Tuesday, May 7, 2024
Homeথ্রিলার গল্পচুনী পান্নার রাজমুকুট - অনিল ভৌমিক

চুনী পান্নার রাজমুকুট – অনিল ভৌমিক

ইবু সলোমানের রত্নভাণ্ডার - অনিল ভৌমিক

ফ্রান্সিস মারিয়া আর ফ্রান্সিসের ভাইকিং বন্ধুরা যখন জাহাজে উঠল তখন রাত্রি নেমেছে। ফ্রান্সিস আর মারিয়া জাহাজের ডেকে এসে দাঁড়াল। ওদের ঘরে দাঁড়াল ভাইকিং বন্ধুরা। সবাই আনন্দে আত্মহারা। কেউ হেঁড়ে গলায় গান গাইছে, কেউ নাচছে। চিকামার গুপ্ত দেবমূর্তি উদ্ধার করেছে ফ্রান্সিস আর মারিয়া।

এবার ফ্রান্সিস গলা চড়িয়ে বলল—ভাইসব। আস্তে আস্তে গোলমাল থেমে গেল। সবাই চুপ করল। ফ্রান্সিস বলল—ভাইসব, গুপ্ত স্বর্ণমূর্তি আমরা উদ্ধার করেছি। আমরা সফল। তবে এর আগে মূল্যবান কিছু না কিছু নিয়ে আমরা স্বদেশে ফিরেছি। এবার আমাদের হাত শূন্য। কিন্তু আমি এজন্যে দুঃখিত নই। আমি ভালোবাসি দুঃসাহসিক অভিযান আর বুদ্ধির খেলা। সেদিক দিয়ে আমাদের অভিযান সফল। বুদ্ধির খেলাতেও আমরা জয়লাভ করেছি। এবার ভাইসব, আজ রাতটুকু বিশ্রাম করে কাল ভোরেই যারা শুরু করবো স্বদেশের দিকে। ফ্রান্সিস থামতেই সব ভাইকিংরা চিৎকার করে উঠল—ও-হো-হো।

ফ্রান্সিস আর মারিয়া চলল নিজেদের কোবনের দিকে অন্য ভাইকিংরাও কেউ কেউ গেল কেবিনে, কেউ কেউ জাহাজের ডেকে দল বেঁধে বসল। গল্পগুজব, ছক্কাপাঞ্জা খেলা শুরু হলো।

পরদিন ভোরে ভাইকিংরা ঘুম থেকে উঠে পড়ল। ডেকে এসে দেখল বাতাস বেশ পড়ে গেছে। শুধু পাল খাটালেই জাহাজের গতি বাড়বে না। তাই একদল চলে গেল দাঁড়ঘরে। সেখানে সারিসারি দাঁড় টানার আসনে বসল। ওদিকে ঘড়ঘড় শব্দে নোঙর তোলা হলো। পাল খাটানো শেষ হলো। দাঁড়িরা দাঁড় টানা শুরু করল। জাহাজ চলল উত্তরমুখো, ভাইকিংদের দেশের দিকে।

মাস চারেক কেটে গেল। জাহাজ চলেছে। এর মধ্যে তিন চারটে বন্দরে জাহাজ ভেড়াতে হয়েছে। জাহাজের মেরামতির কাজ হয়েছে। খাদ্য, জল সংগ্রহ করতে হয়েছে। বার তিনেক ঝড়ের পাল্লায়ও পড়তে হয়েছে ওদের।

তখন জাহাজ ইউরোপের কাছে এসেছে। স্বদেশ আর বেশি দূরে নয়।

সেদিন বিকেল থেকেই আকাশে মেঘের জটলা দেখা গেল। সূর্য ডোবার আগেই গ্রামভাউসা বন্দর এলাকা সমুদ্র অন্ধকার হয়ে গেল। ফ্রান্সিস কেবিনঘরে শুয়েছিল। মারিয়া বিছানায় বসে রুমাল সেলাই করছিল। কাজের মধ্যেই ফ্রান্সিসের সঙ্গে গল্পও করছিল। আকাশে মেঘ জমা, বাতাস পড়ে যাওয়া এসব ফ্রান্সিস মারিয়া বুঝতে পারেনি। জাহাজের নজরদার মাস্তুলের মাথায় ওর জায়গা থেকে নেমে এলো। ডেক-এ বিশ্রামরত দু’তিনজন ভাইকিং-এর কাছে এলো। নজরদার হাত তুলে ওদের আকাশের অবস্থা দেখাল। ওরা ভাইকিং। সমুদ্রের সঙ্গে ওদের নাড়ির টান। ওরা বুঝতে পারল ঝড় আসছে। একজন ভাইকিং ছুটল কেবিনঘরের বন্ধুদের আসন্ন ঝড়ের খবর দিতে। ঝড়ের সঙ্গে লড়াইয়ের জন্যে সবাইকে তৈরি হতে হবে তো। হ্যারি তখনই সিঁড়ি বেয়ে ডেকে-এ উঠে আসছে। ভাইকিং বন্ধুটি সিঁড়ির গোড়ায় হ্যারিকে দেখল। বলল—হ্যারি শিগগির ফ্রান্সিসকে খবর দাও। সাংঘাতিক ঝড় আসছে। হ্যারি ও একনজর মেঘে অন্ধকার আকাশটা দেখেই বুঝল ঝড় আসতে বেশি দেরি নেই। হ্যারি ছুটল ফ্রান্সিসকে খবর দিতে। খবর শুনে ফ্রান্সিস মারিয়া দু’জনেই জাহাজের ডেক-এ উঠে এলো।

ততক্ষণে জাহাজে সাজো সাজো রব পড়ে গেছে। ভাইকিংরা চিৎকার করে পরস্পরকে ডাকাডাকি শুরু করল। সকলে ডেক-এ এসে জড়ো হল। দুচারজন দড়িদড়া বেয়ে উঠে পাল নামিয়ে ফেলল। দাঁড়ঘরে দাঁড়িরা দাঁড়টানা বন্ধ করল। জাহাজের ডেক এ এসে দাঁড়াল সবাই। সবাই তৈরি হল ঝড়ের সঙ্গে লড়াই করবার জন্যে। ফ্রান্সিস মারিয়াকে বলল তুমি এখানে থেকো না। কেবিনঘরে নেমে যাও। মারিয়া মাথা নাড়ল। ফ্রান্সিস বলল—ছেলেমানুষি করো না। যা বুঝছি প্রচণ্ড ঝড় আসছে। ডেক-এ থাকলে তুমি টাল সামলাতে পারবে না। আহত হবে। নীচে নেমে যাও।

রাজকুমারী আপনি কেবিনঘরে চলে যান। এ সময় ডেক-এ থাকা বিপজ্জনক। হ্যারি বলল।

মারিয়া আর আপত্তি করল না। বাধ্য মেয়ের যতো সিঁড়ি দিয়ে নেমে কেবিনঘরে চলে গেল।

ওদিকে সূর্য-ঢাকা প্রায়। অন্ধকার আকাশে বিদ্যুতের চোখ ধাঁধানো আলোর রেখা আকাশটাকে যেন চিরে ফেলতে লাগল। তারপরই উন্মত্ত দানবের মতো দ্রুত বেগে ঝড় এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল জাহাজটার ওপর। বিরাট বিরাট ফেনাভরা ঢেউয়ের মাথায় জাহাজটা উঠতে লাগল। পরক্ষণেই ঢেউয়ের ফাটলে নেমে যেতে লাগল। ঝাঁকুনি খেয়ে উত্তাল সমুদ্রের জলে কলার মোচার মতো জাহাজের ওঠাপড়া চলল। হাতে হুইল ধরে জাহাজের গতি উত্তরমুখো রাখবার প্রাণপণ চেষ্টা করতে লাগল ফ্রান্সিস কিন্তু ঝড়ের তাণ্ডবে ঝড়ো হাওয়ার প্রচণ্ড ধাক্কায় জাহাজ যে কোনদিকে দ্রুতগতিতে চলল ফ্রান্সিস তা আন্দাজ করতে পারল না। ভাইকিংরা দড়িদড়া প্রাণপণে টেনে ধরে ঝড়ের সঙ্গে পাল্লা দিতে লাগল। ডেক-এর ওপর দিয়ে বিরাট বিরাট ঢেউ জাহাজের এপার থেকে ওপার আছড়ে পড়তে লাগল। ডেক এ জলস্রোত রইল। সব ভাইকিং ভিজে নেয়ে উঠল। চলল ঝড়ের সঙ্গে প্রাণপণ লড়াই।

মাস্তুলের মাথায় নজরদার মাস্তুল আঁকড়ে ধরে বসে আছে। মাস্তুল একবার এদিকে হেলছে একবার ওদিকে। কিন্তু নজরদার ওস্তাদ নাবিক। ঠিক ঐ দুলুনির মধ্যে চুপ করে বসে আছে। এদিকে-ওদিকে তাকাচ্ছে—বুঝতে চেষ্টা করছে কোনদিকে ওরা যাচ্ছে। কিন্তু দেখবে কী বুঝবেই বা কী? চারদিকে অঝোর বৃষ্টিধারা আর ছিটকে-ওঠা সমুদ্রের জল একটা ঘন ধোঁয়াটে আবরণের সৃষ্টি করেছে। তার মধ্যে দিয়ে নজরদার প্রায় কিছুই দেখতে পাচ্ছিল না। তবু হঠাৎ যেন খুব অস্পষ্ট দু’পাশে দুটি পাহাড়ি ডাঙা দেখতে কান পেল। ও চোখ কচলে ভালো করে দেখবার চেষ্টা করল দু’পাশের পাহাড়ি ডাঙা। কিন্তু তখন আরো জোরে বড়ো বড়ো ফোঁটায় বৃষ্টি নেমেছে। চারদিক আরো ঝাপসা হয়ে গেল। ঝড়ের প্রচণ্ড ধাক্কায় জাহাজটাও যেন জলের ওপর ছিটকে ছিটকে গড়িয়ে চলেছে। নজরদার আর কিছুই দেখতে পেল না।

আস্তে আস্তে ঝড়ের প্রচণ্ডতা কমতে লাগল। আকাশে মেঘ আস্তে আস্তে সরে যেতে লাগল। আকাশ বেশ পরিষ্কার হল। পশ্চিমদিগন্তে দেখা গেল সূর্য অস্ত যাচ্ছে। আস্তে আস্তে সূর্য ডুবে গেল যেন সমুদ্রের ঢেউয়ের মধ্যে। চারদিক অন্ধকার হয়ে আসতে লাগল। সব ভাইকিংরা সপে ভেজা পোশাক নিয়ে এতক্ষণ ঝড়ের সঙ্গে লড়াই করে ক্লান্তিতে ডেক-এর এখানে-ওখানে শুয়ে ছিল বসে ছিল। এখন সবাই উঠে পোশাক পাল্‌টাতে চলল।

রাতে পরিষ্কার আকাশে তারা ফুটল। চাঁদের আলোয় সমুদ্রের ঢেউয়ের নরম ঝিকিমিকি দেখা গেল।

পরদিন সকালে ফ্রান্সিস হ্যারিকে সঙ্গে নিয়ে জাহাজের ডেক-এ উঠে এলো। একটু পরে মারিয়াও এলো। ফ্রান্সিস চারদিকে তাকাতে তাকাতে একটু আশ্চর্য হয়ে বলল হ্যারি, লক্ষ্য করেছো এখানে সমুদ্র খুব শান্ত। জলের রঙও গভীর নীল। আমরা কি অন্য কোনো সমুদ্রে এসে পড়লাম? চারদিক দেখতে দেখতে হ্যারি বলল—ঠিকই, বলেছো—এরকম সমুদ্র আমরা। পেয়েছিলাম যেবার সোনার ঘণ্টা উদ্ধার করতে গিয়েছিলাম। মারিয়া বলল—আর একটা জিনিস লক্ষ্য করো—শীত কিন্তু অনেক কম। গরমও বেশি নয়। তার মানে আমরা একটা নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলে এসে পড়েছি।

—আপনি ঠিক কথাই বলেছেন রাজকুমারী—হ্যারি বলল—আমার মনে হয় আমরা ঠাণ্ডার দেশ ইউরোপ। থেকে দূরে—বেশ দূরে চলে এসেছি।

ফ্রান্সিস বলল—চলো তো—জাহাজ চালকের কাছে যাই। ও কী বলে দেখা যাক। তিনজনেই জাহাজ চালকের কাছে এলো। চালক ওর হুইল ধরে এদিকে-ওদিকে ঘোরাচ্ছে। ফ্রান্সিস বলল—বলতে পারো ঝড়ের ধাক্কায় আমরা কোথায় চলে এসেছি? চালক মাথা নাড়ল। বলল—কিছুই বুঝতে পারছি না। তবে এই শান্ত সমুদ্র দেখে গরম দেখে মনে হচ্ছে আমরা পর্তুগাল বা স্পেনের কাছে আসিনি। আমরা পথ হারিয়ে ফেলেছি। এখন যেকোনো দেশ বা দ্বীপ পেলে জানতে পারবো আমরা কোথায় এসেছি। এখন কতকটা আন্দাজেই জাহাজ চালিয়ে যাচ্ছি। দেখি কোনো দেশ বা দ্বীপে পৌঁছোতে পারি কিনা।

—হুঁ—এ তো চিন্তার কথা। ফ্রান্সিস চিন্তিতমুখে বলল। মাথা নিচু করে ভাবতে লাগল এখন কী করবে ওরা। হ্যারি তখনই মাস্তুলের মাথার দিকে তাকিয়ে নজরদারকে গলা চড়িয়ে ডাল-পেড্রো—একবার নেমে এসো তো। নজরদার পেড্রো—মাস্তুলে বাঁধা দড়ির মই বেয়ে নেমে এলো। পেড্রো কাছে আসতে হ্যারি বলল—ডাঙা দেখতে পেলে? পেড্রো মাথা নাড়ল।

—কোথায় এসেছি বলে তোমার মনে হচ্ছে? ফ্রান্সিস বলল।

—কী করে বলবো। ঝড়ের পাল্লায় পড়ে আমরা দিক ভুল করেছি। এখন কোনোদিকে যাচ্ছি কিছুই বুঝতে পারছি না। পেড্রো বলল।

—আচ্ছা পেড্রো—মারিয়া বলল-তুমি কি ঝড়ের সময় কোনদিক থেকে ঝড় বইছে কোনদিকে আমরা যাচ্ছি বুঝতে পারো নি? পেড্রো কিছুক্ষণ ভাবল। তারপর বলল—ডানদিকে অর্থাৎ গরমের দেশগুলোর দিকে জাহাজ বাঁক নিয়েছিল এটা বুঝেছি।

নজরে পড়ার মতো কিছু দেখো নি?মারিয়া বলল। পেড্রো আবার ভাবতে লাগল। তারপর বলল—ঝড়ের সময় জোর হাওয়ায় ছিটোনো বৃষ্টির মধ্যে দিয়ে প্রায় কিছুই দেখা যাচ্ছিল না। তবে আমি তখন আবছা দেখেছি দু’ধারে দুটো পাথরের মতো উঁচু ডাঙা। পাথুরে ডাঙা।

—দু’দিকে দুটো পাথরে উঁচু ডাঙা? কথাটা মারিয়া আপন মনে বলল। ভাবতে লাগল—কী হতে পারে ঐ দুটো ডাঙা।

—আমার দেখার ভুলও হতে পারে। পেড্রো বলল। মারিয়া কোনো কথা না বলে ভাবতে লাগল। তারপর কী একটা ভেবে নিয়ে মারিয়া চমকে উঠল। বলল—ফ্রান্সিস আমরা একটা প্রণালী পেরিয়ে এসেছি। তার মানে আমরা ডানদিকে অনেকটা চলে এসেছি—গ্রীসের কাছাকাছি। ইউরোপ থেকে গ্রীসে আসতে গেলে একটা প্রণালী পেরিয়ে আসতে হয়। * [আসলে ফ্রান্সিসের জাহাজ আটলান্টিক মহাসাগর থেকে ঝড়ের ধাক্কায় আজকের জিব্রাল্টার প্রণালী পার হয়ে ক্রীট দ্বীপ, গ্রীসের দিকে যাচ্ছিল। –লেখক]

—বলো কি? তাহলে তো অনেকটা চলে এসেছি। ফ্রান্সিস বলল—এবার তফিরতে হয়।

—আমার অনুমানটা ঠিক কিনা সেটা বুঝতে হলে কোনো ডাঙায় পৌঁছোতে হবে। আগে তো কোনো ডাঙা পাই লোকজন পাই—কথা বলি-তারপর সব বুঝে নিয়ে জাহাজের গতি ঠিক করা যাবে। মারিয়া বলল।

—আমিও তাই বলি—হ্যারি বলল এখন জাহাজ যেমন চলছে চলুক—দেখা যাক কোথায় গিয়ে ডাঙা পাই।

—পেড্রো—ফ্রান্সিস বলল—তোমার জায়গায় যাও—দিনরাত নজরদারি চালাও দেখ ডাঙার দেখো পাও কিনা।

জাহাজ চলল।

দু’দিন পরে সকালবেলা মাস্তুলের ওপর বসে থাকা নজরদার পেড্রো চিৎকার করে উঠল—ডাঙা—ডাঙা দেখা যাচ্ছে। কথাটা ডেকে বসে থাকা ভাইকিংদের কানে গেল। সবাই জাহাজের রেলিঙের কাছে এসে দাঁড়াল। ফ্রান্সিস ও এসে দাঁড়াল। তাকিয়ে দেখল দূরে পাথুরে ডাঙা দেখা যাচে। টিলা আর পাথরের চাই ছড়িয়ে আছে এদিক-ওদিক। জাহাজ আরো কাছে আসতে দেখা গেল এদিকটায় অত টিলা বা পাথরের চাই নেই। বন্দরমতো। দুটো জাহাজ নোঙর বাঁধা রয়েছে। জাহাজ দুটো একেবারে পাথুরে মাটির ধারেই ভাসছে। জাহাজ দুটোর মাথায় কোনো পতাকা উড়ছে না। কাছাকাছি আসতে ফ্রান্সিস ভালো করে খুঁটিয়ে দেখতে লাগল। দেখল একটা জাহাজের সামনের দিকে কালো কাঠ অনেকটা চটে উঠে গেছে। অন্য জাহাজের সঙ্গে জোর ধাক্কা লাগলে এরকম হয়। ফ্রান্সিস বুঝল—এটা যুদ্ধ জাহাজ। ততক্ষণে হ্যারি, মারিয়া আর বিস্কো ওর পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। ফ্রান্সিস বলল হ্যারি, একটা জাহাজ বোধহয় মালবাহী। অন্যটা মনে হচ্ছে। যুদ্ধজাহাজ। ঠিক বুঝতে পারছি না এখানে আমাদের নামা উচিত হবে কিনা।

হ্যারি বলল—আমরা তো আর যুদ্ধ করতে যাচ্ছি না। তবে ভয় কীসের? তাছাড়া আমরা সমুদ্রে পথ হারিয়েছি। এটা কোনো দ্বীপ বা দেশ সেটা জানতে পারলে আমাদের পথ খুঁজে পাওয়ার সুবিধে হবে।

মারিয়া বলল—একটা ব্যাপার দেখো, দুটো জাহাজই কিন্তু জনশূন্য। কোনো পাহারাদারও নেই। অদ্ভুত ব্যাপার!

উপায় নেই। বোঝা যাচ্ছে এটা একটা বন্দর। খোঁজখবর নিতে নামতেই হবে। ফ্রান্সিস বলল। হ্যারি জাহাজ-চালকের কাছে গেল। বলল—যতটা কাছে সম্ভব জাহাজ ভেড়াও। খোঁজখবর নেবার জন্যে কয়েকজনকে নামতে হবে।

দুটো জাহাজের পাশ দিয়ে গিয়ে ফ্রান্সিসদের জাহাজ পাথুরে ডাঙার কাছে এসে থামল। তখনও দেখা গেল জাহাজ দুটো ফাঁকা। কেউ কোথায় নেই। ফ্রান্সিসদের জাহাজ থেকে কাঠের পাটাতন নামানো হলো। তীরে গিয়ে পাটাতন ঠেকল। এবার নামা হবে কিনা তাই নিয়ে ফ্রান্সিসদের মধ্যে কথাবার্তা শুরু হলো। জাহাজ-চালকও ওদের কাছে এলো। বলল—আমরা প্রবল ঝড়ে ছিটকে কোথায় চলে এসেছি কিছুই বুঝতে পারছি না। কাজেই এখানে নেমে খোঁজখবর করতেই হবে। অন্তত একজন মানুষকে পেলেও জানতে পারবো জায়গাটার নাম কী? তখন দিক ঠিক করে জাহাজ চালাতে পারবো।

ফ্রান্সিস হ্যারির দিকে তাকাল। বলল—হ্যারি কী করবে এখন?

হ্যারি বলল—বিস্কো কয়েকজনকে নিয়ে নামুক। বন্দর যখন তখন লোকজন নিশ্চয়ই আছে। দেখো সামনে দুটো পাথরের টিলা মতো। মনে হয় ও দুটোর ওপাশে মানুষের। বসতি আছে।

ঠিক আছে। বিস্কো তুমি কয়েকজনকে সঙ্গে নাও। অস্ত্র নিও না। তোমাদের সশস্ত্র দেখলে লোকজন ভয় পেতে পার। তাছাড়া আমরা তো লড়াই করতে যাচ্ছি না। ফ্রান্সিস, বলল।

চারজন ভাইকিং বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে বিস্কো পাটাতন দিয়ে হেঁটে গিয়ে তীরে নামল। তীরের ঢাল বেয়ে উঠতে লাগল ওরা। চারদিকে তাকিয়ে দেখতে লাগল। কিন্তু মানুষ বা বাড়িঘর দেখতে পেল না। জাহাজ থেকে ফ্রান্সিসরা দেখল বিস্কোরা ঢিলা পার হয়ে নেমে গেল। আর ওদের দেখা গেল না।

ফ্রান্সিসরা জাহাজে অপেক্ষা করতে লাগল কখন বিস্কোরা ফিরে আসে।

বেলা বাড়তে লাগল। কয়েক ঘণ্টা কেটে গেছে। দুপুরের খাবার খাওয়ার সময় হলো। কিন্তু বিস্কোরা ফিরল না। ফ্রান্সিসরা দুশ্চিন্তায় পড়ে গেল। কেউ খেতে বসল না। সবাই তীরের টিলার দিকে তাকিয়ে রইল।

বেলা আরও বাড়ল। তবু বিস্কোদের দেখা নেই। এবার ফ্রান্সিস হ্যারিকে বলল-হ্যারি, বিস্কোরা নিশ্চয়ই কোনো বিপদে পড়েছে। চলো, শাঙ্কো আর কয়েকজনকে নিয়ে আমরা নামি। বিস্কোদের খোঁজ করতেই হবে।

বেশ চলো। হ্যারি বলল।

আমিও যাবো। মারিয়া বলল।

উঁহু, ফ্রান্সিস মাথা নাড়ল—আগে আমরা বিস্কোর খোঁজ নিয়ে আসি তারপর তুমি নামবে।

কয়েকজন ভাইকিং বন্ধু এগিয়ে এলো। একজন বলল—ফ্রান্সিস তোমার সঙ্গে আমরা যাবো।

বেশ, সবাই তলোয়ার নিয়ে এসো। হ্যারি যাও, আমার তলোয়ারটাও নিয়ে এসো। ফ্রান্সিস বলল।

তলোয়ার কোমরে গুঁজে প্রথমে ফ্রান্সিস আর হ্যারি পাথুরে মাটিতে নামল। পেছনে—অন্য বন্ধুরা। তীরের ঢাল পেরিয়ে ওরা টিলাটার কাছে এলো। ফ্রান্সিস চারদিকে সতর্ক দৃষ্টি রেখে হেঁটে চলেছে। টিলাটা পার হতেই দেখল চারদিকে ছোটো ছোটো পাথরের চাই ছড়ানো। তারই মধ্যে বেশ কিছু পাথরের বাড়িঘর। কিন্তু পাথুরে পথে বা বাড়িঘরে কোনো লোকজন দেখা যাচ্ছে না।

ওরা ঢিলা থেকে ঢালু পথ বেয়ে নেমে এলো। চলল বাড়িঘরগুলোর দিকে। পথের দুপাশে পাথরের খাড়া খাড়া চাই। তার মধ্যে দিয়ে ওরা চলল। তখনই ফ্রান্সিস দেখল, পাথরের চাঁইগুলোর ওপাশে বেশ কিছুটা সমতল জায়গা। ঘাসে ঢাকা। সেই জায়গাটা থেকে ধোঁয়া উঠছে। ভালো করে নজর দিয়ে দেখল একটা পাথর দিয়ে তৈরি বড়ো উনুন। তখনও আগুন জ্বলছে। ধোঁয়া উঠছে উনুন থেকে। উনুনের ওপরে একটা লম্বা লোহার ডাণ্ডা বাঁধা। সেই লোহার ডাণ্ডায় পাঁচ-সাতটা ছাল-ছাড়ানো ভেড়া ঝুলছে। ভেড়ার মাংস আগুনে ঝলসানো হচ্ছে। ফ্রান্সিস এটা দেখেই দাঁড়িয়ে পড়ল। মৃদুস্বরে বলল—হ্যারি, আমরা বোধহয় বিপদে পড়লাম। ফ্রান্সিস দ্রুত ভাবতে লাগল কী করবে এখন। পিছু ফিরে জাহাজের দিকে ছুটবে না এগিয়ে যাবে। কিন্তু ফ্রান্সিস কোনো কিছু করারই অবকাশ পেল না। হঠাৎ ফ্রান্সিসরা দেখল রাস্তার দু’পাশের পাথরের চাঁইগুলোর আড়াল থেকে নিঃশব্দে উঠে দাঁড়াচ্ছে সশস্ত্র সৈন্যরা। তাদের মাথায় লোহার শিরস্ত্রাণ, এ বুকে বর্ম হাতে খোলা তলোয়ার। ওদিকে লম্বাটে দুটো পাথরের ঘর থেকে সশস্ত্র সৈন্যরা বেরিয়ে আসতে লাগল। বাড়িঘরের দরজা জানালা খুলে গেল। লোজন বেরিয়ে আসতে লাগল। এতক্ষণে যেন ঘুম ভেঙে এই অঞ্চলটা জেগে উঠল। পাথরের চঁইগুলোর আড়াল থেকে সশস্ত্র সৈন্যরা খোলা তলোয়ার হাতে দ্রুত। নেমে এলো। ঘিরে দাঁড়াল ফ্রান্সিসদের। অন্য সৈন্যরাও তাদের ছাউনি থেকে বেরিয়ে এদিকে আসতে লাগল।

সৈন্যদের সাজসজ্জা দেখেই ফ্রান্সিস বুঝল এরা দুর্ধর্ষ গ্রীক সৈন্যদের মতো যুদ্ধবিদ্যায় শিক্ষিত। এদের একজনের সঙ্গে হয়তো তলোয়ারের লড়াই চালানো যায় কিন্তু কয়েকজনের সঙ্গে লড়াই চালানো অসম্ভব। এখন। ওরা তো মাত্র ছ’জন আর ঐ সুসজ্জিত সৈন্যরা সংখ্যায় একশোরও বেশি। কাজেই লড়াই করতে যাওয়া মানে মৃত্যু ডেকে আনা। ফ্রান্সিস একটু গলা চড়িয়ে বলল—সবাই তলোয়ার ফেলে দাও। ও নিজেই প্রথম পাথুরে রাস্তায় তলোয়ার ফেলে দিল। হ্যারি আর অন্যেরাও তালোয়ার ফেলে দিল। শাঙ্কো তির-ধনুক ফেলে দিল। একজন সৈন্য সেই তলোয়ার তির-ধনুক তুলে নিল। ছাউনি থেকে যে সৈন্যরা আসছিল তাদের সবার সামনে ছিল একজন দীর্ঘদেহী সৈন্য। মুখে সামান্য দাড়ি-গোঁফ। বেশ স্বাস্থ্যবান। সেফ্রান্সিসদের সামনে এসে দাঁড়াল। ফ্রান্সিসদের দিকে তাকিয়ে কী জিজ্ঞেস করল। ফ্রান্সিসের বন্ধুদের মধ্যে হ্যারি ছিল সুশিক্ষিত। ও গ্রীক ভাষা, মোটামুটি জানত। হ্যারি সেই সৈন্যদের দলপতির ভাষা একটু বুঝল। দলপতি জানতে চেয়েছিল, ওরা কারা, কোত্থেকে এসেছে। হ্যারি ভাঙা ভাঙা গ্রীক ভাষায় বলল—আমরা ভাইকিং। চিকামা নামে একটা জায়গা থেকে আমরা ফিরে আসছিলাম। সমুদ্রপথে প্রচণ্ড ঝড়ে অমরা দিভ্রান্ত হয়ে এখানে এসে পড়েছি। আমরা যুদ্ধ চাই না।

দলপতি বলল—কিছুক্ষণ আগে আমরা কয়েকজনকে বন্দি করেছি। তারাও কি তোমাদের সঙ্গে এসেছে?

হ্যাঁ তারাও ভাইকিং। আমাদের বন্ধু। কথাটা বলে হ্যারি জিজ্ঞেস করল এটা কী গ্রীকদেশ।

না, ক্রীট দ্বীপ। এই বন্দরের নাম ফালাসন। পশ্চিম ক্রীটের বন্দর।

আমাদের বন্দি করা হচ্ছে কেন? আমরা তো কোনো অপরাধ করিনি।

সেসব আমাদের বিদ্রোহী নেতা এনরিকো বুঝবেন। কালকে তার কাছে তোমাদের হাজির করা হবে। তিনি যা করতে বলবেন, তাই করা হবে।

এবার হ্যারি ফ্রান্সিসের দিকে তাকাল। দলপতির সঙ্গে যা কথা হল সব বলল। দলপতি জিজ্ঞেস করল—তোমাদের জাহাজে আরো লোকজন আছে?

হ্যাঁ, হ্যারি বলল—তাদেরও কি বন্দি করা হবে?

হ্যাঁ সবাইকে। চলো জাহাজের দিকে। দলপতি হাত তুলে ইঙ্গিত করল। হ্যারি ফ্রান্সিসকে বলল দলপতির কথাটা। ফ্রান্সিস বলল—ওকে বলো যা আমরা দু’জন ওদের সঙ্গে যাবো। জাহাজের বন্ধুদের আত্মসমর্পণ করতে বলবো। অযথা রক্তপাত আমরা চাই না। হ্যারি দলপতিকে সেকথা বলল। দলপতি মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল। ফ্রান্সিস হ্যারি এগিয়ে এলো। আট-দশজন সৈন্য শাঙ্কোদের নিয়ে পেছনের ঘরবাড়ির দিকে চলে গেল।

সবার আগে ফ্রান্সিস আর হ্যারি পেছনে দলপতি আর বিশ পঁচিশজন চলল জাহাজঘাটার দিকে। জাহাজের কাছে এসে ফ্রান্সিস দেখল মারিয়া আর অন্য ভাইকিং বন্ধুরা জাহাজের রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছে। বিদ্রোহী নেতা এনরিকোর সৈন্যদল দেখেই ওরা বুঝল ফ্রান্সিসরা বন্দি হয়েছে।

ফ্রান্সিস জাহাজের কাছে এল। গলা চড়িয়ে বলল—ভাইসব, আমরা বন্দি হয়েছি। সবাই জাহাজ থেকে নেমে এসো। কেউ অস্ত্র নিয়ে আসবে না। মারিয়া আর অন্য ভাইকিংরা বুঝল এখন অত্মসমর্পণ ছাড়া কোনো উপায় নেই। ওরা জাহাজ থেকে আস্তে আস্তে নেমে আসতে লাগল। সৈন্যরা সবাইকে ঘিরে দাঁড়াল। দলপতি হ্যারিকে বলল—জাহাজ ওঠো, আর কেউ আছে কিনা খুঁজে দেখব। হ্যারিকে নিয়ে দলপতি জাহাজে উঠল। রসুইঘরে দুজন ভাইকিং খাবার নিয়ে অপেক্ষা করছিল। ওরা ফ্রান্সিসের কথা শুনতে পায়নি। সেই দুজনকে নিয়ে দলপতি আর হ্যারি জাহাজ থেকে নেমে এলো।

দলপতি হাত তুলে সবাইকে ছোটো টিলাটির দিকে হাঁটতে নির্দেশ দিল। দলপতি সবার সামনে। পেছনে ফ্রান্সিস, হ্যারি, মারিয়া আর অন্য ভাইকিংরা। ওদের ঘিরে নিয়ে সৈন্যরা চলল। যেতে যেতে মারিয়া বলল—কী ব্যাপার বললো তো। এরা কারা? ফ্রান্সিস বলল—এরা বিদ্রোহী নেতা এনরিকোর সৈন্য। এটা ক্রীট দ্বীপ। জানি না এখানকার রাজা কে? এনরিকো কার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছে তাও জানি না। যাক গে, ওরা কালকে আমাদের এনরিকোর সামনে নিয়ে যাবে। দেখা যাক এনরিকো কী হুকুম দেয়।

টিলামতো জায়গাটা পার হয়ে বেশ কিছুটা হেঁটে এলো সকলে। একটা লম্বাটে পাথরের ঘরের সামনে এসে দলপতি দাঁড়াল। ঘরটার ছাদও পাথর গেঁথে তৈরি। একটা মাত্র লোহার দরজা। সেই লোহার গরাদ দেওয়া দরজার সামনে খোলা তলোয়ার হাতে দুজন পাহারাদার সৈন্য দাঁড়িয়ে আছে। দরজার গরাদের ফাঁক দিয়ে বিস্কো আর দু-তিনজনের মুখ দেখা গেল। ফ্রান্সিস বুঝল এটা কয়েদঘর। খুব চিন্তায় পড়ল ফ্রান্সিস এনরিকো যদি ওদের মুক্তি না দেয় তাহলে যে করেই হোক পালাতে হবে। সবাই দরজার সামনে এসে দাঁড়াল। দলপতির নির্দেশে একজন পাহারাদার সৈন্য দরজায় লাগানো বড়ো তালাটা, খুলল। ফ্রান্সিস, মারিয়া হ্যারি সহ সবাইয়ের হাত দড়ি দিয়ে বেধে তারপর একে একে কয়েদঘরে ঢুকিয়ে দেওয়া হলো।

ভেতরে ঢুকে ফ্রান্সিস দেখল কয়েদঘরটা লম্বাটে ধরনের। ছাদের কাছে কয়েকটা ফোকর। মেঝেয় শুকনো ঘাস বিছানো। সেখানে বন্দিরা শুয়ে আছে। বিস্কো এগিয়ে এলো। বলল—ফ্রান্সিস,এভাবে বন্দি হয়ে থাকার চেয়ে লড়াই করে মরা ভালো।

বিস্কো, ছেলেমানুষী করো না। দেখা যাক ওদের নেতা এনরিকো কী বলে। তারপর সময় সুযোগ মতো পালাতে হবে। এখন চুপচাপ থাকো। বিস্কো বলল—এই এনরিকো কে, এই সৈন্যরা কী করতে চায় এসব তুমি জানো?

না! ফ্রান্সিস বলল! তখন বিস্কো বলল, তুমি এদিকে এসো। এখানে একটা লোক কিছুদিন যাবৎ বন্দি হয়ে আছে। নাম কাভাল্লি। ও এখানকার অনেক খবরাখবর জানে।

চলো তো কাভাল্লির কাছে, ফ্রান্সিস বলল। তারপর হ্যারি আর মারিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল।—তোমরাও এসো। বিস্কো ওদের ঘরের কোণার দিকে নিয়ে গেল। কাভাল্লি তখন ঘাসের বিছানায় চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে। ফ্রান্সিসরা ওর সামনে এসে বলল। কাভাল্লির পরণে জোব্বোমতো। মোটা কাপড়ের। ফ্রান্সিস কয়েদ ঘরের দিকে আসার সময় এরকম পোশাক পরা স্থানীয় লোকদের দেখেছে। বিস্কো ডাকল-কাভাল্লি-কাভাল্লি। কাভাল্লি চোখ মেলে তাকাল। বিস্কো ফ্রান্সিসদের দেখিয়ে বলল—এ ফ্রান্সিস, ও রাজকুমারী মারিয়া ও হ্যারি এর সবাই আমার বন্ধু। ফ্রান্সিস তোমার সঙ্গে কথা বলতে এসেছে।

কাভাল্লি, তুমি কি এই ক্রীটের লোক? ফ্রান্সিস জিজ্ঞেস করল।

না—পর্তুগালে আমার বাড়ি। কাভাল্লি পর্তুগীজ ভাষায় বলল—তবে এখানে এসে গ্রীকভাষা শিখেছে।

তুমি এখানে এসেছিলে কেন?হ্যারি জিজ্ঞেস করল।

সে এক ইতিহাস—কথাটা বলে কাভাল্লি আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসল।

তুমি ক্রীটে কবে এসেছিলে? ফ্রান্সিস জিজ্ঞেস করল।

প্রায় পনেরো বছর আগে। বড়ো অভাবের সংসার ছিল আমাদের। তাই ভাগ্য ফেরাতে একদিন বেশ ঘর ছেড়ে একটা মালবাহী জাহাজে কাজ নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিলাম। এই ক্রীট দ্বীপের উত্তরে খানিয়া বন্দর। ক্রীটের রাজধানীও খানিয়া। সেই নগরে এখানে ওখানে থাকলাম কিছুদিন। তারপর হঠাৎই খানিয়ার বিখ্যাত মোজেক শিল্পীর নজরে পড়লাম। তখন মোজেকের মিস্ত্রির কাজ করছিলাম। সেই মোজেক শিল্পী তার নিজের বাড়িতে আমাকে রাখল। মোজেকের কাজে আমার খুব আগ্রহ দেখে আমাকে যত্ন নিয়ে কাজ শেখাতে লাগল। কয়েক বছরের মধ্যেই আমি পাকা মিস্ত্রি হয়ে গেলাম। তখন শেষ বাইজেন্টাইন সম্রাট ক্রীটে রাজত্ব করছেন। বাইজেন্টাইনরা শিল্পীমনের মানুষ। নগরে প্রাসাদে, দুর্গের দেয়ালে মেঝেয় বিচিত্র মোজেকের কাজ করাত তারা। ছবিও আঁকাত। মোজেক মিস্ত্রীর খুব চাহিদা তখন। কাভাল্লি থামল।

তারপর? হ্যারি বলল।

শেষ বাইজেন্টাইন সম্রাট তখন খানিয়া দুর্গে থাকতাম। তাঁর শয়নকক্ষের দেয়াল মেঝে মোজেক করার ডাক পেলাম আমি। খুব মন দিয়ে চারজন সহকর্মী নিয়ে কাজ শুরু করলাম। সম্রাট প্রত্যেকদিন কাজ দেখতে আসতেন। তিনি নিজেও শিল্পী ছিলেন। নিজেই ভেড়ার চামড়ার রঙ দিয়ে নকশা এঁকে দিতেন। আমরা তাই দেখে দেখে কাজ করতাম। প্রায় এক বছর কাজ শেষ হলো। সম্রাট খুব খুশি হলেন কাজ দেখে। এবার সম্রাট নিজে দাঁড়িয়ে থেকে তাঁর রাজমুকুট, পোশাক-পরিচ্ছদ, নানা কারুকাজ করা সোনার রাজদণ্ড, হাতির দাঁতের হাতলওলা তলোয়ার, বিচিত্র রঙে মিনে করা তলোয়ারের খাপ, ছোরা, দামি পাথরের অলঙ্কারমালা এসব সেই সজ্জাকক্ষে আনিয়ে রাখলেন। সভাকক্ষের যে দেখাশুনা করতো সে বৃদ্ধ হয়ে পড়েছিল। সম্রাট তাকে স্বর্ণমুদ্রা বকশিশ দিয়ে দেশের বাড়িতে পাঠিয়ে দিলেন। সজ্জাঘরের সব দায়িত্ব পড়ল আমার ওপর। আমিই সম্রাটকে রাজসভায় যাবার আগে পোশাক পরিয়ে দিতাম। মুকুট পরিয়ে সাজিয়ে দিতাম। কিন্তু আমার ভাগ্যে সুখ শান্তি নেই।

কেন? কী হলো তারপর? ফ্রান্সিস জিজ্ঞেস করল।

একটু ইতিহাস বলি। কনস্টান্টিনোপলে তখন চতুর্থ ধর্মযুদ্ধ চলছিল। সেই যুদ্ধে হেরে গিয়ে একদল সৈন্য জাহাজে চড়ে ক্রীটে এলো। তাদের নেতা ছিল বোনিফেস। সম্রাট আগেই গুপ্তচর মারফৎ খবর পেয়েছিলেন যে বোনিফেস তার সৈন্যদল নিয়ে খানিয়া আসছে। উদ্দেশ্য ক্রীট দখল করা। যা হোক, খানিয়া বন্দরে বোনিফেসের সৈন্যদের সঙ্গে সম্রাটের সৈন্যদের দুদিন ধরে যুদ্ধ হলো। সম্রাটের সৈন্যরা হেরে গেল। বোনিফেস খানিয়া দুর্গ দখল করতে এলো। একটু থেমে কাভাল্লি বলতে লাগল—গভীর রাত তখন। সম্রাট আমাকে ডেকে পাঠালেন। বললেন ক্রীটের চাষিদের জোব্বামতো কিছু পোশাক এনে দিতে। ছুটে গিয়ে এনে দিলাম সেদিন। সেই পোশাক পরে সম্রাট সম্রাজ্ঞী তাদের একমাত্র ছেলেকে নিয়ে দুর্গের পেছনের গোপন দরজা দিয়ে পালিয়ে গেলেন। বোধহয় সমুদ্রতীরে আগেই একটা জাহাজ এনে রাখা হয়েছিল। কাভাল্লি থামল।

তারপর বোনিফেস রাজা হলো, ফ্রান্সিস বলল।

হ্যাঁ। বোনিফেস এসে প্রথমেই খোঁজ করল শেষ বাইজেন্টাইন সম্রাটের ধনদের। সেসব পেলও সম্রাটের সজ্জাকক্ষের সব মূল্যবান জিনিসই ছিল। কিন্তু পাওয়া গেল না, বাইজেন্টাইন সম্রাটদের বংশানুক্রমিকভাবে ব্যবহৃত মূল্যবান মুকুটটা। ফ্রান্সিস এতক্ষণ গল্পের মতো ইতিহাস শুনছিল। নিখোঁজ রাজমুকুটের কথা শুনেই ফ্রান্সিস বেশ উৎসুক হলো। ও ভালো হয়ে বসল। বলল—সেই রাজমুকুট কোথায় থাকত।

ঐ সজ্জাকক্ষেই। কোণার দিকে একটা কাঁচের আধারে। কাভাল্লি বলল।

আচ্ছা তুমি সেই রাজমুকুট শেষ কখন দেখেছিলে? ফ্রান্সিস জিজ্ঞেস করল।

কাভাল্লি মাথা নিচু করে কিছুক্ষণ ভাবতে ভাবতে বলল—তখন তো বোনিফেস আক্রমণ করতে আসছে সেসব নিয়েই খুব চিন্তায় ছিলাম। তবে যতদূর মনে পড়ছে। সম্রাট যে দিন পালিয়ে যান তারতিন কি চার দিন আগে তিনি শেষ রাজসভায় গিয়েছিলেন। রাজসভা থেকে খুব দুশ্চিন্তা নিয়ে সম্রাট ফেরেন। আমি তাকে পোশাক পরিচ্ছদ পাতে সাহায্য করলাম। উনি মুকুট খুলে দিলেন। খুব মৃদুস্বরে কী বললেন বুঝলাম না। শুধুদুটো কথা বুঝলাম সম্রাটদের ভাগ্য। আমি মুকুটটা নিয়ে কাঁচের আধারে রেখে দিলাম। এই পর্যন্ত আমার মনে আছে। তারপর আর রাজসভাও বসেনি,সম্রাট সভাকক্ষে আসেননি। মন্ত্রী অমাত্যদের সঙ্গে যে পরামর্শ সবই দুর্গের মন্ত্রণাকক্ষে করেছেন।

সম্রাট কি আর কখনো সেই সজ্জাকক্ষে যাননি। ফ্রান্সিস জিজ্ঞেস করল। কাভাল্লি ভাবল। হঠাৎই বোধহয় ওর মনে পড়ল। বলল—হ্যাঁ, যে রাতে উনি পালিয়ে যান সেই রাতে সজ্জাকক্ষে কিছুক্ষণের জন্যে ঢুকেছিলেন। কিন্তু আমাকে ঢুকতে দেননি। আমাকে বাইরে দাঁড়াতে বলে দরজা বন্ধ করে দিয়েছিলেন। কিছুক্ষণ পরে আমি যে চাষিদের পোশাক এনে দিয়েছিলাম সেটা পরে বেরিয়ে এসেছিলেন।

সম্রাটের হাতে কিছু ছিল না? ফ্রান্সিস বলল। হা ছিল। সম্রাটদের রাজমুকুটের ছবি। ওটা দেয়ালে ঝোলানো থাকতো। ফ্রান্সিস চমকে উঠল। বলল—তা সেই ছবিটা নিয়ে সম্রাট কী করলেন?

কাভাল্লি একটু ফুঁপিয়ে উঠল। বলল—উনি ছবিটা আমাকে দিলেন। তারপর কোনো কথা না বলে চলে গেলেন। কাভাল্লির চোখে জল ভরে উঠল। চোখ মুছল ও।

ছবিটা কি তুমি এঁকেছিলে?হ্যারি জিজ্ঞেস করল।

না, সম্রাট নিজেই এঁকেছিলেন। কথাটা বলেই কাভাল্লি ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। বলল সম্রাট আমাকে নিজের সন্তানের মতো ভালোবাসতেন। তখনও দুর্গের প্রধান প্রবেশদ্বারে সম্রাটের সৈন্যদের সঙ্গে বোনিফেসের সৈন্যদের লড়াই চলছে। ইচ্ছে করলে আমি সম্রাটের মূল্যবান রাজদণ্ড, তলোয়ারের খাপ, চুন্নী পান্না নিয়ে। পালাতে পারতাম। কিন্তু পারলাম না। আমি সজ্জাকক্ষের খোলা দরজার সামনে বসে কাঁদতে লাগলাম।

তারপর?

কতক্ষণ পরে জানিনা। বোনিফেসের সৈন্যদল এলো। আমি ওদের পায়ের শব্দ পেয়ে সম্রাটের দেওয়া ছবিটা আমার জোব্বার নীচে লুকিয়ে ফেললাম। সৈন্যরা এসে আমাকে তুলে দাঁড় করাল। আমার পরিচয় জানতে চাইল। বললাম সজ্জাকক্ষের প্রহরী আমি।

একটু পরেই বোনিফেস এলো। সজ্জাকক্ষে ঢুকল। সমস্ত মূল্যবান সম্পদ রয়েছে দেখে সে উল্লাসে চিৎকার করে উঠল। সে রাজমুকুটটা খুঁজতে লাগল। কিন্তু কোথাও রাজমুকুটটা দেখতে পেল না। সেএবার আমাকে দেখতে পেল। সৈন্যরা আমার পরিচয় দিল। বোনিফেস আমাকে ঘাড় ধরে সজ্জাকক্ষে ঢোকাল। বলল—বলো, রাজমুকুট কোথায়? আমি কাঁচের আধারটার দিকে আঙুল বাড়িয়েই ভীষণভাবে চমকে উঠলাম। কাঁচের অর্ধেকটা ফাঁকা। সম্রাটের মুকুট সেখানে নেই। বুঝলাম আমি সাংঘাতিক বিপদে পড়েছি। বোনিফেস নিশ্চয়ই ধরে নেবে আমি রাজমুকুট সরিয়েছি। আতঙ্কে আমি চিৎকার করে বললাম-রাজমুকুট এই কাঁচের আধারেই ছিল। বোনিফেস বিশ্বাস করল না। বলল—তুই চুরি করেছিস। আমি বুঝলাম বোনিফেস আমাকে বন্দি করবে। চরম অত্যাচার চালাবে আমার ওপর। আমি দ্রুত ভাবতে লাগলাম কী করে পালানো যায়। একটা চিন্তা মাথায় খেলে গেল। বললাম—তাহলে রাজমুকুট নিশ্চয়ই সম্রাজ্ঞীর সজ্জাকক্ষে আছে। বোনিফেস দুজন সৈন্যকে বলল আমার সঙ্গে যেতে। বলল—যা নিয়ে আয় রাজমুকুট। আমি সৈন্য দু’জনকে নিয়ে চললাম। এই দুর্গের সিঁড়ি পথ ঘুরে সব আমার নখদর্পণে। সৈন্য দুজন তো এই প্রথম দুর্গে ঢুকল। ওরা এই দুর্গের কিছুই চেনে না। দুর্গের দেয়ালে এখানে-ওখানে মশাল জ্বলছে। আলো-আঁধারি পথ, সিঁড়ি, ঘর। একটা অন্ধকার সিঁড়ির পাশ দিয়ে যাবার সময় আমি একলাফে সিঁড়িটায় নেমে পড়লাম। সৈন্য দুজন কিছু বোঝবার আগেই সিঁড়ির নীচের অন্ধকার ঘরে দ্রুতপায়ে ঢুকে পড়লাম। সৈন্য দুজন কিছুক্ষণ চিৎকার চেঁচামেচি করল। আমাকে খুঁজল। তারপর চলে গেল। আমি দ্রুতপায়ে ছুটলাম পেছনের গোপন দরজার দিকে।

তারপর? ফ্রান্সিস বলল।

প্রয়া পাঁচ-ছ বছর খানিয়ায় গা ঢাকা দিয়ে রইলাম। খানিয়ার বন্দর দিয়ে পালাবার উপায় নেই। বোনিফেসের সৈন্যরা বন্দর পাহারা দিচ্ছে। কোনো জাহাজ বন্দর থেকে ছাড়তে দিচ্ছে না। কোনো জাহাজ বন্দরে ভিড়তেও দিচ্ছে না। তখন আমি পশ্চিমমুখো এই ফালাসন বন্দরের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। হেঁটে ঘোড়ায় চড়ে দিন সাতেক পরে এখানে এসে পৌঁছলাম। এই বন্দরটা তখনও অবরোধ করা হয়নি। হয়তো কোনো জাহাজ পাবো। পর্তুগাল পালাবো। কিন্তু এখানে এসে এনরিকোর সৈন্যদের হাতে ধরা পড়লাম। তারা সন্দেহ করল আমি বোনিফেসের গুপ্তচর। এখানে বন্দি করে রাখল।

আচ্ছা, এনরিকো কে? এরা বোনিফেসের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করছে কেন?

এনরিকো আগে ছিল জলদস্যু। বোনিফেস রাজা হয়েই ভেনিসের কাছে ক্রীট দ্বীপকে সামান্য অর্থের বিনিময়ে বাঁধা রেখেছে। এমনিতেই যে ভেনিসীয় লোকেরা এখানে ছিল তারা যথেষ্ট ধনীছিল। এখন ক্রীট দ্বীপের ব্যবসা-বাণিজ্য ওদের হাতে চলে গেছে। ক্রীটবাসীরা এতে রাজা বোনিফেসের ওপর বিক্ষুদ্ধ হয়। জোনোদের নেতা এনরিকো এই বিক্ষোভের সুযোগ নিয়ে ক্রীটবাসীদের নেতা হয়েছে। সে তার সৈন্যবাহিনী গড়ে তুলেছে। রাজা বোনিফেসের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছে। নানা জায়গায় দুই সৈন্যবাহিনীর মধ্যে ছোটোখাটো লড়াই চলছে।

ফ্রান্সিস মাথা ঝাঁকিয়ে বলল—এসব এ দেশের লোকেদের ব্যাপার। আমরা এসবের মধ্যে নেই। যাকগে কাভাল্লি, তোমার নিখোঁজ রাজমুকুটের ঘটনাটা আরো কয়েকবার শুনবো। যতটুকু শুনলাম তাতে মনে হচ্ছে শেষ বাইজেন্টাইন সম্রাটই রাজামুকুটের মর্যাদা রাখতে ওটা কোথাও গোপনে রেখে দিয়েছেন। এটুকু থেমে ফ্রান্সিস বলল—আচ্ছা সম্রাটের আঁকা সেই রাজমুকুটের ছবিটা কি তোমার কাছে আছে? কাভাল্লি বলল—হ্যাঁ আছে। কিন্তু কাউকে সেকথা বলতে পারবে না।

না, বলবো না। ফ্রান্সিস বলল। কাভাল্লি এবার যে ঘাসের ওপর বসেছিল সেখানকার ঘাসগুলো সরাল। নিচ থেকে বার করল একটা গোটানো সাদাটে ভেড়ার চামড়া। চামড়াটা দুহাতে খুলে টান করে ধরল। দেখা গেল নানা রঙ আঁকা একটি রাজমুকুটের ছবি (ভেড়ার চামড়ার ছবিটা পরের পৃষ্ঠায় আছে)। ছবিটার তলায় নানারকম ফুল-পাতার নকশা। হ্যারি সেইনকশাটা খুব মনোযোগ দিয়ে দেখতে দেখতে বলল—ফ্রান্সিস, ছবিটার নীচে নকশার ভেতরে ভেতরে কিছু লেখা আছে। কয়েকটা প্রাচীন গ্রীক অক্ষর পড়তে পারছি। বাকিগুলো ঠিক বুঝতে পারছি না।

যে অক্ষরগুলো তোমার চেনা তা থেকে কোনো শব্দ বুঝতে পারছো? ফ্রান্সিস বলল। হ্যারি নকশার জায়গাটা ভালো করে দেখতে দেখতে বলল—শব্দটা বোধহয় ভাগ্য। ফ্রান্সিস বেশ চমকে উঠল। বলল—আশ্চর্য! কাভাল্লিও সম্রাটের মুখে ভাগ্য’ কথাটা শুনেছিল। তাহলে এই নকশাটার যথেষ্ট গুরুত্ব রয়েছে। নিখোঁজ রাজমুকুটের কিছু হদিস হয়তো এই নকশা থেকেই পাওয়া যেতে পারে।

অসম্ভব নয়। তবে একটা কথা অনায়াসে বলা যায় যে শেষ বাইজেন্টাইন সম্রাট বেশ বিদ্বান ও শিল্পী ছিলেন। হ্যারি বলল। এবার মারিয়া পাতলা চামড়াটা নিয়ে ছবি নকশা দেখতে লাগল। তখনই কয়েদঘরের লোহার দরজায় শব্দ উঠল—ঠাংঠাং। তালা খোলা হচ্ছে। কাভাল্লি তাড়াতাড়ি ছবিটা নিয়ে নিজের জোব্বার মধ্যে লুকিয়ে ফেলল।

দশজন সৈন্য খোলা তলোয়ার হাতে লোহার দরজার বাইরে এসে দাঁড়াল। দুজন দুটো বেশ বড়ো কাঠের পাত্র নিয়ে ঢুকল। একজন সৈন্য ঘাসের বিছানার সামনে পাথরের মেঝেয় এক ধরনের লম্বাটে পাতা পেতে দিতে লাগল। সকাল থেকে কিছু খাওয়া হয়নি। অনেক বেলাও হয়েছে। খুব খিদে পেয়েছে সকলেরই। সকলেই উঠে এসে খেতে বসল। পাতায় দুটো করে বেশ মোটা গোল রুটি আর দু’টুকরো ভেড়ার মাংস ও ঝোল দেওয়া হলো। হ্যারি সৈন্যদের দিকে তাকিয়ে বলল—বাঁধা হাতে খাবো কি করে?

বাঁধন খোলার হুকুম নেই, একজন সৈন্য বলল। সবাই খেতে লাগল। খিদে তো পেয়েছে। খুবই অসুবিধে হচ্ছে খেতে। তবু কেউ কিছু বলল না। খেতে খেতে ফ্রান্সিস বলল—মারিয়া, এরকম কায়েদঘরে থাকা, এভাবে খাওয়া, তোমার নিশ্চয়ই খুব কষ্ট হচ্ছে।

মোটেই না। তোমরা যখন পারছো আমিই বা পারবো না কেন? মারিয়া বলল।

হ্যারি খেতে খেতে বলল—ফ্রান্সিস, নিখোঁজ রাজমুকুট খুঁজতে যাবেনাকি?

নিশ্চয়ই। কিন্তু তার আগে এই কয়েদঘর থেকে মুক্তি পেতে হবে।

দেখি কালকে এনরিকোর সঙ্গে কথা বলে। হ্যারি বলল।

খাওয়ার পর ঘরের কোণায় একটা পাথরের চৌবাচ্চার মতো জায়গায় সৈন্যরা খাবার জল ঢেলে দিল। চিনেমাটির বড়ো বাটি ডুবিয়ে সবাই জল খেল। সৈন্যরা লোহার দরজা বন্ধ করে তালা লাগিয়ে চলে গেল। দুজন সৈন্য খোলা তলোয়ার হাতে দরজায় পাহারা দিতে লাগল।

বিকেল হলো। ফ্রান্সিস ঘাসের বিছানায় শুয়ে শুয়ে কাভাল্লির কাছে শোনা ঘটনাগুলো ভাবছিল। ও মনস্থির করে ফেলেছিল এখান থেকে ছাড়া পেলেই খানিয়া যাবে। খানিয়া দুর্গ থেকে খুঁজে বের করবে বাইজেন্টাইন সম্রাটদের নিখোঁজ রাজমুকুট। ও এবার কাভাল্লির দিকে তাকাল। দেখল কাভাল্লি চোখ বুজে ঝিমুচ্ছে। ফ্রান্সিস ডাকল—কাভাল্লি।

হুঁ। কাভাল্লি মৃদু শব্দ করে ফ্রান্সিসের দিকে তাকাল।

আচ্ছা এখান থেকে কীভাবে খানিয়া নগরে যাওয়া যায়?

স্থলপথে যেতে গেলে পুবের দিকে পোলিরিনা হয়ে যেতে হবে। জলপথে যেতে গেলে উত্তরে গ্রামভাউসা বন্দর হয়ে পুবমুখো যেতে হবে। কেন যাবে নাকি? কাভাল্লি বলল।

ফ্রান্সিস একটু হেসে বলল—আগে তো এখান থেকে ছাড়া পাই। তারপর হ্যারিকে বলল—হ্যারি কালকেদলপতি আমাদের এনরিকোর সামনে নিয়ে যাবে। আমি তো গ্রীক ভাষা জানি না। তবু তুমি কিছু জানো। যা যা বলবে সব ভেবে রাখো।

আমার সব ভাবা হয়ে গেছে। এখন সবকিছু নির্ভর করছে এনরিকো মানুষটা কেমন তার ওপর। বিদ্রোহী নেতা-মনমেজাজ কেমন কে জানে! হ্যারি বলল।

রাত হলো। ফ্রান্সিসদের মধ্যে আর বিশেষ কোনো কথাবার্তা হলোনা। খাওয়া-দাওয়ার পর শুয়ে পড়ল সবাই। রাত বাড়ল। ফ্রান্সিসের মাথায় নানা চিন্তা। তবুমারিয়াকে ডেকে বলল—তোমার অসুবিধে হচ্ছে বুঝি তবু আজেবাজে চিন্তা না করে নিশ্চিন্তে ঘুমোও। শারীরটা ঠিক রাখো। একটু রাতে ফ্রান্সিসের দু’চোখ ঘুমে বুজে এলো।

পরদিন একটু বেলায় সেই লম্বা চেহারার দলপতি এলো। কয়েদঘরের দরজা খোলা হলো। দলপতি সকলের দিকে তাকিয়ে হ্যারিকে খুঁজল। হ্যারি উঠে দাঁড়াল। দলপতি হ্যারিকে দেখে বলল—তুমি গ্রীক ভাষা মোটামুটি জানো বলতেও পারো। তুমি এসো।

আমার সঙ্গে আরো দুজনকে যেতে দিতে হবে।

তারা তো গ্রীক ভাষা জানে না। দলপতি বলল।

তবু আমাকে পরামর্শ তো দিতে পারবে। হ্যারি বলল।

বেশ চলো। দলপতি বলল।

দলপতির পেছনে পেছনে হ্যারি, ফ্রান্সিস আর মারিয়া কয়েদঘর থেকে বেরিয়ে এলো। দুজন সৈন্য খোলা তলোয়ার হাতে ওদের পেছনে পেছনে চলল। ফ্রান্সিস একবার ভাবল হাতের বাঁধন খুলে দিতে বলবে। কিন্তু কিছু বলল না।

পাথর ছড়ানো পাহাড়ি রাস্তা দিয়ে ওরা চলল। রাস্তায় দুধারে পাথর গেঁথে তৈরি বাড়িঘর। স্ত্রী-পুরুষরা ফ্রান্সিসদের দেখল। ওরা খুব অবাক হলো মারিয়াকে দেখে আর মারিয়ার পোশাক দেখে।

একটা ছোটো টিলার ঢালে মোটামুটি পরিচ্ছন্ন একটা পাথরের বাড়ির সামনে এলো ওরা। পাথরের দরজা পার হয়ে দলপতি একটা বেশ বড় ঘরে ঢুকল। পিছনে তাকিয়ে ফ্রান্সিসদেরও ঢুকতে ইঙ্গিত করল।

একটু অন্ধকার মতো ঘরটায় দেখা গেল মখমলমোড়া একটা আসনে সাধারণ অথচ দামি কাপড়ের জোব্বাপরা একজন মধ্যবয়সী লোক বসে আছে। মুখে দড়ি গোঁফ। ফ্রান্সিস বুঝল—এই লোকটাই এনরিকো, বিদ্রোহী নেতা। এনরিকোর চোখের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি লক্ষ্য করে ফ্রান্সিস বুঝল, এনরিকো ধূর্ত এবং ক্ষমতালোভী। দলপতি একটু মাথা নুইয়ে সম্মান জানিয়ে কী বলে গেল—হ্যারি আস্তে আস্তে বলল—আমাদের কথা বলছে। দলপতির কথাগুলো এনরিকো মন দিয়ে শুনল। এবার ফ্রান্সিসদের দিকে তাকিয়ে এনরিকো বলল—তোমরা কারা?

হ্যারি গ্রীকভাষায় উত্তর দিল—আমরা ভাইকিং।

এই ক্রীট দ্বীপে এসেছো কেন? এনরিকো বলল।

আমরাজ জাহাজে চড়ে চিকামা থেকে ফিরছিলাম। ঝড়ে পথ হারিয়ে এখানে এসেছি। আমরা এখানে থাকতে আসিনি। আমরা কাউকে হত্যাও করিনি, লুঠপাটও করিনি। তবে আমাদের বন্দি করা হলো কেন?

তোমরা ভাইকিং এটা দলপতি জেনে তোমাদের বন্দি করেছে। তোমরা দক্ষ নাবিক। বীর যোদ্ধাও। আমার সেনাবাহিনীতে তোমাদের মতো সাহসী যোদ্ধা প্রয়োজন। রাজা বোনিফেসের নাম শুনেছো? এনরিকো বলল।

হ্যারি সঙ্গে সঙ্গে সাবধান হলো। ও খুব সহজভাবে বলল—না।

আমি কে তা জানো? এনরিকো বলল।

না। একই ভঙ্গিতে হ্যারি বলল।

ও। তাহলে এই দ্বীপের কোন সংবাদই তোমরা জানো না। যাকগে শোনো, এই দ্বীপের রাজা এখন বোনিফেস। সে এই দ্বীপকে ভেনিসীয় বডোলোক ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করে দিয়েছে। আমি এনরিকো। আমার নেতৃত্বে ক্রীটবাসীরা বিদ্রোহ শুরু করেছে। রাজা বোনিফেসকে আমরা ক্রীট থেকে তাড়াবো।

হ্যারি খুব বিনীতভাবে বলল—দেখুন এসব তো আপনাদের দেশের ব্যাপার। এসবের সঙ্গে আমাদের তো কোনো সম্পর্ক নেই।

তা নেই। কিন্তু তোমাদের মতো সাহসী যোদ্ধা আমাদের চাই। তোমাদের আমার সৈন্যবাহিনীতে যোগ দিতে হবে।

হ্যারি বেশ চিন্তায় পড়ল। বলল—আমি আমার বন্ধুর সঙ্গে একটু কথা বলে আমাদের মতামত জানাচ্ছি। এনরিকো মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো! হ্যারি ফ্রান্সিসকে সব কথা বলল। সব শুনে ফ্রান্সিস বলল—বলো যে আমরা বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলে দু’একদিন পরে আমাদের মতামত জানাব। হ্যারি এনরিকোকে বলল সেকথা। এনরিকো একটু ভেবে মাথা ঝুঁকিয়ে সম্মতি জানাল। হ্যারি বলল—আমাদের তো কয়েদঘরেই রাখা হয়েছে। কাজেই আমাদের হাতের বাঁধন খুলে দেওয়া হোক।

বেশ তাই হবে। এনরিকো বলল।

মারিয়াকে দেখিয়ে হ্যারি বলল ইনি মারিয়া, ভাইকিং দেশের রাজকুমারী। কয়েদঘরের কষ্টকর জীবন ইনি সহ্য করতে পারছেন না। এই জীবন যাপনে ইনি অভ্যস্ত নন। একে আমাদের জাহাজে থাকতে অনুমতি দিন। তবে এঁকে পাহারা দেবার জন্য সৈন্য রাখতে পারেন। তাছাড়া আমাদের এখানে ফেলে রেখে উনি একা জাহাজ চালিয়ে পালাতেই পারবেন না।

এনরিকো মন দিয়ে হ্যারির কথা শুনল। তারপর দলপতির দিকে তাকিয়ে ফ্রান্সিসদের হাতের বাঁধন খুলে দেওয়া আর মারিয়াকে জাহাজ পাহারায় রাখার নির্দেশ দিল। দলপতি এগিয়ে এসে ফ্রান্সিসের হাতের বাঁধন খুলে দিল। এনরিকো হাত তুলে ফ্রান্সিসদের চলে যেতে ইঙ্গিত করল। ফ্রান্সিসরা ফিরে চলল কয়েদঘরের দিকে। এনরিকো হ্যারির সব অনুরোধ মেনে নিল এই আশায় যে এই দুর্ধর্ষ ভাইকিংদের পেলে তার সৈন্যবাহিনীর শক্তি বাড়বে। ফ্রান্সিস সেটা ভালো করেই বুঝল। কিন্তু ওর দুশ্চিন্তা বাড়ল। হাতে মাত্র দুটো দিন। এর মধ্যে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। যদি এনরিকোর বাহিনীতে যোগ না দেয় তাহলে এনরিকো ওদের প্রতি আর কোনো দয়ামায়া দেখাবে না। কয়েদঘরে হাত-পা বেঁধে বন্দি করে রাখবে। মাত্র দুদিন সময় হাতে। যে করেই হোক পালাতে হবে। কিন্তু কি করে? ফ্রান্সিস সারা রাস্তা এই কথাই ভাবতে ভাবতে এলো।

ফ্রান্সিসরা কয়েদঘরের সামনে এলো। দুজন সৈন্য এগিয়ে এসে মারিয়াকে বলল—আমাদের সঙ্গে জাহাজে চলুন। হারি মারিয়াকে কথাটা বুঝিয়ে দিল। মারিয়া ফ্রান্সিসের দিকে তাকাল। মাথা ঝাঁকিয়ে বলল—না,আমি তোমাদের সঙ্গে এখানেই থাকবো। ফ্রান্সিস মৃদুস্বরে বলল—পাগলামি করো না। তুমি বাইরে মুক্ত থাকবে। বুদ্ধি করে আমাদের মুক্ত করার চেষ্টা করতে পারবে। কিন্তু এই কয়েদঘরে থাকলে সে আশাই থাকবে না। এই কয়েদঘরেই আমাদের তিলে তিলে মরতে হবে। মারিয়া খুব বুদ্ধিমতী মেয়ে। বুঝল ফ্রান্সিসের কথাই ঠিক। ও আর আপত্তি করল না। তবু ফ্রান্সিসদের এই কষ্টকর বন্দিজীবনের কথা ভেবে মারিয়ার মন খারাপ হয়ে গেল। বিষমুখে মারিয়া দুজন সৈন্যের পাহারায় ওদের জাহাজে চলে গেল।

কয়েদঘরে ফ্রান্সিস আর হ্যারি ঢুকতেই সব ভাইকিং বন্ধুরা ওদের ঘিরে ধরল। একজন সৈন্য এসে সবার হাতের বাঁধন খুলে দিল। ফ্রান্সিস সকলের দিকে তাকিয়ে আস্তে আস্তে এনরিকোর সঙ্গে ওদের যা কথাবার্তা হয়েছে সব বলল। সবশেষে বলল—ভাইসব, এনরিকোর সেনাবাহিনীতে আমরা ঢুকবো না! কোনো যুদ্ধে আমরা জড়াবো না। দুদিন সময় হাতে। দেখি এই বন্দিদশা থেকে মুক্তি পাওয়ার কোনো উপায় ভেবে বের করতে পারি কিনা। সবাই আবার ঘাসের বিছানায় গিয়ে বসল। কেউ কেউ শুয়ে পড়ল।

সারাদিন কেটে গেল। তখন সন্ধ্যে হয় হয়। হঠাৎ এনরিকোর সৈন্যদের মধ্যে খুব আনন্দ হৈ-হল্লা শুরু হলো। ফ্রান্সিস হ্যারিকে বলল—পাহারাদারদের জিজ্ঞেস করো তো কি ব্যাপার? হারি কয়েদঘরের দরজার কছে এলো। গরাদের ফাঁকে মুখ চেপে জিজ্ঞেস করলো কী হয়েছে ভাই? এত চ্যাঁচামেচি কীসের? একজন পাহারাদার বলল—খুব খুশির খবর এসেছে। লিসস-এর যুদ্ধে বোনিফেসের সৈন্যবাহিনী হেরে গেছে। সব পালিয়েছে। লিসস এখন আমাদের দখলে। হ্যারি ফিরে এসে ফ্রান্সিসকে বলল সব কথা। হ্যারির কাছে কাভাল্লি শুনল সবকথা। বলল—লিসস দক্ষিণের একটা বন্দর। রাজধানী খানিয়া একেবারে উত্তরে। এনরিকোর খানিয়া দখল করতে এখনও অনেক দেরি।

সন্ধের পরেই শুরু হলো এনরিকোর সৈন্যদের বিজয় উৎসব। পাহাড়ি পথের পাশে পাশে পাথরের চাঁইগুলোরওপাশে যে পাথর ছড়ানো প্রান্তর সেখানে চার জায়গায় শামিয়ানা। মতো টাঙানো হলো। তার নীচে পাথর এনে উনুন পাতা হলো। উনুন জ্বালানো হলো। দশ পনেরোটা ভেড়া কাটা হলো। উনুনের ওপর শিকে ভেড়ার মাংস গেঁথে পোড়ানো হতে লাগল। চলল সৈন্যদের আনন্দ হৈ-হল্লা গান আর নাচ। গাধার পিঠে চাপিয়ে আনা হলো নেশার আরকের ছোটো ছোটো পিপে। একটু রাতে মাংস খাওয়া, আরক খাওয়া শুরু হলো।

ফ্রান্সিসদের রাতের খাওয়া হয়ে গেছে অনেকক্ষণ আগে। রাত বাড়ছে। এখন দুহাত খোলা। মাথার পেছনে দুহাত রেখে ফ্রান্সিস ঘাসের বিছানায় শুয়ে আছে। অনেক চিন্তা মাথায়। এনরিকোর হাতের মুঠি থেকে পালাতে হবে। যে করেই হোক। ফ্রান্সিস ভাবতে ভাবতে চোখ বুজল। কিন্তু ঘুম আসছে না।

রাত বাড়ল। হঠাৎ ফ্রান্সিসের খেয়াল হলো বাইরে সব চিৎকার কোলাহল একেবারে থেমে গেছে। নিস্তব্ধ চারদিক। ও কয়েদঘরের দরজার লোহার গরাদের ফাঁক দিয়ে বাইরে তাকাল। মশালের আলোয় দেখল পাহারাদার দুজন নেই। তাদের পায়ের শব্দ বা কথাবার্তা কিছুই শোনা যাচ্ছে না। ফ্রান্সিস তাড়াতাড়ি উঠে বসল। কী ব্যাপার? ও একছুটে দরজার কাছে এলো। বাইরের মশালের আলোয় দেখল, পাহারাদারদের একজন পাথরের সিঁড়ির উপর হাত পা ছড়িয়ে শুয়ে আছে। মাথার উষ্ণীষ তলোয়ার মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। অন্য পাহারাদারটি বারান্দায় উপুড় হয়ে শুয়ে আছে। তার বর্ম উষ্ণীব দুটোই পাশে পড়ে আছে। তলোয়ারটা পায়ের কাছে মাটিতে। ওদের দুজনেরই মাথার কাছে পড়ে আছে দুটো চীনেমাটির বাটি। একটা বাটিতে কিছু নেই, অন্যটার তলায় কালো রঙের জলের মতো কী যেন রয়েছে। সৈন্য দুজন একেবারে মড়ার মতো পড়ে আছে। নড়ছেও না। প্রান্তরের দিক থেকেও কোনো শব্দ ভেসে আসছে না। চারদিকে কোনো সাড়াশব্দ নেই। কী ব্যাপার? সবাই কি ঘুমিয়ে পড়ল?কিন্তু সবাই একসঙ্গে ঘুমিয়ে পড়ল—আশ্চর্য ব্যাপার। ফ্রান্সিস দ্রুত কাভাল্লির কাছে এলো। ধাক্কা দিয়ে কাভাল্লির ঘুম ভাঙাল। কাভাল্লি উঠে বসল। চোখ ডলতে ডলতে বলল-কী ব্যাপার?

চলো তো দরজার কাছে। সৈন্যদের কোনো সাড়াশব্দ নেই। পাহারাদার দুটো মড়ার মতো পড়ে আছে।

বলো কি। কাভাল্লি ছুটে দরজার কাছে এলো। গরাদের ফাঁক দিয়ে পাহারাদার দুজনকে দেখল। তারপর চীনেমাটির বাটিতে কালো রঙের তরল জিনিসটা দেখে কাভাল্লি মুখে দুহাত চেপে নিঃশব্দে হাসতে লাগল। ততক্ষণে হ্যারি ও উঠে এসেছে। পাহারাদারদের ঐ অবস্থা দেখে হ্যারি ও অবাক। ফ্রান্সিস জিজ্ঞেস করল, কাভাল্লি হাসছ কেন?কী ব্যাপার? কাভাল্লির হাসি বন্ধ হলো। কাভাল্লি বলল–উৎসবের আনন্দে সৈন্য, পাহারাদার সবাই আরক খেয়ে বেহুশ হয়ে গেছে।

আরক?

হ্যাঁ—ঐ যে বাটিটার তলায় একটু পড়ে আছে। কালো রঙের। ওটা পোলিরিনার আরক। কালো কুচকুচে আঙুরের রসের সঙ্গে কী সব মিশিয়ে পোলিরিনার কৃষকরা ঐ আরক বানায়। ঐ আরক এক বাটি খেলে পাঁচ-ছ ঘণ্টা কোনো হুশ থাকে না। খুশির ঠ্যালায় ঐ আরক খেয়ে সব সৈন্য পাহারাদার কুপোকাৎ। কাভাল্লি বলল।

তাই নাকি? ফ্রান্সিস লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল। এই পালাবার সুযোগ। কিন্তু দরজার তালার চাবি? গরাদের ফাঁক দিয়ে দেখল—সিঁড়ির ওপর যে পাহারাদারটা পড়ে আছে তার কোমরে চাবির গোছা লাগানো। এখানে থেকে বেশ দূর। হাত বাড়িয়ে পাওয়া অসম্ভব। ফ্রান্সিস কয়েদঘরের চারদিকে একটা লাঠিমতো কিছু খুঁজতে লাগল! মশালের আলোয় দেখল কয়েদঘরের কোথাও লাঠিমতো কিছু নেই। বিস্কো ও আর কয়েকজন ভাইকিং উঠে এলো৷ ফ্রান্সিস চাপাস্বরে ওদের সব বলল। কিন্তু নিরুপায় ওরা। এই সুবর্ণ সুযোগটাকে ওরা কাজে লাগাতে পারল না। ফ্রান্সিস আক্ষেপের সঙ্গে গবাদ ধরে ঝাঁকুনি দিল। শব্দ হলো ঠং। হ্যারি ধমক দিল—ফ্রান্সিস শব্দ করো না!

সময় বয়ে চলল। ওরা গরাদের সমনে অসহায়ভাবে বসে রইল না।

ওদিকে জাহাজে নিজেদের কেবিনঘরে সৈন্যদের হৈ-হল্প শুনতে শুনতে মারিয়া ঘুমিয়ে পড়েছিল। মারিয়ার ঘুম খুব পাতলা। একটু কানে গেলেই ওর ঘুম ভেঙে যায়। ও হঠাৎ দরজার কাছে একটা শব্দ শুনল–ধপ। ওর ঘুম ভেঙে গেল। কী ব্যাপার?ও একবার ভাবল পাহারাদারদের ডাকে। পরক্ষণেই ভাবল দরজা খুলে দেখা যাক। মারিয়া বিছানা থেকে নেমে এলো। আস্তে আস্তে দরজা ঠেলল। দরজা খুলল না। আবার ঠেলল। কিছুটা দরজা খুলল আবার কিছুর চাপে সরে এল। মারিয়া এবার জোরে ঠেলল। একজন পাহারাদার সৈন্য দরজায় ঠেস দিয়ে চোখ বুজে পড়েছিল। দরজার ধাক্কায় সৈন্যটা গড়িয়ে কাঠের মেঝেয় পড়ে গেল। বেহুশ। মারিয়া দরজা খুলে সৈন্যটিকে ওভাবে পড়ে থাকতে দেখে অবাক। অন্য সৈন্যটিও মেঝেয় উপুড় হয়ে পড়ে আছে। মড়ার মতো দুজনেই অনড়। শরীরে কোনো সাড় নেই। মারিয়া প্রথমে কিছুই বুঝল না। একটুক্ষণ দাঁড়াল। সৈন্য দুজন সেই একইভাবে পড়ে আছে। মারিয়া এর কারণ বুঝল না। কিন্তু ওর মন আনন্দে নেচে উঠল—মুক্তি।

মারিয়া আর এক মুহূর্ত দাঁড়াল না। দ্রুত ভেবে নিল কী করতে হবে। এই সুযোগ হাতছাড়া করা চলবে না। মারিয়া ভেবে দেখল—এই পাহারাদার দুজন যে কারণেই হোক বেহুঁশ হয়ে গেছে। কিন্তু সমুদ্রতীরে পাতা পাটতনের ধারে অন্য সৈন্যরা থাকতে পারে। পাটাতন দিয়ে জাহাজ থেকে নামা চলবে না। সাঁতরে তীরে উঠতে হবে। কিন্তু মারিয়া পরনের পোশাকের দিকে তাকাল। পায়ের পাতা অব্দি ঝুল পোশাকটার। এটা পরে সাঁতরানো যাবে না। মারিয়া হাত বাড়িয়ে চামড়ার ঝোলাটা নিল। ঝোলা খুলে কচি বের করল। তারপর হাঁটুর নীচে থেকে পোশাকের বাড়তি অংশটা কচুক করে দ্রুত হাতে কেটে ফেলল। এবার আর সাঁতরাতে কোনো অসুবিধে হবে না!

মারিয়া আর এক মুহূর্ত দেরি করল না। দ্রুত সিঁড়ি দিয়ে ডেকে উঠে এলো। ছুটে মাস্তুলের আড়ালে গিয়ে দাঁড়াল। আকাশে ভাঙা চাঁদ। মৃদু জ্যোৎস্না পড়েছে সমুদ্রে, সমুদ্রতীরের ছোটো টিলাটায়। ও দেখল, কেউ কোথাও নেই। দ্রুত জাহাজের ওপাশে চলে গেল। দড়িদড়া ধরে ঝুলে পড়ল। আস্তে আস্তে সমুদ্রের জলে নামতে লাগল। হাত ছড়ে যাচ্ছে যেন। তবু মারিয়া দাঁত চেপে সহ্য করল। আস্তে আস্তে সমুদ্রের জলে নামল।

কোনোরকম শব্দ না করে জাহাজের পাশে সাঁতারে চলল। তারপর জাহাজ পাশে রেখে তীরভূমির দিকে সাঁতরে চলল। দূরত্ব বেশি নয়। তবুও যখন জল থেকে পাথর ছড়ানো তীরে উঠল তখনও হাঁপাচ্ছে উত্তেজনায়। চারদিকে তাকাল। না, কেউ কোথাও নেই। চাঁদের অল্প আলোয় পাথরের টুকরোয় ফেলে ফেলে মারিয়া পাথুরে রাস্তাটায় এলো। একটা ঠাণ্ডা হাওয়া ছুটে এলো। জলে ভেজা শরীরটা কেঁপে উঠল। পাথরের টুকরোর ওপর দিয়ে যতটা দ্রুত সম্ভবও ছুটল কয়েদঘরের দিকে।

পাথর ছড়ানো রাস্তাটার ঢাল বেয়ে উঠে এসে ছোটো টিলাটার কাছে পৌঁছে মারিয়া সাবধান হলো। মাথা নিচু করে আসছিল এতক্ষণ। এখন আরো নীচু হয়ে চলতে লাগল। তখনই চাঁদের মৃদু আলোয় দেখল রাস্তার পাশেই একটা পাথরের চ্যাপ্টা চাইয়ের ওপর দু’তিন জন এনরিকোর সৈন্য। মারিয়া ভয়ে একলাফে পিছিয়ে এলো। দেখল সৈন্য ক’জন কেউ নড়ছে না। ও এবার সাহস করে এগিয়ে এলো। দেখল একজন সৈন্য বসে আছে। মাথা বুকের ওপর ঝুঁকে আছে। অন্য দুজন হাত পা ছড়িয়ে শুয়ে আছে। পাথরের চাঁই থেকে পা ঝুলছে। মারিয়া হাঁপ ছাড়ল। আবার মারিয়া মাথা আরো নিচু করে চলল। তখনই একবার মাথা একটু তুলে পাথরের চাইয়ের আড়াল থেকে পাথর ছড়ানো প্রান্তরের দিকে তাকাল। চাঁদের অল্প আলোয় দেখল—প্রান্তর জুড়ে সৈন্যরা এলোমেলো সব শুয়ে আছে। মনে হলো যেন এক দঙ্গল মৃতদেহ। কারো কোনো সাড় নেই। শামিয়ানার নীচে নিভন্ত উনুন থেকে ধোঁয়া বেরোচ্ছে। দুটো গাধা চরে বেড়াচ্ছে।

মারিয়া এবার নিশ্চিন্ত হলো। মনে সাহসও পেল। তবু মাথা নীচু করে ছুটতে ছুটতে কয়েদঘরের সামনে এলো।

.

ফ্রান্সিস, হ্যারি আর কয়েকজন তখনও গরাদ দেওয়া দরজার কাছে বসে আছে। ফ্রান্সিস বাইরের দিকে তাকিয়েছিল। ওই প্রথম মারিয়াকে দেখল। কিন্তু নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারল না। ও চমকে উঠে দাঁড়াল তখন মারিয়া সিঁড়িতে পড়ে থাকা পাহারাদারটিকে ডিঙিয়ে দরজার কাছে এলো। ফ্রান্সিস চাপাস্বরে ডাকল, মারিয়া। মারিয়া হাঁপাতে হাঁপাতে বলল—হ্যাঁ আমি। ফ্রান্সিস চাপাস্বরে বলে উঠল, ঐ যে সৈন্যটা সিঁড়িতে পড়ে আছে—ওর কোমরে চাবির গোছা আছে। খুলে নাও। তাড়াতাড়ি মারিয়া ঘুরে দাঁড়াল। সিঁড়িতে পড়ে থাকা পাহারাদারটির কোমর থেকে আস্তে আস্তে চাবির গোছাটা খুলে নিল। ফ্রান্সিস নিচু হয়ে হ্যারিকে আস্তে আস্তে ধাক্কা দিয়ে ডাকল—হ্যারি, হ্যারি হ্যারি চোখ মেলে তাকাল। ও মশালের আলোয় মারিয়াকে দেখেই একলাফে উঠে দাঁড়াল। ফ্রান্সিস ফিসফিস করে বলল—সবাইকে ডাকো। কোনো শব্দ হয় না যেন। ওদিকে মারিয়া একটার পর একটা চাবি তালায় লাগাচ্ছে। লাগছে না। সময় যাচ্ছে। উত্তেজনায় মারিয়ার হাত কাঁপছে। ভেজা কাপড়জামা গায়ে। তবু যেন। ঘেমে উঠল। ফ্রান্সিস চাপাস্বরে বলল—তাড়াহুড়ো করো না। ঠাণ্ডা মাথায় কাজ করো। দুটো বড়ো চাবি পেল মারিয়া, একটা ঢোকাল, ঘোরাবার চেষ্টা করল। ঘুরল না। পরেরটা ঢুকিয়ে ঘঘারাতেই কটু করে শব্দ হলো। তালা খুলে গেল। ফ্রান্সিস দরজার গরাদ ধরেই ছিল। আস্তে আস্তে দরজাটা খুলল। অস্পষ্ট কাঁচ কোচ শব্দ উঠল লোহার দরজায়। ততক্ষণে সব ভাইকিংরা জেগে গেছে। ফ্রান্সিস আর হ্যারি আস্তে আস্তে বেরিয়ে এলো। ফ্রান্সিস হাত তুলে সবাইকে দাঁড়াতে ইঙ্গিত করল। নিজে গেল টিলাটার কাছে। চারদিকে তাড়াতাড়ি নজর বুলিয়ে নিল। কোনো সৈন্য কোথাও দাঁড়িয়ে নেই। দ্রুত ছুটে এলো বন্ধুদের কাছে। কাভাল্লিকে বলল—ঐ টিলার দিক ছাড়া জাহাজঘাটায় যাওয়ার অন্য কোনো রাস্তা তোমার জানা আছে?

হ্যাঁ, তবে খুব পাথর-টাথরের রাস্তা। কাভাল্লি বলল।

ঠিক আছে—ঐ রাস্তা দিয়ে নিয়ে চলো আমাদের। ফ্রান্সিস বলল।

কাভাল্লি ডানদিকের ঢালের দিকে চলল। পেছনে ফ্রান্সিসরা চলল। সবাই চুপ। কেউ কোনো শব্দ করছে না। ঢাল শেষ হতে কাভাল্লি বাঁ দিকে ঘুরল। সত্যিই বড়ো বড়ো পাথরের টুকরো ছড়ানো এদিকটায়। রাস্তা বলে কিছু নেই। চলল সবাই। দু’তিনজন পাথরে পা হড়কে পড়ে গেল। কেটে ছড়ে গেল হাঁটু, পা। কিন্তু কেউ এতটুকু শব্দকরল না। মারিয়া হোঁচট খেল। পায়ের বুড়ো আঙুলটা টনটন করে উঠল। মারিয়া মুখ বুজে সহ্য করল। ছড়ানো পাথরের ওপর দিয়ে দ্রুত ছোটা যায় না। তবু যত দ্রুত সম্ভব ছুটল সবাই। বাঁ দিকে একটা ছোটো চড়াই পেরোতেই ওরা দেখল সমুদ্রতীরের ঢাল। তীরে ভাসছে ওদের জাহাজ। জাহাজ থেকে পাতা পাটাতনটা তখনও সৈন্যরা তুলে রাখেনি।

পাটাতন দিয়ে সার বেঁধে দ্রুত জাহাজে উঠে পড়ল সবাই। মারিয়া কেবিনঘরে চলে গেল। ভেজা পোশাকে ওর কাপুনি ধরে গেছে। জাহাজে উঠতে আর দু’তিনজন বাকি। তখনই টিলার দিক থেকে কয়েকজন সৈন্যের চিৎকার ভেসে এলো। ওদের তখন হুঁশ ফিরেছে বোধহয়। ফ্রান্সিস চাপাস্বরে বলল—জাহাজ নোঙর করা হয়নি।

দাঁড়িরা দাঁড়ঘরে চলে যাও। কোনো শনাকরেদাঁড় বাইতে থাকো। আমি হুইল ধরছি।

দাঁড়িরা দাঁড়ঘরে চলে গেল। বাকিরা জাহাজে উঠেই কাঠের পাটাতনটা তুলে নিল। টিলার দিক থেকে কয়েকজন সৈন্যকে তখন টলতে টলতে আসতে দেখা গেল। দড়িরা দাঁড় বইতে লাগল। জাহাজ একটু নড়ে উঠেতীরের কাছ থেকেসরে যেতে লাগল। জলে দাঁড়ের ঘায়ের মৃদুশব্দ উঠল—ছপছপ ফ্রান্সিস হুইল ঘোরাল। জাহাজ গতি পেল। ভেসে চলল মাঝ সমুদ্রের দিকে। একটু পরেই ঘন কুয়াশার মধ্যে জাহাজটা ঢাকা পড়ে গেল। জাহাজ চলল উত্তরমুখো। এবার ভাইকিংরা মাস্তুলে উঠে পড়ল। দড়িদড়া টেনে পাল খুলে বেঁধে দিল। হাওয়ায় পালগুলো ফুলে উঠল। জল কেটে জাহাজ বেশ দ্রুত চলল।

ফ্রান্সিস হ্যারি বিস্কো তখন ডেকে দাঁড়িয়ে আছে। পুব আকাশে লাল রঙের ছোপ লেগেছে। সূর্য উঠতে দেরি নেই।

মারিয়া পোশাক পাল্টে ওদের কাছে এলো। বলল—আমার পাহারাদার দুজন তো উঠে বসে আছে। শাঙ্কো ওদের তলোয়ার আগেই সরিয়ে রেখেছে। ওরা হাঁকরে তাকিয়ে আছে। এখনও বুঝতে পারছে না কী ঘটে গেছে।

ওরা দুজন জাহাজেই থাক। সামনে কেনো বন্দরে ওদের নামিয়ে দেব। ফ্রান্সিস বলল।

পুব আকাশ আরো লাল হলো। সূর্য উঠেছে। ফ্রান্সিস কাল সেদিকে। সমুদ্রে সূর্যোদয়ের সেই অতি পরিচিত দৃশ্য। একটু একটু উঠতে উঠতে সূর্যের নীচের দিকটা জলের সঙ্গে লেগে থাকে। একটা বড়ো বিন্দু যেন। একটু পরেই বিন্দুটা লাফিয়ে উঠে ওপরের গোলের সঙ্গে মিশে যায়। সূর্যোদয় দেখতে দেখতে ফ্রান্সিস দীর্ঘশ্বাস ফেলল। মনে মনে বলল—আঃ মুক্তি।

সন্ধেবেলা ফ্রান্সিস,কাভাল্লি, হ্যারি আর মারিয়াকে নিয়ে জাহাজের ডেকে উঠে এলো। ও কাভাল্লিকে বলল—আচ্ছা, রাজধানী খানিয়া বন্দরে যেতে হলে আমরা কীভাবে যাবো?

উত্তরে একটা বন্দর পাবো—গ্রামভাউসা। ওখান থেকে পুবদিক ধরে জাহাজ চালালে আমরা কয়েকদিনের মধ্যেই খানিয়া বন্দরে পৌঁছে যাবো।

গ্রামভাউসা বন্দরের কী অবস্থা জানি না। এনরিকোর সৈন্যরা হয়তো ঐ বন্দর দখল করে নিয়েছে। কাজেই ঐ বন্দরে আমরা নামবো না। খানিয়ার দিকে জাহাজ চালাবো। ফ্রান্সিস বলল।

হ্যারি বলল—ফ্রান্সিস তুমি কি সত্যিই খানিয়া যাবে।

হ্যাঁ—শেষ বাইজেন্টাইন সম্রাটের নিখোঁজ মুকুট খুঁজে বের করবো। ফ্রান্সিস বলল।

হ্যারি মৃদু আপত্তির সুরে বলল—কিন্তু বন্ধুরাকি রাজি হবে? আমরা তো অনেকদিন দেশ ছাড়া।

ঠিক আছে। ফ্রান্সিস বলল—হ্যারি, তুমি সবাইকে ডেকে আসতে বলল। দেখি ওরা কী বলে। হ্যারি সবাইকে খবর দিতে চলে গেল। মারিয়ার দিকেতাকিয়ে ফ্রান্সিস বলল মারিয়া, তুমিও কি দেশে ফিরে যেতে চাও?

তুমি যেখানে যাবে, আমিও সেখানে যাবো। ফ্রান্সিস হেসে বলল—মারিয়া, আমি তোমার কাছ থেকে এই কথাই আশা করেছিলাম।

একটু রাতে সব ভাইকিং বন্ধুরা এসে ডেকে জড়ো হলো। ফ্রান্সিস বলতে লাগল ভাইসব, আমি জানি তোমরা অনেকেই দেশে ফিরে যাবার জন্যে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। কিন্তু দেশে ফিরে কী হবে? সেই তো সুখ স্বাচ্ছন্দ্যের অলস জীবন। তোমরা ভালো করেই জানো ঐ অর্থহীন সুখের একঘেয়ে জীবন আমরা চাই না। একটু থেমে ফ্রান্সিস বলতে লাগল কাভাল্লির কাছে এই ক্রীটের কিছু ইতিহাস শুনেছি। খানিয়া দুর্গে শেষ বাইজেন্টাইন। সম্রাট তাঁদের বংশানুক্রমে ব্যবহৃত রাজমুকুট গোপনে রেখে দিয়েছেন। সেই ইতিহাস তোমরা কাভাল্লির কাছে শুনো। আমি স্থির করেছি সেই নিখোঁজ রাজমুকুট উদ্ধার করবো। কাজেই আমরা এখন খানিয়া যাবে। এবার বলো তোমাদের কারো এতে আপত্তি আছে। কিনা। ফ্রান্সিস থামল। ভাইকিং বন্ধুদের মধ্যে একটু গুঞ্জন উঠল। একজন বলল—ফ্রান্সিস ভেবে দেখো,কতদিন আমরা দেশ ছেড়ে এসেছি। খানিয়াতে গিয়ে আবার কোনো যুদ্ধে জড়িয়ে পড়বো কিনা—

সেসব আমি ভেবেছি। খানিয়াতে আমি যাবোই। যদি দেখি ওখানে যুদ্ধ শুরু হয়েছে। তাহলে ওখানে আমরা নামবো না। দেশের দিকে জাহাজ ঘোরাব। কিন্তু যদি দেখি পরিবেশ শান্তিপূর্ণ তাহলে রাজমুকুট খুঁজে বের করবো। একজন ভাইকিং বলে উঠল—কী দরকার ফ্রান্সিস, চলো না দেশেই ফিরে যাই।

বেশ সামনেই গ্রামভাউসা বন্দর। হয়তো এখনও এনরিকোর সৈন্যরা দখল করেনি। আমি, হ্যারি আর মারিয়া বন্দরে নেমে যাবো। তোমরা জাহাজে ফিরে দেশে চলে যাও। আমরা খানিয়া যাবোই। ফ্রান্সিস বলল।

.

ভাইকিংদের মধ্যে অনেকেই বলে উঠল—না, তোমাদের রেখে আমরা দেশে ফিরে যাবো না। তোমরা যেখানে যাবে সেখানে আমরাও যাবো!

ফ্রান্সিস গলা চড়িয়ে বলে উঠল—এই তো খাঁটি ভাইকিং-এর কথা। সভা ভেঙে গেল। সবাই নিজেদের মধ্যে কথা বলতে লাগল। ডেকে বসল কেউ কেউ। কেউ কেউ কেবিনঘরে চলে গেল।

মারিয়া বলল—আচ্ছা ফ্রান্সিস, তুমি কি উদ্ধার করতে পারবে সেই নিখোঁজ রাজমুকুট?

আগে দোনিয়া দুর্গে যাই, সব দেখি,বুঝি। তারপর বলতে পারবো, মুকুট উদ্ধর সম্ভব কি অসম্ভব ফ্রান্সিস বলল।

পরদিন বিকেলের দিকে ফ্রান্সিসদের জাহাজ গ্রামভাউস বন্দরের কাছে এলো। দূর থেকে বন্দরের রাস্তাঘাট ঘরবাড়ি দেখা গেল। বন্দরটা বেশ সমতল জায়াগায়। দূর থেকে ফ্রান্সিস মনোযোগ দিয়ে বন্দরটা দেখতে লাগল। দেখল রাস্তাঘাটে লোকজন চলাচল করছে। বেশ স্বাভাবিক জীবন। কোনো সৈন্য দেখতে পেল না। তার মানে এনরিকো এখনও এই বন্দরটা দখল করতে পারেনি। হ্যারি পাশেই দাঁড়িয়েছিল। ফ্রান্সিস বলল—এখান থেকে দেখে যা বুঝছিএখানে এনরিকোর সৈন্যরা এখনও আসেনি। জাহাজ ভেড়াবো কিনা তাই ভাবছি।

হ্যারি বলল—রসুইঘরের বন্ধুরা বলেছিল, জল, খাবার এসবকম এসেছে। তুমি খানিয়া যেতে চাইছো। কাজেই কিছু খাদ্য জল তো সংগ্রহ করা প্রয়োজন। তাছাড়া এনরিকোর দুজন সৈন্য জাহাজে রয়েছে। ওদেরও তোনামিয়ে দিতে হবে।

ঠিক আছে। জাহাজ ভেড়ানো যাক। তবে আমরা কেউ আগে নামবো না। আগে কাভাল্লি নামবে সৈন্য দুজনকে নিয়ে। কাভাল্লি জল, খাদ্য এসবের খোঁজ নিয়ে আসবে। সেই সঙ্গে এখানকার অবস্থাটাও বুঝে আসবে। যদি কোন বিপদে পড়ার আশঙ্কানা থাকে তবেই আমরা নামবো। ফ্রান্সিসের নির্দেশে জাহাজতীরের কাছে আনাহলো। ওরা সমতল রাস্তা দিয়ে হেঁটে বন্দরের বসতি অঞ্চলের দিকে চলে গেল।

ফ্রান্সিস জাহাজ-চালককে নির্দেশ দিল—তৈরি থেকো। আমি হাত তোলার সঙ্গে সঙ্গে জাহাজ ছেড়ে দেবে। দাঁড়িরা দাঁড়ঘরে গিয়ে দাঁড়ে হাত রেখে বসল। পালও নামানো হলো না। নোঙরও ফেলা হলো না। কাঠের পাটাতনের কাছেও দু’তিনজন ভাইকিং তৈরি হয়ে রইল। ফ্রান্সিসের নির্দেশ পেলেই পাটাতন তুলে ফেলবে।

ফ্রান্সিস হ্যারি মারিয়া জাহাজের রেলিঙের ধারে দাঁড়িয়ে রইল। তিনজনেই তাকিয়ে আছে বন্দরের বসতি অঞ্চলের দিকে। সবাই টান টান। তৈরি। বিপদের আঁচ পেলেই জাহাজ ছেড়ে দেবে।

প্রায় আধঘণ্টা কেটে গেল। ফ্রান্সিস ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না কী করবে এখন? তখনই দেখা গেল কাভাল্লি ফিরে আসছে। বেশ নিশ্চিন্ত মনেই হেঁটে হেঁটে আসছে। ফ্রান্সিস হাঁপ ছাড়ল—যাক, বিপদের কোনো আশঙ্কা এখানে নেই। কাভাল্লি জাহাজে উঠল, ফ্রান্সিসের কাছে এলো। হেসে বলল-ভয়ের কিছু নেই। এনরিকোর সৈন্যরা এখনও এখানে আসেনি। রাজা বোনিফেসের কিছু সৈন্য এখানে আছে। খুব শান্ত এ জায়গা। আমি জল খাবার-দাবারের ব্যবস্থা করে এসেছি। আমার সঙ্গে লোক দিন আর কিছু স্বর্ণমুদ্রা। আমি সব নিয়ে আসছি। ফ্রান্সিস ভাইকিং বন্ধুদের ডেকে কয়েকজনকে দায়িত্ব দিল। তারা স্বর্ণমুদ্রা, খালি জলের পিপে, বস্তা-টস্তা এসব নিয়ে কাভাল্লির সঙ্গে তীরে নামল। চলল বসতি অঞ্চলের দিকে।

ঘন্টাখানেকের মধ্যেই ভাইকিংরা প্রয়োজনীয় খাবার-দাবার পানীয় জল নিয়ে ফিরে এলো। ফ্রান্সিসরা নিশ্চিন্ত হলো।

রাতে কেবিনঘরে বিছানায় শুয়ে ফ্রান্সিস বুঝল বেশ গরম লাগছে। ফ্রান্সিস কিছুক্ষণ এপাশ ওপাশ করল। ঘুম আসছে না। আবার চিন্তাও আছে মাথায়। খানিয়া যেতে হবে। ওখানে এখন কী অবস্থা তাও জানি না। যদি গিয়ে দেখি বিদ্রোহী এনরিকোর সৈন্যরা ওখানে পৌঁছে গেছে। লড়াই চলছে তাহলে তো খানিয়া বন্দরে নামা চলবে না। ওখান থেকেই জাহাজ ঘোরাতে হবে স্বদেশের দিকে। এসব ভাবতে ভাবতে বেশ রাতে ঘুমিয়ে পড়ল ফ্রান্সিস

হঠাৎ ফ্রান্সিসের ঘুম ভেঙে গেল। একটা চাপা গরমে ও প্রায় ঘেমে উঠেছে। বিছানায় উঠে বসল ফ্রান্সিস মোমবাতির আলোয় দেখল মারিয়া গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। ও আরমারিয়াকে ডাকল না। আস্তে আস্তে বিছানা ছেড়ে উঠল। তারপর কেবিনঘর থেকে বেরিয়ে সিঁড়ি দিয়ে ডেক-এ উঠে এলো। দেখল সমুদ্র শান্ত কিন্তু আকাশ খুব পরিষ্কার নয়। কেমন একটা সাদাটে ধোঁয়ার মতো কুয়াশা আকাশে। চাঁদের আলোও তাই অস্পষ্ট ম্লান।

ফ্রান্সিস দেখল। ডেক-এ এখানে-ওখানে কম্বলমতো মোটা কাপড় পেতে কয়েকজন ভাইকিং বন্ধু শুয়ে ঘুমুচ্ছে। গুমোট গরম থেকে এসে ফ্রান্সিসের ভালোই লাগল। কিন্তু হাওয়া নেই একেবারে। গ্রামভাউসার বাড়িঘরও সাদাটে কুয়াশার আস্তরণে ঢাকা পড়েছে।

ফ্রান্সিস জাহাজের ডেক-এর একেবারে পেছনের দিকে এলো। একটা চৌকোণো মতো জায়গা রয়েছে। ফ্রান্সিস সেখানেই মাথার নীচেহাত রেখে শুয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইল। তখনই মৃদু ঠাণ্ডা হাওয়া বইতে শুরু করল। আস্তে আস্তে ফ্রান্সিসের দুচোখ ঘুমে জড়িয়ে এলো।

কতক্ষণ ঘুমিয়েছে ফ্রান্সিস জানেনা। হঠাৎ কী একটা অস্বস্তিতে ওর ঘুম ভেঙে গেল। ও উঠে বসল। আকাশের দিকে তাকিয়ে বুঝল রাত শেষ হয়ে আসছে। আবার শুয়ে পড়বে কিনা ভাবছেকানে অস্পষ্ট ছলাৎ ছলাৎ জলের শব্দ পৌঁছল। এ তো জাহাজ চলার শব্দ। ফ্রান্সিস দ্রুত উঠে দাঁড়াল। তাকাল বাইরের সমুদ্রের দিকে। অস্পষ্ট জ্যোৎস্নায় দেখল একটা জাহাজ যতটা সম্ভব নিঃশব্দে ওদের জাহাজের দিকে এগিয়ে আসছে। ফ্রান্সিস প্রথমে বুঝে উঠতে পারল না কী করবে। ও জাহাজটার মাস্তুলে কোনো দেশের পতাকা আছে কিনা দেখল। না কোনো পতাকা উড়ছেনা। জাহাজটা আরো কাছে এলোয় সাদাটে কুয়াশা আর অস্পষ্ট চাঁদের আলোয় ফ্রান্সিস দেখল জাহাজের সামনের দিকে কালো রঙের কাঠ অনেকটা চটে উঠে গিয়ে খয়েরি রঙের কাঠ বেরিয়ে আছে। এবার ফ্রান্সিস ভীষণ চমকে উঠল। এই যুদ্ধ জাহাজটাইও ফালাসন বন্দরে ভেড়ানো দেখেছিল। বিদ্রোহী এনরিকোর যুদ্ধ জাহাজটা ঐ জাহাজে চড়েই এনরিকোর সৈন্যরা আসছে গ্রামভাউসা বন্দর দখল করতে।

ফ্রান্সিস দ্রুত মাথা নিচু করল। তারপর জাহাজের ডেক-এর কাঠের পাটাতনের ওপর দিয়ে শুয়ে পড়ল। শরীরটা হিঁচড়ে হিঁচড়ে চলল। একটু আসতেই মাস্তুলের আড়াল পেল। আস্তে আস্তে মাস্তুলের আড়ালে হাঁটু গেড়ে বসল। দেখল কয়েক হাত দূরেই দু’জন ভাইকিং কম্বল মতো মোটা কাপড় পেতে ঘুমিয়ে আছে। তখনই দু’জনের মধ্যে একজন পাশ ফিরল। ফ্রান্সিস দেখল—বিস্কো। ফ্রান্সিস আস্তে আস্তে ডাকল—বিস্কো-বিস্কো। ঘুমন্ত বিস্কোর কানে গেল না সে ডাক। ওদিকে জাহাজটা আরও অনেক কাছে চলে এসেছে। ফ্রান্সিস দ্রুত ডেক-এ আবার শুয়ে পড়ল। মাস্তুলের আড়াল থেকে বুক হিঁচড়ে বিস্কোর কাছে গেল। আস্তে আস্তে বিস্কোর কাঁধে ধাক্কা দিল। বিস্কোর ঘুম ভেঙে গেল। একবারে মুখের কাছে। ফ্রান্সিসকে দেখেও সঠিক চিনল না। দ্রুত উঠে গেল। ফ্রান্সিস ওর মাথা চেপে ধরে বলল—আমি ফ্রান্সিস চুপ করে শুয়ে থাকো। বিস্কো মাথামিয়ে শুয়ে পড়ল। বেশ বুঝল নিশ্চয়ই কিছু হ’য়েছে। ফ্রান্সিস ওর কানের কাছে মুখ এনে বলল—এনরিকোর সৈন্যরা গ্রামভাউসা বন্দর দখল করতে জাহাজে চড়ে আসছে। আর অল্পক্ষণ পরেই ওদের জাহাজ আমাদের জাহাজের গায়ে এসে লাগবে। ঝড়ের সঙ্গে লড়াই করে সবাই ক্লান্ত। ঘুমিয়ে পড়েছে। কাউকে ডাকবো না। আমাদের বন্ধুরা লড়াই যেন না করে। এনরিকোর সৈন্যরা বন্দি করতে এলে যেন বাধা না দেয়। রক্তপাত আমি চাই না। সবাই বন্দিত্ব স্বীকার করে নিও ফ্রান্সিস থামল। একটু দম নিয়ে বলল—তুমি সবাইকে এই কথা বলো। আমি জলে নেমে যাবো। সময় ও সুযোগের জন্যে অপেক্ষা করবো। তোমরা লড়াই করতে যেও না। অবস্থা বুঝে আমি যা করার করবো। আমি যাচ্ছি।

ফ্রান্সিস আবার ডেক-এর পাটাতনে বুক হিঁচড়ে হিঁচড়ে জাহাজের পেছনের দিকে এলো। ও যখন জাহাজের হালের খাঁজে খাঁজে পা রেখে নামতে শুরু করেছে তখনই এনরিকোর সৈন্য ভর্তি জাহাজটা ওদের জাহাজের গায়ে এসে লাগল। এনরিকোর সৈন্যরা ধুপধাপ শব্দ তুলে ফ্রান্সিসদের জাহাজে নামতে লাগল।

বিস্কো দু’হাত তুলে উঠে দাঁড়াল। খোলা তলোয়ার হাতে দু’তিনজন সৈন্য এসে বিস্কোকে ঘিরে দাঁড়াল। সেই অল্প দড়িওলা লম্বাটে চেহারার দলপতি বিস্কোর সামনে এসে দাঁড়াল। বিস্কো বলল—আমাদের কাউকে হত্যা করবেন না। কিন্তু দলপতি বিস্কোর কথা কিছুই বুঝল না। ওদিকে সৈন্যরা খোলা তলোয়ার উঁচিয়ে সিঁড়ি বেয়ে কেবিন ঘরগুলোর দিকে ছুটল। শুয়ে থাকা বসে থাকা ঘুমন্ত ভাইকিংরা কিছু বুঝে ওঠার আগেই বন্দি হতে লাগল, এনরিকোর সৈন্যদের হাতে হাত বেঁধে সব ভাইকিং বন্দিদের ডেক-এ আনা হল। মারিয়াকেও হাত বেঁধে আনা হ’ল। হ্যারি ও এলো। বিস্কো ছুটে হ্যারির কাছে গেল। দ্রুত বলল হ্যারি ফ্রান্সিস আত্মগোপন করেছে। ও বলেছে আমরা যেন যুদ্ধনাকরি। শান্ত হয়ে থাকি। ফ্রান্সিস নিজেই যা করবার করবে। বিস্কো হ্যারির সঙ্গে কথা বলছে তখনই সৈন্যদের দলপতি দু’জনের দিকে এগিয়ে এলো। হ্যারিকে গ্রীকভাষায় জিজ্ঞেস করল—আমাদের নেতা এনরিকো তোমাদের আমাদের হয়ে যুদ্ধ করতে বলেছিল। তোমরা পালালে কেন?

দেখুন—আমরা গ্রীক—নই—এদেশের রাজনীতির সঙ্গে আমাদের কেনো সম্পর্ক নেই। রাজা বোনিফেস আমাদের কোনো ক্ষতি করেননি। তবে কেন আমরা আপনাদের যুদ্ধের সঙ্গে জড়াব? হ্যারি বেশ দৃঢ়স্বরে বলল। দলপতি কিছুক্ষণ হ্যারির মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। বন্দি হ্যারির মুখে এরকম তেজো দৃপ্তকথা শুনে দলপতি বেশ অবাকই হল। দলপতি যখন চলে যাবার জন্যে ঘুরে দাঁড়িয়েছে তখন হ্যারি বলল—আমাদের রাজকুমারী মারিয়াকে এভাবে বন্দি করে রাখবেন না। তাকে তাদের কেবিনঘরে থাকতে দিন। আমরা কথা দিচ্ছি আমরা পালাবার চেষ্টা করবো না। দলপতি একজন সৈন্যকে ডেকে কী বলল। সৈন্যটা গিয়ে মারিয়ার হাতের বাঁধন খুলে দিল। হ্যারি একটু গলা চড়িয়ে বলল—রাজকুমারী—আপনি আপনার কেবিনঘরে চলে যান।

—কিন্তু তোমরা?মারিয়া বলল।

—আমরা বন্দিত্ব মেনে নিয়েছি। এই ডেকেই থাকবো আমরা। মারিয়া একটু ইতস্তত করে বলল—ফ্রান্সিস কোথায়?

হ্যারি এবার এগিয়ে মারিয়ার কাছে গেল। নিম্নস্বরে বলল।

—ফ্রান্সিস ভালো আছে। ও আত্মগোপন করেছে। কাছাকাছিই আছে। ও বলেছে আমাদের মুক্তির উপায় করবে। এখন এই সেনাপতি ও সৈন্যরা যা বলে তাই করবেন। বিরোধিতা করবেন না।

মারিয়া আর কোনো কথা না বলে নিজের কেবিনে চলে গেল।

এসময় দলপতি উচ্চকণ্ঠে কী আদেশ দিল সৈন্যদের। সৈন্যরা এগিয়ে এসে ভাইকিংদের ডেক-এর কাঠের পাটাতনে বসে পড়তে ইঙ্গিত করল। হ্যারি গলা চড়িয়ে বলল ভাইসব—সবাই ডেক-এ বসে পড়ো। সবাই আস্তে আস্তে বসে পড়ল। দু’একজন ভাইকিং একটু জোর গলায় বলল—ফ্রান্সিসকে দেখছিনা—সে কোথায়?হ্যারি বলল—ফ্রান্সিস সুস্থ আছে। নিরাপদে আছে! শুধু এইটুকুই জেনে রাখো তোমরা। ফ্রান্সিস বলেছে—তোমরা এই সৈন্যদের সঙ্গে কোনোভাবে লড়াইতে নামবে না। ওরা যেমন বলে তেমন চলবে। তোমরা বিরোধিতা করবে না। সবাই চুপ করে হ্যারির কথা শুনল। ওরা বীরের জাত। এইভাবে বিনা যুদ্ধে বন্দিদশা মানতে ওদের মন চাইছিল না। কিন্তু ফ্রান্সিস বলেছে। কাজেই ফ্রান্সিসের নির্দেশমতো চলতে হবে। ফ্রান্সিস আত্মগোপন করেছে। মুক্ত আছে। ফ্রান্সিস নিশ্চয়ই মুক্তির ব্যবস্থা করবে। ফ্রান্সিসের ওপর সে বিশ্বাস আছে।

তখন সবে সূর্য উঠছে। পুবের আকাশ লাল হয়ে গেছে। একটু পরে সূর্য উঠল। তবে চারদিকে কেমন সাদাটে কুয়াশার আস্তরণ থাকায় রোদ খুব উজ্জ্বল হ’ল না।

সৈন্যদের দলপতি এবার হাতের তলোয়ার উঁচিয়ে গ্রামভাউসা বন্দরের দিকে যাওয়ার জন্য ইঙ্গিত করে চিৎকার করে কী বলল। সৈন্যরা পর পর সারি বেঁধে জাহাজ থেকে নামতে লাগল। পাথুরে রাস্তা ধরে সৈন্যদল চলল বসতির দিকে। জাহাজে চারজন সৈন্য ভাইকিং বন্দিদের পাহারায় রইল। একজন সৈন্য রইল মারিয়ার পাহারায়।

একটু পরেই সমস্ত এলাকা থেকে লোকজনের আর্ত চিৎকার কান্নাকটির ধ্বনি ভেসে এলো। বোনিফেসের যে ক’জন সৈন্য ছিল তারা তোহার স্বীকার করতে বাধ্য হ’ল। বন্দি এ কাভাল্লি চিৎকার করে বলল—এনরিকোর সৈন্যরা জিতলে আমাদের মুক্তির কোনো আশা নেই। ভাইকিং বন্দিরা শুনল। কিছু বলল না কেউ। কিন্তু কাভাল্লি ওরা যখন খাদ্য জল আনতে গিয়েছিল তখন ওখানকার বসতি ছাড়িয়ে বেশিদূর যায়নি। কিছুদুরে কিন্তু রাজা বোনিফেসের প্রায় শ’খানেক সৈন্যের ছাউনি ছিল। এটা কাভাল্লিরা জানতো না। সেই ছাউনিটা ছিল একটু দূরে একটা ঘাসে ঢাকা উপত্যকার মধ্যে।

কিছুক্ষণের মধ্যেই এনরিকোর সৈন্যরা সেই উপত্যকায় এলো। এর মধ্যে বোনিফেসের সৈন্যরাও তৈরি হয়ে গেছে। কারণ দূর থেকে ওর গ্রামভাউসার অধিবাসীদের আর্ত চিৎকার শুনতে পেয়েছিল।

এনরিকোর সৈন্যরা চিৎকার করতে করতে ছুটে এলো উপত্যকা দিয়ে। বোনিফেসের সৈন্যরাও সশস্ত্র হয়ে ছাউনি থেকে বেরিয়ে এলো। দুই সৈন্যদলে তুমুল লড়াই শুরুহ’ল সেই উপত্যকায়।

ওদিকে ফ্রান্সিস ওদের জাহাজের হাল ধরে শুধু মাথাটা জলের ওপর ঠেকিয়ে চুপ করে জলের মধ্যে ডুবে রয়েছে। ওপরে জাহাজের পাটাতনে শব্দ শুনেই ও বুঝল যে এনরিকোর সৈন্যরা ওদের জাহাজে নামল। সৈন্যদের চিৎকার চ্যাঁচামেচি দলপতির গলা চড়িয়ে সৈন্যদলের আদেশ দেওয়া এসব শুনে ফ্রান্সিস বুঝল—এনরিকোর সৈন্যরা ওদের জাহাজ দখল করেছে। ও আশঙ্কা করেছিল হয়তো ভাইকিং বন্ধুরা অস্ত্রঘর থেকে অস্ত্র সংগ্রহ করে বাধা দেবে লড়াই করবে। কিন্তু ও তলোয়ারের লড়াইয়ের কোনো শব্দ শুনল না। বোঝা গেল—ভাইকিং বন্ধুরা লড়াইয়ের সুযোগই পায় নি। এতে ফ্রান্সিস নিশ্চিন্ত হ’ল। রক্তপাত ও মৃত্যু এসব ঘটল না। তখনই ও শুনল হ্যারি চিৎকার করে ওর বন্ধুদের ফ্রান্সিসের নির্দেশ জানাচ্ছে। ফ্রান্সিস আরো নিশ্চিন্ত হ’ল। ওর নির্দেশ শোনার পর আর বন্ধুরা লড়াইয়ের চেষ্টা করবে না। কিন্তু ফ্রান্সিসের মাথায় তখন চিন্তা। কী করে সবাইকে মুক্ত করা যায়। মারিয়া আর সব বন্ধুরা তো নিশ্চিন্ত ফ্রান্সিস বন্দি হয়নি। মুক্ত আছে। মুক্তির একটা ব্যবস্থা ফ্রান্সিস করবেই। সবাই মুক্তির জন্যে ওর ওপর নির্ভর করে আছে। একথা ভেবে ফ্রান্সিসের দুশ্চিন্তা আরো বেড়ে গেল। অথচ ভেবে পাচ্ছি না কী করে ওদের মুক্ত করবে।

ফ্রান্সিস এবার শব্দ থেকে বুঝল এনরিকোর সৈন্যরা জাহাজ থেকে নেমে যাচ্ছে। হালের আড়াল থেকে দেখল সৈন্যরা সারি বেঁধে গ্রামভাউসার বসতি এলাকার দিকে যাচ্ছে। তার মানে জাহাজে পাহারাদার সৈন্য মাত্র কয়েকজনই আছে। এদের চোখকে ফাঁকি দিয়ে জাহাজ নিয়ে বন্ধুদের আর মারিয়াকে নিয়ে পালাতে হবে। কিন্তু কী করে? ফ্রান্সিস কাভাল্লিদের কাছে শুনেছিল এ গ্রামভাউসারে বোনিফেসের খুবই অল্প সৈন্য আছে। এনরিকোর সৈন্যদের কাছে ওরা সহজেই হার মানবে। কাজেই সৈন্যরা সকলে কিছুক্ষণের মধ্যেই জাহাজে ফিরে আসবে। তখন কি অত সৈন্যদের চোখে ধুলো দিয়ে পালানো যাবে? তাও জাহাজে চড়ে?

ফ্রান্সিস এসব সাত-পাঁচ ভাবছে তখন ইঁদুর থেকে চিৎকার হৈ হৈ শব্দ ভেসে এলো। ফ্রান্সিস চমকে উঠল। তাহলে রাজা বোনিফেসের আরো সৈন্য গ্রামভাউসায় ছিল। যুদ্ধের নানা শব্দ আর্ত চিৎকার এসব শব্দ শুনে ফ্রান্সিস বুঝল জোর লড়াই বেঁধেছে। ওর মন, আনন্দে নেচে উঠল।

যুদ্ধে যদি রাজা বোনিফেসের সৈন্যরা জেতে তাহলে তো বন্ধুদের মুক্ত করতে কোনো অসুবিধেই হবে না। কিন্তু যদি এনরিকোর সৈন্যরা জেতে তাহলে তো মুক্তির কোনো আশাই নেই। তবে একটা ক্ষীণ আশা ফ্রান্সিসের মনে জাগল হয়তো যুদ্ধে জিতলে এনরিকোর সৈন্যরা আর ওদের জাহাজে আজকে নাও ফিরতে পারে। কারণ যুদ্ধে জিতলে জাহাজ পাহারা দেবার জন্যে কয়েকজন পাহারাদারই যথেষ্ট। যদি ঐ সৈন্যরা বেশি সংখ্যায় গ্রামভাউসাতেই থেকে যায় আজ রাতে আর ওদের জাহাজে ফিরে না আসে তাহলে সুবর্ণ সুযোগ। এই সুযোগ আজ রাতের মধ্যে কাজে লাগাতে হবে। যে করে তোক বন্ধুদের মুক্ত করতে হবে। জাহাজ নিয়ে পালাতে হবে এখান থেকে। এখন রাত্রির অন্ধকারের জন্যে অপেক্ষা করা ছাড়া অন্য উপায় নেই। কাজেই ফ্রান্সিস সমুদ্রের জলে মুখ ভাসিয়ে জাহাজের হাল ধরে অপেক্ষা করতে লাগল।

এদিকে বেলা বাড়ছে। ভাইকিং বন্দিরা সকাল থেকে কিছু খায় নি। যে চারজন সৈন্য ওদের পাহারা দিচ্ছিল্ল তারা জাহাজের রসুইঘরে পালা করে গিয়ে খেয়ে এসেছে। ভাইকিং বন্দিদের মধ্যে গুঞ্জন শুরু হ’ল। তারপরই ওরা একসঙ্গে উঠে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে উঠল—ও—হো—হো। পাহারাদার সৈন্যরা তলোয়ার উঁচিয়ে এগিয়ে এলো। হ্যারি দেখল বন্ধুরা উত্তেজিত। ওরা হাত বাঁধা অবস্থায় সশস্ত্র সৈন্যদের সঙ্গে লড়তে পারবে না। যদি উত্তেজিত হয়ে সৈন্যদের আক্রমণ করে বসে তাহলে কয়েকজন ভাইকিং বন্ধুর মৃত্যু হবেই। হ্যারি বাঁধা দু’হাত ওপরে তুলে ভাঙা ভাঙা গ্রীক ভাষায় চেঁচিয়ে বলল—আমরা বন্দি কিন্তু আমরা তো মানুষ। এত বেলা হয়েছে। আমরা কিছু খাইনি, আমাদের খাবারের ব্যবস্থা করো। সৈন্যরা কী করবে বুঝে উঠতে পারলো না। ভাইকিং বন্দিরা আবার চিৎকার করে উঠলো—ও—হো—হো।

এই চিৎকার গণ্ডগোলের শব্দ মারিয়ার কানে গেল। ও দ্রুত পায়ে কেবিনঘর থেকে বেরিয়ে এলো। একজন সৈন্য কেবিনঘরের দোরগোড়ায় পাহারা দিচ্ছিল। মারিয়া তাকে জিজ্ঞেস করল কী ব্যাপার!এত চেঁচামেচি কীসের? পাহারাদার সৈন্যটি মারিয়ার কথা কিছুই বুঝল না। হাঁ করে তাকিয়ে রইল। মারিয়া রাগত স্বরে বলল—গ্রীকভূত!তারপর ডেক-এ ওঠার সিঁড়ির দিকে পা বাড়াল। সৈন্যটি তলোয়ার বাড়িয়ে ধরে মারিয়ার পথ আটকাল। মারিয়া ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে সৈন্যটির দিকে তাকাল একবার। তারপর ডান হাতের এক ঝটকায় তলোয়ারের ফলা সরিয়ে সিঁড়ির দিকে এগোল। সৈন্যটি কী করবে বুঝে উঠতে পারল না। পাছে মারিয়া পালিয়ে যায় তাই ও একছুটে এগিয়ে এসে মারিয়ার পেছনে পেছনে আসতে লাগল। মারিয়া ডেক-এ উঠতেই ভাইকিং বন্দিরা আবার চিৎকার করে উঠল—ও—হো—হো—হো। মারিয়া হ্যারির কাছে এলো। বলল—কী ব্যাপার হ্যারি ?

—রাজকুমারী—সকাল থেকে আমরা কিছু খাইনি। ক্ষুধার্ত আমরা। দুপুরে খাওয়া জুটবে কিনা জানি না। হ্যারি বলল। মারিয়া বলল—হ্যারি আমি সব ব্যবস্থা করছি। কিন্তু আমি যে গ্রীক ভাষা জানি না। সৈন্যরা আমার কথা বুঝবে না। তুমি ওদের বুঝিয়ে বললো। হ্যারি সৈন্যদের বলল—শোনো-রাজকুমারী মারিয়া আমাদের খাবার তৈরি করে দেবেন। উনি পালাবেন না। যদি তোমাদের মনে সেই সন্দেহ থাকে তাহলে রসুইঘরের দরজায় দু’জন পাহারাদার রাখতে পারো। এবার সৈন্যরা নিজেদের মধ্যে কথা বলল। ওরা রাজি হ’ল। দু’জন সৈন্য খোলা তলোয়ার হাতে মারিয়ার পেছনে এসে দাঁড়াল।

—কিন্তু রাজকুমারী হ্যারি বলল—আপনি একা কি পারবেন এতজন লোকের রান্না করতে? আপনার খুব কষ্ট হবে।

—কিছুই না—মারিয়া একটু হেসে বলল। তারপর নীচে নামার সিঁড়ির দিকে চলল। পেছনে তলোয়ার উঁচিয়ে দু’জন পাহারাদার সৈন্যও চলল।

মারিয়া দ্রুতপায়ে রসুইঘরে এলো। সৈন্য দু’জন দরাজায় দাঁড়াল। মারিয়া রাজকুমারী হলেও আলস্যে দিন কাটাতো না। নিজের কাপড় জামা কাঁচতো, কাপড় রুমাল সেলাই করতো। রাজবাড়ির ফরাসী রাঁধুনির কাছে নানারকম খাবারের পদ রান্না করাও শিখেছিল। কিন্তু এত লোকের রান্না তো মারিয়া কোনোদিন রাঁধেনি। তবুও নিজে থেকে এগিয়ে এসে এই দায়িত্ব নিল। এই বন্দি ভাইকিংদের একটাই পরিচয় ওরা ফ্রান্সিসের অন্তরঙ্গ বন্ধু।

প্রথম মারিয়া আটা, ময়দা, চিনি, আনাজপাতি, মশলা এসব কোথায় কোথায় রাখা আছে দেখে নিল। একটা বড়ো গামলায় ভেড়ার মাংস কেটে রাখা আছে দেখল। এবার উনুন জ্বালা। তারপর রান্না।

প্রায় ঘণ্টা তিনেক পরে রান্না শেষ হ’ল। মারিয়া ডেক-এ উঠে এলো। বেশ গলা চড়িয়ে বলল—রান্না হয়ে গেছে। ভাইকিং বন্দিরা আনন্দে চিৎকার করে উঠল—ও—হো—হো। অত লোকের জন্যে রান্না করার ধকলে মারিয়ার মুখ শুকিয়ে গেছে। ও তবু হাসল।

সৈন্যরা চারজন করে ভাইকিংদের পাহারা দিয়ে খাবার ঘরে নিয়ে যেতে লাগল। এই ভাবে ভাইকিং বন্দিরা খেয়ে আসতে লাগল। হ্যারি সবাইকে খেতে পাঠাতে লাগল। ও খাবে সবশেষের দলে, হ্যারি এসময় উঠে দাঁড়াল। একজন সৈন্য তলোয়ার উঁচিয়ে ছুটে এলো। হ্যারি বলল—খাবার আগে আমরা আমাদের দেবতাকে খাদ্য জল উৎসর্গ করে খাই। আমি দেবতাকে ডাকবো। আমাকে জাহাজের পেছন দিকে গিয়ে দেবতাকে ডাকতে হবে। সৈন্যটি কী ভাবল। তারপর তলোয়ারটা বাড়িয়ে ধরে যেতে বলল। হ্যারি জাহাজের পেছন দিকে হালের কাছে এলো। আকাশের দিকে বাঁধা হাতদুটো বাড়িয়ে চেঁচিয়ে বলতে লাগল—হে দেবতা—তুমি অনেকক্ষণ খাওনি। আমাদের রান্না হয়ে গেছে। এবার তুমি খাও ফ্রান্সিস জলের একটু ওপরে মাথা ভাসিয়ে হ্যারির সব কথা শুনল। এত বিপদ এত চিন্তার মধ্যেও হ্যারির কথা শুনে ফ্রান্সিসের হাসি পেল।

হ্যারি ফিরে এলো। পেছনে পেছনে সৈন্যটাও এলো। ও এসবের কিছুই বুঝল না।

সবশেষের দলের সঙ্গে হ্যারি খেতে গেল। হ্যারি খাবার ঘরে ঢুকে মারিয়াকে গ্রীকভাষায় বলল—আপনি তো জানেন—আমাদের দেবতাকে উৎসর্গ না করে আমি কিছু খাইনা। মারিয়া তো অবাক গ্রীক ভাষা তো বোঝেনা। সৈন্যরা এবার বুঝল সে সত্যিই হ্যারি খাবার আগে ওদের দেবতাকে খাবার উৎসর্গ করে। কিন্তু মারিয়া ফ্যাল ফ্যাল করে হ্যারির দিকে তাকিয়ে রইল। এবার হ্যারি ওদের মাতৃভাষায় বলল—একটা পাত্রে খাবার দিন। আর এক মগ জল। আমি দেবতাকে খাবার উৎসর্গ করে খেতে আসছি। মারিয়া ঠিক বুঝল না হ্যারি কী বলতে চাইছে! হ্যারি তাড়া দিল—একটু তাড়াতাড়ি করুন। মারিয়া আর কিছু না বলে একটা এনামেলের থালায় মাংসরুটি সবজি রাখল। একটা মগজল দিল। সেসব নিয়ে হ্যারি, ডেক-এ উঠে এলো। একজন সৈন্যও ওর পেছনে পেছনে চলল। হ্যারি খাবার জলের মগ হাতের কাছে একটা পরিষ্কার জায়গায় রাখল। খাবেব’লে হ্যারির হাতের বাঁধন সৈন্যটি খুলে দিয়েছিল। খাবার জল রেখে হ্যারি সৈন্যটিকে বলল—ভাই—এসময় এখানে কেউ থাকবে না। আমাদের দেবতা যখন খান তখন কারো তা দেখার নিয়ম নেই। তুমি আমার সঙ্গে খাবার ঘরে চলো। সৈন্যটি মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল। এবার হ্যারি দুহাত তুলে গলা। চড়িয়ে বলল—হে দেবতা! আপনার জন্যে এখানে খাদ্য রেখে গেলাম। আপনি এই খাদ্য পানীয় গ্রহণ করে আমাদের কৃতাৰ্থ করুন। হাত নামিয়ে হ্যারি সৈন্যটিকে সঙ্গে নিয়ে ফিরে চলল। ডেক-এর সামনের দিকে পাহারারত সৈন্যদের বলল…ভাই তোমরা দয়া ক’রে হালের দিকে এখন যেও না। আমাদের দেবতা খাবেন এখন?

জলে মাথা ভাসিয়ে থাকা ফ্রান্সিস মনে মনে হ্যারিকে বার বার ধন্যবাদ জানাল। সত্যি ওর তখন ভীষণ ক্ষিদে পেয়েছিল। মনে মনে হ্যারির বুদ্ধিরও প্রশংসা করল। একটু অপেক্ষা করে ফ্রান্সিস ঝোলানো দড়ি ধরে ধরে কাঠের খাঁজে পা রেখে রেখে জাহাজে উঠে এলো। উবু হয়ে বসে দ্রুত খেতে লাগল। খাওয়া শেষ হলে জল খেয়ে ফ্রান্সিস দ্রুত দড়ি ধরে হালের খাঁজ বেয়ে বেয়ে জলে নেমে এলো। এখন রাতের জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া আর কিছু করার নেই।

ওদিকে এনরিকোর সৈন্যদের সঙ্গে ছাউনির বোনিফেসের সৈন্যদের সঙ্গে তুমুল লড়াই শেষ হবার মুখে। বোনিফেসের সৈন্যরা বীরের মতো লড়াই করল। কিন্তু এনরিকোর সৈন্যদের কাছে ওরা শেষ পর্যন্ত হার স্বীকার করতে বাধ্য হ’ল। যুদ্ধক্ষেত্রে অবশেষে নিস্তব্ধতা নেমে এলো। তখন সূর্য অস্ত যেতে বেশি দেরি নেই।

রণক্লান্ত এনরিকোর সৈন্যরা যুদ্ধক্ষেত্রের এখানে-ওখানে শুয়ে পড়ল। বিশ্রাম করতে লাগল। কিন্তু ক্লান্তি নেই দলপতির। সে যুদ্ধক্ষেত্রে ঘুরে ঘুরে সব সৈন্যদের অভিনন্দন জানাতে লাগল। সে স্থানীয় কিছু লোকজন ধরে নিয়ে এলো। ঐ যুদ্ধক্ষেত্রেই পাথর পেতে উনুন বসানো হ’ল। বস্তায় করে ময়দা আনাহ’ল আর ভেড়ার মাংস রান্না চলল।

সন্ধের পরেই রান্না শেষ হ’ল। সব সৈন্যরা খাওয়া-দাওয়া শেষ করে বেনিফেসের সৈন্যদের ছাউনিতেই শুয়ে পড়ল। সৈন্যদের দলপতি শুধু সমুদ্রতীরে এলো। নিজেদের জাহাজে রইল। আরো তিন চারজন সৈন্য জাহাজের পাহারায় আগেই ছিল।

রাত বাড়ছে। জলের মধ্যে শুধু মাথাটা তুলে ফ্রান্সিস অপেক্ষা করছে। কিন্তু তখনও ভেবে পাচ্ছে না কী করে বন্ধুদের মুক্ত করবে। কী করে সবাইকে নিয়ে জাহাজে চড়ে পালাবে।

রাজকুমারী মারিয়া রাতের রান্নাও রাঁধল। খুবই কষ্ট হ’ল মারিয়ার। এত লোকের রান্না সহজ কথা না। কিন্তু মারিয়া মুখ বুজে এই কষ্ট মেনে নিল। ওর মনে শুধু এক চিন্তা ফ্রান্সিস মুক্ত আছে। ও নিশ্চয়ই ওদের মুক্তির ব্যবস্থা করবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পারবে কি? যদি ওদের মুক্তি করতে গিয়ে ফ্রান্সিস নিজে ধরা পড়ে যায় তাহলে তো সর্বনাশ। মারিয়া এবার ডেক-এ উঠে এলো। গলা চড়িয়ে বলল রান্না হয়ে গেছে। খেতে এসোসবাই।

আবার চারজন চারজন করে ভাইকিং বন্ধুরা খাবার ঘরে গিয়ে খেয়ে আসতে লাগল। শেষ চারজনের মধ্যে হ্যারি গেল দুপুরের মতোই দেবতাকে উৎসর্গ করবে বলে খাদ্য জল নিয়ে জাহাজের পেছনে হালের কাছে। দেখল এঁটো থালা গ্লাস রয়েছে। হ্যারি ভীষণ খুশি হ’ল। ফ্রান্সিস তাহলে কাছাকাছি আছে। সঙ্গের পাহারাদার সৈন্যটি এসবের কিছুই বুঝল না। ডেক-এর কাঠের মেঝেয় খাবার জল রেখে দু’হাত ওপরে তুলে বলল—হে দেবতা—আপনি খাদ্য জল গ্রহণ করেছেন এই জন্যে আমরা কৃতার্থ হয়েছি। আবার রাত্রির আহার রেখে গেলাম, গ্রহণ করে আমাদের কৃতার্থ বরুন। হাত নামিয়ে হ্যারি ফিরে চলল। সৈন্যটিও ওর পেছনে পেছনে চলল।

খেতে বসে হ্যারি দেখল মারিয়া একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছে। মারিয়াই পরিবেশন করছে। অপেক্ষা করছে কে কী খেতে চায় তার জন্যে। হ্যারি মারিয়াকে বলল-রাজকুমারী একটু জল দিন। মারিয়া তাড়াতাড়ি এনামেলের জগটা নিয়ে এগিয়ে এলো। মারিয়া গ্লাসে জল ঢালছে তখনই হ্যারি মৃদুস্বরে বলল-দেবতা খাবার খেয়েছে। জাহাজের হালের কাছেই কোথাও আছে। আনন্দে মারিয়ার মন নেচে উঠল। কিন্তু এই আনন্দ সে বাইরে প্রকাশ পেতে দিল না।

খাওয়া-দাওয়া শেষ হ’ল। আবার ভাইকিংদের হাত বেঁধে ফেলা হ’ল। সবাইকে আগের জায়াগায় বসিয়ে রাখা হ’ল।

রাত বাড়ল। অনেকেই হাত বাঁধা অবস্থাতেই শুয়ে পড়ল। কেউ কেউ ঘুমিয়ে পড়ল।

ওদিকে ফ্রান্সিস আস্তে আস্তে জল থেকে উঠে এলো। হালের গায়ে খাঁজে খাঁজে পা রেখে ডেক-এ উঠে এলো। দ্রুত খাবার খেয়ে জল খেয়ে ও আবার হাল বেয়ে সমুদ্রের জলের দিকে নামতে লাগল।

আজ আকাশ অনেক পরিষ্কার। কুয়াশা অনেক পাতলা। চাঁদের আলোও উজ্জ্বল। ফ্রান্সিস হালের খাঁজে দাঁড়িয়ে একবার এনরিকোর সেনাদের যুদ্ধে জাহাজটার দিকে তাকাল। দু’জন সৈন্য জাহাজের ডেক-এ পাহারা দিচ্ছে দেখল। ডেক-এ আর কেউ নেই। হঠাৎ ফ্রান্সিসের নজর পড়ল জাহাজের সামনের দিকে। সেই জাহাজের কালো কাঠের নীচের দিকে। অনেকটা কাঠের চটা উঠে গিয়ে সাদাটে কাঠ দেখা যাচ্ছে। বোঝাই যাচ্ছে অন্য কোনো জাহাজের সঙ্গে ধাক্কা লেগেছিল। আচ্ছা তখন যদি সবটা খুলে উঠে আসতো তাহলে তো হুড় হুড় করে সমুদ্রের জল ঢুকে জাহাজটা ডুবেই যেত।

এই কথাটা ভাবতে ভাবতে হঠাৎ ফ্রান্সিসের মাথায় একটা কথা এসে ধাক্কা দিল—জাহাজটিকে ঐ জায়াগায় ফুটো করতে পারলে আধ ঘন্টার মধ্যেই ডুবে যাবে। ফ্রান্সিস কথাটা ভাবতে ভাবতে দ্রুত জলে নেমে এলো। সাবধান হতে হবে। কিছুতেই সৈন্যদের নজরে পড়া চলবে না। ফ্রান্সিস গলা জলে ডুবে থেকে ভাবতে লাগল এখন একটা করাত চাই। হাতুড়ি বাটালি হলেও চলবে। কিন্তু সেসব তো ওদের জাহাজের কেবিন ঘরগুলোর শেষে এক কোণায় একটা কাঠের বড় বাক্সে রয়েছে। যে করেই হোক ঐ যন্ত্রগুলো আনতে হবে। ফ্রান্সিস অস্থির হয়ে পড়ল। আনতেই হবে ওগুলো। ভাবতে লাগল কীভাবে আনা যায়।

ফ্রান্সিস আবার জল থেকে উঠে এলো। ডেক-এর ওপর শুয়ে পড়ল। বুক হিঁচড়ে হিঁচড়ে গিয়ে মাস্তুলের পেছনে এলো। দেখল চারজন সৈন্য তলোয়ার হাতে বন্দি বন্ধুদের পাহারা দিচ্ছে। ঐ সৈন্যদের চোখকে ফাঁকি দেওয়া যাবে না; রাতও অন্ধকার নয়। চাঁদের আলো উজ্জ্বল। ধরা পড়তে হবে। তখন মুক্তির শেষ আশাটাও থাকবে না। ফ্রান্সিস আবার হালের কাঠের খাঁজে পা রেখে রেখে জলে নেমে এলো। অপেক্ষা করতে লাগল যদি হ্যারি আবার আসে।

ওদিকে মারিয়া বন্ধ কেবিনঘরে কাঠের মেঝেয় পাইচারি করছে। দ্রুত ভাবছে কী করে ফ্রান্সিসের খোঁজ পাওয়া যায়। কী করে ওর সঙ্গে কথা বলা যায়। হঠাৎ মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেল। মারিয়া সঙ্গে সঙ্গে কেবিনঘরের দরজা খুলে বাইরে এলো। পাহারাদার সৈন্যটা দেবগোড়ায় মেঝেয় বসে ঝিমোচ্ছিল। দরজা খোলার শব্দ শুনে তড়িঘড়ি উঠে দাঁড়াল। হাতে তলোয়ার তুলে নিল। মারিয়া সোজা ডেকে-এ ওঠার সিঁড়ির দিকে চলল। এবার আর পাহারাদার বাধা দিল না। মারিয়ার পেছনে পেছনে চলল।

ডেক-এ উঠে মারিয়া চলল বন্দি ভাইকিংদের কাছে। পেছনে পাহারাদার সৈন্যটিও চলল। হ্যারি বাঁধা হাত দুটো মাথায় দিয়ে শুয়ে ছিল। ঘুম আসছে না। কীভাবে মুক্তি পাবে। ফ্রান্সিস কীভাবে ওদের বন্দিদশা ঘোচাবে। এসব সাত-পাঁচ ভাবছিল। মারিয়া কাছে এসে দাঁড়াতে হ্যারি উঠে বসল। ঠিক বুঝল না রাজকুমারী কেন ওর কাছে এসেছে। মারিয়া বলল—হ্যারি—এই গর্দভ পাহারাদারটাকে বলো তো আমি কেবিনঘরে ঘুমুতে পারছি না। ভীষণ গরম লাগছে। আমি হালের ওখানে ডেকে এ শোবো। ঘুমুবো। হ্যারি পাহারাদারের দিকে তাকাল। মারিয়ার কথাগুলো বুঝিয়ে ভাঙা ভাঙা গ্রীক ভাষায় বলল। পাহারাদার মাথা নেড়ে বলল—যদি জলে ঝাঁপ দিয়ে পালিয়ে যায়।

—রাজকুমারী ঠিকই বলেছেন—তুমি একটা নিরেট গর্দভ। হ্যারি বলল। পাহারাদার কথাটা শুনে লাফিয়ে উঠল। তলোয়ার তুলল। হ্যারি বিন্দুমাত্র বিচলিত না হয়ে বলল

—মাথা ঠাণ্ডা করে শোনা। রাজকুমারী যদি জলে ঝাঁপ দিয়ে পালানও-কোথায় পালাবেন? গ্রামভাউসা এখন তোমাদের দখলে। ওখানে লুকোতে পারবেন না। আর রইলো সামনের ঐ সমুদ্র। একজন স্ত্রীলোক সাঁতরে ঐ সমুদ্র পার হতে পারবে? বলো—। হ্যারি আস্তে আস্তে বলল। পাহারাদার এবার একটু ভাবল। অন্য পাহারাদারদের কাছে গেল। বোধহয় পরামর্শ চাইতে। ওদের সঙ্গে কথা বলে পাহারাদার ফিরে এলো। বলল উনি ওখানে ঘুমুতে পারেন কিন্তু আমি পাহারায় থাকবো। হ্যারি মারিয়াকে সেকথা বললো। মারিয়া বলল—ঐ গর্দভকে বলো ঘুমোবার সময় ও আমার নাকের ডগায় ঘুরে বেড়াতে পারবেনা। তাহলে আমি ঘুমুতেই পারবো না। ওকে মাস্তুলের আড়ালে থাকতে হবে। হ্যারি পাহারাদারকে বলল সেকথা। পাহারাদরটা একটু ভাবল। তারপর মাথা ঝাঁকিয়ে বলল—ঠিক আছে। হ্যারি বলল—রাজকুমারীও রাজি হয়েছে। যান শুয়ে পড়ুন তো।

মারিয়া চলল জাহাজের হালের দিকে। পেছনে সেই পাহারাদারটি। মাস্তুলের কাছে এসে মারিয়া পাহারাদারটিকে ইঙ্গিতে ওখানে দাঁড়াতে বলল। পাহারাদারটি কোনো আপত্তি করল না। মাস্তুলের আড়ালেই দাঁড়াল।

মারিয়া হালের কাছে এসে দেখল এঁটো থালা মগ পড়ে আছে। ও বুঝল ফ্রান্সিস কাছেই কোথাও আছে। মারিয়া সঙ্গে সঙ্গে বলতে লাগল—আমাদের দেবতা—আপনি খুশি মনে আমাদের দেওয়া খাদ্য জল গ্রহণ করেছেন। আমরা আনন্দিত। এবার বলুন আর কীভাবে আমরা আপনাকে খুশি করতে পারি? ফ্রান্সিস জলে ডুবে মারিয়ার কথাগুলো শুনল। খুশিতে ওর মন নেচে উঠল। এই সুযোগ। ও ভাবল—কিন্তু মারিয়ার কাছেই যদি কোনো পাহারাদার সৈন্য থাকে তাহলে তো ডেক-এ ওর সঙ্গে কথা বলা যাবে না। উল্টে ধরা পড়তে হবে। ফ্রান্সিস অপেক্ষা করতে লাগল মারিয়া আর কী বলে শোনার জন্যে।

তখনই মারিয়ার ফিসফিস করে বলা কথাটা ওর কানে গেল—এসো—কেউ নেই। ফ্রান্সিস আর দেরি করল না। দড়ি বেয়ে উঠে এলো। ততক্ষণে মারিয়াও ডেক-এর ধারে ঝুঁকে ফ্রান্সিসকে দেখতে পেয়েছে।

ফ্রান্সিস সবটা দড়ি বেয়ে উঠল না। ওপরে তাকিয়ে মারিয়ার ঝুঁকে-পড়া মুখ দেখল। খুব গলা চেপে ফ্রান্সিস বলল—হাতুড়ি বাটালি ছোটো করাত। কথা কটা বলেই ফ্রান্সিস দ্রুত দড়ি বেয়ে জলে নেমে গেল। তারপরই ডুব দিয়ে রইল। যতটা সম্ভব দম চেপে ডুব দিয়ে রইল। তারপর আস্তে আস্তে মাথা তুলল দেখল মারিয়া চলে গেছে। যাক—ওর কথা পাহারাদার সৈন্যরা শুনতে পায়নি।

ওদিকে মারিয়া দ্রুত হাতে এঁটো থালা জলের মগ হাতে তুলে নিল। সেসব নিয়ে বেশ দ্রুত চলল ডেক দিয়ে। দেখল পাহারাদারটি মাস্তুলের ধারে দাঁড়িয়ে আছে। মারিয়া ওকে এঁটো থালা মগ ইঙ্গিতে দেখাল। ওকে এখানে দাঁড়িয়ে থাকতে ইঙ্গিত করল। পাহারাদার আর ওর পেছনে পেছনে এলো না।

মারিয়া সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমেই এটো থালা গ্লাস দ্রুত নামিয়ে রাখল। নিজের কেবিনঘরে ঢুকল। একটা মোটা কম্বল মতো কাপড় গায়ে জড়াল। মোমবাতি জ্বালল। মোমবাতি নিয়ে চলল কেবিন ঘরগুলির পরে যেখানে একটা লম্বাটে কাঠের বাক্স জাহাজ মোরামতির যন্ত্রপাতি থাকে সেদিকে। ছুটতে পারছেনা যদি মোমবাতি নিভে যায়। তখনই একটা দকা হাওয়া বইল। মোমবাতির শিখা নিভু নিভু হ’ল। মারিয়া হাতের চেটোয় সঙ্গে সঙ্গে শিখা আড়াল করল। মোমবাতি নিভল না।

কোনোরকম শব্দ না করে মারিয়া বাক্সের ডালাটা আস্তে আস্তে খুলল। মোমবাতির আলোয় খুঁজতে লাগল হাতুড়ি বাটালি আর করাত। একটু খোঁজাখুঁজি করেই পেয়ে গেল সেসব। তিনটে জিনিসই গায়ের মোটা চাদরের আড়ালে লুকিয়ে নিয়ে চলল সিঁড়ির দিকে। জোরে ছুটল এবার। বেশি দেরি হ’লে পাহারাদারটির সন্দেহ হতে পারে। মোমবাতি নিভে গেল। মারিয়া মোমবাতি ফেলে দিল।

সিঁড়ি বেয়ে ডেকে-এ উঠে এলো। এবার আস্তে আস্তে হালের দিকে চলল। পাহারাদারটি বুঝল গায়ে দেবার কাপড় আনতে গিয়েছিল মারিয়া!

মারিয়া সেই জায়গায় এলো। মোট চাদরটা পেতে শুয়ে পড়ল। পাহারাদারটি ও পর্যন্ত দেখল। তারপর মাস্তুলের আড়ালে চলে গেল।

কিছুক্ষণ পরে মারিয়া আস্তে আস্তে উঠল। চারপাশ দেখে নিল। না—কেউ নেই। হালের কাছে গেল। যে দড়িটা ধরে ফ্রান্সিস ঝুলছিল সেই দড়িটা ধরে দু’বার হ্যাঁচকা টান দিল। ফ্রান্সিস সঙ্গে সঙ্গে বুঝল মারিয়া এসেছে। ও আস্তে আস্তে দড়ি বেয়ে হালের মাথাটার কাছে এলো। মারিয়া হাতুড়ি বাটালি করাত হাত বাড়িয়ে ধরল। ফ্রান্সিস তাড়াতাড়ি সেসব নিয়ে দড়ি বেয়ে নেমে এলো। মারিয়া পাতা চাদরে এসে শুয়ে পড়ল। মারিয়া ভালো করেই জানে আজকে ঘুম আসবে না। তবু যেন ঘুমিয়ে আছে এরকম ভঙ্গীতে চোখ বুজে চুপচাপ শুয়ে রইল।

এবার ফ্রান্সিস ছোটো করাতটা কোমরে গুঁজল। হাতুড়ি বাটালি ঢোলা জামার বুকের কাছ দিয়ে ঢুকিয়ে রাখল। কোমরে চামড়ার বন্ধনী বাঁধা। হাতুড়ি বাটালি পেটের কাছে আটকে রইল।

ফ্রান্সিস একটু দম নিল। বেশ পরিশ্রান্ত মনে হচ্ছে নিজেকে। সেই ভোর রাত থেকে এতক্ষণ জলে ডুবে আছে। শরীর দুর্বল লাগা স্বাভাবিক। তবু দু’বার খেতে পেয়েছে বলে এখনও শরীরটা ঠিক আছে।

একটু বিশ্রাম নিল ফ্রান্সিস আস্তে আস্তে সাঁতার না কেটে জলে কোনোরকম শব্দ না তুলে এগিয়ে চলল, এনরিকোর, সৈন্যদের যুদ্ধ জাহাজের দিকে। চাঁদের একটু উজ্জ্বল আলোয় দেখল জাহাজটার সামনের দিকে চটলা-ওঠা জায়গাটা এদিকেই। একটু এগিয়ে দেখল ঐ জাহাজের একজন পাহারাদার সৈন্য রেলিঙে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ফ্রান্সিস সঙ্গে সঙ্গে ডুব দিল। ডুব সাঁতার দিয়ে ঠিক সেই চটলা-ওঠা জায়গাটার কাছে আস্তে আস্তে ভেসে উঠল। ওপরের দিকে তাকিয়ে বুঝল জাহাজের রেলিঙে একেবারে ঝুঁকেনা পড়লে সৈন্যটি ওকে দেখতে পাবে না।

ফ্রান্সিস চলা-ওঠা জায়গাটায় হাত দিয়ে দেখল কাঠের চটুলা বেশ কিছুটা উঠেছে। তবু এত শক্ত কাঠের জাহাজের খোলা ফুটো করা কম পরিশ্রমের কাজ নয়। অথচ আজকের বাকি রাতের মধ্যে এ কাজ সারতেই হবে। এখন সমস্যা হ’ল বাটালির মাথায় হাতুড়ি মারলে বেশ শব্দ হবে। নিঃশব্দে কীভাবে কাজ সারা যায়। ও ভেবে দেখল যদি জলের একটু নীচে চটলা-ওঠা জায়গাটায় বাটালি বসিয়ে জলের মধ্যে দিয়ে হাতুড়ি দিয়ে ঘা দেওয়া যায় তাহলে অল্প শব্দই হবে। কিন্তু হলেও সে শব্দ বাইরে শোনা যাবে না।

ফ্রান্সিস হাত দিয়ে দেখে চট্রলা-ওঠা খোলার জায়গা বেছে নিল। এখানটায় চটুলা ঘেশ উঠেছে। এবার সেখানে বাটালিটা বসিয়ে জলের মধ্যে দিয়ে হাতুড়ি চালাল। বাটালির মাথায় হাতুড়ির ঘা লাগল বটে শব্দও তেমন হ’ল না। কিন্তু জলের মধ্যে দিয়ে হাতুড়ি চালানোয় ঘা-টা তেমন জোরে হ’ল না। জলের মধ্যে জিনিসের ওজন কমে যায়। তার ওপর জলের বাধা এর সঙ্গে রয়েছে জলের ওপর শরীর ভাসিয়ে রাখার সমস্যা। কাজেই ফ্রান্সিসকে দম নিয়ে নিয়ে দফায় দফায় হাতুড়ি চালাতে হ’ল।

প্রায় একঘন্টার ওপর এভাবে হাতুড়ি চালাল ফ্রান্সিস ক্লান্তিতে ফ্রান্সিসের শরীর ভেঙে আসছে। অথচ থামবার উপায় নেই। অন্ধকার থাকতে থাকতে এ কাজ সারতে হবে।

আবার আধঘন্টামতো ফ্রান্সিস হাতুড়ি চালাল। এবার ঐ জায়গাটায় হাত দিয়ে দেখল প্রায় এক আঙ্গুল মতো ফুটো হয়েছে। এবার হাতুড়ি বাটালি কোমরে গুঁজল। বের করল করাতটা। করাতটা ছোটো। মাথাটা সরু। সুবধেই হ’ল। এবার ঐ কাটা জায়গাটায় করাত বসিয়ে ফ্রান্সিস করাত ঘষতে লাগল। প্রথমে করাতটা ভালো চলছিল না। আস্তে আস্তে করাতের চলাটা সহজ হ’ল। কাঠ কেটে যেতে লাগল। জলের মধ্য করাত কাট কাটাছে। বেশি শব্দ বাইরে এলো না। ফ্রান্সিসের হাত ধরে আসছে। ও জোরে জোরে শ্বাস ফেলছে। শরীরে যেন কোনো সাড় নেই।

হঠাৎ পাথুরে ভাঙার দিকে একটা পাখি ডেকে উঠল। ফ্রান্সিস চমকে উঠল। করাত চালানো থামিয়ে আকাশের দিকে তাকাল। আকাশ পরিষ্কার হয়ে আসছে। চাঁদের আলো অনেক ম্লান হ’য়ে গেছে। পূর্বদিকে তাকাল। ধোঁয়াটে কুয়াশার মধ্যে দিয়ে একটুলাল আভামতো।

ফ্রান্সিস শরীরের সমস্ত শক্তি নিয়ে জোরে করাত চালাতে লাগল। হঠাৎ সমস্ত করাতের মাথাটাই ঢুকে গেল। আনন্দে ফ্রান্সিস জলের মধ্যেই একটা ডিগবাজি খেল। কাটা জায়গাটায় হাত দিয়ে দেখল। জোরে জল ঢুকছে।

ফ্রান্সিস হাতুড়ি বাটালি বের করল। করাতটাও খুলে নিল। সব ফেলে দিল। তারপর পা দিয়ে জল টেনে টেনে আস্তে আস্তে এগিয়ে চলল ওদের জাহাজের দিকে। এখন রেলিঙে কেউ দাঁড়িয়ে নেই। ওকে দেখতে পাবে না।

ওদের জাহাজের কাছে পৌঁছল ওহালের খাঁজে পা রেখে রেখে একটু উঠল। তারপর হালটায় হেলান দিয়ে হাঁপাতে লাগল।

একটু বিশ্রাম নিয়ে ফ্রান্সিস হালের মাথার কাছে উঠে এলো। উঁকি দিয়ে দেখল মারিয়া ঘুমিয়ে আছে। ফ্রান্সিস ফিসফিস করে ডাকল—মারিয়া। মারিয়া সারারাতই জেগে ছিল। এখন একটু তন্দ্রামতো এসেছিল। ফ্রান্সিসের ডাক কানে যেতেই তড়াক করে লাফিয়ে উঠল। হামাগুড়ি দিয়ে ফ্রান্সিসের কাছে এলো। ফ্রান্সিস ফিসফিস করে বলল—এনরিকোর জাহাজ ফুটো—ডুববে শাঙ্কো—ছোরা-দড়ি কাটা ভোরের আগে মুক্তি। খুব দ্রুত কথাগুলি বলে ফ্রান্সিস নেমে এলো।

মারিয়া উঠে পড়ল। আস্তে আস্তে হেঁটে চলল ভাইকিং বন্দিদের দিকে। ওর পাহারাদার মাস্তুলে হেলান দিয়ে ঝিমুচ্ছিল। মারিয়া মুক শব্দ করল—স্। পাহারাদার হকচকিয়ে উঠে দেখে সামনে মারিয়া। মারিয়া ইঙ্গিতে ওকে দাঁড়িয়ে থাকতে বলল। চলল ভাইকিং বন্দিদের দিকে। আর পাহারাদার ওকে দেখল শুধু। কিছু বলল না। বাধাও দিল না।

হ্যারি শুয়ে ছিল। চোখ বুজে। সারারাত ঘুমোয়নি। পাতলা অন্ধকারের দিকে তাকাল এবার। ভোর হতে বেশি দেরি নেই। তখন দেখল মারিয়া ওর দিকেই আসছে। হ্যারি উঠে বসল। মারিয়া ওর কাছে এলো। হ্যারির দিকে তাকাল। কিন্তু কিছুই বলল না। রেলিঙের কাছে গিয়ে দাঁড়াল। তারপর আস্তেআস্তে বলল—দেবতা এসেছিল। ওদের জাহাজ ফুটো করেছে কিছুক্ষণের মধ্যেই ডুববে। শাঙ্কোর ছুরি। হাতের দড়ি কাটো। মুক্তি। কথা ক’টা বলে মারিয়া যেমন আস্তে আস্তে এসেছিল তেমনি আস্তে আস্তে চলে গেল।

হ্যারির মন খুশিতে ভরে উঠল। কিন্তু ও বাইরে সেটা প্রকাশ পেতে দিল না। হ্যারি ফিসফিস করে ডাকল—শাঙ্কো। শাঙ্কোর ঘুম ভাঙল না। হ্যারি পা বাড়িয়ে শাঙ্কোর পায়ে দু’তিনটে ধাক্কা দিল। সতর্ক শাঙ্কোর সঙ্গে সঙ্গে ঘুম ভেঙে গেল। ও আস্তে আস্তে উঠে বসল। হ্যারি মৃদুস্বরে বলল—এনরিকোর জাহাজের খোল কেটেছে ফ্রান্সিস কিছুক্ষণের মধ্যেই ঐ জাহাজ ডুববে। ছুরি বের করো। দড়ি কাটো। প্রয়োজনে লড়াই। শাঙ্কো একথা শুনে লাফিয়ে উঠতে গেল। পরক্ষণেই সাবধান হ’ল। ও হ্যারির দিকে সরে এসে শুয়ে পড়ল। হ্যারি শাঙ্কোর বুকের কাছে ঢিলে জামার মধ্যে হাত চালিয়ে ছুরিটা বের করল। শাঙ্কো ঐ ভীষণ ধারালো ছুরিটা সবসময় হাতের কাছে রাখে। ঘুমোবার সময়ও রাখে। বিপদ বুঝলেই ছুরিটা ঢোলা জামার নীচে চালান করে দেয়।

এবার শাঙ্কো খুব আস্তে আস্তে দড়ি বাঁধা হাত দুটো হ্যারির দিকে এগিয়ে ধরল। শুয়ে শুয়েই। হ্যারি দু’হাত দিয়ে ছুরিটা ধরে শাঙ্কোর হাতের দড়ি ঘষে ঘষে কাটতে লাগল। দু’জনই শুয়ে আছে আর অন্ধকারও সবটা কেটে যায়নি। পাহারাদার বুঝতেই পারল না। শাঙ্কোর হাতের দড়ি কেটে গেল। ও ছুরিটা নিয়ে আস্তে আস্তে ডেক-এর পাটাতনে একটু হিঁচড়ে গিয়ে বিস্কোর হাতের বাঁধন কেটে দিল। এবার বিস্কো ছুরিটা নিল। পাশের ভাইকিং-এর দড়ি কাটল। আস্তে আস্তে ছুরি একে ওকে চালান দিয়ে সবার দড়িই কাটা হয়ে গেল। সবশেষে কাটা হ’ল হ্যারির হাতের দড়ি।

আকাশ অনেক পরিষ্কার হয়ে গেছে। পুৰ আকাশ গভীর লাল। সূর্য উঠতে দেরি নেই। হঠাৎ একজন পাহারাদার দেখল ওদের জাহাজ জলে অনেকটা নেমে গেছে। ও প্রথমে কিছুই বুঝতে পারল না। পরক্ষণেই বুঝল ওদের জাহাজ ডুবছে। ও চিৎকার করে আর সব পাহারাদারদের ডাকল। সকলেই রেলিঙের ধারে ছুটে এলো। ও চিৎকার করে বোধহয় দলপতিকে ডাকতে লাগল।

চিৎকার ডাকাডাকিতে দলপতির ঘুম ভেঙে গেল। সে তাড়াতাড়ি বিছানা থেকে মেঝেয় পা ফেলে উঠতে গেল। দেখে চমকে উঠল, যে ওর পাহাঁটু জলে ডুবে গেছে। ও ভীষণভাবে চমকে উঠল—জাহাজ ডুবছে। ও জল ঠেলে ছুটল কেবিন ঘরের দরজার দিকে। তখনই মড়মড় শব্দ তুলে জাহাজটা ডানপাশে কাত হ’ল। কাত হতেই থাকল। দলপতি সিঁড়ি দিয়ে ডেক-এ উঠতে গিয়ে ছিটকে কোমর সমান জলে গিয়ে পড়ল। আস্তে আস্তে জাহাজের মধ্যে জল বাড়তে লাগল। ডুবন্ত জাহাজের পাহারাদাররা আর দলপতির খোঁজ করতে নীচে নামল না। ছুটে গেল পাতা পাটাতনের দিকে। পাটাতন তখন তীরভূমি থেকে ছিটকে গিয়ে জলে ভাসছে। সৈন্যরা জলে ঝাঁপিয়ে পড়ল। সাঁতরে তীরের দিকে চলল।

ফ্রান্সিসদের জাহাজ তখন বন্ধনমুক্ত ভাইকিংরা উঠে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে উঠল—ও-হো-হো-হো। তারপর ছুটল হাতের কাছে যা পায় তাই জোগাড় করতে। ভাঙা দাঁড়ের কাঠ, শেকল, বড়ো বড়ো, পেরেক, লম্বা লোহার ডাণ্ডা যে যা পেল তাই নিয়ে পাহারাদার সৈন্যদের দিকে এগিয়ে চলল। পাহারাদার সৈন্যরা হাঁ করে তাকিয়ে রইল। তারপর তলোয়ার উঁচিয়ে ছুটে এল। ভাইকিংরা চিৎকার করে একসঙ্গে ওদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। তলোয়ার ঘায়ে দু’একজন আহত হ’ল—কিন্তু—পাহারাদারদের কয়েকজনের হাত থেকে তলোয়ার ছিটকে গেল। হ্যারি চিৎকার করে বলল—কাউকে মেরো না। জলে ছুঁড়ে ফেলে দাও।

ভাইকিং বন্ধুদের চিৎকার কানে যেতেই ফ্রান্সিস বুঝল ওর পরিকল্পনামতোই কাজ হয়েছে। তখন ও আস্তে আস্তে হালের কাঠের খাঁজে খাঁজে পা রেখে ওপরে উঠতে লাগল। কিন্তু শরীর আর চলছে না। ও ওপরের দিকে তাকাল। দেখল মারিয়া হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। ও অনেক কষ্টে আরো দু’ ধাপ উঠল। হাত বাড়িয়ে মারিয়ার হাত ধরল। মারিয়া কিআর ওকে টেনে তুলতে পারে?হয়ত টেনে একটু সাহায্য করা মাত্র। মারিয়ার হাত ধরে ধরে অনেক কষ্টে জাহাজে উঠেই ডেক-এর ওপর চিৎহয়ে পড়ে গেল। ফ্রান্সিসের সারা শরীর ভেজা সপসপে মাথার ভেজা চুল কপালে এসে পড়েছে। মুখ সাদা হয়ে গেছে। দু’হাত থেকে রক্ত ঝরছে। হাতুড়ি বাটালি চালাতে গিয়ে করাত ঘষতে গিয়ে ওর হাত কেটে গেছে। আঙুলে কালসিটে দাগ পড়ে গেছে। ফ্রান্সিস মড়ার মতো চোখ বুজে পড়ে রইল। ফ্রান্সিসের এই অবস্থা দেখে মারিয়া ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। ফ্রান্সিস আস্তে আস্তে চোখের পাতা খুলল। ম্লান হেসে বলল কাঁদছো কেন? এই কথা শুনে মারিয়ার কান্না বেড়ে গেল। ফ্রান্সিস খুব ক্ষীণস্বরে বলল—শিগগির জাহাজ ছাড়তে বলো। তারপর চোখ বুঝল।

মারিয়া এক ঝটকায় উঠে দাঁড়াল। ছুটল ভাইকিং বন্ধুদের খবর দিতে। ওদিকে তখন পাহারাদার সৈন্য সবাইকে ভাইকিংরা জলে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে। ওরা সমুদ্রতীরের দিকে সাঁতরে চলেছে। এনরিকোর সৈন্যদের যুদ্ধজাহাজের মাস্তুলটা তখন দেখা যাচ্ছে। বাকি সবটাই জলের নীচে।

মারিয়া ডেক-এ এসে চিৎকার করে বলল—ভাইসব ফ্রান্সিস এসেছে। হালের কাছে শুয়ে আছে। একটু অসুস্থ। ও বলল—শিগগির জাহাজ ছাড়ো। সব ভাইকিংরা আনন্দে চিৎকার করে উঠল—ও—হো—হো—হো। তারপর ছুটল ফ্রান্সিসকে দেখতে।

ফ্রান্সিসকে ও-রকম মড়ার মতো চোখ বুজে শুয়ে থাকতে দেখে বন্ধুদের ভীষণ মন খারাপ হয়ে গেল। হ্যারি গলা চড়িয়ে চিৎকার করে উঠল—এখন একমুহূর্ত সময় নষ্ট করা চলবে না। দাঁড়িরা দাঁড়ঘরে চলে যাও। পাল তুলে দাও। জাহাজ চালাও যত দ্রুত সম্ভব। কয়েকজন ফ্রান্সিসকে কেবিনঘরে নিয়ে যাও। ফ্রান্সিসের সেবা শুশ্রূষার ব্যাপারে রাজকুমারী মারিয়াকে সাহায্য করো। যাও—জলদি। দুতিন জন গিয়ে তীরের সঙ্গে লাগানো পাটাতন তুলে ফেলল। ফ্রান্সিসকে কাঁধে নিয়ে চলল কয়েকজন। কেবিনঘরে এনে শুইয়ে দিল। দাঁড়িরা ছুটল দাঁড়ঘরের দিকে। পাল খাটানো হ’ল দ্রুত হাতে। নজরদার পেড্রো মাস্তুলের মাথায় নিজের জায়গায় উঠে গেল। জলে দাঁড় পড়তে লাগল—ছপ—ছপ। জাহাজ চলল বাইরের সমুদ্রের দিকে।

তখন উজ্জ্বল রোদ ছড়িয়ে পড়েছে সমুদ্রের বুকে। রোদ ঝিকিয়ে উঠেছে ঢেউয়ের মাথায়। আস্তে আস্তে গ্রামভাউসা বন্দর দূরে মিলিয়ে গেল।

ফ্রান্সিসকে ভেজা পোশাক পাল্টে শুকনো পোশাক পরানো হয়েছে। জাহাজের বদ্যি এসে ফ্রান্সিসের ক্ষত-বিক্ষত দু’হাতে হলুদ রঙের মলম লাগিয়ে দিয়ে গেছে। ফ্রান্সিসের জ্বালা ব্যথা কমছে তাতে। মারিয়া চামড়ার ব্যাগ-এ গরম জল ভরে নিয়ে ফ্রান্সিসের পায়ে গায়ে সেঁক দিতে লাগল। এর মধ্যে রসুইঘরে রাঁধুনি শুধু ফ্রান্সিসের জন্যে মাংস রুটি তৈরি করে ফেলল। থালায় করে নিয়ে এলো ফ্রান্সিসের কেবিনঘরে। মারিয়া ফ্রান্সিসকে ধরে আস্তে আস্তে বিছানায় বসিয়ে দিল। ফ্রান্সিস নিজেই গরম গরম রুটি মাংস খেতে লাগল। খাওয়া শেষ করে জল খেল। তারপর শুয়ে পড়ল। এতক্ষণে ফ্রান্সিসের শরীরে যেন সাড় এলো। ও চুপ করে শুয়ে রইল।

প্রায় ঘণ্টাখানেক জাহাজ চলল। এতক্ষণ হ্যারি জাহাজ-চালকের পাশেই দড়িয়ে রইল। একবার মাত্র গিয়েছিল ফ্রান্সিসকে দেখতে। তখনও ফ্রান্সিস চোখ বুজে শুয়ে আছে।

বিস্কো এসে হ্যারিকে বলল—ফ্রান্সিস এখন অনেকটা সুস্থ। হ্যারি তাড়াতাড়ি ফ্রান্সিসের কেবিনঘরে এলো। দেখল ফ্রান্সিস বিছানায় বসে আস্তে আস্তে দু’-একটা কথা বলছে। হ্যারি এগিয়ে এলো। বিছানায় বসল। ফ্রান্সিসের দিকেতাকাল। তারপর ফ্রান্সিসকেদু’হাত জড়িয়ে ধরল। হ্যারির সারা শরীর থর থর করে আবেগে কাঁপছে। চোখের কোল ভিজে উঠেছে। ফ্রান্সিস দুর্বল কণ্ঠে বলল—অ্যাই—তুমিও কিমারিয়ার মতো কাঁদতে শুরু করলে? এ্যাঁ? ফ্রান্সিসকে ছেড়ে দিয়ে হ্যারি হাতের উল্টে পিঠে দু’চোখ মুছল। বলল—তোমার, কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে না তো?

—না-না। ফ্রান্সিস বলল।

—এখন জাহাজ কোথায় যাবে মানে আমরা কোথায় যাবো? হ্যারি জানতে চাইল।

—খানিয়ায়। নিখোঁজ রাজমুকুটের সন্ধানে। ফ্রান্সিস বলল।-

-তাহলে তো কাভাল্লির সঙ্গে পরামর্শ করতে হয়। হ্যারি বলল।

—হ্যাঁ কাভাল্লিকে ডাকো। ফ্রান্সিস একজন ভাইকিং বন্ধুকে বলল।

একটু পরেই কাভাল্লি এলো। হ্যারি বলল—

—কাভাল্লি—ফ্রান্সিস বলছিল—এখন আমরা কীভাবে খানিয়া যাবো?

—এখন আমাদের পুবমুখো যেতে হবে। ঝড়টড় না হলে আমরা তিন চারদিনের মধ্যেই ক্রীটের উত্তরে রাজধানী খানিয়ায় পৌঁছোতে পারবো। কাভাল্লি বলল।

—হ্যারি জাহাজ-চালককে বলো কাভাল্লির নির্দেশমতো জাহাজ চালাতে। ফ্রান্সিস বলল। তারপর আস্তে আস্তে শুয়ে পড়ল। বোঝা গেল—ফ্রান্সিসের শরীরের দুর্বলতা এখনও সম্পূর্ণ কাটেনি। মারিয়া বাদে সবাই ঘরের বাইরে চলে এলো।

হ্যারি ও কাভাল্লি জাহাজ-চালকের কাছে এসে দাঁড়াল। কাভাল্লির নির্দেশমতো জাহাজ চলল খানিয়া বন্দরের উদ্দেশে।

জাহাজ চলেছে। বিদ্রোহী এনরিকোর যুদ্ধ জাহাজ ফ্রান্সিস ডুবিয়ে দিয়ে এসেছেকাজেই এখন ভাইকিংরা নিশ্চিন্ত। এনরিকোর সৈন্যদের দ্বারা আক্রান্ত হবার কোনো ভয় নাই।

এনরিকোর যুদ্ধ জাহাজ ডোবাতে গিয়ে ফ্রান্সিসকে অনেকক্ষণকাল ঠাণ্ডা জলে মাথা ভাসিয়ে ডুবে থাকতে হয়েছে। তারপর বাটালিতে হাতুড়ি চালাতে হয়েছে। ছোট করাত চালাতে হয়েছে। হাতুড়ির ঘাও কখনও কখনও আঙ্গুলে পড়েছে। বাটালিতে করাতে দু’হাত ক্ষত-বিক্ষত হয়েছে। দু’তিনটি আঙ্গুল ফুলে নীল হয়ে গেছে। জাহাজ ফুটো করবার উত্তেজনায় ফ্রান্সিস তখন এসব গায়ে মাখেনি। পরে দেখেছে ক্ষতগুলো আঙ্গুল ফোলা কোনোটাই কম নয়। জাহাজের বৈদ্যি ক্ষত জায়গায় আঙ্গুলে ওষুধ লাগিয়ে দিয়েছে। ছেঁড়া কম্বলের টুকরো দিয়ে মোটা ব্যান্ডেজমতো বেঁধে দিয়েছে। তাতে একটু ব্যথা জ্বালা যন্ত্রণা কমেছে। কিন্তু একদিনের মধ্যেই ঐ ক্ষত জ্বালা ফোলা আঙ্গুল ফ্রান্সিসকে বেশ কাহিল করে দিল। মাথায় টনটনানিতে ও হাত দুটো তুলতে পারছেনা। সেদিন বিকেল থেকেই ফ্রান্সিস বুঝতে পারল শরীরটা যেন আর বশে নেই। হঠাই ক্ষতস্থানে ফোলা আঙ্গুলে ব্যথা বাড়তে লাগল। সন্ধের মধ্যেই ব্যথা প্রায় অসহ্য হয়ে উঠল। ফ্রান্সিস তবু কাউকে কিছু বলল না। ভাবল কমে যাবে। কিন্তু কমল না। সারা শরীর কেঁপে কেঁপে উঠতে লাগল। বুঝল জ্বর আসছে। ওর শীত শীত করতে লাগল। মোটা কম্বলমতো কাপড়টা গায়ে ঢেকে ও বিছানায় শুয়ে পড়ল।

রাতে খাওয়ার সময় হ’ল। মারিয়া এর মধ্যে দু’একবার ডেক-এ উঠেছিল। তারপর এমব্রয়ডারি নিয়ে বসেছিল। ফ্রান্সিস এতক্ষণ বেশিরভাগ সময়ই চোখ বুজে শুয়ে থেকেছে। তাই মারিয়া ওকে, বিশ্রাম করছে মনে করেছে। ডাকেও নি। বুঝতেও পারে নি যে ফ্রান্সিসের শরীর খারাপ।

এখন খাওয়ার সময় হতে ডাকল—চলো খেয়ে আসি। ফ্রান্সিস আস্তে বলল—এখানেই খাবার নিয়ে এসো। মারিয়া ভাবল সেই ভালো। ফ্রান্সিসের আর হাঁটাচলা করে দরকার নেই। এখানেই বিছানাতে বসেই খেয়ে নিক।

মারিয়া কেবিনঘর থেকে বেরিয়ে এলো। একটু পরেই দু’প্লেট রুটি মাংসের ঝোল সবজি নিয়ে এলো। বিছানায় একটা পরিষ্কার কাপড় পেতে রাখল সেসব। ওদের রাঁধুনি বন্ধু কাঁচের গ্লাসে জল রেখে গেল। মারিয়া ডাকল—ওঠো খেয়ে নাও। ফ্রান্সিস মনে মনে হাসল। ওর শরীর যে এখন এত খারাপ এখনও মারিয়া তা জানে না। জানলে এক্ষুণি চ্যাঁচামেচি শুরু করবে।

ফ্রান্সিস উঠে বসল। স্পষ্ট বুঝল মাথাটা বেশ ঘুরছে। তবু মারিয়াকে কিছু বুঝতে না দিয়ে রুটি ছিঁড়ে মাংস খেতে শুরু করল। কিন্তু পারল না। মুখ বিষ তেতো। বমি হয়ে যাবে। ফ্রান্সিস শুধু ঢ ঢক্‌ করে জল খেল। আর বসে থাকতে পারল না। আস্তে আস্তে শুয়ে পড়ল। মারিয়া খাওয়া শুরু করতে গিয়ে চমকে উঠল। এক ঝটকায় সরে এসে ফ্রান্সিসের কপালে হাত দিল। বেশ গরম। প্রায় চেঁচিয়ে বলে উঠল—সে কি তোমার তো জ্বর এসেছে। ফ্রান্সিস চোখ বন্ধ অবস্থায়ই হাসল। বলল—ও গা গরম হয়েছে একটু। সেরে যাবে।

মারিয়ার আর খাওয়া হল না। খাবার-দাবার সরিয়ে রেখে ও ছুটল দরজার দিকে। বইরে এসে ছুটল হ্যারির কেবিনঘরের দিকে। হ্যারি তখন খাওয়া-দাওয়া সেরে সবে শুয়েছে। মারিয়া দরজায় ধাক্কা দিয়ে ডাকতে লাগল—হ্যারি—হ্যারি হ্যারি তাড়াতাড়ি ছুটে এসে দরজা খুলে দাঁড়াল। দেখল মারিয়া কেমন উদভ্রান্তের মত চেহারা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ও বলল—কী হয়েছে রাজকুমারী?

—ফ্রান্সিস অসুস্থ হয়ে পড়েছে। শিগগির এসো। মারিয়া আর কিছু বলতে পারল না।

—বলেন কি? চলুন। হ্যারি দ্রুত ছুটল ফ্রান্সিস আর মারিয়ার কেবিনঘরের দিকে। ছুটে বিছানার কাছে এসে দেখল ফ্রান্সিস কেমন নিস্তেজ হয়ে দু’চোখ বুজে শুয়ে আছে। হ্যারি ফ্রান্সিসের কপালে গলায় হাত রাখল। বেশ জ্বর। হ্যারি আস্তে ডাকল—ফ্রান্সিস ফ্রান্সিস চোখ মেলে তাকাল। হ্যারি লক্ষ্য করল চোখ দুটো বেশ লাল।

—শরীর খুব খারাপ লাগছে? হ্যারি স্নেহার্দ্রস্বরে বলল। ফ্রান্সিস শুকনো ঠোঁটে জিভ বুলোল। হাসল। মৃদুস্বরে বলল—ও ঠিকহয়ে যাবে। হ্যারি আর কিছু বলল না। ও জানে ফ্রান্সিস সহজে নিজের কষ্টের কথা বলবে না। পাছে মারিয়া হ্যারি বন্ধুরা দুশ্চিন্তায় পড়ে। হ্যারি মারিয়াকে বলল—একটা ছেঁড়া কম্বলের টুকরো ঠাণ্ডা জলে ভিজিয়ে কপালে জল পট্টি দিন। আমি বৈদ্যিকে ডেকে আনছি।

হ্যারি ছুটে বেরিয়ে গেল। মারিয়াও এদিকে ছেঁড়া কম্বলের একটা টুকরো খুঁজে বের করল। গ্লাসের জলে কম্বলের টুকরোটা ভিজিয়ে আস্তে আস্তে ফ্রান্সিসের কপালে চেপে ধরল। একটু আরাম লাগল ফ্রান্সিসের। ও একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। জ্বরের চেয়েও ওকে বেশি কষ্ট দিচ্ছিল ক্ষত-বিক্ষত হাত আঙ্গুলের যন্ত্রণা।

একটু পরেই বৈদ্যিকে সঙ্গে নিয়ে হ্যারি ফিরে এলো। বৈদ্যি ওর চিনেমাটির বোয়াম দুটো বিছানায় রাখল। এবার বিছানায় বসল। আস্তে আস্তে ফ্রান্সিসের দু’হাত আঙ্গুল থেকে ছেঁড়া কম্বলের পট্টিটা খুলতে লাগল। ফ্রান্সিস কঁকিয়ে উঠল। বৈদ্যি আরো সাবধান হ’ল। আস্তে আস্তে সব পট্টি খুলল। দেখল ক্ষতের জায়গাগুলো বেশ ফুলে উঠেছে। দুটো আঙ্গুল আরো ফুলেছে। চিন্তায় বৈদ্যির মুখ শুকিয়ে গেল। ও বুঝল গতিক ভালো নয়। ফ্রান্সিসের ঐ ক্ষতস্থান, ফোলা আঙ্গুল, বৈদ্যির চিন্তাগ্রস্থ মুখ এসব দেখে হ্যারির বুক কেঁপে উঠল। ও পাথরের মতো দাঁড়িয়ে রইল।

বৈদ্যি দু’টো বোয়াম থেকে ওষুধ নিয়ে হাতে ডলে মেশালো। একটু একটু জল দিয়ে মেশানো ওষুধটা চটচটে করল। তারপর ক্ষতস্থানে আঙ্গুলে লাগিয়ে দিতে লাগল। ওষুধ পড়তেই ফ্রান্সিস চোখ বন্ধ অবস্থায় আবার কঁকিয়ে উঠল। মারিয়া ফ্রান্সিসের কপালে হাত বোলাতে লাগল।

ওষুধ লাগানো শেষ হ’ল। ফ্রান্সিস একবারও চোখ খুলল না। নিস্তেজভাবে পড়ে রইল।

বৈদ্যি বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়াতে হ্যারি বলল—কী রকম বুঝছো?

—যদি কালকে ঘাগুলো পেকে না ওঠে তাহলে ভয়ের কিছু নেই। কিন্তু জ্বর এসেছে। পেকে উঠতে পারে। এখন আমার কাছে যা ওষুধ আছে এতে কতটা কাজ হবে জানি না। বৈদ্যি বলল।

—তাহলে ফ্রান্সিসের বিপদ এখনও কাটেনি। হ্যারি বলল।

—না। বৈদ্যি আস্তে মাথা ঝুঁকিয়ে বলল—দেখি এই নতুন ওষুধ কাজ হয় কিনা।

বৈদ্যি বোয়াম নিয়ে চলে যাবার সময় বলল—জলপট্টি দিতে থাকো। জুর বাড়তে দিও না।

মারিয়া এবার জলের গ্লাস নিয়ে ফ্রান্সিসের শিয়রের কাছে ভালো হয়ে বসল। জলপট্টি দিতে লাগল। মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগল।

এবার হ্যারির নজরে পড়ল খাবার পড়ে আছে। হ্যারি বলল—

—রাজকুমারী—আপনি কিছুই খাননি। খেয়ে নিন। আমি দেখছি। মারিয়া কোনো কথা না বলে মাথা নাড়ল। নিজের কাজ করে যেতে লাগল। বোঝাই গেল এখন কিছু খাওয়ার মতো মনের অবস্থা মারিয়ার নেই।

হ্যারি আস্তে আস্তে ফ্রান্সিসের পায়ের কাছে বিছানায় বসল। কম্বলটা দিয়ে ভালো করে ফ্রান্সিসের পাদুটো ঢেকে দিল।

রাত বাড়তে লাগল। ফ্রান্সিসের তখন একআচ্ছন্ন অবস্থা চলেছে। ও কোথায় আছে—এখন রাত না দিন কোনো বোধই ওর নেই।

হঠাৎ ফ্রান্সিসের মনে হ’ল শরীরটা যেন খবু হালকা হয়ে গেছে। হাতের আঙ্গুলের জ্বালা যন্ত্রণা আর নেই। হালকা শরীর নিয়ে ও যেন ওর দেশের বাড়ির ফুলের বাগানে আস্তে আস্তে ঘুরে বেড়াচ্ছে। পায়ের নীচে নরম ঘাস। দিনটা একটু কুয়াশা জড়ানো সূর্যের আলো নিস্তেজ। হঠাৎ সদর দরজা খুলে মা বেরিয়ে এলো। কুয়াশায় অস্পষ্ট দেখাচ্ছে মাকে। তবে মা’র মুখ পোশাক মোটামুটি দেখা যাচ্ছে। মা আরো এগিয়ে এলো। ওর দিকেই। সেই ছোটোবেলা মা’র যেমন মুখ দেখতো। সেই বয়েসের মা। এবার পোশাকটা দেখা গেল। কাঁধ পর্যন্ত ঢেউ তোলা চক্চকে জমকালো পোশাক। এরকম পোশাক পরেই মা রাজবাড়ির উৎসবে, ভোজে, অনুষ্ঠানে যেতো। পরে অবশ্য এসব পোশাক মা কমই পরতো। রাজবাড়িতেও কম যেতো। ফ্রান্সিস ভেজা ঘাসের ওপর দিয়ে ছুটল মা’র দিকে। হঠাৎ একঝলক জোর হাওয়া এলো। ভেজা ভেজা খুব ঘন কুয়াশা ছুটে এলো। মা তখন হাসি মুখে দু’হাত সামনে ছড়িয়ে ওকে ডাকছে। ঘন কুয়াশায় মা ঢাকা পড়ে গেল। ফ্রান্সিস ও হোঁচট খেয়ে ভেজা ঘাসে পড়ে গেল। ঘন কুয়াশায় সাদাটে অন্ধকারে সব ঢেকে গেল। ফ্রান্সিস আর্তস্বরে ডেকে উঠল মা। সত্যি—ফ্রান্সিসের গলা থেকে বেরিয়ে এলো—মা—ফ্রান্সিস চোখ খুলল।

মারিয়া সঙ্গে সঙ্গে ফ্রান্সিসের মুখের ওপর ঝুঁকে পড়ল। বলল—ফ্রান্সিস—কী হয়েছে। ফ্রান্সিস কিছু বলল না। চোখ বুজল।

মারিয়া এবার ফ্রান্সিসের জল ভেজা কপালে হাত দিল। কী গরম। জলপট্টির জল মুহূর্তে শুষে যাচ্ছে। হ্যারি ও ফ্রান্সিসের মা’ ডাক শুনে তাকিয়েছিল। মারিয়া ভয়ার্ত চোখে ওর দিকে তাকাতেই হ্যারি দ্রুত সরে এসে ফ্রান্সিসের গলায় বুকে হাত দিল। প্রবল জ্বর। ভয়ে হ্যারির মুখ শুকিয়ে গেল। হ্যারি বলল—রাজকুমারী—জলপট্টি দিতে থাকুন। আমি বৈদ্যিকে নিয়ে আসছি।

হ্যারি বৈদ্যির কাছে যাওয়ার পথে বিস্কোর কেবিনঘরের দরজায় ধাক্কা দিয়ে জোরে ডাকল—বিস্কো—ফ্রান্সিসের শরীর খুব খারাপ। বিস্কোর ঘুম ভেঙে গেল ও ছুটে ঘরের বাইরে এলো। তারপর ছুটল ফ্রান্সিসের কেবিন ঘরের দিকে। হ্যারির ডাকাডাকি ছুটোছুটি বৈদ্যির দ্রুত ছুটে আসা দু’জন একজন করে সব ভাইকিংদের ঘুম ভেঙে গেল। সবাই জানল—ফ্রান্সিসের শরীর খুব খারাপ। সবাই এল ফ্রান্সিসের কেবিনঘরের কাছে। ঘরের ভেতরে জায়গা কম। ঘরে পথে সবাই ভীড় করে দাঁড়াল। কারো মুখে কথা নেই।

বৈদ্যি ফ্রান্সিসের গলায় বুকে হাত দিয়ে দেখল। কম্বল সরিয়ে পায়ের পাতায় হাত চেপে দেখল। তারপর মারিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল—জুর অতো বেড়েছে। তবে কালকের দিনটা দেখতে হবে। ব’লে কোমরের ফেট্টি থেকে একটা মোটা কাপড়ের থলে বের করল। থলের মধ্যে হাত ঢুকিয়ে দুটো কালো বড়ি বের করে মারিয়ার হাতে দিল। বলল—এখন একটা বড়ি আর ঘণ্টা চারেক পরে আর একটা বড়ি খাইয়ে দিন। জ্বর আর বাড়বে না। জ্বালা যন্ত্রণা কমবে। তবে কথাটা আর শেষ করল না।

হ্যারি ঘরের কোণায় রাখা কাঠের পাত্র থেকে কাঠের গ্লাসে জল ভরে মারিয়াকে দিল। মারিয়া জলের গ্লাস নিয়ে আস্তে আস্তে ডাকল—ফ্রান্সিস ফ্রান্সিস আস্তে আস্তে চোখ খুলল। মোমবাতির আলোয় মারিয়া দেখল চোখ দুটো টকটকে লাল। মরিয়া চমকে উঠল। ওর হাত কেঁপে উঠল। গ্লাস পড়ে যায় যায়। বৈদ্যি গ্লাসটা ধরে ফেলল। মারিয়া মাথা নিচু করে ফুঁপিয়ে উঠল। বৈদ্যি মারিয়ার হাত থেকে বড়ি দু’টো নিল। ফ্রান্সিসের মুখের ওপর ঝুঁকে বলল—ফ্রান্সিস এই ওষুধটা খেয়ে নাও। ফ্রান্সিস আস্তে আস্তে শুকনো ঠোঁট দুটো ফাঁক করল। বৈদ্যি মুখে জল ঢেলে বড়িটা খাইয়ে দিল। অন্য বড়িটা হ্যারি হাত বাড়িয়ে বৈদ্যির কাছ থেকে নিয়ে নিজের কাছে রাখল।

বৈদ্যি চলে গেল। ফ্রান্সিসের সব ভাইকিং বন্ধুরা নীরবে দাঁড়িয়ে রইল। হ্যারি ওদের দিকে তাকিয়ে বলল—তোমরা যাও। শুয়ে পড়ো। আমি আর রাজকুমারী এখানে থাকবো। বিস্কো বলে উঠল—আমরা আজ রাতে কেউ ঘুমুবো না। সবাই এখানে থাকবো। হ্যারি আর কিছু বলল না। ও তো জানে বন্ধুরা ফ্রান্সিসকে কী ভালোবাসে!

হ্যারি চিন্তায় পড়ল। ওদের জাহাজের বৈদ্যি যা বলছে তাতে ওর ওপর তো আর ভরসা করা যাচ্ছে না। অথচ খানিয়া এখনও কতদূর কে জানে। ওখানে পৌঁছে ভালো বৈদ্যি দিয়ে চিকিৎসা করাবার আগেই হয় তো ফ্রান্সিস—হ্যারি আর ভাবতে পারলো না। ওর চোখ ফেটে জল এলো। এত বুদ্ধিমান সাহসী শক্তিধর পুরুষ ফ্রান্সিস—এমন নিষ্পাপ ফুলের মতো হৃদয়ের মানুষ ফ্রান্সিস স্বদেশ স্বজন থেকে এই বিদেশে এক সমুদ্রের বুকে ওদের অসহায় চোখের সামনে মারা যাবে? হ্যারি দু’হাতে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। মারিয়া তো তখন থেকে মাথাই তোলে নি আর।

বিস্কো ছুটে এসে হ্যারির কাঁধে হাত রেখে আস্তে আঁকুনি দিয়ে বলল—হ্যারি তুমি যদি এই সাংঘাতিক বিপদের মুহূর্তে ভেঙ্গে পড়ো তাহলে কার ওপর আমরা ভরসা রাখবো? বিস্কো যতই বলুক হ্যারির মতো অনেক ভাইকিং বন্ধুরই দু’চোখে জল দেখা গেল। বিস্কো বলল—হ্যারি আমাদের আবাল্য বন্ধু ফ্রান্সিস জীবনে কখনও কারো প্রতি কোনো অন্যায় আচরণ করেনি—নিজের জীবন বিপন্ন না হলে কখনও কাউকে অস্ত্রাঘাত করে নি, তার এভাবে এত করুণভাবে মৃত্যু হতে পারে না। অসম্ভব।

হ্যারি চোখ মুছল। সত্যিই তো। এই মুহূর্তে ভেঙে পড়লে চলবে কেন। হঠাৎ ওর কাভাল্লির কথা মনে হ’ল। চারিদিকে তাকাল হ্যারি দেখল দরজায় হাত রেখে কাভাল্লি বিষণ্ণমুখে দাঁড়িয়ে আছে। হ্যারি ডাকল—কাভাল্লি এদিকে এসো। কাভাল্লি এগিয়ে এসে হ্যারির সামনে দাঁড়াল। হ্যারি বলল—

—কাভাল্লি-খানিয়া পৌঁছতে আমাদের আর ক’দিন লাগবে?

কাভাল্লি একটু ভেবে বলল—তা দিন তিন-চার।

—কিন্তু ততদিন তো—হ্যারি বলল—আচ্ছা—এই সমুদ্রপথে ধারে কাছে কোনো বন্দর বা দ্বীপ নেই? কাভাল্লি মাথা নিচু করে একটু ভাবল। তারপর মাথা তুলে বলল উত্তর ক্রীটের একটি লম্বাটে অংশ এই সমুদ্রের দিকে বেরিয়ে আছে। ঠিক তার মাথায় আছে নাক্সোস নামে একটা শহর বন্দর। আমি মাত্র একবার খানিয়া থেকে নাক্সোসে এসেছিলাম। তখন নাক্সোসে রাজত্ব করছিলেন একজন ভেনিসের ডিউক ডিউকমার্কো। মার্কো সম্বন্ধে যতটুকু শুনেছি—ভেনিসের ডিউক হলেও উনি ক্রীট দেশীয় প্রজাদের মঙ্গলই করেছেন।

—ঠিক আছে হ্যারি বলল—এখন বলো নাক্সোস বন্দরশহর কেমন। ওখানে ভালো চিকিৎসক পাওয়া যাবে কি না।

তা পাবেন বৈ কি। বড়ো বন্দর শহর। অনেক ভেনিসীয় মানুষের বাস। তারা সুশিক্ষিত। তাদের মধ্যে ভালো চিকিৎসক নিশ্চয়ই আছে। কাভাল্লি বলল।

—এখন নাক্সোস পৌঁছতে কত সময় লাগবে?হ্যারি জানতে চাইল। কাভাল্লি আবার মাথা নিচু করে কী হিসেব করল। তারপর মাথা তুলে বলল—গ্রামভাউসা থেকে বেশ দূরে চলে এসেছি আমরা। এখন জাহাজ দক্ষিণ মুখো ঘোরাতে হবে। একটু দ্রুত জাহাজ চালাতে পারলে আমরা কাল সন্ধের মধ্যেই নাক্সোস পৌঁছে যাবো।

—না—না—হ্যারি মাথা নেড়ে বলল—যে করেই হোক আমাদের কাল সকালের মধ্যে নাক্সোস পৌঁছতে হবে। কাভাল্লি বলল—রাত তো প্রায় শেষ হয়ে এলো। পারবেন অত তাড়াতাড়ি জাহাজ চালিয়ে পৌঁছতে।

—পারতেই হবে। ফ্রান্সিসকে সুচিকিৎসকের কাছে নিয়ে যেতেই হবে। হ্যারি বলল। এবার হ্যারি ঘরের বাইরে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে থাকা ভাইকিং বন্ধুদের দিকে তাকাল। সবার মুখের ওপর দিয়ে চোখ বুলিয়ে নিল। হ্যারি আস্তে আস্তে দু’হাত ওপরে তুলল। তারপর একটু গলা জড়িয়ে বলতে লাগল ভাইসব—আমাদের সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু ফ্রান্সিস গুরুতর অসুস্থ। ওকে বাঁচাতে হলে এক্ষুণি যতটা সম্ভব দ্রুতবেগে দক্ষিণ মুখো জাহাজ চালাতে হবে। কাভাল্লি বলছে—নাক্সোস পৌঁছোতে কাল সন্ধে হয়ে যাবে। কিন্তু আজ ফ্রান্সিস এতটাই অসুস্থ হয়ে পড়েছে যে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমাদের নাক্সোস পৌঁছোতে হবে। সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। একটু থেমে হ্যারি বলল—ভাইসব, আমরা সময়কে জয় করবো। এই প্রতিজ্ঞা নিয়ে জাহাজ চালাও। কাল সকালের মধ্যে আমাদের নাক্সোসে পোঁছোতেইহবে। ফ্রান্সিসকে তোমরা কত ভালোবাসা আজকের পরীক্ষার দিন এসেছে। হ্যারি আবেগপ্লুতস্বরে সব ভুলে চিৎকার করে বলে উঠল—ভাইসব—প্রচন্ড বেগে জাহাজ চালাও-সময়কে জয় করবো আমরা। হ্যারির চিৎকার কানে যেতে প্রায় অচেতন ফ্রান্সিস মাথাটা এপাশ-ওপাশ করে চোখ মেলে তাকাল। দুর্বলস্বরে ডাকল মারিয়া। মারিয়া এতক্ষণ মাথা নীচু করে আস্তে আস্তে ফুঁপিয়ে কাঁদছিল। ফ্রান্সিসের ডাক কানে যেতে দ্রুত ফ্রান্সিসের মুখের ওপর ঝুঁকে ডাকল—ফ্রান্সিস ফ্রান্সিস একটুক্ষণ মারিয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। মারিয়া বলল—ফ্রান্সিস শরীর খুব খারাপ লাগছে?ফ্রান্সিস কোনো কথা বলল না। আস্তে আস্তে দু’চোখ বন্ধ করল, নির্জীবের মতো শুয়ে রইল। ওর মুখে থেকে গোঙানির শব্দ ভেসে আসতে লাগল। মারিয়া ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। আবার জলপট্টি দিতে লাগল।

অন্য সময় হলে ভাইকিং বন্ধুরা হ্যারির কথা শুনে ও—হো—হো—শব্দের চিৎকার করে উঠতো। কিন্তু এই ঘরে প্রায় অজ্ঞান ফ্রান্সিসের সামনে ওরা কোনো শব্দ করতে চাইল না। সবাই ছুটল যে যার কাজে। হ্যারি কাভাল্লিকে নিয়ে প্রায় ছুটে জাহাজের ডেক এ চলে এলো। দু’জনে ছুটে এলো জাহাজ-চালকের কাছে। হ্যারি জাহাজ চালককে বলল কাভাল্লিকে এনেছি। ও যেদিকে যে পথে জাহাজ চালাতে বলে চালাও। কাভাল্লি এগিয়ে এসে জাহাজ-চালকের সঙ্গে কথা বলতে লাগল।

হ্যারি আকাশের দিকে তাকাল। দেখল অন্ধকার আকাশ মেঘহীন। হাজার হাজার তারা জ্বল জ্বল করছে। হাওয়া বইছে একটু কমে জোরে। জাহাজের গতি বাড়াতে হলে দাঁড় টানতে হবে।

ওদিকে সব ভাইকিংরা প্রচণ্ড তৎপরতায় কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ল। একদল চলে গেল দাঁড় ঘরে। দাঁড়ে হাত লাগাল। বিস্কো দুসারি দাঁড়িদের মাঝখানে দাঁড়াল। তারপর দাঁড় টানার তালে তালে বিস্কো শরীরমাথা তালে তালে দুলিয়ে শুরু করল ওদের চারণ কবিদের গান। দাঁড়িদের মধ্যে জাগল প্রচণ্ড উৎসাহ। সমুদ্রের জলে ছপ ছপ শব্দ উঠল। একে বাজছে দেশের কথা গানের পাগল করা সুর, অন্যদিকে অসুস্থ ফ্রান্সিসকে সকালের মধ্যেই বন্দর শহর নাক্সোসে পৌঁছে দেওয়ার প্রতিজ্ঞা। বিস্কোর গান চলল। দাঁড় বওয়া চলল—ছপ ছপ শব্দ জলে। বিস্কো হঠাৎ তালের ছন্দ বাড়িয়ে দিল। তাল মেলাতে আরো দ্রুত দাঁড় টানতে হল দাঁড়িদের। এতে ওরা খুশিই হ’ল। ওরা উৎসাহে চিৎকার করে উঠল—, ও—হো—হো—একজন দাঁড়ি চেঁচিয়ে বলল—বিস্কো আরো জোরে। বিস্কো গানের তাল আরো বাড়াল। দাঁড়িরা চিৎকার করে উঠল—ও—হো—হো—। অতি দ্রুত দাঁড় পড়তে লাগল সমুদ্রের জলে। জাহাজের গতি অনেক বেড়ে গেল। বিস্কো একটু গান থামিয়ে তালের সঙ্গে দুলতে দুলতে চিৎকার করে বলে উঠল—ফ্রান্সিসকে বাঁচাবো আমরা। সময়কে জয় করবো। সবাই একসঙ্গে চিৎকার করে উঠল—ও—হো-হো—। জাহাজ চলল পূর্ণ বেগে।

ওদিকে মাস্তুলের মাথায় উঠে পড়েছে নজরদার পেড্রো। আট-দশজন ভাইকিং মাস্তুলে পালের কাঠ দড়িদড়া বেয়ে উঠে পড়েছে। সব ক’টা পাল টান টান খুলে দিল। বাড়তি দু’টো পালও লাগাচ্ছে, তখনই শুনল দাঁড় ঘর থেকে বন্ধুদের ও—হো—হো— ধ্বনি। ওরাও চিৎকার করে জবাব দিল—ও—হো—হো—। বাড়তি দুটো পাল লাগানো হল। সব পালগুলো ফুলে উঠল বাতাস লেগে। জাহাজের গতি আরো বাড়ল।

রাত শেষ হয়ে এলো। পুবের আকাশে লাল রঙ ধরল। তখনই হঠাৎ দক্ষিণ মুখো বাতাস খুব জোরে ব’য়ে এলো। ফুলে উঠল পালগুলো। ডেক-এ দাঁড়ানো ভাইকিংরা বাতাসের বেগ দেখে আনন্দে চিৎকার করে উঠল—ও—হো—হো—। দাঁড়ঘরে সেই ধ্বনি পৌঁছল। ওরাও চিৎকার করে সাড়া দিল। জাহাজটা যেন জল ছুঁয়ে উড়ে চলল।

আস্তে আস্তে পুব আকাশে সূর্য উঠল। নরম রোদ এসে পড়ল সমুদ্রের ঢেউয়ে জাহাজের গায়ে।

দাঁড়ঘরে তখনও চলছে পূর্ণোদ্যমে দাঁড় বাওয়া। বিস্কোর গলা ভেঙে গেছে। তালে তালে দুলতে দুলতে ওর শরীর যেন আর সাড়া নেই। তবুও ও একটু থেমে থেমে দম নিয়ে নিয়ে গেয়ে চলেছে ওদের চারণ কবিদের গান। দাঁড়িরা ঘেমে নেয়ে উঠেছে যেন। জোরে জোরে শ্বাস ফেলছে। দম নেই যেন আর। কিন্তু এক মুহূর্তের জন্যেও থামছে না কেউ। শরীরের সমস্ত শক্তি উজাড় করে দিয়ে ওরা দাঁড় বেয়ে চলেছে।

এর মধ্যে হ্যারি একবার অসুস্থ ফ্রান্সিসের কেবিনঘরে গিয়েছিল। দেখল ফ্রান্সিসের শিয়রে পাথরের মূর্তির মতো মারিয়া ফ্রান্সিসের ডান হাতটা কোলে নিয়ে বসে আছে। পায়ের কাছে ফ্রান্সিসের মুখের দিকে অসহায় চোখে তাকিয়ে বসে আছে ওদের জাহাজের বদ্যি। বদ্যি তার জ্ঞানমতো চিকিৎসার সব ব্যবস্থাই করেছে। কিন্তু তাতে বোধহয় ফ্রান্সিসের খুব একটা উপকার হয় নি। হ্যারি দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতেই দেখল ফ্রান্সিস অসহ্য ব্যথায় মাথা এপাশ-ওপাশ করতে লাগল। কষ্টের গোঙানির শব্দ বেরিয়ে এলো ফ্রান্সিসের মুখ থেকে। ফ্রান্সিসের চিরসঙ্গী হ্যারি কতবার দেখেছে কী প্রচণ্ড কষ্ট মুখ বুজে সহ্য করেছে ফ্রান্সিস আজকের কষ্ট বোধহয় এত প্রচণ্ড এত যন্ত্রণাদায়ক যে ফ্রান্সিসের মতো শক্ত ধাতুতে গড়া মানুষও তা সহ্য করতে পারছে না। ফ্রান্সিসকে এত অসহায় এত ব্যথাকাতর হ্যারি কোনোদিন দেখে নি। ফ্রান্সিসের এই কষ্ট হ্যারি আর দেখতে পারল না। মুখ চোখ দুহাতে চেপে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল হ্যারি পাছে ওর কান্নার শব্দ ফ্রান্সিস বা মারিয়ার কানে যায় এই ভয়ে এক ছুটে হ্যারি সেই ঘর থেকে পেরিয়ে এলো।

সিঁড়ি দিয়ে ডেক-এ উঠতে উঠতেই হ্যারি দেড্রোর খুশির চিৎকার শুনতে পেল—ডাঙা—ডাঙা দেখা যাচ্ছে। হ্যারি লাফিয়ে সিঁড়ি পার হয়ে ডেক-এ উঠে এলো। ছুটল, রেলিঙের দিকে। ততক্ষণে পালের তদারকিতে যারা পালের কাঠে বসে পাল এদিক-ওদিক ঘুরিয়ে বেশ বাতাস ধরার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল তারা চিৎকার করে উঠল—হো-ও-ও। দাঁড়িঘরেও চিৎকার উঠল—হো-ও-ও। সারা জাহাজে খুশির হাওয়া বইল। জাহাজ দ্রুত এগিয়ে চলল ডাঙার দিকে।

রেলিঙে ঝুঁকে হ্যারি দেখতে লাগল ডাঙার অবস্থা। জাহাজঘাটা এদিকটাতেই। তিনটে ছোটো জাহাজ জাহাজঘাটায় দাঁড়িয়ে আছে। জাহাজঘাটার পরেই বেশ সমতল একটা পাথরকুচি ছড়ানো রাস্তা চলে গেছে।

জাহাজ আরো কাছে আসতে হ্যারি দেখল জাহাজঘটার পরে রাস্তায় দু’খানা পাথরের বাড়িঘর। লোকজন পথে যাতায়াত করছে। দু’তিনজন সৈন্যকেও দেখল জাহাজঘাটার দিকে হেঁটে আসছে। পরনে গ্রীক সৈন্যদের মতোই লোহার বর্ম উষ্ণীব।

জাহাজ চালক হালের চাকা ঘোরাতে ঘোরাতে ডাকল—হ্যারি হ্যারি ছুটে ওর কাছে গেল। চালক বলে উঠল শিগগির পাল গোটাতে বলো। দাঁড় বাওয়া বন্ধ করতে বলো—নইলে যে গতিতে জাহাজ ছুটছে পাথুরে জাহাজঘাটায় ধাক্কা খেয়ে জাহাজ ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যাবে। হ্যারি সঙ্গে সঙ্গে ডেক-এর উপর দিয়ে ছুটল দাঁড়ঘরের দিকে। যেতে যেতে ওপরের দিকে পালের কাঠে খুঁটিতে বসা ভাইকিং বন্ধুদের চিৎকার করে বলতে লাগল—শিগগির পাল গোটাও—পাল গোটাও। ওরা সঙ্গে সঙ্গে পালের দড়ি ধরে টানাটানি করে পাল গুটিয়ে ফেলতে লাগল।

হ্যারি ছুটে এলো দাঁড়ঘরে। দাঁড়িরা তখনও প্রাণপণে দাঁড় বেয়ে চলেছে। হ্যারি চিৎকার করে বলল—ভাইসব—ডাঙা-ডাঙায় এসে গেছি। দাঁড় বাওয়া বন্ধ করো। দাঁড়িরা দাঁড় বাওয়া বন্ধ করল। হ্যারি দেখল বিস্কোর গলা ভেঙে গেছে। তবুও ফ্যাসফ্যাসে গলায় ও গান গেয়ে চলেছে। দাঁড়িদের উৎসাহ জোগাচ্ছে। হ্যারি ছুটে বিস্কোর কাছে গেল। চেঁচিয়ে বলল—বিস্কো ডাঙা দেখা গেছে। নাক্সোস-এ পৌঁছে গেছি আমরা। বিস্কো গান থামাল। হ্যারির দিকে তাকাল। তারপর সমস্ত গা ছেড়ে দিয়ে কাঠের মেঝেয় পড় পড় হ’ল। হ্যারি দু’হাত ওকে জড়িয়ে ধরল। কিন্তু বিস্কোর দেহে কোনো সাড় নেই। ও চোখ বুঝে আছে। অজ্ঞান হয়ে গেছে। হ্যারি বরাবরই শরীরের দিক থেকে দুর্বল। ও বিস্কোর শরীরের ভার ধরে রাখতে পারল না। আস্তে আস্তে বিস্কোকে কাঠের মেঝেয় শুইয়ে দিল। বিস্কো প্রচণ্ড ক্লান্তিতে চোখ বুজে হাত পা ছড়িয়ে কাঠের মেঝেয় শুইয়ে রইল। হ্যারি দেখল—সব দাঁড়িরা কেউ কাঠের আগুনে শুয়ে। কেউ দাঁড়ের গায়ে মাথা রেখে বিশ্রাম নিচ্ছে, কেউ কাঠের মেঝেয় শুয়ে পড়েছে। কারো শরীরে কোনো সাড়া নেই। সারারাত না ঘুমিয়ে এতক্ষণ একটানা প্রাণপণে দাঁড় চালিয়ে সকলেই অসহ্য ক্লান্তিতে হাত পা ছেড়ে গেছে। ফ্রান্সিসের প্রতি এই বন্ধুদের এই গভীর ভালোবাসা দেখে হ্যারি অবাক হয়ে গেল। ও আর কাউকে ডাকল না। বিশ্রাম করুক ওরা। হ্যারি আস্তে আস্তে সিঁড়ি বেয়ে ডেকে-এ উঠে এলো। এতক্ষণে হ্যারি বুঝল ও নিজেও কম ক্লান্ত নয়। ডেকেই শরীর এলিয়ে পড়তে চাইছে। কিন্তু এখনও বিশ্রামের সময় আসে নি। আসল কাজ এখনও বাকি। ওকে ডেক এ উঠে আসতে দেখে কয়েকজন ভাইকিং বন্ধু ছুটে এলো। শাঙ্কোও ছিল তার মধ্যে। বলল—হ্যারি এখন কী করবে? হ্যারি ক্লান্তস্বরে বলল—জাহাজ ঘাটে লাগলে আমি তোমাকে নিয়ে নামবো। কাভাল্লিকেও সঙ্গে নেবো। ও থাকলে সুবিধে। ও এখানকার রাজা রাজবাড়ি পথ-ঘাট চেনে।

এবার হ্যারি শাঙ্কোকে বলল—শাঙ্কো—একমুহূর্তেও দেরি করা চলবে না। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ফ্রান্সিসের সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। যাও—কাভাল্লিকে ডেকে নিয়ে এসো। শাঙ্কো ছুটে চলে গেল। একটু পরেই কাভাল্লিকে সঙ্গে নিয়ে ফিরে এলো।

ততক্ষণে জাহাজের সেই দ্রুত গতি পড়ে গেছে। জাহাজ আস্তে আস্তে চলল জাহাজঘাটার দিকে। হ্যারি শাঙ্কো আর কাভাল্লি জাহাজের রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে রইল। তিন-চারজন ভাইকিং বন্ধু কাঠের পাটাতনটা হাতে নিয়ে তৈরি হ’ল। আস্তে আস্তে জাহাজটা পাথুরে ঘাটটার গায়ে এসে লাগল। একটা বেশ জোর ঝাঁকুনি খেয়ে জাহাজটা থেমে গেল। দ্রুত পাটাতন ফেলা হ’ল। ঘড়ঘড় শব্দে নোঙ্গর ফেলা হ’ল। পাটাতন দিয়ে হারি ওরা দ্রুত পায়ে জাহাজ ঘাটায় নামল। নামতে নামতে কাভাল্লি বলল—সত্যি তোমরা বীরের জাতি। অসম্ভবকে সম্ভব করলে। এত তাড়াতাড়ি জাহাজ চালিয়ে এলে ভাবাই যায় না। হ্যারি ম্লান হেসে বলল—আমরা ভাইকিং—আমরা যা সংকল্প নিই—তা করে তবে ক্ষান্ত হই। মোটামুটি সমতল পাথর বাঁধানো রাস্তায় উঠতেই তিনজন সৈন্য এগিয়ে এসে ওদের থামতে ইঙ্গিত করল। হ্যারি রা দাঁড়িয়ে পড়ল। হ্যারি চিন্তায় পড়ল। সৈন্যরা আটকে দিলে ঝামেলায় পড়তে হবে। হ্যারি কাভাল্লিকে বলল-কাভাল্লি আমি ভালো করে গ্রীক ভাষা বলতে পারবো না। তুমি একটা কথাই ওদের বোঝাও যে আমরা ভাইকিং। জাহাজে আমাদের এক বন্ধু মরণাপন্ন। তার সুচিকিৎসার জন্যে আমরা এখানকার রাজা ডিউক মার্কোকে অনুরোধ করতে যাচ্ছি।

সৈন্য তিনজন কোমরবন্ধ থেকে তলোয়ার খুলল। হ্যারি দের ঘিরে দাঁড়াল। হ্যারি ওরা নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে রইল। সৈন্যদের একজন গ্রীক ভাষায় বলল—তোমরা কারা? এখানে এসেছো কেন? এবার কাভাল্লি একটু এগিয়ে গেল সৈন্যদের দিকে। হ্যারি যা বলে দিয়েছিল তাই গড় গড় করে বলে গেল। সৈনিকদের একজন বলল—কিন্তু তোমরা বিদ্রোহী এনরিকোর গুপ্তচরও তো হতে পারো। এবার হ্যারি ভাঙা ভাঙা গ্রীক ভাষায় বলল—কে বিদ্রোহী এনরিকো?আমরা এনরিকোর নামই শুনি নি। হ্যারি বুঝল এখন মিথ্যে কথা না বলে উপায় নেই। সৈন্যরা ওদের যত দেরি করিয়ে দেবে ফ্রান্সিসের বিপদ তত বাড়বে। সৈন্য তিনজন পরস্পরের মুখের দিকে তাকাল। হ্যারির কথা যে জন্যেই তোক ওরা বিশ্বাস করল। খোলা তলোয়ার কোমরে গুঁজে রাখল। একজন সৈন্য বলল—যাও তবে রাজা মার্কোর রাজসভা শুরু হতে এখনও ঘণ্টা দুয়েক বাকি। সৈন্য তিনজন চলে গেল। হ্যারি বলল—শাঙ্কো—যা বুঝছি—এখন রাজার সাহায্য চাইতে গেলে অনেক সময় নষ্ট হবে!দু’ঘণ্টা পর রাজা রাজসভায় আসবেন। বেশ সময় যাবে রাজাকে আমাদের আবেদন জানাতে। তিনি আমাদের আবেদনে সাড়া দেবেন কিনা তাও আগে থেকে বলা সম্ভবনা। যদি সাড়া না দেন তাহলে ঘণ্টা তিনেরও বেশি সময় নষ্ট হবে। অথচ ফ্রান্সিসের শরীরের যা অবস্থা তাতে আর এক মুহূর্ত সময় নষ্ট করা চলবে না। শাঙ্কো ভাবল কথাটা। বলল—এখন কী করবে তাহলে?

—এইনগরে একজন ভালো বৈদ্যিকে খুঁজে বের করতে হবে। হ্যারি বলল। তারপর কাভাল্লিকে বলল—কোনো ভালো বৈদ্যিকে চেনেনা তুমি? কাভাল্লি মাথা নাড়ল।

—ঠিক আছে—চলো। হ্যারি পাথর বাঁধানো রাস্তা ধরে দ্রুত পায়ে চলল। রাস্তায় কত লোকচলাচল করছে। হ্যারির সেদিকে চোখ নেই। ও খুঁজছে একটা ওষুধের দোকান। হ্যারি দু’পাশে তাকাতে তাকাতে চলেছে। হঠাৎ ওর নজরে পড়ল একটা ঝাকড়া মাথা গাছের নীচে পাথর বাঁধানো বেদীমতো। তার ওপর কিছু শুকনো আর টাটকা গাছ গাছড়া। নানা রকম শুকনো শেকড়বাকড়—এসব নিয়ে দু’জন লোক বসে আছে। দু’চারজন খরিদ্দার গাছ পাতা শেকড়বাকড় নেড়েচেড়ে দেখছে। হ্যারি দ্রুত তোক দুটির সামনে গিয়ে দাঁড়াল, জিজ্ঞেস করল—এসব কি ওষুধ তৈরির গাছ-গাছড়া? লোক দুটি কথাটা কিছু বুঝল। মাথা নেড়ে একজন বলল, হ্যাঁ।

—এই নগরের বৈদ্যিরা এসব কেনেন—তাই না? হ্যারি বলল। লোকটি আবার মাথা নেড়ে বলল—হ্যাঁ।

—এখানকার কোনো ভালো বৈদ্যিকে চেনো? হ্যারি বলল। লোকটি মাথা নেড়ে বলল—পাসকাতোর-রাজবদ্যি।

—কোথায় থাকেন পাসকারে। হ্যারি জানতে চাইল। লোকটা এবার হাত নেড়ে নেড়ে কি গড় গড় করে বলে গেল। হ্যারি সব কথা বুঝল না। কাভাল্লির দিকে তাকাল। কাভাল্লি—মাথা ঝাঁকিয়ে বলল-বুঝেছি—পাসকালতারমানে রাজবৈদ্যি থাকেন কাছেই। চলো আমার সঙ্গে। তিনজনে পথ দিয়ে চলল। কিছুটা যেতেই একটা মোড় পড়ল। মোড়ের ডান পাশে একটা সবুজ ঘাসে ঢাকা উপত্যকা মতো। কাভাল্লি উপত্যকা দিয়ে চলল। পেছনে হ্যারি আর শাঙ্কো।

দু’পাশে উঁচু উঁচু টিলামতো। তার মাঝখানে দিয়ে পথ। ওরা চলল। কিছুটা যেতেই কাভাল্লি এদিকে-ওদিকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখল। একটা উঁচু পপলার গাছের নীচে পাথরের বাড়িঘর কিছু। কাভাল্লি সেদিকে চলল। একটা বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল। দেখা গেল বাইরের ঘরের দরজা খোলা। কিছু লোকজন ঘরে বসে আছে। কাভাল্লি এগিয়ে গিয়ে সেই লোকজনের সঙ্গে কথা বলল। হ্যারি দের দিকে ফিরে তাকিয়ে বলল—এটাই রাজবৈদ্যির বাড়ি। উনি এখনি আসবেন।

হ্যারি ও শাঙ্কো ঘরটায় ঢুকল। দেখল ঘরের একদিকে—একটা পাথরের বেদীমতো। তাতে পাখির পালকের আসন পাতা। আর একপাশে পাথরের তাকওলা আলমারিমতো। তাতে অনেক কাঠের কৌটো রাখা। নীচের তাকে অনেক শুকনো শেকড়বাকর রাখা। ঘরটার ওপাশের দরজা দিয়ে দেখা গেল উঠানমতো। তা’তে পাথর পাতা উনুন জ্বলছে। বিরাট বড়ো মাটির গামলামতো কী বসান। তাতে নানা গাছপাতা সেদ্ধ হচ্ছে। গামলা থেকে ধোঁয়া উঠছে। হ্যারি বুঝল-কাঠের কৌটোগুলো ওষুধের কৌটো। উনুনে জ্বাল দিয়ে ওষুধ তৈরি করা হচ্ছে।

ঘরে লম্বাটে কাঠের পাটাতন পাতা। রোগীরা বসে আছে। হ্যারি শাঙ্কো আর কাভাল্লিকে ইঙ্গিতে বসতে বলল। নিজে দাঁড়িয়ে রইল।

তখনই পাকা দাড়িগোঁফওলা একজন বৃদ্ধ আস্তে আস্তে ঘরে ঢুকলেন। বৃদ্ধের পরনে ঢোলা সাদা মোটা কাপড়ের জোব্বামতো। কোমরে রেশম কাপড়ের বন্ধনী। হ্যারি বুঝল, ইনিই রাজবৈদ্যি পাসকাতোর। হ্যারি এবার অন্য রোগীদের দিকে তাকিয়ে ভাঙা ভাঙা গ্রীক ভাষায় বলল—ভাই আমাদের এক বন্ধু গুরুতর অসুস্থ। আমি আগে মাননীয় রাজবৈদ্যির সঙ্গে কথা বলবো। রোগীদের দুজন মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল। অন্যেরা কোনো কথা বলল না।

এবার হ্যারি এগিয়ে গেল। পাসকাতোর ততক্ষণে আসনে বসেছেন। হ্যারি মাথা একটুনুইয়ে সম্মান জানিয়ে বলল, রাজবৈদ্য মহাশয়—আমরা বিদেশি ভাইকিং। আমাদের জাহাজে আমাদেরই এক বন্ধু ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েছে। আমরা আপনার কাছে চিরকৃতজ্ঞ থাকবো যদি আপনি দয়া করে আমাদের সঙ্গে জাহাজে এসে আমাদের অসুস্থ বন্ধুকে একটু দেখেন—চিকিৎসা করেন। পাসকাতোর একটুক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর বললেন—আমি বৃদ্ধ হয়ে পড়েছি। জাহাজে ওঠানামা করতে খুবই কষ্ট হবে। আপনার যদি আপনাদের অসুস্থ বন্ধুকে এখানে আনতে পারেন তাহলে তার চিকিৎসার ব্যবস্থা আমি করবো। হ্যারি একটু ভাবলো কী করবে এখন? পরক্ষণেই ভাবল অন্য কোনো উপায় নেই। ফ্রান্সিসকে প্রাণে বাঁচাতে হলে যে ভাবেই হোক ফ্রান্সিসকে এখানে আনতে হবে। ও বলল—বেশ আমরা এক্ষুণি অসুস্থ বন্ধুকে নিয়ে আসছি।

হ্যারি,শাঙ্কো আরকাভাল্লিকেইশারায় ডেকেঘরের বাইরে এলো। হ্যারি বলল—জাহাজে চলো যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ফ্রান্সিসকে এখানে এনে চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে।

হ্যারি রাস্তা দিয়ে ছুটে চলল। শাঙ্কো ও কাভাল্লিও চলার বেগ বাড়াল।

জাহাজে উঠেহ্যারি ছুটল ফ্রান্সিস ও মারিয়ার কেবিনঘরের দিকে। ঘরে ঢুকে দেখল—ফ্রান্সিস চোখ বুজে শুয়ে আছে। কিন্তু স্থির হয়ে শুয়ে নেই। মাঝে মাঝেই জোরে মাথা এপাশ-ওপাশ করছে। গলা দিয়ে বেরিয়ে আসছে কষ্টের গোঙানি। ফ্রান্সিসের শিয়রের দুপাশে বসে মারিয়া আর ওদের বৈদ্যি ফ্রান্সিসের দু’টো হাত কোলে নিয়ে আস্তে আস্তে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। দুঃখে বেদনায় হ্যারির বুক ভরে উঠল। ফ্রান্সিসের মতো শক্ত মনের মানুষ কী প্রচণ্ড কষ্টে এই রকম মাথা নাড়ছে গোঙাচ্ছে এটা বুঝতে পেরে হ্যারি অস্থির হয়ে উঠল। ওর দু’চোখ জলে ভিজে উঠল। পরক্ষণেই হ্যারি চোখ মুছে ফেলল। এখন। মন দুর্বল হলে চলবে না এখন অনেক কাজ।

ততক্ষণে বিস্কো আর কয়েকজন ভাইকিং বন্ধু ঘরে ঢুকল। ওরা শাঙ্কোর মুখে শুনেছে অসুস্থ ফ্রান্সিসকে রাজবৈদ্যির বাড়িতে নিয়ে যেতে হবে। বিস্কোর শরীর এখনও দুর্বল। কিন্তু সেই দুর্বলতা ও গায়ে মাখলনা। হ্যারি ডাকল—রাজকুমারী! মারিয়া আস্তে আস্তে মুখ তুলে হ্যারির দিকে তাকাল। হ্যারি-বলল—একটুকথা ছিল। মারিয়া বিছানা থেকে উঠে হ্যারির কাছে এলো। হ্যারি দেখল-মারিয়ার দুচোখ লাল। চোখের নীচে গভীর কালি। মুখ শুকিয়ে গেছে। দু’গালের চোখের জলের দাগ। হ্যারির বুকব্যথায় ভরে উঠল। মারিয়ার মাথার চুল সারা মুখে ছড়ানো। এলোমেলো। বেদনার প্রতিমূর্তি যেন। আজ বোঝার উপায় নেই মারিয়া কত হাসিখুশি কত প্রাণবন্ত মেয়ে। হ্যারি আস্তে আস্তে মারিয়াকে সব বলল। সব শুনে মারিয়া বলল—তাহলে ফ্রান্সিসকে যে নিয়ে যেতেই হবে। কিন্তু এতে ওর কষ্ট বাড়বে না তো?

—আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করবো ফ্রান্সিসকে সাবধানে সযত্নে নিয়ে যেতে, যাতে ওর কোনো কষ্ট না হয়—বিস্কো বলল।

—বেশ। মারিয়া আর কিছু বলল না। ফিরে গিয়ে বিছানায় বসল। ফ্রান্সিসের একটা পট্টি বাঁধা হাত কোলে তুলে নিল।

এদিকে জাহাজ সাজো সাজো রব উঠল। অসুস্থ ফ্রান্সিসকে রাজবৈদ্যের কাছে নিয়ে যেতে হবে।

বিস্কো ছুটে গেল কেবিন ঘরগুলোর পেছনে। একটুকারমতো জায়গাটায় অনেকগুলো কাঠের তক্তা থাকে থাকে সাজানো। জাহাজ মেরামতের জন্যে ওগুলো লাগে। বিস্কোর সঙ্গে কয়েকজন বন্ধুও ছুটে এসেছিল। ওরা ধরাধরি করে একটা লম্বাটে কাঠের তক্তা বের করল। নিয়ে এলো ফ্রান্সিসের ঘরে। তক্তা মেঝেয় পেতে তার ওপর মোটা কম্বলমতো পাতল দু’টো। রাখল বালিশ। বিছানামতে হ’ল। হ্যারি হাত চেপে পরীক্ষা করে দেখল বেশ নরম হয়েছে। ও একটা মোটা চাদর পেতে দিল। এবার ফ্রান্সিসকে বিছানা থেকে এনে এখানে শোয়াতে হবে। তারপর বিছানা-পাতা তক্তাটা নিয়ে জাহাজ থেকে নেমে যেতে হবে রাজবৈদ্যির বাড়ি।

এবার হ্যারি ওরা চিন্তায় পড়ল। নাড়াচাড়া করতে গেলে যদি ফ্রান্সিসের কষ্ট বাড়ে। হ্যারি কী করবে বুঝে উঠতে পারল না। ওদের ইতস্তত ভাব দেখে মারিয়া বলল—হ্যারি হয়তো এভাবে নিয়ে যেতে গেলে ফ্রান্সিসের কষ্ট বাড়বে। কিন্তু এক্ষুণি তো নিয়ে যেতেই হবে! ওদের বৈদ্যি বন্ধু তখনও বিছানায় মাথা নিচু করে বসেছিল। ভাঙা ভাঙা গলায় বলল—যত কষ্ট হোকফ্রান্সিসকে এক্ষুণি নিয়ে যাও। নইলে-ফুঁপিয়ে উঠে বলল—ফ্রান্সিসকে বাঁচানো যাবে না।

কথাটা শুনে হ্যারি বলে উঠল-রাজকুমারী—ফ্রান্সিসকে তুলে আনতে আপনি সাহায্য করুন। রাজকুমারী আস্তে আস্তে ফ্রান্সিসের কাঁধের নীচে হাত দিয়ে ফ্রান্সিসকে ডাকল—ফ্রান্সিস ? ফ্রান্সিস আস্তে আস্তে চোখ খুলল। চোখ দুটো লাল।—তোমাকে রাজবৈদ্যির কাছে নিয়ে যেতে হবে। ফ্রান্সিস কোনো কথা না বলে আবার চোখ বুজল। মারিয়া ফ্রান্সিসের ঘাড়ের পেছনে হাত দিয়েই বুঝেছিল প্রচণ্ড জ্বর ফ্রান্সিসের। ফ্রান্সিস আবার মাথা দু’একবার এপাশ-ওপাশ করে গোঙাল।

হ্যারি ইঙ্গিতে বিস্কোকে কাঠের তক্তার বিছানাটা ধরতে বলল। দু’জনে বিছানা পাতা তক্তাটা বিছানায় তুলে ফ্রান্সিসের পাশে রাখল। তারপর কয়েকজন ভাইকিংকে ইঙ্গিতে ডাকল। পাঁচ ছ’জন মিলে আস্তে আস্তে ফ্রান্সিসকে তুলল। ফ্রান্সিস গোঙাতে লাগল। ফ্রান্সিসের অসহ্য কষ্ট বেদনার কথা ভেবে বন্ধুদের কারো কারো চোখে জল এলো। হ্যারি চাপাস্বরে বলল—কেউ কেঁদো না। তোমাদের চোখে জল দেখলে ফ্রান্সিস দুর্বল হয়ে পড়বে।

আস্তে আস্তে ওরা ফ্রান্সিসকে ধরে বিছানাপাতা তক্তায় শুইয়ে দিল। মারিয়া ফ্রান্সিসের হাত দুটো আস্তে আস্তে বিছানাটার দু’পাশে নামিয়ে রাখল। বোধহয় অসহ্য হাতের যন্ত্রণার জন্যেই ফ্রান্সিস চোখমুখ কুঁচকে মাথা নাড়ল। ওর গলায় গোঙানির শব্দ হল। ফ্রান্সিস একবার চোখ মেলে মারিয়া আর বন্ধুদের ঝুঁকে পড়া মুখের দিকে তাকাল। কিন্তু কাউকেই চিনল না বোধহয়। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে দু’চোখ বন্ধ করল। আটদশজন ভাইকিং বন্ধু হ্যারি আর বিস্কো বিছানা-পাতা তক্তাটা এবার আস্তে তুলল। খুব সাবধানে, হাতে ধরাধরি করে কেবিনঘরের বাইরে নিয়ে এলো। আস্তে আস্তে ডেক-এ ওঠার সিঁড়ির দিকে চলল।

সিঁড়ি বেয়ে সাবধানে সযত্নে উঠে ডেকে-এ এলো। তারপর ধরাধরি করে নিয়ে চলল কাঠের পাটাতনের দিকে। কাঠের পাটাতন তো খুব বড়ো হয় না। মাত্র দুজন সামনে পেছনে নামতে পারে। এবার শাঙ্কো ছুটে এসে বিছানাটার সামনে ধরল। আর একপাশে ধরল বিস্কো। দুজনে মিলে এবার বিছানাপাতা তক্তাটা নিয়ে পাটাতন দিয়ে নামতে লাগল। একে ফ্রান্সিসের শরীরের ভার তার ওপর সরু পাটাতন। শাঙ্কো আর বিস্কোর ভীষণ কষ্ট হতে লাগল। হাত দুটো যেন ছিঁড়ে যাবে এরকম অবস্থা। কিন্তু ওরা দাঁত চেপে সেই কষ্ট সহ্য করল। আস্তে আস্তে ফ্রান্সিসকে জাহাজঘাটায় নামিয়ে আনল। এবার আট-দশজন বন্ধু ছুটে এলো। ওরা সবাই মিলে সেই বিছানাপাতা তক্তাটা ধরাধরি করে আস্তে আস্তে সাবধানে নিয়ে চলল। ফ্রান্সিস এরমধ্যে একবার মাত্র চোখ চেয়েছিল। মাথা এপাশ-ওপাশ করছিল। ওর গলা থেকে বেরিয়ে এসেছিল গোঙানির শব্দ।

আস্তে আস্তে ওরা রাজবৈদ্যের বাড়ি পৌঁছল। রাজবৈদ্য সহকারী এগিয়ে এলো। পাশের ঘরে একটা কাঠপাতাশয্যায় ফ্রান্সিসকে শুইয়ে দিতে ইঙ্গিত করল। বন্ধুরা সেখানে ফ্রান্সিসকে শুইয়ে দিয়ে বাড়ির বাইরে চলে গেল। শয্যার পাশে বসল মারিয়া। নিশ্চল পাথরের মতো বসে রইল। হ্যারি আর বিস্কো সেই ঘরে দাঁড়িয়ে রইল।

একটু পরে রাজবৈদ্য এলেন। ফ্রান্সিসের বিছানায় বসলেন। ফ্রান্সিসের কপালে গলায় হাত দিয়ে বোধহয় জ্বর কেমন দেখলেন। পায়ের কাছে কম্বল সরিয়ে পা দুটো টিপে হাত বুলিয়ে দেখলেন। তারপর পট্টি বাঁধা হাত দুটো আস্তে আস্তে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখলেন। এবার সহকারীর দিকে তাকিয়ে কী বললেন। সহকারী দ্রুত বেরিয়ে গেল। একটু পরে কালো কাঠের গামলা নিয়ে এলো। তাতে গরম জল। ধোঁয়া উঠছে। সহকারী কিছু মোটা সাদা কাপড়ের টুকরো নিয়ে এলো। সেসব রাজবৈদ্যকে দিল। তারপর একটা ছোট্ট পুঁটুলিমতো বের করল। সেটা গরম জলে চুবিয়ে নাড়তে লাগল। বেগুনি রঙ হয়ে গেল জলটার।

রাজবৈদ্য বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। ফ্রান্সিসের বাঁ হাতটা আস্তে আস্তে তুললেন। তারপর কিছুটা সাদা ন্যাকড়া ছিঁড়ে নিয়ে ঐ গামলার জলে চুবিয়ে ভেজালেন। সেটা হাতের পট্টির গায়ে লাগিয়ে ভেজালেন। আস্তে আস্তে পট্টিটা খুলতে লাগলেন। কিছুটা খুলতেই দগদগে ঘামতে দেখা গেল। রাজবৈদ্য এবার হ্যারির দিকে তাকালেন। মারিয়াকে দেখিয়ে আস্তে বললেন—এই ভদ্রমহিলাকে বাইরে যেতে বলুন। গ্রীকভাষা মারিয়া বুঝল না। হ্যারি মারিয়াকে বলল-রাজকুমারী, আপনি একটু বাইরে যান। মারি। কোনো কথা

বলে ঘরের বাইরে চলে গেল। রাজবৈদ্য সেই গামলার বেগুনি রঙের জলে ন্যাকড়া ভিজিয়ে ভিজিয়ে ফ্রান্সিসের দু’হাতের পট্টি আস্তে আস্তে খুলে ফেলল। দেখা গেল দুটো হাতেই কাটা জায়গাগুলো ঘায়ের মতো হয়ে গেছে। হাত দুটো বেশ ফুলেও গেছে। রাজবৈদ্য সহকারীকে কী বললেন। সহকারী ছুট্টে গিয়ে একটা তিনকোণা পাতায় জড়ানো হলুদ রঙের আঠামতো কী নিয়ে এলো। রাজবৈদ্য সেই জিনিসটা থেকে কিছুটা নিয়ে আস্তে আস্তে ফ্রান্সিসের হাতের ক্ষতস্থানে লাগিয়ে দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে ফ্রান্সিস অস্ফুট

আর্তনাদ করে একবার মাথা তুলল। আবার মাথা নামাল বালিশের ওপর। জোরে জোরে, শ্বাস নিতে লাগল। রাজবৈদ্য সমস্ত ওষুধটাই দু’হাতের ক্ষতস্থানে আস্তে আস্তে লাগিয়ে দিলেন। তাকিয়ে রইলেন ফ্রান্সিসের মুখের দিকে।

কিছুক্ষণ সময় কাটল। ঘরের সবাই তাকিয়ে আছে ফ্রান্সিসের মুখের দিকে। ফ্রান্সিস মাঝে মাঝেই চোখ মুখ কোঁচকাচ্ছিল। আস্তে আস্তে ফ্রান্সিসের শ্বাস-প্রশ্বাস স্বাভাবিক হ’ল। নাকমুখ কোঁচকানো বন্ধ হ’ল। ফ্রান্সিস চুপ করে চোখ বোজা অবস্থায় শুয়ে রইল। বোঝা গেল যেন ওর কষ্ট একটু কমল।

রাজবৈদ্য এবার শুকনো মোটা সাদা কাপড় দিয়ে আস্তে আস্তে ফ্রান্সিসের হাত দুটো বেঁধে দিলেন। দুটো হাত বিছানায় পেতে দিলেন। বিছানা ছেড়ে উঠলেন। হ্যারি রাজবৈদ্যর সামনে এগিয়ে এলো। বলল—আমাদের বন্ধু—সুস্থ হবে তো? রাজবৈদ্য পাকা দাড়ি গোঁফের ফাঁকে হাসলেন। বললেন—আর ঘণ্টা পাঁচ-ছয় দেরি হলে আপনাদের বন্ধুকে বোধহয় বাঁচানো যেত না। যা হোক—ওষুধে কাজ হয়েছে এখন আস্তে আস্তে জ্বর কমবে। ব্যথা জ্বালা যন্ত্রণাও কমবে। বন্ধুটি সুস্থ হবে। হ্যারি রাজবৈদ্যর ডানহাতটা দুহাতে জড়িয়ে ধরল। তারপর হাত ছেড়ে দিয়ে দু’হাতে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। রাজবৈদ্য হ্যারির পিঠে আস্তে আস্তে চাপড় দিয়ে ওকে সান্ত্বনা দিয়ে চলে গেলেন।

মারিয়া দ্রুত ঘরে ঢুকল। হ্যারিকে ফুঁপিয়ে কাঁদতে দেখে মারিয়া কেমন বিহ্বলের মতো বলে উঠল—তাহলে ফ্রান্সিস কি—আমাকে এই জন্যেই এখানে থাকতে দেওয়া হয় নি। হ্যারি তাড়াতাড়ি মাথা ঝাঁকিয়ে বলল-না-না রাজকুমারী। রাজবৈদ্য বলছেন—ফ্রান্সিস সুস্থ হবে। আস্তে আস্তে ওর জ্বর কমবে জ্বালা যন্ত্রণা কমবে। ভয়ের কিছু নেই।

মারিয়া কোনো কথা বলল না। আস্তে আস্তে গিয়ে ফ্রান্সিসের শিয়রের কাছে বসল। একটা হাত আস্তে আস্তে তুলে কোলে রাখল। হাত বুলোত লাগল।

সময় কাটতে লাগল। তখনও ঘরের মধ্যে হ্যারি বিস্কো শাঙ্কো। বাইরে অন্য বন্ধুরা ঠায় দাঁড়িয়ে আছে।

ঘণ্টা দুয়েক কাটল। ফ্রান্সিস আস্তে আস্তে চোখ খুলে তাকাল। মারিয়া ঝুঁকে বলল—ফ্রান্সিস—এখন কেমন লাগছে? মারিয়া দেখল ফ্রান্সিসের চোখের লাল ভাবটা অনেক কম। কপালে হাত দিল। জ্বর অনেক কম। ফ্রান্সিসের চোখের দৃষ্টিও স্বাভাবিক এখন। ফ্রান্সিস অস্ফুটস্বরে বলল—একটু ভালো।

—কোনো ভয় নেই। ফ্রান্সিস—রাজবৈদ্য বলেছেন তুমি ভালো হয়ে যাবে। মারিয়া বলল। ফ্রান্সিস শুনো ঠোঁটে হাসল। ক্লান্তস্বরে বলল—জল। হ্যারি ছুটে গেল। একটু পরেই একটা কাঠের পাত্রে খাবার জল নিয়ে এলো। মারিয়া আস্তে আস্তে ফ্রান্সিসকে জল খাইয়ে দিল। জল খেয়ে ফ্রান্সিস বোধহয় ঘুমিয়ে পড়ল।

হ্যারির মুখে এতক্ষণে হাসি ফুটল। ও হেসে বিস্কো আর শাঙ্কোর দিকে তাকাল। ওরাও হাসল। শাঙ্কো এক লাফে ঘরের বাইরে এলো। বন্ধুরা অনন্ত অনড় দাঁড়িয়ে আছে। শাঙ্কো চাপা গলায় বলল—ভাইসব—ফ্রান্সিস এখন অনেকটা সুস্থ। রাজকুমারীকে চিনতে পেরেছে। কথা বলেছে। জল খেয়েছে। সবাইয়ের মুখে হাসি ফুটল। অন্য সময় হলে হয়তো—ও—হো—হো করে চিৎকার জুড়তো। এখন সবাই চুপ। একজন দু’জন করে ওরা বারান্দার পাথুরে মেঝেতে বসে পড়ল। কেউ কেউ শুয়ে পড়ল। গতকাল সারা রাত ওরা শরীরের সমস্ত শক্তি নিঃশেষ করে জাহাজের দাঁড় বেয়েছে। এখন এই বেলা পর্যন্ত কেউ কিছু খায় নি। ক্লান্তিতে অবসাদে সবাই তখন খাওয়ার কথাও ভুলে গেছে। অবশ্য ফ্রান্সিসের অসুস্থতার কথা ছাড়া অন্য কিছু ভাবতে পারে নি এতক্ষণ। ফ্রান্সিস সুস্থ আছে জেনে এবার ওরা নিশ্চিন্ত হ’ল। উৎকণ্ঠা কেটে গেল। এতক্ষণে ওরা বুঝতে পারল ওরা কী ভীষণ ক্লান্ত।

হ্যারি ওদের কাছে এলো। বলল, ভাইসব—ফ্রান্সিস এখন অনেকটা সুস্থ। গতরাতে তোমরা অমানুষিক পরিশ্রম করে সময়কে জয় করেছিলে। তাই ফ্রান্সিসকে বাঁচাতে পারলাম আমরা। এবার জাহাজে ফিরে যাও। রাঁধুনিকে বলো রান্না করতে। তোমরা খেয়েদেয়ে বিশ্রাম করো। আমি শাঙ্কো আর রাজকুমারী এখানে রইলাম। তোমরা খেতে যাও। আমরা পরে খাবো।

ভাইকিং বন্ধুরা চলে গেল জাহাজে। হ্যারি রাজবৈদ্যের কাছে গেল। বলল—আপনাকে কী করে কৃতজ্ঞতা জানাবো। রাজবৈদ্য হেসে হাত তুলে হ্যারিকে থামালেন। বললেন শুনুন আপনাদের যা শরীরের অবস্থা তাতে তাকে টানাটানি করা তাঁর পক্ষে ক্ষতিকর হবে। রোগী ঐ ঘরেই থাকবে। আমার সহকারী সব ব্যবস্থা করবে।

—তাহলে তো খুবই ভালো হয়। হ্যারি বলল—আমরা কয়েকজন এখানে থাকবো দিন রাত—রাজকুমারী মারিয়া সেবা-শুশ্রূষা করবেন।

হ্যারি ঘরে ফিরে এলো। দেখল মারিয়া ফ্রান্সিসের ডান হাতটা কোলে নিয়ে সেই একইভাবে চুপ করে বসে আছে। হ্যারি আস্তে আস্তে বলল-রাজকুমারী-রাজবৈদ্য বললেন ফ্রান্সিসকে এই ঘরে থাকতে হবে। ওর শরীরের এই অবস্থায় ওকে জাহাজে আনা নেওয়া নাড়াচাড়া করা উচিত হবে না। আমি তাতে রাজি হয়েছি। এখন আপনি বলুন। মারিয়া মাথা নিচু করে শান্তভাবে বলল—তোমরা যা চাইবে তা হবে। আমার মাথার ঠিক নেই। আমি কিছু ভাবতে পারছি না।

—তাহলে ফ্রান্সিস এখানেই থাক। আমরা কয়েকজন পালা করে এখানে থাকবো। আপনাকে সাহায্য করবো। হ্যারি বলল। মারিয়া শুধু মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল। কোনো কথা বলল না।

হ্যারি ঘরের বাইরে বারান্দায় এসে বসল। অপেক্ষা করতে লাগল কখন শাঙ্কো বিস্কো ওর জাহাজ থেকে খাওয়া-দাওয়া শেষ করে আসে।

বেলা বাড়তে লাগল। হ্যারি বারান্দায় পাথরের দেওয়ালের ঠেস দিয়ে বসে রইল। ফ্রান্সিস এখন কিছুটা সুস্থ। আর ফ্রান্সিসের জীবনের আশঙ্কা নেই—রাজবৈদ্য তো তাই বললেন, এতক্ষণে হ্যারি বুঝতে পারল—ও কতটা শ্রান্ত, ক্লান্ত, ক্ষুধার্ত। হ্যারি দু’চোখ বুজল। আস্তে আস্তে ঐ অবস্থাতেই ঘুমিয়ে পড়ল।

বিস্কোর ডাকে হ্যারির ঘুম ভেঙে গেল। হ্যারি চোখ খুলে দেখল—বিস্কো শাঙ্কো ওরা কয়েকজন ওর পাশে এসে বসল।

হ্যারি উঠে দাঁড়াল। ঘরে ঢুকল। দেখল মারিয়া ফ্রান্সিসের কপালে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। ফ্রান্সিস ঘুম ভেঙে চেয়ে আছে। হ্যারি আস্তে আস্তে ডাকল—ফ্রান্সিস ফ্রান্সিস আস্তে আস্তে মুখ ফিরিয়ে ওর দিকে তাকাল। হ্যারি বলল—কিছু খাবে? ফ্রান্সিস কোনো কথা বলল না। আস্তে মাথা ওঠানামা করে চাইল। হ্যারি বলল—দেখি রাজবৈদ্যর সহকারী কী বলে? হ্যারি ভেতরের উঠোন মতো জায়গাটায় গেল। দেখল সহকারী যারা ওষুধ জ্বাল দিচ্ছে তাদের নির্দেশ দিচ্ছে। হ্যারি কাছে গিয়ে বলল—আমাদের বন্ধু—ফ্রান্সিস ও এখন একটু ভালো। ও খেতে চাইছে। ওকে কী খেতে দেব? সহকারী বলল—তাকে তো শক্ত খাবার দেওয়া যাবে না। আমি খাবার তৈরি করিয়ে দিচ্ছি। আপনারা খাইয়ে দিন।

ঘরে এসে হ্যারি মারিয়াকে সেকথা বলল। তারপর অপেক্ষা করতে লাগল।

কিছুক্ষণ পরে একজন তো একবাটি খাবার জলও নিয়ে এলো। বাটিতে একটা ছোটো কাঠের হাতা রাখা! মারিয়া আস্তে আস্তে ডাকল ফ্রান্সিস ফ্রান্সিস চোখ বন্ধ করে ছিল। চোখ খুলে তাকাল। মারিয়া বলল—একটু খেয়ে নাও। ফ্রান্সিস মুখ হাঁ করল। মারিয়া হাতায় করে খাবার খাইয়ে দিতে লাগল।

ফ্রান্সিস খাবার খেয়ে জল খেয়ে একটু যেন ভালো বোধ করতে লাগল। চোখ বন্ধ করল। হ্যারি বলল—রাজকুমারী-জাহাজে চলুন। কাল থেকে আপনি এক ফোঁটা জলও খান নি। মারিয়া মাথা নাড়ল।

—অবুঝ হবেন না রাজকুমারী। এভাবে না খেয়ে থাকলে আপনি অসুস্থ হয়ে পড়বেন। ফ্রান্সিস তো এখন কিছুটা সুস্থ। আসুন। হ্যারি বলল।

মারিয়া আর আপত্তি করল না। আস্তে আস্তে বিছানা ছেড়ে উঠল। হ্যারি মারিয়াকে সঙ্গে নিয়ে ঘরের বাইরে এলো। শাঙ্কো এগিয়ে এলো। হ্যারি বলল—শাঙ্কো তোমরা ফ্রান্সিসের কাছে থাকো। আমরা জাহাজে খেতে যাচ্ছি। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ফিরে আসবো।

তখন সন্ধে হয়ে গেছে। অসুস্থ ফ্রান্সিসের ঘরে একটা মোটা মোমবাতি জ্বলছে। ফ্রান্সিসের শিয়রে মারিয়া বসে আছে। হ্যারি শাঙ্কো মেঝেয় মোটা কম্বলমতো পেতে বসে আছে।

সহকারীকে নিয়ে রাজবৈদ্য এলেন। ফ্রান্সিসের বিছানায় বসলেন। ফ্রান্সিস চোখ বুজে ছিল। মারিয়া মুখ নামিয়ে বলল—ফ্রান্সিস-রাজবৈদ্য এসেছেন। ফ্রান্সিস চোখ মেলে তাকাল। রাজবৈদ্য হেসে গ্রীক ভাষায় বললেন—কেমন আছেন? ফ্রান্সিস বুঝল না। হ্যারি বলে উঠল—ফ্রান্সিস তুমি কেমন আছো রাজবৈদ্য তাই জানতে চাইছেন। ফ্রান্সিস শুকনো ঠোঁটে একটু হাসি ফুটিয়ে মাথা নেড়ে বোঝাল-ভালো। রাজবৈদ্য ফ্রান্সিসের কপালে গলায় গায়ে পায়ে হাত দিয়ে দেখলেন। তারপর হাত দুটো তুলে দেখলেন। ফ্রান্সিস একটু চোখ মুখ কোঁচকাল। রাজবৈদ্য সেটা লক্ষ্য করলেন। সহকারীকে মৃদুস্বরে বললেন। তারপর যখন চলে যাচ্ছেন হ্যারি এগিয়ে গিয়ে বলল—কেমন দেখলেন? রাজবৈদ্য পাকাদাঁড়ি গোঁফের ফাঁকে হেসে বললেন—অনেকটা ভালো। কাল সকালে আবার ওষুধ পড়বে। জ্বর ছেড়ে যাবে। জ্বালা যন্ত্রণাও অনেক কমে যাবে। তিনি চলে গেলেন। ওদিকে সহকারী কাপড়ের পুটুলি থেকে বড়ি বের করে মারিয়াকে ইঙ্গিতে খাইয়ে দিতে বলল। ওষুধ খেয়ে ফ্রান্সিস আবার চোখ বুজে শুয়ে রইল।

রাত হ’ল। হ্যারি মারিয়া শাঙ্কো আর বন্ধুরা কয়েকজন পালা করে জাহাজ থেকে খেয়ে এলো। রাজবৈদ্যর সহকারী ফ্রান্সিসের খাবার দিয়ে গেল। ফ্রান্সিস খাবে বলে উঠে বসতে গেল। পারল না। শুয়ে পড়ে হাঁপাতে লাগল। মারিয়া ব্যস্ত হয়ে বলল—তোমাকে উঠতে হবে না। আমি খাইয়ে দিচ্ছি। মারিয়া ফ্রান্সিসকে খাইয়ে দিতে লাগল।

রাত বাড়তে লাগল। সেই ঘরের মেঝেয় মোটা কম্বলমতো পেতে হ্যারি আর শাঙ্কো শোবে ঠিক করল। হ্যারি শুয়ে পড়ার আগে বলল—রাজকুমারী—আপনি এখন ঘুমিয়ে নিন। আমরা আছি। মারিয়া মাথা নাড়ল। হ্যারি আর শাঙ্কো শুয়ে পড়েই ঘুমিয়ে পড়ল। এত ক্লান্ত ছিল ওরা যে চোখ মেলে তাকাতে পারছিল না।

রাত শেষ হয়ে এসেছে তখন। হঠাৎ হ্যারির ঘুম ভেঙে গেল। ও সঙ্গে সঙ্গে উঠে বসল। দেখল মারিয়া বিছানায় গুটিসুটি হয়ে শুয়ে ঘুমিয়ে আছে। ও আর মারিয়াকে ডাকল না।

হ্যারি বসে রইল। কিছুক্ষণ পরেই বাইরে একটা পাখির ডাক শুনল। তারপর আরো দু’তিনটি পাখির ডাকে বুঝল ভোর হয়ে এসেছে।

হঠাৎ ফ্রান্সিসের অস্ফুট ডাক শুনল—মারিয়া। হ্যারি সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়াল। ফ্রান্সিসের কাছে গেল। মারিয়ার কানে ডাকটা যায় নি। ও তখন অঘোরে ঘুমুচ্ছে। ফ্রান্সিস হ্যারিকে দেখে হাসল। বলল—হ্যারি—দেখতো মনে হচ্ছে জ্বরটা ছেড়ে গেছে। হ্যারি তাড়াতাড়ি ফ্রান্সিসের কপালে হাত রাখল। ঠাণ্ডা। আনন্দে হ্যারির চোখে জল এসে গেল। ও দু’হাতে চোখের জল মুছে ফেলল। ফ্রান্সিস হেসে দুর্বল কণ্ঠে বলল—এই—ছেলেমানুষি করো না। একটু থেমে বলল—হ্যারি—যে জীবন আমরা মেনে নিয়েছি সেখানে সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের কোনো স্থান নেই। আছে শুধু বিরুদ্ধ শক্তির সঙ্গে লড়াই। সংকল্প সাধনের জন্যে লড়াই। সমস্ত দুঃখ কষ্ট ব্যথা বেদনা দাঁত চেপে সহ্য করে লক্ষ্যে পৌঁছোতে হবে। এখানেই মানুষের জীবনের সার্থকতা। ফ্রান্সিস কথাগুলো বলে একটু হাঁপাতে লাগল। হ্যারি বলল বেশি কথা বলো না ফ্রান্সিস তোমার শরীর এখন ভীষণ দুর্বল।

ওদের কথাবার্তাতেই বোধহয় মারিয়ার ঘুম ভেঙে গেল। ও লাফিয়ে উঠে বসল। হ্যারির দিকে তাকিয়ে—আকুলস্বরে বলে উঠল—কী হয়েছে হ্যারি? হ্যারি হেসে বলল—ভয়ের কিছু নয়। ফ্রান্সিসের জ্বর একেবারে ছেড়ে গেছে।

—এ্যাঁ। মারিয়া তাড়াতাড়ি ফ্রান্সিসের কপালে হাত রাখল। গলায় হাত রাখল। তারপর দু’হাত মুখ চেপে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। ফ্রান্সিস হেসে বলল—এই কেঁদো না। সব ঠিক হয়ে যাবে। হ্যারি আস্তে আস্তে এসে নিজের জায়াগায় শুয়ে পড়ল। মারিয়া তখন ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে!

তিন দিন কাটল। চারদিনের দিন ফ্রান্সিসের দু’হাতের পট্টি রাজবৈদ্যি এসে খুললেন। দেখা গেল হাতের ফোলা একেবারেই নেই। ঘাও শুকিয়ে গেছে। এর মধ্যে ফ্রান্সিস বিছানায় উঠে বসেছে। মেঝেয় একটু একটু পায়চারি করেছে। দেখেশুনে ফ্রান্সিসকে পরীক্ষা করে রাজবৈদ্য পাকা দাঁড়িতে হাত বুলোতে বুলোতে বললেন—এবার আপনি আপনাদের জাহাজে ফিরে যেতে পারেন! আর কয়েকদিনের মধ্যেই আপনি সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে যাবেন। ফ্রান্সিস আস্তে আস্তে হাত বাড়িয়ে রাজবৈদ্যর ডান হাত আস্তে ধরল। রাজবৈদ্য সস্নেহে ফ্রান্সিসের মুখের দিকে তাকিয়ে হাসলেন।

সেদিন দুপুরের একটু পরে হ্যারি রা ফ্রান্সিসকে নিয়ে জাহাজঘাটার দিকে রওনা হল। মারিয়া ফ্রান্সিসের হাত ধরে ওর পাশে পাশে চলল। দু’পাশে পেছনে রইল বিস্কো শাঙ্কোরা। ফ্রান্সিস বেশ আস্তে আস্তে হাঁটছিল। হ্যারি বলেছিল ফ্রান্সিসকে—তোমার শরীর দুর্বল। তুমি কাঠের তক্তায় পাতা বিছানায় বসো আমরা ধরে নিয়ে যাচ্ছি। ফ্রান্সিস রাজি হয় নি।

ফ্রান্সিস চলার মধ্যেই একটু থেমে থেমে চলল। জাহাজঘাটায় এলো ওরা। সরু পাটাতনের ওপর দিয়ে উঠতে গিয়ে ফ্রান্সিসের মাথাটা একটু ঘুরে উঠল। টাল খেল ও। পেছন থেকে বিস্কো ফ্রান্সিসকে জোরে জড়িয়ে ধরল। সামনে উঠেছিল শাঙ্কো। সেও ফ্রান্সিসকে ধরল। আস্তে আস্তে ওরা ফ্রান্সিসকে নিয়ে জাহাজে উঠল।

খাওয়া-দাওয়া বিশ্রাম। কয়েকদিনের মধ্যেই ফ্রান্সিস সম্পূর্ণ সুস্থ হল।

সেদিন ফ্রান্সিসের ভাইকিং বন্ধুরা জাহাজে উৎসবের আয়োজন করল।

হ্যারি ফ্রান্সিস মারিয়ার কেবিনঘরে এলো। দেখল—ফ্রান্সিস সেই আগের মতোই প্রাণবন্ত। কী একটা কথা নিয়ে ফ্রান্সিস আর মারিয়া হাসাহাসি করছে।

—এসো হ্যারি। ফ্রান্সিস হাসতে হাসতেই বলল। হ্যারি এগিয়ে এসে বলল ফ্রান্সিস-রাজবৈদ্য তোমাকে চিকিৎসা করে সুস্থ করে তুলেছেন। এবার তাকে তো তার প্রাপ্য পারিশ্রমিক দিতে হয়। ফ্রান্সিস মারিয়ার দিকে তাকিয়ে হাসল। বলল—মারিয়া—চিকমা থেকে কিছু দামি জিনিস আনতে পারলে ভালো হত। একবারে শূন্য হাতে চলে এলাম।

—তাতে আমি মোটেই দুঃখিত নই। মারিয়া বলল। তারপর বিছানার একপাশ থেকে একটা কালো চকচকে কাঠের বাক্স বের করল। বাক্স খুলে বের করল একটা মোটা সোনার চেন-এর হার। তাতে লকেটের মতো ঝুলছে একটা প্রায় হাঁসের ডিমের মতো মুক্তো। ফ্রান্সিস দেখেই চিনল। এই সবচেয়ে বড়ো মুক্তোটা ও মারিয়ার জন্যে মুক্তোর সমুদ্র থেকে এনেছিল। ফ্রান্সিস একটু মনঃক্ষুণ্ণ হ’ল। বলল—মারিয়া—এটা আমাদের স্মৃতির জিনিস।

—ঠিক—মারিয়া বলল—কিন্তু যিনি তোমাকে মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরিয়ে এনেছেন তাঁকে তো আমার সবচেয়ে প্রিয় জিনিসটাই দিতে হবে। ফ্রান্সিস একটু চুপ করে থেকে দেখে বলল—এতে তোমার কোনো কষ্ট হবে না তো।

—বিন্দুমাত্র না—মারিয়া হেসে বলল—তোমার চেয়ে মূল্যবান আমার কাছে অন্য কিছুই নয়। চলো হ্যারি

হ্যারি আরমারিয়া রাজবৈদ্যর বাড়ি এলো। রাজবৈদ্যর তখন শেষ রোগীটা দেখা হয়ে গেছে। হ্যারি আরমারিয়াকে দেখে হেসে বসতে বললেন। ওরা বসল। রাজবৈদ্য মারিয়াকে বললেন—সেদিন আপনাকে ঘরের বাইরে চলে যেতে বলেছিলাম কেন জানেন? আপনার স্বামীর ফোলা হাতের ঘা দেখলে আপনি আতঙ্কগ্রস্ত হতেন। আপনি সহ্য করতে পারতেন না। হ্যারি রাজবৈদ্যরকথাটা মারিয়াকে বুঝিয়ে বলল। মারিয়ার মন রাজবৈদ্যর প্রতি শ্রদ্ধায় ভরে উঠল। এবারমারিয়া বলল—আপনি এত মহৎ হৃদয়ের মানুষ। আমার স্বামীর জীবনদান করেছেন। এই ঋণ পৃথিবীর সবচেয়ে মূল্যবান জিনিস দিয়েও শোধ করা যায় না। তবু আমার প্রার্থনা এই হারটি গ্রহণ করে আমাদের ধন্য করুন। এবার হ্যারি মারিয়ার কথাগুলো গ্রীক ভাষায় রাজবৈদ্যকে বোঝাল। রাজবৈদ্য কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। আর আস্তে আস্তে বললেন—মা—তোমার এই শ্রদ্ধার উপহার আমি নিলাম। কয়েকদিন পরে আমার নাতনির, বিবাহ। এই উপহার তাকে একজন বিদেশিনী মা’র উপহার হিসেবে দেব। হ্যারি কথাটা বল মারিয়াকে বুঝিয়ে বলল। মারিয়া এত খুশি হ’ল যে ওর চোখে জল এসে গেল। ও বার বার মাথা নুইয়ে রাজবৈদ্যকে শ্রদ্ধা জানাল। তারপর ওরা জাহাজে ফিরে এলো। উৎসবের দিন সন্ধেবেলা ভাইকিংরা যে যা কিছু ভালো পোশাক এনেছিল তাই পরল। সবাই জড়ো হলো ডেক-এ। ফ্রান্সিস এখন সম্পূর্ণ সুস্থ। সবাই আনন্দ করতে লাগল।

ওদিকে ফ্রান্সিসের একটা ভালো পোশাক যে মারিয়া সঙ্গে এনেছিল সেটা ফ্রান্সিস জানতো না। রাজবাড়ির অনুষ্ঠানে যাবার পোশাক সেটা। মারিয়া সেই পোশাক বের করে ফ্রান্সিসের হাতে দিল। ফ্রান্সিস তো অবাক। এসব শৌখিন জমকালো পোশাক ফ্রান্সিস কিছুতেই পরতে চায় না। ওর অস্বস্তি হয়। কিন্তু আজকে ওর রোগমুক্তির জন্যে উৎসব। কাজেই, ফ্রান্সিসকে পরতে হ’ল সেই পোশাক। মারিয়াও পরল হালকা নীল রঙের গোড়ালি ঢাকা গাউন। একটু সাজগোজও করল। তারপরে দু’জনে হাত ধরাধরি করে জাহাজের ডেক-এ উঠে এলো। দেখল লাল নীল নানা রঙের কাগজ দিয়ে ডেক সাজানো হয়েছে।

হ্যারি শাঙ্কো বিস্কোরাও যা ভালো পোশাক সঙ্গে ছিল পরেছে। ফ্রান্সিস ও মারিয়া আসতেই সবাই চিৎকার করে ধ্বনি তুলল—ও—হো—হো—। জাহাজে যা সামান্য কিছু বাজি ছিল তাই ফাটানো হল। শুরু হ’ল নাচ গান। পেড্রো ধুলোটুলো ঝেড়ে ওর বেহালা মতো বাজনাটা নিয়ে এলো। সেটার আটটা তারের মধ্যে দুটোই ঘেঁড়ে গেছে। পেড্রো মনের আনন্দে সেই বাজনাই বাজাতে লাগল।

রাত বাড়ল। এবার ডেক-এর একপাশে একটা কাঠের আসনে ফ্রান্সিস ও মারিয়া বসল। ওদের ঘিরে দাঁড়াল বন্ধুরা। একজন বিস্কোকে বলল—বিস্কো তুমি সেদিন দাঁড়ঘরে গান গেয়ে আমাদের তালে তালে দাঁড় চালাতে সাহায্য করেছিল। সেই গান গাওনা ভাই। বিস্কো একটু হাসল। তারপর ওদের দেশের চারণ কবিরা যেসব গান গেয়ে গ্রাম গ্রামান্তরে ঘুরে বেড়ায় সেই গান ধরল।

মাতৃভূমির গান। মাটির গান। সবাই চুপ করে শুনতে লাগল। দেশ থেকে কতদুরে এক অজানা দেশের বন্দরে কানে আসছে দেশের গ্রামের মাটির গান।

বিস্কোর গান থামল। কেউ কোনো কথা বলল না। দেশের কথা মনে এলো। সকলেরই মন বেশ ভারী হয়ে গেল। মারিয়ারও মন খারাপ হয়ে গেল দেশের কথা ভেবে। ও মৃদুস্বরে ফ্রান্সিসকে বলল—ফ্রান্সিস—তোমার শরীর ভালো নেই। খানিয়া আর যাবো না। দেশে ফিরে যাই।

ফ্রান্সিস আস্তে আস্তে মাথা নেড়ে হেসে বলল—না মারিয়া তা হয় না। খানিয়াতে শেষ বাইজেন্টাইন সম্রাটের নিখোঁজ রাজমুকুট আমি খুঁজে করবোই।

কিন্তু কতদিন দেশ ছেড়ে এসেছি—মানে—মারিয়া কথাটা শেষ করতে পারল না। ফ্রান্সিস দৃঢ়স্বরে বলল—মারিয়া—তোমরা যদি কেউ না যাও—আমি একা যাবো। কেউ আমাকে সংকল্পচ্যুত করতে পারবে না। মারিয়া তাড়াতাড়ি বলল। না না—আমরা তোমার সঙ্গেই থাকবো। ফ্রান্সিস হেসে বলল দেশের গান শুনেছো তো—তাই তোমার মন খারাপ হয়ে গেছে। মন শক্ত করো।

এরপর আনন্দে উল্লাসে ভাটা পড়ল। আসল কথা দেশের কথা ভেবে প্রায় সবারই মন খারাপ হয়ে এলো।

রাতের খাওয়া-দাওয়া সেরে অনেকেই কেবিনঘরে শুয়ে পড়ল। বেশ গরম লাগছিল। শাঙ্কো কম্বলমতো মোটা কাপড়টা নিয়ে ডেক-এ উঠে এল। দেখল অনেকেই শুয়ে পড়েছে। শাঙ্কো জাহাজের মাথার কাছে কাপড় পেতে শুয়ে পড়ল। একসময় সমুদ্রের ঠাণ্ডা বাতাসে ওর চোখে ঘুম জড়িয়ে এলো।

তখন ভোর হয় হয়। জাহাজঘাটায় লোকজনের চিৎকার ডাকাডাকি চ্যাঁচামেচিতে শাঙ্কোর ঘুম ভেঙে গেল। ও উঠে দাঁড়াল। দেখল জাহাজঘাটায় লোকজনের খুব ব্যস্ততা। শাঙ্কো একবার ভাবল—নেমে গিয়ে জিজ্ঞেস করে ব্যাপারটা কী? কিন্তু ও তো গ্রীক ভাষা জানে না। ও ছুটল জাহাজের সিঁড়ির দিকে। হ্যারির কেবিনঘরের দরজায় ধাক্কা দিয়ে ডাকল—হ্যারি—হ্যারি।

হ্যারির ঘুম ভেঙে গেল। ও বেরিয়ে এলো।

—কী হয়েছে?

—জাহাজাঘাটায় দেখলাম—সব লোকজন ছুটোছুটি ডাকাডাকি করছে। কী ব্যাপার বুঝতে পারছি না।

—চলো তো। হ্যারি দ্রুত পায়ে সিঁড়ির দিকে ছুটল।

ডেক-এ উঠে দেখল বেশ কিছু ভাইকিং বন্ধু জাহাজের রেলিং ধরে জাহাজঘাটার দিকে তাকিয়ে আছে।

হ্যারি পাটাতন দিয়ে নামতে নামতে দেখল রাজা মার্কোর প্রায় শখানেক সৈন্য জাহাজঘাটায় সার দিয়ে দাঁড়াচ্ছে। সকলেই সশস্ত্র।

হ্যারি জাহাজঘাটায় নামল। সৈন্যদের দলপতিকে খুঁজতে লাগল। দেখল দলনেতা তলোয়ার হাতে সৈন্যদের সাজাচ্ছে। হ্যারি কাছে গেল। জিজ্ঞেস করল কী হয়েছে বলুন তো? দলনেতা একবার হ্যারিকে দেখল। বলল—তোমরা কে?

—আমরা ভাইকিং। ওদের জাহাজ দেখিয়ে বলল—ঐ যে আমাদের জাহাজ।

—জাহাজ চালিয়ে শিগগির পালিয়ে যাও।

—কেন?

—বিদ্রোহী এনরিকো পোলিরিনা দখল করেছে। তারপর এই নাক্সোস আক্রমণ করতে আসছে। অনেক কাছে চলে এসেছে। গুপ্তচর খবর এনেছে একটা যুদ্ধজাহাজ বোঝাই সৈন্য নিয়েই এই বন্দরের দিকে আসছে। আমরা লড়াইয়ের জন্যে তৈরি হচ্ছি। তোমরা পালাও। নইলে মরবে।

হ্যারি চিন্তায় পড়ল। ও দ্রুত ছুটল ওদের জাহাজের দিকে। ফ্রান্সিসকে জাহাজ ডেক এই পেল। ততক্ষণে সবাই ডেক-এ এসে দাঁড়িয়েছে। এত হৈ চৈ সৈন্য সাজানো কেন জানবার জন্যে। হ্যারি ফ্রান্সিসকে সব কথা বলল। ফ্রান্সিস একটুক্ষণ মাথা নিচু করে ভাবল। তারপর মাথা তুলে ডাকল

—পেড্রো? পেড্রো এগিয়ে এলো।

—শিগগির মাস্তুল ওঠো। সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে দেখো কোনো জাহাজ দেখতে পাও কিনা। পেড্রো তর তর করে মাস্তুল বেয়ে উঠে গেল। একটু পরে চিৎকার করে বলল—একটা জাহাজ আসছে—ফ্রান্সিস চিৎকার করে বলল—কত জোরে আসছে— কতক্ষণের মধ্যে এখানে এসে পৌঁছবে? পেড্রো একটুক্ষণ চুপ করে বোধহয় জাহাজের গতিবেগ হিসেব করল। বলল—আর ঘণ্টা দেড়েকের মধ্যে এখানে পৌঁছবে।

—কোনদিকে থেকে জাহাজটা আসছে? ফ্রান্সিস গলা জড়িয়ে বলল।

—বাঁ দিকে থেকে। পেড্রো গলা চড়িয়ে উত্তর দিল। ফ্রান্সিস উত্তরটা শুনেই সঙ্গে সঙ্গে বন্ধুদের দিকে তাকল। গলা চড়িয়ে বলল—ভাইসব আমরা এই যুদ্ধে জড়াবো না। এক মুহূর্ত সময় নষ্ট করা চলবে না। নোঙর তোল—পাল খাটাও—দাঁড়িরা দাঁড়ঘরে চলে যাও যত দ্রুত সম্ভব জাহাজ চালাও—ডানদিক লক্ষ্য করে। জাহাজে সাজো সাজো রব পড়ে গেল। মাস্তুল বেয়ে দ্রুত উঠল কয়েকজন। পালের দড়িদড়া টেনে পাল খুলে দিতে লাগল। শাঙ্কো আর বিস্কো ছুটে গিয়ে ঘর ঘর শব্দে নোঙর তুলে ফেলল। দাঁড়িরা সমুদ্রের জলে দাঁড় ফেলতে লাগল—ছপ ছপ। জাহাজ ঘাট থেকে আস্তে আস্তে সরে এলো। একটু দূরে আসতেই ভাইকিংরা সব পাল খুলে দিল। দাঁড়িরা জোর দিল দাঁড় টানায়। জাহাজ গতি পেল। ফ্রান্সিস ডাকল-কাভাল্লি। কাভাল্লি এগিয়ে এলো।

—এসো—তুমি—চালককে সাহায্য করো। দিক ঠিক করে খানিয়া বন্দরের দিকে জাহাজ চালাও। ফ্রান্সিস বলল। একটু পরেই জাহাজের গতি বাড়ল। দূরে মিলিয়ে গেল নাক্সোস বন্দর। জাহাজ মাঝ সমুদ্রে চলে এলো।

জোর বাতাসে পালগুলো ফুলে উঠল। দাঁড় বাওয়ার ছপ ছপ শব্দ উঠল সমুদ্রে। সমুদ্রের ঢেউ ভেঙে জাহাজ খানিয়ার দিকে পূর্ণবেগে চলল।

দু’দিন কাটল। বাতাস বেগবান। পালগুলো ফুলে রয়েছে। দাঁড়ও বাইতে হচ্ছে না। নির্বিঘ্নে চলছে জাহাজ।

তিন দিনের দিন দুপুর নাগাদ দূর থেকে খানিয়া বন্দরের জাহাজ, বাড়িঘর দেখা গেল। ফ্রান্সিসরা অনেকেই জাহাজের রেলিঙে এসে দাঁড়াল। আরো কিছুটা এগিয়ে বন্দরের স্বাভাবিক কর্মব্যস্ততা নজরে পড়ল। সব খুঁটিয়ে দেখে কাভাল্লি বলল—খানিয়ার অবস্থা শান্তিপূর্ণ। ঐ দেখুন এখানে বিদেশি জাহাজও রয়েছে। ঐ একটা জাহাজ বন্দর ছেড়ে যাচ্ছে। এখন সবই স্বাভাবিক অবস্থায় এসেছে। এবার ফ্রান্সিস হ্যারিকে বলল—কী করবো হ্যারি? জাহাজ বন্দরে ভেড়াবে না কাছাকাছি কোথাও জাহাজ নোঙর করবে। সেখানে থেকে নৌকায় চড়ে তীরে নামা যাবে। হ্যারি একটুক্ষণ ভাবল। তারপর বলল—দেখো, খানিয়ার দুর্গে তোমাকে যেতেই হবে,নইলে রাজমুকুট খুঁজে বের করবে কী করে? কাজেই গোপনীয়তার কোনো মানে হয় না। জাহাজ ঘাটাতেই জাহাজ ভেড়াবো আমরা। জাহাজঘাটা দিয়ে খানিয়ায় ঢুকবো।

বেশ। ফ্রান্সিস বলল। তারপর কাভাল্লির দিকে ফিরে বলল-কাভাল্লি তুমিও আমাদের সঙ্গে যাবে। কাভাল্লির চোখমুখে দুশ্চিন্তা ফুটে উঠল। ও বলল—দেখুন, বোনিফেসের সৈন্যরা আমাকে দেখলেই চিনে ফেলবে। এই সৈন্যরা অনেকেই তো বাইজেন্টাইন সম্রাটের সৈন্য ছিল। আমি কিন্তু বিপদে পড়বো তাহলে। ফ্রান্সিস বলল—কোনো ভয় নেই তোমার। রাজা বোনিফেস এখনও নিষ্মই রাজমুকুট খুঁজে বের করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ঐ মহামূল্যবান রাজমুকুটের জন্য বোনিফেসের মতো লোভী লোক তো পাগল হবেই। আমরা ওর এই দুর্বলতার সুযোগটা নেব। দেখবে। তোমাকে আর বোনিফেস কোনো বিপদেই ফেলবে না।

আপনারা পারবেন আমাকে রক্ষা করতে?কাভাল্লি বলল।

নিশ্চয়ই পারবো। ফ্রান্সিস বলল—বোনিফেসের মতো ভীষণ লোভী রাজা এর আগেও দেখেছি। কাজেই এদের মতিগতি আমি ভালোই বুঝি। তুমি কিছু ভেবো না। এবার ফ্রান্সিস ভাইকিং বন্ধুদের দিকে তাকিয়ে বলল—ভাইসব, আমরা লুকোচুরির মধ্যে যাবো না। বন্দরেই জাহাজ ভেড়াবো। তারপর কাভাল্লিকে নিয়ে আমি, হ্যারি আর মারিয়া খানিয়া নগরে যাবো। নিখোঁজ রাজমুকুট খুঁজে বের করব। এতে কিছুদিন সময় লাগবেই। কাজেই আমরা যদি দু’একদিনের মধ্যে না ফিরি তোমরা চিন্তা করো না। রাজার সঙ্গে কথা হলে আর সবদিক থেকে আমরা নিরাপদ থাকলে আমরা কেউ এসে তোমাদের খবর দিয়ে যাবো। ফ্রান্সিস থামল। একজন ভাইকিং বন্ধু বলল—ঠিক আছে আমরা এখানে তোমাদের খবরের জন্য অপেক্ষা করবো।

ফ্রান্সিসদের জাহাজ ধীরে ধীরে বন্দরে ভিড়ল। নোঙর ফেলা হলো। জাহাজঘাটা পর্যন্ত কাঠের পাটাতন ফেলা হলো। মারিয়া নিজের কেবিনে এলো। মোটামুটি সাজগোজ করে নিল। ফ্রান্সিস হ্যারি তৈরি হয়ে এলো। কাভাল্লি একজন ভাইকিংয়ের কাছ থেকে এক টুকরো কাপড় চাইল। ভাইকিংটি ওর কোমরের ফেট্টি থেকে কিছুটা কাপড় ছিঁড়ে দিল। কাভাল্লি সেইকাপড়ের টুকরোটা মাথা ও মুখের দুপাশে পেঁচিয়ে বাঁধল যাতে কেউ ওকে চিনতে না পারে।

তিনজনে জাহাজ থেকে নেমে এলো। কাভাল্লি ওদের পথ দেখিয়ে নিয়ে চলল খানিয়া দুর্গের দিকে। পথে লোকজনের ভিড়। তারমধ্যে রাজা বোনিফেসের সৈন্যরা ঘুরে বেড়াচ্ছে। দু’ধারে দোকানপাট। ঘোড়ায় টানা গাড়িও চলছে। কাভাল্লি চারিদিকে সতর্ক দৃষ্টি রেখে এগোচ্ছিল। তবু কাভাল্লি নিজেকে লুকিয়ে রাখতে পারল না। একটা মোড়ের মাথায় দু’জন সৈন্যের মুখোমুখি পড়ে গেল। একজন সৈন্য চলেই যাচ্ছিল। অন্যজনের কিন্তু কাভাল্লির কাপড় ঢাকা দেওয়া মুখ দেখে সন্দেহ করলো। সে কাভাল্লির মুখের দিকে ভালো করে তাকাল। সন্দেহ বাড়ল। একটানে কাভাল্লির মুখের ঢাকা দেওয়া কাপড়টা খুলে ফেলল। এবার আর কাভাল্লিকে চিনতে অসুবিধা হলো না। সৈন্যটি বলল—তুমি কাভাল্লি। সম্রাটের সজ্জাকক্ষের পাহারাদার ছিলে। কাভাল্লি ভয়ে আর কথা বলতে পারল না। হ্যারি এগিয়ে এলো। ভাঙা গ্রীক ভাষায় বললও কাভাল্লি। ফ্রান্সিস আর মারিয়াকে দেখিয়ে বলল—আমরা তিনজন ভাইকিং। আমরা ওর সঙ্গে এসেছি।

কেন?

সেসব আমরা রাজা বোনিফেসকে বলবো।

এখন তো রাজসভা শেষ হয়ে গেছে। সৈন্য বলল।

ঠিক আছে। আমাদের দুর্গে নিয়ে চলো। হ্যারি বলল।

দুর্গে গিয়ে কী করবে?

এবার কাভাল্লি বলল—আমি দুর্গরক্ষীদের অধিনায়কের সঙ্গে দেখা করব। তারপর রাজার সঙ্গে সাক্ষাৎ করার ব্যবস্থা করব।

সৈন্যটি বলল—বেশ চলো। কিন্তু কাভাল্লি, তুমি যদি আবার আমাদের চোখে ধুলো, দিয়ে পালাও—

না ও পালাবে না। হ্যারি বলল।

সৈন্য দু’জন ওদের নিয়ে চলল। তারা দু’জন সঙ্গে থাকায় দুর্গদ্বার দিয়ে ওদের ঢুকতে কোনো অসুবিধে হলো না। কাভাল্লি ওদের অপেক্ষা করতে বলে দুর্গের মধ্যে ঢুকে পড়ল। ফ্রান্সিসরা দাঁড়িয়ে আছে। সৈন্য দুজনও। কিছুক্ষণ পরে কাভাল্লি ফিরে এলো। ওর সঙ্গে একজন বেশ সুসজ্জিত মধ্যবয়স্ক লোক এলো। কাভাল্লি হ্যারিকে বলল—ইনিই দুর্গরক্ষীদের অধিনায়ক।

হ্যারি বলল—দেখুন আমরা তিনজন ভাইকিং। কাভাল্লিকে সঙ্গে নিয়ে আমরা এসেছি একটা উদ্দেশ্য নিয়ে।

কী সেই উদ্দেশ্য?

শেষ বাইজেন্টাইন সম্রাটের নিখোঁজ রাজমুকুট খুঁজে বের করতে এসেছি। এইজন্য রাজা বোনিফেসের সাক্ষাৎপ্রার্থী আমরা।

অধিনায়ক একটু ভাবল। বলল—এখন কি রাজা দেখা করবেন?

আপনি শুধু রাজাকে এই সংবাদটুকু পৌঁছে দিন যে কাভাল্লিকে সঙ্গে নিয়ে তিনজন ভাইকিং এসেছে। কী জন্যে এসেছি তাও বলবেন। কপাল ভালো। অধিনায়ক রাজি হলো। কিন্তু সঙ্গের সৈন্য দু’জনকে বলল—দেখো, কাভাল্লি যেন পালাতে না পারে। অধিনায়ক দুর্গে ঢুকে পড়ল।

বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল ওরা। অধিনায়ক ফিরে এলো। বলল—শিগগির এসো—রাজা তোমাদের সঙ্গে কথা বলবেন। সবাই দুর্গের মধ্যে ঢুকল। বিরাট বিরাট পাথরের খিলানওলা দরজা পার হয়ে একটা মস্তবড়ো কাঠের দরজার সামনে এলো ওরা। কাঠের দরজায় পেতলের ফুলপাতা আঁকা নানা কারুকাজ। সুদৃশ্য পেতলের বর্শা হাতে দুজন দ্বাররক্ষী ছিল। অধিনায়কের ইঙ্গিতে ওরা দরজা খুলে দিল।

বিরাট একটা ঘরে ঢুকল ওরা। কাভাল্লি বলল-রাজসভাঘর। হ্যারি সেটা ফ্রান্সিস আরমারিয়াকে বলল। ঘরের চারদিকে পেতলের মশালদণ্ডে মশাল জ্বলছে। রাজসভাঘরের পাথরের দেয়াল ও ছাদের দিকে তাকিয়ে ফ্রান্সিস অবাক হয়ে গেল। মশাল দণ্ডের মাথায় মাথায় উজ্জ্বলরঙে আঁকা কত ছবি দেয়ালে, ছাদে। ফুল লতাপাতা মানুষ সমুদ্র পাহাড় কী অপরূপ ছবি সেসব। বাইজেন্টাইন সম্রাটদের আমলে আঁকা এইসব ছবিই বুঝিয়ে দেয় বাইজেন্টাইন সম্রাটরা কত বড়ো শিল্পরসিক ছিলেন। সামনেই সিংহাসন। রুপোর সিংহাসনে কত কারুকাজ। গভীর নীলরঙের মখমলমোড়া সিংহাসন। দু’পাশে আরও দুখানা রুপোর আসন। রাজ-অমাত্যদের জন্যে।

ফ্রান্সিসরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে রাজসভা দেখতে লাগল। একটু পরে রাজা ঢুকল। সিংহাসনে বসল। বয়স হয়েছে রাজা বোনিফেসের। তবু হাঁটা চলা যুবকের মতো। বোনিফেস ফ্রান্সিসদের একবার দেখে নিয়ে কাভাল্লির মুখের দিকে তাকাল। বলল—তুমি কাভাল্লি? তুমি জানো বাইজেন্টাইন সম্রাটদের মুকুট কোথায় আছে?

হ্যারি আস্তে আস্তে বলল—না, কাভাল্লি জানে না। তবে আপনি যদি অনুমতি দেন তবে আমরা ঐ নিখোঁজ রাজমুকুট খুঁজে বের করতে চেষ্টা করবো।

রাজা বোনিফেস একটু চুপ করে থেকে বলল—নিখোঁজ রাজমুকুট আমার চাই। তারপর বলল—তোমরা ভাইকিং। এ দেশের কী জানো?

ফ্রান্সিসকে দেখিয়ে হ্যারি বলল—আমার এই বন্ধুটির নাম ফ্রান্সিস ফ্রান্সিস সাহস আর বুদ্ধিবলে অনেক গুপ্তধন উদ্ধার করেছে। সব দেখেশুনে ও সঠিক বলতে পারবে ঐ রাজমুকুট উদ্ধার করা সম্ভব কিনা। রাজা একটু ভাবল। বলল—বেশ, চেষ্টা করে দেখো। হ্যারি ফ্রান্সিসকে রাজার সঙ্গে যা কথা হলো বলল। ফ্রান্সিস ওকে দেখিয়ে বলল আর কী কী বলতে হবে। হ্যারি বলল—আমরা কাল থেকেই খোঁজার কাজ শুরু করবো। এজন্যে আপনার কাছে অনুমতি চাইছি।

বেশ—বলো। রাজা বলল।

এক—আমার বন্ধুর দৃঢ় বিশ্বাস এই রাজমুকুট এই দুর্গেই কোথাও আছে। কাভাল্লি এই দুর্গের সব কিছু খুব ভালোভাবে চেনে। সুতরাং আমাদের সঙ্গে কাভাল্লি সবসময় থাকবে।

আপত্তি নেই। রাজা বলল—কিন্তু কাভাল্লি পালালে তোমাদের শাস্তি ভোগ করতে হবে।

বেশ, আমরা রাজি। দুই—এই দুর্গের সর্বত্র আমাদের যেতে দিতে হবে, বিশেষ করে আপনার সজ্জাকক্ষে। হ্যারি বলল।

যাবে, কিন্তু সঙ্গে দুজন পাহারাদার সৈন্য থাকবে। কারণ সজ্জাকক্ষে মূল্যবান অনেক কিছু রয়েছে। আর সজ্জাকক্ষে সকালে যেতে পারবে না, যাবে বিকেলে—দু’ঘন্টার জন্যে।

তাতেই হবে। হ্যারি বলল।

রাজা সিংহাসন থেকে উঠল। ভেতরের দিকে চলে গেল। ফ্রান্সিসেরা রাজসভা কক্ষের বাইরে এলো। দুর্গদ্বার পার হয়ে ওরা যখন রাস্তায় নামল তখন সন্ধে হয় হয়। ওরা জাহাজঘাটার দিকে চলল। রাস্তায় দুপাশে এখানে-ওখানে মশাল জ্বলছে। সেই আলোয় লোকজন দোকানপাট এসব দেখে মারিয়া বলে উঠল—ফ্রান্সিস, কাভাল্লি তো সঙ্গে আছে। চলো না নগরটা একটু ঘুরে-ফিরে দেখি।

মারিয়াও আমরা বেড়াতে আসিনি। এখন অনেক চিন্তা মাথায়। ফ্রান্সিস আস্তে বলল। মারিয়ার বেড়ারার উৎসাহ আর রইল না। মন খারাপ হয়ে গেল ওর। ফ্রান্সিস বুঝল। বলল—মারিয়া, ভুলে যেও না—বিদ্রোহী এনরিকো যেকোনো মুহূর্তে এইখানিয়া আক্রমণ করতে পারে। তার আগেই আমাদের কাজ সেরে চলে যেতে হবে। তবে কথা দিচ্ছি—

বের করার পর যদি যুদ্ধ না লাগে, পুরো একদিন আমরা সবাই এইনগরে ঘুরে বেড়াবো। মারিয়া ফ্রান্সিসের কথার গুরুত্ব বুঝলো। বলল ঠিক আছে, তুমি যা ভালো বুঝবে তাই হবে।

জাহাজে ফিরে এলো ওরা। বন্ধুরা সব ছুটে এসে ওদের ঘিরে ধরল। ফ্রান্সিস রাজা বোনিফেসের সঙ্গে যা যা কথা হয়েছে সব বলল।

রাতে খাওয়া-দাওয়ার পর রুপোর মোমদানিতে মোম জ্বেলে ফ্রান্সিস রাজমুকুটের ছবিটা নিয়ে বিছানায় বসল। ও আগেই কাভাল্লির কাছ থেকে ছবিটা চেয়ে রেখেছিল। পাশে মারিয়াও বসল। তখনই হ্যারি এলো। বলল—আলো জ্বলছে দেখে এলাম। তিনজনেই মন দিয়ে ছবিটা দেখতে লাগল। একসময় হ্যারি বলে উঠল—ফ্রান্সিস, আমার দৃঢ় বিশ্বাস ছবিটার নীচে ঐ নকশার ফাঁকে ফাঁকে কিছু লেখা আছে। কিন্তু ভাষাটা প্রাচীন গ্রীক। আমার অত জ্ঞানগম্যি নেই। তবে তার একটা শব্দ ভাগ্য’। ফ্রান্সিস বলল—লেখাটার পাঠোদ্বার করতেই হবে। তার আগে দুৰ্গটা ভালো করে দেখতে হবে। বিশেষ করে সজ্জাকক্ষটা। কিছুক্ষণ তিনজনে এই ব্যাপারে কথাবার্তা বলল। হ্যারি চলে গেল। ফ্রান্সিস

আর মারিয়া আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়ল।

পরদিন সারা দুপুর ফ্রান্সিস শুয়ে বসে সময় কাটাল। বিকেলে তৈরি হয়ে মরিয়া, হ্যারি আর কাভাল্লিকে নিয়ে ফ্রান্সিস জাহাজঘাটায় নামল। ওরা দুর্গে পৌঁছল। কাভাল্লি ওদের ঘুরে ঘুরে অন্তঃপুর বাদে সমস্ত দুর্গের ঘর, বারান্দা, সিঁড়ি দেখাল। ফ্রান্সিস বেশ মনোযোগ দিয়ে সব দেখতে লাগল। বেশিরভাগ ঘরেই সৈন্যরা থাকে। দেয়ালে ছাদে অনেক জায়গাতেই ছবি আঁকা। মোজেকের কাজ। বেশিরভাগ ঘরে আসবাবপত্র বিশেষ কিছু নেই। দেয়ালে বড়ো আয়না, সৈন্যদের পোশাক রাখার লম্বা বাক্স—এইসব দেখে ফ্রান্সিসের মনে হলো বাইজেন্টাইন সম্রাট পালাবার আগে কোথাও নিশ্চয়ই রাজমুকুটটা লুকিয়ে রেখে গেছেন। সেই সময় সম্রাটের দুর্গের অন্য ঘরে যাওয়ার কোনো পথ নেই। অন্তঃপুর আর সজ্জাকক্ষ সম্রাট সেসময় ঐ দুটো জায়গাতেই গেছেন। ফ্রান্সিস কাভাল্লিকে বলল—এবার সজ্জাকক্ষে চলো। মাত্র ঘণ্টা দুয়েক ওখানে থাকবার অনুমতি দেওয়া হয়েছে।

কাভাল্লি ওদের সজ্জাকক্ষের সামনে নিয়ে এলো। দুজন পাহারাদার সৈন্য চকচকে বর্শা হাতে দাঁড়িয়ে আছে। তাদেরই একজন কাভাল্লিকেও ফ্রান্সিসদের দেখে দরজা খুলে দিল। দরজার কাঠ নানারঙের নকশায় চিত্রিত। ওরা ভেতরে ঢুকল। ফ্রান্সিসের নাকে জেসমিনের মৃদু গন্ধ ভেসে এলো। ঘরটির দেয়ালে মেঝেয় অতি সুন্দর মোজেকের কাজ। গাছ লতাপাতা পাখি। সামনেই বেশ বড়ো একটা আয়না দেয়ালে আটকানো। আয়নার সামনে পাথরের টেবিল। রেশমী কাপড়ে ঢাকা। সেই ঢাকনার কাপড়েও নানা রঙের সুতোর কাজ। তার ওপরে সাজিয়ে রাখা রাজদণ্ড, খাপে ঢাকা তলোয়ার। তলোয়ারের খাপে দামি পাথর বসানো মীনে করা। হাতল হাতির দাঁতের। রাজদণ্ডে কত দামি পাথরের কাজ। নিরেট সোনার সেই রাজদণ্ড। কারুকাজ করা খাপে ঢাকা ছোরা। সম্রাটের ব্যবহৃত হীরে পান্নার কত ছোটো বড়ো হার। সোনার কাজকরা কোমরবন্ধনী। সম্রাটের দুটো পোশাকেও পাথর বসানো সোনার সরু পাতের কাজ। ফ্রান্সিসরা অবাক হয়ে এই মূল্যবান জিনিসগুলো দেখল। বোঝাই যাচ্ছে শেষ বাইজেন্টাইন সম্রাট কিছুই নিয়ে যাননি। শুধু গোপনে কোথাও রেখে গেছেন রাজমুকুটটা।

ফ্রান্সিস ঘরের চারদিকে দেখতে লাগল। একপাশে একটা লম্বা কাঠের সিন্দুক। ফ্রান্সিস সিন্দুকের ডালাটা খুলল। দেখল সম্রাটের পোশাক। সাধারণ দামি দু’ধরনের পোশাক। ফ্রান্সিস কাভাল্লিকে ডাকল। কাভাল্লি কাছে এলো বলল—এই পোশাকগুলো সব তোলো তো। কাভাল্লি সম্রাটের পোশাকগুলো তুলতে লাগল। হ্যারি আর মারিয়াও হাত লাগল। সব পোশাক তোলা হলে দেখা গেল সিন্দুকটা ফাঁকা। ফ্রান্সিস মাথা নাড়ল। সব পোশাক আবার রেখে দেওয়া হল। ঘুরে দাঁড়িয়ে তাকাতেই ফ্রান্সিসের চোখে পড়ল কোণার দিকে কী যেন ঝুলছে। ও কাভাল্লিকে বলল—ওটা কী? কাভাল্লি হেসে বলল সম্রাটের খেয়াল। একটা সোনার পাতলা পাত দিয়ে সম্রাট ফুলদানি তৈরি করিয়েছিলেন। তারপর নিজের হাতে ফুল-পাতা কেটে তৈরি করে এ ফুলদানিতে বসিয়ে দিয়েছিলেন। সম্রাট ঐ ফুলদানিতে প্রতিদিন একটু একটু আতর ঢালতেন। বলতেন, এটা আমার ব্যাবিলনের শূন্যেদান। একটু খেয়াল করে দেখুন এখনো জেসমিন ফুলের গন্ধ পাবেন। ফ্রান্সিস ঝুলন্ত ফুলদানিটার কাছে এলো। দেখল—একটা গাঢ় সবুজ রেশমী কাপড়ে ফুলদানিটা ঢাকা। নানারঙের সুতোয় বোনা একটা জালমত ছাদ থেকে ঝুলছে। তারই ভেতর ফুলদানিটা বসানো। নানারঙের কাপড় কেটে তৈরি ফুল-পাতা ফুলদানি থেকে বেরিয়ে আছে। ফ্রান্সিসরা ফুলদানিটা দেখে বেশ আশ্চর্য হলো। সম্রাটের খেয়ালের নমুনা। ফুল-পাতাগুলো এত সুন্দরভাবে কেটে তৈরি করা মনে হচ্ছে যেন সতেজ। বেগুনি ফুল সবুজ পাতা। ফ্রান্সিস ভেবে পেল না এখানে কী করে কোথায় সম্রাট রাজমুকুট লুকিয়ে রেখে গেছেন।

এবার ফ্রান্সিস সবাইকে নিয়ে সজ্জাকক্ষের বাইরে এলো। একজন সৈন্য দরজাটা বন্ধ করে দিল। ফ্রান্সিস মারিয়ার দিকে তাকাল। বলল—অন্দরমহলে তো আমরা যেতে পারবো না। মারিয়া যাও। সব খুঁটিয়ে দেখে আসবে। বিশেষ করে সম্রাজ্ঞীর সজ্জাকক্ষটা। মারিয়া চলে গেল। ফ্রান্সিসরা অপেক্ষা করতে লাগল।

বেশ কিছুক্ষণ পরে মারিয়া ফিরে এলো। বলল—অন্দরমহল ভালো করে দেখেছি। সম্রাজ্ঞীর সজ্জাকক্ষে সম্রাজ্ঞী কিছুই রেখে যাননি। সেখানে বর্তমান রানী তার পোশাকপত্র অলঙ্কার এসব রেখেছে। কিন্তু মুকুট লুকিয়ে রাখার জায়গা সেখানে নেই। ফ্রান্সিস একটুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল—কালকে আবার দেখতে হবে।

সবাই জাহাজে ফিরে এলো। ভাইকিং বন্ধুরা শুনল, নিখোঁজ রাজমুকুট পাওয়া যায়নি। রাতে ফ্রান্সিসরা আবার মুকুটের ছবিটা নিয়ে বসল। ফ্রান্সিস বার বার বলল—ছবিটা থেকে নিশ্চয়ই কোনো সূত্র পাওয়া যাবে। হ্যারি হতাশস্বরে বলল ছবিটার নীচে নিশ্চয়ই কিছু লেখা আছে। কিন্তু কিছুতেই পাঠোদ্ধার করতে পারছি না। আলো জ্বলছে দেখে কাভাল্লি তখনই কেবিনঘরে ঢুকল। হ্যারি বলল—আচ্ছা কাভাল্লি, তুমি তো অনেকদিন এই খানিয়ায় ছিলে। তুমি কোনো বিদ্বান পণ্ডিত কাউকে চেন। কাভাল্লি একটু ভাবল। বলল—একজনকে জানি, প্যালিওলোগ—খুব পণ্ডিত মানুষ। সম্রাট মাঝে মাঝে তাকে ডেকে পাঠাতেন। কয়েকবার আমাকেও ডাকতে পাঠিয়েছেন। হ্যারি প্রায় লাফিয়ে উঠল। বলল—তুমি আমাদের কাল সকালেই প্যালিওলোগের বাড়ি নিয়ে চলো।

বেশ তো নিয়ে যাবো–কাভাল্লি বলল।

পরদিন একটু বেলায় কাভাল্লি ফ্রান্সিসদের প্যালিওলোগের বাড়ি নিয়ে গেল। প্যালিওলোগ বাইরের একটা ছোটো ঘরে একটা গদিওয়ালা আসনে বসেছিলেন। সামনে একটা পাথরের পাটাতন। তাতে কিছু সাদা পাতলা চামড়া রাখা, চিনেমাটির দোয়াত, পাথর বড়ো পালকের কলমও রয়েছে। প্যালিওলোগ বেশ বৃদ্ধ। মাথায় চুল দাড়ি গোঁফ ভুরু সব পাকা। পরনে ঢিলেঢালা জোব্বা। হ্যারি গ্রীক ভাষায় নিজের পরিচয় দিল। তারপর রাজমুকুটের ছবিটা তার সামনে রাখল। বলল—ছবিটার নীচে লতাপাতা ফুলের মধ্যেই নিশ্চয়ই কিছু লেখা আছে। প্রাচীন গ্রীক ভাষা যদি আপনি পড়তেন। প্যালিওলোগ ছবিটা উঁচু করে ধরলেন। একটুক্ষণ দেখলেন। হেসে বললেন—তুমি ঠিকই ধরেছো। প্রাচীন গ্রীক ভাষায় লেখা—সম্রাটের ভাগ্য সুতোয় ঝোলে। হ্যারি কথাটা বারবার বলল। মনে রাখল। এবার ফ্রান্সিস ও মারিয়াকে যা কথা হলো বলল। শেষে যা লেখা সেটা বলল। ফ্রান্সিস ও কথাটা মনে রাখল। কিন্তু কথাটার সঙ্গে রাজমুকুটের সম্পর্ক বুঝতে পারল না। ওরা জাহাজে ফিরে এলো। সারা দুপুর ফ্রান্সিস কথাটা নিয়ে ভাবল।

সেদিন বিকেলে ওরা আবার দুর্গে গেল। সম্রাটের সজ্জাকক্ষে ঢুকল ওরা। ফ্রান্সিস আবার চারদিকে ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগল। ছবিটা ছিল মারিয়ার হাতে। মারিয়া ছবিটা দেখবার জন্যে চামড়ার গোটানোটা খুলে মেলে ধরল। যাঃ উল্টেমুখো হয়ে রয়েছে। মারিয়া ছবিটা সোজা করতে গিয়ে একেবারে ঝুলন্ত ফুলদানিটার দিকে তাকাল। আরে?

মারিয়া চমকে উঠল। ছবিটা সোজা করল না। মিলিয়ে দেখল মুকুটটা ওল্টালে ঠিক ফুলদানির মতো দেখাচ্ছে। ঠিক তখনই ফ্রান্সিসকে গলা চড়িয়ে বলল—সম্রাটের ভাগ্য সুতোয় ঝোলে। কাভাল্লি, ফুলদানিটাও সুতোয় ঝুলছে। মারিয়া ছুটে ফ্রান্সিসের কাছে এলো। উল্টে রাজমুকুটের ছবিটা আর ফুলদানিটা আঙুল দিয়ে দেখাল। ফ্রান্সিস একমুহূর্ত ভাবল। তারপর উত্তেজিত স্বরে বলল-কাভাল্লি ফুলদানিটা নামাও। কাভাল্লি একটা পাথরের পাটাতনের ওপর উঠে আস্তে আস্তে ফুলদানিটা সুতোর জাল থেকে খুলে নামাল। ফ্রান্সিস তাড়াতাড়ি ফুলদানিটা হাতে নিল। ভেতর থেকে ফুল পাতা তুলে নিলে। দেখা গেল ছবিতে যে সোনার পালকটা মুকুটের মাথায় আঁকা আছে সেটা ফুলদানিটার মধ্যে রাখা। ফ্রান্সিস ফুল-পাতা রেখে সোনার পালকটা ভেতর থেকে তুলে নিল। দেখা আবার হাত ঢোকাল। তুলল মুকুটের পালকের ঠিকনীচেই যে রক্তপ্রবালের ছবিটা রয়েছে সেই চৌকাণো রক্তপ্রবাল। তারপর আবার হাত ঢোকাল। তুলল পাতলা সোনার দোমড়ানো পাতার কিছু অংশ। সেসব মারিয়ার হাতে দিল। ফ্রান্সিস হেসে উঠল। ফুলদানিটা উঁচু করে তুলে চেঁচিয়ে বলল—মারিয়া, হ্যারি, এটাই সেই নিখোঁজ রাজমুকুট। ফ্রান্সিস এবার আস্তে আস্তে ফুলদানির গাঢ় সবুজ রঙের ঢাকানাটা খুলতে লাগল। দেখা গেল চুনী পান্না আর দামি দামি পাথর বসানো ওটার গায়ে। সেসবের চারদিকে নীল সবুজ মীনে করা। যখন সবটার ঢাকনা খোলা হলো, দেখা গেল চুনী পান্না নীলকান্তমণি দামি পাথর বসানো রাজমুকুট। দেয়াল আটকানো মশালের আলো পড়ল রাজমুকুটে। চুনী পান্না নীলকান্তমণি দামি পাথর সব ঝিকমিকিয়ে উঠল। আলো ঠিকরোচ্ছে। কী অপরূপ সুন্দর সেই রাজমুকুট।

কিছুক্ষণ কারো মুখে কোনো কথা নেই। অবাক হয়ে ওরা রাজমুকুটটা দেখতে লাগল। ফ্রান্সিস মারিয়ার হাত থেকে শীর্ষপালকটা নিল। মুকুটের মাথায় যেখানে লাগানো ছিল সেখানে ধরল। বলল—মারিয়া ছবির মতো রক্তপ্রবালটা রাখো। সোনার পালক আর রক্তপ্রবাল রাখা হলে দেখা গেল হুবহু ছবির মতো রাজমুকুটটা। সোনার পালক, রক্তপ্রবাল মুকুটের মধ্যে রেখে দিয়ে ফ্রান্সিস বলল—শেষ বাইজেনস্টাইন সম্রাট শেষবারের মতো এই সজ্জাকক্ষে ঢুকেছিলেন। কাভাল্লিকে ঢুকতে দেননি। দরজা বন্ধ করে কাঁচের আধার থেকে মুকুটটা বের করেছেন। সোনার পালক মুকুট থেকে খুলে নিয়েছেন। মুকুটের ভেতরে রেখেছেন। এবার মুকুটের মতো ঠিক একই মাপে তৈরি করা ফুলদানিটা সুতোর জাল থেকে নামিয়েছেন। কাপড়ের ঢাকনা খুলেছেন। কাপড়ের ফুল পাতা তুলে নিয়েছেন। তারপর ঐ পাতলা সোনার চাদরে তৈরি ফুলদানিটা সহজেই দুমড়ে মুচড়ে রাজমুকুটের মধ্যে রেখেছেন। তার ওপর রেখেছেন ফুলপাতা। এবার ঢাকানায় মুকুটটা ভরে সুতোর জালে ঝুলিয়ে দিয়েছেন। ফুলদানি আগেই ছিল। কাজেই কারো মনেই ফুলদানিটা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে না। ফুলদানিটাকে কেউ কোনো গুরুত্বই দেবে না। কিন্তু সম্রাটের সেই লেখা কথাটা সম্রাটের ভাগ্য সুতোয় ঝোলে—এই কথাটাই আমার দৃষ্টি টানল ঝুলন্ত ফুলদানির দিকে। তখনই মারি ছবিটা উল্টো করে দেখাল। সব পরিষ্কার হয়ে গেল। ঝুলন্ত ফুলদানিটাই নিখোঁজ রাজমুকুট। কাভাল্লি আস্তে আস্তে রাজমুকুটটার কাছে গেল। দুহাতে মুকুটটার গায়ে হাত বুলোত বুলোতে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। শেষ সম্রাটের স্মৃতিও কোনোদিন ভুলতে পারবেনা।

ওদিকে রাজমুকুট পাওয়া গেছে দেখে সজ্জাকক্ষের রক্ষীরা ছুটল রাজা বানিফেসকে খবর দিতে। একটু পরেই রাজা বোনিফেস দ্রুতপায়ে সজ্জাকক্ষে ঢুকল। পাথরের টেবিলের ওপর মুকুটটা রেখেছিল ফ্রান্সিস রাজা বোনিফেস মুকুটটা দু’হাতে উঁচু করে তুলে ঘর কাঁপিয়ে হেসে উঠল-হা-হা-হা। মুকুটটা হাতে নিয়ে পাগলের মতো ঘরময় পায়চারি কপি করতে লাগল। ফ্রান্সিস হ্যারিকে যা যা করতে হবে বলল। রাজার কিন্তু খেয়ালই নেই যে যারা নিখোঁজ রাজমুকুট খুঁজে বের করে দিল তারা তারই সামনে দাঁড়িয়ে। হ্যারি একটু গলা চাড়িয়ে বলল—রাজা, আমাদের কিছু কথা ছিল। এতক্ষণে ওদের দিকে রাজার দৃষ্টি পড়ল। রাজা বলল, হুঁ বলো।

আমরা নিখোঁজ রাজমুকুট খুঁজে বের করে দেব বলেছিলাম, তা দিয়েছি। এবার আমাদের একটা অনুরোধ। হ্যারি বলল।

এজন্যে তোমাদের আমি কিছু দিতে পরবো না। রাজা মাথা ঝাঁকিয়ে বলল।

আমরা কিছু চাইও না। শুধু অনুরোধ—এই সজ্জাকক্ষের দেখাশোনার দায়িত্ব যেন কাভাল্লিকেই আবার দেওয়া হয়।

কিন্তু ওকে কি বিশ্বাস করা যায়? রাজা বলল।

হ্যাঁ যায়। কাভাল্লি সৎ ও বিশ্বস্ত।

—ঠিক আছে। রাজা মাথা নাড়ল।

ফ্রান্সিস বলল—এবার চলো।

ওরা যখন দুর্গের বাইরে এসেছে তখন কাভাল্লি ছুটে এলো। বলল—চলুন জাহাজঘাটা পর্যন্ত আমি যাই। আপনারা আমার জন্যে এত করলেন।

জাহাজে উঠতে উঠতে ফ্রান্সিস হেসে বলল—মারিয়া, এবারও আমাদের হাত শূন্য। মারিয়া মাথা ঝাঁকিয়ে বলল—এ জন্যে আমার বিন্দুমাত্র দুঃখ নেই।

ওরা জাহাজে উঠতেই বিস্কো শাঙ্কো আর ভাইকিং বন্ধুরা ছুটে এলো। ফ্রান্সিস গলা চড়িয়ে বলল—কালকে আমরা খানিয়া নগর ঘুরে বেড়িয়ে দেখবো। পরশু জাহাজ ছাড়বো। তারপর মারিয়াকে বলল—কী? খুশি তো? মারিয়া হেসে উঠল।

Anuprerona
Anupreronahttps://www.anuperona.com
Read your favourite literature free forever on our blogging platform.
RELATED ARTICLES

Most Popular

Recent Comments