Wednesday, August 20, 2025
Homeথ্রিলার গল্পরহস্য গল্পঘাসের আড়ালে কে (প্রেতচক্র) - অনীশ দাস অপু

ঘাসের আড়ালে কে (প্রেতচক্র) – অনীশ দাস অপু

বসন্তের এক চমৎকার দিনে আমি হাজির হলাম বাতেংগো। দক্ষিণ সাগরের পরিনেশিয়ান গ্রামগুলোর মত বাতেঙগোও বিশিষ্ট হয়ে আছে তার লম্বা ঘাসের জন্যে। আর ব্রনক্স বোটানিক্যাল গার্ডেনের জন্যে আমি এবার বিশেষ শ্রেণীর ঘাস খুঁজতেই বেরিয়েছি। বাতেংগার সবেধন নীলমণি লঞ্চঘাটে নামার পরেই পরিচয় হলো ঘাট মাস্টার গ্রেভসের সঙ্গে। সুদর্শন, হাসিখুশি স্বভাবের এই তরুণ খুব সহজেই কাউকে আপন করে নিতে পারে। এমনকি আমার পোষা কুকুর ডন, যে কিনা পলিনেশিয়ান কিংবা মেলানেশিয়ান কাউকেই পছন্দ করে না, সে পর্যন্ত গ্রেভসের ভক্ত হয়ে গেল দশ মিনিটের মধ্যে।

গ্রেভসের ঢেউ খেলানো লোহার ছাদের বাড়িটি আপাদমস্তক ঘোষণা করছে এখানে একজন অবিবাহিত পুরুষ মানুষ বাস করে। গ্রেভস এই দ্বীপে আছে বছর তিনেক। গর্বিত সুরে জানাল, এই সময়ের মধ্যে একদিনও তাকে কেউ কর্তব্যকর্মে গাফিলতি করতে দেখেনি। বেশ কিছুদিন ধরে সাদা চামড়ার মানুষের সান্নিধ্যে থেকে বঞ্চিত গ্রেভস। আমাকে দেখে এত খুশি হলো যে পরিচয়ের আধঘণ্টার মধ্যে জেনে ফেললাম তার শৈশবের সমস্ত ঘটনা এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা।

অবশ্য ভবিষ্যৎ পরিকল্পনাটি খুবই সরল। পরবর্তী ট্রিপে যে স্টীমারটি আসছে ওটায় চড়ে তার বান্ধবী আসবে আমেরিকা থেকে। তারা দুজনে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হবে এবং স্টীমারের ক্যাপ্টেন ওই অনুষ্ঠানে যোগ দেবেন।

বন্ধু, বলল সে, আপনি হয়তো ভাবছেন আমার প্রেমিকা এখানে এসে খুবই একা অনুভব করবে। কিন্তু আপনি জানেন না আমি আমার সমস্ত ভালোবাসার অর্ঘ্য তার পায়ের তলায় নিবেদন করব। নিঃসঙ্গতা তাকে ছুঁতেই পারবে না। একজন মানুষ, যে সারাদিন ভাবতে থাকে কি করে তার প্রেমিকাকে সুখী করবে, সে তার স্বপ্নকন্যাকে কাছে পেলে কি করবে কল্পনা করুন তো একবার! আচ্ছা আপনি না। হয় এবার ভেতরে আসুন। ওর সঙ্গে আপনার পরিচয় করিয়ে দেই।

গ্রেভস আমাকে নিয়ে তার বেডরূমে ঢুকল, ড্রেসিং টেবিলের ওপর দেয়ালে বাঁধানো একটি বড় ছবির সামনে ধ্যানমগ্ন হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল।

একজন সামান্য ঘাট মাস্টারের প্রেমিকা এত সুন্দরী হবে এ আমি কল্পনাই করিনি। মেয়েটি শুধু রূপবতীই নয়, অদ্ভুত লাবণ্যময়ী। অদ্ভুত নিষ্পাপ একটি ভাব খেলা করছে তার সুন্দর মুখখানায়।

খুব সুন্দরী, বলল সে। তাই না?

এতক্ষণ চুপচাপ গ্রেভসের কথাই শুনে গেছি আমি। এবার মন্তব্য করলাম, আমি এখন দিব্যি বুঝতে পারছি কেন আপনি এই অসাধারণ রূপবতী মেয়েটির ছবির দিকে তাকিয়ে নিজেকে একা ভাবেন না। এই মেয়ে কি সত্যি সামনের ট্রিপে এখানে আসছে? আমার এখনও ঠিক বিশ্বাস হচ্ছে না!

হ্যাঁ, বলল গ্রেভস। সুন্দর না?

একজন ঘাট মাস্টার, বলে চললাম আমি, তার নিঃসঙ্গতা কাটানোর জন্য এমনকি তার পোষা কুকুর, বেড়ালের সঙ্গেও কথা বলে। কিন্তু এখন আমি বুঝতে পারছি আসল মানুষটিকে না দেখেও তার ছবির সঙ্গে কথা বলে দিনের পর দিন কাটিয়ে দেয়া যায় যদি সে হয় এরকম শ্বাসরুদ্ধকর সৌন্দর্যের অধিকারিণী। আসুন, হাত মেলাই।

তারপর আমি গ্রেভসকে প্রায় একরকম টেনেই ও ঘর থেকে বাইরে নিয়ে এলাম। কারণ আমার হাতে সময় খুব কম। যে কাজে এসেছি ওটার ব্যাপারে তাড়াতাড়ি খোঁজ খবর নেয়া দরকার।

আমি কি কাজে এসেছি তা কিন্তু এখনও আপনি জানতে চাননি, বললাম আমি। তাই নিজে থেকেই বলছি। আমি ব্রনক্স বোটানিক্যাল গার্ডেনের জন্যে ঘাস সংগ্রহ করছি।

আচ্ছা! প্রায় চেঁচিয়ে উঠল গ্রেভস। তাহলে তো আপনি ঠিক জায়গাতেই এসেছেন, ভাই। এই দ্বীপে একটা গাছও আপনার চোখে পড়বে কিনা সন্দেহ। কিন্তু চারদিকে আপনি শুধু ঘাসের বন্যাই দেখতে পাবেন। আমার বাড়ির চৌহদ্দির মধ্যেই তো কমপক্ষে পঞ্চাশ রকমের ঘাস রয়েছে।

আঠারো পদের ঘাস অবশ্য ইতিমধ্যে আমার চোখে পড়েছে, বললাম আমি। কিন্তু সেটা আসল কথা নয়। আসল কথা হচ্ছে বাতেঙগো দ্বীপের ঘাসে কখন আঁটি হয়?

পনি ভেবেছেন এই প্রশ্ন করে আমাকে বোকা বানাবেন, তাই না? বলল সে। কিন্তু ঘাট মাস্টারের কাজ করলেও এসবেরও ছিটেফোঁটা খবর আমি রাখি, ভাই সাহেব। ওদিকে, হাত তুলে দেখাল সে, ওগুলোকে আমরা বিচ নাট বলি ওগুলোতে প্রথম আঁটি জন্মাবে। আর যতদূর জানি সপ্তাহ দুয়েকের মধ্যেই প্রক্রিয়াটি শুরু হয়ে যাবে।

সত্যি বলছেন?

আরে, আমি মিথ্যা বলতে যাব কোন্ দুঃখে?

সেক্ষেত্রে, বললাম আমি, আপনি আমাকে নির্ধারিত সময়েই আবার এখানে দেখতে পাবেন।

সত্যি? উদ্ভাসিত হয়ে উঠল গ্রেভসের মুখ। তাহলে তো আপনি আমাদের বিয়েতেও অংশ নিতে পারবেন।

ও ব্যাপারেও আমার যথেষ্ট আগ্রহ আছে। আমি আপনার স্বপ্নকন্যাকে বাস্তবে দেখতে চাই।

আপনি যাওয়ার পর আপনার কাজে লাগে এমন কিছু সাহায্য কি করতে পারি? আমার হাতে এমনিতেই প্রচুর সময়…।

ঘাস সম্বন্ধে যদি আপনার মোটামুটি একটা ধারণা থাকে…

তা অবশ্য নেই। তবে আমি ওদিকটাতে একবার যাব। যদিও যেতে হবে একাই। কারণ ওরা কেউ আমার সঙ্গে যেতে চাইবে না।

গ্রামের লোক?

হ্যাঁ। কুসংস্কারে বোঝাই সব। মানুষের চেয়ে ওই গ্রামে কাঠের দেবতার সংখ্যা বেশি। আর সবাই যেন আত্মহত্যার প্রতিযোগিতায় নেমেছে। সবকটা পাগল… আলোইট! হাঁক ছাড়ল গ্রেভস।

তার ডাক শুনে বাড়ির ভেতরে থেকে হেলেদুলে বেরিয়ে এল দশ বারো বছরের একটি ছেলে।

আলোইট, বলল গ্রেভস, এক দৌড়ে দ্বীপের পাহাড়টায় উঠে এই ভদ্রলোকের জন্য কিছু ঘাস নিয়ে আসতে পারবে? উনি তোমাকে এই জন্যে পাঁচ ডলার বকশিশ দেবেন।

মুখ শুকিয়ে গেল আললাইটের। মাথা নাড়ল যাবে না সে।

পঞ্চাশ ডলার?

এবার আরও জোরে মাথা নাড়ল আলোইট। আমি শিস দিয়ে উঠলাম। এতগুলো টাকার লোভ কেউ সামলাতে পারে নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাসই করতাম না।

তাহলে ফোট ব্যাটা কাপুরুষ, ধমকে উঠল গ্রেভস। আমার দিকে ফিরে বলল, দেখলেন তো? টাকা পয়সা, মারধোর কোন কিছু দিয়েই ওদেরকে সাগর তীর থেকে একমাইল দূরেও নিয়ে যেতে পারবেন না। ওরা বলে পাহাড়ের কাছে ওই ঘাসের রাজ্যে গেলে সেই ভয়ঙ্কর ঘটনাটা আপনার জীবনেও ঘটতে পারে।

কোন্ ঘটনা?

বহু বছর আগে এক মহিলা গিয়েছিল ওখানে, বলল গ্রেভস। মহিলাকে পরে লম্বা ঘাসের নিচে পড়ে থাকতে দেখা যায়। তার শরীর পুরোটা কালো হয়ে ফুলে গিয়েছিল। পায়ের গোছের ঠিক ওপরে কিসে যেন কামড় দিয়েছিল তাকে।

সাপ তো হতেই পারে না, বললাম আমি। আমি খুব ভালো করেই জানি এসব দ্বীপে সাপ নেই।

সাপে কামড়েছে এমন কথা ওরাও বলেনি, বলল গ্রেভস। ওরা বলেছে কামড়ের জায়গায় খুব ছোট ছোট দাঁতের দাগ দেখা গেছে। যেন খুব ছোট বাচ্চা কামড়েছে। উঠে দাঁড়াল সে। আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে বলল, এসব গাঁজাখুরি ব্যাপার নিয়ে কথা বলে লাভ নেই। আপনি যদি ঘাস খুঁজতে ওদিকে যেতে চান তো একাই যেতে হবে। আর যদি না যান তাহলে চলুন একবার ঘাটের দিকে যাই। একটা ব্রেক ভেঙে গেছে। ওটাকে মেরামত করতে হবে। হপ্তা পাঁচেক পর আমি আবার যাত্রা শুরু করলাম বাতেগো দ্বীপের দিকে। একমাসেরও বেশি সময় ধরে আমি মানুষজনের সঙ্গ থেকে একরকম বঞ্চিত। তাই যতই বাতেঙগোর লঞ্চ ঘাটের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে আমাদের জলযান, ততই উৎফুল্ল হয়ে উঠছি আমি। গ্রেভস। এবং তার ভাবি স্ত্রীর কথা ভাবছি। মেয়েটির সৎসাহসের প্রশংসা করতেই হয়। সবকিছু ছেড়ে দক্ষিণ সাগরের এই নির্জন দ্বীপে শুধু অর প্রেমিকের স্বার্থে বসবাস করতে আসা চাট্টিখানি কথা নয়।

অবশেষে তীরে এসে ভিড়ল তরী। হাঁটুর কাছে রাখা শটগানটি তুলে নিলাম হাতে। ডন ঘেউ ঘেউ করে তার আনন্দ প্রকাশ করতে লাগল। আমি ট্রিগারে চাপ দিলাম।

গুলির শব্দে বেরিয়ে এল গ্রেভস তার বাড়ি থেকে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে একটি রুমাল নাড়তে লাগল। আমি মেগাফোনে চিৎকার করে বললাম তাকে দেখে খুব খুশি হয়েছি। জানতে চাইলাম সে বাতেগোতে আমার সঙ্গে দেখা করতে পারবে কিনা।

এতদূর থেকেও গ্রেভসের আচরণে কেমন একটা আড়ষ্ট ভাব লক্ষ করলাম আমি। কয়েক মিনিট পর মাথায় একটি টুপি চাপিয়ে বাড়ি থেকে বেরুল সে। দরজা বন্ধ করল। হাঁটতে শুরু করল গ্রামের দিকে। কিন্তু ওর হাঁটার ভঙ্গিতেও স্বতঃস্ফূর্ত ভাবটি অনুপস্থিত। আমাকে দেখে সে খুব একটা খুশি হয়েছে বলে মনে হলো না।

আশ্চর্য তো! ডনকে উদ্দেশ্য করে বললাম আমি। গ্রেভসের ভাবসাব দেখে মনে হচ্ছে অনিচ্ছাসত্ত্বেও সে আমাদের সঙ্গে দেখা করতে আসছে।

ডনকে নিয়ে লঞ্চ থেকে নেমে পড়লাম আমি। এগোলাম তীর ধরে। অনেক গ্রামবাসী দাঁড়িয়ে আছে তীরে। এত অচেনা মানুষের উপস্থিতি ডনের জন্যে রীতিমত অস্বস্তিকর। সে আমার পায়ে পায়ে চলতে লাগল। গ্রেভস আসার আগেই তীরে পৌঁছে গেলাম আমরা। গ্রেভস ওখানে হাজির হতেই গ্রামবাসীরা সভয়ে সরে গেল দূরে, যেন কোন কুরোগীকে দেখছে। আমার দিকে তাকিয়ে শুকনো হাসল গ্রেভস, কথা বলার জন্যে মুখ খুলতেই ডন পা শক্ত করে ক্রুদ্ধ গর্জন করে উঠল।

ডন! চাপা গলায় ধমকে উঠলাম আমি। ডন গুটিসুটি মেরে গেল, কিন্তু ওর পিঠের লোম খাড়া হয়ে উঠল, ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে থাকল গ্রেভসের দিকে। গ্রেভসের মুখটা টানটান, রাগরাগ একটা ভাব। ছেলেমানুষি ভাবটা চেহারা থেকে। একেবারেই উধাও। কিছু একটা ব্যাপারে ও খুব টেনশনে আছে, মনে হলো আমার।

এই যে বন্ধু, বললাম আমি। খবর কি তোমার?

গ্রেভস ডানে আর বাঁয়ে তাকাল একবার, লোকগুলো সিঁটিয়ে গেল, পিছু হটল আরও কয়েক পা।

খবর তো নিজের চোখেই দেখতে পাচ্ছ, কাঠখোট্টা গলায় জবাব দিল সে। আমাকে একঘরে করা হয়েছে। একটু থেমে আবার বলল, এমনকি তোমার কুকুরটাও তা বুঝতে পেরেছে। ডন, গুড বয়! এদিকে এসো!

ডন গরগর করে উঠল।

দেখলে তো!

ডন! ধারাল গলায় বললাম আমি। এই লোকটি আমার বন্ধু। তোমারও। যাও, গ্রেভস। ওকে একটু আদর করো।

গ্রেভস এগোল ডনের দিকে। ওর মাথায় চাপড় মেরে আদুরে গলায় কি যেন বলতে লাগল।

ডন এবার আর গর্জন করল না বটে, কিন্তু গ্রেভসের প্রতিটি চাপড়ে শিউরে উঠল সে, যেন খুব ভয় পাচ্ছে।

তাহলে তোমাকে একঘরে করে রাখা হয়েছে, অ্যাঁ? ব্যাপারটা আমার কাছে বেশ কৌতুককর মনে হলো। তা তোমার দোষটা কি?

কিছুই না। আমি শুধু ওই ঘাসের জঙ্গলে গিয়েছিলাম, বলল গ্রেভস। আর আমার… আমার কিছু হয়নি বলে ওরা আমাকে একঘরে করেছে।

মাত্র এই?

হ্যাঁ।

আচ্ছা! বললাম আমি। আমিও শিগগির একবার ওদিকে যাব। তার মানে আমাকেও ওরা একঘরে করে রাখবে। তাহলে ভালোই হবে। একসঙ্গে দুজন একঘরে হব। আচ্ছা, আমার জন্যে ইন্টাররেস্টিং কোন ঘাসের সন্ধান পেয়েছো ওখানে? ..

ঘাসের খবর আমি জানি না, বলল সে। কিন্তু খুব ইন্টারেস্টিং একটা জিনিসের সন্ধান পেয়েছি। ওটা তোমাকে দেখাব এবং তোমার কাছে কিছু পরামর্শও চাইব। যাবে নাকি আমার বাড়িতে?

লঞ্চেই রাত কাটাব ঠিক করেছি, বললাম আমি। কিন্তু তুমি যদি জোরাজুরি করো আর রাতের খাবারটা।

আমি তোমার জন্যে এখনই লাঞ্চের ব্যবস্থা করছি, তাড়াতাড়ি বলল গ্রেভস। একঘরে হয়ে থাকার পর থেকে রান্নাবান্না সব নিজেকেই করতে হচ্ছে। অবশ্য আমার রান্না তোমার খুব একটা খারাপ লাগবে না আশা করি।

গ্রেভসকে এখন অনেকটা হাসিখুশি দেখাচ্ছে।

ডনকে সঙ্গে নেব?

একটু ইতস্তত করল গ্রেভস, আ…ইয়ে…ঠিক আছে।

তোমার অসুবিধে হলে থাক।

ঠিক আছে, ওকে নিয়ে চলো। দেখি ওর সঙ্গে আবার নতুন করে ভাব করা যায় কিনা।

হাঁটতে শুরু করলাম আমরা গ্রেভসের সঙ্গে। ডন আমার পায়ের সঙ্গে সেঁটেই থাকল।

গ্রেভস, বললাম আমি। এইসব অশিক্ষিত গ্রামবাসী তোমাকে একঘরে করে রেখেছে এটা তোমার মন খারাপের কারণ নয়। অন্য কিছু একটা হয়েছে। কি সেটা? কোন খারাপ খবর?

আরে না,বলল সে।ও ঠিকই আসছে। এটা সম্পূর্ণ আলাদা ব্যাপার। তোমাকে আমি আস্তে আস্তে সব খুলে বলব। আমার ওপর রাগ কোরো না। আমি ঠিকই আছি।

কিন্তু তখন যে বললে ঘাসের জঙ্গলে কি ইন্টারেস্টিং একটা জিনিসের সন্ধান পেয়েছ?

পাথরের বিশাল একটি স্তম্ভ দেখেছি। জিনিসটা নিউ ইয়র্কের এম্পায়ার স্টেট বিল্ডিঙের মতই বড়। হাজার বছর আগের পুরানো, খোদাই করা। মেয়ে মানুষের মূর্তির মত। এছাড়াও অদ্ভুত ধরনের কিছু ঘাস চোখে পড়েছে তোমার কৌতূহল জাগবে। আমি তো আর তোমার মত উদ্ভিদ বিজ্ঞানী নই, তাই ওগুলোকে আলাদাভাবে চিনতে পারিনি। ঘাসগুলোর নিচে লক্ষ লক্ষ ফুলও চোখে পড়ল… মানে কি বলব, এই জায়গাটাকে পৃথিবীর সবচেয়ে দুর্লভ জায়গা বলে মনে হয়েছে আমার।

দরজা খুলল গ্রেভস, একপাশে সরে দাঁড়াল আমাকে আগে যেতে দেয়ার জন্যে। আমি ভেতরে পা বাড়াতেই ঘেউ ঘেউ করে উঠল ডন।

শাট আপ, ডন!

ঠাস করে একটা থাবড়া বসলাম ওর নাকে। চুপ হয়ে গেল ডন, আমার সঙ্গে ভেতরে ঢুকল ভদ্র ছেলের মত। কিন্তু শরীর আড়ষ্ট হয়েই থাকল ওর।

.

গ্রেভসের বুকশেলফের ওপর জিনিসটাকে চোখে পড়ল আমার। হালকা বাদামী রঙের কাঠ দিয়ে তৈরি ওটা, রক্তচন্দন হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি, গোলাপি একটি আভাও রয়েছে। ফুটখানেক উঁচু, কাঠ দিয়ে খোদাই করা জিনিসটা একটি পনেরো ষোলো বছরের মেয়ের মূর্তি। খোদাইয়ের কাজ এত নিখুঁত যে মূর্তিটাকে দারুণ জীবন্ত লাগল আমার কাছে। এমন জিনিস পলিনেশিয়ান বা অন্য কোন দ্বীপে এ পর্যন্ত চোখে পড়েনি আমার।

মূর্তিটি নগ্ন। ওর চোখ দুটি ইস্পাত নীল। –আর চোখের পাতা ঠিক যেন রেশম, একদম রক্তমাংসের নারীর মত। মূর্তিটি এত বেশি জীবন্ত যে কেমন ভয় ভয় করতে লাগল। ডনও চঞ্চল হয়ে উঠে চাপা গলায় গোঁ গোঁ শুরু করল। আমি তাড়াতাড়ি ওর ঘাড় চেপে ধরলাম। মূর্তিটির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার ইচ্ছে ওর একশো ভাগ।

মূর্তিটির দিকে চোখ তুলে তাকাতেই ভয়ের ঠাণ্ডা একটা স্রোত বয়ে গেল শিরদাঁড়া বেয়ে। ওটা কৌতূহল আর অবজ্ঞা নিয়ে তাকিয়ে আছে ডনের দিকে। তারপর ওটার ছোট, বাদামী বুক দুটো ফুলে উঠল, আবার সমান হলো, সবশেষে নাক দিয়ে সশব্দে একটা নিঃশ্বাস ত্যাগ করল।

আঁতকে উঠে একলাফে পিছিয়ে এলাম আমি, পড়লাম গিয়ে গ্রেভসের গায়ে। হাঁপাতে হাঁপাতে বললাম, মাই গড! ওটা জীবন্ত।

সুন্দর না। বলল গ্রেভস, ওকে আমি ঘাসের জঙ্গল থেকে নিয়ে এসেছি। ভয়ানক দুষ্টু আর চঞ্চল ও। তোমার বন্দুকের আওয়াজ শোনার পর ওকে ওখানে তুলে রেখেছি। যাতে দুষ্টুমি করতে না পারে। অত উঁচু থেকে ও লাফাতে পারবে না।

ওকে তুমি ঘাসের জঙ্গল থেকে নিয়ে এসেছ? রুদ্ধ কণ্ঠে বললাম আমি। ওখানে আরও এরকম আছে নাকি?

থকথক করছে কোয়েল পাখিদের মত। বলল সে। কিন্তু ওদের দেখা পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। জিনিসটার দিকে তাকাল গ্রেভস, মুচকি হাসল। কিন্তু তুমি কৌতূহল চাপতে না পেরে বেরিয়ে এসেছিলে, তাই না, খুকি? তারপর তোমার ঘাড়টা কাক করে চেপে ধরে এখানে নিয়ে এলাম আমি। তুমি আমাকে কামড়াবার সুযোগই পাওনি।

ওটার ঠোঁট দুটো ফাঁক হলো। সাদা, ঝকঝকে একসারি দাঁত ঝিকিয়ে উঠল। গ্রেভসের দিকে তাকাল সে, কঠিন চোখ দুটিতে ফুটে উঠল নমনীয়তা। আমি স্পষ্ট বুঝতে পারলাম গ্রেভসকে সে খুবই পছন্দ করে।

ও এক অদ্ভুত পোষা প্রাণী, তাই না? বলল গ্রেভস।

অদ্ভুত? বললাম আমি। বরং বলো ভয়ঙ্কর। ওটাকে- ওটাকেও একঘরে করে রাখা উচিত। ডন ওটাকে মোটেই পছন্দ করেনি। জিনিসটাকে খুন করতে যাচ্ছিল সে।

ওকে দয়া করে জিনিস বলল না, অনুরোধ করল গ্রেভস। আর অমন তুচ্ছ তাচ্ছিল্যও কোরো না। তোমার কথা বুঝতে পারলে খুবই মাইণ্ড করবে। তারপর সে ফিসফিস করে কথা বলতে শুরু করল ওটার সঙ্গে। ভাষাটা গ্রীক বলে মনে হলো। জিনিসটা কথা বলার সময় বারবার উঁচু গলায় হেসে উঠল। হাসিটা মিষ্টি, যেন ঘণ্টা বাজল টুং টাং করে।

তুমি ওর ভাষা জানো?
অল্প অল্প টং মা লাও?
আনা টন সাগ আটো।
নান টেন ডম উড লন আড়ি।

ফিসফিস করে, খুব নরম গলায় কথা বলছে ওরা। আমার দিকে ফিরল গ্রেভস। ও বলছে কুকুরটাকে সে ভয় পায় না। আর সে একা থাকতেই বেশি পছন্দ করবে। তোমার কুকুরটা যেন তাকে বিরক্ত না করে।

ডনের তেমন কোন ইচ্ছেও নেই, বললাম আমি। এখন দয়া করে বাইরে চলল। ওকে আমার মোটেও ভালো লাগছে না। ভয় পাচ্ছি আমি।

জিনিসটাকে শেলফ থেকে নিচে নামাল গ্রেভস, তারপর বেরিয়ে এল বাইরে।

গ্রেভস, বললাম আমি, তোমার ওই একমুঠি জিনিসটা কোন শুয়োর কিংবা বানর নয়, একটি মেয়ে। তুমি ওকে তার আত্মীয় স্বজনের কাছ থেকে ছিনিয়ে এনে অপহরণের মত মারাত্মক অপরাধ করেছ। এখন আমার পরামর্শ হচ্ছে যেখান থেকে ওকে এনেছ সেখানে ওকে রেখে এসো। তাছাড়া মিস চেস্টার ওকে দেখলেই বা কি ভাববেন?

ওকে নিয়ে আমি চিন্তিত নই, বলল গ্রেভস। কিন্তু আমি অন্য একটা ব্যাপার নিয়ে চিন্তায় আছি- খুবই চিন্তায় আছি। কথাটা কি এখন বলব নাকি লাঞ্চের পর?

না, এখন বলো।

শুরু করল গ্রেভস। তুমি চলে যাওয়ার পর আমিও উদ্ভিদ বিজ্ঞান সম্পর্কে বেশ আগ্রহী হয়ে উঠি। তোমার জন্যে ঘাসের নমুনা সংগ্রহ করতে দুবার ওদিকে গিয়েছিলাম। দ্বিতীয়বার আমি একটি গভীর উপত্যকার মত জায়গায় ঢুকে পড়ি। ওখানকার ঘাসগুলো সব বুক সমান উঁচু। আর ওখানেই বিশাল এক পাথরের স্তম্ভ পড়ে থাকতে দেখি। একসঙ্গে আমার চোখে পড়ে কিছু জীবন্ত প্রাণী। ওরা আমাকে দেখে ছুটে পালাচ্ছিল। আমি ওদের পিছু ধাওয়া করি। ওখানে প্রচুর আলগা পাথর ছড়ানো ছিটানো ছিল। একটা পাথর হাতে তুলে নিই ওগুলোর কোনটাকে কজা করা যায় কিনা ভেবে। হঠাৎ দেখি কতগুলো ঘাসের আড়াল থেকে এক জোড়া ছোট, উজ্জ্বল চোখ উঁকি দিচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে পাথরটা ছুঁড়ে মারি জিনিসটাকে লক্ষ্য করে। ধপাস করে পাথরটা ঘাসের মধ্যে পড়তেই গোঙানির আওয়াজ শুনতে পাই আমি। কৌতূহলী হয়ে এগিয়ে যাই ওদিকে। তারপর ওকে দেখতে পাই আমি।

আমাকে দেখে তেড়ে কামড়াতে এসেছিল ও। আমি চট করে ওর ঘাড়টা দুআঙুল দিয়ে চেপে ধরতেই নিস্তেজ হয়ে যায়। তাছাড়া, পাথরের আঘাতে বেশ আহত হয়েছিল ও। আমার হাতে মরার মত পড়েছিল। ওকে ওভাবে মরতে দিতে মন চায়নি আমার। তাই ওকে বাড়িতে নিয়ে আসি। হপ্তাখানেক খুবই অসুস্থ ছিল। তারপর ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে ওঠে। আমার সঙ্গে খেলতে থাকে। আমার টেবিলের নিচের দেরাজটা খুলে প্রায়ই ওটার মধ্যে লুকিয়ে থাকে ও। আর আমার রাবারের বুট জুতো জোড়াকে বানিয়েছে খেলনা বাড়ি। সঙ্গী হিসেবে ও পোষা বেড়াল, কুকুর কিংবা বানরের মতই ভালো। তাছাড়া ও এত ছোট যে ওকে আমি আমার পোষা একটি প্রাণী ছাড়া অন্য কিছুই ভাবতে পারি না। তো এই হচ্ছে ওর গল্প। এরকম ঘটনা যে কারও জীবনে ঘটতে পারে, পারে না?

হুম, তা পারে, বললাম আমি। কিন্তু প্রথম দর্শনেই যে মানুষকে ভয় পাইয়ে দেয় তাকে পোর কোন মানে আছে বলে আমার মনে হয় না। আমার কথা যদি শোনো তাহলে বলব, ওকে যেখানে পেয়েছ সেখানে রেখে এসো।

চেষ্টা করেছিলাম, বলল গ্রেভস। কিন্তু ওকে ছেড়ে আসার পরদিন সকালেই দেখি আমার দরজার সামনে দাঁড়িয়ে কাঁদছে- চোখ দিয়ে জল পড়ছে না, কিন্তু কাঁদছে… তুমি অবশ্য একটা কথা ঠিকই বলেছ-ও শুয়োর কিংবা বানর নয়- একটি মেয়ে।

তুমি কি বলতে চাইছ ওটা তোমার প্রেমে পড়েছে? ঠাট্টার সুরে বললাম আমি।

সম্ভবত তাই।

গ্রেভস, এবার সিরিয়াস হলাম আমি। মিস চেস্টার সামনের ট্রিপের স্টীমারেই আসছেন। এর মধ্যে যা করার করতে হবে।

কি করব? অসহায় গলায় বলল গ্রেভস।

এখনও জানি না। তবে আমাকে ভাবতে দাও, বললাম আমি।

.

মিস চেস্টার আর সপ্তাহখানেক পরে আসবে। ইতিমধ্যে গ্রেভস বার দুই চেষ্টা করেছে বো-কে (ওটার নাম বো রেখেছে সে) ঘাসের জঙ্গলে ছেড়ে আসতে। কিন্তু দুইবারই তাকে পরদিন ভোরবেলা দেখা গেছে বারান্দায় বসে কাঁদতে। আমরা বেশ কয়েকবার চেষ্টা করেছি বো-র আত্মীয় স্বজনকে খুঁজে বের করতে। গ্রেভস ওকে নিজের জ্যাকেটের পকেটে পুরে বেরিয়েছে। কিন্তু কোনবারই সফল হইনি। বো ইচ্ছে করলেই পথ দেখাতে পারত। কিন্তু ইচ্ছে করেনি। খোঁজাখুঁজি পর্বের পুরো সময়টা আমরা তাকে দেখেছি গোমড়া মুখ করে থাকতে। গ্রেভস যে কবার তাকে মাটিতে নামিয়ে রাখতে চেয়েছে, ততবার সে গ্রেভসের জামার হাত ধরে ঝুলে থেকেছে। হাত থেকে তাকে ছোটাতে রীতিমত বেগ পেতে হয়েছে ওকে।

খোলা জায়গায় বো-র গতি ইঁদুরের মতই দ্রুত। আর তাকে ছুঁড়ে ফেলেও নিস্তার নেই, এক দৌড়ে ছুটে এসে ধরত সে আমাদের। কিন্তু ঘন ঘাসের মধ্যে ভালোভাবে চলতে পারত না। আমরা ওকে ফেলে দ্রুত চলে যাচ্ছি, এই সময় কাঁদতে শুরু করত বো। এই কান্না সহ্য করা সত্যি কঠিন।

আমাকে দুচোখে দেখতে পারে না বো। কিন্তু আমার ওপর চড়াও হওয়ার সাহসও পায় না। কারণ সে দেখছে গ্রেভসের ওপর আমার যথেষ্ট প্রভাব রয়েছে। আর আমিও বো-কে কখনও ঘাটাতে যাই না। মানুষ সাপ কিংবা বড় ইঁদুরকে যেমন ভয় পায়, বো-কে আমিও তেমনি ভয় পাই। এমনিতে বো-কে দেখলে যে কোন লোকেরই ভালো লাগবে। কিন্তু ও যখন লাফ মেরে মাছি কিংবা ঘাস ফড়িং ধরে কচকচিয়ে জ্যান্ত চিবিয়ে খায়, কিংবা ওর সঙ্গে একটু ইয়ার্কি করতে গেলেই ওর কান দুটো বেড়ালের মত মিশে যায় মাথার পেছনে এবং হিস হিস শব্দে দাঁত বেরিয়ে পড়ে, তখন দেখে খুবই ভয় লাগে, ভালোবাসতে ইচ্ছে করে না।

ডনও বো-র সঙ্গে লাগতে যায় না। ইতিমধ্যে সে বুঝে গেছে তার প্রতিপক্ষ খুবই শক্তিশালী। বো তার দিকে কোন কারণে তেড়ে আসলে সে রুখে দাঁড়ায় না, বরং লেজ উল্টে পালায়। আমার মত ডনও বুঝতে পেরেছে বো-র মধ্যে সাংঘাতিক কিছু একটা আছে যা প্রকৃতি বিরুদ্ধ। সুতরাং ওকে না ঘটানোই ভালো।

একদিন ভোরবেলা, দিগন্ত রেখায় ধোয়া দেখতে পেলাম আমরা। গ্রেভস তাড়াতাড়ি তার রিভলভার বের করে গুলি ছুঁড়তে শুরু করল। উদ্ভাসিত মুখে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ওর স্টীমার আসছে।

হ্যাঁ, সায় দিয়ে বললাম আমি। তাই তো মনে হচ্ছে। তবে এখনই আমাদের একটা সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

বো-র ব্যাপারে?

অবশ্যই। বো-কে দিন কয়েকের জন্য আমার কাছে রাখব। তোমরা দুজনে মিলে ঘরসংসার একটু সাজাও। তারপর মিসেস চেস্টার, মানে মিসেস গ্রেভার ঠিক করবেন কি করা যায়। তবে বো-কে এসব ব্যাপারে বিন্দুমাত্র আভাস দিয়ো না। ওকে আমার লঞ্চে নিয়ে এসো। তারপরের সব দায়িত্ব আমার।

খুশি মনে আমার পরামর্শ মেনে নিল গ্রেভস। বো-কে নিয়ে সে আমার লঞ্চে চলে এল। বো চারদিকে কৌতূহলী দৃষ্টিতে তাকাতে লাগল। ওকে দ্রুত আমার কেবিনে পুরে বাইরে থেকে তালা মেরে দিলাম। যেই বুঝল ওকে বন্দী করা হয়েছে, সঙ্গে সঙ্গে বন্ধ ঘরের মধ্যে পাগলের মত ছোটাছুটি শুরু করল বো, কাঁদতে কাঁদতে।

গ্রেভসের মুখ অন্ধকার হয়ে গেল। শুকনো গলায় বলল, তাড়াতাড়ি চলো। আমার খুব খারাপ লাগছে।

অবশ্য মিস চেষ্টারকে দেখামাত্র মন ভালো হয়ে গেল গ্রেভসের। খানিক পর সম্ভবত সে ভুলেই গেল বো-র কথা।

মিস চেস্টারকে দেখে আবার মুগ্ধ হলাম আমি। ছবির চেয়েও সুন্দরী সে। এমন একটি মেয়ের স্বামী হতে পারা ভাগ্যের ব্যাপার। গ্রেভস নিঃসন্দেহে ভাগ্যবান।

ওদের বিয়েটা খুব দ্রুত এবং ছিমছামভাবে হয়ে গেল। কন্যা সম্প্রদান করলেন স্টীমারের সবচেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তিটি। ক্যাপ্টেন বিয়ে পড়ালেন। আর নাবিকরা সব সমস্বরে গাইল একটি মধুর বিয়ের গান। শ্যাম্পেন আর কেক দিয়ে সারা হলো সকালের নাস্তা। শ্বেতশুভ্র পোশাক পরা পরীর মত মিস চেস্টার তার স্বামীর হাত ধরে লাজুক হেসে তীরে বাঁধা নৌকায় উঠল খানিক সমুদ্র ভ্রমণ করে দিনটিকে স্মরণীয় করে রাখবার জন্যে। পরপর সাতাশবার পেতলের কামান দেগে অভিনন্দিত করা হলো নব দম্পতিকে। ওদেরকে নিয়ে নৌকা ভেসে পড়ল সমুদ্রে।

এত দ্রুত সবকিছু শেষ হয়ে গেল যে আমি খুবই নিঃসঙ্গবোধ করতে লাগলাম। ফিরে এলাম নিজের আস্তানায়। কোন কাজ নেই বলে বসে বসে রাইফেল আর রিভলভারটি পরিষ্কার করলাম। কিছুক্ষণ নোট লিখলাম দক্ষিণ সাগরের ঘাস সম্পর্কে। তারপরও কিছুই ভালো লাগছে না বলে ডনকে নিয়ে দিগম্বর হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লাম সমুদ্রে। অনেকক্ষণ হুটোপুটি করলাম সাগর জলে। তীরে উঠে চিৎ হয়ে পড়ে থাকলাম উজ্জ্বল সূর্যের নিচে। আস্তে আস্তে সন্ধ্যা নামল। উঠে পড়লাম আমরা। সোজা চলে এলাম লঞ্চে। ধীরে সুস্থে ডিনার খেলাম। তারপর আবার কেবিনে গিয়ে ঢুকলাম বো-র অবস্থা দেখতে।

বুনো বেড়ালের মত ছুটে এল বো আমার দিকে। ঝট করে সরে গিয়েছিলাম বলে রক্ষে, নইলে নির্ঘাত কামড় খেতাম। কিন্তু তারপরও আমার প্যান্টের কাপড় ছিঁড়ে নিয়েছে বো। বিদ্যুৎগতিতে কাজ করল আমার পা, ধাই করে লাথিটা গিয়ে লাগল ওর গায়ে, ছিটকে কেবিনের এক কোনায় গিয়ে পড়ল বো। তাড়াতাড়ি একটা মোমবাতি জ্বেলে নিলাম, সতর্ক একটা চোখ রেখেছি বো-র ওপর। ও একটা চেয়ারের নিচে গিয়ে ঢুকল। ভয়ঙ্কর কুদ্ধ দেখাচ্ছে। আমি আরেকটা চেয়ারে বসে কথা বলতে শুরু করলাম।

এতে কোন লাভ হবে না, বললাম আমি। তুমি বেহুদা আমাকে কামড়ে দিতে চাইছ। তুমি জানো তোমাকে এক লাথিতে আমি ভর্তা বানিয়ে ফেলতে পারি। কিন্তু তোমাকে আমি মারতে চাই না। তারচে আমার কাছে এসে বসো। এসো, আমরা বন্ধু হই। অবশ্য তুমি আমাকে পছন্দ করো না তা আমি জানি। আর আমিও যে তোমাকে দুচোখে দেখতে পারি না সে কথাও তোমার অজানা নয়। কিন্তু কিছুদিনের জন্যে আমাদের সহাবস্থান করতেই হবে। আর ওটা যাতে ভালোভাবে হয় সেই চেষ্টাই আমাদের করা উচিত। সুতরাং চেয়ারে নিচ থেকে বেরিয়ে এসো, আমার সঙ্গে দ্র ব্যবহার করো। আমি তোমাকে বাদাম খাওয়াব। বাদাম খাওয়ার লোভেই বোধহয় সে বেরিয়ে এল চেয়ারের তলা থেকে। আমি পকেট থেকে কিছু বাদাম বের করে মেঝেতে রাখলাম, ও দ্রুত এগিয়ে এল সামনে, কুটকুট করে খেতে লাগল ওগুলো।

এক মিনিটের মধ্যে বাদামগুলো সাবড়ে সে তাকাল আমার দিকে। তার চোখে অসীম বেদনা, যেন বলছে, আমি কি দোষ করেছি? আমাকে কেন তোমার সঙ্গে থাকতে হবে? আমি তোমার সঙ্গে থাকতে চাই না। আমাকে গ্রেভসের কাছে যেতে দাও।

আমি ওকে ব্যাপারটা বোঝাতে চাইলাম। ওর সঙ্গে বন্ধুত্ব করার জন্যে প্রাণপণ চেষ্টা করলাম। কিন্তু কোন কাজ হলো না। তার চোখে আমার জন্যে উপচে পড়ছে ঘৃণা। শেষ পর্যন্ত হাল ছেড়ে দিলাম। একটা বালিশ ছুঁড়ে দিলাম ওর দিকে। ইচ্ছে হলে ঘুমাবে। তারপর বেরিয়ে এলাম বাইরে। দরজা বন্ধ করতেই সে কান্না জুড়ে দিল। আমার খুব কষ্ট হতে লাগল। আবার দরজা খুলে ভেতরে ঢুকলাম। খুব নরম গলায় ভালো ভালো ভালোবাসার কথা বলতে লাগলাম। কিন্তু সে আমার দিকে ফিরে তাকাল না পর্যন্ত। উপুড় হয়ে শুয়ে একভাবে কাঁদতেই থাকল।

এবার মেজাজ চড়ে গেল আমার। ঘাড় ধরে ওকে শূন্যে তুলে ফেললাম। মাথা ঘুরিয়ে ও আমাকে কামড়ে দেয়ার চেষ্টা করল। আমি লক্ষ করলাম ও কাঁদছে, কিন্তু চোখে এক বিন্দু জল নেই। ব্যাপারটা খুব অদ্ভুত। পরীক্ষা করে দেখতে ইচ্ছে হলো। একটা ম্যাগনিফাইং গ্লাস দিয়ে ওকে পরীক্ষা করতে লাগলাম। জলকণার চিহ্ন মাত্র নেই চোখের তারায়। ওর ঘাড়টা বোধহয় খুব জোরে চেপে ধরেছিলাম আমি, ব্যথা পেয়ে ওর ঠোঁট দুটো ফাঁক হয়ে যেতে লাগল, বেরিয়ে পড়ল দাঁত।

এই সময় আমার গ্রেভসের গল্পটা মনে পড়ল। ঘাসের জঙ্গলে মৃত অবস্থায় যে মহিলাকে পাওয়া গিয়েছিল তার সমস্ত শরীর কালো হয়ে গিয়েছিল, দাঁতের দাগ ছিল পায়ের গোছের ওপর। ছোট ছোট দাঁত-বাচ্চাদের।

আমি জোর করে বো-র মুখ হাঁ করালাম। মোমবাতিটা দাঁড় করালাম মুখটার সামনে। কিন্তু ও এত বেশি শরীর মোচড়াচ্ছে যে বাধ্য হয়ে মোমবাতিটা মাটিতে রেখে ওর ঠ্যাং দুটো মুক্ত হাতটা দিয়ে চেপে ধরতে হলো। ইতিমধ্যে যা দেখার দেখে নিয়েছি আমি। সমস্ত শরীর আমার ঠাণ্ডা হয়ে গেল দ্রুত। একসারি ইঁদুরের দাঁতের দুই পাশে সঁচাল দুই ছেদক দন্ত নিয়ে যে শরীরটা আমার হাতের মধ্যে মোচড় খাচ্ছে আর হিস হিস শব্দ তুলছে, ওটা কোন নারী শরীর নয়-বিষাক্ত একটা সাপ!

.

ওটাকে আমি একটা সাবানের পরিত্যক্ত কাঠের বাক্সে ঢুকিয়ে ওপরে কাঠের ছিলকা মেরে দিলাম। ওকে আসলে উচিত লোহার বাক্সে পুরে সমুদ্রে ডুবিয়ে দেয়া। কিন্তু গ্রেভসের সঙ্গে কথা না বলে কাজটা করা ঠিক হবে না ভেবে প্ল্যানটাকে আপাতত দূরে সরিয়ে রাখলাম।

কোন দুর্ঘটনায় যাতে পড়তে না হয় সে জন্যে আগেভাগে কিছু সতর্কতা অবলম্বন করা দরকার। কারণ কে বলতে পারে বো-র ভাই ব্রাদাররা সুযোগ পেলে প্রতিশোধ নিতে আসবে না। তাই পকেটে একটা তীক্ষ্ণধার ছুরি, রাবার ব্যাণ্ডেজ এবং এক বাক্স পারমাঙ্গানেট ক্রিস্টাল (সাপে কামড়ানো রুগীর ফার্স্ট এইডের মহৌষধ) পুরে ডেকে নিয়ে শুয়ে পড়লাম।

চমৎকার তারাজ্বলা রাত। ফুরফুরে হাওয়া বইছে। ঘুমটা জমবে ভালো, কিন্তু ঘুমাবার আগে বো-র অবস্থাটা একবার দেখে আসা উচিত ভেবে উঠে পড়লাম। দরজা বন্ধ করতে নিশ্চই ভুলে গিয়েছিলাম আমি। কারণ ভেতরে ঢুকে দেখি বো নেই। পালিয়েছে। মাথা দিয়ে বাড়ি মেরেই বোধহয় সে নরম কাঠের বাক্সটা ভেঙেছে। ওর শারীরিক সামর্থ্যকে এতটা অবজ্ঞা করা উচিত হয়নি আমার।

লঞ্চের লোকজন লণ্ঠন জ্বেলে তন্ন তন্ন করে খুঁজল বো-কে। কিন্তু কোথাও ওর টিকিটিও দেখা গেল না। তার মানে জলে নেমে গেছে বো। অবশ্য সাপদের জন্য সাঁতার কাটা কোন সমস্যা নয়।

আমি ছোট একটা নৌকায় চড়ে দ্রুত তীরে চলে এলাম। ডনকে সঙ্গে করে, হাতে লোড করা শটগান নিয়ে হনহন করে হাঁটতে শুরু করলাম তীর ধরে। পথ শর্টকাট করার জন্যে ঘাসের একটা জঙ্গলে ঢুকে দ্রুত এগোতে থাকলাম। হঠাৎ ডন কাঁপতে শুরু করল, ঘাসের গায়ে নাক লাগিয়ে কি যেন শুঁকছে।

গুড ডন, চেঁচিয়ে উঠলামি আমি। গুড বয়, ওর পিছু নাও! খুঁজে বের করো ওকে!

প্রকৃতি পূর্ণিমার চাঁদের আলোয় ভেসে যাচ্ছে। আমরা গ্রেভসের বাড়ির কাছাকাছি এসে পড়েছি। দূর থেকে ওর বারান্দায় দুই ছায়ামূর্তিকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম। দেখেই বুঝলাম গ্রেভস এবং তার বৌ। আমি ওকে সাবধান করার জন্যে মুখ খুলেছি, বলতে যাচ্ছি বো পালিয়ে গেছে এবং বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে, এই সময় তীক্ষ্ণ এবং তীব্র একটা চিৎকার বিস্ফোরণের মত আঘাত হানল কানে। দেখলাম গ্রেভস বিদ্যুৎবেগে ঘুরে গেল তার স্ত্রীর দিকে। মেয়েটা পড়ে যাচ্ছে, দুহাতে জড়িয়ে ধরল তাকে।

মিসেস চেস্টার এখনও জ্ঞান হারায়নি, দাঁতে দাঁত চেপে আছে, ঘাম ফুটে উঠেছে কপালে। আমি তাড়াতাড়ি ওর পা থেকে খুলে ফেললাম মোজা। আঙুল এবং গোড়ালির মাঝের জায়গাটায় কামড় বসিয়েছে বো। বিষের ক্রিয়ার ইতিমধ্যে জায়গাটা কালো হয়ে ফুলে উঠেছে। ডাক্তারি ছুরিটা দিয়ে আমি ক্ষতচিহ্নটা চিরে ফেললাম, ওষুধ লাগিয়ে জায়গাটা ব্যাণ্ডেজ করে দিলাম।

গ্রেভস, ওকে একপাশে ডেকে নিয়ে বললাম। তোমার স্ত্রী জ্ঞান হারাতে শুরু করলে অল্প অল্প করে তাকে ব্র্যাণ্ডি খাইয়ে দিয়ো। তবে ভয়ের কিছু নেই বলেই আমার বিশ্বাস। কারণ ঠিক সময়ই ওর চিকিৎসার ব্যবস্থা হয়েছে। আর শোনো, ভুলেও বলতে যেয়ো না কেন এবং কিসে তাকে কামড়েছে…।

বলে আর দেরি করলাম না আমি। ডনকে বারান্দায় একটি থামের সঙ্গে বেঁধে রেখেছিলাম। ও খুবই অস্থির হয়ে উঠেছে। তাড়াতাড়ি ওর বাঁধন খুলে ছুটলাম বো-র পায়ের চিহ্ন লক্ষ্য করে।

উজ্জ্বল চাঁদ দিন করে রেখেছে চারদিক। বালির ওপর বো-র ছোট ছোট পায়ের দাগ স্পষ্ট চেনা যাচ্ছে। ডনকে শোকালাম ওই দাগ, তারপর তাড়া দিলাম, খোঁজো ওকে, ডন! শিগগির খুঁজে বের করো।

পায়ের দাগ ধরে আমরা ক্রমশ ঢুকে পড়লাম দ্বীপের ভেতরের অংশে। ঘাসের গন্ধ তীব্রভাবে নাকে ধাক্কা মারছে। ডনের চলার গতি হঠাৎ মন্থর হয়ে গেল, শরীর হয়ে উঠল আড়ষ্ট, তীক্ষ্ণ চোখে সামনের দিকে তাকিয়ে কি যেন দেখার চেষ্টা করল। আমি মাথা বাড়ালাম। কিছুই চোখে পড়ল না, এদিকে ডন তার লেজের ডগা বিপুল বেগে নাড়তে শুরু করেছে, শরীরটা ক্রমশ মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিতে লাগল, ঘন এক গোছা ঘাসের দিকে মাথাটা এগিয়ে নিল। এক পা সামনে বাড়াল ডন, ওর ডান থাবাটা উঠে গেল শূন্যে, লেজ নাড়ানো থেমে গেল একই সঙ্গে। শক্ত, লোহার মত হয়ে উঠল ওটা।

দাঁড়াও, ডন! প্রায় ফিসফিস করে বললাম আমি। শটগানটা স্থির করলাম ঘন ঘাস গোছাকে লক্ষ্য করে, ট্রিগারে আঙুলের চাপ পড়ল…।

.

তোমার স্ত্রী এখন কেমন আছে?

আগের চেয়ে ভালো। পরপর দুটো গুলির শব্দ শুনলাম। শিকার মিলল কিছু?

Anuprerona
Anupreronahttps://www.anuperona.com
Read your favourite literature free forever on our blogging platform.
RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here


Most Popular

Recent Comments