Tuesday, August 26, 2025
Homeরম্য গল্পসরস গল্পভজহরি ফিল্ম কর্পোরেশন - নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

ভজহরি ফিল্ম কর্পোরেশন – নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

বউবাজার দিয়ে আসতে আসতে ভীমনাগের দোকানের সামনে ঠায় দাঁড়িয়ে গেল টেনিদা। আর নড়তে চায় না। আমি বললুম, রাস্তার মাঝখানে অমন করে দাঁড়ালে কেন? চলো।

–যেতে হবে? নিতান্তই যেতে হবে?–কাতর দৃষ্টিতে টেনিদা তাকাল আমার দিকে; প্যালা, তোর প্রাণ কি পাষাণে গড়া? ওই দ্যাখ, থরে থরে সন্দেশ সাজানো রয়েছে, থালার ওপর সোনালি রঙের রাজভোগ হাতছানি দিয়ে ডাকছে, রসের মধ্যে ডুব-সাঁতার কাটছে রসগোল্লা, পানতো। প্যালা রে–

আমি মাথা নেড়ে বললুম, চালাকি চলবে না। আমার পকেটে তিনটে টাকা আছে, ছোটমামার জন্যে মকরধ্বজ কিনতে হবে। অনেক দেরি হয়ে যাচ্ছে, চলো এখন

টেনিদা শাঁ করে জিভে খানিকটা লাল টেনে নিয়ে বললে, সত্যি বলছি, বড্ড খিদে পেয়েছে রে! আচ্ছা, দুটো টাকা আমায় ধার দে, বিকেলে না হয় ছোটমামার জন্যে মকরধ্বজ

কিন্তু ও সব কথায় ভোলবার বান্দা প্যালারাম বাঁড়ুজ্যে নয়। টেনিদাকে টাকা ধার দিলে সে-টাকাটা আদায় করতে পারে এমন খলিফা লোক দুনিয়ায় জন্মায়নি। পকেটটা শক্ত করে ঢেকে ধরে আমি বললুম, খাবারের দোকান চোখে পড়লেই তোমার পেট চাঁই-চাঁই করে ওঠে– ওতে আমার সিমপ্যাথি নেই। তা ছাড়া, এ-বেলা মকরধ্বজ না নিয়ে গেলে আমার ছেঁড়া কানটা সেলাই করে দেবে কে? তুমি?

রেলগাড়ির ইঞ্জিনের মতো একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল টেনিদা।

ব্রাহ্মণকে সক্কালবেলা দাগা দিলি প্যালা–মরে তুই নরকে যাবি।

-যাই তো যাব। কিন্তু ছোটমামার কানমলা যে নরকের চাইতে ঢের মারাত্মক সেটা জানা আছে আমার। আর, কী আমার ব্রাহ্মণ রে! দেলখোস রেস্তোরাঁয় বসে আস্ত-আস্ত মুরগির ঠ্যাং চিবুতে তোমায় যেন দেখিনি আমি!

উঃ! সংসারটাই মরীচিকা–ভীমনাগের দোকানের দিকে তাকিয়ে শেষবার দৃষ্টিভোজন করে নিলে টেনিদা; নাঃ, বড়লোক না হলে আর সুখ নেই।

বিকেলে চাটুজ্যেদের রোয়াকে বসে সেই কথাই হচ্ছিল। ক্যাবলা গেছে কাকার সঙ্গে চিড়িয়াখানায় বেড়াতে, হাবুল সেন গেছে দাঁত তুলতে। কাজেই আছি আমরা দুজন। মনের দুঃখে দুঠোঙা তেলেভাজা খেয়ে ফেলেছে টেনিদা। অবশ্য পয়সাটা আমিই দিয়েছি এবং আধখানা আলুর চপ ছাড়া আর কিছুই আমার বরাতে জোটেনি।

আমার পাঞ্জাবির আস্তিনটা টেনে নিয়ে টেনিদা মুখটা মুছে ফেলল। তারপর বললে, বুঝলি প্যালা, বড়লোক না হলে সত্যিই আর চলছে না।

–বেশ তো হয়ে যাও-না বড়লোক– আমি উৎসাহ দিলুম।

হয়ে যাও-না! বড়লোক হওয়াটা একেবারে মুখের কথা কিনা! টাকা দেবে কে, শুনি? তুই দিবি?– টেনিদা ভেংচি কাটল। আমি মাথা নেড়ে জানালুম, না আমি দেব না।

–তবে?

লটারির টিকিট কেনো।– আমি উপদেশ দিলুম।

ধ্যাত্তোর লটারির টিকিট! কিনে কিনে হয়রান হয়ে গেলুম, একটা ফুটো পয়সাও যদি জুটত কোনও বার! লাভের মধ্যে টিকিটের জন্যে বাজারের পয়সা চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়লুম, বড়দা দুটো অ্যায়সা থাপ্পড় কষিয়ে দিলে। ওতে হবে না বুঝলি? বিজনেস করতে হবে!

–বিজনেস!

–আলবাত বিজনেস। টেনিদার মুখ সংকল্পে কঠোর হয়ে উঠল; ওই যে কী বলে, হিতোপদেশে লেখা আছে না, বাণিজ্যে বসতে ইয়ে মানে লক্ষ্মী! ব্যবসা ছাড়া পথ নেই বুঝেছিস?

–তা তো বুঝেছি। কিন্তু তাতেও তো টাকা চাই।

–এমন বিজনেস করবে যে নিজের একটা পয়সাও খরচ হবে না। সব পরস্মৈপদী– মানে পরের মাথায় কাঁঠাল ভেঙে।

-সে আবার কী বিজনেস?–আমি বিস্মিত হয়ে জানতে চাইলুম।

–হুঁ হুঁ, আন্দাজ কর দেখি?–চোখ কুঁচকে মিটিমিটি হাসতে লাগল টেনিদা; বলতে পারলি না তো? ওসব কি তোর মতো নিরেট মগজের কাজ? এমনি একটা মাথা চাই, বুঝলি?

সগৌরবে টেনিদা নিজের ব্রহ্মতালুতে দুটো টোকা দিলে।

–কেন অযথা ছলনা করছ? বলেই ফেলো না– আমি কাতর হয়ে জানতে চাইলুম।

টেনিদা একবার চারদিকে তাকিয়ে ভালো করে দেখে নিলে, তারপর আমার কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বললে, ফিলিম কোম্পানি!

অ্যাঁ! আমি লাফিয়ে উঠলাম।

–গাধার মতো চ্যাঁচাসনি টেনিদা ষাঁড়ের মতো চেঁচিয়ে উঠল; সব প্ল্যান ঠিক করে ফেলেছি। তুই গল্প লিখবি– আমি ডাইরেকট–মানে পরিচালনা করব। দেখবি, চারিদিকে হইহই পড়ে যাবে।

–ফিলিমের কী জানো তুমি? আমি জানতে চাইলুম।

–কে-ইবা জানে?–টেনিদা তাচ্ছিল্যভরা একটা মুখ ভঙ্গি করলে; সবাই সমান সকলের মগজেই গোবর। তিনটে মারামারি, আটটা গান আর গোটা কতক ঘরবাড়ি দেখালেই ফিলিম হয়ে যায়। টালিগঞ্জে গিয়ে আমি শুটিং দেখে এসেছি তো।

কিন্তু তবুও–

ধ্যাৎ, তুই একটা গাড়ল। টেনিদা বিরক্ত হয়ে বললে, সত্যি সত্যিই কি আর ছবি তুলব আমরা! ওসব ঝামেলার মধ্যে কে যাবে!

— তা হলে?

–শেয়ার বিক্রি করব। বেশ কিছু শেয়ার বিক্রি করতে পারলে বুঝলি তো?–টেনিদা চোখ টিপল; দ্বারিক, ভীমনাগ, দেলখোস, কে. সি. দাস

এইবার আমার নোয় জল এসে গেল। চুক চুক করে বললুম- থাক, থাক আর বলতে হবে না।

পরদিন গোটা পাড়াটাই পোস্টারে পোস্টারে ছেয়ে গেল।

দি ভজহরি ফিলিম কর্পোরেশন
আসিতেছে–আসিতেছে
রোমাঞ্চকর বাণীচিত্র
বিভীষিকা।
পরিচালনা : ভজহরি মুখোপাধ্যায় (টেনিদা)
কাহিনী : প্যালারাম বন্দ্যোপাধ্যায়।

তার নীচে ছোট ছোট হরফে লেখা : সর্বসাধারণকে কোম্পানির শেয়ার কিনিবার জন্য অনুরোধ জানানো হইতেছে। প্রতিটি শেয়ারের মূল্য মাত্র আট আনা। একত্রে তিনটি শেয়ার কিনিলে মাত্র এক টাকা।

এর পরে একটা হাত এঁকে লিখে দেওয়া হয়েছে : বিশেষ দ্রষ্টব্য শেয়ার কিনিলে প্রত্যেককেই বইতে অভিনয়ের চান্স দেওয়া হইবে। এমন সুযোগ হেলায় হারাইবেন না। মাত্র অল্প শেয়ার আছে, এখন না কিনিলে পরে পস্তাইতে হইবে। সন্ধান করুন- ১৮নং পটলডাঙা স্ট্রিট, কলিকাতা।

আর, বিজ্ঞাপনের ফল যে কত প্রত্যক্ষ হতে পারে, কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই হাতেনাতে তার প্রমাণ মিলে গেল। এমন প্রমাণ মিলল যে প্রাণ নিয়ে টানাটানি। অত তাড়াতাড়ি ব্যাপারটা আমরা আশা করিনি। টেনিদাদের এত বড় বাড়িটা একেবারে খালি, বাড়িসুষ্ঠু সবাই গেছে দেওঘরে, হাওয়া বদলাতে। টেনিদার ম্যাট্রিক পরীক্ষা সামনে, তাই একা রয়ে গেছে বাড়িতে, আর আছে চাকর বিষ্ণু। তাই দিব্যি আরাম করে বসে আমরা তেতলার ঘরে রেডিয়ো শুনছি আর পাঁঠার ঘুগনি খাচ্ছি। এমন সময় বিষ্টু খবর নিয়ে এল মূর্তিমান একটি ভগ্নদূতের মতো।

বিষ্টুর বাড়ি চাটগাঁয়। হাঁইমাই করে নাকি সুরে কী যে বলে ভালো বোঝা যায় না। তবু যেটুকু বোঝা গেল, শুনে আমরা আঁতকে উঠলুম। গলায় পাঁঠার ঘুগনি বেঁধে গিয়ে মস্ত একটা বিষম খেল টেনিদা।

বিষ্টু জানাল : আঁড়িত ডাঁহাইত হইড়ছে (বাড়িতে ডাকাত পড়েছে)।

বলে কী ব্যাটা! পাগল না পেট খারাপ! ম্যাড়া না মিরগেল! এই ভর দুপুর বেলায় একেবারে কলকাতার বুকের ভেতরে ডাকাত পড়বে কী রকম!

বিষ্টু বিবর্ণ মুখে জানাল :নীচে হাঁসি দেইক্যা যান (নীচে এসে দেখে যান)।

আমি ভেবেছিলাম খাটের তলাটা নিরাপদ কিনা, কিন্তু টেনিদা এমন এক বাঘা হাঁকার ছাড়লে যে আমার পালাজ্বরের পিলেটা দস্তুরমতো হকচকিয়ে উঠল।

কাপুরুষ! চলে আয় দেখি একটা বোম্বাই ঘুষি হাঁকিয়ে ডাকাতের নাক ন্যাবড়া করে দি। আমি নিতান্ত গোবেচারা প্যালারাম বাঁড়ুজ্যে, শিংমাছের ঝোল খেয়ে প্রাণটাকে কোনওমতে ধরে রেখেছি, ওসব ডাকাত-ফাকাতের ঝামেলা আমার ভালো লাগে না। বেশ তো ছিলাম, এ-সব ভজঘট ব্যাপার কেন রে বাবা। আমি বলতে চেষ্টা করলুম, এই–এই মানে, আমার কেমন পেট কামড়াচ্ছে–

–পেট কামড়াচ্ছে! টেনিদা গর্জন করে উঠল : পাঁঠার ঘুগনি সাবাড় করার সময় তো সে কথা মনে ছিল না দেখছি। চলে আয় প্যালা, নইলে তোকেই আগে

কথাটা টেনিদা শেষ করল না, কিন্তু তার বক্তব্য বুঝতে বেশি দেরি হল না আমার। জয় মা দুর্গা– কাঁপতে কাঁপতে আমি টেনিদাকে অনুসরণ করলুম।

কিন্তু না– ডাকাত পড়েনি। পটলডাঙার মুখ থেকে কলেজ স্ট্রিটের মোড় পর্যন্ত কিউ!

কে নেই সেই কিউতে? স্কুলের ছেলে, মোড়ের বিড়িওয়ালা, পাড়ার ঠিকে ঝি, উড়ে ঠাকুর, এমন কি যমদূতের মতো দেখতে এক জোড়া ভীম-দর্শন কাবুলিওয়ালা।

আমরা সামনে এসে দাঁড়াতেই গগনভেদী কোলাহল উঠল।

–আমি শেয়ার কিনব—

–এই নিন মশাই আট আনা পয়সা—

ঝি বলল, ওগো বাছারা, আমি এক টাকা এনেছি। আমাদের তিনখানা শেয়ার দাও আর একটা হিরোইনের চান্স দিয়ো

পাশের বোর্ডিংটার উড়ে ঠাকুর বললে, আমিও আষ্টো গণ্ডা পয়সা আনুচি–

সকলের গলা ছাপিয়ে কাবুলিওয়ালা রুদ্র কণ্ঠে হুঙ্কার ছাড়ল : এঃ বাব্বু, এক এক রূপায়া, লায়া, হামকো ভি চান্স চাহিয়ে

তারপরেই সমস্বরে চিৎকার উঠল : চান্স–চান্স! চিৎকারের চোখে আমার মাথা ঘুরে গেল- দুহাতে কান চেপে আমি বসে পড়লুম।

আশ্চর্য, টেনিদা দাঁড়িয়ে রইল। দাঁড়িয়ে রইল একেবারে শান্ত, স্তব্ধ বুদ্ধদেবের মতো। শুধু তাই নয়, এ কান থেকে ওকান পর্যন্ত একটা দাঁতের ঝলক বয়ে গেল তার মানে হাসল।

তারপর বললে, হবে, হবে, সকলেরই হবে, বরাভয়ের মতো একখানা হাত সামনের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললে, প্রত্যেককেই চান্স দেওয়া হবে। এখন চাঁদেরা আগে সুড়সুড় করে পয়সা বের করে দেখি। খবরদার, অচল আধুলি চালিয়ো না, তা হলে কিন্তু

জয় হিন্দ–জয় হিন্দ

ভিড়টা কেটে গেলে টেনিদা দু হাত তুলে নাচতে শুরু করে দিলে। তারপর ধপ করে একটা চেয়ারে বসতে গিয়ে চেয়ারসুদ্ধই চিতপাত হয়ে পড়ে গেল।

আমি বললুম, আহা-হা

কিন্তু টেনিদা উঠে পড়েছে ততক্ষণে। আমার কাঁধের ওপর এমন একটা অতিকায় থাবড়া বসিয়ে দিলে যে, আমি আর্তনাদ করে উঠলাম।

–ওরে প্যালা, আজ দুঃখের দিন নয় রে, বড় আনন্দের দিন। মার দিয়া কেল্লা! ভীমনাগ, দ্বারিক ঘোষ, চাচার হোটেল, দেলখোস-আঃ!

যন্ত্রণা ভুলে গিয়ে আমিও বললুম, আঃ!

–আয় গুনে দেখি– এ কান থেকে ওকান পর্যন্ত আবার হাসির ঝলক উলসে উঠল।

রোজগার নেহাত মন্দ হয়নি। গুনে দেখি, ছাব্বিশ টাকা বারো আনা।

বারো আনা?–টেনিদা ভ্রূকুটি করলে, বারো আনা কী করে হয়? আট আনা এক টাকা করে হলে– উঁহু! নিশ্চয় ডামাডোলের মধ্যে কোনও ব্যাটা চার গণ্ডা পয়সা ফাঁকি দিয়েছে– কী বলিস?

আমি মাথা নেড়ে জানালুম, আমারও তাই মনে হয়।

উঃ–দুনিয়ায় সবই জোচ্চোর। একটাও কি ভালো লোক থাকতে নেইরে? দিলে সক্কালবেলাটায় বামুনের চার চার আনা পয়সা ঠকিয়ে। টেনিদা দীর্ঘশ্বাস ফেলল : যাক, এতেও নেহাত মন্দ হবে না। দেলখোস, ভীমনাগ, দ্বারিক ঘোষ

আমি তার সঙ্গে জুড়ে দিলুম, চাচার হোটেল, কে সি দাস

টেনিদা বললে, ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু শোন প্যালা, একটা কথা আগেই বলে রাখি। প্ল্যানটা আগাগোড়াই আমার। অতএব বাবা সোজা হিসেব- চৌদ্দ আনা–দু আনা।

আমি আপত্তি করে বললুম, অ্যাঁ, তা কী করে হয়?

টেনিদা সজোরে টেবিলে একটা কিল মেরে গর্জন করে উঠল, হুঁ, তাই হয়। আর তা যদি না হয়, তাহলে তোকে সোজা দোতালার জানালা গলিয়ে নীচে ফেলে দেওয়া হয়, সেটাই কি তবে ভালো হয়?

আমি কান চুলকে জানালুম, না সেটা ভালো হয় না!

তবে চল গোটা কয়েক মোগলাই পরোটা আর কয়েক ডিশ ফাউল কারি খেয়ে ভজহরি ফিলম কর্পোরেশনের মহরত করে আসি

টেনিদা ঘর-ফাটানো একটা পৈশাচিক অট্টহাসি করে উঠল। হাসির শব্দে ভেতর থেকে ছুটে এল বিষ্টু। খানিকক্ষণ হাঁ করে তাকিয়ে থেকে বললে, ছটো বাবুর মাথা হাঁড়াপ (খারাপ) অইচে!

কিন্তু দিন কয়েক বেশ কেটে গেল। দ্বারিকের রাজভোগ আর চাচার কাটলেট খেয়ে শরীরটাকে দস্তুরমতো ভালো করে ফেলেছি দুজনে। কে. সি. দাসের রসমালাই খেতে খেতে দুজনে ভাবছি- আবার নতুন কোনও একটা প্ল্যান করা যায় কি না, এমন সময়

দোরগোড়ায় যেন বাজ ডেকে উঠল। সেই যমদূতের মতো একজোড়া কাবলিওয়ালা। অতিকায় জাব্বা-জোব্বা আর কালো চাপদাড়ির ভেতর দিয়ে যেন জিঘাংসা ফুটে বেরোচ্ছে।

আমরা ফিরে তাকাতেই লাঠি ঠুকল : এ বাব্বু– রূপেয়া কাঁহা হামলোগ গা চান্স কিধর?

–অ্যাঃ! টেনিদার হাত থেকে রসমালাইটা বুক-পকেটের ভেতর পড়ে গেল : প্যালা রে, সেরেছে!

–সারবেই তো! আমি বললুম, তবে আমার সুবিধে আছে। চৌদ্দ আনা দু আনা। চৌদ্দ আনা ঠ্যাঙানি তোমার, মানে স্রেফ ছাতু করে দেবে। দু আনা খেয়ে আমি বাঁচলেও বেঁচে যেতে পারি।

কাবুলিওয়ালা আবার হাঁকল :–এঃ ভজহরি বাব্বু–বাহার তো আও—

বাহার আও–মানেই নিমতলা যাও! টেনিদা এক লাফে উঠে দাঁড়াল, তারপর সোজা আমাকে বগলদাবা করে পাশের দরজা দিয়ে অন্যদিকে।

–ওগো ভালো মানুষের বাছারা, আমার ট্যাকা কই, চান্স কই? ঝি হাতে আঁশবটি নিয়ে দাঁড়িয়ে।

–আমারো চান্সো মিলিবো কি না?–উড়ে ঠাকুর ভাত রাঁধবার খুন্তিটাকে হিংস্রভাবে আন্দোলিত করল।

–জোচ্চুরি পেয়েছেন স্যার–আমরা শ্যামবাজারের ছেলে আস্তিন গুটিয়ে একদল ছেলে তাড়া করে এল।

এক মুহূর্তে আমাদের চোখের সামনে পৃথিবীটা যেন ঘুরতে লাগল। তারপরেই–করেঙ্গে ইয়া মারেঙ্গে! আমাকে কাঁধে তুলে টেনিদা একটা লাফ মারল। তারপর আমার আর ভালো করে জ্ঞান রইল না। শুধু টের পেলুম, চারিদিকে একটা পৈশাচিক কোলাহল; চোট্টা–চোট্টা-ভাগ যাতা–আর বুঝতে পারলুম যেন পঞ্জাব মেলে চড়ে উড়ে চলেছি।

ধপাৎ করে মাটিতে পড়তেই আমি হাঁউমাউ করে উঠলুম। চোখ মেলে তাকিয়ে দেখি, হাওড়া স্টেশন। রেলের একটা ইঞ্জিনের মতোই হাঁপাচ্ছে টেনিদা।

বললে, হুঁ হুঁ বাবা, পাঁচশো মিটার দৌড়ে চ্যাম্পিয়ন– আমাকে ধরবে ওই ব্যাটারা! যা প্যালা– পকেটে এখনও বারো টাকা চার আনা রয়েছে, ঝট করে দুখানা দেওঘরের টিকিট কিনে আন। দিল্লি এক্সপ্রেস এখুনি ছেড়ে দেবে।

Anuprerona
Anupreronahttps://www.anuperona.com
Read your favourite literature free forever on our blogging platform.
RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here


Most Popular

Recent Comments