Wednesday, August 20, 2025
Homeথ্রিলার গল্পভৌতিক গল্পকনওয়েকাস্‌লের প্রেতাত্মা - সত্যজিৎ রায়

কনওয়েকাস্‌লের প্রেতাত্মা – সত্যজিৎ রায়

কনওয়েকাস্‌লের প্রেতাত্মা – সত্যজিৎ রায়

তারিণীখুড়ো তাঁর এক্সপোর্ট কোয়ালিটি বিড়িতে দুটো টান দিয়ে বললেন, ভূতের গল্প অনেকে বলতে পারে, তবে পার্সোনাল এক্সপিরিয়েন্স থেকে বলা গল্পের জাতই আলাদা। সেটা আর কজন পারে বলো।

আপনি পারেন? প্রশ্ন করল ন্যাপলা।

হুঁঃ, বলে খুড়ো অন্য দিকে চাইলেন।

তারিণীখুড়োর এক্সপিরিয়েন্সের স্টক যে অফুরন্ত সেটা আমরা জানি। এই সেদিন অবধি সারা দেশময় টোটো করে বেড়িয়েছেন। ভারতবর্ষের তেত্রিশটা শহরে ছাপান্ন রকম কাজ করেছেন। উপার্জনের জন্য। তবে এক বছরের বেশি কোনও কাজে টিকে থাকেননি–সে ব্যবসাই তোক আর চাকরিই হোক। এখন চৌষট্টি বছর বয়সে চরকিবাজি থামিয়ে কলকাতায় এসে রয়েছেন বেনেটোলা লেনে একটা ফ্ল্যাট নিয়ে। এখানে বলে রাখি, তারিণীখুড়ো সকলেরই খুড়ো। বাবাও খুড়ো বলেন, আমিও বলি। ন্যাপলা একবার ওঁকে দাদু বলেছিল, তাতে খুড়ো মহা ক্ষেপে বললেন, এখনও বাস পেলে অক্লেশে হেঁটে আসি বেনেটোলা টু বালিগঞ্জ–দাদু আবার কী? খুড়ো বলবি।

আমি আর পাড়ার পাঁচটা ছেলে মিলে আমাদের দল। আমাদের বাড়িতেই আসেন তারিণীখুড়ো; এলেই খবর চলে যায়, আর পাঁচজন তুরন্ত চলে আসে খুড়োর গল্পের লোভে। একটা গল্পে পুরো একটা সন্ধে কেটে যায়। খুড়ো বলেন আর্টের খাতিরে খানিকটা রং চড়ানো ছাড়া গল্পগুলো ষোলো আনা সত্যি।

আমি তখন থাকি পুনায়, বললেন তারিণীখুড়ো।

পুনে বলল ন্যাপলা।

একটা গল্পের গন্ধ পাচ্ছি, ন্যাপলা যাতে বারবার ইনটারাপ্ট না করে তাই তার কোমরে একটা চিমটি কেটে দিলাম।

ওই হল, বললেন তারিণীখুড়ো, পুনে-পুনা, মুম্বাই-বোম্বাই, তিরুচিরপল্লী-ত্রিচিনপলি–যে-কোনও একটা বললেই হল। আর আমি যখনকার কথা বলছি তখন সবে স্বাধীনতা এসেছে; পুনার পুনে হতে অনেক দেরি। পন্টু একটা চা বলো।

আমি লক্ষ্মণকে ডেকে চা অর্ডার দিলাম–দুধ-চিনি ছাড়া চা–আর খুড়ো তাঁর গল্প শুরু করলেন।

.

আমি রয়েছি আমার এক বন্ধু রাধানাথ চ্যাটুজ্যের বাড়ি। সে ফাগুসন কলেজে ইতিহাসের অধ্যাপক। কোডামায় মাইকা মাইনসের কাজে ইস্তফা দিয়ে শিবাজীর দেশে এসেছি একটা হোটেলের ম্যানেজারি নিয়ে। আমার বয়স তখন চৌত্রিশ।

পৌঁছাবার দুদিনের মধ্যেই রাধানাথ নিয়ে গেল উকিল ঘনশ্যাম আপ্‌টের বাড়ি। সেখানে সন্ধ্যায় আড্ডা বসে, পাঁচ মেশালি আচ্ছা, যাকে বলে মিক্সড ক্রাউড। আমরা তিনজন ছাড়া আসে মহারাষ্ট্র ব্যাঙ্কের এজেন্ট মিঃ যোশী, ম্যাকডারমট কোম্পানির উচ্চপদস্থ কর্মচারী মিঃ হরিহরণ, পুলিশ ইনস্পেক্টর মিঃ আগাশে আর তরুণ সাংবাদিক আনওয়র কুরেশি।

কুরেশির বয়স আমাদের মধ্যে সব চেয়ে কম, ত্রিশ পৌঁছায়নি। তুখোড় ছেলে, হ্যান্ডসাম চেহারা, চোখে জ্বলজ্বলে দৃষ্টি। সে আসে হরিহরণের সঙ্গে দাবা খেলতে। তাঁরা ঘুটি এঘর ওঘর করেন, আর আমরা বাকি পাঁচজনে মারি আড্ডা। সবচেয়ে বেশি কথা বলেন বাড়ির কর্তা আপ্‌টে সাহেব নিজে। আমার বিশ্বাস তাঁর কথা বলার প্রয়োজনেই এই আড্ডার সৃষ্টি। কিছু লোক আছে যারা সাঙ্গোপাঙ্গ ছাড়া বাঁচতে পারে না। এই সাঙ্গোপাঙ্গ যদি তোষামুদে হয় তা হলে তো কথাই নেই। অবিশ্যি আড্ডার সকলে আপ্‌টেকে তোষামোদ করে বললে ভুল হবে, তবে ওঁর মতামতের প্রতিবাদ কেউ করে না।

আগাশের মতো খোশ মেজাজের দারোগা আমি আর দুটি দেখিনি। অবিশ্যি যখন প্রথম আলাপ তখন তিনি একটা ব্যাপারে কিঞ্চিৎ দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। সম্প্রতি কিছু টাটকা জালনোট পাওয়া গেছে পুনাতে। জালিয়াত কারা এবং তাদের আস্তানাটা কোথায় তাই নিয়ে পুলিশ দপ্তরে বেশ চাঞ্চল্য পড়ে গেছে। আগাশেকে তাই মাঝে মাঝে অন্যমনস্ক হয়ে পড়তে দেখা যায়।

দলের মধ্যে স্বল্পভাষী হলেন মিঃ যোশী; তবে শ্রোতা হিসেবে তিনি চমৎকার। সব কথাই উদগ্রীব হয়ে শোনেন। হসির কথায় ঘর কাঁপিয়ে অট্টহাস্য করেন, দুঃখের কথায় তাঁর জিভ দিয়ে চুক চুক শব্দ শুনে আপ্‌টের পোষা ড্যালমেশিয়ন বারান্দা থেকে ল্যাজ নাড়তে নাড়তে যোশীর কাছে চলে এসেছে, এ ঘটনা বহুবার ঘটেছে।

আমার স্টকে হাজার গল্প, বাংলার বাইরে বছরের পর বছর কাটিয়ে ইংরিজিটাও বেশ রপ্ত, তাই। আমার একটা বেশ ভাল পোজিশন হয়ে গেল আপ্‌টের আড্ডায়।

কী প্রসঙ্গে মনে নেই, একদিন কথা উঠল অশরীরী আত্মার। দেখা গেল আপ্‌টে ছাড়া আর সকলেই ভূতে বিশ্বাস করে। আমি আপুটেকে বোঝালুম যে পুরাণ, শেক্সপিয়র, ডিকেন্স, রবীন্দ্রনাথ, দেশবিদেশের উপকথা, সবেতেই ভুতের উল্লেখ আছে, কাজেই ভুতে বিশ্বাস না করার কোনও কারণ থাকতে পারে না। আপ্‌টে তবু মাথা নাড়ে। সে বিজ্ঞানে বিশ্বাসী, যুক্তিবাদী মন তার, খালি বলে ভূত জিনিসটা ভুয়ো।

হঠাৎ কেন জানি রোখ চেপে গেল, ধাঁ করে হাজার টাকা বাজি ধরে ফেললুম। বললুম দুমাসের মধ্যে ভূত দেখিয়ে দেব তোমায়। আটে হেসে উড়িয়ে দিলে। বললে–সাবধান। হাজার টাকা খোয়া যেতে চলেছে তোমার এটা তোমায় বলে দিলাম।

অবিশ্যি আমার দিক থেকে ব্যাপারটা অতিমাত্রায় রিস্কি হয়ে গিয়েছিল তাতে সন্দেহ নেই। রাধানাথের কাছে ভর্ৎসনাও শুনতে হয়েছিল; কিন্তু বাজির ব্যাপারে দাবার মতোই চাল ফেরত নেওয়া যায় না। কাজেই ব্যাক-আউট করার কোনও প্রশ্নই ওঠে না।

এরই দিন সাতেক বাদে আমাদের আড্ডায় এলেন প্রোফেসর অটো হেলমার। জার্মানির স্টুটগার্ট শহরের বাসিন্দা। ভদ্রলোক পক্ষিবিদ, ভারতবর্ষে এসেছেন ভারতীয় পাখির ডাক রেকর্ড করতে। টেপ রেকর্ডার জিনিসটা তখন সবে আবিষ্কার হয়েছে, সাহেবের কাছেই প্রথম দেখলুম সেই আশ্চর্য যন্ত্র। আমাদের নানারকম পাখির ডাক শুনিয়ে সাহেব বললেন পুনায় এক জায়গায় তিনি নাকি হুতোম প্যাঁচার ডাক শুনেছেন। সেইটে রেকর্ড করতে পারলেই নাকি তাঁর মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হয়। প্যাঁচার ডাকের ভাল রেকর্ডিং তিনি এখনও পাননি।

কোথায় শুনলে ডাক? প্রশ্ন করলেন আপ্‌টে।

তাতে হেলমার সাহেব একটা বাড়ির বর্ণনা দিলেন–দুর্গ প্যাটার্নের প্রাচীন পরিত্যক্ত সাহেব বাড়ি। সেন্ট মেরি গিজার পুব পাশে। তারই কম্পাউন্ডে নাকি দুরাত আগে প্যাঁচাটা ডাকছিল। সাহেব ছিলেন গাড়িতে। সঙ্গে টেপরেকডার। চলন্ত অবস্থাতেই ডাকটা শুনে গাড়ি থামিয়ে নেমে কম্পাউন্ডের পাঁচিলের ধারে এক ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকেও কোনও ফল হয়নি। পাচা আর ডাকেনি।

বাড়ির বর্ণনা এবং অবস্থান শুনে আমাদের অনেকেই বললেন যে সেটা কনওয়ে কাল। এখানে বলা দরকার যে ব্রিটিশ আমলে পুনা ছিল সাহেবদের একটা বড় ঘাঁটি। মিলিটারি তো বটেই, সিভিলিয়ানও অনেক থাকতেন পুনা শহরে। তাঁরা অনেকেই রিটায়ার করার পর পুনাতে বাড়ি করে সারাজীবন সেখানেই কাটিয়ে দিতেন। ব্রিগেডিয়ার কনওয়ে ছিলেন এই রকম একজন সাহেব। তাঁরই তৈরি বাড়ি এই কনওয়ে কাল্প। কুরেশি বাড়িটা সম্বন্ধে কিছু তথ্য জানে, সেই বললে। বাড়িটা তৈরি হয় কুইন ভিক্টোরিয়া যে বছর ভারত-সম্রাজ্ঞী হন সেই বছর। অর্থাৎ ১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দে। কনওয়ে এই বাড়িতে প্রবেশ করার ছমাসের মধ্যে নাকি তাঁর স্ত্রী ও দুটি ছেলে মারা যায়। ছেলেরা অবিশ্যি বাড়িতে মরেনি; তারা দুজনেই ছিল আর্মিতে, মরেছিল দ্বিতীয় আফগান যুদ্ধে। স্ত্রী মারা যায় যক্ষ্মারোগে। আর তার তিনমাসের মধ্যে কনওয়ে নিজেও মরে। কীভাবে মরে জানা যায়নি। তবে অনেকের ধারণা সে আত্মহত্যা করে।

মোট কথা সেই থেকে এই বাড়ি অভিশপ্ত বাড়ি বলে পরিচিত। কেউ আর সে বাড়িতে থাকেনি। সকলের পক্ষে সম্ভবও হত না, কারণ এত পেল্লায় বাড়ি মেনটেন করা মুখের কথা নয়। আসবাবপত্র যা ছিল সবই নাকি কনওয়ের এক আত্মীয় বিলেত থেকে এসে নিলামে বিক্রি করে দেয়।

রাধানাথ সব শুনে-টুনে বলল, কনওয়ে কাপ্ল সম্বন্ধে একটা ঘটনা শুনেছি সেটা স্বদেশি আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত।

কোন স্বদেশি আন্দোলন? প্রশ্ন করলেন আপ্‌টে।

বালগঙ্গাধর তিলকের সময়কার, বললে রাধানাথ। উনবিংশ শতাব্দীর একেবারে শেষের দিকে। মেজর লেথব্রিজ বলে এক সাহেবকে হত্যা করার চেষ্টা করেছিল এক সন্ত্রাসবাদী দল। তারা নাকি ওই কাসূলে তাদের গুপ্ত ডেরা করেছিল। পরে আত্মসমর্পণ করে। তবে তাদের লিডার আচরেকারকে নাকি ধরা যায়নি। সে বেপাত্তা হয়ে যায়।

কনওয়ে কালে খোঁজ করা হয়েছিল কি? আপৃটে প্রশ্ন করলেন। আগাশে হো হো করে হেসে উঠলেন।

মিঃ আপ্‌টে–পুলিশও মানুষ। তাদেরও ভুতের ভয় আছে। ওই অভিশপ্ত বাড়ি রেড করতে গেলে রীতিমতো হিম্মৎ লাগে।

এদিকে আমার কৌতূহল চাগিয়ে উঠেছে। ছেলেবেলা থেকেই ডানপিটেমোর শখ। সেটা চৌত্রিশ বছরেও পুরোপুরি বজায় আছে। পর পর অতগুলো মৃত্যু যেখানে ঘটেছে, সেই বাড়ির ভেতরে দু-একটা প্রেতাত্মা বসবাস করবে না কি? বাজি জেতার পক্ষে এ যে একটা বড় সুযোগ।

এর কিছুদিন পরেই হেলমার সাহেব আবার এলেন আড্ডায় তাঁর টেলিফুংকেন টেপ রেকর্ডার নিয়ে। ভদ্রলোকের বাঁ কব্জিতে ব্যান্ডেজ। বললেন কাঁটা ঝোপে হাত কেটে গেছে। মুখের ভাব দেখে বোঝা যাচ্ছে না সুখবর না দুঃসংবাদ। তাঁকে বসতে দিয়ে সকলেই তাঁর দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টি দিলুম। হুতোমের ডাক শোনা যাবে কি?

হেলমার কপালের ঘাম মুছে বললেন, ডাক তুলতে পেরেছি, তবে পারফেক্ট হল না। রাত বারোটার পর প্যাঁচাটা ডাকল, সঙ্গে সঙ্গে মেশিন চালু করলাম। তখন শহরের অন্য শব্দ প্রায় নেই বললেই চলে। নিয়মমতো নিখুঁত রেকর্ডিং হবার কথা, কিন্তু দেখ কী হয়েছে।

শুনলাম প্যাঁচার ডাক। ছেলেবেলা আমাদের বাদুড়বাগানের বাড়ির পাঁচিলের ওপারে পুকুরের ধারে শ্যাওড়া গাছে একটা হুতোম প্যাঁচা থাকত, তাই তার ডাক চেনা ছিল। ইনিও যে হুতোম তাতে কোনও ভুল নেই। কিন্তু ডাকের সঙ্গে সঙ্গে আরেকটা শব্দ তাকে সত্যিই বড্ড ডিস্টার্ব করছে। সাহেবের এত মেহনত ষোলো আনা সার্থক হল না জেনে তাঁর প্রতি মমতা হল।

বাট হোয়াট ইজ দ্যাট আদার সাউন্ড? প্রশ্ন করল কুরেশি। সে দাবা ছেড়ে এগিয়ে এসেছে।

সেটাই তো বুঝতে পারছি না, বললেন হেলমার। মেশিনেই গণ্ডগোল বলে মনে হচ্ছে। এর আগে তো এ রকম হয়নি কখনও।

শুনলে মনে হয় একটা যান্ত্রিক শব্দ। ঘটাং ঘটাং ঘটাং ঘটাং এই রকম। খুবই ক্ষীণ, কিন্তু জার্মান পক্ষিবিদ-এর মন যে তাতে খুঁত খুঁত করবে তাতে আশ্চর্যের কিছু নেই।

প্লে দ্যাট এগেন প্লিজ! হঠাৎ বলে উঠলেন ইনস্পেক্টর আগাশে। তাঁর শরীরটা টান, আর চোখে এক অদ্ভুত তীক্ষ্ণ দৃষ্টি–শিকারের গন্ধ পেলে যেমন হয় হিংস্র জানোয়ারের।

হেলমার টেপটা ব্যাক করে আবার চালালেন। আগাশে কোমর থেকে শরীরটা ভাঁজ করে কানটা নিয়ে গেছেন একেবারে স্পিকারের সামনে।

ততক্ষণে অবিশ্যি আমিও বুঝে গেছি আগাশে কী ভাবছেন।

শব্দটা শুনে প্রিন্টিং মেশিনের কথা মনে হয়। ছোট, পায়ে-চালানোর কল। যাকে বলে ট্রেল মেশিন।

এইরকম যন্ত্রই সাধারণত ব্যবহার হয়ে থাকে নোট জাল করার কাজে।

শব্দটা কাসলের ভিতর থেকেই আসছে না অন্য কোথাও থেকে আসছে সেটা অবিশ্যি বোঝার কোনও উপায় ছিল না। কিন্তু আগাশে স্থির করলেন যে কনওয়ে কাসূলে পুলিশের রেড হবে। আগাশের হুমকিতে নাকি কিছু কস্টেবল রাজি হয়েছে অভিশপ্ত দুর্গে প্রবেশ করতে। এমনি খোশমেজাজ হলে কী হবে, অফিসার হিসেবে নাকি ভদ্রলোক অত্যন্ত কড়া।

আমি কিঞ্চিৎ নিরাশ বোধ করছি। জালিয়াতরা যেখানে আস্ত। না গেড়েছে সেখানে ভূত থাকার কোনও সম্ভাবনা আছে কি? মনে তো হয় না।

পরদিনই রাত্তিরে রেড, আড্ডার সকলে ফলাফলের জন্য উদগ্রী, এমন সময় ইনস্পেক্টর সাহেব এসে হাজির।

সেকী, তোমাদের তো আজই রেড হবার কথা।

আমাদের হয়ে আপ্‌টেই বিস্ময় প্রকাশ করলেন।

আগাশে একটা বোকা হাসি হেসে মাথা নেড়ে সোফায় বসে পড়লো।

ভাবতে পার? আজ বিকেল সাড়ে পাঁচটায় সে গ্যাং ধরা পড়েছে।

কোথায়? আমরা সমস্বরে জিজ্ঞেস করে উঠলাম।

নাসিক, বললেন আগাশে।

তা হলে ওই শব্দটা…?

টেপরেকর্ডারেই কোনও গণ্ডগোল হবে। ওটা বাইরের কোনও শব্দ না। কাল মাঝ রাত্তিরে আমি কাসূলের আশেপাশে ঘোরাঘুরি করে কোনও শব্দ পাইনি।

আর কিছু বলবার নেই। সমস্ত ব্যাপারটার মধ্যে একটা বেলুন চুপসানো ভাব, অথচ তার কোনও কারণ নেই। জালিয়াতের দল ধরা পড়েছে এ তো ভাল কথা; শুধু পুনার কনওয়ে কাসূলে ধরা না পড়ে পড়েছে অন্য শহরের অন্য জায়গায়। কিন্তু তাও বলতে হবে যা ঘটেছে তার মধ্যে যেন নাটকের অভাব।

অবিশ্যি পরমুহূর্তেই মনে হল–জালিয়াত যখন নেই, তখন ভূত থাকতে বাধা কী? কনওয়ে কাসূলে একবার হানা দিলে দোষ কী?

চা-টা শেষ করে আমিই কথাটা পেড়ে বসলাম, কে কে যেতে রাজি আছ বলো।

যোশী গোড়াতেই বললে তার ধুলোয় অ্যালার্জি, তাই ওই পোড়ো বাড়িতে যাওয়া সম্ভব নয়। হরিহরণ বললেন, আমি যাব, কিন্তু আপ্‌টে সাহেবেরও যাওয়া চাই। ভূত যদি থাকে তো সেটা ওঁর চাক্ষুষ দেখা উচিত। আমাদের কথা উনি মানতে নাও পারেন।

আপ্‌টে বললেন, ঠিক আছে, আমি যাব। এবং আমি সঙ্গে ক্যাশ হাজার টাকা নিয়ে যাব। আমার কন্ডিশন হল যে মিঃ ব্যানার্জিও যেন সঙ্গে টাকা রাখেন। বাজির টাকা ফেলে রাখা নিয়মবিরুদ্ধ।

আমি বললুম, তথাস্তু। তা হলে কালই হোক এক্সপিডিশন।

এইভেনে কুরেশি বললে তাকে নাকি দুদিনের জন্য কোলাপুর যেতে হবে একটা রিপোর্টিং-এর ব্যাপারে; ফিরে এসে সে যেতে প্রস্তুত আছে। আমরাও তাতে রাজি হয়ে গেলুম।

আগাশে এতক্ষণ চুপ করে আমাদের কথা শুনছিলেন; এবার তিনি মুখ খুললেন।

জেন্টলমেন, তোমাদের একটা প্রশ্ন করতে চাই। কালের সদর দরজা যদি তালা দিয়ে বন্ধ থাকে, তা হলে সেটা খোলার যন্ত্র, বা জানালা ভেঙে খোলার সরঞ্জাম–এসব তোমাদের আছে কি? কাজটি কিন্তু সহজ নয়।

এ প্রশ্নের জবাব অবিশ্যি হ্যাঁ হতে পারে না। আমাদের যেটা আছে সেটা হল উৎসাহ আর উদ্যম। যন্ত্রপাতি থাকবে কোত্থেকে?

আমরা এ-ওর মুখ চাওয়াচাওয়ি করছি দেখে আগাশে একটু হেসে বললেন, কাজেই বুঝতে পারছ, আমি ছাড়া তোমাদের গতি নেই।

ভালই হল। শুধু জানালা দরজা ভেঙে খোলার সরঞ্জাম নয়, একটি আগ্নেয়াস্ত্রও থাকবে সঙ্গে এটাও কম ভরসা নয়।

.

জুন মাস, দিনে বেজায় গরম, রাত্তিরের দিকটা তবু একটু ঝিরঝির হাওয়া দেয়। বন্দোবস্ত অনুযায়ী খাওয়া-দাওয়া সেরে ঠিক সাড়ে এগারোটার সময় আমরা দুজন সেন্ট মেরি গিজার সামনে জমায়েত হলাম। পাড়াটা নির্জন, গাড়ি চলাচল নেই বললেই চলে। আমরা দল বেঁধে এগোলাম কনওয়ে কাসূলের দিকে।

ফটক থেকে কাসূলের দরজা অবধি লম্বা রাস্তা। এককালে বাহার ছিল রাস্তাটার সেটা আঁচ করা যায়, এখন পথ বলতে প্রায় কিছুই নেই, টর্চের আলোয় কোনওরকমে আগাছা বাঁচিয়ে পা ফেলতে হয়। বাড়িটা আমাদের সামনে অনেকখানি জায়গা জুড়ে এক বিশাল প্রেতপুরীর মতো দাঁড়িয়ে আছে, কেউ যে কস্মিনকালেও সেখানে ছিল সেটা এখন আর বিশ্বাস হয় না। দলে আছি বলে রক্ষে, না হলে যতই ডানপিটে হই না কেন, আশি বছরের মধ্যে মানুষের পা পড়েনি এমন একটা থমথমে অন্ধকার অট্টালিকার সামনে দাঁড়িয়ে বুকের মধ্যে যে একটা ট্রেল মেশিন চলতে শুরু করেছে, সেটা তো অস্বীকার করা যায় না।

আগাশে সদর দরজায় ঠেলা দিতেই সেটা একটা জান্তব আর্তনাদ করে ধীরে ধীরে খুলে গেল, আর সেই সঙ্গে ইঁদুর বাদুড় পায়রা চামচিকে গিরগিটি ছুঁচো মেশানো একটা গন্ধর ধাক্কায় আমরা সকলেই বেশ কয়েক হাত পিছিয়ে গেলুম।

তারপর দুরু দুরু বক্ষে সবাই মিলে ঢুকলুম ভেতরে। এটা ল্যান্ডিং, বাঁ দিকে চওড়া কাঠের সিঁড়ি উঠে গেছে দোতলায়। আগে একতলা সেরে তারপর দোতলায় যাব এটাই আমার ইচ্ছে ছিল, দেখলাম সকলেই তাতে সায় দিলে। আমরা সার বেঁধে গিয়ে ঢুকলুম একটা বিশাল ঘরে। সম্ভবত ডাইনিং রুম ছিল এটা। সারা ঘরে একটিও আসবাব নেই ঠিকই, কিন্তু দেয়ালে ধূলিমলিন ওয়ল পেপারের উপর বড় বড় ছবির ফ্রেমের দাগ রয়েছে, খান তিনেক দেয়ালবাতির মর্চে ধরা ব্র্যাকেট রয়েছে, আর সিলিং থেকে ঝুলে আছে ঝাড়লণ্ঠন আর টানাপাখার হুক। এটার কড়িকাঠেই বাদুড় ঝোলার কথা, তবে তারা বোধহয় রাত্তিরে খাদ্যের সন্ধানে বেরিয়েছে। এত বড় বাড়ির এতগুলো জানালার মধ্যে কয়েকটা কি আর ভোলা নেই? বাদুড় না থাকলেও, ছোটখাটো চতুষ্পদ প্রাণী যে কিছু রয়েছে সেটা মেঝের এদিক ওদিক থেকে সড়াৎ সড়াৎ শব্দেই বুঝতে পারছি।

এতক্ষণ সবাই একটা জমাট দল বেঁধে চলাফেরা করছিলুম, বড় ঘর পেয়ে সেটা কিছুটা আলগা হল। কুরেশি দেখলুম একাই একটা টর্চ নিয়ে হল ঘরের পাশের একটা দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেল। আপ্‌টেও খানিকটা এগিয়ে গেছে আমাদের ছেড়ে, তারও নিজস্ব একটি টর্চ আছে। ভূত এখনও চোখে পড়েনি ঠিকই, কিন্তু এর চেয়ে ভাল ভৌতিক পরিবেশ আর কী হতে পারে আমি জানি না।

হলঘরের একটা দরজা দিয়ে ডাইনে ঘুরে একটা প্যাসেজ পড়ল। সেটার ডাইনে বাঁয়ে দুদিকেই ঘরের সারি। আগাশে তার পাঁচ-সেলের টর্চ জ্বেলে এগিয়ে চলল প্যাসেজ ধরে। আমরা তার পিছনে। ঘর পড়লে দরজা দিয়ে আলো ফেলে একবার চোখ বুলিয়ে নিচ্ছি।

এইভাবে পাঁচখানা ঘর দেখার পর একটা ঘটনা ঘটল যেটা ভাবতে এখনও গায়ের লোম খাড়া হয়ে ওঠে।

একটা গোঙানির শব্দের সঙ্গে সঙ্গে প্যাসেজের শেষ প্রান্তে বাঁয়ের একটা দরজা থেকে পিছন ফিরে টলতে টলতে বেরিয়ে এল কুরেশি। তার মুখ দেখতে না পেলেও, আতঙ্কের ছাপ রয়েছে সর্বাঙ্গে সেটা বুঝতে পারছি। ঘাড় কুঁজো, হাত দুটো পিছনে এবং কনুই-এর কাছে ভাঙা, হাতের আঙুলগুলো ফাঁক।

আগাশের সঙ্গে আমরাও দৌড়ে গেলাম কুরেশির দিকে। আটেও এখন আমাদেরই সঙ্গে রয়েছে।

কী হল? কী ব্যাপার? আগাশে ব্যস্তভাবে প্রশ্ন করলে।

কুরেশি কাঁপা হাত দিয়ে খোলা দরজার দিকে দেখিয়ে দিলে।

ঘরের ভিতর আলকাতরা অন্ধকার। আগাশে তার টর্চটা ফেলতে প্রথমে বিপরীত দিকের দেয়াল ছাড়া আর কিছুই দেখা গেল না। তারপর টর্চটা একটু তুলতেই যা দেখলুম তাতে শরীরের রক্ত হিম হয়ে গেল।

সিলিং থেকে ঝুলছে দড়ি, আর সেই দড়ি ফাঁস দিয়ে বাঁধা একটি আস্ত নরকঙ্কালের গলায়।

ধন্যি ইন্সপেক্টর আগাশে। এই চরম আতঙ্কের মুহূর্তেও সে দিব্যি ঠাণ্ডা গলায় বললে, ইনিই সেই স্বদেশে গ্যাঙের লিডার আচরেকর বলে মনে হচ্ছে। এই কারণেই বেপাত্তা হয়ে গেছিলেন ভদ্রলোক।

বাট এ স্কেলিটন ইজ নট এ গোস্ট।

ঠিকই বলেছেন মিঃ আপ্‌টে। এবং তিনিও যেমন দিব্যি স্বাভাবিক ভাবে বললেন কথাটা, তাতে তাঁর নার্ভের তারিফ না করে পারা যায় না।

সরি বললে কুরেশি, হঠাৎ সামনে কঙ্কালটা দেখে একটু বেসামাল হয়ে পড়েছিলাম।

কিন্তু ওটা কী?

প্রশ্নটা করলেন আগাশে। তাঁর টর্চের আলো এখন সিলিং থেকে নীচের দিকে নেমেছে।

ঘরের কোণে ধুলো আর মাকড়সার জালে মুড়ি দেওয়া কীসের জানি একটা স্তূপ।

আলোটা ভাল করে ধরতে বুঝতে পারলুম জিনিসটা কী, আর পেরে একেবারে তাজ্জব বনে গেলুম।

এ যে দেখছি ট্রেডল মেশিন! এখানে ছাপার যন্ত্র কী করছে?

আগাশে ব্যাপারটার একটা খুব সহজ এক্সপ্ল্যানেশন দিয়ে দিলেন। বললেন, এটা যদি সন্ত্রাসবাদীদের ঘাঁটি হয়ে থাকে তা হলে ছাপার কল থাকা অস্বাভাবিক নয়। এক নম্বর—তাদের মুখপত্র লুকিয়ে ছাপবার জন্যে কলের দরকার হত; দুই সন্ত্রাসবাদীরা টাকার প্রয়োজনে নোট জাল করেছে এও অনেক শোনা গেছে।

রাধানাথ এ কথায় সায় দিল।

মাথার উপর ঝুলন্ত কঙ্কাল আর তার নীচে নির্জীব যন্ত্রটা অদ্ভুত ভাবে যেন এক অতীত যুগের সাক্ষ্য দিচ্ছে।

আরও অনুসন্ধানের প্রয়োজন আছে কি? প্রশ্ন করলেন মিঃ আপ্‌টে।

আমরা সকলেই বললাম যে যখন এসেছি তখন সারা বাড়িটা না দেখে ফিরব না। আমিই অবিশ্যি কথাটায় সবচেয়ে বেশি জোর দিলাম। কঙ্কাল হল মৃতব্যক্তির দেহের পরিণাম। তার আত্মা কী অবস্থায় আছে তা কে বলতে পারে?

প্যাসেজ দিয়ে যখন উলটোমুখে অর্ধেক পথ এসেছি তখন শুনতে পেলাম সেন্ট মেরি চার্চের ঘড়িতে ঢং ঢং করে বারোটা বাজল। ঘণ্টার রেশ মিলিয়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গে আরেকটা শব্দ শুরু হল যেটা আমাদের হাঁটা বন্ধ করে দিল।

যে ঘর থেকে এলাম, সে ঘর থেকেই আসছে শব্দটা।

ট্রেডল মেশিন চলতে শুরু করেছে, আর তার শব্দে সারা কনওয়ে কাসল গম্ গম্ করছে। সেই সঙ্গে মাথার উপর ডানার ঝটপটানি শুরু হয়েছে, কারণ ঘুলঘুলির বাসিন্দা পায়রাগুলোর ঘুম ভেঙে গেছে প্রেসের শব্দে।

আমরা ছজনে রুদ্ধশ্বাসে শব্দটা শুনছি। দ্বিতীয়বার ওই ঘরের দিকে যাবার কোনও মানে নেই, কারণ জানি সে ঘরে যন্ত্র চালানোর মতো কোনও লোক নেই। হয়তো ওই আচরেকারই এককালে যন্ত্রটা চালিয়েছে। তারপর এক সময়ে ব্রিটিশ পুলিশের হাতে লাঞ্ছনা এড়াবার জন্য গলায় দড়ি দিয়ে মরেছে। আর সেই থেকে প্রতিদিন মাঝরাত্তিরে তার প্রেতাত্মা ওই ট্রেড়ল মেশিন চালিয়ে এসেছে। তার মানে হেলমারের রেকর্ডারে যে শব্দটা উঠেছিল সেটা এটারই শব্দ।

কনওয়ে কালের বাইরে বেরোবার পর বেশ কিছুক্ষণ কারুর মুখে কথা নেই। হরিহরণ অসুস্থ বোধ করছে, সে গিয়ে তার গাড়িতে উঠে পড়ল। কথা ছিল আপ্‌টে তার গাড়িতে আমাদের বাড়ি পৌঁছে দেবে। তার ডজ সিডানে ওঠার আগে সে আমার হাতে একটা খাম ধরিয়ে দিয়ে বলল, টেন হানড্রেডরুপি নোট্রস-গুনে নাও।

আমার তখন রীতিমতো অসোয়াস্তি লাগছে। তবে এ তো আর এলেবেলে খেলা নয়–এ বেট ইজ এ বেট।

খাম থেকে নোটের গোছাটা বার করে রাস্তার আলোতে একবার দেখে নিলুম। দশখানাই আছে।

তিনদিন পরে এক শনিবারের সন্ধ্যায় নেপিয়ার হোটেলে ডিনার হল। আমিই খাওয়ালুম। তখনকার সস্তাগণ্ডার দিনে সাত জনের বিল হল একশো নব্বই টাকা। আজ হলে বড় হোটেলে সাত জনের ফাইভ-কোর্স ডিনার হাজার টাকায় হত কি না সন্দেহ।

গল্প শুনে ন্যাপলা বলল, তা হলে খুব দাঁও মারলেন বলুন।

খুড়ো উত্তর দিতে একটু সময় নিলেন, কারণ সদ্য আনা তৃতীয় কাপ চায়ে গলা ভেজানো আছে, তারপর বিড়ি ধরানো আছে।

তা বটে, অবশেষে বললেন খুড়ো, তবে ঘটনার শেষ এখানেই নয়।

আরও আছে? আমরা সকলেই প্রশ্ন করলাম। এর পরে আর কী থাকতে পারে সেটা ভেবে পাচ্ছিলাম না।

তারিণীখুড়ো বলে চললেন—

.

ঘটনার কদিন পরে এক সকালে আমাদের বাড়িতে এসে হাজির হল আমাদের আড্ডার সাংবাদিক আনওয়র কুরেশি। বললে, আমার গাড়ি আছে, তোমাদের একটা জায়গায় নিয়ে যেতে চাই। বিশ মিনিট স্পেয়ার করতে পারবে?

কৌতূহল হল। রাধানাথ আর আমি গিয়ে উঠলুম তার গাড়িতে। কুরেশি নিজেই ড্রাইভ করে। কিছুদুর যেতেই বুঝলাম গাড়ি চলেছে আবার সেই কনওয়ে কাসূলের দিকে। কেন যাচ্ছে সে কথা বললে না ছোরা, খালি বললে এ কদিনে সে নাকি আরও তথ্য আবিষ্কার করেছে কনওয়ে সাহেব সম্বন্ধে।

একটি খবর নাকি বিলিতি কাগজে ছাপেনি, দিশি কাগজে পেয়েছে সেটা কুরেশি। ব্রিগেডিয়ার কনওয়ে তাঁর এক পাংখাবরদারকে বুট দিয়ে লাথিয়ে মেরে ফেলেছিলেন। তাতে রাধানাথ বললে সেটা নাকি সে-যুগের একটা স্বাভাবিক ঘটনা। গরমকালে মাঝরাত্তিরে পাংখাবরদার পাখা টানতে টানতে ঘুমিয়ে পড়ত। মশার কামড়ে ঘুম ভেঙে যেত সাহেবের। আর তখন রাগে দিকবিদিকজ্ঞান হারিয়ে এমন প্রহার করত ভৃত্যকে যে সে বেচারা অনেক সময় মরেই যেত।

মিনিট পাঁচেকের মধ্যে গাড়ি গিয়ে থামল কনওয়ে কাসূলের গেটের সামনে।

কুরেশির পিছন পিছন আমরা গিয়ে ঢুকলাম কাসূলের ভেতর। দিনের বেলাও রীতিমতো অন্ধকার, ঢুকলে গা ছমছম করে।

আমরা কি আবার সেই ঘরেই যাচ্ছি?

রাধানাথের এ প্রশ্নের কোনও জবাব দিলে না কুরেশি। তবে তার লক্ষ্য যে ওই একই ঘরের দিকে তাতে কোনও সন্দেহ নেই। কী দেখব কে জানে। শিরার মধ্যে একটা চাঞ্চল্য অনুভব করছিলুম। কুরেশি ছোঁকরা নির্বিকার।

আর তা হবে নাই বা কেন। সে ঘর যে খালি! দড়ি কঙ্কাল, ছাপার যন্ত্র, সব হাওয়া!

আমাদের হতভম্ব ভাব দেখে কুরেশি হো হো করে হেসে উঠলে। তারপর এক অদ্ভুত প্রশ্ন করলে।

আপ্‌টের বাড়িতে চা ছাড়া কিছু খেয়েছ কখনও? প্র

শ্নটা অপ্রত্যাশিত হলেও বললুম, কই, না তো!

ওই তো! বললে কুরেশি। লোকটা হাড় কঞ্জুস। তা ছাড়া ওর আত্মম্ভরি ভাবটাও মাঝে মাঝে ইরিটেট করে আমাকে। তুমি বাজিটা ফেলে মোটেই বুদ্ধিমানের কাজ করনি। তোমার নির্ঘাৎ হাজার টাকা খসত। তাই ভাবলাম কনওয়ে কালে যদি ভূতের ব্যবস্থা করতে পারি তা হলে তোমারও লাভ, উনিও জব্দ। তাই দুদিন সময় চেয়ে নিয়েছিলাম। কঙ্কালটা আমার বন্ধু আর্টিস্ট কুলকার্নির বাড়ি থেকে আনা। ট্রেড়ল মেশিনটা শিবাজী জব প্রেসের। প্রোপ্রাইটার মধুকর ঢেঢ়ির ছেলে আমার সঙ্গে ইস্কুলে পড়ত। ওটার জন্যে কিছু দক্ষিণা লাগবে; আর ওদেরই আপিসের এক ছোঁকরা অন্ধকারে ঘাপটি মেরে ছিল; সে-ই কলটা চালায়। বেচারা অনেক মশার কামড় খেয়েছে। তাকে কিছু বকশিস দিয়েছি–

আমি আর কথা বলতে দিলুম না কুরেশিকে। এক হিসেবে পুরো টাকাটাই ওর প্রাপ্য, কিন্তু পাঁচশোর বেশি কিছুতেই নিতে রাজি হল না।

প্যাসেজ থেকে বেরিয়ে যখন ল্যান্ডিং-এ এসেছি, তখন কুরেশি বললে, একবার দোতলায় যাবে নাকি? দেখবার জিনিস আছে কিন্তু। এলেই যখন…

কাঠের সিঁড়ি দিয়ে যুদ্ধের দামামার মতো শব্দ তুলে তিনজনে ওপরে হাজির হলুম। ল্যান্ডিং পেরিয়ে বৈঠকখানা। একটা শন্ শন্ মম্ মম্ শব্দ পাচ্ছিলুম, কিন্তু সেটা যে কী সেটা বুঝতে পারছিলুম না।

বৈঠকখানায় ঢুকে প্রচণ্ড চমক।

এ ঘর যে একেবারে আসবাবে ঠাসা। ভিক্টোরীয় যুগের সোফা, টেবিল, আয়না, মার্বেলের মুর্তি, দেয়ালের বাতি, কার্পেট, ঝাড়লণ্ঠন–কোনওটাই বাদ নেই। মনে হয় ঠিক যেমন ছিল তেমনিই আছে, তবে সব কিছুরই উপর আশি বছরের ধুলো জমে সেগুলোর আসল চেহারা বেমালুম ঢেকে দিয়েছে।

কিন্তু মোক্ষম চমকটা ঘরের মেঝে বা দেয়ালে নয়, সেটা হল সিলিং-এ।

সিলিং-এ দুলছে একটি বিশাল শতচ্ছিন্ন টানা পাখা, যার হাওয়া এই জুন মাসের ঘাম ছুটোনো গরমে আমাদের প্রাণ জুড়িয়ে দিচ্ছে।

কিন্তু এই পাখা টানছে কে? আর টানছে কী ভাবে? কারণ পাখার কোনও দড়ি নেই।

অর্থাৎ সেটাকে টানার কোনও উপায় নেই।

ভূতের উৎপাত বলে এ ঘরে কেউ প্রবেশ করেনি, বলল কুরেশি। তাই জিনিসগুলোও নিলাম হয়নি। আমি ঘরটা আবিষ্কার করি ভুতের সব ব্যবস্থা করার পর। তারপর ভেবে মনে হল কঙ্কাল আর ট্রেল মেশিনে ব্যাপারটা আরও জমবে।

অবাক বিস্ময়ে বেশ কিছুক্ষণ চেয়ে রইলুম অশরীরী পাংখাবারদারের অদৃশ্য হাতে টানা পাখার দিকে। ভূত বলেই তার ক্লান্তি নেই ঘুম নেই, সাহেবের লাথিতে মৃত্যু নেই।

আমরা যখন সিঁড়ি দিয়ে নামছি তখনও বেশ কিছুক্ষণ ধরে শুনতে পেলুম ওই টানাপাখার শব্দ।

কঙ্কাল আর ছাপার কলের ব্যাপারটা কুরেশির কারসাজি জেনে মনে একটা খচখচে গিল্টি ভাব জেগে উঠেছিল; এখন বুঝতে পারলুম দিব্যি নিশ্চিন্ত লাগছে।

সন্দেশ, বৈশাখ ১৩৮৯

Anuprerona
Anupreronahttps://www.anuperona.com
Read your favourite literature free forever on our blogging platform.
RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here


Most Popular

Recent Comments