Saturday, October 4, 2025
Homeথ্রিলার গল্পভৌতিক গল্পরাত গভীর - হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

রাত গভীর – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

দোষ আমারই। বন্ধুর বোনের বিয়ে। যাব আর খেয়ে চলে আসব, এই ঠিক ছিল। কিন্তু গিয়েই মুশকিলে পড়লাম। বন্ধু একান্তে ডেকে হাত দুটো ধরে বলল, ‘উদ্ধার করে দে ভাই ভীষণ বিপদে পড়েছি।’

‘কী আবার হল?’

‘পাড়ার ছেলের দল পরিবেশন করবে ঠিক ছিল, কিন্তু তাদের মধ্যে একদল বেপাড়ায় জলসা শুনতে চলে গেছে। লোক কম। তোদের হাত লাগাতে হবে।’

‘ঠিক আছে।’ পাঞ্জাবি খুলে ফেললাম। তারপর কোমরে গামছা বেঁধে লেগে গেলাম কাজে। সব যখন শেষ হল, রাত বারোটা বেজে গেছে। নিজের আর কিছু মুখে দেবার ইচ্ছা ছিল না। একটু দই খেয়ে রাস্তায় যখন পা দিলাম তখন রাত বারোটা। বন্ধু বলছিল, নিমন্ত্রিদের কারও মোটরে উঠিয়ে দেবে।

কিন্তু রাস্তায় নেমে দেখা গেল, সবাই চলে গেছে। কোনো মোটর নেই। বন্ধুকে আশ্বাস দিলাম, আমি বড়ো রাস্তা থেকে একটা ট্যাক্সি ধরে নেব। সাড়ে বারোটা কলকাতার পক্ষে আর এমন কী রাত!

রাস্তার মোড়ে গিয়ে দেখলাম, এদিক-ওদিক ফাঁকা। যানবাহন তো নেই-ই, রাস্তা জন-মানবশূন্য। বরাত। আচমকা ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি শুরু হল। বিরক্তিকর বৃষ্টির ফাঁকে রাস্তার আলোগুলো বেশ নির্জীব। নিষ্প্রভ। পিছিয়ে একটা দোকানের আড়ালে দাঁড়াতে গিয়েই বিপত্তি।

একটা কালো কুকুর শুয়েছিল। দেখতে না পেয়ে একেবারে তার পেটের ওপর পা চাপিয়ে দিতেই কুকুরটা বিকট স্বরে চিৎকার করে উঠল। গেছি রে বাবা! লাফিয়ে রাস্তার কাছে আসতেই চোখে পড়ে গেল। অনেক দূরে থেকে একজোড়া আলো এগিয়ে আসছে। মরিয়া হয়ে রাস্তার মাঝখানে দাঁড়ালাম। বাস, লরি, ট্যাক্সি প্রাইভেট গাড়ি যাই হোক না কেন, দু-হাত তুলে থামাব। তা না হলে সারাটা রাত এইখানে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে, কিংবা পিছু হেঁটে নিমন্ত্রণ বাড়ি গিয়ে বন্ধুকে ঘুম তুলে বিব্রত করতে হবে।

আলো দুটো খুব ধীরে এগিয়ে আসছে। মাঝে মাঝে সন্দেহ হল, বুঝি-বা থেমেই আছে। আর এদিকে আসবেই না। পকেট থেকে রুমাল বের করে সবে ভিজে মাথাটা মুছে নিচ্ছি, আচমকা কর্কশ কণ্ঠস্বরে চমকে উঠলাম।

‘কী মশাই, রাস্তার মাঝখানে নটরাজ নৃত্য দেখাচ্ছেন নাকি, তারপর চাপা দিলেই চটে যাবেন!’ তাড়াতাড়ি রাস্তা থেকে সরে এসেই লক্ষ করলাম, একটা মিনিবাস। দূরের আলোজোড়া আর দেখা গেল না। তার মানে দূরের আলো দুটো এই মিনিবাসেরই। হঠাৎ খুব দ্রুত এসে পড়েছে।

‘দাঁড়াও, দাঁড়াও, আমি উঠব।’ মিনিবাস থামল। হাতল ধরে উঠে পড়লাম।

মিনিবাস একেবারে ফাঁকা। অবশ্য এই মাঝরাতেরও পরে যাত্রী আর পাবে কোথায়? পিছনের সিটে বসে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। মাথাটা ভালো করে মোছা হয়নি। কোঁচার খুঁট খুলে জোরে জোরে মুছে নিলাম। আমার আবার সর্দির ধাত, মাথায় জল বসলেই বেদম কাশি শুরু হয়। মুখ তুলে দেখলাম, একটা ছোকরা আমার হাতে টোকা দিচ্ছে। দাদা টিকিটটা করবেন।

জিজ্ঞাসা করলাম, ‘ঢাকুরিয়া যাবে তো!’

‘হ্যাঁ যাবে। যেতেই হবে।’

‘কত ভাড়া?’

‘তিন টাকা।’

‘তিন টাকা! নব্বুই পয়সা করে যাই যে!’ কথাটা বলেই বুঝতে পারলাম ঠিক বলিনি। দিনের বেলা যা রেট, এই মাঝরাতে দুর্যোগে সে রেট কখনো হতে পারে! বাড়তি পয়সা বোধ হয় ড্রাইভার কনডাক্টরের পকেটে যাবে। কোনো কথা না-বলে তিনটে টাকা এগিয়ে দিলাম। টিকিট দিতে দিতে লোকটা বলল, ‘এ মিনিবাসে যেখানে যাবেন এক ভাড়া। সামনের স্টপেজে নামলে ওই তিন টাকা।’ লোকটার সঙ্গে তর্ক করতে ইচ্ছা হল না। বলুক যা ইচ্ছে, মাঝরাতে যে পৌঁছে দিচ্ছে এই আমার ভাগ্য। সিটে হেলান দিয়ে বাইরের দিকে দেখলাম। সব ঝাপসা। কিছু দেখা যাচ্ছে না। মিনিবাস খুব জোরে ছুটছে। এত রাতে পথিক নেই, ট্রাফিক সিগন্যালের বালাই নেই, তাই এই বেপরোয়া গতি।

কিছুক্ষণ পর ঘুমে চোখ বুজে গেল। ঘুমিয়ে পড়লেও অসুবিধা নেই। লোকটা আমি কোথায় নামব জানে। ঢাকুরিয়া এলে ঠিক ডেকে দেবে। একসময় ঘুম ভাঙল। মিনিবাস একভাবে ছুটছে। চোখ হাতঘড়ির দিকে পড়তেই চমকে উঠলাম।

রাত আড়াইটে। যেভাবে মিনিবাস ছুটছে এতক্ষণে ঢাকুরিয়া পৌঁছে যাবার কথা। জিজ্ঞাসা করার জন্য এদিক-ওদিক দেখেই অবাক হলাম। মিনিবাস খালি। কেউ কোথাও নেই। ‘অ মশাই, শুনছেন, ঠিক রুটে যাচ্ছেন তো? ঢাকুরিয়া পিছনে ফেলে এলেন নাকি?’

কোনো উত্তর নেই। আশ্চর্য, গেল কোথায় লোকটা! আমি যখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, তখন বোধ হয় মিনিবাস থামিয়ে লোকটা নেমে গেছে। কিন্তু এভাবে মাঝপথে কি নেমে পড়তে পারে?

ঝড়ের বেগে মিনিবাস ছুটছে। মনে হচ্ছে, মাঝে মাঝে চাকাগুলো যেন রাস্তাই ছুঁচ্ছে না। ঢাকুরিয়া কখন পার হয়ে গেছে। নীচু হয়ে দেখলাম। দু-পাশে ঘনজঙ্গল। জোনাকির বাহার। শহর ছাড়িয়ে গাঁয়ের মধ্যে দিয়ে কোথায় চলেছে মিনিবাস। আমি এগিয়ে সামনের সিটে গিয়ে বসলাম। ঝুঁকে পড়ে ড্রাইভারকে বললাম, ‘দাদা, কোথায় চলেছেন জায়গাটার নাম কী?’

ড্রাইভার পিছন ফিরল না। গম্ভীর গলায় বলল, ‘আমি বলব কী করে, কনডাক্টর ঘণ্টা না-দিলে আমি বাস থামাই কী করে?’

‘কিন্তু ঘণ্টা দেবে কে? কনডাক্টর তো কখন নেমে গেছে।’ এবার ড্রাইভার পিছন ফিরল।

‘এই পেঁচি ভূতগুলোর কথা আর বলবেন না মশাই। এই আছে, এই নেই। এদের সঙ্গে একসঙ্গে কাজ করাই ঝকমারি।’

আমার মেরুদণ্ড বেয়ে শীতল প্রবাহ।

সমস্ত শরীর কেঁপে উঠল থরথরিয়ে। মানুষ নয়, নরকঙ্কাল! চোখের দুটো গর্তের মধ্যে লাল আলো শিখা। কথা বলবার সময় দাঁতগুলো মড় মড় করে উঠল। গলা দিয়ে ভয়ার্ত স্বর বের হল, ‘আপনি?’

আবার ড্রাইভার হেসে উঠল। দু-হাতে পাশা নড়লে যেমন শব্দ হয় তেমনই আওয়াজ।

কঙ্কাল হাত দিয়ে ড্রাইভার একটা পৈতা তুলে ধরল, খানদানি ব্রহ্মদত্যি। বর্ণশ্রেষ্ঠ ব্রাহ্মণ ছিলাম। আমার সঙ্গে ওদের তুলনা। মরেওছি ব্রাহ্মণের হাতে। ড্রাইভার মুখ ফিরিয়ে আবার স্টিয়ারিং-এর দিকে নজর দিল।

‘কী দাদা, লাফিয়ে বেড়াচ্ছেন কেন? টিকিট করেছেন?’

পিছন থেকে কনডাক্টরের কণ্ঠ।

লোকটা হঠাৎ এল কোথা থেকে। কিন্তু কোথায় লোকটা? শার্ট, প্যান্ট, কাঁধে ব্যাগ সব ঠিক আছে, শুধু লোকের চিহ্ন নেই। আচ্ছা মিনিবাসে উঠেছি তো! ভূতুড়ে বোধ হয়। এখন প্রাণ নিয়ে বাড়িতে ফিরতে পারলে হয়! পকেট থেকে টিকিট বের করে দেখালাম। গলায় সাহস এনে বললাম, ‘কোথায় ছিলেন এতক্ষণ?’

‘কোথায় থাকব? সিটের তলায় একটু ঘুমিয়ে নিচ্ছিলাম। ঘুম হবার কী আর জো আছে!’ তারপর লোকটা পাশে বসল। লোকটা বসল মানে, তার জামাকাপড় বসবার ভঙ্গি করল। ‘আপনাকে কী বলছিল ভৈরব ভটচাজ?’

আমি অবাক। দেহ অদৃশ্য অথচ কণ্ঠস্বর কানে আসছে। জিজ্ঞাসা করলাম, ‘ভৈরব ভটচাজ কে?’

‘ওই যে বাস চালাচ্ছে। বামনাই দেখাচ্ছিল বুঝি? যে আসে তাকেই পৈতা তুলে দেখায়। আজকাল পৈতার কোনো মানসম্মান আছে না কি? ওর জন্যই তো আমার এই অবস্থা।’

‘কী রকম?’

লোকটা ব্যাগটা কাঁধ থেকে কোলের ওপর রাখল। বেশ জুতসই হয়ে যেন বসল।

তারপর বলতে শুরু করল।

‘স্টিয়ারিং ধরলে ভৈরবের আর জ্ঞান থাকে না। তখন মিনিবাস না উড়োজাহাজ কী চালাচ্ছে, ভুলেই যাই। কতবার সাবধান করেছি, কিন্তু কে শোনে কার কথা! পাঁচ-ছ-বছরের বাচ্ছার হাতে মুড়ির ঠোঙা, রাস্তা পার হচ্ছিল, দিলে তাকে চাপা। ব্যস, চারদিক থেকে লোক ঘিরে ফেলল। আধলা ইঁটের বৃষ্টি শুরু হল মিনিবাসের ওপর। চায়ের দোকান থেকে এক টিকিওলা বামুন বের হয়ে এল, হাতে লোহার রড, একেবারে সোজা ভৈরবের মাথায়। আর শব্দটি করতে হল না। স্টিয়ারিং-এর ওপর নেতিয়ে পড়ল। আমি দরজা দিয়ে পালাবার চেষ্টা করছিলাম, থান ইট এসে লাগল আমার চোয়ালে। বাপ বলে ডিগবাজি খেয়ে রাস্তার ওপর পড়লাম। সেই থেকে এই অবস্থা।

ভৈরব বামুনের হাতে গেছে, নিজে বামুন, তাই ব্রহ্মদত্যি। আর আমি—’

কথা আর শেষ হল না।

ভৈরব ভটচাজ হুংকার দিয়ে উঠল, ‘দেখ গুপে, প্যাসেঞ্জারকে যা তা বোঝাতে যাস না। তুই তো বললি, সব ঠিক আছে, চালাও জোরে। বাবুদের অফিসের দেরি হয়ে যাবে।’

‘খবরদার! কপালের নীচে অমন ড্যাবডেবে একজোড়া চোখ রয়েছে কীসের জন্য? রাস্তার লোকজন দেখতে পাও না? আমি বলব, তবে থামবে?’

এবারে ওদের চেহারা দেখা গেল। চেহারা মানে কঙ্কাল। চোঁচামেচি, হইচই শেষকালে হাতাহাতি। সর্বনাশ, ভৈরব ভটচাজ স্টিয়ারিং ছেড়ে বাসের ভিতরে হাত বাড়াল!

‘আজ তোর একদিন, কী আমার একদিন। একবার ইটের ঘায়ে কাবার হয়েছিস, এবার আমার হাতে মরবি।’

গুপেও আস্তিন গুটিয়ে রুখে দাঁড়াল। আঙুলের হাড়গুলো মড় মড় করে উঠল। ব্যাগটা ছুড়ে ফেলে দিল বাসের মেঝের ওপর। ‘বেশ, হয়ে যাক। দাদা বলে এতদিন কিছু বলিনি, কিন্তু আর মানুষ নই যে মিথ্যা কথা সহ্য করব অপমান গায়ে মাখব না। দেখি কার হাড়ে কত শক্তি।’

আমি মহা মুশকিলে পড়লাম। দুই কঙ্কালের মাঝখানে আমি। লড়াই হলে বেশিরভাগ চোট আমার ওপর দিয়েই যাবে।

স্টিয়ারিং ছেড়ে ভৈরব ভটচাজ ভেতরে চলে এসেছে। স্টিয়ারিং-এ কেউ নেই, অথচ ভূতুড়ে বাস উদ্দাম বেগে ছুটেছে। বুঝতে পারলাম, এখনই আশেপাশের দোকানের সঙ্গে কলিশন হবে। মিনিবাস চুরমার, সেই সঙ্গে আমিও।

অনেকগুলো উত্তেজিত কণ্ঠস্বর। কেউ ভৈরব ভটচাজের পক্ষ সমর্থন করছে, কেউ গুপীর। কিন্তু বাস তো খালি ছিল, এতগুলো লোক এল কোথা থেকে। মুখ ফিরিয়ে যা দেখলাম, তাতে আমার মাথার চুল সজারুর কাঁটার মতন খাড়া হয়ে উঠল। মনে হল বুকের টুকটুক শব্দ বুঝি বন্ধ হয়ে যাবে। একেবারে সামনের সিটে, আমার পাশে তখন হালদারের দাদামশাই। মাস দুয়েক আগে যিনি বাজার থেকে আসবার সময় বাসের চাকার তলায় একেবারে থেঁতলে গিয়েছিলেন। তার পিছনের লোকটিও আমার খুব চেনা। আমার অফিসের দপ্তরী। সে ক-দিন আগে অফিসের সামনে ট্রাম থেকে নেমে রাস্তা পার হবার সময় বাসের তলায় গুঁড়িয়ে ছাতু হয়ে গিয়েছিল। আর একজনকে চিনতে পারলাম। আমাদের ঝিয়ের সাত বছরের ছেলে রতন। সেও মারা গেছে বাসের চাকায়। বাকি লোকগুলোকে ঠিক বুঝতে পারলাম না। তবে রক্তমাংসের মানুষ কেউ নয়, সবাই কঙ্কাল। বিকট চিৎকার আর হাড়ের হাততালির কানে তালাধরা শব্দ।

লড়ে যা ভৈরব। গুপী দেখি তোর মুরোদ। আর একদল চেঁচাচ্ছে, সাবাস গুপী, একটা আপার কাট। ভৈরবকে ঠান্ডা করে দে। একবার ভাবলাম, যা থাকে কপালে, বাস থেকে দিই এক লাফ। কিন্তু ছুটন্ত এই বাস থেকে লাফ দিলে নির্ঘাৎ মৃত্যু। তা ছাড়া নামবার জায়গা আটকেই তো যত মারামারি। হঠাৎ প্রচণ্ড একটা শব্দ। মনে হল, মিনিবাসটা দু-হাতে তুলে কে যেন আছড়ে ফেলল। হাড়ের খটাখট, কলকবজার ঝনঝনাৎ, সব লোকগুলো বুঝি তালগোল পাকিয়ে গেল।

আমি বিদ্যুৎগতিতে ছিটকে বাইরে গিয়ে পড়লাম। কতক্ষণ পড়েছিলাম জানি না। জ্ঞান হতে ব্যাঙের কর্কশ ঐক্যতান কানে এল। বুঝতে পারলাম, দেহের কোথায় চোট লেগেছে হাত বুলিয়ে দেখতে গিয়েই চমকে উঠলাম। একতিল মাংস কোথাও নেই, কেবল হাড় আর হাড়। স্বপ্ন দেখছি নাকি। চোখে হাত দিতেই হাত ভিতরে ঢুকে গেল। চোখ নেই, বিরাট দুটি গর্ত। অনেক কষ্টে কঙ্কাল দেহটা নিয়ে উঠে দাঁড়ালাম।

Anuprerona
Anupreronahttps://www.anuperona.com
Read your favourite literature free forever on our blogging platform.
RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here


Most Popular

Recent Comments