Monday, August 25, 2025
Homeথ্রিলার গল্পভৌতিক গল্পবজ্রযোগীর প্রত্যাবর্তন - মুহম্মদ আলমগীর তৈমূর

বজ্রযোগীর প্রত্যাবর্তন – মুহম্মদ আলমগীর তৈমূর

বৃন্দাবন ঘটকের সাথে পরিচয় হয়েছিল আমার এক আত্মীয়ের বিয়েতে বরযাত্রী হয়ে যাওয়ার সময়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বিয়ে-মুসলমানী এইসব অনুষ্ঠান আমি এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করি। বিয়ে বাড়িতে যতবার গিয়েছি ততবারই আনন্দের চেয়ে বেদনাই বেশি হয়েছে। এখনকার কথা বলতে পারব না, তবে আগের দিনে কোনও একটা গণ্ডগোল মন কষাকষি কিংবা দুর্ঘটনা ছাড়া বিয়ে হওয়া অসম্ভব ছিল। আমার ছোট চাচার বিয়ে হয়েছিল বছরের সবথেকে ছোট দিন ২২শে ডিসেম্বর রাতে। উনপঞ্চাশ মাইল দূরে কনের বাড়ি। সারাদিনের পথ। সকাল সাতটায় বারাত বের হওয়ার কথা ছিল। সেটা বেরুতে বেরুতে বাজল এগারোটা। দাদা হাঁপানির রোগী। ভোর বেলায় ফজরের নামাজ পড়তে উঠেছেন, এমন সময় শুরু হলো শ্বাস-কষ্ট। চোখের পাতাটাতা উল্টে বিশ্রী কাণ্ড। ওরে আমার কী হলো রে, বলে পাড়া মাথায় তুলে ফেলল দাদী। যমের জিম্মায় বাপকে রেখে কোন্ ছেলে আর বিয়ে করতে যাবে? ঘণ্টা তিনেক পর দাদা খানিকটা সুস্থ হয়ে হাঁসের মত ফ্যাসফাস করে বললেন, মেয়ের বাপকে পাকা কথা দেয়া আছে। এ বিয়ে হতেই হবে। এক্ষুণি বেরোও।

মফস্বলের বিয়ে হিটলারের প্যাঞ্জার বাহিনী না যে এক্ষুণি বেরুতে বলল আর তক্ষুণি লেফট-রাইট করতে করতে দশ প্লাটুন বেরিয়ে গেল। মেয়েরা সব কাপড়টাপড় খুলে স্নো পাউডার মুছে পানের বাটা নিয়ে বসেছে। ছেলেরা যে যার মত এদিক সেদিক ঘোরাঘুরি করছে। চায়ের দোকানে বসে বিড়ি-সিগারেট ফুকছে। তাদের এত কীসের গরজ! যার বিয়ে সে বুঝুক। ছোট চাচা ফুসুরফুসুর করে আমার ফুপাকে বললেন, দুলাভাই, তাড়াতাড়ি করেন। অলরেডি অনেক বেশি দেরি হয়ে গেছে। অত দূরের পথ…।

তা তো বটেই। তবে তার থেকে বড় জিনিস হলো পরীর (আমার ফুপাতো বোন) নানার যদি আবার হাঁপানির টান ওঠে, তা হলে তোর বিয়ের ফুল কুঁড়িতেই বিনাশ। নিপ ইন দ্য বাড। এদিকের লোকে বলবে, মেয়ে অলক্ষুণে, ওদিকের ওরা বলবে ছেলের বংশে হাঁপানি-পাগলামি এইসব আছে। এখানে বিয়ে দেয়া যাবে না। একবার বেরুতে পারলে হাঁপানি হোক আর হ্যাঁমারেজ, আগে বিয়ে তারপর বাড়ি ফেরা। তোর ব্যাপারটা আমি বুঝি। একদম টেনশান করিস না। দুমিনিটের ভেতর বারাত বেরুনোর ব্যবস্থা করছি। তোর বিয়ে আজকেই হবে।

পরীকে ডেকে ফুপা বললেন, এই, পরী, তোর মাকে একটু ডাক তো। এমনি এমনি ডাকছে বললে এখন কিছুতেই আসবে না। বলবি, আব্দু প্রেশারের ওষুধ খুঁজে পাচ্ছে না। আব্দুর বমি-বমি লাগছে। বলবি আমি বিছানায় শুয়ে আছি।

ফুপু এলেন প্রায় সাথে সাথে।

ফুপা বললেন, জরী, জরুরি কথা শোন, ওই চিটার কন্ট্রাকটার ঝন্টুকে তো চেনো। এই হারামজাদা আজ দুবছর হলো দুলাখ টাকা নিয়ে আজ দেব কাল দেব করছে। শেষমেষ কানা কামালকে লাগিয়েছিলাম। টাকা দিতে পারবে ঝন্টু। তবে রাস্তার ধারে ওর পাঁচ কাঠা জমি আছে। ওটা লিখে দিতে চাচ্ছে। কানা কামাল খবর পাঠিয়েছে, কালকেই ঝন্টুকে রেস্ট্রি অফিসে ধরে নিয়ে আসবে। ভাবছি, জমিটা তোমার নামে রেস্ট্রি করাব। জামিলের বিয়েটা হয়ে গেলে ওখান থেকেই বাড়ির পথে রওনা হয়ে যেতাম। যে অবস্থা দেখছি তাতে বারাত আজ বের হবে বলে তো মনে হচ্ছে না। ওদিকে কাল যদি বাড়ি না পৌঁছতে পারি, তা হলে ঝন্টুকে আবার কবে ধরতে পারব কে জানে! এরা হলো ফটকাবাজ লোক। একপোজনের কাছে টাকা ধার করে বসে আছে।

পরী বলল তোমার প্রেশার, ওষুধ খুঁজে পাচ্ছ না। দাঁড়াও, ওষুধ খুঁজে দিচ্ছি। আগে ওষুধ খাও, তারপর বিয়ের ব্যাপারটা দেখছি।

এইবার কাজ হলো কারেন্টের মত। ছোট চাচার বারাত বেরিয়ে গেল দশ মিনিটের ভেতর। এক ধ্যাড়ধ্যাড়া বাসে আমরা চৌত্রিশজন বরযাত্রী রওয়ানা হলাম। রাস্তা খানা-খন্দে ভর্তি, গাড়ি চলছে খুব ধীরে। নাটোরের বিড়ালদাহ মাজারের কাছে রাস্তা ভাল পেয়ে ড্রাইভার স্পিড উঠাল। গাড়ি চলছে। সাঁই-সাই। জানালা দিয়ে হু-হুঁ করে বাতাস ঢুকছে ভেতরে। আরামে অনেকেরই চোখ বুজে এসেছে, দুর্ঘটনাটা ঘটল ঠিক সেই সময়। কোত্থেকে একটা ছাগল এসে দৌড়ে রাস্তা পার হতে শুরু করল। ড্রাইভার ছাগল বাঁচাতে যেয়ে এক বাগানে নামিয়ে দিল বাস। সামনের চাকা হুড়মুড় করে গিয়ে পড়ল এক চৌকো গর্তে। ভাগ্য ভালই বলতে হবে, হতাহত হয়নি কেউ। কাণ্ড দেখে আশপাশ থেকে কিছু লোকজনও এসে উপস্থিত হলো। জানা গেল পরিত্যক্ত এক গোরস্থানের বহু পুরনো কবর ওটা। বয়স্ক অনেককেই বেশ চিন্তিত মনে হলো। যাত্রার প্রথম থেকেই বাধা। কবরে যানবাহন পড়ে যাওয়া বড় ধরনের কুলক্ষণ। বিপদের হাত-পা নেই, কখন কোন্ দিক থেকে আসে কে জানে! বাস কবর থেকে উঠানো হবে কীভাবে? হলেও ওটা আবার চালু হবে কিনা সেটাই বা কে বলতে পারে? কনের বাড়ি এখনও ত্রিশ মাইল পথ। ভাল মুসিবতে পড়া গেছে। মেয়েদের কেউ কেউ বাথরুমে যাওয়ার জন্যে অস্থির। স্থানীয় কিছু লোক বলল একটু দূরেই বৃন্দাবন ঘটক নামে এক প্রাইভেট কলেজের শিক্ষকের দালান বাড়ি। মহিলারা সেখানে গেলে ভালভাবে বাথরুম করতে পারবে। মেয়েরা দল বেঁধে বৃন্দাবন ঘটকের বাড়ির পথে রওনা হলো। সাথে ছোট চাচা, ফুপা আর আমি।

দুই
জানালা দরজায় খড়খড়ি লাগানো ব্রিটিশ আমলের পুরনো দোতলা বাড়ি। বাগান ও বারান্দা সব ঝকঝকে তকতকে। বোঝাই যাচ্ছে এরা বনেদি পরিবার এবং এখনও সচ্ছল। এক রামুকাকু শ্রেণীর লোক আমাদের বাইরের ঘরে বসিয়ে ভেতরে খবর দিতে গেল। কিছুক্ষণ পরে বেরিয়ে এলেন বাড়ির মালিক বৃন্দাবন ঘটক। ধুতি-ফতুয়া পরা ছোট করে ছাটা চুল, স্বাস্থ্য একটু মোটার দিকে। তিনি আমাদের চা নাস্তা তো খাওয়ালেনই, সেই সঙ্গে একটা গাড়িরও ব্যবস্থা করে ফেললেন। ভদ্রলোক আমাদের তিনজনকে নিয়ে চা খেলেন তার পড়ার ঘরে। লক্ষ করলাম, কামরার আলমারিতে সাজানো অদ্ভুত দর্শন সেকেলে সব জিনিস। এসবের ভেতর তিনটে জিনিস দেখলে গা শিরশির করে। একটা হলো পূর্ণ বয়স্ক সক্ষম পুরুষদের অণ্ডকোষ চূর্ণ করে পুরুষত্বহীন বা খোঁজা করার যন্ত্র। আর একটি জিনিস হচ্ছে শূল। মৃত্যুদণ্ড পাওয়া আসামিকে শূলে চড়িয়ে মারা হত। কাঠের মোটা পাটাতনের সাথে নব্বই ডিগ্রি অ্যাঙ্গেলে শক্ত করে বসানো তীক্ষ্ণ মাথাঅলা সাড়ে তিন ফুট লম্বা লোহার প্রায় তিন ইঞ্চি মোটা একটা রড। রডে ভাল করে ঘি-তেল-কলা মাখিয়ে আসামিকে তার ওপর বসিয়ে দেয়া হত। রডের চোখা মাথা আসামির গুহ্যদ্বার দিয়ে ঢুকে গলা-মুখ কিংবা চোখের ভেতর দিয়ে বেরিয়ে যেত। অত্যন্ত যন্ত্রণাদায়ক বীভৎস মৃত্যু। এর তুলনায় ফাঁসি অনেক আরামদায়ক। তিন নম্বর হলো ছোট লম্বাটে একটা কোদাল। কোদালের আকৃতি এবং গঠনই বলে দিচ্ছে ওটা মাটি কোপানো সাধারণ কোদাল না। খুব কৌতূহল হলো। বৃন্দাবন ঘটককে জিজ্ঞেস করলাম, এটা তো মনে হচ্ছে কোদাল, ঠিক না?

জী, কোদালই বটে। তবে সাধারণ কোদাল না।

কিছু লোক কথা বলার সময় নাটকীয়তা খুব পছন্দ করে। বৃন্দাবন ঘটককে সেই গোত্রের লোক বলে মনে হলো। বললাম, বাবু, বিষয়টা একটু খুলে বলেন না।

ওটা ঠগীদের কোদাল। ঠগীরা মনে করত মন্ত্রপূত কোদাল শক্তির উৎস। একটা দলের কাছে কোদাল থাকত একটাই। জানেন তো একেকটা দলে কোনও কোনও সময় তিন-চারশো ঠগীও থাকত। বিশাল সব কাফেলা। মানুষ শিকারের নেশায় পথ চলছে মাসের পর মাস। এদের হাতে পুরো ভারতবর্ষে প্রতি বছর খুন হত প্রায় পঞ্চাশ হাজার পথিক। চমকে ওঠার মত ফিগারই বটে। তবে নির্ভেজাল সত্যি।

কোদাল বানাতেও অনেক তন্ত্রমন্ত্র পুজোপাঠ, নররক্ত, পশুবলির দরকার হত। সময়ও লাগত প্রচুর। তবে একবার বানানো হয়ে গেলে কোদালের থাকত অলৌকিক ক্ষমতা। এই কোদালকে কুয়োর ভেতর ফেলে দিলেও ওটা একাই উঠে আসত। যাত্রা শুরুর আগে কোদাল মাটিতে ফেলে ঠগীরা জেনে নিত কোন পথে যেতে হবে। কোন পথে পাওয়া যাবে ধনী পথিক, পথ চলতি বণিক কিংবা রাজকর্মচারী অথবা তাদের পরিবার। ঠগীদের মতন নিষ্ঠুর এবং নিপুণ খুনির দল পৃথিবীতে বিরল। এটি আমার কথা নয়, ইংরেজ ঐতিহাসিকদের কথা। ঠগীরা ছিল আমাদের মতই ঘর সংসারী, নিপাট ভদ্রলোক, কিন্তু ছদ্মবেশী এবং নিষ্ঠুরতম খুনি। যে-কোনওরকম রক্তপাত ঠগীদের জন্যে ছিল সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। এরা নরহত্যা করত গলায় ফাঁস লাগিয়ে। এরপর যেভাবে লাশ গুম করত, সেটা শিল্পের পর্যায়ে পড়ে। তারা দেখিয়ে না দিলে কোনওভাবেই সে লাশ খুঁজে পাওয়া সম্ভব ছিল না। মেয়ে-পুরুষ-শিশু-বৃদ্ধ এদের কাছে সবই সমান। খুনের পর সামান্যতম অনুশোচনাও কখনও অনুভব করেনি। ঠগীরা। কোদাল হারিয়ে ফেললে অর্থাৎ কোদাল নিজ থেকে চলে গেলে ঠগীদের মন ভেঙে যেত। অনেক সময় ভেঙে যেত দলও। বাড়ি ফিরে যতক্ষণ না সর্দার আরেকটি কোদাল তৈরি করতে পারছে, ততক্ষণ খুনোখুনির সব কাজ বন্ধ।

এত দুষ্প্রাপ্য জিনিস আপনি পেলেন কীভাবে?

ও-কথা না-ই বা শুনলেন।

হালকা হেসে কথাটি বলেছিলেন বৃন্দাবন ঘটক।

বৃন্দাবন ঘটকের সাথে পরিচয় এভাবেই। রাস্তাঘাটে খুব বড় উপকার যারা করে, সাধারণত তাদের সাথে এ জীবনে দেখা খুব কমই হয়। হলেও সেই উপকারের এক কণাও ফেরত দেয়া হয় না কখনও। বরং উল্টো এক ধরনের অস্বস্তি হয়।

বৃন্দাবন ঘটকের সাথে আমার দ্বিতীয়বার দেখা হলো সম্পূর্ণ ভিন্ন এক পরিবেশে।

তিন
রাজশাহীর বরেন্দ্র যাদুঘর, মধ্যযুগের পুণ্ড পাণ্ডুলিপি এবং পালি ভাষার চর্চা এই বিষয়টি নিয়ে এক জাতীয় সেমিনারের আয়োজন করেছিল। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আমন্ত্রিত হয়ে সেমিনারে যোগ দিয়েছিলাম আমি। যাদুঘরের অডিটোরিয়ামে দুপুর দুটোয় বরেন্দ্র অঞ্চলে পালি ভাষার প্রসারের ওপর আমার পেপার প্রেজেন্ট করার পর শুরু হলো প্রশ্নোত্তর পর্ব। কয়েকটা প্রশ্নের উত্তর দেয়ার পর ঘোষক যখন আমার প্রেজেন্টেশান শেষ হওয়ার ঘোষণা দিল, ঠিক সেই মুহূর্তে পেছনে একজন উঠে দাঁড়িয়ে গেল। তার নাকি একটা প্রশ্ন আছে। মাইক্রোফোন ততক্ষণে দর্শকদের হাত থেকে ঘোষকের হাতে ফিরে গেছে।

প্রশ্নোত্তর পর্ব শেষ।

আপনার প্রশ্নের জবাব দেয়ার সময় এখন আর নেই, দুঃখিত, ঘোষণা করলেন ঘোষক।

স্টেজ থেকে নেমেই পড়েছিলাম। তারপরেও ঘোষককে বললাম, আচ্ছা, ঠিক আছে। দেখা যাক ওঁর প্রশ্নটা কী।

মধ্যযুগে পুণ্ড্রনগরী অর্থাৎ বগুড়ার মহাস্থান গড়ে পালি ভাষার ব্যাপক চর্চা করতেন একজন প্রখ্যাত মহিলা। যুবতী বয়সে ইনি আত্মহত্যা করেন। বলা হয় এঁর মৃত্যুর পরপরই এ অঞ্চলে পালি ভাষার চর্চা পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। আপনি এ ব্যাপারে কোনও আলোকপাত করেননি। কেন করেননি?

অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি মফস্বল শহরের এইসব সেমিনারে স্থানীয় কিছু লোক প্রায়ই উল্টোপাল্টা প্রশ্ন করে দর্শকদের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করে। এরা চায় সেমিনারের বক্তাদের উটকো ঝামেলায় ফেলে বাহবা পেতে। এদের জন্যে একটা আলাদা প্রস্তুতি রাখতে হয়। তবে স্বীকার করতেই হবে, এই বিষয়ে আমি কিছুই জানতাম না। পেপার তৈরি করেছি তাড়াহুড়ো করে। এখন বুঝতে পারছি আমার আরও পড়াশুনা করার দরকার ছিল। কিন্তু সেই স্বীকারোক্তি এখন দিলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। আমি তৎক্ষণাৎ বললাম, সেই মহিলার নাম কি শীলাদেবী?

এটা একটা চালাকি ধরনের উত্তর। মধ্যযুগের ইতিহাসে শীলাদেবী বেশ প্রচলিত নাম। ভদ্রলোক যদি বলেন হ্যাঁ তা হলে বলব এটি অত্যন্ত বিতর্কিত বিষয়। এই ব্যাপারে ঐতিহাসিকরা কেউই একমত হতে পারেননি। ওটাকে কিংবদন্তি ছাড়া অন্য কিছু বলা যায় না। আর ভদ্রলোক যদি বলেন না তা হলে বলব আপনি কোন মহিলার কথা বলছেন বুঝতে পারছি না। ইতিহাসে তো শুধু শীলাদেবীর উল্লেখ আছে। তবে তার অবদান তেমন বিশেষ কিছু নয়।

ভদ্রলোকের উত্তর হলো হ্যাঁ বাচক এবং আমিও হা-এর উত্তরে যা বলার তাই-ই বললাম। লক্ষ করলাম, উত্তর শুনে ভদ্রলোক সামান্য হাসলেন। অন্যান্য মফস্বলী পণ্ডিতদের মত তর্ক না জুড়ে বসে পড়লেন। বিকেল পাঁচটায় সেমিনার শেষ করে অডিটোরিয়াম থেকে আমরা সবাই বের হচ্ছি, হঠাৎ শুনতে পেলাম কে যেন আমার নাম ধরে ডাকছে। ঘুরে তাকাতেই দেখলাম পঞ্চাশোর্ধ্ব এক হিন্দু ভদ্রলোক দরজার পাশে দাঁড়িয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। সেই প্রশ্নকর্তা। দেখে যেন মনে হয়: চিনি উহারে। এর আগেও এঁকে কোথাও দেখেছি। লোকটির কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, আপনি পেছন থেকে ডাকছিলেন আমাকে?

জী, আমিই ডেকেছি।

আপনাকে চেনা চেনা লাগছে। আগে আপনার সাথে দেখা হয়েছে কখনও?

জী, তা একবার হয়েছে। আজ থেকে আট-দশ বছর আগে যখন আমার বাড়িতে এসেছিলেন, তখন দেখা হয়েছে।

ঠিক বুঝলাম না। খুব পরিচিত দুএকজন ছাড়া কারও বাড়িতে আমি কখনও যাই না। আপনার বাড়ি কোথায়? আর গিয়েইছিলাম বা কী কারণে-বলতে পারবেন?

আমার ধারণা ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসরদের স্মরণশক্তি প্রখর হয়। যা হোক, আমার বাড়ি নাটোরের বিড়ালদাহ মাজারের কাছে। আপনাদের কোনও এক আত্মীয়ের বিয়ে ছিল। আপনারা আমার বাসায় কিছু সময়ের জন্যে অতিথি হয়েছিলেন। আমার নাম বৃন্দাবন ঘটক এরপরও যদি চিনতে না পারেন, তো আর কিছু করার নেই।

আমার সবকিছু মনে পড়ল, কিছুটা লজ্জাও পেলাম। এঁর কথা ভুলে যাওয়া খুবই অন্যায় হয়েছে। তার হাত ধরে বললাম, বাবু, আপনাকে চিনতে না পারার জন্যে আমি অত্যন্ত দুঃখিত। প্লিজ, কিছু মনে করবেন না।

আরে না। এরকম হয়। আসুন, কোথাও গিয়ে একটা বসি। আপনাদের এখন অন্য কোনও প্রোগ্রাম নেই তো?

আজ সন্ধ্যায় ঘোড়ামারায় একটা ভাল হোটেলে আয়োজকরা আমন্ত্রিতদের সম্মানে ডিনারের ব্যবস্থা করেছেন। কিন্তু সেকথা বৃন্দাবন ঘটককে আর বললাম না।

না। তেমন কিছু নেই। সন্ধেটা ফ্রি আছি। কোথাও যেতে ইচ্ছে হলে চলেন। মন খুলে কথা বলা যাবে।

পদ্মার পাড়ে বিকেলে হাঁটতে ভাল লাগে। চলুন। ওদিকটাতে যাই।

কোনও সমস্যা নেই। আপনি যেখানে ভাল মনে করেন।

চার
রাজশাহী শহরে পদ্মার ধার ঘেঁষে অনেক উঁচু আর বিশাল লম্বা বাঁধ দেয়া হয়েছে। বৃন্দাবন বাবু আমাকে নিয়ে বাঁধের ওপর উঠে হাঁটতে লাগলেন। সবথেকে ভাল লাগল ব্রিটিশ আমলের বড় বড় অফিসারদের বাড়িগুলো যেখানে, সেই জায়গাটা। পদ্মার ধারে লাইন দিয়ে প্রকাণ্ড কম্পাউণ্ডঅলা লাল রঙের বড় বড় সব বাড়ি। দরজার সমান বড় অসংখ্য জানালা তাতে। কোথায় বাড়ি করতে হবে সেটা ইংরেজদের চেয়ে ভাল আর কেউ জানত না। হাত-পা ছড়িয়ে বাঁধের ওপর বসলাম আমরা। এক বাদামঅলাকে ডেকে দুছটাক বাদাম কিনলেন বাবু। বললেন, আসুন, খেতে খেতে গল্প করি।

এইসব বাড়িগুলোতে কারা থাকে এখন?

ডিসি, এসপি, বড় বড় ইঞ্জিনিয়ার এইসব লোকেরা। ইংরেজ সাহেবদের চেয়েও এদের ঠমক বেশি। দেশের সব ভাল ভাল জিনিস এরাই ভোগ করে। সাধারণ মানুষ আগে ইংরেজদের গোলামি করত, এখন করে এদের দাসত্ব। যেই লাউ সেই কদু।

এ হচ্ছে জর্জ অরওয়েলের দি এনিমেল ফার্ম। সিস্টেম একই থাকে, শুধু তোক পাল্টে যায়। ধনতন্ত্র অবিনাশী।

আগে কিন্তু এরকম ছিল না। রাজনৈতিক পট পরিবর্তন হলে সবকিছু পাল্টে যেত। এই পুরাজ্যের কথাই ধরেন।

বাবু, আপনি পালি ভাষার বিষয়ে অনেক জানেন বলে মনে হচ্ছে। পুরনো জিনিসের মত পুরনো ভাষাতেও আপনার আগ্রহ আছে নাকি? : আগ্রহ ছিল না। তবে বিশেষ কারণে আগ্রহ হয়েছে। আপনার কখনও যাকে বলে অতিপ্রাকৃত এমন কোনও

অভিজ্ঞতা হয়েছে?

জী-না। আমি মানুষ হয়েছি শহরে। আমার ধারণা, অতিপ্রাকৃত ঘটনা শহরের চেয়ে গ্রামেই বেশি ঘটে। প্রাকৃত অপ্রাকৃত কোনও ঘটনা নিয়েই শহরের মানুষের মাথা ঘামানোর সময় নেই। যান্ত্রিকতা এবং ভৌতিকতা দুই মেরুর জিনিস।

এ কথা ঠিক না। শহরেও অতিপ্রাকৃত ঘটনা ঘটে। তবে সেটা জানাজানি হয় কম। যা হোক, আমার জীবনের একটা ঘটনা আপনাকে বলি। একদম সত্যি ঘটনা। তখন জানুয়ারির শেষ। আমি বিড়ালদাহ হাইস্কুলে মাত্র ক্লাস সিক্সে উঠেছি। স্কুল থেকে সিদ্ধান্ত হলো সেবছর বার্ষিক পিকনিক হবে নাটোরের রানী ভবানীর প্রাসাদে। চাল, ডাল, মশলা, ছাগল, তেল, হাঁড়ি-পাতিল, থাল, বাটি এসব নিয়ে শিক্ষক-ছাত্র কেরানী-পিওন ঠাসাঠাসি করে দুটো বাসে রওনা হলো। ভোরে বাস ছাড়ার পর সবাইকে কাগজের ঠোঙায় দেয়া হলো মুড়ি ও পাটালিগুড়ের নাস্তা। সেযুগে বোতলের পানি ছিল না। একজগ পানির সবটাই স্যররা খেলেন। আমরা এক বুক তৃষ্ণা নিয়ে বসে থাকলাম কখন রানী ভবানীর প্রাসাদে পৌঁছব, সেই আশায়। প্রাসাদে পৌঁছে টিউবওয়েল থেকে পেট ভরে পানি খেলাম সবাই। তারপরই ঘটল বিপত্তি। ভোরে উঠে অনেকেই বাথরুম করার সময় পায়নি। দেখা গেল ওই কাজ এখন সমাধা না করলেই নয়। এত বাথরুম তো সেখানে নেই। ঝোঁপঝাড়ই ভরসা। আমি যেখানেই যাই, সেখানেই কেউ না কেউ বসে পেট খালি করছে।

হাঁটতে হাঁটতে চলে গেলাম কম্পাউণ্ডের সর্ব দক্ষিণ কোণে। চারদিকে আম-কাঁঠালের বাগান। এরই আড়ালে জবুথুবু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে তিনদিকে টানা বারান্দাঅলা মন্দির। ধরনের প্রাচীন এক দালান। ছাদ ধসে পড়েছে, কয়েকটা থামে ভর দিয়ে দেয়াল তখনও খাড়া হয়ে আছে বটে, তবে ওগুলো ছেয়ে গেছে বট আর অশ্বত্থ গাছের শেকড়ে। লাল রঙের মেঝে এখনও যথেষ্ট উঁচু। একটাই ঘর, তবে ভেতরে ঢোকার পথ তিনটে। দেয়ালের সাথে ফিট করা লোহার ক্ল্যাম্প দেখে বোঝা যায়, আগে ওগুলোতে দরজা ছিল। ফেটে চৌচির সিঁড়ি বেয়ে উঠে ভেতরে উঁকি দিলাম। ঘরের মেঝে গাছের মরাপাতা, ভাঙা ইটের টুকরো ও ধুলোবালিতে বোঝাই। হঠাৎ চোখে পড়ল লাল-সাদা পাথরের মেঝের এককোণে কালো রঙের স্বস্তিকা আঁকা। স্বস্তিকার চার বাহুতে থেবড়ে বসে আছে হিন্দু ধর্মের চার প্রধান দেবদেবী। এদের চারজনের মাথার ওপর চার পা রেখে দাঁড়িয়ে আছে এক গাভী। তার পিঠের ওপর কৃষ্ণের কাটা মাথা হাতে বসে আছে মহিষাসুর। পুরো চিত্রটা ছয়কোনা একটা লাল তারার ভেতর আঁকা।

হঠাৎ ওই বৃত্তটা থেকে বাতাসের ছোট্ট একটা ঘূর্ণি উঠল। শুকনো পাতা, ধুলোবালি, পাখির পালক ঘুরপাক খেতে লাগল ঘূর্ণির ভেতর। আস্তে আস্তে একটি মানুষের আকৃতি পেল ঘূর্ণিটা। লালচর্মসর্বস্ব এক বুড়ো। গায়ে কোনও কাপড়চোপড় নেই। মাথায় জট পাকানো চুল, নীলচে লম্বা দাড়ি, হলদেটে চামড়া। দেখলাম সম্পূর্ণ নগ্ন ওই বুড়ো একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। বুড়োর দৃষ্টি থেকে চোখ ফেরাতে পারছি না। এক ঘোরলাগা অবস্থা হলো। বারান্দা পেরিয়ে পায়ে পায়ে এগিয়ে যেতে লাগলাম দরজার দিকে। যেতেই হবে ওই ন্যাংটো বুড়োর কাছে। চৌকাঠ পেরিয়ে ঘরের ভেতর পা রাখব, এমন সময় মেয়েলী গলায় পেছন থেকে কে যেন ডাকল আমাকে। ঘোর কেটে গেল। তৎক্ষণাৎ। ঝট করে পেছনে তাকালাম। কোথাও কেউ নেই। দূরে শিমুল গাছের ডালে বসে একটা ঘুঘু ডাকছে। জীবনে কখনও এত ভয় পাইনি। লাফিয়ে নেমে এলাম বারান্দা থেকে। পেছন ফিরে আর তাকানোর সাহস হয়নি।

এক দৌড়ে প্রাসাদের সামনে এসে দেখি জলিল স্যর সবাইকে একটা করে টোস্ট বিস্কুট দিচ্ছেন। এই স্যর সমাজ, বিজ্ঞান, বাংলা এইসব ক্লাস নেন। ইনি ক্লাসে কিছু পড়ান না, শুধু পড়া ধরেন। প্রশ্নের উত্তর দিতে না পারলে পিঠের ছাল চামড়া সব তুলে ফেলেন। একবার বাংলা ব্ল কবিতা যাকে আমরা বলতাম ছিপখান তিন দাঁড় পুরোটা মুখস্থ বলতে না পারায় আমাকে এত জোরে চড় মারলেন যে তিন দিন ধরে কানের ভেতর ঝিঁঝি পোকা ডেকে গেল। আমার তখন বুক কাঁপছে। তারপরও দুরমুশ জলিলের (স্কুলের ছেলেরা স্যরকে এই নামেই ডাকত) কাছ থেকে বিস্কুট নিলাম। বিস্কুট খেয়ে আমরা সবাই আরও এক রাউণ্ড পানি খেলাম। এর পরপরই পেট নেমে গেল আমার। দাঁড়িয়ে থাকতে না পেরে শুয়ে পড়লাম গাছের নিচে। আমার অবস্থা দেখে খেপে গেলেন জলিল স্যর।

সবাইকে শুনিয়ে বললেন, এইসব উটকো ঝামেলা তার একেবারে পছন্দ না। ক্লাস টেনের এক ছাত্রকে দিয়ে লোকাল বাসে বাড়ি পাঠিয়ে দিলেন আমাকে। আমাদের পাড়ারই ছেলে। তার আর পিকনিক খাওয়া হলো না। এরপর একমাস কালাজ্বরে ভুগলাম। ঘুমালেই হলদেটে ঝুলঝুল চামড়ার এক কুৎসিত নগ্ন বুড়োকে দেখতে পেতাম। সন্ধের পর একা থাকতে ভয় করত।

উনি থামতেই আমি বললাম, বৃন্দাবন বাবু, আপনি এটাকে অতিপ্রাকৃত ঘটনা কেন বলছেন? ওটা একটা হ্যালুসিনেশান। এই কাহিনির সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো ওই নগ্ন বুড়ো। সবদেশেই ভয়ানক বিকৃত রুচির কিছু বুড়ো থাকে। এরা শিশুদের সাথে নানারকম নোংরা কাজকর্ম করে। যৌন বিষয়ে শিশুদের কোনও ধারণা থাকে না। তাদের কচি মনে গভীর ছাপ ফেলে এইসব জঘন্য কর্মকাণ্ড। একটা ঘটনা বলি। ক্লাস নাইনে উঠে আমরা আগের বছরের ফেল করা এক ছাত্রকে পেলাম। প্রত্যেক ক্লাসেই এরকম একজন দুজন থাকে। তবে এর ব্যাপার আলাদা। এই ছেলেকে দিয়ে তাদের পাড়ার এক বুড়ো পায়ু মৈথুন করাত। বারংবার এই ঘটনা ঘটার পর তীব্র অপরাধবোধে ভুগতে শুরু করে ছেলেটি। পরে বহুদিন ঘরে আটকে রেখে তার মানসিক চিকিৎসা করাতে হয়েছিল। হয়তো ছোটবেলায় আপনিও ভিকটিম হয়েছিলেন।

জী-না। একমাত্র সন্তান হিসেবে আমি বড় হয়েছি কঠিন বেষ্টনীর ভেতর। বাড়িতে মা সারাক্ষণ চোখে চোখে রাখতেন। বাইরে বের হলে সাথে বয়সে বড় কেউ না কেউ থাকতই। তবে এর পরের ঘটনাগুলো শুনলে আপনার কাছে। বিষয়টি আরও স্বচ্ছ হবে।

পরে আবার কী ঘটনা ঘটল, সে বুড়োর পরিচয় জানতে পারলেন?

সত্যি কথা বলতে কী, ব্যাপার কিছুটা সেই রকমই। এক বছর পরের ঘটনা। আমি তখন ক্লাস সেভেনে পড়ি। সেই সমগ্ন গরমের ছুটিতে মা আমাকে নিয়ে বেড়াতে গেলেন নানাবাড়ি রামপুর বোয়ালিয়ায়। রাজশাহী-বগুড়ার মাঝখানে এক প্রত্যন্ত অঞ্চল এটি। প্রত্যন্ত অঞ্চল হলেও খুব বিখ্যাত। সন্ধের সময় অভ্যেসমত মায়ের আঁচল ধরে বসে আছি দেখে বড় মামা মাকে জিজ্ঞেস করলেন, কী রে, রমা, বিনু এত ভয় পাচ্ছে কেন?

মামাকে ভেঙেচুরে সবকিছু জানালেন মা।

তখন মামা বললেন, সিধু জ্যাঠার কাছে নিয়ে যাব কালকে। দেখি উনি কী বলেন৷

পাঁচ
পরদিন বিকেলের দিকে বড় মামা আমাকে সিধু জ্যাঠার কাছে নিয়ে গেলেন। ওই এলাকায় সবচেয়ে পুরনো আর বড় বংশই মামাদের বংশ। এই সিধু জ্যাঠা আমার নানার ভাই। ইনি দিনে করেন কবিরাজি আর রাতে মহাকালদেবীর পুজো। গাঁয়ের লোকেরা তাঁকে মনে করে তান্ত্রিক। ভাল জ্যোতিষী হিসেবে নাম-ডাক আছে। মন্দিরের কাছাকাছি সেবায়েতের যে পোড়ো বাড়ি ছিল, সেই বাড়িরই ভিটের ওপর বাড়ি করেছিলেন সিধু জ্যাঠার পরদাদা। সেই বাড়িও বলতে গেলে অনেক আগের। জ্যাঠা বিয়ে-শাদি করেননি। তার এক বাল্যবিধবা বোনকে নিয়ে একাই থাকেন ওই জড়ভরত বাড়িটাতে। দেখলাম জ্যাঠার পরনে লালসালু। লম্বা দাড়ি, কাঁচাপাকা চুল মাথার ওপর চুড়ো করে বাঁধা। কপালের মাঝখানে রক্ত তিলক। রাত জেগে জেগে চোখ লাল। পোচ। পোঁচ কালি জমেছে চোখের নিচে। সম্পূর্ণ অনুভূতিশূন্য মরা মাছের চোখ। ওগুলোর দিকে তাকালে ধড়াস করে ওঠে বুকের ভেতর। ঘরের দাওয়ায় মাদুরে বসে ঝকঝকে কাঁসার বাটিতে নারকেল কোরা দিয়ে গুড়মুড়ি খাচ্ছেন সিধু জ্যাঠা। বড় মামাকে দেখে বললেন, বনস্পতি যে, তা এদিকে কী মনে করে?

জ্যাঠা, এ হলো রমার ছেলে বৃন্দাবন। বিড়ালদাহ থেকে কালই এখানে এসেছে। ভাবলাম আপনার কাছে নিয়ে আসি।

সিধু জ্যাঠা তাঁর ইলিশ মাছের চোখ দিয়ে দেখলেন আমাকে। বললেন, আয়, মাদুরে বোস। দেখি তোর বাঁ হাত।

ঠাণ্ডা নরম হাত দিয়ে আমার বাঁ হাতের তালু মেলে ধরলেন। কিছুক্ষণ পর বললেন, কী, ছেলে, রাতে ভয় লাগে? ন্যাংটা বুড়োর কথা মনে পড়ে?

মামা কিছু বুঝলেন না, তবে আমার গায়ের রোম দাঁড়িয়ে গেল। এ লোক অন্তর্যামী নাকি? বড় মামাকে কাছে ডেকে বললেন, বনস্পতি, এই দেখ তোর ভাগ্নের হাত দেখ। এর তো তেনার দর্শন হয়েছে রে।

কার দর্শন হয়েছে, জ্যাঠা? হাতেই বা কী দেখলেন?

তোর ভাগ্নে, এই বেন্দাবন জন্মেছে এক বিশেষ তিথিতে। তই তো কিছুই শিখলি না। সারাজীবন শুধ স্লেচ্ছদের গোলামি করলি। এর বাঁ হাতের তালুর দিকে চেয়ে দেখ। চন্দ্রের ক্ষেত্র থেকে ওই যে রেখাটা উঠে মঙ্গলের কাছে। ধনুকের মত বাঁক নিয়ে বুধের নিচে গিয়ে থেমে গেছে। অতি বিরল রেখা এটি। জাতকের হাতে এই বিশেষ রেখাঁটি থাকলে অতীন্দ্রিয় ক্ষমতার অধিকারী হয় সে। বরেন্দ্রের সবচেয়ে বড় তান্ত্রিক হলো রানী ভবানীর ঠাকুর্দার ঠাকুর্দা রাজা সূর্য নারায়ণ। বহুকাল আগের কথা। সে-ই সব তান্ত্রিকের গুরু। এই রেখা তার হাতে ছিল। এরই সাথে দেখা হয়েছে তোর ভাগ্নের। আর সেই থেকেই ভয়ে সিঁটিয়ে আছে বেন্দাবন। আমার কাছে এসে যখন পড়েছেই, ভয় ভাঙিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করছি। পরশু শুক্লপক্ষের নবমী। সারাদিন উপোস করিয়ে রাখবি তোর ভাগ্নেকে। সন্ধ্যায় ওকে স্নান করিয়ে মন্দিরে নিয়ে আসবি। ভয়কে পেঁদিয়ে বৃন্দাবন দেখিয়ে দেব।

সিধু জ্যাঠা ছিলেন ভয়ানক মুসলমান বিদ্বেষী। যদিও তাঁর রোগী বেশিরভাগই ছিল ওই গোত্রের লোকেরাই। চড়া ফি আদায় করতেন তাদের কাছ থেকে। লোকে বলত জ্যাঠা সাক্ষাৎ ধন্বন্তরি। উনি যা দাবি করতেন লোকে তাই-ই দিত তাকে।

ছয়
জ্যাঠার কথামত সন্ধের সময় বড় মামা আমাকে মন্দিরে নিয়ে গেলেন। মহাকালদেবীর মন্দির অনেক পুরনো। বহুকাল আগে বিরাট বড় ছিল। এখন শুধু অজস্র ভাঙা দেয়াল পিলারের ভেতর ছোট্ট একটি ঘরই টিকে আছে। সিধু জ্যাঠাই কোনওরকমে টিকিয়ে রেখেছেন। মহাকালদেবীর মূর্তি মন্দিরের যে ঘরটিতে ছিল সেটি বহু আগেই জরাজীর্ণ হয়ে ভেঙে পড়েছে। এর সাথে গেছে আরও অসংখ্য কামরা আর প্রকোষ্ঠ। এখন শুধুমাত্র দাঁড়িয়ে আছে মহাকালদেবীর মূর্তি যে ঘরখানাতে ছিল, তার পেছনের কামরাটি। সিধু জ্যাঠা সাধনা করেন ওই কামরাটিতেই। এটি তার কাছে খুবই পবিত্র এক সাধন পীঠ। কালো কষ্টি পাথরে তৈরি তিন ফুট লম্বা মহাকালদেবীর মূর্তি। চোখ ফেরানো যায় না এত সুন্দর। তবে এর ভেতরে কোথায় যেন ভয়ঙ্কর এক নিষ্ঠুরতা লুকিয়ে আছে। সাদা একটা থান পরিয়ে মূর্তির সামনে চিৎ করে শোয়ালেন আমাকে সিধু জ্যাঠা। আমার মাথাটা রাখলেন মূর্তির পায়ের কাছে। চোখ মেলে তাকাতেই দেখলাম দৈবী সরাসরি তাকিয়ে আছেন আমার দিকে। জ্যাঠা বললেন, ভয় পাসনে, বেন্দাবন। চোখ বন্ধ করে খুব আস্তে আস্তে শ্বাস নে। মুখটা একটু হাঁ কর, দুচামচ ওষুধ খাওয়াব তোকে।

ভীষণ তেতো কী একটা খাওয়ালেন আমাকে জ্যাঠা। কিছুক্ষণ পর মনে হলো আস্তে আস্তে খুব গভীর কোনও গর্তে পড়ে যাচ্ছি। হঠাৎ দেখলাম আলো ঝলমলে একটা সবুজ ঘাসে ঢাকা উপত্যকায় দাঁড়িয়ে আছি। সামান্য দূরে ছোটখাট একটা পাহাড়ের চূড়ায় লাল আর সোনালি রঙের অপূর্ব এক বৌদ্ধ মন্দির। বিকেলের আলোয় চকচক করছে। পেছনে সাদা ধপধপে বরফে ঢাকা হিমালয়ের অসংখ্য পাহাড়-চুড়ো। বরফে রোদ লেগে রংধনুর সাত রং বেরুচ্ছে। ঢং-ঢং করে ঘণ্টা বাজতে লাগল মন্দিরটাতে। মন্দিরের সিঁড়িতে পা রাখব, এমন সময় খানিকটা দূরে একটা পাহাড়ের গুহা থেকে গলগলিয়ে ধোয়া বেরিয়ে আসতে দেখলাম। লক্ষ করলাম, ধোঁয়াগুলো আকাশে উঠতে উঠতে পৌরাণিক গল্প উপকথার বীভৎস সব প্রাণীর আকৃতি নিচ্ছে। খুব কৌতূহল হলো। কী হচ্ছে ওখানটাতে? গুহার কাছাকাছি যেতেই ধূপ এবং পোড়া ঘিয়ের গন্ধ পেলাম। গুহাটা সুড়ঙ্গের মত সামনে এগিয়ে ডানে। বাঁক নিয়েছে। বাঁকের কাছেই আলো ছড়াচ্ছে একটা জ্বলন্ত মশাল। চারদিক ঝকঝকে তকতকে। বাঁক ঘুরে দেখলাম গম্বুজের মত ছাদঅলা গোলাকার বিরাট এক হলঘরের মত। হলঘরের এখানে সেখানে পুড়ছে আরও অনেক মশাল। সামনেই গুহার দেয়াল কুঁদে বানানো চওড়া ধূসর বেদীর ওপর কালো কুচকুচে পাথরের বড় একটা মূর্তি। লাল চুনি পাথরের চোখ, কোঁকড়ানো চুল, চওড়া কপাল, পাকানো শরীর। পাতলা ঠোঁটে তাচ্ছিল্যের হাসি। মূর্তিটি অসম্ভব জীবন্ত।

বেদীর সামনে মেঝের ওপর গোল বৃত্তের ভেতর ছয়কোনা একটা তারা আঁকা। তার ওপর পদ্মাসনে বসে হোমের আগুন জ্বেলে, মন্ত্র উচ্চারণ করছে এক বৃদ্ধ। কোমরের ওপর থেকে গা খালি। মশালের আলোয় চকচক করছে শরীরের ফর্সা চামড়া। নিখুঁত কামানো মাথা, শরীরের কোথাও একটা লোম পর্যন্ত নেই। বিচিত্র এক ভাষায় গম্ভীর স্বরে অনর্গল মন্ত্র পাঠ করছে বুড়ো। মনে হলো গভীর রাতে ধানশ্রী রাগে বাঁশি বাজছে দূরে কোথাও। একটা ঘোরের ভেতর চলে গেলাম আমি। পুরোহিত আর বেদীর মাঝখানে জল ভর্তি সবুজ পাথরের শবাধারে একটি নগ্ন তরুণীর লাশ ভেসে থাকতে দেখলাম। পুরোহিতের বাঁ দিকে দাঁড়িয়ে সাদা থান পরা এক যুবতাঁকেও মন্ত্র উচ্চারণ করতে দেখলাম। মেয়েটির কোমর অবধি কোঁকড়ানো এলোচল। ধপধপে সাদা সুডৌল বাহু, গোলগাল পায়ের গোছা। ছোট্ট পাতলা দুটো পাতায় সরু নিপুণ আঙুল। গোলাপি নখ ডেবে আছে সাদা তুলতুলে মাংসের ভেতর। মেয়েটির চুলের প্রান্ত বেয়ে এক ফোঁটা দুফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ে নিতম্বের কাছে কাপড় ভিজিয়ে ফেলেছে। কিছুক্ষণ আগেই স্নান করেছে বোধহয়। বুকের কাছে দুহাত জড় করে গভীর মনোযোগ দিয়ে মন্ত্র উচ্চারণ করছে সে। মেয়েটিকে অসাধারণ সুন্দরী বললেও কম বলা হয়। এমন একটি মেয়ের সাথে সারাজীবনে অনেকের একবারও দেখা হয় না। মুখের দিকে তাকিয়ে মনে হলো এ সাক্ষাৎ স্বরস্বতী। পায়ে পায়ে এগিয়ে গিয়ে তান্ত্রিকের ডান পাশে বসে পড়লাম।

ওই সন্ন্যাসী আমাকে কিছুই বলেনি, তবুও বুঝতে পারলাম, এ বৈশালী নগরের রাজ পুরোহিত চিত্রকূট। যুবতী বৈশালী রাজকন্যা সঙ্মিত্রা। মূর্তিটি আদি পিশাচ দেবতা আহুরার। মন্ত্র পড়তে পড়তে হঠাই চিত্রকূট আমার বা হাতটা ধরল। মেঝেতে আঁকা তারার মত কাঠের একটি তারা আমার হাতের তালুতে রেখে হাতের মুঠো বন্ধ করল। ঠিক তখন সঙ্মিত্রাকে আটটি কস্তুরী মৃগনাভী, একদলা কর্পূর হোমের আগুনে নিক্ষেপ করতে দেখলাম। হোমের আগুন তৈরি হয়েছে চন্দন কাঠ দিয়ে। চারদিকের বাতাসে চন্দন পোড়ার মিষ্টি সুবাস। চিত্রকূট এবং সঙ্মিত্রার মন্ত্র উচ্চারণের শব্দ এখন চাপা ও গম্ভীর। লক্ষ করলাম, সবুজ শবাধারের ভেতরকার তরুণীর লাশটি সটান দাঁড়িয়ে গেল। পানিতে ভিজে ভিজে ওটার শরীরের চামড়া নীলচে হয়ে গেছে। পেছন দিকে বেঁকে গেল লাশটার মাথা, খুলে হাঁ হয়ে গেল মুখ। খোলা মুখ থেকে ঝলকে ঝলকে বেরুতে লাগল তীব্র আলোর রশ্মি। গম্বুজ ভেদ করে অনন্ত নক্ষত্রবীথি স্পর্শ করল সেই আলোর শিখা। একই সাথে লাশের শরীর থেকে নীলচে আলোর ঢেউ বেরিয়ে ভাসিয়ে নিয়ে গেল পুরো গুহা। এরই ভেতর দেখলাম জীবন্ত হয়ে উঠেছে আহুরার মূর্তি। • আগুন-গরম ইস্পাতের মত জ্বলজ্বল করছে, চুনির চোখ। একতাল আঁধার হয়ে বেদী থেকে নেমে এল পিশাচ দেবতা। বজ্রপাতের গুমগুম শব্দে গুহার দেয়াল কাঁপতে লাগল থরথর করে। সেই জমাট বাঁধা অন্ধকার এগিয়ে এসে চিত্রকূটের দেহ ভেদ করে গম্বুজের চূড়াকে দুভাগ করে মিলিয়ে গেল আকাশে। চারদিক থেকে ভেসে এল কানে তালা ফাটানো হা হা, হা-হা, হা-হা শব্দ। তরুণীর লাশ শবাধারের পানি সব উধাও। ছয়কোনা তারাটির মাঝে পড়ে আছে চিত্রকূটের পরিধেয় সাদা কাপড়। অদৃশ্য থেকে কে যেন বলল, ভয় পেয়ো না। এখন থেকে আমাকে সবসময় কাছে পাবে তুমি।

দীর্ঘক্ষণ কথা বলে থামলেন বৃন্দাবন ঘটক।

আমি বললাম, বৃন্দাবন বাবু, এই ঘটনা থেকে আপনি আসলে কী প্রমাণ করতে চাইছেন? এখানে অতিপ্রাকৃত কোনও কিছুই তো দেখতে পাচ্ছি না। মেক্সিকোর অ্যাজটেকরা বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠানে পেয়োটি নামের এক জাতীয় ক্যাকটাস সেবন করত। সাংঘাতিক হ্যালুসিনেটরী ড্রাগ এটি। আপনার সিধু জ্যাঠা কবিরাজ মানুষ। তিনি এ জাতীয় কোনও কিছুর রস খাইয়ে থাকবেন আপনাকে।

এই ঘটনার পর কোনওদিনই কিন্তু আমি আর ভয় পাইনি।

না পাওয়াই স্বাভাবিক। ভয় সম্পূর্ণ মানসিক ব্যাপার। আপনাকে সম্মোহিত করে স্ট্রং সাজেশান দিয়েছিলেন। আপনার সিধু জ্যাঠা। পুনরায় ভয় পাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না।

এ কথার কোনও জবাব না দিয়ে বৃন্দাবন বাবু তাঁর বা হাতটি আমার দিকে এগিয়ে দিলেন। চেয়ে দেখলাম তাঁর হাতের তালুর ঠিক মাঝখানে গাঢ় লাল রঙের ছয়কোনা একটি তারার ছাপ আঁকা। যেন ওখানটাতে উল্কি করিয়েছেন। যে বিষয়টিতে আমার সবচেয়ে বেশি খটকা লাগল, সেটি হলো তারার ছয়টি কোণ। আধুনিক তারা সবই পাঁচকোনা। ছয়কোনা তারা ব্যবহার হত সহস্র বছর আগে। কেউ যদি এর হাতে ট্যাটুও করে থাকে, তা হলে ওই তারা পাঁচকোনা হওয়ার কথা, ছয়কোনা কোনওভাবেই নয়। আমি বললাম, বাবু, সবই না হয় বুঝলাম। কিন্তু প্রশ্ন একটা থেকেও গেল। সেটি হলো এসবের সাথে পালি ভাষার সম্পর্কটা আসলে কোথায়?

ওই ব্যাপারটি জানতে হলে আপনাকে আরও কিছুক্ষণ ধৈর্য ধরতে হবে। এই রাম কাহিনি এখনও শেষ হয়নি।

হাতঘড়ির দিকে চেয়ে দেখলাম রাত সাড়ে আটটা বাজে। প্রায় তিন ঘণ্টা হলো বাঁধের ওপর বসে আছি। নদীর জোরালো হাওয়ায় ভিজে ভিজে লাগছে শরীর, খিদেও পেয়েছে খুব। হিলহিলে ঠাণ্ডা বাতাস দিচ্ছে। মনে হয় কেঁপে বৃষ্টি আসবে। বৃন্দাবন ঘটককে বললাম, বাবু, চলেন মিউজিয়ামের গেস্ট হাউসে যাই। ওখানে বাবুর্চি আছে। তাদেরকে বললেই খাবার রান্না করে দেবে। আজকে রাতে আমার সাথে খাওয়া-দাওয়া করেন।

ভেবেছিলাম বৃন্দাবন ঘটক রাজি হবেন না। কিন্তু বাস্তবে উল্টোটা ঘটল। বাবু আমার সাথে যাওয়ার জন্যে রাজি হয়ে। গেলেন। গেস্ট হাউসে পৌঁছতে পৌঁছতে রাত সাড়ে নটা বাজল। আমার সাথে যারা ছিলেন, তারা সবাই ডিনারে। বাবুর্চিও রান্নাঘর সাফসুতরো করে তালাটালা দিয়ে বাড়ি যাওয়ার জন্যে রেডি। তার হাতে দেড়শো টাকা দিয়ে। বললাম, মুরগির ঝোল সরু চালের ভাত-ডাল আর ভাজি করার জন্যে। আরও বললাম, যদি খুশি করতে পারো, তা হলে আরও বিশ টাকা বখশিশ পাবে। সে সময়ে দেড়শো টাকা বেশ ভাল টাকা। বাবুর্চি বেশ চালাক-চতুর লোক। রান্নায় বসার আগেই আমাদের দুকাপ চা দিয়ে গেল। একটা পুরনো বাংলা টাইপের বাড়িকে গেস্ট হাউস বানানো হয়েছে। চা নিয়ে বেতের চেয়ার পেতে আমরা দুজন বারান্দায় বসলাম। আকাশে মেঘের ঘনঘটা, কড়কড় করে বাজ পড়ল কাছেই কোথাও। সেই সাথে চলে গেল কারেন্ট, শুরু হলো দমকা বাতাস। একই সঙ্গে বাংলোর টিনের চালে বড় বড় ফোঁটায় চড়চড় শব্দে বৃষ্টি পড়তে লাগল। নিকষ কালো অন্ধকারে ডুবে গেলাম আমরা। বৃন্দাবন বাবু আবার তার কাহিনি শুরু করলেন। তাঁর মুখ দেখা যাচ্ছে না, শুধু গলা শুনতে পাচ্ছি।

সাত
এই ঘটনার পর সিধু জ্যাঠার সাথে আমার ভাব হয়ে গেল খুব। প্রতিদিন বিকেলে যাই তাঁর কাছে। নানান গল্প কাহিনি শোনান জ্যাঠা আমাকে। একদিন শোনালেন রামপুর বোয়ালিয়ার ঘটনা। বললেন, তুই জানিস না, বেন্দাবন। এই রামপুর বোয়ালিয়া এক পুরনো জনপদ। এর ইতিহাসে ঘটনার ঘনঘটা। বারোশো সালের শেষের দিকে এদেশে মুসলমান দরবেশরা দলে দলে আসতে শুরু করে। শাহ তুরকান নামের এক আউলিয়া এখানে এসে ইসলাম প্রচার করতে শুরু করলেন। সেই সময়ে এই এলাকা শাসন করত। তান্ত্রিক রাজা অংশুদেব চওবন্দী আর তাঁর ভাই খের্জুরচণ্ড। এরা পুজো করত মহাকালদেবী নামে এক জাগ্রত প্রতিমার। এই দেবীকে তুষ্ট করার জন্যে তান্ত্রিক রাজারা ফি বছর তাঁর বেদীতে নারী ও শিশু বলি দিত। এই রাজাদের সাথে তুরকান। শাহর যুদ্ধ বাধল। তুরকান শাহর পক্ষে থাকল অন্যান্য দরবেশ, অসংখ্য অনুসারী। তান্ত্রিক রাজাদের সৈন্যরা প্রথমে হেরেই যাচ্ছিল। খবর পেয়ে তান্ত্রিক রাজা অংশুদেব সন্ধের সময় মহাকালদেবীর বেদীতে এক অল্প বম্বেসী মা আর তার। দশ মাসের শিশুকে একসাথে উৎসর্গ করল। রাতে দেবী স্বপ্নে দেখা দিয়ে বললেন, পরদিন আবার যখন যুদ্ধ শুরু হবে, তখন বলি দেয়ার খড়গটি নিয়ে রাজাকে যেতে হবে যুদ্ধের ময়দানে। তবে দুপুর হওয়া পর্যন্ত তাকে অপেক্ষা করতে হবে। দুপুরে যুদ্ধের ময়দানে নামাজ পড়তে দাঁড়াবেন তুরকান শাহ। এটা মুসলমানদের অবশ্য কর্তব্য। এই সময় পশ্চিম আকাশের দিকে তাকিয়ে অংশুদেব যদি দেখে তিনটে শকুন চক্রাকারে ঘুরছে, তা হলে সাঁথে সাথে আঘাত হানবে সে।

পরদিন সকাল বেলা আবার যুদ্ধ শুরু হলো। রাজার। সৈন্য মরতে লাগল কাতারে কাতারে। দুপুর নাগাদ তুরকান শাহর বাহিনী রামপুরের প্রায় কাছাকাছি চলে এল। রাজধানীর পতন হবে যে-কোনও মুহূর্তে। ধৈর্য হারাল না রাজা। অক্ষরে অক্ষরে পালন করল দেবীর নির্দেশ। পশ্চিমাকাশে শকুন। চোখে পড়তেই খড়গ হাতে নিয়ে কালো কুচকুচে মাদী ঘোড়ায় চেপে তুরকান শাহ বাহিনীর কেন্দ্র লক্ষ্য করে ছুটে গেল অংশুদেব। দরবেশের যোদ্ধারা দেখল অন্ধকার ছায়ার মত কী একটা তাদের পাশ কাটিয়ে প্রচণ্ড বেগে ছুটে যাচ্ছে। তুরকান শাহ তখন রুকুতে। জয় মা মহাকালদেবী বলে খড়গের এক কোপে দরবেশের ধড় আর মাথা আলাদা করে ফেলল তান্ত্রিক রাজা। ঠিক সেই মুহূর্তে শোনা গেল। বজ্রপাতের প্রচণ্ড শব্দ, ঘনিয়ে এল আঁধার। তুরকান শাহর বাহিনী অবাক হয়ে দেখল, দরবেশের মাথা শূন্যে উড়তে উড়তে চলে গেল বহুদূরে। হারিয়ে গেল দৃষ্টির আড়ালে। মহাকালদেবীর জয় বলে ছুটে এল রাজার সৈন্যরা। নতুন মনোবল নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল তুরকান শাহর বাহিনীর ওপর। কচুকাটা হয়ে গেল সব দরবেশ আর নতুন যারা মুসলমান হয়েছে।

যুদ্ধ শেষ হলে রাজার ভাই খেজুরচণ্ড মহাকালদেবীর তান্ত্রিক পুরোহিতদের নিয়ে তুরকান শাহর লাশ উঠিয়ে আনার চেষ্টা করেছিল। উদ্দেশ্য, দেবীর বেদীতে লাশ উৎসর্গ করা। তবে সে আকাঙ্ক্ষা পূরণ হয়নি। হাতি দিয়ে টেনেও লাশ ওঠাতে পারেনি তান্ত্রিকেরা। বাধ্য হয়ে গভীর এক গর্ত খুঁড়ে লাশ পুঁতে ফেলে তারা। ওখানেই এখন তুরকান শাহ শহীদের মাজার। এরপর কেটে গেল বহুদিন। তান্ত্রিক রাজা অংশুদেব আর খেজুরচণ্ড ততদিনে কিংবদন্তিতে পরিণত হয়েছে। রাতদিন চলছে মহাকালদেবীর পুজো আর নরবলি। ঠিক সেই সময়ে দেখা দিল আরেক দরবেশ। এঁর নাম শাহ মখদুম রূপস। ইনি সাদা কাপড়ে সব সময় মুখ ঢেকে রাখতেন। তার আসল চেহারা কেউ কখনও দেখেনি। স্বয়ং বড়পীর আব্দুল কাদের জিলানী (রঃ) এঁর পরদাদা। তুরকান শাহ হত্যার প্রতিশোধ নিতে বদ্ধপরিকর শাহ মখদুম। অংশুদেব আর খেজুরচণ্ডের সাথে তার সংঘর্ষ হয়ে উঠল অনিবার্য। তবে রূপস তুরকান শাহের মত ভুল করলেন না। তিনি জানতেন, মহাকালদেবীর পুজো করে করে দেবীর কৃপায় অংশুদেব এক অনন্য শক্তির অধিকারী। এর মুখোমুখি হতে হলে তান্ত্রিকদের বিষয়ে ব্যাপক জ্ঞান আছে এমন ব্যক্তির পরামর্শ দরকার। ভাগ্য ভাল ছিল দরবেশের। বাংলায় তখন ইসলাম প্রচার করছেন শাহ সুলতান মাহিসওয়ার। তান্ত্রিকের যম এই সুফি দরবেশ। ইনি এদেশে এসেছিলেন পানিপথে। মাছের আকারের এক নৌকোয় করে। লোকের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ল দরবেশ মাছের পিঠে চড়ে এসেছেন। তার নাম হয়ে গেল মাহিসওয়ার। চিটাগাং-এ পা রেখেই তিনি জানতে পারেন নোয়াখালির দক্ষিণে সমুদ্রপাড়ে হরিরামনগর বলে এক সমৃদ্ধ নগরী আছে। এখানকার রাজা বলরাম অতি বড় তান্ত্রিক এবং ভয়ানক অত্যাচারী। দরবেশ বুঝলেন, জনগণের মন জয় করতে হলে এই অজেয় রাজাকে যুদ্ধে হারিয়ে আমজনতার সামনে এর শিরচ্ছেদ করতে হবে।

তান্ত্রিকদের শক্তির অন্যতম প্রধান উৎস হলো তারা যে দেবী মূর্তির পুজো করে, সেই দেবী মূর্তি। যুগের পর যুগ অসংখ্য নরবলি মন্ত্র সাধনা এবং হোম আর পুজোর পরই কেবল ধীরে ধীরে প্রাণ প্রতিষ্ঠা হয় এসব মূর্তিতে। এরা হয়ে ওঠে জাগ্রত। এসব মূর্তির সামনে রেখে মন্ত্রপূত করা হয় ত্রিশূল কিংবা খড়গ। প্রায় অজেয় হয়ে ওঠে ওই সব বিশেষ অস্ত্রের মালিকেরা। দরবেশরা প্রচুর অর্থের বিনিময়ে কোনও দুর্বল চরিত্রের অর্থলোভী তান্ত্রিক পুরোহিতকে দলে ভেড়াতেন। বলরামের বেলায় বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল তার এক মন্ত্রীও। আউলিয়ারা কোরবানি করা বকনা গরুর রক্ত তামার পাত্রে ধরে রাখতেন। দরবেশদের কথামত গোরক্ত দিয়ে দেবীর চরণ ভেজাত দলছুট পুরোহিত। এরপর তারা ওই রক্ত ছিটিয়ে দিত মন্দিরের চারপাশে। মন্ত্রপূত ত্রিশূল বা খড়গ রাখা হত দেবীর পায়ের কাছে। গোরক্ত মাখিয়ে দেয়া হত ওগুলোতেও। এ কাজগুলো সমাধা হওয়ার পরপরই চালানো হত আক্রমণ। তান্ত্রিক রাজারা যুদ্ধক্ষেত্রে গিয়ে হতভম্ব হয়ে দেখত, দেবীর কোনও শক্তিই কাজ করছে না আর। মুসলমান যোদ্ধাদের কাছে সম্পূর্ণ অসহায় তারা। যুদ্ধে পরাজিত রাজা আর তার সেনাপতিদের শিরচ্ছেদ করা হত। মন্দিরের সামনেই। তান্ত্রিকতার বিনাশ সুফিবাদের সূচনা।

শাহ মখদুম রূপস মাহিসওয়ারের পরামর্শে প্রচুর অর্থের বিনিময়ে অংশুদেবের প্রধান পুরোহিতের শ্যালক পঞ্চানন পাণ্ডেকে হাত করলেন। অবশ্য এর পেছনে অন্য ঘটনাও আছে। চল্লিশজন স্ত্রীর গর্ভে অংশুদেবের পঞ্চাশটা ছেলেমেয়ে জন্মেছিল। এদেরই মধ্যে এক মেয়ে ছিল অনন্য সুন্দরী। মেয়েটিকে দেখে হুঁশজ্ঞান হারিয়ে ফেলে পঞ্চানন। প্রেম নিবেদন করে বসে। সাধারণের জন্যে রাজার মেয়েকে বিয়ে করা কিংবা তার সাথে প্রেম করার শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। প্রধান পুরোহিতের মুখের দিকে তাকিয়ে অংশুদেব পঞ্চাননকে শূলে চড়াল না বটে, তবে তার নাক-কান কেটে দিল। প্রতিহিংসায় দ্বিতীয়বার হুশ হারাল পঞ্চানন। অংশুদেবকে ঝাড়েবংশে শেষ না করে তার শান্তি নেই। তারপর যা হওয়ার তাই হলো। শাহ মখদুম রূপসের সাথে যুদ্ধে হেরে গর্দান হারাল অংশুদেব আর তার ভাই খেজুরচণ্ড। রাজার মেয়েটিকে পেতে ছেয়েছিল পঞ্চানন। তবে শাহ মখদুম রূপস তাতে রাজি হননি। ঘটনা জানাজানি হয়ে যেতে পারে এই ভয়ে টাকা-পয়সা নিয়ে সে পালিয়ে গিয়েছিল বহুদূরের কোশল রাজ্যে। আত্মগোপন করে থাকা রাজার অনুসারী কিছু তান্ত্রিক বিষয়টি আঁচ করতে পেরে একরাতে প্রধান পুরোহিতের বাড়ি আক্রমণ করে ওটাতে আগুন ধরিয়ে দেয়। বহুদিন ওই ভিটে ছিল পরিত্যক্ত। এর অনেকদিন পর ওখানে আবার বাড়ি তৈরি করে ওই পুরোহিতের বংশধরেরা। ওই পুরোহিতেরই নাতির নাতি তস্য নাতি হলো তোদের এই সিধু জ্যাঠা, বুঝলি কিছু রে, বেন্দাবন?

সিধু জ্যাঠা নানান ধরনের তত্ত্বকথাও শোনাতেন। একদিন বললেন, বুঝলি, বেন্দাবন, এই জগৎ সংসার হলো ভাল আর মন্দের যুদ্ধক্ষেত্র, শুম্ভ নিশুম্ভের লড়াই। কে ভাল কে মন্দ সেটি নিয়ন্ত্রণ করে নিয়তি। তোর কথাই ধর। যদি ওই বৌদ্ধ মন্দিরে যেতিস, তুই হতি লোকনাথ বাবার মতন বিরাট সাধু। সেখানে না গিয়ে তুই গেলি চিত্রকূটের গুহায়। বদলে গেল তোর নিয়তি, তোর পথ হলো পিশাচসিদ্ধ তান্ত্রিকের। আমার কথা শোন, এই লাইনে এসেই যখন পড়েছিস, তখন ভাল করে তন্ত্রমন্ত্র শেখ। তবে এজন্যে তোকে সবচেয়ে আগে শিখতে হবে পালি। এ হচ্ছে গৌতম বুদ্ধের ভাষা। থিরুরা দাবি করে দুনিয়ায় পালির মত নিখুঁত কোনও ভাষা নেই। পৃথিবীর সবকিছু বদলে যেতে পারে, শুধু পরিবর্তন হয় না পালির। দেবতা, অপদেবতা, আল্লাহ, ভগবান, ঈশ্বর কেউই মূখের প্রার্থনা পছন্দ করে না। প্রার্থনা হতে হবে সুমধুর, প্রাঞ্জল, হৃদয়গ্রাহী-যার ভাষা হবে নিখুঁত। জানিস তো ইউরোপ আমেরিকায় শয়তানের পুজো করতে ল্যাটিন ভাষা ব্যবহার হয়। আয়, আজ থেকে তোকে পালি শেখাই।

আট
সেই আমার পালি ভাষায় হাতে খড়ি। খুব ধীরে বছরের পর বছর ধরে পালি শিখলাম। তান্ত্রিকদের লেখা পুঁথিও পড়লাম বিস্তর। আদ্যিকালের পুঁথি পাণ্ডুলিপিতে সিধু জ্যাঠার ঘর ভর্তি। এ ছাড়াও অদ্ভুত সব পুরনো জিনিস ছিল তার সংগ্রহে। আপনি আমার বাসায় যে জিনিসগুলো দেখেছিলেন, সেসবই এই সিধু জ্যাঠার কাছ থেকে পাওয়া। অকৃতদার পুরুষ, ছেলেমেয়ে বা তিনকুলে কেউ নেই। আমাকেই সব দিয়ে গেছেন। ভীষণ অভিশপ্ত জিনিস ওগুলো। পিশাচ সাধনায় উপাচার হিসেবে এসব সামগ্রীর গুরুত্ব সীমাহীন।

সিধু জ্যাঠার মৃত্যু হয় ১৯৭১-এ স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়। ওই সময় হিন্দুপ্রধান রামপুর বোয়ালিয়া খান সেনাদের অন্যতম প্রধান টার্গেট হয়ে দাঁড়ায়। রাতদিন রাজাকার ইনফর্মার আর মিলিটারির আনাগোনা। জ্যাঠার তিরিক্ষি মেজাজের কারণে অনেকেরই রাগ ছিল তার ওপর। যে কোনও দিন হামলা হওয়ার সম্ভাবনা। সাবধানের মার নেই ভেবে একদিন খুব ভোরে বিরাট এক, ট্রাঙ্ক মাথায় করে আমাদের বাড়িতে এসে হাজির হলেন সিধু জ্যাঠা। বোনকে রেখে এসেছেন মামাদের বাড়িতে। বিড়ালদাহর কাছেই দাশুড়িয়া বর্ডার দিয়ে ভারতে পালিয়ে যেতে চান। ভারতে যাওয়ার বিষয়টি তখন তত সহজ ছিল না। যাব বললেই যাওয়া যায় না। রাজাকার মিলিটারিদের চোখে ধুলো দিলেও সর্বস্ব কেড়ে নেয়ার জন্যে পথে-প্রান্তরে ওঁৎ পেতে আছে অজস্র দালাল-চোর-ডাকাত। শরণার্থী পরিবারের সোনাদানা, টাকা-পয়সা সব কেড়ে নিয়ে মা-মেয়েকে সবার সামনে বলাৎকার করার ঘটনা তখন আকছার ঘটছে। যুবতী সুন্দরী মেয়ে দেখলে এরা অনেক সময় তাদের নিজেদের ফুর্তির জন্যে কাছেও রেখে দিত। তাকে বললাম, দাদু, আপনাকে কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে। এলাকার বিশ্বস্ত কোনও দালালের সাথে দিতে চাই আপনাকে আমি।

তা না হয় বুঝলাম। কিন্তু কতদিন অপেক্ষা করতে, হবে আমাকে?

একেবারে দিনক্ষণ উল্লেখ করে তো কিছু বলতে পারছি না, দাদু। একদিনও হতে পারে আবার সাতদিনও হতে পারে। রাস্তা-ঘাটের অবস্থা, বর্ডারের পরিস্থিতি সব বুঝে তবেই না ব্যবস্থা।

এসব শুনে খুব একটা খুশি হতে পারলেন না জ্যাঠা। চুপ করে থাকলেন। বললেন, দেখ যা ভাল হয়…

আমাদের পাড়ার কদম রসুল সেই সময় লোক পারাপার করত। জনপ্রতি দুটো টাকা তার রেট। তবে লোক বিশ্বস্ত, সেই ছোটবেলা থেকে আমাদের বাড়িতে এর বাবার আসা যাওয়া। সিধু জ্যাঠা আমার গুরু। তাঁর কাছ থেকে সে কোনও টাকা চায় না। শুধু পথ-খরচা দিলেই হবে। জ্যাঠা ছাড়াও আরও চারজনকে নিয়ে এক বর্ষার রাতে রওনা হলো কদম রসুল। জ্যাঠা তাঁর পাঁচমণি তোরঙ্গ মাথায় করে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। কদম রসুল হেসে বলল, স্রেফ টাকা-পয়সা ছাড়া আর কিছুই সাথে রাখা যাবে না, বাবু। ওই গন্ধমাদন মাথায় করে যেতে দেখলে আমার আপন ভাইও আপনার গলা ফাঁসিয়ে দেবে। কী আর করা, তোরঙ্গ আমার জিম্মায়। রাখতে হলো তাকে।

বর্ডারে পৌঁছতে হলে পনেরো মাইলটাক হাঁটতে হবে। তবে রাস্তা সহজ নয়। বাঁশঝাড়, খেতের আল, আমবাগান, দিঘির পাড়, বাড়ির আঙিনা এসবের ভেতর দিয়ে যাত্রা। অন্ধকারে নিতান্ত প্রয়োজন না হলে টর্চের আলো ফেলা যাবে না। ডাকাত আর লুটেরার দল হায়েনার মত ওঁৎ পেতে আছে সবখানে। সারারাত হেঁটে ছোট্ট দলটি নদীর কাছে যখন পৌঁছল, তখন ভোর হতে আর বেশি বাকি নেই। পাড়ের কাছেই লগিতে নৌকো বেঁধে অপেক্ষা করছে কদম রসুলের কন্ট্যাক্ট। একদল রাজাকার রাতের রোদ শেষে ক্যাম্পে ফিরছিল সেই সময়, ভিতুর ডিম রাজাকাররা জ্যাঠাদের দলটাকে মুক্তিযোদ্ধা মনে করে খান সেনাদের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্যে দুতিন রাউণ্ড ফায়ার করে বসল। ভয় পেয়ে জ্যাঠার দলের লোকেরা হুড়মুড় করে নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে। কেউ একজন জ্যাঠাকেও ধাক্কা দিয়ে থাকবে।

ভাল সাঁতার জানতেন সিধু জ্যাঠা। নৌকোয় নিজে তো উঠলেনই, সেই সাথে চুলের মুঠি ধরে আরও দুজনকে উঠিয়ে নিলেন। বাজখাই গলায় মাঝিকে বললেন নাও ছাড়তে। জ্যাঠারা যখন মাঝ গাঙে তখন পাড়ে এসে উপস্থিত হলো মিলিটারি। দুদিন আগে মুক্তিযোদ্ধাদের এক অপারেশনে চারজন জওয়ান হারিয়েছে তারা। আবারও আক্রমণ হতে পারে ভেবে প্রস্তুতি নিয়েই রেখেছিল। বর্ষার পদ্মা ভয়ঙ্করী, যেমন খরস্রোতা তেমনই চওড়া। অতীত অভিজ্ঞতা থেকে খান সেনারা জানত, মুক্তিযোদ্ধারা আক্রমণ শেষে নৌকো করে খুব দ্রুত রেঞ্জের আড়ালে চলে যায়। এবার মিলিটারি ন্যূনতম একমাইল রেঞ্জের হেভি মেশিনগান সাথে নিয়ে নদীর পাড়ে এসেছে। নৌকোর মাঝখানে দাঁড়িয়ে জ্যাঠা। ছেষট্টি ক্যালিবারের হেভি মেটাল বুলেট ছিন্নভিন্ন করে ফেলে তার দেহ। এসবই পরে কদম রসুলের কাছ থেকে শোনা।

নয়
এখন মূল ঘটনায় আসি। আগেই বলেছি নানা কথা বলতেন সিধু জ্যাঠা আমাকে। শীলাদেবীর কথাও উনিই প্রথম আমাকে শোনান। শাহ সুলতান মাহিসওয়ার পুরাজ্যের রাজধানী মহাস্থান গড় দখলের জন্যে বদ্ধপরিকর। তখন এখানকার রাজা ছিল পরশুরাম। তবে আসল ক্ষমতা ছিল পরশুরামের বোন শীলাদেবীর হাতে। শীলাদেবী ছিল সে যুগের সব থেকে বড় তান্ত্রিক। অনিন্দ্যসুন্দরী এই যুবতী পুজো করত জরাসুরের। ভয়ানক নিষ্ঠুর এই যক্ষের চরণে সে নিবেদন করেছিল নিজেকেই। মহাস্থান গড়ের জীয়তকুণ্ড শীলাদেবীকে এই যক্ষই দান করে। এই শীলাদেবী প্রায়ই ভবিষ্যতে কী ঘটবে তা দেখতে পেত। শীলাদেবী বুঝতে পেরেছিল, মাহিসওয়ার জীয়তকুণ্ড ধ্বংস করবেন এবং পরাজয় অবশ্যম্ভাবী। এর থেকে মুক্তির উপায় বের করার জন্যে সে এক পরিকল্পনা করে। তার খুব বিশ্বস্ত চারজন অনুচরকে প্রাচীন আর্যদের মূলধারার যে তান্ত্রিকতা সেটির খোঁজে পাঠায়। এই চারজনের ভেতর একজন ছিল অংশুদেবের প্রধান পুরোহিতের বড় ছেলে বজ্ৰযোগী। সিধু জ্যাঠার মতে বজ্রযোগীর মত বড় তান্ত্রিক বঙ্গদেশে অতি বিরল। সিধু জ্যাঠা আমাকে এর বেশি আর কিছু বলেননি।

১৯৭৩ সালের দিকে আমাদের এখানে নকশাল আন্দোলন চরমে ওঠে। মোটামুটি অবস্থাসম্পন্ন লোকদের ধরে সর্বহারারা পটাপট মেরে ফেলতে লাগল। এদের কেউ কেউ নানা উপদলে ভাগ হয়ে লুটতরাজ করতেও লেগে গেল। জ্যাঠার ফেলে যাওয়া তোরঙ্গে মূল্যবান কিছু আছে কি দেখার জন্যে একদিন সকালে খুললাম ওটা। তোরঙ্গের ভেতর অনেক কিছুর সাথে ভেড়ার নরম সাদা চামড়ায় শুদ্ধ পালিতে লেখা এই স্কুলটি পেয়েছিলাম। বরেন্দ্র অঞ্চলে মধ্যযুগে পালি ভাষায় যত কিছু লেখা হয়েছে, তার ভেতর একটি অনন্য সাধারণ লেখা এটি। আপনাকে দেখানোর জন্যেই সাথে করে নিয়ে এসেছি আমি। স্ক্রলটি হাতে দিতে যাবে এমন সময় বাবুর্চি এসে খবর দিল খাবার রেডি। বাইরে তাকিয়ে দেখি বৃষ্টি ধরে এসেছে, সেই সাথে কারেন্টও চলে এল। স্ক্রল রয়ে গেল বৃন্দাবন ঘটকের হাতেই। খাওয়া-দাওয়া সেরে পাশাপাশি দুটো বিছানায় শুয়ে পড়লাম আমরা দুজন।

ঘুম ভেঙে দেখলাম সকাল নটা বাজে। পাশের বিছানা খালি, বিদায় হয়েছেন বৃন্দাবন ঘটক। সকালে উঠেই খালি পেটে পানি খাওয়া আমার অনেক দিনের অভ্যেস। বেড সাইড টেবিলে পিরিচে ঢাকা কাঁচের গ্লাসে পানি থাকে। পানির গ্লাস হাতে নিতে যেয়ে দেখি সেই স্ক্রলটি ওখানে। রাখা। পানি খেয়ে বাথরুম সেরে স্ক্রলটা হাতে নিয়ে বসলাম। কালো কালিতে পাখির পালক দিয়ে চিকন হরফে শুদ্ধ পালিতে যে কথাগুলো লেখা, সেটি সরল বাংলায় অনুবাদ করলে এই রকম দাঁড়াবে:

১২২৩ শতাব্দে তিব্বতের নিকট তান্ত্রিক মহাপুরুষ শ্রীমান চিত্রকূট মহাশয়ের সাধন পীঠে বসিয়া আমি বজ্ৰযোগী এই পুঁথি রচনা করিতেছি। ১২২১ শতাব্দে শীলাদেবী পুণ্ড্রনগরী হইতে একদল অনুচরকে তন্ত্রসাধনার বিষয়ে সম্যক অবগত হইবার অভিপ্রায়ে দিকে-দিকে প্রেরণ করেন। ক্রমে এক বৎসরকাল অতিক্রম হইল, অথচ কেহই ফিরিয়া আসিল না। অতঃপর দেবী তাহার একান্ত বিশ্বস্ত দশজন অধ্যক্ষ পুরোহিতের মধ্য হইতে চারজনকে পুনরায় এতদঅভিপ্রায়ে ভারতবর্ষের চতুর্দিকে প্রেরণ করিতে মনস্থ করিলেন। আমাদিগের চারজনকে ঋক, সাম, যজুঃ, অথর্ব এই চারটি সাঙ্কেতিক নামে ভূষিত করা হইল। আমি সর্বকনিষ্ঠ বিধায় আমার নাম হইল অথর্ব। আমাদিগকে চার বৎসরকাল স্বাচ্ছন্দ্যে কাটাইবার নিমিত্তে প্রচুর অর্থ প্রদান করা হইল।

একদিন অতি প্রত্যূষে আমরা চারজন পুণ্ড্রনগরী হইতে যাত্রা করিয়া বুড়িগঙ্গা নদীর তীরবর্তী ঢাকা-ঈশ্বরী মন্দিরে পৌঁছাইলাম। এই স্থলে মাটির গভীরে দশভুজা দেবী সহস্রাদি গুপ্তাবস্থায় ছিলেন। আরাকানের বিতাড়িত মঙ্গত রায় ওরফে রাজা বল্লাল সেন এস্থলে যাত্রাবিরতিকালে দেবী তাহাকে স্বপ্নে দর্শন দেন। বল্লাল সেন আপাদমস্তক স্বর্ণনির্মিত দশভুজাকে উত্থিত করিয়া দেবীর সম্মানে মন্দিরটির নির্মাণ করেন। দশভুজা ঈশ্বরী নামেও পরিচিত লাভ করিয়াছেন। ঈশ্বরী বহুকাল ভূমিতলে গুপ্ত ছিলেন বলিয়া তাঁহাকে ঢাকা-ঈশ্বরী বলা হয়। কিন্তু আমরা দশভুজা দর্শনে এস্থলে আগমন করি নাই। আমরা আসিয়াছি চতুর্ভুজ দেবতা বাসুদেব দর্শনে। বাসুদেব আরাকানী বৌদ্ধ তান্ত্রিকদের প্রধান উপাস্য দেবতা। যাত্রার পূর্বে তাহার কৃপা লাভ করাই আমাদের অন্যতম উদ্দেশ্য, ইহাই শীলাদেবীর নির্দেশ। পরদিন প্রত্যূষে আহার সমাপনান্তে ঋক আরাকান রাজ্যে গমনের অভিলাষে বুড়িগঙ্গা নদীপথে শাগঙ্গার (বর্তমানে চট্টগ্রাম) উদ্দেশে যাত্রা করিল। সাম কামরূপ রাজ্যে গমনের অভিপ্রায়ে পূর্বদিকে সড়কপথে যাত্রা করিল। আমি এবং যজুঃ আরও একদিবস ঢাকেশ্বরী মন্দিরে অতিবাহিত করিলাম এবং অপরাহ্বে নদীতীরে ভ্রমণ করিতে বাহির হইলাম। আমরা লক্ষ করিলাম সেই স্থলে একশ্রেণীর তন্তুবায়ের বাস। তাহারা অতি সূক্ষ্ম তন্তু দ্বারা এক বিশেষ শ্রেণীর বস্ত্র উৎপাদনের উপায় উদ্ভাবন করিয়াছে। এই বস্ত্র মসলিন নামে খ্যাত। বোয়াল নামক এক জাতীয় আঁশহীন বৃহৎ মৎস্যের সূক্ষ্ম দাঁতের সারি ব্যবহার করতঃ উক্ত মসলিন বস্ত্রের তন্তু সূক্ষ্ম হইতে সূক্ষ্মতর ও মসৃণ করা হয়। এই বস্ত্রশিল্পে নারীদের অবদানই অধিক। মসলিন মহামূল্য বস্ত্র হইলেও ইহার প্রস্তুতকারীরা অত্যন্ত দীনহীন। সুষম খাদ্য ও পুষ্টির অভাবে তাহাদের দেহকাণ্ড ক্ষীণ ও নজ। পরিধেয় বস্ত্র অতি মলিন ও শতচ্ছিন্ন। আমি আরও এক শ্রেণীর কুশলী দেখিতে পাইলাম। উহারা শঙ্খ দ্বারা নানা প্রকার দ্রব্য সামগ্রী এবং অলঙ্কার প্রস্তুত করিতেছে। এই কর্মেও নারীদের অবদানই অধিক। সূর্যাস্তকালীন সময়ে আমরা নগরী পরিভ্রমণ শেষে মন্দিরে ফিরিয়া আসিলাম। মন্দিরে অনেক সেবাদাসী রহিয়াছেন। ইহাদের অধিকাংশই অযোধ্যা ও মহারাষ্ট্র হইতে আগত। এইসব রমণীদের দেহ, সৌন্দর্য যে কাহারও মনোবিকার ঘটাইবে। আগামীকাল প্রত্যূষে এস্থল ত্যাগ করিতে হইবে।

পরদিন যথা সময়ে পশ্চিম দিকে যাত্রা করিলাম এবং দীর্ঘ পথ অতিক্রম করিয়া সূতানাটি গোবিন্দপুর (বর্তমানে কোলকাতা) নামক এক প্রখ্যাত নগরীতে পৌঁছাইলাম। এই নগরী গঙ্গা নদীতীরে অবস্থিত। এই অঞ্চলে ছোট ছোট কুটিরে কলি বাজলজ শামুক হইতে প্রচুর পরিমাণে চুন এবং নারিকেল হইতে কাতা বা রজু উৎপন্ন করা হয়। নগরীতে প্রচুর সংখ্যক পান্থশালা রহিয়াছে। আমরা উহার একটিতে আশ্রয় লইলাম। এই নগরীর অধিবাসীগণ দেবী স্বরস্বতীর বর লাভ করিয়াছেন। তাঁহারা প্রায় সকলেই শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিত এবং শিক্ষাক্ষেত্রে খুবই অগ্রগণ্য। পরদিন অপরাহে যজুঃ আমার নিকট হইতে বিদায় গ্রহণপূর্বক কলিঙ্গ রাজ্যে গমনের লক্ষ্যে দক্ষিণ দিকে যাত্রা করিল। এই ক্ষণে আমি সম্পূর্ণ একাকী বোধ করিলাম। সহচরেরা সকলেই বিদায় লইয়াছে। আমি কোন স্থানে কাহার নিকট যাইব সে সম্পর্কে কিয়ৎ পরিমাণ জ্ঞান নাই। তৎক্ষণে অন্যমনস্ক হইয়া গঙ্গা নদীর তীর দিয়া হটিতে লাগিলাম। গঙ্গার তীর অতীব মনোমুগ্ধকর। এ স্থলে কালক্ষেপণ করিলে হৃদয় ভাবাবেগে পূর্ণ হয়। ক্রমান্বয়ে আমি নগরী হইতে দূরে সরিয়া গেলাম। অরুণাচল অস্তগামী হইল। আমি কিয়ৎক্ষণ বিশ্রামের লক্ষ্যে একটি আশ্রয়স্থল সন্ধান করিতে লাগিলাম। অদূরে একটি বৌদ্ধ মঠ দৃষ্টিগোচর হইল। গঙ্গার তীর ঘেঁষিয়া উহার অবস্থান। লাল ইষ্টক নির্মিত এই মঠটির স্থাপত্যশৈলী অতি মনোরম। ইহার মেঝে কালো কষ্টি পাথরে নির্মিত। একটি আয়তক্ষেত্রের আকৃতি বিশিষ্ট এই মঠটির সম্মুখভাগে একটি কূপ রহিয়াছে। কূপের পাশে কাষ্ঠ নির্মিত একটি পাত্রের সহিত লম্বা রঞ্জু সংযুক্তাবস্থায় দৃষ্টিগোচর হইল। ওই কাষ্ঠ নির্মিত আধারটি কূপে নিক্ষেপ করতঃ জল দ্বারা পূর্ণ করিয়া সেই জল উপরে উত্তোলন কারলাম। জল পান করিয়া আমার প্রাণ জুড়াইয়া গেল। মঠটির চতুর্দিকে কৃষ্ণচূড়া ও কদম্ব বৃক্ষের সারি। আমি মঠটির অভ্যন্তরে পূজা মণ্ডপের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করিয়া কাহাকেও দেখিতে পাইলাম না। অথচ বিলক্ষণ উপলব্ধি করিতে পারিলাম কিয়ৎক্ষণ পূর্বেই অকুস্থলে পূজাপাঠ ইত্যাদি সমাপন হইয়াছে।

মঠের একটি স্তম্ভে হেলান দিয়া হস্তপদ ছড়াইয়া অর্ধশায়িতাবস্থায় আমি বৃক্ষসারির মধ্য দিয়া গঙ্গার প্রবাহিত স্রোতধারার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করিলাম। অস্তগামী সূর্যদেবের লাল কিরণমালায় সে স্রোতধারার নৈসর্গিক সৌন্দর্য অতুলনীয়। ক্রমে আমার চেতনা লুপ্ত হইল। আমি গভীর নিদ্রায় আপতিত হইলাম। এবং নিদ্রাকালীন সময়ে অভূতপূর্ব এক স্বপ্ন দর্শন করিলাম। দেখিতে পাইলাম, মঠের প্রধান পুরোহিত এক পকূকেশ বৃদ্ধ আমাকে প্রশ্ন করিলেন কী উদ্দেশে আমি এ স্থলে আগমন করিয়াছি। উত্তর করিলাম, প্রভু, রাজ আজ্ঞা হেতু আমাকে অকুস্থলে আসিতে হইয়াছে। সেই জ্যোতির্ময় পুরুষ কিয়ৎক্ষণ আমার দিকে চাহিয়া উত্তর করিলেন, শীলাদেবী ও তদীয় ভ্রাতা পরশুরামের ভাগ্য বিপর্যয় ঘটিয়াছে। তাহাদের আর কোনও আশা নাই। তাঁহাদের রাজ্য হারাইতে হইবে। তুমি এই ক্ষণে শীলাদেবীর নিকট প্রত্যাবর্তন কর। আমি উত্তর করিলাম, হে, প্রভু, যে উদ্দেশ্যে দেবী আমাকে প্রভূত অর্থ প্রদান করতঃ প্রেরণ করিয়াছেন, তাহা আমাকে সফল করিতে দিন। পকূকেশ সেই বৃদ্ধ আমাকে সুগভীর দৃষ্টিতে নিরীক্ষণ করিয়া ক্ষণকাল পর উত্তর করিলেন:

হে, বৎস, তোমাকে সুদীর্ঘ পথ পরিক্রম করিতে হইবে। তিব্বতের দুর্গম লাসা নগরীর নিকটে এক পর্বত গুহায় জনৈক সিদ্ধ পুরুষ বাস করেন তাহার নাম চিত্রকুট। স্বীয় সাধনা বলে ওই পুরুষ মোক্ষ লাভ করিয়াছেন। তিনি আঁধার জগতের মহাপ্রভুর সাধনা করেন। তাঁহার সাধন পীঠ এস্থল হইতে ছয় মাসের পথ। লাসা নগরীর নিকটবর্তী হইলে হিমালয়ের বরফ মুণ্ডিত দুইটি চূড়া তোমার দৃষ্টিগোচর হইবে। উক্ত স্থানে একটি বৌদ্ধ মন্দির দেখিতে পাইবে। ইহার অদূরে পর্বত গাত্রে একটি সুড়ঙ্গের ন্যায় গুহা আছে। সূর্যাস্তকালীন সময়ে সেই গুহা হইতে ধূম্র নির্গত হইতে দেখিবে। উহাই চিত্রকূটের সাধন পীঠ। স্মরণ রাখিও, চিত্রকূট কাপালিক নহেন। সুউচ্চ স্তরের তন্ত্র সাধনাই তাহার ব্রত। এই সাধনায় স্বীয় সত্তাকেই অন্ধকার রাজ্যের মহাপ্রভুর নিকট উৎসর্গ করিতে হয়।

আমার নিদ্রাভঙ্গ হইলে দেখিলাম রাত্রির অমানিশা কাটিয়াছে। চতুর্দিকে পক্ষীকুল কুজন করিতেছে। তৎক্ষণাৎ সে স্থল পরিত্যাগপূর্বক আমি পান্থশালায় প্রত্যাবর্তন করিলাম ও আমার ভ্রমণের সরঞ্জামাদি লইয়া তিব্বতাভিমুখে যাত্রা করিলাম। দীর্ঘদিন অতিবাহিত হইল। অবশেষে আমি এক পার্বত্য জাতি অধ্যুষিত নগরীতে প্রবেশ করিলাম। সুউচ্চ ভূমিতে অবস্থিত সেই নগরীর নাম থিষ্ণু। এই জাতির মধ্যে ব্যভিচার ও অনাচার অতি মাত্রায় অনুপ্রবেশ করিয়াছে। অসম বিবাহ, অতি মাত্রায় সোমরস পান, কুরুচিপূর্ণ অশ্লীল নর্তন কুর্দন ইহাদের স্বাস্থ্যহানি ঘটাইয়াছে এবং মানবিক গুণাবলীর ধ্বংস সাধন করিয়াছে। এ স্থলে আসিয়া আমি রাত্রি যাপনের নিমিত্তে একটি পান্থশালায় আশ্রয় গ্রহণ করিলাম। সন্ধ্যা পরবর্তী সময়ে সংক্ষিপ্ত বস্ত্রে আচ্ছাদিত বারবণিতারা আমাকে বিপর্যস্ত করিয়া ফেলিল। ইহাদের মধ্যে আমি একটি বালিকাকে দেখিতে পাইলাম। উক্ত বালিকা সকলের পশ্চাতে দণ্ডায়মান ছিল। দীনহীন বালিকাটিকে দেখিয়া আমার হৃদয় আর্দ্র হইল। চল্লিশোর্ধ্ব জনৈক বারবণিতাকে কিঞ্চিত অর্থ প্রদান করিয়া তাহার সহযোগিতায় উক্ত বালিকাটিকে আমার কক্ষে প্রবেশ করাইয়া দ্বার রুদ্ধ করিলাম।

বালিকাটি ভীতা হরিণ শাবকের ন্যায় আমার প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করিল। আমি লক্ষ করিলাম, তাহার দেহ প্রকম্পিত হইতেছে। বালিকাটিকে আমার শয্যার উপর উপবেশন করিতে অনুরোধ করিলাম। অতঃপর উহাকে অভয় দান পূর্বক তাহার পরিচয় ইত্যাদি জ্ঞাপন করিতে বলিলাম। বালিকাটির পিতা দীর্ঘদিন হইল নিরুদ্দেশ হইয়াছে। তাহার মাতা নগরীর শাসকদের মনোরঞ্জন করিত। বর্তমানে তাহার স্বাস্থ্য ভগ্ন হইয়াছে এবং সে জটিল রোগে অতিশয় পীড়িতা। বালিকাটি অনন্যোপায় হইয়া অর্থোপার্জনের লক্ষ্যে বারবণিতাদের সহিত যুক্ত হইয়াছে। ইতিপূর্বে বিকৃতরুচিপূর্ণ একজন প্রৌঢ় তাহাকে এক পান্থশালায় বিগত রজনী হইতে অদ্য দ্বিপ্রহর অবধি নির্যাতন করিয়াছে। বালিকাটির বাহু, কপোল এবং গলদেশে অত্যাচারের চিহ্ন বিদ্যমান। দ্বিপ্রহরে প্রৌঢ় ব্যক্তিটি আহার সংগ্রহে বাহির হইলে বালিকাটি উক্ত পান্থশালা হইতে সবেগে প্রস্থান করিয়াছে। সে ক্ষুধার্ত ও ক্লান্ত। তাহার মাতা ও ছোট একটি ভ্রাতা পথ চাহিয়া আছে। শূন্য হাতে সে ফিরিবে কী প্রকারে?

অতঃপর আমি বালিকা সমভিব্যাহারে উহার মাতার পর্ণ কুটিরে উপস্থিত হইলাম ও বালিকার বাটীতে সপ্ত দিবস অতিবাহিত করিয়া তাহার মাতার চিকিৎসার ব্যবস্থা করিলাম। ইত্যবসরে বালিকার মাধ্যমে ঔষধপত্র, আহার ও বস্ত্রের ব্যবস্থা সম্পন্ন করিয়াছি। কুটির হইতে আমি কদাপি বাহির হইয়াছি। তাহার কারণ এই নগরীর নাগরিকেরা আদর্শহীন কপট শ্রেণীর। আমাকে অসহায় ভিনদেশী মনে করিয়া সর্বস্ব হরণ করিতে পারে। বালিকার মাতার সহিত আমার আলাপচারিতা হইয়াছে। উক্ত রমণীর পিতার আবাস লাসা নগরীর সন্নিকটে। তিব্বত গমনের অতি সহজ পথ নির্দেশ তাহার নিকট হইতে লাভ করিয়াছি। ইহাদের একরূপ ব্যবস্থা হইয়াছে বিধায় অষ্টম দিবসে অতি প্রত্যূষে বালিকাটির শিয়রে কিঞ্চিৎ অর্থ রাখিয়া তিব্বতের পথে নির্গত হইলাম। আমার নির্গমন সম্বন্ধে বাটীর কেহই কিছু জানিতে পারিল না। সুদীর্ঘ দুর্গম পথ পরিক্রম করিয়া অবশেষে আমি লাসা নগরীতে উপস্থিত হইলাম। লাসার নাগরিকদের নিকট প্রশ্ন করিয়া নির্দেশিত স্থানের কোনও হদিশ পাইলাম না। পঞ্চদশ দিবসে নগরীর চতুর্দিকে ক্রমাগত পরিভ্রমণ করিলাম। অথচ কোনও স্থলে ওই বিশেষ বৌদ্ধ মন্দির বা পর্বত শঙ্খ দৃষ্টিগোচর হইল না।

দেশ ত্যাগের পর ষান্মাসিক কাল অতিবাহিত হইতে চলিল। ঋক, সাম, যজুঃ-র কথা স্মৃতিপটে ভাসিয়া ওঠে, ঈশ্বর বলিতে পারেন তাহারা কে কোথায় অবস্থান করিতেছে। এক দিবসে প্রচুর শৈত্য প্রবাহ হইতে লাগিল। আমি পান্থশালার বিশাল চুল্লির অগ্নিকুণ্ডের নিকট বসিয়া আমার পরবর্তী কর্তব্য বিষয়ে চিন্তাক্লিষ্ট ছিলাম। এমতাবস্থায় এক বৃদ্ধ ভিক্ষুনী সে স্থলে প্রবেশ করিল। তাহার সমগ্র পরিচ্ছদ তুষারাবৃত। মুখ মণ্ডল ও হস্তপদ নীলবর্ণ ধারণ করিয়াছে। তাহার চক্ষুদ্বয় ক্লান্ত ও হতাশাপূর্ণ। আমি সেই বৃদ্ধা রমণীকে তাহার জগদ্দল আভরণ হইতে মুক্ত হইতে সহায়তা করিলাম। তাহাকে উষ্ণ বলকারক এক জাতীয় বিশেষ তরল খাদ্যবস্তু (সুপ) ভক্ষণ করাইলাম। বৃদ্ধার হস্তপদ আপন হস্তদ্বারা উত্তমরূপে মর্দন করিয়া দিলাম। খাদ্য গ্রহণের পরপরই ভিক্ষুনী নিদ্রামগ্ন হইল। ভিক্ষুনীর নিদ্রা ভঙ্গ হইলে আমরা একত্রে মধ্যাহ্নের আহার গ্রহণ করিলাম। ভিক্ষুনী আমার প্রতি অত্যন্ত সদয় হইল। সে আমার অত্র দেশে আগমনের হেতু জানিতে চাহিল। আমি অকপটে বৃদ্ধাকে সমস্ত বিষয় অবগত করাইলাম। সব শ্রবণ করিয়া ভিক্ষুনী ক্ষণকাল নিশ্চুপ রহিল। ইহার পর আমাকে আগামী দিবস প্রত্যষে ভ্রমণের নিমিত্তে প্রস্তুতি গ্রহণের নির্দেশ প্রদান করিয়া বাহিরে নির্গত হইল।

আমি তাহার নির্দেশানুযায়ী পর দিবস প্রভাতে ভ্রমণে প্রস্তুত হইয়া অপেক্ষা করিতে লাগিলাম। কিয়ৎক্ষণ পর ভিক্ষুনী আবির্ভূত হইল। আমি উহাকে অনুসরণ করিয়া নগরীর উত্তর প্রান্তে উপনীত হইলাম। সুগভীর এক গিরিখাতের উভয় পার্শ্বে অতিকায় স্তম্ভের সহিত রঞ্জু সংযোগ করিয়া সেতুর ন্যায় একটি সংযোগ ব্যবস্থা স্থাপিত হইয়াছে। তুষারাবৃত সেই রঞ্জু সেতু তীব্র বায়ু প্রবাহে শূন্যে দোদুল্যমান। ভিক্ষুনী অতি কষ্টে সেই রঞ্জু সেতু অতিক্রম করিল এবং আমাকেও অনুরূপ করিতে আজ্ঞা করিল। আমি ভগবানের নাম স্মরণ করিয়া সেই রঞ্জু সেতু অতিক্রম করিলাম। অতঃপর ক্রমাগত ঊর্ধ্ব মুখে উঠিতে লাগিলাম পর্বত সংলগ্ন একটি অতি সরু সড়ক বাহিয়া। সুতীব্র বাত্যাপ্রবাহ আমাদিগকে শূন্যে উড্ডীন করতঃ অনন্ত গহ্বরে। নিক্ষেপ করিতে চাহিল। দ্বিপ্রহর অতিক্রম হইলে আমরা পর্বতের শীর্ষদেশে উপস্থিত হইলাম। ভিক্ষুনী অঙ্গুলী নির্দেশে দূরবর্তী একটি অঞ্চলে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করিল। নির্দেশিত পথে দৃষ্টি নিক্ষেপ করিয়া একটি অতি মনোহর বৌদ্ধ মন্দির দেখিতে পাইলাম। উক্ত মন্দিরের কিয়ৎ দূরে একটি কৃষ্ণকায় পর্বত এবং তাহার অদূরে একটি বরাফাচ্ছাদিত পর্বতচূড়া আমার দৃষ্টিগোচর হইল। আমি হৃদয়ে তীব্র শিহরণ অনুভব করিলাম। এইক্ষণে ভিক্ষুনী আমার নিকট হইতে বিদায় লইয়া আপনার পথে যাত্রা করিল। পর্বতের ঈষৎ বক্র পৃষ্ঠদেশ বাহিয়া আমি গুহার পাদদেশে উপস্থিত হইলাম।

আনুমানিক দুই ক্রোশ পথ চলিবার পর বৌদ্ধ মন্দিরটি যে পর্বতশীর্ষে অবস্থিত, তাহার পাদদেশে পৌঁছিলাম। পশ্চিমাকাশে দিবাবসানের লাল আলোক। বৌদ্ধ মন্দিরে ঢং ঢং শব্দে ঘণ্টা বাজিল। তীব্র বাত্যাপ্রবাহে চতুর্দিকে তুষারকণা ছুটিতেছে। ঠিক সেই পর্বে আমি পর্যবেক্ষণ করিলাম কৃষ্ণ প্রস্তর নির্মিত নিকটবর্তী এক পর্বতের গুহা হইতে অনর্গল ধারায় ধূম্র নির্গত হইতেছে। সেইসব ধূম্রপুঞ্জ বিজাতীয় বীভৎস প্রাণীর রূপ ধরিয়া ঊধ্বাকাশে বিলীন হইয়া যাইতেছে। আমি ধীরে ধীরে উক্ত গুহার দিকে অগ্রসর হইলাম। গুহার সম্মুখভাগ একটি বৃত্তাকার সুড়ঙ্গের ন্যায়। অভ্যন্তরভাগে আগুন জ্বলিতেছে। কিঞ্চিত অগ্রসর হইলাম। বর্তুলাকার একটি প্রকাণ্ড কক্ষের এক প্রান্তে একটি কৃষ্ণকায় সুপুরুষের মূর্তি। কক্ষের মধ্যখানে শুভ্র পট্টবস্ত্র পরিহিত এক বৃদ্ধ বসিয়া অতি গম্ভীর ও মধুর স্বরে মন্ত্র উচ্চারণ করিতেছেন। আমি উপলব্ধি করিলাম, এই পুরুষোত্তমই চিত্রকূট তান্ত্রিক। আমি তাঁহাকে আভূমি নত হইয়া প্রণাম করিলাম। কহিলাম, মহারাজ, আপনি যদি অত্র অধমকে তন্ত্র সাধনা শিক্ষা না দেন, তাহা হইলে এইক্ষণে ইহার বিনাশ সাধন করুন। অতি দূর রাজ্য হইতে আসিয়াছি। রাজ আজ্ঞা: আমাকে এই সাধনা শিখিতে হইবে। আমার উপর করুণা বর্ষণ করুন, মহারাজ।

চিত্রকূট তান্ত্রিক আমাকে শির উত্তোলন করিতে বলিলেন। এই প্রথম আমি তাহাকে পূর্ণ দৃষ্টি মেলিয়া দর্শন। করিলাম। তাঁহার গাত্র সম্পূর্ণ কেশহীন। পট্টবস্ত্রখানিতে কোথাও কোনও সেলাই বা সচিকর্মের চিহ্ন নাই। উজ্জল গৌরবর্ণ শরীর, শরের ন্যায় আঁখিপটের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি। প্রথম দর্শনেই মহারাজকে আমার অত্যন্ত আকর্ষণীয় মানব বলিয়া মনে হইল। তিনি আমাকে স্নানের নির্দেশ ও পট্টবস্ত্র প্রদান। করিলেন। স্নান সমাপন করিয়া আমি উহা পরিধান করিলাম। মহারাজ আমাকে প্রত্যহ অন্ততপক্ষে তিনবার স্নান করিবার। নির্দেশ দিলেন। এই নিমিত্ত আমাকে ছয়টি পট্টবস্ত্র দান করিলেন। প্রতিবার স্নানের সময় বস্ত্রাদি উত্তমরূপে ধৌত করিবার আদেশ করিলেন। বর্তুলাকার কক্ষটিই তাঁহার উপাসনা গৃহ। সর্বদাই কক্ষটিকে ধৌত করতঃ উত্তম রূপে শুষ্ক বস্ত্রখণ্ড সহযোগে মুছিতে হয়। ইহা ছাড়াও আতর ও গোলাপের নির্যাস ছিটাইতে হয়। চন্দন তৈলের প্রদীপ জ্বালিতে হয়। তাহার আরাধ্য দেবতার নাম আহুরা বা পট্রহ এর রাজকুমার। মহারাজ সূর্য উদয় ও সূর্যাস্তের সময় স্বহস্তে দেবমূর্তিটিকে আতর ও গোলাপের জল মিশ্রিত করিয়া উক্ত জল দ্বারা ধৌত করেন। মহারাজ প্রাচীন পারস্য, মিশরীয় ও ইয়াহুদ নামক এক গোত্রের ভাষায় বিশেষ ব্যুৎপত্তি লাভ করিয়াছেন। আমি ওই সকল ভাষা অধ্যয়ন করিতে পারি না। বলিয়া তিনি কিছু কিছু মন্ত্র সংস্কৃত ভাষায় লিপিবদ্ধ করিয়াছেন।

মহারাজ সূর্য অস্ত যাওয়ার পর হইতে সূর্য উদয় পর্যন্ত উপাসনা করেন। মধ্যাহ্নে ও অপরাত্নে নিদ্রা যান। কদাপি গুহা হইতে বাহির হন। প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি বিশ ক্রোশ পথ হাঁটিয়া আমাকেই সংগ্রহ করিতে হয়। রাত্রিকালে বিশাল কেশযুক্ত কতিপয় অতিকায় তিব্বতী কুক্কুরী গুহামুখ আগলাইয়া রাখে। ইহারা রাত্রি দ্বিপ্রহর হইতে সূর্যোদয় পর্যন্ত অবস্থান করে। ইহাদের চক্ষু হইতে ভীতিকর নীলাভ শিখা বিচ্ছুরিত হয়। ইহাদের সুদীর্ঘ ও শক্তিশালী দন্তসারি দূর হইতে দৃষ্টিগোচর হয়।

এ রূপে ছয়মাস অতিবাহিত হইল। আকাশে চাঁদ ক্ষয়প্রাপ্ত হইতে হইতে বৃষের শিঙের আকার ধারণ করিলে ওই বিশেষ নিশিতে গুরুদেবের মহাপ্রভুর আবির্ভাব হয়। গুরুদেব তখন আভূমি নত হইয়া মহাপ্রভুর চরণ চুম্বন করেন। অতঃপর কক্ষের মধ্যখানে যে ছয়প্রান্ত যুক্ত তারকাটি রহিয়াছে, তাহার কেন্দ্রে মুখমণ্ডল, বক্ষ ও পেট স্থাপন করিয়া পৃষ্ঠদেশ ঊর্ধ্বমুখী রাখেন। সেইক্ষণে তাহার দেহ পাঁচ ভাগে বিভক্ত হইয়া পাঁচটি শ্বেতকায় পেঁচকে রূপান্তরিত হয়। পেঁচকগুলি গুহামুখ অতিক্রম করিয়া শূন্যে মিলাইয়া যায়। সূর্য উদয়ের পূর্বে ওই পেঁচকগুলি পুনরায় গুহায় ফিরিয়া আসে ও তারকাটির উপর উপবেশন করে। অতঃপর উহারা পুনরায় গুরুদেবের দেহ ধারণ করে। গুরুদেবকে একদিন প্রশ্ন করিলাম, পেঁচকের রূপ ধারণ করিয়া গুরুদেব কোথায় গমন করেন? গুরুদেব উত্তর করিলেন, মানবদেহ পাঁচটি বস্তু দ্বারা নির্মিত। উহারা হইল: ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ, ব্যোম। সুদীর্ঘ সাধনার পর সিদ্ধিলাভ হইলে মানবদেহ এই পাঁচটি ভাগে বিভক্ত হইয়া যে-কোনও রূপ ধারণ করিতে পারে। আমি পেঁচকের রূপ ধারণ করিয়া আরব উপকূলের দক্ষিণ-পূর্ব কোণে যে স্থলে প্রাচীন উবার নগরী অবস্থিত ছিল, সে স্থানে গমন করি। অত্র দেশে সহস্রাদি পূর্বে সাদ-বিন-আদ নামক জনৈক সম্রাট দেবাদিদেব আহুরার সম্মানে এ জগতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মন্দিরটি নির্মাণ করেন। কালের প্রবাহে সেই স্থাপত্য আজ ধ্বংসপ্রাপ্ত হইলেও ইহার ভূগর্ভস্থ উপাসনা গৃহ এখনও অতীত গৌরবে সমুজ্জ্বল। এই গর্ভগৃহেই মহাপ্রভু আহুরা তাঁহার প্রিয় তান্ত্রিক-পূজারীদিগের সহিত মিলিত হন এবং হাস্যরসে কালাতিপাত করেন। অপূর্ব দেহবল্লরীসম্পন্ন রমণীগণ তাহাদিগকে সোমরস পান করান। মহাপ্রভু আহুরা তাহাদিগকে ভূত-ভবিষ্যতের কথা বর্ণনা করেন এবং সপ্ত আকাশের অশ্রুতপূর্ব রহস্যময় বিষয়ে কথা বলেন।

এইরূপে একাদশ মাস অতিক্রান্ত হইল। আরও একমাস অতিবাহিত হইলে আমি বরেন্দ্রের উদ্দেশে যাত্রা করিব। গুরুদেব আমার মনোবাঞ্ছা সম্যক উপলব্ধি করিলেন। তিনি এক দিবসে আমাকে ডাকিয়া বলিলেন: বস, সাধনায় সিদ্ধি লাভ করিতে অন্যূন বিশ বৎসরাধিককাল একাগ্র চিত্তে উপাসনার প্রয়োজন। কাপালিক সাধকেরা নানারূপ অপদেবতার সাধন ভজন করিয়া থাকে। এইসব অপদেবতারা সবাই মহাপ্রভু আহুরার দাসানুদাস। এই সকল দেবদেবী নিচু স্তরের বলিয়া ইহাদের বুদ্ধিবৃত্তিও অতি নীচ। ইহারা প্রায়শই রক্তলোভী হইয়া থাকে। কাপালিকেরা ইহাদের তুষ্টি সাধন লক্ষে নরহত্যা ও অন্যান্য ঘৃণ্য পাপাচারে লিপ্ত হয়। তদু। এইসব কাপালিকেরা মরণশীল এবং মৃত্যুর পর ইহারা ওহ সকল অপদেবতার আজ্ঞাবহ হয়। মহাপ্রভু আহুরার উপাসনায় শীলাদেবী ও তদীয় ভ্রাতা পরশুরাম সিদ্ধিলাভ করিতে পারিবেন না। উহারা বিষয়ভোগী এবং তাঁহাদের ভাগ্য বিপর্যয় ঘটিয়াছে।

যদি ত্যাগ তিতিক্ষা থাকে, যদি এই জন্যে বাঁচিয়া থাকিতে পার, তাহা হইলে পঞ্চাশোর্ধ্ব বয়সকালে সিদ্ধি লাভ করিবে। অন্যথায় কালের আবর্তে তুমি পুনঃপুনঃ জন্মলাভ করিতে থাকিবে এবং এক সময় পূর্ব জন্মের স্মৃতি জাগরিত হইলে সেই ক্ষণে সিদ্ধি লাভ করিবে।

এক দিবসে গুরুদেব নগরী অভিমুখে যাত্রা করিলেন। আমাকে রাখিয়া গেলেন একাকী গুহায়। মহাপ্রভু আহুরার উদ্দেশে নিয়মিত পূজা-পাঠ করিবার পুনঃপুনঃ কঠোর নির্দেশ দিলেন। গুরুদেবের নির্গমনের পর পঞ্চদশ দিবস অতিক্রান্ত হইল। আমি একাকী গুহায় রহিলাম। রাত্রি দ্বিপ্রহরে কুকুরীসমূহ আসিয়া গুহামুখ আগলাইয়া রাখে। নিদারুণ আতঙ্কের মধ্য দিয়া আমার সময় কাটিতে লাগিল। ষষ্ঠদশ দিবসে বেলা দ্বিপ্রহরে গুরুদেব এক অনন্যসুন্দরী রমণী ও দশজন নেপালী শেরপা সমভিব্যাহারে প্রকাণ্ড একটি সবুজাভ প্রস্তর নির্মিত আধার লইয়া গুহামুখে প্রবেশ করিলেন। এই গুহাটির অদূরে আরও একটি গুহা ছিল। সেই গুহাটিতে সারি সারি সাতটি প্রকোষ্ঠ ছিল। উহার একটিতে গুরুদেব ও অন্যটিতে আমি নিদ্রা যাইতাম। অন্যগুলোতে বস্ত্র এবং আহারের সরঞ্জামাদি ছিল। গুরুদেবের নির্দেশে ইহারই একটি আমি ওই রমণীর জন্য নির্ধারিত করিলাম। ইহার পর গুরুদেব প্রস্তর নির্মিত আধারটির ঢাকনা উত্তোলন করিলে উহার অভ্যন্তরে এক মৃতা তরুণীকে শায়িতাবস্থায় দেখিলাম। মৃতার গাত্রবর্ণ ঘোর কৃষ্ণকায়। গুরুদেব বলিলেন, অপঘাতে মৃত্যু হইয়াছে এমন একজন কুমারী তরুণীর শব ইহা।

অতঃপর গুরুদেব মৃতা তরুণীর শরীরে চন্দন তৈল উত্তমরূপে মালিশ করিলেন। দুর্বোধ্য ভাষায় ক্রমাগত মন্ত্র পাঠ করিতে করিতে গোলাপের নির্যাস জলে মিশ্রিত করিয়া ওই জল দ্বারা শবাধারটি পূর্ণ করিলেন এবং শবাধারটি প্রভু আহুরার পদতলে স্থাপন করিলেন। দেখিতে দেখিতে তরুণীর ঘোর কৃষ্ণবর্ণ দেহ নীলবর্ণ ধারণ করিল। তরুণীর আঁখি পল্লব প্রস্ফুটিত হইল এবং গুরুদেবের সহিত দৃষ্টি বিনিময় ঘটিল। কিয়ৎক্ষণ পরে তরুণীর অক্ষিপট নিমীলিত হইল। যুবতী রমণী ও আমি যুগপৎ গুরুদেবকে তাহার সাধনার কাজে সাহায্য করিতে লাগিলাম। ক্রমে ক্রমে যুবতীর সহিত আমার সখ্য গড়িয়া উঠিল। বাস্তবিক আমি উক্ত রমণীকে প্রাণাধিক প্রণয় করিতাম। এরূপে দ্বাদশ দিবস অতিক্রান্ত হইলে গুরুদেব সন্নিকটে আহ্বান করিয়া মধুর কণ্ঠে কহিলেন, বৎস, এক্ষণে স্বদেশে প্রত্যাবর্তন কর। শীলাদেবীর পারিষদদিগের হইতে সাবধানে থাকিবে। উহারা তোমার প্রাণনাশের কারণ হইতে পারে। এ স্থলে যাহা দেখিয়াছ, তাহা স্মরণ রাখিয়ো এবং সাক্ষাৎ ঘটিলে শীলাদেবীকে বিধৃত করিয়ো৷ লিখিবার সরঞ্জাম লইয়া আইস। উপাসনার নিমিত্ত সমস্ত খুঁটিনাটি বিধৃত করিতেছি। লিখিয়া লও! আশীর্বাদ করি। তোমার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হোক।

বজ্ৰযোগীর বর্ণনা এখানেই শেষ। এরপর পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা শুধু বিভিন্ন গাছ-গাছড়া ও ভেষজ উপাদানের নাম ও পরিমাণ ইত্যাদি লেখা। জটিল সব নক্সা আঁকা। বিভিন্ন মাস-দিন তারিখ-গ্রহ-নক্ষত্রের পূর্ণাঙ্গ অপূর্ণাঙ্গ চিত্র এবং প্রাচীন কালের হরফে লেখা অসংখ্য সাঙ্কেতিক চিহ্ন।

স্ক্রলের শেষ পাতার সাথে আটকানো অবস্থায় বৃন্দাবন ঘটকের একটি চিঠি পেলাম।

শুক্রবার। ১৩ আগস্ট

প্রিয়বরেষু শ্রীমান ফারাবী,

আপনার সাথে দেখা হওয়া কোনও কাকতালীয় ঘটনা নয়। আমি জানতাম আপনি এখানে আসবেন এবং আপনার সাথে দেখা হবে। এজন্যেই পালি ভাষার পাণ্ডুলিপিটা সাথে করে এনেছিলাম। আমি ইতিহাসের অধ্যাপক হলেও আপনার মত এত হাই প্রোফাইল গবেষক নই। আশা করি আপনার গবেষণার কাজে এই পাণ্ডুলিপি সহায়ক হবে।

সেই যে ছোটবেলায় চিত্রকূটের সাথে দেখা হলো, এরপর সে আর কখনও আমাকে ছেড়ে যায়নি। আমাকে সব বিপদ আপদ থেকে রক্ষা তো করেছেই, তার ওপর ভবিষ্যতে কী ঘটবে সেকথাও মাঝে মধ্যে জানিয়েছে। সিধু জ্যাঠা বিশ্বাস করতেন আমিই অতীতের বজ্ৰযোগী।

জীবদ্দশায় বজ্ৰযোগী সিদ্ধি লাভ করতে পারেনি। সে পুণ্ড্রনগরে ফিরে আসার আগেই পরশুরামের পতন ঘটে। করতোয়া নদীতে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করে শীলাদেবী। কংস সেন তখন পুণ্ড্রনগরের শাসনকর্তা। শীলাদেবীর অনুসারীরা তার প্রাণনাশ করতে পারে এই ভয়ে তটস্থ কংস। সেইসব অনুসারীদের খুঁজে খুঁজে বের করে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করছে তার গুপ্তচর বাহিনী। সব দেখেশুনে মুষড়ে পড়ে বজ্ৰযোগী। সে চলে আসে রামপুর বোয়ালিয়ায় তার বাবার কাছে। গাঁয়ের এককোণে ছোট্ট এক বাড়িতে বজ্রযোগীর বাবা তখন মৃত্যু শয্যায়। বাবার ইচ্ছে, ছেলের বিয়ে দিয়ে পুত্রবধূ দেখে যাওয়ার। কনের খোঁজ পাওয়া গেল, লগ্নও নির্দিষ্ট হলো। বিয়ের কেনাকাটা করতে বজ্ৰযোগী গেল পুণ্ড্রনগরে। তখনকার দিনে এই এলাকায় ওটাই ছিল সবচেয়ে বড় বাজার। বজ্ৰযোগীর দুর্ভাগ্যই বলতে হবে, ওদিনই ছিল কংসের রাজসূয় যজ্ঞ। কংস বেরিয়েছে সাধারণ নাগরিকদের। সুবিধা-অসুবিধার কথা জিজ্ঞেস করতে। নগরীর পথে পথে হেঁটে বেড়াচ্ছে সে। তার নিরাপত্তার বিষয়টি দেখার জন্যে প্রকাশ্য অ-প্রকাশ্য সব বাহিনীর লোকেরা অবস্থান নিয়েছে। শহরের মোড়ে মোড়ে। ভারতের অন্যান্য সব সমৃদ্ধ নগরীর মতই পুণ্ড্রনগরী ছিল অনেক উঁচু প্রাচীর দিয়ে ঘেরা। নগরীতে প্রবেশ এবং নির্গমনের গেট একটাই। কেনাকাটা করে মাল সামান নিয়ে বেরুনোর সময় ধরা পড়ে গেল বজ্ৰযোগী। রাজদ্রোহিতার অভিযোগ এনে সাতদিনের ভেতর শিরচ্ছেদ করা হলো তার। বজ্ৰযোগীর সাধনার ইতি সেখানেই।

এরপর পেরিয়ে গেল শতাব্দীর পর শতাব্দী। সিধু জ্যাঠার মতে বজ্ৰযোগীর পুনর্জন্ম হলো এবং এ জন্মে সে হলো বৃন্দাবন ঘটক অর্থাৎ আমি। সিধু জ্যাঠা আমাকে তান্ত্রিকতা শিক্ষা দিয়েছেন বছরের পর বছর, প্রস্তুত করেছেন চূড়ান্ত পরিণতির জন্যে। সব থেকে বড় কথা, আমি যে এ জন্মের বজ্ৰযোগী একথা উনি বিশ্বাস করিয়েছেন আমাকে। আপনি হয়তো ভাবতে পারেন, ভবিষ্যই যদি দেখতে পাই, তা হলে সিধু জ্যাঠাকে সাবধান করিনি কেন? সিধু জ্যাঠা ভারতে পালিয়ে যাওয়ার সময় ওঁকে বলেছিলাম তার সামনে খুব বড় বিপদ, আরও কয়েকটা দিন অপেক্ষা করতে। কিন্তু ওঁকে তখন যমে টানছে, আমার কথা শুনবেন কেন? বিয়ে করতে নিষেধ করেছিলেন সিধু জ্যাঠা। কিন্তু বাবা-মায়ের মুখ চেয়ে আমাকে ওই কাজটি করতে হয়েছিল। অতি দুর্ভাগ্য, আমার স্ত্রীর গর্ভাবস্থায় এক্লেমশিয়ায় মা-শিশু দুজনেরই মৃত্যু হয়। এরপর ও-রাস্তা আর মাড়াইনি কখনও।

আমি নিশ্চিত তিব্বতে গেলে চিত্রকূটের সাধন পীঠ এখনও খুঁজে পাওয়া যাবে। আর যদি সাধনা ঠিকমত করতে পারি, তা হলে সিদ্ধিও লাভ হবে। তান্ত্রিকদের একটি অন্যতম দায়িত্ব হলো যোগ্য একজন অনুসারী রেখে যাওয়া। এই দায়িত্বটি আপনাকেই দিয়ে যেতে চাই। যে কলেজে চাকরি করতাম, সেখানে আমার বাড়িটি দান করে দিয়েছি। আগামী মাস থেকে ওটা ছাত্রাবাস হিসেবে ব্যবহার হবে। সাধনার সমস্ত পুঁথিপত্র, উপাচার দুটো ট্রাঙ্কে ভরে কলেজের প্রিন্সিপালের জিম্মায় রাখা আছে। আপনি গিয়ে চাইলেই ওগুলো যাতে আপনাকে দিয়ে দেয়া হয়, এমত নির্দেশ দিয়ে রেখেছি। আপনার কাছে এসব খুবই আজগুবি মনে হতে পারে। তবে আমি নিশ্চিত, আপনি পুরো বিষয়টি একবার হলেও ট্রাই করে দেখবেন। এত নিশ্চিত হলাম কীভাবে সেটা বলি।

আপনার বাঁ হাতের কব্জির নিচে একটি লাল জড়ল আছে, এটি নিশ্চয়ই লক্ষ করেছেন। ঠিক এরকমই একটি জড়ল সিধু জ্যাঠার হাতেও দেখেছি। এটিও হয়তো খেয়াল করেছেন যে খুব বড় বিপদ থেকেও অতি সহজেই রক্ষা পেয়ে যান আপনি এবং অদৃশ্য কেউ সবসময় আপনার সাহায্যে এগিয়ে আসে। প্রথম যেদিন আপনার সাথে দেখা হয়, সেদিনই মনে হয়েছে আপনার মত একজনকেই খুঁজছি আমি। আগ বাড়িয়ে আপনাকে অতকিছু তখন শোনানোর উদ্দেশ্য ওটাই। তখন থেকেই অপেক্ষা করেছি সঠিক সময়ের।

আন্তরিক শুভ কামনা রইল।
ইতি
বৃন্দাবন ঘটক

দশ
চিঠিটা পড়ে বৃন্দাবন ঘটককে অদ্ভুত এক মানসিক রোগী বলে মনে হলো। ছোটবেলা থেকেই সিধু জ্যাঠা না কে তারমধ্যে এক অবসেশনের জন্ম দিয়েছে। বয়েস বাড়ার সাথে-সাথে সেই অবসেশন এখন হয়ে গেছে ম্যানিয়া। তবে একথা ঠিক যে এই পাণ্ডুলিপির অ্যান্টিক ভ্যালু এবং ঐতিহাসিক গুরুত্ব অসীম। ঠিক এই জিনিসটাই আমাকে ধন্দে ফেলেছে। সেমিনার শেষ হয়েছে, কালকেই ঢাকা ফিরে যাব। আজকে সারাদিন তেমন কোনও কাজও নেই। এখান থেকে বিড়ালদাহ ত্রিশ মাইলের বেশি হবে না। একবার গিয়ে দেখলে হয়। যদি দুটো ট্রাঙ্ক বৃন্দাবন ঘটক সত্যিই রেখে যান, তা হলে ওখানে মধ্যযুগীয় পুঁথিপত্র আরও অনেক থাকতে পারে।

বিড়ালদাহ পৌঁছে দেখলাম কলেজ বন্ধ। দারোয়ানের কাছ থেকে ঠিকানা নিয়ে প্রিন্সিপালের বাসায় গেলাম। প্রিন্সিপাল মনে হলো আমার জন্যেই অপেক্ষা করছিলেন। বৃন্দাবন ঘটক নাকি তাকে বলে গেছেন আমি আজই তাঁর সাথে দেখা করব। কলেজ থেকে ট্রাঙ্ক দুটো বাসায় এনে রেখেছেন উনি। আমার জন্যে খাবার দাবারেরও আয়োজন করেছেন। বললেন, এত বড় স্কলার আপনি। আফসোস। কলেজ বন্ধ, তা না হলে আপনাকে দিয়ে একটা লেকচার দেয়াতাম। ছেলেমেয়েরা কিছু শিখতে পারত। তার ওপর আপনি বৃন্দাবন ঘটকের গেস্ট। আপনি হয়তো জানেন না উনি এই এলাকার অত্যন্ত শ্রদ্ধেয় একজন ব্যক্তি।

বিকেলের দিকে একটা রিকশা ভ্যানে ট্রাঙ্ক দুটো উঠিয়ে। বাস স্ট্যাণ্ডের দিকে রওনা করিয়ে দিলেন প্রিন্সিপাল সাহেব। ভ্যানের সামনের দিকে ট্রাঙ্ক রেখে পেছনের দিকে পা ঝুলিয়ে বসলাম আমি। বিদায় নিয়ে অনেকটা পথ চলে এসেছি। সামনেই একটা মোড় যেখানে ছোট রাস্তা হাইওয়েতে উঠেছে। এমন সময় লক্ষ করলাম, খুব জোরে সাইকেল চালিয়ে ষোলো-সতেরো বছর বয়সের একটি ছেলে আমাদের দিকে ছুটে আসছে। এক হাতে সাইকেলের হ্যাঁণ্ডেল ধরা, অন্য হাতে কাঠের ছোট একটা বাক্স। ভ্যানের চালককে ভ্যান থামাতে বললাম। ঘ্যাচ করে ব্রেক কষে চালক ভ্যান থামাল। হাইওয়ে আর ছোট রাস্তার বর্ডার লাইনে। ভ্যান এত দ্রুত থেমে যাবে সেটি সাইকেল চালক বুঝতে পারেনি। সাইকেল থামাতে-থামাতে সে পৌঁছে গেল ভ্যানের সামনের চাকা থেকে আরও দুফুট দূরে। সাইকেল চালককে চিনতে পারলাম। প্রিন্সিপাল সাহেবের বড় ছেলে এটি। ম্যাট্রিক পরীক্ষায় রাজশাহী বোর্ড থেকে স্ট্যাণ্ড করেছে। ছেলেটি কাঠের বাক্সটা ভ্যান চালকের হাতে দিয়েছে, ঠিক সেই মুহূর্তে মোড় নিল বড় একটি বাস। সাইকেলসহ ছেলেটাকে চিড়েচ্যাপ্টা করে বেরিয়ে গেল। দুএক পল এদিক ওদিক হলে সাইকেলের জায়গায় থাকার কথা ছিল ভ্যানটার!

বৃন্দাবন ঘটক ট্রাঙ্কের সাথে কাঠের ছোট বাক্সটিও আমার জন্যে রেখে গিয়েছিলেন। প্রিন্সিপাল সাহেব আমাকে ওটা দিতে বেমালুম ভুলে যান। আমাকে বিদায় দিয়ে ঘরে ফিরলে তার স্ত্রী ওটার কথা মনে করিয়ে দেন তাকে। তিনি তৎক্ষণাৎ বাক্সটা তার ছেলের হাতে দিয়ে বলেন আমার কাছে পে দেয়ার জন্যে। ঘটনার দুদিন পরে ঢাকায় ফিরে খুললাম বাক্সটা। দেখলাম ভেতরে লাল ভেলভেটে মোড়ানো লম্বা, সরু একটা কোদাল!

Anuprerona
Anupreronahttps://www.anuperona.com
Read your favourite literature free forever on our blogging platform.
RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here


Most Popular

Recent Comments