Wednesday, August 27, 2025
Homeরম্য গল্পমজার গল্পঅলৌকিক - শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়

অলৌকিক – শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়

অলৌকিক – শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়

বর্ষা নামিবার সময় উত্তীর্ণ হইয়া গিয়াছে, কিন্তু এখনও বর্ষা নামে নাই। চারিদিকে আগুন। ছুটিতেছে। দ্বিপ্রহরে তাপমান যন্ত্রের পারা অবলীলাক্রমে ১১৮° পর্যন্ত উঠিয়া যায়। মনে হয়, আর দু-চার দিন বৃষ্টি না নামিলে গয়া শহরে লোকগুলার অচিরাৎ গয়াপ্রাপ্ত ঘটিবে।

একটি পাকা বাড়ি। দ্বিপ্রহরে তাহার দরজা জানালা সব বন্ধ; দেখিলে সন্দেহ হয় বাড়ির অধিবাসীরা বাড়ি ছাড়িয়া পালাইয়াছে। কিন্তু আসলে তা নয়। বাড়ির যিনি কর্তা, তিনি গৃহিণী ও পুত্রবধূকে লইয়া দার্জিলিঙ পালাইয়াছেন বটে, কিন্তু বাকি সকলে বাড়িতেই আছে। ইহারা সংখ্যায় তিনজন। এক, কতার পুত্র সুনীল; সে কলেজের ছুটিতে বাড়ি আসিয়া বিরহ এবং গ্রীষ্মের তাপে দগ্ধ হইতেছে, কারণ বৌ দার্জিলিঙে। দুই, সুনীলের বিবাহিতা ছোট বোন অনিলা। সে শ্বশুরবাড়ি হইতে অনেক দিন বাপের বাড়ি আসিয়াছে, শীঘ্রই শ্বশুর তাহাকে লইয়া যাইবেন, তাই সে দার্জিলিঙ যাইতে পারে নাই। তিন, তাহাদের ঠাকুরমা। বৃদ্ধা অতিশয় জবরদস্ত ও কড়া মেজাজের লোক, বাড়ি হইতে তাঁহাকে নড়ানো কাহারও সাধ্য নয়।

দ্বিতলের একটি ঘরে অনিলা দ্বার বন্ধ করিয়া আঁচল ঘুরাইয়া ঘুরাইয়া নিজেকে বাতাস করিতে করিতে ঘুরিয়া বেড়াইতেছিল। আর একটি ঘরে সুনীল লুঙ্গি পরিয়া গায়ে ভিজা গামছা জড়াইয়া মেঝের উপর পড়িয়াছিল। তাহার চক্ষু কড়িকাঠের দিকে, মন দার্জিলিঙ পাহাড়ে। দার্জিলিঙ পাহাড়ে গিয়াও মন কিন্তু তিলমাত্র ঠাণ্ডা হয় নাই। দেহমনের উত্তাপে গামছা যখন শুকাইয়া যাইতেছে, তখন সে কুঁজার জলে গামছা ভিজাইয়া আবার গায়ে জড়াইতেছে।

ঠং ঠং করিয়া ঘড়িতে দুটা বাজিল। এখনও চার ঘণ্টা এই বহ্নি প্রদাহ চলিবে; আকাশে সূর্যদেব ভস্মলোচন সন্ন্যাসীর মতো একদৃষ্টে তাকাইয়া আছেন।

অনিলা আঁচলটা গায়ে জড়াইয়া ঘর হইতে বাহির হইল। সুনীলের দরজায় করাঘাত করিয়া অবসন্ন কণ্ঠে ডাকিল, দাদা!

সুনীল দরজা খুলিয়া দিল। দুই ভাই বোন কিছুক্ষণ ঘোলাটে চোখে পরস্পরের পানে চাহিয়া রহিল, তারপর সুনীল বলিল, কি চাই?

ক্লান্ত মিনতিভরা সুরে অনিলা বলিল, দাদা, একটা কাজ করবে?

সন্দিগ্ধভাবে সুনীল বলিল, কি কাজ? এ অবস্থায় কাজের নাম শুনিলেই মন শঙ্কিত হইয়া ওঠে।

অনিলা বলিল, আমার গলায় দড়ি বেঁধে কুয়োতে চোবাতে পারো? তবু যদি একটু ঠাণ্ডা পাই। 

সুনীল একটু বিবেচনা করিয়া বলিল, চোবাতে পারি, কিন্তু তাতে আমার লাভ কি? আমার শরীর তো ঠাণ্ডা হবে না!

অনিলা বলিল, তোমার শরীর ঠাণ্ডার দরকার কী? তোমার অর্ধাঙ্গিনী দার্জিলিঙে আছেন, তাঁকে চিঠি লেখো না, শরীর আপনি জুড়িয়ে যাবে।

সুনীলের নাসারন্ধ্র স্ফীত হইল, সে বলিল, চিঠি লিখব! অর্ধাঙ্গিনীকে চিঠি লিখব! এ জন্মে আর নয়। অরুচি হয়ে গেছে। ভিজা গামছা বুকে ঘষিয়া বক্ষস্থল কিঞ্চিত শীতল করিয়া বলিল, চিঠি লিখলেই যদি শরীর জুড়িয়ে যায়, তুই হেবোকে চিঠি লিখগে যা না।

হাবু অনিলার স্বামীর ডাকনাম। তাহাকে হেবো বলিয়া উল্লেখ করিলে অনিলা চটিয়া যাইত, কিন্তু আজ তাহার রাগ হইল না। বস্তুত স্বামীর চিঠি কয়েকদিন হইল আসিয়াছে, কিন্তু সে রাগ করিয়া উত্তর দেয় নাই। বিবাহিতা যুবতীদের এমনই স্বভাব, ক্লেশের কোনও কারণ ঘটিলেই তাঁহাদের সমস্ত রাগ পতিদেবতার উপর গিয়া পড়ে।

অনিলা বলিল, বাজে কথা বোলো না, ওর উপর আমার আর একটুও ইয়ে নেই। যদি কোনও উপায় থাকে তো বল।

সুনীল বলিল, একমাত্র উপায় যজ্ঞ করা। আমাদের সংস্কৃতের অধ্যাপক সেদিন বলছিলেন, যজ্ঞ করলেই বৃষ্টি হয়—যজ্ঞাৎ ভবতি পর্জন্য।

অনিলার মাথার মধ্যে বিদ্যুৎ খেলিয়া গেল, সে বিস্ফারিত চক্ষে চাহিয়া বলিল, দাদা!

সুনীল বলিল, কি?

অনিলা রুদ্ধশ্বাসে বলিল, বড়ি!

সুনীলের শঙ্কা হইল, গরমে অনিলার মাথার ঘিলু গলিয়া গিয়াছে, তাই সে এলোমেলো কথা বলিতেছে।

বড়ি! কিসের বড়ি?

 বড়ি বড়ি– বড়া বড়ির নাম শোননি কখনও?

শুনেছি। তা কি হয়েছে?

বলছি, ঠাকুরমা যদি বড়ি দেন, তাহলে নিশ্চয় বিষ্টি হবে। আজ পর্যন্ত কখনও মিথ্যে হয়নি।

কথাটা সত্য। সেকালের ঋষিরা যজ্ঞ করিলে বৃষ্টি হইত কিনা এতকাল পরে তাহা নিঃসংশয়ে বলা যায় না, কিন্তু ঠাকুরমা বড়ি দিলে বৃষ্টি নামিবেই। আজ পর্যন্ত ইহার অন্যথা হয় নাই। এ বিষয়ে ঠাকুরমার ব্যতিক্রমহীন রেকর্ড আছে। তিনি শেষ পর্যন্ত রাগ করিয়া বড়ি দেওয়া ছাড়িয়া দিয়াছেন।

সুনীল একটু উৎফুল্ল হইয়া বলিল, বুদ্ধিটা মন্দ বার করিসনি। কিন্তু বুড়িকে রাজী করানো শক্ত হবে।

অনিলা তাহার হাত ধরিয়া টানিয়া বলিল, চল না, দাদা, চেষ্টা করে দেখি। যেমন করে পারি রাজী করাবো। আমার ডাল ভিজানো আছে। বড়ার অম্বল করব বলে ভিজিয়েছিলাম—

সুনীল বলিল, আচ্ছা তুই এগো, আমি লুঙ্গিটা ছেড়ে যাচ্ছি। ঠাকুরমা দুচক্ষে লুঙ্গি পরা দেখিতে পারে না, লুঙ্গি পরিয়া তাঁহার সম্মুখে উপস্থিত হইলে কার্যসিদ্ধি তো হইবেই না, অনর্থক বকুনি খাইতে হইবে।

নীচের তলায় ঠাকুরঘরটি সবচেয়ে ঠাণ্ডা, কারণ এই ঘরে সংসারের পানীয় জলের ঘড়াগুলি থাকে। ঠাকুরমা মেঝেয় শুইয়া এক হাতে পাখা নাড়িতেছেন, অন্য হাতে মহাভারত বাগাইয়া ধরিয়া পড়িবার চেষ্টা করিতেছেন। অনিলা প্রবেশ করিয়া বলিল, ওমা, তুমি ঘুমাও নি দিদি! তা এই গরমে কি আর ঘুম হয়। পাখা নেড়ে নেড়ে হাতটা বোধ হয় ধরে গেছে। দাও, আমি বাতাস করছি।

শিয়রের কাছে বসিয়া অনিলা ঠাকুরমার হাত হইতে পাখা লইয়া জোরে জোরে বাতাস করিতে লাগিল। ঠাকুরমার মুখখানি ঝুনা নারিকেলের মতো, বাহিরে শুষ্ক হইলেও ভিতরে শাঁস আছে। তিনি নাতিনীর প্রতি একটি তীক্ষ্ণ কটাক্ষপাত করিলেন, কিন্তু কিছু বলিলেন না। অনিলা বলিল, বাবাঃ, কি গরমই পড়েছে এবার, চিংড়িপোড়া হয়ে গেলুম। এমন গরম আগে আর কখনও পড়েনি।

ঠাকুরমা বলিলেন, কেন পড়বে না, ফি বছরই পড়ে।

এই সময় সুনীল প্রবেশ করিল; বিনা বাক্যব্যয়ে ঠাকুরমার পায়ের কাছে বসিল এবং তাঁহার একটা পা কোলের উপর তুলিয়া লইয়া টিপিতে আরম্ভ করিল। বৃদ্ধা ক্রুদ্ধ বিস্ময়ে ঘাড় তুলিয়া বলিলেন, নেলো, ঠ্যাং ছেড়ে দে শিগগির। আজ তোদের হয়েছে কি?

সুনীল বলিল, হবে আবার কি, কিছু না। সবাই বলে আজকালকার ছেলেমেয়েরা গুরুজনকে ভক্তিচ্ছেদ্দা করতে জানে না। তাই দেখিয়ে দিচ্ছি। গুরুজনের মতো গুরুজন পেলেই ভক্তিচ্ছেদ্দা করা যায়। বলিয়া আরও প্রবলবেগে পা টিপিতে লাগিল।

অনিলা পাখা চালাইতে চালাইতে বলিল, যাই বল, মা বাবা শ্বশুর শাশুড়ি সকলেরই আছে; তাঁদের কি আমরা ভক্তি করি না? কিন্তু এমন ঠাম্মা কটা লোকের আছে? আমাদের কি ভাগ্যি বল দেখি দাদা!

ঠাকুরমা উঠিয়া বসিলেন, পর্যায়ক্রমে নাতি ও নাতিনীকে নিরীক্ষণ করিয়া কড়া সুরে বলিলেন, কি মতলব তোদের বল্ দেখি! ঠিক দুপুরবেলা আমাকে হেঁদো কথা শোনাতে এলি কেন?

সুনীল আহত স্বরে বলিল, কোথায় ভাবলাম, দুপুরবেলাটা বৃথাই কেটে যাচ্ছে, যাই ঠাকুরমার সেবা করিগে, তবু পরকালের একটা কাজ হবে। তা তুমি বলছ ঘেঁদো কথা। তবে আর আমরা যাই কোথায়? বলিয়া গভীর দীর্ঘশ্বাস মোচন করিল।

অনিলা বলিল, শুধু কি তাই! বাবা দার্জিলিঙ থেকে চিঠি লিখছেন—তোরা ঠাকুরমার দেখাশুনো করছিস তো! বাবা যদি এসে দেখেন

ঠাকুরমা ধমক দিয়া বলিলেন, আ গেল যা! ইনি আবার ঢাকের পেছনে ট্যামটেনি এলেন! যা বেরো আমার ঘর থেকে। দুটো ভূত-পেত্নী জুটেছে!

ভূত-পেত্নী কিন্তু নাছোড়বান্দা। সুনীল আবার ঠাকুরমার পা টানিয়া টিপিবার উপক্রম করিল। ঠাকুরমা অনিলার হাত হইতে পাখা কাড়িয়া লইয়া সুনীলের পিঠে এক ঘা বসাইয়া দিলেন—তোরা যাবি, না আমার হাড় জ্বালিয়ে খাবি! বেরো শিগগির, আমি এখন দ্রৌপদীর রন্ধন উপাখ্যান পড়ছি।

সুনীল এইরূপ একটা সুযোগেরই অপেক্ষা করিতেছিল, বলিয়া উঠিল, দ্রৌপদীর রন্ধন উপাখ্যান। হুঁ, রন্ধনের কী জাত দ্রৌপদী? তোমার মতন বড়ি দিতে জাত?

অনিলা অমনি বলিল, সে আর জানতে হয় না। দ্রৌপদী তো তস্য কালের মেয়ে, আজকালই বা কটা মেয়ে ঠামার মতন বড়ি দিতে পারে? সরোজিনী নাইড়ু পারে? বিজয়লক্ষ্মী পণ্ডিত পারে?—আহা সেই কবে ঠাকুমার বড়ি খেয়েছি, এখনও যেন মুখে লেগে আছে।

সুনীল সশব্দে ঝোল টানিয়া বলিল, বলিস নি, বলিস নি, আমার জিভে জল আসছে।

ঠাকুরমার মনটা নরম হইল, কিন্তু সন্দেহ দূর হইল না। তিনি বলিলেন, নে, আর ন্যাকরা করতে হবে না, আসল কথাটা কী তাই বল্। কি চাস তোরা?

সুনীল অবাক হইয়া বলিল, চাইব আবার কি, তোমার সেবা করতে চাই। তবে বড়ির কথায় মনে পড়ে গেল। কদ্দিন তোমার বড়ি খাইনি। দুটি বড়ি পাড়োনা দিদি।

অনিলা বলিল, হ্যাঁ দিদি, লক্ষ্মীটি দিদি, আমার ডাল ভিজানো আছে, আমি এক্ষুনি বেটে দিচ্ছি—

কিছুক্ষণ ঠাকুরমার কলহ কলিত কণ্ঠের সহিত নাতি-নাতনীর করুণ মিনতি মিশ্রিত হইল; তারপর বৃদ্ধা পরাভূত হইলেন। কিন্তু আদৌ উহারা যে বড়ি পাড়াইবার মতলবেই আসিয়াছিল, তাহা ধরিতে পারিলেন না।

বেলা তিনটের সময় ঠাকুরমা তেলমাখানো থালায় কয়েকটি বড়ি পাড়িয়া রোদে দিলেন।

.

বেলা চারটের সময় আকাশের কোণে সিংহের মতো স্ফীত কেশর কয়েকটা মেঘ মাথা তুলিল। দেখিতে দেখিতে গুরুগুরু ধ্বনির সহিত বর্ষণ শুরু হইয়া গেল। অতি ভৈরব হরষ, ক্ষিতিসৌরভ রভস, কিছুই বাদ পড়িল না। ঠাকুরমার বড়ি ভাসিয়া গেল।

কিন্তু ইহাই একমাত্র অলৌকিক ঘটনা নয়।

পুলক রোমাঞ্চিত রাত্রি। বৃষ্টির উদ্দাম প্রগলভতা কমিয়াছে; টিপিটিপি মেঘ বধুরা যেন অভিসারে চলিয়াছে।

সুনীল নিজের ঘরে চিঠি লিখিতে বসিয়াছে—

প্রিয়তমাসু, আজ প্রথম বৃষ্টি নেমেছে

অনিলা নিজের ঘরে দ্বার বন্ধ করিয়া চিঠি লিখিতেছে— প্রিয়তমেষু

১০ ভাদ্র ১৩৫৯

Anuprerona
Anupreronahttps://www.anuperona.com
Read your favourite literature free forever on our blogging platform.
RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here


Most Popular

Recent Comments