Sunday, August 24, 2025
Homeবাণী ও কথাঅনুবাদ গল্পএকটি কুকুরের কাহিনী - মার্ক টোয়েন

একটি কুকুরের কাহিনী – মার্ক টোয়েন

আমার বাবা ছিল সেন্ট বার্নার্ড–বংশোদ্ভূত, মা ছিল মেষপালকের দলে, কিন্তু আমি পুরোহিত-বংশের সন্তান, (Presbyterian)। এ কথা মা আমাকে বলেছিল; আমি নিজে এ সব সূক্ষ্ম পার্থক্য বুঝি না। আমার কাছে এগুলি অর্থহীন বড় বড় কথা মাত্র। মা এ সব ভালবাসত; এ সব কথা বলতে তার ভাল লাগত; এত কথা সে জানল কি করে এ কথা ভেবে অন্য কুকুররা তাকে দেখে অবাক হত, ঈর্ষা বোধ করত।

কিন্তু আসলে এটা কোন সত্যিকারের শিক্ষা নয়; এটা শুধু লোক-দেখানো: খাবার ঘরে ও বসবার ঘরে লোকজন এলে সে কান পেতে তাদের কথা শুনত; আবার ছেলেমেয়েদের সঙ্গে রবিবার-বিদ্যালয়ে গিয়ে শুনে আসত; কোন বড় কথা শুনলেই সে বারবার সেটাকে মনে মনে আউড়ে রপ্ত করে নিত; তারপর আশেপাশে কুকুরদের কোন জমায়েত হলেই সেই কথাটাকে সেখানে ঝেড়ে দিত এবং ছোট আদুরে কুকুর থেকে বড় আকারের বলবান কুকুর পর্যন্ত সকলকেই অবাক করে দিত, ঘাবড়ে দিত, আর তাতেই তার সব দুঃখকষ্টের লাঘব হত। কোন আগন্তুক সেখানে হাজির থাকলে তার অবশ্যই সন্দেহ হত; সে কথাটার মানে জানতে চাইত। মাও। মানেটা বলে দিত। অচেনা কুকুরটা কিন্তু এতটা আশা করত না, ভাবত মাকে জব্দ করবে; কিন্তু মা যখন মানেটা বলে দিত তখন সেই লজ্জা পেত, অথচ সে ভেবেছিল মাকেই লজ্জায় ফেলবে। অন্যরাও এর জন্যই অপেক্ষা করে থাকত; তার জন্য খুসি হত, গর্ববোধ করত, কারণ অভিজ্ঞতা থেকেই তারা জানত কি ঘটবে। মা যখনই একটা বড় কথার অর্থ বলে দিত তখনই তারা প্রশংসায় বিগলিত হয়ে ভাবত যে অর্থটা সঠিক হল কি না সে সন্দেহ পর্যন্ত কখনও কোন কুকুর করে নি; না করাটাই যে স্বাভাবিক, কারণ একদিকে সে এমন ঝটপট জবাবটা দেয় যে মনে হয় বুঝি একটা অভিধানই কথা বলছে, আর অন্য দিকে অর্থটা ঠিক কিনা সেটা তারা জানবেই বা কার কাছ থেকে?

সেখানে তার মাই তো একমাত্র লেখাপড়া-জানা কুকুর। ক্রমে আমি যখন আরও বড় হলাম তখন একসময় মা একটা নতুন কথা আমদানি করল–অন-আঁতেল, এবং সারা সপ্তাহ ধরে নানা জমায়েতে কথাটা চালাতে লাগল; আর সেই সময়ই আমি লক্ষ্য করলাম যে সারা সপ্তাহে আট টা ভিন্ন ভিন্ন জমায়েতে তাকে কথাটার মানে জিজ্ঞাসা করা হল আর প্রতিবারেই সে একটা করে নতুন সংজ্ঞা দিতে লাগল; তা থেকেই আমি বুঝতে পারলাম যে শিক্ষার চাইতে তার উপস্থিত বুদ্ধিটাই বেশী; কিন্তু মুখে কিছুই বলালাম না। একটা শব্দকে সে সব সময় হাতের কাছে রেখে দিত একটা রক্ষাকবচের মত; হঠাৎ বে-কায়দায় পড়লে জরুরী আশ্রয় হিসাবে সেটার দিকে হাত বাড়াত-শব্দটা হল সমার্থবাচক। কখনও কোন নতুন শব্দের অর্থ নিয়ে গোলমালে পড়লেই সে অসংকোচে বলে দিত, এটা হ-য-ব-র-ল-র সঙ্গে সমার্থবাচক, আর প্রশ্নকর্তা ভ্যাবাচেকা খেয়ে হাঁ করে থাকত।

বড় বড় বাক্য নিয়েও ওই একই ব্যাপার। গাল-ভরা কোন বাক্য পেলেই মা দুটি রাত ও দুটি বিকেল বারবার সেটাকে আউড়ে নানা জায়গায় নতুন নতুনভাবে সেটাকে বুঝিয়ে দিয়ে বেড়াত; তার কাছে বাক্যটাই বড়, তার অর্থ নিয়ে তার কোন মাথাব্যথা নেই। তাছাড়া সে এটাও জানত যে তার ভুল হলেও সেটা ধরবার মত কেউ নেই। আবার মাঝে মাঝে সে এমন সব ছোট ছোট মজার কাহিনী শুনে আসনে যেগুলো বলতে বলতে আর শুনতে শুনতে বাড়ির লোকজন ও অতিথিরা হেসে একেবারে গড়িয়ে পড়ত। অবশ্য যথারীতি সে একটা গল্পের মুড়োর সঙ্গে আর একটা গল্পের লেজ জুড়ে দিয়ে এক বকচ্ছপ গল্প বানাত যায় মাথামুণ্ডু কিছুই বোঝা যেত না। তাই সেই সব গল্প বলতে বলতে মা যখন সারা মেঝেতে গড়াগড়ি খেয়ে হাসত ও পাগলের মত ঘেউ ঘেউ করে ডাকত, তখন আমি বুঝতে পারতাম যে মা-ও অবাক হয়ে ভাবছে যে সে যখন প্রথম গল্পটা শুনেছিল তখন যতটা মজা লেগেছিল এখন ততটা মজাদার মনে হচ্ছে না কেন। কিন্তু তাতে কোন ক্ষতি হত না, কারণ অন্য কুকুররাও গড়াগড়ি খেতে ও ঘেউ ঘেউ করে ডাকত। হাসির কারণটা ধরতে না পেরে মনে মনে লজ্জিত হলেও তারা কখনই সন্দেহ করতে পারত না যে দোষটা নয়, যেহেতু সেটা বুঝবার মত বুদ্ধিশুদ্ধি কারও ছিল না।

এ থেকেই বুঝতে পারছেন যে মা ছিল অহংকারী আর ছেবলা; তবু অনেক গুণও তার ছিল যাতে এই ক্রটি টা শু ধরে যেত। তার মনটা ছিল দয়ালু, চাল-চলন ছিল শান্ত; কেউ তার প্রতি কোন অন্যায় করলে সেটা মনের মধ্যে পুষে রাখত না, সহজেই মন থেকে মুছে ফেলে ভুলে যেত। ছেলেমেয়েদেরও এই শিক্ষাই দিয়েছিল; তার কাছ থেকেই আমরা শিখেছিলাম সাহসী হতে, বিপদ দেখা দিলে কাজে তৎপর হতে, এবং বন্ধুবা অপরিচিত কেউ বিপন্ন হলে পালিয়ে না গিয়ে এবং ফলাফল চিন্তা না করে তাকে যাহায্য। করতে, বিপদের মুখোমুখি দাঁড়াতে। আর এ সব সে আমাদের শেখাত শুধু মুখে নয়, কাজেও; আর সেই শিক্ষাই তো শ্রেষ্ঠ, নিশ্চিত ও স্থায়ী। কত যে সাহসের কাজ, আশ্চর্য সব কাজ মা করেছে! সে ছিল সত্যিকারের সৈনিক; আবার এত বিনয়ী-তাকে প্রশংসা না করে, তার দৃষ্টান্ত অনুসরণ না করে আপনি পারবেন না; এমন কি তার সমাজে রাজা চার্লসের শিকারী-কুকুরও সম্পূর্ণ অবহেলিত থাকতে পারত না। কাজেই, বুঝতেই পারছেন, শিক্ষার চাইতেও অনেক বেশী গুণ তার ছিল।

.

অবশেষে আমি যখন বড় হয়ে উঠলাম তখন আমি বিক্রি হয়ে গেলাম। আমাকে অনেক দূরে নিয়ে গেল; মাকে আর কখনও দেখি নি। তার বুক ভেঙে গিয়েছিল; আমারও দুজনেই অনেক কাদলাম; মা আমাকে যথাসাধ্য সান্ত্বনা দিতে লাগল, বলল–একটা বিশেষ সৎ উদ্দেশ্য নিয়েই আমাদের এই পৃথিবীতে পাঠানো হয়েছে, কাজেই চোখের জল না ফেলে যার যার কর্তব্য করে যেতে হবে, ভালভাবে বাঁচতে হবে, ফলাফলের আশা না করে অপরের কল্যাণের জন্য কাজ করে যেতে হবে। সে বলল, যে সব মানুষ এই ভাবে চলে । পরজন্মে তারা অনেক ভাল ভাল পুরস্কার পায়, আর যদিও আমরা জন্তুরা সেখানে যেতে পারব না তথাপি ভালভাবে বেঁচে থাকলে এই জীবনেই যে যোগ্যতা ও মর্যাদা আমরা অর্জন করতে পারব সেটাই তো পুরস্কার।

এই ভাবে আমরা পরস্পরের কাছ থেকে বিদায় নিলাম, চোখের জলের ভিতর দিয়ে পরস্পরকে শেষ বারের মত দেখলাম, এবং আমি যাতে ভালভাবে মনে করে রাখতে পারি সেজন্য সকলের শেষে মা আমাকে বলল: যখনই অন্যের কোন বিপদ দেখবে তখনই আমাকে স্মরণ করে নিজের কথা ভাববে না, ভাববে তোমার মায়ের কথা, আর সে যা করত সেই ভাবে কাজ করবে।

সে কথা আমি ভুলতে পারি? না।

.

আমার নতুন বাড়িটা কী সুন্দর। মস্ত বড় বাড়ি, কত ছবি, কত সাজ-সজ্জা, দামী আসবাবপত্র, অন্ধকারের ছায়া কোথাও নেই, পরিপূর্ণ সূর্যের আলোয় সব কিছু ঝলমল করছে; চারদিকে বিস্তীর্ণ মাঠ, মস্ত বড় বাগান-ঘাস, ভাল ভাল গাছ ও ফুলের আর শেষ নেই! আর আমিও যেন পরিবারেরই একজন; তারা আমাকে ভালবাসত, আদর করত, নতুন একটা নাম না দিয়ে মায়ের দেওয়া প্রিয় নাম আইলীন মাভুরনীন বলেই আমাকে ডাকত। একটা গান থেকে নামটা মা পেয়েছিল; গ্রে-পরিবার গানটা জানত; তারা বলত, নামটা সুন্দর।

মিসেস গ্রের বয়স ত্রিশ; কী মিষ্টি আর সুন্দর কল্পনাও করতে পারবেন না; স্যাড়ির বয়স দশ, দেখতে মায়ের মতই, ঠিক যেন তারই একটি প্রতিমূর্তি, এক রাশ সোনালি চুল পিঠের উপর নেমে এসেছে, পরনে ছোট ফুঁ ক; আর ছোট বাচ্চাটার বয়স এক বছর, মোটাসোটা, গালে একটা টোল পড়ে; মিঃ গ্রের বয়স আট ত্রিশ, লম্বা, একহারা, সুন্দর চেহারা, মাথার সামনে ছোট একটু টাক, চটপটে, চলাফেরা দ্রুত, কাজের লোক, সারা মুখে বুদ্ধির দীপ্তি যেন ঝলমল করে! একজন বিখ্যাত বিজ্ঞানী। কথাটার অর্থ আমি জানি না, মা হয় তো জানে। একটা কথা এখানে শুনি-ল্যাবরেটরি। ল্যাবরেটরি কিন্তু বই না, ছবি না, হাত ধোবার জায়গাও না, যদিও কলেজ-প্রেসিডেন্টের কুকুরটা তাই বলেছিল-না, সেটা তো ল্যাভাট রি; ল্যাবরেটরি সম্পূর্ণ আলাদা ব্যাপার; সেখানে পাত্র থাকে, বোতল থাকে, বিদ্যুৎ থাকে, তার থাকে, আরও অদ্ভুত সব যন্ত্রপাতি থাকে প্রতি সপ্তাহেই অন্য বিজ্ঞানীরা আসে, বসে, যন্ত্রপাতিগুলো ব্যবহার করে, আলোচনা করে এবং এমন সব কাজ করে যাকে বলে পরীক্ষণ ও আবিষ্কার; অনেক সময় আমিও দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সব শুনি, দেখি, আর মায়ের মত শিখতে চেষ্টা করি; কিন্তু আমাকে দিয়ে ও সব হবে না।

কখনও বা কর্ত্রীর কাজের ঘরে মেঝেয় শুয়ে ঘুমোই আমাকে পা-পোষ মনে করে সে আমার গায়ে পা ঘসে; সে জানে ওতে আমি খুসি হই, কারণ ঐ ভাবে সে আমাকে আদর করে; কখনও নার্সারিতে গিয়ে ঘন্টাখানেক কাটিয়ে আসি-সকলেই আমাকে নেড়েচেড়ে আদর করে; আবার বাচ্চাটা ঘুমিয়ে পড়লে নার্স যদি কয়েক মিনিটের জন্য বাইরে যায় তো দোলনার পাশে গিয়ে তাকে দেখি; কখনও স্যাডি কে সঙ্গে নিয়ে মাঠে ও বাগানে ছুটাছুটি করি, শ্রান্ত হলে গাছের ছায়ায় গা এলিয়ে দেই, আর স্যাডি বই পড়ে; কখনও বা আশপাশের কুকুরদের সঙ্গে দেখা করতে যাই-কাছাকাছিতেই বেশ কয়েকটি ভাল কুকুর আছে; তার মধ্যে একটি তো যেমন সুন্দর তেমনই ভদ্র; কেঁকড়া নোমওয়ালা একটি আইরিশ কুকুর, নাম রবিন অ্যাডে য়ার; সেও আমার মতই পুরোহিত-বংশের সন্তান; তার মালিক একজন সু মন্ত্রী।

বাড়ির চাকররা সকলেই আমার প্রতি সদয়, আমাকে ভালবাসে; কাজেই আমার জীবন বেশ সুখেই কাটছে। আমার চাইতে সুখী ও কৃতজ্ঞন্ন কুকুর আর একটি ও নেই। সে কথা একশ বার। মায়ের স্মৃতিকে স্মরণ করে তার শিক্ষামত কাজ করতে সাধ্যমত চেষ্টা করি, আর তার ফলেই এই সুখ পেয়েছি।

তারপরই আমার বাচ্চাটা এল; আমার সুখের পেয়ালা পূর্ণ হল। কেমন টলতে টলতে চলে, নরম, কোমল, ভেলভেটের মত গা, সুন্দর ছোট ছোট থাবা, মায়া-ভরা দুটো চোখ, মিষ্টি নিষ্পাপ মুখ; আর ছেলেমেয়েরা ও তাদের মাও তাকে কতই না ভালবাসে, আদর করে। জীবনটা কতই না মধুর হয়ে উঠল

তারপর এল দুঃখের শীত। একদিন আমি নার্সারিতে পাহারায় ছিলাম। অর্থাৎ আমার বিছানায় ঘুমিয়ে ছিলাম। বাচ্চাটি ঘুমিয়ে ছিল তার দোলনায় আমার বিছানার পাশে, ঠিক অগ্নিকুণ্ডটার ধারে। দোলনায় একটা উঁচু তাঁবুর মত টাঙানো ছিল; তার ভিতর দিয়ে সব কিছু দেখা যায়। নার্স গিয়েছিল বাইরে, আমরা দুজন ছিলাম ঘুমিয়ে। কাঠের আগুনের একটা ফুঁ কি ছিটকে তাঁবুটার নীচে গিয়ে পড়ল। মনে হয়, বেশী কিছু সময় কেটে যাবার পরে বাচ্চাটির চীৎকারে আমার ঘুম ভেঙে গেল। দেখি, তাঁবুটা জ্বলছে; আগুন সিলিং পর্যন্ত উঠেছে! কোন কিছু ভাববার আগেই ভয়ে লাফিয়ে মেঝেতে পড়ে দরজার দিকে অর্ধেক পথ ছুটে গেলাম; কিন্তু আধ সেকেণ্ডের মধ্যেই মায়ের সেই বিদায়-বাণী আমার কানে বাজতে লাগল; বিছানার কাছে ফিরে গেলাম। আগুনের মধ্যে মাথাটা ঠেলে দিয়ে কোমরের বেল্ট টা ধরে টানতে টানতে বাচ্চাটিকে বের করে আনলাম, এবং দরজার কাছে পৌঁছে ধোঁয়ার কুণ্ডুলির মধ্যে পথ হারিয়ে মেঝেতে পড়ে গেলাম; আবার বেটাকে চেপে ধরে টানতে টানতে তাকে দরজার বাইরে নিয়ে গেলাম। বাচ্চাটি সমানে চীৎকার করছে, আমিও হলের মোড় ঘুরে এগিয়ে চলেছি; আনন্দে ও গর্বে আমি তখন উত্তেজনায় ফেটে পড়ছি; এমন সময় কানে এল মনিবের চীকার:

পালা, পালা, পাজি কুত্তা! নিজেকে বাঁচাবার জন্য দিলাম এক লাফ, আর সেই লোকটি আশ্চর্য তড়িৎগতিতে হাতের বেত নিয়ে আমাকে তাড়া করল। প্রাণের ভয়ে আমি এদিক-ওদিকে ছুটতে লাগলাম; সেও আমার পিছন পিছন ছুটতে ছুটতে শেষ পর্যন্ত আমার সামনের ডান দিককার পায়ে সজোরে আঘাত করল; আর্তনাদ করে আমি পড়ে গেলাম; বেতটা আবার উঠল, কিন্তু নেমে এল না; নার্সের গলা ভেসে এল, নার্সারিতে আগুন লেগেছে; মনিব সেই দিকে ছুটে গেল; আর আমারও বাকি হাড় কখানা রক্ষা পেল।

খুব ব্যথা করছিল; তা করুক, সময় নষ্ট করা চলবে না; যে কোন মুহূর্তে সে ফিরে আসতে পারে; তিন পায়ে খোঁড়াতে খোঁড়াতে হলের অন্য প্রান্তে চলে গেলাম। সেখানে ভাঙা বাক্স প্রভৃতি জঞ্জলি জমা করে রাখা আছে; বাড়ির লোকজন সেখানে কদাচিৎ যায়। কোন রকমে সেখানে উঠে অন্ধকারে সেই ডাই করা জিনিসপত্রের মধ্যে লুকিয়ে পড়লাম। সেখানে ভয় পাবার কোন মানে হয় না, তবু আমার ভয় করতে লাগল। এত ভয় করতে লাগল যে আহা-উঁহু করে যে ব্যথার একটু উপশম করব তাও সাহস হচ্ছিল না। পাটা চেটে চেটে তবু একটু একটু আরাম পেলাম।

আধ ঘণ্টা ধরে নীচে হৈ-হট্টগোল, ছুটাছুটি চলতে লাগল। তারপর আবার সব চুপচাপ হয়ে গেল। ধীরে ধীরে আমার ভয়টাও কেটে যেতে লাগল। একটু পরেই আবার একটা শব্দ শুনে আমার বুকের ভিতরটা জমে গেল। তারা আমাকে ডাকছে-গালাগালি করছে-আমার খোঁজ করছে!

দূরের জন্য শব্দটা অস্পষ্ট শোনা গেলেও তাতে আমার ভয় কমল না। এত ভয়ংকর শব্দ বুঝি আর কখনও শুনি নি। এখানে-ওখানে-সেখানে একনাগাড়ে ডাকাডাকি চলল: হলে, নানা ঘরে, দুটো তলায়, মাটির নীচের ঘরে; তারপর বাইরে, দূরে, আরও দূরে-আবার সে শব্দ বাড়ির মধ্যেই ফিরে এল। মনে হল, সে শব্দ বুঝি কোনদিন থামবে না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত থামল। ততক্ষণে চিলেকোঠার অস্পষ্ট গোধূলির আলো মুছে রাতের কালো আঁধার ঘরটাকে ঘিরে ধরেছে।

তারপর সেই শান্ত স্তব্ধ তার মধ্যে ধীরে ধীরে আমার ভয় কেটে গেল; পরম নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়লাম। বিশ্রামটা ভালই হল। যখন ঘুম ভাঙল তখন একেবারে গোধূলি নেমে এসেছে। অনেকটা ভাল লাগছে। বসে বসে পালাবার একটা মতলব ভাঁজতে লাগলাম। ভাল একটা মতলব মাথায়ও এল। কিন্তু হঠাৎ মনে হল: আমার বাচ্চাকে ছেড়ে দিয়ে বেঁচে থেকে কি হবে!

হতাশা নেমে এল। কিছুই করার নেই। বুঝতে পারলাম, যেখানে আছি সেখানেই থাকতে হবে; থাকতে হবে, অপেক্ষা করতে হবে, যা ঘটবে তাই মেনে নিতে হবে-সেটা আমার ভাবনার বিষয়ই নয়; এই তো জীবন-মা তো তাই বলে দিয়েছে। তারপর-আবার, আবার সেই ডাকাডাকি শুরু হল! সামনে অনেক দুঃখ। নিজের মনেই বললাম, মনিব কখনও ক্ষমা করবে না। অবশ্য কেন যে সে আমার প্রতি এত বিরূপ ও ক্ষমাহীন হয়েছে সেটা আমি বুঝতে পারলাম না। হয় তো কুকুরের পক্ষে সেটা বোঝা সম্ভব নয়, মানুষ হলে বুঝতে

ডাকের পর ডাক-মনে হল সে ডাক বুঝি দিন রাত চলছে। ক্রমে ক্ষুধা-তৃষ্ণা আমাকে প্রায় পাগল করে তুলল; বুঝতে পারলাম, ক্রমেই দুর্বল হয়ে পড়ছি। এ অবস্থায় পড়লে সকলেই প্রচুর ঘুমোয়, আমিও ঘুমোতে লাগলাম। একদিন ভয়ানক ভয় পেয়ে জেগে উঠলাম-মনে হল ডাকটা যেন চিলেকোঠা থেকেই আসছে! ঠিক তাই: গলাটা স্যাডি র; সে কাঁদছে; আমার নামটা ভেঙে ভেঙে তার ঠোঁট থেকে ঝরে পড়ছে; সে যা বলছে কানে শুনেও তা যেন আমার বিশ্বাস হচ্ছিল নাঃ

ফিরে আয়-ওরে, আমাদের কাছে ফিরে আয়: ক্ষমা কর-তোকে ছাড়া আমরা বড় কষ্টে-

মনের আনন্দে একটু। সকৃতজ্ঞ ডাক আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল, আর পরমুহূর্তেই অন্ধকারের ভিতর দিয়ে ভাঙা আবর্জনাগুলো পেরিয়ে সে আমার দিকে এগিয়ে আসতে আসতে; চীৎকার করে সকলকে বলে উঠল: পাওয়া গেছে, তাকে পাওয়া গেছে!

তার পরের দিনগুলি-আঃ বড় সুন্দর। মা, স্যাডি, চাকরবাকর-আরে, সকলে যেন আমাকে পূজা করতে লাগল। আমার বিছানা করে। তাদের মন ভরে না; ভাল ভাল খাবার না দিলে তাদের মন খুঁতখুঁত করে; আমার বীরত্বের কথা শুনতে বন্ধু ও প্রতিবেশীরা প্রতিদিন দল বেঁধে আসতে লাগল। দিনে অন্তত বারোবার মিসেস গ্রে ও স্যাড়ি নবাগতদের সে কাহিনী শোনাত; বলত, আমার জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আমি বাচ্চাটিকে বাঁচিয়েছি, আর সে জন্য আমাদের দুজনের গায়ের পোড়া দাগ গুলিও তাদের দেখাত। কিন্তু তারা যখন জিজ্ঞাসা করত আমি খোঁড়া হলাম কেমন করে, তখন তারা লজ্জা পেয়ে অন্য কথা পাড়ত।

আমার গৌরবের কিন্তু সেখানেই শেষ নয়; না, মনিবের বন্ধুরা আসত, বিশ জন বিশিষ্ট মানুষের একটি গোটা দল এসে আমাকে ল্যাবরেটরিতে নিয়ে যেত, আমাকে নিয়ে আলোচনা করত, যেন আমিও তাদের একটি আবিষ্কার। কেউ বলত, একটি মূক প্রাণীর এ এক আশ্চর্য রূপ; যতদূর তারা মনে করতে পারে তার মধ্যে এটাই প্রবৃত্তির সূক্ষ্মতম প্রকাশ; কিন্তু মনিব বাধা দিয়ে বলত, এটা প্রবৃত্তির অনেক উপরের জিনিস; এটা বিচার-বুদ্ধি; আর এ জিনিস অনেক মানুষ অপেক্ষা এই বেচারি চতুষ্পদ প্রাণীটির মধ্যেই অনেক বেশী পরিমাণে আছে। তারপর সে হেসে বলত, আরে, আমাকেই দেখুন না-আমি একটি মর্মন্তুদ পরিহাস! এত বুদ্ধির অধিকারী হয়েও আমি কিনা অনুমান করে বসলাম যে কুকুরটা পাগল হয়ে বাচ্চাটাকে মেরে ফেলতে যাচ্ছে, অথচ এই পশুটির বুদ্ধি-তার বিচার-শক্তি না থাকলে শিশুটি তো মারাই যেত!

তাদের তর্কের আর শেষ নেই, আর সে সব তর্ক আমাকেই ঘিরে। বড় ইচ্ছা করছিল, আমার এই পরম সম্মানের কথা আমার মা জানুক; তাহলে সে কত না গর্ববোধ করত।

তারপর তারা আলোক-বিজ্ঞান নিয়ে আলোচনা শুরু করল; আলোচনার বিষয়: মস্তিষ্কের একটি নির্দিষ্ট ক্ষতির ফলে জীব অন্ধ হয়ে যেতে পারে কিনা। একমত হতে না পেরে তারা স্থির করল এ বিষয়টা নিয়ে পরীক্ষা করে দেখা হবে। তাদের কথাবার্তা একঘেয়ে লাগায় একসময় ঘুমিয়ে পড়লাম; আর কিছু জানতে পারলাম না।

দেখতে দেখতে বসন্ত এসে গেল। চারদিক রোদে ঝলমল করছে। সব কিছু মনোরম, সুন্দর। কর্ত্রী ছেলেমেয়েদের নিয়ে বাইরে চলে গেল বেড়াতে। যাবার সময় আমাকে ও আমার বাচ্চাটাকে কত আদর করল। মনিব তার নিজের কাজ নিয়েই ব্যস্ত। তাই আমরা দুজনই খেলে-বেড়িয়ে মনের সুখে দিন কাটাই আর ভাবি, কতদিনে কর্ত্রী ও ছেলেমেয়েরা ফিরে আসবে।

একদিন সেই বিজ্ঞানীরা আবার এল। বলল, এবার পরীক্ষাটা করা হবে। তারা বাচ্চাটাকে ল্যাবরেটিরিতে নিয়ে গেল। আমিও তিনপায়ে খোঁড়াতে খোঁড়াতে গেলাম। বাচ্চাটার প্রতি সকলের এত মনোযোগ দেখে আমার বেশ ভাল লাগল, গর্ব হতে লাগল। তারা অনেক আলোচনা করল; পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাল। হঠাৎ বাচ্চচ টা চীৎকার করে উঠল। সকলে তাকে মেঝেতে নামিয়ে দিল। সে টলমল করে হাঁটতে লাগল। মাথাময় রক্তের ছোপ। মনিব হাততালি দিয়ে বলে উঠল:

ঐ দেখুন, আমি জিতেছি-এবার স্বীকার করুন! ওটা তো বাদুরের মত অন্ধ হয়ে গেছে!

সকলে বলল, তা ঠিক-আপনার থিয়োরি প্রমাণিত হয়েছে। আজ থেকে বিপন্ন মানুষ আপনার কাছে অনেক ঋণে ঋণী হল। মনিবকে ঘিরে ধরে সকলে তার হাত চেপে ধরল, কত তার সঙ্গে তার প্রশংসা করতে লাগল।

সে সব কিছু আমি চোখেও দেখলাম না, কানেও শুনলাম না। সঙ্গে সঙ্গে ছুটে গেলাম বাচ্চাটার কাছে; বুকের কাছে জড়িয়ে ধরে মাথায় রক্ত চেটে নিলাম। বাচ্চাটাও আমার কোলের মধ্যে মাথা রেখে গরগর করতে লাগল; মায়ের ছোঁয়া পেয়ে অনেক যন্ত্রণার মধ্যেও ও যেন কিছুটা সান্ত্বনা পেল। একটু পরেই বাচ্চাটা মেঝের উপর নাক খুবড়ে পড়ে গেল। চুপ করে গেল। আর একবারও নড়ল না।

আলোচনা থামিয়ে মনিব পরিচারককে ডেকে বলল, ওটাকে বাগানের এক কোণে কবর দিয়ে দাও। তারা আবার আলোচনা শুরু করল। আমি পরিচারকের পিছন পিছন গেলাম। মনে মনে খুব খুসি, কারণ বাচ্চাটার তখন আর কোন কষ্ট ছিল না, শান্তিতে ঘুমুচ্ছিল। আমরা বাগানের একেবারে শেষ প্রান্তে পৌঁছে গেলাম। গ্রীষ্মকালের সেখানকার মস্ত বড় দেবদারু গাছটার ছায়ায় আমরা সকলে মিলে। কত খেলা করেছি। পরিচারক সেখানে একটা গর্ত খুঁড়ে বাচ্চাটাকে তার মধ্যে শু ইয়ে দেবার ব্যবস্থা করতে লাগল। স্যাডি যেমন করে গাছের চারা মাটিতে পুঁতে দেয়, পরিচারকটা বোধ হয় সেই ভাবে আমার বাচ্চাটাকেও পুঁতে দেবে। খুব খুসি হলাম, কারণ তাহলে তো আমার বাচ্চাটাও ধীরে ধীরে বড় হবে, রবিন অ্যাডে য়ার-এর মত সুন্দর হয়ে উঠবে। কর্ত্রীরা বাড়ি ফিরে তাকে দেখে অবাক হয়ে যাবে। পরিচারককে সাধ্যমত সাহায্য করলাম। কাজ শেষ করে সে আদর করে আমার পিঠ চাপড়ে দিল; তখন তার চোখে জল; বলল: বেচারি, ওর ছেলেকেই তুই বাঁচিয়েছিলি!

পুরো দুটো সপ্তাহ অপেক্ষা করে আছি। সে তো এল না। এ সপ্তাহে আমার কেমন যেন ভয় ভয় করছে। মনে হচ্ছে, একটা ভয়ংকর কি যেন ঘটে গেছে। সেটা কি আমি জানি না, কিন্তু ভয় আমাকে কাবু করে ফেলেছে; চাকররা ভাল ভাল খাবার এনে দিচ্ছে, আমি খেতে পারছি না; তারা আমাকে আদর করে, রাতের বেলায়ও আমার কাছে আসে, কাঁদতে কাঁদতে বলে, আহারে-ওর কথা ভুলে যা; বাড়ি চল; আমাদের কষ্ট দিস্ না! আমার আরও ভয় করে, আতংক বাড়ে। আরও দুর্বল হয়ে পড়লাম। গতকাল তো দাঁড়াতেই পারি নি। সূর্য পাটে বসছে; ঠাণ্ডা রাত নেমে আসছে। সেদিকে তাকিয়ে চাকররা কি সব বলাবলি করতে লাগল আমি তার মানে বুঝতে পারলাম না, কিন্তু আমার বুকটা যেন ঠাণ্ডা হয়ে এল।

আহা বেচারিরা! কিছু বুঝতেই পারে না। সকালেই কর্ত্রীরা ফিরে আসবেন; যে কুকুরটা এমন সাহসের কাজ করেছিল এসেই তার খোঁজ করবেন; তখন কে সাহস করে সত্য কথাটা তাদের শোনাবে:

জীবজন্তুরা মরলে যেখানে যায় ছোট্ট বন্ধুটি ও সেখানেই চলে গেছে!

[১৯০৩]

Anuprerona
Anupreronahttps://www.anuperona.com
Read your favourite literature free forever on our blogging platform.
RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here


Most Popular

Recent Comments