Thursday, May 2, 2024
Homeকিশোর গল্পরূপকথার গল্পরুশ উপকথা: গপ্পী-বউ

রুশ উপকথা: গপ্পী-বউ

রুশ উপকথা: গপ্পী-বউ

এক ছিল চাষি আর তার বউ। বউটা ভারি গপ্পী ছিল, কোনো কথা পেটে থাকত না। কানে তার কোনো কথা পৌঁছালেই অমনি সেটা সারা গ্রামে রাষ্ট্র হয়ে যেত।

একদিন চাষি তো বনে গেল। বনের মধ্যে নেকড়ে ধরার গর্ত খুঁড়তে গিয়ে হঠাৎ গুপ্তধন পেয়ে গেল। চাষি ভাবল, ‘এখন কী করি? আমার বউ তো গুপ্তধনের কথা শুনলেই সারা পাড়ায় রটিয়ে দেবে। জমিদারের কানে কথাটা যাবে—ব্যস, টাকাও আর পেতে হবে না। জমিদারই সবটা গায়েব করবে।’

ভাবতে ভাবতে একটা বুদ্ধি মাথায় এল। গুপ্তধনটা আবার পুঁতে রেখে জায়গাটা চিহ্ন দিয়ে ফিরে গেল। নদীর কাছে আসতে জালের দিকে তাকিয়ে দেখে, জালের মধ্যে মাছ ছটফট করছে। মাছটা বের করে নিয়ে চাষি আবার চলল। একটু পরেই তারই পাতা একটা ফাঁদের কাছে এসে দেখে একটা খরগোশ তাতে আটকা পড়েছে।

চাষি খরগোশটা বের করে নিয়ে মাছটা সেই জায়গায় রাখল। তারপর খরগোশটা জড়াল জালের মধ্যে।

বাড়ি ফিরল বেশ রাত হয়ে যাওয়ার পর।

‘উনুন জ্বেলে বেশ কিছু সরু চাকলি বানাও তো, তাতিয়ানা!’

‘সে কী? সন্ধ্যার পর কেউ কখনো উনুন ধরায় নাকি? এত রাতে কেই-বা আবার সরু চাকলি তৈরি করে! খেয়াল দেখো!’

‘যা বলছি করো! তর্ক কোরো না। গুপ্তধন পেয়েছি আমি, আজ রাতেই বাড়ি নিয়ে আসব।’

চাষির বউয়ের তো আর খুশি ধরে না। এক নিমেষে উনুন ধরিয়ে সরু চাকলি বানাতে বসে গেল সে।

বলল, ‘গরম, গরম খাও গো!’

চাষি একটা করে সরু চাকলি খায় আর বউয়ের অজান্তে গোটা দু-চার করে থলিতে পোরে। একটা করে খায় আর গোটা দুই করে রাখে।

চাষির বউ বলল, ‘আজ যে দেখি তুমি গোগ্রাসে গিলছ, আমি যে ভেজে উঠতেই পারছি না!’

‘বহুদূর যেতে হবে গো, গুপ্তধনটাও খুব ভারী, তাই পেট পুরে খেয়ে নিচ্ছি।’

সরু চাকলি দিয়ে থলিটা ভরে নিয়ে চাষি বলল,

‘আমার পেট ভরেছে, এবার তুমি কিছু খেয়ে নাও আর চলো বেরিয়ে পড়ি, তাড়াতাড়ি করো।’

খুব তাড়াতাড়ি খেয়ে নিল বউ, তারপর দুজনে বেরিয়ে পড়ল।

ততক্ষণে বেশ রাত হয়ে গেছে। চাষি আগে আগে যায় আর থলি থেকে একটা একটা করে সরু চাকলি বের করে গাছের ডালে ঝুলিয়ে দেয়।

সরু চাকলিগুলো চোখে পড়ল চাষি বউয়ের।

‘দেখো দেখো, সরু চাকলি হয়ে রয়েছে গাছে!’

‘এ আর এমন কী? এই মাত্র দেখলে না সরু চাকলি বৃষ্টি হচ্ছিল।’

‘না, কই দেখিনি তো! আমি মাটিতে চোখ রেখে হাঁটছিলাম, যাতে গাছের শিকড়ে পা বেঁধে হুমড়ি খেয়ে না পড়ি।

চাষি বলল, ‘এইখানে একটা খরগোশ ধরা ফাঁদ পেতেছিলাম। একবার দেখে আসি চলো তো।

ফাঁদের কাছে গিয়ে চাষি একটা মাছ বের করে আনল।

‘আরে! মাছ এসে কী করে এই ফাঁদে ঢুকল?’ চাষির বউ জিজ্ঞেস করল।

‘তাও জানো না? জলের মাছের মতো ডাঙার মাছও যে আছে!’

‘জানতাম না তো! নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাসই হতো না!’

তারপর ওরা এল নদীর ধারে। চাষির বউ বলল,

‘এখানে নিশ্চয়ই কোথাও তোমার জাল পাতা আছে। চলো একবার দেখে আসি।’

ওরা যেই জালটা টেনে তুলেছে, দেখে একটা খরগোশ।

‘মা গো! কী কাণ্ড!’ চাষির বউ গালে হাত দিল। ‘কী সব হচ্ছে আজ। খরগোশ কিনা আটকা পড়ল মাছ-ধরা জালে!’

চাষি বলল, ‘এতে অবাক হওয়ার কী আছে? জীবনে যেন জল-খোরগোশ দেখোনি!’

‘সত্যি দেখিনি তো।’ ইতিমধ্যে যেখানে গুপ্তধন পোঁতা রয়েছে সেই জায়গাটায় এসে পৌঁছাল ওরা। চাষি খুঁড়ে খুঁড়ে টাকার পাত্র বের করে আনল, তারপর যতটা করে পারে টাকাটা ঘাড়ে করে বয়ে নিয়ে চলল বাড়ি।

রাস্তাটা আবার জমিদারের বাড়ির পাশ দিয়ে। বাড়িটার কাছে যেতেই ওরা শোনে, ‘ব্যা… ব্যা… এ্যা…’ করে একটা ভেড়া ডাকছে।

চাষির বউ ফিসফিস করে বলল, ‘ও বাবা, ওটা কী গো! ভীষণ ভয় করছে আমার!’

‘দৌড়ে চলো শিগগির! জমিদার বাবুকে গলা টিপে মারছে ভূতে। আমাদের যেন ওরা দেখতে না পায়!’

দুজনেই ভীষণ হাঁপাতে হাঁপাতে এক দৌড়ে বাড়ি।

টাকা লুকিয়ে রেখে দুজনে ঘুমোতে গেল।

চাষি বলল, ‘দেখো, তাতিয়ানা, গুপ্তধনের কথা আবার কাউকে বলে বেড়িয়ো না যেন। তাহলে বিপদে পড়তে হবে।’

‘কী যে বলো, ঘুণাক্ষরেও কাউকে বলব না!’

পরদিন ওরা ঘুম থেকে উঠল দেরি করে।

চাষির বউ উনুনে আগুন দিয়ে, বালতি নিয়ে গেল জল আনতে। কুয়োর কাছে পাড়াপড়শিরা জিজ্ঞেস করল, ‘ও তাতিয়ানা, আজ এত দেরিতে উনুনে আঁচ পড়ল যে?’

‘আর বোলো না, কাল সারা রাত বাইরে ছিলাম কি না, ঘুম ভেঙেছে দেরি করে।’

‘কেন, রাতে গিয়েছিলে কোথায়?’

‘আমার স্বামী গুপ্তধন খুঁজে পেয়েছে যে, রাতে গিয়েছিলাম টাকা আনতে।

ব্যস, সারা দিন গ্রামে শুধু ওই এক আলোচনা, ‘তাতিয়ানা আর তার স্বামী গুপ্তধন পেয়েছে। দুই বস্তা ভর্তি করে টাকা এনেছে।’

সন্ধ্যাবেলাতেই কথাটা কানে উঠল জমিদারের। জমিদার ডেকে পাঠল চাষিকে।

‘গুপ্তধন পেয়েছ, আমায় জানাওনি কেন?’

চাষি বলল, ‘গুপ্তধন? জীবনে কোনো দিন কথাটা কানেও শুনিনি, বাবু।’

জমিদার চিৎকার করে উঠল, ‘বাজে কথা রাখো! আমি সব জানি, তোমার বউ তো সবাইকে বলে বেড়িয়েছে!’

‘ওর মাথার ঠিক নেই, বাবু। এমন সব কথা বলে, যার মাথামুণ্ডু নেই।’

‘বেশ, পরীক্ষা করে দেখছি, দাঁড়াও!’

জমিদার চাষির বউকে ডেকে পাঠাল।

‘তোমার স্বামী কি গুপ্তধন পেয়েছে?’

‘আজ্ঞে হ্যাঁ বাবু, পেয়েছে।’

‘তোমরা দুজনে টাকা আনতে বেরিয়েছিলে রাত্তিবেলা?’

‘আজ্ঞে হ্যাঁ, বেরিয়েছিলাম।’

‘সব কথা বলো তো দেখি, কী হয়েছিল।’

‘প্রথমে তো আমরা বনের ভেতর দিয়ে যাচ্ছি, দেখি কি, গাছে গাছে সরু চাকলি ফলে রয়েছে।’

‘সরু চাকলি?’

‘আজ্ঞে হ্যাঁ, সরু চাকলি বৃষ্টি হচ্ছিল কিনা। তারপর খরগোশ ধরা ফাঁদে দেখি একটা মাছ আটকে রয়েছে। মাছটা আমরা বের করে নিয়ে আবার চলতে লাগলাম। নদীর ধারে এসে জালটা টেনে তুলে দেখি, জালে পড়েছে একটা খরগোশ! খরগোশটাও নিয়ে নিলাম। তারপর নদী থেকে খানিকটা দূরে জমি খুঁড়ে আমার স্বামী গুপ্তধন বের করল। আর আমরা দুই থলিভর্তি টাকা নিয়ে বাড়ি ফিরে গেলাম। আপনার বাড়ির পাশ দিয়ে আমরা যখন পেরিয়ে যাচ্ছি, ঠিক তখনই তো হুজুরের গলা টিপে ধরেছিল ভূতে।’

এই না শুনে জমিদার তো ভীষণ রেগে, মাটিতে পা ঠুকে চিৎকার করে বলল,

‘বেরিয়ে যাও এখান থেকে, হাঁদা মেয়ে কোথাকার!’

চাষি বলল, ‘দেখলেন তো, আমার বউয়ের কোনো কথাই বিশ্বাস করা চলে না। এভাবেই জীবন কাটাচ্ছি ওকে নিয়ে, অশান্তির শেষ নেই।’

‘খুব বুঝতে পারছি, এবার তুমি বাড়ি যেতে পারো,’ জমিদার হাত নেড়ে বলল।

বাড়ি চলে গেল চাষি। সুখে-স্বাচ্ছন্দ্যে ঘরকন্না করতে লাগল। এখন পর্যন্ত সে বেঁচে আছে আর জমিদার বাবুর কথা ভেবে মনে মনে হাসে।

অনুবাদ: সুপ্রিয়া ঘোষ

Anuprerona
Anupreronahttps://www.anuperona.com
Read your favourite literature free forever on our blogging platform.
RELATED ARTICLES

Most Popular

Recent Comments