Monday, April 29, 2024
Homeবাণী-কথাবৃত্তের বাইরে - বাণী বসু

বৃত্তের বাইরে – বাণী বসু

বৃত্তের বাইরে বাণী বসু

শেয়ার-বাজারে লাখ তিন চার ডুবে গেল। ক বছর ধরেই তেজী চলছিল বাজার। দালাল প্রকাশ দেওরা যেমন যেমন বলেছে তেমন তেমনই করতে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলেন বিজু রায়। তিনি নিজে শেয়ারের পাতাটা খেলার পাতার মতোই একবার উল্টে দেখেন মাত্র। দেওরা শেয়ারের ঘুণ, এমন ভুলটা কী করে করল বিজু রায়ের মাথায় আসে না। মুখ দেখাচ্ছে না লজ্জায়। রক্ষা এই যে আরও যায়নি। কেব্‌ল ম্যানুফ্যাকচারিং-এর বিরাট বিজনেস তাঁর মূলত। টেন্ডার ধরতে, সরকারি বেসরকারি এক্সপার্টদের তুষ্ট করতে, লেবারকে মুঠোর ভেতর রাখতে মাথার ঘায়ে কুকুর পাগল অবস্থা হচ্ছে ইদানীং। ইলেকট্রিকাল ইলেকট্রনিক জিনিসপত্রের এজেন্সিও আছে অনেকদিনের। ইচ্ছে আছে একটু বাজার দেখেশুনে ইলেকট্রনিক্‌স্‌-এও ম্যানুফ্যাকচারিং-এ নেমে পড়বেন। অরোরা, শেঠ, বসাক এরা তো হাজারটা বিজনেস করছে। স্বনামে, বেনামে। তিনিই বা নামবেন না কেন? তিনটে পলিটিক্যাল পার্টিকে বছর বছর মোটা চাঁদা দিয়ে যাচ্ছেন, যার যেমন ওজন তার তেমন। তো সেখানেও তো আজকাল মেলা ঝামেলা হয়ে যাচ্ছে। ভুঁইফোঁড় কিছু মস্তান, পলিটিক্যাল ক্রেডেনশিয়াল্‌স্‌ আছে কি নেই, হুটহাট করে তোলা চাইতে শুরু করেছে। আইচকে তিনদিন ফোন করে পাচ্ছেন না। মিনিস্টারের সঙ্গে আইচের ওঠাবসা। তার মাধ্যমেই এসব ঝামেলাগুলো তিনি মেটান। হাতে চাবির রিং লুফতে লুফতে চোখ গরম দেখিয়ে যাবে তাঁকে, এ জিনিস তিনি বরদাস্ত করতে পারবেন না।

লাল রঙের টেলিফোনটার দিকে হাত বাড়িয়েছেন, আইচকে যত শিগগির সম্ভব কনট্যাক্ট করা দরকার, উমেশ রক্ষিত ঢুকল। এর সামনে আইচের সঙ্গে কথা বলা যাবে না। অথচ এ আসাতে তিনি টেলিফোনটা নামিয়ে রাখলেন এটাও একটু বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে। উমেশ রক্ষিভের কৌতুহল বাড়বে, নিজেকে খামোখা খুব কেউকেটাও ভাবতে শুরু করতে পারে। অতএব তিনি একটা বানানো নম্বর টিপে গেলেন চোখ বুজে। সুখের বিষয় ওদিকে ‘দিস নাম্বার নো লংগার এগজিসটস’ বাজতে লাগল। ঠাস করে রিসিভারটা নামিয়ে রাখলেন বিজু রায়। মুখে দারুণ বিরক্তির কুঞ্চন।

‘বসুন।’

—‘পেলেন না নম্বরটা?’

—‘নাঃ। আজ আবার কী মনে করে? পেমেন্ট তো হয়ে গেছে!’

—‘পেমেন্টের জন্যে কি আমার ঘুম হচ্ছিল না রায়সাহেব? আরে বাবা, মাল আপনার গুদোমে পৌঁছে দিয়েছি। আবার কী? আমি ঘুমোলেও আপনার পেমেন্ট সময়মতো পৌঁছে যাবে। আসলে একটা ভাল জিনিস পেলুম…’

উমেশ রক্ষিত ছোট ব্যবসাদার। ওর কাছ থেকে কিছু পার্টস নেওয়া হয় তাঁর কারখানাতে। নিতেই হবে তার কোনও মানে নেই। উমেশ, রমেশ, দিনেশ, ধীরেশ এদের মধ্যে এসব ছোটখাটো ব্যাপারে কোনও তফাত করবার দরকার হয় না। ফেভার, জাস্ট ফেভার। তবে তোষামোদে ভুলে নয়। তোষামুদিগুলো ওর বড্ডই মোটা দাগের। আপনার মতো উদার, সচ্চরিত্র বাঙালি-ব্যবসাদার দেখা যায় না। কীভাবে হাল ধরে রেখেছেন! ছবির মতো কারখানা। এ সব দেখে শেখবার ইত্যাদি ইত্যাদি, কোনও দিনই এই ঘ্যানঘেনে কথাগুলো ভাল লাগে না বিজু রায়ের। ওকে অর্ডারগুলো দেন স্রেফ ওর পরিবারের সাইজের কথা মনে করে। নিজের চারটি। বড় ভাই অকালে গেছে। তার পুরো ফ্যামিলি ওর ঘাড়ে। বুড়ো বাবা মা এরা তো আছেই।

উমেশ ঝোলার থেকে একটা প্যাকেট বার করল। ভেতরে অনেক কিছু ঠেসেটুসে জিনিসটাকে চৌকো আকার দেবার চেষ্টা হয়েছে। তা সত্ত্বেও বোতলের গড়ানে গোলালো দিকটা মোটামুটি বোঝা যাচ্ছে।

গলোগলো হয়ে উমেশ রক্ষিত বলল—‘আমার এক শালা ফ্রান্সে থাকে, সে-ই..মাঝে মাঝে…খুব ভাল…’

দুম করে বিজু রায় বললেন, ‘কজন শালা আপনার রক্ষিতবাবু?’ যখনই কিছু উপহার দেবে, শালার নাম করবে উমেশ রক্ষিত। বিজু রায়ের প্রশ্নে থতমত খেয়ে বলল, ‘তি তিন। তিনজন নিজের শালা আমার।’

—‘সব্‌বাই-ই বাইরে থাকে?’

—‘আজ্ঞে হ্যাঁ। সেট্‌লড্‌।’ ভেতরের সন্তোষে গর্বে রক্ষিত ফুলে ওঠে। শালাদের ইন্ডিয়ার বাইরে থিতু হওয়ার চেয়ে বড় গৌরব যেন আর নেই।

—‘তাহলে “খেতে বসল জামাই শালা” এ সৌভাগ্য আপনার বড় একটা হয়, কী বলুন?’ বিজু রায় বলেন।

—‘হাঃ হা, তা যা বলেছেন। তা যা বলেছেন। ওদিকেও যেমন জামাইষষ্ঠীর পাট নেই, এদিকেও তেমনি নো ভাইফোঁটা।’ রসিকতাটাতে যোগ দিতে পেরে রক্ষিতের মুখ উজ্জ্বলতর হয়ে ওঠে।

—‘তা যদি বলেন মশাই। তিন তিনখানা এন আর আই আপনার হেপাজতে। বাজেট দেখেছেন তো? এন আর আই মানেই জামাই। দিন না সব কটাকে বিজনেসে নামিয়ে। দেশের মাটিতে কিছু ডলার স্টার্লিং ঢালুক। অর্ডারগুলোও সব আপনিই ধরে নেবেন। বি বি রায়কে আর গিফট দেবার দরকার হবে না।’

শুনতে শুনতে ভীষণ সন্ত্রস্ত হয়ে ওঠে রক্ষিত। ঘেমে নেয়ে যাচ্ছে এমনি ভাব। কতক্ষণে সামলে ওঠে মৃদু কৌতূহল নিয়ে দেখতে থাকেন বিজু রায়। শিগগিরই সামলে উঠবে। কোনও সন্দেহ নেই। একটু আচমকা হয়ে গেছে ধাক্কাটা!

—‘আপনি আজ আসুন। সময় হাতে বড্ড কম।’ এ ফাইল ও ফাইল টেনে বিজু রায় অতিরিক্ত ব্যস্ততার ভানটুকু চমৎকার ফোটালেন।

—‘নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই। খেজুরে গল্প করবার সময় আছে নাকি আপনার?’ উমেশ শশব্যস্তে উঠে তাঁকে নমস্কার করে কেমন পেছু হটতে হটতে বেরিয়ে গেল। যেন যতক্ষণ দেখতে পাওয়া যায় রায়সাহেবকে চোখের আড়াল করতে চায় না। বিজু রায়ের হাসি পেল। তিনি তা হলে এতদিনে নবাব-বাদশা শ্রেণীর হতে পেরেছেন। নবাব-টবাবদের এইভাবে তসলিম জানাতে হয় না? পেছন ফেরা যায় না তাদের সামনে। উমেশ রক্ষিতটা আসলে পুরনোকালের সাম্পল। প্রথম তিনি যে সময়ে ব্যবসায় নেমেছেন সেই তখনকার, তখন এই সব চাল-চলন চালু ছিল। এখন যুগ পাল্টে গেছে। এখন আসছে স্মার্ট ছোকরা-ছুকরির দল। গটগট করে আসে, ফুটফাট ইয়াংকি ইংরিজি কি হিন্দি বলে, আসে প্রার্থী হয়ে। কিন্তু ভাবখানা যেন উদ্ধার করে দিতে এসেছে। প্রত্যেকেই যেন বলতে চায়, আরে আমার মতো একটা খানদানি, এ-ক্লাস, সেন্ট পার্সেন্ট কমপিটেন্ট সাপ্লায়ারকে ওবলাইজ করবে না? ইজ দ্যাট পসিবল বস? এরা নিজেদের প্রোডাক্টের খুঁটিনাটি জানে। শুনিয়ে তবে ছাড়ে। ব্যবসার জগতে এরা নতুন ক্লাস। মূলধন জামাকাপড়ের বাহার, কায়দা, আর আজকালকার ভাষায় ‘এনথু।’

উমেশ রক্ষিত বেরিয়ে গেলে ফাইলগুলো ঠেলে সরিয়ে দিলেন বিজু রায়। রক্ষিত-দত্ত পার্সেলটা টেবিলের এক কোণে বিরাজ করছে। সেটা নিজের ব্রিফকেসের মধ্যে চালান করলেন। একটু পরে সত্যিই তাঁকে বেরোতে হবে। ঘুসুড়ির দিকে একখানা হাই-রাইজ তুলছেন। খুব ঝামেলা পাকিয়েছে সেখানে চোর্পোরেশন। লোহার রডের মাপ নাকি ঠিক হয়নি। আরও কী কী সব গলতি রয়েছে। তিনি যখন প্ল্যান সাংশন পেয়েছিলেন তখন জি-প্লাস এইটের পান। তো এখন বলছে জি-প্লাস ফোরের বেশি করতে দেবে না। বিরানব্বই-এর আইন উননব্বইয়ের প্ল্যানের ওপর খাটবে কি না এখনও তিনি ঠিক জানেন না। সুখেন্দু তাঁর লিগ্যাল অ্যাডভাইজার, তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে। কিন্তু ইতিমধ্যে দুটো তলা তাঁর কমপ্লিট। দোতলায় লোক এসে যাচ্ছে এক মাসের মধ্যে। হঠাৎ ইনসপেকশন। ইনসপেকশন করে বলে গেছে বাড়ি নাকি ভেঙে দিতেও পারে। ভেঙে দেবে না আরও কিছু। আসলে নোলা বেড়েছে। কিন্তু কেমন রোখ চেপে গেছে বিজু রায়ের। পরিষ্কার দলিল, জমির মালিকের সঙ্গে কোনও অবনিবনা নেই, তৎসত্ত্বেও আগের কাউন্সিলারকে খাওয়াতে হয়েছে। এবার ভোটে জিতে নতুন কাউন্সিলার এসেছিস, তোকেও খাওয়াতে হবে? কভ্‌ভি নহি। দে বাড়ি ভেঙে, কত মুরোদ দেখি। দুঁদে মারোয়াড়ি সব মালিক আছে। এখনই অন্তত চারটে। কোটিপতি লোক। তাদের হিন্ট দিয়ে রেখেছেন বিজু রায়। বলেছে, দেখ লেঙ্গে শালে কো। তবু একবার আজ সাইটে যাবেন ঠিক করেছেন। লোহার রডে কনট্র্যাক্টর যদি সত্যি চারশো বিশ না করে থাকে, সিমেন্টে যদি গঙ্গামাটি পাইল না করে থাকে তো ওই চোর্পোরেশনকে তিনি খাওয়াবেন ঠিকই। তবে ঘোল। ঘোল খাইয়ে ছাড়বেন। আর কন্‌ট্র্যাক্‌টর যদি সত্যি গোলমাল করে থাকে তাহলে তাকে তো ফায়ার করবেনই, ড্যামেজ আদায় করবেন গলায় গামছা দিয়ে। এর পর সে খায় কী করে তাও দেখবেন বিজু রায়। এখন, কোর্ট কাছারি যদি করতেই হয় তো আটঘাট বেঁধে এগোতে হবে। সিভল এঞ্জিনিয়ার জয়দীপ চাটুজ্জেকে নিয়ে যাচ্ছেন আজ। চারতলার ছাদ ঢালাই হবার কথা আজকেই। সিমেন্ট, বালি, লোহা, চিপস, সব দেখাবেন। বদনামি বরদাস্ত করবেন না বিজু রায়। যাবার পথে ওর নেতাজী সুভাষ রোডের অফিস থেকে জয়দীপ চাটুজ্জেকে তুলে নেবেন এমন কথা আছে। একটু আগে ফোনে কনফার্ম করে নিয়েছেন।

কীরকম একটা তেতো মুখ, তেতো মনে অফিস থেকে বেরোলেন বিজু রায়। দু ধারে ফলের পসরার মধ্যে দিয়ে ধীরে ধীরে চলেছে গাড়ি। বাজারের শ্রেষ্ঠ কমলালেবু, মুসাম্বি, আপেল, আঙুর, আনারস, ডালিম সাজানো দু দিকে। বিজু রায় লোহা, লক্কড়, নাট, বল্টু, যন্ত্রপাতি ছাড়া কিছুই বড় একটা দেখতে পান না। অর্জুনের এই গুণটি তিনি পেয়েছেন। একাগ্রতা। তাঁর ড্রাইভার সমর ফলগুলোর দিকে চেয়ে ফলওয়ালাকে ধমকে উঠল, ‘এই আবদুল, ডালিমগুলো বেদানা বেদানা করে হাঁকছিস কেন?’

—‘আফগানিস্তানে গণ্ডগোল বাবু, ও বেদানা আর পাওয়া যাবে না, এই বেদানাই নিতে হবে।’

দার্জিলিঙে গোলমালের পর সেখান থেকে লেবু আসাও বন্ধ হয়ে গেছে। চারদিকে শুধু নাগপুর আর নাগপুর। তবু এখানে যা মেলে, শহরের অন্য কোথাও তা মেলে না। দামেও নিউ মার্কেটের থেকে শস্তা। খানদানি মারোয়াড় রেজিমেন্টের ঘাঁটি এখানে। আসলি ঘিউ, আসলি ফল, আসলি মসালা সব আসলি এখানে। অতএব বিজু রায়ের অফিসের অনেকেই এখান থেকে ফল কিনে নিয়ে যায়। একমাত্র বিজু রায়ই কেনেন না। তিনি অবশ্য জানেন না, তাঁর ড্রাইভার কেনে, তাঁরই বাড়ির জন্য। প্রমীলা, তাঁদের বাড়ির নামে-রাঁধুনি আসলে হাউজ-কিপার ফরমাশ করে, সমর কেনে। দু চারখানা যে নিজের পরিবারের জন্য সরায় না, তা নয়। তবে বেশির ভাগটাই রায়ভবনের তিনশো লিটারের পেল্লাই রেফ্রিজারেটরের মাথায় কখনও ত্রিপুরি বাঁশের নৌকায়, কখনও পোড়ামাটির ডোঙায়, কখনও ক্রিস্ট্যালের পাত্রে শোভা পায়। বিজু রায়ের পাতে যখন পড়ে তখন অফিস-সংলগ্ন ফল-বাজারের সওদা খাচ্ছেন বলে বুঝতেই পারেন না তিনি।

জয়দীপ চাটুজ্জেকে খুব অন্যমনস্ক দেখাল। কী হয়েছে জিজ্ঞাসা করলেন না বিজু রায়। এসব জিজ্ঞেস করবার মতো ঘনিষ্ঠতা জয়দীপের সঙ্গে তাঁর নেইও। তবে তাঁর যদি মেজাজ খিঁচড়ে থাকে, তো জয়দীপেরও থাকতেই পারে, কে জানে ও-ও কোথাও মার খেল কি না। জয়দীপ ছেলে ভাল। বছর ত্রিশ-বত্রিশের ব্রাইট ইয়াং ম্যান। বসাকের পার্টিতে আলাপ। সবে নিজের ফার্ম খুলেছে তখন। আর এখন তো সিভল এঞ্জিনিয়ার আর্কিটেক্টদের পোয়াবারো। খুব কামাচ্ছে। তিন চার বছর আগে বসাকের পার্টিতে দেখেছিলেন পাতলা ধরনের চেহারা। চোখে, খুব স্মার্টনেস সত্ত্বেও একটা খরগোস-খরগোস ভাব তাঁর দৃষ্টি এড়ায়নি। সেই ছেলেরই এখন পেটের ফাঁদ বেড়েছে। কথা বলা শেষ করলেই থুতনির তলায় আরেকটা বেড় দেখা দেয়।

ব্রিজ থেকে নামবার মুখে গাড়ি আটকে গেল। মুখ বাড়িয়ে দেখলেন বিজু রায় এখন কিছুদিনের জন্যে নিশ্চিন্ত। নিজের হোল্ডারে একটা সিগারেট লাগিয়ে জয়দীপ সিগারেট কেসটা বাড়িয়ে ধরল বিজু রায়ের দিকে। সিগারেটের জন্য না সুদৃশ্য দামি সিগারেট-কেসটার জন্য বিজু রায় ঠিক বুঝলেন না। যাই হোক, তিনি একটা নিলেন। বললেন, ‘পরের বাড়িটা বুঝলে চ্যাটার্জি তোমার কাছ থেকেই আগাগোড়া প্ল্যানিং টল্যানিং করে নিয়ে নামব। এটার বেলায় আসলে অতটা এক্সপিরিয়েন্স ছিল না। দুলিচাঁদ নামিয়ে দিল। নেমে পড়লুম। এখন কেমন নেশা ধরে গেছে, বুঝলে?’

জয়দীপ গম্ভীরভাবে বলল, ‘হ্যাঁ। প্ল্যান-টল্যানগুলো পরিষ্কার থাকা দরকার। প্ল্যান একরকম সাবমিট করলুম। পরে চতুর্দিকে ক্যান্টিলিভার করে বেশ কয়েক হাজার স্কোয়ার ফুট বাড়িয়ে নিলুম এ তো আজকাল আকচার হচ্ছে। তা ছাড়া, রেসিডেনশ্যাল কমপ্লেক্স একটা সেক্রেড রেসপনসিবিলিটি, পবিত্র দায়। লোকে ঠেকায় পড়ে কিনছে বলেই প্রোমোটার-ডেভলপার কতকগুলো বিপজ্জনক খাঁচা বানিয়ে ছেড়ে দেবে—দ্যাটস নট জাস্টিস!’ সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়ল জয়দীপ জানলার দিকে মুখ করে।

বিজু রায়ের মাথার মধ্যে কে একটা ছোট্ট ওয়ার্নিং বেল বাজাচ্ছে। এই বক্তিমের মানে কী? অন্তত পক্ষে পঁচিশ বছরের ছোট এই ছোকরা কোন সাহসে আপার হ্যান্ড নিচ্ছে রে বাবা! ইতিমধ্যেই আবার কার সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধল? কেনই বা? তিনি তো ওকে রীতিমতো পৃষ্ঠপোষকতা করে থাকেন! আড়চোখে জয়দীপের মুখটা একবার দেখে নিয়ে তিনি বললেন ‘ব্যাপারটা কি জানো! হাজার রকম ধান্দায় থাকি। নেহাত একটা খেয়ালের মাথায় বাড়িটা করা। বাট নাও অ্যায়াম সিরিয়াস। এরপর যদি করি, যেগুলো করব, সেগুলো হবে প্রতিটি স্কোয়ার ইনচ প্রি-প্ল্যানড। একেবারে ছবির মতন। কোন্নগরের দিকে একটা চোদ্দ কাঠা জমি দেখেছি। শিগগিরই সব ফাইনাল হয়ে যাবে। এবার আর…।’

কথাটা শেষ করলেন না বিজু রায়। কোন্নগরের চোদ্দ কাঠাটা আসলে ধাপ্পা। জয়দীপ চাটুজ্জে কতটা উৎসাহিত হয় সেটা দেখবার জন্য টোপ ফেলা। তিনি যদ্দূর জানেন, পেটের ফাঁদ বাড়লেও তেমন সন্তোষজনক কিছু জয়দীপ এখনও করতে পারেনি। খুঁটে তুললেও এ লাইনে ভাল কামাই হয়। কিন্তু একটা মান-মর্যাদার ব্যাপার আছে, পছন্দ-অপছন্দের ব্যাপার আছে—বিশেষত এসব আধুনিক কেতার কোয়ালিফায়েড ছেলেদের।

‘মিডল্‌ ইনকাম-গ্রুপের জন্যে করব। কিন্তু হবে রাজপ্রাসাদের মতো। যতদূর সুবিধে দেওয়া যায়…’ ধোঁয়ার রিং ছাড়ার মতো বিজু রায় ছেড়েই যাচ্ছেন। আসলে এগুলে সুতো। জয়দীপ যদি ধরে।

জ্যাম ছেড়েছে। আই সি বোস রোড ধরে জি টি রোড নিল সমর, তারপর হু হু করে সাইটে পৌঁছে গেলেন। একতলায় অফিসঘর। পরে এটাই এদের অ্যাসোসিয়েশনের ঘর হবে। এখানেই সব কাগজ-পত্তরের ডুপ্লিকেট থাকে। সুপারভাইজ করছিল মিস্ত্রি। কড়কড় কড়কড় করে সিমেন্টে চিপসে মাখা হচ্ছে মেশিনে। বিজুবাবুকে দেখে একবার উঁকি মেরে সেলাম করে গেল। ব্রোশিওরের পাতা উল্টে যাচ্ছে জয়দীপ। এবার উঠছে।

—‘এলিভেশনটা তো ক্লিয়ার এসে গেছে!’ বিজু রায় বললেন।

‘সো ফার সো গুড’ কাঁধ নাচিয়ে বললে জয়দীপ, ‘চলুন একটু ঘুরে দেখে আসি।’ দোতলায় উঠতে উঠতে বলল—‘প্ল্যানে অনেক ডিফেক্ট আছে দাদা। মাঝখানে একটা করে ছোট ফ্ল্যাট স্কুইজ করে দিয়েছেন, অথচ ডাক্ট রাখেননি। অর্থাৎ এরা জাস্ট একটা দিক পাচ্ছে। এ ছাড়াও আছে অনেক টেকনিক্যাল গণ্ডগোল। তবে সে সব তো এখন কিছু করার নেই। আমি জাস্ট বিল্ডিং মেটিরিয়্যালসগুলো যদ্দূর পারি একটু দেখে নেব।’

থাকে থাকে সাজানো সিমেন্টের বস্তাগুলোর মধ্যে একটা আঙুল দেখিয়ে বার করতে বলল। গনির লোক সেটাকে টেনে বার করে খুলে দেখাল। দেখতে দেখতে মুখ বিকৃত করল জয়দীপ। অন্য দিকে তাকিয়ে বলল ‘গভর্মেন্টের মডুলার ইটগুলো নিলেন না কেন? স্ট্যান্ডার্ড ইট!’ বিজু রায় এ কথার উত্তর জানেন না। জানে তাঁর কনট্র্যাক্টর। লোহা সব ঢালাই হয়ে গেছে। সামান্য কিছু পড়ে আছে। জয়দীপ একটু নিচু হয়ে দেখে নিল। তারপর বলল—‘চলুন আমার দেখা হয়ে গেছে।’

নিচের অফিস ঘরে বড় করে জলযোগের আয়োজন ছিল। এক কাপ চা ছাড়া জয়দীপ কিছু ছুঁল না। —‘তাড়া আছে দাদা, বাড়িতে গেস্ট আসবার কথা আছে।’

গাড়ি ব্রিজে উঠতে আয়েস করে ধোঁয়া ছেড়ে বলল—‘সিমেন্টের কোয়ালিটি খুব খারাপ দাদা। নামী কোম্পানির লেবেল লাগিয়ে আপনাকে ভুসি মাল গছিয়েছে। লোহার রড কোয়ার্টার সুতো মতো কম আছে। কর্পোরেশনের ইনসপেক্টর ভুল রিপোর্ট দেয়নি।’

—‘বলো কি?’ বিজু রায় সত্যিই অবাক হয়ে গিয়েছিলেন।

—‘ওই যে বলছিলেন খেয়ালের মাথায় করেছেন। সিরিয়াসলি নেননি! আপনার সেই অ্যাটিটিউডটারই সুযোগ নিয়েছে কনট্র্যাক্টর। আমার তো সরাসরি আপনাকেই রিপোর্ট দেবার কথা। আমি সরকারি লোকও না। কিছুই না। কোথাও ওবলিগেশন নেই। জাস্ট কনসেন্স। বিবেকের কাছে দায়বদ্ধ। বাড়িটা ভাল হচ্ছে না দাদা।

—‘আপনি শিওর? আমি কিন্তু বেস্ট মাল দেবার কথাই গোড়ার থেকে বলে আসছি। শিবশঙ্কর, মানে ওই কনট্র্যাক্টর আমার চেনা লোক। ইন ফ্যাক্ট আমার সল্ট লেকের বাড়ি ও-ই করেছে!’

জয়দীপ কাঁধের একটা ভঙ্গি করল। মুখে কিছু বলল না। জয়দীপকে ওর অফিসে নামিয়ে দিয়ে বেশ কিছুদূর, প্রায় নিজের অফিসে পৌঁছে গিয়েছিলেন বিজু রায়। হঠাৎ মনে হল রক্ষিতের দেওয়া পার্সেলটা জয়দীপের টেবিলে ফেলে এসেছেন। ব্রিফ কেস থেকে কর্পোরেশনের ইনসপেকশন রিপোর্টটা বার করবার সময়ে পার্সেলটাকে টেবিলের ওপর রাখতে হয়েছিল। তারপর ঢোকাতে ভুলে গেছেন। ওটা আবিষ্কার করলে জয়দীপ ঘুষ মনে করতে পারে। ঘুসুড়ির বাড়িটা ওভাবে বাতিল করে দেবার পর ঘুষ দেওয়ার অর্থ খুব খারাপ দাঁড়াবে। মান-সম্মান আর কিছু থাকবে না বিজু রায়ের ওইটুকু একটা ছেলের কাছে। তিনি গাড়ি ঘোরাতে বললেন। নেতাজী সুভাষের গলিতে ঢুকছেন, জয়দীপের গাড়িটা ওদিক দিয়ে বেরিয়ে গেল। জয়দীপ নিজেই ড্রাইভ করছে। পাশে শিবশঙ্কর না? তাঁর কনট্র্যাক্টর জয়দীপের গাড়িতে কী করছে? দুজনে যেন গভীর আলোচনায় মত্ত। বিজু রায় এত অবাক অনেকদিন হননি। শিবশঙ্করের সঙ্গে জয়দীপের আদৌ কোনও জানাচেনা আছে বলে তিনি শোনেননি। ও কি টের পেয়েছে জয়দীপ ওর সমস্ত ব্লাফ ধরে ফেলেছে? তাই ওর অফিসে ছুটে এসেছে? আগে তো তাঁরই কাছে আসা উচিত ছিল। কারণ কোর্টে জজের মুখোমুখি হতে হবে বিজু রায়কেই। শিবশঙ্করকে দেখিয়ে দিয়ে তিনি পার পাচ্ছেন না। তবে শিবশঙ্করকেও মুখোমুখি হতে হবে বিজু রায়ের। তাঁর নিজস্ব আদালতে। সেখানের আর কারুর দিকে আঙুল দেখিয়ে শিবশঙ্করও পার পাবে না। পার্সেলটা আনতে ড্রাইভার সমরকেই পাঠাবেন ভেবেছিলেন। কি মনে করে নিজেই লিফটে উঠলেন। বিশ্রী অন্ধকার বাড়িটা। চারদিকে ঝুল ঝুলছে। পানের পিকে সিঁড়ির কোণ-টোন ভর্তি। দেখলে কল্পনাও করা যায় না, এরই পাঁচতলায় জয়দীপ সাতশো’ স্কোয়্যার ফুট মতো জায়গা অমন ছিমছাম করে দিতে পেরেছে। স্লাইডিং ডোর, কাচ, কাঠ। বড় বড় পোস্টার। রবার গাছ। অচেনা ক্রোটন। মোল্ডেড চেয়ার-ফেয়ার।

পি সি নিয়ে কাজ করছিল একটি লোক। ঢোকবার মুখে টুলের ওপর পিওন। টেবিলে ওটি বোধহয় ড্রাফটসম্যান। বিজু রায়কে দেখে সেই বলল ‘মিঃ চ্যাটার্জি তো এইমাত্র গেলেন কাজে। কিছু বলতে হবে?’

বিজু রায় গম্ভীরমুখে বললেন—‘ভেতরে একটা পার্সেল আছে। আমার। ভুলে ফেলে গেছি।’

—‘এইয্‌ যাঃ। স্যার তো অফিসের চাবি নিয়ে বেরিয়ে গেলেন। খুব দরকারি নাকি?’

বিজু রায় বললেন—‘ফিরে এলে ওটা রেখে দেবেন। আমার ড্রাইভার সমরকে কাল কোনও সময়ে পাঠাব, তুলে নিয়ে যাবে।’

—‘ঠিক আছে। খুব দুঃখিত স্যার। উনি কখনও এত ছোটাছুটি করেন না। কোনও জরুরি ব্যাপার আছে মনে হয়। একটি ভদ্রলোক কদিন ধরেই আসছেন, তাঁকে নিয়ে কর্পোরেশনে গেলেন।’

ছোকরা একটু বেশি কথা বলে। অন্তত জয়দীপ ফিরে যদি শোনে তার অনুপস্থিতির এই কৈফিয়ত সে বিজু রায়কে দিয়েছে সে নিশ্চয়ই ছোকরাকে একটি বকর-বকর-বোক-চন্দর মনে করবে। কিন্তু তখন তারও আর কিছু করার থাকবে না। কিন্তু একটি ভদ্রলোক…মানে শিবশঙ্কর কদিন ধরেই আসছে? জয়দীপের কাছে? কেন? বাজে মাল দিয়ে তো সে আসলে ফাঁসিয়েছে তাঁকে? তাহলে কর্পোরেশনে যাবে কেন? তিন জনে, মানে তিনি, জয়দীপ আর শিবশঙ্কর মিলে পরামর্শ করে কর্পোরেশনে যেতে পারতেন। তা-ও ঠিক কর্পোরেশন-অফিসে নয়। গোটা কতক কাউন্সিলার, দরকার হলে, মেয়রের বাড়ি। ডিলিং ক্লার্কদের শিবশঙ্কর একাই ম্যানেজ করতে পারত। কিন্তু এরা দুজনে মিলে…তাঁর অজ্ঞাতে…গোপনে…? কীভাবে তাঁকে ফাঁসাবে আর? শিবশঙ্কর নিজেও তো পার পাবে না!

অফিস বন্ধ করতে বলে চাবি নিয়ে বিজু রায় আবার গাড়িতে উঠলেন। আজকে আর ভাল লাগছে না। এবার বাড়ি। সেই বাড়ি যা এই শিবশঙ্করেরই করা। শ্রেষ্ঠ আর্কিটেক্টের প্ল্যান। কিন্তু তাকে কংক্রিটে রূপান্তরিত করেছে শিবশঙ্করই। সে সময়ে নিজের বাড়িরও বেশ কিছু সংযোজন ও আগাগোড়া সারাইয়ের কাজ করে নিয়েছিল। ভাল করেই জানেন তিনি। এ জিনিস সব কনট্র্যক্টারই অল্পবিস্তর করে। শিবশঙ্কর একটু বেশি করেছিল। তো তিনি কিছু বলেননি। তাঁর বাড়িখানা তো বানিয়ে দিয়েছে সলিড! সল্ট লেকে বহু বাড়িই চেয়ে দেখবার মতো। তা তার মধ্যেও বিশেষ বোধহয় বিজু রায়ের বাড়ি। এক সময়ে যে এইভাবে ঘর তৈরি করে দিল, সে-ই এখন ঘর ভাঙতে লেগেছে! বিনা প্ররোচনায়! ভাল রে ভাল! কিন্তু শিবশঙ্করকে তো তিনি খুব সহজে ছাড়বেন না! তার লাইসেন্সটি তো বাতিল হয়ে যাবে! কিন্তু কর্পোরেশনের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধলে? পারবেন কী? সে যা-ই হোক। খামোখা এই শিবশঙ্কর যাকে তিনি বহুদিন ধরে কাজ দিয়ে আসছেন, আর এই জয়দীপ চ্যাটার্জি যাকে সবে দিতে শুরু করেছেন এরা হঠাৎ তাঁর ক্ষতিসাধন করতে তৎপর হয়ে উঠবে কেন? দূর হোক গে ছাই, হয়তো রজ্জুতে সর্প দর্শন করছেন! হয়তো অন্য কোনও ব্যাপারে শিবশঙ্করের জয়দীপের পরামর্শ দরকার হয়েছে। অন্য কোনও কেস। কিন্ত…শিবশঙ্কর তো একদিনও বলেনি সে জয়দীপকে চেনে, তার কাছে যায়! জয়দীপও তো কই…

নাঃ মাথাটা গরম হয়ে যাচ্ছে। এভাবে চললে প্রেশার বাড়া ছাড়া আর কিছু লাভ হবে না। বিজু রায় একটু চেষ্টা করে শিবশঙ্কর-জয়দীপ সংক্রান্ত দুর্ভাবনার সুইচটা অফ করে দিলেন।

গত ষোলোই অক্টোবর মায়ের কাজ নির্বিঘ্নে হয়ে গেছে। তারপর সাতাশে বিজু রায় আটান্ন পূর্ণ করে ঊনষাটে পা দিলেন। সরকারি চাকরি জীবনে থাকলে অবসর, পেনশন ইত্যাদি হয়ে যেত। বাবার মতো ইউ.ডি. ক্লার্কের একখানা পোস্টে টিকে থাকতে পারলে এখন তিনি বাতিল বুড়ো, নিজের পাওনা-গণ্ডা বুঝে নিতে সরকারি দফতরে জুততার সুকতলা ক্ষওয়াতে আরম্ভ করে দিয়েছেন। তাঁর ভাগ্য ভাল বাবা তাঁর ভাগ্য এই পথে চালিত করবার আগেই সময়মতো সরে আসতে পেরেছেন। স্টিল-গ্রে সুটের ভেতরে সময় তাঁর শরীরে কোথায় কতটা থাবা বসিয়েছে বাইরে থেকে বোঝা যায় না। শরীরের ওপর সময়ের প্রভাব তিনি। খুব একটা বুঝতেও পারেন না। ডাক্তার বললে মানতেই হয়। দুশো চিনি, একশো একশো-সত্তর রক্ত চাপ। এটা খাবেন না, ওটা খাবেন না, ফ্রি হ্যান্ড এক্সারসাইজ একটু। প্রাতর্ভ্রমণ। কিন্তু মন? আটান্ন বছরের জীবন এমন অন্ধিসন্ধি পর্যন্ত কাজ দিয়ে ঠাসা যে তিনি যুবক হবারও যেমন অবসর পাননি, প্রৌঢ় হবার ফুরসতও তেমনি না। এদিক থেকে ভাবলে বলতেই হয় তিনি খানিকটা ক্লিওপ্যাট্রার মতন। সময়ের আয়ত্তের বাইরে কোনও একটা বিন্দুতে তাঁর মনটা কাজ করে যায়। চিরসবুজ? ওরে নবীন, ওরে আমার কাঁচা? তা হয়ত নয়। কিন্তু চিরহলুদও নয়।

মায়ের দীর্ঘদিন বেঁচে থাকাও তাঁর সময়কে থোড়াই কেয়ার-করা জীবনচর্যার একটা গোপন কথা। ছোট খোকা! ছোট খোকা! কখনও বিজু! এসব বলে ডাকতে তো কেউ ছিল! বস্তুত মায়ের এই বিজু ডাক থেকেই বিজনেস-সার্কলে তিনি বিজু রায়। ঊননব্বুই বছর বয়সে মা গেলেন। শেষের পনেরো যোলো বচ্ছর এক রকম শুয়েই। প্যারালিসিস-টিসিস কিছু নয়। মাঝ সত্তর থেকে হাত পা ভাঙতে আরম্ভ করল, পুরনো বইয়ের পাতা ভাঙবার মতো, কিংবা পুরনো গাড়ির কল-কবজা বিগড়োবার মতো। আজ ব্রেক ঠিক করে আনা হল তো কাল গেল ক্লাচ, আজ কারবুরেটরে গণ্ডগোল তো কাল ফিউয়েল-ট্যাঙ্ক ফুটো। নড়বড়ে হাড়গুলো নিয়ে ফোকলা বুড়ি শুয়ে থাকত আর লোকে জিজ্ঞেস করলেই বলত—‘কী বলি দাদা, আমার হাড়-মুড়মুড়ির ব্যায়রাম ধরেছে। দিবি নাকি খোক্কসের তেল এনে?’ ষোলো বছর মানে প্রায় দেড় যুগ। এই সময়ের মধ্যে একটা শিশু জন্মে লায়েক হয়ে যায়, এই এতদিন শুয়ে শুয়ে, তা সে যত আরামেই হোক, একটা মানুষ যে কী করে অত হাসি হাসতে পারে, কাউ কাউ করে অত কথা বলতে পারে সে-ও একটা বিস্ময়। বিজু রায়ের বাড়িতে প্রচুর লোকের আনাগোনা। তার শতকরা কজন ছেলের কাছে, আর কতজন মায়ের কাছে বলা শক্ত। ছেলের কাছে লোক এসেছে নেহাত কাজে, স্বার্থের তাগিদে, হাজার চেষ্টা করেও সেটা তাদের পক্ষে লুকোনো সম্ভব হত না। কিন্তু মায়ের কাছে তো লোকে ঠিক কাজে আসত না! কত কত দূর সম্পর্কের কাকা, ভাইপো, ভাইঝি, বোনপো, বোনঝি-জামাই, নাতবউ, নাতকুড়, সারা বছর ধরে আসতেই থাকত। আসতেই থাকত। তাদের মধ্যে অনেকে নীচে দাঁড়াতেও সাহস পেত না, কলকেও পেত না, সোজা উঠে যেত তিন তলায়। খয়েরি ক্যামবিসের জুতো, তাপ্পি-মারা ছাতা, খোঁচা খোঁচা পাকা দাড়ি এক বৃদ্ধ যাঁকে মা নতুন ঠাকুরপো বলে ডাকত, যেন সেই সুবাদে বিজু রায়ও নতুন কাকা বলতেন, তাঁকে এই বাড়ির চৌহদ্দির বাইরে হলে তিনি বা তাঁর পরিবারের কেউ বোধহয় চিনতেও পারবে না। এ বাড়িতে ওই কিসিমের লোক ঢুকতে পারে তা-ও কেউ ভাবতে পারবে না। কিন্তু এই নতুন কাকা না কে অবলীলায় খপ খপ করে তেতলায় উঠে যেতেন যত দিন মা ছিলেন। কিছুক্ষণ পর চা আর জলখাবারও এসে যেত। এই বৃদ্ধ থাকাকালীন মায়ের ঘরে ঢুকলে বিজু রায়ও মাঝে মাঝে যোগ দিয়েছেন কথাবার্তায়, ঠাট্টা ইয়ার্কিতে হেসেওছেন। মা যাবার পর থেকে বৃদ্ধ উধাও। আর এলেও বোধহয় দারোয়ান ঢুকতে দেবে না। বিজু রায়ই কি কথা বলবেন? এই যে নতুন কাকা, কখন এলেন? বলতে বলতে নীচে নিজের অফিস ঘরে নেমে যেতে থাকবেন না? নিজের ঘরের পর্দা সরিয়ে তনুশ্রী ভুরু কুঁচকে চাইবে, বুঝতে পারবে না এই বৃদ্ধটি কে এবং কেন! ছেলে এবং মেয়ে খুব সম্ভব ‘বদার’ করবে না। একমাত্র প্রমীলাই আগেকার কথা স্মরণ করে, দিলেও দিতে পারে এক কাপ চা, দুটো বিস্কুট।

কিন্তু মায়ের কাছে যে লোকে কাজে আসত না, এটাও বোধহয় ঠিক কথা নয়। রান্না শিখতে অর্থাৎ লিখে নিতে আসত কেউ কেউ। ‘মালাইয়ের পুর দিবি দিদি, পোস্ত আর নারকেল সামান্য, এই এতটুকু।’ ঘরে ঢুকতে ঢুকতে একদিন শুনতে পেয়েছিলেন যেন। তিনি ঢুকতেই মায়ের নাত-বউটি ‘ওমা! ছোটকাকা’ বলে হুট করে উঠে গেল। আবার এও দেখেছেন বিয়ে-থা কি পুজো-আচ্চা, কি শ্রাদ্ধ অশৌচ ইত্যাদি সম্পর্কেও মার কাছে অনেক আত্মীয়-স্বজন উপদেশ নিতে আসছে। ছাউনি-নাড়া ফুল, ছিরি, বরণ ডালায় কী কী থাকবে, হলুদ মাখানো সুতোটা কপাক বেড় দিতে হবে—অশৌচান্তর নাপিত না পাওয়া গেলে মেয়েরা কী করবে ইত্যাদি ইত্যাদি। আজকালকার মেয়ে-বউরা এসব খুঁটিনাটি অনেক জানে না। কিন্তু ফেলেও দিতে পারে না বোধ হয়। তাই মায়ের কাছে ছুটে আসত। একেকটা বিয়ের মরশুমে এই জাতীয় অতিথি বাড়িতে খুব বেশি হয়ে যেত। অত কথা বলে মা অসুস্থ হয়ে পড়ত। বিজু রায় তখন ঘরে ঢুকে বলতেন—‘আমি এবার সব বারণ করে দিচ্ছি। এ কী কাণ্ড! বুড়ো মানুষকে এভাবে জ্বালাতন করার কোনও মানে হয়?’ মায়ের সঙ্গে চোখাচোখি। মা বলত,

—‘বারণ করিসনি বিজু। বারণ করবি কী জন্যে?’

—‘কী জন্যে? একটা কিছু হলে?’

—‘কী হবে?’ ক্ষীণ কণ্ঠ, কোটরাগত চোখ বিজুর চোখে। অন্য সময়ে এই চোখই কৌতুকে ঝিকমিক করে। আজ ক্লান্ত তাই স্তিমিত। অস্থি চর্মসার দেহ। মাথায় কিছু সাদা তুলোর কুণ্ডলি। চোখ থেকে চোখ সরিয়ে নিচ্ছে না মা। বিজু রায় বুঝতে পেরেছেন মা কী বলতে চায়।

কত অল্প খেয়ে মানুষ বেঁচে থাকতে পারে, মাকে দেখে জানা গেল। মায়ের জন্য গত পনেরো বছর ধরে সকাল আর রাতের আয়ার ব্যবস্থা ছিল। প্রথমটা তিনি ভেবেছিলেন মা আপত্তি করবে, একটা মহা সমস্যা তৈরি হবে। কিন্তু আপত্তি ছেড়ে, কোনও অসন্তোষও মা ঘুণাক্ষরেও প্রকাশ করেনি। তিনিই বরং একদিন আগ বাড়িয়ে কৈফিয়ত দিয়েছিলেন—‘আতুরে নিয়মো নাস্তি। কী বলো, মা?’

‘নিয়ম? কিসের নিয়ম?’ মা অবাক হয়ে বলেছিল। তার পরে ছেলের কথার প্রসঙ্গ ধরতে পেরে বলেছিল ‘আতুরে সব কিছুই নাস্তি ছোটখোকা। স্বস্তিই সব।’ মায়ের অভিমান ছিল কি না বলতে পারবেন না তিনি। থেকে থাকলে সেটা অযৌক্তিক, আবার অযৌক্তিক নয়ও। বিজু রায়ের যা কাজকর্ম তাতে তাঁর পক্ষে ব্যক্তিগতভাবে মায়ের সেবা করা অসম্ভব। তনুশ্রী যদি সাধারণ গেরস্থ ঘরের বউ হত, তাকে করতে হত, কিন্তু তা তো সে নয়। কেন করবে? মাকে যতদূর জেনেছেন খুব গোঁড়া, প্রাচীনপন্থী, শুচিবায়ুগ্রস্ত, নিজের সম্পর্কে লাজুক বলেই জেনেছিলেন। কিন্তু মা নির্বিবাদে মাইনে করা আয়া জাত-জন্মের ঠিক নেই, তার কাছ থেকে বেডপ্যান নিল। তার কাছে স্পঞ্জ করল, হরলিকস খেল, পরে ভাতও খেল। এই মেনে নেওয়াটা মার বয়সে সম্ভব হল কী করে তিনি জানেন না। আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ জিনিস তো মা মেনে নেয়নি। দাঁতে দাঁত চেপে মা যে নিরুপায় হয়ে মেনে নিল, এমনও বলা যাবে না। মা একটা লড়াই দিতে পারত। দাঁতে দাঁত টিপে রইল, কিছু খেল না, অশক্ত হাত-পা নিয়ে বাথরুমে যেতে গেল, পড়ে গেল। এই রকম। তা সেসব কিছু তো মা করেনি। বরং ওই দুটি আয়া, সুলতা আর শিবানী ওদের সঙ্গে খুবই ভাব-ভালবাসা হয়ে গিয়েছিল মার।

মা ছেলে-মেয়েকে যতটা দেয়, ছেলে-মেয়ে মাকে ততটা তো কিছুতেই দিতে পারে না। বাবা সাত বছর শুয়েছিলেন। ঠাকুমা ছ বছর। দুজনেই পক্ষাঘাতে। তাঁরা ভাইবোনেরা যখন-তখন। সে সময়টা কী অসুখই না করত! টাইফয়েড? চলল একাদিক্রমে একুশ দিন, চিকেন পক্স, আবার চলল মাসখানেকের কাছাকাছি। ইনফ্লুয়েঞ্জা? থাক শুয়ে অন্ততপক্ষে পনেরো দিন। তারপরে আছে রক্ত-আমাশা, খোস-পাঁচড়া, বেরিবেরি, ন্যাবা…কী নয়? যখন তখন। সবাইকে মা একা হাতে সেবা করেছে। করে সংসার দেখেছে। কী করে করেছে মা-ই জানে। তখন মনে হত এটাই স্বাভাবিক। ঠাকুমাকে বেড-প্যান দিয়ে, বড় ছেলের গা মুছিয়ে, চান করে মা নতুন টাইফয়েড থেকে ওঠা দুই ছোট ছেলে মেয়ের শিঙি মাছের ঝোল-ভাত পথ্য নিয়ে আসবে। ইতিমধ্যে অন্যদের দুপুরের খাওয়া, জলখাবার, রাতের আহার, বিছানা করা, টেবিল গুছোনা, আলনা গুছোনো। একটিমাত্র ঠিকে কাজের লোক বাড়িতে। দিদি যখন ছিল সামান্য সাহায্য করত। কিন্তু মা সেটা চাইত না। তোরা পড়। মায়ের ওই এক বাক্য, এক মন্ত্র, এক চাহিদা। তোরা পড়। পড়লেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। দারিদ্র্যের সুরাহা হবে। সামাজিক মানমর্যাদার নাগাল পাওয়া যাবে। বড়লোক আত্মীয়ের বাড়ি ‘তোমরা তো ঘরের লোক’ বলে অসাগর খাটুনির পর শেষ ব্যাচে মাংসের শুধু ঝোল, মাছের ছাল, আর ভাঙা ভাঙা লেডিকেনি এসব। সব কিছুর সুরাহা। যাক গে। মা দিয়েছে। সেবা, যত্ন, নিজের কিছু রাখেনি। আদর্শ। আদর্শও মা দিয়েছে। জীবনে বড় হবার মূলমন্ত্র। সেটা কাজে লাগাতে পারেননি বিজু রায়, সেটা আলাদা কথা। কিন্তু মা দিয়েছিল। তিনি ছেলে, ছেলে হিসেবে ফেরত দিয়েছেন সেবা যত্ন। সবই ঠিক। কিন্তু মা নিজের হাতে দিয়েছিল। মা বোকা। তিনি আয়ার হাতে দিচ্ছেন। তিনি কেজো, তিনি চালাক।

মা সারা জীবন এত ব্যস্ত থেকেছে যে মাকে কোনও দিন ভাল করে দেখা হয়নি। কখনও সবুজ পাড়ের শাড়িতে ঘেরা মুখ, কখনও আলুথালু খোঁপার নীচে শাড়ির পাড় হেলায় পড়ে আছে। বেশি বয়সে আবার সেই একই মুখ শুভ্রতার ঘেরে। মা যে কবে কী খেয়েছে, পরেছে, কীভাবে কী করেছে মনে পড়ে না। বড় দাদা-দিদিরা জানত হয়ত। বিজু লাটিম থেকে ঘুড়ি, ঘুড়ি থেকে বিড়ি, বিড়ি থেকে ফেরি, বেওসা…তারপর সিঁড়ি ভেঙে ভেঙে অনেক ওপরে এসে যখন দেখবার অবসর হল দেখলেন এক বৃদ্ধা ফিমর বোন ভেঙে শুয়ে আছেন। নার্সিং হোমের শয্যায়। একটি খুব সুসজ্জিত যুবতী পাশ থেকে উঠে দাঁড়াল। ‘চলো এবার মাকে ও-টিতে নিয়ে যাবে’, যুবতী বলল। চমকে উঠে বিজু রায় দেখলেন তাঁর মা। পড়ে গিয়ে মোক্ষম হাড় ভেঙেছে। ভেতরে লোহার রড ঢোকাতে হবে। নার্সরা তাঁকে নিয়ে ব্যস্ত, তাঁর স্ত্রী হাত-ব্যাগ দোলাতে দোলাতে বাইরে চলে যাচ্ছে। বলল— ‘সেজদাকে ফোন করে দিয়েছি। দিব্য ধরেছিল। ও-ই সব্বাইকে খবর দিয়ে দেবে।’ সেজদা? দিব্য? মানে তাঁর সেজদা কানন? হ্যাঁ। হ্যাঁ তাই-ই তো! সেজদা সরকারি চাকরি করে না? কোন ডিপার্টমেন্টে যেন? ফুড বোধহয়। দিব্য, দিব্যদ্যুতি সেজদার বড় ছেলে তাঁর ভাইপো হল সম্পর্কে। ইলেকট্রিক্যাল এঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে না? সেজদা, এই সেজদার ফ্যামিলিটাই যা একটু…। তাই তাঁর স্ত্রী-পুত্রদের সঙ্গে ওর স্ত্রী-পুত্রদের একটু বেশিই…। আর কে কে যেন আছে? বড়দা, বড়দা ছিল জড়বুদ্ধি। ভাগ্য ভাল মায়ের শরীর থাকতে থাকতে মারা গেছে। মেজদা গগন? গগনবিহারী। একটা মনোহারি দোকান আছে। ব্যবসাই যদি করবি, একটু ফলাও করে করলে কী হয়! মাথায় গোল টাক গগনবিহারীর। ধারে ধারে চুল। ঠিক যেমন বাবার ছিল। মেজদাই ছেলেবেলায় ধরে বেঁধে পড়াত আর মাথায় গাঁট্টা মেরে বলত— ‘বিজুটা পয়লা নম্বরের ফাঁকিবাজ। ওটার কি হবে না।’ তা এম-কম পাশ করেই বা মেজদার কী হল? দোকানদার। লেখাপড়া করে যে-ই গাড়ি ঘোড়া চড়ে সে-ই। মেলেনি। মেজদার ডিগ্রিটা এমন দামে এখনও পর্যন্ত বিকোল না যে একটা সেকেন্ড-হ্যান্ড গাড়িও কিনতে পারে। সেজদার সরকারি চাকরি, প্রশ্নই নেই। একমাত্র বি-কম ফেল বিজনবিহারীরই গাড়ি আছে। চকচকে নতুন। একখানা নয়, তিনখানা। বাড়ি সোনারপুরের দিকে মেজদাও করেছে, শ্বশুরের দেওয়া জমিতে। কিন্তু বিজনবিহারী রায়ের নিজের গায়ে খেটে মাথায় খেটে উপার্জন করা টাকায় কেনা জমি, তৈরি বাড়ি, বাড়ি নয় একটা শিল্পদ্রব্য। মেজদা মেয়ের বিয়েতে খাইয়েছিলও খুব ভাল, কিন্তু মেজদার সঙ্গে ঠিক…। ভীষণ গম্ভীর মুখ, পকেটে বিড়ি আবিষ্কার করে শাসন করছে সেই দিদি। দিদিই বা কী করছে! কেমন প্রার্থী-প্রার্থী চেহারা দেখেছিলেন যেন একবার? থানে-ঘেরা সেই ন্যুব্জতা, তার সঙ্গে ছেলেবেলার দিদি ধারণাটা কিছুতেই খাপ খায় না। কোথায় থাকে দিদি? মায়ের কাজে এসেছিল। সুদ্ধ কাজের দিন। সঙ্গে ছেলে? না নাতি? কেয়ারি করা ঘাড় পর্যন্ত চুল, বড় বড় নখ রেখেছে। হাতে মেহেদির ছাপছোপ। কী অদ্ভুত! তিনি কাজে ব্যস্ত ছিলেন, ওই অদ্ভুত দর্শন ছেলেটির পরিচয় জিজ্ঞেস করেননি। সম্ভবত কেউই করেনি। দিদি শ্রাদ্ধ শেষ হলে ফল-মিষ্টি খেয়ে চলে গেল। বলল— ‘নিয়মভঙ্গে আর আসব না, আমার নিয়ম তো আর ভঙ্গ হবে না। আসতে বড় কষ্ট হয়।’ সমরকে ডেকে বলেছিলেন, শেয়ালদা স্টেশনে পৌঁছে দিতে। ওই লাইনেই কোথায় যেন থাকে! আর ছুটকি? যার সঙ্গে পাশাপাশি টাইফয়েডের শয্যা ভাগ? শিঙ্গি-মাছের ঝোল-ভাত ভাগ? সেই ছুটকি? নাহ…ছুটকির কথা বিজু রায় কিছু জানেন না। এমনকি তনুশ্রী, তাঁর স্ত্রী ছুটকির অস্তিত্বের কথাই জানে না। ছুটকি লজ্জা। ছুটকি মুছে গেছে।

এত সব ভাববার সময় সাধারণত বিজনবিহারীর থাকে না। রাত সাড়ে আটটা নটার আগে তিনি বাড়ি ফিরতে পারেন না। রবিবারের কথা অবশ্য আলাদা। কিন্তু বেশির ভাগ রবিবারেই প্রচুর লোক দেখা করতে আসে। সন্ধেবেলায় তিনি ক্লান্ত হয়ে পড়েন। যতদিন মা বেঁচে ছিল রবিবার সকালে নিয়ম করে আধঘন্টা মায়ের কাছে বসতেন। অন্যান্য দিনও খুব বেশি দেরি না হয়ে গেলে অন্তত পনেরো কুড়ি মিনিট। আজ মঙ্গলবার, মা না থাকায় ফেরার সেই তাড়ার বোধটাও ছিল না। কিন্তু হাতের কাজগুলো ফুরিয়ে গেল। মনটা খারাপও হয়ে গেল খুব। প্রোমোটারের ব্যবসায়ে তিনি নামতে চাননি, দুলিচাঁদ নামাল। দুলিচাঁদের ব্যবসা রমরম করে চলছে। তিনি প্রথমটাতেই মুখ থুবড়ে পড়লেন। সামলে দেওয়া যাবে ঠিকই। কিন্তু বদনাম তো একটা হল। এর আগে বদনাম তাঁর কখনও হয়নি। সবচেয়ে বড় কথা, বুকের মধ্যে গলার মধ্যে ট্যাংরা মাছের কাঁটার মতো খচ-খচ করছে ওই দৃশ্যটা। ছাই-ছাই রঙের স্ট্যান্ডার্ড হেরাল্ড। পুরনো গাড়ি কিনেছে জয়দীপ। সামনের দিকে দুটো মুখ খুব কাছাকাছি। শিবশঙ্করের সঙ্গে জয়দীপ আলোচনায় মত্ত। জয়দীপের সঙ্গে শিবশঙ্করের কী? শিবশঙ্কর তাঁর লোক, জয়দীপকেও, তিনি বসাকের পার্টিতে চিনে অবধি সাহায্য করছেন। ওরা কেউ কাউকে চেনে না, অন্তত চেনবার কথা নয়। অথচ দুজনে ঘনিষ্ঠ হয়ে কথা বলছে। তাঁকে গোপন করে কর্পোরেশন অফিসে গেল। বিজু রায় যখন ব্যবসায়ে নামেন দুজন ব্যক্তির কাছ থেকে সাহায্য পরামর্শ ইত্যাদি পেয়েছিলেন। এই বসাকের বাবা নৃত্যগোপাল বসাক, সংক্ষেপে এন. জি। আর দুলিচাঁদ। এন. জিকে তিনি এখনও নিজের বাবার মতো শ্রদ্ধা করেন। প্রতি জন্মদিনে ধুতি-চাদর, ফুল, মিষ্টান্ন নিয়ে দেখা করেন। বোঝাই যায় বৃদ্ধ এখন ভিমরতির পর্যায়ে। বাড়িতে কেউ তাঁর খোঁজ রাখে না। বিজু রায় কিন্তু যান। সময় পেলেই যান। প্রায় বদ্ধ কালা বৃদ্ধের সঙ্গে বহুক্ষণ আলাপ করে আসেন। তাঁর বিষণ্ণ মুখে যতক্ষণ না হাসি ফুটছে ততক্ষণ অব্দি তিনি অপেক্ষা করেন। আর দুলিচাঁদ! দুলিচাঁদের কোন পরামর্শটা তিনি আজ অব্দি ফেলেছেন? দেওরাকে শেয়ারের দালাল ঠিক করেছিলেন দুলিচাঁদের অনুরোধেই। ডুবোল তো? রিয়্যাল এসটেটে নামাল দুলিচাঁদ। তিনি নেমেছেন সুদ্ধ দুলিচাঁদের পরামর্শের মান রাখতেই। এই দুলিচাঁদই না তাঁকে কচি বয়সে ব্যবসার ঘাঁত ঘোঁত শিখিয়েছে? কিন্তু জয়দীপ? আজকালকার পাশ করা ঝা-চকচকে সিভল এঞ্জিনিয়ার! এই অল্প দিনের পরিচয়েই যথেষ্ট ব্যবসা পাঠিয়েছেন তিনি ওকে। হঠাৎ এমন ব্যবহার করল? আর শিবশঙ্কর তো একরকম তাঁর খেয়ে-পরে মানুষ! ওই রক্ষিতের মতো! তবে?

বাড়ি পৌঁছে বিজু রায় দেখলেন বাড়িখানা আপাদমস্তক শূন্য। মস্তকে মা ছিলেন, মা চলে গিয়ে সেখানটায় টাক পড়ে গেছে। ছেলে মেয়ে স্ত্রী এরা সব কোথায় তিনি তো জানেনই না। লোকজনরাও বিশেষ কিছু বলতে পারল না। তাঁর চান হয়ে গেল। শামি কাবাব, হুইস্কি আর স্টার টি.ভি নিয়ে ঘণ্টা দুয়েক পার হয়ে গেল। সাড়ে নটা। ঘড়িটা কিছুক্ষণ অন্তর-অন্তরই পাখা মেলে নানান ক্যারদানি করে সময় জানান দিচ্ছে। দশটা বাজল, এখনও বুড়ি এল না। সাড়ে দশটা বাজল, এখনও বুড়ি এল না। টি.ভি অফ্‌ করে বিজু রায় উঠে পড়লেন।

এই জায়গাটা তাঁর বাড়ির বিখ্যাত সেন্টার পার্লার। এখানে তাঁরা নিজেরা এবং ঘনিষ্ঠজনেরা ছাড়া কেউ আসতে পায় না। তাদের জন্য নীচে আলাদা বসার ঘর আছে। দেয়ালজোড়া নরম কার্পেট। দেয়ালে হালকা বেগনি রং। তার ওপর বনসাইয়ের ছায়া পড়েছে। কোণে একটা ব্রঞ্জের গাছদান থেকে একটা বিরাট সাদা লিলি সুললিত আঙুল মেলে দিয়েছে। বাটিকের বুদ্ধ যশোধরা রাহুল ঝুলছে আর একটা দেয়াল থেকে। ওদিকে আবার ভ্যান গখের বিদ্‌ঘুটে আত্মপ্রতিকৃতি। যেদিকেই তাকালেন বিজু রায়, দুলিচাঁদ কানোরিয়ার ঘর, রাকেশ গুপ্তর ঘর, অনিল চৌধুরী বা এন. জির ছেলে শরদিন্দু বসাকের ঘর দেখতে পেলেন। ইনটিরিয়র ডেকোরেটর এসে সাজিয়ে দিয়ে গেছে; চরিত্রহীন ঘর। বিজু রায় অবাক হলেন ভেবে আগে কেন কখনও এসব মনে হয়নি, কেন লক্ষ পড়েনি তাঁর সেন্টার পার্লারের এই বেয়াড়া নৈর্ব্যক্তিকতা! বিজু রায় বিরক্তির আওয়াজ করে তাঁর স্ত্রীর শোবার ঘরে গেলেন। ডবল বেড খাটে টান টান বেডকভার। ফুলোফুলো মতন, যেন তুলো বা স্পঞ্জের তৈরি। ব্যাপারটা কী তিনি হাত বুলিয়ে দেখে নিলেন। একদিকের দেয়াল জুড়ে বিরাট ড্রেসিং টেবল্‌। কিছু-কিছু প্রসাধন দ্রব্য সাজানো রয়েছে। ড্রয়ারগুলোতে চাবি। প্রসাধন দ্রব্যগুলো তুলে তুলে শুঁকে শুঁকে দেখতে লাগলেন বিজু রায়। ডিওডোরান্ট, হেয়ার-স্প্রে। আর কিছু নেই। খুব সম্ভব এইগুলো সবশেষে ব্যবহার করে ড্রয়ারে তুলতে ভুলে গেছে তনুশ্রী। বিজু রায় লক্ষ করলেন ড্রেসিং টেবলে, দেয়ালের নানান জায়গায়, খাটের মাথায় সর্বত্র বিভিন্ন ভঙ্গিতে তনুশ্রীর ফটো। একটা অবশ্য ছেলেমেয়েদের সঙ্গে আছে, তারা তখন খুব ছোট, তনুশ্রীও একেবারে কাঁচা। কিন্তু আর সবই তনুশ্রীর একার কিংবা নানান বাইরের লোকের সঙ্গে তোলা। এদের মধ্যে শিল্পপতি, গাইয়ে বাজিয়ে, পলিটিকসের লোক সবরকমই আছে। যেগুলো তনুশ্রীর একার, সেগুলো বেশ ফিলমস্টার ফিলমস্টার ভঙ্গিতে তোলা। মাথায় তোয়ালে বাঁধা, বুকে তোয়ালে জডানো, কামানো বগল দেখিয়ে হাত দুটো ওপরে তোলা— এ ছবি কে তুলেছে কে জানে? আর একটা ওড়না টেনে, নাকে নথ পরে নাচের পোশাকে চারদিকে কুঁচি ছড়িয়ে বসে। এক পা সামনে ছড়ানো। কানের পাশে হাত। তনুশ্রী কি কখনও নাচ-গান জানত? বেশ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ছবিগুলো আজ দেখলেন বিজু রায়। যেন নতুন চোখে। আগেও তো এগুলো এ ভাবেই ছিল। তিনি যে এ ঘরে ঢোকেন না তা-ও নয়। কিন্তু আজই ছবিগুলো যেন প্রথম দেখলেন। ছবিগুলোর মধ্যে দিয়ে তনুশ্রীর সারা জীবনের চাওয়াও বেশ স্পষ্ট করে যেন দেখতে পেলেন তিনি। তনুশ্রী মোটামুটি ভাল দেখতে। প্রাণপণ চেষ্টা করে চেহারা রেখেছে। সে অনেক পেয়েওছে, সম্ভবত যা-যা চেয়েছে সব। পোশাক পরিচ্ছদ, বিউটি সেলুন, কসমেটিক সার্জারি, মাসাজ-ক্লিনিক, সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার ক্লাবের প্রেসিডেন্ট পদ, বড় বড় লোকের সঙ্গে ঘোরাফেরা। কিন্তু বিজু রায় পরিষ্কার আয়নার মধ্যে দিয়ে প্রতিবিম্ব দেখার মতো করে দেখতে পেলেন তনুশ্রী আসলে বেশ্যা হতে চায়। টান টান ত্বক সমেত সরু লম্বা পা, ভাঁজহীন পেট, নধর গোল হাত, মসৃণ কাঁধ, এই সমস্ত তনুশ্রী সবাইকে দেখাতে চায় ভীষণভাবে। নির্দোষ এই চাওয়া হয়। কিন্তু সন্দেহ নেই তনুশ্রী চাইছে, চতুর্দিকে প্রেমিকদের, স্তাবকদের কোলাহল, কেউ পায়ে হাত বুলোচ্ছে, কেউ বুকের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে আছে, কেউ চোখে চোখে ইশারা করছে— এইসব তনুশ্রী অন্তরের অন্তস্তল থেকে বহু বাসনায় প্রাণপণে চাইছে চাইছে চাইছে।

চাইছে শুধু? না পাচ্ছেও? পাচ্ছে নিশ্চয়ই। টাকা। অনেক অনেক নিজের অনর্জিত টাকা। তিনি তনুশ্রীকে আলাদা ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট করে দিয়েছেন অনেক দিন। তাঁর নিজের সঙ্গে জয়েন্ট অ্যাকাউন্টও আছে বেশ কয়েকটা। কিন্তু কথাটা হল তনুশ্রী পেয়ে যাচ্ছে। স্রেফ বিজু রায়ের স্ত্রী হওয়ার সুবাদে। টাকা, পদ, সামাজিক মর্যাদা, খোসামোদ এই সব পেয়ে যাচ্ছে এক্স অফিসিও। বিজু রায়ের ধর্মপত্নীর গুরুত্বপূর্ণ পদে আছে বলে। এই পরিমাণ টাকা, এবং মর্যাদা একটা গুণহীন মেয়েমানুষ যদি ফোকটে পেয়ে যায়, এবং তাকে যদি সমস্ত সাংসারিক দায়দায়িত্ব থেকে মুক্ত করে দেওয়া হয় তা হলে সে কী করবে? হয় বোর হবে নয় অকাজের কাজ করে বেড়াবে। একেকজন একেক ভাবে। নিজের প্রবৃত্তি অনুযায়ী। এই সংসারে কোথায় কী লাগে, কতটা চাল ডাল, কী পরিমাণ চা-দুধ-কফি-চিনি, কে কী খায়, কখন খায়, এ সব তিনি যেমন জানেন না, তনুশ্রীও তেমনই জানে না বলে তাঁর ধারণা। কারণ একেকদিন দুজনে কি তিনজনে, কদাচিৎ চারজনে খেতে বসলে তনুশ্রীকে যেন জিজ্ঞেস করতে শুনেছেন ‘প্রমীলা! আজ কী মেনু?’ তাঁদের অল্পবয়সে ভাইবোনেরা খেতে বসলেও এ প্রশ্ন কেউ-না-কেউ করত। তিনি করতেন। ছুটকি করত। বাবাও করতেন। ‘আজ কী রান্না হয়েছে?’

—‘কী আবার হবে? থোড়-বড়ি-খাড়া আর খাড়া-বড়ি-থোড়!’ মায়ের জবাব।

—‘বলোই না বাবা, অত বিনয় করছ কেন?’ ছুটকি হয়ত বলল।

—‘শুকতো’, মেজদা মুখ বিকৃত করল, ‘শাকে ডালে’, বাবা উৎসাহিত হয়ে বললেন ‘মুলো দিয়েছ তো?’ ‘হ্যাঁ গো হ্যাঁ।’ ‘ডাঁটাচচ্চড়ি।’ বিজু বলল—‘আগে বাঢ়ো, এখনও আমার পছন্দমতো কিছু শুনছি না।’ মুখ টিপে হেসে বলছে, ‘আলু পোস্ত’ ‘হুররে’। সশব্দে বলছে বিজু, অন্যরা নিঃশব্দে। ‘আজকে মাছ নয়, ডিম।’ মা বলছে। ‘তবে তো আরও ভালো, হাঁস না মুরগি?’ বিজুর প্রশ্ন। ‘মারব এক থাবড়া, বামুনবাড়িতে মুরগি!’ ‘মুরগির ডিম কিন্তু সহজপাচ্য মা’ ছুটকি বলল, ‘তা ছাড়া একটা পাখির ডিম খেতে যদি আপত্তি না থাকে তো আরেকটাতে কেন আপত্তি হবে! বলো বাবা!’

বাবা রাশভারী লোক। ছুটকি ছাড়া আর কেউ বাবাকে এভাবে আলোচনায় টানতে সাহস পায় না। বাবা বললেন ‘হাঁসের ডিম বড়ও বেশি, খেতেও অনেক ভাল।’

—‘তুমি মুরগির ডিম খেয়ে দেখেছ বাবা!’ সঙ্গে সঙ্গে ছুটকি তৈরি। ‘না, মানে, লোকে বলে।’

এই ঘরোয়া দৃশ্য এবং কথাবার্তা স্মৃতির কোন কোনায় এত যত্নে এমন নিখুঁত নির্ভুলভাবে সংরক্ষিত ছিল ভেবে অবাক হতে হতে বিজু রায় নিজের ঘরটাতে ঢুকলেন। একটা গুমসোনি গন্ধ নাকে এল প্রথমেই। জানলা খুলে দিলেন। গেল না। খুব মৃদু একটু তামাক, একটু হুইস্কির কড়া গন্ধ—তা-ও মিশে আছে ঘরের বাতাসে। কিন্তু মূল গন্ধটা খুব বিশ্রী, অচেনা। সকালে তিনি ঘর ছেড়ে বেরোবার পর এরা কি পরিষ্কার-টরিস্কার করেনি? বেডকভার সরিয়ে চাদর দেখলেন তিনি। বেশ পরিষ্কার চাদর। চাদর সরিয়ে গদি দেখলেন, পরিষ্কার গদি। দেয়ালের কোণে আয়না-সুদ্ধু ছোট্ট তিন কোনা আলমারি ফিট করা। এইখানে তিনি দাড়ি কামান। দাড়ি কামানোর যাবতীয় সরঞ্জাম এখানেই থাকে। ছেলেবেলায় মায়ের খুড়তুত পিসেমশাইয়ের বাড়ি তিনি এইরকম দেখেছিলেন। মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। দীর্ঘকাল পরে যখন তাঁর নিজের বাড়ি হচ্ছে, সবই পেশাদারি হাতে ছেড়ে দিয়েছিলেন খালি এইটা বলে দেন। ‘আমার ঘরের উত্তর-পূব কোণের দেয়ালে একটা তিন সাড়ে তিন ফুট লম্বা আলমারি ফিট করে দিয়ো। চওড়া যতটা পারমিট করে। ভেতরে তাক থাকবে। তেকোনা ন্যাচার‍্যালি। আমি ভালভাবে মুখ দেখতে পারব, এমন হাইটে কোরো।’ দাড়ি কামান, চুল আঁচড়ান, টাই বাঁধেন সব এই আয়নার সামনে। আরাম চেয়ার রয়েছে একটা। বই, রেডিও, কাগজপত্র রাখবার ড্রয়ার, ওয়ার্ডরোব সব একত্র করে একটা মালটিপারপাস ফার্নিচার করে দিয়েছে এরা। ফুলদানে টাটকা ফুল, টাটকাই তো! আশ্চর্য! তবু চিমসোনি গন্ধে গা গুলিয়ে উঠছে!

বিজু রায় আলো নিবিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলেন। বারান্দায় দাঁড়িয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। চারদিকে গাছপালা। বাগান। অপূর্ব নকশার সব বাড়ি। আকাশ মালিন্যহীন। এক টুকরো চাঁদ ফিক ফিক করে হাসছে। পাটের ফেঁসোর মতো দু চারটে মেঘ অনেক দূরে দূরে স্থির হয়ে আছে। বারান্দায় বেশ মশা। দু চারটে চটাচট গায়ের ওপরেই মেরে ফেললেন তিনি। তারপর কি ভেবে পার্লারে বেরিয়ে, গোল জায়গাটা পেরিয়ে ওদিকে ছেলের ঘরে ঢুকলেন। ঢুকতেই একটা জীবন্তপ্রতিম পোস্টার তাঁকে অভ্যর্থনা করল। খুব সুন্দর একটি মেম সাহেবের আবক্ষ ছবি। গোলাপি বুক ঠেলে উঠেছে। তলপেটে যেন একটা ধাক্কা খেলেন বিজু রায়। হাসছে মেম সাহেবটি। তলায় কি সব লেখা। কাছে গিয়ে আবছা আবছা পড়তে পারলেন—‘ওহ্, মাই ম্যাডোনা। আই লাভ ইউ।’ ম্যাডোনা? ম্যাডোনার ছবি এই রকম? বিজু রায় অবাক হয়ে গেলেন। সে তো গোল ধরনের মুখ। কোমল লাবণ্যে ভরা। মৃদু হাসি। চুলগুলো সিঁথি কেটে আঁচড়ানো। এ লেখাটা কি চিন্টুর? চোখে পড়ার চশমা নেই বলে ভালভাবে অক্ষরের ছাঁদ দেখতে পাচ্ছেন না তিনি। চিন্টু কাকে ম্যাডোনা বলে ডাকছে রে বাবা! দেয়াল-ভর্তি আরও পোস্টার। কোথাও এক যুবক হাতের মাস্‌ল ফুলিয়ে কপ্‌নি জাতীয় কিছু একটা পরে দাঁড়িয়ে আছে। কোথাও যুবক-যুবতী নিবিড় আলিঙ্গনে। চুম্বনে মত্ত। এই ছবিগুলো দেখতে দেখতে ঘুমন্ত বিজু রায় নির্ভুলভাবে জেগে যাচ্ছিলেন। ভাবছিলেন— ‘বারে বিজু ষাটের কাছেও তুই তো বেশ…’ তার পরেই লজ্জা পাচ্ছিলেন। এ সমস্ত উন্মাদনার উপকরণ তাঁর ছেলের। তিনি বাবা না? মুখ ফিরিয়ে টেবিলের ওপর তাকালেন। স্তূপীকৃত বই, পত্রিকা। উল্টে পাল্টে দেখলেন, স্পোর্টস, ফিল্‌ম। বইগুলো একটু আধটু পড়বার চেষ্টা করলেন। কিছু বুঝতে পারলেন না। কী অদ্ভুত ইংরিজি! কত বয়স হল নীলাদ্রির? একটু বেশি বয়সে বিয়ে করেছেন। ছেলেটির বোধহয় একুশ বাইশ। কী পড়ছে, শুনছে? কমার্স পড়ছিল না? নাকি অন্য কিছু? এর সম্পর্কে অথাৎ কেরিয়ার সম্পর্কে এবার ভাবতে হয়। কমার্স পড়ে তাঁর ফার্মে যোগ দেবে এটাই স্বাভাবিক ইচ্ছে। ফার্মে দু এক বছর বসে গেলেই বিয়ের জন্যে পাত্রী দেখতে হচ্ছে। তনুশ্রীর ঘরে যেমন তার আশা-আকাঙক্ষার একটা পুরো ছবি তিনি দেখতে পেয়েছিলেন, এখানে যেন তেমনটা পেলেন না। কিংবা হয়ত পেলেন খানিকটা, নিজের অজান্তেই সেটাকে মেনে নিলেন না। এ সব ছবি প্রকাশ্যে এ ভাবে টাঙানো রয়েছে, এ তাঁদের সময়ে কল্পনা করা যেত না। তবু এই জাতীয় কিছু বই খাতার ফাঁক ফোকর থেকে আবিষ্কৃত হলে সঙ্গে সঙ্গে অভিভাবকরা বিয়ের কথা ভাবতেন। মধ্যবিত্ত ঘরে চাকরি-বাকরি বা অন্য কোনও রোজগার না করলে তখন বিয়ের সম্ভাবনা থাকত না। তবু, মেজদার বইয়ের ভেতর থেকে মধুবালার ছবি বেরোতে বাবা ভয়ানক চিন্তিত হয়ে পড়েছিলেন। নানা জায়গায় যুগপৎ মেজদার চাকরি এবং বিয়ের জন্যে হাঁটাহাঁটি শুরু করে দিয়েছিলেন। নীলাদ্রির বিছানার ওপরও একগাদা অডিও এবং ভিডিও ক্যাসেট ছড়ানো। ভি সি আরটা মেঝেতে কার্পেটের ওপর নামিয়ে রাখা। কেউ কি ওর ঘরখানা একটু গুছিয়েও দেয় না! নিজে তো গুছোতে জানেই না। মা, বোন, এতগুলো কাজের লোক। কেউ রায় সাহেবের একমাত্র ছেলের ঘরখানা গুছিয়ে দেবে না! আচ্ছা এই কাজের লোকেরা, এরা তো কখনও কখনও এ ঘরে ঢোকেই। এই সব ছবি-ছাবা দেখে কী মনে করে? দূর হোক গে! লোকের ভাবনা তো তিনি নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন না! পাছে জয়দীপ তাঁর প্যাকেটটাকে ঘুষ মনে করে তাই তিনি পুরো পথটা আবার গিয়েছিলেন। তার অফিস পর্যন্ত। অফিসের লোকগুলোকে ভাল করে জানিয়ে এসেছেন ওটা তাঁর নিজের জিনিস। জয়দীপের কাছে নিজের মান রাখতে তিনি এতটা করেছেন। কিন্তু ছেলের ব্যাপারে, ছেলের মানরক্ষার জন্য আপাতত তিনি কীই বা করতে পারেন? তাঁর হাত পা বাঁধা। নিচু হয়ে কতকগুলো ভিডিও ক্যাসেট তিনি তুলে নিলেন হাতে। পরক্ষণেই জ্বলন্ত কাঠের টুকরোর মতো সেগুলো ফেলে দিলেন। আর একটুও দাঁড়ালেন না। ঝঞ্ঝাবাত্যার মতো বেগে ঘর থেকে বেরিয়ে দরজাটা ভেজিয়ে দিলেন। যেন তিনি ভেজিয়ে দিলেই এ সব অদৃশ্য থাকবে। তারপর আর একটু দূরত্বে মেয়ের ঘরে ঢুকলেন।

কিছু দেখলেন না প্রথমটায়। টেবিলের সামনে চেয়ার রয়েছে। ভেতরে ঢুকোনো। কিন্তু তিনি গিয়ে বিছানায় বসলেন। বেশ কিছুক্ষণ বসেই রইলেন। বসেই রইলেন। তারপর চোখ মেলে দেখলেন সামনের দেয়ালে একটা ক্রুসবিদ্ধ যিশুর ছবি। বেশ সুন্দর সৌম্য করুণকান্তি যিশু নয়। কেমন হাড় জিরজিরে বুড়ো মতো। চোখকে ধাক্কা দেয়, অপ্রসন্ন করে। টি.ভির ওপরে একটি অচেনা ছেলের ফটো একটু একটু হাসছে। দাঁত বার করে নয়। মুখখানা কোনওক্রমে একটু স্মিত এইটুকু বলা যায়। সাদা-মাটা চেহারা। গেরস্থ ঘরের ছেলে। চিন্টু বা তার বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে বা যে-সমস্ত ছেলেপুলে নিত্যদিন আশে-পাশে চোখে পড়ে তাদের মতো নয়। গালে একটা হাত। বইয়ের র‍্যাকে বেশ কিছু ইংরিজি বাংলা বই রয়েছে। সবই পাঠ্য বই মনে হল। ড্রয়ারগুলো আপাদমস্তক বন্ধ। ওয়ার্ডরোব চাবি লাগানো। ওকে বুঝতে পারলেন না বিজু রায়। চিন্টুর ঘরে ঢুকে মনে হয়েছিল ওর মনটা অস্পষ্ট, নিজেই জানে না কী করবে, কী চায়। কোনও অ্যামবিশন নেই, ইচ্ছাশক্তি, সংকল্প, এসব কিছু নেই ও ঘরে। এটা প্রথম মনে হওয়া। তার পরে মনে হল সর্বনাশ, এ তো একটা বিকৃতরুচি, বিকৃতবুদ্ধি পার্ভার্ট। কিন্তু তিতি যেন খুব কঠিন মুখ করে অনেক কিছু লুকিয়ে রেখেছে। তিতির মুখখানা এই মুহূর্তে চেষ্টা করেও মনে করতে পারলেন না বিজু রায়। তিতি কি উনিশে পড়ল? টি.ভি.র ওপর গালে হাত দিয়ে ছেলেটি কে? বয়স তার বেশি নয়। খুব মধ্যবিত্ত চেহারা। একে কোনওদিন নিজের বাড়িতে দেখেছেন বলে মনে করতে পারলেন না তিনি। অথচ কেমন চেনা-চেনা লাগল।

পার্লারে এসে চোখে পড়ল একটি মোটাসোটা ঘুঘুর মতো দেখতে মহিলা ঘুরঘুর করছে। পরিচ্ছন্ন পোশাক-আশাক। তিনি কৌচে বসতেই সাঁত করে সরে গেলে। ঘুঘু নয়। কেমন কেঁদো ভিজে বেড়ালের মতো। যথেষ্ট ওজন সত্ত্বেও অমনি ক্ষিপ্রতা চলাফেরায়। একটু ধূর্তামি। সব বুঝে জেনেও না বোঝা না জানার ভান। তিনি চিনতে পারলেন এটি তাঁদের রাঁধুনি। তিনি আজকে সকাল-সকাল বাড়ি ফিরে অনেকক্ষণ ধরে এখানে ঘোরাঘুরি করছেন তাই ও বোধহয় টি.ভি. দেখতে পাচ্ছে না। গলা খাঁকারি দিয়ে উঠে পড়লেন বিজু রায়। মহিলা বলল, ‘সাহেব, খাবার দেব?’ গলাটা সম্ভ্রমে ভয়ে যেন কাঁপছে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বিজু রায় দেখলেন সত্যিই তো! এগারটা বেজে গেছে। আর কখন খাবেন?

তিনি ঘড়ির দিকে তাকিয়েই বললেন, ‘তোমার মেম সাহেব, …ছেলেমেয়েরা এরা সব কোথায় গেল? কেউ কিছু বলতে পারল না।’

—‘ওরা জানে না সাহেব। তিতিদিদি বন্ধুদের সঙ্গে কোথায় বেড়াতে গেছে, দু দিন হল। মেম সাহেব কিছু বলেন নি। তবে মনে হয় কোনও নাচ-গানের জলসায় গেলেন। দাদার কথা আমি জানি না।’ থেমে থেমে বলল মহিলা।

—‘হুঁ।’ বিজু রায় কিছুক্ষণ পায়চারি করলেন। মহিলাটি সন্ত্রস্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। তিনি বললেন— ‘খাবার দাও।’

খাবার ঘরে যেতে যেতে হঠাৎ গন্ধটা চিনতে পারলেন বিজু রায়। তাঁর ঘরের চিমসোনি গন্ধটা মর্গের। একবার তাঁকে একটা কেস শনাক্ত করবার জন্য যেতে হয়েছিল। গন্ধটা বাসি মড়ার। প্রভূত বাসি মড়ার।

মুখটা বিকৃত করে তিনি বসে রইলেন চেয়ারে। রাঁধুনি মহিলাটি যত্ন করে তাঁর রাতের খাবার এনে টেবিলে সাজিয়ে দিল। চিকেন সুপ, গরম, ধোঁয়া উঠছে, সুজির রুটি, তিনটে, ফুটবলের মতো ফুলে রয়েছে একখানা এখনও। দু টুকরো মাছ সসে ভেজানো। এবং অনেকটা কাঁচা সালাড। খাবারের সামনে কিছুক্ষণ চুপ করে বসে রইলেন বিজু রায়। তারপর হঠাৎ খাবারগুলো ছুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলে দিতে লাগলেন। বেশ তাক করে করে। সুপের বাটিটা সাইডবোর্ডের কানায় লেগে ভেঙে গেল। তরল পদার্থটা সাইডবার্ডের গা বেয়ে মেঝেয় গড়াচ্ছে। মাছগুলো জানলার কাচে তাক করলেন। থুপ থুপ শব্দ করে সেগুলো কাচে লেগে জানলার তলায় পড়ে রইল। সালাডের শশা, টোম্যাটো, গাজর ইত্যাদির চাকা দেয়ালের গায়ে নতুন ডেকোরেশনের মতো লেগে আছে। সবচেয়ে বেশি দূরে গেল রুটিগুলো। একটা একটা করে সেগুলোকে জানলার বাইরে পাঠাতে চেষ্টা করলেন বিজু রায়। লতা পাতার গ্রিল। আশপাশ দিয়ে টুক টুক করে বেরিয়ে গেল সে গুলো। বেশ নিশ্চিন্ত হলেন এবার বিজু রায়। শব্দ শুনে রাঁধুনি ছুটে এসেছিল। হতভম্ব মহিলাকে বিজু রায় বললেন, ‘আমার ঘর পরিষ্কার হয়নি কেন? যাচ্ছেতাই গন্ধ বেরোচ্ছে।’

তিনি বেশ ধীর দৃঢ় পায়ে তেতলায় উঠে যেতে থাকলেন। সিঁড়ির বাঁকে তিনি অদৃশ্য হয়ে যেতেই রাঁধুনী মহিলা যার নাম প্রমীলা, সে তার সাহায্যকারী ও বন্ধু বদনকে ডাকতে গেল। বদন এগুলো পরিষ্কার করে দেবে, সাহেবের ঘরটাও দেখবে কী হল, ব্যাপারটা সম্পর্কে তারা আলোচনাতেও বসতে পারবে।

তিনতলাটায় অর্ধেক ছাদ। তাতে একরঙা টালি বসানো। গাছ প্রচুর। ফুলগাছই বেশি। মা ও সব পাতাবাহার টাহার পছন্দ করত না। একটা বেশ ঝাড়ালো তুলসীগাছ। একদিকে ঠাকুরঘর, আরেক দিকে মায়ের ঘর, টয়লেটসহ। মাঝখানের পথটা দিয়ে প্রথমেই ছাদে এসে বুক ভরে নিশ্বাস নিলেন বিজনবিহারী। গভীর করে প্রশ্বাস নিলেন, শ্বাস ছাড়লেন বার কয়েক। প্যাসেজের মাঝখানে একটা গোল আলো জ্বলে। সেই আলো খানিকটা গিয়ে পড়েছে ছাদে। আকাশের আলোও আছে। মঞ্জরিত তুলসী দেখা গেল। নীচে তাঁর যে বাগান, তাতে সবুজ লন আছে, মরশুমি ফুলের বেড আছে। কিন্তু ছাদের বাগানে মা শুধুই গন্ধকুসুম রাখত। গন্ধহীনদের মধ্যে একমাত্র জবা আর নয়নতারা। আধা-অন্ধকারে ফুটে আছে দেখতে পাওয়া গেল। এবং সাদা নয়নতারা। কোনও ফুলের গন্ধ পাওয়া গেল না। রজনীগন্ধা গোলাপ এদের তো ফোটার কথা! তিনি ফিরে মায়ের ঘরের দরজাটা খুলে ফেললেন। এ বাড়িতে কোনও ঘরেই কখনও তালা চাবি ইত্যাদি দেওয়া থাকে না। ড্রয়ার, ক্যাবিনেট, আলমারি ইত্যাদি বন্ধ থাকে, কিন্তু ঘর খোলা।

মায়ের ঘরে মায়ের পুরনো আমলের সেগুন কাঠের পালঙ্ক। আলমারি। লোহার সিন্দুক। চৌকির ওপর বসানো কিছু তোরঙ্গ। বাবার আরাম-চেয়ারটা। তা ছাড়াও গোটা দুই চেয়ার। একটা নতুন ডিজাইনের আলনা। এটাই একমাত্র এ যুগের জিনিস ঘরটাতে। পালিশ-টালিশ অন্যান্য আসবাবের সঙ্গে মানানসই। কিন্তু জিনিসটা ঘরের মধ্যে মূর্তিমান ছন্দপতনের মতো দাঁড়িয়ে আছে বলে বিজনবিহারী সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে পারলেন। তাঁর চোখ এখন সুরুচি-সুছন্দে নতুন যুগের সুষমা-সৌন্দর্যের ধারণায় বড্ড বেশি অভ্যস্ত হয়ে গেছে। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ঘর। খুব সম্ভব সন্ধেবেলায় ধূপ জ্বেলে দেওয়া হয়েছিল, ধূপদানির তলায় কুণ্ডলিকৃত ছাই পড়ে আছে। গন্ধটাও আটকে আছে ঘরে। মৃদু কস্তুরী গন্ধ। কিন্তু গন্ধটা সইতে পারলেন না তিনি। তাড়াতাড়ি জানলা খুলে দিলেন। এক ঝলক হাওয়া ঢুকল। পরিষ্কার হলেও, ঘরটাতে অব্যবহারের দরুন কেমন একটা শূন্যতার ছাপ পড়ে গেছে।

আরাম-চেয়ারটাতে বসলেন বিজনবিহারী। সোজা হয়ে এটাতে বেশিক্ষণ বসা যায় না। চেয়ারের বাঁকানো পিঠটা কেমন টানতে থাকে। অভ্যাসবশত পকেটে হাত চলে গেল, সিগারেট ও লাইটারের খোঁজে। কিন্তু ঠিক সিগারেটটা ধরানোর মুহূর্তে ছাদের দিকের জানলা দিয়ে একঝলক ফুলের গন্ধ ঢুকল। গন্ধটা চিনতে পারলেন না বলেই বিজনবিহারীর গায়ে যেন কাঁটা দিল, যেন মা ঢুকল। সাদা থান, গলায় সোনায় গাঁথা রুদ্রাক্ষের মালা। শুকনো বৃদ্ধা এক। মায়ের সামনে এতটা বয়সেও সিগারেট খেতেন না বিজন। একদিন অনেকক্ষণ মার কাছে বসবার পর ছটফট করছিলেন সিগারেট না খেয়ে। মা বলল—‘যা না, একটু বাইরে যা না। ছাদে ঘুরে আয় একটু।’

বিজন হেসে বলেছিলেন— ‘ছাদে খাবার দরকার কী মা! বয়সটা তো কম হল না। তোমার সামনে খেলে কী হয়! এমন নয় যে গন্ধটা তোমার কোনও দিন অভ্যেস ছিল না। বাবা ছিলেন চেইন-স্মোকার, সিগারেটের পয়সা কুলোতে না পারলে বিড়ি খেতেন।’ সে কথা মনে করেই কথাটা বলেছিলেন মাকে।

মা গম্ভীর হয়ে বলল— ‘গন্ধটা আমার কোনও দিনই ভাল লাগেনি। সে উনিই খান, কি আর কোনও গুরুঠাকুরই খান। কিন্তু সে কথা নয়, মায়ের সামনে ছেলের ধূমপান আবার কী।’

—‘এতো সংস্কার ত্যাগ করতে পারলে মা, এটা পারছ না?’

—‘এটা তো সংস্কার নয় বিজু, এটা সভ্যতা, সম্ভ্রম। মা ছেলে যত ঘনিষ্ঠই হোক, সম্পক্কটার মধ্যে শ্রদ্ধা আছে তো!’

—‘কিন্তু মা, আমার ছেলেকে আমি অনুমতি দিয়ে দিয়েছি। নেশা করতে হয় সামনাসামনি করুক।’

—‘ভাল করিস নি। বয়সধর্মে যা করে করুক, একটু নলচে-আড়াল থাকা ভাল।’

মায়ের এই সব কথা স্মরণ করে লাইটারটা নিবিয়ে দিলেন তিনি। কিছুক্ষণ চুপচাপ শুয়ে থাকবার পর হঠাৎ কী মনে হল তিনি উঠে পড়ে আলোটা জ্বেলে দিলেন। লুকোনো জায়গা থেকে সিন্দুকের চাবি বার করলেন। দুটো চাবি দুটো দিকে ঘুরিয়ে খুলে ফেললেন সিন্দুকটা। দুটো তাক। ভর্তি কাগজপত্র। ওপর তাকে একটা মোটা বাঁধানো খাতা। চট করে পাতা উল্টে বাবার হস্তাক্ষর দেখতে পেলেন। কিছু হিসেব-পত্ৰ যেন। সংসার খরচের হিসেব মনে হয়। খুদে খুদে কালো পিঁপড়ের সারির মতো লেখা। তিন এক পঞ্চাশ, চার এক পঞ্চাশ, এইভাবে পর পর সাত আট দিন। হলুদ দু পয়সা, কালো জিরে দুই আনা, ধোপা বারো আনা, কাগজ চার আনা। এইভাবে চলেছে। আশ্চর্য! মা এ খাতাখানাকে সিন্দুকের মধ্যে হীরে-জহরতের মতো করে রেখে দিয়েছে? কেন? পঞ্চাশ সালের বাজার-দরের একটা দলিল হতে পারে অবশ্য খাতাটা। বাবা যেন প্রাণপণে উত্তর-কালের কোনও অর্থনীতিক মীমাংসার জন্যে এক সামান্য নিম্নবিত্ত পরিবারের দৈনন্দিন ব্যয়ের পরিমাণ খুঁটে খুঁটে লিখে গেছে। বাবার কি এরকম অভ্যেস আদৌ ছিল? মনে করবার চেষ্টা করতে লাগলেন তিনি। অমনি যেন কত শতাব্দীর ওপার থেকে ঠাকুমার খনখনে গলার স্বরটা ভেসে এল। খনখনে কিন্তু বড় প্রিয় স্বর। শিশুকালে ওই স্বর এবং তার সঙ্গে মেশানো ছাঁচিপানের গন্ধ ভীষণ মিষ্টি লাগত। ঠাকুমা এইভাবে খনখন করে উঠলেই বাবা একটা খাতার ওপর বা কাগজপত্রের ওপর উপুড় হয়ে পড়তেন। এটা মনে পড়ে গেল। সে কি এই খাতা?

ঠাকুমা বলছে— ‘হ্যাঁ রে বঙ্কু, বাপ-পিতেমোর ভিটে নয়, কিছু নয়, আর একখানা বাড়ি দেখতে কী হয়?’

—‘কেন মা খারাপ কী, গঙ্গার হাওয়া খাচ্ছ তো বিনা পয়সায়।’

—‘চিতের হাওয়াও খাচ্ছি! চিতের হাওয়া খেয়ে খেয়ে বাড়িটার পরকাল যে ঝরঝরে হয়ে গেল!’

—‘চিতের হাওয়াতেই তো সংসারটার পত্তন হল মা। সমুদ্দুরে বাস যার, শিশিরে কী ভয় তার?’

গঙ্গার ধার ঘেঁসে বাড়ি। মাঝখানে গাড়ি চলাচলের রাস্তা। পার হলেই ওদিক দিয়ে ঘাট নেমে গেছে। শ্মশান খুব কাছে। সেখান থেকে ধোঁয়ার কুণ্ডলি মাঝে মধ্যেই পাকিয়ে পাকিয়ে দোতলা ছাদের হাওয়া ছুঁয়ে যায়। এই ধোঁয়া নিয়েই ঠাকুমার আক্ষেপ। পক্ষাঘাত হয়ে যখন প্রায় সুস্থ মানুষটা শুয়ে পড়লেন তখনও তিনি এই চিতের ধোঁয়ারই মুণ্ডপাত করেছিলেন।

মায়ের কাছে বিজুরা শুনেছিল। নিতান্ত গুড়গুড়ে বয়সে ঠাকুর্দাদা মারা যাবার পর বাবাদের ক’ভাই-বোনের হাত ধরে ঠাকুমা নিজেই গাঁয়ের দোতলা বাড়ি জমি-জমা-পুকুর সব বিক্রি করে দিয়ে এই বাঁধা ঘাটের কাছে বাসা নিয়েছিল, ভাইদের কাছাকাছি থাকবে বলে। সেইখানে, বাবারা তিন নাবালক ভাই বড় হল, বড় জন একদিন কোথায় পালিয়ে গেল। লোকে বললে সন্ন্যাসী হয়ে গেছে। মেজ ভাই মামাদের দৌলতে ক্রমে জেলা-ম্যাজিস্ট্রেট হল, বড় ঘরে বিয়ে করল, অন্যত্র বসবাস— আপনি আর কপনি। পিসির বিয়ে হল অনেক দূরে, পঞ্জাবে না কোথায়, খালি ছোট ভাগনেটির বেলাতেই মামাদের দাক্ষিণ্যে কম পড়ে গেল। বড় মামা মারা গেলেন। তিনিই ছিলেন মাথা, অন্যরা নিজেদের নিজেদের সামলাতেই ব্যস্ত। অনেক কষ্টে হুগলি-ডকের চাকরিটা জুটেছিল তাই। ত্রিশ টাকা ভাড়ায় ওই রকম দোতলা বাড়ি আর কেউ দেবে? বাড়ি নিয়ে এই জাতীয় তকরার বাবা আর ঠাকুমার মধ্যে মাঝে মাঝেই হত।

খুব ছেলেবেলা। দাদা-দিদিরা সব বেরিয়ে গেছে, বিজু প্রস্তুত হচ্ছে। বাবা ভেতর-রকে নিজের জন্য নির্দিষ্ট জায়গাটাতে ধুতি গুটিয়ে মোড়ায় বসেছেন।

—‘বলি শুনছ! ছেলে মেয়েগুলো কোথায় গেল সব?’

—‘কোথায় আর যাবে? গঙ্গায় ঝাঁপাই জুড়তে গেছে।’

—‘বারণ করলে না?’

—‘খেলাধুলো করছে, খারাপ কিছু তো নয়! বারণ করতে যাব কেন?’

—একটা বিপদ হলে?

—‘ও সব কথা মনেও স্থান দিয়ো না। গরিবের ছেলে ওইটুকু যে খেলেধুলে আনন্দ করবার সুযোগ পেয়েছে…’ মা বারবার কার উদ্দেশে যেন নমো করছে।

—‘আর সময়ই বা কোথায় আমার তোমার ছেলেমেয়েদের পেছনে খবর্দারি করবার? ওদিকে মা পড়ে পড়ে কোঁকাচ্ছেন, তাঁর এটা ওটা সারাক্ষণ আছে, এরই মধ্যে তুমি রাজ্যির কচুর শাক, ঘোড়, মোচা সব একই দিনে এনে ফেললে, উনুন খাঁ খাঁ করছে।’ মা দ্রুত পা ফেলে রান্নাঘরে চলে যাচ্ছে। মাথায় ঘোমটা।

বিজনবিহারী চোখ দুটো ভাল করে মুছে নিলেন। এত ভাল করে এ সব দৃশ্য, এ সব শব্দাশব্দ, চেহারা তাঁর মনে আছে? আশ্চর্য! সে তো অন্য এক জীবন! অন্য এক জগৎ। অকল্পনীয় সস্তা ভাড়ায় পুরো দোতলা একখানা বাড়ি। দোতলার ঘরগুলোর জানলা খুললেই গঙ্গার হাওয়া ঝাঁপিয়ে পড়ে। কোলে দালান। দূর প্রান্তে কলঘর। নীচেও অমনি সব ঘর। ঠাকুমা নীচে থাকতেন। মা-বাবাকেও তাই নীচেই থাকতে হত। দোতলাটা পাঁচ ভাইবোনের রাজত্ব।

কয়েকটা পাতা উল্টিয়ে গেলেন বিজনবিহারী।

‘আজ বিজু নিরুদ্দেশ হইল। —চলিয়া গিয়াছে এক বছর হইতে চলিল। তাহার পর হইতেই ছোট খোকা সম্পর্কে অস্বস্তিতে ছিলাম। অন্যমনস্ক। উদাসীন। সংসারের কারও প্রতি, কোনও কর্তব্যের প্রতি যেন টান নাই। আঁট নাই। — গেল, গেল। আমার সংসারটিকে আগাগোড়া দুরমুশ করিয়া গেল। পত্নী যেন নীরবে আমাকেই দোষারোপ করেন। বড় মেয়ে কলঙ্কের ভয়ে কি কী জানি, হয়ত লজ্জায় এদিক মাড়ায় না। বড় খোকা— এর ন্যাওটা ছিল। তাহাকে দেখাশোনার ভার সে নিজে হইতেই লইয়াছিল। বড় মায়াবী শরীর। ধাতটাই মায়ের। সে এমন করিতে পারে ইহাতে বিশ্বাস হয় সংসারে অসম্ভব কিছু নাই। বিজুর খোঁজ করিব কোথায়? তাহার বন্ধু-বান্ধব— সবগুলিই তাহা অপেক্ষা বয়সে বড়, বলিতেছে সে ভাগ্যান্বেষণে গিয়াছে। বিবাগী হইবার পাত্র সে নয়। কিন্তু তাহার জ্যাঠা গৃহত্যাগী হইয়াছিলেন। কোনও দিনই আর তাঁহার খোঁজ পাওয়া গেল না। হায়, আমি দরিদ্র মানুষ। কী-ই বা করিতে পারি। পুলিশে একটি ডায়েরি ভিন্ন আর কিছুই আমার হাতে নাই। — এর জন্য আত্মীয়স্বজনের কাছে মুখ দেখাইতে পারি না। বিজু ছোটখোকা আমার বড় প্রিয় ছিল। হায়, ছিল বলিতেছি কেন? আছে আছে, শতবার আছে।’

বাবার এই কথাটুকু পড়ে চমৎকৃত হয়ে গেলেন বিজনবিহারী। ‘ছোট খোকা আমার বড় প্রিয় ছিল।’ তাঁর যতটুকু মনে পড়ে, গঙ্গার ধারের সেই নিম্নমধ্যবিত্ত বাড়ি তখন তাঁর কাছে জ্বলন্ত কটাহস্বরূপ। বি.কম দ্বিতীয়বার ফেল করে তিনি সবার চক্ষুশূল। মেজদা প্রায় কথাই বলে না। সেজদা সুযোগ পেলেই উপদেশ দেয়। বাবা হাপরের মতো দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করেন। যেন সে ইচ্ছে করে ফেলটা করেছে। একমাত্র মা-ই, মুখের হাসি অটুট রেখে শত কাজের মধ্যেও মাথায় হাত বুলিয়ে বলেছে—‘ছোট খোকা আশা হারাসনি, আবার চেষ্টা কর, পারবি, ঠিক পারবি।’ যদিও অন্যদের তাড়নার চেয়ে মায়ের এই স্নেহবাক্যই তাঁর বাড়ি থেকে পালানোর মুখ্য কারণ হিসেবে কাজ করেছে। আবার চেষ্টা? মা এই ‘আবার চেষ্টা’র বাইরে কোনও পথ দেখতে পেত না। অত কল্পনাশক্তি ছিল না মায়ের। কিন্তু আরেকবার চেষ্টার সম্ভাবনাতেও বিজুর গা গুলোত, মাথা ঘুরত, ভেতরে প্রচণ্ড বিদ্রোহ জন্ম নিত। মনে হত সংসারের সব জিনিসপত্তর টুকরো টুকরো করে ভেঙে ছিঁড়ে, মানুষগুলোকে যাচ্ছেতাই গালাগাল-টাল দিয়ে সে উধাও হয়ে যায়। উধাও-ই হল। তবে তার পূর্ববর্তী কাজগুলো সে করে নি। একটি পক্ষাঘাতের রোগী, একটি জড়ব্যাধিগ্রস্ত এবং আরও একটি সামাজিক দূর্ঘটনার আঘাতে টলটলায়মান সেই সংসারকে আঘাত করার মতো নিষ্ঠুরতা বিজুর ছিল না। বাবার ডায়েরির ড্যাশ অংশগুলো হঠাৎ যেন তাকে কুড়ি একুশ বছর বয়সের সেই ধাক্কা-খাওয়া দিনগুলোয় নিয়ে গেল। ক্ষতটা যেন এখনও টাটকা! এরকম হয়? সল্ট-লেকের এই বাড়ি নেই। নেই ছেলে-মেয়ে-স্ত্রী! নেই আটান্ন-ঊনষাট বছর বয়স, তার দীর্ঘ অভিজ্ঞতা, সাফল্য, নানান ব্যবসা সহচর। সমস্যা। কুড়ি-একুশের বিজু একখানা শূন্য ঘর, শূন্য বাড়ি, শূন্য ছাদে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অনুক্ত যন্ত্রণা! ছুটকি ছুটকি ছুটকি!

খোলা পাতাগুলোয় হাত রেখে অনেকক্ষণ বসে রইলেন বিজনবিহারী। কোথাও একটা ঘড়িতে ভীষণ শব্দ করে একটা বাজল। তিনি চমকে উঠলেন। পুরনো খাতা, হাতের চাপে একটু ভেঙে গেছে। যাঃ।

খুব সাবধানে পাতা উল্টে দেখতে লাগলেন তিনি আর কী আছে খাতাটাতে। হিসেব। মেজদার বিয়ের খবর। বেনারসী শাড়ি— এক, একশত পঞ্চাশ টাকা। মুর্শিদাবাদি সিল্ক—পয়তাল্লিশ, তাঁত শাড়ি—চার খানি—চার ইনটু পঁচিশ মোট একশত। এইভাবে এয়োড়ালা, প্রসাধনদ্রব্য, বরের জোড়, ব্র্যাকেটে লেখা—কাশীর সিল্ক দিলাম, গরদের জোড় দিতে পারিলাম না। আমার বিবাহে যাহা পাইয়াছিলাম তাহা বেনারসী জোড়। এক্ষণে পিঁজিয়া গিয়াছে। তাহা মেজ খোকা পরিতে চাহিল না।’ ষাট সালের তারিখ দেওয়া। বিস্তৃত হিসেব— ঘর খরচ, বউ ভাত, প্রীতিভোজ, কার্ড। তিনি সে সময়ে ছিলেন না, পলাতক। এখন শোনেন বাবা মেজদা সেজদা উভয়ের বিয়েতেই বেশ দাঁও মেরেছিলেন। মেজ বউদি একদিন কথায় কথায় শুনিয়েছিল খবরটা। সত্যি কথাই। মেজদা-সেজদার বিয়ে বোধহয় কমাসের আড়াআড়ি হয়। সাল হিসেবে আলাদা। কিন্তু মাসের তফাত ছ সাত মাসের। এত অল্প সময়ের মধ্যে বাবার মতো ডাইনে-আনতে-বাঁয়ে কুলোয়-না মানুষ দুখানা বিয়ে দিয়ে উঠলেন কী করে। বিজন আপন মনেই হাসলেন।

বাবা দেখা যাচ্ছে নিয়মিত হিসেব রাখতেন না। কোনও কোনও গুরুত্বপূর্ণ হিসেব। বিয়ে ইত্যাদির। নইলে মাঝে মাঝে পুজোর খরচ, অন্য কোনও পার্বণ, সত্যনারায়ণের ফর্দ ইত্যাদির। দৈনন্দিন হিসেব মাঝে মাঝে ঢুকে পড়েছে। দৈনন্দিন হিসেবের ব্যাপারে বাবা যেন ঠিক মনঃস্থির করতে পারেননি। রাখবেন কি রাখবেন না। তেড়ে ফুঁড়ে এক হপ্তামতে রেখেছেন, আবার ছেড়ে দিয়েছেন। কেমন একটা অস্থিরচিত্ততা প্রকাশ পাচ্ছে এই হিসেব রাখারাখির ব্যাপারটার মধ্যে দিয়েও। অথচ বাবা যে আদৌ অস্থির হতে পারতেন, কোনও বিষয়ে দ্বিধা, দ্বিমত, মত পাল্টানো ইত্যাদির মধ্যে যেতে পারতেন, সে কথা তাঁর ছেলে হিসেবে বিজনের কখনও মনে হয়নি। বাবা যেন অচল, অনড়, জগদ্দল এক পাথর। কিছুতেই তাঁকে তাঁর সংকল্প, ধারণা ইত্যাদির থেকে নড়ানো যাবে না।

‘বৃদ্ধ’ মানুষ, না মানুষ বলা ঠিক হইল না। বৃদ্ধ ব্যক্তি, না ব্যক্তিই বা কেন? যখন কাহাকেও একটি স্বতন্ত্র সত্তা বলিয়া স্বীকার করা হয় তখনই সে ব্যক্তি। বৃদ্ধের ব্যক্তিত্ব আর কাঁটালের আমসত্ত্ব একই বস্তু। সুতরাং শুধু বৃদ্ধ বলাই ভাল। এই বৃদ্ধ খিড়কির দুয়ার দিয়া পাঁশকুড়ায় ফেলিয়া দিবার যোগ্য একটি অবাঞ্ছিত বস্তু। বিনষ্ট ভ্রূণ যেমন পাপী পাঁশকুড়ায় ফেলিয়া দেয়, বৃদ্ধ নামক মনুষ্যত্বের অপভ্রংশটিকেও তেমনই জীবন পাতক, রাস্তার ধারে, অবহেলায়, লজ্জায়, ক্ষোভে ফেলিয়া দিয়া যায়। বৃদ্ধের না আছে মূল্য, না আছে মান। পরমহংসদেব বলিতেন মান আর হুঁশ দুই মিলিয়া মানুষ। বৃদ্ধের হুঁশ নাই, সুতরাং মানও গিয়াছে। সে আর কোন মুখে মনুষ্য-পদবি যাঞা করে? কিন্তু ইহা কি বৃদ্ধের দোষ? সে তো সাধ করিয়া বৃদ্ধ হয় নাই! পারিলে সে বার্ধক্যকে ঠেকাইয়া রাখিত। বলিতে কি ঠেকাইয়া রাখিবার প্রাণান্তকর প্রয়াস বৈজ্ঞানিক মহলে চলিয়াছে। গেরন্টোলজি নামে একটি নূতন শাস্ত্র হইয়াছে শুনিয়াছি। নূতন কী?’

প্রশ্ন চিহ্ন দিয়ে শেষ করেছেন বাবা। এ কি বার্ধক্য সম্বন্ধে নৈর্ব্যক্তিক ভাবনাচিন্তা? না বাবা তাঁর নিজের অভিজ্ঞতার সার-মর্ম লিখে গেছেন! সালটা কী! সাতষট্টি। বাবার বাঁ দিকটা পড়ে গিয়েছিল। এ সময়টা বাবা ঠিক কোথায় ছিলেন তিনি মনে করতে পারলেন না। মেজদা তো প্রায় ঘর-জামাই-ই হয়ে গিয়েছিল। সোনারপুরে শ্বশুর বাড়ির লাগোয়া জমিতে আস্তে আস্তে বাড়ি করে। তাহলে কি সেজদা? সেজদার কাছেই থাকতেন বাবা এ সময়টায়। সাতষট্টি মানে দাদাদের বিয়ের বছর পাঁচ পরে। বাবা তখন শয্যা নিয়েছেন। আর তার কিছুকাল পরেই বিজন ফিরে এলেন রূপকথার সওদাগরের মতো। ময়ূরপঙ্খী সপ্তডিঙা কূলে ভিড়িয়ে।

বার্ধক্য সম্পর্কে বিজনবিহারীর ধারণা কিন্তু আদৌ তাঁর বাবার অনুরূপ নয়। তার কারণ অবশ্যই তাঁর দাদামশাই ভবানীচরণ। ছোটতে দিনের পর দিন মামার বাড়ি গিয়ে থাকতেন তিনি আর ছুটকি। সে সময়ে মামাবাড়ির প্রধান আকর্ষণ ছুটকির কাছে কে ছিলেন কে জানে কিন্তু বিজুর কাছে নিঃসন্দেহে ভবানীচরণ।

দুপাটি পরিষ্কার বাঁধানো ডেঞ্চার ছিল। নাতি নাতনিরা কোনও দিনই বুঝতে পারেনি যে তাঁর দাঁত পড়ে গেছে বা ফেলে দেওয়া হয়েছে। চুলগুলো ছিল নিকষ সাদা। সেই সাদার কী চমক। সকালে বেল খেতেন। নিয়ম করে বারো মাস। যাওয়ার সময় পুব আকাশ থেকে নতুন রোদটুকু এসে পড়ত সে চুলে, রুপোর মতো ঝিলিক দিত। সূর্য মধ্য-গগনে ওঠবার খানিক আগে আরম্ভ হত দাদামশাইয়ের স্নান-পর্ব। স্নান-যজ্ঞই বলা উচিত তাকে। নাকের ফুটোয়, কানের ফুটোয়, নাভিকুণ্ডে, পায়ের বুড়ো আঙুলের নখের ফোকরে টোপা টোপা তেলের ফোঁটা দিয়ে শুরু হত যজ্ঞ। সে সময়ে দাদামশাইয়ের চুলগুলো হা-হা হো হো করে হাসত। তাঁর মুখময় গা-ময় যেন সূক্ষ্ম রেশমের কাপড়, তাতে একটা সুতো টেনে দিয়েছে কেউ। সূক্ষ্ম কুচি কুচি ভাঁজ। একেবারে পাতলা গরদ হেন চামড়া। বাড়িতে কাচা সাদা থান পরতেন। দৈবাৎ কাপড় টান টান হয়ে লেগে গেলে সেই গরদের চামড়া কেটে গিয়ে ফুটফুট করে রক্ত বেরিয়ে আসত।

রাতের খাবার ছিল খই দুধ। জুঁইফুলের মতো একরাশি খই কানাওয়ালা বড় খাগড়াই কাঁসার বাটিতে দুধের ওপর যেই ফেলতেন শোঁ করে একটা আওয়াজ হত। সোঁদা সোঁদা গন্ধ ছড়িয়ে যেত চারদিকে। সেই আওয়াজটা শোনবার জন্য, সেই গন্ধের শ্বাসটুকু নেওয়ার জন্যে সন্ধে সাতটা থেকে দাদুর কাছে ঘুরঘুর করত বিজু। রুপোর বড় গোল চামচ দিয়ে সাপ সুপ খইগুলো শেষ করে শেষের দুধটুকু বাটির কানা দুহাতে ধরে যখন এক চুমুকে শেষ করতেন দাদুর মুখটা বুকের ওপর থেকে পিঠের দিকে আস্তে আস্তে একশো ষাট ডিগ্রি কোণে ঘুরে যেত। সে দৃশ্যটাই বা কী চমৎকার। সামনে চেয়ারে বসে রয়েছেন বড় মামিমা। ফরাসডাঙার একটু নীলচে কোরওয়ালা কালো পাড় শাড়ি ছাড়া বাড়িতে পরতেন না। কপালের সিঁদুর টিপটা সব সময়েই একটু ধেবড়ে থাকত। মামিমার মুখ আড়ের দিকে চওড়া। ঘোমটা থেকে বেরিয়ে থাকা চুলগুলো চারভাগের তিনভাগই পাকা। মুখে একটা আলগা হাসি ভেসে থাকত, দাদু গোমড়া মুখ পছন্দ করতেন না বলে। এমনি কত ছবি! প্রত্যেকটি স্মরণ করলে এখনও বিজনবিহারীর অনুভব হয় বার্ধক্যটা জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়। খ্যাতি, সম্মান, শ্রদ্ধা, সমীহ আর সেবার শীর্ষ চূড়ায় তার অবস্থান। চারদিকে বিশ্বাস, আস্থা, নির্ভর। যা-কিছু জীবনের, সংসারের, সমাজের শ্রেষ্ঠ ফসল সব টুকরি-ভর্তি উৎকৃষ্ট আমের ভেটের মতো বৃদ্ধর পায়ের কাছে নামানো।

মনে আছে মামাবাড়ির গোয়ালা ডার্বির টিকেট জিতে দশ হাজার টাকা পেয়েছে। অত টাকা দেখে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছে সুবল। ভেউ-ভেউ করে কাঁদছে আর বলছে-‘হমাকে জরুর ফাটকে নিয়ে যাবে বুঢ়াবাবু। আপনি বাঁচাও।’

—‘ফাটকে নিয়ে যাবে কী রে? এ তোর হকের টাকা।’

—‘তো তুমার পাস রাখিয়ে দাও।’

—‘হ্যাঁ তারপর আমি মরে যাই আর তুই টাকা নিয়ে ঝামেলা করিস আমার ছেলেদের সঙ্গে।’

—‘ওরে বাপ্‌। বজরংবলী তবে হমাকে মাফ্‌ করবে নাই বুঢ়াবাবু। তুমি যো করবে সো হোবে।’

সুবলের ছোট ছেলেটি শোনা যায় আই.পি.এস. হয়েছে মতিহারীর দিকে। বড়গুলি হাতে দামি ঘড়ি, পরনে সিল্কের লুঙ্গি, মুখে সিগারেট এখনও জোর দুধের ব্যবসা করছে। গাই, ভঁইস। দেহাতে ওদের বিরাট জমি-জমা। পাঁচটি মেয়ের বিয়ে দিতে সুবল গোয়ালা প্রচুর টাকা খরচ করেছিল।

সেই বাল্যকালেই বিজু পুবের বারান্দায় আরাম-চেয়ার পেতে হাতে দুধের জামবাটি নিয়ে বসে পড়বার জন্য রেডি-স্টেডি হয়ে গিয়েছিলেন। তাঁর বাবা বন্ধুবিহারী রায়, দেখা যাচ্ছে এই বার্ধক্যের সন্ধান পাননি। সে আরাম-চেয়ার থেকেও ছিল না। সে দুধের বাটিও ভোঁ ভাঁ। তবে সবচেয়ে অভাব হয়ত সামনে বসা ওই হালকা-হাসি মুখ বয়স্ক বধূটির সজাগ উপস্থিতি।

কিন্তু, বধূ কেন? বাবার তো নিজের পত্নীই বর্তমান ছিলেন। মা ওই বয়সে বাবার খুঁটিনাটি সেবা সমস্তই করেছে। নিজের অভিজ্ঞতা লিপিবদ্ধ করবার জন্যে এই খাতা এগিয়ে দেওয়া, এ-ও নিশ্চয়ই মারই কাজ ছিল।

আর কয়েক পাতা পরে তিনি বাবার আরও কিছু চিন্তা নথীকৃত দেখতে পেলেন। বিষয় ওই একই।

‘জরাকে আমি আদৌ ভয় পাই না। জানিতাম জীবন এক হাতে লইয়া থাকে। কিন্তু অন্য হাতে পুরাইয়া দেয়। তাহা ব্যতীত ইহা জীবনের ফসলের সময়। স্বর্ণাভ হেমন্তকাল, কোন কবিতায় যেন পড়িয়াছিলাম মাঠের আলের পাশে সে গভীর আলস্যে ঘুমাইতেছে। ফসল-উঠিয়া-যাওয়া ক্ষেত ন্যাড়া হইলে কী হইবে নূতন ধান্যে নবান্ন হইবে না! গোলা ভরিয়া স্বর্ণময় ধান্যের স্তূপ উপচাইয়া পড়িবে না! ঘর ভরিয়া তিন পুত্র, দুই কন্যা। স্বপ্ন দেখিয়াছিলাম ছেলেরা মানুষের মতো মানুষ হইয়াছে। নাতি নাতনিরা চারদিকে স্নুকারের বলের মতো ছিটকাইতেছে। কন্যারা সুখী শ্বশুরগৃহ হইতে মাঝে মাঝেই আসিয়া পড়িতেছে। গৃহিণী তাহাদের জন্য বিশেষ ভোজের আয়োজন করিতেছেন। হইল না। জানি না কাহার ইচ্ছায়। কে সেই সর্বশক্তিমান, মানুষের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ইচ্ছায় বাদ সাধিতে যাঁহার এমন নিষ্ঠুর রঙ্গ!’

বাবা কষ্ট পেয়েছিলেন। কিন্তু সে কষ্টের কথা লিখে যাবার মতো মনও তো বাবার ছিল? বাবা সম্পর্কে দেখা যাচ্ছে তাঁর ছোট খোকার ধারণা খুব অস্পষ্ট।

‘অর্থ জীবনের রং বদলাইয়া দেয়: ইহা জানিতাম। কিন্তু সে চরিত্রের কাঠামো, পারস্পরিক সম্পর্কের চেহারা, ইহলোক-পরলোক ধর্মাধর্ম সবই বদলাইয়া দেয় তাহা ঠিক এইভাবে উপলব্ধি করি নাই।’

বিজনবিহারী খুব আগ্রহসহকারে পড়তে লাগলেন।

‘ছোটখোকা কৃতী হইয়া আসিয়াছে। কৃতী অর্থে পণ্ডিত, ডিগ্রিধারী নয়। সে বাণিজ্যে লক্ষ্মীলাভ করিয়াছে। তাহাকে খরচের খাতায় ধরিয়া রাখিয়াছিলাম। তাই তাহার এ-ভাবে আসা যেন দ্বিগুণ আহ্লাদের। কিন্তু তাহার দাদারা তো সেভাবে আহ্লাদিত হইল না! মেজ খোকা বলিয়া গেল—“অত হ্যাট-কোটে আপনি ভুলবেন না বাবা, খোঁজ করুন ও কীভাবে কী করছে।” সত্য কথাই হয়ত। উহারা ছোটকে সেই ছেলেমানুষ, দস্যি, পড়াশোনায় অষ্টরম্ভা হিসাবেই মনে রাখিয়াছে। তাই সতর্ক করিয়া দিতেছে। সেজবাবুও সেদিন বলিলেন—“এক সংসারে একজন মাস মাইনের ছাপোষা চাকুরে, আরেকজন লাখপতি ব্যবসাদার একসঙ্গে থাকতে পারে না বাবা। আপনি বুঝুন ব্যাপারটা। আমার দিকটা ভাবুন। ” কী ভাবিব? তোমরা তিনজনেই আমার ঔরসজাত পুত্র বই তো নও! আমি অশক্ত হইয়া পড়িয়াছি, বিছানায় পরের হাত তোলা হইয়া আছি। আমি ভাবিবার কে? শুইয়া শুইয়া ছোটকে তীক্ষ্ণভাবে লক্ষ করি। সে বরাবরই তাহার মায়ের ভক্ত। তবু আমার শয্যার পাশে পাঁচ মিনিট হইলেও আসিয়া বসে। সদা অন্যমনস্ক। অর্থাগমের যে পথ সে ধরিয়াছে তাহাতে বিরাম নাই। বিশ্রাম বা স্বস্তি সে জীবনে পাইবে না। কিন্তু তাহা ছাড়াও আমি লক্ষ করি তাহার দাদা বউ-দিদিদের সঙ্গে সম্পর্ক ক্রমেই শিথিল হইয়া আসিতেছে। কাহার দোষ বলা শক্ত। সম্ভবত উভয় পক্ষেরই। আমি বুঝিতে পারি ছোট এখন যে জগতে বাস করে তাহার সহিত আমাদের জগতের মেজবাবু বা সেজবাবুর জগতের মিল নাই। সেদিন মেজ বউমা ঠাট্টা করিয়া বলিল—“সংসার খরচের টাকা দিচ্ছ দু হাজার টাকা? শুধু খাই-খরচ? তুমি বোধহয় একটা টাঁকশালই খুলেছ, তাই না?”

ছোটর উত্তরের জন্য উৎকর্ণ হইয়াছিলাম, সে বলিল—“তোমার কথার অর্থ কী হয় ভেবে বললে মেজ বউদি? সোজা অর্থ হয় ফর্জারি। আমি কি টাকা জাল করছি বলে তোমাদের ধারণা?” লক্ষ করিলাম ছোট বহুবচন ব্যবহার করিল। তাহার দাদারা বিদ্যায় বড়, সে বিত্তে বড়। দুটিতে মিলিতেছে না। বিজু এখানে থাকিতে পারিবে না। এখন আমি ও নীলিমা কী করিব?’

বাবা নৈর্ব্যক্তিকভাবে আরম্ভ করেছিলেন। ব্যক্তিগত সমস্যায় এসে পৌঁছলেন শেষ পর্যন্ত। সে সময়ে তাঁর সল্ট লেকের জমি কেনা হয়ে গেছে। দু হাজার টাকার খাইখরচ দেওয়াতে সেজবউদির প্রতিক্রিয়া দেখে তিনি সাবধান হয়ে যান। জমির কথা কাউকে বলেননি। সাংসারিক ব্যয়ের ব্যাপারে হাত গুটিয়ে নিয়েছিলেন। মেজদার তখন সোনারপুরে বাড়ি উঠছে। মাস্টারি ছেড়ে সে গড়িয়াহাটের দিকে দোকানে বসছে। মেজদা সেজদার হাঁড়ি আলাদা। বাবা-মা সেজদার সঙ্গে, সুতরাং তিনিও সেখানেই উঠেছিলেন। সুবিধে হয়ে গেল। বছর দেড়েকের মধ্যেই সেজদা বললে, ‘সরকারি কোয়ার্টার্স পাচ্ছি সি.আই.টি রোডে। ছাড়াটা কি বুদ্ধিমানের কাজ হবে?’ কথাটা বলল খাওয়ার সময়ে। মা, সেজবউদি এবং সে, তিন জনের উপস্থিতিতে। বিজু বলল—‘কখনোই বুদ্ধিমানের কাজ হবে না সেজদা। যতদিন চাকরি, ততদিন কোয়ার্টার্স। ইতিমধ্যে তুমি ধীরে ধীরে নিজের বাড়ি করে নিতে পারবে।’

সেজদাই আগে গেল। তার পরে মেজদা। বাঁধাঘাটের গলিতে মা বাবা আর বিজু। রই-রই করে উঠে যাচ্ছে সল্ট লেকের বাড়ি। মেজদাদাদের যাবার চার পাঁচ মাস পরেই তাঁরা চলে এলেন সল্ট লেকে। শয্যাশায়ী হলেও যতদূর সম্ভব আরামে ছিলেন বাবা শেষ ক বছর।

আর কী আছে সিন্দুকটাতে। চিঠিপত্রের তাড়া। দুটো তিনটে পলিথিনের ঠোঙার মধ্যে, হলুদ রঙের সরু ফিতে দিয়ে বাঁধা। একটা প্যাকেট খুললেন বিজু রায়। মেজ বউদি, সেজ বউদি, ছোট মামা, বড় মাসি, … প্রচুর চিঠি। সব রেখে দিয়েছে মা। অবসর মতো পড়তে হবে। এটা? দ্বিতীয় প্যাকেটটা খুলে ফেললেন তিনি। অন্তর্দেশীয় পত্র। হাতের লেখা দেখেই চমকে উঠলেন বিজু রায়। সঙ্গে সঙ্গে খুলে ফেললেন চিঠিটা। হাত কাঁপছে।

‘শ্রীচরণেষু মা,

তোমার ১০/৯-এর চিঠি পেয়েছি। তোমার এতদিন বেঁচে থাকার কষ্ট বুঝি। কিন্তু আমার আগের জীবনের তুমিই তো একমাত্র সূত্র। তোমার জামাই যত সুখেই রাখুক আমার জীবনের কুড়িটা বছর তো আমি কিছুতেই মুছে ফেলতে পারব না। মা, জীবনটা সামনে এগোনো সেটা বুঝি। প্রতিদিন পৃথিবী হু হু করে এগিয়ে যাচ্ছে। আজ বিজ্ঞানের যে তত্ত্ব বার হচ্ছে, কাল তা বাতিল হয়ে যাচ্ছে। মানুষের মতো মগজ বসবে কম্পুটারে শিগগিরই। কিন্তু পেছনে কেউ নেই, কিছু নেই, খাঁ খাঁ। এ যে কী কষ্ট। সে যার না হয়েছে সে বুঝবে না। মা তুমি চলে গেলে, গেলে কেন যাবেই যে কোনও দিন, আমার আর কেউ থাকবে না। মা, মা গো। স্বার্থপরের মতো কথা বলছি। শুধু আমার জন্যেই তুমি আর ক বছর অপেক্ষা করো মা। যেমন করে হোক একবার তোমায় দেখে আসব।’

তলায় কোনও সই সাবুদ নেই। তবু বিজু রায় সেখানে অদৃশ্য-কালিতে লেখা নামটা দেখতে পেলেন—ছুটকি। ধাক্কাটা এত অপ্রত্যাশিত, এত তীব্র যে তিনি চিঠিটা প্রায় মুঠো করে ফেলেছিলেন। ঠিকানা আছে? এ চিঠিটাতে ঠিকানা নেই। ঠিকানা নেই কেন? ছুটকি, ছোড়দি তুই ঠিকানা দিসনি কেন? আরও কয়েকটা চিঠি উল্টে-পাল্টে দেখলেন তাড়াতাড়ি, আছে। নানান ঠিকানা। কিন্তু সবই বিভিন্ন পোস্ট অফিসের।

চটপট করে লোহার সিন্দুকের সব কাগজপত্র, মায়ের খাটের তলায় রাখা একটা ডাকব্যাকের বড় সুটকেসে ভরে নিলেন বিজু রায়। তারপর দরজা বন্ধ করে নীচে নেমে এলেন নিজের ঘরে। সেখানেও অনেকক্ষণ ধরে কাগজপত্র, চেক বই, পাস বই, ইত্যাদি নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করলেন। ভোর সাড়ে তিনটে নাগাদ যখন তিনি চুপচাপ গোটা দুই সুটকেস নিয়ে বাড়ি থেকে নিঃশব্দে গেলেন তখন তাঁর ওই চিঠিগুলি, তাদের ঠিকানা এক। তাদের লেখিকা ছাড়া আর কিছু মনে ছিল না। জাতিস্মরের যেমন হঠাৎ পূর্বজন্মের কথা মনে পড়লে এ জন্মের সব কিছু ফিকে হয়ে যায় বলে শোনা যায় এ-ও কতকটা তেমনি। বিজু রায় বেরিয়ে গেলেন সম্পূর্ণ উদভ্রান্তের মতো, এবং একমাত্র সেই অক্লান্ত ঘড়িটাই উড়ে উড়ে তাঁর নিষ্ক্রমণের সময়টা নোট করে রাখল।


ডান-পাশে বসা বসাক বলল—‘এরই মধ্যে?’

মুখে হাত-চাপা দিয়ে ছোট্ট একটা হাই তুললেন মিসেস রায়— ‘ভী-ষণ ঘুম পাচ্ছে। দু নাইট পর পর। আর পারা যাচ্ছে না।’

—‘কাল আসছ তো?’ রাজেশ পাইন বলল।

—‘কাল তো আবার মিড নাইট?’

—‘আরে তাতে অসুবিধে কোথায়?

মিসেস রায়ের মুখে একটা দুর্বোধ্য হাসি। জীবনকে নানা ভাবে উপভোগ করার এই জীবনদর্শন ভাল। খুব ভাল। কিন্তু এই পাইন-বসাকগুলো বুঝবে না পর পর তিনটে রাত জাগলে চেহারায় ওপর কী জাতীয় ধস নামতে পারে। তনুশ্রী যে গান-বাজনা দারুণ একটা ভালবাসেন তা নয়। তাঁর আসল পছন্দের জিনিস হল নাচ। শেখার ইচ্ছে ছিল একসময়ে। বাবা মা কেউই সে ইচ্ছেটাকে আমল দেন নি। নাচ দেখতে দেখতে এখনও ভেতরটা ধা-ধিন-ধিন ধা করতে থাকে তনুশ্রীর। কিন্তু নাচ এসব কনফারেন্সে প্রথম দিকেই হয়ে যায়। তারপর দীর্ঘ সময় ধরে খেয়াল বা সেতার-টেতার শোনবার খুব একটা ধৈর্য থাকে না তনুশ্রীর। গায়ক বা বাদক যখন তবলার সঙ্গে মেতে ওঠে, তবলা যখন বাজনাকে ছাপিয়ে যায়। বা দু পক্ষই তাল ঠুকে হুহুঙ্কার দিতে থাকে, সে সময়টার উত্তেজনাটা উপভোগ করেন তিনি। কিন্তু অন্য কোনও বিশেষ প্রোগ্রাম না থাকলে এ সব কনফারেন্সে তাঁকে আসতেই হয়। তিনি পেট্রন। না এলে মান থাকে না। অনেক গাইয়ে-বাজিয়ে-নৃত্যশিল্পীর সঙ্গে আলাপ-পরিচয় হয়। তাঁর ইচ্ছে বিরজু কি কেলুচরণের মতো কাউকে কিছুদিন বাড়িতে অতিথি রাখা। ব্যাপারটা শিগগির করতে হবে। ভারতবর্ষের সংগীত-নৃত্যের বিস্তৃত ভূগোলে মিসেস রায় তাঁর সল্ট লেকের বাড়ি সমেত একটু জায়গা পেতে চান।

খেয়ালটা থেমেছে। এইবেলা চট করে বেরিয়ে যেতে হবে। রাজেশ পাইন উঠে পড়ে এগোচ্ছে। পেছন পেছন নিজেকে যতদূর সম্ভব মুছে ফেলে বেরিয়ে যেতে হবে। কালো শালটা দিয়ে মাথায় ভাল করে ঘোমটা দিয়ে নিলেন মিসেস রায়। তাঁর বিরাট কানবালা দুটো ঘোমটার বাইরে এসে মৃদু মৃদু দুলতে লাগল।

বাইরে বেরিয়ে বোঝা গেল রাত আর নেই। বেশ পাখি ডাকতে শুরু করেছে। ভোরের পাতলা সর শেষ রাতের গায়ে। লেকের জল স্থির। লোক জমতে আরম্ভ করেছে। স্বাস্থ্য শিকারিরা শর্টস আর কেডস পরে প্রস্তুত। গাড়ি অনেক দূর। উদ্যোক্তারা কেউ কেউ বেরিয়ে এসেছিল।

—‘চললেন তনুশ্রীদি? শরীর খারাপ নাকি?’

—‘না না, আসলে, সকালে মানে বারোটা নাগাদ একটা জরুরি মিটিং আছে ভাই। আই মাস্ট গেট সাম স্লিপ।’

—‘এবার যেন তেমন জমল না, না?’

—‘আরে বাবা আর্টিস্টরাও তো মানুষ’ বসাক খসখসে ভারী গলায় বলল। ওর এই গলাটার জন্যেই মিসেস রায় বিশেষ করে ওকে পাত্তা দেন। গলাটা তাঁকে কেমন চেতিয়ে তোলে। সামহাউ। পাইনের কথা আলাদা। পাইন খুব করিতকর্মা। অনুগত। অনুগত বসাকও। কিন্তু পাইনের মতো করিতকর্মা নয়। মিসেস রায় সমানে পাইনকে তালি দিয়ে দিয়ে বসাককে বাজিয়ে চলেছেন। অথচ দুজনে এমনিতে খুব বন্ধু। বসাকই পাইনকে তাঁর বৃত্তে আনে।

—‘কী? হোম সুইট হোম?’ রাজেশ হেসে জিজ্ঞেস করল।

—‘আবার কী?’ মিসেস রায় ভ্রূভঙ্গি করে জানালেন।

বসাক পেছনে ঠ্যাং ছড়িয়ে বসে আছে। মাথাটা সিটের ওপর কাত। মিসেস রায় আড়চোখে দেখে ভাবলেন ইস্‌স্‌ আকাটটা বসেছে দেখো! মুখটা সুদ্ধু হাঁ করে ফেলেছে, এবার বোধহয় নাক ডাকবে। তাঁর ভেতরটা চট করে নিবে গেল। বসাকের জন্য। রাজেশের জন্য এখনও ভেতরটা জ্বলছে। তার সুপুষ্ট আঙুলগুলো স্টিয়ারিং আঁকড়ে ধরে আছে। আঙুলে হিরের আংটি। বেশ বড়। হঠাৎ মিসেস রায়ের মনে হল তিনি যদি এখন বসাকের মতন বসতে পারতেন! ওহ্‌ কেন পারেন না? কেন পারবেন না? চলাফেরা কথা বলা খাওয়া শোয়া সব কিছু ভেতর থেকে নিয়ন্ত্রিত করে কে? কেন এই অনুশাসন? ভেতর থেকে? না বাইরে থেকে? বুকের ভেতরে না মাথার ভেতরে যেন একটা তর্জনী সব সময়ে উঁচিয়ে আছে। এভাবে নয়, ওভাবে। ওটা ঠিক হল না। এইটে ঠিক। তর্জনীটা এক কোপে কেটে ফেলতে ইচ্ছে করে মাঝে মাঝে। কিন্তু তর্জনীর পেছনে আছে একটা আরও ভয়াবহ বুড়ো আঙুল। বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ।

ভোরবেলার গাড়ি তরতর করে ভেসে চলেছে। পালে হাওয়া লাগছে। কানের পাশ দিয়ে শনশন হাওয়া। মিসেস রায় জানেন না কখন ঘুমিয়ে পড়েছেন। বাড়ির ড্রাইভ-ওয়ে দিয়ে ঢোকবার সময়ে তলার নুড়িতে কড়কড় মড়মড় শব্দ। চটকাটা ভেঙে গেল তখনই। দরজা খুলে দাঁড়িয়েছে বসাক। চোখে ঘুম। বাড়ির দরজা খোলা। এখন থেকে খোলাই থাকে। শিথিল শরীরটাকে এক ঝটকায় টান টান করে নেমে দাঁড়ালেন মিসেস রায়। —‘থ্যাংঙ্কস।’

সিঁড়ি দিয়ে ওঠবার সময়ে একবার যেন বদনের শ্রীমুখখানা দেখতে পেলেন। ঘরের কাছাকাছি আসতে প্রমীলা। হাত থেকে শালটা নিয়ে গুছিয়ে রাখল। ব্যাগটা বিছানার ওপর ছুঁড়ে ফেলে, শাড়ি-টাড়িগুলো টেনে টেনে খুলতে লাগলেন মিসেস রায়। প্রমীলা বেরিয়ে যাচ্ছে। —‘চা দেবো?’

—‘না।’

—‘অন্য কিছু?’

—‘এখন কিছু না।’

ভীষণ ঘুম পাচ্ছে। এখন কিছু না, কেউ না। আলগা হয়ে শিথিল ঘুম শুধু। তর্জনী নেই। বুড়ো আঙুল নেই। বসাক, রাজেশ, অম্বুজ, তিমিরকান্তি, মিসেস দস্তুর, তানিয়া ঘোষাল…কেউ নেই। অনু ডালমিয়া, প্রীতা সোম সব ঘুমের তলায় তলিয়ে গেছে। ঘুম! ঘুম! ঘুম!

প্রথম পর্যায়ে নিশ্ছিদ্র বিস্মরণের অন্ধকার। দ্বিতীয় পর্যায়ে অন্ধকার কাটতে থাকে। আস্তে আস্তে একটা জলপ্রপাতের ওপর ভর দিয়ে শাঁ করে নেমে আসতে থাকে দুটো পা। ছড়ানো দুদিকে। জিনস পরা। পায়ের ওপর কোমর। খোলা। তার ওপর পেট, খোলা। নাভি অর্ধেক দেখা যাচ্ছে। তার একটু ওপরে পাঁজরার ঠিক তলায় একটা শক্ত গিট। লাল নাকি নীল তা তো ঠিক… আবছা ধূসর ধূসর, না গোলাপি বোধহয় টপটা। বেবি পিঙ্ক। ঝুঁকে আছে সোজা সোজা চুল, শেষগুলো ভেতর দিকে একটু পাকিয়ে গেছে। তার মধ্যে মুখ একটা। অনু ডালমিয়ার? ব্রুক শিল্ডস? না জুলিয়া রবার্টস? ভাল করে যতই দেখতে যান ততই মুখটা চুলের ঝাপটায় লুকিয়ে লুকিয়ে যায়। উঁহুঃ ও বোধহয় কামসূত্রর সেই অ্যাড-গার্লটা না? কী যেন নাম…না তো! ও তো তনুশ্রী! তনুশ্রী স্লিপ খেয়ে নেমে আসছে। আবার নামছে। আবার নামছে। টিভিতে ছবিটা তলার দিকে সমানে রোল করে যাচ্ছে। একটা পেটমোটা হাঁস উড়ছে। উড়ছে না তো! থপথপ করে কেমন পেছন দুলিয়ে হেঁটে হাসছে। হঠাৎ কে যেন তনুশ্রীকে প্রচণ্ড জোরে ছুঁড়ে ফেলছে। জলপ্রপাতটা এতক্ষণ ছিল নিস্পাপ স্লাইড একটা। এখন ফুঁসে উঠেছে। হাবুডুবু খেতে খেতে তনুশ্রী শেষ কুটোটুকু আঁকড়ে ধরার মতো করে চেতনাকে ধরেছেন। একটা কুটো ক্রমশ শেকড় হয়ে যায়। শক্তপোক্ত সেই শেকড়টা ধরে মিসেস রায় হাঁকপাঁক করছেন।

শেকড়টা আস্তে আস্তে তিতির মুখ হয়ে যাচ্ছে। —‘মা, মা, ওঠো। প্রমীলাদি কী বলছে শোনো।’ তিতি মাকে নির্মমভাবে ঝাঁকাচ্ছে।

তনুশ্রী চোখ দুটো আধো খুলে তিতির মুখটা জলের মধ্যে শক্ত গাছের শেকড়ের মতো ভাসতে দেখেছিলেন। তিতি…তিতি..কে যেন তিতি..মেয়ে…ও তাঁরই মেয়ে…বেড়াতে গিয়েছিল না? কোথায়? কে জানে! কবে ফেরার কথা ছিল? ফিরেছে তাহলে? বেশ তো, ফিরেছে তো এখানে কেন? এখন, এখানে তাঁকে এভাবে ঝাঁকাবার মানে কী? ভুরু কুঁচকোচ্ছে যে!

হাজার চেষ্টা করেও মুখে কথা আনতে পারছেন না মিসেস রায়। জিভটা অসাড় হয়ে গেছে যেন।

—‘মা, এখন দশটা বেজে পঁচিশ মিনিট। বাবা সকাল থেকে বাড়ি নেই।’ অনেক কষ্টে জিভটা নেড়ে তনুশ্রী বললেন, ‘নেই তো কী! আসবে!’

—‘প্রমীলাদি বলছে সকালে চা দিতে গিয়ে ঘর খালি দেখেছে। বাবা ঠিক সাড়ে পাঁচটায় চা চায়। রাতে বিছানায় শোয়নি। ঘরে ছিল না বোধহয়।’

এবার তনুশ্রী এপাশ ওপাশ করে দু হাতে ভর দিয়ে কোনওক্রমে উঠে বসলেন। ভুরু কুঁচকে গেছে।

—‘তোমার বাবা কোনদিনও এ সময়ে বাড়ি থাকে?’ সদ্য ঘুম ভাঙা গলাটা ভারী, ভাঙা-ভাঙা, ‘হয়ত সকালে কোনও বিশেষ কাজ আছে। কেউ বাড়ি ছিল না, তাই বলে যেতে পারেনি।’

প্রমীলা দরজার ওদিকে ছিল, কাছিয়ে এল।

—‘মেমসায়েব, সায়েব কালকে কেন জানি বড্ড রাগ করেছিলেন। খাবার…ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিলেন।’

তনুশ্রী খুব আশ্চর্য হলেন এবার। তাঁর স্বামী বিজু রায় খুব ঠাণ্ডা মাথার লোক। প্রমীলার রান্নাও একেবারে স্ট্যান্ডার্ড। এদিক-ওদিক হয় না। তা ছাড়া বিজু রায়ের জন্য কীই বা রান্না! ব্লাড শুগার আর উচ্চ রক্তচাপের জন্যে মাপা বাঁধা-ধরা খাওয়া ইদানীং। খাবার ছুঁড়ে ফেলার কোনও কারণ থাকার কথা নয়।

—‘আমায় জিজ্ঞেস করলেন মেমসায়েব ছেলেমেয়ে কোথায়…’ প্রমীলা আর একটু সাহস করে বলল।

—‘তুমি কী বললে?’

—‘আপনি গান শুনতে গেছেন, দিদি বেড়াতে গেছে বললুম, দাদার কথা জানি না, তাই বলতে পারিনি।’

—‘সাহেব তাতে কী বললেন?’

—‘কিছু না। অনেক রাত হয়ে যাচ্ছে দেখে খেতে ডাকলুম, এলেন, দিলুম, তারপর সব খাবার ছুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে উঠে গেলেন।’

তনুশ্রী এবার সম্পূর্ণ হতভম্ব চোখে তিতির দিকে তাকালেন। তিতিও মায়ের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। কিছু বলছে না। —‘চিন্টু চিন্টু কোথায়! সেই বা এখনও ফেরেনি কেন? চিন্টু রাতে ফেরেনি? প্রমীলা!’

প্রমীলা খুব অপরাধী গলায় বলল, ‘না।’

—‘এ কথা আগে বলনি কেন? তনুশ্রী হঠাৎ কঠোর গলায় বললেন। চিন্টুর ফেরা না ফেরার দায় যেন সম্পূর্ণই প্রমীলার।

প্রমীলা আরও ভয়ে ভয়ে বলল, ‘দাদা তো মাঝে মাঝেই অমন রাতে ফেরে না। আমি কী করে জানব আপনি জানেন না!’

‘আচ্ছা। এখান থেকে যাও এখন!’

হঠাৎ তনুশ্রীর খেয়াল হল প্রমীলা একটা কাজের লোক। বড্ড বেশিক্ষণ পারিবারিক কথাবার্তার মধ্যে রয়েছে। এটা ঠিক না।

প্রমীলা চলে গেলে মেয়ের দিকে চেয়ে বললেন, ‘হঠাৎ এত রাগের কী হল?’

তিতি অসন্তুষ্ট গলায় বলল, ‘কোথায় যাচ্ছ, কেন যাচ্ছ বলে গেলেও তো পারো।’

—‘তুমি কি বলে গিয়েছিলে?’ তনুশ্রী মেয়ের সঙ্গে তৎক্ষণাৎ মাঠে নেমে পড়েন।

—‘আমি তোমাকে বলে গেছি। তুমি বাবাকে বলবে এটাই আমার ধারণা। চিরকাল এরকমই হয়ে এসেছে।’

—‘তোমার দাদা? সে বলে গেছে?’

দাদার জবাবদিহি দাদার কাছে চেয়ো। আমি কী বলব?’

—‘বলে যাওয়ার কথা তুলছ তাই বলছি।’

তিতি কিছু বলল না। ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল। তনুশ্রী উঠে পড়লেন। চানে ঢুকতে হবে এবার। অনেকক্ষণ সময় নেবেন আজকে। ইতিমধ্যে কোনও একটা খবর আসবে। ফোন হোক, মেসেঞ্জার হোক। বিজু রায় নিজেই চলে আসতে পারেন। এত ভোরে হঠাৎ কী কাজ পড়ল এটাই কৌতূহলের বিষয়। তিতি বা প্রমীলার যে তর্জনীসংকেত অর্থাৎ কিনা বিজু রায় প্রধানত তাঁর ওপর রাগ করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেছেন, এই ধারণাটাকে এক মুহূর্তের জন্যেও প্রশ্রয় দিচ্ছেন না তিনি। অল রাবিশ! বিজু রায় তাঁর ব্যবসার সুবাদে কখন কোথায় যান, কেন যান, সেটা যেমন তনুশ্রী জানেন না, তনুশ্রী তাঁর সামাজিক কাজকর্মের সুবাদে কখন কোথায় যান বিজু রায়েরও তেমনি জানার কথা নয়। তিতি তাঁর মেয়ে। কিন্তু ওর রকমসকম একেবারে ভাল লাগে না তাঁর। কথাবার্তা বলার খুব একটা সুযোগ হয় না। কিন্তু যখন বলে কেমন একটা সমালোচনার সুর, একটা জবাবদিহির ভঙ্গি থাকে। চাউনি-টাউনিগুলোও কেমন যেন! কে যে বয়সে বড় বোঝা দায়। চিন্টুকে তিনি খানিকটা বুঝতে পারেন। তিতিকে পারেন না। ওর বন্ধুবান্ধবদেরও না।

অনেকক্ষণ ধরে চান করেও মাথাটা তেমন পরিষ্কার হল না। চোখ দুটো লাল হয়ে ফুলে আছে। ঘুমের বিকল্প আসলে কিছু নেই। পাঁচ সাড়ে পাঁচ থেকে বারোটা একটা পর্যন্ত একটা নিশ্চিন্ত ঘুম ঘুমোতে পারলে ক্লান্তিটা কেটে যেত। কিচেনের দিকে গেলেন তনুশ্রী। বদনেতে প্রমীলাতে গল্প জুড়েছে ‘কেউ নেই গো, না ছেলে, মেয়ে, না বউ, একে মা গিয়ে থেকে মানুষটা থম মেরে আছে! আমি তো মুখ দেখে ভয়ে মরি!’

তনুশ্রী কড়া গলায় বললেন, ‘প্রমীলা আমায় কড়া করে কফি দিয়ো।’

রান্নাঘরের ভেতরের কথাবার্তা চট করে থেমে গেল। তনুশ্রী পার্লারে এসে বসলেন। মুখটা থমথম করছে। তিন চারটে কাগজ ম্যাগাজিন হোল্ডারের ওপর থাক করা। একটা আলতোভাবে তুলে নিয়ে চোখ বুলোতে লাগলেন। কিন্তু ভেতরে ঢুকছে না। একটা চিটচিটে রাগে ভেতরটা জ্বলছে। একটু পরে বদন ট্রেতে করে তাঁর ব্রেকফাস্ট নামিয়ে দিয়ে গেল। ফলের রসে একটা চুমুক দিয়ে নামিয়ে রাখলেন তনুশ্রী। ‘প্রমীলা!’ রাগী গলায় ডাকলেন। ঝাড়নে হাত মুছতে মুছতে এসে দাঁড়াল প্রমীলা।

—‘জুস তেতো হয়ে গেছে, নিয়ে যাও।’

বিনা বাক্যব্যয়ে জুসটা তুলে নিয়ে গেল প্রমীলা। ওদিকে অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার আগের মুহূর্তে পেছন ফিরে বলল, ‘চিন্টুদাদা ফিরেছে। ঘুমাচ্ছে ঘরে।’

—‘কৃতার্থ হলুম’, মনে মনে বললেন তনুশ্রী। যত জ্বালা আমার। কেন রে বাবা! স্বাধীনতা যে যখন ইচ্ছে কাউকে জিজ্ঞাসাবাদের বালাই ছাড়াই নিয়েছ, কী ছেলে, কী মেয়ে, কী তাদের বাবা! তাদের ফেরা-না-ফেরার দায় আমায় নিতে হয় কেন? আমাকে কথা শুনতে হয় কেন ঝি-চাকরের কাছ থেকে? এই সব জবাবদিহির বাধ্যবাধকতা এক ধরনের পরাধীনতার লক্ষণ। ষোলো বছরের বড় ব্যবসায়ী বরকে এইজন্যে বিয়ে করা হয়নি। কৈফিয়ত চাইবে না বলে, যত খুশি খরচ করবার অনুমতি কিংবা বিনা অনুমতিতে চলবার অলিখিত কাগজে সই করে দেবে বলেই আরও যুবক, আরও কোয়ালিফায়েড পাত্র প্রত্যাখ্যান করে একে নির্বাচন করা!

ব্রেকফাস্ট শেষ করেও অনেক, অনেকক্ষণ একই জায়গায় বসে কাগজ পড়ার বৃথা চেষ্টা করতে লাগলেন তনুশ্রী। আজকে সন্ধেবেলায় পার্টি আছে। লাঞ্চ স্কিপ। এখন তিনি প্রতি মুহূর্তেই বিজু রায়কে সিঁড়ি দিয়ে উঠে আসতে দেখছেন। এভাবেই বারোটা বেজে গেল। তিতি ঘর থেকে বেরিয়ে আসছে। চুলের ওপর তোয়ালে জড়ানো —‘মা, খাবে নাকি? দাদাকে ডেকে তুলব।’

—‘আমি এ বেলা খাচ্ছি না।’

কেন? জিজ্ঞেস করার জন্য মুখটা খুলেছিল তিতি। গিলে নিল প্রশ্নটা। তনুশ্রী লক্ষ করলেন। এবং লক্ষ করে বিরক্ত হলেন। নিজের মাকে একটা প্রশ্ন করবে তারও কত ধানাইপানাই! দাদার ঘর থেকে গম্ভীর মুখে ফিরে আসছে তিতি। দাদাকে তুলতে পারেনি তাহলে! তনুশ্রী ভেতরে ভেতরে এত রেগে গেছেন যে কোনও কথা জিজ্ঞেস করবার দরকার মনে করছেন না। এখান থেকে খাবার টেবিলের একটা দিক দেখা যায়। বাঁ চোখের কোণ দিয়ে। তিতি খাচ্ছে। উঠে গেল। হাত ধুচ্ছে। সামনে দিয়ে খাবার সময়ে বলে গেল, ‘মা, দাদা নিঃসাড়ে ঘুমোছে। তুলতে পারলুম না। আমি কলেজ যাচ্ছি। লাইব্রেরি হয়ে ফিরতে পাঁচটা বেজে যেতে পারে।’ দেখাচ্ছে। আসলে দেখাচ্ছে ওর কত দায়িত্ববোধ। কত শৃঙ্খলাবোধ। মাকে বলে যাচ্ছে। একেবারে সময়টা পর্যন্ত বলে যাচ্ছে! কখন ফিরবে, কোথায় কোথায় যাচ্ছে! হুঁ!

তনুশ্রী টেলিফোনটা তুললেন। বিজু রায়ের অফিসে ডায়াল করলেন তনুশ্রী। বেজে যাচ্ছে বেজে যাচ্ছে। কেউ ধরছে না। আর একটা নম্বর রয়েছে। ডায়াল করলেন।

এবার ধরেছে। ‘হ্যাললো।’

—‘মিঃ রায় আছেন?

—‘না। উনি এখনও আসেননি। ওঁর অফিসঘর বন্ধ।’

—‘কে বলছেন? সাধনবাবু?’

—‘হ্যাঁ আমি সাধন বিশ্বাস। বউদি নাকি?’

বি বি রায়ের অফিসের একমাত্র এই সাধন বিশ্বাসই তনুশ্রীকে বউদি বলে ডেকে থাকেন। তনুশ্রী সেটা মেনে নেন। বহুদিনের লোক। তনুশ্রী বললেন— ‘শুনুন সাধনবাবু, সাহেব এলেই আমাকে ফোন করতে বলবেন। বাড়ির নম্বরে না পেলে আরেকটা নম্বর দিচ্ছি, সেইখানে।’ নম্বরটা বললেন তনুশ্রী।

সাধন বিশ্বাস তাড়াতাড়ি বললেন—‘আজ সাহেবের এত দেরি কেন? বুঝতে পারছি না তো! কখন বেরিয়েছেন বাড়ি থেকে? অনেকগুলো দরকারি কাজ আছে…’

বোতাম টিপে কানেকশনটা অফ্‌ করে দিলেন তনুশ্রী। বিজু রায় যে শেষ রাত থেকে বাড়ি নেই এ কথাটা অফিসে জানানো ঠিক হবে কিনা তিনি বুঝতে পারছেন না। তবে এখনও, ফোনটা রেখে দেবার পরও তিনি প্রত্যাশা করছিলেন বিজু রায় সিঁড়ি দিয়ে উঠে আসবেন। বা কোনও ফোন আসবে তাঁর।

তবে গিয়ে একবার আয়নার সামনে দাঁড়ালেন তনুশ্রী। ওপরের জোরালো আলোটা জ্বেলে দিলেন। চোখের তলায় বেশ কালি। মুখটাও যেন চুপসে আছে। দু রাত্তির পর পর জাগা! সয় নাকি! মুখে-গলায় ভাল করে নারিশিং ক্রিম মেখে তিনি বিছানার ওপর উপুড় হয়ে শুয়ে পড়লেন। আরেকটা ঘুম দরকার। অ্যালার্মটা সাড়ে তিনটেয় সেট করে দিলেন। কী মনে হল, একবার প্রমীলাকেই ডাকলেন আবার।

—‘সাহেব এলে আমায় জাগিয়ে দিয়ো। সাহেবের ফোন এলেও।’

—‘সাহেব কি আপিসে আছেন? বউদি!’ প্রমীলা ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করল।

—‘না, কাজে, অন্য কোথাও গেছেন।’ কাঠ-কাঠ গলায় বলে তনুশ্রী আবার মুখটা বালিশের ওপর রাখলেন। প্রমীলার মুখ থেকে দুশ্চিন্তা এবং অবিশ্বাসের ছায়া গেল না। সে আড় চোখে একবার মেমসাহেবের শায়িত শরীরটার দিকে বিতৃষ্ণার দৃষ্টিতে চেয়ে সেখান থেকে চলে গেল। এই মেমসাহেবকে সামনাসামনি সে ভয় করে। পেছন ফিরলে একটুও না। বরং একটা তাচ্ছিল্য, একটু ঘেন্না মেশানো থাকে তার দৃষ্টিভঙ্গিতে। এই মেয়েছেলেটার পুরো সংসার তার হাতে। সে-ই চালাচ্ছে সব। সে আর বদনই প্রধান। সকাল পাঁচটা বাজলেই দারোয়ান দরজা খুলে দিয়ে ঘুমোত চলে যাবে। সকালের দারোয়ান এসে বসবে। বদন আরও একটা ঠিকে তোক নিয়ে সমস্ত বাড়ি ঝকঝকে করে পরিষ্কার করবে। টাটকা ফুল তুলে আনবে, তখন প্রমীলা ফুলদানগুলোয় ফুল ভরে ডিনার-টেবিলের ওপর রাখবে। বদন সেগুলো সব জায়গামতো বসাবে। ব্রেকফাস্ট তৈরি করা, সারা দিনে কোন সময়ে কী খাওয়া হবে সে-সব মেনু ঠিক করা—সবই প্রমীলার হাতে। একমাত্র লোক-টোক খেলে এরা হয় বাইরে থেকে পুরো খাবার-দাবার আনায়, নয় কিছুটা বাইরে থেকে আসে। আর কিছুটার জন্য প্রমীলার ওপর খবরদারি করে মেমসায়েব। নিজের রান্নাঘরে কোথায় কী আছে যে জানে না, যার সোয়ামি-পুত্তুরকে অন্য লোকে খাবার বেড়ে দেয়, উপরন্তু যার ঘরের ওপর কোনও আঁট নেই, দিবারাত্তির বেরিয়ে যাচ্ছে আর একেক সময়ে একেক রকম সেজে বাড়ি আসছে আর আয়না দেখছে তেমন মেয়েমানুষের ওপর কোনও শ্রদ্ধা নেই প্রমীলার। সে ইচ্ছে করলেই এ সংসার থেকে অজস্র অপর্যাপ্ত চুরি করতে পারে। করেও। টাকা পয়সা পারে না, কিন্তু অন্যান্য জিনিস, যথেচ্ছ।

যে মানুষটাকে বাইরে ভেতরে উভয়তই ভয় করত সে মানুষটা সাহেবের মা। তিনতলার ঘরে একরকম শোয়াই। নামলেন একেবারে কাঁধে চড়ে। তার আগে একবার উঁকি দিয়ে দেখতেও নীচে নামতেন না। কিন্তু চোখে চোখ রাখতে ভরসা পেত না প্রমীলা। একদিন বদনকে দিয়ে প্রচুর চাল ডাল মশলা বাইরে পাচার করবার পর ওপরে মায়ের খাবার নিয়ে গেছে। মা চোখে চোখ রেখে বললেন —‘প্রমীলা, আমার ছেলে-বউ দুজনেই নানা কাজে ব্যস্ত, সংসার দেখতে পারে না। নাই- পারল। তুই তো রয়েছিস। এদের জিনিস-পত্তর বুক দিয়ে আগলে রাখবি, দেখভাল করবি, আমার ছেলে তোকে ঠকাবে না।’

মা কি ধরে ফেলেছিল সে কী করেছে? অন্তর্যামী নাকি? হতেও পারে। ঘরে সব সময়ে ধূপের গন্ধ, সন্ধে হতেই তুলসীতলায় পিদিম, ঠাকুরের ছবির গলায় ফুলের মালা। সব সময়ে জপ করছে। তো সে মানুষ অন্তর্যামী হলেও হতে পারে। তারপর থেকেই সে একটু সাবধান হয়ে যায়। আর সত্যি কথাই। সাহেব কাউকে ঠকাবার মানুষ না। তার মাইনে বেড়ে-বেড়ে এখন নশো টাকা হয়েছে। সে বেওয়া মানুষ, ছেলে-পুলে নেই। এখানে সে কত সুখে আছে, সেটা থেমে গেলেই টের পায়। দু-এক দিনের বেশি টিকতে পারে না। সেবার তার পেটের একটা বড় অপারেশন হল, তা সরকারের পি. জি হাসপাতালে রেখে কী চিকিৎসাটাই করালে সাহেব। হাসপাতাল থেকে বাড়ি আসার পরও একমাস নিজের ঘরে স্রেফ শুয়ে বসে থেকেছে আর খেয়েছে। তখন আর একটা ঠিকে লোক রেখে বদনই কাজ চালাত। তা সে-ই সাহেব মানুষটা রাত্তিরে কাউকে না বলে কোথা গেল গো? বউ-ছেলেমেয়ে কারুরই তো কোনও গা নেই! কিছু একটা মেমসায়েব তার কাছ থেকে লুকোচ্ছে। রকম দেখলেই সে বুঝতে পারে। ব্যাটাছেলেরা যতই যাই হোক, নিজের পরিবারের কাছ থেকে একটু যত্ন-আত্তি আশা করে। দিনের পর দিন এতটা আছেদ্দা! লোকটা শেষ পর্যন্ত বিবাগী হয়ে গেল গা! এভাবেই প্রমীলা মনে মনে দুই প্রতিপক্ষ খাড়া করে সাহেবের পক্ষ নিয়ে নেয়।

ঠিক চারটের সময়ে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গেলেন তনুশ্রী। রাত্রের পার্টির জন্যে তৈরি হতে তিন সাড়ে তিন ঘণ্টা তো লাগবেই। এই বিউটি-সেলুনের ফোন নম্বরটাই সাধন বিশ্বাসকে দিয়ে এসেছেন তনুশ্রী। বিজু রায় এখানে ফোন করলেই তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারবেন। পার্টিটা দারুণ গুরুত্বপূর্ণ। বিজু রায়ই বলে দিয়েছেন। পুরনো স্টিভেডোর ফ্যামিলির মেয়ের বিয়ে হচ্ছে বিজনেস ম্যাগনেট কে শর্মার ছেলের সঙ্গে। মেয়ের পরিবারের কানেকশন্‌স্‌ অসাধারণ। প্রভাবশালী এমন কেউ নেই যাদের সঙ্গে ওদের দোস্তি নেই। বিখ্যাত উইমেনস ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ার পার্সন মেয়ের মা। তাঁর সঙ্গে জমিয়ে একটা মেম্বারশিপ আদায় করে নিতে পারলেই, প্রতি বছর কনফারেন্সে কনভেনশনে উড়ে বেড়ানোর একটা সুযোগ খুলে যেতে পারে তাঁর জন্যে। আর তাঁর স্বামীর যে কী সুবিধে হবে, ভাবতে গেলে তনুশ্রী রায় কূল পান না। বাঁকুড়ায় বিশাল একটা জায়গা নিয়ে কী নাকি কারখানা খুলবে। বড় বড় হাউজের সঙ্গে টক্কর লাগিয়েছে বিজু রায়। এই পার্টিতে মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, ডি. এম সবাই আসছে। তার ওপর শর্মার সঙ্গে বিজু রায়ের বিশেষ খাতির। শর্মা ওকে সাহায্য করছে। এই ব্যাপারটা করতে পারলে ও বোধহয় ঠিকঠাক শিল্পপতি নামের যোগ্য হবে। ইনডাসট্রিয়ালিস্ট! টপ-নচার! বি. বি. রায় গ্রুপ অফ ইনডাসট্রিজ! ভাবলেও গায়ে কাঁটা দেয়। সেই তনুশ্রী, হ্যাঁ? দুপুরবেলা মর্নিং কলেজ থেকে ফিরে ডেঙর ডাঁটার চচ্চড়ি আর চিংড়ি-পোস্ত দিয়ে ভাত খেতে বসত মায়ের সঙ্গে! বাবা ফিরলেই সন্ধেবেলা সামনে বসে বসে রাজ্যের শার্টে পাঞ্জাবিতে বোতাম বসাও, মোজা রিফু করো, সারাদিন কী করেছ তার ফিরিস্তি দাও। পাঁচ পাঁচখানা মেয়ের বিয়ে দিয়ে ভদ্রলোক কেমন খ্যাপা-পাগলা মতন হয়ে গিয়েছিলেন। উঠতে-বসতে বলতেন ‘রূপেগুণে পার হও, রূপেগুণে পার হও, আর আমার কিছু নেই। কিস্যুটি নেই। রূপেগুণে পার হও।’ ময়লা জামা-কাপড় পরে থাকলে, চুল না বাঁধলে কী বিরক্তই না হতেন। ‘টিপ দাওনি কেন কপালে? পাটভাঙা কাপড় পরবে সব সময়ে। গলার যে হারখানা গড়িয়ে দিয়েছিলুম, পরোনি কেন? আমার ছেরাদ্দের খরচে লাগবে বলে তো আর দিইনি। মেয়েদের সাজসজ্জা অলঙ্কারেই শ্ৰী। কখনও শ্রীহীন থাকতে যেন না দেখি!’

মা একেক সময় বিরক্ত হয়ে বলতেন, ‘তোমার এক বাই হয়েছে। মেয়েদের ব্যাপারে তোমার অত নজর কেন! এ কেমন ব্যাটাছেলে রে বাবা!’

‘সাধে হয়নি, একদিনে হয়নি’, বাবা বলতেন, ‘তুমি সব হিসট্রিটাই জানো। তবু বলবে বাই?’

সম্বন্ধটা যখন এল, ঘটক বলেছিল, ‘বয়সে একটু বড় ঠিকই। কিন্তু এসট্যাবলিশ্‌ড পাত্র পেতে গেলে বয়সের দিকে তাকালে তো চলবে না। দেখলে বুঝতেই পারবেন না। একমাথা চুল, দোহারা চেহারা, খাটিয়ে লোক, এইবারে বিয়ে করে থিতু হতে চাইছে, মানে বেশ ভালই জমিয়ে নিয়েছে। দায়িত্বঅলা লোকেদের রকম-সকমই আলাদা।’

বিজু রায়কে তনুশ্রী প্রথম দেখেন মামার বাড়ির এক নেমন্তন্নে। এল স্যুট-টাই পরা সাহেব। একটা হাজার টাকার গিফ্‌ট্‌ চেক উপহার দিয়ে কোল্ড ড্রিঙ্কস খেয়ে চলে গেল। গ্ল্যামারাস। এক দেখায় পছন্দ হয়ে গেল। তখন সুবিমলের সঙ্গে জোর প্রেম চলছে। সুবিমল মার্চেন্ট অফিসে কাজ করে, টাই-ফাই হাঁকাক আর যাই করুক অ্যাসিস্ট্যান্ট মানে কেরানিই। বাড়িতে বেশ কিছু পোষ্য। এক ভারাক্রান্ত সংসার থেকে আরেক ভারাক্রান্ত সংসারে যেতে মনে মনে ইতস্তত করতে শুরু করেছে তনুশ্রী। জীবনে অ্যাডভেঞ্চার চাই। সুবিমল ভিতু-ভিতু, ক্লান্ত, যেন এখন থেকেই হেরে বসে আছে। বি. বি. রায়ের পাশে সুবিমল যেন রেসের ঘোড়ার পাশে ছ্যাকরাগাড়ির ঘোড়া। একদিন ছুতো করে খুব ঝগড়া করল তনুশ্রী, কাপুরুষ, অকালবৃদ্ধ, ন্যাকাচণ্ডী। সুবিমল রাগ করে সম্পর্ক ছেদ করল। এটাই চাওয়ার ছিল। মাস তিনেকের মাথায় বিজু রায়ের সঙ্গে বিবাহ এবং আন্দামান আইল্যান্ডস্‌-এ হনিমুন। সেই প্রথম তনুশ্রী বারমুডা পরল, সুইমিং কসটিউম পরল। তা তারপর থেকে কোনও জিনিস চেয়ে পায়নি এমন হয়নি। নাকটা বোঁচা ছিল, ঠিকঠাক করিয়ে নিয়েছে, তিনটে ল্যাংঙ্গোয়েজ কোর্স করেছে, ইংরিজি ছাড়া আর দুটোই অবশ্য আধা-খামচা, বিউটিশিয়ানস কোর্স, কুকিং এসবও হয়েছে। তা এখন সে সব দিন গত। এখন উৎসাহ অন্য খাতে। অ্যাডভেঞ্চারের জৌলুস আর কুকিং-ফুকিং-এ ল্যাংঙ্গোয়েজ-টেজ-এ পাওয়া যায় না।

বিউটি-সেলুনে ফেসিয়াল, ওয়্যাক্সিং, ম্যানিকিওর, পেডিকিওর সব করার পর চুল-টুল সেট করে আপাদমস্তক সাজগোজ শেষ হয়ে গেলে ওদের চারদিকের আয়নায় নিজের ভায়োলেট জামেয়ার শাড়ি-পরা চেহারাটা দেখে নিজেই চমকৃত হয়ে গেলেন মিসেস রায়।

সাড়ে সাতটা নাগাদ সাজগোজ শেষ হলে তাঁর খেয়াল হল প্রত্যাশিত ফোনটা আসেনি। সেলুন বন্ধ হবার মুখে, চিনে মেয়েগুলো বিরাট বিরাট হাঁ করে হাই তুলছে, তনুশ্রী টিপ টিপ করে ফোন করলেন— ‘কী বললেন? নেই? কখন বেরিয়েছেন? সে কী? সেই সকাল থেকেই আসেননি? সমর কোথায়?’ ঘড়ি দেখতে দেখতে সমরের জন্যে অপেক্ষা শুরু হল। ‘আমি সমর বলছি মেমসাহেব, সকাল থেকে গাড়ি নিয়ে প্রথমে বাড়িতে তার পরে অফিসে এসে অপেক্ষা করছি, সায়েব এলেন না।’ সমরের গলায় উৎকণ্ঠা। ফোনটা রেখে দিলেন তনুশ্রী। আর অপেক্ষা করবার সময় নেই। বিজুকে ছাড়া পার্টিতে যাওয়া একটু অকওয়ার্ড। কিন্তু বিজু রায় যে কারণেই ভোরবেলা থেকে নিরুদ্দিষ্ট হয়ে থাকুন। এই পার্টিতে তাঁর টিকি বাঁধা আছে। এখানে তাঁকে আজ আসতেই হবে। এখন একাই যেতে হবে। বাহানা কিছু বানাতে হবে একটা। এতক্ষণ সময় এবং টাকা খরচ করে এই ভুবনভোলানো মেকাপ হল…এরপর…। মুহূর্তে মনঃস্থির করে তনুশ্রী বেরিয়ে এসে গাড়িতে বসলেন। ড্রাইভারকে বললেন— ‘চলো গুরুসদয়।’

গেটের কাছেই শর্মা। দুরকম রঙের গাঁদাফুল দিয়ে আজকাল গেট সাজায়। পুরো গেটটাই ফুলে ফুল। হলুদ আর কমলা। সবুজের ওপর হলুদের নক্‌শা। ডেকোরেটররা বানায় আজকাল সব একরকম। মিসেস শর্মা অবধারিতভাবে জিজ্ঞেস করলেন—‘কী ব্যাপার? মিঃ রায় কি পরে আসছেন?’

তনুশ্রী অনেকক্ষণ ধরে একটা উত্তর ভেবে রেখেছিলেন। ‘ভীষণ জ্বর এসেছে বুঝলেন? একেবারে হঠাৎ! তো আমরা ঠিক করলাম কেউ একজন না এলে…’

কিন্তু আসল পরিস্থিতিটার মুখোমুখি হলে বুদ্ধির চর্চা যারা করে তাদের বুদ্ধি অনেক বেশি খুলে যায়। সত্যি কথা বলতে কি বিত্তবানদের জ্বর-ফর হয় না। হয় হার্ট অ্যাটাক, সিরোসিস অফ দা লিভার, বড় জোর হাই ব্লাড সুগার, প্রেশার। এই পর্যন্ত। জ্বর-ফর এলেবেলে ব্যাপার। তনুশ্রী নিজেকে বলতে শুনলেন— ‘আর বলবেন না, আমাকে সাতটায় ফোন করল, কী নাকি ভীষণ জরুরি কাজে আটকে গেছে। বলল “তুমি এখুনি চলে যাও। আমি একটু পরে, কাজটা সেরে যাচ্ছি।” তো এত তাড়াতাড়ি কথা বলেই ফোনটা রেখে দিল আমি জিজ্ঞাসা করতেও সময় পেলাম না, কী কাজ, কোথায় কতক্ষণে আসবে।’

মিসেস শর্মার প্রশ্নের ফলেই এই জবাবটা তৈরি হয়ে গেল। ধন্যবাদ মিসেস শর্মা। যদিও তোমাকে হাড়গিল্লে ঠাকুরানি বলি আমরা কজন আড়ালে। যদিও তুমি প্রচণ্ড জেলাস!

মিঃ শর্মা বললেন, ‘সে কী? রায় আটকে গেল?’ সঙ্গত কারণেই তিনি খুব চিন্তিত। বাঁকুড়ার ব্যাপারটা বোধ হয় রায়-শর্মা গোছের কিছু। তনুশ্রী বিশদ জানেন না।

মিসেস শর্মা বললেন ‘এসো তনুশ্রী আমার বউমার সঙ্গে তোমার আলাপ করিয়ে দিই।’

জায়গাটা বিরাট। খোলা আকাশ ওপরে। মাঝে মাঝে শামিয়ানা-ঘেরা নানান আয়োজন। খোলা জায়গাটায় ফুলের টব, গাছগুলোতে টুনি জ্বলছে। লম্বা লম্বা হ্যালোজেন বাতি। মিসেস শর্মার বউমা হাতে টোম্যাটো জুস নিয়ে আরও কয়েকজন প্রায় সমবয়সী মেয়ের সঙ্গে কথা বলছিল।

‘এই যে প্রমা, দিস ইজ দা গ্ল্যামার-কুইন অফ আওয়ার সেট তনুশ্রী রায়। তোমাকে আগেই বলেছিলাম!’

জুসটা সঙ্গে সঙ্গে কাছের টেবিলে রেখে খুব পাতলা লম্বা দুটো হাত জোড় করে নমস্কার করল প্রমা, নতুন বউ। এত ফর্সা আর এত রোগা যে নীল শিরাগুলো যেন দেখা যাচ্ছে, গালে হাতে। ফুটে ওঠেনি এখনও। একটা নীলচে ছায়া মতন। একটা গরদ-রঙের ভারী সিল্কের শাড়ি পরেছে। পাড়টা বিরাট চওড়া ঢালা সোনালি জরিতে আর একটা অদ্ভুত হলুদে। অনেক সোজা চুল মেয়েটির। কোমর পর্যন্ত। খোলা। চলার তালে সাটিনের ঝিলিক মেরে ঢেউ খায়। কানে হীরের কান। গলায় একটা সরু হীরের হার ঝিকঝিক করছে। ডান হাতে দু-চার গাছি সোনার চুড়ি। আর সিঁথিতে সিঁদুর। একটা টিপ নেই। লিপস্টিক নেই, কোনও প্রসাধন নেই। অদ্ভুত! সাদা শাড়ি পরা, নির্গহনা, বা এত কম গহনা, সব কিছুতে ম্যাচিং নেই, এরকম বউ তনুশ্রী কখনও দেখেননি। নতুন বউ বলে বোঝাই যাচ্ছে না। বেশ নিচু গলায় নমস্কারটা বলল। অত নিচু গলা অথচ বেশ স্পষ্ট, পরিষ্কার শোনা গেল। পাশে দাঁড়িয়ে নিজেকে বড্ড বেশি প্রসাধিত, ভীষণ উচ্চকিত লাগছে তনুশ্রীর। যদিও প্রমার বা অন্য কারও দৃষ্টিতে সেরকম কোনও ইঙ্গিত নেই। তনুশ্রী একটুখানি দাঁড়িয়ে কথা বললেন, ভীষণ অস্বস্তি লাগছিল বলে যত তাড়াতাড়ি পারেন চেনা অন্য এক মহিলার শরণ নিলেন। মিসেস চৌবে। তারপর কে যেন কখন তাঁকে আইসক্রিম পার্লারে ঢুকিয়ে নিল। সেইখানে নিজের বৃত্তের সঙ্গে ফেমিনিজমের বিষয়ে আলোচনায় অনেকক্ষণ মত্ত হয়ে রইলেন তনুশ্রী রায়। প্রমার মায়ের সঙ্গে এখানেই আলাপ হল। দেখে আশ্বস্ত হলেন তনুশ্রী, ইনি মেয়ের চেয়ে বেশি সেজেছেন। অত্যাচারিত মেয়েদের নিয়ে এঁর সঙ্গে তনুশ্রী অনেকটা সময় আলোচনা করলেন। প্রমার মা রাধা চ্যাটার্জির কাছ থেকে তাঁদের অ্যাসোসিয়েশনের পরবর্তী অধিবেশনে নিমন্ত্রণের একটা প্রতিশ্রুতি আদায় হয়ে গেল। সেমিনার হবে বিভিন্ন বিষয়ে। মিসেস চ্যাটার্জি বললেন কার্ড পাঠাবেন। তনুশ্রী যেন অবশ্যই আসেন। ইতিমধ্যে ললিতা বিশ্বাসের সঙ্গে প্রমাকে নিয়েও খানিকটা মনোজ্ঞ আলোচনা হয়ে গেল।

—‘জানো না? ও মা! ও তো সাদা ছাড়া পরে না।’

—‘কারণ কী?’

—‘ওর ওটাই স্টাইল, তবে মন্দ লোকে অন্য কথা বলে।’

—‘যেমন!’

—‘কাউকে বোলো না। কাজিনের সঙ্গে বাল্য প্রেম। কাজিন মারা গেছে বছর পাঁচেক হল। ব্লাড ক্যানসার। সেই থেকে সাদা।’

—‘এদিকে বিয়ে করছে। ওদিকে সাদা!’

—‘ওই তো বলে কে?’

—‘ফার্স্ট কাজিন নাকি?’

—‘তবে? যত বড় ঘর তত কেচ্ছা!’ ললিত বিশ্বাস কথাটা কেমন আক্ষেপের সুরে বললেন। আক্ষেপের হাওয়া তনুশ্রীর মনেও লাগল। ইস্‌স্‌, তাঁর বাড়িতে কোনও কেচ্ছা নেই, কেচ্ছা না থাকলে উচ্চ কোটির লোক বলে গণ্য হওয়া মুশকিল বোধহয়। হঠাৎ মনে হল কেচ্ছা ছিল না, কিন্তু শুরু হয়েছে একটা। বোধ হয়। বিজু রায়ের সহসা নিরুদ্দেশ হওয়াটা…। কোনও মহিলাঘটিত ব্যাপার যদি হয়? সোজা কথায় ঢেঁকির পাড় পড়ল তনুশ্রীর বুকের মধ্যে। সে ক্ষেত্রে তো জীবনের ভিতটাই ধসে যাবে! বিজু রায় তাঁর আছেন বলে তিনি তনুশ্রী রায়। তিনি এই তিনি সেই। যে মুহূর্তে বিজু অন্যের হয়ে যাবেন, যত সহানুভূতিই তাঁর জন্যে লোকে দেখাক, তার আয়ু বেশিদিন থাকবে না। উপরন্তু বিজু রায় যেখানে যাবেন তাঁর বিত্ত, তাঁর সামাজিক সুযোগ সুবিধাও যাবে সেইদিকে। তাঁর স্বামী আটান্ন ঊনষাট হতে পারে। দেখায় না। এরকম বয়সে যাকে বলে ভিন্ন মেয়ের চক্করে কি আর লোকে পড়ে না? পড়েই থাকে পুরুষরা।

বসাক ব্যস্ত হয়ে ঢুকে বলল— ‘আরে ও কী ভাবী তুমি এখানে! ওদিকে রায় তো এখনও এল না, শর্মাজি বলছেন মিনিস্টারের সঙ্গে তোমাকেই আলাপ করতে হবে। কাম অন, কুইক!’

খোলা আকাশের নীচে গার্ডেন চেয়ার পাতা রয়েছে। কাছাকাছি গাছ থেকে আলোর ছটা স্নিগ্ধ হয়ে পড়ছে। হাতে হাতে ঘুরছে গেলাস। এখানটাতেই সবচেয়ে মধু আছে মনে হচ্ছে। থিকথিকে লোক। সকলেই অবশ্য পরস্পরের মধ্যে ভদ্র দূরত্ব রেখে দাঁড়িয়ে রয়েছে। মিনিস্টার, প্রতিমন্ত্রী, ব্যুরোক্র্যাটরা এখানে। শর্মাজি, বসাক, পাইন এবং আরও কিছু ভীষণ মোটা, রাশভারী চেহারার শিল্পপতিকে ওখানেই দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলেন তনুশ্রী। মিসেস শর্মাই আপ্যায়ন করছিলেন এঁদের। তনুশ্রীকে দেখে তাড়াতাড়ি মিনিস্টারের সঙ্গে আলাপ করালেন। হঠাৎ তনুশ্রী দেখলেন মিনিস্টারের চোখ আটকে গেছে। মিসেস শর্মার ইঙ্গিতে তিনি মিনিস্টার আর তাঁর ডিরেক্টরের মাঝখানে বসলেন। মিনিস্টার তাঁকে তাঁর হবি-টবির কথা জিজ্ঞেস করছেন। তনুশ্রী জানাচ্ছেন উচ্চাঙ্গসঙ্গীত। হ্যাঁ হ্যাঁ কনফারেন্সে গিয়েছিলেন বই কি! আজকেরটাই শর্মাজির ছেলের জন্য স্যাক্রিফাইস করেছেন। কণ্ঠসঙ্গীতের মান নেমে গেছে মিনিস্টার তাঁর সঙ্গে একমত। মিনিস্টার বলছেন সে সব গান তাঁর শোনবার কথা নয়, যদি শোনাতে পারতেন। তনুশ্রী জানাচ্ছেন তিনি শুনেছেন খুব ছোটবেলা থেকেই তিনি উচ্চাঙ্গের ভক্ত। বাড়িতে ট্র্যাডিশন? ছিল বই কি! বাবা তো ভীষণ ভাল সেতার বাজাতেন। মা শ্যামাসঙ্গীত। না তিনি কোকিল বংশে কাক। উঁহুঃ, পিয়ানো বাজান। সে তেমন কিছু নয়। তনুশ্রী কথাবার্তার মাঝে মাঝে কিছু ফরাসি ঢুকিয়েছেন। মিনিস্টার স্বভাবতই সেগুলো বুঝতে পারেননি। কিন্তু বিস্মিত মুগ্ধ হয়েছেন। তাঁর ডিপার্টমেন্টের ডিরেক্টর নিজের স্ত্রীর সঙ্গে তাঁর আলাপ করিয়ে দেবেন বলছেন। ছোট্ট পার্টি, মিনিস্টার, তাঁর স্ত্রী। ডিরেক্টর, তাঁর স্ত্রী, তনুশ্রীরা হাজব্যান্ড-ওয়াইফ এবং শর্মারা। মিনিস্টার বললেন তাঁর স্ত্রী আসতে পারবেন কি না বলা যাচ্ছে না, কারণ তিনি সম্প্রতি গুরু নিয়ে ভীষণ মেতেছেন। গুরুদের সম্পর্কে তনুশ্রীর কী মত। তিনি গুরু করেছেন কি না জানতে চাইছেন মিনিস্টার, কৌতূহলের জন্য ক্ষমা চেয়ে। তনুশ্রী সামান্য একটু শ্রাগ করে গুরু সম্পর্কে তাঁর মত বোঝালেন। না গুরু তিনি করেননি। রামকৃষ্ণ কিংবা অরবিন্দ বেঁচে থাকলে করে ফেলতেন সন্দেহ নেই। সকলেই খুব তারিফের হাসি হাসল। এইভাবে নরম পানীয়র গ্লাস হাতে একবার এদিকে ঘাড় হেলিয়ে আর একবার ওদিকে ঘাড় হেলিয়ে বকতে বকতে তিনি সম্পূর্ণ ভুলে গিয়েছিলেন বিজু রায়ের জন্য উদ্বেগটা। ডিনারের জন্য এঁরা সবাই উঠতে শর্মাজি চোখের ইশারায় ডাকলেন, অভিনন্দন জানিয়ে বললেন, বিজু রয় ক্যান বি থ্যাঙ্কফুল যে তাঁর কাজটা তাঁর ওয়াইফই অর্ধেক করে দিয়েছেন। দুম করে কথাটা আবার মনে পড়ে গেল তনুশ্রীর।

—‘আচ্ছা, ও এখনও আসেনি?’

হতাশ গলায় শর্মা বললেন, ‘কই! দেখছি না তো!’

রাত সাড়ে নটা। তিনি বাড়িতে একটা ফোন করলেন।

—‘মা? তুমি কোথা থেকে বলছ?’

—‘শর্মাজির ছেলের বিয়ের পার্টি। তোমার বাবা জানে। তার আসা ভীষণ জরুরি ছিল। ইন ফ্যাক্ট আমি ভাবছিলাম এখানেই ও টার্ন আপ করবে।’

—‘বাবার দেখা নেই। অফিস থেকেও অনেকবার ফোন এসেছে। সাধনকাকা বলছেন খুব জরুরি সব সিদ্ধান্ত নেবার ছিল।’

—‘আশ্চর্য! তোমার দাদা কোথায়?’

—‘এইমাত্র ফিরল।’

—‘জানে?’

—‘সকালে বোধহয় প্রমীলাদির কাছ থেকে শুনে থাকবে। এখন আমাকে জিজ্ঞেস করছিল। মা তুমি তাড়াতাড়ি এসো, এবার আমাদের কিছু একটা ঠিক করতে হয়।’

ফোন ছেড়ে তনুশ্রী দেখলেন তাঁর শীত শীত করছে। দু চোখে উৎকণ্ঠা নিয়ে তিনি সুবেশ পুরুষ-সমুদ্রের মধ্যে আর একবার বিজু রায়কে খুঁজলেন। না, আসেনি। ডিনারে প্রায় কিছুই তেমন উপভোগ করতে পারলেন না। যদিও মিসেস শর্মা নিজে তাঁর সঙ্গে বসেছিলেন।

রাত এগারোটা নাগাদ অনেক কষ্টে মিনিস্টারের কবল ছাড়িয়ে বাড়ির পথ ধরতে পারলেন তনুশ্রী। বাইরে কিছু দূরে প্রচুর বিসদৃশ ময়লা জড়ো হয়েছে। বেশ কিছু ভিখারি বাচ্চা। সেই সঙ্গে ঘেয়ো কুকুর, তাড়ালেও যাচ্ছে না। আতিপাতি করে জঞ্জালের পাহাড় খুঁজছে।

বাড়িটা থমথম করছে। সর্বাঙ্গে আলো। রাত বারোটার কাছাকাছি এইরকম আলোময় বাড়ি, অথচ মনে হচ্ছে ভূতের বাড়ি। বারান্দায় মেয়েকে যেন বসা দেখতে পেলেন তনুশ্রী। দরজা খুলে দিল বদন। খুটখুট করে দোতলায় উঠতে উঠতে নিজের জুতোর শব্দে নিজেরই কেমন গা ছমছম করতে লাগল। পেছনে প্রমীলা আসছে। পার্লারে পৌঁছে দেখলেন তিতি এসে বসে আছে। চিন্টুর ঘর থেকে মৃদু স্বরে রক মিউজিক আসছে ভেসে। চিন্টুও এসে দাঁড়াল। ছেলেকে বোধহয় দেড়দিন পর দেখছেন। এত ঘুমিয়েছে যে মুখচোখ কী রকম অস্বাভাবিক ফুলে গেছে। থমথমে মতন হয়ে রয়েছে মুখটা।

তনুশ্রী বসতে তিতি বলল, ‘সমরদাকে ডাকতে পাঠিয়েছি।’

চিন্টু তার দরজার সামনে দাঁড়িয়েছিল। অপ্রাসঙ্গিকভাবে তনুশ্রী বললেন, ‘খেয়েছ তোমরা?’

—‘হ্যাঁ’ তিতি জবাব দিল।

তনুশ্রী বললেন, ‘চিন্টু কাল রাতে ফেরোনি কেন? কোথায় ছিলে?’

—‘সেইটা কি খুব জরুরি? এখন এই সিচুয়েশনে?’ চিন্টুর গলায় যথাসম্ভব বিরক্তি।

—‘হ্যাঁ জরুরি। একজন কাল রাতে বা আজ ভোরে কাউকে না বলে কোথাও গেছেন, ফিরছেন না। এটা তোমার ক্ষেত্রেও হতে পারত। কী করতাম আমরা?’

—‘চিন্টু বলল, যদি নিয়ে কথা হচ্ছে না। আমি ফিরেছি। বস ফিরছে না। বস ফিরছে না বলে কি আমার ওপর রিভেঞ্জ নেবে না কি?’ সে ঘরের মধ্যে ঢুকে গেল।

সমর এসে গেছে। বলল, ‘কোনও খবর পাওয়া গেল সাহেবের?’

—‘সেটা তো আমরাও তোমায় জিজ্ঞেস করতে পারি’, তনুশ্রী বললেন।

তনুশ্রীর বলার ভঙ্গিতে একটু থতমত খেয়ে গিয়েছিল সমর। সে বলল, ‘আমি তো সকাল নটা চল্লিশে যেমন আসি এসে গেছি। নীচে অপেক্ষা করছি। বারোটা বাজল দেখে বদনকে জিজ্ঞেস করলুম তো বলল সাহেব আগেই চলে গেছেন। গাড়ি নিয়ে আমি অফিসে গিয়ে বসে আছি তখন থেকে। চ্যাটার্জিসাবের অফিস থেকে একটা প্যাকেট আনতে বলে রেখেছিলেন কালকে। সেটা এনে আবার অফিসে। বিশ্বেসবাবু বারবার আমাকে জিজ্ঞেস করছিলেন আমি কিছু বলতে পারিনি।’ তনুশ্রী বললেন, ‘প্যাকেট? কী প্যাকেট?’

—‘আছে গাড়িতে। দেখবেন?’ কিছু একটা করতে পেরে সমর যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল।

একটু পরে প্যাকেটটা এনে দিতে তাড়াতাড়ি সেটা খুললেন তনুশ্রী। চিন্টু আবার ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছে। প্যাকেটের মধ্যে একটা ওয়াইনের বোতল দমপেরিওঁ, সাতশো পঞ্চাশ মিলিলিটারের। একটা শ্যানেল নং ফাইভ সঙ্গে। প্রচুর কুচো কাগজ দিয়ে প্যাক করা জিনিসগুলো।

তিতি মায়ের মুখের দিকে তাকাল। মেকাপের তলায় ফ্যাকাশে দেখাচ্ছে তনুশ্রীর মুখ। সে প্রমীলার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘রাতে বাবা খাওয়া ছেড়ে উঠে গেল, তারপর কী হল? কোথায় গেল? বলো তো ভাল করে।’

—‘তেতলায় উঠে গেলেন।’

—‘তেতলায়? আগে বলোনি তো!’ তনুশ্রী বললেন।

—‘সারারাত তেতলাতেই ছিল?’ তিতি বলল।

—‘তা আমি কী করে জানব? চিন্টুদাদার জন্যে আরও খানিক সবুর করে আমি নীচে শুতে চলে গেছি। যতক্ষণ ছিলুম ওপরে খুটখাট আওয়াজ শুনেছি। এখন বুঝতে পারছি খুব রেগে গেসলেন রাত্তিরে। ঘরে ঘরে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন। আমি তো ভয়ে মরি।’

চিন্টু বলল, ‘আচ্ছা আচ্ছা তুমি এবার যাও। তোমরা যাও বদন, সমর যাও।’

যাবার ইচ্ছে ছিল না কারুরই। কিন্তু আদেশ জারি হয়ে গেছে। আর থাকা চলে না। অনিচ্ছুকভাবে চলে গেল তিনজনে।

চিন্টু বলল, ‘ইটস ডেফিনিটলি আ কেস অব কিডন্যাপিং।’

তনুশ্রী ফ্যাকাশে মুখে বললেন, ‘কী করে জানলে?’

—‘বুঝতে পারছ না? একটা হিউজ অ্যামাউন্ট ক্যাশ চেয়েছিল বসের থেকে, বস সেটা দিতে চায়নি। লাইফ-রিস্ক নিয়েছে। আমাদের একটা হিন্ট দেবার কথা ভেবেছিল। কাউকে বাড়িতে পায়নি। তাই রেগে গেছিল। তেতলায় সেফটির জন্যেই উঠেছিল। এখন গ্যাঙের লোকেরা আগে থেকে সেখানে ছিল কি না। বসকে ক্লোরোফর্ম করে, শেষ রাতের দিকে বিরজু ঘুমোলে নিয়ে গেছে কি না কে বলবে। হয়ত শিগগিরই আমাদের কাছে র‍্যানসম চেয়ে চিঠি আসবে।’

তিতি আর থাকতে পারল না, বলল, ‘এই ফোর্থ ক্লাস থ্রিলারটাই কি একটু আগে চিত হয়ে পড়ছিলি?’

চিন্টু বলল, ‘ফোর্থ ক্লাস থ্রিলার? দিস ইজ হোয়াটস হ্যাপনিং অ্যারাউন্ড। পেপার পড়িস? আর তা নয়ত বি. বি. রায়ের মতো একটা টু হানড্রেড পার্সেন্ট সলভেন্ট লোক উইথ সো মেনি আয়রন্‌স্‌ ইন দা ফায়ার, হঠাৎ ওয়ান ফাইন মর্নিং গেটস আপ অ্যান্ড ডিসাইডস হি উড ওয়াক আউট? কোনও সেন্স আছে এ গল্পটার? তিতি বলল, ‘কে বলতে পারে বাবার মনের মধ্যে কী ছিল?’ বলেই সে হঠাৎ একটা ধাক্কা খেয়ে বুঝতে পারল তার মুখ থেকে একটা ভীষণ সত্যি কথা বেরিয়ে গেছে। সে আস্তে আস্তে বলল, ‘আমরা কেউই বোধহয় জানি না, বাবা…বাবা কী ভাবত, কী ছিল বাবার মনের মধ্যে। আচ্ছা মা, তুমি বলতে পার বাবার স্পিরিচুয়াল লীনিংস ছিল কি না!’

তনুশ্রীর মনে পড়ল লালাবাবু বলে কে একজন হঠাৎ সংসার ত্যাগ করে বেরিয়ে যান। একটা এই জাতীয় পদ্য পড়েছিলেন কোনও সময়ে। কিন্তু স্পিরিচুয়াল লীনিংস বিজু রায়ের! মাস কয়েক আগে একজন বাবা এসেছিলেন এদিকে। দলে দলে লোক তাঁকে দেখতে, তাঁর কীর্তন শুনতে যাচ্ছিল। তনুশ্রীদের দলের অনেকেই যায়। তনুশ্রী বিজুকে বলেছিলেন দুজনে যাবার কথা। বিজু রায় বলেন, ‘বাবা ফাবা ওসব বুজরুকের জন্যে আমার সময় নেই। তোমার ইচ্ছে হলে তুমি যাও না, কে বারণ করেছে! তবে মজে যেয়ো না, এসব বাবারা ডেঞ্জারাস হয়।’

তনুশ্রী বললেন, ‘না।’

—‘কিন্তু মা, ঠাম্মা কীরকম রিলিজিয়াস ছিল, বাবা তো ঠাম্মার সঙ্গে রোজ নিয়ম করে খানিকটা সময় কাটাত। কী করত তখন? তাছাড়া একটা কথা আমাদের মনে হয়নি, ঠাম্মা মারা গেছে অক্টোবর মাসে আর এটা ডিসেম্বর।’

—‘তো কী?’ চিন্টু বলে উঠল, ‘সেঞ্চুরি করতে আর কটা বছর বাকি ছিল ঠাম্মার? মারা যাবে না তো কি চিরদিন বসে থাকবে?’

তনুশ্রী বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘তুমি থামো। তোমার ঠাম্মাকে তোমার বাবা ভীষণ ভালবাসত। তিতি ঠিকই বলেছে।’

—‘বস ভালবাসত? ঠাম্মাকে? কী করে বুঝলে?’ ঠাট্টার হাসি চিন্টুর গলায়। ‘হি ওয়াজ আ মানি-স্পিনিং মেশিন। কীভাবে আরও টাকা, আরও আরও কামানো যায় সব সময়ে তাই-ই ভাবত। অ্যান্ড হি ওয়াজ মেড আপ অব ডিউটিজ, ফর্ম্যালিটিজ। রোজ বাঁধা আধ ঘণ্টা সময় দিত ঠাম্মাকে। ছোটতে মনে আছে কী একটা বানাচ্ছিলাম, মাঝে মাঝে হেলপ করছিল। হঠাৎ ঘড়ি দেখে উঠে পড়ল। আমি বললাম কোথায় যাচ্ছ ড্যাড, বোসো না! বলল, ‘তোমার জন্য নির্দিষ্ট সময় ছিল পঁয়তাল্লিশ মিনিট, পার হয়ে গেছে মাই বয়।’ উঠে পড়ল। এক সেকেন্ডও দাঁড়াল না। হুঁঃ!’

তিতি বলল, ‘মা একবার ওপরে গেলে হয় না?’

তনুশ্রী উঠে পড়ে বললেন, ‘চলো। চিন্টু তুমিও চলো। ওদের কাউকে ডাকব? বিরজু, সমর?’

‘তুমি কি এখনও দাদার গল্পটার ঘোরে রয়েছ?’ তিতি জিজ্ঞেস করল।

ঘরে ঢুকতেই শাশুড়ির নতুন করা ফটোগ্রাফটা যেন সকৌতুকে তাকাল তনুশ্রীর দিকে। এটা অনেক আগেকার ছবি। এই বাড়িতে নতুন আসার পর তোলানো বোধহয়। তারপর থেকে আর ফটো তোলবার কোনও সুযোগ হয়নি। তনুশ্রীর সব কিছু মেনে নিতে পারতেন না ভদ্রমহিলা। একটু টিকটিক করতেন। বিরক্তিকর। কিন্তু কোনও দিন জোর করে কিছু চাপাননি। বা খুব অশান্তি টশান্তি করেননি। ক্রমশ ক্রমশ ওপরে বন্দী হয়ে গেলেন, আর নীচে নামতেন না। ওপরে যাবার সময়ে পেড়ে শাড়ি পরে, মাথায় ভাল করে সিঁদুর দিয়ে, হাতে লোহা গলিয়ে যেতে হত। শখের গয়না পরলে বলতেন—‘কেন বউমা, বিজু যে তোমায় সবসময়ে ব্যবহারের জন্যে পাঁচ ভরির মটরমালা গড়িয়ে দিল? গলায় ও সব পুঁতি টুতি পরেছ কেন? এয়োস্ত্রী মানুষকে কি ওসব মানায়?’ আস্তে আস্তে নিয়ম করে ওপরে যাবার অভ্যাস চলে গেল তনুশ্রীর। উনি কিছু বলতেন না। তিন চার দিন পরে পরে হয়ত একবার ওপরে যাবার সময় হল, মন হল। চুল কেটে ফেলার পর, ভাল করে ঘোমটা দিয়ে যেতেন। প্রথম প্রথম বুঝতে পারেননি। একদিন দমকা হাওয়ায় অসাবধানে ঘোমটা খসে যেতে অনেকক্ষণ চেয়ে ছিলেন। চুলের দিকে। কিছু বলেননি।

ছাতের দিক থেকে দমকে দমকে ফুলের মিশ্র গন্ধ ঢুকতে লাগল। চিন্টু ছোটবেলায় ঠিক যে মাত্রায় ঠাম্মা ভক্ত ছিল বড় হতে হতে ঠিক সেই মাত্রায় উদাসীন হয়ে গিয়েছিল। খালি উপদেশ দেবে, নাতি বড় হয়ে গেছে বুঝতে চাইবে না। ও মেয়েটা কে দাদু? তোমার সঙ্গে বাড়ি ঢুকল! তোমার বন্ধু! বাবা-মা জানে? দুপুরে তো বাবা-মা কেউ ছিল না! কেউ না থাকলে মেয়ে-বন্ধু বাড়ি এনো না! একদিন চিন্টু রেগে বলেছিল, ‘আমার ঘরে তোমায় পাঁজাকোলা করে নিয়ে যাব নাকি? দেখে ফ্ল্যাট হয়ে যাবে।’

—‘ফ্ল্যাট হয়ে যাবার মতন আবার কী রেখেছ ঘরে?’

—‘সে গেলেই দেখতে পাবে!’

—‘তোমার বাবা-মা দেখেছে তো? তাহলেই হল। আমার আর দেখে কাজ নেই।’

—‘ওল্ড হ্যাগ’—মনে মনে বলত চিন্টু।

এ ঘরে নিচু খাট ঢোকাতে চেয়েছিলেন বিজু। মা রাজি হননি। তাঁর পুরনো পালঙ্ক সুজনি ঢাকা পড়ে আছে। আলমারিতে চাবি নেই। তিতি একটু হাত দিতেই খুলে গেল। পুরনো দিনের পেল্লাই আলমারি।

তিতি বলল, ‘মা এটা কিন্তু খোলা।’

তনুশ্রী বললেন, ‘কী হাতি ঘোড়া থাকবে ওর মধ্যে?’ তাঁর অধৈর্য লাগছে। কোনও কাজের কাজ হচ্ছে না, এরা শুধু ছেলেমানুষি করছে। আলমারির দুটো তাক ভর্তি ঠাম্মার জামাকাপড়। আর একটাতে ঠাসা গরম জামা। ঠাম্মা খুব শীতকাতুরে ছিল। ড্রয়ারগুলো টেনে টেনে দেখছে তিতি।

—‘মা এ চাবিটা কী?’

—‘সিন্দুকের চাবি,’ ক্লান্তভাবে বলে শাশুড়ির বিছানায় ধুপ করে বসে পড়লেন তনুশ্রী।

—‘সিন্দুক! খোল তিতি!’ চিন্টু উত্তেজিতভাবে বলে উঠল।

কয়েকবার চেষ্টার পর তিতি খুলে ফেলল সিন্দুকটা। দুটো তাক। ওপর নিচ একদম খালি।

‘চিন্টু বলল, ‘মা। হিয়ার অ্যাট লাস্ট ইজ সাম ক্লু।’

তনুশ্রী সিন্দুকের শূন্য গহ্বরটা দেখছিলেন। বললেন, ‘কী থাকবে ওর মধ্যে? কিছু ছিল না।’

ফাঁকা সিন্দুক এভাবে কেউ চাবি দিয়ে রাখে না। বাবা নিশ্চয় এর মধ্যে আনডিক্লেয়ার্ড মানি, সোনার বিস্কিট ফিস্কিট রাখত।’

তিতি বলল, ‘মা, ওদিকে একটা সুটকেস ছিল। নেই।’

‘—কী সুটকেস?’ তনুশ্রী বললেন।

—‘একটা ডাকব্যাকের সুটকেস। আমার ছিল ওটা। ঠাম্মার ঘরে রেখে দিয়েছিলাম।’

—‘বুঝতে পারছ এতক্ষণে যা বলেছি ঠিক বলেছি কি না?’ চিন্টু বলল, ‘বাবা সিন্দুক থেকে সমস্ত টাকা বার করে ওই সুটকেসটাতে ভরেছে, তারপর গ্যাঙের নির্দেশমতো দিতে গেছে। ওরা বাবাকে ধরে নিয়ে যায়নি। বাবাই ওদের টাকাটা দিতে গেছে।’

তনুশ্রী বললেন, ‘বারবার এক কথা বোলো না। ওই সিন্দুকে ওসব কিছু থাকত না। তোমার বাবা অত কাঁচা কাজ করবার লোক নয়।’

—‘কিন্তু সুটকেসটা ছিল, এখন নেই মা,’ তিতি বলল।

—‘এর থেকে প্রমাণ হয় সুটকেসটা তোমার বাবা নিয়ে গেছে। যেখানেই গিয়ে থাক। আর কিছু না।’

চিন্টু বলল, ‘বাবার কি ভাল লাগেজ নেই, যে একটা পুরনো ব্যাগ ওভাবে নিয়ে যাবে? আসলে এটা হালকা, নোট ভরার পর শুধু কাগজের ওয়েটটা বাড়বে তাই…।’

তিতি বলল, ‘যাই হয়ে থাক, এবার আমাদের পুলিশে খবর দিতে হয়।’

—‘না, না’ তনুশ্রী বলে উঠলেন, ‘পুলিশ কেন? একটা বিশ্রী স্ক্যান্ডাল হবে। ওয়েট করো। দেখো কালকেই হয়ত এসে পড়বে।’

এত ক্লান্ত তবু বিছানায় শুয়ে একফোঁটাও ঘুম এল না তনুশ্রীর। তিনি প্রায় নিঃসন্দেহ হয়ে গেছেন। বিজু রায় দুটো তিনটে সূত্র ফেলে গেছেন। তিনি যে স্বেচ্ছায় বাড়ি থেকে চলে গেছেন এটা বোঝাই যাচ্ছে। ওপরে হালকা সুটকেসটা নেই। নীচে বিজু রায়ের ঘরে একটা মাঝারি সুটকেসে সব সময়ে কিছু জামাকাপড় গোছানো থাকত, সেটাও নেই। বেরিয়েছেন একটা চাপে পড়ে। মহিলাটি চাপ দিচ্ছিল। বিজু আরও অনেক পুরুষের মতোই হয়ত যেভাবে দীর্ঘদিন দু নৌকোয় পা দিয়ে চলছিলেন সেভাবেই চলতে চাইছিলেন। কিন্তু মহিলাটি তা হতে দেবে কেন? মায়ের মৃত্যুর পর থেকে ক্রমাগত চাপ দিয়ে চলেছে। বিজু রায় হয়ত কাল রাতে তাঁকে বলে একটা ফয়সালা করতে চেয়েছিলেন। সেটা সম্ভব নয় দেখে আপাতত যা হাতের কাছে পেয়েছেন, নিয়ে চলে গেছেন। এখন একটা হনিমুন পর্ব চলবে। চিঠি-পত্র, কোর্ট-কেস এসব পরে। কিছুদিন পরে। ওই দমপেরিওঁ আর শ্যানেল নং ফাইভ বিজুকে ধরিয়ে দিয়েছে। শ্যাম্পেনটা যদি একা হত আলাদা কথা ছিল কিন্তু তার সঙ্গে পারফ্যুম মিলে বুঝিয়ে দিয়েছে উপহারটা কেমন মানুষের প্রতি উদ্দিষ্ট। বয় কাট, লম্বা ফিনফিনে, সিগারেট খায়, মদও যেমন খায়। জিনস পরা, শীতে হয়ত একটা পুরুষদের পোলো নেক সোয়েটার পরে। কানে বড় বড় রিং। আঙুলে মস্ত পাথর। খুব সম্ভব বিজুরই দেওয়া। মুখটা খালি তিনি দেখতে পাচ্ছেন না। দেখতে পাচ্ছেন নিজের মুখ আয়নায়। কখন উঠে বসেছেন, রাত-আলোর ভুতুড়ে আভার আয়নার সামনে টুলে এসে বসেছেন নিজেই জানেন না। ভাল করে মেকাপ তোলা হয়নি আজ। গ্রে রঙের ওপর গোলাপি লেস দেওয়া রাত জামার ওপর থেকে ঝাঁকড়া চুলঅলা মাথাটা ভেসে আছে এবং মুখের ওপর জলের দাগ। চোখের জল।

তেইশ বছরের মতো হল না তাদের বিবাহিত জীবন? আর দু বছর বাদেই রজত জয়ন্তী। শর্মাজি, বসাক, পাইন সকলেই বলে রেখেছে পার্টির কথা রায় দম্পতিকে ভাবতে হবে না। ওরাই সব ব্যবস্থা করবে। দুলিচাঁদ বলেছিল তরল জিনিসের খরচ ওর। তেইশ বছর একসঙ্গে বাস করে তনুশ্রী বিজু রায়ের এই গোপন জীবনের সংবাদ জানে না। কবে থেকে আরম্ভ হয়েছিল এটা? তনুশ্রীর ভেতরটা শিউরে উঠল ভেবে সে বোধ হয় একেবারে নির্দিষ্ট একটা দিন দেখতে পাচ্ছে।

এই বাড়ির গৃহপ্রবেশ আর তনুশ্রীর বিয়ে ঠিক সাতদিনের আড়াআড়ি হয়েছিল। ঝকঝকে নতুন প্রাসাদ। দামি আসবাব, লোকজন, অষ্টমঙ্গলায় ঘুরে এসে এইরকমটাই দেখেছিল তনুশ্রী। খালি পাশাপাশি দুটো আলাদা ঘর দেখে সে ভুরু কুঁচকেছিল, দাঁত দিয়ে তলার ঠোঁটটা কামড়ে ধরেছিল। বিজু বললেন, ‘কী? পছন্দ হল? ঘর?’

স্ত্রী জবাব দিচ্ছে না দেখে মুখটা ভাল করে দেখতে দেখতে বিজু বললেন, কী হল? কান্না কান্নাভাব দেখছি যেন!’

—‘আমার সঙ্গ এর মধ্যেই ভাল লাগছে না?’

—‘সে কী? কেন?’

—‘আলাদা ঘর এখন থেকেই?’

—‘ওঃ হো!’ হেসে উঠেছিলেন বিজু। মাঝখানের দরজাটা খুলে দিয়ে বলেছিলেন, ‘এই তো একটা ঘর হয়ে গেল। গেল না? দুজনেরই প্রাইভেসি রইল। আবার… তা ছাড়া এটাই চলে। আমাদের সোসাইটিতে এরকমই হয়।’

সত্যিই পরে তনুশ্রী দেখেছে বসাকদের, শর্মাদের সবারই স্বামী-স্ত্রীর ঘর আলাদা। ব্যাপারটা নিয়ে শাশুড়িরও কম আপত্তি ছিল না। ঠারে-ঠোরে নানান কথা জানতে চাইতেন। অবশেষে কয়েক মাসের মধ্যেই চিন্টু পেটে আসতে নিশ্চিন্ত হয়ে বলেছিলেন, ‘হ্যাঁ বাপু, যতই হ্যাট কোট পরে বেড়াক, ছোট খোকা বেশি বয়সে থিতু হল। যত তাড়াতাড়ি ছেলেপিলে হয় ততই ভাল। মানুষ করতে হবে তো?’

এই উচ্চকোটির প্রাইভেসি। এই জিনিসটা অতিশয় সন্দেহজনক। সারাদিনই তো কাজের ঘোরে আলাদা আলাদা ঘুরছ। রাত্রেও স্ত্রীর সঙ্গে খোলামেলা হতে পারো না? অবশ্য, সত্যি কথা বলতে কি তনুশ্রীর নিজের তাতে সুবিধেই হয়েছে। তার অনেক রকম নার্সিসীয় পাগলামি আছে। কোনওদিন নিজের পা, কোনওদিন হাতের আঙুল, কোনওদিন পেট এসব দেখতে দেখতে তন্ময় হয়ে যায় তনুশ্রী। আরে আঙুলগুলো একটু থ্যাবড়া থ্যাবড়া লাগছে কেন আজ? ইস্‌স্‌ কী সমান পেট, কেউ বলবে দুই সন্তানের মা তনুশ্রী! পায়ের সৌন্দর্য এ জীবনে আর কাউকে দেখানো যাবে না। সেই হনিমুনে আন্দামান আইল্যান্ডস-এ বিজু রায় দেখেছিলেন। তারপরে আর…। অথচ এই তিতি তিতির বন্ধুরা কেমন স্বচ্ছন্দে পা দেখিয়ে দেখিয়ে বিচরণ করছে! এ ছাড়াও একলা ঘরের হাওয়ায় ভাবনাগুলোকে যত সহজে রঙিন বেলুন করে দেওয়া যায়, পাশে আর একজন ভোঁস ভোঁস করে ঘুমোলে সেটা করা যায় কি? কত রকমের বর্ণালি, স্বপ্ন, তার ঘোরে তনুশ্রী আপনমনে হাসে, ভ্রূকুটি করে, কথা বলে—সে সব কি অপরের কানে শোনবার? না, দেখবার? তেইশ বছরের বিবাহিত জীবন একটা লম্বা আনন্দের দিন। বিজুর এজন্য ধন্যবাদ প্রাপ্য। এই আমোদের উপকরণ সে জুগিয়ে গেছে অকাতরে। কিন্তু নিজে? নিজে যেন থেকে গেছে বাইরের মহলেই। বরাবর। লোকটা মনে-প্রাণে কাজ-পাগল ছিল। কিন্তু যা কিছু করণীয় সেগুলো ঘড়ির কাঁটার মতো নির্ভুলভাবে করে গেছে। চিন্টু বলছিল ডিউটিজ-এর কথা। নাকি পঁয়তাল্লিশ মিনিটের বেশি সময় তাকে দিতে পারেনি। ওইটুকুই তার জন্য নির্ধারিত ছিল। তনুশ্রী নিজেও অনেক সভাসমিতি করে। সে বোঝে চূড়ান্ত রকমের অর্গানাইজড ছিল লোকটা, ব্যবস্থিত। না হলে ওইভাবে উন্নতি করা যায় না। আর সব সময়ে ঠাণ্ডা, কু-ল। কিন্তু কাজের বাইরে বিজু রায়ের অন্য একটা জীবন ছিল না সে কথা এখন গ্যারান্টি দিয়ে বলা যাচ্ছে না। তনুশ্রীর সঙ্গে তেইশ বছরের সম্পর্কে বিজু রায়কে সে কখনও উত্তাল-উদ্দাম হতে দেখেনি। সেই প্রথম ক সপ্তাহ ছাড়া। অথচ সে তনুশ্রী বিজু রায়ের থেকে যোল বছরের ছোট, বলতে গেলে স্বামীর তুলনায় তরুণী। আরও তরুণী, আকর্ষক রেখেছে সে নিজেকে। কিন্তু…। বিজু রায় কেন যেন কোনওদিনই তেমন আকৃষ্ট হলেন না। মাঝের দরজাটা রাতে খুলে যাওয়া বন্ধ হয়েছে সম্ভবত বছর তিনেক। তার আগে কমছিল। কিন্তু একদম বন্ধ বছর তিনেক। তনুশ্রী বেঁচেই গিয়েছিল। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে এই তিন কি বড় জোর চার বছরই হল বিজু রায়ের জীবনে নতুন নারীর, নতুন গল্পের আয়ু।

গলাটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে তনুশ্রীর। সে উঠে বসে জল খেল ঢকঢক করে অনেকটা। কান জ্বালা করছে। হাতের পাতা জ্বালা করছে। তনুশ্রী টয়লেটে গিয়ে হাতে কানে জল দিয়ে এল। কেচ্ছা! স্ক্যান্ডাল! যে স্ক্যান্ডালের কথা আজকেই আলোচনা হচ্ছিল সেই স্ক্যান্ডাল এখন তনুশ্রীর নিজের ঘরে। কে ভেবেছিল স্ক্যান্ডাল শুধু ফ্যাশানেবল মোটেই নয়, বরং জ্বালায়! তনুশ্রীর চোখ দিয়ে এত জল পড়ছে কেন? এটা যদি কোর্টে ওঠে, তনুশ্রী কিছুতেই বিজু রায়কে ডিভোর্স দেবে না। কিছুতেই না। সব কিছুই তার পক্ষে। ছেলে, মেয়ে, বন্ধুবান্ধব, সোসাইটি। লড়ুক না কেন বি. বি. রায়। যত পারে লড়ুক। ডিভোর্স হলেও কী পরিমাণ অ্যালিমনি বিজু রায়কে দিতে হবে তা তার কল্পনার বাইরে। স্থাবর সম্পত্তির মধ্যে এই বাড়ি এবং অস্থাবরের মধ্যে লিকুইড ক্যাশ সমস্ত নিয়ে নেবে তনুশ্রী। সমস্ত। কিন্তু তারপর? তাতেও হবে তো! সন্তুষ্ট হতে পারবে? না। কক্ষনো না। স্বয়ং বিজু রায়কেই চাই। এই বাড়িতে তার অভ্যস্ত চলাফেরার চেনা শব্দ। একত্রে পার্টিতে যাওয়া। বাড়িতে কোনও উৎসব হলে একটু আধটুও আলোচনা। এটুকুই। এটুকু চলে গেলে তনুশ্রীর জীবনের ভিত ধসে যাবে। সে তখন আর কোনও অত্যাচারিত মহিলা সমিতির প্রেসিডেন্ট নয়। একজন সাধারণ পরিত্যক্ত গৃহবধু। সে কারওর জীবন সম্পর্কে সভা বসিয়ে সবার মতামত নিচ্ছে না। তার জীবন নিয়েই সভাটা বসেছে। প্রেসিডেন্টের আসন খালি। প্রেসিডেন্ট মিসেস তনুশ্রী রায়, ডিভোর্সড হতে যাচ্ছেন, পরিত্যক্ত, ন্যাচারেলি তাঁর স্বামীর দ্বারা। কেন? দুজনের মতান্তর? মনান্তর? বিজু রায় বাঘের মতো নাক ডাকেন? বা শারীরিক অত্যাচার করেন মদ খেয়ে যা আর সত্য করা যায় না বলে মিসেস তনুশ্রী রায় ডিভোর্স নিতে বাধ্য হচ্ছেন? না, তা নয়। চুপ চুপ। ফিসফিস। বিজু রায়, বি. বি. রায় দা গ্রেট ইজ অ্যাট লং লাস্ট ইন লভ উইথ আ গার্ল, লেডি, উওম্যান? কে। কে সে? অবশেষে। বেচারা বিজু রায়। স্ত্রীটি তো সাজানো পুতুল। হৃদয় মন বলে কিছু ছিল না। স্বার্থপর, আত্মকেন্দ্রিক। চার বছর ধরে অ্যাফেয়ার চলছে, জানত না পর্যন্ত, এত বোকা? না, না, শি ডাজন’ট কেয়ার। তা ছাড়া ওর নিজের নেই? একটা ছেড়ে, দশটা…।

কিছুদিন হল বসাক আর পাইনকে বড্ড প্রশ্রয় দেওয়া হয়ে গেছে। মিউজিক কনফারেন্স, থিয়েটারে, ফিলম ফেস্টিভ্যালে যেতে হলে, যেতে হয়ই, এ ছাড়া উপায়ও নেই। কেন না বিজু যাবেন না। বিজুর অত সময় নেই। বসাক পাইনের এসব ঝোঁক আছে। ওরা যায়। ওদের স্ত্রীদের নেই। বিজু রায়ের নেই। কাজেই এই জাতীয় জুটি। এসব বিজু জানেন। কোনও ব্যাপারই নয়। কিন্তু ইদানীং এটা শুধু গান-পাগলামি বা থিয়েটার-ফিলমের ঝোঁকের মধ্যে নেই। বসাক আর পাইনের মধ্যে তাঁকে নিয়ে একটা সূক্ষ্ম দ্বন্দ্বযুদ্ধ হয়ে যাচ্ছে। এটা তিনি ঘটতে দিয়েছেন। ফ্লার্ট করতে বরাবরই ভাল পারে তনুশ্রী। সেই স্কুলের ফ্রক পরার বয়স থেকে। এ একটা নেশা। এখনও এ নেশার জের কাটাতে পারে না তনুশ্রী। বিশেষ করে শাশুড়ি মারা যাবার পর বোধহয় একটু বেশি রকমের বেহিসেবি হয়ে পড়েছে। কিন্তু সবটাই বিজু রায়, তার স্বামী পেছনে আছে বলে, একটা শক্ত মাটি পায়ের তলায়, মাথার ওপর একটা দৃঢ় ছায়া। আশ্রয়। বিজু কি কিছু টের পেলেন? কানাঘুসো? তাঁদের সোসাইটি অত ঠুনকো নয় যে দু এক দিন তনুশ্রী রায়কে বসাক বা পাইনের সঙ্গে দেখলে একেবারে মুচ্ছো যাবে। রাজেশ পাইনের সঙ্গে দু দিন সুন্দরবন ট্যুর করে এলেন কদিন আগে। বিজু রায়কে বলেই যাওয়া। তবে একা রাজেশ যাচ্ছে এটা খুলে বলা হয়নি। একেবারে লাস্ট মিনিটে টিকিট করা, তাদের লঞ্চে কেবিন পাওয়া গেল না। সজনেখালি ট্যুরিস্ট লজে রাত কাটাবার জন্যে নামিয়ে দিল। এক বিঘত করে ঘর। টেকা যায় না এত ছোট। সাদা ফুলের মতো বিদেশি নাইটির ওপর কালো শাল জড়িয়ে অতএব তনুশ্রী বেরিয়ে এল বাইরের কাঠের বারান্দায়। ইলেকট্রিক আলো নেই। দরজার সামনে একটা করে হারিকেন-লণ্ঠন বসানো। কী অদ্ভুত ঝকঝকে একটা জড়োয়া সেটের মতো আকাশ! আর তাতে জমকালো পোশাক পরা মানুষের মতো সব নক্ষত্র। যেন জীবন্ত জোড়া জোড়া চোখ তাকিয়ে আছে, তোমার দিকে, বলছে গল্প কর। বেরিয়ে এস। দেখ। দেখাও। তখন আর নিজেকে সীমাবদ্ধ মানুষী বলে মনে হয় না। রাজেশ যখন সেই নির্জন রাতের বারান্দায় চারদিকে সুন্দরবন, জল, আর মাথার ওপর জ্যান্ত আকাশের তলায় তাকে অর্কিডের গুচ্ছের মতো জড়িয়ে ধরল, যখন তারপর দুজনে দুজনের শরীরের স্বাদ নিতে নিতে বাঘ আর বাঘিনী হয়ে গিয়েছিল, তখন কোনও অপরাধবোধ তো হয়ইনি, বরং মনে হয়েছিল এতদিনে এই প্রথম জানল কী ছিল ভেতরে, কী প্রবল আবেগ, কী শক্তি। রাজেশ তনুশ্রীর চেয়ে কয়েক বছরের ছোটই হবে। বলেছিল, ‘আই অ্যাম ফিলিং লাইক আই ওয়াজ আ ভার্জিন বিফোর দিস।’ সেই এক অনুভূতি তনুশ্রীরও। কিন্তু সে অনেক সতর্ক, সাবধান। রাজেশ পরে যতই এখানে সেখানে যাবার প্রস্তাব দিক। কর্ণপাত করেনি। ঠিকসময় সঠিক সুযোগের অপেক্ষায় আছে। তনুশ্রী অত সস্তা না। সিংহেরা সিংহীরা না বারো বছরে একবার? ইতিমধ্যে বসাক তাদের দুজনের মধ্যে একটা গোপন বৈদ্যুতিক আঁতাতের আঁচ পায়। ও-ও তো তালে আছে। কিন্তু ওই আঁচ পাওয়া পর্যন্তই। প্রমাণ কিছু নেই। কিছু নেই কি? পুলিসি তদন্ত হলে, প্যাসেঞ্জার লিস্টে দেখা যাবে না রাজেশ পাইন আর তনুশ্রী রায়? কোনও মিসেস পাইন নেই! আচ্ছা রাজেশই তো বুক করেছিল ঠিকঠাক পাইন আর রায় নামেই বুক করেছিল তো? তার জানবার কথা নয়। সর্বনাশ! জনা পঞ্চাশেক লোক ছিল লঞ্চে। এ সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। যদিও তার চোখে ছিল প্রায় মুখ-ঢাকা গগ্‌লস্! চুল সেট করানো ছিল এমনভাবে যে মুখের অর্ধেকটা প্রায় ঢাকা। জিনস আর শার্ট পরেছিল। দুটি বেলজিয়ান ছেলে ছিল। ভ্যাগাবন্ডের মতো দেখতে, রং জ্বলা তাপ্পি দেওয়া শর্টস পরা, তলায় সুতো ঝুলছে, আসলে য়ুনিভার্সিটির ছাত্র কিন্তু, ভারত দর্শনে বেরিয়েছে। ওদের সঙ্গেই এক টেবিলে বসে লাঞ্চ খেয়েছে। কথা বলেছে। আর একজন ছিল এক দিল্লিওয়ালা বুড়ো! মজবুত গাঁট্টাগোট্টা বুড়ো অবশ্য। সে বাঘের পাগ-মার্ক, আর হরিণের খুরের গর্ত দেখিয়েছিল নেতি ধোপানিতে। এর সঙ্গেও অনেক সময় কাটানো হয়েছে। লঞ্চের কেউ তাকে আদৌ বাঙালি বলে বুঝতে পেরেছে কি না সন্দেহ। অন্যান্য যাত্রীরা বেশির ভাগই ফ্যামিলি নিয়ে এসেছে। মিনিটে মিনিটে বাচ্চাদের পোশাক বদলাচ্ছে, মেয়েরা নিজেদের কার্ডিগান, শাল পালটাচ্ছে আর হরেকরকমের ড্রাই ফুড বার করছে। যে যার গ্রুপে জমে ছিল। লক্ষ করবার মতো কেউ ছিল না। সে লক্ষ করেনি। কিন্তু কেউ যদি তাকে লক্ষ করে থাকে, কেচ্ছার গন্ধ পেয়ে থাকে… বিজু রায়কে কেউ কিছু বলে থাকে। বলবেই বা কী? রাত্তিরবেলা সেই নিশ্ছিদ্র অন্ধকারে সজনেখালির টুরিস্ট লজে নিশ্চয়ই কোনও চোখ ছিল না। বিজু রায় তো জানতেনই, তনুশ্রী রাজেশের সঙ্গে সুন্দরবন যাচ্ছে। তবে?

তনুশ্রীর বড্ড গা শিরশির করতে লাগল। বারবার বাথরুম পাচ্ছে। তিনি, তাঁরা শর্মা বা বসাকদের মতো তিন পুরুষে বড়লোক তো নন। এই সেদিন পর্যন্ত শাশুড়ি ওপরে যখের মতো পুরনো সব মূল্যবোধ আঁকড়ে শুয়ে থাকতেন। এ সবের তো একটা প্রভাব আছেই। দু জোড়া চোখ। এক জোড়া কোটরাগত, প্রশ্নে ভরা কিন্তু কেমন একটা তীক্ষ্ম কৌতুক সে চোখে, শাশুড়ির চোখ। আর এক জোড়া বিজু রায়ের, অন্যমনস্ক। সব সময়ে কিছুতে যেন মগ্ন হয়ে আছে লোকটা। মা বলল—‘বারান্দা দিয়ে দেখে আয়, বর এসেছে, বুড়ো-বুড়ো করছিস, কেমন বুড়ো বর তোর।’ আগেই দেখেছিল তনুশ্রী, সে কথা ভাঙা হয় নি। বারান্দা দিয়ে দেখল, স্বাস্থ্যবান, জোড়-টোড় পরে চমৎকার মানিয়েছে, মাথায় চুলগুলো দেখবার মতো, বেশ পুলক জাগাবার মতো। কিন্তু বিজু রায় কিরকম যান্ত্রিক ধরনের মানুষ ছিলেন। কোনও যেন রসকষ নেই। যদিও অত্যন্ত কর্তব্যপরায়ণ। আসলে মানুষের ধাত। যে মানুষের যা। বলবার কিছু নেই। তনুশ্রীর নিজেরও খুব একটা ভাবাবেগ-টেগ ছিল না। তার একটা দিক ছিল প্রচণ্ড হিসেবি। এখনও আছে। এই যে রাজেশকে ঠেকিয়ে রেখেছে এটাও সেই হিসেবি মন থেকে এসেছে। তখন ছিল সীমাহীন উচ্চাকাঙক্ষা। যা কোনও দিন স্বপ্নেও আশা করেনি সেই বিত্ত, সেই মান পেয়ে তনুশ্রী উচ্চাকাঙ্ক্ষার লাগাম ছেড়ে দিয়েছিল। দারুণ দারুণ সেজে পার্টিতে যাব। ফ্যাশন-ম্যাগাজিনের জীবন। বহু বহু পুরুষ তাকে ঘিরে। সে মাতালের মতো দুলছে, দুলে দুলে হাসছে। পাশে বিজু রায়। ঘুরছে, ফিরছে, অদর্শন হচ্ছে আবার কাছে চলে আসছে। মিসেস তনুশ্রী রায়ের স্বামী। ‘স্বামী’, ‘কর্তা’ প্রভুত্ববাচক বলে তাঁদের সংস্থা আজকাল শব্দগুলো ব্যবহার করতে দ্বিধা করছে। কিন্তু লোকটা পাশে থাকলে গর্বে বুক ফুলে যেত। নির্ভরযোগ্য পুরুষ বটে। স্বামী। ঠিকই। কিন্তু বিজু কোনও দিনও প্রভূত্ব খাটায়নি। অবাধ স্বাধীনতা দিয়েছে। একদম ভোরের দিকে তনুশ্রী ঘুমিয়ে পড়লেন।


রাত্রি সাড়ে দশটা। শীতের কলকাতা প্রায় নিঝুম হয়ে এসেছে। রাস্তার মোড়ে কিছু লোক আগুন করে বসে জুয়ো খেলছে। ঘড় ঘড় ঘড় ঘড় ট্রামের শব্দ। ট্রাকের প্রতাপ বাড়ছে রাতের সঙ্গে সঙ্গে। সামনের মৃতদেহটির দিকে তাকিয়ে বিজু রায় একেবারে অবাক হয়ে রইলেন। নিতাই ভট্‌চাজ্যি বলল— ‘কী হল রায়বাবু, তুলুন?’

মণিময় বলল—‘গামছাটা ভাল করে কাঁধে ঠেসে ঠুসে নেবেন। না হলে লাগবে কিন্তু।’

প্রতুল বিশ্বাস বলল—‘ভয় খাচ্ছেন কেন? আমরাও পাঁচ জনে আছি তো। কাঁধ বদল করে নেবেন একটু পরেই।’

বিজু রায় দুঃখের হাসি হেসে বললেন— ‘ওজন তো শুধু এই খাটিয়াটারই।’

—‘না না দাদা, ভুল করছেন’, নিতাই ভট্‌চাজ্যি বললেন— ‘যত সময় যায় মড়ার ওজন বাড়ে। সে যত রোগাই হোক। এনার আত্মীয়স্বজনের হদিশ খুঁজতে আমাদের কম সময় গেল? ছিল ইঁদুর, দেখবেন হাতি হয়েছে।’

—‘বলো হরি, হরি বোল’… মণিময় বলে উঠল। চারজনের কাঁধে কাঁধে উঠে পড়ল নলিনীকান্ত করের লাশ।

আহিরিটোলার এই আস্তানার খোঁজ পেয়েছিলেন বিজন এই নলিনী করের কাছেই মাত্র তিনদিন আগে। একটা ট্যাকসি নিয়ে প্রথমেই গিয়েছিলেন সেই বাঁধাঘাট। শ্মশানের ধারের বাড়ি। নেই। বহুতল উঠছে। দুলিচাঁদের মতো কোনও ঘাঘু প্রোমোটার কিম্বা বিজু রায়ের মতো কোনও অ্যামেচার কলকাতা, বৃহত্তর কলকাতা এবং সমস্ত পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের চেহারা পাল্টে দেবার সংকল্প নিয়েছে। আকাশ কিনছে, আকাশ বেচছে। সুতরাং বিজু রায়ের ছেলেবেলা ধূলিসাৎ। দেখে কেন কে জানে খারাপ লেগেছিল। তিনি সেন্টিমেন্টাল লোক নন। এও ভাল করেই জানেন গঙ্গার ধারের সেই বালিখসা নোনা-ধরা বাড়ি আজও টিকে থাকার কথা নয়। তাকে আগাগোড়া সংস্কার করলেও টিকত কিনা বলা যায় না। কী আশা নিয়ে তিনি সেখানে গিয়েছিলেন বলা শক্ত। ঘুসুড়ির বাড়িটার জন্যে তো কতবার জি.টি. রোডের ওপর দিয়ে বেরিয়ে গেছেন। একবারও তো মনে হয়নি, ছেলেবেলার সেই বাড়ি দেখে আসি। এখনই কেন হল, বলা সত্যিই শক্ত। আশাভঙ্গ কেন হল সেটা বলা আরও শক্ত। কিন্তু হল। ট্যাকসিটা ছেড়ে দিয়ে ছিলেন, খানিকটা ঘোরাঘুরি করে বাঁধাঘাটের একটা দোকান থেকে গরম গরম জিলিপি আর চা খেলেন, বেশ কয়েক ভাঁড়। তারপর অনেককাল আগেকার মতো লঞ্চে চেপে বসলেন। ওপারে আহিরিটোলা যাবেন। স্রেফ যাবার জন্যেই। কোনও উদ্দেশ্য ছিল না। বেরিয়ে আসার একমাত্র উদ্দেশ্য, ছুটকি। ছুটকিকে খুঁজে বের করা। কিন্তু সেটা সহজ নয়। চিঠিগুলো এখনও সব পড়া হয়নি। কিন্তু যতগুলো পড়েছেন কোথাও ঠিকানা নেই। অথচ মা, সবগুলোর না হলেও কোনও-কোনওটার জবাব দিয়েছে। ঠিকানাটা এই কাগজের স্তূপের মধ্যে থেকে খুঁজে বার করতে হলে একটু সময় চাই। কোথাও বসতে পারা চাই। কিন্তু কোনও হোটেলে গেলে হঠাৎ কেউ তাঁকে চিনে ফেলতে পারে। তাঁর সময় চাই। বাসে, ট্রামে, ট্রেনে তো আর পুরনো চিঠি খুলে পড়া যায় না। আহিরিটোলার জেটিতে বসে এইসবই ভাবছিলেন। খেয়াল করেননি একজন কেউ তাঁকে অনেকক্ষণ ধরে লক্ষ করছে।

—‘মহাশয়ের কি এদিকে এই প্রথম আসা?’

চিন্তাক্লিষ্ট বিজু রায় মুখ তুলে দেখলেন রোগা লম্বা এক প্রৌঢ়। চওড়া পাড়ের ধুতির ওপর গরম ফ্লানেলের পাঞ্জাবি, তার ওপর জামেয়ার শাল। চকচকে বার্নিশ করা নিউ-কাট। মুখের রং, বোঝা যায় একসময়ে ফর্সা ছিল, জ্বলে গেছে। খয়েরি খয়েরি ছোপ নানা জায়গায়। চুলে বোধহয় কলপ দিতেন, সম্প্রতি ছেড়েছেন। অর্ধেক চুল পানের বাসি ছছাপের মতো লাল।

বিজু রায় তখনও ঠিক করতে পারেননি কী বলবেন। ভদ্রলোক বললেন— ‘হাতে দু দুটো সুটকেস, বাঁধাঘাটের স্টিমারে এলেন, এসে থেকে বসে আছেন, আর আকাশ পাতাল ভাবছেন, কী ব্যাপার বলুন তো। অবিশ্যি যদি বলেন পরের ব্যাপারে নাক গলাচ্ছি কেন তো চলে যাবো। কিন্তু ভাবব। ভাবনার ওপর তো ট্যাক্স বসাতে পারেন না?’ পারেন? কী দাদা পারেন?

বিজু বললেন— ‘আসলে খুঁজতে এসেছি এক জনকে। কিন্তু কোথায় উঠছেন, কীভাবে খুঁজব ভেবে পাচ্ছি না।’ বিজু রায়, বি.বি. রায় এই কথা বললেন একজন সম্পূর্ণ অজানা অচেনা লোককে।

—‘কে পালিয়েছে। ছেলে না মেয়ে? পুলিশের কাছে যাচ্ছেন না কেন। জানি ওরা একটি ওয়ার্থলেস লট। তবু লোকে তো যায়। আপনি গোপন রাখতে চাইছেন? না কি?

বিজু রায় এমনভাবে হাসলেন যার মানে ‘হ্যাঁ ঠিক ধরেছেন’ এরকম হতে পারে, আবার না-ও পারে।

—‘থাকতে পারেন তো আমার বাসায় নিয়ে যেতে পারি। ভাড়া খাই খরচ লাগবে। তবে হোটলে-ফোটেলের থেকে কম। যাবেন?’

এভাবে একজন অচেনা লোকের কথায় হুট করে কোথাও যাওয়া বিপজ্জনক, সেটা স্বভাবতই বিজু রায় জানেন। কিন্তু তিনি তো আর ছেলেমানুষ নন। উঠতে উঠতে বললেন—‘পেয়িং গেস্ট রাখেন বুঝি? বাঃ এর চেয়ে ভাল ব্যবস্থা আর হতে পারে না।’

ভদ্রলোকটির চেহারা পড়তি বড়লোকদের। টাকার থলিতে বেদম টান পড়েছে। এখন এইভাবে পেয়িং-গেস্ট রেখে চালান নিশ্চয়। দেখলেই বোঝা যায়। বিজু রায়ের কথার জবাবে ভদ্রলোক হাসলেন। বললেন… ‘চলুন। দেখুন পছন্দ হয় কি না।’

—‘আপনার নাম কী?’

—‘বিজন রায়। বিহারীটা বাদ দিলেন বিজু রায়। তাঁর নাম যে বিজনবিহারী এ বোধহয় তাঁর অতি ঘনিষ্ঠরা ছাড়া কেউ জানে না। এমন কি ছেলে-মেয়েও জানে কি না সন্দেহ।

—‘আমি এন.কে. মানে নলিনী কর। মাঝে এক কান্ত ছিল, বহুদিন হেঁটে দিয়েছি।’

পলেস্তারাহীন, একঠেঙে, আদ্যিকালের যে বাড়িটাতে তাঁকে নিয়ে ঢুকলেন নলিনী কর, সেটা কোনওকালে ধনী লোকের বাড়ি ছিল না। ঠ্যাংঠেঙে উঁচু উঁচু সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে নলিনীবাবু গলা বাড়িয়ে বললেন—‘ঠাকুর, আমার গেস্ট আছে। একটা মিল বেশি নিয়ো।’ ডালে সম্বরার ঝাঁজ আসছে। বিজু রায় হেসে ফেলে বললেন—‘হোটেল নাকি?’

—‘এখন দু কাপ চা আর টোস্ট পাঠিয়ে দিয়ে ঠাকুর, টোস্টে একটু চিনি দেবে।’

গালে সাবান হাতে ক্ষুর, দোতলার ঘর থেকে দু চারজন বেরিয়ে এসেছিল। বেশির ভাগই বয়স্ক, কেমন খিঁচড়ে মুখ। দু এক জন অপেক্ষাকৃত অল্পবয়সীও আছে। একজন বললেন— ‘কী ব্যাপার নলিনীদা, আপনার গেস্ট?’

—‘কেন, তোমরা কি ভাব নলিনীদা বাপে-তাড়ানো মায়ে-খ্যাদানো বলে তার গেস্ট থাকতে পারে না? নলিনীবাবু খেঁকিয়ে উঠলেন। বিজু রায়কে দেখে সবাই চুপ করে গেল। তিনতলার ঘর। একখানাই ঘর। এক চিলতে বাথরুম। বাকিটা ছাদ। একখানা তক্তাপোশ পাতা। কোণে মাটির কুঁজো। দেয়ালে গোঁজ দেওয়া। তাই থেকে একটা ধবধবে পাঞ্জাবি ঝুলছে। তক্তাপোশের বিছানাটায়ও একটা নতুন ঝকঝকে জয়পুরি বেডকভার।

—‘চলবে?’ নলিনী কর বললেন, ‘এটা মেস। যা এখন কলকেতার শহরে প্রায় অবসলিট হয়ে গেছে। এই আমার ঘর। আপনাকে একটা স্টিলের ফোল্ডিং খাট পেতে দেব পাশে। রাতে শোয়ার জন্যে। যদ্দিন ছেলে বা মেয়েকে চুপিচুপি খুঁজবেন ততদিন থেকে যান এখানে। কেউ ডিসটার্ব করবে না। আমার ঘরভাড়া একশো পাঁচ, আপনি হাফ সাড়ে বাহান্ন দেবেন। গেস্টের মিল, এরা মাছের মিল দশ টাকা, মাংসের পনেরো নেয়, নিরমিষ্যি আট। ব্রেকফাস্ট চার টাকা। চা এক টাকা পঁচিশ পয়সা। বড় কাপে দেয়। ভাল আসাম। ঠাকুর রাঁধে ভাল। ডালে ফেন চালায়। স্টিল্‌ল্‌।

বিজু রায় বললেন— ‘একলার একটা ঘর পাওয়া যায় না?’

—‘একলা? সব ফিল্ড আপ। নো ভেকান্সি। আপনি যে থাকবেন সেটা আমার খাতিরেই। তা ছাড়া আপনার ঘাবড়াবার কিছু নেই। আমি মোস্ট নন-ইনটারফিয়ারিং লোক। বুঝলেন কিছু?’

এই সময়ে একটি গেঞ্জি আর গামছা-পরা লোক, কলাইয়ের থালার ওপরে দুটো মোটা মোটা কাপে চা, এবং চার পিস টোস্ট নিয়ে এল।

—‘নিন খেয়ে নিন’— ঘরের একমাত্র টিনের চেয়ারটা টেনে বিজু রায়কে বসতে দিয়ে নলিনী কর বললেন।

বিজু রায় টোস্টে চিনিগুলো কলাইয়ের বাসনটার ওপর যথাসাধ্য ঝেড়ে ফেলে দিতে লাগলেন।

—‘মধুমেহ?’

—‘আজ্ঞে?’

—‘ডায়াবিটিস?’

—‘এখনও ঠিক নয়, ব্লাড শুগার আছে।’

—‘তবে তো মশাই এ চাও আপনার চলবে না। চিনি দেওয়া আছে।’

—‘একবার খেলে কিছু হবে না’ বিজু রায় চায়ে চুমুক দিলেন। বেশ কড়া, কিন্তু রীতিমতো ভাল চা। বিজু রায় উচ্চতম দামের দার্জিলিং খান, লিকার পাতলা, কিন্তু এই কড়া লিকারের চা যে যথেষ্ট ভাল তাতে সন্দেহ নেই। পাঁউরুটিখানাও তিনি খুব তৃপ্তির সঙ্গেই খেতে লাগলেন। মোটা মোটা পাঁউরুটি, টাটকা রুটির গন্ধটা বেরোচ্ছে। তাঁর খিদে পেয়েছে।

নলিনী তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন— ‘ভাল। না? আসলে কি জানেন, খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারটা আমরা এখানে নিজেরাই দেখি। চাঁদু মিত্তির আছে দোতলায়। এক্সপার্ট লোক। মাসকাবারি বাজারটা সে-ই করে। ডেলি বাজারও এরা পালা করে করে। নয়ত এন.কে এখানে থাকত?’

তারপরে গালের কুঁচকানো চামড়ায় আরও ভাঁজ তুলে হাসলেন—‘আমার তো ডায়াবিটিস।’

বিজু বললেন— ‘তবে এত চিনি-টিনি?’

—‘কে দেখছে?’ যেন একমাত্র কেউ দেখে ফেলবে বলেই রোগীর যা-কিছু সাবধানতা।

—‘বয়স কত হল বলুন তো?’

বিজু রায়ের মনে হল—বাহাত্তর তিয়াত্তর অন্তত, বললেন—‘চৌষট্টি পঁয়ষট্টি হবে।’

—‘ফিফটি নাইন রানিং।’

—চমকে উঠলেন বিজু রায়।

একটা কিং সাইজ সিগারেট বার করে নলিনীকান্ত বললেন—‘জীবনে কী করেছি আর কী করিনি হিসেব দিতে গেলে মাথা খারাপ হয়ে যাবে মশাই। বছর তেইশ বয়সে বাড়ি থেকে পালালুম। তারপর জাহাজের খালাসি হওয়া থেকে জাহাজ কেনা পর্যন্ত করেছি। করতে পেরেছি। শেয়ারে কামিয়ে লালে লাল হয়ে গেছি। আবার বেগার, একেবারে ভিক্ষুক। ধরুন, অবস্থা যখন ছিল পাল পাল আত্মীয়স্বজনকে গ্র্যান্ডে খাওয়ানো থেকে, ব্যালকনির টিকিটে সিনেমা দেখানো, বক্সে থিয়েটার দেখানো, দামি দামি উপহার কিনে দেওয়া—কী না করেছি। যখন পকেট গড়ের মাঠ হয়ে গেল, নিজের ভাই, আমার পয়সায় যে এঞ্জিনিয়ার, সেই ভাই গলাধাক্কা দিয়ে বাড়ি থেকে বার করে দিল। নিন ধরুন একটা।’ নলিনীকান্ত সিগারেটের প্যাকেট তাঁর দিকে এগিয়ে ধরলেন।

বিজু রায় ইতস্তত করছিলেন। নলিনীকান্ত বললেন—‘রেসট্রিকশান? একদিন একটায় আসবে যাবে না।’

এই সময়ে একটি যুবক ঘরে মুখ বাড়াল, —‘আসতে পারি।’

—‘আবার জিজ্ঞেস করছো কেন? কৌতূহলে তো ছটফট করছ সবাই। এসে যাও এসে যাও। নীচে গিয়ে রিপোর্ট দিয়ো।

—‘আঃ আপনি না নলিনীদা! কোনও জিনিসটাই সহজভাবে নিতে পারেন না। এলুম আপনার ফরমাস খাটতে। এই নিন আপনার টুথপেস্ট, আর এই সুপার সফ্‌ট ব্রাশ। ক্রিমটা অফিস-ফেরত আনব।’

যুবকটি একটা দামি টুথপেস্ট আর ব্রাশ এগিয়ে দিল।

—‘এ হে হে হে হলদে আনলে কেন হে? হলদে আমি মোটে পছন্দ করি না। গ্রিন, গ্রিন আনতে হয়।’

—‘ভুল হয়ে গেছে দাদা। দয়া করে ফেরত দিতে বলবেন না।’

—‘এসেছ যখন কৌতূহল নিবৃত্তি করে যাও। ইনি আমার বন্ধু বিজন রায়, মানে জুনিয়র ফ্রেন্ড। এই তুমি যেমন। আর বিজনবাবু ইটি মণিময়। নামেও রত্ন, স্বভাবেও রত্ন। আচ্ছা এবার এসো গিয়ে, তোমার আপিসের দেরি হয়ে যাচ্ছে।’

মণিময় বলল— ‘নমস্কার বিজনদা, পরে আলাপ হবে।’

—‘ছেলে-মেয়ে নয় মনে হচ্ছে,’ মণিময় চলে গেলে এন.কে বললেন, ‘ছেলে-মেয়ে হলে এতক্ষণে দাপিয়ে বেড়াতেন, তবে কি ভাইপো-ভাইঝি, ভাগনে-ভাগনি গোছের কেউ?’ বলেই জিভ কেটে বললেন—‘ছি ছি এই দেখুন, ইনটারফেয়ারেন্স হয়ে গেল দাদা, মনে কিছু করবেন না।’

বিজন হেসে বললেন— ‘ও সব কেউ নয়। অনেকদিন থেকে সম্পর্ক নেই এমন এক জনের ঠিকানা খুঁজে বার করবার চেষ্টা করছি।’

—‘বুঝেছি।’ এন. কে বললেন, তারপর ঘরটা বিজনকে পুরোপুরি ছেড়ে দিয়ে নিজের কাজে, ভগবান জানেন কী কাজ, চলে গেলেন।

দিদির চার পাঁচটা চিঠি পেলেন বিজন। প্রত্যেকটাতেই কিছু টাকার প্রাপ্তিস্বীকার আছে। তাঁর মনে পড়ল, মা যতদিন ছিল মাসে হাজার টাকা করে মাসোহারা দিতেন তিনি। খুব আস্তে টাকাটা মায়ের বালিশের তলায় ঢুকিয়ে রাখতেন। মা একদিন, একদিনই বলেছিল—

—‘আমি তো একটা শোয়া-মানুষ, সব কিছুই তো অপরের ওপর। নিজে হাতে খরচ করার সাধ্যও নেই। এত আমায় দিস কেন?’

বিজু বলেছিলেন, ‘এ টাকা নিয়ে তুমি যা খুশি করবে মা।’

‘এত টাকা নিয়ে সত্যিই কখনও নাড়া-চাড়া করি নি’, দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেছিল মা। টাকা নিয়ে মা কী করত বিজন জানেন না। জানবার আগ্রহও বোধ করেননি কোনও দিন। দিয়ে দিয়েছেন ব্যস। তবে মা হয়ত নাতি নাতনিদের, বউমাদের কিছু উপহার-টার দিত অনেক সময়ে। তিতি যেন একদিন কাকে বলছিল— ‘ঠাম্মার টাকা দিয়ে এই চুড়িদারটা করিয়েছি। কেমন হয়েছে?’ কাকে বলছিল? তাঁকে তো নয়ই। ওর মাকে কি? মনে করতে পারলেন না বিজন। শুধু ‘ঠাম্মার টাকা’ কথাটা মনে লেগে আছে। কিন্তু সেদিন আলমারি, সিন্দুক ঘাঁটাঘাঁটি করে শুধু একটা সোনার হার ছাড়া আর কোনও মূল্যবান জিনিস পাননি। সামান্য কিছু খুচরো পয়সা, ব্যস। সোনার হারটা ঝকঝকে নতুন, মা কোনও সময়ে করিয়ে রেখেছে। বাক্সের মধ্যে চিরকুটে লেখা ‘ছোটখুকুকে আশীর্বাদ’। ভাই-বোনদের মধ্যে দিদিই সবচেয়ে অভাবী। চিঠি পড়ে মনে হচ্ছে সে টাকার অধিকাংশই দিদিকে পাঠিয়েছে মা। কাকে দিয়ে পাঠাল? খুব সম্ভব সুলতা আর শিবানী ওই দুটি নার্সকে দিয়ে। তারা যে মেরে দেয়নি এটা মায়ের ভাগ্য, দিদিরও ভাগ্য। কিন্তু তাঁরও তো দিদির কথা ভাবা উচিত ছিল। মায়েরও বলা উচিত ছিল। তিনি দিদির কথা ভাবেননি, তার প্রধান কারণ তিনি অতটা জানতেন না। দিদি এমন কিছু দূরে থাকে না। কিন্তু দিদি, দিদির ছেলেরা কেউ কখনও তাঁর সল্ট লেকের বাড়িতে এসেছে বলে তিনি মনে করতে পারলেন না। সল্ট লেক কেন। ছুটকি চলে যাবার পর থেকেই দিদি বাঁধাঘাটের বাড়িতেও আর আসেনি। ও। এই জন্যে। দিদির শ্বশুরবাড়ি খুব গোঁড়া, আচারপরায়ণ, বিজু একবার দিদির সুখচরের বাড়িতে গিয়ে দিদির শ্বশুরমশাইয়ের কাছে র্ভৎসনা শুনেছিল, বামুনের ছেলে হয়ে আহ্নিক করে না বলে। প্রসাদী মাংস ছাড়া ওদের বাড়ি ঢুকত না। তাহলে ছুটকির কারণেই দিদির সঙ্গে রায়বাড়ির যোগাযোগ ছিন্ন হয়ে গেল। তাই-ই দিদির কথা ভাবেননি তিনি কখনও। মেজদার মেয়ের বিয়েতে যেন একটুখানির জন্যে দেখা হয়েছিল। আর? ওই মায়ের কাজে।

দিদি লিখেছে— ‘মনি-অর্ডার পেয়েছি। না, পেলে যে কী হত তা জানি না। ভাগ্যে তুমি ছিলে। ভাইয়েরা তো থেকেও নেই। এবারের মতো সামলে দিতে পেরেছি। তুমি দীর্ঘ জীবন লাভ করো…’ দিদিকে প্রয়োজনের সময়ে মনি-অর্ডার পাঠাবার জন্যেই কি মায়ের দীর্ঘ জীবন লাভের প্রার্থনা?

শ্রী চরণেষু মা,

তোমার দেওয়া মূলধনে তোমার ছোট নাতি নূতন করে ব্যবসা শুরু করেছে। খুবই ভাল চলছে। ওই টাকা শাঁটুল বলছে ফিরিয়ে দেবে। দিতে পারলেই আমার সোয়াস্তি। কত দিলে মা! মেয়ের বিপদে মা ছাড়া আর কে করে! সবই ঠিক। তবু লজ্জা হয়। শাঁটুল শিগগিরই বাড়ির কলি ফেরাবে।’

আশ্চর্য! দিদির এত বিপদ গেছে তবু কখনও বিজনের কাছে হাত পাতেনি? মাকে জানিয়েছে। মার সাধ্য ছিল তাই করেছে, না হলে? হঠাৎ বিজন স্থির করলেন তিনি দিদির বাড়িই আগে যাবেন। একটাই মুশকিল। তাঁর প্রাণটা এখন ছুটকির জন্য দাপাচ্ছে। ভেতরে ভেতরে তিনি ভীষণ অস্থির। ছুটকিকে খুঁজে বার না করে, তার সঙ্গে কথা না বলে বাড়ি ফিরে যাবার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে তাঁর নেই। তা ছাড়া, বাড়ির লোককে… তনুশ্রী, তিতি আর চিন্টু এদের একটু ভোগাবার ইচ্ছে তাঁর। এ অবস্থায় দিদির বাড়ি গেলে তিনি গোপনতাটা রাখতে পারবেন কি? বাড়ি থেকে তাঁর জন্যে বিজ্ঞাপন-টন দিলে এই আহিরিটোলার বাসও তাঁর উঠবে। দেখা যাক।

নলিনী কর ফিরে আসবার আগেই তিনি চান সেরে নিয়েছেন। বেরোবার জন্য প্রস্তুত। — ‘এ কী? চললেন কোথায় মশাই? খেয়েছেন?’

—‘বাইরে কোথাও খেয়ে নেব এখন।’

—‘সে কী? আমি মিল বলে দিয়েছি যে। দশটা টাকা গচ্চা যাবে না।’

ভদ্রলোক কিছুতেই ছাড়বেন না। একতলার খাবার ঘরে আসন পেতে বসে, থালার চারদিকে জলের ছিটে দিয়ে, বাঁ কনুই বাঁ হাঁটুর ওপর রেখে বিজু রায়ের সঙ্গে খেলেন নলিনী। চানের কথা উড়িয়ে দিলেন। শীতকালে নাকি উনি অর্ধেক দিন চান করেন না। ভোজনের পর পরিষ্কার হয়ে নেবেন।

রান্না সত্যিই খুব ভাল। এ ভাবে চুড়ো-করা ভাতের সঙ্গে সুক্তো, মাছের মুড়ো দিয়ে বাঁধাকপি, বড় বড় পার্শে মাছের ঝাল, কুমড়ো, বেগুনের অম্বল—এসব কবে শেষ খেয়েছিলেন মনে পড়ে না বিজু রায়ের। বাঙালিরা ধনশালী হলেই তাদের খাদ্যাভ্যাস পর্যন্ত আমূল পাল্টে ফেলে। তাঁরা ছোটবেলায় জলখাবার খেয়েছেন এক পয়সার চারটে করে বলের মতো হিঙের কচুরি আর খোসাসুদ্ধ আলুর তরকারি। নয়ত দুধ-জিলিপি। বাঁধা জলখাবার। তাঁর ছেলেমেয়েরা খায় দুধের মধ্যে কর্নফ্লেক্‌স, আধ-সেদ্ধ ডিম, দুটো করে সিঙ্গাপুরি কলা। প্রমীলাকে তিনি হোটেলের বয়-বাবুর্চির মতো বলতে শুনেছেন—‘ডিম সেদ্ধ না ভাজা?’ সেদ্ধ ভাজার বাইরে স্ক্র্যাম্‌বল্‌ড্‌-এগের ফরমাসও হত। দুপুরে ভাত খান না বিজু রায়, আটার রুটি, গোনা দুখানা। নলিনী বললেন— ‘আপনি বোধহয় টেবিলে খান, না? খুব অসুবিধে হচ্ছে।’

বিজু রায় বললেন—‘রান্না খুব ভাল।’

—‘ভাল তো খাচ্ছেন কই? এ যে মেয়েদের খাওয়া মশাই।’

আরেক বাটি ডাল চেয়ে নিলেন বিজু রায়। বললেন-ব্লাড শুগার, বললাম না?

—‘ওঃ হো তাই বলুন। তা আমার তো ইউরিনেও চিনি এসে গেছে। তাই বলে বাঁধাকপি দিয়ে ভাত মেখে খাব না। এমন পার্শে মাছের সর্ষে-বাটার ঝাল, ভাতে মেখে না খেলে রোচে?’

খেয়ে-দেয়ে বিজু রায় সুখচরের উদ্দেশে বেরিয়ে পড়লেন।

এই তাহলে এখনকার সুখচর? বিয়াল্লিশ তেতাল্লিশ বছর আগে দেখা সেই ছায়া নিবিড় মফস্বলের সঙ্গে কোনও মিল নেই। বড় বড় সুন্দর সুন্দর বাড়ি। বহুতল। কিছুকাল আগেও একটা সময় ছিল যখন বিলেত-আমেরিকা থেকে ফিরে এসে লোকে বলত— ‘এ কী? তিরিশ বছর আগে যা দেখেছি, যেমন দেখে গেছি, এখনও তো অবিকল তাই-ই?’ ইদানীং আর সেটা বলতে পারবে না তারা। অন্তত সুখচরের চেহারা দেখে বিজু রায়ের তাই মনে হল। তিনি নিজের চেষ্টায় ভটচাজ্যি বাড়ি খুঁজে বার করতে পারলেন না। রিকশা-অলা, পান-সিগারেটের দোকান, লন্ড্রি ইত্যাদিতে জিজ্ঞেস করতে করতে পৌঁছলেন যখন দেখলেন সারা সুখচর বদলে গেলেও তাঁর দিদির বাড়ির পরিবেশ এতটুকুও বদলায়নি। সেই সামনে একটা পচা ডোবা এই দুপুরবেলায়ও যার ওপর থিকথিকে মশা। এবং পেছনে বিয়াল্লিশ বছর আগে দেখা দোতলা বাড়ির কঙ্কাল। খিলেন থেকে একটা অশথ গাছ গজিয়ে প্রায় মহীরুহ হয়ে গেছে। বাড়ির গায়ে কোনও দিন কোনও পলেস্তারা ছিল বলেও মনে হয় না। বিরাট দরজাটা বহু কাল রং-টং না হওয়া সত্ত্বেও সম্ভবত কাঠের সেগুনত্বর গুণে এখনও অটুট আছে। ভেতরে ঢুকে বিজু গলা তুলে ডাকলেন—‘দিদি! দিদি।’

সদর দিয়ে ঢুকে একটা ছোট গলি মতো। তার দুধারে বাঁধানো রক। আগেকার বড়সড় বাড়িতে এমনই থাকত। গলি পেরিয়ে চৌকো উঠোন। শান জায়গায় জায়গায় ফেটে গেছে, সেখানে আগাছা। শেয়ালকাঁটা, পাথরকুচি। শানের ওপর শ্যাওলা, তার ওপর ধ্যাবড়া করে চুন ফেলা হয়েছে। বিজুর মনে পড়ল উঠোন পেরিয়ে কলঘরে যেতে হত। এখনও তা হলে তাই আছে। বড়দির ছোট ছেলে শাঁটুল তাহলে কলি ফেরাতে পারেনি। ব্যবসাটা ফেল মেরেছে হয়ত। তিনি আবার গলা তুলে ডাকলেন— শাঁটুলবাবু। শাঁটুলবাবু। দিদির খুব সম্ভব দুই মেয়ে, দুই ছেলে। মেয়েদের নাম যেন ছিল খুকি আর টুকি। কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও বড় ভাগনের নাম মনে করতে পারলেন না। পোশাকি নামগুলো তো নয়ই। অগত্যা শাঁটুলবাবু! শাঁটুলবাবু!

এবারে দাওয়ার ওপরের ঘরের ভেতর থেকে একটি বউ বেরিয়ে এল। হাতে খন্তি। তার রকম দেখে বিজু রায়ের মনে হল— সে এইভাবেই মাঝে মাঝে বেরিয়ে আসে এবং গরম খন্তির ছ্যাঁকা দিয়ে দেয় তাঁর মতো বে-আক্কেলে মিনসেদের।

তাঁকে দেখে বউটি জ্বলজ্বলে সিঁদুরের ওপর গাছকোমর থেকে টেনেটুনে একটু ঘোমটা টানল। এখানে এখনও বউয়েরা বাইরে লোক দেখে ঘোমটা টানে? কলকাতার থেকে কত দূর সুখচর?

—‘কাকে চান?’ স্বরটি ভাল।

—‘আমি বিজু, শাঁটুলের ছোটমামা। দিদি আছেন?’

বউটির চোখ বড় বড় হয়ে উঠছিল, সে এক ছুট্টে ভেতরে গেল। বোধহয় রান্না এবং খন্তির একটা ব্যবস্থা করে আর একটু ভদ্রস্থ হয়ে বেরিয়ে এসে ঢিপ করে পেন্নাম করল, —‘মা ভেতরের ঘরে শুয়ে আছে। আসেন।’

—‘মা দেখো, কে আসছেন।’

দিদি ওপাশ ফিরে শুয়ে ছিল। বউয়ের কথায় এদিকে ফিরে ভুরু কুঁচকে বলল —‘কে?’

ঘরটা অন্ধকার। বউটি এসে টিমটিমে আলো জ্বেলে দিন।

—‘আমি বিজু দিদি।’

—‘বিজু! বিজু! ছোট খোকা!’ দিদি উত্তেজনায় উঠে বসল।

—‘তুমি কেন? কোথা থেকে? কী করে খবর পেলে?’

বিজু রায় বললেন— ‘কেন? আসতে নেই? তোমাকে দেখতে ইচ্ছে হল।’

—‘আমাকে দেখতে?’ দিদি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।

—‘কী হয়েছে দিদি তোমার? শুয়ে কেন?’

—‘ডাক্তার তো ধরতে পারছে না কিছু। পেটে যনতন্‌না! তোমাকে, তাহলে এরা খবর দেয়নি! এমনিই এসেছ! —বউমা! ছোটমামার খাবার জোগাড় করো।’ দিদি শেষ কথাটা গলা তুলে বলল।

বিজু বললেন, ‘আমি খেয়ে-দেয়ে এসেছি দিদি। কাউকে ব্যস্ত করতে হবে না। ভাগ্নেরা কোথায়?’

—‘ভাগ্নেরা?’ দিদি অবাক হয়ে বলল ‘রা কোথায় পেলে? বাঁটুল তো সেই কবেই ছোটতেই…’

তখন বিজু বুঝতে পারলেন কেন বড় ভাগ্নের নাম মনে পড়ছিল না। খুব সম্ভব তিনি যখন নিরুদ্দিষ্ট, তখনই…। তাঁর কোনও দোষ নেই।

গলাটা একটু পরিষ্কার করে বললেন— ‘খুকি, টুকি সব ভাল তো?’

—‘আর কে ভাল, কে মন্দ! মেয়ে-সন্তান বিয়ে দিয়ে দিলেই পর, তার ওপর নিজের ছেলেপিলে সংসার নিয়ে জড়িয়ে পড়লে তো আর কথাই নেই। পরস্য পর। খুকি থাকে মজফ্‌ফরপুর। টুকির বর খুব উন্নতি করেছে, আগে কটকে থাকত, এখন বোম্বাই। এদিকে ওদের কেউ নেইও। মাঝে সাঝে চিঠি দেয়।’

—‘শাঁটুল? শাঁটুল কোথায় গেল?’

দিদি অনেকক্ষণ পরে বলল ‘—জানি না।’

—‘জানি না মানে?’

দিদি এদিক-ওদিক তাকিয়ে বলল—‘লেখাপড়ায় তো তেমন চৌকস ছিল না। গোড়ার থেকেই এ ব্যবসা সে ব্যবসা করে বাপের পয়সাগুলো সব ফুঁকে দিলে। তার পরেও অনেক অনেক দিয়েছি। শেষের দিকটা বেশ দু পয়সা আসছিল। তারপর একদিন…’ দিদি চুপ করে গেল।

এই সময়ে বউটি এক কাপ চা, আর দুটো দানাদার এনে রাখল।

বিজু বললেন—‘আমার মিষ্টি চলে না, ব্লাড শুগার আছে। চা-টা খেয়ে নিচ্ছি। এগুলো নিয়ে যাও মা।’

বউটি দানাদারের প্লেট তুলে নিয়ে বিনা বাক্যব্যয়ে চলে গেল। বেশ কিছুক্ষণ পর দিদি আবার এদিক তাকিয়ে মাথাটা একটু তুলে চুপি চুপি বলল—‘হিন্দুস্থানী’।

—‘কে?’

—‘বউ।’

—‘তো কী? ভালই তো!’

—‘ভাল-মন্দ জানি না। শিগগিরই বোধহয় কাটান-ছাড়ান হয়ে যাবে।’

—‘তাই?’

—‘ আর কী হবে বলে! শাঁটুল তো পুলিশের হাত এড়িয়ে বেড়াচ্ছে।’

—‘সে কী? কেন?’

—‘কি জানি। সিমেন্ট বলে নাকি গঙ্গামাটি পাইল করে দিয়েছে, একদিন রাতে সাতখানা মোটর বাইক গর্জন করে বাড়ি ঘিরে ধরল। এদের সব বসিয়ে দিয়েছে নাকি। খিড়কি দিয়ে শাঁটু পালিয়ে গেল। বউ আটকে আছে আমার জন্যেই। বাপের সঙ্গে ঝগড়া করে শাঁটুকে বিয়ে করেছিল। তা অ্যাদ্দিনে বোধহয় বাপ একটু নরম হয়েছে। ছেলেটাকে নিয়ে গেছে। বউটা, হাজার হোক মানুষ তো, এমন অবস্থায় আমায় ফেলে যেতে পারছে না।’

দিদির চোখ দিয়ে জল পড়তে লাগল।

ময়লা বিছানায় শীর্ণ বৃদ্ধার দিকে তাকিয়ে হঠাৎ বিজুর মনে হল—দিদি, ইনি বি.বি. রায়ের দিদি। শুয়ে থাকতে থাকতে দিদি হঠাৎ কুঁকড়ে যেতে লাগল। মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। বিজু উঠে দাঁড়িয়ে তাড়াতাড়ি কাছে গিয়ে বললেন— ‘কী হল দিদি! ব্যথা?’

—‘উঃ, মাগো! মাঃ আর পারছি না যে!’

বিজু বাইরে এসে ডাকলেন— ‘বউমা।’

বউটি এসে দাঁড়াল।

—‘ডাক্তার দেখেছে?’

—‘হ্যাঁ।’

—‘কী বলছে?’

—‘ক্যানসার।’

বিজু রায় দাওয়ার ওপর কাঠের বেঞ্চে বসে পড়লেন।

বউটি কাঠ-কাঠ গলায় বলল— ‘ওর ছেলে ফেরার। এই রোগ বাধিয়েছে। আমার গলায় পড়েছে। আমার কোনও ক্ষমতাই নাই। আপনি ওর ভাই। শুনেছি রইস লোক। অনেক পয়সা। নিয়ে যান। নিয়ে এই নরক থেকে আমায় ছেড়ে দিন।’ বলে দাঁড়িয়ে রইল। একটু পরে রুক্ষ গলায় বলল— ‘আপনি যদি এত পয়সা-অলা লোক তো আপনার দিদির, ভান্‌জার এমন অবস্থা হয় কেন? আমার পিতাজিও বেওসা করেন, আমাদের মতিহারী থেকে যে দেশোয়ালি যখন এসেছে কোনও না কোনও হিল্লে লাগিয়ে দিয়েছেন। নিজের লোকের তো কথাই নাই। আপনারা বঙ্গালিরা কেমন মানুষ?’ রাগে মেয়েটির মুখ লাল হয়ে উঠেছে। সে আবার রান্নাঘরে ঢুকে গেল। এত কী রাঁধছে সে ভগবানই জানেন।

বিজু রায় গালে চড় খেয়ে বসে ভাবতে লাগলেন। এক করা যায়, দিদিকে নিয়ে এখুনি সল্ট লেকের বাড়ি চলে যাওয়া যায়। মায়ের ঘর খালি পড়ে আছে, দিদি অনায়াসেই থাকতে পারবে। নার্স রেখে দেওয়া যাবে, মায়ের মতো। তনুশ্রী সম্ভবত ব্যাপারটা পছন্দ করবে না। এরকম ঘটনা এর আগে ও বাড়িতে হয়নি। কিন্তু তার জন্য কিছু এসে যাবে না। দিদি থাকবে ওপরে, সব কিছু আলাদা। তার সেবার ভার মাইনে-করা লোকেদের। তনুশ্রীর বলবার কিছু থাকতে পারে না। হঠাৎ বিজু রায়ের একটা কথা মনে পড়ে গেল, তিনি গালে আরেকটা চড় খেলেন। তাঁদের বিয়ের কিছুদিন পরই তনুশ্রীর বাবা মারা যান। মা একা পড়ে গেলেন। ছয় মেয়ে। তনুশ্ৰীই একমাত্র খাস কলকাতায়। সে মাকে নিজের কাছে এনে রাখতে চেয়েছিল। বিজু রায় রাজি হননি—যুক্তি দেখিয়েছিলেন অনেক। দুই পক্ষের মা এক সংসারে থাকলে জটিলতা বাড়বে। অনর্থক। তাঁর বাড়ির কতকগুলো নিজস্ব নিয়ম, শৃঙ্খলা আছে, সেগুলো নষ্ট হওয়া তাঁর শুধু অনভিপ্রেত তাই-ই নয়। তাঁর জীবিকা-ইত্যাদির পক্ষে ক্ষতিকর। শাশুড়ি যদি সেগুলোতে হাত লাগান। অল শাশুড়িজ আর গ্র্যাবিং, ডমিনেটিং টাইপ্‌স, তখন শুধু-শুধু সম্পর্ক খারাপ হয়ে যাবে। তা ছাড়া, ভদ্রমহিলার আরও পাঁচ মেয়ে রয়েছে। সাধ্যের বাইরে গিয়ে সবারই মোটের ওপর ভাল-ভাল বিয়ে দিয়েছেন, তা তারাও তো রাখতে পারে। তনুশ্রীর মুখটা কেমন হয়ে গিয়েছিল। একবার তবু বলেছিল— ‘ঠিক আছে মাকে একবার জিজ্ঞেস করতে পারি তো?’

বিজু রায় বলেন— ‘তা পারো। কিন্তু মা রাজি হলেও আমি রাজি হতে পারব না।’ তবু তনুশ্রী জিজ্ঞেস করেছিল মাকে। খুব স্বস্তি পেয়েছিলেন বিজু যখন মা-ও তাঁর মতে মত দিয়েছিল। ‘না, কুটুম্বকে ও ভাবে বাড়িতে রাখলে অশান্তি হবার সম্ভাবনা, তার চেয়ে বিজু একটা মাসোহারার ব্যবস্থা করে দিক। বউমা গিয়ে গিয়ে দেখাশোনা করুক।’

তনুশ্রীর মার হার্টের অসুখ ছিল। ঠিক কী জাতীয় তা বিজু রায় জানেন না। তিনি মাসোহারা দিতেন, চিকিৎসার ভাল ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। কিন্তু তনুশ্রীর মা নিজের ঘরে একদিন মরে কাঠ হয়ে পড়েছিলেন। প্রতিবেশীরা দরজা কেটে বার করে। বিজু রায় গিয়েছিলেন। শাশুড়ির চোখের সেই ভয়ে ঠিকরে আসা চোখের মণি দুটো তিনি কখনও ভুলতে পারবেন না। একাকিত্বের আতঙ্কেই হঠাৎ উনি মারা গেলেন, না হার্টের অসহ্য যন্ত্রণায় ওইরকম অবস্থা হয়েছিল, কে বলবে! বিজু রায় কুঁচকে গেলেন। কেমন মনে হল, দিদিকে ওখানে তুললে তিনি তনুশ্রীর কাছে খুব ছোট হয়ে যাবেন।

দিদির চিৎকার ক্রমশ বাড়ছে। মেয়েরা এমনিতেই খুব সহনশীল হয়। তা সত্ত্বেও একজন চুয়াত্তর পঁচাত্তর বছরের বৃদ্ধা যখন এই ভাবে ডাক ছেড়ে কাঁদছে তখন অনুমান করা যায় তার যন্ত্রণার তীব্রতাটা কী রকম! বিজু রায় ভাবলেন— ‘আর এই সময়ে আমি কারও কাছে ছোট হওয়ার কথা ভাবছি। কী অদ্ভুত একা মানুষ! ভাই-বোন-ছেলে-মেয়ে সব আছে। সব থাকে। অথচ কেউ নেই। কেউ থাকে না। কিছু থাকে না। থাকে শুধু মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্কের মধ্যে খাড়া হয়ে চূড়ান্ত অহমিকা। অহম্‌, অহম্‌, অহম্।

তিনি তাড়াতাড়ি দিদির ঘরে ঢুকলেন। বললেন— ‘দিদি। ব্যথা বাড়লে কোনও ওষুধ খাও?’ হাত বাড়িয়ে একটা পাতা দেখাল দিদি। তুলে বিজু রায় দেখলেন স্পাজমোপ্রক্সিভন। হতাশ হয়ে বললেন—‘এতে হয়?’

—‘কী জানি। হয় হয়তো!’ দিদির গলা রুদ্ধ হয়ে যাচ্ছে। ওষুধটা দিদিকে খাইয়ে দিয়ে তিনি বাইরে বেরিয়ে বউটিকে ডাকলেন—বললেন— ‘এখানে কোথায় কোন ডাক্তার বসেন আমি তো জানি না, একটু বলে দেবে কোনদিকে পাব?’

বউটি বলল— ‘আপনি বসেন, আমি ডাকছি। ফি-এর টাকা বত্রিশ, আগে না দিলে আসবে না।’

পকেট থেকে তাড়াতাড়ি বার করে দিলেন তিনি টাকাটা। বললেন— ‘অবস্থাটার কথা বলে ইঞ্জেকশন ওষুধ যা লাগে নিয়ে আসতে বোলো। আমি সঙ্গে সঙ্গে মিটিয়ে দেব।’

টাকা নিয়ে বউটি চলে গেল। একটা ক্যানসারের রোগী, মরণাধিক যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে। ডাক্তার আগে থেকে ফি না পেলে আসবে না? বিজু রায় অবাক হয়ে রইলেন। এঁরা তো এখানকার বহুদিনের বাসিন্দা! আদি বাসিন্দাদের মধ্যেই। জমিদারশ্রেণীরই ছিলেন বোধ হয়। এখন টাকা না থাকলেও সেই পুরনো মান-মর্যাদা! তারও কি কিছুই নেই? ডাক্তার! ডাক্তার! কত লাখ টাকার সরকারি খরচে একটা ডাক্তার হয়?

ডাক্তারটি যখন এল, বিজু রায় দেখলেন নেহাতই ছোকরা। চটপট পেথিডিন ইনজেকশান দিয়ে দিল। তিনি দামটা দিয়ে দিলেন। তারপরে বললেন— ‘শুনলাম, আপনি নাকি আগে থেকে ফি না পেলে আসেন না?’

—‘কে বললে?’ ডাক্তারটি চোখ তুলে বলল— ‘রত্না! ওকে জিজ্ঞেস করুন তো কত বার ইনজেকশন ওষুধ দিয়ে গেছি এ বাড়িতে, এক পয়সাও পাইনি।’

—‘পাননি কেন সেটা চারদিক দেখেই নিশ্চয় বুঝতে পারছেন। এক জনের কাছ থেকে ফিজ না পেলে আপনার বাড়িতে হাঁড়ি চড়বে না এমন অবস্থা নিশ্চয়ই আপনার নয়।’

—‘আপনি কে?’ ডাক্তারটি রাগত স্বরে বলল, ‘কী রাইট আছে আপনার এখানে ডেকে এনে আমাকে অপমান করবার? আমি যদি চিটেড হতে না চাই, সেটা আমার অপরাধ?’

—‘চিটেড? ডু য়ু নো ইয়াং ম্যান দ্যাট ইয়োর্স ইজ দা নোবলেস্ট প্রফেশন? জানো সরকার তোমার জন্যে কত টাকা খরচ করেছে? জানো ইউ আর ডিলিং উইথ হিউম্যান পেইন, সাফারিং! মানুষের অমানুষিক শারীরিক যন্ত্রণার সামনে দাঁড়িয়ে তুমি একটা ডাক্তার, চিটিঙের কথা মুখে আনতে পারছ?’

—‘ওহ্, রত্নার কাছে শুনলাম শমিতবাবুর বড়লোক মামা এসেছেন। বিজনেসম্যান। আমরা ডাক্তাররা অনেক পেইন, সাফারিং, ডেথ দেখতে দেখতে ইমিউন হয়ে গেছি, বুঝলেন? অ্যান্ড উই ডোন্ট কজ সাফারিং, ডোন্ট কজ পেইন। আর আপনারা? আপনাদের মতো অসাধু, কালোবাজারিদের জন্যে যে দেশটা ভিখিরিতে আর নবাবে দু ভাগ হয়ে গেল, তার বেলা? গরিবের মুখের অন্ন কেড়ে খান না? আপনাদের জন্যেই না গরিবি টিকে আছে! এই তো গরিব আত্মীয়, উপায় না দেখে চিটিংবাজি সুদ্ধু ধরেছে, কিছু করেছেন তাদের জন্যে? আবার বড় বড় কথা।’

হনহন করে বেরিয়ে গেল দুর্মুখ লোকটা। বিজু রায় অনুভব করলেন তিনি ঘামছেন। এভাবে তাঁর সঙ্গে ব্যবহার… না তিনি মনে করতে পারছেন না কেউ করেছে বলে। তাঁদের কথা কাটাকাটির মধ্যে রত্না বউটি বেরিয়ে এসেছিল। ঈষৎ উৎকন্ঠার গলায় বলল— ‘কী করলেন মামা, ও তো আর হাতে-পায়ে ধরলেও আসবে না।’

—‘ওর আসবার দরকার নেই। লেট হিম গো টু হেল।’ কোন মতে বলতে পারলেন বিজু রায়। একটা কালো হয়ে যাওয়া হাত পাখা আর এক গ্লাস জল নিয়ে এল রত্না। —‘আপনাকে খুব হয়রান দেখাচ্ছে, জলটা খেয়ে নিন।’ হাওয়া করতে লাগল সে। তারপর বলল— ‘বয়স হয়ে গেছে, একসাইটমেন্ট ভাল না। ও সবের মধ্যে যান কেন?’

‘আশ্চর্য, মেয়েটি ঠিকই বুঝতে পেরেছে তাঁর বয়স হয়েছে। অথচ নলিনী কর, তাঁর সমবয়সী লোকটি, সে বুঝতে পারিনি। যুবক-যুবতীরা ঠিকই বুঝতে পারে। খুব সম্ভব চোখের দিকে তাকিয়ে পারে। বড় কাঁসার গেলাসের জলে নিজের চোখের ছায়া দেখতে দেখতে ভাবলেন বিজু রায়। তিনি বললেন, ‘অমানুষিকতা, অন্যায় আমি সইতে পারি না।’ বলেই মনে হল— ‘সত্যি? পারি না কি?’ মেয়েটির ঠোঁটে একটা বাঁকা হাসি। বোধ হল সে-ও মনে-মনে এই কথাই বলছে। পারো না। পারো না। সইতে না পারা তো দূরের কথা। অন্যায় অমানুষিকতা তুমি নিজেই প্রশ্রয় দাও। নিজেই করো।

তিনি বললেন— ‘শাঁটুল কখনও আমার কাছে যায়নি কেন?’

‘কী ব্যাপারে?’

‘নিজের কাজ-কর্মের ব্যাপারে?’

কিছুক্ষণ চুপ করে রইল রত্না, তারপর বলল— ‘ও বলত স্নব, আমাদের দেখলে চিনতে পারে না। চিনতে চায়ও না, না খেয়ে মরব তবু ওই মামার কাছে কাঁদাকাটি করতে যাব না।… কিছু মনে করবেন না বললুম বলে।’

বিজু রায় অবাক হয়ে রইলেন। চিটিংবাজেরও তাহলে এইরকম আত্মসম্মান বোধ থাকে? না খেয়ে মরব, জেলে যাব, তবু স্নব মামার কাছে যাব না! এ কী মুখ তাঁর। কী ভয়ঙ্কর বীভৎস হাস্যকর মুখ আয়নায়। একেক মানুষের কাছে কি তাঁর একেক রকম মুখ?

তিনি উঠে দাঁড়ালেন। রত্না বলল—‘চলে যাচ্ছেন! রাগ করলেন?’ তার গলায় দারুণ উৎকণ্ঠা।

বিজু বললেন, একটু হেসে বললেন— ‘ভয় নেই। আমার দিদির ভার বইতে তোমাকে আটকে রাখব না। এখুনি ওঁকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে। তার ব্যবস্থা করছি।’

রত্নার মুখটা কালো হয়ে গিয়েছিল। সেদিকে তাকিয়ে বিজু বললেন —‘শাঁটুল তো অনেক দিন নেই। আসবার সম্ভাবনাও নেই। চলছে কী করে? তুমি এই টাকাটা রাখো।’ তিনি পার্স থেকে হাজার খানেক টাকা বার করতে লাগলেন।

রত্না মেয়েটি হঠাৎ তীব্র গলায় বলল—‘আপনার অনেক পয়সা-টাকা আছে, না? লোকের মুখের উপর ছুঁড়ে মারতে পছন্দ করেন! জানেন আমি আমার গয়না বিকিয়ে সংসার চালিয়েছি, শাসের ইলাজ করিয়েছি।’

বিজু রায় শান্ত গলায় বললেন— ‘খুব ভাল করেছ। মানুষের কাজই করেছ। কিন্তু ও ভাবে গুরুজনদের সঙ্গে কথা বোলো না। আমাদের ছোটতে বাবা-টাবা আমাদের ওপর অন্যায় করছেন জানলেও আমরা কিছু বলতাম না, কেন জানো? স্রেফ গুরুজন বলে। বিদ্রোহ ভাল। মুখের ওপর উচিত কথা শুনিয়ে দেওয়াও ভাল। কিন্তু জায়গা বুঝে, মানুষ বুঝে। আমি টাকা তোমার মুখের ওপর ছুঁড়ে মারছি না। হাতে দিচ্ছি। তোমার দরকার বলে। আর আমি মামা বলে।’

রত্না কেঁদে ফেলল। সম্ভবত এই কান্নাটা তার অনেকদিন ধরে জমা ছিল। সে টাকাটা হাতে নিয়ে রান্নাঘরের মধ্যে ঢুকে গেল। দিদি ঘুমোচ্ছ। বিজু রায় বেরিয়ে এলেন।

নিজের চেনা ডাক্তারদের কাছে যেতে পারছেন না। চেনাশোনা প্রভাবশালী লোকদের রেফারেন্স দিতে পারছেন না। শুধু টাকাটা আছে। বিজু রায় ব্যাঙ্কে গিয়েছিলেন টাকা তুলে এনেছেন। আরও আনবেন দরকার হলে। ব্যবস্থা করেছেন। একজন সম্পূর্ণ আনকোরা, পরিচিতিহীন নাগরিক হিসেবে বিজু রায় কোথাও কোনও সুযোগ পেলেন না। ডাক্তার, যিনি ভর্তি করাবেন হাসপাতালে, আগে নিজে দেখে রায় দেবেন তার পরে ভর্তির কথা। দিদির কোনও মেডিক্যাল রিপোর্ট টিপোর্টও নেই। স্রেফ আন্দাজের ওপর ডায়াগনোসিস। কিন্তু কোনও ডাক্তারই এখান থেকে সুখচরে গিয়ে রোগী দেখে আসতে পারবেন না। পুরোটা রাস্তা গাড়িতে নিয়ে যাওয়া আসা করলেও না। অবশেষে রাত্রি নটা নাগাদ নিজের জেদ ছেড়ে বিজু রায় চলে গেলেন ডক্টর পি. চ্যাটার্জির কাছে। প্রচুর রোগী অপেক্ষা করছে। কলকাতার সেরাদের মধ্যে একজন মেডিসিনে। নিজের একটা কার্ড পাঠিয়ে দিলেন বিজু রায়। সমুদ্র দুভাগ হয়ে গেল মন্ত্রবলে, মাঝখান দিয়ে এক ত্রাণকর্তা বি.বি. রায় আরেক ত্রাণকর্তা পি. চ্যাটার্জির কাছে চলে গেলেন।

ধৈর্য ধরে সব শুনলেন ডক্টর চ্যাটার্জি। কোনও প্রেসক্রিপশন, ডায়াগনোসিস, প্যাথলজিক্যাল রিপোর্ট, বায়পসি কিছু নেই। বললেন— ফোন করে দিচ্ছি, আমার নার্সিং হোমের অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে চলে যান, নিয়ে আসুন, এখুনি ভর্তি করে নিচ্ছি। তারপর দেখছি কী করা যায়।

রাত্তির সাড়ে এগারটার পরে দিদিকে ভর্তি করে, রত্নাকে তার বাপের বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে আহিরিটোলায় ফিরলেন বিজু রায়। সর্বক্ষণ গামছা পরে থাকা সেই হরিহর নামে লোকটি দরজা খুলে দিল। হা-ক্লান্ত বিজু রায় তিনতলায় চিলেকোঠায় উঠে দেখলেন নলিনী কর পেশেন্স খেলছেন। — ‘এই যে, এসো। বিজনভায়া। আমি গেস করতে পেরেছিলুম দেরি হবে। শেষ পর্যন্ত কি পুলিশেই গেলে?’

‘না, আপনাকে তো বলেইছি এ পুলিশের ব্যাপার নয়।’

‘ওঃ হে, ভুলে গিয়েছিলুম এ সেই অনে-ক কালের হারানো একজন। না? বুঝি, বুঝি বিজনভায়া, বুঝি সবই! ইন্টারফেয়ার করতে চাই না, তাই…বুঝলে না?’

শীতের রাতে বিজন বালতি বালতি জল ঢেলে চান করলেন। হরিহর রুটি বেগুনভাজা আর আলু-কপির তরকারি গরম করে নিয়ে এল। বিজন বললেন— ‘এ সবের দরকার ছিল না। খেতে ইচ্ছে করছে না।’

নলিনী কর বললেন— ‘ভাগ্য হল চোরের মতন, বা বলতে পারো জোচ্চোর। তো সেই চোর-জোচ্চরের ওপর রাগ করে মুখের খাবার কেউ ফেরায়? ফিরিয়ো না ভায়া, বড় দাদা বলছি, খেয়ে নাও, তারপরে ওষুধ দেব। গায়ের ব্যথা মরবে।’

বিজন দেখলেন হঠাৎ তাঁর পেটের মধ্যে থেকে দারুণ খিদে চাড়া দিয়ে উঠছে। তিনি রুটি বেগুন ভাজা নিয়ে বসে গেলেন।

নলিনী কর বললেন— ‘আলু কপির ডালনা থেকে আলুগুলো বাদ দিয়ে খাও ভায়া। একদিনে বড্ড অত্যেচার হয়ে যাবে নইলে।’ তিনি চৌকির তলা থেকে একটা ট্রাঙ্ক বার করলেন টেনে। তার ভেতর থেকে একটা লম্বা গোল বোতল বার হল। বিদেশি হুইস্কি। বললেন- ‘চলে না বললে শুনব না ভায়া, একটু খাও, ক্লান্তি দূর হবে, গায়ের ব্যথা মরবে, ভাল ঘুম হবে।’

নিজের তক্তাপোশটিতে তিনি নতুন চাদর পাতলেন। বালিশের ওয়াড় বদলালেন। ট্রাঙ্ক থেকে একটি বিলিতি রাগ বার করলেন। বললেন— ‘দেখলেই বোঝা যায় ভায়া শৌখিন মানুষ। চোখের সামনেই সব বদলে দিলুম। এবার আরাম করে শুয়ে পড়ো।’

—‘আপনি?’

—‘আমি এই ক্যাম্প খাটে! দুদিনের তো ব্যাপার।’

তো সেই নলিনী করই এখন খাটিয়াতে ফুলের মালা ইত্যাদিতে শোভিত হয়ে শুয়ে আছেন। মেস-বন্ধুরা ট্রাঙ্ক থেকে তাঁর চুনোট করা ধুতি, গিলে করা পাঞ্জাবি বার করে পরিয়ে দিয়েছে।

বিজন কদিন দিদির জন্য নির্দম ছোটাছুটি করছেন। ডাক্তার বলছে অপারেশন করার ঝুঁকি আছে। আবার করলে ভালও হতে পারে। অপারেশনের তারিখ পড়েছে দুদিন পর। দিদিকে ফলের রস খাইয়ে, কিছুক্ষণ গল্প করে, ওষুধপত্র সব কিনে দিয়ে, রত্নাকে আবার পৌঁছে দিতে হল। সে নার্সিং হোমে এসে বসে আছে। বলল, একাই চলে যেতে পারবে। কিন্তু বিজু তা দিতে পারেন না। তিনি তাকে বাপের বাড়ির গলি অব্দি পৌঁছে দিলেন। যাবার সময়ে মুখ নিচু করে বলল— ‘কাল গুড্ডুকে নিয়ে যাব মামা? খুব দাদি-দাদি করছে। ওঁর হাতেই তো মানুষ।’

‘এনো’—বিজন বললেন।

তারপর ফিরে দেখলেন এই ব্যাপার। এঁরা সবাই তাঁর জন্য অপেক্ষা করছেন। নলিনীকান্তর ট্রাঙ্ক-বাক্স হাঁটকে নাকি কোনও ঠিকানাই পাওয়া যায়নি। মণিময় বলল—‘আপনি ওর অনেকদিনের বন্ধু, আপনিই মুখে আগুনটা দিন, বামুনও বটেন।’

বিজন হেসে বললেন—‘কে বলল আমি ওঁর অনেকদিনের বন্ধু? যেদিন ওঁর সঙ্গে এলাম তার আগে চিনতাম না পর্যন্ত।’

চাঁদু, যে মাসকাবারি বাজার করে সে বলল—‘বলেন কী?’ একটু পরে বলল—‘নলিনীদার কারবারই আলাদা। আপনার হাত থেকে আগুনটা নেবেন বলেই বোধহয়…আগুনটা আপনারই হাতে মাপা ছিল।’

আহিরিটোলার মেসবাড়ির চিলেকুঠুরির ভাড়ার উত্তরাধিকার বিজু রায়ই পেলেন। ট্রাঙ্ক-বাক্স হাতড়ে যা টাকাপয়সা পাওয়া গেল তাতে কোনওমতে মেসের পাওনা চুকল। সবাই চাঁদা করে শেষ কাজের টাকাটা তুলল, গঙ্গার ঘাটেই কাজটা হবে ঠিক হয়ে গেল। বিজুকেই করতে হবে। কেউ শুনল না। তিনিই নাকি নলিনী করের একমাত্র ওয়ারিস।


শুক্তি মেয়েটি ছোটখাটো, রোগা, রং-ও ময়লা, কিন্তু মুখটা ভীষণ মিষ্টি। খুব বুদ্ধিযুক্তও বটে। সে শার্ট-প্যান্ট ছাড়া পরে না। গরমকালে শর্টস। এই শুক্তি তার নিজের মহলে যাকে বলে ক্রেজ। শুক্তির এম. এ. ফাইন্যাল ইয়ার। কিন্তু সে ইতিমধ্যেই অন্য অনেক কিছু করছে ও করেছে। যেমন টুথপেস্টের বিজ্ঞাপনে মডেলিং। স্টেটসম্যানের ‘নাউ অ্যান্ড এগেইন’ কলামে লেখা। বস্তির বাচ্চাদের নিয়ে নাইট স্কুল। আনন্দবাজারেও দু-একবার আর্টিকল লিখেছে। তার বন্ধুরা তাকে জিজ্ঞেস করে থাকে সে ওইসব হাই-ব্রাও কাগজে অ্যাট অল পাত্তা পেল কী করে! কনসিটেড পিপল, ওরা তো ঢোকবার পথেই পাবলিককে আটকে দেয়।

এসব প্রশ্নের উত্তর দেওয়া শুক্তি তার সম্মানের পক্ষে হানিকর বলে মনে করে। সে মুখের ওপর একটা মৃদু তাচ্ছিল্যের ভাব ফুটিয়ে ডান হাত দিয়ে ক্রমাগত সামনে ঝুঁকে-আসা চুলগুলোকে পেছনে ঠেলে দেয়। শুক্তির মধ্যে দুটো জিনিস খুব শক্তিশালী। এক, সে যা করতে চায় তা করেই ছাড়ে। ভীষণ জিদ্দি, তার মা বলে থাকেন তাকে বাধা দিয়ে কিছু লাভ হয় না এমত সময়ে। একটি সাময়িক পত্রিকায় সে একবার খিদিরপুরের ফ্যান্সি মার্কেট সম্পর্কে একটা আর্টিকল লিখেছিল। সম্পাদকের নামেই সে সেটা পোস্ট করে দেয়। খুবই স্পর্শকাতর অথচ কৌতূহলপ্রদ বিষয় বলে সম্পাদক তাকে ডেকে পাঠান, এবং তার চেহারা ও বয়স দেখেশুনে হাঁ হয়ে যান। বেশ কিছুটা সম্পাদনা করে, তেমন তেমন ফটো বাদ দিয়ে লেখাটা ছাপা হয়েছিল। কিন্তু শুক্তি এই সম্পাদনায় অত্যন্ত আহত অপমানিত বোধ করে। সে সম্পাদকের ঘরে গিয়ে বেশ ভালই ঝগড়া করে আসে। যেমন সে বলে—‘আপনি আমার কাছ থেকে আরও কৌতূহলপ্রদ বিষয়ে লেখা পেতে পারতেন, কিন্তু পাবেন না। এবং একজন বিকচমান সংবাদদাতাকে আপনি হত্যা করলেন।’ শুক্তি যখন বাংলা বলে ইংরিজি ব্যবহার করে না এবং শুদ্ধ পরিষ্কার বাংলা বলার চেষ্টা করে। যাই হোক তার ক্রোধ দেখে সম্পাদক মুচকি হেসে তাকে চা খাওয়ালে সেটা সে খেয়ে নিয়েছিল। শুক্তির দ্বিতীয় ব্যাপার তার পতিতোদ্ধারিণী গঙ্গে রূপ। পতিত-পতিতা সে যেমনভাবেই যে অর্থেই হোক, তাকে সে রেহাই দেয় না। এটাতেই সবচেয়ে গণ্ডগোল বাধে। যেমন ড্রাগ বিক্রেতা এক পান-সিগারেটওয়ালাকে ধরে ফেলতে পেরে সে নিত্য সেখানে পান খেতে এবং সিগারেট পিতে যেতে আরম্ভ করে। ফাঁকে ফাঁকে তার ধর্মোপদেশও চালায়। ফলে পানওয়ালা ঠিক জায়গায় খবর পৌঁছে দেয় এবং সে উত্তম-মধ্যম ধোলাই খায় এক সন্ধেবেলা বাড়ি ফেরবার পথে। শুক্তির চরিত্রে প্রতিহিংসা নেই। তাই তার আতঙ্কিত বাবা-মা পুলিশে এফ আই আর ইত্যাদি করলেও সে এ ব্যাপারটাতে আর কোনও কৌতুহল দেখায় না। না হলে কী হত বলা যায় না। মার খাওয়ার পর তখনও ঘা শুকোয়নি, কপালে ব্যান্ডেজ, হাতে পায়ে নানা জায়গায় স্টিকিং প্লাস্টার…এই অবস্থায় সে সেই পানওয়ালার কাছে যায়। কোমরে দু হাত রেখে পান এবং সিগারেট চায়। দুটোই কেনবার পর সেগুলো সজোরে মাটিতে ফেলে পিষে দেয় পা দিয়ে তারপরে পানওয়ালাকে ডেকে ডেকে যথেষ্ট ঘৃণা সহকারে নিজের ক্ষতচিহ্নগুলো দেখাতে থাকে। বলে—‘দেখো ইয়ে তুমহারী জওয়ানী কী রোশনি, ঔর ইয়ে সব তুমহারী মর্দানগী কী নিশানী।’ তারপর ধীর পদক্ষেপে এমনভাবে চলে আসে যে পানওয়ালার বোধে আসে যে এই মেয়েটিকে ঠেঙিয়ে ঠেকানো যাবে না।

সংস্কারক শুক্তির সাম্প্রতিকতম লক্ষ্য হল নীলাদ্রি ওরফে চিন্টু। সংস্কারক শুক্তির করুণা আকর্ষণ করার জন্যে অবশ্য তার অনেক বন্ধুই এক পায়ে খাড়া। এ নিয়ে তাদের নিজেদের মধ্যে ফাটাফাটিও হয়ে যায়। ষড়যন্ত্রও হয়। যেমন বন্ধুমহলে রটে গেল সোহন তার গার্লফ্রেন্ড তাকে ডিচ করবার পর ভীষণ ডিপ্রেশনে ভুগছে। শুক্তির ছোট ছোট কান দুটো খাড়া। কিন্তু সে কিছু বলছে না। —‘শুক্তি জানিস, সোহনটা বোধহয় পাগলই হয়ে যাবে!’ দীর্ঘশ্বাস।

দু-তিন দিন পরে শুক্তি ঠিক সোহনের ঘরে পৌঁছে গেছে। সোহনের একমুখ দাড়ি। পরনে ময়লা পাজামা, একটা অনুরূপ ফতুয়া। সে যেন শুক্তিকে লক্ষই করেনি এমনি ভাব। শুক্তি তার সামনে গিয়ে নিজে একটা সিগারেট ধরাল, সোহনকেও একটা দিল। সোহন আস্তে মাথা নেড়ে মুখ ফিরিয়ে রইল। শুক্তি তখন সোহনকে পুলকিত করে তার কোলের ওপর বসে পড়বে এবং তার ময়লা ফতুয়া ছিঁড়ে ফেলতে থাকবে।

—‘এই শুক্তি কী হচ্ছে, কী হচ্ছে, এই এই ছাড় বলছি।’

কিন্তু এর ক’দিন পরে যখন শুক্তি সোহনকে নিয়ে তাদের আড্ডায় যাবে এবং সোহন উজ্জ্বল মুখে একহাতে চায়ের কাপ আর এক হাতে শুক্তির কাঁধ জড়িয়ে ধরে—‘শুক, লেটস লীভ দিস স্টিংকিং জয়েন্ট’ বলবে তখন সোহনেরই পরম বন্ধু এবং ষড়যন্ত্রে অংশগ্রহণকারী পারভেজ হঠাৎ লাফিয়ে উঠে কোথা থেকে একটা পেনসিল কাটা ছুরি আস্ফালন করে বলবে—‘দাস ফার, সোহন, নো ফার্দার।’ এর পর স্বভাবতই পারভেজে-সোহনে একটা বিরাট ঝটাপটি লাগবে। অন্য বন্ধুরা দু ভাগে ভাগ হয়ে যাবে এবং মোরগা-লড়াইয়ের মতো দুজনকে উত্তেজিত করতে থাকবে। এই সময়ে সকলের অলক্ষ্যে শুক্তি বেরিয়ে আসবে। তার মুখের ভাব শান্ত, ধীর, উজ্জ্বল। সে সোহনকে, প্রাণচঞ্চল, মজাদার ছেলে সোহনকে লড়াইক্ষম করে দিতে পেরেছে। তার কাজ ফুরিয়েছে। সে সফল। এই ধরনের একটা তৃপ্তি নিয়ে সে ফেরে।

নীলাদ্রির মুশকিল হল সে কোনও কিছুতেই মন বেশিদিন বসাতে পারে না। শুক্তিও খেয়ালি। কিন্তু সে যেটা করে সেটা খুব সুন্দরভাবে করে। নীলাদ্রি কিছুই করতে পারে না। এম এ পড়ছিল, পরীক্ষা দিল না। ফ্রেঞ্চ ক্লাসে ভর্তি হয়েছে, কিন্তু জে সুই নীলাদ্রি, ভু জেৎ মঁসিয় বানার্জি আর এলে মাদমোয়াজেল শুক্তি পর্যন্ত শিখে আর এগোতে চাইছে না। তার দিক্‌তে অর্থাৎ ডিকটেশন থেকে রাশি রাশি ভুল বার হচ্ছে, মঁসিয় বানার্জি ধৈর্য রাখতে পারছেন না। এমনকি নীলাদ্রি যে শুধু সুন্দর সুন্দর মেয়েদের দেখবার জন্যেই আলিয়াঁস ফ্রাঁসেতে এসে জুটেছে এ কথা তিনি প্রকাশ্য ক্লাসেই বলেছেন।

‘অব্যবস্থিতচিত্ততা!’ শুক্তি দাঁতের তলায় চেপে নিজের মনে বলেছে। এর যা লক্ষণ দেখা যাচ্ছে, একে সাহায্য না করলে শেষ পর্যন্ত সাট্টাবাজ, ড্রাগ-পেড্‌লার, খুনি যা খুশি হয়ে যেতে পারে।

ডেনিমের একটা মিডি স্কার্ট আর বাসন্তী রঙের পুলোভার পরে অতএব শুক্তি নীলাদ্রির বাড়ির সিঁড়ি টপকে টপকে উঠছে। তার কাঁধে একটা খাদির ব্যাগ। নীলাদ্রিদের বাড়ি সব সময়ে ফাঁকা। বাবা থাকেন না, মা থাকেন না, বোন আছে একটা, তার চেহারা পর্যন্ত কখনও দেখেনি শুক্তি। দূরে দূরে কিছু লোকজন ঘুরে বেড়ায়। তাদের রকম-সকম পিংপং বলের মতো। শুট্‌ করে কোথায় ছিটকে সরে যাবে আবার শুট করে কখন নেটের ঠিক পাশটিতে এসে ড্রপ খাবে বলা যায় না। এইরকম নির্জন শীতালো দুপুরে শুক্তি নীলাদ্রির ঘরের দরজার পর্দা সরিয়ে নিঃশব্দে এসে দাঁড়িয়েছে।

নীলাদ্রি তিন-চারটে বালিশ মাথায় দিয়ে বিছানায় আধশোয়া। হাতে একটা ছোট্ট অ্যালবাম মতন। অখণ্ড মনোযোগে দেখছে। শুক্তি এসেছে, ঘরে ঢুকেছে, এবং নিঃশব্দে তার মাথার পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে সে কিছুই বুঝতে পারেনি। শুক্তি বিদ্যুদ্বেগে অ্যালবামটা ছিনিয়ে নিল। চমকে বিছানার ওপর লাফিয়ে উঠল চিন্টু।

‘এই, এই দে দে, প্লীজ দে শুক্তি।’

মন দিয়ে অ্যালবামের ছবিগুলো দেখতে দেখতে শুক্তি বলল—‘ওহ্‌ নীল তুই তাহলে একটা বুড়ো ভাম! আউটওয়ার্ডলি ইয়াং, ইনওয়ার্ডলি রটন।’

—চিন্টু বলল, ‘এই শুক্তি ধ্যাত, ওগুলো দে।’

—‘কোথায় পেলি এগুলো?’

—‘মেট্রোর পাশের গলিটায় একজন সেল করছিল। জাস্ট আউট অফ কিউরিয়সিটি! নাথিং সিরিয়াস! এই শুক্তি প্লীজ!’

শুক্তি ততক্ষণে পুরো ঘরটায় চক্কর দিচ্ছে আর সব জিনিসপত্র উল্টে-পাল্টে দেখছে। চিন্টু তার পেছন পেছন ভিক্ষুকের মতো হাত বাড়িয়ে আসছে আর ক্রমাগত বলে যাচ্ছে, ‘শুক্তি প্লীজ!’

শুক্তি বলল—‘তাই ভাবি, একটা যুবক ড্রাগ খায় না, অতিরিক্ত মদ্যপান করে না, প্রেমে পড়ে না অথচ হয় ফেল করছে আর নয়ত ড্রপ। পরীক্ষা দিচ্ছে না। গোপন কথাটা তা হলে এই!’ বলে সে আবার ঝটিকাবেগে একটা ক্যাসেট তুলে নিয়ে ভি. সি. পি-তে চাপিয়ে দিল। কিছুক্ষণের মধ্যেই দুটি প্রায় উলঙ্গ নর-নারী টি ভি-র পর্দায় ওলটপালট খেতে লাগল। শুক্তি দেখছে খুব কৌতূহল নিয়ে। চিন্টু মাথাটা দু হাতে ধরে বসে পড়েছে একটা চেয়ারে। কিছুক্ষণ পর টি ভি-র সুইচ অফ করে দিয়ে শুক্তি ক্যাসেটটা বার করে নিল, তার পরে অ্যালবামটা তুলে ধরে বলল, ‘এগজিবিট নম্বর এক, তারপর ক্যাসেটটা লুফতে লুফতে বলল—এগজিবিট নম্বর দুই। নীলাদ্রি রায়ের বিচার হবে।’

চিন্টু মুখ তুলছে না।

শুক্তি বলল—‘এগুলো কারা দেখে জানিস? বুড়ো ভামরা, আর গেরুয়ারি স্বামীজী জাতীয় লোকেরা। তোর মতো একটা অল্পবয়সী ছেলের মধ্যে সেক্স প্রকাশ পাবে প্রেমের মধ্যে দিয়ে, আর যদি খুব ওভারসেক্সড হোস তো জাস্ট হ্যাভ হেলথি সেক্স উইথ সামবডি উইলিং! তাই বলে নীল ছবি দেখবি বাড়ি বসে বসে? এসপ্লানেড থেকে উলঙ্গ মেয়ের ছবি এনে দেখবি? রিয়্যালি…।’ শুক্তি পর্দা সরিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এল। পেছনে পেছনে চিন্টু চেঁচাচ্ছে ‘শুক্তি! এই শুক্তি। প্লীজ।’

দু-চারটে করে সিঁড়ি টপকাতে টপকাতে শুক্তি তার ঝোলা নিয়ে নীচে নেমে গেল। চিন্টু হতাশ হয়ে সিঁড়ির মাথায় দাঁড়িয়ে রইল। তার এখনও আশা শুক্তি দয়া করে জিনিসগুলো তাকে দিয়ে যাবে। এদিকে শুক্তি বেরিয়ে যাবার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই নীচে গাড়ি এসে দাঁড়াল। চিন্টু দেখল তার মা নামছে। সাদার ওপর লাল ছোপ ছোপ একটা সিল্কের শাড়ি। কপালে ধ্যাবড়ানো তেল-সিঁদুরের ফোঁটা। গলায় একটা জবাফুলের মালা। হাতে বেতের ছোট চ্যাঙারি। দৃশ্যটা এত অবাস্তব যে চিন্টু হাঁ করে তাকিয়ে রইল। তার মা তনুশ্রী রায় উঠে আসছে সিঁড়ি দিয়ে, গলায় জবাফুলের মালা। মাথাতেও সিঁদুর মাখামাখি। সে বেরিয়ে এসে অবাক হয়ে বলল—‘এ কি? মাম্মি? কোথায় গিয়েছিলে?’

তনুশ্রী জবাব না দিয়ে নিজের ঘরের দিকে চলে যেতে লাগলেন তাড়াতাড়ি। সমস্ত ব্যাপারটাই চিন্টুর কেমন অস্বাভাবিক লাগল। সে মায়ের পেছন-পেছন যেতে যেতে আবার জিজ্ঞেস করল—‘কোথায় গিয়েছিলে? মাম্মি?’

তনুশ্রী এবার কেমন নিস্তেজ গলায় বললেন—‘ঠাকুরবাড়ি।’

তখন চিন্টুর মনে পড়ল আজ তিন-চার দিন হয়ে গেল বস বাড়ি নেই। কোথাও থেকেই কোনও খবরও পাওয়া যায়নি।

সে বলল ‘ওসব ঠাকুর-ফাকুর কী হবে? অল বোগাস। আমি বুঝতে পারছি না তুমি এখনও পুলিশে খবর দিচ্ছ না কেন? তিনদিন হয়ে গেল চারদিন চলছে। ব্যাপারটা বিপজ্জনক হয়ে যাচ্ছে।’

তনুশ্রী তার কথার জবাব না দিয়ে নিজের ঘরে ঢুকে গেলেন। দরজাটা বন্ধ করে দিলেন। চিন্টু কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাঁধ দুটো শ্রাগ করে ফিরে এল।

ঘরে এসে সে চটপট তার ঝোল্লা জিনস আর টি শার্ট পরে তৈরি হতে লাগল। আসলে এখন এম.এ. পরীক্ষা চলছে। তার দেওয়ার কথা ছিল, সে বসছে না। তার য়ুনিভার্সিটির বন্ধুরা সকলেই পরীক্ষা দিচ্ছে। অন্যান্য বন্ধুরাও যে যার কাজে ব্যস্ত। দুপুরবেলায় শুধু শুধু ঘরে বসে কেউ নেই। ধুস্‌। বাড়িতে ভাল লাগছে না। মায়ের যে রকম মুড তাতে ঘরে মিউজিক-টিক চালানোও বোধহয় ঠিক হবে না। কোথাও থেকে ঘুরে আসা যাক।

সিঁড়ির মাথায় এসে পৌঁছেছে। এমন সময়ে তনুশ্রীর ঘরের দরজা খুলে গেল। তনুশ্রী বললেন—‘পুলিশে যাচ্ছ নাকি, চিন্টু! খবর্দার থানায় যাবে না কিন্তু।’

—‘বাট হোয়াই?’ চিন্টু ফিরে দাঁড়াল।

—‘সে তুমি বুঝবে না। ইউ নো নাথিং।’

হঠাৎ চিন্টুর শিরদাঁড়ার মধ্যে দিয়ে একটা হিম স্রোত নেমে গেল। মা কি বাবাকে খুন-টুন করেছে নাকি? লাশটা লুকিয়ে রেখেছে! কী অদ্ভুত ব্যবহার করছে! সে এগিয়ে এসে মায়ের মুখোমুখি দাঁড়াল— বলল— ‘অল রাইট। জানি না। কী জানি না? যা নাকি তুমি জানো!’

তনুশ্রী কাঁপা-কাঁপা গলায় বললেন—‘বিজনেসের ব্যাপার। কোথায় কী করে রেখেছে কে জানে, কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে যদি সাপ বেরোয়!’

—‘এই তো সেদিন তুমি বলছিলেন বাবা কাঁচা কাজ করে না।’

তনুশ্রী ভয়ার্ত দৃষ্টিতে ছেলের দিকে তাকিয়ে রইলেন, কিছু বলতে পারলেন না।

—‘কিছু লুকোচ্ছ আমার কাছে। ডেফিনিট। কী লুকোচ্ছ বলো তো?’ চিন্টু কড়া গলায় জিজ্ঞেস করল।

—‘ঠিক আছে। যাও, তোমার যদি ইচ্ছে হয় থানায় যেতে পারো। কিন্তু ফল ভোগ করতে হবে তোমাকেই। যাও, ঠিক আছে যাও।’ কেমন অসংলগ্ন ভাবে কথাগুলো চেঁচিয়ে বলে তনুশ্রী আবার দরজা বন্ধ করে দিলেন।

গারাজের কাছে বাগানে একটা ঢিপির ওপর সমর বসেছিল, চিন্টুকে আসতে দেখে উঠে দাঁড়াল। বলল—‘দাদা, সাহেবের কোনও খবর পাওয়া গেল?’

চিন্টু বলল— ‘বাবা হঠাৎ একটা এস.টি.ডি পেয়ে পাটনা গেছে।’

—‘পাটনা?’ সমর অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে।

—‘সাহেব কি ফোন-টোন করেছিলেন?’

—‘না হলে আর জানছি কোথা থেকে?’ রুক্ষ গলায় বলল চিন্টু।

—‘বিশ্বাসবাবু বড্ড ব্যস্ত হচ্ছেন। ওঁকে তো কেউ জানায়নি, তাহলে বলে আসব খবরটা?’

—‘বলতে পারো। তবে ড্যাড দু-চার দিনের মধ্যেই এসে যাচ্ছে।’

সমর ড্যাবড্যাব করে চিন্টুর দিকে তাকিয়ে রইল। সে একটা কথাও বিশ্বাস করেনি। সে সাহেবকে চেনে কিন্তু তাঁর এই ছেলে-মেয়েদের একেবারেই চেনে না। এরা তার কাছে বিলেত-আমেরিকার মানুষ। কিন্তু শুধু-শুধু মিথ্যে কথাটা কেন বলল সাহেবের ছেলে সেইটা তার মাথায় কিছুতেই এল না। চিন্টু তার পাশ দিয়ে গাড়িটা নিয়ে বোঁ করে বেরিয়ে গেল। শীতের হাওয়ায় তার চুল উড়ছে। চোখে সানগ্লাস, তলায় চোখের ভাব কিছুই পড়া যায় না।

মায়ের সঙ্গে থানা-পুলিশের কথা হলেও চিন্টু কিন্তু আদৌ সে দিকে গেল না। এই সিদ্ধান্ত নিতে হলে মায়ের সমর্থন চাই। তার জীবনের বৃত্তের মধ্যে থানা-পুলিশ এসব গুরুত্বপূর্ণ এবং জটিল ব্যাপার পড়ে না। সে বাইরে শিস দিতে দিতে গাড়ি চালালেও ভেতরে-ভেতরে এসব ভয় পায়। প্রথমটা কোথায় যাবে সে ঠিক করতে পারেনি, তার পরে ভেবে-চিন্তে সোহনের বাড়ির দিকে গাড়ি চালাল। সোহন ফটোগ্রাফার, তাকে এ সময়ে তার ডার্করুমে পাওয়া গেলেও যেতে পারে। বেথুন কলেজের পেছন দিকের গলিতে থাকে সোহন। একটা বিরাট পোড়ো বাড়ির একতলায়। বিডন স্ট্রিটে ঠিক বেথুন কলেজের গেটের দিকে মুখ করে সে বেশ কিছুক্ষণ গাড়ি থামিয়ে বসে রইল। তেমন কেউ যদি বেরোয়। কিন্তু কিছুক্ষণ পর তার হঠাৎ শুক্তির সমস্ত কথাগুলো মনে পড়ে গেল। সে বলল— ‘ধুস, মুডটাই দিলে নষ্ট করে।’ তারপর সোহনের বাড়ি গিয়ে হাজির হল।

এ বাড়ি কলকাতার আদি ধনীবাড়ির একটা। শরিকে শরিকে ভাগ হয়ে গেছে। অনেকে এ বাড়ি থেকে চলেও গেছে। একতলার বাঁ দিকে বিরাট একটা লাইব্রেরি। ঠাসা আইনের বই এবং বাঁধানো জার্নাল। এটাতে বসেন সোহনের কোনও কাকা-টাকা। ডান দিকে দু খানা ঘর। প্রথমটাতে সোহন বসে, আড্ডা মারে। ঘরটা ভর্তি তার তোলা নানা ফটোর প্রিন্টে। কিছু বাঁধানো, কিছু সুদ্ধ বোর্ডের ওপর পিন দিয়ে আটকানো। ভেতর দিকটায় সোহনের ডার্করুম। দরজায় টোকা দিয়ে চিন্টু চেঁচিয়ে বলল— ‘সোহন, কাম আউট ম্যান।’

—‘কে দুপুরবেলা চিল্লাচিল্লি করছিস! উল্লুক কাঁহাকা!’

চিন্টু গলা ছেড়ে বলল— ‘কুইক’।

ডার্করুমটার ভেতর থেকে সাবধানে শুক্তি বেরিয়ে এল। চিন্টু তাকে দেখে ঘাবড়ে গিয়ে ঢোক গিলল। তারপর বাঁকা হাসি হেসে বলল— ‘মাদ্‌মোয়াজেল কি ডার্করুমে লাল ছবি দেখছিলেন?’

শুক্তি গম্ভীরভাবে কেটে কেটে বলল—‘একজিবিটগুলো এখনও পীপলস কোর্টে পেশ করিনি।’ এই সময়ে সোহনও বেরিয়ে এল, বলল— ‘এই শালা, চাঁচাইছিলি ক্যানে?

চিন্টু বলল— ‘না মানে, আমি ঠিক তাদের ডিসটার্ব করতে চাইনি। আই কোয়াইট আন্ডারস্ট্যান্ড। পারভেজ মে গেট ম্যাড। বাট আই আন্ডারস্ট্যানড।’

শুক্তি ঝোলার ভেতর থেকে অ্যালবামটা বার করে চট করে সোহনের দিকে ছুঁড়ে দিল, বলল ‘পেশ করলুম, এগজিবিট এ।’ জিনিসটা ছিনিয়ে নিতে চেষ্টা করেছিল চিন্টু কিন্তু সোহন তার থেকে অনেক ক্ষিপ্র। সে একেবারে সোজা ক্যাচ লুফে নিয়ে অ্যালবামটা খুলেই বলল— ‘হা! দিস ইজ সামথিং। কার কাছে তোলালি রে শুক্তি! আমি তো মনে করতে পারছি না তুলেছিলুম বলে।’

চিন্টু টেবিল চাপড়ে বলল— ‘হিয়ার হিয়ার!’

শুক্তি রাগে কথা বলতে পারছিল না, ফুঁসতে ফুঁসতে শুধু বলতে পারল— ‘ইউ মীন থিংস!’ সে বেরিয়ে যাচ্ছিল, সোহন লম্বা হাত বাড়িয়ে, তার চুলের ঝুঁটিটা খপ করে ধরে ফেলে বলল— ‘আরে রাগ করিস কেন?’

চিন্টুর হঠাৎ তার সমস্যাটার কথা মনে পড়ে গেল। সে বলল— ‘শুক্তি তুই তো নিজের আই.কিউ নিয়ে খুব বোস্ট করিস। আমার একটা প্রবলেম সল্‌ভ্‌ করে দিতে পারবি?’

—‘তোর প্রবলেম? তুই তো বিরাট একটা নিজেই প্রবলেম, আশিরনখদন্তহস্তপদ।

—‘কী কী বললি? বিরাট একটা গালাগাল দিলি মনে হচ্ছে?’

শুক্তি বাঁকা হাসি হেসে বলল— ‘এবারটা থাক। পরের জন্মে নিশ্চয়ই বুঝতে পারবি। আশা রাখ। আশা হারাস না।’

চিন্টু বলল— ‘না রে রাট-টাগ রাখ। সোহন উই আর ইন আ ফিক্স। আমার বাবাকে পাওয়া যাচ্ছে না।’

সোহন কাগজ পাকিয়ে কানে সুড়সুড়ি দিতে দিতে বলল— ‘কী বললি। আবার বল? কানে শালা এমনি খোল জমেছে। তোর বাচ্চাকে পাওয়া যাচ্ছে না। এর মধ্যে কবে আবার বাচ্চা পাড়লি বাওয়া।’

চিন্টু বলল—‘দিস ইজ নো জোক সোহন। আজ নিয়ে সাড়ে তিনদিন পুরো হয়ে গেল ড্যাড বাড়ি ফিরছে না। ভোরবেলায় দুটো সুটকেস হাতে করে বেরিয়ে গেছে। কোনও খবর নেই। কাউকে কিছু বলেও যায়নি।’

—‘দ্যাখ, ইনকাম ট্যাক্স থেকে রেইড-টেইড করবে খবর এসেছে হয়ত।’

চিন্টু রাগ করে বলল— ‘ঠিক হ্যায়। চললুম। মনে থাকবে। বিপদের সময়ে সো-কলড্‌ বন্ধুদের ব্যবহার মনে থাকবে। সানগ্লাসটা সে মাথার ওপর থেকে নামিয়ে নাকের ওপর বসিয়ে দিল। পেছন ফিরছিল।

শুক্তি বলল— ‘কী ব্যাপার? একটু আগেই তো তোর বাড়ি থেকে ঘুরে আসছি। তখন তো বলিসনি কিছু।’

চিন্টু বলল— ‘সরি। একদম ভুলে গিয়েছিলাম। ইনফ্যাক্ট উই আর নট অ্যাকাসটম্‌ড টু হ্যাভিং আওয়ার ড্যাড অ্যারাউন্ড। তুই চলে যাবার পর আমার মা কোথা থেকে পুজো-টুজো দিয়ে মা-কালী সেজে বাড়ি ফিরল তখন মনে পড়ে গেল। ইট ইজ সীরিয়াস। মাকে আমার কেমন অ্যাবনর্ম্যাল লাগল। অথচ কিছুতেই পুলিশে খবর দিতে দেবে না।’

শুক্তিকে দেখে মনে হল তার দুর্গে দুর্গতিনাশিনী রূপটা আগেকার পতিতোদ্ধারিণী রূপটার দখল নিয়ে নিয়েছে। সে বলল— ‘সোহন এদিকে একটু মন দে, কানটা পরে পরিষ্কার করিস। ইজিয়ান স্টেবল্ একদিনে পরিষ্কার হয় না।’

সোহন তার চেয়ারটা এগিয়ে নিয়ে বসে বলল— ‘বল কী বলবি।’

চিন্টু মুখ গোমড়া করে বলল— ‘আর কী বলব? আই হ্যাভ অলরেডি টোল্ড ইয়ু। অ্যাবাউট থ্রি ডেজ ব্যাক, ড্যাড জাস্ট ওয়াকড আউট উইথ টু ব্যাগস।’

—‘কে দেখেছিল?’

—‘ন্যাচারেলি নো বডি। নো বডি ওয়াজ দেয়ার টু সি। এনি ওয়ে ইট ওয়াজ ইদার আফটার মিডনাইট, অর দ্য স্মল আওয়ার্স।’

—‘কী করে জানলি দুটো ব্যাগ না কী নিয়ে গেছেন?’

—‘ওই দুটোই মিসিং। একটা ভি.আই.পি, মাম্মি বলছে সব সময়ে ট্যুরের জন্যে রেডিকরা থাকতই। আর একটা।’

—‘তাহলে হয়ত ট্যুরেই গেছেন। বলছিস বাড়িতে কেউ ছিল না? হাউ কাম?’

চিন্টু বিরক্ত মুখে বলল—‘এগুলো আনইমপর্ট্যান্ট। ছিল না কেউ। বাস।’

শুক্তি বলল— ‘কেউ নেই সারারাত, এরকম তোদের বাড়িতে প্রায়ই হয় না কি?’

চিন্টু চিবিয়ে চিবিয়ে বলল— ‘কেন? তুই তাহলে যাবি? না কী? নাইট স্পেন্ড করতে?’

শুক্তি খুব রেগে-মেগে কিছু বলতে যাচ্ছিল, হঠাৎ চুপ করে গেল। তারপর বলল— ‘সোহন, এত স্পর্শকাতর সাক্ষী হলে তদন্ত সম্ভব নয়। আমি চললাম।’ সে আর একটুও দাঁড়াল না। বলতে বলতেই চলছিল, একেবারে চৌকাঠের বাইরে নাগালের বাইরে চলে গেল।

চিন্টু রাগে মুখ লাল করে বলল— ‘সোহন তোর হিপক্রিসির একটা সীমা থাকা। উচিত। তুই জানিস না মনডে নাইট আমি কোথায় ছিলাম? রাসকেল একটা!’

সোহন ডানহাতটা তুলে বলল— ‘ঠিকাছে ঠিকাছে। আম্মো যেখানে, তুম্মো সেখানে। কিন্তু বেবি, তোমার সিসু, তোমার মা? তারাও কি সেখানে বা ওইরকম কোথাও ছিল?’

চিন্টু বলল— ‘জবান সমহালকে সোহন, য়ু আর টেকিং টু মেনি লিবার্টিজ। দেয়ার্স নো নীড টু পোক ইয়োর ব্লাডি নোজ ইনটু আওয়ার প্রাইভেট অ্যাফেয়ার্স।’

—‘অ রাইট, অ রাইট, বাট ইয়োর পা ইজ অ্যাবসকন্ডিং, দ্যাট টূ ইজ ইয়োর প্রাইভেট অ্যাফেয়ার। তো সেই থলি কা বিল্লি ভি তুমি এখানে ছাড়লে কেন? এতে যদি টাচি।’

চিন্টু বলল— ‘অ্যাবসকন্ডিং? হোয়াট ডু ইউ মীন সোহন?’

—‘আরে খেপছিস কেন?’ সোহন এবার চেয়ার আরেকটু এগিয়ে নিল, পা দুটো সোজা করে ঝুলিয়ে দিল, পিঠ সোজা। —‘আফটার অল আমাদের তো ইনভেস্টিগেটিং স্পিরিটেই সবটা দেখতে হবে। কী কী সম্ভাবনা আছে, থাকতে পারে? এতে একটা বাচ্চা মেয়ের মতো থেকে থেকেই ঠোঁট ফোলাবার কী মানে? ইভন শুক ইজ মোর ম্যাচুওর দ্যান য়ু।’

—‘ঠিক আছে বলো, কী বলছ!’

—‘তোমার বাবা বড় বিজনেস ম্যান। দুটো বড় বড় স্যুটকেস হাতে মাঝরাতে কি ভোর সকালে বেরিয়ে গেছেন, অ রাইট?

—‘রাইট।’

—এখন প্রথমেই যেটা মনে হবে সেটা হচ্ছে, বাড়িতে ঠেসে রাখা সোনার বিস্কুট-টিস্কুট, টাকা, না বিস্কুট ওনলি বিস্কুট, এনি ওয়ে দা ডিটেইলস মে বি সেট্‌লড্‌ লেটার। এই সমস্ত নিয়ে কোথাও রেখে আসতে গেছেন আই.টি. থেকে রেইড করবে জানতে পেরে।’

—‘তা, তিনদিন হয়ে গেল রেইড কই হল না তো? কোনও চিহ্নই নেই।’

—‘ঠিকাছে। বাবার অফিস, টফিস এরা কী বলছে?’

—‘ড্রাইভার থেকে, ওয়ার্কস ম্যানেজার থেকে সব্বাই ফোন করে জানতে চাইছে, সাহেব আসছেন না কেন! ইনকাম ট্যাক্‌স ফ্যাক্‌স নিয়ে কোনও কথাই কেউ বলেনি।’

—‘অ রাইট। তোর বাবার ইনকম-ট্যাক‌স্‌ নিয়ে কে ডীল করে, জানিস?’

—‘নো। আই নো নাথথিং।’

—‘জেনে নিতে পারবি তো? অফিসের কোনও কর্মচারী নেই, যাঁর সঙ্গে এসব কথা বলা যায়?’

—‘ও, নো,’ চিন্টু বলল, তারপর তর্জনী নেড়ে বলল—‘আছে একজন। সাধন বিশ্বাস, বোধহয় সবচেয়ে পুরনো লোক। কিন্তু আমার সঙ্গে কোনও কানেকশন নেই।’

—‘ওঁর কাছ থেকে জানতে চা, ইনকাম-ট্যাক্স কে দেখে। আয় আমি ডায়াল করছি। নম্বরটা বল।’

চিন্টু ভীষণ ইতস্তত করতে লাগল, বলল—‘আমি কখনও ড্যাডের অফিসে কারও সঙ্গে…মানে দা হোল থিং উইল বি আউট।’

—‘তোর ড্যাড যদি আজকালের মধ্যে ফিরে না আসেন, তাহলে এনি মোমেন্ট ইট উইল বি আউট, সেই জন্যেই একজন বিশ্বস্ত লোকের কথা বলছি। অলরাইট কী নাম বললি ভদ্রলোকের সাধন বিশ্বাস? কী বলে ডাকিস?’

—‘ছোটতে সাধনকাকা বলতাম। এখন কিছু বলি না।’

—‘নম্বরটা বল, তুই বুঝতে পারছিস না, আমাদের এক-একটা করে সম্ভাবনা বাদ দিতে হবে। প্রসেস অফ সায়েন্টিফিক এলিমিনেশন। নম্বরটা বল, কুইক! কিছু হবে না। ঘাবড়াও মাত।’

নম্বরটা শুনতে শুনতে ডায়াল করতে লাগল সোহন।

—‘মে আই স্পিক টু সাধন বিসোয়াস প্লীজ।’ সোহন নিজেই কথা বলতে লাগল।

—‘ও, সাধনকাকা! আমি চিন্টু মানে নীলাদ্রি বলছি। ড্যাডের ইনকাম-ট্যাক্স কারা দেখেন?’

ওদিক থেকে সাধন বিশ্বাস আর্তগলায় বললেন—‘কেন চিন্টু! দাদা কোথায়? আমাদের এদিকে একগাদা কাজ-কারবার সব আটকে আছে। কোথায় গেলেন দাদা?’

—‘আরে ড্যাড তো রাঁচি গেছে।’

—‘রাঁচি? এই যে সমর বলছে, তুমি বলেছ পাটনা!’

চিন্টু এদিক থেকে লাফিয়ে উঠে ঢোক গিলল, বলল—‘সর্বনাশ!’ সোহন তার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে আশ্বস্ত করার ভঙ্গিতে বাঁ হাতটা নাড়ল, তারপর ফোনের মধ্যে বলল—‘সরি, সাধনকা, অ্যাকচুয়ালি ড্যাড কোথায় গেছে, কাউকে বলে যায়নি। মানে আমরা কেউ সে সময়টা ছিলাম না। কিন্তু গেছে, খুব কাজে এটুকু জানি।’

—‘তো ইনকাম ট্যাক্সের কথা জিজ্ঞেস করছ কেন?’

—‘মানে, ইজ ইট ইন অর্ডার?’

—‘প্রতিটি পাই-পয়সা। দাদা এসব বিষয়ে খুব সাবধান।’

—‘ওক্কে, আমার এক বন্ধুর সঙ্গে বাজি ছিল, তাই জিজ্ঞেস করছিলুম, বা-ই।’ ফোন রেখে দিল সোহন।

চিন্টু চোখ বড় বড় করে তার দিকে চেয়েছিল। সোহন বলল—‘বাকআপ বেবি, দিস সাধনকা ম্যান সীমস রিলায়েবল। ইটস নট আই. টি.।’

—‘তা হলে?’ চিন্টু বলল।

—‘ঘাবড়সনি। ধর কোনও বদমাশ তোর ড্যাডের কাছ থেকে একটা হিউজ অ্যামাউন্ট চেয়েছে। প্রাণের ভয় দেখিয়েছে। তোর প্রাণও হতে পারে। ওই ত্রিপুরা আসামের মতন। হয়ত সেটাই পৌঁছে দিতে গিয়ে বিপদে পড়ে গেছেন।’

—‘এই কথাটা আমি একেবারে গোড়ার থেকেই বলে আসছি। যখন দেখলাম আয়রন-চেস্ট একদম ফাঁকা। মাম্মি কিছুতেই মানতে চাইছে না। খালি বলে যাচ্ছে ও চেস্টে কিছু থাকত না। এদিকে মাই মাম্মি ইজ অ্যাক্টিং মিস্টিরিয়াস। পুলিশে খবর দিতে দেবে না। ড্যাড কোনও বদলোকের খপ্পরে পড়েছে মানবে না।’

চোখ সরু করে সোহন বললে—‘কী বললি? মাম্মি অ্যাক্টিং মিস্টিরিয়াস! পুলিশে খবর দিতে দিচ্ছেন না?’

—‘হ্যাঁ। এদিকে ঠাকুরবাড়িতে পুজো দিতে গিয়েছিল।’

—‘ডোন্ট মাইন্ড নীলাদ্রি, তোর বাবা-মা’র মধ্যে সম্পর্ক কেমন?’

—‘কেমন?’ চিন্টু আকাশ-পাতাল ভাবতে লাগল।

—‘মানে ঝগড়া, মন-কষাকষি, ফাইটিং।’

—‘নট দ্যাট আই নো অফ’ চিন্টু বলল, তারপর বলল—‘মাই মাম্মি ইজ আ গ্রেট লেডি। শী ডাজ লটস অফ সোশ্যাল ওয়ার্ক। অ্যাকচুয়ালি শী হ্যাজ আ লাইফ অফ হার ওন।’

—‘প্যারালাল?’ শোহন জিজ্ঞেস করল।

—‘কী বললি?’

বললাম, ‘—ইজ ইট আ লাইফ রানিং প্যারালাল টু ইয়োর ড্যাড’স? দা টোয়েন শ্যাল নেভার মীট…টাইপ?’

চিন্টু কিছুক্ষণ ভেবে বলল—‘আমি ঠিক বলতে পারছি না। ইন ফ্যাক্ট, আমি বাড়ি-টাড়ি মা-বাবা-টাবা নিয়ে কোনও দিন ভাবিনি।’

সোহন হঠাৎ গম্ভীরমুখে বলল—‘চিন্টু, লেটস ড্রপ ইট। মানে তোর মা যখন বলছেন পুলিশে খবর দেবার দরকার নেই, তখন…ইটস হার প্রবলেম। আফটার অল।’

—‘সো আই অ্যাম ব্যাক টু স্কোয়ার এ?’ চিন্টু আরও গম্ভীর মুখে বলল।

—‘দ্যাখ না, দু-চার দিনের মধ্যেই একটা কিছু খবর পেয়ে যাবি।’ হালকা গলায় সোহন বলল, ‘ডোন্ট ওয়ারি। চল বরং একটু ঘুরে আসি। তোর ঘোড়াটা রয়েছে তো?’

চিন্টু বলল— ‘চল।’

সোহন তার ব্যাগের মধ্যে একটা ক্যামেরা বেছে ভরে নিয়ে বলল, —‘চল আজ ফুলের ছবি তুলব। হর্টিকালচারে চল।’

অন্যমনস্কভাবে কর্নওয়ালিস স্ট্রিটে গাড়ি ঢোকাচ্ছিল চিন্টু। সোহন বলল—‘এই, এই, সোজা বিডনি স্ট্রিট দিয়ে সার্কুলার রোড ধরে নে। পার্কসার্কাস থেকে পারভেজকে তুলে নেব। যদি খচ্চরটা থাকে।’

চিন্টু বলল—‘বিডনি স্ট্রিটটা কী বস্তু?’

—‘জানিস না? বিডনি স্ট্রিট, কলেজে স্কোয়ার, হরি ঘোষের স্ট্রিট—এসব শুনিসনি?’

—‘নেভার ইন মাই লাইফ।’

—‘আরে বাঙালি জিভ ইংরিজি যুক্তাক্ষর উচ্চারণ করবার আগে একটু দম নিত, ফট করে হসন্ত থেকে যুক্তাক্ষরে যেতে চাইত না। আমার ঠাকুর্দা, বাবার মুখে শুনেছি, জ্যাঠাদেরও বলতে শুনেছি। বিউটিফুল লাগত শুনতে।’

—‘হরিব্‌ল’ চিন্টু বলল, ‘বাস-ড্রাইভারগুলো বর্বন রোড বর্বন রোড় করে চেঁচায়!’

—‘ওহ নো নো নো’ সোহন সজোরে প্রতিবাদ করে উঠল, ‘এই জ্যাঠা-কাকারা কিন্তু যখন ইংরিজিতে সওয়াল করবে, তর্কবিতর্ক করবে, পরিষ্কার বলবে। কিন্তু বাংলায় বলবার সময়েই ইনভেরিয়েবলি কলেজে স্ট্রিট। অদ্ভুত সাইকলজি আর অদ্ভুত জিভ। জিভের সাইকলজি বলতে পারিস। এই চিন্টু দাঁড়িয়ে গেলি কেন?’

চিন্টু বলল, ‘একটা মেয়ে রাস্তা ক্রস করছে দ্যাখ।’

সোহন দেখল, তারপর বলল, ‘তোর সানগ্লাসটা দে একবার।’ চিন্টুর সানগ্লাস পরে সে ভাল করে মেয়েটিকে দেখল। চিন্টু বলল—‘লিফট দিতে চাইব?’

—‘চা’ সোহন সানগ্লাসটা পরে সিটে হেলান দিয়ে চূড়ান্ত বিশ্রামের ভঙ্গিতে নিজেকে ন্যস্ত করল। চিন্টু শাঁ করে গাড়িটা নিয়ে মেয়েটির পাশে পার্ক করল। মেয়েটি বাস স্টপে দাঁড়িয়েছে। সালোয়ার কামিজ পরেছে, কোনও শীতের পোশাক নেই। কাঁধ থেকে একটা বড়সড় ব্যাগ ঝুলছে।

—‘হাই!’ চিন্টু বলল।

প্রথমে মেয়েটি চমকে উঠেছিল, তারপরে বলল—‘হাই।’ সামান্য একটু হাসির আভাস মুখে।

—‘হোয়্যার ক্যান আই ড্রপ য়ু?’

মেয়েটি দাঁত ঝিকিয়ে হাসল। একটা খুব মনোহর গজদাঁত বাঁদিকে।

রাস্তার দিক থেকে চিন্টুর কাঁধের ওপর হঠাৎ একটা থাবামতো হাত পড়ল।

—‘হোয়াটস হ্যাপনিং হিয়ার?’ একটি লম্বা-চওড়া যুবক।

চিন্টু খানিকটা কুঁকড়ে গিয়ে বলল—‘ওহ নাথিং। ওনলি অফারিং হার আ লিফট। নো ট্রাবল।’

—‘গেট অ্যালং।’ তার কাঁধের ওপর একটা থাবড়া দিয়ে যুবক সরে গেল। চিন্টু গাড়িতে স্টার্ট দিল।

যুবকটি মেয়েটির পাশে গিয়ে দাঁড়াল, বলল—‘যত্ত বড়লোকের বকা ছেলে! এক পয়সা রোজগার করতে হয় না। ফান্টু সেজে ঈভ-টিজিং করে বেড়াচ্ছে। দোব শালা একদিন এমনি চাবকে…’

চিন্টুর গাড়ি দ্রুত সার্কুলার রোডের দিকে চলে যাচ্ছে। সোহন সিটে এলিয়ে থেকেই বলল—‘শুনলি?’

চিন্টুর ভেতরটা চিড়বিড় করছিল। সে চুপ করে রইল। সোহন একটু পরে আবার বলল—‘কী রে ডাম নাকি?’

—‘ইয়া ডেফ অ্যান্ড ডাম। এবার বল তোকে কোথায় নামিয়ে দেব।’ টোম্যাটোর মতো লাল হয়ে চিন্টু বলল।

—‘কোথায় নামিয়ে দেব, মানে? পারভেজকে তুলে হর্টিকালচারে যাবি না?’

—‘ন্‌ নো। তুই এইখানে তোর এই বিডনি স্ট্রিটে নেমে যা। যা বলছি।’ কাঁধ দিয়ে সে সোহনকে জোরসে ঠেলা দিল।

—‘যা বাব্বা,’ সোহন গাড়ির দরজা খুলে টলমল করতে করতে নেমে গেল।

—‘সি ইউ।’ কোনও জবাব দিল না চিন্টু। শাঁ করে সে সার্কুলার রোডে পড়ল। তারপর দক্ষিণের দিকে গাড়ি ছুটিয়ে দিল।

যত জোরেই গাড়ি ছোটাতে ইচ্ছে থাক, ছোটানো যায় না। প্রত্যেক মোড়ে গোঁত্তা খেয়ে খেয়ে থেমে যেতে হয়। এবং দাঁতে দাঁত পিষে গালাগাল দিতে হয়। হোয়াট আ কানট্রি! হোয়াট আ স্টেট! হোয়াট আ সিটি! হোয়াট স্ট্রিটস! হোয়াট পীপল। মাই গড! রাগে উন্মত্ত হয়ে থামতে থামতে, গোঁত্তা খেতে খেতে অবশেষে লোয়ার সার্কুলার রোডে এসে রাস্তা একটু স্বচ্ছন্দ হল। বালিগঞ্জ সার্কুলারে পৌঁছে সে ভেবেছিল এবার একটা ছোট্ট ট্র্যাফিক লাইট পেরোলেই সব ফাঁকা! কিন্তু তা হল না। সে দেখল বুড়োমতো একটা মুখ তার দিকে চেয়ে আছে, গাড়ি কাটিয়ে কাটিয়ে চলে এল পাশে।

‘নীলাদ্রি। কোথায় যাচ্ছ?’

মেজ জ্যাঠা। বহুদিন দেখা-সাক্ষাৎ নেই। সম্প্রতি ঠাম্মার কাজে না দেখে থাকলে চিন্টু চিনতে পারত না।

—‘তুমি কোথায় যাচ্ছ?’

—‘যাব বাড়ি। গড়িয়াহাট পর্যন্ত একটু পৌঁছে দেবে নাকি? ও দিকেই তো যাচ্ছ!’

—‘এসো।’ চিন্টু গাড়ির দরজা খুলতে টুক করে ঢুকে ধুপ করে বসে পড়ল মেজ জ্যাঠা। আড়চোখে দেখল চিন্টু। মাথায় গোল টাক। ধারে ধারে চুলগুলো সবে গজাতে শুরু করেছে। সাদা হয়ে আছে। তার ড্যাডের মাথায় প্রচুর চুল। দু-পাঁচটা সাদা হয়েছে কি হয়নি! যেগুলো সাদা হয়েছে মাথাময় কেমন বিউটি সৃষ্টি করে ছড়িয়ে থাকে। ঠাম্মা মারা যেতে মেজ জ্যাঠা, সেজ জ্যাঠা সবাই ন্যাড়া হল, খালি ড্যাড হয়নি। ঠাম্মা নাকি বারণ করে গিয়েছিল। গড নোজ হোয়াই। ওল্ড হ্যাগ। যত রকম কুসংস্কারের ডিপো একটা। হঠাৎ ড্যাডের চুলের ওপর থেকে ধর্মীয় অনুশাসন উঠিয়ে দিল কেন সে জানে না।

—‘তোমার এম. এ পরীক্ষা চলছে না?’

বাস। নাও এবার। চ্যারিটির ঠেলা সামলাও। বুড়ো। আরেকটা বুড়ো। সব খবর রাখে। মাস্টারি ব্রেইন। সব টুকে রেখেছে। কবে পরীক্ষা আরম্ভ, কবে কী পেপার, কবে রেজাল্ট বেরোচ্ছে। এভরিথিং!

—‘আজ নেই।’ সে আন্দাজে একটা ছুঁড়ে দিল।

—‘নেই?’ মেজ জ্যাঠা বিড়বিড় করে বলল। ‘আমার ধারণা ছিল আজ সেকেন্ড পেপার।’

চিন্টু উত্তর দিল না।

—‘বউমা, তিতি সব ভাল আছে?’

—‘হ্যাঁ।’

—‘বিজু?’

আড়চোখে আরেকবার চাইল চিন্টু। জানে নাকি? জেনে গেছে? দিস ওল্ড নেভ? জেনেশুনেই বোধহয় আরও জানবার জন্যে গাড়ির অলিগলি পেরিয়ে এসে জুটল। সে বলল, —‘কী মনে হয়?’

মেজ জ্যাঠা হতভম্ব হয়ে তার দিকে চাইল। —‘কী মনে হয়? মানে?’

—‘মানে, ড্যাড, তোমার ছোট ভাই কীরকম থাকতে পারে?’

মেজ জ্যাঠার চোখের ভাবটা বদলে গেল। সেখানে একটা রাগ বা ক্ষোভ ধরনের কিছু দেখতে পাচ্ছে চিন্টু। সে বলল—‘ভাল আছে। আবার কী?’

—‘সেটা গোড়াতেই বললে পারতে! দেখা হলে আপনার লোক কুশল প্রশ্ন করেই থাকে।’

—‘অলরাইট, সরি, ইট ওয়াজ আ জোক।’

—‘জোক!’ মেজ জ্যাঠা কিছুটা আহত কিছুটা হতবুদ্ধি চেহারা নিয়ে বসে রইল। চিন্টু একবারও জানতে চাইল না মেজ জ্যাঠা, রবিদা, কুমকুমদি, টুলটুলদি, কুমকুমদির বর এদের সব কী খবর। কে কেমন আছে। ড্যাম ইয়োর সোশ্যাল ফর্ম্যালিটিজ—সে একটা বুড়ো নয়। বুড়ো ভাম। কে যেন কথাটা ব্যবহার করেছিল? অনেকক্ষণ ভাববার পর মনে হল শুক্তি। তাকেই বলেছিল বুড়ো ভাম। বুড়োটা বোঝা গেল। ভামটা কী? ভ্যাম্প নাকি? বিডন স্ট্রিটকে বিডনি স্ট্রিট বানানোর মতো কোনও বেঙ্গলিফিকেশন করেছে ভ্যাম্প শব্দটার?

গড়িয়াহাটের মোড়ে নেমে গেল মেজ জ্যাঠা। গম্ভীর মুখে বলল —‘আচ্ছা। কষ্ট দিলাম তোমাকে।’

‘প্লেজার! প্লেজার!’ যথাসাধ্য হাসিমুখ করে চিন্টু বিড়বিড় করল। মেজ জ্যাঠা দুটো স্টলের মাঝখান দিয়ে যাবার সময়ে কী জানি কী ভেবে একবার ফিরে তাকাল। হঠাৎ যেন একটা আচমকা ধাক্কা খেল চিন্টু। ড্যাড। অবিকল তার ড্যাড। বুড়ো। টাক মাথা। রোগা। ধুতি পাঞ্জাবি-ছাতা-তালতলা-শালে একেবারে বিপরীত। তবু, তা সত্ত্বেও তার ভেতর থেকে বেরিয়ে আসছে। নির্ভেজাল তার ড্যাড।

ড্যাডকে বড় হওয়ার পর সেভাবে চেয়ে দেখেনি সে। ছোটবেলায় সাংঘাতিক অ্যাডমায়ার করত। ড্যাড় যেন স্পাইডারম্যান, টার্জান, যেখানে যা কিছু বীরত্বব্যঞ্জক, পুরুষালি, সব কিছুই ড্যাড। গ্রে সুট, মেরুন টাই পরে মসমস করে চলে যাচ্ছে ড্যাড। একটা মৃদু সুগন্ধ ছড়িয়ে গেল বাতাসে। সমর গাড়ির দরজা খুলে ধরেছে। —‘ড্যাড, ড্যাড।’

চিন্টু একটু দেরি করে ফেলেছে। ড্যাড বোধহয় শুনতে পায়নি। কেননা গাড়িটা হুশ করে বেরিয়ে গেল। সত্যি কথা বলতে কি সেই থেকেই, এরকম কারুর নাকের ওপর দিয়ে হুশ করে গাড়ি হাঁকিয়ে বেরিয়ে যেতে ভালবেসেছে সে। রাত্রে একসঙ্গে ডিনার খায় না তারা কত দিন হয়ে গেল। অর্ধেক দিন মাম্মি থাকে না। তিতি আর ড্যাডের সঙ্গে বসে খেতে তার ভাল লাগে না। কেমন যেন উদোম বোধ করে সে। মা থাকলে একটা ভদ্র আড়াল। একটা সুচারু অনুষ্ঠান। নইলে কে কী বলে উঠবে, কার দৃষ্টি কিসের ওপর পড়বে—সে জানে না। সে বদনকে বলে রেখেছে মা না থাকলে তার ডিনার যেন ঘরে সার্ভ করা হয়। তাই-ই চলে আসছে। তিতি জেনে গেছে। কিছু বলে না। ড্যাড কোনও দিন ভুলেও জিজ্ঞেস করেনি—চিন্টু কোথায়। সে কেন টেবিলে বসেনি। অন্তত সে শোনেনি। জিজ্ঞেস করলে বদন কি প্রমীলা তাকে বলত একবারও। অবশ্য এমন নয় যে সে তার জন্য অভিমান করে বসে আছে। শিট! এসব কথা মনেই হয়নি তার। এখন তিন দিন ধরে ড্যাড বেখবর বেপাত্তা হয়ে থাকায়, মেজ জ্যাঠাকে হঠাৎ অবিকল ড্যাডের মত দেখানোয় ঝট করে কথাগুলো তার মনে এল। কোথায় গেল বস? সোহন হঠাৎ তার বাবা-মা’র সম্পর্কের কথা জিজ্ঞেস করল। তারপর দুম করে সাবজেক্টটা ড্রপ করল কেন? সোহনেরও কি সন্দেহ হয়েছে তার মা কিছু একটা করেছে। পেপারে কত রকম উদ্ভট খবর বেরোয়! ছেলে মা-বাবাকে খুন করছে, মেয়ে মা-ঠাকুমাকে খুন করছে। সেই ছেলে বা সেই মেয়ের বাবা-মা’রা কি আন্দাজ করতে পেরেছিল কার হাতে তাদের মৃত্যু নাচছে? বাবা-মা আফটার অল হাজব্যান্ড-ওয়াইফ। তাদের সত্যিকারের সম্পর্ক কী, কে তা। বলতে পারে? মা যে কিছু একটা জানে, লুকোচ্ছে সেটা খুব স্পষ্ট। আবার পুজো দিতেও তো গিয়েছিল! স্ট্রেঞ্জ! কে জানে হয়ত নিজের সেফটির জন্যেই পুজো দিতে গিয়েছিল! ইয়েস, দ্যাটস কোয়াইট পসিবল। মা, তার মা, তাকে কোলে করে ঘুম পাড়াত, স্কুলে যেতে চাইত না বলে, কিসি দিত, একটা দুটো তিনটে চারটে…। সেই মাম্মি! ঘরের দরজাটা বারবার বন্ধ করে দিচ্ছিল কেন মাম্মি? ওই ঘরেই কি? ওয়ার্ডরোবের ভেতর? চিন্টুর বুকের ভেতরটা হিম হয়ে যেতে থাকল। সোহন। সোহন ইজ ডেভিলিশ ক্লেভার! আঁচ করেছে বোধহয় ব্যাপারটা।

চিন্টু রাসবিহারী দিয়ে বেরিয়ে গেল। আরেকটু হলে একটা অ্যাকসিডেন্ট হত। কোনও মতে মহানির্বাণ রোডে ঢোকাল সে গাড়িটা। তাকে যেতে হবে বালিগঞ্জ সার্কুলারেই। ওইখানেই তার গন্তব্য ছিল। মেজ জ্যাঠার জন্য এতটা সময় গেল। যাকগে। সময়টা বড় কথা নয়। সময় তো কাটতেই চাইছে না! তার ওপর ওয়ারিজ। তার একদম অভ্যেস নেই এসব। যাক, দেখা যাক সঞ্জয় হিরানীর ওখানে গেলে হয়ত একটা হিল্লে হতে পারে তার।


ঝিমঝিম ঝিমঝিম করে সন্ধ্যা নামার শব্দ হয়। ধোঁয়ার সঙ্গে অন্ধকার মিশিয়ে সিমেন্টের বড় বড় বস্তায় ভরে কেউ অনেক উঁচুর আকাশ থেকে ফেলছে। থলির পেছনের কোণ দুটো ধরে উল্টে দিচ্ছে। উড়ছে ধোঁয়া এবং অন্ধকার আকাশময়। নামছে অলিতে-গলিতে। এই শীতকালীন সন্ধ্যারও আবার কত রকমফের আছে। সল্ট লেকের সন্ধ্যা আর আহিরিটোলার সন্ধ্যা, সাদার্ন অ্যাভেন্যু-এর সন্ধ্যা আর বাঁধাঘাটের সন্ধ্যা যেমন এক নয়, তেমন চিলেকোঠার সন্ধ্যায় আর একতলার সন্ধ্যায় তফাত আছে। দশতলা বারোতলায় যে সন্ধ্যা দেখা যায়, দেড়তলার বাসিন্দা কখনওই সে সন্ধ্যা দেখতে পারে না। অঞ্চলভেদে, উচ্চতাভেদে প্রকৃতির দয়া-দাক্ষিণ্য ভাগ হয়ে গেছে।

আহিরিটোলার চিলেকোঠার সন্ধ্যায় নলিনী করের তক্তাপোশের পাশে একমাত্র টিনের চেয়ারে বসে হরিহর আনীত চায়ের সঙ্গে বড় বড় বেগুনি খাচ্ছেন বিজু রায়। এমন সময় বাঁদিকের বাড়ির ছাদ থেকে খুব সরু বাচ্চা-গলার ডাক শুনতে পেলেন,—‘দাদু, দাদু! অ দাদু!’

কে কাকে ডাকছে, বুঝতে পারলেন না বিজু। তবু একবার বেরিয়ে এলেন। বাঁদিকের বহু পুরনো বাড়িটা গায়ে গায়ে লাগা। পাঁচিলের ফোকরে পা দিয়ে একটা ছোট্ট মুখ ঝুঁকে আছে পাঁচিলের ওপর থেকে। বিজু এগিয়ে গেলেন। —‘কে তুমি? কাকে ডাকছ?’

—‘তুমি কে?’

—‘আমি…আমি…’ বিজু রায় ভেবে পেলেন না তাঁর কোন পরিচয়টা এই বাচ্চাটির কাছে গ্রাহ্য হবে। আজ গুড্ডু এসেছিল তার দাদিকে দেখতে। রত্নার নির্দেশে গুড্ডু তাঁকে দাদু বলে ডেকেছিল। এইটুকু বাচ্চাদের জগতে কারও নাম বলে কিছু থাকে না বোধহয়। খালি সম্পর্কবাচক শব্দ দিয়ে পরিচয় তৈরি হয়। মা বাবা, মাসি, মামা, পিসি, কাকা, দাদু, দিদা, এইরকম। এই জগতের পরিচয়পত্রে বিজনবিহারী রায় বা নলিনীকান্ত কর এসব চলবে না। তিনি বললেন—‘আমি দাদু।’

—‘আমার দাদু কোথায় গেল?’ বিজু বুঝতে পারছিলেন বাচ্চা মেয়েটি কার কথা বলছে, কাকে চাইছে। তবু তিনি জিজ্ঞেস করলেন—‘কোন দাদু?’

—‘ওই তো টঙের দাদু! লালচুলের দাদু! রোগা দাদু! ফর্সা দাদু!’

যাক অনেক রকম বর্ণনা পাওয়া গেল। বাসস্থান, চেহারা…মেয়েটি তখনও বলছে চকলেটের দাদু…। বাঃ আদান-প্রদানের বস্তু দিয়ে সম্পর্ক নির্ণয় হচ্ছে। বিজু রায় বাচ্চাদের কোনও দিন ভাল করে দেখেননি। বাচ্চাদের আদর-টাদর করা, তাদের সঙ্গে আধো-আধো কথা বলা এসব কোনও দিনই তাঁর অভ্যেস নেই। তাঁর এই বাচ্চাটির সঙ্গে কথা বলতে বাধো বাধো লাগছে। বাৎসল্য-রসে ভরা হাসি, আদিখ্যেতার নানা শব্দ তাঁর আসছে না। তিনি বললেন—‘তুমি কোথায় গিয়েছিলে?’

—‘বীর চাঁদে।’

—‘বীর চাঁদ? সে কোন জায়গা?’

—‘বীর চাঁদ জানো না? আমার মামার বাড়ি। চিলড্রেন্স পার্ক আছে। বড় বড় রাস্তা আছে। দিদাই আছে।’

বীর চাঁদ নামে কোনও টাউনের কথা বিজু মনে করতে পারলেন না। যাই হোক, জায়গাটায় বাচ্চাটির মামার বাড়ি। কদিন সে সেখানে ছিল। সম্ভবত তাই-ই টঙদাদুর মহাযাত্রার কথা জানে না। তিনি বললেন—‘তোমার টঙদাদুও মামার বাড়ি গেছে নিশ্চয়ই।’

খুক খুক করে হাসল মেয়েটি, বলল—‘অত বড়দের আবার মামার বাড়ি থাকে নাকি?’

—‘কেন থাকবে না? বাঃ।’

—‘বারে! তাদের মামারা, মামিরা, দিদাইরা ভীষণ বুড়ো হয়ে যাবে না?’

—‘হোক না। ভীষণ বুড়ো হলেও তো তারা মামা-ই, মামি-ই, দিদাই-ই নাকি?’

—‘তুমি বুঝতে পারছ না। ভীষণ, ভীষণ বুড়ো, তার চেয়েও বুড়ো, তার চেয়েও বুড়ো।’

তখন বিজু রায় বুঝতে পারলেন বাচ্চা মেয়েটি এইভাবেই মৃত্যুকে বুঝেছে।

—‘কথা বলছ না কেন? আমি মামার বাড়ি থেকে এলেই টঙদাদু চকলেট দেয়।’

—‘তাই? আচ্ছা, এদিকে আসবে?’ বিজু হাত বাড়িয়ে দিলেন। একটু চেষ্টার পর তাকে নিজেদের ছাদে আনতে সমর্থ হলেন। ছোট্ট মুখ। চোখ দুটো একটু বসা, বড় বড়। কচি নাক আর ঠোঁটি, কচিপাতার মতো নরম শামলা রং। একটা নানা রঙের পশম দিয়ে বোনা, পুরোহাতা সোয়েটার পরে আছে সে। পায়ে ফুলমোজা এবং বকলস লাগানো জুতো। শীতের বিরুদ্ধে লড়াইটা দরকার জেনে তার মা তাকে ভালভাবেই অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে সাজিয়েছে। হাতে একটা টুপি।

—‘তুমি টুপিটা পরোনি?’

—‘আমার টুপি পরতে বিচ্ছিরি লাগে।’

—‘ও। এসো টঙে এসো।’

—ঘুরে ঢুকে সে বলল—‘এ মা! তুমি ভাল চাদরটা পেতে রেখেছ কেন? ওটা তো সাইমন কিংবা রফিককাকু এলে দাদু পাতে?’

—‘কে সাইমন? রফিককাকু কে?’

—‘ওমা, সাইমনকে চেনো না? রফিককাকুকে চেনো না! ওরা যে টঙদাদুর জন্যে টাকা আনে! না হলে দাদু আমাকে চকলেট কিনে দেবে কী করে?’

বিছানায় বসে মেয়েটি বললে—‘তুমি টঙদাদুর কে হও গো?’

—‘ভাই।’

—‘ধ্যাঃ।’ টঙদাদু বলত, ‘আমার ভাই নেই, বোন নেই, মা নেই, বাবা নেই, বউ নেই, ছেলে নেই, মেয়ে নেই। এসব কোনও দিন ছিল না। একদিন ভীষণ বিষ্টি হচ্ছিল পুজোর সময়ে, ভীষণ বাজ পড়ছিল, তখন পৃথিবীটা ফাঁক হয়ে গেল আর আমি বেরিয়ে এলুম।’

—‘এই কথা বলত বুঝি!’

—‘হ্যাঁ বলত। সত্যি কথা, বলবে না?’

—‘আমি তাহলে ভাইয়ের মতো। ধরো বন্ধু।’

—‘তাই বলো।’ খুব নিশ্চিন্ত হয়ে বলল খুকুটি। তারপরে বলল—‘আমার চকলেট দাও?’ সে ডান হাতটা পেতে আছে। পেছন ঘসটে এক পা মাটিতে রেখেছে। শরীরটা এখনও তক্তাপোশের ওপরেই।

বিজনবিহারীর হঠাৎ মনে হল জীবন ওই বাচ্চা খুকুটির মতো। অমনি ভাবে হাত পেতে আছে। চোখে অবোধ বাসনা। যতক্ষণ তুমি আছ তোমাকে ওর হাতে মিষ্টান্ন দিয়ে যেতে হবে। তিনি বললেন, ‘তুমি বোসো, আমি কিনে আনছি।’

—‘দূর তুমি কিছু জানো না, ওই তো টেবিলের টানাটায় থাকে। খোলো না?’

বিজনবিহারী চেয়ারে বসেছিলেন, তাঁর পেছনে টেবিল, তিনি ড্রয়ারটা টেনে খুলে ফেললেন। খুকু ছুটে এল। ড্রয়ারের মধ্যে ম্যাগনিফাইং গ্লাস একটা, কিছু সিগারেটের প্যাকেট, লাল রিবন, গোলাপি রঙের ক্লিপ, নাইলন পুতুল একটা আর বেশ কিছু টফি।

—‘ওই তো আমার ফিতে, আমার ক্লিপ, ওই তো আমার পুতুল,’ ড্রয়ারটা ধরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে খুকু বলল, ‘কই চকলেট দাও! ওই তো!’

টফিগুলো তুলে খুকুর হাতে দিলেন বিজু। এগুলোকেই ও চকলেট বলছে। এগুলো কি সেই দাঁতের সঙ্গে আটকে যাওয়াগুলো! তিনি বললেন—‘সবগুলো যেন একসঙ্গে খেয়ো না। আর খেয়ে ভাল করে মুখ ধোবে, দাঁত ঘসে ঘসে ধোবে, নয়ত দাঁতে পোকা লাগবে, ভীষণ ব্যথা করবে কিন্তু।’

একটা টফি মুখে ফেলে খুকু বলল—‘ আমার দাঁতে পোকা আছে তো! আমি বুরুশ দিয়ে দাঁত মাজি তো! শীতকালে রাত্তিরে যে মা মুখ ধুতে বারণ করে।’

—‘তোমার দাঁতে পোকা আছে? যন্ত্রণা হয় না?’

—‘হয় না আবার! মা বলেছে এ দাঁতগুলো পড়ে যাবে, তখন আর হবে না।’

বিজু বললেন, ‘নাও, তোমার লাল রিবন, ক্লিপ তোমার পুতুল, সব নাও।’

—‘এখন কি নিউ ইয়ার? এখন কি আমার জন্মদিন? যে নোব!’

—‘তাই বুঝি? তোমার জন্মদিন কবে?’

—‘সে তো আঠারই ডিসেম্বর। সেইদিন আমি পুতুলটা পাব তো। টঙদাদু বলেছে।’

—‘আর রিবন-ক্লিপ?’

—‘ওগুলো তো ফাস্ট জানুয়ারি নিউ ইয়ারে পরবো।’

—‘টঙদাদু যদি তখনও না ফেরে? তুমি এখনই বরং নিয়ে যাও।’

—‘ন্‌ না। আমার জন্মদিনে টঙদাদু নেমন্তন্ন আসবেই। কেউ তো দাদুকে পায়েস খেতে দেয় না। আমার মা লাল পায়েস করবে, দাদু আসবেই। আচ্ছা আমি যাই, না আসি বলতে হয়; আসি টঙদাদুর বন্ধু। মা ভাববে ভীষণ।’

—‘চলো তোমায় দিয়ে আসি।’ বিজু রায় পাঁচিলের কাছে গিয়ে মেয়েটিকে কোলে তুলে নিলেন। তারপর একটু হাত বাড়িয়ে পাশের পাঁচিলে দাঁড় করিয়ে ধরে রইলেন, মেয়েটি ধুপ করে লাফিয়ে পড়ল ওদিকে।’

—‘তোমার নামটা কী? নাম বললে না তো?’

—‘আমার নাম কুমারী মণিদীপিকা রজক দাস, বলে ছোট্ট দেহ আর মস্ত নামের ভার বইতে বইতে খুকুটি ছুট লাগাল।

ঘরে ফিরে এসে বিজু দেখলেন ড্রয়ারটা তখনও খোলা। রিবন ক্লিপ এবং পুতুল দেখা যাচ্ছে। নলিনী কর নিশ্চয়ই কিছুদিন আগে এগুলো সংগ্রহ করে রেখেছিলেন। আশ্চর্য মণিদীপিকা জানে এসব তারই, তবু একটা জিনিসও ছুঁল না। সময়, লগ্ন। সে তার ওইটুকু মন দিয়ে লগ্নের গুরুত্ব বুঝতে পারে। দরিদ্রের মেয়ে, দেখলেই বোঝা যায়। এইরকম বয়সে হয়ত ছুটকিরও এরকমই চেহারা ছিল!

ছুটকি! ছুটকি কোথায়। এমন ফেরে পড়েছেন, যে চিঠিগুলো তন্ন তন্ন করে পড়বারও সময় পাচ্ছেন না। তবে ছুটকি যে বেঁচে আছে, ভাল আছে, স্বামী পুত্র কন্যা নিয়ে সুখী এটাও অনেক। সে তো হারিয়েই গিয়েছিল। জীবনের কোনওখানে আর তার কোনও স্মৃতি ছিল না, চিহ্ন ছিল না। হঠাৎই শূন্য থেকে রসগোল্লা পড়বার মত ছুটকি নেই থেকে আছে হয়ে গেল। বিজু কী করে তাকে হারিয়ে থাকতে দেবেন। অনেক যে বয়স হয়ে গেল! বয়সটা যে অনেক হয়েছে এ কথা তাঁর একবারও মনে হয়নি, মনে হত না। এন কে বা নলিনী কর তাঁকে মনে করিয়ে দিয়ে গেল। ফিফটি নাইন রানিং, বলেছিল। তখনই বুঝতে পেরেছিলেন লোকটি তাঁর বয়সী। আজ খুকুটি যা বলল তার মধ্যে থেকে ‘পুজোর সময়ে ভীষণ বিষ্টি পড়ছিল, বাজ পড়ছিল।’ কথাগুলো তাঁর কানে আটকে আছে। মা বলত ‘বাপ রে, পুজোর সময়ে সে কী বিষ্টি! পাড়ার ঠাকুর জল পড়ে গলে গেল। সে এক কাণ্ড। অমন তাণ্ডবের মধ্যে জন্মেছিলি, তুই দস্যি হবি না তো হবে কে?’

নলিনী করও ওই পুজোর সময়েই জন্মেছিল। কোন দিনে? জানবার আর বোধহয় উপায় নেই। কিন্তু দু-একদিনের এদিকে ওদিকে আর কী-ই বা আসে যায়। তিনি নলিনী করের একেবারে একবয়সী, যতই নলিনী তাঁকে ‘তুমি তো ভায়া পঁয়তাল্লিশের এদিকে হবে তো ওদিকে হবে না’ বলুক। বয়স জিনিসটাও কত আপেক্ষিক! তিনি চূড়ান্ত সুখে আছেন। নিয়মে আছেন। বিধিদত্ত কাঠামোটাও নিশ্চয় ছিল, সবচেয়ে বড় কথা কাজের মধ্যে আছেন। নিশ্চিদ্র কাজের মধ্য দিয়ে একটা দিন কোথা দিয়ে পার হয়ে গিয়ে আরেকটা দিন শুরু হয়, তিনি বুঝতেই পারেন না। হয়ত তাই। তাই-ই তিনি পঁয়তাল্লিশের এদিকে তবু ওদিকে হবেন না। নলিনীর জীবনে ভাঙা-গড়ার খেলা খেলেছে কেউ নির্মমভাবে, সে নিয়মের ধার ধারেনি। এখন কর্মহীন। দুপুরবেলায় কী করতে বেরোত কে জানে! ওই সাইমন আর রফিকের কাছে? এরা কে? যাই হোক, নলিনীতে জীবনটা আটান্নতেই শেষ হয়ে এসেছিল। তাই স্রেফ সিগারেট ধরিয়ে কাশতে কাশতে জীবনটা গলার মধ্যে দিয়ে বেরিয়ে গেল। কিন্তু আশ্চর্যের কথা নলিনীও তাঁরই মতো বাড়ি থেকে পালিয়েছিল। জাহাজের খালাসি হওয়া আর জাহাজ কেনা সে আক্ষরিক অর্থে বলেছে না আলঙ্কারিক অর্থে, জানা যাবে না। কিন্তু খুব নিচু অবস্থা থেকে দারুণ পরিশ্রমের মধ্যে দিয়ে সে খুব ধনী হয়েছিল এ বিষয়ে সন্দেহ নেই। তাঁর নিজের জীবনের সঙ্গে অদ্ভুত মিল। তারপর কোন লগ্ন, কোন ক্ষণের তফাতের ফলে বাকিটা তফাত হয়ে গেল কে জানে! বিজু রায়, জ্যোতিষ-ট্যোতিষ মানেন না। অথচ এভাবেই ভাবলেন। ভাবলেন—হঠাৎ সিগারেট ধরিয়ে কাশতে কাশতে কত সহজে তাঁর সমবয়সী মানুষটির প্রাণ বেরিয়ে গেল, আগের দিনও মেঝেতে আসন পেতে মুরগির কালিয়া খেলেন কবজি ডুবিয়ে, বিজু রায়ের পাশে বসে। মৃত্যু এইভাবে যখন-তখন জানান না দিয়ে আসতেই পারে। সেই বয়স হয়েছে বিজু রায়ের। নলিনীর ভেতর দিয়ে মৃত্যু যেন এই কথাটাই তাঁকে জানিয়ে দিয়ে গেল। এবং মৃত্যু খুব কাছেই বসে দু চোখ মেলে তোমাকে দেখছে জানলে—হঠাৎ সমস্ত কেমন দূরে সরে যায়! সব সম্পর্ক, সব অর্জন, সব নিমার্ণ। না, সব নয়। একমাত্র ছুটকি দূরে সরে না। ছুটকির সঙ্গে সাক্ষাৎ এখনও জীবনের মস্ত বড় আরব্ধ কর্ম। বাকি রয়ে গেছে।

আপাতত এই নলিনী কর নামে লোকটিকেও তাঁর খুব জানতে ইচ্ছে করছে। যেন একই সালে, একই মাসে জন্মের দরুন শুধু তাঁর সমবয়সীই নয়, আরও ঘনিষ্ঠ কিছু, তাঁর নিজেরই আরেকটা চেহারা হয়ে দাঁড়িয়েছে সে। ওকে যত জানবেন, নিজেকেও তত জানা হবে। রাতে হরিহর তাঁর রুটি তরকারি নিয়ে এলে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন—‘আচ্ছা হরিহর, করবাবুর কাছে কেউ আসত না?’

—‘তেমন কেউ না।’

—‘তেমন কেউ মানে?’

—‘এই ধরুন, আপনার মতন, আসতেই করবাবু মিল বলে দিলেন, সঙ্গে সঙ্গে জলখাবার।’

—‘কিন্তু কেউ না কেউ তো আসত।’

—‘শুনুন বাবু, করবাবু এমনিতে খুব ভাল লোক ছিলেন। কিন্তু…কিন্তু…’

—‘কিন্তু কী?’

—‘মরা মানুষের নামে বলব? পাপ হবে না তো?’

—‘কিছু হবে না, তুমি বলো।’ বিজু রায় কখনও এই ধরনের লোকেদের সঙ্গে এরকম অন্তরঙ্গভাবে কথা বলেননি। বদন, প্রমীলা, তাঁর দারোয়ান বিরজু বা তার বাবা বীরখা। একমাত্র ড্রাইভার সমর দিবারাত্র তাঁকে নিয়ে এখান-ওখান যাতায়াত করত বলে তার সঙ্গে অনেক প্রকার কথা বলতে বাধ্য হতেন তিনি। একমাত্র ওই সমরই।

হরিহর বলল—‘করবাবু বড্ড জুয়া খেলতেন। অনেক রকম। সে সব তো আমি জানি না। কিন্তু আমার কাছ থেকে মাঝে মাঝেই টাকা ধার করতেন।’

—‘শোধ করেছিলেন?’

—‘সব শোধ করে দিতেন, কাউকে বলবেন না বাবু, তবে শেষেরটা আর পারেননি, খাস দফতরের পরোয়ানা এসে গেল কি না!’

বিজু রায় চমৎকৃত হলেন। এই মেসের চাকর লোকটি যে প্রায় সব সময়েই ঝলঝলে ইজেরের ওপর একটি গামছা পরে থাকে সে জুয়োখেলাকে পাপ মনে করছে? যখন সারা কলকাতা, সারা ভারত, সারা বিশ্ব জুয়ো খেলে যাচ্ছে। স্বয়ং সরকারবাহাদুর লটারির খেলা বার করেছেন সেই কবে থেকে! সরকারও জুয়ো খেলছে! দ্বিতীয় কথা ওই খাস দফতরের পরোয়ানা। এরকম লাগসই শব্দ কেমন অনায়াসে ব্যবহার করে ফেলল হরিহর! পরোয়ানাটা শোনা যায়। ‘মৃত্যুর পরোয়ানা’—এ জাতীয় শব্দ যেন পড়েছেন কোথাও। কিন্তু ‘খাস দফতর?’ হয় এটা হরিহরের সম্পূর্ণ মৌলিক উদ্‌ভাবন। না হলে কোনও জায়গা থেকে সংগ্রহ। শুনেছে একবার, মনে রেখেছে। তাকেও প্রায় মৌলিকই বলা যায়। শব্দ বা শব্দবন্ধ আর কজন বানায়! সবাইই তো শোনে। শুনে শুনেই মনে রাখে! তিনি বললেন—‘শেষেরটা কত?’

—‘পাঁচ হাজার।’

—‘অ্যাঁ? চমকে উঠলেন বিজু রায়। মেসের চাকর হরিহর অবলীলায় পাঁচ হাজার টাকা ধার দিতে পারে? সেটা মার খেয়ে গেলে তার কোনও হাহাকার পর্যন্ত থাকে না? তিনি বদনকে পাঁচশো টাকা মাইনে দেন, পুজোয় দেড় হাজার টাকা বোনাস। এ লোকটি কত মাইনে পায়? লোকের মাইনের কথা জিজ্ঞাসা করা অভব্যতা। তবু, উপায় নেই, তিনি জিজ্ঞেস করলেন—‘এখানে তোমাকে কী রকম দেয়-টেয়?’

‘আজ্ঞে, ইনকিমেন্টো হয়ে হয়ে এখন তিনশো দশ হয়েছে। বাবুরা বলেছেন সাড়ে তিনশোয় শেষ। কেল রিচ করে যাব। আপনি অত টাকা ধার দিয়েচি বলে জিজ্ঞেস করছেন? আজ্ঞে বাবু আমি গরিব মানুষ আমার চলে কী করে বলুন, আমি আজ্ঞে টাকাটা খাটাই। সুদ নিই টেন পার্সেন্ট।’

—‘তাই? কাদের কাছে খাটাও?’

—‘সে অনেক আছে, এখানকার বাবুরাও দরকারে অদরকারে হরিহরের কাছেই হাত পাতেন।’

—‘ও। করবাবুর টাকাটা কি সুদসুদ্ধ বললে?’

হরিহর জিভ কেটে বলল— ‘না বাবু, তাই কখনও পারি? ওঁর কাছ থেকে আমি এক পয়সা সুদ নিতুম না আজ্ঞে। বাবুর তো কোনও চাকরি-বাকরি, বাঁধা আয় ছিল না। জ্ঞানত কখনও পাপ করিনি বাবু।

—‘তা এখন যে টাকাটা মারা গেল!’

—‘কী করব বাবু, ভাগ্য। সবই ভাগ্য। মেনে নিতে হচ্ছে।’

—‘সাইমন বা রফিক বলে কাউকে চেনো? এখানে আসত।’

হরিহরের মুখে একটা ভয়ের ভাব খেলে গেল। সে বলল ‘আপনি কী করে জানলেন বাবু!’

—‘বলোই না।’

—‘বাবু কাউকে বলবেন না। করবাবু বলতে বারণ করে দিয়েছিলেন। একটা বেঁটে মতো ফিরিঙ্গি আসত বটে। কালো, সাহেব বলে কেউ বুঝবে না। বাজে লোক। আর রফিক, সুবিধের নয়। দেখলে ভয় লাগে। ইয়া চেহারা। করবাবু বোধহয় ওর কাছেও…। মাঝে মাঝে আমার কাছে প্যাকেট রেখে যেত করবাবু না থাকলে।’

—‘কখন আসত?’

—‘কখন? মেসের বাবুরা ঘুমিয়ে পড়লে। ঠাকুররা ছুটি নিয়ে চলে গেলে। আমি খুলে দিতুম। শনিবার সন্ধেতে মেস খালি। শনিবার সন্ধেয় কি রোববার সকালেও আসত অনেক সময়ে।’

—‘আচ্ছা শোনো, এরা কেউ এলে, বলবে না করবাবু মারা গেছেন, আমি থাকলে সোজা ওপরে আমার কাছে পাঠিয়ে দেবে। বুঝেছ?’

হরিহর বড় করে ঘাড় নাড়ল।

কেন এটা করলেন বিজু রায় জানেন না। কে সাইমন কে-ই বা রফিক, তাদের সঙ্গে নলিনী করের কী সম্পর্ক। তাঁর এ সবের মধ্যে ঢোকবার কী আছে! ভেবে করেননি। তেমনি না ভেবেই আজকে তিনি করবাবুর ট্রাঙ্কটা টেনে বার করলেন— চৌকির তলা থেকে। দু-তিন খানা ধুতি, চারটে পাঞ্জাবি, তার মধ্যে একটা সেই গরম ফ্লানেলের যেটা পরে তিনি নলিনীকে প্রথম দেখেছিলেন। কয়েকটা রুমাল। সেই জামেয়ার শালখানা। একটা প্লাস্টিকের প্যাকেটের মধ্যে দাড়ি কামাবার সরঞ্জাম। ভাল তোয়ালে দুটো। এ ছাড়াও একটা চৌখুপি নক্সা-কাটা খাদির বেড কভার, সাদা চাদর, বালিশের ওয়াড়। বেড কভার টা তুলে ভাল করে গুছিয়ে রাখতে গিয়ে তার ভেতর থেকে ঠক করে একটা ছোট নোট বুক পড়ল। খুব পুরনো। মণিময়রা বলছিল— এঁর কোনও আত্মীয় স্বজনের খোঁজ পাওয়া যায়নি। কিন্তু নোট বুকটাতে তিনি দেখলেন তিন, চারটে ফোন নম্বর ও ঠিকানা রয়েছে। এগুলো কি ওরা দেখেছে? জিজ্ঞেস করতে হবে। তারপর একটা পাতায় লেখা— ‘ওপনিং-এর খেলায় দুয়া চৌয়া পঞ্জা লাকি নং। ক্লোজের খেলায় দিনের পর দিন এক্কা দুয়া নওকা। পাত্তি টু পাত্তি চান্স নিতে হবে একবার। জিতলে পঞ্চাশ। হারলে পাঁচ, কুছ পরোয়া নেই। জীবন-জুয়ায় অমৃত বা বিষ যা উঠল তা আমার। লক্ষ্মী যদি ওঠে তো সে দাদু পাবে।’

ঠিক সাড়ে নটায় চিত্তরঞ্জনে পৌঁছে গেলেন বিজন। তিনি ঢাকবার পাঁচ মিনিট পরেই এল রত্না। এ মেয়েটি যে কেন এখনও এরকম নিয়মিত যাওয়া-আসা করছে তিনি জানেন না। শমিত বা শাঁটুল যার সঙ্গে সম্পর্কের ফলে এর সঙ্গে দিদির সম্পর্ক, সে তো ফেরার, এবং দিদি কাটান-ছাড়ান-এর কথাও উল্লেখ করেছিল। মেয়েটি তাঁকেও খুব রুক্ষভাবে তাঁর কর্তব্যের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে, মুক্তি চেয়েছিল। মেয়েটিকে তিনি মুক্তি দিয়েছেন। ও তবুও আসছে।

দিদিকে ও. টি তে নিয়ে গেল। যাবার সময়ে বিজন সাহস দেবার চেষ্টা করলেন, দিদি কিছুই বলল না। শুধু দু ফোঁটা জল শুকনো গাল দিয়ে গড়িয়ে পড়ল। রত্না নিচু হয়ে কিছু বলল দিদির কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে।

দুজনে বসে আছেন। রত্না হঠাৎ মৃদুস্বরে বলল—‘মামাবাবু ও ফিরে এসেছে।’

বিজন অন্যমনস্ক হয়ে ছিলেন। চমকে উঠে বললেন—‘কী বলছ?’

—‘ও, মানে আপনার ভাঞ্জা ফিরে এসেছে।’

—‘ফিরেছে? কোথায়?’

—‘এখনও বাড়িতে আসেনি। আমার সঙ্গে দেখা করেছে।’

বিজন অপেক্ষা করছেন।

রত্না বলল— ‘কাল রাতে আমি ও বাড়ি সব সাফা করে এসেছি। আজ রাত হলে ও পিছনের দরজা দিয়ে ঢুকে ভিতরে শুতে পারবে।’

বিজন অপেক্ষা করছেন।

—‘ও বলছে বাড়িটা বিক্রি করে আমরা যদি অন্য কোথাও চলে যাই।’

বিজন বললেন—‘কিন্তু ওর নামে শুনেছি ওয়ারেন্ট আছে। যেখানেই যাক ও ফেরারি আসামি।’

—‘আপনি যদি বাড়িটা বিক্রির ভার নেন।’

—‘আমি তো তোমায় বললাম ও যেখানেই যাক ফেরারি আসামিই থাকবে।’

—‘আচ্ছা ও যদি ওই টাকাটা দিয়ে দেয়।’

—‘কী টাকা? কাকে?’

—‘মা আপনাকে কিছু বলেনি?’

—‘পরিষ্কার করে বলো কী বলতে চাইছ।

—‘যাদের ভেজাল সিমেন্ট সাপ্লাই করেছিল, সাত আটটা পার্টি, তাদের যদি কমপেনসেশন দিয়ে দেয়!’

—‘কত টাকার?’

—‘আমার ঠিক জানা নেই, তবে লাখখানেক তো হবেই!’

—‘এত টাকা কোথা থেকে দেবে?’

রত্না ইতস্তত করতে লাগল, কিছুক্ষণ পর বলল — ‘আপনি যদি টাকাটা অ্যাডভান্স করেন।’

বিজন মনে মনে বললেন— ও আমি লাখ বা ততোধিক টাকা অ্যাডভান্স করব, আমি বাড়িটা বিক্রি করিয়ে দেব। ও অন্যত্র গিয়ে থাকবে। ভাল।

মুখে বললেন— ‘সুখচরের বাড়ি কার নামে?’

—‘সেটাই তো মুশকিল। এখনকার কানুন তো মেয়েদেরও ভাগ দেয়, আমার দুই ননদের ভাগ আছে, মার ভাগ আছে, ওরও আছে। এই সময়ে যদি ওটা বিক্রি করে দেওয়া যেত! ছ-সাত লাখ টাকা তো নিশ্চয়ই হবে। আপনার টাকাটা আমরা শোধ দিয়ে দিতাম!’

বিজন বললেন— ‘কিছু মনে কোরো না রত্না, শমিত যাকে তুমি বিয়ে করেছ, বাঁকা পথে ছাড়া অন্য কিছু ভাবতে পারে না দেখছি। এ মতলবটা নিশ্চয় ওরই। বর্ন চিট। তুমি যদি ঠিক করে থাক ওকে ডিভোর্স করবে। তবে করতে পার।’

—‘ও বলছিল আপনি বিজনেসম্যান আপনি ব্যাপারটা বুঝবেন, হ্যান্ডল্‌ করতেও পারবেন।’

তখন বিজন বুঝলেন বিজনেসম্যানের সংজ্ঞা অন্ততপক্ষে শমিতদের কাছেও কী দাঁড়িয়েছে। শমিত, তাঁর ভাগনে তাঁকে ঠগ-ই মনে করে। একজন সফল ঠগ। তাই-ই সে প্রস্তাবটা সময়-সুযোগ বুঝে তাঁর কাছে পেশ করেছে। ব্যাপারটা তাঁকে ভাবাল। কতটা ঠগ তিনি? কিছুটা তো নিশ্চয়ই! কিন্তু কতটা? রত্না মুখ নিচু করে বলল— ‘মামাবাবু, আমি ওকে ডাইভোর্স করতেই পারি। আমার কোনও অসুবিধে হবে না। আমার পিতাজি আমাকে আলাদা সম্পত্তি লিখে দেবে। গুড্ডুও ভাল ভাবে মানুষ হবে। যে লোক সাচ্চা নয়, তাকে নিয়ে এমনি ভেসে পড়বার মুশকিল আছে আমি জানি। কিন্তু আমি ওকে ছেড়ে দিলে ও একদম তলায়, নীচে ঔর ভী নীচে চলে যাবে। এখন, আমার পিতাজি এ সাদি দিতে চাননি। আমার শাস ভী না। ও-ও তখন পিছু হটছিল। আমি জিদ্দি আছি। আমিই জোর করে এটা করেছি। এখন যদি ও গাড্ডায় পড়েছে বলে ভেগে যাই আমার সাচ্চাই কোথায় থাকবে? নিজেকে, আমার নিজের অন্দরে যে ভগোয়ান আছে তাকেই বা কী জবাব দেব?’

বিজন মন দিয়ে শুনছিলেন মেয়েটির কথা। তাঁর ভাগনে-বউ। এ কদিনে জেনেছেন ও মাত্রই স্কুল ফাইন্যাল পাশ। হায়ার সেকেন্ডারিতে আটকে গিয়েছিল। শমিত নাকি ওকে পড়াত। কী যে পড়াত ভগবান জানেন। বি. কম ফেল করেছে দুবার। হঠাৎ যেন বিজন ইলেকট্রিকের শক খেলেন। তিনিও বি. কম ফেল করেছিলেন। তিনি গ্র্যাজুয়েট নন। তৃতীয়বার পরীক্ষায় বসবার ভয়েও বটে, ছুটকি চলে যাওয়ার পরের গভীর অন্ধকার সইতে না পেরেও বটে তিনি পালিয়েছিলেন। বাবা ছুটকির নাম মুখে আনতেন না। মা! মাও কি খড়গহস্ত হয়েছিল। মায়ের ওরকম বিভীষণ চেহারা আর কখনও দেখেন নি বিজু। ওর নাম কেউ আমার সামনে উচ্চারণ করবে না, ভুলে যাও, ওকে তোমরা ভুলে…। গর্ভধারিণী মায়ের চেয়ে সন্তানকে কেউ বেশি ভালবাসে? সেই মা যখন ভূলে যায়, ভোলবার ম্যানডেট জারি করে, তখন অন্য কে আর…। তবে মা সন্তানকে সবচেয়ে ভালবাসে এটা একটা ধারণা। ছুটকি যা করেছিল তা, বা তার চেয়েও বেশি কত কত লোকে করছে আজ। জল-ভাত হয়ে গেছে। অন্তত তাঁদের সোসাইটিতে। কে জানে বিত্তবানের সমাজে হয়ত বরাবরই মূল্যবোধ আলাদা ছিল। শর্মাজির বর্তমান স্ত্রী রেণুকা শর্মা তাঁর আট বছরের মেয়েকে ছেড়ে চলে এসেছিলেন। সে মেয়ের সঙ্গে কোনও সম্পর্ক আছে বলেও তিনি জানেন না। কাজেই মা সন্তানকে সবচেয়ে বেশি ভালবাসবেই— এটা একটা ধারণা। সংস্কার। মা ছুটকিকে চিঠিতে কী লিখেছিল, বড় দেখতে ইচ্ছে করছে। গর্ভধারিণীত্ব শেষ পর্যন্ত জয়ী হয়েছিল। কিন্তু শেষ জীবনে, একেবারে শেষে। তাঁর মনে পড়ল সে সময়ে তিনি ছুটকির জন্য ভীষণ গুমরোতেন। কাউকে বুঝতে দিতেন না। বাইরে যেমন হাসি খুশি, চঞ্চল ইয়ার্কিবাজ তেমনই। কিন্তু গঙ্গার ঘাটে গিয়ে চুপচাপ বসে থাকতেন। বাইরের হাওয়াটা যেমন হু হু করত, ভেতরটাও তেমনি হু হু করত। যেন বুকের ভেতরটা শূন্য মাঠ একটা। খাঁ খাঁ মাঠ। বাতাস বয়ে যাচ্ছে সেই মাঠের ওপর দিয়ে। শূন্য, শূন্য। জীবনের সামান্য সেই লেখাপড়া তা-ও শেষ করতে পারলেন না। পারল না বিজু। বিজনেস অর্গানাইজেশন, কম্পানি ল, ইনকাম-ট্যাক্স, অডিটিং অঙ্ক কিচ্ছু মাথায় ঢুকত না। সমস্ত ডেবিট ক্রেডিট, জার্নাল লেজার ফোলিও, অ্যাডভান্সড অ্যাকাউন্টেন্সির সমস্ত থিয়োরি, ফর্মুলা, ইকোয়েশনের ওপরে ছুটকির মুখ ভেসে উঠত, ছুটকির ঈষৎ ঢেউ-খেলানো মাঝ-পিঠ-ছাপানো বানে ফেঁপে ওঠা গঙ্গার মতো চুল। ছুটকির চোখ, গাঢ বাদামি, দুষ্টু দুষ্টু আবার ভাবুক বড় বড় পল্লবওলা। ছুটকির ছোট্ট তীক্ষ্ণ নাক। ভীষণ মিষ্টি ঠোঁট ছুটকির। তার শ্যামলা রঙের গালে সোনার মাকড়ির ছায়া। ডুরে শাড়ি, সরু সরু ছোট ছোট আঙুল। পারল না বিজু। বি. কমটা পাস করতে পারল না। অথচ সেই বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশনই এখন করছে! তখন অদ্ভুত এক অপারগত্ব। ভীষণ সময়! কোনও স্থির লক্ষ্য সামনে নেই। ভয়াল বাস্তব উদ্যত হয়ে রয়েছে। নতুন কিছু নেই। কেউ নেই। অথচ পুরনো প্রিয়কে, ঘনিষ্ঠকে হারানো। কী ভয়াবহ সময় গেছে বিজুর জীবনে। শ্মশান ধারের সেই বাড়ির ছাদে সমস্ত কথা, তা যত গোপনই হোক, ছুটকির সঙ্গে। ছুটকি এক বন্ধু আর নিতাইদা আর এক। নিতাইদা অনেক অশ্লীল কথা বলত। অশ্লীল কথা উচ্চারণে তখন কেমন একটা মজা পাওয়া যেত। যেন চুরমুর খাওয়া, মুচমুচে সব শব্দ। আবার ইংরিজিও জোগাড় করে আনত, বলত ‘ফাক’ ‘ফাক’ মানে জানিস? জানিস না? মানেটা বুঝিয়ে দিত, দুজনে মিলে হাসত খুব খানিকটা, তারপর বলত ‘কক’ মানে কী বল তো’ ‘কেন মোরগ’ বিজুর জবাব। নিতাইদার হাসি চমৎকার ভাবে বেড়ে যেত। তারপর মানে টানে সব শেষ করে বলত ‘এই খবর্দার। এ সব যেন তোর ওই ছুটকি না ছোড়দিকে বলবি না। তুই তো আবার তোর ছোড়দির সামনে ন্যাংটোও হতে পারিস।’ এটা নিতাইদার বাড়াবাড়ি। কিন্তু সত্যিই নিজের অনেক গোপন অভিজ্ঞতার কথা বিজু ছুটকিকে বলত, কিন্তু ছুটকি কি কিছু বলত? বিজুকে? কিচ্ছু না। নেহাত বাধ্য না হলে না। কিন্তু ভান করত যেন সব বলছে। সবচেয়ে গুরুতর কথাটাই তো একদম চেপে গিয়েছিল। কেউ বিশ্বাস করেনি। ছুটকির প্রাপ্য প্রহারটা বাবার কাছ থেকে দাদাদের কাছ থেকে তাকেই খেতে হয়েছে। — ‘জানিস সব, বলছিস না।’ শেষকালে মা এসে মাঝখানে দাঁড়াল, ‘অতবড় ছেলেকে চোরের ঠ্যাঙানি দিচ্ছ সবাই মিলে কি জন্যে? ও তো বলছে জানে না। আর জেনেও যদি এত মার খেয়েও হজম করে থাকতে পারে। থাকতে দাও।’ ছুটকি তাকে বলেনি, ভাই তো! ওইটুকু দিদিগিরি। কিংবা ভাইয়ের কাছে নিজের আব্রু রক্ষা। ছুটকি চলে যাওয়ার পর অনেক ভেবে সে এটাই বুঝেছে।

রত্না বলল ‘মামাবাবু, আপনি তো কিছু বললেন না।’

বিজন দেখলেন ডাকাবুকো মেয়েটির চোখ ছলছল করছে। তিনি বললেন ‘শমিত কিছু জানে না। কিস্যুই জানে না। আয়্যাম সরি বউমা। আমাকে একটু ভাবতে দাও। আগে দিদির এ ব্যাপারটা চুকে যাক। এখন অন্য কিছু মাথায় নেই।’ বললেন বটে, কিন্তু বলেই বুঝলেন এক দিক থেকে দেখতে গেলে এই যুবক-যুবতীদের, যাদের এখনও অনেক দিন বাঁচতে হবে, একটি শিশুকে মানুষ করে তুলতে হবে, তাদের সমস্যা অনেক গুরুতর, দিদি তো মেরে এনেছে। তিনিও। হয়ত তিনিও।

ডাক্তার বেরিয়ে এলেন। বিজন এগিয়ে যাচ্ছেন। উনিই প্রধান সার্জন, ভেতরে পুরো একটা টীম। বললেন—‘সরি, মিঃ রায়, গোটা লিভার, সপ্লিন, ইনটেসটাইন সর্বত্র স্প্রেড় করে গেছে। কিছু করার নেই। আমরা হাত দিইনি। ওপন করে দেখেই আবার সেলাই করে দিয়েছি।’

—‘এখন, তাহলে?’

—‘অপেক্ষা পাঁচ ঘন্টাও হতে পারে, পাঁচ দিনও হতে পারে, আবার পাঁচ মাসও।’

—‘কিন্তু পেইন? ওই অমানুষিক পেইন সহ্য করতে হবে যে কটা দিন বাঁচবে?’

—‘কেমোথেরাপি করতে পারেন। কিছু লাভ হবে না মিঃ রায়, শুধু গুচ্ছের সাইড এফেক্ট। লেট হার গো ইন পীস।’

—‘পীস?’ বিজু রায় তিক্ত কণ্ঠে বললেন।

—‘ওই হল।’ ডাক্তার মুখ নিচু করে ধীর পদক্ষেপে করিডর বেয়ে চলে গেলেন। অভিজ্ঞ। বয়স্ক মানুষ। অনেক দেখেছেন, যন্ত্রণা, মৃত্যু। তবু যখন এভাবে হেরে যান, প্রতি পদক্ষেপে গভীর হতাশা, ক্লান্তি, দুর্মর একটা অভিমান স্পষ্ট হয়ে ওঠে। রত্না এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করল ‘কী হল মামাবাবু?’

—‘কোনও আশা নেই বউমা!’

রত্না হঠাৎ ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। তারপর জোর করে নিজেকে সামলে নিল। আরও কিছুক্ষণ পর ও.টির দরজা খুলে গেল— দিদি বেরিয়ে আসছে, সাদা চাদরে ঢাকা। মুখটা নীল। বিকেলের দিকে জ্ঞান হবার দুতিন ঘণ্টা পরেই মারা গেল দিদি। ঘোর-লাগা দৃষ্টিতে চারদিকে দেখল, ঘোর-ঘোর গলায় ডাকল— ‘বিজু!’ বিজু রে!’ তারপর চুপ হয়ে গেল।

বিজু সারাদিন ফেরেননি আর। রত্নাও না। কাছাকাছি দোকান থেকে দুপুরে খেয়ে নিয়ে ম্যাটিনিতে একটা ফিল্‌ম্‌ দেখে দুজনে সময় কাটিয়েছিলেন। ভিজিটিং আওয়ার হতে না হতেই হাজির। তা শেষ পর্যন্ত ওই হল। জ্ঞান ফিরল, তারপর চিরকালের মতো চলে গেল। মাঝখান থেকে বিজু অবাক হয়ে রইলেন। দেখা নেই, শোনা নেই, সম্পর্ক নেই, আজ পঁয়ত্রিশ বছরেরও অধিক হল। শুধু শেষ কটা দিন। তবু জীবনের শেষ আলো আঁধারির বারান্দায় দাঁড়িয়ে দিদি ঘড়ঘড়ে গলায় বিজুকেই ডাকল? তবে কি দীর্ঘ জীবনের দীর্ঘ অদর্শনের মধ্যেও দিদির ছোট ভাইয়ের জন্য একটা করুণ আকুলতা ছিল! সেই বিরহবোধই কি তবে দিদির জীবনের শেষতম কথা! আশ্চর্য! তিনি কি দিদির শেষ-কৃত্য করবার জন্যেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন? না। না। শুধু দিদি তো নয়। আরেক জনেরও। সম্পূর্ণ অচেনা একটি সমবয়সী-লোকেরও। সে লোকটিও যেন দিদিরই মতন তাঁর হাতের আগুনের জন্য অপেক্ষা করে ছিল।

রত্না তখন কাঁদতে কাঁদতে বলছিল বিয়েতে অমত করলেও পরে মা তাকে কত ভালবাসত। অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় কী অসামান্য সেবা করেছে। গুড্ডুকে হাতে করে মানুষ করেছে। কিন্তু বিজু রায় অর্ধেক শুনছিলেন। অর্ধেক শুনছিলেন না। অর্ধেক মন দিয়ে ভাবছিলেন, ভাল ভাল। কৃতজ্ঞতা ভাল। বড় বিরল প্রজাতির মানবিক গুণ। ভালবাসা নয়! শুধু অন্তত এইটুকু ছলছলে কৃতজ্ঞতা। আর মনের অপরার্ধ দিয়ে তিনি ভাবছিলেন— এ কি কাকতালীয়? এই সব দেখা-শোনা মৃত্যু এ সব কি দৈবাৎ ঘটে? দৈবাৎ ঘটল? নাকি….. সময়। লগ্ন, সঠিক লগ্নেরই একটা সঠিক টান আছে? ঠিকঠাক সব ঘটিয়ে দেয়! মণিদীপিকার জন্মদিনে লাল পায়েস আর নাইলন ডলের মতো! একদিন আগেও নয়। একদিন পরেও নয়।


কেমন একটা অতীন্দ্রিয় অনুভবে অর্জুন বোঝে যে তিতি তাকে ডাকছে। তার মনে হয় এটা অতীন্দ্রিয় অনুভব। সিক্সথ্‌ সেন্স। কিন্তু কতকগুলো ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য কারণও আছে এই অনুভবের। এটা অস্বীকার করা যায় না। যেমন তিতি দুবার তাদের কেমিস্ট্রি ল্যাবের সামনে দিয়ে ঘুরে গেল। শুধু শুধু। তিতির সঙ্গে একজন বন্ধু ছিল। গোপা বোধহয় মেয়েটার নাম। ভীষণ শব্দ করে গলা খাঁকারি দিল, অসভ্যের মতো। সার মুখ তুলে তাকালেন। প্র্যাকটিক্যাল ক্লাসের পর সে বাইরে বেরিয়ে দেখল ফুলে ভরা জারুল গাছের তলায় তিতি দাঁড়িয়ে আছে। একা। অর্জুন এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করল— ‘ডাকছিলি?’ তিতি কিছু না বলে চলতে আরম্ভ করল। কম্‌পাউন্ড পার হয়ে সে মেন বিল্ডিঙের চত্বরে উঠল। গোপা এবং আরও কয়েকটি মেয়ে দাঁড়িয়ে ছিল, তাদের কিছু বলল, তারপর তর তর করে সিঁড়ি নেমে এসে কলেজ গেটের বাইরে বেরিয়ে এল। অর্জুন সারাক্ষণই তার পেছন পেছন এসেছে, খালি মেন বিল্ডিঙের ওপরে ওঠেনি, একটু দূরে দাঁড়িয়ে ছিল। বাইরে বেরিয়ে এসে দেখল তিতি এখনও চলছে। খুব হনহন করে না হলেও খুব ধীর লয়েও নয়। তার উদ্দেশ্যটা কী এখনও বোঝা যাচ্ছে না। সে কি সত্যিই অর্জুনের সঙ্গে কিছু কথা বলার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছে, না সেরকম কিছু নয়? অন্য কোথাও যাচ্ছে। হয়ত বাড়িই! সেটা অর্জুন পুরোপুরি বুঝতে পারছে না। অথচ ভেতরে ভেতরে তার স্পষ্ট ইন্দ্রিয়াতীত ষষ্ঠ অনুভব তিতি তাকে ডাকছে।

একটু তাড়াতাড়ি হেঁটে সে তিতিকে প্রায় ধরে নিল। বলল— ‘আস্তে চুল। আরেকটু আস্তে।’ তিতি পেছন ফিরল না। থামলও না। তাদের মধ্যে এইরকমই হয়। ব্যক্তিত্বের দ্বন্দ্বের একটা তীব্র টানা-পোড়েন চলে, চলতেই থাকে। কখনও অর্জুন ডমিনেট করে, কখনও তিতি। আজ যেমন। এতটা পথ পেছন পেছন ছুটে এসেও অর্জুন তিতিকে ধরতে পারছে না। তিতিই কর্তা। তিতি ডমিনেট করছে।

অথচ কটা দিন আগেই তিতি যখন তাদের চুঁচড়োর বাড়িতে গিয়েছিল, তিন দিন থেকেছিল তখন, সেই পুরো সময়টা তিতি অর্জুনের নিয়ন্ত্রণে ছিল। অর্জুনই ছিল কর্তা। সে তিতিকে ইচ্ছেমতো হাসিয়েছে, কাঁদিয়েছে, রাগিয়েছে।

প্রথমটা তিতি যেতে চায়নি। সে বন্ধুদের সঙ্গে যখন যেখানে খুশি যায়, বন্ধু থাকে বান্ধবও থাকে। কোনও ব্যাপারই নয়। কিন্তু অর্জুনের বেলায় সে ‘বন্ধুর সঙ্গে বেড়াতে যাচ্ছি’টা বলতে চাইছিল না। একটাই কথা বলেছিল— ‘তুই তো আমার বন্ধু নয়, ভাই। মিথ্যে বললে নিজেকে ছোট করা হয়।’

অর্জুন অবাক হয়ে বলেছিল— ‘কথাটা তুই বলতে পারলি তিতি? তোর সঙ্গে যখন আলাপ হয়, তুই জানতিস আমি তোর ভাই হই সম্পর্কে? আমি জানতুম তুই আমার বোন হোস?’ কেউই জানতুম না। এই সেদিন জেনেছি। সুতরাং বন্ধু পরিচয়টাই প্রথম, আদি পরিচয়।’

—‘কিন্তু গোপা, শৃঞ্জয়, বিশ্বজিৎ পৌলোমী কেউ যাবে না… আমি একা!’ খুবই দ্বিধা প্রকাশ করে তিতি।’

—‘দেখ তিতি, বাজে কথা বলিসনি। তুই খুব ভাল করেই জানিস তোর ওই গোপা শৃঞ্জয় এবং বিশ্বজিৎদের আমি দু-চোখে দেখতে পারি না। পৌলোমী আসতে পারে। যদি সে চায় এবং তুই চাস। কিন্তু আমি চাই না। আমি নিমন্ত্রণকর্তা, আমি চাইছি না, সে ক্ষেত্রে পৌলোমীর আসাটা কি খুব সম্মানজনক হবে? আর তুই তো জানিস তোকে নিয়ে যাচ্ছি আমার নিজের বাড়িতে আমার মা, কাকিমা সবার কাছে। সেখানে নিশ্চয়ই আমার কাছ থেকে তোর শ্লীলতাহানির ভয়টা নেই। না কী?’

‘বাজে কথা বলিস না অর্জুন, তুই আবার আমার শ্লীলতাহানি করবি কী রে? আমি বরঞ্চ তোর এই মভ রঙের শার্টটা টেনে ছিড়ে দিতে পারি। কত দিন পর পর তোকে এই একই শার্টে দেখছি।’

—‘আরও কদিন দেখতে পারিস, রাতে কেচে দিনের বেলায় যদি পরে বেরোতে পারি তাহলে আর সিনথিটিক পোশাকের মানে কী?’

—‘কিন্তু কেন? তোর কি আর নেই?’

—‘নেই তা নয়। তবে কমই আছে। কমই রাখতে চাই। এবং বিশ্বজিতের মতো ফ্যাশন-প্যারেড করা ছেলেদের দেখলে আমার একই সঙ্গে বিবমিষা এবং করুণা হয়। একটা উনিশ-কুড়ি বছরের যুবক হ্যাংলার মত ওয়ার্ডরোব ধুর, কাপড়ের আলমারির দিকে তাকিয়ে জীবন কাটিয়ে দিচ্ছে ভাবলে আমার কী যে হয়, রাগ না ঘেন্না না অবিমিশ্র অবজ্ঞা ঠিক আমি বোঝাতে পারব না রে তিতি। আর তা ছাড়াও জেনে রাখ আমি তোদের মতো বড়লোক নই। তিনটে বিধবার আমি একমাত্র সন্তান। তারা আমাকে নিজেদের সব দিয়ে অনেক কষ্ট করে বড় করছে। আমাকে তাদের দেখতে হবে। আমার কটা শার্ট, আর সে শার্টটা কদিন পরলুম এসব নিয়ে ভাবলে আমার চলে না। এগুলো ভাববার যোগ্য বিষয় বলেও আমার মনে হয় না।

অতএব তিতি অর্জুনদের চুঁচুড়ার বাড়ি গেল। এবং গিয়ে একাধারে মুগ্ধ এবং বিষণ্ণ হয়ে গেল। তিতি একটু অদ্ভুত। অর্জুনও অদ্ভুত কিন্তু তিতি আরও অদ্ভুত। সে যখন তার আগেকার বন্ধুদের অর্থাৎ ওই এবং বিশ্বজিৎদের সঙ্গে থাকে তখন তিতি পাক্কা ফিরিঙ্গি। এই কলকাতার শতকরা পঞ্চাশ জন কলেজি তরুণীর মতো। পরিসংখ্যানটা অর্জুনের নিজের। ওরা দিজেদের মধ্যে এটাকে বলে ‘হাই-ফাই কালচার’, যদিচ কালচার বলে এর ভেতরে কিছু নেই বলে ওর মত। এ নিয়ে তিতির সঙ্গে তার ফাটাফাটি তর্ক হয়েছে এক সময়ে। অৰ্জুন বলে ‘যদি ব্যুৎপত্তিগত’ অর্থে ধরিস তাহলে এটা কালচার। কারণ এরা মাতৃভাষার সঙ্গে সঙ্গে মাতৃভূমির সব কিছু ত্যাগ করে মার্কিন জীবনযাত্রার ধরন “রপ্ত” করেছে। কালটিভেট করেছে অতএব— কালচার বলতে পারিস। নিজের দেশের বাতাসে শ্বাস নেয়। সরকারি টাকার অর্থাৎ ট্যাক্সপেয়ারদের টাকার মুণ্ডুপাত করে বড় বড় পড়াশুনো করে, তারপর প্রাণপণ চেষ্টা করতে থাকে বিলেত-আমেরিকায় উড়ে যাবার। সেখানে গিয়ে এদের শতকরা নিরানব্বুইজন পাত্তা পায় না। কোনওরকমে চাকরিটা সেরে নিজেরা যে দেশি কলোনি গড়েছে সেইখানে শামিল হয়। একটাও বিলিতি বা আমেরিকান লোকের সঙ্গে মেলামেশা করে না। বাইরে থেকে তাদের অনুকরণ করে আর যে সংস্কৃতি এখানে ময়লা কাপড়ের মতো ত্যাগ করে গেছে সেই সংস্কৃতির বহিরঙ্গ ওইখানে প্রতিষ্ঠিত করবার হাস্যকর চেষ্টা করে যায়। দুর্গাপূজো, সরস্বতীপুজো, জলসা।

তিতি বলে— ‘তুইও বাইরে থেকে দেখে বিচার করছিস। সুতরাং অবিচার করছিস। যারা বাইরে যায় শুধু আরাম আর ডলার রোজগারের জন্যে যায় না। কাজ করবার জন্যেও যায়। এখানে কাজ করবার পরিবেশ আছে? জানিস আমার জারতুত দাদা দিব্যদা ইলেকট্রিক্যাল এঞ্জিনিয়ার। কোলাঘাটে আছে। বলে ইউনিয়নের ঠ্যালায় কাজ-কর্ম করাই দায়। দুর্নীতির চোটে হাত-পা বাঁধা জগন্নাথ হয়ে থাকো।

—‘ওকে ঠুঁটো জগন্নাথ বলে’ অর্জুন সংশোধন করে দেয়।

‘বেশ ঠুঁটো জগন্নাথ। তা হলে? কাজের জন্যে লোকে বিদেশে যাবে না কেন? সব প্রতিভা এখানে অপচয় করতে হবে? না কি? খোরানা, কি নারলিকর এখানে বেরোল?’

—‘তুই সরকারি সংস্থার কথা বললি, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান কি এদেশে নেই? গবেষণাগার কি এদেশে নেই?’

—‘আছে। থাকবে না কেন? সেখানেও কি অসুস্থ প্রতিযোগিতা নেই ভাবছিস? প্রফেশন্যাল জেলাসি, ক্লিকবাজি এসব সর্বত্র আছে।’

—‘বিলেত দেশটাও মাটিরই রে! বহুদিন আগেই এক ভদ্রমহিলা এ কথা বলে গেছেন। এখন তো তাড়িয়ে দিচ্ছে। নিজের দেশ ছেড়ে বিদেশে যারা সেকেন্ড ক্লাস সিটিজেন হয়ে আজীবন কাটায় তাদের আমি ধিক্কারই দেব। আর কিছু আমার মুখ দিয়ে বেরোবে না।’

—‘দিস। ধিক্কারই দিস। কিন্তু জেনে রাখিস তারা সবাই অবজ্ঞার পাত্র নয়, করুণার পাত্র বরং। দিব্যদার এক বন্ধুর কথা জানি, ফৈজাবাদে ওয়ার্কস ম্যানেজার না কী হয়ে গিয়েছিল। সে অঞ্চলের লোকেদের অত্যাচারে পালিয়ে আসতে বাধ্য হয়। বাংলো ঘেরাও করে ফেলেছিল মারবে বলে। অপরাধ কী? না কোম্পানির উন্নতির জন্যে কতকগুলো মেজার নিতে আরম্ভ করেছিল। ম্যানেজিং কমিটিই সেটা পাস করে দেয়। ইউনিয়ন লিডাররাও তখনকার মতো সায় দেয়। তারপর ওই ব্যাপার। ইউনিয়ন লিডারগুলো দু পক্ষেরই খায়।

‘বঙ্গালি মনজারকো হঠাও’— এই স্লোগান দিয়াছিল। তা এই তো নিজের দেশের নাগরিকত্ব!’

তিতি সেবার জিতে যায়। অর্জুন তাতে কিছু মনে করে না। তিতি মেয়ে বলেই তাকে হেরে যেতে হবে এতোটা পৌরুষাভিমান নেই তার। কিন্তু ‘বা বা ব্ল্যাকশিপ’ দিয়ে পড়ুয়া জীবন-শুরু করা বাচ্চাদের বাবা-মাদের ওপর তার কোনও শ্রদ্ধা নেই। সে তিতি যতই বলুক। তিতি বলে— ‘ইংরিজিটা জানা না থাকলে কাজকর্ম পেতে অসুবিধে হচ্ছে। বিয়ে-টিয়ে হতেও অসুবিধে হচ্ছে, এটা ঘটনা। বলতে পারিস দাসত্বের উদ্‌গার…’

এইখানে আবার অর্জুন তাকে সংশোধন করে দেয়— ‘দাসত্বের উদ্‌গারটা আবার কী? গুরুভোজন হয়ে গেলে উদ্‌গার বা ঢেকুর ওঠে। কিন্তু গুরুভোজনটা একটা বিলাস। দাসত্বের অভিজ্ঞতা থেকে উদ্‌গারটা ঠিক— বুঝতে পারছিস জুতসই হচ্ছে না। বরং দীর্ঘস্থায়ী দাসত্বের অভ্যাস, অভ্যাসই বল।’

—‘ঠিক আছে বাবা তুই বাংলা ভাল জানিস, তুই যা বলবি আমায় মেনে নিতে হবে। কথার মাঝখানে কথা বলায় তিতি একটু অসন্তুষ্ট।

অর্জুনকে তখন বোঝাতে হয়— ‘দ্যাখ তিতি, তোর সঙ্গে আমার ভদ্রতার, ভব্যতার সম্পর্ক নয়। দুজনেই আমরা বেড়ে উঠছি। তোর ভুল আমি আমার ভুল তুই যদি শুধরে দেওয়া-দেওয়ি না করি তো দুজনেই অসম্পূর্ণ হয়ে থাকব। সেটা কী ভাল?’

তিতির মুখ তবুও গোমড়া।

—‘আচ্ছা তোকে একটা উদাহরণ দিচ্ছি, স্বস্ত্যয়ন বানানটা বল তো!’ তিতির বানান ভুল হল। সে গোমড়া মুখে বলল, ‘জানি না তো কী করব!’

—‘ঠিক আছে! জানিস না। হেমারেজ বানান বল তো?’ তিতির বানান আবার ভুল হল, সে লজ্জা পেয়ে বলল—‘ইস্‌ কথাটা তো যখন-তখন ব্যবহার করি, অথচ বানানটা বলতে পারলাম না, এ মা!’

অর্জুন বিজয়ীর হাসি হেসে বলল— ‘বানান এক আধটা ওরকম ভুল হতেই পারে, ওটা কোনও ব্যাপার না, কিন্তু মাতৃভাষার বহুব্যবহৃত শব্দটা যখন ভুল করলি তোর প্রতিক্রিয়া হল— জানি না, তো কী করব!’ আর ওই ইংরেজি হয়ে যাওয়া ক্ল্যাসিক্যাল শব্দটা ভুল করে তুই লজ্জা পেলি, বললি এ মা!— এর মানে কী? কী দাঁড়ায়? তু-ই বল! আমরা এখনও পরাধীনই আছি। গোলাম। সর্ব বিষয়ে। শুধু বাক-স্বাধীনতাটাই একমাত্র স্বাধীনতা, যা আমরা অর্জন করতে পেরেছি। কথার ওপর কেউ ট্যাক্স বসাতে পারছে না।’ বলে অর্জুন হাসতে থাকে। তিতি ভাবিত। তিতি এই পর্বে হেরে গেছে। কিন্তু সে মনে করছে না কিছু।

তিতি অদ্ভুত। চুঁচড়োয় অর্জুনদের বাড়ি গিয়ে সে আনন্দে একবারে আত্মহারা হয়ে গেল। ‘খড়খড়ি খড়খড়ি! গরাদ-দেওয়া জানলা! ফ্যানটাসটিক্‌!’

প্রথমে গিয়ে দাঁড়াল বাগান পেরিয়ে তিন চার ধাপ উঠে কাঠের বিরাট দরজা খুলে ভেতরের প্রশস্ত দালানে যার এক দিকে ঠাকুর দালান, অন্য দিক দিয়ে কাঠের সিঁড়ি উঠে গেছে। সিঁড়ি বেয়ে নেমে এসেছিলেন অর্জুনের মা। ধবধবে ফর্সা। একটু মোটাসোটা। কাঁচা পাকা চুল। কালোপাড় সাদা শাড়ি। খালি পা। তিতি প্রণাম করল। অর্জুনের মা বললেন—‘এই তোর প্রতীতি?’

অর্জুন গম্ভীরভাবে বলল—‘আমার প্রতীতি আমার নিজের কাছেই আছে মা, ও বরং তোমারই প্রতীতি, দেখো তোমার তনু-বোনের সঙ্গে মিল পাও কি না।’

—‘প্রতীতি, তোমার মা তনু আমার আপন পিসতুত বোন ছিল জানো তো? খুব মামার বাড়ি আসত। কী খেলতুম আমরা! রান্নাবাটি! পুতুল!’

সেই সময়ে তিতি বলে উঠেছিল ‘খড়খড়ি! খড়খড়ি! গরাদ!’ বলেই দু-সিঁড়ি। টপকে টপকে ছুট। সিঁড়ির বড় চাতালটায় পৌঁছে বোধহয় তার খেয়াল হয় সে মুখ ফিরিয়ে বলে—‘মাসি আমি ওপরে আসতে পারি তো?’

—‘নিশ্চয়ই।’ মৃদু হেসে বললেন অর্জুনের মা।

আসলে সিঁড়ির সেই বড় চাতালেই একটা পেল্লাই জানলা ছিল। সেটা দিয়ে পেছনের বাগান দেখা যায়। এই বাগানের পেছনে গঙ্গা। সেটাই ছিল তিতির আহ্লাদের কারণ। জানলায় প্রশস্ত ধাপ ছিল। সেই ধাপের ওপর বসে পড়ে সে দুটো গরাদের মধ্যে নিজের মুখটা চেপে ধরেছিল, আরও দুটো গরাদ হাত দিয়ে ধরে। বলেছিল— ‘জানিস অর্জাই, যেখানে যাব খালি গ্রিল গ্রিল গ্রিল, আমার প্রাণটা হাঁপিয়ে ওঠে। আজ কতদিন পর গরাদ দেখলাম! গরাদে মুখ রাখলাম!’

অর্জুন বলল— ‘তিতি তোর মুখ ডোরা কাটা হয়ে গেছে।’

অর্জুনের মা খুব লজ্জিত হয়ে বললেন— ‘এত জানলা, দরজা এ বাড়িতে যে নিয়মিত ঝাড়া-মোছা করতে পারি না, ইস্ প্রতীতি তোমার মুখটা কী হয়েছে।’

—‘মাসি আমাকে তিতি বলো। এই শাটারগুলো খোলা যায়?’

—‘কেন যাবে না? তবে খুব ধুলো।’

—‘আমি একটু এগুলো ফাঁক করব? ফাঁক করে করে দেখব? ভেঙে যাবে না তো?’

—‘না না ভাঙবে না, ও-সব খুব শক্ত।’

তিতি খড়খড়ি ফাঁক করে দেখতে লাগল, বন্ধ করে দেয়, আবার খোলে।’

অর্জুন এই সময়ে বলে ওঠে— ‘ওপরে চল, এক জানলা থেকে আরেক জানলায় ছুটে যাবার সুযোগ পাবি, তবে অপেরা-গ্লাস-টলাস কি বাইনোকুলার আমার কাছে নেই, আগে থেকেই বলে দিচ্ছি।

—‘কেন, অপেরা গ্লাস কী হবে?’

—‘না হলে চারুলতার ছবিটা ঠিক সম্পূর্ণ হচ্ছে না, হচ্ছে কি’

খড়খড়িগুলো তখনকার মতো বন্ধ করে দিয়েছিল তিতি। গম্ভীর মুখে বলেছিল— ‘তোর অনেক গুণ অর্জুন, কিন্তু এই এক দোষে সব নষ্ট।’

—‘গুণগুলোর কথা ভাল করে জানি না। বলছিস অনেক, তাই জিজ্ঞেস করছি না এখন, বড্ড সময় যাবে। কিন্তু একটা দোষ বলছিস, দোষটা কী জানতে পারি!’ অর্জুন হেসে জিজ্ঞাসা করে।

—‘সিনিসিজ্‌ম্‌। এক ঘড়ি গঙ্গাজলে এক ফোঁটা ইয়ে….।’

“ঘড়ি” নয় রে “ঘড়া” এক ফোঁটা ইয়ে নয় “চোনা”, চোনা মানে গরুর হিসি। খুব পবিত্র জিনিস।’

অর্জুনের মা ধমক দিয়ে উঠেছিলেন এই সময়ে— ‘আঃ কী হচ্ছে টুটুল!’

—‘ওহ জননী। তিতি কি তোমাদের সময়ের মেয়ে যে হিসি শুনলে মুচ্ছো যাবে? ওরা যে সব ইংরিজি স্ল্যাং জানে তা শুনলে আমি সুদ্ধু লাল হয়ে যেতে পারি। তা জানো?’

—‘আচ্ছা অনেক জ্ঞান দেখিয়েছিস তুই। তিতি আয় ওপরে, আগে মুখ ধুয়ে নিবি।’

যে মুহূর্তে ‘তিতি আয়’ বলে ডাকলেন অর্জুনের মা, সেই মুহূর্তে তিতি এক ছুটে গিয়ে তাঁর কোমর জড়িয়ে ধরল, ময়লা মুখটা তাঁর কাঁঠের ওপর রেখে ঘসতে লাগল। কে জানে কাঁদছে কি না!

অর্জুন বলল— ‘অবিকল কুকুরের মতো করছি।’

—‘বল— বলে যা, অপমানিত হচ্ছি না। ডগ্‌স্‌ আর নোব্‌ল অ্যানিমল্‌স।’

—‘আমি তো শুনেছিলাম ঘোড়া, ঘোড়াদের সম্পর্কে এটা বলা হয়ে থাকে, এক কবি তো ঘোড়া হবার প্রার্থনাই জানিয়েছেন।’

“মানবজীবন খোঁড়া করে প্রভু ঘোড়া করো ভগবান।

অবশ্য, ‘বেতো ঘোড়া নয়- ছ্যাকড়া টানিয়া আবার যাইবে প্রাণ। ”

—‘তোদের ঝগড়া থামাবি?’ অর্জুনের মা বললেন।

—‘তাহলে “তিতি আয়”-টা আবার বলো মাসি! তিতির সকাতর প্রার্থনা।

অর্জুনের মা আবারও বললেন অতএব,— হেসে— ‘আয় তিতি, মুখ ধুয়ে নিবি। আয়।’

এবার অর্জুনকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে মাসির সঙ্গে ওপরে উঠে গেল তিতি। ওপরে দুই কাকিমা ততক্ষণে গা ধুয়ে বেরিয়েছেন। সামান্য আগে-পরে বেরিয়ে এলেন দুজনে ঘর থেকে। মেজ কাকিমা, অর্জুনের মায়ের থেকেও কিছু বড়। সিনিয়র কেমব্রিজ পাশ। খুব কেতাদুরস্ত। লম্বা মানুষ, সাদা কালো পাড় শাড়ি কুঁচি দিয়ে পরেছেন। কাঁধে রুপোর ব্রুচ। চুলটাকে তুলে একটা অদ্ভুত কায়দায় বাঁধা। ঠোঁটের ওপর একটা আঁচিল। তিনিই তাঁর টয়লেটে নিয়ে গেলেন তিতিকে। ছোটজও অর্জুনের মার থেকে সামান্য কয়েকমাসের ছোট। তিনি একটা নীল নক্‌শাপাড় টাঙ্গাইল শাড়ি কুঁচি দিয়ে পরেছিলেন। ইনিও ইন্টারমিডিয়েট পাশ করে এসেছিলেন, বেশ ধনী ঘরের মেয়ে, অহঙ্কার আছে বনেদিয়ানার। বাপের বাড়ির লোকেদের প্রসঙ্গ উঠলেই ফুলে ফুলে ওঠেন। কিন্তু এ সবই বাহ্য। ভেতরে ভেতরে তিনজনেই করুণ বিধবা। অর্জুন বড় হতে হতে বিধায় পর্যবসিত হয়েছেন সবাই। ঠিক পর পর, স্ব স্ব স্বামীর বয়ঃক্রম অনুযায়ী। প্রথমে গেলেন অর্জুনের বাবা। নেফ্রাইটিস। তারপর অর্জুনের মেজ কাকা, ওই একই রোগ ধরা পড়ল। কিছু খেতে দেওয়া হত না। সব বারণ। মেজকাকা খ্যাংরা কাঠির মতো রোগা হয়ে গিয়েছিলেন। ঢলঢল করত কোট, প্যান্ট। তারপর একবার বেড়াতে গেলেন, মুসৌরি-দেরাদুন। মেজকাকি একা ফিরলেন। হয়ত কাকা কিছু অত্যাচার-অনিয়ম করে ফেলেছিলেন। হয়ত উপলব্ধি করেছিলেন এ ভাবে বেঁচে থাকার চেয়ে একদিন জীবনটা ভোগ করে মরে যাওয়াও ভাল। অর্জুন জানে না। ছোটকাকা মেজকাকার বিয়ে হয়েছিল একই দিনে। মেজকাকা মারা যাবার পর ছোটকাকা নিজের থেকেই সাবধান হয়ে গেলেন। প্রোটিন খাওয়া কমিয়ে দিলেন। টাকা- পয়সা, সম্পত্তি সব গুছিয়ে বিলিব্যবস্থা করে বউদিকে, স্ত্রীকে বুঝিয়ে দিতে লাগলেন। অর্জুন যে বছর ক্লাস এইট থেকে নাইনে উঠল, ছোটকাকা তাকে বয়ঃপ্রাপ্ত পুত্রের মতো বোঝাতে লাগলেন শেয়ার, ডিবেঞ্চার, ফিক্সড্‌ ডিপজিট, কারেন্ট অ্যাকাউন্ট, সেভিংস। নাইনে পড়তে পড়তেই ছোটকাকার রোগ ধরা পড়ল— নেফ্রাইটিস। তিনজনের নামে সব কিছু ট্রান্সফার করলেন ছোটকাকা। অনেকানেক সম্পত্তি বিক্রি হয়ে গেল। সে সব বোঝালেন অর্জুনকে। তারপর এক সকালে বেশি রোগা হবার আগেই মারা গেলেন।

‘তোদের বাড়িটা অদ্ভুত।’ শুনে করুণ, বিষণ্ণ স্বরে বলেছিল তিতি।

‘পৃথিবীটাই অদ্ভুত, জীবনটাও অদ্ভূত।’ এটা তোর মনে হয় না কখনও তিতি?

—‘অদ্ভুত? পৃথিবীটা? জীবনটা? কেন?’

—‘দ্যাখ সামগ্রিক ভাবে বোঝবার চেষ্টা কর। দেখবার চেষ্টা কর। কোনও কিছুর কোনও মানে নেই। মানুষ জন্মাচ্ছে, বড় হচ্ছে, কত কি তার জল্পনা-কল্পনা, কত আয়োজন, তারপরে মরে যাচ্ছে, আবার তার পরের প্রজন্ম, পরের প্রজন্ম। গাছ হচ্ছে, ফুল ফুটছে। ফল পাকছে, আবার গাছ, আবার ফুল আবার ফল।’

—‘এ তো তুই আউটলাইনটা দেখছিস। ভেতরটা মানুষ কী দিয়ে ভরাট করছে দ্যাখ, কত সাহিত্য, শিল্প, ইনডাস্ট্রি, বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার, চিন্তা দর্শন।

—‘তো কী? কী হল? সমস্ত কিছুরই যোগফল শূন্য।’

—‘শূন্য কেন হবে? শেষে মৃত্যু আছে বলে বলছিস? মৃত্যু যদি না থাকত তা হলেই কি জীবনটা অর্থময় হয়ে উঠত?’

—‘না, তা-ও নয়। বিজ্ঞানীরা যদি কোনওদিন মৃত্যুকে জয় করবার ফমুর্লাও আবিষ্কার করেন, যদি কৃত্রিম উপায়ে প্রাণের জন্ম দিতে পারেন, তবুও, তবুও সব শূন্য। তিতি পৃথিবীর সঙ্গে, পৃথিবী একটা কংক্রিট ব্যাপার, আর জীবন, জীবনটা একটা অ্যাবস্ট্রাকট জিনিস, এ দুটোর কোনওটাকেই আমরা নিয়ন্ত্রণও করতে পারি না, এদের সঙ্গে কোনও যোগাযোগও স্থাপন করতে পারি না। কোনওদিন পারব। না। পাহাড়, পর্বত, নদী, জঙ্গল, এরা কেন, তার ভৌগোলিক, বৈজ্ঞানিক কারণটা নির্ণয় করতে পারি। কিন্তু এদের সঙ্গে কম্যুনিকেট করতে পারি না।’

—‘কী করে কম্যুনিকেট করবি? এগুলো তো জড়?’

—‘জড়? জড় কি না—তাও জানি না। জড় একটা কনসেপ্ট। সেই কনসেপ্টটা দিয়ে সীমাবদ্ধ না থেকে তুই ভাব। জীবনের বা জড়ের ধারণাটা আমাদের একটা ধারণা। জাস্ট ধারণা। দীর্ঘদিন ধরে ভেবে এসেছি বলে তার বাইরে ভাবতে পারি না। কিন্তু যতদিন এই সমস্ত পাহাড় পর্বত নদী নালা জঙ্গল স্পেস, এই সবের সঙ্গে কম্যুনিকেট করতে না পারছি ততদিন শূন্যতা, ব্যর্থতাই আমাদের নিয়তি। যান্ত্রিক ভাবে বেঁচে যাচ্ছি, একটা প্রোগ্র্যামিং করা আছে। শরীরের মধ্যে, মনের মধ্যে, সেইটের নিয়ম অনুযায়ী। যতই কবিতা লিখি, আর ছবি আঁকি, আর আবিষ্কার করি। কোনও মানে নেই। মানে নেই কিচ্ছুর।’

তিতি বলল— ‘কী অদ্ভুত নেগেটিভ চিন্তা তোর! তুই কি কোনও ফিলসফির বই-টই পড়ে এভাবে ভাবতে শিখেছিস?’

‘না, না জীবনই এভাবে ভাবতে শিখিয়েছে আমাকে। সেই অ্যাবস্ট্রাক্ট সোর্স, জীবন। বিমূর্ত শক্তি। আমার বাবা আর কাকারাও এটা বুঝে গিয়েছিলেন, বিশেষত দুই কাকা। এ বিষয়ে আমি নিঃসন্দেহ। বাবা অতটা বোঝাবার সময় পাননি। কিন্তু কাকাদের আগে ছিল এরকম অর্থহীন মৃত্যু, পেছনে ছিল অর্থহীন জীবন। ওঁরা বুঝেছিলেন। আমি মেজকাকার, ছোটকাকার মুখের ভাব এখনও দেখতে পাই। একদম ভাবলেশহীন পাথরের মুখের মতো। তৃষ্ণা নেই। বিতৃষ্ণা নেই। ভয় নেই, ভরসাও নেই। সবটাই শূন্য। সবটা একটা বিরাট ফাঁকি, বুঝেও সেই চেক, শেয়ার অ্যাকাউন্টস বুঝিয়ে যাওয়া সমানে আমাকে, মাকে, মেজকাকিমা, ছোটকাকিমাকে। সে যে কী অদ্ভুত গা-ছমছমে ব্যাপার, তুই, তোকে ঠিক বোঝাতে পারছি না।

“চিরসুখী জন ভ্রমে কি কখন ব্যথিত বেদন বুঝিতে পারে?

কী যাতনা বিষে বুঝিবে সে কিসে কভু আশীবিষে দংশেনি যারে?”

তিতি, কবিতাটা বললাম বটে, কিন্তু আমি ঠিক ব্যথিত বেদনের কথা যাতনার কথা বলতে চাইনি। বেদনা, যাতনা দিয়ে আমার অনুভূতি আমি বোঝাতে পারব না। আমি বোঝাতে চাই জীবন আর মৃত্যুর মধ্যে যেমন একটা দুস্তর ফারাক, যে বুঝেছে আর যে বোঝেনি তাদের মধ্যে ওইরকমই দুস্তর পার্থক্য। শূন্যতার আশীবিষে দংশন করেছে আমাকে। যে শূন্যতা সমস্ত কিছুর বাইরে নিঃশব্দ ধৈর্যে অপেক্ষা করে আছে।’

তিতি বলল—‘মাসিরা? মাসিরাও কি এভাবে ভাবেন?’

‘—মাসিরা? কুন্তী, মাদ্রী আর গান্ধারী?’

—‘কেন এইসব মহাভারতের নামে মাসিদের ডাকছিস কেন?’

অর্জুন বলল— ‘এই যে আমি অর্জুন, অর্জুনের ওপরেই সমস্ত ভরসা ন্যস্ত করে সব কষ্ট হাসিমুখে সহ্য করে যাচ্ছে। সব বিলুপ্ত। কোনওদিন ফিরবে না, বংশের সেই গৌরব সেই ধনসম্পদ সব ফিরিয়ে আনবে তাঁর অর্জুন, এই রকম একটা মানসিকতা লালন করে চলেছেন বলে জ্যেষ্ঠা মুখুজ্জে-গিন্নি কুন্তী। আর মেজকাকিকে কেন মাদ্রী ডাকি জানিস? আমার ধারণা মেজকাকিই মেজকাকার মৃতুর প্রত্যক্ষ কারণ।

—‘সে আবার কী?’

—‘হ্যাঁ, দা, হ্যাপলেস মার্ডারেস। তোর মনে আছে মেজকাকার মুসৌরি যাবার কথা বলেছিলাম!

—‘হ্যাঁ হ্যাঁ, সেখান থেকেই তো আর ফিরলেন না।’

—আমরা সকলেই ভেবেছিলাম অত্যাচার-অনিয়ম। ঠিকই ভেবেছিলাম। কাকা এবং কাকিমার দুজনেরই হয়ত মনে হয়েছিল একদিনের জন্যে হলেও বেঁচে নিই। অত্যাচার-অনিয়মের প্রকৃতিটা কী হতে পারে বলে তোর মনে হয়? মেজকাকার মাঝরাত্তিরে হঠাৎ হার্ট ফেল করেছিল। প্রোটিনহীন ডায়েট। দিনের পর দিন সুদ্ধু দুধ-ভাত। দুধ ভাত, দুধ-ভাত খেতেন। কোনও শারীরিক উত্তেজনার বিদ্যুৎ সত্য করবার মতো ক্ষমতাই ছিল না মেজকাকার। মেজকাকি জানত। দুজনে প্ল্যান করেই গিয়েছিল। ফিরে এল ধবধবে সাদা থান পরে। ওখানেই শেষকৃত্য করে। জানত সব শেষ করতেই যাচ্ছে। কে জানে থানটাও হয়ত সঙ্গে নিয়েই গিয়েছিল।’

তিতি শিউরে উঠে বলল— ‘কী বলছিস, চুপ কর অর্জাই?’

—‘না রে, হয়ত মেজকাকা-কাকি একটা সন্তানের জন্য শেষ চেষ্টা করেছিল মুসৌরী-পাহাড়ে। একটা নকুল বা সহদেব। কিংবা ভাগ্যে থাকলে উভয়েই। ভাগ্য হল না। মেজকাকাকে আমি বলি বীরপুরুষ, মেজকাকিকে বীরাঙ্গনা। দেখে, ভেবে বিস্ময় লাগে, বড় বিস্ময়।’

এই সব কথা হচ্ছিল অর্জুনদের বাগানে বসে। বাগানে বড় বড় গাছ। নীচেটা ঝোপে-ঝাড়ে ভর্তি, কাঠ পিঁপড়ে আছে, কাঠবেড়ালি আছে। মেঠো ইঁদুর-টিঁদুরও আছে। কোথাও কোনও শ্রী-ছাঁদ নেই। আর আছে বাঁধানো চত্বর। পাড়ে বেঞ্চ। বসলে গঙ্গা দেখা যায় অদূরে। এই সব কারণেই তিতির বাগানটা ভীষণ ভাল লেগেছে। এটা বাড়ির পেছনে। সামনে যেটুকু আছে সেখানে কিছুটা ঝাঁট পড়ে। ঘাস খুব বড় হয়ে গেলে বা লতার ঝাড় খুব ঝাঁপালো হয়ে গেলে লোক এনে কাটানো হয়। কিছু কিছু পুষ্পচর্চাও করেন মা-কাকিরা। কসমস, ডালিয়া, চন্দ্রমল্লিকা আছে। মাঝারি আকারের। গ্রীষ্মের ফুলগাছ আছে অনেক। কিন্তু পেছন দিকে সেই সব প্রাচীন গাছ-গাছালি যা হয়ত অর্জুনের প্রপিতামহ করে গিয়েছিলেন। সেই আদি বকুল, জামরুল, আম, ডালিম, বলরামচূড়া, সেই কলকে, দোলন চাঁপা। বাগানটার ওপর তিতির ঝোঁক দেখে অর্জুনের মা আবারও লজ্জিত হয়ে বললেন— ‘দ্যাখো না, অতখানি জায়গা—একটা মালি পাওয়া যায় না, কিছু না। বছরে একবার পুজোর আগে একটু পরিষ্কার করাই…।’

অর্জুন বলল— ‘মালি পাওয়া যায় না বলছ কেন মা। সোজাসুজি বলো রাখতে পারি না। অত আবার ঢাক-ঢাক কিসের?’

তিতি অর্জুনের কথায় কোনও কান না দিয়ে ব্যস্ত হয়ে বলল— ‘মাসি, বাগানটা কিছু কোরো না। প্লিজ এমনিই থাক। কেয়ারি-করা ফুলের বেড, গাদা গুচ্ছের সিজন-ফ্লাওয়ার, কৃত্রিম পুকুরে শালুক,…

—‘ওহ হরিব্‌ল্‌.. আমার দুচোখের বিষ।’

মাসি অবাক হয়ে বললেন— ‘অদ্ভুত মেয়ে তো তুমি। সাজানো বাগান তোমার ভাল লাগে না?’

—‘উহুঃ, সাজানো বাগান, সাজানো ঘর, সাজানো মানুষ, সাজানো জীবন সাজানো কিছু না কিছু না।’

—‘সাজানো জীবনও না?’ মাসি কেমন করুণ গলায় বললেন, বলে চলে গেলেন।

—‘মাসির মনে কি কষ্ট দিলাম?’ তিতি একটু অপ্রস্তুত হয়ে জিজ্ঞেস করল। অর্জন বললেন— ‘নাঃ। মা তো সাজানো জীবন পেয়েছিল, চেয়েছিল। তাই। হয়ত খুব অবাক হয়ে গেছে।’

—‘কিন্তু আমি সত্যি বলছি রে অর্জাই আমার সাজানো কিছু, মানে প্ল্যান্‌ড্‌ জিনিস ভাল লাগে না। অসহ্য লাগে। এম. এ. পাশ করব। বিয়ে হবে। মাপামাপি দুটো ছেলে মেয়ে হবে। বছরে একবার কি দুবার বেড়াতে যাব। ছেলে-মেয়েদের স্কুলে ভর্তির জন্য ছুটোছুটি করব, পড়তে বসাব, তারা বড় হবে… উঃ।’

—‘তোর এমন কেন হবে?’ অর্জুন বলল। ‘তোর এম.এ পর্যন্ত পড়তে ইচ্ছে না হলে পড়বি না। প্রিন্স-টিন্স জাতীয় লোকের সঙ্গে মহা ধুমধাম করে বিয়ে হবে। একটা বাচ্চা হবে, আরেকটা দেখে-শুনে অ্যাডপ্ট করবি। বছরে একবার কেন, একশোবার বেড়াতে যাবি, বাইরে, মানে সমুদ্র পার। …আর তোর ছেলে মেয়ের স্কুল? বি.বি. রায়ের নাতি-নাতনির খুব সম্ভব ইংল্যান্ডেই স্কুলিং হবে। তাদের ভেকেশনের সময় তুই একলা একলা উড়ে যাবি। তোর প্রিন্স-বর ব্যস্ত থাকবে তো?

—‘তারপর সিনিক দা গ্রেট?’ তিতি মুখে খুব তেতো হাসি ফুটিয়ে বলল। অর্জুন বলল— ‘তারপর আবার কী? চক্রবৎ ঘুরতে থাকবে সব। এক সময়ে ফুটে যাবি। প্রচুর মালা-ফালা দিয়ে নিমতলায় নিয়ে যাবে। তোর নাতিপুতি ঘটা করে শ্রাদ্ধ করতে করতে মনে মনে বলবে—‘বুড়ি অ্যাদ্দিনে কাটল।’

তিতি বলল—‘আজ্ঞে না।’

—‘কোনটা না?’

—‘কোনওটাই না। লাইফ হবে আনপ্রেডিকটেব্‌ল্‌। এইরকম ছকের জীবন তোর হোক, আমার নয়।’

—‘আমার ছক গোড়াতেই উল্টে গেছে। তো সে কথা থাক। তোর লাইফ কী রকম হবে? শুনি?’

—‘বললাম তো আনপ্রেডিকটেব্‌ল্‌। আগে থেকে কিছু বলা যাবে না। ধর আজ-কাল-পরশুর মধ্যেই একটা হলিডে-করতে আসা ফরাসি কি বেলজিয়াম কি নরওয়েজিয়ানের সঙ্গে ভাব হয়ে গেল। ধর মাস তিনেকের মধ্যে তাকে বিয়ে করে ফেললুম। তারপর চলে গেলুম তার সঙ্গে প্যারিস, কি ব্রাসেলস কি অসলো। লোকটা আসলে চিট, আন্ডার গ্র্যাজুয়েট লেভেলেই একটা বিয়ে করে রেখেছিল। একদিন সেই মেয়েটা এসে ধুন্ধুমার ঝগড়া করল। সাহেবটাকে ছেড়ে সেই মেয়েটার সঙ্গে বাস করতে লাগলুম…’

—‘থাম থাম, তুই একটা আস্ত পাগল। কোনও ম্যাচিওরিটিই হয়নি। বার্বারা কার্টল্যান্ড পড়ে পড়ে বড় হয়েছিস না কি?’

—‘বারবারা কার্টল্যান্ডে তো গরিব সুন্দরী মেয়েরা দারুণ জমকালো সব রাজপুত্তুর, কর্নেল-ফর্নেলের সঙ্গে প্রেম করে, তাদের অবস্থা ফিরে যায়।

—‘তাই বুঝি। আমি কখনও পড়ে দেখি নি। তা তুই কি উল্টোরকম চাইছিস?’

—‘না, ধর’ এখন তিতি উত্তেজিত হয়ে গেছে, ‘ধর। আমার বাবাই বিয়ে দিল। তারপর কয়েকদিন, কি মাস, কি বছর পরে বরটা দুম করে মরে গেল। কিংবা ধর বাচ্চাটা হারিয়ে গেল।…’

—‘ঠিক আছে, ঠিক আছে বুঝে নিয়েছি, আর বলতে হবে না’… অর্জুন বলল।

—‘কী বুঝলি?’

—‘বারবারা কার্টল্যান্ড নয়। তুই হিন্দি ফিলম্ দেখে বড় হয়েছিস। তোর বাচ্চাটা হারিয়ে গেলে কী হয়, অবিকল তোর বরের মতো দেখতে হবে। একদিন তোর বাড়িতে ডাকাতি করতে আসবে। দেখেই চিনতে পারবি “মেরা লাল, মেরা লাল” করে কেঁদে দুনিয়া ভাসিয়ে দিবি—এইরকম ডাবল রোল খুব চলে।

—‘ধুস—আমি হিন্দি ছবি দেখিই না।’ তিতি ঠেটি বেঁকিয়ে বলে।

—‘দিবারাত্র দেখাচ্ছে। তোর ঘরে বসে দেখতে পাচ্ছিস। দেখি না বললেই বিশ্বাস করব?’

—‘করিস না,’ তিতি বলল, ‘আসলে আমার কিছু ভাল লাগে না। সব কিছু এত একঘেয়ে, বিরক্তিকর। এমন নয় যে আমি সব সময়ে খুব উত্তেজনা চাইছি। একেবারেই না। কিন্তু আমার পরিচয় কী? চারপাশে যা যা ঘটে যাচ্ছে সেই রুটিন ঘটনা প্রবাহের মধ্যে আমার বিশেষ কী কাজ? আমি কেন? নাঃ আমি ঠিক বোঝাতে পারছি না। … তিতি থেমে গেল। অর্জুন বলল,

—‘তা, তোরও তো আমারই মতো অবস্থা।’

—‘না। তোর মতো নয়।’ তিতি প্রতিবাদ করে উঠল, ‘তোর থেকে আমি কিছু গ্রহণ করতে পারি, কিন্তু আমার ভেতরে যে মৌলিক খিদেটা আছে সেটা অন্য, অন্যরকম।’

অর্জুন বলল—‘তাহলে আর কিছুই না, তুই একধরনের রোম্যান্টিক।’

—‘দ্যাখ অর্জাই। লেবেল সাঁটাটা বন্ধ কর। একটু আগেই বলছিলি না—জড় একটা কনসেপ্ট। ওইভাবে ভেবে আসছি, তাই ভাবি। যে একথা বলে সে আবার কোন মুখে লেবেল নিয়ে আঠা হাতে ঘোরে রে?’

‘ঠিক আছে। আঠা ফেলে দিচ্ছি। লেবেলগুলো এই কুচি কুচি করলাম। আমার আত্মখণ্ডনদোষ দেখিয়ে দেবার জন্যে ধন্যবাদ।’

ছোটকাকি নিজের ঘরের জানলায় দাঁড়িয়ে ওদের ডাকলেন। ওরা উঠে পড়ল। চা খাবার সময় হয়েছে। খিড়কি দরজার কাছাকাছি এসে তিতি চুপি চুপি বলল— ‘একদম ভুলে গিয়েছিলাম। ছোটকাকিকে গান্ধারী বলিস কেন রে?’

অর্জুন হেসে ফেলে বলল— ‘বলি প্রধানত দুজন কুন্তী-মাদ্রী হলে একজনকে গান্ধারী হতেই হয় বলে। তবে কোথাও কোথাও গান্ধারীর সঙ্গে মিল আছে। নিজের চোখ দুটো যেন বেঁধে রেখেছে। ছোটকাকা যা-যা বলে দিয়েছে ঠিক তাই তাই করে যাচ্ছে। ছোটকাকা বলেছে পাড়-অলা শাড়ি পরবে, তাই পরে। ছোটকাকা বলে দিয়েছে মাছ খাবে, তাই মাছ খায়। ডিম-মাংস খায় না। ছোটকাকা বলে গেছে… নিজের অংশ অর্জুনকে লিখে দেবে। তো তাই দিয়ে রেখেছে। ছোটকাকার নির্দেশের অর্থ যে বৈধব্যের নিয়ম কানুন পালন না করা, সেটা কাকি বুঝতে পারেনি।’

—‘কিন্তু গান্ধারী তো এ রকম ছিলেন না। খুব ব্যক্তিত্বশালিনী ছিলেন। ধৃতরাষ্ট্রকে দুর্যোধনকে খুব বকা-ঝকা করতেন! কৃষ্ণকে শাপ দিয়েছিলেন।’

—‘হ্যাঁ হ্যাঁ আমার গান্ধারী তেমন নয়। কিন্তু ব্যক্তিত্ব আছে। সেটাকে ছোটকাকার ব্যক্তিত্বের তলায় ইচ্ছাকৃতভাবে চাপা দিয়ে রেখেছে। ওইটুকুতেই কাকীর গান্ধারীত্ব। বেশ কিছুদিন বাস করলেই টের পাবি।

এখন তিতি দু নম্বর বাসের দোতলায় উঠছে। উঠছে বেশ মেপে মেপে। দৌড়ঝাঁপ করে নয়। অর্জুনও সুতরাং পেরে যাচ্ছে তার পেছন পেছন উঠতে। অর্জুনের ঘড়িতে এখন প্রায় আড়াইটে। দু নম্বরের দোতলা প্রায় ফাঁকাই। সামনের দিকে এগিয়ে গিয়ে বসল তিতি। পাশে অৰ্জুন বসে পড়ল। কেউই কিছু বলছে না। কিছুক্ষণ পর অর্জুন আর থাকতে পারল না। বলল—‘বিজনেস ম্যাগনেটের মেয়ে যে কেন সরকারি বাসে চড়ে কলকেতা দেখতে যায় বুঝি না।’

তিতি কিছু বলল না।

—‘বিজনেস ম্যাগনেট নিজে, অথবা তাঁর সমাজসেবিনী স্ত্রী, অথবা তাঁদের সাহেব যুবরাজ যদি দেখে ফেলেন মেম রাজকুমারী গরিব-গুরবো আত্মীয়র ছেলের সঙ্গে এক সিটে বসে সাত পায়েরও বেশি চলে যাচ্ছে, তবে কী হবে?’

তিতি তখনও কিছু বলছে না।

অর্জুন বলল—‘বি. বি. রায় অবশ্য চিনতেই পারবেন না আত্মীয় বলে। শুধু দরিদ্র কুমার বলে উদ্বিগ্ন হবেন। আর সমাজসেবিনী তনুদেবী? তিনিও…তিনি চিনেও চিনবেন না। যেমন সাধারণত করে থাকেন। যেমন করাটা কেতা! আর প্রিন্স যুবরাজ!’

এ সব কথা অর্জুন প্রায়ই তিতিকে বলে। বি. বি. রায় তার বাবা যে আত্মীয় স্বজনদের কারও সঙ্গে মেলামেশা করেন না। কারুর জন্য কিছু করেন না। কনিষ্ঠ অঙ্গুলিটিও নাড়েন না কারও জন্য, এ কথা অৰ্জুন আগেও বলেছে। অর্জুনের বাবা যখন মারা গেলেন বি. বি. রায়-তনুশ্রী রায়ের নামে একটা অতিকায় সাদা পদ্মের রীদ এসেছিল। শ্রাদ্ধের দিনও এঁরা কেউ আসতে পারেননি। আর তার বাবার অসুখের খবর শুনে দীর্ঘদিন পরে তনুশ্রী রায় যে ‘গেট-ওয়েল’ কার্ডটা পাঠিয়েছিলেন, সেটা শ্রাদ্ধের দিনই এসে পৌঁছেছিল। তার দাদা যে কলকাতায় যাচ্ছেতাই সব জয়েন্টে যায়, এই বয়সেই সর্বক্ষণ ট্যাঁকে মেয়ে নিয়ে ঘোরে, তাদের কিছু কিছু যে অন্তত ভাড়া-করা বান্ধবী এ কথাও তিতি অর্জুনের কাছ থেকে শুনেছে। শুনেছে মুখ নিচু করে, কখনও প্রতিবাদ করেনি, কারুর সাফাই গাইবার চেষ্টা করেনি। এমনকি মায়ের পুরুষ-বন্ধু নিয়ে ঘোরার ব্যাপারটাও অর্জুন তাকে তার স্বভাবসুলভ ব্যঙ্গের সঙ্গে শুনিয়েছে। তিতি শুধু মায়ের ব্যাপারেই একবার মাত্র বলেছিল—‘নব্বুইয়ের কলকাতায় বসে পুরুষদের সঙ্গে মেলা-মেশা বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা জারি করছিস না কি?’

উত্তরে অর্জুন বলেছিল—‘দূর আমি অতটা অনাধুনিক না। তবে মিসেস রায় আবার বন্ধুদের বুকের ওপর ঘুমিয়ে পড়েন কিনা। আমি আবার মিউজিক কনফারেন্সে নিয়মিত যাবার নেশাটা করে ফেলেছি। তাই এ সব দৃশ্য দেখতে হয়।’

তিতি আর কিছু বলেনি।

অর্জুন আবার কিছু বলতে যাচ্ছিল। তিতি হঠাৎ মৃদুস্বরে বলে উঠল—‘আমি কিন্তু তোমাকে ঠিক ডাকিনি অর্জুন!’

—‘তা হলে গোপা কেমিস্ট্রি ল্যাবের সামনে গিয়ে আওয়াজ মারছিল কেন?’

—‘আমার নির্দেশে নয়। তবে আমার একটা ক্ষীণ ধারণা হয়েছিল, একজন বন্ধুর সঙ্গ এই সময়ে আমার ভাল লাগবে। সহানুভূতি চাইছি না, কিন্তু সমালোচনাও চাইছি না। ভাল লাগছে না। তুমি নেমে যেতে পারো অর্জুন।’

তিতি জিতে গেছে আজকে। অর্জুন একেবারে বোল্ড। ইয়র্কার ছিল বুঝতে পারেনি। সমানে ঝাঁটা টেনে যাচ্ছিল। টেনে যাচ্ছিল। এমন সময়ে ইয়র্কার। কিন্তু বোল্ড হয়ে ভীষণ উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ল অর্জুন। —‘তিতি, কী হয়েছে রে?’

—‘বি. বি. রায় আজ সাতদিন হল নিরুদ্দেশ। চিঠি নেই। পত্র নেই। কোথাও কোনও হদিশ নেই। শেষ রাত্তিরে দুটো সুটকেস নিয়ে বেরিয়ে গেছেন। দাদার ধারণা ওতে বহু টাকা ছিল, কোনও অ্যান্টি-সোশ্যাল গ্রুপ চেয়েছিল। টাকাটাও নিয়েছে, বাবাকেও…।’ তিতি ঘাড়টা সম্পূর্ণ ঘুরিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে রইল।


সাত-আট দিন হয়ে গেল অথচ হারানো-প্রাপ্তি-নিরুদ্দেশ কলমে নিজের ছবি ইত্যাদি ইত্যাদি কোনও কাগজেই না দেখে খুবই বিস্মিত হলেন বিজু রায়। টিভি দেখবার সুযোগ অবশ্য পাননি। কিন্তু এতদিনে তাঁর যেটুকু গোঁফ দাড়ি বেরিয়েছে, তাদের সযত্নে ট্রিম করছেন তিনি। চোখেও কালো চশমা এঁটে বেরোন। তবু একটা অস্বস্তির কাঁটা বিঁধে থাকে। তিনি কয়েকটা রেডিমেড পায়জামা-পাঞ্জাবি, জহর কোট কিনে নিয়েছেন, একটা আলোয়ানও। এই বেশ তাঁর অনভ্যস্ত। বলতে গেলে এই বেশে তাঁর স্ত্রী ছাড়া বড় কেউ একটা দেখেনি তাঁকে, তা গত কুড়ি বছর তো হলই। সকালে এক কাপ চা খাবার পরই চান-টান করে, দাড়ি কামিয়ে একেবারে ফুলহাতা শার্ট এবং ট্রাউজার্স পরে ফেলেন তিনি। অফিসে যাবার সময়ে এর ওপরেই চাপে কোট, টাই। গরম কালে হয়ত ফুলহাতার জায়গায় হাফ হাতা। একেবারে শোবার আগে, চান সেরে তবে পায়জামা-পাঞ্জাবি পরেন। ভোরবেলা চা দিতে এসে বদন বা প্রমীলা এ বেশে দেখে থাকতে পারে। বাস্। কাজেই এখন বেশ কদিনের না কামানো দাড়ি গোঁফ ট্রিম করে, পাজামা-পাঞ্জাবির ওপর আলোয়ানটা ভাল করে মুড়ি দিয়ে ঘোরাফেরা করলে তেমন ভয় কিছু নেই। তবে সন্ধ্যা হলে আর সানগ্লাসটা পরতে পারেন না।

দিদিকে দাহ করে ফিরতে অনেক দেরি হল। দিদির দেহ আর সুখচরে নিয়ে যাবার হাঙ্গামা করেননি। তবুও। রত্না একাই এসেছিল। সে-ও সুখচরে দেহ নিয়ে যাবার কথা বলেনি। সুখচরের আপাত-পরিত্যক্ত বাড়িতে এখনও খুব সম্ভব শাঁটুল বাস করছে। গোপনে। এটাই বাস্তব অসুবিধে। বলতে গেলে যে ছেলের হাত থেকে শেষ পাথেয় নেবার কথা দিদির, সেই ছেলের জন্যেই দিদি নিজের বাস্তুতে ফিরতে পারল না। দিদির বোধহয় ফেরবার ইচ্ছেও ছিল না। লিভারের ক্যানসার এমনই ভয়ানক রোগ, যে তা মানুষকে নিশ্চিতভাবে ইচ্ছা-অনিচ্ছা, প্রেম-অপ্রেম, আসক্তি-সংস্কার সমস্ত কিছুর বাইরে নিয়ে যায়। হাসপাতালে ভর্তি হবার পর দিদির চোখের দৃষ্টিতে সেই চরম ঔদাসীন্য দেখেছিলেন তিনি। যখন শাঁটুলের ফেরবার খবর রত্না ফিসফিস করে জানাল, তখনও কোনও ভাবান্তর দেখেননি। দিদি, জড়বুদ্ধি বড়দার পরে বিজু রায়ের প্রথম রক্তের সম্পর্ক, মায়ের পেটের রক্তের পোম আপন বলতে তিনটি বোন, তা সেই প্রথম সম্পর্ক এখন মহাপৃথিবীর মাটিতে, জলে, হাওয়ায় মিশে গেল। তিনি ডেকেছিলেন, মেসের পরিচিতদের। মণিময়, নিতাই ভট্টাচার্য চাঁদু মিত্তির প্রতুল বিশ্বাস বলে আরও একটি যুবক এবং কিছু বয়স্ক মানুষও তাঁর সঙ্গে নিমতলার শ্মশানঘাটে গেলেন। মণিময় বলল—‘দিদির অসুখের খবর শুনেই তা হলে আপনি এসেছিলেন বিজনদা!’ খানিকটা ভাবুক স্বরে, ‘হুঁ’, দিয়ে বিজন দূরের দিকে তাকিয়ে রইলেন। এইভাবে শোককাতরতার ভান করতে তাঁর খারাপ লাগছিল। তবে শোককাতর না হলেও এক ধরনের দার্শনিক ভাবুকতা তো তখন তাঁকে পেয়েই বসেছিল। তিনি তো গঙ্গার জলরেখার দিকে তাকিয়ে ভাবছিলেনই। জন্মের সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যু শুরু হয়। ভাই-বোনেদের মৃত্যু দিয়ে সেই মৃত্যুর পদক্ষেপ আরও দৃঢ় হয়। মৃত্যুর কর্মকাণ্ড শুরু হয়ে গেল তাঁর জীবনে। এখন জীবনটাকে বুঝে নিতে হবে। অবশ্য কতটুকুই বা জীবনের দেখেছেন তিনি। বোঝবার ক্ষমতাও অত্যন্ত সীমাবদ্ধ। তবু! যতটুকু পারা যায়।

এই সময়ে রত্না এসে তাঁকে ডাকল। একটু আড়ালে নিয়ে গিয়ে বলল—‘মামাবাবু, মায়ের বাপের বাড়ির কাউকে কি খবর দেওয়া উচিত?’

তখন বিজু রায়ের মনে পড়ে গেল যতক্ষণ অসুখ ছিল, চিকিৎসা ছিল ততক্ষণ দিদি ব্যক্তি, তিনি ব্যক্তি, রত্নাও একজন ব্যক্তি। যে যা পেরেছে, করেছে। কিন্তু মৃত্যু হওয়ামাত্র সমস্ত ব্যাপারটা সমাজের হাতে চলে গেল। এখন কাকে খবর দেওয়া হল আর কাকে হল না— এ সমস্ত ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবে। তিনি খুব ভাবনায় পড়ে গেলেন। মুখাগ্নি তিনি করেছেন। ছেলের অনুপস্থিতিতে শ্রাদ্ধকৰ্ম তাঁরই করার কথা। কিন্তু এখন চতুর্দিকে যদি শ্রাদ্ধবার্তা রটে যায় তা হলে তো তিনি তাঁর কাজ শেষ হবার আগেই ফিরে যেতে বাধ্য হবেন!

একটু ভেবে তিনি বললেন—‘দিদির শ্বশুরবাড়ির দিকেও তো কারও কারও থাকবার কথা!’

রত্না বলল, ‘আমার দুই ননদ আছে, তাদের তো খবর দিতে হবেই। আর কেউ আমাদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখে না। খুড়ো শ্বশুরের পরিবার কাছেই ব্যারাকপুরে থাকে, কখনও খোঁজ খবর নেয় না।’

—‘সে কি তোমার মামারাই কেউ নেয়?’

—‘ওই বিয়ে-থাতে কার্ড আসে, মাঝে মধ্যে চিঠি আসে।’

বিজু বললেন, ‘এক কাজ করো, তোমার ননদদের চিঠি দাও। আর সুখচরের বাড়িতেই কাজের আয়োজন করো। গুড্ডু কাজ করুক। পাঁচের ওপর বয়স তো হয়েছে। আমি কাগজে একটা খবর দিয়ে দিচ্ছি। ছেলে যে কালে বেপাত্তা, অত কার্ড-টার্ড করার তো কিছু নেই।’

—‘ওর কথাটা ভাবলেন কিছু? মামাবাবু?’

—‘ভাবছি, আরও কিছুদিন সময় দাও রত্না।’

মণিময়রা আগেই ফিরে গিয়েছিল। তিনি অস্থি না নিয়ে ফিরতে পারছিলেন না। ওরা থাকবে বলেছিল, কিন্তু পরদিন সবাইকারই অফিস। তিনি জোর করেই ওদের পাঠিয়ে দিলেন। তাঁর ফিরতে এগারোটা হল।

হরিহর বসে বসে ঝিমোচ্ছিল সম্ভবত। দরজা খুলে দিল। বিজু সিঁড়ির ওপর বেশ খানিকটা উঠে গেছেন, হরিহর হঠাৎ চাপা গলায় ডাকল, ‘বাবু।’

বিজু ঘুরে দাঁড়ালেন। হরিহর বলল— ‘সাইমন সন্ধেবেলায় এসেছিল। এই প্যাকেটটা দিয়ে গেছে।’ একটা পাতলা প্যাকেট, ব্রাউন পেপারে মোড়া, সে বিজু রায়ের হাতে তুলে দিল। তারপর নিজের জায়গায় আবার ফিরে গেল। এবার বোধহয় নিশ্চিন্তে ঘুমোব।

বিজু গঙ্গা থেকে চান করে এসেছিলেন। ঘরে গিয়ে আবারও হাত পা ধুলেন। জামাকাপড় বদলালেন। তার পরে শোবার ঠিক আগে প্যাকেটটা খুলে ফেলেন। একটা বড় চৌকো ব্রাউন পেপারের খাম, দুদিকে স্টেপল করে আটকানো। ভেতরে একটা সানডে পত্রিকা। এরই জন্য এত? সানডেটা বেশ পুরনো। কত পুরনো দেখবার জন্যই তুলতেই ভেতর থেকে ঠুক করে একটা লম্বা ব্রাউন পেপারের খাম পড়ল। খামটা হাতে করেই বিজু রায় বুঝতে পারলেন এর মধ্যে টাকা আছে। সাবধানে মুখটা ছিঁড়ে ফেলে দেখলেন একগোছা বেশ নতুন নোট। গুনতে লাগলেন। একশ টাকার পাঁচশটা নোট। অর্থাৎ পঞ্চাশ হাজার। বারে মজা! নলিনী কর যখন পঞ্চভূতে মিলিয়ে গিয়ে অস্তিত্বহীন হয়ে গেছে, ঠিক তখনই তার কাছে ‘সানডে’র প্যাকেটে পঞ্চাশ হাজার টাকাটা দিয়ে গেল সাইমন? ‘পঞ্চাশ হাজার’ এই পরিমাণটা তাঁর মাথার মধ্যে টরে টক্কা টক্কা টরে করে কী যেন বলবার চেষ্টা করল। কিন্তু বিজু রায় এতই অবাক এবং এতই ক্লান্ত যে কিছুতেই সে সংকেত উদ্ধার করতে পারলেন না। নলিনী করের বোতল থেকে এক পেগের মতো হুইস্কি খেলেন তিনি জলে মিশিয়ে খেয়ে কেমন একটা অপরাধবোধ হল। আপন মনেই বললেন ‘শোধ দিয়ে দেব।’ পরক্ষণেই নিজের মনে হেসে উঠলেন, কাকে সোধ দেবেন? নলিনী করের বিছানায় লম্বা হয়ে শুয়ে পড়লেন তিনি। পঞ্চাশ হাজার টাকার প্যাকেট বালিশের নীচে।

বেশ ভোরবেলা। তখনই ভাল করে মানুজনের সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না, এমন সময়ে দক্ষিণের খোলা জানলা দিয়ে একটা মিহি বালিকা-কণ্ঠের ডাক ক্রমাগত ডেকে যাওয়া পাখির নাছোড়বান্দা ডাকের মতো তাঁর ঘুম ভাঙিয়ে দিল। —‘ও দাদু, ও দাদু, ও টঙদাদুর বন্ধু; ও দাদু, ও দাদু!’ তিনি গা থেকে চাদরটা খুলে দক্ষিণের জানলায় দাঁড়ালেন, ও দিকের ছাদে মণিদীপিকার ছোট্ট মুণ্ডু দেখা যাচ্ছে। ও তাঁকে দেখতে পেয়েছে। —‘একবার এদিকে এসো না, ও দাদু!’ ব্যস, হঠাৎ তাঁর মস্তিষ্ক কম্পিউটারের মতো দক্ষতায় টরে টক্কা সংকেতের মর্ম উদ্ধার করে দিল। ‘পাত্তি টু পাত্তি চান্স নিতে হবে একবার। জিতলে পঞ্চাশ। হারলে পাঁচ। কুছ পরোয়া নেই। জীবন জুয়ায় অমৃত বা বিষ যা উঠল তা আমার। লক্ষ্মী যদি ওঠে তো সে দাদু পাবে।’ পঞ্চাশ মানে তা হলে পঞ্চাশ হাজার! তিনি চেঁচিয়ে বললেন—‘আসছি।’ কলঘরে গিয়ে চোখে মুখে ভাল করে জলের ঝাপটা দিতে চোখে যেন ছুঁচ ফুটতে লাগল। আরেকটু ঘুম তাঁর শরীরের প্রাপ্য ছিল বোধহয়। পাঁচিলের ধারে গিয়ে তিনি দেখলেন, অল্প কুয়াশায় শুধু মণিদীপিকাই নয়, অদূরে ভাল করে চাদর দিয়ে সর্বাঙ্গ ঢাকা একটি মেয়েও রয়েছে।

মণিদীপিকা বলল—‘ও মা, ও মা, এই তো টঙদাদুর বন্ধু। বলো, বলো না কথাটা!’

মেয়েটি একটু সংকোচের সঙ্গে কয়েক পা এগিয়ে এসে বলল, —‘আমি আপনার নাম-টাম কিছুই জানি না। কী বলব ভেবে পাচ্ছি না। আজ মণির জন্মদিন। প্রত্যেক বছর এই দিনে উনি মানে নলিনীকাকা আমাদের বাড়িতে খেতেন। উনি মণিকে ভীষণ ভালবাসতেন। আপনি, মানে আপনি কি আসবেন?’

বিজু রায় দেখলেন মেয়েটি নেহাতই অল্পবয়সী। রত্নার চেয়েও। কিংবা হয়ত অপুষ্টির জন্যে এমন দেখাচ্ছে। খুবই রোগা পাতলা। ভিতু-ভিতু মুখ। মুখের আদলটা যেন মণিদীপিকারই মতো। এই ভোর-কুয়াশায় মেয়েটির চোখে জল দেখতে পেলেন তিনি। ‘—উনি আসতেন।’ ঠাণ্ডা হাওয়ার মতো আবার মেয়েটির গলার স্বর ছুঁয়ে গেল তাঁকে। তিনি বললেন—‘নিশ্চয়ই আসব। কখন যেতে হবে?’ শেষ কথাগুলো তিনি বাচ্চাটির দিকে তাকিয়ে বললেন। সে বলে উঠল—‘আমি আর তুমি এগারোটার সময়ে লাল পায়েস খাবো। আর যদি টঙদাদু এসে পড়ে, তো বলব আড়ি, আড়ি, আড়ি।’ মণিদীপিকা তার বুড়ো আঙুল তুলে দেখাতে লাগল। কবেকার খেলা এ সব? বিজু রায়ের মনের ভেতরটা যেন। ঝনঝন করে নড়ে উঠল। পুরনো দরজা জানলা। জানলার শিক, দরজার শেকল সব ঝনঝন করছে। আড়ি, আড়ি, আড়ি, ভাব ভাব ভাব। এই রকমই কচি একফোঁটা আঙুল, দোপাটির মতো নরম গাল, ঠোঁট, নাক, কপাল। ছেলেবেলায় তাঁদের এমনি আড়ি-ভাব ছিল বড্ড। তিনি ডিসেম্বরের ফিকে হতে থাকা আকাশের দিকে তাকিয়ে মনে মনে বললেন—‘ছুটকি, তুই কোথায়? আমি যে কিছুতেই তাকে খুঁজে পাচ্ছি না।’

মাঝে মাঝে ছোটদের সবাইকে নিয়ে লুকোচুরি খেলা হত। বিজু, ছোটখোকা চোখ বুজলেই সব দুদ্দাড় করে লুকোতে ছুটত। লুকোনোর চোটে মায়ের ভাঁড়ারঘর শোবার ঘরের খাটের তলা সব উস্তম খুস্তম হয়ে যেত। এক এক করে সব কটাকে টেনে টেনে বার করতে পারত বিজু। ভোঁদড়, রাজা, নীলি, পল্টু, শোভা, মিনু সব, স-ব। কিন্তু এক এক দিন ছুটকিকে কিছুতেই খুঁজে পেত না। অবশেষে সন্ধ্যা ঘন হয়ে আসত। খেলুড়িরা আর দেরি করতে চাইত না। সব যে যার বাড়ি চলে যেত। অন্ধকার ছাদে দাঁড়িয়ে বিজু ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেলত। —‘ছুটকি, তুই কোথায়?’ সে যেন আর কোনও দিনই ছুটকিকে খুঁজে পাবে না। ছুটকি চিরদিনের জন্য হারিয়ে গেছে। লুকোতে গিয়ে সে পৃথিবীর আস্তরগুলো সরাতে সরাতে এমন জায়গায় চলে গেছে যেখান থেকে আর ফিরে আসা যায় না। রুদ্ধ কান্না ক্রমে চড়া আওয়াজে পৌঁছত। তারপর একসময়ে হঠাৎ পেছন থেকে চোখ টিপে ধরত ছুটকি।

—‘দূর পাগল—এই তো আমি!’

—‘কোথায় ছিলি?’

—‘সে আমার লুকোনো জায়গা, বলব কেন রে?’

—‘তা হলে আর তোর সঙ্গে কোনওদিন খেলব না।’

—‘খেলিসনি। কিন্তু সে জায়গাটা আমি কক্ষনো, কাউকে বলব না।’

—‘কেন?’

—‘তোরা জেনে গেলেই তো খুঁজে বার করবি! তখন? জিততে পারব?’

ছুটকি তুই তোর গোপন জায়গাটার কথা আমাকে কোনও দিনও বললি না। জেতার নেশায় না কিসের নেশায়, তা জানি না। কিন্তু এমন লুকোন লুকোলি যে সত্যিই তোকে আর কিছুতেই খুঁজে বার করতে পারলুম না। দ্যাখ ছুটকি, এখন খেলা ভাঙার খেলা শুরু হয়ে গেছে, সবাই যে যার বাড়ি চলে যাচ্ছে। কার কাছে জিতবি আর? শুকনো চোখে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলেন বিজু রায়। সান্ত্বনাহীন।

—‘বাবু, চা!’ হরিহর। তার গায়ে আজকে একটা পাঁশুটে রঙের চাদর উঠেছে। অধোবাস সেই এক। ঝলঝলে ইজেরের ওপর গামছা। হরিহর তাঁর খুব ভক্ত হয়ে উঠেছে। কেন কে জানে! নলিনী করের পোশাক পরিচ্ছদগুলো তিনি হরিহরকে দিয়ে দিয়েছেন। জামেয়ারটা বাদে। জামেয়ারটাও দেবেন। কিন্তু কদিন বাদে। এ সব পুরনো জিনিসের অনেক দাম পাওয়া যায়। জিনিসটা তো হরিহর কোনও দিন গায়ে দিতে পারবে না। তিনি জিনিসটা যথাস্থানে বিক্রি করে দামটা হরিহরকে দেবেন, ঠিক করেছেন। বলেই করবেন।

পাঁশুটে রঙের চাদরটা দেখিয়ে হরিহর বলল—‘আপনার টাকা দিয়ে কিনলুম বাবু!’ তার মুখে অনাবিল হাসি। নলিনী করের এই লোকটির কাছে অনেক ধার ছিল, শোধ করতে পারেনি। প্রধানত সেই কথা মনে করেই তিনি একে এই কদিনেই বেশ কিছু টাকা দিয়েছেন। হরিহর সেগুলোকে কাজে লাগিয়েছে দেখা যাচ্ছে। তিনি ভোরবেলায় বেড-টি খান, সেটা জানিয়ে দেবার সঙ্গে সঙ্গেই ব্যবস্থা করেছে হরিহর। যে সব বড় হোটেলে কাজ কর্ম উপলক্ষে তাঁকে উঠতে হয়, সেখানে সার্ভিস চার্জ ছাড়াও কতজনকে কত টাকা বকশিশ দিতে হয়, যে সেবার দাম চুকিয়ে দেওয়া হয়েছে তার জন্যেও। বেড-টি, নলিনী করের জীবন রহস্যের উদঘাটনের জন্য প্রয়োজনীয় কলকাঠি নাড়াতে সাহায্য করা এগুলো তো হরিহরের নিত্যসেবার মধ্যে পড়ে না, তাকে কিছু দেওয়াই তাঁর উচিত। এই ভাবেই তিনি বোঝেন জিনিসটা। কিন্তু হরিহর কখনও এ ভাবে পায়নি। সে ভাবে সে উপরি পাচ্ছে। তাই তার ভক্তিটা ক্রমশই গাঢ়তর হচ্ছে।

হরিহর যখন চা-পাউরুটি দিতে এল তিনি নেমন্তন্নর কথাটা জানালেন হরিহরকে। আজকে নো মিল। এ বেলায়। চান-টান করে একটু বাজারের দিকে বেরোলেন তিনি। ক্যাডবেরি কিনলেন কয়েকটা। কিন্তু মণিদীপিকার যে দাঁতে পোকা! তা ছাড়া তিনি দুদিনের জন্য এসে তাকে ক্যাডবেরির স্বাদ চিনিয়ে দিয়ে চলে যাবেন। তারপরে সে যদি রোজ রোজ বায়না করে? কয়েকটা ক্যাডবেরি কিনতে এত ভাবনা তাঁকে কখনও করতে হয়নি। তিনি নিউ মার্কেটে চলে গেলেন। একটা ঠিক মাপসই ফ্রক কিনতে হলে তাঁকে মাপটাও বলতে হয়। কিন্তু দোকানদারের কোনও প্রশ্নেরই তিনি জবাব দিতে পারলেন না। কত বছরের মেয়ে? কত বয়স মণিদীপিকার? সাতের কম। তার এখনও দুধে-দাঁত পড়েনি। হাত দিয়ে মেপে-মেপে অনেক কষ্টে একটা পছন্দ করলেন। গোলাপি রঙের ফ্রক তাতে সাদা লেস দেওয়া, ডোনাল্ড ডাক বসানো ঘেরের ওপর। তাঁর আরও কিনতে ইচ্ছে করছিল, কিন্তু আবারও তাঁকে ভাবতে হল। নিজের হাতে বাচ্চাদের ফ্রক কেনা তিনি বোধহয় জীবনে এই প্রথম করলেন। তাঁর ছেলেমেয়ের পোশাক-আশাক তনুশ্রীই কিনেছে বরাবর। চকলেটও তিনি কমই কিনেছেন। বিশেষত তাঁর ছেলেমেয়ের, অন্তত ছেলের কথা তো মনে পড়ছেই, খুব দ্রুত চকলেটে অরুচি এসে গিয়েছিল। পছন্দের জন্যে দোকানদারের ওপরই নির্ভর করলেন তিনি। ফ্রকটা সত্যিই খুব সুন্দর। এক গোছা গোলাপফুলের মতো। এটা ওই রোগা কচি মেয়েটাকে উপহার দিতে ভাল লাগবে তাঁর। ও খুব খুশি হবে। ওর মা নিশ্চয়ই আরও খুশি হবে। বস্তুর মূল্য বড়রা ছোটদের চেয়ে অনেক ভাল বোঝে।

দোকানি ভাল করে বাক্সের মধ্যে জামাটা ভরে প্যাক করে দিতে, সেটা হাতে নিয়ে বেরোবার সময়ে বিজু রায়ের হঠাৎ খেয়াল হল তিনি এখনও ভাবছেন এই ফ্রকটা উপহার পেয়ে মণিদীপিকা বেশি খুশি হবে না তার মা। সচেতন হবার পর তাঁর বড় লজ্জা হল। একটি শিশুকে এই দামি ফ্রক উপহার দিতে গিয়ে এত চিন্তা তিনি করছেন কেন? এর চেয়েও দামি উপহার তাঁর ব্যবসা-বন্ধুদের ছেলে-মেয়ে বা নাতি-নাতনিকে দেবার সময়ে তো এ সব কথা মনে আসেনি! বিজু রায় আবিষ্কার করলেন তিনি মণিদীপিকা এবং তার মাকে দয়া করছেন। এবং সবচেয়ে খুশি হচ্ছে মণিদীপিকাও নয়, তার মা-ও নয়। তিনি নিজে। ওটা একটা সাড়ে তিনশো টাকা দামের ফ্রকের প্যাকেট নয়। তাঁর দম্ভের প্যাকেট। দম্ভটাকে সুন্দর মোড়কে সাজিয়ে গুছিয়ে দেওয়া হচ্ছে যাতে তাকে চেনা না যায়। ব্যাপারটা আবিষ্কার করে তিনি বিষণ্ণ হয়ে গেলেন। এবং এইরকম বিষণ্ণ হয়েই মণিদীপিকাদের বাড়ি ঢুকলেন।

বাড়িটার একতলায় একটা প্রেস। ময়লা, ঝুল, পানের পিকে ভর্তি একটা সরু প্যাসেজ পার হয়ে, একই রকম নোংরা সিঁড়ি। দোতলায় উঠে তিনি এদিক-ওদিক তাকাচ্ছেন, ডানদিকের একটা ঘরের কপাট খুলে মণিদীপিকার মা বেরিয়ে এল।

—‘আসুন কাকাবাবু, এদিকে।’

রক্তহীন ফর্সা বউটি। সিঁথির সিঁদুরটা কপালেরও খানিকটা অবধি নেমে এসেছে। কপালে একটা সিঁদুরের টিপ। ডুরে শাড়ি পরা, মাথায় ঘোমটা, পানপাতার মতো মুখ, স্বাস্থ্যহীন এইরকম নারীরা এখনও, এ যুগেও আছে? বিজু রায়ের মনে হল তাঁকে যেন কে বা কারা ষড়যন্ত্র করে ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে অনেক দিন আগে। এখন জানেন সেটা ছিল দুর্ভিক্ষের বছর, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময়। চারিদিকে, এ বাড়ি ও বাড়ি তিনি এইরকম নারী, অনেক এ রকম মা, দিদি, বউদি, মাসি-পিসিদের দেখেছিলেন। দলে দলে ভিখারি আসত। তাদের কঙ্কালের মতো চেহারা, মেয়েদের খোলা গায়ে ন্যাতানো মাছের পটকার মতো বুক, কোটরাগত চোখ পাঁজরাসার শিশু, মায়ের বুকের বোঁটা প্রাণপণে আঁকড়ে আছে। সেই হাহাকারের সামনে এইরকম শান্ত, নিরুপায়, অসুস্থ নারীরা, হাতে শাঁখা, ছেঁড়া কাপড়ের আঁচল মাথায় তুলে দিচ্ছে। এনামেলের কাঁসিতে করে ফ্যান ঢেলে দিচ্ছে। তিনি দেখেছেন। দেখেছিলেন। কিন্তু ভুলে গিয়েছিলেন। এখন তিনি যেখানে ঘোরাফেরা করেন, সেখানে মেয়েরা টেনিস বল বুকে নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। সেলুন থেকে নিখুঁত করে তুলে আসে সমস্ত দাগ। টানা ভুরু, আঁকা চোখ, সাটিন-কোমল ত্বকের মেয়েরা সব—ট্রাউজার বা সালোয়ার কামিজ, কদাচিৎ শাড়ি পরে ঘুরে বেড়ায়। এই রকম রং, ফর্সা হলেও সেখানে অচল, এই পানপাতা মুখ কেউ ফিরেও দেখবে না। কিন্তু বিজু দেখলেন। ভাবলেন দুর্ভিক্ষ এখনও আছে, রাজপথ ছেড়ে অন্ধগলিতে আশ্রয় নিয়েছে, তাই সহসা চোখে পড়ে না। তিনি ভেবেছিলেন বাঁধাঘাট থেকে সবাই বেরিয়ে এসেছে। এখন দেখলেন, না। তাঁর ধারণাটা ঠিক নয়। একেবারেই ঠিক নয়।

মণিদীপিকাও এবার কলকল করতে করতে বেরিয়ে এল। বলল, —‘টঙদাদুর বন্ধু, এমন সময়ে এসেছে যে আমি নেলপালিশ পরছিলুম।’ তার কচি আঙুলের নখে লাল টুকটুকে ছোপ।

তার মা লজ্জা পেয়ে বললেন—‘দেখুন না, এমন বায়না করে…’

বিজু তখন ফ্রকের বাক্স আর চকলেটের প্যাকেটগুলো তার হাতে দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে তার মা চকলেটগুলো তার হাত থেকে নিয়ে নিল— ‘ওর ভীষণ কিরমি কাকাবাবু, জানেন তো। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে রোজ যেন ফুটকড়াই চিবোবে।’

ফ্রকের বাক্সের ডালাটা খুলে বউটি অবাক হয়ে তাকাল। ভয়ে ভয়ে বলল—‘এত দামি জামা এনেছেন…’

তার বিস্ময়ের দিকে তাকিয়ে বিজু বড় লজ্জা পেলেন। কোনও রকমে বললেন—‘বেশি দামী নয় বউমা, ওটাই খুকুর জন্যে আমার পছন্দ হল।’

—‘কিন্তু আমার পুতুল?’ মণিদীপিকা এবার গালে আঙুল রেখে বলল, ‘যাঃ পুতুলটা তো আনতে ভুলে গেছ! চলো না। এক্ষুনি চলো, ছাদ দিয়ে গিয়ে নিয়ে আসি। টানাতেই তো আছে!’

তার মা যথাসাধ্য বকুনি দিয়ে নিবৃত্ত করবার চেষ্টা করলেও সে কিছুতেই শুনল না। পাঁচিল টপকে বিজু রায়কে মেসবাড়ির ছাদে যেতে হল। চিলেকোঠার ঘরের তালাচাবি খুলে ড্রয়ার থেকে পুতুলটা বার করতে হল। আবার পাঁচিল টপকে এদিকে এলে, মণিদীপিকা কৈফিয়ত হিসেবে বলল—‘ পুতুলও যে আজ আমাদের সঙ্গে খাবে। ওরও তো আজ জন্মদিন…।’

ওই ঘরটিতেই আসন করে খেতে দিল বউটি। পাশাপাশি দুটি আসনে। তিনি আর মণিদীপিকা, আর মণিদীপিকার কোলে অবশ্যই তার পুতুল। একটি আধছেঁড়া ভালুক, তার গলায় লাল ফিতে এবং একটি কাঠের কুকুরও সঙ্গী হল, তাদের মণিদীপিকা, তার পাতের উল্টোদিকে সাজিয়ে রাখল।

বিজু রায় একটু ইতস্তত করে বললেন—‘খুকুর বাবা? বাবা খাবেন না?’

বউটি সঙ্কোচের সঙ্গে বলল—‘ ট্রেনে ট্রেনে ঘুরতে হয় তো, খুব সকালবেলাই চলে যেতে হয়।’

মণিদীপিকা বলল—‘আমার বাবা রোজ ট্রেনে চড়ে জানো তো দাদু! বাবার কাছে ম্যাজিক ওষুধ থাকে, সব সেরে যায়।’

তার মা আরও সঙ্কোচের সঙ্গে বলল—‘আপনি নলিনীকাকার কতদিনের বন্ধু কাকাবাবু, আগে কখনও আপনাকে দেখিনি তো!’

কিন্তু তার কথা বিজু রায় যেন শুনতে পাচ্ছিলেন না। তাঁর মনে হচ্ছিল নিতাইদা! নিতাইদার মতোই একজন কেউ তা হলে এই ছোট্ট খুকুটির বাবা! ভজহরি ভুজিয়াওয়ালার কাছে বসলে বাড়ির লোকে ঠিক ধরে ফেলবে। গৌরাঙ্গদা মুখে ‘না বলব না। না বলব না’ করলেও ঠিক বাড়িতে বলে দেবে বিজু স্কুল পালাচ্ছে। এদিকে ফাইনাল পরীক্ষা এগিয়ে আসছে। মা আজকাল খিটখিটে হয়ে গেছে খুব, শুনলে ধরে পিটুনি দেবে। কিন্তু নিতাইদা বড় মাই ডিয়ার লোক। সপ্তাহে একদিন দুদিন চাটনি-লজেন্স বিককিরি করতে চাইলে উৎসাহই দেয়। এক একদিন আবার মুড থাকলে বলবে—‘এই যে দেখছেন আমার ছোট্ট ভাইটি, নিজে লেখাপড়া শিখিনি, কষ্ট করছি, ভাইটাকে মানুষ করব বলে। বলুন দাদা, মানুষ হবে না ভাইটা আমার? পড়াশোনায় খুব মাথা!’ বিক্রি চট করে বেড়ে যেত। হয়ত ওদিক থেকে এক মহিলা এক ঠোঙা কিনলেন। এদিকের এক প্রৌঢ় অমনি গম্ভীর ভাবে পকেট থেকে টাকা বার করতে করতে বলে উঠলেন—‘দাও হে, আমাকেও দাও গোটা বারো।’ পরে সব বিকিয়ে গেলে কোনও একটা স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে পাথরের বেঞ্চিতে বসে কচুরি আর ছোলার ডাল খেতে খেতে দুজনের কী হাসি! শেষকালে শালপাতার ঠোঙাটা জিভ দিয়ে চেটে ফেলে দিতে দিতে নিতাইদা বলত ‘জানিস তো পৃথিবীর সব বড় লোকেরাই ল্যাবেষ্ণুস চানাচুর বিককিরি করে বড় হয়েছে।’

বিজু ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষা দিতে যাচ্ছে, একটু সন্দেহকুল হত—‘লজেন্স না হয় সব দেশেই পাওয়া যায়। কিন্তু চানাচুর? সে তো পৃথিবীর সর্বত্র পাওয়া যায় না।’

নিতাইদা ঢোক গিলে বলত—‘বলিস কী? চানাচুর পাওয়া যায় না এমন দেশও আছে? তাহলে ধর দাদের মলম, কিংবা খবরের কাগজ?… তুই বড় বড় লোকেদের লাইফ-হিস্টরি পড়, ধর সুভাষ বোস, কিম্বা মাউন্টব্যাটেন…।’

বিজু বলত—‘কী যে বলো নিতাইদা! সুভাষ বোস খুব বড়লোকের বাড়ির ছেলে, এলগিন রোডে ওঁদের বিরাট বাড়ি, আর মাউন্টব্যাটেন তো লর্ড, লর্ড মানে জমিদার।’

নিতাইদা এবার মাথা চুলকোচ্ছে। ‘কিন্ত আমি শুনেছি যে…’

বিজুই তখন আলোক দিত নিতাইকে— ‘মস্ত বড় বৈজ্ঞানিক এডিসন খবরের কাগজ বিক্রি করতেন এরকম গল্প আছে। এব্রাহাম লিংকন সম্পর্কেও বলে— “ফ্রম লগ কেবিন টু দা হোয়াইট হাউস”…’

নিতাইদা উৎসাহে খাড়া হয়ে যেত, বেঞ্চিতে চাপড় মেরে বলত—‘তবে? তবে? বলিনি? তাই যদি না হবে তো ফ্রম র‍্যাগ্‌স্‌ টু রিচেজ কথাটা কোত্থেকে এল বল তো! বলতে পারিস?’

বিজুর জীবনে যখন কথাটা সত্যি হয়েছিল, তখনই একমাত্র সে জেনেছিল র‍্যাগস্‌ আর রিচেজ-এর মাঝখানের ফাঁকটা কী দিয়ে ভরাট হয়। অন্তত সে কী দিয়ে ভরেছিল। নিতাইদার পাত্তা তখন নেই যে তাকে ওয়াকিবহাল করা যাবে এ বিষয়ে। অবশ্য পাত্তা পাওয়া গেলেও যে বিজু তাকে ঠিকঠাক চিনতে পারত তা নয়। একজন কর্মবীরের ব্যস্ত মধ্যাহ্নে অল্প বয়সের চানাচুর ফেরিঅলা দাদাকে চেনা গেলেও কি ঠিক সে ভাবে চেনা যায়? যে ভাবে তারকেশ্বরের প্ল্যাটফর্মে বেঞ্চে বসে চেনাশোনা হত? তখন নিতাইদাকে চেনা হত একজন হ্যাংলা-চেহারার ভিখারিসদৃশ নিতাই পাল বলে, যার চোখে বিজু রায়ের প্রতি সম্ভ্রম-দৃষ্টি। ‘র‍্যাগস টু রিচেজ’-এর প্রত্যক্ষ উদাহরণ সে চাক্ষুষ করছে। এইরকমই কিছু একটা হত। গৌরাঙ্গদার ক্ষেত্রে তাই-ই হয়েছিল। তিনি একেবারেই চিনতে পারেননি গৌরাঙ্গদাকে। ময়লা জামাকাপড়, একমুখ কাঁচা পাকা দাড়ি, চোখে মোটা পাওয়ারের নিকেল ফ্রেমের চশমা। কী করে চিনবেন। টেবিলের ওধারে ওই আর এধারে সাদা ধবধবে শার্ট। হালকা ব্রাউন ট্রাউজার্স। চুল থেকে ক্রিমের চেকনাই দিচ্ছে। চোখের সামনে প্রভাবশালী পুরুষ মহিলাদের মুখ সব সময়ে। গৌরাঙ্গদা কিছুক্ষণ পর ক্ষুব্ধ গলায় বলে উঠল— ‘চিনতে পারলি না তো?’ ‘তুই’ শুনে অদূরে বসা সেক্রেটারি ভুরু কুঁচকে তাকাল। গৌরাঙ্গদা বিনা বাক্যব্যয়ে উঠে পেছন ফিরে দরজা ঠেলে বেরিয়ে গেল। আরও মিনিটখানেক পর মাথার মধ্যে ক্লিক করল। গৌরাঙ্গ দাস, গৌরাঙ্গদা ছাতুবাবুর ঘাট, গঙ্গায় ঝাঁপাই। রামসীতার মন্দিরের চাতালে গেঁজেল বলু ঠাকুর। ওঃ সে কি এ জন্মের কথা। যে মনে থাকবে?

বউটি তার কথার জবাব না পেয়ে খুব অপ্রস্তুত হয়েছে। না জানি সে কী গর্হিত কথা জিজ্ঞেস করে ফেলেছে। এই ভদ্রলোককে দেখলেই বোঝা যায় বড় বনেদি ঘরের মানুষ। রুপোলি জিনিস প্রচুর থাকার চাকচিক্য সর্বাঙ্গে। নলিনী করও বনেদি ছিলেন। কিন্তু এই রুপোলি চাকচিক্য তাঁর ছিল না। সন্দেহ নেই, নলিনীকাকার এ রকম বন্ধু থাকতেই পারে। সে তাড়াতাড়ি উঠে নতুন গুড়ের পায়েস নিয়ে এল।

বিজু বললেন— ‘আমি এত খাব না বউমা, একটু কমিয়ে দাও। আমার আবার ব্লাড শুগার আছে কি না।’

মণিদীপিকা বলল— টঙ্‌দাদুরও তো ডাক্তারের বারণ। তা-ও খায়। লাল পায়েস খেতে টঙ্‌ দাদু ভীষণ ভালবাসে।’

তার মায়ের দিকে একবার চাইলেন বিজু রায়, সে মৃদুস্বরে বলল— ‘অনেক কিছুই বারণ ছিল, শুনতেন না, গেরাহ্যি করতেন না কিছুকে।…’ বলতে বলতে তার গলা ধরে এল।

খাওয়া-দাওয়ার শেষে খুকুকে আদর করে তিনি বেরিয়ে এলেন—দিদির মৃত্যু সংবাদ ও শ্রাদ্ধের খবরটা কোনও কাগজে দিতে হবে। কাছাকাছি যে খবরের কাগজের বিজ্ঞাপন কাউন্টার থাকবে সেখানেই দেবেন। তারপরে একবার সুখচর যেতে হবে।

খান্না সিনেমার কাছ থেকে বাস ধরলেন বিজু রায়। আটাত্তর নম্বর। প্রথম যেদিন যান, ট্রেনেই গিয়েছিলেন। মুখ লুকিয়ে। সোদপুরে নেমে অনেকটা রাস্তা রিকশায় যেতে হয়। দিদির অসুখ, দিদিকে আনা-নেওয়া, খবরাখবর ইত্যাদি তাড়াতাড়ির সময়ে ট্যাকসি, কখনও অ্যামবুলেন্স। আজকে কী রকম সংকোচ হল। মণিদীপিকাদের বাড়ি থেকে আসার পরই কি? চারিদিকে পিলপিল করছে মানুষের ভিড়। গলদঘর্ম হয়ে যাচ্ছে সব শীতেও। মহিলারা অদ্ভুত দৃশ্য সৃষ্টি করে দৌড়চ্ছেন। জীবনে কখনও খেলার মাঠে দৌড়ননি এঁরা। মাঝবয়সে এসে বাস ধরতে দৌড়চ্ছেন। এমন চমৎকার শরীর-স্বাস্থ্য নিয়ে বিজু রায় কেমন করে বাস এড়াবেন?

দিদির বাড়ি পৌঁছে দেখলেন সদর দরজায় তালা মারা। খুব ঘটা করে। তিনি জানেন খিড়কির দিকে খোলা আছে। কিন্তু সেখান দিয়ে চোরের মতো ঢোকায় তাঁর মত হল না। শাঁটল তাহলে এখনও যায়নি? অথচ রত্নাকে তিনি কাল স্পষ্ট নির্দেশ দিয়েছেন এ বাড়িতেই শ্রাদ্ধ হবে। শাঁটুলকে অতএব অন্য কোনও জায়গা খুঁজে নিতে হবে আপাতত। তিনি বিরক্ত হয়ে ফিরছেন, এমন সময়ে চাপা মেয়ে-গলায় ডাক শুনলেন—‘মামাবাবু।’ জানলা ফাঁক করে রত্না ডাকছে— ‘আপনি যাবেন না। ওদিকের দরজা খুলে রেখেছি, আসুন।’ রত্নার গলায় ভীষণ আর্তি। অগত্যা, ইচ্ছে না থাকলেও, এবং ভেতরে ভেতরে রাগ হলেও বিজু বাড়িটাকে পরিক্রমা করতে আরম্ভ করলেন। বেশ বড় বাড়ি। অন্ততপক্ষে সাত কাঠার ওপর ছড়িয়ে ছিটিয়ে তৈরি হয়েছে। বাইরেও বাগানের অংশে পাঁচ ছ কাঠার মতো হবে। বাড়িটার সমস্ত অঙ্গ থেকে গাছপালা বেরিয়েছে। বাগানও জঙ্গল। পেছনের দিকের দরজাতেও তালা মারা। একটা ছোট্ট দরজা ফাঁক করে রত্না দাঁড়িয়ে আছে। ঢুকতে ঢুকতে বিজু বুঝলেন এটা জমাদার যাওয়া-আসার পথ। তিনি নাকে রুমাল দিলেন। রত্না বলল— ‘মামাবাবু, আর কোনও উপায় ছিল না, আপনি দয়া করে কিছু মনে করবেন না।’ বিজু উত্তর দিলেন না। রত্নার পরনে কোরা লাল পাড় শাড়ি। চুল রুক্ষ। সে অশৌচ পালন করছে। কলঘরের ভেতর দিয়ে উঠোনে এসে পৌঁছলেন তিনি। নাক থেকে রুমাল সরিয়ে বললেন— ‘এরকম দিন-দুপুরে খিড়কি দিয়ে যাতায়াত করলে তো লোকে টের পাবেই। তখন!’

রত্না বলল— ‘আমি যে হররোজ আসিই বাড়ি সাফা করতে আশে-পাশে সবাই জানে। এতটা বাগান চট করে ভেতরে লোকের নজরও পড়ে না।’

বিজু বললেন— ‘ওটা তোমার মনে হওয়া। যাক গে। শাঁটুলকে কি এখনও অন্যত্র সরাতে পারোনি?’

রত্না কিছু না বলে একটা ঘরের দরজা খুলে ধরল। ভেতরে একটা পুরনো পালঙ্কে কেউ শুয়ে আছে মনে হল। তিনি জিজ্ঞাসু চোখে তাকালেন রত্নার দিকে। সে মৃদু গলায় বলল—‘বুখার খুব।’

চটি খুলে ভেতরে ঢুকলেন বিজু। পালঙ্কের বিছানায় একটি যুবক। তারও পরনে থান, গলায় কাছা। তার মুখের দিকে তাকিয়ে তাঁর বাকরোধ হয়ে গেল। কথায় বলে নরাণাং মাতুলক্রম। কিন্তু সেটা এতদিন কথার কথা বলেই মনে করেছিলেন তিনি। এ যুবকটিকে কিন্তু যে কেউ দেখলে বলবে—এ তাঁর ছোট ভাই। ওই একইরকম ঢেউ খেলানো একরাশ চুল। তাঁর মাজা রং, এখন রুপোর উজ্জ্বলতা পেয়েছে। এ ছেলেটি শ্যামবর্ণ। জ্বরের জন্য লালচে দেখাচ্ছে মুখটা। তাঁরই মতো কপাল। ঠোঁটের ঢেউ। বিজু রায়ের ভয় হল শাঁটুল চোখ খুললে, তাঁর কি নিজেরই সঙ্গে চোখাচোখি হবে? নিজের যৌবনের সঙ্গে? শাঁটুলের চুলে অল্প পাক ধরেছে। দু-চারটে করে সাদা চুল তার অজস্র এলোমেলো চুলের মধ্যে। তিনি কপালে হাত রাখলেন। শাঁটুল একটু শিউরে উঠল। জাগল না। বেশ ভালরকম জ্বর। রত্না বলল— ‘রোজ বুখার হচ্ছে বলেই নাকি এখানে এসেছিল, আমায় বলেনি কিছু। এখন বলুন এই বিমার লোককে কী করে বাড়ি থেকে চলে যেতে বলি!’

—‘না, না, তা তো হয় না’ বিজু বলতে বলতে উঠে দাঁড়ালেন। বাইরে বেরিয়ে এলেন— ‘চিকিৎসার কিছু হয়েছে?’

—‘কী করে হবে? ডাক্তার ডাকতে পারছি না। জ্বর কমার দাওয়া দিয়ে যাচ্ছি। দুটো করে। যখন দিই ঘাম দিয়ে দু ডিগ্রি বসে যায়। আবার ওঠে চড়বড় করে।

বিজু রায় নিরুত্তর দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবতে লাগলেন। কিছুক্ষণ পর রত্না বলল— ‘আমরা আপনাকে খুব, মানে আপনি খুব পরেশান হচ্ছেন আমাদের জন্যে।’

বিজু রায় ভাবনায় মগ্ন ছিলেন, কথাগুলো তাঁর কানে ঢুকলেও মাথায় কোনও প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করল না। একটু পরে তিনি বললেন— ‘সিমটমগুলো চট করে বলো তো। সর্দি-কাশি আছে?’

—‘না, একদম না।’

—‘জ্বরটা বাড়ে কখন?’

—‘বেলার দিকে। সকালে কম থাকে।’

—‘আর কিছু?’

—‘খেতে চায় না। পেটটা ভারী।’

—‘জ্বরটা একবার দেখো তো।’ রত্না জ্বর নিয়ে বলল—‘চার ছাড়িয়ে যাচ্ছে।’

—‘বলো কী? শিগগিরই মাথা ধোয়াও। আমি সাহায্য করব?’

—‘না, না। একটা বড় কেতলি আছে, আমি ধুয়ে দিচ্ছি।’

—‘এখানে কাছাকাছি কোথাও ফোন বুথ আছে?’

—‘বেরিয়ে ডান দিকে বেঁকলে যে রাস্তায় পড়বেন, ওখানে একটা বড় দোকান আছে। ওদের ফোন আছে। বড় একটা ব্যবহার করতে দেয় না।’

বিজু বেরিয়ে গেলেন।

অগতির গতি ডক্টর পি. চ্যাটার্জি। লক্ষণাদি শুনে বললেন— ‘কোথা থেকে বলছেন?’

—‘সুখচর।’

—‘ও, আপনার দিদির বাড়ি?’

—‘হ্যাঁ, ওঁর ছেলে; আমার ভাগ্নেরই অসুখটা।’

—‘ও আচ্ছা। এনটারিক মনে হচ্ছে। ওষুধগুলো বলছি লিখে নিন।’

লিখে নিয়ে বিজু বলেন— ‘প্রেসক্রিপশন ছাড়া দেবে?’

ফোনের মধ্যে হাসলেন ডাক্তার, বললেন— ‘চেনা লোককে দিয়ে দেয়। নেহাত না দিলে ফোনে আমার সঙ্গে একটা যোগাযোগ করিয়ে দেবেন।’

বাড়ি ফিরে তিনি দেখলেন রোগীর মাথা ধোয়াননা শেষ। সে উঠে বসে মিছরির শরবত-জাতীয় কিছু একটা খাচ্ছে। তিনি রত্নাকে কাগজটা দিয়ে বললেন— ‘তোমার চেনা দোকান থেকে নিয়ে এসো। সেরকম চেনা দোকান আছে তো?’

—‘হ্যাঁ হ্যাঁ। আমি আমার নিজের পাড়া থেকে আনছি।’ বিজু টাকা বার করতে যাচ্ছিলেন, রত্না বলল— ‘আমার কাছে আছে। আপনি তো বহোত দিয়েছিলেন। কিছুই বিশেষ খরচ হয়নি।’ সে একরকম দৌড়ে চলে গেল।

ঘরের মধ্যে ঢুকে একটা চেয়ার টেনে রোগীর সামনে বসলেন বিজু রায়।

শরবতটা খাওয়া হয়ে গেলে গ্লাসটার জন্য হাত বাড়ালেন।

ক্ষীণ গলায় শাঁটুল বলল— ‘আপনি কে? ডাক্তারবাবু?’ রত্না তাহলে ইতিমধ্যে একে কিছুই বলেনি। তিনি বললেন— ‘শমিত, আমি তোমার ছোট মামা।’

শাঁটুল যেন একটা শক খেল। চোখ তুলে বিজুর দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে একবার তাকাল। তারপর চোখ নামিয়ে নিল। বড় বড় পল্লব ঘেরা নিষ্পাপ চোখ। এত বড় ছেলের এমন চোখ বিজু বহুদিন দেখেননি। এ চোখ শাঁটুল কোথায় পেল? এ তো তাঁর চোখ নয়? এরকম মেয়েলি, মায়াবী চোখ। কোথায় দেখেছিলেন এমন চোখ? বিজুর ভেতরটা কেমন করতে লাগল। এই ছেলে লোক ঠকিয়ে খায়? জোচ্চোর?

শাটুল হঠাৎ বলল— ‘আপনি কি আমায় পুলিশে ধরিয়ে দেবেন?’

—‘এখন তুমি অসুস্থ। এসব কথা থাক শমিত।’

—‘না। থাকবে না। সুস্থ হবার পর? তখন নিশ্চয়ই…’

—‘এত যদি ভয় পাও তো গোলমেলে কাজ করেছিলে কেন?’

—‘বিশ্বসুদ্ধু লোক দু নম্বরি করে খাচ্ছে! আর আমি করলেই কেচ্ছা। আপনিই বলুন।’

বিজু সামান্য হেসে বললেন— ‘সবাই সব পারে না শমিত। এটা তোমাকে স্বীকার করতেই হবে। যে পারে সে পেরে যাচ্ছে। তার কথা আমি বলতে পারব না। কিন্তু তুমি যদি অন্ধকারের জগতে চলে যাওয়ার হাত থেকে রক্ষা পেতে চাও, বেঁচে বর্তে থাকতে চাও একজন সাধারণ সুখী মানুষের মতো তাহলে আমি তোমাকে পরামর্শ দিতে, সাহায্য করতে রাজি আছি।’

শাঁটুল আবার তাঁর দিকে তাকাল। সেই চোখ, সেই দৃষ্টি। এতদিন, দিদির বাড়ি আসার দিন থেকে বিজু রায় ভাবছেন। ক্রমাগত ভেবে চলেছেন কী করবেন, কী করা উচিত। ঠগ জোচ্চোরের হাজতবাসই ভাল। যারা মনে করে দুনিয়ার সব পয়সাওয়ালা লোক অসদুপায়ে উপার্জন করেছে, তাদের শিক্ষা হওয়া ভাল। এমন ভেবেছিলেন। ভেবেছিলেন যে ভাগ্নে মামার সম্পর্কে অতি নীচ ধারণা পোষণ করে, আবার বিপদে পড়ে সেই মামার কাছ থেকেই লাখেরও বেশি টাকা এবং আনুষঙ্গিক নানা সাহায্য চায়, যে সবের তলায় একটা চতুর, ঠগ মন কাজ করে যাচ্ছে বলে তিনি অনায়াসে চিনতে পেরেছিলেন, সেই ভাগ্নেকে কোনওরকম সাহায্য করতে গিয়ে তিনি বিপদে পড়ে যেতে পারেন। হঠাৎ এই চোখ এই দৃষ্টি তাঁকে সিদ্ধান্তে পৌঁছতে সাহায্য করল, সাহায্য নয়, বরং বলা চলে পৌঁছে দিল। সিদ্ধান্তও নয়, সংকল্পে।

তিনি আবারও বললেন— ‘রত্নার কাছে তুমি যে ব্যাপারটা সাজেস্ট করেছ, সেটাতে আমি রাজি আছি। অবশ্য আমার নিজেরও কিছু শর্ত থাকবে।’ তিনি চুপ করে রইলেন। একটু পরে শাঁটুল বলল— ‘বলুন কী বলবেন।’

—‘তুমি লোকগুলির নাম ঠিকানা আমায় দাও। কে কত পায় তার একটা হিসেব দাও। আমি তোমার ওপর থেকে ওয়ারেন্ট তুলে নেবার ব্যবস্থা করছি।’

—‘তারপর?’

—‘তারপর, ওই টাকাটা আমি তোমার হয়ে দিয়েও দেব, এই বাড়ির এগেনস্টে। মানে বাড়িটা ধরো আমার কাছে বন্ধক থাকবে।’

—‘সে কী, বারো কাঠার বাড়ি আপনি নিয়ে নেবেন ওই এক-দেড় লাখ টাকা দিয়ে?’

—‘নিয়ে নেব তা তো বলি নি শমিত।’

—‘কিন্তু আমি ওই টাকা শোধ করব কী করে। শোধ করতে না পারলেই…’

—‘শোনো, তোমার দিদিদের কাছ থেকে “এ বাড়ির ভাগ তাদের চাই না” এই মর্মে কিছু সই-সাবুদ দরকার। তারপর এ বাড়িটা তুমি প্রোমোট করবে। মানে আমিই করব, তুমি আমার সঙ্গে থাকবে। যতটা আমরা তুলতে অনুমতি পাব, তার তেত্রিশ পার্সেন্ট কি ধরো চল্লিশ পার্সেন্ট তুমি পাবে। তোমার দিদিরা ভাগ ছাড়তে না চাইলে, ওই তোমার চল্লিশ পার্সেন্টের ভেতর থেকেই তাদের দিতে হবে। বাড়িটা আউটরাইট সেল করে দিলে যা পাবে, তার চেয়ে অনেক বেশি আসবে এই প্রোমোটিং অ্যান্ড ডেভেলপিং থেকে।’

এই সময়, রত্না এসে ঢুকল। সে ওষুধগুলো পেয়েছে। তবে দোকানি বোধহয় কিছু সন্দেহ করেছে। সে ভীষণ উত্তেজিত ভাবে বলল। জ্বরের লালের তলায় তলায় শাঁটুল ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। সে শুয়ে পড়ল।

বিজু রায় বললেন— ‘জল নিয়ে এসো বউমা, ওষুধগুলো এক্ষুনি পড়া দরকার।’

ওষুধ খেয়ে শাঁটুল বলল, ‘আমার ভীষণ শীত করছে। এখুনি কিছু একটা করুন মামাবাবু। আমাকে… আমি.. কিছুতেই জেলে যাব না… তার আগে বরং ঝুলে পড়ব…।’

রত্না ধমক দিয়ে বলল— ‘কী বাজে-আজে বকছ। মামাবাবু কীভাবে মার জন্যে করেছেন, জানো? আমাদের এ কদিন দেখ্‌ভাল স-ব।

—‘আমি আর কিছু ভাবতে পারছি না, যা হয় করুন। যা হয় করুন, যদি ঠকিয়ে নিতে ইচ্ছে হয় এ বাড়ি তো তাই নিন, কিন্তু আমায় জেলের হাত থেকে বাঁচান।’

শমিত ভীষণ উত্তেজিত গলায় কথাগুলো বলল।

রত্না বলল—‘ওর মাথা ঠিক নেই, মামাবাবু, দয়া করে মনে করবেন না কিছু।’

বিজু রায় বললেন— ‘তুমি ঠগ্‌ বলে আমিও ঠগ হবোই এরকম ধারণা করে তুমি যদি কোনও রকম বিকৃত আনন্দ পেতে চাও শমিত, আমি বাধা দেব না। তবে তার আগে আমার আরও কিছু জানা দরকার। অনেক টাকা পাবে, এ বাড়ি প্রোমোট করলে, অত টাকা দিয়ে কী করবে?’

—‘টাকাটাই তো আমাদের আসল প্রবলেম’, রত্না বলল। ‘টাকা পেলে সবটা ঠিক হয়ে যাবে।’

—‘না, ঠিক হবে না। শমিতকে বলতে দাও। সে কী করবে। বসে বসেও খাওয়া যায় ওই টাকাতে। কিন্তু একটা সুস্থ সবল পুরুষ মানুষ তো ঠিক বসে বসে খেয়ে সুখী হতে পারে না।’

—‘ব্যবসা করব’, অসুখে ক্ষীণ শাঁটুলের গলা থেকে শব্দ বার হল।

—‘ব্যবসা তো আগেও করেছ, সফল হয়েছ একবারও?’

শাঁটুল চুপ করে রইল। বিজু রায় বললেন—‘এই মুহূর্তে আমি ভেবে ঠিকঠাক করতে পারছি না। শিগগিরই তোমার একটা ব্যবস্থা করব। সেই ব্যবস্থা তোমাকে মেনে নিতে হবে। হাতে একগাদা টাকা পাবে আর সেগুলো যা-তা করে উড়িয়ে দেবে সে হবে না। যদি রাজি থাকো তো এগোব, নইলে… থাক।’

রত্না বলল— ‘বলে দাও, বলে দাও, দের করছ কেন? বললাম না ওষুধের দোকানে সন্দেহ করছে।’

বিজু রায় বললেন— ‘প্রেশার দিয়ো না বউমা। ওকে শান্তমনে ঠিক করতে দাও সব। ইতিমধ্যে যদি পুলিশ আসে, সে না হয় আমি অ্যান্টিসিপেটরি বেলের বন্দোবস্ত করছি।’

—‘না, না’, শমিত এবার প্রায় কাঁদো কাঁদো গলায় বলল। ‘একবার থানা-পুলিশের দাগ লাগলে জীবনে কখনও মাথা তুলতে পারব না। কোনও কাজ করতে পারব না। মামাবাবু যা হয় করুন। খালি… খালি…’

বিজু রায় আস্তে বললেন— ‘শোনো শমিত। জীবনে কখনও কখনও এমন সময় আসে যে কাউকে নিঃশর্তে বিশ্বাস করতে হয়, করতেই হয়। আমাকে আমমোক্তারনামা মানে পাওয়ার অফ অ্যাটর্নি দিতে হবে তোমায়, আমি এক্ষুনি উকিলের ব্যবস্থা করছি। নাম আর অ্যামাউন্টগুলোর চটপট দুজনে মিলে একটা লিস্ট তৈরি করে ফেল।’


চারদিক থেকে অন্ধকার নেমে আসছে। দিনের প্রখর আলোতেও সে অন্ধকার সরে না। চারদিকে উজ্জ্বল পরিচ্ছন্ন আসবাব, ছবি, কার্পেট, সুশোভন গাছ, ফুলদান, সব বস্তুপিণ্ড। প্রাণ নেই, মানে নেই, আনন্দ দেবার, সুস্থিতি দেবার কোনও ক্ষমতাই নেই। সকালবেলায় ঘুম থেকে উঠতে ইচ্ছে করে না। মনে হয় মুঠো মুঠো ঘুমের বড়ি গিলে চেতনাকে হত্যা করা যাক। কে তুমি তনুশ্রী রায়? আসলে তুমি কেউ না। তুমি যেটুকু বিজু রায়ের স্ত্রী সেইটুকু তোমার অর্থ আছে। সামাজিক পরিচয়। বিজু রায় আছেন, কোনও কারণে আসতে পারছেন না, তুমি শর্মার ছেলের বিয়ের পার্টিতে গেলে। ঠিক আছে। কিন্তু বিজু রায় নেই। বিজু রায়ের বিশাল ব্যবসার সাম্রাজ্য ভেঙে পড়ছে, অব্যবহৃত জীর্ণ প্রাসাদের মতো। ভগ্নস্তূপ, খণ্ডহর। তুমি আসলে একটি প্রেতিনী। তুমি কোথায় যাবে? কেউ তোমায় ডাকবে না। যদি অগত্যা ডাকেও, গেলে সব তেরছা চোখে চাইবে, নানা ছলছুতো করে সরে যাবে। অন্যত্র। অন্য কারও কাছে। যে এখনও গোটা আছে, ভাঙেনি, তার কাছে। ঠিক এরকম একটা ঘটনা সম্প্রতি একটা পার্টিতে ঘটতে দেখেছে তনুশ্রী। মিঃ সরকার প্রধানত স্টিল পারমিটের সুবাদে ধনী। পারিবারিক ব্যবসাও আছে বহুদিনের। রোলিং মিল। ভাইয়েরা তাঁর বিরুদ্ধে মামলা করল। ভাইয়ে ভাইয়ে বিবাদে পলিটিক্যাল প্রভাব গেল ভাইয়েদের দিকে, মিঃ সরকার একরকম নিঃস্ব হয়ে গেলেন। খুব দিল দরিয়া মেজাজের লোক ছিলেন, লোককে খাওয়াতে, পান করাতে, ভালবাসতেন, ভদ্রলোক সুইসাইড করলেন। বছর খানেক পরে মিসেস সরকার এইরকম একটা বিয়ে না কিসের পার্টিতে নিমন্ত্রিত হয়ে এসেছিলেন। সাদা শিফন শাড়ি, রুপোর গয়না। একসময়ে খুব সুন্দরী ছিলেন মিসেস সরকার। ভাগ্য বিপর্যয়ে কেমন লাবণ্যহীন, ম্যাড়মেড়ে, ওই খণ্ডহর। তনুশ্রীকে ধরেছিলেন, দুজনে কথাবার্তা বলেছিলেন ওয়াইন হাতে নিয়ে, মিসেস শর্মা ছলছুতো করে ডেকে নিয়ে গেলেন— ‘ওটার সঙ্গে এত কী কথা বলছিলেন?’ ‘দ্যাট উওম্যান’ এই শব্দ ব্যবহার করেছিলেন মিসেস শর্মা। এখনও মনে আছে স্পষ্ট। এই মহিলাই একদিন কত জমকালো পার্টির কর্ত্রী, এঁর কৃপাদৃষ্টি পেলেই তনুশ্রী তো কোন ছার, মিসেস শর্মাই বর্তে যেতেন। পার্টি যখন খুব জমে উঠেছে তখন একবার দেখতে পেয়েছিলেন দূরে একটা কোণের সোফায় চুপ করে বসে আছেন মিসেস সরকার। বেয়ারারা ট্রে হাতে ঘুরে বেড়াচ্ছে, ওঁর কাছটা এড়িয়ে যাচ্ছে। ওই বেয়ারা কেন, মাটি, ঘরের মেঝেটা, কার্পেটটাও চেনে কে সম্পন্ন, কে নয়, সে সম্পূর্ণ, কে ভাঙা। তখন তনুশ্রীরও মনে হয়েছিল ‘উইচ, শী ইজ আ উইচ’, রেণুকা শর্মার মতো। মনে হয়েছিল। এখন তনুশ্রী বুঝতে পারছেন না উইচ নয়, এক ভাগ্যহীনা, একাকিনী, কৃপার পাত্রী, তা-ও নয়, মর্মান্তিক ট্রাজেডি এক। তনুশ্রী শিউরে উঠলেন।

হঠাৎ তিনি চমকে বিছানায় উঠে বসলেন। সত্যিই তো। বিজু রায়ের বিজনেসের কী হবে? যদি সত্যিই না ফেরে? মাস ফুরিয়ে আসছে, সবাইকেই মাইনে-পত্র দিতে হবে। সব চেকেই নিশ্চয়ই বিজু রায়ের সই চাই। রাশি রাশি বিল আসবে কদিন পর থেকেই। তনুশ্রীর নিজস্ব অ্যাকাউন্ট আছে। তাতে তাঁর নিজের খরচ চলে, তনুশ্রী দু হাতে খরচ করেন। ছেলের মেয়ের নির্দিষ্ট হাত খরচ আছে, তাদেরও নিজস্ব অ্যাকাউন্ট আছে, তা থেকেই চলে। সংসার খরচের জন্য প্রতি মাসে বিজু রায় তাঁকে একটা মোটা অঙ্কের চেক দেন, তা ছাড়াও আছে কিছু জয়েন্ট অ্যাকাউন্ট। কিন্তু তার পাস বই, চেক বুক সবই থাকে বিজু রায়ের কাছে। বিজু রায়ের টাকা-পয়সার বন্দোবস্তের কথা এর চেয়ে ভাল জানেন না তিনি। ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। কাকে ডাকবেন? ছেলেকে? অপদার্থ একটা। শিখেছে খালি শ্রাগ করতে আর ইংরিজি গালাগাল দিতে। মেয়েকে? মেয়েকে ডাকবেন? যা দেমাকি! কিসের এত দেমাক কে জানে। তনুশ্রীর মতো সুন্দরী নয়। লেখাপড়াতেও আহামরি কিছু নয়। কিসের অহঙ্কার এত! স্বামী ছাড়া প্রকৃতপক্ষে তাহলে একজন সন্তানবতী নারীরও কিছু থাকে না। তনুশ্রীরও বিজু রায় ছাড়া কেউ নেই। তনুশ্রী মাঝের বিশাল দরজাটা খুলে বিজু রায়ের ঘরে গেলেন। পরিষ্কার গোছানো। বিছানা টান-টান। দেয়ালে আলনা আলমারি। থাক থাক ড্রয়ার। ওয়ার্ডরোব। চাবি কোথায়? খাটে। বালিশের তলায়। গদি উল্টে ফেলে দেখছেন, হাঁফাচ্ছেন। সেরেছে। চাবিও নেই?

—‘মা, এখানে কী করছ?’ পেছনে মেয়ের গলা।’

প্রথমেই প্রচণ্ড রাগ হল তনুশ্রীর। তাঁর স্বামীর ঘরে ঢুকে কী করছেন তিনি, মেয়েকে কৈফিয়ত দিতে হবে?

পরক্ষণেই কুটো আঁকড়াবার মতো করে তিতির হাত আঁকড়ে লণ্ডভণ্ড বিছানার ওপরে বসে পড়লেন তনুশ্রী। এই শীতেও দরদর করে ঘামছেন। নিজের চুন্নির প্রান্ত নিয়ে মায়ের ঘাম মুছিয়ে দিতে দিতে তিতি বলল— ‘এত ঘামছ কেন? এ কী?’ সে ছুট্টে গিয়ে এয়ার কুলারটা চালিয়ে দিল। তারপর মায়ের পাশে বসে পড়ে কাঁধে নরম করে হাত রেখে বলল, ‘মা, তুমি এত নার্ভাস হচ্ছ কেন? আমরা তো সবাই আছি। সত্যি বাবা যে কী করে এমন একটা কাজ করল…’

তনুশ্রী আতঙ্কিত দৃষ্টিতে মেয়ের দিকে তাকালেন— ‘কী কাজ! খোঁজ পেয়েছ?’

—‘খোঁজ পাব কী করে?’ তিতি অবাক হয়ে বলল।

—‘তবে যে বললে কী করে এমন কাজ! তোমরা তাহলে ধরেই নিয়েছ বাবা ইচ্ছে করে চলে গেছে? চলে গেছে আমায় ছেড়ে?’

—‘ভুল হয়ে গেছে মা, তা ছাড়া বাবা গেলে তো শুধু তোমায় ছেড়ে চলে যায়নি, আমাদের সবাইকেই ছেড়ে চলে গেছে। কিন্তু বাবা স্বেচ্ছায় ও ভাবে গেছে ভাবাটা ঠিক নয়।’

‘কিন্তু ধরো যদি কোনও কারণ থেকে থাকে, যদি ধরো অন্য কেউ, মানে অন্য কাউকে, মানে অন্য কারুর…’

—‘কী বলছ মা? ঠিক করে বলো।’ তিতি মায়ের হাত দুটো ঝাঁকিয়ে বলল, তনুশ্রী তখনও বড় বড় ভয় পাওয়া চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছেন। তখন সে বুঝল। ভেতরটা হিম হয়ে গেল। অনেক কষ্টে গলায় স্বর এনে আস্তে আস্তে বলল—‘এরকম কেউ ছিল? তুমি জানো?’

তনুশ্রী কেঁদে ফেললেন— ‘না জানি না, কী করে জানব? শর্মাজি যখন তাঁর আগেকার বউকে ডিভোর্স করলেন সেক্রেটারি রেণুকাকে বিয়ে করবার জন্যে তখন সেই আগেকার বউ, অযোধ্যা অঞ্চলের দেহাতি মেয়ে নাকি একেবারে অবাক হয়ে গিয়েছিল। মিসেস বসাকের কাছে শুনেছি। সে এতই মুখ্যু যে তাকে বিশেষ কিছু দিতেও হয়নি শর্মাজির।…’

তিতি বলল— ‘কিন্তু মা, শর্মাজির সেই বউ মুখ্যু, দেহাতি হতে পারে। তুমি তো তা নয়।

তুমি কি তেমন কিছু… মানে এররকম ভাবার কোনও কারণ আছে কি তোমার?’

—‘আমি জানি না। জানি না তিতি। আমি ওকে বিশ্বাস করতাম। এখন বুঝতে পারছি তোমাদের বাবাকে আমি বোধহয় খুব ভাল করে জানি না।’

মায়ের উদ্‌ভ্রান্ত মুখের দিকে তাকিয়ে তিতি ভেতরে ভেতরে কেমন ভয় পেয়ে গেল। তার পায়ের তলা থেকে কে যেন কার্পেট, মাটি, জমি, পৃথিবীটাই সরিয়ে নিচ্ছে। মায়ের কথাটা যেন মায়ের কথা নয়, একটা উদ্ধৃতি। ‘তোমার বাবাকে আমি বোধহয় খুব ভাল করে জানি না।’ সে নিজে, তিতি, সে-ইই কি বলতে পারে খুব ভাল ছেড়ে একটুও জানে কি না সে তার বাবাকে তার মাকে তার দাদাকে? তারাই কি কেউ একটুও জানে তাকে? কী ভয়ঙ্কর এই না জানা! এক ছাতের তলায়, এক পরিবারের মানুষ তারা, হঠাৎ একদিন একজন না-ফিরলে অন্যরা বলতে পারবে না সে কোথায় যেতে পারে, কেন গেল। সে, যখন অর্জুনদের চুঁচুড়ার বাড়িতে গিয়েছিল, শুধু বলে যায় বন্ধুদের সঙ্গে বেড়াতে যাচ্ছে। কোথায়, কী বৃত্তান্ত কিছুই বলে যায়নি। তখন যদি তাকে বাড়িতে খুব দরকার হত! ধরা যাক, তার বাবার হঠাৎ স্ট্রোক হয়েছে কি মায়ের হঠাৎ হার্ট-ব্লক, তাহলে? তাহলে তাকে খবর দেবার কোনও উপায় কারও থাকত না।

তিতি বলল— ‘মা, সেজজ্যাঠার বাড়ি একটু খবর দিই। দিব্যদাকে বলি…

—‘না, না’ তনুশ্রী অস্থির হয়ে উঠলেন।

—‘কিন্তু কেন?’

—‘যদি স্ক্যান্ডাল কিছু হয়, আত্মীয়রা…না না তিতি না…।’

তিতি বলল— ‘মা, স্ক্যান্ডাল তো না-ও হতে পারে। যদি এটা বাবার প্রাণ সংশয় ব্যাপার হয়? তখন?’ বলতে বলতে তার গলা কেঁপে যাচ্ছে। ‘তখন কিন্তু সবাই আমাদের খুব দোষ দেবে। এখনই অনেক দেরি হয়ে গেছে।’

তনুশ্রী কিছু বলতে পারছেন না। ভয়ে একদম বোবা, হাতটা নেড়ে শুধু ‘না না’ বোঝাবার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। অদ্ভুত দৃশ্যটা।

একটু পরে বাক্‌শক্তি ফিরে পেয়ে তনুশ্রী বললেন— ‘ঘরটা ভাল করে দেখো। দেখতে হবে, যদি কিছু থাকে। টাকাকড়িরও দরকার। আমি কোনও চাবি পাচ্ছি না।’

ডুপ্লিকেট চাবি রাখবার লুকোনো জায়গাটা তিতিই খুঁজে বার করল। ওয়ার্ডরোবটা খোলাই ছিল। ভেতরে কোণের দিকে একটা হ্যাঙারে বাবার জোব্বা ঝুলছে। জোব্বাটার পেছনে একটা ছোট্ট আংটা, সেটাতে টান দিতে একটা ছোট্ট খোপ খুলে গেল, তার মধ্যে চাবির গোছা। তিতি অবাক হয়ে গেল দেখে, মা এর কিছুই জানত না। জানে না। একবার মনে হল জিজ্ঞেস করে— ‘তুমি কোন জগতে বাস করো?’ অনেক কষ্টে প্রশ্নটাকে গিলে নিল। ড্রয়ার খুলতে পারল কয়েকটা। থাকে থাকে বাড়ির ট্যাক্সের রসিদ, টেলিফোনের, বিজলির সব আলাদা আলাদা থাক করা। পাস বই দু চারটে। ত্রিশ চল্লিশ হাজারের মতো প্রত্যেকটাতে। জয়েন্ট অ্যাকাউন্ট এগুলো তনুশ্রীর সঙ্গে। যদিও তনুশ্রী কোনও দিন ব্যবহার করেননি। তিতি দেখে-শুনে বলল— ‘মা, আমাদের বাড়ির খরচ-খরচার ভাবনাটা আপাতত ঘুচল।’

টেলিফোনটা বাজছে ওদিকে। থেমে গেল। কেউ ধরেছে। কে? চিন্টু? একটু পরে চিন্টু ঘুমে ভারী চোখ, ভারী গলায় এ ঘরে ঢুকে বলল— ‘শর্মাজি ফোন করছেন মাম্মি, ড্যাডের খবর নিচ্ছেন, বলে দিয়েছি, হাই টেম্পরেচার।’

—‘কেন? একথা বললি কেন?’ তিতি জিজ্ঞেস করল, সে এই মিথ্যে কথা আর গোপনতার দুর্গ থেকে বেরোতে চায়। তার মন বলছে তারা নিজেদের চারপাশে ক্রমশই একটা শক্ত জাল বুনে চলেছে। এর ফলে নিজেরাই বিপদে পড়বে।

চিন্টু বিরক্ত গলায় বলল— ‘তাহলে কী বলব? পুলিশে খবর দিতে দেবে না। কাউকে কিছু বলা বারণ, আমার যা মনে আসে বলে দিয়েছি।’

তিতি বলল—‘এভাবে চলবে না কিন্তু মা। কারুর না কারুর সাহায্য আমাদের নিতেই হবে। থাকগে, তুমি এখন চান করতে যাও।’

ঠেলে-ঠুলে তনুশ্রীকে চানে পাঠিয়ে সে বলল— ‘দাদা, আমাদেরই পরামর্শ করে ঠিক করতে হবে কী করা উচিত। মার কিন্তু বুদ্ধি কাজ করছে না।’

হঠাৎ চিন্টু ঘরের ভেতরে চলে এল, দরজাটা বন্ধ করে দিল। তারপর হ্যাঁচকা টানে ওয়ার্ডরোবের পাল্লাটা খুলে ফেলবার চেষ্টা করতে লাগল।

তিতি বলল— ‘ওটা কী করছিস, ওভাবে খুলতে পারবি? চাবিটা নে।’

চাবিটা হাতে নিয়ে চিন্টু অবাক চোখে তিতির দিকে তাকিয়ে বলল— ‘চাবি? ড্যাডের চাবি নাকি? কোথায় পেলি?’

—‘পেলাম। বাবা ঠিক যেখানে রেখেছিল সেখানে।’ সে রহস্যময় একটা হাসি হাসবার চেষ্টা করল, যদিও হাসিটা খুব শুকনো দেখাল।

একটার পর একটা পরীক্ষা করে দেখতে দেখতে ওয়ার্ডরোবের চাবিটা যেই লেগে গেল, একটা হ্যাঁচকা টান মেরে পাল্লাটা খুলে ফেলে চিন্টু দু লাফে সরে দাঁড়াল। তারপর কী রকম হতভম্ব মুখ করে তিতির দিকে তাকিয়ে রইল। তিতি বলল— ‘কী খুঁজছিস?’

—‘তুই একটু দেখবি, ভেতরটা?’

—‘একটু আগেই তো দেখলাম। ওয়ার্ডরোবটা তন্ন তন্ন করে খুঁজেই তো চাবির গোছাটা বার করতে পারলাম।’

‘ও দেখেছিস? তো খাটের বক্সটা একটু দ্যাখ তো।’

—‘কেন?’

—‘যদি কিছু পাস?’

—‘কী পাব?’

—‘ধর, কোনও ইন্ডিকেশন যে একটা লোক এখানে মার্ডার্ড হয়েছে, কি এই ধরনের কিছু। এ ঘরটা দেখা হলে মাম্মির ঘরটাও দেখব।’

—‘কী বলছিস কি তুই? এই ঘরে, মার্ডার! মা থাকছে, বুঝতে পারবে না।’

—‘হয়ত জানে।’

তনুশ্রী কোনওরকমে হাত পা মুখ ধুয়ে বাথরোবটা চড়িয়ে চানঘর থেকে বেরোতে বেরোতে চিন্টুর শেষ কথাগুলো শুনতে পেলেন। মড়ার মতো ফ্যাকাশে মুখে তিনি সেখানেই দাঁড়িয়ে গেলেন। কী বলছে চিন্টু? এ সব কথার মানে কী? কে মার্ডার হয়েছে। বিজু? তাঁর ঘরে? তিনি জানেন? বাইরে গলার আওয়াজ। অনেক দূর থেকে ভেসে আসছে। প্রমীলা চট করে গলা বাড়িয়ে জানিয়ে গেল শর্মাজি আসছেন। চিন্টু বেরিয়ে যাচ্ছে। তনুশ্রী বিছানায় শুয়ে পড়লেন। যেন তাঁর শরীরে আর এক ফোঁটাও শক্তি নেই। চিন্টু কী ভেবে কথাটা বলল? তিনি জানেন? বিজু মার্ডার্ড? তাঁর ঘরে? এ রকম অদ্ভুত ধারণা চিন্টুর, তাঁর নিজের ছেলের, তাঁর সম্পর্কে? কী ভয়ানক মুখ তাঁর? কী বীভৎস? খুনি মনে হয় তাঁকে? অথচ এতদিন তিনি আয়নাতে দেখেছিলেন— সুন্দর! ভারী সুন্দর। উঃ, হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে যাবে যেন?

তিতি ভয়ার্ত গলায় বলে উঠল— ‘মা, মা, তুমি অমন করছ কেন?’

দরজার গোড়া থেকে শর্মাজির গলা শোনা গেল— ‘আসতে পারি?’

তিতি মায়ের গায়ে একটা কম্বল চাপা দিয়ে দিল, বলল— ‘আসুন আঙ্কল।’

চিন্টুকে সঙ্গে নিয়ে ভেতরে ঢুকে শর্মাজি বললেন— ‘আমি কাছাকাছি এক বন্ধুর বাড়ি এসেছিলাম। খোঁজ নিতে নীলাদ্রি বলছে বাবার হাই টেম্পারেচার কিন্তু এসব কী শুনছি? এতো দেখছি মিসেস রয় শুয়ে আছেন? আমাকে ব্যাপারটা একটু খুলে বলবে? নানা রকম কানাঘুষো শুনছি।’

তনুশ্রী নিঃশব্দে কাঁদতে লাগলেন। তিতি সমস্তটা বর্ণনা করে বলল— ‘মা লজ্জায় আত্মীয়-স্বজনকে, পুলিশকে কাউকেই খবর দিতে দিচ্ছে না।’

তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে তনুশ্রীর দিকে একবার তাকিয়ে শর্মাজি বললেন— ‘দ্যাটস অলরাইট। মিসেস রয় ঘাবড়াবেন না কিছু। আমি দেখছি। একটা প্রাইভেট কনসার্ন আছে ভাল, তাদের দিয়ে…. কোনও ভাবনা নেই।’

শর্মাজি তিতি আর চিন্টুকে চোখের ইশারায় বাইরে ডেকে নিলেন। অতি বুদ্ধিমান লোক, শুধু বললেন— ‘ডোন্ট ওয়ারি, দেখি কী করা যায়।’ তিনি সঙ্গে সঙ্গে ফোনের বোতাম টিপতে লাগলেন।

‘হালো। আমি কে.ডি. শর্মা বলছি, রক্সি আছে?’ তিতি আর চিন্টু দুজনেই বসে ওঁর কার্যকলাপ দেখছে।

—‘রক্সি! একটা কেস আছে, আটমোস্ট সিক্রেসি নীডেড। ..হ্যাঁ। আমি পার্টিকে নিয়ে যাচ্ছি, থাকো একটু। … হ্যাঁ উইদিন সে, টোয়েন্টি মিনিটস।’ ফোন ছেড়ে বললেন— ‘নীলাদ্রি চলো আমার সঙ্গে। এরা খুব কমপিটেন্ট, ডিসক্রীট। ঘাবড়িয়ো না।’

চিন্টু বলল— ‘এক মিনিট।’ গতকাল সারা রাতই প্রায় সে বাড়িতে ছিল না। ছিল তাদের নিজস্ব একটা গোপন ক্লাবে। ভোরের দিকে ফিরে একটু ঘুমিয়ে ছিল। কিন্তু এখন সে চট করে, একটা জীনস গলিয়ে নিল, আর একটা সোয়েট শার্ট গলিয়ে নিল, পায়ে স্নীকার্স। চুলে একটু চিরুনি চালাল কি না চালাল। বেরিয়ে এসে বলল— ‘চলুন আঙ্কল।’

—‘দ্যাটস লাইক আ স্মার্ট বয়’—শর্মা হাসলেন। তিতির দিকে চেয়ে বললেন—‘তুমি তোমার মাকে দেখো। বড্ড আপসেট হয়ে পড়েছে।’

তিতি ঘরে ঢুকে দেখল মা সিলিঙের দিকে চেয়ে কাঠের মত শুয়ে। চোখ দুটো লাল। সে বলল— ‘রাতে কি ঘুমোওনি?’

তনুশ্রী জবাব দিল না। সে আসলে তিতির অস্তিত্ব সম্পূর্ণ বিস্মৃত হয়ে গিয়েছিল। তার চোখের সামনে ভাসছিল সরু গলির মধ্যে একটা দোতলা বাড়ি। টানা বারান্দা। কতকগুলো ছাগল বাঁধা। ভেতরে ফরাস পাতা একটা ঘর। প্রচুর লোক বসে। সে-ও বসে। এক এক জনের ডাক আসছে, সে উঠে যাচ্ছে। ভেতরের একটা ঘরে। কিছুক্ষণ পর বেরিয়ে আসছে। কপালে একটা সিঁদুরের ফোঁটা। তনুশ্রীর ডাক এল। ভেতরের ঘরটা ছায়া-ছায়া, একতলায় ভেতর দিকের ঘর, আলো ঢোকে না। কম পাওয়ারের একটা বিজলিবাতি জ্বলছে। লাল কাপড় পরা জটাধারী একজন তান্ত্রিক বসে আছেন। পেছন ফিরে। তনুশ্রীর সামনে ছত্রিওলা খাটের মতো দেখতে একটা সিংহাসনে একটা লাল জিভ। জিভ শুধু, ফুলের ভারে আর সব ঢাকা পড়ে গেছে কিংবা নেই, বোঝা যাচ্ছে না। জিভটাকে বেড়ে লাল বেনারসী কাপড়ের আভাস চোখে পড়ল। আর চকচকে মোহরের মালা। মোহর কি না কে জানে কিন্তু মোহরের মতো।

বজ্রগম্ভীর গলায় তান্ত্রিক বললেন, —‘তোর আবার কী হল?’ যেন কতদিনের চেনা।

গলার আওয়াজে কাঁপুনি ধরে গেল তনুশ্রীর। সে বলল— ‘স্বামী পাঁচদিন হল নিরুদ্দেশ।’

—‘জয় মা, জয় মা,’ হুঙ্কার দিয়ে বলতে লাগলেন তান্ত্রিক। তারপর হঠাৎ দ্বিগুণ হুঙ্কার দিয়ে ভয়ঙ্কর সব মন্ত্র উচ্চারণ করতে লাগলেন আর মুঠো মুঠো জবাফুল ছুঁড়ে ফেলতে লাগলেন কালীমায়ের জিভের তলায়। পরপর বললেন— ‘জয় মা হিরণ্যকালী, জয়, জয়। যাঃ তোর কাজ হয়ে গেছে।’ এ পাশ ফিরলেন। সিংহাসনটার একদিকে টাঙানো রাশীকৃত জবাফুলের মালার মধ্যে একটা টেনে নিয়ে দুবার ঘুরিয়ে ছুঁড়ে দিলেন তনুশ্রীর দিকে। মালাটা নির্ভুল লক্ষ্যভেদে তার গলায় পড়ল। সামনে গোলা-সিঁদুরের বাটি থেকে বুড়ো আঙুলে করে সিঁদুর গোলা তুলে নিয়ে তনুশ্রীর কপালে টিকা দিয়ে দিলেন।

কোনওক্রমে তনুশ্রী বলতে পারল— ‘কী হল? কী বুঝলেন বাবা?’

—‘বুঝলি না? বাণ মেরে দিলুম।’

—‘ক্‌ কাকে? ক্‌ কোথায়?’

—‘ওই যে সর্বনাশী তোর গড়া ঘর ভাঙছে! একেবারে সোজা বুকের মধ্যে গিয়ে লাগবে। যাঃ ভয় নেই, তোর স্বামী ফিরে আসবে, আবার স্বামীসোহাগী হবি।’

তনুশ্রীর চোখের দিকে তাকিয়ে বলছিলেন সাধুটি। চোখদুটো জ্বলজ্বল করছে। তনুশ্রী কেমন বিহ্বল হয়ে টাকার পার্স তার ভ্যানিটি ব্যাগের মধ্যে থেকে বার করতে লাগল—এ বেটি সোনা ছাড়া আর কিছু বোঝে না। জানিস তো! এক কণা হলেও সোনা দিয়ে যাস। নইলে বেটির আমার বড্ড বদরাগ। জয় মা হিরণ্যকালী!

তনুশ্রী এক কণা সোনা কোথা থেকে পাবে? সে তার বাঁ হাতের মধ্যমা থেকে টেনে টেনে মুক্তোর আংটিটা খুলল। সাধুর হাতে দিতে গেল।

—‘ওইখানে দে। আমার হাতে কেন?’ সিংহাসনের সামনের জায়গাটা দেখিয়ে দিলেন সাধু চিমটে দিয়ে। তনুশ্রী আংটিটা সেখানে রাখল, কী যেন একটা রাখা ছিল তার ওপর। রাখার সঙ্গে সঙ্গে তার হাতের মধ্যে দিয়ে যেন বিদ্যুৎ বয়ে গেল। সে সভয়ে হাত তুলে নিল।

—‘কী হল? বেটি নিলে তাহলে।’ সাধু আবার হুঙ্কার দিলেন। ‘তোর মনোরথ পূর্ণ হলে মুক্তোটা নিয়ে যাস। এ বেটি সোনা ছাড়া কিছু বোঝে না।’ গলায় জবাফুলের মালা। কপালে সিঁদুরের টিপ, হাতে একটা চ্যাঙারিতে প্রসাদ, তনুশ্রী বেরিয়ে আসতে একটি বব চুল আধুনিকা মহিলা আকুল হয়ে বললেন—‘আপনার কাজ হল?’

—‘হবে তো বললেন।’ তনুশ্রী যেন যন্ত্রের মতো বলছে— ‘আপনার কী?’

—‘ছেলের লিউকিমিয়া বলছে ডাক্তার’, মহিলা রুমাল দিয়ে নিজের মুখটা চেপে ধরলেন। একজন অপেক্ষমাণা শান্ত চেহারার শ্রীমতী মহিলা বললেন— ‘যান না দিদি যান, মায়ের কৃপা হলে ছেলে ভাল হয়ে যাবে। আমার স্বামীর লাং ক্যান্সার সেরে গেছে।’

—‘সেরে গেছে?’ ভদ্রমহিলা ব্যাকুল গলায় বললেন। ‘একেবারে? তাহলে এসেছেন?’ শান্ত চেহারার মহিলা বললেন— ‘উনি একেবারে ভাল হয়ে গেছেন। এবার এসেছি ছেলের চাকরির জন্যে। আমরা সব সময়ে মার কাছেই আসি, মা-ই ভরসা। গলায় হাত দিয়ে ব্লাউজের মধ্যে থেকে একটা মোটা বিছে হার টেনে বার করলেন তিনি।

—‘ওঁর আরোগ্যের জন্যে এটিও দেব,’ বলে তিনি হাত দুটো জড়ো করে নমস্কার করলেন।

তনুশ্রী বেরিয়ে এসেছে। যেন ভাল করে চলতে পারছে না। কোনওমতে গাড়িতে গিয়ে উঠল। তাহলে তার অনুমানই ঠিক? বিজু রায় এই বয়সে অন্য কোনও মহিলার, কিংবা কে জানে হয়ত মেয়ের, অনেক ছোট মেয়ের মোহে পড়লেন? তনুশ্রী আর ভাবতে পারছে না, ভাবতে পারছে না। কাগজে এই ‘সাধুবাবা’র বিজ্ঞাপন পড়ে সে ছুটে এসেছে। বাণ মেরে দিয়েছে। সম্ভব এভাবে বাণ-টান মেরে দেওয়া? আসলে বোধহয় ওইটুকুই ঠিক। বিজু রায়ের অন্য নারীর মোহে পড়ে চলে যাওয়াটা। বাকিটা কি আর ঠিক হবে? বাণ-টান এই যুগে?

তিতি বলল— ‘মা, তুমি এত কী ভাবছ? তুমি কিন্তু এখনও বাথরোব গায়ে জড়িয়ে শুয়ে আছ, ওঠো, ড্রেস করো।’ সে পাশের ঘর থেকে মায়ের হাউস কোট টোট নিয়ে এল। জোর করে একটু তুলে ধরল মাকে। এমন সময়ে টেলিফোনটা আবার বাজল।

তিতি দৌড়ে গিয়ে ধরল। — ‘হ্যালো?’

—‘নীলাদ্রি আছে?’ মেয়ে-গলা।

—‘এইমাত্র বেরিয়ে গেছে। কিছু বলতে হবে?’

—‘আপনি কে কথা বলছেন?’

—‘আমি নীলাদ্রির বোন।’

—‘আচ্ছা আঙ্কল ফিরে এসেছেন?’

—‘আপনি কে জিজ্ঞেস করতে পারি?’ তিতির গলা সতর্ক, রুক্ষ।

—‘আমি শুক্তি। নীলাদ্রির বন্ধু। ভীষণ ওয়ারিড হয়ে রয়েছি। নীল কোনও খবরও দিচ্ছে না।’

—‘না। বাবা এখনও ফেরেননি।’ তিতি টেলিফোনটা রেখে দিল। সঙ্গে সঙ্গেই টেলিফোনটা আবার বেজে উঠল। আচ্ছা নাছোড়বান্দা মেয়ে তো! গোপনতা সে পছন্দ করছে না ঠিকই। তাই বলে যে যেখানে আছে সে-ই তাদের পারিবারিক সমস্যার ব্যাপারে নাক গলাবে নাকি? আরও রুক্ষ হওয়া দরকার এই সমস্ত বড় নাকওয়ালিদের সঙ্গে।

—‘হ্যালো।’

—‘তিতি আছে?’

—‘বলছি।’

—‘আমি অর্জুন। কোনও খবর পেয়েছিস?’

—‘না।’

—‘ও। কোনও ব্যবস্থা করা হচ্ছে খোঁজার?’

—‘প্রাইভেট ডিটেকটিভ এজেন্সি।’ সংক্ষেপে বলল তিতি।

—‘ও, তনুমাসি কেমন আছেন?’

—‘ভাল না।’

—‘ও।’

—‘তিতি।… শুনছিস?’

—‘শুনছি।’

—‘ভাবিস না। আমি আছি।’

তিতি বলল— ‘ও’। বলে ফোনটা রেখে দিল।

তিতি সেন্টার পার্লারে ঠিক ভ্যান গখের আত্মপ্রতিকৃতিটার তলায় বসল। একটা পিঠ হেলানো চেয়ার ওখানে। হাতলগুলোর প্রান্ত বাঘ সিংহের থাবার মতো। পৌলোমীর বাবা নেই। মানে চলে গেছেন। অন্য এক মহিলাকে নিয়ে থাকেন। পৌলোমীর মা দাঁতে দাঁত চেপে আছেন। কিছুতেই ডিভোর্স দেবেন না। এইরকম অবস্থাতেই পৌলোমী বারো বছর থেকে উনিশ বছরের হয়ে উঠেছে। ছোটবেলায় পৌলোমীদের বাড়িতে গিয়ে অনেক আদর খেয়েছে তিতি। সে মাসিকে স্নেহশীলা বলেই জানত। এখন যায় না। যদি কখনও যেতে বাধ্য হয়, তার সামনেই উনি পৌলোমীকে অতি তুচ্ছ কারণে বিশ্রীভাবে বকাবকি করেন। রুক্ষ, শ্রীহীন চেহারা। তেমনি রুক্ষ স্বভাব। পৌলোমী মেয়েটা ভিতু-ভিতু, নরম প্রকৃতির। একেক সময়ে বলে— ‘আমার তেমন সাহসও নেই রে তিতি যে সুইসাইড করি।’ তার আরেক বন্ধু অনুভবের তো আরও খারাপ অবস্থা। বাবা কিছু না বলে, এতটুকু টের পেতে না দিয়ে কোনও বিদেশি য়ুনিভার্সিটিতে গিয়ে চাকরি নিয়ে বসে আছেন। সবাই অনুমান করে তিনি সেখানে দ্বিতীয় সংসার পেতেছেন। অনুভবের মা অনেক কষ্টে একটা ক্যানটিন করেছেন। সেইটা দিয়েই সংসার চালান। অনুভব ক্রমশই গম্ভীর, আরও গম্ভীর হয়ে যাচ্ছে, দূরে সরে যাচ্ছে। তাকে নিয়ে অনেকে ঠাট্টা-তামাশাও করে। তিতি একদিন বলেছিল— ‘তুই ওরকম দূরে দূরে থাকিস কেন রে?’

—‘জানিস না?’ অনুভব বলেছিল— ‘আয়্যাম আ লেপার।’

তিতির মা বাবা উভয়েই আছে। যদিও তাদের কারও সঙ্গেই তার মনের কোনও যোগ নেই। কিন্তু সে যা চায় তাই পায়। যেমন ভাবে চায় তেমন ভাবে। অবাধ স্বাধীনতা দিয়ে দিয়েছে তার বাবা-মা। তার বন্ধু শ্রীরাধাদের বাড়িতে সকলে খুব অন্তরঙ্গ। বাবা মা ঠাকুমা, ওরা দুই বোন, এক ভাই। একসঙ্গে খায় রাত্তিরে। বাবার সঙ্গে খুনসুটি করে, মাকে মনের প্রাণের কথা বলে, দোষ করলে ঠাকুমার আঁচলের তলায় আশ্রয় নেয়। কিন্তু খুব আঁটোসাঁটো নিয়মও আছে তেমনি। কোনও আউটিং, এক্সকারশনে চট করে যাবে না, বলবে— ‘জানিস না তিতি, ঠাকুমা বুড়ি রাত্তিরে ঘুমোত পারবে না। ওই রে রাধু বুঝি ধর্ষিত হয়ে গেল। আমার দুঃখের কথা আর বলিস না রে।’

ওদের সবাইকার ভীষণ আড্ডা জমে যায় কোনওদিন, সাতটা বাজলেই শ্রীরাধা লাফিয়ে উঠবে— ‘ইস, আমি যাই।’ কী ব্যাপার, না ‘বাপিন এসে রাধুকে না দেখতে পেলে ফিট হয়ে যাবে।’ তিতি তাই অন্তরঙ্গতা চায়নি। তার বাড়িটা নীরস এটা সত্যি। কিন্তু নিজের মতো চলবার উপায়টা তো আছে। আবার এই স্বাধীনতাও তো একটা আপেক্ষিক ব্যাপার? বাবা না থাকলে তিতির নিজেকে-নিয়ে-ব্যস্ত থাকতে ভালবাসা মা যদি হঠাৎ পৌলোমীর মায়ের মতো বাঘিনী হয়ে যায়, যদি হয়ে যায় অনুভবের মায়ের মতো নিঃস্ব ভিখারিনী। তিতিও তো হয়ে যাবে আরেক অনুভব। হয়ত আরেক পৌলোমী। এই বাড়ি, আসবাব, দাস-দাসী? বিলাস, গাড়ি, সম্মান সব, সবই তো বাবার! তার নিজস্ব নয় তো কোনওটাই।

সিঁড়ি বেয়ে শব্দহীন কিন্তু দ্রুত পায়ে উঠে আসছে অর্জুন। তিতি এতই চিন্তামগ্ন যে সে দেখতেও পাচ্ছে না। বুঝতেও পারছে না। অর্জুনের পরনে একটা পা চাপা যোধপুরী পায়জামা, একটা খাদির পাঞ্জাবি। একটা গরম জহরকোট। সিঁড়ির মাথায় চটি জোড়া খুলে একপাশে সরিয়ে রেখে সে এদিক ওদিক দেখল। আগে দু একবার সে এখানে এসেছে। তিতির বন্ধুর দলের সঙ্গে। মোটামুটি তিতির ঘরটা চেনে। কিন্তু ঘর অবধি যাবার দরকার হল না। ভ্যান গখের নীচে অবিকল ওইরকম অসুখী চেহারা নিয়ে বসে আছে তিতি। সে সামনে গিয়ে দাঁড়াতে তিতি চমকে তাকাল। বলল— ‘তুই?’

—‘কাছেই একটা পাবলিক বুথ থেকে ফোন করছিলাম। চলে এলাম। তনুমাসি কোথায়?’

বাবার শোবার ঘরের দিকে আঙুল দেখাল তিতি। অর্জুন খুব স্বচ্ছন্দ ঋজু ভঙ্গিতে চলে গেল ঘরটার দরজার কাছে। পর্দায় হাত রেখে বলল— ‘আসব?’

—‘কে?’

—‘তনুমাসি আমি। আমি অর্জুন। মঞ্জুর ছেলে। চুঁচড়োর মঞ্জু। মঞ্জু পাঠাল আমায়।’

তনুশ্রী অবাক হয়ে উঠে বসলেন। তারপর বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। বললেন— ‘মঞ্জুদি? চুঁচড়োর?’

—‘হ্যাঁ। তোমার যদি কিছু দরকার থাকে তো বলো। আমাকে নিঃসঙ্কোচে বলতে পারো। আমি অনেক রকম জানি। জানি। পারি।’

—‘কী পারো। কী জানো?’ তনুশ্রীর অবাক হওয়া এখনও ফুরোয়নি।

—‘এই ধরো মন্ত্রতন্ত্র, ঝাঁড়ফুক’ ঠাট্টার মতো করে বলল অর্জুন, তারপরে আরেকটু গম্ভীর হয়ে বলল— ‘মেসো রেসপনসিব্‌ল লোক, এতগুলো মানুষ চরাচ্ছেন, এত ভয় পাচ্ছ কেন? ঠিক চলে আসবেন?’

—‘কিন্তু যদি গুণ্ডাদের হাতে পড়ে থাকে?’ তনুশ্রী এতক্ষণে বললেন।

—‘সেটাই। কিন্তু কেন পড়বেন?’ অর্জুন উঠে দাঁড়াল।

—‘মঞ্জুদি কেমন আছে? আর হরিশঙ্করদা?’

—‘মা ভালই আছে। আর ছোট কাকা? ছোটকাকা তো আজ চার বছর তিন মাস বাইশদিন হল নেই।’

—‘নেই?’ তনুশ্রী কীরকম ফাঁকা গলায় বললেন।

—‘নেই।’ অর্জুন হাসল।

‘মেসোকে আমরা খুঁজে বার করবই— তুমি ভেবো না।’ অর্জুন বেরিয়ে এল। তিতি এই পুরো ব্যাপারটায় কোনও অংশ নেয়নি। সে হাঁ করে দেখছিল, যেন একটা নাটক। অর্জুন যখন একটু নুয়ে তার বাবার ঘর থেকে বেরিয়ে এল তার অর্জুনকে খুব লম্বা লাগল। অর্জুন লম্বাই। কিন্তু আরও যেন লম্বা লাগল। তার পেছন পেছন তনুশ্রী বেরিয়ে এসেছেন।

—‘অর্জুন, এই তিতি, আমার মেয়ে, তিতি, অর্জুন আমার মাসতুতো দিদি মঞ্জুদির ছেলে। মঞ্জুদি আমায় ভীষণ ভালবাসত। এখন তোর বাবার খবর জানতে পেরে অর্জুনকে পাঠিয়ে দিয়েছে। অর্জুন তুমি খেয়ে যাবে, তিতির সঙ্গে গল্প করো। তিতি হয়ত তোমারই বয়সী হবে।’ সমস্তটাই ধৈর্য ধরে শুনে গেল দুজনে। তিতি শেষকালে বলল, ‘মা, অর্জুন আর আমি যে একসঙ্গে পড়ি। ও আমাদের বাড়ি আগেও এসেছে।’

—‘সে কী? কখনও বলিসনি তো!’

—‘না, মানে জানতুম না তখন, সম্প্রতি জেনেছি,’ অর্জুন আরও খানিকটা লম্বা হয়ে বলল।

—‘আমি একটু তেতলার ঘরে যাব? মাসি?’

—‘হ্যাঁ হ্যাঁ যাও না।’ তনুশ্রী সাগ্রহে বললেন কেন কে জানে! শ্বশুরবাড়ির কাউকে জানানো তাঁর মত নয়। কিন্তু বাপের বাড়ির দিকে কেউ যখন জেনে গেছে! মঞ্জুদি ছেলেকে পাঠিয়ে দিয়েছে, মনে হচ্ছে বেশ বুদ্ধিমান, বলিষ্ঠ, নির্ভরযোগ্য ছেলে তখন… তনুশ্রীর এতক্ষণের ভারী-হয়ে-থাকা বুকটা যেন একটু হালকা লাগছে। এই বিপদের মুহূর্তে মা-বাবা না-থাকাটাই যথেষ্ট দুঃখের। দিদিরাও সব দূরে দূরে। কিন্তু মঞ্জুদি। মঞ্জুদি আছে। খোঁজ নিচ্ছে। অর্জুন এসেছে, অর্জুন। আ-হ!

অর্জুন আর তিতি ওপরে চলে যাবার পর ফোনটা আবার বাজল। ওরা কেউ নেই, যে ধরে? তনুশ্রী ফোন-যন্ত্রটার দিকে বিরক্ত দৃষ্টি নিয়ে চেয়ে রইলেন। কিন্তু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এভাবে বেজে যেতে দেওয়া তো ঠিক নয়! একটু পরে তাঁকে ধরতেই হল।

—‘তনুশ্রী আছে?’

‘বলছি।’

‘আমি সেজদিভাই। আজকের ‘আনন্দবাজারটা’ দেখেছ?’

‘আনন্দবাজার’ তাঁদের বাড়িতে আসে না। কিন্তু এত কথা তনুশ্রী বললেন না। সংক্ষেপে বললেন— ‘না। কেন?’

—‘বড়দি মারা গেছে। শাঁটুল কাগজে দিয়েছে। আমি এইমাত্র দেখলুম তোমার ভাসুর দেখালেন। কী কাণ্ড! বলা নেই, কওয়া নেই। কতদিন দেখা-সাক্ষাৎ নেই! হুট করে…’

তনুশ্রী বললেন, ‘বয়স হয়েছিল…’

—‘তাই বলে এমন হুট করে? মা তো কমাস আগেই গেলেন। তখনই দেখেছিলুম অবশ্য চেহারাটা খুব খারাপ। তা তোমরা কী ভাবছ?’

—‘কী ভাবব? আমি তো এইমাত্র শুনলাম।’

—‘বিজুকে অফিসে একটা ফোন করো না, আমাদের সবারই তো কিছু সামাজিক কর্তব্য আছে! এ সময়ে ওদের পাশে গিয়ে দাঁড়ানো দরকার। সবাই মিলে একসঙ্গে যাওয়াই তো ভাল!’

তনুশ্রী চুপ করে রইল। সেজজা বললেন— ‘কী হল?’

—‘আমি এখন কিছুতেই যেতে পারব না সেজদিভাই!’ একেবারে ন্যাড়া-ন্যাড়া গলায় বলতে বলতে কীরকম ফুঁপিয়ে উঠলেন তনুশ্রী।

সেজজা বললেন— ‘কী হয়েছে? তোমাদের অ্যাসোসিয়েশনের কিছু চলছে নাকি? তুমি যদি যেতে না-ও চাও বিজুকে তো যেতেই হবে।’

‘না না, ও যেতে পারবে না।’ তনুশ্রী কথা শেষ করতে দিলেন না।

সেজজা তনুশ্রীর খেয়ালিপনার সঙ্গে যথেষ্ট পরিচিত। দু চোখে দেখতে পারেন না এসব। তবু ধনী মানী আত্মীয়। সেভাবে কিছু বলতে পারেন না। আজ উষ্মা সামান্য প্রকাশ করে ফেললেন— ‘বিজু কি নিজে বলেছে যে সে তার একমাত্র দিদির মৃত্যুর খবর শুনেও যাবে না? তুমি না হয় না যেতে পারো। তোমার সেজদা বলছেন দিব্যকে ওর অফিস থেকে গাড়ি জোগাড় করতে বলবেন, দিব্যর অফিসের গাড়িতেই আমরা চলে যাব, বিজুকে ওর অফিস থেকে তুলে নেব না হয়। তুমি বরং বিজুকে একটা ফোন করে রেখো। আচ্ছা আমিই করছি।’

সেজজা গাড়ির ব্যাপারটা ইচ্ছে করেই বললেন। তাঁদের গাড়ি নেই। কিন্তু দিব্য ইচ্ছে করলে গাড়ি পেতে পারে। এখন সে সি. ই. এস. সি-তে রয়েছে। এই ধনী আত্মীয়রা একসঙ্গে কোথাও যাবার প্রসঙ্গ উঠলেই মনে করে তাদের গাড়িগুলোর সুবিধে আদায় করার জন্যে সবাই মুখিয়ে আছে। নিজেরা নিজেদের অকাজে শত সহস্রবার বেরোবে। স্বামীর আলাদা, স্ত্রীর আলাদা, ছেলের আলাদা, মেয়েরও বোধহয়। কিন্তু কোনও সামাজিক কাজে ব্যবহারের সুদূরতম সম্ভাবনা দেখলেই এরা গুটিয়ে যায়। তিনি এসব জানেন। তাই আশ্বস্ত করলেন ধনী ছোটজা-কে। কিন্তু তনুশ্রী রিসিভারের ওপর যেন ঝাঁপিয়ে পড়লেন— ‘না না, সেজদিভাই ওকে অফিসে ফোন করতে হবে না, কোরো না।’

খুব অপমানিত বোধ করলেন সেজজা। ইচ্ছে হল বলেন— তিনি ফোন করলে কি বিজুর অফিসখানা ক্ষয়ে যাবে? কিন্তু এইসময়ে তাঁর কানে ধরা পড়ল ফোনের ওদিকে তনুশ্রীর গলাটা যেন কেমন বিকৃত। তিনি বললেন—‘কী হল, তনুশ্রী, তোমার কি শরীর খারাপ? বিজুর কিছু হয়েছে!’

‘ও এখানে নেই।’ এখনও গলাটা কেমন বিকৃত। সেজজা বললেন—‘আচ্ছা, ঠিক আছে। দেখা যাক, আমরাই… আচ্ছা ছাড়ছি।’

ফোনটা রেখে অদূরে-বসা স্বামীর দিকে তাকিয়ে বললেন— ‘কী ব্যাপার বলো তো? তনুশ্রীকে খুব ডিসটার্বড্‌ মনে হল! বিজুর সঙ্গে ঝগড়া-টগড়া হয়েছে, নাকি?’

‘ওদের ব্যাপার ওরাই জানে।’ বিজু রায়ের সেজদা কাগজটা পাট করতে করতে বললেন। ….‘যাবে না বলেছে যখন, না-ই যাক। বিজুর সঙ্গে বড়দির কি-ই বা সম্পর্ক! বড়দি আমাদের যতখানি ছিল…’ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন কাননবিহারী।

‘কই কোনদিন তো বড়দির সঙ্গে তোমাদের তেমন কোনও ‘এসো বসো’ দেখিনি!’

সে বড়দি দূরে থাকত, শ্বশুরবাড়ি খুব গোঁড়া…’ ঢোক গিলে বললেন কানন।

‘সুখচর এমন কী দূর! গোঁড়ার সঙ্গে সম্পর্ক কী!’

কোনও জবাব পেলেন না ভদ্রমহিলা। পরিবর্তে তাঁর স্বামী বললেন, —‘বলছে যখন যেতে পারবে না, নিশ্চয়ই কিছু অসুবিধে আছে। কী দরকার ঘাঁটিয়ে। থাকতে দাও না নিজেদের মতো!’

‘তাই বলে নিজের দিদির মৃত্যু-সংবাদ পেয়ে একবার গিয়ে দাঁড়াবে না? কিছু মনে কোরো না— অমন বড়লোকের মুখে আগুন।’ বলে মহিলা আর দাঁড়ালেন না। স্ত্রী একেবারে দৃষ্টিপথের বাইরে চলে গেলে, কানন ধীরে-সুস্থে মেজদা গগনের বাড়ি ফোন করলেন। হ্যাঁ মেজদা জানে, ওরাও কাগজে দেখেছে। চিঠি আসেনি শাঁটুল নিজে এল না সুতরাং মেজদা যেতে চায় না। কানন বললেন—‘কাজে যাবে কি না সে না হয় পরে ঠিক করা যাবে। আপাতত তো ঘুরে আসা যাক।’

‘দিদিকে দেখতে পাব না। শাঁটলোটা বকে গেছে। কী একটা বেজাত বিয়ে করেছে শুনতে পাই। কার কাছে যাব? অসুখের খবরটা পর্যন্ত জানত পারলুম না!’ সখেদে বললেন মেজ গগন।

‘হয়ত অসুখ কিছু হয়নি। হঠাৎ সেরিব্র্যাল কি করোনারি অ্যাটাক!’ কানন বললেন।

‘হ্যাঁ, তা অবশ্য হতে পারে। আমায় দুটো দিন সময় দাও। তোমার বউদির আর্থরাইটিসটা বড় বেড়েছে।’

এবার বিজুর অফিসে ফোন করলেন কানন।

‘বি. বি. রায়ের সঙ্গে কথা বলতে পারি?’

‘আপনি কে বলছেন।’

‘আমি ওঁর দাদা, সেজদা।’

ফোনটা হাতে নিয়ে সাধন বিশ্বাস খুব দ্রুত চিন্তা করে নিলেন। বউদি ওদিকে থেকে আদেশ দিয়ে রেখেছেন কেউ যেন জানতে না পারে। এদিকে সাহেবের নিজের দাদা ফোন করছেন। তিনি বললেন— ‘উনি তো এখন, অর্থাৎ এখানে নেই।’

‘কবে ফিরবে?’

‘তা তো কিছু জানিয়ে যাননি।’

‘আচ্ছা। উনি এলে জানিয়ে দেবেন ওঁর বড়দি, সুখচরের, মারা গেছেন হঠাৎ।’ ফোনটা চুপ হয়ে গেল। রিসিভারটার দিকে বিচলিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন সাধন বিশ্বাস। তিনি ছাপোষা মানুষ, ছেলেপিলে নিয়ে ঘর করেন। এ কী কাণ্ড! সাহেবের দিদি মারা গেলেন, তিনি জানতেও পারলেন না? কোথায় গেলেন? ছেলেমেয়ে বউদিদি সবাই অদ্ভুত ব্যবহার করছে! সাহেব কি কোনও বিপদে পড়েছেন? এতদিন হয়ে গেল না একটা খবর, না কিচ্ছু!


আজ রাতটা খুব ভাল ঘুমোলেন বিজন। কদিনের প্রচণ্ড খাটাখাটুনি শেষ। শমিতের ব্যাপারটার বেশ ভালভাবে নিষ্পত্তি হয়ে গেছে। সব কিছু অরিন্দম দত্ত বলে একজন অ্যাডভোকেটের হাতে তুলে দিয়ে এসেছেন। তাঁর নিজের লিগ্যাল অ্যাডভাইসার সুখেন্দু। কিন্তু এ ব্যাপারে সুখেন্দুর কাছে তিনি যাননি। অরিন্দমকে দিয়েও খুব মাঝে মাঝে তিনি কাজ করিয়ে থাকেন। এ ব্যাপারটা অরিন্দমই যা করার করবে। শমিত এখন একরকম মুক্ত। দু-একটা পার্টি খুব হম্বিতম্বি করছিল, কিন্তু অরিন্দম সেটা সামলে নিতে পেরেছে। দিদির কাজ উপলক্ষে খুকি-টুকি উভয়েই আসছে। শমিত বাড়ির ব্যাপারে ওদের সঙ্গে বোঝাপড়া করুক। তিনি তাকে স্পষ্ট বলে দিয়েছেন— এ নিয়ে যেন অনর্থক ঝগড়া-বিবাদের মধ্যে সে না যায়। দিদিরা যদি ভাগ চায়, ন্যায্য ভাগ তাদের দিতে হবে। তবে আপাতত যে বাড়ি মর্টগেজ দিয়ে সে তার ব্যবসায়ে ক্ষতির টাকাটা জোগাড় করতে বাধ্য হয়েছে, এটাও যেন সে দিদিদের বলে। এবং সবকিছু থেকে ছোটমামার নামটা তারা উহ্য রাখবে— এ প্রতিশ্রুতি আদায় করে এসেছেন। এটাতে শমিতের না হলেও রত্নার আপত্তি ছিল খুব। ‘বাঃ আপনিই সব করলেন, কাউকে কিছু বলব না! কাজেতেও আসবেন না? কেন? আমাদের এত পাপের ভাগী করে যাচ্ছেন মামাবাবু?’ তার চোখ ছলছল করছে। এ কদিনে সম্পর্কটা অনেক সহজ হয়ে গেছে, বিশেষত রত্নার সঙ্গে। বিজু তাকে হাসাবার জন্য বললেন—‘শমিতও তো কত মাস ছুপিয়ে ছিল, এ ব্যাপারটা তো অন্তত তোমার জানার কথা বউমা। আমিও কিছুদিন যে কারণেই হোক ছুপকে ছুপকে থাকতে চাইছি।’

হাসার বদলে রত্না গম্ভীর, বিষণ্ণ হয়ে গেল। তখন বিজু রায় বুঝতে পারলেন তিনি বেফাঁস বলেছেন, এবং তিনি বিজু রায়। শুধু বিজু নন। শেষে বললেন, ‘বউমা যা হবার হয়ে গেছে, অতীত নিয়ে মাথা ঘামিয়ো না একদম। সবসময়ে পাপ-পাপ করবে না। আমি বিশেষ কারণে বাইরে যাচ্ছি। ব্যাপারটা গোপন রাখতে চাই। তোমরা মন দিয়ে দিদির কাজ করো। আমি কাজ শেষ হলেই আবার আসব।’ শ্রাদ্ধের বাজার টাজার রত্নাকে নিয়ে অনেকটাই করে দিয়ে এলেন বিজন। পর দিনই কাজ। তিনি এবার ডুব মারবেন।

কদিন পর রাত্রে মেসে ফিরতে হরিহর একটা ভারী প্যাকেট দিল। বেশ ভারী। বলল— রফিকের লোক দিয়ে গেছে। কেমন একরকম চোখে বিজুর দিকে তাকাল হরিহর। বিজু বললেন— ‘হরিহর তোমার টাকাটা রাখো। পার্সে আলাদা করে ছহাজার টাকার একটা প্যাকেট রেখেছিলেন তিনি।

‘এত টাকা, বাবু?’

‘তুমি যে ধার দিয়েছিলে নলিনীদাকে! সুদসুদ্ধ ফেরত দিলাম।’ হতভম্ব হরিহরের চোখের সামনে দিয়ে বিজু রায় ওপরে উঠে গেলেন। কিন্তু ঘরে ঢুকে রফিকের দেওয়া প্যাকেটটা খুলে দেখে তিনি হরিহরের চেয়েও হতভম্ব হয়ে গেলেন। নলিনী করের ট্রাঙ্কের মধ্যে রেখে দিলেন প্যাকেটটা। তারপর আর দাঁড়াতে পারলেন না। ভয়ানক ঘোরাঘুরি, খাটুনি যাচ্ছে। হাতমুখ ধুয়ে শুয়ে পড়লেন। এত দিনে ভাল শীত পড়েছে। এ রকম জাঁকিয়ে শীত পড়লে তাঁর ঘুম ভাল হয়। টেনশন সত্ত্বেও।

সকালে ব্রেকফাস্ট খাচ্ছেন। একে একে মণিময়, নিতাই ভটচাজ, চাঁদু মিত্তির আর প্রতুল বিশ্বাস এসে ঢুকলেন।

‘আরে আসুন আসুন’— খুশির গলায় বললেন বিজন।

তক্তাপোশের ওপরে বসল ওরা চারজন।

—‘কী ব্যাপার?’ চায়ে চুমুক দিয়ে বলল বিজন।

মণিময় মাথা চুলকেচ্ছে।

‘কিছু বলবেন মনে হচ্ছে?’ বিজন অবাক হয়ে বললেন।

‘হ্যাঁ, মানে এ-ভাবে তো চলতে দেওয়া যায় না বিজনদা!’

‘কীভাবে? কী ব্যাপার?’

‘আমরা আপনাকে জাস্ট আউট অফ কার্টসি নলিনীদার ঘরখানা দিয়েছিলুম, তার মানে এই নয় যে…’ মণিময় চুপ করে গেল।

‘কী আবার? আপনি জানেন না?’ তেরিয়া হয়ে নিতাই ভটচাজ বললেন, ‘দিনের পর দিন এখানে বসে বসে নলিনীদার টাকা আত্মসাৎ করছেন?’

‘ও।’ বিজু রায়ের ভেতরটা কেমন নিভে গেল। এ কদিন যা-ই করুন, যেখানেই যান, যত পরিশ্রমই হোক কেমন একটা চোরাস্রোতের মতো আনন্দধারা বইছিল। বইছিল যে সেটা তিনি সচেতনভাবে বুঝতে পারেননি, এখন সেটা হঠাৎ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বুঝতে পারলেন। তিনি নিজের ভাবান্তর যথাসাধ্য গোপন করে বললেন— ‘আমাকেই তো আপনারা নলিনীদার ওয়ারিস সাব্যস্ত করেছিলেন, সমবেত ভোটে। করেননি?’

‘সেটা তো ঠাট্টা, জাস্ট কার্টসি।’

‘তাই বুঝি? আমি সেটা তলিয়ে বুঝিনি। তা নলিনীদার টাকা আত্মসাৎ করছি, কে বললে?’

‘সে যে-ই বলুক, সাইমন বলে বেঁটেমতো লোকটা ঘাঘু পেনসিলার ছিল, সবাই জানে, নলিনীদা সাট্টা ফাট্টা, রেস-টেস করে জীবনধারণ করতেন। আমরা সবাই জানি।’

‘ও, জানতেন?’

‘আপনি ওরকম ব্যঙ্গ করে কথা বলছেন কেন?’ নিতাইবাবু খেঁকিয়ে উঠলেন। ‘আমরা সবাই ভদ্দরলোক মশাই।’

‘আমিও কিন্তু নিজেকে ভদ্রলোক বলেই মনে করি।’

‘আমরাও করেছিলুম, এখন আর করছি না। নলিনীদার পাওনা-গণ্ডা সব ওই সাইমন আর রফিক চুকিয়ে দিয়ে গেছে। মোটা টাকা। আপনি নিঃশব্দে হজম করেছেন, তারপর থেকে আপনাকে আর ভদ্দরলোক ভাবতে ইচ্ছে করছে না।’

মণিময় বলে উঠল— ‘আহা হা হা, কী করছেন নিতাইদা, অত উত্তেজিত হলে কী করে চলে? বিজনদা আপনার কিছু বলার থাকলে নিশ্চয়ই শুনব। বলুন।’

বিজন বললেন— ‘যখন আপনারা ঠাট্টা করেই হোক, কার্টসি করেই হোক আমাকে নলিনীদার ওয়ারিস বললেন, আমি কিন্তু জিনিসটাকে গুরুত্ব দিয়েছিলুম। ঠাট্টা ভাবিনি। এখন ওয়ারিস যেমন সম্পত্তি পায়, তেমনি বকেয়া ঋণ-টিনও তাকেই মেটাতে হয়— এটা জানেন তো? তা সবচেয়ে বেশি অঙ্কের যে ঋণটা সেটা কিন্তু আমি গতকালই মিটিয়ে দিতে পেরেছি। আর উত্তরাধিকারসূত্রে যা পেয়েছি— তা-ও আপনাদের সামনে রাখছি। হরিহরকে ডাকুন, সে-ই একমাত্র সাক্ষী।’

হরিহর এসে দাঁড়াল। তার মুখে আজ একটা উদ্ধত ভাব। কয়েক ঘণ্টার মধ্যে মুখচোখের ভাবের এমন পরিবর্তন হতে পারে বিজন কল্পনাও করেননি। তিনি বললেন— ‘হরিহর তুমি আমাকে সাইমনের দেওয়া প্যাকেটটা দিয়েছ?’

‘হ্যাঁ, আপনি বলেছিলেন কাউকে না বলতে।’

‘কাউকে না বলতে বলিনি। সাইমন আর রফিক নামে এই লোকগুলিকে চট করে নলিনীদার মৃত্যুর খবরটা দিতে বারণ করেছিলুম।’ হরিহর গোঁজ মুখে চুপ করে রইল।

ট্রাঙ্কটা তক্তাপোশের তলা থেকে বার করে আনলেন বিজন। প্যাকেট দুটো বার করে সবাইকার মাঝখানে বিছানার ওপর রাখলেন, বললেন —‘কোনটা সাইমনের দেওয়া, কোনটা রফিকের দেওয়া বুঝতে পারছ তো?’

‘কেন পারব না!’ হরিহর গোঁজ হয়েই বলল, ‘ওই তো বালি কাগজের প্যাকেটটা সাইমন এনেছিল, আর ওই চটের ভারীটা কাল রফিক…।’

‘ঠিক আছে চিনতে পেরেছ। আচ্ছা মণিময়, তুমি কাইন্ডলি প্যাকেটগুলো খোলো তো। পাতলাটাই খোলো না হয় আগে!’

মণিময় ইতস্তত করতে লাগল। বিজন বললেন— ‘নলিনীদার ওয়ারিস তো আমি তোমরা বললেও হতে পারি না মণিময়, এক হতে পারো তোমরা সবাই, তাঁর এতদিনের প্রতিবেশী, আর হতে পারে সে যাকে তিনি দিয়ে গেছেন। খোলো, খুলে দ্যাখো।’

নিতাইবাবু সাগ্রহে বললেন, ‘আমি খুলছি।’ প্যাকেট খুলে তিনি টাকার গোছাটা বিজয়ীর মতো বার করে আনলেন। চোখ চকচক করছে।

‘ওতে পঞ্চাশ হাজার আছে। গুনে দেখুন।’ বিজন বললেন, ‘নলিনীদা সাট্টা খেলতেন। একটা রিস্ক নিয়েছিলেন পাত্তি টু পাত্তি খেলেছিলেন, পাঁচ টাকার। লাক ফেভার করল, কিন্তু মৃত্যুর পর। ওপ্‌নের খেলায় পাঁচ পাঁচশ হয়ে গেল। ক্লোজের খেলায় পাঁচশ ইনটু একশ হল পঞ্চাশহাজার। খুব রেয়ার লাক। কিন্তু ঘটল। আপনারা অনুধাবন করতে পারছেন নিশ্চয় ব্যাপারটা।’

সবাই চুপ। বিজন বললেন। ‘যাক পুরো সংখ্যাটা যোগ দিয়ে কী দাঁড়ায় সেটা দেখাই আমাদের উদ্দেশ্য। অন্য প্যাকেটটা খুলুন নিতাইবাবু। ওতে কত আছে…।’

নিতাইবাবু অসহিষ্ণুভাবে খুলতে লাগলেন প্যাকেটটা। বললেন, ‘ওইটুকু পাতলা প্যাকেটে যদি পঞ্চাশ হাজার ধরে থাকে, তা’লে এটাতে পাঁচ লাখ, কিংবা হয়ত তারও বেশি। … তা এটা তো আপনি ভাল করে খোলেনইনি দেখছি।’ পোস্ট অফিসের পার্সেল যেমন হয় তেমন চটের থলের ভেতর প্রচুর কুচো কাগজ, তুলে ফেলতে লাগলেন নিতাইবাবু। তারপরে তিনি হঠাৎ হিঁক করে একটা ভয়-পাওয়া আওয়াজ করে পিছিয়ে এলেন। সবাই ঝুঁকে দেখল একটা নীলচে রিভলভারের নল যেন তাঁদের দিকে তাক করে আছে।

বিজন বললেন— ‘এই হল নলিনীদার উত্তরাধিকার। পঞ্চাশ হাজার প্লাস একটি থার্টি এইট অটোম্যাটিক কোল্ট। যোগ করুন কী দাঁড়ায়। এছাড়া ঋণ ছিল হরিহরের কাছে পাঁচ হাজার। সেটা কবে নিয়েছিলেন জানি না, পুরো ছহাজার করে দিয়ে দিয়েছি কাল রাত্রে নিজেরই পকেট থেকে। কী হরিহর? দিইনি!’

হরিহরের মুখটা হঠাৎ ঝুঁকে পড়ল।

‘কী হরিহর, নলিনীদা তোমার কাছ থেকে পাঁচ হাজার ধারতেন?’ মণিময় জিজ্ঞেস করল।

‘আমাদের তো ব্যাটা চাইলে অনেক ভ্যানতাড়া করে তবে দেড়শো দুশো দিস কি না দিস। কাবলিঅলার মতো সুদ কাটিস। নলিনীদার শুকনো কাঠামোয় কী রস পেলি? যে একেবারে পাঁচ হাজার?’ নিতাই ভটচাজ খ্যাঁক খ্যাঁক করে উঠলেন।

হরিহর গোঁজ মুখ করে বলল, ‘বাবু যে আমায় ছহাজার টাকা দিয়েছেন তার প্রমাণ কী? বাজে কথাও তো বলতে পারেন!’

‘অস্বীকার করছ না কি?’ বিজন আশ্চর্য হয়ে বললেন। আশ্চর্য হবার শক্তি মানুষের চট করে ফুরোয় না। ‘তুমি যে নলিনীদাকে পাঁচ হাজার কর্জ দিয়েছিলে তারই বা কী প্রমাণ আছে, হরিহর?’

মণিময় বলল, ‘অফ কোর্স। তারই বা কী প্রমাণ আছে? আশ্চর্য বিজনদা কোনও প্রমাণ ছাড়াই আপনি অতগুলো টাকা ব্যাটাকে গ্যাঁট গচ্চা দিয়ে দিলেন? অদ্ভুত মানুষ তো!’

বিজন বললেন, ‘কী? পঞ্চাশ হাজার প্লাস রিভলভারের যোগফলটা করতে পারলেন নিতাইবাবু?’

‘আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না। এই ব্যাটা হরিহর, তুই নিশ্চয়ই কিছু জানিস।’

হরিহর কাঁদো-কাঁদো হয়ে বলল— ‘রফিক মাগলার, খুব ডেঞ্জার লোক, আমি আর কিছু জানি না বাবু। সাইমন পেনছিলারের সিলিপ করবাবু বেরোবার সময়ে আমার হাতেই দিয়ে যেতেন। কিন্তু রফিকের কোনও সিলিপের কারবার ছিল না।’

মণিময় বলল, ‘বিজনদার ছহাজার টাকা গেঁড়িয়েছিস, স্রেফ মিছে কথা বলে। শিগগির যা, ফিরিয়ে দে।’

‘না না। থাক।’ বিজন বললেন, ‘নলিনীদার প্রাপ্য পঞ্চাশ হাজার কিন্তু ও নিয়ে নিতে পারত। নেয়নি। ওকে কিছু দিতে হবে না। তবে একটা কাজ করতে হবে। এটা আমরা যেমন ছিল আবার প্যাক করে দিচ্ছি। এটা ওকে ওর কাছেই রাখতে হবে।’

হরিহর একেবারে হাঁউমাউ করে উঠল। ‘না বাবু না, ট্যাকা আমি ফেরত দিয়ে দিচ্ছি, ও জিনিস আমি রাখতে পারব না। দয়া করুন বাবু।’ সে বিজনের পায়ে পড়ে গেল।

বিজন বললেন, ‘তোমাকে শাস্তি দেবার জন্যে এটা করছি না হরিহর। বুঝে দ্যাখো, নলিনীদা মারা যাওয়ায় রফিকের সঙ্গে যোগাযোগ তোমার ছাড়া তো আর কারওই নেই!’

‘রফিকের সঙ্গে আমার কিচ্ছু নেই বাবু, বিশ্বাস করুন। নলিনীবাবু না থাকলে স্রেফ দরজার ওপাশ থেকে প্যাকেট বাড়িয়ে দিয়ে বলে— ‘নলিনীবাবু এলে দিয়ে দিবি, খবর্দার বেইমানি করে খুলবি না, যাঃ শালা ভাগ্‌।’

‘ভালই তো হল। ও আবার আসবে। তখন প্যাকেটটা বাড়িয়ে দিয়ে বলবে, নলিনীবাবু নেই, মারা গেছেন। প্যাকেট নিয়ে যাও।’ বিজন বললেন।

‘কিন্তু যদি বলে কবে বাবু মরেছে, আগে বলিসনি কেন?’

‘বলিস, ঘুমচোখে খেয়াল ছিল না।’ মণিময় বলল।

বিজন বললেন, ‘নিজের জিনিস ফেরত পেয়ে গেলে ও আর তোমাকে বিরক্ত করবে না।’ তিনি যত্ন করে প্যাকেটটা যেমন ছিল তেমন করে রাখলেন; তারপরে হরিহরের হাতে দিয়ে বললেন— ‘যাও।’

প্যাকেট হাতে, চোখ মুছতে মুছতে হরিহর চলে গেল। মণিময় বলল, ‘ব্যাপারটা কিন্তু সত্যিই আমরা বুঝতে পারলুম না, আপনি পেরেছেন বিজনদা?’

বিজন বললেন, ‘নাঃ। স্মাগলিং-এর জিনিস যদি নলিনীদার কাছে রাখতে এসে থাকে, তো মাত্র একটা কেন? আবার হতেও পারে, ছোট স্মাগলার। হয়ত সময় সুযোগমতো ওটা বিক্রির সুবিধে পেলেই নিয়ে যেত। তখনই রাখবার মজুরি হিসেবে নলিনীদাকে কিছু পেমেন্ট করত। বুঝতে পারছি না ঠিক। আবার এ-ও হতে পারে খুনে গুণ্ডা। খুন-টুন করে অস্ত্রটা ওঁর জিম্মায় রেখে যেত। এইভাবে উঞ্ছবৃত্তি করেই পেট চালাতেন মানুষটা!’ সবাই চুপ করে রইল। কিছুক্ষণ পর বিজন বললেন, ‘যাক, ওই পঞ্চাশ হাজার টাকা নিয়ে কী করব তার একটা নির্দেশ আমি নলিনীদার নোটবুকে পেয়েছি। উনি দাদু কাকে বলতেন, কেউ জানেন?’

‘ওই তো, পাশের বাড়ির বাচ্চাটাকে?’ দু-তিনজন বলে উঠলেন।

নোটবুকের লেখাটা মণিময়কে চেঁচিয়ে পড়তে বললেন বিজন। পড়ে মণিময় বলল, ‘বিজনদা এর থেকেই ধরলেন, নলিনীদা কিছু টাকা পেতে পারেন, না?’

‘হ্যাঁ।’ বিজন হেসে বললেন, ‘আর তা-ই দাদার মৃত্যুর খবরটা হরিহরকে চেপে রাখতে বলেছিলাম। সাইমন টের পেয়ে গেলে কি আর টাকাটা দিত? মাঝখান থেকে নলিনীদার দাদু ফাঁকে পড়ত।’

সবাই হাসতে লাগল। প্রতুলবাবু বললেন, ‘কিন্তু বিজনবাবু, অভাবের সংসারে ও পঞ্চাশ হাজার টাকা আর কদ্দিন, দেখবেন হয়ত নেশা-ভাং করেই উড়িয়ে দিল।’

‘করে নাকি? নেশা ভাং?’ বিজন বললেন।

‘কে না করে? আমি আপনি ভদ্দরলোক ছোটলোক, কে বাদ আছে নেশা করতে আজকালকার দিনে সেটাই বলুন না মশায়! কী আছে এই শালার জীবনে, স্বস্তি নেই, শান্তি সুখ নেই, আনন্দ নেই, কলুর বলদের মতো খালি ঘুরেই মরছি, ঘুরেই মরছি! নেশা কে না করে?

‘তা অবশ্য’, বিজু চিন্তিত হয়ে বললেন, ‘তবে বাচ্চাটা বা তার মা তো নেশা করবারও সুযোগ পায় না। আপনাদের যদি অনুমতি থাকে তাহলে আমরা টাকাটা খাটিয়ে তার ইন্টারেস্টটা দিয়ে খুকিদের সংসারে একটু সচ্ছলতা আনতে পারি। না হয় ওরা না-ই জানল সবটা। খুকি বড় হলে এটা পাবে। কী বলেন?’

‘হ্যাঁ হ্যাঁ তা তো করাই যায়।’ মণিময় খুশি হয়ে বলল।

‘তা হলে খামটা মণিময় তোমার হেফাজতে রাখো এখন, আমি দেখছি কী করা যায়।’

‘আমার হেফাজতে কেন? বেশ তো ছিল!’

বিজন হেসে বললেন ‘তা হবে না। একবার যখন সন্দেহভাজন হয়েছি, ও টাকাটা আমি আর রাখতে পারব না। আপনারা যেখানে নিরাপদ মনে হয় রাখুন, পরে ব্যবস্থা করে আপনাদের জানালে আপনারা যদি অ্যাপ্রুভ করেন তো নিয়ে যাব।’

মণিময়ও কিছুতে নেবে না। বিজনও কিছুতেই রাখবেন না। অবশেষে বিজনই জয়ী হলেন। প্যাকেটটা নিয়ে ওরা নীচে নেমে গেল। মেসমালিক প্রফুল্লবাবুর কাছে জমা রইল জিনিসটা। তিনি রীতিমতো রসিদে সই-সাবুদ করে দিলেন।

ভাল করে চান করে, দুপুরের খাওয়াটা একা একা সারলেন বিজন। সবাই যে যার অফিস চলে গেছে। শূন্য মেসবাড়ি। বিজন তেতলার কুঠুরিতে এসে চিঠিপত্রের তাড়া খুলে বসলেন।

“মা,

বিজুর সাফল্যের খবর শুনে গর্বে আনন্দে আমার বুক ভরে যায়। খালি মনে হয় একবারটি যদি দেখতে পেতুম! বিজু, সেই ফাজিল, স্কুল পালানো, গোঁয়ার বিজু আজ এত বড় হয়ে তোমাকে এত সুখে রেখেছে, এর জন্য কী বলে কাকে ধন্যবাদ জানাব ভেবে পাই না। কারণ মা, বিজুর যতই কৃতিত্ব থাক, লাক-ফ্যাক্টর একটা থেকেই যায়। তুমি লিখেছ বিজুর সংসার, তার ছেলে মেয়ে বউ আমার দেখতে ইচ্ছে করে কি না। দুঃখ পেয়ো না মা। করে না। আমার জগতে তো ওরা ছিল না। আমি আমার সেই বাঁধাঘাটের ছাদের রোগা হাফ প্যান্ট পরা, বড়-বড় দুষ্টু ভিতু চোখ বিজুকে দেখতে চাই। তাকে আর দেখতে পাব না মা। সেই দিনগুলো আর ফিরে আসবে না। কেউ ফিরিয়ে দিতে পারবে না। কাউকে দোষ দিচ্ছি না। যা ঘটবার তা সব ঘটে যায়। আর ফেরে না। আর কখনোই ফেরে না। এই না ফেরা যে কী ভয়ঙ্কর যাকে অল্পবয়স থেকে নির্মূল হয়ে আসতে হয়, সে জানে। যে দেখতে পায় না ভাই কী করে বড় হল, মা-বাবা কী করে বুড়ো হল, দাদা-দিদিরা কীভাবে আরও বড়, প্রৌঢ়, বৃদ্ধ হল। সে বড় অভাগা মা। তার জীবন থেকে অনেকটা সময় চুরি হয়ে যায়। এ ক্ষতি পূরণ হবার নয়। তোমার জামাই, নাতি-নাতনি ভাল আছে। নাতি-নাতনির নাম জানতে চেয়েছ? একজনের নাম স্বপ্নেন্দু, আরেকজন ঈপ্সিতা। ওই বলেই ডাকি। প্রণাম নিয়ো।’

অনেক উল্টে-পাল্টে দেখলেন বিজু, ঠিকানা তো নেইই। পোস্ট অফিসের ছাপও নেহাতই অস্পষ্ট। অনেক কষ্টে, নলিনী করের ড্রয়ার থেকে ম্যাগনিফাইং গ্লাসটা বার করে জানলায় আলোর ধারে নিয়ে গিয়ে গঞ্জ শব্দটা বুঝতে পারলেন। কিন্তু এ বালিগঞ্জ বা টালিগঞ্জ না করিমগঞ্জ, না সাহেবগঞ্জ? গঞ্জ তো একটা নয়!

এই একইভাবে বয়ে যাচ্ছে ছুটকির সকল চিঠির ধারা। মায়ের অসুখের খুঁটিনাটি, সুলতা ও শিবানীর কথা, আর ছুটকির একটা প্রশান্ত আকুলতা ভাইবোনেদের জন্যে, মায়ের জন্যে, বিশেষত বিজুর জন্যে। অবশেষে ম্যাগনিফাইং গ্লাস দিয়ে পরীক্ষা করতে করতে একদিন একটা চিঠির পোস্ট-অফিসের নাম উদ্ধার করতে পারলেন বিজন। চিনসুরা। বাস, শুধু এইটুকু! এইটুকু তথ্য সম্বল করেই কি তিনি বেরিয়ে পড়বেন? বিজু ভেবে দেখলেন তিনি যখন অল্প বয়সে সৌভাগ্য খুঁজতে বেরিয়ে পড়েন, তাঁর এই কুটোটুকুও সম্বল ছিল না। ঝোঁকের মাথায় বেরিয়ে পড়েছিলেন। দ্বিতীয়বার বি-কম-এ বসতে হবে, বাড়ির এই অবধারিত নিয়মে ক্ষুব্ধ হয়ে, ছুটকি ফিরে আসবে বা কোনও খবর দেবে এই রকম একটা আশাকে শেষ পর্যন্ত ছলনা, মায়া, মোহ বলে চিনতে পেরে, একদিকে বাড়ির প্রতি প্রবল বিতৃষ্ণায় আরেক দিকে উপার্জন করবার, অনেক অনেক উপার্জন করবার তীব্র আকাঙক্ষায় তিনি বেরিয়ে পড়েছিলেন। ফল খারাপ হয়নি। প্রকৃতপক্ষে, তিনি নিজেকে একজন ভাগ্যের সুনজরের মানুষ বলে চিনতে পারেন আজকাল। যখন যেটাতে হাত দিয়েছেন, সফল হয়েছেন। মনের সুখ-শান্তির কথা আলাদা। স্বতন্ত্রভাবে তা খোঁজেনওনি তিনি কোনওদিন। বিপুল পরিমাণ কর্ম ও কর্মের মোহ, মোহই তো? তাঁকে ছুটিয়ে নিয়ে বেড়িয়েছে। আর একটা জিনিস তাঁর খেয়াল হল, এই দ্বিতীয়বার তিনি বাড়ি থেকে পালিয়েছেন। পালিয়ে দিদির সঙ্গে দেখা হল, দিদি যাবার সময়ে তাঁকে বড় ভালবেসে ডেকে গেল। দিদির ছেলেটির হয়ত একটা সুরাহা করে দিতে পারবেন, দীপিকার সঙ্গে ভাব হল, এই মেসবাড়ির মানুষগুলির কাছে সততার অগ্নিপরীক্ষায় পাস করে গেলেন তিনি সসম্মানে, এই সমস্তই কিন্তু সাফল্য। নিঃসন্দেহে। হরিহরকে তিনি চিনতে পারেননি, সে বিশ্বাসঘাতকতার কাজটা করল। কিন্তু সাফল্যের তুলনায় এটুকু ব্যর্থতা কিছুই না। তাহলে তাঁর যে আসল লক্ষ্য, ছুটকিকে খুঁজে বার করা তাতেই বা তিনি বিফল হবেন কেন? অন্তত চেষ্টা করতে দোষ কী?

পরের দিন দশটা পনেরোর ব্যাণ্ডেল লোকালে চেপে পড়লেন বিজন। যথেষ্ট ভিড়। সামনের দিকে এগিয়ে গিয়ে মোটামুটি একটা সিট পেলেন। বসেই গোটা মুখটা বাইরের দিকে ফিরিয়ে বসলেন। আরও সকালের ট্রেনে যেতে পারলে বেশি নিরাপদ হতে পারতেন, কিন্তু পোস্ট অফিস খোলবার পরে তাঁকে যেতে হবে। পোস্ট অফিসই আপাতত তাঁর গন্তব্য। কেউ দেখে ফেললে একটু মুশকিল, ঠিকই। কিন্তু কী করা যাবে! এই ঝুঁকি নিয়েই তিনি কদিন আগে আটাত্তর নম্বরে সুখচর গেছেন।

একটা সাইকেল রিকশা নিলেন বাইরে বেরিয়েই।

‘কোন্ দিকে যাবেন বাবু? হুগলির দিকে যাব? না এদিকে?’ বিজু ইতস্তত করছেন দেখে রিকশাচালক বলল ‘ঠিকানাটা বলুন? দেখছি।’

বিজু বললেন, ‘পোস্ট অফিসটা কোনদিকে?’

‘কোন পোস্টাফিস? চুঁচুড়া মেন?’

বিজু বললেন— ‘হ্যাঁ।’

তাঁর ‘হ্যাঁ’-এর মধ্যে দ্বিধার ভাব টের পেতে দেরি হল না রিকশাঅলার। এসব বিষয়ে সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্মতর অনুকম্পনের সঠিক ব্যাখ্যা করা এদের কাছে কিছুই না। সে বলল, ‘বাবু কি এদিকে নতুন? চলুন না চুঁচড়ো শহর ঘুরিয়ে নিয়ে আসি। ডাকাতে কালী, ক্লক-টাওয়ার, জজের বাংলো, কমিশনারের বাংলো, ডাচ বাংলো, লঞ্চ ঘাট, ভূদেব মুখুজ্জের বাড়ি, অনেক দেখবার আছে এখানে। তিরিশটা টাকা দেবেন। বাস।’

বিজু বললেন—‘পোস্ট অফিস খুব দূরে!’

‘আজ্ঞে না তো! এই তো ঘড়ির মোড় পেরোলেই…’

‘ওখানেই নিয়ে চলো।’

শন শন করে হাওয়া দিচ্ছে। যদিও রোদও যথেষ্ট! হুডটা এতক্ষণে নিশ্চিন্তে খুলে দিলেন তিনি। উল্টো দিক থেকে সারে সারে সাইকেল আসছে। এখান থেকে যারা ডেলি প্যাসেঞ্জারি করে তাদের অনেকেই নিশ্চয় সাইকেলে যায়। স্টেশনের বাইরে বোধহয় কোথাও সাইকেল জমা রাখে। ফেরবার সময়ে আবার নিয়ে নেয়। যারা যাচ্ছে বেশির ভাগই বয়সে তরুণ। ছাত্র গোছের। মেয়েও আছে। আরও বড় চাকুরে জাতীয় লোকও আছে। যুবক তরুণ যারা যাচ্ছিল, তাদের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে বিজনের মনে হচ্ছিল এদেরই কেউ হয়ত স্বপ্নেন্দু। ছুটকির ছেলে। ছেলে কত বড়? ছেলে বড় না মেয়ে বড় এসব ছুটকি লেখেনি। যদি তার সেই বয়সের আশেপাশেই জন্মে থাকে, তা হলে স্বপ্নেন্দু আজ দিব্য-টিব্যর চেয়েও বড়, উপযুক্ত উপার্জনশীল যুবক। কিন্তু কেন কে জানে তাঁর ভাবতে ভাল লাগছে ছুটকির ছেলেমেয়ে তাঁরই চিন্টু-তিতির বয়সী। বেশি বড় নয়। ছেলেটার সবে দাড়ি গোঁফ গজিয়েছে। নরম-নরম। এই রকম বয়সের ছেলের ওপর কি তাঁর দুর্বলতা আছে? এ দুর্বলতা আগে কখনও টের পাননি তো! চিন্টুকে কতদিন দেখেন না। চিন্টুটা ছোটবেলায় তাঁর ভীষণ ন্যাওটা ছিল। এখন চিন্টু কী রকম হয়েছে? কী অদ্ভুত! তিনি চিন্টুর ছেলেবেলার মুখটা আবছা আবছা মনে কতে পারলেও এখনকার মুখটা ঠিকঠাক স্মরণ করতে পারছেন না। তিতির মুখটা বরং এক একবার চমক দিয়ে যাচ্ছে চোখের সামনে। ওরা কোনও খবর কাগজে দিল না কেন? এটা খুব অদ্ভুত! তনুশ্রী! তনুশ্রীর মুখটাও ভাল করে মনে করতে পারলেন না তিনি। কী ভাবছে ওরা? পুলিশে খবর-টবর দিয়েছে তো? নিশ্চেষ্ট হয়ে বসে নেই নিশ্চয়! তবে ওদের কারও বুদ্ধির ওপরই কোনও ভরসা নেই তাঁর। তনুশ্রীটা তো একেবারে গাড়ল! আর ছেলেমেয়ে দুটো? কী পড়ছে? তা পর্যন্ত মনে করতে পারলেন না বিজু রায়। স্কুল পেরিয়ে গেছে। কলেজে তো নিশ্চয়ই! কিন্তু ঠিক কোন পর্যায়ে! জানতে হলে তাঁকে এখন এদের বয়স হিসেব করে দেখতে হয়।

রিকশাঅলা বলল, ‘পোস্ট অফিস এসে গেছে বাবু।’

বিরাট হলুদ রঙের বিল্ডিংটার সামনে নেমে ভাড়াটা মিটিয়ে দিলেন তিনি। গেট ঠেলে ঢুকলেন। অনেকগুলো কাউন্টার। বেশ সরগরম চুঁচড়ো পোস্ট অফিস। তিনি টিকিটের কাউন্টারে দাঁড়ালেন। এঁদের কাছে কী বলে খোঁজ নেবেন তিনি? ঠিকানা নেই। পদবিটা কী? সেটা পর্যন্ত তিনি জানেন না। কোনওদিন বলা হয়নি তাঁকে।

‘আচ্ছা দাদা, একটা খবর দিতে পারেন?’ বিজু রায় কপাল ঠুকে জিজ্ঞেস করলেন।

শুকনো মতো বুড়ো ভদ্রলোকটি কিছু গোনাগাঁথা করছিলেন, একটু পরে মুখ তুলে বললেন, ‘বলুন!’

‘আমাকে দশটা খাম দেবেন?’ বিজু রায়ের হঠাৎ মনে হল এটাই প্রশস্ত।

ভদ্রলোক বললেন, ‘খাম তো অতগুলো হচ্ছে না, চারটে ইনল্যান্ড দিয়ে দেব নাকি?’

‘তাই দিন।’

‘আচ্ছা কেয়া, মানে শ্রীমতী কেয়ার নামে কোনও চিঠি…’

‘কেয়া রায় তো? এই গোবিন্দ! গোবিন্দ!’ তিনি একজনকে ডাক দিলেন। পিওনের পোশাক পরা লোকটি। ‘বাঁ দিকের সর্টিং আপিসে যান এর সঙ্গে আমি বলে দিচ্ছি।’ ভদ্রলোক বললেন।

গোবিন্দর পেছন পেছন বেরিয়ে বাঁ দিকে একটি বড় ঘরে অবাক হয়ে ঢুকলেন বিজন। ভেতরে কয়েকটা বড় বড় টেবিলে বসে বেশ কয়েকজন কাজ করছেন। একদম বাঁ দিকে খোপ খোপ কাটা একটা আসবাব। চিঠিপত্র ঢোকানো হচ্ছে সেখানে।

গোবিন্দ নামধারী হেঁকে বলল— ‘কেয়া রায়ের কোনও চিঠি এসেছে কিনা খোঁজ করছেন ইনি।’

টেবিলে-বসা একজন মুখ তুলে বললেন, ‘রয়েছে দুটো। ওঁর কী হল? নিজেই তো নিয়ে যান। অসুখ-বিসুখ নাকি?’

বিজু সম্মোহিতের মতো বললেন, ‘হ্যাঁ, জ্বরে পড়ে আছেন।’

‘আপনি? লেটার অফ অথরিটি এনেছেন?’

ভদ্রলোক নিজের কাজে মগ্ন হয়ে গেলেন।

বিজু ভাবলেন— ‘ছুটকি নিজে আসে? এই পোস্ট অফিস থেকে নিয়ম করে এসে চিঠিপত্র নিয়ে যায়! যদি এখন, এই মুহূর্তে ছুটকি আসে? গয়নাগাঁটি পরা দোহারা চেহারার চওড়া পাড়-টাড়ের শাড়ি-পরা ছুটকি? ছুটকি কি তাঁকে চিনতে পারবে? রোগা-প্যাংলা সেই বিজুকেই ছুটকির মনে আছে। কিন্তু তিনি? ছুটকিকে দেখবামাত্র চিনতে পারবেন। তিনি ঠিক জানেন।

‘কেন? মানি-অর্ডার-টর্ডার কি রেজিস্টার্ড কিছু এসেছে না কী? সেসব দিতে হবে না। সাধারণ চিঠি যদি কিছু থাকে তো দিন না। তার জন্য আবার অথরিটি লেটার-ফেটার কী হবে?’ বিজন বললেন খুব সপ্রতিভভাবে, হেলাফেলার সঙ্গে। ভেতরে ভেতরে উল্লাসে তিনি ফেটে পড়ছেন। একেই বলে স্ট্রাইকিং পে ডার্ট। এখন শেষ রক্ষা হলেই হয়।

ভদ্রলোক নিঃশব্দে দুটো চিঠি এগিয়ে দিলেন। একটা ছাপানো পোস্ট কার্ড। কোথায় কোন সাধুর জন্মোৎসবের নিমন্ত্রণ। আরেকটা ইনল্যান্ড। পত্রপ্রেরকের নামের জায়গায় নিজের সল্ট লেকের বাড়ির ঠিকানা দেখে চমৎকৃত হয়ে গেলেন বিজু রায়। হাতের লেখাটা অচেনা। কিন্তু ঠিকানাটা তাঁরই। চিঠি দুটো নিয়ে পোস্ট অফিস থেকে বেরিয়ে একটু হেঁটেই অদূরে দেখলেন বিরাট পাঁচিল ঘেরা বাগান। গাছে গাছ। মনে হয় সরকারি বাংলো-টাংলো হবে। নিমেতে কাঠটগরেতে মিলে একটু ছায়া করেছে। পাঁচিলের ধারে সেইখানটায় দাঁড়িয়ে ইনল্যান্ডটা খুলে ফেললেন তিনি। কোন রকম বিবেক দংশনই হল না।

“সাবিত্রীসমানেষু মা ছোটখুকু,

নিজের হাতে লেখার শক্তি নেই, তাই শিবানী আমার নার্স মেয়েটি বড় ভাল মেয়ে তাকে দিয়ে লেখাচ্ছি মা। ওরাই আমার চিঠি ফেলে। কন্যার অধিক সেবা-যত্ন করে। তোমার সেবা পাব সে ভাগ্য করে তো আসিনি মা সব কিছুই অত সহজ নয়। আমার কর্মফলে আমি ভুগছি তোমার দোষের চেয়ে বেশি দোষ আমার। পেটে ধরলেই মা হওয়া যায় না মা, তুমি তোমার ভালবাসার ডালি নিয়ে এসেছিলে মা, আমি তোমার পাপটাই দেখেছিলুম। আজ সর্বান্তঃকরণে বলে যাচ্ছি মা আমাকে মাপ কোরো আমি পাপ-পুণ্যের কিছু বুঝি না, জীবনে অনেক দেখলুম তোমাকে তোমার ছেলে-মেয়েকে আমার ছোট জামাইকে দেখবার সাধ অপূর্ণ রয়ে গেল। সামনাসামনি আশীর্বাদ করবার সাধ অপূর্ণ রয়ে গেল। একটু তোমায় বুকে টেনে চুমু খাবার জন্যে প্রাণটা আমার আঁকু পাঁকু করছে মা। সারা জীবনই করেছে। তোমার বাবা তোমার নাম মুখে নিয়ে স্বর্গে গেছেন। আমিও তাই যাব ছোটখুকু। তোর ঠিকানাটা মাকে কোনওদিনও দিলি না। ভালই করেছিস। আমার কর্মফল। খুকু মরতে বড় দেরি হয়ে গেল মা। যদি ফিরে আসি যেন তোর মেয়ের কোলে ফিরে আসি আবার। নাতনিকে বুকে নিয়ে মনে করিস তোর হতভাগিনী মা তোকে বুকে করছে।

ইতি, আঃ মা।”

চিঠিটা শেষ করে বিজন পাঁচিলের গায়ে হেলান দিলেন। প্রকৃতপক্ষে তাঁর হাত এত দুর্বল হয়ে গিয়েছিল, পা দুটো এত শক্তিহীন, তাঁর কোথাও বসে পড়তে ইচ্ছে করছিল। মায়ের মৃত্যুর পর তিনি কাঁদেননি। ঊননব্বই নব্বুই বছরের মায়ের মৃত্যুতে আটান্ন ঊনষাট বছরের ছেলের হয়ত কাঁদবার কিছু নেই। কিন্তু তিনি বড় শোকার্ত হয়েছিলেন। জীবনের সবচেয়ে বড় স্নেহের ভালবাসার বাঁধন ছিঁড়ে গেল টের পেয়ে তিনিও ভেতরে ভেতরে ছিন্ন হয়েছিলেন। কিন্তু সে শোক তাঁর ভেতরেই বসবাস করছিল। আজ মফঃস্বল শহরের এক ছায়াময় গাছের তলায় দাঁড়িয়ে তাঁর চোখ দিয়ে ভীষণ গরম জল অনর্গল বেরোতে লাগল। এবং একবার কাঁদতে আরম্ভ করে তিনি দেখলেন তিনি কিছুতেই কান্না থামাতে পারছেন না। গোঙানির মতো শোকের হাহাকার বেরিয়ে আসছে। বুক ব্যথা করছে তাকে মুক্তি দিতে না পারলে।

‘আপনার কি শরীর খারাপ লাগছে? পেছন থেকে কে যেন জিজ্ঞেস করল। ‘বুকে ব্যথা?’ আরেকজন।

কী বলবেন তিনি? চোখের জলে সমস্ত ঝাপসা দেখছেন। কোনওমতে চিঠিটা দেখিয়ে বললেন, ‘মায়ের… মৃত্যু সংবাদ…।’

‘আমরা কি আপনাকে একটু ধরব? একটু কোথাও বিশ্রাম করবেন? জল খাবেন?’

‘না, এখুনি সামলে যাব।’ এবার একটু স্পষ্ট করে বললেন বিজু রায়। রুমাল বার করে চোখ মুখ ভাল করে মুছলেন। কার্ডের চিঠিটাতে দেখলেন ঠিকানা লেখা রয়েছে স্পষ্ট অক্ষরে।

একটা খালি রিকশা যাচ্ছিল। তাড়াতাড়ি সেটা ধরে ঠিকানাটা বললেন তিনি। খুব লজ্জা পেয়েছেন। কত জনে তাঁকে এভাবে বেসামাল অবস্থায় দেখল কে জানে! কী দেখল? একটা আধবুড়ো লোক গুঙিয়ে গুঙিয়ে কাঁদছে। প্রকাশ্য রাস্তায়। কিন্তু তিনি তো এভাবে নিজেকে দেখেন না! দেখছেন না আর। তিনি তো আসলে বিজন, বিজু। একটা কুড়ি-একুশ বছরের ছেলে, গালে অল্প কুচো দাড়ি। এখনও ক্ষুর পড়েনি। যেসব বন্ধুর তাড়াতাড়ি দাড়ি গজিয়েছে তারা বলত— মাকুন্দ। সেই বিজু একেবারে কাঁচা, যার সদ্য ভগ্নীবিয়োগ হয়েছে, সে একরকম আত্মবিয়োগও তো বটে! মা বাবা দাদা দিদি সবাইকে ছেড়ে অচেনা-অজানা দুনিয়ার পথে একলা যাত্রী। বিজন।

মায়ের চিঠিটাতে তারিখ তেসরা অক্টোবরের। মা শিবানীকে দিয়ে চিঠি লিখিয়েছে। এতকাল পরে সেই চিঠি! পোস্টের গণ্ডগোল! এইরকম! অক্টোবরের চিঠি আসতে আসতে বছর ফুরিয়ে গেল? তিনি আবার পোস্টের ছাপটা পরীক্ষা করতে লাগলেন, পোস্ট করবার তারিখটা ভালই পড়া যাচ্ছে। সতেরো, বারো, বিরানব্বই। তার মানে? এ চিঠি মা শিবানীকে পোস্ট করতে দিয়েছিল। পোস্ট হয়েছে সতেরো বারোয়। মানে প্রায় আড়াই মাস পরে? আরে! বিজনের মনে পড়ল তেসরা রাত থেকেই মায়ের বুকের কষ্টটা শুরু হয়। তারপর দুটো দিন আর নিঃশ্বাস ফেলবার ফুরসত ছিল না। শিবানীর তো নিশ্চয়ই ছিল না। মা মারা গেল, কাজের দিন অবধি শিবানী ছিল। তার পরেই বোধহয় মাইনে চুকিয়ে দিয়েছিলেন। চলে গেল চোখের জল মুছতে মুছতে। শিবানী কি ভুলে গিয়েছিল চিঠি ফেলতে? তার ব্যাগেই পড়েছিল চিঠিটা এতদিন! না কি বিজুর ভাগ্যই তাকে ভুলিয়ে রেখেছিল, তাকে দিয়ে পোস্ট করিয়েছিল ওই সতেরো বারো তারিখে যাতে বিজু পায়, বিজু হদিশ পায়। মায়েরও। ছুটকিরও।

রিকশাঅলা বলল, ‘এ তো অনেক দূর। নতুন সব ঘরবাড়ি হয়েছে এদিকে। জলা-জঙ্গল ছিল বাবু। ওসব মিউনিসিপ্যাল এরিয়া নয়। পঞ্চায়েতের। তবে সুন্দর সুন্দর বাড়ি উঠেছে আজ্ঞে। একতলা, দোতলা স্টেশন থেকে কাছে পড়বে।’

দূর থেকে পাড়াটা চোখে পড়ল। স্টেশন রোড থেকে ডাইনে নেমে যেতে হবে। একসার দোকান। তারপর মাটির রাস্তা। উঁচু দোতলা বাড়ি। ছকোনা জলের ট্যাঙ্ক। আরও বাড়ি রয়েছে। এদিক ওদিক। তারাও সুন্দর। কিন্তু এটি যেন সগর্বে মাথা তুলে আছে। রিকশাঅলা বলল, ‘বাতিঘর। ওই বাড়িই আমাদের নিশানা বাবু।’

চমৎকার বাড়িটি। ঢালু টালির ছাদ। এগুলো আসলে টালি নয়। সিমেন্ট জমিয়ে ওইভাবে করা। আজকাল করে। ফিকে লাইল্যাক রং বাড়িটাতে। জানলা-দরজাগুলো বন্ধ। ঘিয়ে রঙের। কার্নিসেও মেটে লাল রং। বাড়ির পাশ দিয়ে একতলার জমি থেকে দোতলার ছাদ বেয়ে ট্যাঙ্কের পাশে পর্যন্ত উঠে গেছে চমৎকার ঝিরিঝিরি লতা। ফুল নেই। কিন্তু লতাটিরই বাহার খুব। আশেপাশে অল্পস্বল্প জমি। রিকশাঅলা বাড়িটার কাছাকাছি হতে বিজন অবাক হয়ে দেখলেন— এই ঠিকানাই। “বাতিঘর”। নামটা দেওয়া নেই। কিন্তু ঠিকানা এটাই। তাই তো! তিনি অবাক হচ্ছিলেন কেন? বাতিঘর! অথই জলে নিরুদ্দেশ, কূলহারানো নাবিক ওই বাতিঘর দেখেই তো ভরসায় ফিরবে!

তিনি নেমে আগে রিকশাটিকে বিদায় করলেন। এখন অনেক চমক, চেনাচেনি, জানাজানি। অনেক অপ্রস্তুত নীরবতা। হিল্লোলিত আনন্দ। বাইরের কেউ সাক্ষী না থাকে। তিনি সন্তর্পণে বেলটা একবার বাজিয়েই হাত নামিয়ে নিলেন।

বাড়ির ভেতরে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে বেলের আওয়াজ। নিবিষ্টমনে শুনছে বিজু। দরজা খুলে গেল। বেগুনি পাড় একটা সাদাসিধে শাড়ি পরা রোগামত মহিলা দরজা খুলে দিলেন। অনেক কালো চুলের মধ্যে অনেক সাদা চুল। কপালের ওপর দুটো সমান্তরাল রেখা। আনুভূমিক। ছোট্ট নাক, ঢেউ খেলানো ঠোঁট। মাজা কালো রঙের এক পাতলা মিষ্টি প্রৌঢ়া। বিজন হাঁ করে তাকিয়ে রয়েছে।

‘কাকে চান?’ কোনও কথা বলতে পারছে না বিজন। হাঁ করে দেখছে, সে যেন মিলিয়ে যাবে এখুনি ওই সাদা-কালো চুলের ঢালে, ওই বড় বড় পল্লব ঘেরা চেরা চোখের সাদায়, ওই ছোট্ট নাকটিতে।

‘কাকে চান?’

বিজন বলল, ‘ছুটকি, আমি বিজু রে!’

প্রৌঢ়া তার দিকে তাকিয়ে যেন পাথরের প্রতিমা হয়ে গেলেন। অনেক, অনেকক্ষণ পরে বিজন বলল, ‘তোর বাড়িতে আমায় ঢুকতে দিবি না? ছুটকি?’

নীরবে দরজা ছেড়ে সরে দাঁড়ালেন প্রৌঢ়া।

বিজন ঢুকল। দরজা বন্ধ হয়ে গেল। একটা মস্ত চৌকো দালান। কয়েকটা চমৎকার বেতের সোফা সাজানো, কয়েকটা মোড়া। দালানের ওদিক থেকে দোতলার সিঁড়ি উঠে গেছে। চকচকে পেতলের পাত দিয়ে মোড়া তার ওপরটা। যতটা দেখা যায়, ওপর থেকে একটা পেতলের পাত্র থেকে অর্কিড ঝুলে রয়েছে।

‘বসতে বলবি না, ছুটকি?’

‘বোস’—বোজা গলায় প্রৌঢ়া বললেন।

‘তুই বসবি না?’

দূর থেকে একটা মোড়া টেনে এনে বসলেন প্রৌঢ়া।

‘ছুটকি, তুই খুশি হোসনি?’

প্রৌঢ়া দুহাতে মুখ ঢেকে ফেললেন। আঙুলের ফাঁক দিয়ে জল গলছে। দু হাতের ঢাকার মধ্যে মুখটা কেঁপে কেঁপে উঠছে। বিজন বুঝল এ কোনও প্রৌঢ়া নয়, ঊনষাট বছরের। এ সেই কুড়ি একুশ বছরের তরুণী, যে তার মা-বাবা- দাদা-দিদি বিশেষত যমজ ভাই বিজুকে সাংঘাতিক ভালবাসত, কিন্তু ভাগ্যের ফেরে আরও বেশি ভালবেসে ফেলেছিল এমন একজনকে যাকে তার ভালবাসা উচিত নয় আদৌ। স্বাভাবিকও নয়। বয়সে অনেক বড়, সম্মানে ঐশ্বর্যেও অনেক অনেক বড়, ভিন্ন জাত। যাকে বলে ছোট জাত এবং বিবাহিত। অমোঘভাবে বিবাহিত। একটা সন্তানের জনক। বিজু আজও তাঁর নাম জানে না। পরিচয় জানে না। তার বাড়ির লোকেও জানত কি না সন্দেহ। ছুটকি জানত কেউ মেনে নেবে না। কেউ ক্ষমা করবে না। তাই ছোট্ট একটা চিঠি লিখে রেখে চলে গিয়েছিল। সে লিখে গিয়েছিল— তার ভালবাসার মানুষটির বয়স চল্লিশের ওপর, তিনি ষোলো সতের বছরের একটি পুত্রের পিতা। বিশাল ধনী। কিন্তু তিনি খুবই অসুখী। ছুটকিতেই তার সব সুখ। তিনি ছুটকিকেই বিয়ে করবেন। মা-বাবা যদি মেনে নেন এ ভালবাসা, যদি ক্ষমা করেন, তাহলে তার নির্দেশক হিসেবে অন্তত একমাস যেন প্রতিদিন তার হলুদ কালো খড়কে ডুরে শাড়িটা ছাদে মেলে রাখেন। সে তখন স্বামীর সঙ্গে এসে সবাইকে প্রণাম করে যাবে।

স্তম্ভিত পরিবারের সবাই। বজ্রাহত। কখনও এমন ঘটে, ঘটতে পারে কেউ ভাবেনি পর্যন্ত। কে এ লোক? কোথায় এর সঙ্গে পরিচয় ছুটকির? চল্লিশ বছুরে। বাড়িতে বউ ছেলে মেয়ে সব আছে! তাকে ছুটকি! ছি, ছি,‌ ছি! প্রথমে ঠিক হল ছুটকি যেমন বলেছে তেমনি হবে। হলদে-কালো ডুরে শাড়িটা ছাদে মেলে রাখা হবে। ছুটকি আসবে, তারপর তাকে ঘরে আটকে রাখা হবে। চোরের মার দেওয়া হবে। আর সেই লোকটিকে? সে যদি আসে? আসবেই। ছুটকি একা আসবে না। বিরাট ধনী যে! নাকি কোটিপতি! তাকে অত সহজে মার খাওয়ানো যাবে? রাইটার্সের ছাপোষা কেরানি বঙ্কুবিহারীবাবুর দাঁতে দাঁত লেগে যাচ্ছে ভাবতে গিয়ে। এমন সময় মা ছুটে গিয়ে সেই হলুদ-কালো খড়কে ডুরে শাড়িটা এনে উঠোনের মাঝখানে স্রেফ দাঁত দিয়ে ছিঁড়ে সেটাকে কুটি-কুটি করে ফেলল। বলল, ‘ওর নাম আর কেউ তোমরা আমার সাক্ষাতে উচ্চারণ করবে না। ও মরে গেছে। মরে গেছে ধরে নাও।’ মায়ের চোখ-মুখ ভয়ঙ্কর। পাগলিনীর মতো।

ছুটকির মুখ থেকে হাত সরে গেছে। চোখ বোজা। সে বুকের কাছটা আঁকড়ে ধরেছে। ভিজে মুখ এখন মড়ার মতো ফ্যাকাশে, ভেতরের যন্ত্রণায় বিকৃত হয়ে যাচ্ছে থেকে থেকে। বিজু বুঝতে পারল ছুটকি এখন তার সেই পাওনা মারটা খাচ্ছে। সেই চোরের ঠ্যাঙানি যা দিয়ে তাকে ফিরিয়ে আনবার কথা ভাবা হয়েছিল।

‘ছুটকি! তোর বড় কষ্ট হচ্ছে?’ কুড়ি বছরের তরুণ বিজু এখন। তার গলা বুজে যাচ্ছে।

প্রাণপণে নিজেকে সংবরণ করে ছুটকি বলল, ‘তুই কী করে এলি?’

বিজন হেসে বলল— ‘আমি বিজু, যা অন্যে পারে না, তা পারি। এই নে তোর চিঠি। মায়ের চিঠিটা খুলে পড়েছি। তার জন্য যা শাস্তি ইচ্ছে হয় দিস।’

চিঠি দুটো নিল ছুটকি। মায়ের চিঠিটা খুলে পড়তে লাগল। পড়তে পড়তে সে প্রাণপণে নিজেকে সামলাবার চেষ্টা করছে বুঝতে পারে বিজু। কিন্তু পারছে না, ছুটকি পারছে না। সে বসে বসে টলছে। যেন তার ভার্টাইগো হয়েছে। বিজু উঠে দাঁড়িয়ে তাকে ধরল। কতদিন পরে সেই প্রিয় স্পর্শ। বিজন উপবিষ্ট ছুটকির মাথাটা নিজের কোলের মধ্যে নিল। ছুটকি বলল, ‘কেন এলি, বিজু, কেন এলি?’ তারপর সে উঠে দাঁড়িয়ে একরকম দৌড়ে চলে গেল। বেশ কিছুক্ষণ পরে যখন আবার এসে দাঁড়াল বিজু দেখল চোখ মুখ সে ভাল করে ধুয়ে এসেছে। কিন্তু মুখটা ফুলে গেছে। সে বলল, ‘আমাদের গত সাতাশে অক্টোবর আটান্ন পার হয়ে ঊনষাট হল। ভুল করিসনি ছুটকি, এখন আর মান-অভিমানের দিন নেই। জামাইবাবু কোথায়? তুই ডাকবি না আমি যাব?’

‘নেই রে।’

তখন ছুটকির পোশাকের দিকে তার চোখ পড়ল। মাথায় সিঁদূর নেই। হাতে কিচ্ছু নেই। সাদা, সরু পাড় শাড়ি। বিজু মুখ নিচু করল, তারপর একটু পরে বলল ‘এ জীবনে দেখা হল না, আমার দুর্ভাগ্য, ছুটকি, ছেলেমেয়েরা কোথায়?’

‘নেই, বিজু।’

‘মানে? কোথায়?’

‘নেই। কোনওদিন ছিল না।’

‘স্বপ্নেন্দু, ঈপ্সিতা… মাকে লিখেছিস যে!’

‘ভোলাতে।’

আশ্চর্য হয়ে বিজু বলল, ‘ভোলাবার কী আছে? জামাইবাবুর চলে যাওয়ার খবর দিসনি ভালই করেছিস। কিন্তু ছেলে মেয়ে না হওয়া— এমন কী ব্যাপার, যে বানিয়ে বলতে হবে?’

ছুটকি চুপ করে রইল।

বিজু বলল, ‘আজ কিন্তু তোর বাড়িতে থাকব, নড়ছি না এখান থেকে সহজে। তোর হাতে খাব।’

‘তা হয় না বিজু!’

‘সে কী? আমায় তাড়িয়ে দিচ্ছিস?’

তখন ছুটকি মুখ নিচু করে বলল, ‘বিজু, এ আমার বাড়ি নয় ভাই, আমি এ বাড়ির রাঁধুনি।’

১০
নীলাদ্রি, সাহেবের ছেলে অফিসে বসছে। রোজ। সাধন বিশ্বাস অনেকটা নিশ্চিন্ত। আইন মাফিক কিছুই করতে পারবে না এখনও নীলাদ্রি। কিন্তু কাজগুলো দেখছে, বুঝে নিচ্ছে একটু একটু করে। সাহেবের এগজিকিউটিভ চেয়ারটা শূন্য দেখতে হচ্ছে না। এটা, এটাও অনেক। ফ্যাকটরিতেও যাচ্ছে নীলাদ্রি। রোজ একবার করে। ক্যানিং স্ট্রিট থেকে বেলিলিয়াস রোড। সময় নিয়ে যাচ্ছে। নিয়ে আসছে। অনেক দিন আগে থেকেই কর্পোরেশনের নোটিস এসে পড়ে আছে। ঘুসুড়ির বাড়ি ওরা ডিমলিশ করে দেবে। সাধন বিশ্বাস—সাহেব বাইরে ট্যুরে গেছেন বলে অনেক হাঁটাহাঁটি করে অনেক কষ্টে ঠেকিয়ে রেখেছেন। আজ নীলাদ্রিকে ঘুসুড়ির বাড়িটা দেখাতে যেতেই হবে। কারখানায় যাবে না। ঘুসুড়ি যাবে। নীলাদ্রি আজকে তার ডার্ক ব্রাউন স্যুটটা পরেছে। বড় বড় চেক-কাটা চওড়া টাই। লিগ্যাল অ্যাডভাইসার সুখেন্দু দত্ত একটু আগেই কতকগুলো কাগজপত্র ‘ফর’ দিয়ে সই করা যাবে, জানিয়ে দিয়ে চলে গেলেন। ‘মে আই কাম ইন, সাহাব!’

নীলাদ্রি মুখ তুলে দেখল সুইং ডোরের ওপর থেকে শ্রীমান সোহনের মাথাটা উঁচিয়ে আছে। আর সুইং ডোরের তলায় দুজোড়া পা। অর্থাৎ দুজন আছে। সোহন চাপা গলায় বলল, ‘প্লিজ, স্টে লাইক দ্যাট।’ বিদ্যুতের মতো ক্যামেরা তুলে ক্লিক করল, ফ্ল্যাশগান ঝলসে উঠল। ‘দ্যাটস লাইক আ গুড বয়,’ মন্তব্য করল সোহন। ‘এগজিকিউইটভ নীলাদ্রি রায়ের একটা ছবি নিলুম।’

সোহন ভেতরে এসে বসল। পেছনে অবধারিত ভাবে শুক্তি। নীলাদ্রি গম্ভীর। বলল, ‘কী মনে করে? হঠাৎ?’

সোহন বলল, ‘শুক্তির নতুন নামকরণ হয়েছে। সেটার অনারে একটা খানাপিনা নাচাগানা হবে, চিন্টু রায় না থাকলে জ্যাকসন মার্কা নাচটা করবে কে?’

—‘আমার এখন ওসব বাজে ব্যাপারে সময় দেবার মতো সময় নেই! তোমরা আসতে পারো।’

—‘যাচ্চলে, নামটা আগে শোন, হাতের কাছে পড়েছিল মাইরি, চোখে পড়েনি। সেই আছে না? আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলে, দেখতে আমি পাইনি তোমায় দেখতে আমি পাইনি। নামটা হল শুঁটকি। জাস্ট একটা চন্দরবিন্দু। আর একটু বর্ণ বিপর্যয়। দুর্দান্ত একটা কনোটেটিভ প্রপার নেম হয়ে গেল।

শুক্তি বলল, একটা দন্ত্যবর্ণ ছিল তো সেটা মূর্ধন্যবর্ণ হয়ে গেল। সেটাও বল।’

চিন্টু হঠাৎ সব কিছু ভুলে বলল, ‘তুই রাগিসনি যে বড়? আঁচড়ে কামড়ে ছিঁড়ে দেবার কথা তো তোর সোহন শালাকে।’

‘রেগে গিয়েছিলুম, বিশ্বাস কর, রেগে একেবারে যাকে বলে অগ্নিশর্মা, সোহনটা এত পাজি যে কোকের একটা ক্যান ধরিয়ে দিলে, ওর জাহাজি দাদা রেগুলার সাপ্লাই মানে নিয়মিত সরবরাহ করে জানিস তো? তো তারপর নামটার উইটটা আমাকে এমনভাবে আক্রমণ করল, আচ্ছন্ন করে ফেলল যে আমি হেসে ফেললুম, রাগটা একেবারে জলে গেল রে নীল।’

—‘তা বেশ করেছিস। এখন ফোট, কাজ আছে।’

—‘একটা ঠাণ্ডাও খাওয়াবি না?’ শুক্তি করুণ মুখ করে বলল।

এই সময়ে বেয়ারা তিন কাপ কফি নিয়ে প্রবেশ করল। একটা করে ছোট্ট কাঠের ম্যাট সামনে রেখে কফির কাপগুলো নিঃশব্দে নামিয়ে রাখল। সোহন বলল, ‘থ্যাংকিউ ভাই।’

—‘নে, খেয়ে নে’ নীলাদ্রি কফিটা মুখে তুলল।

—‘কোথায় যাবি রে এখন? নীচে সমরদা বলছিল।’

—‘ঘুসুড়িতে একটা বাড়ি হচ্ছে। সেখানে।’

—সল্ট লেক থেকে ঘুসুড়ি এসে থাকবি? মাইরি তোর ব্রেইন আছে।’ সোহন কফিতে চুমুক দিয়ে বলল।

—‘আজ্ঞে না। এটা মাল্টিস্টোরিড। ড্যাড করছিল। দেখাশোনা করতে হয় এবার।’

—‘আমি যাব।’ শুক্তি ঘোষণা করল।

—‘আমিও যাচ্ছি’, সোহন সঙ্গে সঙ্গে বলল।

‘ওটা নাচাগানার জায়গা নয়। ইটস ক্রুড রিয়্যালিটি। উই আর ইন ট্রাবল ওভার দ্যাট ব্লাস্টেড মাল্টিস্টোরিড।’

‘কঠিন বাস্তব আমি ভালবাসি।’ শুক্তি দ্বিতীয়বার ঘোষণা করল।

সোহন বলল ‘মনে হচ্ছে কয়েকটা ইন্টারেস্টিং ছবি তুলতে পারব। কর্পোরেশন প্ল্যান এবং নিয়মকানুনকে কলা দেখিয়ে ঘুসুড়িতে কোটিপতির বহুতল, ধসে পড়তে যাচ্ছে, রাজমিস্ত্রি কেয়ারটেকার তলায় শুত, একেবারে চেপ্টে গেছে, বেশ ভালই খাবে কাগজগুলো।’

—‘মাফ করতে হচ্ছে, তুমি বা তোমরা জাহান্নামে যেতে পারো, ঘুসুড়ি যাচ্ছ না।’

‘জাহান্নাম তো ঘুরে এসেছি’ সোহন অবাক চোখ করে বলল, ‘এক জায়গায় কি দুবার যেতে ভাল্লাগে রে চিন্টু?’

নীলাদ্রি উঠে দাঁড়িয়ে সুইং ডোর ঠেলে বেরিয়ে এল। সাধন বিশ্বাসকে বলল, ‘সাধনকাকা আমি বেরোচ্ছি, ঘুসুড়ির ফাইলটা দিন, আর আমার অফিসের দরজা বন্ধ করে দিন!’ সে হুড়হুড় করে নেমে গিয়ে গাড়িতে উঠে বসল—‘সমর স্টার্ট দাও, কুইক।’

সমরও গাড়ি ছাড়ল। পেছনে সোহনের মোটরবাইকও সগর্জনে চালু হল। সোহনের পেছনে শুক্তি ওরফে শুঁটকি।

সমর বলল, ‘দাদা আপনার বন্ধুরা তো গাড়িতেই যেতে পারতেন।’ চিন্টু কোনও জবাব দিল না। হতে পারে বস নিরুদ্দেশ। হতে পারে বস একটা ধনী, খ্যাতনামা ব্যবসায়ী। ব্যবসাতে ‘বাটার ওন্ট মেল্ট ইন হিজ মাউথ’ টাইপদের কোনও স্থান নেই, এটাও সে মানতে পারে। কিন্তু বস জেনেশুনে একটা ইললিগ্যাল বাড়ি করছে আর পাঁচটা কমন প্রোমোটরের মতো, এ সাজেশ্‌চন অসহ্য, অপমানকর! কী ভেবেছে সোহন! কবে একটা সিভিল এঞ্জিনিয়ারিং-এর ডিগ্রি নিয়েছিল খড়্গপুর থেকে, আর লন্ডন থেকে ফটোগ্রাফির কোর্স করে এসেছে বলে সবজান্তা হয়ে গেছে? ব্লাডি ফুল! হোয়াট ডাজ হি থিংক অফ হিমসেলফ?

বাড়িটার সামনে এসে সমর গাড়ি পার্ক করল। চিন্টু একবার চেয়ে দেখে নিল চেহারাটা তারপর কোনওদিকে না তাকিয়ে ভেতরে ঢুকে গেল। তার পেছন পেছন যেতে যেতে শুক্তি মন্তব্য করল, ‘কী সুন্দর দেখেছিস সোহন? জানলার ওপর ওইরকম তেকোনা টুপি আমার ভাল লাগে, আর ঝুল বারান্দা!’

নীচে ভাবী অ্যাসোসিয়েশনের ঘর। শিবশঙ্কর সন্ত্রস্ত হয়ে উঠে দাঁড়াল। চিন্টু টেবিলের সামনে গম্ভীরভাবে চেয়ার টেনে বসল। সোহন বলল, ‘হোয়াটস দা ট্রাবল ম্যান?’ তার কাঁধে একটা ঝোলা ব্যাগ। দু হাত কোমরে দিয়ে পা ফাঁক করে হিরো-হিরো স্টাইলে দাঁড়িয়েছে।

শিবশঙ্কর কাকে জবাব দেবে ভেবে পাচ্ছিল না। এরা কে? চিন্টুবাবু গুণ্ডা নিয়ে এসেছে? সঙ্গে আবার একটা বাচ্চা মেয়ে। সে সোহনকে ভয়ে ভয়ে বলল, ‘বাড়ির প্ল্যান ভাল নয়। বলছে কর্পোরেশন। বলছে সিমেন্ট বাজে কোয়ালিটির, লোহা মাপমতো নয়।’

—‘প্ল্যান তো স্যাংশন হয়েছিল, না কি?’

—‘অবশ্যই। তবে সে হল গিয়ে আগেরবারে। ইলেকশনের পর এ ওয়ার্ডে নতুন কাউন্সিলর।

—‘তাই বলে তো স্যাংশনড প্ল্যান বাতিল হয়ে যেতে পারে না? পারে?’ সোহন এক ধমক দিল।

—‘না, তা নয়। ওই বিল্ডিং মেটিরিয়ালস…’

—‘কনট্র্যাক্টর কে?’ সোহনের গলা কড়া থেকে কড়াতর।

—‘আজ্ঞে আমি।’

—‘আপনি গঙ্গা মাটি চালিয়েছেন? সাহস তো কম নয়?’

—‘না না। আমি যথাসাধ্য ভালই সব দিয়েছি। দিচ্ছি। তবু কর্পোরেশন বলছে…’

—‘চলুন, চলুন তো দেখি। চিন্টু আয়, শুক্তি আয়।’

সোহনের পেছন পেছন শিবশঙ্কর। তার পেছনে শুক্তি, সবার পেছনে চিন্টু উপরে উঠতে লাগল। দোতলা তেতলা ঘুরে ঘুরে দেখল।

শিবশঙ্কর বলল—‘সব হাজার তিরিশ স্কোয়ার ফুটের ফ্ল্যাট। কাটিং কী চমৎকার দেখুন। সব দুটো বড় বড় ঘর, ড্রয়িং, ডাইনিং, দুটো ডাবলু সি, কিচেনে সব ঢালাইয়ের তাক-টাক রেডি। মোজেইকটা দেখুন। সে জুতোর ডগা দিয়ে মেঝের আবর্জনা প্লাস্টারের গুঁড়ো কিছুটা খুঁচিয়ে পরিষ্কার করে দিল।

সোহন উবু হয়ে বসে ভাল করে পরীক্ষা করে বলল, ‘ক্লাস ওয়ান। চমৎকার। এই যে গ্রিনের এতগুলো শেডের পাথর দিয়েছেন এ কি আপনিই পছন্দ করলেন?’

—‘না, না, ওসব বিজুবাবু মানে সাহেবই করেছেন।’

সোহন তার বাহিনী নিয়ে তেতলায় উঠল। ডাঁই করা রয়েছে সিমেন্টের বস্তা, বালির স্তূপ, লোহা রয়েছে একদিকে কিছু। লোহাগুলো কিছু উঠিয়ে নিয়ে ভাল করে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখল সোহন, উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘ঠিকই আছে তো! সিমেন্ট দেখান তো?’

ওপর থেকে একটা বস্তা নামিয়ে দিল শিবশঙ্কর।

—‘কোম্পানির নাম তো খুব। ভেতরে কি দু নম্বরি করেছেন?’

—‘না, না, আজ্ঞে না!’

সোহন বলল, ‘একটা প্লাস্টিকের প্যাকেটে আমি সাম্পল নিয়ে যাব। শিগগির আনুন।’

‘শিবশঙ্কর দুড়দাড় করে নীচে নেমে গেল।’

—‘এইরকম মেনিমুখো দেখতে একটা লোককে আঙ্কল বিশ্বাস করেন কী করে? আশ্চর্য!’

সোহন বলল, ‘আই ডেফিনিটলি স্মেল রটন ফিশ।’

একটু পরে শিবশঙ্কর ওপরে উঠে আসছে দেখা গেল। পেছনে-পেছনে আর একটি লোক। সাদা ধবধবে মাখন জিনের প্যান্ট। কালো টি শার্ট একটা। ইয়া মাস্‌ল। বুকের ছাতি। গলায় একটা মোটা সোনার হার। ফর্সা রং এখন গাঢ় তামাটে হয়ে গেছে।

শিবশঙ্করের হাতে একটা প্ল্যাস্টিকের প্যাকেট। লোকটি বলল, ‘নমস্কার বাবুসাহেব, আপনি কে হচ্ছেন?’ সে সোহনের দিকে তাকিয়ে বলল।

—‘হু আর য়ু?’ সোহন প্যাকেটটাতে সাবধানে সিমেন্ট ভরতে ভরতে বলল।

—‘হামি ভানপ্রতাপ।’ লোকটি এমনভাবে বলল, যে বোঝাই গেল তার পদবি-টদবির মতো উদ্বৃত্ত জিনিস দরকার হয় না।

—‘এ সাইটে আপনি কেন?’ সোহন সোজা তাকিয়ে বলল।

—‘হামি ধরুন কেয়ারটেকার আছি।’

—‘ধরতে হবে কেন? সত্যি সত্যি কেয়ারটেকার নন?’

—‘ইয়ে বহোত খতরনাক এরিয়া আছে সমঝলেন? তো কেয়ারটেকার সমশের হমাকে রাতে থাকতে বলে।’

—‘বাঃ আপনি তো খুব পরোপকারী লোক ভানপ্ৰতাপজি!’ ভানপ্রতাপ একটা সিগারেট ধরাল, খুবই আত্মতৃপ্তভাব। প্যাকেট খুলে বাড়িয়ে ধরল। সোহন ছাড়া কেউ নিল না।

—‘কত পাচ্ছিলেন বি. বি. রায়ের কাছ থেকে?’

একটু ইতস্তত করে ভানপ্রতাপ বলল, ‘উ সব ছোটি ছোটি বাত আছে, কোনও কুছু ঠিক হয়নি এখনও সাব। তো আপনি কে হচ্ছেন? বললেন না তো?

—‘আমি সোহন সিং। কলেজ স্ট্রিটের জাভেদ আনসারিকে চেনেন?’

ভানপ্রতাপ চমকে উঠল।

—‘আচ্ছা আজ চলি।’ সোহন প্যাকেটটা নিয়ে সিঁড়িগুলো তরতর করে নেমে গেল। পেছনে পেছনে শুক্তি, চিন্টু।

নেমে এসে অ্যাসোসিয়েশনের ঘরে ঢুকে সোহন হঠাৎ কাগজপত্র দেখতে দেখতে নাটকীয়ভাবে ঘুরে গেল পেছনে দাঁড়ানো শিবশঙ্করের দিকে, ভানপ্রতাপ বাইরে দাঁড়িয়ে, হুঙ্কার দিয়ে বলল, ‘টেক কেয়ার শিবশঙ্করবাবু।’ কথাটা বাইরে ভানপ্রতাপের কানে গেল নিশ্চয়ই। সোহন বাইরে বেরিয়ে গম্ভীর গলায় বলল, ‘আমার ফোন নম্বরটা রাখুন ভানপ্ৰতাপজি’ হিপপকেট থেকে সে একটা নোটবই বার করল, তার ভেতর থেকে ছোট্ট একটুকরো কাগজ। তার ওপর খসখস করে ফোন নম্বর লিখল। তারপর গটগট করে বেরিয়ে মোটরবাইকে স্টার্ট দিল, চেঁচিয়ে বলল, ‘শুক্তি তুই চিন্টুর সঙ্গে যা। আমার কাজ আছে।’

শুক্তি বলল, ‘নীল লাঞ্চ টাইম তো হল, চল তোকে আজ খাওয়াই।’

চিন্টু বলল, ‘ভাল লাগছে না রে শুক্তি।’

—‘চল না ট্রিলিয়নস-এ যাব। দারুণ দারুণ মেয়ে আসে। কলকাতার যত সুন্দরী মেয়ে—সিন্ধি, পার্সি, পাঞ্জাবি, বাঙালি, দক্ষিণী—সব ওখানে ঢুঁ মারে। দারুণ রে জয়েন্টটা।’

চিন্টু বলল, ‘ট্রাই টু গ্রো আপ শুক্তি, হোয়াট ডাজ আ সুন্দরী মেয়ে মীন? অ্যাবাউট ফিফটি টু পাউন্ডস অব ফ্লেশ, সাম ফ্যাট, অ্যান্ড দা এক্সক্রিটরি সিস্টেম! জাস্ট অ্যান অ্যানিমল!’

হাসি চেপে শুক্তি বলল, ‘তুই যে প্রায় বিবেকানন্দর মতো কথা বলছিস রে চিন্টু।’

—‘মে বী, বিবেকানন্দ টূ ওয়জ ইন মাই পোজিশন। ড্যাড নিরুদ্দেশ। তেইশ দিন হল। কোনও খবর নেই। একটা ডিটেকটিভ এজেন্সিকে অ্যাপয়েন্টমেন্ট দিয়েছি বেশ কিছুদিন হয়ে গেল। নাথিং ডুয়িং। আমার অ্যাকাউন্টে সব টাকা শেষ। তিতির, মানে আমার বোনের অ্যাকাউন্টে আছে কিন্তু ও দিচ্ছে না, বলছে যখন তখন কাজে লাগতে পারে। ওর একথা বলার রাইট আছে। শী সেলডম ইউজেস আ কার। মোস্ট ইনএক্সপেনসিভ ক্লোদস পরে। মা-ও গাড়ি চড়ছে না। শর্মাজি আমার বাবার বন্ধু কাঁচা রসিদে টাকা ধার দেবেন বলেছেন, তাই দিয়ে ফ্যাকটরির, অফিসের যাবতীয় খরচ আপাতত মেটাতে হবে। কী সব অর্ডার ক্যানসেল হয়ে গেছে, টের পেয়েছে বি. বি. রয় নেই। কিন্তু নেই, একদম নেই এর কোনও প্রমাণ না দিতে পারলে আমাদের সবাইকার হাত-পা বাঁধা। লিগ্যালি কিছু করতে পারব না। কোনও লোকাস স্ট্যান্ডই নেই। আ গ্রিম ডার্ক নাইট ইজ ডিসেন্ডিং অন আস। আই ডোন্ট নিড উওমেন, শুক্তি, আই নিড ফ্রেন্ডস, রিয়্যাল ফ্রেন্ডস!’

—‘বাট ইউ হ্যাভ গট দেম? হ্যাভ্‌ন্‌ট য়ু?’ শুক্তি চিন্টুর হাত ধরে তার দিকে তাকাল, নরম গলায় বলল, ‘শিগগির একটা না একটা কিছু বার হবে। দ্যাখ না, অত ঘাবড়াচ্ছিস কেন?’

—‘একটা না একটা কিছু মানে তো ড্যাডের ডিকম্পোজড ডেড বডি, ফ্রম সাম ডোবা অর পুকুর, মাইলস অ্যাওয়ে ফ্রম হোম!’

শুক্তি শিউরে উঠে বলল, ‘না, না, পজিটিভ চিন্তা কর, নীল এভাবে ভাবিস না।’

—‘তা আর কী ভাবব বল? এইরকমই তো ঘটে! সবচেয়ে ট্র্যাজিক ব্যাপার আমরা—আমার মা, বোন আর আমি নিজে দিস ব্লাস্টেড ফুল অব আ ম্যান আমরা দিনের পর দিন জিনিসটাকে হালকাভাবে নিয়েছি। ড্যাড? ওহ তার কথা আমাদের চিন্তা করবার কিছু নেই। ড্যাড? ওহ দ্যাট মানি স্পিনিং ওল্ড ফুল? হি ক্যান শিওর টেক কেয়ার অব হিমসেলফ। লাস্ট ফোর ইয়ার্স আমি ড্যাডের সঙ্গে কতবার খেতে বসেছি, গুনে বলে দিতে পারি। অ্যান্ড আয়্যাম শিওর, আমারই জন্য কেউ, কোনও গুণ্ডাদল অনেক টাকা ক্লেইম করেছিল, সেটাই ড্যাড দিতে গিয়েছিল। যে ভোরে দু ব্যাগ ভর্তি টাকা নিয়ে ড্যাড বেরিয়ে গেল, কেউ ছিল না যে সামান্য একটা ইন্ডিকেশন, একটা ক্লু দিয়ে যাবে। খুঁজেছিল সবাইকে। পায়নি। মা, তিতি আমি, আমরা সব যে যার মতো ফুর্তি করছিলুম। ডু য়ু নো হোয়্যার আই ওয়জ? অ্যাট জুনিপার্স, ড্রাঙ্ক, উইথ আ গার্ল অন ইচ সাইড, ডান্সিং অ্যান্ড হ্যাভিং ফান।’

—‘দাদাবাবু!’ হঠাৎ সমর হাউমাউ করে গাড়িটা ঘ্যাঁচ করে রাস্তার পাশে থামিয়ে দিল। তখন চিন্টু সমরের অস্তিত্ব সম্পর্কে সচেতন হল। সে অনেক কথা বলে ফেলেছে অসাবধানে। যদিও বেশির ভাগ ইংরেজি। তবু কিছুটা সমর ধরতে পেরেছে। সে হাউমাউ করে কাঁদছে—‘দাদাবাবু, সাহেব আমাকে আঠারো বছর বয়স থেকে নিজের হাতে শিখিয়ে পড়িয়ে মানুষ করেছেন, দিদিমণি, আমার সাহেবের মতো মানুষ হয় না, তাঁর জন্যে আজ আমার দেশে বাড়ি, ছেলে ডাক্তারি পড়ছে বর্ধমানে। আমার মেয়েটার অ্যাপেন্ডিসাইটিস ফেটে গেছিল, সাহেব না থাকলে…’ স্টিয়ারিং-এর ওপর মাথা রেখে সমর এমন করে কাঁদতে লাগল যে মনে হল তাকে আর কোনওদিন সান্ত্বনা দেওয়া যাবে না।

শুক্তি বলল, ‘সমরদা, সমরদা, তুমি এত ভেঙে পড়ছ কেন। চিন্টুদাদা ভয় পেয়ে ওসব বলেছে। আমরা সবাই সবরকম চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। কাকুকে ঠিক পাওয়া যাবে।’

চিন্টু বলল, ‘সমরদা আমরা সব এক নৌকায়। আমাদের কী হবে আমরা জানি না। সত্যিই জানি না।’

—‘হ্যাভ কারেজ, হাভ সাম কারেজ নীল’ শুক্তি এবার মৃদু ধমক দিল। চিন্টু বলল ‘আমার বোনটা সাইটস এন সাউন্ডস-এ বসছে। কলেজ করতে পারছে না। গড নোজ আর হয়ত কোনওদিন করতেও পারবে না। অত দূরে দোকানটা, প্রায় গড়িয়ার কাছে, গাড়ি নেয় না। বাসে যাতায়াত করে, বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায় সাড়ে আটটার সময়ে, লাঞ্চ প্যাক নিয়ে যায়। ফিরতে ফিরতে নটা।’

শুক্তি বলল, ‘এক কাজ করা যায় না, আমরা ওখান থেকে তিতিকে তুলে নেব, তারপর খাব।’

—‘শী ওন্ট কাম শুক্তি, শী ইজ টু রেসপনসিবল টু ডু দ্যাট। তা ছাড়া এই অ্যামবাসাডর নিয়ে এখন গড়িয়া যাওয়া মানে, অনেকটা পেট্রল খরচ। আমাদের বুঝে চলা উচিত। সামনে কী আছে জানি না তো! বরং চলো, আমাদের অফিসেই ছোট্ট ক্যানটিন আছে মোটামুটি করে দিতে পারবে কিছু। যাবে?’

শুক্তি বলল, ‘তা-ই-ই চল।’

নির্ধারিত দিন কেটে গেল, কর্পোরেশন থেকে ঘুসুড়ির বাড়ি ডিমলিশ করতে কিন্তু এল না। বরং তার কদিন পরেই কর্পোরেশন থেকে নো অবজেকশন্‌স্‌ সার্টিফিকেট গোছের কিছু একটা বার করে নিয়ে এল সোহন। সে নিজে পাশ করা সিভল এঞ্জিনিয়ার, যদিও কোনও চাকরিতে ঢোকেনি, তার কাকা দুঁদে উকিল। তা ছাড়া দেখা গেল ভানপ্রতাপ তাকে সাংঘাতিক খাতির করতে আরম্ভ করে দিয়েছে। কাগজপত্রে রয়েছে এ বাড়ির প্রোমোটর বি. বি. রায় এবং তনুশ্রী রায় যুক্তভাবে। তিনতলার থেকে আরম্ভ করে যারা ফ্ল্যাট বুক করেছিল তারা সবাই এবার তাদের দেয় টাকা দিতে থাকল। খালি শিবশঙ্কর আর কেয়ারটেকার সমশের বরখাস্ত হয়ে গেল। নীলাদ্রি, সোহনের পরিচিত একজন কনট্রাকটরকে নিয়োগ করল। সমশেরের বদলে রইল ভানপ্রতাপ স্বয়ং। ঘুসুড়ির বাড়ির কাজ দ্রুত এগিয়ে চলল। নীলাদ্রি একদিন সোহনকে জিজ্ঞেস করল, ‘কী করে কী করলি রে?’

সোহন ভীষণ ব্যস্ত। ‘উলটপুরাণ’ নাম দিয়ে সে ঘুসুড়ির বাড়ি নিয়ে সত্যিই একটা ফিচার লিখেছে। সঙ্গে যথেষ্ট ফটো। তার প্রতিপাদ্য সারা হাওড়ায় যেদিকে তাকাও বেআইনি বহুতল উঠছে। পনেরো কুড়ি ফুট চওড়া রাস্তায় ছ তলা সাত তলা বাড়ি আখচার। বহু বাড়ি আইনমাফিক জায়গা ছাড়েনি। স্যাংশনড প্ল্যানের বাইরে কাজ করেছে, জলের বন্দোবস্ত করেনি, লিফটের বন্দোবস্ত করেনি। কিন্তু কর্পোরেশন নীরব। অথচ ঘুসুড়িতে একটা বাড়ি একেবারে কাঁটায় কাঁটায় নিয়ম মেনে চলেও কর্পোরেশনের আক্রোশে পড়ে গেছে। কেন? কেন? কেন? ফিচার রাইটারের প্রশ্ন। পাশ করা সিভল এঞ্জিনিয়ার বিল্ডিং মেটিরিয়াল দেখে এসেছেন, একেবারে ঠিকঠাক, কিন্তু কর্পোরেশনের ইন্সপেক্টর যে-ই দেখতে যাচ্ছে সে ভেজাল সিমেন্ট, বাজে লোহা দেখতে পাচ্ছে। কী করে? কী করে? কী করে? ফিচার রাইটারের প্রশ্ন। বেশ শোরগোল তুলে দিয়েছে খবরটা।

—‘এসব কী করেছিস?’ নীলাদ্রি অবাক হয়ে প্রশ্ন করে।

—‘আরে, অ্যাদ্দিনে একটা সাবজেক্ট জুটিয়ে দেবার জন্যে তোকে ধন্যবাদ’ সোহন বলল, অনেকদিনের সাধ জার্নালিস্ট হব।’

—‘কী ব্যাপারটা পুরো বলবি তো?’

—‘কী আর ব্যাপার? লোকাল মাল কিছু থাকে এসব জায়গায়, জানিস না? আঙ্কল সে সব না বুঝে বা না গেরাহ্যি করে বাড়ি তুলে দিচ্ছেন, সবাই মিলে বখেড়া বাধিয়ে দিয়েছে। কেয়ারটেকারটা আর শিবশঙ্কর ওদের ভয়ে যোগসাজস করে এইসব কারবার করছিল। বিল্ডিং মেটিরিয়াল দিনের পর দিন বদলে রাখছে। ভানপ্রতাপকে বাদ দিয়ে ওখানে কেউ কিছু করতে পারে না। ওকে মোটা টাকা দিতে হবে।’

—‘মানে? কিছু করবে না, শুধু শুধু টাকা?’

—‘হ্যা রে চিন্টু। না দিলেই এমনি ফাঁদে ফেলে দেবে।

—‘তো শিবশঙ্করের লাভ? ও তো ফেঁসে গেল।’

—‘গেল। ব্যাপারটা প্রথমেই ওর জানানো উচিত ছিল আঙ্কলকে। কীভাবে আরও মোটা লাভ করা যায় তারই অঙ্ক কষছিল বোধ হয়। খাচ্ছিল তাঁতি তাঁত বুনে কাল হল তাঁতির এঁড়ে গরু কিনে।’

—‘তা ভানপ্রতাপ তো টাকা পেল না! তুই দিলি নাকি?’

—‘ভানপ্রতাপ একা নয়। আরও আছে ভেতরে। অন্ততপক্ষে লাখ তিনেক টাকার ধাক্কা! আমি কোথায় পাব?’

—‘তবে?’

—‘আমি এই ফিচারটা লিখলুম আর আমার ফ্রেন্ড জাভেদ আনসারিকে জানিয়ে দিলুম। ভানপ্রতাপ যদি বাবা হয়, তা হলে জাভেদ হল গিয়ে ওরে বাবা। বুঝলি কিছু?’

—‘এইসব সাঙ্ঘাতিক গুণ্ডাদের সঙ্গে তুই মিশিস?’

—‘আমি তো আর বাপের লালটুস পুত্তুর নই।’ নীলাদ্রির থুতনিটা নেড়ে দিয়ে সোহন বলে, ‘বাপ-মরা, মা-মরা। সিংগিবাড়ির ওই ব্যাচেলর কাকা না থাকলে কবে মায়ের ভোগে চলে যেতুম, দুনিয়ার প্রতিটি ইঞ্চি জমি লড়ে জিততে হয়েছে। ঘাবড়াস না। যা বাড়ি যা।’

রাতে খেতে বসে তিতি বলল—‘মা, তোমার অ্যাসোসিয়েশনের কাজ নেই? বেরোচ্ছ না তো।’

তনুশ্রী খাবার নাড়াচাড়া করছিলেন। বললেন, ‘কী হবে?’

—‘মানে? মা, আমাদের যথাসাধ্য স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে হবে। তুমি এরকম ব্রুড করলে আমরা জোর পাব কোত্থেকে?’

চিন্টু বলল—‘কাল অফিস বেরোবার সময়ে আমি তোমাকে নামিয়ে দিয়ে যাব। ফেরাটা…আমার তো একটু দেরি হবে, তুমি একা পারবে না? না হয় বসাক আঙ্কলকে বলে দেব…।’

—‘না না’ তনুশ্রী তাড়াতাড়ি বলে উঠলেন। তারপর প্রায় কিছু না খেয়েই উঠে গেলেন।

চিন্টু তিতির দিকে তাকাল। তিতি বলল—‘তুইও আবার খাবার-টাবার ছেড়ে উঠে যাস না। আমি তো বারেবারেই বলছি মা ভীষণ দুর্বল প্রকৃতির। আমাদেরই শক্ত হতে হবে। তা ছাড়া তুই সেদিন যা করলি…’

—‘আমি কী করলুম!’

—‘সেই ওয়ার্ডরোবের ভেতরে…বাবাকে খোঁজা।…ছিঃ।’

চিন্টু বলল—‘আমার মাথার ঠিক ছিল না। মা কিছুতেই পুলিশে খবর দিতে দিচ্ছিল না, স্ট্রেঞ্জ বিহেভ করছিল…’

—‘তাই বলে ওইরকম ভাববি? থ্রিলার পড়ে পড়ে তোর মাথা খারাপ হয়ে গেছে।’

—‘হতে পারে,’ চিন্টু মেনে নিল। তারপর বলল—অপরাধী গলায় বলল—‘মা কি ওই জন্যে খাচ্ছে না!’

—‘আমি জানি না। হতে পারে!’ তিতি বলল।

—‘মাফ চাইব?’

—‘দাদা, প্লিজ যথেষ্ট বোকামি করেছিস। আর করিস না!’

তনুশ্রী হাত মুখ ধুয়ে শুয়ে পড়লেন। যদিও জানেন ঘুম আসবে না সহজে। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে ওষুধ খেতে হবে। তারপরেও দুঃস্বপ্ন দেখতে হতে পারে। তাঁর সমস্যা সম্পূর্ণ আলাদা। অতি জটিল। ছেলে-মেয়ের সঙ্গে তা আলোচনাও করা যাবে না। তিতি ঠিকই বলেছে। সমস্ত ব্যাপারটাকে একটা স্বাভাবিক চেহারা দেবার জন্য তিনি অ্যাসোসিয়েশনে যেতে চেয়েছিলেন। শর্মাজিই তাঁকে ফোনে জানিয়ে দেন তিনি যখনই বেরোতে চাইবেন শর্মাজি গাড়ি পাঠিয়ে দেবেন। তনুশ্রী তাঁকে ধন্যবাদ দিয়ে জানান, তাঁর তো নিজের গাড়ি রয়েছেই। ইচ্ছে হলে তিনি বেরোবেন। গাড়ি পাঠাবার দরকার নেই। পরদিন চিন্টু তিতি বেরিয়ে যাবার পরই শর্মাজি এলেন, চা খেলেন, বললেন—‘মিসেস রয়, এখন কিছুদিন তেল কম খরচ করুন, আমি যাচ্ছি ওদিকে—চলুন পৌঁছে দিচ্ছি। বাড়ি বসে ব্রুড করবেন না।’ তনুশ্রী তৈরি হয়ে বেরিয়ে এলেন। শর্মাজি নিজেই ড্রাইভ করছেন। নিজের পাশের দরজাটা সসম্মানে খুলে ধরলেন। তনুশ্রী উঠে বসলেন। ডায়মন্ডহারবার রোডে পড়বার পর থেকেই রাস্তা মোটামুটি নির্জন। তবু শর্মাজির গাড়ি মাতালের মতো আচরণ করছিল, এক-এক ধাক্কায় হেঁচকি তোলে আর তনুশ্রী অতর্কিতে শর্মাজির গায়ের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়েন এবং সলজ্জভাবে দুঃখপ্রকাশ করেন। শর্মাজি তাঁর পাকা চুলের মধ্যে হাত চালিয়ে বলেন—‘প্লেজার, প্লেজার।’ এই ধরনের রসিকতা শর্মাজির পক্ষে একটু বিসদৃশ। রাজেশ পাইন কিংবা বসাক করলে মানিয়ে যেত।

তাঁকে নামিয়ে দিয়ে শর্মাজি বললেন— পাঁচটার সময়ে আবার তুলে নিতে আসবেন। তনুশ্রী তিনটে বাজতেই বসাককে ফোন করলেন।

—‘একটু গাড়িটা নিয়ে আসতে পারবে। আমারটা হঠাৎ খারাপ হয়েছে। আমার শফার আলি ফোন করেছিল।’

—‘ওহ শিওর।’

মিনিট পনেরোর মধ্যে বসাক গাড়ি নিয়ে উপস্থিত। রেসকোর্সের পাশ দিয়ে আসতে আসতে বসাক হঠাৎ ভিক্টোরিয়ার দিকে গাড়ি ঘোরাল। পার্ক করে বলল— ‘তোমাকে কয়েকটা কথা বলা দরকার ভাবী। য়ু চুজ ইদার মি অর রাজেশ।’

তনুশ্রী বললেন—‘কী বলছ আজেবাজে? প্রথম বললে বলে লাইটলি নিচ্ছি। আর কখনও বললে অপমান মনে করব কিন্তু!’

বসাক অনেকক্ষণ তীব্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল তনুশ্রীর দিকে। আস্তে আস্তে বলল—‘সজনেখালির ব্যাপারটা আমি জানি। রাজেশ নিজেই আমাকে বলেছে। উই আর ফ্রেন্ডস। সোজা আঙুলে যদি ঘি না ওঠে তো বিজুদা তো রইলই। টুরে গেছে না কি শুনছিলাম—আসলে বলা যাবে তাকেই।’

তনুশ্রীর ওপর দিয়ে কদিনই ঝড় বইছে। এই কথার পর তিনি ভয়ে প্রায় অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলেন। অজ্ঞানের মতোই হয়ে আছেন।

আজ ছেলে সেই বসাক আঙ্কলকে মায়ের এসকর্ট করতে চাইছে, যেচে।

তনুশ্রী জানেন না, তিনি কী করবেন। এমনকি, এখন বিজু রায় ফিরে আসা ভাল না খারাপ তা-ও তিনি বুঝতে পারছেন না। বিজু রায় না এলেও সামাজিকভাবে তিনি নিশ্চিহ্ন। আর এলে? এলেও বোধহয় তাই। শুধু তাই নয়। কী লজ্জা! কী অপমান! এখন কী হবে? তনুশ্রী জানেন মিসেস শর্মা, রাজেশের স্ত্রী, প্রীতা সোম, রবিনা, এরা যা-খুশি করে। কেতাদুরস্তভাবে যা খুশি। মিসেস শর্মা ছিলেন শর্মাজির সেক্রেটারি, অন্তত চার-পাঁচ বছর দুজনে খোলাখুলি বাস করবার পর বিয়ে করেছেন। আর তিনি একবার, মাত্র একবার গণ্ডির বাইরে পা বাড়িয়েছেন বলে সঙ্গে সঙ্গে তাঁর মৃত্যুদণ্ড হয়ে গেল? এ কী রকম বিচার? কার বিচার? তনুশ্রী মাথার ওপর সিলিং ফ্যানটার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকতে থাকতে শিউরে ওঠেন, শেষ পর্যন্ত ওই-ই কি তাঁর নিয়তি? না না বরং স্লিপিং পিল। জোগাড় করতে হবে—এ দোকান ও দোকান থেকে। একটু একটু করে জমাতে হবে। আর বোধহয় কোনও উপায়, কোনও পথই নেই।

ছেলে-মেয়ে দেখছে মা খায় না, সাজগোজ করে না, কেমন অবিন্যস্ত হয়ে যাচ্ছে। রোগা, জৌলুসহীন হয়ে যাচ্ছে। তারা স্বভাবতই ভাবে—বাবা, বাবার অন্তর্ধানই এর জন্য দায়ী। খুবই স্বাভাবিক। তবে তিতি চিন্টু মনে মনে খুব গোপনে ভাবত—যে বাবার প্রতি তাদের মায়ের আন্তরিক টান জিনিসটা একটু কম। তিতি ভাবত—শুধু বাবা কেন? মা একটু অগভীর ধাতের, ছেলে-মেয়ের প্রতিও তেমন টান নেই। কেমন যেন! এখন মায়ের চেহারা, মায়ের আচরণের দিকে চেয়ে তিতি নিজেকে ধিক্কার দেয়। এগুলো সে খোলাখুলিই আলোচনা করে অর্জুনের সঙ্গে।

অর্জুন, অর্জুন এসেছে সাইটস এন সাউন্ডস-এ। তিতি ক্যাশ কাউন্টারে। চুপচাপ ক্যাশ কাউন্টারে বসে থাকা আর মাঝে মাঝে ক্যাশমেমো দেখে টাকা নেওয়া, ভাঙানি দেওয়া—এই একঘেয়ে কাজের মধ্যে অর্জুন এলে তার দিনটা ঝলমল করে ওঠে। এই দোকানটাই এখন তিতিদের বড় ভরসা।

অর্জুন খুব সমালোচনার দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে তার দিকে, তারপর বলে—‘তুই না খেয়ে থাকলে তো মেসো তাড়াতাড়ি ফিরে আসবেন না! আসবেন!’

—‘আমি যথেষ্ট খাই, আসলে আমার চেহারাই এমনি। তুই সেদিন ঠাম্মার ঘরে কী কাগজপত্র পেলি, দেখালিও না, কিছুই না।’

—‘নাথিং ইমপর্ট্যান্ট, বাট ইনটরেস্টিং।’

—‘বাবাকে খোঁজার কাজে লাগবে?’

—‘লাগতেও পারে, আবার না-ও পারে।’

—‘তবে তুই আমাদের ফ্যামিলি-পেপার্স নিয়ে কী করছিস, দিয়ে দে।’

—‘এক্ষুনি দিয়ে দিতুম, কাছে থাকলে।’ আহত গলায় অর্জুন বলে, ‘পরের দিন দিয়ে দেব।’

তিতি গম্ভীরমুখে বলে—‘আমি তাই বলেছি?’

—‘বললি তো?’

—‘তুই খুব ভাল করেই জানিস কোনটা আসল বলা আর কোনটা নকল। তাড়াতাড়ি কিছু কর অর্জুন। মায়ের অবস্থা আর চোখে দেখা যাচ্ছে না। আর যদি বুঝিস ওই ডকুমেন্টটা পেলে ওই “রক্সি”দের কোনও সুবিধে হবে, তো ওদের দিয়ে দে। ওরা আফটার অল প্রোফেশন্যাল!’

অর্জুন হঠাৎ বলল—‘কিছু মনে করিস না তিতি, একটা কথা জিজ্ঞেস করছি। মেসো-র কোনও বাল্য-প্রেম ছিল?’

—‘মনে করব কেন?’ তিতি বলল, ‘থাকতেই পারে, সেভেনটি পার্সেন্টের থাকে। আবার বাবাদের যুগের লোকেরা যা রোম্যান্টিক ছিল! ছাদে-ছাদে, জানলায়-জানলায় প্রেম হত। তবে আমি জানি না, দুঃখের বিষয়। বাবার সঙ্গে আমার এমন রিলেশন ছিল না যে বাবা আমাকে ডেকে ডেকে বলবে—“তিতি তিতি শোন, আমার না একটা বাল্য-প্রেম ছিল।”

অর্জুন হেসে ফেলল, তারপরেই চিন্তিত মুখে বলল—‘না, এমন কেউ যাকে ঠাম্মাও খুব চিনতেন, ভালবাসতেনও অথচ বোধহয় মেনে নিতে পারতেন না।’

তিতি বলল—‘বলছি তো থাকতেই পারে এসব ঘটনা, তবে আমি জানি না। তুই কি বলছিস এতদিন পরে হঠাৎ সেই শৈবলিনীর খোঁজে বাবা বিবাগী হয়ে গেল? মোস্ট আনলাইকলি। হী ইজ দা মোস্ট লেভ্‌ল-হেডেড পার্সন আই হ্যাভ সীন। ভেরি প্র্যাকটিক্যাল!’

অর্জুন বলল—‘কিছু মনে করিস না তিতি, মাসির সম্পর্কেই বা তোর কী ধারণা ছিল? ধারণাটা তো বদলাতে বাধ্য হয়েছিস? তোদের ফ্যামিলিতে পরস্পরের মধ্যে বিরাট বিরাট কমিউনিকেশন গ্যাপ, তোরা কেউ কাউকে কোনও দিন বুঝিসনি।’

তিতি জানে কথাটা সত্যি, তবু ঝেঁঝে উঠে বলে—‘তুই একাই সব বুঝিস, না?’ অর্জুন থেমে থেমে বলে—‘বুঝি না। তোদের কথা আমার বোঝার ব্যাপার না। কিন্তু চেষ্টা করছি।’

ওই ডকুমেন্ট বা চিঠিটা অর্জুনের মুখস্থ হয়ে গেছে। সে তিতির কাজ শেষ হওয়ার অপেক্ষা করে বসে বসে, আর মনে মনে চিঠিটা ভাঁজে। তিতিকে জানতে দেয় না।

‘মাগো,

আমি কে বলো তো? এতদিনে বোধহয় ভুলেই গেছ মা বলে ডাকবার তোমার আরও কেউ ছিল? বিজু, বিজুও নিশ্চয় ভুলে গেছে। নিজের সংসার অত সম্পদ পেয়ে বিজু কি আমাকে ভুলে গেল? মা, তুমি যতই মনকে চোখ ঠারো, নিশ্চয়ই জানো বিজু আর আমি পরস্পরের আধখানা। আমি সবার অবহেলা, সবার বিরহ সইতে পারি। শুধু বিজুরটা পারি না। আমি নিশ্চিত জানি একদিন না একদিন বিজুর সঙ্গে আমার মিলন হবেই। তুমি যদি দয়া করে এ চিঠির উত্তর দিতে চাও, শ্যামবাজার পোস্ট অফিসে দিয়ো। আমি সংগ্রহ করে নেব। আমার প্রাণভরা ভালোবাসা নিয়ো। সমস্ত হৃদয় নিয়ে মাথা নত করছি তোমার পায়ের কাছে। নেবে না?—ইতি।

চিঠিটার ওপরে ঊননব্বই সালের মার্চ মাসের ঠিকানা। চিঠিটা মেঝেয় ঠাম্মার পালঙ্কের ভারী পায়ার কাছ ঘেঁসে পড়েছিল। অর্জুনের ধারণা, মেসো ঠাম্মার আলমারি আর সিন্দুক ঘেঁটেছিলেন খুব। যা নিয়ে গিয়েছিলেন তা একরাশি কাগজপত্র। সম্ভবত চিঠি। কারণ আলমারির মধ্যে গরম জামা, শাল ইত্যাদির ভেতর থেকে এক থলি হাজারখানেকের মতো চকচকে রুপোর টাকা এবং আরও শ’পাঁচেকের মতো নোট পাওয়া গেছে। তিতির যুক্তি হচ্ছে, সিন্দুকে গয়না থাকতে পারে। আরও অনেক টাকা থাকতে পারে, সে টাকার কাছে এই সামান্য দেড় হাজার কিছুই না। কিন্তু অর্জুন মাসির কথাকে গুরুত্ব দিয়েছে। মাসি নাকি বলেছে—ও সিন্দুকে কিছু মূল্যবান থাকত না। মাসি মূল্যবান বলতে যা বোঝায়, অর্থাৎ টাকাপয়সা, গয়নাগাঁটি তা অর্থাৎ ছিল না। তবু সিন্দুকটা বন্ধ ছিল। এবং ভেতরটা নিশ্চয় ফাঁকা ছিল না। অর্জুন ওর ভেতরে খুব পুরনো ইনল্যান্ডের টুকরো পেয়েছে, একটা সরু ফিতে পেয়েছে হলুদ রঙের। তার অনুমান ঠাম্মার কাছে যা মূল্যবান, অর্থাৎ আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধবদের চিঠিপত্র, তাই-ই ছিল সিন্দুকটায়। এবং মেসো সেগুলোই নিয়ে বেরিয়ে গেছেন। তিতি হেসে উড়িয়ে দিলেও তার মনে হয়েছে—মেসো ওই চিঠির মেয়েটিকে, মানে ভদ্রমহিলাকে খুঁজতে গেছেন—যিনি ওইভাবে আত্মপ্রত্যয়ের সঙ্গে ঘোষণা করেছেন বিজুর সঙ্গে নাকি একদিন তাঁর মিলন হবেই। তিনি আর বিজু নাকি পরস্পরের আধখানা।

অর্জুন সন্তর্পণে এটা পকেটস্থ করেছিল। তিতিকে দেখায়নি। বলেছিল—‘ঠাম্মাকে তো অনেকেই চিঠি লিখত, তেমনি একটা সাধারণ চিঠি। তবু নিয়ে যাচ্ছি যদি অনুমতি দিস।’ —আসলে ব্যাপারটা সে তনুমাসির কাছেই গোপন করতে চায়। তনুমাসির ধারণা হয়েছে এর ভেতর নারীঘটিত কিছু আছে। সে সংশয় তিনি তিতির কাছে প্রকাশ করেছেন। যেটা বোঝেননি সেটা হল—এ বর্তমানের কোনও ব্যাপারই নয়। এ সুদূর অতীতের ইতিহাসের কোনও আনারকলি। যে তার কবর ঠেলে উঠে পড়েছে। যার সঙ্গে মেসোর সম্পর্ক এত নিবিড় যে, মেসো তার ডাক কিছুতেই উপেক্ষা করতে পারেন না। তবে সোজাসুজি মেসোর কাছেই বা উনি লেখেননি কেন, সেটাও একটা প্রশ্ন। একটা সমস্যা। এগুলো নিয়ে অর্জুন ভাবছে। শ্যামবাজার পোস্ট অফিসে খোঁজ করেছিল সে। ঊননব্বুই সালে কেন আরও অনেক সময়ে অনেকেই পোস্ট অফিস থেকে চিঠি নিয়ে যেতেন। যান। সে সব নাম তাঁরা অর্বাচীন এক ছোকরার কাছে প্রকাশ করবেন না। পুলিশ বা গোয়েন্দা হলেও বা কথা ছিল!

১১
বিজনের মনে হল তিনি চোখে অন্ধকার দেখছেন। এ কী নীরন্ধ্র আঁধার যার ওপারে ছুটকি দাঁড়িয়ে আছে! তাঁর প্রার্থনা তাঁর ভালবাসা ওকে ছুঁতে পারছে না। দুর্ভেদ্য বর্মের মতো এই অন্ধকারজালিকা। প্রমীলা। তাঁর চোখে ঝলক দিয়ে যাচ্ছে তাঁর সল্ট লেকের বাড়ির সেই মহিলা। রাঁধুনি! তাকে তো তাঁরা ঠিক মানুষ বলে মনে করতে অভ্যস্ত নন। মানুষ যদি বা হয়, নিচু, খুব নিচু শ্রেণীর মানুষ। তার শ্রেণীতে আর বিজু রায়ের শ্রেণীতে যে সমুদ্র পরিমাণ ফারাক তা পোষা জন্তু-জানোয়ারের সঙ্গেও বোধহয় মানুষের থাকে না। তিনিই যদি চোখে এমন অন্ধকার দেখেন, তা হলে ছুটকি, ছুটকি কী দেখছে? তিনি প্রাণপণে গলা থেকে বাষ্প পরিষ্কার করে বললেন—‘ছুটকি, শুনেছিলুম জামাইবাবু নাকি কোটিপতি লোক। তোর জন্যে কোনও সংস্থান করে যেতে পারেননি? শেষ পর্যন্ত ছুটকি তোকে…জামাইবাবু এ কী করলেন? ছি ছি ছি।’

ছুটকি বলল—‘বিজু, তোর জামাইবাবু বলেও কেউ কোনও দিন ছিল না রে! সেই তিপ্পান্ন সালের এপ্রিল মাস থেকেই আমি একা। বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসার পরে আমাদের সম্পর্কের আয়ু পুরো এক মাসও ছিল না।’

—‘তুই বলছিস কী?’ বিজুর মনে হচ্ছে তাকে কে গুলি করেছে। ঠিক বুকের মাঝখানে।

—‘ঠিকই বলছি রে, সেই রাত্রে আমি গলির মোড়ে এসে তার পেল্লাই স্টুডিবেকারে উঠলাম। আমাকে নিয়ে গেল পুরনো কলকাতার এক গলিতে। একতলায়। মোটামুটি সাজানো বাড়ি। কপালে সিঁদুর দিয়ে দিল। আমি বললুম, কেউ সাক্ষী রইল না যে! সে বলল—“আমাদের অন্তরাত্মা সাক্ষী। তোমার জন্যে বালিগঞ্জ প্লেসে নতুন বাড়ি হচ্ছে। সতীনের সঙ্গে তো আর থাকতে পারবে না! আমিও সেখানেই থাকব। তুমিই আমার আসল, আর সব তুচ্ছ, বাজে। তবে ব্যবসাপত্রের ব্যাপার, বোঝোই তো! মাঝে মাঝে যেতেই হবে। দু-চার দিনের মধ্যেই আনুষ্ঠানিক বিয়ের ব্যবস্থা করছি। যত তাড়াতাড়ি পারি। কিছু বন্ধুবান্ধবও আসবে! তা দিনের পর দিন কাটতে লাগল। বিজু, তার প্রেম উথলে উথলে উঠছে, সে আমাকে দু চক্ষে হারায়, তার আগেকার বিয়েটা নাকি বিয়েই নয়, কোনও দিন সে সুখী হতে পারেনি। কিন্তু সেই প্রত্যাশিত বিয়ের দিন আর এল না। তারপর একদিন ভোরবেলায় উঠে দেখলুম—চলে গেছে। প্রথমে ভেবেছিলুম যেমন কাজে যায় গেছে। তারপরে কেমন গা ছমছম করল, দেখলুম তার শৌখিন জামাকাপড়ে ভরা সুটকেস, দু-তিন জোড়া জুতো, এসেন্স, শেভিং-এর জিনিসপত্র—সব নিঃশেষে নিয়ে গেছে। মায় অ্যাশট্রেটা পর্যন্ত। কোনও পুরুষ কোনও দিন ছিল ঘরগুলোতে তার কোনও প্রমাণ নেই। খালি আমার বিদ্ধ শরীরে ছাড়া।” ছুটকি মুখ নিচু করে আঁচল দিয়ে মুখের নীচের দিকটা চেপে ধরল।

বিজু বললেন—‘ছুটকি তুই একটা অসাধারণ বুদ্ধিমতী মেয়ে, আমি ফেল করা ছেলে হতে পারি কিন্তু তুই যে ফিলসফিতে অনার্স নিয়ে বি. এ পাশ করেছিলি! তুই এমন কাঁচা কাজ করলি কী করে? কী করে?’ তাঁর ভেতর থেকে ক্রোধের আক্ষেপের অগ্নিশিখা লক লক করে বেরিয়ে আসছে। যদি পান, যদি সে লোকটাকে একবার পান।

ছুটকি শোনা যায় না এমন স্বরে বলল—‘তুই তাকে সে সময়ে দেখিসনি বিজু, তার কথাও শুনিসনি। আমি নিজেকে সামলাতে পারিনি। আমার বুদ্ধি-বিদ্যা কোনও কাজে লাগেনি। আমার বুদ্ধি নাশ হয়েছিল।’

‘তো। তারপর?’

‘যেদিন সকালে ওভাবে চোরের মতো চম্পট দিল, পাগলের মতো বাঁধাঘাটে ছুটে গেলুম, মাথায় একগলা ঘোমটা টেনে। লিখে এসেছিলুম এক মাস আমার একটা প্রিয় ডুরেশাড়ি ছিল সেটা ছাদে মেলে রাখতে, যদি মা-বাবা আমাকে ক্ষমা করে। বিজু ছুটে গিয়ে দেখলুম তোরা সবাই আছিস মা-বাবার ভুবন ভরে, খালি আমি নেই। ছাদ ভর্তি করে শুকোচ্ছে জামা-পায়জামা, ধুতি, শাড়ি চাদর, খালি আমার সেই হলুদ ডুরে শাড়িটা যেটা উঁচু তারে টাঙানো থাকার কথা সেটা নেই। মা নেই, বাবা নেই, তুই নেই বিজু, আমি নেই।’ বলতে বলতে ছুটকি অসহ্য যন্ত্রণায় ছটফট করতে লাগল। এবং বিজু এক চমকে সেই দৃশ্যটা পুরো দেখতে পেলেন। উঠোনের চারপাশে তাঁরা। বাবা দাঁড়িয়ে। মাঝখানে মা। দাঁত দিয়ে ছুটকির হলুদ-কালো খড়কে ডুরে, ছুটকির জীবন, প্রাণ, মন কুটিকুটি করে ফেলছে ভয়াবহ হিংস্রতায়।

ছুটকি একবার মুখ ঢাকছে। আবার ঝাঁকি দিয়ে খুলে ফেলছে মুখের আঁচল। উঠে দাঁড়িয়ে সিঁড়ির কাছে চলে যাচ্ছে, আবার এসে বসছে। মাথাটা খালি নাড়ছে যেন কার কথার জবাবে সে ক্রমাগত না না বলে যাচ্ছে। অস্বীকার করতে চাইছে যা ঘটেছে, ঘটে গেছে সেই সমস্ত পুরাঘটিত অতীতের বীভত্স নিষ্ঠুরতা। অবশেষে বিজুর কাছে এসে সে জোর করে তার মুখটা কোলের কাছে টেনে নিল। রুদ্ধগলায় বলল—‘কেন এলি বিজু? কেন? যা চলে যা। এরা সব বাড়িসুদ্ধু দক্ষিণ ভারত বেড়াতে গেছে। কবে ফিরবে বলে যেতে পারেনি। রিটার্ন টিকিটের কনফার্মেশন পায়নি। তো আমি সব সময়ে প্রস্তুত থাকি। তা ছাড়া আশেপাশে প্রতিবেশীরা টের পেতে পারে।’

—‘কী টের পাবে?’ বিজন অনেকক্ষণ পরে বলতে পারলেন, ‘আমি তোকে আজই এখনই নিয়ে যাব। আর একটা দিনও এখানে থাকতে দেব না।’

—‘তা হয় না, বিজু। আমার একটা দায়িত্ব আছে।’

—‘ঠিক আছে, তুই এরা এলে এদের দায়িত্ব বুঝিয়ে দিবি। তারপরে নিয়ে যাব। কিন্তু ছুটকি তুই একটা বি. এ. অনার্স ডিগ্রিঅলা মেয়ে। তুই…তোর আর কোনও কাজ জুটল না? তোকে শেষ পর্যন্ত লোকের বাড়ি রাঁধুনিগিরি করতে হবে?’

ছুটকি করুণ হেসে বলল—‘পরনের কাপড় ছাড়া কিচ্ছু তো আর সঙ্গে আনিনি! বি.এ-র সার্টিফিকেট বা অন্য কোনও পরীক্ষার মার্কশিট-টিট কিচ্ছু আমার কাছে ছিল না। কোথায় প্রমাণ দেব আমার বিদ্যের! আর রাঁধুনিগিরি তো করছি গত কুড়ি-একুশ বছর, তার আগে? অনেক অনেকবার চেষ্টা করেছি মাথা তুলে দাঁড়াতে, পারিনি। কিছুতেই পারিনি।’

বিজু উঠে দাঁড়িয়ে বললেন—‘ছুটকি, এ বাড়িটার মধ্যে আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে। চল আমরা বাইরে কোথাও খেয়ে নেব, কোথাও, অন্য কোথাও বসব।’

—‘কিন্তু এখানে আমাকে সবাই চেনে, কোথায় যাবি? বাজার, পোস্টাপিস, সব, সব-ই আমার চেনা-জানার মধ্যে।’

বিজু বললেন—‘অত ভাবিসনি। তুই বাড়িতে চাবি দিয়ে আয়। আমার সঙ্গে যাবি। ভয় কী?’

ছুটকি খানিকটা ইতস্তত করল। তার পরে সত্যি সত্যিই তালাচাবি নিয়ে ঘরে তালা দিতে লাগল। বাইরে বেরিয়ে মস্ত বড় একটা নবতাল লাগিয়ে, সে বলল—‘দাঁড়া, পাশের বাড়িতে চাবিটা রেখে আসছি।’

—বিজু চেঁচিয়ে বললেন, ‘বলে আসিস, দেরি হবে। বলবি তোর ভাই এসেছে অনেক দিনের পর।’ বলবার সঙ্গে সঙ্গে যেন বিজু একটা ছায়া সরে যেতে দেখলেন। একজোড়া ব্লু-জিনসের পা, যা আজকাল সব যুবক সব প্রৌঢ়েরও পা হয়ে দাঁড়িয়েছে। একটা যেন ধূসর রঙের স্লিভলেস সোয়েটার। যুবকটি পেছন ফিরে কিছু একটা কুড়িয়ে নেবার ভঙ্গি করল। একটা রিকশা ধরে যখন দুজনে গঙ্গার দিকে চলতে আরম্ভ করলেন, তিনি বুঝলেন একটা সাইকেল পেছন পেছন আসছে। পাছে ছুটকি ভয় পায় তাই ফিরে দেখলেন না। কিন্তু তিনি জানেন, তার নীল জিনসের পা, ধুসর উলের বুক। চোখে মুখঢাকা কালো সানগ্লাস। তা হলে তনুশ্রী ডিটেকটিভ লাগিয়েছে! যাক, তনুশ্রীকে যতটা মস্তিষ্কহীন, কিংকর্তব্যবিমূঢ় ধরনের ভেবেছিলেন দেখা যাচ্ছে সে ততটা নয়!

বিজন একটা সোনার সরু পাটিহার বার করে ছুটকির গলায় পরিয়ে দিলেন। বললেন—‘পর। মা’র আলমারিতে এই একটাই উপহার রাখা ছিল, ছোটখুকুর জন্যে।’ গঙ্গায় এখন ছোট ছোট ঢেউ উঠছে। শীত বলে শীর্ণতোয়া। কিন্তু মাঝগঙ্গায় সেই শীর্ণতা টের পাওয়া যায় না। চারদিকে রোদ চমকাচ্ছে। পালতোলা নৌকায় কত বছর পর! এত বড় ছইঅলা নৌকাখানা একা মানুষটি ভাড়া নিয়েছেন। লঞ্চঘাট থেকে খুঁজতে খুঁজতে আসছেন। ভাগ্যে জগন্নাথঘাটে সে মজুত ছিল! বিকেল পজ্জন্ত ভাসবেন। দুশ টাকা ভাড়া কবুল করেছেন। বলেছেন—লাঞ্চো খাওয়াতে হবে। দুই ছেলেকে নিয়ে নৌকা ভাসিয়েছে চাঁদমাঝি।

চাঁদমাঝি বলল—‘পিপুলপাতির দোকান থেকে দুধের সর চাল নিয়েছি। ঝাল ঝাল করে ক্যাঁকড়া রাঁধছি কত্তা। আর আলুটারে শুখনো ঝাল আর পিঁয়াজ দিয়ে মাখাব। হবে তো?’

—‘কী রে?’ ছুটকির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন বিজন। ছুটকি কিছু বলল না। শুধু হাসল। তার মাথা থেকে এখন ঘোমটা খসে গেছে। বেরিয়ে পড়েছে সেই সাদা-কালো কেশের প্রাচুর্য। এখন সব মিলিয়ে মুখটার যা চেহারা হয়েছে তাতে বিজনের সঙ্গে আদল স্পষ্ট। যদিও একজন শীর্ণ, আরেকজন বেশ হৃষ্টপুষ্ট।

জলের ওপর চিকচিকে রোদের দিকে তাকিয়ে ছুটকি বলল, ‘আর শুনতে চাসনি বিজু। আর বলা যায় না। যখন শুনলে কাজ হত, তখন…। অবশ্য এ কথা বলা আমারই ভুল।’ ছুটকি কাঁদছে।

বিজন বললেন—‘সারা জীবন ধরে তোকেই খুঁজে বেড়িয়েছি ছুটকি। তুই হারিয়ে গেলি বলে বাড়ি ছাড়লুম। তুই হারিয়ে গেলি বলে জীবনে কাউকে কোনও দিন সেভাবে আপন ভাবতে পারিনি। মা-বাবাকে, দাদা-দিদিদের পুরো শ্রদ্ধা দিইনি কখনও সুদ্ধু তোকে ত্যাগ করেছিল বলে। যদি ঘুণাক্ষরেও জানতে পারতুম, তুই কোথায় আছিস—সেই দিনই ছুটে চলে যেতুম। তুই এত কাছে ছিলি, মায়ের কাছে তোর চিঠি…আর আমি…পাগলের মতো শুধু কাজই করে যাচ্ছি। তৃপ্তি নেই, শান্তি নেই, শুধু কাজ, কাজ করে যাচ্ছি। টাকা জমছে। টাকা উথলে পড়ছে। থামতে পারছি না। থামলেই শূন্য খাদ…।

ছুটকি বলল—‘একজনের ঘর তো ভাঙতে গিয়েছিলুম, তারই শাস্তি এ সব। বুঝি। জল, চারিদিকে জল রে বিজু, শুধু একফোঁটা খাবার জল নেই। চারিদিকে থই থই করছে মানুষ, বাড়িঘর, বাজার, টাকার লেনদেন, আমি একা সব কিছুর বাইরে দাঁড়িয়ে। প্রতিদিন কাশী মিত্তিরের ঘাটে যেতুম ভোরবেলা, ডুবে মরব বলে। প্রতিদিন ফিরে আসতুম। তিন মাসের আগাম বাড়ি ভাড়া দেওয়া ছিল, যা টাকাপয়সা ছিল টিপে টিপে খরচ করছি। মুড়ি জলে ভিজিয়ে খেয়ে কাটিয়ে দিচ্ছি দিনের পর দিন আর প্রতিদিন আশা করছি লোকটা ফিরে আসবে। বিবেকের দংশন বলেও তো একটা জিনিস আছে! কিন্তু এবার এলে আর ভুলব না। শুধু আমাকে নিজের পায়ে দাঁড়াবার ব্যবস্থাটা করিয়ে নিতে হবে। তিনটে মাস দেখতে দেখতে ফুরিয়ে এল, কোথায় কে? কোনও পাত্তাই নেই। একটা চিঠি পর্যন্ত না।’

—‘নাম কি লোকটার।’ কোথায় থাকে ঠিকানা জানতিস না?’

—‘বালিগঞ্জের দিকেই থাকে, পুরো ঠিকানা জানতুম না, জানলেও যেতে পারতুম না বিজু। এত দিনেও যাইনি কখনও। এ নিদারুণ লজ্জা বিজু সব্বাইকার সামনে প্রকাশ করব কী করে? আমি যে ভদ্রঘরের মেয়ে!’

‘এখনও বেঁচে আছে? জানিস?’

—হ্যাঁ, কাগজে জন্মদিনের অভিনন্দন-টন্দন দেখি তো। আগে দেখতুম কোথায় কি এগজিবিশন কি কোনও সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার সেন্টার ওপন করতে যাচ্ছে। কত ছবি, মালা, ভাষণ।’

—‘নামটা বল’—ভীষণ উত্তেজিত হয়ে বিজু বললেন।

—‘কী করবি?’ ছুটকি হাসল।

—‘ঠিক কী করব জানি না। তবে উচিত শিক্ষা দেব।’

ছুটকি বলল—‘যাই করিস আর তাই করিস, আমার জীবনের আটত্রিশটা বছর তো আর ফিরবে না! বরং যেটুকু বাকি আছে আরও ঘুলিয়ে উঠবে।’

বিজন দেখলেন নামটা ছুটকির মুখ থেকে কোনও অসতর্ক মুহূর্তে বার করে নিতে হবে—এভাবে হবে না। বললেন—‘তারপর কী হল? বল!’

—‘গঙ্গার ঘাটেই একদিন বিধবা এক ভদ্রমহিলা কপালে ফোঁটা কাটছিলেন, আমাকে দেখে বললেন—“রোজই চান করতে এসে দেখি মা শুকনো মুখে বসে আছ, কী ব্যাপার বলো তো? আমি তোমার দিদিমা-ঠাকুমার মতো তো হবোই!” কেমন মরিয়া হয়ে গেলুম। বললুম—আমার স্বামী আমায় ত্যাগ করে চলে গেছেন মা, একটা কাজকর্মের কিছু খোঁজ দিতে পারেন? ভদ্রমহিলা বললেন—“রান্না-বান্না জানো?” আমি কী বলব। প্রথমটা স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলুম। আমি ফিলজফিতে বি. এ. পাশ, কান্ট, হেগেল, লক, হিউম, বার্কলি পড়া একটা ভদ্রবাড়ির মেয়ে, আমার চেহারায় এমনই কিছু একটা ছিল যে একটা রূপবান, কোটিপতি, বয়স্ক লোক মাথার ঠিক রাখতে পারেনি, আমি…আমাকে রান্নার কাজ দেবার কথা ভাববে লোকে? দ্যাখ বিজু, বলতে গিয়ে এখনও আমার গায়ে কাঁটা দিচ্ছে।’

ছুটকি চুপ করে গেল। গঙ্গার হাওয়ায় তার যেন শীত ধরেছে। একটু একটু কাঁপছে। বিজু নিজের গা থেকে গরম আলোয়ানটা খুলে তার গায়ে জড়িয়ে দিলেন।

—‘একবার ভাবলুম বলি, বলি আমি গ্র্যাজুয়েট, সেক্সপিয়র, রবীন্দ্রনাথ আমার কণ্ঠস্থ। তারপর ভাবলুম কী-ই বা লাভ! আমি তো প্রমাণ করতে পারব না কিছুই। “দূর হতে শুনি বারুণী নদীর তরল রব/ মন বলে এ যে অসম্ভব এ অসম্ভব।” যদি এখন আবৃত্তি করি? কিংবা “ক্যানসট নট দাউ মিনিস্টার টু এ মাইন্ড ডিজীজড? প্লাক ফ্রম দা মেমরি এ রুটেড সরো…” তারপর ভাবলুম এ একরকম ভালই হল, কাউকে মুখ দেখাতে হবে না। কী করে এ ভয়ানক সংসারে নিরাপদে থাকব সে ভাবনা ভাবতে হবে না…। তখন কি ছাই জানতুম, নিরাপত্তা অত সহজ নয়।’

বিজু বললেন—‘কত দিন ছিলি সেখানে? নিরাপদে ছিলি না?’

—‘প্রথমটা ভালই ছিলুম। ভদ্রমহিলার দারুণ শুচিবাই। দিনের মধ্যে নিজেও চারবার চান করতেন। আমাকেও করিয়ে ছাড়তেন। যা বলতেন তা-ই করতুম। শুধু রান্না নয়, সব-ই। করতুম আর ভাবতুম আমার পাপের প্রায়শ্চিত্ত হচ্ছে। পাপক্ষয় হচ্ছে। পুরোপুরি ক্ষয় হয়ে গেলে তখন হয়ত, হয়ত আবার মাথা তুলে দাঁড়াতে পারব। কিন্তু ভদ্রমহিলার এক ভাগ্নে আসত মাঝে মাঝে, সে আমাকে নাকের জলে চোখের জলে করে ছাড়ত।’

‘তারপর সে বাড়ি ছেড়ে খুঁজে খুঁজে গড়িয়াহাটার এক দোকানে সেলস গার্লের কাজ নিলুম। কিন্তু থাকব কোথায়? দোকান মালিক নিজের বাড়িতে থাকতে দেবেন বললেন। গিয়ে দেখি, সে একা থাকে, পরিবার দেশে। তিন-চার দিনও সে কাজে টিকে থাকতে পারিনি। তারপর, একের পর এক কাজ আর বাড়ি পাল্টাতে পাল্টাতে বয়স বাড়ল। ক্রমে এই ঘাটে এসে টিকে গেলাম। একদিন গৌরাঙ্গদার সঙ্গে হঠাৎ দেখা। সে-ই তোর খোঁজখবর দিল। ঠিকানা দিল, তারপরেও অনেক অনেক দিন সাহস করিনি, একদিন হিসেব করে দেখলুম মায়ের বয়স নব্বুইয়ের কাছাকাছি এসে গেছে। তখন আর থাকতে পারলুম না। ভাবিনি মা জবাব দেবে।’

খাওয়াদাওয়া হয়ে গেল। অনেকক্ষণ ধরে দুজনে ছইয়ের মধ্যে শুয়ে শুয়ে জলের ছলাত ছলাত শুনতে লাগলেন। তারপর ছুটকি উঠে বসে বলল—‘এবার ফের বিজু, আমার বড্ড দেরি হয়ে যাবে।’

—‘তুই কি সত্যি-সত্যি ওখানে ফিরে যেতে চাস নাকি?’

—‘তো কোথায় যাব?’

—‘তার মানে? আমি এতদিন পরে এত খোঁজ করে এলুম কী জন্যে?’

—‘তা হয় না বিজু। তুই ভুল করছিস। তোর কতদিকে কত কাজ, কত বড় বড় লোকের সঙ্গে ওঠা-বসা, ছেলে-মেয়ে-স্ত্রী নিয়ে ভর্তি সংসার। এতদিন পরে আমাকে সেখানে নিয়ে গিয়ে বিব্রত হওয়া ছাড়া কিছু লাভ হবে না।’

বিজন বললেন—‘এখন আমার মনে হচ্ছে, সংসার নামক দানোটা আমাকে একটার পর একটা কাজ ঘাড় ধরে করিয়ে নিয়েছে, ক্রীতদাসকে যেভাবে মালিক করায়। আমি এবার নিজে নিজের মালিক হয়ে দেখব ছুটকি। আমার বাড়িতে যেতে যদি তোর ভাল না লাগে, না লাগতেই পারে, আমারও লাগে না, আমরা দু ভাই-বোনে আলাদা একটা ছোট বাড়ি নিয়ে থাকব। বাড়ি কি ফ্ল্যাট!’ তিনি সুখচরের কথা ভাবছিলেন।

ছুটকি বলল— ‘তোতে আমাতে? সে কী তোর ছেলে মেয়ে বউ?’

—‘তোর দায়িত্বজ্ঞানটা বড্ড বেশি হয়ে যাচ্ছে রে, ছুটকি। সবই তো গেছে, তবু অন্যকে মনে করতে ছাড়বি না?’

‘ঠেকে শিখেছি রে বিজু! তা নয় তো দায়িত্বজ্ঞানের কী পরিচয়ই বা আমি জীবনে দিয়েছি বল! নিজের কক্ষপথ থেকে ছিটকে পড়লুম স্রেফ স্তোকবাক্য শুনে, মোহে মুগ্ধ হয়ে, তার ফলে আমার যা অবস্থা হয়েছিল বোধহয় শেয়াল-কুকুরে টেনে কাঁচা মাংসগুলো জ্যান্তে খেয়ে নিত। রোজ জানলার কাছে লোক ঘুরঘুর করছে, সকালবেলা তা-ও পিছু নিচ্ছে। সেলস-গার্লের কাজ করতে গেছি, ডিউটির পর মালিকের অফিসে গিয়ে কম্প্যানি না দিলে মাইনে পাব না। বিজু তুই জানিস না ওই একটা ভুলের মধ্যে দিয়ে আমি জীবনের চেহারাটা একেবারে ছবির মতো স্পষ্ট দেখতে পেয়ে গেছি। এত দুঃখের মধ্যেও ওটাই আমার একমাত্র লাভ।’

—‘লাভ? লাভ বলছিস একে?’

—‘লাভ বই কি? মানুষ যখন প্রথম জন্মাল এই পৃথিবীতে, ধর প্রথম মানুষ-মা সে তো তার সন্তানকে কদিন পালন করেই তারপর অন্যান্য জন্তু-জানোয়ারের মতনই তাকে ফেলে চলে গিয়েছিল। তারপর শুধু আদিম জঙ্গল তার ভয়াল হিংস্রতা নিয়ে, আর একটি মনুষ্য শাবক। সেই মনুষ্য শাবক কেমন করে বেঁচেছিল, আমি বুঝতে পারি বিজু। কিংবা আদিম পৃথিবীতেও যাবার দরকার কী! এই দেশের শহরে শহরে, ফুটপাতে ঝোপড়িতে কত শিশুর জন্ম হচ্ছে, একটু বড় হয়ে একেবারে অনাথ হয়ে যাচ্ছে বেশির ভাগই, তখন একটা শিশু, বিশেষ করে নারী-শিশু কেমন করে কাল কাটায়, তার অনেকটাই এখন আমি বুঝি। আমি কুড়ি বছর বয়সে পৌঁছেছিলুম। ঘর সংসার, আত্মীয়, ভালবাসা, স্কুল-কলেজ খেলাধুলো এই জীবনটা পুরোপুরি পেয়েছিলুম। তারপর একদিন স-ব পরিচয়, সব পরিচিত খসে পড়ে গেল চারপাশ থেকে। জন্মদাত্রী জননী পর্যন্ত মুখ দেখতে চাইলেন না আর। যাকে ভালবেসেছিলুম, যে বলেছিল আমায় না পেলে সে সেই মধ্যবয়সে আত্মহত্যা করবে, সেও বিনা বাক্য ব্যয়ে চুপি-চুপি চলে গেল, আমাকে যে নিরাত্মীয় নিরালম্ব করে বাইরের জগতে টেনে বার করেছে সে কথার বিন্দুমাত্র গুরুত্ব দিল না, কোনও ব্যবস্থা করল না, তারপর সংসার অরণ্যে কী করে প্রাণ বাঁচাব, মান বাঁচাব, বাঁচব কিনা, বাঁচাবার যোগ্য কি না এই প্রাণ এই মান, এই প্রশ্ন জিজ্ঞেস করতে করতে অবিরত যুদ্ধ করতে করতে একদিন দেখলম বাঃ অদ্ভুত তো! আমি মোটেই আমি নয়। আমি আই. এ তে বৃত্তি পাওয়া, ফিলজফির ছাত্রী কেয়া রায় নই মোটেই, আমি একজন নামহীন বামুনদি। খুব ভাল রাঁধি, রোগীর সেবা করতে পারি নির্ঘৃণায়, বাচ্চাদের একাহাতে মানুষ করে তুলতে পারি, খুব ভদ্র, শান্ত, শালীন এবং দায়িত্বশীল। এই প্রশংসা-পত্র, এই পরিচয় পত্র নিয়েই অনেক অনেক দিন কেটে গেল রে বিজু। ওরা চলে গেলে খবরের কাগজগুলো পড়ি, শেলফে রাখা গল্পের বইগুলো পড়ি। ইংরিজি বইয়ে আবার আমার হাত দেওয়া বারণ।’

—‘কেন?’

ছুটকি হেসে বলল- ‘একদিন বই ঝাড়তে ঝাড়তে সেই বিখ্যাত নভেল দুটো তাকের ওপর দেখছি- “আনা কারেনিনা” আর “রেজারেকশন”, কৌতূহলে অধীর হয়ে নামিয়ে নিয়ে পড়ছি, এমন সময়ে বাড়ির বড় ছেলে দেখতে পেয়েছে, সে হেসেই অস্থির- “বামুনদিদি তুমি আনা কারেনিনা নিয়ে কী করছ? যাক উল্টো করে ধরোনি তবু ভাল!” সঙ্গে সঙ্গে বুঝে নিলুম— বামুনদিদি পরিচয়ের সঙ্গে আনা কারেনিনা খাপ খায় না। একবার তো মোটামুটি এই রকমই একটা কারণে একটা বাড়ি থেকে উৎখাত হয়েছিলুম।’

—‘কি রকম?’ বিজু ছুটকির কোলে মাথা রেখে জিজ্ঞেস করলেন।

—‘সে এক কাণ্ড। বাড়িতে মা-বাবা কেউ নেই, স্কুল ফাইন্যাল পরীক্ষা দেবে ছেলে, ইংরেজি ট্রানস্লেশন নিয়ে হিমসিম খাচ্ছে। ‘ত্যাজ্য-পুত্র করা’ কী হবে, শেষে তার কান্না দেখে বললুম দেখো তো বোধ হয় “ডিজওন” হবে কিংবা “ডিজইনহেরিট”। “প্রায়োপবেশন” কী হবে? বললুম বোধহয় “ফাস্ট আনটিল ডেথ”। বাবা-মা এলে সে উৎসাহ করে বলেছে বামুনদিদি এই বলেছে। তার মা আমাকে রাত্রে একা ডেকে থমথমে গলায় জিজ্ঞেস করলেন—“তুমি কে?” মুখটাসুদ্ধু থম থম করছে। আমি কী বলব? তিনি আমার জবাব শুনতেও চাইছিলেন না, বললেন “যত তাড়াতাড়ি পারো অন্য জায়গায় কাজ খুঁজে নাও।” তা বিজু আমি আজও জানি না আমি আসলে কে? জন্মপরিচয় বংশপরিচয় মুছে গেল। বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচয় তা-ও লুপ্ত হয়ে গেল। কেয়া নামে কোনও রাঁধুনি হয় না। কারও বাড়ি কাজ নেবার সময়ে শুধু বলতুম নামে কী হবে? আপনারা আমাকে বামুন-মেয়ে বলে ডাকবেন।’

বিজু বললেন— ‘কী আশ্চর্য! লেখাপড়া জানিস বুঝতে পেরে কোথায় তোকে সাহায্য করবে… অদ্ভুত মানুষ তো! তা তুই সেই থেকে বই পড়া ছেড়ে দিলি?’

ছুটকি হাসল, বলল ‘তোর কি মনে হয় কেয়া রায় বই হাতে পেলে ছেড়ে দেবে?’

—‘উঁহু, মনে হয় না, আমি যেমন যেদিকে বই তার উল্টো দিকে হাঁটতুম, তুই ছিলি তেমনি বইয়ের পোকা। — তারপর ব্যবসা দাঁড় করাবার জন্যে প্রচণ্ড খাটতে হয়েছে, কাগজ আর জার্নাল-টার্নাল ছাড়া বিশেষ কিছু…’

ছুটকি বলল— ‘তাহলে আমি তোর থেকে বেশিই পড়বার সুযোগ পেয়েছি কিন্তু। সেই প্রথম যুগে যে বিধবা মহিলা আশ্রয় দিয়েছিলেন তাঁকে কালীপ্রসন্ন সিংহের মহাভারত, ব্যাখ্যাসুদ্ধু গীতা, কৃত্তিবাসী রামায়ণ পড়ে শোনাতে হত। পরে এক শয্যাশায়ী ভদ্রলোকের আয়ার কাজ করেছি। তাঁর কাছে থাকতেও বহু বই আমায় পড়ে শোনাতে হত। রাসেল, বিবেকানন্দ, রাধাকৃষ্ণান, সোয়াইটজার, এমন কি! বলে ছুটকি হাসতে লাগল।

—‘এমন কি…’

—এমন কি হ্যাভেলক এলিস, লেডি চ্যাটার্লিজ লাভার, ট্রপিক অফ ক্যানসার…।’

—‘বলিস কী?’

—‘একটা একুশ বাইশ বছরের মেয়ে তাঁকে এইসব পড়ে শোনাচ্ছে এটাই ছিল ভদ্রলোকের আনন্দের ধরন। ডানদিকটা পুরো প্যারালাইজ্‌ড। ষাটের ওপর বয়স। ঘরে কেউ উঁকি দিয়েও দেখতে আসত না।’

—‘সে কাজটা তো তোর এক হিসেবে বেটার ছিল। ছাড়লি কেন?’

ছুটকি ম্লান হেসে বলল, ‘একটা ওই বয়সের সহায়সম্বলহীন মেয়ের জন্যে শুধু দুটো পথ খোলা থাকে বিজু। একটা আদি ব্যবসা। আরেকটা কোনও মিশন-টিশনে গিয়ে আশ্রয় নেওয়া, সেটাও খুব সহজ নয়। মাঝামাঝি কোথাও বেশি দিন টিকে থাকা যায় না। তুই কি ভাবছিস পড়ানোর কাজ আমি খুঁজিনি! কিন্তু আমার যে থাকার সমস্যা ছিল! বাড়িতে থাকতে দিতে হবে শুনেই লোকে অস্বস্তিতে পড়ত। বি.এ-র মার্কশিট দেখতে চাইত। চেনাশোনা কারুর রেফারেন্স চাইত। বাড়িঘর কোথায়, থাকতে দিতে হবে কেন এ সব প্রশ্নের সদুত্তর চাইত। আমি তো কিছুই দিতে পারতুম না। আমার এ-ও মনে হত, কোনও ভাবে চেনা বেরিয়ে পড়ে যেন বাবা-মা ভাইবোনেদের মুখ আর হেঁট না করতে হয়।’

সূর্যাস্ত হচ্ছে। আবির গোলা জলের মধ্যে দিয়ে ছপাত ছপাত করে নৌকো কূলে ভিড়ল। বিজন ছুটকিকে নামতে সাহায্য করলেন। তারপর গলা কঠিন করে বললেন—‘ছুটকি তোর আর ও বাড়ি ফিরে যাওয়া হবে না। হতে পারে না।’

—‘তা হয় না বিজু।’

—‘তুই কি মনে করেছিস আমি নিজের কাজে মেতে তোকে ভুলে যাব? অবহেলা করব?’

—‘না, তা নয়। জানি তোর এখন অনেক সামর্থ্য। আমার কোনও একটা উপায় কি আর তুই করে দিতে পারিস না! কিন্তু বিজু, আমি এখন কি রকম অদ্ভুত হয়ে গেছি। কিছু না দিয়ে কারও কাছ থেকে আর কিছু নিতে পারি না। ভালবাসার দাবিতে… না, না, ও দাবি আমার জীবন থেকে কেমন শুকিয়ে গেছে। আর তার দরকারই বা কী! এত দিনে আমার সামান্য কিছু সঞ্চয় তো হয়েছেই! যৎসামান্য। ধর ত্রিচীবর আর ভিক্ষাপাত্র, তবু সে আমার নিজের উপার্জন করা। কুড়ি বছর বয়সের পর থেকে যেটুকু পেয়েছি, অতি সামান্য, তবু তা কুল, অর্থ, এমন কি বিদ্যাও নয়, পেয়েছি আমার নিজের শ্রম, নিজের চরিত্রের জোরে। ভেবে দ্যাখ একটা মানুষের নিজস্বতম সত্তার অর্জন সেটুকু। এখন তাই আর কিচ্ছু চাই না।’

বিজু দেখলেন ছুটকির এ অভিমান সহজে যাবার নয়। খুবই স্বাভাবিক! কৈশোরের দিনগুলোতে ছুটকিকে যতটুকু চিনেছিলেন এই অভিমান, এই জেদ তার ছিল। কিন্তু ষাট বছর বয়স হতে চলল এখনও ছুটকি শারীরিক পরিশ্রম করে অন্নসংস্থান করবে? বিজন থাকতে? এ হয় না, হতে পারে না! কিন্তু অভিমান যে যুক্তির ধার ধারে না! কী করে বোঝান এখন তিনি ছুটকিকে! তাঁকে তাহলে বারবার আসতে হবে। বারবার বোঝাতে হবে। ফেরাতে হবে। ফেরাতেই হবে।

যদি রায়-পরিবারের পুরনো আবহাওয়ায় বা নতুন প্রেক্ষিতে না-ও হয়, অন্ততপক্ষে বিজুর কাছে, শুধু বিজুর কাছে ছুটকি ফিরে আসুক। ছুটকি তার বিষণ্ণ মুখের দিকে তাকিয়ে বলল—‘রাগ করিসনি বিজু, কিন্তু একজনের জিনিস চুরি করেছিলুম, সেই পাপের শাস্তি কী, কখন কোথায় তার শেষ আমায় বোধহয় এইভাবেই জানতে হবে।’

তখন বিজু দেখলেন তাঁর গোপন কথা বলবার সময় এসেছে। তিনি আস্তে আস্তে বললেন—‘অনেকক্ষণ থেকে চুরি-চুরি, পাপ-পাপ করছিস ছুটকি। তাহলে শোন। বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে পড়েছি। উদ্দেশ্যহীন। কাশীর টিকিট কিনে দুন এক্সপ্রেসে চড়ে বসেছি। চাপাচাপি ভিড়। পাশে বসেছে এক ভুঁড়োপেট অবাঙালি। মাঝরাত্তিরে ঘুমের মধ্যে শুনলাম কামরায় গোলমাল। যেন পুলিশ উঠেছে। সকালে কাশীতে নামবার সময়ে ব্যাগটা অসম্ভব ভারী লাগল। সেই চেক-চেক ডাকব্যাকের ব্যাগটা মনে আছে? দু-চার দিনের জন্যে কোথাও খেলতে-টেলতে গেলে যেটা নিতুম? কাশীতে নেমে একটা ধর্মশালায় উঠেছি। লাক্সার রোডের কাছে। ব্যাগ থেকে জামাকাপড় বার করতে যাব, চানে যাব বলে, চেনটা টেনেই আমার চক্ষুস্থির। থাকে থাকে একশো টাকার নোট। গুনে-গেঁথে দেখলুম পুরো এক লাখ। ভাবতে পারিস? আমার ব্যাগটাতে ছিল দুটো গেঞ্জি, দুটো প্যান্ট, দুটো পুরনো শার্ট, একটা গামছা আমার খেলার বুটজোড়া দু-চারটে নিম-দাঁতন। বদলে গেছে। পাশের লোকটাকে মনে পড়ল। প্রথমে ভেবেছিলুম, নিশ্চয়ই জাল টাকা। পুলিশ উঠেছিল হয়ত এরই জন্যে। তারপর দেখি সুতো-টুতো সব ঠিক আছে। নোটের নম্বরও এলোমেলো। ব্যাংকের নম্বর মিলোনো নোট নয়। দু-চার দিন অপেক্ষা করলুম যদি মালিকের সন্ধান পাই। পেলুম না। স্রেফ মেরে দিলুম। আজও জানি না সে কার টাকা, কিসের টাকা। স্মাগলারদের? না ব্ল্যাকমানি কেউ কোথাও সরাচ্ছিল। কিন্তু সেই টাকা থেকেই আজকে আমার ‘রায় ইন্ডাস্ট্রিজ।’ কীভাবে তাকে কাজে লাগিয়েছি, কার কার পরামর্শ নিয়েছি, কীভাবে ছোট থেকে বড় আরও বড় ব্যবসায় বিনিয়োগ করেছি সে এক ইতিহাস। অন্য ইতিহাস। কিন্তু ভিত হল স্রেফ কুড়িয়ে পাওয়া টাকা। চুরিও বলতে পারিস। ছুটকি আমরা জোড়া ভাইবোন, তুই দু ঘণ্টা চোদ্দ মিনিটের বড়, দু জনেই দুটো পুঁটলি কুড়িয়ে পেয়েছিলুম। পরিত্যক্ত পুঁটলি। চুরি বলিস চুরি, কুড়নো ধন বলিস কুড়নো ধন। এখন তাকে যদি পাপ বলে সারা জীবন শিঁটিয়ে থাকতে হয়, তো আমারও তো এক্ষুনি প্রায়শ্চিত্তের জন্যে কিছু করা দরকার। সমস্ত বিলিয়ে-টিলিয়ে দিয়ে ভ্যাগাবন্ড হয়ে যাব, না কী। বল!’

ছুটকি বলল—‘তা নয় বিজু। তুই পেয়েছিলি টাকা, জড় বস্তু। তাকে আঁকড়ে থাকলে সে থাকে। বাড়াতে পারলে বাড়ে। আমি পেয়েছিলাম ভালবাসা, সজীব শক্তি। আঁকড়াতে চাইলেই সে থাকবে কোনও মানে নেই। তা ছাড়া বিজু তুই আর আমি দুইয়ে মিলে এক। চাঁদের এ পিঠ আর ও পিঠ। আমার পিঠে শুধু অন্ধকার।’

ছুটকি পাশের বাড়ি থেকে চাবি এনে তালা খুলল। আস্তে আস্তে ভেতরে ঢুকছে। বিজু দরজার মুখে দাঁড়িয়ে আছেন। অপেক্ষা করছেন। কতক্ষণ! শেষে হতাশ বিজু পেছন ফিরলেন। এ কাজ একদিনে হবার নয়। হঠাৎ শূন্য বাড়ির ভেতর থেকে আর্ত গলায় ছুটকি ডেকে উঠল—‘বিজু…!’ যেন ডুবন্ত মানুষের আর্তনাদ। একলা দ্বীপে দণ্ডিতকে নামিয়ে দিয়ে যেন জাহাজ চলে যাচ্ছে। শূন্য দ্বীপের পাহাড়ে পাহাড়ে ধাক্কা খাচ্ছে ছুটকির ডাক ‘বিজু! বিজু!’

চকিতে ফিরে দাঁড়িয়ে বিজু ছুটকির আর্তনাদে নিজের আর্তনাদ মিশিয়ে বললেন—‘ছুটকি, ছুটকি, এই তো আমি! তোর বিজু। তোকে নিতে এসেছি। এক্ষুনি চল। চলে আয়।’

ছুটকি জলভরা চোখে তাঁর দিকে চেয়ে বলল—‘না বিজু, তুই আগে বল, আগে কথা দে তুই পারবি?’

—‘কী পারতে হবে?’

—‘আমাকে আমার সমস্ত পরিচয়সুদ্ধু, সেই কুল ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়া মেয়ে, সেই একজনের ভোগ করে এঁটো পাতের মতো ফেলে যাওয়া নারী, সেই আয়া, রাঁধুনি, সেলসগার্ল, দাসী, দূর দূর করে খেদিয়ে দেওয়া টিউশনি খুঁজতে আসা মেয়ে, বামুন-মা—এই সমস্ত পরিচয়সুদ্ধু যেখানে বসাতে চাইছিস, তোর পাশে, তোর বোন বলে, দিদি বলে। পারবি? বসাতে?’

তখন বিজু রায় বুঝতে পারলেন ছুটকিকে। পুরোটা হয়ত নয়। তবে অনেকটাই। বোঝাটা এল ঝলকে ঝলকে। ছুটকি জীবনে নিষ্ঠুর আঘাত খেয়েছে একটার পর একটা। সমাজের চোখে সে হয়ত অনেক নীচে নেমে গেছে। কিন্তু এই সমস্ত অভিজ্ঞতা দিয়ে সে শেষ পর্যন্ত জীবনকে আবিষ্কার করেছে। যে জীবনকে আড়াল করে থাকে সমাজ, সম্পর্ক। নিজেকে ঘনিষ্ঠভাবে জেনেছে ছুটকি। জেনেছে যা তার স্ব-রূপ। নিজের সেই নিজত্বটুকু তার যুধিষ্ঠিরের কুকুর। তাকে ত্যাগ করে সে স্বর্গে যেতেও চায় না।

একটু দেরি হল জবাব দিতে। তারপর নিশ্বাস ফেলে তিনি বললেন—‘পারব ছুটকি। ঠিক দু দিনের মাথায় তোকে নিতে আসছি। তৈরি থাকিস।’ বলে বিজু হঠাৎ নিচু হয়ে ছুটকির পায়ের ধুলো নিলেন, একটা চুরি, চুরির ফলই বলো কিংবা প্রতিফলই বলো, তারই ওপর তাঁদের দুজনের জীবন দাঁড়িয়ে আছে অথচ তিনি ক্রমশ আত্মবিস্মৃত এবং ছুটকি ক্রমশই আত্মসচেতন। ক্রমশই আরও আরও অন্বেষু এবং আত্ম-নির্ধারণের কঠিন পথে বহু বহু দূর অগ্রসর হয়ে গেছে বুঝতে পেরে।

১২
রাত্তির প্রায় দশটার কাছাকাছি। পথঘাট সুনসান। শীতের হিম-কুয়াশায় পথ-আলোর পেছনে বাড়িগুলো জলের তলার ছবি বলে মনে হয়। রায়-ভবনের বিরাট গ্রে হাউন্ড কঙ্ক পল্লী বিদীর্ণ করে চিৎকার করে উঠল। বাগানের পেছনের কোণ থেকে সে জকিবিহীন রেসের ঘোড়ার মতো অপরূপ তীব্র ভঙ্গিতে দৌড়ে আসছে। দৌড়ে আসছে। কঙ্ক বাগানময় ঘোরাফেরা করে। পেছনের কুকুর-ঘরে ঘুমোয়। তাকে বড় একটা বাড়ির ভেতরে ঘুরতে দেওয়া হয় না। সারারাত সে রায়-ভবনের গোটা খোলা এলাকাময় ঘোরে। বিরজু ঘুমিয়ে পড়লেও কঙ্ক আছে। কঙ্ক আছে। বিজু রায়ের পায়ের কাছে এসে সে পেছনের পা ছড়িয়ে দিয়ে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ল, গরররর, গরররর করছে এখন, লেজটা বিদ্যুদ্বেগে নড়ছে, ডাইনে-বাঁয়ে। সে যেন তার মালিককে প্রণাম করছে, কিংবা জানাচ্ছে তার আকুল অভিমান। নিচু হয়ে তার ঘাড়ে হাত বুলিয়ে দিলেন বিজু রায়, মৃদু গলায় বললেন—‘ঠিক আছে, ঠিক আছে কঙ্ক। সব ঠিক হ্যায়।’ বিরজু এসে সেলাম করে দাঁড়াল। বীরখা ঘুম ভেঙে ছুটে আসছে। কঙ্ক ছুটে যাচ্ছে ওপরে। দু-চার সিঁড়ি উঠছে আর পেছন ফিরে ফিরে দেখছে তার ইউলিসিস আসছে কি না। বিজু উঠছেন। ধীরে ধীরে। তাঁর পায়ে অদ্ভুত জড়তা, অনেক দিন আগে যখন নিরুদ্দিষ্ট পুত্র বাড়ি ফিরেছিলেন তার চেয়েও দ্বিধাগ্রস্ত, এ যেন অন্যের বাড়ি। কিংবা বলা যায় ভীষণ দুষ্টু ছেলের লজ্জা তাঁকে পেয়ে বসেছে। তবু তিনি উঠে যাচ্ছেন এবং উঠতে উঠতে সাহস সংগ্রহ করে নিচ্ছেন। যা করতেই হবে তা করাই ভাল। বিজু রায় উঠছেন, মাঝখানে সামান্য ফাঁক রেখে তাঁর পেছন পেছন নিঃশব্দে সিঁড়ি উঠতে থাকছে নীল জীনস্‌-এর একজোড়া পা, একবুক ধূসর উলের সোয়েটার। কালো চশমা এখন মাথায়। সিঁড়ির প্রথম ল্যান্ডিং পর্যন্ত উঠে বিজু রায় আস্তে পেছন ফিরে তাকালেন, চকমকে চোখে হেসে বললেন—‘তাহলে টিকটিকি মশাই! আপনি ধরে ফেলবার আগেই যদি হারানিধি ফিরে এল তো পুরস্কারটা আপনি পান কেমন করে?’

নীল জীনস চট করে তাঁর পা ছুঁয়ে প্রণাম করে বলল—‘আমি টিকটিকি নই তো মেসোমশাই! আমি তিতির বন্ধু অর্জুন। সকালে কলেজে আসতে আপনাকে চুঁচড়ো পোস্ট অফিসের কাছে ডিস্ট্রিক্ট জাজের বাংলোর গাছের তলায় দেখতে পেয়ে গেলুম দৈবাৎ। তখন থেকেই…’

—‘দৈবাৎ!’ বিজু রায় হেসে উঠলেন, ‘তবে তো তুমি কামালই করেছ হে!’ একেবারে দৈবাৎই না কি?

ওরা আওয়াজ পেয়েছে। কঙ্কর। বিজুর। ওরা ছুটে আসছে। ঘাউ ঘাউ করতে করতে আসছে কঙ্ক। পেছন পেছন চিন্টু, তিতি, প্রমীলা, বদন। একদম শেষে, পা টেনে টেনে ফ্যাকাশে, মড়ার মতো মুখে তনুশ্রী।

চিন্টু বলল—‘ড্যাড, ড্যাড, ড্যাড এসে গেছে। ওহ্ ড্যাড! ওহ্‌ মাই ড্যাড্‌ড! ওহ্ হো!’ সে চোখের জল ভেতরে পাঠাবার প্রবল চেষ্টায় ক্রমাগত মাথাটা ঝাঁকুনি দিয়ে দিয়ে পেছনে হেলাচ্ছে। বিজু ডান হাতটা বাড়িয়ে—তাকে আলিঙ্গন করে ধরলেন। বললেন—‘দেয়ার দেয়ার দ্যাটস অল রাইট মাই বয়, অল রাইট।’ চিন্টু মুখ ঢেকে ফেলল। তিতির মুখে সারাদিনের পরিশ্রমের ক্লান্তি, সে তার লম্বা কালো স্কার্ট আর পাতলা সাদা উলের ব্লাউজ পরে বাবার বুকের ভেতর ঝাঁপিয়ে পড়ল। তার চুলগুলোয় আদর করতে করতে বিজু বললেন—‘তুই যদি চাস তোকে ওই ছেলেটার সঙ্গেই বিয়ে দেব। দেখিস!’

—‘কোন ছেলেটা?’ তিতি আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করল।

বিজু তার মাথাটা পরম মমতায় বুকের ওপর চেপে ধরে বললেন—‘ওই যে তোর ঘরে টিভি-র ওপর যার ছবি যত্ন করে সাজিয়ে রেখেছিস?’

তিতি বাবার বুক থেকে মাথাটা একটু তুলে হেসে উঠল, বলল—‘সে কী? ও তো সুকান্ত! আমাদের কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য! কোন কালে মারা গেছেন!’

বিজু ভীষণ অপ্রস্তুত হয়ে হার-না-মানা জেদের সঙ্গে বললেন—‘তাই বুঝি? তবে এই অর্জুন, এটাকেই… !’

—‘দূর!’ তিতি আরও জোরে হেসে উঠল—‘ও তো ভাই! চুঁচড়োর মঞ্জুর ছেলে।’

খুব মৃদু গলায় অর্জুন বলল—‘যেমন ছুটকির আপনি!’ বিজু চমকে উঠলেন। তার সঙ্গে চোখাচোখি হল।

তারপর বিজু রায় অশান্ত বালকের মতো এদিক-ওদিক তাকাতে লাগলেন। প্রমীলা লজ্জা-লজ্জা মুখ করে, মাথায় কাপড় টেনে বলল—‘বউদি যে ওদিকে ঘরের মধ্যে ঢুকে গেলেন!’

চিন্টু হই-হই করে বাবার হাত ধরে মায়ের ঘরের দিকে যেতে চাইছিল। তিতি চোখের ইশারায় তাকে থামতে বলল। পোশাক পরা এবং না-পরা মেয়ে ব্যাপারটার সঙ্গে তার পরিচয় থাকলেও একজন প্রোষিতভর্তৃকা নারী আর বিরহী পুরুষের মাঝখানে তার ভূমিকা কী হওয়া উচিত দেখা গেল তিতি তার চেয়ে ভাল জানে।

একা-একা ঘরে ঢুকে বিজু দেখলেন বিছানার সঙ্গে মিশে কালো, রোগা তনুশ্রী একটা আধময়লা শাড়ি পরে শুয়ে আছেন। চোখ বোজা। তিনি এদিক ওদিক তাকিয়ে নিচু হয়ে তনুশ্রীর বাঁ গালে একটা চুমো দিলেন, বললেন—‘এ কী করেছ? কী হয়েছে তোমার? ছি ছি ছি!’ তনুশ্রী কাঁপা-কাঁপা গলায় বললেন—‘আমি… আমি তোমার যোগ্য নই জানি… কিন্তু তোমায় ভালবাসি… তুমি যা বলবে তাই হবে। যা শাস্তি দেবে তাই মাথা পেতে নেব।’

—‘শাস্তি?’ বিজু অবাক হয়ে বললেন, ‘শাস্তি-ফাস্তির কথা উঠছে কেন? যোগ্যতা-অযোগ্যতারই বা কী হল?’ তারপর বললেন—‘আমি… আমিও তোমায়…’ তিনি তনুশ্রীর ডান গালে একটা চুমো দিলেন।

বাইরে থেকে চিন্টু হেঁকে বলল—‘ড্যাড, বসাক কাকা আর শর্মাজি আসছেন।’

‘এসো’—তিনি তনুশ্রীর দিকে হাত বাড়িয়ে বললেন।

তনুশ্রী মড়ার মতো ফ্যাকাশে হয়ে প্রায় মৃত গলায় বললেন—‘তুমি যাও, আমি আর পারছি না গো!’

বিজু বললেন—‘তুমি যে গৃহিণী, হোস্টেস। চলো, আমি তোমায় ধরে ধরে নিয়ে যাচ্ছি।’

শর্মাজি বললেন—‘আধঘণ্টা আগে ‘রক্সি’ আমায় ফোন করে জানাল বি. বি. রায় হাওড়া স্টেশন থেকে ট্যাক্সি নিয়ে তাঁর বাড়ির দিকে যাচ্ছেন। বসাক বসেছিল। নিয়ে চলে এলাম।’

বসাক দেখল স্বাস্থ্যল, সুঠাম বি. বি. রায় ডান হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে এক মলিন মুখ শ্রীহীন, ক্ষীণদেহ নারীকে নিয়ে আসছেন। তার ভাবীকে চিনতে শরদিন্দু বসাকের খুবই কষ্ট হল। সে বলল—‘কংগ্র্যাচুলেশনস ভাবী। আমরা সব খবরই রাখি বিজুদা, খবর কাকের মুখে ছড়ায়। জানেন তো? তা রিটার্ন অফ দা প্রডিগ্যাল হাজব্যান্ড সেলিব্রেট করার বন্দোবস্ত করতে হয় তো!’

ভাবীর দিকে সে চোখের কোণ দিয়ে তাকাল। এই শ্রীহীন ম্যাড়মেড়ে নারীকে বসাক চায় না। কোনওদিনই চাইবে না আর।

শর্মাজি বললেন—‘রয় তুমি দেখালে বটে! হোয়াটস দা বিগ আইডিয়া?’

বিজু হেসে বললেন—‘মে বি, জাস্ট টু সি হু ইজ এ ফ্রেন্ড অ্যান্ড হু ইজ্‌ন্‌ট্‌?’

শর্মাজি বললেন—‘থ্যাংক গড, আমি সে পরীক্ষায় বোধহয় পাশ করে গেছি।’

চকচকে সাদা কনটেসাটা বড্ড বড়। দিল্লি রোড, জি. টি. রোড কোথাও তাতেও খুব অসুবিধে হয়নি। চুঁচুড়া স্টেশনের তলার জল-ভরা গাড্ডায় ঝপাং করে বসে পড়েছিল। অনেক কষ্টে-সৃষ্টে উঠল। এখন স্টেশন রোড দিয়ে মসৃণভাবে ভেসে চলেছে। বিজন নিজে চালাচ্ছেন। তাঁর পাশে অর্জুন, পেছনে তিতি। বিজু এদের আনতে চাননি। তিনি জানেন তাঁর আর ছুটকির মধ্যে নির্জনতার প্রয়োজন এখনও ফুরোয়নি। কিন্তু তিতি তাঁকে বুঝিয়েছে—‘পিসিমণি আমাদের দেখলে বুঝতে পারবে, শুধু তুমি নও, আমরা সবাই মিলে তাকে কত চাইছি। মাকেও আনা দরকার ছিল। কিন্তু মার শরীরের যা অবস্থা!’

দূর থেকে দেখা যাচ্ছে বাড়িটা। বাতিঘর। মেটে লাল টালি দৃশ্যমান হচ্ছে ক্রমে। মাটি থেকে দোতলার ছাদ পেরিয়ে তরুলতার ঝিরিঝিরি সবুজ। এখন রোদে ম ম করছে চারদিক। নতুন রং করা নতুন বাড়ি সেই রোদ মেখে হাসছে। বিজনের বুক শিরশির করছে বাড়িটা দেখে। কোনও একটা মুহূর্তে বাড়িটাকে দম বন্ধ করা কারাগার মনে হয়েছিল। এখন মনে হচ্ছে একটুকরো স্বর্গ। ওই ঘিয়ে রঙের দরজা খুলে ছুটকি আসবে। তাঁর হারিয়ে-যাওয়া অর্ধাঙ্গিনী। থোকা থোকা চুল উড়বে। চোখের তারায় ঝিলিক। ঠোঁটের হাসিতে স্বপ্ন। ফ্রকের ঘের উড়বে, শাড়ির আঁচল উড়বে। হলুদ-কালো খড়কে ডুরে। তারপর আনন্দ। আনন্দ। পূর্ণ। পূর্ণ সব। যে জীবন এতদিন প্রতিবন্ধী ছিল, সে তার হাত-পা-মস্তিষ্ক সব ফিরে পেয়ে ভাগ্য-বিধাতার জয়গান গাইবে। প্রকৃতপক্ষে, জীবনের হাত থেকে যে তাঁর এত পাওনা ছিল, এত, বিজু রায় কোনওদিন আশাও করেননি। তাঁর অনেক অক্ষমতা, অনেক ত্রুটি, কিন্তু বড় ভাগ্যবান মানুষ তিনি— স্বীকার করতেই হয়।

‘তোরা বোস’—বলে একলা নামলেন তিনি। বেল বাজালেন। ভেতরে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে শব্দটা। ঠিক সেদিনের মতো। একটু পরে দরজা খুলে গেল। একটি তরুণ। এরা এসে গেছে তাহলে? ভালই হল।

বিজু বললেন—‘কেয়া রায়কে ডেকে দিন! আপনাদের বামুন মা।’

—‘আপনার নাম কি বিজনবিহারী রায়?’ তাঁকে আপাদমস্তক দেখে নিয়ে তরুণটি জিজ্ঞেস করল।

—‘হ্যাঁ।’

—‘ও, একটু দাঁড়ান।’ সে ভেতরে চলে গেল। একটু পরেই একটা লম্বা সাদা মুখ আঁটা খাম নিয়ে ফিরে এল। বলল—‘বামুন মা কালই চাকরি ছেড়ে চলে গেছে। আপনি আসলে এই চিঠিটা দিয়ে দিতে বলেছে।’

তরুণ খামটা বাড়িয়ে দিতে দিতে সসম্ভ্রমে বিজুর দিকে চাইল। কনটেসাটার দিকে তাকাল দ্বিগুণ সম্ভ্রমে। ভেতরে উপবিষ্ট অর্জুন আর তিতির দিকেও পাঠাল তার কৌতূহলী দৃষ্টি। তারপরে একটু ইতস্তত করে দরজাটা বন্ধ করে দিল। স্খলিত পায়ে বিজন ফিরে এলেন। পেছনের দরজা খুলে, কোনওমতে সিটের ওপর নিজের শরীরটাকে ফেলে দিলেন। চোখ বুজলেন।

তিতি বলল—‘কী হল বাবা? পিসিমণি কই?’

বিজন শুধু মাথা নাড়তে লাগলেন। নেই, নেই, ছুটকি নেই।

—‘নেই?’ তিতি হতাশ গলায় বলল।

—‘ছুটকি কোথায়? কী বলল ওই ছেলেটি?’ অর্জুন জিজ্ঞেস করল—‘চিঠি দিল না একটা? নিশ্চয়ই কোনও কারণে… চিঠিতে লিখে গেছেন নিশ্চয়ই!’

চিঠিটা তিতির দিকে শক্তিহীন হাতে বাড়িয়ে দিলেন বিজু রায়। শুকনো, তেষ্টা-পাওয়া গলায় বললেন—‘তুই পড়।’

বেশ মোটা চিঠি। মুখটা ছিঁড়ে উল্টো করে ধরতেই ভেতর থেকে ঠুক করে কী একটা পড়ে গেল। তিতি নিচু হয়ে দেখল চিকচিক করছে। তুলে ধরল। একটা সোনার হার। মা দিয়েছিল ছুটকিকে। মায়ের শেষ আশীর্বাদ। মেয়ের প্রতি মায়ের ভালবাসা যা সমস্ত সম্পর্কের ধ্রুবপদ, সেই জিনিস ফিরিয়ে নেবার অনপনেয় অপরাধের জন্য ব্যাকুল ক্ষমা প্রার্থনা, অন্তর্দাহ। ক্ষরিত রক্তবিন্দু স্নেহবিন্দু সব স্বর্ণবিন্দু হয়ে জ্বলছে। ছুটকি ফিরিয়ে দিয়েছে। তিতি চিঠি মেলে ধরল। পরপর কাগজগুলো সাজাচ্ছে। তারপর অবাক হয়ে বলল—‘এ কী?’

খামের ভেতরে কয়েকটা ধবধবে শাদা পাতা খালি। একেবারে শূন্য।

Anuprerona
Anupreronahttps://www.anuperona.com
Read your favourite literature free forever on our blogging platform.
RELATED ARTICLES

Most Popular

Recent Comments