Friday, March 29, 2024
Homeরম্য গল্পসরস গল্পবাদশাহ আকবর ও বীরবলের মজার গল্প

বাদশাহ আকবর ও বীরবলের মজার গল্প

বাদশা আকবর ও বীরবলের মজার গল্প

ভারতের উত্তর প্রদেশের কল্পি নামক স্থানে ১৫২৮ সালে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। মুঘল সম্রাট আকবরের অন্যতম সভাসদ ছিলেন বীরবল। আকবরের দরবারে গুণী ব্যক্তিদের যে বিশাল সমারোহ ছিল, এর মধ্যে নয়জন বিশিষ্ট ব্যক্তিকে বলা হতো ‘নবরত্ন’। এই নবরত্নের সবচেয়ে ‘উজ্জ্বল রত্নটি’ ছিলেন বীরবল।

বীরবল বাদশাহ আকবরের দরবারে একজন কবি ও গায়ক হিসেবে নিয়োগ পান। কিন্তু বুদ্ধিমত্তা ও চতুরতার জন্য তিনি সবার কাছে সুপরিচিত লাভ করেন। ১৫৮৬ সালের বাদশাহ আকবর তাকে ভারতের উত্তর-দক্ষিণ দিকে অর্থাৎ বর্তমান আফগানিস্তান পাঠান। কিন্তু এই অভিযান অত্যন্ত শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হয় এবং বিদ্রোহী উপজাতিদের আক্রমণে বহু সৈন্যসহ বীরবল মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর মৃত্যুসংবাদ বাদশাহকে অত্যন্ত ব্যথিত করে।

বীরবল শুধু যে তার অসাধারণ বুদ্ধির জন্যই পরিচিত ছিলেন তাই নয়, এর সাথে তার অসাধারণ উপস্থিত বুদ্ধি, জ্ঞান এবং চাতুর্যের জন্যও তিনি প্রসিদ্ধ ছিলেন।এখানে আকবর এবং বীরবলের কয়েকটি অসাধারণ বুদ্ধিমত্তা এবং মজাদার ছোটগল্প দেওয়া হল যেগুলি আপনার ছোট্টটিকে অন্তর থেকে আমোদিত করে তুলবে।


চাষীর কুয়ো

একদা, এক চতুর ব্যক্তি তার নিজের পাত–কুয়োটিকে একজন চাষীকে বিক্রি করে দেন।তার পরের দিন যখন চাষীটি কুয়োর কাছে গেলেন তার থেকে কিছু জল তুলতে তখন সেই ধূর্ত ব্যক্তিটি চাষীকে বলেন যে তিনি চাষীকে কেবল কুয়োটিকে বিক্রি করেছেন কিন্তু তার জল বিক্রি করেন নি। তখন চাষীটি বুঝতে পারলেন না যে তিনি কি করবেন এবং বিষণ্ণ চিত্তে আকবরের সভায় গিয়ে উপস্থিত হলেন। তখন বীরবলকে এই মামলার তদারকি করতে বলা হল।তারপরের দিনই কুয়ো বিক্রি করা লোকটির সাথে সেই চাষীটিকেও রাজ দরবারে ডাকা হল।চতুর লোকটি তখন সেই একই কথা বললেন যে তিনি তার কুয়োটিকে বিক্রি করেছে কিন্তু তার জলকে নয়।এই কথা শুনে বীরবল বললেন যে, ” হে বন্ধু আমার! তবে তো তোমাকে এক্ষেত্রে হয় কুয়ো থেকে সব জল সরিয়ে ফেলতে হবে কিম্বা সেই জল রাখার জন্য কর দিতে হবে কারণ কুয়োটি যে তোমার নয়, চাষীর।” তখন বুদ্ধিতে হেরে গিয়ে অসহায় বোধ করে সেই ব্যক্তিটি তার ভুল বুঝতে পারেন এবং তার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেন।

নীতিকথা

যদি আপনি কাউকে ঠকান তাহলে আপনাকে আপনার কর্মের মূল্য দিতে হবে।


মুরগি এবং মোরগের কাহিনী

একবার সম্রাট আকবর তার প্রিয় মন্ত্রী বীরবলের সঙ্গে একটি কৌতুকপূর্ণ চালাকির খেলা খেলবেন বলে মনস্থ করলেন। তিনি তাঁর বাকি সমস্ত মন্ত্রীদের কাছে তার পরিকল্পনাটি ব্যক্ত করলেন এবং তাদের সাথে তা নিয়ে আলোচনাও করলেন।পরিকল্পনা মাফিক নির্ধারিত দিনে প্রত্যেক মন্ত্রী একটি করে ডিম আনলেন এবং সেগুলিকে তারা তাদের পোশাকের ভেতর লুকিয়ে রাখলেন। পরের দিন সম্রাট আকবর তাঁর সভাসদদের বললেন যে, তিনি একটি স্বপ্ন দেখেছেন– সেই স্বপ্নানুযায়ী তিনি দেখেছেন যে, সভার প্রতিটি মন্ত্রী যদি রাজ–পুকুর থেকে একটি করে ডিম সংগ্রহ করে আনেন তবে সেটি সম্রাটের প্রতি তাদের আনুগত্য প্রমাণ করবে।তাঁর স্বপ্ন বর্ণনের পর, সম্রাট তাঁর সকল মন্ত্রীদের সেই কাজটি করার কথা বললেন যাতে তাঁর প্রতি তাঁর মন্ত্রীবর্গের আনুগত্যটি প্রকাশ পায়। পরিকল্পনা মাফিক সকল মন্ত্রী পরিষদ ডিমের খোঁজ করতে যাওয়ার মত অভিনয় করলেন, এবং প্রায় কোনওরকম সময় না নিয়েই তারা সকলেই তাদের পোশাকের মধ্যে আগে থেকেই লুকিয়ে রাখা ডিমগুলিকে বের করে নিয়ে এলেন। বীরবলও ডিমের সন্ধানে গেলেন কিন্তু অনেক খোঁজাখুঁজি করেও একটি ডিমও খুঁজে পেলেন না।যখন বীরবল খালি হাতে ফিরে এলেন তখন প্রত্যেকেই তার সমালোচনা করলেন এবং নিজেদের মধ্যে হাসাহাসি করতে লাগলেন।বীরবল পুরো ব্যাপারটি বুঝতে পারলেন এবং সোজাসুজি সম্রাটের কাছে গিয়ে জোর গলায় মোরগের মত ডাকতে শুরু করলেন।সম্রাট কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে উঠলেন এবং বীরবলকে জিজ্ঞেস করলেন তিনি কেন এরকম আচরণ করছেন যার প্রত্যুত্তরে বীরবল বললেন, “হে রাজন! আমি কোনও মুরগি নই আর তাই কোন ডিম আমি আপনাকে এনে দিতে পারিনি; কিন্তু আমি একটি মোরগ হতে পারি আর সেজন্য আমি আপনার জন্য সবচেয়ে ভাল এইরকম ডাক ডাকতে পারি“। একথা শুনে প্রত্যেকেই উচ্চ হাসিতে ফেটে পড়লেন।

নীতিকথা

আত্মবিশ্বাস যেকোনো কঠিন পরিস্থিতির সঙ্গে মোকাবিলা করতে সবথেকে বেশি সাহায্য করে।


স্বর্ণ মুদ্রা এবং ন্যায়বিচার

ঠিক অন্যান্য দিনের মতই সম্রাট আকবরের সভায় একদিন আকবর বীরবলকে জিজ্ঞাসা করলেন যে, “বন্ধু বীরবল যদি আমি তোমাকে ন্যায়বিচার এবং স্বর্ণ মুদ্রা এই দুটির মধ্যে কোনওটিকে বেছে নিতে বলি তুমি কোনটিকে বেছে নেবে?” বেশি সময় না নিয়েই বীরবল উত্তর দিলেন যে। “আমার প্রিয় প্রভু! নিঃসন্দেহে আমি স্বর্ণমুদ্রাকেই বেছে নেব“। বীরবলের এই নিমেষের উত্তরে সকলেই বিস্ময়ে হতবুদ্ধি হয়ে উঠলেন এমনকি স্বয়ং আকবরও ছিলেন তাদের মধ্যে এবং সকলেই ভেবেছিলেন যে বীরবল হয়ত এই বার একবার হলেও উত্তর দেওয়ার আগে তোতলাবেন ও ইতস্থত বোধ করবেন উত্তর দিতে।আকবর তাঁকে বললেন যে, “আমি তোমার উপর ভীষণ হতাশ হয়েছি বীরবল।কেন তুমি ন্যায়বিচারের মত একটা বড় জিনিসকে বাদ দিয়ে সোনার মত এক সামাণ্য জিনিসকে বেছে নিলে?” তখন বীরবল তাঁর মুখে এক বিদ্রূপের হাসি এনে উত্তর দিলেন যে। “হে আমার দয়াপরবশ রাজা!ন্যায়বিচারের তো কোনও অভাব নেই কারণ আপনার রাজ্যের সর্বত্রই তো ন্যায়বিচার রয়েছে।আর আমি মনে করি না যে জিনিসটি আমার কাছে ইতিমধ্যেই প্রচুর পরিমাণে আছে এবং যার ফুরাণ নেই সেটির প্রয়োজন আছে কিনা তা জিজ্ঞাসা করার আর কোনও প্রয়োজন আছে বলে কিন্তু হে প্রভু, এক দিন না একদিন আমার অর্থের ঘাটতি অবশ্যই হবে আর তখনের জন্য স্বর্ণ মুদ্রাটাই সবচেয়ে ভাল“। এই উত্তর শোনার পর আকবর নির্বাক হয়ে গেলেন, কিন্তু তাঁর মুখে এক বৃহৎ হাসি দেখা গেল।বীরবলের এই বুদ্ধিদীপ্ত যৌক্তিক উত্তরে তিনি অত্যন্ত খুশি হয়ে উঠলেন এবং তাঁকে 100 টি স্বর্ণ মুদ্রা উপহার দিলেন।

নীতিকথা

কথা বলার সময় বুদ্ধি দিয়ে শব্দগুলিকে বেছে নেওয়া উচিত।


বুদ্ধিমান বীরবল

একদিন আকবর তাঁর হাতের একটি আংটি হারিয়ে ফেলেছিলেন যেটি তার কাছে অত্যন্ত মূল্যবান ছিল।সেই আংটিটি তার বাবা তাকে উপহার দিয়েছিলেন এবং সেটিকে হারিয়ে ফেলে আকবর খুবই দুঃখিত হয়ে পড়েছিলেন। এরপর আকবর বীরবলকে ডেকে পাঠালেন এবং সেই আংটিটিকে খুঁজে দেওয়ার জন্য তাঁকে অনুরোধ করলেন।সেই সময় রাজ দরবার ছিল প্রচুর সভাসদে পরিপূর্ণ।এমন সময় বীরবল ঘোষণা করলেন যে, “হে আমার প্রিয় রাজন! আংটিটি ঠিক এই সভাকক্ষের মধ্যেই রয়েছে, এবং যার কাছে সেই আংটিটি আছে তার দাড়িতে একটি খড় আটকে আছে।” তখন সকলেই একে অপরের মুখ চাওয়া–চায়ি করল এবং উপস্থিত সভাসদদের মধ্যে একজন তার দাড়ির মধ্যে খড় খুঁজতে শুরু করলেন।বীরবল তখন সিপাহীদের ডাকলেন এবং তাদের বললেন সেই সন্দেভভাজন ব্যক্তিটিকে ভালো করে পরীক্ষা করতে। সেই সন্দেহভাজন ব্যক্তিটিকে ভালো করে তল্লাশি চালানোর পর তার থেকে সেই আংটিটি উদ্ধার হল।তখন বিস্মিত হয়ে আকবর বীরবল কে প্রশ্ন করলেন যে কি করে তিনি সেই আংটিটি খুঁজে বের করলেন।উত্তরে বীরবল জানান যে, “হে আমার প্রভু! যার মধ্যে অপরাধবোধ থাকবে বা ভুল কাজ করবেন তিনি সর্বদাই ভয় পাবেন“।

নীতিকথা

যার মধ্যে অপরাধবোধ থাকে তার প্রতি আর আলাদা করে অভিযোগ করার প্রয়োজন পড়ে না।


বীরবল বীরবলই

বন্ধুরা, আমরা আগেই বলেছি যে, বাদশাহ আকবর, বীরবলকে বেশি ভালোবাসতেন। আর সে কারণে দরবারের অন্যান্যরা মনে মনে ঈর্ষা করতেন। বীরবল তাদের মনের কথা ভালো করেই বুঝতেন। একদিন তাঁরা বাদশাহকে বললেন, ‘জাঁহাপনা, আমরা বীরবলের চেয়ে কোনো অংশে কম নই। কিন্তু আপনি সব কথা বীরবলকে জিজ্ঞেস করেন, আমাদের করলে আমরা কি পারব না?

আকবর বললেন, ‘তাই নাকি, তোমরা বীরবলের সমান? এ তো অতি উত্তম কথা। ঠিকাছে, আমি তোমাদের একটি কাজের দায়িত্ব দিচ্ছি। তোমরা আমাকে এমন একটি বীজ এনে দাও যাতে সমস্ত বনস্পতি অঙ্কুরিত হয়। যদি পারো জানব তোমরা বীরবলের চেয়ে শ্রেষ্ঠ।’

এ কথা শুনে সবাই নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে রইলেন। আনা তো দূরের কথা, এমন কথা, এমন বীজের কথা তারা কেউ ভেবেও পাচ্ছিলেন না- এখন কী করবেন। সবাই একে অন্যের মুখের দিকে চেয়ে ভাবতে থাকেন কে কী বলবেন- এই ভেবে। আকবরও মনোযোগ দিয়ে সকলের দিকে বারবার চাইছিলেন- কে কী করেন তা দেখার জন্য।

বাদশাহ তখন বীরবলকেও একই অনুরোধ জানালেন। বীরবল একটি পাত্রে পানি নিয়ে এসে বাদশাহকে বললেন, ‘এই সমুদয় বনস্পতির বীজ। নিন হুজুর।’

একথা শুনে বাদশাহ তার মন্ত্রী ও উপদেষ্টাদের বললেন, এবার বুঝলে তো, তোমরা বীরবলের সমকক্ষ কি না! বীরবল বীরবলই, সে তোমাদের বুদ্ধির কত উপরে একবার ভেবে দেখো।’


বীরবলের বুদ্ধিদীপ্ত জবাব

একবার দিল্লির দরবারে এক পণ্ডিত বাদশাহ আকবরকে বললেন, ‘জাঁহাপনা, আমি বিভিন্ন রাজ্যের পণ্ডিতদের তর্কশাস্ত্রে পরাজিত করে নিরানব্বইটি সোনার পদক লাভ করেছি! এখন আপনার দরবারের পণ্ডিতদের কাছে তিনটি প্রশ্ন করব। যদি কেউ এগুলোর যথার্থ উত্তর দিতে না পারেন, তাহলে মাত্র একটি সোনার পদক দাবি করব। সেটাই হবে আমার একশতম পদক। আর যদি আপনার সভাসদদের মধ্যে কেউ প্রশ্ন তিনটির উত্তর দিতে পারেন তাহলে আমি আমার নিরানব্বইটি পদকই তাকে দিয়ে দিব।’

এই প্রস্তাবে বাদশাহ রাজি হলেন। এবার পণ্ডিত একে একে প্রশ্ন তিনটি উত্থাপন করলেন। তার প্রথম প্রশ্ন, স্বপ্নে আমি একজন স্ত্রীলোককে দেখেছিলাম। তাকে জিজ্ঞেস করলাম, সে কে? সে বলল, ‘আমি বুদ্ধি’। কোথায় থাক? তার উত্তর “মগজে থাকি।” এখন আপনাদের মধ্যে কেউ কি বলতে পারেন, মগজ থেকে বুদ্ধি বেরিয়ে যায় কার?

আমার দ্বিতীয় প্রশ্নটি হলো : ‘আমি একটি মেয়েকে স্বপ্নে দেখলাম। তার নাম জিজ্ঞেস করে জানলাম ‘শক্তি’। কোথায় থাকে জিজ্ঞেস করতে বলল, “বাহু আর শরীরে আমার স্থান।” এখন আপনারা কি বলতে পারবেন, বাহু আর শরীর থেকে শক্তি চলে যায় কার?

সভাসদরা কেউই পণ্ডিতের প্রশ্নের উত্তর দিতে পারলেন না। আকবর বাদশাহ এইসব প্রশ্ন শুনে নিজেও কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেলেন। সত্যি সত্যি কি কেউই এর জবাব দিতে পারবে না?

এবার পণ্ডিত তার তৃতীয় প্রশ্নটি বলার জন্য মুখ খুললেন। বললেন, আমি আর একটি মেয়েকে দেখলাম। তার নাম জিজ্ঞেস করতে সে বলল, ‘হিম্মত’। সে কোথায় থাকে জিজ্ঞেস করাতে বলল, “হৃদয়ে থাকি!” এবার আপনারা বলুন হৃদয় থেকে হিম্মত চলে যায় কি?

যখন কেউ উত্তর দিতে পারল না, তখন বীরবল উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, ‘প্রথম প্রশ্নের উত্তর হচ্ছে- সবসময় যারা স্বপ্নজাল বোনে তাদের বুদ্ধি মগজ থেকে বেরিয়ে যায়।’ দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তর- মানুষ যখন বৃদ্ধ হয় তখন তার বাহু আর শরীর থেকে শক্তি চলে যায়।’ তৃতীয় প্রশ্নের উত্তর—‘মানুষ যখন ভীরু কাপুরুষ হয়ে পড়ে তখন তার হিম্মত হৃদয় থেকে চলে যায়।’

বীরবলের বুদ্ধিদীপ্ত জবাব শুনে পণ্ডিত লজ্জায় লাল হয়ে পরাজয় স্বীকার করে নিলেন। সেইসঙ্গে প্রতিজ্ঞা করলেন, আর কখনও কোথাও জ্ঞানের বড়াই করবেন না। অঙ্গীকার অনুযায়ী বীরবলকে তিনি তাঁর নিরানব্বইটি পদকই দিতে গেলেন। কিন্তু বীরবল তা গ্রহণ না করে উদারতার পরিচয় দিলেন। বাদশাহকে অনুরোধ করে আর একটি পদকও জোগাড় করে দেন তিনি।


বীরবলের ফারসি শেখা

কিশোর বয়সে এক মৌলভীর কাছে ফারসি শিখতে গিয়েছিলেন বীরবল। একদিন পড়া বলতে না পারায় মৌলভী সাহেব তার ওপর খুব রেগে গেলেন। বললেন, জানো তোমার বয়সে বাদশাহ হুমায়ুন প্রতিদিন দশ ঘণ্টা করে লেখাপড়া করতেন?

বীরবল সবিনয়ে জানাল, জী! আপনার মতো বয়সে হুমায়ুন বাদশাহ হয়ে ভারত শাসন করেছিলেন, আর আপনি আমাদের মতো ছোট্ট ছাত্রদের ভাঙা মাদ্রাসায় বসে পড়াচ্ছেন।


সত্য ও মিথ্যার ব্যবধান

একদিন গ্রীষ্মকালের স্নিগ্ধমধুর প্রভাতে বায়ু সেবনের জন্য বীরবলকে সঙ্গে নিয়ে প্রাতঃভ্রমণে বের হলেন বাদশাহ আকবর। অনেকদূর পর্যন্ত কথা বলতে বলতে চলে গেলেন তাঁরা। ফেরার সময় বেশ রৌদ্র উঠল এবং আবার অসহ্য গরম পড়ে গেল। বাদশাহ বললেন, উঃ বড্ড গরম লাগছে! অনেক বেলা হয়ে গেছে। তুমি আমার ভারী জামাটা কাঁধে নেবে বীরবল?’

বীরবল ‘হ্যাঁ’ বলে সম্রাটের সেই জামাটা কাঁধে ফেলে ধীরে ধীরে চলতে লাগলেন। অনেকটা দূর গিয়ে বাদশাহ একবার মুখ ফিরিয়ে প্রশ্ন করলেন, ‘খুব ভারী মনে হচ্ছে? নিশ্চয়ই তোমার কষ্ট হচ্ছে? এই বোঝা কতটা ভারী হবে বলো তো?” বীরবল জবাব দিলেন, তা একটা গাধার বোঝা হবে বৈকি।’ বাদশাহ স্তব্ধ হয়ে বীরবলের দিকে তাকিয়ে রইলেন।

তারপর পথ চলতে লাগলেন এবং রাজদরবারে পৌছে গেলেন। রাজদরবারের মাঝখানে সিংহাসনে বসে বাদশাহ আকবর প্রশ্ন করে বসলেন, “বলো তো বীরবল, সত্য ও মিথ্যার মাঝখানে ব্যবধান কতটুকু?”

বীরবল এদিক-ওদিক তাকিয়ে পরিষ্কার কণ্ঠে জবাব দিলেন, ‘মাত্র চার ইঞ্চি হুজুর। এর বেশি কোনোমতেই হতে পারে না।’

‘মাত্র চার ইঞ্চি!’ বাদশাহ অবাক হয়ে বললেন, সে কী কথা? তুমি ঠিক বলছ তো?

জ্বি হুজুর। মাত্র চার ইঞ্চি! আমরা দুই চোখে যা দেখি তা সত্য। কিন্তু দুই কানে যা শুনি তা অনেক সময় সত্য হয়, অনেক সময় মিথ্যা। চোখ দিয়ে দেখা এবং কান দিয়ে শোনা, এ দুইয়ের মধ্যে ব্যবধান যেমন চার ইঞ্চির বেশি নয়, সত্য ও মিথ্যার পার্থক্যও ততটুকু।

জবাব শুনে সম্রাটের মুখ প্রফুল্ল হয়ে উঠল। তিনি বীরবলকে বললেন, ‘সত্যি, তোমার তুলনা তুমিই।


আকবরপুত্রের বন্ধুত্ব নষ্টে বীরবল

বাদশাহ আকবরের পুত্র সেলিমের সঙ্গে এক মন্ত্রিপুত্রের ব্যাপক বন্ধুত্ব হয়েছিল। সবসময়ই তারা একসঙ্গে থাকতেন, হাসি-ঠাট্টা করতেন। একেবারে এক আত্মা, এক প্রাণ। দু’জন দু’জনকে ছেড়ে থাকতে পারতেন না। খাওয়া, ওঠাবসা সবসময়ই করতেন একসঙ্গে। কিন্তু ওঁদের এত বন্ধুত্ব বাদশাহর ভালো লাগত না। একদিন তিনি বীরবলকে ডেকে বললেন, ‘বীরবল, সেলিমের সঙ্গে মন্ত্রিপুত্রের এত ভাব আমার ভালো লাগছে না। তুমি ওদেরকে যেকোনো ভাবে আলাদা করে দাও। বীরবল বললেন, আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন জাঁহাপনা, আমি ওদের বন্ধুত্ব নষ্ট করে দিচ্ছি। এজন্য আপনাকে কোনও ভাবনাচিস্তা করতে হবে না।’

সেলিম ও মন্ত্রিপুত্র একদিন বসে গল্প করছিলেন। বীরবল গিয়ে সেলিমের কানের কাছে মুখ নিয়ে শুধু ফুসফুস করে শেষে বললেন, ‘যে-কথা বললাম কাউকে যেন সে কথা বলো না।’

বীরবল চলে যেতেই মন্ত্রিপুত্র সেলিমকে জিজ্ঞেস করলেন, উনি কী বলে গেলেন? আবার যাওয়ার সময় বলে গেলেন—না বলতে।’ সেলিম বললেন, কিছুই না, শুধু ফুসফুস করলেন। সত্যি বলছি, আর কিছু বলেননি।

মন্ত্রিপুত্র সে-কথা বিশ্বাস করলেন না। জরুরি কাজ আছে বলে উঠে চলে গেলেন। মন্ত্রিপুত্র মনে মনে ভাবলেন হয়তো তাঁরই সম্পর্কেই বীরবল কিছু বলতে মানা করছেন। সেলিম কিন্তু সেজন্যই বলছে না। এরপর থেকেই কোনোদিনই আর তাদের দু’জনকে একত্রে দেখা যেত না। মন্ত্রিপুত্র আর একেবারেই আসতেন না।


বীরবলের বিচারক নিয়োগ

বাদশাহ একদিন বেশ হাসিখুশি মুখে ছিলেন। সেই সুযোগে বীরবল বললেন, বাদশাহ, আপনার কাছে একটি ভিক্ষে চাই?’ বাদশাহ বললেন, ‘বেশ তো, বলো?’

বীরবল বললেন, যদি আমি কোনোদিন দোষ করি, আমার মনোনীত জুরিরা যেন আমার বিচার করেন।

বাদশাহ বললেন, ‘বেশ ভালো কথা। তাই হবে।’

বেশ কিছুদিন পরে ইচ্ছা করেই বীরবল একটি ঘোরতর অন্যায় কাজ করে বসলেন। বাদশাহ সিদ্ধান্ত নিলেন বীরবলকে শাস্তি দিতেই হবে। বীরবল বুঝতে পারলেন, যদি ঠিকমতো শাস্তি হয় তবে অন্তত দশ-বিশ হাজার টাকা তার অর্থদণ্ড হতে বাধ্য। কিন্তু সেই সময় বাদশাহকে তিনি পূর্বপ্রতিজ্ঞা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বললেন, ‘হুজুর, আমার জুরিদের আমিই স্থির করব বলে যে অনুরোধ করেছিলাম আপনি তা দেবেন বলে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিলেন। আপনার কথা যদি এখন রাখেন তবে আমার পক্ষে ভালো হয়।

বাদশাহ বললেন, ‘তাই হোক, পাঁচজন বিচারক স্থির করে দাও, তাদের বিচার যাই হোক না কেন তোমাকে কথা দিলাম, আমি মেনে নেব।’

বীরবল বললেন, ‘তাহলে গ্রাম থেকে পাঁচজন দরিদ্র লোককে আনতে বলুন, তারা এসে আমার বিচার করুক। তারা যা বিচার করে দেবে তা আমি মাথা পেতে নেব।”

‘মানে? সম্ভ্রান্ত বিচারক তুমি চাও না?

‘হুজুর। দরিদ্ররাও তো মানুষ, সম্ভ্রান্ত লোকরাও মানুষ! সৃষ্টিকর্তার কাছে কেউ ছোট নয়, কেউ বড় নয়। এ তো আপনারই কথা! দিন না তাদের বিচার করতে হুজুর?

এরপর বাদশাহ’র হুকুমে গ্রাম থেকে পাঁচজন বৃদ্ধ কিন্তু অতি দরিদ্র লোককে আনা হলো। বাদশাহ নিজে তাদের ডেকে মামলাটা ভালো করে বুঝিয়ে দিলেন এবং এও মনে করিয়ে দিলেন যে, ‘ভালো করে বিচার করবে যাতে তোমাদের সুনাম হয়।’

তারা সবাই ভালো করে মাথা খাটিয়ে আলোচনা করে দেখল, বীরবল ভীষণ অপরাধী। এত বড় অপরাধের জন্য বীরবলের কমপক্ষে দেড়শো টাকা জরিমানা হওয়া উচিত। এর কমে কিছুতেই হতে পারে না। যেমনই অপরাধ তার তেমনি সাজা। একজন বলল, “দেড়শো? না, না, বীরবল মরে যাবেন। অত টাকা তিনি পাবেন কোথায়? স্ত্রী-পুত্র নিয়ে পথে পথে ভিক্ষে করবেন বলতে চাও? না-না, তা হতেই পারে না কিছুতেই, এতটা অন্যায় বিচার করা যায় না।’

আরেকজন বলল, তা ঠিক বলেছ, বেচারা পাবে কোথায়? যাকগে, পঁচাত্তর টাকা অর্থদণ্ড হোক। এর কম করলে বিচার ঠিক হবে না। পাঁচজনে পাঁচরকম আলাপ করার পর অবশেষে মাত্র পঞ্চাশ টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ডিত করার সিদ্ধান্ত হল। এও অনেক টাকা। বীরবল চিরজীবন এই শাস্তি মনে রাখবেন। তিনি পঞ্চাশ টাকা কোথা থেকে পাবেন?’

বিচারের রায় নিয়ে, তারা এল বাদশাহ’র কাছে। এসে বলল, জাঁহাপনা, জানি বীরবলের ওপর এটা কঠোর শাস্তি। কিন্তু অপরাধ তাঁর গুরুতর। এই বিপুল পরিমাণ অর্থদণ্ড তাঁর পক্ষে মৃত্যুদণ্ডেরই মতো। কিন্তু উপায় নেই, এ হল ন্যায়বিচারের মানদণ্ড! আপনি দেখুন, এই বিপুল অর্থদণ্ড ছাড়া আমাদের বিচারে আর কিছু করা যায় না।’

বাদশাহ যখন শুনলেন বীরবলের মাত্র পঞ্চাশ টাকা জরিমানা হয়েছে তখন আর বুঝতে বাকী রইল না কেন এই দরিদ্র ব্যক্তিদের দিয়ে বিচারের নামে প্রহসন করলেন বীরবল! অতি দরিদ্র ব্যক্তিদের বিচারে পঞ্চাশ টাকাই হল বিপুল পরিমাণ জরিমানা, সন্দেহ নেই। কিন্তু বাদশাহ খুশি হলেন এই ভেবে যে, বীরবল মানুষের মনোজগতেরও বহু খবর রাখেন। দরিদ্র প্রজাদের মন সরল ও নিরপেক্ষ এবং তাদের দ্বারাও যে মহৎ উপকার হয়, তা বুঝিয়ে দিলেন তিনি।

Anuprerona
Anupreronahttps://www.anuperona.com
Read your favourite literature free forever on our blogging platform.
RELATED ARTICLES

Most Popular

Recent Comments