Friday, May 3, 2024
Homeবাণী-কথাপহেলি পেয়ার - বুদ্ধদেব গুহ

পহেলি পেয়ার – বুদ্ধদেব গুহ

বুদ্ধদেব গুহ

হাঁটা পথে মাইল তিনেক পড়ত। পঁয়তাল্লিশ মিনিট থেকে এক ঘন্টার পথ। টাঙায় গেলে পনেরো থেকে কুড়ি মিনিট।

মাঝে মাঝে যেতাম। পাশের বাড়ির ভোমরা-ভাবীর জন্যে সুর্মা কিনতে, কি আতর কিনতে। কখনো-বা যেতাম বানারসী মঘাই পান খেতে।

সন্ধ্যেবেলা পুরো জায়গাটার চেহারাই পালটে যেত। গোঁফে আতর মেখে, ফিনফিনে আদ্দির পাঞ্জাবি পরে সাদা ঘোড়ায়-টানা একলা এক্কা চালিয়ে কতশত নবাবেরা আসতেন। মিথ্যে নবাব। এবং সত্যি নবাব। সবাই আসতেন।

দোতলা বাড়িগুলোর মহলে মহলে ঝাড়লণ্ঠন জ্বলত, জর্দার খুশবু, সারেঙ্গির গজের গুমরানি, অশান্ত ঘোড়ার পা ঠোকার আওয়াজ এবং তার সঙ্গে মাঝে মাঝে বারান্দায় হঠাৎ দেখা-দেওয়া। দু-একজন সুগন্ধি শরীরিণী। কেয়া ফুলের গন্ধ যাদের চুলে, জিনপরীর মায়া যাদের চোখে, পান খেয়ে ঢোক গিললে যাদের ফর্সা স্বচ্ছ গলায় নীল উপশিরারা লাল হয়ে যায়, সেই কতশত নাম জানা না-জানা সুন্দরী, গায়িকা।

এরা কেউ সকাল বেলায় গায় না। আশ্চর্য। সমস্ত মহল্লা ঘুমিয়ে থাকে সকালে। বাসি ফুলের স্মৃতি নিয়ে। ফরাশে ইতস্তত তাকিয়া ছড়ানো থাকে, ক্লান্ত সারেঙ্গি গা খুলে শুয়ে থাকে। জানলা দিয়ে কোনো ভিনদেশি মাছি এসে তারে তারে নেচে বেড়ায়–অলস হাওয়ায়–পিড়িঙ পিড়িঙ করে। একলা ঘরে সুর চমকায়। বাইজির পেলব গা ঘেঁষে শুয়ে থাকা কাবুলি বেড়ালটি, হয়তো ঘুম ভেঙে এসে ম্যায়ফিলের ঘরে হাই তুলে বলে, মিয়াঁও মিয়াঁও, মুঝে কুছ তো পিলাও।

অথচ যেমনি পাঁচটা বাজে, পাথরে পাথরে রোদের উষ্ণতাটা থাকে শুধু রোদের পরশ যখন মুছে যায়, পথে পথে টাঙাগুলো যখন মাতালের মতো টলতে টলতে ঝুমঝুমি বাজিয়ে চলে তখন চার দিকে একটা ব্যস্ততা পড়ে যায়।

বিকেল থাকতে থাকতে মুজাববর বাগানে ঢোকে ফুল তুলতে। আমাদের মছিন্দার বাড়িতে। মুজাববর আমাদের খিদমদগার রহমানের ভাইপো। আমি তখন কলেজে পড়ি। গরমের ছুটিতে মছিন্দাতে গেছি। ঠাকুমা আছেন শুধু। বিন্ধ্যবাসিনীর মন্দিরে পুজো দেন, গঙ্গায় স্নান করেন এবং আমাকে ভালোটা মন্দটা রেধে খাওয়ান।

পড়াশোনা করতে চাই। নিজেকে বার বার শাসন করি, বকি, কিন্তু দুপুর থেকে যেই ঝুরঝুর করে গাছের পাতায় পাতায় হাওয়া দেয়, শুকনো পাতা ওড়ে–টিয়া পাখির ঝাঁক ট্যাঁ ট্যাঁ ট্যাঁ করে তীক্ষ্ণ সুর ছড়িয়ে গঙ্গার দিক থেকে উড়ে আসে-মনটা উদাস উদাস লাগে। পথ বেয়ে মছিলার পথে ভাড়ার-টাঙা টুঙটুঙিয়ে চলে। পড়া হয় না। বারান্দার চেয়ারে বসে মুজাববরের প্রতীক্ষায় পথ। চেয়ে থাকি।

রোজ মুজাববর ফুল তোলে। শুধু গোলাপ। লাল গোলাপ। কাঁটা মুড়িয়ে ডাঁটা ভাঙে–তারপর ঝুড়ি ভরে চলে যায় মীর্জাপুরে বাইজিপাড়ায়। ঘরে ঘরে ফুল দেয় ও। ওকে রোজ দেখি আর হিংসা হয়। ঠাকুমা ঘরের ইজিচেয়ারে বসে গুনগুনিয়ে অতুলপ্রসাদের গান করেন আমার বাগানে এত ফুল…। আমি মুজাববরের জগতের কথা ভাবি আর কৌতূহলে কাঁদি। মুজাববর আমার। চেয়ে বয়সে সামান্যই বড়ো হবে, অথচ পৃথিবীর ও কত জানে শোনে, কত বোঝে। সকালে ও যখন আমাকে পথ দেখিয়ে পাহাড়ে তিতির মারতে নিয়ে যায় তখন ওকে আমার কাছের মানুষ। বলে মনে হয়। কিন্তু যেই বিকেল হয়ে আসে, হাসনুহানার গন্ধ হাওয়ার সঙ্গে মিশে বুকের মধ্যে মোচড় দিতে থাকে অমনি ও যেন হঠাৎ অনেক দূরে চলে যায়। ও যেন মুহূর্তের মধ্যে অনেক। বড়ো হয়ে যায়-আমার গুরুজন হয়ে ওঠে। ও যে জগতে প্রবেশ করে, সে জগতের চৌকাঠ। মাড়ানোর কোনো উপায় নেই আমার। সেই মুহূর্তে প্রতিদিন মুজাববরকে আমার বড়ো হিংসে হয়।

একদিন ওকে বলেই ফেললাম। কিন্তু প্রথমে ও কিছুতেই রাজি হল না। বলল, গুণ্ডা বদমাশ আছে। মীর্জাপুর খতরনাক জায়গা। এক মানুষ লম্বা লাঠি নিয়ে লোকে পথেঘাটে চলাফেরা করে–তুমি কি করতে যাবে? তা ছাড়া, ঠাকুমা জানলে কেলেঙ্কারি হবে। আমার চাকরি তো যাবেই। কাকার চাকরিটাও যাবে।

কিন্তু আমি ওর প্রায় পা ধরতে বাকি রাখলাম। শেষকালে আমায় নাছোড়বান্দা দেখে ও বলল, আচ্ছা চলো। কাল চলো।

যে সময়ে ও যায় রোজ তেমনি আগে চলে গেল। ওর নির্দেশমতো যথাসময়ে পানের দোকানটির সামনে এসে দাঁড়ালাম। দোকানজোড়া আয়না। লোকে পান কিনছে। মিঠি-মিঠি বলছে। লক্ষৌর লোকের মতো মীর্জাপুরের লোকেদেরও বড়ো মিঠি জুবান। আয়নায় নিজের মুখের ছায়া। পড়তেই দেখলাম, চোখমুখ লাল হয়ে গেছে। পরীক্ষার প্রশ্নপত্র পাবার আগে যেমন লাগে তেমন লাগছে। কান গরম। এমন সময় মুজাববর এল। এবং মনে হল ওই যেন প্রশ্নপত্র। ও আসতেই ভয়টা প্রায় উবে গেল। রইল শুধু কৌতূহল।

এগোতে এগোতে মুজাববর বলল, টাকা এনেছ?

টাকা কীসের?

টাকা নয় তো, তারা কি তোমার সুরত দেখে গান শোনাবে?

এটা সত্যিই ভাবিনি। বললাম, সঙ্গে দশ টাকার একটা নোট আছে। ঠাকুমা জন্মদিনে দিয়েছিলেন। ও হাসল। বলল ঠিক আছে। দশটাকায় মুখও দেখতে পাবে। অন্য কিছু নয়। গান শোনাই হবে না।

খুবই মনঃক্ষুণ্ণ হলাম। তখন আর কিছু করার নেই।

যেসব লোক ও পথে আসছিল, যাচ্ছিল, তারা আমায় দেখে অবাক হচ্ছিল। দু-একজন কী সব মন্তব্য-টন্তব্য করল। হেসে উঠল। মুজাববর আমাকে নিয়ে একটি বাড়ির ভিতরে ঢুকে গেল। দোতলায় উঠে গেল। চকমেলানো বাড়ি। ভিতরে চাতাল। তার চার পাশেদু-তলাতেই ঘোরানো বারান্দা। কোনো ঘরের দরজা বন্ধ, কোনো ঘরের দরজা খোলা। কয়েকটি ঘর থেকে সারেঙ্গীর আওয়াজ শোনা যাচ্ছে, গানও বিভিন্ন স্কেলে শোনা যাচ্ছে।

মুজাববর বলল, সব ঘরে ঢুকে কী করবে? সবাইকে দেখলে ভালো লাগবে না। যাকে দেখলে ভালো লাগবে তার ঘরেই নিয়ে যাব। আমি বারান্দায় দাঁড়িয়ে রইলাম–ও যে-যে ঘরে মেহেমান এসেছেন সেই-সেই ঘরে ফুল দিয়ে এল।

তারপর আমায় নিয়ে সেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে পাশের বাড়িতে পৌঁছে সটান দোতলায় উঠে একটি ঘরে ঢুকে পড়ল। ঘর মানে ফ্ল্যাটের মতো। একটির বেশি ঘর আছে, মধ্যে একটুখানি। প্যাসেজ। সেই প্যাসেজ পেরিয়ে গিয়েই একটি বিরাট ঘরে গিয়ে পৌঁছোলাম। পৌঁছেই থমকে দাঁড়ালাম।

ধবধবে ফরাশ পাতা। মোটা গদির উপর। দেওয়ালে হেলানোভাবে টাঙানো আয়না। আয়নার নীচে সারি দেওয়া দুধ-সাদা তাকিয়া একটার পর একটা সাজানো। মাথার উপর থেকে ঝাড়লণ্ঠন ঝুলছে।

একটি ছিপছিপে মেয়ে আমাদের দিকে পিছন ফিরে জানলার গরাদ ধরে দাঁড়িয়েছিল। ফুল সাজানো বেণীটি পিঠ থেকে টান টান হয়ে ঝুলে ছিল নীচে। জানলা দিয়ে কিছু দেখছিল বোধ হয়। ঘাড় না ফিরিয়েই শুধোলো, কওন?

ম্যায়, মুজাববর।

মেহমান নেহী আঁয়ে হ্যাঁয়, তো ম্যায় ফুলোঁসে ক্যা করু?

মুজাববর আবার সংকোচের সঙ্গে ডাকল, বাই!

এবার মেয়েটি ঘুরে দাঁড়াল। আমার মনে হল ঝাড়লণ্ঠনের আলো ম্লান হয়ে গেল। তার দু-চোখ ঠিকরে এত আলো বেরুচ্ছিলো যে তাতে আমার চোখের সামনের সব কিছু ম্লান হয়ে গেল। অবাক হলাম। আমি যেমন বিস্ময়-বিমুগ্ধ চোখে ওর দিকে চেয়েছিলাম ও-ও তেমনি চোখে আমার দিকে চেয়েছিল।

ওর পক্ষে অবাক হওয়া স্বাভাবিক। আমার বাপ-ঠাকুরদা কেউ কোনো দিন বাইজি বাড়ি যায়নি–তাদের সে পাপ অথবা পুণ্যের কোনো ছাপ হয়তো আমার চেহারায় ছিল। তা ছাড়া আমি তাজমহল দেখবার চোখ নিয়ে তার কাছে গেছিলাম, মুরগির মাংস খাবার চোখ নিয়ে যাইনি। ও হয়তো এই নিপাট-আনাড়ির চোখে এমন কিছু দেখেছিল যার জন্যে ও অবাক হয়ে আমার দিকে

এগিয়ে এল।

এসে মুজাববরকে শুধোলো, এ কে রে?

মুজাববর অপরাধীর মতো বলল, আমার চাচার মনিবের ছেলে। গান ভালোবাসে খুব-তাই আপনার গান শুনতে এল। বারণ করেছিলাম। কিছুতে শুনল না। কিন্তু ওর টাকা নেই। মানে, মাত্র দশটাকা।

মেয়েটি টুন্ডা প্রপাতের মতো ঝরঝরিয়ে হেসে উঠল। শ্বেতা দাঁতে আর নখে হীরের আলো চমকাল। বেণী থেকে একটি বেলফুল খসে পড়ল হাসির দমকে।

হাসতে হাসতে বলল, আয়া মেরী মেহমান। তারপর কৌতুকের চোখে শুধোলো, কিতনা উমর হোগী আপ কি?

বললাম, কুড়ি বছর। ও বলল, ম্যায় ভি বিশ সালকি। মগর কিতনা ফারাক।

তারপর মেয়েটি হঠাৎ আত্মীয়তার সুরে বলল, আইয়ে আইয়ে, তসরিফ রাখিয়ে। আপকি পুরী তারিফ তো মুঝে বালাইয়ে?

বেশ কেটে কেটে আমার নাম বললাম। সত্যি নাম। গোপন করলাম না। আমার বেশ রাগ হচ্ছিল। ও ভেবেছে কী? দেখতে না হয় সুন্দরীই, গানও না হয় ভালোই গায়। রাজা-রাজড়া লোক না হয় ওর পায়ের কাছে মাথা কোটেই, তা বলে আমাকে অমন নস্যাৎ করার কী ছিল জানি না।

আমি বললাম, গান শোনার মতো আমার টাকা নেই। শুধু দেখতে এসেছি। এবার মেয়েটি হাসতে হাসতে কাঁপতে কাঁপতে একটি বেলজিয়ান দেওয়াল-আয়নার মতো টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙে ফরাশের উপর ছড়িয়ে পড়ল। বসে কুর্নিশ করে বলল, আদাব, আদাব। বড়ো মেহেরবানি আপকি।

বসবার জন্যে জোর করাতে বসলাম, সংকোচের সঙ্গে, ফরাশের উপর।

মুজাববর দাঁড়িয়ে রইল।

মেয়েটি তেমনি অবাক চোখে আবার শুধোলো, আপ খুদ গানা গাঁতে হ্যাঁয়?

বললাম, থোড়া বহত।

বড়ি খুশিকি বাত।

ম্যায় গানা শুনাউঙ্গী আপকো, জরুর শুনাউঙ্গী, মগর আপকোভি গানা শুনানা পড়েগা।

চমকে উঠলাম, বললাম, আমি গোসলখানাতে গাই, নইলে একা একা গাই, ম্যায়ফিলে গাইবার উপযুক্ত গান জানি না।

সে নাছোড়বান্দা।

বলল, এই ঘরও আপনার গোসলখানা মনে করে নিন না কেন?

মহা মুশকিলে পড়লাম। গান শুনতে এসে মহা ফ্যাসাদে ফাঁসলাম।

বাইজি চাকরকে ডেকে পান আনতে বলল এবং অন্য চাকরকে বলল দরজা বন্ধ করতে। মুজাববর বাইরে যাবার জন্যে পা বাড়াচ্ছিল, অবাক ও-ও কম হয়নি। হঠাৎ আমার কী মনে হল, মুজাববরকে বললাম, তোমার থলিতে আজ কত গোলাপ আছে? ও বলল, তা না হলেও দশ টাকার হবে।

বললাম, তোমার সব গোলাপ আজ আমি কিনে নিলাম।

ও অবাক হয়ে গোলাপের থলি উপুড় করে ফরাশে ঢেলে দিল। এবং বাইজি নির্বাকে আমার দিকে চেয়ে রইল।

বাইজি হাততালি দিল এবং সঙ্গে সঙ্গে যেন মন্ত্রবলে সারেঙ্গিওয়ালা, হারমোনিয়ামওয়ালা এবং তবলচি এসে উদয় হল। বাইজি আমার আরও কাছে সরে এল। অত কাছ থেকে ও বয়সে

মা-ঠাকুমা-দিদি ছাড়া আর কোনো মেয়েকে দেখিনি। আজও আমার চোখে সে সৌন্দর্যের সংজ্ঞা হয়ে আছে। সরু কোমর, কবুতরী বুক, এবং বুদ্ধিদীপ্ত চঞ্চল চাউনির চোখ। অনেক সুন্দরী আজ অবধি দেখলাম কিন্তু অমনটি আর দেখলাম না।

সারেঙ্গিওয়ালার গজের টানে টানে কত কী অব্যক্ত বেদনা, কথা, গান সব বাজতে লাগল। ঠুংরির ঠাট কাঠঠোকরার মতো স্মৃতি ঠোকরাতে লাগল। ও পিছনের আয়নায় একবার নিজের চেহারার দিকে বিমুগ্ধ নয়নে চাইল। তারপর শরৎ সকালের মতো চোখ মেলে আমার চোখে চাইল। আমার মনে হল এ চাহনি জাদুর খেপলা-জাল ছোঁড়া চাহনি নয়–ও যেন নিজে বাঁধা পড়ে গেছে। হয়তো আমার অভাবনীয় সারল্যে, আমার সাবলীল স্পর্ধায় ও নিজেকে পুষ্পিত করে তুলেছে। সেই মুহূর্তে ওর নকল আমিকে ছাপিয়ে ওর আসল আমি ওর উপরে আধিপত্য বিস্তার করে রয়েছে। আঁট করে চুল বাঁধা নার্সারি ক্লাসের ছটফটে মেয়ে তার ক্লাসের সহপাঠীর দিকে যেমন স্বর্গীয় চোখে চায় সেই সুগন্ধি সন্ধ্যার জওহরবাই আমার দিকে তেমনি চোখে চেয়ে রইল।

আমাকে প্রায় ধমকে বলল, অব শুরু কিজিয়ে।

আমি আগে না।

আপনি আগে। আবদার করে মাথা নাড়ল।

বুড়ো সারেঙ্গিওয়ালা বলল, অব শুরু কিজিয়ে।

কী গান গাইব ভেবে পেলাম না। হঠাৎ মনে এল মির্জা গালিবের চারটি লাইন-তাতে সুর বসিয়ে গেয়ে দিলাম–

বুঢ়া না মান গালিব–

যো দুনিয়া বুঢ়া কহে,
অ্যায়সাভি কোহি হ্যায় দুনিয়ামে
সবহি ভালা কহে যিসে?

কেন জানি না ওর চোখে চেয়ে আমার মনে হয়েছিল সমস্ত পৃথিবী ওকে খারাপ আখ্যা দিয়ে ওর এই কুড়ি বছরের মনটাকে একেবারে দুখিয়ে রেখেছে। ও যে ভালোনা, ওর যে কিছুই ভালো। নেই, মনে হল সে বিষয়ে ও নিঃসন্দেহ হয়ে গেছে। তাই মনে হল, গালিবের কথা ওকে বলি যে, এখনও সব ফুরোয়নি, আশা আছে, এখনও ভালো লাগা আছে, এত বড়ো পৃথিবীতে এখনও ভালোলাগার ভালোবাসার অনেক কিছু আছে। শরীরের স্বর্গ পেরিয়েও আরও অনেক মহতী স্বর্গ আছে। কাজেই অমন কান্না কান্না চোখে চাইবার কিছুই হয়নি।

কী হল জানি না, কী করলাম জানি না কেমন গান গাইলাম জানি না। কিন্তু জওহরের কানে সে গান কী কথা বয়ে নিয়ে গেল তা ওই জানে।

গান শেষ হলে ও কোনো কথা বলল না, কেবল মুখ নীচু করে নীরবে আমাকে বার বার আদাব জানাল–দু-চোখ বেয়ে ঝর ঝর করে জল ঝরতে লাগল।

ঠিক এই রকম হবে তা ভাবিনি। আমি গান শুনে ভালো লাগায় কাঁদতে এসেছিলাম, গান শুনিয়ে কাউকে ব্যথায় কাঁদাতে চাইনি।

জওহর ওর নরম হাতে আমার হাত ধরল, চোখের দিকে চেয়ে দেখলাম, সেই সব গর্ব, কৌতুক মজাক কিছুই আর নেই চোখে। জল-ভরা চোখে অন্য কী যেন আছে–যার নাম জানি না।

ফিসফিসে গলায় জওহর বলল, ভাইসাব আপকি তহজিব, আপকি একলাখ, ঔর আপকি তমদুন কী ইজ্জত কিয়া যায় অ্যায়সা কুছভি হামারা পাস হ্যায় নেহি। ম্যায় মাফি মাঙতি।…

এইটুকু বলে ও ঘর ছেড়ে সোজা উঠে ভিতরের ঘরে গিয়ে দুয়ার বন্ধ করল।

আমি বোকার মতো বসে থাকলাম। বসে বসে ভাবতে লাগলাম। ও যা বলল, সে কথাগুলো আমার কানে টুঙি পাখির শিষের মতো বাজছিল। ভাই সাহেব, তোমার সংস্কৃতি, তোমার। উদারতা, তোমার ব্যবহারের ইজ্জত দেব এমন কিছু আমার নেই। আমায় তুমি ক্ষমা করো।

আর এলই না ঘর থেকে জওহর বাই। অনেকক্ষণ বসে থেকে চলে এলাম মুজাববরকে নিয়ে।

ভালো মন্দ জানি না। জানি জওহর মানে বিষ? আমার বিশ বছর। জওহরের বিষ বছর। আগেকার দিনের সুন্দরী রাজকুমারীদের মতো আংটির বিষ চুষে মরে যায় না কেন জওহর? কী দরকার এমন করে কাঁদার? এক শরীরের জ্বালা কি অন্য অন্য শরীরের জ্বালা দিয়েই নিবৃত্ত করতে হয়? এর কি কোনো অন্য পথ নেই?

জানি না। আর কতকুটুই বা জানি। মুজাববরকে রোজ জিগগেস করি। জওহরকে খুব দেখতে ইচ্ছে করে। একবার ওর কাছে যেতে ইচ্ছে করে। কিন্তু মুজাববর বলেছে, জওহর গুণ্ডাদের বলে রেখেছে–আর কোনোদিন আমাকে ও পাড়ায় নিয়ে গেলে মুজাবরকে জানে খতম করে দেবে। জানি না কেন? ওর কথা মনে হলেই মনটা মুচড়ে মুচড়ে ওঠে।

বিরহী নদীতে বিকেলে জেলেরা মাছ ধরে। মাছ কিনতে গেছি। সেদিন মাছ পাওয়া যায়নি। সন্ধ্যে হয়ে আসছে। পা চালিয়ে মছিন্দার দিকে ফিরছি। জায়গাটা ভালো নয়। উলটোদিক থেকে একটি ফিটন গাড়ি আসছে। কুচকুচে কালো ঘোড়ায় টানা। মাথায় বাক্স-তোরঙ্গ বাঁধা। কোচোয়ানের পাশে একটি গুণ্ডামতো লোক বসে। মাথায় পাগড়ি।

আমার পাশ দিয়ে যাবার সময় হঠাৎ একটা পুরুষ কণ্ঠ বলল, বাবুজি।

থমকে দাঁড়ালাম। কোচোয়ানের পাশের লোকটিকে চেনা চেনা লাগল। চিনতে পারলাম। এ সেই সারেঙ্গিওয়ালা।

ফিটনের দরজা খুলে গেল। একটি অপরূপ সুন্দরী মেয়ে মুখ বাড়িয়ে বলল, মির্জা গালিব, কাঁহা চলতে হ্যাঁয়?

দেখি জওহর। হাসছে। আজকে ও সাজেনি একটুও। সাধারণ শাড়ি। সুন্দর টিকোলো নাকে। হীরের নাকছাবি–ফিনফিনে ফিঙের মতো রেশমি চুল। বিকেলের বিষণ্ণ হাওয়ায় অলক উড়ছে।

শুধোলাম, কোথায় যাচ্ছ?

জওহরের মুখ চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল, ও যেন এই মুহূর্তে আমাকেই ভীষণভাবে খুঁজছিল।

হেসে বলল, কোথায় আরব? এক জাহান্নামে থেকে অন্য জাহান্নামে।

ওকে দেখে, এবং ওর বলার ভঙ্গি দেখে আমার ভীষণ কষ্ট হল। হঠাৎ বলে ফেললাম, তোমাকে আমি যদি যেতে না দিই? যদি আমাদের বাড়ি নিয়ে যাই?

ও ভীষণ চমকে উঠে আমার ঠোঁটে ডান হাতে তর্জনী চুঁইয়ে বলল, চুপ। বিলকুল চুপ। অ্যায়সা বাত কভি না কহনা, কভি না শোচনা।

কিছুক্ষণ চুপ করে ফিটনের দরজা ধরে দাঁড়িয়ে রইলাম। তারপর বললাম, তুমি তো চলে যাবেই, চলো না একটু বিরহীর ধারে বসবে? পরমুহূর্তে মনে পড়ল এ জায়গাটা ভালো নয়। বললাম, না না দরকার নেই, এ জায়গাটা খারাপ।

ও নামতে নামতে হাসল, বলল, আমি যেখানে থাকি, তার চেয়েও?

আমরা দু-জনে গিয়ে বিরহীর পাশের আমলকি তলায় বসলাম। গঙ্গা থেকে তোড়ে জল ঢুকছে। বিরহীতে। একটি একলা মাছরাঙা শেষ বিকেলে মেহেন্দি রঙা জলে ছোঁ মেরে মেরে বেড়াচ্ছে।

বললাম, তোমার গান শুনতে গেলাম, গান শোনালে না তো!

আমার গান শুনে আর কী করবে? ও তো সকলকেই শোনাই। যে পয়সা দেয় তাকেই শোনাই।

আর যে ফুল দেয়? শুধু লাল ফুল?

ও বিষণ্ণ হাসল, বলল, তাকে কী দেব?

বললাম, তোমাক গান শোনালাম, ফুল দিলাম, তুমি আমাকে কিছুই দিলে না।

ও মুখ ফিরিয়ে আমার দিকে ফিরে বলল, কিছুই দিইনি? ঠিক জান?

আমি মাথা নাড়লাম।

গঙ্গার দিক থেকে এক ঝাঁক পিংক-হেডেড পোচার্ড অস্তগামী সূর্যকে পিছনে ফেলে ডানা শনশনিয়ে দূরের বিলের দিকে উড়ে গেল। আমরা চুপ করে অনেকক্ষণ পাশাপাশি বসে রইলাম। দেখতে দেখতে বিরহীর জলের মেহেন্দিতে সন্ধ্যের জাম-রঙা বেগুনি ছায়া পড়ল।

জওহর উঠল, বলল, চলি।

ধীরে ধীরে গাড়ি অবধি গেলাম দুজনে। দরজা খুলে দিলাম, ফিটনে উঠে বসল ও।

–আবার কবে দেখা হবে?

–জানি না, কোনোদিন আর নাও হতে পারে।

–আমাকে কিছু দিয়ে যাও জওহর, যাতে তোমাকে মনে রাখি।

কোচোয়ান জিভ আর তালু দিয়ে অদ্ভুত আওয়াজ করে ঘোড়াকে এগোতে বলল, পা দিয়ে ঘন্টা বাজাল। জওহরের বিদায়ের ঘন্টা। চাকা গড়াতে লাগল।

আমি সঙ্গে সঙ্গে হাঁটতে লাগলাম, আবার বললাম, কিছুই দিয়ে গেলে না জওহর? আমাকে তুমি কিছুই দিলে না।

জহর এবার হাতের ইশারায় আমাকে কাছে আসতে বলল। ওর আরও কাছে সরে গেলাম, ওর খোলা চুলে চন্দনের গন্ধ পেলাম, ও আমার কানে কানে বলল, তুমি এখনও ছোটো আছ। যা তোমাকে দিয়েছি, তার দাম আরও বড়ো হলে বুঝতে পারবে।

তবু অধৈর্য হয়ে বললাম, বলো না তাকী জওহর, বলো না?

জওহর কান্নার মতো হাসল।

তারপর, দরজায়-রাখা আমার হাতের উপর ওর হাতটা ছুঁইয়ে বলল, পহেলি পেয়ার।

Anuprerona
Anupreronahttps://www.anuperona.com
Read your favourite literature free forever on our blogging platform.
RELATED ARTICLES

Most Popular

Recent Comments