Sunday, September 14, 2025
Homeবাণী ও কথাঅনুবাদ গল্পলন্ডস কটেজ - এডগার অ্যালান পো

লন্ডস কটেজ – এডগার অ্যালান পো

গত গ্রীষ্মের কথা!

গ্রীষ্মের বিকেলে পায়ে হেঁটে বেড়াচ্ছিলাম। বেড়ানো মানে যাকে বলে নদীর পাড় ধরে হাঁটাহাঁটি করা। ব্যস, তাকে এর বেশি কিছু বলা যাবে না। হাঁটতে হাঁটতে বহু দূরে চলে যাওয়া। রাতবাস করা। যাক গে; যে কথা বলতে চাচ্ছি, নদীময় অঞ্চল, দিনের আলো প্রায় নিভে গিয়ে প্রকৃতির বুকে আলো-আঁধারির খেলা শুরু হয়ে গেছে।

একটু পরেই নেমে আসবে সন্ধ্যার অন্ধকার।

আবছা অন্ধকারে হাঁটতে হাঁটতে এক সময় আমি থমকে দাঁড়িয়ে পড়লাম। চারদিকে তাকিয়ে জায়গাটা সম্বন্ধে একটু-আধটু ধারণা করে নেবার চেষ্টা করতে লাগলাম।

কিন্তু হায়! কী মুশকিলেই যে পড়লাম তা আর বলার নয়। আঁকাবাঁকা পথটা যে কোথায় গেছে, কোথায় গিয়ে শেষ হয়েছে, কিছুই ঠাহর করতে পারলাম না।

পথটা যে কেবল আঁকাবাঁকা তা-ই নয়। ভূমির গঠন প্রকৃতিও অদ্ভুত। উঁচু-নিচু, যাকে বলে রীতিমত ঢেউ খেলোননা। এমন একটা বিচিত্র ধরনের পথ বেয়ে আমি পুরো একটা ঘণ্টা ধরে হেঁটে চলেছি, তবু এ-পথের যেন বিরাম নেই, শেষ নেই। আমি কোথায় যে চলেছি, কোথায় গিয়ে যে এ-চলার শেষ হবে, কিছুই বুঝতে পারছি না। হতাশা আর হাহাকার সম্ভল করে অনবরত হেঁটেই চলেছি।

কিন্তু আর কতক্ষণ যে এমনি হারা উদ্দেশ্যে ঢেউ খেলানো পথ ধরে হাঁটতে হবে কিছুই আমার জানা নেই।

আমার মাথা ঝিম ঝিম করছে। কান দুটো রীতিমত ভোঁ-ভোঁ করছে। ভবিষ্যৎ যার ঘোলাটে তার মাথা তো ঘোরবারই কথা। কিন্তু ব্যাপারটা কেমন হলো কিছুই মাথায় ঢুকছে না। যে গ্রামে আশ্রয় নিয়ে রাতবাস করব মনস্থ করে বেরিয়েছি, সে ছোট্ট মিষ্টি-মধুর গ্রামটা যে কোথায়, কোন্‌দিকে আর কতদূরে তা বুঝতেই পারছি না।

সূর্যদেব সারাটা দিন যে কোন গোপন অন্তরালে লুকিয়ে ছিলেন কে জানে। সারাটা দিন মুখও দেখতে পাইনি। চারদিক হালকা কুয়াশার চাদরে মোড়া ছিল। তা সত্ত্বেও ভ্যাপসা গরমে রীতিমত হাইফাই করছি। না, কুয়াশা বলাটা হয়তো ঠিক হবে না, বরং ধোঁয়াশা বলাই উচিত।

সূর্য পাটে বসতে না বসতে ধোঁয়াশার আস্তরণটা যেন আরও পুরু হয়ে আমার সামনে হাজির হয়েছে। আর অবাঞ্ছিত ধোয়াশার জন্যই হয়তো আমাকে এমন ধন্ধে। পড়তে হয়েছে। সবকিছু ওলট-পালট হয়ে পড়েছে। অনুসন্ধিৎসু চোখে চারদিকে তাকিয়েও কিছুই ঠাহর করতে পারছি না।

আমি এক পথহারা পথিক, খুবই সত্য বটে। পথের নিকানা হারিয়ে আমি এখন যেন অজানা দেশের দিকে হেঁটে চলেছি। তবে আমি ঘাবড়ে গেছি। মুষড়ে পড়েছি এমন কথা কেউ যদি ভেবে থাকেন তবে কিন্তু আমার প্রতি অবিচারই করা হবে। কারণ, পথে নামার সময় আমিতো মোটামুটি জেনেই এসেছিলাম, আমার মন পছন্দ–ভালো-লাগা মিষ্টি মধুর ছোট্ট গ্রামটার হদিস যদি নেহাৎ না-ই পাই, ছোট্টমিেট্ট ওলন্দাজ খামার বাড়ি বা কোনোরকমে মাথা গোঁজবার মতো ব্যবস্থা যা হোক একটা না একটা হয়েই যাবে। যদিও চোখের সামনে জনবসতির চিহ্নও নেই।

সত্যি এমন সঙ্কটজনক একটা পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েও আমি এতটুকুও ঘাবড়ে যাইনি। বরং মনকে এই বলে শক্ত করে বেঁধেছি, যদি কোনোরকম উপায় না ই হয় তবে…ক্যাম্বিসের ব্যাগটাকে বালিশ হিসেবে ব্যবহার করে, আর একমাত্র সঙ্গি কুকুরটাকে পাহারায় মোতায়েন করে খোলা আকাশের তলায় ঘুমিয়ে মজা লোটার জন্যও আমি মানসিক প্রস্তুতি অনেক আগেই নিয়ে রেখেছি।

তাই তো আমি কোনোরকম উদ্বেগ উৎকণ্ঠার শিকার না হয়ে সম্পূর্ণ নিশ্চিন্তে দুলকি চালে পথ পাড়ি দিয়ে চলেছি। এমন সময় হঠাৎ-ই আমার নজরে পড়ল একটা ঘাসের আস্তরণে মোড়া জমি। আর অন্যান্য ঘাসগুলো সে জমিটা থেকে একটু বিচ্ছিন্ন, গাড়ি-চলার পথের দিকে এঁকে বেঁকে এগিয়ে গেছে।

সামান্য ঝুঁকে আবছা আলোয় প্রায় ঢেকে-থাকা পথটার দিকে অনুসন্ধিৎসু চোখে ব্যাপারটাকে ভালোভাবে বোঝার চেষ্টা করলাম।

হ্যাঁ, আমার অনুমান অভ্রান্তই বটে। গাড়ির চাকা চলার প্রায় অস্পষ্ট চিহ্ন চোখে পড়ল। মাথার ওপরের গাছের ডালপালা ঝুঁকে পড়েছে। তবে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি করেনি যে, তারা পাহাড়ি গাড়ি চলার প্রতিবন্ধক হয়ে উঠতে পারে। গাছপালার ফাঁক দিয়ে এগিয়ে-যাওয়া পথটাকে দেখতেও অসুবিধা হলো না। তবে পথ বলতে আমরা যা বুঝি এটা কিন্তু ঠিক সে রকম নয়। তবে চাকার চিহ্ন যে রয়েছে এতে তিলমাত্রও সন্দেহ নেই। আর তা প্রায় অস্পষ্ট হলেও বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, এখান দিয়ে মাঝে মধ্যে গাড়ি চলাচল করে।

আর একটা ব্যাপার আমার নজরে পড়ল, এখানকার জমির ঘাসগুলো ভেলভেটের মতোই তুলতুলে আর পুরুও যথেষ্ট। আর বরং অস্বাভাবিক উজ্জ্বল। এখন দৃষ্টিনন্দন ঘাস ইংল্যান্ডের আর কোথাও চোখে পড়েনি।

আর এ ঘাসের গালিচার ওপর দিয়ে গাড়ির চাকা নিঃশব্দে যাতায়াত করে। নিঃশব্দে বলছি এ কারণে যে, পথের ওপর পাথরের কুঁচি অথবা ভাঙা ডালপালার মতো কোনো সমস্যা নেই। পথ আপনা থাকতে সৃষ্টি হয়নি, তৈরি করা হয়েছে। পাথর সরিয়ে ফেলে দুদিকে অনুচ্চ আলের মতো তৈরি করে সীমানা নির্ধারণ করে নেওয়া হয়েছে। তবে এ-কথাও বলা যাবে না যে, খুবই গোছগাছ করে বা একেবারেই অগোছালোভাবে সেটাকে তৈরি করা হয়েছে।

সযত্নে পাথর গেঁথে গেঁথে, পাথরে নিয়মিত ব্যবধানে থোকা থোকা ফুল ফুটে রয়েছে, যা পথটাকে আরও বেশি চমৎকারিত্ব দান করেছে। এক নজরে দেখলেই মনে হয় চোখের সামনে বুঝি কেউ পটে-আঁকা একটা ছবি টাঙিয়ে রেখেছে। সে যে কী মনোলোভা এক দৃশ্য! তা নিতান্তই উপলব্ধির ব্যাপার, কাউকে বলে বোঝানো সম্ভব নয়।

ব্যাপারটা কিন্তু ঠিক আমার মাথায় ঢুকল না। চোখের সামনে যে দৃশ্য দেখছি তা সে একটা উন্নতমানের শিল্পকীর্তি এ বিষয়ে কিছুমাত্রও সন্দেহের অবকাশ নেই। যে কোনো শিল্পরসিক অবশ্যই আমার সঙ্গে একমত হবেন।

কেবলমাত্র আমার হাতের নাগালের মধ্যেকার পথটুকুর কথাই বা বলি কেন, সম্পূর্ণ পথটাই রীতিমত চমৎকারিত্বের দাবি রাখে।

স্বীকার না করে পারছি না, এখানে যা-কিছু চাক্ষুষ করছি অবহেলা অবজ্ঞাসহকারে তৈরি করা হলেও সুরুচিসম্পন্ন শিল্প-ভাবনার জন্য শিল্পকীর্তিতে অবহেলা কিছু আছে বলে চোখে ধরা পড়ল না। তাই কায়িক পরিশ্রম আর সময়ও খুব কমই করতে হয়েছে। বিস্ময় উৎপাদনকারী ব্যাপারই বটে।

অন্যন্য শিল্পকর্ম আমার চোখ ও মনকে এমনই প্রভাবিত করে ফেলল যে, মনে হলো কোন অদৃশ্যশক্তি যেন চুম্বকের মতো আমার পা দুটোকে আঁকড়ে ধরে রেখেছে। চলার মতো শক্তি ও মন উভয়ই যেন আমি হারিয়ে ফেলেছি। তবে কেউ যদি ভাবেন, শিল্পাধিক্যের জন্য আমার এ হাল হয়েছে তবে নিতান্তই ভুল করবেন। শিল্পাধিক্যের জন্য না ভেবে বরং শিল্পনৈপুণ্যের কথা যদি বলেন তবে অবশ্যই মেনে নেওয়ার মতোই কথা হবে বটে।

সে, যে দৃষ্টিকোণ থেকেই বিচার করুন না কেন, আমি কিন্তু সুদক্ষ শিল্পীর সুনিপূর্ণ দৃষ্টিনন্দন শিল্পীকীর্তিকে অবজ্ঞা করে আর একপা-ও এগিয়ে যেতে পারলাম না। পথের ধারে ঘাসের গালিচার ওপর বসে পড়তে বাধ্য হলাম। সেখানে বসে উৎসাহী চোখের মণি দুটোকে বার বার এদিক-ওদিক ঘুরিয়ে ফিরিয়ে শিল্প- নৈপূণ্যটুকু চাক্ষুষ করে আধঘণ্টা ধরে চোখ ও মনকে তৃপ্ত করে নিলাম।

হায়! এ কী অপরূপ শোভার আধার আমি চোখের সামনে দেখলাম! আমি যতই দেখলাম, ততই উপলব্ধি করলাম, একজন কৃতী শিল্পীর দেখভালের মাধ্যমেই এমন মনোরম প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের সৃষ্টি হয়েছে।

আর একটা ব্যাপার আমার অনুসন্ধিৎসু চোখে ধরা পড়েছে, সরল রেখায় সজ্জা উপস্থিত বটে। আবার সে সঙ্গে ছন্দবদ্ধভাবে রঙের বক্রতাও উপস্থিত। অতএব বৈচিত্র যে আছে তা তো স্বীকার করতেই হচ্ছে। তবে বৈচিত্রের মধ্যে সমন্বয় সাধন করে শিল্পকীর্তিকে আরও অনেক, অনেক বেশি মনোলোভা করে চোখের সামনে মেলে ধরা হয়েছে।

উফ! কী যে অসামান্য সমন্বয় ভাবা যায় না। একেবারেই পরিপাটি, পুরোপুরি নিখুঁত সমন্বয়। নিতান্ত খুঁতখুঁতে স্বভাবের সমালোচকের পক্ষে এতটুকু ত্রুটি বিচ্যুতি বের করা সম্ভব হবে না।

এক সময় নরম সবুজ ঘাসের আসন ছেড়ে উঠে পড়তেই হলো। আমার যে বসে বসে শিল্প নৈপূণ্য দেখে চোখ ও মনকে তৃপ্তিদান করলেই চলবে না। আমাকে যে এগিয়ে যেতে হবে, মাথা গোঁজার মতো একটা ঠাই খুঁজে বের করতে হবে।

যা-ই হোক, আমি উঠেই পড়লাম। দু-চার পা এগিয়ে ডান দিকে বাঁক ঘুরে এ পথে পা দিলাম। এগিয়ে চললাম। সামান্য এগিয়েই লক্ষ্য করলাম, হেলেসাপের মতো আঁকাবাঁকা গতিতে এগিয়ে আমার সামনের পথটা এক সময় নজরের বাইরে চলে গেছে। কয়েক পা গিয়েই আবার বাঁক নিতে হলো। তারপর আবারও বাক নিয়ে গতি অব্যাহত রাখতে হলো।

একটু পরেই খুবই হালকা, অস্পষ্টও বলা চলে এমন একটা তিরতিরে আওয়াজ আমার কানে এলো। উকৰ্ণ হয়ে লক্ষ্য করে আওয়াজটা সম্বন্ধে স্পষ্ট ধারণা করে নিতে চাইলাম। মনে হলো পানি পড়ার আওয়াজ। কাছে কোথাও কোনো অনুচ্ছ জায়গা থেকে পানি নিচে পড়ছে। হঠাৎই বাঁক নিয়ে দুপা এগোতেই চোখে পড়ল একটা বাড়ির দিকে পথটা ক্রমে ঢালু হতে হতে একই সর্পিল গতিতে এগিয়ে গেছে। বার বার উঁকি-ঝুঁকি দিয়ে ব্যাপারটা সম্বন্ধে সুস্পষ্ট ধারণা নেবার চেষ্টা করলাম।

না, ব্যাপারটা ঠিক বুঝে উঠতে পারলাম না। নিচের উপত্যকাটা কুয়াশার চাদরে মোড়া থাকায় স্পষ্টভাবে কিছু দেখা সম্ভব হলো না। সূর্য পশ্চিম আকাশের গায়ে হেলে পড়েছে অনেক আগেই। এখন দূরে পাহাড়ের আড়ালে গা-ঢাকা দেবার সুযোগের অপেক্ষায় রয়েছে। ঝির ঝির করে ভালোলাগা বাতাস বইছে। দেহে ও মনে রোমাঞ্চ জাগানো হাওয়া। আর তারই দৌলতে কুয়াশা একটু একটু করে ওপরে উঠে যাচ্ছে। আর এরই ফলে সামনের দৃশ্য ক্রমেই স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হয়ে উঠতে আরম্ভ করেছে।

এবার আমার সামনের কুয়াশার বাধা ক্রমে সরে যাওয়ায় অদৃশ্য একটা ছবির যেন একটু অংশ আমার চোখের সামনে ফুটে উঠল। ওই তো ওদিকে একটা চিমনির ওপরের অংশ, এদিকে একটা ঝাকড়া গাছ আর ওই দিকে পানি–জলাশয়। আমি যেন ঠিক এক অত্যাশ্চর্য মরিচিৎকার মুখোমুখি হলাম।

কুয়াশা ক্রমে সরতে সরতে প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল। সূর্যের রক্তিম আভা অনেক আগেই মিলিয়ে গেছে। এখন পাহাড়টার আড়ালে পুরোপুরি গা ঢাকা দিয়েছে। প্রকৃতির বুকে গোধুলির আধো আলো আধো অন্ধকার বিরাজ করছে।

পাহাড়ের ফাঁক দিয়ে তখনও হালকা অলোকরশ্মি উঁকি মেরে চলেছে। বেগুনি আর কমলা রঙের নিচে মখমলের মতো আশ্চর্য সবুজ ঘাসে চাদরের ওপরে সাদা কুয়াশা প্রতিফলিত হয়ে এক স্বপ্নময় পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। সে যে কী মনোরম দৃশ্য! তা চাক্ষুষ না করলে কিছুতেই উপলব্ধি করা সম্ভব নয়।

উপত্যকাটার দৈর্ঘ্য খুব বেশি হলেও চার শো গজ। আর প্রস্থ কোথাও পঞ্চাশ আর কোথাও বা দেড়-শো কি দুশ গজ। উপত্যকাটার উত্তরের অংশ সবচেয়ে সঙ্কীর্ণ। সেখান থেকে ক্রমে প্রশস্ত হতে হতে দক্ষিণ দিকে নেমে এসেছে। তবে ছকবাঁধা কোনো নিয়ম মেনে কিন্তু এ রকমটা হয়নি।

উপত্যকার সবচেয়ে প্রশস্ত স্থানটা দেখা যাবে দক্ষিণ সীমান্তের আটগজের মধ্যেই। আর উপত্যকাটা দিয়ে ঘেরা ক্রমে ঢালু হয়ে নেমে-যাওয়া চলে না। তবে উত্তর প্রান্তের জায়গাটার কথা অবশ্য স্বতন্ত্র।

উত্তরপ্রান্ত জুড়ে গ্রানাইট পাথরের স্কুপ খাড়াভাবে নব্বই ফুট উচ্চতা পর্যন্ত উঠে গেছে। দারুণ খাড়া স্তূপ।

উপত্যকার উত্তর দিকটা পঞ্চাশ ফুটের বেশি প্রশস্ত নয়, আগেই তো বলে রেখেছি। তবে এ উঁচু স্থানটা থেকে একটু একটু করে দক্ষিণ দিকে অগ্রসর হলে ডাইনে আর বাঁয়ে ক্রমে ঢালু হয়ে নেমে-যাওয়া যে জায়গাটা নজরে পড়বে, তা ক্রমে কম-খাড়াই, কম-পাথুরে আর ঢালু হতে হতে এগিয়ে গেছে। সংক্ষেপে দক্ষিণ দিক যেমন ক্রমে ঢালু হয়ে নেমে গেছে ঠিক তেমনই পেলবও হয়েছে। তবুও উচ্চতা সম্পূর্ণ উপত্যকাটাকে মালার মতো ঘিরে রেখেছে, তবে ব্যতিক্রম কেবলমাত্র দুটো স্থানে। যে ব্যতিক্রমের কথা বলছি তার একটা দিক পশ্চিমে অবস্থান করছে। সে স্থানটার গ্রানাইট পাথরের গায়ে দশ গজ চওড়া ফাঁক দিয়ে উপত্যকার দিকে সূর্যরশ্মি ছুটে আসছে।

ফাঁক বলতে আমি গিরিপথের কথা বলতে চাচ্ছি। এ-গিরিপথটা যেন আরও প্রশস্ত হয়ে অগ্রসর হয়েছে দুর্গম পর্বত আর অজানা অচেনা পর্বতের দিকে।

এরকমই আরও একটা গিরিপথ অবস্থান করছে দক্ষিণ দিকে। এ-দিকটা খুবই কম ঢালু। আর তা রয়েছে পূর্ব থেকে পশ্চিমদিকে। বড় গজ দেড়-শো গজ হবে।

এ-গিরিপথ দুটোর মাঝে অবস্থিত অধিত্যকাটাকে দেখলে মনে হয়, কেউ যেন স্থানটাকে জোর করে চেপে নামিয়ে দিয়েছে।

গাছগাছালির ব্যাপার সম্বন্ধে তো কথাই চলে না–এখানকার সবকিছুতেই যেন কোমলতা লক্ষিত হয়। কেবলমাত্র উত্তরেই নয় সোজা দক্ষিণ দিকে চলে গেছে কোমলতার ছোঁয়াটুকু।

আর উত্তর দিকে? সে দিকে উঁকি-ঝুঁকি মারা খাড়াই পাথরের সামান্য দূরেই দৃষ্টিনন্দন চিরসবুজ গাছগাছালি দলে দলে কাতারে কাতারে দাঁড়িয়ে রয়েছে। মৃদুমন্দ বাতাসে ডালপালা অনবরত দোল খেয়ে চলেছে। হাজারো জানা-অজানা গাছের মধ্যে সবচেয়ে বেশি করে নজরে পড়ছে কালচে ওয়ালনাট, চেস্টনাট আর ও গাছ। এদের মধ্যেও বেশি করে ওয়ালনাটের কথাই বলতে হয়। এদের ইয়া মোটা মোটা সোজাভাবে আকাশের দিকে উঠে গিয়ে পাথরের মাথায় যেন দোয়ার মতো আচ্ছাদন সৃষ্টি করে রেখেছে।

আবার যদি পায়ে পায়ে দক্ষিণ দিকে এগিয়ে যাওয়া যায়, তবে একই রকম গাছগাছালি। উত্তর দিকের গাছগুলোর সঙ্গে সবচেয়ে বেশি বৈসাদৃশ্য লক্ষিত হবে উচ্চতার দিক থেকে। উত্তর দিক থেকে ক্রমে উচ্চতা কমতে কমতে যেন এখানে এসে ভূমির সঙ্গে মিশে গেছে।

দক্ষিণ-দিকের পুরো ঢালু অঞ্চলও জুড়ে অবস্থান করছে ছোট ছোট আগাছা আর লতাপাতা। ব্যস, কেবল ছোট-বড় ঝোঁপঝাড়। আর তাদের ফাঁকে ফাঁকে এখানে ওখানে ছড়িয়ে রয়েছে রূপালি উইলো গাছ নইলে সাদা পপলার।

আর উপত্যকার পায়ের দিকে দৃষ্টিপাত করলে দেখা যাবে, তিনটি মাত্র গাছ অকৃত্রিম সৌন্দর্যরাশি গায়ে জড়িয়ে নিয়ে অতুলনীয় রূপ নিয়ে সদম্ভেনিজেদের অস্তিত্ব ঘোষণা করছে। তাদের একটা হচ্ছে, মনোলোভা সৌন্দর্যের আঁকর এলম গাছটার ওপর থেকে চোখ ফেরানোই দায়। আর এটা যেন অন্ত্র প্রহরীর মতো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে উপত্যকার দক্ষিণের তোরণ-দ্বারটা আগলাচ্ছে।

আর পশ্চিম দিকের প্রবেশপথটা আগলাচ্ছে হিকরি বাদাম গাছটা। এটা এলম গাছটার তুলনায় আকারে বেশ বড়। আর সৌন্দর্যের বিচারেও অনেকটাই এগিয়ে। এটা ভূমির সঙ্গে পয়তাল্লিশ ডিগ্রি কোণে ঝুঁকে পড়ে সবগুলো ডালপালাকে অধিত্যকার ভেতরে বিদায়ী সূর্যের শেষ রক্তিম আভার দিকে।

আর এ-উপত্যকা আর অধিত্যকা অঞ্চলের সবচেয়ে সুন্দর গাছটা হিকরি বাদাম গাছটা থেকে প্রায় ত্রিশ গজ পূর্বে দাঁড়িয়ে নিজের রূপ সৌন্দর্যকে অকৃপণভাবে মেলে দোিয় রয়েছে। এ-গাছের মনোলোভা রূপ জীবনে আর কোথাও আমার চোখে পড়েনি। তিন-তিনটি গুঁড়ির অত্যাশ্চর্য টিউলিপ গাছটাকে উপত্যকা গর্ব বললেও অত্যুক্তি হয় না।

টিউলিপ গাছটার গুঁড়ি তিনটি অদ্ভুতভাবে পরস্পরের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। মাটি থেকে তিন ফুট ওপর থেকেই গুঁড়ি তিনটি বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়ে অল্প অল্প করে তিনদিকে সরে গিয়ে ক্রমেই দূরত্ব বাড়াতে বাড়াতে ওপরে উঠে গেছে। তবে আকাশের দিকে বেশি ওপরে ওঠেনি। আর এরই ফলে ডালপালা আর পাতা ও ফুলে ছাতার মতো ছড়িয়ে পড়েছে। ওপরের দিকে একটা গুঁড়ির সঙ্গে অন্যটার ব্যবধান চার ফুটের কাছাকাছি।

গুঁড়ি তিনটির মধ্যে মাঝেরটা সোজা আশি ফুট ওপরে উঠে গেছে। আর তিনটি গুঁড়ির ডালপালা একত্রে মিলেমিশে গিয়ে একশো বিশ ফুট ওপরে গিয়ে শেষ হয়েছে।

টিউলিপ গাছের এমন মনোলোভা রূপ আর গাম্ভীর্য পৃথিবীর অন্য কোথাও, অন্য কোনো বনে খুঁজে পাওয়া যাবে না। তার ওপর ঘন সবুজ পাতার গায়ে সূর্যরশ্মির ছোঁয়া লেগে যেমন ঝকমক করে তখনকার শোভার বর্ণনা কেবলমাত্র ভাষার মাধ্যমে কারো কাছে ব্যক্ত করা সম্ভব নয়। আর পূর্ণবয়স্ক এক-একটা পাতা আট ইঞ্চি চওড়া যা গাছটা–ডালপালার সৌন্দর্যকে অনেকাংশে বাড়িয়ে দিয়েছে। সবুজ! সবুজ! আর কেবলই সবুজ! সবুজের এমন গৌরবময় বিচিত্র সমারোহও ফুলের চোখ ধাঁধানো সৌন্দর্যের কাছে নিতান্তই ম্লান হয়ে পড়েছে।

ফুলগুলো কেবলমাত্র চমৎকারিত্বেরই দাবি রাখে না। যে সঙ্গে প্রতিটা ফুলও বিরাট আকৃতিবিশিষ্ট। তার ওপর স্বল্পপরিসর স্থানে এমন বিরাট অপরূপ সৌন্দর্যমণ্ডিত লাখ দশেক ফুল যদি পাশাপাশি গা ঘেঁষাঘেঁষি করে ফুটে থাকে, তবে তা কি যে কোনো সৌন্দর্য-রসিকের চোখ ও মনকে কেড়ে নেবার দাবি রাখে না? আমার পাঠক পাঠিকার কাছে একটাই প্রত্যাশা রাখছি, দৃশ্যটা কী অপরূপ সৌন্দর্যমণ্ডিত হয়ে উঠতে পারে তা কল্পনায় আনার চেষ্টা করুন। যদি তা কিছুটাও অন্তত সম্ভব হয় তবে মনে করব লেখনির মাধ্যমে ছবিটা আকার যে প্রয়াসী আমি হয়েছি তা সার্থকতায় পরিপূর্ণ হয়ে উঠেছে।

আরও কিছু সময় আমি পাঠক-পাঠিকার কাছ থেকে চেয়ে নিচ্ছি। এবার তিনটি গুঁড়ির কথা ভাবুন। তাদের আকৃতির একটা ছবি আপনার কল্পনার মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করুন। প্রতিটা গুঁড়ির ব্যাস চারফুট, ভূমি থেকে বিশ ফুট ওপরে। অগণিত ফুলের মন-মাতানো মিষ্টি-মধুর গন্ধ মিলেমিশে বাতাসের কাঁধে ভর দিয়ে বহুদূর পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছে। ছড়িয়ে পড়েছে সম্পূর্ণ উপত্যকাটায়। মাতোয়ারা করে তোলে প্রতিটা পথিকের মন-প্রাণ। পরিবেশটার কথাটা একবার ভাবুন তো।

একটা আগে পথের ধারে ধারে যেমন সবুজঘাসের বিচিত্র সমারোহ মন কেড়ে নিয়েছিল, চোখ দুটোকে করেছিল বিশেষভাবে প্রভাবিত, এখন উপত্যকার বুকে তা সম্পূর্ণ পৃথক রূপ নিয়ে আমার চোখের সামনে উপস্থিত। সে আগেকার সে মনোলোভা ঘন সবুজ ঘাস উপত্যকাটাকে মুড়ে রেখেছে। গালিচার মতো নরম, পুরু। আর অভাবনীয় সবুজ। এত অপরূপ রূপের সে বিচিত্র সমাবেশ ঘটতে পারে, তা সে বাস্তবিকই কল্পনাতীত।

আগেই উপত্যকার প্রবেশ-পথ দুটোর বর্ণনা দিয়ে রেখেছি। রূপের বিচারে কেউ কারো থেকে কোনো অংশে কম যায় না।

উত্তর-পশ্চিমে যে প্রবেশ পথটা রয়েছে, সেদিক থেকে ছোট্ট একটা পাহাড়ি নদী নেচে নেচে হেলে দুলে কুল কুল ধ্বনির সৃষ্টি করে ফেনার মুকুট মাথায় নিয়ে পাথরের স্তূপটার কাছে চলে এসেছে। যেখানে আকাশের দিকে সদম্ভে মাথা উঁচিয়ে নিজের অস্তিত্ব ঘোষণা করছে হিকরি বাদাম গাছটা।

হিকরি বাদাম গাছটাকে পাশ কাটিয়ে আবার হেলে সাপের মতো এঁকেবেঁকে। জলরাশি অপরূপ সৌন্দর্যের আধার টিউলিপ গাছটা থেকে বিশ ফুট দক্ষিণ দিক থেকে দুর্বার গতিতে এগিয়ে গেছে। এবার এদিক-ওদিক না তাকিয়ে সোজা পূর্ব-পশ্চিমের সীমানার মাঝামাঝি জায়গা দিয়ে বয়ে গেছে। এখান থেকে আবার একই গতিতে ছুটে চলেছে ডিম্বাকার অধিত্যকাটায়। সেখানে গিয়ে স্রোতস্বিনী স্রোত যেন অনেকাংশে হারিয়ে ফেলেছে। তবু তার চলার বিরাম নেই। আবার বার বার কোমর দুলিয়ে নাচতে নাচতে এগিয়ে গিয়ে অধিত্যকার সৌন্দর্যের আধার ডিম্বাকার হ্রদে গিয়ে নিজের অস্তিত্ব হারিয়েছে।

ডিম্বাকার হ্রদটার সৌন্দর্য বাস্তবিকই অতুলনীয়। যে কোনো শিল্পরসিকের মতো সৌন্দর্য নিজের দেহে ধারণ করে দিনের পর দিন দশদিকের মনোরঞ্জন করে চলেছে।

বিদায়ী সূর্যের শেষ রক্তিম আভাটুকু হ্রদের স্বচ্ছ পানির সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়ে যেন এক স্বপ্নময় জগৎ সৃষ্টি করেছে। একমাত্র ডিম্বাকার আয়নার সঙ্গেই এর তুলনা চলতে পারে।

হ্রদটার সৌন্দর্য অতুলনীয় হলেও আকৃতি কিন্তু মোটেই উল্লেখযোগ্য নয়। ঠিক ঠিকভাবে বলতে গেলে এটাকে ছোট্ট একটা হ্রদ বলাই শ্রেয়। এর সবচেয়ে চওড়া জায়গাটার ব্যাস এক গজের কিছু কম ছাড়া বেশি নয়।

আর পানি। স্বচ্ছ তো বটেই। তবে পানির স্বচ্ছতার বিচার করতে হলে সবার আগে কৃস্টাল পাথরের কথাই মনের কোণে জেগে ওঠে। সত্যি কথা বলতে কি, পানি এতই স্বচ্ছ যে, কোনো ক্রিস্টাল পাথরও বুঝি এর চেয়ে বেশি স্বচ্ছ নয়।

পানি অত্যাধিক স্বচ্ছ হওয়ায় তলদেশের ছোট-বড় আর বিভিন্ন আকৃতিবিশিষ্ট নুড়ি পাথরগুলোকে ঝকমক করতে স্পষ্ট দেখা যায়। আর হ্রদের চারদিকে পাড়গুলো সবুজ ঘাসের মখমল ছেয়ে রেখেছে। সবুজ! সরুজ! সবুজের এমন বিচিত্র সমারোহ দেখলে অতি বড় নিন্দুকও আবেগে আপ্লুত হয়ে এর রূপ-সৗন্দর্যে ভূয়সী প্রশংসা না করে পারবে না।

আরও আছে, মাথার ওপরের নীল আকাশের গায়ে পেঁজা তুলার মতো ভেসে বেড়ানো টুকরো টুকরো মেঘের প্রতিবিম্ব হ্রদের স্বচ্ছ জলে পড়ে এক অনন্য মনোলোভা দৃশ্য সৃষ্টি করেছে।

রূপের সৌন্দর্য হ্রদটার পানি কোথায় শুরু আর কোথায় যে তার শেষ এক নজরে তা বোঝার উপায় নেই। আর হ্রদের আয়নার মতো স্বচ্ছ জলে ট্রাউট মাছ ছাড়া জানা অজানা হরেক রং আর আকৃতিবিশিষ্ট মাছ মনের আনন্দে খেলায় মেতেছে যার বর্ণনা দেওয়ার চেষ্টা না করাই ভালো। আবার কোথাও দেখা যাচ্ছে স্বচ্ছ পানির ওপর দিয়ে উড়ুক্কু মাছ অনবরত চক্কর খেয়ে বেড়াচ্ছে। তারা এত ব্যস্ততার সঙ্গে ও দ্রুত পানিতে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে যে, হঠাৎ করে দেখলে মনে হয় তারা বুঝি সর্বক্ষণ পানির ওপরেই মনের আনন্দে ছুটোছুটিতে মেতে রয়েছে। তারা বুঝি শুন্যেই অবস্থান করছে হ্রদের জলে নয়।

ছোট্ট একটা ডিঙি নৌকা হ্রদের স্বচ্ছ জলে ভাসছে। বাতাসে অনবরত হালকাভাবে দোল খাচ্ছে। কেবলমাত্র তার তলদেশই নয়, সম্পূর্ণ শরীরটা–এমনকি প্রতিটা সূক্ষ্মতম অংশও দর্পণের মতো স্বচ্ছজলে প্রতিবিম্বিত হচ্ছে।

হ্রদটার উত্তর দিকের পাড়ের কাছে, একেবারে গায়েই রয়েছে ছোট্ট একটা দ্বীপ দ্বীপভূমি। সেখানে একটা মুরগির খামার দেখা যাচ্ছে। দ্বীপটা এতই ছোট যে খামারবাড়িটাই পুরো জায়গা দখল করে নিয়েছে।

ছায়াছবির মতো সুদৃশ্য এ-দ্বীপটার সঙ্গে ছোট অথচ চমৎকার একটা সকোর সাহায্যে যোগাযোগ স্থাপন করা হয়েছে। সাঁকোটা এতই ছোট যে, এক সঙ্গে বেশি মানুষ নয়, কেবলমাত্র একজনের পক্ষেই কোনোরকমে যাতায়াত সম্ভব। কল্পনাতীত হালকা। আর গঠন বৈচিত্র্য আদিমযুগের সাঁকোর মতোই মনোলোভা সৌন্দর্যমণ্ডিত। টিউলিপ কাঠের একটা মাত্র তক্তা এটা তৈরির কাজে ব্যবহার করা হয়েছে। দৈর্ঘ্য চল্লিশ ফুট। চোখে লাগার মতো খিলের মাধ্যমে সাঁকোর তক্তাটাকে উঁচু করে তুলে রেখেছে–যাতে এদিক-ওদিক হেলে না যায় আর নড়বড় না করে তারই জন্য এ ব্যবস্থা।

খুবই সরু একটা জলধারা হদের দক্ষিণ প্রান্ত থেকে ত্রিশ গজ জায়গা জুড়ে নাচানাচি দাপাদাপি করতে করতে শেষমেশ জলপ্রপাতের আকার নিয়ে লাফিয়ে একশো ফুট তলায় আছড়ে পড়েছে।

হ্রদটার গভীরতা উল্লেখযোগ্য ভাবে গভীর। কোথাও কোনো গভীরতা ত্রিশ ফুটের কম নয়। তবে কল্লোলিনী জলাধারাটার গভীরতা কিন্তু কোথাও তিন ফুটের কম ছাড়া বেশি নয়। আর চওড়া? আট ফুটের বেশি চওড়া নয়। সবচেয়ে বেশি চওড়া জায়গাটার কথা বলছি।

হ্রদের পাড় দুটোর মতোই দ্বীপের চারদিক সবুজ ঘাসে ছাওয়া নয়–এটুকুই যা পার্থক্য লক্ষিত হয়। আর দ্বীপের অগভরী পানি কোন কোন ক্ষেত্রে মাত্রাতিরিক্ত স্বচ্ছ। দর্পণের চেয়ে পরিষ্কার প্রতিবিম্ব পড়ে, মুখ দেখা যায়।

মাঝে মধ্যে ঘাসের সবুজ পাড়ের সবুজ আভায় ঘাটতি পড়েছে। কারণ, হরেক রঙের আর নিখুঁত গোলাকার ঝোঁপ থাকার জন্যই এমনটা হয়েছে।

অধিত্যকার ঘন সবুজ ঘাসের মখমলের ওপর দলে দলে ভেড়া, তিনটি পোষা। হরিণ, অগণিত ধবধবে সাদা হাঁসের দল মনের আনন্দে ঘুরে বেড়াচ্ছে। একটা বিশালদেহী মাসটিক কুকুর সতর্ক দৃষ্টি মেলে তাদের পাহারা দিচ্ছে। তার লম্বা ঝুলন্ত কান, ঠোঁট আর লক্লকে জিভটা চোখে পড়লেই বুকের রক্ত হিম হয়ে আসে। সে অধিত্যকার সর্বত্র ঘুরে ঘুরে হরিন, ভেড়া আর হাঁসগুলোর ওপর চোখেল মণি দুটোকে অনবরত ঘোরাচ্ছে।

প্রচুর আইভিলতার ঝোঁপ পূর্ব আর পশ্চিম প্রান্তের নিরস-কর্কশ পাথরগুলোকে ঢেকে রেখেছে। লতার আধিক্যের জন্যই পাথরের একটা অংশও চোখে পড়ছে না।

আর উত্তর দিক? সরস, নিটোল আর লকলকে আঙুর লতায় উত্তর দিকের খাড়াই পাথর ঢাকা পড়ে গেছে। লতাগুলোর মধ্যে কোনটা পথরের খাঁজ থেকে আর কোনটা বা মাটি থেকে সরাসরি গজিয়ে বিস্তীর্ণ অঞ্চল ছেয়ে ফেলেছে। এ কী মনোলোভা দৃশ্য। তা চাক্ষুষ না করলে অন্যের মুখ থেকে শুনে সম্যক ধারণা লাভ করা কিছুতেই সম্ভব। নয় বলেই আমার বিশ্বাস।

উপত্যকার ঠিক নিচের দিকে সামান্য উচ্চতার একটা পাথরের প্রাচীর রয়েছে। হরিণ তিনটি সে প্রাচীরটাকে ডিঙোবার জন্য প্রাণান্ত প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু শত চেষ্টা করেও সেটাকে ডিঙিয়ে বিপরীত দিকে যেতে পারছে না। শেষপর্যন্ত তারা হতাশ হয়ে হাল ছেড়ে দিল।

কোথাও বেড়া জাতীয় কোনোকিছুর অস্তিত্ব নেই। তার দরকারই বা কি? প্রকৃতিই সে কাজ সেরে রেখেছে। স্থানে স্থানে পাথরের প্রাচীর সদম্ভে মাথা উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে থেকে একটা স্থানকে অন্য স্থান থেকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে। আর তাদের সামনে লতার বাধা সৃষ্টি হয়েছে। যত সতর্ক হয়েই চলাফেরা করুক না কেন ভেড়া বা হরিণের পা তাতে আটকে গিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়াই স্বাভাবিক।

যেখান সেখান দিয়ে ভেতরে ঢোকার সুযোগ নেই। একটামাত্র পথ দিয়েই ভেতরে ঢুকতে হয়–আমি যে-দিকে দাঁড়িয়ে ভূ-স্বর্গের অন্যান্য দৃশ্য চাক্ষুষ করে চোখ ও মনকে তৃপ্ত করে চলেছি।

পাহাড়ে সঙ্কীর্ণ অথচ স্রোতস্বিনীর নেচে নেচে হেলে-দুলে এগিয়ে যাওয়ার অনন্য সৌন্দর্যের কথা তো বলেছি। কিন্তু উত্তর থেকে দক্ষিণে আবার পশ্চিম থেকে পূর্বে যাওয়ার পথের মাঝে একটা ফাস তৈরি করার ফলে মাঝখানে ছোট্ট অথচ অপরূপ রূপের আধার একটা উপদ্বীপ গড়ে উঠেছে–পানির মাঝে প্রকৃতি সৃষ্ট ছোট্ট এক খণ্ড ভূখণ্ড। আর সে উপদ্বীপটার কেন্দ্রস্থলে মনে দাগ কাটার মতো চমৎকার একটা বাড়ি, একটা বসতবাড়ি অবস্থান করছে। উপদ্বীপটার দিকে এক নজরে দৃষ্টিপাত করলেই সেটাকে পটে আঁকা একটা দৃষ্টিনন্দন ছবি বলেই মনে হয়। যাক, যে কথা বলতে চাচ্ছি–যাকে বাড়ি বললাম সেটা কিন্তু অন্য পাঁচটা বাড়ির মতো ইট-কাঠ পাথরের বাড়ি নয়, ছিমছাম একটা ছোট্ট কুড়েঘর ছাড়া কিছু নয়।

যেখানে দাঁড়িয়ে আমি দেখছি, সেখান থেকে সুন্দর কুঁড়ে-ঘরটাকে আরও অনেক অনেক বেশি সুন্দর দেখাতে লাগল। সত্যি কথা বলতে কি, আমার তখন মনে হল, পটে আঁকা ছবিও বুঝি এমন মনোলোভা রূপ নিয়ে চোখের সামনে ফুটে ওঠে না।

সম্পূর্ণ বাড়িটার কথা বলছি না, মূল বাড়িটার দৈর্ঘ্য চব্বিশ ফুট, আর প্রস্থ ষোল ফুট। এর বেশি মোটেই নয়। আর মেঝে থেকে ছাদ অবধি মোট উচ্চতা আঠারো। ফুটের কিছু কম হতে পারে, কিন্তু বেশি অবশ্যই নয়।

বাড়িটার নিচের দিকটা লতা-পাতার ঝোঁপ দিয়ে ঘিরে রেখেছে, আর সামনে সবুজ ডালি মাথায় নিয়ে দাঁড়িয়ে সুদৃশ্য একটা ন্যাসপাতি গাছ। এটা বাড়িটার সৌন্দর্যকে অনেকাংশে বাড়িয়ে দিয়েছে। গাছের এ-ডালে ও-ডালে হরেকরকম খাঁচা ঝুলছে। প্রত্যেকটায় ভিন্ন-ভিন্ন জাতের পাখি বসে চারদিকে টুলটুল করে তাকাচ্ছে। তাদের সমবেত কলতানে উপত্যকাটা গমগম করছে।

সুদৃশ্য সার্সি দিয়ে জানালাগুলো ঢাকা। আর বাড়িটা টিউলিপ ফুলের সঙ্গে মিলিয়ে রঙ করা।

আমি দৃষ্টিনন্দন বাড়িটার দিকে এক পা-দুপা করে এগিয়ে গেলাম। কাছাকাছি গিয়েই থমকে দাঁড়িয়ে পড়লাম। অনুসন্ধিৎসু চোখের মণি দুটোকে বাড়িটার গায়ে আলতোভাবে বুলাতে লাগলাম।

বাড়িটাকে যত দেখছি ততই যেন আমার চোখে সুন্দর দেখাতে লাগল।

পরমুহূর্তেই সাদা-কালো পাথরের চিমনিটার ওপর আমার দৃষ্টি নিবদ্ধ হলো।

বাড়িটার দিকে আরও কয়েক মুহূর্ত নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে থাকার পর আমি এবার বুঝতে পারলাম, বাড়িটার আগাগোড়াই মিশরীয় নকসার অস্তিত্ব বর্তমান। আর সেটার ওপরের দিকটা সরু, নিচের দিকটা ক্রমশ সরু হতে হতে ভূমি পর্যন্ত মিশে গেছে।

সেতুটা পেরিয়ে আমি কাকড় ছড়ানো জমিতে নামামাত্রই নিঃশব্দে, একেবারে বাঘের শিকার ধরার মুহূর্তের মতো পা টিপে টিপে কিছুটা এগিয়ে গিয়ে শেষমেষ আচমকা একটা লম্বা লাফ দিয়ে একেবারে আমার মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়ে পড়ল ইয়া তাগড়া চেহারাধারী মাসপি।

একান্ত পরিচিত বন্ধুর কায়দায় মাসটি আমার দিকে একটা পা বাড়িয়ে দিল, আমাকে বন্ধু বলে স্বীকার করে নেবে কি না, না জেনেই এমনটা করল। আমিও বন্ধুর কায়দায়ই হাত উঁচিয়ে তাকে ইশারা করলাম।

মাসটিফ এবার চোয়াল বন্ধ করল। আমাকে নিয়ে তার চিন্তার অবসান ঘটল, বুঝলাম। সে আবার একটা পা বাড়িয়ে দিয়ে আমার প্রিয়-পোষা কুকুর পন্টোকে সাদর অভ্যর্থনা জানাল।

দরজায় কোন ঘণ্টা চোখে পড়ল না। খুঁজে পাব কি করে, আসলে ঘণ্টার ব্যবস্থাই যে নেই। ফলে বাধ্য হয়ে হাতের ছড়ির ধাতব মাথাটা দিয়ে দরজার পাল্লায় টোকা দিলাম। দরজাটা আধ-খোলা অবস্থাতেই রয়েছে দেখলাম।

দরজায় বার-কয়েক টোকা দিতেই বাড়ির ভেতর থেকে পায়ের আওয়াজ ভেসে এলো।

মুহূর্তের মধ্যেই দরজার পাল্লা দুটো হাট হয়ে গেল। প্রায় আঠারো বছর বয়স্কা এক মহিলার মুখ আমার চোখের সামনে ভেসে উঠল। তার চোখে-মুখে হাসির প্রলেপ। এমন অত্যুজ্জ্বল চোখ আর মিষ্টি-মধুর হাসিমাখা মুখ আর জীবনে অবশ্য কোথাও, অন্য কোনো মহিলার মুখেই আমি দেখিনি। সংক্ষেপে বলতে গেলে, এমন মহিলা বাস্তবিকই নজিরবিহীন আর তুলনাবিহীন।

নারী নয়, নারীর নারীত্বই শেষপর্যন্ত পুরুষকে কাছে টানে। ভালোবাসার জোরে বাঁধে, অন্তরের ভালোবাসা নিঙড়ে দিয়ে নিজেকে নিঃস্ব, রিক্ত করে তোলে। তার চোখে সে অত্যাশ্চর্য নারীত্বকেই দেখলাম। তার চলনের মনোলোভা ভঙ্গিমাতেও যে নারীত্বকে চাক্ষুষ করলাম।

তার চাহনি পুরুষকে মুহূর্তে আপন করে নেওয়ার আশ্চর্য ক্ষমতা ধরে। চাহনি সহস্য আমার অন্তরের অন্তঃস্থলে প্রবেশ করল।

অ্যানি! সে অষ্টাদশীর নাম অ্যানি।

আঃ! কী মধুর নাম–অ্যানি!

ভেতর থেকে এক পুরুষ-কণ্ঠ ভেসে এলো অ্যানি–প্রেয়সী অ্যানি। ডাক শুনেই বুঝে নিলাম, গৃহস্বামী ডাকছেন।

আমি তখনও অপলক চোখে অ্যানির পিঙ্গলে চোখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। আর তাকিয়ে তাকিয়ে দেখলাম, তার সোনালি কাধপর্যন্ত নেমে-আসা কেশরাশি। কুঞ্চিত কেশরাশি তার কাঁধ দুটো জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে। আমি বিস্ময় বিস্ফারিত চাহনি মেলে তার যৌবনের জোয়ার-লাগা দেহপল্লবের সৌন্দর্য মন-প্রাণ ভরে উপভোগ করলাম।

অ্যানি, কী মিষ্টি মধুর নাম। নাম আর দৈহিক সৌন্দর্যের মধ্যে এমন অভাবনীয় সাদৃশ্য সচরাচর চোখে পড়ে না।

তারপর হ্যাঁ, তারপরই আমি এসে দাঁড়ালাম সৌম্যকান্তি, স্বল্পভাষী যুবক গৃহস্বামী মুখোমুখি। পরে জানতে পারি তার নাম মি. ল্যান্ডর।

নিতান্তই সাদামাটা আসবাবপত্রে ঘরটাকে পরিপাটি করে সাজানো কোথাও এতটুকুও আড়ম্বরের লেশমাত্রও নেই।

ঘরটার একধারে একটা মর্বেল পাথরের গোল টেবিল। তার ওপর কয়েকটা বই। ক্রিস্টাল কাঁচের প্রায় বর্গাকার একটা আতর। তার ফুলদানিতে হরেক রঙের ফুলের তোড়া শোভা পাচ্ছে।

আমি বর্তমান কাহিনীর লক্ষ্যে পৌঁছে গেছি। অহেতুক বাড়িটার বর্ণনাকে আর টেনে নিয়ে লাভও তো কিছু নেই।

Anuprerona
Anupreronahttps://www.anuperona.com
Read your favourite literature free forever on our blogging platform.
RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here


Most Popular

Recent Comments