাবেই জবাব দিলেন, ‘সব বউরাই স্বামীরে ডরায়।’
‘না, আপনি একটু বেশি ভয় পান। যমের মতো।’
‘কবিরাজের দেওয়া ওষুধডি খাও এহন।’
‘আপনি কথা এড়াচ্ছেন, আম্মা। আচ্ছা, ওষুধ দেন আগে।’
ফরিনা আলমারি খুলে ওষুধ বের করলেন। এগিয়ে দিলেন পদ্মজার হাতে। পদ্মজা ওষুধ খেয়ে বলল, ‘কবিরাজ আনার অনুমতি ওরা দিয়েছে ভেবে আমি অবাক হয়েছি আম্মা! ওরা কেন চায়? আমি সুস্থ থাকি?’
ফরিনা কিছু বললেন না। পদ্মজা ফরিনার মুখের দিকে চেয়ে থাকে। মানুষটার আয়ু কী শেষের পথে? কেমন যেন মৃত মৃত ছাপ মুখে। চোখ বুজলে মনে হবে অনেক দিনের উপোষ করে মারা গিয়েছেন। পদ্মজার মায়া হয় মানুষটার জন্য। কোন দুঃখে তিনি ধুঁকে, ধুঁকে মরছেন! পদ্মজা বিছানা থেকে নেমে এসে ফরিনার সামনে দাঁড়াল। বলল, ‘আম্মা, আপনি আমাকে নিজের মেয়ে ভেবে একটা আবদার রাখবেন?
‘তুমি তো আমার ছেড়িই।’
‘তাহলে আবদার রাখবেন?’
‘রাখাম।’ ফরিনার শুষ্ক চোখ। গলা ভেজা।
পদ্মজা বলল, ‘তাহলে আপনার সব গোপন কথা আমাকে বলুন। যা ভেবে ভেবে আপনি কষ্ট পান।’
ফরিনা দুই হাতে পদ্মজার দুই হাত মুঠোয় নিয়ে চুমু খেলেন। এক ফোঁটা চোখের জল পড়ে পদ্মজার হাতে। মমতাময়ী স্পর্শে পদ্মজার শরীরের লোম খাড়া হয়ে যায়। ফরিনা বললেন, ‘তার আগে কও আমি সব কওয়ার পর তোমারে যা করতে কইয়াম তাই করবা তুমি।’
পদ্মজা অপলক নয়নে ফরিনার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে। কী করতে বলবেন তিনি? যদি সে সেটা করতে না পারে! সম্ভব না হয়! পদ্মজা বলল, ‘আপনার চাওয়া যদি যুক্তিগত হয় তো তাই করব, আম্মা।’
ফরিনা চোখের জল মুছে বললেন, ‘আমি বাবুর বাপরে দেইখা আইতাছি। তুমি শুইয়া থাকো।’
কথা শেষ করেই ফরিনা দ্রুত পায়ে বেরিয়ে যান। পদ্মজার মাঝে উত্তেজনা কাজ করছে। সে জানে না সে কী শুনতে চলেছে তবে সেটা কোনো সাধারণ ঘটনা বা কথা হবে না—এটা নিশ্চিত। সে ঘরে পায়চারি করতে করতে জানালার ধারে আসে। দেখতে পায় রিদওয়ানকে। হাতে একটা পলিথিন নিয়ে জঙ্গল থেকে বেরিয়ে আসছে। এই জঙ্গলের মাঝেই তো আছে তালাবন্ধ রহস্যজাল; যার চাবি তার কাছে আছে। আলমগীরের দেয়া চাবিটাকে পদ্মজার কোনো তালাবন্ধ রহস্যজালের চাবি মনে হয়! রিদওয়ান গত দিনগুলোতে তিন-চার বার তাকে দেখতে এসেছে। কিন্তু কিছু বলেনি। রিদওয়ানের মতিগতি বোঝা যায় না। অদ্ভুত সে। রিদওয়ানকে দেখলে পদ্মজার শরীর রাগে কাঁপে।
বেশ কিছুক্ষণ পর পায়ের শব্দ আসে কানে। শব্দটা শুনে মনে হচ্ছে পুরুষের পায়ের শব্দ। পদ্মজা দ্রুত এসে বিছানার এক কোণে বসে, যে কোণে ছুরি রাখা আছে। ঘরে প্রবেশ করে রিদওয়ান। পদ্মজাকে দেখেই লম্বা করে হেসে বলল, ‘তারপর বলো, কেমন আছো?’ পদ্মজার থেকে জবাব না পেয়ে রিদওয়ান আবার প্রশ্ন করল, ‘সুস্থ আছো তো?’
পদ্মজা সাড়া দিল না। রিদওয়ান চেয়ার টেনে বসল। বলল, ‘তোমাকে এত চুপচাপ দেখে অবাক হচ্ছি। কী পরিকল্পনা করছো বলো তো?’
পদ্মজা তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিয়ে তাকাল। বলল, ‘কাপুরুষ বোধহয় আপনার মতো মানুষকেই বলা হয়।’
রিদওয়ানের ঠোঁটের হাসি মিলিয়ে যায়। চোয়াল শক্ত হয়ে আসে। তারপর হুট করেই হেসে দিল। বলল, ‘কাপুরুষের কী করেছি?’
স্বামীর অবর্তমানে তার স্ত্রীর গায়ে হাত তুলেছেন। আবার সেই স্ত্রী অসুস্থ ছিল। এমন তো কাপুরুষরাই করে।’
‘এত কথা না বলে চুপচাপ যা বলি শুনো। আমির আমাদের ব্যপারে অনেক নাক গলিয়েছে। অনেক সমস্যা করেছে। তবুও আমরা আমিরকে এক শর্তে ফিরিয়ে দেব। যদি তুমি সেই শর্ত মানো।’
‘কী শর্ত?’
‘তুমি আমিরকে নিয়ে ঢাকা চলে যাবে। কখনো অলন্দপুরে ফিরবে না।’
‘যদি না মানি?’
‘অবুঝের মতো প্রশ্ন করতে বলিনি। শর্ত দিয়েছি, মানা না মানা তোমার ব্যপার।’
‘আপনারা আমাকে ভয় পাচ্ছেন কেন?’
রিদওয়ান হাসল।
পদ্মজা বলল, ‘সেদিন মেরে আধমরা করেছেন। এবার একদম মেরে দিন। তাহলেই আপনাদের সমস্যা শেষ। বেহুদা, আমাদের মুক্তি দিয়ে ভেজাল কেন বাড়াচ্ছেন? ঢাকা ফিরে গিয়ে পুলিশ নিয়েও তো আসতে পারি।’
রিদওয়ান বিরক্তিতে ‘চ’ সূচক উচ্চারণ করল। বলল, ‘তোমাকে মারা যাবে না।’
‘আমাকে দিয়ে আপনাদের কী কাজ হবে যে মারা যাবে না?’
‘এত প্রশ্ন কেন করছো?’
‘মনে আসছে তাই।’
রিদওয়ান রাগে উত্তেজিত হয়ে পড়ছে, ‘তুমি শর্তে রাজি নাকি না?’
‘আগে বলুন, কার কাজে আমি লাগব? কার খাতিরে আমাকে মারা যাবে না?’
তুমি শর্তে রাজি নাকি সেটা বলো। এই যে আমার পাঞ্জাবিতে তাজা লাল দাগটা দেখছো, এটা কিন্তু রক্তের। আর রক্তটা আমিরের।’
পদ্মজার চোখ দুটি জ্বলে উঠে। এমনিতেই এই হিংস্র মানুষটার হাসি, কথা তার গা জ্বালিয়ে দিচ্ছে। তার উপর তার স্বামীর রক্ত দেখাচ্ছে! পদ্মজা উঁচু গলায় প্রশ্ন করল, ‘উনাকে জঙ্গলেই রেখেছেন তাই না?’
‘শর্তে রাজি তুমি?’
‘না।’
‘তোমাকে তো আমি—’
রিদওয়ান রেগে তেড়ে আসে। পদ্মজা পাশের টেবিল থেকে ওষুধের কাচের বোতলটা নিয়ে আঘাত করে রিদওয়ানের মাথায়। আকস্মিক আক্রমণে বিছানায় পড়ে গেল রিদওয়ান। পদ্মজাও দ্রুততার সঙ্গে ছুরি তুলে নিলো হাতে। রিদওয়ান বিছানায় পড়ার দুই সেকেন্ডের মধ্যে তার পিঠে আঘাত করল ছুরি দিয়ে। আহত রিদওয়ান আর্তনাদ করে উঠল। পাঞ্জাবি ছিঁড়ে ছুরির আঘাত শরীরের মাংস পর্যন্ত চলে গিয়েছে। সুযোগ পদ্মজার হাতের মুঠোয়। সে এই সুযোগ হারাবে না। এতদিন সে এদের মানুষ ভেবে এসেছে। কিন্তু এরা মানুষরূপী শয়তান। আর শয়তানকে বুঝেশুনে নয়, ইচ্ছামতো আঘাত করা উচিত।
পদ্মজা দ্রুত কাঠের চেয়ারটা তুলে নিলো হাতে, শরীরের সব শক্তি দিয়ে আঘাত করল রিদওয়ানের মাথায়। রিদওয়ানের কানের পাশ দিয়ে নামল রক্তের ধারা, নিস্তেজ হয়ে পড়ল শরীরটা। পদ্মজা হিংস্র বাঘিনীর মতো হাঁপাতে থাকে। মিনিট দুয়েক পর শাড়ির আঁচল মেঝে থেকে তুলে বুকে জড়িয়ে নিলো, হুট করেই যেন শান্ত সমুদ্র গর্জন তুলে লণ্ডভণ্ড করে দিয়েছে চারপাশ।
৬৩
ফরিনা পদ্মজার ঘরে প্রবেশ করে ঘাবড়ে গেলেন। বিছানায় রক্তাক্ত দীর্ঘদেহী একজন পুরুষ সংজ্ঞাহারা হয়ে পড়ে আছে। নাকি মরে গেছে? ফরিনা শিউরে ওঠেন। পদ্মজা ফরিনাকে এক নজর দেখে জগ থেকে গ্লাসে জল নিয়ে ঢকঢক করে পান করল। ফরিনার মনে হচ্ছে বিছানায় পড়ে থাকা রক্তাক্ত পুরুষ মানুষটি রিদওয়ান! যখন শতভাগ নিশ্চিত হলেন এটা রিদওয়ানই, তখন মনে তীব্র একটা ভয় জেঁকে বসল। তিনি নিশ্বাস আটকে পদ্মজার কাছে ছুটে গিয়ে চাপা স্বরে প্রশ্ন করলেন, ‘রিদু কী মইরা গেছে?’
পদ্মজা তাৎক্ষণিক জবাব দিতে পারলো না। সময় নিয়ে ধীরেসুস্থে বলল, ‘মরেনি বোধহয়। তবে বেশিক্ষণ এভাবে থাকলে মরে যাবে।’
পদ্মজার তরঙ্গহীন গলার স্বর ফরিনার ভয়ের মাত্রা বাড়িয়ে দিল। তিনি পদ্মজাকে আচমকা বুকের সঙ্গে জড়িয়ে ধরলেন। থতমত খেয়ে গেল পদ্মজা। ফরিনার হৃৎপিণ্ডের কাঁপুনি টের পেল সে। ফরিনা অস্থির হয়ে বললেন, ‘ও মা—’
পদ্মজা ফরিনার বুক থেকে মাথা তুলে বলল, ‘কী হয়েছে, আম্মা?’
ফরিনার চোখের দৃষ্টি অস্থির। তিনি ঢোক গিলে বললেন, ‘তুমি পলাইয়া যাও। আর আইবা না। রুম্পার মতো চইলা যাও।’
‘আম্মা, ওরা আমাকে মারবে না। রিদওয়ান ভাইয়াই বলেছে।’
‘মিছা কথা… মিছা কথা কইছে।’
‘আম্মা, আপনি এমন করছেন কেন?’
ফরিনা দ্রুত সংজ্ঞাহীন রিদওয়ানকে চাদর দিয়ে ঢেকে দিলেন। তারপর বললেন, ‘তুমি পলায়া যাও। তোমার আব্বা, ওই শকুনের বাইচ্ছা আমার নিষ্পাপ কলিজার টুকরা বাবুরে মাইরা ফেলছে কিন্তু…’
জুতার ছপছপ আওয়াজ শুনে ফরিনা থমকে যান। এরকম আওয়াজ মজিদের জুতোয় হয়। মনে হয় জুতায় পানি নিয়ে হাঁটছে। তিনি আতঙ্কে চোখ দুটি বড়ো বড়ো করে তাকালেন। মজিদ তো ঘরে ছিলেন না! কখন চলে এলেন? আর যতক্ষণ মজিদ ঘরে থাকেন, ততক্ষণ ফরিনাকেও ঘরে থাকতে হয়। তিনি পুরোপুরি নিশ্চিত মজিদ এখন পদ্মজার ঘরে আসবেন। রিদওয়ানকে দেখে ফেলবেন! তিনি পদ্মজার আলমারি খুলে তালা-চাবি বের করলেন। একটা ঝড় থামতেই যেন আরেকটা ঝড় শুরু হয়েছে। পদ্মজা ফরিনাকে উদ্বিগ্ন হয়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘আম্মা, কিন্তু কী? বাবু মানে উনাকে মেরে ফেলেছে মানে? আপনি কীভাবে জানেন? আম্মা…’
ফরিনা নিজের এক হাতে পদ্মজার এক হাত শক্ত করে চেপে ধরলেন। তারপর দৌড়ে বেরোলেন ঘর থেকে। বারান্দায় পা রাখতেই মজিদের সঙ্গে দেখা। ফরিনা মজিদের উপস্থিতি অগ্রাহ্য করে পদ্মজাকে টেনে নিয়ে গেলেন তিন তলায়। মজিদ হতভম্ব হয়ে দেখলেন ঘটনাটা। পদ্মজা বার বার জিজ্ঞাসা করছে ফরিনাকে, ‘আম্মা, আপনি এটা কী বললেন! আমার বুক কাঁপছে। আম্মা, কোথায় যাচ্ছেন?’
মজিদ পদ্মজার ঘরে উঁকি দিলেন। তার চোখের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ। বিছানার ওপর রিদওয়ানকে দেখতে না পেলেও রিদওয়ানের পাজোড়া চোখে পড়ে গেল। হন্তদন্ত হয়ে ঘরে ঢুকলেন তিনি, আঁতকে উঠলেন চাদর সরিয়ে রিদওয়ানকে দেখে। এদিকে, ফরিনা পদ্মজাকে ঠেলে একটা ঘরে ঢুকিয়ে দিয়েছেন, ঘরের দরজাটি লোহার। পদ্মজা ধাক্কা খেয়ে ঘরের মধ্যিখানে পড়ে। সে মেঝে থেকে উঠতে উঠতে ফরিনা বাইরে থেকে দরজায় তালা লাগিয়ে দিলেন। পদ্মজা আচমকার ঘটনায় হতবুদ্ধি হয়ে পড়েছে। তার মাথায় বার বার বাজছে, ‘তোমার আব্বা, ওই শকুনের বাইচ্ছা আমার নিষ্পাপ কইলজার টুকরা বাবুরে মাইরা ফেলছে!
পদ্মজা দুই হাতে মুখ চেপে ধরে। মনে হচ্ছে তার দম বন্ধ হয়ে আসছে। এখনই মারা যাবে। বুকে রক্তক্ষরণ হচ্ছে। ফরিনা বলেছিলেন, সম্পত্তির জন্য হলেও আমিরকে ওরা জানে মারবে না! এজন্যই পদ্মজা ধৈর্য ধরে পাঁচটি দিন কাটাতে পেরেছে। ভেবেছিল, শরীরে একটু শক্তি জমিয়ে তারপর সে তার স্বামীকে খুঁজে বের করবে। কিন্তু একটু আগে ফরিনা যা বললেন তাতে পদ্মজার কলিজা ফেটে যাচ্ছে। রিদওয়ান শর্ত দিয়েছিল, পদ্মজা ঢাকা চলে গেলে আমিরকে ছেড়ে দিবে। পদ্মজা তাই মানত। শুধু না করে আরেকটু কথা বের করতে চেয়েছিল। তার আগেই রিদওয়ান আক্রমণ করতে উদ্যত হয়। আর পদ্মজাও আঘাত করে বসে। পাঁচ দিনের সব ধৈর্য, পরিকল্পনা ওলটপালট হয়ে গেল ফরিনার এক কথায়। পদ্মজা দরজায় থাপ্পড় দিয়ে ডাকল, ‘আম্মা…আম্মা কেন আটকালেন আমাকে? দরজা খুলুন। আম্মা আপনার ছেলের কী হয়েছে? কী বললেন? আম্মা…’
ফরিনা হাতের চাবিটা দূরে ছুঁড়ে ফেললেন। সিঁড়িতে শব্দ হচ্ছে দপদপ! তিনি নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে দেখেন, অস্বাভাবিকভাবে হাত কাঁপছে। কাঁপছে পা। মজিদ, খলিল একসঙ্গে উঠে এসে ফরিনার সামনে এসে দাঁড়াল। ফরিনা ভয়ে জমে গেছেন। মজিদের চেহারা ক্ষুদ্ধ। তিনি রাগে গজগজ করতে করতে প্রশ্ন করলেন, রিদওয়ানকে পদ্মজা আঘাত করেছে?’
ফরিনা কিছু বললেন না। মজিদের গলার স্বর শুনে পদ্মজা চুপ হয়ে যায়। ফরিনা এলোমেলো দৃষ্টি নিয়ে কাঁপছেন। খলিল বলল, ‘ভাবিরে জিগাও কেন? ওই ছেড়ি ছাড়া আর কার এত সাহস আছে? ওই ছেড়ি এই ঘরের ভিতরে?’
ফরিনা দরজার সঙ্গে লেপটে দাঁড়িয়ে আছেন। খলিলের প্রশ্ন শুনে আরো শক্ত হয়ে দাঁড়ালেন। মজিদ ফরিনাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেখেন, দরজায় তালা! তখনই পদ্মজা দরজায় থাপ্পড় দিয়ে ডাকল, ‘আম্মা…আম্মা দরজা খুলুন। কী হচ্ছে ওখানে?’
মজিদের ক্ষুদ্ধ চেহারা আরো ভয়ংকর হয়ে উঠে। তিনি ফরিনার কাছে চাবি চাইলেন, ‘চাবি দাও। কী বলছি, কানে যায় না? চাবি দাও।’
ফরিনা আমতা আমতা করে বললেন, ‘ন…না-ই।’
মজিদ ফরিনার মুখ চেপে ধরে চাপা স্বরে বললেন, ‘চাবি দাও।’
ফরিনা তাও বললেন, চাবি নেই। মজিদ আরো একবার বললেন, ‘চাবি দাও বলছি। শাড়ির কোন ভাঁজে লুকিয়ে রেখেছো?’
‘চাবি নাই। চাবি নাই আমার কাছে।’ গলা উঁচিয়ে বললেন ফরিনা।
খলিল দরজায় জোরে কয়টা লাথি মারল, চেষ্টা করলেন তালা ভাঙার। দুপদাপ শব্দ হচ্ছে! সেই সঙ্গে পদ্মজাকে উদ্দেশ্য করে নোংরা গালি। খলিলের মুখের ভাষা শুনে পদ্মজার কান ঝাঁ ঝাঁ করে উঠল। চোখ-মুখ কুঁচকে গেল ঘৃণায়। ফরিনার উঁচুবাক্য শুনে মজিদ হাওলাদার রাগে কাঁপতে থাকলেন। ফরিনার এত সাহস কবে হলো! তিনি ফরিনার শরীর হাতড়ে চাবি খুঁজতে খুঁজতে বললেন, ‘চাবি কোথায় রাখছো? জলদি বলো। নয়তো এরপর যা হবে ভালো হবে না।’
ফরিনার শরীর কাঁপছে ভয়ে। তিনি জানেন, এই মুহূর্তে তিনি খুন হয়ে যেতেও পারেন। তবুও চাবি দিবেন না। নয়তো ওরা পদ্মজাকে খুন করে ফেলবে। ওরা পারে না এমন কিছু নেই! মজিদের নিকৃষ্ট অনেক কাজের সাক্ষী তিনি। এই মানুষটা তার জীবনের নরক। মজিদ রাগে হুঁশজ্ঞান হারিয়ে ফেললেন। ফরিনা কিছুতেই কথা মানছে না বলে, ছোটো ভাইয়ের সামনে ফরিনার শাড়ি টেনে খুলে ফেললেন তিনি। বললেন, ‘চাবি কোন চিপায় রাখছো? বলো, নয়তো মেরে পুঁতে ফেলব।’
ফরিনা টু শব্দও করলেন না। খলিলের সামনে যুবতীকালে তাকে বিবস্ত্ৰ করেও মজিদ মেরেছে! সম্মান-ইজ্জত কবেই হারিয়ে গেছে। নতুন করে হারানোর কিছু নেই। বয়সও অনেক হয়েছে! তবে এদের শিকার পদ্মজাকে হতে দিবেন না কিছুতেই। মজিদ কোনোভাবেই ফরিনার কাছ থেকে চাবি উদ্ধার করতে পারেননি। এদিকে রিদওয়ানের অবস্থা খারাপের দিকে। খলিল দ্রুত নিচে চলে গেল। মজিদ ফরিনাকে মেঝেতে ফেলে ইচ্ছেমত লাথি, থাপ্পড় দিলেন; সঙ্গে বিশ্রি গালিগালাজ। চারপাশ ফরিনার কান্নায় ভারি হয়ে ওঠে। ফরিনার কান্নার স্বর পদ্মজার কানে আসতেই সে চিৎকার করে বলল, ‘আব্বা, আম্মাকে মারবেন না। আব্বা…দোহাই লাগে। আম্মা লাশের মতো হয়ে গেছে। আব্বা, আম্মাকে মারবেন না। আমাকে মারেন, আব্বা। আম্মা, আপনি দরজা খুলুন। আম্মাকে এভাবে কেন মারছেন, আব্বা? আপনি তো অলন্দপুরের ফেরেশতা ছিলেন, আব্বা। আপনার এমন রূপ কেন? আম্মা, দরজা খুলুন। আব্বা, আম্মা খুব কষ্ট পাচ্ছে। অনুরোধ করছি, আর মারবেন না।’
বাইরে ফরিনার কান্না, ঘরের ভেতর পদ্মজার কান্না। আর দরজায় এলোপাথাড়ি থাপ্পড়ের আওয়াজ। সব মিলিয়ে চারপাশ যেন চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যাচ্ছে। খলিলের ডাক শুনে মজিদ চলে গেলেন। কিন্তু যাওয়ার পূর্বে ফরিনার পেটে বড়ো একটা লাথি বসিয়ে দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে ফরিনার মুখ দিয়ে বমি বেরিয়ে আসে। মজিদ চলে যাওয়ার মিনিট দুয়েক পর দৌড়ে আসে লতিফা। সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময় সে দুইবার হোঁচট খেল। ফরিনার মাথা নিজের কোলে নিয়ে কেঁদে বলল, ‘খালাম্মা, আপনি কেন খালুর বিরুদ্ধে গেলেন। ও খালাম্মা কথা কন। খালাম্মা?’
লতিফার ব্যকুল কণ্ঠস্বর শুনে পদ্মজা আরো জোরে থাপ্পড় দিল দরজায়। বলল, ‘লুতু বুবু আম্মার কী হয়েছে? লুতু বুবু দরজা খুলো। ও লুতু বুবু।’
ফরিনা অস্পষ্ট স্বরে লতিফাকে বললেন, ‘তোর খালু চইলা গেছে?’
‘হ, গেছে।’
‘বাড়ি থেইকা বাইর হইছে?’ ফরিনার কণ্ঠ নিভে আসছে।
লতিফা ফরিনার মাথাটা সাবধানে মেঝেতে রেখে বারান্দা থেকে বাইরে উঁকি দিল। মজিদ, খলিল, মদন আর বাড়ির দারোয়ান মিলে গরু গাড়ি দিয়ে রিদওয়ানকে নিয়ে যাচ্ছে। গেটের কাছাকাছি চলে গেছে। সে ফরিনাকে এসে বলল, ‘বাইর হইয়া গেছে, খালাম্মা।’
পদ্মজা দরজায় এলোপাথাড়ি থাপ্পড় দিচ্ছে। বিকট শব্দ হচ্ছে! ফরিনা আঙুলের ইশারায় ডান দিকটা দেখিয়ে বললেন, ‘ওইহানে খুঁইজা দেখ, চাবি পাবি একটা। দরজাডা খুইলা দে।’
লতিফা ফরিনার কথামতো চাবি খুঁজল। পেয়েও গেল। তারপর দরজা খুলতেই হুড়মুড়িয়ে বেরোল পদ্মজা। ফরিনাকে দেখে তার হাত পা ঠান্ডা হয়ে এলো। গায়ে শাড়ি নেই। পেটিকোট হাঁটু অবধি তোলা। মিষ্টি রঙের ব্লাউজে রক্তের দাগ। নাক দিয়ে রক্ত ঝরছে। ফুলে গেছে দুই চোখ। হাতে-পায়ে জখম। বয়স্ক মানুষটাকেও ওরা ছাড়েনি! পদ্মজা হাঁটুগেড়ে বসে ফরিনাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদল, ‘আম্মা, আপনি কেন চাবিটা দিলেন না? এরা মানুষ? নিজের বউকে কেউ এভাবে মারে? লুতু বুবু, আম্মাকে ধরো।’
লতিফা ফুঁপিয়ে কাঁদছে। সে কাঁদতে কাঁদতে বলল, ‘পদ্মজা, তুমি কিছু জানো না। খালু এমনেই মারে।’
‘ধরো আম্মাকে।’
লতিফা আর পদ্মজা মিলে ফরিনাকে ধরে ধরে তিন তলার আরেকটি ঘরে নিয়ে এলো, যে ঘরটিতে প্রথম রুম্পা ছিল; তারপর রানি। নিচতলায় নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। ফরিনা মেঝেতে পা সোজা করে ফেলতে পারছেন না। চোখ দুটি বার বার খুঁজে যাচ্ছে। একটা অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে পদ্মজার যেমনটা তার মায়ের মৃত্যুর আগে হয়েছিল। পদ্মজার গা কেঁপে উঠে। চোখ ছাপিয়ে নামে জল। মনে মনে কেঁদে বলল: আল্লাহ! কেন আমার সঙ্গে এমন হচ্ছে! কীসের পরীক্ষা নিচ্ছো তুমি? আমার চারপাশ এত নির্মম কেন? কোথায় আছো আম্মা? কোথায় আছেন, পারিজার আব্বু? আমি ভীষণ একা। ভীষণ।
পদ্মজার হেঁচকি উঠে গেল। সে ঢোক গিলে নিজেকে সামলায়। ফরিনার যত্ন নিতে হবে। ফরিনাকে বিছানায় শুইয়ে দিতেই তিনি থেমে থেমে বললেন, ‘আমার কই মাছের জান। আমি মরতাম না। তুমি, তুমি পলায়া যাও।
‘আম্মা, আমি আপনাকে ছেড়ে কোথাও যাব না। লুতু বুবু, হালকা গরম পানি নিয়ে আসো। আমার ঘরের আলমারির ডান পাশের ড্রয়ার থেকে স্যাভলন আর তুলাও এনো।’
পদ্মজার আদেশ পাওয়া মাত্র লতিফা বেরিয়ে গেল। ফরিনা করুণ চোখে পদ্মজার দিকে চেয়ে বললেন, ‘কান্দো কেরে? কাইন্দো না।’
পদ্মজার সুন্দর দুটি চোখে জলের পুকুর। বিরতিহীনভাবে পানি গড়িয়ে পড়ছে গলায়, বুকে। সে ফরিনার এক হাতে কপাল ঠেকিয়ে ব্যর্থ কণ্ঠে বলল, ‘আম্মা, আমি কী করব? যখনই ভাবি এবার সব ঠিক হয়ে যাবে। তখনই ভয়ংকর সব ঘটনার সম্মুখীন হতে হয়। আমি আর পারছি না। এত খারাপ পরিবেশ আমি আর নিতে পারছি না আম্মা। নিজেকে কিছুক্ষণ আগেও শক্তিশালী মনে হয়েছে। মনে হয়েছে, আমি চাইলে সব পারব। কিন্তু এখন খুব দুর্বল মনে হচ্ছে। আমি ওদের বিরুদ্ধে পেরে উঠছি না। আপনি ভালো হয়ে উঠুন। আপনার ছেলে কি সত্যি— ‘
পদ্মজা তাকিয়ে দেখল, ফরিনার চোখ বন্ধ অবস্থায়। ছ্যাঁত করে উঠল বুকটা। সে ফরিনার নাকের কাছে হাত নিয়ে পরীক্ষা করল, নিশ্বাস নিচ্ছেন নাকি। নিচ্ছেন! সেই সময় লতিফা স্যাভলন, তুলা আর হালকা গরম পানি নিয়ে ঘরে প্রবেশ করল।
ফরিনা ঘুমাচ্ছেন। কথা বলার অবস্থায় নেই। পদ্মজার পায়ে ঘা হয়েছে। পাঁচদিনে কি ছেঁড়াকাঁটা ভালো হয়? শীতের কারণে উলটো আরো কষ্ট বাড়ে। পায়ের অবস্থা যা তা! তাতে অবশ্য যায় আসে না পদ্মজার। সে অস্থির হয়ে আছে। বুকে এক ফোঁটাও শান্তি নেই। রিদওয়ান দুপুরে জঙ্গল থেকে ফিরেছিল। পদ্মজার ধারণা আমির জঙ্গলের কোথাও বন্দি আছে। অথবা লাশটা হলেও আছে! ভাবনাটা পদ্মজার মাথায় আসতেই সে দ্রুত মাথা চেপে ধরে বিড়বিড় করে, ‘না! আমি কী ভাবছি! কিছু হয়নি। কারো কিছু হয়নি। সবাই ভালো আছে।’
লতিফার দায়িত্বে ফরিনাকে রেখে নিচতলায় নেমে এলো সে। সঙ্গে ছুরি, রাম-দা নিয়েছে। আজ খোঁপা করেনি, বেণী করেছে। বাড়িতে কোনো পুরুষ নেই। সব হাসপাতালে। ওরা ফিরলে সে আর আস্তো থাকবে না। তার আগেই আমিরকে বের করতে হবে। সেই সঙ্গে লুকোনো গুপ্ত রহস্য। সদর ঘরে আমিনা ছিলেন। তিনি আলোকে খিচুরি খাওয়াচ্ছেন। নির্বিকার ভঙ্গি! কোনো তাড়া নেই, চিন্তা নেই! রিদওয়ানের অবস্থা কী দেখেনি? এই মানুষটা শুধু রানির জন্যই কাঁদেন। আর কারোর জন্য না! কিন্তু কেন? পরিবারের সবার সঙ্গে দূরত্ব বজায় রাখেন। কথা বললেও তাতে মিশে থাকে অহংকার আর বিদ্রুপ।
পদ্মজা বেরিয়ে পড়ল, সন্ধ্যার নামাজ পড়েই বেরিয়েছে। আজ জঙ্গলে মরবে…নয়তো আগামীকাল এই বাড়ির পুরুষগুলোর হাতে! সে মনে মনে মৃত্যু মেনে নিয়েছে। ধীর পায়ে হেঁটে ঢুকল জঙ্গলে। বোনদের কথা খুব মনে পড়ছে। সে মারা গেলে, ওদের কী হবে? খুব কী কাঁদবে? কাঁদতে কাঁদতে জ্বর উঠে যাবে! পূর্ণার তো খুব কান্নার পর জ্বর হয়। প্রেমা নিজেকে সামলাতে পারবে।
এসব ভাবতে ভাবতে একসময় পদ্মজা মানুষের উপস্থিতি টের পেল। ফিসফিসিয়ে কাছেই কথা বলছে কেউ। পদ্মজা এখনও ভালো করে জঙ্গলের গভীরে প্রবেশ করেনি। হিজল গাছের আড়ালে লুকিয়ে পড়ল সে। আস্তে আস্তে দুটি মানুষ চোখের পর্দায় ভেসে উঠে। তারা জঙ্গলের পশ্চিম দিক থেকে এসেছে। অস্পষ্ট তাদের মুখ। জঙ্গল থেকে বেরিয়ে অন্দরমহলের পেছনে গিয়ে দাঁড়াল তারা। একটা মুখ চিনতে পারে পদ্মজা। মৃদুল! মৃদুলের হাতে টর্চ। সেই টর্চের আলোতে পাশের জনের হাত ভেসে উঠে। এক হাতে লাল তাজা রক্ত, অন্য হাতে রাম-দা। শিউরে উঠল পদ্মজা, ঘামছে অনবরত। উত্তেজনায় তার হৃৎপিণ্ড ফেটে যাওয়ার উপক্রম। গলা শুকিয়ে কাঠ। মৃদুল কিছু একটা বলল, উত্তরে অচেনা লোকটাও বলল একটা কিছু। ঝাপসা আলোয় মৃদুলের সঙ্গের লোকটার দেহ আর চুল স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে: লম্বা শরীর, মাথায় ঝাঁকড়া চুল।
চারপাশটা যেন স্থির হয়ে গেল। পদ্মজার শরীর বেয়ে মুহূর্তে ছুটে গেল শীতল কিছু একটা…
…বিস্ময়ের ঘোর ও কিছুতেই কাটাতে পারছে না।
৬৪
চন্দ্র-তারকাহীন ম্লান আকাশের কারণে চারপাশ অদ্ভুত ভয়ংকর হয়ে আছে। পদ্মজার মুখ ঘেঁষে একটা পাতা মাটিতে পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে ভয় পেয়ে পিছিয়ে গেল দুই পা। যখন ব্যাপারটা বুঝতে পারল, তখন নিজের ভয় পাওয়া দেখে নিজের ওপরই বিরক্ত হলো খুব। দুই পা এগিয়ে এসে অন্দরমহলের দিকে তাকাল আবার। আধো অন্ধকারে আবিষ্কার করল, মৃদুল এবং আগন্তুক নেই! চোখের পলকে মুহূর্তেই ভোজবাজির মতো অদৃশ্য হয়ে গেছে! সাবধান হয়ে উঠল পদ্মজার মস্তিষ্ক। মৃদুলের মধ্যে ঘাপলা আছে—ভাবতেই ইচ্ছে করছে না। কিন্তু এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে সে সবকিছু ভাবতে পারে। সবকিছু!
পরিকল্পিত পথ ধরে হাঁটা শুরু করল পদ্মজা। মনে মনে প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে: মৃদুল জঙ্গলের ভেতরে ঢোকেনি তো? আর দীর্ঘদেহী, ঝাঁকড়া চুলের আগন্তুকও কি সঙ্গে রয়েছে? পদ্মজা এক হাতে ছুরি নিলো, অন্য হাতে রাম- দা। তার চোখের দৃষ্টি প্রখর। চারপাশে চোখ বুলিয়ে সাবধানে এক-পা এক- পা করে এগোচ্ছে। নিশ্বাস যেন আটকে আছে। এই বুঝি কেউ আক্রমণ করে বসল! সেদিন যতটুকু এসেছিল সে, ঠাওর করে করে নিরাপদভাবে ঠিক ততটুকুই চলে আসে। সামনে বড়ো বড়ো গাছপালা ডালপালা মেলে দাঁড়িয়ে আছে। ভূতুড়ে পরিবেশ। পদ্মজা কেন জানি নিশ্চিত, আজও কেউ থাকবে এখানে, অজানা রহস্যজাল পাহারা দেয়ার জন্য। আর আশপাশেই আছে সেই গুপ্ত রহস্যজাল। পদ্মজার শিরায়, শিরায় প্রবল উত্তেজনা বয়ে গেল। কয়েকটা গাছ পেরিয়ে থমকে দাঁড়াল সে। একটা শব্দ ভেসে আসছে কানে। পদ্মজা দুরু দুরু বুকে শব্দের উৎসের দিকে তাকাল। কিছুটা দূরে একজন লোক উবু হয়ে বসে আছে, সম্ভবত প্রস্রাব করছে। পদ্মজা প্রস্তুত হয় লোকটিকে পেছন থেকে আক্রমণ করার জন্য। কিন্তু জানে না কেন, কেঁপে উঠল তার হাত। সে কাউকে প্রাণে মারতে পারবে না, সেই সাহস হচ্ছে না। একটা খুন করেছে ভাবলেই তার গাঁ কেঁপে ওঠে। সেদিনের খুনটা তার নিজের অজান্তেই হয়ে গিয়েছে। সে যেন ছিল অন্য এক পদ্মজা। সেই পদ্মজাকে সে নিজেও চিনত না।
আচমকা উঠে দাঁড়াল লোকটা। পদ্মজাও দ্রুত একটা গাছের আড়ালে লুকিয়ে পড়ে। আড়াল থেকে উঁকি দিয়ে—রুদ্ধশ্বাসে তাকিয়ে থাকে লোকটির দিকে। লোকটির মুখ অস্পষ্ট। অবয়ব শুধু স্পষ্ট। দুলকি চালে এদিকেই এগিয়ে আসছে। পরনে লুঙ্গি ও সোয়েটার পরা। মাথায় টুপিও রয়েছে। লোকটার হাঁটা দেখে মনে হচ্ছে না, সে টের পেয়েছে অন্য কারো উপস্থিতি। তবুও পদ্মজার নিশ্বাস আটকে যায়। সে রাম-দা শক্ত করে ধরল। লোকটি তার কাছে আসতেই সে শরীরের সবটুকু জোর দিয়ে মাথায় আঘাত করে। লোহার রাম-দার এক পাশের আঘাতে লোকটি লুটিয়ে পড়ল মাটিতে। গোঙানির শব্দ করে, হাত পা ধাপড়াতে থাকল। সেকেন্ড কয়েক পরই দেহটি নিস্তেজ হয়ে গেল। পদ্মজার বুক ফুঁড়ে বেরিয়ে এলো নিশ্বাস। তবে লোকটাকে কাঁচা খেলোয়ার মনে হলো! এক আঘাতেই কুপোকাত!
পদ্মজা একবার ভাবল—টর্চের আলোয় লোকটার মুখ দেখবে। তারপর মাথায় এলো টর্চের আলো দেখে যদি ওঁত পাতা বিপদ তার উপস্থিতি টের পেয়ে এগিয়ে আসে! তাই আর টর্চ জ্বালাল না। সে নিথর দেহটিকে পেছনে ফেলে সামনে এগিয়ে গেল। বাতাসের শোঁ শোঁ শব্দ, ঝিঁঝিপোকার ডাক, অশরীরীর মতো দাঁড়িয়ে থাকা গাছপালা আর রাতের অন্ধকার বার বার পদ্মজার গা হিম করে দিচ্ছে। পদ্মজা প্রমাদ গুণে নিজের মধ্যে সাহস জোগানোর চেষ্টা করছে। বড়ো বড়ো গাছপালা ফেলে সে খোলা জায়গা এসে দাঁড়াল। সামনে কোনো বড়ো গাছ নেই।
জঙ্গলের মাঝে এরকম খোলা জায়গা কেন? এতে কি কোনো রহস্য লুকিয়ে আছে! একদমই খোলা তাও নয়। জংলি লতাপাতা রয়েছে। তবে একটু অন্যরকম। লতাপাতার মাঝে জোঁক বা কোনো বিষাক্ত জীব থাকতে পারে। বিপদের কথা ভেবেও পদ্মজা ঝুঁকি নিলো। সে পা বাড়াল সামনে। কয়েক কদম এগোতেই জুতা ভেদ করে পায়ে ফুটল একটা কাঁটা! আঘাতে আবার আঘাত লেগেছে। ব্যথায় পদ্মজার কলিজা ছেঁড়ার যন্ত্রণা অনুভব হয়। সে কাঁটা বের করার চেষ্টা করে। চোখ দিয়ে টপটপ করে জল বেরোয়।
রক্তজবা ঠোঁট দুটি ভিজে যায় জলে।
.
মৃদুল এদিক-ওদিক দেখে বলল, ‘লিখন ভাই, চলো চইলা যাই।’
অসহনীয় যন্ত্রণায় লিখনের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। সেসবকে তোয়াক্কা করে সে বলল, ‘পদ্মজার খোঁজ নিতে হবে আগে।’
মৃদুল বুঝতে পারছে না সে কী করবে! লিখনের হাত থেকে গলগল করে রক্ত বেরোচ্ছে। দুপুরে সে পূর্ণার সঙ্গে দেখা করতে মোড়ল বাড়িতে গিয়েছিল। পূর্ণা চোখ-মুখ ফুলে যা তা অবস্থা। অনেক কান্নাকাটি করে পদ্মজার জন্য। পূর্ণা আশঙ্কা করছে তার বোন ভালো নেই। মৃদুলেরও তাই মনে হয়। সে যেতেই পূর্ণা ঝরঝর করে কাঁদতে থাকল। তখন লিখন শাহ আসে। তার শুটিং শেষের দিকে, সপ্তাহখানেক পর ঢাকা ফিরবে। তাই পূর্ণাদের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল। পূর্ণাকে ওভাবে কাঁদতে দেখে লিখন বিচলিত হয়ে পড়ে। তারপর প্রশ্ন করে বিস্তারিত জানতে পারে।
লিখন হাওলাদার বাড়িতে আসতে চাইলে মৃদুল না করল। সে বলল, ঢুকতে দেবে না। লিখন মৃদুলের কথা শুনে…চলে এলো হাওলাদার বাড়িতে। পিছু পিছু এলো মৃদুলও। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত দারোয়ান গেটের ভেতরেই ঢুকতে দিল না লিখনকে। তখন মৃদুল লিখনের সঙ্গে পরিকল্পনা করে, তারা বাড়ির পেছনের ভাঙা প্রাচীর পেরিয়ে বাড়ির ভেতর ঢুকবে। লিখন প্রথম রাজি না হলেও, পরে রাজি হয়। সে চিন্তিত হয়ে পড়েছে। পদ্মজার খোঁজ নেই কথাটা সে ভাবতেই পারছে না! এত বয়সে এসেও সে একটা মেয়ের জন্য এত ব্যকুল হয়ে পড়ছে! তাও বিবাহিত মেয়ে! এমন মেয়েকে ভালোবেসে ব্যকুল হওয়া তো সমাজের চোখে খারাপ। এই সমাজের জন্যই সে পদ্মজার থেকে নিজের এত দূরত্ব রাখে। যাতে কোনো খারাপ কথা, কোনো দুর্নাম পদ্মজাকে ছুঁতে না পারে। পদ্মজা যেন অসুখী না হয়। সেই পদ্মজার নাকি চারদিন ধরে খোঁজ নেই! মৃদুল দেখা করতে চাইলে তাও করতে দেয়া হচ্ছে না! লিখনের মাথার রগরগ দপদপ করতে থাকে।
আঁধার নামতেই দুজনে হাওলাদার বাড়ির পেছনের ভাঙা প্রাচীর দিয়ে বাড়ির সীমানায় ঢুকে পড়ে। বাড়ির পেছনে যে জঙ্গল, সেই জঙ্গলসহ পুরো বাড়ির সীমানা মিলিয়ে চারিদিকে গোল করে প্রাচীর দেয়া। তাই পেছনের প্রাচীর দিয়ে তারা আগে পশ্চিম দিকের জঙ্গলে পা রাখে। মৃদুল একবার মদনের সঙ্গে পশ্চিম দিকে এসেছিল, একটা ঔষধি পাতা নিতে। তাই সে জানত, এদিকে বড়ো বড়ো কাঁটা আছে। এজন্য সে রাম-দা নিয়ে এসেছে, লিখনের হাতে ছিল সেটা। লিখন অসাবধানবশত কাঁটার লতাপাতা কাটতে গিয়ে নিজের হাতে আঘাত করে বসে, ফলে ক্ষত সৃষ্টি হয়ে। গলগল করে বেরিয়ে আসে রক্ত। রক্তাক্ত হাত নিয়ে বেরিয়ে আসে জঙ্গল থেকে। মৃদুল চিন্তিত ভঙ্গিতে বলল, ‘ভাই, রক্ত তো বন্ধই হইতাছে না।’
‘কী করা যায়, বলো তো?’
‘আসো চইলা যাই। বাজারে যাইবা। নয়তো ডাক্তারের বাড়িতে নিয়া যাব।’
‘ব্যস্ত হয়ো না, মৃদুল।’
লিখন এক জায়গায় বসল। তারা অন্দরমহলের বাঁদিকে আছে। মৃদুলের হাত থেকে টর্চ নিয়ে লিখন চার পাশটা দেখে নিলো। তারপর বলল, ‘ওই যে দেখা যাচ্ছে, ওই পাতাটা নিয়ে এসো।’
‘আচ্ছা, ভাই।’
মৃদুল লিখনের দেখানো কয়েকটা পাতা নিয়ে আসে। তারপর কচলে নরম করে লিখনের ক্ষতস্থানে লাগায়। লিখন বলল, ‘হয়েছে এবার। রক্তপড়া বন্ধ হয়ে যাবে। ‘
‘আমরা চইলা যাইলেই পারতাম।’
‘পদ্মজার খোঁজ না নিয়ে কীভাবে যাই?’
‘পদ্মজা ভাবিরে এত ভালোবাসো ভাই, অবাক করে আমারে।’
লিখন মুচকি হেসে বলল, ‘এসব বলো না, মৃদুল। এসব বলতে নেই।’
‘সত্যি কথা কইতে ডর কীসের?
লিখন ঠোঁটে হাসি রেখেই উঠে দাঁড়াল। হাঁটতে হাঁটতে বলল, ‘বিবাহিত নারী নিয়ে এসব বলতে নেই। সমাজ ভালো চোখে দেখে না।’
‘সমাজরে আমি জুতা মারি।’
‘তোমার বয়স বেড়েছে ঠিকই, জ্ঞান হয়নি।’ বলতে বলতে লিখন অন্দরমহলের পেছনে এসে দাঁড়াল। গা হিম করা ঠান্ডা বইছে। তার পরনে শীতবস্ত্র নেই। ঠান্ডায় জমে যাচ্ছে সে। মৃদুল বলল, ‘এই কথা আমার আম্মাও বলে।’
‘এসব কথা বাদ দাও এখন। শুনো, আমরা বাড়ির সামনে যাব নাকি পিছন থেকেই কিছু করব?’
লিখনের ভাবগতি বোঝা যাচ্ছে না। মৃদুল লিখনের দৃষ্টি অনুকরণ করে অন্দরমহলের দুই তলায় তাকাল। পদ্মজার ঘরের জানালার দিকে। প্রশ্ন করল, ‘পেছনে কী করার আছে?’
‘পদ্মজার ঘরের জানালার পাশে রেইনট্রি গাছটা দেখেছো? গাছে উঠে উঁকি দিলেই পদ্মজাকে দেখা যাবে। কথা বলাও যাবে।’
‘উঠতে পারো গাছে?’
‘আরে পুরুষ মানুষ হয়েছি কী জন্য?’
‘তাইলে গাছে উঠমু আমরা?’
‘একবার সামনে দিয়ে চেষ্টা করা উচিত। তুমি যাও, গিয়ে দেখো ঢুকতে দেয় নাকি।’
মৃদুল মুখ কালো করে বলল, ‘দিবে না। আবার অপমান হতে ইচ্ছা করতাছে না।’
‘তাহলে চলো গাছে উঠি।’
মৃদুল চুল ঠিক করতে করতে গুরুতর ভঙ্গিতে বলল, ‘তুমি যহন কইছো, আমি যাব।’
লিখন হাসল। পূর্ণার মতোই মৃদুলের স্বভাব। পূর্ণাকে যে কারণে ভালো লাগে, ঠিক একই কারণে মৃদুলকেও ভালো লাগে। মৃদুল চলে যায়। লিখনের মাথাটা ব্যথা করছে। সে দুহাতে কপালের দুপাশ চেপে ধরে পদ্মজার ঘরের জানালার দিকে তাকিয়ে ভাবে, একজন জনপ্রিয় অভিনেতা হয়ে এভাবে প্রাচীর ডিঙিয়ে, লুকিয়ে এক পাক্ষিক ভালোবাসার মানুষের খোঁজ নিতে আসাটাকে হয়তো কারো চোখে পাগলামি মনে হবে। কিন্তু তার চোখে সেটা গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব! নিজেকে ভালো রাখার দায়িত্ব! পদ্মজা ভালো আছে ভেবেই সে মানসিকভাবে ভালো থাকে। এ কথা ঠিক, পদ্মজার সঙ্গে আমিরের এত সুখ দেখে তার বুকে চিনচিন ব্যথা হয়। তবে এটাও ঠিক পদ্মজার সুখ দেখে সে শান্তিও পায়! বেঁচে থাকার মানসিক মনোবল পায়। আশা থাকে মনে, আছে! বেঁচে আছে পদ্মফুল! চাইলেই দূর থেকে দেখা যাবে। চাইলে কথা বলাও যাবে। কিন্তু যদি নাই বা থাকে? তবে—
মৃদুল এসে জানাল, শালার ব্যাটা দুলাভাই নাই। কেউই নাই দরজার সামনে।’
লিখন বলল, ‘তাহলে চলো। সামনে দিয়েই যাই। আমারও কেমন লাগছিল, এভাবে লুকিয়ে বাড়ির পিছন দিয়ে…’ লিখন হাসল। ম্লান হাসি। সে এগিয়ে গেল। সঙ্গে মৃদুল। দুজন অন্দরমহলে প্রবেশ করল নির্বিঘ্নে। কোনো বাধা আসেনি।
আমিনা সদর ঘরে বসে ছিলেন। তিনি লিখনকে দেখে বললেন, ‘তুমি এইহানে কেরে আইছো?’
মৃদুল ঘরে ঢুকে বলল, ‘ফুফুআম্মা, পদ্মজা ভাবি কই?’
আমিনা বসা থেকে উঠে দাঁড়ালেন। মৃদুলের কাছে এসে আদুরে গলায় বললেন, ‘কই আছিলি, বাপ? তোর ফুপায় বকছে বইলা চইলা যাবি কেন? আমি তোর ফুফুআম্মা আছি না? তুই এইহানেই থাকবি। যতদিন ইচ্ছা থাকবি।’
মৃদুল কপালে ভাঁজ সৃষ্টি করে বলল, ‘ধুর! বাদ দেও এসব কথা। তোমার জামাই একটা ইবলিশ। ইবলিশের ধারেকাছে মানুষদের থাকতে নাই।’
আমিনা মৃদুলের মুখ ছুঁয়ে বললেন, ‘এমন কয় না বাপ।’
‘আদর পরে কইরো। এখন কও তো পদ্মজা ভাবি কই?’
‘ঘরেই আছে।’
ভাবির কি শরীর ভালা আছে?’
আমিনা ক্ষণমুহূর্ত সময় নিয়ে লিখনকে দেখলেন। বললেন, ‘হ ভালা।’
‘আচ্ছা, ফুফুআম্মা আমরা ওপরে যাইতাছি।’
আমিনা লিখনের দিকে আঙুল তাক করে তীক্ষ্ণ স্বরে বললেন, ‘এই ছেড়াও যাইব?’
লিখন চোখের দৃষ্টি অন্যদিকে ফিরিয়ে নিলো। পরপুরুষ হয়ে পদ্মজার মতো মেয়েকে দেখতে যাওয়া ঠিক হবে না বোধহয়। মৃদুল তো এই বাড়ির আত্মীয়। সে গেলে সমস্যা নেই। মৃদুল কিছু বলার পূর্বে লিখন বলল, —আমি এখানে বসি। তুমি যাও।’
‘না ভাই, তুমি আইয়ো।’
‘আরে, মৃদুল যাও তো।’
মৃদুল সিঁড়িতে পা রাখল। আমিনা ভাবছেন, পদ্মজা তো ঘরেই আছে। বাড়িতে কোনো পুরুষ নেই। এরকম সময়ে যদি পদ্মজার নিচে নেমে আসে? লিখনের সঙ্গে কথা বলে! আর এ খবর কোনোভাবে খলিল হাওলাদারের কানে যায়। তবে তার রক্ষে নেই। তিনি উঁচুকণ্ঠে ডাকলেন, ‘মৃদুলরে?’
মৃদুল তাকাল। আমিনা জানেন না, পদ্মজা সত্যি যে ঘরে নেই। তিনি মিথ্যে ভেবে বললেন, ‘পদ্মজায় তো ঘরে নাই।’
লিখন উদ্বিগ্ন হয়ে প্রশ্ন করলো, ‘কেন? কোথায় গিয়েছে?
আমিনা নির্বিকার কণ্ঠে বললেন, ‘আমি কিতা কইতাম? গেছে কোনো কামে।’
মৃদুল সিঁড়ি ভেঙে নেমে এলো, ‘ভাবি একলা গেছে?’
আমিনা আরেকটা মিথ্যা বললেন, ‘না, একলা যায় নাই। আমিরের লগে গেছে।’
মৃদুল উৎসুক হয়ে জানতে চাইল, ‘আমির ভাই বাড়িত আছিল? আমি যে দেহি নাই। ভাবছি জরুরি কোনো কামে ঢাকাত গেছে। আচ্ছা, ফুফুআম্মা অন্দরমহল নজরবন্দিতে আছিল কেন? আমারে ঢুকতে দেয় নাই কেন?’
আমিনা তৃতীয়বারের মতো মিথ্যে বললেন, ‘আমির তো ঢাকাতই গেছিল। কাইল রাইতে আইছে। আমির নাই এজন্য পদ্মজার —
লিখন কথা কেড়ে নিয়ে বলল, ‘বুঝতে পেরেছি। সিকিউরিটি মানে নিরাপত্তা দিয়ে গিয়েছিল। আমি আছি তো গ্রামে! আমির হাওলাদার খুব ভালোবাসেন পদ্মজাকে!’ শেষ শব্দ তিনটি লিখন জোরপূর্বক হেসে বলল। তার চোখের মণি চিকচিক করছে। মৃদুল আফসোস করে বলল, ‘ধুর, দেখা হইল না।’
‘আসি চাচি।’ বলল লিখন।
মৃদুল, লিখন বেরিয়ে আসে। মৃদুল বলল, ‘পদ্মজা ভাবির চিঠি দেখে তো মনে হয় নাই এত সহজ ব্যপার।’
‘হু। পদ্মজা একটা রহস্যময়ী, মায়াময়ী। তাই বোধহয় রহস্য রেখে চিঠি লিখেছে। আমির হাওলাদার যেহেতু এখন সঙ্গে আছে নিশ্চয় পদ্মজা ভালো আছে।
মৃদুল গভীর মগ্ন হয়ে কিছু ভাবছে। সে লিখনের কথার জবাবে বলল, ‘উমম।’
‘তবুও, আগামীকাল পদ্মজা পূর্ণার সঙ্গে যোগাযোগ না করলে আমরা আবার আসব না হয়।’
মৃদুল লাফিয়ে উঠে বলল, ‘এটাই ভাবছিলাম।’
লিখনের হাতের রক্তপড়া বন্ধ হলেও ব্যথা তীব্র। তা মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে। মৃদুল বলল, ‘ভাই, সাইকেল নিয়া আসি। এ অবস্থায় হেঁটে যাওয়া ঠিক হইব না।’
লিখনও সায় দিল। মৃদুল আলগ ঘর থেকে সাইকেল নিয়ে আসে। মৃদুল সামনে, লিখন পেছনে বসল। তাদেরকে দারোয়ান দেখে অবাক হয়। তবে বেশিকিছু বলতে পারেনি, মৃদুল হুমকি-ধামকি দিয়ে বেরিয়ে পড়ে। রাতের স্নিগ্ধ বাতাসে লিখন অনুভব করল, তার বুকের সূক্ষ্ম ব্যথাটা সর্বাঙ্গে ছড়িয়ে পড়ছে। সে একবার ঘুরে তাকাল হাওলাদার বাড়ির গেটের দিকে! খ্যাতিমান, সুদর্শন, ধনী লিখন শাহ, যে সবসময় ঠোঁটে প্লাস্টিকের হাসি ঝুলিয়ে রাখে, তাকে দেখে সবাই কত সুখী মনে করে! কত যুবক স্বপ্ন দেখে লিখন শাহর অবস্থানে আসার! কিন্তু তারা কী কখনো জানবে, লিখন শাহ সর্বক্ষণ বুকের ভেতর বিষাক্ত সূচ নিয়ে হাসে…
…যে সূচের তীব্রতা তাকে এক মুহূর্তও শান্তি দেয় না।
.
পদ্মজা চারিদিকে নজর ফেলে হাঁটছে। কিন্তু চোখে পড়ার মতো কিছু পাচ্ছে না। কী এমন আছে এখানে, যা পাহারা দেয়ার জন্য কেউ না কেউ থাকে? কিছুই তো নজরে আসছে না। পদ্মজা জংলি লতাপাতার উপর হাঁটতে হাঁটতে অনেক দূরে চলে এলো। শিশিরের জলে পায়ের তালু থেকে হাঁটু অবধি ভিজে গিয়েছে। পাজোড়া ঠান্ডায় জমে যাওয়ার উপক্রম। থেকে থেকে কাছে কোথাও শেয়াল ডাকছে। পদ্মজার বুক ধুকপুক, ধুকপুক করছে। মনে হচ্ছে, কয়েকজোড়া চোখ তার দিকে তাকিয়ে আছে। যেকোনো মুহূর্তে আক্রমণ করে বসবে। ছিঁড়ে খাবে দেহ! ভাবতেই পদ্মজার গা শিউরে উঠল সে ঢোক গিলল। তারপর আয়তুল কুরসি পড়ে বুকে ফুঁ দিল। আয়তুল কুরসি যতবার সে পড়ে ততবার নিজের মধ্যে একটা শক্তি অনুভব করে, ভরসা পায়। এই মুহূর্তেও তার ব্যক্তিক্রম হয়নি।
সামনে এগোতে এগোতে একসময় আবিষ্কার করল, তার পায়ের নিচে মাটির বদলে অন্যকিছু আছে! চকিতে পদ্মজার মস্তিষ্ক চারগুণ গতিতে সচল হয়ে উঠল। সে পায়ের নিচের লতাপাতা সরাতে গিয়ে দেখে, এই লতাপাতাগুলোর শেকড় নেই! পদ্মজা দ্রুতগতিতে সব লতাপাতা সরাল। তখনই আবছা আলোয় চোখে ভেসে উঠল লোহার মেঝে! পদ্মজার মুখে একটি গাঢ় বিস্ময়ের ছাপ ফুটে উঠে, উত্তেজনা বেড়ে যায়। শীতল শরীর উত্তেজনায় ঘামতে শুরু করেছে। লোহার মেঝেটা খুব একটা বড়ো নয়। পদ্মজা টর্চ জ্বালিয়ে খুঁটিয়ে, খুঁটিয়ে দেখে নিলো একবার। এক পাশে ছিদ্র রয়েছে। এখানে হয়তো চাবি ব্যবহৃত হয়! চকিতে পদ্মজার মাথায় এলো আলমগীরের দেয়া চাবিটার কথা। সে দ্রুত পেটিকোটের দুই ভাঁজ থেকে চাবিটি বের করল। প্রবল উত্তেজনায় তার হাত মৃদু কাঁপছে। বিসমিল্লাহ বলে, ছিদ্রে প্রবেশ করাল চাবি।
কাজ করল চাবিটা! পদ্মজা বিস্ময়ে বাকহারা হয়ে পড়ে! কী হতে চলেছে? সে লোহার এই অংশটি দুই হাতে তোলার চেষ্টা করে। যতটা ভারি ভেবেছিল, ততটা নয়! দেখে লোহার মনে হলেও, বোধহয় আসলে লোহার না। ধীরে ধীরে পদ্মজা আবিষ্কার করল, এটি একটা দরজা, গুপ্ত কোনো ঘরের দরজা। আতঙ্কে হিম হয়ে গেল সে। নিচের দিকে একটা সিঁড়ি নেমে গেছে। পদ্মজা তার কাঁপতে থাকা পা এগিয়ে দিল ভেতরে। ভয় যে একেবারে পাচ্ছে না, তা না! খুব ভয় হচ্ছে। এমন আচানক ঘটনার সম্মুখীন তো আগে হয়নি। সিঁড়ি ভেঙে অনেক দূর নেমে এলো সে। ভীষণ ঠান্ডা এদিকে। মনে হচ্ছে সব স্বপ্ন! কোনো রূপকথার গল্পের রাক্ষসপুরীতে চলে এসেছে! চোখের সামনে ভেসে উঠে আরেকটি দরজা। এই দরজাটি অদ্ভুত ধরনের। তাদের ঢাকার বাড়িতে হুবহু একইরকম দরজা আছে! এই দরজার আড়ালে যাই হোক না কেন, বাইরে শব্দ আসে না! পদ্মজা অস্পষ্ট একটা সন্দেহে বিভোর হয়ে ওঠে I
এই দরজাটা খুলতেও কাজে এলো আলমগীরের দেয়া চাবিটা! চাবিতে চুমু খেল পদ্মজা। এত গুরুত্বপূর্ণ চাবি আলমগীর তাকে দিল কেন? এসব ভাবার সময় এখন নয়। বাকিটুকুও তাকে দেখতে হবে। দরজা খুলে অন্য একটি অংশে প্রবেশ করতেই মুখে তীব্র আলো ধাক্কা খেল। পদ্মজা কপাল কুঁচকে দুই হাত সামনে বাড়িয়ে আলোর গতিবেগ রোধ করে মুখে অস্ফুট বিরক্তিসূচক শব্দ করল। তারপর ধীরে ধীরে তাকাল চোখ পিটপিট করে। চারিদিকে রং-বেরঙের বাতি জ্বলছে। এই বাতিগুলোও তার চেনা। তাদের বাড়িতে আছে। যখন বিদ্যুত থাকে না, ব্যাটারিচালিত এই বাতিগুলো পুরো বাড়ি আলোয় আলোয় ভরিয়ে তোলে! দুইদিকে আরো দুটো দরজা। প্রথম দরজাটিতে লেখা ‘স্বাগতম’। দ্বিতীয়টিতে লেখা ‘ধ-রক্ত।’
রুম্পা তো এমন কিছুই বলেছিল!
পদ্মজা আর এক মুহূর্তও দাঁড়াল না। দ্বিতীয় দরজাটির দিকে এগিয়ে গেল। এটার তালা নেই। তাহলে খুলবে কী করে? ধাক্কা দিল পদ্মজা, সঙ্গে সঙ্গে খুলেও গেল দরজা। পদ্মজার মুখ হাঁ হয়ে যায়, ঠোঁট বার বার শুকিয়ে যাচ্ছে। এ কোথায় এসেছে সে! আর কি ফিরতে পারবে নিজের ঘরে? আচমকা পদ্মজার কানে ভেসে আসে মেয়েদের কান্নার চিৎকার! পদ্মজার রক্ত হিম হয়ে যায়। এরকম একটা জায়গায় এতগুলো মেয়ে কেন কাঁদছে? কত কষ্ট, যন্ত্রণা সেই কান্নায়! কান্নার বেগ বাড়ছে। যেন বিরতিহীনভাবে আঘাত করছে কেউ। পদ্মজা দুই হাতে ছুরি আর রাম-দা শক্ত করে ধরল। তারপর সেই কান্না অনুসরণ করে এগিয়ে গেল সামনে।
যত এগুচ্ছে কান্নাগুলো তীব্র ধাক্কা দিচ্ছে বুকে। নিশ্বাস আটকে আছে পদ্মজার। সে চলে এসেছে খুব কাছে। চোখের সামনে আরেকটা ঘরের দরজা, একটু খোলা ওটা। সে সাবধানে দরজা ঠেলে ঘরের ভেতর তাকাল। আর ঠিক তখনই তার পায়ের পাতা থেকে মাথার তালু অবধি শিরশির করে উঠল। চোখের সামনে দেখা দৃশ্যটা দুঃস্বপ্ন বলে মনে হতে লাগল। মনে হচ্ছে জায়গায় জমে গেছে সে!
বিবস্ত্র অবস্থায় পাঁচ-ছয়টি মেয়ে হাতজোড় করে কাঁপছে, কাঁদছে। তাদের শরীর রক্তাক্ত। আর সামনে দাঁড়িয়ে আছে একটা লম্বা শ্যামবর্ণের দেহ। গায়ে শার্ট নেই। প্যান্ট নেমে এসেছে নাভির অনেক নিচ অবধি। তার হাতে বেল্ট! সম্ভবত বেল্ট দিয়েই মেয়েগুলোকে আঘাত করছিল! প্রশস্ত ও হৃষ্টপুষ্ট শরীরের গড়নের মানুষটিকে চিনতে পেরে পদ্মজার বুকের পাঁজর টনটন করে উঠল। তার হাত থেকে পড়ে যায় ছুরি ও রাম-দা। বিকট শব্দ হলো একটা। সেই শব্দ অনুসরণ করে উপস্থিত মানুষগুলোর চোখ ছুটে গেল দরজার দিকে। পদ্মজা ধপ করে বসে পড়ে মাটিতে। শরীরের সবটুকু শক্তি নিমিষেই কে যেন শুষে নিয়েছে!
পদ্মজাকে দেখে মানুষটির চোখ হিংস্র জন্তুর মতো জ্বলজ্বল করে উঠল কপালের শিরা ভেসে ওঠে, হিংস্র চাহনিটা যেন মূহূর্তে হয়ে উঠল আরো ভয়ংকর। সে ভাবতেই পারছে না, পদ্মজা এত দূর চলে এসেছে! পদ্মজা বিস্ময়ভরা ছলছল চোখ দুটি সেই মানুষটার দিকে তাক করে অস্পষ্ট স্বরে বলল, ‘ছি!’