Monday, April 29, 2024
Homeথ্রিলার গল্পভৌতিক গল্পমূর্তির কবলে - হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

মূর্তির কবলে – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

ভয় সমগ্র - হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

একেবারে আচমকা। তাও অন্য কোনো বড়ো শহর হলে এক কথা। আপশোস করার বিশেষ কিছু থাকত না।

কিন্তু বদলি করল কলকাতা থেকে এলোর। অন্ধ্রদেশে, ইংরেজ আমলে ওই নাম ছিল, এখন স্বাধীনতা পরবর্তী যুগে নাম হয়েছে এলরু।

একটা আশার কথা বিয়ে থা করিনি। বউ-ছেলেপুলের বালাই নেই। ঝাড়া হাত-পা।

কাজেই তল্পি-তল্পা বেঁধে ট্রেনে উঠলাম।

স্টেশনে রামকৃষ্ণ রাও ছিলেন। এঁর জায়গাতেই আমি যাচ্ছি। ইনি বদলি হচ্ছেন কোয়াম্বোটুর।

এঁকে থাকবার একটা আস্তানার সন্ধান করতে বলেছিলাম। বিদেশ বিভুঁই, কিছুই জানা নেই। অন্তত মাথা গোঁজবার একটা জায়গা থাকা দরকার।

করমর্দন, পরস্পরের কুশল জিজ্ঞাসার পর প্রশ্ন করেছিলাম, ‘আমার আসার কী ব্যবস্থা হবে?’ রামকৃষ্ণ প্রশান্ত হেসে উত্তর দিয়েছিলেন, ‘চিন্তার কোনো কারণ নেই। আমি যেখানে ছিলাম সেখানেই আপনি থাকতে পারবেন। বাড়িওয়ালা খুব সদাশয়, বাড়িটাও যথেষ্ট খোলামেলা।’

যেতে যেতে রামকৃষ্ণ বললেন, ‘আমি এখানে একলাই থাকতাম। বদলির চাকরির জন্য স্ত্রী, পুত্রকে মামার বাড়ি মাদ্রাজে রেখে দিয়েছি।’

তারপর হঠাৎ থেমে রামকৃষ্ণ জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘আপনার নিজের রান্না করার অভ্যাস আছে?’

‘বিশেষ নেই, তবে কলকাতায় ঝি না এলে মাঝে মাঝে নিজেকেই চালিয়ে নিতে হত।’

‘ওই এক মুশকিল। এখানকার রান্না খেতে আপনাদের মানে বাঙালিদের হয়তো অসুবিধা হবে। সবই নারকেল তেলে রান্না কি না?’

আর কিছু বললাম না। অদৃষ্টে দুর্ভোগ আছে জানি।

বাড়িটা বেশ পছন্দসই। চারপাশে একটু বাগান আছে। নারকেল আর কিছু আম গাছ।

রান্না করার লোক একটা হয়ে গেল। শঙ্করণ। সে শুধু ভাত রেঁধে দিয়ে যাবে। মাছ, মাংস, ডিম ছোঁবে না। ওগুলো আমাকেই করে নিতে হত।

রামকৃষ্ণ যাবার সময় একটি জিনিস দিয়ে গেলেন। টেরাকোটার মূর্তি। লাল রং-এর। প্রথমে আমি ভেবেছিলাম নটরাজের মূর্তি। কিন্তু ভালো করে দেখলাম। না, নটরাজ নয়, সেই ধরনের ভঙ্গি। মুখ-চোখের চেহারা বীভৎস! চারিদিকে আগুনের লেলিহান শিখা।

রামকৃষ্ণ বললেন, ‘কী মূর্তি জানি না। হরিদ্বারে এক সাধুর কাছ থেকে পেয়েছিলাম। তিনি বলেছিলেন কালভৈরবীর মূর্তি। রোজ শুতে যাবার আগে এ মূর্তিকে প্রণাম করে শুলে মঙ্গল হবে, অবহেলা করলে অশুভ।’

এসব ব্যাপারে আমার ভক্তি-শ্রদ্ধা একটু কম। বরং বলা যায়, আমি কিছুটা নাস্তিক। নিজের পুরস্কার ছাড়া আর কিছু মানি না।

তবু রামকৃষ্ণের মুখের ওপর আমি কিছু বলিনি। বলতে পারিনি। মূর্তিটা নিয়ে আলনার ওপর রেখে দিলাম।

এলুরুর চারিপাশে আমাদের খেত। আমার কাজ এইসব তামাক পরিদর্শন করো। একেবারে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত।

তামাকে যাতে পোকা না লাগে, লাগলে তার প্রতিষেধক কী, তারপর কীভাবে তাকে গুদামজাত করে রপ্তানির উপযোগী করা যায়, সে বিষয়ে নির্দেশ।

অনেকদিন আমাকে গ্রাম অঞ্চলেই কাটাতে হত।

তখন শঙ্করণ থাকত বাড়ির তদারকিতে। একেবারে নিস্তরঙ্গ জীবন। সংস্কৃতির ছিঁটেফোঁটা কোথাও নেই।

‘কী আর করা যাবে! ক-টা লোক আর জীবন জীবিকা মেলাতে পারে।

মাস খানেক পর মুশকিলে পড়লাম। শঙ্করণ এল না।

এইসময় বর্ষার খুব প্রকোপ। চারিদিকে ম্যালেরিয়া। দিন পনেরো শয্যাপাত করে রাখে।

নিরুপায়, নিজে সেই হাত পুড়িয়ে রান্নাবান্না করতে হয়।

কাজ বিশেষ নেই। রাত আটটার মধ্যে শুয়ে পড়ি।

বাইরে বৃষ্টির নূপুর আর ব্যাঙের আলাপ জলসার আবহাওয়ার সৃষ্টি করেছে। শোওয়া মাত্র— চোখে ঘুম এল।

রাত কত খেয়াল নেই। হঠাৎ ধড়মড় করে বিছানার ওপর উঠে বসলাম।

মশারিতে আগুন দাউ দাউ করে জ্বলছে। কী আশ্চর্য, কী করে এটা হল!

বেড সুইচ নেই। ঘরের আলো বন্ধ করে আমি শুয়েছি।

কারণ আলো থাকলে আমি ঘুমোতে পারি না। ভীষণ বিপদে পড়ে গেলাম। মশারির চারিদিক জ্বলে উঠেছে। নাইলনের মশারি। নামবার কোনো পথ নেই। আগুনের তাপ আমার শরীর ঝলসে দিচ্ছে।

চেঁচাবার শক্তি পর্যন্ত হারিয়ে ফেলেছি। আর চেঁচিয়েও কোনো লাভ নেই। সবচেয়ে কাছে যে বাড়ি সেটাও আধ মাইল দূর।

বিদেশে এভাবে কি পুড়ে মরতে হবে! মরিয়া হয়ে নামবার চেষ্টা করলাম। এ ছাড়া উপায় নেই।

একটু এগিয়ে থেমে গেলাম।

সেই অগ্নিশিখার পিছনে বিরাট এক মূর্তি। শুধু বিরাট নয়, বিকটও। কালভৈরবীর মূর্তি। দুটি চোখে অগ্নিপিণ্ড ঠোঁটের দু-পাশে আগুনের ঝলক। ভাবলাম ভুল দেখছি। চোখদুটো ভালো করে রগড়ে নিলাম।

কিন্তু না, এক দৃশ্য।

কালভৈরবীর মূর্তি যেন জীবন্ত হয়েছে। এদিকে আগুনের উত্তাপ বাড়ছে। বিছানার ওপর বসে থাকা আর সম্ভব নয়।

লাফিয়ে মেঝের ওপর পড়লাম। সঙ্গে সঙ্গে আগুন যেন মিলিয়ে গেল। কালভৈরবীর মূর্তিও উধাও।

কিন্তু আর একটা আশ্চর্য কাণ্ড। একটা অদৃশ্য টানে কে যেন আমাকে আলনার দিকে নিয়ে গেল। আলনার কাছে গিয়েই অবাক হলাম। কালভৈরবীর মূর্তিটা নেই!

শঙ্করণ মূর্তিটা আলনার ওপর একটা তাকের মধ্যে রাখত।

মাঝে মাঝে লক্ষ করেছি, সে মূর্তির সামনে হাতজোড় করে দাঁড়িয়ে বিড় বিড় করে মন্ত্র পড়ছে।

আমি নিজে এসব না মানলেও, কারও ধর্মবিশ্বাসে বাধা দিতে চাইনি।

পিছন ফিরে দেখলাম, মশারির অবস্থা স্বাভাবিক। আগুনের সামান্য চিহ্নও কোথাও নেই।

নিজের ওপর রাগ হল।

নিশ্চয় বিশ্রী একটা স্বপ্ন দেখেছিলাম। স্বপ্ন দেখে এতটা ভয় পাওয়া নিঃসন্দেহে ছেলেমানুষি।

কিছুক্ষণ পায়চারি করে শুতে গেলাম।

ভোরের দিকে একই কাণ্ড।

এবারে কালভৈরবীর মূর্তির দুটি নাসারন্ধ্র দিয়ে আগুনের হল্কা। মশারি পুড়ছে। আগের বারের মতন লাফ দিয়ে নীচে নামতে সব স্বাভাবিক। আর বিছানায় যাইনি। আলো ফোটা পর্যন্ত বেতের চেয়ারে চুপচাপ বসে রইলাম।

শেষ রাত্রের দিকে বৃষ্টি থেমে গিয়েছিল। আকাশ প্রায় পরিষ্কার। ছেঁড়া মেঘের ফাঁকে ফাঁকে নীল আকাশের আভাস।

শঙ্করণ এসে হাজির। জ্বর নেই, তবে চেহারা বেশ কাহিল।

একবার ভাবলাম শঙ্করণকে কিছু বলব না। আমার সম্বন্ধে তার ধারণা খারাপ হবে। ভাববে, আমি অহেতুক ভয় পেয়েছি।

কিন্তু তাকে অন্যভাবে জিজ্ঞাসা করলাম।

‘আচ্ছা শঙ্করণ, সেই কালভৈরবীর মূর্তিটা কোথায় জানো?’

‘কালভৈরবীর মূর্তি! কেন, তাকের ওপর নেই?’

শঙ্করণ ছুটে এল ঘরের মধ্যে।

তাক খালি। মূর্তি নেই।

লক্ষ করলাম, শঙ্করণের মুখ পাংশু, নীরক্ত হয়ে গেল।

এদিক-ওদিক খুঁজতে লাগল।

‘তাইতো, কোথায় গেল? আপনি ফেলে দেননি তো?’

আমার ঈশ্বর-বিশ্বাসের ওপর শঙ্করণের মোটেই শ্রদ্ধা ছিল না। সে আমার হালচাল দেখে হয়তো কিছুটা মালুম করেছে।

আমি বললাম, ‘মূর্তি সম্বন্ধে আমি কোনো খোঁজ রাখি না। তুমিই তো দেখাশোনা করতে।’

শঙ্করণের আমার কথার উত্তর দেবার অবকাশ নেই। সে তন্ন তন্ন করে মূর্তিটা খুঁজছে। আলনাটা সরিয়েই সে চেঁচিয়ে উঠল, ‘এই তো এখানে পড়ে রয়েছে।’

দেখলাম দু-জোড়া জুতোর ফাঁকে মূর্তিটা পড়ে আছে।

শঙ্করণ সন্তর্পণে মূর্তিটা তুলে নিল।

রুক্ষকণ্ঠে বলল, ‘এটা এখানে কে ফেলল?’

উত্তর দেওয়া প্রয়োজন মনে করলাম না। চুপ করে রইলাম।

শঙ্করণ মূর্তিটা কাপড় দিয়ে ভালো করে মুছে তাকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করল। নতজানু হয়ে মূর্তির সামনে বিড় বিড় করে মন্ত্রোচ্চারণ করল।

মাস খানেক একভাবে গেল। কোনো উপদ্রব নেই।

কলকাতা থেকে একটা চিঠি এল। বন্ধু অসিতের লেখা।

অসিত শুধু আমার মামুলি বন্ধুই নয়, কলেজে আমরা অভিন্ন হৃদয় ছিলাম। অসিত বম্বেতে এক কাপড়ের কলের টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ার।

সে লিখেছে, দু-মাসের ছুটিতে কলকাতা এসেছে। এসে ভালো লাগছে না, কারণ আমি কলকাতায় নেই। তার খুব ইচ্ছা আমার কাছে মাস খানেক কাটিয়ে যাবে।

প্রস্তাবটা খুব ভালো লাগল। পাণ্ডববর্জিত দেশে অসিতের মতন বন্ধু পাশে থাকলে সময়টা ভালোই কাটবে। পত্রপাঠ তাকে আসতে লিখে দিলাম। চিঠি লেখার সাতদিনের মধ্যে এসে হাজির। এলুরু স্টেশন থেকে ট্যাক্সি করে নিয়ে এলাম। বাড়ি দেখে অসিত বেজায় খুশি।

সবকিছুতেই তার দারুণ উৎসাহ। বিন্দুতে সিন্ধুর স্পর্শ পেল!

‘বা এ যে একেবারে বাগানবাড়ি রে? শহর অথচ শহরের গোলমাল নেই। বেশ আছিস।’

চা খেতে খেতে হঠাৎ তার দৃষ্টি মূর্তির দিকে গেল।

জিজ্ঞাসা করল, ‘ওটা কীসের মূর্তি রে?’

‘কালভৈরবীর।’

‘সেটা আবার কী?’

চা শেষ করে অসিত মূর্তির সামনে গিয়ে দাঁড়াল। অনুসন্ধানী দৃষ্টি দিয়ে দেখে বলল, ‘বাড়ির মধ্যে এই কিম্ভুতকিমাকার মূর্তিটা রেখেছিস কেন? ফেলে দে!’

‘শঙ্করণ ওই মূর্তিটা রোজ পূজা করে, তাই আর সরাইনি। নাহলে ও মোটেই আমার পছন্দসই নয়।’

‘শঙ্করণ পছন্দ করে তো এটা সে তার বাড়িতে নিয়ে যাক, কিংবা রান্নাঘরে, তার কাজের জায়গায় রাখুক। তোকে তো নাস্তিক বলেই জানতাম, অন্তত মূর্তিপূজার বিরোধী।’

কিছু বললাম না। কীই-বা বলব। অসিত আমার মনের কথাই বলেছে।

আমার ঠিক পাশের ঘরটা তার শোবার জন্য নির্দিষ্ট হয়েছিল।

দুটো দরজার মাঝখানে একটা দরজা ছিল।

বেশ কিছুটা গল্পগুজব করার পর অসিত শুতে গিয়েছিল।

আমার ঘুম আসেনি। টেবল-ল্যাম্প জ্বেলে টোবাকো কিওরিং সম্বন্ধে একটা বই পড়লাম, তারপর শুতে গেলাম।

বোধ হয় মাঝরাত, ঠিক খেয়াল নেই। পাশের ঘরে দুপদাপ শব্দ। অনেকগুলো লোক যেন দাপাদাপি করে বেড়াচ্ছে।

একবার মনে হল ডাকাত পড়েছে। তারপর ভাবলাম ডাকাতদের তো এই ঘরের মধ্যে দিয়েই যেতে হবে। পাশের ঘরে ঢোকবার আলাদা কোনো রাস্তা নেই।

সারা ঘর জুড়ে তাণ্ডব নৃত্য চলেছে, অথচ অসিতের কোনো শব্দ নেই।

তবে কি তার কোনো বিপদ ঘটল।

উঠে পড়লাম।

দরজার পাশে গিয়ে দেখলাম, অসিত পাশের দরজাটা ভেজিয়ে দিয়েছে।

হাত রাখতেই দরজাটা খুলে গেল।

শব্দ চলছে, কিন্তু কাউকে দেখতে পেলাম না।

শুধু অসিতের মশারিটা প্রবল বাতাসে উড়ছে।

অথচ আজ গুমোট। বাতাস একেবারেই নেই।

‘অসিত, অসিত!’

বার কয়েক চেঁচালাম। কোনো উত্তর নেই।

Anuprerona
Anupreronahttps://www.anuperona.com
Read your favourite literature free forever on our blogging platform.
RELATED ARTICLES

Most Popular

Recent Comments