Wednesday, August 27, 2025
Homeকিশোর গল্পবকুলগাছের লোকটা - সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ

বকুলগাছের লোকটা – সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ

এ আমার ছেলেবেলার কাহিনি। ইচ্ছে হলে বিশ্বাস না করতেও পারো কেউ! কিন্তু সত্যি ঘটেছিল।

এক শীতের সকালে পুবের বারান্দায় ঝলমলে রোদ্দুর খেলছে। আমি আমার বোন ইলু সতরঞ্জি পেতে বসে খুব চেঁচিয়ে-চেঁচিয়ে পড়া মুখস্থ করছি। কদিন বাদেই বার্ষিক পরীক্ষা কি না! তার ওপর মেজকাকা বলে দিয়েছেন, যত জোরে চেঁচিয়ে পড়া মুখস্থ করবি, তত ভালো রেজাল্ট হবে। ইলু তো গলা ভেঙে ফেলল উৎসাহের চোটে। কিছুক্ষণ পরে শুনি, ফাঁস-ফাঁস আওয়াজ বেরুচ্ছে বেচারির গলা থেকে। সে মাঝে-মাঝে বই থেকে মুখ তুলে করুণ চোখে তাকিয়ে যেন মেজকাকাকেই খুঁজছে।

মেজকাকার পাত্তা নেই। আমি বললুম,–ইলু, বরং জল খেয়ে আয়!

ইলু ফাঁসাসে গলায় বলল,–যদি মেজকাকু এসে পড়েন!

–তুই ঝটপট খেয়ে আয় গে না! আমি বলব মা ইলুকে ডেকেছেন।

এই শুনে ইলু জল খেতে গেল ভেতরে। আমি আবার চেঁচিয়ে পড়তে শুরু করেছি, মোগল সম্রাট আকবর…মোগল সম্রাট আকবর…, সেই সময় কোত্থেকে হেঁড়ে গলায় কে বলে উঠল, কী পড়া হচ্ছে খোকাবাবু?

আমাদের বাড়ির এদিকটায় বাগান। বাগানের ওপাশে ধানখেত। সবে পাকা ধান কেটে নিয়েছে চাষিরা। সেদিকে দূরে ঘন নীল কুয়াশা ভাসছে, যেন বুড়ো মাঠ আলোয়ান গায়ে দিয়ে এখন ঘুম-ঘুম চোখে তাকিয়ে আছে। বারান্দা থেকে কয়েক মিটার তফাতে আছে একটা ঝাকড়া বকুলগাছ। মনে হল, আওয়াজটা এসেছে ওই থেকেই। তাই মুখ তুলে হাঁ করে তাকিয়ে আছি। খুঁজছি কে কথা বলল।

হঠাৎ দেখি, বকুলগাছ থেকে হনুমানের মতো ধুপ করে নিচে লাফিয়ে পড়ল একটা বেঁটে নাদুসনুদুস গড়নের লোক। হাঁটু অব্দি পরা ধুতি, খালি গা, কুচকুচে কালো রং। বুকের ওপর দিয়ে একটা পৈতে ঝুলছে। তার মাথার কঁচাপাকা চুলগুলো ছোট করে ছাঁটা, খোঁচাখোঁচা হয়ে আছে। টিকিতে ফুল গোঁজা। তার গোঁফগুলোও সেইরকম বিচ্ছিরি। হাতে একটা হুঁকোও আছে। পায়ে খড়ম আছে। সে আমার দিকে তাকিয়ে ফিক করে হাসল। তারপর এগিয়ে আসতে লাগল। আমি তো অবাক। হাঁ করে তাকিয়ে আছি। নাকে ভুরভুর করে তামাকের মিঠে গন্ধ ভেসে আসছে। আমাদের পাঠশালার পণ্ডিতমশাই ঠিক এমন সুগন্ধি তামাক খেতেন।

কিন্তু বকুলগাছে এমন হুঁকো খাওয়া বিদঘুঁটে চেহারার লোক থাকাটা যদি বা মেনে নেওয়া যায়, তার এভাবে পড়া-ডিস্টার্ব করতে আসাটা মোটেও উচিত হয়নি। মেজকাকা থাকলে নিশ্চয় আপত্তি করতেন।

সে হুঁকোয় গুড়ুক-গুড়ুক আওয়াজ করে টান দিতে দিতে আমার একটু তফাতে পা ঝুলিয়ে বসল। তারপর হুঁকো নামিয়ে বাঁ-হাতে ধরে রেখে বলল,–কী? ওটা কী পড়া হচ্ছে?

গম্ভীর মুখে জবাব দিলুম,–ইতিহাস।

এই শুনে সে খিকখিক করে হেসে উঠল,–ইতিহাস? সে আবার কেমন হাঁস খোকা? আঁ? ঢের-ঢের হাঁসের নাম শুনেছি। ইতিহাস নামে কোনও হাঁসের কথা তো শুনিনি!

কী বোকা লোক রে বাবা! হাসি পেল, বললুম, না, না, হাঁস নয়। ইতিহাস।

লোকটা বলল,–সেই তো বলছি গো! পাতিহাঁস, এলেহাঁস, বেলেহাঁস, জলহাঁস, রাজহাঁস, বুনোহাঁসকত রকম হাঁস আছে। সেসব ছেড়ে ওই উছুটে ইতিহাঁস নিয়ে পড়াটা সুবিধের নয়। বরং ওই যে কী বলে পাতাল হাসনাকি হাসপাতাল সেটাও মন্দ নয়!

এবার একটু রাগ হল। বললুম,–তুমি কি বোঝো না!

বুঝি না? আমি বুঝি না? লোকটাও চটে গিয়ে মুখখানা তুম্বো করে ফেলল। আমি বুঝি না তো কে বোঝে শুনি? কোথায় থাকে তোমার ইতিহাস?

বইয়ের পাতা দেখিয়ে বললুম,–এই তো এখানে থাকে।

সে আবার ফিক করে হাসল,–ওই শুকনো খসখসে বইয়ের পাতায় ইতিহাস থাকে? বলছ কী খোকা! খায় কী? এখানে তো দেখছি জলটল একফেঁটা নেই। সাঁতার কাটছেই বা কেমন করে?

বুঝলুম, বকুলগাছের এই হুঁকোখার লোকটা একটি মুখ। লেখাপড়াই জানে না। তাই ওকে ব্যাপারটা বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য বললুম, ইতিহাঁস নয়, ইতিহাস। এর মানে কী জানো?

সে আপত্তি করে বলল, আমাকে মানে বোঝাতে এসো না! বিস্তর হাঁস দেখে দেখে বুড়ো হয়ে গেলুম। দিনরাতে ঝাঁকে ঝাকে ডানা শনশন করে কত হাঁস আসছে যাচ্ছে মাথার ওপর দিয়ে। কত রকম গানও গায়, জানো? শোনো। বলে সে হেঁড়ে গলায় গুনগুন করে গেয়ে উঠল :

তেপান্তরের মধ্যিখানে
মস্ত একটা বিল আছে
কলমিদামে শালুক পানায়
কত যে ফুল ফুটতাছে
শামুক বুড়ো চিংড়িবুড়ি
বড় সুখে রোদ পোহায়
যে যাবি ভাই আয় রে সাথে
শনশনিয়ে আয় রে আয়–

গানটা কেমন ঘুমঘুম সুরে ভরা। শুনতে-শুনতে হাই ওঠে। ঢুলুনি চাপে। শীতের লম্বা রাতের বেজায় লম্বা ঘুমের পর এই মিঠে রোদের সক্কালবেলায় আবার ঘুমিয়ে পড়াটা বিপজ্জনক। মেজকাকা এসে টের পেলেই চুল খামচে ধরবেন।

গান শেষ করে লোকটা চোখ নাচিয়ে বলল, দারুণ গান, তাই না? বলে সে আবার গুড়ক আওয়াজ করে হুঁকো টানতে থাকল।

আমি ঘোরলাগা চোখে তাকিয়ে বললুম,–গানটা ভালো লাগল। তবে বড় ঘুম পায় যে। ওগো লোকটা, তুমি বরং রাতের শোওয়ার সময় এসো। এখন যাও। পড়ায় ডিসটার্ব কোরো না। মেজকাকা বকবেন।

–কে তোমার মেজকাকা? ঢ্যাঙা রোগামতো ছোকরাটা বুঝি?

–চুপ! ও কথা বোলো না। মেজকাকাকে রোগা বললে আগুন হয়ে ওঠেন। মেজকাকার একটা কুকুর আছে, জানো তো? তার নাম কালু। কালুকে

এ পর্যন্ত শুনেই লোকটা যেন চমকে উঠল। চাপা গলায় জিগ্যেস করল, কালু এখন বাড়িতে আছে নাকি?

বললুম, মনে হচ্ছে না। থাকলে এতক্ষণ তোমাকে–

–ওরে বাবা! বোলো না, বোলো না!

ওকে ভয় পেতে দেখে খুব মজা লাগল। বললুম,–তাই তো বলছি, পড়ায় ডিসটার্ব না করে তুমি কেটে পড়ো। এক্ষুণি কালু এসে পড়তে পারে। বোধহয় মেজকাকার সঙ্গে পাড়া বেড়াতে বেরিয়েছে।

লোকটা উঠে দাঁড়াল। তারপর বলল,–তাহলে আসি। আমার কথা কাকেও বোলো না যেন। পরে সময়মতো এসে তোমাকে আরও হাঁসের গান শোনাব। ইচ্ছে করলে দেখতে যেতেও পারও হাঁসেরা কোথায় থাকে। কিন্তু তাই বলে সেখানে তোমার ওই ইতিহাস দেখতে পাবে ভেবো না। তোমার পড়ার বইতে মিথ্যে লিখেছে! বরং ওই যে কী বলে পাতালহাঁস বা হাসপাতাল সত্যি হলেও হতে পারে!

এই বলে সে খড়ম পায়ে চাপা খটখট শব্দ তুলে বলুগাছে দিব্যি চড়ে গেল এবং ঝাকড়া ডালপালার মধ্যে অদৃশ্য হল। আমি অবাক হয়ে বসে রইলুম। আমাদের বাগানের বকুলগাছটাতে এমন কেউ থাকে তা তো শুনিনি। বাবা মা মেজকাকা সেজকাকা ছোটকাকা কেউই বলেনি?

ইলু এতক্ষণে এসে ফাঁসফেঁসে গলায় বলল, কী রে বিশু? কী দেখছিস অমন করে? সেই লেজঝোলা পাখিটা?

উঁহু, বকুলগাছের লোকটা পইপই করে বারণ করেছে। কাকেও ওর কথা বলব না।

–কী রে বিলু? বলছিস না যে! বারবার জিগ্যেস করতে আমার কষ্ট হচ্ছে na বুঝি?

ইলুকে পাত্তা না দিয়ে আবার পড়া শুরু করলুম : মোগলসম্রাট আকবর মোগলসম্রাট আকবর ইতিহাস না–পাতিহাঁস, এলেহাঁস, বেলেহাঁস, রাজহাঁস পুষতে ভালোবাসতেন। তাই তিনি–

ইলু অবাক হয়ে বলল, কী পড়ছিস রে। দাঁড়া মেজকাকা আসুক—

বকুলগাছের লোকটার কথা আমি কাকেও বলিনি। সেই যে ওর সঙ্গে আমার আলাপ হয়ে গেল, তারপর কতবার এই বারান্দা কিংবা বাগানে একলা হলেই সে এসে আমার সঙ্গে কথা বলেছে। কতরকম মজার-মজার গল্প শুনিয়েছে। কত আজব ছড়া!

কিন্তু মুশকিল বাধাচ্ছিল মেজকাকার কুকুর কালু। বেশ দুজনে কথা বলছি, হঠাৎ কালুটা কোথায় ঘেউ-ঘেউ করে ওঠে, অমনি লোকটা বকুলগাছে লুকিয়ে পড়ে। কালুটা মহাপাজি। গাছটা চক্কর দিয়ে ওপরে মুখ তুলে কতক্ষণ ঘেউ-ঘেউ করে। আমি ওকে তাড়াতে গেলে দাঁত বের করে আমাকেই কামড়াতে আসে। আমি ঢিল ছুঁড়ে তাড়াই।

একদিন বিকেলে স্কুল থেকে শেষ পরীক্ষা দিয়ে ফিরে বাগানে একলা দাঁড়িয়ে ওর একটা গল্প শুনছি। গল্পটা দারুণ মজার। আমাদের গাঁয়ের এক শাকতলানী বুড়ি গেছে তেপান্তরের মাঠের মধ্যিখানে সেই হাঁসচরা বিলে। বুড়িটা ছিল বড় কুঁদুলী। লোকে বলত পাড়ার্কুদুলী। কারণ, পাড়ার লোকের সঙ্গে হুট করতেই কোঁদল জুড়ে দিত।

সেই পাড়াকুঁদুলী বুড়ি আপন মনে হাঁসচরা বিলে কলমি শাক তুলছে। তার স্বভাব যাবে কোথায়? একটা শামুকের গুঁড়ে ওর ঠ্যাঙে সুড়সুড়ি লেগেছে বলে বুড়ি তার সঙ্গে কেঁদল জুড়ে দিয়েছে।

বুড়ি নেচে নেচে ছড়া গেয়ে কেঁদল করছে :

তোর মুণ্ডু খাই, তোর কত্তবাবার খাই।
কড়মড়িয়ে খাই আমি মড়মড়িয়ে খাই।
খেয়েদেয়ে ভ্যাডেঙ্গিয়ে নাতির বাড়ি যাই–

এদিকে হয়েছে কী, জলার ধারে থাকে একশাকচুন্নী। সেও পেত্নিপাড়ার নামকরা কুঁদুলী। শাঁখ, গুগলি, কাঁদা আর শামুক তার খাদ্য। এ বুড়ি যেমন পেটের জ্বালায় শাক তুলতে গেছে সেই শাকচুন্নীও তেমনি পেটের জ্বালায় গুগলি, শামুক খুঁজতে গেছে। শাকতলানীর গলা পেয়ে সে ট্যাক্স-ট্যাঙস করে সেখানে হাজির হয়েছে। হয়ে বলেছে, কী কী কী?

ব্যস! দুই কুদুলীতে লেগে গেছে তুমুল কোদল। কেউ থামবার নয়। পরস্পর আঙুল তুলে পরস্পরকে শাসাচ্ছে। সে কী চিলাচানি! সে কী নাচনকোদন!

হেন সময়ে জলার হাসদের রাজার কানে গেছে সেই খবর। হাঁসের রাজা রাজহাঁস খাপ্পা হয়ে বলল?

প্যাঁক প্যাঁক প্যাঁকোর প্যাঁক–
শিগগির গে দ্যাখ তো
কারা দেখায় জাক রে
কাট তাদের নাক
 তবু না থামে যদি,
কাটিস চুল আর দুকানের লতি
প্যাঁক প্যাঁকোর প্যাঁক
শিগগির দ্যাখ তো।…

হুকুম পেয়েই জলার যত পাতিহাঁস বেলেহাঁস শনশনিয়ে ডানা কাঁপয়ে আঁকেঝকে আসতে লেগেছে। আকাশ-বাতাসে হুলুস্থুল। জলার জল ঢেউয়ে তোলপাড়। তারপর কিনা…

আচমকা ঘেউ-ঘেউ! ঘেউ-ঘেউ! বাড়ির ভেতর থেকে হতচ্ছাড়া কালুটা বেরিয়ে বারান্দা থেকে লাফ দিয়ে পড়ল এবং তাকে দেখেই আমার বকুলগাছের কোখেকো বন্ধুবেচারা এক লাফে গাছে চড়ে অদৃশ্য হল। তার কোটা পড়ে গেল হাত ফসকে। কলকে উল্টে ছাই পড়ল গড়িয়ে। আগুনের ফুলকি উঠল চিড়বিড়িয়ে।

বগবগ করে একটু জলও হুঁকোর খোলের ফুটো থেকে গড়িয়ে পড়ল।

কালু চেঁচামেচি করে গাছ চক্কর দিচ্ছে। এমন সময় মেজকাকা বেরিয়ে এলেন বাড়ি থেকে। এসেই কালুকে ধমক দিয়ে বললেন,-শাট আপ! শাট আপ!

কালু থামবার পাত্র নয়। সে মেজকাকুর কাছে এসে হাঁটুর কাছে মুখ তুলে কেঁউমেউ করে কী বলল। তারপর আবার দৌড়ে গেল গাছতলায়।

এবার মেজকাকা সন্দেহাকুল চোখে গাছটা দেখতে-দেখতে বললেন,-গাছে হনুমান আছে নাকি রে বিলু?

বললুম, না মেজকাকু। কালু একটা কাঠবেড়ালি দেখেছে।

হঠাৎ গাছতলায় উল্টে থাকা কোটার দিকে চোখ গেল মেজকাকার। হুঁকোটা তুলে নিয়ে অবাক হয়ে বললেন,–এ কার হুঁকো রে বিলু?

–আমি তো জানিনে মেজকাকু।

মেজকাকু ধমক দিয়ে বললেন–জানো না? এখনও কলকের আগুন রয়েছে। কে হুঁকো খাচ্ছিল বল হতভাগা?

–জানিনে মেজকাকু।

আলবাৎ জানিস বলে হুঁকোটা তুলে ভুড়ভুড়ুক করে কয়েকটা টান মেরে মেজকাকা ফুরফুর করে ধোঁয়া উড়িয়ে দিলেন। বাঃ। এ তো ভারি সুগন্ধি তামাক!

–ও মেজকাকু! ছা-ছা। তুমি কো খাচ্ছ? বলে দেব বাবাকে?

মেজকাকু চোখ টিপে বললেন, চুপ। লেবেনচুস দেব। তারপর মনের আনন্দে হুঁকো খেতে থাকলেন। ততক্ষণে কালু মেজকাকার কাছে ফিরে এসে মুখ তুলে তামাকের গন্ধ শুঁকছে। কালুর মুখটা বেজায় গম্ভীর। চোখে সন্দেহের চাউনি।

তারপর কালু আমার কাছে এসে বেজায় ধমক দিল বারতিনেক। আমি অবিকল মেজকাকার গলায় বললুম, শাট আপ কালু। শাট আপ।

কালু যেন কুকুরের ভাষায় পাল্টা ধমক দিয়ে বলল, চালাকি কোরো না বিলু। সব বুঝতে পেরেছি আমি। তারপর সে কিছুক্ষণ ঘুরঘুর করে লেজ তুলে বাড়ির ভেতর চলে গেল।

মেজকাকা তারিয়ে-তারিয়ে হুঁকো খাওয়ার পর চাপাস্বরে বললেন,–এই বিলু, আরও দুটো লেবেনচুস দেব। বল না, কার হুঁকো এটা?

বলব, না বলব না ভাবছি হঠাৎ বিদঘুঁটে ব্যাপার ঘটে গেল। ততক্ষণে শীতের বেলা ফুরিয়ে এসেছে। বাগানে আর একটুও দিনের আলো নেই। আবছায়া ঘনিয়েছে। গাছগুলো গায়ে কুয়াশার চাদর টেনে নিয়েছে। সেই ধূসর কুয়াশা আর আবছা অন্ধকারে বকুলগাছটা থেকে একটা মস্ত লম্বা কালো হাত বেরিয়ে খপ করে মেজকাকার হাত থেকে হুঁকোটা ছিনিয়ে নিয়ে গেল।

অমনি মেজকাকা আঁতকে উঠে গোঁ-গোঁ করে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলেন।

আর আমিও এতদিন পরে এতক্ষণে ঝটপট বুঝে নিয়েছি, বকুল গাছের বন্ধুটি খুব সহজ লোক নয়। ভয় পেয়ে চেঁচিয়ে উঠেছি সঙ্গে-সঙ্গে।

আমার চেঁচামেচিতে বাবা বেরিয়ে এলেন। এলেন। আর সব কাকারা এলেন। সে এক হুলুস্থুলুস ব্যাপার। আলো আন! জল আন! পাখা আন!

পরদিন সকালে বুধু ওঝাকে ডেকে আনা হল। সে নাকি ভূতপ্রেতের যম। লোকে বলে বুধু ওস্তাদ। সে মেজকাকাকে খুব ঝাড়ফুঁক করে বলল, বলুন, নেই।

মেজকাকা মিনমিনে স্বরে বললে,–নেই।

তারপর বুধু গাছটার চারপাশে ঘুরে দেখে-শুনে বাবাকে বলল, বড়বাবু! এই গাছটা আজই কেটে ফেলুন। এ গাছে ব্ৰহ্মদত্যি আছে।

বাবা ভয় পেয়ে বললেন, বলো কী হে ওস্তাদ!

আজ্ঞে হ্যাঁ বড়বাবু।–বলে বুধু আমার দিকে যেন চোখে তাকিয়ে ফের বলল, আমার মনে হচ্ছে, খোকাবাবুর দিকেও নজর পড়েছে ওনার। কেমন যেন শুকনো-শুকনো দেখাচ্ছে! –খোকাবাবুর চোখে ব্ৰহ্মদত্যিমশাইকে দেখতে পাচ্ছি। ওই তো ইকো টানছে গুড়ুক গুড়ুক করে।

মা সভয়ে আমাকে টেনে নিয়ে বললেন, হ্যাঁ, হ্যাঁ। খোকা কিছুদিন থেকে ভালো করে খাচ্ছেটাচ্ছে না। খালি বকুলতলায় মন পড়ে থাকে। কী যেন ভাবে আর বিড়বিড় করে কথা বলে।

আমি বললুম, ভ্যাট। আমার কি হয়নি।

বুধু আমার বুকে তার কড়ে আঙুল ছুঁইয়ে বিড়বিড় করে কী মন্ত্র পড়ল। তারপর ঘুরে বকুলগাছটার দিকে কটমট করে তাকিয়ে ধমক দিল, যা, যা! ভাগ!

সেদিন দুপুরে দেখি, মকবুল কাঠুরেকে ডেকে আনা হয়েছে। সে কুড়ুল দিয়ে গাছটার কাছে যেতেই আমি কান্নাকাটি জুড়ে দিলুম। মেজকাকা আমাকে থাপ্পড় তুলে ধমক দিলেন, শাট আপ! শাট আপ!

আমার চোখের সামনে নিষ্ঠুর মকবুল কাঠুরে গাছটার গোড়ায় কোপ মারতে শুরু করল। দুঃখেরাগে আমি অস্থির। কিছুক্ষণের মধ্যেই অত সুন্দর বকুলগাছটা মড়মড় করে ভেঙে পড়ল। মকবুল দাঁত বের করে হেসে বলল,-এবার শীতের রোদ্দুর অনেকটা পাবেন বাবুমশাই। এখানে ফুলের গাছ লাগাবেন। দেখবেন, রাঙা-রাঙা ফুল ফুটবে।

Anuprerona
Anupreronahttps://www.anuperona.com
Read your favourite literature free forever on our blogging platform.
RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here


Most Popular

Recent Comments