অমর-ধাম – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

ভয় সমগ্র - হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

মাস খানেক ধরে শরীরটা খারাপ হয়েছে। যা খাই, অম্বল হয়। বিকালে মাথার যন্ত্রণা। রাতে ঘুম নেই। কাজে একেবারে উৎসাহ পাচ্ছি না। পাড়ার ডাক্তার বলল, ‘ওষুধে সাময়িক উপকার হতে পারে, স্থায়ী কিছু হবে না। তার চেয়ে বরং ভালো জায়গায় চেঞ্জে চলে যান। মাস দুয়েক থাকলেই সেরে যাবেন।’

কোথায় যাব তাই নিয়েই এক সমস্যা। এক এক বন্ধু এক একরকম উপদেশ দিতে লাগল। কেউ বলল, ভুবনেশ্বর, কেউ হাজারিবাগ, আবার কেউ-বা দেওঘর।

কী করব, কোথায় যাব যখন ভাবছি তখন হঠাৎ অমলের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল।

অফিস থেকে বেরিয়ে ফাঁকা ট্রামের জন্য অপেক্ষা করছি, আচমকা পিঠে তার স্পর্শ।

ফিরে দেখি অমল। কলেজ ছাড়ার পর অমলের সঙ্গে আর দেখা হয়নি।

আমাকে দেখে অমল বলল, ‘চেহারা যে বড্ড খারাপ হয়ে গেছে। কী ব্যাপার?’

কী ব্যাপার বললাম।

শুনে অমল বলল, ‘ওসব ভুবনেশ্বর দেওঘরের চিন্তা ছেড়ে দাও। ওখানে কিছু হবে না। তুমি মিলনপুরে চলে যাও। তিনদিনে তোমার অম্বল সেরে যাবে।’

‘মিলনপুর কোথায়? কখনো তো নাম শুনিনি।’

অমল হাসল, ‘বেশি লোক নাম শোনেনি না বলেই তো জায়গাটা এখনও ভালো আছে। ভিড় হলেই জলবায়ু বদলে যায়।’

‘যাব কী করে? থাকব কোথায়?’

‘কোনো অসুবিধা নেই, আমার বাবা একটা বাংলো কিনেছিল মিলনপুরে। এখন কেউ যাই না। আমিও তো এখন অন্য জায়গায় থাকি, তবে লোক আছে। তার কাছে আমার নাম কোরো। কোনো অসুবিধা হবে না।’

অমল আরও বলল, ‘গিরিডি স্টেশনে নেমে তেরো মাইল। মিলনপুরে নেমে অমর-ধাম বললেই যেকোনো লোক দেখিয়ে দেবে। তুমি চলে যাও। শরীরটা সারিয়ে এসো।’

তাই গেলাম।

মিলনপুরে যখন নামলাম, তখন রাত প্রায় আটটা। চারদিক অন্ধকার। একদিকে উঁচু-নীচু পাহাড়। তার কোলে ঘন অরণ্য। আর একদিকে সরু নদী, প্রায় নালার মতন, কিন্তু কী জলের গর্জন! স্রোত পাথর থেকে পাথরে লাফিয়ে চলেছে।

টর্চ জ্বেলে কোনোরকমে এগোতে লাগলাম। সরু পায়ে চলা পথ। লাল মাটি। মাঝে মাঝে কালো পাথর। অন্যমনস্ক হলে হোঁচট খাবার আশঙ্কা।

পথের একপাশে একটা মুদির দোকান। মুদি ঝাঁপ বন্ধ করছিল, আমি গিয়ে দাঁড়ালাম।

‘এখানে অমর-ধাম কোথায় বলতে পার?’

মুদি লণ্ঠন তুলে কিছুক্ষণ আমার দিকে দেখে বলল, ‘সেখানে তো কেউ থাকে না। বাড়ি একেবারে জঙ্গল হয়ে আছে।’

বুঝলাম, মুদি বাড়িটার সম্বন্ধে বিশেষ খোঁজ রাখে না। জঙ্গল হলে কি অমল আমাকে আসতে বলত। এমন হতে পারে মালী হয়তো বাড়ির চারপাশ পরিষ্কার করে না। তাতেই আগাছা জন্মেছে।

আমি বললাম, ‘ঠিক আছে, বাড়িটা কোন দিকে বলো?’

মুদি বলল, ‘সোজা চলে যান। সামনে একটা নীচু টিলা দেখবেন, সেটা বাঁ-দিকে রেখে ঘুরে যাবেন। এক জায়গায় গোটা চারেক শাল গাছের মেলা। পাশে সাহেবদের গোরস্থান। সেটা ছাড়িয়ে একটু এগোলেই সাদা পাঁচিল ঘেরা অমর-ধাম।

এক হাতে সুটকেস, আর এক হাতে টর্চ। সাবধানে এগোতে লাগলাম। রাত ন-টার বেশি হয়নি, কিন্তু এই জনমানবহীন ঘন জঙ্গলে ঘোর অন্ধকার জায়গায় মনে হচ্ছে যেন নিশুতি রাত। ঝিঁ ঝি ডাকছে, ঝোপে ঝোপে জোনাকির ঝাঁক, মাঝে মাঝে পায়ের কাছে খর খর শব্দ করে কী যেন সরে যাচ্ছে। সাপ হওয়াও বিচিত্র নয়।

একসময়ে নীচু টিলা পেলাম। গোরস্থানও। অন্ধকারে অনেকগুলো আলোর ফুটকি। সম্ভবত শেয়ালের চোখ। বড়ো শেয়াল অর্থাৎ বাঘ হওয়াও আশ্চর্য নয়।

যাক, অবশেষে অমর-ধাম পাওয়া গেল। বেশ ভালো বাংলো। অন্তত একসময়ে বেশ ভালোই ছিল, এখন অযত্নে জায়গায় জায়গায় পলেস্তারা খসে ইট বেরিয়ে পড়েছে। জলের পাইপে আগাছা হয়েছে, সামনের চাতাল শ্যাওলায় সবুজ হয়ে আছে।

গেট ঠেলতে ক্যাচ করে বিশ্রী একটা শব্দ করে গেট খুলে গেল। ভিতরে গিয়ে জোরে জোরে কড়া নাড়তে লাগলাম। বার দশেক কড়া নাড়ার পর দরজা খোলার শব্দ হল।

বারান্দায় গলা শোনা গেল, ‘কে?’

আমি ওপর দিকে মুখ তুলে বললাম, ‘আমি অমরের বন্ধু। আমার আসার কথা ছিল।’

‘আরে পার্থ না? তোমার জন্যই তো অপেক্ষা করে রয়েছি। দাঁড়াও, দরজা খুলে দিচ্ছি।’

আমার নিজের খুব অবাক লাগল। কে লোকটা? আমার নাম জানল কী করে? তবে কি আমাদের কোনো বন্ধু আমার মতন শরীর সারাতে এখানে এসে উঠেছে।

নীচের দরজা খুলতেই খোলা দরজা দিয়ে এক ঝাঁক চামচিকে উড়ে গেল। আর একটু হলেই তাদের ডানা আমার মাথায় লেগে যেত।

লম্বা চেহারার একটি লোক আমার দু-কাঁধে দু-হাত রেখে বলল, ‘ও পার্থ, কত যুগ পরে দেখা বলো তো?’ টর্চের আলোটা তার দিকে ফেরালাম।

লম্বা পুলক। আমাদের কলেজে দুজন পুলক ছিল, তাই একজন লম্বা পুলক আর একজন বেঁটে পুলক।

তারপরের কথাটা মনে হতেই মেরুদণ্ড বেয়ে ঠান্ডা প্রবাহ নামল। বুকের শব্দ দ্রুততর।

তাই তো শুনেছিলাম, বছর পাঁচেক আগে টালা ব্রিজের কাছে লম্বা পুলক দুর্ঘটনায় মারা গেছে। পুলক মোটর সাইকেলে ছিল, সামনাসামনি এক লরির সঙ্গে ধাক্কা, পুলক আর তার মোটর সাইকেল, দুইই একেবারে ছাতু হয়ে গিয়েছিল।

‘কি, সারারাত বাইরে দাঁড়িয়ে থাকবে নাকি?’

পুলক তাড়া দিল।

ভিতরে ঢুকতে ঢুকতে বললাম, ‘না চলো। একটা কথা ভাবছিলাম।’

‘কী কথা?’

‘শুনেছিলাম দুর্ঘটনায় তুমি মারা গেছ। বছর পাঁচেক আগে।’

পুলক খুব জোরে হেসে উঠল।

‘আরে একরকম মরাই তো। দেখ না বাঁ-পায়ে একদম জোর পাই না। হাসপাতাল থেকে সোজা এখানে চলে এসেছি। বলতে নেই, এখন বেশ ভালো আছি ভাই। এখানকার জলহাওয়ায় খুব উপকার পেয়েছি। এসো, ভিতরে এসো।’

শরীর খুব পরিশ্রান্ত। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আলোচনা করতে আমারও ভালো লাগছিল না। কোনোরকমে কিছু মুখে দিয়ে শুয়ে পড়তে পারলে বাঁচি।

‘স্নান করবে তো?’ পুলক জিজ্ঞাসা করল।

‘এত রাতে? নতুন জায়গায়? সাহস হচ্ছে না।’

‘আরে গরম জলে স্নান করে নাও শরীর ঝরঝরে লাগবে। গরম জল এখনই পাঠিয়ে দিচ্ছি।’

স্নান সেরে বাইরে আসতে দেখি টেবিল সাজিয়ে পুলক বসে আছে। প্লেট ভরতি গরম ভাত আর মুরগির মাংস।

‘এখানে রান্না করে কে?’

পুলক বলল, ‘রান্না, বাসনমাজা, ঘরদোর পরিষ্কার সবই মুংলা করে। এদেশি লোক। ভারি কাজের।’

‘তুমি খাবে না?’

‘আমি সন্ধ্যা ছ-টার মধ্যে খেয়ে নিই। নাও, তুমি আর বসে থেকো না। নিশ্চয় খুব ক্লান্ত। শুয়ে পড়ো। ওটা তোমার ঘর।’

এ ঘরে ঢুকেই আশ্চর্য হয়ে গেলাম। সিঙ্গল খাটের ওপর পরিপাটি বিছানা। মাথার কাছে টিপয়ের ওপর জলের গ্লাস। ভোরে উঠে আমার যে জল খাওয়ার অভ্যাস, এটা পুলক জানল কী করে?

শুয়ে পড়লাম। বিছানায় গা ঠেকানো মাত্র গভীর নিদ্রা।

মাঝরাতে পেঁচার বিদঘুটে ডাকে ঘুম ভেঙে গেল। মাথার কাছে খোলা জানলা দিয়ে চাঁদের আলো বিছানার ওপর এসে পড়েছে। ঘরের সব কিছু পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে।

পাশ ফিরে শুতে গিয়েই চমকে উঠলাম। বরফের মতন ঠান্ডা স্পর্শ। চোখ খুলেই রক্ত হিম হয়ে গেল।

আমারই বালিশে মাথা দিয়ে একটা কঙ্কাল শুয়ে! একটা হাত প্রসারিত। সেই হাতটাই আমার শরীরে ঠেকেছিল।

আর্তনাদ করে উঠে বসলাম।

‘কী, কী হল পার্থ?’

পুলক খাটের কাছে এসে দাঁড়িয়েছে।

কঙ্কালের দিকে আঙুল দেখাতে গিয়েই দেখলাম, ‘বিছানা খালি! কোথাও কিছু নেই!’

‘না, তুমি নিতান্ত ছেলেমানুষ। সরো, আমি না-হয় তোমার পাশে শুই।’

লজ্জা পেয়ে মাথা নাড়লাম, ‘না, না, তোমার শুতে হবে না। তুমি যাও।’

পুলক সরে গেল।

ঘুমোবার চেষ্টা করতে করতে নতুন এক চিন্তা মনে এল। শোবার আগে আমি তো দরজা বন্ধ করে দিয়েছিলাম, তাহলে পুলক ঘরের মধ্যে ঢুকল কী করে? উঠে আর পরীক্ষা করতে ইচ্ছা হল না। ঘুমে চোখ বন্ধ হয়ে এল।

পরের দিন সকালে উঠেই দেখলাম ঘরের দরজা ভিতর থেকে খিল দেওয়া। এদিক-ওদিক চোখ ফিরিয়ে দেখলাম ভিতরে ঢোকার আর কোনো পথ নেই।

তাহলে পুলক কাল রাতে ঘরের মধ্যে ঢুকল কী করে?

দরজা খুলতেই পুলককে দেখলাম। বাগানে দাঁড়িয়ে আছে।

কাল রাতে তার ঘরে ঢোকার কথা বলতেই সে হেসে উঠল খুব জোরে।

‘তুমি নিশ্চয় স্বপ্ন দেখেছ। আমি আবার কখন তোমার ঘরে ঢুকলাম?’

‘স্বপ্ন? তা হবে! কিন্তু এত পরিষ্কার স্বপ্ন জীবনে কখনো দেখিনি? এখনও চোখের সামনে যেন ঘুমন্ত নরকঙ্কালটা দেখতে পাচ্ছি।’

‘মুখ-হাত ধুয়ে নাও। মুংলা এখনই চা দিয়ে যাবে।’

বারান্দায় দুটো বেতের চেয়ার পাতা। মাঝখানে গোল বেতের টেবিল।

হাত-মুখ ধুয়ে একটা চেয়ারে বসলাম। উলটোদিকের চেয়ারে পুলক বসে বলল, ‘মুংলা, পার্থবাবুর চা নিয়ে এসো।’

চা আর টোস্ট নিয়ে যে এল, তাকে দেখে আমার সারা শরীর কেঁপে উঠল। এমন বীভৎস চেহারা আমি জীবনে দেখিনি!

গায়ে চিমটি কাটলেও এক তিল মাংস উঠবে না, এমনই শীর্ণ চেহারা। চোখ দুটো এত ভিতরে ঢোকা যে আছে কিনা বোঝাই যায় না। সরু কাঠির মতন হাত পা। ঝকঝকে দাঁতের পাটি সর্বদাই বাইরে।

চা টোস্ট দিয়ে চলে যেতে আমি বললাম, ‘লোকটার চেহারা দেখলে ভয় করে।’

পুলক বলল, ‘মানুষের চেহারা আর কতটুক? ছাল ছাড়ালে সবাই সমান। মুংলার চেহারা যেমনই হোক, লোকটা কিন্তু খুব কাজের। তা ছাড়া নিজের লোক ছাড়া আমরা তো আর যাকে তাকে রাখতে পারি না।’

‘নিজের লোক মানে?’

‘মানে খুব জানাশোনা। একেও এখানকার গাঁ থেকে অমলই জোগাড় করে এনেছে। খেতে খেতে বললাম, তোমার চা টোস্ট কই?’

পুলক উত্তর দিল, ‘আমি এসব খাই না ভাই। সহ্য হয় না। ভোরে উঠে ছোলা ভিজানো খাই আদা দিয়ে।’

একটু থেমে পুলক বলল, ‘তুমি বসো। আমি একটু ঘুরে আসি।’

‘এখন আবার কোথায় যাবে?’

‘একবার পোস্ট অফিসে যাব, তা ছাড়া আরও দু-এক জায়গায় ঘুরে আসব। তুমি আমার জন্য অপেক্ষা করো না। আমি বাইরে কোথাও খেয়ে নেব।’

সারাটা দিন পুলক ফিরল না। সন্ধ্যার সময়েও না।

মুংলাকে জিজ্ঞাসা করতে সে বলল, ‘বাবুর ফেরার কোনো ঠিকঠিকানা নেই। কোথায় কোথায় যে যান—’

খাবার সময়ে এক কাণ্ড। বসে খাচ্ছি, পাশে মুংলা দাঁড়িয়ে। তাকে বললাম, ‘একটু তরকারি নিয়ে এসো তো, আর দু-খানা রুটি।’

মুংলা চৌকাঠের কাছ পর্যন্ত গিয়ে বাইরে হাত বাড়িয়ে তরকারি আর রুটি এনে দিল। ঠিক মনে হল এগুলো নিয়ে কে যেন বাইরে অপেক্ষা করছিল।

কিছু আর জিজ্ঞাসা করলাম না, কিন্তু এ বাড়ির বাতাসে কেমন যেন ভয়ের গন্ধ! মনে হয় অশরীরী আত্মারা আনাচেকানাচে লুকিয়ে আছে।

সেই রাত্রেই দারুণ দৃশ্য চোখে পড়ল। পুলক তখনও ফেরেনি।

ঘুম আসেনি, বিছানায় শুয়ে এপাশ-ওপাশ করছি। হঠাৎ বাইরে খরখর আওয়াজ। পাশা দু-হাতে রগড়ালে যেমন শব্দ হয়, ঠিক তেমনই।

আস্তে আস্তে উঠে জানলার খড়খড়ি খুলে বাইরে চোখ রাখলাম। ম্লান চাঁদের আলো। খুব স্পষ্ট নয়, আবার একেবারে অস্পষ্টও নয়।

উঠানে একটা গুঁড়ির ওপর দুটো কঙ্কাল ঘেঁষাঘেঁষি বসে। একজনের হাত আরেক জনের গলায়। আর একটু দূরে একটা গাছের ডাল ধরে মুংলা দোল খাচ্ছে। কী লম্বা চেহারা! সারা দেহে কোথাও এক তিল মাংস নেই! চোখের দুটো গর্ত থেকে গাঢ় লাল রং বের হচ্ছে।

অজান্তেই মুখ থেকে একটা আর্তনাদ বের হয়ে গিয়েছিল। সঙ্গে সঙ্গে কঙ্কাল দুটো ফিরে দেখল। চোখ নেই, তবুও কী মর্মভেদী দৃষ্টি! বুকের রক্ত শুকিয়ে জমাট হয়ে গেল।

আশ্চর্য কাণ্ড! একটু একটু করে কঙ্কাল দুটোয় মাংস লাগল। সেকেন্ড কয়েকের মধ্যে দুটি পূর্ণ মানুষের মূর্তি ফুটে উঠল।

তখন আর চিনতে অসুবিধা হল না। একজন পুলক, আর একজন অমল। কাঁপতে কাঁপতে বিছানায় ফিরে গোলম।

সারা রাত ঘুমাতে পারলাম না। যা দেখেছি তারপর ঘুমানো সম্ভবও নয়। বাইরে খটখট শব্দ। মনে হল একাধিক কঙ্কাল মূর্তি উঠানে পায়চারি করছে। সেই শব্দের সঙ্গে পেঁচার ডাক, বাদুড়ের ডানার ঝটপটানি মিশে ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি করল।

ভোর হতে আর এক মুহূর্তও অপেক্ষা করিনি। সুটকেসটা হাতে নিয়ে ছুটতে লাগলাম। বের হবার সময় রান্নাঘর থেকে বাসনপত্রের আওয়াজ আসছিল। একটু পরেই হয়তো মুংলা চা নিয়ে সামনে এসে দাঁড়াবে। দিনের আলোতেই মুংলার মুখোমুখি দাঁড়াবার সাহস আমার নেই।

ছুটতে ছুটতে যখন মুদির দোকানের সামনে গিয়ে পৌঁছোলাম, তখন মুদি সবে দোকানের ঝাঁপ খুলছে।

হাঁপাতে হাঁপাতে বললাম, ‘এক গ্লাস জল!’

মুদি আমাকে দেখে অবাক। বোধ হয় জীবন্ত দেখবে আশাও করেনি। জল দিয়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘আপনি অমর-ধাম থেকে আসছেন?’

‘হ্যাঁ।’

‘খাওয়াদাওয়ার কী করতেন?’

মুদির কাছে কিছু বলতে ইচ্ছা হল না। শুধু বললাম, ‘কেন, মুংলা রাঁধত।’

মুদির মুখটা হাঁ হয়ে গেল। দুটো চোখ বিস্ফারিত।

কাঁপা গলায় বলল, ‘মুংলা মানে মুংলা মুণ্ডা? মুংলাকে তো বছর পাঁচেক আগে অমর ধাম-এর এক গাছের ডালে ঝুলন্ত অবস্থায় পাওয়া গিয়েছিল।’

‘আত্মহত্যা?’

‘কী জানি, অনেকে বলেছিল, বিষয়সম্পত্তি নিয়ে গোলমাল হওয়ায় ভাইপোরাই নাকি মেরে ঝুলিয়ে রেখেছিল।’

আর দাঁড়াইনি। গিরিডি না পৌঁছানো পর্যন্ত শান্তি নেই। অমর-ধামের বাসিন্দারা গন্ধ শুঁকে শুঁকে হাজির হলেই সর্বনাশ!

বাকিটা শুনলাম গিরিডির স্টেশন মাস্টারের কাছে। ওই বাড়ির অমলবাবু মাঝে মাঝে আসা-যাওয়া করতেন। বছর দুয়েক আগে তাঁকে ঘাড় মটকানো অবস্থায় বাড়ির উঠানে পাওয়া গিয়েছিল। গিরিডি থেকে পুলিশের কর্তা গিয়েছিল, কিন্তু খুনের কোনো হদিস হয়নি।

মাথাটা ঘুরে উঠল। তাহলে কলকাতার রাস্তায় অমলের সঙ্গে দেখা, আমাকে মিলনপুরে আসার আমন্ত্রণ করা— এ সবের কী ব্যাখ্যা হতে পারে?

আর পুলকের দুর্ঘটনায় মৃত্যু, এ তো আমার জানাই ছিল। নিজেদের দল বাড়াবার জন্যই কি আমাকে ডেকে আনা হয়েছিল? তাহলে হাতের মুঠোর মধ্যে পেয়ে ছেড়ে দিল যে!

গলায় পৈতা আছে বলেই কি?

কী জানি, যত ভাবি এ প্রশ্নের কোনো উত্তর পাই না।

Facebook Comment

You May Also Like