Sunday, August 24, 2025
Homeরম্য গল্পমজার গল্পহৃদয় ঘটিত - তারাপদ রায়

হৃদয় ঘটিত – তারাপদ রায়

রাত দুটো নাগাদ সোমনাথ স্পষ্ট বুঝতে পারলেন যে তার হার্টঅ্যাটাক হয়েছে। সাড়ে দশটায় ভাত খেয়ে এগারোটার সময় শুয়েছিলেন। তখন থেকেই মনটা কেমন যেন খুঁতখুঁত করছিল, শরীরেও অস্বস্তি বোধ হচ্ছিল। দুটো ঘুমের বড়ি খেয়ে তবুও ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। মিনিট পনেরো হল সোমনাথবাবুর ঘুম ভেঙে গেছে।

ঘটনার শুরু অবশ্য সন্ধ্যাবেলায়। রিটায়ার্ড মানুষ সোমনাথবাবু প্রতিদিন বাড়ির পাশের পার্কটায় গিয়ে পায়চারি করেন, সকালের দিকে একবার, আর সন্ধ্যার দিকে একবার।

আজও সন্ধ্যায় তাই করেছেন। তবে তার সঙ্গে একটু অতিরিক্ত করেছেন। পার্কের বেঞ্চিতে বসে অল্প চিনেবাদাম কিনে খেয়েছেন। অল্প মানে এক টাকার চিনেবাদাম, ছোট একটা ঠোঙা, গোনাগুনতি ছোটবড় পনেরো-বিশটার বেশি বাদাম হবে না। সোমনাথবাবুদের অল্প বয়েসে, সেই পুরনো কালের এক আনায় এর দ্বিগুণ পরিমাণ বাদাম পাওয়া যেত।

তবে ডাক্তারিসম্মতভাবেই বাদামগুলো খেয়েছিলেন সোমনাথবাবু। একালের ডাক্তারেরা বলেন, বেশি আঁশযুক্ত মানে ফাঁইবারওলা খাবার খেতে, সেই নির্দেশ মান্য করে সোমনাথবাবু বাদামগুলো খোসাসুদ্ধ চিবিয়ে খেয়েছিলেন। খেতে খুব ভাল লেগেছিল তা নয়, কিন্তু স্বাস্থ্যের কারণে খেয়েছিলেন।

হয়তো বাদাম না কিনলেও চলত, সেটাই ভাল হত। এই বয়েসে বাদাম খাওয়ার খুব লোভও নেই সোমনাথবাবুর। কিন্তু আজ বিকেলে এক যুবতী বাদামওয়ালিকে দেখে তিনি অভিভূত হয়ে যান। যদিও বিকেলবেলা জল খাওয়ার পরে আর রাতের খাবারের আগে এর মধ্যে সোমনাথবাবু কিছুই খান না, এই বয়েসে বাদামওয়ালির লাস্য দেখে এবং মধুর অনুরোধ শুনে তিনি ভুল করেছিলেন।

বুকের ব্যথাটা ক্রমশ ঠেলে ঠেলে উঠছে। একটা চাপা ঢেকুর, সঙ্গে গলাজ্বালা। সারা শরীরে কেমন। অস্বস্তি হচ্ছে। কয়েকবার বিছানায় উঠে বসলেন সোমনাথবাবু। দুবার বাথরুমে গেলেন। কেমন একটা বমি বমি ভাব।

বমি হলে তবু ভাল লাগত। কিন্তু খুব চেষ্টা করেও, গলায় আঙুল দিয়েও বমি করতে পারলেন না। সোমনাথ। এদিকে বুকের ব্যথাটা কমছে, বাড়ছে। হার্টঅ্যাটাক হয়েছে সুনিশ্চিত ধরে নিয়ে ফুল স্পিড পাখার তলায় বিছানার ওপরে বালিশে ঠেস দিয়ে বসে দরদর করে ঘামতে লাগলেন সোমনাথ।

 অবশ্য এই প্রথম নয়, সোমনাথের মাঝে মধ্যেই হার্টঅ্যাটাক হয়ে থাকে। এই তো গত বুধবারেই সোমনাথবাবুর একবার হার্টঅ্যাটাক হয়ে গেছে। সকালে বাজার করে বাড়ি ফিরছিলেন। বাড়ির দরজার সামনে তার হার্টঅ্যাটাক হল। কোনও রকমে সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় নিজের ফ্ল্যাটের সামনে উঠে বাজারের থলেটা সিঁড়ির মুখে ফেলে দিলেন, কলিংবেলটা আর টেপার ক্ষমতা নেই। মেঝেতে হাটুমুড়ে বসে বাঁ হাতে দরজার কড়াটা নাড়বার ক্ষীণ চেষ্টা করতে লাগলেন ডান হাতে বুকটা চেপে ধরে।

এই সময় তিনতলার মিস যমুনা চক্রবর্তী সিঁড়ি দিয়ে নামছিলেন, তিনি সোমনাথবাবুকে এই ভয়াবহ অবস্থায় দেখে দাঁড়িয়ে গেলেন, যমুনাদেবীর অফিস যাওয়ার তাড়া ছিল, কিন্তু প্রতিবেশীসুলভ কর্তব্যবোধে তিনি সোমনাথবাবুর মাথার ওপর দিয়ে হাত বাড়িয়ে কলিংবেলটা টিপে দিলেন।

এ বাড়িতে সহজে দরজা খোলে না, কলিংবেল অনেকক্ষণ ধরে টিপতে হয়। বাড়িতে সদস্য সংখ্যা মাত্র তিনজন। সোমনাথবাবু, তার স্ত্রী মনোরমাদেবী এবং একমাত্র কন্যা সুজাতা। এ ছাড়া একটি ঠিকে কাজের মেয়ে আছে। আগে তার নাম ছিল পাঁচুর মা, এখন তার নাম শতাব্দী।

সুজাতা সকাল সাড়ে পাঁচটায় বেরিয়ে গেছে মর্নিং কলেজ করতে। শতাব্দী অবশ্য সাড়ে আটটা পর্যন্ত ছিল, বাসন মেজে, ঘর ঝাড় দিয়ে, মুছে সেও সময়মতো চলে গেছে।

এখন বাড়ির মধ্যে সোমনাথগৃহিণী শ্রীযুক্তা মনোরমা একা।

কিন্তু মনোরমাদেবীর খালি বাড়িতে একা থাকা উচিত নয়। তিনি হার্টের রোগী। তা ছাড়া মাঝে মধ্যে তাঁর ক্যানসার হয়। একবার এইডস হয়েছিল।

অবশ্য, এইডস হওয়া ব্যাপারটা বেশিদূর গড়ায়নি। কারণ সোমনাথবাবু তার স্ত্রীকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছিলেন যে এইডস হওয়া ভাল নয়। ব্যাপারটা তাদের দুজনের পক্ষেই খুব অসম্মানজনক, তা ছাড়া পাড়ার লোকে ঘুণাক্ষরেও টের পেলে পাড়ায় বসবাস করা সম্ভব হবেনা। গায়ের জোরে থেকে গেলেও একঘরে হয়ে থাকতে হবে, শুধু ধোপা-নাপিত নয়, কাজের মেয়ে থেকে অকাজের প্রতিবেশিনী এমনকী খবরের কাগজওলা, ডাকপিয়ন, ইলেকট্রিক মিস্ত্রি বাড়িমুখো হবে না।

সোমনাথবাবু অবশ্য আরও একটু বাড়িয়ে বলছিলেন, তবে খুন-ডাকাতি-রাহাজানি করতে পারলে সুবিধে আছে, থানা থেকে একটি সেপাইও ধরতে আসবে না, ফৌজদারি আদালতের কোনও পেয়াদা। সমন ধরাতে আসবে না।

এত কথা মনোযোগ দিয়ে শোনার মহিলা মনোরমাদেবী নন। তিনি শুধু একটি সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন করেছিলেন, তা আমার এইডস হলে তোমার অসম্মান হবে কেন? আমরা জানি না মনোরমাদেবীকে ব্যাপারটা কী ভাবে বুঝিয়েছিলেন সোমনাথবাবু, উত্তরযৌবন দাম্পত্য জীবনের সেই নিগূঢ় সমীক্ষায় আমার কোনও কৌতূহল নেই।

মনোরমা অবশ্য আরও জানতে চেয়েছিলেন, আমার যদি এইডস না হয়ে থাকে তবে আমার সর্দি সারে না কেন?

মোক্ষম প্রশ্ন। এইডসের সারমর্ম কী করে যে মনোরমাদেবী জেনেছিলেন। সোমনাথবাবুও ব্যাপারটা জানেন, এইডস কোনও রোগ নয়, রোগের বন্ধু। এইডস আক্রান্ত ব্যক্তির কোনও অসুখ হলে সেটা সারে না, সারবে না।

বলা বাহুল্য, এই রচনা এইডস বিষয়ক কোনও কথোপকথননির্ভর শিক্ষামূলক মামুলি প্রবন্ধ নয়।

সুতরাং আমাদের ফিরে যেতে হবে সেই বুধবার সকালে যখন সিঁড়ির ওপরে নিজের ফ্ল্যাটের দরজার সামনে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে সোমনাথবাবু বুকে হাত দিয়ে বসে পড়েছিলেন।

তিনতলার ফ্ল্যাটের যমুনাদেবী কলিংবেল বাজিয়ে যখন অনেকক্ষণ পরে পায়ের শব্দ পেলেন, মৃদু হেসে সোমনাথবাবুকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, আপনার আবার হার্টঅ্যাটাক হল?

এই শোচনীয় মুহূর্তে ভদ্রমহিলার এরকম পরিহাস, কিন্তু যমুনাদেবীকে দোষ দেওয়া যায় না। তিনি রীতিমতো ভুক্তভোগিনী।

গত ছয় মাসে অন্তত তিন চারবার মধ্য বা শেষরাতে, বাংলা বনধের দুপুরে যমুনাদেবীকে অন্যান্য প্রতিবেশীর সঙ্গে ছুটোছুটি করতে হয়েছে হৃদরোগাক্রান্ত সোমনাথবাবুকে হাসপাতাল বা নার্সিংহোমে পৌঁছে দেওয়ার জন্য।

গত বুধবারে অবশ্য যমুনা চক্রবর্তী বেশ সহজেই অব্যাহতি পেয়েছিলেন কিংবা বলা যায় অফিসের তাড়াতাড়ির জন্য পালিয়ে বেঁচেছিলেন। মনোরমা দরজা খোলা মাত্র তার হাতে স্বামীকে গছিয়ে দ্রুত পায়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে গিয়েছিলেন যমুনা।

বিকেলে অফিস থেকে ফিরে যমুনা সোমনাথের খোঁজ করেছিলেন, অফিসে নানা কাজের মধ্যে সারাদিনই মনটা খুঁতখুঁত করেছিল, কী জানি ভদ্রলোকের যদি সত্যিই হার্টঅ্যাটাক হয়ে থাকে।

বিকেলে খোঁজ নিয়ে দেখলেন তার আশঙ্কা অমূলক। পাড়ার মোড়ে ছেলেরা ম্যারাপ বেঁধে রবীন্দ্র-নজরুল সন্ধ্যা করছে। সেখান সোমনাথবাবু গেছেন আবৃত্তির বিচারক হয়ে।

আজ রাত দুটোয় বিছানার ওপর বুকে হাত দিয়ে বসে ঘামতে ঘামতে গত বুধবারের অবস্থাটা মনে করছিলেন সোমনাথ। কিন্তু আজকেরটা সেদিনের মতো মিথ্যে অ্যাটাক নয়। বুকের ব্যথা, ঘাম, দমবন্ধভাব–কিছুদিন আগে একটা মেটিরিয়া মেডিকা কিনেছিলেন, সেই বইয়ের হার্টঅ্যাটাকের বর্ণনার সঙ্গে নির্ঘাত মিলে যাচ্ছে। মেটিরিয়া মেডিকাটি সহজ বাংলায় একটি অসুখ ও ওষুধ নির্ণয়ের বই, কয়েকমাস আগে সেটা কেনার পর থেকে সোমনাথবাবু আগাগোড়া পড়ে পড়ে গুলে খেয়েছেন।

অদূরেই অন্য একটা খাটে মনোরমা শুয়ে আছেন। সোমনাথবাবুর এই অবস্থায় যা কিছু করণীয় সবই মনোরমাকেই করতে হবে। কিন্তু সোমনাথ মনোরমাকে ডাকার সাহস পাচ্ছেন না।

গতকাল সকাল থেকে মনোরমাদেবীর জিভে ক্যানসার হয়েছে। এখনও ডাক্তার দেখানো হয়নি তবে মনোরমাদেবী নিশ্চিত যে তার ক্যানসারই হয়েছে। সোমনাথ একবার বলার চেষ্টা করেছিলেন যে মনোরমার মাড়ির যে দাঁতটা কিছুদিন আগে ভেঙে গেছে, সেই ভাঙা দাঁতের ঘষাতেই জিভটা ছড়ে ছড়ে কেটে গিয়েছে। সোমনাথ বোঝাতে চেয়েছিলেন যে ভাঙা দাঁতটা তুলে ফেললে এবং জিভে একটা লোশন লাগালেই এ যাত্রা কর্কট রোগের হাত থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যাবে, কিন্তু কে শোনে কার কথা।

এ তবুও ভাল বলা যায়। গতবছর পুজোর সময় মনোরমার যখন ব্রেনে ক্যানসার হয়েছিল তখন সোমনাথ নিজেও ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন। রীতিমতো পয়সা খরচ হয়েছিল, ব্রেন স্ক্যান থেকে অনেক কিছু করতে হয়েছিল, তবে এরই মধ্যে এইডসে আক্রান্ত হয়ে যাওয়ায় মনোরমাদেবীর ব্রেন ক্যানসারটা চাপা পড়ে যায়।

আজ রাতে কিন্তু সোমনাথবাবু ভরসা পাচ্ছেন না মনোরমাকে তার গুরুতর শারীরিক অবস্থার কথা জানাতে। মনোরমাদেবী পাশের খাটে চোখ বুজে ঘুমিয়ে আছেন, আহা ক্যানসারের রোগী, তার আর কতটুকুই বা ক্ষমতা।

কিন্তু এদিকে যে সোমনাথবাবুর বুকের ব্যথা আবার অসহ্য হয়ে উঠেছে। অবশেষে আজ রাতে বিনা চিকিৎসায় প্রাণ যেতে বসেছে তাঁর।

এখন একমাত্র সুজাতা ভরসা। সে যদি ডাক্তারবাবুকে ফোন করে, পাড়া-প্রতিবেশীকে খবর দেয় হয়তো সুচিকিৎসা হলে প্রাণটা বাঁচলেও বাঁচতে পারে।

কোনও রকমে বিছানা আঁকড়িয়ে ধরে মেঝেতে নামলেন সোমনাথবাবু। পাশের ঘরেই সুজাতা থাকে। দেওয়াল ধরে ধরে সুজাতার ঘরের কাছে পৌঁছালেন তিনি।

সুজাতার ঘরে আলো জ্বলছে। বোধহয় পরীক্ষা সামনে তাই রাত জেগে পড়াশুনা করছে মেয়েটা। দরজাটা আলগা করে ভেজানো। দরজার কাছে গিয়ে সোমনাথবাবু শুনতে পেলেন ঘরের মধ্যে কী যেন সব কথাবার্তার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। সর্বনাশ, এত রাতে আবার মেয়েটার ঘরে কে?

 দরজায় ঠুকঠুক করে আওয়াজ করলেন। সুজাতা বিছানা থেকে তড়াক করে লাফিয়ে এসে দরজা খুলল। ঘরের মধ্যে অন্য লোকজন কেউ নেই। তবে একটা টিভি চলছে। টিভিতে চ্যানেল ভি নাকি চ্যানেল পাঁচ কী একটা চলছে, জামাকাপড় প্রায় খুলে ফেলে ধুন্ধুমার নাচ, গান, বিলিতি বাজনা শব্দটা খুব কমিয়ে দিয়ে সুজাতা তাই দেখছিল।

বাবাকে দেখে চিন্তান্বিত হয়ে সুজাতা জিজ্ঞাসা করল, তোমার আবার কী হল?

কোনও রকম কথা বলতে পারলেন না সোমনাথ। বুকে হাত দিয়ে মেয়ের পড়ার টেবিলটায় ভর দিয়ে সামনের চেয়ারটায় বসে পড়লেন সোমনাথবাবু।

বিচক্ষণা মেয়ে, অবস্থা বুঝতে তার বিশেষ অসুবিধে হল না। অসুবিধে হওয়ার কথাও নয়, সুজাতার এ বিষয়ে যথেষ্ট পূর্ব অভিজ্ঞতা আছে।

সুজাতা গম্ভীর হয়ে জিজ্ঞাসা করল, হার্টঅ্যাটাক?

সোমনাথবাবু মৃদু স্বরে বললেন, হ্যাঁ।

 এবার সুজাতাকে বেশ চিন্তিত দেখাল, সে বলল, কিন্তু মারও তো হার্টঅ্যাটাক হয়েছে।

খবরটা শুনে এই রকম শারীরিক অবস্থার মধ্যেও সোমনাথ খুব বিব্রত বোধ করলেন। একটু কষ্ট করে দম নিয়ে ধরে ধরে বললেন, সে কী? কখন?

সুজাতা এগিয়ে গিয়ে টিভিটা বন্ধ করে দিয়ে এসে বলল, রাত একটা নাগাদ হবে। তারপর সোমনাথকে সান্ত্বনা দিয়ে বলল, তোমাকে চিন্তা করতে হবে না। আমি ছোট মামাকে ফোন করে দিয়েছি।

সুজাতার ছোট মামা মানে সোমনাথের ছোট শ্যালক পরেশ কাছেই থাকেন মাইল দেড়েকের মধ্যে। তা ছাড়া পরেশবাবুর একটা সুবিধে এই যে তার নিজের একটি গাড়ি আছে এবং হাসপাতাল-নার্সিংহোমে ভরতি করানোয় তিনি একজন এক্সপার্ট। সুদক্ষ ব্যক্তি ছাড়া চিকিৎসালয়ে ভরতি করানো আজকাল যার তার পক্ষে সম্ভব নয়।

পরেশবাবু তাঁর দিদি-জামাইবাবুর ব্যাপারটা সম্যক জানেন। কখন কী অবস্থা নেওয়া উচিত সে বিষয়ে পরেশবাবুর বাস্তববোধ আছে।

ভাগিনেয়ীর ফোন পেয়ে পরেশবাবু খুব যে একটা চিন্তিত বোধ করেছেন তা নয়। কিন্তু এরকম সংবাদ পেয়ে চুপ করে বসে থাকাও যায় না। হঠাৎ যদি কিছু হয়ে যায়।

পরেশবাবু এসে গেলেন। একটা ঝকঝকে অ্যাম্বুলেন্স গাড়ির মাথায় লাল আলো ঘুরপাক খাচ্ছে, তার সামনে পথ দেখিয়ে পরেশবাবুর গাড়ি। জামাইবাবুদের ফ্ল্যাটবাড়ির উঠোনটায় নিজের গাড়ি ও অ্যাম্বুলেন্স রেখে পরেশবাবু দোতলায় উঠে এসেছেন।

ইতিমধ্যে সুজাতা গিয়ে তিনতলায় যমুনাদেবীকে বাবার খবর দিয়েছে। যমুনাদেবী বুদ্ধিমতী মহিলা, তিনি আশেপাশের ফ্ল্যাটে জানা-চেনা, মিশুক স্বভাবের যারা আছেন যেটুকু সময় পেয়েছেন তার মধ্যে তাদের ফোন করে সোমনাথের অবস্থা জানিয়েছেন।

সুজাতা কিন্তু যমুনাদেবীকে তার মা মনোরমাদেবীর হার্টঅ্যাটাকের কথা বুদ্ধি করেই কিছু বলেনি। এক সঙ্গে স্বামী-স্ত্রী দুজনের হার্টঅ্যাটাকের সংবাদ পেয়ে তার কী প্রতিক্রিয়া হবে এই ভেবে সুজাতা খবরটা চেপে যায়।

সুজাতাকে নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নামার মুখে সিঁড়ির জানলা দিয়ে যমুনাদেবী দেখলেন, উঠোনে অ্যাম্বুলেন্স দাঁড়িয়ে। অ্যাম্বুলেন্স এসে যাওয়ায় যমুনাদেবী একটু আশ্বস্ত হলেন, যাক তা হলে পুরো ঝামেলাটা তার কাঁধে পড়বে না।

যমুনাদেবীর মুখভাব দেখে সুজাতা নিজে থেকেই বলল, মামাকে ফোন করেছিলাম। মামাই বোধহয়, অ্যাম্বুলেন্সটা নিয়ে এসেছে।

সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে যমুনাদেবী দেখলেন সুজাতার মামা পরেশবাবু সুজাতাদের ফ্ল্যাটে ঢুকে গেলেন, তার পিছে পিছে স্ট্রেচার নিয়ে সাদা পোশাক পরা দুই ব্যক্তির সঙ্গে আরও একজন। তার গলায় স্টেথস্কোপ। এরাও ঢুকল।

এদিকে পরেশবাবু যার জন্যে ওই অ্যাম্বুলেন্স, স্ট্রেচার ইত্যাদি নিয়ে এসেছেন সেই মনোরমাদেবী এখন অঘোরে ঘুমোচ্ছেন। সুজাতাকে নিজের স্ট্রোকের কথাটা জানিয়েই তিনি কাতরোক্তি করতে করতে মৃত্যু আজ অনিবার্য ভেবে চোখ বুজে শেষ মুহূর্তের জন্যে অপেক্ষা করছিলেন। ওই অবস্থাতেই তিনি একটু পরে ঘুমিয়ে পড়েন এবং যথাসময়ে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে যান।

এখন স্ট্রেচারবাহীরা পরেশবাবুর পিছে পিছে মনোরমা-সোমনাথের শয়নকক্ষে প্রবেশ করে মনোরমাকে বিছানায় গভীর নিদ্রায় শায়িত দেখে তিনি অচৈতন্য আছেন ভেবে স্ট্রেচারে তুলতে গেল।

মনোরমার ঘুম ভেঙে গেল। ততক্ষণে অন্যান্য ফ্ল্যাটবাড়ির লোকেরা যমুনার ডাকে সাড়া দিয়ে ওই ফ্ল্যাটে এসে গেছে। ঘরের মধ্যে গিজগিজ করছে লোক। হঠাৎ সুখনিদ্রা ভেঙে চোখ মেলে মনোরমা এই ভিড় দেখে কেমন হকচকিয়ে গেলেন। তারপর সামনে নিজের সহোদর ভাই পরেশকে দেখতে পেয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, কী হয়েছে? কী হয়েছে রে পরেশ?

পরেশ তখন বলল, তোমার কী হয়েছে সে তুমিই বলতে পারবে।

শুনে মনোরমা চিন্তায় পড়লেন, একটু দূরে মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, এই সুজাতা কী হয়েছে রে?

সুজাতা বলল, এখনকার কথা বলতে পারব না তবে ঘণ্টা দেড়েক আগে তোমার হার্টঅ্যাটাক হয়েছিল।

মনোরমাদেবী এই কথা শুনে বিছানার ওপর উঠে বসলেন। পাশের টেবিলে রাখা একটা প্লাস্টিকের কৌটো খুলে একটা জর্দা পান বের করে মুখে দিয়ে বললেন, হার্টঅ্যাটাটা কেটে গেছে। এখন একটু ক্যানসার ক্যানসার লাগছে। মুখে পানটা চিবোচ্ছি, জিবটা কেমন জ্বালা করছে।

অনতিবিলম্বে স্ট্রেচারসহ স্ট্রেচারবাহীরা সঙ্গে সেই স্টেথস্কোপবাহী ডাক্তার ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে গেলেন। কিন্তু তাঁরা সিঁড়ি দিয়ে নামার আগেই সুজাতা গিয়ে পথ আটকাল, আপনারা যাবেন না, পাশের ঘরে রোগী আছেন, আমার বাবার হার্টঅ্যাটাক হয়েছে।

কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থায় অ্যাম্বুলেন্সের লোকেরা সিঁড়ির ওপর দাঁড়িয়ে গেল। তবে তারা কিছু বুঝবার আগেই পাশের ঘর মানে সুজাতার ঘর থেকে যমুনাদেবী বেরিয়ে এলেন। তিনি এসে ঘোষণা করলেন, না, সোমনাথবাবুর অ্যাম্বুলেন্স লাগবে না। তিনি ভাল হয়ে গেছেন৷ বুকে ম্যাসেজ করে তার হার্টঅ্যাটাক সারিয়ে দিয়েছি। তিনি এবার ঘুমিয়ে পড়েছেন।

নানা রকমের কানাঘুষা করতে করতে প্রতিবেশীরা একে একে চলে গেল নিজেদের শেষ রাতের ঘুমটুকু পুষিয়ে নিতে। স্ট্রেচারবাহীরা কটু ভাষায় গালমন্দ করতে করতে লাল আলো জ্বালিয়ে তীব্র সাইরেনের ধ্বনি তুলে গেল।

Anuprerona
Anupreronahttps://www.anuperona.com
Read your favourite literature free forever on our blogging platform.
RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here


Most Popular

Recent Comments