একুশে পা – বাণী বসু

একুশে পা - বাণী বসু

‘এতটা সর্দারি প্রথম দিনেই? ইস্‌স্….’

ইমনকে হঠাৎ দেখলে সে ছেলে কি মেয়ে বোঝবার উপায় নেই। চুল ছেলেদের মতো, সামনে বড় বড়, পেছনে ছোট ছোট করে কাটা। মাথার পেছনটা পরিষ্কার তিনকোণা। মাজা গায়ের রং। মুখখানা বালকসুলভ। চোখে একটা মৃদু হাসি। যেন যা-যা দেখছে মোটের ওপর সমর্থনই করছে সে। লম্বায় বোধ হয় পাঁচ পাঁচ। মেয়ে হিসেবে বেশ লম্বাই তো! ছেলে হিসেবে কি একটু বেঁটের দিকে! খাপ ছাড়া তাপ্পি-দেওয়া রঙ-জ্বলা জীনস আর ঝলঝলে টি-শার্ট পরে আছে। ভীষণ স্টাইলিশ দেখাচ্ছে। আলগা আলগা ভাবে অথচ বেশ স্বচ্ছন্দে, যেন কুশলী সাঁতারুর মতো সে যে কোনও পরিপার্শ্বর মধ্যে দিয়ে চলে যাচ্ছে, নিজেকে বুঝি তার মনে নেই। এই পরিবেশও বুঝি আদৌ তার অচেনা নয়। অথচ, হোস্টেলে উঠেছে যখন তখন ধরেই নেওয়া যায় সে বহিরাগত। এই শহরের অন্তহীন শব্দবাদ্য, উৎসবপ্রিয়তা, মিছিল, জট, ধোঁয়ায় এখুনি এখুনি তার অভ্যস্ত হয়ে যাবার কথা নয়।

অগাস্ট মাসের মাঝামাঝি এখন। প্রখর রোদ, ভ্যাপসানি গরম। রাস্তার পিচ তলতল করছে। আকাশের রঙটা এই সময়ে ক্ষয়াটে নীল হয়। কাকগুলো উড়ছে না, ডাকছে না। গাছপালার ভেতরে ঘাপটি মেরে বসে আছে বোধহয়। কলেজ-গেটের বাঁ দিকে একটা কৃষ্ণচূড়া। কৃষ্ণচূড়া, রাধাচূড়া, নিম, তেঁতুল এই সব দেখলে ইমনের মনটা কিরকম হালকা হয়ে যায়। গাছগুলো চেনা বলে কি? না বোধহয়। বট অশত্থও তো চেনা, তাদের দেখলে তো কিছু হয় না! এই গাছগুলোরই ঝিরিঝিরি পাতায় কোনও বিশেষ গুণ আছে। মনের মধ্যে গিয়ে ঝিলমিল করতে থাকে, গুমোট কেটে যায়।

এই মাত্র যে ‘টু বি’ বাসটা চলে গেল সেটা থেকে নিজেদের টেনে হিঁচড়ে নামাল কয়েকটি মেয়ে। একজন নিজের কচি-কলাপাতা চুন্নিটা টেনে নিতে নিতে বাসের সংকীর্ণ প্রবেশ-পথের দিকে অগ্নিদৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল ‘ডিসগাসটিং! স্পেস-স্যুট পরে যাতায়াত করতে হবে দেখছি এ রুটে!’ এই মেয়েটি মেমসাহেবের মতো লালচে ফর্সা। একটু বাদামি রঙের চুলে দুটো মোটা বিনুনি করা। চওড়া মুখ। লম্বা দোহারা চেহারা। বেশ গোটা গোটা স্পষ্ট নাক-চোখ-মুখ-দাঁতের মেয়ে। এ উজ্জয়িনী। একে দেখলে মনে হয় ভীষণ অহঙ্কারী, কাউকে গ্রাহ্য করে না। এর পাশেপাশে যে হাঁটছিল সে মিঠু। উজ্জয়িনীর মাথায় মাথায়। রোগা বলে আরও লম্বা দেখায়। রঙ চাপা। চুলে স্টেপকাট। মিঠুর চিবুকের কাছটা সরু হয়ে এসেছে। বুদ্ধিমান চোখ। হাসলে গোটা মুখটাই ঝিকিয়ে ওঠে। মিতু তার লম্বা স্কার্ট দুলিয়ে বলে উঠল ‘কষে থাপ্পড় দিলি না কেন?’

উজ্জয়িনী বলল ‘কম চালাক নাকি? লাস্ট মোমেন্টে….’

‘পেছনে আসছে অণুকা, মোটাসোটা, চুলে ববকাট। সে গালে টোল ফেলে বলল ‘এই লোকগুলোকে এলিমিনেট করে দেওয়া উচিত। একদম শটাশট।’

ওরা তিনজনে রাস্তা পার হল। কলেজ গেট দিয়ে ঢুকতে ঢুকতে ইমনকে ওরা লক্ষ্য করেছিল। মিঠু হতাশ গলায় বলল ‘দূর এ তো গরুর গোয়াল! কত দিন ধরে আশা করে আছি প্রেসিডেন্সিতে পড়ব। ঠি-ক সেই হল না! অথচ কী ভাল পরীক্ষা দিয়েছিলাম!’

উজ্জয়িনী মাথা ঝাঁকিয়ে বলল ‘তুই নাকে-কান্না ছাড় তো মিঠু। হল না তো হল না! কী আমার প্রেসিডেন্সি রে! যার যাতে ন্যাক নেই তাই পড়তে হবে না কি তাই বলে। ইংলিশ নিয়ে পড়বার চান্স পেয়েছিস, এর জন্যেই ভাগ্যকে ধন্যবাদ দে। আমাদের পাশের ফ্ল্যাটের সুষ্মা ভার্গব! অত ভাল মেয়ে তো! জয়েন্টে পেলো? আই. আই. টি পেলো? এখন শেষ পর্যন্ত ম্যাথ্‌স্ নিয়ে বিদ্যাসাগরে পড়ছে। আমার এক মামাত কাজিনের কথা জানিস? কেমিস্ট্রিতে ব্যাক পেল! অবাক কাণ্ড! পরের বছর গ্র্যাজুয়েশন করে স্টেটসে চলে গেল। ওখানে ওর প্রোফেসররা কী বলে জানিস ‘ঘোষ, য়ু আর একসেপশন্যালি ব্রিলিয়ান্ট।’ অতদূর কেন, বাঙ্গালোরে যা না, স্ট্যান্ডার্ড ইউনিভার্সিটিতে চান্‌স্ পেয়ে যাবি, যে সাবজেক্টে ইচ্ছে, খরচটা একটু বেশি হবে খালি। এখানেই খালি সব পেটারন্যাল প্রপার্টি। পরীক্ষাটা মেরিটের হয় না, হয় ভাগ্যের।’

মিঠু চুপ করে গেল এই তোড়ে বক্তৃতার সামনে। কিন্তু বোঝা যাচ্ছে তার মনের কষ্ট যায়নি। চোখ চকচক করছে।

কলেজ-হলের মুখোমুখি তাদের অভ্যর্থনা জানাল সন্তোষ আগরওয়াল। ‘আরে! তুমলোগ ভী ইঁহা!’ হাসিতে চশমার পেছনের চোখ দুটো প্রায় বুজিয়ে বলল সন্তোষ ‘তব্ তো বড়া মজা আ জায়েগা।’ সন্তোষ ওদের সাঁতার ক্লাবের বন্ধু।

মিঠু বলল ‘ঋতুকে চিনিস তো? ঋতু, রাজেশ্বরী ওরাও এখানেই ভর্তি হয়েছে। পল সায়েন্স। আমাদের পুরো গ্রুপটাই বলতে গেলে এখানে।’

পেছন থেকে একদল ছেলে চটির শব্দ করতে করতে এগিয়ে আসছিল। খুব। উত্তেজিত। ‘কী হওয়া উচিত জানিস তো? ছাত্র-রাজ। এখন গভার্নিং বডিতে রিপ্রেজেনটেটিভ দিতে বাধ্য হচ্ছে। এরপর বিধানসভায়, পার্লামেন্টে সব জায়গায় দিক। নইলে দুর্নীতি, ছাত্র এক্সপ্লয়টেশন কোনদিন বন্ধ হবে না….’

ওরা কথা বলতে বলতে অনেক দূর চলে গেছে। সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠছে খুব সম্ভব ‘গভমেন্ট অফ দা স্টুডেন্টস, বাই দা স্টুডেন্টস…ফর দা স্টুডেন্টস্’ ভেসে এলো হাওয়ায়।

মিঠু ফিক করে হেসে বলল ‘ছাত্র এম. এল. এ? এ ছাত্র এম. পি? পড়বে কখন রে ছাত্ররা, এই অণু! এই উজ্জয়িনী! গভমেন্ট যখন, তখন মিনিস্টারও হবে…’।

‘বিনা পরীক্ষায় পাশ করাটা ছাত্র এম. এল. এ, এম. পি-দের পার্কসের মধ্যে পড়বে। বুঝলি না?’ উজ্জয়িনী বলল।

সন্তোষ আগরওয়াল বলল ‘তবে তো আমি জরুর এম. এল. এ, এম. পি-ই হচ্ছি।’

‘আচ্ছা আচ্ছা আগে চল তো এখন ক্লাসরুম-টুম গুলো খুঁজে বার করা যাক। কী বিশাল কলেজ! বাব্‌বা!’

‘ইমন মুখার্জি! রোল নাম্বার সিক্সটীন!’ বি. ডি. জি অর্থাৎ বেলা দাশগুপ্ত রোল কল করছেন। প্রথম দিনের প্রথম ক্লাস। ভাঙা-ভাঙা গলায় জবাব এলো ‘ইয়েস ম্যা’য়াম।’ বি. ডি. জি কয়েক সেকেন্ড গাবদা পেনখানা রেজিস্টারের দিকে তাক করে রেখে চশমার ঘন কাচের মধ্যে দিয়ে ভালো করে চেয়ে দেখলেন, তারপরে চোখ নামিয়ে পরের রোল নম্বরে চলে গেলেন। ‘তন্ময় হালদার—সেভেনটীন!’

ফাস্ট, সেকেন্ড, থার্ড বেঞ্চে ছড়িয়ে বসতে হয়েছে ওদের। কথা বলতে হলে থার্ড বেঞ্চের মেয়েদের সামনে ঝুঁকে পড়তে হচ্ছিল, সেকেন্ড বেঞ্চের মেয়েরা আড় হয়ে বসেছিল, ফাস্ট বেঞ্চের মেয়েরা ক্রমাগত পেছন ফিরে যাচ্ছিল। ছোটখাট একটা সভা-ঘরের মতো উপছো-উপছি ভর্তি ক্লাস। স্কুলের শৃঙ্খলা, বকুনি শোনা, এ-সবের অভ্যেস একদিনেই অনেকটা পেছনে পড়ে গেছে। এখন তো যা-খুশির দিন। কলেজ! বেলা একটা পঁয়তাল্লিশের ক্লাস। এর আগে পর্যন্ত একটা ক্লাসও আর হয়নি। টাইম-টেব্‌ল দেখে-দেখে এক একটা ঘরে গিয়ে বসছে আর কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে হুড়হুড় করে বেরিয়ে আসছে ওরা। এর ঠিক আগের ক্লাসটা কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে ঝাঁকড়া-চুলো একটা হিলহিলে ছেলে সামনে এগিয়ে এসে খাতা ঝাঁকিয়ে বলল ‘বন্ধুগণ, ওয়েট করে লাভ নেই। অনেকগুলো ডিপার্ট এখনও নাকি রুটিন পায়নি, আজকের স্কুপ। এখনও কদিন এমনি চলবে।’

এর চেয়ে ভারী গলার একজন বলে উঠল ‘নেক্সট উইকে ফ্রেশার্স, তারপরই স্বাধীনতা দিবস, তদ্দিনই এমনি চলবে।’

ওরা বেরিয়ে এসেছিল করিডরে। হলে। চশমা-পরা, পড়ুয়া-চেহারার একটি বেণী দোলান মেয়ে সামনে দিয়ে যাচ্ছিল, যেরকম সীরিয়াস, মনে হয় থার্ড ইয়ার। মোটা গলার ছেলেটি তাকে গিয়ে পাকড়াও করল ‘এই যে দিদি, ভেতরের খবরটা ছাড়ুন তো, এ-কলেজে ক্লাস-টস হয়? না স্রেফ অ্যাডমিশন দিয়ে সব যে-যার চরে খেতে ছেড়ে দেয়!’

মেয়েটি ভাল করে ওর দিকে তাকিয়ে বলল ‘এসো, দেখছি।’ শাঁ করে ঢুকে গেল, হল পেরিয়ে পাশের ডানদিকের ঘরে। দু সেকেন্ড পরেই ঝোলা গোঁফ, মোটা ফ্রেমের চশমা-পরা একজন প্রোফেসর বেরিয়ে এলেন। সঙ্গে আগের মেয়েটি। মেয়েটি ইশারায় ওকে দেখিয়ে দিল।

‘এই যে শোনো, শোনো হে, কী নাম তোমার?’

‘আজ্ঞে ভেঙ্কট।’

‘কী বললে? ভেঙ্কট? সাউথ ইন্ডিয়া?’

‘না সার, ঈস্ট। ভেঙ্কটেশ পাল, তিরুপতির দোর ধরা..তাই… গ্র্যান্ডমাদার…’

‘তা বেশ বেশ। নন্দিতাদিকে কী যেন বলছিলে?’

ভেঙ্কটেশ ঘাবড়ে গিয়ে আমতা আমতা করতে আরম্ভ করল।

‘না মানে ক্লাস কখন..ক্লাসের টাইম…’

‘উঁহু তুমি চরে-খাওয়া টাওয়ার কথা কি সব জিজ্ঞেস করেছিলে না?’ চোখের চশমা এবার স্যারের ডান হাতে নেমে এসেছে। চশমা সুদ্ধ ডান হাতটা নেড়ে-নেড়ে ভেঙ্কটেশকে বোঝাবার চেষ্টা করছিলেন তিনি। নন্দিতাদি নামের ম্যাডাম সারের হাতে ভেঙ্কটেশ পালকে তুলে দিয়ে পর্দা সরিয়ে সুড়ুৎ করে ভেতরে ঢুকে গেছেন।

‘ক্লাস যথা সময়ে হবে…কিন্তু বাকি কথাগুলোয় তুমি ঠিক কী মীন করেছ, আমাদের জানা দরকার।’

‘না স্যার, ম্যাডামকে ম্যাডাম বলে ঠিক বুঝতে পারিনি স্যার…।’

‘ম্যাডামকে ম্যাডাম বলে…তুমি কি ওঁকে জেন্টলম্যান বলে ভেবেছিলে?’

‘না স্যার, না স্যার…’ ভেঙ্কটেশ তীব্র প্রতিবাদ করে ওঠে।

‘ঠিক আছে। এবারের মতো তোমায় ছেড়ে দেওয়া গেল। কি বললা নন্দিতা?’ পদার্টা একটু সরিয়ে উনি ভেতর দিকে স্বর পাঠালেন।

ক্ষীণ স্বরে জবাব এল ‘হ্যাঁ হ্যাঁ আবার কী?’

‘ভেঙ্কটেশ, নন্দিতাদি তোমায় ক্ষমা করেছেন। বেলাদি-ই-ই।’ আবার উনি পর্দা তুলে ভেতরে স্থিত কোনও মহিলাকে লক্ষ্য করে হাঁক পাড়লেন, কী সব কথাবার্তা বললেন, তারপর ফিরে বললেন, ‘একটা পঁয়তাল্লিশে তোমাদের সোনার পাথরবাটির ক্লাসটা হবে আট নম্বর রুমে। বেলাদি নেবেন। বেলা দাশগুপ্ত। আর কিছু জিজ্ঞাস্য আছে?’

ভেঙ্কটেশ তার সঙ্গীকে নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল একেবারে সামনে। পেছনে, বেশ পেছনে মিঠু-উজ্জয়িনী এরা। এদের আর কী? মিটিমিটি হাসছিল। ভেঙ্কটেশ যেন কাছাকোঁচা খুলে যাচ্ছে এমনি ভাব করতে করতে দৌড় মারল ‘চরে গৌতম, একেবারে গুলবাঘার খপ্পরে।’ উজ্জয়িনীরা শুনতে পাচ্ছিল স্টাফরুমে ভীষণ হাসির হল্লা উঠেছে। গুলবাঘার জোরালো বাঘা গলা সর্বোচ্চ হাঃ হাঃ হাঃ। সেই সঙ্গে কিছু সরু মোটা তারের হাসি। উজ্জয়িনী বলল ‘শীগগির চ। আট নম্বর রুম দোতলায়। সামনে জায়গা পাবো না। সোনার পাথরবাটি ক্লাস আবার।’

‘সোনার পাথরবাটি ক্লাস ব্যাপারটা কী রে?’ অণু জিজ্ঞেস করল।

মিঠু বলল ‘কমপাল্‌সারি অ্যাডিশন্যাল, বুঝলি না?’

উজ্জয়িনী বলল ‘ওটা ক্লাস নয় ওটা আসলে ট্‌লাস।’

সেই সোনার পাথরবাটি ট্‌লাসেই ওরা বসে সবাই এখন। সায়েন্সের ঘর কি না কে জানে। গ্যালারি। দেয়াল-জোড়া ব্ল্যাকবোর্ড। তাতে লাল রঙ দিয়ে গ্রাফ আঁকা। কী সব গ্রাফ কষাও রয়েছে চক দিয়ে। ক্লাসটা মস্ত বড় বলেই বোধ হয় এ ঘরে ব্যবস্থা। একবারটি পেছন দিকে চেয়ে নিয়ে মিঠু বলল ‘সমুদ্র’।

‘দিঘি-টিঘি বল্’, উজ্জয়িনী ফুট কাটল। রাজেশ্বরী ঢুকছে। ছাপা শাড়ি পরেছে। ‘দ্যাখ, দ্যাখ, মিঠু, রাজেশ্বরী শাড়ি পরেছে, রাজেশ্বরী-ই, আমরা এখানে…।’

মিঠু বলল ‘ওই তো ঋতু, ঋতু কী সেজেছে দ্যাখ, কী মড লাগছে!’

বাইরের দিকের জানলাগুলো দিয়ে গাছের শ্যাওলা-ভরা গুঁড়ি, ঘন সবুজ পাতাভরা ডাল। একগুচ্ছ দোলনচাঁপা না গুলঞ্চসুদ্দু একটা ডাল মাঝের জানলার ঠিক বাইরে। ওখানটা খুব ছায়া। কী একটা পাখি ডাকছে কু কি কি! কু কি কি!

ইমন মুখার্জি বসেছিল একেবারে শেষ বেঞ্চে। গ্যালারির উঁচুর দিকে, যেখান থেকে ক্লাসের সব ছেলেমেয়ের মাথা গুনতি করা যায়। আশেপাশে তার ছেলেই বেশি। অণুকা বলল ‘এই মিঠু, ও ছেলে না মেয়ে রে?’

মিঠু ঠোঁট উল্টোল। অর্থাৎ জানে না। সন্তোষ আড় হয়ে বসে বলল ‘শী ইজ এ গার্ল। ডোন্ট য়ু সী!’ সে একটু অর্থপূর্ণ হাসল। কিন্তু গলার আওয়াজটা শোনবার জন্য ওরা ব্যস্ত হয়ে ছিল। ‘ইয়েস ম্যা’আম’ শোনার পর সন্তোষ বলল ‘দেখলে?’

উজ্জয়িনী বলল ‘কী জানি! ছেলেদের গলা ভাঙে না! সেইরকম ভাঙা-ভাঙা গলা বাবা! যাই বলো, আমি এখনও শিওর হতে পারিনি। আমরা কি জীন্‌স্ পরি না? আমাদের কারও কি বয়-কাট চুল নেই? তখন কি আমাদের নিয়ে ধাঁধায় পড়তে হয়?’

‘নামটাও কিরকম উভলিঙ্গ দেখলি? ইমন!’ মিঠু গলা বাড়িয়ে বলল।

‘নামের কথা যদি বলিস তো আমাদের সন্তোষের সঙ্গে কেউ পাল্লা দিতে পারবে না …উজ্জয়িনী বলল, ‘আমার পিসেমশাইয়ের আর ওর এক নাম, বুঝে দ্যাখ! পিসেমশাইকে যদি দেখিস না! যেমনি মোটা, তেমনি গাল ফোলা, এতখানি গোঁফ দাড়ি তার ওপরে, ট্রিম করে না। আমাকে দেখলেই বলবে “আহো উজ্জয়িনী নাম্নী নগরী, তোমার কালিদাস কোথায়? বিক্রমাদিত্যই বা কই?”

ওদের হাসি দেখে সন্তোষ বলল ‘আমার নাম শুনেই ঘাবড়াচ্ছো? আমার মাম্মির নাম জানো— কৈলাশ, আমার দিদির নাম—ভিজয়, আন্টিব নাম অজিত, অজিত কাউর।’

‘অজিত? অ-জিত? অনেক শুনেছি তোদের অদ্ভুত নাম, অজিত কখনও শুনিনি’, ঋতু বেঞ্চের ওপর তবলা বাজিয়ে দিল ‘আমার বাপীর নাম তো অজিত। এবার থেকে মিস অজিত কাউর বলে খেপাব।’

অণুকা বলল ‘তুই বাবাকে খেপাস? বাবা কি তোর ছোট ভাই? না ইয়ার?’

ঋতু বলল ‘বাপীকে যদি খেপাতে না পারবো তো জীবনে মজা কোথায়?’

মিঠু বলল ‘জানিস না ঋতুটা কী আহ্লাদি! বাবা মা সব ওর ইয়ার। আমার বাবাও বন্ধুর মতো। কিন্তু ভেতরে ভেতরে ভীষণ স্ট্রিক্‌ট্। একটু এদিক-ওদিক হয়েছে তো “মিঠু, এটা তোমার থেকে আশা করিনি”।’

বেলাদির রোলকল শেষ হয়ে গেছে বোধহয়। উনি মেয়েদের জটলাটার দিকে তাকিয়ে যারপরনাই বিরক্তি প্রকাশ করলেন। অণুকাকে দাঁড় করিয়ে জিজ্ঞেস করলেন উনি এতক্ষণ ক্লাসে কী বলছিলেন। অণুটা সবসময়েই ছটফট করে, যেন ওকে ছারপোকায় কামড়াচ্ছে। সেইরকম নড়তে নড়তেই জবাব দিল ‘ইউ হ্যাড বীন কলিং দ্য রোল, ম্যা’য়াম।’

ক্লাসের পেছন দিক থেকে একটা হাসির রোল উঠল। মেয়েদের গলা ছাপিয়ে আছে ছেলেদের শ্রীকণ্ঠ। ‘এই অণু’ পেছন দিক থেকে উজ্জয়িনী ওর কুর্তার তলাটা ধরে টানছে, ‘সিলেবাস বলছিলেন রে! অণুকা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে ওর পেটেন্ট তোয়ালে-রুমাল দিয়ে ঘাম মুছতে লাগল।

হাসি অগ্রাহ্য করে বেলাদি বললেন মর্নিং শোজ দ্য ডে। ইউ ক্যান সিট ডাউন। ডোন্ট টক।’

বসে পড়ে ফিসফিস করে বলল অণুকা ‘আমাদের কথা বলছিলেন নাকি রে? মর্নিং শোজ দ্য ডে?’

উজ্জয়িনী হাসতে হাসতে ফিসফিসোলো ‘দূর অ্যাম্‌প্লিফিকেশনের জন্যে কতকগুলো আইডিয়া দিচ্ছেন!’

‘চাইল্ড ইজ ফাদার অফ দ্য ম্যান’ থেমে থেমে বললেন বেলাদি। সবাই লিখে নিচ্ছে। অণুটাও এতক্ষণে পেন বার করল।’

‘এ বার্ড ইন হ্যান্ড ইজ ওয়ার্থ টু ইন দ্য বুশ’, বেলাদি শেষেরটা বলে থামলেন। ‘দীজ য়ু মাস্ট লার্ন, দীজ ফাইভ। লার্ন অ্যাট হোম, অ্যান্ড রাইট ইন দ্য ক্লাস। দিস ইজ মাই পলিসি। নাউ ইউ মে গো।’ রেজিস্টার এক হাতে, হাঁটুতে আরেক হাতের ভর দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন বেলাদি। এক পা এক পা করে নামলেন প্ল্যাটফর্ম থেকে। তারপর টলমল টলমল করতে করতে বেরিয়ে গেলেন। পেছন থেকে কে মন্তব্য করল ‘জাহাজ’। আবার হাসির হুল্লোড়।

মিঠু বলল ‘এসব তো আমরা স্কুলে থাকতেই করেছি রে!’

উজ্জয়িনী বলল ‘সরকারি স্কুলে তো সিক্স থেকে ইংলিশ আরম্ভ হয়। ভালোই তো আমাদের এই এলেবেলে ব্যাপারগুলো করতে হবে না।’

ক্লাসের তিনটে পেল্লাই দরজা দিয়ে সবাই হুড়মুড় করে বেরোচ্ছিল। ভেঙ্কটেশ আর গৌতম এসে ধরল উজ্জয়িনীদের।

‘দ্যাখো! শাসানোর ভঙ্গিতে তর্জনী তুলল ভেঙ্কটেশ ‘যা দেখছি, এইট্টি পার্সেন্টই মেয়ে, মাত্র টোয়েন্টি পার্সেন্ট এই আমরা, হতভাগ্যরা, নিজেদের মধ্যে গ্রুপ করে থাকবে তো দেখাব মজা! স্কুল থেকে এসেছে, না?’

মিঠু হাসি-হাসি মুখে বলল ‘হ্যাঁ।’

‘দেখেই বুঝেছি। স্কুলের বালিকা সব। দুগ্ধপোষ্য এখনও।’

‘কী করে বুঝলে?’ উজ্জয়িনী পাশ থেকে বলে উঠল, জাস্ট চেহারা দেখেই বোঝা যায় বুঝি?’

‘শুধু চেহারা নয়, ওই হিহি হিহি আর খুঁক খুঁক খুঁক, স্কুলবালিকাদের আইডেনটিফিকেশন মার্ক। একমাত্র স্কুলবালিকারাই এভাবে হাসিয়া থাকে!’

‘তুমি বুঝি কলেজ থেকে দু’ বছর ডিগ্রির ক্লাস করে ফেরৎ এসেছ?’ উজ্জয়িনী ভালোমানুষের মতো মুখ করে বলল।

‘ওরে গৌতম, চাট মারে রে! স্কুলবালিকা বলাতে অপমান হয়েছে! নো অফেন্স মেন্ট ফ্রেন্ডস’, ভেঙ্কটেশ হাত বাড়িয়ে দিল ‘হাত মিলাও কমরেড লোগ, দোস্তি কে পহলে দিন আজ, সেলিব্রেট তো করো কম সে কম কুছ খিলাকে!’

কেউই ওর হাতে হাত মেলাল না। উজ্জয়িনী বলল ‘হাত সাবান দিয়ে ধুয়ে এসো আগে। নো অফেন্স মেন্ট।’

‘ঠিক আছে ভাই, শোধবোধ, তবে আমি কিন্তু হেলথ-সোপ লাইফ-বোয় দিয়ে চান করি। লাইফ-বোয়’ বলে বিজ্ঞাপনের গানের কলি তার ভারী গলায় গেয়ে উঠল ভেঙ্কটেশ ‘আমাকে অচ্ছুৎ ভাবার কোনও কারণ নেই।’

গৌতম দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল ‘ছেলেরা সায়েন্স না পড়লেই আজকাল আনটাচেব্‌ল্ হয়ে যাচ্ছে রে। এক গেলাস জল দিয়ে দ্যাখ খাবে না।’

রাজেশ্বরী পেছনে ছিল, সবার ওপরে মাথা তুলে মিটিমিটি হেসে বলল ‘আইসক্রিম দিলে খাবো।’

‘ঠিক হ্যায়, আইসক্রিমই খিলাবো, কী নাম কমরেড তোমার?’ ভেঙ্কট জিজ্ঞেস করল।

‘রাজরাজেশ্বরী।’

‘ক্‌কী? ক্‌কী? রাজ-রাজেশ্বরী? আই বাপ এরকম ঘ্যাম নাম তো কখনও শুনিনি!’ শর্ট ফর্মে শুধু রাজেশ্বরী বলেও ডাকতে পারো।’

‘পারি? অনুমতি দিলে? আরও শর্ট করে নিয়ে যদি রানী বলি?’

‘সেক্ষেত্রে অনুমতি ফিরিয়ে নেবো।’

‘কেন? রাজরাজেশ্বরী মানে তো রানী!’

‘ভেঙ্কট তো বিষ্ণুর নাম, তোমাকে বিষ্ণু, কি নারাণ, কি হরি বলে ডাকি তা হলে?’

‘ও হো হো, সরি ভাই, ভেঙ্কটটাই যথেষ্ট গোলমেলে, তার ওপর বিষ্ণু, হরি, নারাণ? দয়া করে এই আমার তরবারি সারেন্ডার করে দিলুম।’ সে দু হাতে তরোয়াল ধরে রাজেশ্বরীর পায়ের কাছে নামিয়ে রাখার ভঙ্গি করল।

উজ্জয়িনী বলল, ‘চল চল, আইসক্রিম খাওয়া যাক, গেটের বাইরেই দাঁড়িয়ে আছে।’

ভেঙ্কটের ঘাড় ভেঙে আইসক্রিম খাবার সময়ে ইমনকে ওরা মেয়েদের কমন রুমের দিকে যেতে দেখল। গৌতম বলল ‘একে চেনো?’

‘না কে ও?’

ভেঙ্কট অবাক হয়ে বলল, ‘চেনো না? দু বছর পর পর টেবল টেনিস চ্যাম্পিয়ন হয়েছে বেঙ্গলে! জুনিয়র। আরে তোমাদের মেয়েদেরই তো গৌরব। আমাদের কী! এবার ওকে দিয়েই আমাদের কলেজ খেলাধুলোয় খাতা খুলবে। স্পোর্টস ম্যাগে নাম উঠবে অনেক দিন পর আই মুখার্জির দৌলতে।’

‘ওই আই মুখার্জি! তা মুখটা চেনা চেনা লাগছিল।’ মিঠু বলল।

‘অমনি তোর চেনা-চেনা লেগে গেল!’ উজ্জয়িনী আইসক্রিম এক চামচ মুখে তুলে বলল।

‘বিশ্বাস করছিস না? বছর দুই আগে ওর ছবি বেরিয়েছিল কাগজে। বাবা দেখতে দেখতে বলেছিল মফঃস্বলের মেয়ে, কম কথা না! এ মেয়েটার পোটেনশ্যালিটি আছে।’

গৌতম বলল ‘হ্যাঁ হ্যাঁ ও ঠিকই বলেছে। দু বছর আগে ও প্রথম আবিষ্কৃত হয়। রানাঘাটের মেয়ে। দুর্দান্ত ফুট-ওয়ার্ক। আর ফোর হ্যান্ড। বেঙ্গল টি টি অ্যাসোসিয়েশন থেকে বোধ হয় ওকে কোনও…’

ভেঙ্কট ওর মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলল, ‘বৃত্তি দেয়। রাইট! এখানে কারুর বাড়ি থাকে, না হোস্টেলে থাকে বল তো!’

গৌতম বলল, ‘জানি না। তবে জানতে কতক্ষণ। এই উজ্জয়িনী, ও তো লেডিজ কমন রুমে গেল। যাও না। ভাবসাব করো। উঠতি স্টার বলে কথা!’

ইচ্ছে ছিল, কিন্তু উজ্জয়িনী তক্ষুনি গেল না। এই ছেলে দুটো মহা সর্দারি আরম্ভ করেছে। এই দলটার মুকুটহীন রানী সে। কারও কারও সঙ্গে খুব নিচু ক্লাস থেকে এক সঙ্গে পড়েছে, যেমন মিঠু, অণুকা, আবার কেউ-কেউ এইচ-এস-এ এসে যোগ দিয়েছে ভিন্ন স্কুল থেকে। যেমন রাজেশ্বরী। এদের সবইকার সঙ্গেই যে স্কুলে থাকতে খুব ভাব ছিল তা-ও না। যেমন ঋতু। অনেক ছোট থেকে এক সঙ্গে পড়ছে। মোটের ওপর কাছাকাছিই থাকে। তবু খুব একটা মাখামাখি ছিল না। ছোটবেলার বন্ধুরা অনেকেই ভিন্ন স্ট্রীমে চলে গেছে। শেষ পর্যন্ত এই কজন। যাই হোক। কলেজ একটা বিরাট ব্যাপার। সেখানে এসে খুব স্বাভাবিক ভাবেই সে তার স্কুলের বাকি মেয়েদের রাখাল। কিন্তু ভেঙ্কট এমন ভাব করছে যেন ও-ই লীডার। ও যা বলবে এই সব বালখিল্য স্কুল বালিকারা তাই-ই করবে। এতটা সর্দারি প্রথম দিনেই! ইস্‌স্! সে বলল, ‘না, না, আমরা এখন কমন রুমে যাচ্ছি না, আমরা লিন্ডসে যাবো। এই সন্তোষ, অণু আমরা যাচ্ছি তো! মিঠু, রাজেশ্বরী।’

রাজেশ্বরী বলল, ‘আমার গানের ক্লাস আছে তিনটেয়। আমি চলি। আইসক্রিমের জন্য ধন্যবাদ ভেঙ্কট’ সে উত্তরের অপেক্ষা না করেই ব্যাগটা সামলে হন হন করে এগিয়ে গেল।

ঋতু বলল, ‘আমারও একটা জরুরি কাজ আছে। সী ইউ’ —হাসি হাসি মুখে সবাইকার মুখের ওপর দিয়ে চোখ দুটো ঘুরিয়ে নিয়ে সে চলে গেল।

বাকিরা লিন্ডসে যাবে বলে ব্যাগের পয়সা গুনতে লাগল। এই সময়ে মিঠু চেঁচিয়ে উঠল, ‘বিষ্ণুপ্রিয়া না!’ মাথায় খাটো, কিন্তু খুব সুশ্রী একটি শাড়ি পরা মেয়ে মিঠুর দিকে তাকিয়ে এগিয়ে এলো, ‘মিঠু! মিঠু চৌধুরী! আরে উজ্জয়িনী না! এমা! কত বড় হয়ে গেছিস!’

‘হ্যাঁ হ্যাঁ আর তুই কত ছোট হয়ে গেছিস!’ উজ্জয়িনী বলল। ‘আমরা লিন্ডসে যাচ্ছি, যাবি?’

বিষ্ণুপ্রিয়া বলল, ‘কদ্দিন পর তোদর সঙ্গে দেখা, যাবো না? ইস্‌স্ এক যুগ।’

বিষ্ণুপ্রিয়া ওদের স্কুলেই পড়ত। মাঝে ওর বাবা বদলি হয়ে যাওয়ায় ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। এখন দেখা যাচ্ছে বিষ্ণুপ্রিয়া একই কলেজে ঢুকেছে।

উজ্জয়িনী বলল ‘ভেঙ্কট, যাবে আমাদের সঙ্গে? গৌতম?’

‘মার্কেটিং করতে যাচ্ছ নাকি?’

—‘লিন্ডসে যাচ্ছি। তারপর মার্কেটিং করব কি কী করব সে-সব এতো আগে থেকে জানা নেই।’

—‘ওরে ওরে কী দিচ্ছে?’ ভেঙ্কট বলল ‘কিন্তু মেয়েদের মার্কেটিং-এর মতো ক্যাডাভেরাস হায়ারোগ্লিফিক মেগালোম্যানিয়া আর নেই, কী বল গৌতম?’

‘ওহ একেবারে ল্যাকাডেইজিক্যাল গোনাডোট্রাপিক হাইড্রোপনিক্‌স্।’ বলতে বলতে গৌতম ক্যানটিনের পথে পা বাড়াল। পেছনে ভেঙ্কট।

রাস্তায় বেরিয়ে উজ্জয়িনী বলল, ‘উঃ ছিনে জোঁকের মতো লেগেছিল এতক্ষণে দুটোতে। এখন শান্তি। লিন্ডসেতেই যাবি তো!’

অণুকা বলল, ‘এই প্লীজ আজ লিন্ডসেতে যাস না। আমার স্ট্রেংথ কম।’

‘তাতে কী! আমরা কি নিউ মার্কেটটা উঠিয়ে নিয়ে আসব নাকি? স্রেফ উইনডো শপিং করব। পুড়ে যাবার পর নতুন উইংটা কি রকম করল আমার দেখাই হয় নি।’

‘দেখিস নি এখনও?’ বিষ্ণুপ্রিয়া বলল ‘দারুণ করেছে। ট্রেজার আইল্যান্ডের মতো অনেকটা। তবে আরও বড়। চল তোদের দেখাই।’

উজ্জয়িনী বলল, ‘ধুর তোর দেখা! তবে তো মজাই মাটি। সারাক্ষণ গুরুগিরি করবি। চল তার চেয়ে এ.সি. মার্কেটে যাই। অনেক এক্সক্লুসিভ জিনিস পাওয়া যায়।’

উজ্জয়িনী যখন মনে করেছে নিউ মার্কেট যাবে না, এ.সি মার্কেট যাবে, তখন সে তা-ইই যাবে। তার ইচ্ছাশক্তির জোর অন্যদের চেয়ে অনেক বেশি। সুতরাং ওরা এ.সি. মার্কেটেই চলল। গুমোট বেশ। আকাশময় এখন ভাঙা ভাঙা মেঘ। তাইতে ভ্যাপসা ভাবটা আরও বেশি। মিঠু বলল, ‘বাকি দুপুরটা এ.সি. মার্কেটে উইনডো শপিং করে কাটিয়ে দেব, বুঝলি? বাব্বা! যা গরম! ব্যাগে যা আছে তাতে হয়ত একটু ঠাণ্ডা খাওয়া হয়ে যাবে, কী বল উজ্জয়িনী!’

উজ্জয়িনী ভুরু কুঁচকে বলল, ‘কত ঠাণ্ডা খাবি? এই তো আইসক্রিম খেলি? জানিস তো ঠাণ্ডা খেতে হয় শীতকালে। আইসল্যান্ডের লোকেরা আইসক্রিম খায় শরীর গরম রাখতে।’

উজ্জয়িনীর এখন আর এ.সি. মার্কেটে যেতে ইচ্ছে করছে না। বাড়িতে ফিরতেও ভালো লাগছে না। কিন্তু এখন মত বদল করলে বন্ধুরা ক্ষ্যাপা ভাববে। শুধু নিজের কথা ও কাজের সামঞ্জস্য রাখতে তাকে যেতে হচ্ছে। কিন্তু তার ভুরু কুঁচকে আছে। মিঠু আর বিষ্ণুপ্রিয়া নিজেদের মধ্যে কলকল করতে করতে বাসে উঠল। পেছন পেছন অণু আর সন্তোষ। বাসটা ছেড়ে দিল। অণু, সন্তোষ ব্যস্ত হয়ে কনডাকটরকে কিছু বলছে। উজ্জয়িনী খানিকটা চেঁচিয়ে, খানিকটা হাত পা নেড়ে বলল, ‘তোরা যা, আমি পরেরটাতে আসছি।’ কিন্তু কিছুদূরে গিয়ে বাসটা ঘ্যাঁচ করে থেমে গেল। কনডাক্টর মুখ বাড়িয়ে তাকে হাত নেড়ে ডাকতে লাগল। ‘ও দিদি শীগগির করুন।’ অগত্যা জোর পা চালিয়ে তাকে বাসে উঠে পড়তেই হল। অণুর পেছনে বসে সে বলল, ‘এইটুকু রাস্তা আমাকে ছেড়ে যেতে পারিস না? আমি তো পরের বাসেই এসে যেতাম! থিয়েটার রোডের মোড়ে একটু দাঁড়াতিস!’ এখনও বিরক্তিতে তার কপাল কুঁচকে আছে। মা খেল কি না কে জানে?


তাকে খুব মন দিয়ে পথ চলতে হবে…এবং …এবং

ইমন হাসছিল। খুব যে খুশির হাসি তা নয়। আবার নিছক সামাজিকতার হাসিও না। দুটো মিলিয়ে। হাসলে ইমনের মুখের মধ্যে একটা চাপা আভা বিদ্যুতের মতো যাওয়া-আসা করে। ত্বকের নিচে একটা মৃদু হলুদ বাল্‌ব জ্বলে ওঠে। এরা তাকে চিনে ফেলেছে। সেকেন্ড ইয়ারের উশ্রীদি, মণিদীপাদি প্রথম চিনল। তারপর সেকেন্ড ইয়ারের অনেকেই এক এক করে তার আশে-পাশে দাঁড়িয়ে গেল। আসলে উশ্রীদি আর মণিদীপাদি দুজনেই খেলে। শখের খেলা হলেও, মোটামুটি নিয়ম করে যায় ওয়াই. ডবলু, সি. এ. তে, ওয়াই, এম. সি. এ তেও। ইমনকে খেলতে দেখেছে। নইলে কে আর কাকে চিনছে?

‘তুই আই মুখার্জি না? এই দ্যাখ মণিদীপা কাকে ধরেছি।’

ইমন নিঃশব্দ হাসি হাসছে। সে এই ধরনের উত্তেজনা ছড়াতে মোটামুটি অভ্যস্ত।

‘নাম কিরে তোর? কাগজে খালি আই. মুখার্জি, আই মুখার্জি লেখে।’

‘ইমন।’

‘ইমন! ফ্যানটাসটিক! এবারেও চ্যাম্পিয়ন হবি তো?’

‘হ্যাঁ। ইমন সাদাসিধে ভাবে বলল।

‘হ্যাঁ? কী সঙ্ঘাতিক কনফিডেন্স রে! এরকম ছেলে সেজে আছিস কেন?’

‘সুবিধে হয়।’

‘আয় এক হাত খেলি। ও বিল্ডিংএ যেতে হবে।’

ইমনের ইচ্ছে নেই। বলল, ‘পরে হবে।’

উশ্রীদি বলল, ‘সংযুক্তা পানিগ্রাহীর সঙ্গে আলাপ হলেই যদি বলিস, একটু নাচুন তো দেখি! নাচবে!’

মণিদীপা বলল, ‘তাই তো! খুব ডাঁটিয়াল না কি রে তুই!’

‘যা ভাবেন।’

ডাঁটিয়াল ভাবলেও কিছু আসে যায় না তোর?’

ইমন ডাইনে বাঁয়ে মাথা নাড়ল।

‘আশ্চর্য মেয়ে তো তুই। দাঁড়া তোকে ছাড়ছি না। এই কঙ্কণা, গোপা, চল এ মেয়েটাকে ক্যানটিনে ধরে নিয়ে যাওয়া যাক।’

ইমন রাজি হল। কেননা সে ক্যানটিনে যাবার কথাই ভাবছিল। ভীষণ খিদে পেয়েছিল। ভীষণ খিদে পায়।

ক্যানটিন অন্য বিল্ডিং-এ। ফ্রেঞ্চ টোস্ট খেলো দুটো, বেশ বড় এক খণ্ড পুডিং। প্রথমে সে রাজি হয় নি তাকে খাওয়ানের প্রস্তাবে, বলেছিল, ‘আপনারা আপনাদের যা ইচ্ছে খান না। আমি দেখছি কী নেওয়া যায়।’

হাত থেকে মেনু-কার্ডটা টেনে নিয়ে উশ্রীদি ধমক দিয়ে উঠল, ‘তোকে দেখতে হবে না। আমরা দেখছি। আর অত আপনি আপনি কিসের রে? তুমি বলতে পারিস না? ইমন অতএব স্মিত মুখে বসেছিল।

‘কফি খাবি তো?’

‘না।’

‘কারণ আছে না কি রে? ট্রেনিং-এ আছিস তো? কী কী খেতে বলেছে?

‘বারণ-টারণ কিছু না। টাইম ফিক্সড্ আছে, চা, কফি আমি এমনিই খাই না। বেশি মশলা, ফ্যাটি জিনিসও চলে না।’

‘ইস অনেকগুলো কথা বলে ফেললি যে রে! এতক্ষণ হুঁ হাঁ করে সারছিলিস! কে তোকে প্রথম আবিষ্কার করে রে?

‘আবিষ্কার আবার কী।’ ইমন হেসে বলল, ‘ওখানে একটা ক্লাব ছিল, খেলাধুলো করতুম। ডানপিটে, গেছো ছিলুম। রমুদা, মানে রমেন বিশ্বাস বলে একজন টেবল্‌ টেনিস শেখাতেন। দেখে দেখে আমি একদিন বললুম খেলব। রমেনদার সঙ্গে অনেকক্ষণ র‍্যালি হল। উনি ইচ্ছে করেই খানিকটা খেলতে দিচ্ছিলেন আর কি! তারপর খুশি হয়ে ট্রেনিং দিলেন।

‘জাস্ট দেখে দেখে খেললি? শুনে শুনে গান তোলার মতো!’

‘বাড়িতে খেলতুম। মেঝেতে। মাঝখানে একটা নারকেল দড়ি টাঙিয়ে নেট হত।’

‘দারুণ! দারুণ। তার পর?’

‘ক্লাবে সবাই চলে গেলে, বোর্ড ফাঁকা পেলে বন্ধুদের কাউকে নিয়ে খেলতুম। মারগুলো প্র্যাকটিস করতুম।’

‘ইস কী ট্যালেন্ট! ভীষণ ভাল লাগল রে! আমাদের সঙ্গে খেলবি তো?’

‘খেলবো না কেন?’ ইমন তার ঝোলাটা নিয়ে উঠে পড়ল। ‘আজ যাই। কাজ আছে। হ্যাঁ।’

‘দিদিদের অনুমতি নিচ্ছিস? হাউ সুইট!’

ইমন বেরিয়ে এল। সে কোনদিকে তাকাল না। যেন তার গন্তব্য সর্বদা ঠিক থাকে। লক্ষ্যবস্তু যেন অনেক আগে থেকে দেখে নিয়েছে। লম্বা লম্বা পা ফেলে সে হোস্টেলের দিকে হাঁটতে শুরু করল। ইমনের হাঁটার ভঙ্গিটা একেবারেই মেয়েলি নয়। এটা কি তার পোশাকের জন্য? নাকি তার শরীর যথেষ্ট পুষ্ট নয় বলে? ইমন খুব সম্ভব আলাদাভাবে মেয়ে হবার সময় পায় নি এখনও।

কলকাতা সে ভালো করে চেনে না। খেলার সূত্রেই মাঝে মাঝে আসতে হত। কিন্তু সে কতগুলো নির্দিষ্ট জায়গায় নির্দিষ্ট লোকেদের সঙ্গে। এখন সে এখানে বসবাস করছে। ভর্তি হওয়ার পর, গত পরশু দিন সবে এলো। বাসে-ট্রামে বেশ ভিড়। কিছুক্ষণ হাঁটার পর সে লক্ষ্য করল রাস্তাতেও বেশ ভিড়। মাঝে মাঝেই সামনে-ধেয়ে-আসা মানুষদের এড়িয়ে এঁকে বেঁকে চলতে হচ্ছে, যে ভাবে বাধা বিপত্তি এড়িয়ে নদী চলে। যতই খণ্ডিত হোক তার চলা, একটা নিরন্তরতা আছে, প্রবাহ আছে, সবচেয়ে বেশি করে যা আছে তা হল ছন্দ। এই যে অত্বরিত ছন্দোময় চলা, যা বাধা বিপত্তি সত্ত্বেও অনায়াস এবং নদীসদৃশ, এই চলা ইমনকে যতটা উন্মোচিত করে আর কিছু বোধহয় ততটা করে না। সে এমন একজন, যে নিরুচ্ছ্বাস এবং অনভিব্যক্ত বলে বোঝ যায় না যে সে আসলে বীর। প্রথা না মানার ব্যাপারটা সে এমন নির্দ্রোহ ভঙ্গিতে করে যে বোঝা যায় না সে কিছু গড়ার সঙ্গে সঙ্গে কিছু কিছু ভাঙছেও।

হোস্টেলটা একদম চুপচাপ। ইমন নিজের ঘরে চলে গেল। দোতলার কোণের দিকের ঘর। এ ঘরে দুজন থাকে। দুদিকে দুটো লোহার খাট। মাথার কাছে একটা ছোট টেবিল আর চেয়ার। টেবিলে তাক করা আছে। ইমনের এখনও বিশেষ বই-টই কেনা হয়নি। তাকটা প্রায় খালিই। খাটের তলায় তার ট্রাঙ্ক। টেবিলের তলায় এক দিকে ছোট্ট আলমারি মতো করা আছে, তাতে সে তার নিজস্ব কিছু খাদ্য রাখে। তার রুমমেট এখনও এসে পৌঁছয়নি। ফাঁকা ঘরে একলা খাটে শুতে তার দুটো রাত কেমন-কেমন যেন লেগেছে। ভেতরে-ভেতরে একা হলেও, বাইরে এতটা একা থাকা তার অভ্যেস নেই। ভয় ঠিক হয় না। কী রকম অদ্ভুত অনুভূতি হয়। এইবারে জীবন যেন তাকে সম্পূর্ণ একা করে দিল। তাকে একা করে দেওয়ার এই প্রকল্পটা যেন জীবন অনেক দিন আগে থেকেই শুরু করেছে। সে বুঝতে পারত, একটা কিছু চলছে ভেতরে ভেতরে। ঠিক কী সেটা, তা বুঝতে পারত না। এখন, এই দুদিন একলা থাকতে থাকতে স্পষ্ট হয়েছে ব্যাপারটা। প্রথমে ছিল সে, বাবা, মা, ভাই। বাবাকে কেড়ে নেওয়া হল। বাবার সঙ্গেই তার যা কিছু গল্প, স্বপ্ন দেখা, মতের আদান-প্রদান। বাবার চলে যাওয়া মানেই তার জুড়ি চলে যাওয়া এক রকম। মাকে কাজে বেরোতে হল। সারা দিন রাত কাজ। সে-ও তো এক রকম কেড়ে নেওয়াই। যে মা রাঁধতে-রাঁধতে, ঘরের কাজ সারতে-সারতে নিশ্চিন্ততার একটা গন্ধ ছড়িয়ে রাখত বাড়িতে, সকাল দশটা থেকে এগারটার মধ্যে ভাত পাওয়া যাবেই, ভাতের গন্ধ ভাসবে উঠোনে, নয়নতারা আর টগরের ঝোপের আশেপাশে, ভোরবেলায় চুল ঝাড়ার আওয়াজ, গামছা দিয়ে সপাটে লম্বা চুল ঝাড়া, বিকেলবেলা সুজির গন্ধ, সেলাই হাতে মা, রাত্রে মা সাবান মেখে গা ধুয়ে এসে শুয়েছে। এই সব শব্দ গন্ধ একটা চমৎকার নিশ্চিন্দিপুর তৈরি করে রাখে। মাকে কাজে বেরিয়ে যেতে হলে, ঠিক সেইভাবে সেই গন্ধ, সেই স্পর্শ, সেই শব্দ পাওয়া যায় না। বাবা চলে যাওয়ার পর মায়ের সঙ্গে একটা সখ্য হয়েছিল। তার ভিত প্রয়োজন। দুজনের একাকিত্ব। কিন্তু মা তার স্বপ্নের সঙ্গে নিজের স্বপ্ন মেলাতে পারেনি। অর্থাৎ তার ভেতরে অর্ধেকটা একা, একদম একা। ভাই, ভাইটা কত ছোট। তাকেই আঁকড়ায় যেন মা, যেন বাবা। তাকে, তার নিত্যদিনের উপস্থিতিটাকে ভাইয়ের একান্ত প্রয়োজন। এখনও ভাই তার জীবনের শরিক হতে পারেনি। প্রতিদিনকার খুঁটিনাটির মধ্যে দিয়ে হয়ে উঠতে পারত হয়ত। কিন্তু সেই সম্ভাবনাটা মূলেই বিনষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ভেতরের নিঃসঙ্গতাটা তাই ক্রমেই বাইরে বেরিয়ে আসছে। ছড়িয়ে যাচ্ছে। এখানে এখনও কেউ নেই যার কাছে যাওয়া যায়। কিছুক্ষণ কথা বলা যায়। রানাঘাটে আর কেউ না থাক রমুদা ছিলেন। অন্য কিছু নয়, খেলাধুলো নিয়েই কথা বলতেন। টেবল টেনিসের কিংবদন্তীপুরুষ ভিক্টর বার্নার কাছে ট্রেনিং নিয়েছিলেন এক সময়ে। সেই সব সুন্দর, আশাব্যাঞ্জক, টেকনিক্যাল খুঁটিনাটিতে ভরা গল্প। ইমনের এক চতুর্থাংশ একটা সঙ্গী পেত। এখানে তা-ও না। কলকাতায় তার আসার ইচ্ছে ছিল না। কিন্তু যা কিছু বলার মতো খেলা তো এখানেই। টুনামেন্ট খেলার জন্য এসে রমুদার মামাত ভাইয়ের বাড়ি আর উঠতে হবে না। প্র্যাকটিসের ভাল সুযোগ পাওয়া যাবে। সমকক্ষ প্রতিযোগী। সুতরাং বহু চেষ্টাচরিত্র করে বৃত্তি যোগাড়। কিন্তু ওয়াই.এম.সি.এ তে আগে আগে যখনই খেলতে এসেছে ইমন, প্রতিযোগীদের কেমন অন্য গ্রহের মানুষ বলে মনে হয়েছে। মেলামেশা করতে ইচ্ছে হয়নি। এগুলো সে কাউকে বলেনি, নিজের ভেতরে রেখে দিয়েছে। এগুলো সে জয় করবার চেষ্টা করে যাচ্ছে তার নিজের মতো করে। তার অনেক লড়াইয়ের মধ্যে এটাও একটা।

অনেকক্ষণ সন্ধে হয়ে গেছে। ইমন খেয়াল করে নি। তার আলোর দরকার হয় নি। ঘরের আলোটা টুক করে জ্বলে উঠল।

‘হ্যাললো, সিটিং ইন দ্য ডার্ক।’ লাজুক লাজুক স্বরে নেপালি মেয়েটি বলল। এ বোধহয় উল্টো দিকের ঘরে থাকে।

‘তুমি একলা থেকে বালোবাসছো?’

‘কই না! এসো না!’

‘তুমার রুমমেট আসেনি!’

‘না।’

মেয়েটি নেপালি নয়। খাসিয়া। শিলং থেকে ও পড়তে এসেছে এখানে। কেমিস্ত্রি নিয়ে পড়ছে। জলি দেবী, এই ভাবে ও নিজের নাম বলে। থার্ড ইয়ার সবে আরম্ভ হয়েছে। এসে যোগ দিয়েছে। এখনও পরীক্ষার ফলাফল বেরোয়নি।

জলি দেবী এতো চুপচাপ যে ইমনকেই কথা বলতে হয়, ‘বি.এসসির পর কী করবে?’ ‘টীচার্স ট্রেনিং নেবো।’

‘এম.এসসি পড়বে না?’

‘না পড়তে বালো লাগে না। আই’ল বী অ টীচার ইন দ্য লোক্যাল স্কুল।

‘বাস?’

‘নো। বাস নো। আই’ল ম্যারি,’ গাল দুটো লাল করে খুব খুশির হাসি হেসে জলি দেবী বলল, ‘অ্যান্ড য়ু?’

‘আমার অনেক কিছু করার আছে।’ ইমন আস্তে আস্তে বলল।

‘জানে। তুমি ক্যালো।’

ইমন হাসল। যদি খেলা দিয়েই তার ‘অনেক কিছু’র ব্যাখ্যা হয়ে যায় তো ভালোই। সে নিজেই কি জানে এই অনেক কিছু ঠিক কী কী? জানে না। কিন্তু জলির মতো অত সহজে তার পথ শেষ হবে না, এটুকু সে জানে। এবং পথে অনেক চড়াই-উৎরাই থাকবে। এবং তাকে খুব মন দিয়ে পথ চলতে হবে। এবং একা। সে একা।

জলি চলে গেলে সে একটা ইনল্যান্ড লেটার নিয়ে বসল। মাকে একটা চিঠি লেখা যাক। এক দিনেই অবশ্য সে চিঠিটা শেষ করতে চায় না। দু-তিন দিন ধরে লিখবে। বেশ হপ্তাখানেকের অভিজ্ঞতা থাকবে চিঠির পাতায়। মায়ের সঙ্গে কথা বলবে। মুখেও যেমন সে বেশি কথা বলতে পারে না, চিঠিতেও তেমনি। আজকের পুরো দিনটা সম্পর্কে তাই সে শুধু লিখতে পারল—‘কলেজটাতে বিরাট বিরাট রাজবাড়ির মতো দরজা। ক্লাস একটা ঘরে হয় না। হোস্টেল ভালো। কারো কারো সঙ্গে আলাপ হয়েছে।’

এইটুকু লিখে সে তার ডট কলমটা খটাস করে বন্ধ করে দিল। তার কি এই প্রথম চিঠি লেখা? বোধ হয়। বাইরের কথা কিছু লেখা হল। ভেতরের কথা নয়। চারদিক-ছেয়ে-থাকা এই একাকিত্বর কথা লিখলে মা মুষড়ে পড়বে। অথচ চিঠিটা পড়ে মায়ের সহজাত বোধে বুঝতে পারবে যে ইমন সব কথা লেখেনি। মায়ের মাথায় ভেতরে অত কাজের মধ্যে একটা ছোট্ট দুশ্চিন্তা-চক্র পাক খাবে। কিন্তু তার মায়ের কিছু করার নেই। জীবন নামক অজানা-মালিকের হাতে মেয়েকে এইভাবে সঁপে দিতে তো তিনি বাধ্যই হলেন। ইমনেরও কিছু করার নেই। তার হাতে শুধু কয়েকটা মার আছে। তার পা দুটো কোমর পর্যন্ত অত্যন্ত দ্রুতগতিতে জায়গা বদল করতে পারে। পা নয় যেন জাত সাপ। এ ছাড়া তার আছে একটা ব্লটিং পেপারের মতো মন। চারদিকে যা হচ্ছে, ঘটছে সব খুব নিপুণভাবে শুষে নেয়। সে খুব সতর্ক। তার খেলোয়াড়ি প্রশিক্ষণ থেকেই হয়ত এই সতর্কতাটা পেয়েছে, কিংবা বাড়িয়েছে সে। ব্যস। আর কিছু নেই আপাতত। এইটুকু নিয়ে সে ভেসে পড়েছে। একলা।


‘আই হ্যাভ গন ক্রেজি—হি.হি.হি…’

দাশ সাহেবের আজকে বাড়ি ফিরতে দেরি হয়ে গেছে। কম্পুটার ওরিয়েন্টেশনের একটা প্রোগ্রাম নিয়েছে কোম্পানি। আয়োজনের সব দায়িত্ব তাঁর। উপস্থিতও থাকতে হবে। সপ্তাহে তিন দিন এই যন্ত্রণা। একসিকিউটিভদের তো ঘরসংসার নেই! তারা চব্বিশ ঘণ্টার বাঁধা চাকর! আজ দেরিটা বড্ডই বেশি হয়ে গেছে। নটা বেজে গেছে। দরজা খুলে দিল তাঁদের বহুদিনের কাজের লোক বাসন্তী।

‘বউদি কোথায়?’ সামনের ঘরগুলোর অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন মিঃ দাশ। বাড়ি ফিরে বাড়ি অন্ধকার দেখলে, মীনাক্ষীকে না দেখলে চোখে সত্যি-সত্যি অন্ধকার দেখেন তিনি। স্বামী অত্যন্ত ব্যস্ত এই অভিযোগে যখন বিয়ের অনেকদিন পর মীনাক্ষী একটা মারোয়াড়ি স্কুলে কাজ নিলেন, এবং স্কুলের পাহাড়প্রমাণ খাতা দেখায় নিমজ্জিত হয়ে গেলেন, তখন প্রথম দিকটা খুশিই হয়েছিলেন দাশসাহেব। মীনাক্ষীর ব্যস্ত হয়ে থাকাটা তাঁর পক্ষে ভালো। কিন্তু কমার্শিয়াল ফার্মের চাকরিতে কোনদিন নিশ্চিন্ততা আসেনা। তাঁরও আসে নি। ইতিমধ্যে হোমফ্রন্টে তাঁকে ঘিরে যে একটা ব্যস্ততা, আশা, আনন্দের বলয় তৈরি হত, মীনাক্ষী কাজে নেমে পড়ায় সেটা আর হচ্ছে না। সে-ও ব্যস্ত থাকে, সে-ও ক্লান্ত থাকে, তারও বেশ কিছু ‘শপ-টক’ তৈরি হয়েছে, যেগুলো দাশসাহেবের শুনতে একেবারে ভালো লাগে না। সবচেয়ে বড় কথা মীনাক্ষী যেন আর পুরোটা তাঁর আয়ত্তে নেই। সব সময়েই তাঁর আজকাল হারাই-হারাই ভাব। এমন নয় যে মীনাক্ষী এই বয়সে, বড় মেয়ের বিয়ে দেবার পর, ছোট মেয়ে কলেজে ঢোকার পর হঠাৎ দুম করে পরাসক্ত হয়ে পড়বে। কিন্তু ও হয়ত স্কুলের পার্টির সঙ্গে পনেরো দিন এক্সকারশনে বেরিয়ে গেল। কিংবা রবিবার ওর কোনও সহকর্মিনীর বাড়ি নেমন্তন্ন। রবিবার। সপ্তাহের একমাত্র দিন, যে দিনটাতে অজিত দাশের মনে হয় তিনি একজন সংসারী মানুষ। স্ত্রী-কন্যা ইত্যাদি আছে। তাই রাত নটার পর ঘর অন্ধকার দেখলে ভয় করে, মীনাক্ষী আবার কোথাও গেল না তো! হয়ত ফোন করে জানাবে কিছুক্ষণ পর, আজ আর ফিরতে পারছে না। হ্যাঁ, সকালে বলতে ভুল হয়ে গিয়েছিল মিসেস ভিমানীর বাড়ি দাওয়াত, সেই ব্যারাকপুর। এত রাতে কি আর ফেরা সম্ভব, আনতির বাড়ি…ওই তো বাঙ্গুরে..ওইখানে থেকে যাচ্ছে।

বাসন্তী বলল, ‘বউদির মাথা ধরেছে। এতক্ষণ ছটফট করছিলেন। এখন বোধ হয় ঘুমিয়েছেন।’

‘ঋতু!’

ঘরে। ওরাও বোধ হয় মাথা ধরেছে।’

মা মেয়ে দুজনেরই মাথা ধরেছে? ধরতে যে পারে না তা নয়। কিন্তু একই সঙ্গে দু’জনেরই ধরল? এ তো ফুড পয়জনিং নয় যে বাড়িসুদ্ধ সবার একসঙ্গে হবে, কাজেই দাশসাহেবের অস্বস্তি লাগতে থাকে। মাথা ধরা একটা এমন রোগ, যেটা সত্যিই হতে পারে, আবার মিথ্যে হতেও কোনও বাধা নেই। রাগ-অভিমান-ক্ষোভ-অসন্তোষ এসব জানাবার জন্যে মাথা ধরা আখছার ব্যবহৃত হয়। সত্যিকারের মাথা ধরা হলে তার বিহিত আছে। চটজলদি ওষুধ। মাথা টেপা। এসবে উপকার হয়। কিন্তু মিথ্যেকারের মাথা ধরার প্রতিকার করা খুব শক্ত। মিঃ দাশ সেটা তাঁর দীর্ঘদিনের গার্হস্থ্য জীবনে হাড়ে হাড়ে বুঝেছেন।

মেয়েকে তিনি বুঝতে পারেন না, তাই ভয়ও করেন বেশি। অতএব আগে ঢুকলেন স্ত্রীর ঘরে। সোজা বলগুলো তো আগে খেলে নেওয়া যাক। মীনাক্ষী মিডিয়াম-পেস, ভালো সুইং করতে পারে না। বেশি রাগ হলে ছুঁড়ে ছুঁড়ে বল দেবে। তিনি চট করে মাথা নিচু করে সেগুলোকে উইকেটের অনেক ওপর দিয়ে বেরিয়ে যেতে দেবেন।

‘মীনাক্ষী!’ আলতো করে ডেকে, বিছানার ওপর ঝুঁকে তিনি দেখলেন মীনাক্ষী এত টান-টান হয়ে শুয়ে আছে, চোখ দুটো এমন শক্ত করে বন্ধ যে এটা আসল ঘুম হতেই পারে না। অর্থাৎ মীনাক্ষী ইচ্ছে না করলে সাড়া পাওয়া যাবে না।

‘ওহ, আজ যা গরম! অফিস থেকে বেরিয়ে পর্যন্ত সেদ্ধ হচ্ছি। চানটা সেরে আসি। বুঝলে? তারপর…’ তারপর কী, দাশসাহেব জানেন না। কিছু না-কিছু একটা ঘটবেই। নিয়ত পরিবর্তনশীল এ জগতে কোনও কিছুই থেমে থাকতে পারে না। মাথা ধরা অবস্থাটাও কেটে যেতে বাধ্য। চানটা বড় আরামের। দুশ্চিন্তা যত বেশি থাকে চানের সময়টাও ততই বেশি হয়ে যায়। শীগগিরই হয়ত ফ্রান্সে যেতে হবে একটা টিম নিয়ে। ম্যানেজমেন্ট থেকে একজন, টেকনিক্যাল তিন জন। খুব কম করে হলেও দশ এগারো সপ্তাহের প্রোগ্রাম। মীনাক্ষীকে নিয়ে যাওয়া যায়। মীনাক্ষী যদি ছুটি ম্যানেজ করতে পারে। কিন্তু সে ক্ষেত্রে মেয়ে একটা সমস্যা হয়ে দাঁড়াবে। তার কলেজ আছে, নাচ আছে। দিদির বাড়ি সে অনায়াসেই থাকতে পারে, কিন্তু সে থাকবে কি না এবং তার দিদি তাকে আদৌ আগলাতে চাইবে কি না সে কথা এই মুহূর্তে জানা নেই তাঁর। এতগুলো এক্স-ফ্যাক্টর থাকলে লম্বা সময় ধরে চান না করে উপায়?

সময়টা বোধ হয় একটু বেশিই হয়ে গিয়েছিল। বেশির চেয়েও বেশি। বাথটবে জল ভরে, ভাসছেন তো ভাসছেনই। দরজায় করাঘাত।

‘কে?’

‘আজ রাতটা কি ওখানেই থাকবে?’

—‘আসছি। এখ্‌খুনি!’ মীনাক্ষীর মাথা ধরা তাহলে সেরে গেছে! হৃষ্টমুখে দাশসাহেব চটপট গা-হাত-পা মুছে, তোয়ালে কোমরে জড়িয়ে আরেকটা তোয়ালে দিয়ে মাথাটা জোরে জোরে মুছতে মুছতে বেরিয়ে পড়লেন।

মীনাক্ষী ড্রেসিং টেবিলের সামনের টুলে। —‘এসকেপিজমের একটা সীমা আছে।’ সঘৃণায় উচ্চারণ করল।

যাঃ, দাশসাহেবের কূটনৈতিক চালের এক নম্বর ধপাস। মন্দের ভালো শয্যাটি খালি। শয্যাশায়িনী উপবিষ্টা।

‘কিছু তো বলবে?’—মীনাক্ষী একটা আলগা মেরেছে। এখন ক্যাচ উঠবে, না মাথার অনেক ওপর দিয়ে উড়ে ওভার বাউন্ডারি হয়ে যাবে দাশসাহেব ঠিক জানেন না। যা থাকে কুল-কপালে—‘এবার ফ্রান্স, এগারো সপ্তাহ, যাচ্ছ তো?’ মাথা মুছতে মুছতে যথাসম্ভব স্বর নিয়ন্ত্রণে রেখে বললেন তিনি।

‘আমি মরছি মেয়ের জ্বালায়, তুমি আমায় ট্যুর দিয়ে ভোলাতে এসেছ?’ ক্যাচ কট কট। দাশসাহেব হতাশ হয়ে পাঞ্জাবি গলালেন।

‘কী ব্যাপার?’

‘জানি না। রেগে এটা ছুঁড়ে ফেলছে।’ ওটা ছুঁড়ে ফেলছে। খায়নি। প্রচণ্ড না কি মাথা ধরেছে, শুয়ে পড়েছে।

‘কিছু দিয়েছিলে? ট্যাবলেট টেট?’

‘বলে কাছেই যেতে দিচ্ছে না। রাগের কোনও ওষুধ আছে? মাথায় এক বালতি ঠাণ্ডা জল ঢেলে দেওয়া ছাড়া? সে কাজটা তুমিই করো।’

দাশসাহেব আউট। মিড্ল স্টাম্প ছিটকে গেছে। তিনি সোজা প্রতিদ্বন্দ্বীর হাতের মুঠোয় চলে গেছেন। ব্যাট বগলে নিয়ে তিনি ফিরে চলেছেন। মাঝের দরজাটা দিয়ে টুক করে গলে পড়েছেন পাশের ঘরে। ভাবছেন মীনাক্ষীকেই খেলতে পারছেন না! মেয়েকে খেলবেন কী করে! সে তো দুর্ধর্ষ! কখন যে কোনটা মারে! মনে হচ্ছে সোজা আসছে বলটা, আসতে আসতে হঠাৎ আচম্‌কা বেঁকে গেল। আবার হয়ত মনে হচ্ছে মারছে একটা গুগলি, দেখা গেল একটা নেহাতই সাদাসিধে বল।

এক সময়ে ঘরটা ছিল দুই মেয়ের। সোমদত্তা আর ঋতুপর্ণা। এখন সোমার বিয়ে হয়ে গেছে। সুতরাং পুরো ঘরটাই ঋতুর দখলে। খুট করে একটা আলো জ্বাললেন দাশসাহেব।

‘বাপী, তুমি ফ্রান্স যাচ্ছ? আমি যাব!’ চোখের ওপর থেকে হাত সরিয়ে আবদারের সুরে ঋতু বলল।

‘আচ্ছা সে পরে দেখা যাবে এখন। আপাতত তো খাবি চল। ভীষণ খিদে পেয়েছে আমার।’

‘যাচ্ছি, আগে প্রমিস করো।’

‘ওহ, প্রমিস করার আমার উপায় নেই ঋতু, খাবি আয়।’

ঋতু এক লাফে বিছানা থেকে উঠে পড়ল। তার কাফতান মেঝেতে লুটোচ্ছে। দুহাতে সেটাকে একটু তুলে খালি পায়ে নাচতে নাচতে সে খাবার টেবিলে এসে বসল।

‘ইস্‌স্—টোমাটো স্টাফ।’ চট করে একটা তুলে নিয়ে সে ঠোঁট ফাঁক করে দাঁত দিয়ে কেটে কেটে খেতে লাগল পা নাচাতে নাচাতে।

‘তাই বলো, বাবা ফেরেনি বলে রাগ!’ মীনাক্ষী বললেন, ‘মা কেউ নয়।’

‘নয়ই তো কেউ!’ ঋতু তেমনি পা নাচাতে নাচাতে বলল, ‘মা কেউ নয়, সোমদত্তা অ্যান্ড কোং কেউ নয়, খালি অজিত কাউর ইজ সামবডি’

দাশসাহেব বললেন, ‘অজিত কাউর? আমি আবার মহিলা হলাম কবে থেকে?’ ঋতু ফিক ফিক করে হাসতে লাগল। মেয়ের মেজাজ ঠিক হয়ে গেছে এতেই মীনাক্ষী খুশি। তার এতক্ষণের অসভ্যতা, রাগ সব মাফ করে দিয়েছেন।

‘কি রে, আরেকটা টোমাটো দিই?’

‘ইচ্ছে হলেই নেব। ইউ নীড্‌ন্‌ট বদার।’

মীনাক্ষী মুখ গম্ভীর করে হাত গুটিয়ে নিলেন। যখন তখন এইভাবে তাঁকে অপমান করে ঋতু। ভেতরে ভেতরে কাঁদো কাঁদো হয়ে গেলেও মুখে সেটা প্রকাশ করেন না। ওঁ শান্তি, ওঁ শান্তি মনে মনে বলছেন সব সময়ে।

বড় মেয়ে সোমা এর থেকে আট বছরের বড়। শান্ত, শিষ্ট, ধীর, স্থির। ইকনমিক্সে পি.এইচ.ডি করেছে। এখন জোকার আই.আই.এম.-এ রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট হয়েছে। জামাইটিও যাদবপুর ইউনিভার্সিটির ইতিহাস বিভাগের লেকচারার। সোমা থাকতে ঋতু এতটা বাড়েনি। আসলে আট বছর পরে হওয়ায় ঋতু বোধ হয় মা-বাবার কাছ থেকে একটু অতিরিক্ত আদর-প্রশ্রয় পেয়ে থাকবে। অন্তত সোমার তো দৃঢ় মত তাই। তবে সোমা যে ঋতুকে নিয়ন্ত্রণে রাখত সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। সোমার বিয়ে হয়েছে বছর তিনেক। এই সময়টার মধ্যে ঋতু যেন একশখানা মানুষ হয়ে গেছে। মাকে থোড়াই কেয়ার, বাবাকে ব্যতিব্যস্ত করে ছাড়ে। কেন যে এমন এঁরা বোঝেন না। মীনাক্ষীর সন্দেহ যে ঋতু দিদির কাছে একটা হীনম্মন্যতায় ভোগে। দিদি লেখাপড়ায় চৌখস, স্বভাব চরিত্রও এমন সংযত দায়িত্বশীল যে সবাই সোমা বলতে অজ্ঞান। ঋতু দিদিকে ভেতরে ভেতরে হিংসে করে। দিদির শাসন কোনদিনই ভালো মনে নেয়নি সে। তখন ছোটও ছিল। এখন সুদ সুদ্ধ সব আদায় করে নিচ্ছে। মনে মনেই ভাবেন। ঘুণাক্ষরেও মুখে এসব কথা বলেন না মীনাক্ষী।

ঋতু তার খাওয়া প্রায় শেষ করে এনেছে। দু আঙুলে চাটনি চাটছে এখন। মীনাক্ষী জিজ্ঞেস করলেন, ‘কি ফ্রান্স-ফ্রান্স করছিলে যেন?’

‘টুর আছে। দু’মাসের একটু বেশি সময়।’

—‘কবে?’

‘এই তো মাস তিনেকের মধ্যে কী তারও আগে। পুজোর ঠিক পরটাতেই বোধ হয়।’

ঋতু বলে উঠল, ‘আমি তো যাচ্ছি বাপীর সঙ্গে।’

‘শোন ঋতু’—চোখ ভয়ে গোল গোল করে অজিত বললেন, ‘তোকে যেতে অ্যালাও করবে না। তা ছাড়া তোর কলেজ-টলেজ আছে। এবার তো সিরিয়াস হতে হয়, যদি অ্যাট অল আই. এ. এস হতে চাস! নয়? তবে তোকে রেখে যেতে তোর মায়ের সমস্যা হবে।’

মীনাক্ষী বললেন, ‘আমি যাচ্ছি না, কাজেই কোনও সমস্যাই নেই।’

অজিত দাশের মুখটা কাতর হয়ে গেল। দু মাসেরও বেশি বিদেশে থাকতে হবে, মীনাক্ষী ছাড়া? সমুদ্রপারে তিনি বহুবার গেছেন। নিসর্গ-টিসর্গ কী মিউজিয়ম, আর্ট এসব কিছুতেই কোনও নতুনত্বের স্বাদ তিনি পান না। তবে হ্যাঁ, পরিচ্ছন্ন প্রশস্ত রাস্তাঘাট, সুশৃঙ্খল নগরজীবন, পরিকল্পিত সবুজ, ভালো হোটেল, ভিন্ন ভিন্ন দেশের খাবার, সাদা লোকজন—এসব বেশ ভালোই লাগে তাঁর। মীনাক্ষীর আবার যেখানে যাবে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সব টুরিস্ট স্পট দেখার অভ্যাস আছে। মীনাক্ষী না গেলে এই স্বল্পমেয়াদী প্রবাসগুলো তার দুঃসহ লাগে।

ঋতু বলল, ‘অফ কোর্স তুমি যাবে। পুজোর ছুটির সঙ্গে আর কয়েক সপ্তাহ যোগ করে দিতে তোমাদের মিসেস ভিমানি যদি আপত্তি করে তো ছেড়ে দাও না শখের চাকরিটা! ওটা তো মড্ হবার জন্যে, ফেমিনিস্ট বন্ধুদের খুশি করার জন্যে নিয়েছ!’

তাঁর চাকরি সম্পর্কে এইরকম তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে কথা মীনাক্ষী একদম পছন্দ করেন না। যার বলার, অর্থাৎ স্বামী, কখনও বলেন না। কিন্তু ছোট মেয়ে সুযোগ পেলেই বলে।

মীনাক্ষী গম্ভীরভাবে মেয়ের কথা সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে বললেন, ‘আমি গেলে তুমি থাকবে কোথায়?’

‘বাসন্তী রয়েছে, আমার তো কোনও অসুবিধে হবে না! অসুবিধেটা তো তোমাদের! তো সোমাদের রেখে যাও নিশ্চিন্ত হবার জন্যে!’

মীনাক্ষী হতভম্ভ হয়ে বললেন, ‘সোমারা? সোমাদের রেখে যেতে পারি? তুই সত্যি বলছিস?’

‘কেন? সোমা এলে আমি অশান্তি করি?’

অশান্তি করার সম্ভাবনাই বেশি। কিন্তু সেটা বলা যাবে না। মীনাক্ষী বললেন, ‘সুবিধে-অসুবিধেও তো আছে! ওদেরও। তোমারও।’

‘সোমা থাকবে সোমার মতো। আমি থাকব আমার মতো। আমার ওপর খবরদারি করতে বারণ করে দেবে। আমার এ বছরই কত্থকের ফিফ্‌থ্ ইয়ার, এখন কোথাওই যাওয়া সম্ভব নয়।’

মীনাক্ষী বললেন, ‘সে তুমি যাইই বলো, আমি যাচ্ছি না।’

‘সেটা তোমার ব্যাপার। আমি পার্মিশন দিয়ে দিলাম।’ ঋতু উঠে পড়।

‘আচ্ছা গুড নাইট বাপী, গুড নাইট মা।’

ঋতু চলে গেলে দাশসাহেব ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী ব্যাপার?’

মীনাক্ষী ঠোঁট ওল্টালেন। তিনি জানেন না। বললেন, ‘আনপ্রেডিক্টেব্‌ল্। যা মেজাজ। আমাকে তো তৃণাদপি তুচ্ছ জ্ঞান করে।’

অজিত বললেন, ‘এখন পার্মিশন পেয়েছ, যাবে কি না ঠিক করো। এ সুযোগ রোজ রোজ আসবে না। আমার তেমন জরুরি কিছু কাজ থাকবে না। আসল কাজ তো সিসটেম অ্যানালিস্টদের। চাই কী ইয়োরোপের আরও কিছু-কিছু ঘুরে আসতে পারি। জাপান হয়েছে। ইউ. এস. এ হয়েছে। ইয়োরোপটা হলে একটা…’

‘ওকে আবার হওয়া বলে নাকি? অত বড় আমেরিকা মহাদেশটা, কতটুকু দেখিয়েছ?’

‘ওকে হা, ওই হলো, ওই হলো, খুঁটিয়ে দেখতে গেলে, তিন চার বছর বাস করতে হয়।’

‘কিন্তু সোমা কি ওকে আগলাতে চাইবে?’

‘সেটা দেখো। তবে এটা গুড সাইন। আফটার অল ও-ও তো বড় হচ্ছে। নাচটা সিরিয়াসলি নিয়েছে। আসলে কোথাও একটা জেনুইন ইন্টারেস্ট চাই, বুঝলে? শী ইজ আউটগ্রোয়িং আস।’

মীনাক্ষী নিচের ঠোঁটটা সামান্য একটু বিকৃত করলেন। বিপদ কেটে গেলেই দাশসাহেবের মাথায় নানা রকমের তত্ত্ব আসতে থাকে।

ঋতু নিজের ঘরে ঢুকে দুটো দরজাই বন্ধ করে দিল। মা-বাবার ঘরের দিকের দরজা। আর হলের দিকের দরজা। তার ঘরে ড্রেসিংটেবল নেই। একটা দেয়ালজোড়া আয়না আছে। বারান্দার দিক থেকে আসা আলোয় সে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের প্রতিবিম্ব দেখতে লাগল, দেখতেই লাগল। ড্রয়ারের ভেতর থেকে ক্রিমের শিশি বার করে অনেকক্ষণ ধরে মাখল। মাখতেই লাগল। মাখতেই লাগল। নিজেকে এভাবে দেখতে, এইভাবে ক্রিম মাখতে অদ্ভুত ভালো লাগে আজকাল। আয়নার ভেতরের ওই মেয়েটাকে দারুণ ভালোবাসে সে। বাবার ইচ্ছে সে আই. এ. এস হয়। মুসৌরির রাস্তায় ঘোড়ায়-চড়া ট্রেনী আই. এ. এস—এই মূর্তিটা তার খুব মনে ধরেছিল তাই বাবার উচ্চাশায় সে বরাবর তাল দিয়ে এসেছে। এখন কিন্তু বুঝতে পেরে গেছে অশ্বারোহিণী রাজিয়ার রোম্যান্স আই. এ. এস-এর একেবারে গোড়ার দিকের নেহাত ভগ্নাংশ। রাজ্যের সরকারি ফাইল দেখবে বলে কি সে এতা ভালো কত্থক শিখল? আরও শিখবে, ওড়িশি শিখবে। বেসিসটা আছে। সে খাজুরাহোয় নাচবে। ঠিক যে নাচের জন্যে, নাচ শিল্পটার প্রতি ভালোবাসাবশত তা নয়। সে নাচবে ঋতু নামক এই বিশিষ্ট অঙ্গ প্রত্যঙ্গ গুলোকে সৌন্দর্যে ছড়িয়ে দেবার জন্যে, নাচবে এই চোখ দিয়ে কটাক্ষপাতের তীব্র আনন্দে, ভিন্ন ভিন্ন গ্রীবাভঙ্গির অহঙ্কার অনুভব করবার জন্য।

কলেজের ফ্রেশার্স-এ সে বাধ্য হয়ে নেচেছে। দুপুর বেলা। হলের মধ্যে গুমোট গরম। চারদিক থেকে আলো ঢুকছে। এ গাইছে, ও আবৃত্তি করছে। এই ধরনের হট্টমেলায় মোটেই তার নামতে ইচ্ছে ছিল না। ড্রেস ছাড়া তো আর কত্থক হয় না। সে একটা রবীন্দ্রসংগীতের সঙ্গে কম্পোজিশন করেছিল। অনেক হেলায় করলেও জিনিসটা ভালো উৎরেছিল। সেকেন্ড ইয়ারের ছেলেমেয়েরা তো খুব বাহা বাহা করল। কিন্তু দেখাবার মতো লোক ওখানে কই? কে আছে তেমন সমঝদার?

ইতিমধ্যে ঋতু মা-বাবার আসন্ন ফ্রান্স-যাত্রা উপলক্ষে তার নিজের স্বাধীনতা দিবস কাছে এগিয়ে আসছে মনে করে আনন্দ ধরে রাখতে পারছে না। এত বড় ফ্ল্যাটটায় সে ছাড়া কেউ থাকছে না, বাসন্তী তার আজ্ঞাবহ। কিন্তু মা কি তাকে একদম একা রেখে যেতে চাইবে? ঠিক আছে সোমারা আসুক। তখনও কিন্তু ঋতুর পরিচালনাতেই সংসার এবং ঋতু নিজে চলবে। সেটা সোমাকে বুঝিয়ে দিতে হবে। ইতিমধ্যে সে মিঠুকে একটা ফোন করে ফেলল। সে রাশি রাশি ফোন করে বলে এবং তার প্রাইভেসি নষ্ট হবে বলে ফোনটা নিজের ঘরে করিয়ে নিয়েছে কবেই।

মিঠুই ধরেছে, ‘হ্যাললো।’

‘মিঠু, আমি ঋতু বলছি। হি হি।’

‘ঋতু? এত রাত্রে?’

জবাবে ঋতু শুধু বেশ খানিকটা হাসল—

‘হাসছিস কেন?’

‘আই হ্যাভ গন ক্রেজি। হি হি হি।’

‘মিঠুকে কী দরকার রে? ঘুমিয়ে পড়েছে, ডাকব?’

চৈতন্য ফিরে পেয়ে ঋতু বলল, ‘ও মা। মাসি! আমি একদম বুঝতে পারিনি। না না মিঠুকে ডাকতে হবে না।’

‘কোনও মজার কথা আছে মনে হচ্ছে?’

‘সে কালকে হবে।’ ঋতু অপ্রতিভ হয়ে ফোন রেখে দিল, তারপর সমস্ত ব্যাপারটার মজায় একলা একলাই হেসে গড়াতে লাগল।


‘গোধূলি! গোধূলি’…ওই ডাকটা…দুপুরটা..অ্যাসোসিয়েশনটা…

আকাশ কালো করে আসছে। গুম গুম মেঘের ডাক। এ বছর বৃষ্টি আর ফুরোতেই চায় না। গরমও তেমনি। কদিন অসহ্য গুমোট হচ্ছে। দু তিনদিন চলতে থাকছে একই রকম। তার পরেই গুম গুম গুড় গুড়, ঝমাঝ্ঝম। রাস্তার অবস্থা যা তাতে সর্বত্রই চোরা পুকুর। তাতে ভেসে রয়েছে ময়লা, গাড়ির তেলকালি। উজ্জয়িনী পেছন ফিরে বলল, ‘এই মিঠু, তুই কি বি. কে. সি-র ক্লাসটা করবি না কি? আমি বাবা বাড়ি চললাম। বৃষ্টি নাবলে আর ফিরতে হচ্ছে না।’ আজকে অনেকেই আসেনি। ছেলেগুলো তো মনে হয় মাঝে মাঝে বেড়াতে আসে। রোজ বইখাতা নিয়ে কলেজে বেরয়। অর্ধেক দিনই কলেজে ঢোকে না, কোথাও না কোথাও গিয়ে আড্ডা জমায়। কলেজে ঢুকলেও দেখো কমনরুমে, কী লাইব্রেরিতেও। ক্লাসে মুখ দেখায় কম। আজকাল পলিটিকসের ধার মরে গেছে। সে রকম জোর পলিটিকসের আলোচনাও শোনা যায় না। ইউনিয়ন যা করতে বলে সব্বাই মুখ বুজে মোটামুটি তাই করে যায়। কী যে এত আড্ডা মারে ছেলেগুলো। উজ্জয়িনীরা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে। আড্ডার বিষয়বস্তু কি? মিঠু একটু পিছিয়ে ছিল, বলল, ‘বি কে সি কিন্তু আজ নতুন চ্যাপ্টার শুরু করবেন।’

‘কাকে নিয়ে শুরু করবেন? অর্ধেক তো আসেইনি! আমরা কিছু যদি কেটে যাই তো পরের দিন। চল এই বেলা পালাই। আজ গাড়ি আছে। আয় না।’ উজ্জয়িনী মিঠুর কনুই ধরে টান দিল।

ভিক্টোরিয়ার কাছাকাছি আসতে ওরা একটা অদ্ভুত সুন্দর দৃশ্য দেখল। জলভরা নীল রঙের মেঘের প্রেক্ষাপটে আরও সাদা হয়ে ভিক্টোরিয়ার গম্বুজটা ফুটে আছে। দু’পাশে একটু একটু আকাশ, আবার মেঘ। উজ্জয়িনী বলল, ‘মোহনদা, একটু থামাও তো! মিঠু ভিক্টোরিয়ায় যাবি?

‘যেতে তো খুব ইচ্ছে করছে, কিন্তু বৃষ্টি এলে?’

‘এলে ভিজব। চট করে বাড়ি পৌঁছে যাব তো! এ তো আর কলেজ স্ট্রিট নয় যে জ্যামে পড়ব, কি গাড়িতে জল ঢুকে যাবে!’

‘চল’— দুজনে নেমে দৌড়ল। গেটের কাছ থেকে ঝালমুড়ি কিনে নিয়ে ঢুকল।

মিঠু বলল, ‘ঝালমুড়িতে আজকাল নাকি ব্রাউন শুগার মিশিয়ে দিচ্ছে, জানিস?’

‘তাহলে আর এক টাকাতে ঠোঙা দিতে হত না!’

‘কি জানি! বাড়িতে তো বাইরের এসব খেতে একদম বারণ করে, কাগজে নাকি বেরিয়েছিল।’

‘তো তুই খাস নি!’ এক ঝটকা দিল উজ্জয়িনী, ‘—ফ্যাল, ফ্যাল ঠোঙাটা’, মিঠুর হাত থেকে ঠোঙাটা কেড়ে নিয়ে সে অনেক দূরে ছুঁড়ে ফেলে দিল, একটা চিল সেটাতে ছোঁ মারল, যতই ওপরে যাচ্ছে ছড়িয়ে পড়ছে মুড়ি, ছোলা, বাদাম, পেঁয়াজ, ঝুরিভাজা, কাঁচালংকা।’

মিঠুর মুখটা বিবর্ণ হয়ে গেছে। উজ্জয়িনী আস্তে বলল, ‘সরি, এই মিঠু এক্সট্রীমলি সরি রে!’

মিঠু কেঁদে ফেলল। তার শামলা রঙের চিকণ গালের ওপর দিয়ে জলের ধারা নামছে। চোখদুটো ঈষৎ লাল। একগুচ্ছ চুল হাওয়ার বেগে খালি কপালের ওপর এসে লুটোপুটি খাচ্ছে। খয়েরি রং-এর স্কার্ট দুলছে সে হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে চোখ মুছতে লাগল।

উজ্জয়িনী বলল, ‘যাঃ, তুই কেঁদে ফেললি! আমি না আসলে মাথাটা না কি রকম গরম হয়ে গেল…আচ্ছা আমরা তো একটা ঠোঙা থেকেই খেতে পারি, পারি না?’

মিঠু ধরা-ধরা গলায় বলল, ‘তুই খা। আমার লাগবে না। ব্যাপারটা যে ঠিক খাওয়া না খাওয়ার নয়, সেটুকুও তুই বুঝতে পারিস নি।’

উজ্জয়িনী বলল, ‘এখানে বাঁদর থাকলে বেশ হত। এই ঠোঙাটাও সে ব্যাটাকে দিয়ে দিতাম। আয়, এই বেঞ্চটাতে বসি।’

মিঠু বলল, ‘না, জলের ধারে বসব, অবশ্য তুই যদি আমায় ঠেলে ফেলে না দিস।’

‘তার মানে?’ উজ্জয়িনী চোখ বড় বড় করে বলল, ‘তোর মনে হয় আমি তোকে ঠেলে ফেলে দিতে পারি?’

‘হ্যাঁ, তোর ধর হঠাৎ ইচ্ছে হল, তুই বোধ হয় নিজেই জানিস না কী পারিস আর কী না পারিস!’ জলের ধারের একটা বেঞ্চ দেখে মিঠু বসে পড়ল।

‘ওখানে বসলি যে? যদি তোকে ঠেলে ফেলে দিই?’

‘এখানে ঠেলা মারলে, মাটিতে পড়ব, জলে পড়ব না, পড়লেও সাঁতারটা তো জানি’ বলে মিঠু হেসে ফেলল।

উজ্জয়িনী পাশে বসে বলল, ‘না রে মিঠু, সত্যিই। হাসি নয়। তুই বোধ হয় না জেনেই আমার সম্পর্কে একটা সত্যি কথা বলেছিস। আমি নিজেই জানি না কী পারি আর কী না পারি। আমার ভেতরে একটা ভীষণ ক্রুয়েলটি আছে, আমি টের পাই…’

‘কী বাজে কথা বলছিস?’

‘বাজে কথা নয়। কারণ আছে, শুধু শুধু বলছি না বাবা। আসলে বাবার থেকে বোধ হয় এটা পেয়েছি আমি।’

‘মিঠু ভয়ের চোখে তার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘য্যাঃ, বাবার সম্পর্কে ওভাবে ভাবতে আছে না কি?’

‘তুই আর কতদিন খুকী থাকবি মিঠু!’ উজ্জয়িনী বিরক্ত হয়ে বলল, ‘বাবা মা বলে কি সব সমালোচনার উর্ধ্বে? না স্বর্গের দেব-দেবী? আমি দেখছি, প্রতিদিন দেখছি মাই ফাদার ইজ আ ক্রুয়েল ম্যান, আর্ধেক দিন আমার মা রাতে ঘুমোয় না, খায় না ভালো করে, বাবার অপমানকর ব্যবহারের জন্যে, আর বলতে পাব না সেটা..!’

‘আরে? তোমরা এখানে?’ ওরা পেছন ফিরে দেখল বিষ্ণুপ্রিয়া আর তন্ময়।

‘তোরা?’ বিষ্ণুপ্রিয়ার চোখে চোখ রেখে বলল উজ্জয়িনী।

তন্ময় পাতলা চেহারার, গম্ভীর, একটু ভাবুক ধরনের একটি ছেলে। খুব নিয়মিত ক্লাস করে। তন্ময় বিষ্ণুপ্রিয়া দুজনেই পলিটিক্যাল সায়েন্সে অনার্স। শোনা যাচ্ছে তন্ময় সায়েন্স স্ট্রিম থেকে এসেছে। ও নাকি খুবই ভালো ছেলে। ইকো, স্ট্যাট্‌স্ নিয়েছে পল সায়েন্সের সঙ্গে।

বিষ্ণুপ্রিয়া একটু বেঁটে। খুব কাটা কাটা চোখ মুখ। উজ্জ্বল রঙ। প্রচুর চুলে একটা বেণী বাঁধা। সে বলল, ‘আজ তো আমাদের ডিপার্টমেন্টে প্রায় সব প্রোফেসরই অ্যাবসেন্ট। কী নাকি সেমিনার আছে, সব ঝেঁটিয়ে গেছে। অনেকেই আগে জানত, আসেনি। আমি আর তন্ময় একা পড়ে গেলুম। তাই চলে এলুম। ও কী দারুণ নোটস রাখে! ওয়ার্ড ফর ওয়ার্ড। এই তন্ময়, খাতাটা দেখা না রে ওদের!’

তন্ময় বলল, ‘ডোন্ট বি সিলি। এই তোমরা ঘাসের ওপর এসে বসো না! বেঞ্চে চারজন কমফর্টেবলি বসতে পারবে না।’

‘যদি হয় সজ্জন!’ বলে উজ্জয়িনী সরে বসে। মিঠুকেও টেনে আনল। ওরা বসতে উজ্জয়িনী বলল, ‘তোমরা তো বেড়াচ্ছিলে! আমরা আবার তোমাদের ডিসটার্ব করলাম না তো!’

বিষ্ণুপ্রিয়ার গাল লাল হয়ে গেল। সে বলল, ‘দেখ, ইচ্ছে করলে অনায়াসে তোদের এড়িয়ে চলে যেতে পারতুম। দেখতেও পেতিস না। তন্ময়টা তলে তলে…জানিস ইকোতে সেভেনটি এইট পার্সেন্ট পেয়েছিল। ম্যাথসে লেটার।’

তন্ময় বলল, ‘কী হচ্ছে বিষ্ণুপ্রিয়া! বাজে বকলে আমি কিন্তু উঠে যাচ্ছি।’

‘আহা!’ বিষ্ণুপ্রিয়া দমবার পাত্রী নয় ‘জানিস, তন্ময় টি ভি-তে প্রোগ্রাম করে, ইয়ুথ টাইমে কুইজ কনডাক্ট করেছিল।’

‘দেখি দেখি’, মিঠু মুখ বাড়িয়ে বলল, ‘তাই ওর মুখটা আমার কেমন চেনা চেনা লাগছিল। তুই বোধ হয় প্রায়ই করিস, না রে তন্ময়!’

তন্ময় বলল, ‘মাঝে মাঝে। আসলে রেডিওতে অনেক দিন আগে থেকেই করছি। “বিদ্যার্থীর জন্য”তে বিদ্যার্থী সেজে যে কতবার বসেছি! তোরা কেউ আবৃত্তিতে ইন্টরেস্টেড?’

মিঠু গীতিকবিতা খুব ভালো আবৃত্তি করে, ওর গলাটা মাইকে আসে মিষ্টি, রিনরিনে, অথচ স্পষ্ট, তীক্ষ্ণ নয়। সে বলল, ‘কেন রে?’

‘আমাদের একটা খুব ভালো আবৃত্তির ক্লাস হয়। ভয়েস থ্রো কনট্রোল, মডুলেশন, উচ্চারণ খুব ভালো শেখানো হচ্ছে। আমি তো জাস্ট তিন চারটে ক্লাস করার পরেই অনেকটা ইমপ্রুভ করে গেছি।’

‘কোথায়?’ মিঠু জিজ্ঞেস করল।

‘সল্ট লেক। করুণাময়ী।’

‘ও ব্বাবা!’

‘কেন? তুই থাকিস কোথায়?’

‘বালিগঞ্জ ফাঁড়ির কাছে।’

‘বাস রয়েছে। অসুবিধে কী?’

‘না বাবা। কলেজ করতেই প্রাণ বেরিয়ে যাচ্ছে। তারপর গানের ক্লাস।’

‘ওঃ হো, বলতে ভুলে গেছি, ফ্রেশার্স-এ বিউটিফুল গেয়েছিলি তুমি যে সুরের আগুন…’

‘থ্যাংকস—’ মিঠু বলল, ‘তা বিষ্ণুপ্রিয়াকে বল না তোদের ক্লাসে ভর্তি হতে, ও তো মানিকতলায় থাকে।’

‘বিষ্ণুপ্রিয়ার কোনও আগ্রহই নেই।’

উজ্জয়িনী বলল, ‘মিঠু দেখ, মেঘ কেটে গেছে। বৃষ্টিটা তার মানে হল না। ইস্ শুধু শুধু বি কে সি-র ক্লাসটা করা হল না।’

বিষ্ণুপ্রিয়া হেসে উঠল, ‘আরে বি কে সি তো সেমিনারে। ক্লাস হতই না, বললুম না!’

মিঠুর হাতে একটা চোরা টান দিয়ে উজ্জয়িনী উঠে পড়ল, বলল, আমরা চলি রে। এই মিঠু দেরি হয়ে যাবে কিন্তু, মোহনদাকে আবার ছাড়তে হবে।’ বলেই সে হনহন করে প্রায় ছুটতে লাগল। মিঠু অন্য দুজনের দিকে তাকিয়ে বিদায় জানিয়ে কয়েক পা দৌড়ে উজ্জয়িনীকে ধরে ফেলল। উজ্জয়িনী বাঁকা চোখে ওর দিকে তাকিয়ে মুখ টিপে হেসে বলল, ‘টু ইজ কম্প্যানি, থ্রি ইজ…!’ মিঠু হাসতে হাসতে বলল, ‘য্যাঃ, আমরা এতদিন পর্যন্ত গার্লস স্কুলে পড়েছি বলেই আমাদের ওরকম মনে হয়। জাস্ট ফ্রেন্ডস ওরা।’

‘ওই আনন্দেই থাক। প্রিয়াটা কী রকম কনজারভেটিভ বাড়ির মেয়ে জানিস? এখনকার দিনেও ওদের মা-কাকিমারা ঘোমটা দিয়ে থাকে। আর কী বিরাট জয়েন্ট ফ্যামিলি। বাপরে। তোর দম বন্ধ হয়ে আসবে ওদের বাড়ি গেলে! এ ঘর থেকে একজন কাকা বেরোল তো ও ঘর থেকে একজন জেঠী! ঠাকুর্দা, ঠাকুমা! একেবারে সেভেনটিন্‌থ্ সেঞ্চুরি। প্রথম চান্স পেয়েই প্রিয়াটা…’ বলে উজ্জয়িনী হাসিতে ফাটতে ফাটতে ছুটতে লাগল। ওদের গাড়ি লোয়ার সার্কুলার রোডে ঢোকবার পর হঠাৎ ঝমঝম করে বৃষ্টি নামল। উজ্জয়িনী বলল, ‘দুটোতে খুব ভিজবে এবার।’

‘এমা সত্যিই তো!’ মিঠু বলে উঠল, ‘বৃষ্টিটা কী অসভ্য।’

উজ্জয়িনী বলল, ‘ভিজুক না। না ভিজলে প্রেম হয়? জলে ভিজবে, রোদে পুড়বে, মাইলের পর মাইল হাঁটবে। ঝড়ো কাকের মতো চেহারা হবে, তবে না? ‘বলে সে ভীষণ হাসতে লাগল। মিঠু ড্রাইভারের দিকে ইশারা করে দেখাতে উজ্জয়িনী বলল, ‘এবারে নিজেকেই ড্রাইভ করতে হবে দেখছি। নইলে সব মজাই মাটি। কী বলো মোহনদা?’

মোহনলাল পাঁড়ে স্টীয়ারিং-এর দিকে চোখ রেখে বলল, ‘জী?’ আরেক দফা হাসি শুরু হল উজ্জয়িনীর।

দূর থেকেই কিন্তু বৃষ্টিটাকে আসতে দেখেছিল বিষ্ণুপ্রিয়া। উজ্জয়িনীরা বাঁ দিকের প্রধান গেট দিয়ে বেরিয়ে গেছে। বিষ্ণুপ্রিয়া তন্ময়কে বলল, ‘শিগগির চল, ভিক্টোরিয়ায় উঠতে হবে। বৃষ্টি আসছে।’ দৌড়চ্ছে দুজনেই। বৃষ্টিটা ওদের একটুর জন্যে ধরে ফেলল। চুন্নি দিয়ে মাথাটা আলতো করে মুছতে মুছতে বিষ্ণুপ্রিয়া খিলখিল করে হাসছিল। তন্ময়ও তার রুমাল দিয়ে মাথাটা মুছছে। চশমাটা খুলে নিয়ে মুছে নিল কাচগুলো। তারপর বলল, ‘আচ্ছা তোমরা মেয়েরা অকারণে এত হাসো কেন বলো তো?’

‘অকারণে? এতটা দৌড়লুম। বৃষ্টির সঙ্গে কমপিটিশনে নামলুম। একটুর জন্যে সেকন্ড এলুম। হাসব না? হোয়াট ফান!’

তন্ময় বলল, ‘কি জানি! আমার তো কই হাসি পাচ্ছে না! যাই বলো, তোমাদের সঙ্গে আমাদের কতকগুলো ফান্ডামেন্টাল ডিফরেন্স আছে।’

‘সবাই, আই মিন, সব মেয়েই কি হাসে আমার মতন?’

‘মোর অর লেস সব্‌বাই। মিঠু হাসে, উজ্জয়িনী হাসে…’

‘ইমন? ইমনকে আমি এভাবে হাসতে দেখিনি। অবশ্য এরকম পরিস্থিতিতেও পড়িনি কখনও ইমনের সঙ্গে।’ বিষ্ণুপ্রিয়া বলল।

‘ইমন স্পোর্টসওম্যান তো! একটু আলাদা, অত মেয়েলি নয়,’ তন্ময় মন্তব্য করল।

‘ঠিক আছে বাবা, আর হাসব না, গ্রাম্পি-ফেস হয়ে থাকব, মেয়েলি-টেয়েলি কত গালাগালি!’

‘গালাগালি? মেয়েকে মেয়েলি বললে গালাগালি হয়? আচ্ছা তো!’ তন্ময় বলল, ‘এবার বোধ হয় কাঁদবে।’

ঝাঁঝাল গলায় বিষ্ণুপ্রিয়া বলল, ‘ভারি বয়ে গেছে কাঁদতে, অত সস্তা না।’

তন্ময় বলল, ‘কিন্তু সত্যি, খেয়াল করে দেখবে মেয়েরা অল্পে হাসে, অল্পে কাঁদে। ফলে ওরা কিন্তু ভেতরে কোন কিছুই জমিয়ে রাখতে পারে না। মেয়েদের হার্ট অ্যাটাক কম হয় ওই জন্যে। হাউ স্ট্রেঞ্জ আর নেচার্স ওয়েজ!’

বিষ্ণুপ্রিয়ার ক্রমশই রাগ বেড়ে যাচ্ছে। বলল, ‘মেয়েদের গভীরতা নেই, এই বলতে চাইছ তো? মেয়েরাই, কিন্তু জগতে বেশি ফেইথফুল, দায়িত্বশীল, নির্ভরযোগ্য বলে প্রমাণিত হয়েছে।’

‘আমি কিন্তু বলতে কিছু চাইনি,’ ভাবুক মুখ করে তন্ময় বলল, ‘আই ওয়াজ জাস্ট কিউরিয়াস! বুঝতে চাইছিলাম। আর তুমি যে গুণগুলোর উল্লেখ করলে সেগুলোর জন্যেও বোধ হয় হাসিকান্নার সেফটি-ভালভের দরবার হয়। নার্ভ জিনিসটা মেয়েদের খুব স্ট্রং। দায়িত্বশীল, নির্ভরযোগ্য…এসব হতে গেলে নার্ভাস সিসটেমে একটা ব্যালান্স দরকার হয়।’

‘সব কিছুরই একটা করে ফিজিওলজিক্যাল এক্সপ্ল্যানেশন আছে বুঝি! মনটা কিছু না!’

‘ফিজিওলজিক্যাল এক্সপ্ল্যানেশন তো থাকবেই! তা নয়ত মেয়েরা অ্যাজ এ ক্লাস আলাদা কেন? ছেলে অ্যাজ এ ক্লাস আলাদা কেন? ব্যক্তির কথা হচ্ছে না। ক্লাসের কথা হচ্ছে। আর মন? মনটার তো আংশিকভাবে শরীরেরই সৃষ্টি। মেডিক্যাল সায়েন্স তো এদিকেই এগোচ্ছে!’

‘ওঃ, পারও তুমি!’

‘না, আমার খুব আশ্চর্য লাগে, শরীর আগে না মন আগে! বস্তুবাদ ক্রমেই শরীরকে পয়লা নম্বরে রাখছে। আরেকটা জিনিস দেখো। মেয়েরা এখন ক্লেম করছে তারা পুরুষের সব কাজ করতে পারে। করছেও। বাট আই হ্যাভ মাই ডাউটস!’

‘কী রকম? তুমি কি মেয়েদের রান্নাঘরে ফিরে যেতে বলছ?’

‘আরে দূর! তা নয়! কিন্তু কোথাও একটা সীমারেখা আছে। বেসিক্যালি দে আর ডিফরেন্ট। মেন্ট ফর ডিফরেন্ট কাইন্ডস অফ জবস্। ভেবে দেখো, আজকের দিনে অনেক ফ্যামিলিতেই ছেলে আর মেয়েকে বাবা-মা একইভাবে মানুষ করে। আমার বাড়িতেই ধরো না। ছোট থেকে আমি আর আমার বোন এক ধরনের খেলনা পেয়েছি। একসঙ্গে বাড়ির কাজ শিখেছি। ইন ফ্যাক্ট আমাদের পাঁচ জনের ফ্যামিলি। আমরা চার জন আর দিদা। মানে বাবার পিসিমা। তিনিও সব সময়ে থাকেন না। তুমি বোর হচ্ছ না তো!’ তন্ময় বিষ্ণুপ্রিয়ার দিকে তাকাল।

‘উঁহু, বলো না, ইনট্‌রেস্টিং, লাগছে।’

‘কী যেন বলছিলাম!’

‘তোমাদের বাড়ির কথা!’

‘ও হ্যাঁ, তো ছোট থেকেই আমি আর বোন ভাগাভাগি করে কাজ করি। আমাদের খুব ছোট্ট ফ্ল্যাট। কোনও কাজের লোক নেই। বাবা বাজার, ব্যাঙ্ক, পোস্ট অফিস এইসব বাইরের কাজ করে, দিদা রান্না করেন, জাস্ট রান্নাটুকু। মা দিদাকে সাহায্য করে। ঘর-টর পরিষ্কার করে। আমি বাসন মাজি। যে যার কাপড় কেচে নিই। আমার বোন ঘর মোছে। এই রকম ছেলেমেয়ে নির্বিশেষে কাজের ভাগ তো! কিন্তু আমার বোন বাইরের কাজের চেয়ে রান্নাটাই প্রেফার করে। বাবার হয়ত অসুবিধে আছে ব্যাংকে যেতে পারবে না। বোন বলবে—তুই যা আমি তোর বাসন মেজে রাখছি। আমাকে রান্নার কাজ দিলে, ও বলবে, আমি রান্নাটা করি না মা, দাদা বাজার করবে।’

‘তুমি রান্না করো! তুমি?’

‘খাবে না কি এক দিন! ভাত, ডাল, মাছের ঝোল, সুকতো, মাংস, ফ্রায়েড রাইস, চচ্চড়ি—সব পারি। আনাজপাতি ছুরি দিয়ে, মাছ খুব ভালো ড্রেস করতে পারি।’

‘মা!’

‘মা? ওরে বাব্বা, মা একটা ভীষণ গোলমেলে কলেজের প্রিন্সিপ্যাল। দশটা থেকে চারটে তো সেখানে এনগেজড্ বটেই, বাড়িতে এত ফাইল নিয়ে আসবে। অনবরত ফোন আসবে, এখান সেখান, রাইটার্স, সি এস সি দৌড়াদৌড়ি। এর ওপর বাড়ির কাজের চাপ পড়লে…সম্ভব নয়। বাবা বরং অনেক ফ্রি। অফিসের কাজ অফিসে সেরে বাড়ি চলে এলো। ব্যাস, নো মোর ঝঞ্ঝাট!’

বিষ্ণুপ্রিয়া চুন্নির প্রান্ত পাকাতে পাকাতে বলল, ‘আমাদের বাড়িতে এসব ভাবতেই পারবে না। আমার ছোটকাকিমাও তো ব্যাঙ্কে কাজ করে! সকালবেলায় ব্রেকফাস্ট তৈরি করবার ভার কাকিমার। সেসব করে তবে অফিস যায়। সন্ধেবেলায় কাকা-কাকিমা প্রায় একই সঙ্গে ফেরে কিন্তু চা-জলখাবার এসব দেয় কাকিমা। এ রকমই সিসটেম আমাদের। আমি আমার দাদার জুতো পালিশ করি, শার্ট-টার্ট ইস্ত্রি করে দিই। একবার বাড়িতে অনেকদিন কাজের লোক ছিল না, তো মা বলেছিল—খেয়ে দেয়ে যে যার বাসন তুলে দেবে। দাদা যেই তুলতে গেছে ঠাম্মা এসে বলল, ‘ব্যাটাছেলেকে দিয়ে আর এঁটো বাসনটা নাই তোলালে বউমা।’

বিষ্ণুপ্রিয়া এখন একটু গম্ভীর হয়ে গেছে। তন্ময় বলল, ‘চলো, দরকার হলে ঢোকা যাক।’

এখনও বৃষ্টি ভালোই পড়ছে। সমান ধারে। কারো কাছেই ছাতা নেই। তন্ময় ছাতা ব্যবহারই করে না। বিষ্ণুপ্রিয়ার ছাতা বাড়িতে পড়ে আছে। ছবি দেখতে দেখতে বিষ্ণুপ্রিয়া বলল, ‘তন্ময় তোমার কোন পেপারটা সবচেয়ে ভালো লাগে?’

‘থিয়োরি, অফ কোর্স। ফোর্থ পেপারও ভালো লাগে।’

‘দূর, আমি থিয়োরি ভালো বুঝতে পারি না।’

‘বল, আর ল্যাসকিটা ভালো করে পড়, আর বি কে সি-র ক্লাসগুলো মন দিয়ে করো। ওতেই হবে।’

‘আচ্ছা তন্ময়, তোমার যা রেজাল্ট তাতে তো তুমি আরও নাম-করা কলেজে যেতে পারতে। আর্টসে। পেতে না?’

‘পেতাম। কিন্তু আমি চেষ্টা করিনি। আমার বাবা মা সব এই কলেজের। তা ছাড়াও সত্যিকার কারণটা শুনবে?’

‘এ ছাড়াও একটা সত্যিকার কারণ আছে? আলাদা? বলো বলো’, বিষ্ণুপ্রিয়া উৎসুক হয়ে বলল।

তখন দুপুরবেলা। এপ্রিল। এখানে সীট পড়েছিল। ফার্স্ট হাফটা দিয়ে উঠেছি, সেকেন্ড হাফে আমার কিছু নেই। বাইরে এসে, কৃষ্ণচূড়াটা দেখেছ তো? দেখি মাথাটা একেবারে হোরিখেলা হয়ে আছে। গেট দিয়ে বেরিয়ে হাঁটছি। ভীষণ চুপচাপ চারিদিক। হঠাৎ খুব দূর থেকে কে যেন ডাকল —গোধূলি! গোধূলি! ছেলে গলার ডাক। আমি ফিরে চাইলুম, কাউকে দেখতে পেলুম না। তারপর আরও দূর থেকে আরও ক্ষীণ হয়ে ডাকটা ভেসে এল —গোধূলি! গোধূলি! তখনই মনে মনে ঠিক করলুম আমি এখানেই পড়ব।’

বিষ্ণুপ্রিয়া আশ্চর্য হয়ে বলল, ‘গোধূলির জন্যে গোধূলি নামের কোনও মেয়ের জন্যে? স্ট্রেঞ্জ! তুমি একদম খ্যাপা তন্ময়! তা পেলে খুঁজে তোমার গোধূলিকে?’

তন্ময় বলল, ‘খুঁজিনি তো!’

‘সে কি? খোঁজনি? গোধূলির জন্যে এলে। তাকেই খুঁজলে না!’

‘ঠিক গোধূলি নামের কোনও মেয়ের জন্যে এসেছি ভেবেছ নাকি? পা-গল! জাস্ট ওই ডাকটা, ওই দুপুরটা, অ্যাসোসিয়েশনটা, সব মিলিয়ে আমাকে চুম্বকের মতো টানল। আমি বুঝে গেলুম এটাই আমার জায়গা।’

‘স্ট্রেঞ্জ!’ বিষ্ণুপ্রিয়া বলল, ‘তুমি কি কবি টবি নাকি?’

‘হতে পারি। তবে এখনও লিখিনি এক লাইনও। আবৃত্তি করি। বললুম না তোমায়, করুণাময়ীতে আমাদের একটা ক্লাস হয়। একটা শুনবে?’ তন্ময় একটু চুপ করে থেকে হঠাৎ ভিন্ন স্বরগ্রামে ভিন্ন গলায় বলে উঠল—

“শুধু কবিতার জন্য এই জন্ম, শুধু কবিতার

জন্য কিছু খেলা, শুধু কবিতার জন্য একা হিম সন্ধেবেলা

ভুবন পেরিয়ে আসা, শুধু কবিতার জন্য

অপলক মুখশ্রীর শান্তি একঝলক

শুধু কবিতার জন্য তুমি নারী, শুধু

কবিতার জন্য এত রক্তপাত, মেঘে গাঙ্গেয় প্রপাত

শুধু কবিতার জন্য, আরো দীর্ঘদিন বেঁচে থাকতে লোভ হয়।

মানুষের মতো ক্ষোভময় বেঁচে থাকা, শুধু কবিতার

জন্য আমি অমরত্ব তাচ্ছিল্য করেছি।”

‘বাঃ খুব সুন্দর আবৃত্তি করো তো! গলাটাকে যেন গড়িয়ে দিলে, বেশ অল্প অল্প থেমে বাঁক নিতে নিতে এগিয়ে গেল!’

‘ভালো লাগল? ধন্যবাদ! ওই যে গলাটাকে গড়িয়ে দেওয়া বললে, একটা কনটিনিউয়িটির ব্যাপার, এটা এই কবিতাটার বৈশিষ্ট্য, যখন এটা পড়তে গিয়ে কেউ অযথা যতি চিহ্ন খরচ করে আমার খুব অসোয়াস্তি হয়। তুমি এটা বুঝতে পারো কিনা দেখবার জন্যে এই কবিতাটাই বললাম, খুব দমও লাগে।’

‘ও মা! তুমি খুব ডেঞ্জারাস তো! আরও অনেক পরীক্ষা করছ না কি আমাকে লুকিয়ে লুকিয়ে?’

‘তুমিও করো না। কে বারণ করেছে? নইলে কে কার বন্ধু হতে পারে কী করে বোঝা যাবে! তোমার নামটা কিন্তু বড্ড বড় আর ভারী।’ তন্ময়ের মুখে হাসির আভাস।

বিষ্ণুপ্রিয়া বলল, ‘আমার বন্ধুরা তো সবাই ছোট করে ডাকে।’

চাপা হাসিতে মুখ ভাসিয়ে তন্ময় বলল, ‘আমার পক্ষে ওই শর্ট ফর্মে ডাকাটা খুব অকওয়ার্ড হবে না?’

এক মুহূর্ত থেমে দু জনেই দরবার ঘর ফাটিয়ে হেসে উঠল। আরও যারা ঘুরে ঘুরে ছবি দেখছিল তারা আশপাশ থেকে, পেছন ফিরে, মুখ বাড়িয়ে ওদের দেখতে থাকল সকৌতূহলে।


‘ভারতবর্ষে আছে শুধু ডাক্তার, এঞ্জিনিয়ার, চার্টার্ড অ্যাকাউন্টট্যান্ট আর কোটি কোটি ফালতু…’

বিবেকানন্দ রোডের একটা দোতলা বাড়ির একতলার বড় ঘর। খুব সম্ভব দুটো ঘর ছিল। মাঝখানের দেয়ালটা, ভেঙে একটা বড় ঘর করে নেওয়া হয়েছে। ঠিক কলেজ বা স্কুলের মতোই সারি সারি চেয়ার ও বেঞ্চ। বি. কে. সি.-র কোচিং এ অঞ্চলে এক ডাকে সবাই চেনে। ‘দোতলায় বোধ হয় সার থাকেন’ —বলছিল গৌতম, ‘একতলায় গোয়াল’ ভেঙ্কট বলল, ‘কদাচ আত্মগ্লানি করিবে না।’ গৌতম বলল, ‘নাঃ আসলে ভাবছিলুম পূর্বপুরুষরা এইভাবে প্ল্যান করে বাড়ি করে গেলে, কত সুবিধে বল।’ ভেঙ্কট বলল, ‘শুধু আমরাই নেই, ওদিকে রান্নামহল আছে। একেকদিন ছ্যাঁচড়ার গন্ধ আসে।’ ‘ছ্যাঁচড়া?’ গৌতম নাক কুঁচকোলো। ‘কিছু মনে করিসনি ভেঙ্কট বি. কে. সি.-র এখন আমাদের দৌলতে যা মালকড়ি তাতে করে এবেলা ওবেলা মাংস খাওয়া উচিত। ইল্লিশ মৎস্য, রোগন জুস, মুর্গ মুসল্লম, কাশ্মীরি কাবাব, তা না খেয়ে ছ্যাঁচড়া খাচ্ছেন? ছিঃ। এইজন্যই কবি বলেছিলেন, “রেখেছ বাঙালি করে মানুষ করোনি”।’

বি. কে. সি. আজ বেশ মেজাজে আছেন মনে হচ্ছে। বেশ টুসটুসে চেহারাটি ভদ্রলোকের। গাল-টালগুলো বেশ লালচে। কিন্তু চোখগুলো খুব সিরিয়াস। বি. কে. সি. উদাস মুখে বললেন, ‘বুঝলে বাবারা, পড়তে এসেছ, পড়ো, পরীক্ষা পাস করো। সবাই করো। কিন্তু চোখ-কান খোলা রেখে দিও। এমন একটা যুগ এসেছে যে তোমাদের নিজেদের জোরেই চলতে হবে। তাই বলে কি আর আমাদের কাছ থেকে গাইড্যান্স পাবে না? সে কথা বলছি না। কিন্তু মনে রেখো তোমরাই এভরিথিং। আমাদের নানা দিকে বাঁধন। বহু ওবলিগেশনস। অত কর্মশক্তি নেই। তোমাদের বয়সে আমরা প্রায় পুরোটাই অভিভাবকদের দ্বারা পরিচালিত হতাম। এই সমাজ, সংস্কার, এই রাজনীতি, এর ভেতরে ছোট ছোট নাট বল্টু ছিলাম। যে যার নিজের জায়গায় পুরো সিসটেমটার সঙ্গে সঙ্গে পাক খেতাম। ভাবতাম খুব করছি। ফলে কখনও কখনও খুব আত্মপ্রসাদ হত, আবার কখনও কখনও খুব হতাশ হয়ে পড়তাম। এখনও ঘুরছি। চাকাটার সঙ্গে ঘুরে যাচ্ছি। কিন্তু এটাকে ভিশাস সাইকল বলে এখন চিনতে পারি, বুঝতে পারি। পুরো ঘোরাটা দেখতে পাই। তোমরা আমাদের থেকে ভালো পোজিশনে আছ এই জন্যে যে অনেক ছোট থেকেই তোমরা বাস্তবের মুখোমুখি হচ্ছ। এখন এ যুগের ছেলেমেয়েদের কাছে কিছুই আর গোপন নেই। আমরা পরিণত বয়সে এসে তবে এই চক্র দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু তোমরা দেখতে পেয়েছ এখন থেকেই। হয়ত শনাক্তও করেছ এটাকে অনেকেই। সমাজের নানা স্তরে—শিক্ষায়, রাজনীতিতে সামাজিক নানান ব্যাপারে, সর্বত্র যে চাকাটা একইভাবে গড়িয়ে চলেছে তাকে থামানো দরকার। থামিয়ে আবার নতুন করে ঘুরিয়ে দিতে হবে। এবং নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। কাজটা একদিনে হবার নয়। কারণ এ চাকার এই অভিমুখে ঘূর্ণন তো একদিনে হয়নি। বহু শতাব্দী ধরে হয়েছে।’ বি. কে. সি. থামলেন।

বি. কে. সি.-র কোচিং ক্লাসে দু ব্যাচ ছাত্র আসে। ফার্স্ট ব্যাচ, সেকেন্ড পার্ট। দশ জনের জায়গা আছে। সেকেন্ড ব্যাচ, ফার্স্ট পার্ট। দশ জন। দক্ষিণা আড়াইশ। বি. কে. সি. নাকি দুর্দান্ত সব নোটস দেন। সম্ভাব্য প্রশ্নের তালিকাও প্রত্যেকবার শতকরা আশি ভাগ মিলে যায়। গৌতম, ভেঙ্কট, রাজেশ্বরী, বিষ্ণুপ্রিয়া এবং আরও কেউ-কেউ ভর্তি হয়েছে। কিন্তু এখনও কোনও নোটস পায়নি। সম্ভাব্য প্রশ্নতালিকা তো নয়ই। অবশ্য দেরি আছে অনেক। ইতিমধ্যে সার বেশ কিছু প্রশ্ন লিখতে দিয়েছেন। শক্ত শক্ত ইংরিজি টেক্সট বুক থেকে সংক্ষিপ্ত করতে দিয়েছেন। সংক্ষিপ্তকরণে গৌতম আর রাজেশ্বরী সারকে পুরোপুরি সন্তুষ্ট করতে পেরেছে। উত্তর প্রায় কারোই মনোমত হয়নি। সার আজকে খাতাগুলো ফেরত দিয়ে কিছুটা আলোচনা করে আবার লিখে আনতে বললেন। তারপর অন্য প্রসঙ্গে চলে গিয়েছিলেন।

একটি ছেলে হঠাৎ উঠে দাড়িয়ে হেঁড়ে গলায় বলল, ‘সার, প্লিজ এক্সকিউজ মি, ওই ভিশাস সাইকলের ব্যাপারটা কি আমাদের সিলেবাসে আছে? এবার কোয়েশ্চেন আসার কোনও চান্স আছে?’

বাকিরা শিউরে উঠল। কেউ কেউ মজা পেল। বি. কে. সি. কিন্তু রাগলেন না। বললেন, ‘য়ুনিভার্সিটি পরীক্ষায় ঠিক এই ফর্মে আসার চান্স নেই। তবে এখনও ওই চক্রের মধ্যে আছ। ভবিষ্যতেও থাকবে। তাই এখন থেকে সচেতন করে দিচ্ছি।’

‘আপাতত য়ুনিভার্সিটি পরীক্ষার সিলেবাস মাফিক নোটস-টোটসগুলো পেলেই আমাদের চলবে সার। মাস-মাস আড়াইশ টাকা করে গচ্চা যাচ্ছে। প্লিজ ডেলিভার দা গুডস সার! গার্জেনদের কাছে আমাদের কৈফিয়ত দিতে হয়।’

এতটা খোলাখুলি আক্রমণে বি. কে. সি. একটু থতিয়ে গেলেন। তারপরে বললেন, ‘গুডস সম্পর্কে তোমার ধারণাটা কী শুনি! কী পেলে তুমি মনে করবে তোমার আড়াইশ টাকা উশুল হল?’

‘নোটস ন্যাচারালি। সাজেশনস! যাতে পরীক্ষাটা ভালোভাবে উতরোতে পারি।’

‘তারপর?’

‘তারপর আমার ভাগ্য। চাকরিবাকরি জোটা সবই তো কপাল! লাইন মারতে হবে। ঠিকঠাক লাইন করতে পারলে চাকরি পেয়ে যাব।’

‘অর্থাৎ চক্রটার মধ্যে ঢুকে পড়বে?’

‘চক্র-ফক্র জানি না সার। স্রেফ লাইন, লাইন মেরে একটা কলেজে ঢুকে যাব। তারপর দেখি আমাকে কে ঠেকায়।’

‘কী পড়াবে?’

‘এই তো নোটস যোগাড় করছি। এই সবই স্রেফ ঝেড়ে দেব ক্লাসে। কোচিং খুলব। পাঁচশ নেব, এই নোটসগুলোই দেব।’

‘তাহলে হরে-দরে চাকা ঘুরে ঠিক এই জায়গাতেই পৌঁছবে—ভিশাস সাইকল?’

ছেলেটি এবার সত্যি-সত্যি ভিশাস চেহারা ধারণ করল। চেঁচিয়ে বলল, ‘তো আপনি কী করছেন? আপনি নেই এই ভিশাস সাইকলে? কলেজে ফাঁকি দিয়ে বাড়িতে কোচিং করছেন না? দু হাতে কামাচ্ছেন না? একগাদা নোটস তৈরি করে রেখে বছরের পর বছর সেগুলোকে ভাড়া খাটাচ্ছেন না?’

‘নো।’ বি. কে. সি. উত্তেজিত গলায় বললেন, ‘প্রথমত আমি কলেজ আওয়ার্সের বাইরে কোচিং করি, এবং নোটস প্রত্যেক বছর রিভাইজিং করি, দ্বিতীয়ত,’ দু হাত মুঠো করে টেবিলের ওপর আঘাত করে তিনি বললেন, ‘আই অ্যাম ট্রাইং টু ব্রেক দিস সাইকল ইন মাই ওন, স্মল, লিমিটেড ওয়ে। আমি তোমাদের নোটস দোব না, দরকার মনে না করলে। আমি তোমাদের শেখাতে চাইছি। নিজেরা যাতে বিষয়টা ধরতে পার, দখল আসে তার ওপর, এবং লিখতে পার সেই চেষ্টাই আন্তরিকভাবে করব বলে, গোড়ার থেকে নোট দেওয়া বন্ধ করেছি। তার চেয়ে অনেক অনেক বেশি খাটছি তোমাদের জন্যে। এর চেয়ে বেশি চার্জ করলেও অন্যায় হত না। রাতে যখন শুই, আই ফিল কমপ্লিটলি ড্রেইনড। একেবারে ছিবড়ে হয়ে যাই, বুঝলে?’

আরেকটি ছেলে এই সময়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘কিছু মনে করবেন না সার, আমরা আপনর নোটের খ্যাতি শুনেই এসেছি। গত দু বছরের ছাত্রদের তো আপনি নোটস দিয়েছেন, আমাদের বেলায় দেবেন না কেন?’

‘শুনবে তাহলে কেন? বি. কে. সি. গম্ভীর গলায় বললেন, ‘সাইক্লোস্টাইল করে সেই নোটস ছাত্ররা বিক্রি করেছে। কিছু কিছু মাস্টারমশাইও সেগুলো কিনেছেন এবং তাঁদের ক্লাসে ও কোচিঙে ব্যবহার করছেন।’ চেয়ারের ওপর বসে পড়েছেন বি. কে. সি.। অপেক্ষাকৃত শান্ত গলায় বললেন, ‘এই পাইরেটেড নোটস তোমরা কিনতে পাবে। সেগুলো নিয়ে আমাকে নিষ্কৃতি দাও।’

রাজেশ্বরী এই সময়ে তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়াল। সে যেমনি লম্বা, তেমনি চওড়া। টকটকে ফর্সা তার ওপর। সে ক্লাসে এলে সবাই তার দিকে তাকাবেই এমনি তার ব্যক্তিত্ব। সে বলল, ‘সার, আমি পুলকের অভদ্র আচরণের তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছি। আমরা এখানে শিখতেই এসেছি। আপনার ক্লাস-লেকচার শুনেই আমরা এসেছি। নোট কিংবা সাজেশ্‌নের জন্যে নয়। আপনি যেমন বুঝবেন, দেবেন। আপনি আমাদের গাইড করলেই আমরা খুশি।’ বলেও রাজেশ্বরী দাঁড়িয়েই রইল। সার তখনও দু হাতে মাথার চুল আঁকড়ে বসে আছেন।

ভেঙ্কট বলল, ‘এই পুলক, মাফ চা সারের কাছ থেকে।’

পুলক নামের ছেলেটি কিছু বলবার আগেই বি. কে. সি. বললেন, ‘শ্রদ্ধয়া দেয়ম, অশ্রদ্ধয়া অদেয়ম—বলে একটা কথা আছে। আমি তো পুলক এবং তার মতো মনোবৃত্তিসম্পন্ন কোনও ছাত্রকে শ্রদ্ধার সঙ্গে দিতে পারব না। কাজেই মাফ চেয়ে কোনও লাভ নেই। পুলক, আমি তোমাকে তোমার গত মাসের টাকাটা ফেরত দিচ্ছি?’ তিনি সেক্রেটারিয়েট টেবিলের একটা ড্রয়ার চাবি দিয়ে খুললেন, টাকাটা বার করলেন।

পুলক পেছন থেকে ভারী ভারী পা ফেলে এগিয়ে এল, টাকাটা নিল, তারপর হঠাৎ সেগুলোকে খুব নাটকীয়ভাবে কুচিয়ে কুচিয়ে ঘরময় ছড়িয়ে দিয়ে দুমদুম করে বেরিয়ে গেল। একা একা।

বি. কে. সি. বললেন, ‘আই অ্যাম সরি স্টুডেন্টস, আজ আর ক্লাস নেবার মুড নেই। আমি তোমাদের একটা এক্সট্রা দিন নিয়ে নেব। ডোন্ট ওয়রি।’

ওরা ন’জন খাতাকলম গুছিয়ে আস্তে আস্তে বেরিয়ে এলো। সেই বিমান বলল, ‘কী বিশ্রী ব্যাপার হয়ে গেল বলো তো!’

বিষ্ণুপ্রিয়া বলল, ‘তুমিও তো যোগ দিলে, তাইতে তো ও আরও জোর পেয়ে গেল।’

‘তা তোমরাও অনেস্টলি বলল, নোটস দিচ্ছেন না বলে আমরা চিন্তিত হয়ে পড়ছিলুম না! সকলেই?’

রাজেশ্বরী বলল, ‘কিন্তু আমরা ওভাবে সারের ওপর বিশ্বাস, ধৈর্য, এসব হারাইনি। তা ছাড়া উনি তো যথেষ্টই খাটছিলেন, ধরো ওই যে সামারিটা করতে দিয়েছিলেন, প্রত্যেকেরটা আলাদা করে দেখে দিয়েছেন, যে সব প্রশ্নের উত্তর লিখতে দিলেন প্রত্যেকটি পয়েন্ট দিয়েছেন। মাস্টারমশাই কিভাবে পড়াবেন যদি আমরাই বলে দিতে পারি তো তাঁদের কাছে যাওয়ার দরকার কী? আর বি. কে. সি.-র মতো সিনসিয়ার টিচার!’ রাজেশ্বরীর গলায় ক্ষোভ ফেটে পড়ছিল।

‘সে দেখো’, বিমান বলল, ‘তোমরা কলেজে ওঁর কাছে পড়ছ, ওঁর ক্যালি জানো। আমরা অন্য কলেজের। আর পুলকের তো সত্যি কথা বলতে পড়বার সময়ই নেই। বাড়িতে বাবা পেনশন নিয়েছেন। বড় ভাই কেটে পড়েছে। বাড়ির যেখানে যা কাজ সব একধার থেকে পুলক। কলেজেও ও এস এফ-এর চাঁই। কম কাজ না কি ওর?’

রাজেশ্বরী মুখটা বিমানের দিক থেকে ফিরিয়ে নিয়ে বলল, ‘প্রিয়া, যাবি নাকি?’ মেয়েদের দলটা চলে গেল। ভেঙ্কট বলল, ‘কী কেলো! এর পর সারকে মুখ দেখাতে লজ্জা করবে, যাই বল গৌতম! কোত্থেকে সব আসে বল তো এরা! সামান্য ভদ্রতাটুকুও শিখে আসেনি!’

বিমান ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল, ‘মুখ সামলে কথা বলবে।’ একজনের দোষে সব্বাইয়ের হাতে মাথা কাটছ!’

গৌতম উদ্বিগ্ন হয়ে বলল, ‘এই ঘেঁটু চলে আয়, চলে আয়। কী হচ্ছেটা কী?’

ভেঙ্কট চলতে চলতে আস্তিন গুটোতে লাগল। বলল, ‘যা বলেছি, ঠিক বলেছি। ভেঙ্কটেশ পাল কাউকে ভয় পায় না।’

বিমান রাস্তা পার হতে হতে চেঁচিয়ে বলল, ‘ঠিক আছে, পুলককে বলব কথাটা!’ চট করে একটা ট্রামে চড়ে উল্টো দিকে চলে গেল সে।

গৌতম ভেঙ্কটের সঙ্গে নিজেদের বাড়ির অভিমুখে চলতে চলতে হঠাৎ বলল, ‘এই ঘেঁটু, আমাদের ভবিষ্যৎ কী রে?’

ভেঙ্কট বলল, ‘এই যাই, জিজ্ঞেস করে আসি।’

‘কাকে জিজ্ঞেস করবি?’

‘দেখি, আল্লা, কালী, গড় যাকে পাই, আর কাউকে না পাই রাজরাজেশ্বরীকে। ও মেয়েটা মনে হয় সব রাশিফল টল জানে।’

গৌতম বলল, ‘যাঃ, সব সময়ে ইয়ার্কি ভালো লাগে না। স্কুল ফাইনালে স্টার পেলুম। এইচ এস-এ সেটা হয়ে গেল মাটির পিদিম। কোথাও কোনও কিছুর সার্টনটি নেই। স্টেবিলিটি নেই। ভাবলুম মেকানিক্যাল এঞ্জিনিয়ারিং পড়ব, এখন পড়ছি পল সায়েন্স। ওই পুলককেই দেখ না, বাম পলিটিক্স করে, অত বড় একটা কলেজের ইউনিয়নের চাঁই, তা সত্ত্বেও ভবিষ্যৎ সম্পর্কে নিশ্চিন্ত নয়। কী রকম ডেসপ্যারেট হয়ে গেছে দেখলি তো? আমাদের তো লাইন-ফাইন কিস্যু নেই। ধর সারের কাছে পড়ছি, চেষ্টা চরিত্তির করে একটা হাই-সেকেন্ড ক্লাস পেলুম। ধর এম.এ-টাও করলুম। তারপর? কী করব?’

‘চাকরি করব’, নিশ্চিন্তমুখে ভেঙ্কট বলল।

‘চাকরি করবি কী রে শালা। চাকরি নিয়ে তোর জামাইবাবু বসে আছে?’

‘দেখ গৌতম, আমার মেজাজ ভালো নেই। জামাইবাবু তুলিসনি।’

‘তো তুই কক্ষনো সিরিয়াস হবি না?’

‘যাহা আসিবেক তাহা আসিবেক বৎস, ভাবিয়া-চিন্তিয়া কোনও কিনারা করিতে পারিবে না। যে মুহূর্তে ডাক্তারি, এঞ্জিনিয়ারিং, সায়েন্স ইত্যাদিতে চান্স না পাইয়াছ, কিংবা কমার্সে না গিয়াছ, সে মুহূর্তেই তোমার ভাগ্য ফুটা হইয়া গিয়াছে। পৃথিবীতে, মানে ভারতবর্ষে আছে শুধু ডাক্তার এঞ্জিনিয়ার চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট আর কোটি কোটি ফালতু। পাত্র-পাত্রীর বিজ্ঞাপনগুলি দেখো নাই? তুমি আমি সেই ফালতু। ভাবিয়া লাভ নাই।’

‘দূর। তোর সঙ্গে কথা বলে কোনও লাভ নেই, সত্যি কিছু ভাবিস না?’

‘কী তখন থেকে ক্যাঁচ ক্যাঁচ করছিস বল তো! আছি আমি হেসে খেলে, বেশ আছি। যখন প্রবলেম আসবে তখন সলভ করব। এখন বলে আমার মেজাজ খারাপ!’

‘এই তো বলছিস হেসে-খেলে বেশ আছিস, আবার মেজাজ খারাপ কেন?’

‘রাজেশ্বরীর চেয়ে আমি দু আঙুল বেঁটে!’ ভেঙ্কটেশ কাঁদো-কাঁদো গলায় বলল।

‘তুই কি ওদিকে লাইন মারছিস নাকি? সাবধান ভেঙ্কট, ওদিকে গেলে চিরকাল ল্যাং-বোট হয়ে থাকতে হবে। কী পার্সন্যালিটি! যেন ক্লিওপ্যাট্রা!’

ভেঙ্কট ছদ্ম কান্নার সুরে বলল, ‘যেদিন থেকে ঠাকুমা শত্রুতা করে এই জগঝম্প নাম গলায় ঝুলিয়ে দিয়েছে সেইদিন থেকে কেউ আমায় কোনও গুরুত্ব দেয় না রে গৌতম। এ বুকটায় বড় দুঃখ!’

‘বাড়ি গিয়ে বুকে একটু জল থাবড়ে শুয়ে পড়’, গৌতম পা চালাল।

রঙমহলের কাছাকাছি একটা গলিতে ভেঙ্কটেশের বাড়ি। বাড়ি ওদের একার নয়। তিনতলা বাড়িটাতে পাঁচ শরিক। এই পাঁচ আদি শরিকের আবার ডালপালা আছে। সব্‌বাইকার নাম বাইরে নেম প্লেটে লেখা। হঠাৎ দেখলে মনে হবে পলি-ক্লিনিক না কি? দরজাটা রাত এগারোটার আগে বন্ধ হয় না। দিবারাত্র রাস্তায় কোনও না কোনও হুজুগে মাইক লেগে আছে। আলো, লোকজন। চুরি-ডাকাতির কোনও ভয় এ পাড়ায় নেই। ভেঙ্কট বলে, ‘আমরা গুপ্তযুগে বাস করি। দরজা সব সময়ে খোলা।’ এখন ছটার কাছাকাছি। এত সকাল সকাল সে কোনদিনই বাড়ি ফেরে না। দরজা দিয়ে ভেতর ঢুকেই একটা চৌকো উঠোন। কাঁচা উঠোন, তার ওপরে রাজ্যের ময়লা এবং আগাছা। শরিকদের যার যখন ইচ্ছে উঠোনটায় আবর্জনা ফেলছে। সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠতে উঠতে ভেঙ্কটের খেয়াল হল সিঁড়িগুলো বোধ হয় কালে-ভদ্রে পরিষ্কার হয়। পায়রার। বিষ্ঠায় ভর্তি। একটা হুমদো-মতো বেরাল নেংটি ইঁদুর মুখে করে পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেল। সিঁড়িতে আলো জ্বলছে না। চারদিক ঘিরে বারান্দা। তারও অবস্থা তথৈবচ। যেখানেই সবাইকার চলনপথ সেখানেই আর কারুর হাত পড়বে না। দোতলার ডানদিকের দুটো ঘর তালাবন্ধ। মেজ ঠাকুর্দার ছেলে নেই। তিন বিবাহিত মেয়েই প্রবাসে থাকে। একজন কানাডায়। তার ছেলে- মেয়েরাও সেখানে বসবাস করছে। কেউ কোনদিন আসবে না। আরেক জন থাকে পুনে, তারও ছেলেদের বিয়ে হয়ে গেছে। পিসিমা নিজে ডাক্তার, ওখানে ফলাও প্র্যাকটিস। আসে না বিশেষ। ছোট পিসিমা থাকে আসাম। অনেক ভেতরে, কোথায় সরকারের এগ্রিকালচার‍্যাল রিসার্চ সেন্টার আছে, সরভোগ না কি, সেইখানে। এ পিসির মেয়ের বিয়ে হয়েছে দিল্লি। মাঝে মাঝে সেখানে গেছে ভেঙ্কট। যাই হোক, এদের কথা মনে রেখেই দোতলার এই চমৎকার ঘর দু’খানা মেজ ঠাকুর্দা তালা দিয়ে রেখেছেন। তলায় বিরাট গারাজ। তাতে ছোড়দাদুর গাড়ি থাকে। কিন্তু আরও তিনটে গাড়ি থাকতে পারত অনায়াসেই। সেই জায়গায় তার এক দাদার স্কুটার। ঘর দুটোর নাম পিসিমার ঘর। গত পাঁচ বছরের মধ্যে কোনও পিসিমা এখানে এসেছেন বলে মনে করতে পারল না ভেঙ্কট। মেজ ঠাকুর্দা নিজে থাকেন আর একটু এগিয়ে দু’খানা ঘর নিয়ে। ঠাকুমা বহুদিন গত। ভেঙ্কটের মা-ই তাঁর দেখাশোনা করেন। দোতলাটা পুরোই ছিল ঠাকুমা-ঠাকুর্দাদের দখলে। বড় ঠাকুর্দা অনেক দিন গেছেন, ঠাকুমা গেলেন সম্প্রতি, তাঁদের ঘরখানা তালা দেওয়া থাকে। তিন তলায় উঠতে উঠতে ভেঙ্কট মায়ের গলা পেল, ‘একটু ব্লিচিং পাউডার ছড়িয়ে দেবে, তাতেও এদের ভাগাভাগি, আমি কেন, তুমি নয় কেন, ছি ছি ছি! এ বাড়িতে মানুষ থাকে!’

‘তুমিও থাকো দিদি, মানুষের মধ্যে তাহলে তুমিও পড়ো না।’ ঝাঁঝাল গলার জবাব এলো।

‘নারদ, নারদ, নারদ নারদ’, বলতে বলতে দু তিন সিঁড়ি টপকে নিজেদের ঘরের কাছাকাছি পৌঁছে গেল ভেঙ্কট। মা ঘরের মধ্যে থেকে বেরিয়েই তাকে দেখে চমকে গেল, ‘কি রে, তুই? এত তাড়াতাড়ি?’

‘কাজ হয়ে গেল, বাড়ি আসব না?’

‘কিছু একটা মতলব আছে নিশ্চয়ই’, কাকিমা সঙ্গে সঙ্গে বলল।

মা বলল, ‘যা বলেছ, নির্ঘাৎ কিছু মতলবে এসেছে।’

‘বাঃ, কী সুন্দর মাতৃসম্বোধন।’ মা কাকিমার দিকে পরপর চেয়ে ভেঙ্কট বলল, ‘এই তো ঝগড়া কাজিয়া করছিলে। যেই ঘেঁটু এলো অমনি দুজনে এককাট্টা হয়ে গেলে? মাইরি কাকিমা, তোমাদের প্রতিভা আছে। করো না, কাজিয়াটা কনটিনিউ করো, শুনি, যদি কিছু শিখতে পারি!’

‘ভালো হবে না ঘেঁটু, আমার হয়েছে এখন মাথার ঘায়ে কুকুর পাগল!’ মা বলল।

কাকিমা বলল, ‘ঝগড়া থেকে কী শিখতে পারিস? শুনি!’

‘কথার পিঠে কথা, লাগসই সব প্রবাদ-বাক্য। আমাদেরও তো দরকার হয়!’

কাকিমা ছদ্মকোপে বলল, ‘হনুমান একটা।’

‘সে কাকিমা তুমিও। তুমিও হনুমতী, দেখো এইটাকে হনু বলে, কাকিমার মুখে হনু-নির্দেশ করে ভেঙ্কট মার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘সমস্যাটা কী তোমাদের?’

মা বলল, ‘তোকে বলে কী করব? করিস তো ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো।’

‘বলো না। বলো না, দেখাই যাক না ঘরের খেয়ে ঘরের মোষ তাড়াতে পারি কি না!’

‘উঠোনটা দেখেছিস? কী অবস্থা! থাকতে ঘেন্না হয়। মেজ জ্যাঠামশাই গন্ধে টিকতে পারছেন না। আমরাও টের পাচ্ছি। অসম্ভব মাছি-মশা বেড়ে গেছে। কেউ পরিষ্কার করাবে না। জমাদারও পাওয়া যাচ্ছে না।’

‘আমি যদি করে দিই, কী দেবে?’

‘তুই? তুই করবি? তাহলেই হয়েছে! তবে করলে ধন্যবাদ দেব।’ কাকিমা বলল।

‘শুকনো ধন্যবাদে আর চিঁড়ে ভিজবে না আন্টি। ডেভেলপ্ড কানট্রিতে ছেলে-মেয়েদের ঘরের কাজের জন্যে পে করতে হয়। তা জানো?’

‘এটা তো ভেডেলপড্ কানট্রি নয়। এটা উন্নয়নশীল।’

‘কিন্তু এখানকার ছেলেমেয়েরা উন্নত হয়ে গেছে অলরেডি। সবাই মিলে কিছু কিছু পহা ছাড়ো আমি শুধু উঠোন কেন, সিঁড়ি, বারান্দা সব পরিষ্কার করে দিচ্ছি।’

পরদিন ভোরবেলা এক অভিনব দৃশ্য দেখা গেল। হাফ-প্যান্ট আর গেঞ্জি পরা ভেঙ্কট মুড়ো ঝাঁটা, খুরপি, শাবল আর বালতি নিয়ে উঠোনে নেমে পড়েছে। প্রথমেই সে তার পেল্লাই ঝাঁটা দিয়ে ময়লাগুলো সব জড়ো করল বালতিতে। দু তিনবারে সেগুলো গলির বাঁকে কর্পোরেশনের ট্যারা-হয়ে-থাকা ডাস্টবিনটাতে ফেলে দিয়ে এলো। একটা মরা ছুঁচো থেকেই মারাত্মক গন্ধটা বেরোচ্ছিল। এরপর সে খুরপি দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে আগাছাগুলো তুলে ফেলল। সেগুলোরও গতি হল ডাস্টবিনে, তিন চার দফায়। এবার সে আগাগোড়া উঠোনটার মাটি শাবল দিয়ে কুপিয়ে কুপিয়ে ওলটপালট করে দিল। দশটা নাগাদ যখন তার কাজ শেষ হল ঘামে গা চকচক করছে, পা হাঁটু পর্যন্ত মাটি মাখা, মুখে জয়ের উল্লাস। তার নিজস্ব কাকিমা বলল, ‘কী নিঘ্‌ঘিন্‌নে ছেলেরে বাবা!’ শেষ দাদাটি অফিসে বেরিয়ে যাবার সময়ে বলে গেল, ‘ব্রাভো, ঘেঁটু থ্যাংকিউ।’ ভেঙ্কট নিচের কলতলায় আপাদমস্তক চান করে তার পরিষ্কৃত ঝাঁটা বালতি শাবল খুরপি ব্লিচিং ইত্যাদি কলঘরের কোণে গুছিয়ে রেখে বেরিয়ে এলো। এই বস্তুগুলো সে কাল বাড়িরই বিভিন্ন শরিকের কাছ থেকে সংগ্রহ করেছে। ব্লিচিং পাউডার ফিনাইল ইত্যাদি কেনা হয়েছে মেজদাদুর পয়সায়।

খেয়ে-দেয়ে কলেজ বেরোবার মুখে সে মেজদাদুর ঘরে ঢুকে জিজ্ঞেস করল, ‘কী মেজদাদু, গন্ধ আর পাচ্ছ?’

উত্তরে মেজদাদু বললেন, ‘আয় ঘেঁটু ইদিকে আয়।’

কাছে যেতে মেজদাদু সরু গলায় বললেন, ‘আমাদের স্বর্গীয় পিতৃদেব ব্যারিস্টার সর্বাণীভূষণ পাল এই বাড়ি করেছিলেন অনেক সাধ করে, পরের জেনারেশনগুলোয় অকৃতী অধমও তেমন কেউ নেই, তবু তাঁর সাধের বাড়ি কেউ নিজের বলে ভাবে না। একটু যত্ন করে না, তুমি করলে—আশীর্বাদ করি জয়ী হও।’

‘জয়ী হলে কী পুরষ্কার দেবে?’

‘যা চাইবে বাপধন, এখনও একটু ব্লিচিং-এর গন্ধ পাচ্ছি যেন!

‘শিগগিরই সুগন্ধ পাবে কথা দিচ্ছি। তখন কিন্তু পুরস্কারের কথা ভুলো না।’

মাসখানেক ধরে ভেঙ্কট তাদের এজমালি বাড়ির উঠোন, সিঁড়ি, বারান্দা পরিষ্কার করল। প্রতিদিন। তারপর মেজদাদুকে একদিন বলল, ‘সুগন্ধ চাও তো!’

‘—আর কী চাইব বল! ওই একটি ক্ষমতাই তো এখনও টিকে আছে। আজকাল তো খাবার-দাবারে পর্যন্ত সোয়াদ পাই না। বউমা রাগ করে বলে আপনার মন আর কোনদিনই পাব না। কিন্তু সত্যি বলছি ঘেঁটু মুখে দিলে সব অন্ন-ব্যঞ্জন আমার ঘাস মনে হয়।’

‘টেস্ট-বাডগুলো গেছে আর কি! তা সুগন্ধ চাও তো শতখানেক টাকা ছাড়।’

মেজদাদুর নিজের তো যথেষ্ট টাকাকড়ি আছেই। তিন মেয়ে যখন-তখন টাকা পাঠায়। শেষোক্ত টাকাগুলো তিনি ব্যাঙ্কে তোলেন না। তোশকের তলা থেকে একটা খাম বার করে তিনি দুশ টাকা ভেঙ্কটকে দিলেন। কিছুদিনের মধ্যেই নিচের উঠোন ফুলের টবে ভরে উঠল। সবই গন্ধপুষ্প। ভেঙ্কট নিজে এগুলোর পরিচর্যা করে। দু একটি ভাইপো ভাইঝি ফুল দেখে আকৃষ্ট হল। তখন সে তাদেরও লাগিয়ে দিল ফুলবাগানের কাজে।

কয়েকদিন আগেই কর্পোরেশন থেকে একটা নোটিস এসেছিল। বাড়ি অবিলম্বে সারাই করতে হবে, নইলে বাড়ি ভাঙা হবে। সেই নোটিসটা নিয়ে ভেঙ্কট তার ছোড়দাদুর কাছে গেল।

‘ছোড়দাদু, নোটিসটা দেখেছ তো! কী করবে ঠিক করলে?’

‘ওসব ঘুষ-ঘাষ দিয়ে কপোরেশনকে ঠেকিয়ে রাখা কিছু শক্ত না। তুই ছেলেমানুষ ওসব নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছিস কেন?

ভেঙ্কট বলল, ‘যা ব্বাবা গ্র্যান্ডি ফ্লোরা, কেউ মাথা ঘামাবে না, এদিকে বিশুকাকাদের ছাতে মাঝে মাঝেই আমাদের কার্নিসের চাঙড় খসে পড়ছে, সে কথা জানো? ওদের ঠাকুরের ছবি ছিটকে পড়ে চুরমার হয়ে গিয়েছিল একদিন, তা জানো? যদি কোনও মানুষের ঘাড়ে পড়ে তো তোমাদের সবার হাতে দড়ি পড়বে কিন্তু ছোড়দাদু।’

‘পড়লে পড়বে। ঘানি টানব এখন। তুই যা দিকি নি। কী পড়ছিস আজকাল? হঠাৎ বাড়ি নিয়ে এত মাথা ঘামাচ্ছিস কেন?’

‘বাঃ একেই বলে গ্র্যান্ডি ফ্লোরা। দিবারাত্র শুনছি ঘরের খেয়ে নাকি বনের মোষ তাড়াই। যেই একটু চ্যারিটি বিগিনস অ্যাট হোম করতে গেলুম অমনি মাথা ঘামাচ্ছিস কেন? পরিষ্কার সিঁড়ি দিয়ে পরিষ্কার বারান্দায় উঠতে কেমন লাগছে বলো? দুরকমের গোলাপ এনেছি। ক্রমশ গোলাপবাগান করে ফেলব উঠোনটা। কেমন লাগছে?’

‘ভালোই করেছিস। এ বাড়ির ছেলেগুলো তো সব স্বার্থপরের চূড়ান্ত। যে যার নিজের টুকুর বাইরে আর কিছুই দেখতে পায় না। মক্কেলগুলো আসে, সদর দিয়ে ঢুকেই ধাপার মাঠ। অ্যাদ্দিন কী লজ্জাই করত! এই তো গত পরশু দ্বিজেন সমাদ্দার, একজন ধনী মক্কেল জিজ্ঞেস করছিল পড়ো উঠোনটা কী করে এমন হল!’

‘ম্যাগনিফিকো প্রোফান্ডিস! ছোড়দাদু তুমি যদি অনুমতি দাও বাড়িটা আমি সারাবার ব্যবস্থা করি।’

‘তুই বাড়ি সারাবি? তুই?’

‘হ্যাঁ আমি। আমার ভান্ডার আছে ভরে তোমা সবাকার ঘরে ঘরে, জানো না! সহযোগিতা করতে হবে। সর্বপ্রথম লাগবে অনুমতি।’

‘তো যা, দিলুম অনুমতি।’

‘লিখিত দাও।’

‘লিখিত আবার কী রে? পালা পালা। বড্ড ডেঁপো হয়ে গিয়েছিস।’

‘অ, যেই আটঘাট বেঁধে কাজ করতে নামছি অমনি ডেঁপো হয়ে গেলুম। শাস্ত্রে পড়েছ শতং বদ, মা লিখ। সেইটে ফলো করছ ছোড়দাদু! কিন্তু তুমি এখন ভার্চুয়াল হেড অফ দা ফ্যামিলি, তুমি লিখিত অনুমতি না দিলে আমার স্ট্যাটাস কী? লোকে আমায় টাকা দেবে কেন! এই দেখো মেজদাদু লিখে দিয়েছে।’

মেজদাদু এবং ছোড়দাদুর অনুমতি-পত্র হাতে করে, বাড়ি সারানোর এস্টিমেট এক হাতে, কর্পোরেশনের নোটিস আরেক হাতে ভেঙ্কট অতঃপর সবার দ্বারস্থ হতে লাগল গলবস্ত্র হয়ে। কোথা থেকে একটা নতুন গামছা যোগাড় করেছে, সেইটাকে গলায় ঝুলিয়ে হাত জোর করে প্রত্যেককে বলে ‘আজ্ঞে আমার গৃহদায়, কিছু ছাড়ুন, পুরো হিসেব পেয়ে যাবেন।’

কেউ বিরক্ত হয়ে, কেউ চক্ষুলজ্জায়, কেউ বা ভালোই হবে, আমাকে ঝামেলা পোয়াতে হবে না এই মনে করে প্রাথমিকভাবে কিছু কিছু দিল। কিছুদিনের মধ্যেই ভেঙ্কটের তত্ত্বাবধানে, সম্ভবত পঞ্চাশ বছর পরে পালবাড়ি আগাপাশতলা সারাই আরম্ভ হল।


‘এখন সব প্রতিষ্ঠানই রাজনৈতিক সংগঠন’… ‘ধর্ম কি একটা চাই-ই?’

ঠিক দু’দিনের আড়াআড়ি এস. এফ. আই এবং ছাত্র পরিষদ রাজেশ্বরীকে কলেজের ছাত্র-ইউনিয়নের নিবার্চনে তাদের সেকশনের প্রতিনিধি হয়ে দাঁড়াতে বলল। দু’দলকেই না করে দিল সে। কিন্তু ব্যাপারটা তাকে খুব অবাক করল। দু’দল দু’রকম পোস্টার সাঁটছে। মুখোমুখি হলেই দাঁতে-নখে। রাজেশ্বরী কাদের সমর্থন করে, আদৌ এ সব ব্যাপারে কোনও আগ্রহ আছে কি না, কোন কথাই কেউ জানতে চাইল না, জানবার চেষ্টাও করল না। এসে স্রেফ বলে দিল তুমি আমাদের হয়ে দাঁড়াও! তার মনে হল উজ্জয়িনীর সঙ্গে আলোচনা করবে এটা নিয়ে। এমনিতে উজ্জয়িনীকে সে খুব একটা পছন্দ করে না। উজ্জয়িনী ধনীর দুলালী। যথেচ্ছ আশকারা পেয়ে বড় হয়েছে এবং হচ্ছে। অহংকারী, খামখেয়ালী। বন্ধুদের ওপর ছড়ি ঘোরাবার অভ্যেস আছে। রাজেশ্বরী এগুলো ভালো করেই লক্ষ করেছে। ওর সঙ্গে একত্রে হায়ার সেকেন্ডারি পড়েছে সে। উজ্জয়িনী ছিল তাদের হাউজ-লিডার। অনেক কাজই অণুকা বা মিঠুকে দিয়ে করাত তখন। অণুকে তো ক্রীতদাসীর মতো ব্যবহার করত—‘এই অণু আমার ব্যাগটা ধর তো, কাঁধে ব্যথা করছে,’ কিংবা ‘অণু কাল আমি স্কুলে আসব না, তুইও আসবি না খবর্দার,’ কলেজে ঢোকবার পর রাজেশ্বরী লক্ষ করেছে অণু পাস ক্লাসের সব নোটস রাখে উজ্জয়িনীর জন্যে। খুব ভাগ্য সে দু’জনের আলাদা-আলাদা বিষয়ে অনার্স। না হলে অণুকে উজ্জয়িনীর সব লাইব্রেরি-ওয়ার্ক করে দিতে হত। স্কুল-জীবনে যে মিঠুকে দিয়ে কত চার্ট করিয়েছে। কত প্রাচীর-পত্রিকা লিখিয়েছে তার ঠিক নেই। পরীক্ষা, অসুখ কিছুই মানবে না। অণুকাকেও সে এই একই কারণে পছন্দ করে না, অমন ক্রীতদাস মনোবৃত্তি হবেই বা কেন। তার সন্দেহ অণু একেবারেই মধ্যবিত্ত বলে এইরকম একটা হীনম্মন্যতা তার মধ্যে আছে। টাকার পরিমাপ, তা-ও আবার বাবা-মার টাকার পরিমাপে মানুষের মনুষ্যত্বের গুণমান বিচার হবে? ব্যাপারটা রাজেশ্বরীর খুব অশ্লীল লাগে। মিঠুর ধরনটা একটু অন্যরকম। সে উজ্জয়িনীকে সত্যি-সত্যি ভালোবাসে। মিঠুর বাড়ি খুব প্রগতিশীল। কিন্তু মিঠু মেয়েটা খুব নরম প্রকৃতির। মিঠুর প্রগতিশীল দিকটা সে পছন্দ করে, অত্যধিক নরম দিকটা ততটা নয়। সে জন্যেই উজ্জয়িনীকে এই আলোচনার জন্যে বাছল সে। হাজার হলেও অতদিন ক্লাস-ক্যাপটেন হাউস-লিডার হবার অভিজ্ঞতারও একটা দাম আছে তো! উজ্জয়িনীর বাঁ পাশে নিজের ব্যাগটা রাখল সে। বেঞ্চের ওপর মাথা নামিয়ে ফিসফিস করে কথাগুলো তাকে বলল রাজেশ্বরী। গোপনতা রক্ষা করতে বলল। দ্বিগুণ বিস্মিত হয়ে উজ্জয়িনী বলল, ‘তোকেও বলেছে এস. এফ? আমাকেও তো ভীষণ প্রেশার দিচ্ছে?’ রেগেমেগে ক্লাসে বসেই দু’জনে ঠিক করল ইউনিয়ন রুমে যাবে, এর ফয়সালা হওয়া দরকার।

তিনটের আগে ইউনিয়ন রুমে যাবার সুযোগ পেল না ওরা। উজ্জয়িনীর ক্লাস শেষ হয়ে গেছে। সে রাজেশ্বরীর জন্যে বসে আছে। মিঠু অণু দু’জনকেই সে কাটিয়ে দিয়েছে আজকে। ব্যাপারটার গোপনতা এখনও রক্ষা করছে ওরা। রাজেশ্বরী ক্লাস করে ছুটতে ছুটতে এলো।

ইউনিয়ন রুমে বেশ কয়েকজন ছেলে বসে বসে ফাইল গুছোচ্ছিল। ওরা গিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘সুকান্তদা নেই?’

‘বসো, এসে যাবে।’ কিছুক্ষণ বসে থাকবার পর একজন বলল ‘সুকান্তকে খুঁজছ কেন?’

‘দরকার আছে।’

‘আমি তোমাদের সুকান্তদার আগে পর পর তিন বছর জি. এস. ছিলুম। আমাকে বলা যায় না? আচ্ছা, তোমাদের মধ্যে কে যেন ফার্স্ট ইয়ার ‘এ’ থেকে দাঁড়াচ্ছ না?’ রাজেশ্বরী আর উজ্জয়িনী মুখ চাওয়া-চাওয়ি করল। উজ্জয়িনী যুদ্ধং দেহি গলায় বলল, ‘সেটাই জানতে চাইছি। কে? কাকে আপনারা দাঁড়াতে বলছেন? নিজেরাই বোধ হয় মনস্থির করতে পারেননি এখনও, না? আমাকেও বলছেন, ওকেও বলছেন!’

এই সময়ে সুকান্তদা এসে গেল। রাজেশ্বরীকে দেখে বলল, ‘কী? মত বদলেছ, ভেরি গুড।’

তখন পূর্ববর্তী জি এস বলল, ‘উঁহু, এদের তোর নামে গুরুতর অভিযোগ আছে। তুই নাকি একই সময়ে দু’জনের কাছেই প্রোপোজাল রেখেছিস?’

‘তো কী হয়েছে? বিয়ের প্রোপোজাল তো আর নয়!’ সুকান্ত হাসতে হাসতে বলল, ‘আরে ভাই এসো, চা খাও। তোমরা দু’জনে খুব বন্ধু না? হবেই। দু’জনেই বর্ন-লিডার। কে দাঁড়াবে। তোমরা নিজেরাই ঠিক করো না!’

‘কেন? আর কাউকে বলেননি?’ রাজেশ্বরীর গলায় উষ্মা। ‘আমি তো না-ই বলে দিয়েছি।’

‘না না। তোমরাই ক্লাসে সবচেয়ে পপুলার। ইনফ্লুয়েনশ্যাল। ব্যক্তিত্ব আছে। কাজও করতে পারবে। কে রাজি হবে তা তো জানি না, তাই দু’জনের কাছেই…অন্যায় হয়েছে তাতে? মাফ চাইছি।’ সুকান্তদা হাত জোড় করল।

উজ্জয়িনী এক ঝটকায় উঠে দাঁড়াল, ‘আমি দাঁড়াচ্ছি না। আমাকে বাদ দিতে পারেন।’

রাজেশ্বরী বলল, ‘আমিও ইনটারেস্টেড নই।’

‘দয়া করো ভাই, দয়া করো’ সুকান্ত করুণ গলা করে বলল, ‘এক্কেবারে ডুবে যাব। রাজি হয়ে যাও রাজেশ্বরী। তোমাকে কিছু করতে হবে না, আমরাই সব করব।’

এমনভাবে প্রথমে তিন চারজন, পরে পাঁচ ছ’জন রাজেশ্বরীকে ঘিরে দাঁড়াল যে রাজেশ্বরী চট করে উজ্জয়িনীর মতো বেরিয়ে যেতে পারল না। তারপর সবাই মিলে চলল অনুনয়-বিনয়, ‘ভেবে দেখো, দায়িত্ব নেবার ক্ষমতা সবার থাকে না, যাদের থাকে তারাও যদি এভাবে মুখ ফিরিয়ে নেয়! তোমাদের ক্লাসে আমরা একটা মোটামুটি সার্ভে করেছি, বেশির ভাগই তোমাকেই প্রতিনিধি হিসেবে চায়।’

‘আপনাদের রাজনৈতিক মতাদর্শে আমি বিশ্বাস করি কি না-করি সেটাও তো আপনারা জানেন না। জানেন?’

‘আরে তোমাকে দেখলেই বোঝা যায় তুমি প্রগতিশীল, এর চেয়ে বেশি আমাদের জানবার দরকার করে না। একটা তো বছর…থাকলই বা অনার্স…এমন কিছু সময় তোমার থেকে আমরা দাবি করব না।’

শেষপর্যন্ত গলদ্‌ঘর্ম হয়ে যখন সে বেরোতে পারল তখন সুকান্তরা তার মত আদায় করে নিয়েছে।

কিন্তু কিছুদিন পর যখন ভোটের মনোনয়নপত্র দাখিল করা হয়ে গেল, এবং ক্লাসে রাজেশ্বরী আচার্যর নামে পোস্টার পড়তে লাগল, একদিন সবিস্ময়ে সবাই দেখল ছাত্র পরিষদের প্রার্থী হিসেবে তার পাশেই উজ্জয়িনী মিত্রর নাম পড়েছে।

মিঠু বলল, ‘আমরা কেউ জানতাম না বিশ্বাস কর। উজ্জয়িনীকে বলব উইথড্র করে নিতে। আমাদের কাউকেই ঘুণাক্ষরেও বলেনি। কোনও মানে হয়? তা ছাড়া দেখ, কালেজ ইউনিয়নে ভোট হবে তার আবার এস. এফ. আই, সি, পি. কি রে? যাচ্ছেতাই ব্যাপার সব!’

গৌতম কাছেই ছিল, বলল, ‘এ মেয়েটা কী রে! এস. এফ. আই. আর আর সি. পি. দুটো রাজনৈতিক দলের ছাত্রশাখা। দুটো দলই সব কলেজগুলোকে কব্জা করতে চাইছে। ভোটের বয়স আঠারো হওয়ায় গুরুত্বও ভীষণ বেড়ে গেছে ছাত্রদের রাজনৈতিক দিক থেকে। এটা বুঝতে অসুবিধে কোথায়?’

মিঠু বলল, ‘তোদের মগজ ওইভাবেই ধোলাই হয়েছে তাই বুঝতে পারিস না।’

‘ছাত্ৰশাখা তো কী! কলেজটা কি রাজনৈতিক সংগঠন? কলেজের গেটের বাইরে যা করবার করুক। ইচ্ছে হলে বাইরে থেকেও গাইড করতে পারে, কিন্তু ভেতরে এভাবে সর্দারি করাটা, খোলাখুলি রাজনৈতিক দলের নামে নির্বাচন হওয়াটা ভালগার। ভালো করে বুঝে দেখ।’

গৌতম বলল, ‘এভাবে কেউ এখন ভাবে না মিঠু। এখন সব প্রতিষ্ঠানই রাজনৈতিক সংগঠন। সারা দেশে কোনও মানুষই শুধু নিজের ব্যক্তি-পরিচয়ে চলাফেরা করছে না। কোনও না কোনও পার্টির কালারে তার পরিচয়। কে কংগ্রেস, তার মধ্যে আবার ভজকট, কে জনতা, কে বি. জে. পি, কে লেফট, কে রাইট।’

‘তাহলে বল আমরা ক্রমশ অরওয়েলের “নাইনটিন এইট্টি ফোর”-এর দিকে চলেছি। যদিও সারা পৃথিবীতে পার্টি ডিকটেটরশিপ অচল হয়ে যাচ্ছে ক্রমে ক্রমে। গর্বাচেভ হ্যাজ আশার্ড ইন আ নিউ এরা। পূর্ব ইউরোপের দেশগুলো এক এক করে শেকল খুলে ফেলছে। আমরাই কী তবে খালি একটা পুরনো টেক্সট বই, পুরনো মডেল আঁকড়ে থাকব?’

‘উত্তরে গৌতম বলল, ‘কোথাও পার্টি ডিকটেটরশিপ অচল হয়ে যাচ্ছে না কমরেড। কোনও না কোনও ফর্মে, মানুষ ঠিকই গোষ্ঠীভুক্ত, দলভুক্ত হয়ে যাচ্ছে। এতদিন তার পেছনে একটা যাই হোক আদর্শবাদ ছিল, এখন প্রত্যেক দল, প্রত্যেক গোষ্ঠী খোলাখুলি নিজের নিজের কায়েমী স্বার্থ রক্ষার তাগিদে কাজ করবে। আমাদের মতো ইল্‌লিটারেট থার্ড ওয়ার্ল্ড কানট্রিতে ডেমোক্র্যাসি চলে? চলে না।’

মিঠু আর গৌতমের প্রচণ্ড তর্কবিতর্ক লেগে গেল। গৌতম যত বেশি কাগজ পড়ে, রাজনৈতিক খবরাখবর রাখে, মিঠু ততটা রাখে না। ওদিকে মিঠু আবার কিছুটা তত্ত্ব এবং সাহিত্য পড়েছে গৌতমের ততটা পড়া নেই। মিঠু বলে পার্টি-ইজম বাদ দিয়ে কি ডেমোক্র্যাসি হয় না? মানব সেবা বাদী বিশ্বসংঘের কথাও বলে সে। গৌতম বলে ওসব স্বপ্নের প্রাসাদ। রিয়্যালিটি হল, হয় মাল্টিপার্টি ডেমোক্র্যাসি, নয়তো পার্টি ডিকটেটরশিপ। গৌতমের গলা খুব চড়েছিল, মিঠুর অত গলার জোর নেই, তার প্রায় নাকের জলে, চোখের জলে অবস্থা। ইমন কোথায় ছিল, দুজনের মাঝখানে এসে দাঁড়াল।

‘মিঠু, আজ আমার হোস্টেলে যাবে বলেছিল না?’

গৌতম বলল, ‘তাই যা বাবা, তাই যা। ওফ্ এমনি এঁড়ে তক্ক করতে পারে না এই মেয়েগুলো, জানবে না শুনবে না, কেঁদে জিতবে।’

মিঠু বলল, ‘ভালো হবে না গৌতম, কথায় কথায় মেয়ে-মেয়ে করে খোঁচা দিবি না। ভবিষ্যতের পৃথিবীতে মেয়েরাই নেতা হবে তা জানিস? বেশি কথা কী, ক্লাস-রিপ্রেজেনটেটিভ দাঁড় করানোর জন্যে পর্যন্ত তো ওই মেয়েদের কাছেই ছুটেছিস তোরা… তার বেলা?’

‘সেটা তো স্রেফ স্ট্র্যাটেজি… তোরা মেজরিটি তাই। যেমন বড়বাজারে মাড়োয়ারি দাঁড় করানো হয়, রাজাবাজারে মুসলমান… তেমনি।’ এই সময়ে অনু চুপিচুপি গৌতমকে কী একটা ইশারা করল, কিছু বললও।

গৌতম বলল, ‘তো কী! আমি তো খারাপ কিছু বলি নি! এই মিঠু, রাজাবাজারে… মুসলমান বলে আমি তোকে কিছু আঘাত দিয়েছি? আমি অবশ্য জানতুম না তুই… কিন্তু না-ই বা জানলুম… কী এসে যায় এখনকার দিনে আর এইসব ধর্মে-টর্মে!’

মিঠু ভীষণ রেগে গিয়েছিল। তার মুখে কথা জোগাচ্ছিল না। ইমন তাকে জোর করে টেনে বার করে নিয়ে এলো। বাইরে এসে মিঠু সত্যি-সত্যি কেঁদে ফেলল। ইমন বলল, ‘চলো চলো অনেক ডিবেট হয়েছে, এবার মুখটা ধুয়ে নেবে চলো। তাহলেই রাগও ধুয়ে যাবে।’

বেলা শেষ হয়ে এসেছে। উজ্জয়িনীকে কোত্থাও দেখতে পেল না মিঠু। বলল, ‘ইমন, আজ তোর হোস্টেলে গেলে বড্ড দেরি হয়ে যাবে যে! বরং তুই আমাদের বাড়ি চ। মা বাবাকে কত বলেছি তোর কথা, খুব খুশি হবে সবাই।’

ইমন বলল, ‘হোস্টেলে তো এরকম নিয়ম নেই।’

‘চল না। মেট্রনকে বলি গিয়ে। যদি পার্মিশন দেন!’

ইমনের ভীষণ লোভ হচ্ছে। কতদিন যেন সে পারিবারিক স্নেহ আদর পায়নি। উপবাসী সে। এই অদ্ভুত গোলমেলে শহরটার মধ্যে এখন তার অনেক পরিচিতি। কিন্তু সবই খেলার সূত্রে। কলেজেও যারা যেচে এসে আলাপ করে ওই জন্যেই করে। ইমন জানে চ্যাম্পিয়নশিপ তাকে একটা গ্ল্যামার দিয়েছে, সে সেটা উপভোগ করে। নিজের এই প্রতিমা সে ভাঙতে চায় না। কিন্তু প্রতিমার আড়ালে সে বন্ধু খোঁজে। সত্যিকারের বন্ধু। মিঠু কি বন্ধু হবে?

এত কৃত্রিম এই শহরের মেয়েরা! এত কাঁচা বে-আব্রু এই শহরের ছেলেরা! কার সঙ্গে মিশবে সে! এরা মিশ্র ভাষায় কথা বলে। আগে ছিল ইংরিজিয়ানা। এখন আচার-আচরণে হিন্দিয়ানা ঢুকেছে খুব। নাকে-নাকে নাকছাবি। হাতে হাতে মেহেদির কারুকার্য, পায়ে পায়েল। সব মিলিয়ে কেমন যেন! সে সহজ হতে পারে না। কাউকে সেটা বুঝতেও দেয় না। এমন নয় যে সে হিন্দিভাষীদের অপছন্দ করে। কিন্তু বাঙালি মেয়ে যখন হিন্দিভাষীদের অনুকরণ করে তার মনে হয় এরা ঠিক করছে না। সে দূরে দূরে থাকে। দূরত্ব রেখে চলাটা তার খ্যাতির সঙ্গে মানিয়ে যায়। কিন্তু সে যে তার অনাথা মাকে ছেড়ে, পিতৃহীন ছোট ভাইটিকে ছেড়ে ভাগ্যান্বেষণে এসেছে! তার বুকের মধ্যে অনেকগুলো খালি জায়গা খাঁ খাঁ করে। মিঠু কি তার একটাও ভরতে পারবে? মিঠুদের বাড়ি… সে কী রকম? —চক্ষু ছানাবড়া হয়ে যাবার মতো নাকি? মিঠুর মা কি খুব আধুনিকা? লিপস্টিক মাখা, চুল-ছাঁটা মা? মিঠুর বাবা? অ্যাসোসিয়েশনের ওইসব ভদ্রলোকদের মতো? যাঁদের বাবার বয়সী হওয়া সত্ত্বেও দাদাই বলতে হয়; বাবার মতো কিছুতেই নন যাঁরা।

মিঠু বলল, ‘কী ভাবছিস এত!’

ইমন হাসল। সে যে ভাবছিল তা অস্বীকার করল না। আবার সরাসরি স্বীকারও করল না।

পেভমেন্টের ওপর দিয়ে হোস্টেলে যাবার পথটা এই পড়ন্ত বেলায় কী সুন্দর, শান্ত, বড্ড যেন মন-কেমন-করা। এই পথটাই যেন এঁকে বেঁকে চলে গেছে সারা জীবন বেয়ে। এটাই পৌঁছেছে তাদের বাড়ি। এটাই চলে গেছে সেই অদূর অতীতের দিনগুলোতে যখন বাবাতে ইমনেতে দালানের মাঝখানে নারকোল দড়ি টাঙিয়ে পিংপং খেলা জমে উঠত। মা গেলাস ভর্তি চা নিয়ে এসে দাঁড়াত আঁচলে জড়িয়ে, ভাই বল ধরবার জন্য হাত বাড়াত। সাড়ে তিনজন মানুষ বসে হুশহাশ শব্দ করতে করতে গরম খিচুড়ি খাওয়া হত শীতের দুপুরে।

হোস্টেলের গেট দিয়ে ঢুকতে ঢুকতে মিঠু বলল, ‘তুই কি করে একা একা থাকিস রে ইমন! ভয় করে না?’

‘ভয়?’ ইমন হাসল। মনে মনে বলল—ভয় করলে তার চলবে না। আরও অনেক অনুভূতির মতো ভয়টাও তার পক্ষে বিলাসিতা। ‘আমার ঘরে তো আরও একজন থাকে, অজন্তা।’ সে মিঠুকে আশ্বস্ত করতে চাইল।

‘ওরে বাবা, মা বাবাকে, বিশেষ করে মাকে ছেড়ে থাকবার কথা তো আমি ভাবতেই পারি না।’

‘যাকে থাকতেই হয়, তাকে থাকতে হয়’, উদাস গলায় বলল ইমন। চট করে ওর মুখের দিকে তাকাল মিঠু। নাঃ, ইমনের মুখে এখনও শান্ত সুদূর হাসি। ইমন কি আর আমাদের মতো’? ও অন্য ধাতু দিয়ে গড়া। কত সাহসী, আত্মবিশ্বাসী। সেন্টিমেন্টাল নয় একদম। ইমন কাঁদে না, মন খারাপ করে না। একমনে নিজের কাজ করে যায়। ওর সংকল্পের জোরই আলাদা। কী স্মার্ট ইমন, কোনও পরিস্থিতিতেই বোকা বনবার নয়। উজ্জয়িনী অত ব্রাইট, রাজেশ্বরীর অত ব্যক্তিত্ব, কিন্তু ওদের চেয়েও স্মার্ট ইমন। কত ভাগ্য যে ইমনের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়েছে। কে জানে ইমন শেষ পর্যন্ত বন্ধু থাকবে কি না!

হালকা হলুদ বর্ডার দেওয়া সবুজাভ বাড়িটা। দুয়ারের কাছাকাছি পেভমেন্টের ওপর একটা কাঠবাদামের গাছ। বারান্দায় একজন মহিলা দাঁড়িয়ে আছেন। মিঠু ওপর দিকে মুখ তুলে হাসল। একটু পরেই দরজা খুলে গেল। ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে পাথরের ফলকে পড়ল ইমন—‘সাদেক চৌধুরী, অনুরাধা চৌধুরী’। সিঁড়ি দিয়ে সোজা ওপরে উঠে গোল দালান। পেছন দিকে জাফরি কাটা। মিঠুর মা দাঁড়িয়ে আছেন। হালকা হলুদ রঙের শাড়িতে কালো বুটি, কালো পাড়। মাথার চুলে একটা আলগা খোঁপা বাঁধা। দু চার গাছা সাদা চুল। চোখে চশমা। ‘ইমন, না’?

‘হ্যাঁ মা, নিয়ে এলাম। ভালো করিনি?’

‘বেশ করেছিস। দেখেছ ইমন তোমার কথা শুনে শুনে তুমি কি রকম আমাদের মুখস্থ হয়ে গেছে?’

ইমন নিচু হয়ে হঠাৎ প্রণাম করল। মিঠুর মা অবাক হয়ে বললেন ‘ওমা, তুমি প্রণাম করতে জানো? আমার ছেলেমেয়ে তো কক্ষনো আমাকে প্রণাম করে না।’

মিঠু বলল, ‘আহা, জন্মদিনে করি না?’

ইমন হাসল। মিঠুর মা মুগ্ধ হয়ে তার দিকে চেয়ে বললেন, ‘এসো, ঘরে এসো।’

মিঠু বলল, ‘মা, আজ কিন্তু ইমন আমাদের বাড়ি থাকবে।’

‘নিশ্চয়ই, এখন এত সন্ধেয় আবার সেই নর্থে ফিরতে পারে না কী? হোস্টেলে বলে এসেছ তো?’

মিঠু বলল, ‘ইমনের যা প্রেসটিজ! একবার বলতেই মেট্রন হ্যাঁ করে দিলেন। সুপারকেও উনিই বলে দেবেন। মা, আজকে কিন্তু ইমনকে বিরিয়ানি খাওয়াতে হবে!’

‘দেখি পারি কি না!’ মিঠুর মা হাসিমুখে বললেন, ‘এখন তো তোরা হাত মুখ ধো!’ ইমন যত বলে আমি এইভাবেই থাকব। মিঠু ততই জোর করে।

‘না তোকে আমার জিনিস পরতে হবে। চান করে আবার কেউ ছাড়া জামা কাপড় পরতে পারে না কি? ঘেন্না করবে না? এত যদি সঙ্কোচ করিস তবে আর বন্ধু কী?’ অগত্যা ভালো করে চান করে, ইমন মিঠুর ফুলছাপ লম্বা স্কার্ট আর লাল টপ পরে বাইরে আসে, আর মিঠু তাকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেতে থাকে। ‘ইস্‌স্ ইমন। আমার ড্রেস তোকে কি সুন্দর ফিট করেছে। ফ্রি সাইজ হলে কী হয়, সবাইকে কিন্তু ফিট করে না। কী সুন্দর মেয়ে মেয়ে দেখাচ্ছে তোকে! বাচ্চা মেয়ের মতো!’

হাতে কফির মগ নিয়ে বারান্দার জাফরিতে পা রেখে মিঠু বলল, ‘দেখ ইমন, উজ্জয়িনীকে আমাদের বলতে হবে নাম উইথড্র করে নিতে। আমরা সবাই এক স্কুলে পড়েছি। একজন তো হারবেই। কী বাজে হবে বল তো সেটা! তা ছাড়া আমরা! আমাদের তো দুজনেই বন্ধু। আমরা কাকে দেব? তুই কিছু বলছিস না যে?’

ইমন মন দিয়ে রাস্তা দেখছে। সে বলল, ‘আমি এ সব ঠিক বুঝি না মিঠু। তবে মনে হয় যে কোনও প্রতিযোগিতাই খেলার মেজাজে নেওয়া উচিত।’

‘তুই বুঝছিস না এটা ঠিক খেলার মতো নয়। আমরা একজনকে আমাদের প্রতিনিধি বলে বেছে নেব। দুজনেই আমাদের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। দুজনেরই যথেষ্ট যোগ্যতা আছে। উজ্জয়িনী বরাবর আমাদের হাউজ-ক্যাপটেন ছিল স্কুলে। আর রাজেশ্বরী ভীষণ ভালো ডিবেট করতে পারে, বক্তৃতা করতে পারে, মেয়েও খুব ভালো। অনেস্ট। জাস্ট। আমাদের ডিলেমাটা বুঝতে পারছিস না?’

‘আমি তো তোমাদের স্কুলের নই! যে বেশি যোগ্য তারই নির্বাচিত হওয়া উচিত। তবে তোমার কথা শুনে বুঝতে পারছি এর মধ্যে একটা বন্ধুত্বের সঙ্কটের ব্যাপার আছে।’

‘সবচেয়ে ভালো কী হত জানিস তো! যদি দুজনে উইথড্র করে নিত নাম আর সবাই মিলে তোকে পাঠাত।’

‘না না, আমার অনেক কাজ মিঠু। এই কথাটা কারুর মাথায় ঢুকিও না প্লিজ।’

‘জানি। সেইজন্যেই বলছি না। কিন্তু এ সঙ্কট থেকে কী করে উদ্ধার পাই বল তো?’

‘সব সঙ্কট থেকে উদ্ধার পাওয়া বোধ হয় যায় না মিঠু। ছোট ছোট সঙ্কটগুলো দেখতে হয় নিস্পৃহভাবে। প্রার্থনা করা যাক বড় বড় সঙ্কটগুলো থেকে যেন আমরা উদ্ধার পাই।’

মিঠু অবাক হয়ে বলল, ‘তুই এসবই ভাবিস, না রে? তুই আসলে জীবনটাকে অন্যভাবে দেখিস। আমাদের সঙ্গে তোর দেখাটা মেলে না।’

ইমন বলতে গেল, ‘জীবন যে এক এক পাত্রে একেক রকম মিঠু।’ কিন্তু বলল না। নিজেকে শেষ মূহুর্তে সামলে নিল। সে তার ব্যক্তিগত ব্যাপারগুলো খুব সাবধানে আড়াল করে রাখে। নইলে তার পরিবারের কথা এসে পড়বে। তার দৃষ্টিতে তার মা বাবা ভাই যা, অন্যের দৃষ্টিতে তো তা নয়!

কিন্তু মিঠু একটু পরে বলল, ‘ভাবিসনি আমার কোনও সঙ্কট নেই। জানিস তো আমার বাবা মুসলিম, মা হিন্দু। আমি কী রে? আমার ধর্ম কী? পরীক্ষা-টরীক্ষার ফর্মে লিখতে হয়—ইসলাম। কেননা বাবার পরিচয়েই ছেলেমেয়েদের পরিচয় হবার প্রথা। কিন্তু আমার বাবা কোনও ধর্ম মানে না। একদম শতকরা একশ ভাগ সেকুলার। আর আমার মা সব ধর্ম মানে। আমি মাঝে মাঝে ভাবি এই যে অযোধ্যা নিয়ে এত কাণ্ড হচ্ছে, যদি হিন্দু-মুসলমানে দাঙ্গা বাধে তো কে আমাকে মারবে? আমি কার শত্রু!’

ইমন বলল, ‘কেউ তোমাকে মারবে না মিঠু।’

‘কিন্তু আমি কোথায় বিলঙ করি আমায় তো জানতে হবে! বাবা-মার রেজিস্ট্রি ম্যারেজ। মা ধর্ম পাল্টায়নি। আমার বড় দাদা মারা যাবার পর মা ভীষণ ভিতু হয়ে গেছে। এমন কি কালীমন্দিরে মানত করে। জন্মদিনে আমাদের মাথায় পুজোর ফুল ঠেকায়। আমি বাবাকে বলি—বাবা তুমি কী ঠেকাবে ঠেকাও। বাবা বলে “আমার কিচ্ছু নেই। খালি কোনক্রমে আমার আমিত্বটুকু এখনও বজায় আছে।” এইসব আমার সঙ্কট ইমন। এই সঙ্কটে আমায় পড়তে হত না, যদি ফর্মে রিলিজন ব্যাপারটা না থাকত। মুসলিম মেয়েদের ডিভোর্সের আইন চালু হল না বলে বাবা রাত্রে খেল না। সকালে উঠে আমার মাথায় হাত রেখে বলল—ভাগ্যিস আমার মেয়েটা মুসলিম নয়, আমি তখন পুঁচকে, বললাম—তাহলে আমি কি? হিন্দু? তাতেও বাবা বলল—ভাগ্যিস আমার মেয়েটা হিন্দু নয়! আচ্ছা তুই-ই বল, ‘বাবা না হয় একটা নতুন ধরনের হেঁয়ালি উদ্ভাবন করে মজা পেল। হয়ত বাবা অনেক কিছু পেছনে ফেলে এসেছে। কিন্তু আমার পক্ষেও এ হেঁয়ালি হজম করা সম্ভব? আমি কী? আমি কী?’

ইমন মন দিয়ে শুনছিল, বলল, ‘তোমাকে কিছু হতেই হবে, তার কী মানে আছে? ধর্ম একটা চাই-ই?

‘বাঃ, সবার আছে, আমার না থাকলে, আমার কেমন খালি খালি লাগবে না?’

ইমন হেসে ফেলল। বলল, ‘এক হিসেবে তুমি কিন্তু খুব ভাগ্যবান মিঠু। তোমার কোনও সংস্কার নেই, অন্তত থাকার কথা নয়।’

মিঠু বলল, ‘সত্যিই নেই। কিন্তু খুব সংকটের সময় আমাকেও তো কারো কাছে প্রার্থনা জানাতে হয়! ইমন আমি মনে মনে গড বলি, গডের কাছে যা বলবার বলি। তাহলে দেখ একটা না একটা খুঁটি তো আমার ধরতেই হল! জানিস, আইরিশ কবি ইয়েটস ধর্মের অভাব পূর্ণ করতে চেয়েছিলেন দেশের উপকথা পুরাণ দিয়ে, শেষ পর্যন্ত অকাল্টিজম-এ চলে গেলেন।’

‘তুমি দূর্গা পুজো, সরস্বতী পুজো এসব সময়ে কী করো?’

‘নতুন জামা-কাপড় পরে ঠাকুর দেখতে যাই। আমার বাবা তো মূর্তি গড়েন। অর্ডার পান প্রত্যেকবার নিউ ইয়র্ক থেকে।’

‘ঈদের সময়ে?’

‘ঈদের সময়েও নতুন জামাকাপড় পেতাম। কিন্তু কেউ তো বাড়িতে রোজাও করে না। ঈদের চাঁদ দেখার জন্যে ব্যস্তও হয় না। অঞ্জলি দেওয়া, নামাজ করা কিচ্ছু নেই। নতুন জামাকাপড় পরে একটা মজা হত। এখন আর হয় না। আমার বাবার বন্ধুরা কেউ ঈদ মুবারক বললে আমার ভালো লাগে। আমিও বলি ঈদ মুবারক।

‘মাসী কী করেন?’

‘মা-ও প্রকাশ্যে কিচ্ছু করে না। পুজো-টুজো, অঞ্জলি দেওয়া, উপোস, বার-ব্রত।’

ইমন বলল, ‘এসব আজকাল কেউই করে না মিঠু, উচ্চশিক্ষিত মানুষদের মধ্যে এসব উঠে গেছে।’ মনে-মনে সে বলল, ‘আমার মা অবশ্য করে, আমি বারণ করি শোনে না।’

মিঠু বলল, ‘কিন্তু মা ওই সব মানত-টানত করে, পুজো পাঠায়। কেমন একটা জগা-খিচুড়ি।’

ওদের দুই বন্ধুকে আগে খেতে ডাকলেন মিঠুর মা। আজকে ইমনের সম্মানে তিনি চমৎকার একটা বিদেশি ডিনার সেট বার করেছেন। বললেন, ‘বিরিয়ানির সময় করতে পারিনি। চটজলদি একটা পোলাও করেছি মিঠু। সামান্য একটু মাংসের কুচি আছে, মাছও দিয়েছি। দ্যাখ ইমনের ভালো লাগে কি না।’ তিনি পাশে দাঁড়িয়ে ইমনকে চাটনি, রায়তা, মাংস, মাছ, ভাজা তুলে তুলে দিতে লাগলেন।

অতি সুন্দর সুগন্ধ পোলাও ইমন মুখের মধ্যে খুব সাবধানে রাখল, মনে মনে বলল, ‘বাবুয়া খা, বাবুয়া দিদি দিচ্ছে খা।’ মাছের চপ ভেঙে মুখে দিতে দিতে মাকে স্মরণ করল যেমন লোকে ঠাকুরকে স্মরণ করে ‘খাও মা খাও, আমার মুখ, আমার জিভ, আমার দাঁত দিয়ে খাও মা, যত দিন না নিজের হাতে দিতে পারছি।’

যখন সে কোথাও খেলতে গিয়ে খায়, এত খিদে থাকে, এত অপরিচিত মানুষ থাকে চারদিকে, আর আবহাওয়াটাও এমন পেশাদারি থাকে যে এসব কথা তার মনে আসে না। কিন্তু এখন সুন্দর আলোর নিচে, চমৎকার টেবিল-ঢাকার ওপর, ফুলকাটা কাচের বাসনে ঘরোয়া পরিবেশে সুখাদ্য খাবার সময়ে বাবুয়া আর মার কথা মনে করে হঠাৎ তার চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে।

‘ইমন, ভাল হয়েছে রান্না?’ কাঁধের ওপর আলতো হাত রেখে জিজ্ঞেস করলেন অনুরাধা। ইমন বলল, ‘খুব ভালো।’ সে একটুও মাথা নাড়ল না। যেটুকু বাষ্প আছে চোখে, আগে শুকিয়ে যাক।

ওদের খাওয়া প্রায় শেষ হয়ে এসেছে এমন সময়ে মিঠুর বাবা আর দাদা এসে বসলেন ইমনের অনুমতি নিয়ে। ইমন চোখ তুলে তাকিয়ে দেখল নীল ট্রাউজার্স আর কোরা রঙের বুশ শার্ট পরা বেশ হৃষ্টপুষ্ট একজন ভদ্রলোক। মুখ পরিষ্কার কামানো। চুল প্রায় অর্ধেক সাদা। ভারি স্নেহভরা দু চোখে চেয়ে বললেন, ‘এই ইমন! এ কি এত রোগা কেন তুমি ইমন। খাও, খুব ভালো করে খাও। আজকাল মেয়েরা বড্ড ফিগার-কনশাস হয়ে যাচ্ছে। মিঠুটা তো আলু, ভাত এসব খেতেই চায় না। তবে মিষ্টি আর আইসক্রিমে পুষিয়ে নেয়, তাই না রে মিঠু?’

মিঠুর দাদাকে ঠিক মিঠুর মতো দেখতে, সে বলল, ‘না বাবা, মোটা হলে ও খেলবে কী করে? এখন খেলা প্রচণ্ড ফাস্ট। বিদ্যুতের মতো ঘোরাফেরা করতে হয়। ইমন তুমি আমার বাবার মতে মোটেই চলো না।’

মাসি বললেন, ‘আচ্ছা, এখন তো ওকে খেতে দাও তোমরা। এই সময়ে আবার খাওয়ার তত্ত্ব আরম্ভ করলে।’

ইমন হাসি-হাসি চোখে একবার মেসোমশাই আর একবার দাদার দিকে তাকাতে থাকল, হঠাৎ যেন একটা বহু পরিচিত গন্ধ তাকে আচ্ছন্ন করে ফেলছে। একটা চেনা প্রিয় গন্ধ। সেটা তার পাশে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকা মিঠুর মায়ের শরীর থেকে আসছে। না উল্টো-দিকে-বসা সাদেক চৌধুরীর দিক থেকে বইছে সে ভালো বুঝতে পারল না। কিছুক্ষণ পর যখন মিঠু ঘরে গিয়ে নীল ডায়মন্ড চালিয়ে দিল, আর রেমব্রান্টের ছবির অ্যালবাম দেখতে দিল তাকে, তখন কানে সুর চোখে ছবি নিয়ে মনে মনে সে বলতে লাগল বাবা! বাবা!

কত ভাগ্য মিঠুর বাবা রয়েছেন। কিছু নয় শুধু থাকাটা জরুরি। মিঠু জানে বাবাদের চারপাশ থেকে একটা আভা বেরোয়। সেই আভা ছেলেমেয়েদের ছেয়ে থাকে। সে হঠাৎ বলল, ‘মিঠু, আমাদের ওদিকটায় অনেক মুসলিম আছেন। আমার বন্ধুদের মধ্যে অনেকেই মুসলিম। কিন্তু মেসোমশাইয়ের মতো এরকম পুরোপুরি ধর্মের ঊর্ধ্বে আমি কাউকে দেখিনি। এটা লাক। খুবই গুড লাক তোমার।’

মিঠু নরম গলায় জিজ্ঞেস করল, ‘আমার মা-বাবাকে তোর খুব ভালো লেগেছে, না?’

ইমন বলল, ‘হ্যাঁ, দাদাকেও।’

‘বারে, আর আমাকে?’ মিঠু আবদেরে ভঙ্গিতে ইমনের গলা জড়িয়ে ধরল। এরকম করে তার গলা জড়ায় একমাত্র বাবুয়া, তার ভাই।

ইমন হেসে বলল, ‘তুমি? বাঃ তুমি তো আগে!’

মিঠুর পাশে শুয়ে শুয়ে তার ঘুম এলো চমৎকার। যদিও একদম আলাদা জায়গা, আলাদা পরিবেশ। মিঠু সকাল বেলায় উঠে দেখল ইমন পাশে নেই, দালানে বসে সে জুতোর ফিতে বাঁধছে। খুব ভোর, বাইরে অল্প কুয়াশা জড়িয়ে রয়েছে শহরের বাড়িঘর গাছপালার গায়ে। মা এক গ্লাস গরম দুধ এনে রাখল।

মিঠুর শীত করছে, সে বেড-কভারটাই গায়ে জড়িয়ে ঘুম চোখে উঠে এসেছে, সে ঘুমে ধরা-ধরা গলায় বলল, ‘এ কী রে?’

‘এবার যাই। একটু ছুটতে হবে।’

সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বেল্টটা ঠিকঠাক করে নিল ইমন। মুখে মায়াময় হাসি লেগে আছে।

‘আবার আসবে ইমন। নিজের বাড়ি মনে করে আসবে, হ্যাঁ?’ মৃদুস্বরে বললেন অনুরাধা।

‘ইস ইমন তুই কী পাজি! এক্ষুনি চুপিচুপি পালিয়ে যাচ্ছিলি!’

‘পালাচ্ছি না। হোস্টেলে ঠিক সময়ে ফিরছি শুধু। আবার আসব।’

ইমন মিছে কথা বলে না। ইমন আশ্বাসের হাসি হাসছে। একটা জার্কিন গায়ে চড়িয়ে ইমন বেরিয়ে যাচ্ছে।


‘এতক্ষণ আমাতে অমিতেতে আড্ডা মারছিলাম..

বাবা-মার ঘরটাতে ঢুকল ঋতু। দুদিকে দুটো খাট। মাঝখানে পর পর দুটো আলমারি। বারান্দার দিকের দরজার পাশে ড্রেসিং টেব্‌ল। এখন একদম ফাঁকা। বাবাদের যাওয়া পেছোতে পেছোতে জানুয়ারি হয়ে গেল। মিসেস মীনাক্ষী দাশ রকমারি প্রসাধন-দ্রব্য তাঁর কসমেটিক্‌স্‌ বক্সে পুরে নিয়ে গেছেন। প্যারিসের রাস্তায় রূপসী যুবতী সেজে বেড়াবেন। ঋতু নিজেই গুছিয়ে দিয়েছে সুটকেসটা। গাঢ় অরেঞ্জ, বেগনি সব শাড়িগুলো জোর করে দিয়ে দিয়েছে সে। মা খুব আপত্তি করছিল।

ঋতু বলেছিল, ‘এই লাস্ট চান্স মাম্মি পরে নাও।’ অরেঞ্জ শাড়ির সঙ্গে ম্যাচিং পলার সেট, বেগনি কাঞ্জিভরমের সঙ্গে আলেকজান্ডার স্টোন, সব মিলিয়ে মিলিয়ে দিয়েছে। খালি লালটা মা কিছুতেই নিতে রাজি হল না। বয়স্ক মহিলারা যখন চড়া রঙের শাড়ি পরে, রঙচঙ মেখে, রাজ্যের গয়নাগাঁটি পরে ঘোরে তখন ঋতুর ভীষণ হাসি পায়। অনেকে আবার ব্লাশার মাখে। আই শ্যাডো ব্যবহার করে দিনের বেলাতেও। ঋতুর মা মোটামুটি ভালোই দেখতে, খুব কিছু মোটা হয়ে যায়নি, চুলও আছে বেশ, সামান্যই। পেকেছে, অনেকেই বলে সোমার দিদির মতো লাগে দেখতে। এটা নিয়ে মার একটা প্রচ্ছন্ন গর্ব আছে বুঝতে পারে ঋতু। ভাগ্যিস ঋতুকে কেউ মায়ের বোন বলে না। তাহলে তার সঙ্গে তার এক হাত হয়ে যেত। মায়ের সাজ দেখতে হয় বাবার সঙ্গে কোথাও বেরোলে। সোমার সঙ্গে বেরোলে খুব হালকা সাজবে। সাদার ওপর বুটির টাঙ্গাইল পরবে, গাদোয়াল পরবে, সোমা যদি বলে, ‘মা পরো না পিঙ্ক শাড়িটা,’ মা বলবে, ‘দূর, তোর মা না!’ ঋতুর সঙ্গে বেরোলে আর একটু চড়ে মায়ের সাজ। কিন্তু বাবার সঙ্গে বেরোলে সাজের কী ধূম! অত রঙ লাগালে, কড়া লিপস্টিক মাখলে আরও বুড়োটে দেখায় মা জানে না। ঋতু এখন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের চেহারাটা আপাদমস্তক দেখল। জিভ বার করে, ঘাড় ঘুরিয়ে, দাঁত বার করে হেসে, ভ্রূকুটি করে, নানা ভাবে। ঋতুর চেহারার সবচেয়ে বৈশিষ্ট্য যে তাকে ভীষণ বাচ্চা-বাচ্চা দেখতে। একরাশ বাদামি চুল। সোজা কানের পাশ দিয়ে পিঠের ওপর, বুকের ওপর নেমে এসেছে। মসৃণ গমের মতো রঙ। বড় বড় বিস্ফারিত চোখ। ঠোঁট দুটো ফোলা-ফোলা, যে কোনও মুহূর্তেই আবদারে ফুলতে পারে। সোমা খুব লেডি-লাইক। তার পাশে ঋতু যেন খুকি। আয়নাটাকে জিভ ভেংচে, ঋতু বিছানার ওপর ধপাস করে বসে পড়ল।

‘বাসন্তী, বাসন্তী, শিগগিরই এক গ্লাস ঠাণ্ডা জল খাওয়াও।’

বাসন্তী ঋতুর ছোট্ট থেকে আছে। এক রকম মানুষই করেছে তাকে। কিন্তু ঋতু তাকে বাসন্তীই বলে। সে বাবা-মা ছাড়া আর সকলকেই প্রায় নাম ধরে ডাকে। দিদিকে সোমা, দিদির বরকে অমিত, বাবাকেও মাঝে মাঝে আদর করে নাম ধরে। সে বলে, ‘নামটাই তো পরিচয়। তা ছাড়া বাসন্তী ইজ দাসী। হাজার মাসি-পিসি ডাকলেও সে দাসীই থাকবে, ওসব ডাক এক ধরনের ভণ্ডামি।

বাসন্তী জল এনে দাঁড়াল। এক হাতে জল খেতে খেতে অন্য হাত তুলে বাসন্তীকে দাঁড়াতে বলল ঋতু। তারপর গ্লাসটা ড্রেসিং টেব্‌লের ওপর রেখে খাটের কোনায় হাত দিল। বলল, ‘হাত লাগাও তো, খাটদুটোকে জুড়তে হবে।’ মাঝখানের কার্পেটটাকে সে আগেই গুটিয়ে রেখেছে।

বাসন্তী বলল, ‘কেন?’

‘যা বলছি করো। কেন আবার কী? সোমারা আসবে না? এখানে থাকবে না?’

চটপট খাট জোড়া হয়ে গেল। আলমারি থেকে তোয়ালে, নতুন সাবান বার করে বাথরুমে রেখে আসা হল। বসবার ঘর থেকে বাবার ছোট্ট লেখার টেবিলটা আর দুটো চেয়ার সে শোবার ঘরের অন্য কোণে আলোর ঠিক তলায় রেখে দিল। এয়ারপোর্ট থেকে ফেরবার পথে অনেক ফল কিনে এনেছিল, সেগুলো ভালো করে মুছে ফ্রিজের মাথায় রেখে দিল। একগুচ্ছ লাল গোলাপ রাখল শোবার ঘরে টেবিলটার ওপর। এরপর একটু দূর থেকে সবটা দেখে বেশ পরিতুষ্ট মুখে নিজের ঘরে ঢুকে, দু ঘরের যোগাযোগের দরজাটা বন্ধ করে দিল।

সোমারা না এলেই সে খুশি হত। কিন্তু জানা কথাই, বাবা-মা তাকে এতদিন বাসন্তীর ভরসায় একা রাখবে না। যাই হোক, সোমারা থাকলেও, সে-ই বাড়ির কর্ত্রী। এই সব চাবি, বাসন্তীকে ফরমাশ করে সংসার চালাবার অধিকার তার। সে হাতে করে চাবির থলোটা পরীক্ষা করে দেখতে লাগল।

বাসন্তী ঘরে ঢুকে বলল, ‘ওরা কখন আসবে?’

‘অমিত য়্যুনিভার্সিটি থেকে সোজা আসবে। ওর জন্যে ভালো কিছু টিফিন করো। সোমার বোধ হয় আরো দেরি হবে। এয়ার-পোর্ট থেকে সোজা জোকায় চলে গেল। সেখান থেকে বাড়ি ফিরবে, গোছগাছ করবে, তারপর আসবে। কী বানাচ্ছ রাত্রের জন্য?’

‘মাটন রান্না করা আছে। রুটি হবে।’

‘মাটন আবার কী? মাটনের প্রিপারেশনটা কী বলো?’

‘মাটন মানে মাটন, যেভাবে রাঁধি রেঁধেছি। অতশত জানি না।’

‘জানো না বললেই পারতে, আমি বই দেখে দেখে বলে দিতাম। আর কিচ্ছু করো নি!’

‘সোমা আসুক, জিজ্ঞেস করে নেবো।’

‘কেন? সোমা কেন? আমি কি নেই? এটা এখন আমার বাড়ি। আমি যা বলব তাই করতে হবে। যাও বেগুন-ভাজা করো গিয়ে। পুডিং বানাও। কাশ্মিরী আলুর দম বানাও।’

‘কী মুশকিল, বেগুন না হয় খাবার সময়ে ভেজে দেব। আলু সোমা খেতে চায় না। পুডিং না হয় করছি। যদিও দুধ বেশি নেই, কনডেন্সড্ মিল্ক ঢালতে হবে, আগে থেকেই বলে দিচ্ছি।’

‘হোক। আর সোমা তো একা খাবে না। অমিত কাশ্মিরী আলুর দম খেতে ভালবাসে। আমিও বাসি। স্যালাড কেটেছ?’

‘ক-খন। ফ্রিজে ঢোকানো আছে।’

অমিত কিন্তু আগে এলো না। ওরা দুজনে একসঙ্গে পেল্লাই একটা সুটকেস নিয়ে নামল, রাত নটা। বাসন্তী খুলে দিল। তার মুখে খুশির হাসি।

‘ঋতু কোথায়? ঋতু?’ সোমা ঢুকেই জিজ্ঞেস করল।

‘মাথা ধরেছে। শুয়ে আছে।’

‘মাথা ধরেছে? কেন?’ সোমার ভুরু কুঁচকে উঠেছে।

‘তোমাদের জন্যে বাড়ি কত গুছোলো… রান্না-টান্না…’ বাসন্তী ঢোঁক গিলল।

‘ঋতু রান্না করেছে?’

‘তা নয়। বলল আমাকে কী কী করতে হবে, ঠায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিল।’

অমিত সুটকেসটা লিভিংরুমের একধারে রেখে ডাকতে লাগল, ‘ঋতু, ঋতু উঠে পড়ো।’ ডাকতে ডাকতে সে ঋতুর ঘরের সামনে চলে গেল, ‘আসব?’

‘এসো।’ ঋতুর ধরা-ধরা গলা শোনা গেল।

‘কী হল? উঠে পড়ো! খুব মনমেজাজ খারাপ নাকি মা-বাবার জন্য?’

অমিত ঋতুর বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে। ঋতু আড়মোড়া ভেঙে উঠে দাঁড়িয়ে একটা হাই তুলল মুখে হাত চাপা দিয়ে, ‘এক্সকিউজ মি।’ তারপর অমিতের শার্টের বোতামে হাত রেখে আদুরে গলায় বলল, ‘হোয়াই কুড নট্ ইউ কাম আর্লিয়ার অমিত?’

‘আরে বাড়ি ঠিকঠাক বন্ধ করতে হবে! নিচ্ছিদ্রভাবে তালা-ফালা দিতে হবে। এই ঢাউস সুটকেস তার পর, সোমা একা পারে না কি?’

‘ইউ প্রমিজ্‌ড্! আমি তোমার জন্যে চিকেন ওমলেট বানাতে বলে দিয়েছিলাম। তুমি ভালোবাসো বলে।’

‘তো কী আছে? আমি তো পালিয়ে যাচ্ছি না! প্রত্যেক সন্ধ্যায় আমি য়ুনিভার্সিটি থেকে প্রচণ্ড খিদে নিয়ে ফিরব, তখন দেখি তুমি কত খাওয়াতে পার। বোর হয়ে যাবে বলে দিলুম।’

সোমা ও-ঘর থেকে চেঁচিয়ে ডাকল, ‘অমিত চান করতে যাও। আমি গিজার চালিয়ে দিয়েছি ন’টা বেজে গেছে।’ তারপর তোয়ালে হাতে ঋতুর ঘরে এসে বলল, ‘ঋতু টেবিলটা ঘরে এনে খুব বুদ্ধিমানের কাজ করেছিস রে! গোলাপগুলো একেবারে টাটকা। অমিত, তুমি ও বাথরুমে যাও, আমি ঋতুরটাতে যাই বরং। বড্ড দেরি হয়ে গেছে।’

খাবার টেবিলে বসে সোমা বলল, ‘অ্যাত্তো কি সব রাঁধিয়েছিস রে?’

‘তোমার পছন্দ না হয় খেও না।’

‘উঃ, আমি কি তাই বলেছি? আমার এমন রাক্ষসের মতো খিদে পায়! সমস্ত খাব। ··· ইস্‌স্ মাটনটা কী ভালো হয়েছে!’

অমিত বললে, ‘এ বাড়িতে এলে ঠিকঠাক জমিয়ে খাওয়া যায়। তোমার তো খালি বয়েল্‌ড আর স্টু।’

‘সেইজন্যেই অম্বলে না ভুগে সুস্থ শরীরে খাটতে পার। বুঝলে? একদিন দুদিন মুখ বদলাবার জন্যে এরকম ঠিক আছে। তাই বলে রোজ না। ঋতু তুই আজকাল রোজই এরকম খাস না কি রে?’

বাসন্তী বলল, ‘ওর তো খেয়ালের ওপর। খাওয়ার দশ মিনিট আগে হয়ত বলল—ঢাকাই পরোটা করে দাও।’

‘তাই দাও?’

‘না করে উপায়?’ বাসন্তী যেন এক দিনেই ঋতুর অভিভাবিকা হয়ে উঠেছে।

‘ঋতু অত ভাজাভুজি, মশলা খেও না সত্যি! অমিত বলল।

‘আমি তোমাদের মতো ডেস্‌ক্ ওয়ার্ক করি না বসে বসে। রীতিমতো লম্ফ-ঝপ করতে হয়, বুঝলে? ওসব ফ্যাট-ট্যাট, মশলা-টশলা সব কোথায় তলিয়ে যায়।’

সোমা বলল, ‘তা অবশ্য। নাচে প্রচণ্ড খাটুনি। কিন্তু একটু আলগা দিলেই মোটা হয়ে যাবি। ও কি হাত গুটিয়ে আছিস যে?’

‘খাওয়া হয়ে গেছে।’

‘হয়ে গেল? এরই মধ্যে? পুডিংটা খাবি না?’

‘নাঃ, আমি উঠছি, ডোন্ট মাইন্ড।’ ঋতু উঠে চলে গেল, ঘরের দরজা বন্ধ করবার শব্দ হল।

অমিত বলল, ‘কিছু হল যেন মনে হচ্ছে?’

‘রাগ হয়ে গেল বোধ হয়’, সোমা স্যালাড নিতে নিতে বলল।

‘রাগ? কেন?’

‘ঋতুর রাগ-অনুরাগের কোনও কেন নেই অমিত। ওর মন নামে জটিল যন্ত্রটির কোন কথায়, কখন তার ঢিলে হয়ে যায় আমরা কেউ জানি না।’

‘ডেকে আনব? কিছুই তো খেল না!’

‘খবর্দার, অমন কাজটিও করো না। ও তো তাই-ই চায়। দরজায় ঘা দেব। দুজনেই খাওয়া ফেলে ঋতু-ঋতু বলে ছোটাছুটি করব। অ্যান্ড শী’ল থ্রো ওয়ান অফ হার ফেমাস ট্যানট্রাম্‌স্!’

‘তাই বলে খাবে না?’

‘খেয়েছে তো! ও ওইরকমই খায়। বারে বারে খায়। রাত্তির তেরোটার সময়ে হয়ত ফ্রিজ থেকে পুডিং বার করে খেয়ে নেবে। এ নিয়ে বাড়াবাড়ি করো না তো!’

কিন্তু ঋতু বেশ ভালো হয়েই তো থাকছে। সকালে সর্বপ্রথম বেরোয় সোমা। অমিতের একটু বেলায় ক্লাস থাকে। ইউনিভার্সিটিও খুব কাছে! ঋতু প্রায়ই গোড়ার দিকের ক্লাসগুলোয় যায় না তাই এগারোটা, সাড়ে এগারোটা, কোন কোন দিন বারোটায় দুজনে খেতে বসে। অমিতের দুদিন যেতে হয় না। সে দুটো দিন, নিজের ব্যক্তিগত পড়াশোনা, পেপার টাইপ, লাইব্রেরি এ সব থাকে তার। ঋতুও প্রায়ই এই দিনগুলোতে গড়িমসি করে কলেজ যায় না। বলে, ‘ধুর। ভাল্লাগছে না, এই অমিত রাখো তো তোমার বালিশের মতো বইগুলো, এসো গল্প করি।’

কত যে গল্প ঋতুর! তার নাচ-ক্লাসের মাস্টার মশাইয়ের প্রতিভার গল্প। মেয়েদের মধ্যে, ছেলেদের মধ্যে প্রতিযোগিতার পলিটিক্‌স্। অমিত যখন জার্মানিতে ছিল তখনকার গল্প। খালি সোমার সঙ্গে অমিতের প্রেমের গল্পটা সে কখনোই শুনতে চায় না।

উজ্জয়িনী আর মিঠু এলো একদিন।

‘কিরে ঋতু, কলেজ যাসনি কেন?’

‘এই তো পরশুই গেছি! আবার কী! ভারি তো কলেজ!’

‘তাই বলে দিনের পর দিন ফাঁকি দিবি? তারপর নন-কলেজিয়েট হয়ে গেলে?

‘আহা, ক জন প্রোফেসর রোলকল করতে পারেন রে! অনার্স ক্লাসেই তো সাতচল্লিশ জন স্টুডেন্ট। সব ফুটকি দেওয়া থাকে আমি দেখেছি। পরীক্ষার সময়ে একটা মেডিক্যাল সার্টিফিকেট দিয়ে দেব। বি কে সি-কে বলব, অনার্সের ‘পি’গুলো দিয়ে দিতে।’ গলা তুলে সে বাসন্তীকে ডাকতে লাগল, ‘বাসন্তী! বাসন্তী! আমার বন্ধুরা এসেছে কফি করো, কফি উইথ ক্রীম, এই চিকেন রোল খাবি?’

উজ্জয়িনী বলল, ‘তুই ব্যস্ত হোস না তো! এখন আর বাসন্তীদিকে কোথাও পাঠাতে হবে না।’

‘পাঠাব না তো! এভরিথিং ইজ রেডি। জাস্ট ভাজবে আর দেবে।’

‘তুই খুব গিন্নি হয়েছিস তো!’

‘হয়েছিই তো। জানিস না মা আর বাপী ফ্রান্স গেছে। আমিই তো এখন সব দেখছি।’

‘সে কি রে? তুই একা রয়েছিস?’

‘সোমা-অমিত আছে! এতক্ষণ আমাতে অমিতেতে আড্ডা মারছিলাম তো!’

‘অমিত কে রে? সোমাদির বর?’

‘আবার কে? এই অমিত এদিকে এসো শিগগির।’

বারান্দার দিকের দরজা দিয়ে পাজামা-পাঞ্জাবি পরা অমিত ঢুকলো। ঋতু বলল, ‘ইজ্‌ন্‌ট্ হি হ্যান্ডসাম?’

মিঠু-উজ্জয়িনী জবাব না দিয়ে অমিতের দিকে তাকিয়ে নমস্কার করল। অমিত বলল ‘হাই!’

চিকেন রোল আর কফি খেতে খেতে শিগগিরই চারজনে খুব আড্ডা জমে গেল। মিঠু বলল, ‘আপনার রোজ রোজ বেরোতে হয় না, কী মজা, না অমিতদা?’

‘আরে! কে বললে যেতে হয় না। ক্লাস ছাড়াও অনেক কাজ থাকে। তো এই আহ্লাদি শ্যালিকাকে আগলাচ্ছি। মা বাবা নেই, মন-মেজাজ খারাপ। ঋতু তোমার বন্ধুরা এসে গেছে। আমি একটু বেরোচ্ছি।’

‘কেন?’

‘দরকার আছে।’

‘কী দরকার?’

‘আরে! আছে।’

‘দেরি করবে না, তাড়াতাড়ি ফিরবে।’ ঘড়ি দেখে বলল, ‘উইদিন হাফ অ্যান আওয়ার।’

‘অত তাড়াতাড়ি হবে না। ঘণ্টা দেড়েকের মধ্যে ফিরব।’ অমিত চট করে পোশাক বদলে বেরিয়ে গেল।

উজ্জয়িনী বলল, ঋতু, কলেজ ইলেকশন-এ আমি এবার ক্লাস-রিপ্রেজেন্টেটিভ দাঁড়িয়েছি। আমাকে ভোটটা দিবি তো?’

‘তুই দাঁড়িয়েছিস? তুই? অফ কোর্স দেব। আর কেউ দাঁড়িয়েছে না কি রে?’

‘হ্যাঁ, দেখ না রাজেশ্বরীও দাঁড়িয়েছে।’

‘সে কী? তোদের দুজনের মধ্যে আবার ভোটাভুটি কী?’

মিঠু তাড়াতাড়ি বলল, ‘দেখ না, এটাই উজ্জয়িনীকে বোঝাতে পারছি না কিছুতেই। রাজেশ্বরীর নামটা আগে পড়েছে। ও দাঁড়িয়ে গেছে, উজ্জয়িনীর আবার দাঁড়াবার দরকার কি ছিল, বল তো!’

মাথায় একটা ঝটকা দিয়ে উজ্জয়িনী বলল, ‘তো দিস নি! বারবার এক কথা বলছিস কেন? দিস ইজ ইনসাল্টিং। আমাকে ডেকে দাঁড়াতে বলে ওরা হঠাৎ রাজেশ্বরীকে দাঁড় করালো কেন? আমার একটা প্রেসটিজ নেই? এটা আমার চ্যালেঞ্জ। রাজেশ্বরীকে আমি হারাব, এমন করে হারাব যে ওই সুকান্তদা, শৈলেশদা বুঝতে পারবে। এটা আমার চ্যালেঞ্জ জেনে রাখিস। আর তোরা তো রাজেশ্বরীকেও উইথড্র করতে বলতে পারতিস! আমার কাছেই খালি ঘ্যানঘ্যান করছিস কেন? বল ঋতু!’

ঋতু মজা পেয়ে বলল, ‘তোরা খুব একসাইটেড মনে হচ্ছে এই ব্যাপারটা নিয়ে। সত্যিই তো মিঠু তোরা রাজেশ্বরীকে বলছিস না কেন?’

মিঠু বলল, ‘আসলে রাজেশ্বরীর নামটাই তো প্রথমে পড়েছে। ওকে নাম উঠিয়ে নিতে বলার কোনও মর‍্যাল রাইট আমাদের নেই। তবে, উজ্জয়িনী যদি এত ইয়ে করে, তো রাজেশ্বরীকেও বলতে হবে।’

ঋতু বলল, ‘এখখুনি বল। দাঁড়া ফোনে ডাকি ওকে।’

মিঠু বলল, ‘অত তাড়া করছিস কেন? মুখোমুখি না হলে এ সব হয়?’

‘উঁহুঃ, ফোন ইজ বেস্ট।’ বলে ঋতু চট করে ডায়াল ঘোরালো।

‘রাজেশ্বরী আছে? হ্যাঁ আমি ঋতু বলছি রে। এই ফিরলি? হ্যাঁ? হ্যাঁ। আমার বাপী-মা নেই তো তাই!’ রিসিভারের ওপর হাত চাপা দিয়ে উত্তেজিতভাবে ফিস-ফিস করে ঋতু বলল, ‘আমার কাছে ভোট চাইছে! এই শোন রাজেশ্বরী, শুনলাম উজ্জয়িনীও দাঁড়িয়েছে! তুই উইথড্র করে নে নামটা। দুই বন্ধুতে…কী? না কেউ বলেনি বলতে। আমারই মনে হল। …বল!’ আবার রিসিভারে হাত চাপা দিয়ে ঋতু বলল, ‘ও-ও একই কথা বলছে। বলছে ও আগে দাঁড়িয়েছে। উজ্জয়িনীকে নাম তুলে নিতে বল।’ রিসিভারের দিকে ফিরে ঋতু বলল, ‘কোত্থেকে জানলাম? যেটুকু গেছি তাইতেই কানে এসেছে। আচ্ছা রাখি! রাখছি রে!’ ফোন রেখে হাঁসিতে ফেটে পড়ল ঋতু।

ঋতু বিরক্ত হয়ে বলল, ‘তোরা দুজনেই খুব ওয়ারিড না? এত গোঁ কেন রে তোদের? এক জন নামটা তুলে নিলেই তো ফুরিয়ে যায়।’

‘ঠিক আছে। দিস নি আমাকে ভোটটা। আমি চলি’, উজ্জয়িনী উঠে দাঁড়াল।

‘ইস? এত সহজে রেগে যাস কেন রে? ভোটটা তোকেই দোব। হল তো?’

‘ঠি-ক!’

‘ঠিক! কী আশ্চর্য তোর সঙ্গে কত দিনের বন্ধুত্ব!’

উজ্জয়িনী বলল, ‘থ্যাংকিউ।’ মিঠুও উঠে পড়ল। কিন্তু তার মুখে স্পষ্ট অশান্তির ছাপ। উজ্জয়িনী আড়চোখে সে দিকে তাকিয়ে বলল, ‘মিঠু তুই রাজেশ্বরীকেই দিস। তোর থেকে আমি ভোট চাইছি না। তোকে আমার সঙ্গে আসতেও হবে না। কী জানি! তোকে যদি আবার ইনফ্লুয়েন্স করি! আমার কী মর‍্যাল রাইট আছে বল!’

মিঠু কাঁদো-কাঁদো মুখে বলল, ‘কী হচ্ছে উজ্জয়িনী! আমি একবারও বলেছি তোকে দেব না!’

উজ্জয়িনী ক্রুদ্ধ মুখে ফিরে দাঁড়িয়ে বলল, ‘এই তো ঋতু কত সহজে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিল। মানছি তোদের পক্ষে অস্বস্তিকর হচ্ছে ব্যাপারটা। কিন্তু আমারও তো একটা প্রেসটিজ আছে। তা ছাড়া কোথায় আমি, কোথায় রাজেশ্বরী! রাজেশ্বরী তে এসেছে মোটে এইচ.এস-এ। আর আমার সঙ্গে পড়ছিস নার্সারি থেকে। তোদের মনে এত দ্বিধা আসে কোত্থেকে? আমি সব বুঝি মিঠু। তোর আমাকে ভালো লাগে না আর। আমি খেয়ালি, আমি তোকে ঠেলে দিতে পারি জলে। তো ঠিক আছে, রাজেশ্বরীকে ভালো লাগে। তাকে বেশি ডিপেন্ডেব্‌ল্ মনে হলে তার কাছে যা। আমি তো তোকে বেঁধে রাখি নি! যেখানে খুশি, যার কাছে খুশি যানা!’

মিঠুর চোখের কোল ভরে উঠছে। সেদিকে তাকিয়ে ঠোঁট বেঁকিয়ে উজ্জয়িনী বলল, ‘ক্রাই বেবি!’ সে বেরিয়ে গেল।

মিঠুকে ঋতু টেনে বসিয়ে রাখল। মিঠু রুমাল দিয়ে চোখ মুছছে। ধরা গলায় বলল, ‘সত্যি রে ঋতু, আমি একটা অপদার্থ, চরিত্রের কোনও জোর নেই, কিছুই পারি না। কিচ্ছু না!’

ঋতু বলল, ‘দূর। ছাড় তো! উজ্জয়িনীটা চিরকাল একটা বুলি। সেলফিশ। নিজেরটা ছাড়া কারুরটা দেখতে পায় না। আমি ওকে কথা দিয়েছি যখন ওকেই দেব। তুই রাজেশ্বরীকে দে। ও তো তোকে অনুমতি দিয়েই দিয়েছে!’

‘তা হয় না ঋতু। উজ্জয়িনী দাঁড়ালে ওকে আমার দিতেই হবে। তাই বলে ওর ভুলটা অমি দেখিয়ে দেব না? আমি যাই রে!’

‘যাবি? যা তা হলে। শুধু শুধু মন-খারাপ করিস না।’


‘আসল কথা না জেনেই এরকম করছিস…’

উজ্জয়িনী বাড়ি পৌঁছতে ওদের যে রান্না করে সেই যমুনাদি বলল, ‘জুনিদিদি মা তো আজও খেল না সকালে। কয়েক কাপ চা খেয়ে আছে খালি। এমনি করলে যে একটা অসুখ করে যাবে!’

মা-বাবাকে নিয়ে উজ্জয়িনী পড়েছে মহা মুশকিলে। দুজনের মধ্যে কথা-বার্তা নেই। প্রায় এক বছর হতে চলল। সে মাঝখানে সংযোগ রক্ষা করে চলেছে। বাবা ডক্টর রজত মিত্র, প্রচণ্ড রুক্ষ ভাষী, মেজাজী। বদরাগী। মা অমিতা মিত্র অনেকগুলো মেয়েদের সংস্থা চালান। কোথাও সেক্রেটারি, কোথাও প্রেসিডেন্ট। মার অভিমান, আত্মমর্যাদাজ্ঞান খুব বেশি। মা-বাবার মধ্যে শীতল যুদ্ধ চলছে অনেক দিন। যখন সে খুব ছোট ছিল, মনে পড়ে মা-বাবার হাত ধরে বেড়াতে যেত হংকং, সিঙ্গাপুর, ইয়োরোপ। সে-সব দিনগুলো কী সুন্দর ছিল। হাত ভরে যেত উপহারে। গাল ভরে যেত চুমোয়। মার কোলে, বাবার কোলে। সাত-আট বছর বয়স পর্যন্ত সে কোলে চড়েছে বাবার। এখনকার বাবাকে সে চিনতে পারে না।

সাড়ে ছটা প্রায়। সে মায়ের ঘরে ঢুকে ডাকল, ‘মা’।

মা বলল, ‘আজ এত দেরি করলি?’

‘ঋতুদের বাড়ি হয়ে এলাম, দরকার ছিল।’

‘কী খাবি?’

‘আমি খেয়ে এসেছি। এখন তুমি কী খাবে বলো?’

‘আমি আবার এখন…’

‘মা, এরকম যদি করো, আমি কিন্তু কোথাও চলে যাব।’

‘চলে যাবার ব্যবস্থাই তো হচ্ছে।’

‘মানে?’

‘তোমার বাবা তোমাকে স্টেটসে পড়তে পাঠাবেন।’

‘আমার তো এখনও পার্ট ওয়ানই হল না।’

‘তা জানি না, তুমি টোয়েফ্‌ল আর স্যাটে বসেছিলে, ভালো করেছ, কোন কোন য়ুনিভার্সিটিতে অ্যাপ্লাই করতে হবে, সেইসব বলছিলেন।’

‘তাই কি তুমি খাওনি?’ উজ্জয়িনী মৃদু স্বরে বলল, ‘মা, চলো না তুমি আমি দুজনেই চলে যাই। ওখানে আমরা বেশ থাকব দুজনে। কোনও ঝামেলা থাকবে না।’

তিক্ত হাসি হেসে অমিতা বললেন, ‘আমার কাছ থেকে দূরে রাখবার জন্যেই তো এত ব্যবস্থা! আমার যাওয়ার কোনও প্রশ্নই ওঠে না।’

‘তোমার কাছ থেকে দূরে? আমি থাকতেই পারব না! আমি বাবাকে বলব মা? বলি, হ্যাঁ? যে আমরা দুজনে…’

‘খবর্দার জুনি। বলো না। হিতে বিপরীত হয়ে যাবে। ওঁর ধারণা হয়েছে তোমার ওপর আমার প্রভাবটা বেশি হয়ে যাচ্ছে। সে জন্যেই এ ব্যবস্থা নিচ্ছেন। এখন যদি তুমি আমাকে পাঠাবার কথা বলো তো ওঁর আরও জেদ চেপে যাবে।’

উজ্জয়িনীর ঘরে একটা বেল বাজল। এখান থেকে শোনা যায়। এটা বাজছে বাবার চেম্বার থেকে। উন্নয়িনীর একদম যাবার ইচ্ছে নেই। সে বাবাকে, বাবার চেম্বারের ওই অংশটাকে একদম পছন্দ করে না। এই মাল্টি স্টোরিড বাড়িটাতে তাদের দুটো ফ্ল্যাট। আট তলায় একটা আর দোতলায় একটা। দোতলার ফ্ল্যাটটা বাবার চেম্বার, রোগীদের ওয়েটিং রুম, খাবার, রেস্ট রুম, কিচেন, টয়লেট সবই আছে। বেশির ভাগ সময়েই বাবা ওখানেই কাটান। দুপুরের খাবার ওখানে দিয়ে আসতে হয়। রাতটা ওপরে এসে খান। নিজের আলাদা ঘরে শোন। গত কয়েক মাস ধরে নিচেই শুচ্ছেন। সে অত্যন্ত অনিচ্ছুক পায়ে বেরিয়ে গেল, ইচ্ছে করে সিঁড়ি ভাঙতে লাগল, যাতে দেরি হয়। পাশের দরজা দিয়ে, বাবার রেস্ট রুম দিয়ে সে চেম্বারে ঢুকল। পেছন থেকে দেখতে পেল বাবাকে। গাঢ় ব্রাউন রঙের সুট পরা। মাথার পেছন দিকটা পুরো টাক। টাকটার পর্যন্ত গোলাপি রং। ইস, সেই মহিলা ঘরে ঢুকছে। দেখে আপাদমস্তক জ্বলে গেল উজ্জয়িনীর। কী নির্লজ্জ, কী বেহায়া। এই বদমাস মহিলার জন্য তার মায়ের যত কষ্ট, যত অপমান! খুব নাকি সুদক্ষ ও. টি. নার্স। বাবার চেম্বারেও গত কয়েক বছর ধরে সন্ধে বেলায় ডিউটি দেয়। মানে চাকরি করে। একজন নাম্বার ওয়ান ও. টি. নার্স ডাক্তারের প্রাইভেট চেম্বারে রোগী পরীক্ষায় সাহায্য করবার কাজ নিয়েছে! উজ্জয়িনীকে দেখে এক মুখ হেসে আবার বলছে, ‘কী জুনি! কেমন আছ!’ বিরস মুখে উজ্জয়িনী বলল, ‘ভালো।’ ফিরে ‘আপনি কেমন আছেন’টা সে বলল না। কেমন আছে দেখাই তো যাচ্ছে। গালে লালচে আভা। একটা দামী সিল্কের শাড়ি পরেছে। আজকে নার্সের পোশাকে নেই। কী মতলব, কে জানে!

বাবা চেয়ারটা ঘুরিয়ে উজ্জয়িনীর মুখোমুখি হল, বলল, ‘আমি কদিনের জন্যে শিলিগুড়ি যাচ্ছি। খুব জরুরি কেস আছে। কবে ফিরব বলতে পারছি না।’ বাবা পকেট থেকে একটা চেক-বই বার করে দুটো তিনটে ফাঁকা চেক খস খস করে সই করে দিল তলায়। বলল, ‘এটা রাখো।’ তারপর তার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ফিরে আসি তোমার স্টেটস যাবার ব্যবস্থা সব পাকা করে ফেলব তারপর! এখানে কী হবে? কিস্যু হবে না।’ ভদ্রমহিলার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘চলো শীলা, চলো।’ মসমস করে বেরিয়ে গেল বাবা, পেছন-পেছন সেই মহিলা—শীলা না অনুশীলা। হাতে আবার পাতলা একটা লাগেজ। উজ্জয়িনী তাড়াতাড়ি বারান্দায় ছুটে গেল। একটু পরেই সাদা অ্যামবাসাডর গাড়িটায় বাবা উঠল, পাশে উঠে বসল শীলা। মদন গাড়ির বুটে দুটো সুটকেস তুলে দিল। তারপর গাড়িটা দ্রুত বেরিয়ে গেল। যতক্ষণ দেখা গেল সাদা বিন্দুটার দিকে তাকিয়ে রইল উজ্জয়িনী। তারপর লিফটে চড়ে ওপরে চলে এলো।

সাড়ে আটটা নাগাদ উজ্জয়িনী বলল, ‘মা বড্ড খিদে পেয়েছে। দেবে?’ মা সেন্টারের কি সব মিলোনোর কাজ করছিল। বলল, ‘চল দিচ্ছি।’

‘দুজনে এক সঙ্গে বসব কিন্তু।’

‘ঠিক আছে।’

আস্তে আস্তে বসে বসে গল্প করতে করতে মাকে খাওয়ালো উজ্জয়িনী। সারা দিনের পর এই রাত সাড়ে আটটায় বোধ হয় কিছু পড়ল তাঁর পেটে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে অমিতা বললেন, ‘যমুনা, সাহেবের খাবারটা রেডি করো, সময় হয়ে আসছে।’

ন’টার সময়ে ডক্টর মিত্র খান দুখানা আটার রুটি, এক বাটি চিকেন স্টু, একটু স্যালাড। এক গ্লাস দুধ খাবেন আরও রাতে, শোবার সময়ে।

উজ্জয়িনী বলল, ‘মা, বাবা জরুরি কল-এ শিলিগুড়ি চলে গেল।’

‘কখন?’ অমিতা ভুরু কুঁচকে বললেন।

‘এই তো, যখন আমায় ডাকল।’

‘সে তো অনেকক্ষণ। এতক্ষণ বলিসনি!’ অমিতা ফেলে ছড়িয়ে খেতে লাগলেন। কিছুক্ষণ পর মায়ের খাওয়া মোটামুটি শেষ বুঝতে পেরে উজ্জয়িনী বলল, ‘ওই মহিলা সঙ্গে গেল, অপারেশন আছে বোধ হয়।’

সতর্ক হয়ে বসলেন অমিতা, ‘কে? শীলা ভার্গব? শিলিগুড়ি গেল?’

গ্লাসের জলটা শেষ করে, অমিতা উঠে পড়লেন। নিজের ঘরে গিয়ে একটা বেতের চেয়ারে গা এলিয়ে দিয়েছেন। একটু পরেই আবার উঠে পড়লেন। উজ্জয়িনী নিজের ঘর থেকে মায়ের চলা-ফেরা দেখতে পাচ্ছে। মা পায়চারি করছে, হাত মুঠো করল, রাগে মুখ থমথম করছে, তার পরেই মুখ কালো হয়ে গেল, মা আলো নিবিয়ে দিল, চেয়ারে পিঠ হেলিয়ে দিয়েছে, চোখের ওপর হাত চাপা।

এই প্রথম উজ্জয়িনী এমনি সময়ে মার ঘরে ঢুকতে সাহস করল, ডাকল ‘মা।’ চমকে চোখের ওপর থেকে হাত সরালেন অমিতা।

‘দিনের পর দিন এভাবে…কী লাভ?’

‘তুই গান-টান শুনগে যা জুনি!’

‘গান-টান শুনিয়ে ভুলিয়ে রাখবার দিন আমার চলে গেছে মা!’ তার গলার স্বর রূঢ়।

অমিতা আবার চমকে উঠলেন, বললেন, ‘কী বলবি, বল?’

‘তুমি সহ্য করছ কেন এ সব? আজ শীলা, কাল শর্বরী। পরশু রোজি। তোমরা মনে করো খুব স্থূলভাবে কিছু চোখের ওপর না দেখলে আমি বুঝতে পারব না? আমি এখন বড় হয়েছি, বন্ধু-বান্ধবের একটা সার্কল আছে আমার। আমি আর কতদিন এভাবে মরমে মরে থাকব? তোমরা একটা কিছু স্থির করো! কিছু একটা করো মা! সক্কলে জানে। তুমি মনে করো কেউ কারো খবর রাখে না? আমার পরিচয় পেলেই লোকে দ্বিতীয়বার ফিরে তাকায় তা জানো? আমি আর সহ্য করব না। সহ্য করতে পারছি না।

‘তোর বাবা তো তোকে খুব ভালোবাসে জুনি!’ একটু পরে অমিতা বললেন।

‘ওকে ভালোবাসা বলে না, দিবারাত্র মেয়ের চোখের সামনে মাকে অপমান করে, “জুনি আমি তোমাকে স্টেটস পাঠাব।” ভেংচে উঠল উজ্জয়িনী। ‘নিজের ক্ষমতা দেখানো হচ্ছে? আমার চাই না ওই বাজে লোকটার ভালোবাসা, যে তোমাকে এভাবে কষ্ট দিচ্ছে, তাকে আমি বাবা বলে মানতে পারব না। বলে দিলাম এই শেষ কথা।’

শিউরে উঠে অমিতা বললেন, ‘এদিকে আয় জুনি।’

মেঝেতে কার্পেটের ওপর বসে জুনি চেয়ারে বসা মায়ের কোলো মাথা রাখল। অমিতা তার চুলে হাত বুলোতে বুলোতে বললেন, ‘যতই হোক। তোর বাবা। বাবার সম্পর্কে ওভাবে বলিস নি।’

‘তাহলে তুমি প্লিজ এবার ডক্টর মিত্রকে আলটিমেটাম দাও।’

‘কী হবে দিয়ে? উনি বলবেন, তোমার না পোষায় তুমি চলে যেতে পার।’

‘যাব। তাই যাব মা। তুমি আর আমি চলে যাব।’

‘ডিভোর্স করতে বলছিস?’

‘হ্যাঁ, তাই করবে দরকার হলে।’

‘অনেকবার ভেবেছি। তোর কথা মনে করে পারি না যে জুনি।’

‘আমার কথা? এই অশান্তির চেয়ে লজ্জার চেয়ে বরং আমি অন্য যে কোনও অবস্থায় থাকতে রাজি আছি। এই লজ্জা, এই ঘেন্না নিয়ে দিনের পর দিন…’

উজ্জয়িনীর চোখ দিয়ে গরম জল পড়তে লাগল।

অমিতা বললেন, ‘তুই চিরদিন খুব আদরে মানুষ জুনি। পারবি না। বলা সোজা, কিন্তু কষ্ট সহ্য করা ভীষণ শক্ত কাজ, পারবি না।’

‘কী বলছ মা! আমি এত মীন যে তোমার এত অপমানের পরও স্রেফ বিলাসের লোভে এই ঘৃণ্য বাড়িতে ওই ঘৃণ্য ভদ্রলোকের সঙ্গে থাকব? আমাকে তুমি এত ছোট মনে করো?’

‘তুই আমাকে খুব ভালোবাসিস না রে?’ অমিতা ভিজে-ভিজে গলায় বললেন।

উজ্জয়িনী জবাবে মায়ের হাঁটু দুটো আরো জোরে চেপে ধরল, সজল গলায় বলল, ‘তোমাকে ভালোবাসায় আমার তো কোনও বাহাদুরি নেই মা। মাকে সবাই ভালোবাসে। কিন্তু তুমি তো কবে থেকেই আমার মা-বাবা সবই। তোমাকে কেউ কষ্ট দিলে আমার মনে হয় তাকে…তাকে.. তা ছাড়া ওই ভদ্রলোককে আমার আজকাল বাবা বলে মনে হয় না।’

‘জুনি, তোর বাবাকে ডিভোর্স করা আমার পক্ষে এখন আর সম্ভব নয়।’

‘কেন? ঠিক আছে এবার বাবা ফিরলে আমি, আমিই যা বলার বলব, আই’ল হ্যাভ এ শো-ডাউন উইথ হিম।’

‘না না’, ভীষণ ব্যস্ত হয়ে অমিতা বললেন, ‘অমন কাজও করিস নি, মাথা গরম করিস নি। সর্বনাশ হয়ে যাবে।’

‘কিসের সর্বনাশ! একজন চরিত্রহীন লোককে বাবা বলে পরিচয় দেবার চেয়েও সর্বনাশ! মা তোমাকে আমি এই কদিন ভাববার সময় দিলাম। এর মধ্যে তুমি যা হয় ঠিক করো।’

‘ওরে না না, এসব বলিস নি, জুনি এসব বলিস নি।’ অমিতা আকুলভাবে মাথা নাড়তে লাগলেন।

‘তাহলে, তুমি কি এখনও, এসব সত্ত্বেও বাবাকে ভালোবাসো? বলো! জবাব দাও!’

অমিতা মাথা নাড়তে থাকেন।

‘তাহলে এই সুখ, ঐশ্বর্য, বিলাস, স্ট্যাটাস এই সবের জন্যে ছাড়তে পারছ না? বুঝেছি।’

‘কিছুই বুঝিস নি। শোন জুনি, তোর একটা ভালো দেখে বিয়ে হয়ে যাক। তারপর, তার-পর আমি তোর বাবাকে ছেড়ে চিরদিনের মতো চলে যাব। ডিভোর্স-টিভোর্স কিচ্ছু লাগবে না। স্রেফ এ বাড়ি ছেড়ে চলে যাব। আমার যা গয়নায়গাঁটি আর নিজস্ব টাকা আছে তাতে আমার কোনক্রমে চলে যাবে। জুনি ভালো পাত্র দেখা আছে আমার, দেখলেই তোর পছন্দ হবে। তুই বাবাকে বলবি তোর পছন্দের কথা, উনি এটাতে আপত্তি করবেন না, তারপর…’

‘কী বাজে কথা বলছ? মোটেই আমি এখন বিয়ে করতে রাজি নই মা! তোমাদের দেখে দেখে বিয়েতেই আমার ঘেন্না ধরে গেছে।’

‘তোর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেব ছেলেটির, শুভংকর, তোর বড় মেসোর বন্ধুর ছেলে, দেখেছিস না দেবারতির বিয়েতে!’

ভুরু কুচকে উজ্জয়িনী বলল, ‘তুমি কি ভাবছ, ডিভোর্স করলে বা ওই রকম কিছু করলে আমার বিয়ের অসুবিধে হবে? সে রকম ছেলেকে আমি বিয়েই করব না জেনে রাখো সেটা।’

‘আমার বড্ড মাথা ধরেছে জুনি, আমায় একটু চোখ বুজোতে দে এবার। সামনে ক্যাশ মিলিয়েছি আর ক্যাশমেমো কেটেছি সকাল থেকে। একটু বিশ্রাম দরকার।’

‘ঠিক আছে, আমি চলে যাচ্ছি এখন, কিন্তু এ প্রশ্নের জবাব না দিলে ভালো হবে না।’ উজ্জয়িনী চলে গেল নিজের ঘরে। সামনে একটা আমজাদ আলির ক্যাসেট পেলো, সেটাই চড়িয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ল।

কিছুক্ষণ পর একটা বিশ্রী আওয়াজ পেয়ে অমিতা মেয়ের ঘরে ছুটে এলেন। উজ্জয়িনী ক্যাসেটটাকে বার করে প্রচণ্ড জোরে ঘরের কোণে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে। সে আরও ক্যাসেট বার করছে, সেগুলো দুমড়ে ভেতরে থেকে টেপগুলো বার করবার চেষ্টা করছে। তার মুখ-চোখ রাগে, চোখের জলে মাখামাখি। সে একটা বহু মূল্যবান পাথরের চতুর্ভুজ বিষ্ণুমূর্তি তুলে ধরতে যাচ্ছিল, অমিতা তাড়াতাড়ি এসে তার হাত ধরলেন, ‘ছাড় জুনি, ছাড় বলছি! উজ্জয়িনী হাত তুলে নিল মূর্তিটা থেকে, তারপর ক্ষিপ্ত গলায় বলল, ‘সব ভেঙে চুরে ফেলব, যা যা দিয়ে এতদিন এই নরকটা সাজিয়েছ, সব, স-ব চুরমার করে ফেলব, ফেলে যে দিকে দু চোখ যায় চলো যাব।’

অমিতার চোখদুটো ভয়ে বড় বড় হয়ে উঠেছে, তিনি বললেন, ‘আসল কথা না জেনেই এরকম করছিস? জানলে তাহলে কী করবি? ওঃ ভগবান, কী বিপদেই পড়লুম।’

হঠাৎ উজ্জয়িনী শান্ত হয়ে গেল। বলল, ‘কী আসল কথা মা? বলো না, আমি তো বড় হয়ে গেছি, এত বড় মেয়ের কাছ থেকে কিছু লুকোনো যায় না। আমি অন্যভাবে জেনে নেবই। তখন তোমার মুখ কোথায় থাকবে?’

অমিতা তার চোখের জলে ভেজা লালচে মুখের দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইলেন, তারপর বললেন, ‘তুই যে আগে তোর বাবার মেয়ে। তোর বাবা দয়া করে আমার হাতে তুলে দিয়েছে তাই আমার হয়েছিস মা।’

অমিতার চোখ ছলছল করছে, ঘরে ঘড়ির বাজনা শুরু হল। সাড়ে ন’টা বাজছে। অমিতা বললেন, ‘তুই একজন অ্যাংলো ইন্ডিয়ান নার্সের মেয়ে। তোর জন্মের সময়ে সে মেয়েটি মারা যায়। রাঁচির ভেতর দিকে একটা মিশনারি হাসপাতালে ডেলিভারি হয়েছিল। ওরাই তোকে রাখতে চেয়েছিল। আমি নিঃসন্তান। স্বামী থেকেও নেই। তোকে আমি চেয়ে নিই। সবাই জানে তুই আমারই মেয়ে, তোক নিয়ে পুরো এক বছর আমি ওই মিশনারি প্রতিষ্ঠানে কাটাই। আত্মীয়রা জানত আমি স্বামীর ওপর রাগ করে চলে গেছি, তারপর—বাচ্চা হবে বুঝতে পেরে আবার ফিরে এসেছি। তোর বাবা আর আমি ছাড়া এ কথা আর কেউ জানে না। রাগারাগি করে যদি আমরা পরস্পরকে ছাড়ি, তুই যদি আমার কাছে থাকতে চাস, তোর বাবা সেটা হতে দেবে না। তোর আসল জন্মবৃত্তান্ত প্রকাশ করে দেবে।’

পাথরের মতো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুনছিল উজ্জয়িনী। তার দেহ কি রকম অসাড় হয়ে যাচ্ছে। চোখ ঝাপসা। পায়ের তলায় মাটি দুলছে। অমিতা তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে আস্তে আস্তে বিছানায় নিয়ে গিয়ে শুইয়ে দিলেন। মাথায় হাত বুলোতে বুলোতে বললেন, ‘তোর পাঁচ দিন বয়স থেকে তোকে বুকে করে বড় করেছি। আমি নিজেই ভুলে গেছি তুই আমার কোলে জন্মাসনি। আমিই তোর সত্যি মা। তুই ছাড়া পৃথিবীতে আমার কেউই নেই। চলছি যে এতদিন ধরে, কাজ করছি, সংসার করছি, সামাজিকতা করছি, সবই তোর জোরে। তুই না থাকলে আমিও নেই। আজ এইভাবে তোর বাবা এক দিক থেকে তুই আরেক দিক থেকে আমাকে বড্ড কোণঠাসা করলি, নইলে কোনও দরকার ছিল না তোর জানবার। তোর বার্থ সার্টিফিকেট পর্যন্ত আমার নামে। তোর বাবা নিজে ডেলিভারি করিয়েছে বাড়িতে এই মর্মে করিয়ে নিয়েছিল, সেটা তো তোর ফাইলে দেখেছিস…..’

উজ্জয়িনীর চোখের সামনেটা ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে। এই মা সাদা খোলের টাঙাইল শাড়ি পরা মাথার খোঁপা ভেঙে পড়েছে, মার চুলগুলো ডান দিকের খানিকটা সাদা হয়ে গেছে। কপালে ছোট লাল টিপ। অনেক দূর থেকে এই মূর্তিটা দেখতে পাচ্ছে উজ্জয়িনী। মা বক্তৃতা করছে, মুখ দিয়ে অনর্গল শব্দ বেরিয়ে আসছে, উদ্দীপিত হচ্ছে কত সমাজসেবী, মহিলাদের উন্নয়নের জন্য মা ভীষণ পরিশ্রম করে, অনেক পদস্থ লোক খাতির করেন মাকে। যেমন রাজ্যপাল, মন্ত্রী, এম.পি, বড় বড় ব্যবসায়ী বাড়ি, বিশেষ সম্মান দিয়ে কথা বলেন মার সঙ্গে। এই মাতৃমূর্তি উজ্জয়িনীকে গর্বে, আনন্দে, আশায়, বিশ্বাসে ভরে দেয়। এই মা তার না!

ভালো করে মার দিকে চাইল উজ্জয়িনী, অমিতা বললেন, ‘এই নিয়ে তুই ব্রুড করলে আমিও আমার মানসিক ভারসাম্য বজায় রাখতে পারব কি না বলতে পারছি না। সারা জীবনটা বড্ড ঝড় গেল রে জুনি, আর কি পারব…’

অমিতা কাঁদছেন না। তিনি খুব শক্ত মেয়ে। কিন্তু কান্নার জন্য শুধু চোখের জলই দরকার হয় না। উজ্জয়িনী দেখল তার মার দু চোখে অতল অন্ধকার, তিনি যেন কোথাও আর এতটুকু আলো দেখতে পাচ্ছেন না।

সে আস্তে আস্তে মার ডান হাতটা জড়িয়ে ধরে বলল, ‘মা। আমি ব্রুড করব না। করব না কথা দিচ্ছি তোমায়। সার্টিফিকেটে তো তোমারই নাম আছে। তাহলে তুমি ভয় পাচ্ছ কেন?’

‘আসলটা, রাঁচির সেই হসপিটালের ডিসচার্জ সার্টিফিকেটটা তোর বাবা নিজের কাছে রেখে দিয়েছে।’

মা এখন উজ্জয়িনীর খাটে তার পাশে শুয়ে পড়েছে। উজ্জয়িনী পাশ ফিরে ডান হাত দিয়ে তার মাকে জড়িয়ে আছে। এক বালিশে দু’জনের মাথা। মায়ের দু চোখ বোজা। উজ্জয়িনী লুকিয়ে লুকিয়ে মাকে দেখছে। কী ক্লান্ত! কী সর্বহারার মতো দেখাচ্ছে। কী দুঃখিনী এই মা তার! কত আশা নিয়ে হয়ত একদিন জীবন আরম্ভ করেছিলো, কানাঘুষায় শুনেছে বাবা মাকে ভালোবেসে বিয়ে করেছিল, প্রচণ্ড আপত্তির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে। সেই বিবাহের এই পরিণতি! ‘স্বামীর মিসট্রেস’ বাংলা প্রতিশব্দটা মনে মনেও উচ্চারণ করতে পারল না সে, স্বামীর ‘মিসট্রেস’-এর মেয়েকে নিজের সন্তানের মতো মানুষ করেছেন, এখন তাকেও কেড়ে নেবার পরিকল্পনা হচ্ছে। উজ্জয়িনী মনে মনে প্রতিজ্ঞা করল—সে কখনও কাউকে বিয়ে করবে না, কোনও পুরুষকে সে ভালোবাসবে না। বাবার যে প্রিয় ছাত্রটি গত জন্মদিনে তাকে এক বাক্স ফরাসী পারফুম দিয়েছে, সে বুঝতে পারে বাবার প্রশ্রয়ে সে একটু একটু করে তার দিকে এগোচ্ছে, তাকে তো না-ই, মায়ের নির্বাচিত ওই শুভঙ্করকেও কদাপি নয়। পুরুষ জাতির প্রতি নিবিড় নির্মম ঘৃণায় তার শরীর-মনের প্রতিটি রন্ধ্র পূর্ণ হয়ে গেল বুঝি বা। কেউ কেউ বলে তাকে বাবার মতো দেখতে। কিন্তু বেশির ভাগেরই মত সে নাকি বসানো অমিতা মিত্র। স্নেহ-ভালোবাসার মধ্যে দিয়ে মায়ের আদলটুকুও কি অলৌকিকভাবে তার শরীরে বয়ে এসেছে? বেশ কিছুক্ষণ এইভাবে ভাববার পর উজ্জয়িনী একেবারে স্থির নিশ্চিত হয়ে গেল অলৌকিক ব্যাপার পৃথিবীতে আছে। এবং সবার ওপরে ভাগ্য সত্য। অবিবাহিত অ্যাংলো ইন্ডিয়ান নার্সের মেয়ে, রাঁচির মিশনে আর পাঁচজন অনাথ এবং আদিবাসীর সঙ্গে মানুষ হবার কথা তার। এখন হয়ত তার জন্মদাত্রী মায়ের মতো সে নার্সিংই শিখছে, কিংবা শর্ট-হ্যাণ্ড টাইপ-রাইটিং। এত জ্বলজ্বলে রঙ তার, সুন্দরী বলে সবাই। সে এতদিনে আবার কোনও নারীখাদকের গর্ভে যাবার জন্যে তৈরি হচ্ছে, হত। এই অমিতা মিত্র যদি সমস্ত লজ্জা-ঘেন্না-কষ্ট চেপে তাকে বুকে করে না নিতেন। অতুল ঐশ্চর্য, বংশ পরিচয়, স্ট্যাটাস, নিচ্ছিদ্র নিরাপত্তা, সবার ওপরে এই মা, এই মহীয়সীকে মা বলে সে পেয়েছে। এত ভাগ্য কল্পনা করা যায়!

দুজনের কেউই ঘুমোচ্ছে না। দুজনে দুজনকে পৃথিবীর একমাত্র নির্ভরযোগ্য প্রিয়জন বলে অনুভব করছে। এভাবে থাকতে থাকতেই উজ্জয়িনী বুঝতে পারল—এই স্ট্যাটাস, এই নিজের হাতে গড়া সাজানো-গোছানো বাড়ি, ঘরসংসার, সামাজিক প্রতিষ্ঠা এই বয়সে ছাড়তে মায়ের কী অসহ্য কষ্ট, কী লজ্জা হবে। প্রধানত তার জন্য, তাঁর মেয়ের জন্যই তিনি তাঁর শূন্যগর্ভ ঘরের চারপাশ এমনিভাবে গড়ে তুলেছেন, তারপর এক সময়ে এটাই তাঁর অভ্যাস, তাঁর জীবন হয়ে গেছে। স্টেটস যাওয়াটা সে যেমন করে হোক ঠেকিয়ে রাখবে, যেভাবে হোক, খুব সাবধানে কূট বুদ্ধি করে চলতে হবে। বুঝতে দিলে চলবে না মাকে ফেলে যেতে হবে বলেই সে যেতে চায় না। কিন্তু কী উপায়ে মাকে এই প্রতিদিনের অপমান থেকে বাঁচানো যায়, কিভাবে?’

ভাবতে ভাবতে একটা দিবাস্বপ্নের মধ্যে ঢুকে পড়ল উজ্জয়িনী। বাবা যেন ঘুমোচ্ছে। ওই তো ওদিকের ঘরে। রাত এগারোটা কি বারোটার সময়ে। এক গ্লাস দুধ নিয়ে যাচ্ছে সে বাবার জন্যে, বাবা ওপরে শুলে সে সব সময়েই এটা নিয়ে যায়। বাবা রাত-আলোটা জ্বেলেছে। পায়জামা পাঞ্জাবি পরেছে, রুক্ষ চোখে যতটা সম্ভব স্নেহ নিয়ে বাবা তাকাচ্ছে উজ্জয়িনীর দিকে। —‘কী রকম পড়াশোনা চলছে? জুনি, তোমাকে আমি স্টেটস পাঠিয়ে দেব। এখানে কী হবে? কিস্যু হবে না।’ দুধটা এগিয়ে দিচ্ছে উজ্জয়িনী, ড্রয়ার থেকে একগাদা ওষুধ বার করে খাচ্ছে বাবা, দুধের সঙ্গে, শুয়ে পড়ল। ঘুমিয়ে পড়েছে। পাশের বালিশটা আস্তে আস্তে তুলে নিয়েছে সে, বাবার মুখের ওপর জোর করে চেপে ধরেছে। হাই ডোজে ঘুমের ওষুধ খায় বাবা। নেতিয়ে থাকে এখন। দুর্বলভাবে নড়াচড়া করছে। কিন্তু উজ্জয়িনীর গায়ে খুব জোর। সে প্রাণপণে বালিশটা চেপে উপুড় হয়ে আছে।

‘জুনিদিদি, চা এনেছি, মুখ ধুয়ে এসো’ —চমকে উঠে বসল উজ্জয়িনী। সে ঘামে ভিজে গেছে। সামনে যমুনাদি। মা ঘরে ঢুকছে। বোধ হয় মুখ-চোখে জল দিয়ে এলো। সেই কালচে ভাবটা এখনও মায়ের মুখ থেকে পুরোপুরি যায়নি। কিন্তু মুখ এখন শান্ত। কাল রাতে যে নিদারুণ মনঃকষ্ট, দ্বন্দ্ব আর দিশা হারানোর আঁচড় দেখেছিল, সেগুলো আর দেখা যাচ্ছে না। মা তুমিও কি দিবাস্বপ্নে কাউকে? …না মায়ের দিবাস্বপ্ন অন্য রকম হবে। মাকে দেখেই বুঝতে পারছে উজ্জয়িনী। পরে, অনেক পরে, যদি পরিবেশ অনুকূল বলে বুঝতে পারে, তা হলে মায়ের দিবাস্বপ্নের কথা সে জিজ্ঞেস করবে। আপাতত যে কটা দিন বাবা বাইরে থাকে, সে আর মা, তার মা, দুজনে মুক্ত।


‘এনলাইট্‌ন্‌ড্ কো-অপারেশন… এই এখন একমাত্র পথ…

নির্বাচন নিয়ে উজ্জয়িনীর সঙ্গে মন কষাকষি হবার পর মিঠু যখন বাড়ি ফিরছিল তার মনটা কি রকম চুরমার হয়ে ভেঙে যাওয়া কাচের পেয়ালার মতো হয়ে গিয়েছিল। সে পা টেনে টেনে বাড়ি ফিরল। বুকের ভেতরের গুম গুম শব্দটা সে নিজেই শুনতে পাচ্ছে। অনেক কষ্টে অনেক দিন ধরে জোড়াতালি লাগিয়ে এই বন্ধুত্ব সে টিকিয়ে রেখেছিল। আর থাকবে না। উজ্জয়িনী চিরদিনের মতো তার থেকে দূরে অনেক দূরে চলে গেল। শুধুমাত্র ভুল বুঝে। বাড়ি ফেরার সময়ে সাধারণত বারান্দায় মা দাঁড়িয়ে থাকে। আজ বাবা-মা দুজনেই বসে আছে মনে হল। কিন্তু মিঠুর মনে হল কেউই নেই তার। সে দরজা খোলা পেয়ে ওপরে উঠল, মুখ-হাত ধুয়ে জামাকাপড় বদলে ঘরে আলো না জ্বালিয়ে পড়ার টেবিলে মাথা রেখে বসে রইল। কিছুক্ষণ পর মায়ের গলা শোনা গেল বারান্দা থেকে, ‘কি রে মিঠু। খাবি না!’

‘না, ঋতুর বাড়ি অনেক খেয়েছি।’

বাবা চেঁচিয়ে ডাকল, ‘মিঠুমায়ি, এখানে এসে বসো।’

মিঠু ধীরে ধীরে উঠে গিয়ে বারান্দায় দাঁড়াল। বেশ প্রশস্ত ঝুল বারান্দা। মা বাবা দুটো বেতের চেয়ারে বসে আছে। বারান্দার কোণে একটা পেল্লাই টাইগার লিলি ফুটেছে। মিঠু একটা মোড়া নিয়ে গিয়ে বসেছে। মা বাবা গল্প করছে। হঠাৎ মিঠু মুখটা মায়ের কাঁধের কাছে গুঁজে দিল। মা কিছুই জিজ্ঞেস করছে না। বাবার কথা থেমে গেছে। মিঠু কাঁদছে বুঝতে পেরে অবশেষে বাবা বলল, ‘কি রে মিঠু?’

‘আমি খুব বাজে বাবা।’

‘কে বললে?’ বাবার গলায় হাসির আভাস। মা বলল ‘উজ্জয়িনীর সঙ্গে ঝগড়া হয়েছে বুঝি?’

‘কী করে বুঝলে?’ এবারে মিঠু মুখ তুলল।

‘সত্যি তো কী করে বুঝলে?’ —সাদেক বললেন।

অনুরাধা বললেন, ‘প্রত্যেকের জীবনে একটা করে সমস্যা থাকে, উজ্জয়িনীর সঙ্গে বন্ধুত্ব মিঠুর জীবনের সেই কেন্দ্রীয় সমস্যা।’ শুনে সাদেক গলা ছেড়ে হেসে উঠলেন।

‘বাবা তুমি চুপ করো তো, তুমি কিছু বোঝ না?’ মিঠু ঝাঁঝিয়ে উঠল, ‘ও মা! তুমি বাবাকে হাসতে বারণ করো না।’

‘কই, বাবা তো আর হাসছে না।’

‘বলো না ভোটের কী করব? উজ্জয়িনীকে তো আমায় দিতেই হবে।’

‘তো দিবি, সিক্রেট ব্যালট তো।’

‘না, বাবা, তুমি কিছু বোঝ না, বন্ধুদের মধ্যে ওরকম করলে ট্রেচারির মতো দেখাবে ব্যাপারটা। এমনিতেই তো উজ্জয়িনী আমায় সর্বক্ষণ ভুল বুঝছে। এর পর যদি রাজেশ্বরীও ভুল বুঝতে আরম্ভ করে…’

‘তো বল মা তারা দাঁড়াই কোথা? না কি রে মিঠু?’ বাবা হাসি হাসি মুখে বলল।

‘সোজাসুজি বলবি ওকে’, মা বলল।

‘আমিও তাই ভাবছিলাম। সোজাসুজি ওকে বলব, ওকেও আমি খুবই যোগ্য মনে করি, কিন্তু উজ্জয়িনীর সঙ্গে ছোট্ট থেকে বন্ধুত্ব, কাজেই উজ্জয়িনীকে আমায় দিতেই হবে।’

‘ঠিক।’ মা বলল!

‘সাদেক বললেন, ‘সবচেয়ে ঠিক, অর্থাৎ ঠিকেরও ঠিক ডিসিশন হল কাউকেই ভোট না দেওয়া।’

‘তা কি করে হবে বাবা। দুজনে দাঁড়িয়েছে যে।’

‘উদ্দেশ্যটা কী? ক্লাসের প্রতিনিধিত্ব? ক্লাসের ছাত্র-ছাত্রীদের অসুবিধে, ইত্যাদির কথা জানাতে যাচ্ছে, এই তো? ছাত্রদের হাতে কিছু ক্ষমতা আছে, কিছু বার্ষিক আয়-ব্যয় বরাদ্দ আছে, অ্যাকটিভিটিজ কিছু আছে সেইগুলো ঠিকঠাক চালাতে হবে, বুঝতে হবে, এই তো? তা এর মধ্যে ভোট-টোটের কী আছে? সবাই মিলে একজনকে মেনে নিলেই তো ল্যাঠা চুকে যায়।’

‘ঠিক বলেছ বাবা, ঠিক। আমিও ঠিক এইভাবে ভাবি। সক্কলে বলে আমি কিছু বুঝি না। আকাশে পা দিয়ে হাঁটি। পার্টি নাকি থাকবেই।’

সাদেক বললেন, ‘বাঘে ছুঁলে আঠারো ঘা, পুলিসে ছুঁলে ছত্রিশ, আর পলিটিকসে ছুঁলে? রক্ষা নেই। ঘা গোনা যাবে না, এত।’

অনুরাধা বললেন, ‘এটা কি তুমি ঠিক বললে! অনেকগুলো মানুষ যেখানে জমেছে, সেখানে পছন্দ-অপছন্দের পার্থক্য তো হবেই।’

‘কথাটা তো পছন্দ-অপছন্দের নয়, রাধা, যোগ্যতার। যাকে যোগ্য মনে করছ তাকে পাঠিয়ে দিলেই তো হল। এই করে করে কমপিটিটিভ মনোভাবের বিষ ছোট ছোট ইউনিটে ঢুকে যাচ্ছে। সর্বত্র, সাবার মাথার মধ্যে ঢুকে যাচ্ছে এ ছাড়া পথ নেই, এটাই গণতন্ত্র। আসলে কিন্তু এসব গণতন্ত্রের ছদ্মবেশে গোষ্ঠীতন্ত্র। গোষ্ঠীর স্বার্থতন্ত্র। একটা কলেজ। কতটুকু তার পরিধি? কাজ কী? না একটা পত্রিকা বার করা, একটা কি দুটো অ্যানুয়্যাল ফাংশন নাবানো, আজকাল ছাত্র প্রতিনিধি কলেজের গভর্নিং বডিতে থাকছে, নিজেদের অভাব-অভিযোগ সরাসরি জানাবার জন্য। এর জন্যে এত! মানুষে মানুষে সম্পর্ক খারাপ হয়ে যাচ্ছে যে। দেখো দেখি আমার ছোট্ট মেয়েটা মনে কত দুঃখ পেল? অথচ সবটাই শুধু শুধু। একেবারে অনর্থক। এনলাইট্‌ন্‌ড্ কো-অপারেশন, এই এখন একমাত্র পথ, মিঠু বুঝলি। সহযোগিতা আর সৌহার্দ্য এ ছাড়া বাঁচবার পথ নেই মা।’

মিঠুর মনে পড়ছিল গৌতমের সঙ্গে তার তুমুল তর্কের কথা। সে তা হলে তার সহজাত বোধ দিয়ে ঠিক জিনিসটাই বুঝেছে। তার মনটা আস্তে আস্তে হালকা হয়ে যাচ্ছে।

‘বাবা একটা কথা জিজ্ঞেস করব, কিছু মনে করবে না?’ মিঠু আস্তে গলায় বলল।

‘মনে করব? হায় আল্লা, তাহলে বাবা হলাম কেন?’

মিঠু বলল, ‘বাবা আমার ধর্ম কী? আমি হিন্দু না মুসলিম?’

‘কোনটাই না হবার অতি দুর্লভ সৌভাগ্য তোর হয়েছে মিঠু। তুই পৃথিবীর সেই স্বল্পতম, একমুঠো মানুষের অন্যতম যাদের পেছনে ধর্মের ভূত ষাঁড়ের মতো তাড়া করছে না, যারা খোলা চোখে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টি নিয়ে ধর্মের দিকে তাকাতে পারবে।’

‘কিন্তু বাবা, আমি যে লিখি আমি মুসলিম।’

‘কিন্তু তুমি জানো মিঠু, আচরণে তোমাকে আমরা হিন্দু-মুসলিম-খ্রিস্টান কিছু হতেই শেখাইনি। তোমার কোনও পূর্ব-সংস্কার থাকার কথা নয়।’

‘ধর্ম কি খারাপ?’

‘শোন মিঠু, চার ধরনের মানুষ ধর্ম তৈরি করেছে, তারাই ধর্ম ভোগ করে। এক নম্বর ভিতু, নার্ভের অসুখ এর, এই বিশাল জগৎ-ব্যাপারের সামনে, জীবনের জটিলতার সামনে এ ভয়ে জুজু হয়ে যায়। বোঝে না ভুবন বিশাল হলেও তার ওপর মোটেই ভুবনের ভার ন্যস্ত নয়। দু’নম্বর ক্ষমতালোভী, এ দেখে বেশ মজা তো, ধর্মের ভয় দেখিয়ে বা লোভ দেখিয়ে অনেক মানুষের ওপর দিব্যি ছড়ি ঘোরানো যায় তো! পাওয়াও যায় অনেক কিছু! এরা ভণ্ড, পাপিষ্ঠ, স্বার্থান্ধ, সব ধর্মের চার্চ এরা চালায়। তিন নম্বর কবি। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের কথা ভাবতে ভাবতে, প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য এবং রহস্য অবলোকন করতে করতে এঁরা নানান অলঙ্কারের মধ্যে দিয়ে নিজেদের বিস্ময়, আকর্ষণ, ভক্তি প্রকাশ করেন, এঁরা কল্পনা করেন কোটি দেব-দেবী, তাঁদের নিয়ে বহু পুরাণ, এঁরা দেখেন পাখা-মেলে-উড়ে আসা দেবদূত, কণ্ঠ শোনেন জিব্রাইলের, এঁরা কল্পনা করেন এক জ্যোতির্ময় শিশু কোনও পিতার সাহায্য ছাড়াই ভূমিষ্ঠ হচ্ছে এবং বৃদ্ধ প্রাজ্ঞ ব্যক্তিরা তার পূজা করছেন। আর চার নম্বর হলেন দার্শনিক, আইডিয়া বা ভাবের জগতের লোক এঁরা, এঁরা কোনও না কোনও একটা তত্ত্ব দিয়ে বিশ্বরহস্যকে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেন, বিশ্বসংসারকেই নৈতিক পথে পরিচালিত করবার চেষ্টা করেন। এই চারটে শ্রেণীর মধ্যে একজনের ভেতর একাধিক প্রবৃত্তি থাকতে পারে। কিন্তু ধর্মের পেছনে যে উদ্দেশ্য-শক্তি কাজ করছে তাতে তুই এই চারটে ধারায় ভাগ করে ফেললে তোর বুঝতে সুবিধে হবে!

‘তাহলে কি বাবা, ঈশ্বর বলে কিছু নেই!’

‘এই রে! তা তো আমি বলিনি! কিছু একটা তো আছেই। কিন্তু তা এখনও পর্যন্ত আমাদের ধারণার বাইরেই আছে। ক্ষমতালোভীর দণ্ডচালনায় ভিতুর গলির মধ্যে ঢুকে সে বস্তুর খোঁজ পাওয়া যায় না!’

‘তাহলে কী বাবা, বিভিন্ন ধর্মে যে সব কথা পাওয়া যায় সেগুলো সব হয় চালাকি, নয় ভণ্ডামি, নয় কবিতা আর তা নয়ত হাইপথেসিস?’

‘কতকটা তাই। একটা জিনিস ভেবে দেখ—সব ধর্মগুলোই তো সৃষ্টি হয়েছে অনেক দিন আগে যখন বিজ্ঞানের চোখই ফোটেনি। বিশেষ করে প্রকৃতিবিজ্ঞান। এখন এইসব ধর্ম ইতিহাসের অন্তর্গত। ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায় এরা। গবেষকের চোখ দিয়ে দেখতে হবে এদের। খুঁজতে খুঁজতে তোর নিজের স্বভাবের সঙ্গে সামজ্ঞস্যপূর্ণ বলে কোনও তত্ত্ব তোর ভালো লেগে যেতে পারে, তখন তার থেকে আচার-আচরণ, মোল্লা-পুরোহিত এই সমস্ত খোসার মতো ছাড়িয়ে ফেলে তুই সে তত্ত্বের চর্চা করতে পারিস, সত্য কী জানি না, তবে সেই সত্যের কাছাকাছি পৌঁছনোর আনন্দটা পেতে পারিস!’

মিঠু বলল, ‘বাবা আমার ভাবতে ভালো লাগে একজন আছেন, তিনি আমায় রক্ষা করবেন, আমার ডাক শুনবেন। বাবা আমি কি ভিতুর দলে?’

‘নিঃসন্দেহে মা। তুই তো একা নয়। আমাদের বেশির ভাগের মধ্যেই এই ভিতু মানুষটা কম বেশি পরিমাণে থাকে।’

অনুরাধা বললেন, ‘না রে মিঠু, যদি কাউকে ডেকে ভরসা পাস নিশ্চয়ই ডাকবি, আস্তে আস্তে বুঝতে পারবি সে যে প্রাণের মানুষ আছে প্রাণে, তাই হেরি তায় সকল খানে!’

রাতের অন্ধকারে তিনজনে বসে রইলেন আধো-অন্ধকার বারান্দায়। অনুরাধা বললেন, ‘একটা গান ধর না মিঠু! তোরা বড্ড কথা বলিস। গান গা।’

‘কী গাইব বলো!’

অনুরাধা নিজেই ধরলেন, ‘কী আর চাহিব বলে, হে মোর প্রিয়…’। মিঠু ধরে নিল দ্বিতীয় পঙক্তি থেকে ‘তুমি যে শিব তাহা বুঝিতে দিও।’ মায়ের পরিণত গলা আর মেয়ের কাঁচা গলার ভক্তিরসে প্লাবিত হয়ে যেতে লাগল সদর্থে ধর্মহীন বাড়িটার সান্ধ্য বারান্দা।

১০
‘এনভায়রনমেন্ট পাল্টাপাল্টি করে দিলে দুটো মানুষে কি সত্যি খুব তফাত হবে?’

সার ব্যালট বাক্সটা উপুড় করে দিলেন, ‘দেখো উজ্জয়িনী, আর নেই। আর একটাও নেই।’ উজ্জয়িনীর মুখ পাংশু হয়ে গেছে। ঠিক যেন তার গালে কেউ একটা চড় মেরেছে। মিঠুর মুখেরও তাই দশা। অণুকা প্রায় ছুট্টে ঘরের বাইরে বেরিয়ে গেল। বাইরে স্লোগান উঠছে—‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ। জিতছে কে, জিতছে কে, এস এফ আই আবার কে!’

সার বললেন, ‘রাজেশ্বরী আচার্য কই? সে-ও দেখুক। এসব ফর্মালিটিজ মানো তোমরা, যখন সবই আইনমাফিক করছ।’ এদিক-ওদিক তাকিয়ে কোথাও রাজেশ্বরীকে দেখতে পেলো না মিঠু। ভেঙ্কট এগিয়ে এসে বলল, ‘আমি রাজেশ্বরীর এজেন্ট সার, আমি দেখেছি, ঠিক আছে। সই করে দিচ্ছি।’

গৌতম বলল, ‘কোথায় গেল রাজেশ্বরী? এই তো একটু আগেও এখানে ছিল!’ রাজেশ্বরীকে কোথাও দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না। মিঠুর মুখের দিকে তাকিয়ে গৌতম আস্তে আস্তে বলল, ‘এস.এফ.আই যাকে দাঁড় করাবে, সে-ই জিতবে, এই সামান্য জিনিসটা বুঝতে তোরা এত সময় নিলি?’

ঠিক তার স্কুলের বন্ধু যে কজন সেই কটা ভোট পেয়েছে উজ্জয়িনী। সে বন্ধুদের সঙ্গে কাউন্টিং হলের বাইরে বেরিয়ে আসছে। একটা হাতে মিঠুর হাত এত শক্ত করে ধরেছে যে মিঠুর হাতে লাগছে। ভেঙ্কট উজ্জয়িনীর মুখের দিকে তাকিয়ে ভীষণ অপ্রস্তুত হল। সে থতমত খেয়ে বলল, ‘সরি উজ্জয়িনী নো অফেন্স মেন্ট।’ উজ্জয়িনী এক ঝটকায় পেছন ফিরে গেল। সে ফুলে ফুলে কাঁদছে। জীবনের গ্রন্থ থেকে তার একটা একটা করে ছবিঅলা পাতা খসে যাচ্ছে। হারাবার খেলা। হারবার খেলা শুরু হয়ে গেছে। ক্রমশই ন্যাড়া, বিবর্ণ হয়ে যাচ্ছে সব। মিঠু রুমাল দিয়ে মুছে মুছে লাল করে ফেলেছে মুখ, চোখ দুটোও ভারী, লাল হয়ে আছে।

ভেঙ্কট বলল, ‘ইস ছি ছি, মেয়েগুলো এত সেন্টিমেন্টাল হয়! গৌতম তন্ময়কে ডাক তো একবার!’

তন্ময় এসে বলল, ‘কী হয়েছে? হেরেছে? তো কী? ভ্যাট! উজ্জয়িনী, বেঁচে গেছ। গৌতম চল আমরা ক্যানটিনে যাই। মিঠু বিষ্ণুপ্রিয়া, উজ্জয়িনী চলো সবাই।’

উজ্জয়িনী অনেক কষ্টে বলল, ‘আমি এখন বাড়ি যাব। তোমাদের আমাকে করুণা দেখাতে হবে না।’

ভেঙ্কট বলল, ‘কে তোকে বাড়ি যেতে দিচ্ছে? দেবই না যেতে! এই সবাই মিলে ওকে ঘেরাও কর তো!’ মুহূর্তের মধ্যে উজ্জয়িনী আর মিঠুকে ঘিরে একটা বলয় তৈরি হয়ে গেল।

‘কী হচ্ছেটা কী? উজ্জয়িনী রেগে কাঁই হয়ে বলল, ‘সবাই মিলে রিজেক্ট করে এখন আবার ঢং করা হচ্ছে!’

মিঠু জানে উজ্জয়িনী ভীষণ অহংকারী। পরাজয় সে কখনও সহ্য করতে পারে না। পরাজয়ের কাছে কখনও আত্মসমর্পণও করে না। কোনও ব্যাপারে হারলে তার প্রতিক্রিয়া হল—ভারি বয়ে গেল। মিঠুর নিজের জোর অনেক অনেক কম। উজ্জয়িনী যেমন তাকে আঘাত করে, তেমনি আবার অনেক সময়ে তার এই ‘বয়ে গেল’ জীবনদর্শন দিয়ে তাকে উদ্বুদ্ধও করে। এসব ব্যাপারে উজ্জয়িনী মিঠুর আশ্রয়। যে কোনও বন্ধুবান্ধবের দলের মধ্যে এই ধরনের একটা পারস্পরিক পরিপূরকতার ব্যাপার থাকে, এই ভিত্তিতেই বন্ধুতা গড়ে ওঠে, মোটেই সবসময়ে মনের মিলের ওপর গড়ে না। এটা আজকাল মিঠু খুব স্পষ্ট করে বুঝতে পারে। উজ্জয়িনীকে কখনও এত বিচলিত হয়ে পড়তে সে দেখেনি। প্রকাশ্যে, সর্বজনসমক্ষে উজ্জয়িনী কাঁদছে এটা একটা নতুন ঘটনা।

ভেঙ্কট উজ্জয়িনীর কথা শুনে অবাক হয়ে বলল, ‘রিজেক্ট? কী বলছে রে গৌতম? রিজেক্ট কী?’

‘আর ই জে ই সি টি—বুঝলি না?’ গৌতম সঙ্গে সঙ্গে যোগান দিল।

‘অ, তাই বল! রিজেক্ট? কে বললে তোকে রিজেক্ট করা হয়েছে? যত দিন যাবে বুঝবি শাপে বর হয়েছে তোর। শাপে বর, বুঝলি?’

‘বুঝেছি। আর বোঝাতে হবে না। পথ ছাড়ো আমি বাড়ি যাব।’

‘চেষ্টা করে দেখ!’

‘ভেঙ্কট, আমি কিন্তু প্রিন্সিপ্যালের কাছে নালিশ করব তোমাদের নামে!’ উজ্জয়িনীর চোখ-মুখ থমথম করছে রাগে।

‘এই তো কী সুন্দর রীজনেবল কথা বলছিস! এমনি রাগ-টাগ করবি তবে তো তোকে মানাবে! চল আজ আমার বাড়ি চল সবাই। খাওয়াবো। উজ্জয়িনী চল প্লিজ!’

উজ্জয়িনী কিছুতেই রাজি হল না। সে মিঠুকে নিয়ে বেরিয়ে গেল। মোহন গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়েছিল, দুজনে উঠতে সে বলল, কী ধর?’

‘বাড়ি চলল, কোঠি।’

‘বাস!’ মোহন সাধারণত এত সকাল সকাল কোঠি ফরমাশ শুনতে অভ্যস্ত নয়।

‘হাঁ হাঁ কোঠি চলো না!’ স্বভাব মতো আদেশের সুরে অধৈর্যভাবে ঝাঁঝিয়ে উঠল উজ্জয়িনী। তারপরে সীটে হেলান দিয়ে চোখ দুটো বুজতে হঠাৎ তার এখনকার বাস্তব তার কাছে হু হু করে ফিরে আসতে লাগল। কে সে? ডক্টর মিত্রর চাকরকে এভাবে আদেশ করবার সে কে? যে কোনও দিন ডাঃ মিত্র ফিরে এসে তাঁর একটি অঙ্গুলিহেলনে তাকে চিরদিনের জন্য ধ্বংস করে দিতে পারেন, নয়ত তাকে মেনে নিতে হবে মায়ের সঙ্গে বিচ্ছেদের নিয়তি।

মিঠু বলল, ‘এই উজ্জয়িনী, অত ভেঙে পড়ছিস কেন? বুঝতেই তো পারছিস সবই পলিটিক্‌সের খেলা। প্লিজ একটু হাস তুই এরকম করে থাকলে আমার ভেতরটা কিরকম করতে থাকে।’

উজ্জয়িনী গাড়ির জানলা দিয়ে রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে থাকা একটি ভিখারিণীর দিকে আঙুল দেখিয়ে বলল, ‘মিঠু তুই আমাকে খুব ভালোবাসিস, না রে? আচ্ছা ধর, আমি যদি ওই রকম একটা বেগার-মেইড হতাম। ভালোবাসতিস?’

‘এ আবার কী খেয়াল?’ মিঠু বলল, ‘ইলেকশনে হেরে তোর এমন অবস্থা হল যে ভিখারির সঙ্গে নিজের তুলনা করছিস…?’ উজ্জয়িনী কোনও জবাব দিল না। কিছুক্ষণ পর মিঠু বলল, ‘দেখ উজ্জয়িনী, জীবনের এক একটা ঘটনা আমাদের এমনভাবে আঘাত করে যে কতকগুলো মৌলিক প্রশ্নের সামনে যেন আমাদের দাঁড় করিয়ে দেয়, না রে? আমি কে? শুধু আমি, সমস্ত আনুষঙ্গিক বাদ দিয়ে সুদ্ধ আমিটুকু কে! তার মূল্য কী! অন্য আরেক জনের সঙ্গে আমার তফাত কোথায়! ধর সত্যিই ভিখারিণী মেয়েটা যদি আমার জায়গায় জন্মাতো আর আমি যদি ওর জায়গায় জন্মাতাম কী তফাত হত!’

উজ্জয়িনী বলল, ‘তোর এরকম মনে হচ্ছে?’ তার গলা এত আস্তে যে প্রায় শোনাই যাচ্ছে না।

মিঠু বলল, ‘হচ্ছে না। মাঝে মাঝেই হয়। এনভয়রনমেন্ট যদি পাল্টাপাল্টি করে দেওয়া হয় তাহলে কি সত্যি দুটো মানুষে খুব তফাত হবে?’

উজ্জয়িনী বলল, ‘সত্যি! দৈবাৎ, একেবারে দৈবাৎ আমরা আমাদের ভাগ্যটা ভোগ করছি। এভাবে ভোগ করার কোনও অধিকারই আমাদের নেই রে মিঠু। ওই রাস্তায় রাস্তায় ঘোরা অনাথ ছেলে-মেয়েগুলোর জন্যে আমাদের কিছু করা উচিত। এভাবে..এটা ঠিক নয়। একদম ঠিক নয়।’ সে ‘নয়’ বলতে বলতে মাথা নাড়ছিল, তার গাল বেয়ে এক দানা চোখের জল টুপ করে চিবুকের ওপর পড়ল। মিঠুর ভেতরটা উজ্জয়িনীর জন্যে করুণায়, সমবেদনায়, ভালোবাসায় দ্রব হয়ে যাচ্ছিল।

সেই সময়ে কলেজের ইউনিয়ন রুমে আর একটা নাটক হচ্ছিল। কাউন্টিং প্রায় শেষ হয়ে এসেছে এমন সময়ে হঠাৎ রাজেশ্বরী ফলাফলটা কী হতে যাচ্ছে সেটা বুঝতে পারে। সে এসে সোজা সুকান্তকে একটা পদত্যাগপত্র দেয়। খাতার পাতা থেকে ছিঁড়ে নিয়ে খসখস করে লিখেছে সে পদত্যাগপত্রটা। তার চোখমুখ লাল। না কাঁদলেও ঝড়ের আকাশের মতো তার অবস্থা।

সুকান্ত বলল, ‘এ কি করছ রাজেশ্বরী! এ রকম হয় নাকি? এইমাত্র অত মার্জিনে জিতে এলে এক্ষুনি আবার ব্যাক আউট করা যায় না কি? আবার ইলেকশন, আবার হাঙ্গামা। না না, এরকম হয় না।’

‘আবার ইলেকশনের কী আছে? আমি ড্রপ করলেই উজ্জয়িনী আপসে চলে আসছে।’

‘তা হয় না রাজেশ্বরী। ওকে দাঁড় করিয়েছে সি.পি। আমরা এমনি এমনি ছেড়ে দেব না কি?’

‘সে আপনারা যা ইচ্ছে করবেন।’ বলে রাজেশ্বরী আর দাঁড়াল না। তার চোখের সামনে খালি ভাসছে উজ্জয়িনীর ক্রমশ ছাইয়ের মতো হয়ে যাওয়া মুখটা। সে কারুকে ডাকলো না, একলা একলা চুপি চুপি বাস-স্টপের দিকে চলে গেল।

উজ্জয়িনীর ফোন এসেছে। —‘হাল্লো!’

‘আমি ভেঙ্কট কথা বলছি। শোনো উজ্জয়িনী। জোর খবর। রাজেশ্বরী ভীষণ কান্নাকাটি করে রেজিগনেশন দিয়ে গেছে।’

‘কী?’

‘যা বললুম নির্জলা সত্যি। এস এফ আই-কে আবার ক্যান্ডিডেট দাঁড় করিয়ে আমাদের ক্লাসের ভোট নতুন করে করতে হবে। শোনো, ক্লাসের সবাইকে আমরা বলে দিচ্ছি, কেউ দাঁড়াতে রাজি হবে না। তোমাকে আমরা ইউনানি মাসলি পাঠাচ্ছি।’

‘এ সব কী হচ্ছে? আমি কি তোমাদের কাছে এসব চেয়েছি? রাজেশ্বরীই বা হঠাৎ এরকম করল কেন?’ উজ্জয়িনী এখন অনেক শান্ত হয়ে গেছে।

‘রাজেশ্বরী তো তোকে হারিয়ে ভীষণ আপসেট হয়ে গেছে, সুকান্তদা বলছে, কেঁদে কেঁদে চোখ মুখ লাল করে ফেলেছে। তোরা মাইরি দেখালি একখানা!’

‘আমি হেরে গেছি সেটা মেনে নেওয়াই আমি সম্মানজনক মনে করি ভেঙ্কট। ওসব মতলব ছাড়ো। ন্যাড়া বেলতলায় দুবার যায় না।’

‘যা ব্বা বা।’

‘বাবাকেই ডাকো আর মাকেই ডাকো, রাখছি।’

রাজেশ্বরীর নম্বর ডায়াল করল উজ্জয়িনী।

‘হ্যাললো?’

আমি উজ্জয়িনী বলছি। রাজকে একটু ডেকে দেবেন?’

‘উজ্জয়িনী? রাজির কি হয়েছে রে? হাউ-হাউ করে কাঁদল কলেজ থেকে এসে। খেলো না। এখন তো শুয়ে পড়েছে।’

‘প্লিজ একটু ডাকুন মাসি। আমার নাম করে বলবেন।’

কিছুক্ষণ পরে ভারী ধরা গলা শোনা গেল ওদিকে।

উজ্জয়িনী বলল, ‘রাজ কংগ্র্যাচুলেশনস।’

‘কিসের জন্য? আমি তো রিজাইন করেছি। বাজে যত সব।’

‘তুই না গেলে আর কেউ যাবে রাজ, আর কাউকে তো আমরা তোর মতো বিশ্বাস করতে পারব না! প্লিজ, পাগলামি করিস না। কালকে গিয়ে চিঠিটা ফিরিয়ে নিস।’

‘দূর, পড়াশোনার ক্ষতি হবে, আমি পারব না।’

‘একটা তো বছর। চালিয়ে দে না। আমাদের মুখ চেয়ে কর রাজ, প্লিজ।’

‘দেখি। চিন্তা করতে হবে।’

‘দেখি নয়, কথা দে। বিশ্বাস কর আমি কিছু মনে করিনি। আর আমারই তো ভুল, অনেকেই আমায় বলেছিল উইথড্র করে নিতে।’

‘তো নিলি না কেন?’

‘কি রকম একট রোখ চেপে গিয়েছিল, সত্যি বলছি ভুল করেছি। ক্ষমা করবি না?’

এইভাবে কিছুক্ষণের মধ্যেই কে জয়ী, কে পরাজিত, কে কাকে সান্ত্বনা দিচ্ছে, সব গুলিয়ে গেল। উজ্জয়িনী রাজেশ্বরীর কাছ থেকে কথা আদায় করে, হালকা মনে মিঠুকে ফোন করল একঘণ্টা ধরে। রাতে খুব শান্তির ঘুম ঘুমোলো। পরদিন কলেজ গিয়ে রাজেশ্বরীকে পাকড়াও করল। তারপর চিঠি ফেরত নেবার জন্য ইউনিয়ন রুমে চলল।

সুকান্ত বলল, ‘কী ছেলেমানুষি কাণ্ড বলো তো উজ্জয়িনী। ভাগ্যিস তুমি ছিলে তাই আমরা রক্ষা পেলুম। তুমিই দেখছি বেশি স্টেডি। রাজেশ্বরী, ওকে দেখে শেখো। অত ইমোশন্যাল, ইরর‍্যাশন্যাল হলে কোনও কাজ করা যায় না।’

রাজেশ্বরী বলল, ‘ফেলো ফিলিং বাদ দিয়ে, ইমোশন, ইনভলভমেন্ট এসব বাদ দিয়ে যে কাজ তাতে আমি বিশ্বাস করি না। আমি আমার বন্ধুদের সঙ্গে ইনভলভড। এতে যদি আপনাদের কাজের অসুবিধে হয় তো আমি থাকছি না। বলেই তো দিয়েছি।’

‘উঃ বাবা, এই মেয়েগুলো আমার মাথা ধরিয়ে দিলে, রাজেশ্বরী কালচ্যারাল সেক্রেটারি থাকবে, বুঝলি অরবিন্দ। ওকে লিডারশিপ দেওয়া যাবে না।’

উজ্জয়িনী ক্লাসে এলে গম্ভীরভাবে ভেঙ্কট বলল, ‘আমরা সেলিব্রেট করব। আমার বাড়িতে কাল সন্ধেয়, সুবিধে হবে কি না দেখো।’

বিষ্ণুপ্রিয়া বলল, ‘সন্ধেয় বলছিস, আমি ফিরব কী করে?’

‘কেন? তন্ময় পৌঁছে দেবে।’

তন্ময় বলল, ‘হ্যাঁ, এর মধ্যে অসুবিধের কি আছে! ভেঙ্কট, গৌতম আমরা সবাই তো নর্থে আসব।’

মিঠু বললে, ‘তোরা কেউ ইমনকে দেখেছিস?’

‘ইমন? তুই জানিস না। ও তো ন্যাশনাল চ্যাম্পিয়নশিপ খেলতে ব্যাঙ্গালোর গেছে।’

‘তাই বুঝি? ও মা। আমাকে বলেনি তো!’

‘কাউকেই বলেনি। ভোটের ব্যাপারে যোগাযোগ করতে গিয়ে শুনলুম।’

‘ইমন যদি ভালো কিছু করে, তাহলে কিন্তু আমার বাড়িতে সেলিব্রেট করব।’ ভেঙ্কট বলল।

‘কী ব্যাপার রে ভেঙ্কট, তোর যে দেখি ভীষণ উৎসাহ!’ মিঠু বলল।

ভেঙ্কট হাসি-হাসি মুখে বলল, ‘আরে বাবা আছে। র‍্যাটিওসিনেটিভ সিনক্রোনাইজেশন।’

সব্বাই হাসতে লাগল। আসলে ভেঙ্কট একটা ছোটখাটো বিপ্লবই করে ফেলেছে। ওদের বাড়িতে পাঁচ শরিকের ডালপালার সবার সঙ্গে সবাইকার ভালো সম্পর্ক নেই। ফলে অত বড় সেকালের বাড়ি, তার সেগুন কাঠের জানলা দরজা, পাথরের মেঝে, বাথ-টবঅলা বড়-বড় বাথরুম নিয়ে অবহেলিত পড়েছিল। কার্নিশ থেকে গজিয়েছে বিশাল বটগাছ। ছাতের পাঁচিলের ফাঁকে তো রীতিমতো একটা ডুমুর গাছ। তাতে কষা কষা ডুমুর ফলে। যেখান সেখান থেকে ভেঙে ভেঙেও পড়ছিল। কিন্তু কারুর নজর ছিল না। সেইখানে ভেঙ্কট উদ্যোগ নিয়ে, সবাইকার কাছ থেকে টাকাকড়ি আদায় করে বাড়ি সারিয়েছে, উৎকৃষ্টতম রঙ দিয়ে রঙ পালিশ হয়ে বাড়ি এখন ঝকঝক করছে। মাঝের উঠোনটা বাঁধানো হয়েছে তার মাঝখানে একটা লাল নীল মাছের ছোট্ট পুকুর, এবং ধারে ধারে হরেক রকমের গোলাপ। ঘরের মালিকানার একটু অদলবদলও হয়েছে। এখনও নিচেই সবাইকার আলাদা আলাদা রান্নাঘর। কিন্তু দোতলায় তেতলায় প্রত্যেকটা পরিবার মোটামুটি পাশাপাশি। সকলেই মোটের ওপর তুষ্ট, এবং ভেঙ্কটের ওপর সবারই একটা আলাদা রকম আস্থা এসেছে। সবচেয়ে খুশি হয়েছেন তার দুই জীবিত দাদু, মেজদাদু ও ছোড়দাদু। পুরস্কারস্বরূপ মেজদাদু তাঁর অংশের দোতলার পাশাপাশি ঘরদুটো ভেঙ্কটকে ব্যবহার করবার অনুমতি দিয়েছেন। ঘর দুটো বিশাল। তাতে খুব সুন্দর সেকেলে আসবাব আছে। সেগুলো পালিশ করে হয়েছে যেন রাজরাজড়ার ঘর। একটা শোয়া, পড়াশোনা ইত্যাদির জন্যে ব্যবহার করে ভেঙ্কট, আরেকটা বসার ঘর। অদূরেই বাথরুম, এটাকেও একেবারে আধুনিক করে ফেলেছে ভেঙ্কট। বসার ঘরে একটু রান্নার ব্যবস্থাও রেখেছে। মেজদাদু এবং ছোড়দাদু দুজনেই তাকে বেশ কিছু টাকা দিয়েছেন। উপরন্তু মেজদাদু তাকে শেয়ার বাজারের নানা খুঁটিনাটি শেখাচ্ছেন। সে শিগগিরই একটা পরীক্ষা দেবে। দাদুদের কাছ থেকে পাওয়া টাকাগুলো সে খাটাচ্ছে। বাড়ির আর সবাইকে সে বলেছে, ‘দেখো, আজকাল বড় বড় ফ্ল্যাট বাড়িতে অ্যাসোসিয়েশন করে কমন খরচগুলো চালায়, তা তোমরাও আমাকে বাড়ির কেয়ারটেকার করে দাও। প্রত্যেক ফ্যামিলি কিছু কিছু দেবে, আমি সব কিছু দেখাশোনা করব।’

পরীক্ষামূলকভাবে এ ব্যবস্থা চালু হয় এক মাস। ভেঙ্কট সবাইকার আস্থা ও বিশ্বাস অর্জন করতে পেরেছে। ফলে, এখন তার নিজের নামে ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট হয়েছে, সে বাড়ির প্রয়োজনে ইলেকট্রিক মিস্ত্রি, ছুতোর মিস্ত্রি, জমাদার ইত্যাদি সব কিছুরই দায়িত্ব নিয়েছে। ছোটখাটো কাজ সে নিজেই করে দেয়। তার এখন এসব বিষয়ে প্রচুর ব্যবহারিক জ্ঞান। কোন পেন্টের কত দর, সিমেন্ট কোন কোম্পানির ভালো, পুরনো সেগুন কোথায় কিনতে পাওয়া যায়, রাজমিস্ত্রির রোজ, জোগাড়ের রোজ, কিভাবে ওরা ফাঁকি দেয়, এসব এখন তার নখদর্পণে। পাড়ার নিতাই জ্যাঠা তাকে অনুরোধ করছেন তাঁদের বাড়িটা সারিয়ে দিতে। ভেঙ্কট বলেছে, ‘টু পাইস দেবেন তো জ্যাঠা!’

‘আরে ভাই, কনট্রাক্টরকে দিলেও তো সে নেবে।’

‘হ্যাঁ, নেবে মানে সব মালের থেকে কেটে কেটে নেবে, আপনি জানতেও পারবেন না। কত নিল, কোনখানে দু নম্বরি মাল দিয়ে এক নম্বরের দাম আদায় করল। তো আমি তা করব না। কাজেই আমার খাটুনির দাম পুষিয়ে দেবেন।’

এখন নিতাই জ্যাঠার সঙ্গে তার দর কষাকষি চলছে।

যাই হোক, তার নিজের একখানা চমৎকার আস্তানা হয়েছে, এবার সে কলেজের বন্ধুদের এখানে এনে আড্ডা দিতে চায়। ভেঙ্কটের এখন সর্বদাই ফুরফুরে মেজাজ। দিলদরিয়া ভাব। দাড়িটা আজকাল সে খুব কায়দা করে ট্রিম করছে। তার গোল মুখটা, ঈষৎ ছুঁচলো আঁতেল আঁতেল দেখায়, জামাকাপড়ের যত্ন বেড়েছে। রাজেশ্বরীর থেকে বেঁটে হওয়ার মনোদুঃখটা বোধ হয় অনেকটা ভুলেও গেছে সে।

গৌতমকে একদিন কোচিং থেকে ফিরতে ফিরতে বলল, ‘তুই সেদিন ভবিষ্যৎ-ভবিষ্যৎ করছিলি না? কী করবি ঠিক করলি?’

‘কী আর ঠিক করব? এখন আমি দু ফুট দূর পর্যন্ত দেখতে পাই। তো তাইতেই সন্তুষ্ট আছি। বেশি দূর অবধি দেখতে চাইলে সমস্ত মজাই মাটি। খিদে চলে যাবে। মাথা ধরবে, অম্বল হবে….’

‘থাম, থাম। তোর সঙ্গে অনেক জরুরি আলোচনা আছে’

‘জরুরি আলোচনা? কে করবে রে ভেঙ্কট? তুই? হাঃ হাঃ।’

‘কিছুদিন আগেই তো তুই ভবিষ্যতের কথা জিজ্ঞেস করছিলি। এখন আবার উল্টো গাইছিস?

‘কিন্তু এখন এই মুহূর্তে ভাবতে ইচ্ছে করছে না। তুই হঠাৎ সিরিয়াস হয়ে গেলি কেন? তোর সঙ্গে কথা বলে আমি যা হোক একটু শান্তি পাই। এমনিতেই তো সবারই মুখ গোমড়া, বাবা মা, দিদি দাদা বউদি। সব একধার থেকে রামগরুড়। কলেজে এসে মনটা একটু মুখ বদলায়।

গৌতমকে নিয়ে ভেঙ্কট হেদুয়ার ভেতর ঢুকল। খালি বেঞ্চি আর পাওয়াই যায় না। অবশেষে ঘাসের ওপরেই দুজনে বসে পড়ল। ভেঙ্কট বলল, আমার মাথায় অনেক কিছু খেলছে। দেখ তুই যদি পার্টনার হোস তো সাহস করে নেমে পড়তে পারি।’

‘ব্যবসা-ট্যাবসা করবি না কি?’ গৌতম সন্দিগ্ধ সুরে বলল, ‘দেখ ঘেঁটু। ওসব আনসার্টন ব্যাপারে আমি নেই। মাস গেলে থোক পকেটে আসবে। নিশ্চিন্ত মনে ঘুম যাব। আমি এই বুঝি। প্রাণপণে রেজাল্টটা ভালো করবার চেষ্টা করছি। আজকাল টিচিং লাইনে মালকড়ি ভালোই দিচ্ছে।’

‘দূর দূর ও আবার একটা টাকা নাকি? জানিস, আমি এখন শুধু পার্টটাইমে কত কামাচ্ছি!’

‘এই যাঃ, মনে করিয়ে দিলি। উঠি রে ভেঙ্কট টুইশনি আছে।’ গৌতম তড়বড় করে উঠে পড়ল, ‘আরেকদিন হবে।’

গৌতম চলে গেলেও ভেঙ্কট একা একা বসে রইল জলের দিকে তাকিয়ে। তার মাথায় ঘুরছে আর সি সি, এফ এ আর, ট্রাডিশনাল ব্রিক, মডুলার ব্রিক, নীট সিমেন্ট, ডেডো ফিনিশ, চাঝা, কলাম, বিম…। কলকাতার আশেপাশে বিশাল-বিশাল বাড়ি উঠছে ভেঙ্কটের। মোটা মোটা তাড়ার নোট সে গুনে গেঁথে মেজদাদুর আয়রন চেস্টে তুলে রাখছে। আস্তে আস্তে ভরে গেল সিন্দুকটা। তখনও টাকা রয়ে গেছে প্যান্টের পাশ পকেটে, হিপ পকেটে। ভেঙ্কট মস্ত বড় একটা গাড়ির পাল্লা খুলে বসল, স্প্রিংটা তাকে নাচিয়ে নিল একবার। ভেতরটা চমৎকার ঠাণ্ডা। এয়ার-কন্ডিশনড তো! সে নিজেই ড্রাইভ করছে। ভি আই পি রোড ধরে সোজা। দুধারে সুন্দর সুন্দর বাড়ি সরে সরে যাচ্ছে। গাছপালা, মাঠ-ময়দান, গরু-বাছুর। তার পেছনে, সামনে আরও গাড়ি। ভেঙ্কট একটা সিগারেট ধরালো। না, পাইপ। পাইপ না হলে ঠিক মানায় না। সে এখন এয়ারপোর্টে যাচ্ছে। তার গাড়ির বুটে একটা ফাইবারের সুটকেস আছে। সঙ্গে একটা বিউটিফুল ব্যাগ। সে আজ সন্ধের ফ্লাইটে নিউ ইয়র্ক যাচ্ছে। দিন সাতেক নিউ ইয়র্ক, তার পিসতুতো ভাই শুভো আছে, তারপর কানাডা। উত্তর আমেরিকা মহাদেশটা সে ভালো করে দেখবে। তিন মাস ধরে। কয়েক লাখ টাকা খরচ হবে। তা হোক।

১১
‘ওর ভেতরে একটা সূক্ষ্ম ইম্পিশ ব্যাপার আছে…’

সোমার বেশির ভাগ দিনই বাড়ি ফিরতে সন্ধে হয়ে যায়। একেক দিন সন্ধে উতরে যায়। অমিত রিডারশিপের জন্য চেষ্টা করছে। তারও পোস্ট ডক্টর‍্যাল পেপার্সের জন্যে খাটতে হয়। একেকদিন সেও ফেরে সোমার সামান্য আগে বা পরে। সোমা দেখছে শ্বশুরবাড়িতে এসে অমিতের কেমন একটা গা-ছাড়া ভাব এসে গেছে। আজ নিয়ে তিনদিন সে বাড়ি ফিরে দেখল অমিত ঋতুর ঘরে চিতপটাং হয়ে শুয়ে আছে, আর ঋতু উপুড় হয়ে তার গা ঘেঁষে, পা দুটোকে ওপরে তুলে গালে হাত দিয়ে মগ্ন হয়ে গল্প করে যাচ্ছে। পাশেই বেড সাইড টেবিলে দুটো প্লেটে ভুক্তাবশিষ্ট। অর্থাৎ এইখানে, এই শোবার ঘরেই খাওয়া-দাওয়া হয়েছে। সামান্য উঠে গিয়ে খাবার টেবিলে বসতেও আলস্য। সোমা মাস কয়েক হল অভ্যন্তরে একটি নতুন প্রাণের বীজ বহন করছে। এই নিয়ে তাকে প্রাণান্তকর খাটুনি খাটতে হয়। একে জোকায় যাওয়া-আসা। সেটাই তো প্রাণ বের করে দেয়। নেহাত সময়টা শীত তাই সহ্য করা যাচ্ছে। মাঝে মাঝেই তার ভীষণ শির টেনে ধরে পায়ে, পেটে। পাগলের মতো খিদে পায়। তার পরেই গা বমি করতে থাকে। নিয়মিত ডাক্তারের কাছে যাওয়া-আসাটাও সে একাই করে। অমিত কাজ করুক। পড়াশোনা করুক। কিন্তু এ কী? ঋতুর নিজের পড়াশোনা, কলেজ ইত্যাদিও চুলোয় গেছে।

সোমা বাবা-মাকে তার অবস্থার কথা বলেনি। ফ্রান্স যাওয়া ঠিকঠাক হয়ে যাবার পরে তার মা ব্যাপারটা বুঝতে পারেন। সোমা অবশ্য খুবই স্বাবলম্বী। সে কোনও অবস্থাতেই কারো সাহায্য নেওয়া পছন্দ করে না। মায়েদের সময়েও এ অবস্থায় বাপের বাড়ি থাকার রেওয়াজ ছিল। কিন্তু সোমা এসব প্রথাকে পাত্তা দেয় না। মীনাক্ষী অপরাধী গলায় বলেছিলেন, ‘তার ওপর ঋতুকে তোর ওপর চাপিয়ে যাচ্ছি।’

সোমা তখন খুব রাগ করেছিল, ‘মা, আমি একটা অ্যাডাল্ট মেয়ে, আড়াই মাসের জন্য ছোটবোনের দায়িত্ব নিতে পারব না?’

‘কিন্তু তোমার ছোটবোনটি যে কখন কী মেজাজে থাকে।’

‘—আমার ওপর ছেড়ে দাও’, চূড়ান্ত আত্মবিশ্বাসে বলেছিল সোমা, ‘তাছাড়াও ঋতু তো বড় হচ্ছে!’ সোমার ধারণা তার ক্ষেত্রে যেমন বড় হবার সঙ্গে সঙ্গে মেজাজে ভারসাম্য এসেছিল, দায়িত্ববোধ এসেছিল, নিজের জীবন সম্পর্কে নিজের একটা আলাদা কৌতূহল এসেছিল, ঋতুর বেলাতেও তাই-ই হবে। কিন্তু এক সপ্তাহে এ বাড়িতে থাকতে এসে তার সেসব ধারণা পাল্টে যাচ্ছে। ঋতুকে ঠিক যে অবস্থায় রেখে সে শ্বশুরবাড়ি গিয়েছিল, ফিরে এসে তাকে ঠিক সে জায়গায় তো সে দেখতে পাচ্ছেই না। উপরন্তু একজন সম্পূর্ণ অচেনা, কিরকম কুঁড়ে, উচ্চাকাঙক্ষাহীন, নাক উঁচু, মরিয়া ধরনের এক তরুণীর সঙ্গে বাস করতে হচ্ছে তাকে। ব্যক্তিস্বাধীনতায় সেও বিশ্বাস করে, কিন্তু তাই বলে কিছু বলতে পারে না? সে বাথরুমে গিয়ে মুখ-হাত ধুয়ে, বাইরের জামাকাপড় বদলে, গায়ে একটা গরম শাল মুড়ি দিয়ে বিছানায় কাত হয়ে শুয়ে পড়ল। কিছুক্ষণের মধ্যেই বাসন্তী চা এনে হাজির করল, সঙ্গে চিকেন ওমলেট।

সোমা বলল, ‘নিয়ে যাও বাসন্তীদি। খিদে নেই।’ বাসন্তী বলল, ‘কিছু খেয়েছ আপিসে?’ ‘না’, ‘তাহলে? সোমা এখন খিদে ফেলে রাখতে নেই, খেয়ে নাও।’ সোমা উল্টো দিকে ফিরে শুলো। বাসন্তী চা এবং জলখাবার টেবিলে রেখে, ঋতুর ঘরে সোজা ঢুকে গেল। ঋতু এখন অমিতের মাথায় চুল নিয়ে খেলা করছে। বাসন্তী বলল, ‘জামাইবাবু, সোমাদিদি এসেছে, শুয়ে পড়েছে ও ঘরে, কিছু খেলো না। না খেলে কিন্তু ভয়ঙ্কর যন্তন্‌না হবে—কিছুক্ষণ পর, বলে দিচ্ছি।’

অমিত ধড়মড় করে উঠে বসল, তারপর এক লাফে মাটিতে নেমে তাড়াতাড়ি ও ঘরে পৌঁছে গেল।

‘সোমা, সোমা, কখন এসেছ? খাওনি কেন? এই তো এখানে রয়েছে, ওঠো। খেয়ে নাও।’ সোমা একইভাবে শুয়ে। একটু নিচু হয়ে অমিত দেখল তার গালে জলের দাগ চিকচিক করছে, সে এদিক-ওদিক দেখে সোমার গালে একটা ভারী গোছের চুমু দিয়ে বলল, ‘কী হল? রাগ করেছ কেন? আমি বুঝতে পারিনি তুমি এসেছ।’

‘আমি আছি, আমি তোমার স্ত্রী, আগে বান্ধবী ছিলুম, এসব কিছুই মনে রাখবার দরকার কি অমিত? যাও, যেখানে ছিলে সেখানে যাও। আমায় বিরক্ত করো না।’

‘তাই বলে তুমি খাবে না? সারাদিনের পর? তারপরে যন্ত্রণা শুরু হবে, তখন ছোটাছুটি…’

‘তোমাকে ছোটাছুটি করতে হবে না। লেট মি অ্যালোন।’

অমিত অসহায়ের মতো দরজার দিকে মুখ করে ডাকল, ‘ঋতু, ঋতু দিদির কি হল দেখো তো, খাচ্ছে না …।’

এবার সোমা সটানে উঠে দাঁড়াল—তার মুখ ভয়ঙ্কর আকার ধারণ করেছে, সে প্রাণপণে নিজেকে সংযত করবার চেষ্টা করতে করতে চাপা গলায় বলল, ‘বেরিয়ে যাও এ ঘর থেকে অমিত, বেরিয়ে যাও বলছি!’

ঋতু ঘরে ঢুকে দাঁড়িয়েছিল। বলল, ‘পাগলের মতো চেঁচামেচি করছিস কেন? খাবি না তো খাস না—তাই বলে শুধু শুধু সীন ক্রিয়েট করবি?’ সোমা আর পারল না, হাত বাড়িয়ে ঋতুর গালে একটা ঠাস করে চড় কষিয়ে দিল, তারপর টাল সামলাতে না পেরে দড়াম করে পড়ে গেল।

‘রাইটলি সার্ভড’—ঋতু খানিকটা সরে যাওয়ায় বেশি লাগেনি। সে নিজের গালে হাত বুলোতে বুলোতে বলল।

‘অমিত বলল, “বলছ কি ঋতু—ওকে তোলো! বাসন্তীদি! বাসন্তীদি!’ বাসন্তী রান্নাঘরের ভেতর দিকে স্টোররুমের মধ্যে ছিল। কিছু বুঝতে পারেনি। সে ঘরে এসে দেখল—সোমা সটান মেঝের ওপর পড়ে আছে। অজ্ঞান। সে বলল, ‘তখনই বলেছিলুম তিন মাস পোয়াতি, সারাদিন খেটেখুটে এসে না খেলে এমন যন্তন্‌না হবে, তা মেঝেতে শুয়ে পড়েছে কেন?’

অমিত বলল, ‘পড়ে গেছে।’

‘পড়ে গেছে?’ বাসন্তী আতঙ্কিত গলায় বলল, ‘পড়ে গেছে? হাঁ করে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছ কী? ঋতু বাড়ির ডাক্তারবাবুকে কল দাও, শিগগিরই। দেখো দিকিনি, মা-বাবা নেই, এ সময়ে কত যন্ত-আত্তি, সেবার, আদরের দরকার। কেউ নেই। কী করি গো!’ বাসন্তী গ্লাসে করে জল এনে সোমার মাথায় ছিটোতে লাগল।

ডাক্তারবাবু চেম্বারে নেই, আসবামাত্র তাঁকে যেন খবরটা দেওয়া হয় বলে ঋতু ফোন রাখল। বাসন্তীতে অমিতে মিলে এখন সোমাকে বিছানায় শুইয়েছে। বাসন্তী তার পায়ে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে, অমিত মাথায় কপালে জলের ছিটে দিচ্ছে একটু একটু। সোমার পাতলা চেহারা, ঋতুর মতো সে ছোটখাটো মানুষ নয়, চেহারার ধরনটা বেশ লম্বাটে। সে এখন চিত হয়ে শুয়ে আছে বলে ঋতু বুঝতে পারল দিদি অন্তঃসত্ত্বা, এইবার বোধহয় সোমার জ্ঞান হয়েছে, চোখের পাতা ঈষৎ কাঁপছে, ঠোঁট দুটোও থরথর করে কাঁপছে। মাঝে মাঝে সে যন্ত্রণার শব্দ করছে। বাসন্তী মুখ ফিরিয়ে বলল, ‘রান্নাঘর থেকে একটু দুধ ছেঁকে নিয়ে এসো তো ঋতু, আমি এই জাল দিয়ে নামিয়ে এসেছি। একটা চামচও এনো।’

ঋতু দুধটা এনে বাসন্তীর হাতে দিল। সে নরম গলায় বলল, ‘সোমা, খুকু—দুধটা খেয়ে নাও তো সোনা!’ চামচে করে সে দুধ খাইয়ে দিতে লাগল, সোমা বাচ্চা মেয়ের মতো দুধটা খেয়ে নিল। ঋতু আস্তে আস্তে সেখান থেকে সরে এসে বারান্দায় দাঁড়াল। ডাক্তার-কাকা আসছেন না কেন এখনও?

রাত সাড়ে আটটা নাগাদ ডাক্তার সেন এবং অমিত দুজনে মিলে অ্যাম্বুলেন্সে করে তাকে নার্সিং হোমে নিয়ে গেলেন। তার পেটে খুব যন্ত্রণা হচ্ছে, ব্লীডিং হচ্ছে।

ঋতু বারান্দায় দাঁড়িয়েই ছিল, দাঁড়িয়েই ছিল। বাসন্তী যখন খাবার জন্য ডাকতে এলো, সে ববল, ‘অমিত এলে খাব।’

বাসন্তী সামান্য ঝাঁঝাল গলায় বলল, ‘অমিতের সঙ্গে তোমার কী? সে কখন আসবে তার কোনও ঠিক আছে নাকি? আর এও বলি ঋতু অত বড় জামাইবাবুকে দাদা বলতে পার না?’

‘জ্ঞান দিচ্ছ নাকি আমাকে?’ ঠাণ্ডা গলায় ঋতু বলল।

‘যা খুশি বলল আমাকে, ছোট থেকে আছি তোমাদের বাড়ি। তোমাকে দু হাতে মানুষ করেছি। কাজ করে খাই বলে মনে করো না, আমার চোখ নেই, কান নেই। মানতে না পার যেদিন বলবে চলে যাব। এখন সোমাটার কী হবে ভেবে আমার প্রাণ উড়ে যাচ্ছে।’ ঋতু চুপ করে বারান্দায় বসে রইল। দশটা নাগাদ অমিত ফিরল, উদভ্রান্ত চেহারা। বাসন্তী উৎকণ্ঠিত মুখে বলল, ‘কী হল জামাইবাবু, ভালো আছে?’ ঋতুও পেছনে দাঁড়িয়ে। অমিত বলল, ‘চেষ্টা করছেন ডাক্তাররা, সী ইজ বীয়িং, গিভন এভরি কাইন্ড অফ হেল্‌প। আমি একটু পরেই আবার যাব।’

ঋতু বলল, ‘আমিও যাবো অমিত।’

অমিত খাচ্ছিল, মুখ তুলে বলল, ‘তুমি কোথায় যাবে, ছেলেমানুষ!’

ঋতুর খাওয়ার রুচি চলে গেল। তবু সে প্লেটের খাবারগুলো নাড়াচাড়া করতে লাগল। বাসন্তী আপন মনেই বলল, ‘আজকাল সব ছেলে-ছোকরার কাণ্ড। বাড়িতে একটা বড়ো মানুষ কেউ নেই। শরীরের যত্ন, মনের যত্ন, এ সময়ে মনটাও নরম হয়ে যায়। বউদি যে এই সময়ে কেন গেল?’

অমিত মুখ-টুখ ধুয়ে ওইখানেই বসে একটা সিগারেট ধরালো। তারপর ব্যাগের ভেতর থেকে আর কিছু টাকাকড়ি নিয়ে বেরিয়ে গেল, যাবার সময়ে বলে গেল, ‘বাসন্তীদি, ঋতুকে দেখো। আমি দরকার হলে টেলিফোন করব।’

দিন সাতেক পরে সোমা বাড়ি এলো। অনেক কষ্টে বাচ্চাটা বেঁচেছে। আপাতত একদম বেড-রেস্ট। খুব ফ্যাকাশে হয়ে গেছে সোমা। স্ট্রেচার থেকে তাকে বিছানায় শুইয়ে দেবার পর ঋতু একটা পাতলা কম্বল তার গায়ে ঢাকা দিয়ে দিল। বলল, ‘সোমা! এখন কেমন আছিস?’

‘ঠিক আছি।’ সোমা একটু বিবর্ণ হাসল, ‘তুই? ঠিক আছিস তো? ব্যস্ত হোস না। কলেজ-টলেজ যা।’

অমিত ছুটি বাড়িয়ে নিল। বাসন্তীই সব করছে সেবার কাজ। ঋতু মাঝে মাঝে বাসন্তীর নির্দেশমতো একটু আধটু রান্না করে। তার কলেজ এবং নাচের ক্লাস বন্ধ করতে দেয় না কেউই। অমিত প্রায় সব সময়েই সোমার ঘরে। বিশেষত ঋতু এলেই সে যেখানেই থাকুক বোঁ করে সোমার ঘরে ঢুকে যায়। ঋতুর এতে অত্যন্ত অপমানবোধ হয়। সে-ও ঢুকেই কোন দিকে না তাকিয়ে নিজের ঘরে চলে যায়, সেখানে বসেই খায়। একটু পরে সোমার ঘরে গিয়ে সোমার খোঁজ নেয়। তারপর আবার নিজের ঘরে ঢুকে যায় বা বারান্দায় গিয়ে বসে। রাত্রে খাওয়ার সময়ে অমিত ঘরে খায়। ঋতু খায় খাবার টেবিলে। একা।

সোমা এখন একটু ভালো। গায়ে জোর পেয়েছে। সে বলল, ‘ঋতু ফিরলেই তুমি ওরকম ল্যাজ তুলে এ ঘরে দৌড়ে আসো কেন?’

অমিত গম্ভীরভাবে বলল, ‘তোমার স্বাস্থ্যটা তো দেখতে হবে?’

‘অমিত শ্লেষ করে নিজের দোষ ঢাকবার চেষ্টা করো না। দিনের পর দিন কাজ ফেলে বাড়িতে বসে আড্ডা দিয়েছ, আমাকে বাদ দিয়ে দুজনে সিনেমা গেছ, দোকানবাজার গেছ, দিনের পর দিন। প্রতিদিন রাত্তির সাড়ে ছটা সাতটায় বাড়ি ফিরে দেখেছি …’ সোমা থেমে গেল।

‘কী দেখেছ বলো! বললে না!’

‘তুমিও জানো আমিও জানি, বলবার আর কী আছে?’ সোমা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।

‘সেই জন্যেই তো এই ব্যবস্থা নিয়েছি।’

‘এটাও মোটেই ঠিক হচ্ছে না। ও কি ভাবছে বলো তো! একটা ছোট মেয়ে বই তো নয়।’

‘তুমি যতটা ভাবছ ততটা ছোট ও নয় বোধহয়, ওর ভেতরে একটা সূক্ষ্ম ইম্পিশ ব্যাপার আছে।’

‘সূক্ষ্ম-টুক্ষ্ম নয়। বেশ স্থূলভাবেই আছে। ও নিজে সব সময় সবার মনোযোগের কেন্দ্র হতে চায়। ছলে-বলে-কৌশলে। না হতে পারলে খেপে যায়’, সে ক্ষীণ স্বর তুলে ডাকতে লাগল, ‘ঋতু! ঋতু!’

বেশ কিছুক্ষণ পর ঋতু এসে দরজার গোড়ায় দাঁড়াল। সোমা বলল, ‘খেয়েছিস?’

‘হ্যাঁ।’

‘এখানে এসে বস না রে একটু! শুয়ে শুয়ে বোর হয়ে গেলাম।’

‘কেন একজন তো রয়েছে।’

‘দূর দুজনে আড্ডা হয়! এখন তো আমি আউট অফ ডেঞ্জার। চলে আয়, তিনজনে মিলে আড্ডা দেওয়া যাবে।’

ঋতু একবার অমিতের, একবার সোমার মুখের দিকে তাকাল। তার পর গম্ভীরভাবে বলল, ‘আমার নাচ প্র্যাকটিস আছে। ও ঘরে যাচ্ছি।’ সে চলে যাবার জন্য ফিরে দাঁড়িয়েছে, সোমা বলল, ‘এ ঘরে কর না।’

‘এ ঘরে স্পেস নেই যথেষ্ট,’ বলে ঋতু আর দাঁড়াল না।

একটু পরে সোমা বলল, ‘ওর মেজাজ ঠিক হতে সময় লাগবে।’

অমিত বলল, ‘তোমার অত ব্যস্ততার দরকার কি? যখন ঠিক হবে, হবে।’

‘সে তো বটেই।’ সোমা বলল, ‘তবে আমার আট ন’বছরের ছোট বোন কি না! দেখো অমিত ও ছেলেমানুষ। ওর মধ্যে এখনও অনেক ইম্যাচুওরিটি আছে। চড়টা আমি ওকে মেরেছিলুম অসভ্যতার জন্য। বড় দিদি হিসেবে শাসন করবার রাইট আছে বলে। কিন্তু, আসল চড়টা আমি নিজের গালেই মেরেছি।’

অমিত জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে। সোমা হতাশ হয়ে বলল, ‘বুঝতে পারলে না? তুমি কিন্তু ছেলেমানুষ নও, ইম্যাচিওর নও, বুঝতে না পারার কোনও কৈফিয়ত তোমার নেই। জীবনে যা করবে, দায়িত্ববান মানুষ হিসেবে করবে।’

অমিত বলল, ‘বুঝলুম।’

‘কী বুঝলে?’

‘সময়ে বলব। আপাতত বাদানুবাদ চালাবার পক্ষে বড্ড চিঁচিঁ করছ। চুপ করো।’

১২
‘বোলও তো চমৎকার বললে …’

এই সময়ে উজ্জয়িনীদের বাড়ির জমায়েতটা ঋতুর কাছে আশীর্বাদের মতো এলো। এমনিতে উজ্জয়িনী তার বাড়িতে যেতে কাউকে উৎসাহিত করে না। কারণটা ঋতু জানে। অনুকা আর মিঠুরই একমাত্র ও বাড়িতে অবাধ যাতায়াত। অনুর কাছ থেকেই সে শুনেছে। স্কুলে থাকতে অবশ্য উজ্জয়িনীর জন্মদিনে গেছে। সামান্য কয়েকজন বন্ধুকে ডাকত উজ্জয়িনী। ঋতুদের বাড়ির মতো জমজমাট পার্টি হত না। মাসি বাড়িতেই রান্না করে খাওয়াতেন। সেই সময়ে কখনও কখনও উজ্জয়িনীর বাবাকে দেখেছে। টকটকে ফর্সা, যেন ইংরেজ। দারুণ সুন্দর ছিলেন, এককালে বোঝা যায়। এখনও মোট-টোটা হয়ে গেলেও খুব আকর্ষণীয়। অন্তত ঋতুর তাই মনে হয়। গলার আওয়াজটা? দূর থেকে যেন মেঘের ডাক ক্রমেই কাছে এগিয়ে আসছে। সব মিলিয়ে ভেরি ভেরি মাচ ম্যাসকুলিন। কলেজের অত জনকে বাড়িতে ডেকে উজ্জয়িনী পার্টি দেবে শুনে সে একটু অবাকই হয়েছিল। অনুকে জিজ্ঞেস করে জানলো উজ্জয়িনীর বাবা এখন এখানে নেই। জরুরি কেসে বাইরে গেছেন।

ওই আকর্ষণীয় মানুষটিকে দেখতে পাবে না বলে ঋতুর একটু মেজাজ খারাপ হল। কিন্তু বাড়িতে আরো স্যাঁতসেঁতে থাকে মেজাজ। ঢুকেই মিঠুকে দেখতে পেল ঋতু। তারপর রাজেশ্বরী, অনু। প্রচুর ফুল সাজিয়েছে উজ্জয়িনী। কিন্তু নিজে একদম সাজেনি। একটা হলুদ-কালো হায়দ্রাবাদি শাড়ি পরেছে। ঋতু কিন্তু অনেক দিন পর হল্লা হবে বলে খুব সেজেছে। লিভিংরুমে লম্বা আয়নায় নিজের নতুন ফ্যাশনের সালোয়ার কুর্তা পরা চেহারাটা দেখে সে খুব খুশি হল। ফিল্‌ম স্টারের মতো দেখাচ্ছে। গ্ল্যামারাস। মিঠু বলল, ‘ঋতু তুই দিন দিন সুন্দর হচ্ছিস।’ ঋতু বলল—‘আহা কে কাকে বলছে?’ এই সময়ে খোলা দরজা দিয়ে আরও কয়েকজন ঢুকে এলো। সঙ্গে সঙ্গে ঋতুর মেজাজ খারাপ হয়ে গেল! ওই ভেঙ্কট আর গৌতম বলে ফাজিল ছেলেগুলোকে কেন যে উজ্জয়িনী-মিঠুরা এত পাত্তা দেয়! একেবারে ফালতু। তন্ময় হালদারও এসেছে। এটা অত ফাজিল নয়। কিন্তু ওরা কি ঋতুদের ‘সেট’-এর। সে যেখানে বসেছিল সেখানেই বসে বসে উজ্জয়িনীদের য়ুরোপ ঘোরার অ্যালবামটা দেখতে লাগল। মাসি সবার সঙ্গে পরিচয় করছেন।

ভেঙ্কট দারুণ মাঞ্জা দিয়ে এসেছে, গৌতমও তাই। খালি তন্ময় পরিষ্কার শার্ট-প্যান্ট পরা। মাসি বললেন, ‘কোথায়, ঠিক কোন জায়গায় থাকো বলো তো?

‘সাহিত্য পরিষদ স্ট্রিট।’ ভেঙ্কট বলল।

‘সাহিত্য পরিষদের পালবাড়ি? মঞ্জুষা তোমার কে হয়?’

ভেঙ্কট বলল, ‘মঞ্জুপিসি? আমার পিসি হন, মেজদাদুর মেজ মেয়ে।’

‘তাই বলো, মঞ্জু তো আমার ভীষণ বন্ধু ছিল, কত গেছি এক সময়ে তোমাদের বাড়ি। মঞ্জু এখন কোথায় আছে?

‘পুনেতে।’

‘আসে?’

‘কই আর? ওখানে প্র্যাকটিস করে তো! রেগুলার চিঠিপত্র দেয়। ফোন করে!’

‘খুব ভালো লাগল তোমার সঙ্গে দেখা হয়ে, আমাদের সেইসব অল্প বয়সের দিনগুলো! মাধুরীদি, অলকা ওদের কী খবর?’

ভেঙ্কট বলল, ‘মাধুরী পিসিমা কানাডায় সেট্লড, অলকা পিসি থাকে আসাম।’

‘কী বিরাট পরিবার ছিল তোমাদের। কত দিনের ঐতিহ্য! তোমার বাবার নামটা বলো তো হয়ত চিনতে পারব।’

‘আমার বাবার নাম পঙ্কজ পাল। আমাদের এখনও ওই রকমই বিরাট ফ্যামিলি মাসিমা।’

‘ওরে ব্বাবা, পঙ্কজদা? দারুণ ফুটবল খেলতেন। ভীষণ ব্রাইট। কোথায় আছেন এখন?’

‘বাবা তো অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি, হেলথ ডিপার্টমেন্টে।’

‘আচ্ছা! ক’ভাই বোন তোমরা?

‘—বোন নেই মাসিমা, বড় দাদা আছে, ইলেকট্রিক্যাল এঞ্জিনিয়ার, সি ই এস সি-তে আছে।’ ঋতু কান খাড়া করে ছিল। ফুটবল? বারবেরিয়ানস’ গেম! অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রটারি, হেল্থ! দাদা এঞ্জিনিয়ার? ভেঙ্কটের সোশ্যাল ব্যাকগ্রাউন্ড তো খারাপ না! মাসি যা করছেন, ভেঙ্কটের সঙ্গেই বোধহয় সারাক্ষণ কথা বলবেন!

তন্ময়ের মা যে কলেজের প্রিনসিপ্যাল, সেখানে মাসিরা পড়েছেন দেখা গেল। মাসি এবং ভেঙ্কটেশের পিসিরা—মাধুরী, মঞ্জুষা আর অলকা।

উজ্জয়িনী বলল, ‘মা, তুমি ওদের এমন করে ঠিকুজি-কুলুজি নিতে শুরু করেছ যে!’ মাসি বললেন, ‘আসলে, নর্থ ক্যালকাটায় আমার মামার বাড়ি। ছোটবেলায় বাবার ঘুরে ঘুরে কাজ ছিল, আমরা তো মামার বাড়ি থেকেই মানুষ। সেইসব ছিল জীবনের সবচেয়ে সুন্দর দিন। কত দিন যাওয়া হয় না। অনেক দিন ধরে ভাবছি আমাদের মহিলা-শিল্প সমিতির একটা উত্তরের শাখা খুলব। তোমাদের বাড়ি একদিন মেলোমশাইকে দেখতে যাব ভেঙ্কট।’

‘নিশ্চয়ই যাবেন, আমি তো একটু আগেই বলতে যাচ্ছিলাম।’

ঋতু অ্যালবামটা বন্ধ করে রেখে দিল। মিঠু বলল, ‘এই আজকে ঋতুর নাচ হোক। ঋতুর কত্থকের সিক্সথ ইয়ার চলছে। দারুণ নাচে। ঋতু প্লিজ নাচ্।’ ঋতু বলল, ‘তবলা নেই। তাছাড়া বোল বলে বলে আমি নাচতে পারব না। হাঁফিয়ে যাই।’

রাজেশ্বরী বলল, ‘ঠুংরির সঙ্গে নাচ না। আমি গেয়ে দিচ্ছি।’

গৌতম একটু লাজুক গলায় বলল, ‘তবলা আছে?’

অমনি সবাই হই-হই করে উঠল। মাসি বললেন, ‘সব আছে, তবলা, ঘুঙুর, হার্মোনিয়াম। মেয়ে কিছুই শিখল না।’

কিছুক্ষণের মধ্যেই সব বেরোল। ঘুঙুরের বাক্স থেকে ঘুঙুরগুলো বার করে নেড়ে-চেড়ে দেখল ঋতু। বলল, ‘খুব ভালো ঘুঙুর রে উজ্জয়িনী, দারুণ আওয়াজ, ওয়েটটাও ঠিক আছে।’

‘তবে তো সাত মন তেল পুড়ল, রাধা এবার নাচুক।’ ভেঙ্কট মন্তব্য করল।

কিছুক্ষণের মধ্যেই রাজেশ্বরী হার্মোনিয়ম নিয়ে, গৌতম তবলা ঠুকতে ঠুকতে বসে গেল। গৌতম বলল, ‘বোল যদি কিছু মাঝখানে বলতে হয়, লিখে দাও। আমি বলে দেব।’

উজ্জয়িনী বলল, ‘সবই যদি হল তাহলে আর আলোকসম্পাতটা বাকি থাকে কেন! খাবার টেবিল একেবারে ধারে সরিয়ে মাঝখানে নাচের ফ্লোর হল। এটা জ্বালিয়ে ওটা নিবিয়ে উজ্জয়িনী এমন আলো জ্বালল, যাতে মাঝখানে ঋতুর ওপরেই শুধু আলো পড়ে। দারুণ জমে গেল। মাসি মুগ্ধ হয়ে বললেন, ‘এ তো প্রোফেশন্যাল স্ট্যান্ডার্ড একেবারে।’ ঋতু গৌতমের দিকে কটাক্ষে তাকিয়ে বলল, ‘তুমি তো দারুণ বাজাও!’

‘শখ আর কি!’ গৌতম লজ্জা পেয়ে উড়িয়ে দিতে চাইল।

‘বোলও তো চমৎকার বললে!’

‘ওই। শখ। মাঝে মাঝে নাচের সঙ্গেও বাজাতে হয় তো। বলতেও হয়।’

রাজেশ্বরী দুটো ভজন গাইল। তবলায় গৌতম নন্দী। মিঠু গাইল দুটো রবীন্দ্রসঙ্গীত। মাসি খুব হৃষ্ট মুখে বললেন, ‘এ তো রীতিমত জলসা হয়ে গেল রে! যাক তোরা গল্প স্বল্প কর, আমি খাবার জোগাড় করি।’

উজ্জয়িনী আলো জ্বেলে দিল কতকগুলো। বলল, ‘প্রিয়া তুই এতো চুপচাপ কেন রে? কি হয়েছে?’

‘..কই? কিছু না তো!’

মিঠু বলল, ‘সন্তোষকে বলিস নি উজ্জয়িনী?’

‘সন্তোষ আজ দিন আষ্টেক হল কলেজে আসেনি, ফোনও নেই। থাকে বেহালায়। খবর দেওয়া যায়নি।

রাজেশ্বরী বলল, ‘ও জানতে পারলে খুব রাগ করবে রে!’

ভেঙ্কট বলল, ‘তাতে কী হয়েছে? আমাদের পরবর্তী প্রোগ্রাম তো আমার বাড়িতে। তখন আসবে। হই চই হবে।’

এই সময়ে একটা ট্রলি ঠেলে যমুনা প্রবেশ করল, তার ওপর লম্বা ডাঁটির ছোট ছোট সুদৃশ্য পাত্রে লাল রঙের পানীয়।

গৌতম আর ভেঙ্কট সবিস্ময়ে মুখ চাওয়া-চাওয়ি করল। উজ্জয়িনীর মা বললেন, ‘রাজেশ্বরী ইলেকশন জিতেছে, সেই জয়ের অনারে একটা ভোদকার বোতল খুলেছি। সবাই নাও।’ ভোদকার সঙ্গে টোম্যাটো রস, ব্লাডি মেরি।

ভেঙ্কট বলে উঠল, ‘মাসিমা হুর্‌রে, আপনি না…’

‘কী? গেম?’ হাসতে হাসতে অমিতা বললেন।

ভেঙ্কট মাথা নাড়ল, জনান্তিকে গৌতম আর তন্ময়কে বলল, ‘গেম ফেম নয় মাসিমা একেবারে ঘ্যাম।’

মিঠু বলল, ‘আপনি নেবেন না, মাসি?’

‘হ্যাঁ নেব।’ একটা পাত্র তুলে নিয়ে অমিতা বললেন, ‘চীয়ার্স।’ সবাই প্রতিধ্বনি করল, একটু পরে অমিতা বললেন, ‘এটা কিন্তু একসেপশন, ডোন্ট মেক ইট এ রুল।’ সবাই হেসে উঠল।

ক্রমশ টেবিল খাদ্যসম্ভারে ভরে উঠল। উজ্জয়িনী ওদের হাতে প্লেট চামচ, সব তুলে দিতে লাগল। সে তার মাকে এত হাসিখুশি, উজ্জ্বল, ছেলেমানুষ কখনো দেখেনি। তার নিজের মধ্যেটা এখনও ভারী হয়ে রয়েছে। যদিও যা শুনেছে তা অতি দূর, অদেখা, সুতরাং, গল্পকথার মতো। কিন্তু মা? মা কি গোপন কথা বলতে পেরে হালকা হয়ে গেছে?

বন্ধুরা চলে গেলে উজ্জয়িনী একলা বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াল। ওরা বাঁক ফিরে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে একে একে। সবাই স্বাভাবিক পরিবারের ছেলে মেয়ে। মা আছে বাবা আছে। এইরকম লজ্জাকর অতীত। লজ্জাকর বর্তমান কি কারো? সে আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল হে-ভগবান, আমি কেন? আমাকেই কেন? এত জনের মধ্যে থেকে সব রকম দুর্ভাগ্যের জন্যে আমাকেই বেছে নিলে কেন? সব কিছুতে আমাকেই হারতে হবে কেন? আমি কেন? কেন? কেন? এখন আমি কী করব? বাবা যে কোনও মুহূর্তে আমার জীবনটা তাসের ঘরের মতো ভেঙে দিতে পারে। যেভাবে শীলা ভার্গবকে নিয়ে বেরিয়ে গেল, বাবা মরিয়া হয়ে গেছে। হয়ত নিজেই ডিভোর্স চাইবে। লোকলজ্জার বালাই তো নেই। সবার চোখের সামনে দিয়েই তো এইভাবে চলছে, মাথা উঁচু করে বেঁচে আছে। যত লজ্জা, যত দুঃখ, অপমান তো স-বই মায়ের। আর আমার। কত সুখী আর সবাই! ওরা যখন জানতে পারবে আমার পরিচয়। চোখে চোখ ফেলবে না। মুখ লুকিয়ে পালিয়ে যাবে লজ্জায়!

উজ্জয়িনী আর ভাবতে পারছে না। মা এসে বলল, ‘জুনি শুতে চল।’ উজ্জয়িনী আস্তে আস্তে নিজের ঘরে গেল। মা বলল, ‘ড্রেস চেঞ্জ করে আমার ঘরে আয়। আমার কাছে শুবি।’

অনেক রাতে অমিতার ঘুম ভেঙে গেল, পাশে মেয়ে নেই। জানলার দিকে তাকাতেই চোখে পড়ল বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। গালের ওপর রাস্তার আলো পড়েছে। সেই উজ্জয়িনী, গর্বিত, অভিমানী, আদুরে, অসহিষ্ণু, সর্দারি করা যার মজ্জাগত ; কথায় কথায় বন্ধুদের সঙ্গে ঝগড়া, এই ছাড়াছাড়ি হয়ে গেল। আবার দুদিন পরেই ভাব, কোনক্রমেই লেখাপড়া বা অন্য কিছুতে গুরুত্ব দিতে শেখাতে পারেননি। সে যেন চিরকাল তার অবস্থানের জোরেই সব কিছু পেয়ে যাবে, তাকে কোনও উদ্যম নিতে হবে না। আজ তাকে চেনা যাচ্ছে না। অমিতার ভয় করতে লাগল। কিন্তু তিনি কত পাহারা দিয়ে রাখবেন ওকে? তীক্ষ্ণ নজর রাখতে লাগলেন তিনি মেয়ের ওপর। কিন্তু নড়লেন না। চুপচাপ বসে রইলেন। আধঘণ্টা পরে উজ্জয়িনী ঘরে এলো। ফিসফিস করে বলল, ‘মা, তুমি বসে আছ?’

‘তুই বারান্দায় দাঁড়িয়ে, আমার ঘুম ভেঙে গেল।’

উজ্জয়িনী আস্তে আস্তে শুয়ে পড়ল। ছটফট করছে। অমিতা মাথায় হাত রাখলেন, ‘ঘুমো, ঘুমো।’

‘ঘুম আসছে না মা।’

ভোর রাত অবধি দুজনে জেগে রইল। সমস্ত পৃথিবীর মধ্যে যেন তারা দুটিই মাত্র বিনিদ্র মানুষ।

১৩
তার কষ্ট বেশি না ইমনের?

ইমন ফাইনাল খেলছে। উল্টো দিকে বম্বের মায়া ভাবনানি। ইমনের চোখ, মন সমস্ত সবুজ টেবিলটার আলোকবৃত্তের ওপর কেন্দ্রীভূত। সে দেখে নিয়েছে মায়া ভাবনানির ফোর হ্যান্ডটা দুর্বল। মায়া বেঁটেখাটো। একটা পিংপং বলের মতোই সে লাফাচ্ছে তার উল্টো দিকে। ইমন লম্বা, রোগা, সে দুলছে জোরালো হাওয়ার বেগে বাঁশের কঞ্চির মতো। মায়া সার্ভিস করে যেন কেউটে সাপের ছোবল। টেবিলের কোনায় পড়ে ছিটকে যাচ্ছে বল। ওর সার্ভিসগুলোতে ছুঁতে পারছে না ওকে ইমন। শেষ বলটা সে চমৎকার একটা টপ স্পিন মারল। পয়েন্ট ইমনের। ইমনের সার্ভিস। তুলেছে মায়া, নেটের ওপর দিয়ে টুক করে ড্রপ শটে পড়ল, এক লাফে এগিয়ে এসে ইমন তুলল বলটাকে, টেবিলের বাইরে চলে গেল। এইভাবে পাঁচটা অবধি গড়ালো গেম, ইমন পারল না। একটুর জন্যে হেরে গেল। ঘামে সোঁপাটে ভিজে গেছে। ভাবনানির সঙ্গে হ্যান্ড শেক করে ইমন ফিরে যাচ্ছে। ক্লিক ক্লিক ক্যামেরা, সাংবাদিকরা তাকে ঘিরে ধরেছে। ‘দারুণ খেলেছেন, জাস্ট ব্যাড লাক।’ ‘স্টাইল অনবদ্য।’

‘কী মনে হচ্ছে আপনার? টুনামেন্টটা কিন্তু আপনারই হাতে ছিল। অত ভ্যারাইটির মার। কী মনে হচ্ছে?’ নাছোড় সব সাংবাদিক।

‘কী মনে হবে? পারলাম না এই মনে হচ্ছে!’ ইমন হাসল। আসলে কিন্তু সে সবুজ জলের তলা দিয়ে যাচ্ছিল। চারপাশে অজানা গাছ। গুল্ম, সমুদ্রের তলার সব প্রাণী তাকে নিরীক্ষণ করছিল। ইমন ভেসে ভেসে বেরিয়ে যাচ্ছিল। যখন খুব মনোযোগ থাকে, তখন সে এইরকম আলোকময় সবুজ জলের তলায় চলে যায়। অনেকক্ষণ এই জায়গা থেকে বার হতে পারে না। ট্রোফি নিল মায়া। সে রানার আপ। টীম ইভেন্টেও বম্বে। ডাবল্‌স্-এ কুসুম ভার্গিজের সঙ্গে তারা জিতেছে।

হোটেলে ফিরে চান-টান খাওয়া-দাওয়া সেরে সবাই লাউঞ্জে বসে আছে। কুসুম বললে, ‘ইমন, তোমার ওপর কিন্তু আমাদের অনেক আশা ছিল।’ ইমন বলল, ‘জানি।’ ইমন জানে তার ওপর অনেকের আশা, অনেকের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে। কুসুম আবারও বলল, ‘দারুণ খেলা তোমার যেন গান গাইছ, কিন্তু ইমন ওই যে বলে কীলার ইনস্টিংট! ওইটেরই কি অভাব তোমার?’ ইমন উঠে বসল। সত্যিই তো! খেলতে খেলতে খেলার শিল্পে সে মগ্ন হয়ে যায়, প্রতিপক্ষকে প্রতিপক্ষ বলে মনে করে না, যেন তার পার্টনার। জেতার ওপর সে গুরুত্ব দেয় না। কুসুম বলল, ‘কিচ্ছু না, তুমি কোচ পাল্টাও। ইমন।’

সংবাদটা টিভি-র মারফত শুনে মন খারাপ হয়ে গেল মিঠুর, ভেঙ্কটের। খেলা খানিকটা দেখালও। মিঠুর দাদা সুহাস বলল, ‘একটা এক্স ফ্যাকটর থাকে, থেকেই যায় এসব খেলায়। একটু এদিক ওদিক হলেই পয়েন্ট গেল। তাছাড়া বম্বের কোচিং অনেক বেশি বৈজ্ঞানিক। কত খরচ করে ওদের পেছনে। এখানে কী আছে? না কোনও এনকারেজমেন্ট, না টাকা-পয়সা, না প্রপার কোচিং। আমি ইমনের খেলা আগেও দেখেছি। খুব ভালো। কিন্তু ঠিক লোকের হাতে পড়া চাই।’

অনুরাধা বললেন, ‘ওর কি সব চান্সই চলে গেল? এই শেষ?’

‘তা কেন?’ সাদেক বললেন, ‘আবার আসছে বছর খেলবে, আসছে বছর ও পাবেই। আমি বলে দিলুম, দেখো।’

ভেঙ্কট প্রথমটায় খুব ভেঙে পড়েছিল। খবর শুনেই মাথায় হাত দিয়ে নিজের ঘরে শুয়ে পড়ল। পারল না? ইমনটা পারল না! বেঙ্গলে ওকে কেউ ছুঁতে পারেনি দু বছর। কলকাতায় থাকতে এসে কি অবনতি হল মেয়েটার?

কলেজ গিয়ে কিন্তু সে সম্পূর্ণ অন্য কথা বলতে লাগল। ন্যাশনাল চ্যাম্পিয়নশিপ-এ রানার আপ হওয়াটাই কি সোজা কথা! তাছাড়া কাগজে ফলাও করে ইমনের স্টাইলের প্রশংসা করেছে। এমনিতেই তো খেলার পাতার দুই তৃতীয়াংশ জুড়ে থাকে ক্রিকেট আর ফুটবল, বাকি টুকুতেও টেনিস, হকির জয়জয়কার। টেব্‌ল্ টেনিস কোণঠাসা হয়ে যাচ্ছে ক্রমশ, অথচ কী বিউটিফুল খেলাটা! ভেঙ্কট বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে তর্ক জুড়ে দেয়। বলে, দেখ ইমনের হার কোনও কারণে সেদিন শরীরটা ঠিক ছিল না। এইসব আনুষঙ্গিক ব্যাপারই ভীষণ জরুরি হয়ে দাঁড়ায় এ ধরনের টুর্নামেন্টে। সবাই বলল, ‘ভেঙ্কট তুই-ই ট্রোফিটা দিয়ে দে ইমনকে।’

‘দেবই তো, দেবই তো’ ভেঙ্কট একটুও দমে না।

মঙ্গলবার খেলা শেষ হল, ইমন কলেজে এলো পরের সোমবার। সেই একই রকম আলগা শার্ট আর ব্লু-জীন্‌স্ পরে লম্বা লম্বা পায়ে হাঁটতে হাঁটতে সে তন্ময়ের কাছে সাহায্য প্রার্থনা করল। অনেকদিন কলেজ কামাই হয়ে গেছে, তন্ময় নোট-টোট যদি দেয়। ভেঙ্কট বলল, ‘আমি তোর জন্যে সব জিরক্স করে রেখেছি। ফিলসফির জন্যে রাজেশ্বরীকে বল।’ মিঠু বলল, ‘এতদিন কোথায় ছিলি রে ইমন?’ ইমন বলল—‘বাড়ি গিয়েছিলাম, মাকে ভাইকে দেখতে।’

‘বাবা?’

‘বাবা তো নেই!’

‘তোর বাবা নেই? বলিসনি তো?’

‘বলবার আর কি আছে!’ ইমন স্মিতমুখে বলছে যেন বাবা না থাকাটা খুব একটা স্বাভাবিক ব্যাপার।

‘তোর ভাই কত বড় রে?’

‘বছর দশ হবে।’

‘কোথায় পড়ে?’

‘ওখানেই স্কুলে পড়ে।’

‘খেলে তোর মতো?’

‘না।’

উজ্জয়িনী বলল, ‘শেখাস না?’

‘পারবে না। পোলিওতে একটা পা জখম।’

‘ইস্‌স্। মাসিমা ওকে নিয়ে একা একা? কার কাছে থাকিস তোরা?’

বিপজ্জনকরকম ব্যক্তিগত আওতায় চলে আসছে আলোচনা। ইমন বলল, ‘কার কাছে থাকবে? একা একাই থাকে। কোয়াটার্স আছে।’

‘মাসি কাজ করেন? কোথায় রে?’

‘হাসপাতালে, নার্স।’

উজ্জয়িনী পাশেই দাঁড়িয়ে শুনছিল। হঠাৎ তার মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গেল। সে তাড়াতাড়ি সেখান থেকে চলে গেল। মিঠু লক্ষ্য করেনি। কিন্তু ইমন লক্ষ্য করেছিল। সে জানে, সে জানত তার মায়ের বৃত্তির পরিচয় পেলে এরা এইসব সম্পন্ন পরিবারের শহুরে মেয়েরা সেটা ভাল ভাবে নেবে না। তার বাবা নেই। তার ভাইয়ের পোলিও, তার মা নার্স, নার্স মানে কী? তাদের তো আলাদা কোনও কোয়াটার্স নেই, ছোট্ট এক ঘরের একটা আস্তানা, একটু রান্নাঘর আর কলঘর। উজ্জয়িনীর বাবা মস্ত বড় ডাক্তার, গাইনি, সে জানে, মিঠুর বাবা নামকরা কমার্শিয়াল আর্টিস্ট, ঋতুর বাবা প্রাইভেট ফার্মে বড় অফিসার, ওদের মায়েরাও বড় বড় কাজ করেন, কেতাদুরস্ত, চলায় বলায় একেবারে অন্য জগতের মানুষ। এরা তার দিকে, তার মায়ের দিকে বাঁকা চোখে চাইবে, সে সহ্য করতে পারবে না। তাই সে একা একা থাকে, কারো সঙ্গে অন্তরঙ্গ হতে চায় না। নিষ্ঠুর, দাম্ভিক, এই শহর, সে জানে। কিন্তু তার মা যে তার মা-ই। তার সমস্ত ছেলেবেলা, আনন্দ, ভালবাসার কেন্দ্র, তার পঙ্গু ভাইটি আর তার মা, আর তার অকালমৃত বাবা, যিনি হাসপাতালের ক্লার্ক ছিলেন। কী কঠোর দারিদ্রে তাদের দিন কাটছে। এরা এইসব ফর্সা, চুল কাটা, লিপস্টিক মাখা মেয়েরা সেসব কল্পনাও করতে পারবে না।

হোস্টেলে গিয়ে সে দেখল তার নামে একটা লম্বা খামের চিঠি এসেছে। উল্টেপাল্টে সে দেখল সেন্ট্রাল গর্ভমেন্টের। রেলওয়েজ। তাকে যত শীঘ্র সম্ভব দেখা করতে বলা হচ্ছে।

উজ্জয়িনী নার্স কথাটা কানে এলেই ধাক্কা খায়। সে সরে এসেছিল ওই কারণেই। মিঠু ক্লাস শেষ হতে বলল, ‘উজ্জয়িনী তখন তুই চট করে চলে এলি, ইমন বোধ হয় কিছু মনে করল।’ ইমনের সঙ্গে মিটু অন্যদের চেয়ে বেশি ঘনিষ্ঠ। সে অনুভব করে ইমনের ভেতরে কোথাও ব্যথার জায়গা আছে। বাবা নেই, ভাইয়ের পোলিও, এই দুটো কথাতেই ইমনের দুর্ভাগ্যের একটা ছবি যেন কেউ কাঠকয়লা দিয়ে তার সামনে এঁকে দিয়েছিল।

উজ্জয়িনী অন্যমনস্ক ভাবে বলল, ‘কে বললে?’

‘কে আবার বলবে? আমার মনে হল।’

‘আচ্ছা, আমি ইমনের সঙ্গে কথা বলব।’

‘কী বলবি? দূর কিছু বলতে যাস নি।’

মিঠু মনে মনে দুঃখ পেল, উজ্জয়িনীকে সে এত ভালবাসে, কিন্তু ওর মধ্যে করুণা, ভালবাসা, এ জিনিসগুলো বোধ হয় কোনদিন আর জন্মাবে না। ইদানীং আবার সে যেন আগের চেয়েও খামখেয়ালি হয়ে উঠেছে। সে তবু বলল, ‘ইমনের কী কষ্ট বল তো! বাবা মারা গেছেন। মাকে সব চালাতে হয়, ভাইটার আবার পোলিও। যত কষ্ট কি একজনকেই দিতে হবে?’ হঠাৎ যেন উজ্জয়িনীর মুখের ওপর কে চাবুক মারল। অস্পষ্ট ভাবে সে বুঝতে পারল, ইমনের অনেক সমস্যা আছে। তার চেয়ে বেশি কী? সারা ক্লাস ধরে সে শুধু এই কথাই ভাবে। তার কষ্ট বেশি না ইমনের? ইমন কি কোনভাবে তার সমস্যার কাছাকাছিও আসতে পেরেছে? না, বোধ হয় না। পরক্ষণেই মনে হয়, তার জাগতিক সুখ সৌভাগ্য অনেক আছে, ইমনের সেসব নেই। তাহলে?

এইসব কথাই সে আজকাল ভাবে সবসময়। এইরকম ভাবতে ভাবতেই একদিন সে বাড়ি গিয়ে দেখল সামনে অনেকগুলো গাড়ি দাঁড়িয়ে। সে ভেতরে ঢুকল, লিফটম্যান তার দিকে যেন কেমন করে তাকাল, দরজা খোলা, মা বসে আছে, সঙ্গে একগাদা আত্মীয়স্বজন, সবাইকার থমথমে মুখ। কী হল? যাক মা, মা অন্তত আছে। তার এক পিসতুতো দাদা তাকে কোণে টেনে নিয়ে গিয়ে বলল, ‘মামার প্লেন অ্যাকসিডেন্ট করেছে। বেশির ভাগই মৃত। মামা যুঝছে, এখনও কাউকে যেতে দিচ্ছে না।’ উজ্জয়িনী দুহাতে মুখ ঢাকল। মা বলল, ‘জুনি, আমার কাছে আয়।’ সবাই পথ করে দিচ্ছে। উজ্জয়িনীকে ধরে ধরে তার মার কাছে পৌঁছে দিল তার পিসতুতো দাদা। মা উজ্জয়িনীকে জড়িয়ে ধরে আছে। মা কি জানে উজ্জয়িনীর সেই স্বপ