Thursday, August 21, 2025
Homeবাণী ও কথাকাকজোৎস্না - ফয়সল সৈয়দ

কাকজোৎস্না – ফয়সল সৈয়দ

কাকজোৎস্না – ফয়সল সৈয়দ

ভোরের কুয়াশায় সবুজ ঘাস ভিজে আছে। গাছের পাতাগুলো হি হি করে কাঁপছে শৈত প্রবাহে। আমজাদও আকাশের দিকে তাকায়। বেলা অনেক হয়েছে সূর্যের দেখা নেই। হাড় কাঁপানো শীতে নাস্তানুবাদ মানুষ, পশু-পাখিসব। ঘন কুয়াশায় অদূরের মানুষ, যানবাহন ঠিক মতো দেখা যাচ্ছে না। শহরের রাস্তায় দূর্ঘটনা এড়াতে দিনের বেলায়ও হেডলাইট জ্বালিয়ে যানবাহন চলছে। সন্ধ্যার সাথে সাথে শীতের ঘনত্ব আরো বেড়ে যায়। মানুষের দূর্দশা আর ভোগান্তির শেষ নেই।

আমজাদ আবার আকাশের দিকে তাকায়। মনে মনে ভাবে এ শীত আরো কয়েক সপ্তাহ থাকবে। শীতের দিনে শীত, বৃষ্টির দিনে বৃষ্টি, গরমের দিনে গরম পড়া প্রকৃতির স্বাভাবিক রীতি —রেওয়াজ। কিন্ত অতি শীত, অতি বৃষ্টি, অতি গরম—এসব আল্লাহ পাকের পক্ষ থেকে আজাব। পৃথিবীর মানুষগুলোর ওপর তার বেজায় ক্ষোভ, ক্রোধ, ঘৃণা। তার ভাষায় ওরা অধিকাংশ বেঈমান, বেশরম, নিমকহারাম। নিজেকে দিয়ে বিচার করে রায় দিয়ে দেয়। বিয়ের সময় শ্বশুরপক্ষ বলেছিল তিন লাখ টাকা দিবে তাকে। বিয়ের দিন নগদ এক লাখ দিয়ে মেয়েকে তার হাতে তুলে দেয়। বাকি টাকা জোগাড় করে খুব শীঘ্রই দিয়ে দিবে। কিন্ত কোথায় সেই টাকা? বিয়ের দেড় বছরেও শ্বশুরকুল থেকে আর কানাকড়ি পাইনি। ইতোমধ্যে গত হয়ে বেঁচে গেছে শ্বশুর। ক্ষোভে আমজাদের মাথায় রক্ত জমে যায়।

কথায় কথায় আমাজাদ স্ত্রী রোজিনাকে টাকাগুলোর কথা স্নরণ করিয়ে দেয়; খোটা দেয়, টিপ্পনী কাটে। জাত বংশ ধরে। রোজিনাও কটকট করে মুখের ওপর কথা বলে। কোনো কথা মাটিতে ফেলতে দেয় না সে। মরা বাপ কি কবর থেকে উঠে টাকা দিবে? জিজ্ঞেস করে রোজিনা।

মা রহিমা খাতুনের সাথেও রোজিনার সম্পর্ক সাপে-নেউলে। আমজাদ মনে মনে সিদ্ধান্ত নেয়। এমন ট্যাটন বউ ঘরে রাখবে না। কোন একটি সূত্র ধরে রোজিনাকে বাপের বাড়ী পাঠিয়ে দিবে। সংসারের আপদ বিদায় করবে। তারপর দেখেশুনে আরেকটি বিয়ে করবে। নগদে নগদে হবে সেই বিয়ে। কিন্ত তার সব ভাবনা ভেস্তে যায়। রোজিনা জানায়; তার পেটে বাচ্চা। অনাগত সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে সবকিছু ভুলে যায় আমজাদ।

ফর্সা গোলগাল চেহারা। হাত পা নেড়ে হাসে আমজাদের ছেলে। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে বাবার দিকে। খুশিতে জমজম করতে থাকে বাবার চোখ-মুখ। পরম মমতায় ছেলেকে জড়িয়ে ধরে। সন্তানের স্পর্শে তার ভেতরে অন্যরকম অনুভূতি জাগে। দেখি , দেখি আমার নাতিটারে দেখি, আমাজাদের মা রহিমা খাতুন ছেলের কাছে থেকে নাতিকে নিয়ে দু’হাতে আগলে ধরে —ওরে সাতরাজার ধন, বাপের চোক্ষের মণি, দেখতে এক্কেবারে বাপের মতো হয়েছে; — ঢলঢলে চেহারা। নাক, ঠোঁট পেয়েছে দাদার।

ক্ষেতে কাজ করতে করতে হঠাৎ পায়ের আঙ্গুলের ব্যথা অনুভব করে আমজাদ। পা তুলে দেখে পায়ের বৃদ্ধা আঙ্গুলের একপাশে অনেকটা কেটে গেছে। গড়িয়ে রক্ত বের হচ্ছে। কুঁজো হয়ে মাটিতে হাত দিয়ে কাঁচের একটি টুকরা খুঁজে পায় সে। কাঁচের টুকরাটি হাতে নিয়ে — শালারপুত, বাইনঞ্চোদ বলে ছুঁড়ে মারে । শুন্যে। ক্ষত পা ধনুকের মতো বাঁকা করে ব্যাঙ্গের মতো লাফিয়ে লাফিয়ে আইলের একপাশে বসে। যেখানে জেগে আছে অসংখ্য আগাছার সাথে কয়েকটি লিবুজি গাছ। লিবুজি পাতা ছিঁড়ে দু’হাতের তালুতে পিষে ক্ষতস্থানে চেপে ধরে। কিছুক্ষণ পর ক্ষতস্থান থেকে রক্ত পড়া বন্ধ হয়ে যায়। তারপর লুঙ্গির গোছ থেকে বিড়ি বের করে। আয়েশিভাবে বসে কুন্ডলি পাকিয়ে ধোঁয়া ছাড়ে।

ভ্যাঁপসা দুপুর। সূর্য লোকাচুরি খেলছে। আকাশের বুক চিড়ে সূর্য উঁকি দিচ্ছে; প্রাণহীন, নিস্তেজ সূর্য। রহিমা বেগম ওম ভাঙ্গতে হাতের মুরগীটি পুকুরে ছুড়ে মারে। মুরগীটি উচ্চৈঃস্বরে কক কক করে ডাকতে ডাকতে সাঁতার কাটতে থাকে।

আমজাদ গাই ক্ষীরাচ্ছে। বাছুরের গলা রশি টেনে ধরে আছে রোজিনা। বাছুরটি বাঁটের দুধ খেতে ছটফট করছে, পা তুলে লাফাচ্ছে। ঘরের ভেতরে রোজিনার দগ্ধ শিশু ঘুম থেকে উঠে হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে। বাছুরটিকে আমগাছের সাথে বেঁধে ছুটে যায় রোজিনা। বুক অনাবৃত করে স্তনের বোঁটা ঠেলে দেয় শিশুর মুখে। স্তন চুষতে চুষতে মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে হাসতে থাকে নবজাতক শিশুটি। মাও মাথা নত করে শিশুর কপালে, পায়ে চুমু খায়।

দুধ ক্ষীরিয়ে ক্ষত পা সোজা করে উঠে দাঁড়ায় আমজাদ। পায়ের ব্যথা মনে হচ্ছে কমেছে। কুসুম কুসুম গরম পানিতে লবন ভূষি মিশিয়ে ডান হাত দিয়ে নেড়ে গাইটি খেতে বলে আমজাদ। গাইয়ের শরীরে হাত বুলায়। ঘ্রাণ শুকে। গরু গোশতের কেজি ৭৫০ টাকা। স্বাদ আছে সাধ্যে নেই। অনেক দিন গরুর গোশাত খাইনি সে। আগে কেউ মারা গেলে চার দিনে, চল্লিশ দিনে মোল্লা (খাবারের অনুষ্ঠান) করতো মানুষ। ইদানিং হুজুরদের কারণে সেই রীতি-নীতি উঠে যাচ্ছে। মানুষ খাওয়ানো নাকি জাহেলীয়া যুগের রীতি। যতসব আজাইরা প্যাচাল।

ক্ষত পা’নিয়ে গোসল করতে পানিতে নামতেই সিনসিন ব্যথা অনুভব করে আমজাদ। হৃদপিন্ড যেন শরীর থেকে বের হয়ে যাওয়ার উপক্রম। পুকুরে কয়েক ডুব দিয়ে মাথায়, চুলে সাবান মাখে। ভেজা লুঙ্গি পাল্টিয়ে তাতে সাবান লাগায়। দু’হাত দিয়ে কাপড় কাচে-কাপড়ের সব ময়লা গলা টিপে বের করতে চায়। শরীরের যত্নের চেয়ে কাপড়ের যত্ন বেশী নেয়।

দুপুরে খেতে বসে আমজাদ দেখে ডালে লবণ কম হয়েছে। উগরে ফেলে মুখের ভাত। লাথি মেরে ডালের বাটি ফেলে দেয়। —ঘরে দু’টো মানুষ আছে, কেউ দেখলো না লবণ কম হয়েছে। ঘ্যানঘ্যান করতে করতে রান্নাঘর ছেড়ে আমজাদ ঘরে ভেতরে যায়। ক্ষত পা’টির নীচে একটি বালিশ দিয়ে শুয়ে পড়ে। ক্ষতস্থানে তীব্র ব্যথা করছে। চোখ বুজে এপাশ-ওপাশ করতে থাকে। ঘুমাতে চেষ্টা করে। কিছুতে ঘুম আসছে না। আজ মাথাটাও বড্ড তেতে আছে তার।

উঠানে ঝগড়া করছে রোজিনা আর রহিমা বেগম। বিড়ালে দুধের হাঁড়িতে মুখ দিয়েছে। রাহিমা বেগম দুধের হাঁড়ি উঠানে ছুঁড়ে মেরে বলে— নবাবজাদিকে বলেছি সবকিছু ঢেকে রাখতে। সব দুধ নষ্ট করছোস। দুধ কি মাগনা আসে। দুধের কেজি আশি টাকা।
—আমি তো সব ঢেকে রেখেছি, বিড়ালে কিভাবে দুধে মুখ দিয়েছে। বলে ভ্রু তোলে রোজিনা।
— বল, আমি সরাইছি। চেঁচিয়ে উঠে রহিমা বেগম। ছেলে আমাদেরও ছিল, কাজ পেলে রেখে সারাদিন ছেলে নিয়ে পড়ে থাকিনি। ডালে লবণ কম হয়েছে কেন?
—মা ভুলে, আন্দাজ করতে পারেনি।
—ভুলে যাবি। ভুলে তো যাবি। তোর বাপ তো ভুলে গিয়ে কবরে গেছে।
পারভীন প্রমাদ গুনে। ঘুমন্ত শিশুর গায়ে কাঁথা টানে— থুতনির নীচ বরাবর। বুঝতে পারে কথার স্রোত জোর করে অন্যদিকে গড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে শাশুড়ী।
—হারামজাদী, তোর ওপর খোদার গজব পড়ে না কেন?
—আপনার ওপর পড়ে না কেন, সাথের সবাই মারা গেছে, কৈ মাছ…

ঘরের ভেতরে থেকে বের আসে আমজাদ। গর্জে উঠে বলে—তোরা চুপ করবি মাগি। শান্তিতে একটূ বিশ্রাম নিতেও দিবি না।
জ্ঞানশুন্য হয়ে আমজাদ উঠানে পড়ে থাকা দা’টি ছুঁড়ে মারে রোজিনার দিকে ।

দা সোজা নবজাতকের বুকে বিঁধে। রোজিনা তার কোল থেকে রক্তের একটি স্রোত গড়িয়ে যেতে দেখে। জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে
লুটিয়ে পড়ে সে।
—ও আল্লাহ গো, হারামজাদি আমার নাতিটারে খেয়ে ফেলেছে । রহিমা বেগমের চিৎকারে আকাশ ভারী আসে।
নির্বাক আমজাদ দাঁড়িয়ে থাকে।
তার পায়ের নীচে মাটিগুলো সরে যাচ্ছে।
আস্তে আস্তে দেবে যাচ্ছে মাটিতে সে।

Anuprerona
Anupreronahttps://www.anuperona.com
Read your favourite literature free forever on our blogging platform.
RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here


Most Popular

Recent Comments