Tuesday, September 9, 2025
Homeবাণী ও কথাপ্লুটনিক - বাণী বসু

প্লুটনিক – বাণী বসু

শীতকালে বৃষ্টি বড়ো বিরক্তিকর। ঘরে বসে তবু একরকম। কিন্তু বেড়াতে গিয়ে ভোগ করতে হলে সব মাটি। জায়গাটা গোপালপুর। যাকে আগে লোকে বলত গোপালপুর-অন-সি। আমাদের বড়ো প্রিয় জায়গা। গ্রীষ্মে, বর্ষায়, শীতে। সমুদ্রের রূপ এখানে মে-জুন মাসে উত্তাল, দুর্ধর্ষ, জল যেন টগবগ করে ফুটছে মনে হয় একেক সময়।

শীতকালে আবার সেই সমুদ্রকেই চেনা যাবে না। একেবারে সুনীল জলধি। গুঁড়ি-মেরে-এগিয়ে-আসা নীচু ব্রেকারগুলো নয় নয় করেও কিছু তো থাকেই। না থাকলে মনে হত মানস সরোবর। যেসব ভাগ্যবানরা মানস সরোবরে গেছেন তাঁদের ভোলা ছবিতে এই রকমটাই যেন দেখেছি। দু-এক বছর বাদ বাদই আমরা গোপালপুরে বেড়াতে আসি। গ্রীষ্মেও আসি। শীতেও আসি। উঠি ব্যাবিংটন সাহেবের বাংলোয়। বরাবর। আমরা আসছি শুনলেই উনি বেরহামপুর স্টেশনে শওকতকে দিয়ে জিপ পাঠিয়ে দেন। আরামে চলে আসি।

এই বাংলোর ওপর আমাদের এত ঝোঁক কেন সেটা চট করে এককথায় বোঝানো যাবে না। কারণ বাংলোটা সুন্দর নয়, আধুনিক তো নয়ই। আশেপাশেই কয়েকটা আছে এটার চেয়ে অনেক সুদৃশ্য। ব্যাবিংটন সাহেবের বাংলো পথের শেষে একটা বালিয়াড়ির ওপর দাঁড়িয়ে আছে। অর্ধেকটা তার বাঁধানো রাস্তায়, অর্ধেকটা বালির আঁটসাঁট উঁচু স্তূপের ওপর। দাঁড়িয়ে আছে বললেও ভুল হবে। হেলে আছে। পেছন দিকে সমুদ্র। এই পেছন দিকটায় বালিয়াড়িটা এমন ক্ষয়ে ক্ষয়ে গেছে যে সমুদ্রের দিক থেকে দেখলে মনে হবে বাড়িটা যে-কোনো মুহূর্তে হুমড়ি খেয়ে পড়বে। কিন্তু পড়ে না তো! ছ-সাত বছর ধরে দেখছি। একই রকম বিপজ্জনক ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে। হয়তো কোনোদিন আমরা থাকাকালীনই হুড়মুড়িয়ে পড়বে। তা সত্ত্বেও কী রকম একটা আকর্ষণ আছে বাড়িটার। ভেতরে ঢুকলে মনে হয় পুরোনো ইংল্যান্ডের কোনো পোড়ো কানট্রি-হাউজে এসেছি। ঢুকে পড়েছি ভিন দেশের অতীত ইতিহাসের পোকায় খাওয়া পাতার ভেতরে। সামনের দিকে বেশ বড়ো হাতা, তার একদিকে একটা ছোট্ট আউট হাউজ। হাতাটা ঢালু। শান বাঁধানো হলে কি হবে, বালিতে ভরতি থাকে সবসময়। ধারে ধারে কেয়ারি করা। তেমন কিছু গাছপালা নেই। কে-ই বা যত্ন করবে! তবে বেশ কিছু টবের পাতাবাহার আর ফুলগাছ আছে। এই-ই বাংলোর বাগান।

ঢুকে প্রথমে বাঁদিকে ব্যাবিংটনের নিজের ছোট্ট ঘর। ডানদিকে একটা লাউঞ্জ মতো। সেটা ব্যাবিংটন সাহেবের অফিস। একদিকে ক-টা বেতের চেয়ার। সামনে কাউন্টার। তার পেছনে ব্যাবিংটন সাহেব শর্টস আর আলগা টি শার্ট পরে খুব কায়দা মেরে বসে থাকে। গাবদা একটা খাতা নিয়ে সারা সকাল খুটখাট কাজ করে। কত তো ওর গেস্ট আসছে! কুল্লে ঘর তো তিনখানা। লাউঞ্জ দিয়ে ঢুকতে পেল্লাই একটা হল। তার বাঁদিকে ওই হলের মতোই প্রায় লম্বা আর একটা পেল্লাই ঘর। উঁচুতে বোধহয় বিশ ফুটেরও বেশি। এই ঘরটা ওর চারজনের। তবে দরকার হলে ছ জনের দলকেও অনায়াসেই দেওয়া যায়। দেয়ও। ডানদিকে দুখানা ঘর ডবল বেড। হল পেরিয়ে সমুদ্রের দিকে গেলে আগে একটা টাকা দালান, তার বাঁদিকে রান্নাঘর আর স্টোর। দালানটাতে কিচেন টেবল আছে, আরও নানা খুচখাচ ঘরকন্নার জিনিস। এই দালানটার শেষে বিরাট, মোটা কাঠের দরজা। তার ওদিকে আবার চাতাল। খোলা। মাথার ওপর অর্ধেকটা টালির ছাদ আছে। বাকি সব দিক ভোলা। এইখানে বসে সমুদ্র দেখা যায় অবাধ।

হলটা দারুণ। যেমন লম্বা তেমন চওড়া। মেঝে ভরতি পুরনো দিনের মেরুন রঙের কার্পেট। মাথায় ঝাড়বাতি। যদিও জ্বলে না। একদিকে গ্র্যান্ডফাদার ক্লক। বাজে না। ঠিকঠাক সময়ও দেয় না। কিন্তু চলে। আপন খেয়ালে, সময়ের কোনও তোয়া ক্কা না রেখে টিক-টিক টিক-টিক চলে। হলে ঢুকতেই বড়ো বড়ো গদি দেওয়া সোফাসেট। আর রান্নার চাতালের ধার ঘেঁষে বহুদিন আগেকার ডিমের মতো আকারের বিরাট ডিনার টেবিল। চেয়ারগুলো লাল ভেলভেটের গদি-মোড়া, বাঁকানো পায়ের। পিঠের দিকে বেশ কারুকার্যও আছে। সব আসবাবই সেগুন কাঠের, চকচকে পালিশঅলা, আকারে বড়ো। কাবার্ড, আলমারি সবই। বেমানান খালি একদিকে একটা খুব খুদে ফ্রিজ। আর তার ওপরে টেলিফোন। এই দুটো জিনিস বাদে ঘরখানাতে একটাও এ শতাব্দীর জিনিস নেই, বাজি ধরে বলতে পারি।

ঘরের আসবাবও ওই রকমই। ওয়ার্ডরোব, খাট, দেরাজ-আয়না। শুধু অতিরিক্ত বিছানা দিতে হলে, স্টিল ফ্রেমের ফিতে-লাগানো খাট দেওয়া হয়। ওপরে ডানলোপিলোর তোশক বা গদি যাই হোক।

এখানে বেশিরভাগ বাড়িই পোর্তুগিজ গোত্রীয় সাহেবদের। এটাই বোধহয় একমাত্র কলকাতাইয়া অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানের। অন্তত আমি যদ্দূর জানি। ব্যাবিংটন সাহেবের রং বেশ লালচে ফরসা, অনায়াসেই আসল সাহেব বলে চালিয়ে দেওয়া যায়। পঞ্চাশের ওপর বয়স মনে হয়, কিন্তু খুব মজবুত শরীর। কটা চুল। পাকা টাকা বুঝি না। সব সময়েই দেখি শর্টস পরে ঘোরে। খালি শীতের শর্টসটা একটু মোটা ধরনের, আর গরমেরটা পাতলা। গরমে অনেক সময়ে খালি গায়েও ঘুরতে দেখেছি।

চব্বিশে ডিসেম্বর পর্যন্ত আবহাওয়ায় শীতের কোনো লক্ষণই নেই। এমনিতেই সমুদ্রের ধারে শীত তত বোঝা যায় না। এবার যেন একটু বাড়াবাড়ি রকমের শৈত্যাভাব। এমনিতে বেশ মনোরম কিন্তু একটু রোদ উঠলেই আর সি-বিচে থাকা যাচ্ছে না। চান করে উঠে আমাদের পাশ দিয়ে যেতে যেতে কুহু আর গোবিন্দ বলতে বলতে গেল, ভাববা তো, পৃথিবীর নানান জায়গায়, এমনকী ভারতবর্ষেও কোথাও কোথাও এখন বরফ পড়ছে! এরা স্বামী-স্ত্রী বোধহয় অল্পদিন বিবাহিত, বিয়ের ঠিক পরেই বেরোবার সুযোগ পায়নি, এখন ক-মাস পরে এসেছে হনিমুনে। আছে আমাদের ডানদিকের ঘর দুটোর একটায়। আমরা ওদের নিজেদের মধ্যে বলি কুহু ও কেকা। খুব একটা ভাব না হলেও কুহুর সঙ্গে মাঝে মাঝে আমার ভালোই কথাবার্তা বিনিময় হয়। বেশ মিশুক মেয়েটা। আরেকটা ঘরে আছেন বি, সেন বলে এই ভদ্রলোক। এঁরও বয়স পঞ্চাশের ওদিকে। কিন্তু নিশ্চয় করে বলাও কিছু যায় না। মাথায় চুল বেশিরভাগই পাকা হলে হবে কি, বেশ তাগড়া চেহারা। হাঁটা-চলা সবল, দ্রুত। থলথলে না হলেও একটু মোটার দিকেই। তামাটে রং গায়ের। খুব শৌখিন। মাথায় বিদেশি ক্রিম-ট্রিম মাখেন বোধহয়, সবসময়ে একটু মৃদু গন্ধ বেরোয়, মনে হয় মাথার চুল থেকেই। গন্ধটা ঠিক ধরতে পারি না। জামাকাপড় জুতো সব ফিটফাট, যখনকার যা তখনকার তেমনটি। সবুজ রঙের সুইমিং ট্রাংক পরে চান করতে নামবেন, বিরাট একটা টার্কিশ তোয়ালে গায়ে জড়িয়ে। বিচ দিয়ে হাঁটছেন দেখব পাতলা লাটখাওয়া ট্রাউজার্স আর আলগা টি শার্ট পরে, পায়ে ক্যাম্বিসের জুতো। আবার সন্ধেবেলায় বসবেন, সুট-টাই হাঁকিয়ে, পালিশ করা কেতাদুরস্ত জুতো। তাই এঁকে আমরা বলি বড়োসাহেব। এঁর কাছে ব্যাবিংটন আপাতত ছোটোসাহেব হয়ে গেছেন। কুহু আর গোবিন্দ বা কুহু ও কেকা যেমনি হাঁসকুটে, গপ্পোবাজ, তেমনি একলফেঁড়ে ওই বি. সেন। কারও সঙ্গেই যেন আলাপ করার গরজ নেই। গতিবিধিও আমাদের সঙ্গে মেলে না।

দুই সাহেব সন্ধে থেকেই বোতল নিয়ে বসে। সমুদ্রের দিকের চাতালটায়। দৃশ্যটা ভারি মজার। বাঁ পাশে এক সারি মরকুটে ঝাউগাছ। আধভাঙা বালিয়াড়ির ওপর সিমেন্ট-চটা চাতাল। চাতালের ওপর গেলে স্টিলের ফোল্ডিং টেবলটা পেতে ফেলে ব্যাবিংটন। শওকত, তার হুকুমবরদার, স্টিলের ফোল্ডিং চেয়ার পেতে ফেলে যেন অন্তত আধডজন লোকের মজলিশ বসবে। পাপাম্মা, ব্যাবিংটনের আরেক হুকুমবরদার, একটি তেলেঙ্গি মেয়ে, বড়ো এক প্লেট কাজুবাদাম, বোতল গেলাস সব সাজিয়ে রেখে যায়। ওরা দুজনে সমুদ্রের দিকে চেয়ে বসে থাকে, হাতে গেলাস, মাঝে মাঝে চুমুক দিচ্ছে, নামিয়ে রাখছে, আবার তুলে নিচ্ছে। পাশাপাশি চেয়ারে বসে দুজনেই একেবারে আকাট চুপ। গম্ভীরভাবে, কেউ কারও দিকে না তাকিয়ে বসে বসে গিলে যাচ্ছে। অন্তত আমি তাই বলি। যাই হোক, গেলার প্রভাব কিন্তু কারও ওপরই বিন্দুমাত্রও পড়ে বলে মনে হয় না। ব্যাবিংটন আগেও যেমন হাসিখুশি সদাশয় ভদ্রলোক, পরেও ঠিক তেমনি। বি. সেন আগেও যেমন গোমড়া, পরেও তেমন গামড়া।

এই সময়টা কুহু-কেকা ফেরেই না, কোথায় কোথায় বেরিয়ে যায়, আমরা বুঝতেই পারি না। আমরাও সাড়ে সাতটা-আটটা পর্যন্ত বাংলোর কাছাকাছি সমুদ্রের ধারে বসে থাকি। যতক্ষণ দিনের আলো থাকবে ততক্ষণ বিচ ধরে বেড়াব, অন্ধকার হলেই বসে পড়ব। লাইট-হাউজটা কাছেই। অন্ধকার জলের ওপর লাইট-হাউজের আলোটা যতক্ষণ না ঘুরতে আরম্ভ করছে, ততক্ষণ আমার ছেলে বাবাই আমাদের উঠতেই দেবে না। এখান থেকে দুই সাহেবের পান-দৃশটা দেখা যায়। বাবাই বলে, মা, ওরা কত থামস আপ খাবে!

ঘোষ সাহেব অর্থাৎ বাবাইয়ের বাবা বলে, ওরা থামস আপ খাচ্ছে? তুই তো দেখছি বুন্ধু দা গ্রেট।

আমি চিমটি কেটে থামবার চেষ্টা করলে কী হবে, ঘোষ সাহেব তার সদাসত্য বলিবে কদাচ মিথ্যা বলিবে না নীতি অনুসারে বলে, থামস আপের বোতল তুই চিনিস না? ইয়ার্কি পেয়েছিস?

তবে কী খাচ্ছে বাবা, মদ? মদটা খুব চুপিচুপি বলে বাবাই।

এই তো ঠিক ধরেছিস ব্যাটা, বলে বাবা ছেলের পিঠে একটা বিরাশি-সি ক্কা ওজনের তারিফসূচক থাবড়া দিয়ে, জনান্তিকে আমাকে বলে, থামস আপ, ধোঁকা দিতে শিখেছে কেমন দেখেছ! তোর বাপ চেনে আর তুই চিনিস না?

আমরা তিন ঘর অতিথিই এক ডিনার-টেবিলে খাই। কিন্তু ভিন্ন ভিন্ন সময়ে। সবচেয়ে প্রথমে আটটা থেকে সাড়ে আটটার মধ্যে খেয়ে নেয় ব্যাবিংটন আর বি. সেন! নটা নাগাদ খাই আমরা। নব-দম্পতির খাওয়া সবচেয়ে দেরিতে। ওরা যখন খায় তখন আমরা সামনের, কি পেছনের চাতালে বসে গল্পগাছা করছি। নয়তো শুয়েই পড়েছি কোনো কোনো দিন। ওদের হাহা হুহু কানে আসে। পাপাম্মা বলে তেলেঙ্গি মেয়েটি, আমরা যতদিন আসছি, দেখছি ব্যাবিংটনের বাংলোতেই আছে। খুব ভালো রাঁধে, বিশেষ করে পশ্চিমি রান্না। খাওয়ার জন্যে আলাদা চার্জ দিতে হয়, যে যা খেতে চায় তা-ই বেঁধে দেয়। স্পেশ্যাল তেল-ঘি বা কোনো ডিশ খেলে সেগুলো কিনে দিতে হয়। এসব থেকে দু হাতে মারে, বুঝতে পারি। কিন্তু এত ভালো রাঁধে, আর এত ভালো ব্যবহার যে মেনে নিই। মেয়েটা আঁটসাঁট গড়নের, কুচকুচে কালো। মাথার বেণীতে সবসময়ে ফুল থাকবে, নাকের দুদিকে দুটো নাকছাবি। খুব পরিষ্কার। শাড়ি ব্লাউজ ঝকঝক করে, ভালো ট্যালকম পাউডারের গন্ধ বেরোয় গা থেকে। কাজেই আমাদের কোনো অসুবিধেই হয় না। হ্যাঁ বলতে ভুলেছি, ব্যাবিংটনের বাংলোর সবচেয়ে মজাদার অধিবাসী হল প্লুটো, একটা তাগড়া অ্যালসেশিয়ান। সবসময়ে নখের খপ খপ শব্দ করে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সকালবেলা মুখে করে কাগজ নিয়ে আসবে। পাপাম্মার সঙ্গে বাজারে যাবে, ভারী থলিটা মখে করে কামড়ে নিয়ে আসবে। যতক্ষণ পাপাম্মা টেবিলে পরিবেশন। করবে, টেবিলের একধারে থাবা দিয়ে দাঁড়িয়ে হ্যাঁ-হ্যাঁ করবে জিভ বার করে। একমাত্র ব্যাবিংটনের খাওয়ার সময়েই পাপাম্মা পরিবেশন করে, ব্যাবিংটন আর বি. সেনকে। আমাদের টেবিল সাজিয়ে দিয়ে চলে যায়। প্রথম প্রথম পরিবেশন করত, কিন্তু টেবিলের ধারে কুকুরটার অমনি দাঁড়িয়ে থাকা আমাদের মোটে পছন্দ হয় না, তাই ওকে বলি কুকুর নিয়ে চলে যেতে, হয়ে গেলে সব তুলে-টুলে নেয়। রাতে আবার কুহু-কেকা খেতে এলে, সব গুছিয়ে দিয়ে চলে যায়। দশটার পর ও আর বাংলোয় থাকতে চায় না। আউট-হাউজে চলে যায়।

যাই হোক, চব্বিশে পর্যন্ত বেশ ছিল। পঁচিশে সকাল থেকেই আরম্ভ হল বৃষ্টি। ঘ্যানঘেনে, প্যানপেনে। সেইসঙ্গে হাওয়া চলছে খুব। আমরা জানি ব্যাবিংটন ক্রিসমাস করে খুব ঘটা-পটা করে। জানি মানে জানতাম, ওর কাছে থেকেই শুনেছিলাম। এবার দেখবার সুযোগ হল। মাঝের হলঘরটা চব্বিশ তারিখে সারাদিন ধরে পরিষ্কার হল। লোক বলতে শওকত, সেই আধবুড়ো ড্রাইভার, পাপাম্মা, ব্যাবিংটন আর প্লুটো। একটা অ্যান্টিরুমে ক্রিসমাসের সব সাজ-সরঞ্জাম থাকে। সেখান থেকে ওর কৃত্রিম ফারগাছ বেরোল, বেরোল চকচকে সব কাগজের শিকলি। চীনে লণ্ঠন, গুচ্ছের নানান আকার নানান আয়তনের বেলুন, জাপানি ফিতের ফুল। আর একটা বিরাট সোনালি বেথলিহেম স্টার। বেশিরভাগ জিনিসই মুখে করে করে নিয়ে এল প্লুটো। আমার ছেলেও মহা উৎসাহে হাত লাগাল। ব্যাবিংটন বলল, তার ফারগাছের শাখা থেকে উপহারের প্যাকেট ঋলবে, ভালো করে প্যাক করে আমরা যেন সব রাত্তিরে টেবিলে রেখে যাই। কার উপহার বোঝ যাবে, কিন্তু কে দিচ্ছে বাইরে থেকে বোঝা গেলে চলবে না। যা ববা বা। ঘোষ সাহেব বললে, পড়েছি ব্যাবিংটনের হাতে, খানা তো খানা, আরও কত কী সঙ্গে করতে হয় দেখো। তা যা পারলাম, করলাম।

কিন্তু ওই যে বললাম সকাল থেকে ঘ্যানঘ্যানে বৃষ্টি। হাওয়া ভীষণ জোলো। ঠান্ডা। গায়ে যেন ভিজে কম্বল লেপটে আছে। দু-একবার পেছনের চাতালে যাবার চেষ্টা করলাম। দেখি এলোমেলো হাওয়া দিচ্ছে, অর্থাৎ ক্রমশই সাইক্লোনিক হয়ে যাচ্ছে ওয়েদার। ব্যাবিংটন বলল, মিসেস ঘোষ, খবরদার ওদিকে যেয়ো না। হঠাৎ দমকা হাওয়া এসে উড়িয়ে নিয়ে গিয়ে একেবারে আছড়ে ফেলে দেবে সি-বিচের ওপর।

সর্বনাশ! তাড়াতাড়ি শওকতকে ডাকি। আমি না হয় না গেলাম। কিন্তু বাবাই। সারাদিন ঘরের মধ্যে থেকে উত্যক্ত হয়ে রয়েছে, যা দস্যি, টুক করে সবার অলক্ষ্যে ওদিকে চলে গেলেই হল। শওকত, পাপাম্মা, ব্যাবিংটন সবাই মিলে ঝোড়ো হাওয়ার মুখে সেই বিশাল দরজা বন্ধ করে দিল। দুপাশ থেকে দুটো চওড়া লোহার খিল পড়ল। লাউঞ্জের দিকের দরজাও বন্ধ। আমাদের সব ঘরের জানলার শার্সিও বন্ধ। এবার ঝড় এ চত্বরের বাইরে যত খুশি মাতামাতি করুক।

সন্ধে হতেই ঝাড়লণ্ঠনে মোম জ্বলে উঠল। চীনে লণ্ঠন জ্বলে উঠল, ক্রিসমাস ট্রির গায়ে ছোটো ছোটো টুনি বালব জ্বলে উঠল। চারিদিক ঝিকমিক ঝিকমিক করছে। বিশেষ করে হলের দরজার মাথায় সেই সোনালি রঙের বেথলিহেম স্টারটা। সেটা থেকে রীতিমতো আলো ঠিকরোচ্ছে।

কী মাস্টার বাবাই, এবার তোমার মন ভালো হয়েছে? ব্যাবিংটন বলল। জবাবে বাবাই দুম করে একটা বন্দুক ফাটাল। সবাই হা-হা করে হেসে উঠল। ব্যাবিংটন বলল, ব্যাস, আমাদের ক্রিসমাস উৎসব আরম্ভ হয়ে গেল। প্লুটো পর্যন্ত দেখি প্রচণ্ড ল্যাজ নাড়াতে নাড়াতে ঘুরে বেড়াচ্ছে। অর্থাৎ তারও খুব আহ্লাদ।

ভোজ হল জমাট রকম। ছোটো ছোটো চিকেনের গোটা রোস্ট। বাঙালি পোলাও, প্রতি গ্রাসে কাজু, কিসমিস, মটরশুটি। পমফ্রেটের ফ্রাই। দু রকম স্যালাড। আর ক্রিসমাস পুডিং পাপাশা সত্যিই দারুণ রাঁধিয়ে। একেবারে ওস্তাদ। ওর রান্নার লোভেই বোধহয় ব্যাবিংটনের ভুতুড়ে বাড়িতে সারা বছর একটা গেস্টের ধারা অব্যাহত থাকে। আজকের ভোজটা আবার ব্যাবিংটনই দিতে চেয়েছিল। আমরা সবাই আপত্তি করেছি। জোরজার করে চাঁদা দিয়েছি। কাউন্টারে গাবদা খাতা খুলে বসে হিসেব কষলেও, তেমন কিছু উপার্জন ওর নেই। নইলে গত ছ-সাত বছর ধরে দেখছি তো! রঙ তো দূরের কথা, বাড়িটাকে চুনকাম পর্যন্ত করায়নি একবারও। শুধু কিছু কিছু প্লাস্টারের তাপ্পি চলছে জায়গায় জায়গায়।

সবাই যে যার গিফট পেয়ে গেছি। বাবাইয়ের কোলে তো অ্যাত্তোগুলো জড়ো হয়েছে। তার পরেই ব্যাবিংটনের। আমরা সবাই দু-তিনটে করে পেয়েছি। খুলতে যাব, ব্যাবিংটন বলল, ধৈর্য ধরো মিসেস ঘোষ, প্যাকেট খুলবে একেবারে রাত্তিরে, যে যার ঘরে গিয়ে। এখন আড়া। খালি মাস্টার বাবাই যা ইচ্ছে করতে পারে। বাবাই তৎক্ষণাৎ তিন লাফ দিয়ে একটার পর একটা প্যাকেট খুলতে লাগল। টিনটিনের কমিকস পেয়েছে দুটো, ব্যাবিংটন দিয়েছে। একটা ইয়াবড় টয়লেট সাবান, বিদেশি–বি, সেন দিয়েছেন অবশ্যই। কাজুবাদামের প্যাকেট-কুহু ও কেকা। আমরা আসবার সময়ে একটা স্ক্র্যাবলস গেম কিনে এনেছিলাম, সেটাই দিয়েছি। ভাগ্যিস, ওকে আগে দেখাইনি।

বাবাই তার উপহারের প্যাকেট সব দু হাতে আঁকড়ে ধরে ঘরের মধ্যে ঢুকে গেল। এখন ও কমিকস দুটো গোগ্রাসে গিলবে।

ব্যাবিংটন বলল, কী? আড্ডায় সবাই রাজি তো?

আমাদের তো কোনো আপত্তিই নেই। কুহুরাও দেখলাম খুব উৎসাহী।

কী মিস্টার সেন? বসছেন তো? ঘোষ সাহেব জিজ্ঞেস করলেন।

বি. সেন ধীরসুস্থে একটা পাইপ ধরালেন, তারপর এই প্রথম চাপা হাসিতে উজ্জ্বল মুখে বললেন, ইয়েস। অফ কোর্স। তবে অন কন্ডিশন। যদি ইন্টারেস্টিং গল্প শুনতে পাই।

ব্যাবিংটন বলল, ইন্টারেস্টিং গল্প? মানে ভূতের?

বি. সেন বললেন, প্রেমের হতে পারে।

প্রেম আর ভূত? কুহু খিলখিলিয়ে হেসে উঠল।

একটু ভেবে দেখলেই বুঝতে পারবেন দুটোর মধ্যে কিন্তু প্রচুর মিল আছে, বি. সেন মিটিমিটি হেসে বললেন।

ঘোষ সাহেব বললেন, কেন? প্রেমও ভূতের মতো হুট করে ঘাড়ে চাপে, তারপর পট করে ঘাড় মটকায় বলে?

ব্যাবিংটন বললে, ছিঃ মহিলারা মনে কষ্ট পায় এমন কথা না-ই বললে মিঃ ঘোষ! বলছে বটে, কিন্তু তার মুখে দুষ্টু হাসি।

আর কোনো মিল? দুটোর মধ্যে? বি. সেন চারদিকে চোখটা ঘুরিয়ে নিলেন একবার, যেন কুইজ-মাস্টার!

কেকা অর্থাৎ গোবিন্দ বলল, আমি একটা মিলের কথা বলতে পারি—ভূতও নেই, প্রেমও নেই।

ব্যাবিংটন এবারে সশব্দে প্রতিবাদ করে উঠল, নো, নো, ইয়াং ম্যান। তুমি একটা সদ্য-বিবাহিত যুবক। হনিমুন কাটাতে এসেছ, তোমার মুখে এসব কথা! নো, নো… ব্যাবিংটন মাথা নাড়তে লাগল।

বললে আর কী করবেন? ঠ্যাঙাতে পারবেন? দিন না বেশ করে দু ঘা। কুহু হাসতে হাসতে বলল।

এরই মধ্যে বি. সেনের গলার আওয়াজ শোনা গেল।

উঁহু। প্রেম আছে, যেমন ভূতও আছে। কী বলেন, মিসেস ঘোষ!

সবাইকে ছেড়ে আমাকেই ভদ্রলোক সাক্ষী মানলেন কেন বোঝা গেল না। বললাম হ্যাঁ কবি বলেছেন বটে বোঝা গেল না, গেল না। ওকি মায়া কি স্বপনছায়া? ও কি ছলনা?

কুহুর যেমন অভ্যেস। সে হেসে গড়াতে লাগল। অন্য সবাইয়েরও স্মিত মুখ। ব্যাবিংটনের সুদ্ধ। যদিও এত শক্ত বাংলা ও বুঝতে পেরেছে কিনা আমার সন্দেহ আছে। কিন্তু বি. সেন যেন হাসিটা গিলে নিয়ে বললেন, এ তো রোমান্টিক ব্যাপারস্যাপারের কথা বলছেন। প্রেমের রহস্য কিন্তু আরও অনেক সিরিয়াস।

রোমান্টিক হলে সেটা কেন আর সিরিয়াস হবে না আমি বুঝতে পারলাম না। রোমান্টিক শুনলে নিউ জেনারেশন নাক সিঁটকোয়, ইনি নিউ জেনারেশন না হয়েও নাক সিঁটকোচ্ছেন। অথচ এ যুগের রোববা, ডাইনোসর, মাইকেল জ্যাকসন এসব যেন আর রোম্যান্টিক নয়! তবে বি. সেন লোকটা যে রকম ঘোড়েল, ও যে চূড়ান্ত রকমের আনরোমান্টিক হবে তাতে আর কোনো সন্দেহ নেই।

এই সময়ে ব্যাবিংটন চোখ গোলগোল করে বলল, প্রেম আর ভূত দুই-ই আছে, এমন একটা গল্প শুনবে না কি?

কুহু এগিয়ে বসে বলল, বলুন মি. ব্যাবিংটন প্লিজ।

তাহলে কফি খাওয়াও। পাপাম্মা আউটহাউজে চলে গেছে। তোমার হাতের কফি খাই। কুহু কোমরে শাড়ি জড়িয়ে উঠে পড়ল। বলল, নিশ্চয়ই। রান্নাঘরের দিকে চলে গেল ও। মিনিট কয়েক পরেই ওদিক থেকে ডাকল, রীনাদি, একটু হেল্প করবে এস না।

আমি উঠে পড়ে রান্নাঘরে যেতেই খুব উত্তেজিত কাঁপা-কাঁপা গলায় বলল, কী গিফট পেয়েছ রীনাদি?

এখনও তো খুলিনি।

আমি আর কৌতূহল সামলাতে পারিনি ভাই, খুলে ফেলেছি এই দ্যাখো, একটা কী রহস্যময় গিফট পেয়েছি! বলে ও একটা দামি কাগজ মেলে ধরল। তার মধ্যে একটা লিপস্টিক। কাগজটাতে লেখা, উইথ কিসেস।

কে বলো তো?

আমি হেসে উড়িয়ে দিলাম। বললাম, তোমার বর আবার কে?

ও চিন্তিত হয়ে বলল, এটা মোটেই ওর হাতের লেখা নয়। ওর কাগের ঠ্যাং বগের ঠ্যাং আমি চিনি।

আমি হেসে বললাম, আমার বরেরও নয়, একটু আশ্বাস দিতে পারি। ও ভুরু কুঁচকে কফি তৈরি করতে লাগল, ইতিমধ্যে আমি চট করে ওই চাতালের দিকের দরজা দিয়ে নিজেদের ঘরে ঢুকে দেখি বইটই, খেলনা-টেলনা ছড়িয়ে বাবাই ঘুমিয়ে কাদা। আমার প্যাকেটগুলো খুললাম। এক প্যাকেট খুব সুন্দর বাহারি মোমবাতি। কে দিয়েছে নাম নেই। আমার কর্তা কিসসু দেয়নি মনে হল, কিন্তু এ কী? কুহুর মতোই একটা কাগজের প্যাকেট না? খুলে দেখি ভেতরে একটা ছোট্ট পারফুমের শিশি, কাগজে লেখা, টোয়েন্টি সেভেন্থ, মিডনাইট, হোয়েন দা ওয়ার্ল্ড ফলস অ্যাস্লীপ লাস্ট চান্স। ওবলাইজ। ভেনু-ব্যাক টেরেস।

এ কি রে বাবা! আমরা অবশ্য আঠাশে সত্যিই চলে যাচ্ছি। কিন্তু এ লেখার কী মানে? কেউ ঠাট্টা করেছে? ব্যাবিংটন জানে আমরা কবে যাব। অন্যরা জানলেও জানতে পারে। কিন্তু ঠাট্টাও যদি হয়, কী জংলি আপমানজনক ঠাট্টা! আমার মাথার মধ্যেটা জ্বলতে লাগল। কাগজটা বালিশের তলায় কোনোমতে দুমড়ে খুঁজে রেখে রান্নাঘরে ফিরে গেলাম। কুহুর কফি তৈরি হয়ে গিয়েছিল।

আমি নিয়ে গেলাম ট্রে-টা। পেছনে আর একটা ট্রেতে বিরাট পট-টট নিয়ে ও।

কুহু বসে পড়ে বলল, নিন এবারে বলুন। প্রেমিক ভূত, না ভুতুড়ে প্রেম বলতে বলতে কুহু আমার দিকে অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে চাইল। বুঝতে পারছি ও ব্যাবিংটনকে সন্দেহ করছে।

ভয় পেলে কিন্তু চলবে না। ব্যাবিংটনের মুখ এখন আরও গোল হয়ে গেছে।

আমি বললাম, ভয়? যা নেই তাকে ভয়টয় আমরা করি না মি. ব্যাবিংটন। তবে যা আছে কিন্তু লুকিয়ে আছে তাকে একটু ভয় পাই। কুহু মুচকি হেসে আমার দিকে চাইল।

ব্যাবিংটন বলল, হেই প্লুটো, এদিকে আয় তো!

গরগর গরগর করে একটা চাপা আওয়াজ করে অ্যালসেশিয়ানটা এগিয়ে এলো, ব্যাবিংটনের চেয়ারের পাশে থাবা গেড়ে বসল। ল্যাজটা খুশিতে যেন লাফাচ্ছে।

এর কত বয়স হবে বলো তো?

কত হবে? দশ কি এগারো। বড়োসাহেব বি. সেন বললেন। বলবার হক ওঁরই আছে মনে হল। আমার আবার কুকুর-টুকুর আসে না।

কুহু আমার কানে কানে বলল, নেড়ি কুকুর ছাড়া আর কোনো কুকুরেরই বয়স বাবা আমি বলতে পারি না।

আমি চুপিচুপি জিজ্ঞেস করলাম, নেড়ি কুকুরেরটাই বা কী করে পার?।

আমাদের বাড়ির একতলার গুদোমঘরে একটা নেড়ি বাচ্চা পেড়েছিল। পাঁচটার মধ্যে চারটে বছরখানেকের মধ্যেই মরে গেল। পঞ্চমটা সাত বছর পরে, ঠিক যে গুদোমে জন্মেছিল সেইখানেই এসে মরে।

এই সময়ে ব্যাবিংটন ঘোষণা করল, প্লুটোর উনিশ বছর বয়স পেরিয়ে গেছে।

ইমপসসিবল, বি. সেন বললেন।

ব্যাবিংটন বলল, এগজ্যাকটলি। আমিও তাই বলি। কিন্তু সম্ভব হয়েছে। হয়তো প্লুটো প্লুটো নয়। অন্য কেউ।

মানে? বি. সেন মুখ থেকে চুরুট সরিয়ে ফেলেছেন।

ব্যাবিংটন বলল, তোমরা ট্রান্সমাইগ্রেশন অফ সোলস মানো? বিশ্বাস করো?

বি. সেন বললেন, আরে জন্মান্তরবাদ তো আমাদের সংস্কারের মধ্যে ঢুকে বসে আছে। মানি বা না মানি।

আমার কর্তা বলল, না না, উনি বোধহয় সেই পিথ্যাগোরাসের থিয়োরির কথা বলছেন, একজন মারা গেল তো তার আত্মা হয়তো অন্য কেউ, এমনকি কোনো জন্তুজানোয়ারকেই গিয়ে আশ্রয় করল। বহু পুরোনো তত্ত্ব। তাই না, মি. ব্যাবিংটন?

ব্যাবিংটন নীরবে মাথা নাড়ল।

অলরাইট, বলো তোমার গল্প—বি. সেন চুরুটের ছাই ঝেড়ে বললেন।

ব্যাবিংটন বলতে লাগল, পাপাম্মাকে দেখছ তো! অন্ধোর মেয়ে। ক্রিশ্চান। সব কিছুতে একসপার্ট। তেমনি বিশ্বাসী। প্রথমে ওর মা এখানে কাজ করত, ও স্কুলে পড়ত। তারপর ওর মা হঠাৎ মারা যেতে ও আমার কাছে আশ্রয় চাইল। আপন আর কেউ নেই। সেই থেকে কাজ করতে আরম্ভ করল এখানে। ওর মা থাকত দূরে, ওদের বস্তিতে, ও কিন্তু এইখানে আউটহাউজটা পরিষ্কার করে থাকতে আরম্ভ করল। কিছুদিনের মধ্যেই কাজকর্মে মাকে তো বটেই, আরও অনেককেই ছাড়িয়ে গেল। আমার তো একেবারে ডান হাত। গেস্টদের এমন যত্ন করত যে কিছুদিনের মধ্যেই আমার বাংলোর কথা চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল। সারা বছর গেস্ট। আর আমাকেও এমন দেখাশোনা করত যে আমি বলতাম ও একাধারে আমার পাপা আর মা। এইভাবে বেশ চলছিল। ইতিমধ্যে একটি ক্রিশ্চান ছোকরা ওর প্রেমে পড়ল। অন্ধোরই ছেলে। বোধহয় সাত-আট ক্লাস পর্যন্ত পড়েছে, তাইতেই নিজেকে নিজেদের কমিউনিটির মধ্যে একটা কেউকেটা গোছের ভাবতে শুরু করেছে। শুটকি মাছ চালানের ছোটোখাটো কারবার করে সেই যোসেফ এসে পাপাম্পাকে বিয়ে করতে চাইল। কী আর করি। বললাম, করতে পার, কিন্তু আমার আউটহাউজে তাই বলে থাকতে দেব না। যোসেফের মতলব ছিল ওকে কাজ থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে যাওয়া। কিন্তু পাপাম্মা এতদিন এই পরিবেশে মানুষ। এত বড়ো বাড়িতে স্বাধীনভাবে ঘুরে বেড়ায়, নানান রকমের মানুষ দেখে, কত মেমসাহেবদের সঙ্গে কথাবার্তা বলে, আমার কাছ থেকে লেখাপড়াও আরও শিখছিল, ভালো ভালো খানা রান্না করে, ফুলবাগান করে, তার ওখানে পোষাবে কেন? সে যেমন আমার কাজ করছিল করতে লাগল। কিন্তু আর এখানে থাকত না।

কফিতে চুমুক দিল ব্যাবিংটন। কুহুর বর বলল, মি. ব্যাবিংটন, শেষ পর্যন্ত আমাদের চাকরানির প্রেমের গল্প শোনাচ্ছেন?

বি. সেনের মুখের ওপরও এক চিলতে তাচ্ছিল্যের হাসি ফুটে উঠল। ব্যাবিংটনের মুখটা থমথম করছে, বলল, ওহ, তার হাতের রান্না খেয়ে রোজ তারিফ করতে পার, তার পাতা বিছানার শুয়ে স্বপ্ন দেখতে পার, আর তার যে একটা প্রাইভেট লাইফ আছে, সেটাও ইন্টারেস্টিং হতে পারে, তা মানতে চাও না! বেশ আমি আর বলছি না।

প্লুটো গরগর করে দুবার ল্যাজ ওলটপালট করল।

কুহু তিরস্কারের দৃষ্টিতে গোবিন্দর দিকে তাকিয়ে বলল, না না, মি. ব্যাবিংটন বলুন, প্লিজ, ও না শোনে, না শুনুক, আমাদের খুব ভালো লাগছে।

ব্যাবিংটন আর এক চুমুক দিল কফিতে। পট থেকে আরও একটু ঢালল। আমার কর্তা ঘোষ সাহেব বলল, আরে, বলোই না ব্যাবিংটন। আমরা সবাই এখন মেজাজে আছি। এমন করে কেউ দুম করে সুইচ অফ করে?

ব্যাবিংটনের বলবার ইচ্ছে মোলো আনা। আমার ভেতরের রাগ আর জ্বালা এখনও থামেনি। অর্ধেক মন দিয়ে শুনছি। আর অর্ধেক মন দিয়ে ভাবছি লোকটা কে? কী করে এর শোধ নেওয়া যায়। ওদিকে ব্যাবিংটন বলে চলেছে।

যোসেফের সব ভালো। রোজগার ভালো করত। ফিটফাট বাবু থাকত সবসময়ে। পাপাম্মাকে ভালোও বাসত খুব। কিন্তু এক দোষে সব গুণ বরবাদ। ভয়ানক মদ খেত। আর মাতাল হয়ে গেলে তার আর জ্ঞান থাকত না। বউকে মেরে ধরে একশা করে দিত। সন্দেহ বাতিকও ছিল প্রচণ্ড। ওদের পাড়ায় পাপাম্মার মতো মেয়ে তো আর ছিল না। স্মার্ট, শিক্ষিত, রুচি বলে একটা জিনিস আছে, কেতাদুরস্ত। ব্যাস, অমুকের সঙ্গে কথা বলেছিলি কেন? অমুকের সঙ্গে বাজার গেলি কেন? মার, প্রচণ্ড মার।

চোখ মুছতে মুছতে মেয়েটা কাজ করতে এলে বলতাম, দূর, মদ খেয়ে নিজের পয়সাগুলোও উড়োচ্ছে, তোরগুলোও উড়োচ্ছে। রোজ ঠ্যাঙাচ্ছে। দে ওকে ছেড়ে, না হয় অন্য কাউকে বিয়ে কর।

ও বলত, ভাবি তো সায়েব, কিন্তু যোসেফ তাহলে পাগল হয়ে যাবে, নেশা কেটে গেলে অন্য মানুষ একেবারে। পায়ে ধরে কান্নাকাটি করবে, এই দ্যাখো কেমন নাকছাবি গড়িয়ে দিয়েছে। আর অন্য কাউকে বিয়ে! যোসেফ বেঁচে থাকতে? যোসেফকে ছেড়ে? যোসেফ তাকে খুনই করে ফেলবে।

বি, সেন একটু হেসে বললেন, যাক, এতক্ষণের লভের মোটিফটা স্পষ্ট হচ্ছে।

ব্যাবিংটন তখন গল্পের ঘোরে। সে অত লক্ষই করল না। সে বলে চলল।

তার পর একদিন মেয়েটা আমার কাছে এসে একেবারে আছড়ে পড়ল। সারা পিঠে দাগড়া দাগড়া লাল দাগ। বেত না লাঠি কী দিয়ে নিমর্মভাবে পিটিয়েছে। সর্বাঙ্গে কালশিটে, ফুলো, মাথা ফেটে রক্ত পড়ছে, চোখমুখ ফুলে গেছে, আমি বললাম, এ কী? এ যে তোকে খুন করে ফেলতে বাকি রেখেছে। আমি এখুনি যাচ্ছি থানায়, ডায়েরি করতে। তো মেয়েটা বললে, থানায় যেও না সাহেব, ও ওর যা খুশি করুক, জাহান্নামে যাক, আমি আর ওর কাছে ফিরছি না। বলে আউটহাউজে ওর পুরনো জায়গায় গিয়ে শুয়ে রইল। ডাক্তার ডাকলাম। কপালে স্টিচ হল, মাথায় ব্যান্ডেজ হল। ওষুধ ইঞ্জেকশান।

এটা সকালের কথা, দুপুরবেলায় যোসেফ এল। ত্যান্ডাইম্যান্ডাই নেই। ভয়ে একেবারে এতটুকু হয়ে গেছে, আমি বললাম, গেট আউট, আভভি নিকালো হিয়াসে। পায়ে পড়ে গেল। এমন আর কখনও হবে না সাহেব, মা মেরির দিব্যি, যিশুর দিব্যি, আমি আর মদ ছোঁব না। মাতাল হলেই আমার ভেতর থেকে শয়তান বেরিয়ে আসে। কিছুতেই যাবে না। ছিনে জোঁক একেবারে। সকালে আসছে, দুপুরে আসছে, সন্ধেয় আসছে—একবার, একটিবার ওর সঙ্গে দেখা করিয়ে দাও সাহেব। কত আর হাঙ্গামা সইব। একদিন বললাম, ঠিক আছে যাও। কিন্তু কোনো ঝামেলা করবে না। নিক বাবা, নিজেদের মধ্যে বোঝাপড়া করে নিক।

আউটহাউজের জানলা খোলা। আমার অফিস থেকে দেখা যায়। দেখতে পাচ্ছি–পাপাম্মা শুয়ে রয়েছে। কপালে ব্যান্ডেজ, মুখের নানা জায়গায় স্টিকিং প্লাস্টার আটকানো। যোসেফ ঘরে ঢুকে আস্তে আস্তে গিয়ে কপালে হাত রাখল। সঙ্গে সঙ্গে চমকে উঠে বসল মেয়েটা। ওর হাতটা ছুড়ে ফেলে দিল। খাট ছেড়ে ঘরের কোণে চলে গেল। কী বলছে শুনতে তো পাচ্ছি না। কিন্তু ভঙ্গি দেখে বুঝতে পারছি বেরিয়ে যেতে বলছে। আরও কদিন এল। খিল এঁটে পড়ে রইল মেয়েটা। দরজাই খুলল না। ভালো হয়ে উঠে একদিন রান্নাঘরে কাজ করছিল দূর থেকে যোসেফকে আসতে দেখেই রান্নাঘরের দরজা বন্ধ করে দিল। ভেতর থেকে শাসাতে লাগল, যোসেফ এক্ষুনি চলে না গেলে পুড়ে মরবে। সে এক কেলেঙ্কারি ব্যাপার।

এর কদিন পরে শুনলাম যোসেফ বিষাক্ত মদ খেয়ে মরে গেছে। এ রকম এখানে মাঝে মধ্যে হয়। মেছোগুলো প্রচণ্ড টানে, যত সস্তা পাবে, তত টানবে। নানারকম বিষক্রিয়া হয় তাতে। একটু ধরপাকড় হয়। আবার যে কে সেই। আরও কয়েকটা লোকও অসুস্থ হয়ে পড়েছিল, কিন্তু মারা গেল একা যোসেফ। লোকটা কি আত্মহত্যা করল? না কি ব্যাপারটা কাকতালীয়? ঠিক বুঝলাম না। যা জ্বালাচ্ছিল, মনে মনে ভাবলাম আপদ গেছে। পাপাম্মারও কোনো ভাবান্তর নেই। মুখ টিপে আছে একেবারে। চোখে জল-টল কিছুই দেখলাম না।

সেই সময়ে প্লুটো কিছুদিন হল আমার কাছে এসেছে। নেহাত ছেলেমানুষটি নয়। ছিল এখানকারই ডি সুজা সাহেবের কুকুর। আমায় ভলোই চিনত। ডিসুজা সব বেচেবুচে চলে গেল অস্ট্রেলিয়া, কুকুরটাকে আমার কাছে দিয়ে গেল। ক বছরই বা বাঁচবে আর, কোথায় ফেলব, একে একটু যত্ন কোরো ব্যাবিংটন। সঙ্গে, ওই যে ড্রেসারটা দেখছ ওটাও উপহার দিয়ে গেল। তা তো দিল। প্লুটোকে নিয়ে পড়লাম মহা মুশকিলে। আমাকে চেনে, কোনো অসুবিধে করে না, কিন্তু কদিন পর থেকেই নিজের মনিবকে দেখতে না পেয়ে ভীষণ মনমরা হয়ে গেল। যোসেফ যখন হাঙ্গামা করছে সে সময়টা আমি প্লুটোকে নিয়ে অস্থির। খেতে দিলে খায় না। জল পর্যন্ত খুব তেষ্টা না পেলে খাবে না। বাইরের চাতালে গিয়ে মুখ উঁচু করে করুণ সুরে কাঁদে। ক্রমশই শীর্ণ হয়ে পড়ছে। কমজোরি হয়ে পড়ছে। থাবায় মুখ গুঁজে শুয়ে থাকে আর শরীরটা থর থর করে কাঁপে। মাছি ঘোরে আশেপাশে। বুঝলাম একে বাঁচাতে পারব না। যে কোনো মুহূর্তে মরে যাবে।

ঠিক আগের দিন যোসেফ মারা গেছে, খবর এসেছে পরদিন সকালবেলা। আমি বাগানে কাজ করছি। হঠাৎ দেখি ঝাঁঝরি হাতে পাপাম্মা রান্নাঘরের দিক থেকে দৌড়তে দৌড়তে আসছে। মুখে প্রচণ্ড আতঙ্ক।

সায়েব, সায়েব ওর পেছন পেছন দেখি প্লুটোও আসছে। মাংসপেশিগুলো ফুলে উঠেছে। শীর্ণ, কমজোরি ভাবটা আর নেই।

দেখে তো আমি খুব খুশি। বললাম, ডর খাচ্ছিস কেন? এতদিনে কুকুরটা পোষ মানল।

পাপাম্মা তেমনি ভয়ের সঙ্গে বলল, যোসেফ, যোসেফ এসেছে।

কোথায় রে? আচ্ছা তো! দিনের বেলায় ভূত দেখছে! এদের যা কুসংস্কার! বললাম, চল দেখি কোথায় তোর যোসেফ।

আঙুল দিয়ে প্লুটোকে দেখিয়ে বলল, ওই যে ওর মধ্যে ঢুকেছে। রান্নাঘরে একেবারে আমার কাপড়ের মধ্যে ঢুকে গেছিল। আমরা সবাই হেসে উঠেছি। আমি সুষ্ঠু। বি. সেন সুষ্ঠু।

ব্যাবিংটন গম্ভীরভাবে আমাদের সবার দিকে তাকিয়ে বলল, আমিও প্রথমটা হেসেই ছিলাম। কিন্তু তারপর ব্যাপারটা লক্ষ করলাম। পাপাম্মা খেতে না দিলে খাবে না, খেতে খেতে মাঝে মাঝেই ওর দিকে চাইবে, চোখে যেন জল। কালো কালো কী রকম চোখ দেখছ তো? চাউনি যেন কুকুরের মতো নয়। কোনো মতেই নয়। আস্তে আস্তে মেয়েটার ভয় কেটে গেল। আমাকে বলল, দেখো সাহেব, ও যে যিশুর নামে দিব্যি গেলেছিল ভালো ছেলে হবে, দেখো হয়েছে।

কী রে প্লুটো? হয়েছিস ভালো ছেলে? ব্যাবিংটন অ্যালসেশিয়ানটার দিকে তাকাল। প্লুটো অমনি পেছনের পারে ভর দিয়ে, ব্যাবিংটনের কাঁধের ওপর দুই থাবা রেখে উঠে দাঁড়াল।

দেখে কুহু আমার দিকে ঘেঁষে এসে বলে উঠল বাবা রে!

প্লুটো বলল, ঘাঁউ ঘাঁউ! তারপরে আবার থাবা নামিয়ে শান্তশিষ্ট হয়ে যেমন বসেছিল, বসে পড়ল।

বি. সেন মুচকি হেসে নিবে-যাওয়া চুরুটে অগ্নিসংযোগ করে বললেন, আচ্ছা একখানা আষাঢ়ে গল্প শোনালে যা হোক।

ব্যাবিংটন গম্ভীর হয়ে গেল, বলল, ও কীভাবে বাজারের থলি বয়ে নিয়ে আসে, কাগজ নিয়ে আসে মুখে করে, দুধঅলা, ডিমঅলা, মাছঅলা এলেই চেঁচিয়ে ডাকে পাপাম্মাকে খেয়াল করেননি? দেখেননি কীভাবে গাল চেটে পাপাম্মাকে আদর করে, সারাটা দিন ওর পায়ে ঘোরে, রান্নাঘরে ওর হাতা-বাসন পর্যন্ত এগিয়ে দেয়!

বি. সেন বললেন, অনেক কুকুরই এরকম করে থাকে মি. ব্যাবিংটন। শেখালেই করে। আমার তিনটে কুকুর আছে, আমি জানি। মনিবকে, যে খেতে দেয় তাকে, এরা, বিশেষত এইসব পেডিগ্রি ডগগুলো ভীষণ মানে। আমার তো মনে হয় তোমার কুক ওই মেয়েটির থেকে ও তোমারই বেশি ভক্ত। খাওয়াদাওয়া হয়ে গেছে, এখন আর ওর খোঁজ করছে না। তোমার সঙ্গে সেঁটে রয়েছে।

ব্যাবিংটন আরও গম্ভীর হয়ে বলল, সে কথা নয় আসলে রাত হলে ও আর আমার কাছছাড়া হতে চায় না।

কেন? এর মধ্যে বিশেষত্বই বা কী আছে? ঘোষ সাহেব বলল।

ব্যাবিংটনের মুখ ঈষৎ লাল। বলল, দেখো না কেমন বেয়াড়া লোকটা।এক্কে! বারে সন অফ এ বিচ। যত বলি ও মেয়েটা আমার বাপ-মা, সব। আমাকে বিশ্বাস করতে চায় না। সারা রাত আমাকে ঠায় পাহারা দেবে। টয়লেট পর্যন্ত হুশ হুশ করে ঢুকে যাবে। টয়লেটটা আউটহাউজের দিকে মুখ করে কি না। পাঁড় জেলাস শয়তানটা, দেখবে? বলতে বলতে ব্যাবিংটন হাত বাড়িয়ে দেয়ালে একটা সুইচ টিপল।

কিছুক্ষণ পরই হলঘরের লাউঞ্জের দিকের দরজাটার বেল বাজল। ব্যাবিংটন আমার দিকে তাকিয়ে বলল, মিসেস ঘোষ, যদি কিছু মনে না করো তুমিই গিয়ে দরজাটা খুলে দাও। একটু কষ্ট হবে, তবু তুমিই দাও, দেবে?

আমি বললাম, নিশ্চয়ই।

কিন্তু তার আগেই লাফিয়ে উঠেছেন বি. সেন। দরজার দিকে যেতে যেতে বলছেন, হোয়াট ননসেন্স, এই ভায়োলেন্ট ওয়েদারে একজন মহিলাকে দরজা খুলতে পাঠানো?

ব্যাবিংটন বলে উঠল, না সেন, তুমি যেও না, লেট মিসেস ঘোষ গো, শি শিওরলি ওন্ট মাইন্ড!

কিন্তু ততক্ষণে বি. সেন দরজার কাছে পৌঁছে গেছেন। ব্যাবিংটন হাঁ হাঁ করে ছুটে যেতে না যেতেই দরজাটা খুলে ফেলেছেন। আমরা বিদ্যুতের মতো কতকগুলো ঘটনা চমকাতে দেখলাম। বি. সেন প্রাণপণে দরজাটা খুলে ধরলেন। সাইক্লোনিক ঝড়ের ঝাপটা সামলাতে সামলাতে পলিথিনের ওয়াটারপ্রুফ পরে ভেতরে ঢুকে এলো পাপাম্মা। এবং প্লুটো উল্কার মতো ছুটে গিয়ে পাপাম্মা আর বি. সেনের মাঝখানে তার ভয়াবহ বিশালতা নিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল, দুই থাবা বি. সেনের কাঁধে। দেখলাম হিংস্রভাবে সে বি. সেনের গাল থেকে মাংস খাবলে নিচ্ছে।

Anuprerona
Anupreronahttps://www.anuperona.com
Read your favourite literature free forever on our blogging platform.
RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here


Most Popular

Recent Comments