Thursday, August 28, 2025
Homeবাণী ও কথাএই পরবাসে - হুমায়ূন আহমেদ

এই পরবাসে – হুমায়ূন আহমেদ

অকর্মা লোক খুব ভালো চিঠি লিখতে পারে বলে একটা প্রবচন আছে। অকর্মাদের কাজকর্ম নেই–ইনিয়ে-বিনিয়ে দীর্ঘ চিঠি তাদের পক্ষেই লেখা সম্ভব।

আমি নিজেও এইসব অকর্মাদের দলে। গুছিয়ে চিঠি লিখবার ব্যাপারে আমার জুড়ি নেই। পাঠকরা হয়ত ভুরু কুঁচকে ভাবছেন–এই লোকটা দেখি খুব অহংকারী।

তাদের জ্ঞাতার্থে জানাচ্ছি, আমি আসলেই অহংকারী, তবে লিখিতভাবে সেই অহংকার কখনো প্রকাশ করিনি। আজ করলাম। আমি যে চমৎকার চিঠি লিখতে পারি তার এখন একটি প্রমাণ দেব। আমার ধারণা, যে-সব পাঠক এতক্ষণ ভুরু কুঁচকে ছিলেন প্রমাণ দাখিলের পর তাদের মুখের অবস্থা স্বাভাবিক হয়ে যাবে।

প্রবাস জীবনের সাত মাস পার হয়েছে। আমার স্ত্রী গুলতেকিন আমার সঙ্গে নেই। সে আছে দেশে। হলিক্রস কলেজ থেকে আই-এস-সি পরীক্ষা দেবে। কোমর বেঁধে পড়াশোনা করছে। পরীক্ষার আর মাত্র মাস খানেক দেরি। এই অবস্থায় আমি আমার বিখ্যাত চিঠিটি লিখলাম। চার পাতার চিঠিতে একা থাকতে যে কী পরিমাণ খারাপ লাগছে, তার প্রতি যে কী পরিমাণ ভালোবাসা জমা করে রেখেছি এইসব লিখলাম। চিঠির শেষ লাইনে ছিল–আমি এনে দেব তোমার উঠোনে সাতটি অমরাবতী।

এই চিঠি পড়ে সে খানিক্ষণ কাঁদল। পরীক্ষা-টরীক্ষার কথা সব ভুলে গিয়ে সাত মাস বয়েসী শিশু কনাকে কোলে নিয়ে চলে এল আমেরিকায়। আমি আমার চিঠি লেখার ক্ষমতা দেখে স্তম্ভিত। পরীক্ষা-টরীক্ষা সব ফেলে দিয়ে চলে আসায় আমি খানিকটা বিরক্ত। দু’মাস অপেক্ষা করে পরীক্ষা দিয়ে এলেই হতো।

গুলতেকিন চলে আসায় আমার জীবনযাত্রা বদলে গেল। দেখা গেল সে একা আসেনি, আমার জন্যে কিছু সৌভাগ্য নিয়ে এসেছে, সে আসার সঙ্গে সঙ্গে ইউনিভার্সিটি আমাকে একটা বাড়ি দিল।

দু’তলা বাড়ি। এক তলায় রান্নাঘর, বসার ঘর এবং স্টাডি রুম। দু’তলায় দুটি শোবার ঘর। এত বড় বাড়ির আমার প্রয়োজন ছিল না। ওয়ান বেডরুমই যথেষ্ট ছিল। তবে নর্থ ডাকোটা স্টেটের নিয়ম হচ্ছে বাচ্চার জন্যে আলাদা শোবার ঘর থাকতে হবে। বাচ্চাদের মধ্যে একজন ছেলে এবং একজন মেয়ে হলে তাদের জনো আলাদা আলাদা শোবার ঘর থাকতে হবে। তবে দু’জই ছেলে বা মেয়ে হলে একটি শোবার ঘরেই চলবে।

আমরা নতুন বাড়িতে উঠে এলাম। বলতে গেলে প্রথমবারের মতো আমার সংসার শুরু করলাম। এর আগে থেকেছি মা-র সংসারে। আলাদা সংসারের আনন্দ বেদনার কিছুই জানি না। প্রবল উৎসাহে আমরা ঘর সাজাবার কাজে লেগে পড়লাম। রোজই দোকানে যাই। যা দেখি তাই কিনে ফেলি। এমন অনেক জিনিস আমরা দুজনে মিলে কিনেছি যা বাকি জীবনে একবারও ব্যবহার হয়নি। এই মুহর্তে দুটি জিনিসের নাম মনে পড়ছে–টুল বক্স, যেখানে করাত-ফরাত সবই আছে। এবং ফুট বাথ নেবার জন্যে প্লাস্টিকের গামলা জাতীয় জিনিস।

গুলতেকিন প্রবল উৎসাহে রান্নাবান্না নিয়েও ঝাঁপিয়ে পড়ল। ভাত মাছ ছাড়াও নানান পরীক্ষামূলক রান্না হতে লাগল। অতি অখাদ্য সেই সব খাদ্যদ্রব্য মুখে নিয়ে আমি বলতে লাগলাম, অপূর্ব।

খুব সুখের জীবন ছিল আমাদের। সাত মাস বয়সের পুতুলের মতো একটি মেয়ে যে কাউকে বিরক্ত করে না, আপন মনে খেলে। মাঝে মাঝে তার মনে গভীর ভাবের উদয় হয় সে তার নিজস্ব ভাষায় গান গায়–

গিবিজি গিবিজি, গিবিজি গিবিজি
গিবি ॥
গিবিজি গিবিজি পিবিজি গিবিজি
গিবি ॥

আহা, সে বড় সুখের সময়।

প্রসঙ্গত বলে রাখি, এই দেশে প্রবাসী ছাত্রদের স্ত্রীরা ভয়াবহ জীবন যাপন করেন। এদের কিছুই করার থাকে না। স্বামী কাজে চলে যায়, ফেরে গভীর রাতে

এই দীর্ঘ সময় বেচারীকে কাটাতে হয় একা একা! এরা সময় কাটায় টিভির সামনে বসে থেকে কিংবা শপিং মলে ঘুরে ঘুরে।

রাতে স্বামী যখন ক্লান্ত হয়ে ফিরে আসে তখন অতি অল্পতেই খিটিমিটি লেগে যায়। স্ত্রী বেচারীর ফুপিয়ে কাঁদা ছাড়া কিছুই করার থাকে না। আমি এক ভদ্রলোককে জানতাম যিনি রাত একটায় তার স্ত্রীকে গলা ধাক্কা দিয়ে বের করে দিয়েছিলেন। একবারও ভাবেননি এই বিদেশ-বিভুইয়ে আত্মীয়-পরিজনহীন শহরে মেয়েটি কোথায় যাবে, কার কাছে যাবে।

যাক ওসব, নিজের গল্পে ফিরে আসি। আমি মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে রেখেছিলাম, প্রবাসী জীবনে আমি কখনো আমার স্ত্রীর উপর রাগ করব না। কখনো তাকে একাকীত্বের কষ্ট পেতে দেব না।

আমি অবাক হয়ে লক্ষ করলাম আঠারো বছরের এই মেয়ে আমেরিকান জীবনযাত্রার সঙ্গে নিজেকে খুব সহজেই মানিয়ে নিচ্ছে। অতি অল্প সময়ে সে চমৎকার ইংরেজী বলা শিখল। সুন্দর একসেন্ট। আমি অবাক হয়ে বললাম, এত চমক্কার ইংরেজী কোথায় শিখলে?

সে বলল টিভি থেকে। চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে ১৪ ঘণ্টা টিভি খোলা থাকে। ইংরেজী শিখব না তো করব কি?

একদিন বাসায় এসে দেখি ফুটফুটে চেহারার দু’টি আমেরিকান বাচ্চা আমার মেয়ের সঙ্গে ঘুরঘুর করছে। অবাক হয়ে বললাম, এরা কারা?

গুলতেকিন হাসিমুখে বলল, বেবি সিটিং শুরু করেছি।

সে কি?

অসুবিধা তো কিছু নেই। আমার নিজের বাচ্চাটিকে তো আমি দেখছি, এই সঙ্গে এই দু’জনকেও দেখছি। আমার তো সময় কাটাতে হবে।

গুলতেকিন খুবই অবস্থাপন্ন পরিবারের মেয়ে। ওদের ধানমণ্ডির বাসায় আমি প্রথম কাপড় ধোয়া এবং কাপড় শুকানোর যন্ত্র দেখি। ওদের পরিবারের ম্যানেজার জাতীয় একজন কর্মচারী আছে, তিনজন আছে কাজের মানুষ। ড্রাইভার আছে, মালী আছে! এদের প্রত্যেকের আলাদা শোবার ঘর আছে। এরা যেন নিজেরা রান্না-বান্না করে খেতে পারে সে জন্যে আলাদা রান্নাঘর এবং বাবুর্চি আছে।

সেই পরিবারের অতি আদরের একটি মেয়ে বেবি সিটিং করছে। ভাবতে অবাক লাগে। কাজটা হচ্ছে আয়ার। এই জাতীয় কাজের মানসিক প্রস্তুতি নিশ্চয়ই তার ছিল না। বিদেশের মাটিতে সবই বোধহয় সম্ভব। বেবী সিটিং-এর কাজটি সে চমক্কারভাবে করতে লাগল। বাসা ভরতি হয়ে গেল বাচ্চায়। সবাই গুলতেকিনকে বেবি সিটার হিসেবে পেতে চায়।

মাঝে মাঝে দুপুরে বাসায় খেতে এসে দেখি পুরোপুরি স্কুল বসে গেছে। বাড়ি ভর্তি বাচ্চা। তারা আমার মেয়ের দেখাদেখি গুলতেকিনকে ডাকে আম্মা, আমাকে ডাকে আব্বা।

মাঝে মাঝে এমনও হয়েছে আমেরিকান দম্পতি দুপুর রাতে তাদের বাচ্চা নিয়ে উপস্থিত। লজ্জিত গলায় বলছে, আমার বাচ্চাটা চেঁচামেচি করছে রাতে তোমার সঙ্গে ঘুমুবে। কিছুতেই শান্ত করতে পারছি না। আমরা খুবই লজ্জিত। কী করব বুঝতে পারছি না।

গুলতেকিন হাসিমুখে বলল–বাচ্চাকে রেখে যান।

এর জন্যে আমি তোমাকে পে করব।

পে করতে হবে না। রাতের বেলা তোমার বাচ্চা আমার গেস্ট।

গুলতেকিন শুয়েছে, একদিকে তার গলা জড়িয়ে ধরেছে আমাদের নিজের মেয়ে নোভা। অন্যদিকে আমেরিকান বাচ্চা। চমক্কার দৃশ্য।

চিটিং অ্যাসিসটেন্ট হিসাবে আমি যত টাকা পেতাম সে তারচে অনেক বেশি পেতে লাগল। আমরা চমৎকার একটা গাড়ি কিনলাম–ভূজ কোম্পানির পোলারী।

ছুটির দিনগুলিতে গাড়ি করে ঘুরে বেড়াই। প্রায়ই মনে হয় আমি আমার জীবনের শ্রেষ্ঠতম সময়টা কাটাচ্ছি।

টাকা-পয়সা নিয়ে আমরা যত তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যই করি, সুখের উপকরণগুলির মধ্যে টাকা-পয়সার ভূমিকাটা বেশ বড়। যতই দিন যাচ্ছে ততই তা বুঝতে পারছি। কিংবা কে জানে ধনবাদী এই সমাজ আমার চিন্তা-ভাবনাকে পাল্টে দিতে শুরু করেছে কিনা।

পরবাসে আমার রুটিনটা হলো এরকম : ভোরবেলা ল্যাবরেটরিতে চলে যাই। সন্ধ্যাবেলা ফিরে আসি। ঘরে পা দেবার পর ক্লাসের বইপত্র ছুঁয়েও দেখি না। টিভি চালিয়ে দেই, গান শুনি, লাইব্রেরি থেকে নিয়ে আসা গাদা গাদা গল্পের বইয়ের পাতা উল্টাই। নোভাকে বাংলা শেখাতে চেষ্টা করি। গ্লাসের পানি দেখিয়ে বলি–এর নাম পানি। বল, পানি।

সে বলে, গিবিজি।

গিবিজি নয়। বল পানি পা-নি-

গিবিজি গিবিজি।

মেয়েটিকে নিয়ে তার মা খুব দুশ্চিন্তায় ভোগে। শুধুমাত্র গিবিজি শব্দ সম্বল করে সে এই পৃথিবীতে এসেছে কিনা কে জানে। তার দেড় বছর বয়স হয়ে গেছে, এই বয়সে বাচ্চারা চমৎকার কথা বলে। অথচ সে শুধু বলে–গিবিজি। আমি নিজেও খানিকটা চিন্তিত বোধ করলাম।

দু’বছর বয়সে হঠাৎ করে সে কথা বলতে শুরু করল। ব্যাপারটা বেশ মজার, কারণ সে কথা বলা শুরু করল ইংরেজিতে। একটা দুটা শব্দ নয়, প্রথম থেকে বাক্য। এবং বেশ দীর্ঘ বাক্য। বাসায় দুটো ভাষা চালু ছিল–ইংরেজী ও বাংলা। আমরা নিজেরা বাংলা বলতাম। যে সব বাচ্চারা সারাদিন বাসায় থাকত তারা বলত ইংরেজি। সে দুটি ভাষাই দীর্ঘদিন লক্ষ করেছে। বেছে নিয়েছে একটি। ভাষা বিজ্ঞানীদের জন্যে এই তথ্যটি সম্ভবত গুরুত্বপূর্ণ।

আমার দীর্ঘ সাত বছরের প্রবাস জীবনের অনেক সুখ-দুঃখের গল্প আছে। সবই ব্যক্তিগত গল্প। তার থেকে দু একটি বলা যেতে পারে।

একদিনের কথা বলি। সন্ধ্যা মিলিয়েছে বিলে রাখা ভালো সামারে সন্ধ্যা হয় রাত নটার দিকে। আমি পোর্চে বসে চা খাচ্ছি, হঠাৎ লক্ষ করলাম ন’দশ বছরের একটি বালিকা আমার বাসার সামনে হাঁটাহাঁটি করছে। মেয়েটির চেহারা ডল পুতুলের মত। ফ্রকের হাতায় সে চোখ মুছছে। আমি বললাম কী হয়েছে খুকী।

সে বলল, কিছু হয়নি। আমি কি তোমার বাসার সামনে খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে পারি?

অবশ্যই পারো। ভেতরে এসেও বসতে পার।

না। আমার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতেই ভালো লাগছে।

রাত সাড়ে দশটায় খাবার শেষ করে বাইরে এসে দেখি মেয়েটি তখনো দাঁড়িয়ে। আমি বললাম, এখনো দাঁড়িয়ে আছো?

সে কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, আমি তো তোমকে বিরক্ত করছি না। শুধু দাঁড়িয়ে আছি।

ব্যাপারটা কি তুমি আমাকে বলবে?

মেয়েটি ঘটনাটা বলল।

তার মা একজন ডিভোর্সি মহিলা। মেয়েকে নিয়ে থাকে। সম্প্রতি একটি ছেলের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা হয়েছে। ছেলেটিকে নিয়ে সে ডেটিং-এ যায়। মেয়েটিকে একা বাড়িতে রেখে যায়। সন্ধ্যা মেলাবার পর মেয়েটির একা একা ভয় করতে থাকে। সে তখন ঘর বন্ধ করে বাইরে এসে দাঁড়ায়। মায়ের জন্য অপেক্ষা করে। আমার ঘরের সামনে এসে দাঁড়ানোর কারণ হচ্ছে আমাদের ঘরে অনেক রাত পর্যন্ত বাতি জ্বলে। সে লক্ষ করেছে আমি খুব রাত জাগি।

মেয়েটির কষ্টে আমার চোখে পানি এসে গেল। আমি বললাম, খুকী তুমি আমার ঘরে এসে মার জন্য অপেক্ষা কর।

সে কঠিন গলায় বলল, না।

সেবারের পুরো সামারটা আমার নষ্ট হয়ে গেল। মেয়েটি রোজ গভীর রাত পর্যন্ত আমার দরজার সামনে দাঁড়িয়ে তার মার জন্যে অপেক্ষা করে। ভদ্রমহিলা মধ্যরাতে মাতাল অবস্থায় ফেরেন। আমার ইচ্ছা করে চড় দিয়ে এই মহিলার সব কটি দাঁত ফেলে দেই। তা করতে পারি না। কান পেতে শুনি মহিলা তার মেয়েকে বলছেন–আর কখনো দেরি হবে না। তুমি কি খুব বেশি ভয় পাচ্ছিলে?

না।

আমি তোমাকে ভালোবাসি, মা।

আমিও তোমাকে ভালোবাসি।

আই লাভ ইউ কথাটি একজন আমেরিকান তাঁর সমস্ত জীবনে কত লক্ষ বার ব্যাবহার করেন আমার জানতে ইচ্ছে করে। এই বাক্যটির আদৌ কি কোনো অর্থ তাদের কাছে আছে?

আরেকটা ঘটনা বলি।

আমার স্ত্রী জেনি লি নামের একটি মেয়ের বেবি সিটিং করতো। মেয়েটির বয়স সাত-আট বছর। মেয়েটির মা একজন ডিভোর্সি মহিলা, আমাদের ইউনিভার্সিটিতে সমাজবিদ্যার ছাত্রী। সে ইউনিভার্সিটিতে যাবার পথে মেয়েটিকে রেখে যায়। ফেরার পথে নিয়ে যায়। একদিন ব্যতিক্রম হলো, সে মেয়েকে নিতে এল না। রাত পার হয়ে গেল। পরদিন ভোরে তার বাসায় গিয়ে দেখি বিরাট তালা ঝুলছে। খুব সমস্যায় পড়লাম। মহিলা গেলেন কোথায়? তিন দিন কেটে গেল কোনো খোঁজ নেই। আমরা পুলিশে খবর দিলাম। মহিলার মার ঠিকানা বের করে তাঁকে লং ডিসটেন্স টেলিফোন করলাম। ভদ্রমহিলা কঠিন গলায় বললেন, এই সব ব্যাপার নিয়ে আমাকে বিরক্ত না করলে খুশি হব। আমার মেয়ের সঙ্গে গত সাত বছর ধরে কোনো যোগাযোগ নেই। নতুন করে যোগাযোগ হোক তা আমার কাম্য নয়। জীবনের শেষ সময়টা আমি সমস্যা ছাড়া বাঁচতে চাই।

আমাদের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। তবে জেনি লি নির্বিকার। সে বেশ সহজ ভঙ্গিতে বলল, আমার মা আমাকে তোমাদের ঘাড়ে ডাম্প করে পালিয়ে গেছে। সে আর আসবে না।

আমি তাকে সান্ত্বনা দেবার জন্যে বললাম, অবশ্যই আসবে।

না আসবে না। আমি না থাকলেই তার সুবিধা। বয় ফ্রেন্ডের সঙ্গে যেখানে ইচ্ছা সেখানে যেতে পারবে। আমি তোমাদের সঙ্গেই থাকব।

কথাগুলি বলবার সময় মেয়েটির গলা একবারও ধরে এল না। চোখের কোণে অঢ় চিকচিক করল না। একমাত্র শিশুরাই পারে নির্মোহ হয়ে সত্যকে গ্রহণ করতে।

জেনি লির মা চারদিন পর ফিরে আসে। সে তার বয় ফ্রেন্ডের সঙ্গে ডিসটেন্স ড্রাইভে দশ হাজার মাইল দূর মন্টানার এক পাহাড়ে চলে গিয়েছিল।

আমেরিকা কী ভাবে বিদেশী ছাত্রদের জীবনে প্রভাব ফেলতে থাকে তার একটি চমৎকার উদাহরণ দিয়েই গল্প শেষ করব।

শীতের সময়কার ঘটনা।

এখানকার শীত মানে ভয়াবহ ব্যাপার। ঘর থেকে বেরুনো বন্ধ। আমি ইউনিভার্সিটিতে যাই। ইউনিভার্সিটি থেকে ফিরে আসি। জীবন এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ হয়ে গেল।

আমেরিকানদের মতে এই সময়টা স্বামী-স্ত্রীদের জন্যে খুব খারাপ। সবার মধ্যেই তখন থাকে–কেবিন ফিবার। দিনের পর দিন ঘরে বন্দি থেকে মেজাজ হয় রুক্ষ। ঝগড়াঝাটি হয়। পরিসংখ্যানে দেখা গেছে ডির্ভোসের শতকরা ৭৬ ভাগ হয় শীতের সময়টায়।

আমেরিকানদের কেবিন ফিবারের ব্যাপারটা যে কত সত্যি তার প্রমাণ হাতে হতে পেলাম। অতি সামান্য ব্যাপার নিয়ে কুৎসিত একটা ঝগড়া করলাম গুলতেকিনের সঙ্গে। সে বিস্মিত গলায় বারবার বলতে লাগল, তুমি এ রকম করে কথা বলছ কেন? এসব কী? কেন এরকম করছ?

আমি চেঁচিয়ে বললাম, ভালো করছি।

তুমি খুবই বাজে ব্যবহার করছ। কেউ এরকম ভাবে আমার সঙ্গে কথা বলে না।

কেউ না বলুক, আমি বলি।

আমি কিন্তু তোমাকে ছেড়ে চলে যাব।

চলে যেতে চাইলে যাও। মাই ডোর ইজ ওপেন! দক্ষিণ দুয়ার খোলা।

সে কয়েক মুহূর্ত অপেক্ষা করলো তারপর নোভাকে চুমু খেয়ে এক বস্ত্রে বের হয়ে গেল। আমি মোটেই পাত্তা দিলাম না। যাবে কোথায়? তাকে ফিরে আসতেই হবে।

আশ্চর্যের ব্যাপার–সে ফিরে এল না। একদিন এবং একরাত কেটে গেল। আমার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ল। নোভা ক্রমাগত কাঁদছে, কিছুই খাচ্ছে না। আমি কিছুতেই তাকে শান্ত করতে পারছি না। সম্ভব অসম্ভব সব জায়গায় খোঁজ করলাম। কেউ কিছু বলতে পারে না। পুলিশে খবর দিলাম।

ফার্গো শহরে অসহায় মহিলাদের রক্ষা সমিতি বলে একটি সমিতি আছে। সেখানেও খোঁজ নিলাম। আমার প্রায় মাথা খারাপ হয়ে যাবার জোগাড়।

দ্বিতীয় দিন পার হ’ল। রাত এল। আমি ঠিক করলাম রাতের মধ্যে যদি কোনো খোঁজ না পাই তাহলে দেশে খবর দেব।

রাত আটটায় একটা টেলিফোন এল। একজন মহিলা এ্যাটোনি আমাকে জানালেন যে আমার স্ত্রী গুলতেকিন আহমেদ আমার ব্যবহারে অতিষ্ঠ হয়েছেন। তিনি ডিভোর্সের মামলা করতে চান।

আমি বললাম, খুবই উত্তম কথা। সে আছে কোথায়?

সে তার এক বান্ধবীর বাড়িতে আছে। সেই ঠিকানা তোমাকে দেয়া যাবে না। আমি কি মামলার বিষয়ে তোমার সঙ্গে কথা বলব?

মামলার বিষয়ে কথা বলার কিছুই নেই। আমাদের বিয়ের নিয়ম-কানুন খুব সহজ। এই নিয়মে আমার স্ত্রীকে স্বামী পরিত্যাগ করার অধিকার দেয়া আছে। এই অধিকার বলে সে যে কোনো মুহূর্তে আমাকে ত্যাগ করতে পারে। তার জন্যে কোর্টে যাবার প্রয়োজন নেই।

তোমাদের দেশের নিয়ম-কানুন তোমাদের দেশের জন্যে। আমেরিকায় এই নিয়ম চলবে না।

তোমার বকবকানি শুনতে আমার মোটেই ভালো লাগছে না। তুমি কি দয়া করে আমার স্ত্রীর সঙ্গে আমার যোগাযোগ করিয়ে দেবে?

আমি তোমার অনুরোধের কথা তাকে বলতে পারি। যোগাযোগ করবার দায়িত্ব তার।

বেশ তাই কর।

আমি টেলিফোন নামিয়ে সারা রাত জেগে রইলাম-যদি গুলতেকিন টেলিফোন করে। সে টেলিফোন করল না। বিভীষিকাময় একটা রাত কাটল। ভোরবেলা সে এসে হাজির।

যেন কিছুই হয়নি এমন ভঙ্গিতে সে রান্নাঘরে ঢুকে চায়ের কেতলি বসিয়ে দিল। আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি। কিছুই বলছি না। সে খুবই স্বাভাবিক ভঙ্গিতে দু’কাপ চা বানিয়ে এক কাপ আমার সামনে রেখে বলল, তোমাকে আমি একটা শিক্ষা দিলাম। যাতে ভবিষ্যতে আমার সঙ্গে আর খারাপ ব্যবহার না কর। যদি কর আমি কিন্তু ফিরে আসব না।

আমি বললাম, আমেরিকা তোমাকে বদলে দিয়েছে।

হ্যাঁ দিয়েছে। এই বদলানোটা কি খারাপ?

নী।

না-বলার সৎ সাহস যে তোমার হয়েছে সে জন্যে তোমাকে ধন্যবাদ। তবে যে বিদ্রোহ এখানে আমি করতে পারলাম দেশে থাকলে তা কখনো করতে পারতাম না। দিনের পর দিন অপমান সহ্য করে পশু-শ্রেণীর স্বামীর পায়ের কাছে পড়ে থাকতে হত।

আমি কি পশু-শ্রেণীর কেউ?

হ্যাঁ। নাও চা খাও। তোমার চেহারা এত খারাপ হয়েছে কেন? এই দুদিন কিছুই খাওনি বোধ হয়?

বলতে বলতে পশু-শ্রেণীর একজন মানুষের প্রতি গাঢ় মমতায় তার চোখে জল এসে গেল।

সে কাঁদতে কাঁদতে বলল, আমি জানি এর পরেও তুমি আমার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করবে, তবুও আমি বারবার তোমার কাছেই ফিরে আসব। এই দুদিন আমি একবারও আমার মেয়ের কথা ভাবিনি। শুধু তোমার কথাই ভেবেছি।

আমি মনে মনে বললাম, ভালোবেসে যদি সুখ নাহি তবে কেন মিছে এ ভালোবাসা। ভাগ্যিস রবীন্দ্রনাথ জনেছিলেন। না জন্মালে ভাব প্রকাশে আমাদের বড় অসুবিধা হত।

Anuprerona
Anupreronahttps://www.anuperona.com
Read your favourite literature free forever on our blogging platform.
RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here


Most Popular

Recent Comments