বৃত্তের বাইরে – বাণী বসু

বৃত্তের বাইরে বাণী বসু

শেয়ার-বাজারে লাখ তিন চার ডুবে গেল। ক বছর ধরেই তেজী চলছিল বাজার। দালাল প্রকাশ দেওরা যেমন যেমন বলেছে তেমন তেমনই করতে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলেন বিজু রায়। তিনি নিজে শেয়ারের পাতাটা খেলার পাতার মতোই একবার উল্টে দেখেন মাত্র। দেওরা শেয়ারের ঘুণ, এমন ভুলটা কী করে করল বিজু রায়ের মাথায় আসে না। মুখ দেখাচ্ছে না লজ্জায়। রক্ষা এই যে আরও যায়নি। কেব্‌ল ম্যানুফ্যাকচারিং-এর বিরাট বিজনেস তাঁর মূলত। টেন্ডার ধরতে, সরকারি বেসরকারি এক্সপার্টদের তুষ্ট করতে, লেবারকে মুঠোর ভেতর রাখতে মাথার ঘায়ে কুকুর পাগল অবস্থা হচ্ছে ইদানীং। ইলেকট্রিকাল ইলেকট্রনিক জিনিসপত্রের এজেন্সিও আছে অনেকদিনের। ইচ্ছে আছে একটু বাজার দেখেশুনে ইলেকট্রনিক্‌স্‌-এও ম্যানুফ্যাকচারিং-এ নেমে পড়বেন। অরোরা, শেঠ, বসাক এরা তো হাজারটা বিজনেস করছে। স্বনামে, বেনামে। তিনিই বা নামবেন না কেন? তিনটে পলিটিক্যাল পার্টিকে বছর বছর মোটা চাঁদা দিয়ে যাচ্ছেন, যার যেমন ওজন তার তেমন। তো সেখানেও তো আজকাল মেলা ঝামেলা হয়ে যাচ্ছে। ভুঁইফোঁড় কিছু মস্তান, পলিটিক্যাল ক্রেডেনশিয়াল্‌স্‌ আছে কি নেই, হুটহাট করে তোলা চাইতে শুরু করেছে। আইচকে তিনদিন ফোন করে পাচ্ছেন না। মিনিস্টারের সঙ্গে আইচের ওঠাবসা। তার মাধ্যমেই এসব ঝামেলাগুলো তিনি মেটান। হাতে চাবির রিং লুফতে লুফতে চোখ গরম দেখিয়ে যাবে তাঁকে, এ জিনিস তিনি বরদাস্ত করতে পারবেন না।

লাল রঙের টেলিফোনটার দিকে হাত বাড়িয়েছেন, আইচকে যত শিগগির সম্ভব কনট্যাক্ট করা দরকার, উমেশ রক্ষিত ঢুকল। এর সামনে আইচের সঙ্গে কথা বলা যাবে না। অথচ এ আসাতে তিনি টেলিফোনটা নামিয়ে রাখলেন এটাও একটু বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে। উমেশ রক্ষিভের কৌতুহল বাড়বে, নিজেকে খামোখা খুব কেউকেটাও ভাবতে শুরু করতে পারে। অতএব তিনি একটা বানানো নম্বর টিপে গেলেন চোখ বুজে। সুখের বিষয় ওদিকে ‘দিস নাম্বার নো লংগার এগজিসটস’ বাজতে লাগল। ঠাস করে রিসিভারটা নামিয়ে রাখলেন বিজু রায়। মুখে দারুণ বিরক্তির কুঞ্চন।

‘বসুন।’

—‘পেলেন না নম্বরটা?’

—‘নাঃ। আজ আবার কী মনে করে? পেমেন্ট তো হয়ে গেছে!’

—‘পেমেন্টের জন্যে কি আমার ঘুম হচ্ছিল না রায়সাহেব? আরে বাবা, মাল আপনার গুদোমে পৌঁছে দিয়েছি। আবার কী? আমি ঘুমোলেও আপনার পেমেন্ট সময়মতো পৌঁছে যাবে। আসলে একটা ভাল জিনিস পেলুম…’

উমেশ রক্ষিত ছোট ব্যবসাদার। ওর কাছ থেকে কিছু পার্টস নেওয়া হয় তাঁর কারখানাতে। নিতেই হবে তার কোনও মানে নেই। উমেশ, রমেশ, দিনেশ, ধীরেশ এদের মধ্যে এসব ছোটখাটো ব্যাপারে কোনও তফাত করবার দরকার হয় না। ফেভার, জাস্ট ফেভার। তবে তোষামোদে ভুলে নয়। তোষামুদিগুলো ওর বড্ডই মোটা দাগের। আপনার মতো উদার, সচ্চরিত্র বাঙালি-ব্যবসাদার দেখা যায় না। কীভাবে হাল ধরে রেখেছেন! ছবির মতো কারখানা। এ সব দেখে শেখবার ইত্যাদি ইত্যাদি, কোনও দিনই এই ঘ্যানঘেনে কথাগুলো ভাল লাগে না বিজু রায়ের। ওকে অর্ডারগুলো দেন স্রেফ ওর পরিবারের সাইজের কথা মনে করে। নিজের চারটি। বড় ভাই অকালে গেছে। তার পুরো ফ্যামিলি ওর ঘাড়ে। বুড়ো বাবা মা এরা তো আছেই।

উমেশ ঝোলার থেকে একটা প্যাকেট বার করল। ভেতরে অনেক কিছু ঠেসেটুসে জিনিসটাকে চৌকো আকার দেবার চেষ্টা হয়েছে। তা সত্ত্বেও বোতলের গড়ানে গোলালো দিকটা মোটামুটি বোঝা যাচ্ছে।

গলোগলো হয়ে উমেশ রক্ষিত বলল—‘আমার এক শালা ফ্রান্সে থাকে, সে-ই..মাঝে মাঝে…খুব ভাল…’

দুম করে বিজু রায় বললেন, ‘কজন শালা আপনার রক্ষিতবাবু?’ যখনই কিছু উপহার দেবে, শালার নাম করবে উমেশ রক্ষিত। বিজু রায়ের প্রশ্নে থতমত খেয়ে বলল, ‘তি তিন। তিনজন নিজের শালা আমার।’

—‘সব্‌বাই-ই বাইরে থাকে?’

—‘আজ্ঞে হ্যাঁ। সেট্‌লড্‌।’ ভেতরের সন্তোষে গর্বে রক্ষিত ফুলে ওঠে। শালাদের ইন্ডিয়ার বাইরে থিতু হওয়ার চেয়ে বড় গৌরব যেন আর নেই।

—‘তাহলে “খেতে বসল জামাই শালা” এ সৌভাগ্য আপনার বড় একটা হয়, কী বলুন?’ বিজু রায় বলেন।

—‘হাঃ হা, তা যা বলেছেন। তা যা বলেছেন। ওদিকেও যেমন জামাইষষ্ঠীর পাট নেই, এদিকেও তেমনি নো ভাইফোঁটা।’ রসিকতাটাতে যোগ দিতে পেরে রক্ষিতের মুখ উজ্জ্বলতর হয়ে ওঠে।

—‘তা যদি বলেন মশাই। তিন তিনখানা এন আর আই আপনার হেপাজতে। বাজেট দেখেছেন তো? এন আর আই মানেই জামাই। দিন না সব কটাকে বিজনেসে নামিয়ে। দেশের মাটিতে কিছু ডলার স্টার্লিং ঢালুক। অর্ডারগুলোও সব আপনিই ধরে নেবেন। বি বি রায়কে আর গিফট দেবার দরকার হবে না।’

শুনতে শুনতে ভীষণ সন্ত্রস্ত হয়ে ওঠে রক্ষিত। ঘেমে নেয়ে যাচ্ছে এমনি ভাব। কতক্ষণে সামলে ওঠে মৃদু কৌতূহল নিয়ে দেখতে থাকেন বিজু রায়। শিগগিরই সামলে উঠবে। কোনও সন্দেহ নেই। একটু আচমকা হয়ে গেছে ধাক্কাটা!

—‘আপনি আজ আসুন। সময় হাতে বড্ড কম।’ এ ফাইল ও ফাইল টেনে বিজু রায় অতিরিক্ত ব্যস্ততার ভানটুকু চমৎকার ফোটালেন।

—‘নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই। খেজুরে গল্প করবার সময় আছে নাকি আপনার?’ উমেশ শশব্যস্তে উঠে তাঁকে নমস্কার করে কেমন পেছু হটতে হটতে বেরিয়ে গেল। যেন যতক্ষণ দেখতে পাওয়া যায় রায়সাহেবকে চোখের আড়াল করতে চায় না। বিজু রায়ের হাসি পেল। তিনি তা হলে এতদিনে নবাব-বাদশা শ্রেণীর হতে পেরেছেন। নবাব-টবাবদের এইভাবে তসলিম জানাতে হয় না? পেছন ফেরা যায় না তাদের সামনে। উমেশ রক্ষিতটা আসলে পুরনোকালের সাম্পল। প্রথম তিনি যে সময়ে ব্যবসায় নেমেছেন সেই তখনকার, তখন এই সব চাল-চলন চালু ছিল। এখন যুগ পাল্টে গেছে। এখন আসছে স্মার্ট ছোকরা-ছুকরির দল। গটগট করে আসে, ফুটফাট ইয়াংকি ইংরিজি কি হিন্দি বলে, আসে প্রার্থী হয়ে। কিন্তু ভাবখানা যেন উদ্ধার করে দিতে এসেছে। প্রত্যেকেই যেন বলতে চায়, আরে আমার মতো একটা খানদানি, এ-ক্লাস, সেন্ট পার্সেন্ট কমপিটেন্ট সাপ্লায়ারকে ওবলাইজ করবে না? ইজ দ্যাট পসিবল বস? এরা নিজেদের প্রোডাক্টের খুঁটিনাটি জানে। শুনিয়ে তবে ছাড়ে। ব্যবসার জগতে এরা নতুন ক্লাস। মূলধন জামাকাপড়ের বাহার, কায়দা, আর আজকালকার ভাষায় ‘এনথু।’

উমেশ রক্ষিত বেরিয়ে গেলে ফাইলগুলো ঠেলে সরিয়ে দিলেন বিজু রায়। রক্ষিত-দত্ত পার্সেলটা টেবিলের এক কোণে বিরাজ করছে। সেটা নিজের ব্রিফকেসের মধ্যে চালান করলেন। একটু পরে সত্যিই তাঁকে বেরোতে হবে। ঘুসুড়ির দিকে একখানা হাই-রাইজ তুলছেন। খুব ঝামেলা পাকিয়েছে সেখানে চোর্পোরেশন। লোহার রডের মাপ নাকি ঠিক হয়নি। আরও কী কী সব গলতি রয়েছে। তিনি যখন প্ল্যান সাংশন পেয়েছিলেন তখন জি-প্লাস এইটের পান। তো এখন বলছে জি-প্লাস ফোরের বেশি করতে দেবে না। বিরানব্বই-এর আইন উননব্বইয়ের প্ল্যানের ওপর খাটবে কি না এখনও তিনি ঠিক জানেন না। সুখেন্দু তাঁর লিগ্যাল অ্যাডভাইজার, তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে। কিন্তু ইতিমধ্যে দুটো তলা তাঁর কমপ্লিট। দোতলায় লোক এসে যাচ্ছে এক মাসের মধ্যে। হঠাৎ ইনসপেকশন। ইনসপেকশন করে বলে গেছে বাড়ি নাকি ভেঙে দিতেও পারে। ভেঙে দেবে না আরও কিছু। আসলে নোলা বেড়েছে। কিন্তু কেমন রোখ চেপে গেছে বিজু রায়ের। পরিষ্কার দলিল, জমির মালিকের সঙ্গে কোনও অবনিবনা নেই, তৎসত্ত্বেও আগের কাউন্সিলারকে খাওয়াতে হয়েছে। এবার ভোটে জিতে নতুন কাউন্সিলার এসেছিস, তোকেও খাওয়াতে হবে? কভ্‌ভি নহি। দে বাড়ি ভেঙে, কত মুরোদ দেখি। দুঁদে মারোয়াড়ি সব মালিক আছে। এখনই অন্তত চারটে। কোটিপতি লোক। তাদের হিন্ট দিয়ে রেখেছেন বিজু রায়। বলেছে, দেখ লেঙ্গে শালে কো। তবু একবার আজ সাইটে যাবেন ঠিক করেছেন। লোহার রডে কনট্র্যাক্টর যদি সত্যি চারশো বিশ না করে থাকে, সিমেন্টে যদি গঙ্গামাটি পাইল না করে থাকে তো ওই চোর্পোরেশনকে তিনি খাওয়াবেন ঠিকই। তবে ঘোল। ঘোল খাইয়ে ছাড়বেন। আর কন্‌ট্র্যাক্‌টর যদি সত্যি গোলমাল করে থাকে তাহলে তাকে তো ফায়ার করবেনই, ড্যামেজ আদায় করবেন গলায় গামছা দিয়ে। এর পর সে খায় কী করে তাও দেখবেন বিজু রায়। এখন, কোর্ট কাছারি যদি করতেই হয় তো আটঘাট বেঁধে এগোতে হবে। সিভল এঞ্জিনিয়ার জয়দীপ চাটুজ্জেকে নিয়ে যাচ্ছেন আজ। চারতলার ছাদ ঢালাই হবার কথা আজকেই। সিমেন্ট, বালি, লোহা, চিপস, সব দেখাবেন। বদনামি বরদাস্ত করবেন না বিজু রায়। যাবার পথে ওর নেতাজী সুভাষ রোডের অফিস থেকে জয়দীপ চাটুজ্জেকে তুলে নেবেন এমন কথা আছে। একটু আগে ফোনে কনফার্ম করে নিয়েছেন।

কীরকম একটা তেতো মুখ, তেতো মনে অফিস থেকে বেরোলেন বিজু রায়। দু ধারে ফলের পসরার মধ্যে দিয়ে ধীরে ধীরে চলেছে গাড়ি। বাজারের শ্রেষ্ঠ কমলালেবু, মুসাম্বি, আপেল, আঙুর, আনারস, ডালিম সাজানো দু দিকে। বিজু রায় লোহা, লক্কড়, নাট, বল্টু, যন্ত্রপাতি ছাড়া কিছুই বড় একটা দেখতে পান না। অর্জুনের এই গুণটি তিনি পেয়েছেন। একাগ্রতা। তাঁর ড্রাইভার সমর ফলগুলোর দিকে চেয়ে ফলওয়ালাকে ধমকে উঠল, ‘এই আবদুল, ডালিমগুলো বেদানা বেদানা করে হাঁকছিস কেন?’

—‘আফগানিস্তানে গণ্ডগোল বাবু, ও বেদানা আর পাওয়া যাবে না, এই বেদানাই নিতে হবে।’

দার্জিলিঙে গোলমালের পর সেখান থেকে লেবু আসাও বন্ধ হয়ে গেছে। চারদিকে শুধু নাগপুর আর নাগপুর। তবু এখানে যা মেলে, শহরের অন্য কোথাও তা মেলে না। দামেও নিউ মার্কেটের থেকে শস্তা। খানদানি মারোয়াড় রেজিমেন্টের ঘাঁটি এখানে। আসলি ঘিউ, আসলি ফল, আসলি মসালা সব আসলি এখানে। অতএব বিজু রায়ের অফিসের অনেকেই এখান থেকে ফল কিনে নিয়ে যায়। একমাত্র বিজু রায়ই কেনেন না। তিনি অবশ্য জানেন না, তাঁর ড্রাইভার কেনে, তাঁরই বাড়ির জন্য। প্রমীলা, তাঁদের বাড়ির নামে-রাঁধুনি আসলে হাউজ-কিপার ফরমাশ করে, সমর কেনে। দু চারখানা যে নিজের পরিবারের জন্য সরায় না, তা নয়। তবে বেশির ভাগটাই রায়ভবনের তিনশো লিটারের পেল্লাই রেফ্রিজারেটরের মাথায় কখনও ত্রিপুরি বাঁশের নৌকায়, কখনও পোড়ামাটির ডোঙায়, কখনও ক্রিস্ট্যালের পাত্রে শোভা পায়। বিজু রায়ের পাতে যখন পড়ে তখন অফিস-সংলগ্ন ফল-বাজারের সওদা খাচ্ছেন বলে বুঝতেই পারেন না তিনি।

জয়দীপ চাটুজ্জেকে খুব অন্যমনস্ক দেখাল। কী হয়েছে জিজ্ঞাসা করলেন না বিজু রায়। এসব জিজ্ঞেস করবার মতো ঘনিষ্ঠতা জয়দীপের সঙ্গে তাঁর নেইও। তবে তাঁর যদি মেজাজ খিঁচড়ে থাকে, তো জয়দীপেরও থাকতেই পারে, কে জানে ও-ও কোথাও মার খেল কি না। জয়দীপ ছেলে ভাল। বছর ত্রিশ-বত্রিশের ব্রাইট ইয়াং ম্যান। বসাকের পার্টিতে আলাপ। সবে নিজের ফার্ম খুলেছে তখন। আর এখন তো সিভল এঞ্জিনিয়ার আর্কিটেক্টদের পোয়াবারো। খুব কামাচ্ছে। তিন চার বছর আগে বসাকের পার্টিতে দেখেছিলেন পাতলা ধরনের চেহারা। চোখে, খুব স্মার্টনেস সত্ত্বেও একটা খরগোস-খরগোস ভাব তাঁর দৃষ্টি এড়ায়নি। সেই ছেলেরই এখন পেটের ফাঁদ বেড়েছে। কথা বলা শেষ করলেই থুতনির তলায় আরেকটা বেড় দেখা দেয়।

ব্রিজ থেকে নামবার মুখে গাড়ি আটকে গেল। মুখ বাড়িয়ে দেখলেন বিজু রায় এখন কিছুদিনের জন্যে নিশ্চিন্ত। নিজের হোল্ডারে একটা সিগারেট লাগিয়ে জয়দীপ সিগারেট কেসটা বাড়িয়ে ধরল বিজু রায়ের দিকে। সিগারেটের জন্য না সুদৃশ্য দামি সিগারেট-কেসটার জন্য বিজু রায় ঠিক বুঝলেন না। যাই হোক, তিনি একটা নিলেন। বললেন, ‘পরের বাড়িটা বুঝলে চ্যাটার্জি তোমার কাছ থেকেই আগাগোড়া প্ল্যানিং টল্যানিং করে নিয়ে নামব। এটার বেলায় আসলে অতটা এক্সপিরিয়েন্স ছিল না। দুলিচাঁদ নামিয়ে দিল। নেমে পড়লুম। এখন কেমন নেশা ধরে গেছে, বুঝলে?’

জয়দীপ গম্ভীরভাবে বলল, ‘হ্যাঁ। প্ল্যান-টল্যানগুলো পরিষ্কার থাকা দরকার। প্ল্যান একরকম সাবমিট করলুম। পরে চতুর্দিকে ক্যান্টিলিভার করে বেশ কয়েক হাজার স্কোয়ার ফুট বাড়িয়ে নিলুম এ তো আজকাল আকচার হচ্ছে। তা ছাড়া, রেসিডেনশ্যাল কমপ্লেক্স একটা সেক্রেড রেসপনসিবিলিটি, পবিত্র দায়। লোকে ঠেকায় পড়ে কিনছে বলেই প্রোমোটার-ডেভলপার কতকগুলো বিপজ্জনক খাঁচা বানিয়ে ছেড়ে দেবে—দ্যাটস নট জাস্টিস!’ সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়ল জয়দীপ জানলার দিকে মুখ করে।

বিজু রায়ের মাথার মধ্যে কে একটা ছোট্ট ওয়ার্নিং বেল বাজাচ্ছে। এই বক্তিমের মানে কী? অন্তত পক্ষে পঁচিশ বছরের ছোট এই ছোকরা কোন সাহসে আপার হ্যান্ড নিচ্ছে রে বাবা! ইতিমধ্যেই আবার কার সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধল? কেনই বা? তিনি তো ওকে রীতিমতো পৃষ্ঠপোষকতা করে থাকেন! আড়চোখে জয়দীপের মুখটা একবার দেখে নিয়ে তিনি বললেন ‘ব্যাপারটা কি জানো! হাজার রকম ধান্দায় থাকি। নেহাত একটা খেয়ালের মাথায় বাড়িটা করা। বাট নাও অ্যায়াম সিরিয়াস। এরপর যদি করি, যেগুলো করব, সেগুলো হবে প্রতিটি স্কোয়ার ইনচ প্রি-প্ল্যানড। একেবারে ছবির মতন। কোন্নগরের দিকে একটা চোদ্দ কাঠা জমি দেখেছি। শিগগিরই সব ফাইনাল হয়ে যাবে। এবার আর…।’

কথাটা শেষ করলেন না বিজু রায়। কোন্নগরের চোদ্দ কাঠাটা আসলে ধাপ্পা। জয়দীপ চাটুজ্জে কতটা উৎসাহিত হয় সেটা দেখবার জন্য টোপ ফেলা। তিনি যদ্দূর জানেন, পেটের ফাঁদ বাড়লেও তেমন সন্তোষজনক কিছু জয়দীপ এখনও করতে পারেনি। খুঁটে তুললেও এ লাইনে ভাল কামাই হয়। কিন্তু একটা মান-মর্যাদার ব্যাপার আছে, পছন্দ-অপছন্দের ব্যাপার আছে—বিশেষত এসব আধুনিক কেতার কোয়ালিফায়েড ছেলেদের।

‘মিডল্‌ ইনকাম-গ্রুপের জন্যে করব। কিন্তু হবে রাজপ্রাসাদের মতো। যতদূর সুবিধে দেওয়া যায়…’ ধোঁয়ার রিং ছাড়ার মতো বিজু রায় ছেড়েই যাচ্ছেন। আসলে এগুলে সুতো। জয়দীপ যদি ধরে।

জ্যাম ছেড়েছে। আই সি বোস রোড ধরে জি টি রোড নিল সমর, তারপর হু হু করে সাইটে পৌঁছে গেলেন। একতলায় অফিসঘর। পরে এটাই এদের অ্যাসোসিয়েশনের ঘর হবে। এখানেই সব কাগজ-পত্তরের ডুপ্লিকেট থাকে। সুপারভাইজ করছিল মিস্ত্রি। কড়কড় কড়কড় করে সিমেন্টে চিপসে মাখা হচ্ছে মেশিনে। বিজুবাবুকে দেখে একবার উঁকি মেরে সেলাম করে গেল। ব্রোশিওরের পাতা উল্টে যাচ্ছে জয়দীপ। এবার উঠছে।

—‘এলিভেশনটা তো ক্লিয়ার এসে গেছে!’ বিজু রায় বললেন।

‘সো ফার সো গুড’ কাঁধ নাচিয়ে বললে জয়দীপ, ‘চলুন একটু ঘুরে দেখে আসি।’ দোতলায় উঠতে উঠতে বলল—‘প্ল্যানে অনেক ডিফেক্ট আছে দাদা। মাঝখানে একটা করে ছোট ফ্ল্যাট স্কুইজ করে দিয়েছেন, অথচ ডাক্ট রাখেননি। অর্থাৎ এরা জাস্ট একটা দিক পাচ্ছে। এ ছাড়াও আছে অনেক টেকনিক্যাল গণ্ডগোল। তবে সে সব তো এখন কিছু করার নেই। আমি জাস্ট বিল্ডিং মেটিরিয়্যালসগুলো যদ্দূর পারি একটু দেখে নেব।’

থাকে থাকে সাজানো সিমেন্টের বস্তাগুলোর মধ্যে একটা আঙুল দেখিয়ে বার করতে বলল। গনির লোক সেটাকে টেনে বার করে খুলে দেখাল। দেখতে দেখতে মুখ বিকৃত করল জয়দীপ। অন্য দিকে তাকিয়ে বলল ‘গভর্মেন্টের মডুলার ইটগুলো নিলেন না কেন? স্ট্যান্ডার্ড ইট!’ বিজু রায় এ কথার উত্তর জানেন না। জানে তাঁর কনট্র্যাক্টর। লোহা সব ঢালাই হয়ে গেছে। সামান্য কিছু পড়ে আছে। জয়দীপ একটু নিচু হয়ে দেখে নিল। তারপর বলল—‘চলুন আমার দেখা হয়ে গেছে।’

নিচের অফিস ঘরে বড় করে জলযোগের আয়োজন ছিল। এক কাপ চা ছাড়া জয়দীপ কিছু ছুঁল না। —‘তাড়া আছে দাদা, বাড়িতে গেস্ট আসবার কথা আছে।’

গাড়ি ব্রিজে উঠতে আয়েস করে ধোঁয়া ছেড়ে বলল—‘সিমেন্টের কোয়ালিটি খুব খারাপ দাদা। নামী কোম্পানির লেবেল লাগিয়ে আপনাকে ভুসি মাল গছিয়েছে। লোহার রড কোয়ার্টার সুতো মতো কম আছে। কর্পোরেশনের ইনসপেক্টর ভুল রিপোর্ট দেয়নি।’

—‘বলো কি?’ বিজু রায় সত্যিই অবাক হয়ে গিয়েছিলেন।

—‘ওই যে বলছিলেন খেয়ালের মাথায় করেছেন। সিরিয়াসলি নেননি! আপনার সেই অ্যাটিটিউডটারই সুযোগ নিয়েছে কনট্র্যাক্টর। আমার তো সরাসরি আপনাকেই রিপোর্ট দেবার কথা। আমি সরকারি লোকও না। কিছুই না। কোথাও ওবলিগেশন নেই। জাস্ট কনসেন্স। বিবেকের কাছে দায়বদ্ধ। বাড়িটা ভাল হচ্ছে না দাদা।

—‘আপনি শিওর? আমি কিন্তু বেস্ট মাল দেবার কথাই গোড়ার থেকে বলে আসছি। শিবশঙ্কর, মানে ওই কনট্র্যাক্টর আমার চেনা লোক। ইন ফ্যাক্ট আমার সল্ট লেকের বাড়ি ও-ই করেছে!’

জয়দীপ কাঁধের একটা ভঙ্গি করল। মুখে কিছু বলল না। জয়দীপকে ওর অফিসে নামিয়ে দিয়ে বেশ কিছুদূর, প্রায় নিজের অফিসে পৌঁছে গিয়েছিলেন বিজু রায়। হঠাৎ মনে হল রক্ষিতের দেওয়া পার্সেলটা জয়দীপের টেবিলে ফেলে এসেছেন। ব্রিফ কেস থেকে কর্পোরেশনের ইনসপেকশন রিপোর্টটা বার করবার সময়ে পার্সেলটাকে টেবিলের ওপর রাখতে হয়েছিল। তারপর ঢোকাতে ভুলে গেছেন। ওটা আবিষ্কার করলে জয়দীপ ঘুষ মনে করতে পারে। ঘুসুড়ির বাড়িটা ওভাবে বাতিল করে দেবার পর ঘুষ দেওয়ার অর্থ খুব খারাপ দাঁড়াবে। মান-সম্মান আর কিছু থাকবে না বিজু রায়ের ওইটুকু একটা ছেলের কাছে। তিনি গাড়ি ঘোরাতে বললেন। নেতাজী সুভাষের গলিতে ঢুকছেন, জয়দীপের গাড়িটা ওদিক দিয়ে বেরিয়ে গেল। জয়দীপ নিজেই ড্রাইভ করছে। পাশে শিবশঙ্কর না? তাঁর কনট্র্যাক্টর জয়দীপের গাড়িতে কী করছে? দুজনে যেন গভীর আলোচনায় মত্ত। বিজু রায় এত অবাক অনেকদিন হননি। শিবশঙ্করের সঙ্গে জয়দীপের আদৌ কোনও জানাচেনা আছে বলে তিনি শোনেননি। ও কি টের পেয়েছে জয়দীপ ওর সমস্ত ব্লাফ ধরে ফেলেছে? তাই ওর অফিসে ছুটে এসেছে? আগে তো তাঁরই কাছে আসা উচিত ছিল। কারণ কোর্টে জজের মুখোমুখি হতে হবে বিজু রায়কেই। শিবশঙ্করকে দেখিয়ে দিয়ে তিনি পার পাচ্ছেন না। তবে শিবশঙ্করকেও মুখোমুখি হতে হবে বিজু রায়ের। তাঁর নিজস্ব আদালতে। সেখানের আর কারুর দিকে আঙুল দেখিয়ে শিবশঙ্করও পার পাবে না। পার্সেলটা আনতে ড্রাইভার সমরকেই পাঠাবেন ভেবেছিলেন। কি মনে করে নিজেই লিফটে উঠলেন। বিশ্রী অন্ধকার বাড়িটা। চারদিকে ঝুল ঝুলছে। পানের পিকে সিঁড়ির কোণ-টোন ভর্তি। দেখলে কল্পনাও করা যায় না, এরই পাঁচতলায় জয়দীপ সাতশো’ স্কোয়্যার ফুট মতো জায়গা অমন ছিমছাম করে দিতে পেরেছে। স্লাইডিং ডোর, কাচ, কাঠ। বড় বড় পোস্টার। রবার গাছ। অচেনা ক্রোটন। মোল্ডেড চেয়ার-ফেয়ার।

পি সি নিয়ে কাজ করছিল একটি লোক। ঢোকবার মুখে টুলের ওপর পিওন। টেবিলে ওটি বোধহয় ড্রাফটসম্যান। বিজু রায়কে দেখে সেই বলল ‘মিঃ চ্যাটার্জি তো এইমাত্র গেলেন কাজে। কিছু বলতে হবে?’

বিজু রায় গম্ভীরমুখে বললেন—‘ভেতরে একটা পার্সেল আছে। আমার। ভুলে ফেলে গেছি।’

—‘এইয্‌ যাঃ। স্যার তো অফিসের চাবি নিয়ে বেরিয়ে গেলেন। খুব দরকারি নাকি?’

বিজু রায় বললেন—‘ফিরে এলে ওটা রেখে দেবেন। আমার ড্রাইভার সমরকে কাল কোনও সময়ে পাঠাব, তুলে নিয়ে যাবে।’

—‘ঠিক আছে। খুব দুঃখিত স্যার। উনি কখনও এত ছোটাছুটি করেন না। কোনও জরুরি ব্যাপার আছে মনে হয়। একটি ভদ্রলোক কদিন ধরেই আসছেন, তাঁকে নিয়ে কর্পোরেশনে গেলেন।’

ছোকরা একটু বেশি কথা বলে। অন্তত জয়দীপ ফিরে যদি শোনে তার অনুপস্থিতির এই কৈফিয়ত সে বিজু রায়কে দিয়েছে সে নিশ্চয়ই ছোকরাকে একটি বকর-বকর-বোক-চন্দর মনে করবে। কিন্তু তখন তারও আর কিছু করার থাকবে না। কিন্তু একটি ভদ্রলোক…মানে শিবশঙ্কর কদিন ধরেই আসছে? জয়দীপের কাছে? কেন? বাজে মাল দিয়ে তো সে আসলে ফাঁসিয়েছে তাঁকে? তাহলে কর্পোরেশনে যাবে কেন? তিন জনে, মানে তিনি, জয়দীপ আর শিবশঙ্কর মিলে পরামর্শ করে কর্পোরেশনে যেতে পারতেন। তা-ও ঠিক কর্পোরেশন-অফিসে নয়। গোটা কতক কাউন্সিলার, দরকার হলে, মেয়রের বাড়ি। ডিলিং ক্লার্কদের শিবশঙ্কর একাই ম্যানেজ করতে পারত। কিন্তু এরা দুজনে মিলে…তাঁর অজ্ঞাতে…গোপনে…? কীভাবে তাঁকে ফাঁসাবে আর? শিবশঙ্কর নিজেও তো পার পাবে না!

অফিস বন্ধ করতে বলে চাবি নিয়ে বিজু রায় আবার গাড়িতে উঠলেন। আজকে আর ভাল লাগছে না। এবার বাড়ি। সেই বাড়ি যা এই শিবশঙ্করেরই করা। শ্রেষ্ঠ আর্কিটেক্টের প্ল্যান। কিন্তু তাকে কংক্রিটে রূপান্তরিত করেছে শিবশঙ্করই। সে সময়ে নিজের বাড়িরও বেশ কিছু সংযোজন ও আগাগোড়া সারাইয়ের কাজ করে নিয়েছিল। ভাল করেই জানেন তিনি। এ জিনিস সব কনট্র্যক্টারই অল্পবিস্তর করে। শিবশঙ্কর একটু বেশি করেছিল। তো তিনি কিছু বলেননি। তাঁর বাড়িখানা তো বানিয়ে দিয়েছে সলিড! সল্ট লেকে বহু বাড়িই চেয়ে দেখবার মতো। তা তার মধ্যেও বিশেষ বোধহয় বিজু রায়ের বাড়ি। এক সময়ে যে এইভাবে ঘর তৈরি করে দিল, সে-ই এখন ঘর ভাঙতে লেগেছে! বিনা প্ররোচনায়! ভাল রে ভাল! কিন্তু শিবশঙ্করকে তো তিনি খুব সহজে ছাড়বেন না! তার লাইসেন্সটি তো বাতিল হয়ে যাবে! কিন্তু কর্পোরেশনের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধলে? পারবেন কী? সে যা-ই হোক। খামোখা এই শিবশঙ্কর যাকে তিনি বহুদিন ধরে কাজ দিয়ে আসছেন, আর এই জয়দীপ চ্যাটার্জি যাকে সবে দিতে শুরু করেছেন এরা হঠাৎ তাঁর ক্ষতিসাধন করতে তৎপর হয়ে উঠবে কেন? দূর হোক গে ছাই, হয়তো রজ্জুতে সর্প দর্শন করছেন! হয়তো অন্য কোনও ব্যাপারে শিবশঙ্করের জয়দীপের পরামর্শ দরকার হয়েছে। অন্য কোনও কেস। কিন্ত…শিবশঙ্কর তো একদিনও বলেনি সে জয়দীপকে চেনে, তার কাছে যায়! জয়দীপও তো কই…

নাঃ মাথাটা গরম হয়ে যাচ্ছে। এভাবে চললে প্রেশার বাড়া ছাড়া আর কিছু লাভ হবে না। বিজু রায় একটু চেষ্টা করে শিবশঙ্কর-জয়দীপ সংক্রান্ত দুর্ভাবনার সুইচটা অফ করে দিলেন।

গত ষোলোই অক্টোবর মায়ের কাজ নির্বিঘ্নে হয়ে গেছে। তারপর সাতাশে বিজু রায় আটান্ন পূর্ণ করে ঊনষাটে পা দিলেন। সরকারি চাকরি জীবনে থাকলে অবসর, পেনশন ইত্যাদি হয়ে যেত। বাবার মতো ইউ.ডি. ক্লার্কের একখানা পোস্টে টিকে থাকতে পারলে এখন তিনি বাতিল বুড়ো, নিজের পাওনা-গণ্ডা বুঝে নিতে সরকারি দফতরে জুততার সুকতলা ক্ষওয়াতে আরম্ভ করে দিয়েছেন। তাঁর ভাগ্য ভাল বাবা তাঁর ভাগ্য এই পথে চালিত করবার আগেই সময়মতো সরে আসতে পেরেছেন। স্টিল-গ্রে সুটের ভেতরে সময় তাঁর শরীরে কোথায় কতটা থাবা বসিয়েছে বাইরে থেকে বোঝা যায় না। শরীরের ওপর সময়ের প্রভাব তিনি। খুব একটা বুঝতেও পারেন না। ডাক্তার বললে মানতেই হয়। দুশো চিনি, একশো একশো-সত্তর রক্ত চাপ। এটা খাবেন না, ওটা খাবেন না, ফ্রি হ্যান্ড এক্সারসাইজ একটু। প্রাতর্ভ্রমণ। কিন্তু মন? আটান্ন বছরের জীবন এমন অন্ধিসন্ধি পর্যন্ত কাজ দিয়ে ঠাসা যে তিনি যুবক হবারও যেমন অবসর পাননি, প্রৌঢ় হবার ফুরসতও তেমনি না। এদিক থেকে ভাবলে বলতেই হয় তিনি খানিকটা ক্লিওপ্যাট্রার মতন। সময়ের আয়ত্তের বাইরে কোনও একটা বিন্দুতে তাঁর মনটা কাজ করে যায়। চিরসবুজ? ওরে নবীন, ওরে আমার কাঁচা? তা হয়ত নয়। কিন্তু চিরহলুদও নয়।

মায়ের দীর্ঘদিন বেঁচে থাকাও তাঁর সময়কে থোড়াই কেয়ার-করা জীবনচর্যার একটা গোপন কথা। ছোট খোকা! ছোট খোকা! কখনও বিজু! এসব বলে ডাকতে তো কেউ ছিল! বস্তুত মায়ের এই বিজু ডাক থেকেই বিজনেস-সার্কলে তিনি বিজু রায়। ঊননব্বুই বছর বয়সে মা গেলেন। শেষের পনেরো যোলো বচ্ছর এক রকম শুয়েই। প্যারালিসিস-টিসিস কিছু নয়। মাঝ সত্তর থেকে হাত পা ভাঙতে আরম্ভ করল, পুরনো বইয়ের পাতা ভাঙবার মতো, কিংবা পুরনো গাড়ির কল-কবজা বিগড়োবার মতো। আজ ব্রেক ঠিক করে আনা হল তো কাল গেল ক্লাচ, আজ কারবুরেটরে গণ্ডগোল তো কাল ফিউয়েল-ট্যাঙ্ক ফুটো। নড়বড়ে হাড়গুলো নিয়ে ফোকলা বুড়ি শুয়ে থাকত আর লোকে জিজ্ঞেস করলেই বলত—‘কী বলি দাদা, আমার হাড়-মুড়মুড়ির ব্যায়রাম ধরেছে। দিবি নাকি খোক্কসের তেল এনে?’ ষোলো বছর মানে প্রায় দেড় যুগ। এই সময়ের মধ্যে একটা শিশু জন্মে লায়েক হয়ে যায়, এই এতদিন শুয়ে শুয়ে, তা সে যত আরামেই হোক, একটা মানুষ যে কী করে অত হাসি হাসতে পারে, কাউ কাউ করে অত কথা বলতে পারে সে-ও একটা বিস্ময়। বিজু রায়ের বাড়িতে প্রচুর লোকের আনাগোনা। তার শতকরা কজন ছেলের কাছে, আর কতজন মায়ের কাছে বলা শক্ত। ছেলের কাছে লোক এসেছে নেহাত কাজে, স্বার্থের তাগিদে, হাজার চেষ্টা করেও সেটা তাদের পক্ষে লুকোনো সম্ভব হত না। কিন্তু মায়ের কাছে তো লোকে ঠিক কাজে আসত না! কত কত দূর সম্পর্কের কাকা, ভাইপো, ভাইঝি, বোনপো, বোনঝি-জামাই, নাতবউ, নাতকুড়, সারা বছর ধরে আসতেই থাকত। আসতেই থাকত। তাদের মধ্যে অনেকে নীচে দাঁড়াতেও সাহস পেত না, কলকেও পেত না, সোজা উঠে যেত তিন তলায়। খয়েরি ক্যামবিসের জুতো, তাপ্পি-মারা ছাতা, খোঁচা খোঁচা পাকা দাড়ি এক বৃদ্ধ যাঁকে মা নতুন ঠাকুরপো বলে ডাকত, যেন সেই সুবাদে বিজু রায়ও নতুন কাকা বলতেন, তাঁকে এই বাড়ির চৌহদ্দির বাইরে হলে তিনি বা তাঁর পরিবারের কেউ বোধহয় চিনতেও পারবে না। এ বাড়িতে ওই কিসিমের লোক ঢুকতে পারে তা-ও কেউ ভাবতে পারবে না। কিন্তু এই নতুন কাকা না কে অবলীলায় খপ খপ করে তেতলায় উঠে যেতেন যত দিন মা ছিলেন। কিছুক্ষণ পর চা আর জলখাবারও এসে যেত। এই বৃদ্ধ থাকাকালীন মায়ের ঘরে ঢুকলে বিজু রায়ও মাঝে মাঝে যোগ দিয়েছেন কথাবার্তায়, ঠাট্টা ইয়ার্কিতে হেসেওছেন। মা যাবার পর থেকে বৃদ্ধ উধাও। আর এলেও বোধহয় দারোয়ান ঢুকতে দেবে না। বিজু রায়ই কি কথা বলবেন? এই যে নতুন কাকা, কখন এলেন? বলতে বলতে নীচে নিজের অফিস ঘরে নেমে যেতে থাকবেন না? নিজের ঘরের পর্দা সরিয়ে তনুশ্রী ভুরু কুঁচকে চাইবে, বুঝতে পারবে না এই বৃদ্ধটি কে এবং কেন! ছেলে এবং মেয়ে খুব সম্ভব ‘বদার’ করবে না। একমাত্র প্রমীলাই আগেকার কথা স্মরণ করে, দিলেও দিতে পারে এক কাপ চা, দুটো বিস্কুট।

কিন্তু মায়ের কাছে যে লোকে কাজে আসত না, এটাও বোধহয় ঠিক কথা নয়। রান্না শিখতে অর্থাৎ লিখে নিতে আসত কেউ কেউ। ‘মালাইয়ের পুর দিবি দিদি, পোস্ত আর নারকেল সামান্য, এই এতটুকু।’ ঘরে ঢুকতে ঢুকতে একদিন শুনতে পেয়েছিলেন যেন। তিনি ঢুকতেই মায়ের নাত-বউটি ‘ওমা! ছোটকাকা’ বলে হুট করে উঠে গেল। আবার এও দেখেছেন বিয়ে-থা কি পুজো-আচ্চা, কি শ্রাদ্ধ অশৌচ ইত্যাদি সম্পর্কেও মার কাছে অনেক আত্মীয়-স্বজন উপদেশ নিতে আসছে। ছাউনি-নাড়া ফুল, ছিরি, বরণ ডালায় কী কী থাকবে, হলুদ মাখানো সুতোটা কপাক বেড় দিতে হবে—অশৌচান্তর নাপিত না পাওয়া গেলে মেয়েরা কী করবে ইত্যাদি ইত্যাদি। আজকালকার মেয়ে-বউরা এসব খুঁটিনাটি অনেক জানে না। কিন্তু ফেলেও দিতে পারে না বোধ হয়। তাই মায়ের কাছে ছুটে আসত। একেকটা বিয়ের মরশুমে এই জাতীয় অতিথি বাড়িতে খুব বেশি হয়ে যেত। অত কথা বলে মা অসুস্থ হয়ে পড়ত। বিজু রায় তখন ঘরে ঢুকে বলতেন—‘আমি এবার সব বারণ করে দিচ্ছি। এ কী কাণ্ড! বুড়ো মানুষকে এভাবে জ্বালাতন করার কোনও মানে হয়?’ মায়ের সঙ্গে চোখাচোখি। মা বলত,

—‘বারণ করিসনি বিজু। বারণ করবি কী জন্যে?’

—‘কী জন্যে? একটা কিছু হলে?’

—‘কী হবে?’ ক্ষীণ কণ্ঠ, কোটরাগত চোখ বিজুর চোখে। অন্য সময়ে এই চোখই কৌতুকে ঝিকমিক করে। আজ ক্লান্ত তাই স্তিমিত। অস্থি চর্মসার দেহ। মাথায় কিছু সাদা তুলোর কুণ্ডলি। চোখ থেকে চোখ সরিয়ে নিচ্ছে না মা। বিজু রায় বুঝতে পেরেছেন মা কী বলতে চায়।

কত অল্প খেয়ে মানুষ বেঁচে থাকতে পারে, মাকে দেখে জানা গেল। মায়ের জন্য গত পনেরো বছর ধরে সকাল আর রাতের আয়ার ব্যবস্থা ছিল। প্রথমটা তিনি ভেবেছিলেন মা আপত্তি করবে, একটা মহা সমস্যা তৈরি হবে। কিন্তু আপত্তি ছেড়ে, কোনও অসন্তোষও মা ঘুণাক্ষরেও প্রকাশ করেনি। তিনিই বরং একদিন আগ বাড়িয়ে কৈফিয়ত দিয়েছিলেন—‘আতুরে নিয়মো নাস্তি। কী বলো, মা?’

‘নিয়ম? কিসের নিয়ম?’ মা অবাক হয়ে বলেছিল। তার পরে ছেলের কথার প্রসঙ্গ ধরতে পেরে বলেছিল ‘আতুরে সব কিছুই নাস্তি ছোটখোকা। স্বস্তিই সব।’ মায়ের অভিমান ছিল কি না বলতে পারবেন না তিনি। থেকে থাকলে সেটা অযৌক্তিক, আবার অযৌক্তিক নয়ও। বিজু রায়ের যা কাজকর্ম তাতে তাঁর পক্ষে ব্যক্তিগতভাবে মায়ের সেবা করা অসম্ভব। তনুশ্রী যদি সাধারণ গেরস্থ ঘরের বউ হত, তাকে করতে হত, কিন্তু তা তো সে নয়। কেন করবে? মাকে যতদূর জেনেছেন খুব গোঁড়া, প্রাচীনপন্থী, শুচিবায়ুগ্রস্ত, নিজের সম্পর্কে লাজুক বলেই জেনেছিলেন। কিন্তু মা নির্বিবাদে মাইনে করা আয়া জাত-জন্মের ঠিক নেই, তার কাছ থেকে বেডপ্যান নিল। তার কাছে স্পঞ্জ করল, হরলিকস খেল, পরে ভাতও খেল। এই মেনে নেওয়াটা মার বয়সে সম্ভব হল কী করে তিনি জানেন না। আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ জিনিস তো মা মেনে নেয়নি। দাঁতে দাঁত চেপে মা যে নিরুপায় হয়ে মেনে নিল, এমনও বলা যাবে না। মা একটা লড়াই দিতে পারত। দাঁতে দাঁত টিপে রইল, কিছু খেল না, অশক্ত হাত-পা নিয়ে বাথরুমে যেতে গেল, পড়ে গেল। এই রকম। তা সেসব কিছু তো মা করেনি। বরং ওই দুটি আয়া, সুলতা আর শিবানী ওদের সঙ্গে খুবই ভাব-ভালবাসা হয়ে গিয়েছিল মার।

মা ছেলে-মেয়েকে যতটা দেয়, ছেলে-মেয়ে মাকে ততটা তো কিছুতেই দিতে পারে না। বাবা সাত বছর শুয়েছিলেন। ঠাকুমা ছ বছর। দুজনেই পক্ষাঘাতে। তাঁরা ভাইবোনেরা যখন-তখন। সে সময়টা কী অসুখই না করত! টাইফয়েড? চলল একাদিক্রমে একুশ দিন, চিকেন পক্স, আবার চলল মাসখানেকের কাছাকাছি। ইনফ্লুয়েঞ্জা? থাক শুয়ে অন্ততপক্ষে পনেরো দিন। তারপরে আছে রক্ত-আমাশা, খোস-পাঁচড়া, বেরিবেরি, ন্যাবা…কী নয়? যখন তখন। সবাইকে মা একা হাতে সেবা করেছে। করে সংসার দেখেছে। কী করে করেছে মা-ই জানে। তখন মনে হত এটাই স্বাভাবিক। ঠাকুমাকে বেড-প্যান দিয়ে, বড় ছেলের গা মুছিয়ে, চান করে মা নতুন টাইফয়েড থেকে ওঠা দুই ছোট ছেলে মেয়ের শিঙি মাছের ঝোল-ভাত পথ্য নিয়ে আসবে। ইতিমধ্যে অন্যদের দুপুরের খাওয়া, জলখাবার, রাতের আহার, বিছানা করা, টেবিল গুছোনা, আলনা গুছোনো। একটিমাত্র ঠিকে কাজের লোক বাড়িতে। দিদি যখন ছিল সামান্য সাহায্য করত। কিন্তু মা সেটা চাইত না। তোরা পড়। মায়ের ওই এক বাক্য, এক মন্ত্র, এক চাহিদা। তোরা পড়। পড়লেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। দারিদ্র্যের সুরাহা হবে। সামাজিক মানমর্যাদার নাগাল পাওয়া যাবে। বড়লোক আত্মীয়ের বাড়ি ‘তোমরা তো ঘরের লোক’ বলে অসাগর খাটুনির পর শেষ ব্যাচে মাংসের শুধু ঝোল, মাছের ছাল, আর ভাঙা ভাঙা লেডিকেনি এসব। সব কিছুর সুরাহা। যাক গে। মা দিয়েছে। সেবা, যত্ন, নিজের কিছু রাখেনি। আদর্শ। আদর্শও মা দিয়েছে। জীবনে বড় হবার মূলমন্ত্র। সেটা কাজে লাগাতে পারেননি বিজু রায়, সেটা আলাদা কথা। কিন্তু মা দিয়েছিল। তিনি ছেলে, ছেলে হিসেবে ফেরত দিয়েছেন সেবা যত্ন। সবই ঠিক। কিন্তু মা নিজের হাতে দিয়েছিল। মা বোকা। তিনি আয়ার হাতে দিচ্ছেন। তিনি কেজো, তিনি চালাক।

মা সারা জীবন এত ব্যস্ত থেকেছে যে মাকে কোনও দিন ভাল করে দেখা হয়নি। কখনও সবুজ পাড়ের শাড়িতে ঘেরা মুখ, কখনও আলুথালু খোঁপার নীচে শাড়ির পাড় হেলায় পড়ে আছে। বেশি বয়সে আবার সেই একই মুখ শুভ্রতার ঘেরে। মা যে কবে কী খেয়েছে, পরেছে, কীভাবে কী করেছে মনে পড়ে না। বড় দাদা-দিদিরা জানত হয়ত। বিজু লাটিম থেকে ঘুড়ি, ঘুড়ি থেকে বিড়ি, বিড়ি থেকে ফেরি, বেওসা…তারপর সিঁড়ি ভেঙে ভেঙে অনেক ওপরে এসে যখন দেখবার অবসর হল দেখলেন এক বৃদ্ধা ফিমর বোন ভেঙে শুয়ে আছেন। নার্সিং হোমের শয্যায়। একটি খুব সুসজ্জিত যুবতী পাশ থেকে উঠে দাঁড়াল। ‘চলো এবার মাকে ও-টিতে নিয়ে যাবে’, যুবতী বলল। চমকে উঠে বিজু রায় দেখলেন তাঁর মা। পড়ে গিয়ে মোক্ষম হাড় ভেঙেছে। ভেতরে লোহার রড ঢোকাতে হবে। নার্সরা তাঁকে নিয়ে ব্যস্ত, তাঁর স্ত্রী হাত-ব্যাগ দোলাতে দোলাতে বাইরে চলে যাচ্ছে। বলল— ‘সেজদাকে ফোন করে দিয়েছি। দিব্য ধরেছিল। ও-ই সব্বাইকে খবর দিয়ে দেবে।’ সেজদা? দিব্য? মানে তাঁর সেজদা কানন? হ্যাঁ। হ্যাঁ তাই-ই তো! সেজদা সরকারি চাকরি করে না? কোন ডিপার্টমেন্টে যেন? ফুড বোধহয়। দিব্য, দিব্যদ্যুতি সেজদার বড় ছেলে তাঁর ভাইপো হল সম্পর্কে। ইলেকট্রিক্যাল এঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে না? সেজদা, এই সেজদার ফ্যামিলিটাই যা একটু…। তাই তাঁর স্ত্রী-পুত্রদের সঙ্গে ওর স্ত্রী-পুত্রদের একটু বেশিই…। আর কে কে যেন আছে? বড়দা, বড়দা ছিল জড়বুদ্ধি। ভাগ্য ভাল মায়ের শরীর থাকতে থাকতে মারা গেছে। মেজদা গগন? গগনবিহারী। একটা মনোহারি দোকান আছে। ব্যবসাই যদি করবি, একটু ফলাও করে করলে কী হয়! মাথায় গোল টাক গগনবিহারীর। ধারে ধারে চুল। ঠিক যেমন বাবার ছিল। মেজদাই ছেলেবেলায় ধরে বেঁধে পড়াত আর মাথায় গাঁট্টা মেরে বলত— ‘বিজুটা পয়লা নম্বরের ফাঁকিবাজ। ওটার কি হবে না।’ তা এম-কম পাশ করেই বা মেজদার কী হল? দোকানদার। লেখাপড়া করে যে-ই গাড়ি ঘোড়া চড়ে সে-ই। মেলেনি। মেজদার ডিগ্রিটা এমন দামে এখনও পর্যন্ত বিকোল না যে একটা সেকেন্ড-হ্যান্ড গাড়িও কিনতে পারে। সেজদার সরকারি চাকরি, প্রশ্নই নেই। একমাত্র বি-কম ফেল বিজনবিহারীরই গাড়ি আছে। চকচকে নতুন। একখানা নয়, তিনখানা। বাড়ি সোনারপুরের দিকে মেজদাও করেছে, শ্বশুরের দেওয়া জমিতে। কিন্তু বিজনবিহারী রায়ের নিজের গায়ে খেটে মাথায় খেটে উপার্জন করা টাকায় কেনা জমি, তৈরি বাড়ি, বাড়ি নয় একটা শিল্পদ্রব্য। মেজদা মেয়ের বিয়েতে খাইয়েছিলও খুব ভাল, কিন্তু মেজদার সঙ্গে ঠিক…। ভীষণ গম্ভীর মুখ, পকেটে বিড়ি আবিষ্কার করে শাসন করছে সেই দিদি। দিদিই বা কী করছে! কেমন প্রার্থী-প্রার্থী চেহারা দেখেছিলেন যেন একবার? থানে-ঘেরা সেই ন্যুব্জতা, তার সঙ্গে ছেলেবেলার দিদি ধারণাটা কিছুতেই খাপ খায় না। কোথায় থাকে দিদি? মায়ের কাজে এসেছিল। সুদ্ধ কাজের দিন। সঙ্গে ছেলে? না নাতি? কেয়ারি করা ঘাড় পর্যন্ত চুল, বড় বড় নখ রেখেছে। হাতে মেহেদির ছাপছোপ। কী অদ্ভুত! তিনি কাজে ব্যস্ত ছিলেন, ওই অদ্ভুত দর্শন ছেলেটির পরিচয় জিজ্ঞেস করেননি। সম্ভবত কেউই করেনি। দিদি শ্রাদ্ধ শেষ হলে ফল-মিষ্টি খেয়ে চলে গেল। বলল— ‘নিয়মভঙ্গে আর আসব না, আমার নিয়ম তো আর ভঙ্গ হবে না। আসতে বড় কষ্ট হয়।’ সমরকে ডেকে বলেছিলেন, শেয়ালদা স্টেশনে পৌঁছে দিতে। ওই লাইনেই কোথায় যেন থাকে! আর ছুটকি? যার সঙ্গে পাশাপাশি টাইফয়েডের শয্যা ভাগ? শিঙ্গি-মাছের ঝোল-ভাত ভাগ? সেই ছুটকি? নাহ…ছুটকির কথা বিজু রায় কিছু জানেন না। এমনকি তনুশ্রী, তাঁর স্ত্রী ছুটকির অস্তিত্বের কথাই জানে না। ছুটকি লজ্জা। ছুটকি মুছে গেছে।

এত সব ভাববার সময় সাধারণত বিজনবিহারীর থাকে না। রাত সাড়ে আটটা নটার আগে তিনি বাড়ি ফিরতে পারেন না। রবিবারের কথা অবশ্য আলাদা। কিন্তু বেশির ভাগ রবিবারেই প্রচুর লোক দেখা করতে আসে। সন্ধেবেলায় তিনি ক্লান্ত হয়ে পড়েন। যতদিন মা বেঁচে ছিল রবিবার সকালে নিয়ম করে আধঘন্টা মায়ের কাছে বসতেন। অন্যান্য দিনও খুব বেশি দেরি না হয়ে গেলে অন্তত পনেরো কুড়ি মিনিট। আজ মঙ্গলবার, মা না থাকায় ফেরার সেই তাড়ার বোধটাও ছিল না। কিন্তু হাতের কাজগুলো ফুরিয়ে গেল। মনটা খারাপও হয়ে গেল খুব। প্রোমোটারের ব্যবসায়ে তিনি নামতে চাননি, দুলিচাঁদ নামাল। দুলিচাঁদের ব্যবসা রমরম করে চলছে। তিনি প্রথমটাতেই মুখ থুবড়ে পড়লেন। সামলে দেওয়া যাবে ঠিকই। কিন্তু বদনাম তো একটা হল। এর আগে বদনাম তাঁর কখনও হয়নি। সবচেয়ে বড় কথা, বুকের মধ্যে গলার মধ্যে ট্যাংরা মাছের কাঁটার মতো খচ-খচ করছে ওই দৃশ্যটা। ছাই-ছাই রঙের স্ট্যান্ডার্ড হেরাল্ড। পুরনো গাড়ি কিনেছে জয়দীপ। সামনের দিকে দুটো মুখ খুব কাছাকাছি। শিবশঙ্করের সঙ্গে জয়দীপ আলোচনায় মত্ত। জয়দীপের সঙ্গে শিবশঙ্করের কী? শিবশঙ্কর তাঁর লোক, জয়দীপকেও, তিনি বসাকের পার্টিতে চিনে অবধি সাহায্য করছেন। ওরা কেউ কাউকে চেনে না, অন্তত চেনবার কথা নয়। অথচ দুজনে ঘনিষ্ঠ হয়ে কথা বলছে। তাঁকে গোপন করে কর্পোরেশন অফিসে গেল। বিজু রায় যখন ব্যবসায়ে নামেন দুজন ব্যক্তির কাছ থেকে সাহায্য পরামর্শ ইত্যাদি পেয়েছিলেন। এই বসাকের বাবা নৃত্যগোপাল বসাক, সংক্ষেপে এন. জি। আর দুলিচাঁদ। এন. জিকে তিনি এখনও নিজের বাবার মতো শ্রদ্ধা করেন। প্রতি জন্মদিনে ধুতি-চাদর, ফুল, মিষ্টান্ন নিয়ে দেখা করেন। বোঝাই যায় বৃদ্ধ এখন ভিমরতির পর্যায়ে। বাড়িতে কেউ তাঁর খোঁজ রাখে না। বিজু রায় কিন্তু যান। সময় পেলেই যান। প্রায় বদ্ধ কালা বৃদ্ধের সঙ্গে বহুক্ষণ আলাপ করে আসেন। তাঁর বিষণ্ণ মুখে যতক্ষণ না হাসি ফুটছে ততক্ষণ অব্দি তিনি অপেক্ষা করেন। আর দুলিচাঁদ! দুলিচাঁদের কোন পরামর্শটা তিনি আজ অব্দি ফেলেছেন? দেওরাকে শেয়ারের দালাল ঠিক করেছিলেন দুলিচাঁদের অনুরোধেই। ডুবোল তো? রিয়্যাল এসটেটে নামাল দুলিচাঁদ। তিনি নেমেছেন সুদ্ধ দুলিচাঁদের পরামর্শের মান রাখতেই। এই দুলিচাঁদই না তাঁকে কচি বয়সে ব্যবসার ঘাঁত ঘোঁত শিখিয়েছে? কিন্তু জয়দীপ? আজকালকার পাশ করা ঝা-চকচকে সিভল এঞ্জিনিয়ার! এই অল্প দিনের পরিচয়েই যথেষ্ট ব্যবসা পাঠিয়েছেন তিনি ওকে। হঠাৎ এমন ব্যবহার করল? আর শিবশঙ্কর তো একরকম তাঁর খেয়ে-পরে মানুষ! ওই রক্ষিতের মতো! তবে?

বাড়ি পৌঁছে বিজু রায় দেখলেন বাড়িখানা আপাদমস্তক শূন্য। মস্তকে মা ছিলেন, মা চলে গিয়ে সেখানটায় টাক পড়ে গেছে। ছেলে মেয়ে স্ত্রী এরা সব কোথায় তিনি তো জানেনই না। লোকজনরাও বিশেষ কিছু বলতে পারল না। তাঁর চান হয়ে গেল। শামি কাবাব, হুইস্কি আর স্টার টি.ভি নিয়ে ঘণ্টা দুয়েক পার হয়ে গেল। সাড়ে নটা। ঘড়িটা কিছুক্ষণ অন্তর-অন্তরই পাখা মেলে নানান ক্যারদানি করে সময় জানান দিচ্ছে। দশটা বাজল, এখনও বুড়ি এল না। সাড়ে দশটা বাজল, এখনও বুড়ি এল না। টি.ভি অফ্‌ করে বিজু রায় উঠে পড়লেন।

এই জায়গাটা তাঁর বাড়ির বিখ্যাত সেন্টার পার্লার। এখানে তাঁরা নিজেরা এবং ঘনিষ্ঠজনেরা ছাড়া কেউ আসতে পায় না। তাদের জন্য নীচে আলাদা বসার ঘর আছে। দেয়ালজোড়া নরম কার্পেট। দেয়ালে হালকা বেগনি রং। তার ওপর বনসাইয়ের ছায়া পড়েছে। কোণে একটা ব্রঞ্জের গাছদান থেকে একটা বিরাট সাদা লিলি সুললিত আঙুল মেলে দিয়েছে। বাটিকের বুদ্ধ যশোধরা রাহুল ঝুলছে আর একটা দেয়াল থেকে। ওদিকে আবার ভ্যান গখের বিদ্‌ঘুটে আত্মপ্রতিকৃতি। যেদিকেই তাকালেন বিজু রায়, দুলিচাঁদ কানোরিয়ার ঘর, রাকেশ গুপ্তর ঘর, অনিল চৌধুরী বা এন. জির ছেলে শরদিন্দু বসাকের ঘর দেখতে পেলেন। ইনটিরিয়র ডেকোরেটর এসে সাজিয়ে দিয়ে গেছে; চরিত্রহীন ঘর। বিজু রায় অবাক হলেন ভেবে আগে কেন কখনও এসব মনে হয়নি, কেন লক্ষ পড়েনি তাঁর সেন্টার পার্লারের এই বেয়াড়া নৈর্ব্যক্তিকতা! বিজু রায় বিরক্তির আওয়াজ করে তাঁর স্ত্রীর শোবার ঘরে গেলেন। ডবল বেড খাটে টান টান বেডকভার। ফুলোফুলো মতন, যেন তুলো বা স্পঞ্জের তৈরি। ব্যাপারটা কী তিনি হাত বুলিয়ে দেখে নিলেন। একদিকের দেয়াল জুড়ে বিরাট ড্রেসিং টেবল্‌। কিছু-কিছু প্রসাধন দ্রব্য সাজানো রয়েছে। ড্রয়ারগুলোতে চাবি। প্রসাধন দ্রব্যগুলো তুলে তুলে শুঁকে শুঁকে দেখতে লাগলেন বিজু রায়। ডিওডোরান্ট, হেয়ার-স্প্রে। আর কিছু নেই। খুব সম্ভব এইগুলো সবশেষে ব্যবহার করে ড্রয়ারে তুলতে ভুলে গেছে তনুশ্রী। বিজু রায় লক্ষ করলেন ড্রেসিং টেবলে, দেয়ালের নানান জায়গায়, খাটের মাথায় সর্বত্র বিভিন্ন ভঙ্গিতে তনুশ্রীর ফটো। একটা অবশ্য ছেলেমেয়েদের সঙ্গে আছে, তারা তখন খুব ছোট, তনুশ্রীও একেবারে কাঁচা। কিন্তু আর সবই তনুশ্রীর একার কিংবা নানান বাইরের লোকের সঙ্গে তোলা। এদের মধ্যে শিল্পপতি, গাইয়ে বাজিয়ে, পলিটিকসের লোক সবরকমই আছে। যেগুলো তনুশ্রীর একার, সেগুলো বেশ ফিলমস্টার ফিলমস্টার ভঙ্গিতে তোলা। মাথায় তোয়ালে বাঁধা, বুকে তোয়ালে জডানো, কামানো বগল দেখিয়ে হাত দুটো ওপরে তোলা— এ ছবি কে তুলেছে কে জানে? আর একটা ওড়না টেনে, নাকে নথ পরে নাচের পোশাকে চারদিকে কুঁচি ছড়িয়ে বসে। এক পা সামনে ছড়ানো। কানের পাশে হাত। তনুশ্রী কি কখনও নাচ-গান জানত? বেশ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ছবিগুলো আজ দেখলেন বিজু রায়। যেন নতুন চোখে। আগেও তো এগুলো এ ভাবেই ছিল। তিনি যে এ ঘরে ঢোকেন না তা-ও নয়। কিন্তু আজই ছবিগুলো যেন প্রথম দেখলেন। ছবিগুলোর মধ্যে দিয়ে তনুশ্রীর সারা জীবনের চাওয়াও বেশ স্পষ্ট করে যেন দেখতে পেলেন তিনি। তনুশ্রী মোটামুটি ভাল দেখতে। প্রাণপণ চেষ্টা করে চেহারা রেখেছে। সে অনেক পেয়েওছে, সম্ভবত যা-যা চেয়েছে সব। পোশাক পরিচ্ছদ, বিউটি সেলুন, কসমেটিক সার্জারি, মাসাজ-ক্লিনিক, সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার ক্লাবের প্রেসিডেন্ট পদ, বড় বড় লোকের সঙ্গে ঘোরাফেরা। কিন্তু বিজু রায় পরিষ্কার আয়নার মধ্যে দিয়ে প্রতিবিম্ব দেখার মতো করে দেখতে পেলেন তনুশ্রী আসলে বেশ্যা হতে চায়। টান টান ত্বক সমেত সরু লম্বা পা, ভাঁজহীন পেট, নধর গোল হাত, মসৃণ কাঁধ, এই সমস্ত তনুশ্রী সবাইকে দেখাতে চায় ভীষণভাবে। নির্দোষ এই চাওয়া হয়। কিন্তু সন্দেহ নেই তনুশ্রী চাইছে, চতুর্দিকে প্রেমিকদের, স্তাবকদের কোলাহল, কেউ পায়ে হাত বুলোচ্ছে, কেউ বুকের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে আছে, কেউ চোখে চোখে ইশারা করছে— এইসব তনুশ্রী অন্তরের অন্তস্তল থেকে বহু বাসনায় প্রাণপণে চাইছে চাইছে চাইছে।

চাইছে শুধু? না পাচ্ছেও? পাচ্ছে নিশ্চয়ই। টাকা। অনেক অনেক নিজের অনর্জিত টাকা। তিনি তনুশ্রীকে আলাদা ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট করে দিয়েছেন অনেক দিন। তাঁর নিজের সঙ্গে জয়েন্ট অ্যাকাউন্টও আছে বেশ কয়েকটা। কিন্তু কথাটা হল তনুশ্রী পেয়ে যাচ্ছে। স্রেফ বিজু রায়ের স্ত্রী হওয়ার সুবাদে। টাকা, পদ, সামাজিক মর্যাদা, খোসামোদ এই সব পেয়ে যাচ্ছে এক্স অফিসিও। বিজু রায়ের ধর্মপত্নীর গুরুত্বপূর্ণ পদে আছে বলে। এই পরিমাণ টাকা, এবং মর্যাদা একটা গুণহীন মেয়েমানুষ যদি ফোকটে পেয়ে যায়, এবং তাকে যদি সমস্ত সাংসারিক দায়দায়িত্ব থেকে মুক্ত করে দেওয়া হয় তা হলে সে কী করবে? হয় বোর হবে নয় অকাজের কাজ করে বেড়াবে। একেকজন একেক ভাবে। নিজের প্রবৃত্তি অনুযায়ী। এই সংসারে কোথায় কী লাগে, কতটা চাল ডাল, কী পরিমাণ চা-দুধ-কফি-চিনি, কে কী খায়, কখন খায়, এ সব তিনি যেমন জানেন না, তনুশ্রীও তেমনই জানে না বলে তাঁর ধারণা। কারণ একেকদিন দুজনে কি তিনজনে, কদাচিৎ চারজনে খেতে বসলে তনুশ্রীকে যেন জিজ্ঞেস করতে শুনেছেন ‘প্রমীলা! আজ কী মেনু?’ তাঁদের অল্পবয়সে ভাইবোনেরা খেতে বসলেও এ প্রশ্ন কেউ-না-কেউ করত। তিনি করতেন। ছুটকি করত। বাবাও করতেন। ‘আজ কী রান্না হয়েছে?’

—‘কী আবার হবে? থোড়-বড়ি-খাড়া আর খাড়া-বড়ি-থোড়!’ মায়ের জবাব।

—‘বলোই না বাবা, অত বিনয় করছ কেন?’ ছুটকি হয়ত বলল।

—‘শুকতো’, মেজদা মুখ বিকৃত করল, ‘শাকে ডালে’, বাবা উৎসাহিত হয়ে বললেন ‘মুলো দিয়েছ তো?’ ‘হ্যাঁ গো হ্যাঁ।’ ‘ডাঁটাচচ্চড়ি।’ বিজু বলল—‘আগে বাঢ়ো, এখনও আমার পছন্দমতো কিছু শুনছি না।’ মুখ টিপে হেসে বলছে, ‘আলু পোস্ত’ ‘হুররে’। সশব্দে বলছে বিজু, অন্যরা নিঃশব্দে। ‘আজকে মাছ নয়, ডিম।’ মা বলছে। ‘তবে তো আরও ভালো, হাঁস না মুরগি?’ বিজুর প্রশ্ন। ‘মারব এক থাবড়া, বামুনবাড়িতে মুরগি!’ ‘মুরগির ডিম কিন্তু সহজপাচ্য মা’ ছুটকি বলল, ‘তা ছাড়া একটা পাখির ডিম খেতে যদি আপত্তি না থাকে তো আরেকটাতে কেন আপত্তি হবে! বলো বাবা!’

বাবা রাশভারী লোক। ছুটকি ছাড়া আর কেউ বাবাকে এভাবে আলোচনায় টানতে সাহস পায় না। বাবা বললেন ‘হাঁসের ডিম বড়ও বেশি, খেতেও অনেক ভাল।’

—‘তুমি মুরগির ডিম খেয়ে দেখেছ বাবা!’ সঙ্গে সঙ্গে ছুটকি তৈরি। ‘না, মানে, লোকে বলে।’

এই ঘরোয়া দৃশ্য এবং কথাবার্তা স্মৃতির কোন কোনায় এত যত্নে এমন নিখুঁত নির্ভুলভাবে সংরক্ষিত ছিল ভেবে অবাক হতে হতে বিজু রায় নিজের ঘরটাতে ঢুকলেন। একটা গুমসোনি গন্ধ নাকে এল প্রথমেই। জানলা খুলে দিলেন। গেল না। খুব মৃদু একটু তামাক, একটু হুইস্কির কড়া গন্ধ—তা-ও মিশে আছে ঘরের বাতাসে। কিন্তু মূল গন্ধটা খুব বিশ্রী, অচেনা। সকালে তিনি ঘর ছেড়ে বেরোবার পর এরা কি পরিষ্কার-টরিস্কার করেনি? বেডকভার সরিয়ে চাদর দেখলেন তিনি। বেশ পরিষ্কার চাদর। চাদর সরিয়ে গদি দেখলেন, পরিষ্কার গদি। দেয়ালের কোণে আয়না-সুদ্ধু ছোট্ট তিন কোনা আলমারি ফিট করা। এইখানে তিনি দাড়ি কামান। দাড়ি কামানোর যাবতীয় সরঞ্জাম এখানেই থাকে। ছেলেবেলায় মায়ের খুড়তুত পিসেমশাইয়ের বাড়ি তিনি এইরকম দেখেছিলেন। মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। দীর্ঘকাল পরে যখন তাঁর নিজের বাড়ি হচ্ছে, সবই পেশাদারি হাতে ছেড়ে দিয়েছিলেন খালি এইটা বলে দেন। ‘আমার ঘরের উত্তর-পূব কোণের দেয়ালে একটা তিন সাড়ে তিন ফুট লম্বা আলমারি ফিট করে দিয়ো। চওড়া যতটা পারমিট করে। ভেতরে তাক থাকবে। তেকোনা ন্যাচার‍্যালি। আমি ভালভাবে মুখ দেখতে পারব, এমন হাইটে কোরো।’ দাড়ি কামান, চুল আঁচড়ান, টাই বাঁধেন সব এই আয়নার সামনে। আরাম চেয়ার রয়েছে একটা। বই, রেডিও, কাগজপত্র রাখবার ড্রয়ার, ওয়ার্ডরোব সব একত্র করে একটা মালটিপারপাস ফার্নিচার করে দিয়েছে এরা। ফুলদানে টাটকা ফুল, টাটকাই তো! আশ্চর্য! তবু চিমসোনি গন্ধে গা গুলিয়ে উঠছে!

বিজু রায় আলো নিবিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলেন। বারান্দায় দাঁড়িয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। চারদিকে গাছপালা। বাগান। অপূর্ব নকশার সব বাড়ি। আকাশ মালিন্যহীন। এক টুকরো চাঁদ ফিক ফিক করে হাসছে। পাটের ফেঁসোর মতো দু চারটে মেঘ অনেক দূরে দূরে স্থির হয়ে আছে। বারান্দায় বেশ মশা। দু চারটে চটাচট গায়ের ওপরেই মেরে ফেললেন তিনি। তারপর কি ভেবে পার্লারে বেরিয়ে, গোল জায়গাটা পেরিয়ে ওদিকে ছেলের ঘরে ঢুকলেন। ঢুকতেই একটা জীবন্তপ্রতিম পোস্টার তাঁকে অভ্যর্থনা করল। খুব সুন্দর একটি মেম সাহেবের আবক্ষ ছবি। গোলাপি বুক ঠেলে উঠেছে। তলপেটে যেন একটা ধাক্কা খেলেন বিজু রায়। হাসছে মেম সাহেবটি। তলায় কি সব লেখা। কাছে গিয়ে আবছা আবছা পড়তে পারলেন—‘ওহ্, মাই ম্যাডোনা। আই লাভ ইউ।’ ম্যাডোনা? ম্যাডোনার ছবি এই রকম? বিজু রায় অবাক হয়ে গেলেন। সে তো গোল ধরনের মুখ। কোমল লাবণ্যে ভরা। মৃদু হাসি। চুলগুলো সিঁথি কেটে আঁচড়ানো। এ লেখাটা কি চিন্টুর? চোখে পড়ার চশমা নেই বলে ভালভাবে অক্ষরের ছাঁদ দেখতে পাচ্ছেন না তিনি। চিন্টু কাকে ম্যাডোনা বলে ডাকছে রে বাবা! দেয়াল-ভর্তি আরও পোস্টার। কোথাও এক যুবক হাতের মাস্‌ল ফুলিয়ে কপ্‌নি জাতীয় কিছু একটা পরে দাঁড়িয়ে আছে। কোথাও যুবক-যুবতী নিবিড় আলিঙ্গনে। চুম্বনে মত্ত। এই ছবিগুলো দেখতে দেখতে ঘুমন্ত বিজু রায় নির্ভুলভাবে জেগে যাচ্ছিলেন। ভাবছিলেন— ‘বারে বিজু ষাটের কাছেও তুই তো বেশ…’ তার পরেই লজ্জা পাচ্ছিলেন। এ সমস্ত উন্মাদনার উপকরণ তাঁর ছেলের। তিনি বাবা না? মুখ ফিরিয়ে টেবিলের ওপর তাকালেন। স্তূপীকৃত বই, পত্রিকা। উল্টে পাল্টে দেখলেন, স্পোর্টস, ফিল্‌ম। বইগুলো একটু আধটু পড়বার চেষ্টা করলেন। কিছু বুঝতে পারলেন না। কী অদ্ভুত ইংরিজি! কত বয়স হল নীলাদ্রির? একটু বেশি বয়সে বিয়ে করেছেন। ছেলেটির বোধহয় একুশ বাইশ। কী পড়ছে, শুনছে? কমার্স পড়ছিল না? নাকি অন্য কিছু? এর সম্পর্কে অথাৎ কেরিয়ার সম্পর্কে এবার ভাবতে হয়। কমার্স পড়ে তাঁর ফার্মে যোগ দেবে এটাই স্বাভাবিক ইচ্ছে। ফার্মে দু এক বছর বসে গেলেই বিয়ের জন্যে পাত্রী দেখতে হচ্ছে। তনুশ্রীর ঘরে যেমন তার আশা-আকাঙক্ষার একটা পুরো ছবি তিনি দেখতে পেয়েছিলেন, এখানে যেন তেমনটা পেলেন না। কিংবা হয়ত পেলেন খানিকটা, নিজের অজান্তেই সেটাকে মেনে নিলেন না। এ সব ছবি প্রকাশ্যে এ ভাবে টাঙানো রয়েছে, এ তাঁদের সময়ে কল্পনা করা যেত না। তবু এই জাতীয় কিছু বই খাতার ফাঁক ফোকর থেকে আবিষ্কৃত হলে সঙ্গে সঙ্গে অভিভাবকরা বিয়ের কথা ভাবতেন। মধ্যবিত্ত ঘরে চাকরি-বাকরি বা অন্য কোনও রোজগার না করলে তখন বিয়ের সম্ভাবনা থাকত না। তবু, মেজদার বইয়ের ভেতর থেকে মধুবালার ছবি বেরোতে বাবা ভয়ানক চিন্তিত হয়ে পড়েছিলেন। নানা জায়গায় যুগপৎ মেজদার চাকরি এবং বিয়ের জন্যে হাঁটাহাঁটি শুরু করে দিয়েছিলেন। নীলাদ্রির বিছানার ওপরও একগাদা অডিও এবং ভিডিও ক্যাসেট ছড়ানো। ভি সি আরটা মেঝেতে কার্পেটের ওপর নামিয়ে রাখা। কেউ কি ওর ঘরখানা একটু গুছিয়েও দেয় না! নিজে তো গুছোতে জানেই না। মা, বোন, এতগুলো কাজের লোক। কেউ রায় সাহেবের একমাত্র ছেলের ঘরখানা গুছিয়ে দেবে না! আচ্ছা এই কাজের লোকেরা, এরা তো কখনও কখনও এ ঘরে ঢোকেই। এই সব ছবি-ছাবা দেখে কী মনে করে? দূর হোক গে! লোকের ভাবনা তো তিনি নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন না! পাছে জয়দীপ তাঁর প্যাকেটটাকে ঘুষ মনে করে তাই তিনি পুরো পথটা আবার গিয়েছিলেন। তার অফিস পর্যন্ত। অফিসের লোকগুলোকে ভাল করে জানিয়ে এসেছেন ওটা তাঁর নিজের জিনিস। জয়দীপের কাছে নিজের মান রাখতে তিনি এতটা করেছেন। কিন্তু ছেলের ব্যাপারে, ছেলের মানরক্ষার জন্য আপাতত তিনি কীই বা করতে পারেন? তাঁর হাত পা বাঁধা। নিচু হয়ে কতকগুলো ভিডিও ক্যাসেট তিনি তুলে নিলেন হাতে। পরক্ষণেই জ্বলন্ত কাঠের টুকরোর মতো সেগুলো ফেলে দিলেন। আর একটুও দাঁড়ালেন না। ঝঞ্ঝাবাত্যার মতো বেগে ঘর থেকে বেরিয়ে দরজাটা ভেজিয়ে দিলেন। যেন তিনি ভেজিয়ে দিলেই এ সব অদৃশ্য থাকবে। তারপর আর একটু দূরত্বে মেয়ের ঘরে ঢুকলেন।

কিছু দেখলেন না প্রথমটায়। টেবিলের সামনে চেয়ার রয়েছে। ভেতরে ঢুকোনো। কিন্তু তিনি গিয়ে বিছানায় বসলেন। বেশ কিছুক্ষণ বসেই রইলেন। বসেই রইলেন। তারপর চোখ মেলে দেখলেন সামনের দেয়ালে একটা ক্রুসবিদ্ধ যিশুর ছবি। বেশ সুন্দর সৌম্য করুণকান্তি যিশু নয়। কেমন হাড় জিরজিরে বুড়ো মতো। চোখকে ধাক্কা দেয়, অপ্রসন্ন করে। টি.ভির ওপরে একটি অচেনা ছেলের ফটো একটু একটু হাসছে। দাঁত বার করে নয়। মুখখানা কোনওক্রমে একটু স্মিত এইটুকু বলা যায়। সাদা-মাটা চেহারা। গেরস্থ ঘরের ছেলে। চিন্টু বা তার বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে বা যে-সমস্ত ছেলেপুলে নিত্যদিন আশে-পাশে চোখে পড়ে তাদের মতো নয়। গালে একটা হাত। বইয়ের র‍্যাকে বেশ কিছু ইংরিজি বাংলা বই রয়েছে। সবই পাঠ্য বই মনে হল। ড্রয়ারগুলো আপাদমস্তক বন্ধ। ওয়ার্ডরোব চাবি লাগানো। ওকে বুঝতে পারলেন না বিজু রায়। চিন্টুর ঘরে ঢুকে মনে হয়েছিল ওর মনটা অস্পষ্ট, নিজেই জানে না কী করবে, কী চায়। কোনও অ্যামবিশন নেই, ইচ্ছাশক্তি, সংকল্প, এসব কিছু নেই ও ঘরে। এটা প্রথম মনে হওয়া। তার পরে মনে হল সর্বনাশ, এ তো একটা বিকৃতরুচি, বিকৃতবুদ্ধি পার্ভার্ট। কিন্তু তিতি যেন খুব কঠিন মুখ করে অনেক কিছু লুকিয়ে রেখেছে। তিতির মুখখানা এই মুহূর্তে চেষ্টা করেও মনে করতে পারলেন না বিজু রায়। তিতি কি উনিশে পড়ল? টি.ভি.র ওপর গালে হাত দিয়ে ছেলেটি কে? বয়স তার বেশি নয়। খুব মধ্যবিত্ত চেহারা। একে কোনওদিন নিজের বাড়িতে দেখেছেন বলে মনে করতে পারলেন না তিনি। অথচ কেমন চেনা-চেনা লাগল।

পার্লারে এসে চোখে পড়ল একটি মোটাসোটা ঘুঘুর মতো দেখতে মহিলা ঘুরঘুর করছে। পরিচ্ছন্ন পোশাক-আশাক। তিনি কৌচে বসতেই সাঁত করে সরে গেলে। ঘুঘু নয়। কেমন কেঁদো ভিজে বেড়ালের মতো। যথেষ্ট ওজন সত্ত্বেও অমনি ক্ষিপ্রতা চলাফেরায়। একটু ধূর্তামি। সব বুঝে জেনেও না বোঝা না জানার ভান। তিনি চিনতে পারলেন এটি তাঁদের রাঁধুনি। তিনি আজকে সকাল-সকাল বাড়ি ফিরে অনেকক্ষণ ধরে এখানে ঘোরাঘুরি করছেন তাই ও বোধহয় টি.ভি. দেখতে পাচ্ছে না। গলা খাঁকারি দিয়ে উঠে পড়লেন বিজু রায়। মহিলা বলল, ‘সাহেব, খাবার দেব?’ গলাটা সম্ভ্রমে ভয়ে যেন কাঁপছে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বিজু রায় দেখলেন সত্যিই তো! এগারটা বেজে গেছে। আর কখন খাবেন?

তিনি ঘড়ির দিকে তাকিয়েই বললেন, ‘তোমার মেম সাহেব, …ছেলেমেয়েরা এরা সব কোথায় গেল? কেউ কিছু বলতে পারল না।’

—‘ওরা জানে না সাহেব। তিতিদিদি বন্ধুদের সঙ্গে কোথায় বেড়াতে গেছে, দু দিন হল। মেম সাহেব কিছু বলেন নি। তবে মনে হয় কোনও নাচ-গানের জলসায় গেলেন। দাদার কথা আমি জানি না।’ থেমে থেমে বলল মহিলা।

—‘হুঁ।’ বিজু রায় কিছুক্ষণ পায়চারি করলেন। মহিলাটি সন্ত্রস্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। তিনি বললেন— ‘খাবার দাও।’

খাবার ঘরে যেতে যেতে হঠাৎ গন্ধটা চিনতে পারলেন বিজু রায়। তাঁর ঘরের চিমসোনি গন্ধটা মর্গের। একবার তাঁকে একটা কেস শনাক্ত করবার জন্য যেতে হয়েছিল। গন্ধটা বাসি মড়ার। প্রভূত বাসি মড়ার।

মুখটা বিকৃত করে তিনি বসে রইলেন চেয়ারে। রাঁধুনি মহিলাটি যত্ন করে তাঁর রাতের খাবার এনে টেবিলে সাজিয়ে দিল। চিকেন সুপ, গরম, ধোঁয়া উঠছে, সুজির রুটি, তিনটে, ফুটবলের মতো ফুলে রয়েছে একখানা এখনও। দু টুকরো মাছ সসে ভেজানো। এবং অনেকটা কাঁচা সালাড। খাবারের সামনে কিছুক্ষণ চুপ করে বসে রইলেন বিজু রায়। তারপর হঠাৎ খাবারগুলো ছুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলে দিতে লাগলেন। বেশ তাক করে করে। সুপের বাটিটা সাইডবোর্ডের কানায় লেগে ভেঙে গেল। তরল পদার্থটা সাইডবার্ডের গা বেয়ে মেঝেয় গড়াচ্ছে। মাছগুলো জানলার কাচে তাক করলেন। থুপ থুপ শব্দ করে সেগুলো কাচে লেগে জানলার তলায় পড়ে রইল। সালাডের শশা, টোম্যাটো, গাজর ইত্যাদির চাকা দেয়ালের গায়ে নতুন ডেকোরেশনের মতো লেগে আছে। সবচেয়ে বেশি দূরে গেল রুটিগুলো। একটা একটা করে সেগুলোকে জানলার বাইরে পাঠাতে চেষ্টা করলেন বিজু রায়। লতা পাতার গ্রিল। আশপাশ দিয়ে টুক টুক করে বেরিয়ে গেল সে গুলো। বেশ নিশ্চিন্ত হলেন এবার বিজু রায়। শব্দ শুনে রাঁধুনি ছুটে এসেছিল। হতভম্ব মহিলাকে বিজু রায় বললেন, ‘আমার ঘর পরিষ্কার হয়নি কেন? যাচ্ছেতাই গন্ধ বেরোচ্ছে।’

তিনি বেশ ধীর দৃঢ় পায়ে তেতলায় উঠে যেতে থাকলেন। সিঁড়ির বাঁকে তিনি অদৃশ্য হয়ে যেতেই রাঁধুনী মহিলা যার নাম প্রমীলা, সে তার সাহায্যকারী ও বন্ধু বদনকে ডাকতে গেল। বদন এগুলো পরিষ্কার করে দেবে, সাহেবের ঘরটাও দেখবে কী হল, ব্যাপারটা সম্পর্কে তারা আলোচনাতেও বসতে পারবে।

তিনতলাটায় অর্ধেক ছাদ। তাতে একরঙা টালি বসানো। গাছ প্রচুর। ফুলগাছই বেশি। মা ও সব পাতাবাহার টাহার পছন্দ করত না। একটা বেশ ঝাড়ালো তুলসীগাছ। একদিকে ঠাকুরঘর, আরেক দিকে মায়ের ঘর, টয়লেটসহ। মাঝখানের পথটা দিয়ে প্রথমেই ছাদে এসে বুক ভরে নিশ্বাস নিলেন বিজনবিহারী। গভীর করে প্রশ্বাস নিলেন, শ্বাস ছাড়লেন বার কয়েক। প্যাসেজের মাঝখানে একটা গোল আলো জ্বলে। সেই আলো খানিকটা গিয়ে পড়েছে ছাদে। আকাশের আলোও আছে। মঞ্জরিত তুলসী দেখা গেল। নীচে তাঁর যে বাগান, তাতে সবুজ লন আছে, মরশুমি ফুলের বেড আছে। কিন্তু ছাদের বাগানে মা শুধুই গন্ধকুসুম রাখত। গন্ধহীনদের মধ্যে একমাত্র জবা আর নয়নতারা। আধা-অন্ধকারে ফুটে আছে দেখতে পাওয়া গেল। এবং সাদা নয়নতারা। কোনও ফুলের গন্ধ পাওয়া গেল না। রজনীগন্ধা গোলাপ এদের তো ফোটার কথা! তিনি ফিরে মায়ের ঘরের দরজাটা খুলে ফেললেন। এ বাড়িতে কোনও ঘরেই কখনও তালা চাবি ইত্যাদি দেওয়া থাকে না। ড্রয়ার, ক্যাবিনেট, আলমারি ইত্যাদি বন্ধ থাকে, কিন্তু ঘর খোলা।

মায়ের ঘরে মায়ের পুরনো আমলের সেগুন কাঠের পালঙ্ক। আলমারি। লোহার সিন্দুক। চৌকির ওপর বসানো কিছু তোরঙ্গ। বাবার আরাম-চেয়ারটা। তা ছাড়াও গোটা দুই চেয়ার। একটা নতুন ডিজাইনের আলনা। এটাই একমাত্র এ যুগের জিনিস ঘরটাতে। পালিশ-টালিশ অন্যান্য আসবাবের সঙ্গে মানানসই। কিন্তু জিনিসটা ঘরের মধ্যে মূর্তিমান ছন্দপতনের মতো দাঁড়িয়ে আছে বলে বিজনবিহারী সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে পারলেন। তাঁর চোখ এখন সুরুচি-সুছন্দে নতুন যুগের সুষমা-সৌন্দর্যের ধারণায় বড্ড বেশি অভ্যস্ত হয়ে গেছে। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ঘর। খুব সম্ভব সন্ধেবেলায় ধূপ জ্বেলে দেওয়া হয়েছিল, ধূপদানির তলায় কুণ্ডলিকৃত ছাই পড়ে আছে। গন্ধটাও আটকে আছে ঘরে। মৃদু কস্তুরী গন্ধ। কিন্তু গন্ধটা সইতে পারলেন না তিনি। তাড়াতাড়ি জানলা খুলে দিলেন। এক ঝলক হাওয়া ঢুকল। পরিষ্কার হলেও, ঘরটাতে অব্যবহারের দরুন কেমন একটা শূন্যতার ছাপ পড়ে গেছে।

আরাম-চেয়ারটাতে বসলেন বিজনবিহারী। সোজা হয়ে এটাতে বেশিক্ষণ বসা যায় না। চেয়ারের বাঁকানো পিঠটা কেমন টানতে থাকে। অভ্যাসবশত পকেটে হাত চলে গেল, সিগারেট ও লাইটারের খোঁজে। কিন্তু ঠিক সিগারেটটা ধরানোর মুহূর্তে ছাদের দিকের জানলা দিয়ে একঝলক ফুলের গন্ধ ঢুকল। গন্ধটা চিনতে পারলেন না বলেই বিজনবিহারীর গায়ে যেন কাঁটা দিল, যেন মা ঢুকল। সাদা থান, গলায় সোনায় গাঁথা রুদ্রাক্ষের মালা। শুকনো বৃদ্ধা এক। মায়ের সামনে এতটা বয়সেও সিগারেট খেতেন না বিজন। একদিন অনেকক্ষণ মার কাছে বসবার পর ছটফট করছিলেন সিগারেট না খেয়ে। মা বলল—‘যা না, একটু বাইরে যা না। ছাদে ঘুরে আয় একটু।’

বিজন হেসে বলেছিলেন— ‘ছাদে খাবার দরকার কী মা! বয়সটা তো কম হল না। তোমার সামনে খেলে কী হয়! এমন নয় যে গন্ধটা তোমার কোনও দিন অভ্যেস ছিল না। বাবা ছিলেন চেইন-স্মোকার, সিগারেটের পয়সা কুলোতে না পারলে বিড়ি খেতেন।’ সে কথা মনে করেই কথাটা বলেছিলেন মাকে।

মা গম্ভীর হয়ে বলল— ‘গন্ধটা আমার কোনও দিনই ভাল লাগেনি। সে উনিই খান, কি আর কোনও গুরুঠাকুরই খান। কিন্তু সে কথা নয়, মায়ের সামনে ছেলের ধূমপান আবার কী।’

—‘এতো সংস্কার ত্যাগ করতে পারলে মা, এটা পারছ না?’

—‘এটা তো সংস্কার নয় বিজু, এটা সভ্যতা, সম্ভ্রম। মা ছেলে যত ঘনিষ্ঠই হোক, সম্পক্কটার মধ্যে শ্রদ্ধা আছে তো!’

—‘কিন্তু মা, আমার ছেলেকে আমি অনুমতি দিয়ে দিয়েছি। নেশা করতে হয় সামনাসামনি করুক।’

—‘ভাল করিস নি। বয়সধর্মে যা করে করুক, একটু নলচে-আড়াল থাকা ভাল।’

মায়ের এই সব কথা স্মরণ করে লাইটারটা নিবিয়ে দিলেন তিনি। কিছুক্ষণ চুপচাপ শুয়ে থাকবার পর হঠাৎ কী মনে হল তিনি উঠে পড়ে আলোটা জ্বেলে দিলেন। লুকোনো জায়গা থেকে সিন্দুকের চাবি বার করলেন। দুটো চাবি দুটো দিকে ঘুরিয়ে খুলে ফেললেন সিন্দুকটা। দুটো তাক। ভর্তি কাগজপত্র। ওপর তাকে একটা মোটা বাঁধানো খাতা। চট করে পাতা উল্টে বাবার হস্তাক্ষর দেখতে পেলেন। কিছু হিসেব-পত্ৰ যেন। সংসার খরচের হিসেব মনে হয়। খুদে খুদে কালো পিঁপড়ের সারির মতো লেখা। তিন এক পঞ্চাশ, চার এক পঞ্চাশ, এইভাবে পর পর সাত আট দিন। হলুদ দু পয়সা, কালো জিরে দুই আনা, ধোপা বারো আনা, কাগজ চার আনা। এইভাবে চলেছে। আশ্চর্য! মা এ খাতাখানাকে সিন্দুকের মধ্যে হীরে-জহরতের মতো করে রেখে দিয়েছে? কেন? পঞ্চাশ সালের বাজার-দরের একটা দলিল হতে পারে অবশ্য খাতাটা। বাবা যেন প্রাণপণে উত্তর-কালের কোনও অর্থনীতিক মীমাংসার জন্যে এক সামান্য নিম্নবিত্ত পরিবারের দৈনন্দিন ব্যয়ের পরিমাণ খুঁটে খুঁটে লিখে গেছে। বাবার কি এরকম অভ্যেস আদৌ ছিল? মনে করবার চেষ্টা করতে লাগলেন তিনি। অমনি যেন কত শতাব্দীর ওপার থেকে ঠাকুমার খনখনে গলার স্বরটা ভেসে এল। খনখনে কিন্তু বড় প্রিয় স্বর। শিশুকালে ওই স্বর এবং তার সঙ্গে মেশানো ছাঁচিপানের গন্ধ ভীষণ মিষ্টি লাগত। ঠাকুমা এইভাবে খনখন করে উঠলেই বাবা একটা খাতার ওপর বা কাগজপত্রের ওপর উপুড় হয়ে পড়তেন। এটা মনে পড়ে গেল। সে কি এই খাতা?

ঠাকুমা বলছে— ‘হ্যাঁ রে বঙ্কু, বাপ-পিতেমোর ভিটে নয়, কিছু নয়, আর একখানা বাড়ি দেখতে কী হয়?’

—‘কেন মা খারাপ কী, গঙ্গার হাওয়া খাচ্ছ তো বিনা পয়সায়।’

—‘চিতের হাওয়াও খাচ্ছি! চিতের হাওয়া খেয়ে খেয়ে বাড়িটার পরকাল যে ঝরঝরে হয়ে গেল!’

—‘চিতের হাওয়াতেই তো সংসারটার পত্তন হল মা। সমুদ্দুরে বাস যার, শিশিরে কী ভয় তার?’

গঙ্গার ধার ঘেঁসে বাড়ি। মাঝখানে গাড়ি চলাচলের রাস্তা। পার হলেই ওদিক দিয়ে ঘাট নেমে গেছে। শ্মশান খুব কাছে। সেখান থেকে ধোঁয়ার কুণ্ডলি মাঝে মধ্যেই পাকিয়ে পাকিয়ে দোতলা ছাদের হাওয়া ছুঁয়ে যায়। এই ধোঁয়া নিয়েই ঠাকুমার আক্ষেপ। পক্ষাঘাত হয়ে যখন প্রায় সুস্থ মানুষটা শুয়ে পড়লেন তখনও তিনি এই চিতের ধোঁয়ারই মুণ্ডপাত করেছিলেন।

মায়ের কাছে বিজুরা শুনেছিল। নিতান্ত গুড়গুড়ে বয়সে ঠাকুর্দাদা মারা যাবার পর বাবাদের ক’ভাই-বোনের হাত ধরে ঠাকুমা নিজেই গাঁয়ের দোতলা বাড়ি জমি-জমা-পুকুর সব বিক্রি করে দিয়ে এই বাঁধা ঘাটের কাছে বাসা নিয়েছিল, ভাইদের কাছাকাছি থাকবে বলে। সেইখানে, বাবারা তিন নাবালক ভাই বড় হল, বড় জন একদিন কোথায় পালিয়ে গেল। লোকে বললে সন্ন্যাসী হয়ে গেছে। মেজ ভাই মামাদের দৌলতে ক্রমে জেলা-ম্যাজিস্ট্রেট হল, বড় ঘরে বিয়ে করল, অন্যত্র বসবাস— আপনি আর কপনি। পিসির বিয়ে হল অনেক দূরে, পঞ্জাবে না কোথায়, খালি ছোট ভাগনেটির বেলাতেই মামাদের দাক্ষিণ্যে কম পড়ে গেল। বড় মামা মারা গেলেন। তিনিই ছিলেন মাথা, অন্যরা নিজেদের নিজেদের সামলাতেই ব্যস্ত। অনেক কষ্টে হুগলি-ডকের চাকরিটা জুটেছিল তাই। ত্রিশ টাকা ভাড়ায় ওই রকম দোতলা বাড়ি আর কেউ দেবে? বাড়ি নিয়ে এই জাতীয় তকরার বাবা আর ঠাকুমার মধ্যে মাঝে মাঝেই হত।

খুব ছেলেবেলা। দাদা-দিদিরা সব বেরিয়ে গেছে, বিজু প্রস্তুত হচ্ছে। বাবা ভেতর-রকে নিজের জন্য নির্দিষ্ট জায়গাটাতে ধুতি গুটিয়ে মোড়ায় বসেছেন।

—‘বলি শুনছ! ছেলে মেয়েগুলো কোথায় গেল সব?’

—‘কোথায় আর যাবে? গঙ্গায় ঝাঁপাই জুড়তে গেছে।’

—‘বারণ করলে না?’

—‘খেলাধুলো করছে, খারাপ কিছু তো নয়! বারণ করতে যাব কেন?’

—একটা বিপদ হলে?

—‘ও সব কথা মনেও স্থান দিয়ো না। গরিবের ছেলে ওইটুকু যে খেলেধুলে আনন্দ করবার সুযোগ পেয়েছে…’ মা বারবার কার উদ্দেশে যেন নমো করছে।

—‘আর সময়ই বা কোথায় আমার তোমার ছেলেমেয়েদের পেছনে খবর্দারি করবার? ওদিকে মা পড়ে পড়ে কোঁকাচ্ছেন, তাঁর এটা ওটা সারাক্ষণ আছে, এরই মধ্যে তুমি রাজ্যির কচুর শাক, ঘোড়, মোচা সব একই দিনে এনে ফেললে, উনুন খাঁ খাঁ করছে।’ মা দ্রুত পা ফেলে রান্নাঘরে চলে যাচ্ছে। মাথায় ঘোমটা।

বিজনবিহারী চোখ দুটো ভাল করে মুছে নিলেন। এত ভাল করে এ সব দৃশ্য, এ সব শব্দাশব্দ, চেহারা তাঁর মনে আছে? আশ্চর্য! সে তো অন্য এক জীবন! অন্য এক জগৎ। অকল্পনীয় সস্তা ভাড়ায় পুরো দোতলা একখানা বাড়ি। দোতলার ঘরগুলোর জানলা খুললেই গঙ্গার হাওয়া ঝাঁপিয়ে পড়ে। কোলে দালান। দূর প্রান্তে কলঘর। নীচেও অমনি সব ঘর। ঠাকুমা নীচে থাকতেন। মা-বাবাকেও তাই নীচেই থাকতে হত। দোতলাটা পাঁচ ভাইবোনের রাজত্ব।

কয়েকটা পাতা উল্টিয়ে গেলেন বিজনবিহারী।

‘আজ বিজু নিরুদ্দেশ হইল। —চলিয়া গিয়াছে এক বছর হইতে চলিল। তাহার পর হইতেই ছোট খোকা সম্পর্কে অস্বস্তিতে ছিলাম। অন্যমনস্ক। উদাসীন। সংসারের কারও প্রতি, কোনও কর্তব্যের প্রতি যেন টান নাই। আঁট নাই। — গেল, গেল। আমার সংসারটিকে আগাগোড়া দুরমুশ করিয়া গেল। পত্নী যেন নীরবে আমাকেই দোষারোপ করেন। বড় মেয়ে কলঙ্কের ভয়ে কি কী জানি, হয়ত লজ্জায় এদিক মাড়ায় না। বড় খোকা— এর ন্যাওটা ছিল। তাহাকে দেখাশোনার ভার সে নিজে হইতেই লইয়াছিল। বড় মায়াবী শরীর। ধাতটাই মায়ের। সে এমন করিতে পারে ইহাতে বিশ্বাস হয় সংসারে অসম্ভব কিছু নাই। বিজুর খোঁজ করিব কোথায়? তাহার বন্ধু-বান্ধব— সবগুলিই তাহা অপেক্ষা বয়সে বড়, বলিতেছে সে ভাগ্যান্বেষণে গিয়াছে। বিবাগী হইবার পাত্র সে নয়। কিন্তু তাহার জ্যাঠা গৃহত্যাগী হইয়াছিলেন। কোনও দিনই আর তাঁহার খোঁজ পাওয়া গেল না। হায়, আমি দরিদ্র মানুষ। কী-ই বা করিতে পারি। পুলিশে একটি ডায়েরি ভিন্ন আর কিছুই আমার হাতে নাই। — এর জন্য আত্মীয়স্বজনের কাছে মুখ দেখাইতে পারি না। বিজু ছোটখোকা আমার বড় প্রিয় ছিল। হায়, ছিল বলিতেছি কেন? আছে আছে, শতবার আছে।’

বাবার এই কথাটুকু পড়ে চমৎকৃত হয়ে গেলেন বিজনবিহারী। ‘ছোট খোকা আমার বড় প্রিয় ছিল।’ তাঁর যতটুকু মনে পড়ে, গঙ্গার ধারের সেই নিম্নমধ্যবিত্ত বাড়ি তখন তাঁর কাছে জ্বলন্ত কটাহস্বরূপ। বি.কম দ্বিতীয়বার ফেল করে তিনি সবার চক্ষুশূল। মেজদা প্রায় কথাই বলে না। সেজদা সুযোগ পেলেই উপদেশ দেয়। বাবা হাপরের মতো দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করেন। যেন সে ইচ্ছে করে ফেলটা করেছে। একমাত্র মা-ই, মুখের হাসি অটুট রেখে শত কাজের মধ্যেও মাথায় হাত বুলিয়ে বলেছে—‘ছোট খোকা আশা হারাসনি, আবার চেষ্টা কর, পারবি, ঠিক পারবি।’ যদিও অন্যদের তাড়নার চেয়ে মায়ের এই স্নেহবাক্যই তাঁর বাড়ি থেকে পালানোর মুখ্য কারণ হিসেবে কাজ করেছে। আবার চেষ্টা? মা এই ‘আবার চেষ্টা’র বাইরে কোনও পথ দেখতে পেত না। অত কল্পনাশক্তি ছিল না মায়ের। কিন্তু আরেকবার চেষ্টার সম্ভাবনাতেও বিজুর গা গুলোত, মাথা ঘুরত, ভেতরে প্রচণ্ড বিদ্রোহ জন্ম নিত। মনে হত সংসারের সব জিনিসপত্তর টুকরো টুকরো করে ভেঙে ছিঁড়ে, মানুষগুলোকে যাচ্ছেতাই গালাগাল-টাল দিয়ে সে উধাও হয়ে যায়। উধাও-ই হল। তবে তার পূর্ববর্তী কাজগুলো সে করে নি। একটি পক্ষাঘাতের রোগী, একটি জড়ব্যাধিগ্রস্ত এবং আরও একটি সামাজিক দূর্ঘটনার আঘাতে টলটলায়মান সেই সংসারকে আঘাত করার মতো নিষ্ঠুরতা বিজুর ছিল না। বাবার ডায়েরির ড্যাশ অংশগুলো হঠাৎ যেন তাকে কুড়ি একুশ বছর বয়সের সেই ধাক্কা-খাওয়া দিনগুলোয় নিয়ে গেল। ক্ষতটা যেন এখনও টাটকা! এরকম হয়? সল্ট-লেকের এই বাড়ি নেই। নেই ছেলে-মেয়ে-স্ত্রী! নেই আটান্ন-ঊনষাট বছর বয়স, তার দীর্ঘ অভিজ্ঞতা, সাফল্য, নানান ব্যবসা সহচর। সমস্যা। কুড়ি-একুশের বিজু একখানা শূন্য ঘর, শূন্য বাড়ি, শূন্য ছাদে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অনুক্ত যন্ত্রণা! ছুটকি ছুটকি ছুটকি!

খোলা পাতাগুলোয় হাত রেখে অনেকক্ষণ বসে রইলেন বিজনবিহারী। কোথাও একটা ঘড়িতে ভীষণ শব্দ করে একটা বাজল। তিনি চমকে উঠলেন। পুরনো খাতা, হাতের চাপে একটু ভেঙে গেছে। যাঃ।

খুব সাবধানে পাতা উল্টে দেখতে লাগলেন তিনি আর কী আছে খাতাটাতে। হিসেব। মেজদার বিয়ের খবর। বেনারসী শাড়ি— এক, একশত পঞ্চাশ টাকা। মুর্শিদাবাদি সিল্ক—পয়তাল্লিশ, তাঁত শাড়ি—চার খানি—চার ইনটু পঁচিশ মোট একশত। এইভাবে এয়োড়ালা, প্রসাধনদ্রব্য, বরের জোড়, ব্র্যাকেটে লেখা—কাশীর সিল্ক দিলাম, গরদের জোড় দিতে পারিলাম না। আমার বিবাহে যাহা পাইয়াছিলাম তাহা বেনারসী জোড়। এক্ষণে পিঁজিয়া গিয়াছে। তাহা মেজ খোকা পরিতে চাহিল না।’ ষাট সালের তারিখ দেওয়া। বিস্তৃত হিসেব— ঘর খরচ, বউ ভাত, প্রীতিভোজ, কার্ড। তিনি সে সময়ে ছিলেন না, পলাতক। এখন শোনেন বাবা মেজদা সেজদা উভয়ের বিয়েতেই বেশ দাঁও মেরেছিলেন। মেজ বউদি একদিন কথায় কথায় শুনিয়েছিল খবরটা। সত্যি কথাই। মেজদা-সেজদার বিয়ে বোধহয় কমাসের আড়াআড়ি হয়। সাল হিসেবে আলাদা। কিন্তু মাসের তফাত ছ সাত মাসের। এত অল্প সময়ের মধ্যে বাবার মতো ডাইনে-আনতে-বাঁয়ে কুলোয়-না মানুষ দুখানা বিয়ে দিয়ে উঠলেন কী করে। বিজন আপন মনেই হাসলেন।

বাবা দেখা যাচ্ছে নিয়মিত হিসেব রাখতেন না। কোনও কোনও গুরুত্বপূর্ণ হিসেব। বিয়ে ইত্যাদির। নইলে মাঝে মাঝে পুজোর খরচ, অন্য কোনও পার্বণ, সত্যনারায়ণের ফর্দ ইত্যাদির। দৈনন্দিন হিসেব মাঝে মাঝে ঢুকে পড়েছে। দৈনন্দিন হিসেবের ব্যাপারে বাবা যেন ঠিক মনঃস্থির করতে পারেননি। রাখবেন কি রাখবেন না। তেড়ে ফুঁড়ে এক হপ্তামতে রেখেছেন, আবার ছেড়ে দিয়েছেন। কেমন একটা অস্থিরচিত্ততা প্রকাশ পাচ্ছে এই হিসেব রাখারাখির ব্যাপারটার মধ্যে দিয়েও। অথচ বাবা যে আদৌ অস্থির হতে পারতেন, কোনও বিষয়ে দ্বিধা, দ্বিমত, মত পাল্টানো ইত্যাদির মধ্যে যেতে পারতেন, সে কথা তাঁর ছেলে হিসেবে বিজনের কখনও মনে হয়নি। বাবা যেন অচল, অনড়, জগদ্দল এক পাথর। কিছুতেই তাঁকে তাঁর সংকল্প, ধারণা ইত্যাদির থেকে নড়ানো যাবে না।

‘বৃদ্ধ’ মানুষ, না মানুষ বলা ঠিক হইল না। বৃদ্ধ ব্যক্তি, না ব্যক্তিই বা কেন? যখন কাহাকেও একটি স্বতন্ত্র সত্তা বলিয়া স্বীকার করা হয় তখনই সে ব্যক্তি। বৃদ্ধের ব্যক্তিত্ব আর কাঁটালের আমসত্ত্ব একই বস্তু। সুতরাং শুধু বৃদ্ধ বলাই ভাল। এই বৃদ্ধ খিড়কির দুয়ার দিয়া পাঁশকুড়ায় ফেলিয়া দিবার যোগ্য একটি অবাঞ্ছিত বস্তু। বিনষ্ট ভ্রূণ যেমন পাপী পাঁশকুড়ায় ফেলিয়া দেয়, বৃদ্ধ নামক মনুষ্যত্বের অপভ্রংশটিকেও তেমনই জীবন পাতক, রাস্তার ধারে, অবহেলায়, লজ্জায়, ক্ষোভে ফেলিয়া দিয়া যায়। বৃদ্ধের না আছে মূল্য, না আছে মান। পরমহংসদেব বলিতেন মান আর হুঁশ দুই মিলিয়া মানুষ। বৃদ্ধের হুঁশ নাই, সুতরাং মানও গিয়াছে। সে আর কোন মুখে মনুষ্য-পদবি যাঞা করে? কিন্তু ইহা কি বৃদ্ধের দোষ? সে তো সাধ করিয়া বৃদ্ধ হয় নাই! পারিলে সে বার্ধক্যকে ঠেকাইয়া রাখিত। বলিতে কি ঠেকাইয়া রাখিবার প্রাণান্তকর প্রয়াস বৈজ্ঞানিক মহলে চলিয়াছে। গেরন্টোলজি নামে একটি নূতন শাস্ত্র হইয়াছে শুনিয়াছি। নূতন কী?’

প্রশ্ন চিহ্ন দিয়ে শেষ করেছেন বাবা। এ কি বার্ধক্য সম্বন্ধে নৈর্ব্যক্তিক ভাবনাচিন্তা? না বাবা তাঁর নিজের অভিজ্ঞতার সার-মর্ম লিখে গেছেন! সালটা কী! সাতষট্টি। বাবার বাঁ দিকটা পড়ে গিয়েছিল। এ সময়টা বাবা ঠিক কোথায় ছিলেন তিনি মনে করতে পারলেন না। মেজদা তো প্রায় ঘর-জামাই-ই হয়ে গিয়েছিল। সোনারপুরে শ্বশুর বাড়ির লাগোয়া জমিতে আস্তে আস্তে বাড়ি করে। তাহলে কি সেজদা? সেজদার কাছেই থাকতেন বাবা এ সময়টায়। সাতষট্টি মানে দাদাদের বিয়ের বছর পাঁচ পরে। বাবা তখন শয্যা নিয়েছেন। আর তার কিছুকাল পরেই বিজন ফিরে এলেন রূপকথার সওদাগরের মতো। ময়ূরপঙ্খী সপ্তডিঙা কূলে ভিড়িয়ে।

বার্ধক্য সম্পর্কে বিজনবিহারীর ধারণা কিন্তু আদৌ তাঁর বাবার অনুরূপ নয়। তার কারণ অবশ্যই তাঁর দাদামশাই ভবানীচরণ। ছোটতে দিনের পর দিন মামার বাড়ি গিয়ে থাকতেন তিনি আর ছুটকি। সে সময়ে মামাবাড়ির প্রধান আকর্ষণ ছুটকির কাছে কে ছিলেন কে জানে কিন্তু বিজুর কাছে নিঃসন্দেহে ভবানীচরণ।

দুপাটি পরিষ্কার বাঁধানো ডেঞ্চার ছিল। নাতি নাতনিরা কোনও দিনই বুঝতে পারেনি যে তাঁর দাঁত পড়ে গেছে বা ফেলে দেওয়া হয়েছে। চুলগুলো ছিল নিকষ সাদা। সেই সাদার কী চমক। সকালে বেল খেতেন। নিয়ম করে বারো মাস। যাওয়ার সময় পুব আকাশ থেকে নতুন রোদটুকু এসে পড়ত সে চুলে, রুপোর মতো ঝিলিক দিত। সূর্য মধ্য-গগনে ওঠবার খানিক আগে আরম্ভ হত দাদামশাইয়ের স্নান-পর্ব। স্নান-যজ্ঞই বলা উচিত তাকে। নাকের ফুটোয়, কানের ফুটোয়, নাভিকুণ্ডে, পায়ের বুড়ো আঙুলের নখের ফোকরে টোপা টোপা তেলের ফোঁটা দিয়ে শুরু হত যজ্ঞ। সে সময়ে দাদামশাইয়ের চুলগুলো হা-হা হো হো করে হাসত। তাঁর মুখময় গা-ময় যেন সূক্ষ্ম রেশমের কাপড়, তাতে একটা সুতো টেনে দিয়েছে কেউ। সূক্ষ্ম কুচি কুচি ভাঁজ। একেবারে পাতলা গরদ হেন চামড়া। বাড়িতে কাচা সাদা থান পরতেন। দৈবাৎ কাপড় টান টান হয়ে লেগে গেলে সেই গরদের চামড়া কেটে গিয়ে ফুটফুট করে রক্ত বেরিয়ে আসত।

রাতের খাবার ছিল খই দুধ। জুঁইফুলের মতো একরাশি খই কানাওয়ালা বড় খাগড়াই কাঁসার বাটিতে দুধের ওপর যেই ফেলতেন শোঁ করে একটা আওয়াজ হত। সোঁদা সোঁদা গন্ধ ছড়িয়ে যেত চারদিকে। সেই আওয়াজটা শোনবার জন্য, সেই গন্ধের শ্বাসটুকু নেওয়ার জন্যে সন্ধে সাতটা থেকে দাদুর কাছে ঘুরঘুর করত বিজু। রুপোর বড় গোল চামচ দিয়ে সাপ সুপ খইগুলো শেষ করে শেষের দুধটুকু বাটির কানা দুহাতে ধরে যখন এক চুমুকে শেষ করতেন দাদুর মুখটা বুকের ওপর থেকে পিঠের দিকে আস্তে আস্তে একশো ষাট ডিগ্রি কোণে ঘুরে যেত। সে দৃশ্যটাই বা কী চমৎকার। সামনে চেয়ারে বসে রয়েছেন বড় মামিমা। ফরাসডাঙার একটু নীলচে কোরওয়ালা কালো পাড় শাড়ি ছাড়া বাড়িতে পরতেন না। কপালের সিঁদুর টিপটা সব সময়েই একটু ধেবড়ে থাকত। মামিমার মুখ আড়ের দিকে চওড়া। ঘোমটা থেকে বেরিয়ে থাকা চুলগুলো চারভাগের তিনভাগই পাকা। মুখে একটা আলগা হাসি ভেসে থাকত, দাদু গোমড়া মুখ পছন্দ করতেন না বলে। এমনি কত ছবি! প্রত্যেকটি স্মরণ করলে এখনও বিজনবিহারীর অনুভব হয় বার্ধক্যটা জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়। খ্যাতি, সম্মান, শ্রদ্ধা, সমীহ আর সেবার শীর্ষ চূড়ায় তার অবস্থান। চারদিকে বিশ্বাস, আস্থা, নির্ভর। যা-কিছু জীবনের, সংসারের, সমাজের শ্রেষ্ঠ ফসল সব টুকরি-ভর্তি উৎকৃষ্ট আমের ভেটের মতো বৃদ্ধর পায়ের কাছে নামানো।

মনে আছে মামাবাড়ির গোয়ালা ডার্বির টিকেট জিতে দশ হাজার টাকা পেয়েছে। অত টাকা দেখে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছে সুবল। ভেউ-ভেউ করে কাঁদছে আর বলছে-‘হমাকে জরুর ফাটকে নিয়ে যাবে বুঢ়াবাবু। আপনি বাঁচাও।’

—‘ফাটকে নিয়ে যাবে কী রে? এ তোর হকের টাকা।’

—‘তো তুমার পাস রাখিয়ে দাও।’

—‘হ্যাঁ তারপর আমি মরে যাই আর তুই টাকা নিয়ে ঝামেলা করিস আমার ছেলেদের সঙ্গে।’

—‘ওরে বাপ্‌। বজরংবলী তবে হমাকে মাফ্‌ করবে নাই বুঢ়াবাবু। তুমি যো করবে সো হোবে।’

সুবলের ছোট ছেলেটি শোনা যায় আই.পি.এস. হয়েছে মতিহারীর দিকে। বড়গুলি হাতে দামি ঘড়ি, পরনে সিল্কের লুঙ্গি, মুখে সিগারেট এখনও জোর দুধের ব্যবসা করছে। গাই, ভঁইস। দেহাতে ওদের বিরাট জমি-জমা। পাঁচটি মেয়ের বিয়ে দিতে সুবল গোয়ালা প্রচুর টাকা খরচ করেছিল।

সেই বাল্যকালেই বিজু পুবের বারান্দায় আরাম-চেয়ার পেতে হাতে দুধের জামবাটি নিয়ে বসে পড়বার জন্য রেডি-স্টেডি হয়ে গিয়েছিলেন। তাঁর বাবা বন্ধুবিহারী রায়, দেখা যাচ্ছে এই বার্ধক্যের সন্ধান পাননি। সে আরাম-চেয়ার থেকেও ছিল না। সে দুধের বাটিও ভোঁ ভাঁ। তবে সবচেয়ে অভাব হয়ত সামনে বসা ওই হালকা-হাসি মুখ বয়স্ক বধূটির সজাগ উপস্থিতি।

কিন্তু, বধূ কেন? বাবার তো নিজের পত্নীই বর্তমান ছিলেন। মা ওই বয়সে বাবার খুঁটিনাটি সেবা সমস্তই করেছে। নিজের অভিজ্ঞতা লিপিবদ্ধ করবার জন্যে এই খাতা এগিয়ে দেওয়া, এ-ও নিশ্চয়ই মারই কাজ ছিল।

আর কয়েক পাতা পরে তিনি বাবার আরও কিছু চিন্তা নথীকৃত দেখতে পেলেন। বিষয় ওই একই।

‘জরাকে আমি আদৌ ভয় পাই না। জানিতাম জীবন এক হাতে লইয়া থাকে। কিন্তু অন্য হাতে পুরাইয়া দেয়। তাহা ব্যতীত ইহা জীবনের ফসলের সময়। স্বর্ণাভ হেমন্তকাল, কোন কবিতায় যেন পড়িয়াছিলাম মাঠের আলের পাশে সে গভীর আলস্যে ঘুমাইতেছে। ফসল-উঠিয়া-যাওয়া ক্ষেত ন্যাড়া হইলে কী হইবে নূতন ধান্যে নবান্ন হইবে না! গোলা ভরিয়া স্বর্ণময় ধান্যের স্তূপ উপচাইয়া পড়িবে না! ঘর ভরিয়া তিন পুত্র, দুই কন্যা। স্বপ্ন দেখিয়াছিলাম ছেলেরা মানুষের মতো মানুষ হইয়াছে। নাতি নাতনিরা চারদিকে স্নুকারের বলের মতো ছিটকাইতেছে। কন্যারা সুখী শ্বশুরগৃহ হইতে মাঝে মাঝেই আসিয়া পড়িতেছে। গৃহিণী তাহাদের জন্য বিশেষ ভোজের আয়োজন করিতেছেন। হইল না। জানি না কাহার ইচ্ছায়। কে সেই সর্বশক্তিমান, মানুষের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ইচ্ছায় বাদ সাধিতে যাঁহার এমন নিষ্ঠুর রঙ্গ!’

বাবা কষ্ট পেয়েছিলেন। কিন্তু সে কষ্টের কথা লিখে যাবার মতো মনও তো বাবার ছিল? বাবা সম্পর্কে দেখা যাচ্ছে তাঁর ছোট খোকার ধারণা খুব অস্পষ্ট।

‘অর্থ জীবনের রং বদলাইয়া দেয়: ইহা জানিতাম। কিন্তু সে চরিত্রের কাঠামো, পারস্পরিক সম্পর্কের চেহারা, ইহলোক-পরলোক ধর্মাধর্ম সবই বদলাইয়া দেয় তাহা ঠিক এইভাবে উপলব্ধি করি নাই।’

বিজনবিহারী খুব আগ্রহসহকারে পড়তে লাগলেন।

‘ছোটখোকা কৃতী হইয়া আসিয়াছে। কৃতী অর্থে পণ্ডিত, ডিগ্রিধারী নয়। সে বাণিজ্যে লক্ষ্মীলাভ করিয়াছে। তাহাকে খরচের খাতায় ধরিয়া রাখিয়াছিলাম। তাই তাহার এ-ভাবে আসা যেন দ্বিগুণ আহ্লাদের। কিন্তু তাহার দাদারা তো সেভাবে আহ্লাদিত হইল না! মেজ খোকা বলিয়া গেল—“অত হ্যাট-কোটে আপনি ভুলবেন না বাবা, খোঁজ করুন ও কীভাবে কী করছে।” সত্য কথাই হয়ত। উহারা ছোটকে সেই ছেলেমানুষ, দস্যি, পড়াশোনায় অষ্টরম্ভা হিসাবেই মনে রাখিয়াছে। তাই সতর্ক করিয়া দিতেছে। সেজবাবুও সেদিন বলিলেন—“এক সংসারে একজন মাস মাইনের ছাপোষা চাকুরে, আরেকজন লাখপতি ব্যবসাদার একসঙ্গে থাকতে পারে না বাবা। আপনি বুঝুন ব্যাপারটা। আমার দিকটা ভাবুন। ” কী ভাবিব? তোমরা তিনজনেই আমার ঔরসজাত পুত্র বই তো নও! আমি অশক্ত হইয়া পড়িয়াছি, বিছানায় পরের হাত তোলা হইয়া আছি। আমি ভাবিবার কে? শুইয়া শুইয়া ছোটকে তীক্ষ্ণভাবে লক্ষ করি। সে বরাবরই তাহার মায়ের ভক্ত। তবু আমার শয্যার পাশে পাঁচ মিনিট হইলেও আসিয়া বসে। সদা অন্যমনস্ক। অর্থাগমের যে পথ সে ধরিয়াছে তাহাতে বিরাম নাই। বিশ্রাম বা স্বস্তি সে জীবনে পাইবে না। কিন্তু তাহা ছাড়াও আমি লক্ষ করি তাহার দাদা বউ-দিদিদের সঙ্গে সম্পর্ক ক্রমেই শিথিল হইয়া আসিতেছে। কাহার দোষ বলা শক্ত। সম্ভবত উভয় পক্ষেরই। আমি বুঝিতে পারি ছোট এখন যে জগতে বাস করে তাহার সহিত আমাদের জগতের মেজবাবু বা সেজবাবুর জগতের মিল নাই। সেদিন মেজ বউমা ঠাট্টা করিয়া বলিল—“সংসার খরচের টাকা দিচ্ছ দু হাজার টাকা? শুধু খাই-খরচ? তুমি বোধহয় একটা টাঁকশালই খুলেছ, তাই না?”

ছোটর উত্তরের জন্য উৎকর্ণ হইয়াছিলাম, সে বলিল—“তোমার কথার অর্থ কী হয় ভেবে বললে মেজ বউদি? সোজা অর্থ হয় ফর্জারি। আমি কি টাকা জাল করছি বলে তোমাদের ধারণা?” লক্ষ করিলাম ছোট বহুবচন ব্যবহার করিল। তাহার দাদারা বিদ্যায় বড়, সে বিত্তে বড়। দুটিতে মিলিতেছে না। বিজু এখানে থাকিতে পারিবে না। এখন আমি ও নীলিমা কী করিব?’

বাবা নৈর্ব্যক্তিকভাবে আরম্ভ করেছিলেন। ব্যক্তিগত সমস্যায় এসে পৌঁছলেন শেষ পর্যন্ত। সে সময়ে তাঁর সল্ট লেকের জমি কেনা হয়ে গেছে। দু হাজার টাকার খাইখরচ দেওয়াতে সেজবউদির প্রতিক্রিয়া দেখে তিনি সাবধান হয়ে যান। জমির কথা কাউকে বলেননি। সাংসারিক ব্যয়ের ব্যাপারে হাত গুটিয়ে নিয়েছিলেন। মেজদার তখন সোনারপুরে বাড়ি উঠছে। মাস্টারি ছেড়ে সে গড়িয়াহাটের দিকে দোকানে বসছে। মেজদা সেজদার হাঁড়ি আলাদা। বাবা-মা সেজদার সঙ্গে, সুতরাং তিনিও সেখানেই উঠেছিলেন। সুবিধে হয়ে গেল। বছর দেড়েকের মধ্যেই সেজদা বললে, ‘সরকারি কোয়ার্টার্স পাচ্ছি সি.আই.টি রোডে। ছাড়াটা কি বুদ্ধিমানের কাজ হবে?’ কথাটা বলল খাওয়ার সময়ে। মা, সেজবউদি এবং সে, তিন জনের উপস্থিতিতে। বিজু বলল—‘কখনোই বুদ্ধিমানের কাজ হবে না সেজদা। যতদিন চাকরি, ততদিন কোয়ার্টার্স। ইতিমধ্যে তুমি ধীরে ধীরে নিজের বাড়ি করে নিতে পারবে।’

সেজদাই আগে গেল। তার পরে মেজদা। বাঁধাঘাটের গলিতে মা বাবা আর বিজু। রই-রই করে উঠে যাচ্ছে সল্ট লেকের বাড়ি। মেজদাদাদের যাবার চার পাঁচ মাস পরেই তাঁরা চলে এলেন সল্ট লেকে। শয্যাশায়ী হলেও যতদূর সম্ভব আরামে ছিলেন বাবা শেষ ক বছর।

আর কী আছে সিন্দুকটাতে। চিঠিপত্রের তাড়া। দুটো তিনটে পলিথিনের ঠোঙার মধ্যে, হলুদ রঙের সরু ফিতে দিয়ে বাঁধা। একটা প্যাকেট খুললেন বিজু রায়। মেজ বউদি, সেজ বউদি, ছোট মামা, বড় মাসি, … প্রচুর চিঠি। সব রেখে দিয়েছে মা। অবসর মতো পড়তে হবে। এটা? দ্বিতীয় প্যাকেটটা খুলে ফেললেন তিনি। অন্তর্দেশীয় পত্র। হাতের লেখা দেখেই চমকে উঠলেন বিজু রায়। সঙ্গে সঙ্গে খুলে ফেললেন চিঠিটা। হাত কাঁপছে।

‘শ্রীচরণেষু মা,

তোমার ১০/৯-এর চিঠি পেয়েছি। তোমার এতদিন বেঁচে থাকার কষ্ট বুঝি। কিন্তু আমার আগের জীবনের তুমিই তো একমাত্র সূত্র। তোমার জামাই যত সুখেই রাখুক আমার জীবনের কুড়িটা বছর তো আমি কিছুতেই মুছে ফেলতে পারব না। মা, জীবনটা সামনে এগোনো সেটা বুঝি। প্রতিদিন পৃথিবী হু হু করে এগিয়ে যাচ্ছে। আজ বিজ্ঞানের যে তত্ত্ব বার হচ্ছে, কাল তা বাতিল হয়ে যাচ্ছে। মানুষের মতো মগজ বসবে কম্পুটারে শিগগিরই। কিন্তু পেছনে কেউ নেই, কিছু নেই, খাঁ খাঁ। এ যে কী কষ্ট। সে যার না হয়েছে সে বুঝবে না। মা তুমি চলে গেলে, গেলে কেন যাবেই যে কোনও দিন, আমার আর কেউ থাকবে না। মা, মা গো। স্বার্থপরের মতো কথা বলছি। শুধু আমার জন্যেই তুমি আর ক বছর অপেক্ষা করো মা। যেমন করে হোক একবার তোমায় দেখে আসব।’

তলায় কোনও সই সাবুদ নেই। তবু বিজু রায় সেখানে অদৃশ্য-কালিতে লেখা নামটা দেখতে পেলেন—ছুটকি। ধাক্কাটা এত অপ্রত্যাশিত, এত তীব্র যে তিনি চিঠিটা প্রায় মুঠো করে ফেলেছিলেন। ঠিকানা আছে? এ চিঠিটাতে ঠিকানা নেই। ঠিকানা নেই কেন? ছুটকি, ছোড়দি তুই ঠিকানা দিসনি কেন? আরও কয়েকটা চিঠি উল্টে-পাল্টে দেখলেন তাড়াতাড়ি, আছে। নানান ঠিকানা। কিন্তু সবই বিভিন্ন পোস্ট অফিসের।

চটপট করে লোহার সিন্দুকের সব কাগজপত্র, মায়ের খাটের তলায় রাখা একটা ডাকব্যাকের বড় সুটকেসে ভরে নিলেন বিজু রায়। তারপর দরজা বন্ধ করে নীচে নেমে এলেন নিজের ঘরে। সেখানেও অনেকক্ষণ ধরে কাগজপত্র, চেক বই, পাস বই, ইত্যাদি নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করলেন। ভোর সাড়ে তিনটে নাগাদ যখন তিনি চুপচাপ গোটা দুই সুটকেস নিয়ে বাড়ি থেকে নিঃশব্দে গেলেন তখন তাঁর ওই চিঠিগুলি, তাদের ঠিকানা এক। তাদের লেখিকা ছাড়া আর কিছু মনে ছিল না। জাতিস্মরের যেমন হঠাৎ পূর্বজন্মের কথা মনে পড়লে এ জন্মের সব কিছু ফিকে হয়ে যায় বলে শোনা যায় এ-ও কতকটা তেমনি। বিজু রায় বেরিয়ে গেলেন সম্পূর্ণ উদভ্রান্তের মতো, এবং একমাত্র সেই অক্লান্ত ঘড়িটাই উড়ে উড়ে তাঁর নিষ্ক্রমণের সময়টা নোট করে রাখল।


ডান-পাশে বসা বসাক বলল—‘এরই মধ্যে?’

মুখে হাত-চাপা দিয়ে ছোট্ট একটা হাই তুললেন মিসেস রায়— ‘ভী-ষণ ঘুম পাচ্ছে। দু নাইট পর পর। আর পারা যাচ্ছে না।’

—‘কাল আসছ তো?’ রাজেশ পাইন বলল।

—‘কাল তো আবার মিড নাইট?’

—‘আরে তাতে অসুবিধে কোথায়?

মিসেস রায়ের মুখে একটা দুর্বোধ্য হাসি। জীবনকে নানা ভাবে উপভোগ করার এই জীবনদর্শন ভাল। খুব ভাল। কিন্তু এই পাইন-বসাকগুলো বুঝবে না পর পর তিনটে রাত জাগলে চেহারায় ওপর কী জাতীয় ধস নামতে পারে। তনুশ্রী যে গান-বাজনা দারুণ একটা ভালবাসেন তা নয়। তাঁর আসল পছন্দের জিনিস হল নাচ। শেখার ইচ্ছে ছিল একসময়ে। বাবা মা কেউই সে ইচ্ছেটাকে আমল দেন নি। নাচ দেখতে দেখতে এখনও ভেতরটা ধা-ধিন-ধিন ধা করতে থাকে তনুশ্রীর। কিন্তু নাচ এসব কনফারেন্সে প্রথম দিকেই হয়ে যায়। তারপর দীর্ঘ সময় ধরে খেয়াল বা সেতার-টেতার শোনবার খুব একটা ধৈর্য থাকে না তনুশ্রীর। গায়ক বা বাদক যখন তবলার সঙ্গে মেতে ওঠে, তবলা যখন বাজনাকে ছাপিয়ে যায়। বা দু পক্ষই তাল ঠুকে হুহুঙ্কার দিতে থাকে, সে সময়টার উত্তেজনাটা উপভোগ করেন তিনি। কিন্তু অন্য কোনও বিশেষ প্রোগ্রাম না থাকলে এ সব কনফারেন্সে তাঁকে আসতেই হয়। তিনি পেট্রন। না এলে মান থাকে না। অনেক গাইয়ে-বাজিয়ে-নৃত্যশিল্পীর সঙ্গে আলাপ-পরিচয় হয়। তাঁর ইচ্ছে বিরজু কি কেলুচরণের মতো কাউকে কিছুদিন বাড়িতে অতিথি রাখা। ব্যাপারটা শিগগির করতে হবে। ভারতবর্ষের সংগীত-নৃত্যের বিস্তৃত ভূগোলে মিসেস রায় তাঁর সল্ট লেকের বাড়ি সমেত একটু জায়গা পেতে চান।

খেয়ালটা থেমেছে। এইবেলা চট করে বেরিয়ে যেতে হবে। রাজেশ পাইন উঠে পড়ে এগোচ্ছে। পেছন পেছন নিজেকে যতদূর সম্ভব মুছে ফেলে বেরিয়ে যেতে হবে। কালো শালটা দিয়ে মাথায় ভাল করে ঘোমটা দিয়ে নিলেন মিসেস রায়। তাঁর বিরাট কানবালা দুটো ঘোমটার বাইরে এসে মৃদু মৃদু দুলতে লাগল।

বাইরে বেরিয়ে বোঝা গেল রাত আর নেই। বেশ পাখি ডাকতে শুরু করেছে। ভোরের পাতলা সর শেষ রাতের গায়ে। লেকের জল স্থির। লোক জমতে আরম্ভ করেছে। স্বাস্থ্য শিকারিরা শর্টস আর কেডস পরে প্রস্তুত। গাড়ি অনেক দূর। উদ্যোক্তারা কেউ কেউ বেরিয়ে এসেছিল।

—‘চললেন তনুশ্রীদি? শরীর খারাপ নাকি?’

—‘না না, আসলে, সকালে মানে বারোটা নাগাদ একটা জরুরি মিটিং আছে ভাই। আই মাস্ট গেট সাম স্লিপ।’

—‘এবার যেন তেমন জমল না, না?’

—‘আরে বাবা আর্টিস্টরাও তো মানুষ’ বসাক খসখসে ভারী গলায় বলল। ওর এই গলাটার জন্যেই মিসেস রায় বিশেষ করে ওকে পাত্তা দেন। গলাটা তাঁকে কেমন চেতিয়ে তোলে। সামহাউ। পাইনের কথা আলাদা। পাইন খুব করিতকর্মা। অনুগত। অনুগত বসাকও। কিন্তু পাইনের মতো করিতকর্মা নয়। মিসেস রায় সমানে পাইনকে তালি দিয়ে দিয়ে বসাককে বাজিয়ে চলেছেন। অথচ দুজনে এমনিতে খুব বন্ধু। বসাকই পাইনকে তাঁর বৃত্তে আনে।

—‘কী? হোম সুইট হোম?’ রাজেশ হেসে জিজ্ঞেস করল।

—‘আবার কী?’ মিসেস রায় ভ্রূভঙ্গি করে জানালেন।

বসাক পেছনে ঠ্যাং ছড়িয়ে বসে আছে। মাথাটা সিটের ওপর কাত। মিসেস রায় আড়চোখে দেখে ভাবলেন ইস্‌স্‌ আকাটটা বসেছে দেখো! মুখটা সুদ্ধু হাঁ করে ফেলেছে, এবার বোধহয় নাক ডাকবে। তাঁর ভেতরটা চট করে নিবে গেল। বসাকের জন্য। রাজেশের জন্য এখনও ভেতরটা জ্বলছে। তার সুপুষ্ট আঙুলগুলো স্টিয়ারিং আঁকড়ে ধরে আছে। আঙুলে হিরের আংটি। বেশ বড়। হঠাৎ মিসেস রায়ের মনে হল তিনি যদি এখন বসাকের মতন বসতে পারতেন! ওহ্‌ কেন পারেন না? কেন পারবেন না? চলাফেরা কথা বলা খাওয়া শোয়া সব কিছু ভেতর থেকে নিয়ন্ত্রিত করে কে? কেন এই অনুশাসন? ভেতর থেকে? না বাইরে থেকে? বুকের ভেতরে না মাথার ভেতরে যেন একটা তর্জনী সব সময়ে উঁচিয়ে আছে। এভাবে নয়, ওভাবে। ওটা ঠিক হল না। এইটে ঠিক। তর্জনীটা এক কোপে কেটে ফেলতে ইচ্ছে করে মাঝে মাঝে। কিন্তু তর্জনীর পেছনে আছে একটা আরও ভয়াবহ বুড়ো আঙুল। বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ।

ভোরবেলার গাড়ি তরতর করে ভেসে চলেছে। পালে হাওয়া লাগছে। কানের পাশ দিয়ে শনশন হাওয়া। মিসেস রায় জানেন না কখন ঘুমিয়ে পড়েছেন। বাড়ির ড্রাইভ-ওয়ে দিয়ে ঢোকবার সময়ে তলার নুড়িতে কড়কড় মড়মড় শব্দ। চটকাটা ভেঙে গেল তখনই। দরজা খুলে দাঁড়িয়েছে বসাক। চোখে ঘুম। বাড়ির দরজা খোলা। এখন থেকে খোলাই থাকে। শিথিল শরীরটাকে এক ঝটকায় টান টান করে নেমে দাঁড়ালেন মিসেস রায়। —‘থ্যাংঙ্কস।’

সিঁড়ি দিয়ে ওঠবার সময়ে একবার যেন বদনের শ্রীমুখখানা দেখতে পেলেন। ঘরের কাছাকাছি আসতে প্রমীলা। হাত থেকে শালটা নিয়ে গুছিয়ে রাখল। ব্যাগটা বিছানার ওপর ছুঁড়ে ফেলে, শাড়ি-টাড়িগুলো টেনে টেনে খুলতে লাগলেন মিসেস রায়। প্রমীলা বেরিয়ে যাচ্ছে। —‘চা দেবো?’

—‘না।’

—‘অন্য কিছু?’

—‘এখন কিছু না।’

ভীষণ ঘুম পাচ্ছে। এখন কিছু না, কেউ না। আলগা হয়ে শিথিল ঘুম শুধু। তর্জনী নেই। বুড়ো আঙুল নেই। বসাক, রাজেশ, অম্বুজ, তিমিরকান্তি, মিসেস দস্তুর, তানিয়া ঘোষাল…কেউ নেই। অনু ডালমিয়া, প্রীতা সোম সব ঘুমের তলায় তলিয়ে গেছে। ঘুম! ঘুম! ঘুম!

প্রথম পর্যায়ে নিশ্ছিদ্র বিস্মরণের অন্ধকার। দ্বিতীয় পর্যায়ে অন্ধকার কাটতে থাকে। আস্তে আস্তে একটা জলপ্রপাতের ওপর ভর দিয়ে শাঁ করে নেমে আসতে থাকে দুটো পা। ছড়ানো দুদিকে। জিনস পরা। পায়ের ওপর কোমর। খোলা। তার ওপর পেট, খোলা। নাভি অর্ধেক দেখা যাচ্ছে। তার একটু ওপরে পাঁজরার ঠিক তলায় একটা শক্ত গিট। লাল নাকি নীল তা তো ঠিক… আবছা ধূসর ধূসর, না গোলাপি বোধহয় টপটা। বেবি পিঙ্ক। ঝুঁকে আছে সোজা সোজা চুল, শেষগুলো ভেতর দিকে একটু পাকিয়ে গেছে। তার মধ্যে মুখ একটা। অনু ডালমিয়ার? ব্রুক শিল্ডস? না জুলিয়া রবার্টস? ভাল করে যতই দেখতে যান ততই মুখটা চুলের ঝাপটায় লুকিয়ে লুকিয়ে যায়। উঁহুঃ ও বোধহয় কামসূত্রর সেই অ্যাড-গার্লটা না? কী যেন নাম…না তো! ও তো তনুশ্রী! তনুশ্রী স্লিপ খেয়ে নেমে আসছে। আবার নামছে। আবার নামছে। টিভিতে ছবিটা তলার দিকে সমানে রোল করে যাচ্ছে। একটা পেটমোটা হাঁস উড়ছে। উড়ছে না তো! থপথপ করে কেমন পেছন দুলিয়ে হেঁটে হাসছে। হঠাৎ কে যেন তনুশ্রীকে প্রচণ্ড জোরে ছুঁড়ে ফেলছে। জলপ্রপাতটা এতক্ষণ ছিল নিস্পাপ স্লাইড একটা। এখন ফুঁসে উঠেছে। হাবুডুবু খেতে খেতে তনুশ্রী শেষ কুটোটুকু আঁকড়ে ধরার মতো করে চেতনাকে ধরেছেন। একটা কুটো ক্রমশ শেকড় হয়ে যায়। শক্তপোক্ত সেই শেকড়টা ধরে মিসেস রায় হাঁকপাঁক করছেন।

শেকড়টা আস্তে আস্তে তিতির মুখ হয়ে যাচ্ছে। —‘মা, মা, ওঠো। প্রমীলাদি কী বলছে শোনো।’ তিতি মাকে নির্মমভাবে ঝাঁকাচ্ছে।

তনুশ্রী চোখ দুটো আধো খুলে তিতির মুখটা জলের মধ্যে শক্ত গাছের শেকড়ের মতো ভাসতে দেখেছিলেন। তিতি…তিতি..কে যেন তিতি..মেয়ে…ও তাঁরই মেয়ে…বেড়াতে গিয়েছিল না? কোথায়? কে জানে! কবে ফেরার কথা ছিল? ফিরেছে তাহলে? বেশ তো, ফিরেছে তো এখানে কেন? এখন, এখানে তাঁকে এভাবে ঝাঁকাবার মানে কী? ভুরু কুঁচকোচ্ছে যে!

হাজার চেষ্টা করেও মুখে কথা আনতে পারছেন না মিসেস রায়। জিভটা অসাড় হয়ে গেছে যেন।

—‘মা, এখন দশটা বেজে পঁচিশ মিনিট। বাবা সকাল থেকে বাড়ি নেই।’ অনেক কষ্টে জিভটা নেড়ে তনুশ্রী বললেন, ‘নেই তো কী! আসবে!’

—‘প্রমীলাদি বলছে সকালে চা দিতে গিয়ে ঘর খালি দেখেছে। বাবা ঠিক সাড়ে পাঁচটায় চা চায়। রাতে বিছানায় শোয়নি। ঘরে ছিল না বোধহয়।’

এবার তনুশ্রী এপাশ ওপাশ করে দু হাতে ভর দিয়ে কোনওক্রমে উঠে বসলেন। ভুরু কুঁচকে গেছে।

—‘তোমার বাবা কোনদিনও এ সময়ে বাড়ি থাকে?’ সদ্য ঘুম ভাঙা গলাটা ভারী, ভাঙা-ভাঙা, ‘হয়ত সকালে কোনও বিশেষ কাজ আছে। কেউ বাড়ি ছিল না, তাই বলে যেতে পারেনি।’

প্রমীলা দরজার ওদিকে ছিল, কাছিয়ে এল।

—‘মেমসায়েব, সায়েব কালকে কেন জানি বড্ড রাগ করেছিলেন। খাবার…ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিলেন।’

তনুশ্রী খুব আশ্চর্য হলেন এবার। তাঁর স্বামী বিজু রায় খুব ঠাণ্ডা মাথার লোক। প্রমীলার রান্নাও একেবারে স্ট্যান্ডার্ড। এদিক-ওদিক হয় না। তা ছাড়া বিজু রায়ের জন্য কীই বা রান্না! ব্লাড শুগার আর উচ্চ রক্তচাপের জন্যে মাপা বাঁধা-ধরা খাওয়া ইদানীং। খাবার ছুঁড়ে ফেলার কোনও কারণ থাকার কথা নয়।

—‘আমায় জিজ্ঞেস করলেন মেমসায়েব ছেলেমেয়ে কোথায়…’ প্রমীলা আর একটু সাহস করে বলল।

—‘তুমি কী বললে?’

—‘আপনি গান শুনতে গেছেন, দিদি বেড়াতে গেছে বললুম, দাদার কথা জানি না, তাই বলতে পারিনি।’

—‘সাহেব তাতে কী বললেন?’

—‘কিছু না। অনেক রাত হয়ে যাচ্ছে দেখে খেতে ডাকলুম, এলেন, দিলুম, তারপর সব খাবার ছুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে উঠে গেলেন।’

তনুশ্রী এবার সম্পূর্ণ হতভম্ব চোখে তিতির দিকে তাকালেন। তিতিও মায়ের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। কিছু বলছে না। —‘চিন্টু চিন্টু কোথায়! সেই বা এখনও ফেরেনি কেন? চিন্টু রাতে ফেরেনি? প্রমীলা!’

প্রমীলা খুব অপরাধী গলায় বলল, ‘না।’

—‘এ কথা আগে বলনি কেন? তনুশ্রী হঠাৎ কঠোর গলায় বললেন। চিন্টুর ফেরা না ফেরার দায় যেন সম্পূর্ণই প্রমীলার।

প্রমীলা আরও ভয়ে ভয়ে বলল, ‘দাদা তো মাঝে মাঝেই অমন রাতে ফেরে না। আমি কী করে জানব আপনি জানেন না!’

‘আচ্ছা। এখান থেকে যাও এখন!’

হঠাৎ তনুশ্রীর খেয়াল হল প্রমীলা একটা কাজের লোক। বড্ড বেশিক্ষণ পারিবারিক কথাবার্তার মধ্যে রয়েছে। এটা ঠিক না।

প্রমীলা চলে গেলে মেয়ের দিকে চেয়ে বললেন, ‘হঠাৎ এত রাগের কী হল?’

তিতি অসন্তুষ্ট গলায় বলল, ‘কোথায় যাচ্ছ, কেন যাচ্ছ বলে গেলেও তো পারো।’

—‘তুমি কি বলে গিয়েছিলে?’ তনুশ্রী মেয়ের সঙ্গে তৎক্ষণাৎ মাঠে নেমে পড়েন।

—‘আমি তোমাকে বলে গেছি। তুমি বাবাকে বলবে এটাই আমার ধারণা। চিরকাল এরকমই হয়ে এসেছে।’

—‘তোমার দাদা? সে বলে গেছে?’

দাদার জবাবদিহি দাদার কাছে চেয়ো। আমি কী বলব?’

—‘বলে যাওয়ার কথা তুলছ তাই বলছি।’

তিতি কিছু বলল না। ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল। তনুশ্রী উঠে পড়লেন। চানে ঢুকতে হবে এবার। অনেকক্ষণ সময় নেবেন আজকে। ইতিমধ্যে কোনও একটা খবর আসবে। ফোন হোক, মেসেঞ্জার হোক। বিজু রায় নিজেই চলে আসতে পারেন। এত ভোরে হঠাৎ কী কাজ পড়ল এটাই কৌতূহলের বিষয়। তিতি বা প্রমীলার যে তর্জনীসংকেত অর্থাৎ কিনা বিজু রায় প্রধানত তাঁর ওপর রাগ করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেছেন, এই ধারণাটাকে এক মুহূর্তের জন্যেও প্রশ্রয় দিচ্ছেন না তিনি। অল রাবিশ! বিজু রায় তাঁর ব্যবসার সুবাদে কখন কোথায় যান, কেন যান, সেটা যেমন তনুশ্রী জানেন না, তনুশ্রী তাঁর সামাজিক কাজকর্মের সুবাদে কখন কোথায় যান বিজু রায়েরও তেমনি জানার কথা নয়। তিতি তাঁর মেয়ে। কিন্তু ওর রকমসকম একেবারে ভাল লাগে না তাঁর। কথাবার্তা বলার খুব একটা সুযোগ হয় না। কিন্তু যখন বলে কেমন একটা সমালোচনার সুর, একটা জবাবদিহির ভঙ্গি থাকে। চাউনি-টাউনিগুলোও কেমন যেন! কে যে বয়সে বড় বোঝা দায়। চিন্টুকে তিনি খানিকটা বুঝতে পারেন। তিতিকে পারেন না। ওর বন্ধুবান্ধবদেরও না।

অনেকক্ষণ ধরে চান করেও মাথাটা তেমন পরিষ্কার হল না। চোখ দুটো লাল হয়ে ফুলে আছে। ঘুমের বিকল্প আসলে কিছু নেই। পাঁচ সাড়ে পাঁচ থেকে বারোটা একটা পর্যন্ত একটা নিশ্চিন্ত ঘুম ঘুমোতে পারলে ক্লান্তিটা কেটে যেত। কিচেনের দিকে গেলেন তনুশ্রী। বদনেতে প্রমীলাতে গল্প জুড়েছে ‘কেউ নেই গো, না ছেলে, মেয়ে, না বউ, একে মা গিয়ে থেকে মানুষটা থম মেরে আছে! আমি তো মুখ দেখে ভয়ে মরি!’

তনুশ্রী কড়া গলায় বললেন, ‘প্রমীলা আমায় কড়া করে কফি দিয়ো।’

রান্নাঘরের ভেতরের কথাবার্তা চট করে থেমে গেল। তনুশ্রী পার্লারে এসে বসলেন। মুখটা থমথম করছে। তিন চারটে কাগজ ম্যাগাজিন হোল্ডারের ওপর থাক করা। একটা আলতোভাবে তুলে নিয়ে চোখ বুলোতে লাগলেন। কিন্তু ভেতরে ঢুকছে না। একটা চিটচিটে রাগে ভেতরটা জ্বলছে। একটু পরে বদন ট্রেতে করে তাঁর ব্রেকফাস্ট নামিয়ে দিয়ে গেল। ফলের রসে একটা চুমুক দিয়ে নামিয়ে রাখলেন তনুশ্রী। ‘প্রমীলা!’ রাগী গলায় ডাকলেন। ঝাড়নে হাত মুছতে মুছতে এসে দাঁড়াল প্রমীলা।

—‘জুস তেতো হয়ে গেছে, নিয়ে যাও।’

বিনা বাক্যব্যয়ে জুসটা তুলে নিয়ে গেল প্রমীলা। ওদিকে অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার আগের মুহূর্তে পেছন ফিরে বলল, ‘চিন্টুদাদা ফিরেছে। ঘুমাচ্ছে ঘরে।’

—‘কৃতার্থ হলুম’, মনে মনে বললেন তনুশ্রী। যত জ্বালা আমার। কেন রে বাবা! স্বাধীনতা যে যখন ইচ্ছে কাউকে জিজ্ঞাসাবাদের বালাই ছাড়াই নিয়েছ, কী ছেলে, কী মেয়ে, কী তাদের বাবা! তাদের ফেরা-না-ফেরার দায় আমায় নিতে হয় কেন? আমাকে কথা শুনতে হয় কেন ঝি-চাকরের কাছ থেকে? এই সব জবাবদিহির বাধ্যবাধকতা এক ধরনের পরাধীনতার লক্ষণ। ষোলো বছরের বড় ব্যবসায়ী বরকে এইজন্যে বিয়ে করা হয়নি। কৈফিয়ত চাইবে না বলে, যত খুশি খরচ করবার অনুমতি কিংবা বিনা অনুমতিতে চলবার অলিখিত কাগজে সই করে দেবে বলেই আরও যুবক, আরও কোয়ালিফায়েড পাত্র প্রত্যাখ্যান করে একে নির্বাচন করা!

ব্রেকফাস্ট শেষ করেও অনেক, অনেকক্ষণ একই জায়গায় বসে কাগজ পড়ার বৃথা চেষ্টা করতে লাগলেন তনুশ্রী। আজকে সন্ধেবেলায় পার্টি আছে। লাঞ্চ স্কিপ। এখন তিনি প্রতি মুহূর্তেই বিজু রায়কে সিঁড়ি দিয়ে উঠে আসতে দেখছেন। এভাবেই বারোটা বেজে গেল। তিতি ঘর থেকে বেরিয়ে আসছে। চুলের ওপর তোয়ালে জড়ানো —‘মা, খাবে নাকি? দাদাকে ডেকে তুলব।’

—‘আমি এ বেলা খাচ্ছি না।’

কেন? জিজ্ঞেস করার জন্য মুখটা খুলেছিল তিতি। গিলে নিল প্রশ্নটা। তনুশ্রী লক্ষ করলেন। এবং লক্ষ করে বিরক্ত হলেন। নিজের মাকে একটা প্রশ্ন করবে তারও কত ধানাইপানাই! দাদার ঘর থেকে গম্ভীর মুখে ফিরে আসছে তিতি। দাদাকে তুলতে পারেনি তাহলে! তনুশ্রী ভেতরে ভেতরে এত রেগে গেছেন যে কোনও কথা জিজ্ঞেস করবার দরকার মনে করছেন না। এখান থেকে খাবার টেবিলের একটা দিক দেখা যায়। বাঁ চোখের কোণ দিয়ে। তিতি খাচ্ছে। উঠে গেল। হাত ধুচ্ছে। সামনে দিয়ে খাবার সময়ে বলে গেল, ‘মা, দাদা নিঃসাড়ে ঘুমোছে। তুলতে পারলুম না। আমি কলেজ যাচ্ছি। লাইব্রেরি হয়ে ফিরতে পাঁচটা বেজে যেতে পারে।’ দেখাচ্ছে। আসলে দেখাচ্ছে ওর কত দায়িত্ববোধ। কত শৃঙ্খলাবোধ। মাকে বলে যাচ্ছে। একেবারে সময়টা পর্যন্ত বলে যাচ্ছে! কখন ফিরবে, কোথায় কোথায় যাচ্ছে! হুঁ!

তনুশ্রী টেলিফোনটা তুললেন। বিজু রায়ের অফিসে ডায়াল করলেন তনুশ্রী। বেজে যাচ্ছে বেজে যাচ্ছে। কেউ ধরছে না। আর একটা নম্বর রয়েছে। ডায়াল করলেন।

এবার ধরেছে। ‘হ্যাললো।’

—‘মিঃ রায় আছেন?

—‘না। উনি এখনও আসেননি। ওঁর অফিসঘর বন্ধ।’

—‘কে বলছেন? সাধনবাবু?’

—‘হ্যাঁ আমি সাধন বিশ্বাস। বউদি নাকি?’

বি বি রায়ের অফিসের একমাত্র এই সাধন বিশ্বাসই তনুশ্রীকে বউদি বলে ডেকে থাকেন। তনুশ্রী সেটা মেনে নেন। বহুদিনের লোক। তনুশ্রী বললেন— ‘শুনুন সাধনবাবু, সাহেব এলেই আমাকে ফোন করতে বলবেন। বাড়ির নম্বরে না পেলে আরেকটা নম্বর দিচ্ছি, সেইখানে।’ নম্বরটা বললেন তনুশ্রী।

সাধন বিশ্বাস তাড়াতাড়ি বললেন—‘আজ সাহেবের এত দেরি কেন? বুঝতে পারছি না তো! কখন বেরিয়েছেন বাড়ি থেকে? অনেকগুলো দরকারি কাজ আছে…’

বোতাম টিপে কানেকশনটা অফ্‌ করে দিলেন তনুশ্রী। বিজু রায় যে শেষ রাত থেকে বাড়ি নেই এ কথাটা অফিসে জানানো ঠিক হবে কিনা তিনি বুঝতে পারছেন না। তবে এখনও, ফোনটা রেখে দেবার পরও তিনি প্রত্যাশা করছিলেন বিজু রায় সিঁড়ি দিয়ে উঠে আসবেন। বা কোনও ফোন আসবে তাঁর।

তবে গিয়ে একবার আয়নার সামনে দাঁড়ালেন তনুশ্রী। ওপরের জোরালো আলোটা জ্বেলে দিলেন। চোখের তলায় বেশ কালি। মুখটাও যেন চুপসে আছে। দু রাত্তির পর পর জাগা! সয় নাকি! মুখে-গলায় ভাল করে নারিশিং ক্রিম মেখে তিনি বিছানার ওপর উপুড় হয়ে শুয়ে পড়লেন। আরেকটা ঘুম দরকার। অ্যালার্মটা সাড়ে তিনটেয় সেট করে দিলেন। কী মনে হল, একবার প্রমীলাকেই ডাকলেন আবার।

—‘সাহেব এলে আমায় জাগিয়ে দিয়ো। সাহেবের ফোন এলেও।’

—‘সাহেব কি আপিসে আছেন? বউদি!’ প্রমীলা ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করল।

—‘না, কাজে, অন্য কোথাও গেছেন।’ কাঠ-কাঠ গলায় বলে তনুশ্রী আবার মুখটা বালিশের ওপর রাখলেন। প্রমীলার মুখ থেকে দুশ্চিন্তা এবং অবিশ্বাসের ছায়া গেল না। সে আড় চোখে একবার মেমসাহেবের শায়িত শরীরটার দিকে বিতৃষ্ণার দৃষ্টিতে চেয়ে সেখান থেকে চলে গেল। এই মেমসাহেবকে সামনাসামনি সে ভয় করে। পেছন ফিরলে একটুও না। বরং একটা তাচ্ছিল্য, একটু ঘেন্না মেশানো থাকে তার দৃষ্টিভঙ্গিতে। এই মেয়েছেলেটার পুরো সংসার তার হাতে। সে-ই চালাচ্ছে সব। সে আর বদনই প্রধান। সকাল পাঁচটা বাজলেই দারোয়ান দরজা খুলে দিয়ে ঘুমোত চলে যাবে। সকালের দারোয়ান এসে বসবে। বদন আরও একটা ঠিকে তোক নিয়ে সমস্ত বাড়ি ঝকঝকে করে পরিষ্কার করবে। টাটকা ফুল তুলে আনবে, তখন প্রমীলা ফুলদানগুলোয় ফুল ভরে ডিনার-টেবিলের ওপর রাখবে। বদন সেগুলো সব জায়গামতো বসাবে। ব্রেকফাস্ট তৈরি করা, সারা দিনে কোন সময়ে কী খাওয়া হবে সে-সব মেনু ঠিক করা—সবই প্রমীলার হাতে। একমাত্র লোক-টোক খেলে এরা হয় বাইরে থেকে পুরো খাবার-দাবার আনায়, নয় কিছুটা বাইরে থেকে আসে। আর কিছুটার জন্য প্রমীলার ওপর খবরদারি করে মেমসায়েব। নিজের রান্নাঘরে কোথায় কী আছে যে জানে না, যার সোয়ামি-পুত্তুরকে অন্য লোকে খাবার বেড়ে দেয়, উপরন্তু যার ঘরের ওপর কোনও আঁট নেই, দিবারাত্তির বেরিয়ে যাচ্ছে আর একেক সময়ে একেক রকম সেজে বাড়ি আসছে আর আয়না দেখছে তেমন মেয়েমানুষের ওপর কোনও শ্রদ্ধা নেই প্রমীলার। সে ইচ্ছে করলেই এ সংসার থেকে অজস্র অপর্যাপ্ত চুরি করতে পারে। করেও। টাকা পয়সা পারে না, কিন্তু অন্যান্য জিনিস, যথেচ্ছ।

যে মানুষটাকে বাইরে ভেতরে উভয়তই ভয় করত সে মানুষটা সাহেবের মা। তিনতলার ঘরে একরকম শোয়াই। নামলেন একেবারে কাঁধে চড়ে। তার আগে একবার উঁকি দিয়ে দেখতেও নীচে নামতেন না। কিন্তু চোখে চোখ রাখতে ভরসা পেত না প্রমীলা। একদিন বদনকে দিয়ে প্রচুর চাল ডাল মশলা বাইরে পাচার করবার পর ওপরে মায়ের খাবার নিয়ে গেছে। মা চোখে চোখ রেখে বললেন —‘প্রমীলা, আমার ছেলে-বউ দুজনেই নানা কাজে ব্যস্ত, সংসার দেখতে পারে না। নাই- পারল। তুই তো রয়েছিস। এদের জিনিস-পত্তর বুক দিয়ে আগলে রাখবি, দেখভাল করবি, আমার ছেলে তোকে ঠকাবে না।’

মা কি ধরে ফেলেছিল সে কী করেছে? অন্তর্যামী নাকি? হতেও পারে। ঘরে সব সময়ে ধূপের গন্ধ, সন্ধে হতেই তুলসীতলায় পিদিম, ঠাকুরের ছবির গলায় ফুলের মালা। সব সময়ে জপ করছে। তো সে মানুষ অন্তর্যামী হলেও হতে পারে। তারপর থেকেই সে একটু সাবধান হয়ে যায়। আর সত্যি কথাই। সাহেব কাউকে ঠকাবার মানুষ না। তার মাইনে বেড়ে-বেড়ে এখন নশো টাকা হয়েছে। সে বেওয়া মানুষ, ছেলে-পুলে নেই। এখানে সে কত সুখে আছে, সেটা থেমে গেলেই টের পায়। দু-এক দিনের বেশি টিকতে পারে না। সেবার তার পেটের একটা বড় অপারেশন হল, তা সরকারের পি. জি হাসপাতালে রেখে কী চিকিৎসাটাই করালে সাহেব। হাসপাতাল থেকে বাড়ি আসার পরও একমাস নিজের ঘরে স্রেফ শুয়ে বসে থেকেছে আর খেয়েছে। তখন আর একটা ঠিকে লোক রেখে বদনই কাজ চালাত। তা সে-ই সাহেব মানুষটা রাত্তিরে কাউকে না বলে কোথা গেল গো? বউ-ছেলেমেয়ে কারুরই তো কোনও গা নেই! কিছু একটা মেমসায়েব তার কাছ থেকে লুকোচ্ছে। রকম দেখলেই সে বুঝতে পারে। ব্যাটাছেলেরা যতই যাই হোক, নিজের পরিবারের কাছ থেকে একটু যত্ন-আত্তি আশা করে। দিনের পর দিন এতটা আছেদ্দা! লোকটা শেষ পর্যন্ত বিবাগী হয়ে গেল গা! এভাবেই প্রমীলা মনে মনে দুই প্রতিপক্ষ খাড়া করে সাহেবের পক্ষ নিয়ে নেয়।

ঠিক চারটের সময়ে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গেলেন তনুশ্রী। রাত্রের পার্টির জন্যে তৈরি হতে তিন সাড়ে তিন ঘণ্টা তো লাগবেই। এই বিউটি-সেলুনের ফোন নম্বরটাই সাধন বিশ্বাসকে দিয়ে এসেছেন তনুশ্রী। বিজু রায় এখানে ফোন করলেই তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারবেন। পার্টিটা দারুণ গুরুত্বপূর্ণ। বিজু রায়ই বলে দিয়েছেন। পুরনো স্টিভেডোর ফ্যামিলির মেয়ের বিয়ে হচ্ছে বিজনেস ম্যাগনেট কে শর্মার ছেলের সঙ্গে। মেয়ের পরিবারের কানেকশন্‌স্‌ অসাধারণ। প্রভাবশালী এমন কেউ নেই যাদের সঙ্গে ওদের দোস্তি নেই। বিখ্যাত উইমেনস ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ার পার্সন মেয়ের মা। তাঁর সঙ্গে জমিয়ে একটা মেম্বারশিপ আদায় করে নিতে পারলেই, প্রতি বছর কনফারেন্সে কনভেনশনে উড়ে বেড়ানোর একটা সুযোগ খুলে যেতে পারে তাঁর জন্যে। আর তাঁর স্বামীর যে কী সুবিধে হবে, ভাবতে গেলে তনুশ্রী রায় কূল পান না। বাঁকুড়ায় বিশাল একটা জায়গা নিয়ে কী নাকি কারখানা খুলবে। বড় বড় হাউজের সঙ্গে টক্কর লাগিয়েছে বিজু রায়। এই পার্টিতে মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, ডি. এম সবাই আসছে। তার ওপর শর্মার সঙ্গে বিজু রায়ের বিশেষ খাতির। শর্মা ওকে সাহায্য করছে। এই ব্যাপারটা করতে পারলে ও বোধহয় ঠিকঠাক শিল্পপতি নামের যোগ্য হবে। ইনডাসট্রিয়ালিস্ট! টপ-নচার! বি. বি. রায় গ্রুপ অফ ইনডাসট্রিজ! ভাবলেও গায়ে কাঁটা দেয়। সেই তনুশ্রী, হ্যাঁ? দুপুরবেলা মর্নিং কলেজ থেকে ফিরে ডেঙর ডাঁটার চচ্চড়ি আর চিংড়ি-পোস্ত দিয়ে ভাত খেতে বসত মায়ের সঙ্গে! বাবা ফিরলেই সন্ধেবেলা সামনে বসে বসে রাজ্যের শার্টে পাঞ্জাবিতে বোতাম বসাও, মোজা রিফু করো, সারাদিন কী করেছ তার ফিরিস্তি দাও। পাঁচ পাঁচখানা মেয়ের বিয়ে দিয়ে ভদ্রলোক কেমন খ্যাপা-পাগলা মতন হয়ে গিয়েছিলেন। উঠতে-বসতে বলতেন ‘রূপেগুণে পার হও, রূপেগুণে পার হও, আর আমার কিছু নেই। কিস্যুটি নেই। রূপেগুণে পার হও।’ ময়লা জামা-কাপড় পরে থাকলে, চুল না বাঁধলে কী বিরক্তই না হতেন। ‘টিপ দাওনি কেন কপালে? পাটভাঙা কাপড় পরবে সব সময়ে। গলার যে হারখানা গড়িয়ে দিয়েছিলুম, পরোনি কেন? আমার ছেরাদ্দের খরচে লাগবে বলে তো আর দিইনি। মেয়েদের সাজসজ্জা অলঙ্কারেই শ্ৰী। কখনও শ্রীহীন থাকতে যেন না দেখি!’

মা একেক সময় বিরক্ত হয়ে বলতেন, ‘তোমার এক বাই হয়েছে। মেয়েদের ব্যাপারে তোমার অত নজর কেন! এ কেমন ব্যাটাছেলে রে বাবা!’

‘সাধে হয়নি, একদিনে হয়নি’, বাবা বলতেন, ‘তুমি সব হিসট্রিটাই জানো। তবু বলবে বাই?’

সম্বন্ধটা যখন এল, ঘটক বলেছিল, ‘বয়সে একটু বড় ঠিকই। কিন্তু এসট্যাবলিশ্‌ড পাত্র পেতে গেলে বয়সের দিকে তাকালে তো চলবে না। দেখলে বুঝতেই পারবেন না। একমাথা চুল, দোহারা চেহারা, খাটিয়ে লোক, এইবারে বিয়ে করে থিতু হতে চাইছে, মানে বেশ ভালই জমিয়ে নিয়েছে। দায়িত্বঅলা লোকেদের রকম-সকমই আলাদা।’

বিজু রায়কে তনুশ্রী প্রথম দেখেন মামার বাড়ির এক নেমন্তন্নে। এল স্যুট-টাই পরা সাহেব। একটা হাজার টাকার গিফ্‌ট্‌ চেক উপহার দিয়ে কোল্ড ড্রিঙ্কস খেয়ে চলে গেল। গ্ল্যামারাস। এক দেখায় পছন্দ হয়ে গেল। তখন সুবিমলের সঙ্গে জোর প্রেম চলছে। সুবিমল মার্চেন্ট অফিসে কাজ করে, টাই-ফাই হাঁকাক আর যাই করুক অ্যাসিস্ট্যান্ট মানে কেরানিই। বাড়িতে বেশ কিছু পোষ্য। এক ভারাক্রান্ত সংসার থেকে আরেক ভারাক্রান্ত সংসারে যেতে মনে মনে ইতস্তত করতে শুরু করেছে তনুশ্রী। জীবনে অ্যাডভেঞ্চার চাই। সুবিমল ভিতু-ভিতু, ক্লান্ত, যেন এখন থেকেই হেরে বসে আছে। বি. বি. রায়ের পাশে সুবিমল যেন রেসের ঘোড়ার পাশে ছ্যাকরাগাড়ির ঘোড়া। একদিন ছুতো করে খুব ঝগড়া করল তনুশ্রী, কাপুরুষ, অকালবৃদ্ধ, ন্যাকাচণ্ডী। সুবিমল রাগ করে সম্পর্ক ছেদ করল। এটাই চাওয়ার ছিল। মাস তিনেকের মাথায় বিজু রায়ের সঙ্গে বিবাহ এবং আন্দামান আইল্যান্ডস্‌-এ হনিমুন। সেই প্রথম তনুশ্রী বারমুডা পরল, সুইমিং কসটিউম পরল। তা তারপর থেকে কোনও জিনিস চেয়ে পায়নি এমন হয়নি। নাকটা বোঁচা ছিল, ঠিকঠাক করিয়ে নিয়েছে, তিনটে ল্যাংঙ্গোয়েজ কোর্স করেছে, ইংরিজি ছাড়া আর দুটোই অবশ্য আধা-খামচা, বিউটিশিয়ানস কোর্স, কুকিং এসবও হয়েছে। তা এখন সে সব দিন গত। এখন উৎসাহ অন্য খাতে। অ্যাডভেঞ্চারের জৌলুস আর কুকিং-ফুকিং-এ ল্যাংঙ্গোয়েজ-টেজ-এ পাওয়া যায় না।

বিউটি-সেলুনে ফেসিয়াল, ওয়্যাক্সিং, ম্যানিকিওর, পেডিকিওর সব করার পর চুল-টুল সেট করে আপাদমস্তক সাজগোজ শেষ হয়ে গেলে ওদের চারদিকের আয়নায় নিজের ভায়োলেট জামেয়ার শাড়ি-পরা চেহারাটা দেখে নিজেই চমকৃত হয়ে গেলেন মিসেস রায়।

সাড়ে সাতটা নাগাদ সাজগোজ শেষ হলে তাঁর খেয়াল হল প্রত্যাশিত ফোনটা আসেনি। সেলুন বন্ধ হবার মুখে, চিনে মেয়েগুলো বিরাট বিরাট হাঁ করে হাই তুলছে, তনুশ্রী টিপ টিপ করে ফোন করলেন— ‘কী বললেন? নেই? কখন বেরিয়েছেন? সে কী? সেই সকাল থেকেই আসেননি? সমর কোথায়?’ ঘড়ি দেখতে দেখতে সমরের জন্যে অপেক্ষা শুরু হল। ‘আমি সমর বলছি মেমসাহেব, সকাল থেকে গাড়ি নিয়ে প্রথমে বাড়িতে তার পরে অফিসে এসে অপেক্ষা করছি, সায়েব এলেন না।’ সমরের গলায় উৎকণ্ঠা। ফোনটা রেখে দিলেন তনুশ্রী। আর অপেক্ষা করবার সময় নেই। বিজুকে ছাড়া পার্টিতে যাওয়া একটু অকওয়ার্ড। কিন্তু বিজু রায় যে কারণেই ভোরবেলা থেকে নিরুদ্দিষ্ট হয়ে থাকুন। এই পার্টিতে তাঁর টিকি বাঁধা আছে। এখানে তাঁকে আজ আসতেই হবে। এখন একাই যেতে হবে। বাহানা কিছু বানাতে হবে একটা। এতক্ষণ সময় এবং টাকা খরচ করে এই ভুবনভোলানো মেকাপ হল…এরপর…। মুহূর্তে মনঃস্থির করে তনুশ্রী বেরিয়ে এসে গাড়িতে বসলেন। ড্রাইভারকে বললেন— ‘চলো গুরুসদয়।’

গেটের কাছেই শর্মা। দুরকম রঙের গাঁদাফুল দিয়ে আজকাল গেট সাজায়। পুরো গেটটাই ফুলে ফুল। হলুদ আর কমলা। সবুজের ওপর হলুদের নক্‌শা। ডেকোরেটররা বানায় আজকাল সব একরকম। মিসেস শর্মা অবধারিতভাবে জিজ্ঞেস করলেন—‘কী ব্যাপার? মিঃ রায় কি পরে আসছেন?’

তনুশ্রী অনেকক্ষণ ধরে একটা উত্তর ভেবে রেখেছিলেন। ‘ভীষণ জ্বর এসেছে বুঝলেন? একেবারে হঠাৎ! তো আমরা ঠিক করলাম কেউ একজন না এলে…’

কিন্তু আসল পরিস্থিতিটার মুখোমুখি হলে বুদ্ধির চর্চা যারা করে তাদের বুদ্ধি অনেক বেশি খুলে যায়। সত্যি কথা বলতে কি বিত্তবানদের জ্বর-ফর হয় না। হয় হার্ট অ্যাটাক, সিরোসিস অফ দা লিভার, বড় জোর হাই ব্লাড সুগার, প্রেশার। এই পর্যন্ত। জ্বর-ফর এলেবেলে ব্যাপার। তনুশ্রী নিজেকে বলতে শুনলেন— ‘আর বলবেন না, আমাকে সাতটায় ফোন করল, কী নাকি ভীষণ জরুরি কাজে আটকে গেছে। বলল “তুমি এখুনি চলে যাও। আমি একটু পরে, কাজটা সেরে যাচ্ছি।” তো এত তাড়াতাড়ি কথা বলেই ফোনটা রেখে দিল আমি জিজ্ঞাসা করতেও সময় পেলাম না, কী কাজ, কোথায় কতক্ষণে আসবে।’

মিসেস শর্মার প্রশ্নের ফলেই এই জবাবটা তৈরি হয়ে গেল। ধন্যবাদ মিসেস শর্মা। যদিও তোমাকে হাড়গিল্লে ঠাকুরানি বলি আমরা কজন আড়ালে। যদিও তুমি প্রচণ্ড জেলাস!

মিঃ শর্মা বললেন, ‘সে কী? রায় আটকে গেল?’ সঙ্গত কারণেই তিনি খুব চিন্তিত। বাঁকুড়ার ব্যাপারটা বোধ হয় রায়-শর্মা গোছের কিছু। তনুশ্রী বিশদ জানেন না।

মিসেস শর্মা বললেন ‘এসো তনুশ্রী আমার বউমার সঙ্গে তোমার আলাপ করিয়ে দিই।’

জায়গাটা বিরাট। খোলা আকাশ ওপরে। মাঝে মাঝে শামিয়ানা-ঘেরা নানান আয়োজন। খোলা জায়গাটায় ফুলের টব, গাছগুলোতে টুনি জ্বলছে। লম্বা লম্বা হ্যালোজেন বাতি। মিসেস শর্মার বউমা হাতে টোম্যাটো জুস নিয়ে আরও কয়েকজন প্রায় সমবয়সী মেয়ের সঙ্গে কথা বলছিল।

‘এই যে প্রমা, দিস ইজ দা গ্ল্যামার-কুইন অফ আওয়ার সেট তনুশ্রী রায়। তোমাকে আগেই বলেছিলাম!’

জুসটা সঙ্গে সঙ্গে কাছের টেবিলে রেখে খুব পাতলা লম্বা দুটো হাত জোড় করে নমস্কার করল প্রমা, নতুন বউ। এত ফর্সা আর এত রোগা যে নীল শিরাগুলো যেন দেখা যাচ্ছে, গালে হাতে। ফুটে ওঠেনি এখনও। একটা নীলচে ছায়া মতন। একটা গরদ-রঙের ভারী সিল্কের শাড়ি পরেছে। পাড়টা বিরাট চওড়া ঢালা সোনালি জরিতে আর একটা অদ্ভুত হলুদে। অনেক সোজা চুল মেয়েটির। কোমর পর্যন্ত। খোলা। চলার তালে সাটিনের ঝিলিক মেরে ঢেউ খায়। কানে হীরের কান। গলায় একটা সরু হীরের হার ঝিকঝিক করছে। ডান হাতে দু-চার গাছি সোনার চুড়ি। আর সিঁথিতে সিঁদুর। একটা টিপ নেই। লিপস্টিক নেই, কোনও প্রসাধন নেই। অদ্ভুত! সাদা শাড়ি পরা, নির্গহনা, বা এত কম গহনা, সব কিছুতে ম্যাচিং নেই, এরকম বউ তনুশ্রী কখনও দেখেননি। নতুন বউ বলে বোঝাই যাচ্ছে না। বেশ নিচু গলায় নমস্কারটা বলল। অত নিচু গলা অথচ বেশ স্পষ্ট, পরিষ্কার শোনা গেল। পাশে দাঁড়িয়ে নিজেকে বড্ড বেশি প্রসাধিত, ভীষণ উচ্চকিত লাগছে তনুশ্রীর। যদিও প্রমার বা অন্য কারও দৃষ্টিতে সেরকম কোনও ইঙ্গিত নেই। তনুশ্রী একটুখানি দাঁড়িয়ে কথা বললেন, ভীষণ অস্বস্তি লাগছিল বলে যত তাড়াতাড়ি পারেন চেনা অন্য এক মহিলার শরণ নিলেন। মিসেস চৌবে। তারপর কে যেন কখন তাঁকে আইসক্রিম পার্লারে ঢুকিয়ে নিল। সেইখানে নিজের বৃত্তের সঙ্গে ফেমিনিজমের বিষয়ে আলোচনায় অনেকক্ষণ মত্ত হয়ে রইলেন তনুশ্রী রায়। প্রমার মায়ের সঙ্গে এখানেই আলাপ হল। দেখে আশ্বস্ত হলেন তনুশ্রী, ইনি মেয়ের চেয়ে বেশি সেজেছেন। অত্যাচারিত মেয়েদের নিয়ে এঁর সঙ্গে তনুশ্রী অনেকটা সময় আলোচনা করলেন। প্রমার মা রাধা চ্যাটার্জির কাছ থেকে তাঁদের অ্যাসোসিয়েশনের পরবর্তী অধিবেশনে নিমন্ত্রণের একটা প্রতিশ্রুতি আদায় হয়ে গেল। সেমিনার হবে বিভিন্ন বিষয়ে। মিসেস চ্যাটার্জি বললেন কার্ড পাঠাবেন। তনুশ্রী যেন অবশ্যই আসেন। ইতিমধ্যে ললিতা বিশ্বাসের সঙ্গে প্রমাকে নিয়েও খানিকটা মনোজ্ঞ আলোচনা হয়ে গেল।

—‘জানো না? ও মা! ও তো সাদা ছাড়া পরে না।’

—‘কারণ কী?’

—‘ওর ওটাই স্টাইল, তবে মন্দ লোকে অন্য কথা বলে।’

—‘যেমন!’

—‘কাউকে বোলো না। কাজিনের সঙ্গে বাল্য প্রেম। কাজিন মারা গেছে বছর পাঁচেক হল। ব্লাড ক্যানসার। সেই থেকে সাদা।’

—‘এদিকে বিয়ে করছে। ওদিকে সাদা!’

—‘ওই তো বলে কে?’

—‘ফার্স্ট কাজিন নাকি?’

—‘তবে? যত বড় ঘর তত কেচ্ছা!’ ললিত বিশ্বাস কথাটা কেমন আক্ষেপের সুরে বললেন। আক্ষেপের হাওয়া তনুশ্রীর মনেও লাগল। ইস্‌স্‌, তাঁর বাড়িতে কোনও কেচ্ছা নেই, কেচ্ছা না থাকলে উচ্চ কোটির লোক বলে গণ্য হওয়া মুশকিল বোধহয়। হঠাৎ মনে হল কেচ্ছা ছিল না, কিন্তু শুরু হয়েছে একটা। বোধ হয়। বিজু রায়ের সহসা নিরুদ্দেশ হওয়াটা…। কোনও মহিলাঘটিত ব্যাপার যদি হয়? সোজা কথায় ঢেঁকির পাড় পড়ল তনুশ্রীর বুকের মধ্যে। সে ক্ষেত্রে তো জীবনের ভিতটাই ধসে যাবে! বিজু রায় তাঁর আছেন বলে তিনি তনুশ্রী রায়। তিনি এই তিনি সেই। যে মুহূর্তে বিজু অন্যের হয়ে যাবেন, যত সহানুভূতিই তাঁর জন্যে লোকে দেখাক, তার আয়ু বেশিদিন থাকবে না। উপরন্তু বিজু রায় যেখানে যাবেন তাঁর বিত্ত, তাঁর সামাজিক সুযোগ সুবিধাও যাবে সেইদিকে। তাঁর স্বামী আটান্ন ঊনষাট হতে পারে। দেখায় না। এরকম বয়সে যাকে বলে ভিন্ন মেয়ের চক্করে কি আর লোকে পড়ে না? পড়েই থাকে পুরুষরা।

বসাক ব্যস্ত হয়ে ঢুকে বলল— ‘আরে ও কী ভাবী তুমি এখানে! ওদিকে রায় তো এখনও এল না, শর্মাজি বলছেন মিনিস্টারের সঙ্গে তোমাকেই আলাপ করতে হবে। কাম অন, কুইক!’

খোলা আকাশের নীচে গার্ডেন চেয়ার পাতা রয়েছে। কাছাকাছি গাছ থেকে আলোর ছটা স্নিগ্ধ হয়ে পড়ছে। হাতে হাতে ঘুরছে গেলাস। এখানটাতেই সবচেয়ে মধু আছে মনে হচ্ছে। থিকথিকে লোক। সকলেই অবশ্য পরস্পরের মধ্যে ভদ্র দূরত্ব রেখে দাঁড়িয়ে রয়েছে। মিনিস্টার, প্রতিমন্ত্রী, ব্যুরোক্র্যাটরা এখানে। শর্মাজি, বসাক, পাইন এবং আরও কিছু ভীষণ মোটা, রাশভারী চেহারার শিল্পপতিকে ওখানেই দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলেন তনুশ্রী। মিসেস শর্মাই আপ্যায়ন করছিলেন এঁদের। তনুশ্রীকে দেখে তাড়াতাড়ি মিনিস্টারের সঙ্গে আলাপ করালেন। হঠাৎ তনুশ্রী দেখলেন মিনিস্টারের চোখ আটকে গেছে। মিসেস শর্মার ইঙ্গিতে তিনি মিনিস্টার আর তাঁর ডিরেক্টরের মাঝখানে বসলেন। মিনিস্টার তাঁকে তাঁর হবি-টবির কথা জিজ্ঞেস করছেন। তনুশ্রী জানাচ্ছেন উচ্চাঙ্গসঙ্গীত। হ্যাঁ হ্যাঁ কনফারেন্সে গিয়েছিলেন বই কি! আজকেরটাই শর্মাজির ছেলের জন্য স্যাক্রিফাইস করেছেন। কণ্ঠসঙ্গীতের মান নেমে গেছে মিনিস্টার তাঁর সঙ্গে একমত। মিনিস্টার বলছেন সে সব গান তাঁর শোনবার কথা নয়, যদি শোনাতে পারতেন। তনুশ্রী জানাচ্ছেন তিনি শুনেছেন খুব ছোটবেলা থেকেই তিনি উচ্চাঙ্গের ভক্ত। বাড়িতে ট্র্যাডিশন? ছিল বই কি! বাবা তো ভীষণ ভাল সেতার বাজাতেন। মা শ্যামাসঙ্গীত। না তিনি কোকিল বংশে কাক। উঁহুঃ, পিয়ানো বাজান। সে তেমন কিছু নয়। তনুশ্রী কথাবার্তার মাঝে মাঝে কিছু ফরাসি ঢুকিয়েছেন। মিনিস্টার স্বভাবতই সেগুলো বুঝতে পারেননি। কিন্তু বিস্মিত মুগ্ধ হয়েছেন। তাঁর ডিপার্টমেন্টের ডিরেক্টর নিজের স্ত্রীর সঙ্গে তাঁর আলাপ করিয়ে দেবেন বলছেন। ছোট্ট পার্টি, মিনিস্টার, তাঁর স্ত্রী। ডিরেক্টর, তাঁর স্ত্রী, তনুশ্রীরা হাজব্যান্ড-ওয়াইফ এবং শর্মারা। মিনিস্টার বললেন তাঁর স্ত্রী আসতে পারবেন কি না বলা যাচ্ছে না, কারণ তিনি সম্প্রতি গুরু নিয়ে ভীষণ মেতেছেন। গুরুদের সম্পর্কে তনুশ্রীর কী মত। তিনি গুরু করেছেন কি না জানতে চাইছেন মিনিস্টার, কৌতূহলের জন্য ক্ষমা চেয়ে। তনুশ্রী সামান্য একটু শ্রাগ করে গুরু সম্পর্কে তাঁর মত বোঝালেন। না গুরু তিনি করেননি। রামকৃষ্ণ কিংবা অরবিন্দ বেঁচে থাকলে করে ফেলতেন সন্দেহ নেই। সকলেই খুব তারিফের হাসি হাসল। এইভাবে নরম পানীয়র গ্লাস হাতে একবার এদিকে ঘাড় হেলিয়ে আর একবার ওদিকে ঘাড় হেলিয়ে বকতে বকতে তিনি সম্পূর্ণ ভুলে গিয়েছিলেন বিজু রায়ের জন্য উদ্বেগটা। ডিনারের জন্য এঁরা সবাই উঠতে শর্মাজি চোখের ইশারায় ডাকলেন, অভিনন্দন জানিয়ে বললেন, বিজু রয় ক্যান বি থ্যাঙ্কফুল যে তাঁর কাজটা তাঁর ওয়াইফই অর্ধেক করে দিয়েছেন। দুম করে কথাটা আবার মনে পড়ে গেল তনুশ্রীর।

—‘আচ্ছা, ও এখনও আসেনি?’

হতাশ গলায় শর্মা বললেন, ‘কই! দেখছি না তো!’

রাত সাড়ে নটা। তিনি বাড়িতে একটা ফোন করলেন।

—‘মা? তুমি কোথা থেকে বলছ?’

—‘শর্মাজির ছেলের বিয়ের পার্টি। তোমার বাবা জানে। তার আসা ভীষণ জরুরি ছিল। ইন ফ্যাক্ট আমি ভাবছিলাম এখানেই ও টার্ন আপ করবে।’

—‘বাবার দেখা নেই। অফিস থেকেও অনেকবার ফোন এসেছে। সাধনকাকা বলছেন খুব জরুরি সব সিদ্ধান্ত নেবার ছিল।’

—‘আশ্চর্য! তোমার দাদা কোথায়?’

—‘এইমাত্র ফিরল।’

—‘জানে?’

—‘সকালে বোধহয় প্রমীলাদির কাছ থেকে শুনে থাকবে। এখন আমাকে জিজ্ঞেস করছিল। মা তুমি তাড়াতাড়ি এসো, এবার আমাদের কিছু একটা ঠিক করতে হয়।’

ফোন ছেড়ে তনুশ্রী দেখলেন তাঁর শীত শীত করছে। দু চোখে উৎকণ্ঠা নিয়ে তিনি সুবেশ পুরুষ-সমুদ্রের মধ্যে আর একবার বিজু রায়কে খুঁজলেন। না, আসেনি। ডিনারে প্রায় কিছুই তেমন উপভোগ করতে পারলেন না। যদিও মিসেস শর্মা নিজে তাঁর সঙ্গে বসেছিলেন।

রাত এগারোটা নাগাদ অনেক কষ্টে মিনিস্টারের কবল ছাড়িয়ে বাড়ির পথ ধরতে পারলেন তনুশ্রী। বাইরে কিছু দূরে প্রচুর বিসদৃশ ময়লা জড়ো হয়েছে। বেশ কিছু ভিখারি বাচ্চা। সেই সঙ্গে ঘেয়ো কুকুর, তাড়ালেও যাচ্ছে না। আতিপাতি করে জঞ্জালের পাহাড় খুঁজছে।

বাড়িটা থমথম করছে। সর্বাঙ্গে আলো। রাত বারোটার কাছাকাছি এইরকম আলোময় বাড়ি, অথচ মনে হচ্ছে ভূতের বাড়ি। বারান্দায় মেয়েকে যেন বসা দেখতে পেলেন তনুশ্রী। দরজা খুলে দিল বদন। খুটখুট করে দোতলায় উঠতে উঠতে নিজের জুতোর শব্দে নিজেরই কেমন গা ছমছম করতে লাগল। পেছনে প্রমীলা আসছে। পার্লারে পৌঁছে দেখলেন তিতি এসে বসে আছে। চিন্টুর ঘর থেকে মৃদু স্বরে রক মিউজিক আসছে ভেসে। চিন্টুও এসে দাঁড়াল। ছেলেকে বোধহয় দেড়দিন পর দেখছেন। এত ঘুমিয়েছে যে মুখচোখ কী রকম অস্বাভাবিক ফুলে গেছে। থমথমে মতন হয়ে রয়েছে মুখটা।

তনুশ্রী বসতে তিতি বলল, ‘সমরদাকে ডাকতে পাঠিয়েছি।’

চিন্টু তার দরজার সামনে দাঁড়িয়েছিল। অপ্রাসঙ্গিকভাবে তনুশ্রী বললেন, ‘খেয়েছ তোমরা?’

—‘হ্যাঁ’ তিতি জবাব দিল।

তনুশ্রী বললেন, ‘চিন্টু কাল রাতে ফেরোনি কেন? কোথায় ছিলে?’

—‘সেইটা কি খুব জরুরি? এখন এই সিচুয়েশনে?’ চিন্টুর গলায় যথাসম্ভব বিরক্তি।

—‘হ্যাঁ জরুরি। একজন কাল রাতে বা আজ ভোরে কাউকে না বলে কোথাও গেছেন, ফিরছেন না। এটা তোমার ক্ষেত্রেও হতে পারত। কী করতাম আমরা?’

—‘চিন্টু বলল, যদি নিয়ে কথা হচ্ছে না। আমি ফিরেছি। বস ফিরছে না। বস ফিরছে না বলে কি আমার ওপর রিভেঞ্জ নেবে না কি?’ সে ঘরের মধ্যে ঢুকে গেল।

সমর এসে গেছে। বলল, ‘কোনও খবর পাওয়া গেল সাহেবের?’

—‘সেটা তো আমরাও তোমায় জিজ্ঞেস করতে পারি’, তনুশ্রী বললেন।

তনুশ্রীর বলার ভঙ্গিতে একটু থতমত খেয়ে গিয়েছিল সমর। সে বলল, ‘আমি তো সকাল নটা চল্লিশে যেমন আসি এসে গেছি। নীচে অপেক্ষা করছি। বারোটা বাজল দেখে বদনকে জিজ্ঞেস করলুম তো বলল সাহেব আগেই চলে গেছেন। গাড়ি নিয়ে আমি অফিসে গিয়ে বসে আছি তখন থেকে। চ্যাটার্জিসাবের অফিস থেকে একটা প্যাকেট আনতে বলে রেখেছিলেন কালকে। সেটা এনে আবার অফিসে। বিশ্বেসবাবু বারবার আমাকে জিজ্ঞেস করছিলেন আমি কিছু বলতে পারিনি।’ তনুশ্রী বললেন, ‘প্যাকেট? কী প্যাকেট?’

—‘আছে গাড়িতে। দেখবেন?’ কিছু একটা করতে পেরে সমর যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল।

একটু পরে প্যাকেটটা এনে দিতে তাড়াতাড়ি সেটা খুললেন তনুশ্রী। চিন্টু আবার ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছে। প্যাকেটের মধ্যে একটা ওয়াইনের বোতল দমপেরিওঁ, সাতশো পঞ্চাশ মিলিলিটারের। একটা শ্যানেল নং ফাইভ সঙ্গে। প্রচুর কুচো কাগজ দিয়ে প্যাক করা জিনিসগুলো।

তিতি মায়ের মুখের দিকে তাকাল। মেকাপের তলায় ফ্যাকাশে দেখাচ্ছে তনুশ্রীর মুখ। সে প্রমীলার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘রাতে বাবা খাওয়া ছেড়ে উঠে গেল, তারপর কী হল? কোথায় গেল? বলো তো ভাল করে।’

—‘তেতলায় উঠে গেলেন।’

—‘তেতলায়? আগে বলোনি তো!’ তনুশ্রী বললেন।

—‘সারারাত তেতলাতেই ছিল?’ তিতি বলল।

—‘তা আমি কী করে জানব? চিন্টুদাদার জন্যে আরও খানিক সবুর করে আমি নীচে শুতে চলে গেছি। যতক্ষণ ছিলুম ওপরে খুটখাট আওয়াজ শুনেছি। এখন বুঝতে পারছি খুব রেগে গেসলেন রাত্তিরে। ঘরে ঘরে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন। আমি তো ভয়ে মরি।’

চিন্টু বলল, ‘আচ্ছা আচ্ছা তুমি এবার যাও। তোমরা যাও বদন, সমর যাও।’

যাবার ইচ্ছে ছিল না কারুরই। কিন্তু আদেশ জারি হয়ে গেছে। আর থাকা চলে না। অনিচ্ছুকভাবে চলে গেল তিনজনে।

চিন্টু বলল, ‘ইটস ডেফিনিটলি আ কেস অব কিডন্যাপিং।’

তনুশ্রী ফ্যাকাশে মুখে বললেন, ‘কী করে জানলে?’

—‘বুঝতে পারছ না? একটা হিউজ অ্যামাউন্ট ক্যাশ চেয়েছিল বসের থেকে, বস সেটা দিতে চায়নি। লাইফ-রিস্ক নিয়েছে। আমাদের একটা হিন্ট দেবার কথা ভেবেছিল। কাউকে বাড়িতে পায়নি। তাই রেগে গেছিল। তেতলায় সেফটির জন্যেই উঠেছিল। এখন গ্যাঙের লোকেরা আগে থেকে সেখানে ছিল কি না। বসকে ক্লোরোফর্ম করে, শেষ রাতের দিকে বিরজু ঘুমোলে নিয়ে গেছে কি না কে বলবে। হয়ত শিগগিরই আমাদের কাছে র‍্যানসম চেয়ে চিঠি আসবে।’

তিতি আর থাকতে পারল না, বলল, ‘এই ফোর্থ ক্লাস থ্রিলারটাই কি একটু আগে চিত হয়ে পড়ছিলি?’

চিন্টু বলল, ‘ফোর্থ ক্লাস থ্রিলার? দিস ইজ হোয়াটস হ্যাপনিং অ্যারাউন্ড। পেপার পড়িস? আর তা নয়ত বি. বি. রায়ের মতো একটা টু হানড্রেড পার্সেন্ট সলভেন্ট লোক উইথ সো মেনি আয়রন্‌স্‌ ইন দা ফায়ার, হঠাৎ ওয়ান ফাইন মর্নিং গেটস আপ অ্যান্ড ডিসাইডস হি উড ওয়াক আউট? কোনও সেন্স আছে এ গল্পটার? তিতি বলল, ‘কে বলতে পারে বাবার মনের মধ্যে কী ছিল?’ বলেই সে হঠাৎ একটা ধাক্কা খেয়ে বুঝতে পারল তার মুখ থেকে একটা ভীষণ সত্যি কথা বেরিয়ে গেছে। সে আস্তে আস্তে বলল, ‘আমরা কেউই বোধহয় জানি না, বাবা…বাবা কী ভাবত, কী ছিল বাবার মনের মধ্যে। আচ্ছা মা, তুমি বলতে পার বাবার স্পিরিচুয়াল লীনিংস ছিল কি না!’

তনুশ্রীর মনে পড়ল লালাবাবু বলে কে একজন হঠাৎ সংসার ত্যাগ করে বেরিয়ে যান। একটা এই জাতীয় পদ্য পড়েছিলেন কোনও সময়ে। কিন্তু স্পিরিচুয়াল লীনিংস বিজু রায়ের! মাস কয়েক আগে একজন বাবা এসেছিলেন এদিকে। দলে দলে লোক তাঁকে দেখতে, তাঁর কীর্তন শুনতে যাচ্ছিল। তনুশ্রীদের দলের অনেকেই যায়। তনুশ্রী বিজুকে বলেছিলেন দুজনে যাবার কথা। বিজু রায় বলেন, ‘বাবা ফাবা ওসব বুজরুকের জন্যে আমার সময় নেই। তোমার ইচ্ছে হলে তুমি যাও না, কে বারণ করেছে! তবে মজে যেয়ো না, এসব বাবারা ডেঞ্জারাস হয়।’

তনুশ্রী বললেন, ‘না।’

—‘কিন্তু মা, ঠাম্মা কীরকম রিলিজিয়াস ছিল, বাবা তো ঠাম্মার সঙ্গে রোজ নিয়ম করে খানিকটা সময় কাটাত। কী করত তখন? তাছাড়া একটা কথা আমাদের মনে হয়নি, ঠাম্মা মারা গেছে অক্টোবর মাসে আর এটা ডিসেম্বর।’

—‘তো কী?’ চিন্টু বলে উঠল, ‘সেঞ্চুরি করতে আর কটা বছর বাকি ছিল ঠাম্মার? মারা যাবে না তো কি চিরদিন বসে থাকবে?’

তনুশ্রী বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘তুমি থামো। তোমার ঠাম্মাকে তোমার বাবা ভীষণ ভালবাসত। তিতি ঠিকই বলেছে।’

—‘বস ভালবাসত? ঠাম্মাকে? কী করে বুঝলে?’ ঠাট্টার হাসি চিন্টুর গলায়। ‘হি ওয়াজ আ মানি-স্পিনিং মেশিন। কীভাবে আরও টাকা, আরও আরও কামানো যায় সব সময়ে তাই-ই ভাবত। অ্যান্ড হি ওয়াজ মেড আপ অব ডিউটিজ, ফর্ম্যালিটিজ। রোজ বাঁধা আধ ঘণ্টা সময় দিত ঠাম্মাকে। ছোটতে মনে আছে কী একটা বানাচ্ছিলাম, মাঝে মাঝে হেলপ করছিল। হঠাৎ ঘড়ি দেখে উঠে পড়ল। আমি বললাম কোথায় যাচ্ছ ড্যাড, বোসো না! বলল, ‘তোমার জন্য নির্দিষ্ট সময় ছিল পঁয়তাল্লিশ মিনিট, পার হয়ে গেছে মাই বয়।’ উঠে পড়ল। এক সেকেন্ডও দাঁড়াল না। হুঁঃ!’

তিতি বলল, ‘মা একবার ওপরে গেলে হয় না?’

তনুশ্রী উঠে পড়ে বললেন, ‘চলো। চিন্টু তুমিও চলো। ওদের কাউকে ডাকব? বিরজু, সমর?’

‘তুমি কি এখনও দাদার গল্পটার ঘোরে রয়েছ?’ তিতি জিজ্ঞেস করল।

ঘরে ঢুকতেই শাশুড়ির নতুন করা ফটোগ্রাফটা যেন সকৌতুকে তাকাল তনুশ্রীর দিকে। এটা অনেক আগেকার ছবি। এই বাড়িতে নতুন আসার পর তোলানো বোধহয়। তারপর থেকে আর ফটো তোলবার কোনও সুযোগ হয়নি। তনুশ্রীর সব কিছু মেনে নিতে পারতেন না ভদ্রমহিলা। একটু টিকটিক করতেন। বিরক্তিকর। কিন্তু কোনও দিন জোর করে কিছু চাপাননি। বা খুব অশান্তি টশান্তি করেননি। ক্রমশ ক্রমশ ওপরে বন্দী হয়ে গেলেন, আর নীচে নামতেন না। ওপরে যাবার সময়ে পেড়ে শাড়ি পরে, মাথায় ভাল করে সিঁদুর দিয়ে, হাতে লোহা গলিয়ে যেতে হত। শখের গয়না পরলে বলতেন—‘কেন বউমা, বিজু যে তোমায় সবসময়ে ব্যবহারের জন্যে পাঁচ ভরির মটরমালা গড়িয়ে দিল? গলায় ও সব পুঁতি টুতি পরেছ কেন? এয়োস্ত্রী মানুষকে কি ওসব মানায়?’ আস্তে আস্তে নিয়ম করে ওপরে যাবার অভ্যাস চলে গেল তনুশ্রীর। উনি কিছু বলতেন না। তিন চার দিন পরে পরে হয়ত একবার ওপরে যাবার সময় হল, মন হল। চুল কেটে ফেলার পর, ভাল করে ঘোমটা দিয়ে যেতেন। প্রথম প্রথম বুঝতে পারেননি। একদিন দমকা হাওয়ায় অসাবধানে ঘোমটা খসে যেতে অনেকক্ষণ চেয়ে ছিলেন। চুলের দিকে। কিছু বলেননি।

ছাতের দিক থেকে দমকে দমকে ফুলের মিশ্র গন্ধ ঢুকতে লাগল। চিন্টু ছোটবেলায় ঠিক যে মাত্রায় ঠাম্মা ভক্ত ছিল বড় হতে হতে ঠিক সেই মাত্রায় উদাসীন হয়ে গিয়েছিল। খালি উপদেশ দেবে, নাতি বড় হয়ে গেছে বুঝতে চাইবে না। ও মেয়েটা কে দাদু? তোমার সঙ্গে বাড়ি ঢুকল! তোমার বন্ধু! বাবা-মা জানে? দুপুরে তো বাবা-মা কেউ ছিল না! কেউ না থাকলে মেয়ে-বন্ধু বাড়ি এনো না! একদিন চিন্টু রেগে বলেছিল, ‘আমার ঘরে তোমায় পাঁজাকোলা করে নিয়ে যাব নাকি? দেখে ফ্ল্যাট হয়ে যাবে।’

—‘ফ্ল্যাট হয়ে যাবার মতন আবার কী রেখেছ ঘরে?’

—‘সে গেলেই দেখতে পাবে!’

—‘তোমার বাবা-মা দেখেছে তো? তাহলেই হল। আমার আর দেখে কাজ নেই।’

—‘ওল্ড হ্যাগ’—মনে মনে বলত চিন্টু।

এ ঘরে নিচু খাট ঢোকাতে চেয়েছিলেন বিজু। মা রাজি হননি। তাঁর পুরনো পালঙ্ক সুজনি ঢাকা পড়ে আছে। আলমারিতে চাবি নেই। তিতি একটু হাত দিতেই খুলে গেল। পুরনো দিনের পেল্লাই আলমারি।

তিতি বলল, ‘মা এটা কিন্তু খোলা।’

তনুশ্রী বললেন, ‘কী হাতি ঘোড়া থাকবে ওর মধ্যে?’ তাঁর অধৈর্য লাগছে। কোনও কাজের কাজ হচ্ছে না, এরা শুধু ছেলেমানুষি করছে। আলমারির দুটো তাক ভর্তি ঠাম্মার জামাকাপড়। আর একটাতে ঠাসা গরম জামা। ঠাম্মা খুব শীতকাতুরে ছিল। ড্রয়ারগুলো টেনে টেনে দেখছে তিতি।

—‘মা এ চাবিটা কী?’

—‘সিন্দুকের চাবি,’ ক্লান্তভাবে বলে শাশুড়ির বিছানায় ধুপ করে বসে পড়লেন তনুশ্রী।

—‘সিন্দুক! খোল তিতি!’ চিন্টু উত্তেজিতভাবে বলে উঠল।

কয়েকবার চেষ্টার পর তিতি খুলে ফেলল সিন্দুকটা। দুটো তাক। ওপর নিচ একদম খালি।

‘চিন্টু বলল, ‘মা। হিয়ার অ্যাট লাস্ট ইজ সাম ক্লু।’

তনুশ্রী সিন্দুকের শূন্য গহ্বরটা দেখছিলেন। বললেন, ‘কী থাকবে ওর মধ্যে? কিছু ছিল না।’

ফাঁকা সিন্দুক এভাবে কেউ চাবি দিয়ে রাখে না। বাবা নিশ্চয় এর মধ্যে আনডিক্লেয়ার্ড মানি, সোনার বিস্কিট ফিস্কিট রাখত।’

তিতি বলল, ‘মা, ওদিকে একটা সুটকেস ছিল। নেই।’

‘—কী সুটকেস?’ তনুশ্রী বললেন।

—‘একটা ডাকব্যাকের সুটকেস। আমার ছিল ওটা। ঠাম্মার ঘরে রেখে দিয়েছিলাম।’

—‘বুঝতে পারছ এতক্ষণে যা বলেছি ঠিক বলেছি কি না?’ চিন্টু বলল, ‘বাবা সিন্দুক থেকে সমস্ত টাকা বার করে ওই সুটকেসটাতে ভরেছে, তারপর গ্যাঙের নির্দেশমতো দিতে গেছে। ওরা বাবাকে ধরে নিয়ে যায়নি। বাবাই ওদের টাকাটা দিতে গেছে।’

তনুশ্রী বললেন, ‘বারবার এক কথা বোলো না। ওই সিন্দুকে ওসব কিছু থাকত না। তোমার বাবা অত কাঁচা কাজ করবার লোক নয়।’

—‘কিন্তু সুটকেসটা ছিল, এখন নেই মা,’ তিতি বলল।

—‘এর থেকে প্রমাণ হয় সুটকেসটা তোমার বাবা নিয়ে গেছে। যেখানেই গিয়ে থাক। আর কিছু না।’

চিন্টু বলল, ‘বাবার কি ভাল লাগেজ নেই, যে একটা পুরনো ব্যাগ ওভাবে নিয়ে যাবে? আসলে এটা হালকা, নোট ভরার পর শুধু কাগজের ওয়েটটা বাড়বে তাই…।’

তিতি বলল, ‘যাই হয়ে থাক, এবার আমাদের পুলিশে খবর দিতে হয়।’

—‘না, না’ তনুশ্রী বলে উঠলেন, ‘পুলিশ কেন? একটা বিশ্রী স্ক্যান্ডাল হবে। ওয়েট করো। দেখো কালকেই হয়ত এসে পড়বে।’

এত ক্লান্ত তবু বিছানায় শুয়ে একফোঁটাও ঘুম এল না তনুশ্রীর। তিনি প্রায় নিঃসন্দেহ হয়ে গেছেন। বিজু রায় দুটো তিনটে সূত্র ফেলে গেছেন। তিনি যে স্বেচ্ছায় বাড়ি থেকে চলে গেছেন এটা বোঝাই যাচ্ছে। ওপরে হালকা সুটকেসটা নেই। নীচে বিজু রায়ের ঘরে একটা মাঝারি সুটকেসে সব সময়ে কিছু জামাকাপড় গোছানো থাকত, সেটাও নেই। বেরিয়েছেন একটা চাপে পড়ে। মহিলাটি চাপ দিচ্ছিল। বিজু আরও অনেক পুরুষের মতোই হয়ত যেভাবে দীর্ঘদিন দু নৌকোয় পা দিয়ে চলছিলেন সেভাবেই চলতে চাইছিলেন। কিন্তু মহিলাটি তা হতে দেবে কেন? মায়ের মৃত্যুর পর থেকে ক্রমাগত চাপ দিয়ে চলেছে। বিজু রায় হয়ত কাল রাতে তাঁকে বলে একটা ফয়সালা করতে চেয়েছিলেন। সেটা সম্ভব নয় দেখে আপাতত যা হাতের কাছে পেয়েছেন, নিয়ে চলে গেছেন। এখন একটা হনিমুন পর্ব চলবে। চিঠি-পত্র, কোর্ট-কেস এসব পরে। কিছুদিন পরে। ওই দমপেরিওঁ আর শ্যানেল নং ফাইভ বিজুকে ধরিয়ে দিয়েছে। শ্যাম্পেনটা যদি একা হত আলাদা কথা ছিল কিন্তু তার সঙ্গে পারফ্যুম মিলে বুঝিয়ে দিয়েছে উপহারটা কেমন মানুষের প্রতি উদ্দিষ্ট। বয় কাট, লম্বা ফিনফিনে, সিগারেট খায়, মদও যেমন খায়। জিনস পরা, শীতে হয়ত একটা পুরুষদের পোলো নেক সোয়েটার পরে। কানে বড় বড় রিং। আঙুলে মস্ত পাথর। খুব সম্ভব বিজুরই দেওয়া। মুখটা খালি তিনি দেখতে পাচ্ছেন না। দেখতে পাচ্ছেন নিজের মুখ আয়নায়। কখন উঠে বসেছেন, রাত-আলোর ভুতুড়ে আভার আয়নার সামনে টুলে এসে বসেছেন নিজেই জানেন না। ভাল করে মেকাপ তোলা হয়নি আজ। গ্রে রঙের ওপর গোলাপি লেস দেওয়া রাত জামার ওপর থেকে ঝাঁকড়া চুলঅলা মাথাটা ভেসে আছে এবং মুখের ওপর জলের দাগ। চোখের জল।

তেইশ বছরের মতো হল না তাদের বিবাহিত জীবন? আর দু বছর বাদেই রজত জয়ন্তী। শর্মাজি, বসাক, পাইন সকলেই বলে রেখেছে পার্টির কথা রায় দম্পতিকে ভাবতে হবে না। ওরাই সব ব্যবস্থা করবে। দুলিচাঁদ বলেছিল তরল জিনিসের খরচ ওর। তেইশ বছর একসঙ্গে বাস করে তনুশ্রী বিজু রায়ের এই গোপন জীবনের সংবাদ জানে না। কবে থেকে আরম্ভ হয়েছিল এটা? তনুশ্রীর ভেতরটা শিউরে উঠল ভেবে সে বোধ হয় একেবারে নির্দিষ্ট একটা দিন দেখতে পাচ্ছে।

এই বাড়ির গৃহপ্রবেশ আর তনুশ্রীর বিয়ে ঠিক সাতদিনের আড়াআড়ি হয়েছিল। ঝকঝকে নতুন প্রাসাদ। দামি আসবাব, লোকজন, অষ্টমঙ্গলায় ঘুরে এসে এইরকমটাই দেখেছিল তনুশ্রী। খালি পাশাপাশি দুটো আলাদা ঘর দেখে সে ভুরু কুঁচকেছিল, দাঁত দিয়ে তলার ঠোঁটটা কামড়ে ধরেছিল। বিজু বললেন, ‘কী? পছন্দ হল? ঘর?’

স্ত্রী জবাব দিচ্ছে না দেখে মুখটা ভাল করে দেখতে দেখতে বিজু বললেন, কী হল? কান্না কান্নাভাব দেখছি যেন!’

—‘আমার সঙ্গ এর মধ্যেই ভাল লাগছে না?’

—‘সে কী? কেন?’

—‘আলাদা ঘর এখন থেকেই?’

—‘ওঃ হো!’ হেসে উঠেছিলেন বিজু। মাঝখানের দরজাটা খুলে দিয়ে বলেছিলেন, ‘এই তো একটা ঘর হয়ে গেল। গেল না? দুজনেরই প্রাইভেসি রইল। আবার… তা ছাড়া এটাই চলে। আমাদের সোসাইটিতে এরকমই হয়।’

সত্যিই পরে তনুশ্রী দেখেছে বসাকদের, শর্মাদের সবারই স্বামী-স্ত্রীর ঘর আলাদা। ব্যাপারটা নিয়ে শাশুড়িরও কম আপত্তি ছিল না। ঠারে-ঠোরে নানান কথা জানতে চাইতেন। অবশেষে কয়েক মাসের মধ্যেই চিন্টু পেটে আসতে নিশ্চিন্ত হয়ে বলেছিলেন, ‘হ্যাঁ বাপু, যতই হ্যাট কোট পরে বেড়াক, ছোট খোকা বেশি বয়সে থিতু হল। যত তাড়াতাড়ি ছেলেপিলে হয় ততই ভাল। মানুষ করতে হবে তো?’

এই উচ্চকোটির প্রাইভেসি। এই জিনিসটা অতিশয় সন্দেহজনক। সারাদিনই তো কাজের ঘোরে আলাদা আলাদা ঘুরছ। রাত্রেও স্ত্রীর সঙ্গে খোলামেলা হতে পারো না? অবশ্য, সত্যি কথা বলতে কি তনুশ্রীর নিজের তাতে সুবিধেই হয়েছে। তার অনেক রকম নার্সিসীয় পাগলামি আছে। কোনওদিন নিজের পা, কোনওদিন হাতের আঙুল, কোনওদিন পেট এসব দেখতে দেখতে তন্ময় হয়ে যায় তনুশ্রী। আরে আঙুলগুলো একটু থ্যাবড়া থ্যাবড়া লাগছে কেন আজ? ইস্‌স্‌ কী সমান পেট, কেউ বলবে দুই সন্তানের মা তনুশ্রী! পায়ের সৌন্দর্য এ জীবনে আর কাউকে দেখানো যাবে না। সেই হনিমুনে আন্দামান আইল্যান্ডস-এ বিজু রায় দেখেছিলেন। তারপরে আর…। অথচ এই তিতি তিতির বন্ধুরা কেমন স্বচ্ছন্দে পা দেখিয়ে দেখিয়ে বিচরণ করছে! এ ছাড়াও একলা ঘরের হাওয়ায় ভাবনাগুলোকে যত সহজে রঙিন বেলুন করে দেওয়া যায়, পাশে আর একজন ভোঁস ভোঁস করে ঘুমোলে সেটা করা যায় কি? কত রকমের বর্ণালি, স্বপ্ন, তার ঘোরে তনুশ্রী আপনমনে হাসে, ভ্রূকুটি করে, কথা বলে—সে সব কি অপরের কানে শোনবার? না, দেখবার? তেইশ বছরের বিবাহিত জীবন একটা লম্বা আনন্দের দিন। বিজুর এজন্য ধন্যবাদ প্রাপ্য। এই আমোদের উপকরণ সে জুগিয়ে গেছে অকাতরে। কিন্তু নিজে? নিজে যেন থেকে গেছে বাইরের মহলেই। বরাবর। লোকটা মনে-প্রাণে কাজ-পাগল ছিল। কিন্তু যা কিছু করণীয় সেগুলো ঘড়ির কাঁটার মতো নির্ভুলভাবে করে গেছে। চিন্টু বলছিল ডিউটিজ-এর কথা। নাকি পঁয়তাল্লিশ মিনিটের বেশি সময় তাকে দিতে পারেনি। ওইটুকুই তার জন্য নির্ধারিত ছিল। তনুশ্রী নিজেও অনেক সভাসমিতি করে। সে বোঝে চূড়ান্ত রকমের অর্গানাইজড ছিল লোকটা, ব্যবস্থিত। না হলে ওইভাবে উন্নতি করা যায় না। আর সব সময়ে ঠাণ্ডা, কু-ল। কিন্তু কাজের বাইরে বিজু রায়ের অন্য একটা জীবন ছিল না সে কথা এখন গ্যারান্টি দিয়ে বলা যাচ্ছে না। তনুশ্রীর সঙ্গে তেইশ বছরের সম্পর্কে বিজু রায়কে সে কখনও উত্তাল-উদ্দাম হতে দেখেনি। সেই প্রথম ক সপ্তাহ ছাড়া। অথচ সে তনুশ্রী বিজু রায়ের থেকে যোল বছরের ছোট, বলতে গেলে স্বামীর তুলনায় তরুণী। আরও তরুণী, আকর্ষক রেখেছে সে নিজেকে। কিন্তু…। বিজু রায় কেন যেন কোনওদিনই তেমন আকৃষ্ট হলেন না। মাঝের দরজাটা রাতে খুলে যাওয়া বন্ধ হয়েছে সম্ভবত বছর তিনেক। তার আগে কমছিল। কিন্তু একদম বন্ধ বছর তিনেক। তনুশ্রী বেঁচেই গিয়েছিল। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে এই তিন কি বড় জোর চার বছরই হল বিজু রায়ের জীবনে নতুন নারীর, নতুন গল্পের আয়ু।

গলাটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে তনুশ্রীর। সে উঠে বসে জল খেল ঢকঢক করে অনেকটা। কান জ্বালা করছে। হাতের পাতা জ্বালা করছে। তনুশ্রী টয়লেটে গিয়ে হাতে কানে জল দিয়ে এল। কেচ্ছা! স্ক্যান্ডাল! যে স্ক্যান্ডালের কথা আজকেই আলোচনা হচ্ছিল সেই স্ক্যান্ডাল এখন তনুশ্রীর নিজের ঘরে। কে ভেবেছিল স্ক্যান্ডাল শুধু ফ্যাশানেবল মোটেই নয়, বরং জ্বালায়! তনুশ্রীর চোখ দিয়ে এত জল পড়ছে কেন? এটা যদি কোর্টে ওঠে, তনুশ্রী কিছুতেই বিজু রায়কে ডিভোর্স দেবে না। কিছুতেই না। সব কিছুই তার পক্ষে। ছেলে, মেয়ে, বন্ধুবান্ধব, সোসাইটি। লড়ুক না কেন বি. বি. রায়। যত পারে লড়ুক। ডিভোর্স হলেও কী পরিমাণ অ্যালিমনি বিজু রায়কে দিতে হবে তা তার কল্পনার বাইরে। স্থাবর সম্পত্তির মধ্যে এই বাড়ি এবং অস্থাবরের মধ্যে লিকুইড ক্যাশ সমস্ত নিয়ে নেবে তনুশ্রী। সমস্ত। কিন্তু তারপর? তাতেও হবে তো! সন্তুষ্ট হতে পারবে? না। কক্ষনো না। স্বয়ং বিজু রায়কেই চাই। এই বাড়িতে তার অভ্যস্ত চলাফেরার চেনা শব্দ। একত্রে পার্টিতে যাওয়া। বাড়িতে কোনও উৎসব হলে একটু আধটুও আলোচনা। এটুকুই। এটুকু চলে গেলে তনুশ্রীর জীবনের ভিত ধসে যাবে। সে তখন আর কোনও অত্যাচারিত মহিলা সমিতির প্রেসিডেন্ট নয়। একজন সাধারণ পরিত্যক্ত গৃহবধু। সে কারওর জীবন সম্পর্কে সভা বসিয়ে সবার মতামত নিচ্ছে না। তার জীবন নিয়েই সভাটা বসেছে। প্রেসিডেন্টের আসন খালি। প্রেসিডেন্ট মিসেস তনুশ্রী রায়, ডিভোর্সড হতে যাচ্ছেন, পরিত্যক্ত, ন্যাচারেলি তাঁর স্বামীর দ্বারা। কেন? দুজনের মতান্তর? মনান্তর? বিজু রায় বাঘের মতো নাক ডাকেন? বা শারীরিক অত্যাচার করেন মদ খেয়ে যা আর সত্য করা যায় না বলে মিসেস তনুশ্রী রায় ডিভোর্স নিতে বাধ্য হচ্ছেন? না, তা নয়। চুপ চুপ। ফিসফিস। বিজু রায়, বি. বি. রায় দা গ্রেট ইজ অ্যাট লং লাস্ট ইন লভ উইথ আ গার্ল, লেডি, উওম্যান? কে। কে সে? অবশেষে। বেচারা বিজু রায়। স্ত্রীটি তো সাজানো পুতুল। হৃদয় মন বলে কিছু ছিল না। স্বার্থপর, আত্মকেন্দ্রিক। চার বছর ধরে অ্যাফেয়ার চলছে, জানত না পর্যন্ত, এত বোকা? না, না, শি ডাজন’ট কেয়ার। তা ছাড়া ওর নিজের নেই? একটা ছেড়ে, দশটা…।

কিছুদিন হল বসাক আর পাইনকে বড্ড প্রশ্রয় দেওয়া হয়ে গেছে। মিউজিক কনফারেন্স, থিয়েটারে, ফিলম ফেস্টিভ্যালে যেতে হলে, যেতে হয়ই, এ ছাড়া উপায়ও নেই। কেন না বিজু যাবেন না। বিজুর অত সময় নেই। বসাক পাইনের এসব ঝোঁক আছে। ওরা যায়। ওদের স্ত্রীদের নেই। বিজু রায়ের নেই। কাজেই এই জাতীয় জুটি। এসব বিজু জানেন। কোনও ব্যাপারই নয়। কিন্তু ইদানীং এটা শুধু গান-পাগলামি বা থিয়েটার-ফিলমের ঝোঁকের মধ্যে নেই। বসাক আর পাইনের মধ্যে তাঁকে নিয়ে একটা সূক্ষ্ম দ্বন্দ্বযুদ্ধ হয়ে যাচ্ছে। এটা তিনি ঘটতে দিয়েছেন। ফ্লার্ট করতে বরাবরই ভাল পারে তনুশ্রী। সেই স্কুলের ফ্রক পরার বয়স থেকে। এ একটা নেশা। এখনও এ নেশার জের কাটাতে পারে না তনুশ্রী। বিশেষ করে শাশুড়ি মারা যাবার পর বোধহয় একটু বেশি রকমের বেহিসেবি হয়ে পড়েছে। কিন্তু সবটাই বিজু রায়, তার স্বামী পেছনে আছে বলে, একটা শক্ত মাটি পায়ের তলায়, মাথার ওপর একটা দৃঢ় ছায়া। আশ্রয়। বিজু কি কিছু টের পেলেন? কানাঘুসো? তাঁদের সোসাইটি অত ঠুনকো নয় যে দু এক দিন তনুশ্রী রায়কে বসাক বা পাইনের সঙ্গে দেখলে একেবারে মুচ্ছো যাবে। রাজেশ পাইনের সঙ্গে দু দিন সুন্দরবন ট্যুর করে এলেন কদিন আগে। বিজু রায়কে বলেই যাওয়া। তবে একা রাজেশ যাচ্ছে এটা খুলে বলা হয়নি। একেবারে লাস্ট মিনিটে টিকিট করা, তাদের লঞ্চে কেবিন পাওয়া গেল না। সজনেখালি ট্যুরিস্ট লজে রাত কাটাবার জন্যে নামিয়ে দিল। এক বিঘত করে ঘর। টেকা যায় না এত ছোট। সাদা ফুলের মতো বিদেশি নাইটির ওপর কালো শাল জড়িয়ে অতএব তনুশ্রী বেরিয়ে এল বাইরের কাঠের বারান্দায়। ইলেকট্রিক আলো নেই। দরজার সামনে একটা করে হারিকেন-লণ্ঠন বসানো। কী অদ্ভুত ঝকঝকে একটা জড়োয়া সেটের মতো আকাশ! আর তাতে জমকালো পোশাক পরা মানুষের মতো সব নক্ষত্র। যেন জীবন্ত জোড়া জোড়া চোখ তাকিয়ে আছে, তোমার দিকে, বলছে গল্প কর। বেরিয়ে এস। দেখ। দেখাও। তখন আর নিজেকে সীমাবদ্ধ মানুষী বলে মনে হয় না। রাজেশ যখন সেই নির্জন রাতের বারান্দায় চারদিকে সুন্দরবন, জল, আর মাথার ওপর জ্যান্ত আকাশের তলায় তাকে অর্কিডের গুচ্ছের মতো জড়িয়ে ধরল, যখন তারপর দুজনে দুজনের শরীরের স্বাদ নিতে নিতে বাঘ আর বাঘিনী হয়ে গিয়েছিল, তখন কোনও অপরাধবোধ তো হয়ইনি, বরং মনে হয়েছিল এতদিনে এই প্রথম জানল কী ছিল ভেতরে, কী প্রবল আবেগ, কী শক্তি। রাজেশ তনুশ্রীর চেয়ে কয়েক বছরের ছোটই হবে। বলেছিল, ‘আই অ্যাম ফিলিং লাইক আই ওয়াজ আ ভার্জিন বিফোর দিস।’ সেই এক অনুভূতি তনুশ্রীরও। কিন্তু সে অনেক সতর্ক, সাবধান। রাজেশ পরে যতই এখানে সেখানে যাবার প্রস্তাব দিক। কর্ণপাত করেনি। ঠিকসময় সঠিক সুযোগের অপেক্ষায় আছে। তনুশ্রী অত সস্তা না। সিংহেরা সিংহীরা না বারো বছরে একবার? ইতিমধ্যে বসাক তাদের দুজনের মধ্যে একটা গোপন বৈদ্যুতিক আঁতাতের আঁচ পায়। ও-ও তো তালে আছে। কিন্তু ওই আঁচ পাওয়া পর্যন্তই। প্রমাণ কিছু নেই। কিছু নেই কি? পুলিসি তদন্ত হলে, প্যাসেঞ্জার লিস্টে দেখা যাবে না রাজেশ পাইন আর তনুশ্রী রায়? কোনও মিসেস পাইন নেই! আচ্ছা রাজেশই তো বুক করেছিল ঠিকঠাক পাইন আর রায় নামেই বুক করেছিল তো? তার জানবার কথা নয়। সর্বনাশ! জনা পঞ্চাশেক লোক ছিল লঞ্চে। এ সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। যদিও তার চোখে ছিল প্রায় মুখ-ঢাকা গগ্‌লস্! চুল সেট করানো ছিল এমনভাবে যে মুখের অর্ধেকটা প্রায় ঢাকা। জিনস আর শার্ট পরেছিল। দুটি বেলজিয়ান ছেলে ছিল। ভ্যাগাবন্ডের মতো দেখতে, রং জ্বলা তাপ্পি দেওয়া শর্টস পরা, তলায় সুতো ঝুলছে, আসলে য়ুনিভার্সিটির ছাত্র কিন্তু, ভারত দর্শনে বেরিয়েছে। ওদের সঙ্গেই এক টেবিলে বসে লাঞ্চ খেয়েছে। কথা বলেছে। আর একজন ছিল এক দিল্লিওয়ালা বুড়ো! মজবুত গাঁট্টাগোট্টা বুড়ো অবশ্য। সে বাঘের পাগ-মার্ক, আর হরিণের খুরের গর্ত দেখিয়েছিল নেতি ধোপানিতে। এর সঙ্গেও অনেক সময় কাটানো হয়েছে। লঞ্চের কেউ তাকে আদৌ বাঙালি বলে বুঝতে পেরেছে কি না সন্দেহ। অন্যান্য যাত্রীরা বেশির ভাগই ফ্যামিলি নিয়ে এসেছে। মিনিটে মিনিটে বাচ্চাদের পোশাক বদলাচ্ছে, মেয়েরা নিজেদের কার্ডিগান, শাল পালটাচ্ছে আর হরেকরকমের ড্রাই ফুড বার করছে। যে যার গ্রুপে জমে ছিল। লক্ষ করবার মতো কেউ ছিল না। সে লক্ষ করেনি। কিন্তু কেউ যদি তাকে লক্ষ করে থাকে, কেচ্ছার গন্ধ পেয়ে থাকে… বিজু রায়কে কেউ কিছু বলে থাকে। বলবেই বা কী? রাত্তিরবেলা সেই নিশ্ছিদ্র অন্ধকারে সজনেখালির টুরিস্ট লজে নিশ্চয়ই কোনও চোখ ছিল না। বিজু রায় তো জানতেনই, তনুশ্রী রাজেশের সঙ্গে সুন্দরবন যাচ্ছে। তবে?

তনুশ্রীর বড্ড গা শিরশির করতে লাগল। বারবার বাথরুম পাচ্ছে। তিনি, তাঁরা শর্মা বা বসাকদের মতো তিন পুরুষে বড়লোক তো নন। এই সেদিন পর্যন্ত শাশুড়ি ওপরে যখের মতো পুরনো সব মূল্যবোধ আঁকড়ে শুয়ে থাকতেন। এ সবের তো একটা প্রভাব আছেই। দু জোড়া চোখ। এক জোড়া কোটরাগত, প্রশ্নে ভরা কিন্তু কেমন একটা তীক্ষ্ম কৌতুক সে চোখে, শাশুড়ির চোখ। আর এক জোড়া বিজু রায়ের, অন্যমনস্ক। সব সময়ে কিছুতে যেন মগ্ন হয়ে আছে লোকটা। মা বলল—‘বারান্দা দিয়ে দেখে আয়, বর এসেছে, বুড়ো-বুড়ো করছিস, কেমন বুড়ো বর তোর।’ আগেই দেখেছিল তনুশ্রী, সে কথা ভাঙা হয় নি। বারান্দা দিয়ে দেখল, স্বাস্থ্যবান, জোড়-টোড় পরে চমৎকার মানিয়েছে, মাথায় চুলগুলো দেখবার মতো, বেশ পুলক জাগাবার মতো। কিন্তু বিজু রায় কিরকম যান্ত্রিক ধরনের মানুষ ছিলেন। কোনও যেন রসকষ নেই। যদিও অত্যন্ত কর্তব্যপরায়ণ। আসলে মানুষের ধাত। যে মানুষের যা। বলবার কিছু নেই। তনুশ্রীর নিজেরও খুব একটা ভাবাবেগ-টেগ ছিল না। তার একটা দিক ছিল প্রচণ্ড হিসেবি। এখনও আছে। এই যে রাজেশকে ঠেকিয়ে রেখেছে এটাও সেই হিসেবি মন থেকে এসেছে। তখন ছিল সীমাহীন উচ্চাকাঙক্ষা। যা কোনও দিন স্বপ্নেও আশা করেনি সেই বিত্ত, সেই মান পেয়ে তনুশ্রী উচ্চাকাঙ্ক্ষার লাগাম ছেড়ে দিয়েছিল। দারুণ দারুণ সেজে পার্টিতে যাব। ফ্যাশন-ম্যাগাজিনের জীবন। বহু বহু পুরুষ তাকে ঘিরে। সে মাতালের মতো দুলছে, দুলে দুলে হাসছে। পাশে বিজু রায়। ঘুরছে, ফিরছে, অদর্শন হচ্ছে আবার কাছে চলে আসছে। মিসেস তনুশ্রী রায়ের স্বামী। ‘স্বামী’, ‘কর্তা’ প্রভুত্ববাচক বলে তাঁদের সংস্থা আজকাল শব্দগুলো ব্যবহার করতে দ্বিধা করছে। কিন্তু লোকটা পাশে থাকলে গর্বে বুক ফুলে যেত। নির্ভরযোগ্য পুরুষ বটে। স্বামী। ঠিকই। কিন্তু বিজু কোনও দিনও প্রভূত্ব খাটায়নি। অবাধ স্বাধীনতা দিয়েছে। একদম ভোরের দিকে তনুশ্রী ঘুমিয়ে পড়লেন।


রাত্রি সাড়ে দশটা। শীতের কলকাতা প্রায় নিঝুম হয়ে এসেছে। রাস্তার মোড়ে কিছু লোক আগুন করে বসে জুয়ো খেলছে। ঘড় ঘড় ঘড় ঘড় ট্রামের শব্দ। ট্রাকের প্রতাপ বাড়ছে রাতের সঙ্গে সঙ্গে। সামনের মৃতদেহটির দিকে তাকিয়ে বিজু রায় একেবারে অবাক হয়ে রইলেন। নিতাই ভট্‌চাজ্যি বলল— ‘কী হল রায়বাবু, তুলুন?’

মণিময় বলল—‘গামছাটা ভাল করে কাঁধে ঠেসে ঠুসে নেবেন। না হলে লাগবে কিন্তু।’

প্রতুল বিশ্বাস বলল—‘ভয় খাচ্ছেন কেন? আমরাও পাঁচ জনে আছি তো। কাঁধ বদল করে নেবেন একটু পরেই।’

বিজু রায় দুঃখের হাসি হেসে বললেন— ‘ওজন তো শুধু এই খাটিয়াটারই।’

—‘না না দাদা, ভুল করছেন’, নিতাই ভট্‌চাজ্যি বললেন— ‘যত সময় যায় মড়ার ওজন বাড়ে। সে যত রোগাই হোক। এনার আত্মীয়স্বজনের হদিশ খুঁজতে আমাদের কম সময় গেল? ছিল ইঁদুর, দেখবেন হাতি হয়েছে।’

—‘বলো হরি, হরি বোল’… মণিময় বলে উঠল। চারজনের কাঁধে কাঁধে উঠে পড়ল নলিনীকান্ত করের লাশ।

আহিরিটোলার এই আস্তানার খোঁজ পেয়েছিলেন বিজন এই নলিনী করের কাছেই মাত্র তিনদিন আগে। একটা ট্যাকসি নিয়ে প্রথমেই গিয়েছিলেন সেই বাঁধাঘাট। শ্মশানের ধারের বাড়ি। নেই। বহুতল উঠছে। দুলিচাঁদের মতো কোনও ঘাঘু প্রোমোটার কিম্বা বিজু রায়ের মতো কোনও অ্যামেচার কলকাতা, বৃহত্তর কলকাতা এবং সমস্ত পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের চেহারা পাল্টে দেবার সংকল্প নিয়েছে। আকাশ কিনছে, আকাশ বেচছে। সুতরাং বিজু রায়ের ছেলেবেলা ধূলিসাৎ। দেখে কেন কে জানে খারাপ লেগেছিল। তিনি সেন্টিমেন্টাল লোক নন। এও ভাল করেই জানেন গঙ্গার ধারের সেই বালিখসা নোনা-ধরা বাড়ি আজও টিকে থাকার কথা নয়। তাকে আগাগোড়া সংস্কার করলেও টিকত কিনা বলা যায় না। কী আশা নিয়ে তিনি সেখানে গিয়েছিলেন বলা শক্ত। ঘুসুড়ির বাড়িটার জন্যে তো কতবার জি.টি. রোডের ওপর দিয়ে বেরিয়ে গেছেন। একবারও তো মনে হয়নি, ছেলেবেলার সেই বাড়ি দেখে আসি। এখনই কেন হল, বলা সত্যিই শক্ত। আশাভঙ্গ কেন হল সেটা বলা আরও শক্ত। কিন্তু হল। ট্যাকসিটা ছেড়ে দিয়ে ছিলেন, খানিকটা ঘোরাঘুরি করে বাঁধাঘাটের একটা দোকান থেকে গরম গরম জিলিপি আর চা খেলেন, বেশ কয়েক ভাঁড়। তারপর অনেককাল আগেকার মতো লঞ্চে চেপে বসলেন। ওপারে আহিরিটোলা যাবেন। স্রেফ যাবার জন্যেই। কোনও উদ্দেশ্য ছিল না। বেরিয়ে আসার একমাত্র উদ্দেশ্য, ছুটকি। ছুটকিকে খুঁজে বের করা। কিন্তু সেটা সহজ নয়। চিঠিগুলো এখনও সব পড়া হয়নি। কিন্তু যতগুলো পড়েছেন কোথাও ঠিকানা নেই। অথচ মা, সবগুলোর না হলেও কোনও-কোনওটার জবাব দিয়েছে। ঠিকানাটা এই কাগজের স্তূপের মধ্যে থেকে খুঁজে বার করতে হলে একটু সময় চাই। কোথাও বসতে পারা চাই। কিন্তু কোনও হোটেলে গেলে হঠাৎ কেউ তাঁকে চিনে ফেলতে পারে। তাঁর সময় চাই। বাসে, ট্রামে, ট্রেনে তো আর পুরনো চিঠি খুলে পড়া যায় না। আহিরিটোলার জেটিতে বসে এইসবই ভাবছিলেন। খেয়াল করেননি একজন কেউ তাঁকে অনেকক্ষণ ধরে লক্ষ করছে।

—‘মহাশয়ের কি এদিকে এই প্রথম আসা?’

চিন্তাক্লিষ্ট বিজু রায় মুখ তুলে দেখলেন রোগা লম্বা এক প্রৌঢ়। চওড়া পাড়ের ধুতির ওপর গরম ফ্লানেলের পাঞ্জাবি, তার ওপর জামেয়ার শাল। চকচকে বার্নিশ করা নিউ-কাট। মুখের রং, বোঝা যায় একসময়ে ফর্সা ছিল, জ্বলে গেছে। খয়েরি খয়েরি ছোপ নানা জায়গায়। চুলে বোধহয় কলপ দিতেন, সম্প্রতি ছেড়েছেন। অর্ধেক চুল পানের বাসি ছছাপের মতো লাল।

বিজু রায় তখনও ঠিক করতে পারেননি কী বলবেন। ভদ্রলোক বললেন— ‘হাতে দু দুটো সুটকেস, বাঁধাঘাটের স্টিমারে এলেন, এসে থেকে বসে আছেন, আর আকাশ পাতাল ভাবছেন, কী ব্যাপার বলুন তো। অবিশ্যি যদি বলেন পরের ব্যাপারে নাক গলাচ্ছি কেন তো চলে যাবো। কিন্তু ভাবব। ভাবনার ওপর তো ট্যাক্স বসাতে পারেন না?’ পারেন? কী দাদা পারেন?

বিজু বললেন— ‘আসলে খুঁজতে এসেছি এক জনকে। কিন্তু কোথায় উঠছেন, কীভাবে খুঁজব ভেবে পাচ্ছি না।’ বিজু রায়, বি.বি. রায় এই কথা বললেন একজন সম্পূর্ণ অজানা অচেনা লোককে।

—‘কে পালিয়েছে। ছেলে না মেয়ে? পুলিশের কাছে যাচ্ছেন না কেন। জানি ওরা একটি ওয়ার্থলেস লট। তবু লোকে তো যায়। আপনি গোপন রাখতে চাইছেন? না কি?

বিজু রায় এমনভাবে হাসলেন যার মানে ‘হ্যাঁ ঠিক ধরেছেন’ এরকম হতে পারে, আবার না-ও পারে।

—‘থাকতে পারেন তো আমার বাসায় নিয়ে যেতে পারি। ভাড়া খাই খরচ লাগবে। তবে হোটলে-ফোটেলের থেকে কম। যাবেন?’

এভাবে একজন অচেনা লোকের কথায় হুট করে কোথাও যাওয়া বিপজ্জনক, সেটা স্বভাবতই বিজু রায় জানেন। কিন্তু তিনি তো আর ছেলেমানুষ নন। উঠতে উঠতে বললেন—‘পেয়িং গেস্ট রাখেন বুঝি? বাঃ এর চেয়ে ভাল ব্যবস্থা আর হতে পারে না।’

ভদ্রলোকটির চেহারা পড়তি বড়লোকদের। টাকার থলিতে বেদম টান পড়েছে। এখন এইভাবে পেয়িং-গেস্ট রেখে চালান নিশ্চয়। দেখলেই বোঝা যায়। বিজু রায়ের কথার জবাবে ভদ্রলোক হাসলেন। বললেন… ‘চলুন। দেখুন পছন্দ হয় কি না।’

—‘আপনার নাম কী?’

—‘বিজন রায়। বিহারীটা বাদ দিলেন বিজু রায়। তাঁর নাম যে বিজনবিহারী এ বোধহয় তাঁর অতি ঘনিষ্ঠরা ছাড়া কেউ জানে না। এমন কি ছেলে-মেয়েও জানে কি না সন্দেহ।

—‘আমি এন.কে. মানে নলিনী কর। মাঝে এক কান্ত ছিল, বহুদিন হেঁটে দিয়েছি।’

পলেস্তারাহীন, একঠেঙে, আদ্যিকালের যে বাড়িটাতে তাঁকে নিয়ে ঢুকলেন নলিনী কর, সেটা কোনওকালে ধনী লোকের বাড়ি ছিল না। ঠ্যাংঠেঙে উঁচু উঁচু সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে নলিনীবাবু গলা বাড়িয়ে বললেন—‘ঠাকুর, আমার গেস্ট আছে। একটা মিল বেশি নিয়ো।’ ডালে সম্বরার ঝাঁজ আসছে। বিজু রায় হেসে ফেলে বললেন—‘হোটেল নাকি?’

—‘এখন দু কাপ চা আর টোস্ট পাঠিয়ে দিয়ে ঠাকুর, টোস্টে একটু চিনি দেবে।’

গালে সাবান হাতে ক্ষুর, দোতলার ঘর থেকে দু চারজন বেরিয়ে এসেছিল। বেশির ভাগই বয়স্ক, কেমন খিঁচড়ে মুখ। দু এক জন অপেক্ষাকৃত অল্পবয়সীও আছে। একজন বললেন— ‘কী ব্যাপার নলিনীদা, আপনার গেস্ট?’

—‘কেন, তোমরা কি ভাব নলিনীদা বাপে-তাড়ানো মায়ে-খ্যাদানো বলে তার গেস্ট থাকতে পারে না? নলিনীবাবু খেঁকিয়ে উঠলেন। বিজু রায়কে দেখে সবাই চুপ করে গেল। তিনতলার ঘর। একখানাই ঘর। এক চিলতে বাথরুম। বাকিটা ছাদ। একখানা তক্তাপোশ পাতা। কোণে মাটির কুঁজো। দেয়ালে গোঁজ দেওয়া। তাই থেকে একটা ধবধবে পাঞ্জাবি ঝুলছে। তক্তাপোশের বিছানাটায়ও একটা নতুন ঝকঝকে জয়পুরি বেডকভার।

—‘চলবে?’ নলিনী কর বললেন, ‘এটা মেস। যা এখন কলকেতার শহরে প্রায় অবসলিট হয়ে গেছে। এই আমার ঘর। আপনাকে একটা স্টিলের ফোল্ডিং খাট পেতে দেব পাশে। রাতে শোয়ার জন্যে। যদ্দিন ছেলে বা মেয়েকে চুপিচুপি খুঁজবেন ততদিন থেকে যান এখানে। কেউ ডিসটার্ব করবে না। আমার ঘরভাড়া একশো পাঁচ, আপনি হাফ সাড়ে বাহান্ন দেবেন। গেস্টের মিল, এরা মাছের মিল দশ টাকা, মাংসের পনেরো নেয়, নিরমিষ্যি আট। ব্রেকফাস্ট চার টাকা। চা এক টাকা পঁচিশ পয়সা। বড় কাপে দেয়। ভাল আসাম। ঠাকুর রাঁধে ভাল। ডালে ফেন চালায়। স্টিল্‌ল্‌।

বিজু রায় বললেন— ‘একলার একটা ঘর পাওয়া যায় না?’

—‘একলা? সব ফিল্ড আপ। নো ভেকান্সি। আপনি যে থাকবেন সেটা আমার খাতিরেই। তা ছাড়া আপনার ঘাবড়াবার কিছু নেই। আমি মোস্ট নন-ইনটারফিয়ারিং লোক। বুঝলেন কিছু?’

এই সময়ে একটি গেঞ্জি আর গামছা-পরা লোক, কলাইয়ের থালার ওপরে দুটো মোটা মোটা কাপে চা, এবং চার পিস টোস্ট নিয়ে এল।

—‘নিন খেয়ে নিন’— ঘরের একমাত্র টিনের চেয়ারটা টেনে বিজু রায়কে বসতে দিয়ে নলিনী কর বললেন।

বিজু রায় টোস্টে চিনিগুলো কলাইয়ের বাসনটার ওপর যথাসাধ্য ঝেড়ে ফেলে দিতে লাগলেন।

—‘মধুমেহ?’

—‘আজ্ঞে?’

—‘ডায়াবিটিস?’

—‘এখনও ঠিক নয়, ব্লাড শুগার আছে।’

—‘তবে তো মশাই এ চাও আপনার চলবে না। চিনি দেওয়া আছে।’

—‘একবার খেলে কিছু হবে না’ বিজু রায় চায়ে চুমুক দিলেন। বেশ কড়া, কিন্তু রীতিমতো ভাল চা। বিজু রায় উচ্চতম দামের দার্জিলিং খান, লিকার পাতলা, কিন্তু এই কড়া লিকারের চা যে যথেষ্ট ভাল তাতে সন্দেহ নেই। পাঁউরুটিখানাও তিনি খুব তৃপ্তির সঙ্গেই খেতে লাগলেন। মোটা মোটা পাঁউরুটি, টাটকা রুটির গন্ধটা বেরোচ্ছে। তাঁর খিদে পেয়েছে।

নলিনী তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন— ‘ভাল। না? আসলে কি জানেন, খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারটা আমরা এখানে নিজেরাই দেখি। চাঁদু মিত্তির আছে দোতলায়। এক্সপার্ট লোক। মাসকাবারি বাজারটা সে-ই করে। ডেলি বাজারও এরা পালা করে করে। নয়ত এন.কে এখানে থাকত?’

তারপরে গালের কুঁচকানো চামড়ায় আরও ভাঁজ তুলে হাসলেন—‘আমার তো ডায়াবিটিস।’

বিজু বললেন— ‘তবে এত চিনি-টিনি?’

—‘কে দেখছে?’ যেন একমাত্র কেউ দেখে ফেলবে বলেই রোগীর যা-কিছু সাবধানতা।

—‘বয়স কত হল বলুন তো?’

বিজু রায়ের মনে হল—বাহাত্তর তিয়াত্তর অন্তত, বললেন—‘চৌষট্টি পঁয়ষট্টি হবে।’

—‘ফিফটি নাইন রানিং।’

—চমকে উঠলেন বিজু রায়।

একটা কিং সাইজ সিগারেট বার করে নলিনীকান্ত বললেন—‘জীবনে কী করেছি আর কী করিনি হিসেব দিতে গেলে মাথা খারাপ হয়ে যাবে মশাই। বছর তেইশ বয়সে বাড়ি থেকে পালালুম। তারপর জাহাজের খালাসি হওয়া থেকে জাহাজ কেনা পর্যন্ত করেছি। করতে পেরেছি। শেয়ারে কামিয়ে লালে লাল হয়ে গেছি। আবার বেগার, একেবারে ভিক্ষুক। ধরুন, অবস্থা যখন ছিল পাল পাল আত্মীয়স্বজনকে গ্র্যান্ডে খাওয়ানো থেকে, ব্যালকনির টিকিটে সিনেমা দেখানো, বক্সে থিয়েটার দেখানো, দামি দামি উপহার কিনে দেওয়া—কী না করেছি। যখন পকেট গড়ের মাঠ হয়ে গেল, নিজের ভাই, আমার পয়সায় যে এঞ্জিনিয়ার, সেই ভাই গলাধাক্কা দিয়ে বাড়ি থেকে বার করে দিল। নিন ধরুন একটা।’ নলিনীকান্ত সিগারেটের প্যাকেট তাঁর দিকে এগিয়ে ধরলেন।

বিজু রায় ইতস্তত করছিলেন। নলিনীকান্ত বললেন—‘রেসট্রিকশান? একদিন একটায় আসবে যাবে না।’

এই সময়ে একটি যুবক ঘরে মুখ বাড়াল, —‘আসতে পারি।’

—‘আবার জিজ্ঞেস করছো কেন? কৌতূহলে তো ছটফট করছ সবাই। এসে যাও এসে যাও। নীচে গিয়ে রিপোর্ট দিয়ো।

—‘আঃ আপনি না নলিনীদা! কোনও জিনিসটাই সহজভাবে নিতে পারেন না। এলুম আপনার ফরমাস খাটতে। এই নিন আপনার টুথপেস্ট, আর এই সুপার সফ্‌ট ব্রাশ। ক্রিমটা অফিস-ফেরত আনব।’

যুবকটি একটা দামি টুথপেস্ট আর ব্রাশ এগিয়ে দিল।

—‘এ হে হে হে হলদে আনলে কেন হে? হলদে আমি মোটে পছন্দ করি না। গ্রিন, গ্রিন আনতে হয়।’

—‘ভুল হয়ে গেছে দাদা। দয়া করে ফেরত দিতে বলবেন না।’

—‘এসেছ যখন কৌতূহল নিবৃত্তি করে যাও। ইনি আমার বন্ধু বিজন রায়, মানে জুনিয়র ফ্রেন্ড। এই তুমি যেমন। আর বিজনবাবু ইটি মণিময়। নামেও রত্ন, স্বভাবেও রত্ন। আচ্ছা এবার এসো গিয়ে, তোমার আপিসের দেরি হয়ে যাচ্ছে।’

মণিময় বলল— ‘নমস্কার বিজনদা, পরে আলাপ হবে।’

—‘ছেলে-মেয়ে নয় মনে হচ্ছে,’ মণিময় চলে গেলে এন.কে বললেন, ‘ছেলে-মেয়ে হলে এতক্ষণে দাপিয়ে বেড়াতেন, তবে কি ভাইপো-ভাইঝি, ভাগনে-ভাগনি গোছের কেউ?’ বলেই জিভ কেটে বললেন—‘ছি ছি এই দেখুন, ইনটারফেয়ারেন্স হয়ে গেল দাদা, মনে কিছু করবেন না।’

বিজন হেসে বললেন— ‘ও সব কেউ নয়। অনেকদিন থেকে সম্পর্ক নেই এমন এক জনের ঠিকানা খুঁজে বার করবার চেষ্টা করছি।’

—‘বুঝেছি।’ এন. কে বললেন, তারপর ঘরটা বিজনকে পুরোপুরি ছেড়ে দিয়ে নিজের কাজে, ভগবান জানেন কী কাজ, চলে গেলেন।

দিদির চার পাঁচটা চিঠি পেলেন বিজন। প্রত্যেকটাতেই কিছু টাকার প্রাপ্তিস্বীকার আছে। তাঁর মনে পড়ল, মা যতদিন ছিল মাসে হাজার টাকা করে মাসোহারা দিতেন তিনি। খুব আস্তে টাকাটা মায়ের বালিশের তলায় ঢুকিয়ে রাখতেন। মা একদিন, একদিনই বলেছিল—

—‘আমি তো একটা শোয়া-মানুষ, সব কিছুই তো অপরের ওপর। নিজে হাতে খরচ করার সাধ্যও নেই। এত আমায় দিস কেন?’

বিজু বলেছিলেন, ‘এ টাকা নিয়ে তুমি যা খুশি করবে মা।’

‘এত টাকা নিয়ে সত্যিই কখনও নাড়া-চাড়া করি নি’, দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেছিল মা। টাকা নিয়ে মা কী করত বিজন জানেন না। জানবার আগ্রহও বোধ করেননি কোনও দিন। দিয়ে দিয়েছেন ব্যস। তবে মা হয়ত নাতি নাতনিদের, বউমাদের কিছু উপহার-টার দিত অনেক সময়ে। তিতি যেন একদিন কাকে বলছিল— ‘ঠাম্মার টাকা দিয়ে এই চুড়িদারটা করিয়েছি। কেমন হয়েছে?’ কাকে বলছিল? তাঁকে তো নয়ই। ওর মাকে কি? মনে করতে পারলেন না বিজন। শুধু ‘ঠাম্মার টাকা’ কথাটা মনে লেগে আছে। কিন্তু সেদিন আলমারি, সিন্দুক ঘাঁটাঘাঁটি করে শুধু একটা সোনার হার ছাড়া আর কোনও মূল্যবান জিনিস পাননি। সামান্য কিছু খুচরো পয়সা, ব্যস। সোনার হারটা ঝকঝকে নতুন, মা কোনও সময়ে করিয়ে রেখেছে। বাক্সের মধ্যে চিরকুটে লেখা ‘ছোটখুকুকে আশীর্বাদ’। ভাই-বোনদের মধ্যে দিদিই সবচেয়ে অভাবী। চিঠি পড়ে মনে হচ্ছে সে টাকার অধিকাংশই দিদিকে পাঠিয়েছে মা। কাকে দিয়ে পাঠাল? খুব সম্ভব সুলতা আর শিবানী ওই দুটি নার্সকে দিয়ে। তারা যে মেরে দেয়নি এটা মায়ের ভাগ্য, দিদিরও ভাগ্য। কিন্তু তাঁরও তো দিদির কথা ভাবা উচিত ছিল। মায়েরও বলা উচিত ছিল। তিনি দিদির কথা ভাবেননি, তার প্রধান কারণ তিনি অতটা জানতেন না। দিদি এমন কিছু দূরে থাকে না। কিন্তু দিদি, দিদির ছেলেরা কেউ কখনও তাঁর সল্ট লেকের বাড়িতে এসেছে বলে তিনি মনে করতে পারলেন না। সল্ট লেক কেন। ছুটকি চলে যাবার পর থেকেই দিদি বাঁধাঘাটের বাড়িতেও আর আসেনি। ও। এই জন্যে। দিদির শ্বশুরবাড়ি খুব গোঁড়া, আচারপরায়ণ, বিজু একবার দিদির সুখচরের বাড়িতে গিয়ে দিদির শ্বশুরমশাইয়ের কাছে র্ভৎসনা শুনেছিল, বামুনের ছেলে হয়ে আহ্নিক করে না বলে। প্রসাদী মাংস ছাড়া ওদের বাড়ি ঢুকত না। তাহলে ছুটকির কারণেই দিদির সঙ্গে রায়বাড়ির যোগাযোগ ছিন্ন হয়ে গেল। তাই-ই দিদির কথা ভাবেননি তিনি কখনও। মেজদার মেয়ের বিয়েতে যেন একটুখানির জন্যে দেখা হয়েছিল। আর? ওই মায়ের কাজে।

দিদি লিখেছে— ‘মনি-অর্ডার পেয়েছি। না, পেলে যে কী হত তা জানি না। ভাগ্যে তুমি ছিলে। ভাইয়েরা তো থেকেও নেই। এবারের মতো সামলে দিতে পেরেছি। তুমি দীর্ঘ জীবন লাভ করো…’ দিদিকে প্রয়োজনের সময়ে মনি-অর্ডার পাঠাবার জন্যেই কি মায়ের দীর্ঘ জীবন লাভের প্রার্থনা?

শ্রী চরণেষু মা,

তোমার দেওয়া মূলধনে তোমার ছোট নাতি নূতন করে ব্যবসা শুরু করেছে। খুবই ভাল চলছে। ওই টাকা শাঁটুল বলছে ফিরিয়ে দেবে। দিতে পারলেই আমার সোয়াস্তি। কত দিলে মা! মেয়ের বিপদে মা ছাড়া আর কে করে! সবই ঠিক। তবু লজ্জা হয়। শাঁটুল শিগগিরই বাড়ির কলি ফেরাবে।’

আশ্চর্য! দিদির এত বিপদ গেছে তবু কখনও বিজনের কাছে হাত পাতেনি? মাকে জানিয়েছে। মার সাধ্য ছিল তাই করেছে, না হলে? হঠাৎ বিজন স্থির করলেন তিনি দিদির বাড়িই আগে যাবেন। একটাই মুশকিল। তাঁর প্রাণটা এখন ছুটকির জন্য দাপাচ্ছে। ভেতরে ভেতরে তিনি ভীষণ অস্থির। ছুটকিকে খুঁজে বার না করে, তার সঙ্গে কথা না বলে বাড়ি ফিরে যাবার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে তাঁর নেই। তা ছাড়া, বাড়ির লোককে… তনুশ্রী, তিতি আর চিন্টু এদের একটু ভোগাবার ইচ্ছে তাঁর। এ অবস্থায় দিদির বাড়ি গেলে তিনি গোপনতাটা রাখতে পারবেন কি? বাড়ি থেকে তাঁর জন্যে বিজ্ঞাপন-টন দিলে এই আহিরিটোলার বাসও তাঁর উঠবে। দেখা যাক।

নলিনী কর ফিরে আসবার আগেই তিনি চান সেরে নিয়েছেন। বেরোবার জন্য প্রস্তুত। — ‘এ কী? চললেন কোথায় মশাই? খেয়েছেন?’

—‘বাইরে কোথাও খেয়ে নেব এখন।’

—‘সে কী? আমি মিল বলে দিয়েছি যে। দশটা টাকা গচ্চা যাবে না।’

ভদ্রলোক কিছুতেই ছাড়বেন না। একতলার খাবার ঘরে আসন পেতে বসে, থালার চারদিকে জলের ছিটে দিয়ে, বাঁ কনুই বাঁ হাঁটুর ওপর রেখে বিজু রায়ের সঙ্গে খেলেন নলিনী। চানের কথা উড়িয়ে দিলেন। শীতকালে নাকি উনি অর্ধেক দিন চান করেন না। ভোজনের পর পরিষ্কার হয়ে নেবেন।

রান্না সত্যিই খুব ভাল। এ ভাবে চুড়ো-করা ভাতের সঙ্গে সুক্তো, মাছের মুড়ো দিয়ে বাঁধাকপি, বড় বড় পার্শে মাছের ঝাল, কুমড়ো, বেগুনের অম্বল—এসব কবে শেষ খেয়েছিলেন মনে পড়ে না বিজু রায়ের। বাঙালিরা ধনশালী হলেই তাদের খাদ্যাভ্যাস পর্যন্ত আমূল পাল্টে ফেলে। তাঁরা ছোটবেলায় জলখাবার খেয়েছেন এক পয়সার চারটে করে বলের মতো হিঙের কচুরি আর খোসাসুদ্ধ আলুর তরকারি। নয়ত দুধ-জিলিপি। বাঁধা জলখাবার। তাঁর ছেলেমেয়েরা খায় দুধের মধ্যে কর্নফ্লেক্‌স, আধ-সেদ্ধ ডিম, দুটো করে সিঙ্গাপুরি কলা। প্রমীলাকে তিনি হোটেলের বয়-বাবুর্চির মতো বলতে শুনেছেন—‘ডিম সেদ্ধ না ভাজা?’ সেদ্ধ ভাজার বাইরে স্ক্র্যাম্‌বল্‌ড্‌-এগের ফরমাসও হত। দুপুরে ভাত খান না বিজু রায়, আটার রুটি, গোনা দুখানা। নলিনী বললেন— ‘আপনি বোধহয় টেবিলে খান, না? খুব অসুবিধে হচ্ছে।’

বিজু রায় বললেন—‘রান্না খুব ভাল।’

—‘ভাল তো খাচ্ছেন কই? এ যে মেয়েদের খাওয়া মশাই।’

আরেক বাটি ডাল চেয়ে নিলেন বিজু রায়। বললেন-ব্লাড শুগার, বললাম না?

—‘ওঃ হো তাই বলুন। তা আমার তো ইউরিনেও চিনি এসে গেছে। তাই বলে বাঁধাকপি দিয়ে ভাত মেখে খাব না। এমন পার্শে মাছের সর্ষে-বাটার ঝাল, ভাতে মেখে না খেলে রোচে?’

খেয়ে-দেয়ে বিজু রায় সুখচরের উদ্দেশে বেরিয়ে পড়লেন।

এই তাহলে এখনকার সুখচর? বিয়াল্লিশ তেতাল্লিশ বছর আগে দেখা সেই ছায়া নিবিড় মফস্বলের সঙ্গে কোনও মিল নেই। বড় বড় সুন্দর সুন্দর বাড়ি। বহুতল। কিছুকাল আগেও একটা সময় ছিল যখন বিলেত-আমেরিকা থেকে ফিরে এসে লোকে বলত— ‘এ কী? তিরিশ বছর আগে যা দেখেছি, যেমন দেখে গেছি, এখনও তো অবিকল তাই-ই?’ ইদানীং আর সেটা বলতে পারবে না তারা। অন্তত সুখচরের চেহারা দেখে বিজু রায়ের তাই মনে হল। তিনি নিজের চেষ্টায় ভটচাজ্যি বাড়ি খুঁজে বার করতে পারলেন না। রিকশা-অলা, পান-সিগারেটের দোকান, লন্ড্রি ইত্যাদিতে জিজ্ঞেস করতে করতে পৌঁছলেন যখন দেখলেন সারা সুখচর বদলে গেলেও তাঁর দিদির বাড়ির পরিবেশ এতটুকুও বদলায়নি। সেই সামনে একটা পচা ডোবা এই দুপুরবেলায়ও যার ওপর থিকথিকে মশা। এবং পেছনে বিয়াল্লিশ বছর আগে দেখা দোতলা বাড়ির কঙ্কাল। খিলেন থেকে একটা অশথ গাছ গজিয়ে প্রায় মহীরুহ হয়ে গেছে। বাড়ির গায়ে কোনও দিন কোনও পলেস্তারা ছিল বলেও মনে হয় না। বিরাট দরজাটা বহু কাল রং-টং না হওয়া সত্ত্বেও সম্ভবত কাঠের সেগুনত্বর গুণে এখনও অটুট আছে। ভেতরে ঢুকে বিজু গলা তুলে ডাকলেন—‘দিদি! দিদি।’

সদর দিয়ে ঢুকে একটা ছোট গলি মতো। তার দুধারে বাঁধানো রক। আগেকার বড়সড় বাড়িতে এমনই থাকত। গলি পেরিয়ে চৌকো উঠোন। শান জায়গায় জায়গায় ফেটে গেছে, সেখানে আগাছা। শেয়ালকাঁটা, পাথরকুচি। শানের ওপর শ্যাওলা, তার ওপর ধ্যাবড়া করে চুন ফেলা হয়েছে। বিজুর মনে পড়ল উঠোন পেরিয়ে কলঘরে যেতে হত। এখনও তা হলে তাই আছে। বড়দির ছোট ছেলে শাঁটুল তাহলে কলি ফেরাতে পারেনি। ব্যবসাটা ফেল মেরেছে হয়ত। তিনি আবার গলা তুলে ডাকলেন— শাঁটুলবাবু। শাঁটুলবাবু। দিদির খুব সম্ভব দুই মেয়ে, দুই ছেলে। মেয়েদের নাম যেন ছিল খুকি আর টুকি। কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও বড় ভাগনের নাম মনে করতে পারলেন না। পোশাকি নামগুলো তো নয়ই। অগত্যা শাঁটুলবাবু! শাঁটুলবাবু!

এবারে দাওয়ার ওপরের ঘরের ভেতর থেকে একটি বউ বেরিয়ে এল। হাতে খন্তি। তার রকম দেখে বিজু রায়ের মনে হল— সে এইভাবেই মাঝে মাঝে বেরিয়ে আসে এবং গরম খন্তির ছ্যাঁকা দিয়ে দেয় তাঁর মতো বে-আক্কেলে মিনসেদের।

তাঁকে দেখে বউটি জ্বলজ্বলে সিঁদুরের ওপর গাছকোমর থেকে টেনেটুনে একটু ঘোমটা টানল। এখানে এখনও বউয়েরা বাইরে লোক দেখে ঘোমটা টানে? কলকাতার থেকে কত দূর সুখচর?

—‘কাকে চান?’ স্বরটি ভাল।

—‘আমি বিজু, শাঁটুলের ছোটমামা। দিদি আছেন?’

বউটির চোখ বড় বড় হয়ে উঠছিল, সে এক ছুট্টে ভেতরে গেল। বোধহয় রান্না এবং খন্তির একটা ব্যবস্থা করে আর একটু ভদ্রস্থ হয়ে বেরিয়ে এসে ঢিপ করে পেন্নাম করল, —‘মা ভেতরের ঘরে শুয়ে আছে। আসেন।’

—‘মা দেখো, কে আসছেন।’

দিদি ওপাশ ফিরে শুয়ে ছিল। বউয়ের কথায় এদিকে ফিরে ভুরু কুঁচকে বলল —‘কে?’

ঘরটা অন্ধকার। বউটি এসে টিমটিমে আলো জ্বেলে দিন।

—‘আমি বিজু দিদি।’

—‘বিজু! বিজু! ছোট খোকা!’ দিদি উত্তেজনায় উঠে বসল।

—‘তুমি কেন? কোথা থেকে? কী করে খবর পেলে?’

বিজু রায় বললেন— ‘কেন? আসতে নেই? তোমাকে দেখতে ইচ্ছে হল।’

—‘আমাকে দেখতে?’ দিদি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।

—‘কী হয়েছে দিদি তোমার? শুয়ে কেন?’

—‘ডাক্তার তো ধরতে পারছে না কিছু। পেটে যনতন্‌না! তোমাকে, তাহলে এরা খবর দেয়নি! এমনিই এসেছ! —বউমা! ছোটমামার খাবার জোগাড় করো।’ দিদি শেষ কথাটা গলা তুলে বলল।

বিজু বললেন, ‘আমি খেয়ে-দেয়ে এসেছি দিদি। কাউকে ব্যস্ত করতে হবে না। ভাগ্নেরা কোথায়?’

—‘ভাগ্নেরা?’ দিদি অবাক হয়ে বলল ‘রা কোথায় পেলে? বাঁটুল তো সেই কবেই ছোটতেই…’

তখন বিজু বুঝতে পারলেন কেন বড় ভাগ্নের নাম মনে পড়ছিল না। খুব সম্ভব তিনি যখন নিরুদ্দিষ্ট, তখনই…। তাঁর কোনও দোষ নেই।

গলাটা একটু পরিষ্কার করে বললেন— ‘খুকি, টুকি সব ভাল তো?’

—‘আর কে ভাল, কে মন্দ! মেয়ে-সন্তান বিয়ে দিয়ে দিলেই পর, তার ওপর নিজের ছেলেপিলে সংসার নিয়ে জড়িয়ে পড়লে তো আর কথাই নেই। পরস্য পর। খুকি থাকে মজফ্‌ফরপুর। টুকির বর খুব উন্নতি করেছে, আগে কটকে থাকত, এখন বোম্বাই। এদিকে ওদের কেউ নেইও। মাঝে সাঝে চিঠি দেয়।’

—‘শাঁটুল? শাঁটুল কোথায় গেল?’

দিদি অনেকক্ষণ পরে বলল ‘—জানি না।’

—‘জানি না মানে?’

দিদি এদিক-ওদিক তাকিয়ে বলল—‘লেখাপড়ায় তো তেমন চৌকস ছিল না। গোড়ার থেকেই এ ব্যবসা সে ব্যবসা করে বাপের পয়সাগুলো সব ফুঁকে দিলে। তার পরেও অনেক অনেক দিয়েছি। শেষের দিকটা বেশ দু পয়সা আসছিল। তারপর একদিন…’ দিদি চুপ করে গেল।

এই সময়ে বউটি এক কাপ চা, আর দুটো দানাদার এনে রাখল।

বিজু বললেন—‘আমার মিষ্টি চলে না, ব্লাড শুগার আছে। চা-টা খেয়ে নিচ্ছি। এগুলো নিয়ে যাও মা।’

বউটি দানাদারের প্লেট তুলে নিয়ে বিনা বাক্যব্যয়ে চলে গেল। বেশ কিছুক্ষণ পর দিদি আবার এদিক তাকিয়ে মাথাটা একটু তুলে চুপি চুপি বলল—‘হিন্দুস্থানী’।

—‘কে?’

—‘বউ।’

—‘তো কী? ভালই তো!’

—‘ভাল-মন্দ জানি না। শিগগিরই বোধহয় কাটান-ছাড়ান হয়ে যাবে।’

—‘তাই?’

—‘ আর কী হবে বলে! শাঁটুল তো পুলিশের হাত এড়িয়ে বেড়াচ্ছে।’

—‘সে কী? কেন?’

—‘কি জানি। সিমেন্ট বলে নাকি গঙ্গামাটি পাইল করে দিয়েছে, একদিন রাতে সাতখানা মোটর বাইক গর্জন করে বাড়ি ঘিরে ধরল। এদের সব বসিয়ে দিয়েছে নাকি। খিড়কি দিয়ে শাঁটু পালিয়ে গেল। বউ আটকে আছে আমার জন্যেই। বাপের সঙ্গে ঝগড়া করে শাঁটুকে বিয়ে করেছিল। তা অ্যাদ্দিনে বোধহয় বাপ একটু নরম হয়েছে। ছেলেটাকে নিয়ে গেছে। বউটা, হাজার হোক মানুষ তো, এমন অবস্থায় আমায় ফেলে যেতে পারছে না।’

দিদির চোখ দিয়ে জল পড়তে লাগল।

ময়লা বিছানায় শীর্ণ বৃদ্ধার দিকে তাকিয়ে হঠাৎ বিজুর মনে হল—দিদি, ইনি বি.বি. রায়ের দিদি। শুয়ে থাকতে থাকতে দিদি হঠাৎ কুঁকড়ে যেতে লাগল। মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। বিজু উঠে দাঁড়িয়ে তাড়াতাড়ি কাছে গিয়ে বললেন— ‘কী হল দিদি! ব্যথা?’

—‘উঃ, মাগো! মাঃ আর পারছি না যে!’

বিজু বাইরে এসে ডাকলেন— ‘বউমা।’

বউটি এসে দাঁড়াল।

—‘ডাক্তার দেখেছে?’

—‘হ্যাঁ।’

—‘কী বলছে?’

—‘ক্যানসার।’

বিজু রায় দাওয়ার ওপর কাঠের বেঞ্চে বসে পড়লেন।

বউটি কাঠ-কাঠ গলায় বলল— ‘ওর ছেলে ফেরার। এই রোগ বাধিয়েছে। আমার গলায় পড়েছে। আমার কোনও ক্ষমতাই নাই। আপনি ওর ভাই। শুনেছি রইস লোক। অনেক পয়সা। নিয়ে যান। নিয়ে এই নরক থেকে আমায় ছেড়ে দিন।’ বলে দাঁড়িয়ে রইল। একটু পরে রুক্ষ গলায় বলল— ‘আপনি যদি এত পয়সা-অলা লোক তো আপনার দিদির, ভান্‌জার এমন অবস্থা হয় কেন? আমার পিতাজিও বেওসা করেন, আমাদের মতিহারী থেকে যে দেশোয়ালি যখন এসেছে কোনও না কোনও হিল্লে লাগিয়ে দিয়েছেন। নিজের লোকের তো কথাই নাই। আপনারা বঙ্গালিরা কেমন মানুষ?’ রাগে মেয়েটির মুখ লাল হয়ে উঠেছে। সে আবার রান্নাঘরে ঢুকে গেল। এত কী রাঁধছে সে ভগবানই জানেন।

বিজু রায় গালে চড় খেয়ে বসে ভাবতে লাগলেন। এক করা যায়, দিদিকে নিয়ে এখুনি সল্ট লেকের বাড়ি চলে যাওয়া যায়। মায়ের ঘর খালি পড়ে আছে, দিদি অনায়াসেই থাকতে পারবে। নার্স রেখে দেওয়া যাবে, মায়ের মতো। তনুশ্রী সম্ভবত ব্যাপারটা পছন্দ করবে না। এরকম ঘটনা এর আগে ও বাড়িতে হয়নি। কিন্তু তার জন্য কিছু এসে যাবে না। দিদি থাকবে ওপরে, সব কিছু আলাদা। তার সেবার ভার মাইনে-করা লোকেদের। তনুশ্রীর বলবার কিছু থাকতে পারে না। হঠাৎ বিজু রায়ের একটা কথা মনে পড়ে গেল, তিনি গালে আরেকটা চড় খেলেন। তাঁদের বিয়ের কিছুদিন পরই তনুশ্রীর বাবা মারা যান। মা একা পড়ে গেলেন। ছয় মেয়ে। তনুশ্ৰীই একমাত্র খাস কলকাতায়। সে মাকে নিজের কাছে এনে রাখতে চেয়েছিল। বিজু রায় রাজি হননি—যুক্তি দেখিয়েছিলেন অনেক। দুই পক্ষের মা এক সংসারে থাকলে জটিলতা বাড়বে। অনর্থক। তাঁর বাড়ির কতকগুলো নিজস্ব নিয়ম, শৃঙ্খলা আছে, সেগুলো নষ্ট হওয়া তাঁর শুধু অনভিপ্রেত তাই-ই নয়। তাঁর জীবিকা-ইত্যাদির পক্ষে ক্ষতিকর। শাশুড়ি যদি সেগুলোতে হাত লাগান। অল শাশুড়িজ আর গ্র্যাবিং, ডমিনেটিং টাইপ্‌স, তখন শুধু-শুধু সম্পর্ক খারাপ হয়ে যাবে। তা ছাড়া, ভদ্রমহিলার আরও পাঁচ মেয়ে রয়েছে। সাধ্যের বাইরে গিয়ে সবারই মোটের ওপর ভাল-ভাল বিয়ে দিয়েছেন, তা তারাও তো রাখতে পারে। তনুশ্রীর মুখটা কেমন হয়ে গিয়েছিল। একবার তবু বলেছিল— ‘ঠিক আছে মাকে একবার জিজ্ঞেস করতে পারি তো?’

বিজু রায় বলেন— ‘তা পারো। কিন্তু মা রাজি হলেও আমি রাজি হতে পারব না।’ তবু তনুশ্রী জিজ্ঞেস করেছিল মাকে। খুব স্বস্তি পেয়েছিলেন বিজু যখন মা-ও তাঁর মতে মত দিয়েছিল। ‘না, কুটুম্বকে ও ভাবে বাড়িতে রাখলে অশান্তি হবার সম্ভাবনা, তার চেয়ে বিজু একটা মাসোহারার ব্যবস্থা করে দিক। বউমা গিয়ে গিয়ে দেখাশোনা করুক।’

তনুশ্রীর মার হার্টের অসুখ ছিল। ঠিক কী জাতীয় তা বিজু রায় জানেন না। তিনি মাসোহারা দিতেন, চিকিৎসার ভাল ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। কিন্তু তনুশ্রীর মা নিজের ঘরে একদিন মরে কাঠ হয়ে পড়েছিলেন। প্রতিবেশীরা দরজা কেটে বার করে। বিজু রায় গিয়েছিলেন। শাশুড়ির চোখের সেই ভয়ে ঠিকরে আসা চোখের মণি দুটো তিনি কখনও ভুলতে পারবেন না। একাকিত্বের আতঙ্কেই হঠাৎ উনি মারা গেলেন, না হার্টের অসহ্য যন্ত্রণায় ওইরকম অবস্থা হয়েছিল, কে বলবে! বিজু রায় কুঁচকে গেলেন। কেমন মনে হল, দিদিকে ওখানে তুললে তিনি তনুশ্রীর কাছে খুব ছোট হয়ে যাবেন।

দিদির চিৎকার ক্রমশ বাড়ছে। মেয়েরা এমনিতেই খুব সহনশীল হয়। তা সত্ত্বেও একজন চুয়াত্তর পঁচাত্তর বছরের বৃদ্ধা যখন এই ভাবে ডাক ছেড়ে কাঁদছে তখন অনুমান করা যায় তার যন্ত্রণার তীব্রতাটা কী রকম! বিজু রায় ভাবলেন— ‘আর এই সময়ে আমি কারও কাছে ছোট হওয়ার কথা ভাবছি। কী অদ্ভুত একা মানুষ! ভাই-বোন-ছেলে-মেয়ে সব আছে। সব থাকে। অথচ কেউ নেই। কেউ থাকে না। কিছু থাকে না। থাকে শুধু মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্কের মধ্যে খাড়া হয়ে চূড়ান্ত অহমিকা। অহম্‌, অহম্‌, অহম্।

তিনি তাড়াতাড়ি দিদির ঘরে ঢুকলেন। বললেন— ‘দিদি। ব্যথা বাড়লে কোনও ওষুধ খাও?’ হাত বাড়িয়ে একটা পাতা দেখাল দিদি। তুলে বিজু রায় দেখলেন স্পাজমোপ্রক্সিভন। হতাশ হয়ে বললেন—‘এতে হয়?’

—‘কী জানি। হয় হয়তো!’ দিদির গলা রুদ্ধ হয়ে যাচ্ছে। ওষুধটা দিদিকে খাইয়ে দিয়ে তিনি বাইরে বেরিয়ে বউটিকে ডাকলেন—বললেন— ‘এখানে কোথায় কোন ডাক্তার বসেন আমি তো জানি না, একটু বলে দেবে কোনদিকে পাব?’

বউটি বলল— ‘আপনি বসেন, আমি ডাকছি। ফি-এর টাকা বত্রিশ, আগে না দিলে আসবে না।’

পকেট থেকে তাড়াতাড়ি বার করে দিলেন তিনি টাকাটা। বললেন— ‘অবস্থাটার কথা বলে ইঞ্জেকশন ওষুধ যা লাগে নিয়ে আসতে বোলো। আমি সঙ্গে সঙ্গে মিটিয়ে দেব।’

টাকা নিয়ে বউটি চলে গেল। একটা ক্যানসারের রোগী, মরণাধিক যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে। ডাক্তার আগে থেকে ফি না পেলে আসবে না? বিজু রায় অবাক হয়ে রইলেন। এঁরা তো এখানকার বহুদিনের বাসিন্দা! আদি বাসিন্দাদের মধ্যেই। জমিদারশ্রেণীরই ছিলেন বোধ হয়। এখন টাকা না থাকলেও সেই পুরনো মান-মর্যাদা! তারও কি কিছুই নেই? ডাক্তার! ডাক্তার! কত লাখ টাকার সরকারি খরচে একটা ডাক্তার হয়?

ডাক্তারটি যখন এল, বিজু রায় দেখলেন নেহাতই ছোকরা। চটপট পেথিডিন ইনজেকশান দিয়ে দিল। তিনি দামটা দিয়ে দিলেন। তারপরে বললেন— ‘শুনলাম, আপনি নাকি আগে থেকে ফি না পেলে আসেন না?’

—‘কে বললে?’ ডাক্তারটি চোখ তুলে বলল— ‘রত্না! ওকে জিজ্ঞেস করুন তো কত বার ইনজেকশন ওষুধ দিয়ে গেছি এ বাড়িতে, এক পয়সাও পাইনি।’

—‘পাননি কেন সেটা চারদিক দেখেই নিশ্চয় বুঝতে পারছেন। এক জনের কাছ থেকে ফিজ না পেলে আপনার বাড়িতে হাঁড়ি চড়বে না এমন অবস্থা নিশ্চয়ই আপনার নয়।’

—‘আপনি কে?’ ডাক্তারটি রাগত স্বরে বলল, ‘কী রাইট আছে আপনার এখানে ডেকে এনে আমাকে অপমান করবার? আমি যদি চিটেড হতে না চাই, সেটা আমার অপরাধ?’

—‘চিটেড? ডু য়ু নো ইয়াং ম্যান দ্যাট ইয়োর্স ইজ দা নোবলেস্ট প্রফেশন? জানো সরকার তোমার জন্যে কত টাকা খরচ করেছে? জানো ইউ আর ডিলিং উইথ হিউম্যান পেইন, সাফারিং! মানুষের অমানুষিক শারীরিক যন্ত্রণার সামনে দাঁড়িয়ে তুমি একটা ডাক্তার, চিটিঙের কথা মুখে আনতে পারছ?’

—‘ওহ্, রত্নার কাছে শুনলাম শমিতবাবুর বড়লোক মামা এসেছেন। বিজনেসম্যান। আমরা ডাক্তাররা অনেক পেইন, সাফারিং, ডেথ দেখতে দেখতে ইমিউন হয়ে গেছি, বুঝলেন? অ্যান্ড উই ডোন্ট কজ সাফারিং, ডোন্ট কজ পেইন। আর আপনারা? আপনাদের মতো অসাধু, কালোবাজারিদের জন্যে যে দেশটা ভিখিরিতে আর নবাবে দু ভাগ হয়ে গেল, তার বেলা? গরিবের মুখের অন্ন কেড়ে খান না? আপনাদের জন্যেই না গরিবি টিকে আছে! এই তো গরিব আত্মীয়, উপায় না দেখে চিটিংবাজি সুদ্ধু ধরেছে, কিছু করেছেন তাদের জন্যে? আবার বড় বড় কথা।’

হনহন করে বেরিয়ে গেল দুর্মুখ লোকটা। বিজু রায় অনুভব করলেন তিনি ঘামছেন। এভাবে তাঁর সঙ্গে ব্যবহার… না তিনি মনে করতে পারছেন না কেউ করেছে বলে। তাঁদের কথা কাটাকাটির মধ্যে রত্না বউটি বেরিয়ে এসেছিল। ঈষৎ উৎকন্ঠার গলায় বলল— ‘কী করলেন মামা, ও তো আর হাতে-পায়ে ধরলেও আসবে না।’

—‘ওর আসবার দরকার নেই। লেট হিম গো টু হেল।’ কোন মতে বলতে পারলেন বিজু রায়। একটা কালো হয়ে যাওয়া হাত পাখা আর এক গ্লাস জল নিয়ে এল রত্না। —‘আপনাকে খুব হয়রান দেখাচ্ছে, জলটা খেয়ে নিন।’ হাওয়া করতে লাগল সে। তারপর বলল— ‘বয়স হয়ে গেছে, একসাইটমেন্ট ভাল না। ও সবের মধ্যে যান কেন?’

‘আশ্চর্য, মেয়েটি ঠিকই বুঝতে পেরেছে তাঁর বয়স হয়েছে। অথচ নলিনী কর, তাঁর সমবয়সী লোকটি, সে বুঝতে পারিনি। যুবক-যুবতীরা ঠিকই বুঝতে পারে। খুব সম্ভব চোখের দিকে তাকিয়ে পারে। বড় কাঁসার গেলাসের জলে নিজের চোখের ছায়া দেখতে দেখতে ভাবলেন বিজু রায়। তিনি বললেন, ‘অমানুষিকতা, অন্যায় আমি সইতে পারি না।’ বলেই মনে হল— ‘সত্যি? পারি না কি?’ মেয়েটির ঠোঁটে একটা বাঁকা হাসি। বোধ হল সে-ও মনে-মনে এই কথাই বলছে। পারো না। পারো না। সইতে না পারা তো দূরের কথা। অন্যায় অমানুষিকতা তুমি নিজেই প্রশ্রয় দাও। নিজেই করো।

তিনি বললেন— ‘শাঁটুল কখনও আমার কাছে যায়নি কেন?’

‘কী ব্যাপারে?’

‘নিজের কাজ-কর্মের ব্যাপারে?’

কিছুক্ষণ চুপ করে রইল রত্না, তারপর বলল— ‘ও বলত স্নব, আমাদের দেখলে চিনতে পারে না। চিনতে চায়ও না, না খেয়ে মরব তবু ওই মামার কাছে কাঁদাকাটি করতে যাব না।… কিছু মনে করবেন না বললুম বলে।’

বিজু রায় অবাক হয়ে রইলেন। চিটিংবাজেরও তাহলে এইরকম আত্মসম্মান বোধ থাকে? না খেয়ে মরব, জেলে যাব, তবু স্নব মামার কাছে যাব না! এ কী মুখ তাঁর। কী ভয়ঙ্কর বীভৎস হাস্যকর মুখ আয়নায়। একেক মানুষের কাছে কি তাঁর একেক রকম মুখ?

তিনি উঠে দাঁড়ালেন। রত্না বলল—‘চলে যাচ্ছেন! রাগ করলেন?’ তার গলায় দারুণ উৎকণ্ঠা।

বিজু বললেন, একটু হেসে বললেন— ‘ভয় নেই। আমার দিদির ভার বইতে তোমাকে আটকে রাখব না। এখুনি ওঁকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে। তার ব্যবস্থা করছি।’

রত্নার মুখটা কালো হয়ে গিয়েছিল। সেদিকে তাকিয়ে বিজু বললেন —‘শাঁটুল তো অনেক দিন নেই। আসবার সম্ভাবনাও নেই। চলছে কী করে? তুমি এই টাকাটা রাখো।’ তিনি পার্স থেকে হাজার খানেক টাকা বার করতে লাগলেন।

রত্না মেয়েটি হঠাৎ তীব্র গলায় বলল—‘আপনার অনেক পয়সা-টাকা আছে, না? লোকের মুখের উপর ছুঁড়ে মারতে পছন্দ করেন! জানেন আমি আমার গয়না বিকিয়ে সংসার চালিয়েছি, শাসের ইলাজ করিয়েছি।’

বিজু রায় শান্ত গলায় বললেন— ‘খুব ভাল করেছ। মানুষের কাজই করেছ। কিন্তু ও ভাবে গুরুজনদের সঙ্গে কথা বোলো না। আমাদের ছোটতে বাবা-টাবা আমাদের ওপর অন্যায় করছেন জানলেও আমরা কিছু বলতাম না, কেন জানো? স্রেফ গুরুজন বলে। বিদ্রোহ ভাল। মুখের ওপর উচিত কথা শুনিয়ে দেওয়াও ভাল। কিন্তু জায়গা বুঝে, মানুষ বুঝে। আমি টাকা তোমার মুখের ওপর ছুঁড়ে মারছি না। হাতে দিচ্ছি। তোমার দরকার বলে। আর আমি মামা বলে।’

রত্না কেঁদে ফেলল। সম্ভবত এই কান্নাটা তার অনেকদিন ধরে জমা ছিল। সে টাকাটা হাতে নিয়ে রান্নাঘরের মধ্যে ঢুকে গেল। দিদি ঘুমোচ্ছ। বিজু রায় বেরিয়ে এলেন।

নিজের চেনা ডাক্তারদের কাছে যেতে পারছেন না। চেনাশোনা প্রভাবশালী লোকদের রেফারেন্স দিতে পারছেন না। শুধু টাকাটা আছে। বিজু রায় ব্যাঙ্কে গিয়েছিলেন টাকা তুলে এনেছেন। আরও আনবেন দরকার হলে। ব্যবস্থা করেছেন। একজন সম্পূর্ণ আনকোরা, পরিচিতিহীন নাগরিক হিসেবে বিজু রায় কোথাও কোনও সুযোগ পেলেন না। ডাক্তার, যিনি ভর্তি করাবেন হাসপাতালে, আগে নিজে দেখে রায় দেবেন তার পরে ভর্তির কথা। দিদির কোনও মেডিক্যাল রিপোর্ট টিপোর্টও নেই। স্রেফ আন্দাজের ওপর ডায়াগনোসিস। কিন্তু কোনও ডাক্তারই এখান থেকে সুখচরে গিয়ে রোগী দেখে আসতে পারবেন না। পুরোটা রাস্তা গাড়িতে নিয়ে যাওয়া আসা করলেও না। অবশেষে রাত্রি নটা নাগাদ নিজের জেদ ছেড়ে বিজু রায় চলে গেলেন ডক্টর পি. চ্যাটার্জির কাছে। প্রচুর রোগী অপেক্ষা করছে। কলকাতার সেরাদের মধ্যে একজন মেডিসিনে। নিজের একটা কার্ড পাঠিয়ে দিলেন বিজু রায়। সমুদ্র দুভাগ হয়ে গেল মন্ত্রবলে, মাঝখান দিয়ে এক ত্রাণকর্তা বি.বি. রায় আরেক ত্রাণকর্তা পি. চ্যাটার্জির কাছে চলে গেলেন।

ধৈর্য ধরে সব শুনলেন ডক্টর চ্যাটার্জি। কোনও প্রেসক্রিপশন, ডায়াগনোসিস, প্যাথলজিক্যাল রিপোর্ট, বায়পসি কিছু নেই। বললেন— ফোন করে দিচ্ছি, আমার নার্সিং হোমের অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে চলে যান, নিয়ে আসুন, এখুনি ভর্তি করে নিচ্ছি। তারপর দেখছি কী করা যায়।

রাত্তির সাড়ে এগারটার পরে দিদিকে ভর্তি করে, রত্নাকে তার বাপের বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে আহিরিটোলায় ফিরলেন বিজু রায়। সর্বক্ষণ গামছা পরে থাকা সেই হরিহর নামে লোকটি দরজা খুলে দিল। হা-ক্লান্ত বিজু রায় তিনতলায় চিলেকোঠায় উঠে দেখলেন নলিনী কর পেশেন্স খেলছেন। — ‘এই যে, এসো। বিজনভায়া। আমি গেস করতে পেরেছিলুম দেরি হবে। শেষ পর্যন্ত কি পুলিশেই গেলে?’

‘না, আপনাকে তো বলেইছি এ পুলিশের ব্যাপার নয়।’

‘ওঃ হে, ভুলে গিয়েছিলুম এ সেই অনে-ক কালের হারানো একজন। না? বুঝি, বুঝি বিজনভায়া, বুঝি সবই! ইন্টারফেয়ার করতে চাই না, তাই…বুঝলে না?’

শীতের রাতে বিজন বালতি বালতি জল ঢেলে চান করলেন। হরিহর রুটি বেগুনভাজা আর আলু-কপির তরকারি গরম করে নিয়ে এল। বিজন বললেন— ‘এ সবের দরকার ছিল না। খেতে ইচ্ছে করছে না।’

নলিনী কর বললেন— ‘ভাগ্য হল চোরের মতন, বা বলতে পারো জোচ্চোর। তো সেই চোর-জোচ্চরের ওপর রাগ করে মুখের খাবার কেউ ফেরায়? ফিরিয়ো না ভায়া, বড় দাদা বলছি, খেয়ে নাও, তারপরে ওষুধ দেব। গায়ের ব্যথা মরবে।’

বিজন দেখলেন হঠাৎ তাঁর পেটের মধ্যে থেকে দারুণ খিদে চাড়া দিয়ে উঠছে। তিনি রুটি বেগুন ভাজা নিয়ে বসে গেলেন।

নলিনী কর বললেন— ‘আলু কপির ডালনা থেকে আলুগুলো বাদ দিয়ে খাও ভায়া। একদিনে বড্ড অত্যেচার হয়ে যাবে নইলে।’ তিনি চৌকির তলা থেকে একটা ট্রাঙ্ক বার করলেন টেনে। তার ভেতর থেকে একটা লম্বা গোল বোতল বার হল। বিদেশি হুইস্কি। বললেন- ‘চলে না বললে শুনব না ভায়া, একটু খাও, ক্লান্তি দূর হবে, গায়ের ব্যথা মরবে, ভাল ঘুম হবে।’

নিজের তক্তাপোশটিতে তিনি নতুন চাদর পাতলেন। বালিশের ওয়াড় বদলালেন। ট্রাঙ্ক থেকে একটি বিলিতি রাগ বার করলেন। বললেন— ‘দেখলেই বোঝা যায় ভায়া শৌখিন মানুষ। চোখের সামনেই সব বদলে দিলুম। এবার আরাম করে শুয়ে পড়ো।’

—‘আপনি?’

—‘আমি এই ক্যাম্প খাটে! দুদিনের তো ব্যাপার।’

তো সেই নলিনী করই এখন খাটিয়াতে ফুলের মালা ইত্যাদিতে শোভিত হয়ে শুয়ে আছেন। মেস-বন্ধুরা ট্রাঙ্ক থেকে তাঁর চুনোট করা ধুতি, গিলে করা পাঞ্জাবি বার করে পরিয়ে দিয়েছে।

বিজন কদিন দিদির জন্য নির্দম ছোটাছুটি করছেন। ডাক্তার বলছে অপারেশন করার ঝুঁকি আছে। আবার করলে ভালও হতে পারে। অপারেশনের তারিখ পড়েছে দুদিন পর। দিদিকে ফলের রস খাইয়ে, কিছুক্ষণ গল্প করে, ওষুধপত্র সব কিনে দিয়ে, রত্নাকে আবার পৌঁছে দিতে হল। সে নার্সিং হোমে এসে বসে আছে। বলল, একাই চলে যেতে পারবে। কিন্তু বিজু তা দিতে পারেন না। তিনি তাকে বাপের বাড়ির গলি অব্দি পৌঁছে দিলেন। যাবার সময়ে মুখ নিচু করে বলল— ‘কাল গুড্ডুকে নিয়ে যাব মামা? খুব দাদি-দাদি করছে। ওঁর হাতেই তো মানুষ।’

‘এনো’—বিজন বললেন।

তারপর ফিরে দেখলেন এই ব্যাপার। এঁরা সবাই তাঁর জন্য অপেক্ষা করছেন। নলিনীকান্তর ট্রাঙ্ক-বাক্স হাঁটকে নাকি কোনও ঠিকানাই পাওয়া যায়নি। মণিময় বলল—‘আপনি ওর অনেকদিনের বন্ধু, আপনিই মুখে আগুনটা দিন, বামুনও বটেন।’

বিজন হেসে বললেন—‘কে বলল আমি ওঁর অনেকদিনের বন্ধু? যেদিন ওঁর সঙ্গে এলাম তার আগে চিনতাম না পর্যন্ত।’

চাঁদু, যে মাসকাবারি বাজার করে সে বলল—‘বলেন কী?’ একটু পরে বলল—‘নলিনীদার কারবারই আলাদা। আপনার হাত থেকে আগুনটা নেবেন বলেই বোধহয়…আগুনটা আপনারই হাতে মাপা ছিল।’

আহিরিটোলার মেসবাড়ির চিলেকুঠুরির ভাড়ার উত্তরাধিকার বিজু রায়ই পেলেন। ট্রাঙ্ক-বাক্স হাতড়ে যা টাকাপয়সা পাওয়া গেল তাতে কোনওমতে মেসের পাওনা চুকল। সবাই চাঁদা করে শেষ কাজের টাকাটা তুলল, গঙ্গার ঘাটেই কাজটা হবে ঠিক হয়ে গেল। বিজুকেই করতে হবে। কেউ শুনল না। তিনিই নাকি নলিনী করের একমাত্র ওয়ারিস।


শুক্তি মেয়েটি ছোটখাটো, রোগা, রং-ও ময়লা, কিন্তু মুখটা ভীষণ মিষ্টি। খুব বুদ্ধিযুক্তও বটে। সে শার্ট-প্যান্ট ছাড়া পরে না। গরমকালে শর্টস। এই শুক্তি তার নিজের মহলে যাকে বলে ক্রেজ। শুক্তির এম. এ. ফাইন্যাল ইয়ার। কিন্তু সে ইতিমধ্যেই অন্য অনেক কিছু করছে ও করেছে। যেমন টুথপেস্টের বিজ্ঞাপনে মডেলিং। স্টেটসম্যানের ‘নাউ অ্যান্ড এগেইন’ কলামে লেখা। বস্তির বাচ্চাদের নিয়ে নাইট স্কুল। আনন্দবাজারেও দু-একবার আর্টিকল লিখেছে। তার বন্ধুরা তাকে জিজ্ঞেস করে থাকে সে ওইসব হাই-ব্রাও কাগজে অ্যাট অল পাত্তা পেল কী করে! কনসিটেড পিপল, ওরা তো ঢোকবার পথেই পাবলিককে আটকে দেয়।

এসব প্রশ্নের উত্তর দেওয়া শুক্তি তার সম্মানের পক্ষে হানিকর বলে মনে করে। সে মুখের ওপর একটা মৃদু তাচ্ছিল্যের ভাব ফুটিয়ে ডান হাত দিয়ে ক্রমাগত সামনে ঝুঁকে-আসা চুলগুলোকে পেছনে ঠেলে দেয়। শুক্তির মধ্যে দুটো জিনিস খুব শক্তিশালী। এক, সে যা করতে চায় তা করেই ছাড়ে। ভীষণ জিদ্দি, তার মা বলে থাকেন তাকে বাধা দিয়ে কিছু লাভ হয় না এমত সময়ে। একটি সাময়িক পত্রিকায় সে একবার খিদিরপুরের ফ্যান্সি মার্কেট সম্পর্কে একটা আর্টিকল লিখেছিল। সম্পাদকের নামেই সে সেটা পোস্ট করে দেয়। খুবই স্পর্শকাতর অথচ কৌতূহলপ্রদ বিষয় বলে সম্পাদক তাকে ডেকে পাঠান, এবং তার চেহারা ও বয়স দেখেশুনে হাঁ হয়ে যান। বেশ কিছুটা সম্পাদনা করে, তেমন তেমন ফটো বাদ দিয়ে লেখাটা ছাপা হয়েছিল। কিন্তু শুক্তি এই সম্পাদনায় অত্যন্ত আহত অপমানিত বোধ করে। সে সম্পাদকের ঘরে গিয়ে বেশ ভালই ঝগড়া করে আসে। যেমন সে বলে—‘আপনি আমার কাছ থেকে আরও কৌতূহলপ্রদ বিষয়ে লেখা পেতে পারতেন, কিন্তু পাবেন না। এবং একজন বিকচমান সংবাদদাতাকে আপনি হত্যা করলেন।’ শুক্তি যখন বাংলা বলে ইংরিজি ব্যবহার করে না এবং শুদ্ধ পরিষ্কার বাংলা বলার চেষ্টা করে। যাই হোক তার ক্রোধ দেখে সম্পাদক মুচকি হেসে তাকে চা খাওয়ালে সেটা সে খেয়ে নিয়েছিল। শুক্তির দ্বিতীয় ব্যাপার তার পতিতোদ্ধারিণী গঙ্গে রূপ। পতিত-পতিতা সে যেমনভাবেই যে অর্থেই হোক, তাকে সে রেহাই দেয় না। এটাতেই সবচেয়ে গণ্ডগোল বাধে। যেমন ড্রাগ বিক্রেতা এক পান-সিগারেটওয়ালাকে ধরে ফেলতে পেরে সে নিত্য সেখানে পান খেতে এবং সিগারেট পিতে যেতে আরম্ভ করে। ফাঁকে ফাঁকে তার ধর্মোপদেশও চালায়। ফলে পানওয়ালা ঠিক জায়গায় খবর পৌঁছে দেয় এবং সে উত্তম-মধ্যম ধোলাই খায় এক সন্ধেবেলা বাড়ি ফেরবার পথে। শুক্তির চরিত্রে প্রতিহিংসা নেই। তাই তার আতঙ্কিত বাবা-মা পুলিশে এফ আই আর ইত্যাদি করলেও সে এ ব্যাপারটাতে আর কোনও কৌতুহল দেখায় না। না হলে কী হত বলা যায় না। মার খাওয়ার পর তখনও ঘা শুকোয়নি, কপালে ব্যান্ডেজ, হাতে পায়ে নানা জায়গায় স্টিকিং প্লাস্টার…এই অবস্থায় সে সেই পানওয়ালার কাছে যায়। কোমরে দু হাত রেখে পান এবং সিগারেট চায়। দুটোই কেনবার পর সেগুলো সজোরে মাটিতে ফেলে পিষে দেয় পা দিয়ে তারপরে পানওয়ালাকে ডেকে ডেকে যথেষ্ট ঘৃণা সহকারে নিজের ক্ষতচিহ্নগুলো দেখাতে থাকে। বলে—‘দেখো ইয়ে তুমহারী জওয়ানী কী রোশনি, ঔর ইয়ে সব তুমহারী মর্দানগী কী নিশানী।’ তারপর ধীর পদক্ষেপে এমনভাবে চলে আসে যে পানওয়ালার বোধে আসে যে এই মেয়েটিকে ঠেঙিয়ে ঠেকানো যাবে না।

সংস্কারক শুক্তির সাম্প্রতিকতম লক্ষ্য হল নীলাদ্রি ওরফে চিন্টু। সংস্কারক শুক্তির করুণা আকর্ষণ করার জন্যে অবশ্য তার অনেক বন্ধুই এক পায়ে খাড়া। এ নিয়ে তাদের নিজেদের মধ্যে ফাটাফাটিও হয়ে যায়। ষড়যন্ত্রও হয়। যেমন বন্ধুমহলে রটে গেল সোহন তার গার্লফ্রেন্ড তাকে ডিচ করবার পর ভীষণ ডিপ্রেশনে ভুগছে। শুক্তির ছোট ছোট কান দুটো খাড়া। কিন্তু সে কিছু বলছে না। —‘শুক্তি জানিস, সোহনটা বোধহয় পাগলই হয়ে যাবে!’ দীর্ঘশ্বাস।

দু-তিন দিন পরে শুক্তি ঠিক সোহনের ঘরে পৌঁছে গেছে। সোহনের একমুখ দাড়ি। পরনে ময়লা পাজামা, একটা অনুরূপ ফতুয়া। সে যেন শুক্তিকে লক্ষই করেনি এমনি ভাব। শুক্তি তার সামনে গিয়ে নিজে একটা সিগারেট ধরাল, সোহনকেও একটা দিল। সোহন আস্তে মাথা নেড়ে মুখ ফিরিয়ে রইল। শুক্তি তখন সোহনকে পুলকিত করে তার কোলের ওপর বসে পড়বে এবং তার ময়লা ফতুয়া ছিঁড়ে ফেলতে থাকবে।

—‘এই শুক্তি কী হচ্ছে, কী হচ্ছে, এই এই ছাড় বলছি।’

কিন্তু এর ক’দিন পরে যখন শুক্তি সোহনকে নিয়ে তাদের আড্ডায় যাবে এবং সোহন উজ্জ্বল মুখে একহাতে চায়ের কাপ আর এক হাতে শুক্তির কাঁধ জড়িয়ে ধরে—‘শুক, লেটস লীভ দিস স্টিংকিং জয়েন্ট’ বলবে তখন সোহনেরই পরম বন্ধু এবং ষড়যন্ত্রে অংশগ্রহণকারী পারভেজ হঠাৎ লাফিয়ে উঠে কোথা থেকে একটা পেনসিল কাটা ছুরি আস্ফালন করে বলবে—‘দাস ফার, সোহন, নো ফার্দার।’ এর পর স্বভাবতই পারভেজে-সোহনে একটা বিরাট ঝটাপটি লাগবে। অন্য বন্ধুরা দু ভাগে ভাগ হয়ে যাবে এবং মোরগা-লড়াইয়ের মতো দুজনকে উত্তেজিত করতে থাকবে। এই সময়ে সকলের অলক্ষ্যে শুক্তি বেরিয়ে আসবে। তার মুখের ভাব শান্ত, ধীর, উজ্জ্বল। সে সোহনকে, প্রাণচঞ্চল, মজাদার ছেলে সোহনকে লড়াইক্ষম করে দিতে পেরেছে। তার কাজ ফুরিয়েছে। সে সফল। এই ধরনের একটা তৃপ্তি নিয়ে সে ফেরে।

নীলাদ্রির মুশকিল হল সে কোনও কিছুতেই মন বেশিদিন বসাতে পারে না। শুক্তিও খেয়ালি। কিন্তু সে যেটা করে সেটা খুব সুন্দরভাবে করে। নীলাদ্রি কিছুই করতে পারে না। এম এ পড়ছিল, পরীক্ষা দিল না। ফ্রেঞ্চ ক্লাসে ভর্তি হয়েছে, কিন্তু জে সুই নীলাদ্রি, ভু জেৎ মঁসিয় বানার্জি আর এলে মাদমোয়াজেল শুক্তি পর্যন্ত শিখে আর এগোতে চাইছে না। তার দিক্‌তে অর্থাৎ ডিকটেশন থেকে রাশি রাশি ভুল বার হচ্ছে, মঁসিয় বানার্জি ধৈর্য রাখতে পারছেন না। এমনকি নীলাদ্রি যে শুধু সুন্দর সুন্দর মেয়েদের দেখবার জন্যেই আলিয়াঁস ফ্রাঁসেতে এসে জুটেছে এ কথা তিনি প্রকাশ্য ক্লাসেই বলেছেন।

‘অব্যবস্থিতচিত্ততা!’ শুক্তি দাঁতের তলায় চেপে নিজের মনে বলেছে। এর যা লক্ষণ দেখা যাচ্ছে, একে সাহায্য না করলে শেষ পর্যন্ত সাট্টাবাজ, ড্রাগ-পেড্‌লার, খুনি যা খুশি হয়ে যেতে পারে।

ডেনিমের একটা মিডি স্কার্ট আর বাসন্তী রঙের পুলোভার পরে অতএব শুক্তি নীলাদ্রির বাড়ির সিঁড়ি টপকে টপকে উঠছে। তার কাঁধে একটা খাদির ব্যাগ। নীলাদ্রিদের বাড়ি সব সময়ে ফাঁকা। বাবা থাকেন না, মা থাকেন না, বোন আছে একটা, তার চেহারা পর্যন্ত কখনও দেখেনি শুক্তি। দূরে দূরে কিছু লোকজন ঘুরে বেড়ায়। তাদের রকম-সকম পিংপং বলের মতো। শুট্‌ করে কোথায় ছিটকে সরে যাবে আবার শুট করে কখন নেটের ঠিক পাশটিতে এসে ড্রপ খাবে বলা যায় না। এইরকম নির্জন শীতালো দুপুরে শুক্তি নীলাদ্রির ঘরের দরজার পর্দা সরিয়ে নিঃশব্দে এসে দাঁড়িয়েছে।

নীলাদ্রি তিন-চারটে বালিশ মাথায় দিয়ে বিছানায় আধশোয়া। হাতে একটা ছোট্ট অ্যালবাম মতন। অখণ্ড মনোযোগে দেখছে। শুক্তি এসেছে, ঘরে ঢুকেছে, এবং নিঃশব্দে তার মাথার পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে সে কিছুই বুঝতে পারেনি। শুক্তি বিদ্যুদ্বেগে অ্যালবামটা ছিনিয়ে নিল। চমকে বিছানার ওপর লাফিয়ে উঠল চিন্টু।

‘এই, এই দে দে, প্লীজ দে শুক্তি।’

মন দিয়ে অ্যালবামের ছবিগুলো দেখতে দেখতে শুক্তি বলল—‘ওহ্‌ নীল তুই তাহলে একটা বুড়ো ভাম! আউটওয়ার্ডলি ইয়াং, ইনওয়ার্ডলি রটন।’

—চিন্টু বলল, ‘এই শুক্তি ধ্যাত, ওগুলো দে।’

—‘কোথায় পেলি এগুলো?’

—‘মেট্রোর পাশের গলিটায় একজন সেল করছিল। জাস্ট আউট অফ কিউরিয়সিটি! নাথিং সিরিয়াস! এই শুক্তি প্লীজ!’

শুক্তি ততক্ষণে পুরো ঘরটায় চক্কর দিচ্ছে আর সব জিনিসপত্র উল্টে-পাল্টে দেখছে। চিন্টু তার পেছন পেছন ভিক্ষুকের মতো হাত বাড়িয়ে আসছে আর ক্রমাগত বলে যাচ্ছে, ‘শুক্তি প্লীজ!’

শুক্তি বলল—‘তাই ভাবি, একটা যুবক ড্রাগ খায় না, অতিরিক্ত মদ্যপান করে না, প্রেমে পড়ে না অথচ হয় ফেল করছে আর নয়ত ড্রপ। পরীক্ষা দিচ্ছে না। গোপন কথাটা তা হলে এই!’ বলে সে আবার ঝটিকাবেগে একটা ক্যাসেট তুলে নিয়ে ভি. সি. পি-তে চাপিয়ে দিল। কিছুক্ষণের মধ্যেই দুটি প্রায় উলঙ্গ নর-নারী টি ভি-র পর্দায় ওলটপালট খেতে লাগল। শুক্তি দেখছে খুব কৌতূহল নিয়ে। চিন্টু মাথাটা দু হাতে ধরে বসে পড়েছে একটা চেয়ারে। কিছুক্ষণ পর টি ভি-র সুইচ অফ করে দিয়ে শুক্তি ক্যাসেটটা বার করে নিল, তার পরে অ্যালবামটা তুলে ধরে বলল, ‘এগজিবিট নম্বর এক, তারপর ক্যাসেটটা লুফতে লুফতে বলল—এগজিবিট নম্বর দুই। নীলাদ্রি রায়ের বিচার হবে।’

চিন্টু মুখ তুলছে না।

শুক্তি বলল—‘এগুলো কারা দেখে জানিস? বুড়ো ভামরা, আর গেরুয়ারি স্বামীজী জাতীয় লোকেরা। তোর মতো একটা অল্পবয়সী ছেলের মধ্যে সেক্স প্রকাশ পাবে প্রেমের মধ্যে দিয়ে, আর যদি খুব ওভারসেক্সড হোস তো জাস্ট হ্যাভ হেলথি সেক্স উইথ সামবডি উইলিং! তাই বলে নীল ছবি দেখবি বাড়ি বসে বসে? এসপ্লানেড থেকে উলঙ্গ মেয়ের ছবি এনে দেখবি? রিয়্যালি…।’ শুক্তি পর্দা সরিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এল। পেছনে পেছনে চিন্টু চেঁচাচ্ছে ‘শুক্তি! এই শুক্তি। প্লীজ।’

দু-চারটে করে সিঁড়ি টপকাতে টপকাতে শুক্তি তার ঝোলা নিয়ে নীচে নেমে গেল। চিন্টু হতাশ হয়ে সিঁড়ির মাথায় দাঁড়িয়ে রইল। তার এখনও আশা শুক্তি দয়া করে জিনিসগুলো তাকে দিয়ে যাবে। এদিকে শুক্তি বেরিয়ে যাবার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই নীচে গাড়ি এসে দাঁড়াল। চিন্টু দেখল তার মা নামছে। সাদার ওপর লাল ছোপ ছোপ একটা সিল্কের শাড়ি। কপালে ধ্যাবড়ানো তেল-সিঁদুরের ফোঁটা। গলায় একটা জবাফুলের মালা। হাতে বেতের ছোট চ্যাঙারি। দৃশ্যটা এত অবাস্তব যে চিন্টু হাঁ করে তাকিয়ে রইল। তার মা তনুশ্রী রায় উঠে আসছে সিঁড়ি দিয়ে, গলায় জবাফুলের মালা। মাথাতেও সিঁদুর মাখামাখি। সে বেরিয়ে এসে অবাক হয়ে বলল—‘এ কি? মাম্মি? কোথায় গিয়েছিলে?’

তনুশ্রী জবাব না দিয়ে নিজের ঘরের দিকে চলে যেতে লাগলেন তাড়াতাড়ি। সমস্ত ব্যাপারটাই চিন্টুর কেমন অস্বাভাবিক লাগল। সে মায়ের পেছন-পেছন যেতে যেতে আবার জিজ্ঞেস করল—‘কোথায় গিয়েছিলে? মাম্মি?’

তনুশ্রী এবার কেমন নিস্তেজ গলায় বললেন—‘ঠাকুরবাড়ি।’

তখন চিন্টুর মনে পড়ল আজ তিন-চার দিন হয়ে গেল বস বাড়ি নেই। কোথাও থেকেই কোনও খবরও পাওয়া যায়নি।

সে বলল ‘ওসব ঠাকুর-ফাকুর কী হবে? অল বোগাস। আমি বুঝতে পারছি না তুমি এখনও পুলিশে খবর দিচ্ছ না কেন? তিনদিন হয়ে গেল চারদিন চলছে। ব্যাপারটা বিপজ্জনক হয়ে যাচ্ছে।’

তনুশ্রী তার কথার জবাব না দিয়ে নিজের ঘরে ঢুকে গেলেন। দরজাটা বন্ধ করে দিলেন। চিন্টু কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাঁধ দুটো শ্রাগ করে ফিরে এল।

ঘরে এসে সে চটপট তার ঝোল্লা জিনস আর টি শার্ট পরে তৈরি হতে লাগল। আসলে এখন এম.এ. পরীক্ষা চলছে। তার দেওয়ার কথা ছিল, সে বসছে না। তার য়ুনিভার্সিটির বন্ধুরা সকলেই পরীক্ষা দিচ্ছে। অন্যান্য বন্ধুরাও যে যার কাজে ব্যস্ত। দুপুরবেলায় শুধু শুধু ঘরে বসে কেউ নেই। ধুস্‌। বাড়িতে ভাল লাগছে না। মায়ের যে রকম মুড তাতে ঘরে মিউজিক-টিক চালানোও বোধহয় ঠিক হবে না। কোথাও থেকে ঘুরে আসা যাক।

সিঁড়ির মাথায় এসে পৌঁছেছে। এমন সময়ে তনুশ্রীর ঘরের দরজা খুলে গেল। তনুশ্রী বললেন—‘পুলিশে যাচ্ছ নাকি, চিন্টু! খবর্দার থানায় যাবে না কিন্তু।’

—‘বাট হোয়াই?’ চিন্টু ফিরে দাঁড়াল।

—‘সে তুমি বুঝবে না। ইউ নো নাথিং।’

হঠাৎ চিন্টুর শিরদাঁড়ার মধ্যে দিয়ে একটা হিম স্রোত নেমে গেল। মা কি বাবাকে খুন-টুন করেছে নাকি? লাশটা লুকিয়ে রেখেছে! কী অদ্ভুত ব্যবহার করছে! সে এগিয়ে এসে মায়ের মুখোমুখি দাঁড়াল— বলল— ‘অল রাইট। জানি না। কী জানি না? যা নাকি তুমি জানো!’

তনুশ্রী কাঁপা-কাঁপা গলায় বললেন—‘বিজনেসের ব্যাপার। কোথায় কী করে রেখেছে কে জানে, কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে যদি সাপ বেরোয়!’

—‘এই তো সেদিন তুমি বলছিলেন বাবা কাঁচা কাজ করে না।’

তনুশ্রী ভয়ার্ত দৃষ্টিতে ছেলের দিকে তাকিয়ে রইলেন, কিছু বলতে পারলেন না।

—‘কিছু লুকোচ্ছ আমার কাছে। ডেফিনিট। কী লুকোচ্ছ বলো তো?’ চিন্টু কড়া গলায় জিজ্ঞেস করল।

—‘ঠিক আছে। যাও, তোমার যদি ইচ্ছে হয় থানায় যেতে পারো। কিন্তু ফল ভোগ করতে হবে তোমাকেই। যাও, ঠিক আছে যাও।’ কেমন অসংলগ্ন ভাবে কথাগুলো চেঁচিয়ে বলে তনুশ্রী আবার দরজা বন্ধ করে দিলেন।

গারাজের কাছে বাগানে একটা ঢিপির ওপর সমর বসেছিল, চিন্টুকে আসতে দেখে উঠে দাঁড়াল। বলল—‘দাদা, সাহেবের কোনও খবর পাওয়া গেল?’

চিন্টু বলল— ‘বাবা হঠাৎ একটা এস.টি.ডি পেয়ে পাটনা গেছে।’

—‘পাটনা?’ সমর অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে।

—‘সাহেব কি ফোন-টোন করেছিলেন?’

—‘না হলে আর জানছি কোথা থেকে?’ রুক্ষ গলায় বলল চিন্টু।

—‘বিশ্বাসবাবু বড্ড ব্যস্ত হচ্ছেন। ওঁকে তো কেউ জানায়নি, তাহলে বলে আসব খবরটা?’

—‘বলতে পারো। তবে ড্যাড দু-চার দিনের মধ্যেই এসে যাচ্ছে।’

সমর ড্যাবড্যাব করে চিন্টুর দিকে তাকিয়ে রইল। সে একটা কথাও বিশ্বাস করেনি। সে সাহেবকে চেনে কিন্তু তাঁর এই ছেলে-মেয়েদের একেবারেই চেনে না। এরা তার কাছে বিলেত-আমেরিকার মানুষ। কিন্তু শুধু-শুধু মিথ্যে কথাটা কেন বলল সাহেবের ছেলে সেইটা তার মাথায় কিছুতেই এল না। চিন্টু তার পাশ দিয়ে গাড়িটা নিয়ে বোঁ করে বেরিয়ে গেল। শীতের হাওয়ায় তার চুল উড়ছে। চোখে সানগ্লাস, তলায় চোখের ভাব কিছুই পড়া যায় না।

মায়ের সঙ্গে থানা-পুলিশের কথা হলেও চিন্টু কিন্তু আদৌ সে দিকে গেল না। এই সিদ্ধান্ত নিতে হলে মায়ের সমর্থন চাই। তার জীবনের বৃত্তের মধ্যে থানা-পুলিশ এসব গুরুত্বপূর্ণ এবং জটিল ব্যাপার পড়ে না। সে বাইরে শিস দিতে দিতে গাড়ি চালালেও ভেতরে-ভেতরে এসব ভয় পায়। প্রথমটা কোথায় যাবে সে ঠিক করতে পারেনি, তার পরে ভেবে-চিন্তে সোহনের বাড়ির দিকে গাড়ি চালাল। সোহন ফটোগ্রাফার, তাকে এ সময়ে তার ডার্করুমে পাওয়া গেলেও যেতে পারে। বেথুন কলেজের পেছন দিকের গলিতে থাকে সোহন। একটা বিরাট পোড়ো বাড়ির একতলায়। বিডন স্ট্রিটে ঠিক বেথুন কলেজের গেটের দিকে মুখ করে সে বেশ কিছুক্ষণ গাড়ি থামিয়ে বসে রইল। তেমন কেউ যদি বেরোয়। কিন্তু কিছুক্ষণ পর তার হঠাৎ শুক্তির সমস্ত কথাগুলো মনে পড়ে গেল। সে বলল— ‘ধুস, মুডটাই দিলে নষ্ট করে।’ তারপর সোহনের বাড়ি গিয়ে হাজির হল।

এ বাড়ি কলকাতার আদি ধনীবাড়ির একটা। শরিকে শরিকে ভাগ হয়ে গেছে। অনেকে এ বাড়ি থেকে চলেও গেছে। একতলার বাঁ দিকে বিরাট একটা লাইব্রেরি। ঠাসা আইনের বই এবং বাঁধানো জার্নাল। এটাতে বসেন সোহনের কোনও কাকা-টাকা। ডান দিকে দু খানা ঘর। প্রথমটাতে সোহন বসে, আড্ডা মারে। ঘরটা ভর্তি তার তোলা নানা ফটোর প্রিন্টে। কিছু বাঁধানো, কিছু সুদ্ধ বোর্ডের ওপর পিন দিয়ে আটকানো। ভেতর দিকটায় সোহনের ডার্করুম। দরজায় টোকা দিয়ে চিন্টু চেঁচিয়ে বলল— ‘সোহন, কাম আউট ম্যান।’

—‘কে দুপুরবেলা চিল্লাচিল্লি করছিস! উল্লুক কাঁহাকা!’

চিন্টু গলা ছেড়ে বলল— ‘কুইক’।

ডার্করুমটার ভেতর থেকে সাবধানে শুক্তি বেরিয়ে এল। চিন্টু তাকে দেখে ঘাবড়ে গিয়ে ঢোক গিলল। তারপর বাঁকা হাসি হেসে বলল— ‘মাদ্‌মোয়াজেল কি ডার্করুমে লাল ছবি দেখছিলেন?’

শুক্তি গম্ভীরভাবে কেটে কেটে বলল—‘একজিবিটগুলো এখনও পীপলস কোর্টে পেশ করিনি।’ এই সময়ে সোহনও বেরিয়ে এল, বলল— ‘এই শালা, চাঁচাইছিলি ক্যানে?

চিন্টু বলল— ‘না মানে, আমি ঠিক তাদের ডিসটার্ব করতে চাইনি। আই কোয়াইট আন্ডারস্ট্যান্ড। পারভেজ মে গেট ম্যাড। বাট আই আন্ডারস্ট্যানড।’

শুক্তি ঝোলার ভেতর থেকে অ্যালবামটা বার করে চট করে সোহনের দিকে ছুঁড়ে দিল, বলল ‘পেশ করলুম, এগজিবিট এ।’ জিনিসটা ছিনিয়ে নিতে চেষ্টা করেছিল চিন্টু কিন্তু সোহন তার থেকে অনেক ক্ষিপ্র। সে একেবারে সোজা ক্যাচ লুফে নিয়ে অ্যালবামটা খুলেই বলল— ‘হা! দিস ইজ সামথিং। কার কাছে তোলালি রে শুক্তি! আমি তো মনে করতে পারছি না তুলেছিলুম বলে।’

চিন্টু টেবিল চাপড়ে বলল— ‘হিয়ার হিয়ার!’

শুক্তি রাগে কথা বলতে পারছিল না, ফুঁসতে ফুঁসতে শুধু বলতে পারল— ‘ইউ মীন থিংস!’ সে বেরিয়ে যাচ্ছিল, সোহন লম্বা হাত বাড়িয়ে, তার চুলের ঝুঁটিটা খপ করে ধরে ফেলে বলল— ‘আরে রাগ করিস কেন?’

চিন্টুর হঠাৎ তার সমস্যাটার কথা মনে পড়ে গেল। সে বলল— ‘শুক্তি তুই তো নিজের আই.কিউ নিয়ে খুব বোস্ট করিস। আমার একটা প্রবলেম সল্‌ভ্‌ করে দিতে পারবি?’

—‘তোর প্রবলেম? তুই তো বিরাট একটা নিজেই প্রবলেম, আশিরনখদন্তহস্তপদ।

—‘কী কী বললি? বিরাট একটা গালাগাল দিলি মনে হচ্ছে?’

শুক্তি বাঁকা হাসি হেসে বলল— ‘এবারটা থাক। পরের জন্মে নিশ্চয়ই বুঝতে পারবি। আশা রাখ। আশা হারাস না।’

চিন্টু বলল— ‘না রে রাট-টাগ রাখ। সোহন উই আর ইন আ ফিক্স। আমার বাবাকে পাওয়া যাচ্ছে না।’

সোহন কাগজ পাকিয়ে কানে সুড়সুড়ি দিতে দিতে বলল— ‘কী বললি। আবার বল? কানে শালা এমনি খোল জমেছে। তোর বাচ্চাকে পাওয়া যাচ্ছে না। এর মধ্যে কবে আবার বাচ্চা পাড়লি বাওয়া।’

চিন্টু বলল—‘দিস ইজ নো জোক সোহন। আজ নিয়ে সাড়ে তিনদিন পুরো হয়ে গেল ড্যাড বাড়ি ফিরছে না। ভোরবেলায় দুটো সুটকেস হাতে করে বেরিয়ে গেছে। কোনও খবর নেই। কাউকে কিছু বলেও যায়নি।’

—‘দ্যাখ, ইনকাম ট্যাক্স থেকে রেইড-টেইড করবে খবর এসেছে হয়ত।’

চিন্টু রাগ করে বলল— ‘ঠিক হ্যায়। চললুম। মনে থাকবে। বিপদের সময়ে সো-কলড্‌ বন্ধুদের ব্যবহার মনে থাকবে। সানগ্লাসটা সে মাথার ওপর থেকে নামিয়ে নাকের ওপর বসিয়ে দিল। পেছন ফিরছিল।

শুক্তি বলল— ‘কী ব্যাপার? একটু আগেই তো তোর বাড়ি থেকে ঘুরে আসছি। তখন তো বলিসনি কিছু।’

চিন্টু বলল— ‘সরি। একদম ভুলে গিয়েছিলাম। ইনফ্যাক্ট উই আর নট অ্যাকাসটম্‌ড টু হ্যাভিং আওয়ার ড্যাড অ্যারাউন্ড। তুই চলে যাবার পর আমার মা কোথা থেকে পুজো-টুজো দিয়ে মা-কালী সেজে বাড়ি ফিরল তখন মনে পড়ে গেল। ইট ইজ সীরিয়াস। মাকে আমার কেমন অ্যাবনর্ম্যাল লাগল। অথচ কিছুতেই পুলিশে খবর দিতে দেবে না।’

শুক্তিকে দেখে মনে হল তার দুর্গে দুর্গতিনাশিনী রূপটা আগেকার পতিতোদ্ধারিণী রূপটার দখল নিয়ে নিয়েছে। সে বলল— ‘সোহন এদিকে একটু মন দে, কানটা পরে পরিষ্কার করিস। ইজিয়ান স্টেবল্ একদিনে পরিষ্কার হয় না।’

সোহন তার চেয়ারটা এগিয়ে নিয়ে বসে বলল— ‘বল কী বলবি।’

চিন্টু মুখ গোমড়া করে বলল— ‘আর কী বলব? আই হ্যাভ অলরেডি টোল্ড ইয়ু। অ্যাবাউট থ্রি ডেজ ব্যাক, ড্যাড জাস্ট ওয়াকড আউট উইথ টু ব্যাগস।’

—‘কে দেখেছিল?’

—‘ন্যাচারেলি নো বডি। নো বডি ওয়াজ দেয়ার টু সি। এনি ওয়ে ইট ওয়াজ ইদার আফটার মিডনাইট, অর দ্য স্মল আওয়ার্স।’

—‘কী করে জানলি দুটো ব্যাগ না কী নিয়ে গেছেন?’

—‘ওই দুটোই মিসিং। একটা ভি.আই.পি, মাম্মি বলছে সব সময়ে ট্যুরের জন্যে রেডিকরা থাকতই। আর একটা।’

—‘তাহলে হয়ত ট্যুরেই গেছেন। বলছিস বাড়িতে কেউ ছিল না? হাউ কাম?’

চিন্টু বিরক্ত মুখে বলল—‘এগুলো আনইমপর্ট্যান্ট। ছিল না কেউ। বাস।’

শুক্তি বলল— ‘কেউ নেই সারারাত, এরকম তোদের বাড়িতে প্রায়ই হয় না কি?’

চিন্টু চিবিয়ে চিবিয়ে বলল— ‘কেন? তুই তাহলে যাবি? না কী? নাইট স্পেন্ড করতে?’

শুক্তি খুব রেগে-মেগে কিছু বলতে যাচ্ছিল, হঠাৎ চুপ করে গেল। তারপর বলল— ‘সোহন, এত স্পর্শকাতর সাক্ষী হলে তদন্ত সম্ভব নয়। আমি চললাম।’ সে আর একটুও দাঁড়াল না। বলতে বলতেই চলছিল, একেবারে চৌকাঠের বাইরে নাগালের বাইরে চলে গেল।

চিন্টু রাগে মুখ লাল করে বলল— ‘সোহন তোর হিপক্রিসির একটা সীমা থাকা। উচিত। তুই জানিস না মনডে নাইট আমি কোথায় ছিলাম? রাসকেল একটা!’

সোহন ডানহাতটা তুলে বলল— ‘ঠিকাছে ঠিকাছে। আম্মো যেখানে, তুম্মো সেখানে। কিন্তু বেবি, তোমার সিসু, তোমার মা? তারাও কি সেখানে বা ওইরকম কোথাও ছিল?’

চিন্টু বলল— ‘জবান সমহালকে সোহন, য়ু আর টেকিং টু মেনি লিবার্টিজ। দেয়ার্স নো নীড টু পোক ইয়োর ব্লাডি নোজ ইনটু আওয়ার প্রাইভেট অ্যাফেয়ার্স।’

—‘অ রাইট, অ রাইট, বাট ইয়োর পা ইজ অ্যাবসকন্ডিং, দ্যাট টূ ইজ ইয়োর প্রাইভেট অ্যাফেয়ার। তো সেই থলি কা বিল্লি ভি তুমি এখানে ছাড়লে কেন? এতে যদি টাচি।’

চিন্টু বলল— ‘অ্যাবসকন্ডিং? হোয়াট ডু ইউ মীন সোহন?’

—‘আরে খেপছিস কেন?’ সোহন এবার চেয়ার আরেকটু এগিয়ে নিল, পা দুটো সোজা করে ঝুলিয়ে দিল, পিঠ সোজা। —‘আফটার অল আমাদের তো ইনভেস্টিগেটিং স্পিরিটেই সবটা দেখতে হবে। কী কী সম্ভাবনা আছে, থাকতে পারে? এতে একটা বাচ্চা মেয়ের মতো থেকে থেকেই ঠোঁট ফোলাবার কী মানে? ইভন শুক ইজ মোর ম্যাচুওর দ্যান য়ু।’

—‘ঠিক আছে বলো, কী বলছ!’

—‘তোমার বাবা বড় বিজনেস ম্যান। দুটো বড় বড় স্যুটকেস হাতে মাঝরাতে কি ভোর সকালে বেরিয়ে গেছেন, অ রাইট?

—‘রাইট।’

—এখন প্রথমেই যেটা মনে হবে সেটা হচ্ছে, বাড়িতে ঠেসে রাখা সোনার বিস্কুট-টিস্কুট, টাকা, না বিস্কুট ওনলি বিস্কুট, এনি ওয়ে দা ডিটেইলস মে বি সেট্‌লড্‌ লেটার। এই সমস্ত নিয়ে কোথাও রেখে আসতে গেছেন আই.টি. থেকে রেইড করবে জানতে পেরে।’

—‘তা, তিনদিন হয়ে গেল রেইড কই হল না তো? কোনও চিহ্নই নেই।’

—‘ঠিকাছে। বাবার অফিস, টফিস এরা কী বলছে?’

—‘ড্রাইভার থেকে, ওয়ার্কস ম্যানেজার থেকে সব্বাই ফোন করে জানতে চাইছে, সাহেব আসছেন না কেন! ইনকাম ট্যাক্‌স ফ্যাক্‌স নিয়ে কোনও কথাই কেউ বলেনি।’

—‘অ রাইট। তোর বাবার ইনকম-ট্যাক‌স্‌ নিয়ে কে ডীল করে, জানিস?’

—‘নো। আই নো নাথথিং।’

—‘জেনে নিতে পারবি তো? অফিসের কোনও কর্মচারী নেই, যাঁর সঙ্গে এসব কথা বলা যায়?’

—‘ও, নো,’ চিন্টু বলল, তারপর তর্জনী নেড়ে বলল—‘আছে একজন। সাধন বিশ্বাস, বোধহয় সবচেয়ে পুরনো লোক। কিন্তু আমার সঙ্গে কোনও কানেকশন নেই।’

—‘ওঁর কাছ থেকে জানতে চা, ইনকাম-ট্যাক্স কে দেখে। আয় আমি ডায়াল করছি। নম্বরটা বল।’

চিন্টু ভীষণ ইতস্তত করতে লাগল, বলল—‘আমি কখনও ড্যাডের অফিসে কারও সঙ্গে…মানে দা হোল থিং উইল বি আউট।’

—‘তোর ড্যাড যদি আজকালের মধ্যে ফিরে না আসেন, তাহলে এনি মোমেন্ট ইট উইল বি আউট, সেই জন্যেই একজন বিশ্বস্ত লোকের কথা বলছি। অলরাইট কী নাম বললি ভদ্রলোকের সাধন বিশ্বাস? কী বলে ডাকিস?’

—‘ছোটতে সাধনকাকা বলতাম। এখন কিছু বলি না।’

—‘নম্বরটা বল, তুই বুঝতে পারছিস না, আমাদের এক-একটা করে সম্ভাবনা বাদ দিতে হবে। প্রসেস অফ সায়েন্টিফিক এলিমিনেশন। নম্বরটা বল, কুইক! কিছু হবে না। ঘাবড়াও মাত।’

নম্বরটা শুনতে শুনতে ডায়াল করতে লাগল সোহন।

—‘মে আই স্পিক টু সাধন বিসোয়াস প্লীজ।’ সোহন নিজেই কথা বলতে লাগল।

—‘ও, সাধনকাকা! আমি চিন্টু মানে নীলাদ্রি বলছি। ড্যাডের ইনকাম-ট্যাক্স কারা দেখেন?’

ওদিক থেকে সাধন বিশ্বাস আর্তগলায় বললেন—‘কেন চিন্টু! দাদা কোথায়? আমাদের এদিকে একগাদা কাজ-কারবার সব আটকে আছে। কোথায় গেলেন দাদা?’

—‘আরে ড্যাড তো রাঁচি গেছে।’

—‘রাঁচি? এই যে সমর বলছে, তুমি বলেছ পাটনা!’

চিন্টু এদিক থেকে লাফিয়ে উঠে ঢোক গিলল, বলল—‘সর্বনাশ!’ সোহন তার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে আশ্বস্ত করার ভঙ্গিতে বাঁ হাতটা নাড়ল, তারপর ফোনের মধ্যে বলল—‘সরি, সাধনকা, অ্যাকচুয়ালি ড্যাড কোথায় গেছে, কাউকে বলে যায়নি। মানে আমরা কেউ সে সময়টা ছিলাম না। কিন্তু গেছে, খুব কাজে এটুকু জানি।’

—‘তো ইনকাম ট্যাক্সের কথা জিজ্ঞেস করছ কেন?’

—‘মানে, ইজ ইট ইন অর্ডার?’

—‘প্রতিটি পাই-পয়সা। দাদা এসব বিষয়ে খুব সাবধান।’

—‘ওক্কে, আমার এক বন্ধুর সঙ্গে বাজি ছিল, তাই জিজ্ঞেস করছিলুম, বা-ই।’ ফোন রেখে দিল সোহন।

চিন্টু চোখ বড় বড় করে তার দিকে চেয়েছিল। সোহন বলল—‘বাকআপ বেবি, দিস সাধনকা ম্যান সীমস রিলায়েবল। ইটস নট আই. টি.।’

—‘তা হলে?’ চিন্টু বলল।

—‘ঘাবড়সনি। ধর কোনও বদমাশ তোর ড্যাডের কাছ থেকে একটা হিউজ অ্যামাউন্ট চেয়েছে। প্রাণের ভয় দেখিয়েছে। তোর প্রাণও হতে পারে। ওই ত্রিপুরা আসামের মতন। হয়ত সেটাই পৌঁছে দিতে গিয়ে বিপদে পড়ে গেছেন।’

—‘এই কথাটা আমি একেবারে গোড়ার থেকেই বলে আসছি। যখন দেখলাম আয়রন-চেস্ট একদম ফাঁকা। মাম্মি কিছুতেই মানতে চাইছে না। খালি বলে যাচ্ছে ও চেস্টে কিছু থাকত না। এদিকে মাই মাম্মি ইজ অ্যাক্টিং মিস্টিরিয়াস। পুলিশে খবর দিতে দেবে না। ড্যাড কোনও বদলোকের খপ্পরে পড়েছে মানবে না।’

চোখ সরু করে সোহন বললে—‘কী বললি? মাম্মি অ্যাক্টিং মিস্টিরিয়াস! পুলিশে খবর দিতে দিচ্ছেন না?’

—‘হ্যাঁ। এদিকে ঠাকুরবাড়িতে পুজো দিতে গিয়েছিল।’

—‘ডোন্ট মাইন্ড নীলাদ্রি, তোর বাবা-মা’র মধ্যে সম্পর্ক কেমন?’

—‘কেমন?’ চিন্টু আকাশ-পাতাল ভাবতে লাগল।

—‘মানে ঝগড়া, মন-কষাকষি, ফাইটিং।’

—‘নট দ্যাট আই নো অফ’ চিন্টু বলল, তারপর বলল—‘মাই মাম্মি ইজ আ গ্রেট লেডি। শী ডাজ লটস অফ সোশ্যাল ওয়ার্ক। অ্যাকচুয়ালি শী হ্যাজ আ লাইফ অফ হার ওন।’

—‘প্যারালাল?’ শোহন জিজ্ঞেস করল।

—‘কী বললি?’

বললাম, ‘—ইজ ইট আ লাইফ রানিং প্যারালাল টু ইয়োর ড্যাড’স? দা টোয়েন শ্যাল নেভার মীট…টাইপ?’

চিন্টু কিছুক্ষণ ভেবে বলল—‘আমি ঠিক বলতে পারছি না। ইন ফ্যাক্ট, আমি বাড়ি-টাড়ি মা-বাবা-টাবা নিয়ে কোনও দিন ভাবিনি।’

সোহন হঠাৎ গম্ভীরমুখে বলল—‘চিন্টু, লেটস ড্রপ ইট। মানে তোর মা যখন বলছেন পুলিশে খবর দেবার দরকার নেই, তখন…ইটস হার প্রবলেম। আফটার অল।’

—‘সো আই অ্যাম ব্যাক টু স্কোয়ার এ?’ চিন্টু আরও গম্ভীর মুখে বলল।

—‘দ্যাখ না, দু-চার দিনের মধ্যেই একটা কিছু খবর পেয়ে যাবি।’ হালকা গলায় সোহন বলল, ‘ডোন্ট ওয়ারি। চল বরং একটু ঘুরে আসি। তোর ঘোড়াটা রয়েছে তো?’

চিন্টু বলল— ‘চল।’

সোহন তার ব্যাগের মধ্যে একটা ক্যামেরা বেছে ভরে নিয়ে বলল, —‘চল আজ ফুলের ছবি তুলব। হর্টিকালচারে চল।’

অন্যমনস্কভাবে কর্নওয়ালিস স্ট্রিটে গাড়ি ঢোকাচ্ছিল চিন্টু। সোহন বলল—‘এই, এই, সোজা বিডনি স্ট্রিট দিয়ে সার্কুলার রোড ধরে নে। পার্কসার্কাস থেকে পারভেজকে তুলে নেব। যদি খচ্চরটা থাকে।’

চিন্টু বলল—‘বিডনি স্ট্রিটটা কী বস্তু?’

—‘জানিস না? বিডনি স্ট্রিট, কলেজে স্কোয়ার, হরি ঘোষের স্ট্রিট—এসব শুনিসনি?’

—‘নেভার ইন মাই লাইফ।’

—‘আরে বাঙালি জিভ ইংরিজি যুক্তাক্ষর উচ্চারণ করবার আগে একটু দম নিত, ফট করে হসন্ত থেকে যুক্তাক্ষরে যেতে চাইত না। আমার ঠাকুর্দা, বাবার মুখে শুনেছি, জ্যাঠাদেরও বলতে শুনেছি। বিউটিফুল লাগত শুনতে।’

—‘হরিব্‌ল’ চিন্টু বলল, ‘বাস-ড্রাইভারগুলো বর্বন রোড বর্বন রোড় করে চেঁচায়!’

—‘ওহ নো নো নো’ সোহন সজোরে প্রতিবাদ করে উঠল, ‘এই জ্যাঠা-কাকারা কিন্তু যখন ইংরিজিতে সওয়াল করবে, তর্কবিতর্ক করবে, পরিষ্কার বলবে। কিন্তু বাংলায় বলবার সময়েই ইনভেরিয়েবলি কলেজে স্ট্রিট। অদ্ভুত সাইকলজি আর অদ্ভুত জিভ। জিভের সাইকলজি বলতে পারিস। এই চিন্টু দাঁড়িয়ে গেলি কেন?’

চিন্টু বলল, ‘একটা মেয়ে রাস্তা ক্রস করছে দ্যাখ।’

সোহন দেখল, তারপর বলল, ‘তোর সানগ্লাসটা দে একবার।’ চিন্টুর সানগ্লাস পরে সে ভাল করে মেয়েটিকে দেখল। চিন্টু বলল—‘লিফট দিতে চাইব?’

—‘চা’ সোহন সানগ্লাসটা পরে সিটে হেলান দিয়ে চূড়ান্ত বিশ্রামের ভঙ্গিতে নিজেকে ন্যস্ত করল। চিন্টু শাঁ করে গাড়িটা নিয়ে মেয়েটির পাশে পার্ক করল। মেয়েটি বাস স্টপে দাঁড়িয়েছে। সালোয়ার কামিজ পরেছে, কোনও শীতের পোশাক নেই। কাঁধ থেকে একটা বড়সড় ব্যাগ ঝুলছে।

—‘হাই!’ চিন্টু বলল।

প্রথমে মেয়েটি চমকে উঠেছিল, তারপরে বলল—‘হাই।’ সামান্য একটু হাসির আভাস মুখে।

—‘হোয়্যার ক্যান আই ড্রপ য়ু?’

মেয়েটি দাঁত ঝিকিয়ে হাসল। একটা খুব মনোহর গজদাঁত বাঁদিকে।

রাস্তার দিক থেকে চিন্টুর কাঁধের ওপর হঠাৎ একটা থাবামতো হাত পড়ল।

—‘হোয়াটস হ্যাপনিং হিয়ার?’ একটি লম্বা-চওড়া যুবক।

চিন্টু খানিকটা কুঁকড়ে গিয়ে বলল—‘ওহ নাথিং। ওনলি অফারিং হার আ লিফট। নো ট্রাবল।’

—‘গেট অ্যালং।’ তার কাঁধের ওপর একটা থাবড়া দিয়ে যুবক সরে গেল। চিন্টু গাড়িতে স্টার্ট দিল।

যুবকটি মেয়েটির পাশে গিয়ে দাঁড়াল, বলল—‘যত্ত বড়লোকের বকা ছেলে! এক পয়সা রোজগার করতে হয় না। ফান্টু সেজে ঈভ-টিজিং করে বেড়াচ্ছে। দোব শালা একদিন এমনি চাবকে…’

চিন্টুর গাড়ি দ্রুত সার্কুলার রোডের দিকে চলে যাচ্ছে। সোহন সিটে এলিয়ে থেকেই বলল—‘শুনলি?’

চিন্টুর ভেতরটা চিড়বিড় করছিল। সে চুপ করে রইল। সোহন একটু পরে আবার বলল—‘কী রে ডাম নাকি?’

—‘ইয়া ডেফ অ্যান্ড ডাম। এবার বল তোকে কোথায় নামিয়ে দেব।’ টোম্যাটোর মতো লাল হয়ে চিন্টু বলল।

—‘কোথায় নামিয়ে দেব, মানে? পারভেজকে তুলে হর্টিকালচারে যাবি না?’

—‘ন্‌ নো। তুই এইখানে তোর এই বিডনি স্ট্রিটে নেমে যা। যা বলছি।’ কাঁধ দিয়ে সে সোহনকে জোরসে ঠেলা দিল।

—‘যা বাব্বা,’ সোহন গাড়ির দরজা খুলে টলমল করতে করতে নেমে গেল।

—‘সি ইউ।’ কোনও জবাব দিল না চিন্টু। শাঁ করে সে সার্কুলার রোডে পড়ল। তারপর দক্ষিণের দিকে গাড়ি ছুটিয়ে দিল।

যত জোরেই গাড়ি ছোটাতে ইচ্ছে থাক, ছোটানো যায় না। প্রত্যেক মোড়ে গোঁত্তা খেয়ে খেয়ে থেমে যেতে হয়। এবং দাঁতে দাঁত পিষে গালাগাল দিতে হয়। হোয়াট আ কানট্রি! হোয়াট আ স্টেট! হোয়াট আ সিটি! হোয়াট স্ট্রিটস! হোয়াট পীপল। মাই গড! রাগে উন্মত্ত হয়ে থামতে থামতে, গোঁত্তা খেতে খেতে অবশেষে লোয়ার সার্কুলার রোডে এসে রাস্তা একটু স্বচ্ছন্দ হল। বালিগঞ্জ সার্কুলারে পৌঁছে সে ভেবেছিল এবার একটা ছোট্ট ট্র্যাফিক লাইট পেরোলেই সব ফাঁকা! কিন্তু তা হল না। সে দেখল বুড়োমতো একটা মুখ তার দিকে চেয়ে আছে, গাড়ি কাটিয়ে কাটিয়ে চলে এল পাশে।

‘নীলাদ্রি। কোথায় যাচ্ছ?’

মেজ জ্যাঠা। বহুদিন দেখা-সাক্ষাৎ নেই। সম্প্রতি ঠাম্মার কাজে না দেখে থাকলে চিন্টু চিনতে পারত না।

—‘তুমি কোথায় যাচ্ছ?’

—‘যাব বাড়ি। গড়িয়াহাট পর্যন্ত একটু পৌঁছে দেবে নাকি? ও দিকেই তো যাচ্ছ!’

—‘এসো।’ চিন্টু গাড়ির দরজা খুলতে টুক করে ঢুকে ধুপ করে বসে পড়ল মেজ জ্যাঠা। আড়চোখে দেখল চিন্টু। মাথায় গোল টাক। ধারে ধারে চুলগুলো সবে গজাতে শুরু করেছে। সাদা হয়ে আছে। তার ড্যাডের মাথায় প্রচুর চুল। দু-পাঁচটা সাদা হয়েছে কি হয়নি! যেগুলো সাদা হয়েছে মাথাময় কেমন বিউটি সৃষ্টি করে ছড়িয়ে থাকে। ঠাম্মা মারা যেতে মেজ জ্যাঠা, সেজ জ্যাঠা সবাই ন্যাড়া হল, খালি ড্যাড হয়নি। ঠাম্মা নাকি বারণ করে গিয়েছিল। গড নোজ হোয়াই। ওল্ড হ্যাগ। যত রকম কুসংস্কারের ডিপো একটা। হঠাৎ ড্যাডের চুলের ওপর থেকে ধর্মীয় অনুশাসন উঠিয়ে দিল কেন সে জানে না।

—‘তোমার এম. এ পরীক্ষা চলছে না?’

বাস। নাও এবার। চ্যারিটির ঠেলা সামলাও। বুড়ো। আরেকটা বুড়ো। সব খবর রাখে। মাস্টারি ব্রেইন। সব টুকে রেখেছে। কবে পরীক্ষা আরম্ভ, কবে কী পেপার, কবে রেজাল্ট বেরোচ্ছে। এভরিথিং!

—‘আজ নেই।’ সে আন্দাজে একটা ছুঁড়ে দিল।

—‘নেই?’ মেজ জ্যাঠা বিড়বিড় করে বলল। ‘আমার ধারণা ছিল আজ সেকেন্ড পেপার।’

চিন্টু উত্তর দিল না।

—‘বউমা, তিতি সব ভাল আছে?’

—‘হ্যাঁ।’

—‘বিজু?’

আড়চোখে আরেকবার চাইল চিন্টু। জানে নাকি? জেনে গেছে? দিস ওল্ড নেভ? জেনেশুনেই বোধহয় আরও জানবার জন্যে গাড়ির অলিগলি পেরিয়ে এসে জুটল। সে বলল, —‘কী মনে হয়?’

মেজ জ্যাঠা হতভম্ব হয়ে তার দিকে চাইল। —‘কী মনে হয়? মানে?’

—‘মানে, ড্যাড, তোমার ছোট ভাই কীরকম থাকতে পারে?’

মেজ জ্যাঠার চোখের ভাবটা বদলে গেল। সেখানে একটা রাগ বা ক্ষোভ ধরনের কিছু দেখতে পাচ্ছে চিন্টু। সে বলল—‘ভাল আছে। আবার কী?’

—‘সেটা গোড়াতেই বললে পারতে! দেখা হলে আপনার লোক কুশল প্রশ্ন করেই থাকে।’

—‘অলরাইট, সরি, ইট ওয়াজ আ জোক।’

—‘জোক!’ মেজ জ্যাঠা কিছুটা আহত কিছুটা হতবুদ্ধি চেহারা নিয়ে বসে রইল। চিন্টু একবারও জানতে চাইল না মেজ জ্যাঠা, রবিদা, কুমকুমদি, টুলটুলদি, কুমকুমদির বর এদের সব কী খবর। কে কেমন আছে। ড্যাম ইয়োর সোশ্যাল ফর্ম্যালিটিজ—সে একটা বুড়ো নয়। বুড়ো ভাম। কে যেন কথাটা ব্যবহার করেছিল? অনেকক্ষণ ভাববার পর মনে হল শুক্তি। তাকেই বলেছিল বুড়ো ভাম। বুড়োটা বোঝা গেল। ভামটা কী? ভ্যাম্প নাকি? বিডন স্ট্রিটকে বিডনি স্ট্রিট বানানোর মতো কোনও বেঙ্গলিফিকেশন করেছে ভ্যাম্প শব্দটার?

গড়িয়াহাটের মোড়ে নেমে গেল মেজ জ্যাঠা। গম্ভীর মুখে বলল —‘আচ্ছা। কষ্ট দিলাম তোমাকে।’

‘প্লেজার! প্লেজার!’ যথাসাধ্য হাসিমুখ করে চিন্টু বিড়বিড় করল। মেজ জ্যাঠা দুটো স্টলের মাঝখান দিয়ে যাবার সময়ে কী জানি কী ভেবে একবার ফিরে তাকাল। হঠাৎ যেন একটা আচমকা ধাক্কা খেল চিন্টু। ড্যাড। অবিকল তার ড্যাড। বুড়ো। টাক মাথা। রোগা। ধুতি পাঞ্জাবি-ছাতা-তালতলা-শালে একেবারে বিপরীত। তবু, তা সত্ত্বেও তার ভেতর থেকে বেরিয়ে আসছে। নির্ভেজাল তার ড্যাড।

ড্যাডকে বড় হওয়ার পর সেভাবে চেয়ে দেখেনি সে। ছোটবেলায় সাংঘাতিক অ্যাডমায়ার করত। ড্যাড় যেন স্পাইডারম্যান, টার্জান, যেখানে যা কিছু বীরত্বব্যঞ্জক, পুরুষালি, সব কিছুই ড্যাড। গ্রে সুট, মেরুন টাই পরে মসমস করে চলে যাচ্ছে ড্যাড। একটা মৃদু সুগন্ধ ছড়িয়ে গেল বাতাসে। সমর গাড়ির দরজা খুলে ধরেছে। —‘ড্যাড, ড্যাড।’

চিন্টু একটু দেরি করে ফেলেছে। ড্যাড বোধহয় শুনতে পায়নি। কেননা গাড়িটা হুশ করে বেরিয়ে গেল। সত্যি কথা বলতে কি সেই থেকেই, এরকম কারুর নাকের ওপর দিয়ে হুশ করে গাড়ি হাঁকিয়ে বেরিয়ে যেতে ভালবেসেছে সে। রাত্রে একসঙ্গে ডিনার খায় না তারা কত দিন হয়ে গেল। অর্ধেক দিন মাম্মি থাকে না। তিতি আর ড্যাডের সঙ্গে বসে খেতে তার ভাল লাগে না। কেমন যেন উদোম বোধ করে সে। মা থাকলে একটা ভদ্র আড়াল। একটা সুচারু অনুষ্ঠান। নইলে কে কী বলে উঠবে, কার দৃষ্টি কিসের ওপর পড়বে—সে জানে না। সে বদনকে বলে রেখেছে মা না থাকলে তার ডিনার যেন ঘরে সার্ভ করা হয়। তাই-ই চলে আসছে। ত&#