Sunday, September 14, 2025
Homeবাণী ও কথাআলো - সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়

আলো – সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়

সেকালটাই ছিল মজার কাল। সবেতেই মজা। বাড়িতে চোর পড়লেও মজা। চোরেরাও ছিল অন্যরকম। প্রকৃতই অভাবী মানুষ। পেটের দায়ে চোর। ছিচকে চোর। ঘটি, বাটি, গামছা, জামা, লোহার বালতি, তোলা উনুন, কেরোসিন তেলের বোতল, হাতের কাছে যা পাওয়া যায় তাইতেই সন্তুষ্ট। কোনওক্রমে রান্নাঘরে ঢুকতে পারলে সেই মাঝরাতেই হাপুসহুপুস করে খানিক পায়েস খেয়ে নিলে।

কোনও ইজ্জত ছিল না তাদের। চরিত্রে আত্মসম্মান বোধটাই অনুপস্থিত। সেকালের চোর ধরা পড়লে গণপিটুনিতে মরত না। ভোর হওয়ার আগেই চড়চাপড় দিয়ে ছেড়ে দেওয়া হত। সে ছিল শান্তির কাল।

একদিন মাঝরাতে চোর এসেছে! জ্যাঠামশাইয়ের ঘরে। খাটের কাছে গিয়ে ঝুঁকে পড়ে দেখছে, ঘুম কতটা গভীর! জ্যাঠামশাইয়ের ভরাট মুখে অসাধারণ এক জোড়া গোঁফ ছিল, ইংরেজিতে। যাকে বলে, ‘হ্যান্ডলবার মুস্ট্যাশ।’ গোঁফ জোড়া দেখে চোর মুগ্ধ। আলতো করে টেনেছে।

জ্যাঠামশাই ঘুমোতে-ঘুমোতেই বলছেন—আসল, আসল। বিরক্ত না করে ডিবেতে কাশীর জর্দা দেওয়া পান আছে, দুটো খিলি মুখে পুরে চলে যা।

চোর বললে—কত্তা, রাতে খাওয়াই জোটেনি। শুধু-শুধু পান খেয়ে কী করব!

খুব রেগে গিয়ে জ্যাঠামশাই বলছেন—হতচ্ছাড়া! রাতের খাবারটাও জোটাতে পারিস না, চুরি করতে এসেছিস!

বালিশের তলা থেকে একটা পাঁচ টাকার নোট বের করে চোরকে দিয়ে বললেন—নে ধর।

পুরো ব্যাপারটাই হচ্ছে চোখ বুজিয়ে।

চোর বললে কত্তা, মাথাটা একটু তুলুন না, দেখি বালিশের তলায় আর কী আছে!

জ্যাঠামশাই বললেন—সমান দুভাগ করেছি। বউয়ের তবিল থেকে দশ ঝেড়েছিলুম, তোর পাঁচ আমার পাঁচ। একেবারে ন্যায়বিচার। ওই পাঁচ-ও দিতে পারি যদি আমার পা-দুটো টিপে দিস!

সে আমি দিচ্ছিখন। তোমার ঘরে খাবারদাবার কিচ্ছু নেই?

গাছপাকা দুটো আতা আছে তাকে। খবরদার ঘরের মেঝেতে বিচি ফেলবি না।

রাত আড়াইটের সময় আতা খেয়ে চোর পা টিপতে বসল। আবার জিগ্যেস করল কাল কী এই টাইমে আসব?

দুঃখ মেশানো গলায় জ্যাঠামশাই বললেন—সুখের দিনের আজই শেষ রাত্তির। কাল সকালেই ফিরে আসছেন বাপের বাড়ি থেকে। তুই বরং একটা কাজ করতে পারিস, এক ফাঁকে এসে বলে যেতে পারিস, টাকা দশটা তুই নিয়েছিস।

চোর বলল—মাপ করো কত্তা। মা ঠাকুরুনকে আমরা খুব চিনি। টাকা তুমি ফিরিয়ে নাও।

আর আতা!

কত্তা! সে তো খেয়ে ফেলেছি। এই লাইটারটা কাল চুরি করেছিলুম। তুমি রাখো। যা হয় কোরো।

আর একদিন চোর মাঠের ওপর দিয়ে দৌড়োচ্ছে, পেছন-পেছন আমার বলশালী কাকাবাবু ছুটছেন, ব্যায়ামবীর। তার পেছনে আমরা। ওপাশে চোর মুখ ঘুরিয়ে থমকে দাঁড়িয়েছে, এপাশে আমার কাকাবাবু। মাঝখানের ব্যবধান হাত পঞ্চাশ। এতক্ষণ হচ্ছিল দৌড়ের অলিম্পিক। এবার রেস্টলিং।

দুজনেই দুজনকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ছে।

চোর বলছে–কী হল! হিম্মত থাকে এসে ধরো।

কাকাবাবু বললেন—হিম্মত থাকে তো তুই আয় না।

চোর বললে—কোনও দিন শুনেছ, চোর এসে সাধ করে ধরা দিচ্ছে! চোর সবসময় পালায়, আর চোর পালালে তোমাদের বুদ্ধি বাড়ে।

তা পালা, থামলি কেন হঠাৎ! চোর আর ছুঁচো এই দুটোকে আমি ধরি না। আমার ঘেন্না করে। নে নে, ছোট-ঘোট।

আর কত ছুটব! প্রায় এক মাইল হল, সেই গজার মোড় থেকে দৌড় শুরু হয়েছে।

কাকাবাবু বললেন—তুই তো ব্যাটা আচ্ছা অধার্মিক। চোরের ধর্মই হল পালানো।

এতক্ষণে এটা তো বুঝেছ, আমি তোমার চেয়ে জোরে দৌড়োই। ইচ্ছে করলে পালাতে পারি।

তা পালাচ্ছিস না কেন?

কী করে পালাব? তোমাদের বাগানে কৃষ্ণকলির ঝোপে আমার মাল পড়ে আছে যে!

তোর চোরাই মাল আমাদের বাগানে! নিয়ে যা, নিয়ে যা।

চোর আর কাকাবাবু দুজনে গল্প করতে-করতে ফিরে এলেন, যেন হলায়-গলায় বন্ধু। দাওয়ায় বসে কাকাবাবু বললেন—আয় বোস, একটু জিরিয়ে নেওয়া যাক। দৌড়টা বেশ ভালোই হল কী বল? তামাক সাজতে পারিস?

তা আর পারি না!

যা, ওইধারে সব আছে। টিকে, দেশলাই, দুটো-কো, অম্বুরি তামাক। ভালো করে সেজে আন।

দুজনে আয়েস করে তামাক খেতে লাগলেন। ওদিকে ভোর হতে শুরু করেছে। এই চোর কালু কিছুদিনের মধ্যেই কাকাবাবুর ব্যবসায় কাকাবাবুর ডান হাত হয়ে গেলেন। আরামবাগে। কাকাবাবুর বিরাট কাপড়ের আড়ত। কালীবাবু বিশ্বাসী ম্যানেজার। ভীষণ খাঁটিয়ে।

বেশ কিছুদিন পরে কাকাবাবু বললেন কালু, এইবার একটি ভালো মেয়ে দেখে তোর বিয়ে দেবো।

কালু বলল—আবার! ওই চক্করে আর পা দিচ্ছি না।

সে কী রে! বিয়ে করিছিলি? বউ কোথায়?

চুরি হয়ে গেছে।

এখন তাই ভাবি, এই হাইটেক যুগে এইরকম সৎ চোর আর দেখতে পাওয়া যাবে না। আর রসিক গৃহস্থ! আমার দাদু, চোরের কাঁঠাল কাঁধে করে চোরের বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে এসেছেন!

.

২.

দাদু আমাদের পরিবারে সবচেয়ে মজার মানুষ। নাম করা আইনজীবী। খুব ‘পপুলার’। যখন গম্ভীর তখন ধারেকাছে যাওয়ার সাহস থাকে না কারুর। মারাত্মক চেহারা। ছ’ফুটের ওপর লম্বা। সেই রকম স্বাস্থ্য। ভোরবেলা দমাদ্দম ব্যায়াম করেন। মুঠো-মুঠো ভিজে ছোলা হল ব্রেকফাস্ট। গায়ে সরষের তেল ডলে গঙ্গাস্নান। কথায়-কথায় গরিলাদের মতো বুকে দুমদুম চাপড় মেরে সঘোষে নির্ঘোষ—শরীরম আদাম খলু ধর্ম সাধনম। আই অ্যাম এ হোয়াইট গরিলা। আমাকে যথেষ্ট সম্মান করে, সকলের সামনে, স্কুলের বন্ধুদের সামনেও ‘টিকটিকি’ বলে ডাকেন। হুইচ ইজ সো ইনসাল্টিং। মাকে বহুবার বলেছি—মা, তোমার বাবাকে সাবধান করে দিও।

মা বললে–বাবাকে সাবধান! আমার নাম রেখেছে ঘৃতকুমারী। তোর বাবার নাম হয়েছে মুষল। জ্যাঠামশাইয়ের নাম রেখেছে হাবিলদার। কাকাবাবু চৌকিদার। কী করবি বল!

দাদু একদিন রাতে খাওয়ার আগে খানাঘরে আসনে বসে বললেন—তোমাদের ভোজের আসরে আমার একটি সারস্বত নিবেদন আছে। ইদানীংকাব্যরচনায় মনোনিবেশ করেছি। লিখেও। ফেলেছি কয়েকছত্র। এতে মহাকাব্যের গুণ দেখতে পাচ্ছি। অনেক-অনেক দিন মহাকাব্য কেউ লিখলেন না। তার কারণ মুনি-ঋষিরা কেউ নেই। অবশেষে আমাকেই হাত দিতে হল। এই কাব্যের নাম, ‘টিকটিকিকাব্য’।

আমার ভীষণ প্রতিবাদ—এই কাব্য পাঠ করলে, আমি খাবার ঘর ছেড়ে চলে যাব। দাদু বললেন—সেটা অবশ্যই খুব বোকামির কাজ হবে; কারণ আজ শনিবার। তুমি স্পেশ্যাল ভোজ মিস করবে। পোলাও, মালাইকারি, রসনাসিক্তকারী সুখাদ্য যাবতীয়। বৎসে! ইংরেজরা আইন করেও কলমের স্বাধীনতা হরণ করতে পারেনি। সুতরাং শান্ত হয়ে বসে শ্রবণ করো। এটি পরে। নানাভাষায় অনূদিত হবে। চতুর্দিক থেকে মানুষ আসবে এই টিকটিকি কুঞ্জে অবতার দর্শনে।

এ অতি সুস্বাদু জীবন কাহিনি
অবতরিলেন এক সুদৃশ্য টিকটিকি।
মাথা ভরা কৃষ্ণ কেশ কৃষ্ণের মতো।
সারাদিন নানাভাবে পরিচয্যারত।

আর এগোলো না। খাবার এসে গেল। পোলাও-এর সুগন্ধে মহাকাব্য চাপা পড়ে গেল। খেতে খেতে দাদু বললেন—জানো তো, আমার আর ভালোমন্দ খেতে ইচ্ছে করে না। নিজেকে অপরাধী মনে হয়। সেদিন ভোলানাথের সঙ্গে কথা হচ্ছিল। অত বড় গুণী মানুষ; কিন্তু নেগলেকটেড। একসময় মানুষটা খেয়ে আর খাইয়ে আনন্দ পেত। আমাকে বলছে—ধোঁকা খেতে কী ভালোই বাসতুম। স্ত্রী চলে যাওয়ার পর কাকেই বা বলব, কে-ই বা শুনবে! কারই বা সময় আছে!

আমার খুব ইচ্ছে!

সকলেই উন্মুখ! জ্যাঠামশাই বললেন সামনের রবিবার নেমন্তন্ন করা যাক। ধোঁকা এমন একটা কিছু হাতি-ঘোড়া ব্যাপার নয়!

দাদু বললেন—আমি সমস্যার গভীরে যেতে চাই।

বাবা বললেন—ডিপ ইনসাইড।

দাদু ভীষণ খুশি হয়ে বললেন—অ্যায়! তুমি ঠিক বাঙলাটা বলেছ—ডিপ, ডিপ, ডিপ ইনসাইড দা প্রবলেম।

জ্যাঠামশাই বললেন—বিস্তারিত জানতে ইচ্ছে করছে। বাংলা করলে, ইন ডিটেলস।

বাড়ির বাইরে লাল রঙের আলাদা একটা লেটার বক্স প্লেস করব। তার গায়ে লেখা থাকবে— ভোজন বক্স।

জ্যাঠামশাই বললেন—ওয়ান্ডারফুল। তার মধ্যে ধোঁকা থাকবে। ভোজন বক্স না লিখে ধোঁকার বাক্স লিখলে কেমন হয়?

আমার আইডিয়া আরও সুদূরপ্রসারী। এই পাড়ায় যার যা খেতে ইচ্ছে করছে, বিশেষ কোনও পদ, অতীতে খেয়েছে, স্মৃতিতে আছে, যেমন ধরো কচুরলতি, কি ইলিশপাতুরি, কি কইমাছের গঙ্গা-যমুনা, ভাপা ভেটকি, জাস্ট একটা স্লিপে লিখে ভোজন বক্সে ফেলে যাবে। শনিবার আমরা খুলে দেখব, রবিবার দুপুরে সার্ভ করা হবে।

বাবা বললেন—শুধু একটা আইটেমে তো হবে না, রীতিমতো খাওয়াতে হবে পাতা পেড়ে।

অফকোর্স। এতে আমাদেরও লাভ, আমরাও খাব। আমরা তো অনেক সময় আইটেম খুঁজে পাই না। আর আমাদের মেয়েরাও খুব উৎসাহ পাবে। আমাদের রবিবারগুলো উৎসবের চেহারা নেবে। সবাই লাইন দিয়ে আসছেন, কচুরলতি, মোচা, দই-করলা, ভাপা ইলিশ। সব পিলপিল করে আসছেন। হাঁচতে-হাঁচতে। কাশতে-কাশতে। লাঠি ঠকঠক করতে-করতে। কেউ কোমর সোজা করতে পারে না, কারও হাঁটু মোড়ে না। সকলেরই ওপরে যাওয়ার নোটিশ এসে গেছে।

জ্যাঠামশাই মুগ্ধ হয়ে বললেন—পৃথিবীর কোথাও এমন হয়নি। বাঙলায় বললে, দিস ইজ দি ফাস্ট টাইম ইন দি ওয়ার্লড।

বাবা এতক্ষণ একটাও কথা বলেননি, এইবার বললেন—তাহলে দক্ষিণ পাড়ারটা।

দাদু বললেন—দক্ষিণ পাড়ারটা মানে?

প্রথমে দক্ষিণ পাড়ার জমিটা বিক্রি করা যাক, তারপর চাঁপাডাঙ্গা, তারপর মধুপুরের বাগানটা।

কেন-কেন, জমিজায়গা বিক্রি করবে কেন? খুব অর্থাভাব! আমাকে বললেই হয়। মক্কেলরা সব টাকা নিয়ে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

আপনার এই পরিকল্পনা কার্যকরী হলে মাসে কী পরিমাণ টাকা লাগবে ধারণা আছে?

পুঁইশাক, কচুরলতি, মোচা, ডুমুর, পেঁপে, এসবের আর কী এমন দাম!

জ্যাঠামশাই বললেন—প্রজেক্ট কস্টটা তুই বের করে ফেল ছোট। এটা তোর সাবজেক্ট।

বাবা সায়েনসের। গণিতজ্ঞ। অঙ্ক নিয়ে খেলা করেন। জ্যাঠামশাই আর্টসের। ইংরিজি কেটে জোড়া দেন। সাহেবরা ইংরিজি শিখতে আসেন। দাদু আইনের। যার কেস ধরেন সেই মামলা জেতে। পাড়ার অনেকেই আমাদের হিংসে করে।

জ্যাঠামশাই অনেকক্ষণ ধরে একটা মাংসর হাড় নিয়ে কসরত করছেন। চুষে কিছুতেই ম্যারোটা বেরোচ্ছে না। থালায় ঠকাস-ঠকাস করে ঠুকছেন। বাবা বললেন—হয় তবলা ঠোকা হাতুড়িটা চেয়ে নাও, না হয় ওটার মায়া ত্যাগ করো।

বাবার কথায় কান না দিয়ে জ্যাঠামশাই বললেন—কিছু লিফলেট ছাপিয়ে বাড়ি-বাড়ি বিলি করতে হবে। তাতে লেখা থাকবে, নিমন্ত্রণের তারিখ আমরা জানাব। তাহলে হবে কী, ব্যাপারটা আমাদের কন্ট্রোলে থাকবে। সপ্তাহে একজন। জমিজমা বিক্রির প্রয়োজন হবে না।

দাদু বললেন—যদি দেখা যায় তিনজন কী চারজন একই আইটেম খেতে চাইছে, আমরা একই দিনে সেই ক’জনকেই আমন্ত্রণ জানাব।

জ্যাঠামশাই বললেন—গুড আইডিয়া, ভেরি গুড আইডিয়া।

বাবা বললেন—সমস্ত ব্যাপারটাই ভেরি রিস্কি। কিছু লোক পেয়ে বসবে। শুধু তাই নয়, তাদের বাড়ির লোককে অপমান করা হবে। তাঁরা বলবেন—কী আমরা খাওয়াতে পারি না? মার চেয়ে মাসির দরদ বেশি! ফলে হবে কি, সেই লোকটির বাড়িতে তিষ্ঠানো দায় হবে। গাল বাড়িয়ে চড় খাওয়ার মানে হয় না।

দাদু বেশ চিন্তিত—অতি যুক্তিপূর্ণ কথা। তাহলে আমরা কী করব? অভিনব একটা কিছু। তোমরা সবাই ভাবো।

জ্যাঠামশাই বললেন,—আপাতত আমরা মন দিয়ে খাওয়াটা সেরে ফেলি; কারণ আমরা উঠলে তবেই মেয়েরা খেতে বসতে পারবে। অলরেডি আমরা অনেকটা সময় নিয়ে ফেলেছি।

দাদু বললেন—ঠিক-ঠিক। এ ব্যাপারটা আমাদের মনে ছিল না। রান্না তো উপাদেয় হয়েছে। অ্যাজ উপাদেয় অ্যাজ পসিবল। আচ্ছা আমি কি আর এক রাউন্ড চাটনি পেতে পারি!

অফকোর্স, অফকোর্স!

জ্যাঠামশাই সেই হাড়টার মায়া ছাড়তে পারেননি। আবার বারকতক ঠকঠক করলেন।

বাবা বললেন—ওরে কে আছিস, মেজদাকে দেখেশুনে একটা সহজ হাড় দে না।

জ্যাঠামশাই বললেন—ছোটু! খাওয়াটা বড় কথা নয়, বড় কথা হল বের করা। প্রশ্ন হল— বেরোবে না কেন?

ওটা আর্টের পথে বেরোবে না। বেরোবে বিজ্ঞানের পথে। আমার হাতে দাও।

তোর এখনও খাওয়া হয়নি। আমার এঁটোটা হাতে নিবি!

জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা পিতৃতুল্য।

শোন ছোটু, সামনের বার আবার আমরা একসঙ্গে জন্মাব। তোর কোনও আপত্তি নেই তো?

একটুও নেই। তবে একটা কথা, চ্যাটাস-চ্যাটাস করে যখন-তখন মারতে পারবে না।

তাহলে আমারও একটা কথা আছে। যখন-তখন আমার তলপেটে তোমার মাথা দিয়ে ভেড়ার মতো ঢুঁস মারা চলবে না।

আমাকে গরু, ভেড়া, ছাগল, না বললেই হল। মাঙ্কি বলা তো একেবারেই চলবে না। তাহলেই মারব ঘাড়ে লাফ।

বাবা একটা কায়দা করে নলিটার পিছন দিকে ছোট্ট একটা ফুটো করে দিলেন।

নাও, এবার টানো।

ফুড়ুত করে একটা শব্দ হল। জ্যাঠামশাই আধ-বোজা চোখে বললেন—স্পেলনডিড!

মনে রেখো, এই হল টেকনিক।

পরের জন্মে এই জন্মের কিছু মনে থাকবে না রে ছোটু!

সদরে গাড়ি থামার শব্দ হল। ছোট কাকা মার্চ করে ঢুকলেন, পিছনে কালীদা। দু-হাতে দুটো পেল্লায় ইলিশ ঝুলছে।

কাকাবাবু বললেন—যাঃ, খাওয়া ফিনিশ! বউদি দুটো গেল কোথায়?

দাদু বললেন হয়ে গেল। চারটে নাগাদ আবার আমাদের খেতে বসতে হবে। কোনও উপায় নেই।

কাকাবাবু আরামবাগ থেকে মাঝে-মাঝেই হুট করে চলে আসেন, তখন বাড়ি একবারে জমজমাট। খেতে আর খাওয়াতে ভালোবাসেন। ব্যায়ামবীর। ফুটবল পাগল এখনও। মাঝে মাঝে আমার কাঁধে হাত রেখে তেপান্তরের মাঠে বেড়াতে-বেড়াতে কত গল্প। সব কথাই শেষ হয়ে একটি কথায়—ঘনশ্যাম, আমিও বিয়ে করিনি, তুইও বিয়ে করিস না। তোর বাবাকে অনেক বারণ করেছিলুম, অবশ্য এটাও ঠিক, তোর বাবা বিয়ে না করলে তোকে তো পেতুম না। আই। লাভ ইউ ভেরি মাচ বাদশা খান।

যেটাকে আমরা তেপান্তরের মাঠ বলি, সে এক বিশাল মাঠ। উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব, পশ্চিমে চারটে পাড়া। পশ্চিমে কুমোর পাড়া। সুন্দর-সুন্দর চালা বাড়ি। মাঝখান দিয়ে মোটামুটি চওড়া একটা পথ, সোজা চলে গেছে নদীর ধারে। ওই নদীপথেই আসে এঁটেল মাটি বোঝাই নৌকো, পুজোর আগে। বিশ্বকর্মার মূর্তি তৈরির ফাঁকে-ফাঁকেই মা দুর্গা গড়ার কাজ শুরু হয়ে যায়। রাত্তির বেলায় দাওয়ায়-দাওয়ায় লণ্ঠন ঝোলে। ঘরে-ঘরে দেব-দেবীর মূর্তি। সেই আলো-আঁধারিতে হঠাৎ হাজির হলে মনে হয় স্বর্গে এসেছি।

আমার এক বান্ধবী আছে এই পটুয়াপাড়ায়। তার নাম সৌরভী। ঠিক যেন মা দুর্গা, ফ্রক পরে। হাঁটছে। লেখাপড়ায় ভীষণ ভালো। আমার বাবা লেখাপড়ার ভীষণ ভক্ত। কেউ ভালো লেখাপড়া করছে জানতে পারলে, ডেকে পাঠাতেন। তার প্রায় সব দায়িত্ব নিজের কাঁধে নিতেন। তাকে নিজেই পড়াতেন। সৌরভী বাবার প্রিয় ছাত্রী। সৌরভীর ঠাকুরদার বাবা কৃষ্ণনগর থেকে। আমাদের গ্রামে এসেছিলেন। মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের সব কাজ এঁরাই করতেন। রাজপটুয়া। সবাই লেখাপড়া জানা। সৌরভীর ঠাকুরদা ছিলেন সংস্কৃতে পণ্ডিত। আমি তাঁর কাছে সংস্কৃত পড়েছি। সৌরভীর মা খুব ভালো কীর্তন করেন। মা আর মেয়েকে প্রায় একরকম দেখতে। কালীবাবুর কাঁধে এক গাঁট কাপড়, আমার মাথায় একটা বড়সড় পোঁটলা। কাকাবাবুর দু-হাতে দুটো পেল্লায় ব্যাগ। তেপান্তরের মাথার ওপর ঝুলছে তেপান্তর আকাশ। শরৎ-নীল। হালকা-হালকা, সাদা পালতোলা মেঘ। এক সার বক তিরের ফলার মতো উড়ে যাচ্ছে। মাঠ পেরিয়ে যাচ্ছি আমরা পটুয়াপাড়ার দিকে। যেখান থেকে পাড়ার শুরু সেখানে দাঁড়িয়ে আছে বিশাল বট। পটুয়াপাড়ার যেসব দেব-দেবী কোনও কারণে পূজা পায় না, সেইসব মূর্তি বটতলায় বেড় দিয়ে সাজানো। মহাদেব হাঁটছেন। মা শীতলার গাধা দাঁড়িয়ে গেছে। বিশ্বকর্মার হাতে হাতুড়ি। প্রতিমাদের ফাঁকে-ফাঁকে কাঠবিড়ালির ভীষণ লুকোচুরি। আর তাদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে গাছের মাথায় এক ঝাঁক টাটকা টিয়া প্রচণ্ড আলোচনায় ব্যস্ত। আকাশ ফেটে পড়ছে।

পটুয়াপাড়ায় ঢুকেই একটা অঙ্গন, চারপাশ ঘিরে পরিচ্ছন্ন চালা কয়েকটি। সেই জায়গায় চলেছে জোর কপাটি খেলা। সৌরভীও রয়েছে সেই খেলায়। সে যেন নায়িকা। তার ফ্রক উড়ছে, বিনুনি দুলছে। ফরসা মুখ ঘাম-চকচকে।

কাকাবাবু ডাকলেন—সৌরভী।

সঙ্গে-সঙ্গে সে দৌড়ে এসে কাকাবাবুর কোমর জড়িয়ে ধরল।

দাও, একটা ব্যাগ আমার হাতে দাও।

পারবি? বেশ ভারী!

দাও না।

আমরা মিছিল করে এগিয়ে চলেছি। সামনে সৌরভী। তারপর আমরা। বাঁশঝাড়ের পাশ দিয়ে, কলাবাগান, তালপুকুর, প্রাথমিক বিদ্যালয়। এরা সবাই মিলে পাড়াটাকে এত সুন্দর করে রেখেছে, হাঁ করে তাকিয়ে দেখার মতো।

প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ঠিক পিছন দিকে সৌরভীদের সুন্দর বাড়ি। ছোট সংসার। বাবা, মা আর ওই মেয়ে। ঝামেলা নেই ঝঞ্চাট নেই। বিদ্যালয়টা চালান বাবা আর মা। তকতকে নিকোনো দেয়ালে অপূর্ব আলপনা। দরজার মাথায় ঝুলছে শোলার ফুলের মালা। সৌরভীদের বাড়িটা যেন মন্দির। দালানের সামনে দাঁড়ালেই দেখা যায় ঘরের ভেতর মা সরস্বতীর অপূর্ব মূর্তি।

দাওয়ার ওপর কাপড়ের গাঁট, পোঁটলা-পুঁটলি, ব্যাগ, সব নামানো হল। তিনটে খরগোশ ভয় পেয়ে ছুটে পালাল। খরগোশের দৌড় দেখতে বেশ মজা লাগে। ওঠ-বোস করতে করতে কেমন দৌড়োয়। সৌরভীর মা-বাবা বেরিয়ে এলেন। এইসব কাপড়, জামা-প্যান্ট, সোয়েটার, লজেন্স, বিস্কুট সব বিতরণ করা হবে। দুর্গাপুজো এসে গেল। আর বসে থাকলে চলবে! একটা সোশ্যাল ব্যাগ, সেই ব্যাগে সৌরভীর বাবা, মা আর সৌরভীর জামা-কাপড়। সেই ব্যাগটি মায়ের হাতে তুলে দিতে-দিতে কাকাবাবু বললেন—আমাদের বাড়িতে আজ রাতে আপনাদের নিমন্ত্রণ। একজোড়া ইলিশ—যা পেয়েছি না, আপনারা না খেলে শান্তি পাব না।’

সৌরভী আমার কানে-কানে বললে—আমরা এখানে থেকে কী করব, চলো কপাটি খেলি।

সবাই তো মেয়ে!

তোমাকে আমি মেয়ে সাজিয়ে দেব। হাসতে লাগল সৌরভী।

খুব জোর খেলা শুরু হল। শরতের মাঠে, শরতের আকাশের তলায়। পুকুরের স্থির জলে মেঘ ভাসছে। বিরাট যেন রাজহাঁস। সৌরভী আমার বিপরীত দলে। কিত-কিত শব্দ করতে-করতে ঢুকেছি। ওদের কয়েকটাকে মোর করে বেরিয়ে আসছি; জাপটে ধরল সৌরভী। কী জোর! বাপরে! মাটিতে চিত। সৌরভী আমার বুকের ওপর। আমার পিঠের তলায় নরম-নরম ঘাস। সন্ধে হল। দিনের আলো কমছে। এক ঝাঁক ফড়িং উড়ছে। প্রাণপণে কিত-কিত শব্দ করছি। দম ফুরিয়ে আসছে। আর পারছি না। সৌরভীর ঠোঁট দুটো আমার ঠোঁটের ওপর চেপে বসল। থেমে গেল কিত-কিত।

হেরে গেছি। তবু সৌরভী আমাকে ছাড়ছে না। ফিশফিশ করে বললে—এইবার কী হবে? পালাবে? আমার কাছ থেকে পালাতে পারবে? আমি দুর্গা।

রাত্তির বেলা পড়ায় মন বসল না। কেবল সৌরভীকে মনে পড়ছে। চাঁদ উঠেছে। হু-হু চাঁদের আলো তেপান্তরের মাঠে খেলা করছে। কাকাবাবু এসেছেন, বড়রা সব গল্পে ব্যস্ত। কালীদা খাটের তলায় বালি বিছিয়ে আলু রাখছেন, সারা বছরের আলুর স্টক। রান্নাঘরে মা আর জ্যাঠাইমা ইলিশ নিয়ে ব্যস্ত। হঠাৎ মনে হল কাকাবাবু সৌরভীদের নেমন্তন্ন করেছেন, আমি যদি গিয়ে বলি, আপনাদের নিতে পাঠিয়েছেন, তাহলে কেউ কিছু মনে করতে পারবেন না। আমার যে সৌরভীকে ভীষণ দেখতে ইচ্ছে করছে।

মনে হওয়া মাত্রই যাত্রা শুরু। একদিন না পড়লে কী আর হবে! ফাঁকা মাঠ। কেউ কোথাও নেই। দূরে কোথাও গান হচ্ছে। সুর ভেসে আসছে। মনে পড়েছে, দক্ষিণপাড়ায় রায় জমিদারদের মন্দিরে কীর্তন হচ্ছে। প্রত্যেক পুর্ণিমায় হয়। মাঝমাঠ বরাবর যেতে না যেতেই দেখি, ওরা তিনজন ওদিক থেকে আসছে। সৌরভী বললে কোথায় যাচ্ছ?

তোমাদের ডাকতে।

সৌরভী বললে—ভালোই হয়েছে। মা, তোমরা এগিয়ে যাও, আমরা মদনমোহনের মন্দির ঘুরে যাচ্ছি।

অনেক দেরি হয়ে যাবে না?

দেরি কী গো, এই তো একটু আগে সন্ধে হল। শুনছ না, আরতি হচ্ছে!

আমরা দক্ষিণপাড়ার দিকে এগোচ্ছি। চাঁদের আলোয় মন্দিরের সাদা চূড়াটা ধকধক করছে, যেন আকাশের গায়ে কাঞ্চনজঙ্! দাদুর মুখে শুনেছি, একশো বছর আগে এই মাঠটা ছিল। ডাকাতদের, ফাঁসুড়েদের। কত মানুষ যে খুন হয়েছে এই মাঠে! কথাটা মনে হওয়া মাত্রই আমি সৌরভীর গা-ঘেঁষে হাঁটতে লাগলুম।

কী হল, ভয় করছে?

জানো, দাদু বলেছেন, একশো বছর আগে এই মাঠে ডাকাতরা মানুষ মেরে পুঁতে দিত। তারা সব ভূত হয়ে এখানে আছে।

আছে তো আছে। তাতে তোমারই বা কী, আর আমারই বা কী? আমি দুবার দেখেছি। একদিন দুপুরবেলায় দেখেছি।

দুপুরবেলায় ভূত!

ও মা, তুমি সেই কথাটা শোনোনি, ঠিক দুপুরবেলা ভূতে মারে ঢেলা! একটা লোক দড়িতে বাঁধা একটা ছাগল নিয়ে হাঁটতে-হাঁটতে যাচ্ছে। যেই জিগ্যেস করলুম, কাকু! কোন হাট থেকে ছাগলটা কিনলে? ব্যস, সঙ্গে-সঙ্গে ভ্যানিশ। মানুষটা নেই, ছাগলটা আছে। এইবার শুনবে! ছাগলটা আমাদের পাড়ার বিমলাদের ছাগল। ছাগলটা পাগল হয়ে গেল।

ছাগলও পাগল হয়?

হবে না, ভূতে ধরেছিল যে! থেকে-থেকে তার চোখ দুটো সাদা হয়ে যেত। আর ভীষণ-ভীষণ সব কাণ্ড করত। পায়রা, মুরগি এইসব ধরে-ধরে খেত।

শেষে কী হল?

জলে ডুবে মারা গেল।

মন্দির যত এগিয়ে আসছে বাদ্যিবাজনার আওয়াজ তত জোর হচ্ছে। বাড়ির দাওয়া থেকে আমাদের সকলের ‘রাঙা দিদিমা’ জিগ্যেস করলেন—দুটিতে চল্লে কোথায় গো? রাধা আর কৃষ্ণ!

সৌরভী বললে রাধা আর কৃষ্ণ দেখবে দিদিমা? আমাকে বললে—বাঁশি ধরে বাঁ-দিকে বেঁকে যাও। সৌরভী আমার গায়ে-গা লাগিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। দিদার কী হাসি!

নাড়ু খাবি আয়।

আজ নয় গো দিদা। আজ তোমার রাধাকৃষ্ণ ইলিশ খাবে।

মন্দিরে মদনমোহন আজ কী সেজেছেন! কীর্তনীয়া মাথুর গাইছেন ভঙ্গি করে।

প্রচুর খাওয়ার পর প্রচুর গল্প। দাদু জিগ্যেস করলেন—দুটোতে কোথায় গিয়েছিলিস? দাদুর সঙ্গে আমাদের বন্ধুর সম্পর্ক। ইয়ারকি-টিয়ারকি একটু আধটু চলে। সৌরভীটা আজকাল একটু ফাজিল হয়েছে।

সৌরভী বললে—প্রেম দেখতে।

কার প্রেম?

রাধাকৃষ্ণের।

সে ভালো। প্রেম করেছিস?

একটু। তোমার নাতিকে আজ বেশ করে চুমু খেয়েছি।

আগেই খেয়ে ফেললি? বিয়ে পর্যন্ত অপেক্ষা সইল না?

ধুর, তার এখনও অনেক দেরি।

মদনমোহনতলায় মন্দিরের পেছনে একটা কুয়ো আছে, দেখেছিস?

না!

ওর কোনও তল নেই।

মানে?

পাতাল পর্যন্ত নেমে গেছে। ভেতর দিকে জলের কিছুটা ওপরে ডান দিকে একটা সুড়ঙ্গ আছে, সেটা সোজা চলে গেছে পাইনদের রাজবাড়িতে। একেবারে গর্ভমন্দিরে। নবাবি আমলে, যখন মন্দির ভাঙাভাঙি হচ্ছে, মূর্তি চুরমার করছে, মদনমোহন তখন ওই সুড়ঙ্গে অনেকদিন ছিলেন। পাইনদের রাজবাড়ির পুরোহিত ওই দিক থেকে রোজ দুবেলা এসে চুপিচুপি পুজো করে যেতেন। ওপরে জঙ্গল। বোঝার উপায় ছিল না, যে, তলা দিয়ে চলে আসছে একটা সুড়ঙ্গ-পথ।

সৌরভী জিগ্যেস করলে—এখনও সেই পথ আছে?

এদিকে, ওদিকে কিছুটা তো আছে। মাঝে-মাঝে নেই। জঙ্গলটাই চলে গেছে। মানুষের বসতি হয়ে গেছে। জঙ্গলের শক্র মানুষ।

এইবার সবাই এসে ঘিরে বসলেন। আমাদের লাইনের গল্প থেমে গেল। জ্যাঠামশাইয়ের প্রিয় বিষয় হল, মাছ। আসরে বসেই বললেন—আহা, এমন চাঁদের আলো, মাছ ধরতে গেলে হত। কবিতার মতো রাত। জলার ধারে এইরকম রাতে অনেক রকমের অভিজ্ঞতা হয়। আমি একবার কথা-বলা মাছ দেখেছিলুম। বিরাট মাছ। জল থেকে রুপোর তৈরি মাথাটা তুলে বললে, আমার নাম সৌরভী, তোমার নাম?

সৌরভী বললে—সৌরভী তো আমার নাম।

জ্যাঠামশাই বললেন—সে আমি কী করব। মাছ বললে, আমার নাম সৌরভী। কী সুন্দর দেখতে। নাকে নোলক। চোখ দুটো টানা-টানা। কপালে টায়রা। আর এক চাঁদের আলোর রাতে দেখি, অপূর্ব সুন্দর, রাজার মতো একজন মানুষ জলের কাছে দাঁড়িয়ে আছেন। আর ওপারে সাদা ধবধবে একটা বক। বেশ বড়। মাথায় রুপোলি একটা ঝুঁটি। চাঁদের আলোয় ঝিলমিল করছে। এমন বক কখনও দেখিনি! ভয়ে-ভয়ে জিগ্যেস করলুম—আপনি কে?

সে কী? আমাকে চিনতে পারছ না? মহাভারত পড়োনি?

সংক্ষিপ্ত মহাভারত পড়েছি।

যুধিষ্ঠিরকে চিনতে পারছ না? ওই দেখো ওপারে বকরূপী ধর্ম। কিছুতেই জল নিতে দিচ্ছে না। মহাভারতের সেই প্রশ্নোত্তরের ‘কুইজ কন্টেস্ট’ শুরু হয়ে গেল, আমি ছিপ হাতে চুপটি করে বসে-বসে শুনছি—

বক। বলো যুধিষ্ঠির, পৃথিবীর চেয়ে গুরুতর কী, আকাশের চেয়ে উঁচুকী, বাতাসের চেয়ে দ্রতগামী কী, ঘাসের চেয়ে বিস্তৃত কী? সৌরভী বললে—আমি জানি। বেশ, তাহলে তুমি হও যুধিষ্ঠির আর আমি বুড়ো বক। উত্তর দাও।

মা পৃথিবীর চেয়ে গুরুতর। মদনমোহন মন্দিরের লালাজি আমাকে শিখিয়েছেন, ‘জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরীয়সী।’ আকাশের চেয়ে উঁচু পিতা। বাতাসের চেয়ে দ্রুতগামী আমাদের মন। আর আমাদের চিন্তা ঘাসের চেয়ে বিস্তৃত।

বক।। কোন ধর্ম শ্রেষ্ঠ?

সৌরভী।। দয়া।

কোন ধর্ম ভালো ফল দেয়?

শাস্ত্রের ধর্ম।

মানুষ কী করলে দুঃখ পাবে না?

মনকে বশে রাখলে।

কার সঙ্গে বন্ধুত্ব করলে মানুষ ঠিক থাকবে, নষ্ট হবে না? এই যে এইটার সঙ্গে।

সবাই গুরুজন, তাঁদের সামনে সৌরভী আমার কাঁধে হাত রেখে বললে—সৎলোক।

কাঁধ থেকে হাতটা নামল না। ঘাড়ের কাছে ঠান্ডা-ঠান্ডা চুড়ির স্পর্শ। ভীষণ লজ্জা করছে। কেউ কিছু মনে করছেন না। সবাই জানেন, আমরা দুজনে ভীষণ বন্ধু।

বকরূপী জ্যাঠামশাই প্রশ্ন করলেন–বলো যুধিষ্ঠির, বার্তা কী?

সবাই থমকে আছেন, এইবার সৌরভী কী বলে! সবচেয়ে কঠিন প্রশ্ন। সৌরভী হাসতে-হাসতে বললে—শুনুন ধর্মরাজ! পৃথিবীর এই মায়ার কড়াতে, সূর্যের আগুনে দিন আর রাতের কাঠ দিয়ে, মাস আর ঋতুর হাতা দিয়ে ঘেঁটে রাঁধুনী কাল জীবদের পাক করছে। ধর্মরাজ! এই হল বার্তা।

সবাই চটাপট-চটাপট হাততালি দিয়ে বললেন—এ মেয়েটা কে রে! কোথায় শিখলি?

ওই লালাজি। রামায়ণ, মহাভারত পড়েন, আমি বসে-বসে শুনি।

ধর্মরাজ বললেন—সাইলেন্স, সাইলেন্স। শেষ হয়নি এখনও। বলল, আশ্চর্য কী?

রোজ মানুষ মরছে। মানুষ দেখছে, তবু ভাবছে, আমি বোধহয় অমর। এরচেয়ে আশ্চর্য আর কী আছে!

বলো, পথ কী?

‘মহাজনো যেন গতঃ স পন্থাঃ।’

জ্যাঠামশাই আর পারলেন না। সৌরভীকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। কী পুরস্কার চাস, বল? জ্যাঠামশাইয়ের বুকে মুখ গুঁজে সৌরভী বললে—একটা রাজকুমার।

রাজকুমার কোথায় পাব মা?

মুখ না তুলে, পেছন দিকে হাত ঘুরিয়ে বললে—ওই যে, ওইখানে একটা বসে আছে। দাদু এতক্ষণ মৌজ করে পান চিবোচ্ছিলেন। দাদুর পান আমার বড়মা ছাড়া কেউ সাজতে পারেন না। বড়মা জমিদারের মেয়ে। বন্দুক চালাতে পারেন। ভীষণ সাহসী। একবার কোথা থেকে ঘোড়ায় চেপে একটা লোক। দুপুরবেলা। পুরুষরা কেউ ছিল না। যেন চম্বলের দস্যু। গুলি-গুলি চোখে। আমার দিকে তাকিয়ে ভয় দেখাবার চেষ্টা করছিল। বড়মাবন্দুক হাতে বেরিয়ে এলেন। একটা ফাঁকা আওয়াজ করতেই লোকটা দমাস করে ঘোড়ার পিঠ থেকে পড়ে গেল। পরে জানা গেল, পাইনদের বড় ছেলে ঘোড়ায় চেপে বিয়ে করতে যাবে, তাই তারকেশ্বর থেকে ঘোড়া। আনিয়েছিল। ওদের বাড়ির একজন ডাকাত সেজেছিল।

দাদু বললেন—এই টিকটিকিকে বিয়ে করবি গিরগিটি? তোর কী পছন্দ রে! আমরা বিয়ে করে ফেলেছি।

কবে করলি?

আজ।

কোথায় করলি?

মদনমোহনের মন্দিরে গেলুম কেন? ও কৃষ্ণ আর আমি রাধা। ওই জন্যেই না তোমরা এত খাওয়ালে!

দাদু বললেন—এবারে ডাকাতদের গল্প শোনো। ভয় পাবে না তো? না, ভয় পাবে কেন!

সেকালের ডাকাতদের কোনও তুলনা একালে খুঁজে পাওয়া যাবে না। সকালে জমিদার, রাত্তিরে ডাকাত। আমার মেসোমশাই যথেষ্ট ধনী ছিলেন। হরেকরকম ব্যবসা করে এত টাকা করে ফেললেন যে ডাকাতদের লিস্টে নাম উঠে গেল। মাসিমা অনেকবার সাবধান করেছিলেন, আর যাই করো বিপজ্জনক রকমের বড়োলোক হোয়োনা।

মেসোমশাই করুণ গলায় বলেছিলেন—আমি কী ইচ্ছে করে হচ্ছি! জোয়ারের জলের মতো টাকা এলে আমি কী করব! টাকায় আমার অরুচি ধরে গেছে। যাতে হাত দিচ্ছি সেইটাই লেগে যাচ্ছে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন—ভাই রে! একেই বলে কপাল!

ডাকাতের চিঠি এল:

প্রিয় ব্রজবাবু, আগামী বুধবার আমরা আপনার অতিথি হব। তা জন পঞ্চাশ। মায়ের পুজো সেরে বেরোতে-বেরোতে মধ্যরাত হবে। এর আগে সাধারণত আমরা কোথাও যাই না। ফুলকো ফুলকো লুচি আর পাঁঠার মাংসর ব্যবস্থা রাখবেন। চার-পাঁচ রকমের ভালো মিষ্টি অবশ্যই। মঙ্গলবার যে-কোনও সময় আমাদের একজন যাবে একটা সাইনবোর্ড নিয়ে। সঙ্গে-সঙ্গে বাড়ির বাইরে ঝুলিয়ে দেবেন। আপনার সম্মান বাড়বে। আমরা যেখানে-সেখানে ডাকাতি করি না। আমাদের দল, এক নম্বর বনেদি দল। আমরা তিন পুরুষে ডাকাত। কোনও ভেজাল নেই। মায়ের দিকে তিন পুরুষ, বাপের দিকেও তিন পুরুষ। একমাত্র আমাদের দলেই সাতটা ‘মসার’ পিস্তল। দশটা গাদা বন্দুক আছে। আমরা অন্যদলের মতো মরচে ধরা তরোয়াল, টিনের পাতপ্যাতে। খাঁড়া, পাকা বাঁশের লাঠি, এ-সব ব্যবহার করি না। রণপা-র প্রয়োজন হয় না। ও-সব ভড়ং। সার্কাস। নিকৃষ্ট ডাকাতরা ব্যবহার করে। আমরা রেজিস্টার্ড। পুলিশকে নিয়মিত চাঁদা দি। কমসে কম দুশো মেয়ের ভালো পাত্রে বিয়ে দিয়েছি নিজে বসে থেকে। হাজার বিধবাকে কাশী, বৃন্দাবনে পাঠিয়েছি। নিয়মিত মাসোহারা পায়। আমার পূর্বপুরুষরা ডাকাতি করতে যাওয়ার আগে নরবলি দিত। হিংসা আমি সহ্য করতে পারি না, তাই কুমড়ো বলি দি। আমার স্ত্রী পরে ছক্কা বেঁধে, মহাপ্রসাদ হিসেবে বাড়ি-বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসে।

আমাদের বাড়িতে দোল, দুর্গোৎসব সবই হয়। নিত্য দরিদ্র নারায়ণ সেবা।

ইতি,

বিনীত, বিশ্বনাথবাবু

চিঠিটা পাওয়ার পর পাড়াসুদ্ধ লোকের সে কী আনন্দব্রজ, এতদিন তুমি একটা বড়লোকই ছিলে, আজ, তুমি জাতে উঠলে। ব্রাহ্মণ সন্তানের যেমন পৈতে হয়।

প্রায় তিন বিঘে জমির ওপর চকমেলানো বাড়ি। দু-খানা পুকুর। আম, জাম, লিচু, সবেদা, কাঁঠাল গাছ। অনেকটা ফাঁকা জায়গা। সেখানে ম্যারাপ বাঁধা হল। বিশ্বনাথবাবু বসবেন। কার্পেট ঢাকা। মঞ্চ। রুপোর নল লাগান ফর্সি। অম্বুরি তামাক। সাদা পাগড়ি মাথায় মেলোমশাইয়ের কর্মচারীর দল। গোরা ব্যান্ড এসেছে। ভিয়েন বসেছে। বিরাট-বিরাট সাইজের ডাকাতে লাড়ু তৈরি হচ্ছে। যেন মেসোমশাইয়ের মেয়ের বিয়ে।

সকাল থেকেই উদবেগ। বিশ্বনাথ ডাকাতবাবুর সাইনবোর্ড তো এল না। সাইনবোর্ডে লেখা। থাকবে, ‘বিশ্বানাথবাবু কৃপা করেছেন।’ এল না কেন! ‘কৃপাবোর্ড’ এল না কেন? সকলের মুখে মুখে একই উদবেগ। ডাকাতরা যে আসছে, তার আবার সিগন্যাল ছিল। দূরে রাতের আকাশ। কুঁড়ে পরপর তিনটে তারাবাজি উঠে ফুল ছড়াবে। তিনখানা আগুনে-মালা আকাশ পথে দুলতে দুলতে যে বাড়িতে ডাকাতি হবে, সেই বাড়ির দিকে এগিয়ে আসবে।

সূর্য ডুবতে-না-ডুবতেই চারপাশ আলোয় আলো। সবাই উৎসবের সাজে সেজে উঠল। মেয়েদের মাথায় বড়-বড় খোঁপা। গলায় চিকচিকে সোনার হার। রং-বেরং-এর শাড়ি। মেসোমশাই পরেছেন চুনোট করা ফরাসডাঙ্গার ধুতি। গিলে করা আদ্দির পাঞ্জাবি। হাতে দুলছে মোষের শিঙের স্টিক। গোঁফে আতর।

রাত আটটার সময় রব উঠল, আসছে, আসছে! ঘোড়া আসছে, কৃপা আসছে। এল একটা চিঠি।

‘প্রিয় ব্রজবাবু, আমাদের ভুল হয়েছে। আপনারই গ্রামের স্বরূপ দামোদরবাবু আবেদন করেছেন। তিনি আপনার চেয়ে ঢের বড়লোক। তাঁর কাছে বাদশাহি মোহর আছে, যা আপনার নেই। আমি দুঃখিত।

ইতি’

মেসোমশাই হাত থেকে ছড়ি ছুড়ে ফেলে দিয়ে বললেন—আমি মামলা করব।

সব গল্পই যেমন হয়, মধুরেণ সমাপয়েৎ। প্রবীণদের পরামর্শে মেসোর বড় মেয়ে চম্পার সঙ্গে দক্ষিণপাড়ার বিশ্বনাথের বিয়ে হল ওই রাতে। তিনি ডাক্তার, নাম করা। ডাকাতের বদলে ডাকতার এল ঘরে।

গল্পে-গল্পে রাত এগোচ্ছে। সময় খালি হাঁটে। বসতে জানে না। তেপান্তরের মাঠের ও-মাথায়, বোসপাড়ার দিকে শেয়াল ডাকছে। প্রহর ঘোষণা করছে। সেই শজারুটা বেরিয়েছে। রোজ রাতে নাচতে বেরোয়। তেপান্তরের মাঝমাঠে গোল হয়ে ঘুরে-ঘুরে নাচে। ঝমঝম আওয়াজ হচ্ছে।

সৌরভী জ্যাঠামশাইয়ের কোলে মাথা রেখে কখন ঘুমিয়ে পড়েছে। বড়মা একটা বালিশ এনেছেন। সৌরভীর মাথাটা আস্তে করে তুলে বালিশে রাখছেন, ঘুমন্ত সৌরভী বলছে,—আমার খোঁপা, খোঁপা, আমার খোঁপা।

বড়মা আস্তে একটা আদরের চাপড় মেরে বললেন—এদিকে ঘুমে ন্যাতা, ওদিকে খোঁপা ভেঙে যাওয়ার চিন্তা।

কপালে ছোট্ট করে একটা চুমু খেলেন।

দাদু বললেন—’নাঃ, পৃথিবীটা সত্যিই খুব সুন্দর। এখানে বারেবারে আসতে হবে বেড়াতে। এই গ্রুপ। একেবারে পাক্কা। দেখো, সায়েবদের বিয়ের আগে একটা ব্যাপার থাকে—’এনগেজমেন্ট’। সেই কাজটা আমি করে ফেলতে চাই। পরির মতো এই মেয়েটার সঙ্গে দেবদূতের মতো এই ছেলেটার ‘এনগেজমেন্ট’। তোমাদের আপত্তি আছে?’

কী আশ্চর্য! আমরা সবাই তো এই একই কথা ভাবছি।

তাহলে দেবদূত পরির অনামিকায় এই রুবির আংটিটা পরাও।

ঘুমোচ্ছে; কিন্তু আঙুলটা উঁচু করল।

দাদু বললেন—ভীষণ আনন্দ হচ্ছে আমার। বিয়েটা যখন হবে তখন তো আমি থাকব না। পৃথিবীর দিন ফুরিয়ে যাবে।

হালুম করে বাঘ যেমন শিকারের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে সৌরভী সেইভাবে দাদুর ঘাড়ে গিয়ে পড়ল

—থাকবে না মানে? থাকবে না মানে?

দুজনে জড়াজড়ি করে মাটিতে গড়াগড়ি।

Anuprerona
Anupreronahttps://www.anuperona.com
Read your favourite literature free forever on our blogging platform.
RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here


Most Popular

Recent Comments